১. তলোয়ার গিলে নিতে

ফারাও – উইলবার স্মিথ
অনুবাদ: শাহেদ জামান

যদিও কথাটা মেনে নেওয়ার আগে বরং নিজের তলোয়ার গিলে নিতেই আমি বেশি পছন্দ করব; কিন্তু অন্তরের গভীরে ঠিকই বুঝতে পারলাম, সব শেষ।

পঞ্চাশ বছর আগে পুবের বন্য অঞ্চল থেকে কোনো রকম পূর্বাভাস ছাড়াই আমাদের মিশরের সীমান্তে এসে হাজির হয়েছিল হিকসসদের দল। পুরোদস্তুর বন্য এবং নিষ্ঠুর এক জাতি ওরা, ভালোর ছিটেফোঁটাও নেই কারো মধ্যে। কেবল একটা কারণেই যুদ্ধে অপরাজেয় হয়ে উঠেছিল তারা। আর তা হচ্ছে তাদের ঘোড়া এবং রথ, যেগুলোর কোনোটাই এর আগে কোনো মিশরীয় দেখেনি, এমনকি সেগুলোর কথাও আগে শোনেনি; এবং যেগুলোকে আমরা অত্যন্ত ভয়ানক এবং ঘৃণার বস্তু বলে ধারণা করেছিলাম।

পদাতিক সৈন্যের দল নিয়ে হিকসস আক্রমণের মুখোমুখি হয়েছিলাম আমরা; কিন্তু সহজেই আমাদের হারিয়ে দিয়েছিল ওরা। রথের সাহায্যে অনায়াসে আমাদের ঘিরে ফেলা হতো, তারপর তীরের বৃষ্টি বর্ষণ করা হতো আমাদের ওপর। ফলে নৌকায় করে নীলনদের উজানে দক্ষিণ দিকে পালিয়ে যাওয়া ছাড়া কোনো পথ ছিল না আমাদের। বড় বড় জলপ্রপাতের ওপর দিয়ে নৌকাগুলো টেনে নিয়ে গিয়েছিলাম আমরা, হারিয়ে গিয়েছিলাম বুনো প্রকৃতির মাঝে। সেখানেই জন্মভূমির জন্য শোকবিহ্বল অবস্থায় দশ বছর কাটিয়ে দিই আমরা।

সৌভাগ্যক্রমে পালিয়ে যাওয়ার আগে শত্রুদের অনেকগুলো ঘোড়া দখল করতে সক্ষম হয়েছিলাম আমি। সেগুলো নিয়ে গিয়েছিলাম নিজেদের সাথে। খুব তাড়াতাড়িই আবিষ্কার করলাম ঘোড়াগুলো আসলে ভয়ানক তো নয়ই বরং অন্যান্য প্রাণীর মাঝে সবচেয়ে বেশি বুদ্ধিমান, খুব সহজেই পোষ মেনে যায়। আমার নিজের নকশায় আলাদা করে রথ তৈরি করলাম, যেগুলো হিকসসদের রথের চাইতে অনেক বেশি হালকা, দ্রুতগামী এবং সহজে নিয়ন্ত্রণযোগ্য। টামোস নামের ছেলেটি যে পরে মিশরের ফারাও পদে অভিষিক্ত হয় তাকে একজন দক্ষ রথচালক হিসেবে গড়ে তুলি আমি।

সঠিক সময় উপস্থিত হলে নৌকায় করে নীলনদ ধরে ফিরে আসি আমরা। মিশরের ঠিক কিনারায় অবতরণ করে আমাদের রথ বাহিনী, এবং সেগুলোর সাহায্যে শত্রুদের ওপর আক্রমণ চালিয়ে তাদের উত্তরের সমভূমির দিকে বিতাড়িত করি। পরবর্তী দশকগুলোতে হিকসস শত্রুদের সাথে প্রায় নিয়মিত লড়াইয়ে লিপ্ত হতে হয়েছে আমাদের।

কিন্তু এখন ভাগ্যের চাকা পুরোপুরি ঘুরে গেছে। ফারাও টামোস এখন একজন বৃদ্ধ ব্যক্তি এবং হিকসস তীরের আঘাতে মুমূর্ষ অবস্থায় পড়ে আছেন তার তাঁবুতে। ধীরে ধীরে কমে এসেছে মিশরীয় সৈন্যসংখ্যা। আগামীকাল সেই অবশ্যম্ভাবী নিয়তির মুখোমুখি হতে হবে আমাকে।

গত অর্ধ-শতাব্দীর লড়াইয়ে মিশরকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য অপরিহার্য ছিল আমার সাহস। কিন্তু সেই সাহসও এখন আর যথেষ্ট নয়। গত এক বছরে পরপর দুটো বড় যুদ্ধে পরাজয় বরণ করতে হয়েছে আমাদের, দুটোই ছিল আমাদের জন্য তিক্ত এবং রক্তাক্ত এক অভিজ্ঞতা। আমাদের পিতৃভূমির বেশির ভাগ অংশ যারা দখল করে নিয়েছে সেই হিকসস অনুপ্রবেশকারীরা এখন তাদের চূড়ান্ত বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে। মিশরের প্রায় পুরোটাই এখন তাদের দখলে। হেরে যাচ্ছে আমাদের সৈন্যরা, মনোবল ভেঙে পড়ছে তাদের। আমি যতই তাদের নির্দিষ্ট অবস্থানে সাজিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার উৎসাহ দিই না কেন মনে হচ্ছে যেন তারা নিজেরাই নিজেদের পরাজয় আর অসম্মান মেনে নিতে প্রস্তুত। আমাদের প্রায় অর্ধেক ঘোড়া মারা পড়েছে, যেগুলো দাঁড়িয়ে আছে সেগুলোও আর মানুষ বা রথের ওজন টানতে পারছে না। আর সৈন্যদের মাঝে প্রায় অর্ধেকের শরীরে রয়েছে তাজা ক্ষতচিহ্ন, ঘেঁড়া কাপড় দিয়ে কোনোমতে বেঁধে রাখা। এর আগে বছরের শুরু থেকে যে দুটো যুদ্ধে আমাদের লড়তে হয়েছে তাতে প্রায় তিন হাজার সৈন্য হারিয়েছি আমরা। যারা বেঁচে গেছে তাদের বেশির ভাগই এখন এক হাতে তলোয়ার আর আরেক হাতে ক্যাচ নিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে যোগ দিয়েছে যুদ্ধে।

এটা সত্যি যে, আমাদের সেনাবাহিনীর এই দৈন্যদশার পেছনে মূল কারণ যতটা না মৃত্যু বা যুদ্ধক্ষেত্রে আহত হওয়া তার চাইতে বেশি সৈন্যদের পালিয়ে যাওয়া। ফারাওয়ের একসময়ের গর্বিত সৈন্যরা শেষ পর্যন্ত মনোবল হারিয়ে ফেলেছে, শত্রুর সামনে থেকে দলে দলে যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে পালিয়ে গেছে তারা। দারুণ লজ্জায় চোখে পানি নিয়ে তাদের মিনতি করেছি আমি, এমনকি চাবুক, মৃত্যু আর অসম্মানের ভয়ও দেখিয়েছি। তবু আমার পাশ কাটিয়ে বিপুলসংখ্যক সৈন্য সরে গেছে বাহিনীর পেছনে। আমার কথায় কেউ কোনো কান দেয়নি, একবার আমার দিকে তাকায়ওনি, শুধু অস্ত্র ছুঁড়ে ফেলে দৌড়ে বা খুঁড়িয়ে পালিয়ে গেছে। আর এখন লুক্সরের প্রবেশপথের ঠিক বাইরেই জড়ো হয়েছে হিকসস বাহিনী। প্রায় অবশ্যম্ভাবী এক ভয়ানক পরিণতি এড়ানোর জন্য, বলতে গেলে অত্যন্ত ক্ষীণ একটা সুযোগ রয়েছে আমাদের হাতে, আর কাল সকালে দলের নেতৃত্ব দেওয়ার মাধ্যমে সেটা কাজে লাগাব আমি।

যুদ্ধক্ষেত্রের ওপর রাত নেমে এলো। দাসদের সাহায্যে আমার ঢাল এবং বর্ম থেকে তাজা রক্তের দাগ পরিষ্কার করে নিলাম আমি, সেইসাথে হেলমেটের দেবে যাওয়া জায়গাটাও পিটিয়ে ঠিক করে নিলাম। আজ সকালেই একটা। হিকসস তলোয়ারের আঘাত ঠেকিয়েছে এই হেলমেট। হেলমেটের পালকটা এখন আর নেই, কেটে পড়ে গেছে ওই একই আঘাতে। কাজ শেষ হতে মশালের কম্পমান আলোয় আমার পালিশ করা ব্রোঞ্জের হাত-আয়নায় নিজের চেহারার প্রতিফলন পরীক্ষা করে দেখলাম। বরাবরের মতোই এটা আমার ভেঙে পড়া মনকে একটু হলেও চাঙ্গা করে তুলল। আরো একবার আমার মনে পড়ল নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে পড়তে যাচ্ছে জেনেও সৈন্যরা কীভাবে একটা ধারণা বা নামকে অনুসরণ করে সামনে এগিয়ে যেতে পারে। আয়নার দিকে তাকিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করলাম, চোখের নিচে জমাটবাঁধা বিষণ্ণ কালো ছায়াগুলোকে অগ্রাহ্য করার চেষ্টা করছি। তারপর তাঁবুর দরজার মাঝ দিয়ে মাথা নিচু করে বের হয়ে এসে এগিয়ে গেলাম আমার প্রিয় ফারাওয়ের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে।

নিজের অসংখ্য সন্তানের মাঝ থেকে ছয় ছেলে এবং তিনজন চিকিৎসকের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে নিজ বিছানায় শুয়ে আছেন ফারাও টায়োস। তাদের পরে আরো বড় একটা বৃত্ত রচনা করে দাঁড়িয়ে আছে তার জেনারেল এবং একান্ত পরামর্শকরা, তাদের সাথে তার পাঁচজন প্রিয় স্ত্রী। সবার চেহারা বিষণ্ণ, কাঁদছে কেউ কেউ। কারণ মারা যাচ্ছেন ফারাও। দিনের শুরুর দিকেই যুদ্ধক্ষেত্রে এক ভয়ানক আঘাতের শিকার হয়েছেন তিনি। তার পাঁজরের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আছে একটা হিকসস তীরের অবশিষ্টাংশ। ফারাওয়ের যেসব চিকিৎসক এখানে উপস্থিত তারা কেউই তার হৃৎপিণ্ডের এত কাছ থেকে তীরের বাঁকানো মাথাটা বের করে আনতে সাহস পায়নি, এমনকি তাদের মাঝে যে সবচেয়ে দক্ষ সেই আমিও না। আমরা শুধু ক্ষতের মুখের কাছ থেকে তীরের গোড়াটা ভেঙে এনেছি এবং এখন অপেক্ষা করছি সেই অবশ্যম্ভাবী পরিণতির। এটা প্রায় নিশ্চিত যে আগামীকাল দুপুরের আগেই ফারাও তার সোনালি সিংহাসন ছেড়ে দেবেন তার বড় ছেলে উটেরিক টুরোর হাতে। তার ছেলে এখন ফারাওয়ের পাশে বসে আছে, বোঝা যাচ্ছে যে মিশরের শাসনভার নিজের হাতে চলে আসার মুহূর্ত উপস্থিত হওয়ায় অনেক কষ্টে নিজের আনন্দটা ঢেকে রাখার চেষ্টা করছে সে। উটেরিক একজন খামখেয়ালি এবং অপদার্থ যুবক, এটা কল্পনাই করতে পারছে না যে আগামীকাল সূর্য ডোবার সময় তার সাম্রাজ্যের হয়তো কোনো অস্তিত্বই থাকবে না। অন্তত সেই সময়ে আমি তার সম্পর্কে এটাই ভাবছিলাম। কিন্তু খুব শীঘ্রই আমি জানতে পারব যে তাকে বিচার করতে কত বড় ভুল হয়েছিল আমার।

টামোস এখন একজন বৃদ্ধ মানুষ। নিখুঁতভাবে তার বয়স জানা আছে আমার, এমনকি ঘণ্টার হিসাবও বলতে পারব; কারণ এই কঠিন পৃথিবীতে নবজাতক ফারাওয়ের জন্ম নেওয়ার সময় আমি নিজে সেখানে উপস্থিত ছিলাম। জনপ্রিয় কিংবদন্তি আছে, তিনি জন্মের পর প্রথম যে কাজটা করেছিলেন সেটা হচ্ছে আমার গায়ে প্রচুর পরিমাণে প্রস্রাব করে দেওয়া। পরবর্তী ৬০ বছরে সেই একইভাবে আমার প্রতি নিজের বিরক্তি প্রকাশ করতে কখনো একটুও দ্বিধা বোধ করেননি তিনি, কথাটা মনে পড়তে এই দুঃখের মাঝেও হাসি চাপতে হলো আমাকে।

এবার তিনি যেখানে শুয়ে আছেন সেদিকে এগিয়ে গেলাম আমি, তার হাতে চুমু খেলাম। সত্যিকার বয়সের চাইতেও অনেক বেশি বয়স্ক লাগছে ফারাওকে। যদিও কিছুদিন আগে নিজের চুল আর দাড়িতে রং করিয়েছিলেন তিনি, আমি জানি যে তার পছন্দের উজ্জ্বল তামাটে রঙের নিচে চুলগুলো সব সূর্যের তাপে পোড়া শেওলার মতো ধবধবে সাদা হয়ে গেছে। মুখের চামড়ায় অজস্র গভীর বলিরেখা, তার সাথে রোদে পোড়া ফুটকি ফুটকি দাগ। দুই চোখের নিচে ফুলে আছে চামড়া, চোখগুলোতে আসন্ন মৃত্যুর চিহ্ন সুস্পষ্ট।

নিজের বয়স সম্পর্কে সামান্যতম ধারণাও নেই আমার। তবে এটা ঠিক যে, ফারাওয়ের চাইতে আমার বয়স অনেক বেশি; যদিও চেহারা দেখলে মনে হতে পারে যে আমার বয়স তার স্রেফ অর্ধেক। এর কারণ হলো আমি একজন দীর্ঘজীবী মানুষ এবং দেবতাদের আশীর্বাদপুষ্ট- বিশেষ করে দেবী ইনানার আশীর্বাদ আছে আমার ওপর। ইনানা হচ্ছে দেবী আর্টেমিসের এক গোপন নাম।

মুখ তুলে আমার দিকে তাকালেন ফারাও। কথা বলতে ব্যথা পাচ্ছেন, কষ্ট হচ্ছে তার। কণ্ঠস্বর খসখসে হয়ে আছে। নিঃশ্বাসে ঘড়ঘড় শব্দ হচ্ছে, অনেক কষ্টে শ্বাস নিচ্ছেন তিনি। টাটা! ছোটবেলায় আমাকে আদর করে যে নাম। দিয়েছিলেন সেই নাম ধরেই ডাক দিলেন তিনি। আমি জানতাম যে তুমি আসবে। তোমাকে কখন আমার সবচেয়ে বেশি দরকার সেটা বুঝতে কখনো অসুবিধা হয়নি তোমার। বলো হে প্রিয় বন্ধু আমার, আগামীকাল কী ঘটতে যাচ্ছে?

আগামীকালের মালিক তো আপনি এবং মিশর, মহান প্রভু আমার। জানি না কেন তার কথার জবাবে ঠিক এ কথাগুলোই কেন বেছে নিলাম আমি, যখন এটা প্রায় নিশ্চিত যে আমাদের সবার ভবিষ্যই এখন কবরস্থান আর মৃত্যু পরবর্তী জীবনের দেবতা আনুবিসের হাতে। তবু আমার ফারাওকে আমি ভালোবাসি এবং চাই যে যতটা সম্ভব শান্তিপূর্ণভাবে মৃত্যুবরণ করার সুযোগ পান তিনি।

মৃদু হাসলেন ফারাও, আর কোনো কথা বললেন না। তবে কাঁপা কাঁপা হাতটা বাড়িয়ে দুর্বল আঙুলগুলো দিয়ে আমার হাত ধরলেন তারপর নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে রাখলেন যতক্ষণ না ঘুম নেমে এলো তার চোখে। চিকিৎসক এবং তার ছেলেরা এক এক করে তাঁবু থেকে বেরিয়ে গেল। শপথ করে বলতে পারি, দরজা দিয়ে বের হয়ে যাওয়ার আগে উটেরিক টুরোর ঠোঁটে এক চিলতে হাসি দেখলাম আমি। মধ্যরাতের অনেক পরেও টামোসের সাথে বসে রইলাম আমি, ঠিক যেমনটা ছিলাম তার মায়ের মারা যাওয়ার সময়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সারা দিনের যুদ্ধের পর আগত অপরিসীম ক্লান্তির কাছে হার মানতে বাধ্য হলাম। ফারাওয়ের হাত থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিলাম আমি, তখনো সেই হাসি লেগে আছে তার মুখে। কোনোমতে টলতে টলতে নিজের কম্বলের কাছে এসে দাঁড়ালাম আমি, তারপর মৃত্যুর মতো ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে গেলাম তার ওপর।

.

ভোরের প্রথম আলোয় আকাশ সোনালি হয়ে ওঠার আগেই আমাকে ডেকে তুলল আমার চাকররা। তাড়াহুড়োর সাথে যুদ্ধের পোশাক পরে নিলাম আমি, কোমরে বেঁধে নিলাম আমার তলোয়ার। তারপর দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলাম রাজকীয় তাবুর দিকে। আরো একবার যখন ফারাওয়ের বিছানার পাশে হাঁটু গেড়ে বসলাম, তখনো তার মুখে সেই হাসি খেলা করছে। কিন্তু আমার হাতের নিচে ঠাণ্ডা লাগল তার হাত, বুঝতে পারলাম মারা গেছেন তিনি।

তোমার জন্য পরে শোক করব আমি, আমার মেম, সোজা হয়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে তাকে প্রতিশ্রুতি দিলাম আমি কিন্তু এখন আমাকে যেতে হবে, চেষ্টা করতে হবে তোমার কাছে, সেইসাথে আমাদের মিশরের প্রতি আমি যে শপথ করেছিলাম তা পালন করার।

দীর্ঘ জীবন পাওয়ার এই হলো অভিশাপ: যাদের তুমি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসো তাদের সবাইকে এক এক করে হারিয়ে যেতে দেখা।

আমাদের এলোমেলো সেনাদলের যা কিছু বাকি ছিল তারা সবাই সোনালি শহর লুক্সরের সামনে পথের শুরুতে এসে জড়ো হয়েছে। এখানেই গত পঁয়ত্রিশ দিন ধরে এক রুদ্ধশ্বাস পরিস্থিতিতে হিকসসদের রক্তপিপাসু বাহিনীকে ঠেকিয়ে রেখেছি আমরা। সৈন্যদের মুষ্টিমেয় দলগুলোর সামনে দিয়ে যুদ্ধ-রথ নিয়ে এগিয়ে গেলাম আমি। আমাকে চিনতে পারার সাথে সাথে যারা যারা সক্ষম ছিল তারা সবাই নিজের পায়ে উঠে দাঁড়াল। ঝুঁকে নিজেদের আহত সঙ্গীকেও সোজা হয়ে দাঁড়াতে সাহায্য করল তারা, পাশাপাশি দাঁড়িয়ে যুদ্ধের অবস্থান নিল। তারপর সুস্থ ও সবল সৈন্যরা, সেইসাথে যেসব সৈন্য ইতোমধ্যে মৃত্যুর পথে অর্ধেক এগিয়ে গেছে তাদের সবাই ভোরের আকাশের দিকে নিজেদের অস্ত্র তুলে ধরল, আমি এগিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে অভিনন্দন জানাল আমাকে।

সুরেলা একটা ধ্বনি ভেসে আসতে শুরু করল: টাইটা! টাইটা! টাইটা!

মিশরের এই সাহসী সন্তানদের এমন করুণ পরিস্থিতিতে দেখে কোনোমতে চোখের পানি আটকে রাখলাম আমি। তার বদলে জোর করে হাসি ফোঁটালাম ঠোঁটে, হাসি আর চিৎকারের মাধ্যমে পাল্টা উৎসাহ দিলাম তাদের সবাইকে। সেনাদলের মাঝে পরিচিত মুখগুলোকে নাম ধরে ডাকলাম।

এই যে ওসমেন! জানতাম যে তোমাকে সামনের সারিতেই পাওয়া যাবে।

আপনার কাছ থেকে আমার দূরত্ব কখনো এক তলোয়ারের বেশি ছিল না প্রভু, আর হবেও না! সেও পাল্টা চিৎকার করে জবাব দিল আমার কথার।

লোথান, ব্যাটা লোভী বুড়ো সিংহ। ইতোমধ্যে যথেষ্ট হিকসস কুকুর কুপিয়ে মেরেছ তুমি, আর কত?

যথেষ্ট মেরেছি ঠিক কিন্তু আপনি যতগুলো মেরেছেন তার অর্ধেকও পারিনি, প্রভু টাটা। লোথান আমার বিশেষ প্রিয়ভাজনদের একজন, তাই তাকে অনুমতি দিয়েছি আমার ডাকনাম ধরে সম্বোধন করার। সবার সামনে দিয়ে আমার রথ পার হয়ে যাওয়ার পর সৈন্যদের উচ্ছ্বাসধ্বনি নীরব হয়ে গেল, আরো একবার তার জায়গা দখল করল ভয়ংকর নীরবতা। আবার হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল সবাই, তাকিয়ে রইল উঁচু পাহাড়ের মাঝ দিয়ে চলে যাওয়া পথের শেষ প্রান্তের দিকে। সবাই জানে যে ওখানে হিকসস সেনাবাহিনী অবস্থান নিয়েছে, ভোরের আলো সম্পূর্ণ ফুটলেই আবার পুরোদমে আক্রমণ চালাবে তারা। আমাদের চারপাশের যুদ্ধক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়ে আছে বিগত দিনগুলোর যুদ্ধে মারা যাওয়া মানুষগুলোর লাশ। প্রত্যুষের হালকা বাতাসে অপেক্ষারত আমাদের কাছে বয়ে আনছে মৃত্যুর গন্ধ। প্রতিটা নিঃশ্বাসের সাথে সেই গন্ধ। টেনে নিচ্ছি আমি, মনে হচ্ছে যেন তেলের মতো ঘন হয়ে সেই গন্ধ লেগে থাকছে আমার জিভ আর গলার ভেতরে। বারবার গলা পরিষ্কার করে থুতু ফেলছি রথের পাশে, তবু প্রতিবার নিঃশ্বাস নেওয়ার সাথে সাথে মনে হচ্ছে যেন আরো বেশি শক্তিশালী আর বিশ্রী হয়ে উঠছে গন্ধটা।

ইতোমধ্যে আমাদের চারপাশে ছড়ানো লাশগুলোর ওপর জুটে বসে ভোজে মেতেছে শব-খেকো পাখির দল। শকুন আর কাকেরা ধীর গতিতে চক্কর দিচ্ছে যুদ্ধক্ষেত্র জুড়ে, তারপর মাটিতে এসে নামছে। শেয়াল আর হায়েনাদের হট্টগোল আর চেঁচামেচিতে যোগ দিচ্ছে তারা, পচতে শুরু করা মানুষের মাংস টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলে আস্ত গিলে নিচ্ছে। হিকসস তলোয়ারের সামনে পরাজয়ের পর এই একই পরিণতি আমার জন্যও অপেক্ষা করছে কথাটা ভাবতেই অনুভব করলাম ভয়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে শরীরে।

থরথর করে কেঁপে উঠে চিন্তাগুলো মাথা থেকে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করলাম, চিৎকার করে ক্যাপ্টেনদের নির্দেশ দিলাম তীরন্দাজদের সামনে পাঠাতে। লাশগুলো থেকে যতগুলো সম্ভব তীর সংগ্রহ করে আনতে হবে, যাতে সবার খালি হয়ে আসা তূণ আবার ভরে নেওয়া যায়।

তারপর পাখি আর পশুদের হইচইয়ের তীক্ষ্ণ শব্দ ছাপিয়ে ঢাকের শব্দ ভেসে এলো আমার কানে, সামনের পথটার মাঝে প্রতিধ্বনি তুলল। আমার লোকেরাও সবাই শুনতে পেল সেই শব্দ। গলা ফাটিয়ে নির্দেশ ছুড়ল সার্জেন্টরা। যে কটা তীর পাওয়া গেছে তাই নিয়েই যুদ্ধের মাঠ থেকে তড়িঘড়ি করে ফিরে এলো তীরন্দাজরা। পেছনে থাকা সৈন্যরা এবার সামনে চলে এলো, কাঁধে কাঁধ ঠেকিয়ে দাঁড়াল তারা। প্রত্যেকের ঢাল ঠেকিয়ে রেখেছে পাশের জনের ঢালের সাথে। সবার তলোয়ারের ফলা আর বর্শার মাথা বহু। ব্যবহারে ভোঁতা হয়ে গেছে ভেঙে গেছে জায়গায় জায়গায়। তবু সেগুলোই শত্রুর দিকে ফিরিয়ে রেখেছে তারা। তাদের ধনুকের যেখানে যেখানে ফেটে গেছে সেখানে সরু তার দিয়ে বাঁধা, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে কুড়িয়ে আনা তীরগুলোর মাঝে অনেকগুলোতে অদৃশ্য হয়েছে পালক। তবে সন্দেহ নেই কাছাকাছি দূরত্বে এখনো ওগুলো সঠিকভাবেই কাজ করবে। বহু যুদ্ধের অভিজ্ঞ সৈনিক আমার লোকেরা, ক্ষতিগ্রস্ত অস্ত্র আর যন্ত্রপাতি দিয়েও কী করে সর্বোচ্চ ফলাফল বের করে আনতে হয় তা ভালো করেই জানে।

দূরে পথের অন্য পাশে ভোরের কুয়াশার মাঝে ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হতে শুরু করল শত্রু সৈন্যদের অগ্রযাত্রা। দূরত্ব আর স্বল্প আলোর কারণে প্রথমে তাদের দলটাকে ছোটখাটো দুর্বল বলে মনে হলো; কিন্তু আমাদের দিকে তারা এগিয়ে আসার সাথে সাথে দ্রুত বেড়ে উঠল আকারে। চিৎকার করে প্রতিবাদ জানিয়ে আকাশে উড়াল দিল শকুনরা, শেয়াল আর অন্যান্য শবভোজী প্রাণীর দল এদিক-ওদিক পালিয়ে গেল তাদের এগিয়ে আসার সাথে সাথে। পথের সম্পূর্ণ প্রস্থ পূর্ণ হয়ে গেছে হিকসস বাহিনীর কারণে, যা দেখে আরো একবার সাহস হারিয়ে ফেলতে শুরু করলাম আমি। মনে হচ্ছে যেন আমাদের চাইতে কমপক্ষে তিন বা চার গুণ হবে ওদের পরিমাণ।

তবে আরো কাছে এগিয়ে আসার পর আমি দেখলাম আমাদের ওপর ওরা যা অত্যাচার চালিয়েছে তার সাধ্যমতো জবাবও আমরা দিয়েছি। ওদের বেশির ভাগই আহত, আমাদের মতোই ক্ষতস্থান বেঁধে রেখেছে রক্তে ভেজা ঘেঁড়া কাপড় দিয়ে। কেউ কেউ ক্র্যাচে ভর দিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে সামনে এগোচ্ছে, বাকিদের অবস্থাও ভালো নয়। সেনাবাহিনীর সার্জেন্টদের অনেকের হাতেই রয়েছে পশুর চামড়ার তৈরি চাবুক, তাদের তাড়া খেয়ে হোঁচট খেতে খেতে আগে বাড়ছে তারা। নিজেদের সৈন্যদের সঠিক অবস্থানে ধরে রাখতে এমন কঠোর পদ্ধতি অবলম্বন করতে বাধ্য হয়েছে হিকসসরা, দেখে খুশি হয়ে উঠলাম আমি। রথ চালিয়ে আমাদের বাহিনীর সামনে চলে এলাম এবার। চিৎকার করে উৎসাহ দিচ্ছি আমার লোকদের, সেইসাথে দেখাচ্ছি হিকসস ক্যাপ্টেনদের হাতে থাকা চাবুকের দিকে।

দায়িত্বের গুরুত্ব বুঝে নেওয়ার জন্য কখনো চাবুকের ভয় দেখাতে হয়নি তোমাদের, হিকসস ঢাকের শব্দ আর তাদের বর্মপরা পায়ের ঝনঝনানি ছাপিয়ে পরিষ্কারভাবে সবার কানে পৌঁছে গেল আমার কণ্ঠস্বর। উল্লাসে চিৎকার করে উঠল আমার লোকেরা, অপমান আর ঠাট্টা-তামাশা জুড়ে দিল ক্রম অগ্রসরমাণ শত্রুকে লক্ষ্য করে। পুরো সময়টা জুড়ে দুই সেনাবাহিনীর মাঝে দ্রুত কমে আসতে থাকা দূরত্বটা মেপে নিচ্ছিলাম আমি। এই যুদ্ধ শুরুর সময়ে তিন শ বিশটা রথ ছিল আমার কাছে, এখন সেখানে আছে আর মাত্র বায়ান্নটা। ঘোড়ার সংখ্যা কমে যাওয়ায় সত্যিই খুব অসুবিধা হয়ে গেছে। তবে আমাদের একমাত্র সুবিধা হচ্ছে এই খাড়া এবং বন্ধুর পথের মাথায়। অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী অবস্থানে আছি আমরা। নিজের দীর্ঘ জীবনে অসংখ্য যুদ্ধ থেকে পাওয়া সমস্ত বুদ্ধি আর অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়েই এই অবস্থানকে বেছে নিয়েছি আমি।

নিজেদের তীরন্দাজদের তীরের পাল্লার মাঝে আমাদের নিয়ে আসার জন্য রথের ওপর অনেক অংশে নির্ভর করে হিকসসরা। আমাদের দুই প্রান্ত বাঁকানো ধনুকের উদাহরণ চোখের সামনে থাকা সত্ত্বেও ওরা কখনো এমন কিছু বানানোর চেষ্টা করেনি, তার বদলে গোঁয়ারের মতো নিজেদের সোজা ধনুক আঁকড়ে ধরে থেকেছে। আমাদের অপেক্ষাকৃত উন্নত অস্ত্রগুলোর মতো এত বেশি দূরত্বে এবং দ্রুততার সাথে তীর ছুঁড়তে পারে না ওদের ধনুক। পাথুরে পথটার প্রবেশমুখেই রথ রেখে আসতে বাধ্য করেছি ওদের, ফলে এটাও নিশ্চিত হয়ে গেছে যে ওদের তীরন্দাজরা এত তাড়াতাড়ি তীর ছোঁড়ার মতো কাছাকাছি দূরত্বে আসতে পারছে না।

এবার সেই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত উপস্থিত, যে রথগুলো বাকি ছিল সেগুলো ব্যবহার করার সময় হয়েছে। নিজে রথ বাহিনীর নেতৃত্ব দিলাম আমি, রথগুলোকে সারিবদ্ধ অবস্থায় সাথে নিয়ে এগিয়ে গেলাম হিকসসদের দিকে। ষাট অথবা সত্তর কদম দূরে থাকতে তীর ছুড়ল আমাদের তীরন্দাজরা, লক্ষ্যবস্তু হলো সরু পথ ধরে দলবেঁধে এগিয়ে আসা শত্রুরা। ওরা আমাদের কাছাকাছি আসার আগেই প্রায় ত্রিশজনকে ঘায়েল করতে পারলাম আমরা।

এর পরেই নিজের রথ থেকে লাফ দিয়ে নেমে পড়লাম আমি। চালক এবার আমার রথটাকে ঘুরিয়ে নিয়ে চলে গেল, আর আমি সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে থাকা আমার দুই সঙ্গীর মাঝে ঢালটা সোজা করে ধরে দাঁড়িয়ে গেলাম। শত্রুর দিকে মুখ করে রইল আমার ঢাল।

প্রায় সাথে সাথেই হাজির হলো সেই প্রলয়ংকর মুহূর্ত, দুই পক্ষ লিপ্ত হলো মরণপণ যুদ্ধে। শত্রুসৈন্যরা আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, ব্রোঞ্জের সাথে ব্রোঞ্জের সংঘর্ষে তীক্ষ্ণ শব্দে কেঁপে উঠল বাতাস। পরস্পরের সাথে নিজেদের ঢাল আটকে ধরেছে দুই দলের সৈন্যরা, সেই অবস্থায় একে অপরকে ঠেলে বা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। প্রত্যেকেই চাইছে প্রতিপক্ষের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় ফাটল ধরাতে। এ যেন এমন এক লড়াই, যেখানে কোনো বিকৃত যৌন মিলনের আসনের চাইতেও শারীরিকভাবে অনেক বেশি ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়েছি আমরা। পেটের সাথে পেট, মুখের সাথে মুখ ঠেকিয়ে ঠেলছি একে অপরকে। গলা দিয়ে যখন নানা রকম চিৎকার বা জান্তব আওয়াজ বেরিয়ে আসছে তখন, তার সাথে আমাদের বিকৃত মুখ থেকে ছিটকে আসছে থুতু, গিয়ে লাগছে আমাদের চাইতে মাত্র কয়েক ইঞ্চি দূরে থাকা শত্রুর মুখে। আমাদের দীর্ঘ অস্ত্রগুলো এই অবস্থায় ব্যবহার করার উপায় নেই, অনেক বেশি কাছাকাছি রয়েছে শত্রুরা। ব্রোঞ্জের ঢালগুলোর মাঝে আটকা পড়ে গেছি আমরা। এই অবস্থায় কেউ যদি পা ফসকে পড়ে যায় তাহলে তার অর্থ হবে দুই দলেরই সদস্যদের ব্রোঞ্জের স্যান্ডেলের নিচে ভয়ানকভাবে পিষ্ট হওয়া, এমনকি মৃত্যুও হতে পারে।

এই ঢালের প্রাচীরের মাঝে আমাকে এতবার যুদ্ধ করতে হয়েছে যে, শুধু এই পরিস্থিতিতে ব্যবহার করার জন্যই একটা বিশেষ অস্ত্রের নকশা করেছি আমি। এমন অবস্থায় পদাতিক সৈনিকের লম্বা তলোয়ার কোনো কাজে আসে না, সুতরাং সেটা খাপেই রেখে দিতে হয়। তার বদলে ব্যবহার করা হয় একটা সরু ছোরা, যার ফলার দৈর্ঘ্য হবে খুব বেশি হলে হাতের কবজি থেকে আঙুলের ডগার সমান। যখন বর্মপরা দেহের চাপে নিজের দুটো হাতই আটকা পড়ে যায়, শত্রুর মুখ থাকে নিজের মুখ থেকে মাত্র কয়েক ইঞ্চি দূরে, তখনো এই ছোট্ট অস্ত্রটা ব্যবহার করতে অসুবিধা হয় না। শত্রুর বর্মের সামনের দিকে কোনো একটা ফুটোয় ঢুকিয়ে দিতে হয় ছুরির ফলা, তারপর চাপ দিয়ে পাঠিয়ে দিতে হয় জায়গামতো।

সেই দিন লুক্সরের প্রবেশপথের রাস্তায় একই জায়গায় দাঁড়িয়ে অন্তত দশজন বিশালদেহী দাড়িওয়ালা হিকসস বর্বরকে খুন করলাম আমি, একবারও কয়েক ইঞ্চির বেশি নাড়ানো লাগল না আমার ডান হাত। আমার হাতে ধরা ছুরির ফলা শত্রুর শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোকে বিদ্ধ করার সাথে সাথে ব্যথায় বিকৃত হয়ে উঠতে লাগল তাদের চেহারাগুলো। মাটিতে পড়ে যাওয়ার আগে ফুসফুস থেকে বেরিয়ে আসা শেষ নিঃশ্বাসটুকু গরম ভাপ ছড়িয়ে দিল আমার মুখের ওপর। পুরো ব্যাপারটা অদ্ভুত এক সন্তুষ্টির অনুভূতি জাগিয়ে তুলল আমার মনে। এমনিতে আমি নিষ্ঠুর বা অত্যাচারী প্রকৃতির মানুষ নই; কিন্তু দেবতা হোরাস সাক্ষী আছেন, আমি এবং আমার লোকেরা এই বর্বর জাতিগোষ্ঠীর হাতে যথেষ্ট অত্যাচার সয়েছি। এখন তাই যেকোনো উপায়ে প্রতিশোধ নিতে পারাই আমাদের জন্য অনেক আনন্দের।

জানি না এভাবে কতক্ষণ ওই ঢালের প্রাচীরে বন্দি হয়ে ছিলাম আমরা। আমার কাছে মনে হলো যেন বহু ঘণ্টা ধরে এমন লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি; কিন্তু মাথার ওপর নিষ্করুণ সূর্যের অবস্থান পরিবর্তন দেখে বোঝা গেল যে এক ঘণ্টারও কম সময় পার হয়েছে। তার পরেই হঠাৎ হিকসসরা নিজেদের ঢাল ছাড়িয়ে নিল, একটু দূরে সরে গেল আমাদের কাছ থেকে। লড়াইয়ের তীব্রতায় দুই দলই ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। মাঝখানের সরু এক চিলতে মাটির ওপর দিয়ে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইলাম, আমরা বুনো জন্তুর মতো হাঁপাচ্ছি। নিজেদের রক্ত আর ঘামে ভিজে আছে সবার শরীর, টলতে টলতে দাঁড়িয়ে আছি কোনোমতে। যদিও তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে আমার জানা আছে এই বিশ্রামের দৈর্ঘ্য খুবই সামান্য, তার পরেই পাগলা কুকুরের মতো আবার একে-অপরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ব আমরা। এটাও জানি যে, আজই আমাদের শেষ লড়াই। নিজের চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলোর দিকে তাকালাম আমি। দেখলাম ওরাও সবাই শেষ সীমার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। খুব বেশি হলে বারো শর মতো হবে ওদের সংখ্যা সব মিলিয়ে। ঢালের প্রাচীর তুলে ধরে হয়তো আরো ঘণ্টাখানেকের মতো টিকে থাকতে পারবে ওরা; কিন্তু তার বেশি নয়। তার পরেই সব শেষ হয়ে যাবে। তীব্র দুঃখবোধ আচ্ছন্ন করে ফেলতে চাইল আমাকে।

তখনই হঠাৎ কে যেন আমার পেছনে এসে দাঁড়াল। আমার হাত ধরে টান দিল সে, চিৎকার করে কিছু একটা বলছে। যদিও কথাগুলোর অর্থ প্রথমে আমার মাথায় ঢুকতে চাইল না। প্রভু টাইটা, আমাদের পেছনে আরো একটা বড় সেনাদল এসে হাজির হয়েছে। আমাদের সম্পূর্ণ ঘিরে ফেলেছে ওরা। এখন আপনি যদি আমাদের বাঁচানোর মতো কোনো রাস্তা খুঁজে বের করতে না পারেন তাহলে আমরা শেষ!

কে এমন ভয়ানক খবর নিয়ে এলো দেখার জন্য চরকির মতো ঘুরে দাঁড়ালাম আমি। এই কথা যদি সত্যি হয়ে থাকে তাহলে আমাদের অবস্থা সত্যিই শোচনীয়। কিন্তু আমার সামনে যে মানুষটাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম তার কথা অনায়াসে বিশ্বাস করা যায়। ফারাওয়ের সেনাবাহিনীর অন্যতম এক তরুণ সৈনিক, সে এক শ একতম ভারী রথ বাহিনীর দলনেতা। আমাকে নিয়ে চলো সেখানে মেরাব! তাকে নির্দেশ দিলাম আমি।

এইদিকে আসুন প্রভু! আপনার জন্য একটা তাজা ঘোড়া প্রস্তুত করে রেখেছি আমি। মেরাব নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছিল যে আমি কতটা ক্লান্ত, কারণ কথাটা বলেই আমার হাত চেপে ধরল সে, তারপর যুদ্ধক্ষেত্রে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে থাকা মৃত এবং মৃতপ্রায় মানুষ আর নানা রকমের অস্ত্র এবং অন্যান্য জিনিসের স্তূপ ডিঙিয়ে এগিয়ে যেতে সাহায্য করল। সেনাদলের পেছন দিকে থাকা নিজেদের অশ্বারোহী সৈনিকদের কাছে চলে এলাম আমরা। এখানে দুটো ঘোড়াকে আমাদের জন্যই প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে। ততক্ষণে অবশ্য কিছুটা শক্তি ফিরে পেয়েছি আমি, ফলে মেরাবের হাতটা সরিয়ে দিলাম। নিজের সৈন্যদের সামনে, এমনকি সামান্যতম দুর্বলতার চিহ্নটুকুও দেখাতে চাই না আমি।

একটা ঘোড়ায় উঠে বসলাম আমি, তারপর অশ্বারোহীদের ছোট্ট দলটা নিয়ে সেই উঁচু জায়গাটার ওপরে উঠে এলাম, যেটা আমাদের অবস্থান থেকে নীলনদের নিচু পাড়কে পৃথক করেছে। জায়গাটার ওপর উঠে আসার সাথে সাথে আমি এমন আচমকাভাবে আমার ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরলাম যে, আঁকি দিয়ে ঘাড় বাঁকা করে ফেলল প্রাণীটা, ছটফটে পায়ে চক্কর খেল একটা। চোখের সামনে যে দৃশ্যটা দেখলাম তাতে নিজের হতাশা কীভাবে প্রকাশ করব তার কোনো ভাষা খুঁজে পেলাম না আমি।

একটু আগে মেরাব আমাকে যা বলেছিল তাতে আমি আন্দাজ করেছিলাম যে, খুব বেশি হলে হয়তো আরো তিন থেকে চার শ হিকসস সৈন্য আমাদের পেছনে এসে হাজির হয়েছে, দুই দিক থেকে আমাদের আক্রমণ করার মতলব ওদের। ওই তিন-চার শ সৈন্যই অবশ্য আমাদের শবাধারে শেষ পেরেকটা ঠুকে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট হতো। কিন্তু এখন আমি দেখলাম আক্ষরিক অর্থেই হাজার হাজার পদাতিক সৈন্যসহ বিশাল এক সেনাবাহিনী দাঁড়িয়ে আছে, সাথে কমপক্ষে পাঁচ শ রথ আর একই পরিমাণ অশ্বারোহী। নীলনদের এই তীরেই অবস্থান নিয়েছে তারা। বিদেশি যুদ্ধজাহাজের একটা বাহিনী থেকে নেমে আসছে সবাই। সোনালি শহর লুক্সরের নিচে নদীর তীরে নোঙর ফেলেছে। জাহাজগুলো।

শত্রুদের অশ্বারোহী সেনাবাহিনী ইতোমধ্যে প্রায় সম্পূর্ণ নেমে পড়েছে তীরে। বারো কি তেরোজন অশ্বারোহী নিয়ে গঠিত আমাদের ছোট্ট দলটাকে দেখার সাথে সাথেই ঘোড়া ছুটিয়ে ঢাল বেয়ে উঠে এলো তারা, উদ্দেশ্য আমাদের ওপর আক্রমণ চালাবে। বুঝতে পারলাম, ওদের সামনে একেবারেই অসহায় আমরা। ক্লান্তির শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে আমাদের বেশির ভাগ ঘোড়া। এখন যদি ঘুরে দাঁড়িয়ে পালানোর চেষ্টা করি, সন্দেহ নেই যে শত্রুদের শক্তিশালী এবং তাজা ঘোড়াগুলো এক শ কদম যাওয়ার আগেই আমাদের ধরে ফেলবে। আবার যদি অবস্থান ধরে রেখে লড়াই করতে চাই তাহলে এক ফোঁটা ঘামও না ঝরিয়ে আমাদের টুকরো টুকরো করে ফেলতে পারবে ওরা।

তবে তার পরেই হতাশা কাটিয়ে উঠতে পারলাম আমি, নতুন দৃষ্টিতে তাকালাম এই আগন্তুকদের দিকে। খুব সামান্য একটু স্বস্তির ছোঁয়া লাগল আমার মনে, তবে আমার সাহসকে ফিরিয়ে আনার জন্য ওটুকুই যথেষ্ট। ওদের কারো মাথায় হিকসস ধাচের শিরস্ত্রাণ দেখা যাচ্ছে না। এমনকি যে জাহাজগুলো থেকে ওরা নেমে আসছে সেগুলোর সাথেও হিকসসদের যুদ্ধজাহাজের চেহারার কোনো মিল নেই।

দাঁড়াও ক্যাপ্টেন মেরাব! ধমকে উঠলাম আমি। এই আগন্তুকদের সাথে প্রথমে আমি কথা বলতে যাব। তারপর তরুণ ক্যাপ্টেনকে তর্ক করার কোনো সুযোগ না দিয়ে কোমর থেকে খুলে আনলাম খাপসহ তলোয়ার এবং খাপ থেকে বের না করে উল্টো করে ধরলাম, শান্তির সর্বজনীন চিহ্নের অনুকরণে। তারপর বিদেশি অশ্বারোহীদের মুখোমুখি হওয়ার জন্য ঘোড়া নিয়ে ধীরগতিতে ঢাল বেয়ে নামতে শুরু করলাম।

সামনে এগিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে আমার মাঝে যে হতাশার অনুভূতি মাথাচাড়া দিয়েছিল, তার কথা এখনো মনে আছে আমার। বুঝতে পারছিলাম যে, এবার বোধ হয় ভাগ্যনিয়ন্তা দেবী টাইকির ওপরে একটু বেশিই ভরসা করা হয়ে গেছে। তার পরেই অবাক হয়ে দেখলাম অশ্বারোহী দলটির নেতা চড়া গলায় নির্দেশ দিল কিছু একটা, সাথে সাথে তার দলের সবাই নিজেদের তলোয়ার খাপবদ্ধ করে ফেলল আবার। তারপর নেতার পেছনে ঘোড়া নিয়ে শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে গেল তারা।

তাদের উদাহরণ অনুসরণ করে আমিও আমার ঘোড়াটাকে দাঁড় করালাম, ফলে দলের নেতা এবং আমার মাঝে দূরত্ব থাকল স্রেফ বিশ কি ত্রিশ কদম। এই অবস্থায় মুখোমুখি দাঁড়িয়ে একটা লম্বা নিঃশ্বাস নিতে যতটা সময় লাগে ঠিক ততক্ষণই পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইলাম আমরা। তারপর নিজের চেহারা দেখানোর জন্য আমার দোমড়ানো শিরস্ত্রাণের ভাইজর বা সামনের মুখাবরণ ওপরে তুলে দিলাম আমি।

.

হেসে উঠল বিদেশি অশ্বারোহী দলের নেতা। এমন শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে শব্দটা একেবারেই অপ্রত্যাশিত লাগল; কিন্তু একই সাথে অত্যন্ত পরিচিতও মনে হলো আমার কাছে। এই হাসির শব্দ আমি চিনি। তার পরেও প্রায় আধা মিনিট ধরে তাকিয়ে রইলাম মানুষটার দিকে, এবং শেষ পর্যন্ত তার পরিচয় উদ্ধার কতে পারলাম। এখন অনেক বয়স হয়েছে তার; কিন্তু একই সাথে বিশাল পেশিবহুল এবং আত্মবিশ্বাসী চেহারা। তারুণ্যে ভরপুর সদা ব্যগ্র চেহারার সেই ছেলেটার আর কোনো চিহ্ন নেই, যে কিনা এই কঠিন আর রুক্ষ পৃথিবীতে নিজের একটা জায়গা খুঁজে বেড়াত সব সময়। নিশ্চয়ই সেই জায়গাটা খুঁজে পেয়েছে সে। এখন তার ব্যক্তিত্বে পূর্ণ কর্তৃত্বের ছাপ স্পষ্ট, পেছনে রয়েছে এক বিশাল শক্তিশালী সেনাবাহিনী।

জারাস? সন্দিহান গলায় নামটা উচ্চারণ করলাম আমি। আমি যাকে দেখছি সে নিশ্চয়ই তুমি নও, তাই না?

নামটা একটু বদলে গেছে; কিন্তু আমার আর সব কিছুই সেই আগের মতোই আছে, টাইটা। তবে এটা বলতে পারো যে আগের চাইতে বয়স একটু বেড়েছে, সাথে বোধ হয় একটু জ্ঞানীও হয়েছি।

এতগুলো বছর পরেও আমাকে মনে রেখেছ তুমি। কত দিন হলো? তাকে প্রশ্ন করলাম আমি।

বেশি না, মাত্র ত্রিশ বছরের মতো। আর হ্যাঁ, এখনো তোমাকে মনে রেখেছি আমি। আর কোনো দিন ভুলব বলেও মনে হয় না, এমনকি বর্তমান বয়সের চাইতে আরো দশ গুণ বেশি বাঁচার সুযোগ পেলেও তোমাকে মনে থাকবে আমার।

এবার আমার হেসে ওঠার পালা। নামটা বদলে গেছে তোমার, তাই তো বললে? এখন তাহলে কী নামে পরিচিত তুমি জারাস?

এখন আমার নাম হুরোতাস। আমার আগের নামটা নিয়ে কিছু দুর্ভাগ্যজনক ঝামেলা তৈরি হয়েছিল, জবাব দিল সে। ব্যাপারটাকে মোটেই গুরুত্ব দিতে চাইছে না দেখে মুচকি হাসলাম আমি।

তার মানে ল্যাসিডিমনের রাজা আর তোমার নাম এখন একই? প্রশ্ন করলাম আমি। নামটা আগেই শুনেছি আমি, এবং প্রত্যেকবারই গভীর সম্মান আর বিস্ময়ের সাথে উচ্চারিত হয়েছে সেটা।

ঠিক তাই, মাথা ঝাঁকাল সে। তোমার পরিচিত সেই ছোট্ট জারাসই এখন ল্যাসিডিমনের রাজা।

নিশ্চয়ই ঠাট্টা করছ আমার সাথে? অবাক হয়ে বলে উঠলাম আমি। দেখা যাচ্ছে আমার প্রাক্তন অধঃস্তন এখন পৃথিবীর বুকে বেশ ভালোভাবেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে, সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে গেছে নিজেকে। কিন্তু তোমার কথা যদি আসলেই সত্যি হয় তাহলে আমাকে এটা বলো যে ফারাও টামোসের বোন এবং রাজকুমারী তেহুতির কী খবর, যাকে তুমি আমার অভিভাবকত্ব থেকে অপহরণ করে নিয়ে গিয়েছিলে?

তুমি আসলে বলতে চাইছ ভালোবেসে নিয়ে গিয়েছিলাম, অপহরণ শব্দটা ভুল হচ্ছে। আর তা ছাড়া এখন সে আর রাজকুমারী নয়, জোরে জোরে মাথা নাড়ল হুরোতাস। এখন সে একজন রানি, কারণ আমাকে বিয়ে করার মতো সঠিক সিদ্ধান্তটা নিতে দেরি করেনি সে।

এখনো কি আগের মতোই সুন্দরী আছে সে? কিছুটা উদাস গলায় প্রশ্ন করলাম আমি।

আমার রাজ্যের ভাষায় স্পার্টা শব্দের অর্থ হচ্ছে সবচেয়ে সুন্দরী। এবং আমার স্ত্রীর সম্মানেই ওই শহরের নামকরণ করেছি আমি। আর তাই এখন রাজকুমারী তেহুতি হচ্ছে ল্যাসিডিমনের রানি স্পার্টা।

আর বাকিদের কী খবর, যারা আমার একই রকম প্রিয় ছিল? যাদের তুমি বহু বছর আগে তোমার সাথে উত্তরে নিয়ে গিয়েছিলে–

নিশ্চয়ই রাজকুমারী বেকাথা এবং হুইয়ের কথা বলছ তুমি, আমার কথা শেষ na হতেই বলে উঠল রাজা হুরোতাস। এখন ওরাও আমাদের মতোই স্বামী স্ত্রী। তবে হুই এখন আর সামান্য কোনো ক্যাপ্টেন নয়। এখন সে ল্যাসিডিমন নৌবাহিনীর প্রধান অ্যাডমিরাল এবং নৌ-সেনাপতি। নদীতে যে জাহাজের বহর দেখছ সেগুলো সবই ওর অধীনে, বলে নীলনদের তীরে নোঙর করে থাকা জাহাজগুলোর বিশাল দলের প্রতি ইঙ্গিত করল সে। এই মুহূর্তে ও আমার বাকি সৈন্যদের তীরে নামানোর তদারকি করছে।

তাহলে এবার বলো রাজা হুরোতাস, এত বছর পর কেন মিশরে ফিরে এলে তুমি? জানতে চাইলাম আমি।

আমার প্রশ্নের জবাব দেওয়ার সময় উত্তেজিত হয়ে উঠল তার চেহারা। আমি এসেছি কারণ অন্তরের গভীরে আমি এখনো একজন মিশরীয়। আমার গুপ্তচরদের কাছ থেকে জানতে পেরেছিলাম যে মিশর এখন চরম বিপদের মুখে, হিকসস বাহিনীর হাতে পরাজয় বরণের দ্বারপ্রান্তে এসে পড়েছ তোমরা। আমাদের প্রিয় জন্মভূমিকে অপবিত্র করেছে ওই পশুগুলো। আমাদের নারীদের ধর্ষণ করেছে, খুন করেছে শিশুদের। ওদের শিকারের মাঝে আমার নিজের মা এবং দুই ছোট বোনও ছিল। তাদের ওপর নির্যাতন চালানোর পর জীবন্ত অবস্থাতেই ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল আমাদের বাড়ির জ্বলন্ত ধ্বংসাবশেষের মাঝে পুড়ে মরতে দেখে অট্টহাসি হেসেছিল ওই হিকসসগুলো। আমি মিশরে ফিরে এসেছি আমার মা আর বোনদের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে, সেইসাথে মিশরের আর কারো কপালে যেন এমন দুর্ভাগ্য নেমে না আসে তা নিশ্চিত করতে। যদি আমি সফল হই তাহলে আমার আশা এই যে, আমাদের দুই দেশ মিশর এবং ল্যাসিডিমনের মাঝে এক দীর্ঘস্থায়ী মৈত্রী প্রতিষ্ঠিত হবে।

ফিরে আসার আগে কেন তেইশ বছর অপেক্ষা করলে তুমি?

তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে টাইটা, শেষবার যখন আমাদের দেখা হয়েছিল তখন আমরা ছিলাম স্রেফ কিছু পালিয়ে যাওয়া মানুষ তিনটে ছোট নৌকা ছিল আমাদের সম্বল। এমন এক ফারাওয়ের কাছ থেকে আমরা পালাচ্ছিলাম, যিনি আমাদের বিচ্ছিন্ন করতে চেয়েছিলেন ভালোবাসার নারীদের কাছ থেকে।

মাথা ঝাঁকিয়ে কথাটার সত্যতা মেনে নিলাম আমি। এখন আর এটা করতে কোনো বিপদের আশঙ্কা নেই, কারণ যে ফারাওয়ের কথা হুরোতাস বলছে তিনি হলেন টামোস। এবং গতকালই তার মৃত্যু হয়েছে।

রাজা হুরোতাস, একসময় যে পরিচিত ছিল জারাস নামের এক তরুণ হিসেবে, আবার বলে চলল। নিজেদের জন্য নতুন কোনো দেশ কোনো আশ্রয় খুঁজছিলাম আমরা। সেই দেশ খুঁজে পেতে এবং তাকে শক্তিশালী এবং সমীহের যোগ্য করে তোলার জন্য পাঁচ হাজারেরও বেশি দক্ষ যোদ্ধার সমন্বয়ে এক সেনাবাহিনী গড়ে তুলতে এই সময়ের দরকার ছিল আমাদের।

এবং সেটা কীভাবে সম্ভব করলেন, হে মহান রাজা? ঠাট্টার সুরে জিজ্ঞেস করলাম আমি।

একটু কূটনীতি খাঁটিয়ে, আর কিছু নয়, নিষ্পাপ গলায় জবাব দিল হুরোতাস। তবে আমার চেহারায় সন্দেহের ভাব ফুটে উঠতে দেখে হেসে ফেলল সে, তারপর স্বীকার করল আসল কথা। কূটনীতির সাথে অবশ্য কিছুটা অস্ত্রবাজির মহড়া আর দখলও চালাতে হয়েছে। হাতের ইশারায় নীলনদের পুব তীরে জড়ো হতে শুরু করা শক্তিশালী সেনাবাহিনীর দিকে ইঙ্গিত করল সে। এখন যে বাহিনী তুমি দেখতে পাচ্ছ তেমন শক্তিশালী কিছু যখন তোমার সাথে থাকবে তখন খুব কম মানুষই তোমার সাথে তর্কে জড়াতে চাইবে।

এটাই বরং তোমার স্বভাবের সাথে বেশি মেলে, একটু খোঁচা মেরে বললাম আমি। মাথা ঝাঁকিয়ে এবং একটু হেসে আমার ঠাট্টা গ্রহণ করল হুরোতাস, তারপর আবার নিজের কথায় ফিরে গেল।

আমি জানতাম এই মুহূর্তে তোমাকে সাধ্যমতো সাহায্য করাটা একজন দেশপ্রেমিক হিসেবে আমার দায়িত্ব। আরো এক বছর আগেই আসতাম আমি; কিন্তু তখনো আমার নৌবাহিনী এতটা শক্তিশালী হয়ে ওঠেনি যে আমার পুরো সেনাবাহিনীকে বহন করতে পারবে। আরো জাহাজ তৈরি করতে হয়েছে আমাকে।

তাহলে তোমাকে উষ্ণ স্বাগতম জানাচ্ছি আমি। একেবারে সঠিক মুহূর্তে এসে উপস্থিত হয়েছ তুমি। আর এক ঘণ্টা পরে এলেই দেখতে অনেক দেরি করে ফেলেছ। এক লাফে ঘোড়া থেকে নামলাম আমি; কিন্তু আমার আগেই নিজের ঘোড়া থেকে নেমে পড়েছে হুরোতাস। নিজের অর্ধেক বয়সী কোনো মানুষের মতো ক্ষীপ্র ওর চালচলন, দ্রুত পায়ে এগিয়ে এলো আমার দিকে। আপন ভাইয়ের মতো পরস্পরকে জড়িয়ে ধরলাম আমরা। অন্তরের গভীরে তো আমরা তাই। যদিও হুরোতাসের জন্য কেবল ভ্রাতৃসুলভ ভালোবাসা নয়, বরং আরো বেশি কিছু অনুভব করছি আমি। সে শুধু আমার প্রিয় মিশরকে নিষ্ঠুর ডাকাতদের হাত থেকে বাঁচানোর উপায় বয়ে আনেনি, তার সাথে এটাও বোঝা যাচ্ছে যে, আমার প্রিয় তেহুতিরও খবর নিয়ে এসেছে, যে কিনা রানি লসট্রিসের মেয়ে। আমার দীর্ঘ জীবনে এই দুই নারীকেই সবচেয়ে বেশি ভালোবেসে এসেছি আমি।

আমাদের আলিঙ্গনটা হলো উষ্ণ, তবে ক্ষণস্থায়ী। নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে হুরোতাসের কাঁধে হালকা একটা ঘুষি মারলাম। সামনে এসবের জন্য অনেক সময় পাওয়া যাবে। এই মুহূর্তে পথের ও প্রান্তে কয়েক হাজার হিকসস আমার এবং তোমার মনোযোগ আকর্ষণের অপেক্ষায় আছে, পেছন দিকে ইঙ্গিত করে বললাম আমি। একটু যেন চমকে গেল হুরোতাস। কিন্তু প্রায় সাথে সাথেই সামলে নিল নিজেকে, খাঁটি আনন্দের হাসি ফুটেছে মুখে।

ক্ষমা চাইছি পুরনো বন্ধু আমার। বোঝা উচিত ছিল যে আমি পৌঁছানোর সাথে সাথেই আমার জন্য যথেষ্ট বিনোদনের ব্যবস্থা করবে তুমি। তাহলে চলো হতচ্ছাড়া হিকসসগুলোর একটা হেস্তনেস্ত করে ফেলি এখনই। কী বলো?

মাথা নাড়লাম আমি, যেন রাজি নই। তোমার সব সময়ই অনেক বেশি তাড়াহুড়ো। জোয়ান ষাঁড় যখন গাভীর পালের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাড়াহুড়ো করে কয়েকটা গাভির দখল নিতে চেয়েছিল তখন বুড়ো ষাঁড় কী বলেছিল জানো তো?

বলো, কী বলেছিল বুড়ো ষাঁড়, আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইল হুরোতাস। আমার ছোট ছোট কৌতুকগুলোতে দারুণ মজা পায় সে। এবারও সেই মজা থেকে তাকে বঞ্চিত করতে ইচ্ছে করল না।

বুড়ো ষাঁড় বলেছিল, তার চাইতে বরং আস্তে আস্তে সামনে এগিয়ে যাই, গিয়ে সবকটাকে ধরি।

অট্টহাসি বেরিয়ে এলো হুরোতাসের মুখ দিয়ে। তোমার পরিকল্পনা কী বলো টাইটা। আমি জানি ইতোমধ্যে কিছু একটা বুদ্ধি করে ফেলেছ তুমি। সব সময়ই তাই করো।

পরিকল্পনাটা খুব সাধারণ, ফলে কয়েক কথায় তাকে বুঝিয়ে দিলাম আমি। তারপর লাফ দিয়ে উঠে বসলাম আমার ঘোড়ার পিঠে। একবারও পেছনে না। তাকিয়ে মেরাব এবং অন্যান্য অশ্বারোহীসহ আমার ছোট্ট দলটাকে নিয়ে টিলার ওপর উঠে এলাম। জানি যে হুরোতাস, একসময় যার পরিচয় ছিল জারাস নামে; আমার পরামর্শ সে অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে। যদিও এখন সে একজন রাজা; কিন্তু এটা ভুলে যাওয়ার মতো বোকা নয় যে আমার উপদেশ কখনো খারাপ হয় না।

.

টিলার ওপর উঠে আসতেই দেখলাম একেবারে ক্রান্তিলগ্নে এসে উপস্থিত হয়েছি আমরা। আহত মুষ্টিমেয় কিছু মিশরীয় যোদ্ধাকে লক্ষ্য করে আবারও সামনে এগোতে শুরু করেছে। হিকসসদের দল। ঘোড়ার গতি বাড়ালাম আমি। ঢাল দিয়ে তৈরি করা দেয়ালের কাছে পৌঁছানোর মাত্র কয়েক সেকেন্ড পরেই আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে শত্রুরা। ঘোড়াটাকে ছেড়ে দিয়ে পেছনে পাঠিয়ে দিলাম আমি। কেউ একজন একটা ব্রোঞ্জের ঢাল ধরিয়ে দিল আমার হাতে। সামনের সারির মাঝখানে নিজের নির্দিষ্ট জায়গায় এসে দাঁড়ালাম আমি। তার পরই মরুঝড়ের মতো তীব্র শব্দ উঠল, ব্রোঞ্জের সাথে বাড়ি লাগল ব্রোঞ্জের। হিকসসদের সামনের সারির সৈন্যরা আক্রমণ করল আমাদের দুর্বল ব্যুহের ওপর। প্রায় সাথে সাথেই যুদ্ধক্ষেত্রের দুঃস্বপ্নের মতো ভয়াবহতা যেন গিলে নিল আমাকে, সময় তার গুরুত্ব হারিয়ে ফেলল। প্রতিটি মুহূর্ত পরিণত হলো অনন্ত কালে। আতঙ্কের কালো পর্দার মতো আমাদের চারপাশে বিস্তার লাভ করতে লাগল মৃত্যু। কতক্ষণ পরে ঠিক বলতে পারব না, এক ঘণ্টা হতে পারে বা এক শ বছর- অবশেষে অনুভব করলাম আমাদের ভঙ্গুর ব্যুহের ওপর হিকসসদের অসহ্য চাপ ধীরে ধীরে কমে আসছে। তার পরেই দেখলাম হোঁচট খেতে খেতে পিছিয়ে যাওয়ার বদলে দ্রুত গতিতে সামনে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা।

শত্রুদের হেঁড়ে গলায় যুদ্ধ বিজয়ের উন্মত্ত গর্জনের বদলে এখন শোনা যাচ্ছে হিকসসদের বর্বর ভাষায় নানা রকম আর্তনাদ আর আর্তচিৎকার। তার পরেই মনে হলো যেন শত্রুদের দলটা হঠাৎ ছোট হয়ে এসেছে, কমে আসছে তাদের সংখ্যা। ফলে এখন আর সামনে কী হচ্ছে তা দেখতে অসুবিধা হলো না আমার। দেখলাম হুরোতাস আমার নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে, ঠিক যেমনটা আমি আশা করেছিলাম। নিজের লোকদের দুই ভাগে ভাগ করে আমাদের দুই পক্ষের পেছন দিক দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে সে। ফলে বৃত্তের মতো একটা সীমানার মাঝে বন্দি হয়ে পড়েছে হিকসসরা, ঠিক যেন কোনো জেলের জালে আটকা পড়েছে এক ঝাঁক সার্ডিন মাছ।

দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার পরে যে বেপরোয়া মনোভাব তৈরি হয় তাই নিয়ে লড়ল হিকসসরা। কিন্তু আমাদের তৈরি করা ঢালের দেয়াল তাদের সামনে এগোতে দিচ্ছে না, অন্যদিকে ল্যাসিডিমন থেকে আসা হুরোতাসের সৈন্যরাও যুদ্ধের জন্য পূর্ণ উদ্যমে তৈরি। ঘৃণিত শত্রুদের আমাদের তৈরি করা ব্যুহের দিকে ঠেলে দিতে লাগল তারা, যেভাবে কাঁচা মাংস টুকরো টুকরো করে কাটার জন্য কাঠের গুঁড়ির ওপর আছড়ে ফেলে কসাই। যুদ্ধের গতিপথ বদলে গেল খুব দ্রুত, স্বাভাবিক সংঘর্ষের বদলে শুরু হলো স্রেফ ঠাণ্ডা মাথায় খুন। অবশিষ্ট কয়েকজন হিকসস শেষ পর্যন্ত অস্ত্র ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে রক্তেভেজা পিচ্ছিল মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। প্রাণভিক্ষা চাইছে সবাই; কিন্তু তাদের আবেদন শুনে হেসে উঠল রাজা হুরোতাস।

চিৎকার করে বলে উঠল সে, আমার মা আর ছোট ছোট দুই বোনও তোদের কাছে একইভাবে ক্ষমাভিক্ষা চেয়েছিল। তোদের পাষাণ বাপ-দাদারা আমার প্রিয় মানুষগুলোকে যে জবাব দিয়েছিল আমিও তোদের সেই একই জবাব দিচ্ছি। মর হারামজাদার দল, মর!

শেষ পর্যন্ত যখন সর্বশেষ হিকসসের অন্তিম চিৎকারের প্রতিধ্বনিও বাতাসে মিলিয়ে গেল, রক্তে মাখামাখি যুদ্ধক্ষেত্রের মাঝ দিয়ে নিজের লোকদের নিয়ে এগিয়ে গেল রাজা হুরোতাস। শত্রুদের কারো মাঝে জীবনের সামান্য চিহ্ন দেখা গেলেও তাকে জবাই করা হলো। আমিও স্বীকার করছি, যুদ্ধের উন্মাদনায় কিছুক্ষণের জন্য হলেও নিজের মহৎ এবং দয়ালু সত্তাটাকে সরিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছিলাম। বেশ কিছু আহত হিকসসকে তাদের কুৎসিত দেবতা সেথের অপেক্ষমাণ বাহুবন্ধনে পাঠিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে আমি নিজেও বিজয় উদযাপনে যোগ দিলাম। যাদের জবাই করলাম তাদের প্রত্যেককে আমার পক্ষের একজন করে সাহসী ব্যক্তির স্মৃতির প্রতি উৎসর্গ করলাম মনে মনে, যারা এই একই দিনে একই যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত্যুবরণ করেছে।

.

রাজা হুরোতাস এবং আমি যখন যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করলাম তখন রাত নেমে এসেছে, আকাশে উঠেছে বিশাল পূর্ণিমার চাঁদ। আমাদের মাঝে বন্ধুত্ব বহু পুরনো, ফলে এটা হুরোতাস অনেক আগে থেকেই জানে যে সকল আহত সৈনিককে নিরাপদে ফিরিয়ে আনতে হবে, তাদের যত্ন নিতে হবে। তারপর নির্ধারণ করতে হবে শিবিরের সীমানা এবং সেই অনুযায়ী পাহারা বসাতে হবে। কেবল তার পরেই সেনাপতিরা নিজেদের কাজে মনোযোগ দিতে পারবে। ফলে এই সব দায়িত্ব পালন করতে করতে মাঝরাত পেরিয়ে গেল। তারপর আমরা দুজন ঘোড়া নিয়ে নীলনদের ঢালু পাড় বেয়ে নিচে নেমে এলাম, যেখানে নোঙর করা রয়েছে হুরোতাসের বহরের প্রধান জাহাজটি।

জাহাজে উঠতেই অ্যাডমিরাল হুই এগিয়ে এলো আমাদের স্বাগত জানাতে। হুরোতাসের পরেই হুই আমার সবচেয়ে প্রিয় ব্যক্তিদের একজন, এবং পুরনো ও প্রিয় বন্ধুর মতোই একে অপরকে স্বাগত জানালাম আমরা। তার মাথায় সেই ঘন ঝোঁপের মতো চুল এখন আর নেই, ধূসর এবং পাতলা হয়ে আসা চুলের গোছার মাঝ দিয়ে উঁকি দিচ্ছে চকচকে চামড়া। কিন্তু চোখগুলো এখনো আগের মতোই উজ্জ্বল, সতর্ক। তার প্রখর রসবোধের কারণে কিছুক্ষণের মাঝেই সজীব হয়ে উঠল আমার মন। আমাদের নিয়ে ক্যাপ্টেনের কামরায় প্রবেশ করল সে, এবং নিজের হাতে হুরোতাস ও আমাকে বড় বড় দুই পেয়ালা মধু মেশানো লাল মদ ঢেলে দিল। মনে হলো এর মতো সুস্বাদু পানীয় খুব কমই খেয়েছি আমি। বেশ কয়েকবার আমার পেয়ালা ভরে দিল হুই, যতক্ষণ না ক্লান্তি এসে বাধা দিল আমাদের উচ্ছ্বসিত পুনর্মিলনীতে।

পরদিন সকালে সূর্য পরিষ্কারভাবে দিগন্তের ওপর উঠে আসা পর্যন্ত ঘুমোলাম আমরা। তারপর নদীতে গোসল করে সব ময়লা আর গতকাল যুদ্ধক্ষেত্র থেকে শরীরে লাগা রক্তের দাগ ধুয়ে ফেললাম। তারপর যখন মিশর এবং ল্যাসিডিমনের যৌথ সেনাবাহিনী নদীর পাড়ে একত্র হলো, তাজা ঘোড়ায় উঠে বসলাম আমরা। আমাদের সামনে গর্বিত পদক্ষেপে কুচকাওয়াজ করে চলতে শুরু করল হুরোতাসের বাহিনী, সেইসাথে আমার দলের যারা বেঁচে ছিল। বিজয় নিশান ওড়ানো হলো, ঢাক আর বাঁশির শব্দে মুখরিত হলো বাতাস। নদীর পাড় থেকে লুক্সর শহরের বিজয়দ্বারের দিকে এগোতে শুরু করলাম আমরা, উদ্দেশ্য মিশরের নতুন ফারাও টামোসের জ্যেষ্ঠ পুত্র উটেরিক টুরোকে আমাদের বিশাল বিজয়ের সংবাদ জানানো।

তবে সোনালি শহরের দরজায় পৌঁছে দেখলাম বন্ধ করা রয়েছে দরজার পাল্লা। ঘোড়া নিয়ে সামনে এগিয়ে গিয়ে দ্বাররক্ষকদের উদ্দেশ্যে ডাক দিলাম আমি। ভেতরে ঢুকতে চাওয়ার কথা জানিয়ে বেশ কয়েকবার চিৎকার করতে হলো আমাকে। তার পরেই প্রাচীরের ওপর প্রহরীদের চেহারা উদয় হতে দেখা গেল। ফারাও জানতে চাইছেন তোমরা কারা, কেন এসেছ, প্রহরীদের প্রধান জানতে চাইল আমার কাছে। তাকে ভালো করেই চিনি আমি। তার নাম ওয়েনেগ, সুদর্শন এক তরুণ ক্যাপ্টেন। ইতোমধ্যে মিশরের সর্বোচ্চ সামরিক সম্মান বীরত্বের স্বর্ণ পরার সুযোগ পেয়েছে সে। আমাকে চিনতে পারেনি দেখে বেশ অবাক হলাম আমি।

তোমার স্মৃতিশক্তি অনেক দুর্বল হয়ে গেছে ক্যাপ্টেন ওয়েনেগ, নিচ থেকে জবাব দিলাম আমি। আমি লর্ড টাইটা, রাজপরিষদের সভাপতি এবং ফারাওয়ের সেনাবাহিনীর প্রধান সেনাধ্যক্ষ। হিকসসদের সাথে যুদ্ধে আমাদের বিশাল বিজয়ের খবর জানাতে এসেছি ফারাওকে।

এখানেই দাঁড়ান! এই কথা বলে সরে গেল ক্যাপ্টেন ওয়েনেগ, মাথাটা অদৃশ্য হয়ে গেল প্রাচীরের কিনারের ওপাশে। এক ঘণ্টা ধরে দাঁড়িয়ে রইলাম আমরা। তারপর আরো এক ঘণ্টা।

মনে হচ্ছে নতুন ফারাও কোনো কারণে খেপে আছেন তোমার ওপর, তিক্ত হাসি হেসে আমাকে বলল রাজা হুরোতাস। কে এই নতুন ফারাও? আমি কি তাকে চিনি?

কাঁধ ঝাঁকালাম আমি। তার নাম উটেরিক টুরো। আর তোমার তাকে চেনার কথা নয়।

গত কয়েক দিনে নিজের রাজকীয় দায়িত্ব অনুযায়ী যুদ্ধক্ষেত্রে আসেননি কেন তিনি? কেন যুদ্ধ করেননি তোমার পাশে দাঁড়িয়ে?

কারণ তিনি সবে পঁয়ত্রিশ বছরের এক শিশু, এসব নীচু স্তরের লোকজনের সঙ্গ এবং তাদের রুক্ষ আচার-ব্যবহার একেবারেই সহ্য করতে পারেন না, বুঝিয়ে বললাম আমি। হাসি চাপতে গিয়ে বিদঘুঁটে শব্দ বেরিয়ে এলো হুরোতাসের নাক থেকে।

তোমার কথাবার্তায় সেই আগের মতোই ধার আছে টাইটা, একটুও কমেনি! শেষ পর্যন্ত ক্যাপ্টেন ওয়েনেগকে শহর-প্রাচীরের ওপর দেখা গেল আবার। মহান ফারাও উটেরিক টুরো দয়াপরবশ হয়ে আপনাকে শহরের ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দিয়েছেন। তবে তার নির্দেশ এই যে, আপনাদের ঘোড়াগুলো বাইরে রেখে আসতে হবে। আপনার সাথে যে অপরিচিত মানুষটি আছেন তিনিও ভেতরে আসতে পারবেন, তবে আর কেউ নয়।

কথাগুলোর মাঝে লুকিয়ে থাকা উদ্ধত ভাব ধরতে পেরে সশব্দে চমকে উঠলাম আমি। উপযুক্ত একটা জবাব উঠে এসেছিল ঠোঁটের ডগায়; কিন্তু শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিতে বাধ্য হলাম। ল্যাসিডিমন এবং সমস্ত মিশরের সেনাবাহিনী এখন আমার কথা শুনছে অখণ্ড মনোযোগের সাথে। প্রায় তিন হাজার মানুষ। এই অবস্থায় এমন কিছু বলা আমার একেবারেই উচিত হবে না।

ফারাওয়ের দয়ার সীমা নেই, জবাব দিলাম আমি। ধীরে ধীরে খুলে গেল বিশাল দরজাটা।

এই যে আমার সাথে দাঁড়িয়ে থাকা অপরিচিত মানুষ, চলুন ভেতরে যাই, হুরোতাসকে উদ্দেশ্য করে তিক্ত গলায় বললাম আমি। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সামনে এগোতে শুরু করলাম আমরা। শিরস্ত্রাণের মুখাবরণ ওপরে ওঠানো, হাত রাখা যার যার তলোয়ারের বাঁটে; এই অবস্থায় আমরা লুক্সর শহরে প্রবেশ করলাম। কেন জানি না; কিন্তু কিছুতেই নিজের মাঝে বিজয়ী সেনাপতির অনুভূতিটা আসছিল না আমার।

আমাদের সামনে সামনে এগিয়ে চলল ক্যাপ্টেন ওয়েনেগ এবং তার কিছু সৈন্য। শহরের রাস্তাগুলো ভৌতিক রকমের নির্জন নিস্তব্ধ। নিশ্চয়ই যে দুই ঘণ্টা আমাদের বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছিল সেই সময়টা ফারাও জনতার উৎসুক ভিড়কে সরিয়ে রাখার কাজে ব্যয় করেছেন। প্রাসাদের সামনে পৌঁছানোর পর যেন নিজেই ধীরে ধীরে খুলে গেল প্রধান ফটক। কোথাও কোনো বাজনার আওয়াজ নেই আমাদের স্বাগত জানাতে, এগিয়ে আসতে দেখা গেল না কোনো উল্লসিত জনতার ভিড়কে।

চওড়া সিঁড়ি বেয়ে রাজদরবারের প্রধান দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম আমরা। কিন্তু দরজায় দাঁড়িয়ে দেখলাম বিশাল ভবনটা এখন সম্পূর্ণ ফাঁকা, নিস্তব্ধ। কেবল আমাদের ব্রোঞ্জে বাঁধানো জুতা ছাড়া আর কোনো কিছুর শব্দ নেই। পাথরের তৈরি সারি সারি শূন্য আসনের পাশ কাটিয়ে সামনে এগিয়ে গেলাম আমরা, কক্ষের একেবারে শেষ মাথায় উঁচু মঞ্চের ওপর রাখা সিংহাসনের দিকে এগোচ্ছি।

শূন্য সিংহাসনটার সামনে থমকে দাঁড়ালাম আমরা। আমার দিকে তাকাল ক্যাপ্টেন ওয়েনেগ। কর্কশ গলায় কোনো ভদ্রতার ধার না ধরে বলল, এখানেই দাঁড়ান! প্রায় ধমকের সুরে কথাটা বলল সে, তারপর চেহারায় কোনো পরিবর্তন না এনেই নিঃশব্দে ঠোঁট নাড়তে শুরু করল। ঠোঁটের নড়াচড়া দেখেই কী বলা হচ্ছে বুঝে নিতে পারি আমি, তাই তার কথাগুলো বুঝতে কোনো অসুবিধা হলো না। সে বলছে, ক্ষমা করবেন প্রভু টাইটা। আপনাদের সাথে এমন আচরণ করার কোনো ইচ্ছেই আমার ছিল না। ব্যক্তিগতভাবে আমি আপনাকে অত্যন্ত সম্মান করি।

ধন্যবাদ ক্যাপ্টেন, বললাম আমি। নিজের দায়িত্ব তুমি খুব ভালোভাবেই পালন করেছ। আমার কথার জবাবে মুঠিবদ্ধ হাত বুকে ঠেকাল ওয়েনেগ। তারপর নিজের লোকদের নিয়ে চলে গেল সে। শূন্য সিংহাসনের সামনে পাথরের মূর্তির মতো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম আমরা।

চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকা পাথরের দেয়ালগুলোর ফুটো দিয়ে যে অনেকগুলো অনুসন্ধিৎসু চোখ আমাদের দিকে চেয়ে আছে সেটা হুরোতাসকে মুখে বলে দেওয়ার দরকার হলো না আমার। তার পরেও স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছি, এই নতুন ফারাওয়ের অদ্ভুত রীতিনীতি দেখে আমার নিজের ধৈর্যও ধীরে ধীরে কমে আসতে শুরু করেছে।

অবশেষে দূর থেকে হাসিঠাট্টা আর মানুষের গলার আওয়াজ পাওয়া গেল। ধীরে ধীরে কাছে এগিয়ে আসতে লাগল তা, আরো জোরালো হয়ে উঠল। শেষ পর্যন্ত ঝটকা দিয়ে সরে গেল সিংহাসনের পেছনে দরবার কক্ষের দরজায় ঝুলে থাকা বিশাল পর্দা। ভেতরে প্রবেশ করল ফারাও উটেরিক টুরো, নিজেকে যে মহান উটেরিক টুরো হিসেবে পরিচয় দিতে বেশি পছন্দ করে। চুলগুলোকে কোঁকড়া করা হয়েছে তার, এখন সেগুলো ঝুলে আছে দুই কাঁধের ওপর দিয়ে। গলায় ফুলের মালা। হাতে একটা ডালিম, সেখান থেকে দানা তুলে নিয়ে খাচ্ছে সে, আর বিচিগুলো থু থু করে ফেলে দিচ্ছে মেঝেতে। আমার এবং হুরোতাসের দিকে একবারও না তাকিয়ে সিঁড়ি বেয়ে সিংহাসনের কাছে এগিয়ে গেল সে, গদি সাজিয়ে তৈরি করা আসনে বসল আরাম করে।

উটেরিক টুরোর পেছন পেছন দরবারে প্রবেশ করেছে ছয়জন অল্পবয়স্ক কিশোর, সবার পোশাক কমবেশি এলোমেলো। তাদেরকেও ফুলের সাজে সাজানো হয়েছে। ঠোঁটে লাগানো হয়েছে রক্তের মতো লাল রং, চোখের চারপাশে নীল অথবা সবুজ আভা। কেউ কেউ ফারাওয়ের মতোই কোনো ফল বা মিষ্টান্ন খাচ্ছে, তবে দু-তিনজনের হাতে মদের পেয়ালাও দেখা গেল। নিজেদের মাঝে হাসিঠাট্টায় ব্যস্ত তারা, মাঝে মাঝে চুমুক দিচ্ছে পেয়ালায়।

সবার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটার দিকে একটা গদি ছুঁড়ে মারল ফারাও। মদের পেয়ালা পড়ে গেল তার হাত থেকে, ভেতরের মদটুকু ছিটকে গিয়ে লাগল গায়ের পোশাকে। হাসির ফোয়ারা বয়ে গেল দরবারে।

ওহ, দুষ্টু ফারাও! ধমকে উঠল ছেলেটা। দেখো দেখি, আমার এত সুন্দর পোশাকটা একেবারে নষ্ট করে দিলে!

মাফ করে দাও প্রিয় আনেন্ত, ঢং করে চোখ ঘুরিয়ে বলল উটেরিক। এসো, বসো আমার পাশে। খুব বেশি সময় নেব না এখানে, কথা দিচ্ছি। এই দুই ভদ্রলোকের সাথে দুদণ্ড কথা বলব শুধু। দরবারে ঢোকার পরে প্রথমবারের মতো আমার এবং হুরোতাসের দিকে সরাসরি তাকাল সে। শুভেচ্ছা নাও প্রিয় টাইটা। আশা করি বরাবরের মতোই সম্পূর্ণ সুস্থ আছ তুমি? তার পরেই আমার সঙ্গীর দিকে তাকাল। বলল, আর তোমার সাথে এই লোকটা কে? আমার সাথে বোধ হয় তার পরিচয় নেই, কি বলো?

মহামান্য ফারাও, ইনি হচ্ছেন ল্যাসিডিমন রাজ্যের সর্বাধিকারী রাজা হুরোতাস। তার সাহায্য ছাড়া আপনার সোনালি শহর লুক্সরের দরজায় এসে হাজির হওয়া হিকসসদের কিছুতেই পরাজিত করতে পারতাম না আমরা। হাতটা লম্বা করে দিয়ে ইশারায় আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে দেখালাম আমি। মিশরীয় সভ্যতা সম্পূর্ণভাবে বিপদমুক্ত হয়েছে এই ব্যক্তির কারণে, সে জন্য আমরা সবাই তার কাছে কৃতজ্ঞ…

ডান হাতের তালু ওপরে তুলে ধরল উটেরিক, ফলে সাথে সাথে থেমে গেল আমার উদাত্ত বক্তৃতা। হুরোতাসের দিকে চিন্তিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সে, মনে হলো যেন একটু বেশিই সময় নিল কাজটা করতে। তারপর বলল, রাজা হুরোতাস, তাই না? কিন্তু একে দেখে আমার অন্য এক ব্যক্তির কথা মনে পড়ছে।

থতমত খেয়ে গেলাম আমি, এই কথার জবাবে কী বলব বুঝতে পারলাম না। এবং কোনো কথার জবাবে কিছু বলতে না পারাটা আমার সাথে একেবারেই বেমানান। এর পরেই অদ্ভুত এক ঘটনা ঘটল। টামোসের সন্তানদের মাঝে যে ছিল পুরোপুরি দুর্বল অপদার্থ কিসিমের, আমার চোখের সামনেই সে পরিণত হলো উন্মত্ত ভয়ানক এক দানবে। চেহারা লাল হয়ে উঠল তার, জ্বলে উঠল চোখগুলো। প্রচণ্ড ক্রোধে কাঁপতে শুরু করল কাঁধ দুটো। আমার সঙ্গীর দিকে আঙুল তাক করল ফারাও।

আমার মহান পিতা ফারাও টামোসের সেনাবাহিনীর এক সাধারণ ক্যাপ্টেনের সাথে এই লোকের চেহারার মিল খুঁজে পাচ্ছি আমি; যার নাম ছিল জারাস। তুমি নিশ্চয়ই সেই গুণ্ডাটার কথা ভুলে যাওনি টাইটা? তখন আমি অনেক ছোট ছিলাম, তবু এই জারাস নামের লোকটার কথা আমার ঠিকই মনে আছে। তার শয়তানিতে ভরা চেহারা আর উদ্ধত আচরণের কথা কখনো ভুলব না আমি। কণ্ঠস্বর উঁচুতে চড়ছে তার, ধীরে ধীরে মুখ থেকে থুতুর ছিটা বেরিয়ে আসছে। আমার মহান পিতা শক্তিমান ফারাও টামোস এই লোকটাকে বিশেষ এক উদ্দেশ্যে পাঠিয়েছিলেন ক্রিট দ্বীপে অবস্থিত রাজা মিনোসের রাজধানী নসোসে। আমার দুই ফুপু রাজকুমারী তেহুতি এবং রাজকুমারী বেকাথাকে নিরাপদে ক্রিটে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব ছিল এর ওপর। ঠিক হয়েছিল ক্রিটের রাজা মিনোসের সাথে তাদের বিয়ে হবে, যাতে আমাদের দুই রাজ্যের মধ্যে বন্ধুত্ব আরো দৃঢ় হয়। অথচ পথিমধ্যে এই জারাস আমার আত্মীয়দের অপহরণ করে, তারপর নিয়ে যায় পৃথিবীর একেবারে সর্বশেষ প্রান্তে এক বর্বর ভয়ানক দেশে। আর কখনো আমার দুই ফুপুর খবর জানতে পারেনি কেউ। তাদের দুজনকেই অত্যন্ত ভালোবাসতোম আমি, কী সুন্দরী ছিলেন তারা… এই পর্যায়ে এসে একের পর এক অভিযোগের তীর ছোঁড়া থামাতে বাধ্য হলো উটেরিক। নিজের নিঃশ্বাস স্বাভাবিক করল সে প্রাণপণ চেষ্টায়, কোনোমতে আগের সেই নির্লিপ্ত ভাবটা ফিরিয়ে আনতে চাইল। কিন্তু হুরোতাসের দিকে তুলে রাখা তার কম্পিত আঙুল একটুও নিচু হলো না।

 মহামান্য ফারাও… সামনে এগিয়ে এসে বললাম আমি, দুই হাত দুদিকে ছড়িয়ে দিয়ে তার উন্মত্ত অকারণ ক্রোধ প্রশমিত করার চেষ্টা করছি। কিন্তু ফলশ্রুতিতে একই রকম রাগ নিয়ে এবার আমার দিকে ফিরল ফারাও উটেরিক।

আর তুমি, বিশ্বাসঘাতক কুকুর! আমার বাবা আর তার সকল মন্ত্রীকে তুমি ধোকা দিতে পারো; কিন্তু আমি তোমাকে কোনো দিন বিশ্বাস করিনি। তোমার কোনো দুরভিসন্ধি বা ষড়যন্ত্র কখনো আমার চোখকে ফাঁকি দিতে পারেনি। তোমার আসল পরিচয় আমি সেই শুরু থেকেই জানতাম। তুমি একটা দু-মুখো সাপ, মিথ্যেবাদী, কুচক্রী শয়তান… পাগলের মতো চিৎকার করে উঠল সে, প্রহরীদের সন্ধানে এদিক-ওদিক তাকাল। এদের গ্রেপ্তার করো। বিশ্বাসঘাতকতার দায়ে ওদের মৃত্যুদণ্ড দেব আমি…

হঠাৎ যেন শক্তি হারিয়ে ফেলল ফারাওয়ের গলা। রাজকীয় দরবার কক্ষে নেমে এলো অটুট নিস্তব্ধতা।

কোথায় আমার দেহরক্ষীরা? মেয়েদের মতো তীক্ষ্ণ গলায় বলে উঠল উটেরিক। তার কিশোর সঙ্গীরা সবাই গিয়ে সিংহাসনের পেছনে জড়ো হয়েছে, সবার চেহারা ফ্যাকাশে, ভয়ার্ত। শেষ পর্যন্ত যাকে আনেন্ত নামে ডেকেছিল উটেরিক সেই ছেলেটা কথা বলে উঠল।

তোমার রক্ষীদের তুমি নিজেই বিদেয় করে দিয়েছিলে প্রিয়। এখন আবার আমাকে বোলো না কাউকে গ্রেপ্তার করতে, বিশেষ করে এই দুই গুণ্ডাকে তো একেবারেই নয়। দেখেই মনে হচ্ছে ঠাণ্ডা মাথার খুনি এরা। ঘুরে দাঁড়িয়ে পেছনের দরজার পর্দা সরিয়ে ওপাশে অদৃশ্য হয়ে গেল সে। সাথে সাথে তার পিছু নিয়ে বাকি ছেলেগুলোও বেরিয়ে গেল।

আমার প্রহরীরা কোথায়? সবাই কোথায় গেল? কাঁদো কাঁদো হয়ে এলো ফারাওয়ের গলা, যেন এখনই মাফ চাইতে শুরু করবে কারো কাছে। ওদের বলেছিলাম গ্রেপ্তার করার জন্য প্রস্তুত হয়ে অপেক্ষা করতে। এখন কোথায় গেল সব? কিন্তু কেউ তার কথার জবাব দিতে এগিয়ে এলো না। আমাদের দুজনের দিকে তাকাল সে ভয়ার্ত চোখে, দেখল আমাদের বর্ম পরা শরীর, শক্ত হাতের মুঠোতে ধরা তলোয়ারের বাট, গম্ভীর চেহারা। সিংহাসন থেকে নেমে পর্দায় ঢাকা দরজার দিকে পিছু হঠতে শুরু করল সে। দ্রুত পায়ে তার দিকে এগিয়ে গেলাম আমি। সাথে সাথে প্রচণ্ড ভয়ে বিকৃত হয়ে উঠল ফারাওয়ের চেহারা। ধপ করে আমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল সে। দুই হাত সামনে বাড়িয়ে রেখেছে, যেন আমার তলোয়ারের আঘাত ঠেকাতে চায়।

টাইটা, প্রিয় টাইটা, আমি তো স্রেফ ঠাট্টা করছিলাম তোমার সাথে। একটু মজা করছিলাম শুধু, তোমার কোনো ক্ষতি করার ইচ্ছে ছিল না আমার। তুমি তো আমার বন্ধু, আমার পরিবারের রক্ষাকর্তা। দয়া করে আমাকে মেরো না। তুমি যা বলবে তাই করব আমি… তার পরেই ঘটল সেই আশ্চর্য ঘটনা। মলত্যাগ করে ফেলল উটেরিক। কাজটা সে এমন জোরালো আওয়াজ আর দুর্গন্ধের সাথে করল যে, এক মুহূর্তের জন্য স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম আমি। একেবারে যেন জমে গেছি, সামনে এগোনোর জন্য শূন্যে পা তুলেছি ঠিকই কিন্তু নামাতে আর মনে নেই।

আমার পেছনে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল হুরোতাস। রাজকীয় সম্মান, টাইটা! মিশরের মহাশক্তিমান শাসক তোমাকে এই রাজ্যের সর্বোচ্চ সম্মানে ভূষিত করেছেন!

হুরোতাসের সাথে সাথে নিজেও হাসিতে ফেটে পড়ার হাত থেকে অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিলাম আমি, যদিও কাজটা কীভাবে করতে পারলাম আমার জানা নেই। কোনোমতে চেহারা ভাবলেশহীন রেখে সামনে এগিয়ে গেলাম। আমার তলোয়ারের আঘাত ঠেকানোর জন্য ফারাওয়ের সামনে বাড়িয়ে রাখা হাতগুলোর একটা শক্ত করে ধরলাম, তারপর তাকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করলাম। মৃদু গলায় বললাম, আহা, ফারাও উটেরিক টুরো। আপনাকে অনেক বড় দুরবস্থার মাঝে ফেলে দিয়েছি। কিন্তু মহান দেবতা হোরাস সাক্ষী, এমন কিছু করার ইচ্ছে মোটেও ছিল না আমার। এখনই নিজের কামরায় চলে যান, গোসল করে নিন। পরিষ্কার কাপড় পরুন। তবে তার আগে আমাকে এবং রাজা হুরোতাসকে অনুমতি দিন আমরা যেন আপনার সেনাবাহিনীকে নিয়ে উত্তরে নদী-অববাহিকার দিকে রওনা দিতে পারি, আক্রমণ করতে পারি হিকসসদের স্বঘোষিত রাজা খামুদির ওপর। জন্মভূমির বুক থেকে হিকসস হানাদার নামের ওই অভিশাপকে চিরতরে দূর করার শপথ নিয়েছি আমরা। আমার কাছ থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিল উটেরিক, পিছিয়ে গেল কয়েক পা। এখনো ভয়ার্ত হয়ে আছে তার চেহারা। জোরে জোরে কয়েকবার মাথা ঝকাল সে, ফোঁপাতে ফোঁপাতে কাঁপা গলায় বলল হা! হা! এখনই যাও! অনুমতি দিচ্ছি তোমাদের। তোমার যা কিছু দরকার, যাকে যাকে দরকার সবাইকে নিয়ে যাও। তাড়াতাড়ি যাও! বলেই ঘুরে দাঁড়াল সে, এক দৌড়ে বেরিয়ে গেল রাজকীয় দরবার থেকে। প্রতিবার পা ফেলার সাথে সাথে তার জুতো থেকে ফুচুত ফুচুত শব্দ হতে লাগল।

.

দরবার কক্ষ থেকে বের হয়ে এসে শহরের নির্জন রাস্ত গুলোতে ফিরে এলাম আমি আর রাজা, হুরোতাস। যদিও অভিযানের পরবর্তী ধাপে এখনই পা দেব কি না বুঝে উঠতে পারছি না; কিন্তু এটাও চাইছি না যে গুপ্তচরদের মুখে আমাদের তাড়াহুড়ো করে লুক্সর ছাড়ার খবর পৌঁছাক ফারাওয়ের কানে। নিশ্চয়ই আশপাশের বাড়িঘর আর অলিগলিতে এমন অনেক চরই লুকিয়ে আছে, নজর রাখছে আমাদের ওপর। তাই বাধ্য হয়েই ধীর পদক্ষেপে সামনে এগোলাম আমরা। শেষ পর্যন্ত যখন শহরের বিজয়দ্বার নামক ফটক দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম, দেখলাম আমাদের যৌথ সেনাবাহিনী তখনো আমাদের অপেক্ষায় রয়েছে।

পরে শুনেছিলাম সৈনিকদের মাঝে নাকি নানা রকম গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল, এবং আমরা শহরের মাঝে যত বেশি সময় ছিলাম ততই সেই গুজবের মাত্রা বাড়ছিল। কেউ কেউ এমনকি এটাও বলছিল যে, আমাদের দুজনকে বানোয়াট অভিযোগের ভিত্তিতে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, প্রথমে ভূগর্ভস্থ কারাগার এবং পরে অত্যাচারের কক্ষে পাঠানো হয়েছে। আমাদের প্রত্যাবর্তনে পোড় খাওয়া সব সৈনিকের মাঝে যে উষ্ণ প্রতিক্রিয়া দেখলাম তা সত্যিই আমার এবং রাজা হুরোতাসের হৃদয় ছুঁয়ে গেল। বৃদ্ধ সৈনিক থেকে শুরু করে তরুণ পদাতিক সবার চোখে অশ্রু নামল, আমাদের নামে জয়ধ্বনি দিতে দিতে গলা ভেঙে ফেলল সবাই। সৈন্যদের মাঝ থেকে সামনের সারিগুলো এগিয়ে এলো। আমাদের বরণ করতে, কেউ কেউ তো হাঁটু গেড়ে বসে আমাদের পায়ে চুমুই খেয়ে বসল।

তার পরেই আমাদের কাঁধে তুলে নিল তারা, নীলনদের তীরে নিয়ে গেল। সেখানে ল্যাসিডিমনের নৌবাহিনী সদলবলে নোঙর করেছে। তারস্বরে বিজয়ের গান গাইতে লাগল সবাই, আমার এবং হুরোতাসের কান প্রায় বধির হয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত থামার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না কারো মাঝে। স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছি, নতুন ফারাওয়ের শিশুসুলভ আচরণ নিয়ে খুব বেশি মাথা ঘামাইনি আমি, কারণ তার চাইতে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ চিন্তা কাজ করছিল আমার মাথায়। আমি ভেবেছিলাম হুরোতাস এবং আমি নিশ্চয়ই ফারাওয়ের মাথায় যথেষ্ট পরিমাণ বিচারবুদ্ধি ঢোকাতে সক্ষম হয়েছি এবং এর পরে আর তার পক্ষ থেকে তেমন কোনো ঝামেলা হবে না।

ল্যাসিডিমন নৌবাহিনীর প্রধান জাহাজে উঠলাম আমরা। সেখানে আমাদের স্বাগত জানাল নৌ-সেনাপতি অ্যাডমিরাল হুই। যদিও বিক্ষুব্ধ দিনটা তখন প্রায় শেষের পথে, আঁধার নেমে এসেছে দিগন্তে। কিন্তু প্রায় সাথে সাথেই হিকসসদের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযানের সর্বশেষ অধ্যায়ের পরিকল্পনায় লেগে পড়লাম আমরা। এবার যুদ্ধ হবে নীলনদের উত্তর অববাহিকায় ঘাঁটি গেড়ে বসা অবশিষ্ট যত হিকসস আছে তাদের রাজা খামুদির বিরুদ্ধে। আমরা যেখানে আছি সেখান থেকে আরো ভাটিতে, মেফিসে নিজের রাজধানী গড়েছে খামুদি। তার সেনাবাহিনী সম্পর্কে বিস্তারিত এবং সর্বশেষ তথ্যের ভাণ্ডার রয়েছে আমার কাছে। মিশরের মাঝে হিকসস অধ্যুষিত এবং দখলকৃত এলাকাগুলোয় বেশ পোক্ত অবস্থানে রয়েছে আমার গুপ্তচররা।

চরদের মতে পুরো উত্তর মিশর থেকে প্রায় সকল সৈনিক এবং রথকে সরিয়ে নিয়ে তাদের দক্ষিণে পাঠিয়েছে খামুদি, ইচ্ছা যে মিশরীয় শক্তির ওপর মরণ আঘাত হেনে তাদের চিরতরে দূর করে দেবে। কিন্তু আগেই বলেছি আমি, রাজা হুরোতাসের সময়োচিত আবির্ভাবে ছেদ ঘটেছে খামুদির সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনায়। হিকসস বাহিনীর বিরাট বড় এক অংশ এখন লুক্সরের সামনের গিরিপথে মৃত অবস্থায় পড়ে আছে, শেয়াল-শকুনের খাবার হচ্ছে। মিশরের বুকে হিকসস নামের দুঃস্বপ্নের চিরতরে অবসান ঘটানোর জন্য এই মুহূর্তের চাইতে সঠিক সময় আর আসবে না।

হিকসস সেনাবাহিনীর যে সামান্য পদাতিক এবং অশ্বারোহী সৈন্য বাকি আছে তারা সবাই এখন নীলের উত্তর অববাহিকায় খামুদির রাজধানী শহর মেফিসে। সব মিলিয়ে তাদের সংখ্যা তিন হাজারের বেশি হবে না। ওদিকে হুরোতাস এবং আমার অধীনে রয়েছে সব মিলিয়ে এর প্রায় দ্বিগুণ সৈন্য, তার সাথে কয়েক শ রথ। তবে এগুলোর প্রায় সবই ল্যাসিডিমন থেকে আগত, ফলে আমি নিজে মিশরের এবং খুব সম্ভব সভ্য পৃথিবীর সবচেয়ে দক্ষ এবং অভিজ্ঞ সেনানায়ক হওয়া সত্ত্বেও সৌজন্যবোধের খাতিরে ঠিক করলাম যে, আমাদের যৌথ বাহিনীর দায়িত্ব রাজা হুরোতাসকেই দেওয়া ঠিক হবে। আমাদের আক্রমণের দ্বিতীয় পর্যায় কেমন হবে সেটা হুরোতাসকে নির্ধারণ করার আমন্ত্রণ জানালাম আমি। এর মাধ্যমেই প্রকাশিত হলো প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব থেকে আমার অব্যাহতি নেওয়ার ইচ্ছা, সরাসরি আর মুখে বলা লাগল না আমাকে। কিন্তু হুরোতাসের মুখে সেই ছেলেমানুষি হাসিটা ফুটল আমার কথায়, বহু বছর আগে যে হাসি দেখতাম ওর মুখে। বলল, আদেশের কথা যদি বলো, কেবল একজনের সামনেই মাথা নত করতে রাজি আছি আমি। আর সেই মানুষটা এই মুহূর্তে এই টেবিলে আমার সামনেই বসে আছে। দয়া করে বলো টাইটা। তোমার যুদ্ধ পরিকল্পনার কথা শোনাও আমাদের। তোমার নেতৃত্বেই সামনে এগিয়ে যাব আমরা।

ওর বিচক্ষণ সিদ্ধান্তে খুশি হয়ে মাথা কঁকালাম আমি। হুরোতাস কেবল সাহসী যোদ্ধাই নয়, ওর বিচক্ষণতা কখনো অহংকারের সামনে পরাজিত হয় না। সুতরাং পরবর্তী প্রশ্নগুলো ওর উদ্দেশ্যে ছুঁড়তে শুরু করলাম এবার তাহলে এবার বলো যে কীভাবে হঠাৎ করে লুক্সর এসে হাজির হলে তুমি, অথচ আমরা বা হিকসসরা- কেউই তোমার আগমনের কথা জানতে পারল না? হিকসস দুর্গ আর প্রাচীরঘেরা শহরের পাশ দিয়ে নদীর উজানে শত শত লিগ পথ পাড়ি দিয়ে বিশটা বড় বড় যুদ্ধজাহাজ নিয়ে কীভাবে এসে পৌঁছালে আমাদের কাছে?

মামুলি ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকিয়ে আমার প্রশ্নটা উড়িয়ে দিল হুরোতাস। পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কিছু সারেংকে আমি আমার জাহাজগুলোতে নিয়োগ দিয়েছি টাইটা। যদিও তোমার কাছে তাদের যোগ্যতা কিছুই নয়। নীলনদের মুখে প্রবেশ করার পর কেবল রাতের বেলায় জাহাজ চালিয়েছি আমরা, দিনের বেলায় নদীর কিনারে নোঙর করে গাছের ডাল কেটে তাই দিয়ে ঢেকে রেখেছি নিজেদের। সৌভাগ্যক্রমে আকাশের দেবী নুট সেই সময়টায় চাঁদকে ছোট রেখেছিলেন, যাতে আমরা চলাচল কারো চোখে না পড়ে। মাঝরাতের পরে নদীর তীরে অবস্থিত শত্রুদের দুর্গ পার হয়েছি আমরা এবং সব সময় মাঝ নদীতে থেকেছি। কয়েকজন জেলে হয়তো আমাদের দেখে থাকবে তবে অন্ধকারে নিশ্চয়ই আমাদের হিকসস বলে ধরে নিয়েছে তারা। এবং অত্যন্ত দ্রুত ছিল আমাদের গতি। নীলনদের মুখ থেকে রওনা দিয়ে তোমাদের সাথে যেখানে দেখা হলো সে পর্যন্ত আসতে মাত্র ছয় রাত গায়ের জোরে দাঁড় টেনেছে আমার মাল্লারা।

তার মানে ওদের চমকে দেওয়ার যে সুবিধাটা সেটা এখনো আমাদের হাতে আছে, আনমনে বলে উঠলাম আমি। গিরিপথের যুদ্ধে কিছু শত্রু যদি বেঁচে গিয়েও থাকে যদিও সেটা একেবারেই অসম্ভব- হেঁটে মেসি ফিরে সবাইকে সতর্ক করতে বেশ কয়েক সপ্তাহ সময় লাগবে ওদের। লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে ডেকের ওপর পায়চারি করতে লাগলাম আমি। এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে ব্যাপারটা সেটা হলো আমরা যখন খামুদির রাজধানীতে আক্রমণ চালাব তখন কোনো শত্রুকে পালাতে দেওয়া যাবে না। যদি ওরা পালিয়ে গিয়ে সুয়েজ আর সিনাই-এর সীমান্ত পর্যন্ত চলে যেতে পারে এবং সেখান থেকে আরো পুবে ওদের জন্মভূমিতে পৌঁছে যায় তাহলে কয়েক বছর পর নতুন করে দল গঠন করে আবার আমাদের ওপর হামলা চালাতে ফিরে আসবে। সে ক্ষেত্রে যুদ্ধ, পরাজয় আর ক্রীতদাসে পরিণত হওয়ার এই অভিশপ্ত চক্র চলতেই থাকবে।

ঠিক বলেছ টাইটা, আমার কথায় সম্মতি প্রদান করল হুরোতাস। এর শেষ দেখতে হবে। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সদস্যরা যেন পৃথিবীর সবচেয়ে সভ্য জাতি হিসেবে শান্তিপূর্ণভাবে বেঁচে থাকতে পারে, তাদের জন্য যেন কোনো হিকসস হুমকি না থাকে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু গল্পের এমন শুভ সমাপ্তি কীভাবে লিখব আমরা? আমার মনে হয় রথ বাহিনীকে পুব সীমান্তে মোতায়েন করা উচিত, যাতে বেঁচে যাওয়া কোনো হিকসস তাদের প্রাচীন জন্মভূমিতে ফিরে গিয়ে নিরাপত্তা খুঁজে নিতে না পারে, বললাম আমি।

কয়েক মুহূর্তের জন্য আমার প্রস্তাবটা নিয়ে চিন্তা করল হুরোতাস, তার পরেই হঠাৎ হাসি ফুটল তার মুখে। তোমাকে পেয়ে আমরা সত্যিই সৌভাগ্যবান টাইটা। নিঃসন্দেহে আমার পরিচিত যত দক্ষ এবং অভিজ্ঞ রথচালক আছে তাদের মাঝে তুমিই সেরা। তুমি যদি সীমান্তে পাহারা দেওয়ার দায়িত্ব নাও তাহলে একটা হিকসস কুকুরও যেন তার খোয়াড়ে ফিরে যেতে না পারে সেটা আমি অনায়াসে নিশ্চিত করতে পারব।

মাঝে মাঝে আমার সন্দেহ হয়, আমার পুরনো বন্ধু হুরাতাস বোধ হয় প্রশংসার ছলে আমাকে নিয়ে মজা করে। তবে সাধারণত যেটা হয়, আমি কিছু বলি না। এবারও তার ব্যতিক্রম হলো না।

ওদিকে প্রায় মধ্যরাত গড়িয়ে গেছে; তবে অন্ধকারের কারণে আমাদের যাত্রার প্রস্তুতি নিতে কোনো অসুবিধা হলো না। মশাল জ্বালিয়ে নিলাম আমরা, তারপর সেই আলোয় সবগুলো রথকে তুলে নিলাম ল্যাসিডিমন থেকে আসা জাহাজগুলোতে। তারপর জাহাজে উঠল আমাদের সৈন্যরা, তাদের সঙ্গে থাকল মিশরীয় সৈন্যদের মাঝ থেকে মুষ্টিমেয় কিছু অংশ, যারা যুদ্ধে বেঁচে গেছে।

বাড়তি ওজন বইতে হওয়ায় জাহাজগুলো এত বেশি ভরে গেল যে ঘোড়াগুলোকে তোলার কোনো উপায় থাকল না। তাই যাদের ওপর প্রাণীগুলোর দায়িত্ব ছিল তাদের নির্দেশ দিলাম নীলনদের পুব তীর ধরে জাহাজবহরের সাথে সাথে ওগুলোকে নিয়ে যেতে। তারপর অন্ধকার থাকতে থাকতেই নোঙর তুললাম আমরা, ভাটি ধরে এগিয়ে চললাম হিকসস এলাকার দিকে। নদীর বাঁক এবং মোড়গুলোতে আসার সাথে সাথে সাবধান করে দিতে লাগল সারেং, প্রধান মাল্লার কণ্ঠে ধ্বনিত হলো ছন্দময় সংগীত। নদীর তীরে হালকা চালে ছুটে চলা ঘোড়াগুলো প্রায় বহরের সাথে সাথেই রইল, যদিও আমাদের জাহাজগুলো স্রোতের দিকে চলছে বলে বেশ দ্রুত গতিতে ছোটার সুযোগ পাচ্ছে।

.

সূর্য ওঠার আগেই প্রায় ত্রিশ লিগ পথ পাড়ি দিলাম আমরা। সূর্য উঠলে তীরে নোঙর ফেললাম, উদ্দেশ্য দিনের মাঝে সবচেয়ে গরম সময়টা বিশ্রাম নিয়ে কাটাব। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ঘোড়ার পালগুলো যোগ দিল আমাদের সাথে, নদীর তীরে জন্মানো ফসল আর শস্যের ক্ষেতে নেমে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেতে শুরু করল।

এসব ফসল লাগিয়েছে হিকসস চাষিরা। এখন শত্রু এলাকায় রয়েছি আমরা। চাষিদের প্রথমে তাদের উদারতার জন্য ধন্যবাদ জানানো হলো, তারপর পাঠিয়ে দেওয়া হলো অ্যাডমিরাল হুইয়ের জাহাজগুলোতে। সেখানে দাঁড় টানার কাজে লাগিয়ে দেওয়া হলো তাদের, মাল্লাদের নির্দিষ্ট জায়গায় বসিয়ে পায়ে বেঁধে দেওয়া হলো ক্রীতদাসের শিকল। মেয়েদের তুলে দেওয়া হলো হুরোতাসের সৈন্যদের হাতে। তবে তাদের কপালে কী ঘটল তা আর জানার চেষ্টা করলাম না আমি। যুদ্ধ মানেই নিষ্ঠুরতা। বিনা আমন্ত্রণেই আমাদের দেশে পা রেখেছে ওরা, আমাদের চাষিদের কাছ থেকে ফসলি জমি ছিনিয়ে নিয়ে তাদের ক্রীতদাস বানিয়েছে। এখন আমাদের কাছ থেকে এর চাইতে ভালো আচরণ ওরা কীভাবে আশা করে?

সব কাজ শেষ হওয়ার পর নদীর তীরে জন্মানো ডুমুর গাছগুলোর ছায়ায় বসলাম আমরা। বাবুর্চিরা নাশতা দিয়ে গেল; আগুনে ঝলসানো মাংস আর মাটির চুলায় তৈরি করা মচমচে বাদামি রুটি। সদ্য প্রস্তুত বিয়ার সহযোগে উদরপূর্তি করলাম আমরা। মনে হলো এমন তৃপ্তিসহকারে খাওয়ার জন্য আমি এমনকি ফারাওয়ের সাথে রাজকীয় ভোজে বসার সুযোগও ছেড়ে দিতে রাজি আছি। সূর্য পশ্চিম দিকে হেলে পড়তে শুরু করার সাথে সাথে জাহাজে উঠলাম আমরা। আবার শুরু হলো মেফিসের উদ্দেশ্যে আমাদের উত্তরমুখী যাত্রা। তবে এখনো প্রায় দুই দিন এভাবে চলতে হবে আমাদের। ওদিকে হুই আর হুরোতাসের অপ্রত্যাশিত প্রত্যাবর্তনের পর এই প্রথম ওদের সাথে আমাদের ফেলে আসা জীবন নিয়ে আলাপ করার সুযোগ পেলাম আমি। সত্যি কথা বলতে, আমি আসলে সেই দুই রাজকুমারীর খবর জানার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছি; ফারাও টামোসের ক্রোধ থেকে পালানোর সময় যাদের নিজেদের সাথে নিয়ে গিয়েছিল হুই আর হুরোতাস।

জাহাজের পেছনের ডেকে বসে ছিলাম আমরা। তিনজন বাদে আর কেউ নেই আশপাশে, নাবিকদের কারো আড়ি পেতে শোনার সম্ভাবনাও নেই। এবার দুজনকে উদ্দেশ্য করে কথা বলতে শুরু করলাম আমি।

তোমাদের দুজনকে আমি এমন কিছু প্রশ্ন করতে চাই, যেগুলোর উত্তর তোমরা দিতে চাইবে বলে মনে হয় না। তোমাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, আমার তত্ত্বাবধান থেকে ফারাও টামোসের দুই অল্পবয়স্ক কুমারী বোনদের চুরি করে নিয়ে গিয়েছিলে তোমরা, যাদের জন্য অনেক বেশি ভালোবাসা ছিল আমার মনে?

তোমার মাথায় যে শুধু নোংরা চিন্তাভাবনা চলে সেটা আমি জানি টাইট। আশা করা যায় আমার কথা শুনলে সেই চিন্তাগুলো দূর হয়ে যাবে, আমার প্রথম প্রশ্নটা পুরো না শুনেই বলে উঠল হুরোতাস। এখন আর ওরা অল্পবয়স্ক নয়, কুমারীও নয়।

হেসে উঠে সম্মতি জানাল হুই। তবে হ্যাঁ, প্রত্যেকটা বছরই যেন ওদের প্রতি আমাদের ভালোবাসা আরো বেশি বেড়ে চলেছে। তারা দুজনই তুলনীয় রকমের অভিজাত সত্যবাদী এবং উর্বর। আমার বেকাথা চারটে পুত্রসন্তান উপহার দিয়েছে আমাকে।

আর তেহুতি আমাকে উপহার দিয়েছে একটি কন্যা, যার সৌন্দর্যের কথা ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়, জোর গলায় বলে উঠল হুরোতাস। তবে তার মতামত নিয়ে আমার মনে কিছুটা সন্দেহ কাজ করল, কারণ আমি জানি যে প্রতিটি মা-বাবাই তাদের সন্তান সম্পর্কে অনেক লম্বা চওড়া ধারণা পোষণ করতে ভালোবাসে। আরো অনেক পরে যখন আমি প্রথমবারের মতো হুরোতাস আর তেহুতির একমাত্র কন্যাকে সচক্ষে দেখি; কেবল তখনই বুঝতে পেরেছিলাম যে নিজের মেয়ে সম্পর্কে আসলে কিছুই বাড়িয়ে বলেনি হুরোতাস। তেহুতি বা বেকাথা তোমাদের কাছে আমার জন্য কোনো চিঠি দিয়েছে বলে তো মনে হয় না, কণ্ঠস্বর থেকে উদাস অবটা লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করলাম আমি। আমাদের যে আবার দেখা হবে এমন সম্ভাবনা তো ছিল না বললেই চলে, তা ছাড়া এতগুলো বছর পর আমার কথা কি আর ওদের মনে আছে… আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই হাসিতে ফেটে পড়ল হুই আর হুরোতাস।

তোমাকে ভুলে যাবে ওরা? হাসির দমক কোনোমতে থামিয়ে প্রশ্ন করল হুরোতাস। তুমি কি জানো আমার স্ত্রী যেন ল্যাসিডিমন ছেড়ে মিশরে এসে তার প্রিয় টাটাকে খুঁজতে শুরু না করে সেটা নিশ্চিত করতে কত কষ্ট করতে হয়েছে আমাকে? তেহুতি আমাকে আদর করে যে নামে ডাকত সেই একই নাম হুরোতাসের মুখে শুনে লাফ দিয়ে উঠল আমার বুকের ভেতরে। ওর কথাগুলো আমি মুখস্থ করে তোমার কাছে পৌঁছে দিতে পারব কি না এটা নিশ্চিত হতে পারেনি তেহুতি। তাই তার বদলে সব কথা প্যাপিরাসে লিখেছে, আমাকে বলেছে যেন তোমার হাতে তুলে দিই সেই চিঠি।

প্যাপিরাস? আনন্দে প্রায় চেঁচিয়ে উঠলাম আমি। কোথায় সেটা? দাও আমাকে, এখনই!

আমাকে ক্ষমা করে দাও টাইটা। লজ্জিত দেখাল হুরোতাসকে। কিন্তু চিঠিটা এত ভারী হয়ে গিয়েছিল যে কিছুতেই বহন করা যাচ্ছিল না। ভাবছিলাম ল্যাসিডিমনেই রেখে আসব কি না। চোখে যুগপৎ বিস্ময় আর রাগ নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম আমি, ঠিক কীভাবে ধমকালে ওর উপযুক্ত শাস্তি হবে তাই ঠিক করার চেষ্টা করছি। তবে বেশিক্ষণ আমাকে কষ্টে রাখল না হুরোতাস, অথবা বলা যায় রাখতে পারল না। নিজেকে সামলাতে না পেরে হো হো করে হেসে উঠল সে। আমি তো জানতাম এমন কাজ করলে তুমি আমাকে কী করবে টাইটা! তাই চিঠিটা আমার ব্যক্তিগত জিনিসপত্রের সাথে নিয়ে এসেছি। এখন আমার কামরায় আছে সেটা।

ওর কাঁধে ঘুষি মারলাম আমি, প্রয়োজনের চাইতে একটু বেশিই জোরে। এখনই নিয়ে এসো ওটা বদমাশ! না হলে কখনো তোমাকে ক্ষমা করব না আমি। ডেকের নিচে চলে গেল হুরোতাস, ফিরে এলো প্রায় সাথে সাথেই। সাথে রয়েছে প্যাপিরাসের বেশ ভারী একটা চিঠি। সেটা প্রায় ছোঁ মেরে ওর হাত থেকে ছিনিয়ে নিলাম আমি, তারপর সামনের ডেকে চলে গেলাম। এখানে একাকী থাকা যাবে কিছুক্ষণ, নির্বিঘ্নে পড়া যাবে চিঠিটা।

আমার পরিচিতদের মাঝে সবচেয়ে সুন্দরভাবে হায়ারোগ্লিফ আঁকতে পারে আমার প্রিয় তেহুতি। আমার প্রতীক ভাঙা ডানার বাজপাখির ছবিটা এত সুন্দর করে এঁকেছে সে, মনে হচ্ছে যেন ওটা ছবি নয়, রক্ত-মাংসের তৈরি। এখনই প্রাণ ফিরে পাবে, তারপর প্যাপিরাসের ওপর থেকে উঠে আমার চোখে জমা হওয়া নোনা কুয়াশার মাঝ দিয়ে উড়ে প্রবেশ করবে আমার হৃদয়ে।

যে কথাগুলো তেহুতি লিখেছিল সেগুলো আমাকে এতই স্পর্শ করেছে যে, আর কখনো কোনো জীবিত প্রাণীর কাছে সেগুলো দ্বিতীয়বার উচ্চারণ করার কথা আমি ভাবতেও পারব না।

.

লুক্সর ছেড়ে আসার পর তৃতীয় দিন সকালে আমাদের নৌবহর এমন একটা জায়গায় এসে পৌঁছাল যেখান থেকে হিকসসদের দখলে থাকা মেম্ফিস শহর মাত্র বিশ লিগ উজানে। শহরটা নদীর দুই তীর জুড়ে অবস্থিত। এখানে আমাদের জাহাজগুলো চড়ায় তুলে রাখলাম আমরা, তারপর রথগুলো নামিয়ে ফেললাম। রাখালরা ঘোড়াগুলো তাড়িয়ে এনে নির্দিষ্ট দল অনুযায়ী ভাগ করে ফেলল। রথচালকরা রথের সাথে জুড়ে নিল নিজ নিজ ঘোড়াগুলোকে।

ল্যাসিডিমন বাহিনীর প্রধান জাহাজে শেষবারের মতো একবার পরামর্শে বসলাম আমরা তিনজন। এখানে আরো একবার আমাদের পরিকল্পনার সকল পুঙ্খানুপুঙ্খ ব্যাপারগুলো আলোচনা করা হলো, মেসি আক্রমণের সময় সম্ভাব্য সকল ঝামেলা থেকে বাঁচার উপায় ঠিক করে রাখা হলো। তারপর হুই আর হুরোতাসের কাছ থেকে বিদায় নিলাম আমি, তবে তার আগে তাদের দুজনকেই পালা করে জড়িয়ে ধরে তাদের ওপর সকল দেবতার আশীর্বাদ চেয়ে নিতে ভুললাম না। এবার নিজের রথ বাহিনী নিয়ে রওনা দিলাম লোহিত সাগরের মুখ বরাবর জায়গাগুলো অবরোধ করতে, যাতে হিকসস বাহিনী মিশর থেকে পালানোর পথ না পায়। ওরা চলে গেল আরো উত্তরে, যেখান থেকে হিকসসদের রাজা খামুদির ওপর চূড়ান্ত আঘাত হানাটা সহজ হবে।

মেফিস শহরের গোড়ায় অবস্থিত বন্দরে পৌঁছে হুয়োতাস আর হুই দেখতে পেল ইতোমধ্যে সেটাকে ত্যাগ করেছে খামুদি। পাথরের ঘাটে নোঙর করে থাকা সবগুলো জাহাজে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে সে। পোড়া জাহাজগুলো থেকে যে কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী উঠছিল তা এমনকি বহু লিগ দূরে সুয়েজের কাছাকাছি মিশর সীমান্তে অবস্থানরত আমার চোখেও পরিষ্কার ধরা পড়েছিল। তার পরেও প্রায় ত্রিশটি হিকসস জাহাজকে আগুনের হাত থেকে বাঁচাতে সক্ষম হলো হুরোতাস আর হুই। কিন্তু জাহাজগুলো চালানোর মতো পর্যাপ্ত নাবিক নেই আমাদের কাছে।

এবং এখানেই আমার রথ বাহিনী কাজে লাগল। সুয়েজ এবং সিনাইয়ের মাঝে মিশর সীমান্তে অবস্থান নেওয়ার কয়েক ঘণ্টার মাঝেই আমরা কাজে নেমে পড়লাম, পরাজিত শহর মেফিস থেকে পালিয়ে আসা শত শত শরণার্থীকে জড়ো করতে শুরু করলাম এক জায়গায়। স্বাভাবিকভাবেই এদের প্রত্যেকের কাছেই ছিল অনেক মূল্যবান জিনিস।

বন্দিদের সতর্কতার সাথে আলাদা আলাদা ভাগে ভাগ করা হলো। বৃদ্ধ এবং শিশুদের কাছ থেকে সব কিছু কেড়ে নেওয়া হলো, তারপর সিনাই মরুভূমি দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হলো। তবে তার আগে বলে দেওয়া হলো যে, এরপর আর কখনো মিশরে ফিরতে পারবে না তারা। অপেক্ষাকৃত কমবয়সী এবং শক্তিশালী যারা তাদের প্রতি দশজনকে একসাথে দড়ি দিয়ে বাধা হলো, তারপর তাদের নিয়ে আবার মেফিস এবং নীলনদের দিকে যাত্রা। শুরু করলাম আমরা। তাদের মূল্যবান জিনিসপত্রগুলো এখনো আমাদের কাছেই রয়েছে। যারা আমাদের হাতে বন্দি হয়েছে তাদের পদমর্যাদা বা সামাজিক অবস্থান যা-ই হোক না কেন, আয়ু বেশি নেই ওদের। আমাদের যুদ্ধজাহাজে শিকলে বাঁধা অবস্থায় দাঁড় টানার কাজে খুব বেশি দিন টিকতে পারবে না কেউ। আর তা না হলে নীলনদের তীরে ফসলের ক্ষেতে ভারবাহী জন্তুর মতো কাজ করতে হবে। মেয়েগুলোর মাঝে যাদের চেহারা খুব একটা খারাপ নয় তাদের পাঠিয়ে দেওয়া হবে পতিতালয়গুলোতে, আর তা না হলে আমাদের মিশরের প্রাসাদগুলোর রান্নাঘর অথবা ভঁড়ার ঘরে। পাশার দান উল্টে গেছে। ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় মিশরীয়দের সাথে যে আচরণ ওরা করেছিল এখন সেটাই ফেরত পাবে।

বন্দিদের দলগুলো নিয়ে আমরা যখন মেসি শহরে পৌঁছলাম, দেখলাম ইতোমধ্যে তাকে ঘিরে অবরোধ বসিয়েছে হুরোতাসের সৈন্যরা। রথ জিনিসটা যতই কাজের হোক, অবরোধের মতো ক্ষেত্রে খুব একটা কাজে আসবে না। তাই রথচালকদের নামিয়ে শহর প্রাচীরের নিচে সুড়ঙ্গ খোঁড়ার কাজে লাগিয়ে দেওয়া হলো। ওই পথ দিয়েই শহরে ঢুকব আমরা, খামুদি আর তার সাঙ্গোপাঙ্গদের বের করে আনব শহরের ভেতর থেকে।

আর সব অবরোধের মতোই এটাও হলো অত্যন্ত ক্লান্তিকর সময়সাপেক্ষ এক অভিযান। প্রায় ছয় মাস ধরে মেফিসের বাইরে তাঁবু খাঁটিয়ে অবস্থান নিতে বাধ্য হলো আমাদের সেনাবাহিনী। তবে ক্রমাগত সুড়ঙ্গ খোঁড়ার ফলে একদিন শহরের পুরো পুব অংশের প্রাচীর ধসে পড়ল, গুরুগম্ভীর গর্জনের সাথে সাথে ধুলোর মেঘ উড়ল আকাশে। বহু দূর থেকে দেখা গেল সেই ধুলো। ধসে পড়া অংশের ফাঁকা জায়গা দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল আমাদের লোকেরা।

আরো অনেক দিন লাগল শহরকে সম্পূর্ণ শত্রুমুক্ত করতে, কারণ শহরটা নদীর দুই তীরেই বিস্তৃত। তবে শেষ পর্যন্ত আমাদের বিজয়ী বাহিনী খামুদির আস্তানা খুঁজে বের করতে সক্ষম হলো। নিজের প্রাসাদের নিচে এক গুপ্তঘরে পরিবারকে নিয়ে লুকিয়ে বসে থরথর করে কাঁপছিল খামুদি। সৌভাগ্যক্রমে আমরা আবিষ্কার করলাম, সোনা আর রুপার এক বিশাল সম্পদের ভাণ্ডারের ওপর বসে আছে তারা। তার সাথে আরো রয়েছে দামি গহনাভর্তি অসংখ্য বড় বড় সিন্দুক। মিশরীয় জনগণের কাছ থেকে প্রায় এক শতাব্দী সময় নিয়ে এই বিশাল সম্পদ ছিনিয়ে নিয়েছে খামুদি আর তার বাপ-দাদারা। এবার খামুদি আর তার সঙ্গের সবাইকে নীলনদের তীরে বন্দরের ওপর নিয়ে এলো হুরোতাসের সৈন্যরা। এখানে গান আর হাসিঠাট্টার শব্দের সাথে সাথে তাদের এক এক করে পানিতে ডুবিয়ে মারা হলো। সবার আগে মারা হলো পরিবারের সবচেয়ে ছোট সদস্যকে।

পরিবারের মাঝে বয়স সবচেয়ে কম ছিল দুই যমজ শিশুর, বয়স হবে দুই কি তিন বছর। অবাক হয়ে আমি আবিষ্কার করলাম, হিকসস উপজাতির অন্যদের মতো নয় এদের চেহারা, বরং বেশ সুন্দরই বলতে হবে। নীলের পানিতে ছুঁড়ে ফেলা হলো তাদের, পানির নিচে চুবিয়ে ধরে রাখা হলো। হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল খামুদি। এটার জন্যও আমি প্রস্তুত ছিলাম না। কেন যেন আমার ধারণা ছিল অসভ্য জন্তু-জানোয়ারদের মতোই হিকসসদের মাঝে ভালোবাসা বা কষ্টের কোনো চিহ্ন থাকে না।

খামুদিকে রেখে দেওয়া হয়েছিল সবার শেষে মারার জন্য। যখন তার পালা এলো, পরিবারের অন্যদের চাইতে একটু বেশি গুরুত্বের সাথে পৃথিবী ছাড়ার ব্যবস্থা করা হলো তার জন্য। প্রথমেই কয়লার আগুনে পুড়িয়ে টকটকে লাল করে তোলা ছুরি দিয়ে জ্যান্ত অবস্থায় তুলে ফেলা হলো খামুদির চামড়া। তারপর চারটে ঘোড়ার সাথে বাঁধা হলো তার চার হাত-পা, ঘোড়া দিয়ে টেনে ছিঁড়ে ফেলা হলো অঙ্গগুলো। উপস্থিত দর্শকদের সবাই উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠল। বোঝা গেল হুরোতাসের সৈন্যদের রসবোধ একটু অতিমাত্রায় চড়া।

এই ঘটনাগুলো যখন ঘটছিল তখন সম্পূর্ণ ভাবলেশহীন চেহারায় দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি। এমনিতে এই সব ব্যাপারে আমি থাকতে না পারলেই খুশি হতাম। কিন্তু আমার অনুপস্থিতিকে দুর্বলতার পরিচয় হিসেবে ধরে নিতে পারত আমার লোকেরা। মাঝে মাঝে মানুষের সশরীরে উপস্থিতি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, শুধু তাদের সুনাম তখন আর যথেষ্ট থাকে না।

.

হুরোতাস, হুই এবং আমি যখন মেসি প্রাসাদে ফিরে এলাম তখন আমরা সবাই ক্লান্ত। তবে খামুদির প্রাসাদের নিচে গুপ্তঘরে রাখা ধনসম্পদের পরিমাপ এবং তালিকা করার কাজে হাত দিতেই খুব দ্রুত স্বাভাবিক চাঙ্গা ভাব আর হালকা মেজাজ ফিরে এলো আমাদের মাঝে। মাঝে মাঝে একটা ব্যাপার আমার কাছে খুব অদ্ভুত মনে হয়। জীবনের সব কিছু, সব আশা যদি হারিয়ে যায়, কেবল স্বর্ণ একাই সেই সব কিছু ফিরিয়ে দিতে পারে।

হুরোতাসের লোকদের মাঝ থেকে সবচেয়ে বিশ্বাসী পঞ্চাশজন লোক আমাদের সাহায্য করল, তবু সব সম্পদের তালিকা গুছিয়ে আনতে কয়েক দিন সময় লেগে গেল। শেষ পর্যন্ত যখন মূল্যবান ধাতু আর রঙিন পাথরের বিশাল স্কুপের দিকে আমরা আমাদের মশালগুলো তাক করলাম মনে হলো যেন উজ্জ্বল আলোয় ধাধিয়ে যাবে আমাদের চোখ। দারুণ বিস্ময়ে হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম আমরা।

তামিয়াতের দুর্গে যে ক্রিটীয় গুপ্তধন আমরা দখল করেছিলাম তার কথা মনে আছে তোমার? মৃদু স্বরে আমাকে প্রশ্ন করল হুরোতাস।

যখন তুমি সবেমাত্র সেনাবাহিনীর এক তরুণ ক্যাপ্টেন এবং যখন তোমার নাম ছিল জারাস? সেই ঘটনার কথা কখনো ভুলব না আমি। আমার মনে হয়েছিল সমস্ত পৃথিবীতেও এই পরিমাণে সোনা এবং রুপা আছে কি না সন্দেহ।

অথচ আমাদের সামনে এখন যা রয়েছে, ওই গুপ্তধন এর দশ ভাগের এক ভাগের সমানও হবে না, বলল হুরোতাস।

তাতে তেমন কিছু আসে-যায় না, বললাম আমি।

হুরোতাস আর হুই দুজনেই অবাক হয়ে চাইল আমার দিকে। কেন টাইটা?

কারণ এই সম্পদকে আমাদের অন্তত চার ভাগে ভাগ করতে হবে, বুঝিয়ে বললাম আমি। তার পরেও যখন দুজনের চেহারা থেকে বিভ্রান্ত ভাব কাটল না তখন আরো ব্যাখ্যা করে বললাম: তুমি আর হুই, আমি এবং উটেরিক টুরো। ওই আস্ত গাড়ল উটেরিকের কথা বলছ তুমি? হুরোতাসের চেহারা দেখে মনে হলো কেউ বাড়ি মেরেছে ওর মাথায়।

ঠিক বলেছ! তাকে আশ্বস্ত করলাম আমি। মহান উটেরিক, মিশরের ফারাও। এই গুপ্তধনের আসল মালিক ছিল তার পূর্বপুরুষেরা।

আমার কথাগুলো নীরবে কিছুক্ষণ ভেবে দেখল ওরা। তারপর বেশ সতর্কতার সাথে হুরোতাস প্রশ্ন করল, তার মানে তুমি উটেরিক টুরোর রাজত্বেই থেকে যাবে বলে ঠিক করেছ?

সেটাই তো স্বাভাবিক, তাই না? প্রশ্নটা শুনে বেশ অবাক হয়ে বললাম আমি। আমি একজন মিশরীয়, অভিজাত সম্প্রদায়ের অন্তর্গত। এই দেশে আমার প্রচুর সম্পত্তি রয়েছে। আর কোথায় যাব আমি?

তাকে তুমি বিশ্বাস করো?

কাকে?

কাকে আবার, আস্ত গাড়ল উটেরিককে? বেশ জোর দিয়ে বলল হুরোতাস।

সে আমার ফারাও। অবশ্যই আমি তাকে বিশ্বাস করি।

লুক্সর যুদ্ধের সময় কোথায় ছিল তোমার ফারাও? কড়া গলায় প্রশ্ন করল হুরোতাস। কোথায় ছিল সে যখন মেফিসের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ওপর আমরা আক্রমণ চালালাম?

উটেরিক আসলে ঠিক যোদ্ধা প্রকৃতির নয়। তার মনটা খুবই নরম, ফারাওয়ের পক্ষে অজুহাত তৈরি করার চেষ্টা করলাম আমি। তবে তার বাবা টামোস ছিলেন একজন দক্ষ এবং সাহসী যোদ্ধা।

এখানে ছেলেকে নিয়ে কথা হচ্ছে, বাবাকে নিয়ে নয়, আমাকে মনে করিয়ে দিল হুরোতাস।

কিছুক্ষণ চুপচাপ ওর কথাগুলো নিয়ে চিন্তা করলাম আমি। অবশেষে প্রশ্ন করলাম, তাহলে কি আমি ধরে নিতে পারি যে আমি যখন ফারাও উটেরিক টুয়োর কাছে এই বিজয়ের খবর নিয়ে যাব তখন তুমি আমার সঙ্গী হচ্ছ না?

মাথা নাড়ল হুরোতাস। আমার মন পড়ে রয়েছে ল্যাসিডিমনে আমার রানি আর কন্যার কাছে। লুক্সরে আমার যে কাজ ছিল তা শেষ হয়েছে। তা ছাড়া ওই শহরে এখনো এমন মানুষ আছে যারা আমাকে সেই আগের জারাস বলে চিনে ফেলার ক্ষমতা রাখে। তোমার ফারাও উটেরিক টুরোর সাথে আমার মাত্র একবার দেখা হয়েছে, এবং সেই সাক্ষাতে তাকে আমার পছন্দ করার মতো কোনো মানুষ বলে মনে হয়নি। আমার মনে হয় নিজের আস্তানায় ফিরে গেলেই ভালো করব আমি। সেখানে অন্তত পরিস্থিতি আমার নিয়ন্ত্রণে থাকবে, আরেকজনের হাতে নয়। এগিয়ে এসে আমার কাঁধে চাপড় মারল সে। তুমি আমার পুরনো বন্ধু। আমরা সবাই যেমন জানি তুমি যদি সত্যিই ততটা জ্ঞানী হয়ে থাকো তাহলে এই বিশাল সম্পদে তোমার অংশটুকু আমার কাছে দিয়ে দেওয়াই উচিত হবে তোমার। তাহলে তোমার কাছ থেকে খবর পাওয়ার আগ পর্যন্ত এই সম্পদ আমি নিরাপদে রাখতে পারব এবং সম্পদ হারিয়ে ফেলার কোনো ভয় থাকবে না তোমার। যদিও আমার কেন যেন সন্দেহ হচ্ছে আমার কথা শুনলে শীঘ্রই আমাকে ধন্যবাদ জানাবে তুমি।

আমি ভেবে দেখব কথাটা, কিছুটা অনিচ্ছুক গলায় জবাব দিলাম আমি।

হুরোতাস আর হুই আরো দশ দিন রইল মেফিসে। এই সময়ের মাঝে মেসি থেকে পাওয়া সকল ক্রীতদাস আর অন্যান্য সম্পদের ভার জাহাজে তুলল তারা। তার মাঝে হিকসস গুপ্তধন থেকে পাওয়া আমার নিজের অংশও রইল। অনেক চিন্তাভাবনার পর সেগুলো হুরোতাসের জিম্মায় রাখতে সম্মত হয়েছি আমি। সব শেষে নিজেদের রথ আর ঘোড়াগুলো জাহাজে তুলল তারা। নীলনদের পশ্চিম তীরে পাথরের তৈরি জাহাজঘাটায় দাঁড়িয়ে একে অপরকে বিদায় জানালাম আমরা।

হুই এবং রাজকুমারী বেকাথার চার ছেলে আমাদের সাথে ছিল মেফিসে। প্রত্যেকে এখন একটি করে রথ বাহিনীর প্রধান। যদিও ওদের সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ তেমনভাবে পাইনি আমি; তবে মনে হয়েছে ওরা ওদের বাবা এবং মায়ের সব লক্ষণই পেয়েছে। আর তার অর্থ হচ্ছে প্রত্যেকেই সুদর্শন যুবক, সাহসী এবং দক্ষ রথচালক। সবার বড় জনের নাম হচ্ছে হুইসন, কারণটা তো নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে। বাকি তিনজন হলো সস্টেটাস, পালমিস এবং লিও। নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে নামগুলো বর্বর গ্রিক ভাষা থেকে নেওয়া। কিন্তু যেভাবে ওরা আমাকে জড়িয়ে ধরে আমাদের সম্মানিত ও সাহসী স্বজন বলে সম্বোধন করল তাতে ওদের প্রতি আমার ভালোবাসা আরো বেড়ে গেল। ল্যাসিডিমনে পৌঁছেই নিজেদের মা আর খালার কাছে আমার ভালোবাসার কথা পৌঁছে দেবে বলে আমাকে প্রতিশ্রুতি দিল ওরা।

নীলনদের অববাহিকা থেকে ল্যাসিডিমন দ্বীপ পর্যন্ত যাতায়াতের জন্য একটি অনুমতিপত্র লিখে আমার হাতে দিল হুরোতাস। তার সাথে আরো দিল মেসি থেকে পাওয়া গুপ্তধনে আমার অংশের দলিল। সেগুলো আমার হাতে খুঁজে দিয়ে বলল, এবার আশা করি প্রথম সুযোগেই আমাদের সাথে দেখা করতে যাবে তুমি, আর কোনো অজুহাত দেখাবে না। কথাগুলো বলার সময় ওর কণ্ঠস্বর ভারী হয়ে এলো, দ্বিতীয়বার আমাদের বিদায়ের মুহূর্তে কষ্ট লুকানোর চেষ্টা করছে।

ওদিকে আমি নিজেও আমার দুই প্রিয় রাজকুমারী তেহুতি এবং বেকাথার জন্য আলাদা আলাদা চিঠি লিখলাম দুটো প্যাপিরাসে। বাড়ি ফেরার সাথে সাথেই ওগুলো তাদের হাতে তুলে দেবে হুই আর হুরোতাস। এখানে আমার মুখের কথাই হয়তো যথেষ্ট হতো; কিন্তু এই দুই গুণ্ডা কথাগুলো হুবহু ওদের স্ত্রীদের মুখস্থ শোনাতে পারবে কি না তাতে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। চিঠিতে এত সুন্দর কাব্যিক অলংকার দিয়ে লিখেছিলাম আমি যে এত বছর পরেও সেগুলো নিঃশব্দে আবৃত্তি করতে গেলে পানি চলে আসে আমার চোখে।

এবার সবাই জাহাজে উঠল, ঘাট থেকে ঠেলে সরিয়ে নেওয়া হলো জাহাজ। দাঁড়িদের দাঁড় টানার সুবিধার জন্য তালে তালে বাজতে শুরু করল ঢাক। লম্বা দাঁড়গুলো ছন্দবদ্ধ তালে সাগরের বুকে উঠতে আর নামতে শুরু করল। জাহাজের সারি দেখে মনে হতে লাগল ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে কোনো বিশালাকায় সাগর দানব। নীলনদের স্রোত অনুকূলে থাকায় বেশ দ্রুতই প্রথম মোড়টা ঘুরে ওপাশে অদৃশ্য হয়ে গেল তারা। পরবর্তী গন্তব্য নদীর অববাহিকা যেখানে বিশাল ভূমধ্যসাগরে নেমে গেছে নীলনদ।

একাকী বিষণ্ণ মনে দাঁড়িয়ে রইলাম আমি।

.

তিন দিন পর আমি আমার নিজের জাহাজে উঠলাম। দক্ষিণ দিকে রওনা দিলাম আমরা, গন্তব্য এবার সেই সোনালি শহর লুক্সর, যেখানে আমাদের বাড়ি। কিন্তু আমার মনটা এখনো ভারী হয়ে আছে, মনে হচ্ছে যেন বাতাস আর দাঁড়ের টান আমাকে যেদিকে নিয়ে চলেছে তার উল্টোদিকে কোথায় যেন বাঁধা পড়ে গেছে আমার হৃদয়।

লুক্সরের শহরের গোড়ায় অবস্থিত বন্দরে যখন আমরা পৌঁছলাম, বোঝা গেল মেফিসে আমাদের বিশাল বিজয়ের খবর ইতোমধ্যে পত্রবাহী পায়রার মাধ্যমে ফারাও উটেরিকের প্রাসাদে পৌঁছে গেছে। মনে হচ্ছে যেন পুরো মিশরের জনগণ এসে হাজির হয়েছে বন্দরে এত ভিড়। তাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ফারাওয়ের প্রধান প্রধান তিনজন মন্ত্রী। জনতার ভিড়ের পেছনে দেখা যাচ্ছে। কমপক্ষে বিশটি মালবাহী গাড়ি, প্রতিটা টানার জন্য রয়েছে বারোটা করে ষাঁড়। আন্দাজ করলাম এগুলো রাখা হয়েছে হিকসসদের কাছ থেকে পুনরুদ্ধার করা সম্পদ বয়ে নিয়ে ফারাওয়ের কোষাগার পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার জন্য। সন্দেহ নেই এই সম্পদের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে কোষাগার। হার্প, বাঁশি, ট্রাম্পেট, তাম্বুরিন এবং ঢাকের মিলিত শব্দ শোনা যাচ্ছে, ফারাও উটেরিক ঢুরোর সম্মানে রচিত নতুন একটা গানের তালে বাজনা বাজাচ্ছে। তারা। গুজব ছড়িয়েছে গানটা নাকি সে নিজেই লিখেছে। উপস্থিত জনতা খুব রাখেনি। এখন সেগুলো মাথার ওপরে তুলে প্রবল উৎসাহে জোরে জোরে নাড়ছে তারা, সেইসাথে বাদকদের সাথে গলা মিলিয়ে গান গাইছে।

প্রধান ঘাটে বাঁধা হলো আমার জাহাজটা। মনে মনে ফারাও উটেরিক টুরো এবং সেইসাথে উপস্থিত বিপুল জনতার কাছ থেকে প্রশংসা এবং আন্তরিক ধন্যবাদ পাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলাম আমি। মিশরকে খামুদি আর তার উপজাতির ভয়ানক সদস্যদের হাত থেকে বাঁচানো, সেইসাথে শত্রুদের খপ্পর থেকে এই অপরিমেয় সম্পদ উদ্ধার করার পর এমনটাই তো স্বাভাবিক।

উটেরিকের প্রধানমন্ত্রী হচ্ছে সুদর্শন এক যুবক, ক্রীতদাস ব্যবসায় বিশাল লাভবান হয়েছে সে। তার নাম হচ্ছে মেনাক্ট। ফারাওয়ের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সঙ্গী ও সহযোগী সে। এবং শুধু ঘনিষ্ঠ বললে ভুল হবে, কারণ তাদের ঘনিষ্ঠতা মানসিক পর্যায় থেকে অনেক আগেই শারীরিক পর্যায়েও গড়িয়েছে। গুজব শুনেছি আমি, তাদের দুজনের মাঝেই নাকি ওই ধরনের কামুক মনোবৃত্তি আছে। তার ভাষণটা সম্ভবত কোনো কেরানি লিখে দিয়েছে, কারণ সেটা একেবারেই একঘেয়ে কণ্ঠে পড়ে গেল সে, একটু বড় শব্দ পড়তে গেলেই হোঁচট খেল বারবার। এতে হয়তো আমি তেমন কিছু মনে করতাম না; কিন্তু তার ভাষণটা শোনার সাথে সাথে একটা ব্যাপার বেশ বড় রকমের খটকা জাগিয়ে তুলল আমার মনে। হিকসসদের বিরুদ্ধে আমি সর্বশেষ যে অভিযান পরিচালনা করলাম তাতে আমার অবদানের কথা বেমালুম বাদ দিয়ে গেল সে। সত্যি কথা বলতে একবারের জন্যও আমার নামটা তার মুখে উচ্চারিত হতে শুনলাম না। কেবল তার পালনকর্তা ফারাও উটেরিক টুরোর কথা বলে গেল সে, সেইসাথে যুদ্ধক্ষেত্রে যে সাহসী সৈন্যরা যুদ্ধ করেছে, যাদের নেতৃত্বে থাকার কথা ছিল ফারাওয়ের নিজের; তাদের কথা। ফারাও উটেরিক টুরোর নেতৃত্বের গুণাবলি, সাহস এবং তার জ্ঞান আর তীক্ষ্ণ বুদ্ধির কথা বলে চলল সে, যার মাধ্যমে আমাদের মিশরকে এক শতাব্দীব্যাপী দাসত্ব থেকে মুক্ত করা গেছে। সে এটাও বলল যে, উটেরিকের আগে যে পাঁচ ফারাও এসেছেন তারা সবাই একই ফলাফল অর্জনের চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হয়েছেন বারবার। সেই পাঁচ ফারাওয়ের মাঝে, এমনকি উটেরিক টুরোর বাবা টামোসও আছেন। নিজের ভাষণ সে শেষ করল এই বলে যে, এই বিশাল বিজয়ের মাধ্যমে নিশ্চিতভাবেই ফারাও উটেরিক টুরো স্বর্গের দেবতা হোরাস আইসিস, ওসিরিস এবং হাথোরের পাশে স্থান পাওয়ার যোগ্য হয়ে উঠেছেন। এবং এ কারণেই মেফিসে হিকসসদের কাছ থেকে ফারাও উটেরিক যে সম্পদ পুনরুদ্ধার করেছেন তার একটি প্রধান অংশ ব্যবহার করা হবে একটি মন্দির তৈরির কাজে। ফারাও উটেরিকের সাধারণ মানুষ থেকে স্বর্গীয় এবং অমর দেবতায় পরিণত হওয়ার ঘটনাকে উদ্যাপন করতে তৈরি করা হবে মন্দিরটি।

মেনাক্ট যখন এই ভাষণের মাধ্যমে জনতার মাঝে জ্ঞানের আলো ছড়াতে ব্যস্ত, আমার নাবিকরা তখন আমাদের সাথে নিয়ে আসা সম্পদ সব জাহাজ থেকে নামিয়ে ঘাটের ওপর তূপ করে রাখতে শুরু করেছে। সে সময় সত্যিই এক। অপার্থিব দৃশ্যের সৃষ্টি হলো। উপস্থিত জনতার সবার মনোযোগ মেনাক্টের লম্বা চওড়া বক্তৃতা থেকে সরে গিয়ে স্থির হলো স্থূপীকৃত সম্পদের ওপর।

অবশেষে নীরব হলো মেনাক্ট, শেষ হলো তার বক্তৃতা। নির্দেশ পেয়ে সামনে এগিয়ে এলো গাড়িগুলো। ক্রীতদাসরা ঘর্মাক্ত দেহে সম্পদভর্তি সিন্দুকগুলো তুলতে লাগল সেগুলোতে। সব ভোলা হয়ে গেলে চাবুক বাতাসে ছুঁড়ে তীক্ষ্ণ শব্দ তুলল গাড়িগুলোর চালকরা। সাথে সাথে ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত প্রহরীরা তাদের ঘিরে তৈরি করল নিরাপত্তা বেষ্টনী। লুক্সর শহরের প্রধান দরজার দিকে চলতে শুরু করল সম্পদবাহী গাড়ির বহর।

এই সব কিছু দেখে একেবারে অবাক হয়ে গেলাম আমি। ভেবেছিলাম এই শোভাযাত্রার নেতৃত্ব দেওয়ার সৌভাগ্য হবে আমার, ফারাওয়ের হাতে সম্পদের ভার তুলে দেওয়ার সম্মানটুকু আমি ছাড়া আর কেউ পাবে না। এই উপহার পাওয়ার পর নিশ্চয়ই কৃতজ্ঞ বোধ করবে ফারাও, তার সম্পূর্ণ স্বীকৃতি এবং শুভেচ্ছা পাব আমি। এখন যা ঘটছে তার প্রতিবাদ জানাতে চাইলাম আমি, গাড়িবহরের নেতৃত্বের অবস্থান যে একান্তই আমার অধিকার সেটা বোঝানোর জন্য এগিয়ে গেলাম মেনাক্টের দিকে।

তবে চারপাশে মানুষের ভিড় এবং সেই সময়ে তৈরি হওয়া উত্তেজনার কারণে আমি একটা ব্যাপার খেয়ালই করিনি। কখন যেন প্রাসাদ প্রহরীদের ছয়জন উচ্চপদস্থ সদস্য ঘাটের জনসমুদ্রের মাঝ থেকে আমার জাহাজে উঠে এসেছে। কোনো রকম ঝামেলা বা হইচই ছাড়াই বৰ্ম আর খোলা অস্ত্র দিয়ে তৈরি এক নিশ্চিদ্র দেয়ালের মাঝে আমাকে ঘিরে ফেলল তারা।

প্রভু টাইটা, ফারাওয়ের একান্ত নির্দেশে আপনাকে রাজদ্রোহিতার দায়ে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। দয়া করে আমার সাথে আসুন, প্রহরীদের নেতা মৃদু কিন্তু শক্ত গলায় আমার কানে কানে বলল কথাগুলো। ঘুরে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম আমি। এ যে সেই ক্যাপ্টেন ওয়েনেগ, যার জন্য আমার মনে আলাদা একটা জায়গা আছে- এটা বুঝতে আমার এক মুহূর্ত সময় লেগে গেল।

কী সব বাজে কথা বলছ ক্যাপ্টেন ওয়েনেগ? আমাকে তুমি ফারাওয়ের সবচেয়ে অনুগত প্রজা বলে ধরে নিতে পারো, অপমানিত গলায় প্রতিবাদ জানালাম আমি। কিন্তু আমার আপত্তিতে কান দিল না সে, শুধু সঙ্গীদের দিকে তাকিয়ে মাথা ঝকাল একবার। সাথে সাথে সবাই আমাকে এমনভাবে চারপাশ থেকে ঘিরে ধরল, একটুও নড়ার উপায় রইল না আমার। অনুভব করলাম পেছন থেকে একজন আমার তলোয়ারটা বের করে নিল খাপ থেকে। জাহাজের সিঁড়ি দিয়ে নামিয়ে আনা হলো আমাকে। সেই একই মুহূর্তে উপস্থিত বাদকদের দিকে হাত দিয়ে একটা ইশারা করল মেনাক্ট। ফলে সাথে সাথে নতুন একটা বাজনা শুরু হয়ে গেল, দেবোপম ফারাওয়ের প্রশংসা এবং প্রশস্তি বর্ণনা করা হতে লাগল তার তালে তালে। সেই শব্দে ঢাকা পড়ে গেল আমার প্রতিবাদ। জাহাজ থেকে আমাকে যখন পাথরের ঘাটে নামিয়ে এনেছে প্রহরীরা ততক্ষণে জনতার ভিড় ঘুরে গেছে বাদকদের দিকে। তাদের পিছু নিয়ে সম্পদবোঝাই গাড়িগুলো যেদিকে গেছে সেদিকে অর্থাৎ শহরের প্রধান দরজা অভিমুখে এগোতে শুরু করেছে তারা।

.

আমরা একাকী হয়ে পড়ার সাথে সাথেই প্রহরীদের নির্দেশ দিল ক্যাপ্টেন ওয়েনেগ। চামড়ার দড়ি দিয়ে আমার হাত পিছমোড়া করে বাঁধা হলো। দলের বাকিরা চারটে যুদ্ধের রথ নিয়ে এলো। আমাকে শক্ত করে বাঁধার পর ঠেলেঠুলে সবচেয়ে সামনের রথটার পাদানিতে উঠিয়ে দিল তারা। তীক্ষ্ণ শব্দ তুলল চাবুক, রওনা হয়ে গেলাম আমরা। তবে বাদকদল আর সম্পদবোঝাই গাড়িগুলো যে পথে গেছে সেদিকে নয়, বরং শহরের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া একটা বিকল্প পথের দিকে। সেই পথ দিয়ে কিছু দূর এগোনোর পর দূরের পাথুরে পাহাড়গুলোর দিকে এগোতে শুরু করল আমাদের রথগুলো। দেখেই বোঝা যাচ্ছে এই পথটা তেমন ব্যবহার করা হয় না। সত্যি কথা বলতে শহরের বাসিন্দাদের বেশির ভাগ অংশ একান্ত ঠেকায় না পড়লে এই পথে কখনো আসে না। অবশ্য পথটা কোথায় গিয়ে থেমেছে সেটা বিবেচনা করলে এমনটাই স্বাভাবিক। রাজপ্রাসাদ এবং শহরের প্রাচীর থেকে পাঁচ লিগেরও কম দূরত্বে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে একটা নিচু পর্বতমালা। সেই পাহাড়গুলোর মাঝে সবচেয়ে উঁচু পাহাড়টার মাথায় বসে আছে ভয়াল চেহারার এক পাথুরে দালান। পাথর কেটে কেটে তৈরি করা হয়েছে ভবনটা, একেবারেই কর্কশ আর নিষ্প্রাণ চেহারা। রংটা কেমন যেন বিষণ্ণ নীলাভ। এই হচ্ছে লুক্সরের রাজকীয় কারাগার। মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার ফাঁসিকাঠ এবং কেন্দ্রীয় অত্যাচার কক্ষগুলোও এখানেই অবস্থিত।

পাহাড়শ্রেণির গোঁড়ায় পৌঁছানোর জন্য ছোট একটা নালা পার হওয়া লাগল আমাদের। নালার ওপরে সেতুটা বেশ সরু, ঘোড়ার খুরে জোরালো শব্দ তৈরি হলো সেখানে। আমার উত্তপ্ত মস্তিষ্কের সেই শব্দকে মনে হতে লাগল মৃত্যুর এগিয়ে আসার পদধ্বনির মতো। কারাগারের একমাত্র ফটক, যার নাম দুর্দশার দরজা; সেখানে আসার আগ পর্যন্ত কাউকে এগিয়ে আসতে দেখা গেল না আমাদের দিকে। দরজার সামনে থেমে লাফ দিয়ে আমাদের রথ থেকে নেমে পড়ল ক্যাপ্টেন ওয়েনেগ, তলোয়ারের বাঁট দিয়ে জোরে জোরে বাড়ি মারল দরজার ওপর। প্রায় সাথে সাথেই আমাদের সামনে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বন্ধ দরজার ওপর এসে হাজির হলো কালো পোশাক পরা এক কারারক্ষী। তার মাথাতেও একই রকমের কাপড় দিয়ে ঢাকা রয়েছে, ফলে চোখ আর মুখ বাদে আর কিছু বোঝা যাচ্ছে না।

কে ঢুকতে চায় ভেতরে? চিৎকার করে প্রশ্ন ছুড়ল সে।

কয়েদি আর তার রক্ষী! জবাব দিল ওয়েনেগ।

তাহলে নিজ দায়িত্বে প্রবেশ করো, সাবধান করে দিল কারারক্ষী। কিন্তু জেনে রেখো, ফারাও এবং মিশরের সকল শত্ৰু এই দেয়ালের ভেতরে প্রবেশ করার পর চিরতরে ধ্বংস হয়ে যায়। তারপর দরজাটা ঘড়ঘড় শব্দে ওপরে উঠে গেল। রথ নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলাম আমরা। তবে কেবল আমরাই ভেতরে ঢুকলাম, আমাদের পাহারা দিয়ে বাকি যে তিনটি রথ এসেছিল তারা বাইরেই রয়ে গেল। তাদের সামনেই আবার ঘড়ঘড় শব্দে নেমে এলো ভারী ঝুলন্ত দরজা।

ভেতরে ঢোকার পর প্রথম যে জিনিসটা আমার চোখে পড়ল সেটা হচ্ছে: ছোট্ট একটা ভোলা জায়গাকে চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছে আকাশছোঁয়া দুর্ভেদ্য প্রাচীর। অনেক ওপরে দেখা যাচ্ছে এক চিলতে চারকোনা আকাশ। সেটা দেখার জন্য ঘাড় অনেকখানি কাত করে ওপরে তাকাতে হলো আমাকে। দেয়ালগুলোর গায়ে অজস্র সারি সারি তাক বা কুলুঙ্গি।

প্রতিটি তাকে রয়েছে একটা করে দাঁত বের করে থাকা মাথার খুলি। শত শত খুলি চোখে পড়ল আমার। অবশ্য এখানে এটাই আমার প্রথমবার আসা নয়। এর আগেও বিভিন্ন সময়ে এখানে বন্দি হওয়া হতভাগ্য কিছু লোকের সাথে দেখা করতে আসতে হয়েছে আমাকে, চেষ্টা করেছি যতটা সম্ভব তাদের সাহায্য করার, স্বস্তি দেওয়ার। তার পরেও চারপাশে মৃত্যুর এমন ভয়াবহ প্রমাণ, খোলাখুলি উপস্থিতি দেখে প্রতিবারই ভয়ে কুঁকড়ে উঠেছে আমার ভেতরটা। আর এবার সেটা আরো বেশি ঘটল, কারণ বিপদটা এখন আমার নিজের।

এর চেয়ে বেশি দূরে আমার যাওয়ার অনুমতি নেই, প্রভু টাইটা, মৃদু স্বরে বলল ওয়েনেগ। আশা করি আপনি বুঝতে পারছেন, আমি শুধু আমার ওপরে থাকা হুকুম পালন করছি। আপনার সাথে আমি যা করেছি তাতে ব্যক্তিগত কোনো কারণ নেই, এবং কাজটা করতে আমার মোটেই ভালো লাগেনি।

আমি তোমার সমস্যা বুঝতে পেরেছি ক্যাপ্টেন, জবাব দিলাম আমি। আশা করি এরপরে যখন আমাদের পরবর্তী সাক্ষাৎ হবে, উভয়ের জন্যই অনেক বেশি আনন্দের হবে।

এবার আমাকে রথের পাদানি থেকে নামতে সাহায্য করল ওয়েনেগ, তারপর ছুরির এক পোচে আমার হাতের বাঁধন কেটে মুক্ত করে দিল। কারারক্ষীদের কাছে আমাকে বুঝিয়ে দেওয়ার আনুষ্ঠানিকতাটুকু তাড়াহুড়ো করে শেষ করে দিল সে, আমার শাস্তিসংক্রান্ত প্যাপিরাসগুলো তুলে দিল তাদের হাতে। প্যাপিরাসের নিচে ফারাও উটেরিকের হায়ারোগ্লিফ প্রতীক চিনতে পারলাম আমি। তারপর আমাকে স্যালুট করল ক্যাপ্টেন ওয়েনেগ, এবং ঘুরে দাঁড়াল। আমার চোখের সামনে এক লাফে রথে উঠে পড়ল সে, তারপর লাগামটা হাতের মুঠোয় নিয়ে রথ ঘুরিয়ে দরজার দিকে ফিরল। ঝুলন্ত দরজাটা যথেষ্ট পরিমাণ ওপরে উঠতেই তীরবেগে বাইরে বেরিয়ে গেল ওয়েনেগের রথ, একবারও পেছনে তাকাল না সে।

চার কারারক্ষী এগিয়ে এলো আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। ওয়েনেগ বের হয়ে যাওয়ার সাথে সাথেই চারজনের মাঝে একজন তার মাথার কালো কাপড়টুকু সরিয়ে ফেলল, তারপর বীভৎস হাসি মুখে নিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়াল। লোকটা বিচ্ছিরি রকমের মোটা শরীরের অধিকারী, গলার নিচ থেকে কয়েক পরত চর্বি ঝুলে পড়েছে বুক বরাবর।

আপনাকে পেয়ে আমরা সম্মানিত বোধ করছি, হে প্রভু। এমন বিখ্যাত উচ্চপদস্থ আর ধনী ব্যক্তির খেদমত করার সৌভাগ্য তো আমাদের সব সময় হয় না। সম্পদের দিক দিয়ে ফারাওয়ের পরেই নাকি আপনার অবস্থান। আপনাকে কোনোভাবেই খাটো করে দেখতে চাই না আমি। প্রথমেই আমার পরিচয়টা দিয়ে দিই। আমার নাম ডুগ। চকচকে টাকসহ বিশাল মাথাটা নুইয়ে সম্মান দেখানোর ভঙ্গি করল সে। টাক মাথার পুরোটা জুড়ে আঁকা রয়েছে কুরুচিপূর্ণ উল্কি; এক দল কাঠের পুতুল পরস্পরের সাথে এমন সব কাজ করছে, যা দেখলে বমি আসতে বাধ্য। কিন্তু লোকটার কথা থামেনি। বলে চলেছে: আপনার মতো জ্ঞানী এবং শিক্ষিত ব্যক্তি নিশ্চয়ই খুব সহজেই বুঝতে পারবেন যে ডুগ হচ্ছে গুড কথাটার ঠিক উল্টো, এবং বোঝার সাথে সাথে জেনে যাবেন যে আমার কাছ থেকে কী আশা করা যায়। আমাকে যারা ভালোভাবে চেনে তারা প্রায়ই আমাকে শয়তান ডুগ বলে ডাকে। ডুগের কোনো একটা স্নায়ুঘটিত সমস্যা আছে, যার কারণে প্রতিটা বাক্যের শেষে দ্রুত কয়েকবার ডান চোখের পাতা ফেলে সে। লোভ সামলাতে পারলাম না আমি, পাল্টা চোখ টিপলাম।

হাসি মুছে গেল তার মুখ থেকে। ঠাট্টা-তামাশা করতে খুব মজা লাগে আপনার, তাই না? ঠিক আছে, তামাশা আমিও জানি। আপনাকে এমন হাসি হাসাব, পেট ফেটে মরবেন, প্রতিশ্রুতি দিল সে। কিন্তু সেই মজাটা পেতে হলে আমাদের দুজনকেই একটু অপেক্ষা করতে হবে। ফারাও আপনাকে রাজদ্রোহিতার দায়ে গ্রেপ্তার করেছেন ঠিকই, কিন্তু এখনো আপনার বিচার হয়নি, আপনি দোষী প্রমাণিত হননি। যাই হোক, সেই সময় অবশ্যই আসবে। কথা দিচ্ছি, তখন প্রস্তুত থাকব আমি।

আমাকে কেন্দ্র করে ঘুরতে শুরু করল সে; কিন্তু আমিও একই গতিতে ঘুরে তার মুখোমুখি হয়ে রইলাম। একে শক্ত করে ধরে রাখো! সাঙ্গোপাঙ্গদের উদ্দেশ্য করে হিসিয়ে উঠল ডুগ। খপ করে আমার দুই হাত চেপে ধরল ওরা, তারপর চাপ দিয়ে হাঁটু গেড়ে বসতে বাধ্য করল।

আপনার পোশাকগুলো খুব সুন্দর প্রভু টাইটা, মন্তব্য করল ডুগ। এমন দারুণ জিনিস খুব কমই দেখেছি আমি। কথাটা সত্যি, কারণ আমি মনে মনে আশা করছিলাম যে হিকসসদের হাত থেকে উদ্ধার করা সম্পদ সরাসরি ফারাও এবং তার পারিষদের কাছে বুঝিয়ে দিতে হবে। আমার মাথায় রয়েছে একটা সোনালি শিরস্ত্রাণ, অনেক আগে যুদ্ধক্ষেত্রে এক হিকসস সেনাপতির কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিলাম এটা। সোনা আর রুপোয় তৈরি এক অসাধারণ শিল্পকর্ম। আমার কাঁধে ঝুলছে স্বর্ণসাহস আর স্বর্ণপ্রশংসার পদক, তার সাথে একই রকম উজ্জ্বল রঙের সোনালি কণ্ঠহার, যেগুলো ফারাও টামোস নিজ হাতে আমাকে পরিয়ে দিয়েছিলেন। তার প্রতি আমার ত্যাগ ও সেবার নিদর্শন এগুলো। আমি জানি এই অবস্থায় আমাকে সত্যিই অসাধারণ লাগছে দেখতে। এমন সুন্দর পোশাককে কোনোভাবেই ময়লা বা নষ্ট হতে দিতে পারি না আমরা। এখনই খুলে ফেলুন ওগুলো। সব আমি আমার নিজের জিম্মায় রেখে দেব, বলল ডুগ। তবে সেইসাথে এটাও বলে রাখছি, আপনার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ার পর আপনি মুক্ত হলেই এগুলো সব ফিরিয়ে দেব। আমি শুধু নীরবে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে, আমার প্রতিবাদ বা মিনতি শুনে তৃপ্তি লাভ করার কোনো সুযোগ দিতে রাজি নই। আমার লোকেরা আপনাকে পোশাক খুলতে সাহায্য করবে, বলে নিজের ছোট্ট বক্তৃতার ইতি টানল ডুগ। আমি নিশ্চিত দেয়ালের তাকগুলোতে যে লোকগুলো এখন খটখটে খুলি হয়ে ঝুলে আছে তাদের সবাইকেও সে এই একই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।

সঙ্গীদের দিকে মাথা ঝাঁকিয়ে ইশারা করল ডুগ। সাথে সাথে আমার মাথা থেকে শিরস্ত্রাণটা খুলে নিল তারা, গলা থেকে সরিয়ে নিল সোনার হারগুলো। আমার শরীরে যে সুন্দর পোশাক ছিল তাও খুলে নেওয়া হলো, ফলে ছোট্ট এক টুকরো কাপড় বাদে প্রায় উলঙ্গ হয়ে পড়লাম আমি। সব শেষে আমাকে আবার নিজের পায়ে দাঁড় করানো হলো, তারপর জোর করে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো খোলা জায়গাটুকুর অপর পাশে অবস্থিত দরজাগুলোর দিকে।

আমার পাশে পাশে চলতে লাগল ডুগ। এই কারাগারের প্রাচীরের ভেতর আমরা যারা চাকরি করি তারা সবাই ফারাও উটেরিক টুরোর সিংহাসনে আরোহণ নিয়ে অত্যন্ত আনন্দিত। নিজের উত্তেজনার পরিমাণ বোঝাতে চার পাঁচবার চোখ টিপল সে, প্রতিবার চোখ টেপার সময় ঝাঁকি খেল মাথাটা। ফারাও আমাদের জীবন বদলে দিয়েছেন, মিশরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নাগরিকদের অন্তর্ভুক্ত করেছেন আমাদের। ফারাও টামোসের রাজত্বের সময় সপ্তাহে এক-আধবার আমাদের ডাক পড়ত। কিন্তু এখন তার বড় ছেলে আমাদের সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ব্যস্ত রেখেছেন। সব সময়ই হয় কারো মাথা কেটে ফেলা, না হলে পুরুষ এবং মহিলাদের পেট থেকে নাড়িভুড়ি টেনে বের করে আনা; অথবা তাদের হাত-পা ভেঙে ফেলা, অথবা তাদের গলায় বা অণ্ডকোষে দড়ি বেঁধে ঝুলিয়ে দেওয়া; অথবা গরম লোহার শিক দিয়ে চামড়া তুলে ফেলা- ইত্যাদি কাজে ব্যস্ত থাকতে হয় আমাদের। খুশি খুশি গলায় হেসে উঠল সে। এক বছর আগেও আমার ভাই এবং আমার পাঁচ ছেলের হাতে কোনো কাজ ছিল না। কিন্তু এখন তারা আমার মতোই পেশাদার অত্যাচারকারী এবং জল্লাদ। কয়েক সপ্তাহ পর পরই লুক্সরের রাজপ্রাসাদে আমাদের ডেকে পাঠান ফারাও উটেরিক টুকরা। আমরা যখন আমাদের দায়িত্ব পালন করি সেটা দেখতে ভালোবাসেন তিনি। যদিও তিনি এখানে কখনো আসেননি। তার বদ্ধমূল ধারণা, এই দেয়ালগুলোর ওপর কোনো একটা অভিশাপ আছে। এখানে যারা আসে তাদের নিয়তিতে মৃত্যু ছাড়া আর কিছু লেখা থাকে না। আর সেই মৃত্যুকে ডেকে আনার কাজটা করি আমরা। তবে আমি যখন কমবয়সী মেয়েগুলোর ওপর আমার দক্ষতা ফলাই তখন সেটা দেখতে খুব ভালোবাসেন ফারাও, বিশেষ করে তারা যদি গর্ভবতী হয়। তাই এমন কাউকে পাওয়া গেলে তাদের রাজপ্রাসাদে নিয়ে যাই আমরা। আমার ছোট্ট একটা শখ হচ্ছে, ওদের স্তনের মাঝে ব্রোঞ্জের হুক আটকে ঝুলিয়ে রাখা, সেইসাথে আরো একটা হুক দিয়ে ওদের পেট থেকে জ্বণটা ছিঁড়ে বের করে আনা। নিজের বর্ণনা শুনে নিজেই ক্ষুধার্ত জন্তুর মতো লালা ফেলতে শুরু করেছে লোকটা। এমন বীভৎস সব কাজের কথা শুনে বমি করে দিতে ইচ্ছে হলো আমার।

আপনার পালা আসতে এখনো সময় লাগবে, তবে ততক্ষণ আমার কাজের সাক্ষী হওয়ার সুযোগ পাবেন আপনি। এমনিতে আমি এসব ক্ষেত্রে একটা ফি রাখি, তবে আপনি যেহেতু আপনার শিরস্ত্রাণ আর সোনার হারগুলো আমাকে রাখতে দিয়েছেন, আপনার কাছে আমি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ… আমার দেখা সবচেয়ে ঘৃণিত লোকগুলোর মাঝে এই লোকটা অন্যতম। যে কালো পোশাক সে পরে আছে সেটা নিঃসন্দেহে তার শিকারদের রক্তের দাগ গোপন করার জন্য। কিন্তু অনেক বেশি কাছাকাছি থাকায় আমি দেখতে পাচ্ছি যে, কিছু কিছু দাগ এখনো ভেজা। যে দাগগুলো শুকিয়ে গেছে সেসব জায়গায় পচন ধরেছে। কাপড়ে। লোকটার পুরো শরীরে চারপাশে যেন ভারী হয়ে ঝুলে আছে মৃত্যু আর পচনের দুর্গন্ধ, ঠিক যেমন জলাভূমির ওপর ঝুলে থাকে সঁতসেঁতে কুয়াশার চাদর।

জেলখানা নামের এই নরককুণ্ডের মাঝ দিয়ে আমাকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে চলেছে ভুগের সহকারীরা। আশপাশে সবাই তাদের বীভৎস দায়িত্ব পালন করতে ব্যস্ত। রুক্ষ পাথুরে দেয়ালে প্রতিধ্বনি তুলেছে তাদের শিকারের কাতর আর্তনাদ, মিশে যাচ্ছে পেশাদার নিপীড়নকারীদের চাবুকের তীক্ষ্ণ শব্দ আর খিক খিক হাসির সাথে। তাজা রক্ত আর মানুষের মলমূত্রের গন্ধ এত ভয়ানকভাবে বাতাসে মিশে আছে যে, দম বন্ধ হয়ে এলো আমার, একটু বিশুদ্ধ বাতাসের জন্য খাবি খেতে লাগলাম।

একসময় একটা সরু সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলাম আমরা। নিচে রয়েছে একটা ছোট্ট জানালাবিহীন ভূগর্ভস্থ কামরা। একটামাত্র মোমবাতি জ্বলছে সেখানে, আর কিছুই নেই। কামরাটা এত ছোট যে হাঁটুগুলো থুতনির নিচে নিয়ে এসে একটু বসতে পারব আমি, তার চেয়ে বেশি কোনো জায়গা নেই। ঠেলেঠুলে সেখানে ঢুকিয়ে দেওয়া হলো আমাকে।

আজ থেকে তিন দিন পর ফারাও আপনার বিচার করবেন। তখন আপনাকে নিতে আসব আমরা। তা ছাড়া আপনাকে কোনোভাবেই বিরক্ত করা হবে না, নিশ্চিত থাকুন, আমাকে আশ্বস্ত করল ডুগ।

খাবার চাই আমার, সেইসাথে পান করা এবং নিজেকে পরিষ্কার করার জন্য বিশুদ্ধ পানি, প্রতিবাদ করলাম আমি। বিচারের দিন পরার মতো কিছু পরিষ্কার কাপড়ও দরকার।

কয়েদিরা সাধারণত এসব ব্যাপার নিজেরাই জোগাড় করে নেয়। আমরা ব্যস্ত মানুষ। আপনি নিশ্চয়ই আশা করেন না যে এসব সামান্য বিষয়ে আমরা মাথা ঘামাব? ব্যঙ্গের হাসি হেসে এক ফুঁ দিয়ে মোমটা নিভিয়ে দিল ডুগ, তারপর মোমের বাকি অংশটুকু নিজের আলখাল্লার মাঝে ঢুকিয়ে রাখল। তারপর দড়াম করে আমার কামরার দরজাটা বন্ধ করে দিল সে। ওপাশ থেকে তালায় চাবি ঢোকানোর শব্দ শুনতে পেলাম আমি। এই বদ্ধ নোংরা পাথরের ঘরটায় তিনটি দিন কাটাতে হবে আমাকে, কোনো খাবার এবং পানি ছাড়া। জানি না তিন দিন পর আমি বেঁচে থাকব কি না।

তোমাকে টাকা দেব আমি, নিজের কণ্ঠস্বরে হতাশার আভাস পাচ্ছি।

আমাকে দেওয়ার মতো কিছুই নেই আপনার কাছে, মোটা কাঠের দরজা ভেদ করেও ভেসে এলো ডুগের কণ্ঠস্বর। তারপর তাদের পায়ের শব্দ ধীরে ধীরে দূরে সরে গেল, নীরব হয়ে গেল একসময়। নিশ্চিদ্র অন্ধকারে ডুবে গেলাম আমি।

বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে আমি নিজের চারপাশে একটা প্রতিরক্ষা স্তর তৈরি করতে পারি। কিছু কিছু পোকামাকড়ের খোলস বা খুঁটি যেভাবে কাজ করে আমার এই প্রতিরক্ষা স্তরটাও ঠিক তেমন। এই সময় নিজের অনেক গভীরে এক নিরাপদ জায়গায় নিজেকে গুটিয়ে নিই আমি। এখনো আমি সেটাই করলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *