৮. চতুর্থদিন বিকেলবেলা

চতুর্থদিন বিকেলবেলা আমি মাত্র দাঁড় বাওয়া সেরে ঘামতে ঘামতে উপরে ডেকে গিয়ে জাহাজের সামনে সাগরের দিকে তাকালাম।

দ্বীপের তটরেখা না দেখা পর্যন্ত আমি হিসেব করে বুঝতে পারছিলাম আর কত দূর যেতে হবে। এমনকি নিশ্চিতও নই যে আমরা সঠিক পথে রয়েছি। পথ দেখাবার ভার আমি ইনানার উপর ছেড়ে দিয়েছিলাম। যাইহোক সামনে সাগর এখনও শূন্য আর দিগন্ত রেখায় কিছুই দেখা যাচ্ছে না।

বাতাস নেই। আকাশে মেঘও নেই। পরিবেশ থমথমে আর ভারী হয়ে রয়েছে। সামান্য কটু গন্ধকের স্বাদ পাওয়া যাচ্ছে, আমার গলা শুকিয়ে গেল। একবার কেশে জাহাজের পাশ দিয়ে পানিতে থুথু ফেললাম। জাহাজ ভেসে যাওয়া ছাড়া আর কোনো কিছু নড়ছে না।

জিন উপসাগর ছেড়ে আসার পর একবারও ভালো ঘুম হয়নি, তাই ভাবলাম নিচে কেবিনে গিয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে নেই। ঘুরতে যাবো এমন সময় সামনে দিগন্তে কিছু একটা আমার চোখে পড়লো। সরু কালো একটি রেখা। দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ লক্ষ্য করে বুঝতে পারলাম একঝাঁক পাখি আমাদের দিকে উড়ে আসছে। পাখি আমার খুব পছন্দ, তবে কাছে আসা পর্যন্ত এগুলো চিনতে পারলাম না। তারপর অবাক হয়ে দেখলাম এগুলো সাধারণ কাক। ক্রিট দ্বীপের কাক সাধারণত একা কিংবা যুগলে থাকে। এছাড়া কাক সবসময় ডাঙার কাছে থাকে। এসব কারণেই দূর থেকে এদেরকে চিনতে পারিনি। কয়েকশো কাকের একটি ঝক। এরা সবচেয়ে কাছের ডাঙা থেকে কমপক্ষে একশো লিগ কিংবা তার চেয়েও বেশি দূরে রয়েছে। আমি ওদেরকে মাথার উপর দিয়ে উড়ে যেতে দেখলাম। কাকগুলো অনবরত একে অন্যের সাথে কা কা করছে যেন কোনো দুর্গত কিংবা সাবধান বার্তা দিচ্ছে।

এগুলো চলে যাবার পর আবার উত্তর দিকে তাকিয়ে দেখলাম আরও পাখি উড়ে আসছে। এই আঁকে কাক ছাড়া অন্য পাখিও রয়েছে। সারস, বক, ছোট বাজপাখি, ঈগল আর অন্যান্য পাখি আমাদের মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেল। এরপর এল ছোট ছোট রবিন, চড়ুই, ভরতপাখি, কবুতর আর কলিকার পাখি। আকাশ পাখিতে ভরে রয়েছে। সূর্য প্রায় ঢাকা পড়েছে। পাখির ডাকে কান ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে। একসাথে এতো পাখির চলে যাবার মধ্যে একটা মরিয়াভাব অনুভূত হচ্ছিল।

আকাশ থেকে একটা ছোট হলুদ ক্যানারি পাখি আমার কাঁধের উপর পড়লো। স্পষ্টতই এটি পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছে। আমি পাখিটিকে হাতে নিয়ে মাথায় হাত বুলাতে লাগলাম। এর সারা শরীর থরথর করে কাঁপছিল।

আবার উপরে তাকিয়ে দেখলাম আরও পাখি ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে যাচ্ছে। হুই আর জারাস আমার কাছে এসে দাঁড়াল। তারপর দুজনেই মাথা পেছনে হেলিয়ে উপরে তাকিয়ে রইল।

হুই জিজ্ঞেস করলো, কী হচ্ছে তায়তা?

মনে হচ্ছে বিপুল সংখ্যায় পাখি দেশান্তরী হচ্ছে। তবে এর আগে এরকম কখনও দেখিনি।

হুই বললো, মনে হচ্ছে ভয়ঙ্কর কোনো কিছু থেকে ওরা পালাচ্ছে।

জারাস একমত হয়ে বললো, বন্য পশুপাখি বিপদ আসার আগেই টের পায়। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললো, তাই না তায়তা? আমি তার প্রশ্ন উপেক্ষা করলাম, এজন্য নয় যে উত্তরটা আমি জানি না বরং সেই মুহূর্তে জাহাজের কাঠামোর সাথে ভারী কোনো দেহ ধাক্কা খাওয়ার কারণে পানি ছলকে উঠলো।

আমি এক পাশ দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম সাগরের উপরিভাগ জ্যান্ত হয়ে ফুটছে। চকচকে দেহ নিয়ে বিশাল প্রাণী জাহাজের নিচে দেখা যাচ্ছে। পাখিরা যে পথে যাচ্ছিল একই পথে একঝাক টুনা মাছও যাচ্ছে। আমি সামনে তাকিয়ে দেখলাম উত্তর দিগন্ত পর্যন্ত মাছের ঝাঁক ছড়িয়ে রয়েছে।

তাদের রূপালি দেহগুলো আমাদের পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে। ওদের সাথে অন্যান্য সাগরের প্রাণীও দেখা যাচ্ছে। ধারাল ডানাসহ চকচকে কালো শুশুকের দলও পানির উপর দিয়ে ভেসে যাচ্ছে। আমাদের জাহাজের সমান লম্বা তিমি পানির উপরে উঠে শ্বাস নেওয়ার সময় বাষ্পের মেঘ উপরে ছুঁড়ছে। বাঘের মতো ডোরাকাটা দেহবিশিষ্ট হাঙ্গরও ধারাল দাঁত বের করে দক্ষিণ দিকে যাচ্ছে।

মনে হল উত্তর দিগন্তের ওপারে ভয়ঙ্কর কোনো প্রলয়কাণ্ড ঘটতে যাচ্ছে, আর তাই সমস্ত প্রাণী ভয় পেয়ে পালাচ্ছে।

কয়েকঘন্টা পর উড়ন্ত আর সাঁতার কেটে চলা এই বিপুল প্রাণীর সংখ্যা কমতে কমতে একসময় আর দেখা গেল না।

.

রাত ঘনাতেই তারার আলোয় পথ দেখে চলতে লাগলাম। পরদিন ভোরে সূর্য উঠার পর দেখলাম আকাশ আর সাগরে কোনো প্রাণের চিহ্ন নেই। সবকিছু নীরব নির্জন, থমথমে হয়ে রয়েছে।

কেবল দাঁড় বাওয়ার শব্দ, জাহাজের গায়ে পানির ছলকে ওঠার শব্দ আর দাঁড় বাওয়ার তালে তালে ঢাক পেটাবার ধুম ধুম শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ শোনা যাচ্ছে না। লোকজন কেউ কথা বলছে না কিংবা হাসছে না।

এমনকি আমার কাঁধের উপরের হলুদ ক্যানারি পাখিটিও নিশ্চুপ হয়ে একসময় দুপুরের দিকে টুপ করে ডেকে পড়ে গেল। আমি তুলে দেখলাম পাখিটা মরে গেছে। মরা পাখিটি সাগরের পানিতে পাখির দেবী আর্টেমিসের হাতে তুলে দিলাম। তারপর মাস্তুলের ডগায় আমার অবস্থানে উঠে পড়লাম।

দিগন্তের চারদিক তাকিয়ে হতাশ হয়ে দেখলাম সব শূন্য, কিছুই নেই। এক ঘন্টা বসে থাকলাম, তারপর আরও এক ঘন্টা বসে আশা নিয়ে দেখতে থাকলাম।

কড়া রোদে চোখ ব্যথা করছিল। আর কিছুক্ষণ পর চোখে ভূতুড়ে জাহাজ আর কাল্পনিক দ্বীপ দেখতে শুরু করলাম। চোখ বুজে চোখকে বিশ্রাম দিলাম।

যখন আবার চোখ মেলে তাকালাম, তখন অবাক হয়ে দেখলাম আমার মতিভ্রম আরও বেড়ে গেছে। আমাদের জাহাজের সামনে দিগন্তরেখা পর্বতমালার মতো আকাশের দিকে উঠছে। প্রতি মুহূর্তে এই সামুদ্রিক আল্পস পর্বতমালা উঁচু হয়ে আরও ভীতিকর হচ্ছে। চূড়ায় সদ্য পড়া তুষারের মতো সাদা ফেনা দেখা যাচ্ছে।

তারপর নিচে থেকে লোকজনের কথাবার্তা শোনা গেল। নিচের দিকে তাকিয়ে দেখলাম জারাস, হুই আর অন্যান্য কর্মকর্তারা দ্রুত জাহাজের সামনের গলুইয়ের দিকে ছুটছে। ওরা সেখানে সমবেত হয়ে সামনের দিকে আঙুল নির্দেশ করে নিজেদের মধ্যে তর্কাতর্কি করছে। উপরের ডেকের দাঁড়িরা দাঁড় বাওয়া থামিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে সামনে তাকিয়ে রয়েছে। জাহাজরে গতি ধীর হয়ে প্রায় থেমে এসেছে।

আমি দ্রুত মাস্তুল বেয়ে ডেকে নেমে সামনের দিকে ছুটে চললাম। লোকজনদেরকে চেঁচিয়ে নির্দেশ দিলাম যার যার অবস্থান নিয়ে জাহাজের দিক সঠিক পথে রাখতে।

সামনের দিক থেকে জারাস আর অন্যান্য কর্মকর্তারা আমার কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়ে ঘুরে তাকাল।

জারাস ছুটে আমার কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো, এসব কী হচ্ছে? পৃথিবী কী উল্টে পড়ছে? তারপর কাঁধের উপর দিয়ে পেছন দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে আতঙ্কিত স্বরে বললো, সাগরতো ফুলে উঠে প্রায় আকাশ ছুঁয়ে ফেলছে।

আমি কণ্ঠস্বর যতদূর সম্ভব শান্ত রেখে বললাম, এটা একটা ঢেউ।

সে প্রচণ্ডভাবে মাথা নেড়ে বললো, এটা খুব বড়। এতো দ্রুত আসছে যে এটাকে শুধু ঢেউ বলা যাবে না।

আমি নিশ্চিত হয়ে বললাম, এটা সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস। একই রকম জলোচ্ছ্বাস যা প্রাচীন কালের আটলান্টিস সাম্রাজ্যকে ডুবিয়ে দিয়েছিল।

সকল দেবতার দিব্যি। এর হাত থেকে বাঁচার কি কোনো উপায় নেই?

জারাসের মতো মানুষ এতো সহজে লড়াই ছাড়া হার মানার কথা নয়। তাকে ধমকে বলে উঠলাম, সমস্ত লোকজনকে সাবধান হতে বল। আর অতিরিক্ত দাঁড় হাতের কাছে রাখতে বল। ঐ জলোচ্ছ্বাস যখন আঘাত হানবে তখন বেশ ক্ষতি হবে। দাঁড়গুলো ভেঙে যাবে। আমাদেরকে গতিপথ ঠিক রেখে জাহাজ চালিয়ে যেতে হবে। এক পাশ থেকে আঘাত হানলে একটা কাঠের গুঁড়ির মতো উল্টে ফেলবে। কাজেই সমস্ত খোল কোনো কিছু দিয়ে ঢেকে মজবুতভাবে সুরক্ষিত করো। পানিতে ভেসে থাকার জন্য দাঁড়ি বেঞ্চে কিছু একটা ব্যবস্থা নাও যাতে দাঁড়িরা ভেসে না যায়।

আমার নির্দেশ মোতাবেক জারাস হুইকে নিয়ে কাজে লেগে পড়েলা। আমি আর তাদের কাজে হস্তক্ষেপ করলাম না। ওদেরকে ওদের মতো কাজ করতে দিয়ে জাহাজের সামনে দাঁড়িয়ে ঢেউয়ের এদিকে আসা লক্ষ্য করতে লাগলাম।

যতই এটা কাছে আসছে ততই উঁচু হয়ে মনে হচ্ছে আরও দ্রুত গতিতে আমাদের দিকে ধেয়ে আসছে। জলোচ্ছ্বাসের প্রথম ধাক্কাটি সামলাবার প্রস্তুতি নেবার মতো যথেষ্ট সময়ও হাতে নেই।

প্রচণ্ড ঢেউয়ের ধাক্কায় জাহাজের সামনের গলুই এতো দ্রুত উপরের দিকে উঠলো যে, তাল সামলাতে না পেরে আমি হাঁটু ভেঙে পড়ে গেলাম। আমার পেট ফুসফুঁসে চাপ দিতেই আমার প্রায় দম বন্ধ হয়ে এলো। তারপরও আমরা উপরের দিকে উঠতেই থাকলাম। জাহাজের পেছনের গলুই নিচু হতেই ডেক বাঁকা হয়ে প্রায় খাড়া হয়ে গেল। আমি দুই হাতে জাহাজের কিনারা ধরে রাখলাম। ডেকের উপরের যেসব আলগা জিনিসপত্র ছিল সেগুলো গড়িয়ে নিচের দিকে চলে গেল।

এমন লণ্ডভণ্ড বিশৃঙ্খল অবস্থা সত্ত্বেও জারাস আর হুই শক্ত হাতে জাহাজের নিয়ন্ত্রণ সামলাতে চেষ্টা করছিল। ওরা লোকজনদের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিচ্ছিল।

বিপদ থেকে পরিত্রাণ পেতে মাঝিমাল্লারা দাঁড় বাইতে বাইতে চিৎকার করে দেবতা আর তাদের মায়ের উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করছিল।

যতই আমরা উঁচু হলাম জাহাজ ততই খাড়া হতে হতে ডেক প্রায় খাড়া হয়ে গেল আর দাঁড়গুলো আকাশের দিকে মুখ করে থাকলো।

এক মুহূর্তের জন্য আমি বিশাল ঢেউয়ের চূড়ার উপর দিয়ে সামনে তাকালাম। দেখলাম আমরা এতো উঁচুতে উঠেছি যে আমি দূর দিগন্তে ক্রিটদ্বীপের দক্ষিণ তীর পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। আর এর উপরে দ্বীপের অন্য পাশে ক্রোনাস পর্বতের চূড়ার ফাটল দিয়ে ধুয়ার স্তম্ভ সগর্জনে উপরের দিকে উঠছে। হলুদ গন্ধকের মেঘ পাক খেতে খেতে উঠে উত্তর দিকের পুরো আকাশ ঢেকে ফেলেছে। তারপর ঢেউয়ের সাদা চূড়া আমাদের জাহাজের উপর আছড়ে পড়ে সবুজ পানিতে আমাদেরকে ভাসিয়ে দিল।

জীবন রক্ষার জন্য যে রশি সবার কোমরে বেঁধে রাখা হয়েছিল, প্রচণ্ড চাপে তার একটা ছিঁড়ে যেতেই চারজন নাবিক সাগরে ভেসে গেল। তারপর আর ওদের দেখা গেল না। বাকিরা কোনোমতে প্রাণ বাঁচাবার চেষ্টা করে যেতে লাগলো। আমার কোমরে জড়ানো মোটা শনের রশিটা শক্ত করে কোমরে চেপে বসে আমাকে কেটে প্রায় দুইভাগ করে ফেলছিল। ধীরে ধীরে চারদিক অন্ধকার হয়ে এলো। বুঝতে পারলাম আমরা ডুবে যাচ্ছি।

তারপর হঠাৎ জলোচ্ছাসের ঢেউয়ের পেছনের ঢাল দিয়ে জাহাজের সামনের গলুই ভেসে উঠলো। আমি আবার পরিষ্কার বাতাস বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারলাম। মনে হল যেন আমরা অনন্তকালের পর মুক্ত হয়েছি। শুধু কোমরে বেঁধে রাখা রশির কারণে আমরা জাহাজ থেকে ছিটকে পড়া থেকে বেঁচে গেলাম।

তারপর আবার আমাদের জাহাজ সাগরের বুকে ধপাস করে পড়লো। প্রচণ্ড সংঘর্ষের কারণে কাঠের তক্তা, বাল্কহেড আর কাঠামোর অন্যান্য অংশ ভেঙে পড়ার উপক্রম হল। দাঁড়গুলো শুকনো কাঠির মতো ছিঁড়ে গেল।

আমি ভেবেছিলাম আমরা আবার গভীর পানিতে ডুবে যাব। তবে আমাদের ছোট্ট জাহাজটি এবার কাঁপতে কাঁপতে মুক্ত হল। আবার আমরা ভেসে উঠলাম, পুরো ডেক পানিতে ভেসে গেছে। ডেকের উপর মানুষ আর যন্ত্রপাতি একে অপরের উপর স্থূপীকৃত হয়ে রয়েছে।

জারাস আর হুই চিৎকার করে লোকজনদের যার যার অবস্থানে যেতে নির্দেশ দিল। কয়েকজন নাবিক গুরুতরভাবে আহত হয়েছিল, কয়েকজনের হাতপা ভেঙে গিয়েছিল আর অন্যান্যদের পাঁজরের হাড় ভেঙে গিয়েছিল। এদেরকে একপাশে টেনে নিয়ে যাওয়া হল। অতিরিক্ত ভালো দাঁড়গুলো নিচে দাঁড়ি বেঞ্চে ক্ষতিগ্রস্ত দাঁড়ের জায়গায় বাঁধা হল। দাড়ীরা ভাঙা দাঁড়ের গোড়ার অংশগুলো ছুঁড়ে ফেলে নূতন দাঁড় নিয়ে বাওয়া শুরু করলো।

তারপর আমরা পাগলের মত পানি সেচতে শুরু করলাম। ধীরে ধীরে জাহাজের উচ্চতা বেড়ে জাহাজ আবার পানির উপর হালকা হল। ঢাকিরা আবার ঢাক পেটাতে শুরু করলো। দাঁড়ীরা আবার তাদের আসনে বসে দাঁড় টানতে শুরু করলো। আমরা আবার ক্রিটের দিকে চললাম। এই নিচু অবস্থান থেকে এখন ক্রিটের তটরেখা আবার দিগন্তের নিচে অদৃশ্য হয়ে গেছে। তবে এখন ক্রোনাস পর্বত থেকে নিঃসৃত আগ্নেয়গিরির ধূঁয়া আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চললো।

দুপুরের একটু পর বাতাস জোরে বইতে শুরু করলো। নাবিকেরা মাস্তুল খাঁটিয়ে সমস্ত পাল খাটাল। এবার চলার গতি দ্বিগুণ হল। জলোচ্ছাসের পর পানিতে ভাঙা গাছের ডালপালা, আর সামনের দ্বীপ থেকে বিধ্বস্ত জাহাজ এবং দালানকোঠার ভাসমান ভাঙা টুকরা ছড়িয়ে রয়েছে। আমরা এর মধ্য দিয়েই সাবধানে পথ করে নিয়ে এগিয়ে চললাম।

দুইঘন্টা পর আবার ক্রিট দ্বীপ নজরে এলো। এর উপরে আকাশ পর্যন্ত উঁচু আগ্নেয়গিরির ধুয়ার স্তম্ভের তুলনায় এটাকে অত্যন্ত ক্ষুদ্র আর গুরুত্বহীন মনে হচ্ছিল। এখন উন্মাদ ক্রোনাস দেবতার গুড় গুড় গম্ভীর গর্জন আমাদের উপরও এসে পড়ছে। এতো দূর থেকেও গর্জন ঠিকই শোনা যাচ্ছিল। আর দেবতার তাণ্ডবের তালে তালে সাগরের পানিও নাচছিল।

দাঁড়ীরা ঘাড় ফিরিয়ে পেছনে তাকিয়ে আতঙ্কিত হয়ে দাঁড় টানছিল। অন্যান্য নাবিকরা ডেকে গা ঘেঁসাঘেসি করে বসে আহত আর মৃতপ্রায়দের সেবা করতে লাগলো। আতঙ্কে সবার মুখ সাদা হয়ে গেছে। তারপরও আমি ক্রিটের দিকে ওদেরকে যেতে বাধ্য করছিলাম। যখন মনে হল ওরা বিদ্রোহ করে বসতে পারে, তখন জারাস আর হুই চাবুক হাতে দাঁড়িয়ে প্রস্তুত হয়ে রইল।

ডাঙার কাছাকাছি হতেই জলোচ্ছাসের তাণ্ডবলীলায় যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা দেখে আমি হতবাক হয়ে গেলাম। ক্রিমাদ বন্দরের কাছে পৌঁছে চিনতেই পারছিলাম না। কেবল পেছনে ইডা পাহাড়ের চূড়া দেখে বুঝা গেল এটা ক্রিমাদ বন্দর।

প্রচণ্ড ঢেউ এসে সমস্ত দালানকোঠা ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। এমনকি পোতাশয় রক্ষা করা বাঁধের ভারী পাথরখণ্ডগুলোও বাচ্চাদের খেলার ব্লকের মতো সাগরে ভেঙে পড়েছে।

পর্বতের পাদদেশ জুড়ে যেসব বন আর কৃষি ভূমি ছিল, সেগুলো সব রিক্ত হয়ে গেছে। বড় বড় গাছ, দালানের ধ্বংসাবশেষ আর বিশাল জাহাজের ধ্বংসাবশেষ একসাথে মিশে জঞ্জালের মতো স্তূপীকৃত হয়ে পড়ে রয়েছে।

সবচেয়ে খারাপ লাগলো, যখন দেখলাম আস্তাবলটা নেই। সহিস আর ঘোড়াগুলো নিশ্চয়ই ঢেউয়ের তোড়ে সাগরে ভেসে গেছে। রাজকুমারীরা দ্বীপের অন্যপাশে রয়েছে। ঘোড়া ছাড়া এই জট পাকানো জঙ্গলের ধ্বংসাবশেষের মধ্য দিয়ে ওদের কাছে পৌঁছাতে অনেকদিন লেগে যাবে।

বড় জোর এটুকু আশা করা যায়, দ্বীপের এমাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত যে কয়েকটি রসদ সরবরাহ চৌকি করেছিলাম সেগুলো হয়তো অনেক উঁচুতে অবস্থানের কারণে জলোচ্ছাসের ছোবল থেকে রক্ষা পেয়েছে। হয়তো কয়েকটা ঘোড়াও বেঁচে থাকতে পারে।

ক্রিমাদ বন্দরের ধ্বংসাবশেষ থেকে একটু দূরে গভীর সমুদ্রে আমরা জাহাজের নোঙর ফেললাম। তারপর জারাস আর হুইকে ডেকে বললাম, পর্বতের উপরে প্রতিটি রসদ সরবরাহ ঘাটির আস্তাবলে দশ থেকে বিশটা ঘোড়া থাকার কথা। যদি এখনও বেঁচে থাকে। তোমরা ত্রিশজন ভালো লোক। বেছে নিয়ে আমার সাথে তীরে চল। ওরা কেবল অস্ত্র নেবে কোনো বর্ম নয়। এতো ভার ঘোড়া নিতে পারবে না।

আমাদের দলটি তৈরি হওয়ার পর যে কয়েকটা ডিঙি প্রবল জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষা পেয়েছিল সেগুলো পানিতে ভাসালাম। এতো লোকের ভারে ডিঙিগুলো বিপজ্জনকভাবে দুলে উঠলো।

ঢেউয়ের ধাক্কায় পানি ছলকে নৌকার গলুইয়ের দুই পাশ দিয়ে উঠতেই আমি নিরবে ইনানার প্রতি প্রার্থনা করতে শুরু করলাম। দেবীকে স্মরণ করিয়ে দিলাম যে, আমি কেবল তার নির্দেশ অনুসরণ করছি এবং তিনি নিশ্চয়ই তা শুনেছেন। পোতাশ্রয় রক্ষা বাঁধের কাছে পৌঁছার আগে কেবল তিনজন লোক নৌকা থেকে পানিতে পড়ে গিয়েছিল। এদের মধ্যে একজন কোনোমতে সাঁতার কেটে জাহাজে ফিরে যেতে পেরেছিল।

পাথরের গায়ে জোরে ধাক্কা লাগতেই ডিঙিগুলো ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। তবে আমরা হাত ধরাধরি করে নিজেদের সামলে পোতাশ্রয় রক্ষা বাঁধে উঠলাম। আর কোনো ক্ষতি ছাড়াই শক্ত মাটিতে পা রাখলাম।

তারপর জারাস সমস্ত লোকজনকে দুই সারীতে বিভক্ত করার পর আমি ওদেরকে পানিতে ডুবে যাওয়া নগরীর ধ্বংসাবশেষের মধ্য দিয়ে এগিয়ে নিয়ে চললাম। জঞ্জালের নিচে অর্ধেক দেহ মাটিচাপা পড়া ফুলে উঠা কয়েকটি লাশ ছাড়া শহর সম্পূর্ণ জনমানবশূন্য। এরপর আমরা পর্বতের ঢাল বেয়ে উঠতে শুরু করলাম। এই স্থানটিও প্লাবিত হয়েছিল। আমি প্রথম সরবরাহ চৌকির দিকে যাওয়ার পথটি খুঁজতে শুরু করলাম। সমস্ত চিহ্ন ধুয়েমুছে গেছে। হয়তো কখনও তা খুঁজে পেতাম না যদি শিকারীর শিঙা ফুকার শব্দ না শুনতাম। সরবরাহ দলের তিনজন সদস্য উঁচু জায়গা থেকে আমাদেরকে দেখতে পেয়ে নিচে নেমে এলো।

ওরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল, আমাদেরকে দেখে নিশ্চিন্ত হয়ে ভেবেছিল যে আমরা ওদের উদ্ধার করতে এসেছি। তবে বেশ হতাশ হল যখন বুঝতে পারলো আসলে তা নয় বিষয়টি। আমি সকলকে সরবরাহ চৌকির দিকে দৌড়ে উঠতে বললাম। পাগল ক্রোনাস দেবতার মেজাজের সাথে তাল রেখে পায়ের নিচে মাটি থরথর করে কেঁপে উঠছিল।

প্রথম চৌকিতে পৌঁছে ছয়জন লোক আর বিশটি ঘোড়া পেলাম। এরা কোনোভাবে তাণ্ডব থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করতে পেরেছিল। নিচে মাটি কাঁপার কারণে ঘোড়াগুলো আতঙ্কে পাগলপ্রায় হয়ে উঠেছিল। গন্ধক পোড়া গন্ধ শুঁকে ঘোড়াগুলোর নাসারন্ধ্র ফুলে উঠছিল। অনেক চেষ্টার পর ঘোড়াগুলোকে শান্ত করলাম।

কিছুক্ষণ থেমে অস্ত্রশস্ত্রগুলো পরীক্ষা করে নিলাম। নিশ্চিন্ত হলাম দেখে যে আমার বাঁকা ধনুকটি মোমলাগান চামড়ার বাক্সে তখনও শুকনো রয়েছে। তবে ধনুকের অতিরিক্ত ছিলাগুলোর অবস্থা দেখে মনঃপুত হল না। কাজেই চৌকির অধিনায়কের কাছ থেকে তার আপত্তি সত্ত্বেও বেশ কিছু ধনুকের ছিলা নিলাম। তারপর ওদেরকে নির্দেশ দিলাম, কোনো কারণে আমরা যদি ফিরে আসতে বাধ্য হই তখন আমাদেরকে সাহায্য করার জন্য ওরা যেন এখানেই অবস্থান করে।

তারপর আর এক মুহূর্তও নষ্ট না করে জারাস আর হুইকে ঘোড়ায় চড়তে নির্দেশ দিয়ে পথ দেখিয়ে আমাদের ছোট দলটিকে ইডা পর্বতের উপরের পথের দিকে এগিয়ে চললাম।

চূড়ায় পৌঁছাবার একটু আগে সামনের পথ থেকে ছুটে আসা একদল বন্য পশুর খুরের প্রচণ্ড বজ্রধ্বনির মতো শব্দ আর গর্জন শুনতে পেলাম। সাথে সাথে আমার দলের লোকদেরকে নিয়ে পথের পাশে ঘন গাছের মাঝে লুকালাম। একটু পরই একদল দানবাকৃতির পশু আমাদের পাশ কাটিয়ে নিচের দিকে গেল।

অবশ্য সাথে সাথে পশুগুলোকে চিনতে পারলাম। এগুলো ছিল একপাল বন্য উরুস ষাঁড়। রক্তের মতো জ্বলজ্বলে লাল চোখ নিয়ে এগুলো আমাদের পাশ দিয়ে ছুটে গেল। পিঠে কুজ। পিঠের চামড়া কালো আর গাঢ় বাদামি রংয়ের লম্বা দাগ। হা করা মুখ থেকে জিহ্বা বের হয়ে রয়েছে আর সেখান থেকে ফেনিল লালা ঝরছিল। পশুগুলো আতঙ্কিত হয়ে পর্বতের চূড়ার পাশের পথ দিয়ে ছুটে পালাচ্ছিল।

ঠিক এসময়ে আরেকবার ভূকম্পনে আমাদের নিচে পর্বত আবার কেঁপে উঠলো। তাকিয়ে দেখলাম যেপথে বন্য ষাঁড়গুলো ছুটছিল সেদিকে পর্বতের চূড়ার কিনারায় একটি গভীর ফাটল দেখা দিয়েছে। পর্বতের ঢালটি এতো খাড়া ছিল আর পশুর পালটি এতো দ্রুত ছুটছিল যে তাল সামলাতে না পেরে পশুগুলো নিচের দিকে পতন সামলাতে পারলো না। সম্পূর্ণ পশুর পালটি চূড়ার উপর থেকে নিচে পড়ে গেল। পেছনেরগুলো সামনেরগুলোকে ঠেলতেই সমস্ত পশু শূন্যে ঝাঁপিয়ে পড়লো। কয়েকশো ফুট নিচে পাথরের উপর বিশাল দেহগুলো আছড়ে পড়ার শব্দ শুনতে পেলাম। তারপর সব নীরব হয়ে গেল, তারপর আবার নীরবতা ভঙ্গ হল আগ্নেয়গিরির প্রচণ্ড গর্জনে।

আমরা আবার সবাই পথে নেমে শেষ খাড়া ঢাল বেয়ে চূড়ায় উঠলাম। এখানে একটু থামলাম। পেছন ফিরে বিধ্বস্ত ক্রিমাদ বন্দর থেকে একটু দূরে নোঙর করা আমাদের জাহাজের ক্ষুদ্র আকৃতিটি দেখলাম। তারপর আবার ঘোড়ার পিঠে ঘুরে বসে সামনের ধ্বংসাবশেষের দিকে তাকালাম, যা ছিল এককালে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী সাম্রাজ্যের রাজধানী, কুমুসস।

বিশাল বন্দরটি আর নেই। বাতিঘরেরও চিহ্ন নেই। সম্ভবত বন্দরের অববাহিকায় ডুবে গেছে। বন্দরের দেয়ালগুলো ভিত্তিসহ পানিতে ভেসে গেছে। কোনো প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই সাগরের পানি পাথরের উপর দিয়ে ভেসে চলেছে, যেখানে একসময় এক বিশাল নগরী দাঁড়িয়েছিল।

সর্বাধিরাজ মিনোজ তার নৌবহরের যে দশ হাজার জাহাজের জন্য দম্ভ করতেন, সেগুলো সব জোয়ার রেখার উপর দিয়ে আছড়ে পড়ে ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। পুরো উপসাগরের বুকে ভেসে থাকা একটি জাহাজেরও চিহ্ন নেই। বিধ্বস্ত জাহাজের ভাসমান জঞ্জালে পানি সয়লাব হয়ে রয়েছে। যে প্রাসাদে সর্বাধিরাজ মিনোজ আমার রাজকুমারীদের বিয়ে করেছিলেন সেটিও আর নেই। এছাড়া নৌসদর দপ্তর থেকে শুরু করে সৈকত জুড়ে যে সুরম্য অট্টালিকাগুলো ছিল সেগুলোও নিশ্চিহ্ন হয়েছে।

এই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির মাঝে জমজ আগ্নেয়গিরি প্রচণ্ড গর্জনের সাথে অগ্নিশিখা আর ধূঁয়া উদ্‌গিরণ করে আকাশ ঢেকে ফেললো।

আমি অবিশ্বাসের চোখে সামনের ধ্বংসলীলার দিকে তাকিয়ে রইলাম। মিনোয়ান সাম্রাজ্যের চিহ্ন নেই। এর নিজের উন্মাদ দেবতা সাম্রাজ্যকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলেছে।

কিন্তু আমার মেয়েরা কোথায়? আমার বুকের ভেতরে ফুঁপিয়ে কান্না শুরু হল। কেন তুমি আমাকে এখানে পাঠালে ইনানা? এটা কি শুধু আমার সাথে মজা করার জন্য আর আমাকে কষ্ট দেবার জন্য করেছ?

তারপর হঠাৎ চোখে পড়লো, যেখানে আমার ঘোড়াটি দাঁড়িয়ে রয়েছে ঠিক তার নিচে পাহাড়ের পাদদেশে মিসরীয় দুতাবাস ভবনটির দিকে। কিছুদিনের জন্য হলেও এটা আমার বাড়ি ছিল। ভবনটি সম্পূর্ণ অক্ষত রয়েছে। এতো উঁচুতে জোয়ারের ঢেউ পৌঁছাতে পারেনি। দ্বীপের উত্তর ঢালে একমাত্র এই ভবনটি টিকে রয়েছে।

জারাস আর হুইকে চেঁচিয়ে ডাকলাম, আমার পেছন পেছন এসো। ঘোড়ার পাঁজরে পা দিয়ে তো দিতেই ঘোড়া সামনের দিকে চলতে শুরু করলো। পর্বতের জঙ্গলের মধ্য দিয়ে নামা শুরু করতেই আরেকবার ক্রোনাস পর্বতের জমজ চূড়া থেকে প্রচণ্ড কম্পন শুরু হল। আমার ঘোড়াটি আতঙ্কে কাঁপতে লাগলো। আমি তাকে নিয়ন্ত্রণে আনার আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগলাম। তবে রেকাবের দুইপাশে ঝুলে থাকা লোক দুইজন ভারসাম্য হারিয়ে বিপজ্জনকভাবে পড়ে যাচ্ছিল। আমি ঘোড়াটিকে শান্ত করা পর্যন্ত ওরা অতিকষ্টে নিজেরদেরকে ধরে রাখলো। তারপর আবার আমরা নিচের দিকে নামতে শুরু করলাম।

দূতাবাস প্রাঙ্গণ দেখে মনে হল জনশূন্য। দ্রুত মূল ফটকের সামনে পৌঁছেই লাফ দিয়ে ঘোড়ার পিঠ থেকে নামলাম।

জারাস আর হুই, তোমরা দুজনে পেছনের আস্তাবলে গিয়ে খুঁজে দেখো কোনো ঘোড়া পাও কি না। মেয়েদেরকে খুঁজে পেলে ক্রিমাদ ফিরে যেতে আরও ঘোড়া প্রয়োজন হবে। কোনোমতেই হতাশার কাছে হার মানবো না। আমার রাজকুমারীরা জীবিত না থাকলে ইনানা কখনও আমাকে এখানে ডেকে আনতেন না।

দূতাবাসের দরজা হাট করে খোলা রয়েছে। আমি এক ছুটে ভেতরে ঢুকে জীবিত কেউ আছে কি না জানতে হাঁকডাক শুরু করলাম। তবে কেবল প্রতিধ্বনি আমাকে ব্যঙ্গ করতে লাগলো। সমস্ত কামরা শূন্য তবে বেশির ভাগই লুট করা হয়েছে। জিনিসপত্র চারপাশে ছড়ানো ছিটানো। চাকরবাকর আর নগরী থেকে আসা আশ্রিতরা যা পেয়েছে লুট করে নিয়ে পালিয়েছে।

ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না কোন দিকে ঘুরবো। হতাশাবোধ আমাকে প্রায় গ্রাস করার উপক্রম হয়েছে। মন শক্ত করে দেবীর কাছে জোরে জোরে প্রার্থনা করতে লাগলাম, ইনানা! ওরা কোথায়? এখন তুমি আমাকে ছেড়ে যেও না। মিনতি করছি আমাকে ওদের কাছে নিয়ে চল।

সাথে সাথে আমার ডাকে সাড়া পাওয়া গেল। ভবনের উপরতলা থেকে তার কণ্ঠস্বর প্রতিধ্বনিত্ব হল। প্রভু তায়তা তুমি? সিঁড়িতে কারও পায়ের শব্দ শোনা গেল। তারপর সে চিৎকার করে বলে উঠলো, আমি মনে করেছিলাম লুটপাট করতে আরও লুটেরা দস্যুদল এসেছে। আপাদমস্তক আলখাল্লায় ঢাকা মূর্তিটি সিঁড়ির শেষ ধাপগুলো ছুটে পার হয়ে আমার দুইহাতের মাঝে আঁপিয়ে পড়লো। আমি দুই হাতে তার মুখ ধরে উপরে তুললাম। তারপর এক মুহূর্ত তার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠলাম, লক্সিয়াস, তুমি এখানে কী করছো বাছা! আমি তোমাকে অন্য কেউ মনে করেছিলাম।

আমার প্রভু তোরান আমাকে এখানে পাঠিয়ে বলেছেন আপনার জন্য অপেক্ষা করতে। আমরা জানতাম আপনি অবশ্যই আসবেন। আপনাকে পথ দেখিয়ে ক্রোনাস পর্বতে দেবতার প্রধান মন্দিরে নিয়ে যেতে বলেছেন। সে একনাগাড়ে এতোদ্রুত কথাগুলো বলে গেল যে, সে কী বলছিল তা আমি ঠিকমতো বুঝতে পারলাম না। আমি তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে শান্ত করলাম। তারপর বললাম, শান্ত হও বাছা! আমি তোমার কথা কিছুই বুঝতে পারিছ না। লম্বা একটা শ্বাস নাও। তারপর ধীরে ধীরে খুলে বলল কী ঘটেছে।

সর্বাধিরাজ মিনোজের নির্দেশে পুরোহিতরা তেহুতি আর বেকাথাকে প্রধান মন্দিরে নিয়ে গেছে। সেখানে ওরা ক্রোনাস দেবতাকে শান্ত করার জন্য তাদেরকে বলি দেবে, যাতে দেবতা খুশি হয়ে অগ্নিবর্ষণ করে আর গন্ধক ছুঁড়ে মিনোয়ান সাম্রাজ্য ধ্বংস না করেন। তারপর একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে দ্রুত বলে চললো, ঐ পুরোহিতরা ইতোমধ্যে সর্বাধিরাজ মিনোজের চল্লিশজন কুমারীবধূকে বলি দিয়েছে। তবে ক্রোনাস তাদেরকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তার দুর্বার ক্রোধ প্রশমিত করা যাচ্ছে না। তিনি চরম বলি দাবী করছেন: মিসরীয় ফারাও রাজপরিবারের রাজকুমারীদের বলি চাচ্ছেন।

তোরান কোথায়?

এই ভয়ঙ্কর কাজটি করা থেকে সর্বাধিরাজ মিনোজকে বিরত করতে আর আপনি আসা পর্যন্ত অন্তত বলি বিলম্বিত করার জন্য তিনি প্রধান মন্দিরে গেছেন। তিনি বলেছেন একমাত্র আপনিই তেহুতি আর বেকাথাকে বাঁচাতে পারেন। যেভাবেই হোক তিনি জানতেন আপনি অবশ্যই আসবেন। একজন আলখাল্লাপরা নারী স্বপ্নে তাকে সাবধান করেছিলেন

আমি তাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, তুমি মন্দিরে যাওয়ার পথ চেনো?

সে বললো, হ্যাঁ, চিনি। এখান থেকে বেশি দূরে নয়। তোরান আমাকে বলেছেন কীভাবে গোপন দরজাটা খুঁজে বের করে গোলকধাঁধার পথ দিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।

আমি তার হাত ধরে দূতাবাসের সামনের ফটকের দিকে ছুটে চললাম। জারাস আর হুই তাদের লোকজনদের নিয়ে সেখানে আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। জারাস ঘোড়ার পিঠ থেকে লাফ দিয়ে নেমে আমার কাছে এসে বলতে শুরু করলো, আপনি ওদেরকে খুঁজে পেয়েছেন? তারপর আলখাল্লাপরা লক্সিয়াসকে চিনতে পেরে জিজ্ঞেস করলো, রাজকুমারীরা কোথায়?

আমি তাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, যথেষ্ট হয়েছে। যেতে যেতে সবকিছু খুলে বলবো। লক্সিয়াস জানে কোথায় ওদেরকে খুঁজে পাওয়া যাবে। সে আমাদেরকে সেখানে নিয়ে যাবে।

দূতাবাসের আস্তাবলে হুই আরও ছয়টি ঘোড়া খুঁজে পেয়েছিল। সবাই ঘোড়ায় চড়ে এগিয়ে চললাম। আমি লক্সিয়াসকে আমার পেছনে বসালাম। সে দুই হাত দিয়ে আমার কোমর জড়িয়ে ধরলো। চাবুক মেরে ঘোড়া ছুটালাম।

লক্সিয়াস পর্বতের পাশ দিয়ে দ্বীপের পশ্চিম দিকে আমাদেরকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চললো। দুই লিগ দূরত্ব যাওয়ার পর পথের একটি দুইমুখি বাঁক পেলাম। রাস্তার মূল রাস্তাটি সোজা চলে গেছে। আর অন্য শাখাঁটি ইডা পর্বতের চূড়ার দিকে উঠে গেছে। এই পথের চিহ্ন হিসেবে একটি বিশাল সিডার গাছ দাঁড়িয়ে রয়েছে। এর উপরের ডালপালাগুলো গর্জনরত আগ্নেয়গিরির মেঘের দিকে উঠে গেছে।

লক্সিয়াস আমার কাঁধের পেছন থেকে বলে উঠলো, প্রভু তোরান বলেছেন এই গাছটির বয়স তিনহাজার বছর। তারপর আঙুল তুলে সামনে সিডার গাছের কাঠে পেরেক দিয়ে লটকানো একটি বিশাল বন্য সঁড়ের মাথার খুলি দেখিয়ে বললো, আর ঐ যে ওটি হচ্ছে ক্রোনাস দেবতার প্রতিক। এর শিংগুলো আমার ক্রীতদাস ওয়াগাকে যে ষাঁড়টি হত্যা করেছিল তার প্রায় দ্বিগুণ। বহুবছর ধরে রোদে পুড়ে রং জ্বলে চকচকে সাদা হয়ে গেছে।

এসব নিয়ে ভেবে আর এক মুহূর্তও নষ্ট না করে আমরা লক্সিয়াসের দেখানো পথে উপরের দিকে এগিয়ে চললাম। ঘন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে পথটি উপরে উঠে গেছে। সংকীর্ণ পথটি দিয়ে পাশাপাশি কেবল দুটি ঘোড়া চলতে পারবে। তারপর হঠাৎ পথটি একটি উঁচু কালো পাথরের চূড়ার সামনে শেষ হল। চূড়ার পাদদেশে একটি বিশাল পিতলের দরজা দেখা গেল। দরজাটির ঠিক মাঝখানে একই ধাতুর একটি গোলাকার তালার চাকা রয়েছে।

লক্সিয়াস আমার পেছনে জিনের উপর থেকে একটা বিড়ালের মতো লাফ দিয়ে মাটিতে নামলো। তারপর এক দৌড়ে তালার চাকার কাছে গিয়ে চাকাটি ঘুরাতে শুরু করলো। জোরে জোরে গুণে সে একবার বামদিকে আরেকবার ডান দিকে এভাবে কয়েকবার চাকাটি ঘুরালো।

তার পেছনে আমি ঘোড়া থেকে নেমে আমার ধনুকে একটা নতুন শুকনো ছিলা পরিয়ে ছিলাটা টেনে ধরলাম। তারপর তৃণির থেকে একজোড়া তীর নিয়ে কোমরবন্ধে গুজলাম, যাতে দরকার মতো সাথে সাথে তুলে নিতে পারি। তৃতীয় আরেকটি তীর ধনুকে লাগিয়ে বাম হাতে ধনুকের মাথা ধরলাম। ডান হাত দিয়ে খাপ থেকে তলোয়ার বের করলাম। জারাস, হুই আর অন্যরা আমাকে অনুসরণ করে অস্ত্রহাতে নিয়ে প্রস্তুত হল।

লক্সিয়াস শেষ একবার চাকাটা ঘুরাতেই যন্ত্রটি থেকে জোরে ক্লিক শব্দ শোনা গেল। ঢাকনিটা টেনে খুলতে লক্সিয়াসকে সাহায্য করতে আমি জারাসকে ইশারা করলাম। তারপর একপাশে সরে দাঁড়িয়ে ধনুক উঁচু করে জারাসের কাঁধের উপর দিয়ে লক্ষ স্থির করলাম।

ভারী দরজাটা ধীরে ধীরে খুলে গেল। এর পেছনেই সবুজ পোশাক পরা হেরেমের দুইজন উগ্রচণ্ডা রক্ষী দাঁড়িয়ে রয়েছে। উভয়েই খোলা তরবারি নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। দরজা খোলার সাথে সাথে ওরা সামনে এগিয়ে জারাস আর লক্সিয়াসকে আক্রমণ করলো।

জারাস তৈরি ছিল, সে একজনকে তার বালকসুলভ নগ্ন বুকে তলোয়ার বিধিয়ে হত্যা করলো। আমি অন্যজনকে তীর ছুঁড়ে মারলাম। এতো কাছের লক্ষ্যে তীরটি তার বুকে ঢুকে পাঁজর ভেদ করে পিঠ দিয়ে বের হল। দুই নারী যোদ্ধাই টু শব্দ না করে মাটিতে ঢলে পড়লো। আমরা মৃতদেহের উপর দিয়ে পার হলাম। কাঁধে কাঁধ ঠেকিয়ে আমি আর জারাস সুরঙের মধ্য দিয়ে ছুটলাম। দুইপাশের দেয়ালে ব্র্যাকেটে লাগানো ধূঁয়া উঠা মশালের আলোয় সুড়ঙটি মৃদু আলোকিত হয়ে রয়েছে।

লক্সিয়াস আমার পেছন থেকে বলে উঠলো, তোরান বলেছেন প্রত্যেকবার বামদিকে ঘুরবেন আর নয়তো আমরা এই গোলকধাঁধায় হারিয়ে যাবো।

আমি পর পর তিনবার বামদিকে মোড় ঘুরলাম। তারপর সুরঙের সামনে থেকে মন্ত্র পরার মৃদু শব্দ প্রতিধ্বনিত্ব হয়ে ভেসে এলো। সামনে এগোতেই শব্দটি বাড়তে লাগলো। আরেকবার বামে মোড় ঘুরতেই সামনে মৃদু আলোর আভাস চোখে পড়লো।

লক্সিয়াস আর অন্যদেরকে সাবধান করে সেখানেই দাঁড়াতে বললাম। তারপর দুইপাশে জারাস আর হুইকে নিয়ে আমি সামনে এগোলাম। আলো উজ্জ্বল হয়ে উঠলো, তারপর শেষ বাকটি ঘুরলাম।

সেখানে আরও দুইজন নারী যোদ্ধা আমাদের দিকে পেছন ফিরে সুরঙের পথ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ওদের সম্পূর্ণ মনোযোগ সামনের দিকে থাকায় ওরা আমাদের উপস্থিতি টের পেল না। আমরা নিঃশব্দে ওদের পেছনে এগিয়ে গেলাম, জারাস আর হুই দুই হাত দিয়ে ওদের মুখ চেপে ধরলো, ওরা কোনো শব্দ করতে পারলো না। তারপর দ্রুত একবার তরবারি ঝলসে উঠতেই মেয়েগুলোর দেহ মাটিতে ঢলে পড়লো। ওদের শরীরের উপর দিয়ে সামনে এগোতেই আমরা একটা ব্যালকনিতে এসে পৌঁছলাম। জীবন্ত আগ্নেগিরির গা কেটে ব্যালকনিটি তৈরি কর হয়েছে।

আমাদের বিশ কিউবিট কিংবা তার চেয়েও বেশি নিচে মস্ত ফাঁক হয়ে থাকা একটি বিশাল গুহামুখের মতো খোলা জায়গা দেখা যাচ্ছে। এর সামনের দেয়ালে দুই পাশে স্তম্ভ বসানো একটি প্রবেশ পথ দিয়ে দিনের আলো ঢুকে জায়গাটি আলোকিত হয়েছে। প্রবেশ পথটির মধ্য দিয়ে আমরা বিধ্বস্ত ক্রোনাস নগরী আর দিগন্তজুড়ে বিস্তৃত ক্রোনাস পর্বতের জমজ চূড়া দেখতে পেলাম।

আমাদের ঠিক নিচে একটি প্রশস্ত অর্ধ-বৃত্তাকার মল্লভূমি দেখা যাচ্ছে। এর মেঝে সুক্ষ সাদা বালু দিয়ে ঢাকা, এর উপরে একটি সোনা আর রূপার একটি বেদি রয়েছে। বেদিতে একটি বন্য ষাঁড়ের সোনালি মূর্তি দাঁড় করানো রয়েছে। ষাঁড়ের মূর্তিটি ফুল আর সুগন্ধি ধুপের পাত্র দিয়ে সাজানো হয়েছে।

মল্লভূমি আর বেদির চারপাশ ঘিরে কয়েক স্তরে গ্যালারির মতো ধাপে ধাপে পাথরের আসন পাতা রয়েছে।

নিচের দুই ধাপের আসনে সারিবদ্ধভাবে বসে রয়েছে কালো পোশাক আর উঁচু টুপিপরা মিনোয়ান অভিজাত ব্যক্তিবর্গ। তাদের মুখে চক-খড়ি চূর্ণ মেখে সাদা করা হয়েছে আর চোখের চারদিকে প্রথাগতভাবে কালো সুরমা মাখা। ওরা সবাই কোনো নড়াচড়া না করে একদৃষ্টিতে নিচে রঙ্গালয়ের শূন্য মেঝের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। কেবল এক সুরে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সময় গাওয়া শোকসঙ্গীত উচ্চারণ করার সময় তাদের মুখ নড়ছিল।

মাত্র কয়েকজনকে দেখে আমি অবাক হলাম। তেহুতি আর বেকাথার সাথে মিনোজের বিয়ের সময় বন্দরের রাজপ্রাসাদে ওরা কয়েকহাজার ছিল। আর আজ এখানে পঞ্চাশ জনেরও কম দেখা যাচ্ছে। অগ্নৎপাত আর সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে মিনোয়ান সমাজের ফুলের ভয়াবহ ক্ষতি স্বীকার করতে হয়েছে।

স্তব গেয়ে চলা লোকগুলোর পেছনের সারির আসনগুলো শূন্য পড়ে রয়েছে। গ্যালারির কেন্দ্রস্থলে একটি উঁচু সোনার সিংহাসন রয়েছে। এটিও শূন্য।

সিংহাসনের ঠিক পেছনে ভূগর্ভস্থ মন্দিরে ঢোকার সুরঙ্গ পথের মুখ দেখা যাচ্ছে। গুহার মতো মুখটি দিয়ে কুনুসস উপসাগরের ওপারে দূরে ক্রোনাস পর্বতের দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। জমজ আগ্নেয়গিরি ধুয়ার কুণ্ডলি উদ্‌গিরণ করে আকাশের অনেক উঁচুতে উঠে সূর্যকে প্রায় ঢেকে ফেলেছে।

আমরা যে ব্যালকনিতে হামাগুড়ি দিয়ে বসেছিলাম সেটি নিচের মল্লভূমির মেঝে থেকে এতো উঁচুতে ছিল যে, আমাদের দিকে মুখ করে বসা দর্শকরা আমাদের দেখতে পাচ্ছিল না। এছাড়া গুহার ছাদ থেকে বালুময় মেঝের একটু উপর পর্যন্ত ঝুলানো একটি গাঢ় রঙের পর্দার আড়ালে আমরা আংশিক ঢাকা পড়েছিলাম। তারপরও আমি, জারাস আর হুইকে সাবধান করে বললাম একটু পিছিয়ে ছায়ার মাঝে গিয়ে ওদের অস্ত্রগুলো কিছু একটা দিয়ে ঢেকে রাখতে যাতে এর উপর দিনের আলো প্রতিফলিত হয়ে মন্দিরে আমাদের উপস্থিতি ফাঁস না হয়ে যায়।

আমার কথাগুলো বলা শেষ হতে না হতেই এই রঙ্গমঞ্চের দুইদিকে দিয়ে রক্ত লাল আলখাল্লাপরা দুইসারি পুরোহিত ভেতরে ঢুকলো। ওরা সোনালি সিংহাসনের চারদিকে অবস্থান নিয়ে অন্যান্য অভিজাত ব্যক্তিদের সাথে গলা মিলিয়ে শোক সঙ্গীতে সামিল হল।

তারপর হঠাৎ সমস্ত শব্দ থেমে গেল। চতুর্দিকে গভীর নীরবতা নেমে এল। সমবেত উপাসকবৃন্দ এবার গোঙনির মতো শব্দ করে একটানা কিছু উচ্চারণ করে যেতে লাগলো আর সবাই একসাথে সকলে হাঁটু গেড়ে বসে মার্বেল পাথরের মেঝেতে মাথা ঠেকালো।

সর্বাধিরাজ মিনোজ এবার আসবেন মনে করে আমি সারাক্ষণ শূন্য সিংহাসনটির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম, ভেবেছিলাম মানুষকে ঠকানোর জন্য আরেকটি নাটকীয় কৌশল ব্যবহৃত হবে। তারপরও আমি অবাক হয়ে গেলাম।

এক মুহূর্ত সিংহাসনটি খালি ছিল আর তার পরের মুহূর্তেই দেখলাম মিনোয়ান নৃপতি সেখানে বসে রয়েছেন। আর দুর্বল কংকালসার দেহ নিয়ে তার মাও তার পাশে বসে রয়েছেন।

তার মা একজন বিধবার কালো বেশ পরে রয়েছেন। তবে মিনোজ অত্যন্ত উজ্জ্বল রাজভূষণ পরে রয়েছেন। মনে হচ্ছে তার উপস্থিতি দিয়ে গুহামুখে সমস্ত প্রজাদের উপর প্রাধান্য বিস্তার করে রয়েছে। তার বর্ম আর দামি ধাতুর তৈরি বীভৎস ষাঁড়ের মুখোশ থেকে উজ্জ্বল আলোর চিকন ছটা ছায়ায় ছিটকে পড়ছে।

লুকোনো জায়গা থেকে বাদকদল রণসঙ্গীত বাজাতে শুরু করতেই পুরো গুহামুখ তুমুল কোলাহলপূর্ণ শব্দে ভরে গেল। আর সেই সাথে সমবেত উপাসকবৃন্দ আবেগে আত্মহারা হয়ে ব্যক্তি পূজার আনন্দে চিৎকার করে উঠলো।

সর্বাধিরাজ মিনোজ এবার তার বর্ম পরা ডান হাতের মুঠো উঁচু করতেই আবার সম্পূর্ণ নীরবতা নেমে এলো। এমনকি ব্যলকনিতে বসা আমরা তিনজনও সেই সাথে নিশ্চুপ হয়ে রইলাম।

মিনোজ আবার আরেকটি ইঙ্গিত করতেই আবার সবাই সমস্বরে অন্যধরনের একটি আদিম পাশবিক ক্রদ্ধ শব্দ করতে শুরু করলো। তারপর গুহার ছাদ থেকে ঝুলে থাকা পর্দাগুলো দুইদিকে সরিয়ে দেওয়া হল। রঙ্গস্থলের দুই পাশের পাথরের দেয়ালে দুটি বন্ধ দরজা দেখা গেল। সমবেত উপাসকরা আরও জোরে স্তব করতে লাগলো। এমনকি লাল পোশাকপরা পুরোহিতরাও তাদের সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে চিৎকার করে স্তব করতে লাগলো। শব্দটি এখন আর প্রার্থনা কিংবা পূজার স্তব রইল না। এটি এখন একটি প্রচণ্ড যৌন কামনা এবং ধর্ষকাম বিষয়ক আনন্দের কামোত্তেজনা জাগানো গর্জনে পরিণত হয়েছে।

পর্দা সরানো খোলা দরজা দিয়ে সবুজ পোশাক পরা একদল নারীযোদ্ধা ঢুকলো। ওরা মাথায় ফ্ল্যামিঙ্গো পাখির উজ্জ্বল পালক উঁচু করে লাগানো টুপি পরে রয়েছে। হাতের উঁচু ঢালগুলো লবণ মাখানো কুমিরের চামড়ার তৈরি। ওরা চারপাশ থেকে গোল হয়ে ঘিরে ধরে কিছু একটা লুকিয়ে নিয়ে আসছিল। রঙ্গমঞ্চের ঠিক মাঝখানে এসে ওরা থামলো। তারপর পূর্বনির্ধারিত ইঙ্গিতে সরে দাঁড়াতেই আমার দুই রাজকুমারীকে মাঝখানে দাঁড়ানো অবস্থায় দেখা গেল।

তেহুতি আর বেকাথা হাত ধরাধরি করে হতবাক হয়ে মুখ উঁচু করে তাদের সামনে গ্যালারিতে বসা উপাসক আর পুরোহিতদের বিকট চিৎকার শুনছে। ওদের মাথায় সাদা গোলাপের মুকুট পরানো রয়েছে।

তবে মাথায় মুকুট ছাড়া পরনে আর কিছু নেই। দুজনেই পুরোপুরি নগ্ন। ওদেরকে দেখে খুব কমবয়সি, নাজুক প্রায় শিশুর মতো মনে হচ্ছিল। তেহুতি আর বেকাথাতে একা দাঁড়ানো অবস্থায় রেখে নারী-দেহরক্ষী দলটি ঘুরে রঙ্গমঞ্চ থেকে বের হয়ে গেল।

সমবেত উপাসকদের একযোগে প্রচণ্ড চিৎকার করে মন্ত্র পড়ার শব্দে মেয়েদুটো অভিভুত হয়ে আতঙ্কে কাঁপতে লাগলো। সর্বাধিরাজ মিনোজ আবার উঠে দাঁড়াতেই চিৎকার থামিয়ে সবাই চুপ হলো। ধীরে ধীরে তিনি ঘুরতেই তার সোনালি মুখোশটি মন্দিরের পেছনের দেয়ালমুখি হল। দেয়ালের গায়ে দূরবর্তী ক্রোনাস পর্বতের ছবি আঁকা ছিল। এবার তিনি গলা চড়িয়ে তার দেবতাকে আবাহন করতে শুরু করলেন। তার শিরস্ত্রাণের মধ্য থেকে প্রতিধ্বনিতৃ হয়ে বের হয়ে আসা চিৎকার আর ষাঁড়ের মত গর্জনের একটি বর্ণও আমি বুঝতে পারলাম না।

তবে এবার কথাগুলোর অর্থ ঠিকই বুঝা গেল, যখন তিনি তার রত্নখচিত কোমরবন্ধ থেকে ব্রোঞ্জের বিশাল তলোয়ারটি বের করলেন। তলোয়ারটি আমার সমান লম্বা। তিনি ঘুরে নিচে বলির মেঝেতে দাঁড়ানো নগ্ন মেয়েদুটির দিকে তাকালেন।

যদিও মাথাটকা ধাতব মুখোশ আর পেছনে পাথরের দেয়ালে প্রতিধ্বনিত্ব হয়ে কথাগুলো কিছুটা দুর্বোধ্য আর অস্পষ্ট হয়ে পড়েছিল, তারপরও এই প্রথমবার আমি তার উচ্চারিত কথাগুলোর অর্থ সঠিক ধরতে পারলাম।

হে প্রিয় ক্রোনাস! সকল দেবতার প্রথম দেবতা- ক্রোনাস! আমি আপনার পুত্র; আপনার ঔরসজাত; আপনার দেহ এবং রক্তের অংশ। হাজার বছর ধরে আমি আপনার উপাসনা করে আসছি। হাজার বছর ধরে আপনাকে ভালোবেসে আপনাকে মান্য করে এসেছি। এখন আবার দাঁড়িয়ে আপনার প্রতি আমার আনুগত্য এবং শপথ ঘোষণা করছি। আমি আপনার জন্য বলি এনেছি যা আপনার পবিত্র আত্মা ব্যকুলভাবে কামনা করছে। আপনার পানের জন্য কুমারী রাজকন্যার রক্ত আর খাওয়ার জন্য কুমারী রাজকন্যার মাংস এনেছি। আসুন আপনার পার্থিব রূপে এসে আপনার জন্য যে অর্ঘ্য এনেছি তা গ্রহণ করুন। মেরে ফেলুন! খেয়ে ফেলুন!

তারপর তিনি তলোয়ারটি তুলে তেহুতি আর বেকাথার সামনের বন্ধ দরজার উপর জোরে একটি খোঁচা মারলেন।

দরজাটির দুই দিকের পাল্লা খুলে গেল তবে ভেতরে অন্ধকার দেখা গেল। আমি তাকালাম তবে দরজার ওপাশে প্রথমে কিছুই দেখতে পেলাম না। তারপর ভেতরে কিছু একটা নড়াচড়া করে উঠলো, যা এতো বিশাল আর ভয়ঙ্কর যে আমার কল্পনার বাইরে।

ভীত সন্ত্রস্ত বেকাথা হু হু করে কেঁদে উঠে তার বড় বোনের গা ঘেঁসে এলো। আতঙ্কে তার মুখ সাদা হয়ে গেছে। তেহুতি এক হাত দিয়ে তার বোনকে ধরলো। বেকাথাও দুই হাত দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলো। দুজনেই তোরণের দিক থেকে পিছিয়ে এলো।

পুরো মঞ্চ জুড়ে নিবিড় এবং স্পষ্ট বোধগম্য নিস্তব্ধতা নেমে এলো; আর বাইরের জগতেও। আগ্নেয়গিরির মেঘের মত গুড়গুড় গর্জনও হঠাৎ থেমে গেল। নিচে পৃথিবী স্থির হয়ে রয়েছে। মনে হল বিশাল দেবতা ক্রোনাসও তার নিজের মন্দিরে যে নাটক ঘটতে যাচ্ছে তাতে সম্মোহিত হয়ে পড়েছেন।

নাকের ক্রদ্ধ ফেস-ফেঁসানি আর বালু ছড়ানো পথে ভারী খুরের ধপ ধপ শব্দে নীরবতা ভঙ্গ হল। একটি বন্য উরুস ষাঁড় তীব্র গতিতে খোলা দরজা দিয়ে রঙ্গমঞ্চে ঢুকলো। সমবেত কণ্ঠের মন্ত্রোচ্চারণের প্রচণ্ড কোলাহল হঠাৎ কানে যেতেই সে আচমকা মাঝ পথে থেমে পড়লো। তারপর সামনের পায়ের খুর দিয়ে বালু আঁচড়ে ধুলির মেঘ উড়াতে শুরু করলো।

এযাবত যত উরুস ষাড় আমি দেখেছি সেগুলোর গায়ে কালো আর গাঢ় বাদামি ডোরা কাটা ছিল। তবে এই ষাঁড়টির গায়ের রঙ ধবধবে সাদা। চোখদুটো পালিশ করা রুবির মতো উজ্জ্বল। প্রচণ্ড ক্রোধে মাথাটি এদিকওদিক নাড়তেই মনে হল ষাঁড়টির দেহ আরও ফুলে আরও বড় হয়ে উঠছে। ক্রোধটি কোথায় ঝাড়বে সেই লক্ষ্য খুঁজছে।

বিশাল শিংগুলো হাতির দাঁতের মতো সাদা। কালো চকচকে ডগাগুলো বর্শার আগার মতো তীক্ষ্ণ। একজন মানুষ হাত মেলে ধরলে তার দ্বিগুণ হবে শিংদুটোর বিস্তার। . প্রাণীটি সামনে দাঁড়ানো নগ্ন মেয়েদুটির দিকে স্থির দৃষ্টিতে একবার তাকালো, তারপর মাথা নিচু করলো। রাগে এর দুই কাঁধের মাঝখানের বিশাল কুজটি ফুলে উঠেছে। তারপর এটি খুর দিয়ে মাটি আঁচড়াতে লাগলো।

জন্তুটির গায়ের রঙ ও আকৃতি আর সেই সাথে এর দেহ থেকে যে অশুভ আভা নিঃসৃত হচ্ছে তা থেকে হঠাৎ আমি বুঝতে পারলাম যে, এটি কোনো বনজঙ্গল কিংবা পর্বতের প্রাণী নয়। এটি এমন একটি কিছু যাকে এর দানবীয় প্রভুর তরফ থেকে বলি গ্রহণ করার জন্য আগ্নেয়গিরির গভীর অগ্নিকুণ্ড থেকে পাঠানো হয়েছে।

শিকারের দিকে তাকিয়ে এটি দাঁত বের করে ক্রুদ্ধ গর্জন করলো। উপরের ঠোঁট পেছনের দিকে কুঁচকাতেই লম্বা তীক্ষ্ণদাঁত বের হয়ে পড়লো। এই দাঁত তৃণভোজীর নয় এটি মাংসাশী প্রাণীর দাঁত।

সর্বাধিরাজ মিনোজ এই প্রাণীটিকে প্ররোচিত করে বলতে লাগলেন, আমি আপনার পানের জন্য কুমারীর রাজরক্ত এনেছি। আপনার খাওয়ার জন্য কুমারী রাজকন্যার মাংস এনেছি। মেরে ফেলুন! খেয়ে ফেলুন!

আমাকে অসাড় করতে যাচ্ছিল যে আতঙ্কবোধ, তা ঝেড়ে ফেলে দিলাম। তারপর মিনোয়ানদের সমবেত কণ্ঠের মন্ত্রপাঠের কানে তালা লাগানো শোরগোলের উপর দিয়ে গলা তুলে চিৎকার করে বললাম, জারাস, হুই! আমাদেরকে নিচে গিয়ে ওদেরকে বাঁচাতে হবে। পর্দা ব্যবহার করে নামতে চেষ্টা কর। তবে যেভাবেই হোক নেমে পড়।

ওরা দুজন প্রায় ধাক্কা দিয়ে দ্রুত আমাকে পাশ কাটাল। একজনের পর একজন ব্যালকনির রেলিং টপকালো, তারপর ঝুলন্ত পর্দাটি ধরে নিচে নামলো। নিচে মঞ্চে নামার সময় আঘাত এড়াতে ওরা পর্দা ধরে সরসর করে পিছলে নামলো। তবে দেখলাম তেহুতিকে বাঁচাতে ওরা অনেক দেরি করে ফেলেছে।

চকচকে সাদা বঁড়টি এখন তেহুতির দিকে এর সমস্ত মনোযোগ কেন্দ্রিভূত করেছে। এবার প্রচণ্ড গর্জন করে সোজা তার দিকে তেড়ে গেল।

বেকাথা চিৎকার করে উঠলো। এই শব্দে নিশ্চিত দানবটির মেজাজ বিগড়ে গিয়ে চোখ আরও লাল হল। জারাস আর হুই তখন মাত্র মেঝেতে পা রেখেছে। আক্রমণের মাঝখানে হস্তক্ষেপ করার আগে মঞ্চের অর্ধেক জায়গা পার হতে হবে।

আমি ধনুকের ছিলায় টান দিয়ে একটা তীর ছুঁড়লাম। তীরটা ঠিক বঁড়টির বিশাল কাঁধে আঘাত করলো যেখানে আমি লক্ষস্থির করেছিলাম। তবে কাঁধের হাড়ে লেগে তীরটা ছিটকে সরে গিয়ে দর্শকসারিতে বসা একজন মিনোয়ান অভিজাতের বুকে আঘাত করলো। লোকটি অদৃশ্য হয়ে গেল।

তীরের আঘাত বঁড়টির গায়ে আঁচড়ও কাটতে পারেনি। আর তীর ছুঁড়ার সাহস হল না, কেননা বেকাথা তখন তার বোনের কাছ থেকে আলাদা হয়ে গেছে। আতঙ্কে দিগ্বিদিক জ্ঞান শূন্য হয়ে সে সোজা ষাঁড়ের হামলার পথেই ছুটতে শুরু করেছে।

ষাঁড়টি তার দিকে ঘুরে দানবীয় মাথাটা নিচু করলো। লম্বা চকচকে একটা শিং দিয়ে বেকাথাকে গুতো মারতেই এটি তার বাহুর উপরে বিঁধলো। শিংয়ের তোয় বেকাথা ষাঁড়টির পিঠের উপর দিয়ে শূন্যে উড়ে গিয়ে মেঝেতে পড়লো। আমি দেখলাম তার বাহুর হাড় ভেঙে গিয়ে রক্ত ঝরছে। মনে হল মাটিতে নরম বালুর উপর পড়ায় সে বেশি আঘাত পায় নি। ষাঁড়টি আবার ঘুরে তাকে অনুসরণ করলো।

তেহুতি আমাদের সবার চেয়ে দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেখাল। সে একছুটে ষাঁড়টির আক্রমণের পথে গিয়ে জোরে চিৎকার করে দুই হাত তুলে ষাঁড়টির দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করলো।

ষাঁড়টির দপদপ করে উঠা নাসারন্ধ্রের ছিদ্র থেকে বের হওয়া নিঃশ্বাসের গরম আর দুর্গন্ধময় বাষ্প গুহার স্যাঁতসেঁতে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছিল। তেতি এই বাস্পের নিচ দিয়ে ছুটতে ছুটতে মাথার গোলাপের মুকুটটি খুলে নিয়ে জন্তুটির মুখে ছুঁড়ে মেরে জম্ভটিকে পাশ কাটাল।

হতচকিত হয়ে বিশাল ষাঁড়টি একটু থামলো, এই ফাঁকে তেহুতি আবার এক চরকি মেরে ঘুরতেই জারাসকে দেখতে পেল। সে তখন মাত্র পর্দা বেয়ে রঙ্গমঞ্চের মেঝের কাছাকাছি নেমেছে।

সে চিৎকার করে উঠলো, জারাস! বঁড়টি এক মুহূর্ত ইতস্তত করলো, তারপর বেকাথাকে ছেড়ে ঘুরে তেহুতির দিকে তাড়া করতে ছুটলো। তেহুতি একটি হরিণীর মতো দ্রুতগামি হলেও ষাঁড়টি তার চেয়েও দ্রুতগামি ছিল। এটি প্রায় তার উপর এসে পড়তেই সে চোখের পলকে এক লাফ দিয়ে দিক বদল করলো। এতে বঁড়টি ঘুরে আবার তার পিছু নেওয়ার আগে সে একগজের মতো জায়গা পেল।

আমি দেখলাম এবার সে আমি যেখানে ব্যালকনির রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম ঠিক তার নিচ দিয়ে যাবে। আমি কোমরবন্ধে গোঁজা তলোয়ারটি বের করে উঁচু করে ধরে নিচে মঞ্চের দিকে ছুঁড়ে মারলাম। তলোয়ারটি সরাসরি নিচের দিকে পড়তেই এর ডগাটি বালুতে গেঁথে গেল। হাতলটি তেহুতির সামনে খাড়া হয়ে দাঁড়ালো।

চিৎকার করে তেহুতিকে বললাম, তলোয়ারটি তুলে নাও!

আরেকবার তেহুতি একজন ক্রীড়াবিদের দ্রুতো আর শক্তি নিয়ে প্রতিক্রিয়া দেখাল। ছুটন্ত অবস্থায় পাশ কাটাবার সময় সে তলোয়ারটি ঝট করে মাটি থেকে ডান হাতে তুলে নিল।

ষাঁড়টি আবার প্রায় তার উপর এসে পড়েছে। এটি মাথা ঘুরাতেই বামদিকের শিং বাতাসে হিশশ শব্দ করে তেহুতির কাঁধ ঘেসে গেল। তেহুতি মাথা নিচু করে ডিগবাজি খেয়ে মাটিতে শুয়ে পড়লো। বঁড়টি আবার তাকে পাশ কাটিয়ে গেল। তারপর ভারসাম্য ফিরে পাওয়ার জন্য বঁড়টি ঝটকা মেরে মাথা উচুঁ করতেই তেহুতি এক হাত দিয়ে বঁড়টির কাছের শিংটি ধরে ফেললো।

তেহুতি এক হাত দিয়ে ধরে থাকা অবস্থায় বঁড়টি শিং উপরের দিকে তুলতেই সে বাধা দিল না। বরং সে ষাঁড়টির সাথে একই দিকে লাফ মারলো। ষাঁড়ের কুজওয়ালা পিঠের উপর দিয়ে শূন্যে ভেসে সে অন্যপাশে মাটিতে নামলো। মাটিতে নামার সময় সে তলোয়ারের ডগাটি ষাঁড়টির কাঁধের হাড়ের মাঝামাঝি জায়গায় নিশানা করলো।

নরম এই স্থানটিতে কোনো হাড় নেই। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে তেহুতি তলোয়ারটি পুরোপুরি ষাঁড়ের দুই কাঁধের মাঝখান দিয়ে হৃৎপিণ্ডের দিকে ঠেলে ঢুকিয়ে দিল। তারপর তলোয়ারটি ভেতরে সেঁধানো অবস্থায় হাতলটি ছেড়ে দিল।

তারপর সে পিঠ বাঁকা করে আহত বঁড়টির পেছনে হালকা পায়ে এক লাফে নেমে দুই হাত উঁচু করে পেছন দিকে সরে গেল। সেখানে দাঁড়িয়ে দানবীয় জন্তুটির টলে পড়া লক্ষ্য করতে লাগলো। বঁড়টি সামনের দুই পা দুইদিকে ছড়িয়ে মাথা নিচু করে নাক মাটিতে ঠেকাল। মুখ হা করে প্রচণ্ড গর্জন করলো। এর গলা দিয়ে উজ্জ্বল রক্ত ফিনকি দিয়ে বের হল।

তারপর টলতে টলতে পেছন দিকে হেলতেই পেছনের পাদুটো ভেঙে যেতেই পশুটি প্রচণ্ড শব্দে মঞ্চের মেঝেতে পড়ে গেল। শব্দটি শুনে মনে হল যেন কুঠার দিয়ে একটি সিডার গাছ কেটে মাটিতে ফেলা হয়েছে। একপাশে গড়িয়ে পড়ে এটি কিছুক্ষণ পর পর পেছনের পা দুটো ছুঁড়তে লাগলো। তারপর নিশ্চল হয়ে গেল।

পুরো গুহায় নীরবতা নেমে এলো। আমি বুক ভরে শ্বাস নিলাম।

এরপর উপসাগরের ওপারে আগ্নেয়গিরিতে বিশাল দেবতা ক্রোনাস প্রচণ্ড রোষে ফেটে পড়লেন। দেবতা তার বলি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। তার আত্মস্বরূপ প্রাণীটিকে তার নিজ মন্দিরের ভেতরেই হত্যা করা হয়েছে।

আমি মন্দিরের রঙ্গমঞ্চ থেকে মুখ তুলে বাইরে কুমুসস উপসাগরে একটি আশ্চর্য দৃশ্য দেখতে পেলাম।

চরমতম ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে ক্রোনাস তার নিজের দুর্গ ধ্বংস করেছেন। মনে হল এটি বেশ ধীরে ধীরে ঘটছে। সম্পূর্ণ পর্বতটি বড় বড় কয়েক হাজার টুকরায় বিস্ফোরিত হল। এক একটি খণ্ড ক্রিট কিংবা তার চেয়েও বড়। সমুদ্রপৃষ্ঠের কয়েক হাজার ফুট নিচে আগ্নেয়গিরির কেন্দ্রস্থল থেকে প্রচণ্ড শক্তির বলে এগুলো অনেক উঁচুতে সজোরে নিক্ষিপ্ত হল। পাথরগুলো কেন্দ্রস্থলের গভীর চুল্লিতে উত্তপ্ত হয়ে একসময় গলে যায় এবং এমন উজ্জ্বল সাদা আলো নিয়ে জ্বলতে থাকে, যা সূর্যকে ম্লান করে দিয়ে পুরো পৃথিবীকে আলোকিত করে। তারপর পাথরগুলো সাগরে পড়তেই সাগরের পানি টগবগ করে ফুটতে থাকে।

ফুটন্ত পানি থেকে বাষ্প বিস্ফোরিত হয়ে পাক খেয়ে খেয়ে সাদা মেঘ হয়ে সবকিছু নিশ্চিহ্ন করে আকাশের দিকে উঠে যায়। এখন কিছুই আর নেই; সাগর, পৃথিবী আর আকাশ। শুধু ঘন বাস্পের দেয়াল রয়েছে।

মনে হল সমস্ত কিছু নিঃশব্দে ঘটেছে আর সারা পৃথিবী আর এর মাঝের সমস্ত জীবন্ত প্রাণী শ্বাস বন্ধ করে রেখেছে।

তারপর এই প্রলয় কাণ্ডের আওয়াজ শোনা গেল। উপসাগরের পানির উপর দিয়ে শব্দটি আসতে যা সময়টুকু লেগেছিল। অনেকটা পাথর পতনের মতো শব্দটি একটি কঠিন বস্তুর মতো ক্রিট দ্বীপের উপর আছড়ে পড়লো।

যদিও আমরা গুহার দেয়াল দিয়ে আংশিক ঢাকা ছিলাম, তারপরও প্রচণ্ড শব্দের ধাক্কায় আমরা মাটিতে পড়ে গেলাম। শব্দের চোটে কানে তালা লেগে যেতেই আমরা মাটিতে শুয়ে কানে হাত চাপা দিয়ে ফোঁপাতে লাগলাম।

প্রচণ্ড শব্দ আর কম্পনের কারণে গুহার ছাদ থেকে বড় বড় পাথরের চাঙর খসে পড়লো। পাথর চাপা পড়ে আমার চারদিকে মানুষ আর্তচিৎকার করে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ছিল। ঝড়ের কবলে পড়া জাহাজের ডেকের মত গুহার মেঝে দুলতে শুরু করলো।

সবার আগে আমি নিজেকে সামলে নিলাম। তবে জ্বলন্ত পর্বতের আলোয় আমার চোখে ধাঁধা লেগে গিয়েছিল আর মেঘের গুড়গুড় গর্জনের মতো শব্দে কানে কিছুই শুনতে পাচ্ছিলাম না। কোনোমতে হাঁটু গেড়ে বসে গুহার চতুর্দিকে তাকালাম। তবে আমিই একমাত্র লোক নড়াচড়া করছিলাম না।

জারাস ষাঁড়ের মৃতদেহের কাছে পড়ে থাকা তেহুতির দিকে হামাগুড়ি দিয়ে এগোল। সে তেহুতিকে তার কোলে তুলে নিল। আমি দেখলাম তেহুতিও বিমুঢ় আর হতভম্ব হয়ে রয়েছে।

হুই বেকাথার পাশে হাঁটু গেড়ে বসে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। মনে হল সে তাকে ছুঁতে ভয় পাচ্ছিল। সে এমন একজন যোদ্ধা যে বহু যুদ্ধক্ষেত্রে ডিঙিয়ে এসেছে, অথচ তার ভালোবাসার নারীর রক্ত দেখে আতঙ্কিত হয়ে রয়েছে। একটি শিশু যেমন তার প্রিয় পিতামাতার কাছে সান্ত্বনা খুঁজে, সেরকমভাবে বেকাথাও ভাঙা হাতটি অন্য হাতে ধরে হুইয়ের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।

এবার ওদের দিক থেকে ফিরে আমি সর্বাধিরাজ মিনোজের দিকে তাকালাম। তিনি গুহার খোলা মুখের কাছে দাঁড়িয়ে বাস্পের মেঘের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন, যা সেই জায়গাটিকে নিশ্চিহ্ন করেছে যেখানে একসময় ক্রোনাস পর্বত অবস্থিত ছিল।

মিনোজ দুই হাতে তার মায়ের রোগা পলকা দেহটিকে ধরে দুই হাত মাথার উপরে উঁচু করে ধরে রেখেছে। তার মাথা চুর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেছে আর চোখগুলো কোটর থেকে বের হয়ে রয়েছে। গুহার ছাদ থেকে খসে পড়া পাথরের আঘাতে তিনি মারা গেছেন।

মিনোজ গর্জন করে উঠলো, কেন তুমি এটা আমার সাথে করলে? হে মহাপরাক্রমশালী ক্রোনাস, আমিতো তোমার সন্তান। আমার মা তোমার প্রেয়সী এবং স্ত্রী ছিলেন। তুমি কি আমার দেওয়া অর্ঘ্য গ্রহণ করে তাকে বাঁচাতে পারতে না?

আমি বুঝলাম সে এই পৃথিবীতে আরও অনিষ্টকর কাজ করার আগেই তাকে আমার মেরে ফেলতে হবে। এরপর সে আমাদের সকলকে-আমার রাজকুমারী, আমার বন্ধু আর আমার সহকর্মীসহ আমাকেও ধ্বংস করবে।

ধনুক তুলে একটা তীর ছুঁড়ে মারলাম। এটা তার পেছনের সোনারবর্মের ঠিক মাঝখানে আঘাত করলো। তার দেহ স্থির হয়ে গেল আর তীরের আঘাতে তার পিঠে যে গর্ত হয়েছিল সেখান থেকে কালো রক্ত ঝরতে লাগলো। রক্তের দুর্গন্ধে সমস্ত মন্দির ভরে গেল, যেন দশদিন রোদে ফেলে রাখার পর পচন ধরা লাশের দুর্গন্ধ।

তীরের আঘাতে মিনোজের দেহ গুহার দেয়ালের খোলা জায়গা দিয়ে নিচে পড়ে গেল। সে নিচে পড়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। তার মায়ের মৃতদেহটিও, কালো কাপড়ের পুতুলের মতো সে যেখানে পড়েছিল তার পাশে পড়লো।

আমি এক লাফে ব্যালকনির দেয়াল টপকে পর্দা বেয়ে মঞ্চের মেঝেতে নামলাম। তারপর যেখানে বেকাথা শুয়েছিল সেখানে ছুটে গেলাম। তলোয়ারের খাপসহ কোমরবন্ধ খুলে তার পাশে হাঁটু গেড়ে বসে হুইকে বললাম, তাকে শক্ত করে ধর। তার খুব যন্ত্রণা হবে।

তার বাহুর ভাঙা হাড়টি সোজা করতেই সে ফুঁপিয়ে উঠলো। হাড়টা সোজা রাখার জন্য তলোয়ারের খাপের সাথে হাতটা বেঁধে দিলাম। তারপর মদের বোতলটি আমার কোমরের থলে থেকে নিয়ে হুইয়ের হাতে দিয়ে বললাম, সে যতটুকু খেতে পারে ততটুকু তাকে খাওয়াও। এতে ভালো কাজ হবে।

যন্ত্রণার মধ্যেও মৃদু হেসে বেকাথা ফিসফিস করে বললো, হুই আমার মনের মানুষ। এখন সে যেখানে যাবে আমিও সেখানে যাবো। তার ঘরই আমার ঘর। আর যে মদ আমি পান করছি তা তার সাথে ভাগাভাগি করে নেব। আমি তার জন্য গর্ববোধ করলাম।

মন্দিরের চতুর্দিকে তাকিয়ে দেখলাম হেরেম থেকে আসা রাজকীয় নারী দেহরক্ষীর দলটি পালিয়েছে। আমি ভেবেছিলাম ওদের সাথে মিলোয়ন অভিজাতরাও পালিয়েছে। তবে তোরানকে দেখলাম লক্সিয়াসের কাঁধে হাত রেখে জারাস আর তেতির পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, বন্ধু, তুমি কি আমাদের সাথে আসবে?

তোরান একটু ভেবে উত্তর দিল, মিনোয়ান সাম্রাজ্য আজ এখানে ধ্বংস হয়েছে। আর কোনোদিন উঠে দাঁড়াতে পারবে না। পাঁচশো বছর আগে এই ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল। তার চেহারা মলিন হল। তারপর এক মুহূর্ত পর বললো, আমি আমার স্বদেশ হারিয়েছি। তবে মিসর হাইকসোদের বিরুদ্ধে তাদের সবচেয়ে মিত্র হারিয়েছে। তারপর একটি দীর্ঘশ্বাস বললো, তবে যাইহোক লক্সিয়াস আর আমি আপনার সাথে থিবসে গিয়ে সেটাকেই আমাদের নতুন দেশ বানাবো।

আমি ঘুরে জারাস আর তেহুতির দিকে তাকিয়ে বললাম, জারাস, তেহুতি, আমি তোমাদের দুজনকে জিজ্ঞেস করতে ভয় পাচ্ছি। তবে অবাক হলাম না যখন তেহুতি দুজনের হয়ে উত্তর দিল।

সে কেবল বললো, তায়তা, আমি তোমাকে আর মিসরকে ভালোবাসি, তবে তার চেয়েও বেশি ভালোবাসি জারাসকে। যদি তোমার সাথে থিবসে ফিরে যাই, তবে আমার ভাই আবার আমাকে অন্য কোনো বর্বর দেশের পাগল রাজার সাথে বিয়ে দেবার চেষ্টা করবেন। আমি যথাসাধ্য ফারাও আর আমার দেশের জন্য সেবা করার চেষ্টা করেছি। তবে এখন আমি মুক্ত হয়ে আমার ভালোবাসার মানুষের সাথে বাকি জীবন কাটাতে চাই। তারপর জারাসের এক হাত ধরে আবার বললো, আমরা হুই আর বেকাথার সাথে চলে যাবো। তারপর আইয়োনিয়ান সাগরের ওপারে উত্তরের দেশে নতুন ঘর বাঁধবো।

আমি বললাম, আমিও তোমাদের সাথে গেলে খুশি হতাম। তবে আমার দায়িত্ব রয়েছে থিবসে ফারাওয়ের সাথে। আমি তাকে জানাবো তুমি আর বেকাথা মরে গেছ, তাহলে তিনি আর কখনও তোমাদের খোঁজে কাউকে পাঠাবেন না।

সে বললো, ধন্যবাদ তায়তা। তারপর একটু ইতস্তত করে আবার বললো, হয়তো একদিন দেবতা প্রসন্ন হলে তুমি আবার আমাদেরকে খুঁজতে আসবে।

আমি একমত হয়ে বললাম, হয়তো আসবো।

সে কথা দিল, আমি আমার প্রথম ছেলে হলে তোমার নামে তার নামকরণ করবো। আমি ঘুরে চোখের পানি লুকালাম। তারপর শূন্য পাথরের বসার ধাপের উপর চড়ে গুহার দেয়ালের খোলা জায়গাটির কাছে এলাম। এখান দিয়েই আমার তীর মিনোজের দেহে আঘাত করেছিল।

খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে তিনশো ফুট নিচে তাকিয়ে দেখলাম পাথরের উপর রক্তের মাঝে মিনোজের দেহটি হাত পা ছড়িয়ে পড়ে রয়েছে। তার বুকের রূপার বর্মের উপর দিয়ে আমার তীরের ডগা বের হয়ে রয়েছে। মাথায় তখনও সেই শিরস্ত্রাণটি পরা রয়েছে। শিরস্ত্রাণের চোখের অন্ধকার গর্তের ভেতর দিয়ে কিছুই দেখতে পেলাম না।

মৃদু কণ্ঠে প্রশ্নটি করলাম, তুমি কী? তুমি কী একজন মানুষ, দানব, শয়তান না দেবতা ছিলে? তারপর মাথা নেড়ে আবার বললাম, প্রার্থনা করছি এই প্রশ্নের উত্তর যেন কোনোদিন জানতে না পারি।

মিনোজের মা, পাসিফের মৃতদেহ আমার পায়ের কাছে পড়েছিল। আমি দেহটি তুলে নিচে ফেলে দিলাম। তারপর আবার নিচের দিকে তাকিয়ে দেখলাম দুটি দেহ একটি আরেকটির উপর বিশ্রিভাবে পড়ে রয়েছে।

তারপর ঘুরে আবার রঙ্গমঞ্চের দিকে গেলাম, যেখানে আমার মেয়েরা আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। সবাই মন্দির থেকে বের হয়ে গোলক ধাঁধার মধ্য দিয়ে হেঁটে জঙ্গলের মাথায় আমাদের ঘোড়াগুলোর কাছে পৌঁছলাম। তারপর ঘোড়ায় চড়ে শেষবারের মতো একটি পরিবারের মতো একসাথে চললাম। ইডা পর্বতের ঢালে পৌঁছে ঘোড়ার লাগাম টেনে থামিয়ে কুনুসস উপসাগরের দিকে ফিরে তাকালাম।

ক্রোনাস পর্বত আর নেই। সমুদ্রের অতল গভীরে তলিয়ে গেছে। কেবল টগবগ করে ফুটতে থাকা সাগরের ঘোলা পানি এর সমাধির চিহ্ন হয়ে রয়েছে।

তারপর সামনে তাকিয়ে দেখলাম, যেখানে একদা ক্রিমাদ বন্দরটি ছিল, সেখানে আমাদের ছয়টি জাহাজের নৌবহর অক্ষত দাঁড়িয়ে রয়েছে। সমুদ্রের জলোচ্ছাসের হাত থেকে রক্ষা পেয়ে জাহাজগুলো তীর থেকে দূরে নিরাপদ স্থানে সমুদ্রে নোঙর করা ছিল। ওরা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল।

আমার চতুর্দিকে সবাই খুশিতে আর উত্তেজনায় চিৎকার করে উঠলো। তারপর ঘোড়া ছুটিয়ে জঙ্গলের পথ ধরে নিচের দিকে নামতে শুরু করলো। ওরা জোড়ায় জোড়ায় ঘোড়া ছুটাচ্ছিল, লর্ড তোরান লক্সিয়াসের সাথে, হুই বেকাথাকে বুকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে তার জখমি হাতটি বাঁচিয়ে। আর এদের পেছনে জারাস আর তেহুতি পাশাপাশি ঘোড়া ছুটাচ্ছিল।

আমি একটু পিছিয়ে ওদেরকে যেতে দিলাম। তারপর ফিসফিস করে উচ্চারণ করলাম, এখান থেকেই ওদের আলাদা আলাদা পথ শুরু হয়ে সুখের পাহাড়ে গিয়ে শেষ হোক। কথাগুলো বললেও তাদের প্রতি আমার আনন্দ একটু দমে এলো যখন আমার নিজের বেদনা আর একাকীত্বের কথা মনে পড়লো। তারপর একটি কন্ঠস্বর শুনতে পেলাম, হয়তো তা কেবল গাছের উপরের সন্ধ্যার হাওয়ার শব্দও হতে পারে।

তুমি কখনও একা হবে না তায়তা। কেননা একটি মহৎ হৃদয় সবসময় চুম্বকের মতো অন্যের ভালোবাসা নিজের দিকে আকৃষ্ট করে।

আমি হতবাক হয়ে পাগলের মতো চারপাশে তাকালাম, মনে হল যেন আমি দেখছি জঙ্গলের দিক থেকে আপাদমস্তক আলখাল্লায় ঢেকে সে আমার। দিকে আসছে। তবে দিনের আলো ম্লান হয়ে আসতেই আমার মনে হল হয়তো আমি ভুল দেখেছি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *