১. যত শিগগির পারিস

দ্য সিক্রেট অভ ভিলহেল্ম স্টোরিৎস – জুলভার্ন অমনিবাস

প্রথম পরিচ্ছেদ

আর যত শিগগির পারিস আসিস কিন্তু ভাই, অঁঁরি; আমি খুব অধীরভাবেই তোকে আসতে লিখছি। তাছাড়া, এ-দেশটাও চমৎকার, দক্ষিণ হাঙ্গেরির এই জেলাটা সত্যি যে-কোনো এনজিনিয়ারকে উসকে দিতে পারে। অন্তত শুধু সেই কারণেও এখানে আসবার জন্যে কষ্ট স্বীকার করাটা তোর কখনও ক্ষোভের কারণ হবে না। তোকে ভালোবাসা জানাই,
তোরই
মার্ক ভিদাল

চৌঠা এপ্রিল ১৭৫৭তে আমার ছোটোভাইটির কাছ থেকে আমি যে-চিঠি পেয়েছিলুম, তা শেষ হয়েছিলো এইভাবে।

এ-চিঠি এসে পৌঁছুবার আগে কোনো অলুক্ষুণে হুঁশিয়ারি আমায় উৎকণ্ঠায় ভরে দেয়নিঃ চিঠিটা বরং এসেছে যথানিয়মে, পর-পর অনেক ডাক-হরকরার হাত-ফেরতা হয়ে, শেষটায় আমার বাড়ির দারোয়ান এবং আমার খাশ খিদমৎগার মারফৎ, এসে পৌঁছেছে।সে যথারীতি একটা রেকাবিতে চিঠিটা সাজিয়ে এনেছিলো আমার কাছে–বেচারা টেরও পায়নি এই মুহূর্তটার গুরুত্ব পরে কী-রকম ফুলে-ফেঁপে অতিকায় হয়ে উঠবে।

আর যখন ছুরি দিয়ে লেফাফার মুখ কেটে আমি চিঠিটা পড়তে শুরু করি, আমিও ছিলুম শান্তসুস্থির, এবং একনিশ্বাসে আমি গিয়ে পৌঁছেছি এই শেষ অনুচ্ছেদটায়, একবারও না-থেমে পড়ে ফেলেছি মার্ক-এর লেখা শেষ বাক্যগুলো, ঘুণাক্ষরেও ভাবিনি যে-অদ্ভুত ঘটনাগুলোয় আমি জড়িয়ে পড়তে চলেছি, এই অনুরোধ-উপরোধে তারই বীজ লুকিয়ে আছে।

মানুষের অন্ধত্ব এইরকমই! এইভাবেই তো মানুষের অজ্ঞাতসারে তার ভবিতব্য গোপনে-গোপনে তার ভাগ্যের রহস্যময় বেড়াজাল বুনে যায়!

আমার এই কনিষ্ঠ ভ্রাতাটি সত্যিকথাই লিখেছিলো। হাঙ্গেরি যাবার জন্যে যত পথশ্রমই স্বীকার করে থাকি না কেন, তা কখনও আমার খেদ বা মনস্তাপের কারণ হয়নি। কিন্তু এখন এ-সব কাহন লিখতে বসে আমি কি ঠিক করছি? জীবনে এমন কিছু-কিছু ব্যাপারও কি থাকে না যে-সম্বন্ধে চিরকালই আমাদের চুপচাপ থাকা উচিত? এ-রকম অদ্ভুত-এক কাহনকে বিশ্বাসই বা করবে কে? যে-আশ্চর্য কাহিনী এমনকী সবচেয়ে দুঃসাহসী কবিও লিখতে গিয়ে দু-বার থমকে যাবেন?

তা, কেউ বিশ্বাস করুক চাই না-করুক! আমি বরং ঝুঁকিটাই নেবো। আমার কাহন কেউ বিশ্বাস করুক বা না-করুক, আমি বরং এই আশ্চর্য ঘটনাগুলো বর্ণনা করতে করতে আরেকবার অনুভব করে নেবো এই অবিশ্বাস্য ঘটনাগুলোর অপ্রতিরোধ্য টান। আমার ছোটোভাইটির চিঠিটি ছিলো সেই ঘটনাচক্রেরই আপাতনিরীহ প্রস্তাবনা।

আমার কনিষ্ঠ ভ্রাতাটি, মার্ক, তখন আঠাশ বছরের যুবক, পোর্ট্রেট আঁকিয়ে হিশেবে সে এর মধ্যেই দারুণ সাফল্য অর্জন করে বসেছিলো। আমাদের দু-ভাইয়ের মধ্যে ছিলো স্নেহ-ভালোবাসার নিবিড় বন্ধন। আমার দিক থেকে স্নেহটা একটু পিতৃস্নেহের মতনই ছিলো, কেননা আমি মার্ক-এর চাইতে ঠিক আটবছরের বড়ো। অল্প বয়েসেই আমরা বাবা-মা দুজনকেই হারিয়েছিলুম, আর তারপর মার্ক-এর দেখাশুনোর ভার এসে পড়েছিলো তার বড়োভাই এই আমারই ওপর। মার্ক মাঝে-মাঝে ঠাট্টা করে বলতে আমি নাকি বড্ড-বেশি দাদাগিরি ফলাচ্ছি, ধরনটা ঠিক নাকি বহু-কথিত বিগ ব্রাদারএরই মতো; তবে এটা ঠিক যে আমারই ওপর দায় বর্তেছিলো মার্ক-এর লেখাপড়া শেখার ব্যবস্থা করার। আর চিত্রকলায় তার আশ্চর্য ঝোঁক আর নৈপুণ্য দেখে, আমিই তাকে। তাতিয়ে ছিলুম চিত্রশিল্পী হতে–আর তারপর তো দেখা গেছে অল্পদিনের মধ্যেই তার নাম শিল্পরসিকদের মুখে-মুখে ছড়িয়ে পড়েছে। তার এই সাফল্য আদপেই পড়ে-পাওয়া কিছু ছিলো না–ছিলো সাধনা আর প্রতিভার সমন্বয়।

তো, এই-তো সেই-মার্ক এখন বিয়ে করতে যাচ্ছে। কিছুকাল ধরেই সে থাকছিলো রাগৎসে-এ, দক্ষিণ হাঙ্গেরির এক প্রধান শহরে। তার আগে কয়েকটা সপ্তাহ কাটিয়েছিলো বুড়াপেন্ট-এ, সেখানে বেশ জমকালো দক্ষিণার বদলে এঁকেছিলো গোটা কয়েক প্রোট্রেট, ছবি হিশেবে সেগুলো খুব আদৃতও হয়েছিলো, আর হাঙ্গেরিতে যেভাবে শিল্পীদের সাগ্রহে বরণ করে নেয়া হয়, সেটাও মার্ক-এর খুব ভালো লেগে গিয়েছিলো। তারপর সে বুড়াপেট থেকে দানিউব ধরে গেছে দক্ষিণে–রাগৎস-এ।

এই শহরের প্রধান পরিবারগুলো অন্যতম ছিলো ডাক্তার রডারিখ-এর পরিবার, চিকিৎসক হিশেবে তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিলো সারা হাঙ্গেরিতেই। এমনিতেই উত্তরাধিকার পেয়েছিলেন বিস্তর ধনসম্পদ-তার সঙ্গে যোগ হয়েছিলো চিকিৎসক হিশেবে তিনি যে বিপুল বিত্ত আহরণ করেছিলেন। বছরে একবার করে তিনি ছুটি নিয়ে দেশবিদেশ বেড়াতে বেরুতেন, আর তার ধনী মক্কেলরা কেউই তার এই দেশভ্রমণক পছন্দ করতো না। গরিবগুরবোরাও তার এই বাৎসরিক ছুটিকে পছন্দ করতো না, কারণ তিনি চিরকালই বিনা মূল্যে, বিনা ফি-তে, তাদের চিকিৎসা করে এসেছেন। তাঁর দানধ্যানের পরিমাণও ছিলো বিপুল, দীনের থেকেও দীন তার কৃপা থেকে কখনও বঞ্চিত হয়নি–আর তার এই লোকসেবাই তাঁর সম্বন্ধে এক সার্বজনীন শ্রদ্ধা ও সম্ভ্রমের কারণ হয়েছিলো।

পরিবার বলতে ডাক্তার রডারিখ-এর বাড়িতে ছিলো আরো তিনজন–তাঁর স্ত্রী, তার ছেলে কাপ্তেন হারালান, আর তার মেয়ে মাইরা। অতিথিবৎসল এই পরিবারের বাড়িতে মাঝে-মাঝে এসেছে মার্ক, আর তার ফলেই এই তরুণীর রূপলাবণ্য আর স্নিগ্ধ শ্রীর সংস্পর্শে এসে মুগ্ধ না-হয়ে পারেনি–আসলে তা-ই সম্ভবত রাগৎস-এ তার অবস্থানকে প্রলম্বিত করেছে। তবে মাইরা রডারিখ যেমন মার্ক ভিদালকে আকৃষ্ট করেছিলো, তেমনিভাবে এই-কথাটা বললেও অত্যুক্তি হবে না যে মাইরাও মার্কের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে এসে আকৃষ্ট হয়েছে। এটাও মানতে কে আপত্তি করবে যে মার্ক ছিলো–ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, এখনও আছে-চমৎকার মানুষ : মাঝারি উচ্চতা, সজীব উজ্জ্বল দুটি নীল চক্ষু, চেস্টানাটরঙের চুল, কবিদের মতো ললাটদেশ, আর মুখচোখ দেখে এটাই বোঝা যেতো যে জীবন তাকে শুধু বেঁচে-থাকার মধুর দিকগুলোই দেখিয়েছে; বন্ধুবৎসল, দরাজদিল, আর শিল্পীদের যেমন হয়ে থাকে–রূপমুগ্ধ।

আর মাইরা রডারিখ? তার কথা আমি শুধু মার্কের উচ্ছ্বাসে-ভরা চিঠিগুলো থেকেই জেনেছি, আর এই চিঠিগুলো পড়েই তাকে একবার চাক্ষুষ দেখবার জন্যে আমি খুবই উৎসুক হয়ে উঠেছিলুম। আর ভ্রাতৃপ্রবর আমার সঙ্গে শুধু তার পরিচয় করিয়ে দেবার জন্যেই উন্মুখ হয়ে থাকেনি, আমাকে প্রায় কাকুতি-মিনতি করে লিখছিলো রাগৎস এ চলে আসতে, বাড়ির কর্তা হিশেবেই, আরো জোর দিচ্ছিলো আমি সেখানে গিয়ে যেন অন্তত মাসখানেক থাকি। তার বাগদত্তা–অনবরত আমাকে লিখে জানিয়েছে সে–অধীরভাবে আমার জন্যে প্রতীক্ষা করে আছে, আর আমি সেখানে গিয়ে পৌঁছুবামাত্র তারা বিয়ের দিন ঠিক করে ফেলবে। কিন্তু তার আগে মাইরা, নিজের চোখে, আমাকে একবার দেখে নিতে চায়, জানতে চায় কে তার হবু ভাশুর, কার সম্বন্ধে মার্ক এমন উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছে–অন্তত সেইভাবেই মাইরা নাকি তার মনের কথা মার্ককে খুলে বলেছে। যে-পরিবারে বিয়ে করে বউ হয়ে আসতে যাচ্ছে, সে-পরিবারের অন্যান্য মানুষরা কেমন, এটা জানবার জন্যে স্বাভাবিকভাবেই তার কৌতূহল জন্মাতে পারে, আগ্রহ জাগতে পারে। বস্তুত, সে নাকি চূড়ান্ত সম্মতি দেবেই না, যতক্ষণ-না অঁঁরির সঙ্গে মার্ক তার পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে।

এই-সমস্ত কথাই আমার উত্তেজিত ভাইটি চিঠিগুলো বারবার করে লিখেছে আর সে-সব চিঠির ভাব ও ভাষা থেকে এটা বুঝতে আমরা অসুবিধে হয়নি যে মাইরার প্রেমে সে তখন একেবারে হাবুডুবু খাচ্ছে।

আমি তাকে বুঝিয়ে লিখেছি যে আমি তো মেয়েটিকে শুধু মার্কের উচ্ছ্বাসভরা চিঠি থেকেই জেনেছি। আর, আমার ভাই শিল্পী বলেই, বিশেষত পোর্ট্রেট-আঁকিয়ে বলেই, এটা আশা করেছি যে মার্কের পক্ষে ভাষায় নিজেকে প্রকাশ না-করে রেখা ও রঙে তাকে ফুটিয়ে-তোলাই সহজ আর স্বাভাবিক হতো, সে মাইরাকে মডেল করে ছবি এঁকে, ক্যানভাস না-হোক, কাগজেই এঁকে আমার কাছে পাঠাতে পারতো, আর আমি তখন তার ছায়ারূপ–তা-ই তো বলে লেখকরা, ছায়া-মাইরা–দেখে তার তারিফ করতে পারতুম।

কিন্তু মাইরার তাতে সায় নেই। মডেল হতে সে নারাজ। মার্ক ঘোষণা করে জানিয়েছে, সশরীরেই সে আমার ধাঁধিয়ে-যাওয়া চোখের সামনে আবির্ভূতা হবে। পড়ে আমার মনে হয়েছে মার্ক হয়তো মেয়েটির সিদ্ধান্ত পালটাবার জন্যে খুব-একটা চেষ্টাই করেনি। দুজনে মিলে একযোগে এটাই চেয়েছে যে অঁঁরি ভিদাল তার এনজিনিয়ারিং বিদ্যে ও দায়িত্ব শিকেয় তুলে রেখে যেন সরাসরি হাঙ্গেরি গিয়ে রডারিখভবনের বৈঠকখানায় নিজের এত্তেলা দেয়–বিয়ের উৎসবের সর্বপ্রথম অতিথি হিশেবে।

আমার মনস্থির করে ফেলবার জন্যে সত্যি কি এতসব যুক্তির দরকার ছিলো? মোটেই না। আমার ছোটোভাইটি বিয়ে করবে অথচ সেখানে আমি সশরীরে হাজির থাকবো না, এ আমি কিছুতেই হতে দিতুম না। বেশি দেরি না-করে এক্ষুনি বরং আমার উচিত মাইরার সঙ্গে আলাপ করে নেয়া–সে আমার ভ্রাতৃবধূ হবার আগেই।

তাছাড়া, অধিকন্তু, চিঠি আমায় বলেছে, হাঙ্গেরির ঐ অঞ্চলে গেলে আমার যে শুধু ভালোই লাগবে তা নয়, আখেরে আমার লাভই হবে। একে তো এটা মাগিয়ারদের দেশ, যাদের অতীত শৌর্যবীর্যের গৌরবগাথায় ভরা, যারা জার্মানদের সঙ্গে বেমালুম মিশে যেতে না-চেয়ে, নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে, মধ্যইওরোপের ইতিহাসে একটা মস্ত ভূমিকা নিয়েছে।

আমি ঠিক করেছিলুম খানিকটা রাস্তা আমি যাবো ডাকের গাড়িতে, তারপর যাবার সময় বাকি রাস্তাটা যাবো দানিউব ধরে দক্ষিণে, আর ফেরবার সময় পুরো রাস্তাটাই আসবো ডাকের গাড়িতে। দানিউবের সৌন্দর্য আর মহিমার কথা কেই বা জানে না? আমি ভিয়েনা থেকেই দানিউব ধরে যাবো। আমি যদি তার সাতশো লিগ ধারাপথ ধরে পুরোপথটা নাও যাই, অন্তত দানিউবের তীরের সবচেয়ে সুন্দর অঞ্চলগুলো আমার চাক্ষুষ দেখা হয়ে যাবে–অস্ট্রিয়া আর হাঙ্গেরির মধ্য দিয়ে যে-দানিউব গেছে, সরাসরি একেবারে রাগৎস অব্দি, সার্বিয়ার একেবারে সীমান্তে।

আমার ভ্রমণবৃত্তান্ত আপাতত শেষ হবে সেখানে গিয়েই। সময়ের অভাবেই আমার পক্ষে সম্ভব হবে না লৌহতোরণ পেরিয়ে কৃষ্ণসাগরে যেখানে গিয়ে দানিউব যেখানে সমুদ্রের অথৈ জলে পড়েছে, সেই ত্রিবেণী সঙ্গমে যাওয়া। আমি যতদূর যাবো তার জন্যে তিন মাসের ছুটিই যথেষ্ট হবে বলে আমি ভেবেছি। পারী থেকে রাগৎস গিয়ে পৌঁছুতে লাগবে একমাস; মাইরা রডারিখ নিশ্চয়ই এতটা অধীর হয়ে নেই যে আমাকে পথের জন্যে অন্তত এই সময়টুকু ব্যয় করতে দেবে না। আমার ভাইয়ের নতুন দেশে গিয়ে তারপর আমি একটা আস্ত মাস কাটাবো, আর তারপর সেখানে থেকে ফ্রান্স ফিরে

আসতে আরো-একটা মাস আমি ব্যয় করতে পারবো। . আমার জরুরি কাজগুলো চটপট সেরে নিলুম। মার্ক কতগুলো দলিলপত্র নিয়ে যেতে লিখেছিলো, সেগুলোও জোগাড় করে নিলুম। এবার যাত্রার জন্যে তৈরি হতে হবে। তৈরি-হওয়া বলতে বিস্তারিত বা বিশদ-কিছু করার ছিলো না। বেশি মালপত্র নিয়ে অহেতুক পথের ঝামেলা বাড়াবার ইচ্ছে আমার আদপেই ছিলো না। নেবো তো শুধু একটা তোরঙ্গ, মোটামুটি প্রমাণ মাপেরই, কিছু জামাকাপড়, বিয়ের উৎসবে যোগদান করার জন্যে যথোচিত পোশাক, আর টুকিটাকি যা-সব লাগে। ও-দেশের ভাষা নিয়ে আমার অযথা কোনো মাথাব্যথা ছিলো না–এর আগে কাজে-অকাজে আমায় জার্মানি যেতে হয়েছে, তাই আলেমান ভাষা আমার জানা। আর মাগিয়ার ভাষা? সেটা বুঝতে আমায় হয় তো তেমন মুশকিলে পড়তে হবে না। তাছাড়া সারা হঙ্গেরিতেই তো চমৎকার ফরাশি চলে, আর-কেউ জানুক না-জানুক অভিজাত সম্প্রদায়ের লোকেরা তো জানবেই, তাছাড়া মার্ক জানিয়েছে অস্ট্রিয়ার সীমান্ত পেরিয়ে ওপাশে গিয়ে ভাষার জন্যে তাকে কোনো অসুবিধেয় পড়তে হয়নি।

আপনি যেহেতু ফরাশি, হাঙ্গেরিতে আপনার নাগরিক অধিকার আছে বলে জানবেন, একবার একজন সন্ত্রান্ত ব্যক্তি আমাদের দেশের কাউকে জানিয়েছিলেন। আর সেই উষ্ণ অভ্যর্থনাতেই বোঝা যাচ্ছিলো ফ্রাসের প্রতি মাগিয়ারদের প্রকৃত মনোভাব কী ।

কাজেই মার্কের শেষ চিঠির উত্তরে আমি তাকে লিখে জানিয়েছি যে সে যেন মাইরাকে জানিয়ে দেয় তার সঙ্গে দেখা করার জন্যে আমিও তারই মত সমান অধীর হয়ে আছি। আরো যোগ করেছি : ভাবী ভাতৃবধূর সঙ্গে দেখা করতে আমি অচিরেই হাঙ্গেরির উদ্দেশে রওনা হয়ে পড়ছি, তবে ঠিক কবে যে রাগৎস-এ গিয়ে পৌঁছুবো তা আমি নিজেই সঠিক জানি না, কেননা সেটা নির্ভর করবে পথের অবস্থা ও ঘটনাসংযোগের ওপর। তবে সেইসঙ্গে আমার কনিষ্ঠ ভ্রাতাটিকে এও ভরসা দিয়ে জানিয়েছি যে পথে আমি কখনোই লেটলতিফ চালে চলবো না। কাজেই রডারিখ পরিবার যদি চান তো অবিলম্বেই মে মাসের শেষে বিয়ের জন্যে একটা দিন স্থির করে নিতে পারেন।

দয়া করে আমাকে দুমদাম করে অভিশাপ দিসনে, আমি যোগ করেছি চিঠিতে, যদি পথের বিভিন্ন স্থান থেকে নাও লিখে জানাই যে কবে কোথায় গিয়ে হাজির হয়েছি, এটা জানিস যে অন্তত মাঝে-মধ্যে মাদমোয়াজেল মাইরাকে আশ্বস্ত করবার জন্যে আমি নিশ্চয়ই জানিয়ে দেবো তাদের পৈতৃক ভবন থেকে আমি ঠিক কত লিগ দূরে আছি–যাতে সে আমার পোঁছুনো সম্বন্ধে মোটামুটি একটা ধারণা করে নিতে পারে। তবে পরে তোকে ঠিকই জানিয়ে দেবোযথাসময়েই-ঠিক ক-টার সময় গিয়ে রাগৎস-এ। পৌঁছুবো, সম্ভব হলে এমনকী ক-টা বেজে কত মিনিটে তাও জানিয়ে দেবো।

রওনা হবার আগের দিন সন্ধেবেলায়, ১৩ই এপ্রিল, আমি পুলিশ-লিউটেনাস্টের দফতরে গিয়ে হাজির হয়েছি; লিউটেনান্টের সঙ্গে আমার সম্ভাবই ছিলো, বন্ধুতাই প্রায়; ফলে পাসপোর্টটা নেয়া এবং তাঁর কাছ থেকে বিদায় নেয়া–এক ঢিলে দুই পাখিই খতম করার জন্যে তার দফতরে যেতে চেয়েছি আসলে। পাসপোর্টটা হাতে তুলে দেবার সময় পুলিশ-লিউটেনান্ট আমার ভাইয়ের উদ্দেশে সহস্র অভিনন্দন জানিয়েছেন; মার্কের বিস্তর খ্যাতি ছড়িয়েছে আজকাল, অনেকেই তার নাম জানে, তবে তিনি তাকে ব্যক্তিগতভাবেও জানতেন, তাছাড়া তার বিয়ের কথা নাকি সম্প্রতি তিনি কার কাছ থেকে শুনেছেন।

আর এটাও জানি, পুলিশ-লিউটেনান্ট আরো বলেছেন, আপনার ভাই যে-রডারিখ পরিবারে বিয়ে করতে যাচ্ছেন, রাগৎস-এ সে-পরিবারের দারুণ সুনাম আছে।

আপনাকে কেউ এ-সম্বন্ধে জানিয়েছেন বুঝি? আমি জিগেস করেছি।

হ্যাঁ, এই তো গতকালই, অস্ট্রিয়ার অ্যামবাসাডারের বাড়িতে সন্ধের সময় পার্টি ছিলো, তখনই তো–

আর তিনিই আপনাকে এই খবর দিয়েছেন?

বুডাপেটের একজন উঁচু অফিসার-হাঙ্গেরির রাজধানীতে থাকবার সময় আপনার ভাইয়ের সঙ্গে তাঁর বন্ধু হয়েছিলো–তিনি তো তার প্রশংসায় একেবারে পঞ্চমুখ। তার সাফল্য ছিলো তর্কাতীত, আর বুডাপেন্ট তাঁকে যেমন উষ্ণভাবে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলো, রাগৎস-এ গিয়ে তিনি তার চেয়েও বেশি সমাদর পেয়েছেন–খ্যাতি তো হাওয়ার বেগে দৌড়োয়। তাতে অবশ্য আমাদের অবাক হবার কিছু নেই, ভিদাল।

কিন্তু, আমি নাছোড়ভাবে খুঁচিয়েছি, সেই অফিসার রডারিখ পরিবারের প্রশংসাতেও কি তেমনি উচ্ছ্বসিত ছিলেন?

খুবই উচ্ছ্বসিত। ডাক্তার রডারিখকে সবাই প্রায় ঋষির মতো শ্রদ্ধাভক্তি করে। অস্ট্রিয়া আর হাঙ্গেরি-দু-দেশের সর্বত্রই তার খুব নাম। যত-রকম ভূষণ, পদক, খেতাব সম্ভব–সবই তিনি পেয়েছেন। কাজেই আপনার ভাই চমৎকার একটি পরিবারেই বিয়ে করতে যাচ্ছেন, কারণ যতটুকু শুনেছি মাদমোয়াজেল মাইরা রডারিখও খুব আকর্ষণীয়া ব্যক্তিত্ব।

আপনি নিশ্চয়ই অবাক হবেন না, উত্তরে আমি তাকে বলেছি, যখন বলবো যে মার্কেরও ধারণা ও-রকম মেয়ে কেউ হয় না; সে প্রায় আপ্লুত হয়ে আছে মাইরাতে।

সে-তো দারুণ ব্যাপার, ভিদাল, খুবই ভালো কথা। আমার শুভেচ্ছা আর অভিনন্দন তাকে জানিয়ে দেবেন–আমি ঠিক জানি নবদম্পতির সুখসমৃদ্ধি বিস্তর লোকের ঈর্ষার কারণ হবে।…তবে, একটু দোনোমনা করেছেন পুলিশ-লিউটেনান্ট, জানি না কোনো বেস কথা বলে ফেলছি কি না…তবে–

বেফাঁস কথা? আমি তাজ্জব হয়ে গেছি।

তাহলে মার্ক আপনাকে জানাননি যে তিনি রাগৎস-এ যাবার মাস কয়েক আগে…

মার্ক রাগৎস-এ যাবার আগে? আমি বুঝি হতভম্বের মতো ঐ কথাই আবার আউড়েছি।

হ্যাঁ…মাদমোয়াজেল মাইরা রডারিখ…তা, ভিদাল, এমনও হতে পারে যে আপনার ভাই সে-কথা শোনেনইনি।

হেঁয়ালি ছেড়ে বলে ফেলুন তো কী ব্যাপার–কারণ আপনি যে কী বলতে চাচ্ছেন সেটা আমার মগজে ঢুকছেই না।

বেশ, বলছি। যদুর শুনেছি–এবং তাতে, আশ্চর্য হবারও কিছু নেই মাদমোয়াজেল রডারিখ-এর বিস্তর পাণিপ্রার্থী ছিলো–আর তাদের মধ্যে একজন অন্তত ছিলো যার সম্বন্ধে খুব-একটা শ্রদ্ধা হবার কোনো কারণ নেই। এই কঙ্কাই সেদিন পার্টিতে আমার বন্ধু আমাকে বলেছিলেন। ব্যাপারটা ঘটেছিলো পাঁচ সপ্তাহ আগে, তখন আপনার ভাই ছিলেন বুড়াপেন্ট-এ।

আর এই প্রতিদ্বন্দ্বীটি–?

ডাক্তার রডারিখ তাকে দরজা দেখিয়ে দিয়েছিলেন।

তাহলে আর এ-ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাবার কী আছে। তাছাড়া, মার্ক যদি না জানে যে তার কোনো-একজন প্রণয়প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলো, অন্তত কোনো চিঠিতেই সে ঘুণাক্ষরেও এমন-কোনো কথা উল্লেখ করেনি, তাহলে ব্যাপারটা নিশ্চয়ই বেশি দূরে গড়ায়নি-সেটা নিশ্চয়ই তেমন গুরুতর-কিছু নয়।

তা ঠিক।

আপনি আমাকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে ঠিকই করেছেন-নেহাৎ যদি কেচ্ছাগুজব—না হয়…

না, ভিদাল। যে-খবরটা পেয়েছি তা মোটেই হালকা-কিছু নয়–

খবরটা হয়তো হালকা নয়, তবে বিষয়টার কোনো গুরুত্বই নেই। আমি বলেছি, আর সেটাই সবচেয়ে বড়ো কথা। আমি ওঠবার উপক্রম করেছি। কিন্তু আপনার বন্ধু কি সেই প্রতিদ্বন্দ্বীটির নাম বলেছিলেন–ঐ যাকে ডাক্তার রডারিখ দরজা দেখিয়ে দিয়েছিলেন?

বলেছিলেন।

আর তার নাম?

ভিলহেল্ম স্টোরিৎস।

ভিলহেল্ম স্টোরিৎস?! রসায়ন-পণ্ডিতের–না, না, সেই কিমিয়াবিদের ছেলে?

হ্যাঁ।

হ্যাঁ, এটা একটা নাম বটে! এমন-এক বিজ্ঞানসাধকের নাম যাঁর আবিষ্কারগুলো তাকে দারুণ বিখ্যাত করেছিলো।

এবং যাঁর সম্বন্ধে গোটা জার্মানি সংগতভাবেই খুব গর্বিত।

কিন্তু তিনি কি মারা যাননি?

হ্যাঁ, বেশ কবছর আগেই মারা গেছেন, কিন্তু তার ছেলে বেঁচে আছে–এবং, আমার কাছে যে-খবর আছে, সেই অনুযায়ী, এই ভিলহেল্ম স্টোরিৎস তেমন সুবিধের লোক নয়।

সুবিধের লোক নয়? অর্থাৎ?

কীভাবে যে আপনাকে কথাটা বলবো, সেটা ঠিক বুঝতে পারছি না। তবে আমার অফিসারবন্ধুর কথা বিশ্বাস করতে হলে বলতে হয় এই ভিলহেল্ম স্টোরিৎস আদৌ তার বিখ্যাত বাবার মতো নয়।

তাই নাকি? আমি তখন আবহাওয়াটা হালকা করবার জন্যে রসিকতা করেছি। তাহলে অবশ্য ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে হয়। তা এই প্রণয়প্রার্থীটির কি তিনটে পা আছে–না কি চারটে হাত-না কি শুধুই আছে যষ্ঠেন্দ্রিয়?

তা অবশ্য তেমন স্পষ্ট নয়, আমার বন্ধু হেসে উঠেছেন, তবে আমার ধারণা বাবার মতো নয় কথাটার মর্মার্থ কিন্তু শারীরিক বৈশিষ্ট্যের কথা বলছে না, বরং তার নৈতিক দিক সম্বন্ধেই কটাক্ষ করছে। এর সম্বন্ধে একটু সাবধান থাকাই উচিত।

বেশ, সাবধানই থাকবো না-হয়–অন্তত বিয়েটা চুকে না-যাওয়া অব্দি নিশ্চয়ই চোখকান খোলা রাখবো।

অতঃপর এই তথ্যটি নিয়ে আর-তেমন মাথা না-ঘামিয়ে, আমি পুলিশ লিউটেনান্টের সঙ্গে করমর্দন করেছি, তারপর বাড়ি গিয়ে আমার যাত্রার প্রস্তুতি সাঙ্গ করতে লেগে গিয়েছি।

.

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

ডাকের গাড়িতে করে আমি পারী ছেড়েছি ১৪ই এপ্রিলের সকালবেলায়, সাতটার সময়। দশদিনের মধ্যেই আমার অস্ট্রিয়ার রাজধানীতে পৌঁছে-যাওয়া উচিত।

আমার যাত্রার প্রথম অংশটার কেবল বুড়ি ছুঁয়ে যেতে চাই আমি। পথে তেমন কোনো ঘটনাই ঘটেনি, আর যে-সব জায়গায় ভেতর দিয়ে আমাদের গাড়ি গেছে তা পাঠকের এতই জানা যে সে নিয়ে নতুন-কিছু বলতে যাওয়াও বিড়ম্বনা মাত্র।

আমরা প্রথম গিয়ে থেমেছি স্ট্রাসবুর্গে, আর আমি বেশ কয়েকটা রাত্রি কাটিয়েছি রাজপথের খোয়র ওপর চলন্ত চাকার গান শুনে-শুনে, আর এই অবিশ্রাম গুঞ্জনটা এমনই যা স্তব্ধতার চেয়েও অনায়াসে যে-কাউকে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। আরো-কতগুলো শহরের মধ্য দিয়েও গেছি আমি, তারপর অস্ট্রিয়ার সীমান্তের কাছে এসে আমাকে কিছুক্ষণের জন্যে সাৎসবুর্গে আটকে থাকতেও হয়েছে। তারপর, অবশেষে, ২৫শে এপ্রিল, সন্ধে ছটা পঁয়ত্রিশে, মুখে-ফেনা-তোলা ঘোড়াগুলো খটাখট আওয়াজ করে গিয়ে ঢুকেছে। ভিয়েনার সেরা হোটেলটার চত্বরে।

সেখানে আমি সবশুদু মাত্র ছত্রিশ ঘণ্টা থেকেছি–শুধু দুটো রাত্রিই কাটিয়েছি ঐ রাজধানীতে। ফেরবার পথে ঠিক করেছি আরো ভালো করে দ্বীন বা ভিয়েনার একটা সরেজমিন তদন্ত করবো।

দানিউব কিন্তু ভিয়েনার মধ্য দিয়েও যায়নি, অথবা গা ঘেঁসেও যায়নি; আমাকে অন্য-একটা কোচবাক্সে করে এক লিগ পেরিয়ে তবেই যেতে হয়েছে সেই নদীর তীরে যার সহায় সলিল আমাকে সরাসরি রাগৎস-এ এগিয়ে পৌঁছে দেবে। আগের রাত্তিরেই আমি হালকা জলপোত ডরোথিতে যাত্রীদের ভিড়ভাট্টা সত্ত্বেও একটা টিকিট কেটে রাখতে পেরেছি।

ডরোথিতে উঠে দেখি সেখানে প্রায় সকলেরই কিছু-না-কিছু আছে : সব ধরনের লোক, আলেমান, অস্ট্রিয়ান, মাগিয়ার, রুশী, ইংরেজ-কে বাদ নেই। যাত্রীরা আছে ডেকে, গলুইয়ের কাছে, নিচে খোলের মধ্যে মালপত্র এত ঠাশা যে কারুই কোনো জায়গা হতো না সেখানে।

আমার প্রথম ভাবনাটা ছিলো কী করে সার্বজনীন ডরমিটরিতে একটা বাঙ্ক বাগিয়ে নেয়া যায়। আমার তোরঙ্গটা সেখানে নিয়ে যাবার কোনো কথাই ওঠেনিঃ খোলা হাওয়ায় সেটা ডেকের ওপরেই ফেলে যেতে হবে, পারলে কোনো বেঞ্চির কাছে, যাতে তার। ওপর বসে অনেকক্ষণ সময় কাটাতে পারি দানিউবকে দেখতে-দেখতে, আর তাতে আমার তোরঙ্গটার ওপরও নজর রাখতে পারবো।

একে স্রোতের বেগ ক্ষিপ্রপ্রবল, তায় জোর হাওয়া দিচ্ছিলো-এই দুয়ের যোগসাজসে বজরাটা ভেসে চলেছিলো দ্রুতবেগেই, গলুইটা তরতর করে গেরি জল কেটে এগুচ্ছিলো, কারণ কিংবদন্তি যা-ই বলুক না কেন দানিউব ঠিক নীল ছিলো না, যেন গেরুয়া রঙেই ছোপানো ছিলো। পথে অনেক নৌযানের দেখা পাওয়া গিয়েছে, হাওয়ায় ফাঁপাননা তাদের পাল, দেশগাঁয়ের জিনিশপত্র নিয়ে বড়ো গঞ্জে বা শহরগুলোর উদ্দেশে চলেছে। সেই বিশাল ভেলাগুলোর একটার পাশ কাটিয়ে গিয়েছে ডরোথি, ভেলাটা যেন আস্ত একটা জঙ্গলের গাছপালা জুড়ে-জুড়ে বানানো, আর তার ওপর যেন তুলে

আনা হয়েছে আস্ত একখানা গ্রামকেই, যেটা ঠিক যাত্রার সূচনায় বানিয়ে নেয়া হয় আর। গন্তব্যে পৌঁছুলে ফের খুলে ফেলা হয়, ঠিক মনে করিয়ে দেয় আমাজোনের ওপর মস্ত সব ভাসমান গ্রামগুলো, ব্রাজিলের যা বৈশিষ্ট্য। তারপর ছোটো-ছোটো দ্বীপের পর দ্বীপ, যেন কোনো পরিকল্পনা না-করেই বসানো হয়েছে একেকটা মাটির ঢিবি, তার কোনো কোনোটা নেহাৎ ছোটোও নয়, তবে তাদের বেশির ভাগই যেন জল থেকে মাথাটা একটুখানি শূন্যে তুলে তাকিয়ে আছে-ভয় পেলেই ফের ভুউশ করে ডুবে যাবে-এতই নিচু জমি যে বান ডাকলে সবই জলের তলায় মিলিয়ে যাবে। অথচ কী উর্বর জমি, কী সতেজ, কী প্রফুল্ল, গাছপালার সবুজ আর কত রঙের ফুলেরই যে বর্ণালি তাতে, কত রংবাহার; কত গন্ধময় হাওয়া তাতে খেলে বেড়ায়। আমরা আরো পেরিয়ে গিয়েছি। জলের ওপর গড়ে-তোলা গ্রাম, নৌকোয় গড়া গ্রাম, বজরায়-বজরায় থাকার আস্তানা, তীরের খুঁটির গায়ে দড়ি বা লোহার শেকল দিয়ে বাঁধা, অনবরত হাওয়ায় দোল খাচ্ছে। দু-একবার তো এমন হয়েছে যে আমাদের পালতোলা বজরা এদের দড়ির তলা দিয়ে। গেছে, একতীর থেকে আরেকতীরে খুঁটিতে-খুঁটিতে বাঁধা দড়ি, মনে হয়েছে আমাদের বজরার পাল বুঝি তাতে ধাক্কা খাবে, অথচ আশ্চর্য, কেমন সন্তর্পণে যেন সে-সব পেরিয়ে এসেছে ডরোথি।

এইভাবেই অবশেষে আমরা এসে পৌঁছেছি বুড়াপেণ্ট; সেখানে আমি কয়েকদিন কাটিয়েছি, আশপাশে সব দ্রষ্টব্য ঘুরে-ঘুরে দেখে। যাত্রার আগের দিন আমি একটা বড়ো হস্টেলে গিয়েছি বিশ্রাম করতে। আমি হাঙ্গেরির বিখ্যাত শাদা ওয়াইন খাচ্ছিলুম, এমন সময় আমার চোখ পড়েছে একটা খোলা খবরকাগজের ওপর। কিছু না-ভেবেই সেটা আমি হাতে তুলে নিয়েছি, আর অমনি আমার চোখে পড়ে গেছে মস্ত-মস্ত গথিক হরফে লেখা দুটি শব্দ :

স্টোরিৎস্ স্মৃতিবার্ষিকী

এই নামটাই তো বলেছিলেন পুলিশ-লিউটেনান্ট, এটাই তো সেই নামজাদা আলেমান কিমিয়াবিদের নাম, এটা তো মাইরা রডারিখের হলেও-হতে-পারতো পাণিপ্রার্থীর নামও। সে-সম্বন্ধে কোনো সন্দেহই আমার ছিলো না।

সেই কাগজে যা পড়েছি তা এই :

আর তিন সপ্তাহ পর, ২৫শে মে, অটো স্টোরিৎস-এর স্মৃতিবার্ষিকী উদ্যাপিত হবে স্পেমবার্গ-এ। এটা নিশ্চিত ভাবেই বলা যায় যে এই প্রসিদ্ধ জ্ঞানসাধকের জম্মস্থলে দলে-দলে লোক গিয়ে গোরস্থানে হাজির হবে।

এটা সকলেরই জানা যে, এই অনন্যসাধারণ প্রতিভা তাঁর আশ্চর্য সব উদ্ভাবনী মারফৎ সারা জার্মানিকেই বিখ্যাত করে গেছেন, বস্তুবিজ্ঞানের অগ্রগতির পিছনে এই বিজ্ঞানসাধকের কাজের অবদান যে কতটা, তাও কারু নিশ্চয়ই অজ্ঞাত নেই।

নিবন্ধকার যে কোনো অত্যুক্তি করেননি, সেটা ঠিক। অটো স্টোরিৎ-এর নাম সংগত কারণেই ভৌতবিজ্ঞানজগতে শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হয়। কিন্তু যেটা আমাকে ভাবিয়ে তুলেছিলো, সেটা এর পরের কথাগুলোই :

এ-কথাও নিশ্চয়ই কারু অজ্ঞাত নেই যে তাঁর জীবদ্দশায় অতিপ্রাকৃতে যাঁদের বিশ্বাস ছিলো তাঁদের কাছে অটো স্টোরিৎস প্রায় ঐন্দ্রজালিক হিশেবেই গণ্য হতেন। দু-এক শতাব্দী আগে এটাও সম্ভব ছিলো যে তিনি নিশ্চয়ই গ্রেফতার হতেন কোতোয়ালির হাতে, তারপর বিচারের পর হাটের মাঝখানে তাঁকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হতো। আমরা আরো জানাতে চাই যে তার মৃত্যুর পর অনেক লোকই –বিশেষত গালগল্প শুনে যাঁরা মজে যান–তাঁকে এখন আরো বেশি করে জাদুবিদ্যার সাধক বলেই ভাবছেন, ভাবছেন যে তিনি নিশ্চয়ই অতিমানুষিক শক্তির অধিকারী ছিলেন। তবে তাঁদের যা আশ্বস্ত করে সেটা এই তথ্য যে তিনি তাঁর নিজের যাবতীয় গুপ্তকথা নিয়েই কবরে গেছেন। তাঁদের কাছে অবশ্য অটো স্টোরিৎস চিরকালই থেকে যাবেন মন্ত্রসিদ্ধ ঐন্দ্রজালিক, এমনকী নব্য শয়তানিবিদ্যারও উপাসক।

যে যা-খুশি তা-ই ভাবুক, কিন্তু তথ্য হলো এটাই যে–আমি ভেবেছি-তার ছেলেকে ডাক্তার রডারিখ কিছুদিন আগে তার দরজা দেখিয়ে দিয়েছেন। তা না-হলে কে কী ভাবলো, তাতে আমার বয়েই যেতো।

নিবন্ধটি অবশ্য তার পরেও এই কথাগুলো বলে উপসংহার টেনেছিলো :

কাজেই এ-কথা ভাবা যুক্তিসংগত হবে যে জনসমাবেশ হবে বিপুল, যেমন প্রতিবারই স্মৃতিবার্ষিকীর দিনে হয়ে থাকে। আর তাঁর গুণমুগ্ধ বন্ধুবান্ধব যে চিরকালই তাঁর অনুরক্ত থেকে যাবেন, তাতেও কোনো সন্দেহ নেই। এটা ভাবলেও বাড়াবাড়ি হবে না প্রেমবার্গ-এর কুসংস্কারগ্রস্ত লোকজন কোনো অলৌকক কীর্তির জন্যে অপেক্ষা করে আছে, তারা এই আশ্চর্য ও অলৌকিককে স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করতে চায়। শহরে আজকাল যে-সব জনরব শোনা যাচ্ছে, তা থেকে অনুমান হয় গোরস্থান সেদিন অদ্ভুত অসম্ভব কোনো দৃশ্যের পটভূমি হয়ে উঠবে। যদি সাধারণ ভয়ভীতির মধ্যে সেদিন কবরের পাথর ঠেলে সরিয়ে এই অদ্ভুতকর্মা কিমিয়াবিদ আবার উঠে দাঁড়ান, প্রেমবার্গ-এর লোক তাতে আদৌ অবাক হবে না।

কারু-কারু মতে, অটো স্টোরিৎস আদৌ মারা যাননি, এবং তাঁর অন্ত্যেষ্টি ছিলো নিছকই একটি ধাপ্পা।

এই আজগুবি বুজুর্গ-এর অবিশ্বাস্য কীর্তিকথা নিয়ে আমরা অধিকতর বাক্যব্যয় করতে চাই না। তবে সকলেই তো জানেন, কুসংস্কারের সঙ্গে কদাপি যুক্তি বা কাণ্ডজ্ঞানের কোনো সম্পর্ক নেই। এবং কাণ্ডজ্ঞান যখন এইসব হাস্যকর কিংবদন্তির সমূহ বিনাশ ঘটাবে, তার আগে নিশ্চয়ই আরো-অনেক বছর জাদুবিশ্বাসেই কেটে যাবে।

এই লেখাটা পড়ার পর কতগুলো মন-খারাপ-করা চিন্তার উদয় হয়ে গিয়েছিলো আমার মধ্যে। অটো স্টোরিৎস যে মারা গেছেন, তাকে যে যথারীতি কবর দেয়া হয়েছে, এ সম্বন্ধে ককখনো কারু মনে কোনো সন্দেহ ছিলো না। ২৫শে মে সেই তার কবরটা যে খুলে যাবে আর তিনি কোনো নতুন ল্যাজারাসের মতো ভিড়ের সামনে এসে আবির্ভূত হবেন–এটা এমনই-এক অদ্ভুত কুসংস্কার যে এ-সম্বন্ধে দ্বিতীয়বার কিছু ভাবারও অবকাশ নেই। তবে পিতার মৃত্যু বিষয়ে কোনো প্রশ্ন যেমন ওঠে না, তেমনি এটাও তো মেনে নিতে হবে পুত্রটি বহালতবিয়তেই আছেন, এবং রডারিখ পরিবার কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত ভিলহেল্ম স্টোরিৎসই যে ঐ পুত্রসন্তান সে-বিষয়েও কোনো সন্দেহ নেই। সে-যে মার্ককে কোনো মুশকিলে ফেলবে না–এটা কিন্তু কেউই নিশ্চয় করে জানে না; বিয়ের সময় সে নানারকম ওজর-আপদ তৈরি করতেই পারে।

নাঃ, কাগজটা টেবিলে ছুঁড়ে ফেলে আমি নিজেকেই বুঝিয়েছি, আমি বড্ড যুক্তিহীন হয়ে উঠছি। ভিলহেল্ম স্টোরিৎস মাইরার পাণিপ্রার্থনা করেছিলো, এবং তার প্রস্তাব উপেক্ষা করা হয়েছিলো…তো কী? তারপর থেকে এই স্টোরিসের তো কোনো পাত্তাই পাওয়া যায়নি, আর মার্কও এ নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য করেনি। আমার তবে কেন খামকা মনে হচ্ছে এই ঘটনাটার মধ্যে বিপদের বীজ লুকিয়ে আছে।

আমি তক্ষুনি মার্ককে একটা চিঠি লিখতে বসে গিয়েছি, তাকে জানিয়েছি যে আমি পরদিনই বুড়াপেন্ট থেকে রওনা হয়ে যাবো, আর রাগস গিয়ে পৌঁছুবো ১১ই মে-র অপরাহ্,ে কারণ আমি তো রাগৎস থেকে এখন মাত্র পঁয়ষট্টি লিগ দূরে আছি। এটাও উল্লেখ করেছি যে এ-যাবৎ আমার যাত্রায় না-কোনো অযথা বিলম্ব করার কারণ ঘটেছে, না-বা কোনো অভাবিত উৎপাত এসে হাজির হয়েছে, ফলে আমার ধারণা বাকি পথটুকুও উপদ্রবহীন কেটে যাবে। সেইসঙ্গে অবশ্য ডাক্তার ও মাদাম রডারিখকে সম্ভাষণ জানাতে আমি ভুলিনি, মাদমোয়াজেল মাইরারও কুশল কামনা করেছি; ঠিক। জানতুম মার্ক পত্রপাবামাত্র যথাস্থানে বার্তা পৌঁছে দেবে।

পরদিন সকাল আটটায় ডরোথি তার নোঙর তুলে তার গন্তব্যের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়েছে। এটা তো বলাই বাহুল্য যে, ভিয়েনা ছাড়ার পর থেকেই যতবার আমরা থেমেছি ততবারই যাত্রীদের ওঠানামা চলেছে, পুরোনো যাত্রীরা অনেকেই নেমে গেছে, আবার নতুন যাত্রীরা এসে বজরায় উঠেছে। শুধুমাত্র পাঁচ-ছজন যাত্রীই–তাদের মধ্যে দু-তিনজন ইংরেজও ছিলো–অস্ট্রিয়ার রাজধানীতে বজরায় উঠেছিলো–তারা নামেনি, তারা সরাসরি কৃষ্ণসাগরের দিকে চলেছে। অন্য জায়গার মতো, বুড়াপেটেও, কিছু নতুন যাত্রী এসে ডরোথিতে উঠেছিলো। তাদের মধ্যে একজন তার অদ্ভুত চেহারার জন্যে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলো। যাত্রীটির বয়েস পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ, ঢ্যাঙা, গলানো সোনার মতো চুল মাথায়, চোখ দুটি জ্বলজ্বলে নীল, মুখ-চোখে কেমন-একটা রূঢ় বিরূপ ভঙ্গি। তার হাবভাবে কেমন-একটা বিশ্রী ঔদ্ধত্যের ছাপ। যতবারই সে ডরোথি-র কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলেছে, ততবারই তার কথাবার্তায় একটা রুক্ষ কাটা-কাটা ভঙ্গি ফুটে বেরিয়েছে। এই যাত্রীটির মধ্যে অন্য-কারু সম্বন্ধে কোনো গরজ বা কৌতূহলই ছিলো না। তাতে অবশ্য আমার কিছুই এসে যায়নি, কেননা অ্যাদ্দিন অব্দি আমি সহযাত্রীদের সঙ্গে একটা ভদ্র ও শোভন দূরত্ব বজায় রেখেই চলেছি। শুধু বজরার কাপ্তেনের সঙ্গেই আমার যা দু-চারটে কথাবার্তা হয়েছে।

এই যাত্রীটির কথা যতবারই আমার মনে হানা দিয়েছে, ততবারই আমার ধারণা হয়েছে সে নিশ্চয়ই আসলে আলেমান, সম্ভবত প্রশিয়া থেকে এসেছে–সেটা প্রায় যেন বোঝাই যাচ্ছিলো, কেননা তার সবকিছুর মধ্যেই কেমন-একটা রুক্ষ টিউটনিক ছাপ। মাগিয়ারদের সঙ্গে তাকে গুলিয়ে ফেলাটা আদপেই যেন সম্ভব ছিলো না–তাছাড়া বীর মাগিয়াররা চিরকালই ছিলো ফ্রাসের প্রকৃত বন্ধু।

পাঠক নিশ্চয়ই অবাক হবেন–যদি ধরেই নেয়া যায় কোনোদিন আমার কোনো পাঠক জুটবে!–যদি আমার যাত্রাটা এতই নির্বিঘ্ন ও ঘটনাহীন হয়ে থাকে, তবে কেন এই কাহন আমি শুরু করেছিলুম যাত্রাটাকে অদ্ভুত বা আশ্চর্য বলে অভিহিত করে। তা যদি তার মনে হয়ে থাকে, তবে আমার সেই পাঠককে একটু ধৈর্য ধরতে বলবো। একটু পরেই তিনি দেখতে পাবেন আমার এই ভ্রমণবৃত্তান্তটা সত্যি কতটা রহস্যময় আর অদ্ভুত হয়ে উঠেছিলো।

সত্যি-বলতে, বুড়াপেস্ট ছাড়ার পর-পরই একটা ঘটনা ঘটেছিলো যার কথা ভাবলে এখনও আমার আশ্চর্য লাগে। সত্যি-বলতে ঘটনাটি ছিলো অতীব তুচ্ছ ও অকিঞ্চিৎকর। এমন তুচ্ছ-কোনো বিষয় নিয়ে কাহন ফঁদতে গিয়ে এই খটকাটা জাগবেই যে সত্যি একে কোনো ঘটনা বলা যাবে কি না। তাছাড়া হয়তো পুরোটাই ছিলো কল্পনার সৃষ্টি–অন্তত ব্যাপারটা যে আদপেই বাস্তব নয় তার প্রমাণ আমি তো প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই পেয়েছিলুম। ব্যাপারটা না-হয় খুলেই বলা যাক।

আমি দাঁড়িয়েছিলাম গলুইয়ের কাছে, আমার তোরঙ্গটার পাশেই–তার ডালার ওপর একটা কাগজ সাঁটা ছিলো, তাতে যে-কেউই আমার নাম, ধাম, পেশা সম্বন্ধে সমস্ত তথ্যই পেয়ে যেতে পারতো। রেলিঙের ওপর ভর দিয়ে আমি অলস শূন্য চোখে দানিউবের দৃশ্য দেখছিলুম; আর এটাও সোজাসুজি বলে রাখি, আমি তখন কিছুই ভাবছিলুম না।

হঠাৎ কেমন-একটা অদ্ভুত অনুভূতি হলো আমার–কে যেন ঠিক আমার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে।

এটা সত্যি যে আমাদের কারুই পেছনে কোনো চোখ নেই, তবু অনেকেই নিশ্চয়ই এই অনুভূতি বোধ করেছেন যদি তাদের অজ্ঞাতসারেই কেউ একদৃষ্টে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। আসলে যে-অনুভূতিটা তখন হচ্ছিলো, আমি তা হয়তো ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারছি না। আর-কিছু না-হোক, অনুভূতিটা কেমন যেন কুহেলিভরা ছিলো। এটা ঠিক যে অন্তত সেই মুহূর্তে আমি তা-ই অনুভব করেছিলুম।

এবং অমনি আমি পেছন ফিরে তাকিয়েছি–আর আশ্চর্য!-আমার আশপাশেই কেউ তখন ছিলো না।

পেছন ফিরে কাউকে দেখতে পাবো–এই ধারণাটা এমনই তীব্র ছিলো যে পেছন ফিরে সত্যি যখন কাউকে দেখতে পাইনি, আমি কেমন ভড়কে গিয়েছি। শেষটায় অবশ্য প্রত্যক্ষ (কিংবা অপ্রত্যক্ষ) প্রমাণটাকেই স্বীকার না-করে উপায় থাকেনি–আমার সহযাত্রীদের মধ্যে সবচেয়ে কাছে যিনি ছিলেন তাঁর সঙ্গে আমার দূরত্ব ছিলো অন্তত দশ ফ্যাদম।

স্নায়ুর এই বেশামাল অবস্থার জন্যে নিজেকেই তিরস্কার করতে-করতে আমি আবার রেলিঙ ধরে নদীর দৃশ্যের দিকে তাকিয়েছি, আর নিশ্চয়ই এই নিতান্তই তুচ্ছ ঘটনাটা আমার মনেই থাকতো না যদি-না এর পরে যে-সব অপ্রত্যাশিত ঘটনাবলির আবর্তে গিয়ে আমি পড়েছিলুম সেগুলো এই অলৌকিক ঘটনাকে ফের আমার স্মৃতির মধ্যে জাগিয়ে দিতো।

তখন অবশ্য এ-ব্যাপার নিয়ে আমি আর কিছুই ভাবিনি, মনের ভুল বলেই সব মন থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়েছি, আর তাকিয়ে থেকেছি বদলে-যেতে-থাকা দানিউবের জলের দিকে–জলের ওপর রোদ্দুর পড়ে কেমন-একটা মরীচিৎকার মতো মায়া রচনা করে বসেছিলো তখন।

পরের দিনে আর-কোনোকিছুই ঘটেনি, আর ৯ই মে আমরা আবার যথাসময়ে নোঙর তুলে বেরিয়ে পড়েছি।

ন-টা নাগাদ, ঠিক যখন আমি ক্যাবিনে ঢুকতে যাবো, দেখি সেই সোনালিচুল আলেমান যাত্রীটি ক্যাবিন থেকে বেরিয়ে আসছে। প্রায় ধাক্কাই খেতে যাচ্ছিলুম তার সঙ্গে এমন আচমকা সে বেরিয়েছিলো, আর তারপরে সে যে-রকম অদ্ভুত চোখে আমাকে নিরীক্ষণ করেছিলো তাইতেই আমি কেমন ভ্যাবাচাকা খেয়ে গিয়েছিলুম। এই-প্রথম দৈব আমাদের মুখোমুখি এনে ফেলেছে, অথচ তবু তার দৃষ্টিতে কেমন-একটা উদ্ধত তাচ্ছিল্যের ভাব–আর সেইসঙ্গে দৃষ্টির মধ্যে মেশানো ছিলো–আমি হলফ করে বলতে। পারি–অদ্ভুত-একটা বিজাতীয় ঘৃণার ভাব।

আমার বিরুদ্ধে কী রাগ সে পুষে রেখেছিলো? আমি ফরাশি বলেই কি তার মধ্যে অমন তাচ্ছিল্য আর ঘৃণার ভাব? কেননা তক্ষুনি আমার মনে পড়ে গিয়েছিলো যে সে তো ক্যাবিনে আমার তোরঙ্গটার ওপরই আমরা নামধাম পড়ে ফেলতে পেরেছে। হয়তো সেইজন্যেই সে অমন অদ্ভুতভাবে আমার দিকে তাকিয়ে থেকেছে। বেশ, সে যদি আমার নাম জেনেই থাকে, তো কী? আমি গায়ে পড়ে তার নামধাম জানতে যাবো না। তার সম্বন্ধে কোনো কৌতূহলই নেই আমার। তার সঙ্গে আলাপ করারও গরজ নেই কোনো।

দশ তারিখে লোকটার সঙ্গে বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছে ডেকের ওপর, আর প্রতিবারই সে যেমন করে আমার দিকে তাকিয়ে থেকেছে যেটা আমার মনে হয়েছে ভারি বিরক্তিকর। আমি এমনিতে গায়ে পড়ে কখনও কারু সঙ্গে ঝগড়া বাধাতে চাই না, সেটা আমার ধাতেই নেই, কিন্তু তাই বলে এমন বিচ্ছিরিভাবে ঠোঁট বেঁকিয়ে কেউ আমার দিকে ঠায় তাকিয়ে থাকবে, সেটা বিনাবাক্যব্যয়ে সহ্য করে চলাও ছিলো আমার পক্ষে মুশকিল। তার যদি আমাকে কিছু বলারই থেকে থাকে, তবে এই উদ্ধত লোকটা সে-কথা সরাসরি মুখ ফুটে বলে ফেলছে না কেন? এ-রকম পরিস্থিতিতে কেউ তো শুধু চোখের ভাষাতেই কথা বলে না, আর সে যদি ফরাশি না-ই জানে আমি তো তার নিজের ভাষাতেই তার কথার জবাব দিয়ে তার সব কৌতূহল নিবৃত্ত করতে পারতুম। তবে দৈবাৎ যদি এই টিউটন মাতব্বরটির সঙ্গে আমাকে কখনও কথাই বলতে হয়, তবে তার সম্বন্ধে একটু খোঁজখবর নেয়া উচিত আমার। কাজেই আমি ডরোথির কাপ্তেনের কাছে গিয়ে জিগেস করেছি তিনি এর সম্বন্ধে কিছু জানেন কি না।

এঁকে এই প্রথমবারই চোখে দেখছি আমি, কাপ্তেন আমায় জানিয়েছেন।

লোকটা জার্মান, আমি তাকে তাতাবার চেষ্টা করেছি।

তাতে তো কোনো সন্দেহই নেই, মঁসিয় ভিদাল, তবে আমার মনে হয় এ হচ্ছে ডবোল-জার্মান, সাধারণ জার্মানের দুনো, নিশ্চয়ই পুঁশিয়ান।

তা, দুনো না-হয়ে নিছক-জার্মান হলেই হতো! আমার মুখ থেকে কথাটা বেরিয়ে এসেছে । জানি, কথাটা বলা ঠিক হয়নি, কোনো ভদ্রলোকের মুখে এমনতর কথা মানায় না, এ মোটেই সুস্থ মার্জিত রুচির পরিচয় হয় না, তবে কাপ্তেন এ-কথা শুনে একটু খুশিই হয়েছেন, কেননা জন্মসূত্রে তিনি মাগিয়ার, হাঙ্গেরীয় ।

পরদিন, নদীর অগুনতি বাঁক ঘুরে, ডরোথি শেষকালে গিয়ে পৌঁছেছে ভুকোভার এ। সেই শহরটা ছেড়ে আসবার পর সেই জার্মানটিকে জাহাজে আর দেখতে পাইনি আমি, তার মানে সে নিশ্চয়ই ভুকোভার-এই নেমে গিয়েছে। যাক, আমি ভেবেছি, লোকটার হাত থেকে অবশেষে রেহাই পাওয়া গেলো, না-হলে আমাকে হয়তো তার কাছে ঐ অস্বাভাবিক তাকিয়ে-থাকার জন্যে একটা কৈফিয়ৎ চাইতে হতো।

তবে, তখনও, আমার মন অন্য-কতগুলো চিন্তায় ভারাক্রান্ত ছিলো। আর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তো রাগৎস-এ গিয়ে পৌঁছুবো। এক বছরেরও ওপর হলো মার্কের সঙ্গে আমার ছাড়াছাড়ি হয়েছে-এবার আবার তার সঙ্গে দেখা হবে, তার মারফৎ তার হবু-শ্বশুরবাড়ির সঙ্গেও আলাপ হবে। আমি সেই চিন্তাতেই মশগুল হয়ে ছিলুম।

বেলা পাঁচটা নাগাদ, বামতীরের গাছপালার আড়াল দিয়ে, কতগুলো চার্চের দেখা পাওয়া গেলো, কতগুলোর মাথায় উঁচু-উঁচু গম্বুজ, কতগুলোর মিনার আবার যেন আকাশের পটে এঁকে রেখে গেছে কেউ। সেই মস্ত শহরটার প্রথম যা চোখে পড়ে জাহাজ থেকে, তা এই চার্চগুলোই, নদীর শেষ মোহানাটায় শহরটা পুরোপুরি উম্মোচিত হয়েছে চোখের সামনে, কতগুলো উঁচু পাহাড়ের তলায় ছবির মতো সাজিয়ে বসানো –একটু উঁচু পাহাড়ের ওপর দেখা গেলো পুরোনো-একটা দুর্গ, হাঙ্গেরির পুরোনো শহরগুলোর যেন কুললক্ষণই এ-সব কেল্লা।

হাওয়ার চালে বজরাটা যখন জেটিতে এসে ভিড়বে, ঠিক তখনই আমার ভ্রমণ বৃত্তান্তের দ্বিতীয় রহস্যময় ঘটনাটি ঘটেছে। এটা ঠিক বলবার মতো কোনো তথ্য কিনা, তা আমার জানা নেই।… পাঠককে নিজেই তার বিচার করে নিতে হবে।

আমি দাঁড়িয়েছিলুম গ্যাঙওয়েতে, তীরের দিকে তাকিয়ে; বেশির ভাগ যাত্রীই তাড়াহুড়ো করে তখন নামবার চেষ্টা করছে। তীরে, যেখানে গ্যাঙওয়ে গিয়ে লেগেছে, সেখানে কয়েকটা ছোটো-ছোটো দলে ভাগ হয়ে কিছু লোক দাঁড়িয়েছিলো–মার্ক যে এদেরই মধ্যে কোথাও আছে, তাতে আমার কোনো সন্দেহ ছিলো না।

তারপর, যখন আমি মুখ তুলে তাকিয়ে তাকে আবিষ্কার করার চেষ্টা করছি, তখন শুনতে পেলুম, খুব কাছে থেকেই কে যেন আলেমান ভাষায় কাটা-কাটা ভাবে অপ্রত্যাশিত কথাগুলো বলছে : মার্ক ভিদাল যদি মাইরা রডারিখকে বিয়ে করে, তবে সর্বনাশ হোক মাইরার, সর্বনাশ হোক মার্কের!

শোনবামাত্র, আমি তড়াক করে ঘুরে দাঁড়িয়েছি… কেউ নেই আমার আশপাশে, আমি একই আছি! অথচ এইমাত্র কেউ আমার সঙ্গে কথা বলেছে! আমি স্পষ্ট শুনতে পেয়েছি কথাগুলো, আর আমি এ-কথাও জোর দিয়ে বলতে পারি এই অপ্রত্যাশিত কণ্ঠস্বর আদৌ আমার অপরিচিত ছিলো না!…

অথচ কেউই নেই আশপাশে, আবারও বলছি, কেউই ছিলো না ধারে-কাছে! কথাগুলো শুনেছি বলে যে মনে হয়েছে তা নিশ্চয়ই আমার বিভ্রম, নাস্তানাবুদ ঘাবড়ে যাওয়া কল্পনার ফসল, কোনো অলীক ও বেঘোর মায়া… আমার স্নায়ুগুলো নিশ্চয়ই কোনোকারণে একবারে ছিঁড়ে যেতে বসেছে, না-হলে দু-দিনের মধ্যেই দু-দুবার এমন ভুল।… হতভম্ব, ভ্যাবাচাকা, আমি আবারও চারপাশে তাকিয়ে দেখেছি!… তারপর কাধ আঁকিয়ে, অসহায়ভাবে, নিজেকে মনের জোর আনতে বলে, তীরে নেমে-যাওয়া ছাড়া আমার আর কীই-বা করার ছিলো।

আর আমি তা-ই করেছি, তীরে নেমে ভিড়ের মধ্যে দিয়ে পথ করে বেরিয়ে এসে চেষ্টা করেছি মার্ককে কোথাও চোখে পড়ে কিনা, তাকিয়ে দেখতে।

.

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

যা ভেবেছি, মার্ক আমার জন্যে অপেক্ষা করছিলো। দেখেই, দুজনে দুজনকে জড়িয়ে ধরেছি। তারপর মার্ক আমার হাত চেপে ধরে রুদ্ধ স্বরে বলে উঠেছে : অঁরি … অঁরি! শুধু-যে তার গলাতেই আবেগ ছিলো তা নয়, তার চোখে দুটোও জলে ভরে উঠেছিলো–ওদিকে সারা চোখমুখে আবার সেইসঙ্গেই ফুটে উঠেছে আনন্দের উদ্ভাস।

আয়, মার্ক, আমি বলেছি, ফের হাতে হাত দেয়া যাক। তারপর অনেক দিন পর দুই ভাইয়ের মধ্যে দেখা হবার প্রথম আবেগপ্লুত মুহূর্ত কেটে যাবার পর আমি তাকে বাস্তব অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করেছি, বলেছি :চল। এখান থেকে যাওয়া যাক। তুই আমাকে তোর সঙ্গে নিয়ে যেতে এসেছিস তো!

হ্যাঁ । তোকে আমার হোটেলেই নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করেছি। হোটেলটা কাছেই, দশ মিনিটের পথও নয়। কিন্তু আয়, তার আগে তোর সঙ্গে আমার হবু শ্যালকের আলাপটা করিয়ে দিই।

ততক্ষণ অব্দি আমি খেয়াল করিনি যে মার্কের পেছনেই সামরিক ধরাচুড়ো পরা পদাতিক বাহিনীর একজন কাপ্তেন দাঁড়িয়ে আছে। বয়েস বেশি হলে হবে আঠাশ বছর, ঢ্যাঙা, চেস্টনাট রঙের দাঁড়িগোঁফ, কী-রকম একটা মাগিয়ার আভিজাত্য ফুটে বেরুচ্ছে চেহারা থেকে, যেন আজন্ম লোককে হুকুম করতেই সে অভ্যস্ত। অথচ তার চোখে অভ্যর্থনার ছাপ, মুখে মৃদু হাসি।

মার্ক পরিচয় করিয়ে দিয়েছে : কাপ্তেন হারালান রডারিখ!

কাপ্তেনের প্রসারিত হাত দু-হাতে তুলে নিয়ে আমি সম্ভাষণ জানিয়েছি।

আর সে বলেছে : মঁসিয় ভিদাল, আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে আমরা সবাই যে কতটা খুশি হয়েছি তা বলে বোঝাতে পারবো না। আপনি ভাবতেও পারবেন না আমাদের গোটা পরিবারটা কেমন অধীরভাবে আপনার আগমনের প্রতীক্ষা করছিলো!

মাদমোয়াজেল মাইরাও খুশি হয়েছেন তো? আমি একটু ফোড়ন কেটেছি।

মার্ক আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলেছে : নিশ্চয়ই! আর অঁরি, এটা মোটেই মাইরার দোষ নয় যে তোরা ভিয়েনা ছাড়বার পর থেকে ডরোথি ঘণ্টায় দশ লিগ পথও যেতে পারেনি!

একটুক্ষণের মধ্যেই আমি টের পেয়েছি যে কাপ্তেন হারালান চমৎকার ফরাশি বলে, সাবলীলভাবে, তার বাড়ির সকলেই স্বচ্ছন্দে ফরাশি বলে, কারণ তারা ফ্রাসে বেড়িয়ে গিয়েছে আগে । তাছাড়া আমার আর মার্কের আলেমান ভাষায় দখলও যথেষ্ট, আর হাঙ্গেরীয় ভাষারও দুটো-একটা কথা আমি জানি। ফলে আমাদের কথাবার্তায় এই তিনটে ভাষাই অনায়াসে মিলে-মিশে যাচ্ছিলো।

একটা কোচবাক্সে করে মালপত্তর সমেত আমরা হোটেলে এসে পৌঁছেছি।

পরদিন প্রথমবার আমি রডারিখ পরিবারকে সম্ভাষণ জানাতে যাবো, এই ব্যবস্থা। করে মার্কের সঙ্গে হোটেলের মস্ত আরামপ্রদ ঘরটায় তারপর কয়েকঘণ্টা কাটিয়ে দিয়েছি আমি, মার্ক থাকে এই হোটেলেরই পাশের ঘরে, রাগৎস-এ পদার্পণ করার পর থেকেই এইঘরেই সে থাকে।

তারপর মার্ক, আমি বলেছি, তাহলে আবার দুই ভাইয়ে দেখা হলো–দুজনেরই তো শরীরস্বাস্থ্য দিব্বি ভালোই আছে।

হ্যাঁ, অঁরি, আমার ছোটোভাইটি বলেছে, ক্যালেণ্ডারের হিশেবে একবছরের একটু বেশি, অথচ মনে হচ্ছে কতদিন যেন দুজনের মধ্যে দেখা হয়নি। মাইরা না-থাকলে এই সময়টাকেই আরো দীর্ঘ ও অসহ্য বলে বোধ হতো। শেষের কয়েক মাস মাইরার সঙ্গে আলাপ হবার পর যেন চক্ষের পলকে কেটে গিয়েছে। তা, অবশেষে, এখানে তোর আবির্ভাব হলো। এটা ভাবিসনি যে এই ক-দিনের অনুপস্থিতিতে আমি বেমালুম ভুলে গিয়েছি তুই আমার বড়োভাই-তোর দাদাগিরির কথা আমি মোটেই ভুলিনি।

দাদাগিরি বলছিস কেন, মার্ক? আমরা তো ভালো বন্ধুও।

তা তুই ভালো করেই জানিস, অঁঁরি। সেইজন্যেই তোর অনুপস্থিতিতে কিছুতেই আমাদের বিয়েটা হতে পারতো না। আর, তাছাড়া, বিয়ের আগে আমি তোর কাছ থেকে একটা অনুমতিও তো চাচ্ছি।

অনুমতি?

বাঃ রে, বাবা বেঁচে থাকলে তার কাছ থেকে অনুমতি চাইতুম না বুঝি আমি? তবে বাবাও যেমন বিয়ের প্রস্তাবটা প্রত্যাখ্যান করতেন না, তেমনি তুইও কোনো বাগড়া দিবি না–এটা আমি জানি। বিশেষত একবার মাইরার সঙ্গে দেখা হলেই তুই বুঝতে পারবি…।

তোর চিঠি থেকেই মনে হয় তাকে আমি জেনে গিয়েছি। তাছাড়া এও আমি জানি তুই কত সুখী হয়েছিস।

তুই ভাবতেও পারবি না আমি কীরকম সুখী হয়েছি। তবে তোর সঙ্গে তো ওর দেখা হবে, তুই নিজেই আন্দাজ করে নিতে পারবি ওকে কেমন পছন্দ করা যায়, তুইও ওকে স্নেহ করবি-এ আমি ঠিক জানি। সত্যিকার এক ছোটোবোন পাবি

তা, ছোটোবোনটিকে সাদর অভ্যর্থনা জানাই। তোর পছন্দে যে কোনো খুঁত থাকবে না, এ আমি জানি, মার্ক । কিন্তু আজই কেন আমরা ডাক্তার রডারিখের বাড়ি যাচ্ছি না।

না-না, কাল যাবো… আমরা ভাবতেও পারিনি যে তোর বজরা এত তাড়াতাড়ি এসে পৌঁছুবে, ভেবেছি তুই আজ সন্ধের পর এসে পৌঁছুবি। নেহাৎ বিচক্ষণ আর দূরদর্শী বলেই আমি আর হারালান সকালবেলায় জাহাজঘাটায় গিয়েছিলুম, ভেবেছিলুম। সাবধানের মার নেই–ডরোথি হয়তো আগেই চলে আসতে পারে। সেইজন্যেই তুই ঘাটে পা দেবামাত্র তোর সঙ্গে আমাদের দেখা হলো। ইশ! মাইরা যদি জানতো!… তোকে অভ্যর্থনা করতে যেতে পারেনি বলে বেচারা নিশ্চয়ই ভারি কষ্ট পাবে ।… হ্যাঁ, যা বলছিলুম, কালকের আগে তুই আসতে পারবি না ভেবে, মাদাম রডারিখ তার মেয়েকে নিয়ে আজ এক জায়গায় নিমন্ত্রণে গেছেন । কাল তারা তোর কাছে এইজন্যে ক্ষমা চাইবেন।

বেশ। তা-ই হবে তাহলে। এখন বরং শোনা যাক এই দীর্ঘ একবছরে তুই কী করেছিস।

মার্ক তারপর কাহন কেঁদেছে, পারী ছাড়বার পর থেকে সে কী-কী করেছে, কোথায় কোথায় গেছে, কোন-কোন শহরে তার নামডাক হয়েছে, ভিয়েনা আর স্পেমবার্গ-এ কেমন ছিলো সে, বিশেষত কীভাবে ও-সব শহরে শিল্পের আর শিল্পীদের জগৎ কেমন সাগ্রহে দুয়ার খুলে তাকে বরণ করে নিয়েছিলো। কিন্তু এ-সব গল্প আমায় নতুন-কোনো তথ্যই জোগায়নি। মার্ক ভিদালের নাম স্বাক্ষর করা যে-কোনো পোর্ট্রেটই এখন ধনী অস্ট্রিয়ান আর ধনী মাগিয়ারদের মধ্যে যে চড়া দামে বিকোয়, তা তো আমি আগেই জেনে গিয়েছি।

এত লোকের চাহিদা আমি আদপেই মেটাতে পারিনি, অঁরি । সবখান থেকে অনবরত তাগিদ আসছিলো, বায়না আসছিলো। প্রেমবার্গের বুর্জোয়াদের মধ্যে মুখে মুখেই ছড়িয়ে গিয়েছিলো যে প্রকৃতির চাইতেও ভালো করে কাউকে খুটিয়ে তুলতে পারে মার্ক ভিদাল। কাজেই, মার্ক রসিকতা করে বলেছে, শিগগরিই একদিন হয়তো ভিয়েনার রাজসভা থেকে তলব আসবে, রাজসভার সবাইকার পোর্ট্রেট এঁকে দিতে হবে।

সাবধান কিন্তু, মার্ক, সাবধান। তোকে যদি এখন রাগস ছেড়ে ভিয়েনার রাজসভায় গিয়ে পারিষদদের ছবি আঁকতে বসে যেতে হয়, তবে সেটা তেমন সুবিধের ব্যাপার হবে না!

জাগতের সবচেয়ে জাহাবাজ এত্তেলা পেলেও আমি তাকে কোনো পাত্তা দেবো না, অঁরি । অন্তত এই মুহূর্তে কারু কোনো পোর্ট্রেট আঁকার প্রশ্নই ওঠে না। কিংবা অন্যভাবে ঘুরিয়ে বলতে পারি, আমার শেষ পোট্রটটা আমি এঁকেই ফেলেছি।

মাইরার?

মাইরার–আর ওতে কোনো সন্দেহই নেই যে আমার জীবনের সবচেয়ে উঁচা কাজ হয়েছে ওটাই।

কে জানে? আমি বলে উঠেছি, কোনো শিল্পী যখন কোনো পোর্ট্রেটের চাইতে তার মডেল নিয়েই বেশি মাথা ঘামায়

তা, অঁরি, সেটা তুই নিজের চোখেই দেখতে পাবি।… আবারও তোকে বলছি, প্রকৃতির নিজের হাতের কাজের চাইতেও ভালো–সত্যি যা হওয়া উচিত!… লোকে তো বলে, সেটাই নাকি আমার ঈশ্বরদত্ত ক্ষমতা!… তবে, এটা ঠিক যে মাইরা যখন ছবি আঁকবার জন্যে বসেছিলো, আমি ছবি আঁকবো কি, ওর ওপর থেকে চোখই সরাতে পারিনি। ওর কাছে কিন্তু ব্যাপারটা ঠিক ঠাট্টা ছিলো না। সে তো আর বাত্তকে নয়, শিল্পীকেই ঐ দুটি ঘণ্টা দিতে চেয়েছিলো,… আর আমার তুলি পটের ওপর যেন ছিটকে চলেছিলো… আর কেমন দুর্ধর্ষ আবেগ ছিলো তুলির… মাঝে-মাঝে মনে হচ্ছিলো গালাতেয়ার মূর্তির মতো এই ছবিটাও বুঝি জ্যান্ত হয়ে উঠবে।

ধীরে, পিগমালিয়ন, ধীরে! বরং খুলে বল তো রডারিখ পরিবারের সঙ্গে তোর আলাপ হলো কী করে?

সে-তো কপালে লেখা ছিলো।

তাতে আমার কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু তবু…

আমি রাগৎস এসে পৌঁছুবামাত্র এখানকার অভিজাত মহলের ড্রয়িংরুমের দরজা আমার জন্যে খুলে গিয়েছিলো। আর আমারও তাতে কোনো আপত্তি ছিলো, না–বিদেশ বিভুয়ে একটা অচেনা শহরে অন্তত দীর্ঘ সন্ধ্যাবেলাগুলো কাটাবার একটা উপায় হলো তো! এইরকমই একটা বাড়িতে সন্ধেবেলার একটা পার্টিতে কাপ্তেন হারালানের সঙ্গে আবার নতুন করে আলাপ জমাবার সুযোগ হয়ে গেলো।

আবার? মানে?

হ্যাঁ, অঁরি, আবার। কারণ বুড়াপেন্ট-এ এর আগে তার সঙ্গে আমার কয়েকবার দেখা হয়েছিলো। সামরিক বাহিনীতে তার দারুণ সুনাম, সকলেরই ধারণা ভবিষ্যতে একজন কেউকেটা হবে, অথচ দারুণ ভদ্র, আদৌ দেমাক-টেমাক নেই। তা, তারপর থেকেই রোজই সন্ধেবেলায় তার সঙ্গে দেখা, আড্ডা, শেষটায় বন্ধুতাই হয়ে গেলো। একদিন এসে বললে বাড়ির লোকদের সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দিতে চায়, আর আমিও তক্ষুনি একপায়ে খাড়া, কারণ তারই আগে একটা পার্টিতে মাইরার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়ে গিয়েছিলো, আর…

আর, আমি হেসে বলেছি, বোনটিও যেহেতু ভাইয়ের চাইতে কম মনোহারিণী নন, অতএব তুই রডারিখদের বাড়ি যাওয়া শুরু করে দিলি।

হ্যাঁ, অঁরি, আর গত তিনমাসে একটা সন্ধেও বাদ যায়নি, যেদিন আমি ওদের বাড়ি যাইনি। কিন্তু আমি মাইরা সম্বন্ধে যা-ই বলি না কেন, তুই নিশ্চয়ই ভাববি আমি বাড়িয়ে বলছি…

না, তা আমি বলছি না মোটেই। আমি ঠিক জানি তোর ভাবী স্ত্রী সম্বন্ধে তুই নিশ্চয়ই কিছু বাড়িয়ে বলছিস না। তাছাড়া এটা তো ঠিক যে তুই হাঙ্গেরির একটি বিশেষ সম্ভ্রান্ত পরিবারে বিয়ে করতে যাচ্ছিস

হ্যাঁ, অঁঁরি, মার্ক বলেছে, চিকিৎসক হিশেবে ডাক্তার রডারিখকে সারা দেশের লোক শ্রদ্ধাভক্তি করে, তাছাড়া মাইরার মাতৃদেবীও সম্মানিতা মহিলা, সমাজসেবার জন্যে তাঁর দারুণ নাম–

এবং এই দম্পতি যেন আসলে অপার্থিবই। সারা ফ্রান্স ছুঁড়ে বেড়ালেও তুই হয়তো এঁদের মতো শ্বশুর-শাশুড়ি খুঁজে পেতিস না। তাই না, মার্ক?

হ্যাঁ, তুই ঠাট্টাই করে চল। যত-ইচ্ছে ফোড়ন কাট। তবে এটা মনে রাখিস আমরা এখন আর ফ্রাসে বসে নেই, বরং হাঙ্গেরিতে রয়েছি–মাগিয়ারদের এই দেশে পুরোনো দিনের ঐতিহ্য এখনও ধরে রেখেছে লোকে, অভিজাত্যকে লোকে এখানে। দাম দেয়

তারপর, বলুন, অভিজাতমশাই, কেননা ক-দিন পর তুইও তো আভিজাত্যের বড়াইই করবি।

অভিজাত্য থাকার মধ্যে আবার মন্দ কী আছে?

তা জানি না, তবে তোর এই প্রণয়োপাখ্যান খুব-একটা অসাধারণ-কিছু নয়–বরং এ-রকম গল্প হাজারগণ্ডা বলে দেয়া যায়। কাপ্তেন হারালানের সৌজন্যে তার পরিবারের সঙ্গে তোর আলাপ হলো, তারা ভদ্রতা করে তোকে সমাদর করেছেন, আর সেটাও অবাক কাণ্ড কিছু না–কারণ শিল্পী হিশেবে এরই মধ্যে তোর বেশ নামডাক হয়েছে। আর তারপর তুই মাদমোয়াজেল মাইরার রূপ দেখে একেবারে ভির্মি খেয়ে পড়েছিস

বল, তোর যা-ইচ্ছে।

সেইসঙ্গে মাদমোয়াজেল মাইরাও মার্ক ভিদালকে দেখে একেবারে মোহিত–

আমি কিন্তু তা বলিনি, অঁঁরি!

কিন্তু আমি বলছি–অন্তত সত্যের খাতিরে। আর ডাক্তার এবং মাদাম রডারিখ–তারা যখন বুঝতে পারলেন কী ঘটতে চলেছে, তারা কোনো আপত্তি করেননি। ফলে একদিন শুভক্ষণে মার্ক ভিদাল তার হৃদয়টা কাপ্তেন হারালানের কাছে খুলে ধরলেন। এবং কাপ্তেন হারালানও ব্যাপারটাকে বিরূপভাবে নেননি। বরং তিনি তার পিতামাতার কাছে গোপন কথাটি খুলে বললেন, তারা তারপর বললেন তাদের বিদুষী ও রূপসী কন্যাটিকে। তারপর মার্ক ভিদাল একদিন প্রকাশ্যে বিবাহের প্রস্তাব করলেন, কন্যাপক্ষ সেটি সানন্দে লুফে নিলে এবং প্রণয়োপাখ্যানটি এ-রকম বহু উপাখ্যানের মতোই ঘটাপটা করে শেষ হতে চলেছে–

তুই যাকে শেষ বলছিস, অঁঁরি, মার্ক মাঝখানে পড়ে বলেছে, আমার কাছে সেটাই কিন্তু সত্যিকার শুভারম্ভ বলে মনে হচ্ছে।

তুই ঠিকই বলেছিস, মার্ক, আমার গোড়া থেকেই শব্দের প্রয়োগ সম্বন্ধে সচেতন হওয়া উচিত ছিলো…তা বিয়ের দিনটা ধার্য হয়েছে কবে?

তুই এলে পর দিন ঠিক হবে, এইজন্যে অ্যাদ্দিন আমরা অপেক্ষা করছিলুম।

বেশ, যখন তোদের ইচ্ছে, তখনই হতে পারে…ছ-হপ্তা…ছ-মাস…কিংবা ছ বছর…

শুনুন, এনজিনিয়ার অঁরি, মার্ক উত্তর দিয়েছে, আমি জানি যে একজন এনজিনিয়ারের কাছে সময় কতটা মূল্যবান, এবং আপনি যদি ততদিন এই রাগংস নগরে কাটাতে চান তাহলে সারা সৌরজগৎই তো বানচাল হয়ে যাবে।

অর্থাৎ আমিই যাবতীয় বান, বন্যা, ভূমিকম্প এবং ঐজাতীয় সমস্ত দুর্বিপাকের জন্য দায়ী হবো!

হ্যাঁ, তা-ই। আর সেইজন্যেই আমরা অনুষ্ঠানটিকে ততদিন পেছিয়ে দিতে পারবো না।

বেশ, তাহলে পরশুই বিয়েটা হয়ে যাক, কিংবা চাইলে আজ সন্ধেতেই বিয়ে হতে আটকাচ্ছে কীসে?… তুই নিশ্চিন্ত থাকতে পারিস, মার্ক, যা দরকার আমি তা-ই বলবো। তুমি যতটা ভাবছিস, বিশ্বব্রহ্মাণ্ড নিয়মমতো চালাতে আমার অবশ্য ততটা কারদানি লাগে না। তাই মাসকাবারের আগেই আমি মঁসিয় ও মাদাম মার্ক ভিদালের বাড়িতে সান্ধ্যনেমন্তন্ন চাই।

সে-তো চমৎকার হবে!

কিন্তু, মার্ক, ঠাট্টা থাক। তোর সত্যিকার প্ল্যানটা কী বল তো? বিয়ের পরই কি তুই রাগৎস ছেড়ে চলে যেতে চাচ্ছিস?

সেটা এখনও ঠিক হয়নি, মার্ক আমায় জানিয়েছে, সে নিয়ে ভাববার জন্যে পরে ঢের সময় পাওয়া যাবে। ভবিষ্যৎ নয়, আমি এখন বর্তমান নিয়েই মশগুল। ভবিষ্যৎ বলতে শুধু এই বুঝি যে শিগগিরই আমার বিয়ে হতে চলেছে। তারপর কী হবে, সে আর আমি এখন ভাবতে পারছি না।

অতীত আমাদের আঁকড়ে ধরে নেই, আমি উদ্ধৃতি দিয়েছি, ভবিষ্যৎও এখনও এসে হাজির হয়নি। বর্তমানই সবকিছু।

এইভাবেই খাবার সময় আসা অব্দি আমাদের কথাবার্তা চলেছে। পরে, খাওয়া দাওয়া শেষ হলে পরে, আমরা দুজনে দুটো চুরুট জ্বালিয়ে দানিউবের বাম তীর ধরে হাঁটতে বেরিয়ে পড়েছি। বলাই বাহুল্য, তখনও আমাদের আলোচনার বিষয়বস্তু তেমন একটা পালটায়নি, তখনও মাইরা রডারিখকে ঘিরেই আমাদের কথা চলেছে। আর এই আলোচনা চলতে-চলতেই কী-একটা কথা থেকে হঠাৎ আমার মনে পড়ে গেছে : আমি পারী ছাড়বার আগে পুলিশ-লিউটেনান্ট আমায় কী বলেছিলেন। মার্ক এমন-কিছু ঘুণাক্ষরেও বলেনি যাতে মনে হতে পারে তাদের রোম্যান্সের মধ্যে কখনও-কিছু গণ্ডগোলের বিষয় ছিলো। অথচ এই প্রেমে মার্কের যদি কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী না-থেকে থাকে, সে নিশ্চয়ই অতীতে কখনও ছিলো, কেননা অটো স্টোরিৎস-এর ছেলে একদিন তার পাণিপ্রার্থনা করেছিলো। এ-রকম কোনো সম্ভ্রান্ত এবং বিদুষী ও রূপসী তরুণীর যে অনেক গুণমুগ্ধ ভক্ত থাকবে, তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই।

হঠাৎ আমার মনে পড়ে গেছে ডরোথি থেকে নামবার সময় আচমকা কী কথা আমি শুনতে পেয়েছিলুম বলে আমার মনে হয়েছিলো। তখনও আমার মনে হচ্ছিলো পুরোটাই নিশ্চয়ই আমার বিভ্রম ছিলো। সত্যি-যদি এই হুঁশিয়ারি কেউ উচ্চারণ করে থাকে, তবে তা থেকে কী সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে পারি? কে-যে এই কথাগুলো বলতে পারে তা কিছুই আমার মাথায় ঢোকেনি। কার স্বার্থ, এই হুমকি দিয়ে? বুড়াপেটে সেই যে জার্মানটি এসে বজরায় উঠেছিলো এ হয়তো তারই কাজ–কিন্তু তাও তো নয়-সে তো ভুকোভার-এই বজরা ছেড়ে নেমে গিয়েছিলো। তাহলে এ হয়তো অচেনা কারু মজা করবারই নমুনা–যদিও এমনতর মজার ধারণা আমার অন্তত ককখনো হতো না। ঘটনাটার কথা আমি অবশ্য মার্ককে বলিনি। তবে কোনো ছুতোয় ভিলহেল্ম স্টোরিৎস এর কথা পাড়বো বলেই আমি ঠিক করে রেখেছিলুম।

নামটা করতে-না-করতেই মার্ক তার স্বভাবসিদ্ধ তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে ব্যাপারটা উড়িয়ে দিয়েছে। তারপর অবহেলার সুরে বলেছে, হ্যাঁ, হারালান একবার লোকটার কথা বলেছিলো বটে। সে-ই সম্ভবত মায়াসিদ্ধ অটো স্টোরিৎস-এর একমাত্র ছেলে-অন্তত জার্মানিতে অটো স্টোরিসের পরিচয় ইন্দ্রজালবিদ্যায় ওস্তাদ হিশেবেই। অথচ এটা ভারি অন্যায়-অটো স্টোরিৎস বোধহয় বড়ো বৈজ্ঞানিকও ছিলেন–রসায়নে আর পদার্থবিদ্যায় তার নানা গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে। হ্যাঁ, তার ছেলে যদি কোনো প্রস্তাব করেও থাকে, সে-প্রস্তাব কিন্তু প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলো।

তোর প্রস্তাব গৃহীত হবার অনেক আগেই নিশ্চয়ই?

তার অন্তত চার-পাঁচ মাস আগে।

তাহলে এই দুয়ের মধ্যে কোনো সম্বন্ধই নেই বলছিস?

কিছুমাত্র না।

মাদমোয়াজেল মাইরা কি জানে যে ভিলহেল্ম স্টোরিৎস এককালে তাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলো?

বোধহয় না।

আর তারপর আর-কিছুই হয়নি?

কিসসু না। লোকটা নিশ্চয়ই বুঝে গিয়েছিলো যে তার কোনো সম্ভাবনাই নেই। ফলে ব্যাপারটা সেখানেই চুকে-বুকে গিয়েছে।

কিন্তু তার কোনো সম্ভাবনা ছিলো না কেন? সে কি তার বদনামের জন্যে?

না। ভিলহেল্ম স্টোরিৎস-এর সে-রকম কোনো বদনামই নেই। লোকটা ভারি রহস্যময়। কী করে, না-করে, সব কুহেলিঢাকা। সবসময়েই সে লোকচক্ষুর অগোচরে থাকে।

এখানে থাকে? রাগৎস-এ?

হ্যাঁ, বুলভার তেকেলির এককোণায় একটা বিচ্ছিন্ন বাড়িতে থাকে ভিলহেল্ম স্টোরিৎস। কেউই এমনিতে ও-তল্লাটটা মাড়ায় না। লোকে তাকে একটু ভয়ই পায়–লোকটা নাকি কেমনতর; বিদঘুঁটে, উদ্ভট সব বাতিক আছে নাকি তার; এছাড়া তার আর-কোনো খ্যাতি-কুখ্যাতি কিছুই নেই। কিন্তু সে তো আগাপাশতলা জার্মান-আর ডাক্তার রডারিখ যে তার প্রস্তাবটায় পাত্তাই দেবেন না, সেজন্যে সে-যে জামান, এই তথ্যটাই যথেষ্ট। কারণ মাগিয়াররা সাধারণত টিউটনদের খুব-একটা পছন্দ করে না।

তোর সঙ্গে তার কখনও দেখা হয়েছে?

হয়েছে দু-তিনবার, একবার আর্ট গ্যালারিতেও। সে আমাদের দেখতে পায়নি। কাপ্তেন হারালানই তার দিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

সে কি এখন রাগৎস-এ আছে নাকি?

সেটা তোকে সঠিক বলতে পারবো না। শুধু এটুকু জানি যে গত দু-তিন হপ্তায় কেউ তাকে একবারও এখানে দ্যাখেনি।

শহর ছেড়ে চলে গিয়ে থাকলেই ভালো।

মার্ক তখন বলেছে :যাক, লোকটা যে-চুলোয় যেতে চায়, যাক! তবে যদি কখনও কোনো ফ্রাউ ভিলহেল্ম স্টোরিৎস দেখা দেন, তিনি যে মাইরা রডারিখ হবেন না, এটা ঠিক…

তা ঠিক, কেননা তখন তিনি হবেন, আমি হেসে বলেছি, মাদাম মার্ক ভিদাল।

জাহাজঘাটার পাশ দিয়েই, স্ট্র্যাণ্ড ধরে, আমরা হাঁটছিলুম। এই পদব্রজে ঘুরে বেড়ানোটা ইচ্ছে করেই প্রলম্বিত করছিলুম আমি। কেননা বেশ কিছুক্ষণ ধরেই আমার মনে হচ্ছিলো কেউ যেন সারাটা পথ আমাদের অনুসরণ করে আসছে। শুধু অনুসরণই করছে না, এমনভাবে পেছনে লেগে আছে যেন আমাদের কথাবার্তা শুনতে চাচ্ছে আড়ি পেতে। আমি এ-সম্বন্ধে নিশ্চিত হতে চাচ্ছিলুম।

সেতুর ওপর এসে আমরা মিনিট কয়েকের জন্যে থেমেছিলুম। এই অবকাশে আমি পেছন ফিরে দেখতে চাচ্ছিলুম কেউ আমাদের পিছু নিয়েছে কি না। কিছুটা দূরে মাঝারি উচ্চতার একটা লোককে দেখা গেলো বটে, কিন্তু তার চলাফেরার শ্লথমন্থর ভঙ্গিতে মনে হলো লোকটার নিশ্চয়ই অনেক বয়েস হয়েছে।

সে যা-ই হোক, ব্যাপারটা নিয়ে আমি আর মাথা ঘামাইনি। আমি তখন মার্ককে আশ্বস্ত করে বলেছি তার শেষ চিঠিতে মার্ক যে-সব দলিলপত্তর সঙ্গে আনতে বলেছিলো সব আমি নিয়ে এসেছি। বিয়ের জন্যে যে-সব দলিল জরুরি, সে-সম্বন্ধে তাকে কিছু। ভাবতে হবে না–এই বলে তাকে আশ্বস্ত করতে চেয়েছি আমি।

আমাদের কথাবার্তা ঘুরে-ফিরে মাইরার দিকেই চলেছে সারাক্ষণ–ঠিক যেমন করে চুম্বককে টানে মেরুতারা। আমরা হোটেলের দিকে ফিরে এসেছি তারপর। হোটেলের কাছে এসে শেষবারের মতো একবার আমি পেছন ফিরে তাকিয়েছি। রাস্তাটা তখন ফাঁকা, জনশূন্য। যে এতক্ষণ আমাদের পিছু নিয়েছিলো–যদি পুরোটাই আমার বেঘোরবিভ্রম না-হয়ে থাকে–সে যেন মায়াবলে হাওয়ায় উবে গিয়েছে, কেননা আমাদের পেছনে কোনো জনমানুষ নেই।

সাড়ে-দশটার সময় মার্ক আর আমি হোটেলে যে যার ঘরে। আমি তক্ষুনি গিয়ে শুয়ে পড়েছি বিছানায়, তৎক্ষণাৎ ঘুমিয়েও পড়েছি। কিন্তু হঠাৎ আঁৎকে উঠেছি ঘুম থেকে। কোনো স্বপ্ন? দুঃস্বপ্ন? কোনো আবেশ? কেননা ঘুমের ঘোরেও আবার আমি শুনতে পেলুম, যে-কথাগুলো শুনতে পেয়েছিলুম ডরোথিতে! যে-কথাগুলো মার্ক আর মাইরাকে বিষমভাবে শাসিয়েছিলো।

.

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

পরের দিনই আমি সামাজিক সৌজন্যের খাতিরে রডারিখদের বাড়ি গিয়ে হাজির হয়েছি।

ডাক্তার রডারিখের বিশাল বাড়ির চারপাশে মস্ত একটা বাগান থাকলে কী হবে, ভবনটি বস্তুত আধুনিক কারিগরিবিদ্যারই ফসল–আর সর্বত্রই সুরুচির চিহ্ন ছড়ানো। চমৎকার একটা স্ফটিক বসানো দরদালান-সারি-সারি দরজা বসানো, দরজাগুলোর ওপর প্রাচীন মাগিয়ার দারুশিল্পের নিদর্শন। এ-রকমই একটি দরজা নিয়ে যায় ডাক্তার রডারিখের পড়ার ঘরে, একটা যায় বৈঠকখানায়, আর আরো-একটা খাবারঘরে। টানা, লম্বা বারান্দাটার একপাশে একটা ইজেল, আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে দেখেছি মাদমোয়াজেল মাইরার পোর্ট্রেট-না, মার্ক নেহাৎ তার নাম সইই করে দেয়নি, সত্যি একটা চমৎকার পোর্ট্রেটও এঁকেছে।

ডাক্তার রডারিখের বয়েস হবে পঞ্চাশ, যদিও তাকে দেখে অত বয়েস হয়েছে। বলে মনে হয় না; ঋজু, বলিষ্ঠ, দীর্ঘ শরীর; ঝাকড়াচুল শাদা হয়ে আসছে; উপচে পড়া স্বাস্থ্যের আভা দেখে মনে হয় কখনও কোনো রোগ ভোগ করেননি। আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবামাত্র তার উষ্ণ করমর্দন থেকেই প্রতিভাত হয়েছে যে মানুষটা সত্যি সিধে-সহজ।

মাদাম রডারিখ, তার বয়েস হয়তো পঁয়তাল্লিশ বছর, এখনও তার যৌবনের সৌন্দর্য সারা শরীরে ধরে রেখেছেন; স্নিগ্ধ সৌজন্যের প্রতিমা, দেখে মনে হয়েছে বাড়িঘর ছেলেমেয়ে নিয়ে তিনি খুবই হৃষ্ট ও সুখী। আমার সঙ্গে পরিচয় হবামাত্র যেভাবে সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণ করেছিলেন, তা আমাকে খুবই স্পর্শ করেছিলো। আমাকে আশ্বস্ত করে বলেছিলেন, মার্ক ভিদালের ভাইও এ-বাড়িরই লোক, তবে একটা শর্ত আছে : অঁরি ভিদালকেও কিন্তু এ-বাড়িটাকে নিজের বাড়ি বলে মনে করতে হবে।

আর মাইরা? তার সম্পর্কে আর কী বলবো? সে মৃদু হেসে প্রায় দুই বাহু বাড়িয়ে দিয়েই সম্ভাষণ করতে এগিয়ে এসেছিলো। হ্যাঁ, সত্যি, এই তরুণীটি আমার ছোটোবোনের অভাব পূরণ করে দেবে। না, মার্ক কিছুই বাড়িয়ে বলেনি। বাইরে, ক্যানভাসে যে মেয়েটির প্রতিরূপের দিকে আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়েছিলুম, এ তারই জীবন্ত প্রফুল্ল রূপ। তার সুগঠিত মাথাটিতে সোনালি চুলের ঢাল, মুখটি যেন সদ্যফোঁটা হাঙ্গেরীয় কারনেশন, ঘন নীল দুই চোখে বুদ্ধির দীপ্তি, বুদ্ধির সঙ্গে কৌতুকও মেশানো, মুখের ডৌলটি ভারি সুন্দর, আধোখোলা রক্তিম ওষ্ঠাধরের মধ্য দিয়ে দেখা গেলো ফেনশুভ্র দন্তরুচি। সাধারণের চাইতে একটা লম্বাই, সাবলীল সচ্ছন্দ ভঙ্গি, সে যেন নিজেই কোনো উজ্জীবন্ত মায়া। মার্ক যদি চারপাশে এইজন্যে সমাদর পেয়ে থাকে যে সে তার পোর্ট্রেটের মধ্যে ভেতরের মানুষটিকে ঠিক ফুটিয়ে তুলতে পাবে, তবে বলতেই হয় মাইরার ছবিতে সে মেয়েটির অনেকটা অংশই ফুটিয়ে তুলতে পারেনি।

তার মায়ের মতো, মাইরা রডারিখও পরে ছিলো মাগিয়ার পোশাক, গলাবন্ধ এক জামা, মণিবন্ধ অব্দি নেমে-আসা সূচিকাজ করা হাতা, ধাতুর বোতাম-আঁটা ঢোলা ঘাগরা, জরি-বসানো কোমরবন্ধ, আর নরম চামড়ায় তৈরি চপ্পল–যেন আলেমান ফ্যাশনের কোনো পোশাক পরবে না বলেই বিশেষ করে এই দেশীয় সাজ-অথচ বাড়াবাড়ি বা দেখানেপনা নেই কোথাও।

কপ্তেন হারালানও ছিলো সেখানে, কড়াইস্ত্রিকরা সামরিক উর্দিতে ফিটফাট, আর এখন একসঙ্গে দুজনকে দেখে দুই ভাইবোনের চেহারার আশ্চর্য সাদৃশ্যটাও চোখে। পড়লো। সেও হাত বাড়িয়ে দিয়েছে আমার দিকে, সেও তার বড়োভাইয়ের মতোই ব্যবহার করেছে আমার সঙ্গে, আর আমার তো মনে হচ্ছিলো তার সঙ্গে আমার যেন। কতকালের ভাব, যদিও তার সঙ্গে আমার দেখাই হয়েছে মাত্র একদিন আগে।

তাহলে পুরো পরিবারটিকেই এখন আমি জানি।

আপনাকে এ-বাড়িতে দেখে কী ভালোই যে লাগছে, মঁসিয় ভিদাল! অভ্যর্থনা জানাবার ভঙিতে হাত দুটি বাড়িয়ে দিয়ে আবারও-একবার আমায় বলেছে মাইরা রডারিখ। পথে বোধহয় বড় বেশি সময় লেগেছে আপনার–আমরা তো ভাবনায় পড়ে গিয়েছিলুম। বুডাপেন্ট থেকে আপনার চিঠি আসার আগে অব্দি আমরা কেউই কোনো স্বস্তি পাইনি।

নিজেকে বড় দোষী ঠেকছে, মাদমোয়াজেল মাইরা, আমি উত্তরে বলেছি, পথে এতটা সময় নিয়ে নেয়ার জন্য বড় অপরাধী লাগছে। ভিয়েনা থেকে ডাকের গাড়িতে করে এলে আমি আরো আগেই রাগৎস এসে পৌঁছুতে পারতুম। তবে হাঙ্গেরির কেউই কখনও আমায় ক্ষমা করতো না যদি দানিউবকে আমি অবহেলা করতুম।

ঠিক আছে, দানিউবের সুবাদেই আপনাকে না-হয় ক্ষমা করা গেলো, মঁসিয় ভিদাল, মাদাম রডারিখ আমায় আশ্বস্ত করেছেন, কেননা অবশেষে আপনি তো সশরীরে এসে হাজির হয়েছেন–এখন আর এই ছেলেমেয়ে দুটির বিয়েটা স্থগিত রাখার কোনো কারণ নেই। কথা বলার সময় তিনি অবশ্য মার্ক আর মাইরার ওপর একবার প্রশ্রয় ও স্নেহের ভঙ্গিতে তাকিয়েছেন।

সেদিন অপরাহ্বে বেড়াতে বেরুবার কোনো কথাই ওঠেনি। মা আর মেয়ে ঘুরে ঘুরে সারা বাড়িটা দেখিয়েছেন আমায়, দেখিয়েছেন কত-কী অপরূপ মাগিয়ার শিল্পকর্মে সারা বাড়ি সাজানো।

আর মিনারটা? মাইরা যেন টগবগ করে উঠেছে, মঁসিয় ভিদাল কি ভেবেছেন মিনারটায় না-উঠে এ-বাড়িতে তার পদার্পণ আদৌ সম্পূর্ণ হবে?

না, মাদমোয়াজেল মাইরা, না! আমি বলেছি, সত্যি-বলতে, মার্কের এমন-কোনো চিঠি আমি পাইনি, যাতে এই মিনারটার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা ছিলো না। আমি তো ফ্রান্স থেকে এসেছি শুধু এই মিনারটার ওপরে ওঠবার জন্যেই!

আমার রসিকতাকে বিন্দুমাত্র আমল না-দিয়ে মাদাম রডারিখ বলেছেন, তাহলে আমাকে বাদ দিতে হবে। আমার পক্ষে মিনারটা বড় উঁচু।

বাঃ-রে! মাইরা আপতি করেছে, মাত্র-ততা একশো ষাটটা ধাপ!

তোর বয়েসে তাকেই মাত্র চারটে ধাপ বলে মনে হয়। বলেছে কাপ্তেন হারালান। বেশ, মা, তুমি তবে বাগানেই থেকো–আমরা এসে সেখানেই তোমার সঙ্গে দেখা করবো।

তাহলে চলো মহাকাশবিজয়ে, খিলখিল করে হেসে উঠেছে মাইরা।

সে প্রায় ছুটেই উঠেছে ওপরে। তার হালকা পদক্ষেপের সঙ্গে তাল রাখতে গিয়ে আমাদের বেশ কষ্টই হচ্ছিলো। কিন্তু কয়েক মিনিট পরে যখন ওপরে উঠে দাঁড়িয়েছি পুরো ল্যাণ্ডস্কেপটা যেন গোটানো পটের মতো আচমকা আমাদের চোখের সামনে খুলে গিয়েছে। চমৎকার!

সত্যিই, দিগন্ত অব্দি ছড়ানো এই চমৎকার ভূদৃশ্য দেখে আমি একেবারে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলুম। মাইরার মনে হচ্ছিলো, এতেও শেষ হয়নি, কতগুলো বিশেষ দ্রষ্টব্য নির্দেশ করে দেখানোই যেন রাগৎস-এর বাসিন্দা হিশেবে তার কাজ।

ঐ-যে, দেখছেন, সে বিশদ করে বলেছে, ওটা হলো এখানকার অভিজাত পাড়া–বলতে পারেন বৈভবমহল্লা। জমকালো প্রাসাদ, চকমেলানো ইমারত, লাল চক নীল চক, সারি-সারি মূর্তি-কী নেই ওখানে। ঐ দিকেই আরো এগিয়ে গেলে আপনি গিয়ে পড়বেন বড়োবাজারে, এখানকার বাণিজ্যকেন্দ্র, ভিড়ভাট্টা, দোকানপাট, ব্যস্ততা, হুড়োহুড়ি–সব পাবেন।…আর দানিউব-ঘুরে-ফিরে সবসময়েই আমরা দানিউবে ফিরে আসি-দানিউবকে এখন কী-রকম ঝলমলে দেখাচ্ছে, না! আর ঐ সবুজ দ্বীপটা, তার ঝোঁপঝাড়, বীথিকা, কুঞ্জবন আর হাজার রকমের ফুল! আমার ভাই যেন আপনাকে শিগগিরই একদিন সবুজ দ্বীপটা দেখিয়ে আনে।

তুই নিশ্চিন্ত থাকতে পারিস, কাপ্তেন হারালান তক্ষুনি বলে উঠেছে, রাগৎস এর সবচেয়ে ঘিঞ্জি গলিটাও আমি মঁসিয় ভিদালকে দেখাতে ছাড়বো না।

আর আমাদের চার্চগুলো, মাদমোয়াজেল মাইরার মুখ থেকে ফুলঝুরি ছুটেছে, দেখতে পাচ্ছেন ঐ চার্চগুলো আর তাদের ঘণ্টাঘর? রোববার দিন শুনতে পাবেন ঘন্টার শব্দ–একের পর এক, সুরে মেলানো। আর আমাদের পুরভবন–তার গুণিজন-সম্বর্ধনা ঘর, তার উঁচু ছাত, তার বিশাল সব রঙিন কাঁচ বসানো জানলা, আর ঘণ্টাঘর–যেখান থেকে দানাদার গলার স্বর প্রতিঘণ্টায় প্রহর হাঁকে!

কালকেই, আমি তাকে নিশ্চিন্ত করেছি, কালকেই গিয়ে আমি পুরভবনে হাজিরা দেবো–আমি যে এ-শহরে এসেছি সেটা তো জানাতে হবেই।

তারপর মঁসিয়, মাদমোয়াজেল মাইরা তখন মার্কের দিকে ফিরেছে, আমি যখন আপনার ভ্রাতৃদেবকে পুরভবন দেখাচ্ছিলুম, আপনি তখন কী দেখছিলেন?

ক্যাথিড্রালটি, মাদমোয়াজেল মাইরা, ক্যাথিড্রালটি। কী তার আশ্চর্য কাজকরা গম্বুজ, কী তার বিশাল আয়তন, আর মাঝখানের ঐ উঁচু মিনারটা যেন প্রার্থনার মতোই আকাশের দিকে উঠে গিয়েছে

ছবির মতো খুলে গিয়েছিলো রাগৎস, দেখে-দেখে যেন আশ মেটে না। তবু একসময় আমরা নিচে নেমে এসেছি বাগানে, যেখানে মাদাম রডারিখ আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছিলেন।

সেদিন রডারিখ পরিবারেই আমাকে আতিথ্য নিতে হয়েছে; শুধু ভোজই নয়, সারা সন্ধেটাই কাটিয়েছি আমরা একসঙ্গে, সবাই মিলে। একাধিকবার, মাইরা গিয়ে বসেছে ক্লাভিকর্ডে, আর সুললিত কণ্ঠে গেয়ে শুনিয়েছে সেইসব আশ্চর্য মাগিয়ার লোকগীতির সুর, যা যেমন উচ্ছল তেমনি মনমাতানো। শেষটায় একসময় কাপ্তেন হারালান যদি সময় সম্বন্ধে আমাদের সচেতন করিয়ে না-দিতো তাহলে আরো-কতক্ষণ যে ওভাবে মশগুল কেটে যেতো, কে জানে।

হোটেলে ফিরে আসার পর, নিজের ঘরে যাবার আগে, মার্ক আমার সঙ্গে-সঙ্গে আমার ঘরে এসেছে ঢুকেছে। কী? আমি কি বাড়িয়ে বলেছিলুম? সোজাসুজি আক্রমণ করেছে সে আমাকে, জগতে কোথাও এ-রকম আর-কোনো মেয়ে–

আর-কোনো? আমি তাকে থামিয়ে দিয়ে উলটে চড়াও হয়েছি, আমার তো এর মধ্যেই মনে হচ্ছে ও-রকম কেউ সত্যি আছে কি না? একজনও? পুরোটাই মায়া, না মতিভ্রম? মাদমোয়াজেল মাইরা বলে সত্যি কি কেউ আছে?

ওঃ, অঁরি, তুই বুঝতেই পারবি না আমি কী-রকম প্রেমে পড়ে গিয়েছি!

তাতে আমি আশ্চর্য হইনি, মার্ক। বরং তুই যদি প্রেমে না-পড়তিস, তবে তোকে আমার ভাই বলে স্বীকার করতেই বাধতে।

.

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

পরদিন ভোর-ভোরই কাপ্তেন হারালানের সঙ্গে আমি রাগৎস সরেজমিন ঘুরে দেখতে বেরিয়ে পড়েছি। বিয়ের জোগাড়যন্তরতদ্বিরে মার্ক ব্যস্ত ছিলো বলে আমাদের সঙ্গে যায়নি, বিয়ের দিন ধার্য হয়েছে পয়লা জুন, তিন হপ্তার মধ্যেই। এদিকে কাপ্তেন হারালান ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলো তার জন্মভূমি কত সুন্দর, কত ঐতিহ্যমণ্ডিত-সেটাই ঘুরে-ঘুরে দেখাতে। এর আগে কোথাও গিয়ে এমন-কোনো গাইড পাইনি আমি যে শুধু শিক্ষিত, পরিশীলিত, দক্ষই ছিলো না যে তার নিজের বিষয়কে এমন ভালোবাসতো।

যদিও স্মৃতির মধ্যে একগুয়ের মতো বারেবারে হানা দিয়ে আমাকে চমকে-চমকে দিচ্ছিলো সেই বেঘোর-বিভ্রমে শোনা হুঁশিয়ারগুলো (যা হয়তো নিছকই মতিভ্রম ছিলো –যার কোনো বাস্তব ভিত্তি অন্তত আমার নজরে পড়েনি), তবু আমি একবারও ঘুণাক্ষরেও ভিলহেল্ম স্টোরিৎসের নাম করিনি। কাপ্তেন হারালান এ নিয়ে কোনো কথাই বলেনি, হয়তো এ-কথা কখনও তার মাথাতেই আসেনি।

সারা শহর আমরা চষে বেড়িয়েছি, সব-শেষে এসেছি সেই চকে, যেখানে রৌদ্রে ঝলমল করে উঠেছিলো রাজভবন। সেখানে একটু থমকে থেমে সব খুঁটিয়ে দেখেছি। আমরা। কাপ্তেন হারালান আমাকে জানিয়েছে :এটা রাজভবন–রাজ্যপালের বাসভবন। এখানেই বিয়ের অনুষ্ঠানে ক্যাথিড্রালে যাবার আগে মার্ক আর মাইরাকে এসে রাজ্যপালের কাছ থেকে অনুজ্ঞাপত্র দিতে হবে।

অনুজ্ঞাপত্ৰ? তার মানে বিয়ে করতে হলে রাজ্যপালের অনুমতি চাই?

হ্যাঁ। এটা এখানকার ভারি প্রাচীন একটা রীতি। নগরের সর্বোচ্চ অধিনায়কের অনুমতি ছাড়া কোনো বিয়েই হতে পারে না এখানে। শুধু তা-ই নয়, এই অনুজ্ঞাপত্র পাত্রপাত্রীর মধ্যে একটা দৃঢ় বন্ধন তৈরি করে। তখনও বিয়ে হয়নি অবশ্য, কেননা চার্চের অনুষ্ঠান হয়নি, তবে নিছক বান্দানের চাইতে আরো-সুদৃঢ় একটা স্বীকৃতি পাওয়া যায়–যদি কোনো অপ্রত্যাশিত অভাবিত কারণে বিয়ে পেছিয়ে যায় তবুও পাত্রপাত্রী কেউই নতুন-কোনো বন্ধন স্বীকার করে নিতে পারবে না।

এই স্মরণীয় রীতিটি ব্যাখ্যা করতে-করতে কাপ্তেন হারালান আমাকে নিয়ে এসেছিলো সেই রাস্তায়, যা গিয়ে শেষ হয়েছে সন্ত মিখায়েলের ক্যাথিড্রালের সামনে। এয়োদশ শতাব্দীর পুরোনো এই ক্যাথিড্রালটির যত বৈশিষ্ট্য ছিলো, সব বেশ খুঁটিয়ে বলেছিলো কাপ্তেন হারালান। পরে কখনও ভেতরে গিয়ে খুঁটিনাটি সব ঘুরে-ঘুরে দেখা যাবে। এখন বরং চলুন দুৰ্গটা গিয়ে দেখে আসি। তারপর বুলভার ধরে-ধরে সারা শহরটা ঘুরে ঠিক লাঞ্চের আগেই আমরা ফিরে যেতে পারবো।

দুর্গের দিকে যেতে হলে ঐ ছোটো-বড়ো বাজারগুলোর একটার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। তখনই পুরোদমে বিকিকিনি চলেছে, সবখানেই ব্যস্ততা আর হুড়োহুড়ি, কিন্তু আমরা বাজারটার মধ্যে গিয়ে পড়বার আগেই সেখানে এমন-একটা শোরগোল উঠলো, যেটাকে নিছকই দৈনন্দিন কেনাবেচার গুঞ্জন বলে মনে হয়নি।

কয়েকজন স্ত্রীলোক একটা লোককে ঘিরে দাঁড়িয়ে পড়েছে, লোকটা মাটিতে পড়ে কারাচ্ছে, চেষ্টা করেও উঠতে পারছে না।

কেউ-একজন ধাক্কা দিয়েছে আমাকে…জোরে ঠেলা দিয়েছে…এত জোরে ধাক্কা মেরেছে যে আমি হুমড়ি খেয়ে পড়ে গিয়েছি।

কিন্তু তোমায় ধাক্কাটা দিলে কে? স্ত্রীলোকদের একজন জিগেস করেছে। আমার দোকান থেকে স্পষ্ট দেখেছি হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাবার সময় তোমার আশপাশে কেউই ছিলো না। কেউ না।

ছিলো, নিশ্চয়ই ছিলো। লোকটা চেঁচিয়ে বলেছে। ঠিক বুকে ধাক্কা মেরেছে! শয়তানে নিক হতচ্ছাড়াকে, এখনও বুকে ব্যথা করছে!

কাপ্তেন হারালান লোকটাকে জিগেস করে যা জানতে পেলে, তা এইরকম : চাষীটি রাস্তা দিয়ে চুপচাপ হেঁটে যাচ্ছিলো, এমন সময় সজোর একটা ধাক্কা খায়, যেন কোনো দশাসই পালোয়ান এসে তার গায়ে বেশামাল পড়েছে। এতই জোরে, যে সে প্রায় ডিগবাজি খেয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। সত্যি–তার কোনো সংশয়ই নেই-কারু সঙ্গে ধাক্কা খেয়েই এই চোটটা পেয়েছে সে। কিন্ত সে-যে কে তাকে অমনভাবে ধাক্কা দিয়েছে, সে-সম্বন্ধে তার কোনো ধারণাই নেই–কোনোরকমে ওঠবার চেষ্টা করার সময় সে নিজেও আশপাশে কাউকে দেখতে পায়নি।

কতটা সত্য ছিলো এই গল্পে? সত্যিই কি লোকটা আচমকা ও-রকম বেদম একটা ধাক্কা খেয়েছে? কিন্তু ধাক্কা খাওয়ার মানে কেউ তাকে সেই ধাক্কা দিয়েছে–এমনকী দমকা হাওয়া এসেও যখন আচমকা ঠেলা দেয় তখন তো এটা জানা থাকে যে দমকা হাওয়া এসেছিলো। কিন্তু হাওয়াও তো শান্ত এখন। শুধু একটা জিনিশই নিশ্চিত: লোকটা আচমকা পড়ে গিয়েছে, এবং তার কোনো বুদ্ধিগ্রাহ্য ব্যাখ্যাও পাওয়া যাচ্ছে না। আর সেইজন্যেই এখানে এত উত্তেজনা। কেউ-কেউ বলতে শুরু করেছে লোকটা হয় মতিচ্ছন্ন মাতাল, আর নয়তো জেগে-জেগেই দুঃস্বপ্ন দ্যাখে। শুধু মাতালরাই বেটাল চলতে গিয়ে দুমদাম পড়ে যায়। লোকটা কিন্তু সজোরে উলটো কথাই বললে : গত চব্বিশ ঘণ্টায় সে একফোঁটাও মদ খায়নি। শেষটায় একজন পাহারাওলা এসে লোকটাকে আর গোল না-পাকিয়ে কেটে পড়তে বলেছে।

আমরা তারপর উৎরাই বেয়ে একটা রাস্তা ধরে দুর্গের দিকে এগিয়েছি-একটা ছোটো টিলার ওপর নিরেট বসানো দুর্গা।

এবারও কাপ্তেন হারালান ঘুরে-ঘুরে তার বৈশিষ্ট্যগুলো দেখিয়েছে। শেষটায় তারই ইঙ্গিতে সদর দরজাটাও খুলে গিয়েছে। তারপর ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে-বেয়ে আমরা দুশো চল্লিশটা ধাপ পেরিয়ে শেষটায় এসে পৌঁছেছি তার ছাতে। আর সেখান থেকে আবার শহরটাকে দেখা গেছে, ঠিক যেমনভাবে পাখির চোখ দূরের আকাশ থেকে নিচের সবকিছু দ্যাখে।

শুধু দ্রষ্টব্য বিষয় নিয়েই নয়, আরো নানা বিষয়ে সারাক্ষণ আমরা আলোচনা চালিয়ে গিয়েছি। একবার কাপ্তেন হারালান আমায় বলেছে :আমাদের শহরে কিন্তু আপনি তেমন গরিব মানুষ দেখতে পাবেন না। দারিদ্র্যের কোনো লক্ষণ দেখা গেলেই কর্তৃপক্ষ নানারকম ব্যবস্থা নিয়ে দারিদ্র্য দূর করার চেষ্টা করেন।

সেটা বোঝা যায়। আমি বলেছি, ডাক্তার রডারিখ যে কখনও গরিবদের চিকিৎসার জন্যে কোনো ত্রুটি করেন না, সেটা আমি এখানে আসার আগেও লোকের কাছে শুনেছি! তাছাড়া শুনেছি মাদাম রডারিখ আর মাদমোয়াজেল মাইরাও নানারকম সমাজসেবার কাজে লেগে আছেন!

আমার মা-বোন যা করেন তা যে-কোনো অবস্থাপন্ন ঘরের মানুষেরই করা উচিত। আমার মতে, মানুষ সমাজে থাকে বলেই সমাজসেবা মারফৎ সে সমাজের কাছে তার ঋণ শোধ করবার একটু চেষ্টা করতে পারে। তাছাড়া এ-শহরটা এমনিতে নির্বিরোধী, শান্তিপ্রিয়। তেমন-কোনো রাজনৈতিক উত্তেজনা বা হুলুস্থুলও নেই। অথচ তবু শহরের সকলেই নিজের দাবি ও অধিকার সম্বন্ধে সচেতন–কেন্দ্রীয় সরকার ককখনও কোথাও বাড়াবাড়ি করলেই তার প্রতিবাদ ওঠে। এখানকার লোকদের শুধু একটাই দোষ।

আর, সেটা?

তাদের নানারকম সংস্কার আছে; অলৌকিকে বিশ্বাস করে, অতিপ্রাকৃত নিয়ে মাথা ঘামায়। ভূতের গল্প আর শয়তানের কীর্তি সম্বন্ধে বড় বেশিই মাথা ঘামায়।

এমনকী সব শিক্ষিত মানুষও?

সব না-হলেও বেশির ভাগই। বিজ্ঞানচেতনা বা শিক্ষা এ-দিকটায় তেমন প্রভাব ফ্যালেনি। কেন-যে লোকদের এই দুর্বলতা, তা জানি না। আমি তো ভেবে-ভেবে এর কোনো মাথামুণ্ডু খুঁজে পাইনি। কেন-যে ভুত-প্রেতে লোকের এমন বদ্ধমূল বিশ্বাস, তার কোনো কারণ খুঁজে পাওয়াই কঠিন।

দুৰ্গটা দেখে বেরিয়ে আসার সময় কাপ্তেন হারালান জানিয়েছে, শহরে একটা পুরোনো কেল্লায় মস্ত খাবারঘরে একটা হোটেল থেকে লাঞ্চের ব্যবস্থা করা হয়। আমরা সেখানেই দুপুরবেলায় খেয়ে নেবো। আবারও কথা বলতে-বলতেই আমরা শহরের অন্যপ্রান্তের দিকে এগিয়েছি। একটু পরেই আমরা বুলভার তেকেলিতে এসে পড়েছি, আর অমনি চোখে পড়েছে একটা বিরাট বাগানের মধ্যে একটা মস্ত অট্টালিকা। দেখে মনে হয় পোড়োবাড়ি, ছন্নছাড়া পরিত্যক্ত চেহারা, বন্ধ জানলাগুলো বোধহয় স্মরণকালের মধ্যে কখনও খোলা হয়নি, দেয়ালে শ্যাওলা আর পরগাছা গজিয়েছে। শহরের অন্য বাড়িগুলোর পাশে এটাকে কেমন-যেন হানাবাড়ি বলেই মনে হয়। রেলিঙঘেরা বাড়িটার সামনে লৌহফটক, তারপর উঠোন, খোয়ারিবিছানো রাস্তার দুপাশে দুটো উইলো গাছ, শুকনো, মরা–গাছ দুটি এতই প্রাচীন যে যেন বয়েসের ভারেই মরে গিয়েছে। বাড়িটার সামনের দিকে আরো-একটা দরজা, তার ওককাঠের পাল্লাগুলো রংচটা, জীর্ণ। তিনটে ভাঙা সিঁড়ির ধাপ পেরিয়ে পৌঁছুনো যায় ঐ দরজায়। দোতলাও আছে, তারপর উঁচু দর্শন-অলিন্দ। পুরু পর্দা দিয়ে ঢাকা সরু-সরু গবাক্ষ। যদি-বা বাড়িটা বাসযোগ্যও হয়, দেখে মনে হয় না বাড়িটায় কেউ থাকে।

আমি জিগেস করেছি : কার বাড়ি এটা?

ভারি আজব একজন লোকের, কাপ্তেন হারালান বলেছে।

আমি বলেছি : বুলভারের বাকি বাড়িগুলোর পাশে ভারি বেমানান । পুরসভার উচিত বাড়িটা কিনে নিয়ে ভেঙে ফেলে নতুন করে কিছু তৈরি করে দেয়া।

সত্যি তা-ই উচিত। বাড়িটা ভেঙে ফেললে হয়তো তার অদ্ভুত মালিকটিও শহর, ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হবে। শহরের জনরব বিশ্বাস করলে বলতে হয় তাহলেই হয়তো সে তার নিকটতম আত্মীয় বীলজেবারের বাড়ি গিয়ে আশ্রয় নেবে।

তা-ই না কি? তা এই বিদঘুটে ব্যক্তিত্বটি কে?

একজন জার্মান।

জার্মান?

হ্যাঁ, প্রুশিয়ার লোক।

আর তার নাম?

ঠিক যখন কাপ্তেন হারালান নামটা বলতে যাবে, অমনি আচমকা বাড়ির সামনের ঐ দরজার রংচটা কবাটগুলো খুলে গেলো, আর ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো দুটি লোক। দুজনের মধ্যে যে বড়ো, তার সত্যি বয়েস হয়েছে, অন্তত ষাট তো হবেই, সে সিঁড়িতেই দাঁড়িয়ে রইলো, অন্যজন নেমে চলে এলো ফটক বেরিয়ে বুলভারে।

আচ্ছা! কাপ্তেন হারালান কেমন অদ্ভুত স্বরে বললে। মহাশয় তবে এখানেই আছেন। আমি ভেবেছিলুম সে চলে গিয়েছে শহর ছেড়ে!

সে ফিরতেই লোকটা আমাদের দেখতে পেলে। সে কি চেনে কাপ্তেন হারালানকে? সন্দেহ করার জো কী–কেননা দুজনেই প্রচণ্ড বিদ্বেষের চোখে পরস্পরের দিকে তাকিয়েছে।

আমিও তখন লোকটাকে চিনতে পেরেছি। সে কয়েক পা এগিয়ে যেতেই আমি বলে উঠেছি : তাহলে সত্যি-সত্যি এ-ই সেই লোক?

আপনার সঙ্গে এর আগে দেখা হয়েছে? কাপ্তেন হারালান একটু আশ্চর্যই হয়েছে।

হয়েছে। আমি জানিয়েছি, বুডাপেন্ট থেকে ভুকোভার অব্দি এর সঙ্গেই আমি ডরোথিতে করে এসেছি। তবে এটা বলবো যে এর সঙ্গে যে রাস-এ ফের দেখা হয়ে যাবে, এটা আমি আশা করিনি।

কাপ্তেন হারালানও সায় দিয়ে বলেছে :এ এখানে না-থাকলেই ভালো হতো। মনে হচ্ছে তোমার সঙ্গে এই জার্মানের খুব-একটা ভাব নেই?

কারই বা ভাব থাকবে? তাছাড়া আমার তো একে অপছন্দ করবার বিশেষ কারণ আছে। এর ধৃষ্টতা একবার ভেবে দেখুন। এ কি না আমার বোনকে বিয়ে করতে চেয়েছিলো! কিন্তু বাবা আর আমি এমনভাবে প্রস্তাবটা নাকচ করে দিয়েছি যে দ্বিতীয়বার সে আর এই প্রস্তাবটা করতে সাহস পাবে না।

তার মানে? তবে এ-ই সেই লোক?

আপনি তাহলে একে চেনেন?

হ্যাঁ, কাপ্তেন। এতক্ষণে আমি বুঝে গিয়েছি যে এইমাত্র যাকে দেখতে পেয়েছি সে হলো ভিলহেল্ম স্টোরিৎস, প্রেমবার্গের বিখ্যাত রসায়ন-বিজ্ঞানী অটো স্টোরিৎস এর সুপুত্র।