৭. সাগরের এই পথ

সাগরের এই পথ হাইপ্যাটসের খুব চেনা। সে বিভিন্ন ডুবো চর আর অন্তরীপ এড়িয়ে বেশ সহজে জাহাজ নিয়ে এগোল।

স্থলভূমির পাশ দিয়ে যেতে যেতে আমি অবাকবিস্ময়ে তাকালাম। সারা জীবন মরুভূমিতে কাটিয়েছি, তাই এতো পর্বতময় স্থান আর সবুজ বনানী দেখে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম।

দুপুরের একটু পর দ্বীপের পূর্বদিকের প্রান্তসীমা ঘুরে উত্তর উপকূল ধরে কুনুসসের দিকে চললাম। সূর্যের আলোর কোণ বদলে যেতেই সাগরের পানির রং অপূর্ব নীল হল।

সামনের সাগরে নোঙর করা ছোট ছোট মাছধরা নৌকা থেকে শুরু করে বিভিন্ন রঙের পালসহ বিশাল তিনস্তরের দাঁড়ওয়ালা বাণিজ্যপোত ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।

উপসাগরের প্রবেশ পথ আর বন্দর পার হতেই আমরা দেখলাম এখানেও প্রচুর নোঙর করা জাহাজ ভীড় করে মাল উঠানামা করছে। বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী আনা-নেওয়া করে এই বাণিজ্যপোতগুলো যে সম্পদ আহরণ করছে, তা এই ক্ষুদ্র দ্বীপ রাষ্ট্রটিকে সভ্য জগতের সামনে এক বিশাল আকারে পরিণত করেছে।

আমি জানি এই স্থানটি পর্বতময় আর এবড়োথেবড়ো। মাটি ভালো নয়, মূল্যবান কোনো খনিজ নেই আর চাষেরও আযোগ্য। বিশাল বনএলাকা থাকলেও, গাছের শিকড় মূল্যবান ফসল চাষের বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এই সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে মিনোয়ানরা তাদের জাহাজ পাঠিয়ে অন্যান্য দেশ থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ করে ক্রিটে নিয়ে এসেছে। তারপর তাদের প্রযুক্তি আর নব উদ্ভাবনী কৌশল কাজে লাগিয়ে এইসব কাঁচামাল দিয়ে উচ্চ চাহিদাসম্পন্ন পণ্য উৎপাদন করেছে, যার জন্য বাকি বিশ্ব বুভুক্ষ হয়ে রয়েছে।

অন্যান্য আদিম জাতিরা ধারালো গাছের ডাল দিয়ে মাটি খুঁড়ে যেসব আকরিক ধাতু বের করে, ওরা তা শোধন করে এবং এই ধাতু দিয়ে যোদ্ধাদের জন্য তলোয়ার, ছুরি, শিরস্ত্রাণ, বর্ম আর কৃষকদের জন্য নিড়ানি, খড় তোলার জন্য লম্বা হাতলওয়ালা কাটা লাগানো দণ্ড এবং লাঙলের ফলা তৈরি করে।

ওরা পাথর-বালি আর অন্যান্য খনিজ পদার্থ নিখুঁতভাবে পুড়িয়ে কাঁচ উৎপাদন করে। এটি একটি অসাধারণ পদার্থ যা দিয়ে থালা, বাসন এবং বিভিন্ন তৈজসপত্র তৈরি করে রাজামহারাজাদের খাবার টেবিলে ব্যবহৃত হয়। আর ধনী ব্যক্তিদের স্ত্রীদের মনোরঞ্জনের জন্য বিভিন্ন রঙের গহনা ও অলঙ্কার; আর কিছু কিছু গোষ্ঠির মুদ্রা হিসেবে ব্যবহারের জন্য পুঁতি তৈরি করা হয়। কোনো কোনো আদিম দেশে এইধরনের একটি কাঁচের পুঁতির মালা দিয়ে একটি তেজস্বী ঘোড়া কিংবা একজন সুন্দরী কুমারিকে কেনা যায়।

মিনোয়ানরা এসব পণ্যের বিনিময়ে অন্যান্য দেশের সাধারণ কৃষকদের দ্বারা উৎপাদিত ভাং, তুলা,পাটের কাপড় এবং পশমি সুতা কিনে নেয়। এই সুতা বুনে তৈরি করা কাপড় এবং ক্যানভাস দিয়ে পোশাক, তাবু এবং জাহাজের পাল তৈরি করা হয়।

আবার এগুলো দিয়েও বাণিজ্য করা হয়; এভাবে চক্রাকারে বার বার এটি নিরন্তর চলতে থাকে যতদিন না আর কোনো জাতি তাদের সম্পদের সমকক্ষ হয়। এমনকি আমাদের মিসরও নয়।

অন্তহীন সম্পদ আহরণের অন্বেষণের কারণে একটি গোপন মূল্যও দিতে হয়েছে।

পবিত্র ষাঁড় নামে জাহাজটির উঁচু স্থানটি থেকে আমি স্থলভূমির দিকে। তাকিয়ে দেখতে পেলাম অসংখ্য কামারশালা আর চুল্লি থেকে ধূঁয়া বের হচ্ছে। এসব জায়গায় আকরিক পরিশুদ্ধ করা হচ্ছে, ধাতুতে খাদ মেশানো হচ্ছে আর বালু থেকে কাঁচ উৎপাদন করা হচ্ছে।

নগরী এবং কারখানা এলাকার উপরিভাগে পাহাড়ি অঞ্চলের অনেকখানি জায়গাজুড়ে ক্ষতবিক্ষত জমি পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে রয়েছে। এখানে কুঠার দিয়ে জঙ্গলের গাছ কেটে মিনোয়ান জাহাজের জন্য কাঠের কড়ি-বরগা কিংবা কারখানার চুল্লিতে পোড়ানোর জন্য কাঠকয়লা তৈরি করা হত।

আমি দেখলাম তটসংলগ্ন সাগরের পানির রং বিবর্ণ আর কলুষিত হয়ে আছে। কারখানাগুলোতে বিষাক্ত রঙ আর ক্ষয়কারী তরল ব্যবহার করার পর তরল বর্জ্য সরাসরি সাগরে নিষ্কাশন করার ফলে এটি হয়েছে।

অন্য জীবিত যে কোনো মানুষের মতো আমিও আমার হাতে সোনা রূপার ওজন এবং এর ঔজ্জল্য পছন্দ করি। তবে আদি-অকৃত্রিম প্রকৃতির এই অবক্ষয়ের মুখোমুখি হয়ে আমি অবাক হয়ে ভাবি যে, মানুষকে তার সীমাহীন লোভের পরিণামে চরম মূল্য দেবার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।

নিচে থেকে হঠাৎ কারও চিৎকার শুনে আমার চিন্তার সূত্র ভেঙে গেল। নিচে তাকিয়ে দেখলাম নিচের ডেক থেকে রাষ্ট্রদূত তোরান আমাকে নিচে যাওয়ার জন্য ডাকছেন। আমি তার কাছে পৌঁছতেই সে দুঃখ প্রকাশ করে বললো, কিছু মনে করবেন না, আমি বেশিক্ষণ উঁচুতে থাকতে পারি না। আর মাস্তুলের উপরে উঠলে জাহাজের ঘূর্ণন খুব বেশি মনে হয়। আসুন পাঁচক আমাদের জন্য যে চমৎকার প্রাতরাশ তৈরি করে রেখেছে তার গ্ল্যবহার করি। তারপর সে আমার হাত ধরে সামনের দিকে নিয়ে চলতে চলতে আবার বললো, চলুন জাহাজের সামনে থেকেও সবকিছু ভালোভাবে দেখা যাবে। আর ড্রাগোনাদা দ্বীপ পার হতে হতে আমি আপনাকে কয়েকটি সুন্দর দৃশ্য দেখাবো। এর সাথে কুনুসস আর ক্রোনাস পর্বতও পুরোপুরি দেখা যাবে। সামনের পালের ছায়ার নিচে আমরা আরাম করে বসলাম। জাহাজটি দ্বীপের মাথা দিয়ে ঘুরতেই ক্রিটের উত্তর উপকূলের নতুন একটি দৃশ্য আমাদের সামনে ছড়িয়ে পড়লো।

একদিকে ইডা পর্বতের চমৎকার দৃশ্য চোখে পড়লো, এর আগে দ্বীপের দক্ষিণ দিক থেকে যখন দেখেছিলাম এখন তার সম্পূর্ণ বিপরীত দেখছি। এখান থেকে পবর্তটি আরও উঁচু, খাড়া আর খুব বেশি রুক্ষ মনে হচ্ছে। এর নিচেই কুমুসস নগরী আর বন্দর আমাদের সামনে ছড়িয়ে রয়েছে।

বন্দরটি বিশাল আর এখানে বেশ কয়েকটি মিনোয়ান রণতরী আর বাণিজ্যপোত নোঙর করা রয়েছে। কিছু কিছু জাহাজ এতো বিশাল যে, এগুলোর তুলনায় আমাদের পবিত্র ষড় জাহাজটিকেও মনে হচ্ছে বেশ ছোট।

বন্দরের উপরেই নগরীর দালানকোঠা দেখা যাচ্ছে। দেখার সাথে সাথেই আমি বুঝলাম যে, এই নগরীটি থিবস আর ব্যবিলন মিলে যা হবে তার চেয়েও কয়েকগুণ বড়। তবে কুনুসসের তুলনায় ঐ ছোট ছোট শহরগুলো বেশ সুন্দর, উচ্ছল এবং প্রীতিকর ছিল।

উঁচু পর্বতমালা আর এর বিশাল পরিসরের স্থাপত্যশিল্পের প্রেক্ষাপট সত্ত্বেও কুমুসস একটি বিষণ্ণ অন্ধকারময় স্থান। আমার অত্যন্ত সুক্ষ অনুভূতি দিয়ে আমি সাথে সাথে বুঝতে পারলাম যে, কুমুসস এমন একটি বিরল ক্ষমতার ক্ষেত্রের উপর গড়ে তোলা হয়েছে যার উপর দেবতারা তাদের সমস্ত শৌর্যবীর্য কেন্দ্রিভূত করেছিলেন।

আলোকপ্রাপ্ত এই যুগে একজন শিক্ষিত মানুষ মেনে নিয়েছেন যে, পৃথিবী একটি জীবন্ত এবং নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়া প্রাণী। একটি বিশালকায় কচ্ছপের মত এটি অনন্তকালের কালো সমুদ্রে চিরদিন সাঁতার কেটে চলেছে। শক্ত খোলসের যে ফলকগুলো দিয়ে কচ্ছপটির পিঠ ঢাকা রয়েছে, সেগুলো এই ক্ষমতার রেখার সাথে সমান্তরালভাবে সংযুক্ত রয়েছে। যখনই পৃথিবী নড়াচড়া করে তখন এই জোড়গুলোর কারণে এর দেহ আর অঙ্গপ্রতঙ্গগুলো বেঁকে যায়। এগুলো অকল্পনীয় শক্তির কেন্দ্র, কিছু কিছু শক্তি শুভ আর অন্যগুলো অশুভ।

এখানে অশুভ শক্তি রয়েছে; আমি আমার জীহ্বার পেছনে এর অতিমাত্রায় দোষযুক্ত স্বাদ আর নাকে পূতিগন্ধটি অনুভব করলাম।

এর বিশালতা বুঝার চেষ্টা করতেই আমার সারা দেহ কেঁপে উঠলো।

তোরান উৎকণ্ঠিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার কি শীত করছে?

মাথা নেড়ে মৃদু হাসলেও আমার চেহারায় মনে হল তা প্রকাশ পায় নি। আমি ঘুরে সরাসরি সাগরের দিকে তাকালাম। তবে চোখের সামনেই ক্রোনাস পর্বতের জোড়া চূড়া চোখে পড়তেই মন আরও অশান্ত হয়ে উঠলো। আমার উত্তেজিত চেহারা চোখে পড়তেই মুখে চুচুক শব্দ করে তোরান আমার পিঠ চাপড়ে বললো, মন খারাপ করবেন না তায়তা! বেশিরভাগই লোকেরই প্রথমবার সকল দেবতার পিতা ক্রোনাস নগরদুর্গ দেখার সাথে সাথেই একই ধরনের প্রতিক্রিয়া হয়। আপনি এই জায়গার ইতিহাস আর কীভাবে এই রহস্যগুলো ঘটে চলেছে তার কাহিনী জানেন?

আমি বললাম, তেমন কিছু জানি না। আসলে আমি এ-বিষয়ে তোরানের চেয়েও বেশি জানতাম, তবে অনেক সময় না জানার ভান করাই ভালো। এতে আরও কিছু রহস্য জানার সুযোগ থাকে, যা হয়তো আমি জানতাম না।

আমার একথার পর তোরান উৎসাহ নিয়ে বললো, একজন শিক্ষিত মানুষ হিসেবে আপনি নিশ্চয়ই একমত হবেন যে ক্রোনাস হচ্ছেন সকল দেবতার পিতা। তার আগে কেবল গয়া নামে পৃথিবী এবং ইউরেনাস নামে আকাশ ছিল। এদের মিলনের ফলেই ক্রোনাসের জন্ম হয়।

সতর্কভাবে তার কথা মেনে নিয়ে আমি বললাম, এটুকু অবশ্য আমি জানি। তারপরও আপনি বলে যান তোরান। আমি কোনো তর্কে গেলাম না, যদিও আমি জানি এর সৃষ্টির পেছনে আরও কিছু যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা আছে।

একসময় ক্রোনাস তার পিতা ইউরেনাসের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে তাকে পরাজিত করেন। তারপর খোঁজা বানিয়ে তাকে নিজের ক্রীতদাস করেন। দেবতাদের সম্পূর্ণ স্বর্ণযুগে ক্রোনাস রাজত্ব করেন। তবে তিনি সেই ভবিষ্যদ্বাণীটি সম্পর্কে সচেতন ছিলেন যে, তিনি যেরকম তার পিতার বিরুদ্ধে লড়েছিলেন সেরকম তারও কোনো এক সন্তান তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে। কাজেই তা রোধ করার জন্য জন্মাবার সাথে সাথে তিনি তার সমস্ত সন্তানকে খেয়ে ফেলতেন।

আমি সরল চেহারায় ঠাট্টাচ্ছলে বললাম, এই পরিস্থিতিতে এটা ছাড়া আর কোনো উপায় নিশ্চয়ই ছিল না। আমি এরকম অনেক মরণশীল পিতার কথা জানি যারা এই ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। তবে তোরান আমার কথাটি সত্যি মনে করে মাথা নাড়তে নাড়তে বললো, ঠিকই বলেছেন। তবে ক্রোনাসের জ্যেষ্ঠ স্ত্রী রিয়া ষষ্ঠ পুত্র সন্তানের জন্ম দিয়ে তার নাম দেন জিউস এবং তাকে তার পিতার কাছ থেকে লুকিয়ে ইডা পর্বতের একটি গুহায় রাখেন। পর্বতের পাশে উপসাগরের ওপার দেখিয়ে সে বলে চললো, এরপর ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী সে ক্রোনাসের সাথে লড়াই করে। তাকে পরাজিত করার পর তার পেট চিরে ফেলতেই তার সকল ভাই পেট থেকে বেরিয়ে মুক্তি পায়।

তোরান একটু পণ্ডিতি ভাব দেখানোতে এবার আমি তার বক্তৃতাটিকে একটু দ্রুত স্তরে নিয়ে বললাম, তারপর জিউস তার ভাই-বোনদের নিয়ে উড়ে অলিম্পাস পর্বতের চূড়ায় গিয়ে আশ্রয় নেন। এখনও ওরা সেখানে আছেন আর উদ্ধতভাবে আমাদের জীবন শাসন করে চলেছেন। জিউস এখন সকল দেবতার পিতা এবং ঝড়ের প্রভু। তার বোন হেস্টিয়া হচ্ছেন গৃহ এবং ভিটেমাটির দেবী; দেমেতার হচ্ছেন কৃষি এবং সুন্দর ফসলের দেবী; হেরা হচ্ছেন বিয়ের দেবী; হেইডস পাতালের প্রভু এবং পসেইডন হচ্ছেন সাগরের দেবতা।

তোরান একটু ক্ষুব্ধ চেহারা নিয়ে বললো, আপনি বলেছিলেন যে এদের ইতিহাস আপনি জানেন না। তারপর আমি বাকিটুকু বলার আগেই বলতে শুরু করলো, তবে তার পিতা অমর হওয়ার কারণে জিউস তাকে হত্যা করতে পারেনি। সেজন্য অলিম্পাস পর্বতে যাওয়ার আগে সে ক্রোনাসকে ঐ আগ্নেয়গিরির অগ্নিগর্ভে আটকে রেখে যায়। আর এখন এটি তার নামেই পরিচিত।

আমরা দুজনেই নিরবে পর্বতটির দিকে তাকিয়ে রইলাম।

তোরান নীরবতা ভঙ্গ করে বললো, এটি পৃথিবীর প্রাচীনতম এবং সবচেয়ে শক্তিশালী আগ্নেয়গিরি। এর সমস্ত শক্তি ক্রোনাস নিয়ন্ত্রণ করেন। আর এর দ্বারা তিনি বিদেশি রাজাদের ঈর্ষা এবং কমসভ্য জাতির বিষয়-লালসা থেকে আমাদের রক্ষা করেন। একটি উদাহরণ দেওয়া যায়, যখন ইউবোয়িআনরা আমাদের উপর আক্রমণ করার জন্য নৌবহর পাঠায়, তখন ক্রোনাস তার পর্বতের চূড়া থেকে বড় বড় জ্বলন্ত পাথরের টুকরা তাদের উপর নিক্ষেপ করে। ফলে ওদের বেশিরভাগ জাহাজ ডুবে যায় আর যারা বেঁচে ছিল তারা যেখান থেকে এসেছিল সেখানে পালিয়ে যায়।

আমি পর্বতটির দিকে তাকিয়ে রইলাম। এটি আসলেই মনে হচ্ছে একটি রুদ্র দৃশ্য। খাড়া পিরামিড আকৃতির বাঁধে কোনো উদ্ভিদ কিংবা প্রাণীর চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না। উজ্জ্বল কালো আর চকচকে লাল জমাটবাধা কঠিন ও ভঙুর লাভার স্রোতের দেয়াল সোজা সাগরে নেমে গেছে।

পর্বত চূড়াটিকে ভেদ করে পথ করে নেওয়া জোড়া ফাটল দিয়ে এখনও গলিত লাভা ধীরে ধীরে নির্গত হয়ে নিচের দিকে চুঁইয়ে পড়ছে। প্রচণ্ড উত্তপ্ত অবস্থায় ঝিকমিক করা আগুনের নদী পর্বতের গোড়ায় নেমে পানির ছোঁয়া পেতেই ধূঁয়ার মেঘে বিস্ফোরিত হচ্ছে।

তোরান ব্যাখা করে বললো, যখন ক্রোনাস খুব বেশি খুশি কিংবা অত্যন্ত উত্তেজিত হন তখন তিনি ধূঁয়া এবং আগুন নির্গত করেন। তার অগ্নিময় নিঃশ্বাসের পরিমাণ এবং শক্তি থেকে তার রাগ কিংবা আনন্দের তীব্রতা পরিমাপ করা যায়। এখন মৃদু নিঃশ্বাসের সাথে গ্যাস বাষ্প নিঃসারণ করা দেখে আপনি হয়তো বুঝতে পারছেন যে, তিনি ঘুমাচ্ছেন কিংবা হাসিখুশি মেজাজে রয়েছেন। যখন সত্যি সত্যি জেগে উঠেন তখন গলিত লাভা উপরের দিকে ছুঁড়ে মারেন আর গন্ধকযুক্ত ধূঁয়ার মেঘ আকাশের অনেক উঁচুতে উঠে মেঘের সাথে মিশে যায়। আর তার হাকডাক, গর্জন সমগ্র ক্রিট থেকে শোনা যায়। তার প্রচণ্ড কম্পন সাগর পেরিয়ে অনেক দূর দেশে অনুভূত হয়।

আমি তোরানকে জিজ্ঞেস করলাম, কী কারণে তিনি ক্রুদ্ধ হন?

সমস্ত দেবতার মধ্যে তিনি হচ্ছেন সবচেয়ে ক্ষমতাবান। ক্রুদ্ধ হতে ক্রোনাসের কোনো কারণ দরকার পড়ে না আর তার খেয়ালখুশি আর বাতিকের বিষয়ে তিনি কারও কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য নন। তিনি রেগেছেন কেননা তিনি রেগেছেন; এটা সহজ কথা।

বিশেষ একজন দেবতার ক্ষমতার উচ্চ প্রশংসা আর সীমা ছাড়িয়ে যাওয়া আচরণের স্বপক্ষে যুক্তি দেখানো কথাগুলো কথা শুনে আমি বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়তে লাগলাম। আমি সকল দেবতার ইতিহাস আর তাদের উৎপত্তি নিয়ে গবেষণা করেছি। এরকম শতশত দেবতা আছেন। মরণশীল মানুষ আর উপ-দেবতার মতো এদেরও শক্তি, প্রকৃতি আর এদের সগুণ আর অবিচারের মধ্যে বিশাল পার্থক্য আছে।

তবে আমি হতবুদ্ধি হলাম একারণে যে তোরানের মতো একজন শ্রেষ্ঠ মানুষ কী করে হোরাসের মতো একজন মহান এবং দয়াশীল দেবতার বদলে ক্রোধে উম্মক্ত এরকম একটি দানবের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে তার আনুগত্য স্বীকার করছে।

আমি ক্রোনাস কিংবা শেঠ কাউকেই বিশ্বাস করি না। এছাড়া জিউসের ব্যাপারেও আমি পুরোপুরি নিশ্চিত নই। কী করে আপনি এমন একজনকে বিশ্বাস করবেন, যিনি দেবতা হয়েও, মানবজাতি এবং নিজে পরিবারের সাথেও নোংরা ছলচাতুরি করে আনন্দলাভ করেন?

না ভাই, আমি সম্পূর্ণভাবে একজন হোরাস সমর্থক।

.

কুনুসস বন্দরে বিভিন্ন জাহাজের এতো ভীড় ছিল যে, আমরা বন্দরের দিকে এগোতেই বন্দরের পরিচালক একটি ডিঙি পাঠিয়ে আমাদেরকে জানালেন যে, এই মুহূর্তে আমাদেরকে বন্দরে ঢুকতে দেওয়া যাবে না। বন্দরের ভেতরের এলাকায় জায়গা খালি হওয়া পর্যন্ত আমরা যেন বাইরেই নোঙর করি।

রাজপ্রাসাদে আমাদের আগমনের খবর জানাতে রাষ্ট্রদূত তোরান বন্দর পরিচালকের ডিঙিতে চড়ে তীরে গেলেন।

তোরান যাওয়ার ঘন্টা খানেক পর এক মাস্তুল বিশিষ্ট একটি নৌযান আমাদের জাহাজের কাছে এলো। এর পালে ক্রিটের রাজকীয় পতাকা উড়ছিল। একদিকে ছিল সোনালি ষাঁড়ের প্রতিকৃতি আর উল্টোদিকে ছিল দুই পাতওয়ালা ঘাতকের কুঠার; এটি সর্বাধিরাজ মিনোজের ব্যবহৃত জীবন মৃত্যুর ক্ষমতা প্রকাশ করছে।

তীরে যাওয়ার আগে তোরান আমাকে সাবধান করে বলেছিল যে, আৰু ছাতক রাজপরিবারের ভাবী বধূ হিসেবে তেহুতি আর বেকাথাকে পুরুষের নজরের আড়ালে কেবিনের ভেতরেই থাকতে হবে। যখন ওরা জনসমক্ষে বের হবে তখন তাদের মুখ ভারী ঘোমটায় ঢাকা থাকবে এমনকি হাত-পাও পুরোপুরি ঢাকা থাকবে। রাজার হেরেমে ঢোকা পর্যন্ত ওদেরকে পর্দার মাঝেই থাকতে হবে।

মেয়েদেরকে মিনোয়ানদের পোশাক সম্পর্কিত এসব নিয়ম-কানুনের কথা বলতেই ওরা রেগে গেল। ওরা যখন ইচ্ছা তখন সম্পূর্ণ নগ্ন থাকতে অভ্যস্ত ছিল। অনেক কষ্ট করে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ওদেরকে মিনোয়ান আচার-আচরণ এবং সামাজিক রীতিনীতি মেনে নিতে রাজি করালাম। ওদেরকে বুঝালাম যে, এখন থেকে ওদেরকে মিনোয়ান রাজপরিবারের সদস্যদের মতো আচরণ করতে হবে।

এসব কঠিন নিয়ম-কানুনের কথা মনে রেখে আমি পবিত্র সঁড়ের পেছনের ডেকে দাঁড়িয়ে রাজপ্রাসাদ থেকে আগত প্রতিনিধিদের স্বাগত জানাবার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।

রাজপ্রাসাদের তিনজন কর্মকর্তাসহ রাষ্ট্রদূত তোরান এক মাস্তুল বিশিষ্ট একটি নৌযানে চড়ে এদিকে আসছিলেন। কাছাকাছি হতেই ঐ তিনজনের একজন কর্মকর্তা সর্বাধিরাজ মিনোজের নামে চিৎকার করে আমাদের জাহাজে উঠার অনুমতি প্রার্থনা করলো। ক্যাপ্টেন হাইপ্যাটস সাথে সাথে তাদেরকে উঠার অনুমতি দিয়ে উত্তর দিলেন।

আপাদমস্তক কালো আলখাল্লা পরা লোকগুলো ধীরে ধীরে ডেকের উপর দিয়ে হেঁটে এগিয়ে এলো। তাদের আলখাল্লার প্রান্ত ডেকের উপর দিয়ে লুটাতে লুটাতে চলছিল। ওরা মাথায় কালো ফিতা জড়ানো উঁচু কানাবিহীন টুপি পরেছিল। কুচকুচে কালো দাড়ি আংটা দিয়ে কোঁকড়ানো রয়েছে। মুখে চকের গুড়ো মেখে সাদা করা হয়েছে, তবে চোখের চারপাশে গোল করে সুর্মা লাগানো রয়েছে। আশ্চর্যরকম বৈপরীত্য। চোখমুখে বিষণ্ণ ভাব।

ওরা আমার সামনে এসে থেমে দাঁড়াতেই রাষ্ট্রদূত তোরান তাদের সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিল। তোরান একে একে তাদের লম্বা-চওড়া নাম আর উপাধি উচ্চারণ করে যেতেই আমি মাথা ঝুঁকিয়ে অভিবাদন করলাম।

জ্যেষ্ঠ দূত আমাকে অভিবাদন করে বললো, সম্মানিয় তায়তা, সর্বাধিরাজ মিনোজের আদেশক্রমে আমি আপনাকে ক্রিটে স্বাগত জানাচ্ছি। তারপর সে জানালো প্রাসাদে সবাই আমাদের জন্য সাগ্রহে প্রতিক্ষা করছেন। তবে আনন্দের অনুষ্ঠানটি উদযাপনের সঠিক সময় ও তারিখ নিয়ে এখনও একটু অনিশ্চয়তা রয়েছে। সর্বাধিরাজ মিনোজের সাথে বাগদত্তা মিসরীয় রাজপরিবারের নারীদের স্বাগত জানাবার জন্য যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে আরও চব্বিশ ঘন্টা লাগবে।

তারপর সে বললো, আগামীকাল দুপুরে একটি রাজকীয় বজরা এই জাহাজের কাছে আসবে। এটা আপনাকে এবং ভাবী রাজবধূদেরকে রাজপ্রাসাদে বহন করে নিয়ে যাবে। আপনাদেরকে রাজ পরিবারে স্বাগত জানাবার জন্য সর্বাধিরাজ মিনোজ সেখানে অপেক্ষা করে থাকবেন।

আমি ধন্যবাদ জানিয়ে বললাম, সর্বাধিরাজ মিনোজ অত্যন্ত সৌজন্যময়। আমি জানি কূটনীতির ভাষার এই আমন্ত্রণ আসলে রাজার নির্দেশ।

মহানুভব রাজা আরও জানিয়েছেন, মিসরীয় রাজপরিবারের মহিলাদের আগমনে তিনি আনন্দিত। তিনি তাদের জন্য এই উপহার সামগ্রী পাঠিয়েছেন। এই কথা বলে সে তার সাথে আসা সহকারীদের হাতের ভারী রূপার কৌটার দিকে ইঙ্গিত করলো। ওরা উপহারগুলো আমার সামনে ডেকের উপর রেখে মাথা ঝুঁকিয়ে পিছু হটলো।

সাক্ষাতকারের এখানেই পরিসমাপ্তি হল। ওরা আবার এক মাস্তুলবিশিষ্ট নৌযানটিতে ফিরে গেল। আমি জানছিলাম যে মিনোয়ানরা অত্যন্ত গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ। কোনো ধরনের সৌজন্যমূলক আনুষ্ঠানিকতায় ওরা বেশি সময় নষ্ট করে না। রাষ্ট্রদূত তোরানও ওদের সাথে চলে গেল। যাওয়ার আগে সে আমার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে মৃদু হেসে হাত নাড়লো।

আমি আশা করেছিলাম সর্বাধিরাজ মিনোজ যে উপহার পাঠিয়েছেন তা দেখে আমার রাজকুমারীদের মন একটু হালকা হবে। উপহারগুলো দেখেই বুঝা গেল এগুলো আসলেই পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী রাজার উপযুক্ত জিনিস বটে। সোনা-রূপা চকচক করে উঠলো আর মূল্যবান রত্নের বিভিন্ন রংয়ের দূতির ছটায় কেবিন ভরে গেল। তেহুতি আর বেকাথা জিনিসগুলোর দিকে একবার তাকিয়েই আবার বিষণ্ণতায় ফিরে গেল।

এযাবত আমার কঠিন নির্দেশ ছিল যে, আমার মেয়েরা যেন আঙুরের মদ পানের সুযোগ না পায়। তবে আমি বুঝলাম এখন এটাই একমাত্র তাদের মন ভালো করার সঠিক প্রতিষেধকের কাজ করবে। নিচে নেমে জাহাজের খোলে গিয়ে রাষ্ট্রদূত তোরানের একটি মদের পিপা খুললাম। তারপর তিনটি তামার বড় মদের ঘড়ার অর্ধেক অংশে অতীব সুমিষ্ট লাল সিক্লডস মদ ঢালোম। তার উপর পানি ভরে জাহাজের পরিবেশনকারীকে মেয়েদের কেবিনে নিয়ে যেতে বললাম।

তেহুতি বললো, তুমি আমাদেরকে এই বিষ পান করতে বলছো? অথচ তুমি বলেছিলে এটা খেলে আমাদের চুল পড়ে যাবে?

আমি ব্যাখ্যা করে বললাম, খুব কম বয়সে খেলে এটা হয়। দেখো আমার দিকে? আমার কি টাক পড়েছে? অনিচ্ছা নিয়ে ওরা আমার একথা মেনে নিল।

এবার বেকাথা মনে করিয়ে দিল, তুমি বলেছিল এটা খেলে দাঁত পড়ে যাবে? সাথে সাথে আমি আমার পুরো দাঁতের সারি ওদের দেখালাম। ওরা নিরবে এটা নিয়ে কিছুক্ষণ ভাবলো।

এরপর আমি বললাম, এটা তোমাদের মন খুশিতে ভরে দেবে?

বেকাথা দৃঢ়ভাবে বললো, আমি হাসিখুশি হতে চাই না। আমি শুধু মরতে চাই।

আমি বললাম, অন্তত খুশি হয়ে মরতে পারবে।

মিনোয়ন মেয়েটির দিকে তাকিয়ে একটু চিন্তা করে তেহুতি বললো, প্রথমে লক্সিয়াসকে দিয়ে শুরু করা যাক। কথাটি বলে সে একটি মদের পাত্র টেবিলের উপর দিয়ে লক্সিয়াসের দিকে ঠেলে দিল। লক্সিয়াস একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। কম আনন্দদায়ক আর মোটামুটি ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়গুলো তার ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে সে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল। সে পেয়ালাটি তুলে ঠোঁটের কাছে নিয়ে ছোট্ট একটা চুমুক দিল; তারপর পেয়ালাটি মুখের কাছে ধরে সোজা হয়ে বসলো।

তেহুতি আদেশ দিল, গিলে ফেল! সে তার নির্দেশ পালন করলো। আর ওরা সতর্কচোখে তার দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করতে থাকলো দেখার যে, তার চুল কিংবা দাঁত পড়ে যাচ্ছে কিনা।

লক্সিয়াস মৃদু হেসে আবার পেয়ালার উপর মাথা ঝুঁকিয়ে বললো, এটা বেশ সুস্বাদু।

তেহুতি প্রতিবাদ করে বললো, যথেষ্ট হয়েছে! তোমার সবটুকু খাওয়ার দরকার নেই। একথা বলে সে গ্লাসটা তার হাত থেকে নিল। তারপর গ্লাসটি টেবিলের চারদিকে একজন থেকে আরেকজনের হাতে ঘুরেফিরে চললো। হাতপা নেড়ে ওরা এর স্বাদ বর্ণনা করতে শুরু করলো। বেকাথা মনে করলো এর স্বাদ বড়ইয়ের মতো, তবে তেহুতি বললো এর স্বাদ অবশ্যই পাকা ডালিমের মতো। লক্সিয়াস কোনো মন্তব্য করলো না, তবে তার অংশ খেতে . ছাড়লো না। প্রথমে সেই হাসতে শুরু করলো। বাকি দুজন তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। তারপর বেকাথা খিলখিল করে হেসে উঠলো।

এক ঘন্টার মধ্যে তিনজনেই সমস্ত পোশাক খুলে সর্বাধিরাজ মিনোজ যে অলঙ্কারগুলো পাঠিয়েছিল সেগুলো পরে সাজলো। আমি আমার বীণায় ওদের প্রিয় একটা সুর বাজাতে শুরু করলাম। ওরা হাসাহাসি করতে করতে কেবিনের চারদিকে তিড়িং বিড়িং করে লাফালাফি করতে লাগলো। শেষপর্যন্ত মধ্যরাতের একটু আগে বেকাথা তার বিছানায় লুটিয়ে পড়লো। বাকি দুজনও আর দেরি করলো না। আমি ওদের গায়ে চাদরটাকা দিয়ে প্রত্যেকের কপালে চুমু খেয়ে শুভ রাত্রি বলে আলো নিভিয়ে বিদায় নিলাম। তারপর ডেকের সিঁড়ি বেয়ে উপরের ডেকে উঠে রাতের খোলা হাওয়ার মাঝে এসে দাঁড়ালাম। অনেকদিন পর মনটা বেশ খুশিখুশি লাগছে।

.

পরদিন দুপুরবেলায় একটি রাজকীয় বজরা বন্দর থেকে বের হয়ে পবিত্র ষাঁড়ের দিকে আসতে শুরু করলো। আমার রাজকুমারীরা মিনোয়ান রীতিতে পোশাক পরে তৈরি হয়ে মূল ডেকে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল। নড়চড়া না করলে বুঝার উপায় নেই যে কালো কাপড়ের কয়েকটি স্তর আর ঘোমটার নিচে কোনো জীবিত প্রাণীর অস্তিত্ব আছে। রাষ্ট্রদূত তোরান আজ সকালেই এই পোশাকআশাকগুলো পাঠিয়েছিল। অনেক অনুনয়বিনয় আর ছলচাতুরির পর মেয়েদেরকে এই অদ্ভুত ভিনদেশি পোশাকগুলো পরতে রাজি করেছিলাম। লক্সিয়াসের বেলায়ও তেমন অমর্যাদা করা হয়নি। যদিও তার পোশাকটিও লম্বা আর কালো ছিল আর টুপিটি ছিল উঁচু আর কৌণিক আকারের, তবুও তার মুখ আর হাত খোলা ছিল। সে কেবল একজন পরিচারিকা হওয়াও আমার বিশ্বাস যদি সে বুক উন্মুক্তও রাখে তারপরও কেউ তার দিকে তেমন লক্ষ্য করবে না।

ডেকে বসা চারজন যাজকের মৃদু তালে ঢোলক বাজনার তালে তালে আমি মেয়েদেরকে নিয়ে নিচে বজরার দিকে এগিয়ে নিয়ে চললাম। তারপর বৈঠা বেয়ে বজরাটি বন্দরের দিকে এগিয়ে চললো। এই ফাঁকে আমি পোতাশ্রয়ের চারদিক ঘিরে থাকা উঁচু উঁচু অট্টালিকাগুলো ভালোমতো দেখার সুযোগ পেলাম।

পাহাড় থেকে আনা মেটে-ধূসর রঙের পাথরের বড় বড় টুকরা দিয়ে এই অট্টালিকাগুলো নির্মাণ করা হয়েছে। একটি দালানের সাথে আরেকটি দালানের খুব একটা তফাৎ নেই। সবগুলো দেখতে বিশ্রী। ছাদগুলো সমতল। আর সরু জানালাগুলো আলোনিরোধক ধূসর কাঁচ দিয়ে ঢাকা।

সবচেয়ে বড় ভবনটি বন্দরের ঠিক উল্টোদিকে অবস্থিত। এর ছাদে ক্রিটের সোনালি ষাঁড়ের প্রতিকৃতি না থাকলেও বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, এটি সর্বাধিরাজ মিনোজের চারটি প্রাসাদের একটি।

অত্যন্ত দক্ষতার সাথে দাঁড় টেনে দাঁড়িরা বজরাটিকে প্রাসাদের সামনের জেটিতে এনে রাখলো। তীরে কয়েকজন উচ্চপদস্থ ব্যক্তি আমাদের ছোট দলটিকে স্বাগত জানাবার জন্য অপেক্ষা করছিল। এরা সবাই একইরকম কালো পূর্ণদৈর্ঘ্য পোশাক আর উঁচু কোণিক আকারের টুপি পরে ছিল। সবার মুখ চুনা-পাথরের মতো সাদা আর চোখের চারপাশে গোল করে সূর্মা লাগানো। কয়েকজন পোশাকের উপর সোনা আর রূপার হার পরে রয়েছে।

আমিও রাষ্ট্রদূত তোরানের পাঠানো লম্বা কালো আলখাল্লা পরেছিলাম। তবে আমি আমার সেই পাখির পালক লাগানো জমকালো সোনার শিরস্ত্রাণটি পরেছিলাম আর আমার মুখে কোনো চুন কিংবা সূর্মা লাগানো ছিল না।

সমবেত লোকজনের মধ্যে কেবল চারজনের পরনে কালো পোশাক ছিল না। এরা ছিল উজ্জ্বল সবুজ আঁটোসাঁটো জ্যাকেটপরা নমনীয় শরীরের চারজন কালো যোদ্ধা। এদের বুকের উপর আড়াআড়ি চামড়ার ফিতা বসানো আর মাথায় চামড়ার শিরস্ত্রাণ পরা। রাজকুমারীরা তীরে পা রাখতেই ওরা চটপটে সামনে এগিয়ে এসে ওদের দুজনের পাশে অবস্থান নিল। ওরা সবাই ছোট তরবারি আর ছুরি বহন করছিল। দুজনের হাতে চাবুকও ছিল।

সবুজ পোশাকপরা দেহরক্ষীদলটির মাঝে আজব ধরনের মেয়েলি কিছু একটা ছিল। মসৃণ মুখে দাড়ি নেই। সুগঠিত কমনীয় দেহ আর হাতগুলোও সেকরম। শুধু নারীসুলভ স্তনের প্রস্ফীতি নেই। যে কোনো বালকের মতো ওদের বুকও সমান। আমার মনে হল এরা উভলিঙ্গ জাতীয় মানুষ যা এর আগেও এই আজব দেশে দেখেছি। যাইহোক এদের নিয়ে চিন্তা মন থেকে বাদ দিয়ে আমার রাজকুমারীদের অনুসরণ করে প্রবেশদ্বার দিয়ে প্রাসাদের গুহার মতো লবিতে ঢুকলাম।

এই স্থানটিতে কালোপোশাকপরা চুন-সাদা মুখের মানুষ কাঁধে কাঁধ ঠেকিয়ে ভীড় করে দাঁড়িয়েছিল। তবে পুরো জনসমাবেশের মধ্যে একজনও নারী দেখা গেল না। আমরা মিসরীয়রা আমাদের নারীদের নিয়ে গর্বিত আর সবসময় আশা করি যে নারীরা আমাদের জাতীয় জীবনে একটি প্রধান এবং অত্যন্ত প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করুক। এই নারী বিচ্ছিন্নতা দেখে আমার খুবই অস্বাভাবিক এবং অপছন্দনীয় মনে হল।

মানুষের ভীড়ের মাঝখানে মার্বেল পাথরের মেঝের উপর দিয়ে যাওয়ার জন্য আমার মেয়েদের আর তাদের সবুজ পোশাক পরা দেহরক্ষীদলের জন্য একটি পথ খোলা ছিল। এটি সোজা চলে গেছে হলের শেষ মাথায় আরেকটি দরজার কাছে। এই গলি দিয়ে আমরা হাঁটা শুরু করতেই, কয়েক কদম যাওয়ার পর ভীড়ের মধ্য থেকে একজন লোক এসে আমার পাশাপাশি হাঁটতে শুরু করলো। প্রথমে আমি বুঝতে পারিনি লোকটি রাষ্ট্রদূত তোরান। সেও আপাদমস্তক কালো পোশাকে আবৃত ছিল আর তার মুখও একজন মরামানুষের মতো সাদা রং আর চোখে গোল করে সূর্মা লাগানো ছিল। তবে সে একটি সোনার হার পরেছিল, যা দেখে আমি চিনতে পারলাম। বিষাদময় স্বরে কথা বললেও আমি তার কণ্ঠস্বর চিনতে পারলাম।

সামনের বন্ধ দরজাটি দেখিয়ে সে বললো, সবকিছু পরিকল্পনামাফিক হচ্ছে। ঐ দরজার পেছনেই বন্ধ কামরাটিতে সর্বাধিরাজ মিনোজ তার সভাসদদের নিয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। রাণীমাতাও তার সাথে আছেন। এটি একটি বিরল সম্মান। আজকের অনুষ্ঠানে আপনার অংশগ্রহণ করার মতো কিছু নেই। তবে কাল থেকে নৌ-বাহিনী প্রধান এবং যুদ্ধপরিষদের সাথে আপনি হাইকসোদের বিরুদ্ধে অভিযানের পরিকল্পনার বিষয়ে আলোচনা করবেন।

আমিও তার মতো নিচুস্বরে বললাম, শুনে খুব খুশি হলাম। তবে বিয়ের উৎসবটি কখন হবে? এতোবছরের পরিকল্পনা আর ঐকান্তিক প্রচেষ্টার পর এই পর্যায়ে এসেছি। আমরা প্রায় সফলতার দ্বার প্রান্তে পৌঁছেছি। তাই আমার আস্বস্ত এবং খুশি হওয়াটা স্বাভাবিক।

সূর্মা লাগানো চোখে তোরান আমার দিকে তাকিয়ে কিছু বলার আগেই চকচকে পলিশ করা সিডার কাঠের দরজাটি নিঃশব্দে খুলে গেল। একটি ঢাকের কাঠির আওয়াজের সাথে তাল মিলিয়ে আমরা রাজদরবারে ঢুকলাম। ঢুকার পর একটু থামতেই পেছনে দরজাটি আবার নিঃশব্দে বন্ধ হয়ে গেল।

ভেতরে স্লান আলো। কোনো প্রদীপ দেখা যাচ্ছে না। কয়েকটি মাত্র সরু জানালা কালো রঙের পর্দা দিয়ে ঢাকা। ছাদ এতো উঁচু যে উপরে ছায়াছন্ন হয়ে আছে। তবে আবছা আলোয় আমার চোখ সয়ে এলে প্রায়ান্ধকারে বিভিন্ন বস্তুর আকৃতি আর মানুষের অবয়ব বুঝতে পারলাম।

কামরাটির মাঝখানে একটি উঁচু মঞ্চের উপর সিংহাসনটি স্থাপন করা রয়েছে। এর নিচে চারদিক ঘিরে রয়েছে কয়েকজন মানুষ। সিংহাসনের বামদিকে ক্রোনাস দেবতার যাজকরা সমবেত হয়ে রয়েছেন। এরা ঢিলা লম্বা আস্তিনহীন টুপিযুক্ত আলখাল্লা পরে রয়েছে। এতে তাদের শরীরের আকার কিছুই বুঝা যাচ্ছে না। পোশাকের রং ছিল ষাঁড়ের রক্তের মতো লাল।

সিংহাসনের অন্যপ্রান্তে দাঁড়িয়ে ছিল আরেকদল সভাসদ আর অভিজাত ব্যক্তি। এরা কেউ কেউ ঐতিহ্যগতভাবে লম্বা কালো আলখাল্লা আর উঁচু টুপি পরেছিল।

এদের মুখোমুখি ছিল উচ্চপদস্থ সামরিক এবং নৌকর্মকর্তারা। এদের পোশাক বেশ জমকালো এবং রঙচঙে হলেও সভাসদদের পোশাক ছিল মেটে রঙের।

সিংহাসনটি বিশাল। আবলুশ কাঠের উপর মুক্তার কাজ। বসার জায়গায় বেশ চওড়া, পাঁচজন বড় বড় মানুষ বসতে পারে। তবে এখন দুজন বসে রয়েছে। একজন ছিলেন নারী, রাজদরবারে উপস্থিত আমার রাজকুমারী আর লক্সিয়াস ছাড়া তিনি ছিলেন একমাত্র মহিলা।

আমি অবিশ্বাসি চোখে তার দিকে তাকালাম। এমন অতি প্রবীণা নারী আমি কখনও দেখিনি। তাকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন সময়ের সমবয়সী এক বৃদ্ধা। হাড্ডিসার দেহটি ধূলিমলিন কালো লেস কাপড়ে আবৃত, তবে হাতে কোনো দাস্তানা নেই। বাতরোগ আর বয়সের কারণে আঙুলগুলো অদ্ভুতভাবে বেঁকে রয়েছে। কঙ্কালসার হাতের পিঠে নীল শিরাগুলো জট পাকিয়ে রয়েছে।

পাণ্ডুর মুখের চামড়ার বলিরেখাগুলো দেখে মনে হচ্ছিল যেন গাছ থেকে পড়ে যাওয়া একটি আপেল রোদে শুকিয়ে রয়েছে। এটা দেখে আর মানুষের মুখ মনে হচ্ছে না। মাথার কয়েকগাছি চুল উজ্জ্বল লাল রঙ করা। চোখ দুটো গর্তে ঢুকে রয়েছে। একটা চোখ কালো রঙের কাঁচের মতো আগ্নেয় শিলার মতো চকচকে। আর অন্যটি অনচ্ছ আর সেই চোখ থেকে পানি চুঁইয়ে শুকনো গাল বেয়ে পড়ছে। চোখের পানিতে দেহের উপরের কালো লেসের পোশাক ভিজে যাচ্ছে।

নীরবতা ভঙ করে বৃদ্ধা হুউক করে কেশে উঠলো আর সবুজ আর হলুদ রঙের একদলা কফ মুখ থেকে বের করে মার্বেলের মেঝেতে থুক করে ফেললো। মুখ খুলতেই আমি তার কালো দাঁতগুলো দেখলাম।

তোরান ফিসফিস করে বললো, রানি মাতা, পাসিফে।

রূপার ঝালরের কারুকাজকরা আলখাল্লা আর বুকে সোনার বর্মপরা দানবীয় একজন মানুষ তার পাশে বসে রয়েছে। তবে প্রাণীটিকে দেখে মানুষের চেয়ে অনেক বড় মনে হল। ভাবলাম এটি কি মিনোয়ান অমর সর্বদেবতার মন্দির থেকে আসা কোনো প্রকৃতিক্রমবহির্ভূত জন্তু কিংবা মানব?

এর হাতদুটো কালো লোমশ চামড়ার দাস্তানায় ঢাকা। মনে হল বন্য মহিষের চামড়া। এর নিচের অঙ্গও একই চামড়ার তৈরি উঁচু বুটজুতা দিয়ে ঢাকা।

সবচেয়ে আশ্চর্যের জিনিস হল এর মাথা। মাথাটি সম্পূর্ণ মূল্যবান ধাতুর মুখোশে ঢাকা। মুখোশটির আকার ছিল নাকের ছিদ্র আর রুক্ষ কেশরসহ একটি বন্য ষাঁড়ের মাথার মতো। মুখোশে লাগানো বিশাল শিংগুলো ছিল আসল। সম্ভবত একই প্রাণীর কোনো মৃতদেহ থেকে আনা। লম্বা শিংগুলো সামনের দিকে বাঁকা আর ডগাগুলো ভয়ঙ্কর রকমের সুচোলো। এ-ধরনের মহিষের শিং আমি ব্যবিলনে রাজা নিমরদের প্রাসাদের দেয়ালে ঝোলানো দেখেছি।

মুখোশের চোখের ছিদ্রগুলো মনে হল কালো এবং শূন্য। তবে আমি একপাশে একটু সরতেই মুখোশের মাথাটিও সেইদিকে ঘুরলো। আর এতে জানালা থেকে আলো পড়তেই আমি চোখের গর্তের গভীরে জীবন্ত চোখের নড়াচড়া বুঝতে পারলাম। এটা কি মানুষের চোখ নাকি কোনো জন্তু কিংবা দেবতার চোখ? তবে জানার কোনো উপায় নেই।

আড়াল থেকে ঢাকিরা দুবার ঢাক পিটিয়ে নীরব হল। হঠাৎ নীরব হয়ে যাওয়া কামরায় কেউ নড়চড়া করছে না। তারপর সিংহাসনে বসা মুখোশ পরা মানব-মূর্তিটি উঠে দাঁড়িয়ে দুইহাত দুপাশে মেলে ধরলো। তারপর সে একটি বন্য ষাঁড়ের মতো গর্জন করে উঠলো। শব্দটি এই প্রাণীর মাথার মুখোশের মধ্যে এমন প্রচণ্ডভাবে প্রতিধ্বনিত হল যে, আমার মনে হল মিনোয়ান প্রকৌশলীরা নিশ্চয়ই এই মুখোশের মধ্যে এমন কোনো ব্যবস্থা করেছে যার কারণে শব্দটি অসম্ভব জোরে শোনা যাচ্ছিল।

সাথে সাথে পুরোহিতসহ উপস্থিত সমস্ত মানুষ শ্রদ্ধা দেখিয়ে গম্ভীরভাবে গোঙানির মতো একটি শব্দ করে মুখ নিচের দিকে করে উপুড় হয়ে মাটিতে শুয়ে পড়লো। দুই রাজকুমারীর দুইপাশে দাঁড়ানো সবুজ পোশাক পরা প্রহরীরা রাজকুমারীদেরকে জোর করে মুখ নিচু করে মার্বেল পাথরের মেঝেতে প্রণত হতে বাধ্য করলো।

রাষ্ট্রদূত তোরান আমার কব্জি ধরে আমাকে নিচের দিকে টেনে মাটিতে প্রণত করে হিশশ করে বললো, চুপ করে শুয়ে থাকুন! প্রাণ বাঁচাতে হলে উপরের দিকে তাকাবেন না!

আমি তার কথা মান্য করলাম। বুঝতে পারছি না কী হচ্ছে, তবে এটুকু বুঝতে পারলাম এখন তর্ক করার সময় নয়। চুপ করে শুয়ে রইলাম; অন্যরা যখন মেঝেতে কপাল ঠুকে গোঙানির মতো শব্দ করছে, তখন তাদের মতো আমিও মেঝেতে কপাল ঠুকে গুঙিয়ে উঠলাম। এদিকে সিংহাসন থেকে আগের মতোই প্রচণ্ডভাবে ক্রোধদ্দীপ্ত বক্তৃতা হয়ে চলেছে। শব্দটি বাড়তে বাড়তে এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে, প্রচণ্ড যন্ত্রণায় আমার মাথা দপদপ করতে লাগলো।

যদিও মিনোয়ান ভাষা আমি ভালোভাবেই শিখেছিলাম, তবুও সর্বাধিরাজ মিনোজ যা বলছিলেন তার একবর্ণও বুঝতে পারলাম না। হয় তিনি কোনো রহস্যময় ভাষায় লম্বা-চওড়া বক্তৃতা দিচ্ছেন কিংবা শব্দগুলো প্রতিধ্বনিত হয়ে বিকৃত হওয়ায় আমি তা বুঝতে পারছি না।

ডানহাতে আমি একটি ব্রেসলেট পরেছিলাম। চিকণ একটি চেইন থেকে ছোট্ট একটি সোনার চাকতি ঝুলছে। চাকতিটা পলিশ করে আয়নার মতো চকচকে করেছিলাম। হাত না উঠিয়ে আমার সামনে বা পেছনে কোনো জিনিস বা মানুষের ছবি এতে প্রতিফলিত হলে আমি দেখতে পারতাম। এভাবে আমি অনেক কিছু দেখেছিলাম আর কয়েকবার এর মাধ্যমে মৃত্যুও এড়াতে পেরেছি।

হঠাৎ আমার ছোট্ট আয়নায় দেখা গেল ছাদের ছায়া থেকে একটি কালো গোলাকার পর্দা নিঃশব্দে পড়ে গেল। যে মঞ্চের উপর সিংহাসনটি বসানো ছিল পর্দাটির আকার ঠিক তার সমান। পর্দাটি নিচে নেমে সম্পূর্ণভাবে সর্বাধিরাজ মিনোজ আর তার মা, পাসিফেকে ঢেকে ফেললো।

তারপর এটা যেমন নেমেছিল সেরকম দ্রুত আবার উপরের দিকে উঠে গেল। সিংহাসন আর মঞ্চটি শূন্য পড়ে রইল। সর্বাধিরাজ মিনোজ আর তার মা অদৃশ্য হয়ে গেছেন। এ-ধরনের চাতুর্যপূর্ণ মঞ্চাভিনয়ের শৈলী আমি আর কখনও দেখিনি।

আড়াল থেকে ঢাকিরা আবার ঢাক পেটাতে শুরু করলো। এই ইঙ্গিতটি পাওয়ার পর সবাই হাঁটু গেড়ে বসে মাথা তুললো। সর্বাধিরাজ মিনোজ আর তার মা অদৃশ্য হয়েছেন বুঝতে পেরে সবাই অবাক বিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠলো। আমিও তাদের সাথে যোগ দিলাম। ক্রিটের রাজার আশ্চর্য ক্ষমতার প্রদর্শনী দেখে আমার বিস্ময় প্রকাশ করার পর আমি দাঁড়িয়ে তোরানকে জিজ্ঞেস করলাম, আশা করি সর্বাধিরাজ মিনোজ বিয়ের অনুষ্ঠানের একটা দিনক্ষণ ঠিক করেছেন, তাই না?

সে অত্যন্ত বিব্রত হয়ে বললো, ক্ষমা করুন প্রভু তায়তা। আমার আগেই আপনাকে পুরো ব্যাপারটা খুলে বলা উচিত ছিল। আমি মনে করেছিলাম কী ঘটছিল তা আপনি বুঝতে পেরেছিলেন। এতোক্ষণ যা দেখলেন তা ছিল বিয়ের অনুষ্ঠান।

প্রথমে আমার মুখে কোনো কথা জোগাল না, তারপর কোনোমতে বললাম, কিছু বুঝতে পারছি না তোরান। আমিতো মিসরী রাজকুমারীদের বিয়ের কথা বলছিলাম।

সে বললো, এটাই তো বিয়ে। এরা আর রাজকুমারী নেই। ওরা এখন মিনোয়ান রানি। আপনি আর আমি যা সম্পন্ন করতে চেয়েছিলাম তা এখন সাফল্যের সঙ্গে শেষ করা হয়েছে। তারপর সে আমার হাত ধরতেই আমি তার হাত ঝটকা মেরে সরিয়ে দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে বললাম, এখন আমার মেয়েদের কী হবে?

মাথা ঘুরিয়ে সবুজ পোশাকপরা দেহরক্ষীদলটিকে দেখিয়ে সে বললো, ঐ রণচণ্ডীরা এখন ওদেরকে রাজকীয় হেরেমে নিয়ে যাবে।

আমি প্রতিবাদ করে বললাম, আমি এখনও ওদের সাথে যাওয়ার জন্য তৈরি হই নি। আগে আমাকে পবিত্র আঁড় থেকে আমার ব্যক্তিগত জিনিসপত্র নিতে হবে।

আমি অত্যন্ত দুঃখিত তায়তা। রাজমহিষীদের প্রাসাদে কোনো পুরুষের প্রবেশাধিকার নেই।

আপনিতো জানেন তোরান যে, আমি একজন পুরোপুরি পুরুষ নই। আমাকে কখনও আমার মেয়েদের কাছ থেকে জোর করে আলাদা করা হয়নি।

সে বললো, মিনোয়ান আইনে আপনি একজন পুরুষ।

সবুজ পোশাকপরা যে দেহরক্ষীরা রাজকুমারীদেরকে নিয়ে যাচ্ছিল, তাদের দিকে তাকিয়ে বললাম, ওদের বিষয়টা কি তোরান? ওরা কি পুরুষ নয়?

না তায়তা। ওরা পশ্চিম আফ্রিকার বেলালা গোত্রের নারী।

আমি প্রতিবাদ করলাম, কিন্তু ওদেরতো স্তন নেই!

বয়ঃসন্ধির সময়ে এগুলো কেটে ফেলা হয় যাতে ওরা ভালোভাবে তরবারি চালাতে পারে। তবে এর নিচে ওরা পুরোপুরি নারী। আপনাকে প্রমাণ করে দেখাচ্ছি। একথা বলে সে দেহরক্ষীদের অধিনায়কদের দিকে ফিরে কিছু বললো। সাথে সাথে সে তার সবুজ ঘাগড়ার প্রান্ত তুলে তার স্ত্রী অঙ্গ দেখাল।

আমি প্রায় অনুনয়ের স্বরে বললাম, আবার কখন আমি আমার মেয়েদের দেখা পাবো?

তোরান চূড়ান্তভাবে বললো, আমাকে যে এই প্রশ্নের উত্তর দিতে হচ্ছে সেজন্য আমার খুব খারাপ লাগছে। কেননা উত্তরটি হল কখনও না। ওদের মৃত্যু পর্যন্ত সর্বাধিরাজ মিনোজ ছাড়া আর কোনো পুরুষ তাদের দেখতে পাবে না।

পরে তার কথাটি ভাবতে গিয়ে আমার মনে হল শেষ কথাটি একধরনের সতর্কবার্তা ছিল। তবে এই বিশাল ক্ষতির সম্মুখিন হয়ে তখন আমি এতো মনোকষ্টে ছিলাম যে এই কথাটি আগে ভাবার সময় পাইনি।

চার রণচণ্ডি নারী দেহরক্ষী ঘোমটায় ঢাকা রাজকুমারীদের নিয়ে চললো, লক্সিয়াস তাদের অনুসরণ করলো। তবে যাবার আগে আমার দিকে ফিরে ফিসফিস করে বললো, আমি জীবন দিয়ে ওদের রক্ষা করবো। কথাগুলো না শুনলেও ওর ঠোঁটনাড়া পড়ে বুঝতে পেরেছিলাম।

আর সামলাতে না পেরে ওদেরকে বাধা দেবার জন্য আমি এগোতেই তোরান আমার হাত টেনে ধরে থামিয়ে বললো, আপনি নিরস্ত্র তায়তা। ঐ রণচণ্ডি নারীগুলো প্রশিক্ষিত হত্যাকারী। ওদের মনে কোনো দয়ামায়া নেই।

আমি দাঁড়িয়ে ওদের চলে যাওয়া দেখলাম। লক্ষ্য করলাম বেকাথা কাঁদছিল, ঘোমটার নিচে তার সারা শরীর কাঁপছিল। তবে তেহুতি একজন বীর নারীর মতো অজানার পথে পা বাড়ালো।

সিংহাসনের পেছনে দেয়ালে একটি কালো রঙের দরজা নিঃশব্দে খুলে গেল। হতাশা নিয়ে আমি দেখলাম ওরা সেই দরজা দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল।

.

মনে হচ্ছিল যেন আমার জীবন শেষ হয়ে গেছে। ওরা চিরদিনের জন্য আমার কাছ থেকে চলে গেছে। যাদের জন্য এতোবছর বেঁচে ছিলাম তারা আর নেই।

রাষ্ট্রদূত তোরান জানতো কত গভীরভাবে রাজকুমারীদের সাথে আমি জড়িত ছিলাম আর ওদেরকে হারিয়ে আমি কতটুকু আহত হয়েছি। এবার সে প্রমাণ করলো যে, সে আমার সত্যিকার বন্ধু হয়েছে। প্রাসাদের পেছনের উঠানে আমার জন্য একটা ঘোড়ার গাড়ি অপেক্ষা করছিল। রাষ্ট্রদূত তোরান আর আমি সেই গাড়িতে চড়ে আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে কুনুসস নগরীর উপরে পাহাড়ের ধারে এক বিশাল অট্টালিকায় গেলাম। এটিই এখন থেকে মিসরীয় দুতাবাস হবে আর আমি হলাম রাষ্ট্রদূত।

উপরে উঠবার সময় তোরান শহরের বিভিন্ন দৃশ্য দেখিয়ে আমার মন চাঙ্গা করার চেষ্টা করতে লাগলো। এর মধ্যে ছিল নৌবাহিনীর সদর দপ্তর আর সরকারি বিভিন্ন ভবন, যেখান থেকে সর্বাধিরাজ মিনোজ দূর-দূরান্তে তার সাম্রাজ্য পরিচালনা করেন।

তোরান বললো, সরকারের সর্বোচ্চ দপ্তর হচ্ছে রাজ্য পরিষদ, সর্বাধিরাজ মিনোজ এর দশজন সম্মানিত সদস্য নিয়োগ দেন। এদের দায়িত্ব হচ্ছে আমাদের জাতীয় জীবনের সকল দিক দেখাশুনা করা। যেমন, সকল নাগরিকের জন্য বাধ্যতামূলক ক্রোনাস দেবতার উপাসনা থেকে শুরু করে কর আদায় পর্যন্ত, এটা অবশ্য ঐচ্ছিক নয়। এই সামান্য রসিকতাটা করে সে চুকচুক করলো, তারপর বললো, এরপর আছে নৌপরিদপ্তর, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং সেনাবাহিনী।

অনেক চেষ্টার পর আমি আমার হারানোর ব্যথা একপাশে সরিয়ে এইসব গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলোর দিকে মনোযোগ দিলাম।

তাকে জিজ্ঞেস করলাম, অবশ্যই সারা পৃথিবী মিনোয়ান নৌবাহিনীর কথা জানে, তবে আমি জানতাম না যে আপনাদের একটি সেনাবাহিনীও আছে।

তোরান গর্বভরে উত্তর দিল, আমাদের সেনাবাহিনীতে প্রায় পঞ্চাশ হাজার সেনা সদস্য রয়েছে।

আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, হোরাসের দিব্যি, তার মানে এটাতো আপনাদের জনসংখ্যার অধিকাংশ।

সমস্ত উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা মিনোয়ান তবে সাধারণ সেনারা ভাড়াটে সৈন্য। আমাদের দেশের অধিকাংশ জনগণ হচ্ছে দক্ষকর্মী, ওরা সেনাসদস্য নয়।

এই তথ্যটি জেনে আমি খুব অবাক হলাম। তারপর বললাম, এবার আমি বুঝেছি। আর নিশ্চিত হয়েছি যে, আপনাদের এই চমৎকার নৌবহরের জাহাজে অত্যন্ত দ্রুত এই যোদ্ধাদেরকে বহন করে যখন যেখানে প্রয়োজন সেখানে নিতে পারবেন।

তোরান সকল জ্যেষ্ঠ সেনাপতি আর তাদের যার যার দায়িত্বের বিশদ বিবরণ জানাল। তারপর সে এদের প্রত্যেকের ক্ষমতা আর দুর্বলতা নিয়ে আলোচনা করলো। কেউ কেউ অত্যন্ত কুশলী এবং দূরদৃষ্টি সম্পন্ন যোদ্ধা। তবে অন্যান্যদের বেশিরভাগই শুধু তাদের সম্পদ, পেট আর জৈবিক কামনা মেটাবার বিষয় নিয়ে ব্যস্ত।

তবে তাকে সর্বাধিরাজ মিনোজ আর সোনার মুখোশের পেছনে মানুষটি সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞেস করার চেষ্টা করতেই সে তা এড়িয়ে গেল আর হালকা সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বললো, সর্বাধিরাজ মিনোজ সম্পর্কে আলোচনা করা মানেই মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার সামিল অপরাধ। আপনি কেবল এটা জেনে সন্তুষ্ট হতে পারেন যে, তিনি হলেন আমাদের জাতির আত্মার মূর্তপ্রকাশ। এবারকার মতো আমি মনে করবো আপনি না জেনে একথা জিজ্ঞেস করেছেন, তবে আমি আপনাকে এ-বিষয়ে সাবধান করে দিচ্ছি তায়তা।

দুজনেই কিছুক্ষণ বিব্রতকর নীরবতায় কাটিয়ে হাঁটতে হাঁটতে একটা মোড় ঘুরতেই হঠাৎ আমার থাকার অট্টালিকার সামনে পৌঁছলাম। বিশাল ভবনটি অন্যগুলোর মতোই সাদামাটা, কোনো ফুলের বাগান নেই। শুধু চারপাশে একটি আঙুরের মাচা দেখা যাচ্ছে।

এই আবাসনের পরিচারকবৃন্দ আমাকে স্বাগত জানাবার জন্য সারিবদ্ধ হয়ে মুল দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

তোরান বললো, এরা সবাই ক্রীতদাস। এদের জিহ্বা কেটে ফেলা হয়েছে, কাজেই কোনো ধরনের অনর্থক বকবকানি আপনাকে শুনতে হবে না।

মনে মনে ভাবলাম, তার মানে এদের কাছ থেকে কোনোকিছু জানতে পারব না। তবে একথা মুখে প্রকাশ করলাম না।

গাট্টাগোট্টা চেহারার হাসিহাসি মুখে দাঁড়ানো একজনকে দেখিয়ে সে বললো, এ হল বেশাস, আপনার প্রধান পরিচারক। এ মিসরীয় ভাষা বুঝে তবে সেই একই কারণে কথা বলতে পারে না। আপনার যা প্রয়োজন তা একে বলতে পারেন।

তোরান ঘুরে ঘুরে আমার নতুন আবাসস্থলটি দেখাল। কামরাগুলো বেশ বড় তবে আড়ম্বরহীন। আমার ব্যক্তিগত জিনিসপত্র আগেই বন্দর থেকে এখানে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এগুলো সব ধুয়ে পরিষ্কার করে সুন্দরভাবে থাকার জায়গায় সাজিয়ে রাখা হয়েছে। শোবার কামরার পাশেই একটি গ্রন্থাগারে একশোর মতো বড় বড় লেখার কাগজের পাকানো ফালি এবং গ্রন্থ তাকে সাজিয়ে রাখা হয়েছে।

তোরান বললো, এখানে মিনোয়ান সাম্রাজ্যের সঠিক ইতিহাস জানতে পারবেন, এখানে আমারও বেশকিছু লেখা আছে। আশা করি এগুলো আপনার কাজে লাগবে। তারপর কামরার মাঝখানে লেখার টেবিল দেখিয়ে বললো, এখানে আপনার একান্ত ব্যবহারের জন্য কালি, তুলি আর উৎকৃষ্ট মানের সাদা প্যাপিরাস কাগজ পাবেন। আর আপনার লেখা কোনো পত্র পৃথিবীর যেকোনো জায়গায় পাঠাতে চাইলে আমি তার ব্যবস্থা করতে পারবো।

ভাবলেশহীন মুখে তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বললাম, আপনি সত্যি একজন হৃদয়বান লোক তোরান। তবে মনে মনে হেসে ভাবলাম, তা পাঠাবেন তবে তার আগে একটা অনুলিপি করে রাখবেন। আমি বুঝেছি যে তার বন্ধুত্ব আর দয়াশীলতারও একটা পরিসীমা আছে।

তারপর সে বলে চললো, ভঁড়ারে পঞ্চাশটি উৎকৃষ্টমানের মদের পিপা রাখা আছে। এগুলো খালি হলেই সাথে সাথে আবার ভরে দেওয়া হবে। রোজ সকালে বন্দর থেকে টাটকা মাছ-মাংস আসবে। আপনার দুজন পাঁচকই ভালো, আমি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। আমি নিজে ওদেরকে পছন্দ করেছি।

আস্তাবলে গিয়ে পৌঁছতেই প্রধান সহিস আমার সামনে মাটিতে উপুড় হয়ে শুয়ে প্রণত হল। তার পিঠে সদ্য চাবুকের দাগ দেখতে পেলাম।

বন্ধুত্বপূর্ণ কন্ঠে আমি তাকে বললাম, উঠে দাঁড়াও! এককালে আমিও ক্রীতদাস ছিলাম, তাই চাবুকের আঘাতের কথা আমার ভালো মনে আছে। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার নাম কী? সে কোনমতে উত্তর দিল, ওয়াগা। লোকটি বেশ হাসিখুশি ধরনের, স্পষ্টতই ক্রিটবাসি নয়।

আমি তার নামটি উচ্চারণ করে বললাম, ঠিক আছে ওয়াগা। এবার তোমার ঘোড়াগুলো দেখাও। সে আমার আগে আগে আস্তাবলের মধ্য দিয়ে ছুটে চলতে চলতে খালিপেটের গলা থেকে অর্থহীন তবে উৎসাহব্যঞ্জক শব্দ উচ্চারণ করতে লাগলো।

আস্তাবলের পেছনে ছোট্ট চারণভূমিতে আটটি সুন্দর ঘোড়া দেখা গেল। ওয়াগা শিস দিয়ে ওদের ডাকতেই ঘোড়াগুলো সাথে সাথে তার কাছে ছুটে এলো। সে প্রত্যেকটি ঘোড়াকে তার কোমরে বেঁধে রাখা থলে থেকে এক টুকরা করে যবের পিঠা খাওয়াল। ঘোড়াগুলি যদি তাকে বিশ্বাস করে তাহলে আমিও এভাবে এগুলোকে খাওয়াব। ঘোড়া সাধারণত খুব ভালোভাবে বিবেচনা করতে পারে।

খুব শিঘ্রই একদিন আমাকে ঘোড়ায় চড়ে দক্ষিণ উপকূলে ক্রিমাদ যেতে হবে। পথ দেখাবার জন্য আমার একজন পথপ্রদর্শক দরকার। তুমি কি রাস্তাটা চেনো? ওয়াগা সায় দিয়ে মাথা ঝুঁকালো। আমি তাকে বললাম, তাহলে তৈরি থেকো। আমি তোমাকে হঠাৎ যাবার কথা বলতে পারি আর খুব জোরে ছুটতে হবে। আমার কথা শুনে সে দাঁত করে করে হাসলো। মনে হল আমাদের দুজনের মধ্যে বনিবনা হয়ে গেছে।

.

পরদিন ভোরে সূর্য উঠার আগে ঘুম থেকে উঠে দ্রুত প্রাতরাশ সেরে পাহাড় বেয়ে নিচে নেমে নৌ-প্রশাসনের সদর দফতরে গেলাম। সেখানে নৌবাহিনীর উপ-প্রধান হেরাকল আর তার সহকারীদের সাথে সারাদিন আলোচনা আর তর্কবিতর্ক করে কাটালাম। তবে তেমন ফল হল না। ওরা আমাকে আটটি জরাজীর্ণ দুই স্তরের দাঁড়বিশিষ্ট জাহাজ দেবার প্রস্তাব করলো। এগুলো অনেক বছর বাণিজ্যপোত হিসেবে ব্যবহারের পর এখন প্রায় ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। ওরা চাচ্ছে এগুলো দিয়ে আমি হাইকসোদের মোকাবেলা করি। এতোদিনে আমি জেনেছি যে, মিনোয়ানরা গোমড়ামুখো এবং কঠিন প্রকৃতির লোক। বিদেশিদের প্রতি বৈরী মনোভাব পোষণ করে। একমাত্র ব্যতিক্রম দেখতে পেয়েছি রাষ্ট্রদূত তোরানকে, যে খুবই আমায়িক এবং পরোপকারী। তাকে অনায়াসে একজন জন্মগত মিসরী বলা যায়।

সন্ধ্যায় অত্যন্ত হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরলাম। পাঁচক যে ভেড়ার কাবাব রান্না করেছিল তা ছুঁয়েও দেখলাম না। তবে তোরান আমার ভাঁড়ারে যে সুস্বাদু মদ রেখেছিল তা পান করে শক্তি সঞ্চয় করলাম। তারপরদিন ভোরে আবার নৌ সদর দফতরে গেলাম।

আমার সমস্ত কলাকৌশল ব্যবহার করে আর তোরানের সহায়তায় অনেক দরকষাকষির পর শেষ পর্যন্ত দশম দিনে তিন ডেক বিশিষ্ট প্রায় নতুন ছয়টি রণতরীর ব্যবস্থা করলাম। এগুলো পানিতে ভাসাবার জন্য একান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও নৌবাহিনীর উপ-প্রধান কয়েকজন মিনোয়ান অভিজ্ঞ নৌ-কর্মকর্তা দিলেন। এছাড়া জাহাজ চালাতে উত্তর ইতালিয়ার আদিম গোত্রের শক্তিশালী ভাড়াটে নাবিক নেওয়া হল। এরা নিজেদেরকে ল্যাটিন কিংবা এটুস্কান হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকে। তোরান আমাকে আস্বস্ত করলো, এরা অত্যন্ত চমৎকার নাবিক এবং ভয়ঙ্কর যোদ্ধা। এক একটি তিনডেকওয়ালা রণতরীতে একশো বিশজন করে এই আদিম গোত্রের লোকদের নিয়ে আমি সন্তুষ্ট হলাম যে, এবার হাইকসো নৌবহরের যে কোনো জাহাজের মোকাবেলা করতে পারবো।

নতুন জাহাজের ক্যাপ্টেনদের দ্বীপ ঘুরে অন্যপাশে ক্রিমাদ বন্দরে যেতে নির্দেশ দিলাম। সেখানে জারাস আর হুই আমার সুমেরিয় দুই ডেকওয়ালা রণতরীগুলো নিয়ে অপেক্ষা করছিল। এখন থেকে এটিই আমার সমস্ত কর্মকাণ্ডের মূলঘাটি হবে। এখান থেকে মাত্র ছয়শো লিগ দক্ষিণে শত্রুর অবস্থানে আঘাত হানতে পারবো। অনুকূল বাতাসে সমুদ্র পথে মাত্র পাঁচ দিনের পথ।

.

আমার সংগ্রহ করা নতুন তিন ডেকওয়ালা জাহাজগুলো সকালেই কুমুসস  থেকে যাত্রা শুরু করলো। আর এদিকে একইদিন ভোর হবার আগেই অন্ধকার থাকতেই আমি ওয়াগাকে নিয়ে ঘোড়ায় চড়ে জাহাজগুলো পৌঁছাবার আগেই ক্রিমাদ বন্দরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। আমার নির্দেশ মোতাবেক ওয়াগা দুটি ঘোড়ায় জিন পরিয়েছিল আর আরও চারটি ঘোড়া সাথে নিয়েছিল। পথে কোনো একটি পরিশ্রান্ত হয়ে পড়লেই সাথে সাথে ঘোড়াটি বদলে নিতে পারবো।

তোরান আমাকে সতর্ক করে বলেছিল পথে পাহাড়ি জঙ্গলে দস্যু আর পলাতক আসামিরা লুকিয়ে থাকে। একথা ভেবে কোমরের খাপে একটা ছোট তরবারি আর ডান কাঁধে আমার লম্বা বাঁকা ধনুকটাও ঝুলিয়ে নিলাম।

ক্রীতদাস হিসেবে নিষেধাজ্ঞার কারণে ওয়াগা কোনো ধারালো অস্ত্র বহন করতে পারে না। তবে সে একটা গুলতি আর একটি থলে ভর্তি নদী থেকে আহরণ করা গোলাকার পাথর নিল। এই অস্ত্রটি দিয়ে তাকে আমি আকাশে অনেক উপরে উড়তে থাকা তিতির পাখি শিকার করতে দেখেছি। আরেকবার দেখেছি রান্নাঘরের পেছনের বাগানে ঘুরতে থাকা একটি হরিণকে এই অস্ত্র দিয়ে ঘায়েল করে মাটিতে ফেলে দিয়েছিল।

ভোর হবার আগেই আমরা রওয়ানা দিলাম। একজন দক্ষ ঘোড়সওয়ার হিসেবে ওয়াগা আমার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারছিল। সে রাস্তার প্রতেক্যটি বাঁক আর মোড় চিনতো। আমার ডান দিক দিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে সে পশুর মতো ঘোঁতঘোঁত শব্দ করে আর হাতের ইশারায় আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চললো।

প্রথমে ইডা পাহাড়ের ঢাল দিয়ে তির্যকভাবে পার হলাম তারপর পূর্বদিকে সবচেয়ে উঁচু চূড়ার গিরিপথের দিকে চললাম। গ্রীষ্মের শেষেও এই জায়গাটি বরফাবৃত ছিল। এই উচ্চতার বড় বড় গাছগুলো কেটে কামারশালার হাপর আর কারখানার চুল্লির জন্য জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এই ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ দেখে আমার মন খারাপ হল। কাঠুরেরা একটি গাছও রাখেনি।

অবশেষে অনেক উঁচুতে আমরা আদিম অবস্থায় থাকা জঙ্গলে পৌঁছে বিশাল গাছগুলোর মধ্য দিয়ে ঘোড়ায় চড়ে চলতে লাগলাম। গাছের উপরের শাখাগুলোর একটি আরেকটির সাথে জোড়া লেগে নিচে ছায়া দিচ্ছে। ঘন শৈবালের উপর দিয়ে চলার কারণে ঘোড়র ক্ষুরের শব্দ চাপা পড়ে গিয়েছিল। শুধু পাখির ডাক আর ছোট ছোট প্রাণীর শব্দ শোনা যাচ্ছিল। পাহাড়ের বরফ গলে যে ঝরণা বয়ে চলেছে, ঘোড়াগুলোকে সেই ঝরণার ঠাণ্ডা আর পরিষ্কার পানি পান করালাম।

জঙ্গলের মাঝে একটি খোলা জায়গায় পৌঁছে সূর্য দেবতা হেলিওসকে লক্ষ্য করার জন্য একটু থামলাম। পূর্ব দিগন্তের উপরে সূর্য দেবতা মাথা তুলেছেন।

এটি একটি পবিত্র স্থান। এখানেই সকল দেবতার পিতা ক্রোনাস আর তার পুত্র কন্যার জন্ম হয়। আমি তাদের উপস্থিতি অনুভব করলাম আর জঙ্গলের সুমিষ্ট বাতাসে আর দোঁ-আশ মাটিতে তাদের সুঘ্রাণ পেলাম। অমরাত্মাদের এতো কাছে আসতে পেরে কেমন এক অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছিল। হয়তো আমার মাঝে এই অনুভূতি জেগে উঠার পেছনে কারণ হচ্ছে আমার শিরার মধ্যে একই সূত্রে জাত রক্ত প্রবাহিত হওয়া যা, ইনানা আমাকে প্রথম জানিয়েছিল। তারপর আমি নিজেকে স্মরণ করিয়ে দিলাম যে, ইনানা আমার একটি কল্পনা প্রসূত বিষয় মাত্র। আর আমি আমার নিজের অলস কুসংস্কারের একটি শিকার ছিলাম। তবে তার চেহারা বার বার আমার মনে ফিরে আসায় আমি খুবই বিরক্ত হচ্ছিলাম।

ইনানার চিন্তা মন থেকে ঝেড়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নিতেই আমি তার হাসির প্রতিধ্বনি শুনতে পেলাম। বুঝতে পারলাম সে কাছেই রয়েছে আর এতে আমার অটল সিদ্ধান্ত ভেঙে পড়লো।

ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে খাড়া ঢাল বেয়ে নামতে শুরু করলাম। নিচে ক্রিটের দক্ষিণ উপকূলে পাহাড়ের ধারে ক্রিমাদ বন্দরের অবস্থান। দুপুর হতে আরও দুই ঘন্টা বাকি। আমরা বেশ ভালোই এগোচ্ছি।

মনে হল বিশ লিগ দূরত্ব থেকেই আমি বন্দরে নোঙর করা আমার সুমেরিয় জাহাজগুলোর মাস্তুলের ডগা দেখতে পাচ্ছি। ঘোড়ার পিঠে বসে পেছন ফিরে ফেলে আসা পথের দিকে তাকাতেই সেই আগ্নেয়গিরিটি দেখতে পেলাম যার মাঝে ক্রোনাস দেবতাকে বন্দী করে রাখা হয়েছে। উত্তর দিগন্তে এটা সোজা পানির উপরে উঠে গেছে। এর যমজ চূড়া থেকে বেয়ে পড়া ক্রিম রঙের ধূঁয়ার স্রোত-প্রবাহের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। মৃদু হাসলাম। তার মানে দেবতার মেজাজ এখন শান্ত।

এই ফাঁকে ওয়াগা ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে কাছের গাছটির পেছনে বসে পেচ্ছাব করতে লাগলো। এই আচরণ থেকে বুঝা যাচ্ছে ক্রীতদাস হওয়ার আগে সে একটি দ্র পরিবারের সন্তান ছিল। কেবলমাত্র নিম্ন শ্রেণীর এবং সাধারণ মানুষেরা দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করে।

তারপর ওয়াগা লাফ দিয়ে উঠে পোশক হাঁটুর নিচে নামিয়ে হাত দিয়ে ইশারা করে যেখানে সে বসে প্রস্রাব করছিল তার কাছেই মাটির দিকে দেখাল। আর সেই সাথে মুখ দিয়ে বিভিন্ন ধরনের শব্দ করতে লাগলো। কী হয়েছে জানার জন্য আমি ঘোড়া থেকে নেমে তার কাছে গেলাম।

গাছটির গোড়ায় নরম মাটি এমনভাবে এলোমেলো হয়ে রয়েছে যে, কিছুক্ষণ লাগলো বুঝতে যে, বিশাল কোনো পশুর দ্বিখণ্ডিত খুরের ছাপ সেখানে রয়েছে। খুরের ছাপটি নীল নদের তীরে আমার খামারে যে দুধেল গাই রয়েছে সেগুলোর তুলনায় অনেক গুণ বড়।

হাঁটু গেড়ে বসে হাত দিয়ে খুরের ছাপটি মাপার চেষ্টা করলাম। আমার এক হাতে কুলোলো না। তারপর দুই হাত মেলে একটা খুরের ছাপ পুরোপুরি ঢাকতে পারলাম।

প্রচণ্ড বিস্ময়ে ওয়াগার দিকে তাকিয়ে বললাম, মালিন শেঠের দিব্যি। কোন দানব এই পায়ের ছাপ ফেলেছে? এর উত্তরে সে কী বললো তা আমি বুঝতে পারলাম না। বারবার মুখ দিয়ে একই শব্দ করতে লাগলো আর ভয়ে কাঁপতে লাগলো। তারপর একছুটে ঘোড়র কাছে গিয়ে কোনোমতে ঘোড়ার পিঠে উঠে পড়ে আমাকেও ঘোড়ায় চড়তে ইশারা করলো। তারপর চারপাশের জঙ্গলের দিকে চকিত ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকাতে লাগলো। তার দেখাদেখি আমিও ঘোড়ার পিঠে চড়ে সামনের দিকে ঘোড়া এগিয়ে নিলাম।

এই বিশাল খুরের ছাপের কোনো একটি যুক্তিযুক্ত ব্যাখ্যা বের করার চেষ্টা করছিলাম। এই আকারটি দেখে বাস্তবতার চেয়ে কাল্পনিক মনে হচ্ছিল, তারপর ব্যবিলনে রাজা নিমরদের প্রাসাদের দেয়ালে ঝুলানো বিশাল বিরল উরুস ষাড়ের মাথার খুলি আর শিংয়ের কথা মনে পড়ে গেল। তবে ইউফ্রেটিস নদীর উত্তর-পুবে অনেক দূরে জাগরোস পর্বতের যে এলাকা থেকে সে এগুলো সংগ্রহ করেছিল, তা এই ক্ষুদ্র ঘনবসতিপূর্ণ দ্বীপ থেকে অর্ধেক পৃথিবী দূরে অবস্থিত।

এই চমৎকার জঙ্গলে বিরল বন্য উরুস ষাঁড়ের বিচরণ বেশ অস্বাভাবিক, তবে সর্বাধিরাজ মিনোজ একে আশ্রয় দিয়ে থাকলে ভিন্ন কথা। সম্ভবত তিনি এই দানবীয় প্রাণীটিকে মিনোয়ান জাতির কুলমর্যাদাচিহ্ন এবং ক্রোনাস দেবতার পবিত্র প্রাণী হিসেবে ঘোষণা করেছেন। রূপার যে মুখোশটি মিনোজ পরে থাকেন তা থেকে এই সম্ভাবনার বিশ্বাস পাওয়া যায়। তবে এই বিষয়ে তোরানের সাথে আলোচনা করাটা ঠিক হবে না। সে ইতোমধ্যেই আমাকে মিনোয়ান শাসকের ব্যাপারে বেশি গভীরে নাক গলাতে নিষেধ করেছে।

আমি ওয়াগার দিকে তাকালাম। সে তখনও ভীষণ উত্তেজিত হয়ে রয়েছে। সে প্রচণ্ড ঘামছিল আর তার নিচের ঠোঁট থরথর করে কাঁপছিল। ঘোড়ার পিঠে বসে ছটফট করতে করতে পথের দুইদিকে ঝোঁপগুলোর দিকে উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে বার বার তাকাচ্ছিল। আমি বেশ বিরক্ত বোধ করছিলাম। এই পর্বতে এখনও বন্য উরুস ষাঁড়ের বিচরণ থাকলেও সে খুবই বাড়াবাড়ি করছে।

যত বড়ই হোক না কেন উরুস হচ্ছে গরু আর গরু সাধারণত শান্ত প্রাণী হয়। তাকে কিছু বলতে যাবো এমন সময় সে চিৎকার করে উঠলো। তার গলা থেকে হঠাৎ এমন অদ্ভুত চিৎকারটি শুনে আমি চমকে উঠলাম।

তার ঘোড়াটি হঠাৎ প্রচণ্ডভাবে আমার ঘোড়াটির গায়ে এসে এমনভাবে হেলে পড়লো যে সাথে সাথে সাবধান না হলে আমি ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে যেতাম। কোনোমতে সামলে নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে ধমকে উঠলাম। কিন্তু সে তখনও আতঙ্কিত হয়ে বিড়বিড় কিছু বলছিল আর যে পথের দিকে আমরা যাচ্ছিলাম তার উপরের কেঁপের দিকে দেখাল।

আমি তার দিকে চিৎকার করে বললাম, শান্ত হও বোকা! সাথে সাথে সামনের ঝোঁপের কাছে বিশাল কালো আকৃতিটির দিকে নজর পড়তেই আমি থেমে গেলাম। প্রথমে মনে করেছিলাম পর্বতের পাথুরে একটা অংশ। তারপর আকৃতিটি নড়াচড়া করতেই আকৃতিটি পরিষ্কার হয়ে চোখে ধরা পড়লো।

নিশ্চিতভাবে এটি একটি জীবন্ত প্রাণী।

ঘোড়ার পিঠে বসে পেছনের দিকে হেলান দিয়ে বিশাল প্রাণীটির চোখের দিকে তাকালাম। চোখগুলো বিরাট। আমার দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। ওয়াগার চিৎকার শুনে প্রাণীটি বিশাল ঘন্টার আকৃতির কানগুলো সামনের দিকে খাড়া করে রেখেছে। পিঠে উটের মতো কুঁজ। দুই শিংয়ের মাঝে ফাঁক আমার দুই হাত মেলে ধরলে তার সমান হবে। শিংগুলো হাতির দাঁতের মতো মোটা আর সুঁচোলো। থিবসে ফারাওয়ের প্রাসাদে আমি যে হাতির দাঁত দেখেছি সেগুলোর মত।

এটি কোনো জাবরকাটা শান্ত গরু নয়। অবাক বিস্ময়ে ওয়াগার মতো আমিও চেঁচিয়ে উঠলাম।

প্রাণীটি মাথা নিচু করে ভয়ঙ্কর শিংদুটো আমাদের দিকে তাক করে ধরলো। সেই সাথে সামনের পা দিয়ে মাটি আঁচড়াতে শুরু করলো। তারপর একটি বিশাল তুষারধ্বসের মতো ঝোঁপঝাড় ভেঙে পর্বতের ঢাল বেয়ে নিচে আমাদের দিকে দৃষ্টি স্থির নিবদ্ধ রেখে এক লাফ দিল।

সঙ্কীর্ণ পথে আমি আটকে পড়েছিলাম। পেছনে ফেরার বা ঘোরার কোনো উপায় নেই। তরবারি কিংবা ধনুক বের করারও সময় পেলাম না।

ওয়াগার ঘোড়াটি আতঙ্কিত হয়ে পালাবার পথ খুঁজতে গিয়ে আরোহীসহ সরাসরি বঁড়টির হামলার মুখোমুখি পড়ে গেল। তবে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েও লোকটি অসম্ভব সাহসের কাজ করলো। তার পশমি আলখাল্লাটি গোল করে পাকানো অবস্থায় জিনের সামনে বাঁধা ছিল। সে এটা টেনে নিয়ে ছিঁড়ে একটা পতাকার মতো ছড়িয়ে দিল। তারপর একটা চাবুকের মতো বঁড়টির মাথার উপর ছুঁড়ে মারলো। আমি বুঝতে পারিনি তার উদ্দেশ্যে, তবে আলখাল্লাটি ষাঁড়ের শিংয়ের নিচে লেগে এর মাথার চতুর্দিকে পেঁচিয়ে বঁড়টির চোখ পুরোপুরি ঢেকে ফেললো।

ঘোড়া আর আরোহীকে চোখে না দেখলেও বঁড়টি বিশাল শিং দিয়ে ওদের দিকে তো মারলো। আমি তাকিয়ে দেখলাম একটি শিংয়ের ডগা ওয়াগার ডান বগলের নিচে বুকে ঢুকে গেল। তার বুকের পাঁজর ভেদ করে শিংয়ের সুচালো ডগাটি উল্টোদিকে পিঠ দিয়ে বের হল।

ষাঁড়টি মাথা ঝাঁকাতেই ওয়াগার দেহ অনেক দূরে শূন্যে ছিটকে পড়লো। তারপর অন্ধ বঁড়টি আবার শিং দিয়ে গুতো মারলো আর এবার ঘোড়াটিকে আঘাত করতেই ঘোড়াটি হাঁটু ভেঙে পড়ে গেল।

এবার বঁড়টি সম্পূর্ণ উন্মাদের মতো হয়ে গেল। শিংয়ে জড়ানো মাথা ঢাকা কাপড়টি সরাবার জন্য এদিক-ওদিক ঝোঁপঝাড়, গাছের কাণ্ডে গুতো মারতে লাগলো।

ওয়াগা আমাকে যে মূল্যবান সময়টুকু দিয়েছিল সেই সুযোগ আমি এক লাফে জিন থেকে মাটিতে নামলাম। ধনুকটি ইতোমধ্যেই হাতে নিয়ে এক টানে গুণ টেনে টান টান করে নিয়েছিলাম।

ভূণির তখনও ঘোড়ার জিনে আটকানো ছিল, তবে এ-ধরনের পরিস্থিতির জন্য আমি সবসময় দুটো আলগা তীর কোমরবন্ধে গুঁজে রাখতাম। একটা তীর ধনুকে জুড়ে ধনুকের গুণ টেনে ধরলাম।

ষাঁড়টি সম্ভবত আমার নড়াচড়ার শব্দ কিংবা গন্ধে আমার উপস্থিতি টের পেয়েছিল। এবার সে তার বিশাল দেহটি ঘুরিয়ে আমার দিকে মুখ করে দাঁড়াল। তখনও এদিক সেদিক মাথা দোলাচ্ছিল। আমি অপেক্ষা করলাম, তারপর নড়াচড়ার ফলে তার ডান কাঁধ আর বুকের সামনের অংশ আমার দিকে উন্মুক্ত হয়ে পড়লো। এবার আমি তীর ছুঁড়লাম। এতো কাছের দূরত্বে তীরটা প্রচণ্ড গতিতে গিয়ে আঘাত করলো। তীরটি সম্পূর্ণ ষাঁড়ের বুকের ভেতরে ঢুকে অদৃশ্য হয়ে গেল। শুধু বাইরের দিকে সামান্য একটু ক্ষত রয়ে গেল যেখান থেকে উজ্জ্বল রক্ত ছলকে বের হল। আমার দ্বিতীয় তীরটি একই সারিতে এক আঙুল উপরে আঘাত করলো। ষাড়টি থমকে পিছিয়ে গেল তারপর এক চক্কর ঘুরে গিয়ে ঝোঁপের মাঝে অন্ধের মতো পড়ে গেল। শুনতে পেলাম পর্বতের খাড়া ঢালের গা ঘষটে নামছে। একমুহূর্ত পর নিচের দিকে পড়লো। বিশাল দেহটি ধপাস করে মাটিতে আছড়ে পড়ার শব্দ শোনা গেল। তারপর ঝোঁপের মধ্যে পেছনের পা ছুঁড়ে ছটফট করতে লাগলো। অবশেষে বিকট একটি আর্তচিৎকার করে ছটফট করতে করতে মরে গেল। তার চিৎকারের শব্দ পর্বতের চূড়ায় প্রতিধ্বনিত হল।

এক মুহূর্ত পর নিজেকে সামলে নিয়ে কাঁপতে থাকা হাত স্থির করলাম। প্রথমে ওয়াগা যেখানে পড়েছিল সেখানে গেলাম। প্রথম দৃষ্টিতেই বুঝা গেল তার মৃত্যু হয়েছে। ক্ষতস্থান থেকে গলগল করে রক্ত ঝরছে। পাশে হাঁটু গেড়ে বসলাম। ভোলা চোখদুটো স্থির হয়ে উপরের দিকে তাকিয়ে রয়েছে, মুখ হা করা। আর কিছুই করার নেই, সব কিছুর ঊর্ধ্বে চলে গেছে।

তার ঘোড়াটাও মারাত্মক আহত হয়ে মাটিতে পড়ে রয়েছে। পশুটির গলায় আঘাত লেগেছে। এছাড়া সামনের পাও মারাত্মকভাবে জখম হয়ে ভেঙে গেছে। আমি দাঁড়িয়ে তলোয়ার বের করলাম, তারপর পশুটির দুই কানের মাঝে মাথার খুলির উপর এক কোপ মারতেই পশুটি সাথে সাথে মারা গেল।

অন্য ঘোড়াগুলোর লাগামের দড়ি তখনও মৃত ঘোড়াটির জিনের সাথে বাঁধা ছিল। দড়ি খুলে ঘোড়াগুলোকে কাছেই একটা গাছের সাথে বাঁধলাম। তারপর আমার ঘোড়াটি আর এর সাথে বাঁধা অন্য ঘোড়াগুলোর খোঁজে চললাম। এগুলো বেশি দূর যায়নি। জঙ্গলের মধ্যেই ভোলা একটি জায়গায় ঘাস খাচ্ছিল। এদেরকে নিয়ে যেখানে অন্য ঘোড়াগুলো ছিল সেখানে এসে একই গাছের সাথে বাঁধলাম।

সবকিছু ঠিক করার পর ঢাল বেয়ে নিচে নেমে যেখানে উরুস ষাঁড়টি পড়েছিল সেখানে গেলাম। মৃত পশুটির চতুর্দিক এক চক্কর ঘুরে দেখলাম, আবার অবাক হলাম এর বিশাল আকৃতি দেখে। এবার বুঝতে পারলাম ওয়াগা কেন এতো ভয় পেয়েছিল। আমার দেখা সমস্ত প্রাণীর মধ্যে এটা সবচেয়ে ভয়ঙ্কর। কোনো ধরনের উসকানি ছাড়াই আমাদেরকে আক্রমণ করেছিল।

বুঝলাম কেন রাজা নিমরদ এই পশু একশোটি শিকার করার জন্য গর্ব করতো আর কেন মিনোয়ানরা এটাকে তাদের জাতির কুলমর্যাদাচিহ্ন মনে করতো।

বিশাল প্রাণীটির পাশে হাঁটু গেড়ে বসে শ্রদ্ধামিশ্রিত ভয় নিয়ে এর দিকে তাকালাম, আর একটু হলেই আমি মারা যেতাম। ওয়াগার রক্তমাখা আলখাল্লাটা এর শিং থেকে খুলে নিলাম। ভাঁজ করে বগলের নিচে রাখলাম। তারপর দাঁড়িয়ে হাত মুঠো করে ভয়ঙ্কর প্রতিপক্ষকে অভিবাদন করলাম। তারপর ঘুরে চললাম। আমার তীর মারার উপযুক্ত প্রতিপক্ষ বটে।

এরপর উপরে যেখানে সাহসী ওয়াগার মৃতদেহ পড়েছিল সেদিকে চললাম। মুখ থেকে রক্ত মুছে তারই আলখাল্লা দিয়ে তার শরীর পেচিয়ে দিলাম। তারপর দেহটা কাঁধে ঝুলিয়ে নিয়ে জঙ্গলের একটা উঁচু গাছে উঠে দুই ডালের মাঝে গুঁজে রাখলাম। পরে সুযোগমতো তার সমাধির ব্যবস্থা করবো।

গাছে তার পাশে বসে তার নিজের দেবতার কাছে তাকে অর্পণ করে একবার সংক্ষিপ্ত প্রার্থনা করলাম। তারপর গাছ থেকে নেমে এলাম।

.

মাটিতে পা ছুঁতেই মাটি এমন ভীষণভাবে কেঁপে উঠলো যে আমি প্রায় টলে পড়ে যাচ্ছিলাম। নিজেকে খাড়া রাখতে গাছের কাণ্ড জাপটে ধরলাম। গাছটিও কাঁপছিল, এর শাখাপ্রশাখা দুলছিল। উপরের দিকে তাকাতেই উপর থেকে গাছের পাতা আর ছোট ছোট ডাল আমার উপর ঝরে পড়তে লাগলো। ভাবলাম ওয়াগার দেহটি হয়তো সরে গেছে তাই গাছের পাতা পড়ছে। কিন্তু আমি তো খুব ভালোভাবে লাশটি খুঁজে রেখেছিলাম।

আমার চারপাশে পুরো জঙ্গল ভয়ানকভাবে কাঁপছিল। এমনকি পর্বতও যেন নেচে উঠছে। প্রচণ্ড গর্জন শুনে ঘুরে ইডা পর্বতের চূড়ার দিকে তাকাতেই দেখলাম চূড়া থেকে বিশাল একটি গ্রানাইট খণ্ড ভেঙে আলগা হয়ে নিচে উপত্যকার দিকে গড়িয়ে পড়লো।

ঘোড়াগুলো আতঙ্কিত হয়ে উঠেছে। পেছনের পা ছুঁড়ে মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে দড়ির বাঁধন থেকে ছুটার চেষ্টা করতে লাগলো। ভূমিকম্পে কেঁপে উঠা মাটির উপর দিয়ে টলমল পায়ে হেঁটে ওদের কাছে গিয়ে গায়ে হাত বুলিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করলাম। পাখি আর অন্যান্য পশুর মতো ঘোড়ার সাথেও আমি বিশেষ উপায়ে কথা বলে শান্ত করতে পারি। ওদেরকে শান্ত করে মাটিতে শুইয়ে দিলাম যাতে ওরা আহত না হয়।

তারপর ফিরে কুমুসস বন্দরের উপর দিয়ে উত্তর দিকে আর খোলা সাগর পেরিয়ে ক্রোনাস পর্বতের জমজ চূড়ার দিকে তাকালাম।

দেবতা ক্রুদ্ধ হয়েছেন। জিউস যে শিকল দিয়ে তাকে বেঁধে রেখেছেন তা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য লড়াই করছেন। অনেক দূর থেকেও তার কান ফাটা গর্জন শোনা যাচ্ছে। পর্বতের অন্ধকার পাতালঘরের ছিদ্র দিয়ে ধূঁয়া, বাষ্প আর আগুনের বিরাট ঢেউ উঠে উত্তর দিগন্ত ঢেকে ফেলেছে। দেখলাম নগরীর দালানের সমান আকৃতির বড় বড় পাথর খণ্ড আকাশের দিকে ছুঁড়ে মারছে।

আকষ্মিক এমন প্রলয়ঙ্কর ক্ষিপ্ততার সামনে আমার নিজেকে অত্যন্ত ক্ষুদ্র আর অসহায় মনে হল। এমনকি সূর্য দেবতা হেলিওসেরও মুখ ঢাকা পড়েছে। পুরো পৃথিবীর উপর অন্ধকার হতাশা নেমে এসেছে। আতঙ্কে পৃথিবীও কাঁপছে আর গন্ধকের কটু গন্ধে বাতাস ভরে রয়েছে।

আমি ঘোড়াগুলোর কাছে বসে হাতের ভাঁজে মুখ ঢাকলাম। আমিও ভয় পেয়েছি। দেবতার রোষ থেকে রক্ষা পাবার কোন আশ্রয়স্থল এই পৃথিবীর কোথাও নেই।

দেবতার আত্মস্বরূপ সেই দানবীয় শিংওয়ালা প্রাণীটিকে আমি হত্যা করেছি। নিশ্চিত এরকম ধর্মদ্রোহীতাপূর্ণ অপরাধের কারণে ক্রোনাসের আক্রোশ আমার উপর এসে পড়েছে।

এরপর প্রায় দুই ঘন্টা ধরে দেবতা তার তাণ্ডব চালিয়ে গেলেন, তারপর সূর্য মধ্যগগনে এসে পৌঁছতেই হঠাৎ এটা থেমে গেল যেমন হঠাৎ শুরু হয়েছিল। গন্ধকের মেঘ উবে গেল, পর্বত স্থির হল আর পৃথিবীতে শান্তি ফিরে এলো।

.

মাটি থেকে ঘোড়াগুলোকে উঠিয়ে আমার ঘোড়ার পিঠে চড়ে বসলাম, তারপর লাগামের দড়িতে বাঁধা অন্য ঘোড়াগুলো নিয়ে পর্বতের পথ বেয়ে নিচের দিকে নামতে শুরু করলাম।

তিনদিন আগে আমি জারাসকে আমার আসার কথা জানিয়ে একটি বার্তা পাঠিয়েছিলাম। ক্রিমাদ বন্দরে পৌঁছার অনেক আগে জারাস আর হুইকে দেখলাম পাহাড়ের পথ বেয়ে আমার দিকে আসছে। দূর থেকে দেখেই আমাকে চিনতে পেরে ওরা উল্লাসে চিৎকার করে উঠলো, তারপর ঘোড়া ছুটিয়ে এগিয়ে এলো। কাছে পৌঁছতেই লাফ দিয়ে মাটিতে নামলো। তারপর প্রায় টেনে আমাকে ঘোড়ার পিঠ থেকে নামিয়ে একজনের পর একজন বুকে জড়িয়ে ধরলো। আমি হোরাস আর হাথরের প্রতি আমার ভালোবাসার দিব্যি দিয়ে বলতে পারি, যখন সে আমাকে তার কঠিন আলিঙ্গন থেকে মুক্ত করলো তখন তার চোখে এক ফোঁটা পানি দেখা গিয়েছিল।

তারপর সে বললো, আমরা ভেবেছিলাম অবশেষে হয়তো আমরা তোমাকে হারালাম। তবে দেবতা ক্রোনাসও সেই কাজটি করতে পারেনি। যদিও আমার চোখ শুকনো ছিল, তবে আমি কৃতজ্ঞ বোধ করলাম যে, এমন ভাবপ্রবণ দৃশ্যটি দেখার মতো আর কেউ সেখানে ছিল না।

পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা হিসেবে আমি বললাম, মিনোয়ান যুদ্ধজাহাজগুলো কি ক্রিমাদ বন্দরে পৌঁছেছে?

জারাস মুখ থেকে সেঁতো হাসি মুছার চেষ্টা করে সাগরের দিকে দেখিয়ে বললো, না আসেনি। দেখতেই পাচ্ছেন ভূমিকম্পে সাগরের কি উথাল-পাথাল অবস্থা হয়েছে। নিশ্চয়ই ওরা পথ হারিয়েছে। মনে হয় ফিরে আসতে কয়েকদিন দেরি হবে।

তোমার জাহাজগুলো কীভাবে ঝড় সামলেছে? পাহাড়ের পথ বেয়ে নামতে নামতে আমরা কেবল নৌসংক্রান্ত আলোচনা করে চললাম। হুই যে হাতের ইশারা করে জারাসকে কিছু বলতে চাচ্ছে, তা দেখেও না দেখার ভাণ করলাম। যাইহোক ক্রিমাদ বন্দরের কাছাকাছি আসতেই সে আর নিজেকে সামলাতে না পেরে বলে বসলো, আমরা ভেবেছিলাম আপনি হয়তো আমাদের জন্য কোন বার্তা নিয়ে এসেছেন।

আমি ভ্রু কুঁচকে বললাম, বার্তা? কার কাছ থেকে তোমরা বার্তা পাওয়ার আশা করেছিলে?

হয়তো প্রাসাদ থেকে?

আমি না জানার ভাণ করে বললাম, তোমরা রাজাধিরাজ মিনোজের কাছ থেকে বার্তা আশা করেছিলে? তাদের করুণ চাউনি উপেক্ষা করে আবার বললাম, না, কোনো বার্তা নেই। তবে তোমরা হয়তো শুনে থাকবে যে রাজকুমারী তেহুতি আর বেকাথা, দুজনেরই মিনোয়ান রাজার সাথে বিয়ে হয়েছে আর ওরা এখন রাজকীয় হেরেমের নিরাপদ আশ্রয়ে আছেন। তোমরা দুজনেই প্রশংসনীয় দায়িত্ব পালন করেছ। প্রথম সুযোগেই আমি ফারাওকে একথা জানাবো। আমি জানি তিনি কৃতজ্ঞ হবেন। একটু থেমে আবার বলে চললাম, তোমরা হয়তো ভাবছো কেন আমি একা এসেছি। পথে একটা দুর্ঘটনা ঘটেছিল আর একটা বন্যপশুর আক্রমণে আমার পরিচারকের মৃত্যু হয়েছে। তোমরা পাহাড়ে লোক পাঠিয়ে তার মরদেহটা খুঁজে যথাযথ সমাধির ব্যবস্থা করো।

আমি কথা বলেই চললাম, ওদেরকে রাজকুমারীদের নিয়ে কোনো কথা বলার সুযোগ দিলাম না। আমি বলতে চাই নি যে মেয়েদের সাথে আমার কোনো যোগাযোগ নেই আর ওরা হেরেমে কেমন আছে তাও আমি জানিনা।

বন্দরে পৌঁছে আমি অবাক হলাম দেখে দ্বীপের এপাশেও ক্রোনাস পর্বতের আগ্নেয়গিরির তাণ্ডবের প্রভাবে সাগরে বিক্ষুব্ধ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। বড় বড় ঢেউ বন্দরের দেয়ালে আছড়ে পড়ছিল। তবে জারাস আর হুই তাদের জাহাজগুলো রক্ষার জন্য যথাসম্ভব ব্যবস্থা নিয়েছিল। ওরা পাথরের জেটির সাথে দ্বিগুণ শক্তিতে জাহাজ বেঁধে রেখেছিল আর একটা জাহাজের সাথে আরেকটা জাহাজের সংঘর্ষ এড়াতে মাঝখানে পাকানো দড়িদড়ার গুচ্ছ ব্যবহার করেছিল।

কেবল একজন নাবিক জাহাজে রেখে বাকি সবাই তীরে বন্দর পরিচালকের অতিথি হিসেবে শূন্য গুদামে আশ্রয় নিয়েছিল। এর নাম পোইম্যান, অন্যান্য মিনোয়ানদের মতো সেও একজন বিষাদগ্রস্ত নিরাশাবাদি লোক।

রাতে সে আমাকে আমার কর্মকর্তাদেরসহ নৈশভোজে আমন্ত্রণ জানালো। তার এমন আতিথেয়তায় আমি অবাক হলাম। পরে জেনেছি সে মিনোয়ান গুপ্ত পুলিশের একজন কর্নেল। আর তার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে সকল মিসরীয়দের সম্পর্কে প্রতিবেদন তৈরি করে পাঠাচ্ছে।

খাবারদাবার ছিল অতিরিক্ত লবণাক্ত আর পোড়া। মদও ছিল বিস্বাদ। সমস্ত কথাবার্তা কেবল ভূমিকম্প আর সাগরে যে ঝড় সৃষ্টি হয়েছিল তার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। আমি আলোচনাটা অন্য দিকে ঘোরাতে চাচ্ছিলাম। তাই তাকে জিজ্ঞেস করলাম, এই ভূমিকম্প আর আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের কারণ কী বলতে পারেন?

কারও কোনো সন্দেহ নেই যে দেবতার বিরুদ্ধে কোনো একটি অপরাধ সংঘটিত হওয়ার কারণে মানুষের উপর শাস্তিস্বরূপ এগুলো চাপানো হয়েছে।

আমি আবার বোকার মতো প্রশ্ন করলাম, এমন কী গুরুতর সে অপরাধ যার জন্য এমন শাস্তির প্রয়োজন পড়লো? আর কী উপায়ে এই অপরাধের প্রতিকার হবে?

সবাই এবার কামরায় উপস্থিত রাজাধিরাজ মিনোজের একমাত্র জ্যেষ্ঠ প্রতিনিধি বন্দর-পরিচালকের দিকে তাকাল। সে একজন জ্ঞানী লোকের মতো ভাব আর কর্তৃত্বব্যঞ্জক কণ্ঠে বললো, দেবতার দৈব ইচ্ছার বিষয়ে আমরা কিছু বলতে পারি না। কেবল রাজাধিরাজ মিনোজ, প্রশংসিত হোক তার নাম চিরদিন- এ বিষয়ে এই জ্ঞান রাখেন। যাইহোক আমরা এটা জেনে খুশি হতে পারি যে, মহামান্য মিনোজ এই দৈব রোষের কারণটি খুঁজে বের করেছেন এবং তিনি এর সম্পূর্ণ ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করবেন। তারপর সে ঘাড় বাঁকা করে ঘরের দেয়ালের বাইরে ঝড়ের শব্দ শোনার চেষ্টা বললো, ঐ যে শুনুন! ঝড়ের প্রকোপ কমে আসছে। দেবতার রোষ ইতোমধ্যেই প্রশমিত হয়ে আসছে। আগামীকাল এই সময়ের মধ্যেই সমুদ্র শান্ত হয়ে আসবে আর পর্বতও স্থির হয়ে যাবে।

আমি তবু নাছোড়বান্দার মতো বিষয়টির পেছনে লেগে থেকে জিজ্ঞেস করলাম, রাজাধিরাজ মিনোজ কী উপায়ে এতো সহজে দেবতাকে শান্ত করেন?

সে কাঁধে একটা ঝাঁকি দিয়ে একজন মুরব্বীর ভাব দেখিয়ে বললো, একমাত্র যে উপায়ে কোন দেবতাকে খুশি করা যায়। অর্থাৎ একটি বলি দিয়ে।

তোরান সাবধান বাণী উচ্চারণ না করলে হয়তো রাজাধিরাজ মিনোজের স্বভাবের বিষয়ে জানতে অনধিকার অনুপ্রবেশ করতাম। তবে আমি জিহ্বা সামলাম। বন্দর-পরিচালক অন্যদিকে ঘুরে তার সহকারীদের সাথে ঝড়ে তাদের কী কী ক্ষতি হয়েছে তা নিয়ে আলোচনা করতে লাগলো।

আমি বেশ অস্বস্তিবোধ করতে লাগলাম এই কথাটি ভেবে যে, উরুস ষাড়কে আমি হত্যা করার পর ক্রোনাসের দৈব ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ, দুটি ঘটনাই খুব কাছাকাছি সময়ে ঘটেছে আর এদুটোকে কেবল হঠাৎ যুগপৎ ঘটে যাওয়া ঘটনা বলা যায় না।

আমি ভাবলাম শান্ত হওয়ার জন্য ক্রোনাস দেবতা রাজাধিরাজ মিনোজের কাছে কী বলি দাবী করেছিলেন?

.

পরদিন ভোরে ক্রিমাদ বন্দর রক্ষাকারী দেয়ালের গায়ে সাগরের ঢেউয়ের আছড়ে পড়া কমে এলো আর জারাস এবং হুইও হাইকেসোদের বিরুদ্ধে নৌ অভিযানের প্রস্তুতি নেবার কাজে ব্যস্ত হল।

চারদিন পর মিনোয়ান নৌবাহিনীর উপ-প্রধান হেরাকল যে ছয়টি তিনডেকওয়ালা যুদ্ধ জাহাজ আমার জন্য বরাদ্দ করেছিলেন সেগুলো ক্রিমাদ পৌঁছালো। সাগরের ঢেউ তাদেরকে পুবদিকে অনেক দূরে প্রায় সাইপ্রাস পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিল। ওদের পানিও প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিল আর দাড়িরাও পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছিল।

আমি ক্রিটের নাবিকদেরকে তিনদিনের পূর্ণ বিশ্রামের সুযোগ দিয়ে নিশ্চিত করলাম যেন ওরা ঠিকমতো খাবারদাবার, জলপাই তেল এবং যথেষ্ট পরিমাণে মদও পায়। এতে ওদের মাঝে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া হল। বিশ্রাম শেষ হবার পর দুটি নৌবহরের মধ্যে যৌথ অনুশীলন শুরু করলাম।

ভাষাই আমাদের প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়াল, তবে আমি প্রতিটি জাহাজে দুইজন করে দোভাষি নিয়োগ দিলাম আর পতাকার ইঙ্গিত মিনোয়ান আর মিসরীয়দের একই অর্থ করা হল।

দুই নৌবহরেই সুশিক্ষিত এবং অভিজ্ঞ নাবিক ছিল আর এক সপ্তাহের মধ্যে ওরা জটিল কৌশলী অভিযান পরিচালনার কাজ শুরু করলো। মিনোয়ানরা শিঘ্রই সৈকতে রথ আর পদাতিক সেনা অবতরণ করা এবং আবার যুদ্ধাভিযানের পর সৈন্য, ঘোড়া এবং রথ কীভাবে উদ্ধার করতে হয় তা শিখলো।

যতই ওরা দক্ষ হতে শুরু করলো সেই সাথে মিসরীয় এবং মিনোয়ানদের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাঁপড়া এবং সহযোদ্ধার মনোভাব গড়ে উঠলো। আমি জানি খুব শিঘ্রই এদেরকে হাইকসোদের বিরুদ্ধে অভিযানে পাঠাবো। তবে আমার মূল চিন্তা হল সিদ্ধান্ত নিতে হবে কোথায় ওরা হাইকসোদের সবচেয়ে বেশি ক্ষতিসাধন করতে পারবে।

উত্তম গোয়েন্দাগিরির মাধ্যমে প্রথম তীর ছোঁড়ার আগেই কিংবা খাপ থেকে তরকারি বের করার আগেই যুদ্ধ জয় করা যায়।

তারপর হঠাৎ একদিন একটি ছোট্ট এবং প্রায় পরিত্যক্ত একটি ধাউ ক্রিমাদ বন্দরের প্রবেশ মুখে এসে উপস্থিত হল। পালটি ঘেঁড়া আর ময়লা দাগে ভরা। আটজন মাল্লা প্রাণপণ চেষ্টায় পানি সেচে নৌকাটি পানিতে ভাসিয়ে রাখার চেষ্টা করছিল। নাবিকদের চেহারা হতবিধ্বস্ত। জাহাজে কোনো পতাকা নেই আর এটা পানিতে বেশ নিচু হয়ে ভাসছিল, যেকোন মুহূর্তে ডুবে ডেতে পারে। কোনো জলদস্যু এই জাহাজের দিকে ফিরেও তাকাবে না, সম্ভবত সে কারণেই সাগরে ভেসে এতোদূর আসতে পেরেছে।

পাঁচটি ডিঙিতে সশস্ত্র লোকজন নিয়ে জারাসকে ধাউটিতে চড়ার নির্দেশ দিলাম। সে ধাউটিকে টেনে নিয়ে বন্দরে ঢুকলো। প্রবেশ পথ পার হতেই অচেনা ধাউটির পাল গুটিয়ে মিসরীয় পতাকা উড়াল। জারাস এটাকে জেটির সাথে বাঁধলো।

ধাউয়ের অধিনায়ক প্রভু তায়তার সাথে সাক্ষাত করতে চাওয়ায় তাকে আমাদের চারজন নাবিক চ্যাংদোলা করে তীরে নিয়ে এলো। আমি উপস্থিত হয়ে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে তাকে বিশ ঘা চাবুক মারার নির্দেশ দিলাম, যাতে সে বুঝে এখানে কে হুকুম চালায়। হতভাগা লোকটি হাঁটু গেড়ে বসে জেটির পাথরে কপাল ঠেকিয়ে বাম হাতের আঙুল দিয়ে একটি শনাক্তকরণ সংকেত করলো। এটন আর আমি যখন ক্রীতদাস ছিলাম তখন আমরা এই সংকেতটি ব্যবহার করতাম।

এবার চাবুক মারার নির্দেশটি বাতিল করে তাকে আমার জাহাজের কেবিনে নিয়ে আসতে বললাম। কেবিনে ঢোকার পর প্রহরীদেরকে চলে যেতে বললাম, তারপর আমার পরিচারককে নির্দেশ দিলাম বন্দীটির হাতমুখ ধোয়ার জন্য গরম পানি আর নাবিকদের একটি পোশাক আনতে।

আমার পাঁচক টেবিলে আমাদের জন্য রান্না করা চিংড়ি আর টুনা মাছ ভাজি রাখলো, আর আমি এটুস্কান মদের একটি বোতলের কাঠের ছিপি খুললাম। তারপর বললাম, তোমার নাম কী বন্ধু?

সে দাঁত বের করে হেসে বললো, অন্য যেকোনো নামের মতো বন্ধুও একটি ভালো নাম। আমার মা যে নামটি রেখেছিলেন তার চেয়েও ভালো।

আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, আমাদের পরস্পরের পরিচিতজনের খবর কী?

সে উত্তর দিল, মোটা লোক। তিনি শুভেচ্ছা আর কিছু উপহার পাঠিয়েছেন। মাটিতে ফেলে রাখা পুরোনো জামার হাতায় সেলাই করে লুকিয়ে রাখা একগুচ্ছ পাকানো প্যাপিরাস কাগজ বের করে সে আমার হাতে দিল। পাকানো কাগজটি খুলতে খুলতে তাকে আমি খাবারগুলো খেতে ইশারা করলাম। সে টেবিলে গিয়ে গোগ্রাসে খেতে শুরু করলো।

কাগজটায় এক নজর দিয়েই আমি বুঝতে পারলাম এটা হাইকসো নৌবহরের বর্তমান সমর পরিকল্পনার একটি অংশ। এছাড়া এটন নীল নদের বদ্বীপে কয়েকটি সম্ভাব্য লক্ষবস্তু নির্দেশ করে দিয়েছে যা, তার বিবেচনায় আমার জন্য ভালো হবে।

এটন যখন এ-ধরনের কাগজ পাঠায় তখন আমি এর সত্যতা নিয়ে মাথা ঘামাই না। কাগজটি আবার পাকিয়ে রাখলাম, পরে খুঁটিয়ে দেখতে হবে।

তুমি কি উপহারের কথা বলেছিলে, বন্ধু?

সে বেশ খুশি মনে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, আমি আপনার জন্য আটচল্লিশটা সংবাদবাহক পায়রা এনেছি। এগুলো আমার জাহাজের খাঁচায় রাখা আছে। এটনের চিঠিটা আবার খুলে আরেকবার পড়লাম।

আমি মৃদুকণ্ঠে বললাম, মোটা লোকটি এখানে লিখেছেন, তিনি আমার জন্য একশোটি পায়রা পাঠিয়েছেন। বাকিগুলোর কী হল?

আমাদের খাবার শেষ হয়ে গিয়েছিল।

তার ধৃষ্টতা দেখে আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, তুমি আমার পাখিগুলো খেয়ে ফেলেছো? তারার চেঁচিয়ে জারাসকে ডাকলাম। সে আসতেই তাকে বললাম, এখুনি এই বদমাশের জাহাজে যাও। সেখানে আটচল্লিশটা কবুতর পাবে। এখুনি এখানে নিয়ে এসো। নইলে এগুলোও রহস্যজনকভাবে গায়েব হয়ে যাবে। জারাস কোনো প্রশ্ন না করে আমার নির্দেশ পালন করতে ছুটে গেল। 

সে আমার দামি মদ আরেক গ্লাস খেয়ে আমাকে অভিবাদন জানিয়ে বললো, চমৎকার মদ। আপনার রুচির প্রশংসা করতে হয়। আমাদের মোটা বন্ধু তার জন্য যথোপযুক্ত উপহার পাঠাতে আপনাকে অনুরোধ করেছেন।

আমি বিষয়টা নিয়ে এক মুহূর্ত ভাবলাম। আমি জানি কুনুসসে রাষ্ট্রদূত তোরানের একটি বড় কবুতরের খাঁচা আছে। কীভাবে এই আমার পাখি পাঠাবো বল। শেয়াল আর হায়েনারা যদি এগুলোও খেয়ে ফেলে?

আমার এই অপমানজনক উক্তি গায়ে না মেখে সে বললো, আপনার কোনো জাহাজে করে আমাকে সাগর পার করিয়ে নীলনদের বদ্বীপের কোনো নির্জন জায়গায় নামিয়ে দিন, আমি নিজ হাতে এগুলো তার কাছে পৌঁছে দেবো।

আমি বললাম, এর চেয়েও ভালো ব্যবস্থা করা যাবে, বন্ধু। এই মুহূর্তে কার্থেজের একটি বাণিজ্যপোত ক্রিমাদ বন্দরে অবস্থান করছে। এর ক্যাপ্টেন গতকাল আমার সাথে নৈশভোজ করেছে। চারদিন পর সে বদ্বীপে হাইকসোদের রোসেটা বন্দর হয়ে কার্থেজে ফিরে যাবে। তুমি নিশ্চয়ই জানো কার্থেজের সুলতান আর রাজা গোরাবের মধ্যে নিরপেক্ষ সম্পর্ক আছে। আমি তার জাহাজে করে তোমাকে রোসেটা পর্যন্ত পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করে দিতে পারি। তুমি একশো কবুতর সাথে নিয়ে যাবে, এগুলো কুনুসসে ডিম ফুটে বের হয়েছে। ছেড়ে দিলেই এগুলো নিজের বাসায় ফিরে আসার জন্য উদগ্রীব হবে। আর এভাবেই সেই বিশালদেহি লোকটি আর আমি খুব শিঘ্রই পরস্পরের মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ রাখতে পারবো।

আমি জানি এই ব্যবস্থায় তিনি খুব খুশি হবেন। চাই কী আপনারা দুই এক দান বাও খেলাও পত্র বিনিময়ের মাধ্যমে খেলতে পারবেন।

লোকটির এই ধরনের রসিকতায় আমার মনে হল সে সীমা লঙ্ঘন করছে। আর আমার একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়টি তার জানাটা বেশ অনধিকার চর্চা মনে হচ্ছে। এই ধরনের অপরিচিত গুপ্তচরের সঙ্গ আমি খুব একটা পছন্দ করি না। তোরানের কবুতরগুলো এখানে আনার ব্যবস্থা করার জন্য জারাসকে কুমুসস পাঠালাম। আর ইতোমধ্যে আমার বন্ধু মিসর থেকে যে ভগ্নপ্রায় ধাউটি নিয়ে সাগর পার হয়ে এখানে পৌঁছেছিল, তা ক্রিট দ্বীপে অবস্থান করা কোনো হাইকসো গুপ্তচরের চোখে পড়ার আগেই গভীর সাগরে পাঠিয়ে ডুবিয়ে দিলাম। তার সাতজন মাল্লাকে আমার জাহাজের দাঁড় টানার কাজে লাগিয়ে দেওয়া হল।

চারদিন পর রোসেটা হয়ে কার্থেজগামি জাহাজটিতে একশো কুবরসহ বন্ধুকে তুলে দিলাম।

কাৰ্থেজিয় জাহাজটি দক্ষিণ দিগন্তে অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার আগেই আমি এটনকে উপহারের জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে একটি বার্তা লিখে তার পাঠানো কবুতরের পায়ে বেঁধে পাঠালাম। আর বন্ধুর হাতে রোসেটা পর্যন্ত জাহাজে তার জন্য যে উপহার পাঠিয়েছি সেকথাও জানালাম। সবশেষে বাও খেলার প্রথম চাল-পশ্চিম দুর্গ থেকে আমার সারস পাখি মুক্ত করে দিলাম। এই চালটি এটনকে সবসময় অস্বস্তিতে ফেলে দেয়।

.

পরদিন ভোরে পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠতেই আমি জারাস আর হুইয়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ইডা পর্বতের ঢাল বেয়ে উপরে উঠে আবার কুনুসসের পথে রওয়ানা দিলাম। আমার নির্দেশ মোতাবেক হুই পথের বিভিন্ন জায়গায় নির্দিষ্ট দূরত্বে সরবরাহ চৌকির ব্যবস্থা করেছিল। প্রতি চৌকিতে নতুন ঘোড়াসহ সহিস আমার জন্য অপেক্ষা করে থাকবে। ব্যবস্থাটি বেশ চমৎকার ছিল।

ওর লোকেরা একটু পর পর সারা পথে গাছের গায়ে ব্রোঞ্জের গজাল মেরে দূরত্ব নির্দেশক রেখেছিল। এতে আমার নিজের অবস্থান সম্পর্কে কোনো সন্দেহ রইল না আর চলার গতিও কমাতে হয় নি। এক একটি চৌকির কাছাকাছি পৌঁছেই আমি শিঙ্গা ফুকে সহিসদের আমার আগমনের আগাম সংকেত দিতাম। তারপর সেখানে পৌঁছেই দেখতাম ওরা নতুন ঘোড়ায় জিন পরিয়ে অপেক্ষা করে রইছে। আমি একটু থেমে পানি মেশানো কয়েক ঢোক মদ খেয়েই নতুন ঘোড়ায় চড়ে সাথে সাথে রওয়ানা দিতাম। সহিস আমার হাতে মাংস আর পেঁয়াজের কাবাব খুঁজে দিতেই তা চিবোতে চিবোতে এগিয়ে চলতাম।

একটু পর যে ক্রীতদাসটি আমার জন্য জীবন দিয়েছিল, সদ্য খোঁড়া তার সমাধির কাছে এসে রাশ টেনে ধরলাম।

প্রার্থনা করে বললাম, শান্তিতে ঘুমাও ওয়াগা। আমি জানি আবার কোথাও আমাদের দেখা হবে। তখন আমি তোমাকে আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবো। তারপর হাত মুঠো করে তাকে অভিবাদন জানিয়ে ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে পাহাড়ের পেছন দিকের ঢাল বেয়ে কুনুসস বন্দরের দিকে ফিরে চললাম।

আমার রাষ্ট্রদূতের নতুন অট্টালিকার পেছনে আস্তাবলে পৌঁছে বিকেলের সূর্যের দিকে তাকিয়ে ক্রিমাদ থেকে এখানে পৌঁছার সময় মাপলাম।

সন্তুষ্ট হয়ে আপন মনে বললাম, দ্বীপটি পার হতে ছয় ঘন্টা লেগেছে। দীর্ঘ যাত্রার পর ক্লান্ত হলেও সোজা গ্রন্থাগারে গিয়ে লেখার টেবিলে গিয়ে বসলাম। সেখানে অনেক পাকানো প্যাপিরাস কাগজ আমার মনোযোগর জন্য রাখা হয়েছিল। বেশিরভাগই ছিল রাষ্ট্রদূত তোরানের কাছ থেকে আসা পত্র।

নৈশভোজ করার আগে একজন ক্রীতদাসের হাতে চিঠির উত্তরগুলো দিয়ে রাজপ্রাসাদের কাছে তোরানের বাড়িতে পৌঁছে দেবার জন্য পাঠালাম। খাওয়াদাওয়ার পর শোবার কামরায় গেলাম।

সে রাতে আবার স্বপ্নে ইনানাকে দেখলাম। আমার শোবার ঘরের বাইরে বারান্দায় সে দাঁড়িয়ে রয়েছে। মাথা ঢাকা ঘোমটা আর আলখাল্লা চাঁদের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে রয়েছে, তবে মুখ দেখা গেল না। আমি উঠে তার কাছে যেতে চেষ্টা করলাম, কিন্তু আমার সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ শীসার মতো ভারী হয়ে রয়েছে আর নড়াচড়াও করতে পারছি না। কথা বলার চেষ্টা করলাম, তবে জিহ্বা থেকে কোনো শব্দ বের হল না। তবে এতে তেমন উদ্বিগ্ন হলাম না। বরং অনুভব করলাম আমার উপর সে তার করুণা ঢেলে দিয়েছে আর তার দৈব শক্তি আমাকে একটি ঢালের মতো ঢেকে রেখেছে। নিশ্চিন্ত হয়ে আমি ঘুমিয়ে পড়লাম।

পরদিন ভোরের আগেই তরতাজা হয়ে ঘুম থেকে উঠলাম। তারপর গতরাতের স্বপ্নের কথা মনে পড়তেই মনটা খারাপ হয়ে গেল ভেবে যে এটা সত্যি ছিল না।

নগ্ন অবস্থায় কামরা থেকে বের হয়ে বারান্দায় গিয়ে বুক ভরে সাগর থেকে ভেসে আসা তাজা বাতাস টেনে নিলাম।

সামনে ক্রোনাস পর্বতের দিকে তাকিয়ে দেখলাম দেবতা আবার শান্তরূপ ধারণ করেছেন। একবার কালো ধূঁয়া বের হতেই মৃদু হাসলাম। তবে এখন এসব ভেবে নষ্ট করার মতো সময় হাতে নেই। কেননা আমি পরিকল্পনা করেছিলাম নীল নদীর বদ্বীপের উত্তর উপকূল জুড়ে হাইকসো অবস্থানে আগামী দশদিনের মধ্যে প্রথম হামলা চালাবো।

ঘুরে শোবার ঘরের দরজার কাছে পৌঁছতেই পায়ে নরম কোনো কিছুর সাথে ধাক্কা লাগলো। জিনিসটা কী দেখার জন্য নিচের দিকে তাকালাম। তারপর ঝুঁকে জিনিসটা হাতে তুলে নিয়ে একটু কৌতূহল নিয়ে পরীক্ষা করতে শুরু করলাম।

অবাক হয়ে চেয়ে দেখলাম এটা একটা লিলি ফুল। তবে এরকম ফুল আমি কখনও দেখিনি। একটা বড় পানপাত্রের সমান আকার। পাপড়িগুলো সোনালি আর নিচের দিকে সিঁদুরে রঙের। পুংকেশরগুলো গজদন্তের মতো সাদা আর ডগাগুলো নীলকান্ত মণির মতো নীল।

ফুলটি এমন সুন্দর আর টাটকা যে বোঁটা থেকে তখনও স্বচ্ছ রস ঝরে পড়ছিল। দু আঙুলে ধরে ধীরে ধীরে ঘুরাতে ঘুরাতে এর সুগন্ধ পেলাম। গন্ধটা এতে পরিচিত যে এটা মনে হতেই আমার ঘাড়ের পেছনে কাঁটা দিয়ে উঠলো।

এটি ছিল ইনানা দেবীর সুগন্ধ; ফুলের দেবী ইশতারের সুগন্ধ। যার প্রতীক হচ্ছে লিলি ফুল।

ফিসফিস করে বললাম, এটা স্বপ্ন নয়। সে সত্যিই এসেছেল।

ফুলটা ঠোঁটের কাছে তুলে নিয়ে চুমু খেলাম। সাথে সাথে অনুভব করলাম ফুলটি শুকিয়ে যাচ্ছে; পাপড়িগুলো কুঁকড়ে যাচ্ছে। রঙ ফ্যাকাশে হয়ে মলিন বাদামি হয়ে যাচ্ছে। তারপর পাপড়িগুলো গুঁড়িগুড়ি হয়ে ধূলোর মতো আমার আঙুলের ফাঁক গলে নিচের দিকে ভাসতে ভাসতে বারান্দার মেঝেতে ছড়িয়ে পড়লো। ভোরের মৃদু বাতাসে উড়ে গেল।

মনে হল লিলি ফুলটির মধ্য দিয়ে দেবীর সত্তা আমার দেহে চলে এসে আমাকে নববলে বলিয়ান করে তুলেছে।

.

বারান্দায় চামড়ার বালতিতে পরিচারকেরা গরম পানি রেখে গিয়েছিল। সেই পানিতে স্নান সেরে নাবিকদের একটা নীল জামা পরে গ্রন্থাগারের দিকে চললাম।

গতরাতে দরজাটা একটু ফাঁক রেখে গিয়েছিলাম। দরজা ঠেলে ভেতরে পা দিতেই আতঙ্কে সেখানেই জমে গেলাম। আমার দিকে পেছন ফিরে আপাদমস্তক আলখাল্লায় ঢাকা একটি নারী মূর্তি জানালার কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

ফিস ফিস করে বললাম, ইনানা! আর তখনই সে দ্রুত ঘুরে আমার পায়ের কাছে এসে নতজানু হয়ে বসে আমার হাতে চুমু খেল।

মাথা ঢাকা কাপড়টা ঠেলে ফেলে দিয়ে সে বলে উঠলো, প্রভু তায়তা! আপনাকে দেখে কি ভালো লাগছে। আপনার কথা খুব মনে পড়তো। আমরা সবাই আপনার অভাব অনুভব করেছি।

আমি বিস্ময়ে বলে উঠলাম, লক্সিয়াস, তুমি! আমি মনে করেছিলাম অন্য কেউ। কী করে আমাকে খুঁজে পেলে?

আমি আমার বন্ধু প্রভু তোরানকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তিনিই জানালেন আপনি এখানে আছেন।

তাকে ধরে তুলে দাঁড় করিয়ে কৌচের দিকে নিয়ে গেলাম। তাকে বসিয়ে লেখার টেবিলে পিতলের ঘন্টা বাজাতেই রান্নাঘর থেকে তিনজন ক্রীতদাস সিঁড়ি বেয়ে ছুটে এলো।

ওদেরকে নির্দেশ দিলাম, খাবার নিয়ে আস।

বড় থালায় ক্রীতদাসেরা সিদ্ধ ডিম, শুকনো মাছ, মাংসের বড়া আর শক্ত রুটি রেখে গেল। আমরা দুজনে মুখোমুখি বসে খেতে শুরু করলাম।

এখানে তোমার আসাটা নিরাপদ তো? আমি ভেবেছিলাম তেহুতি আর বেকাথার মতো তোমাকেও হেরেমে বন্দী করে রাখা হয়েছে।

সে মাথা নেড়ে বললো, না! ঐ খাণ্ডারি মেয়েগুলো আমাকে নিচুজাতের ক্রীতদাসি মনে করে। ওরা আমাকে আমার ইচ্ছামতো ভিতরবাহির আসা যাওয়া করতে দেয়।

তাহলে ক্রীতদাসির জীবন তোমার জন্য ভালোই হয়েছে, লক্সিয়াস। তবে আগের চেয়ে দেখতে সুন্দর হয়েছে।

সে লজ্জা পেয়ে বললো, আপনি খুব মন জুগিয়ে কথা বলতে পারেন তায়তা।

আমার অন্য মেয়েদের কথা বল। ওরা কি তোমার মতো খুশি আছে?

ওরা দুজনেই ভীষণ একঘেয়েমিতে ভুগছে। আপনার কাছ থেকে একটি গল্প শোনার জন্য উদগ্রীব হয়ে রয়েছে।

আমি একটু কৌশল করে বললাম, কেন, ওদের নতুন স্বামী কি ওদের সঙ্গ দেন না?

সে হেসে বললো, আপনি সেই টিনের মাথাওয়ালা বুড়ো সর্বাধিরাজ মিনোজের কথা বলছেন? আমরা তার এই নাম দিয়েছি, তবে সে যদি শুনতে পায় তবে নিশ্চয়ই আমাদের কল্লা কেটে নেবে। বিয়ের অনুষ্ঠানের পর তেহুতি কিংবা বেকাথা কেউ তাকে আর দেখেনি। হেরেমে আমাদের নতুন বন্ধুরাও কেউ তাকে বিয়ের পর একবারও দেখেনি। অনেকে বিশ বছরের বেশি সেখানে থাকার পরও তাকে কোনোদিন দেখেনি। আসলে কেউ তাকে সেই টিনের মাথা ছাড়া দেখেনি।

আমি প্রতিবাদ জানিয়ে বললাম, বুঝলাম না। তার স্ত্রীদের কারও সাথে কি রাজার দৈহিক সম্পর্ক হয়নি? তুমি কি আমাকে একথা বলতে চাচ্ছো?

লক্সিয়াস বেশ কিছুদিন থেকেই রাষ্ট্রদূত তোরানের সাথে মেলামেশা করছে, কাজেই আমার কথার মানে বুঝতে তার খুব একটা অসুবিধা হল না। সে লজ্জিত হয়ে চোখ নামিয়ে বললো, কিছু দিন পর পর মিনোজ প্রহরীদের দিয়ে তার কয়েকজন স্ত্রীকে ডেকে পাঠান। তবে একবার হেরেম ছেড়ে যাওয়ার পর ওরা আর ফিরে আসে না।

আমি হতবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কী হয় ওদের?

প্রহরীরা বলে ওদেরকে দেবতার পছন্দের সারীতে উন্নিত করা হয়। তারপর ওদেরকে পর্বতের উচ্চ মন্দিরে পাঠান হয়।

আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লক্সিয়াসকে আরও প্রশ্ন করলাম, তবে মনে হল সে এর বেশি কিছু জানে না। তাছাড়া উচ্চ মন্দিরের অবস্থান সম্পর্কেও তার খুব একটা আগ্রহ নেই। সে বারবার প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে জারাস আর হুই কেমন আছে, কোথায় আছে এসব জানতে চাচ্ছিল। আমি জানি রাজকুমারীদের নির্দেশেই সে এই তথ্যগুলো জানতে চাচ্ছিল।

আর আমিও বারবার সর্বাধিরাজ মিনোজের অগণিত স্ত্রীদের দিকে আলাপ ঘুরিয়ে নিতে থাকলাম।

আবার তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমরা হেরেমে যাওয়ার পর থেকে কতজন বধূ দেবতার প্রিয় হয়েছেন?

সে একমুহূর্ত ইতস্তত না করে উত্তর দিল, চল্লিশজন। আমি অবাক হয়ে গেলাম তার এই নিশ্চিত উত্তর আর সংখ্যাটি শুনে।

তার মানে তুমি আর রাজকুমারীরা হেরেমে যাওয়ার পর প্রায় প্রতিদিন একজন করে স্ত্রীকে নেওয়া হত?

না না তায়তা। চল্লিশজন একইসময়ে হেরেম ছেড়ে যায়। ওরা চুলে ফুল খুঁজে নাচতে নাচতে আর গাইতে গাইতে চলে যায়।

এবার আমি একটু সরস মন্তব্য না করে পারলাম না, তাহলে সর্বাধিরাজ মিনোজ বেশ ব্যস্ত রাতই কাটিয়েছেন। তুমি নিশ্চিত যে এই চল্লিশজনের কেউ আর হেরেমে ফিরে আসেনি?

লক্সিয়াস চেহারা যতদূর সম্ভব নির্বিকার রাখার চেষ্টা করছিল, তবে তার চোখে হাসির ঝিলিক দেখা যাচ্ছিল। সে বললো, আমি পুরোপুরি নিশ্চিত। রাজপ্রাসাদের আমাদের অংশে যা যা ঘটে তা সব আমরা জানি।

আমি তার উত্তরটা শুনে কিছুক্ষণ ভাবলাম। আমার একধরনের অস্বস্তিকর অনুভূতি হচ্ছিল, মনে হচ্ছিল গুরুত্বপূর্ণ কোনো একটা বিষয় আমার নজর এড়িয়ে যাচ্ছে।

তারপর আবার বললাম, চল্লিশজন স্ত্রী একসাথে গেল কিন্তু একজনও ফিরে এল না।

লক্সিয়াস মুখ ভার করে বললো, একথাটা একবার কিন্তু বলেছি তায়তা। তেহুতি জানতে চায় জারাস এখন কোথায় আছে। ক্রিমাদে আছে নাকি জাহাজে দায়িত্ব পালন করছে? সে তাকে একটি উপহার পাঠাতে চায়। আপনি কি সেটা নিয়ে যাবেন? আমি তার প্রশ্ন উপেক্ষা করলাম। এখন আমি তার কথার প্যাঁচে পড়তে চাই না।

এবার তাকে জিজ্ঞেস করলাম, বধূরা কখন হেরেম ছেড়ে গিয়েছিল?

লক্সিয়াস অধৈর্য হয়ে বললো, যেদিন ভূমিকম্প হয় সেদিন দুপুরবেলা ওরা হেরেম থেকে চলে যায়। একথা কি আগে বলিনি?

আমি তার দিকে তাকিয়ে রইলাম, কথার মারপ্যাঁচের সাথে তাল মিলিয়ে মনে দ্রুত চিন্তা চলছিল। বললাম, তাহলে তুমি বলতে চাচ্ছো টিনের মাথা ওয়ালা ভূমিকম্পের মধ্যেই চল্লিশজন কুমারীর সাথে দুষ্টামি করতে চাচ্ছিল?

সে খিলখিল করে হেসে বললো, তাই তো মনে হচ্ছে। ইশ দেখতে পেলে কী মজা হত তাই না? তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললো, আমার এখুনি ফিরে যাওয়া উচিত, নয়তো ঐ উগ্রচণ্ডা প্রহরীরা আমাকে প্রাসাদে ঢুকতে দেবে না। মেয়েদেরকে কিছু বলবো?

ওদেরকে বল আমি পৃথিবীর আর সবকিছুর চেয়ে ওদেরকে ভালোবাসি।

সে মুখ ভার করে বললো, আর আমি?

বেশি লোভ করা না লক্সিয়াস। তুমিতো ইতোমধ্যেই একজন বুড়ো মানুষকে পেয়েছে, যে তোমাকে ভালোবাসে।

সে প্রতিবাদ করে বললো, তিনি এতো বুড়ো নন। তার বয়স খুব বেশি। আর তিনি অনেক ধনী। দেখবেন একদিন তিনি ঠিক আমাকে বিয়ে করবেন।

সে চলে যাবার পর আমি বারান্দায় বসে সে যা যা বলেছে সেগুলো নিয়ে ভাবতে লাগলাম। খুব একটা মাথামুণ্ডু অর্থ খুঁজে পেলাম না, তবে মনে হচ্ছিল মারাত্মক কিছু একটা ঘটতে চলেছে।

আমার এখন ক্রিমাদে ফিরে গিয়ে জারাস আর হুইয়ের সাথে যুদ্ধের পরিকল্পনা নিয়ে পরামর্শ করা দরকার। তবে তার আগে রাষ্ট্রদূত তোরানের কবুতরের খাঁচায় গিয়ে দেখতে হবে থিবসে এটনের কাছে আমাদের বন্ধু যে কবুতরগুলো নিয়ে গিয়েছিল, তার কোনো একটা ফিরতি ডাক নিয়ে এসেছে কিনা।

.

সেনাপতির কামরায় আমি যখন নৌবাহিনী প্রধান এডমিরাল হেরাকল আর ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনায় ব্যস্ত ছিলাম, তখন কামরার বন্ধ দরজার বাইরে শোরগোল শোনা গেল।

হেরাকল বিরক্ত হয়ে যাড়ের মতো চেঁচিয়ে উঠলো, কী ব্যাপার? আমি তো নির্দেশ দিয়েছিলাম এখানে কোনো ধরনের ব্যাঘাত করা যাবে না!

প্রহরীদলের অধিনায়ক পলিশকরা সেডার কাঠের দরজা খুলে ভেতরে এসে মাথা ঝুঁকিয়ে অভিবাদন করে ক্ষমা চেয়ে বললো, সম্মানিত মন্ত্রণাপরিষদ-সদস্য প্রভু তোরান একটি বার্তা পাঠিয়েছেন। তিনি বলেছেন এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, অবিলম্বে বার্তাটি যেন মিসরীয় প্রভু তায়তার হাতে পৌঁছান হয়।

হেরাকল আমার দিকে হতাশার চোখে তাকিয়ে দুই হাত দুই দিকে ছড়িয়ে দিয়ে বললো, আসতে দাও বুদ্ধ লোকটাকে। ওদের সকলকে আসতে দাও! আর সবাই যখন ইচ্ছা তখন আমার নির্দেশ অমান্য কর।

হেরাকলের রোষ থেকে লোকটিকে রক্ষা করতে আমি দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, মাননীয় এডমিরাল, আমি এ-বিষয়ের সম্পূর্ণ দায় দায়িত্ব নিচ্ছি। মিসরে আমার সূত্র থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বার্তা আসার কথা ছিল।

আমরা আপনার সুবিধামতো অপেক্ষা করবো, সম্মানিত তায়তা। একথা বলে হেরাকল গজগজ করতে করতে তার আসন থেকে উঠে জানালার কাছে গিয়ে উপসাগরের ওপারে ক্রোনাস পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে রইল।

জিনিসটা ছিল আমার কড়ে আঙুলের উপরের গাঁটের সমান প্রায় ওজনহীন একটি পাকানো হলুদ রেশমি কাপড়। ভাঁজ খোলার পর দেখলাম আমার পুরো হাতের সমান লম্বা আর এর উপর ঘনবিন্যস্ত সঙ্কেতলিপি লেখা রয়েছে, যার অর্থ কেবল এটন আর আমার জানা আছে। অন্যান্য যেকোনো লিখিত ভাষার তুলনায় এই সঙ্কেতলিপিতে অনেক সুবিধা রয়েছে। ঠাসাঠাসি করে বার্তা লেখা যায়, এতে লেখকের সুবিধা হয় আর সঠিক অর্থ বুঝাতে অনেক দিক দিয়ে ব্যতিক্রমী ধরনের সুবিধা রয়েছে।

দ্রুত একবার চোখ বুলিয়ে এডমিরালের দিকে তাকিয়ে বললাম, মাননীয় এডমিরাল, চমৎকার খবর এসেছে। আমাদের উভয়ের শত্রুর ঠিক বুকে আঘাত হানার সুযোগ এসেছে। নীল বদ্বীপের পশ্চিম প্রান্তের শূর সমভূমিতে হাইকসো রাজা গোরাব এক হাজার রথসহ একটি পদাতিক বাহিনী সাজিয়েছে।

জানালার দিক থেকে ফিরে উচ্ছ্বসিত হয়ে হেরাকল বললো, আমি ঐ এলাকাটা চিনি! জিন আর ধুয়ারা শহরের মাঝে মধ্যসাগরের তীর জুড়ে এর অবস্থান।

আমি একমত হয়ে বললাম, ঠিক বলেছেন! গত একবছর ধরে আমার ফারাও আর জেনারেল ক্র্যাটাস নীল নদের পশ্চিম তীরে তাদের আক্রমণভাগ সাজিয়েছেন। ওরা উত্তরদিকে মেয়েরিস হ্রদ পর্যন্ত এগিয়েছেন। জিন শহর থেকে দক্ষিণে এর দূরত্ব মাত্র আশি লিগ। তারপর চারকোণা হলুদ রেশমি কাপড়টা টেবিলে বিছিয়ে দিলাম। হেরাকল তার লোকজনসহ এর চারপাশে ঘিরে দাঁড়াল। এটন একপাশে বার্তাটি লিখেছিল। আর অন্যপাশে উত্তর মিসরের একটি বিস্তৃত মানচিত্র এঁকেছিল। এতে হাইকসো আর মিসরীয় বাহিনীর অবস্থান তুলে ধরা হয়েছিল।

রেশমি মানচিত্রে হাত রেখে আমি বললাম, আমার সূত্র জানিয়েছে গোরাব একটি বড় ধরনের আক্রমণের পরিকল্পনা করেছে। মিসরের পূর্ব সীমান্ত থেকে নেমে এসে কুয়ামে আমাদের রক্ষাকূহ্যের উপর হামলা করার চেষ্টা করবে। এটি একটি চতুর পরিকল্পনা তবে, জিনে যে জায়গায় তার সেনাবাহিনীর সমাবেশ হবে তা সাগর থেকে আক্রমণের ঝুঁকির মুখে পড়ে যাবে। মনে হচ্ছে এরকম একটা সুযোগের জন্য ক্রিমাদে অপেক্ষারত আমাদের সম্মিলিত নৌবহর সম্পর্কে গোরাব এখনও অবহিত নয়।

হেরাকল বললো, আপনি বলছেন গোরাব এক হাজার রথ সাজিয়েছে? তার মানে তার কাছে তিনহাজারেরও বেশি রথ রয়েছে। এই সংখ্যাটি খুব বেশি হয়ে যায়। গোরাব যদি আপনার পরিকল্পনা জানতে পারে, তাহলে আপনি আক্রমণ করার চেষ্টা করলেই সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবেন।

তার কথার উত্তরে আমি রেশমি কাপড়ের টুকরাটির উপর টোকা দিয়ে বললাম, এটা ঠিক যে গোরাব জিন নগরীতে এক হাজার রথের সমাবেশ ঘটিয়েছে। তবে আমার কাছে খবর আছে যে, মোয়েরিস হ্রদে ফারাও আর জেনারেল ক্রাটাসের মুখোমুখি অবস্থান করা মূলবাহিনী থেকে সে এখনও রথীসেনাদেরকে সরিয়ে এখানে আনেনি। তার মানে পাঁচশোরও কম রথীসেনা এই রথগুলোর পাহারায় রয়েছে। তারপর এটনের বার্তা থেকে পড়ে শোনালাম, পাঁচশো সেনা আর তার দ্বিগুণ ঘোড়া।

হেরাকল তার গোঁফ সমান করতে করতে চিন্তিতভাবে বললো, এটা প্রায় আপনার বাহিনীর সমান।

আমার নৌবহর সাগরে ভাসার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত আর গোরাব তার বাকি সেনাদেরকে এখানে আসার আগেই এখন থেকে ছয়দিনের মধ্যে আমরা জিন নগরীতে পৌঁছাতে পারবো। ওরা বুঝে উঠার আগেই জাহাজের পেছন দিক থেকে রথগুলো সৈকতে নামিয়ে ওদের উপর আক্রমণ চালাতে পারবো। অতর্কিত আক্রমণ করা মানে এক হাজার রথিসেনার সমান সুবিধা পাবো।

আমি আপনাকে একটা সরাসরি কথা বলতে চাই প্রভু তায়তা। এই ব্যাপারটা আমার পছন্দ হচ্ছে না। বিষয়টা খুব বেশি পরিপাটি আর একেবারে আকস্মিক মনে হচ্ছে। এখানে একটা ফাঁদের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। যাইহোক সর্বাধিরাজ মিনোজ আপনার উপর পূর্ণ কর্তৃত্ব দিয়েছেন। এই হঠকারী পরিকল্পনার জন্য আমার অনুমোদন নেবার প্রয়াজন নেই।

তাহলে আর কোনো আলোচনার প্রয়োজন নেই, মাননীয় এডমিরাল। আপনার পরামর্শ আর শুভেচ্ছার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। এখন তাহলে আমি যেতে পারি।

আমি একাকী পাহাড়ের পথে জোরে ঘোড়া ছুটিয়ে চললাম। সূর্যাস্তের ঘন্টাখানেক আগে ক্রিমাদ পৌঁছলাম। আস্তাবলে জারাস আর হুইকে পেলাম। ওরা আমাকে অবাক হল, তবে আমি যা পরিকল্পনা করেছি তা শোনার পর খুশিতে ফেটে পড়লো।

হুইকে বললাম, আলো থাকতে থাকতেই ঘোড়াগুলো জাহাজে তুলে ফেল। আর জারাসের দিকে ফিরে বললাম, তুমি যতজন লোক দরকার নাও আর রথের গাড়িগুলো জাহাজে তোলার পর ভালোভাবে রশি দিয়ে বেঁধে নিও। ওরা আমার নির্দেশমতো ওদের লোকজনদেরকে চেঁচিয়ে নির্দেশ দিয়ে ছুটলো।

আমি কবুতরের খোপগুলোর কাছে গেলাম। এটন যে কবুতরগুলো পাঠিয়েছিল সেগুলোর এটা নতুন বাসা। দুটো মোটাসোটা শক্তিশালী গড়নের কবুতর বেছে নিলাম, তারপর দুটোর পায়ে একই ধরনের দুটো বার্তা বেঁধে দিলাম। তারপর একটার পর একটা কবুতরের মাথায় চুমু খেয়ে হাওয়ায় ছুঁড়ে দিলাম। বন্দরের চারদিকে চারবার চক্কর দিয়ে সঠিক দিক ঠিক করার পর কবুতরগুলো দক্ষিণ-দক্ষিণ-পুবে উড়ে অন্ধকারে হারিয়ে গেল। রাতের বেলা ওড়াই ওদের জন্য মঙ্গলজনক। ঈগল আর বাজপাখি রাতের অন্ধকারে শিকার করে না। তবে নিশ্চিত হওয়ার জন্য আমি দুটো বার্তা এটনের জন্য পাঠিয়েছিলাম।

ছয়দিন পর আমাদের জন্য জিনের সৈকতে পথপ্রদর্শক রাখতে আমি তাকে অনুরোধ জানিয়েছি। আমরা সৈকতে অবতরণ করার পর তার লোক আমাদেরকে পথ দেখিয়ে যেখানে রাজা গোরাব তার রথের সমাবেশ করেছে সেখানে নিয়ে যাবে।

মাঝরাতের ঘন্টাখানেক আগে আমাদের ছয়টি যুদ্ধজাহাজের নৌবহর বন্দর ত্যাগ করলো। গভীর সমুদ্রে ঢোকার সাথে সাথে আমরা দক্ষিণমুখি হয়ে মিসর আর জিন উপসাগরের দিকে চলতে শুরু করলাম।

ভোরের একটু আগে অন্ধকারে জলদস্যু সর্দার নাকাতির নেতৃত্বে বারোটি যুদ্ধ জাহাজ আমাদের নজর এড়িয়ে পাশ কাটিয়ে উল্টোদিকে গেল। নাকাতি তার নিজের জাহাজ শান্তির কপোতে চড়ে দ্রুত ক্রিমাদের দিকে যাচ্ছিল। আমি যে খুশিমনে আমার ক্ষুদ্র নৌবহর নিয়ে বিশ্বাসঘাতকতা আর বিপদের মুখে চলেছি, সে সম্পর্কে আমাকে সাবধান করতে সে ক্রিমাদের দিকে দ্রুত ছুটছিল।

ভোরের কয়েকঘন্টা পর ক্রিমাদ বন্দরে পৌঁছে নাকাতি দেখলো আমরা কেউ সেখানে নেই। তবে আমি আহত আর অসুস্থ পাঁচজন সৈন্যকে বন্দরে রেখে গিয়েছিলাম। সিডন থেকে সুমেরিয়া জাহাজে আসার সময় আমি যখন নাকাতির শান্তির কপোত জাহাজটি কজা করে তাকে শিকলে বেঁধে বৈঠা বাওয়ার কাজে লাগিয়েছিলাম, তখন এই আহত লোকগুলো আমার সাথে ছিল। আবার যখন নাকাতিকে শৃঙ্খলমুক্ত করে তার জাহাজ তাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম তখনও এরা সেখানে উপস্থিত ছিল। কাজেই ওরা জানতো নাকাতি আমাদেরই একজন হয়েছে, তাই কোনো ইতস্তত না করে ওরা তাকে জানালো আমি কোথায়, কী উদ্দেশ্যে জিনের দিকে গিয়েছি।

বন্দরে আমার গুদাম থেকে পানি আর রসদ সংগ্রহ করে পরদিন ভোরের তিনঘন্টা পর নাকাতি আবার নৌবহর পানিতে ভাসালো। এবার সে আমাকে খুঁজতে বেড়িয়েছে। তবে আমি তার আট ঘন্টা আগে বন্দর থেকে জাহাজ নিয়ে বের হয়েছি।

আমার অবশ্য জানার কথা নয় যে নাকাতি দ্রুত গতিতে আমাকে অনুসরণ করছে। বরং তাকে ছেড়ে দেবার পর থেকে তার কোনো খবর এযাবত আমি পাই নি। এখন ঐ সিদ্ধান্ত নেবার জন্য অনুতাপ করছিলাম। আমি বিশ্বাস করতে শুরু করছিলাম যে, সে আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে আবার জলদস্যুদের সর্দারের ভূমিকায় ফিরে গেছে। আর তার সাথে আমার দেখা হবে না।

পরে অবশ্য আমি জানতে পেরেছিলাম, নাকাতির সাথে আমার যে চুক্তি হয়েছিল সে অনুযায়ীই সে কাজ করেছিল। এতোদিন যাবত সে সাগরের জলদস্যুদের মধ্য থেকে তার জাহাজের জন্য নাবিক সংগ্রহের কাজে ব্যস্ত ছিল।

আমার ধারণা ছিল সাগরের জলদস্যুরা বিশৃঙ্খল হয়; আধুনিক নৌবাহিনীর মতো ওদের মাঝে কোনো সংগঠন আর কাঠামোগত প্রক্রিয়া নেই। আমি এটা খেয়াল করিনি যে সাগরের জলদস্যুদের মাঝেও অনেক প্রশিক্ষিত এবং রণকুশল নাবিক রয়েছে। পরিস্থিতির কারণে ওরা দলত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিল। ওদের একটি বিশাল আর সুসংগঠিত গোয়েন্দাবিভাগ রয়েছে যা, আমার পুরোনো বন্ধু এটনের গোয়েন্দা বিভাগের চেয়েও অনেক কর্মদক্ষ। এটনের লোকদের মাঝেও তার নিজের লোক ছিল, তবে মেমফিসে হাইকসো সদরদপ্তরেও সে গুপ্তচর নিযুক্ত করেছিল। আমার কোনো সন্দেহ নেই যে আমার গোয়েন্দা বিভাগেও সে তোক ঢুকিয়েছে। এইসব সূত্র থেকেই সে এটন আর আমার মধ্যেকার বার্তা বিনিময়ের বিষয় জেনেছে। সে জানতো যে আমি জিনে হাইকসো রথের সমাবেশে হামলা করতে যাচ্ছি আর এও জানতে যে হাইকসোরাও আমার উদ্দেশ্য সম্পর্কে সচেতন। তবে কী ঘটতে চলেছে তা জানাবার জন্য তার কাছে আমাকে পাঠাবার মতো কোনো বার্তাবাহক কবুতর ছিল না। তাই এই বিপদ থেকে আমাকে উদ্ধার করার জন্য সে নিজেই চলে এসেছিল, তবে তার আসতে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল।

.

ক্রিমাদ ছেড়ে আসার পর পঞ্চম দিনে সূর্য উঠার এক ঘন্টা আগে আমরা আফ্রিকার উপকূলে জাহাজ ভেড়ালাম। আমি ইচ্ছা করেই একটু পশ্চিম দিকে সরে জাহাজ চলার পথ বেছে নিয়েছিলাম। এমন কোনো নাবিক জীবিত নেই যে ডাঙা না দেখে পাঁচদিন জাহাজ চালিয়ে জিন উপসাগরের মতো একটি নির্দিষ্ট গন্তব্যস্থলে সঠিকভাবে পৌঁছতে পারে। উপসাগরের পূর্বদিকে জাহাজ ভেড়ানো আমার জন্য বিপজ্জনক ছিল। নীলনদের বদ্বীপের কাছে উপকূল জুড়ে ঘন জনবসতি রয়েছে। দিগন্তের উপরে পৌঁছার সাথে সাথে আমরা মানুষের চোখে ধরা পড়ে যেতাম। সোজা পথে জিন উপসাগরের দিকে যেতে না পারায় একটু পশ্চিম দিক ঘেঁসে যাওয়াটাই নিরাপদ ছিল। পশ্চিম উপকূলে ছিল সাহারা, এখানে বসবাস করতো খুবই কম সংখ্যক কিছু ভবঘুরে বেদুঈন।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল ডাঙা দেখার সাথে সাথে আমি আমার পথের নিশানা সম্পর্কে সম্পূর্ণ নিশ্চিত হলাম। কোনো ইতস্তত না করে আমি আমার নৌ-বহর ঘুরিয়ে পাল তুলে মরুভূমি ঘেঁসে চলার নির্দেশ দিলাম। তীরের সমান্তরাল হয়ে পাল তুলে তিন ঘন্টা ভেসে চলার পর বুঝা গেল আমার ইচ্ছাকৃত ভুলটি একটু বেশি হয়ে গেছে। প্রথমে এতে বেশ উদ্বিগ্ন হয়েছিলাম, তবে পরবর্তীতে এটা সুফল বয়ে এনেছিল। এতে সময় অপচয়ের ফলে নাকাতির আমার সাথে দেখা হওয়ার যে বিলম্ব ঘটেছিল, তা পূরণ করার সুযোগ হয়।

অবশেষে আমরা জিন উপসাগরের মোহনায় এলাম। উত্তর দিক থেকে আসার পথে তীরভূমি ঢেকে রাখা সুস্পষ্ট অন্তরীপটি দেখেই এটা চিনতে পারলাম। নির্দেশ দিলাম বাতাসের গতিপথ আর পালের অবস্থান অনুযায়ী জাহাজের গতিপথ নির্ধারণ করে পর্যায়ক্রমে জাহাজ চালাতে। এভাবে চলে তারপর আমরা প্রবেশপথ দিয়ে উপসাগরে ঢুকলাম।

হাইকসোরা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। অন্তরীপের মাঝখানে দিয়ে জীন উপসাগরে ঢুকতেই ওরা দলবেঁধে আমাদের দিকে তেড়ে এলো। ওরা নিশ্চয়ই উপসাগরের তীর আর নীল নদীর বদ্বীপের একশো লিগ এলাকা জুড়ে ভাসমান সবধরনের জলযান মোতায়েন করে রেখেছিল। চারকোণা পালের ছোট জাহাজ থেকে শুরু করে বিশাল তিনতলা জাহাজ নিয়ে ওরা আমাদের নৌবহরের উপর আক্রমণ করলো। কাছের জলযানগুলো পেছনের জাহাজকে ঢেকে রেখেছিল আর ছোটগুলো বড় জাহাজের আড়ালে ছিল। তবে দ্রুত একবার হিসাব করে আমি দেখলাম, আমাদের ছয়টি জাহাজের বিপরীতে ওদের প্রায় বিশটি জাহাজ ছিল।

সবকটি জাহাজের ডেকে অস্ত্রসজ্জিত লোক দাঁড়িয়ে রয়েছে। সূর্যের আলোয় তাদের শিরস্ত্রাণ, তরবারির ফলা আর বর্মগুলো ঝিকমিক করছে। আমাদের কাছাকাছি আসতেই তাদের রণহুঙ্কার আর যুদ্ধের আহ্বান পরিষ্কার বাতাসে ভেসে আসছে।

আমাদের পেছন দিকের উন্মুক্ত সাগর থেকে ভোরের বাতাস প্রবেশপথ দিয়ে উপসাগরে ঢুকে হাইকসোদের মুখোমুখি বয়ে যাচ্ছিল। এতে আমরা জাহাজের মুখ ঘুরিয়ে যে পথ দিয়ে এসেছিলাম সেদিক দিয়ে পালাবার পথও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।

অন্যদিকে হাইকসোদের জাহাজগুলো বাতাসের মুখোমুখি হয়ে সরাসরি আমাদের দিকে ধেয়ে আসছিল। ওরা অবশ্য সঠিকভাবে জাহাজের দিক নির্দেশনা করতে পারছিল না, বৃথা সময় নষ্ট করছিল। আর এদিকে অনুকূল বাতাসে পাল ফুলে গিয়ে আমাদের ছয়টি জাহাজ দ্রুত গতিতে সামনের দিকে ধেয়ে চলছিল। দশবারো বার দাঁড় বাইতেই আমরা পুরোপুরি আক্রমণের গতি অর্জন করলাম।

আমি দেখতে পাচ্ছিলাম যে, শত্রুদের জাহাজের ডেকে লোকজন এতো ঘেঁসাঘেসি করে দাঁড়িয়ে রয়েছে যে, ওদের তীরন্দাজরা মানুষের শরীর আর বর্মের চাপে পড়ে ঠিকমতো ধনুকের ছিলা টানতে পারছিল না। এদিকে জারাস, হুই, আকেমি আর দিলবারসহ আমার অন্যান্য জাহাজের ক্যাপ্টেনরা, তাদের জাহাজগুলোতে কম লোক থাকার সুবিধাটি কাজে লাগাতে পারছিল। তবে উপসাগরের অন্তরীপ ঢোকার আগেই আমাদের তীরন্দাজরা যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত ছিল। ওরা ধনুকের গুণ টেনে তীর ধনুকের গায়ে ঠেকিয়ে রেখেছিল। শত্রু আর আমাদের অগ্রগামী জাহাজের মধ্যের দূরত্ব লম্বা পাল্লায় তীর ছোঁড়ার আওতায় আসতেই জারাস তীর ছোঁড়ার নির্দেশ দিল। আমাদের মাথার উপর দিয়ে বয়ে আসা অনুকূল বাতাস আমাদেরকে সাহায্য করলো। এতে আমরা একশো গজের সুবিধা পেলাম। হাইকসোরা তাদের ধনুক উঁচু করার আগেই আমাদের তীরন্দাজরা দশবার তীর ছুঁড়তে পারলো।

পিঙ্গল বর্ণের তীরের মেঘে তাদের ডেক ছেয়ে গেল আর বিপুল সংখ্যায় মানুষ হতাহত হল। আহতদের আতকারের সাথে মিশে তীরের আঘাতের থাপ থাপ শব্দ শোনা যাচ্ছে।

শত্রুর বিশাল তিনতলা জাহাজটি আমাদের বহরের যেকোনো জাহাজের প্রায় দেড়গুণ বড় ছিল। তবে এই ধরনের বিরূপ হাওয়ার পরিস্থিতিতে এর বিশাল আকার সুবিধার বদলে একটি বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রবল বাতাসের সামনে এর খেসারত দিচ্ছে। এর বিশাল বিপজ্জনক ব্রোঞ্জের ডগাটি আর আমাদের দিকে মুখ করে নেই। বরং তিনতলা দাড়ির ডেকসহ এর কাঠামোর চওড়া দিকটি আমাদের দিকে উন্মুক্ত হয়ে রয়েছে।

জারাসকে বললাম, এটা ঘুরতেই এর গায়ে গোত্তা মারো। সে এক লাফ দিয়ে আমার নির্দেশ পালন করতে গেল। ঢাকিরা দ্রুত লয়ে আক্রমণাত্মক গতিতে ঢাক পিটাতে লাগলো। দাঁড়ি বেঞ্চে বসা আমাদের দাড়িরা ছিল তরতাজা আর অধীর আগ্রহে এরকম আক্রমণের জন্য অপেক্ষা করছিল। ওরা প্রাণপণে দাঁড় বাইতে লাগলো। হাওয়ার ধাক্কার সাথে বৈঠার গতি মিলে আমার নির্মম জাহাজটি সজোরে সামনের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়লো। আমি জারাসকে নানারকম নির্দেশ দিতে লাগলাম যাতে আমাদের জাহাজের মাথায় স্থাপিত ব্রোঞ্জের তীক্ষ্ণ ডগাটি শত্রুর তিনতলা জাহাজের সবচেয়ে দুর্বল দিকে মুখ করে থাকে।

আমাদের জাহাজ আর আমাদের লক্ষবস্তর মাঝখানে হাইকসোদের ছোট ছোট একতলা জলযানগুলোকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে তিনতলা জাহাজটিকে তা দেওয়ার আগে জারাস চিৎকার করে বলে উঠলো, বৈঠা হাতে নাও! আমাদের দাঁড়িরা জোরে দাঁড় বেয়ে চললো আর প্রচণ্ড শব্দে আমাদের জাহাজের ঈগলের মতো বাঁকা এবং তীক্ষ্ণ ঠোঁট শত্রুর তিনতলা জাহাজটির গায়ে আঘাত হেনে এক পাশ দিয়ে অপর জাহাজটির উপরে চড়ে বসলো। মানুষের আর্তচিৎকারের সাথে কাঠের তক্তা আর ভেঙে চুরমার হয়ে যাওয়া দাঁড়ের শব্দ মিশে গেল। জাহাজের দুটি মাস্তুলই ভেঙে ডেকের উপর পড়ে গেল। জাহাজটি একদিকে কাত হয়ে পড়লো। খোলা দাঁড়ের ছিদ্র দিয়ে পানি ঢুকতে শুরু করেছে। বেঞ্চে শিকলে বাঁধা ক্রীতদাসেরা সঙ্গে সঙ্গে পানিতে ডুবে মরলো। আর উপরের ডেকের যোদ্ধারা জাহাজের কাঠামো উল্টে যেতেই সবাই পানিতে পড়ে গেল।

প্রচণ্ড সংঘর্ষের ধাক্কায় জারাস আর আমি আমাদের জাহাজের ডেকে পড়ে গেলাম। আমাদের জাহাজটি পানিতে থেমে পড়েছিল, আমরা উঠে দাঁড়াতেই চতুর্দিক থেকে ছোট ছোট হাইকসো জলযানগুলো আমাদেরকে ঘিরে জাহাজের পাশে দড়ি বাঁধা লোহার আঁকশি ছুঁড়ে মারতে লাগলো। এক পাল নেকড়ের মতো চিৎকার করতে করতে শত্রু সেনারা আমাদের জাহাজের ডেকে উঠে পড়লো। দুইপাশ দিয়ে এসে কুড়াল আর তরবারি হাতে ওরা আমাদেরকে ঘিরে ফেললো।

জারাস, আমি আর ডেকের অন্যান্য কর্মকর্তারা পরস্পরের পিঠে পিঠ ঠেকিয়ে একটি বৃত্ত রচনা করে দাঁড়ালাম। অসিচালনায় সবাই সুদক্ষ ছিল আর অনেকবার আমরা একসাথে লড়াই করেছিলাম। আমরা সহজেই হাইকসো আক্রমণকারীদের পরাস্ত করলাম। তবে ওদেরকে মেরে ফেলতেই আরও একদল হাইকসো শত্রু দুই পাশ দিয়ে উঠে এল।

আমার পায়ের নিচে ডেকের মেঝে রক্তে পিচ্ছিল হয়ে গেল আর কণুই পর্যন্ত আমার বাহু জমাট বাঁধা রক্তে মাখামাখি হয়ে গেল। তারপরও অসভ্য হাইকসোরা আমাদেরকে আক্রমণ করতে এসে মারা যাচ্ছিল। আমার ডানপাশে জারাস ক্লান্তিহীনভাবে লড়ে যাচ্ছে কিন্তু আমি দ্রুত ক্লান্ত হয়ে পড়ছিলাম। হাত ভারি হয়ে আসছিল আর পাগুলো আর তাল সামলাতে পারছিল না।

একটা লোককে মেরে লাথি দিয়ে ফেলে দিয়ে সামনে জাহাজের এক পাশ দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম আমার নৌবহরের অন্যান্য রণতরীর নাবিকরাও প্রচণ্ড লড়াই করছে। শত্রু জাহাজগুলো ওদেরকে ঘিরে ফেলেছে আর ওরা প্রাণ বাঁচাতে লড়ে যাচ্ছে। তারপর আমি আতঙ্কিত হয়ে দেখলাম আরও দশবারোটি শত্রু জাহাজ ভোলা সাগর থেকে উপসাগরে ঢুকছে। বড় বড় একতলা রণতরীগুলোর লোকেরা উল্লাসে চিৎকার করে দাঁড় বেয়ে আসছে। আমি জানি শুধু সংখ্যার কারণে এতোগুলো যুদ্ধ জাহাজের সাথে আমরা বেশিক্ষণ লড়াই চালিয়ে যেতে পারবো না। একবার ভাবলাম কোনোভাবে লড়াই থামিয়ে খোলা সাগরের দিকে যেতে পারবো কি না। তবে বুঝতে পারলাম যে এই ভাবনা শুধু এক কাপুরুষ মনের শেষ ভাবনা নয়, এটি ছিল হতাশা থেকে এক অলীক কল্পনা। মনে হচ্ছে রক্তস্নান থেকে বাঁচার আর কোনো উপায় নেই। আরও শত্রু জাহাজে উঠে আসতেই আমরা তাদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাতে লাগলাম। অবশেষে চরম ক্লান্তিতে নিঃশেষিত হয়ে আমার পা টলমল করতে লাগলো। জারাস আমার শরীরের সাথে তার ঢাল চেপে ধরে আমাকে খাড়া করে রাখতে চেষ্টা করলো। তবে এখন আমার তরবারি উঠাবার শক্তিও প্রায় শেষ হয়ে গেছে। যেসব শত্রু সেনাদেরকে হত্যা করেছি তাদের রক্তে আমার সারা মুখ, হাত রক্তে মাখামাখি হয়ে রয়েছে।

তারপর আরেকটি দাড়িওয়ালা শত্রুর মুখ আমার সামনে উদয় হতেই আমি আমার তরবারির ভেতা অংশ দিয়ে তাকে আঘাত করলাম। এততক্ষণ লড়াই করার পর তরবারির ধারালো অংশটি ভোতা হয়ে কয়েক জায়গায় ভেঙে গেছে। আমার আঘাতটি এতো দুর্বল ছিল যে নতুন শত্রু অবজ্ঞাভরে তার হাতের কব্জি ঘুরিয়ে এটা এক পাশে সরিয়ে দিল।

তারপর সে চিৎকার করে উঠলো, প্রভু তায়তা! আমি একটু থেমে হতভম্ভ হয়ে তার দিকে তাকালাম। তার দাড়ির কারণে প্রথমে আমি তাকে চিনতে পারিনি। তাছাড়া চোখে রক্তের ছিটা পড়ায় আমি ঝাপসা দেখছিলাম। তবে এখন বুঝলাম সে হাইকসো শত্রু নয়, তার চেহারা পরিচিত মনে হচ্ছে।

এবার তার কণ্ঠস্বর চিনতে পারলাম। সে বলে উঠলো, অস্ত্র থামান প্রভু তায়তা। আমি আপনার অধীনস্থ লোক।

হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম, নাকাতি তুমি? আমি মনে করেছিলাম তুমি আর আসবে না।

সে দাঁত বের করে হেসে বললো, দেবতারা সবসময় আপনার প্রার্থনা পূর্ণ করেন না। তারপর সে হাত বাড়িয়ে আমাকে ধরে আমার পড়ে যাওয়া ঠেকাল। তবে আমি ঝটকা মেরে তার হাত সরিয়ে দিলাম। নতুন আশায় আমার মধ্যে নতুন শক্তি সঞ্চার হয়েছে।

তুমি বেশ ভালো সময়েই এসেছো নাকাতি। যাইহোক তোমাকে স্বাগত জানাচ্ছি। হাত তুলে জাহাজের গলুইয়ের কাছে দেখালাম, হাইকসোরা লড়াই ছেড়ে পালাচ্ছে। জাহাজ তীরে ফেলে ওরা স্থলপথে পালাচ্ছে। ঐ ব্যাটাদের পাকড়াও কর। তারপর আমরা ওদের রথগুলো খুঁজে সেগুলো ধ্বংস করবো।

আমার কথা শুনে সে হেসে বললো, আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, হাইকসো অশ্বারোহী সৈন্যবাহিনী তা থেকে মাত্র এক লিগ দূরত্বে আছে।

আমি বললাম, তুমি নিশ্চিত?

প্রভু এটনের মতো আমার অনেক সংবাদদাতা না থাকলেও তারা কোনো অংশে কম দক্ষ নয়। গোরাবের লোকেরা যে এখানে আপনার জন্য ওঁৎ পেতে অপেক্ষা করছিল আমার সংবাদদাতারা আমাকে সে খবর জানায়। আপনাকে সাবধান করার জন্য আমি সাথে সাথে ক্রিমাদের উদ্দেশ্যে জাহাজ নিয়ে ছুটি, কিন্তু সেখানে পৌঁছে দেখি আপনি আগেই চলে গেছেন। হোরাস আর আইসিসকে ধন্যবাদ যে সময়মতো এখানে পৌঁছে আপনাকে জীবিত পেয়েছি।

পোশাকের কিনারা দিয়ে মুখ থেকে ঘাম আর রক্ত মুছে আমি বললাম, সেজন্য আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ। তারপর নিচু হয়ে ডেক থেকে শত্রুর একটি তরবারি তুলে নিলাম। তারপর সোজা হয়ে জারাসের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বললাম, আমাদেরকে তীরে নিয়ে চল। একটিও হাইকসো জানোয়ার যেন পালাতে না পারে!

বালুকাবেলার দিকে আমরা জাহাজ নিয়ে চললাম। আমার নির্দেশ মতো নাকাতি তার লোকজনদের নিয়ে পলাতক হাইকসোদের পেছনে ছুটলো। এদিকে জারাস আর হুই রথগুলো নামিয়ে ঘোড়াগুলোর লাগাম পড়াতে শুরু করলো।

এটন যে বেদুঈন পথপ্রদর্শক পাঠিয়েছিল, ওরা সাগরতীরের বালিয়াড়িতে লুকিয়েছিল। এখন ওরা বের হয়ে এলো। অর্ধেক রথ নিয়ে হুই আর আমি বেদুঈনদের অনুসরণ করে হাইকসো অশ্বারোহী সেনাছাউনির দিকে চললাম।

জারাস নাকাতির সাথে যোগ দিল। বাকি রথে চড়ে ওরা যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে পালানো হাইকসোদের খুঁজতে বালিয়াড়ির দিকে ছুটলো।

রথের গুদামের হাইকসো প্রহরীরা লড়াই থেকে অনেক দূরে থাকার কারণে সেখানে কি ওলোটপালট ঘটনা ঘটেছে তা কিছুই জানতো না। হুই আর আমি রথে চড়ে গুদামের সীমানা বেষ্টনির কাছে পৌঁছাবার পর আমি ওদের ভাষায় প্রহরীদের মূল ফটক খুলতে বললাম। ওরা আমাদেরকে দক্ষিণের মূল হাইকসো বাহিনী থেকে আসা নতুন সেনাদল মনে করে ফটক খুলে দিল।

ওরা যখন ভুলটি বুঝতে পারলো ততক্ষণে আমাদের লোকেরা ওদের মাঝে ঢুকে ওদের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে ছুঁড়ে ফেললো। ওদেরকে মাটিতে হাঁটুগেড়ে বসতে বাধ্য করে পিছমোড়া করে বাঁধলো।

রথের গুদামে সারিবদ্ধভাবে রাখা ৮৫০টি ঝকঝকে নতুন রথের গাড়ি পাওয়া গেল।

পরিষ্কার বুঝা গেল হাইকসো কারিগররা আমাদের মিসরীয় রথের গাড়ির নকশা নকল করেছিল। চিরাচরিত হাইকসো যন্ত্রের চেয়ে এগুলো অনেক উন্নত ধরনের। মূল কাঠামো মালাক্কা বেত আর বাঁশ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। এগুলো শক্ত পাইন কিংবা সিডার কাঠের চেয়ে অনেক হালকা আর নমনীয়। কঠিন নিচ্ছিদ্র না করে চাকাগুলোতে স্পোক বসিয়ে দ্রুতগামী এবং আরও টেকসই করা হয়েছে।

গাড়িগুলো বার্ণিশ করে গাদাগাদি করে রাখাছিল। সাথে আনা প্রদীপের তেল এগুলোর উপর ছিটিয়ে জ্বলন্ত মশাল দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হল। গাড়িগুলো একটার সাথে আরেকটি লেগে থাকায় কিছুক্ষণের মধ্যেই সমস্ত গাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে গেল।

হাইকসো রথগুলোর ব্যবস্থা নেওয়ার পর বেদুঈন পথপ্রদর্শক আমাদেরকে ঘোড়ার আস্তাবলের দিকে নিয়ে গেল। সেখানে নল খাগড়ার ছাউনির আস্তাবলে প্রায় দুই হাজার ঘোড়া ছিল।

একটি বিষয়ে আমি হাইকসোদের প্রশংসা করবো, তা হল ঘোড়ার যত্ন নেওয়ার বিষয়ে। এই প্রাণীগুলোকে সযত্নে লালন-পালন করে বেছে নেওয়া হয়েছিল। তারপর প্রশিক্ষণের মাধ্যমে একেবারে নিখুঁতভাবে গড়ে তোলা হয়েছিল। অন্য যেকোনো প্রাণী থেকে আমি ঘোড়া বেশি পছন্দ করি। একটি ঘোড়ার উপর আস্থা রাখা যায়।

সৈকতের যেখানে জাহাজগুলো ছিল, ঘোড়াগুলোকে সেখানে তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হল। ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না কীভাবে এতগুলো ঘোড়ার ব্যাপারে বন্দোবস্ত করা যায়। দুই হাজার ঘোড়া বিশাল একটি সংখ্যা। নাকাতির বহরসহ সমস্ত জাহাজেও এতগুলো ঘোড়ার জায়গা করা সম্ভব নয়।

নাকাতির একজন কর্মকর্তা এই চমৎকার প্রাণীগুলোকে হত্যা করার পরামর্শ দেওয়ায় আমি বেশ বিরক্ত হলাম। আমি নাকাতির দিকে ফিরে বললাম, তোমার এই দলের মধ্যে পঞ্চাশ জনও কি নেই যারা ঘোড়াকে বুঝতে পারে আর ভালোবাসে?

আমার ক্ষিপ্তভাব টের পেয়ে সে বললো, অবশ্যই আছে প্রভু তায়তা।

ওদেরকে আমার কাছে নিয়ে এসো। পুরো ঘোড়ার পালটি ওদের মধ্যে বিভিন্ন অংশে ভাগ করে দেবো। তারপর ওরা আলাদা আলাদা পথে ঘোড়াগুলোকে তাড়িয়ে মিসরীয় এলাকায় নিয়ে যাবে। মেশিরে আমার এস্টেটে পৌঁছে দেবার পর প্রতিটি ঘোড়ার জন্য আমি একটি করে রূপার ডেবেন দেবো। এই কাজটি করতে গিয়ে কেউ মারা গেলে আমি তার পরিবারের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নেবো। এ ব্যাপারে আমি প্রতিজ্ঞা করতে রাজি আছি!

আধাঘন্টার মধ্যে নাকাতি স্বেচ্ছাসেবক দলের সমাবেশ করলো। ওরা যার যার পছন্দমতো ঘোড়ার পাল বেছে নিয়ে ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে গোধূলির আলোয় যাত্রা করলো।

ওদের মধ্যে কিছু লোক সাহারা হয়ে হাইকসো অবস্থান ঘুরে পশ্চিম দিক দিয়ে মিসরে পৌঁছাবার পথ বেছে নিল। অন্যান্যরা নীল নদীর বদ্বীপ পার হবার সিদ্ধান্ত নিল। সাঁতরে নদী পার হয়ে ওরা পূর্বদিকে সিনাই উপদ্বীপে পৌঁছাতে চেষ্টা করবে। সেখান থেকে দক্ষিণ দিকে লোহিত সাগরের উপকূল ধরে থিবসে পৌঁছতে পারবে।

ওদের চলে যাওয়া দেখে আমি হোরাস আর ইনানার উদ্দেশে ঐকান্তিক প্রার্থনা করলাম, যেন এই কঠিন যাত্রাপথে ওরা আমার ঘোড়াগুলোর উপর সদয় দৃষ্টি দেন।

.

এরপর বন্দীদের দিকে দৃষ্টি ফেরালাম।

রথের গুদাম আর জিন উপসাগরের যুদ্ধ থেকে বেঁচে যাওয়াসহ মোট ৭৯৩ জন হাইকসো সৈন্য আর নাবিককে বন্দী করা হয়েছিল। জারাস আর নাকাতি বন্দীদেরকে সৈকতে লম্বা সারিতে হাঁটু গেড়ে বসিয়ে রেখেছিল। পুরো নগ্ন করে পিছমোড়াকরে দুইহাত বেঁধে রাখা হয়েছিল। হাল ছেড়ে দিয়ে গোমড়ামুখে ওরা হাঁড়িকাঠের নিচে ফাঁসির আসামির মতো জল্লাদের ডাকের জন্য অপেক্ষা করছিল।

নাকাতি আর আমার লোকদেরকে জিজ্ঞেস করলাম, এই হতভাগাদের নিয়ে কী করা যায়? ওরা কেউ এদের ব্যাপারে তেমন আগ্রহ দেখাল না। আমাদের ক্ষতিগ্রস্ত জাহাজগুলো দ্রুত মেরামত করা হয়েছিল। যেগুলো মেরামত করার উপায় ছিল না সেগুলো বালুকা বেলায় পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল। লড়াই হয়েছে আর আমরা জয়ী হয়েছি। নতুন করে হাইকসো গোষ্ঠির লোকেরা প্রতিশোধ নেবার জন্য বালিয়াড়ির উপর দিয়ে আসার আগেই সবাই জাহাজে চড়ে গভীর সমুদ্রে চলে যেতে চাইছে।

হুই বললো, এদেরকে মেরে ফেললেই হয়।

জারাসও সায় দিয়ে বললো, আমারও তাই মত। ওদের সকলকে হত্যা করা হোক। সে জোরে জোরে হাইকসো ভাষায় কথগুলো বলছিল যাতে কাছের বন্দীরা তা শুনতে পায়।

নাকাতি তার মত দিয়ে বললো, এটা ভালো প্রস্তাব। ওদেরকে ছেড়ে দিলে ওরা কাল আবার আমাদের লোকদের হত্যা করবে আর মেয়েদেরকে ধর্ষণ করবে। সবাই চেঁচিয়ে একমত হল। তবে নাকাতি এক হাত তুলে ওদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে আমাকে বললো, তবে প্রভু তায়তা, আপনাকে আমি ভালো করেই জানি, আপনি কখনও আমাদের এই প্রস্তাবে রাজি হবেন না। যে লোক আত্মসমর্পণ করেছে তাকে আপনি কখনও ঠাণ্ডা মস্তিষ্কে মারতে পারবেন না।

আমি কাঁধে ঝাঁকি দিয়ে বললাম, দুর্বল ও অসহায়ের প্রতি সহানুভূতি দেখাবার বিষয়ে তুমি আমার সম্পর্কে হয়তো একটু বেশি বলে ফেলেছ। আমি হয়তো তোমাকে অবাক করে দিতে পারি। তবে সে ঠিকই জানে আমার এই প্রতিবাদ সমাটেই আন্তরিক নয়। সে দাঁত বের করে হেসে বললো, তাহলে আমি একটা প্রস্তাব করছি। আমি আপনাকে দেখাচ্ছি কীভাবে নিশ্চিত করা যায় যে, এই কুকুরগুলো আর কখনও ফারাও আর আমাদের মিসরের বিরুদ্ধে তীর ছুঁড়তে পারবে না কিংবা তরবারি উঠাতে পারবে না। তারপর আমরা তাদেরকে ছেড়ে দিতে পারি যাতে আপনার বিবেকের কাছে আপনি পরিষ্কার থাকতে পারেন।

তার এই অন্তঃসারশূন্য বিতর্কে বিরক্ত হয়ে আমি বললাম, কীভাবে সেটা করবে শুনি? কী কারণে ওদেরকে বিশ্বাস করতে বলছো?

হাঁটু গেড়ে বসা বন্দীদের পাহারায় তার যে লোকগুলো ছিল, তাদের দিকে একবার তাকিয়ে মাথা নেড়ে কিছু ইঙ্গিত করে সে আমাকে বললো, আমি আপনার ক্ষমা প্রার্থনা করছি, অনুগ্রহ করে এক মুহূর্ত এদিকে তাকান! ওরা একজন হাইকসো রথিসেনাকে টেনে নিয়ে এসে মুখ বালুর উপর রেখে উপুড় করে শোয়াল। বন্দীর দুই হাত পিছমোড়া করে বাঁধা ছিল। নাকাতি লোকটির পেছনে দাঁড়িয়ে তরবারি বের করলো।

সে লোকটিকে নির্দেশ দিল, তোমার বুড়ো আঙ্গুল তুলে ধর! বন্দীটি তার নির্দেশ পালন করলো। তরবারির দুই কোপে সে লোকটির বুড়ো আঙুল দ্বিতীয় গাঁট থেকে কেটে ফেললো। লোকটি যন্ত্রণায় চেঁচিয়ে উঠলো। ক্ষতস্থান থেকে দরদর করে রক্ত ঝরে পড়তে লাগলো আর কাটা বুড়ো আঙুলের অংশগুলো বালুতে পড়ে কাঁপতে লাগলো।

নাকাতি বললো, এবার আমি বাজি ধরে বলতে পারি, এই লোকটি আর কখনও মিসরের বিরুদ্ধে তীর কিংবা তরবারি কোনোটাই চালাতে পারবে না। আমরা সবাই অবাক বিস্ময়ে হা করে কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। তারপর আমার লোকেরা উল্লাসে ফেটে পড়লো।

এরপর আমি কিছু বলার আগেই জারাস সামনে এগিয়ে গেল। সে এক পা দিয়ে নগ্ন আর আহত বন্দী লোকটিকে ঠেলে উল্টিয়ে চিৎ করে শোয়াল। তলোয়ার বের করে লোকটির পুরুষাঙ্গের নিচে তলোয়ারের ডগাটি ঢোকাল। তারপর সে বললো, এভাবে নিশ্চিত করা হল যেন, সে আর কখনও কোনো মিসরীয় নারী কিংবা সদ্যজাত শিশুকে ধর্ষণ করতে না পারে। এই কথা বলার সাথে সাথে তলোয়ারের ধারালো ফলার উপরের দিকে এক টানে সে লোকটির পুরুষাঙ্গ কেটে ফেললো। তারপর তলোয়ারের ডগায় বিধিয়ে সাগরের ফেনায় ছুঁড়ে ফেললো।

আমার চতুর্দিকের লোকেরা আবার উল্লাসে চিৎকার করে উঠলো। তবে আমি ওদের চেয়েও জোরে চিৎকার করে জারাসকে বললাম, এই নিষ্ঠুরতা এখনই থামাও জারাস। তোমার তলোয়ার খাপে ঢোকাও। তুমি তো হাইকসো পশুদের মতো একই পর্যায়ে নিচে নেমে পড়েছ!

জারাস ওর তলোয়ার খাপে ঢুকিয়ে ঘুরে আমার মুখোমুখি হল। চিবুক তুলে আমার মতোই একইভাবে হিংস্র ও রাগী দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, প্রভু তায়তা। এদেরকে বন্দী করে আমাদের জাহাজে নেবার মতো জায়গা নেই। আর যদি অক্ষত অবস্থায় ওদেরকে মুক্তি দেন তাহলে আমাদের আর কত লোককে ওরা হত্যা করবে বলুন? আর কত নারী ও শিশু ওদের হাতে মারা পড়বে?

ধীরে ধীরে তার কঠিন যুক্তির সামনে আমার ক্রোধ কমে এলো। আমি। বুঝতে পারলাম খোঁজা করার সময় আমার উপর যখন ছুরি চালান হয় সেই ক্ষতের স্মৃতি আমার বিচার বিবেচনাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। আমি চাই না যে এ-ধরনের নৃশংসতা আর কোনো মানুষের সাথে হোক, তা সে যতই খারাপ হোক না কেন। লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করলাম, তারপর কণ্ঠস্বর স্বাভাবিক করে রাগটা দূর করার চেষ্টা করে বললাম, তুমি ঠিক কথাই বলেছো জারাস। আমি যাচ্ছি তুমি এসে আমার সাথে দেখা করো। বুড়ো আঙুল কাটো ঠিক আছে, তবে পুরুষাঙ্গটা বাদ দাও, ওটা ওদের দেবতা শেঠের জন্য রেখে দাও।

আমার কথা শুনে অন্যান্যরা একটু খোশ মেজাজে ফেরার চেষ্টা করে একটু অশ্লীল রসিকতা করতে লাগলো। আমিও ওদের কথা শুনে জোর করে হাসার চেষ্টা করলাম, কিন্তু ঘুরে জারাসের দিকে তাকাতেই আমার ঠোঁট থেকে হাসি মুছে গেল।

জারাস অগ্নিদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়েছিল। চারদিকে নীরবতা নেমে এল। শুধু শোঁ-শোঁ বাতাসের শব্দ আর আহত বন্দীটির ফোঁপানি শোনা যাচ্ছিল। এরপর জারাস শীতল আর পরিষ্কার কণ্ঠে বলতে শুরু করলো, হাইকমোরা যখন আমাদের গ্রামে হামলা চালায় তখন আমার দুই বোনের বয়স ছিল সাত আর আট বছর। বাবা তার সেনাদলের সাথে দূরে ছিলেন। হাইকমোরা প্রথমে আমার মা, তারপর পালাক্রমে দুই বোনকে ধর্ষণ করে। অর্ধেক দিন এভাবে ওদের উপর নির্যাতন চালায়। আমার তখন বয়স ছিল মাত্র পাঁচ বছর, তবে আমি কোনক্রমে পালিয়ে মাঠে লুকালাম। সেখান থেকে সবকিছু দেখতে পেলাম। সবশেষে আমাদের কুটিরে আগুন লাগিয়ে আমার মা আর বোনদেরকে জীবন্ত অবস্থায় আগুনের মধ্যে ফেলে দেয়। আমি মাঠ থেকে ওদের আর্তচিৎকার শুনতে পাচ্ছিলাম। কথা শেষ করে সে একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলো, এখন আপনি আমাকে কী করতে বলেন?

আমি তাকে কোনো উত্তর দিতে পারলাম না। বিষণ্ণভাবে মাথা নেড়ে বললাম, ফারাও আর তোমার পরিবারের স্মৃতির প্রতি তোমার দায়িত্ব পালন কর।

জারাস উত্তর দিল, ধন্যবাদ প্রভু। তারপর খাপ থেকে তলোয়ার বের করে নাকাতির সাথে যোগ দিল।

অঙ্গচ্ছেদ করার উদ্দেশ্যে ওরা দুজনে ত্রিশজন লোক বেছে নিল, যারা খুব ভালোভাবে কুড়াল চালাতে পারে। প্রত্যেকের সাথে চারজন করে সহকারী দেওয়া হল, যারা বন্দীকে টেনে নিয়ে গিয়ে বেঁধে রাখবে। প্রথম প্রথম বন্দীদের দুএকজন হাত মুঠো করে রেখেছিল। কিন্তু কুড়ালধারীরা সময়ের অপচয় না করে পুরো হাতটা কব্জি থেকে কোপ মেরে কেটে ফেললো। এরপর বন্দীরা সহযোগিতা করলো।

তারপর সহকারীরা ওদেরকে উল্টে চিৎ করে শুইয়ে দিল। তারপর ওদের পুরুষাঙ্গ কেটে নিয়ে বালিয়াড়ির উপর ছেড়ে দেওয়া হল। ওরা গোঙাতে গোঙাতে কাটাস্থান চেপে ধরে রক্তপাত কমাবার চেষ্টা করতে লাগলো।

রক্তের গন্ধে গাংচিলের দল আকৃষ্ট হয়ে কাটা বুড়ো আঙুল আর যৌনাঙ্গের স্থূপের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো।

সমস্ত দৃশ্যটি দেখে আমি অসুস্থবোধ করে ঘুরে আমাদের জাহাজের দিকে চললাম। হাইকসো বন্দীদের আর্তচিৎকার আর কাকুতিমিনতি উপেক্ষা করার চেষ্টা করলাম। বরং রথের গাড়ি আর ঘোড়াগুলো জাহাজে উঠাবার কাজ তত্ত্বাবধান করতে লাগলাম।

রক্তপাতের কাজটি সমাপ্ত করার পর নাকাতি আমার কাছে বিদায় নিতে এল। তার সাথে আমার চুক্তি অনুযায়ী সে মধ্যসাগরের উপকূল জুড়ে হাইকসো বন্দর আর নগরগুলোতে লুটতরাজ চালিয়ে যাবে।

অবশেষে জারাস জাহাজের ডেকে উঠেই সাথে সাথে আমার কাছে এসে হাঁটু গেড়ে বসে বললো, প্রভু আমি আপনার কথা অমান্য করেছি। সমস্ত লোকের সামনে আমি আপনার নির্দেশ অমান্য করেছি। আপনি অবশ্যই আমাকে পদাবনতি দিয়ে অধিনায়কের দায়িত্ব থেকে খারিজ করতে পারেন।

আমি উত্তর দিলাম, তুমি যা ভালো মনে তা করেছে। আর কোনো মানুষ এর চেয়ে ভালো কিছু করতে পারে না। এখন যাও জাহাজ পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে ক্রিমাদের পথে চল।

সে উঠে দাঁড়িয়ে বললো, ধন্যবাদ তায়তা। আর কোনো দিন আপনার অবাধ্য হবে না।

.

সর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়তেই আমি মাস্তুলের ডগায় উঠলাম, সেখান থেকে পেছনে সাগরের দিকে তাকিয়ে নিশ্চিত হলাম যে, পেছন থেকে কোন হাইকসো জাহাজ আমাদের পিছু নেই নি। সবকিছু পরিষ্কার। সাগরের গভীর নীলের উপরে মিসরের হালকা নীল উত্তর উপকূল দেখা যাচ্ছে। অন্ধকার সাগরে সঠিক অবস্থান নিশ্চিত করার সুবিধার্থে জাহাজগুলোর পেছনের গলুইয়ে লণ্ঠন জ্বালিয়ে রাখা হয়েছে।

সবচেয়ে আগের মাঝি চেঁচিয়ে বললো, এই রশিতে তল পাওয়া যাচ্ছে না!

আমার গভীর সাগরে ক্রিটের দিকে চলেছি। আমি আমার পছন্দের জায়গা মাস্তুলের ডগায় অবস্থান নিয়েছি। জারাস পাহারাদারকে ছুটি দিল। দাঁড়িরা বৈঠা তুলে রেখে ডেকে কুণ্ডলি পাকিয়ে শুয়ে পড়লো। পেছন দিক থেকে আসা বাতাসে পালগুলো ফুলে রয়েছে।

হঠাৎ আমার দেহ-মনে ভীষণ ক্লান্তি ভর করলো। কঠিন লড়াই আর তারপর জারাসের সাথে মুখোমুখি হওয়াটা আমাকে নিঃশেষিত করে দিয়েছে। একবার ভাবলাম নিচে নেমে কেবিনে গিয়ে শুয়ে পড়ি। তবে পেছন থেকে আমার প্রিয় মিসরের স্মৃতিসুরভিত উষ্ণ হাওয়া বয়ে আসছিল। মূল মাস্তুলের দোলানিতে আমার ঘুম পাচ্ছিল। জিন উপসাগরের যুদ্ধে শরীরের ক্ষতগুলোর কারণে ব্যথা অনুভব করছিলাম। মনে হল কেবিন অনেক দূরে। মাস্তুলে পিঠ ঠেকিয়ে বসে কোমরের চারদিকে শক্ত করে মাস্তুলের সাথে দড়ি বাঁধলাম। তারপর চোখ বুজে চিবুক বুকে ঠেকালাম।

এরপর ঘুম ভাঙতেই দেখলাম চাঁদ আকাশের মাঝখানে আর সাগরের বুকে এর প্রতিচ্ছায়া ঢেউয়ের উপর একটি চকচকে রূপালি পথ তৈরি করে আমাদের সাথে তাল মিলিয়ে চলছে। আফ্রিকার গন্ধের বদলে এখন সাগরের লোনা গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। জাহাজের নিচে পানির শব্দ, মাস্তুলের গোড়ায় কাঁচকোচ আর বাতাসের ফিসফিসানি ছাড়া আর কোনো শব্দ শোনা যাচ্ছে না।

হঠাৎ সমস্ত ক্লান্তি দূর হয়ে আমি আবার সতেজ আর সতর্ক হয়ে উঠলাম। মনে এমন আজব অনুভূতি হল যাতে আমি বুঝতে পারলাম দেবী ইনানা কাছেই এসেছেন। আগ্রহভরে তাকিয়ে দেখলাম তিনি চাঁদের প্রতিফলনে সৃষ্ট রূপালি পথ ধরে শূন্যে ভাসতে ভাসতে জাহাজের দিকে আসছেন। মুখের আবরণ নেই আর চাঁদের আলো তার মুখে খেলা করছে। তাকে দেখতে অপূর্ব লাগছিল।

জাহাজের কাছে এসে তিনি সাগরের বুক থেকে ডেকে উঠে আমার দিকে তাকালেন।

তার মুখের ভাব পরিবর্তিত হতেই আমারও মেজাজ বদলে গেল। হঠাৎ আমার মনে আতঙ্ক ভর করলো। আমি বুঝলাম তিনি আমার বিজয়ে অভিনন্দন জানাতে আসেন নি।

কথা না বললেও আমি আমার তার কণ্ঠস্বরের মসৃণ কোমল প্রতিধ্বনি আমার মস্তিষ্কে শুনতে পেলাম।

দেবতা রুষ্ট হয়েছেন। ক্রোনাস চরম বলি দাবি করছেন।

আমি বলতে চেষ্টা করলাম, আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। কিন্তু কথাগুলো গলায় আটকে গেল।

তিনি নিঃশব্দে বললেন, ওদের কাছে যাও। ওরা বিপদের মধ্যে রয়েছে। এবার বাতাসের শব্দের উপর দিয়ে সাবধান বাণীটি পরিষ্কার শুনতে পেলাম।

চেষ্টা করলাম তার কাছে যেতে, কিন্তু নড়াচড়া করতে পারলাম না। আমি চাচ্ছিলাম তিনি তার হেঁয়ালিমূলক বার্তাটি ব্যাখ্যা করুন, কিন্তু কোনো কথা মুখ দিয়ে বের হল না।

তারপর গভীর ঘুমের ছায়া আমাকে আচ্ছন্ন করলো আর তিনিও চলে গেলেন। অন্ধকারে আমি চিৎকার করে বলতে চেষ্টা করলাম, ইনানা যেও না। আমার জন্য অপেক্ষা করো! তোমার কথা আমি বুঝতে পারিনি। কিন্তু অন্ধকার আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেললো।

পরের বার কতক্ষণ ঘুমিয়েছি বুঝতে পারিনি, তবে চোখ মেলতেই দেখলাম ভোর হয়ে এসেছে।

নিচে তাকিয়ে দেখলাম ডেকে কর্মতৎপরতা শুরু হয়েছে। প্রথম দাঁড়িরা দাঁড়ি বেঞ্চে তাদের জায়গায় নামছে।

কোমরে বাঁধা রশিটা খুলে মাস্তুল থেকে নিচে উপরের ডেকে পা দিতেই জারাস হাসিমুখে আমার কাছে এসে বললো, প্রভু, আপনি আবার মাস্তুলে দড়ি বেঁধে ঘুমিয়েছেন, তাই না? কেবিনে আরাম পান না? তারপর আমার চেহারা দেখে তার মুখের হাসি মুছে গেল। সে বললো, কী ব্যাপার, কী হয়েছে?

আমি নির্দেশ দিলাম, এখুনি সমস্ত রথের গাড়ি পানিতে ফেলে দাও। ঘোড়াগুলো অন্য জাহাজে নেবার ব্যবস্থা কর।

সে আড়ষ্ট হয়ে বললো, কেন তায়তা?

প্রশ্ন করো না। তোমার সাথে তর্ক করার সময় নেই আমার। অধৈৰ্য্য হয়ে তার কাঁধ ধরে জোরে কঁকি মেরে বললাম, প্রত্যেক জাহাজ থেকে একদল করে দাঁড়ি নাও। আমি প্রতি ঘন্টায় দাঁড়ি বদল করতে চাই।

প্রত্যেক ঘন্টায়?

আমি ক্রিমাদ পর্যন্ত সারা পথ আক্রমণের গতিতে যেতে চাই।

সে অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, আক্রমণের গতি?

আমি তাকে ধমকে উঠলাম, একই কথা বার বার বলো না, জারাস। আমি পাঁচ দিনের মধ্যে কিংবা আরও আগে ক্রিমাদ গেঁছাতে চাই।

সে প্রতিবাদ করে বললো, আপনি আমার লোকদের মেরে ফেলবেন।

রাজকুমারীদের বদলে ওরা মরলে বরং ভালো।

সে আমার দিকে ভয়াকুল চোখে তাকিয়ে বললো, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

দুই রাজকুমারী চরম বিপদে আছেন। হয়তো অনেক দেরি হয়ে গেছে। তবে প্রত্যেকটি ঘন্টা আমরা হারাববা আর ওরা নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাবে।

সে ঘুরে তার সহকারীর দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বললো, সমস্ত জাহাজের ক্যাপ্টেনদের আসার বার্তা জানিয়ে পতাকা তোলো।

অন্যান্য জাহাজগুলো আমাদের জাহাজের দুইপাশে দুটি করে এসে ভিড়লো। ওরা প্রত্যেকে পাঁচদিনের পানি আর রসদসহ তাদের সেরা বিশজন দাঁড়িকে আমাদের জাহাজে তুলে দিল। এর বদলে আমরা আমাদের নাবিকদের মধ্য থেকে ক্রীতদাস আর দুর্বল লোকগুলোকে তাদের জাহাজে পাঠিয়ে দিলাম।

মাল তোলার কপিকলে তুলে সমস্ত ঘোড়া অন্যান্য জাহাজে তুলে দিলাম। একইভাবে রথের গাড়িগুলোও উপরে উঠিয়ে পানিতে ফেলে দিলাম। জাহাজটিকে আমি যতদূর সম্ভব হালকা করতে চেয়েছিলাম। ক্রিটে পাঁচ দিনে পৌঁছানো কম কথা নয়।

হুই তার জাহাজ নিয়ে আমাদের জাহাজের কাছে ভিড়তেই জারাস তাকে একপাশে নিয়ে তার সাথে কথা বললো। কথা না শুনলেও ওদের ঠোঁটনড়া থেকে বুঝতে পারলাম। হুই ঘুরে দৃঢ়সংকল্পিত চেহারা নিয়ে আমার কাছে এল।

সে কিছু বলার আগেই আমি বললাম, ভালো হয়েছে হুই। একজন ভালো লোকের হাতে তোমার জাহাজের দায়িত্ব তুলে দিয়ে এখানে চলে এসো। তবে মনে রেখো তোমাকেও কিন্তু দাঁড় বাইতে হবে।

সমস্ত লোকজন জাহাজে উঠে আসার পর দাঁড়িদের প্রথম দলটি তাদের জায়গা নিতেই ঢাকিরা দ্রুত লয়ে ঢাক পেটাতে শুরু করলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই মিনিটে দশবার দাঁড় বাওয়ার গতি অর্জন করলো।

আমাদের জাহাজে যেন ডানা গজিয়েছে আর আমরা পানির উপর দিয়ে উড়ে চললাম। এক ঘন্টার মধ্যেই বহরের বাকি জাহাজগুলোকে দিগন্তের নিচে ফেলে এলাম।

দাঁড়িদের দল বদল করার পর প্রথম দলের ঘর্মাক্ত ক্লান্ত লোকগুলো হাঁপাতে লাগলো। পরবর্তী তিনদিন আর রাত আমরা একবারও গতি কমালাম না।

জারাস আর হুই নিয়মিত দাঁড় বাইল আর আমিও প্রতি বারো ঘন্টায় এক ঘন্টা করে দাঁড় বাইলাম। ইনানার সাবধান বাণীটি বার বার মনে পড়লো।

ওদের কাছে যাও। ওরা মারাত্মক বিপদের মুখে পড়েছে।

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *