৫. অপেক্ষার পালা

এরপর কেবল অপেক্ষার পালা। ধৈর্য ধরে বসে রইলাম আমরা। লুক্সর প্রাসাদ এবং প্রধান বন্দরের ওপর দিনরাত চোখ রেখেছে ওয়েনেগ আর তার গুপ্তচররা কোনো অস্বাভাবিক কর্মকাণ্ড চোখে পড়ে কি না দেখছে। আমি বুঝতে পারছি খুব বেশি দিন অপেক্ষা করতে হবে না ওদের। পেন্টু আমাকে জানিয়েছে, সে যখন গিথিয়ন বন্দর ছেড়ে রওনা দেয় তার পরপরই যাত্রা শুরু করার কথা ছিল হুরোতাসের, এবং আমার আন্দাজই সত্যি হলো। সে এসে পৌঁছানোর মাত্র বারো দিনের মাথায় শহর থেকে বেরিয়ে আসা রাস্তাটা ধরে এগিয়ে আসতে দেখা গেল ওয়েনেগকে। আনন্দের বাগানের প্রাচীরের ওপর থেকে তাকে আসতে দেখলাম আমি। প্রায় আধ লিগ দূরত্ব থেকেও পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে দারুণ উত্তেজিত হয়ে আছে সে। প্রাচীরের ওপর আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেই ঘোড়ার রেকাবের ওপর ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াল সে, দুই হাত নাড়তে লাগল মাথার ওপর তুলে।

দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসে তার সাথে দেখা করার জন্য প্রধান দরজায় চলে এলাম আমি। এলাহি কারবার শুরু হয়ে গেছে পুরো লুক্সর শহরে! কথা শুনতে পাওয়ার মতো দূরত্বে আসার সাথে সাথে চিৎকার করে আমাকে জানাল ওয়েনেগ। ঢাক আর শিঙার আওয়াজে কান পাতা দায়! যুদ্ধের জন্য নিজের পশ্চাদ্দেশ সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে উটেরিক অথবা বলা যায় নিজের লোকদের পশ্চাদ্দেশ সামলাতে বলে নিজে বিছানার তলে গিয়ে লুকোতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।

তার মানে অবশেষে হুরোতাস, তার হুই তাদের মিত্রদের নিয়ে মিশরের কাছাকাছি এগিয়ে এসেছে! যাও, রামেসিসকে খুঁজে বের করো! এক ঘণ্টা আগে ওকে রাজকুমারীর সাথে বাগানে দেখেছিলাম। ওকে বলবে উটেরিকের যুদ্ধপ্রস্তুতি কত দূর তা দেখার জন্য লুক্সর যেতে হবে আমাদের। সেইসাথে তার মতলবটা আসলে কী সেটাও জানার চেষ্টা করতে হবে। প্রথম দিন তোমার মদের দোকানে যে ছেঁড়া কাপড় পরে ঢুকেছিলাম আমরা সেই ছদ্মবেশই নেব আজকে। প্রস্তুত হয়ে প্রধান দরজায় চলে আসতে বলো ওকে। সেখানেই যেন আমার সাথে দেখা করে ও।

ইচ্ছে করেই ছদ্মবেশের জন্য ব্যবহৃত সেই ছেঁড়া কাপড়গুলো পরিষ্কার করিনি আমি। তবে প্রচণ্ড দুর্গন্ধ বের হতো ওগুলো থেকে, তাই একটা বাক্সে বন্ধ করে রেখে দিয়েছিলাম। এখন বাক্স খুলে বের করলাম ওগুলো। এবং দেখলাম গন্ধটা এখনো এত তীব্র যে একবার নাকের কাছে নিয়ে শুঁকতেই পানি বেরিয়ে এলো আমার চোখ দিয়ে। হাত আর মুখে কালি মেখে নিলাম আমি, তারপর মাথায় চড়ালাম মানুষের চুল আর পশুর লোম দিয়ে তৈরি একটা পরচুলা। এটাও আমার পোশাকের মতোই ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে এবং নানা ধরনের পোকামাকড় আর উকুনের আস্তানা। উকুনগুলোর কারণে অবশ্য সুবিধাই হয়েছে, কারণ এতে করে উৎসুক আগন্তুকরা দূরে থাকবে আমার কাছ থেকে।

আস্তাবলের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় একটু থেমে ঘোড়ার পানি খাওয়ার পাত্রে নিজের প্রতিবিম্ব দেখে নিলাম আমি। এবং সন্তুষ্ট হলাম, কারণ যথেষ্ট কুৎসিত লাগছে আমাকে দেখতে। এবার দ্রুত আনন্দের বাগানের প্রধান দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম। রামেসিস সেখানে অপেক্ষা করছিল আমার জন্য। ও নিজেও একই রকম কুৎসিত ছদ্মবেশ নিয়েছে, দুর্গন্ধে কাছে যাওয়া যায় না। কিন্তু আমার চাইতে অন্তত ভালো লাগছে ওকে দেখতে। কিন্তু ওর পাশে দাঁড়িয়ে। থাকা বুড়িটাকে আমি মোটেই চিনতে পারলাম না। ইয়া মোটা শরীর, চেহারা ঢাকা পড়েছে এলোমেলো ময়লা পাকা চুলের ওপাশে। হেলেদুলে এগিয়ে এলো বুড়ি, এবং যখন বুঝতে পারলাম যে তার উদ্দেশ্য হচ্ছে আমাকে জড়িয়ে ধরা, সভয়ে পিছিয়ে গেলাম আমি।

খবরদার বুড়ি, দূরে থাকো! তাকে সাবধান করে দিয়ে বলে উঠলাম। তোমাকে আগেই বলে দিচ্ছি আমার শরীরে কিন্তু কুষ্ঠ আর বসন্ত- দুটো রোগই আছে।

দুটোই? ইস, তুমি এত লোভী কেন, টাটা? তবে অসুবিধা নেই, আমি অত বাছবিচার করি না। যেকোনো একটা আমাকে দিলেই হবে। সুরেলা হাসির দমকে কেঁপে উঠল বুড়ি। এবার একটু স্থির হয়ে দাঁড়াও তো, তোমাকে একটা চুমু খাই।

সেরেনা! চেঁচিয়ে উঠলাম আমি। তুমি হঠাৎ এত মোটা হয়ে গেলে কীভাবে?

মায়ের পাঠানো পোশাকগুলো থেকে কয়েকটা আমার কোমরে জড়িয়ে নিয়েছি। তোমার কাছ থেকেই তো শিখেছি বুদ্ধিটা। তবে একটা ব্যাপার স্বীকার করতেই হচ্ছে: তোমার চুলগুলো দারুণ পছন্দ হয়েছে আমার!

এবার দুর্গের পেছনের দরজা দিয়ে সবার অলক্ষ্যে চুপি চুপি বের হয়ে এলাম আমরা, যেদিকটা শহর থেকে সবচেয়ে দূরে। তারপর জঙ্গলের আড়ালে আড়ালে ঘুরপথে গিয়ে সম্পূর্ণ অন্য দিক দিয়ে লুক্সরের দিকে এগিয়ে চললাম। শহর থেকে বেশ অনেকটা পথ দূরে থাকতেই যুদ্ধের বাজনা ভেসে এলো আমাদের কানে। শহরের ভেতর থেকে ভেসে আসছে ঢাক, বাঁশি আর ট্রাম্পেটের কান ফাটানো নিনাদ। শহর ঘিরে থাকা পাহাড়ের মাথায় উঠে এলাম আমরা। নিচে তাকানোর পর প্রথম যেটা চোখে পড়ল সেটা হচ্ছে। নীলনদে নোঙর করে থাকা যুদ্ধজাহাজের বহর। দেখে মনে হলো কমপক্ষে কয়েক শ হবে তাদের সংখ্যা, সহজে গুনে শেষ করা অসম্ভব। এত কাছাকাছি নোঙর করে রয়েছে যে, নদীর ওই অংশে পানিই দেখা যাচ্ছে না।

যদিও সবগুলো জাহাজের পাল নামানো রয়েছে এখন তবে মাস্তুল এবং খোলের প্রায় সম্পূর্ণ অংশে নানা রকম আকার আকৃতি এবং রঙের পতাকায় ভর্তি। জাহাজগুলোর মাঝে সরু জায়গায় চলাচল করছে ছোট ছোট দাঁড়টানা নৌকা। সেসব নৌকার ওপর ভর্তি নানা আকৃতির পিপে আর মালামাল, বড় জাহাজগুলোতে আনা-নেওয়া করা হচ্ছে সেগুলো। এই সুবিশাল আয়োজন দেখে দ্রুত হয়ে উঠল আমার হৃদস্পন্দন।

বেশির ভাগ মানুষই আমাকে চেনে সাধু-সন্ন্যাসী প্রকৃতির মানুষ হিসেবে, যার হৃদয় মহৎ, যার আচরণ ভদ্র এবং ক্ষমাশীল। কিন্তু আর কেউ না জানলেও আমি জানি যে এই শান্ত চেহারার আড়ালে লুকিয়ে আছে এক ক্রুদ্ধ যোদ্ধা, এক বেপরোয়া মানুষ। সেই মুহূর্তে ফারাও উটেরিকের প্রতি আমার ঘৃণা এত তীব্র হয়ে উঠল, মনে হলো যেন সেই ঘৃণার উত্তাপে আমার নিজের হৃদয়েই আগুন ধরে যাবে।

নদীর তীর এবং আমাদের মাঝখানে শহরের দিকে তাকালাম আমরা। দেখলাম নদীবক্ষের মতোই একই রকম যুদ্ধকালীন উত্তেজনা আর প্রস্তুতির এলাহি কারবার চলছে শহর প্রাচীরের ভেতরেও। প্রতিটি ভবনের ছাদ এবং মিনার, প্রতিটি দেয়াল এবং শহর প্রাচীরের ওপর উড়ছে নানা রঙের এবং আকৃতির পতাকা।

শহর প্রাচীরের বাইরে প্রতিটি রাস্তা গিজগিজ করছে মানুষ আর গাড়ি-ঘোড়ায়। রথ, নানা আকৃতির গাড়ি আর বাহনের ভিড় জমেছে সেখানে। কোনোটা টানছে মানুষ, কোনোটা ঘোড়া বা গরু, এমনকি ছাগলে টানা গাড়িও আছে তাদের মধ্যে। আর এই বিশাল হট্টগোলের কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে লুক্সর। পাহাড়ের গায়ে জন্মানো ঘন জঙ্গলের মাঝ দিয়ে এবার নামতে শুরু করলাম আমরা তিনজন। জঙ্গলের ভেতরে বেশ কিছুক্ষণ চলার পর একটা পথ পাওয়া গেল, যেটা শহরের পেছন দিকের একটা প্রবেশপথের দিকে এগিয়ে গেছে। এবার একজন একজন করে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এলাম আমরা, তারপর ছেঁড়া কাপড়ের ছদ্মবেশ ঠিকঠাক করতে করতে এগোতে লাগলাম সামনের দিকে, কেউ দেখলে ভাববে জঙ্গলের মাঝে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গিয়েছিলাম। একটু এগিয়ে গিয়ে লুক্সর অভিমুখে এগিয়ে যাওয়া জনতার স্রোতের সাথে মিশে গেলাম আমরা। কেউ খেয়াল করল না আমাদের দিকে, এবং শহরের দরজায় পৌঁছানোর পর কেউ কোনো প্রশ্নও জিজ্ঞেস করল না। জনতার ভিড়ে মিশে শহরে ভেতর ঢুকে পড়লাম তিনজন।

বাইরের রাস্তাগুলোর তুলনায় ভেতরের রাস্তাগুলোতে মানুষ বরং আরো বেশি। শুধু ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত সৈনিকদের সারি বাদে আর কেউই কোথাও নিজের প্রয়োজনমতো যেতে পারছে বলে মনে হয় না। পথ ধরে এগিয়ে গিয়ে বন্দরে অপেক্ষারত জাহাজগুলোতে উঠছে সৈন্যদের দল। তাদের সামনে সামনে যাচ্ছে সেনা কর্মকর্তারা, হাতে চাবুক। গালিগালাজের তুবড়ি ছুটিয়ে, সেইসাথে চাবুকপেটা করে রাস্তা থেকে উৎসুক জনতাকে সরিয়ে দিচ্ছে তারা, সেইসাথে পথ করে দিচ্ছে সৈন্যদের জন্য।

সৈন্যরা পার হয়ে যাওয়ার সাথে সাথেই আবার ভিড়ে ভরে যাচ্ছে রাজপথ। তাই এদিক-ওদিক খুব বেশি নড়াচড়ার উপায় নেই আমাদের। মানুষের সাথে কাঁধে কাঁধ আর পেটে পিঠ ঠেকিয়ে কোনোমতে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি আমরা। অবশ্য রামেসিস আর আমি দুজনই এই শহরকে খুব ভালো করেই চিনি, এই শহরেই প্রায় সারা জীবন কেটেছে আমাদের। তাই জনতার ভিড়ের সবচেয়ে দুর্ভেদ্য অংশটাকে কাটিয়ে অলিগলি এবং মাটির নিচের পথ বেছে নিলাম আমরা। এসব পথের মধ্যে কিছু কিছু পথ এত সরু যে, পাশাপাশি দুজন চলার কোনো উপায় নেই, কোথাও আবার তার চেয়েও বেশি সরু হওয়ায় পাশ ফিরে হাঁটতে হলো। পথ চেনার জন্য মাথার ওপর জ্বলন্ত মোমবাতি জ্বেলে ধরে রাখেছি আমরা। যদিও জানি যে আশপাশের ভাঙাচোরা দালানগুলো যেকোনো সময় ধসে পড়তে পারে, আবর্জনার স্তূপের নিচে চাপা দিতে পারে আমাদের। ইতোমধ্যে আমাদের পায়ের নিচে এমন বহু লোকের সমাধি হয়ে গেছে, কারণ ধস নামা এসব অঞ্চলে খুবই স্বাভাবিক ঘটনা।

এসব সুড়ঙ্গ মাঝে মাঝেই হুট করে গিয়ে শেষ হচ্ছে নানা আকৃতি এবং উচ্চতার গুহা বা ভুগর্ভস্থ ঘরের মতো বিভিন্ন জায়গায়। সেসব ঘরে ভিড় জমিয়েছে ব্যবসায়ীরা, নিজেদের সাথে নিয়ে আসা অসংখ্য নাম না জানা পণ্য কেনাবেচায় ব্যস্ত তারা।

এই সব পণ্যের মাঝে একটা জিনিস আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। সেটা হচ্ছে বোতলে ভর্তি হাথোরের প্রস্রাব। একটা শিশি তুলে নিয়ে রাজকুমারী সেরেনাকে উপহার দিতে চাইলাম আমি, কারণ জিনিসটা এখানে খুব কম দামে পাওয়া যাচ্ছে। তবে সেরেনা প্রত্যাখ্যান করল উপহারটা, বলল যে প্রস্রাবের দরকার হলে সে নিজেই উৎপাদন করতে পারবে।

এই ব্যবসায়ীদের মাঝে একজন হঠাৎ করে এগিয়ে এলো আমার দিকে। মুখে নানা রঙের আঁকিবুকি কাটা পুরুষ না মহিলা তা বোঝার কোনো উপায় নেই। এই যে দুষ্টু ছেলে। একটু আসা-যাওয়া চলবে নাকি? মানে আমি বলতে চাইছি একটু ঢোকা আর বেরোনো?

না না, এত তাড়াতাড়ি নয়। একটু আগেই নাশতা করলাম। এখন ওসব কাজ করলে হিক্কা উঠবে আমার, শান্ত গলায় জবাব দিলাম আমি।

লোকটা অথবা মেয়েলোকটা কয়েক মুহূর্ত সরু চোখে তাকিয়ে থাকল আমার দিকে। তারপর বলল, তোমাকে দেখে আমার বিখ্যাত ভবিষ্যদ্রষ্টা প্রভু টাইটার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। তবে তার চাইতে তোমার বয়স অনেক বেশি, দেখতেও অনেক বেশি কুৎসিত।

হাহ, তুমি কোনো দিন প্রভু টাইটাকে দেখার সুযোগ পেয়েছ বলে আমার মনে হয় না, পাল্টা জবাব ছুড়লাম আমি।

দেখিনি মানে? আমার নাকের নিচে তর্জনী ঘোরাল লোকটা। প্রভুকে খুব ভালো করেই চিনতাম আমি।

তাহলে তার সম্পর্কে এমন কিছু বলো, যেটা আর কেউ জানে না।

প্রভু টাইটার দণ্ডটা ছিল বিশাল বুঝলে? হাতির গুঁড়ের চাইতেও লম্বা, তিমি মাছের ইয়ের চাইতেও মোটা। কিন্তু এখন আর তিনি বেঁচে নেই।

তুমি যার কথা বলছ সে হচ্ছে টাইটার যমজ ভাই। আসল প্রভু টাইটা ছিলেন বাঁহাতি। এ ছাড়া আর কোনো তফাত নেই তাদের মধ্যে, লোকটাকে জ্ঞান দিলাম আমি।

বিভ্রান্ত দেখাল লোকটাকে। নাক খুঁটতে শুরু করল সে। তারপর মাথা নেড়ে বিড়বিড় করে বলে উঠল, কী অদ্ভুত! আমার কখনো মনেই হয়নি যে প্রভু টাইটার একটা যমজ ভাই থাকতে পারে। তারপর নাক খুঁটতে খুঁটতেই অন্য এক দিকে চলে গেল সে। এবার রামেসিস আর সেরেনা দুজনই তাদের চোখের ওপর থেকে পরচুলার আবরণ সরিয়ে আমার দিকে তাকাল।

তোমার মতো নির্বিকার মুখে মিথ্যে কথা বলাটা শিখতে পারলে খুব ভালো হতো, আফসোসের গলায় বলল রামেসিস।

তোমার এই যমজ ভাইয়ের নামটা কী বলো তো? সে যদি তোমার চাইতে কম বয়স্ক এবং সুদর্শন হয় তাহলে তার সাথে দেখা করতে চাই আমি, বেশ গম্ভীর গলায় বলে উঠল সেরেনা, এবং সাথে সাথে নিতম্বে রামেসিসের চিমটি খেয়ে লাফিয়ে উঠল।

*

মাটির নিচের বিভিন্ন অলিগলি দিয়ে ধীরে ধীরে ওপরে উঠে আসার রাস্তা করে নিতে লাগলাম আমি আর রামেসিস। শেষ পর্যন্ত একটা বাতিল পয়োনিষ্কাশন পথের দেখা পেয়ে সেটা ব্যবহার করে বেরিয়ে এলাম। দেখলাম কুচকাওয়াজের ময়দানের এক কোণে পড়ে থাকা বেশ কিছু ভাঙাচোরা জিনিসপত্র পড়ে আছে আর তার মাঝখানে এসে উঠেছি আমরা। জায়গাটাকে লোকজন প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার স্থান বানিয়েছে। আমরা যখন উঠে এলাম তখনো বেশ কয়েকজনকে ওই কাজে ব্যস্ত থাকতে দেখা গেল। তবে কেউ আমাদের দিকে খেয়াল করল না, আমরাও কাউকে বিরক্ত না করে নিজেদের কাজে এগিয়ে গেলাম।

তবে স্বীকার করতেই হবে যে, আজকের দিনে শহরের সবচেয়ে ব্যস্ত এবং কোলাহলপূর্ণ এলাকা হচ্ছে এই ময়দান। সঠিক রাস্তা ধরে এলে জীবনেও এখানে পৌঁছতে পারতাম না আমরা। পূর্বনির্ধারিত ব্যবস্থা অনুযায়ী আবর্জনাভর্তি জায়গাটার মুখেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল ওয়েনেগ আর তার চার সঙ্গীকে। আমাদের তিনজনকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এলো তারা, তারপর চারপাশ থেকে আমাদের ঘিরে ধরে সামনে এগিয়ে চলল। ভিড়ের মধ্যে আমরা যেন মানুষের পায়ের নিচে চাপা না পড়ি সে জন্যই এই ব্যবস্থা। পাথরে বাঁধাই করা পথ ধরে এগিয়ে চললাম আমরা। বেশ কিছু দূর এগোনোর পর একটা উঁচু সমতল জায়গা পাওয়া গেল, যেখান থেকে পুরো ময়দানের ওপর বেশ ভালোভাবে নজর রাখা যায়। মনে হচ্ছে যেন লুক্সরের সম্পূর্ণ জনসংখ্যা আজ এই ময়দানে এসে উপস্থিত হয়েছে।

শুধু ময়দানের মাঝখানটা খালি। দড়ি দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে জায়গাটাকে, তার ওপর জনতার ভিড় যেন জায়গাটার ওপর হামলে পড়তে না পারে সে জন্য খোলা তলোয়ার হাতে প্রহরীরা চারপাশ থেকে ঘিরে ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি তার ঠিক নিচেই রয়েছে একটা কাঠের তৈরি উঁচু মঞ্চ। তবে এই মুহূর্তে মঞ্চের ওপরটাও খালি। মঞ্চের সামনে রয়েছে এক দল বাদক, যাদের সদস্য সংখ্যা হবে প্রায় পঞ্চাশজন। এই মুহূর্তে নানা রকম উত্তেজনাকর যুদ্ধসংগীত আর দেশপ্রেমমূলক গানের সুর বাজাচ্ছে তারা।

ধীরে ধীরে চড়ায় উঠল তাদের বাজনা, তারপর একটা চূড়ান্ত বাজনার সাথে সাথে থেমে গেল। এবার বাদকদলের নেতা ধীরে ধীরে জনতার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে এক হাত উঁচু করল। নিস্তব্ধ হয়ে এলো জনতার হইচই।

তারপর সেই নীরবতার মাঝে মঞ্চের ওপর উঠে এলো দীর্ঘদেহী এক ব্যক্তি। সমস্ত শরীর সোনা দিয়ে ঢাকা তার। মাথা থেকে পা পর্যন্ত ঢাকা পড়ে গেছে মূল্যবান ধাতুর আড়ালে। সোনার তৈরি শিরস্ত্রাণ আর মুখাবরণ, সেইসাথে সোনার বর্ম এবং জুতো। তার ওপর সূর্যের আলো এসে ঝলকানোর কারণে চোখ ঝলসে যাচ্ছে, বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না। সন্দেহ নেই মানুষের মনোযোগ আকর্ষণের দারুণ এক উপায়।

তার পরেই আবারও পুরোদমে বাজনা শুরু করল বাদকদের দল। এবার বাজনাটা চিনতে পারলাম আমি। নিজের গুণাবলি সবিস্তারে বর্ণনা করে একটা গান লিখেছিল উটেরিক, সেই গানের সুর। গানটার নাম হচ্ছে অপরাজেয়। এই গানের সংকেত পেয়ে এবার একদল রাজকীয় দেহরক্ষী মাঠে নেমে এলো। সংখ্যায় হাজারখানেক হবে তারা, প্রত্যেকে গানের তালে তালে তলোয়ার দিয়ে ঢালের ওপর বাড়ি দিচ্ছে আর গানের অংশবিশেষ সমস্বরে গাইছে:

অযুত বীরের মৃত্যু হলেও
অপরাজেয় বেঁচে থাকে!
অযুত বছর পেরিয়ে গেলেও
অপরাজেয় বেঁচে থাকে!

গানটার অদ্ভুত এবং হাস্যকর কথাগুলো শুনতে শুনতে মিশরের সিংহাসনে এই মুহূর্তে বসে থাকা দানবটার প্রতি আমার ঘৃণা এবং ক্রোধ আরো বেড়ে উঠল। লোকটার পাগলামিকে আরো বাড়িয়ে তুলেছে তার ধূর্ততা আর চালাকি। পাশে বসে থাকা সেরেনার দিকে এক নজর তাকালাম আমি। প্রায় সাথে সাথেই আমার দৃষ্টি অনুভব করল ও এবং সোনালি মূর্তিটার দিক থেকে চোখ না সরিয়েই আমার নীরব প্রশ্নের জবাব দিল।

ঠিকই আন্দাজ করেছ তুমি টাইটা। উটেরিক উন্মাদ কিন্তু একই সাথে চালাকও বটে। মিশরীয় সমাজের অভিজাত সম্প্রদায় যাদেরকে তার বাবা ফারাও টামোস বিভিন্ন দরকারের জন্য প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে তুলেছিলেন এবং যারা হিকসসদের এই মিশরের বুক থেকে বিতাড়িত করেছিল তাদের সবাইকে সে সরিয়ে দিচ্ছে। কারণ ওরা সবাই তার পিতার সমর্থক ছিল। তাদের সবার আনুগত্য নিহিত রয়েছে ফারাও টামোসের প্রতি। তাই তোমার এবং রামেসিসের মতো তাদের সবার প্রয়োজনও উটেরিকের কাছে ফুরিয়ে গেছে। সে জানে যে তোমরা সবাই তাকে ঘৃণা করো, তাই তোমাদের ধ্বংস করে দিতে চায় সে। তার বদলে নিয়ে আসতে চায় পানমাসির মতো লোকদের, যারা তাকে পুজো করে।

এবার প্রথমবারের মতো মাথাটা ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকাল ও, এবং হাসল। তুমি নিশ্চয়ই জানেনা যে আমাকে অপহরণ করেছিল যে পানমাসি সে এখন উটেরিকের সেনাবাহিনীর একজন প্রধান কর্মকর্তা? সত্যি কথা বলতে, রাজকীয় দেহরক্ষীদের প্রধান সে, যাদের তুমি ওই মাঠের মাঝখানে দেখতে পাচ্ছ। বলে থুতনি দিয়ে সামনে ইঙ্গিত করল ও। আঙুল দিয়ে ইশারা করলে যে ওর প্রতি মানুষের অনাকাক্ষিত মনোযোগ আকৃষ্ট হতে পারে এটুকু বোঝার মতো বুদ্ধি আছে ওর মাথায়। ওই যে, মঞ্চের ওপর ফারাওয়ের ঠিক পেছনেই দাঁড়িয়ে আছে পানমাসি।

সেরেনা দেখিয়ে দেওয়ার আগ পর্যন্ত লোকটাকে চিনতেই পারিনি আমি। মাথার শিরস্ত্রাণের কারণে চেহারা ঢেকে আছে তার, সেইসাথে আশপাশে দাঁড়িয়ে থাকা আরো কয়েকজন লোকের আড়ালে প্রায় ঢাকা পড়ে গেছে সে।

আর তোমার কী মতামত? প্রশ্ন করলাম আমি। ওই দুজন, উটেরিক আর পানমাসিকে একসাথে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তোমার রাগ হচ্ছে না? ওরাই তো তোমাকে অপমান করেছে, তোমার ওপর অত্যাচার চালিয়েছে।

আমার প্রশ্নটার উত্তর দিতে গিয়ে কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করল সেরেনা, তারপর মৃদু গলায় জবাব দিল, না, রাগ নয়। শুধু রাগ বললে আসলে কিছুই বলা হবে। না। আমি যা অনুভব করছি তাকে বলা যায় তীব্র জ্বলন্ত ক্রোধ।

পরচুলার এক অংশ মুখের ওপর এসে পড়ায় কথাটা বলার সময় সেরেনার অভিব্যক্তি দেখার সুযোগ হলো না আমার। কিন্তু ওর কণ্ঠস্বরে এমন কিছু একটা ছিল যে, কথাটা সাথে সাথে বিশ্বাস করলাম আমি। সেই মুহূর্তে মাঠের মাঝখানে কুচকাওয়াজরত প্রহরীরা একযোগে মাটির ওপর পা দিয়ে আঘাত করল এবং তারপরেই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। সোনালি বর্ম পরা উটেরিকের উদ্দেশ্যে অভিবাদন জানানোর ভঙ্গিতে এক হাতে তলোয়ার উঁচু করল সবাই। অটুট নীরবতা নেমে এলো চারপাশে। কুচকাওয়াজে অংশগ্রহণকারী এবং দর্শক- সবাইকে যেন চাদরের মতো ঢেকে দিল সেই নীরবতা, যেন ইচ্ছে করলেই ছোঁয়া যাবে।

তারপর স্বর্ণবর্মে ঢাকা ফারাও এসে দাঁড়াল মঞ্চের কিনারে। ধীরে ধীরে অত্যন্ত যত্নের সাথে ডান হাত থেকে দস্তানাটা খুলে আনল সে, তারপর খালি হাতটা তুলে ধরল মাথার ওপরে। অনুভব করলাম আমার পাশে হঠাৎ শক্ত হয়ে উঠল সেরেনা। কিন্তু ওর মাঝে এমন প্রতিক্রিয়ার কোনো কারণ আন্দাজ করতে পারলাম না। নিজের বাহিনীর অভিবাদনের জবাব দেওয়ার সময় কোনো ফারাওয়ের পক্ষে এভাবে খালি হাত উঁচু করে ধরা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে এরপর যেটা ঘটল সেটার জন্য আমরা কেউই প্রস্তুত ছিলাম না।

ময়দানের যে জায়গায় মঞ্চটা তৈরি করা হয়েছে তার ঠিক উল্টো দিকে একটা ছোট টিলার মতো রয়েছে। জায়গাটা দর্শকদের জন্য খুবই সুবিধাজনক একটা জায়গা এবং শুধু বিশেষ সুবিধার অধিকারী দর্শকরাই ওখানে বসার সুযোগ পায়। মঞ্চের সামনে থেকে টিলার চূড়া পর্যন্ত মাঝখানের জায়গাটুকুর দৈর্ঘ দুই শ কদমের বেশি হবে না।

হঠাৎ করেই দূরের টিলাটার ওপর বসে থাকা জনতার মাঝখান থেকে উড়ে আসতে শুরু করল একটা ছোট্ট কালো রঙের বস্তু। আমার দৃষ্টিশক্তি অত্যন্ত তীক্ষ্ণ এবং শক্তিশালী, ফলে এই জনতার ভিড়ের মাঝখানেও জিনিসটা দেখতে কোনো অসুবিধা হলো না আমার। মাটি থেকে শূন্যে ওঠার সাথে সাথেই জিনিসটা দেখতে পেলাম আমি। প্রথমে মনে হলো কোনো পাখি হবে; কিন্তু পরক্ষণেই নিজের ভুল ধরতে পারলাম।

ওই দেখো! বলে উঠলাম আমি। কে যেন তীর ছুঁড়েছে!

কোথায়? প্রশ্ন করল রামেসিস। কিন্তু আমার প্রায় সাথে সাথেই তীরটা সেরেনারও চোখে পড়েছে।

ওই যে টিলার ওপরে, আঙুল দিয়ে ইশারা করল ও। তীরটা তখন সর্বোচ্চ বিন্দুতে পৌঁছে আবার নিচে নামতে শুরু করেছে। ঠিক আমাদের দিকেই আসছে।

দ্রুত হিসাব কষে ফেললাম আমি। আমাদের এখান পর্যন্ত পৌঁছবে না। অনেক উঁচুতে ছোঁড়া হয়েছে তীরটা। কিন্তু সোজা উটেরিকের দিকে যাচ্ছে ওটা! বলতে বলতে উঠে দাঁড়ালাম আমি। তীরের লক্ষ্য যে উটেরিক, আমার এক নম্বর শত্ৰু, সেটা বুঝতে পেরে দারুণ অবাক হয়ে গেছি। এখন যদি সে তীরের আঘাতে মারা পড়ে তাহলে আমার এবং আমার প্রিয় মানুষদের ওপর সে যে অত্যাচার চালিয়েছে তার কোনো প্রতিশোধই নিতে পারব না আমি। একবার মনে হলো চিৎকার করে তাকে সাবধান করে দিই। কিন্তু তীব্র গতিতে ছুটে আসছে তীরটা, আমি কিছু করার আগেই যা ঘটার ঘটে যাবে। এখনো ডান হাত তুলে ধরে দাঁড়িয়ে আছে উটেরিক।

সোনালি শিরস্ত্রাণ আর বর্মটা যেন আহ্বান করছে তীরটাকে আর সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে ছুটে আসছে ওটা। মনে হচ্ছে যেন মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার জন্য দাঁড়িয়ে রয়েছে উটেরিক। আমি দেখলাম শক্ত পাথর খোদাই করে তৈরি করা হয়েছে তীরের মাথাটা, এমনভাবে তৈরি যে খুব সহজেই যেকোনো বর্ম ভেদ করে ঢুকে যাবে। আর সোনার তৈরি বর্মের ক্ষেত্রে তো কথাই নেই। এমনভাবে ভেদ করবে, যেন ওটা প্যাপিরাসের তৈরি। মনে হছে যেন ধীর হয়ে এসেছে সময়ের গতি। আমি এবং বাকি সবাই, এমনকি উটেরিকের কর্মচারীরা পর্যন্ত যেন জমে গেছে নিজ নিজ জায়গায়, নড়তে পারছে না কেউ। শেষ কয়েক ফিট দূরত্ব ঝাপসা মনে হলো তীরটাকে। তার পরেই বড় কোনো ঘণ্টার মতো শব্দ তুলে আঘাত হানল ওটা। আঘাতের চোটে কয়েক পা পিছিয়ে গেল উটেরিক। কিন্তু যে দু-এক মুহূর্ত সে দাঁড়িয়ে থাকতে পারল তার মাঝেই আমি দেখে নিলাম তীরটা তার বুক ভেদ করে পিঠ দিয়ে বেরিয়ে এসেছে। মনে হলো যেন তীরটা তাকে পাথরের মূর্তিতে পরিণত করেছে।

কিন্তু তার পরেই মঞ্চের কাঠের মেঝের ওপর হুড়মুড় করে পড়ে গেল উটেরিক। এত জোরে পড়ল যে কয়েক জায়গায় ভেঙে গেল মেঝে। স্থির হয়ে পড়ে রইল সে, নড়াচড়া করল না আর। তীরটা তার হৃৎপিণ্ড ফুটো করে দিয়েছে। সাথে সাথে মারা গেছে সে।

*

নিঃশ্বাস ফেলতে ভুলে গেছে পুরো পৃথিবী। তার পরেই হঠাৎ প্রচণ্ড চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু হয়ে গেল পুরো ময়দানে। কয়েকজন আর্তনাদ করে উঠল এমনভাবে, যেন এই পুরো বিশ্বের প্রধান মারা গেছে এই মাত্র। দৌড়ে সামনে এগিয়ে এলো উটেরিকের সেনা কর্মকর্তারা। সবার সামনে দেখা গেল জেনারেল পানমাসি আর তার সাথে আরো কয়েকজন চাটুকার আর অনুগত কর্মচারী। তাদের মাঝে একজন কোথা থেকে যেন একটা কম্বল নিয়ে এলো। সেটা দিয়ে মুড়িয়ে ফেলা হলো মৃতদেহটা। তবে তার দেহ থেকে তীরটা বের করার চেষ্টা করল না কেউ, তার চেহারা এবং শরীর ঢেকে রাখা বর্ম খোলার প্রতিও আগ্রহ দেখা গেল না কারো মাঝে।

তারপর তাদের মাঝে ছয়জন মিলে মৃতদেহটা কাঁধে তুলে নিয়ে মঞ্চের পেছনে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলো নিচে। দেহটাকে পাশের পাথর দিয়ে তৈরি দালানের ভেতর নিয়ে গেল তারা। শোকার্ত বাজনা বাজাতে শুরু করল বাদকদল। মনে হলো যেন বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছে জনতা, বুঝতে পারছে না কী করবে। কেউ কেউ হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করেছে, সেইসাথে মুঠো মুঠো চুল ছিঁড়ে আনছে মাথা থেকে। তবে অনেককেই দেখলাম অনেক কষ্টে খুশি চেপে রেখেছে। কাপড়ের কোনা দিয়ে চেহারা ঢেকে রেখেছে তারা, একই সাথে চোখে পানি আনার জন্য জোরে জোরে চোখ ডলছে।

তবে এই বিশাল জনতার মাঝে যে কয়েকজন উটেরিকের মৃত্যু দেখে সত্যিই দুঃখ পেল তাদের মাঝে আমিও ছিলাম। নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য রামেসিস আর সেরেনাকে নিজের কাছে জড়িয়ে ধরলাম আমি। প্রচণ্ড হতাশ লাগছে আমার, মনে হচ্ছে সত্যি সত্যি কেঁদে ফেলব যেকোনো মুহূর্তে।

এমনটা হওয়ার কোনো কথাই ছিল না, ফিসফিস করে ওদের বললাম আমি। নিজের নিষ্ঠুরতা আর অমানবিক আচরণের জন্য কোনো শাস্তি না পেয়েই পালিয়ে গেল উটেরিক।

তবে রামেসিস অবশ্য দারুণ খুশি হয়ে উঠেছে। আর যা-ই হোক, উটেরিক মারা গেছে। চিরতরে বিদায় হয়েছে আপদ। অবশ্য ওর খুশি হওয়াই স্বাভাবিক, কারণ এখন ওর ফারাও হওয়া কেউ ঠেকাতে পারবে না। কিন্তু তীরটা কে ছুড়ল? তাকে একটু দেখতে ইচ্ছে করছে আমার। এই সাহসী কাজ করার জন্য তাকে ধন্যবাদ এবং যথাযোগ্য পুরস্কার দিতে চাই আমি।

ধীরে ধীরে নড়েচড়ে উঠল জনতার স্রোত। ধীর দ্বিধান্বিত পায়ে বের হওয়ার দরজার দিকে এগোতে শুরু করল সবাই। আমরা তিনজনও তাদের সাথে যোগ দিলাম। কিন্তু বেশি দূর এগোতে পারলাম না আমরা, তার আগেই দরজার সামনে দাঁড়ানো সশস্ত্র প্রহরীরা বাধা দিল সবাইকে। জনতার গুঞ্জন ছাপিয়ে তাদের উচ্চকিত গলার নির্দেশ ভেসে এলো আমাদের কানে।

পিছিয়ে যাও! যে যেখানে ছিলে সেখানে ফিরে যাও সবাই! হত্যাকারীকে খুঁজে পাওয়ার আগ পর্যন্ত কেউ নড়তে পারবে না ময়দান থেকে। এই বলে হাতের বর্শা উল্টো করে ধরল তারা, তারপর হাতলের দিক দিয়ে গুঁতো দিতে দিতে জনতাকে দরজার কাছ থেকে সরে যেতে বাধ্য করল। অপরাজেয় ফারাও উটেরিককে যে ব্যক্তি তীর ছুঁড়ে খুন করেছে তার পরিচয় জানি আমরা, বলল তারা।

অগত্যা বিড়বিড় করে গাল বকতে বকতে আবার আগের জায়গায় ফেরত এলাম আমরা।

আমার পাশ ঘেঁষে বসল সেরেনা। রামেসিসের দিক থেকে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বসল ও। রামেসিস তখনো তার পাশে বসা লোকটার কাছে নিজের অসন্তোষ প্রকাশ করতে ব্যস্ত। এবার মৃদু স্বরে কথা বলে উঠল সেরেনা, এত আস্তে যে আমি ছাড়া আর কেউ শুনতে পেল না সেটা। সে ছিল না ওখানে, বলল ও।

বুঝলাম না। কে ছিল না, কোথায় ছিল না? ওর দেখাদেখি একই রকম মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করলাম আমি।

ওই যে, সোনার বর্ম পরা লোকটা। ও আসলে উটেরিক ছিল না। তীরের আঘাতে মরেনি উটেরিক, আবার বলল সেরেনা। ওই লোকটা ছিল উটেরিকের নকল।

তুমি কীভাবে বুঝলে সেটা? লোকটার মুখ তো মুখোশে ঢাকা ছিল। সেরেনার হাত চেপে ধরে ওকে আমার আরো কাছে নিয়ে এলাম আমি। অনুভব করছি উটেরিকের ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার একটা সুযোগ এখনো থাকতে পারে বুঝে স্বস্তির স্রোত বয়ে যাচ্ছে আমার শরীরে।

তার ডান হাত দেখেছি আমি, জবাব দিল সেরেনা।

তবু কিছুই ঢুকছে না আমার মাথায়, প্রতিবাদ জানালাম আমি। এর সাথে উটেরিকের হাতের কী সম্পর্ক–বলতে বলতে হঠাৎ থেমে গিয়ে তাকিয়ে রইলাম সেরেনার দিকে। সাধারণত কোনো কিছু বুঝতে আমার এত দেরি লাগে না। তুমি বলতে চাইছ দস্তানা খুলে ফেলার পর লোকটার হাত দেখে তুমি বুঝতে পেরেছ যে ওটা উটেরিকের হাত ছিল না?

ঠিক বলেছ! জবাব দিল সেরেনা। উটেরিকের দুই হাতই অত্যন্ত কোমল, কোনো দাগ নেই তাতে। দেখলে মনে হতে পারে বাচ্চা মেয়ের হাত এবং সেগুলো নিয়ে দারুণ গর্ব করে সে। উটেরিকের ঘনিষ্ঠ যারা তারা বলে সে নাকি দিনে তিনবার নারিকেলের দুধ দিয়ে হাত ধোয়।

তুমি এগুলো কীভাবে জানলে সেরেনা? প্রশ্ন করলাম আমি। উটেরিকের হাত সম্পর্কে এত কিছু জানার সুযোগ কীভাবে পেলে?

যতবার আমাকে চড় মারার জন্য হাত তুলেছে সে ততবার তার হাত খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে আমার। যতবার আমার নাক মুচড়ে ধরেছে, যতবার তার আঙুল আমার যোনি বা পায়ুপথে ঢুকিয়ে দিয়েছে আর তার সুন্দরী প্রেমিকরা হি হি করে হেসে উঠেছে ততবার তার হাত খুব কাছ থেকে দেখেছি আমি, তিক্ত স্বরে বলে উঠল ও। কণ্ঠস্বরেই বোঝা গেল কী প্রচণ্ড ক্রোধ আর ঘৃণা কাজ করছে ওর ভেতরে। সোনার মুখোশ পরা যে লোকটা তীরের আঘাতে মারা পড়েছে তার হাত ছিল কর্কশ, কড়া পড়া। কৃষকদের হাত যেমন হয়। উটেরিক ছিল না ওটা, আর যেই হোক।

এখন তোমার কথার অর্থ পরিষ্কার হয়েছে আমার কাছে। কিন্তু তোমার ওপর যে অত্যাচার হয়েছে তার এমন পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিতে তোমাকে বাধ্য করেছি আমি, সে জন্য আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত।

আমি কিছু মনে করিনি। কিন্তু রামেসিসকে কখনো বোলো না এসব কথা। আমি চাই না যে ও এই ব্যাপারে কিছু জানুক। আমাকে প্রতিশ্রুতি দাও টাইটা, ওকে কখনো কিছু বলবে না তুমি।

আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি তোমাকে। জানি যে কথাগুলো খুব মেকী শোনাল বলার সময়, সেরেনার হাতে চাপ দিয়ে আমার প্রতিশ্রুতির গুরুত্ব বোঝানোর চেষ্টা করলাম আমি।

এক ঘণ্টা ধরে বসে থাকতে হলো আমাদের, তারপর আরো এক ঘণ্টা। এর মাঝে একমাত্র সান্ত্বনা বলতে রইল ফারাওয়ের মৃত্যুতে বাদকদের বাজানো শোকার্ত বাজনা। ওদিকে জনতার মাঝে রাগান্বিত গুঞ্জন এতক্ষণে ক্রোধে রূপ নিতে শুরু করেছে। এমন কিছু কথা কানে এলো আমার, যেগুলোকে অনায়াসে রাজদ্রোহিতার সমান বলে ধরা যায়। ফারাও এখন আর জীবিত নেই ফলে নাগরিকদের যারা আগে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে নিজেদের মতামত প্রকাশ করত এখন তাদের অনেকেই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।

তারপর হঠাৎ করেই বাদকদের বাজনার ধরন বদলে গেল, শোকার্ত সুরের বদলে দ্রুত লয়ের চটুল তালের বাজনা বাজাতে শুরু করল তারা। জনতার মধ্যে যারা এতক্ষণ অসন্তোষ প্রকাশ করছিল তারা সবাই চুপ হয়ে গেল, চেহারায় বিভ্রান্ত ভাব। দেখলাম গত দুই ঘণ্টা যাবৎ যেসব পুরুষ এবং মহিলা ফারাও আর তার মৃত্যু সম্পর্কে নানা রকম উল্টোপাল্টা মন্তব্য করছিল তারা এখন উদ্বিগ্ন চোখে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে, বোঝার চেষ্টা করছে যে কারা তাদের কথাগুলো শুনতে পেয়েছিল। এখন মনে হচ্ছে কথাগুলো বলার জন্য দারুণ আফসোস হচ্ছে তাদের।

মঞ্চের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা পাথুরে দালানটা থেকে বেরিয়ে এলো জেনারেল পানমাসি এবং আরো চার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। ঘণ্টাদুয়েক আগে ওই দালানের ভেতরেই কম্বলে মুড়িয়ে ফারাওয়ের মৃতদেহ নিয়ে গিয়েছিল তারা। তাদের আগমনের সাথে সাথে নতুন করে উচ্ছল বাজনায় ফেটে পড়ল বাদকদের দল। মঞ্চের ওপর উঠে কাঁধে কাঁধ ঠেকিয়ে পাশাপাশি দাঁড়াল সবাই। শেষ পর্যন্ত বাজনার শব্দ থামতে জেনারেল পানমাসি সামনে এগিয়ে এলো, তারপর হাতে ধরা চোঙাটা মুখের সামনে ধরে কথা বলতে শুরু করল। যন্ত্রটা থাকার কারণে তার পুরো ময়দান জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল তার কণ্ঠস্বর। এ ছাড়া যারা মঞ্চ থেকে বেশি দূরে রয়েছে তাদের কাছে পানমাসির বক্তব্য পৌঁছে দেওয়ার জন্য কিছু দূর পরপর দাঁড় করিয়ে দেওয়া হলো অন্যান্য অল্পবয়সী সৈনিকদের। মিশরের অনুগত নাগরিকগণ, আপনাদের জন্য সুখের সংবাদ নিয়ে উপস্থিত হয়েছি আমি। আমাদের প্রিয় ফারাও উটেরিক, যাকে একটু আগে আপনারা সবাই মাটিতে লুটিয়ে পড়তে দেখেছিলেন তিনি তার অপরাজেয় নামকে সত্যি প্রমাণিত করেছেন। মৃত্যুকে ফাঁকি দিয়ে এখনো আমাদের মাঝে বেঁচে আছেন তিনি! এবং বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল!

*

Done page 222

এই কথা শোনার পরেই নীরবতা নেমে এলো জনতার মাঝে। সবাই দেখেছে তীরের আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে। উটেরিক, সাথে সাথে মৃত্যু হয়েছে তার। এমন আঘাত থেকে বেঁচে ফিরতে পারে না কেউ। সবাই ধরে নিয়েছে তাদের ভুল বোঝানোর জন্য কোনো একটা ছলনার আশ্রয় নেওয়া হচ্ছে। মাথা নিচু করে রইল সবাই পা দিয়ে মাটি খুঁড়তে লাগল। খুব সাবধানে পরস্পরের সাথে চোখাচোখি করা থেকে নিজেদের বিরত রেখেছে তারা, কেউ চায় না যে তাদের বিরুদ্ধে কোনো রাজদ্রোহমূলক আচরণের অভিযোগ আনা হোক।

এবার ঘুরে দাঁড়াল পানমাসি, মঞ্চে ওঠার সিঁড়ির দিকে ফিরল। তার পরেই মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল সে। অন্য চার কর্মকর্তাও সাথে সাথে তাকে অনুসরণ করল, মঞ্চের কাঠের মেঝেতে কপাল ঠেকাল যেন কার উদ্দেশ্যে।

সেই একই সোনালি বর্ম পরা ব্যক্তি আবার উদয় হয়েছে সিঁড়ির গোঁড়ায়, যাকে দুই ঘণ্টা আগে রক্তমাখা কম্বল মোড়ানো অবস্থায় মঞ্চ থেকে নামিয়ে নিয়ে যেতে দেখেছি আমরা। এখন দীর্ঘ আত্মবিশ্বাসী পদক্ষেপে হাঁটছে সে। দেখে মনে হচ্ছে না যে একটু আগেই এক মারণ আঘাত হানা হয়েছে তার ওপর। শুধু বর্মের ওপর এখনো রক্তের দাগ লেগে আছে আর আততায়ীর তীর যেখানে তার সোনার বর্ম ভেদ করে ভেতরে ঢুকেছিল সেখানে একটা ফুটো। শক্ত পায়ে হেঁটে এসে মঞ্চের সামনে দাঁড়াল সে, তারপর মাথা থেকে খুলে ফেলল শিরস্ত্রাণ। সবার সামনে উন্মোচিত হলো ফারাও উটেরিকের সুপরিচিত চেহারা।

ভিড়ের মাঝে উপস্থিত যেসব ব্যক্তি একটু আগে ফারাওয়ের মৃত্যুতে মনে মনে আনন্দে নাচছিল এবার তারাই আনুগত্যের ভারে যেন নুয়ে পড়বে বলে মনে হলো। আদুরে কুকুরছানার মতো কুঁইকুঁই করতে করতে ফারাওয়ের এই অলৌকিক প্রত্যাবর্তনে নিজেদের আনন্দ প্রকাশ করতে লাগল তারা।

অহংকারী চোখে জনতার দিকে তাকাল উটেরিক। প্রসাধনের মাধ্যমে আরো সুন্দর করে তোলা হয়েছে তার চেহারা, প্রায় মেয়েদের মতোই লাগছে দেখতে। তার সাথে যোগ হয়েছে গর্ব আর অহংকারের হাসি। বোঝা যাচ্ছে জনতার এই প্রশংসা দারুণ উপভোগ করছে সে। শেষ পর্যন্ত এক হাত উঁচু করে সবাইকে চুপ করতে ইশারা করল সে।

সেরেনাকে ফিসফিস করে বললাম আমি, তুমি ঠিকই বলেছিলে। আসলেই ওর হাতগুলো মেয়েদের মতো।

মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি প্রকাশ করল সেরেনা।

কিন্তু তীরের আঘাতে কে মারা পড়ল তাহলে? নিজের মনেই বলে উঠলাম আমি। তা হয়তো কখনোই জানা যাবে না, জবাব দিল সেরেনা। ইতোমধ্যে হতভাগ্য লোকটার মৃতদেহকে আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে, আর তা না হলে পায়ে পাথর বেঁধে ফেলে দেওয়া হয়েছে নীলনদের বুকে। তার পরেই মঞ্চের ওপর দাঁড়ানো ফারাও কথা বলতে শুরু করল। কী বলে তা শোনার জন্য ইশারায় আমাকে চুপ থাকতে বলল সেরেনা।

আমার প্রিয় জনগণ, আমার প্রিয় প্রজারা, আমি আবার তোমাদের কাছে ফিরে এসেছি! আততায়ীর তীর আমাকে যে আঁধারের মাঝে ডুবিয়ে দিতে চেয়েছিল সেই আঁধার থেকে ফিরে এসেছি আমি। সাথে সাথে সমস্বরে চিৎকার করে উল্লাস প্রকাশ করল জনতা। তারপর আবার হাত উঁচু করল ফারাও। সাথে সাথে চুপ হয়ে গেল সবাই।

এখন আমরা জানি, আমাদের মাঝেই লুকিয়ে আছে বিশ্বাসঘাতকের দল! হঠাৎ করেই রাগ আর অভিযোগের উন্মত্ততা ফুটে উঠল উটেরিকের কণ্ঠে। সেই বিশ্বাসঘাতকরা আমাকে খুন করার পরিকল্পনা করেছিল, সফল করতে চেয়েছিল নিজেদের কুটিল ষড়যন্ত্রকে। সাথে সাথে জনতার মাঝ থেকে অস্থির গুঞ্জন উঠল, যেন এমন ষড়যন্ত্রের কথা শুনে সত্যিই দারুণ কষ্ট পেয়েছে তারা। এই বিশ্বাসঘাতক খুনিদের পরিচয় কী আমি জানি। তাদের সংখ্যা ত্রিশজন, এবং আমার বিশ্বাসী প্রহরীরা তাদের সবাইকে আটক করেছে। এখন তাদের। অপরাধ অনুযায়ী দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে। এবার জেনারেল পানমাসির ইশারায় দর্শকরা সবাই বুনো আনন্দে ফেটে পড়ল। সবার উল্লাস থামার পর ফারাও বলে চলল, এই অপরাধীদের মধ্যে প্রথমেই আছে সেই ব্যক্তি যে আমাকে লক্ষ্য করে তীর ছুঁড়েছিল। সে আর কেউ নয়, বরং আমারই মন্ত্রীদের একজন, যার ওপর আমি সম্পূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন করেছিলাম। আমার প্রহরীরা সাক্ষী আছে যে, আমার বুকে যে তীর এসে বিঁধেছিল সেটা এই ব্যক্তিই ছুঁড়েছে। এই বলে শেষ কথাটা গলা চড়িয়ে বলে উঠল সে, সেই বিশ্বাসঘাতক ইরাসকে সামনে নিয়ে আসা হোক!

রাজমন্ত্রী ইরাসের কথা বলছে ও! আতঙ্কিত কণ্ঠে ফিসফিস করে বলে উঠল রামেসিস। তা কী করে হয়? উনি বৃদ্ধ একজন মানুষ, অভিজাত এবং ভদ্র বলে সবার কাছে পরিচিত। তিনি কখনো খুনের মতো কাজ করবেন না। এমনকি ধনুক থেকে তীর ছোঁড়ার মতো শক্তিও তার গায়ে আছে বলে আমার মনে হয় না।

রামেসিসকে শান্ত রাখার জন্য, সেইসাথে ও যেন উঠে না দাঁড়ায় সেটা নিশ্চিত করতে ওর হাতটা নিজের হাতে চেপে ধরল সেরেনা। ইরাসকে বাঁচানোর কোনো উপায় নেই আমাদের হাতে প্রিয়তম, ফিসফিস করে বলল ও। তাকে যে লোকটা এখন সামনে নিয়ে আসছে খুব সম্ভব সেই ছুঁড়েছিল ওই তীরটা। লোকটার নাম অরকোস, উটেরিকের সবচেয়ে কুখ্যাত জল্লাদদের একজন সে। একই সাথে ধনুর্বিদ্যাতেও লোকটার জুড়ি মেলা ভার।

বিষণ্ণ ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল রামেসিস। অরকোসকে খুব ভালো করেই চিনি আমি। এটাও জানি যে, উটেরিকের বেশ কিছু নিষ্ঠুর এবং বর্বর সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিলেন ইরাস। খুব সম্ভব সে জন্যই এই চড়া মূল্য দিতে হচ্ছে তাকে।

আজ এখানে দারুণ এক চাল চেলেছে উটেরিক। প্রথমত জনগণের চোখে নিজের অমরত্বকে প্রমাণ করেছে সে। তার প্রজারা তাকে খুন হতে দেখেছে অথচ তার পরেই আবার নিজের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে মৃত্যুর কবল থেকে ফিরে এসেছে সে। মৃদু কিন্তু দৃঢ়কণ্ঠে বলে চলেছে সেরেনা। যারা তার বিরোধিতা করেছে তাদের মধ্যে ইরাস অন্যতম। মিশরের সকল সৎ এবং সম্মানী লোকদের কণ্ঠস্বরকে স্তব্ধ করে দেওয়ার ব্যবস্থা করছে উটেরিক। সে এটাও জানতে পেরেছে যে, আমার বাবা ইতোমধ্যে তার রণতরীর বহর এবং রথ বাহিনী নিয়ে রওনা দিয়েছে। সে এবং তার সকল মিত্র রাজারা এদিকেই আসছে। এখন বাবার আক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করতে রওনা দেওয়ার আগে নিজের পেছন দিকটা নিরাপদ করে রেখে যেতে চাইছে সে। আমার বাবা তার বাহিনী নিয়ে মিশর পৌঁছানোর আগে কিছুই করতে পারব না আমরা। শুধু অপেক্ষা করা ছাড়া কোনো পথ নেই আমাদের সামনে। যদি কপাল ভালো হয় তাহলে হয়তো ইরাস এবং অন্য অভিযুক্তদের দুঃখ-দুর্দশার ফটকে পাঠাবে উটেরিক এবং সে ক্ষেত্রে ওদের বাঁচানোর একটা ব্যবস্থা করতে পারব আমরা।

ইরাস এবং অন্য বন্দিদের এবার রাজকীয় প্রহরীদের তত্ত্বাবধানে মঞ্চের ওপর তুলে আনা হলো। সবার হাত বাঁধা হয়েছে পিছমোড়া করে। এক নজরেই বোঝা গেল যে সবাইকে নিষ্ঠুরভাবে পেটানো হয়েছে। অনেকেরই শরীর থেকে রক্ত ঝরছে এবং তাদের তথাকথিত নেতা ইরাস প্রায় অর্ধ অচেতন হয়ে পড়েছেন। একসময়ের সুদর্শন মুখটা এখন মারের চোটে ফুলে বীভৎস হয়ে গেছে, ফলে প্রায় চেনাই যাচ্ছে না তাকে। মাথার লম্বা সাদা চুলগুলো এখন তার নিজেরই শুকনো রক্তে ভিজে জট পাকিয়ে গেছে। শরীর থেকে সমস্ত কাপড় খুলে নেওয়া হয়েছে তার, শুধু ছোট্ট এক টুকরো নেংটি রয়েছে এখন। নগ্ন পিঠের ওপর চাবুকের নিষ্ঠুর বাড়ির দাগ। দুই প্রহরী দুই পাশ থেকে সোজা করে দাঁড় করিয়ে রেখেছে তাকে। সেই অবস্থাতেই তাকে ফারাওয়ের মুখোমুখি করা হলো।

সাথে সাথেই ইরাসের বিরুদ্ধে তীব্র বিষোদ্গারে ফেটে পড়ল উটেরিক। আরো একবার পাগলের মতো উন্মত্ত ক্রোধ জেগে উঠেছে তার ভেতরে। তার মুখ থেকে থুতুর ছিটার সাথে যে অশ্রাব্য গালিগালাজগুলো বেরিয়ে আসছে তার মতো ভয়ানক অশ্লীল কথা জীবনে খুব কমই শুনেছি আমি। ডান হাতে একটা ঘোড়া চালানোর চাবুক ধরে রেখেছে উটেরিক। নিজের কথাকে আরো ওজনদার করার জন্য সেটাকে বারবার বৃদ্ধ মানুষটার মুখের ওপর চালাচ্ছে সে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই নতুন করে রক্তের ধারায় ভিজে গেল হতভাগ্য লোকটার শুভ্র দাঁড়ি, শরীরে নিচ থেকে ভার নিতে অসম্মতি জানাল পা দুটো। কিন্তু প্রহরীরা তাকে ছাড়ল না, বরং শাস্তির সবটুকু যেন তার ওপরে নিশ্চিতভাবে পড়ে সে জন্য শক্ত করে ধরে খাড়া করিয়ে রাখল তাকে।

শেষ পর্যন্ত পিছিয়ে দাঁড়াল উটেরিক। হাপরের মতো ওঠানামা করছে তার বুক, গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে ঘামের ধারা। যে চাবুকটা দিয়ে এতক্ষণ ইরাসকে পেটাচ্ছিল সেটা ফেলে দিল সে, তারপর কোমরের খাপ থেকে টেনে বের করল তলোয়ার।

ছেড়ে দাও ওকে, প্রহরীদের নির্দেশ দিল সে। হাঁটু গেড়ে বসতে দাও ব্যাটাকে, যাতে আমার কাছে মাফ চাইতে পারে। হাতের বাঁধন খুলে দাও, যাতে আমার সামনে হাত জোড় করে ক্ষমাভিক্ষা করতে পারে। বোঝা গেল এই কাজ আগেও বহুবার করেছে প্রহরীরা। দাঁত বের করে হাসতে হাসতে ফারাওয়ের নির্দেশ পালন করল তারা।

দুই হাত সামনে বাড়িয়ে দে ব্যাটা বিশ্বাসঘাতক কুকুর। মাফ চা আমার কাছে, হারামজাদা বুড়ো শয়তান, ইরাসকে উদ্দেশ্য করে চেঁচিয়ে উঠল উটেরিক। কিন্তু এখন আর কোনো কিছু শোনার বা বোঝার ক্ষমতা নেই বৃদ্ধের মাঝে। আস্তে করে বিহ্বল ভঙ্গিতে কেবল কয়েকবার মাথা নাড়লেন তিনি। কাটা ঠোঁট থেকে গড়িয়ে পড়া রক্ত নতুন করে ভিজিয়ে দিল তার দাড়ি।

ওর হাতগুলো সামনে টেনে ধরো! প্রহরীদের উদ্দেশ্য করে চেঁচিয়ে উঠল উটেরিক। আগের মতোই হাসতে হাসতে সামনে এগিয়ে এলো তারা, তারপর বৃদ্ধের কবজিতে বাঁধা লম্বা দড়ি টেনে ধরে হাতগুলো সামনে নিয়ে এলো। ইচ্ছে করেই দড়িগুলো রেখে দিয়েছিল তারা, সম্ভবত এই উদ্দেশ্যেই। দড়িতে জোরসে টান পড়তেই মঞ্চের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়লেন ইরাস; কিন্তু তার হাতগুলো লম্বা হয়ে রইল তার মাথার দুই পাশে।

এবার খোলা তলোয়ার হাতে সামনে এগিয়ে এলো উটেরিক। তলোয়ারের মাথাটা আলতো করে ইরাসের বাহুতে ঠেকাল সে, দূরত্ব মেপে নিল। তারপর তলোয়ারটা মাথার ওপর তুলেই এক কোপে নামিয়ে আনল। ব্রোঞ্জের তলোয়ারটা নিখুঁতভাবে দুটুকরো করে দিল ইরাসের বাম বাহুর মাংস আর হাড়। দড়ি টেনে ধরে থাকা প্রহরীরা পিছিয়ে গেল, বাহুর কর্তিত অংশ থেকে ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে এলো তাজা রক্ত। দুর্বল একটা চিৎকার বেরিয়ে এলো ইরাসের মুখ থেকে। দর্শক জনতার মাঝেও যেন সেই চিৎকারেরই প্রতিধ্বনি শোনা গেল; ভয় আর উত্তেজনার মিশেল ঘটেছে তাদের ভেতর।

আরো একবার তলোয়ার ওপরে তুলল উটেরিক জল্লাদের অভিজ্ঞ দৃষ্টিতে মেপে নিল দূরত্ব। তারপর কোপ মারল সে। ইরাসের দ্বিতীয় বাহুও বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল গোঁড়া থেকে। দুই হাত হারিয়ে নিজের রক্ত থেকে তৈরি হওয়া পুকুরের মাঝখানে পড়ে রইলেন ইরাস, মৃদু মৃদু গোঙানি বেরিয়ে আসছে গলা দিয়ে।

এবার উটেরিকের বাম পাশে এসে দাঁড়াল জেনারেল পানমাসি। অপেক্ষমাণ রথগুলোর একটাকে সামনে এগিয়ে আসতে নির্দেশ দিল সে। রথের চালক তার গাড়িটাকে মঞ্চের গোড়ায় নিয়ে এলো। রক্তের গন্ধ পেয়ে উত্তেজিত হয়ে ছটফট করতে শুরু করল তার রথের সাথে বাঁধা ঘোড়া চারটি। ওদিকে দুই প্রহরী তখন ইরাসের দুই গোড়ালিতে দড়ি বাঁধার কাজ শেষ করে ফেলেছে। এবার দড়ির অপর প্রান্তগুলো রথচালকের হাতে তুলে দিল তারা। সেগুলো রথের শেষ প্রান্তের সাথে শক্ত করে বেঁধে ফেলল চালক। তারপর মঞ্চ থেকে লাফ দিয়ে নেমে পড়ল উটেরিক। রথচালক নিজের জায়গা ছেড়ে দিল তার জন্য, রথে উঠে দাঁড়াল ফারাও। লাগামে ঝাঁকি দিল সে, সাথে সাথে ছুটতে শুরু করল ঘোড়াগুলো। ইরাসের পঙ্গু দেহটাও রথের পেছনে পেছনে হিঁচড়ে আসতে লাগল। ব্যথায় চিৎকার করে উঠলেন ইরাস। প্রথমে নিজের নগ্ন ক্ষতবিক্ষত দেহটাকে মাটির ওপর কোনোমতে সোজা করে রাখার চেষ্টা করলেন তিনি, কেটে ফেলা হাতের অবশিষ্ট অংশ ব্যবহার করে মাঠের ওপর পড়ে থাকা পাথর এবং অন্যান্য বস্তু থেকে নিজেকে সামলে রাখতে চাইলেন। কিন্তু রথটা যখন মাঠের ভেতর দ্বিতীয় চক্কর দেওয়া শুরু করল তখন ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়েছেন তিনি, আর রক্ষা করতে পারছেন না নিজেকে। মাটিতে বারবার বাড়ি খেতে লাগল তার মাথা, এবং এভাবেই একসময় প্রাণের শেষ চিহ্নটুকু মুছে গেল তার চোখ থেকে। এবার টেনে-হিঁচড়ে তার মৃতদেহটাকে মঞ্চের কাছে নিয়ে এলো ফারাও উটেরিক, লাফ দিয়ে নেমে দাঁড়াল রথ থেকে।

অপরাজেয় ফারাও, বাকি অপরাধীদের কী শাস্তি দেওয়া হবে? উটেরিক মঞ্চের ওপর উঠে আসতে তাকে জিজ্ঞেস করল জেনারেল পানমাসি। কথাটা বলার সময় খোলা তলোয়ার দিয়ে বাকি ঊনত্রিশজন বন্দির দিকে ইঙ্গিত করল সে। জবাইয়ের জন্য পাঠানো শূকরের মতো হাত আর পা এক করে বেঁধে ফেলে রাখা হয়েছে তাদের সবাইকে।

নিরাসক্ত দৃষ্টিতে তাদের দিকে একবার তাকাল উটেরিক। আজকের দিনের জন্য যথেষ্ট পরিশ্রম করেছি আমি। এই বিশ্বাসঘাতকের দলটাকে দুঃখ-দুর্দশার ফটকে পাঠিয়ে দাও। ওখানে যেসব বিশেষজ্ঞ রয়েছে তারা আশা করা যায়। এদের উপযুক্ত ব্যবস্থা করতে পারবে।

যত দ্রুত সম্ভব আনন্দের বাগানে ফিরে যেতে হবে আমাদের, যাতে উটেরিকের বন্দিদের স্বাগত জানানো যায়, রামেসিস আর সেরেনাকে সতর্ক করে দিলাম আমি। আবার রথে উঠল ফারাও আর তার সঙ্গীরা, তারপর ময়দান থেকে বের হয়ে গেল। সোনালি প্রাসাদের দিকে চলতে শুরু করল তাদের রথ বাহিনী।

*

জনাকীর্ণ পথ দিয়ে বেশ কষ্ট করে চলতে হলো আমাদের, তবে শহরের প্রধান ফটক পার হয়ে পাহাড়ের মাঝ দিয়ে বাকি রাস্তার প্রায় পুরোটাই দৌড়ে পার হলাম। পথ সংক্ষেপ করে নিলাম মাঝে মাঝেই বিভিন্ন ঝরনা পার হয়ে এবং খাড়া ঢাল বেয়ে উঠে স্বাভাবিক সময়ের আগেই জায়গামতো পৌঁছে গেলাম। জানি যে, আমাদের পেছনেই আছে উটেরিকের বন্দিদের বহনকারী রথের দল এবং খুব তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাবে তারাও। আমার এবং রামেসিসের সাথে সেরেনাকে তাল মিলিয়ে চলতে দেখে আরো একবার অবাক হয়ে গেলাম আমি। মাঝে মাঝে, এমনকি আমাদেরও পেছনে ফেলে দিতে লাগল ও। তবে হ্যাঁ, আমাদের দুজনের চাইতে ওর শরীর অনেক হালকা। আমরা যখন পৌঁছলাম তখন লুক্সর থেকে বন্দিদের বহনকারী রথ বাহিনীর পৌঁছতে আর এক ঘণ্টাও বাকি নেই। সত্যি কথা বলতে, পর্যবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা প্রহরীরা যখন শহরের দিক থেকে আসা রথের সারি সম্পর্কে আমাদের সাবধান করল তখনো আমি ভুগের ছদ্মবেশ নেওয়া শেষ করে উঠতে পারিনি।

দ্রুত কাজ শেষ করে প্রধান দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম আমি, তারপর বরাবরের মতোই সেই ভয়ংকর কথাটা শুনিয়ে দ্রুত বন্দিদের ভেতরে নিয়ে এলাম। সেরেনার তৈরি করা আনন্দের বাগানে ঢুকতেই সবাই অবাক হয়ে গেল। যেন স্বর্গে প্রবেশ করেছে, এমন দাঁড়াল সবার চেহারার অবস্থা। তার ওপর আমি যখন ডুগের ছদ্মবেশ খুলে আত্মপ্রকাশ করলাম এবং রামেসিসকে সবার সামনে নিয়ে এলাম তখন সবার কী অবস্থা হলো তা সহজেই অনুমেয়। বন্দিদের মধ্যে সবাই আমাকে এবং রামেসিসকে খুব ভালো করেই চেনে, কারণ বহুদিন ধরে লুক্সরে থেকেছি আমরা। তা ছাড়া আমরা দুজনই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তবে উটেরিকের কাছ থেকে সবাই শুনেছিল যে আমরা মারা গেছি, ফলে আমাদের জীবিত দেখে প্রচণ্ড রকমের অবাক হয়ে গেল তারা। সবাই আমাদের ঘিরে ধরল, কে কার আগে আমাদের জড়িয়ে ধরতে পারে তার প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল তাদের মাঝে। মৃত্যুর মুখ থেকে তাদের বাঁচানোর জন্য শত মুখে আমাদের ধন্যবাদ দিতে লাগল সবাই।

পরিস্থিতি বুঝে নিয়ে মিশরের ভবিষ্যৎ ফারাও হিসেবে রামেসিসের নাম প্রস্তাব করার জন্য কেবল সামান্য ইশারা করা লাগল আমাকে, বাকিটা সহজেই বুঝে নিল সবাই। বর্তমানে যে ঘৃণিত ব্যক্তিটি মিশরের সিংহাসনে বসে আছে এবং যে তাদের মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেছে তাকে সরিয়ে রামেসিসকে বসানোর প্রস্তাবে সবাই খুশি হয়েই রাজি হয়ে গেল।

প্রথমেই একজন দুজন করে সবাই রামেসিসের সামনে হাঁটু গেড়ে বসল এবং তাকে ফারাও হিসেবে স্বীকার করে নিল। তারপর সবাই সমস্বরে রামেসিসের জয়ধ্বনি দিতে লাগল এবং তার প্রতি আনুগত্যের শপথ নিতে লাগল। তাদের আনন্দ এবং উত্তেজনা চরমে পৌঁছানোর পর যখন থিতিয়ে আসতে শুরু করল তখনই চূড়ান্ত চালটা চালোম আমি।

আমার কাছেই একটু আড়ালে অপেক্ষা করছিল সেরেনা। এবার আমার ইশারা পেয়ে বের হয়ে এলো ও। সদ্য মুক্তির স্বাদ পাওয়া বন্দিরা সবাই কৌতূহলী চোখে তাকাল ওর দিকে এবং খুব দ্রুতই তাদের কৌতূহল বদলে গেল বজ্রাহত বিস্ময়ে। সেরেনাকে আমি বলেছিলাম যতটা সম্ভব সুন্দর চেহারা নিয়ে সবার সামনে আসতে। কিন্তু এমনকি আমিও আশা করিনি যে আমার এই কথার কারণে এত বেড়ে যাবে ওর সৌন্দর্য।

ওর মা তেহুতির পাঠানো পোশাকগুলোর মাঝে সবচেয়ে সুন্দর পোশাকটা পরেছে সেরেনা। কাপড়টার রং অপার্থিব রকমের সবুজ এবং ওর নড়াচড়ার সাথে সাথে আলো খেলা করছে তাতে। ফলে তার রং বদলে যাচ্ছে, সেখানে দেখা দিচ্ছে রংধনুর সাত রঙের বাকিগুলো। পোশাকের নিচে সেরেনার দেহের শ্বাসরুদ্ধকর বাঁকগুলোও যেন স্পষ্ট হয়ে উঠছে তখন। বাহুগুলো নগ্ন, ত্বকের কোথাও একটুও দাগ নেই। লম্বা অভিজাত ঘাড়ের ওপর বসানো মুখটা গর্বিত অভিজাত এবং মনোহর। যেকোনো মূল্যবান পান্নার চাইতেও গাঢ় সবুজ রং ওর চোখে, যে কেউ তাকানোর সাথে সাথে সম্মোহিত হয়ে পড়বে।

সেরেনার দিকে এগিয়ে গেলাম আমি, তারপর ওর হাতটা আমার হাতে নিয়ে চলে এলাম রামেসিসের কাছে। সেখানে হবু স্ত্রীর জন্য অপেক্ষা করছিল রামেসিস। আমার পাশে হাঁটতে হাঁটতে যেন চাঁদের মতো ঝিলিক দিতে লাগল সেরেনা, ওর মুখের মনোলোভা হাসিতে যেন আরো একবার সম্মোহিত হয়ে পড়ল দর্শকরা। রামেসিস হাত বাড়িয়ে দিল ওকে স্বাগত জানাতে। এবার আবার আমাদের অতিথিদের দিকে ফিরে কথা বলতে শুরু করলাম আমি।

আমি অত্যন্ত আনন্দের সাথে আপনাদের জানাচ্ছি যে, এই হচ্ছে রাজা হুরোতাস এবং তার স্ত্রী রানি তেহুতির একমাত্র কন্যা। ল্যাসিডিমনের রাজকুমারী সে, নাম সেরেনা। আমাদের ফারাও রামেসিসের সাথে বাগদান হয়ে আছে তার। ভণ্ড ফারাও উটেরিকের হাতে বন্দি হয়ে ছিল সে, যেখান থেকে তাকে উদ্ধার করেছে রামেসিস। সেই হতে যাচ্ছে আপনাদের রানি। উপস্থিত অতিথিগণ, আমি আপনাদের অনুরোধ জানাচ্ছি, আপনারা সবাই তাকে সম্মান জানান!

এক এক করে আবার সামনে এগিয়ে এলো সবাই, সেরেনার প্রতি আনুগত্যের শপথ নিল। জবাবে প্রত্যেককে এমন শ্বাসরুদ্ধকর একটা হাসি উপহার দিল সেরেনা, আমি নিশ্চিত যে বাকি জীবনের জন্য সেরেনার অনুগত ভৃত্যে পরিণত হয়ে গেল সবাই। এই ঘটনার মাধ্যমে রামেসিসকে মিশরের সিংহাসনে বসানোর ব্যাপারটা আরো নিশ্চিত করলাম আমি এবং একই সাথে আমাকে তার প্রধানমন্ত্রী এবং উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগের সম্ভাবনাও জোরদার করলাম।

*

নতুন অতিথিদের নিজনিজ কাজ খুঁজে নেয়ার জন্য অবশ্য খুব বেশি সময় দেওয়া হলো না। প্রত্যেকেরই নাম এবং চেহারা আমার পরিচিত, বিশেষ করে যারা আমাদের কাজে আসতে পারে তাদের সবাইকেই খুব ভালোভাবে চিনি আমি। কোনো সময় নষ্ট না করে তাদের অন্যদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলাম। তারপর প্রত্যেকের জন্য উপযুক্ত কাজ বেছে নিয়ে সেখানে নিয়োগ দিয়ে দিলাম তাদের, যাতে আমাদের পরিকল্পনা দ্রুত বাস্তবায়িত করা যায়।

আমার প্রথম কাজ হলো তাদের কাছ থেকে উটেরিকের সম্পর্কে যতটা সম্ভব তথ্য জোগাড় করা, যাতে তার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আরো পোক্ত হয় আমাদের অবস্থান। যেসব তথ্য পাওয়া গেল তার বেশির ভাগই আমার ইতোমধ্যে জানা হয়ে গেছে। তবে এটা জানতে পেরে বেশ অবাক হলাম যে, উটেরিক এখন সফলভাবে নিজেকে এমন এক রহস্যময় ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছে, যার কতটা বাস্তব আর কতটা কল্পনা তা কেউ বলতে পারে না। অনেকগুলো পরিচয় এবং ছদ্মনাম আছে তার এবং নিজের অনেকগুলো নকল তৈরি করেছে সে। মঞ্চের ওপর তীরের আঘাতে যার মৃত্যু হয়েছিল সেও ওই নকলদের মাঝে একজন। নতুন যারা এসেছে তাদের কাছে জানা গেল জনসমক্ষে যেই উপলক্ষগুলোতে উটেরিককে দেখা যায় সেগুলো বেশির ভাগই তার নকলদের কাজ। বিশেষ করে যুদ্ধক্ষেত্রে সৈন্য পরিচালনায় উটেরিককে দেখা গেলে প্রায় নিশ্চিতভাবেই ধরে নেওয়া যায় যে এটা তার নকলদের কেউ। এর ফলে যুদ্ধের সকল বিপদ এড়িয়ে চলতে পারে সে, আবার বিজয়ের গৌরবও ধরা দেয় তার হাতে। আবার পরাজিত হলেও তার লজ্জা পেতে হয় না তাকে। এর অর্থ হচ্ছে, যা ভেবেছিলাম তার চাইতে অনেক কঠিন হবে উটেরিককে পরাজিত করা। আঘাত করার সময় আসল উটেরিককে আঘাত করছি না তার বিকল্প কেউ, তা নিয়ে কখনো নিশ্চিত হতে পারব না।

নতুন অতিথিদের কাছ থেকে আরো জানা গেল যে, হুরোতাস এবং তার মিত্ররা অবশেষে মিশরে পা রেখেছে। ভূমধ্যসাগর হয়ে বিশাল এক নৌবহর নিয়ে এসেছে তারা এবং নীলনদ যেখানে সাগরে পতিত হয়েছে সেখান থেকে মাত্র পঁয়ত্রিশ লিগ দূরে সাজ্জাতু বলে এক জায়গায় প্রায় এক হাজারের মতো রথ মোতায়েন করেছে। এই রথ বাহিনীর দায়িত্বে আছে হুই। নিজের বাহিনী নিয়ে আবু নাসকোস শহরে হামলা করেছে সে। অন্যদিকে জাহাজগুলো নীলনদের মুখগুলো দিয়ে প্রবেশ করেছে ভেতরে, তারপর নদীপথে একই শহরের ওপর আক্রমণ চালিয়েছে। স্থল এবং জল-উভয় দিক দিয়েই হামলার শিকার হয়েছে আবু নাসকোস।

মেফিসের বদলে এখন আবু নাসকোসকে নিজের উত্তরের রাজধানী হিসেবে নির্বাচন করেছে উটেরিক। খামুদিকে পরাজিত করার জন্য আমি এবং হুরোতাস যে অভিযান পরিচালনা করেছিলাম তাতে মেফিসের নিরাপত্তা প্রাচীর দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাই আরো চল্লিশ লিগ উত্তরে আবু নাসকোস শহরে নতুন করে এক দুর্ভেদ্য রাজধানী তৈরি করেছে উটেরিক। জায়গাটায় এক প্রাচীন শহর ছিল বহু আগে, এখন কেবল তাদের ধ্বংসস্তূপ রয়ে গেছে। সেই শহরের বাসিন্দাদের সম্পর্কে প্রায় সম্পূর্ণ তথ্য এখন হারিয়ে গেছে। কালের গহ্বরে।

এই তথ্যগুলো জানার পর আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, উটেরিক নিজে তার সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দিয়ে উত্তরে নিয়ে যাচ্ছে নাকি তার কোনো নকল তার হয়ে কাজটা করছে সেটা নিজে নিশ্চিত হতে হবে আমাকে। উটেরিক নিজে যদি তার সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে থেকে থাকে তাহলে আগে আমাদের উচিত হবে লুক্সর শহরের দখল নিয়ে নেওয়া। যদিও আনন্দের বাগানে আমাদের সৈন্যসংখ্যা চার শর বেশি হবে না, তবে লুক্সরের সুরক্ষার জন্য উটেরিক খুব বেশি সৈন্য রেখে যাবে না বলেই মনে হয়। আশা করি শহরের বাসিন্দাদের আমাদের পক্ষে নিয়ে আসা সম্ভব হবে। লুক্সর উটেরিক থেকে যখন বিদায় নেবে তখন সেই দৃশ্য দেখার জন্য নিজে উপস্থিত থাকতে চাই আমি এবং সম্পূর্ণ একা। এমনকি রামেসিস বা সেরেনাকেও সঙ্গে নেব না বলে ঠিক করেছি। মধ্যরাতের ঠিক এক ঘণ্টা পর দুর্গের প্রধান দরজা দিয়ে বেরিয়ে এলাম আমি। ইচ্ছে করেই এই সময়টা বেছে নিয়েছি, কারণ এখন সবচেয়ে নীরব থাকে পরিবেশ। প্রহরীদের সাবধান করে দিয়েছি আমার এই বেরিয়ে যাওয়ার খবর যেন কাউকে না জানানো হয়। বাইরে এসে নিশ্চিদ্র অন্ধকারে মিশে গেলাম আমি, পাহাড়ের ঢাল বেয়ে এগিয়ে চললাম লুক্সর শহরের দিকে।

যখন আমার গন্তব্যে পৌঁছলাম তখনো চাঁদ মাথার ওপরে রয়েছে, ভোর হতে আরো কয়েক ঘণ্টা বাকি। উঁচু পাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে নীলনদের দিকে তাকালাম। মশালের আলোয় প্রায় দিনের আলোর মতো উজ্জ্বল হয়ে আছে বন্দর। ভারী বোঝা মাথায় নিয়ে ঘাটের সিঁড়ি বেয়ে ওঠানামা করছে মজুরের দল, জাহাজের খোলে বোঝাই করছে রসদ। প্রতিটি জাহাজের খোল ভরে যাওয়ার সাথে সাথে ঘাট থেকে সরে যাচ্ছে সেটা, তারপর নদীর ভাটি ধরে অন্ধকারে এগিয়ে যাচ্ছে আবু নাসকোস শহরের দিকে।

একসময় আকাশের রং হালকা হয়ে এলো, পুব দিগন্তের ওপাশে উঁকি দিল সূর্য। প্রায় একই সময়ে ছোট্ট এক দল ঘোড়সওয়ার প্রবেশ করল বন্দরের প্রবেশপথ দিয়ে, তারপর একটা জাহাজের পাশে গিয়ে থামল। ঘোড়া থেকে নেমে দলবেঁধে জাহাজের প্রধান ডেকে উঠল আরোহীরা। সবার পরনে একই ধরনের পোশাক, যেটা উটেরিকের সিংহাসনে বসার পর থেকে অভিজাত শ্রেণির মাঝে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এবং এই পোশাকের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে চওড়া কানাওয়ালা টুপি, যেটা পরিধানকারী ব্যক্তির চেহারাকে ঢেকে রাখে। অশ্বারোহীরা জাহাজে উঠতেই নাবিকরা ছেড়ে দিল জাহাজ। জাহাজটা স্রোতে ভেসে এগিয়ে চলেছে, এই সময় এক যাত্রী তার মাথার টুপিটা খুলে ফেলল, তারপর ঝুঁকে এসে পাশের এক পুরুষ সঙ্গীর ঠোঁটে চুমু খেলো। আবার ঘুরে দাঁড়িয়ে টুপিটা মাথায় পরছে সে, এই সময় তার চেহারার এক ঝলক দেখার সুযোগ হলো আমার। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম আমি। কোনো ভুল নেই, ওই লোকটাই উটেরিক। এতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করার ফল অবশেষে মিলে গেছে।

দ্রুত আনন্দের বাগানের ফিরে এলাম আমি, তারপর আলোচনা সভা ডেকে আমাদের পরবর্তী করণীয় ঠিক করতে বসলাম। রাজা হুরোতাসের আক্রমণ থেকে নিজের উত্তরের রাজধানীকে রক্ষা করতে লুক্সর ছেড়ে ছুটে গেছে উটেরিক এবং এই সুযোগটা কীভাবে কাজে লাগানো যায় সেটা এখন ঠিক করতে হবে আমাদের।

এই আলোচনায় সমস্ত দিনের প্রায় পুরো সময়টাই ব্যয় হয়ে গেল আমাদের। শেষ পর্যন্ত আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, আরো পাঁচ দিন অপেক্ষা করতে হবে। এই সময়ের মাঝে উত্তরে অনেক দূরে এগিয়ে যাবে উটেরিক। কেবল তার পরেই লুক্সরে তার রেখে যাওয়া সৈন্যদের ওপর হামলা চালাব আমরা। এখন এটা নিশ্চিত হওয়ার কোনো উপায় নেই যে, তাদের সংখ্যা কত। একে তো সেনাপতি হিসেবে উটেরিক একেবারেই অনভিজ্ঞ, তার ওপর সে এটাও জানে যে আনন্দের বাগানে কত শক্ত এক ঘাঁটি গড়ে তুলেছি আমরা। যাদের সে মৃত্যুদণ্ড দিতে এখানে পাঠিয়েছিল তারাই এখন আমাদের সাহায্য করছে। এখন লুক্সরে খুব বেশি সৈন্য না থাকাই স্বাভাবিক। সোজা কথায় এখন আমাদের জানতে হবে যে ওই সৈন্যদের সংখ্যা কত এবং তাদের নেতৃত্বে কাকে রেখে গেছে উটেরিক।

এই সময়ের মাঝে আমরা আরো একটা সিদ্ধান্ত নিলাম। আমাদের মধ্যে যারা লুক্সরে বেশ প্রভাবশালী এবং পরিচিত ছিল তারা গোপনে শহরে প্রবেশ করবে এবং আমাদের পক্ষে কাজ করার সম্ভাবনা আছে এমন নাগরিকদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করবে। যদিও এখানে যারা আছে তাদেরকে সবাই ডুগ এবং তার চ্যালাদের হাতে মৃত বলেই জানে; কিন্তু তবু এই ঝুঁকিটা নিতে হবে তাদের। শহরের সুনাগরিকদের আমাদের ইচ্ছের কথা জানাবে তারা এবং উটেরিকের বদলে রামেসিসকে মিশরের ফারাও হিসেবে অধিষ্ঠিত করার ব্যাপারে তাদের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করবে।

এমনিতেই এই সব দুশ্চিন্তা আর আসন্ন যুদ্ধের পরিকল্পনায় আমার মাথা ভার হয়ে ছিল, তার ওপর সেদিন বিকেলেই আরো এক আজব ঘটনা ঘটল। মাথাটা একটু ঠাণ্ডা করার জন্য সবে একটা লাল মদের পাত্রের মুখ খুলেছি আমি, এই সময় দুর্গের দক্ষিণ প্রান্তে আমার কামরায় হঠাৎ করেই হাজির হলো রামেসিস আর সেরেনা। দুজনের আচরণেই এমন কিছু একটা ছিল যে, সাথে সাথে সতর্ক হয়ে উঠলাম আমি। প্রথমত সাধারণত যা করে সেভাবে সরাসরি আমার কামরায় ঢুকে পড়ার বদলে আস্তে আস্তে দরজায় টোকা দিয়ে তারপর ভেতরে ঢুকল তারা। দেখলাম হাত ধরাধরি করে আছে দুজন; কিন্তু কেউই আমার চোখের দিকে সরাসরি তাকাচ্ছে না। তারপর আবার জানতে চাইল যে তারা আমাকে কোনোভাবে বিরক্ত করছে কি না। আমি যখন বললাম যে আমার বিরক্তি উদ্রেকের মতো কোনো কারণ ঘটেনি তখন হঠাৎ চুপ হয়ে গেল দুজন। শেষ পর্যন্ত আমিই নীরবতা ভঙ্গ করলাম এবং দুই পেয়ালা মদ তুলে দিলাম দুজনের হাতে; যদিও এটাই আমার শেষ বোতল ছিল। কৃতজ্ঞচিত্তে পেয়ালা দুটো গ্রহণ করল দুজন। তারপর আবার নীরবে গভীর মনোযোগর সাথে চুমুক দিতে লাগল তাতে, কেউ কোনো কথা বলছে না।

শেষ পর্যন্ত আমি জিজ্ঞেস করলাম ওদের আর কিছু বলার আছে কি না। এই কথা শুনে পরস্পরের সাথে অর্থপূর্ণ ভঙ্গিতে দৃষ্টি বিনিময় করল দুজন। শেষ পর্যন্ত সেরেনাই মুখ খোলার সিদ্ধান্ত নিল।

আমরা বিয়ে করতে চাই, বলল ও। কথাটা শুনে দারুণ অবাক হয়ে গেলাম আমি।

ঠিক বুঝতে পারলাম না তোমার কথা, সাবধানতার সাথে জবাব দিলাম আমি। এমন তো নয় যে দুষ্টুমি করতে করতে নিষিদ্ধ কিছু করে ফেলেছ তোমরা, এবং এখন তার ঝামেলা থেকে বাঁচার জন্য তড়িঘড়ি করে বিয়ে করতে চাইছ?

না! না! এভাবে বোলো না টাটা। সত্যি কথা বলতে, ওই দুষ্টুমি না করার কারণেই আজ প্রথমবারের মতো ঝগড়া হয়েছে আমাদের মাঝে।

এবার আমি সত্যিই বিভ্রান্ত বোধ করছি, স্বীকার করলাম আমি। বুঝিয়ে বলো তো কী হয়েছে?

আজ আমাদের মাঝে প্রথমবারের মতো ঝগড়া হয়েছে, কারণ আমি ওটা করতে চাচ্ছিলাম অথচ রামেসিস চাইছিল না। ও বলছে ও নাকি বিয়ের আগে এসব কিছু করবে না বলে কথা দিয়েছে আমার মাকে।

তুমিও তো তোমার মাকে কথা দিয়েছিলে, তাই না সেরেনা? প্রশ্ন করলাম আমি।

দিয়েছিলাম; কিন্তু তখন তো বুঝতে পারিনি যে এত লম্বা সময় ধরে সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে হবে আমাকে, উদাস গলায় বলল ও। এক বছর ধরে অপেক্ষা করে আছি আমি, আর পারছি না। আর এক দিনও অপেক্ষা করা সম্ভব নয় আমার পক্ষে। আমি অত্যন্ত দুঃখিত টাটা। কিন্তু আজ রাতেই আমাদের বিয়ে দিতে হবে তোমাকে!

আগামীকাল হলে ভালো হয় না? একটু সময় নেওয়ার জন্য বলে উঠলাম আমি। ব্যাপারটা নিয়ে একটু চিন্তাভাবনা করতে দাও আমাকে।

সজোরে মাথা নাড়ল সেরেনা। বলল, আজ রাতেই!

আচ্ছা আমার মদটুকু তো শেষ করতে দেবে, না কি?

অবশ্যই দেব, মাথা ঝাঁকাল সেরেনা। আগে আমাদের বিয়ে দাও, তারপর।

তো এই পবিত্র বিয়েটা কোথায় হলে ভালো হয় বলে তোমার ধারণা?

আমার বাগানে। সেখানে সকল দেবতারা আমাদের দেখতে পাবেন এবং তাদের আশীর্বাদ দিতে পারবেন।

বেশ, হার মেনে নিলাম আমি। তোমাদেরকে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ করার। সুযোগ পেয়ে আমি সৌভাগ্যবান বোধ করছি!

সুন্দর একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করলাম আমি। এত সুন্দরভাবে গুছিয়ে কথা বললাম যে, আমাদের তিনজনেরই চোখে পানি চলে এলো। এবং যখনই সেই চূড়ান্ত কথাগুলো বললাম, এই মুহূর্ত থেকে সকল দেবতাকে সাক্ষী রেখে তোমাদের স্বামী এবং স্ত্রী হিসেবে ঘোষণা করছি, সাথে সাথে মনে হলো যেন বাতাসে মিলিয়ে গেল দুজন। পরবর্তী দুই দিন ধরে তাদের কোনো খোঁজ পাওয়া গেল না। শেষ পর্যন্ত যখন আবার আমার সামনে এসে দাঁড়াল, তখন ওরা পরস্পরের হাত ধরে আছে, যদিও এই দুই দিনে ওরা কেবল হাত ধরাধরিই করে ছিল বলে আমার মনে হয় না।

কী? প্রশ্ন করলাম আমি। এবার আশা করি শখ মিটেছে?

এতে এত আনন্দ তা যদি আগে একটু হলেও জানতাম তাহলে রামেসিসের সাথে যেদিন দেখা হলো সেদিনই ওকে বিয়ে করে ফেলতাম আমি, গম্ভীর গলায় জবাব দিল সেরেনা। দশ হাজার বার ধন্যবাদ তোমাকে টাটা। এমন সুখের কথা কোনো দিন কল্পনাও করতে পারিনি আমি।

*

উটেরিক চলে যাওয়ার পর তৃতীয় দিনে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, এবার লুক্সর শহরের হালহকিকত একটু বুঝে দেখা দরকার। রামেসিসকে সাথে নিয়ে আনন্দের বাগানে আশ্রয় নেওয়া লোকদের মধ্য থেকে দশজন দক্ষ লোককে বাছাই করলাম আমি, যাদের ওপর সম্পূর্ণভাবে বিশ্বাস স্থাপন করা যায়। সবাই মিলে গোপনীয়তা বজায় রাখার শপথ নিলাম আমরা। দরকার হলে মরব; কিন্তু কোনো তথ্য ফাঁস করব না। তারপর আলাদা আলাদাভাবে এগোলাম শহরের প্রবেশপথের দিকে। এবং প্রায় সাথে সাথেই প্রহরীদের মনোভাব দেখে মনে মনে সতর্ক হয়ে উঠলাম আমি। এর আগে কখনো ওদের এত সতর্ক অবস্থায় দেখা যায়নি। তাদের এই যুদ্ধংদেহী মনোভাব দেখে কিছু দূর থেকেই আমি আর রামেসিস ঠিক করলাম, এই অবস্থায় শহরে ঢোকা ঠিক হবে না। তাই পথ বদল করলাম আমরা, শহরের দরজার সামনে জমে থাকা ভিড়ের পাশ দিয়ে অন্য একটা পথ বেছে নিলাম। দেখলাম যারা ভেতরে ঢুকতে চাইছে তাদের সবাইকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করা হচ্ছে, তল্লাশি করা হচ্ছে পুরো শরীর।

একটু নিরাপদ দূরত্বে গিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পুরো ব্যাপারটা দেখতে লাগলাম আমরা। দেখলাম আমাদের এক সঙ্গীকে গ্রেপ্তার করল প্রহরীরা, তারপর অন্যদিকে নিয়ে গেল। সেদিন ময়দানে উটেরিকের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের মাঝে এই লোকও ছিল। দুর্ভাগ্যক্রমে প্রহরীরা তাকে চিনে ফেলেছে। কিন্তু সেইসাথে এটাও দেখলাম যে, আমাদের আরো দুই সঙ্গী ঠিকই প্রহরীদের নাকের ডগা দিয়ে শহরে ঢুকে পড়ল। তবে সাতপাঁচ ভেবে আর ঝুঁকি নেওয়া ঠিক হবে না বলেই মনে হলো আমাদের। তাই বাকিদের মধ্যে তখনো যারা শহরে ঢোকার জন্য সারিতে দাঁড়িয়ে ছিল তাদের ডেকে নিলাম, তারপর আগের মতোই আলাদা আলাদাভাবে ফিরে এলাম আনন্দের বাগানে। সারা দিন কেটে গেল যে দুজন ভেতরে ঢুকেছিল তাদের জন্য অপেক্ষা করতে করতে। এবং সূর্যাস্তের ঠিক আগে যখন শহরের প্রবেশদ্বার বন্ধ করে দেওয়া হয়; সেই সময় ফিরে এলো তারা। কিন্তু আমাদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একজন লোককে ঠিকই হারাতে হলো আমাদের। আর কখনো তাকে দেখতে পাইনি আমরা। আমার ধারণা, পানমাসির লোকেরা তার ওপর নির্যাতন চালিয়েছে, তারপর খুন করে ফেলেছে। যদি এটাই তার ভাগ্যে ঘটে থাকে তাহলে বলতে হবে যে, নির্যাতন করলেও আমাদের কথা ফাঁস করেনি সে এবং এই গোপন ঘাঁটির ওপর হামলা চালাতেও এগিয়ে আসেনি কেউ।

শহর থেকে যে দুজন ফিরে আসতে পারল তারাও দারুণ কাজের মানুষ। পরস্পর আপন ভাই তারা, নাম শেহাব এবং মাহাব। শহরের ভেতরে নিজেদের বন্ধু আত্মীয়স্বজন এবং অন্যদের সাথে যোগাযোগ করতে পেরেছে তারা, তাদের কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যও জোগাড় করেছে। জানা গেছে। জেনারেল পানমাসিকেই নিজের অবর্তমানে সব দায়িত্ব দিয়ে গেছে উটেরিক। এই লোকই ল্যাসিডিমন থেকে সেরেনাকে অপহরণ করে নিয়ে এসেছিল মিশরে। তবে সে একই সাথে শত্রু হিসেবে ধূর্ত এবং ভয়ংকরও বটে, এবং ব্যাপারটা চিন্তা করে কিছুক্ষণের জন্য হলেও থমকে গেলাম আমি।

দুই ভাই আরো জানাল যে, জেনারেল পানমাসির হাতে এই মুহূর্তে খুব বেশি হলে তিন থেকে চার শ লোক আছে। সৈন্যদের বাকিরা গেছে উটেরিকের সাথে আবু নাসকোস শহরে হুরোতাসের আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে। এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে পানমাসি এবং উটেরিকের কোনো ধারণাই নেই যে এ পর্যন্ত তাদের হাত থেকে কত লোককে বাঁচিয়েছি আমরা। উটেরিক নিশ্চয়ই ধারণা করেছে যে তার প্রিয় জল্লাদ ডুগ সবাইকেই সফলভাবে খুন করেছে। ডুগ যে এখন আর নিরপরাধ ব্যক্তিদের ওপর অত্যাচার চালানোর মতো অবস্থায় নেই এবং তার চকচকে খুলিটা এখন আনন্দের বাগানের টানা সেতুর ওপর শোভা পাচ্ছে- এটা ঘুণাক্ষরেও সন্দেহ করতে পারেনি তারা।

তাই প্রথমেই পানমাসির এই ভুল ধারণা ভেঙে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম আমি। দুই সাহসী ভাইয়ের কাছ থেকে সব খবর শোনার প্রায় সাথে সাথেই পরিকল্পনা সাজাতে শুরু করলাম আমরা। পানমাসি তার লোকদের জন্য কোথায় থাকার ব্যবস্থা করেছে এবং রাতের বেলা যখন শহরের প্রবেশদ্বার বন্ধ থাকে তখন সেখানে কত লোক থাকে- এই সব খবরই নিয়ে এসেছে তারা। তার ওপরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার যেটা ওরা শুনে এসেছে যে, রামেসিসের নাম এখনো মানুষের মনে জাগরূক। সেইসাথে আমাকেও মনে রেখেছে তারা, বিশেষ করে লুক্সরের বাসিন্দারা। কারণ আমরা দুজনই এই শহরের সন্তান। তাই আমরা ঠিক করলাম আমাদের এই জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়েই পানমাসিকে উৎখাত করার ব্যবস্থা করতে হবে। হুরোতাসের সেনাবাহিনী কবে আবু নাসকোস দখল করবে আর কবেই বা লুক্সরে আমাদের কাছে এসে পৌঁছবে তার জন্য অপেক্ষা করার কোনো সময় নেই। কারণ এতে কয়েক মাস যেমন লাগতে পারে তেমন কয়েক বছরও লাগতে পারে।

উটেরিকের হাত থেকে এ পর্যন্ত ৩৮২ জন শক্তসমর্থ পুরুষকে বাঁচাতে সক্ষম হয়েছি আমরা। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে আমাদের অস্ত্রশস্ত্রের ভাণ্ডার অত্যন্ত অপ্রতুল। তবে আমাদের দুই গুপ্তচর জানাল, শহর ত্যাগ করার আগে উটেরিক তার লোকদের নির্দেশ দিয়ে গেছে শহরের প্রত্যেক বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে সব অস্ত্র এক জায়গায় জড়ো করতে। ফলে শুধু তার লোকদের কাছে ছাড়া আর কোথাও কোনো অস্ত্র নেই। বাজেয়াপ্ত করা অস্ত্রগুলো সব পানমাসির লোকেরা শহরের বাইরে বন্দরের কাছে একটা গুদামে জড়ো করে রেখেছে। এসব অস্ত্রের মাঝে রয়েছে কয়েক শ দুই দিক বাঁকানো ধনুক এবং সবগুলোর জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে শক্ত পাথরের ফলা লাগানো তীর। তার সাথে আরো রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ব্রোঞ্জের তলোয়ার এবং ছোরা আর এক শর ওপরে যুদ্ধের কুঠার।

যে রাতে আমরা লুক্সর শহরের ওপর হামলা চালাব বলে ঠিক করলাম সে রাতে আকাশে কেবল এক ফালি ক্ষয়টে চাঁদ থাকার কথা, এবং আমাদের হিসাব অনুযায়ী তা ঠিক মাঝরাতের পরপরই ডুবে যাবে। ফলে দারুণ সুবিধা হয়ে যাবে আমাদের। চাঁদের হালকা আলোতে পথ চিনে নিয়ে বন্দরের নির্দিষ্ট গুদামের কাছে পৌঁছে যেতে পারব আমরা। তারপর চূড়ান্ত আক্রমণের জন্য যখন নিশ্চিদ্র অন্ধকার প্রয়োজন তখনই চাঁদ ডুবে গিয়ে আমাদের আরো সুবিধা করে দেবে। হামলার জন্য নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের কয়েকটা ছোট ছোট দলে ভাগ করে দেওয়া হবে। প্রত্যেক দলের মধ্যে দড়ির সাহায্যে সংযোগ রাখা হবে, যাতে অন্ধকারের মাঝে কোনো দল আলাদা না হয়ে যায়। প্রত্যেক দলের মধ্যে দুজনের হাতে থাকবে বড় হাতুড়ি, গুদামে পৌঁছানোর সাথে সাথে তার দরজা হাতুড়ি দিয়ে ভেঙে ফেলবে তারা। হাতুড়ির শব্দে শহরের প্রহরীদের সতর্ক হয়ে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই, কারণ বন্দরটা শহর থেকে বেশ দূরে। তার ওপর শহর এবং বন্দরের মাঝখানে রয়েছে বেশ কিছু টিলা, ফলে আরো কমে যাবে শব্দ।

সূর্যাস্তের এক ঘণ্টা পর আনন্দের বাগান থেকে রওনা দিলাম আমরা। কিছুটা দূরত্ব রেখে পরস্পরকে অনুসরণ করতে লাগল ছোট ছোট দলগুলো। নির্দিষ্ট গতিতে এগোলাম আমরা, ফলে সঠিক সময়েই পৌঁছে গেলাম গন্তব্যে। বন্দরের পৌঁছানোর পর সংযোগ রাখার জন্য ব্যবহৃত দড়িগুলো ছুঁড়ে ফেলে দিলাম, তারপর চুপিসারে চলে এলাম গুদামের দরজার কাছে। তিনটি দলই জায়গামতো অবস্থান নেওয়ার পর আমার সেই দুই আঙুলের কান ফাটানো শিসটা বাজালাম একবার। সাথে সাথে হাতুড়ির বাড়ির শব্দে ভরে উঠল জায়গাটা। কয়েক বাড়িতেই ভেঙে পড়ল গুদামের দরজা। ভেতরে ঝিমোচ্ছিল প্রহরীদের দল, হঠাৎ করে আরামের ঘুম ভেঙে যাওয়ায় বিভ্রান্ত হয়ে চেঁচামেচি শুরু করল তারা। তবে যেই হাতুড়ি দিয়ে দরজা ভাঙা হয়েছে সেই একই হাতুড়ির ঘায়ে তাদের আবার ঘুমের দেশে পাঠিয়ে দিতে খুব একটা দেরি হলো না।

শেষ প্রহরীটার মুখও বন্ধ করে দেওয়ার পর কান খাড়া করে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম আমরা। যদি কোনো প্রহরী আমাদের হাত থেকে বেঁচে গিয়ে থাকে। তাহলে নিশ্চয়ই তার সাড়াশব্দ পাওয়া যাবে। কিন্তু না, আর কোনো শব্দ পাওয়া গেল না। ধীরে ধীরে চেপে রাখা দম ছাড়লাম আমরা, তারপর চকমকি ঘষে তেলের বাতিগুলো জ্বালালাম। আলো জ্বলে উঠতে এদিক-ওদিক তাকালাম এবার। দেখলাম লম্বা একটা ঘরের মাঝে রয়েছি আমরা। মেঝের ওপর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে স্কুপ আকারে রাখা রয়েছে নানান ধরনের যুদ্ধাস্ত্র।

সবাই হাত লাগাও বন্ধুরা, তাড়াতাড়ি করো। অনেক কাজ পড়ে রয়েছে। আমাদের সামনে, সবাইকে নির্দেশ দিলাম আমি। সাথে সাথে গুদামের এ মাথা থেকে ও মাথায় ছড়িয়ে পড়ল সবাই, অস্ত্রের স্তূপ থেকে তীর-ধনুক আর নানা ধরনের ধারালো অস্ত্র বেছে নিতে শুরু করল। ধনুকে ছিলা পরানোর আগে সেগুলোর নমনীয়তা পরীক্ষা করে নেওয়া হলো, বুড়ো আঙুলে ঘষে পরীক্ষা করা হলো তলোয়ারের ধার। ওদিকে আমি আর রামেসিস তাড়া দিয়ে চললাম সবাইকে, দ্রুত হাত চালানোর জন্য তাগাদা দিতে লাগলাম।

সবার হাতে পর্যাপ্ত অস্ত্র তুলে নিতে সময় খুব বেশি লাগল না। কিছুক্ষণের মধ্যেই দুই দিক বাঁকানো ধনুক, দুই কাঁধে ঝোলানো তীরভর্তি জোড়া তূণ আর কোমরের খাপে ভরা চকচকে ধারালো তলোয়ার বা ছোরা নিয়ে বেরিয়ে এলো। আমার লোকেরা। দলের নেতাদের কাছ থেকে ভেসে এলো নিচু গলার নির্দেশ, সেই অনুযায়ী তেলের বাতিগুলো নিভিয়ে ফেলে সবাই আবার আগের মতো নিজ নিজ দলে ভাগ হয়ে গেল। তারপর নুড়ি বিছানো পথ ধরে শহরের প্রধান দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম আমরা। দরজার সামনে এসে দেখলাম ভেতর থেকে আটকানো রয়েছে দরজা; কিন্তু কাউকে দেখা যাচ্ছে না আশপাশে। রামেসিস এবং আমার সাথে যারা ছিল তারা পথের দুই পাশে নালার মাঝে নেমে পড়ে অবস্থান নিল আর আমরা দুজন এগিয়ে গেলাম সামনে। দরজার গায়ে কান পাতলাম আমি; কিন্তু এবারও কিছু শোনা গেল না। এবার কোমরের খাপ থেকে ছুরিটা বের করে বাঁট দিয়ে দরজার গায়ে আস্তে আস্তে টোকা দিলাম। সামান্য বিরতি দিয়ে তিনটি করে টোকা, তিনবার।

সাথে সাথেই জবাব পাওয়া গেল। এই সংকেতই ঠিক করে রাখা ছিল আগে থেকে। দরজার গায়ে তৈরি করা ফুটোর দিকে এগিয়ে গেলাম আমি। কয়েক মুহূর্ত পর ওপাশ থেকে ফুটোর আবরণ উঠে গেল। দেখলাম শেহাবের উজ্জ্বল চোখগুলো তারার আলোতে জ্বলজ্বল করছে, তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমাদের বন্ধুদের কী খবর? মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করলাম আমি।

ঘুমাচ্ছে! একই রকম মৃদু গলায় জবাব দিল সে, তারপর ফুটোটা আবার বন্ধ করে দিল। শুনলাম দরজার ওপাশে লাগানো খিলটা নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। সে। বড় ফটকের গায়ে ছোট একটা দরজা আছে। একেবারেই সরু, একবারে বড়জোর একজন মানুষ ঢুকতে পারে; তবে মাথা নুইয়ে এবং কাঁধের ধনুকটা সামলে ভেতরে ঢুকতে হবে তাকে। শেহাবকে দাঁত বের করে হাসতে দেখলাম আমি। দেয়ালের গায়ে ঝুলছে কয়েকটা তেলের প্রদীপ, তার আলোতে শেহাবের পেছনে কয়েকজন প্রহরীকে ঘুমন্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা গেল। কয়েকজন তো আরামে নাক ডাকতে লেগেছে। আরেকজনের হাতে রয়েছে সেই মদের বোতলটা, যেটা গতকাল শেহাবকে দিয়েছিলাম আমি। তবে এখন বোতলটা খালি, সেটাকে বুকের সাথে উল্টো করে চেপে ধরে বেঘোরে ঘুমোতে লেগেছে ব্যাটা। নিজের বাকি সঙ্গীদের মতোই এখন পৃথিবীর কোনো কিছুর প্রতি খেয়াল নেই তার। মদের সাথে লাল শেপেনের যে রস আমি মিশিয়ে দিয়েছিলাম তা অত্যন্ত কড়া ঘুমের ওষুধ।

আমার পেছনে প্রথম যে পাঁচজন ঢুকল তাদের ওপর দায়িত্ব দিলাম ঘুমন্ত প্রহরীদের হাত-পা এবং মুখ বেঁধে ফেলার। সংযোগ রাখার জন্য ব্যবহৃত দড়ি এবং বন্দিদের নিজেদের কাপড়চোপড় ব্যবহৃত হলো এই কাজে। এরপর যারা ভেতরে ঢুকল তাদেরকে কাজে লাগালাম ঝুলন্ত দরজাটাকে ওপরে টেনে তুলতে। বড়সড় কাঠের চাকাটার হাতল ধরে গায়ের জোরে ঘোরাতে শুরু করল তারা। বিশাল দরজাটা ক্যাচকোচ শব্দে ওপরে উঠে যেতে শুরু করল। যথেষ্ট উঁচু হতেই তার নিচ দিয়ে ঢুকে পড়ল আমাদের দলের বাকি সদস্যরা, সবার হাতে সদ্য ছিনতাই করে আনা অস্ত্র। তবে আমার নির্দেশ অনুযায়ী সবাই চেষ্টা করছে যতটা সম্ভব নীরবে কাজ সারার। কেউ কোনো যুদ্ধ হুংকার ছাড়ল না, এমনকি দলের নেতারাও ফিসফিস করে নির্দেশ দিতে লাগল সবাইকে। কিন্তু তার পরও তাদের ব্রোঞ্জের তলাওয়ালা জুতো এবং অস্ত্রের ঝনঝনানিতে যে শব্দ তৈরি হলো তাও নেহাত কম নয়। আমাদের সবাই ভেতরে ঢুকতে পারার আগেই পানমাসির সৈন্যরা ছুটে এলো এদিকে। শহরের ভেতরের রাস্তাগুলোতে টহল দিচ্ছিল তারা, হট্টগোলের আওয়াজ পেয়ে কী হয়েছে দেখতে এসেছে। ধাতব ঝনঝন আর পায়ের শব্দ শুনে প্রবেশপথের দিকে এসেই আমাদের মুখোমুখি হতে হলো তাদের। এক মুহূর্তের মধ্যে নিস্ত ব্ধ রাস্তা পরিণত হলো রক্তাক্ত যুদ্ধক্ষেত্রে। দুই পক্ষের ক্রমাগত রণহুংকারে কেঁপে উঠতে লাগল রাতের নৈশব্দ্য। এই দল যদি বলে অপরাজেয় উটেরিক দীর্ঘজীবী হোন! তো ওই দল বলে রামেসিসের জয় হোক!

নীচু বংশের সব গ্রাম্য ছেলেপিলে দিয়ে নিজের সেনাবাহিনী বোঝাই করেছে উটেরিক, খুব সম্ভব ফারাও টামোসের প্রতি ওদের তেমন কোনো আনুগত্য নেই বলেই। তা ছাড়া ওদেরকে যেকোনো ব্যাপারে প্রভাবিত করাও খুব সহজ। তাদের তুলনায় আমাদের লোকেরা স্বাভাবিকভাবেই অনেক বয়স্ক। অনেকেই আর আগের মতো শক্তসমর্থ নেই। কিন্তু যুদ্ধবিদ্যায় তারা অত্যন্ত দক্ষ এবং জীবনের বেশির ভাগ সময় এই শহরে কাটানোয় এখানকার সব অলিগলি তাদের হাতের তালুর মতো মুখস্থ। শুরুতে তরুণ সৈন্যদের সংখ্যার মুখে আমরা কোণঠাসা হয়ে পড়লাম ঠিকই, স্রোতের মতো সেনানিবাস থেকে বেরিয়ে আসতে লাগল তারা। কিন্তু আমার লোকেরা জানে যে কীভাবে টিকে থাকতে হয়। বৃত্তাকারে দলবেঁধে দাঁড়িয়ে গেল তারা, তারপর ঢাল দিয়ে দুর্ভেদ্য দেয়াল তৈরি করে তার আড়াল থেকে আক্রমণ চালিয়ে গেল উটেরিকের সৈন্যদের ওপর। যুদ্ধ সংগীত গাইতে লাগলাম আমরা। ওদিকে গণ্ডগোলের আভাস পেয়ে লুক্সরের সাধারণ মানুষও ঘুম থেকে জেগে উঠল, আমাদের গানের শব্দ কানে গেল তাদের। রামেসিসের নাম শুনতে পেয়ে অনেকের রক্তে নাচন লাগল। পঁয়ত্রিশ-চল্লিশ বছর বয়সের দাড়িওয়ালা যোদ্ধারাও শুনতে পেল সেই নাম। তাদের মনে পড়ে গেল এই রামেসিসের বাবা ফারাও টামোসের হয়ে যুদ্ধ করেছে তারা এবং তিনি ছিলেন এক মহৎ ফারাও।

উটেরিক নামটার সাথেও তারা বেশ ভালোভাবেই পরিচিত, এই মুহূর্তে তার কুশাসনই বিদ্যমান মিশরে। তার সম্মান রক্ষার্থে যেসব মন্দির তৈরি হচ্ছে তার নির্মাণ খরচ আসে জনগণের ওপর নির্ধারিত আকাশছোঁয়া কর থেকে। একসময় অঢেল পরিমাণে লাল মদ আর মাংস দিয়ে উদরপূর্তি করতে পারত সবাই, এখন সেখানে পচা রুটিও জোটে কি না সন্দেহ। তাদের চোখের সামনেই পুরনো বন্ধুদের বন্দি করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে পাহাড়ের ওপর অবস্থিত ভয়ানক সেই কারাগারে, যেখান থেকে কেউ ফেরে না। অথচ কেউ কোনো প্রতিবাদ করতে পারেনি।

এখন যেই রামেসিসের নাম তাদের কানে প্রবেশ করল, সবাই বুঝতে পারল যে নিজেদের অধিকারের জন্য লড়াই করার এটাই শেষ সুযোগ তাদের সামনে। ফলে অলস সময় কাটানোর সঙ্গী পুঁথিপত্র আর পাশা খেলার ছক ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে উঠে দাঁড়াল তারা। চিৎকার করে নিজেদের স্ত্রীদের নির্দেশ দিল সিঁড়ির নিচ থেকে মরচে ধরা অস্ত্র আর বর্ম আবার বের করে আনতে। তারপর পাঁচ-দশজনের দলে ভাগ হয়ে নেমে আসতে শুরু করল রাস্তায়, কান পেতে শুনল কোন দিক থেকে আসছে সেই রণহুংকার, রামেসিসের জয় হোক! তারপর সেই শব্দ লক্ষ্য করে কেউ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে, কেউ হেঁটে, কেউ বা দৌড়ে এগিয়ে এলো আমাদের কাছে, তারপর পুরনো সঙ্গীদের পাশাপাশি দাঁড়িয়ে গেল, বর্মের দেয়ালের এ পাশ থেকে শুরু করল লড়াই।

সমস্ত রাত ধরে লড়াই করলাম আমরা। রাত গড়িয়ে দিন হলো; কিন্তু লড়াই থামল না। সমস্ত দিন লড়াই চলার পর সন্ধ্যা নাগাদ বুঝতে পারলাম বিজয় আমাদের হাতেই ধরা দিতে চলেছে। নতুন উৎসাহে উজ্জীবিত হয়ে লড়াই চালিয়ে গেলাম আমরা। পানমাসির সৈন্যদের প্রতিরোধ ভেঙে পড়তে শুরু করল আমাদের সামনে। শেষ পর্যন্ত তারা দলে দলে ভাগ হয়ে রামেসিসের পক্ষে যোগ দিতে শুরু করল। দেরিতে হলেও তারা বুঝতে পেরেছে যে রামেসিস বাইরের কেউ নয় বরং এই মিশরেরই সন্তান এবং উটেরিকের চাইতে বহু গুণে যোগ্য একজন ফারাও। রাতের আঁধার নেমে আসার সাথে সাথে পানমাসির দলের যেটুকু প্রতিরোধ বাকি ছিল তাও ধুলোয় মিশে গেল। যারা আমাদের সাথে যোগ দিল না তারা সবাই পালিয়ে গেল শহর ছেড়ে।

পানমাসি এবং তার অনুগত সৈন্যদের উচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্য তাদের পিছু নিয়ে শহর ছেড়ে বেরিয়ে এলাম আমরা এবং প্রধান ফটক দিয়ে বের হওয়ার সাথে সাথে যার সাথে প্রথম দেখা হলো সে হচ্ছে রাজকুমারী সেরেনা।

রামেসিস আর আমি যখন সিদ্ধান্ত নিলাম যে লুক্সর শহরে ঢুকে পানমাসি এবং তার সৈন্যদের ওপর হামলা চালাব তখন সেরেনাকে বোঝতে দারুণ বেগ পেতে হয়েছিল আমার। নিজের সবটুকু ইচ্ছাশক্তি এবং প্রভাব বিস্তার করে শেষ পর্যন্ত ওকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলাম যে, রামেসিস এবং ওর পরিবারের কথা চিন্তা করেই সেরেনার উচিত যুদ্ধক্ষেত্র থেকে দূরে নিরাপদ আশ্রয়ে অবস্থান নেওয়া। এবং অত্যন্ত স্বাভাবিক গলায় এটাও বলেছিলাম যে, এখন ও একজন বিবাহিত নারী এবং যে দারুণ উৎসাহের সাথে ও বিবাহপরবর্তী কর্তব্য সম্পাদন করেছে, তাতে এ সম্ভাবনা খুবই প্রবল যে ওর গর্ভে এখন রামেসিসের সন্তান। এখন আর যুদ্ধক্ষেত্র ওর উপযুক্ত স্থান নয়। এখন থেকে নিজের গর্ভের সন্তানের প্রতিই ওর সবটুকু খেয়াল রাখা উচিত। যদিও সম্ভাব্য সকল উপায়ে আমাকে কাটানোর চেষ্টা করেছে ও, যেভাবেই হোক লুক্সর দখলের যুদ্ধে রামেসিসের পাশে থাকতে চেয়েছে। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে রামেসিসও আমার পক্ষ নিয়েছে বলেছে যে, ওর স্ত্রী হিসেবে নিশ্চয়ই সেরেনার উচিত তার গর্ভের সন্তানকে নিরাপদে রাখা এবং সে জন্য অবশ্যই সেরেনাকে আনন্দের বাগানে থাকতে হবে। এই পর্যায়ে আমি ভয় পাচ্ছিলাম যে, দুজনই। যেমন গোঁয়ার ওদের মাঝে আবার ঝগড়া না বেঁধে যায়। কিন্তু অবাক হয়ে দেখলাম, প্রায় সাথে সাথেই রামেসিসের কথায় রাজি হয়ে গেল সেরেনা। কখনোই বুঝতে পারিনি যে মাতৃত্বের দায়িত্বকে এত গুরুত্বের সাথে নেবে ও। তবে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে দূরে থেকেছে ঠিকই; কিন্তু আমাদের মাঝে কোনো দুর্বলতা দেখলে সাথে সাথে সেই জায়গা দখল করার জন্য ঠিকই শহরের বাইরে এসে হাজিরও হয়েছে। অবশ্য সেরেনার কাছ থেকে এর চাইতে কম কিছু আশা করাও উচিত হয়নি আমার।

সেরেনার সাথে যখন আমাদের দেখা হলো তখন মধ্যরাতের আকাশে সামান্য এক ফালি চাঁদ অবশিষ্ট রয়েছে কেবল, প্রায় নিশ্চিদ্র অন্ধকার বিরাজ করছে চারপাশে। এই সামান্য আলোতে পানমাসি আর তার দলবলের অনুসরণ করা সম্ভব নয়। কিন্তু আমি জানি যে পানমাসি যদি আমাদের চাইতে বারো ঘণ্টার পথ এগিয়ে যেতে পারে তাহলে তাকে আর জীবনেও ধরা সম্ভব হবে না। তাকে আমার চাই। জীবনে আর কখনো কারো ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য এত ব্যাকুল হয়ে উঠিনি আমি। আমার এবং আমার প্রিয় মানুষগুলোর ওপর ওই লোকটা যে পরিমাণে কষ্ট আর দুর্ভোগ নামিয়ে এনেছে তার প্রতিটি মুহূর্ত মনে রেখেছি আমি। পানমাসি এবং তার লোকেদের হাতে নিহত পালমিসের ক্ষতবিক্ষত দেহের কথা মনে পড়ল আমার, সেইসাথে মনে পড়ল ছেলেকে অনন্ত শয্যায় শায়িত করার সময় হুই আর বেকাথার কষ্টের কথা। কিন্তু তার চাইতেও বেশি মনে পড়ল সেরেনাকে অপহরণ করার পর ওকে কীভাবে মেরেছিল সে, মারের চোটে ফুলে উঠেছিল সেরেনার চেহারা। অনুভব করলাম পানমাসির পেটের ভেতর তলোয়ার সম্পূর্ণ সেধিয়ে দেওয়ার আগ পর্যন্ত শান্তি নেই আমার।

কিন্তু পালিয়ে গেছে পানমাসি এবং আমরা সবাই ক্লান্তির চরম সীমায় পৌঁছে গেছি। দীর্ঘ এক রাত এবং এক দিন একনাগাড়ে লড়াই করতে হয়েছে আমাদের, তার ওপর আমাদের বেশির ভাগই যৌবন পার করে এসেছে অনেক আগে। প্রায় সবার শরীরেই আঘাতের চিহ্ন। যদিও বেশির ভাগই ছোটখাটো; কিন্তু তাই বলে ব্যথা কম দিচ্ছে না। আর আমি নিজেও ক্লান্ত, প্রচণ্ড ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। অনেকটা নিজের অজান্তেই যেন সেরেনার দিকে তাকালাম আমি। আমার চোখে হয়তো আবেদন রয়েছে বলে ভুল করল ও।

চাবুক খাওয়া কুকুরের মতো মনিবের কাছে আশ্রয় নিতে ছুটেছে পানমাসি, আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল সেরেনা। সাথে সাথে আমি বুঝতে পারলাম এইমাত্র সমস্যাটার সমাধান হয়ে গেল। পানমাসিকে অনুসরণ করার কোনো প্রয়োজন নেই আমাদের। আমরা জানি যে কোথায় চলেছে সে। হঠাৎ করেই অনুভব করলাম, সব ক্লান্তি দূর হয়ে গেছে আমার শরীর থেকে।

*

আবু নাসকোসে উটেরিকের কাছে পৌঁছানোর আগেই যদি পানমাসিকে ধরতে হয় তবে আমাদের ঘোড়া দরকার হবে। যা বোঝা যাচ্ছে পালানোর আগে নিজের এবং সঙ্গীদের জন্য ঘোড়াগুলো সব নিয়ে গেছে সে। অতিরিক্ত ঘোড়াগুলোকে পঙ্গু করে রেখে গেছে, যাতে আমরা ব্যবহার করতে না পারি। সুন্দর একটা ঘোড়া, যার পেছনের দুই পায়ের রগ কেটে ফেলা হয়েছে তার চাইতে করুণ দৃশ্য পৃথিবীতে আর কিছু আছে কি না আমার জানা নেই। পানমাসি ইচ্ছে করেই করেছে কাজটা। ইচ্ছে করলে ঘোড়াগুলোকে তাড়িয়ে দিতে পারত সে অথবা সরাসরি খুন করে যেতে পারত। কিন্তু তা না করে স্রেফ আমাদের রাগানোর জন্যই ঘোড়াগুলোকে অকেজো করে রেখে গেছে। পানমাসির ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য আরো একটা কারণ তৈরি হলো আমার মনে।

আমি এতই রেগে উঠেছিলাম যে আরেকটু হলেই পানমাসিকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য সেরেনাকে ধমক দিয়ে বসেছিলাম। শয়তানটাকে যখন হাতের মুঠোয় পাওয়া গিয়েছিল তখন স্রেফ সেরেনার কথাতেই আমি আর হুরোতাস তাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হই। কিন্তু সেরেনাকে এত ভালোবাসি আমি, ওর প্রতি নিষ্ঠুরতা কীভাবে দেখাই? তার বদলে বরং ওকে আনন্দের বাগানে পাঠালাম আবার, বললাম ওখান থেকে ঘোড়া নিয়ে আসতে। তারপর ও চলে যেতে পানমাসির হাতে পঙ্গু হয়ে যাওয়া ঘোড়াগুলোর দুই কানের মাঝে তলোয়ারের এক আঘাতে ওদের যন্ত্রণার অবসান ঘটালাম।

আনন্দের বাগান থেকে আসা ঘোড়াগুলো বাদেও পানমাসির লোকদের নজর এড়িয়ে গেছে এমন বেশ কিছু অক্ষত ঘোড়া চোখে পড়ল আমাদের। শহর থেকে পালানোর সময় তাড়াহুড়োতে এই ঘোড়াগুলোকে ফেলে রেখে গেছে। ওরা। ফলে সব মিলিয়ে বাইশটা ঘোড়া জোগাড় করা গেল। এগুলো ব্যবহার করেই পানমাসির পিছু ধাওয়া করতে হবে আমাদের।

সেরেনা যখন জেদ ধরে বসল যে পানমাসি এবং তার লোকদের পিছু নিতে আমাদের সাথে ও নিজেও যোগ দিতে চায়, স্বাভাবিকভাবেই আমি এবং রামেসিস তীব্র আপত্তি জানালাম। সেই একই পুরনো অজুহাত ব্যবহার করলাম আমরা, বললাম যে এই অবস্থায় দীর্ঘ পথ ঘোড়ার পিঠে পাড়ি দিলে তার গর্ভের বাচ্চার ক্ষতি হতে পারে, এমনকি মারাও যেতে পারে সে।

মুখে মিষ্টি হাসি ধরে রেখে আমাদের সব কথা শুনল সেরেনা, বারবার মাথা ঝাঁকাল, যেন আমাদের মতামত মেনে নিতে কোনো আপত্তি নেই ওর। তারপর যখন আমাদের কথা ফুরিয়ে এলো এবং ওর কথা শোনার জন্য আশান্বিত চোখে তাকিয়ে রইলাম আমরা তখন ও মাথা নাড়ল। তোমরা যা বলছ তা যদি সত্যি হতো তাহলে আমি সত্যিই খুশি হতাম। কিন্তু দেবী আর্টেমিসের ইচ্ছে অন্য রকম, বলল ও। তুমি আমাকে আনন্দের বাগানে রেখে আসার ঠিক পরপরই দেবী আমাকে লাল চাঁদ দেখিয়েছেন।

সে আবার কী জিনিস? অবাক হয়ে প্রশ্ন করল রামেসিস। নারীদেহের রহস্যগুলো সম্পর্কে এখনো ও আশ্চর্য রকমের অবোধ।

ওকে বোঝাও টাটা, আবেদন জানাল সেরেনা।

দেবী আর্টেমিস তোমাদের বলতে চাইছেন, যথেষ্ট নয়। আবার চেষ্টা করো, রামেসিসকে বুঝিয়ে বললাম আমি।

কয়েক মুহূর্ত ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা করল রামেসিস, তারপর হঠাৎ খুশির হাসি ফুটে উঠল ওর মুখে। দেবীকে বলো তার নির্দেশ খুব খুশি মনেই পালন করব আমি!

ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই দীর্ঘ যাত্রার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেলাম আমরা। এবার পানমাসিকে ধরতে হবে, চেষ্টা করতে হবে সে যেন কোনোভাবেই উত্তরের শহর আবু নাসকোসে অবস্থানরত তার প্রভু উটেরিকের কাছে পৌঁছতে না পারে। এবং খুব স্বাভাবিকভাবেই আর কোনো তর্কবিতর্কের প্রয়োজন হলো না। লাল চাঁদ দেখা যাক আর না-ই যাক সেরেনা বুঝিয়ে দিয়েছে যে তাকে আর অগ্রাহ্য করা যাবে না। এবার আমাদের সাথে যাবে ও।

ঘোড়ার পিঠে বসা অবস্থায় দুই পা ঘোড়ার পেটের নিচ দিয়ে বেঁধে কীভাবে ঘুমাতে হয় সেই কায়দা অনেক আগেই রপ্ত করে নিয়েছি আমি। শুধু আমাদের সঠিক পথে রাখার জন্য একজন পরিচারক থাকলেই যথেষ্ট। ভোরের এক ঘণ্টা আগে ঘুম ভাঙল আমার, এবং এক মুহূর্তের মধ্যেই সম্পূর্ণ সজাগ হয়ে উঠলাম। অনুভব করছি সম্পূর্ণ চাঙ্গা হয়ে উঠেছে আমার শরীর। শিকারের দেখা পাওয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে উঠেছি আমি।

সাত্তাকিন নদী কি এখনো পার হয়েছি আমরা? সামনের ঘোড়ায় বসে থাকা পরিচারককে জিজ্ঞেস করলাম এবার। লুক্সরের দক্ষিণে নীলনদের মাঝে পতিত হওয়া অজস্র জলধারার মাঝে সবচেয়ে বড় হচ্ছে এই সাত্তাকিন নদী।

এখনো না, বলে মাথা তুলে আকাশের তারা দেখল ছেলেটা। আরো আধ লিগ পথ বাকি আছে, বলল সে।

আমাদের সামনে পানমাসির কোনো চিহ্ন দেখা গেছে?

এই অন্ধকারে ঘোড়া থেকে না নামলে কোনো চিহ্ন দেখা সম্ভব নয় প্রভু। আমি কি নিচে নেমে পরীক্ষা করে দেখব? প্রশ্ন করল সে।

না, তার কোনো দরকার নেই। এক মিনিটও সময় নষ্ট করা যাবে না এখন। চলতে থাকো! নির্দেশ দিলাম আমি।

পেছনে তাকালাম আমি। সেরেনা আর রামেসিসকে দেখা গেল আবছা ছায়ার মতো। আমার ঠিক পেছনেই রয়েছে ওরা। ঠিক আমার ভঙ্গিতেই ঘোড়ার পিঠে বসে ঘুমাচ্ছে রামেসিস, আর সেরেনা ওকে ধরে রেখেছে, যেন হঠাৎ পিছলে পড়ে না যায়। তবে এখনই রামেসিসকে জাগানোর প্রয়োজন বোধ করলাম না আমি। আমাদের পেছনে অন্য ঘোড়াগুলোর খুরের শব্দও পাওয়া যাচ্ছে। তবে অন্ধকারে তাদের দেখতে পাওয়ার কোনো উপায় নেই, যদিও সংখ্যায় নেহাত কম নয় তারা। সামনেটা ভালোভাবে দেখার মতো আলো ফোঁটার আগে চলার গতি বাড়িয়ে কোনো লাভ নেই, তাতে বরং পানমাসির পেতে রাখা কোনো ফাঁদে পা দেওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।

জিনের সাথে চেপে ধরে ধনুকটা বাঁকিয়ে নিলাম আমি, তারপর ছিলা পরালাম তাতে। এবার ওটা কাঁধে ঝুলিয়ে তূণ থেকে পাঁচটা তীর বের করে কোমরে গুঁজে নিলাম, যাতে প্রয়োজন পড়লে দ্রুত একের পর এক ছোঁড়া যায়। পেছনে তাকিয়ে দেখলাম রামেসিসের ঘুম ভেঙেছে। নিশ্চয়ই সেরেনা জাগিয়ে তুলেছে ওকে। রামেসিস নিজেও ওর অস্ত্রগুলো নিয়ে ব্যস্ত, প্রয়োজনের মুহূর্তে দ্রুত ব্যবহারের জন্য গুছিয়ে রাখছে।

আমার দিকে একবার মুখ তুলে তাকাল ও। এবার ওর চেহারাটা পরিষ্কার ধরতে পারলাম আমি। দ্রুত ফুটতে শুরু করেছে ভোরের আলো। এখন রামেসিসের পেছনে থাকা অন্যান্য ঘোড়া আর তাদের আরোহীদেরকেও দেখতে পাচ্ছি আমি। দ্রুত গুনে নিলাম একবার। বাইশজনের সবাই আছে। তারপর তাকালাম আমার ঘোড়ার পায়ের নিচ দিয়ে চলে যাওয়া পথের দিকে। সাথে সাথে চমকে উঠলাম আমি, দ্রুত হয়ে উঠল হৃদস্পন্দন। ভোরের আলোতে দেখা যাচ্ছে পথের শুকনো মাটি খুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গেছে অনেকগুলো খুরের আঘাতে এবং ছাপগুলো এক ঘণ্টার বেশি পুরনো হবে না। এমনকি আমার চোখের সামনেই একটা দাগের কিনারার শুকনো মাটি ভেঙে গুঁড়ো হয়ে গেল।

হাত তুললাম আমি। আমার পেছনে যারা ছিল সবাই ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরল জড়ো হলো এক জায়গায়। রামেসিস আর সেরেনা আমার দুই পাশে এসে দাঁড়াল। পরস্পরের সাথে প্রায় স্পর্শ করে রইল আমাদের জুতোগুলো। ফিসফিস করে কথা বলতে শুরু করলাম আমরা।

আমি বোধ হয় বুঝতে পেরেছি যে আমরা কোথায় রয়েছি। একটু সামনেই খাড়া ঢাল বেয়ে নেমে গেছে পথ, নিচে সাত্তাকিন নদী। ছাপ দেখে বোঝা যাচ্ছে যে খুব বেশি হলে আর আধাঘণ্টার পথ সামনে রয়েছে পানমাসি। অন্ধকারে পেছন থেকে তার দলের ওপর গিয়ে পড়তে পারতাম আমরা। তবে আমি নিশ্চিত যে পানমাসি এখন ওই ঢালের মাঝে তার দলবল নিয়ে যাত্রাবিরতি করেছে। বিশ্রাম নেবে ওরা, ঘোড়াগুলোকে পানি খাওয়াবে। নিঃসন্দেহে নিজেদের পেছনে খেয়াল রাখার জন্য পাহারাদার রাখবে পানমাসি, তবে ওই উঁচু টিলাগুলোর কারণে- বলে হাত তুলে দেখালাম আমি, ওদের চোখ দেখতে এখনো দেখতে পাচ্ছে না আমাদের। বলে যেই পথ দিয়ে এসেছি সেদিকে ঘুরে তাকালাম আমি।

এখন আমাদের সামনে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট উপায় হচ্ছে পিছিয়ে যাওয়া, তারপর একটা চওড়া বৃত্ত তৈরি করে পানমাসির দল থেকে আরো সামনে গিয়ে হাজির হওয়া। ওদের বিশ্রামের সুযোগে এই কাজটা করতে হবে আমাদের। তারপর ওরা যখন আবার চলতে শুরু করবে তখন ওদের নজর পেছনেই থাকবে। কিন্তু আমরা ওদের জন্য অপেক্ষা করব পথের সামনে।

কেউ কোনো আপত্তি জানাল না, এমনকি সেরেনাও না। সুতরাং এবার উল্টো দিকে ঘুরলাম আমরা, দক্ষিণ দিক লক্ষ্য করে বেশ কিছুটা দূর পথ চললাম। তারপর একটা চওড়া অর্ধবৃত্ত রচনা করে রওনা দিলাম পুব অভিমুখে। সাত্তাকিন নদী যেখানে গিরিখাতের মাঝে ঢুকে নীলনদের সাথে মিলিত হওয়ার জন্য এগিয়ে গেছে তার বেশ কিছুটা আগে একটা জায়গায় ঘোড়াগুলো নিয়ে নদী পার হলাম আমরা।

নদী পার হওয়ার পরেও একই অর্ধবৃত্তাকার পথ ধরে এগিয়ে চললাম এবং শেষ পর্যন্ত সেই পথটার দেখা পাওয়া গেল, যেটা লুক্সর থেকে বের হয়ে নীলনদের পুব তীরের পাশাপাশি এগিয়ে গেছে। খুব সাবধানতার সাথে পথটার দিকে এগিয়ে গেলাম আমরা। কয়েক শ হাত দূরে থাকতে নেমে পড়লাম ঘোড়া থেকে, তারপর সঙ্গের সব কিছু একটা অগভীর খাদের মাঝে লুকিয়ে রেখে পায়ে হেঁটে এগোতে শুরু করলাম। রাস্তার কাছাকাছি এসে দেখলাম কোথাও কোনো মানুষ বা ঘোড়ার পায়ের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না। ব্যাপারটা দেখে স্বস্তি পেলাম ঠিকই তবে অবাক হলাম না।

এখান থেকে পশ্চিম দিকে মোটামুটি মাইলখানেক এগোলেই নীলনদ এবং লুক্সর ও আবু নাসকোসের মাঝে যোগাযোগের জন্য সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত পথ। আমি যেমনটা আশা করেছিলাম এখনো দলবল নিয়ে সাত্তাকিন নদীর পারেই অপেক্ষা করছে পানমাসি, ধরে নিয়েছে যে আমরা ওর পিছু নিইনি। চুপিসারে তার সামনের পথে অবস্থান নিতে সক্ষম হয়েছি আমরা। পথের পাশ ধরে দৌড়াতে শুরু করলাম আমি, যাতে ঘাস অথবা আগাছার কারণে আমার পায়ের কোনো ছাপ না পড়ে। একই সাথে খুঁজছি লুকিয়ে থাকার জন্য একটা সুবিধাজনক জায়গা, যেখান থেকে আক্রমণ চালানো যায়। এই কাজটা অবশ্য বেশ কঠিন হলো, কারণ সাত্তাকিন নদীর পাশে যে ছোট ছোট পাহাড় এবং টিলাগুলো রয়েছে তাতে গাছপালা প্রায় নেই বললেই চলে। ঘাস আছে ঠিকই কিন্তু খুব কম জায়গাতেই সেগুলো হাঁটু সমান উচ্চতা ছাড়িয়েছে।

তবে বরাবরের মতোই এবারও দেবতারা আমার সহায় হলেন। পথের পাশ ধরে এগিয়ে যাওয়া একটা অগভীর খাদের দেখা পেয়ে গেলাম আমি, এমনকি পঞ্চাশ কদম দূর থেকেও যেটার অস্তিত্ব বোঝার উপায় নেই। এবং পথ থেকে খাদটার দূরত্বও এমনই হবে। এ ছাড়া এই দূরত্ব থেকে তীর-ধনুকগুলোও দারুণ কাজ করবে। খাদের ওপাশেই রয়েছে একটা উঁচু পাথুরে দেয়ালের মতো জায়গা, যার আড়ালে লুকিয়ে রাখা যাবে আমাদের ঘোড়াগুলো। আমাদের মাঝ থেকে কেবল দুজনকে ঘোড়াগুলোর দেখাশোনা করার জন্য রাখা হলো। বাকি সবাই খাদের মাঝে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লাম আমরা, প্রত্যেকে ধনুকে একটা করে তীর জুড়ে নিলাম। হাতের কাছে প্রস্তুত রাখলাম আরো অনেকগুলো তীর।

*

সকালের সূর্য দিগন্ত ছাড়িয়ে খুব বেশি হলে চার আঙুল ওপরে উঠেছে, এই সময় সাত্তাকিন নদীর পাড় ধরে উঠে আসা পাথুরে পথটার ওপর অনেকগুলো ছুটন্ত ঘোড়ার খুরের শব্দ পাওয়া গেল। এদিকেই আসছে শব্দটা। খাদের কিনারায় একগুচ্ছ ঘাস রেখেছি আমি, যাতে ওগুলোর আড়াল ব্যবহার করে বাইরেটা উঁকি দিয়ে দেখা যায়। বাকি সবাই খাদের কিনারা থেকে নিচে নামিয়ে রেখেছে মাথা, উবু হয়ে বসে আছে। তবে কারা আমার নির্দেশ মানবে আর কারা মানবে না তা খুব ভালো করেই জানা আছে আমার।

সে জন্যই সেরেনাকে ঠিক আমার পেছনে রেখেছি আমি। ফলে আমার দৃষ্টিপথের ভেতরে চলে আসার সম্ভাবনা নেই ওর। এই মুহূর্তে আমার সম্পূর্ণ মনোযোগ নিবদ্ধ সামনের পথ এবং তার ওপর দিয়ে এগিয়ে আসা লোকগুলোর ওপর। ফলে আমি মোটেই বুঝতে পারলাম না যে আমার পেছনে সোজা হয়ে বসেছে সেরেনা এবং আমার মাথা আর ঘাসের গুচ্ছটাকে ব্যবহার করছে নিজের আড়াল হিসেবে। ইতোমধ্যে ধনুর্বিদের বিশেষ হাঁটু গেড়ে বসা অবস্থানে চলে এসেছে ওর শরীর, ধনুকে জুড়ে নিয়েছে একটা তীর। ঈগল তার শিকারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার ঠিক আগে চোখগুলো যেমন তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে তেমনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি খেলা করছে ওর চোখে।

পানমাসি আর তার দলবলকে যথেষ্ট সামনে এগিয়ে আসার সুযোগ দিলাম আমি, তারপর আমার লোকদের তীর ছোঁড়ার নির্দেশ দেওয়ার জন্য মুখ খুললাম। কিন্তু চিৎকারটা আর বের হলো না আমার মুখ দিয়ে, কারণ কানের মাত্র কয়েক ইঞ্চি দূর দিয়ে একটা তীর ছুটে যাওয়ার শব্দে চমকে গেছি আমি। ভারী একটা ধনুক থেকে ছোঁড়া হয়েছে তীরটা, যেটা টানতে প্রায় চল্লিশ ডেবেন ওজনের প্রয়োজন। শব্দটা হলো এমন, যেন চাবুক ফোঁটানোর তীক্ষ্ণ শব্দকে আরো অনেক গুণ বাড়িয়ে তোলা হয়েছে। সূর্যের আলোতে ঝাপসা দেখাল তীরটাকে। তাও কেবল আমার তীক্ষ্ণ চোখের কারণেই ওটার গতিপথ অনুসরণ করা সম্ভব হলো, অন্য কারো চোখে সম্পূর্ণ অদৃশ্য হয়ে যেত তীরটা। পথ ধরে এগিয়ে আসা ঘোড়সওয়ার দলটার সবার সামনে রয়েছে পানমাসি, শরীরের ওপরের অংশ সম্পূর্ণ নগ্ন তার। শিরস্ত্রাণ আর বর্ম বেঁধে রেখেছে ঘোড়ার জিনের সাথে। দলের আর সবার মতোই সূর্যের ইতোমধ্যে কড়া হয়ে ওঠা তাপে দরদর করে ঘামছে সে। সেরেনার তীরটা গিয়ে লাগল পানমাসির দুদিকের পাঁজরের সংযোগস্থলের ঠিক নিচে এবং নাভির ঠিক তিন আঙুল ওপরে। তীরের গোড়ায় যেখানে পালক লাগানো হয়েছে সে পর্যন্ত পানমাসির পেটের ভেতর অদৃশ্য হয়ে গেল ওটা, এত জোরে গিয়ে আঘাত করল যে, ঘোড়ার পিঠ থেকে উড়াল দিল তার শরীর। বাতাসে মোচড় খেল পানমাসি, দেখলাম যে পিঠ দিয়ে বেরিয়ে এসেছে তীরের মাথা। নিঃসন্দেহে মেরুদণ্ড ভেঙে গেছে এই ভয়ংকর আঘাতে। তীব্র ব্যথায় চিৎকার করছে পানমাসি। আঘাতটা ভয়ংকর তাতে সন্দেহ নেই; কিন্তু তীরের অবস্থান খেয়াল করে বুঝতে পারলাম যে মরতে বেশ সময় লাগবে তার। খুন করার জন্যই তীর ছুঁড়েছে সেরেনা; কিন্তু অত্যন্ত নিষ্ঠুরতার সাথে ধীরে ধীরে কাজটা করতে চেয়েছে ও।

বুঝতে পারলাম পানমাসির হাতে নিজের সকল অপমানের শোধ নিতে চাইছে সেরেনা, সেইসাথে ওর পরিবারের সদস্যদের কষ্ট, বিশেষ করে পালমিসের মৃত্যুরও বদলা নিতে চাইছে। যদিও আমার নির্দেশ অমান্য করেছে ও; কিন্তু কিছু বলতে পারলাম না আমি। এটুকু জানি যে, সেরেনার কাছ থেকে মাঝে মাঝে এই অবাধ্যতাটুকু মেনে নিতেই হবে আমাকে।

পানমাসির দলের বাকিদের দেখে মনে হলো কী হচ্ছে এখনো বুঝতে পারেনি তারা। দলের মাঝে প্রায় কেউই সেরেনার তীরটা পানমাসির শরীরে ঢুকতে দেখেনি। বেশির ভাগই মাথা নিচু করে পথ চলছিল আর সামনের অশ্বারোহীর কারণে বেশির ভাগের দৃষ্টিসীমা ছিল সীমাবদ্ধ। পানমাসি যখন ঘোড়ার পিঠ থেকে উড়ে গিয়ে মাটিতে পড়ল, তার ঠিক পেছনে যারা ছিল তাদের পথ গেল আটকে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই পুরো দলটার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল বিশৃঙ্খলা। দলের মধ্যে খুব কম অশ্বারোহীই ধনুকে ছিলা পরিয়েছে, এবং কেউই ধনুকে তীর জোড়েনি এখন পর্যন্ত। সবাই নিজেদের ঘোড়ার পিঠে বসে থাকতেই এত ব্যস্ত হয়ে পড়ল যে তাদের ওপর হামলা চালানো হয়েছে এটা বুঝতেই বেশ কিছুটা সময় পার হয়ে গেল।

আর এই সব যখন ঘটছে তখনই দ্রুত আরো তিনটি তীর ছুঁড়েছে সেরেনা। দেখলাম তিনটিই লক্ষ্যভেদ করল, আরো তিন অশ্বারোহী তাদের ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে গেল নিচে। ঘোড়ার খুরে পিষে গেল তাদের শরীর। পানমাসির মতো পেটের মধ্যে ঢোকেনি এই তীরগুলো, বরং পাঁজর ফুটো করে দিয়েছে। সবারই ফুসফুস অথবা হৃৎপিণ্ড অথবা দুটো অঙ্গই ফুটো হয়ে গেছে, সাথে সাথে মারা গেছে তারা।

তীর ছোড়ো সবাই! নিজের ধনুকটা কাঁধ থেকে নামাতে নামাতে চিৎকার করে নির্দেশ দিলাম আমি, চেষ্টা করছি সেরেনার সাথে তাল মেলানোর। এবার আমার দলের বাকিরাও লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল, তীরের বৃষ্টি বইয়ে দিতে শুরু করল শত্রুদের ওপর। প্রথম কয়েক দফা তীরবৃষ্টিতেই কমপক্ষে পনেরোজন শত্রু ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে গেল, একেকজনের শরীরে অন্তত কয়েকটা করে তীর ঢুকেছে। বাকিরাও পরবর্তী তীরগুলোর আঘাতে একইভাবে ধরাশায়ী হতে লাগল।

প্রথমবার দূর থেকে দেখেই আমি আন্দাজ করেছিলাম যে খুব বেশি হলে ষাটজনের মতো হবে শত্রুদের সংখ্যা। ফলে দশ-বারোবার তীর ছুঁড়ে প্রথমেই ওদের সংখ্যা আমাদের সংখ্যার সমানে নামিয়ে আনলাম আমরা। কিন্তু এখন ওরা নিজেদের বিপদ বুঝে গেছে এবং ধনুকে ছিলা পরানোর চেষ্টা করছে। যত দ্রুত সম্ভব পাল্টা আক্রমণ শুরু করতে চায় সবাই।

তবে আরো একটা কথা ঠিকই খেয়াল রেখেছি আমি। এরা সবাই আমার মিশরের নাগরিক। যদিও বিপথে চলে গেছে; কিন্তু সবাই আমার স্বদেশের সন্তান। তাই খুব বেশি সময় এই হত্যাযজ্ঞ সহ্য করা সম্ভব হলো না আমার পক্ষে। চিৎকার করে নির্দেশ দিলাম আমি, ধনুক ছুঁড়ে ফেলে দাও। না হলে কেউ প্রাণে বাঁচতে পারবে না! তারপর নিজের লোকদের দিকে ঘুরে বললাম, কেউ তীর ছুড়বে না। আত্মসমর্পণের সুযোগ দাও ওদের। ধীরে ধীরে নীরবতা নেমে এলো চারপাশে। কেউ নড়াচড়া করছে না। তারপর হঠাৎ করেই প্রতিপক্ষ দলের এক তীরন্দাজ এগিয়ে এলো সামনে।

আপনি কে আমি জানি, প্রভু টাইটা। হিকসসদের বিরুদ্ধে সিগনিয়ামের যুদ্ধে ফারাও টামোসের সেনাবাহিনীতে আপনার পাশাপাশি দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করেছি আমি। আমি যখন আহত হয়েছিলাম তখন আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন আপনি, তারপর হিকসস কুকুরগুলো যখন যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে পালিয়ে গেল তখন আমাকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিয়ে এসেছিলেন।

লোকটার চেহারা হালকা পরিচিত লাগল আমার কাছে; কিন্তু অনেক বেশি বয়স্ক মনে হচ্ছে। দীর্ঘ এক মুহূর্ত পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইলাম আমরা; মনে হলো যেন সমগ্র সৃষ্টিজগৎ দম আটকে রেখেছে। তারপর হঠাৎ করেই তার নাম মনে পড়ে যেতে হাসি ফুটল আমার মুখে। তাই বলে ভেবো না যে আবারও তোমাকে বয়ে আনতে পারব, মেরিমোস। শেষবার তোমাকে দেখার পর কমপক্ষে দুই থেকে তিন গুণ বেড়ে গেছে তোমার ওজন।

গলা ছেড়ে হেসে উঠল মেরিমোস, তারপর হাঁটু গেড়ে বসে মাথা নোয়াল। প্রভু টাইটার জয় হোক। এই মুহূর্তে মিশরের দুই অংশে যেই লোক তাণ্ডব চালাচ্ছে তার বদলে আপনারই উচিত ছিল মিশরের ফারাও হওয়া।

সাধারণ মানুষের মতামত কত দ্রুত বদলাতে পারে তা চিন্তা করলে বেশ অবাক লাগে আমার। ধনুকে একটা তীর জুড়ে তা ছুঁড়তে যত সময় লাগে তার চাইতেও কম সময়ের মাঝে নিজের আনুগত্য বদলে ফেলেছে মেরিমোস।

না মেরিমোস! এই দায়িত্ব এবং সম্মানের দাবিদার আমি নই, বরং ফারাও রামেসিস এবং তার ফারাওইন ল্যাসিডিমনের রাজকুমারী সেরেনা।

নামগুলো চিনতে পারার সাথে সাথেই সবার মাঝে বিস্মিত গুঞ্জনের ঢেউ বয়ে গেল। প্রথমে একজন, তারপর একে একে সবাই তাদের অস্ত্র ছুঁড়ে ফেলে মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসল, তারপর কপাল ঠেকাল মাটিতে।

রামেসিস এবং সেরেনাকে আমার কাছে ডেকে নিলাম আমি, তারপর নীরব হয়ে আসা যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে এগিয়ে গেলাম। আমাদের প্রাক্তন শত্রুদের সামনে নিয়ে গেলাম ওদের। এক এক করে সবাই নিজেদের নাম জানাল ওদের এবং রাজদম্পতির প্রতি আনুগত্যের শপথ নিল। যুদ্ধের শেষে বেঁচে গেছে মাত্র বত্রিশজন। তবে খুশির কথা এটাই যে, প্রত্যেকেই মিশরের নতুন ফারাওয়ের প্রতি জোর গলায় সারা জীবন অনুগত থাকার প্রতিজ্ঞা করল।

সবার শেষে জেনারেল পানমাসির সামনে এসে দাঁড়ালাম আমরা। সেরেনার তীরের আঘাতে যেখানে পড়ে গিয়েছিল সে, এখনো সেখানেই পড়ে আছে। কেউ তার আহত স্থানের পরিচর‍্যা করার আগ্রহ দেখায়নি। কিছুক্ষণ আগেও যারা তার অনুসারী ছিল, এখন কেউ তার গোঙানি আর প্রলাপের দিকে কর্ণপাত করছে না, কেউ পানি এনে খাওয়াচ্ছে না তাকে। বরং সবাই দূরত্ব বজায় রেখেছে পানমাসির কাছ থেকে। তবে আমরা তিনজন যখন পানমাসির সামনে এসে দাঁড়ালাম, সবাই আগ্রহের সাথে লক্ষ করতে লাগল আমাদের।

আগেই বলেছি লোকটাকে কত তীব্রভাবে ঘৃণা করি আমি। কিন্তু এমনকি আমার ঘৃণারও একটা সীমা আছে। মনে হলো এই লোকটাকে তার কষ্টের শেষ সীমানায় পৌঁছে দিয়ে পক্ষান্তরে আমি নিজেই ওর পর্যায়ে নেমে যাচ্ছি না তো? ইচ্ছে করলেই তার যন্ত্রণার অবসান ঘটাতে পারি আমি, সেই ক্ষমতা আছে আমার। অনুভব করলাম টলে যাচ্ছে আমার সেই ঘৃণার ভিত্তি। অনেকটা যেন আপনাআপনিই আমার ডান হাতটা এগিয়ে গেল কোমরে ঝুলে থাকা ছুরির দিকে। আজ সকালে আক্রমণের জন্য অপেক্ষা করার সময় ছুরিটায় ধার দিয়ে রেখেছি আমি। দক্ষ শল্যচিকিৎসক হিসেবে আমি জানি গলার ঠিক কোথায় প্রধান রক্তনালিগুলো রয়েছে। এটাও জানি যে পানমাসির অবস্থায় থাকা যেকোনো মানুষকে এই উপায়ে অত্যন্ত দ্রুত এবং প্রায় যন্ত্রণাবিহীনভাবে মুক্তি দেওয়া সম্ভব। কিন্তু কাজটা আমি পানমাসির প্রতি করুণা থেকে করছি না, কারণ এমন দুরাচারের প্রতি করুণার ছিটেফোঁটাও নেই আমার মনে। কাজটা করছি আমার নিজের আত্মসম্মান বোধ থেকে।

কিন্তু ছুরির বাঁটে আঙুলগুলো চেপে বসার আগেই অনুভব করলাম আরেকটা হাতের আঙুল চেপে ধরেছে আমার কবজি। সেগুলো উষ্ণ এবং মসৃণ; কিন্তু একই সাথে পাথরের মতো শক্ত। যেন ওই হাতে যে নীল তলোয়ার উঠে আসে তার ফলার মতোই শক্ত হয়ে উঠেছে হাতটাও।

ধীরে ধীরে ঘাড় ঘুরিয়ে আমার হাত ধরে থাকা নারীর দিকে তাকালাম আমি। আমার চোখে চোখ রাখল না সেরেনা; কিন্তু ফিসফিস করে কথা বলে উঠল। ওর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রামেসিস এবং আমি ছাড়া কেউ শুনতে পেল না কথাগুলো।

না! বলল ও।

কেন? প্রশ্ন করলাম আমি।

আমি চাই ও কষ্ট পাক, জবাব দিল সেরেনা।

কাজটা করতেই হবে আমাকে, বললাম আমি।

কেন?

কারণ এটা করলে ওর আর আমার মধ্যে কোনো তফাত থাকে না, মৃদু গলায় জবাব দিলাম আমি।

আমার হৃৎপিণ্ড বিশবার স্পন্দিত হতে যতটুকু সময় লাগে ঠিক ততটা সময় চুপ করে রইল সেরেনা। তারপর ওর আঙুলগুলো ছেড়ে দিল আমার হাতকে। এখনো আমার দিকে তাকাচ্ছে না ও। কিন্তু দেখলাম চোখ বন্ধ হয়ে এলো ওর, নীরব সম্মতির ভঙ্গিতে ঝাঁকি খেল মাথাটা।

কোমরের খাপ থেকে ছোরাটা বের করলাম আমি, তারপর ঝুঁকে এসে মুঠো করে ধরলাম পানমাসির দাড়ি। থুতনিটা টেনে ওপরে তুলে নিলাম, যাতে সম্পূর্ণ গলাটাকে উন্মুক্ত পাওয়া যায়। তারপর ছোরার ধারালো পাশটা এক কানের পাশে রেখে টেনে অন্য পাশে নিয়ে গেলাম। এত গভীরভাবে কাটলাম গলাটা যে ঘাড়ের হাড়ের সাথে ঘষা খেল আমার ছুরি। গলার দুই প্রধান ধমনি কেটে গিয়ে ভলকে ভলকে রক্ত বেরিয়ে এলো। কাটা শ্বাসনালি দিয়ে বেরিয়ে এলো অন্তিম নিঃশ্বাস। একবার ঝাঁকি খেল দেহটা, তারপর মারা গেল পানমাসি।

ধন্যবাদ, মৃদু স্বরে বলল সেরেনা। বরাবরের মতোই সঠিক কাজটা করেছ তুমি টাটা। একই সাথে আমার পরামর্শদাতা এবং আমার বিবেক হিসেবে কাজ করেছ তুমি।

*

পানমাসি যেখানে মারা গেল সেখানেই তাকে রেখে গেলাম আমরা, শেয়াল এবং শকুনের খাবার হিসেবে। সাত্তাকিন নদীর দুই পাশে তৈরি হওয়া গিরিখাত পার হয়ে ফিরে চললাম এবার। সঙ্গী হলো মেরিমোস এবং তার সঙ্গীরা, যারা সবেমাত্র উটেরিকের পক্ষ ত্যাগ করে আমাদের সাথে যোগ দিয়েছে। ঠিক হলো নদী পার হয়ে এক দিনের জন্য বিশ্রাম নেব আমরা, ঘোড়াগুলো এবং দলের বাকিদের একটু চাঙ্গা হয়ে ওঠার সুযোগ দেব।

সেদিন সন্ধ্যায় আগুনের চারদিকে ঘিরে বসে সামান্য খাবার আর এক বোতল লাল মদ দিয়ে রাতের খাবার খেয়ে নিচ্ছিলাম আমরা। ইচ্ছে করেই দলের বাকিদের কাছ থেকে একটু আলাদা হয়ে এসেছি, যাতে নিশ্চিন্তে নিজেদের মাঝে আলাপ করা যায়।

স্বাভাবিকভাবেই পানমাসির মৃত্যু নিয়ে কিছুক্ষণ কথা হলো আমাদের মাঝে। ফলে কিছুটা গুমোট হয়ে উঠল পরিবেশ। কিন্তু তার পরেই সেরেনা তার স্বভাব অনুযায়ী হুট করেই নতুন এক বিষয় টেনে নিয়ে এলো।

তাহলে আমরা লুক্সরে ফিরে যাচ্ছি কেন? প্রশ্ন করল ও।

প্রশ্নটা শুনে অবাক হয়ে গেলাম আমি। কী জবাব দেব কিছুই মাথায় এলো না। শেষে বললাম, কারণ ওটা পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর শহর।

ইতোমধ্যে খুব সম্ভব আবু নাসকোসে চলে এসেছে আমার বাবা আর মা, কিছুটা উদাস গলায় বলল ও। আমার হুই চাচা আর বেকাথা চাচিও নিশ্চয়ই আছে তাদের সাথে, সেইসাথে আমার চাচাতো ভাইয়েরা। উটেরিকের কবল থেকে আমাকে উদ্ধার করতে নিশ্চয়ই আসবে ওরা।

আমারও তাই মনে হয়। তোমার পরিবারের সবাই এখন নীলনদের তীরে তাবু খাঁটিয়ে বসে বসে মশার কামড় খাচ্ছে, ওদিকে উটেরিক আর তার সাঙ্গোপাঙ্গরা সবাই আরাম করে ঘুমাচ্ছে শহরের দেয়ালের ভেতর। সেরেনা আসলে কী বলতে চাইছে সেটা এবার খুব ভালো করেই বুঝতে পারছি আমি এবং চেষ্টা করছি ওকে নিরুৎসাহিত করতে। তুমি যেভাবেই বলো না কেন, এখান থেকে আবু নাসকোস অনেক দূরের পথ…।

ঘোড়ায় চড়ে যাওয়ার কথা তো বলছি না আমি। লুক্সরের জাহাজঘাটায় প্রায় পঞ্চাশটার মতো দারুণ জাহাজ রয়েছে, যেগুলো এখন পানমাসির কাছ থেকে চলে এসেছে আমাদের জিম্মায়, আমাকে মনে করিয়ে দিল সেরেনা। ঘোড়া ছুটিয়ে চললে আগামীকাল ভোরের আগেই লুক্সরে পৌঁছে যেতে পারব আমরা। তারপর দুই মাস্তুলের একটা দ্রুতগামী জাহাজ, একজন দক্ষ সারেং আর দাঁড়ে একদল শক্তসমর্থ দাসকে বসিয়ে দিলে দুই কি তিন দিনের মধ্যেই পৌঁছে যাব আবু নাসকোস। এবার প্রিয় টাইটা, দয়া করে আমাকে দেখাও দেখি আমার হিসাবের কোথায় ভুল আছে?

সুন্দরী কোনো নারীর সাথে কখনোই তর্কে যেতে চাই না আমি, বিশেষ করে সে যদি হয় সুন্দরী এবং বুদ্ধিমতী। আমিও আসলে ঠিক এ কথাগুলোই বলতে চাইছিলাম, মাথা দুলিয়ে বললাম আমি। তবে আমি ভেবেছিলাম তুমি হয়তো আজ রাতে এখানে বিশ্রাম নিতে চাইবে, কাল সকালে রওনা দিতে চাইবে লুক্সরে।

যেকোনো ভালো পরিকল্পনাই খুব সামান্য সময়ের মাঝে বদলে যেতে পারে, গম্ভীর মুখে বলল সেরেনা। হতাশ হয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম আমি। এমনকি হাতের বোতলটা শেষ করার সুযোগও আমাকে দিতে রাজি নয় মেয়েটা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *