০৬-১০. প্রথম চিঠি

. প্রথম চিঠি

মিস্টার ওয়ার্ডের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমি লং স্ট্রিটে আমার নিজের আস্তানাটায় ফিরে এসেছিলুম। সেখানে বৌ-বাচ্চার হৈ-হুঁল্লোড় নেই বলেই এই আশ্চর্য মামলাটা নিয়ে ঠাণ্ডাভাবে বসে-বসে মাথা ঘামাবার যথেষ্ট সময় পাওয়া যাবে। আমার বাড়িতে থাকার মধ্যে আছে এক বুড়ি, আমার মায়ের আমল থেকে সে আমার দেখাশুনো করে আসছে-তারপর মা মারা যাবার পর আমার এখানেই সে কাটিয়ে দিয়েছে পনেরো বছর।

দু-মাস আগে আমি চাকরি থেকে ছুটি নিয়েছিলুম। ছুটি ফুরোতে এখনও দু-হপ্তা বাকি, যদি-না অপ্রত্যাশিত কোনোকিছু এসে গোল পাকায়–কখনও-কখনও এমন-সব মামলা এসে পড়ে যা নিয়ে একফোঁটাও সবুর করা চলে না, তখন এইসব ছুটি-টুটি মাথায় উঠে যায়, ফের হন্তদন্ত হয়ে কাজে লেগে পড়তে হয়। এই ছুটির অনেকটাই যে মাঠে না-হোক, পাহাড়ে মারা গেছে, তার বিবরণ তো আগেই দিয়েছি, যখন গ্রেট আইরির গুপ্ত রহস্য ভেদ করবার জন্যে পাহাড়ে ছুটতে হয়েছিলো।

আর এখন? এখনও কি আমার পক্ষে উচিত হবে না ছুটির কথা ধামাচাপা দিয়ে জলে-ডাঙায় এই-যে অদ্ভুত ব্যাপার ঘটে চলেছে তার ওপর আলো ফেলবার জন্যে আদানুন খেয়ে আবারও কাজে লেগে-পড়া? এই যুগল রহস্য ভেদ করবার সুযোগ পেলে আমি অনেককিছুই দিয়ে দিতে পারতুম, কিন্তু কেমন করে, কোন সূত্র ধরে, এই স্বতশ্চল শকট অথবা বিদ্যুৎক্ষিপ্র তরণীর পেছনে ছুটবো আমি?

ছোটোহাজরি সেরে, পাইপটা জ্বালিয়ে, আরামকেদারায় হেলান দিয়ে বসে আমি অলস ভঙ্গিতে সকালবেলার খবরকাগজটা খুলেছি, ভাবছি কোন পাতায় চোখ বোলাবো। রাজনীতি আমাকে থোড়াই টানে, রিপাবলিকান আর ডেমোক্রাটদের মধ্যে এই চিরন্তন কচকচি আর ঝগড়াঝাটি আমাকে বড্ড বিরক্ত আর অসহিষ্ণু করে তোলে। সমাজের হাই সোসাইটির কীর্তিকলাপও আমায় টানে না, খেলার পাতাতেও আমার মোটেই কৌতূহল নেই। কাজেই, শুনে নিশ্চয়ই কেউ আশ্চর্য হবে না যে, প্রথমে ঠিক করেছিলুম দেখি গ্রেট আইরি সম্বন্ধে নর্থ ক্যারোলাইনার কোনো খবর আছে কি না। খবরকাগজের পাতায় নতুন-কিছু থাকার আশা অবশ্য কমই, কারণ মিস্টার স্মিথ আমায় কথা দিয়েছিলেন যে নতুন-কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটলেই টেলিগ্রাম করে তক্ষুনি আমায় জানিয়ে দেবেন। এ নিয়ে আমার মধ্যে কোনোই সংশয় ছিলো না যে মরগ্যানটনের মেয়র তার চোখকান খোলা রাখবেন–আমি নিজে যতটা সজাগ থাকতুম, ততটাই। খবরকাগজ আমায় নতুন-কিছুই বললে না। একটু পরেই সেটা আমার হাত থেকে খসে পড়ে গেলো, আমি গভীর ভাবনায় তলিয়ে গেলুম।

বারেবারে ঘুরে-ফিরে গানের ধুয়োর মতো একটা কথাই আমার মনের মধ্যে হানা দিচ্ছিলো : মিস্টার ওয়ার্ড যে-কথাটি বলেছেন, সেই কথাটিই : ডাঙার গাড়ি আর জলের জাহাজ-দুটোই আসলে একই জিনিশ নয় তো? আর-কিছু না-ই হোক, দুটো যন্ত্রই যে। একই হাতের তৈরি, তাতে হয়তো সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। আর এতেও কোনো সন্দেহ নেই যে দুটো এনজিনই একই রকম, একই শক্তির উৎস তাতে এমন প্রচণ্ড গতি সৃষ্টি করে, জলে বা ডাঙায় এর আগে কখনোই যার কোনো তুলনা দেখা যায়নি।

একই আবিষ্কর্তা! নিজেকেই আবারও আমি বোঝাবার চেষ্টা করলুম।

এ-রকম কোনো সিদ্ধান্ত করার পক্ষে যুক্তি ছিলো যথেষ্টই। দুটো যন্ত্র যে কখনোই একসঙ্গে একযোগে আবির্ভূত হয়নি, এই তথ্যটাই সিদ্ধান্তটাকে দৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়েছিলো। আপন মনেই আমি নিজেকে শোনালুম :গ্রেট আইরির ঐ রহস্যের পরই পর-পর এসে হাজির মিলাউঁকি আর বস্টন। এই নতুন সমস্যাটার জট খোলাও কি আগেরটার মতো এত কঠিন হবে?

অলসভাবে বসে-বসে আমি ভাবছিলুম যে এই নতুন সমস্যাটার সঙ্গে আগেরটার কিন্তু ভারি অদ্ভুত একটা মিল রয়েছে-যেহেতু দুটোই সাধারণের জীবনহানির ক্ষমতা রাখে। সত্যি-বলতে, গ্রেট আইরির অগ্ন্যুৎপাতে বা ভূমিকম্পে শুধু ব্লু-রিজ অঞ্চলের অধিবাসীদেরই বিপদের সম্ভাবনা ছিলো। এদিকে এখন, মার্কিন মুলুকের প্রতিটি রাস্তা, কিংবা তার উপকূল বা বন্দর ধরে প্রতিটি মাইলেই দেশের মানুষ এই গাড়ি কিংবা

নৌকোর আতঙ্কে ভুগছে-যে-কোনোখানে যে-কোনো সময় ফেটে পড়তে পারে বিপদ, যখন এই গাড়ি বা নৌকো তার খ্যাপা গতিকে নিয়ে বোঁ করে ছুটে বেরুবে।

এটাও দেখলুম–এবং তা প্রত্যাশিতই ছিলো–যে খবরকাগজগুলো নিছক ইঙ্গিতই। করেনি, বরং এই বিপদের সম্ভাবনাটাকে ফেনিয়ে-ফাঁপিয়ে বড়ো করে দেখিয়েছে। নিরীহ নির্বিরোধী লোকেরা চিরকালই এ-সব ক্ষেত্রে ভয়ে আধমরা হয়ে যায়। যে-বুড়ি আমার দেখাশুননা করে, সে একে কুসংস্কারে ভোগে, তায় সহজেই সবকিছু বিশ্বাস করে বসে–সে-তো এ-সব দেখেশুনে ভীষণ ঘাবড়েই গিয়েছে। সেইদিনই, খাবার সময়, টেবিল পরিষ্কার করতে-করতে সে হঠাৎ আমার সামনে এসে থমকে দাঁড়ালে, এক হাতে জলের বোতল, অন্য হাতে একটা ট্রে, সে একটু উদ্বিগ্ন স্বরেই জিগেস করলে :কোনো খবর নেই, সার?

সে কী জানতে চাচ্ছে, বুঝতে পেরেই আমি বললুম, না। কোনো খবর নেই।

ঐ ভুতুড়ে গাড়িটা আর ফিরে আসেনি?

না।

আর ঐ অলৌকিক জলযান?

সেই জলযানেরও কোনো পাত্তা নেই। যাদের খবর সংগ্রহের ব্যবস্থা সবচেয়ে ভালো, তাদেরও কাগজে এ-সম্বন্ধে কিছুই লেখেনি।

তবে, আপনাদের পুলিশের দফতরে কোনো গোপন খবর আসেনি?

আমরাও একই রকম অন্ধকারে আছি।

তাহলে, সার,–কিছু মনে করবেন না–পুলিশ পুষে আর লাভ কী?

এমনতর প্রশ্ন আমাকে প্রায়ই শুনতে হয়, আর কখনোই আমি তার কোনো সদুত্তর দিতে পারি না।

এবার দেখবেন কী হবে, বুড়ির গলায় নালিশের সুর, একদিন ভোরবেলায় সে এসে উদয় হবে, কোনো হুঁশিয়ারি না-দিয়েই এসে হাজির হবে এই ভয়ংকর শোফেয়ার, আমাদের রাস্তায় প্রচণ্ড বেগে চালাবে তার গাড়ি, আর আমাদের সব্বাইকে মেরে ফেলবে!

ভালোই তো! তা যখন হবে তখন তাকে পাকড়াবার একটা সুযোগ পাবো আমরা।

তাকে, সার, আপনারা ককখনো পাকড়াতে পারবেন না।

কেন?

কারণ, সার, সে হলো শয়তান স্বয়ং, খোদ বীলজেবাব, আর শয়তানকে আপনারা গ্রেফতার করবেন কীভাবে?

আমি মনে-মনে ভাবলুম, শয়তানও বিস্তর কাজে লাগে; শয়তান যদি কোথাও নাও থাকতো, আমরা তবু তাকে উদ্ভাবন করে নিতুম, ব্যাখ্যাতীতকে ব্যাখ্যা করবার একটা অস্ত্র তুলে দিতুম লোকের হাতে। সে-ই ঐ লেলিহান শিখা জ্বালিয়েছিলো গ্রেট আইরির চূড়ায়। সে-ই উইসকনসিনে মোটররেসে পুরোনো সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছিলো। সে-ই ছটফট করে ঘুরে বেড়িয়েছে কানেটিকাট আর ম্যাসাচুসেটসের জলে। না-হয় যারা অশিক্ষিত তাদের জন্যে একপাশে দাঁড় করিয়ে রাখা গেলো এই শয়তানকে, কিন্তু তবু মানতেই হয় আমরা সত্যিই এখন এক দুর্বোধ প্রহেলিকার মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছি। দুটো যন্ত্রই কি তবে চিরতরে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে? উল্কার বেগে ছুটে বেরিয়েছে তারা, যেন মহাশূন্যে কোনো তারা খসে পড়েছে; আর আগামী একশো বছরে এই রগরগে কাহিনীটা কিংবদন্তি হয়ে উঠবে, পরের শতাব্দীর মানুষজনের কাছে গিয়ে পৌঁছুবে দিব্বি মুখরোচক এক কেচ্ছা হিশেবে।

কয়েকদিন ধরেই আমেরিকা আর ইওরোপের খবরকাগজগুলো এই ব্যাপার নিয়ে বেদম মাতামাতি করলে। সম্পাদকীয় মন্তব্যের পর লেখা হলো আরো সম্পাদকীয়; একটা গুজবের গায়ে গিয়ে জেল্লা চড়ালো নতুন আরো-একটা গুজব। গল্প বানাতে পেরেই যাদের প্রাণের আরাম, তারা একের পর এক গল্প ফাঁদলে। দুই মহাদেশেরই জনসাধারণ বেজায় উসকে উঠেছে। ইওরোপের কতগুলো দেশে আবার হিংসে হচ্ছিলো : কেন আমেরিকাই এমন-সব চমকপ্রদ ঘটনার কেন্দ্রভূমি হয়ে উঠেছে। যদি এই আশ্চর্য আবিষ্কারগুলো কোনো মার্কিনের হয়, তবে মার্কিন মুলুকের সমরবাহিনী অন্য সব দেশের তুলনায় সমরসজ্জায় অনেকটাই এগিয়ে থাকবে। মার্কিন দেশের প্রতাপ আর দেমাক তাতে যে আরো বেড়ে যাবে!

দশই জুনের তারিখ দিয়ে, নিউইয়র্কের এক খবরকাগজ এই বিষয় নিয়ে অতীব সুচিন্তিত একটি প্রবন্ধ ছাপলে। সবচেয়ে দ্রুতবেগে যেতে পারে বলে জানা আছে এমন জলযানের সঙ্গে তুলনা করলে এই অলৌকিক জলযানের গতির–সবচেয়ে-কম কী ছিলো তার গতি; তারপর সেই সন্দর্ভ চুলচেরা যুক্তি সাজিয়ে প্রমাণ করে দিলে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাতে যদি এই উদ্ভাবনের গোপন সূত্র থেকে থাকে, তবে ইওরোপ তার কাছ থেকে মাত্র তিন দিন দূরে থাকবে-যে-কালে মার্কিন দেশ থাকবে ইওরোপ থেকে পাঁচদিন দূরে।

যদি আমাদের নিজেদের পুলিশবাহিনী নাছোড়ভাবে গ্রেট আইরির রহস্যভেদ করবার চেষ্টা করে থাকে, পৃথিবীর প্রত্যেক দেশেরই গুপ্ত বাহিনীগুলো নাছোড়ভাবে এই সমস্যার পেছনেই লেগে আছে।

যতবারই আমি তার সঙ্গে দেখা করতে গেছি, ততবারই মিস্টার ওয়ার্ড এই প্রসঙ্গটা পেড়েছেন। আমাদের কথাবার্তা শুরু হবে নর্থ ক্যারোলাইনায় আমার ব্যর্থতা নিয়ে টীকা টিপ্পনী দিয়ে, আর আমি তাকে মনে করিয়ে দেবো যে সাফল্যটা নির্ভর করতে কত ডলার খরচ করতে পারতুম, তারই ওপর।

ভেবো না, স্ট্রক, মিথ্যে মনখারাপ কোরো না, বারে-বারেই সান্ত্বনা দিয়েছেন মিস্টার ওয়ার্ড, আমাদের ইনসপেক্টরের কাছে আবারও শিরোপা পাবার কত সুযোগ আসবে, বরং ঐ স্বতশ্চল শকট আর অলৌকিক জলযানের কথাই ভেবে দ্যাখো। জগতের সব ধুরন্ধর গোয়েন্দার আগেই যদি তুমি এদের রহস্য ভেদ করে দিতে পারো, তাহলে ভেবে দ্যাখো এই দফতরের পক্ষে তা কেমন গৌরবের ব্যাপার হবে! আর তোমারই বা গৌরব কতটা হবে!

সন্দেহ নেই, বিভাগের মহিমা বেড়ে যাবে, আমিও প্রত্যুত্তর দিয়েছি, শুধু যদি আপনি এই সমস্যাটার জট খোলবার ভার আমার ওপর দিতেন–

ভবিষ্যতের গর্ভে কী-যে আছে, তা কে বলতে পারে স্ট্রক! বরং একটু সবুর করেই দেখা যাক! একটু অপেক্ষাই করা যাক না-হয়।

অবস্থা যখন এমনি ন-যজৌ ন-তথৌ দাঁড়িয়ে আছে, তখন পনেরোই জুনের ভোরবেলায় আমার বুড়ি দাসী হরকরার কাছ থেকে একটা চিঠি এনে দিলে আমায়, রেজিস্টারি চিঠি, আমাকে সেটা সই করে রাখতে হবে। আমি প্রেরকের ঠিকানাটার দিকে তাকালুম। হাতের লেখাটা আমার একেবারেই অচেনা। ডাকটিকিটের ওপর মরগ্যানটনের ছাপ, দু-দিন আগেকার একটা তারিখ।

মরগ্যানটন! অবশেষে তাহলে মিস্টার এলিয়াস স্মিথের কাছ থেকে এত্তেলা এলো!

হ্যাঁ, আমি আমার বুড়ি দাসীকে শুনিয়ে-শুনিয়েই বললুম, নিশ্চয়ই অবশেষে মিস্টার স্মিথের কাছ থেকে কোনো খবর এলো। মরগ্যানটনে তো আর-কাউকেই আমি চিনি না। আর হঠাৎ যদি তিনি আমায় চিঠি লিখে থাকেন, তবে সেটাই হবে খবর, সংবাদ, বাঁকা হরফে।

মরগ্যানটন? বুড়ি একটু অবাক সুরেই বললে, আচ্ছা, ঐখানেই তো শয়তানের সাঙ্গোপাঙ্গরা তাদের পাহাড়ে আগুন জ্বেলেছিলো, তাই না?

ঠিক তাই।

ওহ্, সার! আশা করি আবার আপনাকে ওখানে ফিরে যেতে হবে না!

কেন? গেলে কী হবে?

তাহলে যে আপনি গ্রেট আইরির ঐ উনুনটায় পুড়ে মরবেন! আমি কিন্তু আপনার অমনতর অপধাত-মরণ চাই না।

আরে, অত মনখারাপ করার কী আছে? দেখাই যাক না, হয়তো ভালো খবরই পাওয়া যাবে এই চিঠিতে।

লেফাফাটার ওপর গালা দিয়ে মোহর-করা, আর পাশে তিনটে তারা খোদাই-করা। কাগজটা শুধু যে খুব পুরু তা-ই নয়, বেশ শক্তপোক্ত। আমি খামটা খুলে ভেতর থেকে চিঠিটা বার করে নিয়ে এলুম। একটাই কাগজ, দামি, চার ভাজ করা, তার শুধু একদিকেই লেখা। আমি প্রথমে পত্ৰলেখকের স্বাক্ষরটা খুঁজলুম।

কোথাও কারু কোনো স্বাক্ষর নেই! শেষ পঙক্তির পরে শুধু কারু পুরো নামের তিনটে আদ্যক্ষর।

চিঠিটা দেখছি মরগ্যানটনের মেয়রের কাছ থেকে আসেনি।

তাহলে কার কাছ থেকে এলো চিঠি? বুড়ি কেমন ভ্যাবাচাকা খেয়ে জিগেস করলে। তার কৌতূহল আর বাগ মানছে না।

তিনটে হরফের দিকে আরেকবার চোখ বুলিয়ে আমি বললুম, এই হরফগুলো দিয়ে নাম হতে পারে, এমন-কাউকেই আমি চিনি না। মরগ্যানটনেও নয়, অন্য কোথাও নয়!

হাতের লেখা স্পষ্ট, দানাদার। সবশুদু কুড়ি লাইনও হবে কি না সন্দেহ। এই রইলো চিঠিটা, ভাগ্যিশ কী ভেবে তখন আমি তার একটা নকল রেখেছিলুম। আমাকে স্তম্ভিত করে দিয়ে চিঠিটার নাম/তারিখ আমাকে জানালে যে সে এসেছে ঐ রহস্যময় গ্রে টু আইরি থেকে :

গ্রেট আইরি, ব্লু-রিজ মাউন্টেনস
নর্থ ক্যারোলাইনা; জুন ১৩

মিস্টার স্ট্রক বরাবরে
চীফ ইন্সপেক্টর অভ পুলিশ
৩৪ লং স্ট্রিট, ওয়াশিংটন, ডি. সি.

সবিনয় নিবেদন :

আপনার উপর গ্রেট আইরির রহস্য ভেদ করিবার দায়িত্ব ন্যস্ত হইয়াছিল।

আপনি ২৮শে এপ্রিল পাহাড়ে আসিয়াছিলেন, সঙ্গে ছিলেন মরগ্যানটনের মেয়র এবং দুইজন পথপ্রদর্শক।

আপনি দেয়ালটির পাদদেশ অব্দি আরোহণ করিয়াছিলেন, তাহার ব্যাস ঘিরিয়া একবার পাকও খাইয়াছিলেন, বুঝিয়াছিলেন যে ইহা অত্যন্ত উঁচু এবং এতই খাড়াই যে ইহার চূড়ায় চড়া একেবারেই অসম্ভব।

আপনারা তন্নতন্ন করিয়া হাৎড়াইয়া দেখিয়াছিলেন কোথাও কোনো খাঁজ বা ফাটল আছে কি না-থাকিলে হয়তো উপরে উঠা যাইবে। কিন্তু আপনারা ঐ-রূপ কোনোকিছুই আবিষ্কার করিতে পারেন নাই।

জানিয়া রাখুন : গ্রেট আইরিতে কাহারও প্রবেশাধিকার নাই; যদি কেহ তবুও দৈবাৎ, তাহার ভিতর ঢোকে, তবে সে আর-কখনও ফিরিয়া আসে না।

কখনও আর এইরূপ চেষ্টা করিবেন না, কেননা দ্বিতীয় বারের বেলায় প্রথম বারের মতো ফল হইবে না–বরং আপনার পক্ষে ফলাফল রীতিমতো মারাত্মক হইবে।

এই সতর্কবার্তা অগ্রাহ্য করিবেন না, নতুবা আপনার কপালে বিশেষ দুর্ভোগ আছে।

আবারও : সাবধান!

মা. অ. ও.

.

. তিন নম্বর যন্ত্র

কবুল করতেই হয় যে চিঠিটা পড়ে গোড়ায় আমি একেবারেই বোমকে গিয়েছিলুম। আপনা থেকেই আমার মুখ ফুটে বেরিয়ে আসছিলো উঃ আর আঃ। বুড়ি দাসী আমার হাবভাব দেখে ফ্যালফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়েছিলো, কী-যে ভাববে কিছুই বুঝতে পারছিলো না।

অ্যাঁ, সার? কোনো খারাপ খবর নাকি?

আমি উত্তরে–কারণ সেই ছেলেবেলা থেকেই আমি তার কাছে কোনোকিছু গোপন করিনি–চিঠিটা তাকে আদ্যোপান্ত, আগাপাশতলা, পড়ে শোনালাম। শুনতে-শুনতে উৎকণ্ঠায় তার প্রায় ভির্মি খাবার জোগাড়।

ঠাট্টা করেছে নিশ্চয়ই কেউ, আমি একটু অস্বস্তির সঙ্গে শুধু আমার কাঁধ ঝাঁকালুম।

তা, আমার কুসংস্কারে-ভরা পরিচারিকা বললে, এ যদি খোদ শয়তানের কাছ থেকে নাও এসে থাকে, শয়তানের মুলুক থেকে তো এসেছে!

বুড়ি হাতের কাজ সামলাতে চলে যেতেই, আমি আবারও এই অপ্রত্যাশিত চিঠিটা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পড়ে নিলুম। ভেবে-টেবে মনে হলো কেউ নিশ্চয়ই আমার সঙ্গে ইয়ার্কি করে আমাকে ভড়কে দিতে চেয়েছে। আমি যে গ্রেট আইরি গিয়েছিলুম, অভিযানে, সে-কথা তো সব্বাই জানে। খবরকাগজগুলোয় তার বিশদ বিবরণ বেরিয়েছে। কোনো রসিক ব্যক্তি–এমনকী মার্কিন মুলুকেও এমনতর রসিক আছে কয়েকজন নিশ্চয়ই আমাকে বিদ্রূপ করে এই হুমকিভরা চিঠিটা পাঠিয়েছে।

আইরি যে সত্যি-সত্যি একদল দুবৃত্তের গোপন আস্তানা হয়ে পড়েছে, তা কেমন যেন অবিশ্বাস্য বলে মনে হয়, পুলিশ তাদের গোপন ডেরাটা খুঁজে বার করে ফেলবে, এইই যদি তাদের আশঙ্কা হয়ে থাকে, তবে তারা নিশ্চয়ই যেচে সাধ করে নিজেদের দিকে এভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইবে না। তাদের নিরাপত্তা ততদিনই অটুট থাকবে, যতদিন তাদের উপস্থিতি সম্বন্ধে কেউ কিছু জানবে না। তারা নিশ্চয়ই এটা বুঝতে পারবে যে এভাবে হুমকি দিয়ে নিজেদের জানান দিয়ে নিজেদের জাহির করে–তারা গোটা পুলিশবাহিনীকেই তাতিয়ে দেবে–আবার তাদের আইরিতে ডেকে আনবে। ডায়নামাইট বা মেলিনাইট অনায়াসেই তাদের দুর্গে ঢোকবার রাস্তা তৈরি করে দেবে। তাছাড়া, তারা নিজেরাই বা কেমন করে আইরির ভেতরে গিয়ে ঢুকেছে–যদি-না আইরিতে যাবার এমন-কোনো গোপন রাস্তা থেকে থাকে যেটা আমাদের চোখ এড়িয়ে গেছে? নিশ্চয়ই এটা কোনো ভাড় না-হয় পাগলের কীর্তি : এই শাসানিতে আমার মাথা ঘামাবার কিছু নেই–এটা নিয়ে দ্বিতীয়বার ভাববারই কিছু নেই-না-হলে এই ভড়কে বড্ড-বেশি আশকারা দেয়া হবে।

কাজেই, যদিও একবার আমি ভেবেছিলুম মিস্টার ওয়ার্ডকে গিয়ে চিঠিটা দেখিয়ে আসি, আমি ঠিক করলুম, না, এ নিয়ে আর-কোনো উচ্চবাচ্যই নয়। তিনি নিশ্চয়ই এই হুমকিটাকে কোনো পাত্তাই দেবেন না। তবে আমি অবশ্য চিঠিটা বাজে কাগজের ঝুড়িতে ফেলে দিইনি, বরং সযত্নে আমার ডেস্কে চাবি বন্ধ করে রেখে দিয়েছি। যদি এই একই মা অ, ও আদ্যক্ষর সমেত আরো এই ধরনের হুমকি আসে, তখন না-হয় এ-চিঠি নিয়ে আবার ভাবা যাবে। .

বেশ শান্তভাবেই কেটে গেছে কয়েকদিন । শিগগির যে আমায় ওয়াশিংটন ছেড়ে বুনো হাঁসের সন্ধানে বেরিয়ে পড়তে হবে, এমন কোনো সম্ভাবনাই দেখতে পাচ্ছিলুম না। তবে আমি যে-ধরনের কাজ করি তাতে পরের দিন যে কী হবে, তা কেউই আগে থেকে বলতে পারে না। যে-কোনো মুহূর্তে আমাকে তলব করে বলা হতে পারে, ওহে স্ট্রক, অরেগন থেকে ফ্লরিডা ছোটাছুটি করে মরো, ধৈয়ে যাও মাইন থেকে টেক্সাস। আর ঐঅস্বস্তিটা খচখচ করে বেঁধে সারাক্ষণ : আমার হাতে যে-নতুন কাজের দায়িত্ব দেয়া হবে, তা যদি গ্রেট আইরির অভিযানটার মতোই ব্যর্থ হয়, তাহলে আমার বোধহয় দফতরে ফিরে গিয়ে মাথা নিচু করে ইস্তফাই দিয়ে আসতে হবে। রহস্যময় শোাফেয়ার সম্বন্ধে আর-কোনো খবরই নেই। জানতুম যে আমাদের সরকার–অন্যান্য বিদেশী দেশের সরকারও–আমেরিকার জলে-ভাঙায় সারাক্ষণ কড়া নজর রেখে চলেছে। অবশ্য এটা ঠিক আমাদের এই মার্কিন মুলুক এতই বিশাল-একটা দেশ যে তার সর্বত্র সবসময় সজাগ পাহারা রাখা সম্ভব নয়; কিন্তু এই যুগল আবিষ্কর্তা এর আগে তো তাদের বাহাদুরি দেখাবার জন্যে কোনো জনমানবশূন্য ফাঁকা এলাকা বেছে নেয়নি, বরং বাহবা পাবার জন্যে এমন সব জায়গায় আবির্ভূত হয়েছে যেগুলো খুবই জনবহুল। শুধু তা-ই নয়, একটা বহুবিজ্ঞাপিত রেসের দিনে সে এসে হাজির উইসকনসিনের রাস্তায়, সবসময় যেখানে হাজার জলযান চলে সেখানে, বস্টনে, আবির্ভাব হয়েছে তার জল্যান নিয়ে। একে মোটেই আত্মগোপন করে থাকবার ব্যাকুল চেষ্টা বলে বর্ণনা করা যায় নঐ দুঃসাহসী বেপরোয়া চালকটির যদি সলিল সমাধি না-হয়ে থাকে তার ডুবে-মরার সম্ভাবনাটা হয়তো অলৌকিক জলযানটি এখন ইওরোপের জলে তোলপাড় তুলে ছুটে বেড়াচ্ছে, আর নয় তো গিতে আশ্রয় নিয়েছে কোনো গোপন আস্তানায়। আর, সেক্ষেত্রে–

আহ! বারেবারে এই একটা কথাই আমি শোনালুম নিজেকে। এ-রকম কোনো আশ্রয়, যদি এই বাহাদুর উদ্ভাবক চায়, যেটা যুগপৎ গোপন এবং অগম্য, তাহলে গ্রেট আইরির চেয়ে ভালো আর-কোন জায়গা সে পাবে! কিন্তু কোনো জলযান সেখানে যাবে কী করে, আর কোনো মোটরগাড়ির বা কী করে বেয়ে উঠবে পাহাড়ের ঢাল! শুধু সেইসব শিকারি পাখি, যারা মহাশূন্যে পাক খায়, ঈগল কিংবা কণ্ডর, তারাই সেখানে আশ্রয় পেতে পারে।

উনিশে জুন আমি আমার দফতরে যাবো বলে বেরিয়েছি, রাস্তায় দেখি দুটি অচেনা লোক কিরকম তা তে আমাকে দেখছে। লোকগুলোকে আদপেই চিনি না বলে গোড়ায় আমি ব্যাপারটা খেয়াল করিনি। সত্যি বলতে, আমি তাদের কোনো পাত্তাই দিতুম না, যদি-না বাড়ি ফিরে-আসার পর আমার বুড়ি দাসী এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করতো।

কয়েকদিন ধরেই নাকি–সে খেয়াল করেছে এই দুটো লোক রাস্তায় আমার ওপর কড়া নজর রেখে চলেছে। সারাক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকেছে–আমার বাড়ি থেকে একশো পা দূরে হবে কি না সন্দেহ, এমন জায়গায়, প্রকাশ্যে; আর তার অনুমান : আমি যেখানেই যাই তারা বোধহয় ছায়ার মতো আমার পেছনে এঁটে থাকে, আমাকে সর্বত্র অনুসরণ করে।

এটা তুমি ঠিক জানো? আমি জানতে চেয়েছি।

হ্যাঁ, সার; এই-তো কালকেই, আপনি যখন বাড়ি ফিরে এলেন, লোকগুলো পায়ে-পায়ে ঠিক আপনার পেছন-পেছন এলো, একেবারে দরজা অব্দি, তারপর ভেতরে ঢুকে আপনি যেই দরজা বন্ধ করে দিলেন, অমনি তারা চটপট কেটে পড়লো।

নিশ্চয়ই তোমার বোঝবার কোনো ভুল হয়েছে?

মোটেই না।

লোক দুটোকে আবার দেখতে পেলে তুমি চিনবে পারবে?

নিশ্চয়ই।

বেশ, আমি হেসে ফেলেছি, দেখতে পাচ্ছি তোমার মধ্যেও গোয়েন্দা হবার মতো মালমশলা আছে। আমাদের দফতরেই তোমাকে একটা কাজ দেবার সুপারিশ করবো।

বেশ, যত-ইচ্ছে ঠাট্টা করুন। তবে আমার চোখ-দুটোয় এখনও ছানি পড়ে যায়নি–লোককে দেখে চেনবার জন্যে এখনও আমার কোনো চশমা লাগে না। কেউ-একজন যে আপনার ওপর সারাক্ষণ নজর রেখে চলেছে, এ-বিষয়ে আমার কোনোই সন্দেহ নেই। আপনার বরং উচিত হবে এরা কে তা জানবার জন্যে এদের পেছনে পুলিশের লোক লেলিয়ে দেয়া।

ঠিক আছে, তা-ই করবো না-হয়, তাকে আশ্বস্ত করবার জন্যে আমি বলেছি। আর আমাদের লোক যখন ছিনে জোঁকের মতো তাদের এটে বসবে, তখনই আমরা বুঝতে পারবো এই রহস্যময় লোকেরা আমার কাছে কী চায়।

সত্যি-বলতে, আমি তার আশঙ্কা বা উত্তেজনাটাকে খুব-একটা পাত্তা দিইনি। তবু, তার মন রাখার জন্যে, বলেছি, এবার বাইরে গেলে আমার আশপাশে কারা আছে, সেটা ভালো করে লক্ষ করে দেখবো।

তা-ই সবচেয়ে ভালো হবে, সার।

আমার এই বুড়ি দাসী অকারণেই নিজেকে সবসময় ভয় পাইয়ে দেয়; সে বলেছে, আবার যদি তাদের আমি দেখতে পাই, আপনি বাড়ির বাইরে বেরুবার আগে আপনাকে আমি তাদের কথা জানিয়ে দেবো।

ঠিক আছে! রাজি।এই বলে এই আলোচনাটায় আমি ইতি টেনে দিয়েছি। কারণ, জানাই ছিলো, তাকে যদি এ নিয়ে আরো কিছু বলতে দিই তো সে শেষটায় খোদ বীলজেবাবকে না-হোক তার দক্ষিণ হস্তটিকে আমার পেছনে এনে দাঁড় করিয়ে দেবে।

পরের দু-দিন অন্তত কেউই আমার ওপর নজর রাখেনি-বেরুবার সময়েও না, ফেরবার সময়ও না। কাজেই আমি ধরে নিয়েছি যে আমার বুড়ি দাসী আবারও কিছুই

থেকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে একটা গন্ধগোকুলের টিবি তৈরি করে বসেছে। কিন্তু বাইশে জুনের সকালবেলায় হুড়মুড় করে হাঁফাতে-হাঁফাতে সে ছুটে এসেছে ওপরতলায়, আমার ঘরে দুম করে ঢুকে পড়ে উত্তেজনায় খাবি খেতে-খেতে বলেছে :সার! সার!

কী?

আবার তারা এসে হাজির হয়েছে!

কারা?

ঐ দুই খোচর–নাছোড়বান্দার মতো!

দুই খোচর! অ্যাদ্দিন ধরে সে যে-কাহনটা ফাঁদছিলো আমি সেটা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলুম।

ঐ তারাই! রাস্তায়! ঠিক আমাদের জানলার সামনে! বাড়িটার ওপর নজর রাখছে, খেয়াল রাখছে কখন আপনি বাড়ি থেকে বেরোন।

আমি জানলার কাছে গিয়ে খড়খড়িটা একটু ফাঁক করে বেশি তুলিনি, কারণ সত্যি কেউ যদি নজর রেখে থাকে তবে তার মনে উটকো সন্দেহ ঢুকে যেতে পারে–আমি দেখতে পেলুম, সাইডওয়াকে, ফুটপাথে, দুটি লোক দাঁড়িয়ে আছে। বেশ ভালো দেখতে তাদের, স্বাস্থ্যবান, চওড়া-কাঁধ, প্রাণের প্রাচুর্যে যেন টগবগই করছে, বয়েস দুজনেরই চল্লিশের নিচে, পরনে হালফ্যাশানের পোশাক, চোখ অব্দি টেনে নামানো টুপি, ভারি পশমের কোট-পাঁৎলুন, মজবুত বুটজুতো, হাতে ছড়ি। না, কোনো সন্দেহই আর নেই, এরা সারাক্ষণ আমার বাড়ির ওপরই নজর রেখে চলেছে-আমার বাড়িতে যেহেতু কোনো দারোয়ান নেই তাতে তাদের সুবিধেই হয়েছে। তারপর, নিজেদের মধ্যে কী-সব বলাবলি করে, তারা পায়চারি করতে-করতে একটু দূরে চলে গেলো–এবং ফিরে এলো আবার, ঠিক জানলার নিচে।

তুমি ঠিক চিনতে পেরেছে এদের? এরাই সেই লোক, যারা আগেও নজর রেখেছিলো?

হ্যাঁ, সার।

না, বেঘোর-বিভ্রম বলে আর ব্যাপারটাকে উড়িয়ে দেয়া চলে না। ঠিক করলুম, এক্টা হেস্তনেস্ত করে ফেলবো। আমি নিজেই যে তাদের অনুসরণ করবো, তা হয় না, কারণ আমি নিশ্চয়ই তাদের কাছে অতি-পরিচিত। সরাসরি গিয়ে তাদের সঙ্গে কিছু বলেও ঠিক কোনো ফায়দা হবে না। কিন্তু আজই, সম্ভব হলে এক্ষুনি, আমাদের দফতরের একজন সেরা গোয়েন্দাকে আমার বাড়িটাকে পাহারা দিতে বলতে হবে। যদি তারা কালকেও আবার এসে হাজির হয়, তবে তাদের পেছন নিয়ে গিয়ে তাদের আস্তানাটা দেখে আসতে হবে–যতক্ষণ-না জানা যাচ্ছে এরা কে, বা কারা, ততক্ষণ এদের ওপর থেকে নজর সরানো চলবে না।

এখন কি তারা অপেক্ষা করে আছে জানতে, কখন আমি দফতরে যাই? কারণ, যেমন রোজই যাই, আজও তো সেখানেই যাবো আমি। যদি তারা আমার সঙ্গ নেয় তবে তাদের আমার আতিথ্য গ্রহণ করতে আমন্ত্রণও জানাতে পারি, যদিও সেজন্যে তারা আমায় কোনো ধন্যবাদ দেবে না।

আমার টুপিটা তুলে নিলুম আমি; বুড়ি দাসী সমানে জানলা দিয়ে উঁকি দিয়ে যাচ্ছে; আমি নিচে নেমে, দরজা খুলে, রাস্তায় এসে দাঁড়ালুম।

লোক দুটো সেখানে আর নেই।

সারাক্ষণ সজাগ থেকেও সেদিন আমি রাস্তায়-রাস্তায় ঘুরে বেড়াবার সময় তাদের টুপির ডগাটিও আর দেখতে পাইনি। সেইদিন থেকে আমার বুড়ি দাসী, অথবা আমি, কেউই তাদের আর বাড়ির সামনে দেখতে পাইনি, অন্য-কোনোখানেও তাদের সঙ্গে আমার আর-কোনো মোলাকাৎ হয়নি। তাদের চেহারাছিরি অবিশ্যি আমার স্মৃতিতে গাঁথা হয়ে গিয়েছিলো। এদের আমি কোনোদিনই ভুলবো না।

তাদের নজরদারির লক্ষ্য আমিই ছিলুম, এটা ধরে নিয়েও হয়তো বলা যায় যে এরা ঠিক আমার পরিচয় জেনে নিতে পারেনি–অর্থাৎ আমায় শনাক্ত করতে পারেনি।

একবার আমার আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে তারা এখন আর আমার পেছনে ছায়ার মতো, লেগে নেই। কাজেই শেষটায় আমার মনে হলো মা, অ, ও-র চিঠিটা যেমন, এও বোধকরি তেমনি-কোনো ব্যাপার : গুরুত্বহীন, এলেবেলে।

তারপর চব্বিশে জুন, এমন-একটা নতুন ঘটনা ঘটলো যে তাতে আগেকার অলৌকিক জলয়ান বা স্বতশ্চল শকটের মতোই এই নতুন ঘটনায় জনসাধারণের এবং আমার কৌতূহল বেজায় উসকে উঠলো। ওয়াশিংটন ইভনিংস্টার নিচের বিবরণটি দিয়ে হুলুস্থুল বাধিয়ে দিলে সবখানে, আর পরদিন ভোরে সবগুলো কাগজেই সেই বিবরণ বিশদভাবে বেরুলে।

টোপেকা থেকে চল্লিশ মাইল পশ্চিমে, ক্যানসাস-এ কিরডাল নামে একটা হ্রদ আছে, যার কথা খুব বেশি লোকের জানা নেই। অথচ এই হ্রদটার কথা সকলেরই জানা উচিত ছিলো, এবং আশা করা যায় সবাই এখন থেকে লেক কিরডাল সম্বন্ধে আগ্রহী হবে–কেননা একটি ভারি অদ্ভুত ঘটনার ফলে এর দিকে সকলের মনোযোগ আকৃষ্ট হয়েছে।

চারপাশে দুর্গম পাহাড়, মাঝখানে এই হ্রদ, সেখান থেকে জল বেরুবার কোনো রাস্তাই বোধহয় নেই। মেঘ হয়ে, বাষ্প হয়ে যা উবে যায়, তাকেই পূরণ করে দেয় আশপাশের ছোটো-ছোটো পাহাড়ি সোঁতা আর বর্ষার মুলধারে বৃষ্টি।

লেক কিরডাল প্রায় পঁচাত্তর বর্গমাইল আয়তনে, আর যে-পাহাড়গুলো তাকে ঘিরে আছে তার চাইতে তার উপরিতল অল্প-একটু নিচে। পাহাড়ের মধ্যে বন্দী, সেখানে পৌঁছুতে গেলে পেরুতে হয় সংকীর্ণ ও উপলবন্ধুর কতগুলো নয়ানজুলি। তার তীরগুলোয় অবশ্য কতগুলো ছোটো-ছোটো পাড়াগাঁ গজিয়ে উঠেছে। হৃদে অজস্র মাছ আছে, জেলেডিঙিগুলো সারাক্ষণই ঘুরে বেড়ায় হৃদের জলে।

কোনো-কোনো জায়গায় লেক কিরডাল পঞ্চাশ ফিট গভীর, তাও তীরের আশপাশেই। এই বিশাল অববাহিকার ধারে-ধারে উঠে গিয়েছে তীক্ষ্ণ, ধারালো পাথর। জোরে যখন হাওয়া দেয়, ঢেউগুলো খ্যাপার মতো তীরে আছড়ায়, কাছাকাছি যে-সব বাড়ি থাকে, তাতে পিচকিরির মতো জল ঝরে পড়ে, কখনও প্রায় হারিকেনের মতোই তীব্র। লেকটা তীরের কাছেই জায়গায় জায়গায় বেশ গভীর, মাঝখানটা আরো-গভীর, সেখানে কোথাও-কোথাও মেপে দেখা গেছে যে সেখানে তিনশো ফিটেরও বেশি জল আছে।

এখানকার মাছের ব্যাবসা বেশ কয়েক হাজার লোকেরই জীবিকানির্বাহের উপায়, শুধু-যে কয়েকশো জেলেডিঙিই আছে সেখানে তা নয়, গোটা বারো ছোটো-ছোটো স্টীমারও রয়েছে ধীবরদের সাহায্যের জন্যে। পাহাড়ের গণ্ডিটা পেরিয়ে গেলে পৌঁছুনো যায় রেলের রাস্তায়,– যেখান থেকে মাছ চালান হয় গোটা ক্যানসাস রাজ্যে, ও আশপাশের রাজ্যেও।

আমরা যে-চমকপ্রদ ঘটনার বিবরণ দিতে বসেছি, সেটা বোঝবার জন্যে লেক কিরড়ালের এই পরিচয় মনে-করে-রাখা খুবই জরুরি।

কিছুকাল ধরে, জেলেরা লক্ষ করছে লেকের জলে মাঝে-মাঝেই তুমুল আলোড়ন উঠছে। কখনও জল এতটাই ফেনিয়ে ফুলে ওঠে যে মনে হয় কিছু-একটা যেন ভেতর থেকে গা ঝাড়া দিয়ে সবেগে উঠে আসতে চাচ্ছে। এমনকী আবহাওয়া যখন অতীব প্রশান্ত, যখন– কোথাও কোনো হাওয়ার রেশমাত্র নেই, তখনও মাঝে-মাঝে ফেনিয়ে চর্কি দিয়ে জল স্তম্ভের মতো উঠে আসে।

প্রচণ্ড ঢেউ আর ব্যাখ্যাতীত সব চোরাস্রোতের পাল্লায় পড়ে, কোনো-কোনো জেলেডিঙি পাগলের মতো আছড়ায় জলে, আয়ত্তের, বাইরে চলে যায়। কখনও একটার গায়ে আরেকটা এসে প্রচণ্ড বেগে আছড়ে পড়ে, ধাক্কা খায়, তার ফলে অনেক নৌকোরই সমূহ ক্ষতি হয়েছে, এই ক-দিনে।

জলের এই দুর্দম আলোড়নের স্পষ্টতই কোনো উৎস আছে এই লেকের গভীরে; ব্যাপারটা বোঝাবার জন্যে অনেকরকম ব্যাখ্যা দেবারই চেষ্টা করা হয়েছে। প্রথমে, এরকম-একটা মত শোনা গিয়েছিলো যে, এই উৎপাতের মূল কারণ হয় জলের তলায় কোনো ভূকম্পন অথবা কোনো আগ্নেয়গিরির আড়মোড়া ভাঙা। কিন্তু, এই অনুমানটিকে এই জন্যেই বাতিল করতে হয়েছে যে জলের এই আলোড়ন কোনো-একটা বিশেষ জায়গাতেই সীমাবদ্ধ নয়, যখন-তখন যে-কোনোখানে, সারা হ্রদেই, এই জলস্তম্ভ ফিনকি দিয়ে উঠে যেতে পারে। এই তীরে, ঐ তীরে, মাঝখানে কিংবা পাড় ঘেঁসে, প্রায় একটা সরলরেখায় এই জলস্তম্ভ ছুটে চলে–আর তাইতে ভূমিকম্প বা আগ্নেয়গিরির কথাটা পুরোপুরি বাতিল করে দিতে হয়েছে।

আরো একটা অনুমান একসময় বেশ চলেছিলো, লোকে ৮ ভেবেছিলো বুঝি কোনো অতিকায় জলরাক্ষস এসে এখানে আশ্রয় নিয়েছে, সে-ই জলের মধ্যে এমন অস্থির আলোড়ন তোলে। কিন্তু জন্তুটি যদি এই হ্রদে জম্মে না-থাকে, এবং এই হ্রদেই যদি সে এমন অতিকায় আকার না-নিয়ে থাকে, যেটা বোধকরি আদৌ বিশ্বাস্য নুয়–তাহলে সে নিশ্চয়ই বাইরে থেকে একদিন এখানে এসে হাজির হয়েছে। লেক কিরডালের সঙ্গে, আবারও মনে করিয়ে দিই, অন্যকোনো জলাশয়ের কোনো যোগাযোগই নেই। লেকটা যদি কোনো সমুদ্রের ধারে অবস্থিত হতো, হয়তো জলের তলায় গভীর-গোপন খাল থাকতে পারতো; কিন্তু মার্কিন মুলুকের একেবারে মাঝখানে, সমুদ্রতল থেকে কয়েক হাজার ফিট ওপরে, এ-রকম কিছুই হতে পারে না। অর্থাৎ, এটা এমনই-একটি ধাঁধা যার উত্তরটা কারুই জানা নেই; এই হিংটিংছট হেঁয়ালিটির কী কী যে সুষ্ঠু সমাধান নয়, তা বলা যতখানি সহজ, এর সত্যিকার মীমাংসাটা যে কীসে, সেটা বলা তার চেয়ে শতগুণে কঠিন।

এমন কি সম্ভব যে লেকের জলের তলায় কেউ কোনো ডুবোজাহাজ নিয়ে নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছে? ডুবোজাহাজ তো আজ আর কল্পনার সামগ্রী নয়, অসম্ভবও নয়। কাপ্তেন নেমোর নটিলাসএর কথা বাদ দিলেও, এটা নিশ্চয়ই অনেকে জানেন যে কয়েক বছর আগে কানেটিকাটের ব্রিজপোর্টে দ্য প্রোটেক্টর নামে একটা জাহাজ ভাসানো হয়েছিলো, সেটা জলের ওপর দিয়ে যেমন যেতে পারতো, জলের তলাতেও তেমনি সে অবাধে আনাগোনা করতে পারতো, এমনকী সেটা ছিলো উভচর-ডাঙার ওপর দিয়েও চলাফেরা করার ক্ষমতা তার ছিলো। লেক নামক এক বৈজ্ঞানিক এই প্রোটেক্টর-এর উদ্ভাবন করেছিলেন, তার ছিলো দুটি মোটর, যেটা বিদ্যুতে চলতো সেটা ছিলো পঁচাত্তর অশ্বশক্তির, আর যেটা গ্যাসোলিনে অর্থাৎ পেট্রলে চলতো সেটা ছিলো আড়াইশো অশ্বশক্তির, তার আবার একগজ বেড়ের চাকাও ছিলো একাধিক, যার সাহায্যে সে ডাঙার ওপর দিয়ে গড়গড় করে চলে যেতে পারতো–সমুদ্রেও সাঁৎরে যেতে পারতো।

কিন্তু তৎসত্ত্বেও, যদি ধরেই নেয়া যায় যে লেক কিরডালে জলস্তম্ভ ওঠায় কোনো শক্তিশালী ডুবোজাহাজ, আগেরগুলোর চাইতে যেটা আরো-নিখুঁত, তবু এই ধাঁধাটা থেকেই যায় : এই ডুবোজাহাজ লেক কিরডালে এসে পৌঁছুলো কী করে। পাহাড় দিয়ে ঘেরা এই হ্রদ কোনো জলরাক্ষসের কাছে যেমন, কোনো ডুবোজাহাজের কাছেও তেমনি অগম্য।

যেভাবেই এই হেঁয়ালিটির সমাধান হোক না কেন, এই অত্যদ্ভুত ব্যাপারটির সত্যতা সম্বন্ধে বিশে জুনের পর থেকে আর-কোনো সন্দেহ নেই। সেদিন, অপরাহ্নে স্কুনার মার্কেল সব পাল খাঁটিয়ে তরতর করে ভেসে যাচ্ছিলো, হঠাৎ সে জলের তলায় কিসের সঙ্গে যেন প্রচণ্ড ধাক্কা খায়, সেখানে কাছাকাছি কোনো ডুবোপাহাড়, বা পাথর, ছিলো না–কেননা হ্রদটা সেখানে ছিলো অন্তত নব্বই ফিট গভীর। স্কুনারটির গলুই এবং পাশ ভয়ংঙ্কর চোট খেয়ে জখম হয়ে যায়, প্রায় ডুবেই যাচ্ছিলো। তার ডেকগুলো সম্পূর্ণ ডুবে যাবার আগে সে কোনোমতে ধুঁকতে ধুঁকতে তীরে এসে পৌঁছুতে পেরেছিলো।

যখন পাম্প করে জল সরিয়ে মার্কেলকে ডাঙায় ভোলা হয়, পরীক্ষা করে দেখা যায় যে কোনো চোখা ধারালো কিছুর সঙ্গে ঘা খেয়ে তার গলুইটা একেবারেই ভেঙে গিয়েছে।

এ থেকে বোঝা যায় যে লেক কিরডালের জলের তলায় সত্যিই কোনো পরম শক্তিশালী ডুবোজাহাজ অত্যন্ত দ্রুতবেগে ছুটোছুটি করে বেড়ায়।

এটা অবশ্য সত্যিই ব্যাখ্যার অগম্য। শুধু-যে এই ধাঁধাটার কোনো উত্তর নেই-ডুবোজাহাজটা সেখানে গেলে কী করে, তা-ই নয়, এটাও একটা বড়ো প্রশ্ন : ঐ ডুবোজাহাজ লেক কিরডালের জলের তলায় কী করছে? কেন সে কখনও জলের ওপর ভেসে ওঠে না? কেন তার উদ্ভাবক বা মালিক এ-রকমভাবে আত্মগোপন করে আছে? তার এই উদ্দাম ছোটাছুটির জন্যে আরো-কত বিপর্যয় বা সর্বনাশ আমরা প্রত্যাশা করবো?

সেদিন ছিলো একটা রহস্যময় স্বতশ্চল শকট, তারপর এলো রহস্যময় জলযান। এখন এসে হাজির এক রহস্যময় ডুবোজাহাজ–যেন নটিলাসেরই দোসর।

আমরা কি তবে এই সিদ্ধান্ত করবো যে তিনটি এনজিনই একই উদ্ভাবকের দুর্দান্ত প্রতিভার পরিচায়ক? এও কি হতে পারে এই তিনই আসলে একটিই যান–একে-তিন-তিনে-এক সর্বত্রগামী অসীম শক্তিশালী কোনো শকট?

.

. যেমন করেই হোক

ইভনিং স্টার-এর ইঙ্গিতটা প্রায় যেন কোনো উদ্ভাস, যেন কোনো দিব্যদৃষ্টির ফল । সকলেরই সেটা মনে ধরে গেলো। এই তিনটি যন্ত্র যে একই উদ্ভাবকের প্রতিভার ফসল তাই নয়, তিনটি যন্ত্রই আসলে এক–ভিন্ন-ভিন্ন কোনো যান নয়। ডাঙায় যেটা চলে, সেটা জলের ওপরেও ভাসে, আবার জলের তলা দিয়েও চলে যায়–একে-তিন-তিনে এক–কিন্তু কেমন করে যে একটি যান থেকে তার অন্য যানে রূপান্তর হয়, সেটা অবশ্য সহজে বোঝা যায় না। কেমন করে একটা মোটরগাড়ি জাহাজ হয়ে যায়? তারপর সেটা, আবার, ডুবোজাহাজ? এই চমকপ্রদ যান যেন একটা জিনিশই করতে পারে না–এখনও জানে না কী করে আকাশপথে উড়ে যেতে হয়। তবে এই তিনটি যান সম্বন্ধে এখন অনেক তথ্যই জানা : কী তাদের আকৃতি, কেমন গড়ন, তাদের চলার পথে না-থাকে গন্ধ না-থাকে বাষ্পজনিত কোনো ধোঁয়া, আর তাদের ঐ সব-হার-মানানো চমকপ্রদ দুর্ধর্ষ গতি–এই সমস্তকিছু জুড়ে দিয়েই এখন তাদের শনাক্ত করা গেছে একই যান বলে। জনসাধারণ পর-পর এত-সমস্ত আশ্চর্যের বাহার দেখে কেমন যেন থম মেরে গিয়েছিলো, এবার এই অভিনব আশ্চর্যটি আবার তাদের কৌতূহল উসকে দিলে।

খবরকাগজগুলো এখন কেবলই এই আশ্চর্য উদ্ভাবনের গুরুত্ব সাতখানা করে ব্যাখ্যান করছে। এই নতুন এনজিন, তা সে একটী যানের মধ্যেই পোরা থাক অথবা তিনটে ভিন্ন-ভিন্ন যানে, অনায়াসেই বুঝিয়ে দিতে পেরেছে তার কেরামতি। তাক লাগিয়ে দেবার মতোই ক্ষমতা ধরে এই এনজিন। যে-কোনো দামে, যে-করেই-হোক, যেন তেনপ্রকারেণ কিনে নিতে হবে একে দখল করে নিতে হবে। সারা জাতির ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের উচিত এক্ষুনি এই এনজিনটা কিনে নেয়া। সন্দেহ নেই, ইওরোপের হাষড়া শক্তিগুলোও যে-কোনো-প্রকারে এই যন্ত্রটাকে হাতিয়ে নিতে চাইবে-সামরিক শক্তির কথা বিবেচনা করলে এই যন্ত্রের দারুণ সম্ভাবনার কথা অস্বীকার করবে কে? জলে-ডাঙায় কী প্রচণ্ড শক্তি পাবে, যদি কোনো রাষ্ট্র এই এনজিনটা কিনে নিতে পারে। এর গুণপনাই বা কী, সীমাবদ্ধতাই বা কী–এ-সব জানা না-গেলে এর বিধ্বংসী ক্ষমতা অবশ্য পুরোপুরি আঁচ করা যাবে না। এর গুপ্তরহস্যটা যদি জানা যায়, তবে কুবেরের ভাণ্ডারও উজাড় করে দেয়া যায়: আমেরিকা তার কোটি-কোটি ডলার এর চেয়ে ভালো আর-কীসের জন্যে খরচ করতে পারতো?

কিন্তু যন্ত্রটা কিনে নিতে হলে যে তার উদ্ভাবকের সন্ধান পাওয়া চাই। আর সেটাই তো দেখা যাচ্ছে সবচেয়ে কঠিন কাজ। খামকাই লেক কিরডালের জল তোলপাড় করে এই কিনার থেকে সেই কিনার অব্দি খোঁজা হলো। এমনকী সবখানে জলের গভীরতাও তন্নতন্ন করে মেপে দেখা হলো। উঁহু, উদ্ভাবকের কোনো খোঁজ নেই–সে তার যন্ত্রটা নিয়ে বেমালুম যেন হাওয়ায় উবে গিয়েছে। তবে কি ধরে নিতে হবে ডুবোজাহাজটা আর ঐ জলে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে নেই? কিন্তু তা যদি হয়, তবে এই ডুবোজাহাজ এখান থেকে চলে গেলে কী করে? আর সেই কথা যদি ওঠে, তবে এই ধাঁধাটারই বা উত্তর কী-যন্ত্রটা এখানে আগে এসেছিলোই বা কেমন করে? দুর্বোধ রহস্য, দুর্ভেদ্য!

ডুবোজাহাজের কথা আর-কোথাও শোনা যায়নি, না লেক কিরলে, না-বা অন্য কোথাও। ডাঙার রাস্তা থেকে যেমন একদিন উধাও হয়ে গিয়েছিলো স্বতশ্চল শকট, আমেরিকার জল থেকে যেমন একদিন উধাও হয়ে গিয়েছিলো ঐ অলৌকিক জলযান, ঠিক তেমনিভাবেই এই দুর্ধর্ষ ডুবোজাহাজ এখন লেক কিরডালের জল থেকে উধাও হয়ে গিয়েছে। মিস্টার ওয়ার্ডের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে আলোচনা করবার সময়ে আমরা বারে বারে এই প্রসঙ্গটায় ফিরে গেছি। আমাদের চরেরা হাজার চোখকান দিয়ে সবখানে কড়া নজর রেখেছে–অন্য দেশেরও চর নিশ্চয়ই আছে এমন কিন্তু তার চিহ্নমাত্রও যেন কোথাও নেই।

সাতাশে জুনের সকালবেলায় মিস্টার ওয়ার্ডের ঘরে আমার তলব হলো।

শোনা, স্ট্রক, কোনো ভনিতা না-করেই ঘরে পা দেবামাত্র মিস্টার ওয়ার্ড আমায় বলেছেন, এতদিনে তোমার কাছে শোধ নেবার একটা চমৎকার সুযোগ এসেছে।

গ্রেট আইরির ব্যর্থতার শোধ?

নিশ্চয়ই।

কী সুযোগ? উনি কি ঠাট্টা করছেন, না সীরিয়াসভাবে বলছেন? কোন সূযোগ?

বা রে, এই-তো, মিস্টার ওয়ার্ড বলেছেন, সুবর্ণসুযোগ! এই একে-তিন-তিনে এক যানটার বাহাদুর বৈজ্ঞানিকটিকে তুমি খুঁজে বার করতে চাও না?

চাই, মিস্টার ওয়ার্ড। আমাকে শুধু একবার ব্যাপারটার দায়িত্ব দিয়ে দেখুন, আমি একেবারে অসাধ্যসাধন করে ফেলবোসফল হতে গেলে যা-যা করতে হবে তা-ই করবো। আমি জানি, কাজটা খুব-একটা সহজ হবে না।

কঠিন কাজ, স্ট্রক, কঠিন কাজ। হয়তো গ্রেট আইরির পাষাণ ভেদ করে ভেতরে যাবার চেষ্টা করার চাইতেও কঠিন।

স্পষ্ট বুঝতে পারছিলুম, আমার ব্যর্থতার কথা তুলে মিস্টার ওয়ার্ড আমায় তাতিয়ে দিতে চাচ্ছেন। এটা আমি জানতুম যে আমার প্রতি তার অগাধ আস্থা না-থাকলে গ্রেট আইরির কথা তিনি এখন তুলতেন না। নিশ্চয়ই আমার মধ্যে জেদ জাগিয়ে দেবার জন্যেই কথাটা তিনি তুলেছেন। আমাকে তিনি ভালোই জানেন; এটাও জানেন যে আগের বারের হার মানার শোধ তোলবার জন্যে আমি মরীয়া হয়ে উঠবো। আমি শুধু চুপচাপ বসে তার নির্দেশেরই অপেক্ষা করেছি।

মিস্টার ওয়ার্ড ঠাট্টা ছেড়ে দিয়ে এবার সীরিয়াসভাবেই বলেছেন : আমি জানি, স্ট্রক, যে তুমি মানুষের সাধ্যে যতটুকু কুলোয় তার সবটাই করেছিলে; কোনো গাফিলতির দোষ অন্তত তোমার ঘাড়ে চাপানো যায় না। কিন্তু এখন আমরা যে-রহস্যটার মাথামুণ্ডু বুঝতে গিয়ে নাজেহাল হচ্ছি, গ্রেট আইরির রহস্যের চাইতে তা একেবারেই অন্যরকম। যেদিন সরকার চাইবেন যে গ্রেট আইরির পাথর উড়িয়ে দিয়ে ভেতরে কী আছে দেখবেন সেইদিনই সরকার সেটা করতে পারবেন। আমাদের শুধু কয়েক হাজার ডলার ওড়াতে হবে–আর অমনি–চিচিং ফাঁক–রাস্তাটা খুলে যাবে।

আমি অন্তত সেটাই করতে বলবো।

কিন্তু এখন, মিস্টার ওয়ার্ড মাথা নেড়ে বলেছেন, আমাদের কাছে আরো-জরুরি হলে এই অদ্ভুতকর্মা বৈজ্ঞানিকটিকে হাতে পাওয়া–সে যেন ঈল মাছের মতো বারে বারে ৩মাদের হাত থেকে পিছলে বেরিয়ে যাচ্ছে। এ-কাজটা একজন গোয়েন্দার–সত্যি-বলতে, একজন ধুরন্ধর গোয়েন্দার কাজ।

তার আর-কোনো নতুন খবর পাওয়া যায়নি?

না। আর যদিও এ-কথা বিশ্বাস করার যথেষ্ট সংগত কারণ আছে যে সে ছিলো এবং এখনও আছে-হা, লেক কিরডালেরই জলের তলায় –অথচ তবু কোত্থাও তার কোনো হদিশ পাওয়া যায়নি। মাঝে-মাঝে মনে হয় লোকটার বুঝি জাদুগরদের মতো নিজেকে অদৃশ্য করে ফেলবার ক্ষমতা আছে–এই যন্ত্রবিদদের প্রোটেউস বোধহয় মায়াবী। কেউ!

আমার তো মনে হয়, আমি তখন বলেছি, সে স্বেচ্ছায় দেখা না-দিলে কেউ তাকে কোনোদিন চোখেও দেখতে পাবে না।

তুমি ঠিক কথাই বলেছো, স্ট্রক। আর আমার মনে হয় তার সঙ্গে বুদ্ধির প্যাঁচ কষার চাইতে বরং অন্য-একটাই রাস্তা আছে আমাদের : তার আবিষ্কারের জন্যে এমন বিপুল অঙ্কের পুরস্কার ঘোষণা করা যে সে তখনই আর তার উদ্ভাবন নিয়ে এসে হাজির হবে।

মিস্টার ওয়ার্ড ভুল বলেননি। সরকার সত্যি এরই মধ্যে এই যুগন্ধর বৈজ্ঞানিকের সঙ্গে কথাবার্তা চালাবার জন্যে অনেক চেষ্টা করেছেন, তাকে যুগন্ধর বলে অন্যায়ও কিছু করেননি সরকার, কারণ, সত্যি-তো, আর কাকেই বা এই খেতাব মানাতো? খবরকাগজগুলো ফলাও করে এই খবর ছাপিয়েছে এবং এই অসাধারণ মানুষটি নিশ্চয়ই এতটা হাঁদা নন যে তিনি জানেন না সরকার তার কাছ থেকে কী চান–এবং তাও আবার তিনি যে-শর্ত আরোপ করতে চান, সেই শর্তেই।

সত্যি-বলতে, মিস্টার ওয়ার্ড বলেছেন, এই আবিষ্কার তার নিজের আর-কোন ব্যক্তিগত কাজে লাগবে যে তাকে সবকিছু আমাদের কাছ থেকে চেপে রাখতে হবে? কেন-যে তাকে আবিষ্কারটা বিক্রি করতে হবে, তার পেছনে হাজারটা কারণ আছে। প্রশ্ন হচ্ছে : এই অজ্ঞাতকুলশীল মহাশয়টি কি এর মধ্যেই দুর্বত্তগিরিতে এতটাই হাত পাকিয়েছেন যে তার অদ্ভুতকর্মা যন্ত্রের সাহায্যে সকলের চোখে ধুলো দিয়ে চিরকাল আড়ালে-আড়ালেই থাকতে চান? তিনি কি ভেবেছেন যে সকলের হাত এড়িয়ে তিনি পার পাবেন?

মিস্টার ওয়ার্ড তারপর বিশদ করে বলেছেন এই আবিষ্কর্তাকে আবিষ্কার করার জন্যে কী-কী সব অন্য উপায় অবলম্বন করা হয়েছে। এমনও হতে পারে যে বেপরোয়াভাবে কোনো দুঃসাহসিক ও বিপজ্জনক কাজে যন্ত্রটা চালাতে গিয়ে সে তার যন্ত্রেরই সঙ্গে সঙ্গে ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। তা যদি হয়ে থাকে, তবে ঐ ভেঙে-পড়া যন্ত্রটাও যন্ত্রজগতে অন্যদের কাছে মহামূল্যবান ও শিক্ষণীয় বলে গণ্য হবে। কিন্তু স্কুনার মার্কেল-এর সঙ্গে লেক কিরড়ালে আচমকা ধাক্কা লাগার পর থেকে, তার সম্বন্ধে কোনো খবরই এ-যাবৎ পুলিশের কাছে এসে পৌঁছোয়নি।

এই কথা বলবার সময় মিস্টার ওয়ার্ড কিছুতেই তার হতাশা ও উদ্বেগ চেপে রাখতে পারেননি। হ্যাঁ,উজেগও, কারণ জনসাধারণকে বিপদ-আপদের হাত থেকে রক্ষা করার দায়িত্বটা ক্রমেই তার কাছে খুব কঠিন হয়ে পড়ছে। কেমন করে আমরা দুবৃত্তদের গ্রেফতার করবো, যদি তারা এমন বিদ্যুদ্বেগে জলে বা ডাঙায় পালিয়ে যেতে পারে? কেমন করেই বা সমুদ্রের তলায় গিয়ে আমরা তার পেছন নেব? আর যখন বেলুনবিদ্যাও চূড়ান্ত উন্নতি করে বসবে, তখন আমাদের কিনা আকাশেও দুবৃত্তদের পেছনে ধাওয়া করতে হবে! আমি ভাবছিলুম কালক্রমে আমি এবং আমার সহকর্মীরা একান্তই অসহায় হয়ে পড়বে কি না! যদি পুলিশবিভাগ সমাজের কোনো কাজেই না লাগবে, সমাজ তবে এত টাকা খরচ করে খামকা তাকে পুষবে কেন?

এটা ভাবতেই আমার হঠাৎ সেই-পাওয়া হুমকিটার কথা মনে পড়ে গেলো– টিটকিরির সঙ্গে-সঙ্গে সেখানে আমাকে আবার বেশ করে শাসানো হয়েছে। এও মনে পড়ে গেলো, তখন তারা সর্বক্ষণ আমরা ওপর নজর রাখছিলো। মিস্টার ওয়ার্ডকে কি সব কথা এখন খুলে বলবো? কিন্তু এখন হাতে যে-সমস্যাটা এসে পড়েছে, যা নিয়ে আমরা সবাই চোখে সর্ষেফুল দেখছি, তার সঙ্গে তো এদের কোনো সম্পর্ক আছে বলেই মনে হয় না। গ্রেট আইরির রহস্যটা সরকার তো আপাতত শিকেয় তুলে রেখেছে।–যেহেতু এখন আর কোনো অগ্ন্যুৎপাতের আশঙ্কা আগের মতো ভয় দেখাচ্ছে না। এখন বরং সরকার আমাকে নতুন একটা তদন্তে লাগাতে চাচ্ছে। তাহলে পরেই না হয় একদিন মিস্টার ওয়ার্ডকে এই চিঠির কথা খুলে বলবো-তখন হয়তো এই বিদঘুঁটে ঠাট্টাটাকে আর কাটা ঘায়ে নুনের ছিটের মতো লাগবে না।

মিস্টার ওয়ার্ড তখনও বলে চলেছেন : আমরা ঠিক করেছি যে-করেই হোক এই আবিষ্কর্তার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করবো। সত্যি-যে সে এখন উধাও হয়ে গিয়েছে; কিন্তু সে যে-কোনো মুহূর্তে এই মস্ত দেশটার যে-কোনো অংশে ফের এসে উদয় হতে পারে। আমি ঠিক করেছি সে আবার আবির্ভূত হবামাত্র তুমি তার পেছন নেবে। যে কোনো মুহূর্তে ওয়াশিংটন ছেড়ে বেরিয়ে পড়বার জন্যে তোমাকে তৈরি থাকতে হবে। ককখনো তোমার বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ো না।–শুধু দিনে একবার করে এই দফতরে এসে হাজিরা দিয়ে যাবে। বাড়ি থেকে বেরুবার সময় টেলিফোন করে আমায় জানাবে, আর এখানে এসেই সটান আমার সঙ্গে এসে দেখা করবে।

আপনি যা বলবেন, তা-ই হবে। আমি উত্তর দিয়েছি। কিন্তু একটা প্রশ্ন করতে পারি কি? আমাকে কি একাই কাজ করতে হবে, না সঙ্গে আর-কেউ–

আমাকে থামিয়ে দিয়ে বড়োকর্তা বলেছেন : আমি চাই যে তুমি নিজেই এখান থেকে দুজন লোক বেছে নাও-যাদের তোমার মনে ধরে তাদের

ঠিক আছে। তা-ই হবে। তবে, ধরুন, কখনও যদি এই আবিষ্কর্তার মুখোমুখি পড়ি, তখন আমি তাকে নিয়ে কী করবো?

আর যা-ই করো, ককখনো তাকে চোখের আড়াল কোরো না। আর-কোনো উপায় যদি না-থাকে, তবে তাকে গ্রেফতার কোরো। তোমার সঙ্গে সবসময় একটা গ্রেফতারি পরোয়ানা থাকবে।

সে না-হয় হলো। কিন্তু সে যদি তার যানে লাফিয়ে ওঠে, আর অমন তীরের মতো তার যান ছোঁটায়, তাহলে তাকে আমি থামাবো কী করে? ঘণ্টায় দুশো মাইল বেগে যে তার যান চালাতে পারে, তার সঙ্গে তর্ক করার সময় কোথায় পাবো?

সে যাতে দুশো মাইল বেগে তার যান ছোটাতে না পারে, তোমাকে তারই চেষ্টা করতে হবে, স্ট্রক। আর তাকে গ্রেফতার করেই আমাকে টেলিগ্রাম কোরো। তারপর থেকে পুরো ব্যাপারটার দায়িত্ব আমার কাঁধে থাকবে।

যতই দুঃসাধ্য হোক, আপনি আমার ভরসা করতে পারেন, মিস্টার ওয়ার্ড দিনে রাতে, যে-কোনো সময় রওনা হবার জন্যে আমি আমার সহকর্মীদের নিয়ে তৈরি থাকবো। মামলাটার ভার আমাকে দেবার জন্যে আবারও আপনাকে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। আমি যদি এর কোনো সুরাহা করতে পারি, তবে সে-যে কী গৌরবের এবং লাভের ব্যাপার হবে, তা বুঝিয়ে বলা যাবে না, এই তো? এই বলে আমার রডোকর্তা সেদিনকার মতো আলোচনার ইতি টেনেছেন।

বাড়ি ফিরে এসে আমি যাত্রার তোড়জোড় শুরু করে দিলুম কবে, কোথায়, কখন, কতদিনের জন্যে বেরুবো, কিছুই জানা নেই। আমার তোড়জোড় দেখে আমার বুড়ি দাসী ভাবছিলো আমি বুঝি ফের গ্রেট আইরিতে যাবার উদযোগ করছি-সে-জায়গাটা তো অর কাছে জাহান্নামের খাশমহাল বৈ আর কিছু নয়। মুখে কিছু বললো না বটে, কিন্তু এমনভাবে নিজের কাজ করতে লাগলো যে আমি যেন এর মধ্যেই খোদ বীলজেবারের কবলে পড়েছি। জানি যে সে কখ গুপ্তকথা ফাঁস করবে না, তবু আমি আসল কথা কিছুই বলিনি। এই দুরূহ কাজে কাউকেই কিছু খুলে বলা যাবে না।

দফতরের কোন-দুজনে আমার সঙ্গে যাবে, সেটা বেছে নিতে আমার একটু দেরি হয়নি। দুজনেই আমার সঙ্গে আমার বিভাগে কাজ করে, অনেকবার তাঁরা আমার সঙ্গে কাজও করেছে–চটপটে, চেকশ, কর্মঠ, সবসময়েই টগবগ করে ফুটছে, আবার বুদ্ধিও ধরে। এদের একজন ইলিনয়-এর জন হর্ট, বয়েস তিরিশ; অন্য জন, বয়েস বত্রিশ, ম্যাসাচুসেটসের ন্যাব ওয়াকার। এদের চাইতে ভালো সহকর্মীর কথা আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারতুম না।

কয়েকদিন কেটে গেলো, কিন্তু কিছুরই কোনো খবর নেই, না সেই গাড়ির, না সেই জাহাজের, না-বা সেই ডুবোজাহাজের। গুজব কিন্তু ছড়াচ্ছিলো হাজার মুখে, কিন্তু পুলিশ জানতো সবই মিথ্যে। আর যে-রকম উদ্দাম বলগাছাড়া কল্পনার পরিচয় দিয়ে খবরকাগজগুলো খবর ছাপতে লাগলো, তাদের কোনোটারই কোনো বাস্তব ভিত্তি ছিলো না। সত্য নয় জেনেও এই হুজুগে আজগুবি কোনো খবর ছাপবার প্রলোভন অন্তত কোনো কাগজই ছাড়তে রাজি ছিলো না–এই মওকায় যদি কাগজের কাটতি বাড়িয়ে নেয়া যায়, ক্ষতি কী।

তারপর, পর পর দু-বার, প্রতিবেদন এলো, আমাদের এই প্রহরের মহামানবটি নাকি আবার দেখা দিয়েছেন। প্রথমটায় জানা গেলো, তাকে নাকি দেখা গেছে আরকানসাসের রাস্তায়, লিটল রকে। দ্বিতীয়টায় জানা গেলো, তাকে নাকি দেখা গেছে লেক সুপিরিয়রের অথই জলে।

পুলিশের কাছে পাকা খবর এলেও কী হবে–এই দুটি তথ্যকে একেবারেই মেলানো যাচ্ছিলো না। কেননা প্রথমটা তার আবির্ভাবের সময় দিয়েছে ছাব্বিশে জুনের অপরা, আর দ্বিতীয়টার সময় সেই দিনই সন্ধেবেলা। এখন, মার্কিন মুলুকের এই দুটো জায়গার মধ্যে দূরত্ব কম করেও তো না-হোক কোন-না আটশো মাইল হবে। যদি ধরেও নেয়া যায়, যে এ-যাবৎ যত স্বতশ্চল শকট দেখা গেছে তার তুলনায় এই অভূতপূর্ব যন্ত্রের গতি প্রায় অচিন্ত্যনীয়ই, কিন্তু মধ্যবর্তী অঞ্চলটা সে কারু চোখে না-পড়ে পেরুবে কী করে? কেমন করে সে পর-পর পেরিয়ে আসবে আরকানসাস, মিসুরি, আইওয়া, উইসকনসিন, এ-কিনার থেকে ও-কিনার, অথচ আমাদের চরেরা তার কোনো আঁচই পেলে না, কেউই ছুটে গেলো না সবচেয়ে কাছের টেলিফোনে?

এই দুই আশ্চর্য আবির্ভাবের পর, যদি অবশ্য তাদের আবির্ভাব বলা যায়, যন্ত্রটি আবার যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো। খবর যখন এসে পৌঁছেছিলো, তখন আর ও দুই জায়গার কোনোটাতেই যাবার কোনো মানে হতো না–মিস্টার ওয়ার্ড অন্তত আমাদের কাউকেই ও-সব জায়গায় পাঠাতে চাননি। অথচ এই অদ্ভুতকর্মা যন্ত্রটি যেহেতু এখনও ধ্বংস হয়ে যায়নি, কিছু-একটা তো করা উচিত। মার্কিন মুলুকের সব খবরকাগজেই তেসরা জুলাই নিচের এই সরকারি বিজ্ঞপ্তিটি বেরুলো, তার বয়ানটা রীতিমতো গুরুগম্ভীর।

বর্তমান বৎসরের বিগত এপ্রিল মাসে একটি স্বতশ্চল শকট পেনসিলভ্যানিয়া, কেনটাকি, ওহায়ো, টেনোসি, মিসুরি এবং ইলিনয় প্রদেশের বিভিন্ন রাস্তায় চলাফেরা করিয়াছিল; এবং, সাতাশে মে তারিখে, আমেরিকান অটোমোবাইল ক্লাব যে মোটররেসের আয়োজন করিয়াছিল, তাহাতে সে উইসকনসিনের পুরা রাস্তাটাই অতিক্রম করিয়াছিল। অতঃপর সে অদৃশ্য হইয়া যায়।

জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে একটি জলযান অত্যন্ত দ্রুতবেগে নিউ ইংল্যাণ্ডের উপকূলে, কেপ কড হইতে কেপ সেবল-এর মধ্যে, বিশেষত বস্টনের নিকট, সমুদ্রের জল তোলপাড় করিয়া ছুটিয়া যায়। তাহাঁর পর অকস্মাৎ এই জলযানটিও বেমালুম হাওয়ায় উবিয়া যায়।

সেই একই মাসের দ্বিতীয় ভাগে, একটি ডুবোজাহাজ ক্যানসাস রাজ্যের লেক রিলের জলের তলায় চলাফেরা করিয়াছিল। পরে সেও অন্তর্হিত হইয়া যায়।

সমস্তকিছু লক্ষ করিয়া ইহাই বিশ্বাস হয় যে একই আবিষ্কর্তা নিশ্চয়ই এই তিনটি যন্ত্রের নির্মাতা; অথবা তিনটি নহে, উহারা সকলে মিলিয়া সম্ভবত একটিই যন্ত্র, জলেস্থলে সর্বত্রই যাহার অবাধ গতিবিধি।

ঐ যন্ত্রটি অধিকার করিবার জন্য উক্ত আবিষ্কর্তার নিকটতা তিনি যে-ই হোন না কেন–তাই একটি প্রস্তাব করা হইতেছে।

তাঁহাকে অনুরোধ করা যাইতেছে যে তিনি যেন সর্বসমক্ষে আত্মপ্রকাশ করেন, এবং বিজ্ঞাপিত করেন যে কী-কী শর্তে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের সহিত কাজকারবার করিবেন। তাহাকে এই অনুরোধও করা হইতেছে যে তিনি যেন যথাসত্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডি. সি.-স্থিত আন্তঃরাজ্য পুলিশ দফতরের সহিত অনুগ্রহ করিয়া যোগাযোগ করেন।

বড়ো-বড়ো হরফে, মার্কিন মুলুকের সব খবরকাগজেরই প্রথম পাতায় এই বিজ্ঞপ্তিটি বেরিয়েছিলো। যার প্রতি এটা উদ্দিষ্ট, সে যে-ই হোক না কেন, তার চোখে এটা না পড়েই পারবে না। সে নিশ্চয়ই এটা পড়বে। সেই একইভাবে কোনো বিজ্ঞপ্তি ছাপিয়েও সে তার উত্তরটা জানাতে পারে। আর এ-রকম একটা প্রস্তাব সে উপেক্ষাই বা করবে। কেন–ডলারের অঙ্ক যেখানে যা-খুশি তা-ই হতে পারে! আমাদের শুধু তার কাছ থেকে কোনো উত্তর পাওয়ার জন্যে অপেক্ষা করতে হবে।

এটা নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না যে জনসাধারণের মধ্যে এই বিজ্ঞপ্তিটি কীরকম কৌতূহল ও আগ্রহের সৃষ্টি করেছিলো। পুলিশের দফতরের সামনে, সকাল থেকে গভীর রাত অব্দি, এক উৎসুক ও মুখর জনতা ঠেলাঠেলি করছিলো–অপেক্ষা করছিলো কখন এই আবিষ্কর্তার কাছ থেকে কোনো চিঠি বা টেলিগ্রাম আসে–সে হয়তো সরাসরি ফেডারেল পুলিশেরই সঙ্গে যোগাযোগ করবে। সেরা প্রতিবেদকরা নিঘুম, ক্লান্তিহীন, দাঁড়িয়েছিলো সেখানে। যে-এই তুলকালাম খবরটা প্রথম ছাপাতে পারবে, সেই সংবাদদাতা কিংবা সেই খবরকাগজ যে রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে যাবে তা-ই নয়, বিস্তর মুনাফাও লুঠে নিতে পারবে! যে-অজ্ঞাতকে অ্যাদ্দিনের চেষ্টাতেও কোথাও অবিষ্কার করা যায়নি, তার নাম ও হালহকীকৎ বাৎলানো যাবে তবে শেষকালে! আর এও জানা যাবে। সরকারের সঙ্গে সে কোনো দরকষাকষিতে রাজি হবে কি না! এটা বোধহয় না-বললেও চলে আমেরিকা সবকিছুই দারুণ কেতায় করে থাকে। কোটি-কোটি ডলার পেতে পারে এই উদ্ভাবক। যদি দরকার হয়, দেশের সব ক্রোড়পতিই তাদের কোষাগার উন্মুক্ত করে দেবে!

একটা দিন কেটে গেলো! উত্তেজিত ও অধীর জনতার কাছে নিশ্চয়ই মনে হচ্ছিলো যে দিনটার মধ্যে যেন চব্বিশ ঘণ্টার চাইতেও বেশি সময় আছে। আর একেকটা ঘণ্টায় যেন আছে যাট মিনিটের চাইতেও অনেক-বেশি মিনিট। কিন্তু কোথাও কোনো সাড়া নেই-না কোনো চিঠি, না-বা কোনো টেলিগ্রাম! রাতটাও কেটে গেলো। তবু কোনো খবর নেই। আর এইভাবেই নিরুত্তর কেটে গেলো পরের দিন–এবং তারও পরের দিন।

অন্য-একটা ফল হলো বটে এই বিজ্ঞপ্তির-এবং সেটা আগেভাগেই অনুমান করা গিয়েছিলো। কেবলের পর কে গেলো ইওরেপে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আবিষ্কর্তার কাছে কী প্রস্তাব করেছে সেটা মুহূর্তে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়লো। এই আশ্চর্য উদ্ভাবনটিকে হাতে পাবার আশা ইওরোপেরও বড়ো-বড়ো দেশগুলো করেছিলো। এমন প্রচণ্ড একটা ক্ষমতা হাতে পাবার জন্যে তারাই বা কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে না কেন? তারাই বা কেন? তাদের কোষাগার উন্মুক্ত করে প্রতিযোগিতায় নেমে পড়বে না?

সমস্ত বড়ো-বড়ো দেশই ধুমধাম করে ঢাকঢোল পিটিয়ে আসরে নেমে পড়লো–ফ্রান্স, ইংলণ্ড, রুশদেশ, ইতালি, অস্ট্রিয়া, আলেমানদেশ। শুধু অপেক্ষাকৃত দুর্বল দেশগুলোই এই চমকপ্রদ নিলেমের আসরে নামেনি–তাদের অত টাকা কোথায় যে খামকা চেষ্টা করবে? ইওরোপের খবরকাগজগুলোও মার্কিন সরকারের বিজ্ঞপ্তিটির অনুসরণ করে বিজ্ঞপ্তি ছাপালে। এই রহস্যময় শোাফেয়ারকে শুধু একটা মুখের কথা খসাতে হবে-অমনি সে হয়ে উঠবে ফাডেরবিল্ট, অ্যাস্টর, গুল্ড, মরগ্যান বা রথচাইল্ডের প্রতিদ্বন্দ্বী ধনকুবের।

কিন্তু তাতেও যখন এই রহস্যময় আবিষ্কর্তার কাছ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া গেলো না, তখন অবাক হয়ে সবাই ভাবতে বসলো সে-কোন চমকপ্রদ প্রস্তাব করলে সমস্ত গোপনীয়তা ঝেড়ে ফেলে সে আত্মপ্রকাশ করবে? সারা জগৎটাই যেন এক মস্ত নিলেমের আসর হয়ে উঠেছে–এমন-এক নিলোম যেখানে চোখ-কপালে-তোলা সমস্ত দাম হাঁকা হচ্ছে। দিনে দু-বার করে খবরকাগজগুলো কোটি-কোটি টাকা যোগ করে চলেছে–আর যেন প্রতিবারই তা লাফিয়ে-লাফিয়ে প্রায় আকাশে উঠে যেতে চাচ্ছে। এই দর-হাঁকাহাঁকির শেষ এলো, যখন মার্কিন কংগ্রেস বিস্তর তর্কাতর্কির পর, ভোটে ঠিক করলে যে দুশো কোটি ডলার দেয়া হবে এই আবিষ্কর্তাকে। আর এই আশ্চর্য যানটির ওপর এতটাই গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছিলো যে দেশের কোনো নাগরিকই এই প্রস্তাবে কোনো আপত্তিই তোলেনি। আমি? আমি আমার বুড়ি দাসীকে বলেছিলুম :যন্ত্রটা কিন্তু এর চেয়েও অনেক দামি?

জগতের অন্যান্য দেশ কিন্তু আমার মতো ভাবেনি, তাদের প্রস্তাব দুশো কোটি ডলারের ধারে-কাছেও ছিলো না। কিন্তু বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে এই রেষারেষি কতটাই যে অর্থহীন ছিলো! এই আবিষ্কর্তা যেন জম্মায়ইনি কোনোদিন! সবটাই যেন মার্কিন খবরকাগজগুলোর মস্ত এক ধাপ্পা! সেটাই, অন্তত শেষকালে, দাঁড়ালো ইওরোপের সব খবরকাগজের বিঘঘাষিত অভিমত।

এদিকে দিনের পর দিন কিন্তু কেটেই চলেছে। এই আবিষ্কর্তার আর-কোনো খবরই নেই কোনোখানে, তার কাছ থেকে টু শব্দটি অব্দি নেই! আর-কোথাও তার এই আশ্চর্য শকট সকলকে বোমকে দিয়ে দেখা দেয়নি। আমি তো কী-যে ভাববো কিছুই বুঝতে পারছিলুম না–এই আশ্চর্য রহস্যের কোনোদিন যে কোনো মীমাংসা হবে, সেই আশাই আমি ছেড়ে দিয়েছিলুম।

তারপরে, হঠাৎ, পনেরোই জুলাই, ফেডারেল পুলিশভবনের ডাকবাক্সে কোননা পোস্টমার্ক ছাড়াই একটা চিঠি পাওয়া গেলো। কর্তৃপক্ষ গভীর মনোযোগ দিয়ে চিঠিটা খুঁটিয়ে দেখে, ওয়াশিংটনের খবরকাগজগুলোর কাছে চিঠিটা তুলে দিলেন–আর অমনি, বিশেষ সংখ্যা বেরিয়ে গেলো কাগজগুলোর–চিঠির বয়ান একছত্রও এদিক-ওদিক না করে বেরিয়ে গেলো জোর খবর! জোর খবর! হিশেবে :

.

. চিঠি নম্বর দুই

দুর্বারগতি বিভীষিকা থেকে
জুলাই ১৫

পুরোনো ও নতুন জগৎ–দুজনকেই :

ইওরোপের বিভিন্ন দেশের সরকার যে-সব প্রস্তাব করেছে, আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকার অবশেষে যে-দর হেঁকেছে, তাতে এই কথা কটি ছাড়া আর-কিছু জানাবার নেই :

আমার আবিষ্কারের জন্যে যে-খোলামকুচি দর হাঁকা হয়েছে, তাকে আমি ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করি।

আমার যান ফরাশিও হবে না, আলেমানও হবে না, অস্ট্রিয়া তাকে হাতাতে পারবে না, রুশদেশের জারও নন-এই যান না-হবে ব্রিটিশ, না-বা মার্কিন।

এই আবিষ্কার শুধু আমার নিজেরই থাকবে, এবং আমি তাকে আমার যেমন-খুশি তেমনিভাবেই ব্যবহার করবো।

এটা দিয়ে, আমি সারা জগতের ওপর প্রভুত্ব করবোগোটা মানবজাতির এক্তিয়ারে এমন-কোনো উপায় বা ক্ষমতা নেই যা দিয়ে আমাকে ঠেকাতে পারবে, বা প্রতিরোধ করতে পারবে। কোনো অবস্থাতেই কারু পক্ষেই আমাকে ঠেকানো সম্ভব হবে না।

এটা স্পষ্ট করে জানিয়ে দিচ্ছি : কেউ যেন কখনও আমাকে পাকড়াবার বা থামাবার চেষ্টা না-করে। সেটা হবে অসম্ভব চেষ্টা-সম্পূর্ণ অর্থহীন। কেউ যদি আমাকে কোনো আঘাত হানতে চায়, তবে সে আঘাত আমি প্রত্যাঘাত হেনে একশোগুণ ফিরিয়ে দেবো।

আমাকে যে-নগণ্য টাকা দেবার প্রস্তাব করা হয়েছে, তা আমি ঘৃণা করি। আমার সে-টাকায় কোনো দরকার নেই। তাছাড়া, যেদিন আমার কোটি-কোটি ডলার কামাবার ইচ্ছে হবে, সেদিন আমি শুধু আমার হাত বাড়িয়ে তা টুপ করে তুলে নেবো।

পুরোনো এবং নতুন জগৎ, দুইই জেনে রাখুক : তারা আমার বিরুদ্ধে কিছুই করবে পারবে না, কিন্তু আমি-আমার যা-ইচ্ছে হবে তা-ই ইওরোপ ও আমেরিকার বিরুদ্ধে করতে পারবো।

সেইজন্যেই আমি এই চিঠিতে এই বলে স্বাক্ষর করছি

দ্য মাস্টার অভ দি ওয়ার্ল্ড
নিখিলের প্রভু জগতের প্রভু

.

১০. আইনকানুনের পরপারে

মার্কিন সরকারের উদ্দেশে লেখা এইরকম একটা চিঠি! কে-যে খোদ পুলিশের দফতরে এসে এই চিঠিটা ডাকবাক্সে রেখে গিয়েছে, কেউ তাকে দ্যাখেনি।

আমাদের দফতরের বাইরেকার সাইডওয়াক সম্ভবত সারা রাত্তিরে একবারও ফাঁকা থাকেনি। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত, সবসময়েই সেখানে লোকজন ছিলো, শশব্যস্ত, উদ্বিগ্ন অথবা নিছকই কৌতূহলী। সত্যি-যে, তখনও পত্রবাহক হয়তো অনায়াসেই সকলের চোখে ধুলো দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়তে পারতো, ডাকবাক্সে সরাসরি এসে ফেলে দিতে পারতো এই চিঠি। রাত্তিরটা অবশ্য ছিলো ঘুটঘুঁটে অন্ধকার, রাস্তার এপাশ থেকে ওপাশে হয়তো কিছুতেই নজর পৌঁছুতো না।

এই চিঠিটার হুবহু প্রতিলিপিই বেরিয়েছিলো সব কাগজে-সরকার সরাসরি সেসব কাগজে এর বয়ানটা পাঠিয়ে দিয়েছিলো। চিঠিটা পড়ে জনসাধারণের প্রথম প্রতিক্রিয়া স্বভাবত এটাই হতো যে এ নিশ্চয়ই কোনো ভাড়ের কীর্তি-বিদূষকের বদ-রসিকতা। পাঁচ হপ্তা আগে গ্রেট আইরি থেকে আমার কাছে যে-চিঠিটা এসেছিলো, তাকে আমি এইভাবেই গ্রহণ করেছিলুম।

কিন্তু এই চিঠিটা সম্বন্ধে সাধারণের প্রতিক্রিয়া কিন্তু সে-রকম হয়নি, ওয়াশিংটনে তো নয়ই, দেশের অন্যত্রও নয়। যদি জনাকয়েক মাতব্বর মুচকি হেসে বলবার চেষ্টা করতো যে এ-চিঠিটাকে পাত্তা দেবার কোনো মানেই হয় না, বেশির ভাগ লোকই কিন্তু তার উত্তরে বলতো, এ-চিঠিটার বয়ান বা ভঙ্গি কোনোটাই কোনো ফাজিল ফিচেল ফুর্তিবাজ লোকের নয়। শুধু-একজনই এ-চিঠি লিখতে পারতো, এবং সে-হলো ঐ আশ্চর্য যন্ত্রটির আবিষ্কতা।

লোকের কাছে কেন-যে এ-কথা তর্কাতীত বলে মনে হতো, কী-রকম মানসিক অবস্থায় পড়লে লোকে এ-সব মেনে নিতো, তা কিন্তু সহজেই ব্যাখ্যা করা যায়। এতদিন ধরে যতসব অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে, যার চাবিটা অ্যাদ্দিন পাওয়া যায়নি, এই চিঠিটা অবশেষে সে-সব ধাঁধারই সমাধান করে দিয়েছে। লোকে যা ভাবছিলো তা এই : আবিষ্কর্তা এতদিন যে নিজেকে লুকিয়ে রেখেছিলো, তা শুধু একদিন অভিনব উপায়ে নিজেকে জাহির করে সকলকে বোমকে দেবার জন্যেই। কোনো দুর্ঘটনায় অপঘাতে মৃত্যু হওয়ার বদলে এতদিন সে এমন-একটি গোপন আড্ডায় নিজেকে লুকিয়ে রেখেছিলো, পুলিশ যার নামগন্ধও জানতে পারেনি। তারপর জগতের সব সরকার সম্বন্ধেই তার মনোভাব কী, সেটা জোরগলায় জানাবার জন্যেই অবশেষে সে এই চিঠি লিখেছে। কিন্তু কোনো বিশেষ অঞ্চলের বিশেষ-কোনো ডাকঘরে গিয়ে চিঠিটা ডাকে দেবার বদলে–কেননা তাহলে হয়তো সেই সূত্র ধরে কখনও তার নাগাল পাওয়া যেতে–সে সরাসরি ওয়াশিংটনে এসে সকলের নাকের ডগা দিয়ে পুলিশের সদর দফতরে এসে চিঠিটা ডাকবাক্সে ফেলে গিয়েছে।

যদি এই আশ্চর্য মানুষটি ভেবে থাকে যে তার অস্তিত্ব জানান দেবার এই নতুন পদ্ধতি সারা জগতে হুলুস্থুল ফেলে দেবে, তবে সে মোটেই ভুল ভাবেনি। সেদিন, সারা জগতে অগুনতি লোক চোখ রগড়ে বারেবারে চিঠিটা পড়ে মুখস্থ করে ফেলেও যেন। নিজেদের চোখকে বিশ্বাস করতে পারেনি।

আমি নিজে বারেবারে খুঁটিয়ে পড়েছি এই দম্ভ, এই স্পর্ধার ঘোষণা, তার প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি প্রকাশভঙ্গি। হাতের লেখা বড়ো-বড়ো, মিশমিশে কালো কালিতে কলমের। বড়ো-বড়ো টান দিয়ে লেখা শব্দগুলো। কোনো হস্তলিপি বিশেষজ্ঞ হয়তো এই বড়ো বড়ো রেখার টান দেখেই চিনে নিতে পারতো তার মেজাজি ও দেমাকি হাবভাব-জেনে নিতে পারতো এর মধ্যে কীভাবে প্রকাশ পেয়েছে তার দম্ভ আর অসামাজিক মনোভাব। যেহেতু চিঠিটার ফ্যাকসিমিলি বেরিয়েছিলো কাগজে তাই আমার অন্তত এই চিহ্নগুলো খুঁজে পেতে খুব দেরি হয়নি। হঠাৎ আমার অজ্ঞাতসারেই আমার মুখ ফুটে একটা বিস্ময়ের ধ্বনি বেরিয়ে এলো–ভাগ্যিশ আমার বুড়ি দাসী আমার সে-চীৎকার শুনতে পায়নি। কেন আমি এতক্ষণ মরগ্যানটন থেকে ডাকে-ফেলা আমার ঐ আগের চিঠিটার সঙ্গে এই চিঠির আশ্চর্য মিলটাকে লক্ষ করিনি? তাছাড়া, আরো-একটা জিনিশও তো খেয়াল করার ছিলো। আমার চিঠিটায় কারু নাম ছিলো না–শুধু লেখা ছিলো মা, অ, ও,, যার সঙ্গে দ্য মাস্টার অভ দি ওয়ার্ল্ড-এর আদ্যক্ষরগুলো খাপে খাপে মিলে যায়। এ নিশ্চয়ই নেহাৎই কাকতাল নয়!

আর এই দ্বিতীয় চিঠিটা কোত্থেকে এসেছে?দুর্বারগতি বিভীষিকা থেকে। নিশ্চয়ই এই একে-তিন-তিনে-এক যানটারই নাম বিভীষিকা। বিভীষিকার রহস্যময় কাপ্তেনের স্বনির্বাচিত খেতাবই তাহলে দ্য মাস্টার অভ দি ওয়ার্ল্ড, নিখিলের প্রভু জগতের প্রভু! আমার চিঠিতে যে-আদ্যক্ষরগুলো ছিলো তা তাহলে তারই নামের মোহর-আর খোদ এই দ্য মাস্টার অভ দি ওয়ার্ল্ডই আমাকে শাসিয়েছে যে ফের যদি আমি গ্রেট আইরিতে অভিযান চালাই তবে সে আমাকে দেখে নেবে।

আমি উঠে গিয়ে আমার ডেস্কের দেরাজ থেকে তেরোই জুনের চিঠিটা বার করে নিয়ে এলুম। তার সঙ্গে পাশাপাশি রেখে আমি মিলিয়ে দেখলুম খবরকাগজের এই ফ্যাকসিমিলি। না, কোনো সন্দেহই আর নেই। দুটো চিঠিই একই হাতে লেখা।

আমার মনের মধ্যে তখন তুলকালাম আলোড়ন চলেছে। এই চমকপ্রদ তথ্যটা থেকে অবরোহী প্রক্রিয়ায় আমি সম্ভাব্য সিদ্ধান্তে গিয়ে পৌঁছুতে চেষ্টা করছি : আগের চিঠিটার কথা শুধু আমিই জানি। যে-লোকটা আমার অমন হুমকি দিয়েছে সে-ই দুর্বারগতি বিভীষিকার কাপ্তেন–আর যানের নামটাই বা কী, বিভীষিকা, যথার্থ নামই বটে! এবার তো আর আমরা আবছায়ার মধ্যে নেই, এবার তো আর আমরা বুনো হাঁসের পেছনে ছুটছি না! এবার আমরা আবার তন্নতন্ন করে অনুসন্ধান চালাতে পারি। বিভীষিকার সঙ্গে গ্রেট আইরিরসম্বন্ধ কী–সেটা বার করতে পারলেই আমরা এই রহস্যটা ভেদ করতে পারবো। ব্লু রিজ শৈলশ্রেণীর সেই অদ্ভুত শিখা ও ধ্বনির সঙ্গে কোন অকাট্য সম্বন্ধে জড়ানো এই আশ্চর্য যান–বিভীষিকা?

আমার প্রথম পদক্ষেপ কী হবে, ততক্ষণে তা আমি জেনে গিয়েছি। আমার আগের চিঠিটা পকেটে নিয়ে আমি তক্ষুনি পুলিশের সদর দফতরের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লুম। মিস্টার ওয়ার্ড ভেতরে আছেন কি না জেনে নিয়ে আমি তক্ষুনি তার খাশ কামরার সামনে গিয়ে বেশ জোরেই বোধহয় টোকা দিয়েছিলুম, তারপর তিনি ঢুকতে বলবামাত্র আমি হন্তদন্তভাবেই বুঝি ভেতরে ঢুকে পড়েছি।

তুমি এমনভাবে আসছে যে মনে হয় তুমি কোনো জরুরি খবর নিয়ে এসেছে, স্ট্রক?

সেটা আপনি নিজেই বিচার করে দেখুন, এই বলে আমি পকেট থেকে চিঠিটা বার করে তার দিকে এগিয়ে দিয়েছি।

মিস্টার ওয়ার্ড হাত বাড়িয়ে চিঠিটা নিয়েছেন, তারপর একবার সেটায় চোখ বুলিয়ে,–পড়েই জিগেস করেছেন : এ আবার কী, স্ট্রক?

শুধু নামের আদ্যক্ষর মোহর করে লেখা একটা চিঠি–দেখতেই তো পাচ্ছেন।

আর কোথায় কোন ডাকঘরে এটা পোস্ট করা হয়েছিলো?

মরগ্যানটনে, নর্থ-ক্যারোলাইনায়।

চিঠিটা তুমি কবে পেয়েছো, স্ট্রক?

এক মাস আগে, জুন মাসের তোরো তারিখে।

তখন চিঠিটা পড়ে তুমি কী ভেবেছিলে?

যে এটা কারু নিদারুণ ঠাট্টা।

আর-এখন-স্ট্রক?

আমি যা ভাবছি, আপনিও তা-ই ভাববেন, মিস্টার ওয়ার্ড, যদি চিঠিটা একটু খুঁটিয়ে দ্যাখেন।

মিস্টার ওয়ার্ড তারপরেই আবার চিঠিটার ওপর সতর্ক দৃষ্টি বুলিয়েছেন। এখানে নামের বদলে তিনটি হরফ দেখছি।

হ্যাঁ, মিস্টার ওয়ার্ড, আর সেই তিনটে হরফ এই ফ্যাকসিমিলির দ্য মাস্টার অভ দি ওয়ার্ল্ডই বোঝায়।

টেবিল থেকে একটা কাগজ তুলে নিয়ে মিস্টার ওয়ার্ড বলেছেন :ফ্যাকসিমিলি নয়, এই সেই আসল চিঠি।

আমি তাকে উসকে দেবার জন্যেই বলেছি :বোঝা যাচ্ছে দুটো চিঠি একই হাতের লেখা।

তা-ই তো মনে হচ্ছে।

দেখতে পাচ্ছেন নিশ্চয়ই, গ্রেট আইরির গুপ্ত কথা যাতে ফাঁস হয়ে না-যায় সেইজন্যে কেমনভাবে আমাকে শাসানো হয়েছে?

হ্যাঁ, তোমাকে খুন করার হুমকি দিয়েছে। কিন্তু স্ট্রক, এ-চিঠি তুমি পেয়েছে একমাস আগে। এতদিন তুমি চিঠিটা কেন আমাকে দেখাওনি?

কারণ আগে আমি চিঠিটাকে কোনো গুরুত্বই দিইনি। এখন, দুর্বারগতি বিভীষিকা থেকে চিঠিটা আসার পর একে আর কোনোভাবেই তাচ্ছিল্য করা যায় না।

এ-বিষয়ে তোমার সঙ্গে আমার দ্বিমত নেই। আমার কাছে চিঠিটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলেই মনে হচ্ছে। এরই সাহায্যে আমি হয়তো এই অদ্ভুত মানুষটার নাগাল পেয়ে যাবো।

আমিও ঠিক সেই আশাই করি, মিস্টার ওয়ার্ড।

শুধু একটাই প্রশ্ন–এই বিভীষিকার সঙ্গে গ্রেট আইরির সম্পর্ক কী থাকতে পারে?

তা আমি জানিনে। আমি তো কল্পনাও করতে পারছি না–

এর কেবল একটাই ব্যাখ্যা হতে পারে, আমার কথায় কান না-দিয়েই বুঝি মিস্টার ওয়ার্ড বলেছেন, যদিও সেটা বিশ্বাস করতে আদপেই মন চায় না–মনে হয় অসম্ভব।

আর, সেটা?

যে গ্রেট আইরি ছিলো ঐ আবিষ্কর্তার গোপন কারখানা–সেখানে সে তার সব জিনিশপত্র এনে জড়ো করেছিলো।

সে-যে অসম্ভব? আমি বুঝি চেঁচিয়েই উঠেছি, কী করে সে তার জিনিশপত্র সেখানে নিয়ে যাবে? আর তার ঐ যানটাকেই বা সে ওখান থেকে বার করবে কী করে? আমি ওখানে গিয়ে সরেজমিন যা নিজের চোখে দেখে এসেছি, তাতে আপনার এই অনুমানটাকে আমার অবিশ্বাস্যই শুধু নয়–অসম্ভব বলেই মনে হচ্ছে।

যদি-না–

যদি-না, কী? আমি ব্যগ্রস্বরে জানতে চেয়েছি।

যদি-না এই দ্য মাস্টার অভ দি ওয়ার্ল্ড-এর যানটার পাখাও থাকে। শুধু পাখা থাকলেই সে গ্রেট আইরিতে গিয়ে ডেরা বাঁধতে পারে।

যানের নাম বিভীষিকা, সে সমুদ্রের গভীরে ঘুরে বেড়িয়েছে, সে কি সেই সঙ্গে ঈগল আর করের সঙ্গেও পাল্লা দিয়ে আকাশে ঘুরে বেড়াবে? আমি বোধহয় অবিশ্বাসভরে আমার কাধ না-ঝাঁকিয়ে পারিনি। অবশ্য মিস্টার ওয়ার্ডও এরপর আর তার অবিশ্বাস্য ও অসম্ভব অনুমানটি নিয়ে আর-কোনো উচ্চবাচ্য করেননি। বরং তিনি আবার চিঠি দুটো পাশাপাশি রেখে তাদের তুলনা করেছেন–সবকিছু মিলিয়ে দেখেছেন। শুধু মিলিয়েই দ্যাখেননি, অনুবীক্ষণের তলায় রেখে দুটি চিঠিকেই তিনি তন্নতন্ন করে খুঁটিয়ে দেখেছেন–বিশেষত যেভাবে নাম লিখেছে লেখক, আর শনাক্ত করেছেন যে দুটি চিঠিই একই হাতের কাজ, হুবহু। শুধু-যে এক হাতেরই কাজ তা নয়–যে-কলম দিয়ে চিঠি। দুটো লেখা হয়েছে, সেটাও একই কলম। তারপর গভীরভাবে কী যেন ভেবে তিনি বলেছেন : তোমার চিঠিটা আমি এখানে রেখে দেবো, স্ট্রক। মনে হয় এই আশ্চর্য নাটকটায় তোমার একটা বড়ো ভূমিকা রয়েছে-হয়তো একটা নয়, দু-দুটো নাটক কোন সূত্র দিয়ে যে নাটকদুটি গাঁথা তা আমার জানা নেই–কিন্তু আমার স্থির বিশ্বাস, সূত্র একটা আছেই। প্রথম নাটকটার সঙ্গে তুমি আগেই জড়িয়ে পড়েছিলে–আর দ্বিতীয়টাতেও তুমি যদি মস্ত একটা ভূমিকা নাও, তাহলে আমি মোটেই অবাক হবো না।

আপনি তো জানেনই, মিস্টার ওয়ার্ড, আমার কৌতূহল কেমন–কিছুতেই বাগ মামে না।

জানি, স্ট্রক, জানি। সে-কথা তোমায় আবার মনে করিয়ে দিতে হবে না। এখন, আমি কেবল আমার প্রথম নির্দেশটারই পুনরাবৃত্তি করতে পারি : তৈরি হয়ে থেকো, মুহূর্তের নোটিসে তোমায় ওয়াশিংটন ছেড়ে চলে যেতে হতে পারে।

সেদিন সারাদিন ধরে, এই স্পর্ধিত চিঠি নিয়ে লোকের উত্তেজনা কেবলই তুঙ্গে উঠেছে। হোয়াইট হাউস এবং ক্যাপিটল হিল–দুজায়গাতেই লোকেরা উত্তেজিতভাবে গিয়ে দরবার করেছে : কিছু-একটা করা হোক, এক্ষুনি। কিন্তু কিছু করা কি কোনো সহজ কাজ? কোথায় কেউ দেখা পাবে এই দ্য মাস্টার অভ দি ওয়ার্ল্ড-এর? আর তার গোপন আড্ডাটা যদি খুঁজে বার করা যায়, কেমন করে কেউ তাকে গিয়ে পাকড়াবে? তার ক্ষমতা যে কতটা, তার পরিচয় সে আগেই দিয়েছে-কিন্তু সেটা হয়তো তার সত্যিকার ক্ষমতার তুলনায় কিছুই-না, তার ক্ষমতার সে হয়তো নিছকই আংশিক প্রকাশ। পাথরের ওপর দিয়ে কেমন করে সে নিয়ে গিয়েছিলো তার ডুবোজাহাজ, ঐ লেক কিন্ডালে? আর কীভাবেই বা পরে সে সেখানে থেকে চম্পট দিয়েছে? আর যদি সে সত্যিই লেক সুপিরিয়রে দেখা দিয়ে থাকে, তবে কীভাবে সে সকলের অগোচরে মাঝখানের জমি পেরিয়ে এসেছিলো?

কী-যে মাথা-খারাপ-করা, সব-ঘুলিয়ে-দেয়া, কাণ্ড! আর সেইজন্যেই চট করে এই রহস্যের একটা মীমাংসা হওয়া উচিত। দুশো কোটি ডলারে যখন তার মন ওঠেনি, তখন এবার তার বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগ করে দেখা উচিত। আবিষ্কর্তা বা তার আবিষ্কার –কিছুই নাকি কেনা যাবে না! আর কী দম্ভ, কী স্পর্ধার সঙ্গেই সে এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে! তাহলে তা-ই হোক! এই উপেক্ষার ফলে তাকে গণশত্রু বলে গণ্য করা হোক, ঘোষণা করা হোক যে সে সমস্ত সমাজেরই শত্রু–আর এমন দুশমনের বিরুদ্ধে সমস্ত কিছুই প্রয়োগ করা যায়, সেখানে ন্যায়-অন্যায় বলে কিছুই আর থাকে না, অন্যদের কোনো সমূহ ক্ষতি করবার আগেই তার সমস্ত ক্ষমতা কেড়ে নিতে হবে! মাঝখানে যে লোকে ভেবেছিলো সে তার যান-টান নিয়ে দুর্ঘটনায় মারা গেছে, এখন সেই সিদ্ধান্ত সবাই আবর্জনার স্তূপে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। সে বেঁচে আছে, বহাল তবিয়তেই বিরাজমান; আর তার এই বেঁচে-থাকাই জনসাধারণের পক্ষে বিপজ্জনক! সে সাংঘাতিক লোক, মারাত্মক! কিছুতেই তাকে আর বাড়তে দেয়া চলে না।

এমন ভাবনা থেকেই সরকার থেকে নিচের বিজ্ঞপ্তিটি প্রচার করা হলো :

দুর্বারগতি বিভীষিকার অধিনায়ক যেহেতু তাহার আবিষ্কারকে সর্ব সাধারণের গোচরে আনিতে অস্বীকার করিয়াছে, যেহেতু এই যান সে এরূপভাবে চালায় যে তাহার যন্ত্র জনসাধারণের পক্ষে প্রচণ্ড বিপজ্জনক হইয়া উঠিয়াছে, যাহার হাত হইতে কিছুতেই রক্ষা করিবার যেহেতু কোনো উপায়ই নাই, অতএব এতদ্বারা বিভীষিকার কাপ্তেনকে আইন কানুনের পরপারে বহিষ্কৃত করা হইল। তাহাকে অথবা তাহার যন্ত্রকে দখল বা ধ্বংস করিবার জন্য যে-কোনো উপায়ই বৈধ বলিয়া গণ্য হইবে, এবং যে-কেহ তাহাকে বন্দী বা হত্যা করিতে পারিবে, তাহাকে যথোপযুক্তভাবে পুরস্কৃত করা হইবে।

এতো একেবারে যুদ্ধ ঘোষণা, দ্য মাস্টার অভ দি ওয়ার্ল্ড-এর বিরুদ্ধে এক মরণপণ যুদ্ধের আহ্বান–যে-লোকটা কি না ভেবেছে একটা গোটা জাতিকে হেনস্থা করে বা ভয় দেখিয়ে পার পেয়ে যাবে, আর সে-জাতি কি না মার্কিন জাতি।

দিন ফুরোবার আগেই, মোটা-মোটা অঙ্কের সব পুরস্কার ঘোষণা করা হলো : যে কেউ এই সাংঘাতিক আবিষ্কারকের গোপন আচ্ছা বার করে দিতে পারবে, যে-কেউ তাকে সঠিকভাবে শনাক্ত করতে পারবে, যে-কেউ তাকে হত্যা করে আমেরিকাকে মুক্ত করবে পারবে–সকলকেই বিরাট-বিরাট পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি দেয়া হলো।

জুলাইয়ের শেষের দিকে এইরকমই ছিলো পরিস্থিতি। সবই প্রায় যেন ভবিতব্যের হাতে ছেড়ে দেয়া হয়েছিলো। যে-মুহূর্তে এই সমাজবিরোধী আবার দেখা দেবে, অমনি সংকেতে সে-খবর সবখানে ফাঁস করে দেয়া হবে, আর সুযোগ পাবামাত্র তাকে গ্রেফতার করা হবে। সেটা অবশ্য সম্ভব হবে না যদি সে থাকে তার সেই আশ্চর্য স্বতশ্চল শকটে অথবা অলৌকিক জলযানে। না, তাকে যদি পাকড়াও করতে হয় তো তাকে পাকড়াতে হবে আচমকা, অপ্রস্তুত অবস্থায়, যাতে সে তার ঐ অভূতপূর্বগতির যানে করে পালিয়ে যেতে না-পারে।

আমি সেইজন্যেই সজাগ ও উন্মুখ হয়ে ছিলুম, অপেক্ষা করছিলুম কখন মিস্টার ওয়ার্ডের কাছ থেকে রণক্ষেত্রে বেরিয়ে পড়ার নির্দেশ আসে। আমার সহকর্মীরাও সারাক্ষণ প্রস্তুত ছিলো। কিন্তু কোনো নির্দেশই এলো না মিস্টার ওয়ার্ডের কাছে থেকে, কেননা যার বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান তার হাল-হকীকৎ তখনও কারু জানা নেই। জুলাই মাস শেষ হয়ে এলো। খবরকাগজগুলো উত্তেজনায় তেমনি টগবগ করে ফুটছে। তারা এমনকী একের পর এক গুজব ছেপে চলেছে। প্রতি মুহূর্তে নতুন-নতুন সূত্রের কথা বেরুচ্ছিলো, কিন্তু সবই ছিলো অলীক কল্পনাবিলাস। আমেরিকার প্রতি কোণ থেকে অনবরত টেলিগ্রাম আসছে ফেডারেল পুলিশের সদর দফতরে, একেকটা টেলিগ্রাম মুহূর্তের মধ্যে নাকচ করে দিচ্ছে অন্য টেলিগ্রামগুলোর বয়ান। এত-যে বিশাল বিশাল অঙ্কের পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছিলো, তার একটা ফল তো হবেই : এর ওর নামে নালিশ, লোকের পরিচয় নিয়ে ভ্রান্তিবিলাস, পর্বতপ্রমাণ ভুলবিভ্রম, সবই ছিলো, কোনো কোনোটা অবশ্য ইচ্ছাকৃত বিভ্রম নয়, কখনও কোনো ধুলোর ঝড় দেখে লোকে ভেবেছে তার আড়ালে বুঝি কোনো স্বতশ্চল শকট লুকিয়ে আছে। আমেরিকার অজস্র হ্রদে কোনো ঢেউ উঠলেই লোকে ভেবেছে বুঝি-বা জলের তলায় লুকিয়ে আছে কোনো ডুবোজাহাজ। সত্যি-বলতে, লোকের উত্তেজিত মগজ অনবরতই রজ্জুতে সর্পভ্রম করে চলেছে।

শেষটায়, উনতিরিশে জুলাই, টেলিফোন এসে হাজির : এক্ষুনি মিস্টার ওয়ার্ডের কাছে এসে দেখা করতে হবে।

তোমাকে এক ঘণ্টার মধ্যেই বেরিয়ে পড়তে হবে, স্ট্রক, তিনি বলেছেন।

কোথায়?

টলেডো যেতে হবে।

তাকে তবে দেখা গেছে?

হ্যাঁ। টলেডোয় পৌঁছে তুমি পরবর্তী নির্দেশ পাবে।

একঘণ্টার মধ্যেই আমার সহকারীদের নিয়ে আমি বেরিয়ে পড়বে।

চমৎকার! আর, ও, হ্যাঁ, স্ট্রক, আমি তোমাকে এখন সরকারিভাবে একটা নির্দেশ দিচ্ছি।

কী?

যাতে তুমি সফল হও–এবার যাতে কৃতকার্য হও!