কর্নেলের জার্নাল থেকে-১

কর্নেলের জার্নাল থেকে-১

ভোর ছটায় ছাদের শূন্যোদ্যানে গিয়ে দেখলাম, অ্যারিজোনা থেকে আনা ক্যাক্টিতে সুন্দর কিছু ফুল ফুটেছে। আনন্দে অস্থির হয়ে উঠলাম। প্রায় চার মাসের সাধনার সিদ্ধি। বুড়ো না হলে ধেই-ধেই করে না হোক, ব্রেড্যান্স শুরু করে দিতাম। এই প্রজাতির ক্যাকটাসের নাম একিনোক্যাকটাস গ্রুসিনি। দেখতে কতকটা গোল কাঁঠালের মতো। গ্রীষ্মে একছিটে বৃষ্টি হলে ফুল শিগগির ফুটে ওঠে। লাল টুকটুকে পাপড়ির মধ্যে হলুদ শীষ। শীষের মাথায় কালচে টুপি। হাঁটু মুড়ে বসে আতসকাচ দিয়ে পাপড়ির কিনারা পরীক্ষা করতে থাকলাম। অ্যারিজোনার রাজধানী ফিনিক্সে হর্টিকালচার ল্যাবরেটরির ডিরেক্টর ডাঃ মিডলটন বলেছিলেন–পাপড়ির কিনারায় যদি সূক্ষ্ম ভাজ পড়ে, তা হলে জানবেন ভাইরাস সংক্রামিত হয়েছে।

 অনেকক্ষণ খুঁটিয়ে তেমন কিছু দেখতে পেলাম না। মনটা আরও খুশিতে ভরে উঠল। সূর্য। উঠলেই কয়েকটা ফোটো নিতে হবে। মে মাসের শেষ সপ্তাহ। সূর্য উঠলেও পূর্বের কয়েকটা হাইরাইজ বাড়ির জন্য বরাদুর পৌঁছুতে দেরি হয়। বিষদৃষ্টিতে বাড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে আছি,

এমন সময় ষষ্ঠী এসে বলল, -বাবামশাই! ফোং!

বিরক্ত হয়ে বললাম, -হতভাগা! তোকে কতদিন না বলেছি, দুটো থেকে আটটার মধ্যে কেউ টেলিফোন করলে বলবি আমি বাড়ি নেই?

ষষ্ঠী কাঁচুমাচু মুখে বলল-সে ফোং নয় বাবামশাই, জয়ন্ত দাদাবাবু ফোং।

-ওকে আসতে বলে দে।

বললাম তো। কিন্তু দাদাবাবু ফোং।

এই সাতসকালে কার মৃত্যু সংবাদ দিতে জয়ন্ত ফোন করেছে? নিছক মৃত্যু হলে কেনই বা ফোন করবে। খুনখারাপি নয় তো?

ড্রয়িংরুমে নেমে এসে ফোন ধরে বললাম, -গুড মর্নিং, ডার্লিং।

-ব্যাড মনিং, ওল্ড বস!

–সরি জয়ন্ত। সকালবেলাটা ব্যাড করে দিও না। তুমি কোথা থেকে ফোন করছ?

-আর্মেনিয়ান চার্চের কাছে এক বন্ধুর বাড়ি থেকে। আপনি এখনই চলে আসুন। পুলিশ এসে গেছে। পুলিশকে এখনই বডি না নিয়ে যেতে অনুরোধ করেছি

-বডি? কার বডি?

–আমাদের কাগজের একজন ফোটোগ্রাফার ছিলেন। নাম শুনে থাকবেন। প্রচেত রায়। বয়সে খোকা বললেই চলে।

-তা খোকাটির বডি পড়ল কী করে?

-ওঃ কর্নেল। হি ওয়াজ সিরিয়াস। গত রাত্তিরে দশটা নাগাদ প্রচেত দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার অফিস থেকে বের হয়। রাত্তিরে বাড়ি ফেরেনি। ভোরবেলা চার্চের পেছন দিকে একটা পোড়ো বাড়ির ভেতর ওকে মরে পড়ে থাকতে দেখে স্থানীয় লোকেরা পুলিশে খবর দেয়। পুলিশ ওর পকেটে আইডেন্টিটি কার্ড দেখে অফিসে ফোন করে। অফিসের দারোয়ান আমাকে ফোন করে। কারণ ক্রাইম স্টোরি আমি কভার করি। তো—

 প্রচেত রায়ের বাড়িতে খবর দেওয়া হয়েছে কী?

হয়েছে। তবে প্রচেতের দাদা-বউদি ছাড়া আর কেউ নেই। ও দাদার কাছে থাকত।

–জয়ন্ত, আমি গিয়ে কী করব?

–কর্নেল! আপনি এলেই বুঝতে পারবেন, ব্যাপারটা রহস্যজনক।

–একটু আভাস দাও।

–বডিতে কোনও ক্ষতচিহ্ন নেই।

–তাহলে হার্ট অ্যাটাক।

–ঠিক আছে। আপনাকে আসতে হবে না।

জয়ন্ত ফোন ছেড়ে দিল। বুঝলাম, আমার ওপর চটে গেছে। কিন্তু ও তো জানে, আমি নিছক শখের গোয়েন্দা নই। যততত্র কারও লাশ পড়লেই আমি নাক গলাতে যাই না। আসলে জয়ন্ত তার অফিসের লোকের এরকম হেলাফেলায় মৃত্যুর ঘটনা বরদাস্ত করতে পারছে না।

কিন্তু সমস্যা হল, জয়ন্তকে আমি পুত্ৰাধিক স্নেহ করি, যদিও আমরা পরস্পর বন্ধু। যুবকের সঙ্গে বৃদ্ধের বন্ধুত্ব হতে তো বাধা নেই। এযাবৎ অসংখ্য রহস্যময় ঘটনায় জয়ন্ত আমার সহকারীর ভূমিকা পালন করেছে। কাজটা বোধহয় ঠিক করলাম না। অন্তত আমার স্নেহ এবং বন্ধুত্বের খাতিরে ওর ডাকে সাড়া দেওয়া উচিত ছিল।

দোনমনায় পড়ে গেলাম। একটু পরে না যাওয়াই সাব্যস্ত করলাম। সবখানে গোয়েন্দাগিরি করার মানে হয় না। ইতিমধ্যে এদিককার খবরের কাগজগুলো এসে গেল। ষষ্ঠীকে বললাম, –ছাদে যাচ্ছি। কফি দিয়ে আসবি।

কাগজগুলো নিয়ে ছাদে গেলাম। প্রথমেই দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকায় চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিলাম। প্রথম পাতার একটা বড় খবরে চোখ গেল। ফ্লাগ লাইনে ছাপা হয়েছে :

চন্দ্রপুর কেন্দ্রে উপনির্বাচন বাতিল।

পাগলের গুলিতে নির্দল প্রার্থী হত।

আততায়ীর গুলিতে পাগলও হত।

নিজস্ব সংবাদদাতার খবর খবরটা সংক্ষেপে এই :

শিল্পনগরী চন্দ্রপুর বিধাননগর আসনটি বিধায়ক রামহরি ব্যানার্জির মৃত্যুতে খালি হয়েছিল। তাই উপনির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ভোট গ্রহণের তারিখ দোসরা জুন। নির্দল প্রার্থী পরমেশ চক্রবর্তী গতকাল বিকেলে চৌমাথায় জনসভায় বক্তৃতা করছিলেন। তখন হঠাৎ কারা সভায় হইহল্লা শুরু করে। মাইকের তার কেটে দেয়। পটকা ফাটায়। এই বিশৃংখলার সময় এক বৃদ্ধ উন্মাদ ব্যক্তির রিভলভারের গুলিতে পরমেশবাবুর মৃত্যু হয়। কিন্তু তারপরই সেই উন্মাদ আততায়ীকে কেউ মাথার পিছনে গুলি করে। প্রত্যক্ষদর্শীরা উন্মাদ লোকটিকে পরমেশবাবুকে লক্ষ করে গুলি ছুঁড়তে দেখেছেন। কিন্তু সেই উন্মাদের আততায়ীকে কেউ দেখেন নি। তাই প্রথমে সবার ধারণা হয়েছিল, পরমেশবাবুকে মেরে উন্মাদ আততায়ী আত্মহত্যা করেছে। কিন্তু কেউ নিজের মাথার ঠিক পেছনে এভাবে গুলি ছুঁড়ে আত্মহত্যা করতে পারে না। ঘটনাস্থলে পরপর দুবার গুলির শব্দ শোনা গেছে। ….

 খবরটা পড়ে মনে হল, উন্মাদ আততায়ীকে যে মেরেছে সে পরমেশবাবুর বডিগার্ড হতেও তো পারে। কিন্তু সংবাদদাতা সে-কথা উল্লেখ করেননি। বিশেষ কোনও পয়েন্টও খবরে নেই। আসলে খবর লেখার কাজটা যেমন তেমন দায়সারাভাবে করা হয় আমাদের দেশে।

আবার খুঁটিয়ে পড়লাম। তারপর মনে হল, পরমেশবাবুর কোনও বডিগার্ড থাকলে এতে কোনও রহস্য নেই, কিন্তু বডিগার্ড না থাকলে?

না থাকলে যে লোকটি আততায়ীকে মেরেছে, সে যদি পরমেশবাবুর শত্রুপক্ষের লোক হয়, তাহলে সে নিজেই তো পরমেশবাবুকে মারতে পারত।

হ্যাঁ, মারতে পারত। কিন্তু তার ধরা পড়ার চান্স ছিল। মঞ্চে পরমেশবাবু ভাষণ দিচ্ছিলেন। তার আততায়ী মঞ্চে ওঠেনি। নিচে থেকে গুলি করে। হইচই বেধেছিল মঞ্চের নিচে।

উঁচু জায়গা এবং নিচু জায়গা এক্ষেত্রে একটা গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট। নিচের কাউকে হট্টগোলের মধ্যে ভিড়ের ভেতর মাথার পেছনে আগ্নেয়াস্ত্রের নল ঠেকিয়ে গুলি করলে দ্বিতীয় আততায়ীকে কারও দেখতে না পাওয়াই সম্ভব। এদিকে পরমেশবাবুর বডিগার্ড থাকলে সে পরমেশবাবুর কাছে মঞ্চের ওপরই থাকবে।

আর একটা কথা : পরপর দুবার গুলির শব্দ এবং দুটি মৃত্যু।

এতক্ষণে হাইরাইজ বাড়ির ওপর সুর্য উঁকি দিচ্ছে। ক্যামেরায় একিনোক্যাকটাস গ্রুসিনির অসামান্য সুন্দর ফুলগুলোর ছবি তুলতে মন দিলাম। …..

 ব্রেকফাস্টের পর ড্রয়িং রুমে বসে প্রখ্যাত মার্কিন পত্রিকা নেচার-এর পাতা ওলটাচ্ছি এমন সময় এক ভদ্রলোক এলেন। নমস্কার করে বললেন, আপনিই কি কর্নেল নীলাদ্রি সরকার?

বললাম, -আপনার সন্দেহের কোনও কারণ আছে?

ভদ্রলোক একটু বিব্রত হয়ে বললেন, -না-মানে, কাগজে আপনার অনেক কীর্তিকলাপ পড়েছি। তাই বলছিলাম

তার কথার ওপর হাসতে হাসতে বললাম, -ভেবেছিলেন আমি যুবক। কিন্তু চোখে দেখছেন আমিও নেহাত বুড়োমানুষ। মুখে সাদা দাড়ি এবং মাথায় টাক। তাই ভাবছেন, এই বুড়ো লোকটি কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের ঠাকুর্দা!

আমার কৌতুকে ভদ্রলোক আরও বিব্রত হয়ে বললেন, -না মানে……

–আপনার পরিচয় দিন এবার। তারপর বলুন কেন এসেছেন?

ভদ্রলোক এতক্ষণে বসলেন। চল্লিশের কাছাকাছি বয়স। বেশ শক্তসমর্থ গড়নের মানুষ। হাতে একটা ব্রিফকেস। বললেন, –আমার নাম তারক রায়। আসছি চন্দ্রপুর থেকে।

–চন্দ্রপুর। মানে, গতকাল যেখানে ভোটের নির্দল প্রাথী পরমেশ চক্রবর্তী খুন হয়েছেন?

তারকবাবু বললেন, আজ্ঞে হ্যাঁ। আমি পরমেশবাবুর প্রাইভেট সেক্রেটারি। পরমেশবাবুর একটা ইলেকট্রিক বালব তৈরির কারখানা ছিল। কারখানা ভালো চলছিল না। ওঁর চন্দ্রা বালব মার্কেট পায়নি। তাই উনি রাজনীতি করতে নামেন। কিন্তু বড় স্পষ্টভাষী মানুষ। প্রচণ্ড নীতিবাগীশ। তাই কোনও রাজনৈতিক দলে পাত্তা পাননি। অগত্যা নির্দল প্রার্থী হয়ে দাঁড়ান।

কথা বাড়ছে দেখে বললাম- সংক্ষেপে বলুন, কেন এসেছেন আমার কাছে?

 তারকবাবু কুণ্ঠিতভাবে বললেন, -ব্যাপারটা

একটু আশ্চর্য মনে হয়েছে আমার। গতকাল বিকেলে মিটিঙে ওঁকে গুলি করে মারা হয়েছে। কাগজে খবর দেখে থাকবেন। কিন্তু গতকাল সকালে উনি আমাকে কথায়-কথায় হঠাৎ বললেন, –তারক। আমার মনে হচ্ছে, আমার কোনও সাংঘাতিক বিপদ হতে পারে। কিন্তু ভোটে যখন দাঁড়িয়েছি এবং নমিনেশন প্রত্যাহারের তারিখ পেরিয়ে গেছে, তখন আর পিছু হটছি না। যা থাকে বরাতে লড়ব। তবে যদি আমার কোনও বিপদ হয়, তুমি জানবে তার জন্য দায়ী কিষান-মজদুর-পার্টির নেতা অভয় হাজরা। সে আমাকে শাসিয়েছে। তো বিকেলে পরমেশদা মারা পড়লেন। আমি পুলিশকে কথাটা বললাম। পুলিশ বলল, বিনা প্রমাণে অভয় হাজরার মতো ভি. আই. পি-কে আসামি করতে পারব না। বুঝতেই তো পারছেন স্যার, হাজরাবাবুর প্রতিপত্তি আছে। তাই আমি আপনার শরণাপন্ন হয়েছি।

 এ পর্যন্ত শুনে আমি বললাম, আমাকে কি প্রাইভেট গোয়েন্দা ভেবেছেন? দেখুন তারকবাবু আমি ঠিক সে রকম গোয়েন্দা নই। তবে হ্যাঁ, রহস্যের প্রতি আমার একটা আকর্ষণ আছে। কিন্তু আপনার এই কেসে আমি কোনও রহস্য দেখছি না।

তারকাবু একটু চুপ করে থাকার পর বললেন, -রহস্য যে একেবারে নেই, তা নয়। আততায়ীর রিভলবারটা পাওয়া গেছে ঘটনাস্থলে। পুলিশ দেখেছে তাতে মোটে দুটো গুলি ভরা আছে। চারটে গুলি খরচ হয়েছে। এর মধ্যে একটা গুলি পরমেশবাবুর হার্টে বিঁধেছে। আর তিনটে গুলি কী হল?

বললাম, টার্গেট প্র্যাকটিস করে তিনটে গুলি খরচ করে থাকতে পারে আততায়ী।

-তা পারে। কিন্তু স্যার, আততায়ী লোকটা যে একটা বদ্ধ পাগল।

–পাগল?

–হ্যাঁ স্যার। কিনু পাগলা বলে জানি ওকে। বাসটার্মিনাসে থাকত। রোগা পাঁকাটি শরীর।

 –তাকেই তো লোকেরা দেখেছে গুলি ছুঁড়তে?

তারকবাবু শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বললেন, -হ্যাঁ। কিন্তু কিনু পাগলাকেই বা কে গুলি করে মারল?

পরমেশবাবুর বডিগার্ড ছিল?

তারকবাবু মাথা নেড়ে বললেন, না স্যার। পরমেশদা জেদি লোক ছিলেন বটে, তবে ওঁর আত্মবিশ্বাস ছিল প্রচণ্ড। নীতিবাগীশ ছিলেন তা-ও বলেছি।

–রিভলবারটা কি কিনু পাগলের হাতে বা হাতের কাছাকাছি পাওয়া গেছে?

তার হাতেই ধরা ছিল স্যার। –

-হাতে ধরা ছিল?

হ্যাঁ। –তারকবাবু আস্তে বললেন, তখন সভায় হইচই বাধিয়েছিল অভয় হাজরার লোকেরা। ভিড় আর হট্টগোলের মধ্যে হঠাৎ খুনোখুনি। কাজেই

তারকবাবু হঠাৎ চুপ করলে বললাম, –তখন সময় কটা?

–বিকেল পাঁচটা সওয়া পাঁচটা। জায়গাটা একটা চৌমাথা। এমনিতেই ভিড় থাকে সারাক্ষণ।

–মঞ্চে কে-কে ছিলেন মনে পড়ছে?

–আমি, পরমেশদা, প্রাইমারি স্কুলের হেডমাস্টার রমেশবাবু এবং জনা দুই সাংবাদিক। একজন স্থানীয়, অন্যজন কলকাতার। পরমেশদা আমাকে সাংবাদিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেছিলেন। ওঁদের যাতায়াতের ভাড়াও দিয়েছিলেন। কিন্তু কলকাতার কোনও কাগজ পাত্তা দেয়নি। শুধু

দ্রুত বললাম, -দৈনিক সত্যসেবক।

–আজ্ঞে হ্যাঁ। তা-ও যাঁর যাওয়ার কথা তিনি যাননি। গিয়েছিলেন একজন ফোটোগ্রাফার। পরমেশদা তাতেই খুশি। ছবি বেরুলে বেশি পাবলিসিটি হবে খবরের চেয়ে।

ষষ্ঠী কফি এনে দিল। বললাম, -কফি খান। আমি যাব চন্দ্রপুরে। তবে কখন যাব, তা বলতে পারছি না।

কফি খেয়ে তারকবাবু ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বললেন, আপনি আমার সঙ্গে চলুন। আমার বাড়িতে থাকবেন।

উনি অনেকক্ষণ ধরে খুব সাধাসাধি করতে থাকলেন। বিরক্ত হয়ে বললাম, -সময়মতো যাব। ভাববেন না। …

দুপুরে জয়ন্তকে ফোন করলাম দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার অফিসে। ফোন ধরে প্রথমে সে একচোট নিল আমাকে, –আপনার সত্যি ভীমরতি ধরেছে। আপনি এমন একটা সাংঘাতিক রহস্যের কিনারা করলেন না। আর আমার মুখ আপনি দেখতে পারেন না। …ইত্যাদি….।

তাকে মিষ্টি কথায় শান্ত করে বললাম, -তোমার বন্ধু প্রচেতের মর্গের রিপোর্ট পাওয়া গেছে?

-হ্যাঁ। মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণের ফলে মৃত্যু। ক্ষতচিহ্ন চুলের ভেতর পাওয়া গেছে। হাতুড়ির ঘা। বলে সন্দেহ করা হয়েছে।

–ডার্লিং! আজ তোমাদের কাগজে চন্দ্রপুরের খুনোখুনির খবর পড়েছ?

-পড়েছি। মাই গুডনেস! প্রচেত গতকাল চন্দ্রপুরে নিউজ ফোটো আনতে গিয়েছিল। রিপোর্টার অশনির যাওয়ার কথা ছিল। যায়নি।

-অশনি আছে? ওকে ফোন দাও।

–কী ব্যাপার?

–আহা, দাও না ওকে।

 একটু পরে অশনি গুপ্তের সাড়া পেলাম, হ্যালো ওল্ড ডাভ। আমাকে ফাঁসাবেন নাকি?

-না, না। শোনো অশনি। চন্দ্রপুরে পরমেশবাবুর সভার নেমন্তন্ন মিস করলে কেন? তোমাকে। তো রাহাখরচ দিয়েছিলেন ওঁর পি. এ তারকবাবু।

সর্বনাশ! সর্বনাশ! আপনি সত্যিই দেখছি অন্তর্যামী।

-প্লিজ আনসার মাই কোয়েশ্চন, ডার্লিং।

–আসলে শেষ মুহূর্তে চিফ রিপোর্টার আমাকে অন্য একটা অ্যাসাইনমেন্টে পাঠিয়েছিলেন। এদিকে চন্দ্রপুরে কয়েকটা কল-কারখানা বন্ধের খবর আছে। ক্লোজার নামে একটা ফিচার বেরুবে সত্যসেবক পত্রিকা। তাই চিফ রিপোর্টার প্রচেতকেই যেতে বলেছিলেন। বন্ধ কলকারখানার ছবি তুলে আনাই ওকে পাঠানোর আসল উদ্দেশ্য ছিল। আপনি চিফ রিপোর্টারের সঙ্গে কথা বলে জেনে নিন।

-থাক। তুমি জয়ন্তকে দাও।

জয়ন্ত ফোন ধরে বলল, -বস! আপনি হঠাৎ ইন্টারেস্টেড হয়ে উঠলেন যে?

–জয়ন্ত, আমার সঙ্গে চন্দ্রপুর যেতে হবে তোমাকে।

–মাথা খারাপ? আমাকে ইভনিং ফ্লাইটে দিল্লি যেতে হচ্ছে। সরি কর্নেল!

–আর কিছু ইনফরমেশন পুলিশের কাছে জেনেছ?

–আর কিছু-হ্যাঁ, চেতের ক্যামেরা হারায়নি। কিন্তু ভেতরে ফিল্ম রোলটা নেই। অফিসে বলেছিল, রোলটা শেষ হয়নি।

–ফিল্ম রোল নেই?

-নাহ। ক্যামেরা খালি। আপনাকে অত করে অনুরোধ করলাম, আপনি গেলেন না। কী মিস্ট্রি হেলায় হারালেন বুঝুন।

ফোনে কলকাতার সেচ দপ্তরের এক কর্তাব্যক্তিকে বলে চন্দ্রপুরে ওঁদের বাংলো বুক করেছিলাম। বিকেল পাঁচটা নাগাদ ট্রেনে পৌঁছে পোঁছে সাইকেল রিকশায় বাংলোয় পৌঁছলাম। খুশি হলাম দেখে যে, ট্রাংককলে চৌকিদারকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, আমি আসছি। গঙ্গার ধারে একটা খালের মুখে বাংলো। নিসর্গদৃশ্য সুন্দর। চন্দ্রপুরের বসতি এলাকার বাইরে হওয়ায় নিরিবিলি পরিবেশ। জানলা থেকে কিছুক্ষণ বাইনোকুলারে পাখি দেখলাম। গঙ্গার ধারে ঝোপেঝাড়ে প্রজাপতি খুঁজলাম। মোটে দুটো দেখা গেল। তা-ও নিছক সাধারণ প্রজাতির প্রজাপতি।

 কফি খেয়ে পায়ে হেঁটে বেরোলাম। চন্দ্রপুরের বাজারে সেই চৌমাথায় পৌঁছেছি, তখনও যথেষ্ট আলো আছে দিনের। ভিড়-ভাট্টা, রকমারি যানবাহন, খুব হই-হট্টগোল।

রাস্তার ওধারে একটা ড্রেন। আবর্জনা আর পচা পাঁক থিকথিক করছে।

আমার স্বভাব হল, সব রহস্যের ক্ষেত্রে একটা থিওরি খাড়া করে নিই। তারপর তথ্য সংগ্রহে পা বাড়াই। তথ্য না পেলে থিওরিটা বাতিল করে আরেকটা থিওরি সাজাই।

আমি একটা জিনিস খুঁজছিলাম ড্রেনে। চমকে উঠে দেখলাম সেটা আছে। এঁটো শালপাতার স্কুপের পাশ দিয়ে দেখা যাচ্ছে। পেছন দিকে খেলার মাঠ। সেই মুহূর্তে একটা ফুটবল এসে পড়ল সেখানে। চমৎকার সুযোগ পেলাম কুড়িয়ে নেওয়ার। ছেলেগুলো আসার আগেই ফুটবলটা তুলে ছুঁড়ে দিলাম ওদের দিকে। সেই ফাঁকে জিনিসটাও তুলে নিলাম।

জিনিসটা একটা খেলনার রিভলবার। শালপাতায় জড়িয়ে নিলাম। যেন পাশের মাছের বাজার থেকে মাছ কিনেছি।

 এবার রিকশা করে বাংলোয় ফিরে টয় রিভলবারটা বেসিনে রগড়ে ধুয়ে ফেললাম। জানতাম, এমন একটা জিনিস ঘটনাস্থলের আশেপাশে পড়ে থাকার কথা। ওটা কিটব্যাগে রেখে চৌকিদারকে কফি করতে বললাম। গঙ্গার ধারের লনের চেয়ারে বসে গঙ্গা দেখতে থাকলাম। সূর্যাস্তকালে গঙ্গার জলে শেষ আলোর খেলার কোনও তুলনা হয় না। একটু পরে চৌকিদার কফি আনল।

সে কফির পট পেয়ালাসমেত ট্রেতে বেতের টেবিলের ওপর বিনীতভাবে রাখল! তারপর একটু তফাতে দাঁড়িয়ে রইল। বললাম, কিছু বলবে তুমি?

চৌকিদার কাঁচুমাচু হেসে বলল, না স্যার। কফি কেমন হয়েছে দেখুন। খারাপ হলে আবার তৈরি করব।

চুমুক দিয়ে বললাম, ফার্স্টক্লাস হয়েছে। তোমার নাম কী?

–আজ্ঞে মঙ্গল।

 –গতকাল নাকি চন্দ্রপুরে একটা খুনোখুনি হয়েছে?

মঙ্গল গল্পটা বলার জন্য ঘাসে বসল। সে ইনিয়েবিনিয়ে পরমেশবাবুর বোকামির কথা শোনাল। তার মতে, অভয় হাজরার দলবল আছে। তিনি ট্রেড ইউনিয়নও করেন। তিনি এখানকার কলকারখানা বন্ধের মূলে। তার বিরুদ্ধে ভোটে দাঁড়ানো ঠিক হয়নি পরমেশবাবুর। ওঁর বালবের কারখানাও তত বন্ধ করতে বাধ্য করেছেন অভয় হাজরা। আসলে ভোটে জিতে অভয়বাবু মন্ত্রী হবেন সম্ভবত। তারপর সব কারখানা খোলার ব্যবস্থা করবেন। কলকাঠিটা তারই হাতে। তার মতো লোকের বিরুদ্ধে লড়াই করে সাধ্য কার? পুলিশও তো তার কেনা।

বললাম, -শুনলাম কে এক কিনু পাগলা পরমেশবাবুকে গুলি করেছে?

মঙ্গল খিকখিক করে হাসল, -এ স্যার পরের হাতে হুঁকো খাওয়া। পাগলা লোক। তাকে বন্দুকপিস্তল দিয়ে যাকে গুলি করতে বলবে, সে তাকেই গুলি করবে। পাগলের কি জ্ঞানবুদ্ধি আছে?

–কিন্তু কিনু পাগলাকেও কে গুলি করে মারল?

মঙ্গল এদিক ওদিক দেখে চাপা গলায় বলল, -পাগলা মুখ ফসকে যদি বলে ফেলে কে তাকে পিস্তল দিয়েছে, তা-ই তাকেও ভিড়ের হট্টগোলের ফাঁকে মেরে ফেলেছে।

-পিস্তল না রিভলবার?

–ওই হল স্যার। মানুষ মারা কল তো বটেই।

–আচ্ছা মঙ্গল, সভায় তখন নাকি কারা হাঙ্গামা হইচই বাধিয়েছিল। ধরো, কথার কথাই বলছি, সেই সুযোগে কিনুর বদলে কিনুর খুনিই তো পরমেশবাবুকে মারতে পারত। কিনুকে খুন করার দরকারই হতো না।

মঙ্গল একটু ভেবে নিয়ে বলল, -তা ঠিক স্যার। তবে

সে হঠাৎ চুপ করলে বললাম, -তবে?

মঙ্গল চাপাস্বরে বলল, ফোটো তুলছিলেন এক ভদ্রলোক। ফোটোতে খুনির ছবি উঠে যেত।

-তুমি ছিলে সভায়?

 –ছিলাম স্যার।

 –ফোটো তুলতে দেখেছিলে?

হ্যাঁ। বার বার ঝিলিক মেরে ফটো তুলছিলেন। কিন্তু পাগলাকে পিস্তল তুলে গুলি ছুঁড়তেও দেখেছিলাম।

সন্ধ্যায় আঁধার ঘনিয়ে এসেছে। মঙ্গল আলো জ্বালতে চলে গেল। আমার থিওরির সঙ্গে চমৎকার খাপ খেয়ে যাচ্ছে ঘটনাগুলো। ফোটোতে খুনির ছবি উঠেছে, এই আশঙ্কায় ফোটোগ্রাফার প্রচেতকে ওইভাবে মারতে হয়েছে। তাকে অনুসরণ করে কলকাতা গেছে খুনি। তার সঙ্গে ভাব জমিয়েছে। তাকে নির্জন জায়গায় নিয়ে গিয়ে মেরে ফেলেছে। কিন্তু ক্যামেরা ছিনতাই করলেই তো হতো। কেন ক্যামেরা ছিনতাই করেনি? এদিকে চৌকিদার মঙ্গল কিনু পাগলাকে গুলি ছুঁড়তে দেখেছে। ….

চন্দ্রপুর থানার ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর অরুণ মজুমদার আমার পরিচিত। বাংলো থেকে তাকে টেলিফোন করলাম। অরুণবাবু বললেন, -হাই ওল্ড বস! সত্যিই কি আপনি নাকি কোনও

 ডার্লিং! আমিই বটে।

-হাঃহাঃহাঃ। দ্যাটস রাইট। ডার্লিং সম্ভাষণ এই সমগ্র পৃথিবীতে একজনের মুখেই মানায়। তা হঠাৎ এখানে আপনি কি নিছক প্রজাপতি ধরতে ছুটে এসেছেন?

-বলতে পার। তবে এখানকার প্রজাপতি বর্ণচোরা।

 –কর্নেল। আপনার কথায় রহস্যের গন্ধ পাচ্ছি।

–রহস্য একটু আছে। তুমি চলে এসো।

 মিনিট পনেরো পরে অরুণের জিপের আলোয় সেচবাংলো ঝলসে উঠল। তাকে আসতে দেখে মঙ্গল চৌকিদারের মুখে বিস্ময় ও উদ্বেগ ফুটে উঠল। বললাম, মঙ্গল। পটভর্তি কফি আনো শিগগির।

লনে বেতের চেয়ারে বসে অরুণ বলল, -বর্ণচোরা প্রজাপতির কথা শুনেই সন্দেহ হল, আপনি সম্ভবত পরমেশ চক্রবর্তীর মৃত্যুর কেস হাতে নিয়েছেন?

নিয়েছি।

অরুণ একটু হাসল–কিন্তু পরমেশবাবুকে গুলি করে মেরেছে এক বদ্ধ পাগল। আপনি তো জানেন, পাগল অবস্থায় লোকে খুনখারাপি করে। কাজেই পরমেশবাবুকে খুন করা নিয়ে আমরা মাথা ঘামাচ্ছি না। বরং কিনু পাগলাকে ভিড়ের ভেতর কে গুলি করল সেটাই আসল রহস্য।

-তোমার থিওরি কী এ সম্পর্কে?

-খুনি ভিড়ের ভেতর থেকে গুলি ছুঁড়েছে মঞ্চে পরমেশবাবুকে লক্ষ্য করে। একটা গুলিতে মৃত্যু না হতেও পারে। তাই ভেবে দ্বিতীয়বার গুলি ছুঁড়েছে। দ্বিতীয় গুলিটা লেগেছে কিনু পাগলার মাথার পেছনে।

–কিন্তু লোকে কিনু পাগলাকে রিভলবার তুলে গুলি ছুঁড়তে দেখেছে।

অরুণ আবার হাসতে লাগল, একটা গণ্ডগোল বাধলে লোকেরা তা নিয়ে নানারকম গল্প বানায়। ঘটনার আকস্মিকতায় কী দেখতে কী দেখে।

-কিনুর হাতে রিভলবারটাও তোমরা পেয়েছ, অরুণ।

ভিড়ের গণ্ডগোলের সুযোগে ওর হাতে খুনি গুঁজে দিয়েছে।

–তোমার এই পয়েন্টটা ঠিক আছে অরুণ।

–কোন পয়েন্টটা ঠিক নেই?

একটু বসো, দেখাচ্ছি–বলে বাংলোর ভেতর গেলাম। কিটব্যাগ থেকে সেই ড্রেনে কুড়িয়ে পাওয়া খেলনা রিভলবারটা এনে অরুণকে দেখালাম।

অরুণ অবাক হয়ে বলল, -এটা তো টয় রিভলবার। কোথায় পেলেন?

বললাম, –যেখানে সভা হয়েছিল, তার কাছে ড্রেনের মধ্যে। আমি ধরেই নিয়েছিলাম এমন একটা জিনিস কাছাকাছি কোথাও লোকের চোখে পড়ার বাইরে পড়ে থাকবে।

-কী অদ্ভুত। আপনি কি মন্ত্রবলে জানতে পেরেছিলেন, কর্নেল?

হাসতে হাসতে বললাম, -নাহ ডার্লিং। সহজ বুদ্ধিতে। আসলে সত্যিকার রিভলবার চালানো কোনও পাগলের সাধ্য নয়। অটোমেটিক রিভলবারের ট্রিগার টানলে গুলি বেরুবে। কিন্তু কোনও পাগলের ট্রিগার টেনে নির্দিষ্ট স্থানে লক্ষ্যভেদ একেবারে অসম্ভব। তাছাড়া ছটা গুলির মধ্যে তোমরা নাকি দুটো গুলি পেয়েছ রিভলবারে। তাই না?

-হ্যাঁ। চারটে খরচ হয়েছে।

–তা হলে দুটো খরচ হয়েছে গোপনে টার্গেট প্র্যাকটিসে। একটা খরচ হয়েছে পরমেশবাবুকে মারতে। আরেকটা কিনুকে মারতে। কিনু পাগলার মুখ বন্ধ করার জন্য তাকে মারা হয়েছে।

অরুণ টয় রিভলবারটা দেখতে দেখতে বলল, -কী আশ্চর্য। এটা ঠিক ওই আসল অস্ত্রটার হুবহু নকল।

–হ্যাঁ, নকল। লোকেরা এই টয় অস্ত্রটায় দেখেছে কিনু পাগলার হাতে। তার মানে, খুনি তাকে এটা দিয়ে বলেছিল, হট্টগোল বাধলে সে যেন এটা তুলে গুলি ছোঁড়ার ভান করে। পাগলা মানুষ। তাই খুব মজা পেয়েছিল কাজটা করতে। কিন্তু সে জানত না, এটা একটা বিপজ্জনক ফাঁদ। খুনি তার চেনা। তাই তার মুখ বন্ধ করতে তাকে মারা হয়েছে। পয়েন্টটা তুমি বুঝে দ্যাখো অরুণ। একজন পাগলের গুলিতে পরমেশবাবু মারা পড়তে পারেন, এটা তোমরা সহজে বিশ্বাস করতে চাইবে না। খুঁটিয়ে তদন্ত করবে। তাই ধূর্ত খুনি পাগলকেও মেরেছে।

অরুণ গম্ভীর মুখে বলল, -হ্যাঁ। মেরে ভিড়ের সুযোগে খুনি কিনু পাগলের হাতের টয় রিভলবারটা নিয়ে আসল রিভলবারটা গুঁজে দিয়েছে। টয় রিভলবারটা ড্রেনে ফেলে দিয়েছে।

এবার দৈনিক সত্যসেবকের ফোটোগ্রাফার প্রচেত রায়ের মৃত্যুর ঘটনাটা বললাম অরুণকে। শুনে অরুণ খুব উত্তেজিত হয়ে উঠল। তাকে পরমেশবাবুর পি. এ. তারকবাবুর কথাও বললাম।

মঙ্গল চৌকিদার এতক্ষণে কফি আনল। সে দাঁড়িয়ে কথা শুনবে ভাবছিল হয়তো। অরুণ তাকে। ধমক দিয়ে চলে যেতে বলল। সে উদ্বিগ্ন মুখে বাংলোর কিচেনে চলে গেল।

অরুণ বলল, –আমোনিয়ান গির্জা আমি দেখেছি। পাশে একটা কবরখানা আছে। ওখানে প্রচেতবাবু অত রাত্রে গেলেন কেন?

খুনি তার চেনা। খুনি তাকে কোনও অজুহাত দেখিয়ে ওই নির্জন জায়গায় নিয়ে গিয়েছিল। এছাড়া কোনও ব্যাখ্যা হয় না। কারণ অচেনা লোকের সঙ্গে প্রচেত ওখানে যাবে কেন? তাছাড়া চেনা বলেই প্রচেতের ক্যামেরা ছিনতাই করতে পারেনি খুনি।

-তার মানে, খুনি চন্দ্রপুর থেকে প্রচেতবাবুর সঙ্গে কলকাতা গিয়েছিল।

–দ্যাটস রাইট ডার্লিং।

অরুণ কিছুক্ষণ কফিপানের পর বলল, -হাতুড়ি দিয়ে মেরে খুন করেছে প্রচেতবাবুকে?

-হ্যাঁ। সাংবাদিক জয়ন্ত চৌধুরীকে তো তুমি চেনো। সে তা-ই জানাল। মর্গের রিপোর্টে নাকি বলা হয়েছে।

অরুণ আবার বলল, -হাতুড়ি?

মাথা দোলালাম। বললাম, -কোনও সূত্র খুঁজে পাচ্ছ কী?

 পাচ্ছি। -বলে অরুণ উঠে দাঁড়াল : আমার সঙ্গে বেরুতে আপত্তি আছে?

–নাহ।

তা হলে আসুন। ….

অরুণের জিপ থানাচত্বরে ঢুকল।

অফিসার-ইন-চার্জ পুলকেশ দে-র সঙ্গে অরুণ আমার পরিচয় করিয়ে দিল। পুলকেশবাবু গোগ্রাসে এবং বিস্ময়ে বললেন, আপনার মতো প্রখ্যাত মানুষের পায়ের ধুলো পড়বে এখানে, কল্পনাও করিনি কর্নেলসায়েব। আশা করি, পরমেশবাবুর হত্যারহস্য সমাধান আপনার আগমন? তা যদি হয়, আপনার সঙ্গে সহযোগিতায় আমরা তৈরি।

অরুণ বলল, -মি. দে আজ সকালে আমার সামনে বস্তির এক বুড়িমা একটা ডায়রি করতে এসেছিল। তাকে কোনও দজ্জাল গিন্নি নাকি ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছে।

 -পুলকেশবাবু হাসলেন, -সামান্য একটা কয়লাভাঙা হাতুড়ি হারিয়ে গণ্ডগোল। তো এই তুচ্ছ। ব্যাপারে ডায়রি কী হবে? গিন্নি মহিলাকে ডেকে পাঠিয়ে একটু বকাবকি করলাম। মহিলা বললেন, –ভুল হয়েছে। মিটমাট করে দিন। বরং পঞ্চাশ টাকা ওকে দিচ্ছি, ওটাই ওর মাইনে। তা-ই দিচ্ছি। আমি টাকাটা দিয়ে বুড়িকে দিলাম। মিটে গেল। কিন্তু কেন

অরুণ বলল, -কারণ আছে। গিন্নি মহিলার নাম কী?

ডায়রি বইয়ের পাতা উলটে দেখে পুলকেশবাবু বললেন, -সুপ্রভা রায়। স্টেশনের কাছে তিলেপাড়ায় বাড়ি। স্বামীর নাম

আমি বললাম, -তারক রায় কি?

পুলকেশবাবু অবাক হয়ে বললেন, -হ্যাঁ। কিন্তু ব্যাপারটা কী?

বললাম, এখনই তারক রায়কে পরমেশবাবু এবং কিনু পাগলাকে খুনের দায়ে গ্রেফতার করুন। তারপর গ্রেফতার করুন অভয় হাজরাকে। তার প্ররোচনায় এই হত্যাকাণ্ড।

অরুণ উত্তেজিতভাবে উঠে দাঁড়াল।

বলল, -পরমেশবাবুর কারখানা বন্ধ হওয়ায় তারক রায় ঠিকমতো মাইনে পাচ্ছিলেন না শুনেছি। পরমেশবাবু জনপ্রিয় লোক। অভয় হাজরাই তার কারখানা বন্ধের জন্য দায়ী। তাই মরিয়া হয়ে তাকে ঢিট করতে ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন। বোঝা যাচ্ছে, অভয় হাজরার টাকা খেয়ে তারক রায় এই খুনখারাপি করেছেন।

-অরুণ একদল পুলিশ নিয়ে বেরিয়ে গেল। পুলকেশবাবু পুরো ব্যাপারটা জানতে চাইলেন। সবই বললাম। শোনার পর উনি হাসতে হাসতে বললেন, –কিন্তু অমন ধূর্ত তারকবাবু আপনার কাছে গিয়েই ধরা পড়ছেন। যেচে বিপদ ডাকতে গেলেন কেন বলুন তো?

চুরুট ধরিয়ে বললাম, -একটা সহজ কারণ পুলকেশবাবু। তারকবাবু ভালোমানুষ সাজতে চেয়েছিলেন এবং সেই সুযোগ আমাকে দিয়ে বুঝতে চেয়েছিলেন, এ ব্যাপারে দৈবাৎ তার ধরা পড়ার মতো কোনও সূত্র থেকে গেছে কি না। তার ইচ্ছে ছিল, আমি তার বাড়িতে উঠি। তিনি তাহলে আমার সঙ্গে থেকে সূত্রগুলো জানতে পারবেন এবং সেগুলো ম্যানেজ করবেন। কিন্তু আমি তার ফাঁদে পড়িনি। তাকে জানাইনি কবে আমি আসছি কোথায় উঠছি।

–কিন্তু ওঁকে দেখে আপনার সন্দেহ হয়েছিল কেন?

–যে একজন রহস্যভেদীর সাহায্য নিতে এসেছে, সে তাকে নিজের বাড়িতে ওঠার জন্য সাধবে কেন? তাতে তো প্রতিপক্ষ সতর্ক হয়ে যাবে। তাই তারকবাবু নিজের বাড়িতে আমাকে ওঠার জন্য বারবার সাধাসাধি করায় আমার সন্দেহ হয়েছিল, ভদ্রলোকের কোনও অন্য উদ্দেশ্য আছে।

পুলকেশবাবু বললেন, আপনি সত্যি অনন্যসাধারণ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *