লাল মৃত্যুর মুখোশ

লাল মৃত্যুর মুখোশ

লাল মৃত্যুর কবলে পড়ে দেশটা ধ্বংস হচ্ছে। এ রকম ঘৃণ্য আর মারাত্মক ব্যাধি এর আগে দেখা যায়নি। এর সমস্তটুকু ক্রিয়া রক্তেরই ওপর–তার লাল রঙের ভীতিটিই এ ক্ষেত্রে ভয়ঙ্কর প্রভাব বিস্তার করে। প্রথমটা সারা শরীরে প্রবল যন্ত্রণা, তারপর মাথা ঝিম্ ঝিম্‌, সমস্ত লোমকূপ দিয়ে অজস্র রক্তক্ষরণ আর মৃত্যু। সমস্ত শরীরে, বিশেষ করে মুখের ওপর রক্তের লাল দাগ রোগীকে তার বন্ধুবান্ধব আত্মীয়স্বজনের সাহায্য আর সহানুভূতি থেকে বহু দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়। ঐ চিহ্নটি হল রোগের নিষেধাজ্ঞা যেন। আসলে এই রোগের সূত্রপাত, চূড়ান্ত আক্রমণ আর মৃত্যু সব কিছু ঘটে যেতে সময় লাগে বড়জোর আধ ঘণ্টা।

প্রিন্স প্রস্পেরো স্থির বুদ্ধি সম্পন্ন সুখী মানুষ। তিনি রোগের প্রাদুর্ভাবে ভীত হননি অথচ তার রাজ্যের প্রায় অর্ধেক লোক তখন প্রাণ হারিয়েছে। উনি শেষ পর্যন্ত একদিন তার বন্ধুদের ভেতর থেকে বেছে বেছে সুস্থ সবল আর হাসিখুশী হাজার খানেক ভদ্রলোক আর মহিলাকে ডেকে পাঠালেন আর তাদের নিয়ে দুরের একটা দুর্গের মত বিরাট বাড়ীতে বহির্জগৎ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন জীবন যাপনের জন্য চলে গেলেন। প্রিন্স খুব খেয়ালী মানুষ হলেও উচ্চ শ্রেণীর রুচিবান মানুষ ছিলেন। বিরাট বাড়ীটার চারদিকে মজবুত উঁচু পাঁচিল দেওয়া ছিল আর ছিল একটা লোহার বড় দরজা। পারিষদদের নিয়ে প্রিন্স ভেতরে চলে আসার পর আগুন আর বিরাট বিরাট হাতুড়ী এনে দরজাটা পুরোপুরি ঝালাই করে বন্ধ করে দেওয়া হল। হতাশার কোন দুর্বল মুহূর্তে ভেতরের কোন মানুষ যাতে বাইরে বেরিয়ে যেতে না পারে তার জন্যেই এই ব্যবস্থা হল। ভেতরে খাদ্য আর পানীয়ের কোন অভাব ছিলনা। প্রিন্স প্রস্পেনোর ধারণা হয়েছিল এভাবে এরা সবাই ঐ ব্যাধির স্পর্শ থেকে মুক্ত থাকতে পারবেন। রোগ নিয়ে থাকুক বাইরের জগৎ। ওর জন্যে দুঃখ বা চিন্তা কোনটাই যুক্তিযুক্ত নয়। দুর্গের ভেতর আনন্দের উপকরণ ছিল প্রচুর। ওর মধ্যে ছিল ব্যালে নর্তকী, গায়ক, সুন্দরী নারী, প্রচুর মদ, অভিনয়ের মঞ্চ এমনকি হাসির খোরাক যোগানোর জন্যে ভাড়ও ছিল বেশ কয়েকজন। এই সব আর নিরাপত্তার সুদৃঢ় ব্যবস্থা নিয়ে দুর্গে রইলেন প্রিন্স আর তার পারিষদেরা। লালমৃত্যু রইল বাইরে। দুর্গের মধ্যে নির্বাসিত জীবন যাপনের পঞ্চম কি ষষ্ঠ মাসে প্রিন্স বেশ জাঁকজমকের সঙ্গে একটা মুখোশনাচের আয়োজন করলেন। তাতে তার ঐ একহাজার পারিষদ সবাই যোগ দিলেন। ওদিকে বাইরে ঠিক তখনই ঐ মহামারীর প্রকোপ ভয়ানকভাবে দেখা দিয়েছে।

মুখোশনাচের ঐ আয়োজন ইন্দ্রিয়তৃপ্তির দিক থেকে ছিল অনন্যসাধারণ। যেখানে তার আয়োজন হয়েছিল সেই কক্ষগুলোর বর্ণনা আগেই দেওয়া প্রয়োজন। এখানে সাতটা রাজকীয় সুইট ছিল। সাধারণতঃ এরকম প্রাসাদে এরকম সুইটগুলো একটানা একটা দীর্ঘ জায়গা জুড়ে থাকে আর প্রত্যেকটি কক্ষের দরজা হয় ভাঁজ করা। দরজাগুলোকে খুলে দেওয়ালের গায়ে পুরো ঠেকিয়ে রাখা যায় আর এতে পুরো প্রাসাদটা যে কোন দিক থেকে বিনা বাধায় দেখা যায়। আমাদের এই প্রিন্সের চিন্তাভাবনা ছিল উদ্ভট ধরণের তাই দুর্গটিও তার তৈরী হয়েছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরণের। কামরাগুলো এমন এলোমেলো ভাবে ছড়ানো ছিল যে একটার বেশী কামরা একবারে নজরেই পড়ত না। বিশ তিরিশ হাত দূরে দূরে বারান্দা হঠাৎ ঘুরে গেছে ভিন্ন দিকে। ডাইনে বাঁয়ে দেওয়ালের গায়ে বেশ বড় পুরোনো আমলের জানালা। তা দিয়ে ইটগুলোতে যাবার ঘুরপথ বেশ নজরে পড়ে। জানালাগুলো আবার ভিন্ন ভিন্ন রঙের। যে কামরাগুলোর মধ্যে ওই জানালাগুলো খুলছে সেই কামরার রঙের সঙ্গে তার সামঞ্জস্য রাখা হয়েছে। সব জানালায় রঙীন কাঁচ। যেমন একেবারে পূর্ব দিকের কামরা। ওটার রঙ নীল, তাই জানালার কাঁচগুলোও নীল। পরের কামরা, তার সাজ সজ্জা সব কিছুর রঙ ছিল বেগনীলাল, তাই ওটার জানালার কাঁচও ছিল ওইরকম। তৃতীয় কামরা আর তার জানালার রঙ ছিল সবুজ। চতুর্থ, পঞ্চম আর ষষ্ঠ কামরা আর তার জানালার রঙ ছিল যথাক্রমে কমলা সাদা আর বেগনী। সপ্তম কামরার রঙ ছিল কালো। ওর মোটা মোটা পর্দাগুলো পর্যন্ত ঘন কালো রঙের আর সেগুলো লুটিয়ে পড়েছিল ঐ কালো রঙের কার্পেটের ওপর। শুধু এই কামরার রঙের সঙ্গে এর জানালার সাদৃশ্য ছিলনা। এর জানালাগুলোর রঙ ছিল ঘন লাল। এই সাতখানা কামরার কোনটিতেই কিন্তু আমোর ব্যবস্থা ছিলনা। অথচ এগুলোর মধ্যে অজস্র স্বর্ণালঙ্কার ছড়ানো ছিল, কোথাও বা ছাদ থেকে বোলানো ছিল তার কিছু কিছু। লণ্ঠন বা মোমবাতি থেকে একটুকুও আলো পাওয়ার উপায় ছিলনা কোথাও। কিন্তু এই কামরাগুলোর মুখোমুখি লম্বা টানা বারান্দায় প্রত্যেকটি জানালার বিপরীত দিকে মস্তবড় তেপায়ার ওপর বসানো ছিল পেতলের আগুনদান। সেই আগুনের শিখা কাঁচের জানালার ভিতর দিয়ে কামরার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ত। এর ফলে কামরাগুলোর মধ্যে বর্ণবহুল অদ্ভুত একধরণের আলো পাওয়া যেত। পশ্চিমদিকের সব শেষের কালোরঙের কামরায় লাল জানালার ভেতর দিয়ে কালো পদায় যখন আগুনের রশ্মি প্রতিফলিত হোত তখন একটা ভয়ঙ্কর দৃশ্যের অবতারণা করত। ও ঘরে প্রবেশকারীদের মুখের ওপর ওই আলো যে ভীষণ প্রতিচ্ছায়া নিক্ষেপ করত তাতে যে কোন ব্যক্তিই ওর ত্রিসীমানার মধ্যে যেতেও ভয় পেত।

এই কামরারই পশ্চিম দেওয়ালে কালো কাঠের বিরাট ফ্রেম ওয়ালা একটা দেওয়াল ঘড়ি লটকান ছিল। একঘেয়ে গম্ভীর টিক্ টিক শব্দ করে দোকটার এদিক ওদিক যাওয়া, মিনিটের কাঁটা পুরো একপাক ঘুরে ঘণ্টার নির্দেশ দিলে ঘড়িটার ধাতব অন্তরের ভেতর থেকে সংগীতের মত মধুর অথচ সুউচ্চ ধ্বনির প্রবাহ বেরিয়ে আসার মধ্যে এমন একটা বৈশিষ্ট্য আর গুরুত্ব ছিল যার ফলে ঘণ্টা বেজে ওঠবার মুহূর্তে ঐকতান বাদকের দল স্বল্পকালীন নীরবতা পালনে বাধ্য হোত, থেমে যেত দ্বৈতনৃত্যের দ্রুতপদচারণা তাদের বৃত্তপরি ক্রমার মধ্যপথেই হয়তবা। আনন্দময় পরিবেশের মধ্যে অকস্মাৎ ঘটত ছন্দপতন তবু ঘড়ির বাজনা বেজে চলত নিয়মিত ভাবেই। এই মুহূর্তগুলিতে যারা আনন্দোচ্ছল তাদের মুখে নেমে আসত পাণ্ডুরতা, যারা বয়োবৃদ্ধ স্বপ্নবেশের আচ্ছন্নতায় তাদের হাত দ্রুতগতিতে পরিক্রমা করে আসত নিজেদের মুখমণ্ডল। বাজনার প্রতিধ্বনিটি মিলিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু হালকা হাসির তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়ত সকলের মুখে। একধরণের নির্বুদ্ধিতা বা দুর্বলতারই সাময়িক প্রভাবে ওরা স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল–এমনি একটা চিন্তা দ্রুতবেগে খেলে যেত গায়ক-বাদকদের মনের মধ্যে। ওরা পরস্পরের কাছে নীচুগলায় প্রতিজ্ঞা করে এর পরের ঘণ্টাধ্বনি যখন শুরু হবে তখন কোনক্রমেই এইরকম আবেগ সৃষ্টি করতে ওরা কিছুতেই দেবে না। কিন্তু তিন হাজার ছ’শ সেকেণ্ড দিয়ে গড়া ষাট মিনিট দ্রুত বেগে উধাও হয়ে যায়, ঘড়ির বাজনা আবার শুরু হয় আর ঠিক আগের মতই সব কিছুর মধ্যে ছন্দপতন ঘটে, আকস্মিকভাবে সবাই ভীরু আর চিন্তামগ্ন হয়ে পড়ে।

এত সব সত্ত্বেও আনন্দোৎসবের উচ্ছলতা বিন্দুমাত্রও হ্রাস পায়নি। প্রিন্সের রুচির বৈশিষ্ট্য ছিল। কোন রঙ কী ধরণের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে সে সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গী ছিল নিখুঁত। তার পরিকল্পনার মধ্যে সাহসিকতা আর মাদকতা, ধ্যানধারণার মধ্যে আদিমতার ঔজ্জ্বল্য লক্ষ্য করার মতো ছিল। কেউ কেউ অবশ্য তাকে উন্মাদ ভাবত। তার সর্বক্ষণের সঙ্গীরা কিন্তু এ কথা বিশ্বাস করত না। প্রকৃত পক্ষে তিনি যে উন্মাদ নন এই সত্যটুকু উপলব্ধির জন্যে তাঁকে দেখা, তাঁর কথা শোনা আর সান্নিধ্যলাভের প্রয়োজন ছিল।

এই বিরাট উৎসব উপলক্ষে সাতটি ঘরের সাজসজ্জা সম্পর্কে প্রধান পরামর্শদাতা ছিলেন তিনিই। মুখোশনাচের প্রয়োজনগত বৈশিষ্ট্য সৃষ্টির ক্ষেত্রেও মুখ্য অবদান ছিল তার। এটা ঠিক যে পুরো ব্যাপারটাই ছিল অদ্ভুত। এত আড়ম্বর, জাঁকজমক, তীব্রতা আর অলৌকিকতা সৃজিত হয়েছিল যা একমাত্র অতীতেই কিছু কিছু দেখা গিয়েছে। অসঙ্গত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিশিষ্ট অদ্ভুত-দর্শন মানুষদের বিচিত্র কাজে নিযুক্ত করা হয়েছিল। সর্বত্র যে অসঙ্গতচিন্তার ছাপ পড়েছিল তাতে বোঝা যাচ্ছিল সমগ্ৰ পরিকল্পনাটি কোন বিকৃতমস্তিষ্ক ব্যক্তিরই। সেখানে সৌন্দর্যের পাশে উচ্চঙ্খলতা, উদ্ভটের সঙ্গে ভীতিপ্রদ বস্তু আর সবকিছু জড়িয়ে অনেকখানি বিরক্তিকর পরিবেশ সৃজিত হয়েছিল। তবে এ কথাও সত্যি যে ঐ সাতটি কামরার মধ্যে একটা অভূতপূর্ব স্বপ্নের জগৎ সৃজিত হয়েছিল। সে স্বপ্নালু পরিবেশ বর্ণাঢ্য হয়ে উঠেছিল বিচিত্র বর্ণময় প্রাসাদকক্ষগুলোর সাহায্যে আর তারা গতিশীল হয়ে উঠেছিল ঐকতান সঙ্গীতহিল্লোলে। এ সবের মাঝখানে নিয়মিত ভাবে ধ্বনিত হচ্ছিল ভেলভেটমোড়া কামরার কালো ঘড়িটি। কিন্তু তার ঘণ্টাধ্বনির সঙ্গে সঙ্গে অন্য সব ধ্বনিই কয়েক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছিল। সমস্ত স্বপ্ন, সমস্ত আনন্দ শীতল কঠিন স্পর্শে নিপ্রাণ হয়ে যাচ্ছিল, আবার সেই প্রতিধ্বনিটি যাচ্ছিল মিলিয়ে, সাময়িকভাবে স্তব্ধীভূত আনন্দের হাস্যধ্বনি ছড়িয়ে পড়ছিল কামরাগুলোর মধ্যে। আবার সেই সঙ্গীত, সেই স্বপ্নালু পরিবেশ, তেপায়ার ওপর বসানো আগুনের শিখার জানালা দিয়ে কামরার মধ্যে এসে সেই অস্বাভাবিক বর্ণ বহুলতার সৃষ্টি সবই যেন প্রাণবন্ত হয়ে উঠছিল পরক্ষণেই। এখন রাত ভোর হয়ে আসছিল তবু ঐ পশ্চিমের কামরাটিতে মুখোশ ধারীদের কেউই ঢুকতে সাহস পায়নি। রক্তবর্ণ কাঁচের জানালাগুলো দিয়ে গাঢ় লাল আলো কালোরঙের কামরার কালো ভেলভেটপর্দায় প্রতিফলিত হয়ে একটা বীভৎস পরিবেশ সৃষ্টি করছিল। কেউ ও ঘরের ঘন কালো কার্পেটের ওপর গিয়ে দাঁড়ালেই দূরবর্তী অন্য কামরাগুলোর আনন্দধ্বনি ছাপিয়ে ওর কানে বেজে উঠছিল ঘড়িটির চাপা অথচ যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ টিক টিক শব্দ।

অন্য কামরাগুলোর মধ্যে উচ্ছল আনন্দ কিন্তু সীমাহীন উত্তেজনার মধ্যে উপচিয়ে পড়ছিল যেন। মধ্য রাত্রির ঘণ্টাধ্বনি শ্রুত হওয়া পর্যন্ত তার মধ্যে বিরাম ছিল না এক বিন্দুও। তারপরই আগে যেমন বলেছি ঠিক তেমনি ভাবেই যুগলনৃত্যের বৃত্তাকার পরিক্রমা, সঙ্গীত, সব কিছু অকস্মাৎ স্তব্ধ হয়ে গেল। এবার কিন্তু বাবোটি ঘণ্টাধ্বনির জন্যে সময় লাগল একটু বেশী তাই আনন্দোৎসবের জন্য সমবেত জনতার মধ্যে যারা একটু চিন্তাশীল তারা সেই অবসরে একটু বেশী সময়ের জন্যে চিন্তা করে নিতেও সময় পেল। ঠিক অবকাশের মুহূর্তেই, ঘড়ির শেষ ধ্বনির প্রতিধ্বনিটি মিলিয়ে যাবার পূর্বেই একটি মুখোশধারীমূর্তির দিকে নজর পড়ল অনেকেরই। এর আবির্ভাব ইতিমধ্যে কারও দৃষ্টিগোচর হয়নি তাই মৃদু কণ্ঠে এ সংবাদ মুহূর্তের মধ্যে পড়ল ছড়িয়ে আর সমবেত উৎসবকারীদের ভেতর থেকে উখিত হল মৃদু গুঞ্জন। সে গুঞ্জনের মধ্যে অসম্মতি, বিস্ময় আর সেই সঙ্গে ভীতি আর ঘৃণা।

যে ছায়াময় ভৌতিক পরিবেশের ছবি আমি একেছি তার মধ্যে খুব একটা অস্বাভাবিক দৃশ্যের অবতারণা না হলে যে বড় ধরণের উত্তেজনা সৃজিত হতে পারে না, এ কথা সহজেই অনুমান করা যায়। এই রাত্রির মুখোশনাচিয়েদের প্রায় অবাধ স্বাধীনতাই দেওয়া হয়েছিল আর প্রিন্সের পরিকল্পনারও বিস্তৃতি ছিল সীমাহীন। যারা উজ্জ্বল তাদের হৃদয় আবেগের প্রচণ্ডতায় মাত্র আলোড়িত হতে পারে। যাদের কাছে জীবন আর মৃত্যু রসিকতারই সমার্থক, সেই সব মানুষের কাছে রসিকতার জন্যে নির্দিষ্ট কোন বিষয়বস্তুই নেই। তবু সমবেত সমস্ত মানুষই স্বীকার করতে বাধ্য হলেন বর্তমান মুখোশ ধারীর চরিত্রে এবং পোষাকে কোন চাতুর্য বা যৌক্তিকতা ছিল না। নোগা আর লম্বা এই চেহারাটি আগাগোড়া কবরের পোষাকে আবৃত ছিল। মুখোশটি তৈরী হয়েছিল মৃতদেহের বিশুষ্ক মুখমণ্ডলের অনুকরণে। সে অনুকরণ এতই নিখুঁত হয়েছিল যে নিপুণভাবে খুঁটিয়ে দেখেও কোন ত্রুটি বার করা সম্ভব ছিল না। কিন্তু মূকাভিনেতা লালমৃত্যুর চরিত্র অনুকরণ না করলে হয়ত বা এই আনন্দার্থীরা সমর্থন না-করুক সমস্ত ব্যাপারটা সহ্য করতে পারত। সমস্ত পোষাকে রক্ত ছিটিয়ে, প্রশস্ত ভুরুতে আর মুখমণ্ডলে রক্ত মাখিয়ে সমস্ত ব্যাপারটা এক্ষেত্রে ভয়ঙ্কর করে ভোলা হয়েছিল।

ধীর আর সংযত পদক্ষেপে দ্বৈতনৃত্যের সঙ্গে ছন্দ বজায় রেখে এই ভৌতিক মূর্তিটি এগিয়ে চলেছিল, এমন সময় ওর ওপর নজর পড়ল প্রিন্স প্রস্পেয়োর। সঙ্গে সঙ্গে ওঁর সমস্ত শরীর প্রথমে ভয়ে বা ঘৃণায় থরথর করে কেঁপে উঠল। পরক্ষণেই ক্রোধে তাঁর চোখ মুখ লাল হয়ে উঠল। পাশে যে সভাসদরা দাঁড়িয়ে ছিল তাদের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি, কে এ? কার এত দুঃসাহস যে এইভাবে ঈশ্বরদ্রোহী চরিত্রে অভিনয় করে? এই মুহূর্তে ওকে বন্দী করে ওর মুখোশ খুলে নাও। দুর্গ প্রাকারে কাল সূর্যোদয়ের সময় যার ফাঁসি হবে সে কে, তা আমাদের এক্ষুণি জানা দরকার।

প্রিন্স এই সময় দাঁড়িয়ে পূর্বপ্রান্তের নীলরঙের ঘরটিতে। উনি হাত নেড়ে সঙ্গীত বন্ধ করে দিয়েছিলেন অনেক আগে। এর ফলে ওঁর বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর সবক’টি কামরার মধ্যে পরিস্কার ভাবে ছড়িয়ে পড়ল। তার আদেশ প্রচারিত হবার সঙ্গে সঙ্গে সমবেত জনতা কিছুটা সেই অবাঞ্ছিত প্রবেশকারীর দিকে অগ্রসর হয়ে গিয়েছিল। দেখা গেল সেই অবাঞ্ছিত মুখোশধারী ধীর রাজকীয় পদক্ষেপে, প্রিন্সের দিকে এগিয়ে আসছে। এমন এক অস্বাভাবিক আর অবর্ণনীয় ভীতিতে সমস্ত মানুষ অভিভূত হয়ে পড়েছিল যে মুখোশধারীর গায়ে হাত দেবার শক্তিটুকুও কারো ছিল না। সে অগ্রসর হয়ে এলো আর সমগ্র জনতা একই আবেগের দ্বারা পরিচালিত হয়ে দেয়ালের দিকে সরে গিয়ে ঘরের মাঝখানে এর জন্যে স্থান করে দিল। এগিয়ে চলল সে মুখোশধারী, চলল সেই উদ্ধত রাজকীয় ভঙ্গীতে। নীল ঘরের প্রান্তে সে পৌঁছল গিয়ে বেগনীলাল ঘরের মধ্যে। তারপর সবুজ, কমলা, সাদা আর বেগনী রঙের ঘরে পৌঁছনো সত্ত্বেও ওকে বন্দী করার কোন চেষ্টাই হলনা।

প্রিন্স প্রস্পেয়ো নিজের সাময়িক কাপুরুষতার জন্যে বোধহয় লজ্জিত আর ভয়ঙ্কর ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলেন। একটা উন্মুক্ত তলোয়ার নিয়ে প্রিন্স সব ক’টি কামরা পেরিয়ে একাই ঐ মুখোশধারীর কাছে গিয়ে পৌঁছলেন। ভীত সন্ত্রস্ত জনতা থেকে একজনও কিন্তু তাকে অনুসরণ করেনি। সেই মূর্তির তিনচার ফুটের মধ্যে যখন প্রিন্স গিয়ে পড়েছেন তখন সে কালো ভেলভেট মোড়া কামরার মধ্যে পৌঁছেছে। হঠাৎ সে ফিরে তার অনুসরণকারীর মুখোমুখি সোজা হয়ে দাঁড়ালো। হাতের তলোয়ার মেঝের ওপর খসে পড়ল আর চীৎকার করে প্রিন্সও লুটিয়ে পড়লেন মেঝের ওপর। তখন তার মৃত্যু হয়েছে। সমবেত জনতা তখন হতাশার মধ্যেও সমষ্টিগত সাহস সংগ্রহ করে কালো কামরার মধ্যে দৌড়ে গিয়ে কালো ঘড়ির তলায় সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সেই মুখোশধারীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। ওদের ক্রুদ্ধ হাতের মুঠোর মধ্যে ধরা পড়ল কবরখানার কাপড়চোপড় আর তাই দিয়ে বানানো মৃতব্যক্তির মুখোশ। স্পর্শযোগ্য কোন দেহই সেই পোষাকের মধ্যে ছিলনা।

লাল মৃত্যুর উপস্থিতি এবার সমষ্টিগতভাবেই স্বীকৃত হল। রাত্রের অন্ধকারে সে এসেছে চোরের মত। রক্ত সিঞ্চিত কামরা গুলোর মধ্যে আনন্দোৎসবে যোগদানকারী প্রতিটি নরনারী একে একে মৃত্যুর শীতল কোলে লুটিয়ে পড়ল। সব শেষে স্তব্ধ হয়ে গেল সেই বিরাটকায় কৃষ্ণবর্ণ ঘড়িটি। তেপায়ার ওপর অগ্নিকুণ্ডগুলি নির্বাপিত হল। অন্ধকার, ধ্বংস আর লাল মৃত্যুর সীমাহীন রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হল সেখানে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *