তিতলিপুরের জঙ্গলে

তিতলিপুরের জঙ্গলে

০১.

সময়টা ছিল ডিসেম্বরের মাঝামাঝি। কর্নেল কোন সূত্রে খবর পেয়েছিলেন, তা জানি না। দোমোহানি নামে কোন অজ পাড়াগাঁ এলাকার জলাধারে নাকি একঝক নীল সারস এসেছে। কর্নেলের মতে, এই সারস নাকি অতিশয় দুর্লভ প্রজাতির। অতএব তাকে আমার ফিয়াট গাড়িতে চাপিয়ে দোয়োহানি যাচ্ছিলাম।

চৌত্রিশ নম্বর জাতীয় সড়কে পঞ্চাশ কিলোমিটার এগিয়ে একটা ছোট্ট বাজারে পৌঁছে কর্নেলের নির্দেশে গাড়ি দাঁড় করিয়েছিলাম। সেখানে একটা চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে মাটির ভাঁড়ে দুজনে চা খেলাম। কর্নেল চা পছন্দ করেন না। তিনি কফি খান, আমার হিসেবে ঘণ্টায় কমপক্ষে দু-বার। কিন্তু সেখানে কফি পাওয়া যায় না।

চায়ের দাম মিটিয়ে কর্নেল চাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলেন –তিতলিপুর আর কতদূরে?

চাওয়ালা একগাল হেসে বলল–স্যার! এটাই তো তিতলিপুর।

–এখান থেকেই তো দোমোহানি যাওয়া যায়?

–আজ্ঞে স্যার। চাওয়ালা আঙুল তুলে অদূরে একটা বিশাল বটগাছ আর জীর্ণ মন্দির দেখাল। ওই যে দেখছেন কাত্যায়নীতলা। ডাইনে ঘুরে চলে যান। পিচরাস্তা যেন ছাড়বেন না। তা মোটরগাড়িতে ধরুন বিশ-তিরিশ মিনিটে পৌঁছে যাবেন।

আমি কর্নেলের এই অভিযানের লক্ষ্যবস্তু বলতে শুধু জানি দুটো কথা। জলাধার আর নীল সারস। তাই নিছক কৌতূহলে কর্নেলকে এতক্ষণে জিজ্ঞেস করলাম-দোমোহানি গ্রামে বিদ্যুৎ আছে কি?

-চাওয়ালা হেসে উঠল। দোমোহানি গ্রাম নয় স্যার। দুটো নদী উত্তর আর পুবদিক থেকে এসে মিশেছে। সেখানে আগের দিন ছিল অথই জলের বিল। গরমেন্ট বছর দশেক আগে সেই বিলের চারদিকে বাঁধ দিয়ে ড্যাম করেছে। আর স্যার, ওই পথের ওপাশে যে জঙ্গল ছিল, সেটাকে করেছে ফরেস্ট।

কর্নেল ঘড়ি দেখে বললেন–নটা পনেরো। জয়ন্ত! আর তাড়াহুড়ো নয়। আস্তে ড্রাইভ করো।

গাড়িতে উঠে বললাম-জঙ্গলে প্রজাপতি, অর্কিড, আর পাখি-টাখি দেখতে দেখতে যাবেন।

কর্নেল তাঁর প্রকাণ্ড শরীর আমার বাঁপাশে ঢুকিয়ে বললেন-তুমি পাখির সঙ্গে টাখি বললে। বলা যায় না, আমরা টাখিরও দর্শন পেতে পারি।

বলে তিনি চুরুট ধরালেন। কাত্যায়নীতলায় ডাইনে ঘুরে পূর্বমুখী একটা সংকীর্ণ পিচরাস্তায় আস্তে এগিয়ে গেলাম। কলকাতার রাস্তায় প্রায়ই এই স্পিডে আমাকে গাড়ি চালিয়ে দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার অফিসে পৌঁছুতে হয়।

রাস্তাটা মসৃণ নয়। এবড়োখেবড়ো। আমাদের ডাইনে আমবাগান, ঝোপ-জঙ্গল, কোথাও পুরোনো কালের দালানকোঠার ধ্বংসস্তূপ এবং এসবের ফাঁকে তিতলিপুরের ঘর-বাড়ি চোখে পড়ছিল। মাঝে মাঝে ডাইনে একটা করে মাটির রাস্তা, একটা মোরামবিছানো রাস্তা আর পায়ে চলা রাস্তা তিতলিপুরের ভিতরে ঢুকে গেছে। কিন্তু বাঁদিকে টানা জঙ্গল। ঝোপঝাড় যত, তত উঁচু গাছ এবং শালবন। এই শীতে শালবনের চেহারা রুক্ষ, হতশ্রী। পাতা ঝরে গেছে। তবে চিরহরিৎ গাছপালা যেন তাদের দারিদ্র্য ঢেকে রেখেছে।

কর্নেল বাইনোকুলারে অর্কিড প্রজাপতি বা পাখি–আমি বলেছি পাখি-টাখি, অভ্যাসমতো খুঁজছেন। কিছুদূর চলার পর রাস্তা ডানদিকে বাঁক নিল। বাঁদিকে একটানা জঙ্গল, চাওয়ালার ফরেস্ট। ডানদিকে সিঙ্গাপুরি কলাবাগান। কখনও আমবাগান। হঠাৎ কর্নেল বললেন –ডার্লিং! তুমি টাখির কথা বলছিলে। এবার সত্যিই টাখি দেখতে পাবে। স্পিড বাড়াও।

কিছুটা এগিয়েই দৃশ্যটা চোখে পড়ল।

দুজন ভদ্রলোক রাস্তার উপর মল্লযুদ্ধ করছেন। একজনের পরনে প্যান্ট, ফুলহাতা সোয়েটার। অন্যজনের পরনে ধুতি আর গলাবন্ধ লম্বাকোট। দুজনে পরস্পরকে ধরে জাপটাজাপটি করছিলেন। তারপর ওই অবস্থায় রাস্তার পাশে ঘাসে গিয়ে পড়লেন। আশ্চর্য ব্যাপার, দুই যোদ্ধাই প্রবীণ। দুজনেরই মাথার চুল সাদা।

আমাদের গাড়ির প্রতি তাদের দৃকপাত নেই। কর্নেল সত্যিই বলেন, হিংসাজনিত ক্রোধ মানুষকে অন্ধ করে। কর্নেলের ইশারায় আমি যতটা সম্ভব নিঃশব্দে দুই মল্লযোদ্ধার প্রায় হাতবিশেক দূরে গাড়ি দাঁড় করালাম। আমি হাসছিলাম না। কারণ তাদের হুম হাম হুঙ্কার, ফোঁস ফোঁস শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ এবং পরস্পরের পোশাক টানাটানি দেখে মনে হচ্ছিল, এবার একজন। অপরজনের বুকে বসে গলাটিপে মেরে ফেলবেন।

আবার তারা উঠে দাঁড়িয়ে বিকট হুঙ্কার দিয়ে পরস্পর মল্লযুদ্ধে রত হতেই কর্নেল গাড়ি থেকে নামলেন। তারপর ক্যামেরা তাক করে এগিয়ে গেলেন। শাটার টেপার শব্দ কানে আসছিল।

এতক্ষণে অদ্ভুত ঘটনা ঘটে গেল। দুই যোদ্ধারই চোখ পড়ল কর্নেলের দিকে। অমনই প্যান্ট-সোয়েটারপরা শ্যামবর্ণ ভদ্রলোক যেন দিশাহারার মতো বাঁদিকের জঙ্গলের ভিতরে সবেগে। উধাও হয়ে গেলেন। ধুতি-লংকোটপরা ফরসা ভদ্রলোকও ডানদিকে আমবাগানের ভিতরে একই বেগে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।

কর্নেল তাঁর বিখ্যাত অট্টহাসি হেসে বললেন তা হলে জয়ন্ত! আমরা সত্যিই একটা টাখি দেখলাম। তাই না?

গাড়ি থেকে নেমে বললাম কিন্তু কর্নেল, ব্যাপারটা অস্বাভাবিক।

–কেন অস্বাভাবিক?

 –আমাদের দেখে ওঁরা অমন করে পালিয়ে গেলেন কেন?

–বরং বলে আমাকে দেখে। কারণ আমি রাস্তায় নেমে ওঁদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম।

–তা অবশ্য ঠিক। কিন্তু তা হলেও ওঁরা দিশেহারা হয়ে পালিয়ে গেলেন। এর কারণ কী?

-তোমার কী ধারণা? একটু ভেবে বলল জয়ন্ত!

একটু ভেবে নিয়ে বাঁ হাতের ওপর ডান হাতের থাপ্পড় মেরে হাসতে হাসতে বললাম-বুঝেছি। দুজনেই দস্তুরমতো ভদ্রলোক। তাই লজ্জায় অপ্রস্তুত হয়ে কেটে পড়লেন আর কী!

 কর্নেল তাঁর সাদা দাড়ি মুঠোয় চেপে ধরে কী যেন ভাবছিলেন। বললেন-না জয়ন্ত! ক্যামেরা। আমার এই ক্যামেরাই ওঁদের পালানোর কারণ।

কথাটা এবার মনে ধরল। বললাম–হ্যাঁ, হ্যাঁ। ঠিক তা-ই। দুজনেই ভদ্রলোক। বুড়োবয়সে ওইভাবে মল্লযুদ্ধ করছেন। আর আপনি ক্যামেরায় সেই অদ্ভুত ঘটনার ছবি তুলতে যাচ্ছেন। সেই ছবি এলাকার পরিচিত লোকে দেখলে হাসাহাসি করবে। সেই ভেবেই ওঁরা রণক্ষেত্র থেকে পালিয়ে গেলেন। কিন্তু আমি আপনার ক্যামেরার কয়েকটা ক্লিক শুনতে পেয়েছি।

কর্নেল বললেন–হ্যাঁ। আমার হাতে ক্যামেরা এবং আমার উদ্দেশ্য টের পেয়েই ওঁরা পালিয়েছেন। তো-তুমি রণক্ষেত্র বললে। রণক্ষেত্রে ওটা কী পড়ে আছে?

বলে তিনি পিচরাস্তার ডানদিকে পিচ আর পাথরকুচির টুকরো উঠে গিয়ে যে ছোট্ট গর্ত হয়েছে, সেখান থেকে কী একটা জিনিস তুলে নিলেন। জিজ্ঞেস করলুম-পকেট থেকে কয়েন পড়ে গেছে। নিশ্চয়-যা যুদ্ধ চলছিল।

কর্নেল জিনিসটা তার জ্যাকেটের ভিতর-পকেটে ঢুকিয়ে রেখে গাড়িতে উঠলেন। আমিও উঠে পড়লাম। স্টার্ট দিয়ে লক্ষ্য করলাম, আমার বৃদ্ধ বন্ধুর মুখ হঠাৎ বেজায় গম্ভীর হয়ে উঠেছে। তিনি বললেন-এবার স্পিডে চলো, জয়ন্ত! দশটার মধ্যেই আমার সেচবাংলোয় পৌঁছুনোর কথা।

কিছুদূর চলার পর বাঁদিকে বাঁক নিয়ে রাস্তা সোজা এগিয়ে গেছে। এবার ডানদিকে সবুজ মাঠ এবং বাঁদিকে একই জঙ্গল–সেই ফরেস্ট টানা চলেছে। প্রায় দু কিলোমিটার পরে বাঁদিকে জঙ্গলের শেষ প্রান্তে অর্থাৎ পূর্বদিকে পুরোনো আমলের প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ দেখলাম। তার নিচে স্বচ্ছজলের ঝিল। ঝিলের ওপাশে উঁচু বাঁধ। কর্নেলকে জিজ্ঞেস করলাম–ওটা কি কোনও রাজারাজড়ার বাড়ি ছিল?

-হ্যাঁ। তবে বাড়ি নয়। কেল্লা। মোগল আমলের এক ফৌজদার জাহান খাঁর কেল্লাবাড়ি। ইচ্ছে হলে ওটা দেখে নিয়ে ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে গিয়ে দরকারি বই খুঁজে দৈনিক সত্যসেবকে একটা। রিপোর্টাজ লিখে ফেলবে।

-এবার কিন্তু আমার সন্দেহ হচ্ছে, আপনার লক্ষ্য দুর্লভ প্রজাতির নীল সারস, নাকি অন্য কিছু?

কর্নেল হাসলেন। তাই বলুন! গত রবিবার ড. জয়ন্ত ঘোষাল আপনার কাছে এসেছিলেন।

-তুমি জানো না, ড. ঘোষাল একজন প্রখ্যাত ওর্নিহোলজিস্ট!

–সেটা কী?

–ওঃ জয়ন্ত! এযুগে সাংবাদিকদের সবজান্তা হওয়া দরকার। গ্রিক ভাষায় ওর্নিহো মানে পাখি।

-তার মানে ড. ঘোষাল এক পক্ষীতত্ত্ববিশারদ। মুম্বাইয়ের সালিম আলির নাম জানি!

-বাঃ! তিনি তো আর বেঁচে নেই। একজন বঙ্গসন্তান তার মতো কৃতিত্ব অর্জন করলে খুশি হব।

এবার সামনে উঁচু জমির ওপর সুদৃশ্য বাংলো ধাঁচের বাড়ি এবং উঁচু বাঁধের ওপর সারিবদ্ধ ইউক্যালিপটাস গাছের ফাঁকে বিস্তীর্ণ জল চোখে পড়ল। জলে উত্তরের বাতাসে সমুদ্রের মতো ঢেউ দেখা যাচ্ছিল। জায়গাটা আমার ভালো লাগল।

পিচরাস্তাটা বাংলোর দক্ষিণের নিচু পাঁচিলের পাশ দিয়ে এগিয়ে ডাইনে ঘুরে বাঁধের রাস্তায় মিশেছে। সেখানে একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। মনে হল, একটা পুরো পরিবার সাইট-সিইংয়ে এসেছে। হয়তো বাঁধের ওপর পিকনিকও করবে।

দারোয়ান গেট খুলে দিল। গাড়ি সুদৃশ্য লনে নুড়ির ওপর অদ্ভুত শব্দ করছিল। কর্নেলের নির্দেশে ডানদিকের পার্কিং জোনে গাড়ি দাঁড় করালাম। কর্নেলকে দেখে একজন রোগা মধ্যবয়সি ভদ্রলোক হন্তদন্ত এগিয়ে এসে নমস্কার করলেন। –আমি স্যার বাংলোর কেয়ারটেকার রমেন বিশ্বাস। তিনি উর্দিপরা একটা লোককে বললেন-ভৈরব! তুমি সায়েবদের লাগেজ নিয়ে এসো। আসুন কর্নেলসায়েব! আমি আপনাদের রুমে পৌঁছে দিই।

পার্কিং জোনে একটা জিপগাড়ি দেখিয়ে কর্নেল বললেন–কোনও অফিসার এসেছেন বুঝি?

রমেনবাবু চাপাস্বরে বললেন–চন্দ্রপুরের বড়োবাবু–মানে, থানার অফিসার-ইন-চার্জ রাজেন হাটি। দোমোহানির উত্তরে সরকারি জমি দখল করে কিছু উটকো লোকবসতি করেছে। তাই নিয়ে এলাকার দুটো রাজনৈতিক দলের মধ্যে রেষোরেষি চলেছে। বড়োবাবু কয়েকজন আমর্ড কনস্টেবল নিয়ে সেখানে গেছেন। বাংলোর চারটে ঘরের দুটো ঘর-বলতে গেলে উনি নিজেই জবরদখল করেছেন। ইরিগেশন ডিপার্টমেন্টের বাংলো। এখন হঠাৎ আমার ওপরওয়ালা কেউ এসে পড়লে আমাকেই কৈফিয়ত দিতে হবে। কিন্তু পুলিশ বলে কথা! আমি স্যার কী করি বলুন! রামে মারলে মারবে, আবার রাবণে মারলেও মারবে…!

  বাংলোর চারদিকে চওড়া বারান্দা। পূর্ব-দক্ষিণের ডাবলবেড ঘরটি কর্নেলের জন্য রাখা ছিল। পূর্ব এবং দক্ষিণের বারান্দায় বসলে বিস্তীর্ণ জলাধার চোখে পড়ে। কিন্তু পূর্বদিকে উত্তরের উদ্দাম বাতাস। আমরা দুজনে দক্ষিণের বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসে ব্রেকফাস্ট করার পর কফি পান করছিলাম। বারান্দার নিচে রংবেরংয়ের ফুলের গাছ। তার মধ্যিখানে নুড়িবিছানো একফালি পথ। পথের শেষে গেট। উঁচু থেকে দেখতে পাচ্ছিলাম, গেটের ওধারে শানবাঁধানো ঘাটের নিচে একটা সাদারঙের বোট।

.

কেয়ারটেকার রমেন বিশ্বাসের বাড়ি তিতলিপুর। অনর্গল বকবক করা ভদ্রলোকের অভ্যাস। কর্নেলকে সারা এলাকার খুঁটিনাটি খবরাখবর দিচ্ছিলেন। একবার আমি রমেনবাবুকে তিতলিপুরের কাছে রাস্তার ওপর দুই মল্লযোদ্ধা সম্পর্কে প্রশ্ন করতে যাচ্ছিলাম। কর্নেল তা টের পেয়েই চোখ কটমটিয়ে আমাকে বললেন- নীল সারস কি অত সহজে দেখা যায় জয়ন্ত? ড. ঘোষাল সাত-সাতটা দিন ঘোরাঘুরি করার পর দৈবাৎ দেখতে পেয়েছিলেন!

আমি চুপ করে গেলাম। রমেনবাবু বললেন–কী নাম বললেন কর্নেলসায়েব? ড. ঘোষাল?

কর্নেল বললেন-হা, ড. জয়ন্ত ঘোষাল। আপনার তাকে চেনার কথা। উনি এই বাংলোয় ছিলেন।

–হ্যাঁ, হ্যাঁ। চিনতে পেরেছি। ঘোষালসায়েব এ মাসের গোড়ার দিকে এসেছিলেন। দিন ছ-সাত ছিলেন। কিন্তু রাত্রিটুকুই যা বাংলোয় কাটাতেন। ভোরবেলা বেরিয়ে যেতেন। আপনার মতো ক্যামেরা আর দূরবিন ছিল। বনবাদাড়ে আর এই ড্যামের জলে জেলেদের নৌকোয় চেপে পাখিদের ছবি তুলতে যেতেন। সঙ্গে একজন লোক দিয়েছিলাম। চন্দ্রপুরে তার বাড়ি। পাখিধরা তার পেশা স্যার! ফাঁদ পেতে পাখি ধরে কলকাতায় বেচে আসে। পুলিশের চোখে পড়লে তাকে জেল খাটতে হবে। কিন্তু পেটের জ্বালা স্যার সাংঘাতিক জ্বালা।

বললাম–কর্নেল! লোকটাকে সঙ্গী করতে পারেন! নীল সারসের খোঁজ সে নিশ্চয় রাখে।

কর্নেল কিছু বলার আগে রমেনবাবু বললেন–স্যার বললেই আমি রমজান পাখাডুকে খবর দেব।

-পাখাড়ু! অদ্ভুত পদবি তো!

রমেনবাবু হাসলেন। -হ্যাঁ স্যার। পাখি ধরে। তাই পাখাড়ু।

কর্নেল বললেন–তাকে দরকার হলে আমি আপনাকে বলব।

এই সময় বাংলোর কুকনরুঠাকুর এসে আমাদের সেলাম দিল। তারপর ট্রে-তে সাজিয়ে প্লেট, কফির পট আর কাপগুলো নিয়ে গেল। রমেনবাবুকে মুচকি হেসে চাপা স্বরে বললেন–একেই বলে ভাগ্য স্যার! তখন তিতলিপুরের জমিদারদের কথা বলছিলাম, নরু–মানে নরেন সেই বংশের ছোটোতরফের বংশধর। ওর পূর্বপুরুষের দাপটে এক সময় বাঘে-গোরুতে এক ঘাটে জল খেত! পূর্বজন্মের কাজের ফল। আর কী বলব?

কর্নেল অ্যাশট্রেতে চুরুট ঘষে নিভিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। মাথায় টুপি চাপালেন। টাকে ইতিমধ্যে যথেষ্ট হিম লেগেছে মনে হল। তারপর ঘরে ঢুকে ওঁর কিটব্যাগ পিঠে এঁটে বেরিয়ে এলেন। গলায় ক্যামেরা, বাইনোকুলার ঝুলিয়ে বললেন-জয়ন্ত! তুমি বিশ্রাম করো। আমি একবার ড্যামের ওদিকে ঘুরে আসি।

তারপর তিনি পশ্চিমে সদর গেট দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। একটু পরে বাংলোর নিচু বাউন্ডারি ওয়ালের ওপাশে তাকে দেখা গেল। বুঝলাম ড্যামের বাঁধের রাস্তা ধরে এগিয়ে যাবেন। কতদূর যাবেন, তা তিনিই জানেন।

রমেনবাবু জিজ্ঞেস করলেন-কর্নেলসায়েবেরও কি ঘোষালসায়েবের মতো পাখির নেশা আছে?

বললাম–নীল সারসের খোঁজে চললেন। এতক্ষণ কথা বলে বোঝেননি?

-তাই বটে! আপনি রেস্ট নিন স্যার! আমি নিজের কাজে যাই।

–এক মিনিট! আচ্ছা রমেনবাবু, তিতলিপুরের পাশ দিয়ে আসবার সময় রাস্তায় এক ভদ্রলোককে দেখলাম। ফরসা ঢ্যাঙা গড়ন। ধুতি আর ছাইরঙা লংকোট পরে আছেন! মাথার চুল সাদা। গোঁফদাড়ি কামানো। চেহারায় আভিজাত্য আছে। ষাটের বেশি বয়স বলে মনে হল। আর

রমেনবাবু হাসলেন। -বুঝেছি। আপনি যাকে দেখেছেন, তিনি তিতলিপুরের জমিদারদের বড়োতরফের বংশধর। দীপনারায়ণ রায়। কলকাতায় কী চাকরি করতেন শুনেছি। এখন রিটায়ার্ড। তবে মাঝে মাঝে তিতলিপুরে এসে বোনের বাড়িতে থাকেন। কিন্তু উনি কবে এসেছেন, জানি না।

উনি অন্য এক ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলছিলেন। এ ভদ্রলোকের পরনে প্যান্ট আর। সোয়েটার ছিল। শ্যামবর্ণ, একই বয়সের লোক। মাথার চুল সাদা। কিন্তু কাঁচাপাকা গোঁফ আছে। কী দুজনে তর্কাতর্কি হচ্ছিল মনে হল।

রমেনবাবু নড়ে উঠলেন। -বুঝেছি! বুঝেছি! চন্দ্রপুরের জাহাজিবাবু।

-জাহাজিবাবু মানে?

জাহাজে চাকরি করতেন। শম্ভুনাথ চৌধুরি। শম্ভুবাবুকে এ তল্লাটের লোকে জাহাজবাবু বলে। সত্যি বলতে কি, শম্ভুবাবুর সঙ্গে দীপনারায়ণবাবুর আত্মীয়তা আছে। সঠিক খবর জানি না। তবে চন্দ্রপুরে শম্ভুবাবুর পূর্বপুরুষও জমিদার ছিলেন।

–ওঁরা তর্কাতর্কি করলেও মনে হল, দুজনের মধ্যে বন্ধুতা আছে।

–আছে। ছোটোবেলায় দেখেছি শম্ভুবাবু ছুটি নিয়ে দেশের বাড়িতে ফিরলেই প্রায় প্রতিদিন দীপনারায়ণবাবুর সঙ্গে আড্ডা দিতে আসতেন। তবে তর্কাতর্কি হচ্ছে দেখেছেন, ওটা স্যার স্বাভাবিক। আজকাল দেশে যা ঘটছে, তা নিয়ে মানুষে-মানুষে মতান্তর হতেই পারে। একেক গ্রামে দুটো-তিনটে করে দল হয়েছে। ওই যে বললাম মতান্তর! মতান্তর থেকে মনান্তর। তা থেকে মারামারি। খুনোখুনি! ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় ছোটোবেলায় পদ্যে পড়েছি। চলি স্যার!

বলে রমেনবাবু হন্তদন্ত বাংলোর সামনের দিকে গেলেন। দেখলাম, দারোগাবাবু সদলবলে ফিরে আসছেন। আমি ঘরে ঢুকে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। এখানে জলাধারের আবহাওয়ায় শীতটা বড় জোরালো। কম্বল টেনে নিলাম। …

কর্নেলের ডাকে উঠে বসলাম। ঘড়ি দেখে নিলাম। একটা পাঁচ। কর্নেল বললেন–স্নান করে ঘুমোতে পারতে। বাথরুমে গিজার আছে। গরম জল পেতে।

বললাম–আপনি কতদূর ঘুরলেন?

–অনেক দূর।

–নীল সারসের খোঁজ পেলেন?

-নাঃ। তবে ফিলমের রোলটা শেষ করেছি। আজ রাত্রেই বাথরুমকে ডার্করুম বানিয়ে ফিলমগুলো ডেভেলাপ, ওয়াশ আর প্রিন্ট করে ফেলব।

বলে কর্নেল অর্থপূর্ণ হাসলেন। আমি বললাম–আমি দুই মল্লযোদ্ধার পরিচয় পেয়ে গেছি। চেহারার বর্ণনা দিতেই রমেনবাবু বললেন, ধুতিপরা লোকটি দীপনারায়ণ রায়। আর প্যান্টপরা। লোকটি-

কর্নেল চোখ কটমটিয়ে বললেন–জয়ন্ত! তুমি বড্ড বোকামি করে ফেলেছ। রমেনবাবুর বাড়ি তিতলিপুরে। তুমি ওঁকে কি প্রকৃত ঘটনাটা বলেছ?

–আমার মাথাখারাপ? আমি দুজনকে রাস্তায় তর্কাতর্কি করতে দেখেছি। এই বলেছি।

কর্নেল বললেন–তাহলেও তুমি ঠিক করোনি। রমেনবাবু কী বললেন বলো!

রমেনবাবুর কাছে যা শুনেছিলাম, চাপা স্বরে তা জানিয়ে দিলাম। কর্নেলের মুখের গাম্ভীর্য তবু কাটল না। গলার ভিতরে বললেন–সমস্যা হল, রমেনবাবু আমরা এখানে থাকার সময় দৈবাৎ তার গ্রামে গিয়ে যদি দীপনারায়ণ রায়কে আমাদের পরিচয় দেন, কী ঘটবে বুঝতে পারছি না।

চমকে উঠে বললাম-কেন?

কর্নেল একটু চুপ করে থাকার পর বললেন-যে জিনিসটা নিয়ে দুজনের মধ্যে কাড়াকাড়ি এবং শেষে ধস্তাধস্তি বেধেছিল, ওদের দুজনেরই দৃঢ় বিশ্বাস জন্মাবে, সেটা আমিই কুড়িয়ে পেয়েছি। কারণ আমিই গাড়ি থেকে নেমে ওদের ছবি তুলতে এগোচ্ছিলাম। কুড়িয়ে পাওয়া জিনিসটা কয়েন নয়।

–জিনিসটা তাহলে কী?

–ডিমালো গড়নের একটা ব্রোঞ্জের সিল। নাকি ওটা সিল নয়। ওতে একটা সারসের মূর্তি আছে। তা ছাড়া কয়েকটা চিহ্ন আছে। আমার মনে হয়েছে, ওটা মিশর থেকে কেউ চুরি করে এনেছে। মিশরের প্রাচীন চিত্রলিপিতে কিছু কথা লেখা আছে ওতে। জয়ন্ত! হয়তো আমরা না জেনে বিষধর সাপের ল্যাজে পা দিয়েছি। …

.

০২.

 খাওয়ার পর দক্ষিণের বারান্দায় কর্নেল ও আমি রোদে বসে আছি। এমন সময় পশ্চিমের বারান্দা ঘুরে দানবের মতো অতিকায় একজন পুলিশ অফিসার এগিয়ে এলেন। তার গায়ের রং কালো। কিন্তু পাকানো গোঁফের নিচে সাদা দাঁতের হাসি ঝকমক করছিল। কর্নেলের কাছে এসে তিনি করজোড়ে নমস্কার করে বললেন-আমার সৌভাগ্য! এখানে কর্নেলসায়েবের মতো বিখ্যাত মানুষের দর্শন পাব কল্পনাও করিনি। আপনার কত নাম শুনেছি আমাদের পুলিশ মহলে। রমেন, বলছিল, একজন কর্নেলসায়েব এসেছেন। জিজ্ঞেস করতে বলল, কর্নেল নীলাদ্রি সরকার।

কর্নেল বললেন–আপনার কথাও শুনেছি। আপনি চন্দ্রপুর থানার ও সি মি. রাজেন্দ্র কুমার হাটি।

বড়োবাবু খাকি পোশাকে ঢাকা তাঁর প্রকাণ্ড ভুঁড়ি কাঁপিয়ে অট্টহাসি হাসলেন। কর্নেলসাহেব! আপনার নাকি পিছনেও একটা চোখ আছে। যাই হোক, আমাকে এখনই থানায়। ফিরতে হবে। কিংবদন্তির নায়ককে একবার চোখের দেখা দেখতে এলাম। এই অধম যদি আপনার কোনও উপকারে লাগে, প্লিজ স্মরণ করবেন। কদিন থাকছেন স্যার?

–কিছু ঠিক নেই। আমি এসেছি দুর্লভ প্রজাতির নীল সারসের খোঁজে।

 দারোগবাবু আবার হাসলেন। –আপনার এসব হবির কথাও শুনেছি। কলকাতার লালবাজারে ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টে সাব-ইন্সপেকটর নরেশ ধর আমার মাসতুতো ভাই স্যার।

 বাঃ! নরেশবাবুকে বলব আপনার কথা। …

আরও কিছু কথাবার্তার পর পুলিশ অফিসার রাজেন হাটি চলে গেলেন। একটু পরে গেটের ভিতর দিয়ে সেই পুলিশ জিপটা বেরিয়ে গেল। পিছনে বন্দুক হাতে কনস্টেবলদের দেখা যাচ্ছিল।

বললাম–তখন বলছিলেন না জেনে বিষধর সাপের ল্যাজে পা দিয়েছি। এবার রাজেন হাটির মতো জাঁদরেল পুলিশ অফিসার বেদে হয়ে সাপটার বিষদাঁত ভেঙে

কর্নেল আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন-ও কথা নয়। চলো। বেরুনোনা যাক।

-কোথায় যাবেন?

 –প্রশ্ন নয়। শিগগির রেডি হয়ে বেরিয়ে এসো। সঙ্গে তোমার ফায়ার আর্মস নিয়ো।

কথাটা শুনে একটা অস্বস্তিতে শরীরে যেন শিহরন ঘটে গিয়েছিল। একটু পরে কর্নেলের সঙ্গে বেরিয়েছিলাম। সদর গেট পেরিয়ে কর্নেল পিচের রাস্তায় যেদিক থেকে এসেছি, সেইদিকে হাঁটছিলেন। ডাইনে ঝিল পেরিয়ে গিয়ে কলে সোজা ঝোপঝাড়ের ভিতর দিয়ে জঙ্গলে ঢুকলেন। ঝরাপাতার স্তূপে জুতোর চাপ অদ্ভুত শব্দ করছিল। কিছুক্ষণ পরে আমরা জাহান খাঁর কেল্লাবাড়ি এলাকায় ঢুকেছিলাম। শীতের বিকেলে সেখানে এখনই গাঢ় ছায়া। ধ্বংসস্তূপে জঙ্গল গজিয়ে আছে। মাঝে মাঝে একটা ভাঙা পাঁচিল, গম্বুজ ঘর এবং গম্বুজে ফাটল, একটা দেউড়ি, তারপর মুখ থুবড়ে পড়া মসজিদ চোখে পড়েছিল। কর্নেল কখনও একটু থেমে বাইনোকুলারে চারদিক দেখে নিচ্ছিলেন। একবার আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম–নীল সারসের দলটা খুঁজছেন নাকি? কর্নেল শুধু বলেছিলেন–হুঁ।

দ্রুত দিনের আলো কমে যাচ্ছিল। ফাঁকা জায়গা থেকে অদুরে কুয়াশার পর্দা দেখতে পাচ্ছিলাম। কিছুক্ষণ পরে কর্নেল আমার কাঁধে হাত চেপে আমাকে বসিয়ে দিলেন এবং নিজেও গুঁড়ি মেরে বসলেন। তারপর কানে এল, সামনের দিকে ঝরাপাতার ওপর পা ফেলে কে যেন হেঁটে আসছে।

একসময় শব্দটা থেমে গেল। আমরা একটা ভাঙা গম্বুজের আড়ালে ছিলাম। মাটিতে বসে-যাওয়া গম্বুজের চারপাশে ঝোপঝাড়। সিগারেটের ধোঁয়ার গন্ধ ভেসে এল। এখন শীতের হাওয়াটা বন্ধ। মাঝে মাঝে পাখির ডাক শোনা যাচ্ছিল। কে সিগারেট টানছে, দেখার জন্য একটু সরে যাচ্ছিলাম। কর্নেল আমাকে টেনে ধরে বাধা দিলেন। সময় কাটছিল না। কতক্ষণ পরে আবার শুকনো পাতার ওপর শব্দ শোনা গেল। লোকটা চলে যাচ্ছে ভেবেছিলাম। কিন্তু তখনই কেউ চাপা স্বরে বলে উঠল–এত দেরি করলে কেন? অন্ধকার হয়ে যাবে শিগগির। খামোখা তার কথার ওপর অন্যজন বলল–টর্চ আনননি?

–এনেছি।

–আমিও এনেছি।

–তাহলে অসুবিধে কীসের? তুমি খুঁড়বে। আমি আলো দেখাব। আমি খুঁড়ব। তুমি আলো দেখাবে।

-বাবু দাগ দিয়ে রেখে গেছেন। কই সেই দাগ?

–এই যে। কিন্তু আমি একটা কথা ভাবছি।

ভাবছটা কী? সামান্য কাজ।

–সামান্য নয় হে! পাথরের স্ল্যাব। তলায় কতটা পোঁতা আছে কে জানে। তাছাড়া স্ল্যাবের তলায় যদি পেতলের নলটা না থাকে?

–থাকবেই। বাবু গতবছর স্ল্যাবের তলায় ওটা পুঁতে রেখে গিয়েছিলেন। তখন আমিই। স্ল্যাবটার এখানে সুড়ঙ্গ মত করেছিলাম।

–তাহলে তো তুমি সেই জায়গাটা চেনো। আমি আলো জ্বালি। তুমি সেখানটা খোঁড়ো।

 এবার টর্চের আলোর একটু ঝলকানি দেখতে পেলাম। তারপর খোঁড়ার শব্দ। একটু পরে একজন বলল–আচ্ছা, ফরেস্ট গার্ডটা যদি হঠাৎ এসে পড়ে?

–তোমার মাথাখারাপ? এই শীতের সন্ধ্যায় ব্যাটারা ফরেস্টবাংলোর কাছাকাছি কোথাও থাকবে। আমরা তো গাছ কাটছি না যে সেই শব্দ শুনে দৌড়ে আসবে।

আবার মাটি খোঁড়ার শব্দ হতে থাকল। এবার কর্নেল আমাকে টেনে নিয়ে একটু পিছনে একটা ঝোপের আড়ালে। তারপর গুঁড়ি মেরে বসে শুকনো পাতার ওপর জুতোর চাপা শব্দ করতে থাকলেন।

অমনই লোকদুটো একসঙ্গে বলে উঠল–কীসের শব্দ?

–এই! কেল্লাবাড়ির জঙ্গলে সেবার বাঘ এসেছিল। বাঘ নয় তো?

–কিছু বলা যায় না। সঙ্গে মেশিন আছে। আন্দাজে গুলি ছুঁড়ব? যদি ভয় পেয়ে পালায়!

–ঠিক বলেছ। কিন্তু তোমার দিশি পিস্তলের শব্দ শুনে বাঘ যদি উলটে খেপে ওঠে?

 তখনই কর্নেল আমাকে উঠে দাঁড়াতে ইশারা করলেন। আবছা আঁধার এখন ঘন হয়েছে। কর্নেল টর্চের আলো ফেলে তার রিভলভারের নল সেই আলোতে দেখিয়ে গর্জন করে উঠলেন–কোন ব্যাটা রে?

 তাঁর দেখাদেখি আমিও টর্চ জ্বেলে উৎসাহের আতিশয্যে রিভলভার থেকে তাদের মাথার উপর দিয়ে এক রাউন্ড ফায়ার করে ফেললাম।

দুটো লোক একলাফে একটা ধ্বংসস্তূপের আড়ালে চলে গেল। কর্নেল সেদিকে টর্চ জ্বেলে আবার বিকট গর্জন করে এগিয়ে গেলেন। আমি পায়ের কাছে আলো ফেলে দেখলাম, একটা পাথরের স্ল্যাব কোনাকুনি মাটির তলায় ডুবে আছে। একটা ছোট্ট শাবল পড়ে আছে। পাথরের পাশে গর্ত খুঁড়ে একগাদা মাটি তোলা হয়েছে।

কিন্তু কর্নেলের পাত্তা নেই। শুধু একবার করে টর্চের আলোর ঝলকানি দেখতে পাচ্ছি। কর্নেল ওদের তাড়া করে যাচ্ছেন সম্ভবত। এটা কি ঠিক হচ্ছে? আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি। কী করা উচিত ভেবে পাচ্ছি না। প্রায় মিনিট পাঁচেক পরেই কর্নেলের সাড়া পেলাম। চাপা স্বরে ডাকলেন–জয়ন্ত!

সাড়া দিলাম। –এখানে আছি।

কাছে এসে কর্নেল হাসিমুখে বললেন –ওরা আর এখানে আসছে না। তুমি টর্চ জ্বেলে রাখো জয়ন্ত! আমি দেখি, পেতলের নলটা পাই নাকি!

এখানকার মাটি নরম। একটু খুঁড়তেই শাবলের ঘা কোনও ধাতব জিনিসে লেগে ঠং করে শব্দ হল। তারপর কর্নেল পাথরটার তলা থেকে ফুটখানেক লম্বা একটা নল বের করলেন। নলটার ব্যাসার্ধ প্রায় দু ইঞ্চি। নলটা থেকে মাটি পরিষ্কার করে কর্নেল তার পিঠের কিটব্যাগে চালান করে বললেন-কুইক। কেটে পড়া যাক। সোজা একেবারে বাংলোতে। …

বাংলোর বারান্দায় বড্ড হিম। ঘরে বসে কফি পান করতে করতে কর্নেলকে জিজ্ঞেস করলাম–সকালে মল্লযুদ্ধ দর্শনের মতো এই ঘটনাও কি আকস্মিক?

কর্নেল হাসলেন। নাঃ! দুপুরে ড্যামের রাস্তা দিয়ে প্রায় এক কিলোমিটার হেঁটেছিলাম। প্রচুর হাঁস, সারস, একজোড়া গগনভেড় পাখিরও ছবি তুলেছিলাম। ফিমের রোলটা শেষ করে ফেলার ইচ্ছে ছিল। কেন ছিল তা আশা করি বুঝতে পারছ।

-মল্লযুদ্ধের যোদ্ধাদের ছবি প্রিন্ট করা।

–ঠিক। অবশ্য তুমি তার আগেই কুকীর্তি করে বসে আছ।

–কুকীর্তি কী বলছেন? আপনার কোনও উদ্দেশ্য থাকলে কাজটা একধাপ এগিয়ে দিয়েছি।

-নাঃ। আমি এখানে নীল সারসের ছবি তুলতেই এসেছি। কিন্তু আমার বরাত জয়ন্ত! যেখানে যাই, এই রকম গোলমেলে ঘটনায় জড়িয়ে পড়ি।

-আপনি যা বলছিলেন, তাই বলুন। মানে, জাহান খাঁর কেল্লাবাড়িতে অভিযানের ব্যাপারটা।

 কর্নেল উঠে গিয়ে পর্দা তুলে বারান্দার দু-দিক দেখে এলেন। তারপর ইজিচেয়ারে বসে চুরুট ধরিয়ে বললেন –ফেরার পথে ড্যামের রাস্তার ধারে একটা গাছের তলায় বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। কয়েকটা জেলে-নৌকো সেখানে বাঁধা ছিল। ওরা রান্না চাপিয়ে গল্প করছিল। এমন সময় দুটো লোক এসে জেলেদের কাছে মাছ কিনতে চাইল। ওরা, বলল, সব মাছ ভোরবেলা চালান গেছে। মাছ কিনতে হলে ভোরবেলা এসো। কথায় কথায় লোকদুটো যে চন্দ্রপুরের বাসিন্দা, তা জানতে পারলাম। তারা জেলেদের বলল–জাহাজিবাবু পাঠিয়েছেন। জেলেরা গ্রাহ্য করল না। যে-বাবুই পাঠান, এখন মাছ কোথায়? লোকদুটো হুমকি দিল-জাহাজিবাবুকে চেনো না? ইচ্ছে করলে উনি সব নৌকো ডুবিয়ে দেবেন। জেলেদের সঙ্গে এইসব তর্কাতর্কি চলছে, আমি তখনও তো জাহাজিবাবুকে চিনি না। বাইনোকুলারে আকাশ থেকে ধনুকের মতো বেঁকে নেমে আসা হিমালয়ের হাঁস দেখছি। প্যান্ট-সোয়টার পরা লোকদুটো সিগারেট ধরিয়ে কথা বলতে বলতে চলে গেল। আমাকে তারা গ্রাহ্য করেনি। কারণ আমার মতো অনেক টুরিস্ট এ সময় ড্যামের জলে পাখি দেখতে বা বোটে রোয়িং করতে আসে।

কর্নেল একদমে কথাগুলো বলে চুপ করলেন। বললাম-তারপর?

– আমার পিছন দিয়ে যাবার সময় কানে এল ওদের টুকরো-টুকরো কথা। এখন নয় … কেল্লাবাড়ির জঙ্গলে সাঁওতালরা আসে। … রমজান পাখাড়ু? হ্যাঁ, ও ব্যাটা বড্ড বেশি সেয়ানা। …দেউড়ির কাছাকাছি…হ্যাঁ, হ্যাঁ, বাবু ঢ্যারা দেগে রেখেছে। আমি চিনি চিনি। … শাবল চাই বইকি। …পাঁচটার মধ্যেই আসবে কিন্তু। আমি থাকব। …ওদের এইসব কথা আমার কানে ঢুকিয়ে দিচ্ছিল উত্তরের বাতাস। আমি দক্ষিণে। ওরা চলেছে উত্তরে। এই বাংলোর দিকে।

বলে কর্নেল ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজলেন। দাঁতের ফাঁকে চুরুট। আমি সেই পিতলের নলটা দেখার জন্য উশখুশ করছিলাম। বললাম–কিন্তু পেতলের নলে কী আছে দেখছেন কেন?

কর্নেল চোখ বুজেই বললেন–বাংলোয় ফিরে তোমার কাছে জাহাজিবাবুর নামধাম পরিচয় পেলাম। কাজেই কেল্লাবাড়ির জঙ্গলে না গিয়ে পারিনি। এবং আমার অভিযান সফলও হয়েছে!

-আহা, নলটা!

–এখন নয়। ডিনারের পর।

–ঠিক আছে। কিন্তু সেই লোকদুটোই কি পাথরের স্ল্যাব খুঁড়ছিল?

–বোকার মতো প্রশ্ন হল, ডার্লিং।

–মানে, আপনি শিয়োর কি না জানতে চাইছিলাম।

–আজ রাতে ক্যামেরা থেকে ফিল্ম রোলটা বের করে প্রিন্ট করে ফেলব। তুমি লক্ষ্য করোনি, টর্চের আলো জ্বালবার সঙ্গে-সঙ্গে ক্যামেরার শাটার অটোমেটিক করে রেখেছিলাম। তিন মিনিট সময় দেওয়া ছিল। কাজেই ওরা খুঁড়ে নলটা বের করার আগেই আমাকে উঠে দাঁড়িয়ে ওদের চার্জ করতে হয়েছিল।

-বলেন কী! ওদের ফোটোও তাহলে উঠেছে!

–ওঠার কথা। দেখা যাক।

-কিন্তু কর্নেল, আপনার গলা থেকে পেটের কাছে যে ক্যামেরা ঝুলছে, উঠে দাঁড়ানোর সময় তার লেন্স অন্যদিকে ঘুরে যেতে পারে।

কর্নেল ভুরু কুঁচকে এবার তাকালেন। –তুমি সংবাদিক হলে কী করে জানি না। এতকাল ধরে তুমি আমার সঙ্গী। ক্যামেরাটা লক্ষ্য করোনি। এই দ্যাখো ক্যামেরার পিছনে একটা ক্লিপ। ওটা। আমার প্যান্টের বেলটের সঙ্গে আটকে দিলেই ক্যামেরার লেন্স সোজা থাকবে।

হাসতে হাসতে বললাম-এও কি আপনার সামরিক জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে পাওয়া?

কর্নেলও হাসলেন। –নাঃ! যে প্রজাপতি জাল দিয়ে ধরতে যাচ্ছি, এক হাতে তার দিকে ক্যামেরা তাকে করে শাটার টেপার অসুবিধে আছে। তার চেয়ে কোমরে ক্যামেরা আঁটা থাকলে প্রজাপতিটা জালে না ধরা পড়ুক, তার ছবিটা পেয়ে যাব। …

ঠান্ডা ক্রমশ বাড়ছিল। তাই নিয়মভঙ্গ করে কর্নেল রাত্রি সাড়ে নটায় এই ঘরেই ডিনার পাঠাতে বলেছিলেন। নরুঠাকুর আর ভৈরব দুটো ট্রেতে গরম লুচি, আলুর দম আর মুরগির মাংস রেখে গেল। কর্নেল জিজ্ঞেস করলেন–রমেনবাবু কী করছেন?

ভৈরব বলল-ম্যানেজারবাবুর স্যার ঠান্ডার ধাত। তাই এত রাতে বাইরে বেরোন না।

নরুঠাকুর বলল–ওতেই হবে তো স্যার? নাকি আরও একডজন লুচি ভেজে আনব?

কর্নেল হাসলেন। -আমার চেহারা দেখে ঠাকুরমশাই ভাবছেন, আমি লুচির পাহাড় গিলতে পারি? এই যথেষ্ট। আপনারা খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়ুন। এঁটো থালাবাটি সকালে নিয়ে গেলেই চলবে।

নরু ঠাকুর চলে গেল। ভৈরবকে ডেকে কর্নেল বললেন–তোমাদের বাংলোয় গার্ড নেই?

 ভৈরব বলল–দুজন দারোয়ান আছে। পালা করে ডিউটি দেয়। গার্ডের দরকার হয় না স্যার। এ তল্লাটে চোর-ডাকাতের ভয় নেই। যারা ড্যামে বোট চালাতে বা পাখি দেখতে আসে, তারা দিনে এসে সন্ধ্যার আগে চলে যায়।

-দুপুরে যে মাছ খেয়েছি, তা কি এই ওয়াটারড্যামের?

আজ্ঞে হ্যাঁ। বাংলোয় গেস্ট এলে জেলেদের বলে আসি।

–আচ্ছা ভৈরব, তোমার বাড়ি কোথায়?

–চন্দ্রপুর স্যার।

রমেনবাবু চন্দ্রপুরের এক জাহাজিবাবুর কথা বলছিলেন। চেনো তাকে?

ভৈরব বাঁকা মুখে বলল-শম্ভু চৌধুরি সাংঘাতিক লোক স্যার। বছরে একবার বাড়ি আসে। কখন আসবে, তার ঠিক নেই। শুনলাম সে এ মাসে এসেছে। যখনই আসে, একটা করে মানুষ খুন হয়।

চমকে উঠেছিলাম। বললাম–সে কী! পুলিশ তাকে ধরে না?

 ভৈরব বাঁকা মুখেই হাসবার চেষ্টা করল। পুলিশ জানতে পারলে তবে তো তাকে ধরবে!

 কর্নেল হাসলেন। পুলিশ জানে না! তুমি কী করে জানতে পারো?

–আমার সন্দেহ হত আগে। পরে দেখে আসছি, যতবার জাহাজিবাবু বাড়ি আসে ততবার এলাকার কেউ না কেউ খুন হয়। গত বছর জাহাজিবাবু এসেছিল খরার মাসে। তারপর তিতলিপুরের সন্টুবাবুর লাশ পাওয়া গিয়েছিল ড্যামের জলে। জেলেরা লাশের খবর দিয়েছিল থানায়। পুলিশ এসে লাশ তুলল। মাথার পিছনে গুলির দাগ ছিল। সন্টুবাবুও অবশ্যি ভালো লোক ছিল না। বর্ডারে চোরাচালানির কারবার করত। জোরে শ্বাস ছেড়ে ভৈরব চাপা স্বরে ফের বলল–পুলিশ স্যার দেখেও দেখে না। এ পর্যন্ত আমার হিসেবে পাঁচটা খুন হয়েছে। প্রত্যেকটা লাশের মাথার পিছনে গুলির দাগ। আমার স্যার সামান্য মাথা। ক্লাস ফোর পর্যন্ত বিদ্যা। কিন্তু কারও মাথায় কেন এই সোজা ব্যাপারটা ঢোকে না জানি না।

-তুমি কি এ কথা আর কাকেও বলেছ?

–না স্যার! আমার ঘাড়ে কটা মাথা?

তবে আমাদের কাছে বলে ফেললে যে?

ভৈরব আড়ষ্ট মুখে হাসবার চেষ্টা করল। -ম্যানেজারবাবু বলছিল, আপনি স্যার মিলিটারি অফিসার। এতদিন পেটের ভিতরে কথাটা ঢুকে ছিল। আপনাকে বলে শান্তি পেলাম। মিলিটারি আমি কম বয়সে এই তল্লাটে কতবার দেখেছি স্যার! এখান থেকে পাকিস্তানের বর্ডার বেশি দূরে নয়। দুদেশে যুদ্ধ বাধার উপক্রম হলেই এই এলাকা মিলিটারিতে ভরে যেত। মিলিটারির পাওয়ার কত! স্যার এবার যদি আবার লাশ পড়ে, আপনি দয়া করে মিলিটারি ডেকে আনবেন। জাহাজিবাবুকে জব্দ করতে আপনারাই পারবেন।

 কথাগুলো শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বলেই ভৈরব চলে গেল। কর্নেলের মুখের দিকে তাকালাম। তিনি নির্বিকার মুখে মুরগির ঠ্যাংয়ে কামড় দিচ্ছেন। …

রাত দশটায় চুরুট ধরিয়ে কর্নেল দরজা বন্ধ করলেন। তারপর কিটব্যাগ থেকে প্রথমে ব্রোঞ্জের ডিমালো ফলকটা বের করলেন। ওটা কখন কী লোশনের সাহায্যে ব্রাশ দিয়ে ঘষে চকচকে করে ফেলেছেন। ওঁর কিটব্যাগে কি নেই? ফলকটার একপিঠে সারস এবং কয়েকরকম পাখি, তার ফাঁকে কতরকম রেখা দেখতে পেলাম। উলটো পিঠে অন্যরকম চিহ্ন। কর্নেলের ড্রয়িং রুমে একটা বইয়ে পেরেকের মতো লিপি দেখেছিলাম। কর্নেল বলেছিলেন, এর নাম কিউনিফর্ম লিপি। কীলকাকার লিপি বলতে পারো। তবে ও লিপি তিনহাজার বছর আগে চালু ছিল। ফলকটার মাথার দিকে একটা ফুটো আছে। এটা কি গলায় ঝুলিয়ে রাখার জন্য?

কর্নেল ততক্ষণে পিতলের নলের একটা মুখ ছুরির ডগা দিয়ে পরিষ্কার করে ফেলেছেন। একটু পরে তিনি নলের ভিতরটা আতশ কাচ দিয়ে দেখে নিলেন। তারপর একটা চিমটে দিয়ে টেনে বিবর্ণ এবং গুটিয়ে রাখা লম্বা একটা জিনিস বের করলেন। বললাম–কী ওটা?

  –এটাকে বলে স্ক্রোল। প্রাচীন যুগে ভেড়া বা ছাগল জাতীয় প্রাণীর হুঁড়ির চামড়া শুকিয়ে একরকম কাগজ তৈরি করা হত। এতে কালো কালিতে কিছু লেখার পর গুটিয়ে রাখা হত। তাই ইংরেজিতে একে বলা হয় স্ক্রোল।

তিনি স্ক্রোলটা সাবধানে মেলে ধরে বললেন–কিউনিফর্ম লিপিতে কিছু লেখা আছে। কলকাতা না গেলে এর পাঠোদ্ধার সম্ভব নয়।

এই সময় বাইরে নাইটগার্ডের চিৎকার শোনা গেল। –চোর! চোর! ভৈরবদা! ভৈরবদা! চোর! চোর!

কর্নেল বেরিয়ে গেলেন। আমিও দরজার কাছে পর্দা সরিয়ে দাঁড়ালাম। চিৎকারটা উত্তরে বাউন্ডারি পাঁচিলের দিকে শোনা যাচ্ছিল। পাঁচিলে কাঁটাতারের বেড়া বসানো আছে। ভৈরবের হাসি শুনতে পেলাম। সে বলছে–ছিঁচকে চোর। টর্চের আলোয় মুখটা চেনাচেনা লাগল। ব্যাটা ড্যামের ঠান্ডা জলে ঝাঁপ দিলে মজাটা টের পেত। ..

.

০৩.

 সকালে ভৈরবের ডাকে ঘুম ভেঙেছিল। ঘড়ি দেখলাম, সাড়ে সাতটা বাজে। দরজা খোলা এবং ভৈরব চা এনেছে, এতেই বোঝা গেল কর্নেল যথারীতি প্রাতভ্রমণে বেরিয়েছেন। বিছানায় বসে চায়ে চুমুক দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম-কাল রাত্রে বাংলোয় চোর ঢুকেছিল নাকি?

ভৈরব হাসল। ভিতরে ঢোকেনি স্যার। উঁকি দিচ্ছিল। ও দিকে ঝিলের মাথায় বাঁধ আছে। সেই পথে সে এসেছিল। মাধু দারোয়ানের চোখে পড়েছিল।

-তুমি বলছিলে এলাকায় চোরডাকাত নেই!

-ছিঁচকে চোর স্যার। মুখটা এক পলক দেখেছি। কেন যেন চেনাচেনা লাগল। তবে আশ্চর্য ব্যাপার স্যার, এই বাংলোয় কোনওদিন চোরের উপদ্রব হয়নি।

-কর্নেলসায়েব কোনদিকে গেছেন দেখেছ?

–না স্যার। এবেলা হাটু দারোয়ানের ডিউটি। সে জানে।

–আচ্ছা। ঠিক আছে।

 ভৈরব সেলাম দিয়ে চলে গেল। বেডটি খেয়ে বাথরুমে গেলাম। দাড়ি কামিয়ে ফিটফাট হয়ে বারান্দায় বসলাম। আজ ঘন কুয়াশা। বিস্তীর্ণ জলাধার কুয়াশার আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেছে। বারান্দায় বসে কুয়াশা দেখার মানে হয় না। বাংলোর সামনে পার্কিং জোনে আমার গাড়িটা দেখার ইচ্ছে হল। কিন্তু সেখানে গিয়ে আমি চমকে উঠলাম। গাড়িটা নেই। হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। সেই সময় দারোয়ান গেটের পাশে তার ঘর থেকে কম্বলমুড়ি দিয়ে বেরিয়ে বলল–স্যার কি ওখানে কিছু খুঁজছেন?

বললাম–আমার গাড়িটা নেই।

–আপনার গাড়ি কর্নেলসায়েব নিয়ে গেছেন। আমাকে বলে গেছেন, আপনি খোঁজ করলে আমি যেন বলি।

স্বস্তির নিশ্বাস পড়ল। ঘরে ফিরে গিয়ে ওয়ার্ডরোবের ভিতরে ঝোলানো প্যান্টটা দেখলাম। ওই প্যান্টের পকেটে চাবি ছিল। অতএব বৃদ্ধ ঘুঘুমশাই আমার পকেট মেরেছেন।

কিন্তু হঠাৎ ওঁর গাড়ি দরকার হল কেন? উনি না ফিরলে এ প্রশ্নের উত্তর পাব না…।

কর্নেল ফিরলেন সাড়ে নটায়। গাড়ির শব্দ শুনে বারান্দায় বেরিয়েছিলাম। একটু পরে তাকে দেখতে পেলাম। তার মুখে হাসি ঝলমল করছে। ততক্ষণে কুয়াশা খানিকটা পরিষ্কার হয়েছে। কাছে এসে কর্নেল যথারীতি সম্ভাষণ করলেন-মর্নিং জয়ন্ত! আশা করি সুনিদ্রা হয়েছে।

-মর্নিং বস। হাসতে হাসতে বললাম। –আপনি দুটো অপরাধ করেছেন। প্রথমটা পকেটমারি। দ্বিতীয়টা আমার গাড়ি চুরি। গাড়ি নেই দেখে আমি তো ভড়কে গিয়েছিলাম। রাত্রে আমাকে জানাননি আপনার গাড়ির দরকার আছে।

কর্নেল বারান্দায় বসে টুপি খুললেন। তারপর বাঁ হাতে প্রশস্ত টাকে হাত বুলিয়ে ডান হাতে আমার গাড়ির চাবির গোছা আমাকে দিলেন। মৃদু হেসে তিনি বললেন–তোমার গাড়ি চুরি করতে হয়েছিল, তার কারণ আছে। রাত্রে মনে মনে ঠিক করেছিলাম, কেল্লাবাড়ির জঙ্গলে সত্যি নীল সারসের একটা দল এসে জুটেছে কিনা দেখতে যাব। কিন্তু রাত্রে চোর এসেছিল বাংলায়। ভোরে বেরুতে গিয়ে উত্তরে পাঁচিলটা একবার দেখার ইচ্ছে হল। কাঁটাতারের বেড়ায় কোনও ফাঁক আছে। কিনা। নেই। অথচ চোর এসেছিল! পাঁচিলের ধারে ঝাউ আর ক্যাকটাসের টব আছে। একটা করবী আছে। হঠাৎ চোখে পড়ল, একটা ভাঁজকরা কাগজ করবী গাছটার পিছনে কাঁটাতারে গোঁজা আছে। সেই কাগজটা শিশিরে ভিজে গেছে। বারান্দায় এসে সাবধানে খুলে দেখলাম, একটা হুমকি। এতে আমি ভয় পাইনি। কিন্তু এখান থেকে নির্বিঘ্নে কলকাতা ফিরতে হবে। কাজেই তোমার গাড়ি নিয়ে চন্দ্রপুর থানায় গিয়েছিলাম। ও.সি. মি. রাজেন হাটির সাহায্য দরকার হবে।

নরুঠাকুর কফি আর ম্যাক্সের ট্রে রেখে গেল টেবিলে। তারপর বললাম–চিঠিটা দেখতে পারি?

 কর্নেল জ্যাকেটের ভিতর থেকে একটা ভাজকরা কাগজ বের করলেন। কাগজটা ভিজে ছিল, তা স্পষ্ট। সাবধানে খুলে দেখলাম, লাল ডটপেনের লেখাগুলো ভিজে কিছুটা অস্পষ্ট হয়ে গেছে। তবু বোঝা যাচ্ছিল।

পেতলের নলটা যেখানে ছিল, সেখানে আজ সকালে রেখে না এলে খুলি হেঁদা হয়ে যাবে। তুই কি ভেবেছিস তোর পরিচয় আমি পাইনি? কলকাতায় আমার লোক আছে। বুড়ো টিকটিকিকে লেজসুদ্ধ হাপিস করে দেব।

কর্নেলকে চিঠিটা আবার তেমনই ভাঁজ করে ফেরত দিয়ে বললাম-ল্যাজ সম্ভবত আমি।

কর্নেল তুম্বো মুখে বললেন–তুমি তো জানো জয়ন্ত! কেউ আমাকে টিকটিকি বললে আমার টাক থেকে গরম বাষ্প বেরিয়ে যায়। ওটা অশ্লীল শব্দ। কারণ ডিটেকটিভ থেকে বাংলায় টিকটিকি শব্দটা এসেছে। টিকটিকি আমি? প্রকৃতিবিজ্ঞানী কর্নেল নীলাদ্রি সরকার টিকটিকি?

কর্নেলের গাম্ভীর্য আর ক্ষোভ দেখে তাকে নিয়ে রসিকতার সাহস পেলাম না। কফি দ্রুত শেষ করে উনি চুরুট ধরালেন। তারপর হেসে উঠলেন। বললাম- হাসছেন যে! হঠাৎ গরম বাষ্পে বরফ পড়া শুরু হল নাকি?

কর্নেল কিটব্যাগ ঘরে রেখে এসে বারান্দায় বসলেন। তারপর জ্যাকেটের ভিতর থেকে একটা ফোটো বের করে বললেন–কাল সন্ধ্যায় আমার ক্যামেরা আমাকে বঞ্চিত করেনি। ছবিটার দুটো প্রিন্ট করেছিলাম। অত কিছু ভেবে করিনি। মনে হয়েছিল, ভৈরবকে দিয়ে তোক দুটোকে শনাক্ত করাব। ভৈরব চন্দ্রপুরের লোক। আর দরকার হলে পুলিশকে দিয়ে যাব।

ওঁর হাত থেকে ছবিটা নিয়ে দেখলাম, পাথরের স্ল্যাবটা দেখা না গেলেও আঁতকে ওঠা দুটো লোকের ছবি স্পষ্ট উঠেছে। একজন সবে ঘুরতে যাচ্ছে। অন্যজন ফুটবল খেলোয়াড়ের মতো শূন্যে লাফ দিয়েছে। ছবিটা দেখে হাসি এল। বললাম-চন্দ্রপুর থানার বড়োবাবুকে ছবির অন্য কপিটা দিয়ে এসেছেন মনে হচ্ছে।

-তুমি বুদ্ধিমান। যে শূন্যে লাফ দিয়েছে, তার নাম পঞ্চানন দাশ। ডাকনাম পাঁচু। অন্যজন কালোবরণ খটিক। ডাকনাম গলাকাটা কেলো। দাগি ডাকাত। পুলিশ ওদের খুঁজে পাচ্ছে না। এবার খুঁজে পাওয়ার চান্স আছে।

-কী ভাবে?

-জাহাজিবাবু ওদের কেল্লাবাড়ির জঙ্গলে ওত পাততে পাঠাবে। আমি পেতলের নলটা যথাস্থানে রেখে আসব।

–কী আশ্চর্য! কর্নেল নীলাদ্রি সরকার কোনো এক জাহাজিবাবুর হুমকিতে ভয় পেয়ে ওটা ফেরত দিতে যাবেন-এটা কল্পনা করা যায় না।

কর্নেল চুরুটের একরাশ ধোঁয়ার মধ্যে বললেন–হ্যাঁ। রেখে আসব, তবে ভয় পেয়ে নয়। লোক দুটোকে ফাঁদে ফেলার জন্য। পুলিশ উলটোদিক থেকে জঙ্গলে ঢুকে কাছাকাছি লুকিয়ে থাকবে। না–থাকবে না। এখনই তারা লুকিয়ে আছে। তোমার গাড়িতে একজন সাবইন্সপেকটার আর দুজন ভোজপুরি কনস্টেবলকে এনে কেল্লাবাড়ি জঙ্গলের কাছে নামিয়ে দিয়ে এলাম। কাজেই ব্রেকফাস্ট করে নিয়ে শিগগির বেরুতে হবে।

 দশটা বাজে প্রায়। নরুঠাকুর ব্রেকফাস্ট দিয়ে গেল। তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে দরজায় তালা এঁটে আমরা বেরিয়ে পড়েছিলাম। কর্নেলের পিঠে কিটব্যাগটা আঁটা ছিল। গলা থেকে বাইনোকুলার আর ক্যামেরা ঝুলছিল। প্রজাপতিধরা জালের স্টিকটা পিঠের কিটব্যাগের কোনা দিয়ে বেরিয়ে ছিল।

রমেনবাবু সাইকেলে চেপে সবে ফিরছিলেন। নমস্কার করে তিনি বললেন –জেলেদের কাছে টাটকা পাবদা মাছ পেয়েছি কর্নেলসায়েব। যেন শিগগির ফিরে আসবেন।

কর্নেল বললেন–সুখবর পেলাম যাত্রার সময়। তা হলে আজ নীল সারসের দেখা পাবই। …

ডাইনে কেল্লাবাড়ির জঙ্গল আর বাঁদিকে তিতলিপুর আবছা কুয়াশায় তখনও ঢাকা। ঝিলের ধারে ঘাসে শিশির তখনও শুকোয়নি। আমরা কালকের মতো সাবধানে পা ফেলে জঙ্গলে ঢুকলাম। ধ্বংসস্তূপ আর ঘন ঝোপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে কিছুটা এগিয়ে কর্নেল হঠাৎ থমকে দাঁড়ালেন। তার চোখে বাইনোকুলার। নব ঘুরিয়ে দূরত্ব অ্যাডজাস্ট করে নিয়ে চাপা স্বরে বললেন–জয়ন্ত! তুমি ওই লাইমকংক্রিটের ওপর বসে থাকো। আমি শিগগির ফিরে আসছি।

বলে তিনি আমাকে অবাক করে ডানদিকে অদৃশ্য হলেন। অস্বস্তি হচ্ছিল। লাইমকংক্রিটের একটা চাঙড়ে বসে আমি রিভলভারটা জ্যাকেটের পকেট থেকে বের করলাম। কর্নেলের পাগলামি মাঝে মাঝে অসহ্য লাগে। বহুবার দেখেছি, এইভাবে আমাকে প্রতীক্ষায় রেখে উনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা কোথায় কোনও বিরল প্রজাতির পাখির পেছনে ছোটাছুটি করে বেড়ান। কিন্তু এখন তো তেমন সময় নয়। বদমাশ দুটোকে ফাঁদে ফেলার উদ্দেশ্যেই আমরা বেরিয়েছি।

আমার বিরক্তি পনেরো মিনিটের মধ্যে কেটে গেল। একটা ঝোপের ফাঁকে কর্নেলের টুপি দেখতে পেলাম। অমনি অস্ত্রটা লুকিয়ে রাখলাম। তিনি কাছে এসে আমার একটা হাত চেপে ধরে চাপা উল্লাসে বললেন–পাবদা মাছের খবরটা সত্যি সুখবর ডার্লিং। ওদিকে একটা উঁচু দেওয়াল দাঁড়িয়ে আছে। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম শকুন। তারপর দেখলাম, তিনজোড়া নীল সারস দেওয়ালের ওপর বসে রোদ পোহাচ্ছে। ক্যামেরার টেলিলেন্স ফিট করে চারটে ছবি তুলেছি। ওঃ! আজকের মতো শুভদিন জীবনে কখনও আসেনি। চিয়ার আপ জয়ন্ত! কুইক মার্চ, তবে নিঃশব্দে।

আমাকে ভাঙা দেউড়ির ওপাশে অপেক্ষা করতে বলে কর্নেল গুঁড়ি মেরে এগিয়ে গেলেন। কাল শেষ বেলায় ঘন ছায়া এবং তারপর দ্রুত আঁধার এসে পড়ায় কেল্লাবাড়ির জঙ্গল পরিষ্কার দেখতে পাইনি। এখন পাচ্ছিলাম। মিনিট দশেক পরে তিনি একটা ঝোপের আড়াল থেকে ইশারায় আমাকে ডাকলেন। কাছে গেলে চাপা স্বরে বললেন–ফায়ার আর্মস হাতে নাও। কিন্তু সাবধান! গুলি ছুঁড়ো না। এখন গুলি ছোঁড়ার দরকার হবে না।

তারপর ঝোপের পাশ দিয়ে উঁকি মেরে দেখলাম, সেই লোক দুটো এদিক-ওদিকে তাকাতে তাকাতে এগিয়ে আসছে। তারপর দুজন এককোণে দাঁড়িয়ে গেল। একজন বলল–তুমি গিয়ে মালটা নিয়ে এসো। আমি মেশিন হাতে পাহারা দিচ্ছি। বুড়ো মাইরি এমন ভয় পেয়েছে যে

 তারপরই দেখলাম, বাঁদিক, ডানদিক এবং সামনের দিক থেকে একজন পুলিশ অফিসার আর দুজন দৈত্যাকৃতি কনস্টেবল বেরিয়ে এল। পুলিশ অফিসার রিভলভার তাক করে গর্জালেন–হাত ওঠাও। পিস্তলসুদ্ধ একজোড়া হাত ওপরে উঠল। দ্বিতীয় জন পালাতে যাচ্ছিল। ভোজপুরী কনস্টেবলের ছোট্ট লাঠি তার এক হাঁটুর পেছনে গিয়ে ঘা মরাতেই সে বাপ রে বলে পড়ে গেল। পুলিশ ইন্সপেকটারের হুকুমে অন্য ভোজপুরী দৈত্যটি পিস্তল কেড়ে নিয়ে তার গলার কাছে সোয়েটারের একটা অংশ খামচে ধরে পিঠে লাঠির গুঁতো মারল। সে-ও বাপ রে বলে ককিয়ে উঠল। তার সঙ্গী ততক্ষণে অন্য ভোজপুরী দৈত্যের কবলে বেড়ালছানার মতো মিউ মিউ করছে।

কর্নেল আমাকে ইশারা করে নিঃশব্দে কেটে পড়লেন। কেল্লার জঙ্গল পেরিয়ে ঝিলের ধারে এসে বললাম–একেই বলে ঘুঘু দেখেছ, ফদ দ্যাখোনি।

কর্নেল হাসলেন। -দোমোহানির বিখ্যাত পাবদা মাছের ঝোল খাব এবেলা। কী সৌভাগ্য!

-কিন্তু পেতলের নলটা যে পড়ে রইল।

–নলটা এস আই রথীশ চক্রবর্তী নিয়ে যাবেন। ওটা শুধু নল। ভিতরের জিনিস আমার কাছে আছে। শুধু নল নিয়ে পুলিশ মাথা ঘামাক। চলো! আমরা এবেলা ড্যামের জলে রোয়িং করি।

–কী সর্বনাশ! এখন সবে বাতাস উঠেছে। একটু পরে জলাধার সমুদ্র হয়ে উঠবে যে!

–ওঃ জয়ন্ত! তুমি কলকাতার রোয়িং ক্লাবের মেম্বার না? তা ছাড়া তুমি সেবার প্রশান্ত মহাসাগরে একজনের সঙ্গে বোটে চেপে কিয়োতো দ্বীপে গিয়ে উঠেছিলে। আমি আর্মি হেলিকপ্টারে গিয়ে তোমাকে উদ্ধার করেছিলাম। সেই তুমি একরত্তি দোমোহানিকে ভয় পাচ্ছ?

–সেটা ছিল প্রাণের দায়ে। এটা তো নেহাত শখে।

–নেহাত শখ নয় জয়ন্ত! ড্যামের পূর্ব দিকটায় কয়েকটা জলটুঙ্গি আছে। সেখানে সেক্রেটারি বার্ড অর্থাৎ কেরানি পাখির থাকার সম্ভাবনা আছে। তুমি ছবিতে এই পাখি দেখেছ। কিন্তু কানে কলমগোঁজা কেরানিবাবুদের মতো লম্বাঠেঙো এই পাখি জ্যান্ত দ্যাখোনি।

 আমরা পিচরাস্তায় উঠেছি, এমন সময় দেখলাম বাংলোর কুক নরুঠাকুর বাংলো থেকে একটা সাইকেলে চেপে আসছে। আমাদের কাছাকাছি হলে কর্নেল বললেন–ঠাকুরমশাই কি পাবদা মাছের জন্য মশলা কিনতে যাচ্ছ?

নরুঠাকুর সাইকেল থামিয়ে এক পা মাটিতে রেখে বলল–সাংঘাতিক খবর স্যার!

 তার মুখচোখে আতঙ্কের ছাপ লক্ষ্য করলাম। কর্নেল বললেন–কী হয়েছে নরেন?

-দীপনারায়ণদাকে গতরাতে কে খুন করেছে। ওঁর বোন সুনয়নী সম্পর্কে আমার দিদি হয়। বড়দি বলে তাকে ডাকি। বড়দি একটা লোক পাঠিয়ে এইমাত্র খবর দিল। শুনে আমার হাত-পা কাঁপছে স্যার। হাজার হলেও রক্তের সম্পর্ক। কিছু পারি না-পারি, একবার গিয়ে বড়দির পাশে দাঁড়ানো উচিত।

বলেই সে সাইকেল চালিয়ে চলে গেল। কর্নেল নিস্পলক চোখে তার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। তিনি জোরে শ্বাস ছেড়ে বললেন-জয়ন্ত! এই আমার বরাত। আর কী বলব? চলল! আগে বাংলোয় ফেরা যাক।

যেতে যেতে বললাম-ভৈরব আমাকে বলছিল যখন জাহাজিবাবু শম্ভু চৌধুরি বিদেশ থেকে বাড়ি ফিরে আসে, তখনই নাকি একটা করে লাশ পড়ে। সব লাশের মাথার পিছনে নাকি গুলির চিহ্ন খুঁজে পায় পুলিশ। ভৈরব ব্যাপারটা লক্ষ্য করেছে বলল। পুলিশের মাথায় ব্যাপারটা কেন আসে না বলে সে দুঃখ করছিল।

কর্নেল হনহন করে হাঁটছিলেন। ওঁর নাগাল পেতে আমাকে প্রায় জগিং করতে হচ্ছিল। সামরিক জীবনের অনেক অভ্যাস আমার বৃদ্ধ বন্ধুর জীবনে এখনও থেকে গেছে। বহুবার এটা লক্ষ্য, করেছি। তাই আর অবাক হই না।

 গেটের একটা অংশ খুলে দিয়ে দারোয়ান সেলাম দিল। ভৈরব রমেনবাবুর সঙ্গে লনে দাঁড়িয়ে উত্তেজিত ভাবে কথা বলছিল। আমরা ভিতরে গেলে ভৈরব আমাকে বলল–যা বলছিলাম, তা-ই ঘটে গেল স্যার!

 রমেনবাবু বললেন–তিতলিপুরের বড়োবাবুর ভাগ্যে এমন একটা কিছু ঘটবে, গ্রামের লোকেরা সবাই জানে। হাড়বজ্জাত লোক। জমিজমা সম্পত্তি প্রায় সবই কবে বেচে দিয়েছিল। তার বোন বিধবা হয়ে বাবার বাড়ি আশ্রয় নিয়েছিল। বাকি যেটুকু সম্পত্তি ছিল ওই মহিলাই দুহাতে আগলে রেখেছিল। বড়োবাবু বোনকে সমীহ করে চলত।

ভৈরব বলল–ম্যানেজারবাবুকে বলছিলাম, এ কাজ জাহাজিবাবুর।

–ছাড়ো। আমরা ওসব সাতে-পাঁচে নেই। বড়োবাবুর বোন সত্যিকার রায়বাঘিনি। সে যা করার করবে। বলে রমেনবাবু কর্নেলকে অনুসরণ করলেন। -নরেনকে যেতে দিতে হল। জ্ঞাতি বলে কথা। কর্নেলসায়েবদের পাবদামাছ খাওয়ানোর জন্য আমি আছি। একবেলা আমার হাতের রান্না খেয়ে দেখুন।

আমাদের রুমের সামনে গিয়ে কর্নেল বললেন–আপনি যখন রাঁধতে পারেন, তখন কফিও তৈরি করতে পারেন। তাই না?

রমেনবাবু সহাস্যে বললেন–এখনই কফি করে আনছি স্যার। …

 তিনি দ্রুত চলে গেলেন। আমার মনে হল, কোনও কারণে রমেনবাবু দীপনারায়ণবাবুকে পছন্দ করতেন না। গ্রাম্য দলাদলির ব্যাপারও থাকতে পারে।

কর্নেল দরজার তালা খুলে ঘরে ঢুকলেন। আমি দক্ষিণের বারান্দায় দরজার পাশে বেতের চেয়ারে বসলাম। জলাধারের কুয়াশা দিগন্তে সরে গেছে। আকাশ আর জল একাকার হয়ে আছে। একটা জেলেডিঙি কালো হয়ে ভেসে আছে।

কর্নেল বাইরে এসে বসলেন। বললেন–নীল সারসের ছবি তুলতে এসেছিলাম। ছবি তুলেছি। ভেবেছিলাম লাঞ্চ খেয়েই কলকাতা ফিরব। কিন্তু

উনি চুপ করলে বললাম–কিন্তু কী?

–আমার সামনে একটা লাশ।

–কেউ তো আপনার কাছে এসে অনুরোধ করেনি, এই হত্যারহস্যের সমাধান করুন!!

–জয়ন্ত! আমার ক্যামেরা বলছে, শম্ভু চৌধুরি আর দীপনারায়ণ রায় নিজেদের ছবিকে অত ভয় পেয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন কেন? ওঁরা দুজনেই চাননি ওঁরা ছবিতে থাকুন। কথাটা শুনতে তোমার হেঁয়ালি মনে হবে। কিন্তু একটু ভাবলেই দেখবে, ওঁরা চাননি কেউ ওঁদের ছবি তুলুক।

–ও.সি রাজেন্দ্র হাটি জাহাজিবাবু সম্পর্কে কী বললেন?

–এই এলাকার সীমান্তে চোরাচালানের সঙ্গে জাহাজিবাবুর যোগাযোগ আছে বলে তারা জানেন। কিন্তু প্রমাণ পাননি। তাছাড়া জাহাজিবাবু সারা বছর এখানে থাকেনও না। কলকাতা পুলিশের সঙ্গে চন্দ্রপুর থানা এবার যোগাযোগ করবে। শম্ভু চৌধুরি কোথায় থাকে, কী করে ইত্যাদি খবর জানতে চাইবে। জাহাজে আর চাকরি করে না সে, তা তার বয়স থেকে বলা যায়।

কিন্তু প্রাক্তন জাহাজি হিসেবে খিদিরপুর ডকের চোরাকারবারি দলের সঙ্গে তার যোগাযোগ থাকতে পারে।

–তা পারে। কিন্তু ব্রোঞ্জের ফলক আর কিউনিফর্ম লিপিভর্তি পার্চমেন্ট-নাঃ জয়ন্ত! আমার সামনে একটা গভীর রহস্য এসে দাঁড়িয়েছে। দীপনারায়ণ রায়ের হত্যাকাণ্ডের চেয়ে এই রহস্য জটিল।

 ভৈরব কফির ট্রে নিয়ে এল। সে কিছু বলার জন্য ইতস্তত করছিল। কিন্তু কর্নেল তাকে বললেন–ঠিক আছে ভৈরব। দরকার হলে তোমাকে ডাকব।

ভৈরব চলে গেল। বললাম–আপনার রোয়িং প্রোগ্রামের কী হল?

 কর্নেল আস্তে বললেন-থাক। সারাজীবন নরহত্যা দেখে আসছি। আমার সামরিক জীবনের কথাও চিন্তা করো। কিন্তু আশ্চর্য জয়ন্ত! এখনও নরহত্যা আমাকে বিব্রত করে।

-তা হলে চলুন। তিতলিপুরের জমিদারবাড়ি গিয়ে ব্যাপারটা দেখে আসা যাক। আমিও একটা হাতে-গরম খবর পেয়ে যাব। দৈনিক সত্যসবেক পত্রিকার জন্য অন্তত একটা কিছু নিয়ে যাই।

কর্নেল একটু হেসে বললেন-হ্যাঁ। খালি হাতে তোমার কলকাতা ফেরার চেয়ে এটা মন্দ কী! তা ছাড়া প্রাচীন মিশরের ফলক আর কোনো দেশের পার্চমেন্টে লেখা কিউনিফর্ম লিপির সঙ্গে তিতলিপুরের এই হত্যাকাণ্ডের যোগসূত্র তো স্পষ্ট।

রমেনবাবু কিচেনে ছিলেন। ভৈরব তাকে সাহায্য করছিল। কর্নেল শুধু বলে এলেন –একটু বেরুচ্ছি।

গাড়ি স্টার্ট দিয়ে পিচরাস্তায় পৌঁছুলাম। তারপর তিতলিপুর গ্রামে ঢোকার জন্য যে মোরাম বিছানো রাস্তা দেখেছিলাম, বাঁ দিকে ঘুরে সেই রাস্তায় কিছুটা এগোতেই পুলিশের ভ্যান, একটা জিপ আর অ্যামবুল্যান্স দেখা গেল। সেখানে গাড়ি থামিয়ে দুজনে নামলাম। কর্নেলকে দেখে ও.সি মি. হাটি এগিয়ে এলেন। সহাস্যে বললেন–এখানে তো নীল সারস নেই কর্নেলসায়েব। এখানে লাল সারসের কারবার। লাল সারসটা দীপনারায়ণবাবুর মাথার পিছনে ঠোঁট দিয়ে একটা ফুটো করে ফেলেছে।

শুনেই চমকে উঠলাম। তাহলে ভৈরব একটা খাঁটি ক্লু দিয়েছে। ..

.

০৪.

 মোরাম বিছানো রাস্তাটা সোজা চলে গেছে। পুলিশের একটা বেতার-ভ্যান থেকে মাঝে মাঝে অস্পষ্ট কথা শোনা যাচ্ছে। একদল সশস্ত্র কনস্টেবল এখানে-ওখানে দাঁড়িয়ে আছে। একটু দূরে বেটন হাতে কয়েকজন কনস্টেবল ভিড় হটাতে ব্যস্ত। অ্যামবুল্যান্স হর্ন দিচ্ছিল। মি. হাটি একজন পুলিশ অফিসারকে বললেন- চ্যাটার্জিবাবু! আপনি দুজন আর্মড সেপাইকে নিয়ে অ্যামবুল্যান্সের সঙ্গে যান। দেরি করা ঠিক নয়।

অ্যামবুল্যান্স তাঁদের নিয়ে এবার হুটার বাজাতে বাজাতে শীতের দিনের নিঝুম গ্রামকে সচকিত করে চলে গেল। কর্নেল বললেন–চন্দ্রপুরে কি মর্গ আছে?

মি. হাটি বললেন–না। কৃষ্ণনগরে আছে। সেখান থেকে অ্যামবুল্যান্স আসতে দেরি করছিল। তাই এখনও আছি।

-বডি কোথায় পড়েছিল?

–দেখাচ্ছি। আসুন।

 বাঁদিকে একটা ভেঙেপড়া দেউড়ি। সেখানে গেটের বদলে বাঁশের বেড়া। তার ওধারে উঠোন এবং একটা পুরোনো জীর্ণ দোতলা বাড়ি দেখা যাচ্ছিল। মি. হাটি কর্নেলকে নিয়ে ভাঙা দেউড়ির পাশ দিয়ে এগিয়ে গেলেন। আমি ওঁদের অনুসরণ করলাম। বাউন্ডারি পাঁচিল কোনওরকমে দাঁড়িয়ে আছে। ওদিকে বসতি নেই। পোড়ো জমি। ঝোপঝাড়। আগাছার জঙ্গল। একটা আমবাগান। পাঁচিলের পাশ দিয়ে এগিয়ে মি. হাটি যেখানে দাঁড়ালেন, সেখানে বাড়িটার পিছনের দরজা। কপাট দুটোর অবস্থা করুণ। দরজাটা খোলা ছিল। মি. হাটি বললেন-দীপনারায়ণবাবু এই দরজা দিয়ে বাড়ি ঢুকতে যাচ্ছিলেন। সেই সময় প্রায় পয়েন্টব্লাংক রেঞ্জে খুনি তাঁর মাথার পিছনে গুলি করেছে। এই দেখুন, বডির পজিশন দাগ দিয়ে রেখেছি। বডি উপুড় হয়ে পড়েছিল।

ছোট্ট দরজাটার সামনে কিছু হলুদ রঙের ঘাস আর গাছপালার ঝরাপাতা। তার ওপর চাপচাপ রক্তের ছোপ দেখতে পেলাম। রক্তটা তত লাল নয়।

মি. হাটি বললেন–দীপনারায়ণবাবু রাত্রে কোথায় আড্ডা দিতে যেতেন, তার বোন জানেন না। তার ঘরে খাবার ঢাকা-দেওয়া থাকত। উনি কোনও গুলির শব্দ শোনেনি। এই দরজা দিয়ে রাত্রে বাড়ি ফেরেন দীপনারায়ণবাবু। তাই দরজাটা ভেজানো থাকে। ভোরে ভদ্রমহিলা তার দাদার ঘরের সামনে গিয়ে দেখেন, দরজা তেমনি বাইরে থেকে আটকানো আছে। দরজা খুলে দেখেন, খাবার তেমনি ঢাকা দেওয়া আছে। দাদা তাহলে কোনও বন্ধুর বাড়িতে থেকে গেছেন ভেবে উনি নিচে নামেন। তারপর দেখেন, পিছনের দরজাটা হাট করে খোলা। কাছে এসে দাদাকে উনি উপুড় হয়ে পড়ে থাকতে দেখেন। মাথার পিছনে রক্ত।

কর্নেল বললেন-তার মানে, দীপনারায়ণবাবু দরজা ঠেলে খুলেছেন, সেই সময় আততায়ী তার পিছন থেকে গুলি করেছে।

–আমার ধারণা খুনি তার চেনাজানা লোক। রাতবিরেতে এই দরজা দিয়ে বাড়ি ফেরেন, তা তার জানা ছিল।

–সামনের দরজা দিয়ে বাড়ি ফিরতেন না কেন, জিজ্ঞেস করেছেন ওঁর বোনকে?

-ওই দেখুন। উলটোদিকে সাহাবাবুদের বাড়ি। তিতলিপুরে এখন গণেশ সাহা সবচেয়ে ধনী। গ্রামে বিদ্যুৎ এসেছে। দীপনারায়ণবাবুর বাড়িতে বিদ্যুৎ নেই। কিন্তু সাহাবাবুর দোতলার কার্নিশে উজ্জ্বল আলোর বা ফিট করা আছে। সারা রাত জ্বলে। শীতকালে লোডশেডিং হয় না শুনলাম। গ্রীষ্মকালে হয়। মাতাল অবস্থায় ওখান দিয়ে বাড়ি ঢোকা তার পক্ষে লজ্জার ব্যাপার।

 কর্নেল দরজার বাঁদিকে একটা ঝোপের কাছে গিয়ে হাঁটু মুড়ে বসলেন। মি. হাটি তার কাছে গিয়ে বললেন–কী ব্যাপার?

কর্নেল জ্যাকেটের পকেট থেকে আতশ কাচ বের করে মাটিটা পরীক্ষা করতে থাকলেন। মি. হাটি ভুরু কুঁচকে ব্যাপারটা দেখছিলেন। একটু হেসে বললেন- আপনি আতশ কাচ সঙ্গে নিয়ে ঘোরেন। আশ্চর্য তো!

কর্নেল বললেন–খুনি এখানে ওত পেতে বসে ছিল। তার জুতোর ছাপ পড়েছে। শক্ত শুকনো মাটি বলে ছাপ তত স্পষ্ট নয়। তা হলেও আমার ধারণা, তার পায়ে যে জুতো ছিল, তার সোল রবারের। আমি এইরকম জুতো পরি। এই যে দেখছেন। পাখি-প্রজাতির কাছে যেতে হলে এই সোল জুতোয় থাকা দরকার।

–আজকাল অবশ্য এই সোলের জুতো সবাই পরে।

মি. হাটি! দীপনারায়ণবাবুর মাথার পিছনে কোথায় গুলি লেগেছিল? আমার মাথায় জায়গাটা দেখিয়ে দিন। টুপি খুলছি।

ব্যাপারটা হাস্যকর। কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে ফের টুপি পরে বললেন–দীপনারায়ণবাবু সম্ভবত লম্বা মানুষ ছিলেন?

-হ্যাঁ। আমার চেয়ে লম্বা। তার মানে, প্রায় আপনার মতো লম্বা। তবে উনি ছিলেন রোগা।

 –ওঁর পরনে কি লংকোট আর ধুতি ছিল?

 মি. হাটি হাসিমুখে ভুরু কুঁচকে বললেন–আপনার সম্পর্কে যা সব শুনেছি, সত্যি মনে হচ্ছে।

কর্নেল তার কথায় কান না দিয়ে সেই দরজাটার কাছে গেলেন। তারপর বললেন দীপনারায়ণবাবুকে মাথা নিচু করে ঢুকতে হত। কাজেই মাথার পিছনে নিচের দিকে গুলি করেছিল আততায়ী। সে ছিল ভিকটিমের তুলনায় বেঁটে। আর একটা কথা। সে এই নির্জন জায়গায় দীপনারায়ণের বাড়ি থেকে একটু তফাতে সামনে থেকে গুলি করতে পারত। তা করেনি। কেন করেনি?

কর্নেল স্বগতোক্তির ভঙ্গিতে প্রশ্নটা করলেন। মি. হাটি বললেন–হয়তো আচমকা সামনে কাউকে দেখে দীপনারায়ণ চেঁচিয়ে উঠতে পারতেন। তাই খুনি ঝুঁকি নেয়নি।

অতর্কিতে পিছন থেকে গুলি করে মারতে পারত। পিঠের বাঁদিকে অতর্কিতে কাছ থেকে গুলি করলেও পারত সে। কিন্তু আপনার কথাতেই আসছি। সে কোনও ঝুঁকি নেয়নি।

বলে কর্নেল আঙুল তুললেন সাহাবাবুদের বাড়ির দিকে। মি. হাটি বলে উঠলেন–ঠিক! ঠিক! মোরামরাস্তা থেকে এই পিছনের দরজায় আসতে হলে সাহাবাবুদের বাড়ির আনোর ছটা এই জায়গা অবধি পৌঁছুবে। লক্ষ্য করে দেখুন।

কর্নেল বললেন–হ্যাঁ। এই দরজার কাছে আলো পৌঁছোয় না। প্রথমত এই পাঁচিল। দ্বিতীয় ওই ছাতিম গাছটা। তাই আততায়ী আগেই এসে ওখানে অপেক্ষা করছিল। সে জানত, এক গুলিতে কাউকে চিরকালের মতো চুপ করাতে হলে মাথার পিছনে গুলি করা দরকার। মি. হাটি! সামরিক জীবনে আমি শিখেছিলাম, পিছন থেকে চুপিচুপি এগিয়ে শত্রুকে গুলি করার চেয়ে রাইফেলের নল আর বাঁট দুদিক থেকে দুহাতে ধরে মাথার পিছনে আঘাত করলে সে নিঃশব্দে লুটিয়ে পড়বে। রাইফেল কেন? একটা বেঁটে শক্ত লাঠিই যথেষ্ট।

মি. হাটি বললেন–এবার চলুন! দীপনারায়ণবাবুর বোনের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই।

দরজা দিয়ে ঢুকে বাড়ির সামনে গেলাম। বারান্দায় এক বিধবা ফরসারঙের প্রৌঢ়া মহিলা থামে ঠেসে বসে ছিলেন। তাকে ঘিরে প্রতিবেশী মহিলাদের ভিড় ছিল। একজন বৃদ্ধ ভদ্রলোক মোড়ায় বসে কথা বলছিলেন। আমাদের দেখে তিনি উঠে দাঁড়িয়ে নমস্কার করলেন। বললেন–সুনয়নী! পুলিশ-সায়েবরা এসেছেন। তাদের সঙ্গে কথা বলো। যা-যা জানো, সব খুলে বলল।

মি. হাটি গম্ভীর মুখে বললেন–আপনারা বাইরে যান। আমরা ওঁর সঙ্গে কথা বলব।

বৃদ্ধ ভদ্রলোক এবং মহিলারা উঠোনে নেমে গেলেন। তারপর সদর দরজার বাঁশের বাতা দিয়ে তৈরি বেড়ার একটা দিক খুলে কয়েকজন মহিলা বেরিয়ে গেলেন। উঠোনের প্রান্তে একটা পেয়ারাগাছের তলায় সেই বৃদ্ধ এবং দুজন প্রৌঢ়া চাপা গলায় কথা বলতে থাকলেন।

নরুঠাকুরকে দেখতে পাচ্ছিলাম না। তার সাইকেলটাও নেই।

মি. হাটি বললেন–মিসেস রায়! ইনি কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। ইনি আপনার সঙ্গে কথা বলতে চান।

সুনয়নী বারান্দায় মেঝেয় তেমনিভাবে বসে ছিলেন। উঠে দাঁড়িয়ে নমস্কার করে বললেন–এই . ঘরে আসুন আপনারা।

 সামনের ঘরের দরজা খুলে দিলেন তিনি। পিছনের জানালা দুটো খুলে দিলেন। অবাক হয়ে দেখলাম, ঘরে তিনটে পুরোনো আলমারিতে বই ভর্তি। দেওয়ালে পুরোনো আমলের কয়েকটা বড়-বড় পোর্ট্রেট। সম্ভবত পূর্বপুরুষ জমিদারদের ছবি। একটা নড়বড়ে টেবিলের ওপর মারবেলের আঁটা আছে। কয়েকটা চেয়ার আছে। আমরা বসলে সুনয়নী দরজার কপাটে হেলান দিয়ে দাঁড়ালেন। কর্নেল বললেন–দীপনারায়ণবাবু কাল কখন বেরিয়েছিলেন?

সুনয়নী বললেন–পুলিশসায়েবকে সব বলেছি। কাল বিকেলে বেরিয়েছিল বড়দা। কিছু বলে যায়নি। কখন ফিরবে, তা জিজ্ঞেস করলে রাগ করত।

-উনি কোথায় যেতেন আপনি জানেন?

–চন্দ্রপুরে জাহাজিদার বাড়ি। নয়তো গ্রামেরই ক্লাবে দাবা খেলতে যেত। একটা কথা বলতে ভুলেছি। পরশুদিন সকালে বড়দা হাঁপাতে হাঁপাতে বাড়ি ঢুকেছিল। জিজ্ঞেস করলাম। শুধু বলল, শম্ভুকে আমি গুলি করে মারব। নেমকহারাম। বিশ্বাসঘাতক।

–ওঁর কি বন্দুক আছে?

–ছিল। কবে বেচে দিয়েছে সাহাবাবুকে। ওই আলমারিতে বই দেখছেন। তিনপুরুষ আগের দামি দামি সব বই। টাকার দরকার হলে কলকাতায় গিয়ে বেচে আসত। এই ঘরে পূর্বপুরুষের রাখা কতরকম জিনিস ছিল। একটা করে কখন কোথায় কাকে বেচে দিত বড়দা।

-পরশু অপনার দাদা আর কী বলেছিলেন মনে আছে?

সুনয়নী একটু ভেবে নিয়ে বললেন- শীতের গরম পোশাক-আশাক যা ছিল, কবে তা-ও বেচে দিয়েছিল। সম্বল ছিল একটা ছেঁড়া সোয়েটার আর পুরোনো আমলের লম্বা কোট। বড়দা পরশু কোটের পকেট, পাঞ্জাবির পকেট–সব পকেটে হাত ভরে কী খুঁজছিল। জিজ্ঞেস করলাম, জবাব দিল না। কোটের ভেতর-পকেটে ঘেঁদা ছিল। শুধু সেই কথাটা বলে দৌড়ে ওই খিড়কির দোর দিয়ে বেরিয়ে গেল।

কর্নেল বললেন–কখন ফিরেছিলেন উনি?

–দুপুরবেলা। জিজ্ঞেস করলাম, কত টাকা হারিয়েছে? বড়দা শুধু বলল, তোর শুনে কাজ নেই। আমার শেষ সম্বল কোথায় ফুটো পকেট দিয়ে পড়ে গেছে। তন্নতন্ন খুঁজে কোথাও পেলাম না।

-এবার বলুন, আপনার দাদাকে কে খুন করেছে বলে আপনার সন্দেহ হয়?

–কার কথা বলব স্যার? বড়দা কত লোককে খামোখা চটিয়ে রেখেছে। মাতাল হলে মানুষের তো জ্ঞানগম্যি থাকে না।

কর্নেল তার দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টে তাকিয়ে বললেন–জাহাজবাবুকে সন্দেহ হয় না?

সুনয়নী আস্তে বললেন–হয়। শম্ভুদা আমাদের দূরসম্পর্কের আত্মীয়। কিন্তু লোকের কাছে শুনেছি, খুব বজ্জাত লোক। বর্ডারে চোরাচালানিদের দল পুষেছে।

-কিন্তু শম্ভুবাবু তো চন্দ্রপুরে স্থায়ীভাবে বাস করেন না শুনেছি। বছরে নাকি একবার আসেন।

-হ্যাঁ বড়দার কাছে শুনেছি, সে কলকাতায় থাকে। বড়দা যে বাসায় থাকত, সেই বাসা সে ভাড়া নিয়েছে। দুজনের মধ্যে ছোটোবেলা থেকে বন্ধুতা। বিদেশ থেকে ফিরলেই জাহাজিদা আমার জন্যও কতকিছু আনত। আমি ওগুলো কী করব? পাড়াপড়শিদের বিলিয়ে দিতাম।

-আপনার বড়দা কলকাতায় কী করতেন?

—সে দশ-বারো বছর আগের কথা। এখানকার অনেকটা জমি বিক্রি করে কীসের ব্যবসা করত। আমি তা জানি না। জিজ্ঞেসও করিনি। বিধবা হওয়ার পর এ বাড়িতে বছর সাতেক আগে বড়দা আমাকে নিয়ে এসেছিল। হাত পুড়িয়ে তাকে রান্না করে খেতে হয়। বাড়িতে একা একা থাকে। লোক রাখতে হলে মাইনে দিতে হবে। এদিকে আমারও সন্তানাদি নেই।

-আপনার বড়দা বিয়ে করেননি?

-না। সংসারে তত মন ছিল না। বিয়ে করলে আমি জানতে পারতাম। ছোটবেলা থেকে উড়নচণ্ডী স্বভাব। আর ওই নেশাভাং!

কর্নেল বললেন-শম্ভুবাবুকে আপনার সন্দেহ হয় বললেন। এর নিশ্চয় কোনও কারণ আছে?

সুনয়নী একটু চুপ করে থাকার পর চাপা স্বরে বললেন-গত সপ্তাহে একদিন শম্ভুদা সকালবেলা এল। বড়দা দোতলার ঘরে তাকে নিয়ে গেল। আমাকে চা পাঠাতে বলল। চা দিয়ে আসার কিছুক্ষণ পরে কানে এল, দুজনের কী নিয়ে ঝগড়া হচ্ছে। শম্ভুদা বলছে, অ্যাডভান্স খেয়ে হজম করবে তুমি? বড়দা বলছে, আমি দরদামে ঠকেছি। একজন আমাকে ডবল দাম দিতে চেয়েছে। এইসব কথা বুঝতে পারিনি প্রথমে। পরে মনে হল, আমাদের পূর্বপুরুষের কোনও দামি জিনিস বড়দা ওকে বিক্রির জন্য অ্যাডভান্স টাকাকড়ি নিয়েছে। তারপর শম্ভুদা চলে গেল। বড়দা তার পিছনে কথা বলতে বলতে বেরিয়ে গেল।

-কিন্তু আপনার সন্দেহের কারণ কী?

-ওই যে বললাম পরশু বড়দা হাঁপাতে হাঁপাতে বাড়ি এসে পকেট হাতড়াচ্ছিল। কোটের ভিতর-পকেটে ফুটো আছে। জিনিসটা পড়ে গেছে বলে পাগলের মতো বেরিয়ে গেল।

-বুঝেছি। অ্যাডভান্স টাকা দিয়ে শম্ভুবাবু জিনিসটা পাননি। সেটা হারিয়ে গেছে, এ কথায় বিশ্বাস করেননি। তাই রাগের বশে আপনার বড়দাকে খুন করেছেন। এই তো?

–আজ্ঞে হ্যাঁ। আমি মেয়েমানুষ। আমার সামান্য বুদ্ধিতে যা মনে হয়েছে, বললাম। পুলিশ সায়েবকেও বলেছি।

-কলকাতায় আপনার বড়দা যেখানে থাকতেন, সেখান থেকে আপনার শ্বশুরবাড়ির ঠিকানায় নিশ্চয় চিঠি লিখতেন। তেমন চিঠি কি আপনার কাছে আছে?

সুনয়নী চোখ মুছে বললেন–আছে হয়তো। একটু খুঁজতে হবে।

কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন–আমরা বারান্দায় যাচ্ছি, আপনি খুঁজে আনুন।

 সুনয়নী বললেন-না, না। আপনারা বসুন।

উনি বেরিয়ে গেলে কর্নেল আলমারির বইগুলো খুঁটিয়ে দেখতে থাকলেন। তারপর বললেন–আমার ধারণা, এই প্রাক্তন জমিদার পরিবারের কেউ প্রাচীন ইতিহাসের অধ্যাপক ছিলেন।

মি. হাটি বললেন–ওগুলো ইতিহাসের বই নাকি?

-হ্যাঁ। তবে প্রত্ন-ইতিহাস আর প্রাচীন ইতিহাসের দুর্লভ সব বই।

–সুনয়নী দেবীর কাছে জানা যাবে সে-কথা।

মিনিট পাঁচেক পরে সুনয়নী একটা পোস্টকার্ড নিয়ে এলেন। বললেন–একটা চিঠি পেলাম।

কর্নেল আতশ কাছে চিঠিটা দেখে বললেন-ঠিকানা দিয়ে দীপনারায়ণবাবু আপনাকে শিগগির জবাব দিতে বলেছিলেন।

সুনয়নী বললেন–আজ্ঞে হ্যাঁ। আমবাগানে আমার একটা অংশ আছে। তাই বড়দা আমাকে চিঠি দিতে বলেছিল। ব্যবসাতে লোকসান হয়েছে। তাই আমবাগানটা তাকে বেচতে হবে।

কর্নেল খুদে নোটবই বের করে ঠিকানাটা লিখে নিলে। ও সি মি. হাটি বললেন–দেখি! দেখি পোস্টকার্ডটা।

কর্নেল তাকে বিবর্ণ পোস্টকার্ডটা দিয়ে সুনয়নীকে বললেন–শম্ভু চৌধুরি আপনার বড়দাকে টাকা দিয়ে থাকলে আপনি কি বড়দার কাছে এবিষয়ে কিছু শুনেছিলেন?

সুনয়নী বললেন–কত টাকা দিয়েছিল শম্ভুদা, তা জানি না। তবে হাতে যে-ভাবে হোক, টাকা এলে বড়দা আমাকে কিছু টাকা দিত। শেষবারে দিয়েছিল দু হাজার টাকা।

-ঠিক আছে। এবার চলি। আপনি পিছনের দরজাটা ভিতর থেকে এবার বন্ধ করে দিন। ….

সদর দরজা অর্থাৎ বাঁশের বাতা দিয়ে তৈরি আগড় খোলা ছিল। আমরা সেখানে দিয়ে বেরিয়ে গেলাম। মি. হাটি আমাদের গাড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি চাপা স্বরে বললেন জাহাজবাবু ভোরের বাসে নাকি কলকাতা গেছে। এই খুনের খবর পাওয়ার আগে আপনার কথামতো তার বাড়িতে আমাদের লোকজন পাঠিয়েছিলাম। তার বাড়ির কেয়ারটেকার বলেছে, সায়েব-হা, সায়েব…অট্টহাসি হেসে মি. হাটি ফের বললেন-ব্যাটাচ্ছেলেকে একবার টাই-স্যুট পরতে দেখেছিলাম। বর্ডারে দুজন চোরাচালানিকে ব-মাল ধরেছিলাম। জাহাজিবাবু সায়েব সেজে তাদের হয়ে কথা বলতে এসেছিল। ধমক দিয়ে বের করে দিয়েছিলাম।

কর্নেল বললেন–পোস্টকার্ডের ঠিকানা আপনি টুকে নিয়েছেন কি?

-হ্যাঁ। আপনি যে জন্য ঠিকানাটা নিলেন, আমি সেজন্য টুকিনি। ওই ঠিকানায় আশেপাশে লোকজন রেখে তাকে পাকড়াও করতে হবে। গিয়েই কলকাতা পুলিশকে খবর দেব।

গাড়িতে উঠে কর্নেল বললেন–চলি মি. হাটি!

-আপনারা আর কদিন আছেন সেচবাংলোতে?

-নীল সারসের কয়েকটা ছবি তুলে ফেলেছি। কাজেই আজ লাঞ্চের পরই কলকাতা ফিরব। আমার নেমকার্ড তো আপনাকে দিয়েছি। দরকার হলে স্মরণ করবেন। আমিও আপনার ফোনের জন্য অপেক্ষা করব।

বাংলোয় ফিরে নরুঠাকুরকে দেখতে পেয়েছিলাম। সে বলেছিল–বড়দির কাছে গিয়ে চ্যাটাং চ্যাটাং কথা শুনে রাগ হল। নিজের বাড়িতে গিয়ে খোঁজখবর নিয়ে শর্টকাটে ফিরে এসেছি।

দুপুর একটা-পনেরোতে পাবদার ঝোলসহ লাঞ্চ সেরে আমরা কলকাতা ফিরে এসেছিলাম। ইলিয়ট রোড এলাকায় কর্নেলের তিনতলার অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছুতে চারটে বেজে গিয়েছিল। দেরির কারণ হাইওয়েতে একটা ট্রাক উলটে গিয়ে প্রচণ্ড জ্যাম ছিল।

দরজা খুলেই কর্নেলের পরিচারক ষষ্ঠীচরণ একগাল হেসে বলল- টিকটিকিবাবু দুপুরে ফোন করেছিলেন। বলেছি, বাবামশাই আর কাগজের দাদাবাবু কোথায় পাখি দেখতে গেছেন। কবে ফিরবেন জানি না।

কর্নেল চোখ কটমটিয়ে বললেন–কফি!

ষষ্ঠী হাসিমুখে চলে গেল। কর্নেলের জাদুঘরসদৃশ ড্রয়িংরুমে সোফায় বসে বললাম-ষষ্ঠী হালদারমশাইকে আড়ালে টিকটিকিবাবু বলে। ওঁর কানে গেলে দুঃখ পাবেন।

প্রাক্তন পুলিশ অফিসার এবং বর্তমানে প্রাইভেট ডিটেকটিভ কে কে হালদারকে কর্নেলের দেখাদেখি আমিও হালদারমশাই বলি। ঢ্যাঙা শ্যামবর্ণ এই প্রাক্তন পুলিশ অফিসারের চুল খুঁটিয়ে ছাঁটা। সূচালো গোঁফ আছে। উত্তেজিত হলে উনি দাঁতে দাঁত ঘষেন বলে গোঁফের দুই ডগা তিরতির করে কাঁপে। তার চেয়ে বড়ো কথা, উনি পূর্ববাংলার ভাষায় কথা বলা ছাড়েননি। প্রশ্ন তুললে বলেন-মাই মাদার টাং! ছাড়ুম ক্যান?

কর্নেলের নির্দেশে গণেশ অ্যাভিনিউয়ে তার প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সির অফিসে ফোন করতেই সাড়া এল–ইয়েস?

বললাম–হালদারমশাই! আমরা এইমাত্র ফিরেছি। ষষ্ঠী বলল, আপনি কর্নেলকে ফোন করেছিলেন।

-জয়ন্তবাবু নাকি? কর্নেল স্যার ফিরছেন? এখনই যাইতাছি। একখান জব্বর ক্যাস পাইছি। কর্নেল স্যারের লগে কনসাল্ট করনের দরকার আছে। …

.

০৫.

কফি খেতে খেতে কর্নেলের সঙ্গে দীপনারায়ণবাবুর মৃত্যু নিয়ে আলোচনা করছিলাম। কর্নেলের মতে, মিশরীয় তক্তিটার জন্য উনি খুন হননি। তক্তিটা হাতাতে চাইলে জাহাজিবাবু সেদিনই খুন করে ওটা পেয়ে যেত, যেদিন সকালে ওঁরা দুজনে ধস্তাধস্তি করছিলেন। রাস্তা ছিল জনহীন। তাছড়া সুনয়নী বলেছেন, তাঁর বড়দার অনেক শত্রু আছে।

বললাম–কিন্তু পেতলের নলটা জাহাজিবাবু প্রায় এক বছর কেল্লাবাড়ির জঙ্গলে পুঁতে  রেখেছিল কেন, বোঝা যাচ্ছে না।

কর্নেল কফি শেষ করে চুরুট ধরিয়ে বললেন-এর একশো একটা কারণ থাকতে পারে। হয়তো খদ্দের পাচ্ছিল না। কিংবা খদ্দের আসতে কোনও কারণে দেরি করছিল। এইসব প্রাচীন পার্চমেন্ট বা চামড়ায় লেখা কিউনিফর্ম লিপির একটা নিদর্শনের দাম কোটি কোটি টাকা। আমেরিকার মতো ধনী দেশের কোটিপতিরাই এসব জিনিস নানা দেশ থেকে কিনে নিয়ে গিয়ে ব্যক্তিগত জাদুঘরে রাখে। মার্কিন ধনীদের এই বাতিকটা আমি দেখেছি।

এই সময় ডোরবেল বাজল এবং কর্নেল যথারীতি হাঁক দিলেন-ষষ্ঠী!

একটু পরে সবেগে প্রবেশ করলেন প্রাইভেট ডিটেকটিভ কে. কে. হালদার। তিনি ধপাস করে সোফায় বসে আগে এক টিপ নস্যি নিলেন। তারপর নোংরা রুমালে নাক মুখে বললেন-হেভি মিস্ট্রি কর্নেলস্যার! জব্বর একখানা ক্যাস পাইছি।

কর্নেল বললেন–বলুন। শোনা যাক কেমন কেস।

গোয়েন্দাপ্রবর চাপা স্বরে বললেন-আমার মক্কেলের পুরা নাম ক্যাপটেন সৌমেন্দ্রনাথ সিংহ। উনি ক্যাপটেন এস. এন. সিংহ নামে পরিচিত। সাউদার্ন অ্যাভিনিউয়ে ওনার দোতলা পৈতৃক বাড়ি। ওপরে তিনখান ঘরে নিজের জন্য রাখছেন। নিচের তিনখান ঘর ভাড়া দিছেন। সেখানে তিনখান ঘরে মুদির দোকান, স্টেশনারি স্টোর্স আর মিষ্টির দোকান। ওনার বাড়ি এখনও দেখি না। যা শুনছি, কইলাম।

–কিন্তু কেসটা কী?

-ভদ্রলোক প্রাইভেট জাহাজ কোম্পানিতে ক্যাপটেন ছিলেন। নয় বৎসর আগে রিটায়ার করছেন। তো গত সপ্তাহে হঠাৎ ওনার সন্দেহ হইছিল, উনি যেখানে যান, ওনারে একজন লোক একটু দূর থেইক্যা ফলো করে। ওনার গাড়ি ছিল। বেইচ্যা দিছেন। তো যে তারে ফলো করে, তারে চিইন্যা রাখছেন। তাড়া করলে লোকটা পলাইয়া যায়। কিন্তু তারপর আবার ওনারে ফলো করে। উনি থানায় গিছলেন। পুলিশ কইছিল, মাইনষে বুড়া হইলে চক্ষে ভুল দ্যাখে। অরা ক্যাস লয় নাই। হাসহাসি করছিল। তো আপনি জানেন কর্নেলস্যার আমি মাসে একখান-দুইখান বিজ্ঞাপন দিই। হালদার প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সির বিজ্ঞাপন দেইখ্যা উনি আইজ আমার অফিসে গেছিলেন। কইলেন, ফোনে কিছু জানাই নাই। ক্যান কী, ফোন ট্যাপ করতে পারে কেউ।

আমি চমকে উঠেছিলাম। চন্দ্রপুরের শম্ভু চৌধুরিও জাহাজে চাকরি করত। আর হালদারমশাইয়ের মক্কেলও জাহাজের ক্যাপটেন ছিলেন। কর্নেল আমার দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে বললেন–জয়ন্ত! চুপচাপ শোনো।

বললাম–শুনছি তো।

-না। তোমার মুখের লেখা পড়ে টের পাচ্ছি, তুমি হালদারমশাইকে ডিসটার্ব করতে চাও। প্রাইভেট ডিটেকটিভ খিখি করে হেসে বললেন-জয়ন্তবাবু তার নিউজপেপারের জন্য একখান স্টোরির আশা করতেই পারেন। কিন্তু এখন না।

কর্নেল বললেন–এই আপনার কেস?

-হ্যাঁ কর্নেল স্যার! তবে আমার অফিসে আসবার সময় ক্যাপটেন সিংহ ট্যাক্সি ধরছিলেন। কইলেন, অনেক অলিগলি দিয়া আসছেন। কেউ তারে ফলো করে নাই। কিংবা করছিল। কিন্তু কইলকাতার রাস্তায় কারেও গাড়ি লইয়া ফলো করা কঠিন।

কিন্তু কেউ ক্যাপটেন সিংহকে কেন ফলো করবে? তার পিছনে নিশ্চয় কোনও কারণ আছে। আপনি ওঁকে জিজ্ঞেস করেননি?

-হঃ! করছি। উনি কইলেন, কিছু বুঝতে পারেন না। আর কইলেন, লোকটা হয়তো অনেকদিন ওনারে ফলো করছে। উনি লইক্ষ্য করেন নাই। কে ওনারে ফলো করছে আর তার  উদ্দেশ্য কী, আমারে তা যেভাবে হোক, জানতে হবে।

-ক্যাপটেন সিংহের সন্দেহ তার ফোন কেউ ট্যাপ করেছে। কাজেই ফোনে তাঁর সঙ্গে কথা বলা ঠিক হবে না। এখন সাড়ে সাতটা বাজে। শীতকাল বলে বেশি রাত্রি মনে হবে। আমি বলি কী, আপনি এখনই ক্যাপটেন সিংহের বাড়ি চলে যান। ওঁর বাড়িতে কে থাকে, ওঁর ঘরের বিশেষ কোনও জিনিসপত্র যদি চোখে পড়ে, এইসব জেনে নিন। তারপর কাল সকাল ন-টার মধ্যে এসে আমাকে জানাবেন। জাহাজের ক্যাপটেন কত-কত দেশ ঘুরে বেড়ান। তার অভিজ্ঞতাও বিচিত্র নয়।

ষষ্ঠী হালদারমশাইয়ের জন্য বেশি দুধ মেশানোস্পেশাল কফি আনল। গোয়েন্দাপ্রবর কফির পেয়ালা তুলে ফুঁ দিয়ে কফি পান করতে থাকলেন। লক্ষ্য করলাম, উত্তেজনায় ওঁর গোঁফের দুই ডগা মাঝেমাঝে তিরতির করে কেঁপে উঠছে।

কফি শিগগির শেষ করে তিনি বললেন–লোকটারে যে অন্য কেউ ক্যাপটেন সিংহের পিছনে ফলো করতে কইছে, এমনও হইতে পারে।

কর্নেল বললেন–এটা কি আপনার ধারণা, নাকি ক্যাপটেন সিংহ আপনাকে এ কথা বলেছেন?

উনি কইছিলেন। যে লোকটা ওনারে ফলো করে, তার চেহারা সাধারণ লোকের মতো। রোগা। পরনে যেমন-তেমন পোশাক। তবে কখনও প্যান্ট-সোয়েটার পরে। কখনও ধুতি-পাঞ্জাবির ওপর চাদর থাকে। কখনও পাজামা-পাঞ্জাবি-জহরকোট আর মাথায় টুপি। কিন্তু একই লোক।

-ক্যাপটেন সিংহ আপনাকে কী করতে বলেছেন?

-লোকটা কে, তার নাম-ঠিকানা খুইজ্যা বার করতে হইব। ক্যান যে ওনারে ফলো করে তা-ও যেভাবে হোক, তার কাছ থেইক্যা আদায় করতে হইব। তার পিছনে যে আছে, তারও নাম-ঠিকানা ওনার চাই। হেভি কেস!

 কর্নেল হাসলেন। এবং আপনি বলছিলেন হেভি মিস্ট্রি! তা কত টাকার কন্ট্রাক্ট হয়েছে এই কাজে?

-হালদারমশাই চাপা স্বরে বললেন–মক্কেল নিজেই পাঁচহাজার টাকা দেবেন। অ্যাডভান্স  পাঁচশো। কন্ট্রাক্ট পেপারে সই করছেন। যে ফলো করে, তারে আমি কাইলই ধরুম।

–তাড়াহুড়ো করবেন না হালদারমশাই! রাস্তায় যেন গণ্ডগোল বাধাবেন না। আমার মনে হচ্ছে, কেউ ক্যাপটেন সিংহের গতিবিধির ওপর কোনও বিশেষ উদ্দেশ্যে নজর রেখেছে।

ঘড়ি দেখে গোয়েন্দাপ্রবর যাই গিয়া বলে সবেগে বেরিয়ে গেলেন। …

কর্নেল মিটিমিটি হেসে বললেন–জয়ন্ত! এবার বলো তুমি কী বলার জন্য উশখুশ করছিলেন।

বললাম–চন্দ্রপুরের জাহাজিবাবু আর হালদারমশাইয়ের মক্কেল ক্যাপটেন সিংহ–এই দুজনের মধ্যে জাহাজের ব্যাপারে সম্পর্ক আছে। দুজনেই জাহাজে নানা দেশে ঘুরেছেন।

–হ্যাঁ চন্দ্রপুরের জাহাজিবাবু শম্ভুনাথ চৌধুরি যে বহুমূল্য প্রত্নসম্পদ হাতিয়ে কেল্লাবাড়ির জঙ্গলে লুকিয়ে রেখেছিল, তার প্রমাণ আমাদের হাতে এসে গেছে।

-আচ্ছা কর্নেল, ওই ব্রোঞ্জের তক্তিটাও তো একটা বহুমূল্য প্রত্নসম্পদ। কিন্তু ওটা দীপনারায়ণবাবু পেলেন কোথায়? আমার অনুমান, শম্ভু চৌধুরিই ওটা দীপনারায়ণবাবুকে কোনও কারণে লুকিয়ে রাখতে দিয়েছিল। রাস্তায় হাতাহাতি সম্ভবত ওই নিয়েই।

–অনুমান নিছক থিয়োরি। যতক্ষণ না তার প্রমাণ পাচ্ছি, তা নিয়ে জল্পনা নিরর্থক।

বলে কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। তারপর ব্যাগ থেকে একটা গাবদাগোবদা পুরোনো বই নিয়ে এলেন। বইটার পাতা ওলটাতে ওলটাতে তিনি বললেন–বইটা বিভিন্ন দেশে লিপির উদ্ভব এবং বিকাশের ইতিহাস। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, প্রাচীন মিশরীয় তক্তিটার ছবি আমার পরিচিত। দেখি খুঁজে পাই নাকি।

এইসব বই দেখলেই আমার অস্বস্তি হয়। তার ওপর কর্নেল ওর মধ্যে ঢুকে গেলে কখন যে বেরোবেন, তার কোনও ঠিক নেই। ধৈর্য ধরে প্রায় আধঘণ্টা কাটিয়ে বললাম-কর্নেল! আমি এবার উঠি।

কর্নেল বইয়ের পাতায় চোখ রেখে বললেন-বাহুতে বাঁধা তাগার ছবি পাচ্ছি। রামেসিসের তাগা। এতে শেয়ালঠাকুর আনুবিসের ছবি এক পিঠে। অন্য পিঠে সাপ! এটা আমেনহোতেপের বাহুর তাগা। তেমন কিছু না। রা অর্থাৎ, সূর্যঠাকুরের ছবি আর হিজবিজবিজ-বাঃ! এটা তুংক-আমন অর্থাৎ তুতানখামেনের ছবি আর হিজবিজবিজ-বাঃ! এটা তুতাংক-আমন অর্থাৎ তুতানখামেনের তাগা। বেচারা কিশোর বয়সে মিশরের রাজা হয়ে যক্ষ্মারোগে মারা পড়েছিল। তার মমি এখন কায়েরোর জাদুঘরে আছে।

–প্লিজ কর্নেল! আমি বাড়ি ফিরতে চাই।

-কী আশ্চর্য! এটা তুতাংক-আমনের বালিকা বিধবা নেকারতিতির তাগা। জয়ন্ত! জয়ন্ত! পেয়ে গেছি। নেকারতিতির গলার তক্তি। দ্যাখো, দ্যাখো!

বলে তিনি জ্যাকেটের ভিতর পকেট থেকে তিতলিপুরের রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া ব্রোঞ্জের তক্তিটা বের করলেন। এবার আমি কৌতূহলী হয়ে উঁকি দিলাম। তক্তিটার দুই পিঠে যা খোদাই করা আছে, বইয়ের ছবিতেও হুবহু তা-ই আছে। অতএব আমাকে সল্ট লেকের ফ্ল্যাটে ফেরার কথা ভুলতে হল। বললাম–কী সব লেখা আছে, বইয়ে তা পাচ্ছেন?

কর্নেল কিছুক্ষণ পরে মুখ তুলে হতাশ ভঙ্গিতে বললেন–নাঃ! নেকারতিতির তক্তি ছিল সোনার। এটা ব্রোঞ্জের। তার মানে এটা নকল জিনিস। বিদেশের কিউরিয়ো শপে এরকম নকল জিনিস বা রেপ্লিকা বিক্রি হয়। তুমি দিল্লির লালকেল্লায় নিশ্চয় দেখেছ, মিনি তাজমহল বিক্রি হয়। জয়ন্ত! এটা নিছক রেপ্লিকা। মূল সোনার তক্তিতে কী লেখা ছিল, পণ্ডিতেরা তার পাঠোদ্ধার করেছেন।

বললাম–কী লেখা আছে, তা নিয়ে মাথাব্যথা করে কী লাভ? আপনি পার্চমেন্টে লেখা কিউনিফর্ম লিপির পাতা খুঁজে দেখুন!

কর্নেল বললেন–কিউনিফর্ম লিপি পশ্চিম এশিয়া, ইরাক আর পারস্যে প্রচলিত ছিল। নানা ভাষা নানারকমের পেরেক চিহ্নের সমাবেশ। কাজেই এক্ষেত্রে আমাকে বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিতে হবে।

-মূল পার্চমেন্টটা দেখাবেন নাকি?

–মোটেও না। ওটার একটা ফোটোকপি করে নিয়ে যাব। বলব, একটা বইয়ে পেয়েছি। তবে বলা যায় না, কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরুতে পারে।

–সাপ মানে?

-তুমি জানো, আমি ইনটুশনের কথা বলি। ওটা একটা বিস্ময়কর বোধ। অনেক মানুষের মধ্যে এটা লক্ষ্য করেছি। তবে আমার সামরিক জীবনে গেরিলাযুদ্ধ শেখার সময় আমার এই বোধটা জন্মেছিল। বহুবার দেখেছি, কোনও বিপদ আসন্ন, তা হঠাৎ আমি টের পেয়েছি। চামড়ায় লেখা কথাগুলো অর্থাৎ, প্রাচীন পার্চমেন্ট পেতলের নল থেকে বের করেই গতরাতে দোমোহানির বাংলোতে মনে হয়েছিল, এটা বিপজ্জনক।

হাসতে হাসতে বললাম-ওটাও ব্রোঞ্জের তক্তির মতো নকল নয় তো?

-পার্চমেন্টটা আতশকাচে পরীক্ষা করে মনে হয়েছে খুব পুরোনো। অনেক জায়গায় পোকায় কেটেছে। ওতে কীটনাশক পাউডার মাখিয়ে রাখতে হবে।

 বলে কর্নেল টেলিফোনের রিসিভার তুলে ডায়াল করলেন। সাড়া এলে বললেন-কর্নেল নীলাদ্রি সরকার বলছি। ড. মুখার্জি আছেন কি?…ড. মুখার্জি! নমস্কার! আশা করি সুস্থ শরীরে আছেন?…এ বয়সে ওরকম একটু-আধটু অসুখ-বিসুখ হয়েই থাকে। আমারও হয়। …মিলিটারি বডি? বাঃ! বলেছেন ভালো। কিন্তু এবার বডি ছেড়ে মিলিটারি অংশটা পালিয়ে যাচ্ছে। যাই হোক, কালবিকেল চারটে নাগাদ আপনার একটু সময় হবে?..ব্যাপার আপনার কাছে সামান্য। বিশ্বখ্যাত পণ্ডিত আপনি। …না, না! শুনুন! একটা গুরুতর সমস্যায় পড়েছি। আপনার সাহায্য চাই। ..ওকে, ওকে ড. মুখার্জি! ধন্যবাদ।

কর্নেল রিসিভার রেখে বললেন–ড. রথীশ মুখার্জির নাম শুনেছ?

বললাম-না। কে উনি?

-এটাই হয়, জয়ন্ত! প্রকৃত বিদ্বানরা প্রচারবিমুখ। তারা কাজ করেন আড়ালে। আর তাদের কাজের ফল ভোগ করে অন্য সব মানুষ।

আমি এবার উঠি, কর্নেল! বরং সকালে আসব।

কর্নেল হাসলেন। -তুমি সল্ট লেকের ফ্ল্যাটে ফিরেই হয়তো দেখবে, তোমার কাগজের কর্তৃপক্ষ তোমাকে কোথাও কোনও হাঙ্গামার খবর আনতে নির্দেশ দিয়েছেন। অতএব এই বৃদ্ধের ডেরায় লুকিয়ে থাকো!

–আমার চাকরি এবার যাবে!

–যাবে কী বলছ? তোমাদের চিফ রিপোর্টারকে আমি জানিয়ে দেব, একটা রোমাঞ্চকর স্টোরির পিছনে তোমাকে লড়িয়ে দিয়েছি।

 কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্টে আমাকে এ ধরনের ঘটনার সময় রাত কাটাতে হয়। তাই এখানে আমার এক প্রস্থ পোশাক-আশাক আর দরকারি জিনিসপত্র রাখা আছে। কর্নেল প্রায়ই আমাকে সল্ট লেকের ফ্ল্যাটটা ভাড়া দিয়ে তার ডেরায় থাকতে বলেন। এ যাবৎ রাজি হইনি। কারণ, কখন নিছক কোনও বিরল প্রজাতির অর্কিডের জন্য ওঁর পিছনে পাহাড়-জঙ্গলে ছুটোছুটি করে বেড়াতে হবে। …

সকালে ষষ্ঠীচরণের ডাকে ঘুম ভেঙেছিল আমার। বাসিমুখে চা অর্থাৎ বেডটি খাওয়ার অভ্যাস আছে। বেডটি দিয়ে ষষ্ঠী হাসল। -বাবামশাই এখনও ছাদের বাগানে কাকের সঙ্গে যুদ্ধ করছেন। একটা হতভাগা কাক ক্যাকটাসের মধ্যে আটকে গিয়ে কেলেঙ্কারি। হাজার-হাজার কাক এসে বাবামশাইকে চাদ্দিক থেকে ঘিরে ধরেছিল। আমি ছুটে গিয়ে পটকা ফাটালুম। তারপর আধমরা কাকটা বের করে দত্তবাড়ির নিমগাছে ছুঁড়ে দিলাম। আপনি তখন বেঘোরে ঘুমুচ্ছেন। বাবামশাইয়ের দু-হাত তুলে নাচন-কোঁদন দেখলেওঃ! কুরুক্ষেত্তর!

বলে সে চলে গেল। ছাদের বাগানে কর্নেল একটা কাকতাড়ুয়া বসিয়েছিলেন। সেটা কি নেই?

প্রাতঃকৃত্যের পর পোশাক বদলে ড্রয়িংরুমে গেলাম। একটু পরে কর্নেল এলেন। -মর্নিং জয়ন্ত!

-মর্নিং বস! শুনলাম, আপনি কাকেঁদের সঙ্গে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে নেমেছিলেন?

কর্নেল অট্টহাসি হেসে ইজিচেয়ারে বসলেন। -ষষ্ঠীর খবর! ষষ্ঠী তিনটে হাইড্রোজেন বোমা ফাটিয়েছে। অতএব যোদ্ধা সে-ই।

একটু পরে ষষ্ঠী গম্ভীর মুখে কফি আর স্ন্যাক্সের ট্রে রেখে গেল। কর্নেলের হাতে এদিনের ইংরেজি-বাংলা একগাদা খবরের কাগজ ছিল। সোফার কোণে ছুঁড়ে ফেলে কফিপানে মন দিলেন। আমি কাগজগুলোয় দ্রুত চোখ বুলিয়ে তিতলিপুরের খুনের খবর খুঁজলাম। মফস্সলের সংবাদদাতাদের পাঠানো খবর ছাপানোর জায়গা থাকলে ছাপা হবে। নয়তো দুমড়ে টেবিলের তলায় ফেলা হবে। নেতাগোছের কেউ খুন হলে অবশ্য অন্য কথা। দীপনারায়ণবাবুর পূর্বপুরুষ জমিদার ছিলেন। কিন্ত তিনি নিতান্ত সাধারণ মানুষ ছিলেন।

কর্নেল কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন-তুমি কী খুঁজছিলে, জানি। ধৈর্য ধরো ডার্লিং! তুমিই ওই খুনের খবর অদূর ভবিষ্যতে জমিয়ে লিখবে। দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার প্রচারসংখ্যা এক লাফে বেড়ে যাবে।

বললাম–কিন্তু আপনি তো খুনের জায়গা থেকে চলে এলেন! আপনিই বলেন, খুনির পিছনে দৌডুনোর আগে যে খুন হয়েছে, তার পিছনে দৌডুনো উচিত।

কর্নেল হাসলেন-দৌড়ুনোর জন্যই তো কলকাতা ফিরে এসেছি।

–দীপনারায়ণবাবুর খুনের সূত্র এই বিশাল শহর কলকাতায় খুঁজে পাবেন? খড়ের গাদায় উঁচ খোঁজার ব্যাপার হবে না?

কর্নেল চুপচাপ কফি শেষ করে বললেন-সওয়া আটটা বাজে। এখনই একবার বেরিয়ে পড়া যাক। শিগগির ঘুরে আসব। হালদারমশাইয়ের ন-টা নাগাদ আসবার কথা। কুইক জয়ন্ত!

কর্নেলকে এসব ক্ষেত্রে প্রশ্ন করা বৃথা। শুধু বলবেন–চলো তো! আমি পথ দেখাব।

নিচে কর্নেলের একটা খালি গ্যারাজ ঘর আছে। একসময় ওঁর একটা লালরঙের ল্যান্ডরোভার গাড়ি ছিল। পুরোনো গাড়ি। বারবার ঝামেলা বাধাত। তাই বিক্রি করে দিয়েছিলেন। সেই গ্যারাজে আমার ফিয়াট গাড়িটা থাকে।

কর্নেল গ্যারাজের তালা খুলে দিলেন। আমি গাড়ি বের করলাম। কর্নেল আমার বাঁপাশে বসে বললেন–বাইনোকুলার বা ক্যামেরার দরকার নেই। শুধু দর্শন করে আসব।

দারোয়ান সেলাম ঠুকে গেট খুলে দিল। তারপর কর্নেলের নির্দেশে অলিগলি ঘুরতে ঘুরতে পার্ক স্ট্রিট, তারপর থিয়েটার রোডে পৌঁছুলাম। থিয়েটার বোড় আর সার্কাস অ্যাভিনিউয়ের মধ্যে একটা গলিরাস্তার যোগাযোগ লক্ষ্য করলাম। সেই গলিতে কিছুটা এগিয়ে কর্নেল বাঁদিক ঘেঁষে গাড়ি দাঁড় করাতে বললেন। গাড়ি থেকে নেমে এতক্ষণে বুঝলাম, দীপনারায়ণবাবু যে ফ্ল্যাটে থাকতেন, সেই ফ্ল্যাটে এখন জাহাজিবাবু বাস করে। এই ঠিকানাটা দীপনারায়ণবাবুর বোন সুনয়নী দেবী দিয়েছিলেন।

কাছে গাড়ি মেরামতের গ্যারাজে গিয়ে কর্নেল নাম্বার জিজ্ঞেস করে এলেন। তারপর আমাকে তিনি অপেক্ষা করতে বলে একটা বাড়ির খোলা দরজা দিয়ে ঢুকে গেলেন। সামনে দোতলায় ওঠার সিঁড়ি দেখা যাচ্ছিল। কর্নেল সিঁড়িতে ওঠার সময় এক মুসলিম ভদ্রলোক নেমে আসছিলেন। তাঁর মাথায় টুপি। মুখে দাড়ি। পরনে পাঞ্জাবি আর লুঙি। গলায় একটা মাফলার জড়ানো। কলকাতায় ডিসেম্বরেও শীত তীব্র নয়। কর্নেল তাকে কিছু জিজ্ঞেস করলে তিনি আঙুল তুলে কিছু দেখিয়ে নেমে এলেন। তারপর আমার দিকে একবার তাকিয়ে সোজা সার্কাস অ্যাভিনিউয়ের দিকে চলে গেলেন। তার হাতে একটা ব্রিফকেস ছিল।

একটু পরে কর্নেল নেমে এলেন। তারপর দরজা দিয়ে বেরিয়ে বললেন-ঠিকানা ঠিকই আছে। কিন্তু ওই দু-কামরা ফ্ল্যাটে থাকেন কাজি গোলাম হোসেন। পাশের ফ্ল্যাটের এক ভদ্রলোক বললেন-উনি তো এখনই বেরিয়ে গেলেন। না-ওখানে এক হিন্দু ভদ্রলোক অনেক বছর আগে থাকতেন। তারপর ফ্ল্যাটটা খালি ছিল। মালিক থাকেন দিল্লিতে। ওই ফ্ল্যাট তিনিই কাজিসাহেবকে নাকি ভাড়া দিয়েছেন। কাজিসাহেব একা থাকেন। কারও সঙ্গে মেশেন না। বদরাগি লোক বলে তাকে সবাই এড়িয়ে চলেন।

কর্নেল গাড়ির সামনে দিয়ে ঘুরে আমার বাঁদিকে বসতে যাচ্ছেন, সেইসময় তাঁর জ্যাকেটের পিছনে এক টুকরো কাগজ আঁটা দেখতে পেলাম। কাগজটা ছাড়িয়ে নিয়ে বললাম–এটা আপনার পিঠে আঠা দিয়ে আটকানো ছিল।

কর্নেল কাগজটা ছিনিয়ে নিয়ে বললেন-জয়ন্ত! আমাকে জাহাজিবাবু বোকা বানিয়ে চলে গেছে পাশ দিয়ে। যাবার সময় আমার পিঠে এটা আটকে দিয়ে গেছে। এতে লেখা আছে, দ্বিতীয়বার এলেই মারা পড়বে।

.

০৬.

অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে কর্নেল দোমোহানি সেচবাংলোয় পাওয়া হুমকির চিঠিটার সঙ্গে আজকের চিরকুটের লেখা আতশ কাচের সাহায্যে পরীক্ষা করেছিলেন। দুটো লেখাই একজনের। কর্নেল চিঠি আর চিরকুটটা টেবিলের ড্রয়ারে রেখে ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে চুরুট টানছিলেন। চোখ যথারীতি বন্ধ।

বলেছিলাম–জাহাজিবাবু লিখেছিল আপনাকে চেনে। তাহলে এই রিস্ক নিল কেন সে? ওকে তো আবার ওই ফ্ল্যাটে ফিরতে হবে। লোকটা যদি সত্যিই আপনার প্রকৃত পরিচয় জেনে থাকে, তাহলে তার এ-ও জানার কথা, আপনি তার পিছনে পুলিশ লাগিয়ে দেবেন।

কর্নেল বলেছিলেন–পুলিশ নিজে থেকেই ওখানে হানা দেবে। কারণ চন্দ্রপুর থানার ওসি রাজেনবাবু নিশ্চয় লালবাজার ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টে খবর পাঠিয়েছেন। তুমি সাংবাদিক। তোমার জানার কথা, পুলিশ সহজে কোনো বাড়তি কাজে হাত লাগায় না। পুলিশেরও আজকাল অনেক অসুবিধে আছে। কোথায় হাত দিতে গিয়ে কোন রাজনৈতিক গার্জেনের ছোবল খাবে!

-কেন? আপনি ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের ডেপুটি কমিশনার আপনার বিশেষ স্নেহভাজন মি. অরিজিৎ লাহিড়িকে ব্যাপারটা জানিয়ে দিন!

এখনও সে-সময় আসেনি। আমি চাই না পুলিশ এখনই জল ঘোলা করুক। তাতে মূল রহস্য আর কোনওদিনই জানা যাবে না। আমাকে নিজের পদ্ধতিতে এগোতে হবে। হালদারমশাই আসুন। তারপর পুরো ব্যাকগ্রাউন্ডটা কী রকম, তা হয়তো বোঝা যাবে। …

প্রাইভেট ডিটেকটিভ কে কে হালদারের আবির্ভাব ঘটল সাড়ে নটায়। সবেগে ঢুকে ধপাস করে বসে বললেন-হেভি মিস্ট্রি। তাই এটু দেরি হইয়া গেল।

কর্নেল বললেন- বলুন হালদারমশাই!

 হালদারমশাই একটিপ নস্যি নিয়ে যা বললেন, তা এই :

অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপটেন এস এন সিংহ সাউদার্ন অ্যাভিনিউতে বাড়ির দোতলায় একা থাকেন। তার একমাত্র ছেলে থাকে আমেরিকার বস্টনে। সে সেখানে বিয়ে করেছে। বছরে একবার এসে বাবাকে দেখে যায়। ক্যাপটেন সিংহের রান্না আর কাজকর্ম করে দিয়ে যায় একজন ঠিকে ঝি। এই মেয়েটি থাকে লেকের ধারে একটা বস্তিতে। রাস্তায় দিকের ঘরটা ক্যাপটেন সিংহের ড্রয়িং রুম। দেশবিদেশের নানারকম শিল্পদ্রব্যে সাজানো। ভিতরের দরজা দিয়ে গেলে শোবার ঘর। সেখানে আলমারি-ঠাসা বই আর দেওয়ালে টাঙানো আছে তার পারিবারিক ছবি। তৃতীয় ঘরটা কিচেন আর ডাইনিং। কিচেনের অংশটা পাটিশন করা আছে।

কথায়-কথায় ক্যাপটেন সিংহ বলেছেন, সারাজীবন ঘরছাড়া হয়ে কাটিয়েছেন। তাই তার বন্ধুবান্ধব নেই। আত্মীয়-স্বজন কলকাতার নানা জায়গায় থাকেন। তাদের সঙ্গে তার যোগাযোগ কম। অবসরজীবনে তিনি স্থানীয় একটা ক্লাবের সদস্য হয়েছিলেন। ক্লাবটা উঠে গেছে। তবে পাড়ায় কয়েকজন তাঁর বয়সি ভদ্রলোকের সঙ্গে বন্ধুতা আছে। প্রতিদিন ভোরে তাদের সঙ্গে লেকের ধারে হাঁটাহাঁটি করে আসেন। ঠিকে ঝি আসে বেলা আটটা-সাড়ে আটটায়।

হালদারমশাই জানতে চেয়েছিলেন, গতিবিধি জানার জন্য তার পিছনে লোক লাগানোর কোনও কারণ আছে বলে কি তিনি মনে করেন? ক্যাপটেন সিংহ বলেন, তেমন কোনও কারণ তিনি খুঁজে পাচ্ছেন না। তবে বছর দশেক আগে তার এক সহকর্মী তাকে একটা প্যাকেট রাখতে দিয়েছিলেন। তখন তিনি জাহাজে ছিলেন। জাহাজটা আসছিল মিশরের পোর্ট সইদ বন্দর থেকে বোম্বে। তারপর কলকাতা। তার সেই সহকর্মীর নাম ছিল অজয়েন্দু রায়। বোম্বে আসার পথে আরব সাগরে জাহাজটার তলায় ফাটল ধরে ডুবতে থাকে। বিপদসংকেত পাঠান তিনি। বোম্বে বন্দর থেকে উদ্ধারকারী জাহাজ পৌঁছোয়। কিন্তু তখন জাহাজটার পিছন দিক ডুবে যায়। অনেক নাবিক প্রাণ হারায় জলের তলায়। মোড়কটা ক্যাপটেন সিংহের ব্যাগে ছিল। ব্যাগটা তিনি সবসময় কাছে। রাখতেন। তিনি উদ্ধার পান। কিন্তু অজয়েন্দু রায়ের আর খোঁজ পাননি। জাহাজে মিশরের তুলো বোঝাই ছিল। সব নষ্ট হয়ে যায়। বোম্বেতে কিছুদিন থাকার পর ক্যাপটেন সিংহ তার কোম্পানির আর একটা ছোটো মালবাহী জাহাজ নিয়ে কলকাতা বন্দরে আসেন। তারপর প্যাকেটটা বাড়িতে রেখে খিদিরপুর ডকে নিজের কাজে ফিরে যান।

অজয়েন্দু রায়ের অধীনে একজন অফিসার ছিলেন। তাঁর নাম শম্ভুনাথ চৌধুরি। তিনি ক্যাপটেন সিংহের কাছে অজয়েন্দুবাবুর গচ্ছিত প্যাকেটের কথা কীভাবে জানতে পেরেছিলেন, এটাই আশ্চর্য! প্রায়ই এই লোকটা তার কাছে প্যাকেটটা দাবি করত। অন্যের জিনিস তিনি কেন দেবেন শম্ভুবাবুকে? তিনি ওঁকে ধমক দিয়ে বলতেন, তেমন কোনও প্যাকেট অজয়েন্দুবাবু তাঁকে দেননি। তারপর তো চাকরি থেকে ক্যাপটেন সিংহ অবসর নেন। দু-বছর আগে একদিন তিনি ব্যাংকে গিয়েছিলেন। বাড়ি ফিরে তাঁর ঠিকে-ঝি সুশীলার কাছে শোনন, এক ভদ্রলোক তার খোঁজে এসেছিলেন। তাঁকে সুশীলা ড্রয়িংরুমে বসিয়ে রেখেছিল। তারপর কখন ভদ্রলোক চলে গেছেন, সুশীলা দেখতে পায়নি। ক্যাপটেন সিংহ সুশীলাকে বকাবকি করেন। তবে সুশীলার দোষ ছিল না। তাঁকে তিনি বিশ্বাস করেন। তাই বাড়ির চাবি তাকে দিয়ে যেতেন। কারণ সুশীলা সব ঘর পরিষ্কার করত। মেঝে মুছত। যাই হোক, দিনে তার কথাটা মাথায় আসেনি। রাত্রে তিনি সন্দেহবশে বেডরুমে তার খাটে বিছানার তলা খোঁজেন। প্যাকেটটা ম্যাট্রেসের তলায় রাখা ছিল। সেটা উধাও। হয়ে গেছে।

সুশীলার কাছে আগন্তুক ভদ্রলোকের চেহারার যে বিবরণ তিনি পান, তাতে তিনি চিনতে পারেননি ভদ্রলোককে। তার মুখে ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি ছিল। পরনে টাই-সুট ছিল। তিনি পাইপ খাচ্ছিলেন।

এমন সাহেব-মানুষকে সুশীলা ড্রয়িংরুমে বসতে দেবে, এটা স্বাভাবিক। ব্যাংকটা কাছেই। কাজেই ক্যাপটেন সিংহের শিগগির বাড়ি ফেরার কথা। তবে তারপর থেকে সুশীলার হাতে চাবি দিয়ে তিনি বেরোন না। সুশীলা ঘর পরিষ্কার এবং রান্না করে চলে যাওয়ার পর তিনি দরকার হলে বাইরে যান। …

হালদারমশাইয়ের কথা শুনে উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলাম। কিন্তু কর্নেলের কথা বলার আগে আমার কোনও কথা বলা উচিত হবে না। চন্দ্রপুরের জাহাজিবাবুর সঙ্গে হালদারমশাইয়ের মক্কেলের একটা যোগসূত্র তাহলে পাওয়া গেল। ক্যাপটেন সিংহকে অজয়ে রায় যা রাখতে দিয়েছিলেন, তা জাহাজবাবুই যে ছদ্মবেশে চুরি করে নিয়ে যায়, তা-ও স্পষ্ট হল। জিনিসটা যে পিতলের নলে রাখা পার্চমেন্ট, তা-ও বোঝা গেল। শুধু বুঝতে পারলাম না, এতদিন পরে কে ক্যাপটেন সিংহের গতিবিধির ওপর নজর রেখেছে? তার উদ্দেশ্যই বা কী?

হালদারমশাই ব্রেকফাস্ট করে এসেছেন। কর্নেল ও আমি ব্রেকফাস্ট সেরে নিলাম। তারপর কফি আনল ষষ্ঠীচরণ। হালদারমশাই ফুঁ দিয়ে কফিতে চুমুক দিতে দিতে বললেন–দুইখান পয়েন্ট আমার মাথায় আইয়া পড়ছে। কমু?

কর্নেল বললেন-বলুন।

সুশীলা রোজ ঘর পরিষ্কার করত। সে নিশ্চয় প্যাকটেখান বিছানার তলায় দেখছিল। তার লগে শম্ভুনাথ চৌধুরি ছদ্মবেশে গোপনে যোগাযোগ করছিল। সুশীলা ক্যাপটেন সিংহেরে মিথ্যা কইছে। গোপনে সেই টাকার লোভে প্যাকেটখান শম্ভুনাথের দিছে। ক্যাপটেন সিংহ সুশীলার বিশ্বাস কইরা ঠকছেন। এই হইল গিয়া প্রথম পয়েন্ট।

–দ্বিতীয় পয়েন্ট?

গোয়েন্দাপ্রবর চাপা স্বরে বললেন–ক্যাপটেন সিংহ আমার মক্কেল। কিন্তু তিনি আমারে কিছু কথা নিশ্চয় গোপন করছেন। আমার মনে হয় কী জানেন কর্নেল স্যার? কমু?

নিশ্চয়। কী মনে হয়, তা খুলে বলুন।

–অজয়ে রায় ক্যাপটেন সিংহেরে প্যাকেটখানা রাখতে দেন নাই। সিংহসায়েবই অজয়েন্দুবাবুর থেক্যা ওটা চুরি করছিলেন। জাহাজডুবির সময় অজয়েন্দুবাবুরে উনিই সম্ভবত আরব সমুন্দুরে ধাক্কা মাইরা ফেলছিলেন।

কর্নেল হাসলেন। তারপর অজয়ে রায় কোনও ভাবে বেঁচে গিয়েছিলেন এবং ক্যাপটেন সিংহ তাঁকে জিনিসটা ফেরত দেননি বা দিতে পারেননি। কারণ প্যাকেটটা চুরি গিয়েছিল-

কর্নেলের কথার ওপর আমি বললাম–সময়ের কথা ভুলে যাচ্ছেন। জাহাজডুবি হয়েছিল দশবছর আগে। আর ক্যাপটেন সিংহের ঘর থেকে প্যাকেটটা শম্ভুনাথ হাতায় দু-বছর আগে। বেঁচে থাকলে অজয়েন্দুবাবু প্যাকেটটা এতবছর ধরে দাবি করতে আসেননি কেন?

হালদারমশাই বললেন-ক্যাপটেন সিংহ আমারে কিছু কথা গোপন করছেন।

কর্নেল বললেন-হ্যাঁ। আপনার অনুমান যুক্তিসঙ্গত। তবে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট হল, এতদিন পরে ক্যাপটেন সিংহের গতিবিধির উপর যে নজর রেখেছে, সে কি অজয়েন্দুবাবুর চর? অজয়েন্দুবাবু কি বেঁচে গিয়েছিলেন এবং কোনও কারণে দশবছর চুপচাপ ছিলেন? কী সেই কারণ?

আমি বললাম–কিন্তু তিনি চর লাগিয়েছেন কেন? সরাসরি নিজে ক্যাপটেন সিংহের সামনে। যাচ্ছেন না কেন?

হালদারমশাই বললেন-কর্নেলস্যার! এইজন্যই কইছিলাম হেভি মিস্ট্রি। আমার মক্কেল আমারে কথা গোপন করলে আমি তারে ক্যানসেল কইরা দিমু।

কর্নেল বললেন–না হালদারমশাই! আপনার কেসে আমারও ইনটারেস্ট আছে। কেন আছে তা পরে বলব। আপাতত ক্যাপটেন সিংহের কাছে আপনার জানা দরকার, কে তাকে ফলো করে। আপনি ওঁকে রাস্তায় হেঁটে যে কৌশলে হোক, লোকটাকে দেখিয়ে দিতে বলবেন। সাবধান! উনি যেন পিছু ফিরে ইশারায় না দেখান। শুধু মুখের কথায় লোকটার বর্ণনা দেন। হালদারমশাই! চিয়ার আপ! আপনি চৌত্রিশ বছর পুলিশে চাকরি করেছেন। অবসরের সময় আপনি ছিলেন ডিটেকটিভ ইনস্পেকটার। আপনাকে বেশি কথা বলতে চাই না। তবে প্লিজ, হঠকারিতা করবেন না!

উত্তেজনায় গোয়েন্দাপ্রবরের গোঁফের ডগা তিরতির করে কাঁপছিল। তিনি বললেন-না, না কর্নেলস্যার। লোকটা ক্যাপটেন সিংহরে ফলো করে। এবার আমি অরে ফলো করুম।

বলেই তিনি উঠে দাঁড়ালেন। তারপর যাই গিয়া বলে সবেগে প্রস্থান করলেন।

কর্নেল ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুঝে টাকে হাত বুলোতে থাকলেন। একটু পরে টেলিফোন বাজল। অমনই কর্নেল চোখ খুলে সিধে হয়ে হাত বাড়ালেন টেলিফোনের দিকে। তারপর রিসিভার তুলে সাড়া দিলেন। -বলছি। …মি. হাটি! মর্নিং! বলুন। …হ্যাঁ। কাজি গোলাম হোসেন থাকেন। আমি সকালেই গিয়েছিলাম ওখানে!…কাজিসাহেবকে না পাওয়ারই কথা। …কেন একথা বলছি? মি. হাটি, লালবাজারের ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টকে বলুন, সাদা পোশাকে কাজিসাহেবের ডেরার কাছে যেন সারাক্ষণ অন্তত দুজন সশস্ত্র লোক মোতায়েন থাকে। …হা, ঠিক ধরেছেন। ওই কাজিসাহেবই পাজি জাহাজিবাবু। .. হ্যাঁ। শিয়োর। আর একটা কথা। আপনি লালবাজারকে বলুন, কড়েয়া থানা থেকেও যেন কাজিসায়েবের দিকে নজর রাখা হয়। .. হ্যাঁ। ওটা  কড়েয়া থানা এলাকায় পড়ে। …ঠিক আছে। উইশ ইউ গুড লাক!…

রিসিভার রেখে কর্নেল আবার ধ্যানস্থ হলেন। বললাম–তাহলে আমরা চলে আসবার পরই লালবাজার থেকে অফিসার গিয়েছিলেন?

–হুঁ।

-জাহাজিবাবু মহা ধূর্ত। ও এখন কিছুদিন গা ঢাকা দেবে। পাড়ায় নিশ্চয় ওর পোয্য গুণ্ডা-মস্তান আছে!

–অজয়েন্দুবাবুর ব্যাপারটা যদি সত্যি হয়, অর্থাৎ উনি যদি বেঁচে থাকেন, তাহলে এতদিন কোথায় ছিলেন? উনি বেঁচে না থাকলে অন্য কেউ কি পার্চমেন্টটার কথা জানত? সে-ই কি ক্যাপটেন সিংহের ওপর নজর রেখেছে, যাতে উনি জিনিসটা কাকেও বেচলে সে জানতে পারবে?

–হুঁ।

এবার আমার জ্ঞানবুদ্ধির ফিরে এল। কর্নেলের এই  মানে উনি আমার কথা শুনছেন না। এই হুঁ-র সঙ্গে আমি দীর্ঘকাল পরিচিত। তাই চুপ করে গেলাম। খবরের কাগজ টেনে নিয়ে পড়ার চেষ্টা করলাম।

কিছুক্ষণ পরে কর্নেল হঠাৎ চোখ খুলে সিধে হয়ে টেবিলের ড্রয়ার টানলেন। একটা নোটবই বের করে পাতা ওলটাতে থাকলেন। তারপর টেলিফোনের রিসিভার তুলে ডায়াল করলেন। সাড়া এলে ইংরেজিতে বললেন–ইন্ডিয়ান শিপিং কর্পোরেশন?…আমি ম্যানেজিং ডাইরেক্টর মি. অসীম সোমের সঙ্গে কথা বলতে চাই। …আমার নাম কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। ইয়া! কলোনেল!

প্রায় তিন মিনিট পরে সাড়া এল, তা বুঝলাম। কর্নেল বললেন–মি. সোম!…হা, সেই সাদা দাড়িওয়ালা বৃদ্ধই বটে! আমি আপনার সাহায্যপ্রার্থী। …ধন্যবাদ। তবে বিষয়টা একটু জটিল। আন্দাজে ঢিল ছোঁড়ার মতো। আপনি নোট করে নিলে ভালো হয়। …দশবছর আগেকার ঘটনা। জাহাজের নাম জানি না। তবে দেশি জাহাজ। কাজেই আপনাদের কাছে পুরোনো রেকর্ডে খোঁজ মিলতে পারে। পোর্ট সইদ থেকে জাহাজটা আসছিল বোম্বে। মিশরের উৎকৃষ্ট তুলো বোঝাই ছিল। … হ্যাঁ। জাহাজটার তলায় কী ভাবে ফাটল ধরে আরব সাগরে ডুবে গিয়েছিল। সেই জাহাজের ক্যাপটেনের নাম ছিল এস এন সিংহ। সৌমেন্দ্রনাথ সিংহ। এটাই জাহাজটা শনাক্ত করার একটা পয়েন্ট। …ও কে! সেই জাহাজে একজন অফিসার ছিলেন অজয়েন্দু রায়। তিনি নাকি বোম্বে থেকে উদ্ধারকারী জাহাজ সেখানে পৌঁছুনোর আগেই সমুদ্রে তলিয়ে যান। .না। লাইফ জ্যাকেট পরার সুযোগ পেয়েছিলেন কিনা জানি না। মোট কথা তিনি নাকি নিখোঁজ হয়ে যান। ..ক্যাপটেন সিংহ এখন অবসরপ্রাপ্ত। আমার বয়সি বৃদ্ধ। তাকে আমি চিনি। তার কাছেই এই ঘটনা শুনেছি। … হ্যাঁ। তিনিই বলেছেন, অজয়েন্দু রায় আরব সাগরে ডুবে মারা পড়েন। কিন্তু আমার জানার বিষয় শুধু একটা। মাত্র একটা। ..হা অজয়ে রায় সম্পর্কে আপনাদের পুরোনো রেকর্ডে কোনও তথ্য আছে কিনা। থাকলে কী সেই তথ্য?…তা সময় লাগুক। প্লিজ মি. সোম! এটা খুব জরুরি। … হ্যাঁ। একটা কে আমার হাতে এসেছে বইকি। যথাসময়ে আপনাকে জানাব। …ধন্যবাদ মি. সোম। অসংখ্য ধন্যবাদ। …

রিসিভার রেখে কর্নেল নিভে যাওয়া চুরুট লাইটার জ্বেলে ধরালেন। বললাম-বাঃ! এই একটা কাজের কাজ করলেন। কিন্তু জাহাজবাবু শম্ভুনাথ চৌধুরির নামটা ওঁকে দিলেন না কেন?

কর্নেল ধোঁয়ার মধ্যে বললেন-জয়ন্ত! কান টানলে মাথাও আসে। …

লাঞ্চের পর সবে অভ্যাসমতো ডিভানে একটু ভাতঘুম দিতে শুয়েছি, হয়তো ঘুমিয়েও পড়েছিলাম, কর্নেলের ডাকে উঠে বসতে হল। উনি সহাস্যে বললেন–মুখে জলের ঝাপটা দিয়ে এসো। সাড়ে তিনটে বাজে। বিকেল চারটেতে ড. রথীশ মুখার্জির সঙ্গে দেখা করার কথা। উনি থাকেন ওল্ড বালিগঞ্জ প্লেসে। শিগগির রেডি হয়ে নাও…

ওল্ড বালিগঞ্জ প্লেসে একটা পাঁচিলঘেরা বাড়ির গেটের সামনে কর্নেল নামলেন। দেখলাম, তাঁকে সেলাম ঠুকে দারোয়ান গেট খুলে দিল। মন দিয়ে এগিয়ে কর্নেলের নির্দেশে একপাশে গাড়ি দাঁড় করালাম। দোতলার বারান্দা থেকে এক সৌম্যকান্তি বৃদ্ধ, মাথায় কর্নেলের মতো টাক, দাড়ি নেই, কিন্তু একটুখানি গোঁফ আছে, পরনে পাঞ্জাবির ওপর শাল জড়ানো, সহাস্যে বললেন–আসুন! আসুন কর্নেলসায়েব!

নিচে একটি মধ্যবয়সি লোক দাঁড়িয়ে ছিল। সে নমস্কার করে কর্নেল ও আমাকে নিচের ঘরে নিয়ে গেল। বসার ঘর। কিন্তু চারদিকে শিলিং অবধি র‍্যাকে বই ঠাসা। বসার ঘর থেকে সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায়। সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে কর্নেলের হাত ধরে সেই বৃদ্ধ ভদ্রলোক টানতে টানতে একটা ঘরে ঢোকালেন। এ ঘরটাও বইয়ে ঠাসা। এক প্রান্তে বিশাল সেক্রেটারিয়েট টেবিল। পিছনে জানালা। বিকেলের এক চিলতে রোদ এসে টেবিলে পড়েছে। বই ছাড়া ঘরে এখানে-ওখানে টুলের ওপর নানারকম মূর্তি চোখে পড়ল।

কর্নেল আমার সঙ্গে ড. মুখার্জির আলাপ করিয়ে দিলেন। ড. মুখার্জি সেই লোকটাকে শিগগির কফি আনতে বললেন। আমরা তার মুখোমুখি বসলাম।

ড. মুখার্জি মুচকি হেসে বললেন–আপনাকে দেখলেই রহস্যের গন্ধ পাই। এখনও পাচ্ছি।

 কর্নেল হাসলেন। –এবারও লিপিরহস্য!

-কী লিপি?

–পার্চেমেন্টে লেখা কিউনিফর্ম লিপি।

ড. মুখার্জি সকৌতুকে চাপা স্বরে বললেন–গুপ্তধন? আমি বলি গুপ্তধন ইজ লুপ্তধন! দেখি আপনার পার্চমেন্ট।

কর্নেল বললেন-সমস্যা হল, মূল পার্চমেন্টটা হাতে পাইনি। ফোটোকপি এনেছি। বলে তিনি জ্যাকেটের ভিতর পকেট থেকে পার্চমেন্ট স্কোলের মতো গুটিয়ে রাখা একটা একই সাইজের ফোটো বের করে ওঁর হাতে দিলেন।

ড. মুখার্জি ব্যথভাবে ফোটোকপিটা সোজা করে টেবিলল্যাম্পের আলোয় চারটে কাচের পেপারওয়েট চারকোণে চাপা দিলেন। তারপর প্রকাণ্ড আতশ কাচ দিয়ে কিছুক্ষণ লিপিগুলোর, দিকে তাকিয়ে রইলেন।

কর্নেল তীক্ষ্ণদৃষ্টে ড. মুখার্জিকে লক্ষ্য করছিলেন। একটু পরে বললেন–পাঠোদ্ধার সম্ভব কি?

ড. মুখার্জি বললেন–ওপরে বামকোণে এই রেখাগুলো কারুকার্য নয়। আরবি লিপিতে লেখা আছে : আল-কাহিয়রা কাজিনাত আত্-তুহাত্। তার মানে, কায়রো মিউজিয়াম। আল-কাহিরোকে আমরা বলি কায়রো।

-তাহলে এটা কায়রো জাদুঘরের পার্চমেন্ট? কিন্তু লিপি তো কিউনিফর্ম! মিশরে এ লিপি তো প্রচলিত ছিল না বলেই জানি। আপনি অবশ্য আমার চেয়ে আরও বেশি জানেন।

 এই সময় সেই লোকটা ট্রেতে কফি আর বিস্কুট নিয়ে এল। টেবিলে ট্রে একপাশে রেখে সে চলে গেল। ড. মুখার্জি বললেন–আপনারা কফি খান। আমি একটু আগে খেয়েছি। এক মিনিট! বলে তিনি পাশের র‍্যাক থেকে একটা প্রকাণ্ড বই দুহাতে টেনে আনলেন। তারপর সেটার সূচিপত্র। দেখে একটা পাতা বের করলেন। কয়েকটা পাতা উলটে তিনি হাসলেন। পেয়েছি এটা হিটাইট লিপি। বর্তমান তুরস্কের বোগাজ কই নামে একটা পাহাড়ি জনপদে প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ থেকে উনিশ শতকে পাপিরাসে লেখা একটা চিঠি উদ্ধার করা হয়েছিল। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্দশ শতকে হিটাইট অর্থাৎ হাত্তির রাজা সুপ্পিলুলিউমাসকে মিশরের কিশোর রাজা তুত-আংক-আমন অর্থাৎ তুতানখামেনের অকালমৃত্যুর পর তাঁর বিধবা বালিকাবধূ নেকারতিতি এই চিঠিতে অনুরোধ করেছিলেন, তিনি পুনর্বিবাহ করতে চান। কিন্তু মিশরে তার অনেক শত্রু আছে। তাই তিনি হাত্তিদেশের একজন বর চান। কিন্তু কর্নেলসায়েব! প্যাপিরাসে লেখা সেই চিঠির এটা একটা নকল কপি। মূল প্যাপিরাসে লেখা চিঠিটা নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ প্রত্নবিদ উইলিয়াম রাইট পার্চমেন্টে এই কপি করেন। …

.

০৭.

হিটাইট বা হাত্তিদেশের প্রাচীন ইতিহাস নিয়ে ড. মুখার্জির বক্তৃতা আমার ক্রমশ মাথা ধরিয়ে দিচ্ছিল। লক্ষ্য করছিলাম, কর্নেলও উশখুশ করছেন। পণ্ডিতদের পাল্লায় পড়লে এই দুরবস্থা থেকে রেহাই নেই। সন্ধ্যা সাতটা বাজতে চলেছে। কর্নেলের ইশারায় আমি কাচুমাচু মুখে বললাম স্যার! আমাকে কাগজের অফিসে ফিরতে হবে। আমি কর্নেলকে পৌঁছে দিয়ে চলে যাব। ভেবেছিলাম। তো জ্ঞানার্জনের লোভ সম্বরণ করতে পারলাম না।

ড. মুখার্জি বললেন–তা এতক্ষণ বলবেন তো? কর্নেলসায়েব আর একদিন আসুন। মিশরের বিধবা রাজবধূ নেকারতিতির সঙ্গে কোনও হিটাইট রাজপুত্রের সত্যি বিয়ে হয়েছিল কিনা, তার প্রমাণ মেলেনি। যাই হোক, কর্নেলসায়েব! এটা নকল কপি হলেও পার্চমেন্টটা কায়রো মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে। সেই নকলের দামও কম নয়। মার্কিন ধনীরা লক্ষ ডলারে হাতাতে চাইবে। আপনি এটার মূল কপি কোথাও কি দেখেছেন?

কর্নেল কথা না বাড়িয়ে বললেন–না। একটা বিদেশি পত্রিকায় ছবি দেখে কৌতূহল হয়েছিল। …

গড়িয়াহাট রোডে বাঁক নিয়ে কিছুটা যাওয়ার পর কর্নেল চাপা স্বরে বললেন–জয়ন্ত! একটা লাল মারুতি আমাদের ফলো করছে। গাড়িটা ড. মুখার্জির গেটের একটু তফাতে দাঁড়িয়ে ছিল। লক্ষ্য রেখে চলল।

একটু পরে ব্যাকভিউ মিররে দেখলাম গাড়িটা দ্রুত এগিয়ে আসছে। কর্নেল বললেন ডানদিকের গলিরাস্তায় আচমকা মোড় নাও। তারপর আমি গোলকধাঁধায় ঘুরিয়ে মারব মারুতিটাকে।

কর্নেলের নির্দেশে অলিগলি ঘুরতে ঘুরতে একসময় চেনা রাস্তা ব্রড স্ট্রিটে পৌঁছুলাম। কর্নেল বললেন–এটা সুলক্ষণ। কেউ নিজে থেকেই জানিয়ে দিচ্ছে, সে আমাদের এই কেসে খুব জড়িয়ে আছে। কিন্তু এবার আমাদের সাবধানে এগোতে হবে। আমরা সত্যিই বিষধর সাপের ল্যাজে পা দিয়েছি।

বললাম–হ্যাঁ। লক্ষ ডলার দামের জিনিস হাতিয়েছেন। জাহাজিবাবুর মাথা খারাপ হয়ে গেছে।

কর্নেল বললেন–ব্রোঞ্জের চাকতিটা মিশরের বিধবা কিশোরী নেকারতিতির। আবার চিঠিটাও সেই রাজবধূ নেকারতিতির। দুটোই আসলের কপি। পোর্ট সইদ বন্দরও মিশরের। ক্যাপটেন সিংহের জাহাজ ওই বন্দর থেকে তুলো বোঝাই করেছিল। এ থেকে একটা স্পষ্ট ব্যাকগ্রাউন্ড দেখা যাচ্ছে। দুটো জিনিসই কায়রো জাদুঘর থেকে কেউ চুরি করেছিল। এবার প্রশ্ন হল, ক্যাপটেন সিংহ আর অজয়েন্দু রায় এই দুজনেরই কেউ চোর। অথবা তাদের কেউ অন্য কোনও চোরের কাছে দাম দিয়ে দুটো জিনিস কিনেছিলেন। বেশি দামে কারও কাছে বিক্রি করাই উদ্দেশ্য ছিল। তারপর জাহাজিবাবু ওটা ক্যাপটেন সিংহের ঘর থেকে চুরি করে দোমোহানির কাছে কেল্লাবাড়ির জঙ্গলে পুঁতে রেখেছিল।

–প্রায় একবছর ওটা পুঁতে রাখার কারণ কী হতে পারে?

কর্নেল একটু পরে বললেন–হয়তো জাহাজিবাবু উপযুক্ত খদ্দের খুঁজছিল। পাচ্ছিল না।

–ঠিক বলেছেন। এতদিনে খদ্দের পাওয়ায় সে পার্চমেন্টটা তুলে আনতে তার বিশ্বস্ত লোক পাঠিয়েছিল। তারা পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে। কিন্তু কর্নেল, জাহাজিবাবু নিজে ওটা আনতে যায়নি কেন?

–চন্দ্রপুরে নিশ্চয় তার কোনও শত্রু আছে, যে ব্যাপারটা জানে এবং জাহাজিবাবুর ওপর নজর রেখেছিল। তাই সে ঝুঁকি নেয়নি। তবে সেটা জানতে হলে সাবধানে পা বাড়াতে হবে, জয়ন্ত! ধৈর্য ধরো।

অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে ষষ্ঠীচরণের তৈরি কফি খাওয়ার পর কর্নেল জানালা দিয়ে উঁকি মেরে বললেন–জয়ন্ত! লাল মারুতিটা আমার বাড়ির গেটের সামনে দিয়ে গলির ভিতর উধাও হয়ে গেল। গাড়িটা গেটের ওদিকে বড়ো রাস্তায় হয়তো দাঁড়িয়ে ছিল। তবে আমরা গাড়িটার অনেক আগে এসে গেছি।

একটু ভয় পেলাম!–গাড়ি থেকে কি কেউ আমাদের দিকে গুলি ছুঁড়ত?

কর্নেল হাসলেন। –হয়তো ছুঁড়ত। তবে আমাদের মেরে ফেলবার জন্য নয়। ভয় পাইয়ে দেবার জন্য। আর রাত্রেও তুমি আমার এখনে থেকে যাও। ই এম বাইপাসে গাড়িটা তোমাকে বিপদে ফেলতে পারে।

বললাম–ওই রাস্তায় আমি কাগজের অফিস থেকে প্রতি রাত্রে বাড়ি ফিরি। পুলিশ পেট্রলের লোকজন ছাড়াও পুলিশ সার্জেন্টরা আমার পরিচিত। তাদের বললে আমার গাড়ির সঙ্গে আমার ফ্ল্যাট পর্যন্ত যাবে। অপরাধ সংক্রান্ত স্পেশাল করেসপন্ডেন্টকে তারা খাতির করে।

এই সময় ডোরবেল বাজল। তারপর ষষ্ঠী গিয়ে দরজা খুলতেই প্রাইভেট ডিটেকটিভ কে কে হালদার তেমনি সবেগে প্রবেশ করলেন এবং সোফায় বসে একটিপ নস্যি নিলেন।

কর্নেল বললেন–কিছু খবর এনেছেন আশা করি।

–আনছি। একটুখানি রেস্ট লই, তারপর কইতাছি। দেখে মনে হচ্ছিল গোয়েন্দাপ্রবর কারও সঙ্গে হাতহাতি করে এসেছেন। কারণ ডানহাতের তর্জনীতে একটুকরো ব্যান্ডেজ দেখতে পাচ্ছিলাম। একটু পরে তিনি যেন ধাতস্থ হলেন। তারপর বললেন- আপনার কথামতো সকালে আমার মক্কেলের বাড়ি গিছলাম। তারে কইছিলাম, বিকাল চারটায় তিনি য্যান বাড়ি থেইক্যা বারাইয়া দেশপ্রিয় পার্কের দিকে চলেন। আমি আপনার জইন্য ওয়েট করুম। আপনারে একখান ঠিকানা জিগাইমু। আপনি সেই সুযোগে লোকটার চেহারা আর পোশাকের ডেসক্রিপশান দেবেন। তো সেইমতো আমি লোকটার দেখলাম। পরনে প্যান্ট আর সোয়েটার ছিল। মাথায় একখান মাফলার জড়ানো ছিল। মুখে খোঁচা-খোঁচা গোঁফদাড়ি। কাঁধে কাপড়ের ব্যাগ ঝুলছে। কাজেই তারে চেনার অসুবিধা হয় নাই। সে খাড়াইয়া সিগারেট টানছিল। ক্যাপটেন সিংহ হাঁটলেন। সেও হাঁটল।

হালদারমশাই একটু চুপ করে থাকার পর আবার বললেন- দেশপ্রিয় পার্কে ক্যাপটেন সিংহ কিছুক্ষণ বইয়া ছিলেন। দেখলাম, লোকটাও একটু তফাতে খাড়াইয়া আছে। তারপর ক্যান্টেন সিংহ বাড়ি ফিরলেন। তখন পাঁচটা বাজে। সবখানে আলো জ্বলছে। লোকটা ক্যাপটেন সিংহের বাড়ি পর্যন্ত ফলো কইর‍্যা আবার দেশপ্রিয় পার্কের দিকে হাঁটা দিল। তখন অরে ফলো করলাম। সে একখান বাসে চাপল। আমিও চাপলাম। শরৎ বোস রোডে একখানে সে নামল। আমিও নামলাম। তারপর সে বাঁদিকে গলিতে ঢুকল। একটু পরে আরও ছোট্ট গলি। তারপর একটা বাড়ির দরজায় কড়া নাড়ল। তত আলো ছিল না। যে তারে দরজা খুইল্যা দিল, সেই লোকটারে দেখি নাই। তবে বাড়িটা পুরানো। দোতলা। দরজা-জানালা বন্ধ।

 তিনি আবার চুপ করলে বললাম–তা আপনার আঙুল কাটল কিসে?

প্রাইভেট ডিটেকটিভ করুণ হাসলেন। একটু তফাতে পানের দোকানে গিয়া জিগাইলাম, ওই বাড়িতে কে থাকে চেনো? পানওয়ালা কইল, ক্যান? কিনবেন নাকি? হরিবাবু বাড়ি বেচবেন শুনছি। হরিবাবুর পুরা নাম সে জানে না। তারপর আমি কয়েক পা আউগগাইয়া আবার বাড়িটার কাছে গেছি, অমনি আমার কে ঝাঁপ দিল। আমি চৌত্রিশ বৎসর পুলিশে চাকরি করছি। আচমকা এমন অ্যাটাকের জইন্য সবসময় রেডি থাকি। ছিলাম।

কর্নেল চোখ বুজে চুরুট টানতে টানতে কথা শুনছিলেন। আমি বললাম-তার হাতে ছোরা ছিল নাকি?

হালদারমশাই বললেন-হঃ। ঝাঁপ দেওনের সাথে সাথে অর পায়ে হেভি কিক মারছিলাম। ড্যাগারের ডগা আমার এই আঙুলে লাগল। সেকেন্ড কিক অর পেটে মারলাম। তারপর আমার ফায়ার আর্মস তাক করলাম। হাত উঠাও। আমি পুলিশ।

হালদারমশাই খি খি করে হেসে উঠলেন। বললাম–লোকের ভিড় হয়েছিল নিশ্চয়?

গোয়েন্দাপ্রবর বললেন–এটাই আশ্চর্য! কেউ বারায় নাই। লোকটা ড্রেনে পড়ছিল। আমি দেখলাম, আমারই ভ্যানিশ হওনের দরকার। অগো ফায়ার আর্মস থাকতেই পারে। বড়ো রাস্তায় ওষুধের দোকানে আঙুলে ব্যান্ডেজ বাঁধলাম। তারপর ট্যাক্সি লইয়া কর্নেলস্যারের বাড়ি আইলাম। রাস্তায় বড্ড জ্যাম। কই ষষ্ঠীচরণ? এবারে কফি লইয়া আহো।

ষষ্ঠী ভিতরের ঘরের পর্দার ফাঁকে দাঁড়িয়ে কথা শুনছিল। আমি লক্ষ্য করিনি। দেখলাম, সে হাসিমুখে অদৃশ্য হল। টিকটিকিবাবুর দিকে সে সবসময় কেমন চোখে তাকিয়ে থাকে। হালদারমশাই চলে গেলে সে হেসে অস্থির হয়। বলে, এমন মজার মানুষ দেখা যায় না। উনি

পুলিশের অফিসার ছিলেন, তা ভাবতে গেলেই অবাক লাগে।

ষষ্ঠীচরণ কফি দিয়ে যাওয়ার পর কর্নেল চোখ খুলে বললেন–একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে। হালদারমশাই! বাড়িটা চিনেই আপনার চুপচাপ চলে আসা উচিত ছিল। ওরা এবার সতর্ক হয়ে উঠবে।

হালদারমশাই বললেন–কে জানে ক্যান এমন হইয়্যা গেল!

কর্নেল হাসলেন। –আসলে মাঝে মাঝে অ্যাকশনে নেমে ভুলে যান যে আপনি আর পুলিশ ইন্সপেকটার নন। একজন প্রাইভেট গোয়েন্দা।

-হঃ ঠিক কইছেন।

 আমি বললাম- চৌত্রিশ বছরের পুলিশজীবনের জের আর কী!

-হঃ! ওই জেরেই মাঝে মাঝে জেরবার হই। বলে হালদারমশাই প্রাণ খুলে খি খি করে হাসলেন।

কফি খাওয়ার পর তিনি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন-কর্নেলস্যার! এবার কন, আর কী করুম?

 কর্নেল বললেন–এর পর আপনাকে ছদ্মবেশে ছাড়া ওখানে যাওয়ার উপায় দেখছি না। আপনি ছদ্মবেশ ধরতে পটু। সাধু-সন্ন্যাসী বা আধপাগলা ভবঘুরে–যেটা আপনার খুশি। শুধু এটুকু আপনার জানা দরকার, ওই বাড়িতে বসে কে ক্যাপটেন সিংহের পিছনে ওই গুন্ডা লোকটাকে লাগিয়ে রেখেছে। যদি তার নাম হরিবাবু হয়, তা হলে সেই হরিবাবুর চেহারাপোশাক ইত্যাদির বর্ণনা পেলে ভালো হয়। তাই বলে সঙ্গে আমার মতো ক্যামেরা নিয়ে যাবেন না যেন। আর একটা কথা। হরিবাবু গুভা পোষে। তাই আপনার আরও সতর্ক হওয়া উচিত। হ্যাঁ–আজকের ঘটনায় বোঝা যাচ্ছে, আপনি যে ওকে ফলো করেছিলেন, তা গুন্ডাটা যেভাবে হোক, টের পেয়েছিল। এবার সে আর তার মালিক হরিবাবু দুজনেই খুব সতর্ক থাকবে।

-ঠিক! ঠিক কইছেন। বলে হালদারমশাই চলে গেলেন। ….

পরদিন সকালে লালবাজার ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের সাব-ইন্সপেকটার নরেশ ধর সাদা পোশাকে এসে হাজির। নরেশবাবু আমাদের দুজনেরই সুপরিচিত এবং কর্নেলকে অনেক কেসে সাহায্য করেছেন। নমস্কার করে উনি সোফায় বসলেন। তারপর চাপা হেসে বললেন-রাজেনদা আমাকে ঠকিয়েছিলেন। শেষে ধরে ফেললাম আমি।

 কর্নেল বললেন–তা আপনাকে দেখেই বুঝেছি। চন্দ্রপুরের ও সি রাজেন হাটি আমাকে বলেছিলেন, আপনার সঙ্গে তার আত্মীয়তার সম্পর্ক আছে। তবে আমি ওঁর একটা কেসের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছি, আপনি কেমন করে ধরলেন?

-কর্নেলসায়েব! থিয়েটার রোডের যে এলাকায় আপনারা দুজনে গিয়েছিলেন, সেখানে আমাদের একজন সোর্স আছে। তার কাছে শুনেছি, একজন সায়েব আর একজন বাঙালি ভদ্রলোক কাজিসাহেবের ডেরায় গিয়েছিলেন। চেহারার বর্ণনা শুনেই বুঝে ফেলেছিলাম, কারা গেছেন। তারপর রাজেনদা আজ সকালে ফের ফোন করেছিলেন। তখন ওঁকে চেপে ধরলাম। ব্যাস!

কর্নেল হাঁক দিলেন। -ষষ্ঠী! তোর নালবাজারের বাবুমশাইকে কফি খাইয়ে দে। আজ শীতটা টের পাচ্ছি যেন।

বললাম–নরেশবাবু! কাজিসাহেবের খবর কী তা-ই বলুন।

নরেশবাবু একটু হেসে বললেন-ওখানকার সোর্স আমাদের অনেক আগে বলেছিল, তার সন্দেহ হচ্ছে, ভদ্রলোক মুসলমান নন। সোর্স নিজে মুসলমান। তার মতে, মুসলমানদের কতকগুলো আদব-কায়দা ভাবভঙ্গি আছে। ওই ভদ্রলোকের মধ্যে তেমন কিছু নেই। তাই লোকটা সম্পর্কে পুলিশের খোঁজ-খবর নেওয়া উচিত। কিন্তু সমস্যা হল, কোনও ঘটনা না ঘটলে নিছক একজন সোর্সের কথায় ভদ্রলোকের পিছনে লাগার ঝুঁকি আছে। সোর্স ভুল করতেই পারে। অনেকসময় ভুল করেও বটে। তাই আমি এটা নিয়ে মাথা ঘামাইনি। খামোখা কাকেও জেরা করার সময় পুলিশের নেই। একটা কেস চাই। সে ছিল না। এতদিনে কেস পেলাম।

ষষ্ঠীচরণ কফি দিয়ে গেল। কর্নেল বললেন-কফি খান নরেশবাবু। কফি খেতে খেতে বলুন কাজিসাহেব কি ডানা মেলেছেন?

নরেশবাবু কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন-কর্নেলসায়েব! আজ আপনি না গিয়ে যদি আগে আমাদের একটু সুযোগ দিতেন! সেই দুঃখটা জানাতেই এসেছি!

তার মানে, আমাকে দেখার পরই কাজিসাহেব ডেরা থেকে পালিয়েছে?

–তা-ই আমার ধারণা।

-কিন্তু সে আমার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আমার জ্যাকেটের পিঠে একটা আঠামাখানো চিরকুট সেঁটে দিয়েছিল। তাতে লেখা ছিল, দ্বিতীয়বার এলেই মারা পড়ব। আমার মনে হয়েছিল, আমাকে সে ইচ্ছে করেই নিজের পরিচয় দিয়ে গেছে। এটা একটা চ্যালেঞ্জ।

স্যার! চন্দ্রপুরের শম্ভুনাথ চৌধুরি একসময় জাহাজে চাকরি করত। আমাদের রেকর্ডে দেখলাম, সে খিদিরপুর ডক এরিয়ার চোরাচালানি একটা দলের নেতা। তারপর রাজেনদা বললেন, চন্দ্রপুরে তার বাড়ি। সেখান থেকে সে বর্ডারে চোরাচালানি কারবার করে। কিন্তু তাকে এ পর্যন্ত প্রমাণাভাবে ধরা যায়নি। তাছাড়া সে বছরে গড়ে একবার মাত্র চন্দ্রপুরে যায়। নরেশবাবু ঘড়ি দেখে আবার বললেন–শম্ভু চৌধুরির আগেকার ডেরা ছিল খিদিরপুর এলাকায়। লোকটা ছদ্মবেশ ধরতে পারে। ওখান থেকে তাড়া খেয়ে গা-ঢাকা দিয়েছিল। পুলিশ তাকে খুঁজে বের করতে পারেনি। এদিকে সে কাজিসায়েব সেজে থিয়েটার রোডের একটা গলিতে নতুন ডেরায় বসে দিব্যি কারবার চালিয়ে যাচ্ছিল। আবার সে অন্য কোনও ডেরায় গিয়ে জুটেছে।

–ওর ঘর সার্চ করেছেন?

-হ্যাঁ। চন্দ্রপুরে একটা খুন করে এসেই সে সম্ভবত আপনার ভয়ে, রাতারাতি ঘরের জিনিসপত্র সরিয়ে ফেলেছিল। আমরা কিছু আসবাবপত্র দেখলাম। সবই ভাড়ার আসবাব। এক চিলতে চিহ্ন রেখে যায়নি লোকা।

কর্নেল গম্ভীর মুখে বললেন–আপনাদের ডি সি সায়েবকে এ বিষয়ে কিছু জানিয়েছেন?

নরেশবাবু হাসলেন–নাঃ স্যার! আপনার স্নেহধন্য লাহিড়িসায়েবকে জানাবার মতো কেস এটা নয়। তা ছাড়া আপনি যখন এই কেসে জড়িয়ে গেছেন, জানাতে হলে আপনিই জানাবেন।

-এখনও অরিজিৎকে জানাবার সময় হয়নি নরেশবাবু! আপনারা উড়োপাখির ডেরা খুঁজে বের করুন। পুলিশ যা পারে, তা কি আমি পারি?

-কর্নেলসায়েব! আপনি যা পারেন, তা কিন্তু পুলিশ পারে না। আপনি প্রকৃতিবিজ্ঞানী। পাখি প্রজাপতি অর্কিড ক্যাকটাসের খোঁজে আপনি কোথায়-কোথায় ঘোরেন। আপনার বাইনোকুলার আপনাকেই মানায়। পুলিশ কি বাইনোকুলারে আপনার পাখি খোঁজার মতো খুঁজলেই অপরাধীকে পেয়ে যাবে?

সরকারি গোয়েন্দা নরেশ ধর রসিক মানুষ। হাসতে হাসতে উঠে দাঁড়ালেন। কর্নেল বললেন–স্বীকার করছি নরেশবাবু! লোকটা অত ধূর্ত, তা আমি বুঝতে পারিনি। আমি আজ সকালে না গেলে হয়তো জাহাজবাবু আপনাদের হাতে ধরা পড়ত।

-না স্যার! ওটা কথার কথা হিসেবে বলেছি। জিনিসপত্র সে সরাবে বলে রেডি করেই রেখেছিল। আপনারা চলে আসবার পরই ম্যাটাডোরে সব চাপিয়ে সে চলে গেছে। আমাদের সোর্স ওই সময় পাড়ায় ছিল না। আচ্ছা, চলি।

নরেশবাবু পা বাড়িয়ে হঠাৎ ঘুরে ফের বললেন–আপনার হালদারমশাইয়ের খবর কী?

কর্নেল হাসলেন। তিনি একখান জব্বর ক্যাস পাইছেন।

 নরেশবাবু আরও এক চোট হেসে নমস্কার করে বেরিয়ে গেলেন।

কর্নেল হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বললেন-সাড়ে নটা বাজে। আমরা সাড়ে দশটা-পৌনে এগারোটা নাগাদ পৌঁছে যাব। রাস্তায় পেট্রলপাম্প আছে। ফুয়েল ভরে নেব। জয়ন্ত! ঝটপট রেডি হয়ে নাও। আমিও রেডি হচ্ছি!

অবাক হয়ে বললাম–কোথায় যাবেন?

তিতলিপুর!

–সর্বনাশ! আবার সেই সাংঘাতিক জায়গায়? হঠাৎ এ খেয়াল কেন বলুন তো?

-খেয়াল নয়, ডার্লিং! আমার মাথায় একটা থিয়োরি এসে গেছে। আজই তা যাচাই করা দরকার।

কর্নেলের এই খেয়ালি স্বভাবের সঙ্গে আমি পরিচিত। তবে আমিও তীব্র কৌতূহলী হয়ে উঠেছিলাম। তাই দ্রুত পোশাক বদলে এবং জ্যাকেটের ভিতরে আমার পয়েন্ট বাইশ ক্যালিবারের রিভলভার রেখে কর্নেলকে অনুসরণ করলাম। কর্নেলের সেই একই বেশভূষা। পিঠে আঁটা  কিটব্যাগ, গলায় ঝুলন্ত বাইনোকুলার এবং ক্যামেরা।

হাইওয়েতে জায়গায়-জায়গায় জ্যাম ছিল। তিতলিপুর পৌঁছুতে এগারোটা বেজে গিয়েছিল। দোমোহানির রাস্তায় বাঁদিকে জঙ্গল রেখে একটু পরে সেই মোরাম-বিছানো পথে এগিয়ে দীপনারায়ণবাবুর বাড়ির সামনে গাড়ি দাঁড় করালাম। গ্রামের কিছু লোকজন থমকে দাঁড়িয়ে আমাদের দেখছিল। সদর দরজায় বাঁশের বাতার বেড়া আটকানো আছে। দোতলার বারান্দা থেকে সুনয়নী আমাদের দেখে নেমে এসেছিলেন।

তিনি আমাদের নমস্কার করে ভিতরে নিয়ে গেলেন। বারান্দায় দুটো চেয়ার এনে দিল একটা লোক। সুনয়নী দেবী থামে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বললেন–আপনাকে দেখে সাহস পেলাম কর্নেলসায়েব।

কর্নেল বললেন–আমি শুধু একটা কথা জানতে এসেছি। জেনেই চলে যাব।

-বলুন!

–আচ্ছা, আপনাদের পূর্বপুরুষ জমিদার পরিবারের বড়ো তরফের বংশধর ছিলেন আপনার দাদা। আমি শুনেছি, ছোটো তরফের বংশধর নরেনবাবু। সেচ বাংলোতে সবাই বলে, নরুঠাকুর। তাহলে মেজো তরফের কোনও বংশধর নিশ্চয় আছে?

সুনয়নী শ্বাস ছেড়ে বললেন–হ্যাঁ। আছে। তবে তাকে খুব ছোটোবেলায় দেখেছি। সে কলকাতায় থাকত। জাহাজে বড়ো অফিসার ছিল, তা বড়দার কাছে শুনেছি। জাহাজিবাবু শম্ভুকে তো সে-ই জাহাজে চাকরি দিয়েছিল!

–তার নাম কি অজয়েন্দু রায়?

আমাকে অবাক করে সুনয়নী দেবী বললেন–হ্যাঁ। অজয়েন্দু নারায়ণ রায়। আমার মেজদা।

.

০৮.

 কর্নেলের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম। আন্দাজে ঢিল উনি ছোড়েন না। আমার অজ্ঞাতসারে নিশ্চয় ওঁর হাতে কোনও সূত্র এসে গিয়েছিল। কিন্তু এবার তাহলে দেখছি রহস্যটা জমজমাট হয়ে উঠল।

কথাটা বলে সুনয়নী দেবীও অবাক হয়েছেন লক্ষ্য করলাম। তিনি মৃদুস্বরে বললেন মেজদাকে আমি ছোটোবেলায় দেখেছিলাম, সে-কথা তো আপনাকে বলেছি। বড়দার কাছে অবশ্য তার অনেক কথা শুনেছি। মেজদার কথা আপনি জানতে চাইছেন। মেজদা কি

কর্নেল ওঁকে থামিয়ে দিয়ে বললেন–জাহাজে চাকরির কথা ছাড়া আর কী কথা শুনেছেন, আগে বলুন। তারপর আপনার প্রশ্নের উত্তর দেব।

সুনয়নী দেবী মুখ নামিয়ে আস্তে বললেন–বড়দা বলতেন, মেজদা আমেরিকা থেকে এক মেমসায়েবকে বিয়ে করে এনেছিল। মেমবউয়ের সঙ্গে বনিবনা হয়নি। সে মেজদাকে ছেড়ে পালিয়ে যায়।

-আর কিছু?

–আর একটা কথা শুনেছিলাম। সাংঘাতিক কথা। কথাটা বলা উচিত হবে কিনা জানি না।

 সুনয়নী দেবী একটু কুণ্ঠার সঙ্গে কথাটা বললেন। তাই কর্নেল বললেন–আপনি আপনার বড়দার খুনিকে শাস্তি দিতে চান না?

-হ্যাঁ! নিশ্চয় চাই। তবে..

–তাহলে সব কথা খুলে বলুন। আপনার ভয়ের কোনও কারণ নেই। আমি আপনার পাশে আছি।

একটু চুপ করে থাকার পর সুনয়নী বললেন–জাহাজ ডুবে মেজদা মারা গেছে বলে বড়দার কাছে খবর এসেছিল। বড়দা তখন কলকাতায় ছিলেন। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার, এক রাত্রে মেজদা গোপনে বড়দার কাছে এসেছিল। তার কিছু জিনিসপত্তর রেখে গিয়েছিল। বড়দা পরে আমাকে বলেছিলেন, পুলিশ তাকে খুঁজছে! বড়দা রাগি লোক ছিলেন। বলেছিলেন, অজু আমাদের রায়বংশের কলঙ্ক। আর

-হ্যাঁ। বলুন। আপনার ভয়ের কারণ নেই।

-আর জাহাজিৰাবু, মানে চন্দ্রপুরের শম্ভু চৌধুরি যখনই গ্রামে আসত, তখনই বড়দার সঙ্গে প্রায়ই আড্ডা দিত। গতবছর এমনই শীতের এক রাত্রে বড়দার সঙ্গে জাহাজিবাবু চুপিচুপি মেজদা সম্পর্কে কী সব কথা বলছিল। আমি স্পষ্ট কিছু বুঝতে পারিনি।

–আপনি আপনার বড়দার কাছে এ বিষয়ে কিছু জানতে চাননি?

–চেয়েছিলাম। কিন্তু বড়দা রেগে গিয়েছিলেন। আমাকে নাকগলাতে নিষেধ করেছিলেন।

–সেই কথাবার্তার মধ্যে এমন কি কিছু আপনি শুনেছিলেন, যা আপনার মনে পড়ে?

 সুনয়নী দেবী আবার মুখ নামিয়ে আঙুল খুঁটতে থাকলেন। একটু পরে বললেন-জাহাজিবাবু বড়দাকে বলছিল, অজুর লুকিয়ে রাখা জিনিসটার বড়দা যেন তাকে দেয়। তার বদলে জাহাজবাবু বড়দাকে টাকা দেবে।

-হঁ। আর কিছু?

সুনয়নী মাথা নাড়লেন। –আর তেমন কিছু মনে পড়ছে না। ওই যে বললাম, বড়দা খুব রাগি মানুষ ছিলেন। কিছু জানতে চাইলে খাপ্পা হয়ে বেরিয়ে যেতেন।

কর্নেল নিভে যাওয়া চুরুট জ্বেলে বললেন-এবার আপনার প্রশ্নের উত্তর দিই। আপনি দীপনারায়ণবাবুর লেখা যে পোস্টকার্ডটা আমাকে দেখিয়েছেন, ওতে আপনার মেজদা সম্পর্কে একটা লাইন আছে। অজু তোমার কাছে যেতে পারে। তাকে পাত্তা দেবে না। এই অজু কে, সেই নিয়ে ধাঁধায় পড়েছিলাম। আপনার কথা শুনে ধাঁধার জট খুলে গেল। আপনাকে ধন্যবাদ। এবার চলি।

কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। সুনয়নী চাপা স্বরে বললেন-মেজদাকে কেন পুলিশ খুঁজছে, দয়া করে আমাকে বলে যান কর্নেলসায়েব!

উঠোনে হাঁটতে হাঁটতে কর্নেল বললেন–ঠিক সময়ে সব জানতে পারবেন। আর একটা কথা, আপনি একটু সাবধানে থাকবেন। আমি চন্দ্রপুর থানায় বলে দেব। সাদা পোশাকে অন্তত দুজন পুলিশ আপনার বাড়িতে আপনাদের দুরসম্পর্কের আত্মীয় হিসেবে থাকবে।

-কেন একথা বলছেন?

–জাহাজিবাবু আর তার লোকেরা আপনার বড়দার ঘরে হামলা করতে পারে। কিন্তু–আপনি একটুও ভয় পাবেন না।

 এবার সুনয়নী শক্ত মুখে বললেন-কর্নেলসায়েব! আমি জীবনকে অনেক দুঃখকষ্ট পেয়েছি। অনেক ঝড়ঝাপটা সামলেছি। এখন আমি মরিয়া। তা ছাড়া তিতলিপুরের রায়বংশের রক্ত আমার শরীরে আছে। রায়বাঘিনি কথাটা জানেন তো?

কর্নেল হাসলেন। -জানি। তবু আপনি সাবধানে থাকবেন। …

কলকাতা ফেরার পথে কর্নেলকে জিজ্ঞেস করেছিলাম–তাহলে একটা পুরোনো পোস্টাকার্ড থেকে আপনি অজয়েন্দুবাবুর সূত্র খুঁজে পেয়েছিলেন?

কর্নেল বাইনোকুলার চোখে রেখে বললেন–হুঁ।

-কর্নেল?

–বলো?

–সেই লাল মারুতিটা আমাদের ফলো করে আসেনি কিন্তু। এলে টের পেতাম।

কর্নেল আমাকে ভয় পাইয়ে দিয়ে বললেন–এসেছিল। কিন্তু খুব দুর থেকে ফলো করেছিল। এই বাইনোকুলারে যা দেখা যায়, তোমার চর্মচক্ষুতে তা দেখা যায় না।

–সর্বনাশ! এখনও কি গাড়িটা আমাদের ফলো করে আসছে?

-না। মন্দিরের কাছে হাইওয়েতে তোমার গাড়ি বাঁক নেওয়ার সময় গাড়িটা উলটোদিকে উধাও হয়ে গেছে। সম্ভবত চন্দ্রপুরে জাহাজিবাবুর কাছে গেছে।

গাড়িটা তাহলে চন্দ্রপুরের জাহাজবাবুর?

–এ বিষয়ে আমি এখনও শিয়োর নই, জয়ন্ত।

–তাহলে যে বলছেন চন্দ্রপুরে জাহাজবাবুর কাছে গেছে?

–আমি সম্ভবত বলেছি। শিয়োর নই। …

কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্টে ফিরতে পৌনে একটা বেজে গিয়েছিল। ষষ্ঠীচরণ মুচকি হেসে বলেছিল–একটু আগে টিকটিকিবাবু ফোন করেছিলেন। আবার ফোন করবেন বাবামশাইকে।

কর্নেল চোখ কটমটিয়ে বলেছিলেন–আমাদের খিদে পেয়েছে।

-সব রেডি বাবামশাই!

কর্নেল শীতকালে সপ্তাহে মাত্র একদিন স্নান করেন। আজ তার স্নানের দিন নয়। আমি গরমজলে স্নান করে শরীরটা ঝরঝরে তাজা করে নিলাম। দেড়টা নাগাদ খাওয়াদাওয়ার পর যথারীতি ডিভানে চিত হয়ে ভাতঘুমের জন্য প্রস্তুত হলাম। কর্নেল ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজে চরুট টানছিলেন।

কিন্তু টেলিফোনের বিরক্তিকর শব্দে আমার ঘুমের রেশ ছিঁড়ে গেল।

কর্নেল রিসিভার তুলে সাড়া দিয়ে বললেন-বলুন হালদারমশাই!..কিন্তু আপনি কোথা থেকে ফোন করেছেন?..বাড়ি থেকে তার মানে…আশ্চর্য! বলেন কী! সুশীলা..হা আপনার অনুমান তাহলে সত্যি? তারপর? ..হুঁ..হুঁ..হুঁ ঠিক আছে। আপনি আপনার ক্লায়েন্ট ক্যাপটেন সিংহকে এখনই কথাটা জানাবেন না। …হ্যাঁ। আপনি এখনই আমার কাছে চলে আসুন। …আহা! চর্মচক্ষে দিনের বেলায় হরির দর্শন পেয়েছেন। আপনি ভাগ্যবান। ..রাখছি। চলে আসুন।

কর্নেল রিসিভার রেখে আমার দিকে ঘুরলেন। বললাম–আমার ভাতঘুম আজ আর বরাতে নেই। কিন্তু গোয়েন্দাপ্রবর সাংঘাতিক কিছু খবর আপনাকে জানিয়ে দিলেন মনে হচ্ছে। ঘুমের জন্য তাই আমার দুঃখু নেই। কিন্তু সুশীলা-র ব্যাপারটা কী? ক্যাপটেন সিংহের পরিচারিকা

কর্নেল আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন-ঘুম না আসে, চোখ বুজে ভেড়ার পালের ভেড়াগুলো শুনতে থাকো। আমি ততক্ষণ চুরুটের সুখ উপভোগ করি। নো মোর টক। …

কতক্ষণ পরে ডোরবেল বাজল। কর্নেল হাঁক দিলেন-ষষ্ঠী!

তারপর সবেগে গোয়েন্দাপ্রবর কে কে হালদার ঘরে ঢুকলেন। দেখলাম, তার মুখে প্রসন্ন হাসি। পরনে প্যান্ট-শার্ট-সোয়েটার। ছদ্মবেশ ছেড়ে স্নান করেছেন, তা-ও বোঝা যাচ্ছিল। সোফায় বসে আগে একটিপ নস্যি নিলেন। তারপর বললেন-কর্নেল স্যার কইছিলেন হরির দর্শন পাইছি। হঃ! তা পাইছি।

কর্নেল বললেন এবং ক্যাপটেন সিংহের কাজের মেয়ে সুশীলারও?

-হঃ। ঠিক কইছেন!

–কার দর্শন কোথায় পেলেন?

–ফোনে কওন যায় না। এখন কইয়া ফেলি। আমি পাগলা সাজছিলাম। সেই গলির অন্যদিকে বটতলায় একখান মন্দির আছে। সেইখানে বইয়া ছিলাম। হঠাৎ দেখি, সুশীলা আইয়া হরিবাবুর বাড়িতে ঢুকল। তারপর সেই লোকটা–যে ক্যাপটেন সিংহরে ফলো করে, সে বারাইল। কিছুক্ষণ পরে সে একখান ট্যাক্সি আনল। এইবার বাড়ি থেইক্যা যিনি বারাইলেন, তিনিই যে হরিবাবু তা বুঝলাম। ক্যান কী, গলিতে এক ভদ্রলোকে তারে নমস্কার কইরা কইল–এই যে হরিবাবু! কেমন আছেন? হরিবাবু ট্যাক্সিতে চাপল। তার লগে সুশীলাও চাপল। ট্যাক্সিখান যাওয়ার পর সেই ভদ্রলোক হরিবাবুর লোকেরে জিগাইলেন, তোমার বাবু বাড়ি বেচবেন শুনলাম? নোকটা কী একটা কইল, বুঝলাম না। সে বাড়ি ঢুকল। আমিও উঠলাম। ট্যাক্সির নাম্বার দেখছিলাম। পরে নোটবইয়ে টুকছি। কে কইল দেখি নাই–পাগলা লেখাপড়া জানে! আর একজন হাসতাছিল সেয়ানা পাগল! এইসব শুইন্যা আমি কাট করলাম।

কর্নেল গম্ভীর মুখে শুনছিলেন। এতক্ষণে বললেন-হরিবাবুর চেহারা কেমন?

–দেইখ্যা বুড়া মনে হইব। কিন্তু বুড়া না। তাগড়া শরীর। মাথায় সাদা চুল। গোঁফ আছে। গোঁফ কাঁচাপাকা। পরনে ধুতি, সার্জের খয়েরি রঙের পাঞ্জাবি। কাঁধে শাল ছিল। হাতে ছড়ি ছিল। আর একখানা ব্রিফকেস।

আমি বলে উঠলাম–তাহলে এই হরিবাবু কখনই চন্দ্রপুরের জাজিবাবু নয়। হালদারমশাই আমার দিকে ঘুরে কী বলতে যাচ্ছিলেন। কর্নেল চোখ কটমটিয়ে আমাকে বললেন–উঠে পড়ো জয়ন্ত! শুয়ে কথা বলে রোগীরা। উঠে বোসো।

তারপর তিনি হালদারমশাইকে বললেন–আপনি কি সুশীলার বাড়ির ঠিকানা জানেন?

হালদারমশাই সোয়েটারের গলার ভিতর হাত ঢুকিয়ে শার্টের পকেট থেকে একটা ছোট্ট নোটবই বের করলেন। পাতা ওলটাতে ওলটাতে বললেন-ক্যাপটেন সিংহর লগে ঠিকানা লইছিলাম। উনি সুশীলারে বিশ্বাস করেন। কইছিলেন, মাইয়াটারে ওনার দেশের বাড়ি থেইক্যা আনছিলেন।

–ক্যাপটেন সিংহের তাহলে গ্রামে বাড়ি ছিল?

–হঃ।

–আপনি এ কথাটা আমাকে তো বলেননি।

গোয়েন্দাপ্রবর অবাক হয়ে বললেন–আপনি জিগান নাই। জিগাইলে কইতাম।

-ক্যাপটেন সিংহের দেশের বাড়ি কোথায়, তা কি জিজ্ঞেস করেছিলেন?

–না। আপনি যখন কইতাছেন, তখন এবার জিগাইমু।

–দেরি করা ঠিক হবে না হালদারমশাই। আপনি বরং এখান থেকে ফোনে ক্যাপটেন সিংহের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। ওঁর ফোনে আড়ি পেতেছে কেউ, সে-কথা উনি আমাকে জানিয়েছেন। তাই না?

-হঃ।

–তাহলে ফোনে ওঁকে শুধু বলুন, আপনি ওঁর সঙ্গে জরুরি কাজে দেখা করতে যাচ্ছেন।

গোয়েন্দাপ্রবর তখনই রিসিভার তুলে ডায়াল করলেন। তারপর বললেন–রিং হইতাছে। কেউ ধরতাছে না ক্যান? আমি যাইয়া দেখি বরং। মিসটিরিয়াস ব্যাপার।

বলে উনি যথারীতি সবেগে বেরিয়ে যাওযার পর কর্নেল জাপানি ওয়ালকুকে সময় দেখে নিলেন। তারপর বললেন–শিপ কর্পোরেশনের ম্যানেজিং ডাইরেক্টর মি. অসীম সোম এখনও সম্ভবত অজয়েন্দ্র রায়ের ব্যাপারে কোনও রেকর্ড খুঁজে পাননি। অথচ খুব শিগগির আমার ওটা দরকার।

বললাম–সুনয়নী দেবী বলছিলেন, ওঁর মেজদা পুলিশের ভয়ে গা-ঢাকা দিয়ে বেড়াচ্ছিলেন। এদিকে ক্যাপটেন সিংহ বলেছেন, জাহাজডুবির আগে উনি একটা গোপন জিনিস তার কাছে লুকিয়ে রাখতে দিয়েছিলেন।

–হ্যাঁ। ক্যাপটেন সিংহ রিটায়ার করার পর সেই গোপন জিনিসটা নাকি বিছানার তলায় রেখেছিলেন। তা ছাড়া সেই জিনিসটা যে কী, তা কি ক্যাপটেন সিংহের জানবার কৌতূহল হয়নি? জয়ন্ত! ক্যাপটেন সিংহের কথাটা বড্ড গোলমেলে।

একটু উত্তেজিত হয়ে বললাম-কর্নেল! জিনিসটা জাহাজিবাবু চুরি করেছিলেন–এটা আপনারই সিদ্ধান্ত। তাহলে জিনিসটা একটা নলে রাখা পার্চমেন্ট! আপনি সেটা তিতলিপুরের জঙ্গল থেকে উদ্ধার করেছেন।

কর্নেল হাসলেন। চোরের ওপর বাটপাড়ি করেছি। কিন্তু ক্যাপটেন সিংহ যে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা হালদারমশাইকে জানাননি, এটাই আশ্চর্য!

–আমার মতে, যে-ভাবে হোক, ক্যাপটেন সিংহের সঙ্গে আপনার দেখা করা উচিত।

–দেখা যাক।

বলে কর্নেল ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে ধ্যানস্থ হলেন। আমার ভাতঘুম কেটে গেছে। আমি উঠে গিয়ে সোফায় বসলাম। শীতের দিনের আলো কমে এসেছে। একটু পরে ষষ্ঠীচরণ কফি রেখে। গেল। কর্নেল চোখ খুলে সোজা হয়ে বসলেন। তারপর কফিতে চুমুক দিলেন। মুখে অস্বাভাবিক গাম্ভীর্য। তাই আমিও গম্ভীর হয়ে কফি খেতে থাকলাম।

কফিপানের পর কর্নেল চুরুট ধরিয়ে আমার দিকে তাকালেন। দেখলাম, সেই বিকট গাম্ভীর্যটা আর নেই। মুখে একটু হাসি ফুটেছে। বললেন–ডার্লিং! ভাতঘুম নষ্ট করেছি এবং একটু বকে দিয়েছি বলে এই বৃদ্ধের প্রতি তোমার ক্ষোভ হওয়া স্বাভাবিক।

 হেসে ফেললাম। –মোটও না। আপনি তুম্বো মুখ করে থাকলে অস্বস্তি হয়।

-আমি ক্যাপটেন সিংহের পরিচারিকা সুশীলার ব্যাপারটা ভাবছিলাম। মেয়েটি জাহাজিবাবু। শঙ্কু চৌধুরির চর বলে হালদারমশাইয়ের অনুমান। অনুমানটা সম্ভবত ঠিকই। কিন্তু সেই মেয়ে আজ হরিবাবুর বাড়ি এসে ট্যাক্সি চেপে হরিবাবুর সঙ্গে কোথাও বেরিয়েছে। তাহলে হরিবাবুর সঙ্গে জাহাজিবাবুর সম্পর্ক আছে বলে ধরে নেওয়া যায়। তাই না?

–অঙ্ক কষলে তা-ই দাঁড়াচ্ছে বটে! কিন্তু কে এই হরিবাবু?

–সঠিক প্রশ্ন।

–তার মানে, আমরা তিতলিপুরের জঙ্গলে পথ হারিয়ে হন্যে হচ্ছি।

কর্নেল তার বিখ্যাত অট্টহাসিটি হাসলেন। তারপর বললেন–ঠিক বলেছ। তিতলিপুরের জঙ্গলে দুর্লভ প্রজাতির নীল সারসের চেয়ে আরও দুর্লভ কিছু আছে।

অবাক হয়ে বললাম–তার মানে?

এইসময় টেলিফোন বেজে উঠল। কর্নেল রিসিভার তুলে সাড়া দিলেন। –বলছি! বলুন নরেশবাবু!..ধন্যবাদ! চন্দ্রপুরের ও সিমি. রাজেন্দ্র হাটি বুদ্ধিমান!…হ্যাঁ। দীপনারায়ণবাবুর ঘরে নিশ্চয় কিছু সূত্র পাওয়া যেতেই পারে। ..ঠিক আছে। রাখছি।

কর্নেল রিসিভার রেখে আবার আমার দিকে সহাস্যে তাকালেন। বললাম–সুনয়নী দেবীর বাড়িতে সাদা পুলিশের গার্ড রাখবার কথা বলেছিলেন। সেই ব্যাপারটা কি?

-ঠিক ধরেছ।

–কিন্তু কখন লালবাজারের ডিটেকটিভ সাব-ইনপেকটার নরেশবাবুকে ফোন করেছিলেন?

 –তুমি যখন বাথরুমে স্নান করছিলে!

-একটু আগে আপনি বললেন, তিতলিপুরের জঙ্গলে নাকি আরও দুর্লভ কিছু আছে। ব্যাপারটা কী?

কর্নেলের কাছে এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার আগে আবার বাধা পড়ল। ডোরবেল বাজল এবং কর্নেল হাঁক দিলেন-ষষ্ঠী!  

 তারপর প্রাইভেট ডিটেকটিভ কে কে হালদার আবার সবেগে প্রবেশ করে সোফায় সশব্দে বসলেন। বললেন-হেভি মিস্ট্রি কর্নেলস্যার!

কর্নেল বললেন-বলুন হালদারমশাই!

এবার হালদারমশাই উত্তেজিতভাবে যা বললেন, তার সারমর্ম এই : গোয়েন্দাপ্রবর ক্যাপটেন সিংহের বাড়ি গিয়ে দেখেন, তার দোতলার ঘরের দরজা এবং কোলাপসি গেটে তালা আঁটা। একতলার মুদির দোকানের মালিক মিছরিলালকে তিনি ক্যাপটেন সিংহের কথা জিজ্ঞেস করেন। মিছরিলাল তাকে বলেছে, ক্যাপটেনসায়েবের হঠাৎ স্ট্রোক হয়েছিল। সুশীলা ট্যাক্সিতে একজন ডাক্তারবাবুকে ডেকে এনেছিল। সেই ট্যাক্সিতে অজ্ঞান অবস্থায় ক্যাপটেনসায়েবকে কোনো নার্সিং হোম কিংবা হাসপাতালে নিয়ে গেছে। মিছরিলালকে সুশীলা ডেকেছিল। মিছরিলাল একা একশো। সে ক্যাপটেনসাহেবকে সিঁড়ি দিয়ে বয়ে এনে ট্যাক্সিতে ঢুকিয়েছিল। সুশীলা পিছনের সিটে ক্যাপটেনসায়েবকে ধরে বসে ছিল। সামনের সিটে বসেছিলেন ডাক্তারবাবু।

সবটা শোনার পর আমি বললাম–কিন্তু হেভি মিস্ট্রি বলছেন কেন হালদারমশাই?

প্রাইভেট ডিটেকটিভ শ্বাসপ্রশ্বাসের মধ্যে বললেন–বুঝলেন না? হরিবাবু তো ডাক্তার না। তারে ডাকতে অত দূর থেইক্যা সুশীলা আইবে ক্যান? ক্যাপটেন সিংহরে কিডন্যাপ করছে হরিবাবু।

দেখলাম, কর্নেল রিসিভার তুলে ডায়াল করে কাকে চাপাস্বরে কিছু বলছেন। হালদারমশাই একটিপ নস্যি নিয়ে বললেন–ট্যাক্সির নম্বর লইছি। পুলিশেরে কর্নেলস্যার নম্বরটা জানাবেন। তারে ধরলে মিস্ট্রি সম্ভ হওনের কথা। …

.

০৯.

রিসিভার রেখে কর্নেল বললেন–জয়ন্ত! পোশাক বদলে নাও। এখনই বেরুতে হবে। আমিও রেডি হয়ে নিই।

তখনই উঠে পড়লুম। যে ঘরে আমার ডেরা, সেখানে গিয়ে পোশাক বদলে নিলাম। জ্যাকেটের ভেতর-পকেটে গুলিভরা রিভলভারটাও সাবধানে রাখলাম।

ড্রয়িংরুমে গিয়ে দেখি, হালদারমশাই বিরসবদনে বসে আছেন। কিন্তু গোঁফের ডগার কাপন দেখে বোঝা যাচ্ছে, উনি প্রচণ্ড উত্তেজিত। আমাকে দেখে বললেন–প্রব্লেম হইল গিয়া, তখন আমি পাগলার বেশ ধরছি। সেই ট্যাক্সিটারে ফলো করবার উপায় ছিল না। বড়ো রাস্তায় ট্যাক্সি পাইতাম। কিন্তু পাগলেরে কোনো ট্যাক্সিড্রাইভার পাত্তা দিত, কন জয়ন্তবাবু?

বললাম–ঠিক বলেছেন। আপনার কিছু করার ছিল না।

–ছিল। একটুকখান উপায় ছিল। আমারই ভুল।

–কীসের ভুল?

–বাড়ি ফিরিয়্যাই ক্যাপটেন সিংহরে ফোন করা উচিত ছিল আমার। সাড়া নিশ্চয় পাইতাম না। কাজেই সোজা ওনার বাড়ি যাওয়াই উচিত ছিল। গোয়েন্দাপ্রবর শ্বাস ছেড়ে ফের বললেন–তা না কইরা স্নান করছিলাম। খাওয়ায় মন দিছিলাম। তারপর কর্নেলস্যারেরে ফোন করছিলাম। ক্যান যে এমন মতিভ্রম হইল কে জানে? চৌতিরিশ বৎসর পুলিশে চাকরি করছি। এমন ভুল কখনও হয় নাই।

কর্নেল সেজেগুজে বেরিয়ে এলেন। বললেন–আপনি ভুল করেননি হালদারমশাই! আপনি ঘুড়ির সুতো ঢিলে করে দিয়েছেন। ক্যাপটেন সিংহকে কিডন্যাপ করার যথেচ্ছ সুযোগ পেয়েছে হরিবাবু। এর ফলে বরং আমাদেরই সুবিধে হয়েছে। চলুন। বেরুনো যাক। ষষ্ঠী! দরজা বন্ধ কর। কোনও ফোন এলে বলবি, আমি বেরিয়েছি। কখন ফিরব, কিছু ঠিক নেই। …

গাড়ির পিছনের সিটে হালদারমশাই আর কর্নেল বসলেন। দু-পাশের জানালার কাচ তুলে দিলেন কর্নেল। বুঝলাম, উনি সারাপথ আত্মগোপন করে থাকতে চান। বড়ো রাস্তায় পৌঁছে আমার অস্বস্তি ফিরে এল। ব্যাকভিউ মিররে লক্ষ্য রাখলাম, কোনও লাল মারুতি আমাদের অনুসরণ করছে। কি না।

কর্নেল নির্দেশে ড্রাইভ করছিলাম। রাস্তায় লাল মারুতি পিছনে বা সামনে মাঝে মাঝে দেখা যাচ্ছে। একবার ভাবলাম, অস্ত্রটা বাঁ পাশে সিটের ওপর ফেলে রাখি। কিন্তু কার্নেল কী বলবেন ভেবে তা করলাম না। শীতের বিকেল দ্রুত রং হারিয়ে ফেলছে। ল্যান্সডাউন রোডের মোড়ে জ্যামে কিছুক্ষণের জন্য আটকে গেলাম। তারপর ক্রমশ রাস্তার দু-ধারে আলো জ্বলে উঠল।

পিছনে কর্নেলকে বলতে শুনলাম–সেই গলিটা চিনতে পারবেন তো?

হালদারমশাই বললেন–পারব। মুখস্থ হইয়া গেছে। এখনও কিছুটা দুর আছে। হাজরা রোড পার হইয়া।

কর্নেল একটু ঝুঁকে আমার প্রায় কানের কাছে বললেন-হাজরা রোডের মোড়ে গাড়ি একটু সময় দাঁড় করাবে। ওখানে লালবাজার থেকে ডিটেকটিভ এস আই নরেশ ধরের জিপ আর বালিগঞ্জ থানার পুলিশের গাড়ি অপেক্ষা করার কথা। বরং স্পিড কমিয়ে বাঁদিকে ঘেঁষে চলল।

একটু হেসে বললাম–আপনার বাইনোকুলার আনা উচিত ছিল।

কর্নেল কিছু বললেন না। হালদারমশাই বললেন–কী যে কন জয়ন্তবাবু! চারিদিকে আলোর প্রচণ্ড ছটা। বাইনোকুলারের কাম না।

মিনিট দশেক পরে দেখতে পেলাম, হাজরা রোডের মোড়ের এদিকে ফুটপাত ঘেঁষে পুলিশের। একটা জিপ আর একটা কালো ভ্যান দাঁড়িয়ে আছে। নরেশবাবু জিপের পাশে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছেন। আমার ফিয়াট গাড়ির নম্বর ওঁর জানা।

 কাছাকাছি গিয়ে একবার হর্ন বাজালাম। নরেশবাবু তাকালেন। তারপর হাতের মৃদু ইশারায় এগিয়ে যেতে বললেন। একটু পরে গ্রিন সিগন্যাল পেয়ে এগিয়ে চললাম। ব্যাকভিউ মিররে লক্ষ্য করলাম, নরেশবাবুর বাহিনী একটু দূর থেকে আমাদের অনুসরণ করছে।

মিনিট পাঁচেক পরে হালদারমশাই চাপাস্বরে বললেন-সামনে বাঁদিকের গলি জয়ন্তবাবু!

গলিটা সংকীর্ণ। দুটো গাড়ি যাতায়াত করতে পারে। রিশ, ঠ্যালাগাড়ি, মানুষজনের ভিড় পেরিয়ে হালদারমশাইয়ের নির্দেশে আবার বাঁদিকে ঘুরলাম। কর্নেল বললেন-জয়ন্ত! গাড়িটা ওই বটতলার মন্দিরের কাছে রাখো।

এই গলিতে তত আলো নেই। দুধারে ঠাসাঠাসি উঁচু বাড়ি। ফুটপাত বলতে কিছু নেই। তবে এখানে তত ভিড় নেই। শুধু মন্দিরের চত্বরে বসে বিহারের দেহাতি লোকেরা ঢোল কত্তাল তুমুল বাজিয়ে ধর্মসঙ্গীত গাইছে। পাঁচটা বাজতেই এখন রাতের ছায়া। সেই ছায়াকে অবশ্য দুধারের বাড়ির জানালা থেকে আসা আলোর ছটা এলোমেলো করে ফেলেছে। গলিটা ভূতুড়ে দেখাচ্ছে। পথচারীদের কোনও কৌতূহল এখুন লক্ষ্য করছিলাম না।

বেরিয়ে গাড়ি লক করে দেখলাম, কর্নেলও হালদারমশাই একটা বাড়ির দরজার সামনে পৌঁছে গেছেন। তাদের একটু তফাতে পুলিশের গাড়ি দুটো দাঁড়িয়ে আছে। শুধু নরেশবাবু জিপ থেকে বেরিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। এটাই তা হলে সেই হরিবাবুর বাড়ি? বাড়িটা দোতলা। একপাশে দরজা বা গেট। দোতলা বা একতলায় কোনও আলো নেই। কর্নেল চাপা স্বরে বললেন–হালদারমশাই! ব্যাড লাক। দরজার বাইরে তালা আঁটা।

হালদারমশাই উত্তেজিতভাবে বললেন-মাগো পুলিশ হেল্প করুক। তালা ভাইঙ্গা বাড়ি সার্চ করুম! আপনি নরেশবাবুরে ডাকেন।

নরেশবাবু ততক্ষণে এসে গেছেন। একটু হেসে বললেন–ব্ল্যাংক সার্চ ওয়ারেন্ট এনেছি। নাম, বাড়ির নাম্বার, গলির নাম বসিয়ে নিলেই চলবে। তবে আপাতত তার দরকার দেখছি না। তালা ভেঙেই ঢুকতে হবে।

পুলিশভ্যান থেকে একজন উর্দিপরা অফিসার এবং সশস্ত্র কনস্টেবল বাহিনী ডেকে আনলেন নরেশবাবু। এবার পথচারীরা থমকে দাঁড়াচ্ছে দেখতে পেলাম। নরেশবাবুর জিপ থেকে সাদা পোশাকের পাঁচজন পুলিশ নেমে এল। তাদের হাতে বেঁটে লাঠি। তারা ভিড় হটাতে ব্যস্ত হল। দু-পাশের বাড়ির জানালা আর ব্যালকনি থেকে লোকেরা ব্যাপারটা দেখছে।

এক ভদ্রলোক নরেশবাবুকে জিজ্ঞেস করলেন-হরিবাবুকে খুঁজছেন কি?

-হ্যাঁ। আপনি কে?

আজ্ঞে স্যার, আমার নাম অমরেন্দ্র বিশ্বাস। পাশের বাড়িটা আমার।

–তা হলে তো হরিবাবুকে আপনি চেনেন?

–চিনি মানে, তত কিছু না। উনি বেরোন কদাচিৎ। ওঁর সারভ্যান্ট ভগতকেও একটু-আধটু চিনি। হরিবাবু বাড়ি বেচে চলে যাবেন শুনেছি। প্রায়ই খদ্দের আসে দেখেছি। কী জানি কী ব্যাপার বুঝি না। তা স্যার আপনারা…

নরেশবাবু এবার পুলিশি মেজাজে বললেন-বাড়ির পাশে একজন ক্রিমিন্যাল থাকত। আর আপনারা কিছু টের পেতেন না?

অমরেন্দ্র বিশ্বাস করজোড়ে বললেন–আমি ছাপোষা মানুষ স্যার! কী করে জানব পাড়ার কোন লোক ক্রিমিন্যাল?

-হরিবাবু তালা এঁটে কখন কেটে পড়েছে, জানেন?

 ভদ্রলোক বললেন-না স্যার! আমি লক্ষ্য করিনি কিছু। অফিস থেকে ফিরে একটা নার্সিং হোমে গিয়েছিলাম। আমার ভগ্নীপতির হার্টের অসুখ। সেখান থেকে আসছি।

অন্য এক ভদ্রলোক একটু তফাতে পানের দোকানের কাছে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি এগিয়ে এসে সহাস্যে বললেন-হরিবাবুকে অ্যারেস্ট করতে এসেছেন তো? একদিন আপনারা আসবেন, তা জানতাম।

নরেশবাবু বললেন–আপনি কে? কোথায় থাকেন?

–আজ্ঞে, আমি অ্যাডভোকেট নরেন্দ্রকুমার সেনের ক্লার্ক পরিতোষ মণ্ডল। আমার স্যারেরও হরিবাবু সম্পর্কে সন্দেহ ছিল। বাড়িটা এক বিধবা মহিলার। বছর সাত আট আগে তার কাছে হরিবাবু কিনেছিল, পুরো টাকা দেয়নি। আমার স্যার সেই মহিলাকে হেল্প করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু হরিবাবুর হাতে অনেক গুণ্ডামস্তান আছে। আজকাল কী অবস্থা হয়েছে তা তো আপনাদের চেয়ে বেশি কে বুঝবে স্যার? হ্যাঁ! তালা ভেঙে সার্চ করুন আপনারা। পাড়ার লোকরা খুশি হবে স্যার। লোকটা চোরাকারবারি বলে গুজব রটে গেছে।

কিছুক্ষণ পরে দুজন কনস্টেবল একটা ছোট্ট লোহার রডের সাহায্যে তালাটা ভেঙে ফেলল। বুঝলাম, এ-কাজে দুজনেই বেশ দক্ষ। এইসমর হালদারমশাই চাপাস্বরে নরেশবাবুকে বললেন পিছনের দিকে বাড়ির কোনও দরজা আছে কিনা কে জানে!

নরেশবাবু একটু হেসে বললেন–ভাববেন না মি. হালদার! আমাদের লোকজনের সেদিকেও নজর আছে।

দরজার ভিতরে সংকীর্ণ একটা করিডর। বাঁদিকে একটা তিনতলা বানি। জানালায়-জানালায় অজস্র মুখ দেখতে পাচ্ছিলাম। ডান দিকে হরিবাবুর বাড়ি এবং নিচের তলায় একটা দরজা। সেই দরজাতেও তালা আঁটা ছিল। তালা ভেঙে একটা ঘরে ঢুকে নরেশবাবু সুইচ টিপে আলো জ্বেলে দিলেন। পুরোনো সোফাসেট, জীর্ণ একটা চেয়ার আর টেবিল। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার, এ ছাড়া ঘরটাতে কিছুই নেই। এই ঘরের কোণ থেকে দোতলার সিঁড়ি উঠে গেছে। কর্নেল নিচের তলার পাশের ঘরে উঁকি দিয়ে বললেন, -এই ঘরে ভগত থাকে মনে হচ্ছে।

একটা খাটিয়া। মশারি ঝুলছে দেয়ালের কোণে। বিছানা ছাড়া কেরোসিন কুকার, অ্যালুমিনি য়ামের হাঁড়ি, ঘটি আর বাসন-কোসন ছত্রখান হয়ে পড়ে আছে। কর্নেল বিছানা তুলে দেখলেন। তলায় কিছু নেই।

দোতলাতেও দুটো ঘর। প্রথম ঘরটার দরজার তালা ভাঙতে হল। এই ঘরে ভগতের খাটের মতোই খাট ছাড়া আর কোনও জিনিস নেই। পাশের ঘরের দরজা ভেজানো ছিল। সুইচ টিপে আলো জ্বেলে দিলেন নরেশবাবু। একটা সেকেলে খাটে বিছানা পাতা আছে। দেয়ালে ক্যালেন্ডার ঝুলছে। একটা মাত্র কাঠের আলমারিতে অগোছাল বই ঠাসা। সব বই ধর্মসংক্রান্ত। পুবের জানালার ওপরে একটা তাকে সিদ্ধিদাতা গণেশের সিঁদুররাঙা মূর্তি। কিছু শুকনো ফুল পড়ে আছে।

প্রথমে পুলিশি ধরনে সার্চ শুরু হল। কর্নেল খাটের তলায় উঁকি দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। মুচকি হেসে বললেন–হালদারমশাই! হরিবাবু মনে হচ্ছে শুধু ব্রিফকেস আর ছড়ি নিয়ে কেটে পড়েছে। এমন কিছু রেখে যায়নি, যাতে তাকে খুঁজে বের করার সুত্র পাওয়া যায়।

বালিগঞ্জ থানার অফিসার নরেশবাবুকে বললেন–আমার ধারণা, হরিবাবু এখানে মাঝে মাঝে এসে থাকত। স্থায়ীভাবে কেউ এ-বাড়িতে বসবাস করলে আরও আসবাব বা জিনিসপত্র পাওয়া যেত।

বিছানার ওপর চাদরটা তত পরিষ্কার নয়। বালিশ দুটোও যেমন-তেমন। তলার পুরোনোনা তোশক নিচে ফেলে দুজন কনস্টেবল নারকেল ছোবড়ার গদি টেনে এনে একপাশে নামাল। নরেশবাবু বালিশ, তোশক আর গদি খোঁজাখুঁজি করে হাসলেন। লোকটা যে-ই হোক, খুব ধুরন্ধর। নিজের এতটুকু চিহ্ন রেখে যায়নি। কর্নেলসায়েব! আপনার কী ধারণা?

কর্নেল বললেন–আপনার সঙ্গে আমি একমত। চলুন। বেরুনো যাক…

বালিগঞ্জ থানার অফিসারের নির্দেশে দোতলার দরজায় একজন কনস্টেবল হাতকড়া এঁটে দিল। আমরা নেমে এলাম।

গলিতে ততক্ষণে মানুষের ভিড় হটাচ্ছে পুলিশ। নরেশবাবুর কাছে বিদায় নিয়ে কর্নেল বললেন- বাকিটা পুলিশের হাতে ছেড়ে দিয়ে এবার আমরা কেটে পড়ি জয়ন্ত! আসুন হালদারমশাই!…

কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে ষষ্ঠীচরণের তৈরি সুস্বাদু কফি খেতে খেতে বললাম–একটা ব্যাপার আমাকে অবাক করেছে কর্নেল! সত্যি! ভীষণ অবাক হয়েছি।

কর্নেল বললেন- কী ব্যাপারে?

রীতিমতো হইহল্লা করে পাড়ায় শোরগোল তুলে হরিবাবুর বাড়িতে হানা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন কেন? এতে তো হরিবাবু খুব সতর্ক হয়ে যাবে। ওর চ্যালাদের কেউ-কেউ নিশ্চয় ঘটনাস্থলে ছিল।

হালদারমশাই বললেন- জয়ন্তবাবু ঠিক কইছেন। আমিও কিছু বুঝলাম না। দুয়ারে তালা আটকানো ছিল। তার মানে বাড়ির ভিতরে হরিবাবু নাই। আমার ক্লায়েন্টরে কিডন্যাপ কইরা নিজের বাড়িতে সে রাখবে ক্যান?

 কর্নেল চুপচাপ কফি খাওয়ার পর চুরুট ধরালেন। তারপর একটু হেসে বললেন-হ্যাঁ! রীতিমতো শো-বিজনেস বলা যায়। তোমাদের কথা ঠিক। কিন্তু এর দরকার ছিল।

গোয়েন্দাপ্রবর বললে–ক্যান কর্নেলস্যার?

–হরিবাবুর সঠিক ডেরা যে ওই বাড়িটা নয়, তার প্রমাণ পাওয়া গেল। ওখানে সে সবসময় থাকত না, তা ওর ঘরগুলো দেখেও বোঝা গেল। অথচ হালদারমশাই তাকে ফিটফাট ফুলবাবুর বেশে দেখেছেন। যে ওইরকম ফুলবাবুটি সেজে বেরোয়, ঘরে তার অন্তত একটু আভাস মিলবে। কিন্তু মিলল না। ঘরগুলো একেবারে সাদামাটা। চালচুলোহীন লোকের আস্তানা। সোফাসেটও ছেঁড়াখোঁড়া।

বললাম–ক্যাপটেন সিংহকে কিডন্যাপ করার পর সে এসে ঘরের দামি বা দরকারি জিনিসপত্র নিয়ে গেছে হয়তো।

কর্নেল হাসলেন। হরিবাবু নিজে না এসে তার চ্যালা ভগতকে সেসব জিনিস নিয়ে যেতে বলে থাকবে। কারণ হালদারমশাই দেখেছিলেন, বাড়িতে ভগতকে রেখে সে সুশীলার সঙ্গে ট্যাক্সিতে চেপে চলে যায়। যাই হোক, এবার হালদারমশাইকে একটা কাজ করতে হবে।

প্রাইভেট ডিটেকটিভ বললেন কন কর্নেলস্যার!

–আপনি সুশীলার বাড়ি চলে যান। খোঁজ নিন সে বাড়িতে আছে কি না। বাড়িতে থাকলে তার সঙ্গে কথা বলবেন না। আমাকে কোনও জায়গা থেকে টেলিফোনে শুধু জানিয়ে দেবেন। আর ট্যাক্সির নাম্বারটা এই কাগজে লিখে দিন।

কর্নেলকে নাম্বারটা লিখে দিয়ে হালদারমশাই বললেন–আপনি চাইলে ক্যাপটেন সিংহের নেমকার্ড আপনারে দিমু।

–দিন। সুশীলার ঠিকানাটাও বরং লিখে দিন। …

গোয়েন্দাপ্রবর অভ্যাসমতো সবেগে বেরিয়ে গেলেন। তারপর কর্নেল টেলিফোনের রিসিভার তুলে ডায়াল করলেন। একটু পরে সাড়া এলে তিনি বললেন-কর্নেল নীলাদ্রি সরকার বলছি। ..মি. সোম! আপনাকে অজয়েন্দ্র রায়ের সম্পর্ক…ধন্যবাদ। অসংখ্য ধন্যবাদ। ওটা কি কাকেও দিয়ে আমার কাছে পাঠাবেন?…ইউ আর ওয়েলকাম মি. সোম! আমার সৌভাগ্য…হ্যাঁ। আমি আছি। অন্তত এ-রাতে কোথাও বেরুচ্ছি না। শীতের রাতে এই বৃদ্ধ অর্কিড-পাখি-প্রজাপতি-ক্যাকটাসের জন্য কোথাও হানা দিতে অক্ষম মি. সোম। … ঠিক আছে। আসুন। ….

কর্নেল রিসিভার রেখে সোফায় হেলান দিলেন। বললাম–মি. সোম নামটা আমার শোনা মনে হচ্ছে।

কর্নেল চোখ বুজে বললেন–শিপিং কর্পোরেশনের কলকাতা ব্রাঞ্চের ম্যানেজার মিঃ অসীম সোম।

-উনি থাকেন কোথায়?

–ক্যামাক স্ট্রিটে কোম্পানির বাংলোবাড়িতে…

প্রাধ আধঘণ্টা পরে ডোরবেল বাজল। তারপর একজন স্মার্ট চেহারার প্রৌঢ় ভদ্রলোক ঘরে ঢুকে বললেন-পথে একটু দেরি হয়ে গেল। পার্ক স্ট্রিটে জ্যাম। ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট আসবার কথা কাগজে পড়েছিলাম। সম্ভবত তার জন্যই পার্ক স্ট্রিটের ওই অবস্থা।

কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে তার করমর্দন করে বসালেন। তারপর বললেন–অনেকদিন পরে আপনি এলেন!

মি. সোম একটা ব্রিফকেস খুলতে খুলতে বললেন–হ্যাঁ। প্রায় এক বছর। গত নভেম্বরে এসে আপনাকে খুব কষ্ট দিচ্ছিলাম।

কর্নেল হাসলেন। –ও কিছু না। আন্তর্জাতিক মাফিয়া ডনরা অনেকেই আমার পাল্লায় পড়ে কলকাতা ছেড়ে পালিয়েছে। শাহিন খান এখন নাকি দুবাইয়ে ঘাঁটি করেছে। আপনাদের আর সে বিরক্ত করে না আশা করি?

–না। এই নিন আপনার অজয়েন্দু রায়ের পুরো ডেটা। এই খামে সব কাগজপত্র, মাদার কম্পিউটার থেকে বের করতে একটু সময় লেগেছে, এই যা।

কর্নেল একটা লম্বা পেটমোটা খাম নিলেন এবং বললেন–আগে কফি। এটা পরে খুলব। খুঁটিয়ে পড়ার পর কিছু জিজ্ঞাস্য থাকলে পরে আপনাকে রিং করব। ষষ্ঠী! শিগগির কফি চাই। হা–আলাপ করে দিই।

মি. সোম হাসলেন। দরকার হবে না। জয়ন্তবাবুকে আমি দেখেই চিনেছি। উনি হয়তো আমাকে ভুলে গেছেন।

সঙ্গে সঙ্গে খিদিরপুর ডকে শিপিং কর্পোরেশনের একটা জাহাজভর্তি মাল চুরি যাওয়ার সাংঘাতিক ঘটনাটা মনে পড়ে গেল। মি. সোমের সঙ্গে করমর্দন করে বললাম–দুঃখিত মি. সোম। ভুলে গিয়েছিলাম আপনার কথা।

-তাতে কী? আপনারা সাংবাদিক। নিত্যনতুন ঘটনা এসে আপনাদের ব্যস্ত রাখে।

এইসময় টেলিফোন বাজল। কর্নেল রিসিভার তুলে সাড়া দিয়ে বললেন–হ্যাঁ। বলুন মি. হাটি। .ও মাই গড! কোথায় ছিল ট্যাক্সিটা?..রাস্তা থেকে ছিটকে পড়েছিল, আপনি শিয়োর?…মেয়েটিকে শনাক্ত করতে পেরেছেন?…সুশীলা দাসী?…মাথার পিছনে গুলি-কী অদ্ভুত! ঠিক দীপনারায়ণবাবুর মতো…হা, ট্যাক্সিড্রাইভারের পালানোরই কথা। …সকালে দেখা হবে। রাখছি। …

.

১০.

 শিপিং কর্পোরেশনের ম্যানেজার অসীম সোম কর্নেলের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। কর্নেল টেলিফোনের রিসিভার রেখে তার দিকে ঘুরে বসলেন। মি. সোম একটু হেসে বললেন–অজয়েন্দু রায়ের সঙ্গে কোনও এক সুশীলা দাসীকে মার্ডারের সম্পর্ক নেই তো?

কর্নেলও হাসলেন। –আছে।

–বলেন কী কর্নেল সরকার!

যথাসময়ে সব আপনাকে জানাব।

ঘড়ি দেখে মি. সোম উঠে দাঁড়ালেন। বললেন–চলি তাহলে। আজ সন্ধ্যায় আমাদের ক্লাবে একটা ডিনার পার্টি আছে। আপনাকে খামটা দিয়ে সেখানে যাব ভেবেছিলাম। একটু দেরি হয়ে গেল। …

অসীম সোম চলে যাওয়ার পর বললাম–একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটে গেল তাহলে। যে-সুশীলার সাহায্যে হরিবাবু ক্যাপটেন সিংহকে কিডন্যাপ করেছে, তাকেই হরিবাবু কেন গুলি করে মারল?

কর্নেল ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে বসে অভ্যাসমতো চোখ বুজলেন। বুঝলাম, আমার এই প্রশ্ন নিয়ে তিনি আপাতত আলোচনায় রাজি নন।

কিছুক্ষণ করে ডোরবেল বাজল। তারপর সবেগে প্রবেশ করলেন প্রাইভেট ডিটেকটিভ হালদারমশাই। তাঁকে উত্তেজিত দেখাচ্ছিল। কর্নেল চোখ খুলে বললেন-বলুন হালদারমশাই!

হালদারমশাই জোরে শ্বাস ছেড়ে বললেন-সুশীলা থাকত একটা তেরপলের ঝোপড়িতে। একজন কইল, সুশীলা তার ঝোপড়ি পাঁচু মিস্ট্রিরে বিক্রি কইর‍্যা দ্যাশে গেছে। পাঁচু মিস্ট্রিরে জিগাইলাম সুশীলার দ্যাশ কোথা? পাঁচু কইল, সে-খবর তার জানা নাই!

-আপনাকে উত্তেজিত মনে হচ্ছে কেন?

গোয়েন্দাপ্রবর এক টিপ নস্যি নেওয়ার পর আস্তে বললেন–ক্যাপটেন সিংহর বাড়ি গিছলাম। পুলিশ ওনার ঘরের তালা ভাইঙ্গ্যা ঢুকছে। ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের সেই নরেশবাবুরে দেখলাম। আমারে দেইখ্যা উনি কইলেন, ঘরে ক্লোরোফর্মের কড়া গন্ধ ট্যার পাইছেন।

তার মানে ক্যাপটেন সিংহকে ক্লোরোফর্মের সাহায্যে অজ্ঞান করেছিল ওরা?

-হ্যাঁ। ঠিক কইছেন কর্নেল স্যার।

 আপনি কি কফি খাবেন? কফি নার্ভ চাঙ্গা করে হালদারমশাই!

হালদারমশাই এবার মুচকি হেসে বললেন–খামু। কিন্তু আসল ঘটনা এখনও কই নাই। শোনেন কর্নেল স্যার! চৌতিরিশ বৎসরের পুলিশ-লাইফ যার, তারে ফান্দে ফেলে কোন হালায়?

কর্নেল ভুরু কুঁচকে বললেন–আবার কি কেউ আপনাকে আক্রমণ করেছিল?

–হঃ। ক্যাপটেন সিংহর বাড়ির পিছনে একটা গলি দিয়া শর্টকাট করছিলাম। গলিতে আলো কম ছিল। হঠাৎ পাশ থেইক্যা কে আমারে কইল, আপনি মি. হালদার না? আপনার লগে কথা আছে। একটু দাঁড়ান। আমি যেই তার দিকে ঘুরছি, সে চিত্তকার করল, চোর! চোর! তারপর আমার গলার কাছে সোয়েটার চাইপ্যা ধরল। এদিকে তার চিৎকার শুইন্যা আরও লোকে চিৎকার করছিল। চোর! চোর! আমি তখনই তার ফান্দ ট্যার পাইছি। তার প্যাটে একখান লাথি মারলাম। হালা মাটিতে পড়ল। অমনি আমি দৌড় দিলাম। পিছনে পাড়াসুন্ধু চিৎকার করছিল, চোর! চোর।

কর্নেল হেসে ফেললেন। -হ্যাঁ। আপনি ঠিকই বলেছেন। ওটা একটা ফাঁদই বটে। কলকাতায় এ ধরনের ঘটনা প্রায়ই ঘটে। কোনও শত্রুকে গণধোলাই দিয়ে মেরে ফেলার জন্য চোর! চোর চিৎকার ভালো কাজ দেয়। লোকেরা কিছু না বুঝেই বেচারাকে পেটাতে শুরু করে।

বললাম-হালদারমশাই তাহলে খুব বেঁচে গেছেন!

হালদারমশাই বললেন–আমারে পেটায় কে? পকেটে রিভলভার ছিল। দুরাউন্ড গুলি ছুঁড়লেই লোকেরা–হঃ! কী যে কন জয়ন্তবাবু!

ষষ্ঠী কফি দিয়ে গেল। চুপচাপ কফি খেয়ে প্রাইভেট ডিটেকটিভের উত্তেজনা থিতিয়ে গেল। আবার একটিপ নস্যি নিয়ে তিনি বললেন–লোকটা হরিবাবুর স্যাঙাত। কিন্তু আশ্চর্য লাগে কর্নেলস্যার, সে আমার নাম জানল কীভাবে?

কর্নেল এবার গম্ভীর হয়ে বললেন-বোঝা যাচ্ছে, হরিবাবু ক্যাপটেন সিংহের দিকে নজর রাখার জন্য ভগত ছাড়াও আরও কাকেও বেছে নিয়েছিল। সে এমন লোক, যে ক্যাপটেন সিংহের বাড়ির কাছাকাছি থাকে। সম্ভবত সুশীলাকে সে চেনে। যাই হোক, এবার কাজের কথা বলি।

হালদারমশাই বললেন–যেখানে যাইতে কইবেন, যামু।

–হালদারমশাই! উত্তেজিত হবেন না যেন। মাথা ঠান্ডা রেখে শুনুন।

–কন কর্নেল স্যার।

–কিছুক্ষণ আগে চন্দ্রপুর থানা থেকে খবর পেয়েছি, চন্দ্রপুর যাওয়ার পথে তিতলিপুর জঙ্গলের ধারে সেই ট্যাক্সিটা পাওয়া গেছে। সুশীলাকে কেউ মাথার পিছনে গুলি করে মেরে রাস্তার পাশে ফেলে দিয়েছে। ট্যাক্সিডাইভারকে পাওয়া যায়নি। খালি ট্যাক্সিটা রাস্তার ধারে দাঁড় করানো আছে।

গোয়েন্দাপ্রবর গুলিগুলি চোখে কথাগুলো শুনছিলেন। গোঁফের দুইভাগ তিরতির করে কাঁপছিল। এবারে জোরে শ্বাস ছেড়ে বললেন–হরিবাবু না। অরে মারছেন ক্যাপটেন সিংহ। ওনার ফায়ার আর্মস থাকা স্বাভাবিক। জ্ঞান ফেরার পর ক্যাপটেন সিংহ সুশীলারে বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি দিচ্ছেন।

 আমি বললাম-হরিবাবুর তা হলে কী হল?

–তারেও মারছেন ক্যাপটেন সিংহ।

–তার সঙ্গে ভগত ছিল!

–প্রাণভয়ে ভগত পলাইয়া গেছে। ট্যাক্সিড্রাইভারও পলাইয়া গেছে।

–ক্যাপটেন সিংহ নাকি অসুস্থ এবং বৃদ্ধ মানুষ। তিনি হরিবাবুর লাশের কি ব্যবস্থা করেছেন তা হলে?

ঘটনাস্থলে গিয়া ক্লু খুঁজলেই মিলব। শিয়োর! তাই না কর্নেল স্যার?

কর্নেল চুরুট টানছিলেন। একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে বললেন-হালদারমশাই ঠিকই বলেছেন। ঘটনাস্থলে না গেলে কিছু বোঝা যাবে না। হালদারমশাই! এবার বাড়ি ফিরে বিশ্রাম নিন। তারপর কাল সকাল আটটার মধ্যে আমার এখানে চলে আসবেন। আপনার এবার বিশ্রাম দরকার। খুব ধকল গেছে। ….

প্রাইভেট ডিটেকটিভ কে কে হালদার আস্তেসুস্থে বেরিয়ে গেলেন। তারপর কর্নেল টেবিল-ল্যাম্পের আলো জ্বেলে মি. সোমের দিয়ে যাওয়া খামটা খুললেন। ভিতরে টাইপ-করা দু শিট কাগজ ছিল। ওতে শিপিং কর্পোরেশনের এক অফিসার অজয়েন্দু নারায়ণ রায়ের জাহাজি জীবন সম্পর্কে খুঁটিনাটি তথ্য আছে।

কর্নেল দু শিট কাগজে দেওয়া তথ্যগুলো অন্তত বার তিনেক পড়ার পর সোজা হয়ে বসলেন। আমার দিকে ঘুরে বললেন–ভদ্রলোক যেন আরব্য উপন্যাসের একটি চরিত্র। আশা করি, জয়ন্ত আরব্য উপন্যাস পড়েছে?

-পড়েছি। স্রেফ রূপকথা। তবে পড়তে ভালো লাগে। বিশেষ করে সিন্দবাদ নাবিকের উপাখ্যানগুলো রোমাঞ্চকর।

কর্নেল হাসলেন। –বাঃ সিন্দবাদ নাবিক! অজয়েন্দু নারায়ণ রায়ের জাহাজি জীবনটাও কতকটা ওইরকম মনে হল। অবশ্য জাহাজ কোম্পানির তথ্যে এ ধরনের ইশারা আছে মাত্র। কোনও বড়ো বন্দরে তাদের জাহাজ নোঙর করে বেশ কিছুদিন কোনও কারণে আটকে থাকলে অজয়েন্দুশম্ভুনাথ চৌধুরিকে সঙ্গে নিয়ে অ্যাডভেঞ্চারে বেরিয়ে যেতেন। এটা জাহাজ কোম্পানির অফিসার বা কর্মীদের ক্ষেত্রে নিয়মবিরোধী কাজ। কিন্তু ক্যাপটেন সুশীলকুমার সিংহ তাদের গার্জেন। হা-ক্যাপটেন সিংহের দেশের বাড়ি ছিল চন্দ্রপুর।

-বলেন কি! ওই কাগজ দুটো আমাকে দিলে পড়ে আনন্দ পেতাম।

কর্নেল খামটা সকৌতুকে টেবিলের ড্রয়ারে ঢুকিয়ে রেখে মিটিমিটি হেসে বললেন–এখন বেশি কিছু জানতে নেই। জানলে চূড়ান্ত চমকের মজা থেকে বঞ্চিত হবে। মুখে-মুখে বরং যা বলি, শুনতে পারো।

অগত্যা বললাম–কাকেও হাতের তাস আগেভাগে দেখান না আপনি। তো ঠিক আছে। মুখেই বলুন।

কর্নেল ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজলেন। তারপর মৃদুস্বরে বললেন-ক্যাপটেন এস কে সিংহের দেশের বাড়ি ছিল চন্দ্রপুরে। অজয়ে তার বাল্যবন্ধু।

–এসব কথা কি মি. সোমের দেওয়া কাগজে লেখা আছে?

–মোটেই না।

–আমি চোখ না খুলে নির্বিকার ভঙ্গিতে বললেন–ওই তথ্য থেকে একটা স্কেচ এঁকেছি। শুনতে ইচ্ছে হলে শোনো।

হাসতে হাসতে বললাম-ঠিক আছে। বলে যান।

-ক্যাপটেন সুশীল কুমার সিংহের সুপারিশে অজয়ে চাকরি পেয়েছিলেন। শম্ভুনাথ চৌধুরি চাকরি পেয়েছিল অজয়ের সুপারিশে। ওরা দুজনে কোম্পানির নিয়মকানুন না মেনে কোথায়-কোথায় চলে যেত, তা আগেই বলেছি। নিয়মকানুন বিরোধী হলেও জাহাজের লগবুকে ক্যাপটেন সিংহকে সে-কথা লিখে রাখতে হত। কারণ বাইরে গিয়ে বিপদ-আপদ হলে জাহাজ কোম্পানিকেই ঝক্কি সামলাতে হবে। যাই হোক, বছর দশেক আগে একটা জাহাজ মিশরের পোর্ট সইদ ভারত থেকে কলকারখানার যন্ত্রাংশ নিয়ে গিয়েছিল। মাল খালি হলে সেই জাহাজে মিশরের তুলো বোঝাই করার কথা। আমেদাবাদের কাপড়কলের অর্ডার ছিল। তুমি জানো মিশরের তুলো ইজিপ্সিয়ান কটন নামে বিশ্বখ্যাত। তো তুলো আসতে দেরি হচ্ছিল। এই অছিলায় অজয়েন্দু শম্ভুনাথকে সঙ্গে নিয়ে কায়রোতে তুলো কোম্পানির অফিসে যান। দুদিন পরে ওঁরা জাহাজে ফিরে আসেন। তারপর তুলো এসে বন্দরে পৌঁছোয়। সেই তুলো বোঝাই করে জাহাজ বোম্বাই ফিরে আসছিল। আগস্ট মাস। বোম্বাই থেকে আঠারো নটিক্যাল মাইল দূরে ঝড়ের মুখে জাহাজডুবি হয়। ক্যাপটেন সিংহ রবারে ভেলায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে অজয়েন্দু বা শম্ভুনাথ ছিল না। এদিকে বোম্বাইয়ে তার আগে মিশর সরকারের অভিযোগ অনুসারে ভারত সরকার গোয়েন্দাবাহিনী তৈরি রেখেছিলেন। মিশরের অভিযোগ ছিল, ওই তুলোর জাহাজের দুজন অফিসার জাদুঘর থেকে অমূল্য প্রাচীন সম্পদ চুরি করে পালিয়েছে। তাদের সাহায্যকারী ইব্রাহিম বেগকে মিশর সরকার গ্রেফতার করেছিল। ইব্রাহিম ধোলাইয়ের চোটে ওই দুই ভারতীয়ের পরিচয় দিয়েছে।

কর্নেল নিভে যাওয়া চুরুট ধরালেন। বললাম-তারপর?

কর্নেল একটু হেসে বললেন নিশ্চয় ওরা দুজনে এমন কিছু আঁচ করে থাকবে। তা না হলে জাহাজডুবির পর আর তাদের খোঁজ পাওয়া যাবে না কেন? মালবাহী জাহাজ। লোকজন তত বেশি ছিল না। রবারের নৌকো ছাড়াল কয়েকটা হালকা কাঠের বোটও ছিল। রবারের পোশাকও ছিল, যাতে হাওয়া ভরলে ফুলে ওঠে। সমুদ্রে ভেসে থাকা যায়।

-তার মানে সবাই উদ্ধার পেয়েছিল। শুধু অজয়েন্দু আর শম্ভুনাথের খোঁজ পাওয়া যায়নি?

-হ্যাঁ, প্রায় দশ বছর এই দুজন লোক কোম্পানির খাতায় মৃত হলেও কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সি বিআই-এর খাতায় জীবিত। কয়েক বার খোঁজ পেয়েও সি বি আই তাদের ধরতে পারেনি। মি. সোম ফুটনোটে এইসব কথা লিখে দিয়েছেন। আর একটা মূল্যবান তথ্য আছে। মি. সোমের কোম্পানির একজন জাহাজি অফিসার নাকি খিদিরপুর ডকে হংকংয়ের একটা জাহাজে শম্ভুনাথ চৌধুরিকে দেখতে পেয়েছিলেন। সে জাহাজ থেকে একটা বোটে নেমে ডকইয়ার্ডে এসেছিল। সেই অফিসার তাতে চার্জ করতেই শম্ভুনাথকে আড়াল করে তার গ্যাংয়ের লোকেরা। তারপর বেচারা নিরীহ অফিসারকে সেই গুণ্ডারা মারধর করে। সেই সুযোগে শম্ভুনাথ উধাও হয়ে যায়।

বলে কর্নেল ঘড়ি দেখলেন। –জয়ন্ত, সাড়ে নটা বেজে গেছে! এ রাতে শিগগির ডিনার খেয়ে। শুয়ে পড়া যাক, সকালে বেরুতে হবে। বলে তিনি ডাকলেন-ষষ্ঠী!..

ষষ্ঠীচরণ আড়াল থেকে নিশ্চয় কর্নেলের কথা শুনছিল। কিচেনের দিক থেকে সে সাড়া দিয়ে বলল–সব রেডি বাবামশাই!…

সকালে কথামতো হালদারমশাই এসে পৌঁছেছিলেন। আমরা তখনই বেরিয়ে পড়েছিলাম। কর্নেল বলেছিলেন, পথে কোথাও ব্রেকফাস্ট করা যাবে।

তিতলিপুরের মোড় পেরিয়ে কর্নেলের নির্দেশে গাড়ি চালাচ্ছিলাম। ডানদিকে টানা জঙ্গল। বাঁদিকে কখনও মাঠ, কখনও গ্রাম। কিছুক্ষণ পরে হাইওয়ে যেখানে বাঁদিকে ঘুরে গেছে, সেখানে একটি মোটামুটি চওড়া পিচরাস্তা জঙ্গলের ভিতরে দিয়ে এগিয়েছে। কর্নেল বললেন–আমরা ফরেস্ট বাংলোতে উঠব।

হালদারমশাই জিজ্ঞেস করলেন–সেই ট্যাক্সিখান কি এই রাস্তায় আইতেছিল?

-হ্যাঁ। এই জঙ্গলের রাস্তা দিয়ে চন্দ্রপুর যেতে হয়। বলে তিনি বাইনোকুলারে চোখ রাখলেন। একটু পরে বললেন-জঙ্গলে এখনও কুয়াশা। তাই খালি চোখে পুলিশের গাড়ি দেখা যাবে না। বললাম–বাইনোকুলারে পুলিশের গাড়ি দেখতে পাচ্ছেন?
–পাচ্ছি। থানার ওসি রাজেন্দ্র হাটি জিপের পাশে দাঁড়িয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন।

এবার একটা ছোটো জলভরা নদীর ব্রিজ দেখা গেল। ব্রিজ পেরিয়ে গিয়ে পুলিশের জিপ দেখতে পেলাম। বাঁদিকে রাস্তাটা ঘুরে গেছে। সেদিকে একটা গ্রাম দেখা যাচ্ছিল। সমৃদ্ধ গ্রাম বা গ্রামনগরী। বলা যায়। কারণ, অনেক পাকাবাড়ি আর যানবাহন চোখে পড়ল। কর্নেল বললেন–পশ্চিমে একটা পাকা সড়ক আছে। শর্টকাটে হাইওয়েতে পৌঁছোনো যায়। তাই এই রাস্তা এমন নির্জন হয়ে আছে।

ও সি রাজেন্দ্র হাটি সহাস্যে বললেন-মর্নিং কর্নেল সরকার।

কর্নেল হাসলেন। -মর্নিং হাটি। আশা করি, আমাদের দেরি হয়নি?

 মোটেও না।

আমরা গাড়ি থেকে নামলাম। কর্নেল প্রাইভেট ডিটেকটিভ কে কে হালদারের সঙ্গে মি. হাটির আলাপ করিয়ে দিলেন। তারপর বললেন–সেই ট্যাক্সিটা কি থানায় নিয়ে গেছেন?

ও সি বললেন-হ্যাঁ। রাত্রেই ওটা নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এই জঙ্গলের ধারে পড়ে থাকলে গাড়িচোররা ওটাকে হাপিস করে দিত। এই এলাকার চোর-ডাকাত দমন করা কঠিন। এই জঙ্গল আর পনেরো কিলোমিটার দূরে বাংলাদেশের বর্ডার।

–চলুন। ঘটনাস্থলটা দেখি।

ডানদিকে একটু এগিয়ে মি. হাটি বললেন-সুশীলা দাসীর বডি এই ঝোপের ধারে পড়ে ছিল। আর ট্যাক্সিটা ছিল এখানে রাস্তার কাছাকাছি। সম্ভবত গাড়ির মধ্যে ধস্তাধস্তি হচ্ছিল। ড্রাইভার ট্যাক্সির ব্রেক না চাপলে নিচের ওই খালে গিয়ে পড়ত।

হালদারমশাই বললেন–হ্যাঁ। ঠিক কইছেন। ঝোপের অবস্থা দেইখ্যাই তা বুঝছি।

দেখলাম, সুশীলার লাশ যেখানে পড়ে ছিল, সেখানে এখনও রক্তের ছোপ। শিশিরে অবশ্য রক্তের রং ফিকে হয়ে গেছে। ততক্ষণে কর্নেলের গোয়েন্দাগিরি শুরু হয়ে গেছে। ইতস্তত তিনি ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কখনও হাঁটু মুড়ে বসে আতশ কাচে কী দেখছেন। হালদারমশাইও অদ্ভুত ভঙ্গিতে ঘোরাঘুরি করছেন।

আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলাম। মি. হাটি আমাকে সহাস্যে চাপা স্বরে বললেন–আমাদের পক্ষ থেকে তন্নতন্ন খোঁজা হয়েছে। এবার দেখা যাক, কর্নেলসাহেব কোনও ক্ল পান নাকি।

হালদারমশাই জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। মি. হাটি বললেন–ভদ্রলোকের মাথায় ছিট আছে মনে হচ্ছে। ওভাবে কোথায় যাচ্ছেন উনি?

একটু হেসে বললাম–ঠিক ধরেছেন মি. হাটি। উনি আপনার মতো পুলিশ অফিসার ছিলেন। কিন্তু মাথায় ছিট আছে। কর্নেলেরও আছে। ওই দেখুন, কর্নেলও অদৃশ্য হলেন।

মি. হাটি এবার একটু গম্ভীর মুখে বললেন–আমরা অবশ্য জঙ্গলে ঢুকিনি। ঢোকার কোনও কারণও ছিল না। ওঁরা কীসের জন্য জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে গেলেন বুঝতে পারছি না।

মিনিট দশেক অপেক্ষা করার পর মি. হাটি একজন সশস্ত্র কনস্টেবলকে সঙ্গে নিয়ে কর্নেল যেদিকে, সেদিকে চলে গেলেন।

আরও দশ মিনিট পরে দেখলাম, হালদারমশাই হন্তদন্ত বেরিয়ে আসছেন জঙ্গল থেকে। জিজ্ঞেস করলাম–কী ব্যাপার হালদারমশাই?

গোয়েন্দাবরের পোশাক শিশিরে ভিজে গেছে। উত্তেজিতভাবে তিনি বললেন–জুতার ছাপ ফলো করছিলাম। একখানে দেখলাম পুরানকালের ধ্বংসস্তূপ।

-হ্যাঁ। এই জঙ্গলের মধ্যে মোগল আমলের একটা কেল্লাবাড়ির ধ্বংসস্তূপ আছে। কিন্তু কর্নেল কোথায়? তাকে দেখতে পাননি?

–নাঃ। ধ্বংসস্তূপের আড়ালে কে য্যান খাড়াইয়া ছিল। আমি শুধু শুনলাম শুকনা পাতার ওপর দৌড়াইয়া পালানোর শব্দ। জয়ন্তবাবু! এখনই মি. হাটি যদি পুলিশফোর্স লইয়া-বলেই তিনি অবাক হলেন। -অ্যাঁ? মিঃ হাটি গেলেন কই?

-জঙ্গলে। কর্নেলকে ফলো করে গেছেন উনি।

হালদারমশাই একটিপ নস্যি নিয়ে বললেন-মিসটিরিয়াস কারবার।

ওঁদের ফিরতে যত দেরি হচ্ছে, তত আমার উদ্বেগ বাড়ছিল। অবশেষে ওঁদের দেখতে পেলাম। ও সি মি. হাটি একজন লোকের সোয়েটার ও শার্টের কলার চেপে ধরে টানতে টানতে তাকে আনছেন। ভদ্রলোক বলাই উচিত তাকে। কাছাকাছি এলে আমি তাকে চিনতে পারলাম। এই ভদ্রলোকই দীপনারায়ণবাবুর সঙ্গে দোমোহানিগামী রাস্তায় মল্লযুদ্ধ করছিলেন। সেই ছবি কর্নেল তুলেছিলেন। কাজেই আমার চিনতে দেরি হল না। ইনিই সেই শম্ভুনাথ চৌধুরি! অদ্ভুত ব্যাপার! এখন এই জঙ্গলে ঢুকে কী করছিলেন জাহাজিবাবু?

কাছে এসে কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন–জাহাজবাবু দৌড়ে আসছে দেখে আমরা দু-পাশে দুটো স্কুপের আড়ালে ওত পেতেছিলাম। ইনি একেবারে আমাদের ওপর এসে পড়লেন।

হালদারমশাই বলে উঠলেন–আমার সাড়া পাইয়া এই লোকটাই দৌড় দিছিল। ..

.

১১.

স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। যে জাহাজিবাবু শম্ভুনাথ চৌধুরি কাজিসায়েবের ছদ্মবেশে কর্নেলের জ্যাকেটে ভয়-দেখানো কথা লেখা কাগজের টুকরো এঁটে পাশ দিয়ে চলে গিয়েছিল, যাকে প্রায় দশ বছর ব্যাপী কেন্দ্রীয় সরকারের গোয়েন্দারা খুঁজে হন্যে হয়েছেন, এমনকী কলকাতার লালবাজারের ঘুঘু গোয়েন্দারাও এযাবৎ যার টিকিটিও দেখতে পাননি, সে যেন আজ কর্নেলের কাছে স্বমূর্তিতে ধরা দেওয়ার জন্য তিতলিপুরের জঙ্গলে এসে অপেক্ষা করছিল।

মাঝে মাঝে বহু ঘটনা দেখে আমার মনে হয়েছে, কর্নেলের যেন কিছু অলৌকিক শক্তি আছে। আজ আবার তা বিশ্বাস করার মতো ঘটনা ঘটল। এ কথাটা কর্নেলকে বললেই তার বিখ্যাত অট্টহাসি শুনতে পাব। কাজেই চুপ করে থাকাই উচিত।

হালদারমশাইয়ের কথায় আমার সম্বিৎ ফিরল। তিনি বললেন–এই লোকটা সুশীলার সাহায্যে ক্যাপটেন সিংহের ঘর থেইক্যা দামি জিনিস চুরি করছিল? কী কাণ্ড! আর ডানহাতে ব্যান্ডেজ বাঁধা ক্যান?

কর্নেল সহাস্যে বললেন–কারও সঙ্গে আবার মল্লযুদ্ধ করেছে।

অবাক গোয়েন্দাপ্রবর বললেন–আবার মানে? আগেও কি

তাকে থামিয়ে কর্নেল বললেন–যথাসময়ে সব শুনবেন। প্রথম মল্লযুদ্ধের ছবিটাও আপনাকে দেখাব। মি. হাটি! আপনি তা হলে জাহাজিবাবুকে নিয়ে যান। ওর পেট থেকে কিছু বেরোয় কি না দেখুন। আমরা ফরেস্ট বাংলোয় গিয়ে একটু বিশ্রাম করে নিই। ফরেস্ট বাংলোয় টেলিফোন আছে তো?

মি. হাটি বললেন–আছে। এই বাংলোটা সেচবাংলোর চেয়ে সুন্দর। মৌরীনদী পেরিয়ে এসেছেন। সেই নদীর ধারেই ফরেস্ট বাংলো। নদীটা জঙ্গলের ভিতর দিয়ে দোমোহানি জলাধারে গিয়ে মিশেছে। আচ্ছা, চলি কর্নেলসায়েব। সময়মতো দেখা করব।

কর্নেল বললেন–জাস্ট আ মিনিট মি. হাটি! একটা কথা আছে।

দুজনে একটু তফাতে গিয়ে চুপিচুপি কী কথা বললেন। এদিকে জাহাজিবাবুর কোমরে এবং দুই দড়ি বেঁধে কনস্টেবলরা ততক্ষণে জিপের পিছনের দিকে ঢুকিয়েছে।

পুলিশের জিপ চলে যাওয়ার পর কর্নেল বললেন-ফরেস্ট বাংলোয় যাওয়ার আগে একটা কাজ সেরে নেওয়া যাক হালদারমশাই! আপনি জুতোর ছাপ দেখে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। সেই ছাপগুলো কোথায় প্রথমে আপনার চোখে পড়েছিল, একবার দেখে নিতে চাই।

হালদারমশাই রাস্তা থেকে ডাইনে জঙ্গলের দিকে কয়েক পা এগিয়ে কর্নেলকে সেই ছাপ দেখালেন। কর্নেল হাঁটু মুড়ে বসে আতশ কাচ দিয়ে কিছু দেখার পর পাশের একটা ঘন ঝোপের কাছে গেলেন। বললেন-হালদারমশাই! শম্ভুনাথ চৌধুরি সম্ভবত এখানে কিছু খুঁজতে এসেছিল। মাই গুডনেস! লক্ষ্য করছেন কি, ঝোপের ওপর রক্তের ছাপ এখনও স্পষ্ট। শিশিরে কিছুটা ধুয়ে দিলেও ছাপগুলো রয়ে গেছে!

 গোয়েন্দাপ্রবর বললেন-লোকটার হাতে ব্যান্ডেজ দেখলাম! কর্নেল স্যার! আর হাতে কেউ .. গুলি করছে! তাই না?

-ঠিক ধরেছেন। গুলি খেয়ে পালিয়ে গিয়ে জাহাজবাবু কোথাও ব্যান্ডেজ বেঁধে নিয়েছে। চেনা কোনও ডাক্তারের কাছে গিয়ে থাকবে। কিন্তু আজ এখানে কী খুঁজতে এসেছিল সে?

কর্নেলের কথা শুনে হালদারমশাই জায়গাটা খুঁজতে শুরু করলেন। গাড়িতে হেলান দিয়ে দুই গোয়েন্দার কাজকর্ম দেখে মনে হচ্ছিল, অন্য কেউ দেখতে অবাক হয়ে ভাবত, দুই পাগল এখানে এসে জুটল কোথা থেকে?

কিছুক্ষণ পরে গোয়েন্দাপ্রবর ঘন ঘাসের ভিতর থেকে কী একটা জিনিস কুড়িয়ে নিয়ে প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন-পাইছি! কর্নেল স্যার! পাইছি!

 তিনি কর্নেলের কাছে গিয়ে জিনিসটা দেখালেন। এবার দেখতে পেলাম, ওটা একটা ফায়ার, আর্মস। কর্নেল ওটা পরীক্ষা করে দেখে বললেন-সিরাউন্ডার রিভলবার! হুঁ, বিদেশি অস্ত্র। পয়েন্ট আটত্রিশ ক্যালিবার। জাহাজিবাবুর হাতে কেউ গুলি করার সময় এটা ছিটকে পড়েছিল। সে আজ খুঁজতে এসেছিল অস্ত্রটা। পুলিশের গাড়ি থেকে জঙ্গলের আড়ালে ওত পেতে বসেছিল। তারপর আমরা এসে গেলাম এবং আপনি জুতোর ছাপ আবিষ্কার করে এগিয়ে গেলেন। পুরো ঘটনাটা অঙ্কের মতো কষে ফেলা যায়।

-হঃ! বলে উল্লসিত প্রাইভেট ডিটেকটিভ লম্বা পায়ে গাড়ির কাছে এলেন। একটিপ নস্যি নিয়ে খিক খিক করে হাসলেন। -জয়ন্তবাবু কিছু বোঝলেন?

আমিও বললাম-হঃ!…

গাড়ি স্টার্ট দিয়ে কর্নেলের নির্দেশমতো এগিয়ে ডানদিকে একটা মোরাম বিছানো সংকীর্ণ রাস্তায় চললাম। চন্দ্রপুরগামী পিচরাস্তা বাঁদিকে এগিয়েছে। আমরা এবার ঘন জঙ্গলের মধ্যে এগিয়ে যাচ্ছি। দুধারে ল্যাম্পপোস্ট এবং টেলিফোনের তার দেখা যাচ্ছিল। মিনিট সাতেক পরে সেই নদীর ওপর ছোটো ব্রিজ দেখা গেল। ব্রিজে উঠতে যাচ্ছি, হঠাৎ কর্নেল বললেন-জাস্ট আ মিনিট জয়ন্ত! একটু থামো।

কর্নেল নেমে গাড়ির পিছনদিকে রাস্তার ডানদিকে উঁচু একটা গাছের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। তারপরই দ্রুত এসে গাড়িতে উঠে বললেন–চলল! জিজ্ঞেস করলাম–কী দেখতে গিয়েছিলেন?

-অর্কিড।

এখানে অর্কিড? এটা তো পাহাড়ি এলাকা নয়।

জয়ন্ত! পরগাছা বললে তুমি বুঝবে। আসলে অর্কিড দুরকম হয়। ভূমিজীবী আর পরজীবী। পরজীবী অর্কিডকেই আমরা পরগাছা বলি!

পিছনে হালদারমশাই মন্তব্য করলেন-কর্নেলস্যারের লগে-লগে ঘুরলে নলেজ বাড়ে।

ব্রিজ পেরিয়ে গিয়ে সুদৃশ্য ফরেস্ট বাংলো চোখে পড়ল। একটা উঁচু জায়গার ওপর রঙিন ছবির মতো বাংলার পিছনের অংশ দোতলা। সামনে খোলা ছাদে বসে রাত্রিকালে অরণ্যের সৌন্দর্য দেখা যাবে।

হালদারমশাই বললেন–এ জঙ্গলে বাঘ-ভালুক নিশ্চয় আছে। হাতিও থাকতে পারে। তাই না কর্নেলস্যার!

কর্নেল বললেন–বাঘ, ভালুক, হাতি যদি না-ও থাকে, ভূতপ্রেত অবশ্যই আছে।

আমরা দুজনে হেসে ফেললাম। একটুখানি চড়াইয়ের উঠে বাংলোর গেট। গেটের সামনে প্যান্ট-শার্ট-জ্যাকেট পরা এক সুদর্শন আমার বয়সি যুবক দাঁড়িয়ে ছিলেন। করজোড়ে নমস্কার করে তিনি সহাস্যে বললেন–আমি এই ফরেস্টের রেঞ্জার সৌম্য চক্রবর্তী! কর্নেলসায়েব! আমি ভাবিনি চর্মচক্ষে আপনাকে দেখতে পাব। ভিতরে গাড়ি রাখার গ্যারাজ আছে। প্লিজ! ভিতরে আসুন। …

আমাদের জন্য দোতলার প্রশস্ত ঘরটি খালি রাখা হয়েছিল। সৌম্যবাবুর কথা শুনে বুঝতে পেরেছিলাম চন্দ্রপুর থানার ওসি রাজেন্দ্র হাটিই এ ব্যবস্থা করেছিলেন। এখানে মাঝে মাঝে পর্যটক আসে। দল বেঁধে কিংবা একা। তবে শীতের সময় খুব কম লোকই বেড়াতে আসে। গত শরতে সব ঘর নাকি ভর্তি হয়ে গিয়েছিল। এটা ফরেস্ট বাংলো হলেও পর্যটন দফতরের সুপারিশে পর্যটকদের থাকতে দেওয়া হয়। নদীর দুধারে ঘন জঙ্গল শরৎকালে সবুজ হয়ে ওঠে। নদীর ধারে পিকনিক করারও অনুমতি দেওয়া হয়। তা ছাড়া শখের অ্যাডভেঞ্চারের জন্য মোগল ফৌজদার জাহান খাঁর কেল্লাবাড়ির ধ্বংসস্তূপ আছে। প্রায় ছয় বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে কেল্লাবাড়ি ছিল। পূর্বপ্রান্তে দোমোহানির কাছে এখনও কিছু অংশ অটুট আছে, তা আমার দেখা হয়ে গেছে। ধ্বংসস্তূপ বিশাল এলাকায় ছড়িয়ে আছে। হালদারমশাই বাঘ-ভালুকের খবর জানতে উদগ্রীব ছিলেন।

সৌম্যবাবু বললেন–ভালুক না থাকলেও বাঘ আছে। একদল হরিণ এনে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। বুনো শুয়োর, হনুমানের পাল, শেয়াল, সাপ এসব প্রাণীর নির্ভয় আশ্রয় এই জঙ্গল।

কফি পানের পর কর্নেল চুরুট ধরিয়ে খোলা ছাদে গেলেন। তারপর বাইনোকুলারে চারদিক দেখতে থাকলেন। হালদারমশাই নস্যি নিয়ে বারান্দায় বসলেন। আমি বিছানায় চিৎপাত হলাম।

শীতের দিনের আয়ু কম। বেলা দেড়টার মধ্যে নিচের তলায় ডাইনিংরুমে খাওয়াদাওয়ার পর খোলা ছাদের ওপর চেয়ারে বসে রোদের আরাম নিচ্ছিলাম এবং কর্নেল চুরুট ধরিয়ে চোখ বুজে যেন ঝিমোচ্ছিলেন, এমন সময় একজন পরিচালক এসে খবর দিল, কর্নেলসায়েবের টেলিফোন আছে।

কর্নেল তখনই চলে গেলেন। তারপর হালদারমশাই বললেন–যত ভাবছি, তত জট পাকাইয়া যায়। আচ্ছা জয়ন্তবাবু, আপনি কী কন, শুনি!

বললাম–কী ব্যাপারে?

গোয়েন্দাপ্রবর চাপা স্বরে বললেন-কর্নেল কইলেন জাহাজিবাবু ডানহাতে হরিবাবু গুলি করছে। এদিকে সুশীলা ট্যাক্সিতে বইয়া ছিল। তার মাথার পিছনে গুলি লাগল কেমনে? জাহাজিবাবু অরে গুলি করার জন্য রিভলবার তাক করছিল এবং গুলিও হয় তো করছিল। তারপর হরিবাবু অর হাতে গুলি করল। এখন কথা হইল গিয়া সুশীলাকে প্রায় পয়েন্ট ব্ল্যাংক রেঞ্জে গুলি করছে কেউ। নাঃ! অঙ্ক মিলছে না।

এমন যদি হয়, সুশীলা কোনও কারণে গাড়ি থেকে নেমে সেই ঝোপটার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল?

সুশীলা নামবে ক্যান? ক্যাপটেন সিংহরে কি অন্য গাড়িতে লইয়া গেছে হরিবাবু?

–হালদারমশাই! কলকাতায় একটা লাল মারুতি কয়েকবার আমার গাড়িকে ফলো করে বেড়াচ্ছিল। এমনকি গতকাল সকালে হাই ঝোপটার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল?

–সুশীলা নামবে ক্যান? ক্যাপটেন সিংহরে কি অন্য গাড়িতে লইয়া গেছে হরিবাবু?

–হালদারমশাই! কলকাতায় একটা লাল মারুতি কয়েকবার আমার গাড়িকে ফলো করে বেড়াচ্ছিল। এমনকী গতকাল সকালে হাইওয়েতে তিতলিপুরের মোড় পর্যন্ত ফলো করেছিল।

হালদারমশাই নড়ে বসলেন। –তাহলে অঙ্ক ঠিক। হরিবাবুর একটা লাল মারুতি থাকতেই পারে। কোনও কারণে সেই গাড়ির বদলে ট্যাক্সি ভাড়া করছিলেন হরিবাবু। মারুতির ডাইভারেরে হরিবাবু ট্যাক্সিটারে ফলো করতে কইছিলেন। কিন্তু মারুতি বদলে ট্যাক্সি লইলেন ক্যান?

এরপর প্রাইভেট ডিটেকটিভ আরও কিছুক্ষণ অঙ্ক কষতে থাকলেন বা তার থিয়োরি দাঁড় করাতে মগ্ন হলেন। ততক্ষণে রোদের আরামে আমার চোখে ভাত-ঘুমের টান এসে গেছে।

কর্নেলের আবির্ভাবে ঘুমের রেশ ছিঁড়ে গেল। কর্নেল নিশ্চয়ই হালদারমশাইয়ের জল্পনা শুনতে পেয়েছিলেন। সকৌতুকে বলে উঠলেন-হালদারমশাই ট্যাক্সির পিছনে একটা লাল মারুতি এনে দাঁড় করিয়েছেন। বাঃ, এটা মন্দ না। জয়ন্তের কী মত হালদারমশাই?

বললাম–আমার কোনও মত নেই। হালদারমশাইয়ের থিয়োরি ওটা।

-হালদারমশাই! ও সি রাজেন্দ্রবাবুর কথাটা খেয়াল করে শোনেননি মনে হচ্ছে!

গোয়েন্দাপ্রবর উত্তেজিতভাবে বললেন–কী কথা?

–চন্দ্রপুর থেকে ব্রেকভ্যান এনে ট্যাক্সিটা থানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তার সহজ মানে, ট্যাক্সিটি ওইখানে পৌঁছে বিগড়ে গিয়েছিল। ড্রাইভার তাকে চালু করতে পারেনি।

আমি ও হালদারমশাই এক গলায় বলে উঠলাম–তাই তো!

কর্নেল চেয়ারে বসে বললেন–ততক্ষণে ক্যাপটেন সিংহের জ্ঞান ফেরার কথা। ট্যাক্সি চালু করা গেল না দেখে হরিবাবু, সুশীলা আর ভগত গাড়ি থেকে নেমেছিল। ক্যাপটেন সিংহকেও নামানো হয়েছিল। ওই অবস্থায় এটাই স্বাভাবিক।

হালদারমশাই বললেন–সুশীলা যদি সেই বোপটার কাছে জঙ্গলের দিকে পিছন ফিরিয়্যা খাড়াইয়া থাকে, তা হইলে জাহাজিবাবুর গুলি প্রায় পয়েন্ট ব্লাংক রেঞ্জে তার মাথার পিছনে লাগবার কথা। কী কন?

–আপনার থিয়োরি ঠিক। এবার দরকার অন্য একটা গাড়ি। বিগড়ে যাওয়া ট্যাক্সির কাছে বেশিক্ষণ তো দাঁড়ানো ঠিক হত না। কারণ হরিবাবু ক্যাপটেন সিংহকে জোর করে কোথায় ধরে নিয়ে যাচ্ছে। কিডন্যাপের ব্যাপার।

কথাগুলো কর্নেল কৌতুকের ভঙ্গিতে বলছিলেন। হালদারমশাই কিন্তু গম্ভীর মুখে শুনছিলেন। এবার উৎসাহে বললেন–ঠিক। ঠিক কইছেন কর্নেলস্যার! এইজন্যই আমি জয়ন্তবাবুরে কইছিলাম, এর পর দরকার একখান গাড়ি।

একটু হেসে বললাম–গাড়িটা অবশ্যই লাল মারুতি।

 কর্নেল সায় দিলেন। -হুঁ। লাল টুকটুকে মারুতি।

গোয়েন্দাপ্রবর দ্বিগুণ উৎসাহে বললেন–জাহাজিবাবু অ্যাটাক করছিল। সুশীলা মরল। হরিবাবুর পালটা গুলিতে জাহাজবাবুর হাত জখম হইল। রিভলভার ঘাসে গিয়া পড়ল। তখন সে পলাইয়া গেল। এখন কথা হইল গিয়া জাহাজবাবুর এই এলাকায় দলবল থাকতে পারে। কী কন?

–শুনেছি আছে।

–সেইজন্য হরিবাবুদের ওখান থেইক্যা তখনই পলাইয়া যাওনের কথা। হঃ! আর একখান গাড়ি না পাইলে হরিবাবুরা পলাইবে ক্যামনে?

 এসব কচকচি বা জল্পনা-কল্পনা আর আমার ভালো লাগছিল না। বললাম–ওসব কথা থাক

কর্নেল। কে ফোন করেছিল জানতে ইচ্ছে করছে।

কর্নেল বললেন–চন্দ্রপুর থাকা থেকে ও. সি. রাজেন্দ্র হাটি আমাকে যেতে বললেন। জাহাজিবাবুকে জেরা করে বিশেষ কিছু জানা যায়নি। সে নাকি তিতলিপুরে সুনয়নী দেবীর খোঁজখবর নিতে যাচ্ছিল। রাস্তায় যানবাহন পায়নি। হঠাৎ ওই ট্যাক্সিটা এসে তার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ট্যাক্সিরই কোনও লোক তার দিকে গুলি ছোঁড়ে। সে ভয় পেয়ে জঙ্গলের ভিতর পালিয়ে যায়। আর-সুশীলা নামে কোনও মেয়েকে সে চেনে না। কোনও মেয়েকে সে ট্যাক্সিতে দেখেনি। তার মৃতদেহও দেখেনি।

বললাম–তা হলে কখন বেরোবেন? চন্দ্রপুর থেকে রাত্রিবেলা জঙ্গলের পথে ফিরে আসতে হবে। এখনই বেরিয়ে পড়া উচিত।

হালদারমশাই সহাস্যে বললেন-জয়ন্তবাবুর চিন্তার কারণ নাই। থানা থেইক্যা পুলিশফোর্স আমাগো এসকর্ট কইর‍্যা আনব।

কর্নেল বললেন–মি. হাটিকে বলেছি, আপনারা জাহাজিবাবুকে জেরা চালিয়ে যান। আজ আমি থানায় যাচ্ছি না। ফরেস্ট বাংলোর দিকে আসবার সময় একটা গাছের ডালে আশ্চর্য প্রজাতির একটা অর্কিড দেখেছি। পায়ে হেঁটেই সেখানে যাব। জয়ন্ত ইচ্ছে করলে ভাতঘুম দিয়ে নিতে পারে।

বললাম–আর ভাতঘুম আসবে না। আপনার সঙ্গে অর্কিড দেখতে যাব।

গোয়েন্দাপ্রবর উঠে দাঁড়িয়ে বললেন–আমিও যামু! কর্নেলস্যার! গাছের ফাঁকে দেখছিলাম, একখান উঁচু দেউড়ি এখনও খাড়াইয়া আছে। দেখতে ইচ্ছা করে। …

সেজেগুজেই বেরুতে হল। কারণ এখানে শীতের প্রকোপ যেন দোমোহানি এলাকার চেয়ে বেশি। অবশ্য এমনও হতে পারে, এই কয়েকদিনে শীতের দাপট বেড়েছে। দোমোহানি সেচবাংলোয় থাকলে হয়তো শীতের কামড়ে জব্দ হয়ে যেতাম। কারণ ওখানে বিস্তীর্ণ একটা জলাধার আছে।

ব্রিজ পেরিয়ে মোরামবিছানো রাস্তায় আমরা হেঁটে যাচ্ছিলাম। কিছুক্ষণ পরে কর্নেল সেই গাছটার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। গাছটা বিশাল এবং গুঁড়ি থেকে শাখাপ্রশাখা পর্যন্ত মোটা লতা তাকে জড়িয়ে ধরেছে। লতাটার পাতা চওড়া। গুঁড়িকে ঢেকে ফেলেছে।

বিকেলের জঙ্গলে ছায়া ঘন হয়ে আছে। আমি অর্কিডটা খুঁজছিলাম। হালদারমশাই এদিকে-ওদিকে সতর্ক দৃষ্টিতে তাকিয়ে সম্ভবত জাহাজিবাবুর সাঙ্গোপাঙ্গদের খুঁজছিলেন। তার ডান হাত প্যান্টের পকেটে। অর্থাৎ তিনি তার ফায়ার আর্মসের বাঁটে হাত রেখেছেন। কিন্তু কেউ ঝোপঝাড় বা গাছের আড়াল থেকে গুলি ছুঁড়লে তিনি কী করবেন?

কথাটা ভেবে আমার শরীরে মুহূর্তে আতঙ্কের শিহরন জাগল। এদিকে কর্নেল রাস্তা থেকে নেমে পিঠের কিটব্যাগের চেন টেনে একটা ছোটো কাটারি বের করলেন। ওটা একটা জাঙ্গল-নাইফ-যা তার সামরিক জীবনের একটা স্মারক বলে তিনি গর্ব করেন। কাটারির গড়ন কতকটা ভোজালির মতো। সেটা দিয়ে তিনি গুঁড়িতে জড়িয়ে থাকা লতা-পাতা ছাঁটতে শুরু করলেন।

এবার অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম–কোথায় আপনার অর্কিড? লতাপাতার ভিতরে লুকিয়ে আছে নাকি?

কর্নেল জবাব দিলেন। না গুঁড়ির পিছনে জঙ্গলের দিকে মাটি পর্যন্ত লতাপাতার খানিকটা অংশ হেঁটে ফেলে আপন মনে বললেন-। যা ভেবেছিলাম, ঠিক তা-ই।

হালদারমশাই কাছে গিয়ে বললেন–কী কর্নেলস্যার?

কর্নেল গম্ভীরমুখে বললেন–বিদ্যুতের তার।

-অ্যাঁ?

-আসার সময় বাইনোকুলারে ব্যাপারটা চোখে পড়ছিল। বলে কর্নেল রাস্তায় উঠে। এলেন। -ওই দেখুন! এই গাছটার উপরের ডালপালা ঘেঁটে বিদ্যুতের চারটে লাইন গেছে ফরেস্ট বাংলোর দিকে। ওই তারগুলো যাতে গাছের কোনও অংশের সঙ্গে ছোঁয়া না লাগে, তাই গাছটার অনেকটা অংশ কেটে রাখা হয়েছে। বাতাসে বা ঝড়ের সময় দৈবাৎ গাছটার কোনও অংশের সঙ্গে ছোঁয়া লাগলেই ট্রান্সফর্মার জ্বলে যাবে। কারণ সজীব উদ্ভিদ বিদ্যুৎ পরিবাহী। এবার লক্ষ্য করুন। দুটো লাইন অর্থাৎ নেগেটিভ-পজিটিভের সঙ্গে নন-কন্ডাক্টিভ রবারে মোড়া একটা তার জোড়া আছে। সেই তার গাছের লতাপাতার আড়াল দিয়ে মাটিতে এসে ঢুকেছে।

গোয়েন্দাবর গুলিগুলি চোখে তাকিয়ে বললেন-কী কাণ্ড! মাটির তলা দিয়্যা ইলেকট্রিক লাইন চুরি করছে কেউ। কর্নেলস্যার! জঙ্গলের মধ্যে তাহলে কোনও ঘরে বিদ্যুৎ লইয়া গেছে।

আমি বললাম-হয়তো ফরেস্টগার্ডদের কোনও গোপন ঘাঁটি আছে জঙ্গলে। কাঠচোরদের জন্য গার্ডরা সেখানে পাহারা দেয়।

কর্নেল বললেন-জঙ্গলে এমন পাহারার ব্যবস্থা থাকতেই পারে। কিন্তু সে-খবর রেঞ্জার সৌম্যবাবু ছাড়া বাংলোর কেউ সম্ভবত জানে না। সৌম্যবাবু তো দুপুরে জিপ নিয়ে চন্দ্রপুরে তাঁর অফিসে চলে গেছেন।

হালদারমশাই বললেন-কর্নেল স্যার! ফরেস্টগার্ডদের ঘাঁটি খোঁজার দরকার কী?

দরকার আছে। কিন্তু ঘন জঙ্গলে সেই ঘাঁটিটা কোথায়, তা খুঁজে বের করা কঠিন। বোদ কমে আসছে।

–তা হইলে আমরা মাটি খুঁড়িয়া তারটারে ফলো করি?

কর্নেল হেসে উঠলেন। -কাজটা অন্তত হাফডজন মজুরের। কোদাল দরকার। বলে তিনি রাস্তার উত্তরদিকে–যেদিক থেকে আমরা ফরেস্ট বাংলোতে এসেছিলাম, সেই দিকটা দেখতে থাকলেন। বললেন–উত্তর থেকে বাতাস বইছে। কী একটা শব্দ শুনলাম যেন। থানা থেকে মি. হাটি জিপে চেপে আসছেন নাকি?

তারপরই তিনি চাপাস্বরে বলে উঠলেন ফের-মাই গড! লাল মারুতি!

হালদারমশাই ও আমি এক গলায় বললাম–কই? কই?

-বাঁদিকে জঙ্গলে ঢুকে গেল। জয়ন্ত! হালদারমশাই! রাস্তা ছেড়ে বাঁদিকে আমাদের নামতে হবে। ঝোপঝাড়ের আড়াল দিয়ে এগোব। কুইক! বলে কর্নেল রাস্তা থেকে নেমে জঙ্গলে ঢুকলেন। আমরা তাকে অনুসরণ করলাম।

.

১২.

কখনও গুঁড়ি মেরে কখনও ঘন গাছের আড়ালে একটুখানি দাঁড়িয়ে কর্নেল গাড়িটাকে খুঁজছিলেন। প্রায় আধঘণ্টা পরে তিনি চাপাস্বরে বললেন–এখানে গাড়িটা রাস্তা থেকে নেমে জঙ্গলে ঢুকেছে। চাকার দাগ দেখা যাচ্ছে। ফাঁকা ঘাসে ঢাকা জায়গা দিয়ে গেছে গাড়িটা। কিন্তু আমরা ফাঁকা জায়গায়। যাচ্ছি না।

বলে তিনি আমাদের থামতে ইশারা করলেন। তারপর বাঁ দিকে এগিয়ে ঝোপঝাড়ে থাকা একটু ধ্বংসস্তূপে উঠে গেলেন। বুঝলাম, কর্নেল বাইনোকুলারে গাড়িটা খুজবেন। কিন্তু ক্রমে ছায়া ঘন হয়ে এসেছে। নিবিড় জঙ্গলের মধ্যে কি গাড়িটা ওই যন্ত্র দিয়ে খুঁজে পাওয়া সম্ভব?

কিন্তু অসম্ভব হয়তো কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের পক্ষেই সম্ভব হয়ে ওঠে। তিনি সাবধানে স্তূপ থেকে নেমে এলেন। হালদারমশাই ফিশফিশ করে জিজ্ঞেস করলেন-কিছু দ্যাখলেন?

কর্নেল বললেন–একটা ভাঙা দেউড়ি এখনও খাড়া হয়ে আছে। তার নিচের দিকে লাল মারুতির একটুখানি অংশ দেখা যাচ্ছে। সাবধানে আসুন আপনারা। জয়ন্ত তোমার ফায়ার আর্মস এনেছ তো?

বললাম-এনেছি।

–হালদারমশাই?

–হঃ! জঙ্গলে নিরস্ত্র হইয়া ঢুকব ক্যান?

-কিন্তু বিন্দুমাত্র শব্দ নয়। দেখছেন তো? সবখানে ঝরাপাতা পড়ে আছে। যত সময় লাগুক, নিঃশব্দে এগোতে হবে। আর্মস রেডি রাখুন।

শীতের জঙ্গলে ঝরা পাতার ওপর দিয়ে নিঃশব্দে হাঁটা খুব সহজ কাজ নয়। তবে আমরা ঝোপঝাড় এবং কেল্লার ধ্বংসস্তূপের আড়ালে গুঁড়ি সময় লাগল। তারপর একটা স্তূপের আড়ালে লাল মারুতিটা দেখতে পেলাম। একটা উঁচু টুটাফাটা এবং আগাছাটাকা দেউড়ি কাছাকাছি দেখা গেল। গাড়িটার গায়ে হেলান দিয়ে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। ধ্বংসস্তূপের পাশ কাটিয়ে প্রথমে কর্নেল তার সামরিক জীবনের গেরিলাযুদ্ধের একটা কৌশল যেন দেখিয়ে দিলেন।

পিছন থেকে লোকটার ঘাড়ের ওপর ডান হাত দিয়ে আঘাত করলেন। এখন তার বাঁ হাতে রিভলভার। আর লোকটা তখনই নিঃশব্দে নেতিয়ে পড়ে গেল। কর্নেল চাপাস্বরে বললেন জয়ন্ত! আমার কিটব্যাগের চেন টেনে দড়ি বের করো।

হালদারমশাই অস্ত্রহাতে চিতাবাঘের মতো চারদিকে লক্ষ্য রেখেছেন। দড়ি বের করে চেন এঁটে দিলাম। কর্নেল লোকটার দুই হাত টেনে পিঠমোড়া করে বাঁধলেন। দুটো পা বেঁধে ফেললেন। লোকটা গাড়ির ড্রাইভার, তা বোঝা গেল। তার হাত থেকে চাবির গোছা ছিটকে পড়েছিল। চাবি কর্নেল কুড়িয়ে নিলেন।

এবার দেখলাম, দেউড়ির অন্য পাশে বৌদ্ধস্তূপের মতো দেখতে একটা গম্বুজঘর। এ ধরনের গম্বুজঘর দিল্লি, আগ্রা এবং অন্যত্র দেখেছি। এগুলো মোগল আমলে প্রহরীদের জন্য তৈরি করা হত। এই গম্বুজঘরটা ঘন লতাগুল্মে ঢাকা। মুখের দিকটায় লতার ঝালর ঝুলে আছে। তার ফাঁকে আলোর ছটা দেখা যাচ্ছে।

কর্নেলের নির্দেশে হালদারমশাই আর আমি লোকটাকে ধরাধরি করে একটু তফাতে আরেকটা ধ্বংসস্তূপের আড়ালে রেখে এলাম।

কর্নেল বললেন–আর্মস রেডি করে আমার পিছনে আসুন হালদারমশাই! জয়ন্ত! তুমিও এসো।

ঝুলন্ত লতাপাতার ঝালর একটু ছেঁড়া দেখে বোঝা গেল, কেউ বা কারা গম্বুজঘরে ঢুকেছে। গুঁড়ি মেরে সাঁতসেতে শ্যাওলাঢাকা হাত চার-পাঁচ মেঝের পর সিঁড়ির ধাপ দেখা গেল। নিচে থেকে আলোর ছটা ধাপে পড়েছে। শেষ ধাপে কর্নেল থমকে দাঁড়ালেন। সামনে বন্ধ দরজা। দরজার ফাটল দিয়ে আলো বেরিয়ে গম্বুজঘরের মেঝে পর্যন্ত ছটা ফেলেছে।

ভিতর থেকে চাপা গলায় কেউ কাকে ধমক দিচ্ছে–এই শেষবারের জন্য বলছি, সঠিক জবাব দাও।

জড়ানো গলায় এবং কাতর স্বরে কেউ বলল–আমাকে আর কষ্ট দিয়ো না। মেরে ফ্যালো।

–তবু কথাটা বলবে না? তাহলে থাকো তুমি এই পাতালঘরে। আলোর লাইন কেটে দিয়ে দরজায় তালা এঁটে চলে যাই। কেমন?

–অজু! অজু! দয়া করো ভাই। একটু দয়া করো।

 –কোনও দয়া নয়। বিশ্বাসঘাতকের জন্য এই শাস্তিাটাই মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলাম।

আচমকা ঘরের আলো নিভে গেল। তারপর কপাটের ফাটল দিয়ে টর্চের আলো দেখা গেল। আর হ্যাঁচকা টানে কেউ ভিতর থেকে দরজা খুলতেই কর্নেল তার বিশাল শরীরের ধাক্কায়। লোকটাকে ধরাশায়ী করলেন। আমি টর্চ জ্বালোম। হালদারমশাই একলাফে পাতালঘরে ঢুকে ধরাশায়ী লোকটাকে দেখে বলে উঠলেন-অ্যাঁ! এই হালা তো দেখি সেই হরিবাবু।

হরিবাবুর হাতের টর্চ ছিটকে পড়ে মেঝেয় আলো ছড়াচ্ছিল। কর্নেল বললেন–হালদারমশাই! আপনার হরিবাবুর জ্যাকেটের ভিতর-পকেটে শক্ত কী একটা ভরা আছে। ওটা নিশ্চয় ফায়ার আর্মস! বের করে নিন।

গোয়েন্দাপ্রবর এ-কাজে পটু। একটা ফায়ার আর্মস জ্যাকেটের পকেট থেকে বের করে তিনি গর্জন করলেন–ইচ্ছা করে দিই হালার খুলি উড়াইয়া।

কর্নেল হরিবাবুর বুক থেকে উঠে তার জামার কলার ধরে তাকে দাঁড় করালেন। হরিবাবু লাল চোখে তাকিয়ে ফোঁস ফোঁস করে শ্বাস ছাড়ছিলেন। কর্নেল তার ডান কানের পিছনে রিভলভারের নল ঠেকিয়ে বললেন-একটুও নড়বে না হরিবাবু। নড়লেই মুণ্ডু উড়ে যাবে। এবার লক্ষ্মী ছেলের মতো আমার সঙ্গে চলো। হালদারমশাই! আপনি আমার পাশে এসে হরিবাবুকে নিয়ে যেতে সাহায্য করুন। জয়ন্ত! তুমি ক্যাপটেন সিনহাকে নিয়ে এসো।

টর্চের আলোয় ঘরের কোণে এক বৃদ্ধ ভদ্রলোককে জড়োসড়ো হয়ে বসে থাকতে দেখলাম। উনিই সেই ক্যাপটেন এস কে সিনহা। তাঁর কাছে গেলে তিনি কান্নাজড়ানো গলায় বললেন–ও হরিবাবু নয়। ওর নাম অজয়েন্দু রায়।

হালদারমশাই শুধু বললেন-অ্যাঁ! তারপর কর্নেলের সঙ্গে অজয়েন্দু নারায়ণ রায়ের কাঁধের কাছে অন্যদিকের কলার ধরে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে থাকলেন।

আমি বুদ্ধি করে সুইচ খুঁজে আবার আলোটা জ্বেলে দিলাম। এবার চোখে পড়ল, ঘরের মেঝেয়। কয়েকটা প্রকাণ্ড প্যাকেট। একটা বস্তায় কী সব আছে। বস্তার মুখ বাঁধা। কিন্তু সিঁড়ি থেকে কর্নেলের তাড়ায় ক্যাপটেন সিনহাকে ধরে ওঠালাম। পা ফেলতে ওঁর কষ্ট হচ্ছিল।

গম্বুজঘর থেকে বেরিয়ে কর্নেল আমাকে তার প্যান্টের বাঁ পকেট থেকে লাল মারুতির চাবি বের করে নিতে বললেন। –জয়ন্ত! ক্যাপটেনসাহেবকে সামনের সিটে বসাও। অজয়েন্দু ওরফে হরিবাবুকে পেছনে ঢোকাচ্ছি।

হালদারমশাইয়ের সাহায্যে কর্নেল পিছনের দুটো সিটের মাঝখানে যেন গুঁজে দিলেন মোটাসোটা নাদুসনুদুস অজয়েন্দু নারায়ণ রায়কে। এখন তার পরনে প্যান্ট-শার্ট-জ্যাকেট।

কর্নেল বললেন–আমি হরিবাবুকে সামলাচ্ছি। আপনি ড্রাইভারকে কাঁধে বয়ে নিয়ে আসুন।

প্রাইভেট ডিটেকটিভ লম্বা ধ্বংসস্তূপটার কাছে গিয়ে খি খি করে হাসলেন–ভগত মরে নাই কর্নেলস্যার। বাঁধন খুলবার চেষ্টা করতাছে। এই ব্যাটা! মিলিটারি বাঁধন তুই খুলবি ক্যামনে? আয়! তরে মড়া কইর‍্যা কান্ধে চাপাই।

যে কথা, সেই কাজ। আমি বললাম-ওকে এটুকু গাড়িতে কোথায় ঢোকাবেন?

কর্নেল একটু হেসে বললেন-এ গাড়ির ডিকিতে ঢোকাতে হলে ওকে কেটে টুকরো টুকরো করতে হবে।

হাত-পা বাঁধা ভগত হালদারমশাইয়ের কাধ থেকে ঝুলছিল। এ-কথা শুনে ভেউ ভেউ করে কাঁদতে লাগল।

কর্নেল বললেন-বরং এক কাজ করুন হালদারমশাই। ওকে হরিবাবুর কোলের ওপর দিয়ে লম্বালম্বি শুইয়ে দিন। আপনি আমার পাশের সিটে বসে ওর মুণ্ডুটা ধরে থাকুন। 

 সে এক অদ্ভুত অবস্থা। পিছনের দুটো সংকীর্ণ সিটে ডানদিকে কর্নেল, বাঁদিকে হালদারমশাই এবং মাঝখানে অজয়েন্দ্র রায়, তার দুই পা দুমড়ে তলায় ঢুকে আছে। বেচারা যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। এদিকে তার বুকের ওপর বোঝা তার বিশ্বস্ত অনুচর ভগত। হালদারমশাই বললেন-হালা এই হাত দিয়া আমারে মারতে ড্যাগার তুলছিল!

কর্নেলের নির্দেশে গাড়িতে স্টার্ট দিলাম। আমার গাড়িটা পুরোনো ফিয়াট। কিন্তু কালেভদ্রে দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার মারুতি জিপসি আমাকে চালাতে হয়েছে। এক্ষেত্রে একটাই অসুবিধে। জায়গাটা জঙ্গল হেডলাইটে ফাঁকা জায়গা খুঁজে এগোতে হচ্ছিল। মারুতির মতো খুদে গাড়িতে আটজন লোক। যেকোনও মুহূর্তে উলটে যাওয়ার ভয়ও ছিল।

মোরামরাস্তায় সবেগে উঠে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম-কর্নেল! চন্দ্রপুরের পথ আমি চিনি না। থানা কোথায় তা-ও জানি না।

আমার পাশ থেকে ক্যাপটেন সিংহ জড়ানো গলায় বললেন–চলুন। আমি চিনিয়ে দেব।

 চন্দ্রপুরগামী পিচরাস্তায় পৌঁছোনোর পর সামনে দূরে একটা গাড়ির জোরালো হেডলাইট দেখা যাচ্ছিল। পিছন থেকে হালদারমশাই বললেন–জয়ন্তবাবু! সাবধান! এইটুখান রাস্তা।

আমি হর্ন বাজাতে বাজাতে এবং হেডলাইট কখনও নিভিয়ে কখনও জ্বালিয়ে এবার গতি কমিয়ে এগোচ্ছিলাম। একটু পরেই আমাদের গাড়ির পথ আটকে সেই গাড়িটা দাঁড়িয়ে গেল এবং টর্চের আলো পড়ল আমাদের ওপর। তারপরই সামনের গাড়ি থেকে ও সি রাজেন্দ্র হাটিকে রিভলভার উঁচিয়ে নামতে দেখলাম। কর্নেল গাড়ি থেকে নেমে সহাস্যে বললেন–আসুন মি. হাটি! আপনার হাতে অমূল্য সম্পদ দুটো তুলে দিই।

রাজেন্দ্র হাটি এসে আমাদের গাড়ির ভিতর টর্চের আলো ফেললেন, যদিও কর্নেল দরজা খুলে নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মারুতির ভিতরে আলো জ্বলে উঠেছিল। মি. হাটি মুচকি হেসে বললেন–কোনটা কে মি. হালদার?

প্রাইভেট ডিটেকটিভ বললেন–মি. হাটি! আগে এই মালটারে হ্যান্ডকাপ পরানো দরকার। এটা হইল গিয়া হরিবাবু–মানে, অজয়েন্দু নারায়ণ রায়। আর যারে বাইন্ধা মড়ার মতো লম্বা করছি, এটা হইল গিয়া অর চ্যালা ভগত।

কর্নেল চুরুট ধরিয়ে টানছিলেন। পুলিশের জিপ থেকে ততক্ষণে একদঙ্গল কনস্টেবল নেমে লাল মারুতিটাকে ঘিরে ধরেছে। মি. হাটির নির্দেশে অজয়েন্দু এবং ভগতকে টেনে তারা বের করল। হাতকড়ি পরিয়ে অজয়েন্দু রায়কে টেনে নিয়ে গেল। ভগতের পায়ের বাঁধন খোলা যাচ্ছিল না। অগত্যা কর্নেল তার মিলিটারি বাঁধন খুলে দিলেন। তাকেও কনস্টেবলরা পুলিশ জিপের পিছনে ঢোকাল।

মি. হাটি বললেন–সামনের সিটে ইনি কে?

কর্নেল বললেন–ইনিই ক্যাপটেন এস কে সিনহা। অজয়েন্দু রায় এঁকে কলকাতা থেকে কিডন্যাপ করে এনেছিল। বাকি কথা যথাসময়ে শুনবেন। চলুন। আপনার ডেরায় গিয়ে কফি খাব। তারপর অন্য কথা।

পুলিশের গাড়িকে অনুসরণ করে এগোচ্ছিলাম। পিছনের সিটে এবার আরাম করে কর্নেল ও হালদারমশাই বসেছেন। হালদারমশাই বললেন-কর্নেল স্যার! ওই পাতালঘরে চোরাই জিনিস আছে মনে হয়। মি. হাটিরে জানান দেওয়া উচিত ছিল। ক্যান কী, এই সুযোগে অগো চ্যালারা যদি জিনিসগুলি লইয়া যায়?

কর্নেল বললেন–পাতালঘরটার দিকে আপাতত কেউ পা বাড়াবে না।

-কর্নেলস্যার! আমার ধারণা, পাতালঘরটার কথা জাহাজিবাবু জানে। অজয়েন্দু রায়ের লগে অর বন্ধুতা ছিল। বর্ডার এলাকায় দুইজনেই চোরাকারবার করত। আপনি কী কন?

–ঠিক বলেছেন।

 –কিন্তু অগো বন্ধুতা নষ্ট হইল ক্যান?

-পরে সব খুলে বলব। ক্যাপটেন সিনহার কাছে গচ্ছিত জিনিসটা জাহাজবাবু চুরি করার পর জাহাজিবাবু সম্ভব অজয়েন্দ্র রায়ের সঙ্গে আর দেখা করত না। এদিকে অজয়ের সন্দেহ হয়েছিল, ক্যাপটেন সিনহাই সেই জিনিস গোপনে বেচবার চেষ্টা করছেন। তাই সুশীলার সাহায্যে ক্যাপটেন সিনহাকে সে কিডন্যাপ করল।

ক্যাপটেন সিনহা বললেন-আমার এই দুরবস্থার জন্য সুশীলাই দায়ী। মেয়েটার জন্য কষ্ট হয়। কিন্তু শয়তানের ফাঁদে পড়লে মানুষকে মরতে হয়। হতভাগিনী বেঘোরে মারা পড়ল।

কর্নেল বললেন–ট্যাক্সি খারাপ হওয়ার পর সুশীলা বেরিয়েছিল। তাই না?

-হ্যাঁ। তারপর গুলির শব্দ শুনলাম। সুশীলা ঝোপের ওপর পড়ে গেল। তারপর আবার গুলির শব্দ হল। কিন্তু তখন কে কাকে গুলি করছে বুঝতে পারিনি। আমাকেও গুলি করে মারবে ভেবে ঈশ্বরকে ডাকছিলাম।

-এই মারুতি গাড়িটা কোন দিক থেকে এসেছিল, আপনি দেখেছিলেন?

-না। তবে অজয়ের হাতে সেলফোন দেখেছিলাম। আমার ধারণা, ওই ফোনে সে গাড়িটাকে আনতে বলেছিল।

-তারপর আপনাকে এই গাড়িতে চাপিয়ে অজয়েন্দু চন্দ্রপুর নিয়ে গিয়েছিল?

-তাই হবে। মাথা তখন ঝিমঝিম করছিল। শুধু মনে আছে, একটা বাড়ির দোতলায় আমাকে খেতে দিয়েছিল।

-তারপর আজ বিকেলে আপনাকে এই গাড়িতে চাপিয়ে তিতলিপুরের জঙ্গলে নিয়ে এসেছিল।

-হ্যাঁ। অজয়ের দৃঢ় বিশ্বাস, শম্ভু আর আমি ওর চোরাই মাল বেচে অনেক টাকা পেয়েছি। শম্ভুকে খুঁজে না পেয়ে অজয়েন্দু আমার ওপর লক্ষ্য রেখেছিল। নিশ্চয় সুশীলাকে টাকা খাইয়ে বশ করেছিল সে।

–আপনার কাছে গচ্ছিত রাখা জিনিসটা কী, তা আপনি কি জানেন?

–জানতাম। কায়রো মিউজিয়াম থেকে চুরি করে আনা একটা পার্চমেন্ট। পেতলের নলে সেটা ভরা ছিল। তখন অজয়ে ফেরারি আসামি। গোপনে একরাত্রে আমার কাছে ওটা রাখতে এসেছিল।

-ওটার সঙ্গে কোনও ফলক ছিল না?

-না। …ও হ্যাঁ। অজয়ে বলেছিল, একটা ব্রোঞ্জের ফলকও ছিল। সেটা শম্ভু হাতিয়ে নিয়েছিল।

কর্নেল একটু চুপ করে থাকার পর বললেন–অজয়েন্দ্র রায় ঠিক কথা বলেনি। সে নিজেই ওটা তার দাদা দীপনারায়ণকে রাখতে দিয়েছিল। দীপনারায়ণ তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু শম্ভুকে ওটা বেচবেন বলে টাকাকড়ি অগ্রিম নিয়েছিলেন। ঘটনাচক্রে সেটা হারিয়ে যায়। সেই আক্রোশে শম্ভু সম্প্রতি এক রাত্রে দীপনারায়ণবাবুকে খুন করেছে।

আমি কিছু জানি না। বলে ক্যাপটেন সিনহা আমার দিকে তাকালেন–বাবা! একটু জল খাওয়াতে পারো? গলা শুকিয়ে গেছে।

পিছনে থেকে কর্নেল তার জলের বোতল এগিয়ে দিলেন। ক্যাপটেন সিনহা অতিকষ্টে কিছুটা জল খেলেন। কিছুটা তার প্যান্ট ভিজিয়ে দিল। …

চন্দ্রপুর থানা থেকে পুলিশের দুটো গাড়ি এসেছিল। একটা গাড়ি আমায় ও হালদারমশাইকে ফরেস্ট বাংলোয় পৌঁছে দিয়েছিল। কর্নেল অন্য গাড়িতে ও. সি. মি. হাটিকে তিতলিপুর জঙ্গলে সেই পাতালঘর দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন। ক্যাপটেন সিংহকে চন্দ্রপুরে একটা নার্সিংহোমে রাখা হয়েছিল।

গোয়েন্দাবরের খুব ইচ্ছা ছিল, তিনিও কর্নেলের সঙ্গে যাবেন। কিন্তু কর্নেল বলেছিলেন আপনি আর জয়ন্ত একত্র থাকা দরকার। এখনও আমরা বিপদের মধ্যে আছি। জাহাজিবাবুর গ্যাংয়ের লোকেরা সবাই ধরা পড়েনি।

কর্নেল ফিরে এসেছিলেন রাত এগারোটায়। পাতালঘরে দেশবিদেশের কিছু দেবমূর্তি, সোনাদানার অলংকার আর কয়েক প্যাকেট বিস্ফোরক ছিল। আর একটা কথা–সেই ট্যাক্সিচালকের খোঁজ পাওয়া গেছে। লালবাজার থেকে নরেশ ধর চন্দ্রপুর থানায় জানিয়েছেন কাল সকালে তাকে নিয়ে চন্দ্রপুরে আসছেন।

জিজ্ঞেস করেছিলাম–কালকের দিনটাও এখানে আমরা থাকব নাকি?

-না জয়ন্ত! আমরা কাল সকালেই কলকাতা ফিরব। হালদারমশাই তাঁর মক্কেল ক্যাপটেন সিনহার জন্য থেকে যেতে পারেন অবশ্য!

গোয়েন্দাপ্রবর মাথা নেড়ে বলেছিলেন–না কর্নেলস্যার! আমার মক্কেল নার্সিংহোমে আছেন। পুলিশ ওনার দেখভাল করতাছে। আমার কাজ শেষ।

আমি বললাম–আচ্ছা কর্নেল! মিশরের রানি নেকারতিতির চিঠি আর সেই ফলকটার কী ব্যবস্থা করবেন?

কর্নেল মিটিমিটি হেসে বললেন–বেচলে কোটিপতি হতাম। কিন্তু অত টাকা নিয়ে করবটা কী? তার চেয়ে ভারত সরকারের বিদেশমন্ত্রকের মধ্যস্থতায় মিশরের রাষ্ট্রদূতের হাতে সমর্পণ করব। দেখব, কী হইচই পড়ে যায়। পৃথিবী সব দেশের টিভিতে সেই দৃশ্য দেখা যাবে।

প্রাইভেট ডিটেকটিভ খি খি করে হেসে বললেন–আমাগো য্যান বাদ দিবেন না কর্নেলস্যার! কী কন জয়ন্তবাবু?

সায় দিয়ে বললাম–ঠিক বলেছেন হালদারমশাই। …

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *