৬. পরবর্তী পাঁচটি দিন

পরবর্তী পাঁচটি দিন ব্যবিলনে অত্যন্ত ব্যস্ততার মধ্যে কাটলো। নিমরদ আর তার সভাসদদের সাথে শেষ বারের মতো সাক্ষাতকার, দুই জাতির মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষর আর চুক্তি মোতাবেক আমি যে কথা দিয়েছিলাম বাকি রূপা থিবসে নিমরদের প্রতিনিধির কাছে হস্তান্তর করা হবে, তার ব্যবস্থা করা। মনে মনে খুশি হলাম যে, বাহককে বাকি ২৭ লাখ রূপা প্রদানের জন্য বাজপাখি সীলমোহর দিয়ে স্বাক্ষরিত আমার দেওয়া প্রতিশ্রুতি পত্রটি যখন ফারাও ত্যামোসের সামনে উপস্থিত করা হবে তখন আমি সেখানে উপস্থিত থাকবো না।

সর্বোপরি আমাদেরকে স্বাগত জানিয়ে ক্রিটে নিয়ে যাবার জন্য সর্বাধিরাজ মিনোজ ব্যবিলনে যে দূত পাঠিয়েছেন তার আগমন। উচ্চপর্যায়ের সফরসঙ্গি নিয়ে কুমুসস বন্দর থেকে রণতরীর বহর নিয়ে সে রওয়ানা দিয়েছিল। জাহাজগুলো সিডন বন্দরে রেখে সফরসঙ্গীদের নিয়ে স্থলপথে দূত আমাদের সাথে দেখা করতে এসেছে।

তার নাম তোরান, মিনোয়ান ভাষা থেকে অনুবাদ করার পর এর অর্থ হয় যাঁড়ের পুত্র। সে একজন সুদর্শন ব্যক্তি আর পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী এবং শক্তিশালী একজন রাজার প্রতিনিধি হিসেবে বেশ জাঁকজমকের সাথে সফরে এসেছে। রাজা নিমরদ তার সফরসঙ্গীদের থাকার জন্য প্রাসাদের পুরো একটি অংশ ছেড়ে দিয়েছেন। ক্রিটের অতিথিদের আপ্যায়ন এবং আহার বিহারের ব্যবস্থা করার জন্য নিমরদকে আমার দেওয়া তিন লাখ রূপার বেশ কিছু অংশ খরচ করতে হচ্ছিল। তাই তিনি চাচ্ছিলেন তোরান যেন অতি শিঘ্রই ক্রিটে ফিরে যায়।

সুন্দর চেহারা এবং রাজকীয় আচার আচরণ ছাড়াও তোরান ছিল তীক্ষ্ণবুদ্ধি সম্পন্ন এবং বিচক্ষণ একজন লোক। এযাবত আমি যত বুদ্ধিমান মানুষের মোকাবেলা করেছি সে ছিল তাদের মধ্যে অন্যতম। প্রথম সাক্ষাতেই আমাদের মধ্যে একটি পারস্পরিক শ্রদ্ধার বন্ধন সূচিত হল; আর সেই সাথে আমরা একে অপরের উচ্চস্তরের গুণাবলি শনাক্ত করতে পারলাম।

একটি বিষয়ে অবশ্য আমরা উভয়ে এক মত ছিলাম, আর তা হল বর্বর হাইকসোদের প্রতি চরম ঘৃণার মনোভাব পোষণ করা। কোনো ধরনের উস্কানি ছাড়াই গর্হিতভাবে তামিয়াতে ক্রেটান দুর্গে বর্বর হাইকসোদের হামলা আর পরবর্তীতে সেখানে বন্দী ক্রিট সেনাদের উপর নৃশংসতার ঘটনাটি নিয়ে প্রায় একঘন্টা সমবেদনা জানিয়ে কাটালাম। তোরানের সবচেয়ে ছোট ছেলেটিও সেখানে ছিল, আত্মসমর্পণের পর ওরা তার মাথা কেটে ফেলে।

অবশ্য আমরা কেউই বিশাল তিনটি ক্রেটান যুদ্ধ জাহাজ আর হাইকসোরা যে সর্বাধিরাজ মিনোজের ৫৮০ লাখ রূপার পিণ্ড লুট করে নিয়েছিল তা উল্লেখ করলাম না। ব্যাপারটি এমন, যেন এই বিশাল সম্পদের কখনও অস্তিত্বই ছিল না।

মিসরীয় ভাষায় তোরানের স্বাচ্ছন্দ্য বিচরণ লক্ষ্য করে পরিশেষে আমার মনে তোরানের উচ্চ প্রতিভা এবং প্রাগ্রসর ধীশক্তি সম্পর্কে দৃঢ় প্রত্যয় জন্মালো। বিভিন্ন বিষয়ে আমার বেশ কিছু লেখাও সে পড়েছে এবং তা নিয়ে গবেষণাও করেছে। সে জানালো নৌযুদ্ধের কলাকৌশল সম্পর্কে আমার গবেষণামূলক প্রবন্ধটি অবশ্যই একটি প্রতিভামূলক কর্ম। এছাড়া আমার বেশকিছু কবিতা সে মিনোয়ান ভাষায় অনুবাদ করেছে।

দ্বিতীয় দিনে আমরা দুই পরাক্রমশালী জাতির মাঝে প্রস্তাবিত মৈত্রির বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু করলাম। কীভাবে চুক্তিটি সম্পাদিত হবে তার নানা দিক নিয়ে তিন দিন আলোচনা চললো। তারপর চতুর্থ দিনে সন্ধিচুক্তিটি স্বাক্ষরিত হল। আমি অবশ্য চুক্তিটি মিসরীয় গূঢ়লিপি এবং মিনোয়ান রৈখিক এ-হরফে লিখে রেখেছিলাম।

আমি ভাবলাম এবার রাজকুমারীদেরকে পরিচয় করিয়ে দেবার উপযুক্ত সময় এসেছে। পরদিন সন্ধ্যায় তাকে আমাদের সাথে নৈশভোজে আমন্ত্রণ জানালাম।

মদ এবং খাবারের বিভিন্ন পদগুলো বাছাই প্রক্রিয়ায় আমি ব্যক্তিগতভাবে তত্ত্বাবধান করলাম। খাবারের তালিকাটি ক্রিটের সাথে সম্পাদিত সন্ধিচুক্তিটির মতো দীর্ঘ ছিল। তারপর সারা বিকেল আমার দুই রাজকুমারীর অনুষ্ঠানের সাজসজ্জার প্রস্তুতি নিয়ে কাটালাম। তোরানকে এমনভাবে প্রভাবিত করতে হবে যাতে সে কুনুসসের রাজপ্রাসাদে রাজকুমারীদের রূপগুণ সম্পর্কে ইতিবাচক বর্ণনা পাঠায় আর এই বিষয়টি আমার জন্য না হলেও মিসরের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

অত্যন্ত সর্তকতার সাথে থিবস থেকে আনা পোশাকের বিশাল সম্ভার থেকে এমন কাপড় আর রং বাছাই করা হল যা রাজকুমারীদের সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে তুলে। বেকাথার জন্য গোলাপি আর তেহুতির জন্য সবুজ রং বাছাই করা হল।

যে দুই সৌন্দর্যবিশারদ তাদের রূপসজ্জা করছিল, আমি তাদের পাশে বসলাম। আমি চাচ্ছিলাম রূপসজ্জায় যেন কোনো খুঁত না থাকে। সমস্ত প্রচেষ্টার পর যখন আমি সন্তুষ্ট হলাম, তখন ওদের প্রায় কাঁদো কাঁদো অবস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছিল, তবে ফলাফল সত্যি চমৎকার হয়েছিল। আমার মেয়েদের চেয়ে বেশি সুন্দর কেবল দেবী ইনানার চেহারাই সেদিন সন্ধ্যায় দেখেছিলাম। আমি জানি তোরান আর ক্রিটে তার প্রভু আমার দুই রাজকুমারীর সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ না হয়ে থাকতে পারবে না।

সেদিন সন্ধ্যায় নৈশ ভোজের জন্য সুন্দর করে সাজানো টেবিলে তোরান আর অন্যান্য অতিথিরা বসার পর তাদের মদ পরিবেশন করা হল। তারপর আমি দুই রাজকুমারীকে কামরায় প্রবেশ করার সঙ্কেত দিলাম।

বড় দরজা দিয়ে ওরা পাশাপাশি প্রায় ভাসতে ভাসতে ভেতর ঢুকতেই ভোজকক্ষে একটি গভীর নীরবতা নেমে এলো। ওরা ঢোকার সাথে সাথে পুরুষেরা মুগ্ধ হয়ে গেল আর মেয়েরা ঈর্ষান্বিত হল।

রাজকুমারীরা তোরানের সামনে এসে উভয়েই মার্জিতভাবে অভিবাদন করলো।

ওদের পেছন পেছন লক্সিয়াসও এসে মাথা ঝুঁকিয়ে অভিবাদন করলো। অবশ্য এই ক্রেটান মেয়েটির সাজসজ্জার দিকে আমি তেমন মেনোযোগ দেইনি। সে বরং একটি সাধারণ হাঁটু বের করা বেশ খাটো মেটে রংয়ের পোশাক পরেছিল। তার মুখ আর হাঁটুও অবশ্য দেখতে বেশ সুন্দর, তবে তেমন অসাধারণ কিছু নয়। সে নিজেই তার রূপসজ্জা আর চুলের পরিচর‍্যা করেছে। সে অবশ্যই একজন পরিচারিকা আর এটা তার সৌভাগ্য যে ভোজে তাকেও আমি যোগদান করার অনুমতি দিয়েছিলাম।

এতোগুলো সুন্দরী মেয়ের আগমনে তোরানের কি প্রতিক্রিয়া হয়েছে তা দেখার জন্য আমি এক পাশে তাকালাম। লক্ষ্য করলাম আমার দুই রাজকুমারীর মাথার উপর দিয়ে পেছনে তাকিয়ে সে মৃদু হাসছে। সাথে সাথে আমি সেদিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম লক্সিয়াস তার দিকে তাকিয়ে সলজ্জ হাসি দিচ্ছে। এবার আমি বুঝতে পারলাম এর আগে কেন সে রেমরেমের প্রশংসা করেছিল, বুঝা গেল বয়ষ্ক পুরুষের প্রতি মেয়েটির ঝোঁক রয়েছে।

সাথে সাথে তোরানের প্রতি আমার মতের বদল হল। সাহিত্যে উন্নত রুচিসহ আচরণে মধুর ও বিনয়ী এবং সেইসাথে পাণ্ডিত্যপূর্ণ একজন কূটনীতিবিদ হলেও মেয়েদের ব্যাপারে ভালোমন্দ বিচার করার ক্ষমতা তার নেই।

আমি মেয়েদের দিকে তাকিয়ে তাদেরকে তোরানের দুইপাশের আসনে বসার জন্য ইশারা করলাম। তাদের প্রতি আমার নির্দেশ ছিল মিনোয়ান ভাষায় তাদের দক্ষতা দেখিয়ে তোরানকে চমকে দিতে হবে। তারপর হলের শেষ মাথায় তার সমবয়সী আমার অধীনস্থ কর্মকর্তাদের সাথে বসার জন্য লক্সিয়াসকে ইশারা করলাম।

.

পরবর্তী কয়েক সপ্তাহ তোরান, সেনাপতি রেমরেম আর ঊর্ধ্বতন সুমেরিয় সামরিক কর্মকর্তাদের সাথে আমি রাজা গোরাবের বিরুদ্ধে যৌথ অভিযানের পরিকল্পনা আর অন্যান্য খুঁটিনাটি বিষয়টি নিয়ে আলোচনায় কাটালাম। ব্যস্ত দিনগুলো দ্রুত উড়ে যেতে লাগলো আর মনে হলো আর কখনও হয়তো আমি একমুহূর্তও অবসর পাবো না।

ব্যবিলন থেকে কাফেলা সিডনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেবার দুদিন আগে শেষ বারের মতো একবার ইশতার দেবীর মন্দিরে যাবার ইচ্ছা হল। আমার মনে খুব আশা ছিল হয়তো মন্দিরে ইনানার কোনো ধরনের চিহ্ন, তার কাছ থেকে কোনো গুপ্ত বার্তা আর নয়তো তার সেখানে উপস্থিতির কোনো দুর্বোধ্য চিহ্ন হলেও পেয়ে যেতে পারি।

ওনিস নামে সবুজ আলখাল্লা পরা দেবীর একজন পুরোহিতের সাথে বন্দোবস্ত করলাম যেন সমস্ত পূজারিরা মন্দির ছেড়ে চলে যাবার পর যখন মন্দির বন্ধ করে দেওয়া হয় তখন যেন আমি সেখানে ঢুকতে পারি। ইনানার মতোই ধূসর একটি মাথা ঢাকা আলখাল্লা পরে একাকী সেখানে গেলাম। ছোট পকেট দ্বারের কাছে পৌঁছে দেখলাম ওনিস আমার জন্য অপেক্ষা করছে।

তার হাতে একটি রূপার মেম মুদ্রা গুঁজে দিয়ে আমি বললাম, আমি একাই যেতে চাই। সে একটু পিছিয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে আমাকে সম্মান জানিয়ে গীর্জার মূল অংশের ছায়ার মাঝে অদৃশ্য হয়ে গেল।

ছাদের উপরের বিশাল সূর্য-আয়নার প্রতিফলিত আলো না থাকায় মন্দিরটি একটি অন্ধকার ভূতুড়ে জায়গায় পরিণত হয়েছে। সবুজ আলখাল্লা পরা কয়েকজন পুরোহিত আর যাজিকা ছাড়া আর কেউ নেই। ছোট ছোট যে কামরাগুলোতে মেয়েরা দেবীর উদ্দেশ্যে বাধ্যতামূলক সেবা দেবার জন্য অপেক্ষা করতো সেগুলো সব শূন্য। কয়েকটি জমকালো ফ্রেস্কোর সামনে তেলের প্রদীপ জ্বালিয়ে আলোকিত করা রয়েছে।

আঁকা ছবিগুলোর উপর ঢেউ খেলানো আলো নেচে নেচে এগুলোকে রোমাঞ্চকর জীবন দান করছে। আমি কয়েকটা চিত্রের সামনে একটু থেমে এই ছবিগুলো যে দেবতার উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হয়েছে–সেই পবিত্র ও শুদ্ধ দেবতাদের আসল চরিত্রের সাথে এগুলোর দুস্তর ব্যবধানের কথা ভাবলাম। জ্ঞান লাভের উদ্দেশ্যে যখন ইনানা আমাকে শূন্যপথে দীর্ঘ ভ্রমণে নিয়ে গিয়েছিলেন তখন আমি জেনেছি মানুষ দেবতাদের সম্পর্কে যা ভাবে তা বেশিরভাগ তাদের মনের অভিলাসী কল্পনা। প্রার্থনা, উৎসর্গ কিংবা ধার্মিক স্বীকারোক্তির মাধ্যমে দেবকূলকে মানুষ তার ইচ্ছার দিকে ফেরাতে পারে বলে যে কথা বলা হয় তা অত্যন্ত হাস্যকর একটি ধারণা। দেবকূল যা ভালো মনে করেন তাই করেন আর তা শুধু নিজেদের ক্ষমতা আর আনন্দের কারণেই করেন।

গুহাসদৃশ কামরাটির সব জায়গা ধীরে ধীরে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও এগুলোতে ইনানার বিন্দুমাত্র অস্তিত্ব খুঁজে পেলাম না। দেবীকে প্রলুব্ধ করে এখানে এনে তাকে জিতে নেওয়ার প্রচেষ্টায় রাজা মারদুক এই বিশাল স্বপ্ন সৌধটি গড়ে তুলেছিলেন, তবে আমি জানি দেবী কখনও শিকার হন না; বরং তিনিই শিকারী।

মন্দিরের বাইরের দেয়াল ঘিরে ঘুরে ঘুরে উপরের দিকে উঠে যাওয়া বারান্দায় উঠলাম। এখানেই মাঝে মাঝে তাকে দেখা গিয়েছিল কিন্তু এখানে কিছুই নেই। উপরে সমতল ছাদে উঠে বিশাল ধাতব আয়নাটির পাশে বসলাম। এখান থেকেই দিনের বেলা নিচে গীর্জার মূল অংশে সূর্যরশ্মি প্রতিফলিত করা হয়।

উপরে মধ্যরাতের তারাভরা আকাশের দিকে তাকিয়ে খুঁজলাম। কিন্তু সেখানেও তিনি আমার জন্য কিছুই রেখে যান নি। আমার কাছে শুধু তার স্মৃতি আর তিনি যে কথা দিয়েছিলেন আবার ফিরে আসবেন এটিই আছে।

.

নগরীর মূল ফটকের বাইরে রাজা নিমরদ একটি রাজকীয় প্যাভিলিয়ন নির্মাণের নির্দেশ দিয়েছিলেন। পতাকা, ফুল আর পাম পাতাদিয়ে এটি সাজানো হল। যেদিন আমরা সিডনের পথে যাত্রা শুরু করবো সেদিন রাজা এখানে উঁচু মঞ্চে এসে তার স্থান নিলেন।

তাকে ঘিরে দাঁড়াল সুমেরিয় অভিজাত সম্প্রদায়, তার ঊর্ধ্বতন সামরিক নেতৃবৃন্দ এবং নগরীর বিশিষ্ট নাগরিকগণ। সেনাপতি রেমরেম, কর্নেল হুই আর অন্যান্য যেসব মিসরীয় কর্মকর্তাদের এখানে থাকার কথা তারাও মঞ্চে ছিলেন।

মূল দলের আগেই আগের দিন আমি চাকরবাকর, ক্রীতদাস আর অন্যান্য অসামরিক লোকজনদের পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। তাদের সাথে মালপত্র বোঝাই চারচাকার গাড়ি, অতিরিক্ত ঘোড়া আর উটগুলোও ছিল। এখন শুধু রয়েছে কর্মকর্তা আর সেনাবাহিনীর সদস্যরা।

আমাদের সমস্ত রথ, অস্ত্রশস্ত্র আর বর্ম মেরামত করা হয়েছে। পলিশকরা জিনিসগুলো রোদে চকচক করছে। ঘোড়া আর উটগুলোকে দানাপানি খাইয়ে, বিশ্রাম দিয়ে পুষ্ট করে তোলা হয়েছে। জারাসও তার লোকজনের প্রতি লক্ষ্য রেখেছিল যেন তাদের প্রতিও সমান যত্ন নেওয়া হয়। এখন আমাদেরকে দেখে মনে হচ্ছে পুরোপুরি সজ্জিত যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত একটি সেনাবাহিনী, যা আমরা আসলেও তাই।

আমাদের দলের অনেকের সাথে স্থানীয় অধিবাসিদের মাঝে গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, তাই এখন এখানে অনেক ক্রন্দনরত নারী দেখা যাচ্ছে। কয়েকজন আবার পেটে বাচ্চাসহ ফুলো পেট নিয়ে এসেছে। সবকিছু মিলিয়ে এই মুহূর্তে একটি উত্তেজনাময় এবং নাটকীয় পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।

তোরান ছিল আমার বাম পাশে আর ডান পাশে আমার দুই রাজকুমারী। লক্সিয়াস মিনোয়ান রাষ্ট্রদূতের পেছনে জায়গা করে নিয়েছিল। এতে আমি খুব একটা অবাক কিংবা বিরক্ত হইনি। অমি জানতে পেরেছি সে আর এখন রাজকুমারীদের সাথে একই কামরায় শোয় না। তোরান বাগদাদে আসার পর থেকেই সে নিজের জন্য আলাদা একটি থাকার জায়গা করে নিয়েছে।

দুই পাশে রাষ্ট্রদূত আর রাজকুমারীদের নিয়ে আমি ঘোড়ায় চড়ে এগোলাম। আমাদের ঠিক পেছন পেছন সেনা-পল্টনের বাদকদল শিঙা, বাঁশি আর ঢাক নিয়ে এলো। নগরীর ফটক পার হয়ে রাজকীয় মঞ্চ বরাবার এসে আমরা থামলাম। আমি ঘোড়া থেকে নেমে সিঁড়ি বেয়ে মঞ্চে উঠলাম।

রাজা নিমরদের সামনে এসে আমি এক হাঁটু গেড়ে বসার সাথে সাথে বাজনা থেমে গেল আর জনতা শ্রদ্ধাভরে নিশ্চুপ হল। রাজা আমাকে টেনে দাঁড় করিয়ে একজন ভাইয়ের মতো আমাকে আলিঙ্গন করলেন। এটা এজন্য করেছেন, কেননা আমি তার রাজ্য আর সেনাবাহিনী পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে এনেছি। এছাড়া তাকে আমি একজন ধনবান ব্যক্তিতে পরিণত করেছি আর তার পিতা রাজা মারদুক যে সম্পদ তছনছ করেছিলেন তার কিছু অংশ পুনস্থাপন করেছি।

আমরা চিরকাল বন্ধুত্বের শপথ নিলাম, আমার পক্ষ থেকে যা ছিল অকৃত্রিম। তারপর আমি বিদায় নিলাম।

ঘোড়ার পিঠে চড়ার পর ডান হাত তুলে আমি যাত্রা শুরু করার ইঙ্গিত করতেই বাদকদল সেনাবাহিনীর নিজস্ব প্রারম্ভিক সুর বাজাতে শুরু করলো।

এমন এক মুহূর্তে আমার বাম পাশ থেকে একটি আদুরে গলা এমনভাবে চিৎকার করে উঠলো যা নগরীর বিশাল দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো।

রাজকুমারী বেকাথা চিৎকার করে উঠলো, থামো! সাথে সাথে বাদকদল তাদের বাজনা আর তার সাথে জনতার হৈহুল্লোরও অস্বস্তিকরভাবে থেমে গেল। আমিসহ সবাই তার দিকে ঘুরে তাকালাম।

শান্ত কণ্ঠে আমি জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে, বাছা? লক্ষ্য করলাম তার সেই পুরোনো বিখ্যাত বদমেজাজে ফেরার উপক্রম করছে। সম্ভবত তার এই মেজাজ হারিয়ে ফেলার পেছনে আমিও কিছুটা দায়ী। অতীতে বেশি বেশি আদর দিয়ে আমি তার এই অবস্থার সৃষ্টি করেছি।

ডান হাত বাড়িয়ে বেকাথা হুইয়ের দিকে নির্দেশ করে সে বললো, হুই কী মনে করেছে, মঞ্চে সেনাপতি রেমরেমের পেছনে লুকিয়ে সে কী করছে অথচ এদিকে আমি পৃথিবীর শেষ প্রান্তে বিরান আর হতচ্ছাড়া এক জায়গায় রওয়ানা দিয়েছি। দেখো কী রকম কাপুরুষের মতো ওখানে লুকিয়ে রয়েছে!

লক্সিয়াস বেকাথাকে মনে করিয়ে দিল, তুমিতো বলেছিলে হুইকে আর কখনও দেখতে চাও না।

বেকাথা তার দিকে ফিরে বললো, তুমি এখানে নাক গলাতে এসো না। নইলে কিন্তু খুব পস্তাবে!

এবার তেহুতি লক্সিয়াসের সাহায্যে এগিয়ে এসে বললো, লক্সিয়াস ঠিকই বলেছে। তুমি নিজে বলেছো তুমি হুইকে ঘৃণা করো।

আমি কখনও একথা বলিনি। কখনও ঘৃণা শব্দটা ব্যবহার করিনি।

এবার দুজনেই একসাথে বলে উঠলো, হ্যাঁ তুমি বলেছো। আর তেহুতি আরেকটু এগিয়ে বললো, তুমি একথাও বলেছিলে যে তার মাথা কেটে ফেলবে।

রাগে বেকাথার চোখে পানি এসে গেল। সে বললো, আমি কখনও মাথা কেটে ফেলার কথা বলিনি। আমি শাস্তি দেবার কথা বলেছিলাম। বলেছিলাম তাকে আমি শাস্তি দেবো।

মঞ্চে যারা পেছনদিকে ছিল, তারা সামনের দিকে যারা একটু আধটু মিসরী ভাষা জানে এমন লোকদেরকে জিজ্ঞেস করলো, সে কী বলছে?

মেয়েটি বলেছে সে কোনো একজনের মাথা কেটে ফেলবে। একথা শুনে ভীড়ের মধ্যে ছোট ছোট বাচ্চারা আবদার শুরু করলো তাদেরকে বাবামার কাঁধে উঠাতে যাতে ওরা ভালোভাবে মাথা কাটার দৃশ্যটা দেখতে পারে।

এবার আমিও ওদের কথার মাঝে ঢুকে সতর্কভাবে বললাম, আমিও শুনেছি, তুমি বলেছিলে, হুই একজন গেঁয়ো ভূত আর বর্বর লোক।

আমি শুধু বলেছিলাম আমার দিকে তাকিয়ে তার হাসা উচিত হয়নি।

তাহলে তুমি মনে করো সে দেখতে বিশ্রী নয়?

এবার সে চোখ নামিয়ে নিচু কণ্ঠে বললো, এটা সত্যি না। আসলে সে একজন মজার ধরনের সুন্দর মানুষ।

আর তার পাঁচজন স্ত্রী?

সে আমাকে কথা দিয়েছে সে ওদেরকে বাড়িতে ওদের মায়ের কাছে পাঠিয়ে দেবে।

আমি চোখ পিটপিট করলাম। তাহলে ব্যাপার অনেকদূর এগিয়েছে। তারপর বললাম, তাহলে এটা ভালোই হয় তাকে আমরা এখানে ব্যবিলনে রেখে যাই কিংবা তুমি তোমার প্রতিজ্ঞা মতো তার মাথা কেটে ফেল।

এমন ভয়ানক কথা বলো না তাতা। ঠিক বলছো তো, তুমি কি তাহলে চাও হুই আমাদের সাথে ক্রিট চলুক?

সে হেসে ঘাড় কাত করলো। রেকাবে পা রেখে দাঁড়িয়ে আমি সবার মাথার উপর দিয়ে চিৎকার করে বললাম, হুই! তোমার সব জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে কুঁচকাওয়াজের জন্য সারিতে দাঁড়াও। আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করতে পারবো না। সূর্যাস্তের আগে পল্টনে যোগদান না করলে তোমাকে বিনা ছুটিতে অনুপস্থিত দেখাবো।

জুতার গোড়ালি দিয়ে ঘোড়ার পাঁজরের কাছে লাথি দিতেই ঘোড়া চলতে শুরু করলো। চোখের এক কোণ দিয়ে লক্ষ্য করলাম হুই ব্যস্তসমস্ত হয়ে মঞ্চ থেকে দ্রুত নেমে পড়ছে। রেমরেমের প্রতিবাদ উপেক্ষা করে সে তার বাক্সপ্যাটরা আনার জন্য নগরীর ফটকের দিকে ছুটলো।

মনে মনে বেশ খুশি হলাম। একটি কঠিন পরিস্থিতি থেকে মাত্র উতড়েছি। এতে আমার ব্যক্তিগত কোনো লাভ না হলেও মিসরের শ্রেষ্ঠ রথিকে আবার অধীনে আনতে পেরেছি আর আমার আদরের বেকাথাকে আবার খুশি করেছি।

.

পরবর্তী ছয়টি দিন ইউফ্রেটিস নদীর তীর ধরে উত্তর-পশ্চিমে চলতে লাগলাম। তারপর রেসাফা শহরে পৌঁছে রাজার প্রধান জনপথে পৌঁছলাম। তারপর ঘুরে এই জনপথ ধরে পর্বতের মধ্য দিয়ে উঁই ফুলের শহর আশ-শাম পর্যন্ত গেলাম।

লোহিত সাগর ছেড়ে আসার পর আমরা এক বিশাল বৃত্ত জুড়ে চলছিলাম, যার কারণে একবারও হাইকসো অধিকৃত এলাকার সাতশো লিগের কাছাকাছি হই নি।

জেসমিন শহর থেকে শেষ পর্যন্ত আমরা সরাসরি পশ্চিমে সিডন বন্দরে পৌঁছলাম। এর অবস্থান ছিল মধ্য সাগরের পূর্ব উপকূলের শেষ প্রান্তে। এই অংশটি ছিল আমাদের সফরের সবচেয়ে চমৎকার আর আনন্দদায়ক অংশ। এপথে আমাদের লেবাননের পাহাড় আর জঙ্গলের মধ্য দিয়ে চলতে হয়েছিল।

জনপথের দুইপাশে প্রকাণ্ড সেডার গাছের সারি। কোনোকালেও এসব গাছে কুঠারের কোপ পড়েনি। উঁচু স্তম্ভের মতো গাছগুলো দেখে মনে হচ্ছিল যেন এর উপর আকাশ হেলান দিয়ে রয়েছে, তারপর উপরে দেবতাদের বাড়ির দিকে চলে গেছে। বছরের এই সময়ে মাত্র বরফ পড়তে শুরু করেছে, গাছের উপরের শাখাগুলো শুভ্র তুষারের মালা পরে সেজে রয়েছে আর বাতাসে গাছের আঠার তীব্র গন্ধ পাওয়া যাচ্ছিল।

নিচে উপকূলের দিকে এগোতেই আবহাওয়া উষ্ণ হতে লাগলো, গা থেকে আমরা পশমি পোশাক আর জেসমিন শহর থেকে কেনা ভারী পশমি শাল খুলে ফেললাম। সেডার বন থেকে বের হয়ে আবিষ্কার করলাম সামনে আরেকটি পর্বত দাঁড়িয়ে রয়েছে। আমার পথ প্রদর্শক জানালো এর নাম রানা পর্বত, কেনানি ভাষায় যার অর্থ নিখুঁত সৌন্দর্য। ফোনিশিয় বন্দর টায়ার আর সিডনের মাঝে মধ্য সাগরের উপকূলে এর অবস্থান। বন্দর দুটির মাঝে দূরত্ব প্রায় দুশো লিগ।

এই পর্বতের কাছে এসে বাণিজ্য পথটি দুই দিকে চলে গেছে। আমরা ডানদিকের পথ ধরে রানা পর্বত ঘুরে এই প্রথম সাগরের দেখা পেলাম। দিগন্ত বিস্তৃত বিস্ময়কর ঘন আকাশনীল জলরাশি ছড়িয়ে রয়েছে। এমনকি উঁচু হয়ে থাকা মেঘের পেটও নিচের পানির নীল রঙে প্রতিফলিত হয়ে নীল হয়ে রয়েছে।

সিডন বন্দর উপকূলের সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী এবং অন্যতম ব্যস্ত বন্দর নগর। বন্দরে প্রচুর জাহাজ ভীড় করে রয়েছে। এমনকি দূরেও বড় বড় জাহাজের পালে ক্রিটের দুই মাথাওয়ালা কুঠারের প্রতীক দেখা যাচ্ছে। এই জাহাজ বহর নিয়েই তোরান ক্রিট থেকে এখানে এসেছে। সে আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তার জাহাজের নেতৃত্ব গ্রহণ করার জন্য আগেই চলে গিয়েছিল। আমাদের ক্রিটে পৌঁছার সংবাদ সর্বাধিরাজ মিনোজকে জানাবার জন্য সে জাহাজ নিয়ে আগেই চলে গিয়েছিল।

বন্দরের পাথরের দেয়ালের বাইরে অর্ধ লিগ দূরত্বে রাস্তার পাশে একটি খোলা জায়গা আমি বেছে নিলাম। রানা পর্বতের ঢাল বেয়ে নেমে আসা একটি নদীর পানি আমাদেরকে যথেষ্ট পানি যোগাবে। আমি জারাসকে এখানে তাঁবু গাড়তে নির্দেশ দিলাম। তাঁবু গাড়ার আগেই নগরী থেকে একটি প্রতিনিধি দল আমাদের দিকে এগিয়ে এলো।

দলটির নেতৃত্বে ছিল আলখাল্লা পরা একজন উচ্চপদস্থ সুমেরিয় রাজকর্মকর্তা। ঘোড়ায় চড়ে আমার কাছে এসে সে ঘোড়া থেকে নামলো।

সম্মান জানাবার প্রতীক হিসেবে মুষ্টিবদ্ধ হাত বুকের কাছে চেপে ধরে বললো, আমি সিডন প্রদেশের শাসনকর্তা নারাম সিন। আমি জানি আপনি প্রভু তায়তা। আপনার সুনাম ইতোমধ্যেই সারা সুমেরিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে। আমার প্রতি রাজা নিমরদের কঠোর নির্দেশ রয়েছে আপনাকে যথাযথ সম্মান জানাতে এবং আপনার প্রতিটি নির্দেশ সাথে সাথে পালন করার। আমি এখানে এসেছি নিশ্চিত করতে যাতে আপনার এবং রাজপরিবারের মহিলাদের প্রতি সঠিক যত্ন নেওয়া হয়।

আপনার আতিথেয়তার জন্য ধন্যবাদ। আমার প্রথম অনুরোধ হল গবাদি পশুর শুকনো খাদ্য, বিচালি যোগানো।

নারাম সিন ঘুরে তার অধীনস্থদের প্রতি যথারীতি নির্দেশ দিল। ওরা চলে যাবার পর গভর্নর আমার দিকে ফিরে বললো, আপনার আর কোনো কিছুর প্রয়োজন থাকলে অনুগ্রহ করে বলুন প্রভু তায়তা।

দয়া করে আমাকে জাহাজ নির্মাণের জায়গায় নিয়ে চলুন, যেখানে আমার নৌবহরের মেরামত কাজ চলছে। মেরামত কাজগুলো দেখার জন্য আমি অধীর হয়ে আছি।

.

যে ছয়টি যুদ্ধ জাহাজ নিমরদের কাছ থেকে কিনেছিলাম, প্রথমদৃষ্টিতে সেগুলো দেখে আমি হতাশ হলাম। জাহাজগুলো নির্মাণ কাঠামোর উপর দাঁড় করানো থাকায় জাহাজের যে অংশ পানির নিচে থাকে তা পরীক্ষা করতে পারলাম। আসলে আমি এগুলোর সাথে তামিয়াত দুর্গ থেকে নিয়ে আসা বিশাল মিনোয়ান তিনদাঁড়ি যুদ্ধ জাহাজের তুলনা করে ভুল করেছিলাম। এই

সুমেরিয় জাহাজগুলো আকারে মিনোয়ান জাহাজের অর্ধেক আর এগুলোর নকশা দেখে বুঝতে পারলাম তেমন দ্রুতগামিও নয়।

মন থেকে সমস্ত অলীক ধারণা ঝেড়ে ফেলে হাতে যা আছে তা থেকে ভালো কিছু করার দিকে মনোযোগ দিলাম।

পরবর্তী কয়েক সপ্তাহ দিনের বেশিরভাগ সময় জারাস আর জাহাজ মেরামতকারীদের সাথে কারখানায় কাটালাম। ওরা আপ্রাণ চেষ্টা করছিল ভালো কিছু করতে, কিন্তু আমি তাতে সন্তুষ্ট হচ্ছিলাম না। আমি বার বার নিখুঁত কাজের জন্য তাগাদা দিতে থাকলাম।

প্রতিটি কাঠের তক্তা আর মাস্তুল পরীক্ষা করলাম। বিভিন্ন জায়গা থেকে পেরেক তুলে দেখলাম জং ধরেছে কিনা। জাহাজের মাথায় লাগানো ব্রোঞ্জের পাত পরীক্ষা করলাম। যে আঠা দিয়ে জাহাজের পাটাতনের মধ্যেকার ফাঁকগুলো বন্ধ করা হয়েছে তাতে তলোয়ারের ডগা বিঁধিয়ে দেখলাম কী ধরনের কাজ করা হয়েছে। সমস্ত পাল খুলে তীরে বিছিয়ে পালের মোটা ক্যানভাস কাপড়টি তন্ন তন্ন করে পরীক্ষা করে দেখলাম কোথাও কোনো ছেঁড়া ফাটা কিংবা দুর্বল জায়গা আছে কি না।

তারপর জাহাজের কাঠামোতে বেশ কিছু পরিবর্তন করার নির্দেশ দিলাম। ব্যবিলন থেকে আসার সময় জারাস আর আমি পুঙ্খানুপুঙ্খ এসব নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। আমার আঁকা নকশাগুলো দেখে জাহাজ মেরামতকারী সংস্থার তত্ত্বাবধায়ক কিছু কিছু বিষয়ে আপত্তি তুললেও আমি তা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করলাম।

আমার উদ্দেশ্য ছিল যখন আমরা মিসরের উত্তর উপকূলে হাইকসো বাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমণে যাব তখন এই জাহাজগুলো আমাদের স্থলবাহিনীর সাথে নিবিড়ভাবে সহযোগিতা করবে। আগে সংশয় থাকলেও এখন নিশ্চিত হলাম এই জাহাজগুলোতে বহন করে যখনই প্রয়োজন প্রচুর সেনা দ্রুত নীল নদীর বদ্বীপের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় স্থানান্তর করা যাবে। তবে রথী-সেনারা তাদের রথ আর ঘোড়া ছাড়া অকার্যকর হয়ে পড়ে।

শেষপর্যন্ত জাহাজ মেরামত কারখানার তত্ত্বাবধায়ক আমার দাবী মেনে নিয়ে জাহাজের পেছন দিক দিয়ে ঢাল বেয়ে মাল উঠা নামার জন্য সিঁড়ির পরিবর্তে ঢালু পথ বা র‍্যাম্প তৈরি করতে রাজি হল। আর ডেকের দুই পাশের, দাঁড় টানার বেঞ্চির মাঝে পাটাতনটি মজবুত করতে বললাম, যাতে এতে ঘোড়াসহ বারোটি রথ নিয়ে এমনকি তরঙ্গক্ষুব্ধ সাগরেও যাওয়া যায়।

সত্তরটি ঘোড়ায় টানা রথ বহন করে জাহাজগুলো উল্টোদিকে চালিয়ে নিয়ে যে কোনো তীরে ভিড়ানো যাবে আর রথীসেনারা তাদের ঘোড়ায় টানা রথ নিয়ে সরাসরি জাহাজ থেকে নেমে সাথে সাথে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারবে। আবার উদ্দেশ্য সাধনের পর তাদেরকে আবার একইভাবে তীর থেকে দ্রুত সরিয়ে নেওয়া যাবে।

মেরামত কাজ চলার সময় সর্বাধিরাজ মিনোজের কাছ থেকে তোরানের কাছে নির্দেশ এলো, সে যেন আরও কিছু দিন এখানে থেকে আমাদেরকে সাথে নিয়েই ক্রিটে আসে। মিসরীয় রাজকুমারী আর তাদের প্রতিনিধিদলকে সবচেয়ে বড় ক্রেটান জাহাজে চড়িয়ে নিয়ে আসবে যাতে ওরা সবাই আরামে সাগর পাড়ি দিতে পারেন।

সৌভাগ্যবশত ক্রিটের শাসক আমার প্রতি এই সৌজন্য দেখিয়েছিলেন; নয়তো তোরান আমার এই ছোট্ট সেনাবাহিনীর লড়াই করার ক্ষমতা দেখার সুযোগ পেত না।

জাহাজগুলোর পাটাতনে পরিবর্তনের কাজগুলো শেষ করার সাথে সাথেই ঝড়ের ঋতুও শেষ হল। দেবতাদের কৃপায় আমরা সুন্দর আবহাওয়া আর মোটামুটি শান্ত সাগর পেলাম। তবে ক্রিট যাত্রার আগে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম জাহাজের কাঠামোতে যে পরিবর্তন করা হয়েছে তা সাগরে কতটুকু কার্যকর তা একবার পরীক্ষা করে নেওয়া দরকার। আবার সেই সাথে রথীসেনাদেরও জাহাজের পেছনের ঢালু পথ বা র‍্যাম্প বেয়ে ঘোড়ায় টানা রথ উঠানামার কাজটি অনুশীলন করাতে পারবো।

পাল তুলে আমরা সাগরে ভাসলাম তারপর উপকূলের বেশ কয়েক জায়গায় তীরে জাহাজ ভেড়াবার মতো উপযুক্ত স্থানে জাহাজ ভেড়াবার পর রথীসেনারা ঘোড়ায় টানা রথগুলো নিয়ে সরাসরি জাহাজ থেকে স্থলভূমিতে নেমে গেল। কিছুক্ষণ স্থলভূমিতে ঘুরে ফিরে আবার রথগুলো জাহাজে উঠল। এরকম কয়েকদিন অনুশীলন করা হল। বার বার অনুশীলন করে সৈন্য আর ঘোড়াগুলোকে এই কৌশলী পরিচালনায় দক্ষ করে তোলা হল। পুরোপুরি সন্তুষ্ট হবার পর আমরা আবার সিডনে ফিরে এলাম।

ক্রিট যাত্রার দুই দিন আগে শেষবারের মতো কাজের অগ্রগতি দেখতে জারাস আর হুইকে সাথে নিয়ে আমি ভোরবেলা শিবির থেকে জাহাজঘাটার দিকে হেঁটে রওয়ানা দিলাম। পথে এক চক্ষু একজন ভিখারি গায়ে পড়ে আমার সাথে আলাপ করতে এলো। আমি তাকে এড়িয়ে জারাস আর হুইয়ের সাথে কথা চালিয়ে যেতে লাগলাম। কিন্তু নোংরা লোকটি নাছোড়বান্দা হয়ে আমার জামার হাতা খামচে ধরলো। আমি ঘুরে তাকে আঘাত করার জন্য হাতের লাঠি তুললাম। কিন্তু সে মোটেই ভয় পেলো না, বরং দাঁত বের হেসে বললো, প্রভু এটন আপনাকে এক দান বাও খেলার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। কথাটি শুনে আমি হাতের লাঠি নামিয়ে আমি হা করে তার দিকে তাকালাম। এই কথাটি দাঁতহীন, নোংরা আর দুর্গন্ধযুক্ত এমন একটি লোকের কাছ থেকে আসাটা এমন অসঙ্গতিপূর্ণ যে আমি হঠাৎ চমকে উঠলাম। নিজেকে সামলে নেওয়ার আগেই লোকটি একফাঁকে আমার হাতে একটি প্যাপিরাসের টুকরা গুঁজে দিয়েই পেছনের গলি দিয়ে লোকের ভীড়ে মিশে গেল। জারাস তার পিছু নিতে উদ্যত হতেই আমি তাকে থামিয়ে বললাম, যেতে দাও জারাস। সে একজন বন্ধুর বন্ধু।

জারাস থেমে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, আপনি নিশ্চিত তো সে আপনার পকেট মারে নি? আপনি বললে আমি লোকটিকে ধরে দু-এক ঘা লাগিয়ে সত্য কথাটা তার মুখ থেকে বের করতে পারি।

আমি তাকে বললাম, যা বলছি তাই করো! তাকে যেতে দাও! এখানে ফিরে এসো!

আমি তাড়াতাড়ি তাঁবুতে ফিরে গিয়ে প্যাপিরাসটা খুলে একবার চোখ বুলাতেই বুঝলাম এটা এটনেরই পাঠানো একটি বার্তা। দাম্ভিকতা পূর্ণ চরিত্রের মতো তার হাতের লেখাও দেখলে আমার ভুল হয়না।

দেয়ালের গর্তে থাকা আহবাজপাখির নতুন দ্বীপের বাসায় উড়াল দিয়ে চলে যাওয়া বাধা দিয়ে থামাতে শকুন পূর্বদিকে জানাত থেকে প্যাঁচন মাসের পঞ্চম দিনে দুইশো শেয়াল পাঠিয়েছে।

বার্তার বিষয়বস্তুও স্পষ্ট লেখকের পরিচিতি নিশ্চিত করেছে। আমাদের নিজস্ব গোপন সংকেতে এটন আর আমি গোরাবের নাম দিয়েছিলাম শকুন। দুইশো শেয়ালের অর্থ দুইশো হাইকসো রথীসেনা। জানাত হচ্ছে উত্তর মিসর আর সিনাইয়ের মাঝের সীমান্ত শহর নিল্লোর। দেয়ালের গর্ত হল সিডন। নতুন দ্বীপ হচ্ছে ক্রিট। আর অবশ্যই আহত বাজপাখি হচ্ছে আমার ব্যক্তিগত সংকেতলিপি।

সরল ভাষায় বলা যায়, এটন আমাকে সাবধান করে জানাচ্ছে যে, ষোল দিন আগে গোরাব নেল্লোর থেকে সিডন পর্যন্ত উপকূল ঘেঁষে চলে যাওয়া পথ দিয়ে দুইশো রথীসেনার একটি দল পাঠিয়েছে। এদের উদ্দেশ্য আমার ক্রিট যাত্রা থামানো।

এটা খুব একটা অবার হবার বিষয় নয় যে, গোরাব আমার পরিকল্পনা জেনেছে। থিবস থেকে ব্যবিলন হয়ে এখন এই সিডন পর্যন্ত সফরের এই বিশাল কাফেলায় কেউ না কেউ বেফাঁস মুখ খুলেছে কিংবা অন্য কারও কান খুব খাড়া ছিল। দীর্ঘ দিনের এই সফরে সহজেই এই খবর মেমফিসে গোরাবের কানে গিয়ে পৌঁছেছে আর সেও যথারীতি প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। চলার পথে আমার পরিচয় গোপন রাখার যতদূর সম্ভব চেষ্টা সত্বেও গোরাব জেনে ফেলেছে এই মিশন আমার অধীন হচ্ছে। আমার সুখ্যাতি আমার আগে আগে ছড়িয়ে পড়ে। তবে সে নিশ্চয়ই এটিও জানে যে আমি একজন শক্তিশালী প্রতিপক্ষ।

এটন কীভাবে এই খবর জেনেছে আর তার সত্যতাও বা কতটুকু আর কীভাবে সে এখবর আমার কাছে পাঠিয়েছে তা ভেবে আমি এক মুহূর্তও নষ্ট করলাম না। আমার মতো এটনেরও অনেক পথ জানা আছে। আবার আমার মতো সেও কোনো ভুল করে না।

তাঁবুর ভেতর থেকে মাথা বের করে চিৎকার করে জারাসকে ডাকলাম। সে কাছেই ছিল, হুইকে সাথে নিয়ে সে প্রায় সাথে সাথে হাজির হল।

তাকে বললাম, লোকজনসহ রথগুলো নিয়ে এখুনি জাহাজে চড়। আমি দুপুরের আগেই রওয়ানা দিতে চাই।

হুই জিজ্ঞেস করলো, এবার কোন দিকে? নতুন কোন অনুশীলন?

জারাস তার দিকে ফিরে রাগতো স্বরে বললো, বোকার মতো প্রশ্ন করোনা। তায়তা যা নির্দেশ দিচ্ছেন তা করো, খুব তাড়াতাড়ি।

.

দুপুরের একটু আগে নৌ-বহর নিয়ে আমরা সিডন বন্দর ত্যাগ করলাম। আমার আমন্ত্রণে তোরান আমার জাহাজে উঠে আমার পাশে এসে দাঁড়াল। আমি এই জাহাজটির নাম দিয়েছিলাম নির্মম। জাহাজটি প্রথমে চোখে পড়তেই এটিই ছিল আমার প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া।

পোতাশ্রয় রক্ষার বাঁধ পার হওয়ার সাথে সাথেই আমি দক্ষিণ দিকে জাহাজের মুখ ঘুরালাম। বাকি জাহাজগুলোও আমাকে অনুসরণ করতে শুরু করলো। আমরা তীরের সমান্তরাল চলতে লাগলাম। এটনের পাঠানো সংক্ষিপ্ত তথ্যরে উপর ভিত্তি করে আমি দ্রুত কিছু হিসাব করেছিলাম।

এটনের কথামতো হাইকসো আক্রমণকারীরা নিশ্চয়ই শেমু মাসের পঞ্চম দিন জানাত থেকে রওয়ানা দিয়েছে। সেক্ষেত্রে সিডন পৌঁছতে ওদের চারশো লিগ দূরত্ব অতিক্রম করার কথা। এতো লম্বা দূরত্বে রথীসেনা আর অন্যান্য মালসহ একটি রথ দিনে বিশ লিগের বেশি দূরত্ব চলতে পারবে না। অবশ্য যদি ঘোড়া অচল না হয়ে পড়ে। ঘোড়াকে বিশ্রাম আর বিচালি দিতে হবে। তাহলে সবমিলিয়ে ওদের প্রায় বিশ দিন লাগর কথা। এটনের গুপ্তচরদের তথ্য অনুযায়ী ষোলদিন হল ওরা পথে রয়েছে। তাহলে ওরা সম্ভবত সামনে কেবল আট লিগ কিংবা এর কাছাকাছি দূরত্বে রয়েছে। সূর্য ডুবতেই আমি জাহাজের নোঙর ফেললাম।

যখন তোরান জানতে চাইলো কেন আমি অন্ধকারে জাহাজ নিয়ে যেতে চাচ্ছি না তখন আমি তাকে বুঝিয়ে বললাম, অন্ধকারে আমি শত্রুদেরকে পার হয়ে যেতে চাই না। আর জাহাজ নোঙর করাতে আমাদের সাক্ষাত হতে খুব বেশি দেরি হবে না। হাইকসো রথগুলো বেশ দ্রুত আমাদের দিকে আসছে। সেক্ষেত্রে আশা করি আগামী কাল দুপুরের দিকে ওদের দেখা পাবো।

এই হিসাব তোরানকে জানাতেই সে আরেকটি কঠিন প্রশ্ন করলো আমাকে।

ওরা আমাদের পাশাপাশি এলে আমরা কী করে তা বুঝবো? জাহাজের ডেক থেকে তো কেবল মাঝে মাঝে উপকূলের রাস্তা দেখা যাবে।

আমি তাকে বললাম, ধূলা আর ধূঁয়া।

বুঝলাম না।

দুইশো রথ টেনে নিয়ে ছুটতে ছুটতে চলার পথে ঘোড়ার খুর ধূলি উড়িয়ে ধূলার মেঘ সৃষ্টি করবে। সাগরে অনেক দূর থেকে তা দেখা যাবে।

তোরান মাথা নেড়ে সায় দিয়ে আবার প্রশ্ন করলো, আর ধূঁয়া?

হাইকসোদের মর্মস্পর্শী একটি অভ্যাস হল চলার পথে ওর প্রতিটি গ্রাম পুড়িয়ে দেয়। অনেক সময় বাসিন্দাদের ঘরের ভেতরে আটকে রেখে। বুঝতেই পারছেন ওদের এগিয়ে আসাটা জানা যাবে ধূলার মেঘ আর ধূঁয়ার স্তম্ভ থেকে। এজন্যই ওদেরকে আসলেই কেউ ভালোবাসে না।

আমার ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী দ্বিতীয় দিন দুপুরের ঘন্টা খানেক পর তীরভূমির কয়েকশো কদম ভেতরে গাছের জঙ্গলের পেছন থেকে ধূঁয়ার কুণ্ডলী উড়তে দেখা গেল।

আমি মাস্তুলের ডগায় চড়ে সেখান থেকে দেখলাম মাত্র আগুন জ্বালানো হয়েছে। প্রথম ধূঁয়ার কুণ্ডলীর পেছনে আরও তিনটি আলাদা জায়গায় ধূঁয়ার কুণ্ডলী উড়তে শুরু করলো।

আমি বিড়বিড় করে উঠলাম, গেল আরেকটি গ্রাম আর তার মধ্যেকার সমস্ত জীবিত প্রাণী। আর ঠিক সেই মুহূর্তে দেখলাম দুজন নারী ঝোঁপঝাড় পেরিয়ে প্রাণভয়ে সাগরের দিকে ছুটে আসছে। এদের মধ্যে একজন একটি ছোট্ট শিশু কোলে নিয়ে ছুটছিল আর মাঝে মাঝে পেছন ফিরে তাকাচ্ছিল। তীরের হলুদ বালুর উপর দিয়ে ছুটতে ছুটতে ওরা পানির কিনারায় এসে আমাদের জাহাজ দেখতে পেয়ে হাত দিয়ে বার বার ইশারা করে ডাকতে লাগলো।

এরপর হঠাৎ ঝোঁপঝাড় পেরিয়ে একটি হাইকসো রথ এদিকে আসতে দেখা গেল। এতে তিনজন লোক ছিল। ওরা সবাই হাইকসো বর্ম আর গোল বাটির মতো আকৃতির ব্রোঞ্জের শিরস্ত্রাণ পরে ছিল। সাগরের কিনারায় নরম চোরাবালিতে পৌঁছার আগেই রথচালক রাশ টেনে ঘোড়া থামাল। তিনজনই রথ থেকে লাফিয়ে নেমে ছুটন্ত নারীদের পিছু নিল। আমাদের জাহাজের দিকে ফিরেও তাকাল না। আমরা তীর থেকে অনেক দূরে থাকায় ওরা মোটেই ভীত হয়নি। ওরা কেবল ছুটে পালানো নারীদুটোর দিকে তাদের মনোযোগ নিবদ্ধ করে রেখেছিল। আমার তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে আমি জানি মেয়েগুলোর সাথে যা করার তা করার পর ওরা শিশুটির উপরও বর্বর আচরণ করবে।

তোরান কোয়ার্টারডেক থেকে চিৎকার করে বললো, আপনি কি মেয়েগুলোকে উদ্ধার করবেন না?

আমি উত্তর দিলাম, এখানে নিরাপদে জাহাজ ভেড়াবার কোনো জায়গা নেই। হাইকসো কুকুরগুলো এখন কিছুক্ষণ বাঁচুক, তারপর ওদের দুইশোজনকে কচুকাটা করবো। তারপর কাণ্ডারিকে নির্দেশ দিলাম তীর থেকে একটু দূরত্ব বজায় রেখে এগিয়ে যেতে। তোরান জাহাজের পেছনের রেলিং ধরে তীরের দিকে তাকিয়ে লক্ষ্য করতে লাগলো মেয়েগুলোকে ধরার পর হাইকসো রথীসেনারা কীরকম অত্যাচার করছে। দৃশ্যটি দেখে প্রচণ্ড রাগে আর আতঙ্কে সে চিৎকার শুরু করলেও আমি তা উপেক্ষা করলাম।

তীরে কী হচ্ছে তা একবারও আমি ফিরে তাকালাম না। এরকম শত শত দৃশ্য আমি দেখেছি। তার চেয়ে বরং আমার ছোট্ট নৌবহরটি নিয়ে স্থলভূমি থেকে দূরে সরে যাওয়ার দিকে মনোযোগ দিলাম। সাগরে বেশ কিছু দূর যাওয়ার পর আবার ঘুরে তীরের সমান্তরাল হয়ে যে পথ দিয়ে এসেছিলাম সেই পথেই ফিরে চললাম।

কয়েক ঘন্টা আগে আমরা পাথরবেষ্টিত একটি ছোট পোতাশ্রয় পার হয়ে এসেছিলাম। একটি বড় নদী মূলভূমি থেকে এখানে এসে মিশেছে। এই শুষ্ক মৌসুমে নদীটি শুকিয়ে একটি ক্ষীণ জলধারায় পরিণত হয়েছে। উপকূল দিয়ে যে রাস্তাটি চলে গিয়েছে, তা নদীর অগভীর একটি অংশে এসে আবার অপর পার দিয়ে চলে গেছে। এই অংশটি হেঁটে বা রথ নিয়ে পার হয়ে আবার রাস্তায় উঠা যায়। নদীর এই অংশের দুই তীর বেশ খাড়া পাথুরে। হাইকসোদের রথগুলো রাস্তা দিয়ে এসে এখানে পৌঁছে বেশ কঠিন বাধার সম্মুখিন হবে। তাদেরকে প্রতিটি রথ হাতে ধরে নদীর এই অগভীর অংশ পার হতে হবে। এতে তারা অরক্ষিত হয়ে পড়বে।

সকালে এই পোতাশ্রয়টি পার হওয়ার সময় আমি হলুদ বালুর একটি সঙ্কীর্ণ বেলাভূমি দেখেছিলাম। উত্তরের শেষ মাথায় একটি অন্তরীপের পেছনে বেলাভূমিটির অবস্থান। এখানে সৈকতের বালু বেশ শক্ত ছিল, আমাদের রথগুলো সহজেই এখান দিয়ে এগিয়ে সামনের শক্ত মাটিতে গিয়ে পড়বে।

উপকূল ধরে পেছন দিকে চলে আমি এই প্রাকৃতিক পোতাশ্রয়ের দিকে চললাম। অতর্কিত আক্রমণের জন্য ওত পেতে থাকার একটি সুন্দর জায়গা। আমার অন্য জাহাজগুলোর কাছাকাছি গিয়ে চিৎকার করে সৈন্যদেরকে নির্দেশ দিলাম। তীরে নামার জন্য যে জায়গাটি আমি বেছে নিয়েছিলাম ওরা আমার জাহাজকে অনুসরণ করে সেই দিকে চললো। দাঁড়িরা গতি বাড়িয়ে আক্রমণের গতিতে বৈঠা বাইতে শুরু করলো। স্বাভাবিক গতিতে দাঁড়িরা কোনো বিশ্রাম না নিয়ে এক নাগাড়ে তিন ঘন্টা পর্যন্ত বৈঠা বাইতে পারে। আর আক্রমণাত্মক গতিতে বৈঠা বাইলে একঘন্টাতেই ওরা ক্লান্ত হয়ে পড়ে।

অত্যন্ত দ্রুত গতিতে বৈঠা বেয়ে আমরা অতি শিঘই সামনেই পোতাশ্রয়টি দেখতে পেলাম।

ভালোভাবে লক্ষ্য করে দেখলাম, আমি যা ভেবেছিলাম তার চেয়েও জায়গাটি আমাদের উদ্দেশ্য সাধনের জন্য অনেক উপযুক্ত। সৈকতটি যথেষ্ট চওড়া, একসাথে পাশাপাশি দুটো জাহাজের জায়গা হবে। এর ফলে অতি দ্রুত সৈন্যদেরকে তীরে অবতরণ করাতে পারবো।

এছাড়া আরেকটি সুবিধা এখানে পাওয়া যাবে। দেখলাম যে পথ দিয়ে হাইকসোরা আসবে, সেই পথে নদীর অগভীর অংশটি পার হওয়ার জন্য রথ নিয়ে এখানে ওরা থামতে বাধ্য হবে। পথটির দুইদিকে ঘন ঝোঁপ আর গাছের সারি রয়েছে। এতে পেছনের সারির রথগুলো সামলানো খুব মুশকিল হবে। সামনে এগোতে পারবে না, কেননা নদী পারাপারের এই অংশে সামনের রথগুলো টেনে নেওয়ার কারণে রাস্তাটি বন্ধ থাকবে। দ্রুত পিছিয়ে যেতেও যেতে পারবে না, কেননা রাস্তাটি খুব সঙ্কীর্ণ হওয়ায় রথগুলো হাতে ঠেলে বা টেনে পেছন দিকে নেওয়া সম্ভবপর নয়। এখন আমি যদি রাস্তার দুই পাশে ঝোঁপের আড়ালে আমার তিরন্দাজদের লুকিয়ে রাখতে পারি, তবে ওরা খুব কাছ থেকে আটকে পড়া রথগুলোর উপর তীর ছুঁড়তে পারবে।

তীরের দিকে এগোতেই আমি হুইকে ইশারা করলাম তার জাহাজটি আমার পাশে আনতে। কাছাকাছি আসতেই চিৎকার করে বিষয়টি বুঝিয়ে নির্দেশ দিলাম। আমি কী চাচ্ছি সে সাথে সাথে তা বুঝতে পারলো। অন্তরীপের পেছনে পৌঁছতেই আমরা একসাথে জাহাজের পাল গুটিয়ে আর বৈঠা চালিয়ে অর্ধবৃত্তে ঘুরালাম, যাতে জাহাজের পেছনদিকটি সৈকতের দিকে মুখ করে থাকে। এখন রথগুলো জাহাজের পেছনে মাল নামাবার র‍্যাম্পের দিকে মুখ করে রইল। ঘোড়াগুলো লাগামে ছিল আর রথিসেনারা অস্ত্রশস্ত্র আর বর্মে সজ্জিত হয়ে তৈরি অবস্থায় রথে অবস্থান নিল।

শেষ মুহূর্তে তোরান উপরের ডেক থেকে ছুটে এসে আমার রথে আমার সাথে তীরে যেতে চাইল। আমি তার সাহসের প্রশংসা করলাম, তবে সে যোদ্ধা নয়। তীরে গেলে সে একটি বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। তাছাড়া সে ছিল সর্বাধিরাজ মিনোজের সাথে আমার একমাত্র যোগসূত্র। সুতরাং তার কোনো ক্ষতি হোক কিংবা সে মারা যাক এই যুদ্ধে তা আমার কাম্য নয়।

তার আবদার প্রত্যাখ্যান করে আমি বললাম, আপনি বরং জাহাজে থেকে সবকিছু প্রত্যক্ষ করুন যাতে পরবর্তীতে সর্বাধিরাজ মিনোজকে জানাতে পারেন! ঠিক সেই মুহূর্তে জাহাজের পেছনের গলুই ভেজা বালুর সাথে প্রচণ্ড জোরে ধাক্কা লাগতেই তোরান পা ফসকে উল্টে পড়ে গেল। ব্যস এতেই আমার সমস্যার সমাধান হল।

পেছনের র‍্যাম্পটি সশব্দে নিচের দিকে খুলে যেতেই আমি চিৎকার করে উঠলাম, যাও! যাও! যাও! চাবুক মেরে আমার দলটিকে জাহাজ থেকে ঢালু পথ বেয়ে নিচে নামার পথের দিকে এগিয়ে নিলাম। ঘোড়াগুলো পানি ছিটিয়ে ছুটে চললো। শুকনো বালুতে পৌঁছার সাথে সাথে আমি রথ থেকে লাফিয়ে নেমে কাঁধ দিয়ে ঠেলে রথটিকে শক্ত শুকনো ডাঙায় টেনে উঠাতে সাহায্য করলাম। তারপর আবার লাফ দিয়ে রথে চড়ে হালকা চালে স্থলভূমির দিকে এগোলাম। একটার পর একটা রথ জাহাজ থেকে নেমে আমাকে অনুসরণ করলো।

উপকূলের রাস্তায় পৌঁছার আগে কয়েকটি জীর্ণকুটিরসহ একটি ছোট্ট গ্রামের উপর দিয়ে যেতে হল। আমাদের দেখেই গ্রামবাসীরা ছুটে এলো। বাচ্চাসহ মেয়েরা আতঙ্কে থরথর করে কাঁপছিল। এদের মধ্যে ছেঁড়া ন্যাকড়া পরা দশজন পুরুষ ছিল। এতে নোংরা আর হতশ্রী লোকগুলোকে মানুষ মনে হচ্ছিল না। তবে এরা হাতে কাঠের মুগর নিয়ে আমাদের প্রতিরোধ করার জন্য দাঁড়িয়েছিল।

না থেমে আমি সুমেরিয় ভাষায় চিৎকার করে তাদের উদ্দেশ্যে বললাম, নারী আর শিশুদের নিয়ে দৌড়ে জঙ্গলে গিয়ে লুকাও। দক্ষিণদিকের রাস্তা দিয়ে একদল লুটেরা আর ধর্ষক সৈন্য আসছে। দুপুরের আগেই ওরা পৌঁছে যাবে। দৌড়াও! যত শিঘ্রি পার এখান থেকে পালাও। আমি জানতাম একটু দূরে জঙ্গলে গিয়ে ওরা লুকাবার জায়গা পাবে। এছাড়া বাঁচার আর কোনো উপায় নেই। ফিরে তাকিয়ে দেখলাম ওরা আমার সাবধান বাণী মেনে বাচ্চাদের নিয়ে ছুটে পালাচ্ছে। সামান্য যা কিছু সম্বল আছে তা নিয়ে ঘরবাড়ি ফেলে আতঙ্কগ্রস্ত বন্যপশুর মতো জঙ্গলের দিকে ছুটছে। ওদের দিকে আর মনোযোগ না দিয়ে আমি সামনের রাস্তার দিকে এগিয়ে চললাম।

রাস্তায় পৌঁছে একটু থামলাম। সত্তরটি রথই নিরাপদে তীরে নেমে আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। সাগরের দিকে তাকিয়ে দেখলাম জাহাজবহরটি ইতোমধ্যেই উপকূলের প্রায় এক লিগ দূরত্বে চলে গিয়ে পরবর্তী অন্তরীপের আড়ালে নোঙর ফেলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কয়েকজন দাঁড়ি আর পাল টানার লোক ছাড়া সমস্ত লোক অস্ত্র হাতে নিয়ে জারাসের অধীনে তীরে নেমে এসেছে। ওরা আমার রথীবাহিনীর পিছু পিছু ছুটে আসছে।

ধারণা করলাম হাইকসোদের এখানে পৌঁছতে বড় জোর দুই থেকে তিন ঘন্টা লাগবে। এসময়ের মধ্যে আমি ওদের মোকাবেলা করার জন্য মোটামুটি একটা অবস্থান নিতে পারবো। পদাতিক সেনাদের নিয়ে জারাস আসা পর্যন্ত জন্য অপেক্ষা করতে করতে আমি নদীর দুই তীরের জায়গাটি সতর্কভাবে নিরীক্ষণ করলাম।

নদীর অপর তীরে জঙ্গল খুব ঘন, রথ যেতে পারবে না। সেক্ষেত্রে জারাস তার পদাতিক বাহিনী নিয়ে ঘন ঝোঁপের আড়ালে লুকিয়ে শত্রুর জন্য অপেক্ষা করবে। অবশ্য নদীর এই তীরে বেশ খানিকটা খোলা জায়গা আছে। এখানে আমরা সুবিধামতো রথগুলো সাজাতে পারবো।

মনে মনে ছক কাটার করার পর আমি হুইকে নির্দেশ দিলাম রাস্তা পার হয়ে জঙ্গলের শেষ প্রান্তে তার রথগুলো নিয়ে লুকিয়ে থেকে আমার পরবর্তী নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করবে। হুই রথীবাহিনীর একজন চৌকশ নায়ক। লক্ষ্য করলাম সে তার রথিসেনাদের রথ থেকে নেমে ঘোড়াগুলোর লাগাম টেনে নিয়ে ধীরে ধীরে রাস্তা পার হবার নির্দেশ দিল। যাতে ঘোড়ার খুর ধূলির মেঘ উড়িয়ে হাইকসোদেরকে আমাদের উপস্থিতি সম্পর্কে সতর্ক করতে না পারে।

রাস্তা পার হবার পর ওরা ঘাসের জমি উপর দিয়ে সামনে গিয়ে রথের মুখ ঘুরিয়ে জঙ্গলের ভেতরে ঘন ঝোঁপের আড়ালে লুকাল। তারপর পেছনে গিয়ে ডালপালাসহ গাছের ডাল কেটে টেনে নিয়ে এসে রথগুলোর সামনে একটা পর্দার আড়াল তৈরি করলো। হুইকে সাথে নিয়ে আমি রাস্তার কিনারায় এসে নিশ্চিত হলাম যেন রথগুলো সম্পূর্ণ লুকানো থাকে।

ইতোমধ্যে তীরন্দাজবাহিনীসহ জারাস এসে পৌঁছালো। শক্তিশালী একটি বাঁকানো ধনুক ছাড়াও প্রত্যেকে কাঁধে অতিরিক্ত একটা ধনুকের ছিলার ফেটি ঝুলিয়ে নিয়েছিল। আর প্রতি তূণীরে পঞ্চাশটি তীরসহ তিনটি চামড়ার তৃণিরও কাঁধে ঝুলিয়ে নিয়েছিল।

ওদেরকে দম নিতে কয়েকমিনিট সময় দেওয়ার পর জারাসকে দেখালাম। নদীর অপর তীরের কোনো জায়গায় সে অবস্থান নেবে। ওরা চলে যেতেই নদীর উঁচু পার থেকে আমি লক্ষ্য করলাম ওরা উঁচু পাড় থেকে দুইশো গজ নিচে নেমে হেঁটে নদী পার হল।

অপর তীরে উঠার আগে ওরা প্রত্যেকে মুখে আর হাতে নদীর কালো মাটি লেপে নিল। সবশেষে জারাস আর তার বিশ্বস্ত সহকারী আকেমি পার বেয়ে তীরে উঠলো।

নদীর অপর তীরের রাস্তায় পৌঁছার পর জারাস তার লোকদেরকে রাস্তার দুই পাশে বিশ কদম পর পর ঘন জঙ্গলে লুকিয়ে রাখলো। মুখে লেপা কালো মাটির মুখোশের কারণে ঘন লতাপাতার জঙ্গলে কাছ থেকেও ওদেরকে দেখা যাবে না। হাইকসোদেরকে অত্যন্ত সুদক্ষ এই দুই সারি তীরন্দাজের মধ্য দিয়ে যেতে হবে।

জারাসের লোকজন রাস্তার দুপাশের জঙ্গলে অবস্থান নেবার পর আমি দ্রুত আমার রথিসেনাদের কাছে ফিরে গেলাম।

সবাই ঠিকমতো লুকিয়েছে নিশ্চিত হবার পর আমি রথের সারির একটু পেছনে একটা উঁচু গাছ বেছে নিয়ে তার উপরের একটি ডালে চড়ে বসলাম। এখান থেকে নদীর দুই তীরের রাস্তা পরিষ্কার দেখা গেল। এমনকি এই উচ্চতা থেকেও জারাসের লোকদের কোনো চিহ্ন দেখতে পাওয়া গেল না।

সমস্ত প্রস্তুতি সুচারু রুপে সম্পন্ন হওয়ার পর আমি দূরে সাগরের দিকে তাকিয়ে দেখলাম আমার নৌবহরও অন্তরীপের পেছনে অদৃশ্য হয়েছে। এবার হাইকসো হামলাকারীদের মোকাবেলা করার জন্য আমি প্রস্তুত।

অনেকক্ষণ গাছের ডালে বসে অপেক্ষা করে সূর্যের অবস্থান লক্ষ্য করে বুঝলাম প্রায় এক ঘন্টা পার হয়েছে। তারপর আমার দৃষ্টিসীমার কিনারায় জারাস যেখান তীরন্দাজদের নিয়ে অপেক্ষা করছে সেখান থেকে বেশ দূরে জঙ্গলের উপরে হালকা ধূলি উড়ছে লক্ষ্য করলাম।

ধূলির মেঘটি ধীরে ধীরে কাছে আসতেই আরও স্পষ্ট হলো। তারপর হঠাৎ ধূলির মেঘের নিচে সূর্যের আলো প্রতিফলিত হয়ে পালিশ করা ধাতব কোনো কিছু চকচক করে উঠলো। সম্ভবত কোনো শিরস্ত্রাণ কিংবা তরবারির ফলা।

একটু পরই আমি দূরে রাস্তার বাঁকে প্রথম রথজোড়া দেখতে পেলাম। নিঃসন্দেহে ওরা হাইকসো। উঁচু রথের গাড়ি আর প্রান্তে চাকু লাগানো জবরজং ধরনের চাকাগুলো দেখে পরিষ্কার বুঝা গেল এরা হাইকসো।

জারাস রাস্তার যে জায়গায় তার তীরন্দাজদের নিয়ে অপেক্ষা করছিল; হাইকসো রথের সারি সেখানে পৌঁছল। সামনের দিকে হাইকসো রথীসেনাদলের প্রধান নদীর অগভীর অংশের কাছে পৌঁছতেই দাস্তানাপরা মুষ্টিবদ্ধ হাত উঁচু করে পেছনের রথগুলোকে থামার নির্দেশ দিল।

তারপর হাইকসো সেনানায়ক সতর্কভাবে নিচে নদীর তলদেশ আর আমাদের দিকের এলাকা পর্যবেক্ষণ করলো। এতোদূর থেকে তাকিয়েও আমি বুঝতে পারলাম সে একজন শৌখিন ফুলবাবু। তার আলখাল্লাটি নীল রংয়ের। গলায় তিনচারটে চকচকে হার ঝুলছে। পালিশ করা ব্রোঞ্জের শিরস্ত্রাণের মুখের অংশটি সুন্দর কারুকাজ করা রূপার। জিনিসটা দেখে আমার খুব লোভ হল।

যখন হাইকসো সেনানায়কটি সন্তুষ্ট হল ভয়ের তেমন কিছু নেই, তখন সে এক লাফ দিয়ে রথ থেকে নেমে পাথুরে পথ দিয়ে নিচে নদীতে নেমে পড়লো। ইতস্তত না করে নদীতে নেমে সে আরও তিনজনসহ হেঁটে নদী পার হয়ে অপর তীরে পৌঁছল। যখন বুঝতে পারলো নদীটি পার হওয়া যাবে তখন সে আবার ফিরে তার রথের কাছে গেল। রথে উঠে চিৎকার করে ঘোড়া ছুটিয়ে নদীর পাড় বেয়ে নামতে শুরু করলো।

নদীর কাছে এসে ঘোড়াগুলো একটু থমকালেও সে চাবুক হাঁকিয়ে ঘোড়াগুলোকে পানিতে নামালো। সামনে এগোতেই পানি পেট পর্যন্ত ছুঁলো। তারপর হঠাৎ একটা ডুবো পাথরে একটা চাকা ধাক্কা লেগে রথটা উল্টে গেল। ডুবে যাওয়া রথের ওজনে আর স্রোতের টানে লাগামে ধরা ঘোড়াগুলো হাঁটু ভেঙে সেখানেই আটকে পড়লো। রথচালক আর অন্য দুজন রথীসেনা রথ থেকে ছিটকে পড়লো। বর্ম আর সাজসরঞ্জামের ভারে ওরা পানিতে তলিয়ে গেল।

সাথে সাথে পেছনের রথের সেনারা তাদের রথ থেকে লাফিয়ে নেমে পানি ঠেলে হেঁটে অগভীর পানিতে নাকানিচোবানি খাওয়া মানুষ আর ঘোড়াগুলোর দিকে এগিয়ে এলো। চিৎকার চেঁচামেচি করে ওরা ডুবে যাওয়ার আগে ওদেরকে ডাঙায় তুলে নিয়ে এলো। তারপর উল্টেপড়া রথটি আবার চাকার উপর দাঁড় করালো। ঘোড়াগুলো ঠিকমতো দাঁড়াবার পর নদীর খাড়া পাড় বেয়ে রথটি টেনে উপরে তুললো। ঝোঁপের আড়ালে ঠিক যেখানে আমরা রথ নিয়ে লুকিয়ে ছিলাম তার সামনে এসে দাঁড়াল।

এরপর শত্রুদের অন্যান্য রথচালকরা বেশ সাবধানে রথ চালিয়ে নদীর বুকে নামলো, সেখানে অপেক্ষামান অন্যান্যরা ঠেলে ধরাধরি করে রথগুলো অপর তীরে উঠিয়ে দিল। গাছের ডালে বসে আমি পরিষ্কার পেছনের রথের সারি দেখতে পাচ্ছিলাম। গুণে দেখলাম সেখানে ১৬০টি রথ রয়েছে। যদিও এটন বলেছিল ২০০ টি রথ আসবে। বুঝতে পারলাম উত্তর মিসর থেকে ষোল দিনের দীর্ঘ যাত্রায় পথে কিছু রথ ওরা হারিয়েছে। ওদের রথগুলো এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যাতে সহজেই চাকা ভেঙে পড়তে পারে। এছাড়া দীর্ঘ পথে উঁচুনিচু পথে ঘোড়াও অচল হয়ে পড়তে পারে।

প্রতিটি রথ নদী পার হয়ে এপাড়ে ডাঙায় পৌঁছার পর রথীরা ঘোড়াগুলোর দুই পা আলগা করে বেঁধে ঘাস খেতে চরে বেড়াতে দিল। তারপর লোকগুলো কেউ ঘাসে শুয়ে পড়লো আর কেউ কেউ আগুন জ্বেলে গরম খাবার রান্না করতে শুরু করলো।

এরকম অপরিচিত আর বৈরী এলাকায় ওদের সেনাপতি সৈন্যদেরকে এরকম ঢিলেঢালা আচরণ করতে অনুমতি দিয়েছে–দেখে আমি অবাক হলেও খুশি হলাম। কোনো পাহারা বসানো হল না কিংবা সামনে রাস্তায় কোনো শত্রুপক্ষের অবস্থান খুঁজে দেখার জন্য কাউকে পাঠালো না। বেশিরভাগই মনে হল বেশ ক্লান্ত। আর জঙ্গলে যেখানে আমাদের রথগুলো লুকানো আছে তার সীমানায় কেউ দেখতে এলো না। এমনকি যারা প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গিয়েছিল তারাও খুব বেশি দূরে গেল না। এই অচেনা বিদেশে হাইকসোসেনারা স্বভাবতই আত্মরক্ষার স্বার্থেই কাছাকাছি থাকছে।

নদীর অপর তীরে জঙ্গলের পথ বেয়ে আসা মানুষ, রথ আর ঘোড়ার সংখ্যা ক্রমশ কমে আসছিল। এপাড়ে আসা রথের সংখ্যা আমি গুণছিলাম। আমি অপেক্ষা করছিলাম সেই মুহূর্তটির যখন শত্রুরা সমান দুইভাগে বিভক্ত হবে আর আপাত কোনো ধরনের আশঙ্কা না দেখে শান্ত হবে। মাহেন্দ্রক্ষণটি কাছে আসতেই আমি পকেট থেকে উজ্জ্বল হলুদ রঙের রুমালটা বের করে ভাঁজ খুললাম।

নীল কোট আর চমৎকার শিরস্ত্রাণপরা হাইকসো অধিনায়ক তখনও নদীর তীরে দাঁড়িয়ে সৈন্য পারাপার তত্ত্বাবধায়ন করছিল। অবশ্য তখনও জারাস আর তার লোকজনের দেখা গেল না, যদিও আমি জানি ওরা ঠিক কোথায় লুকিয়ে আছে।

পরবর্তী হাইকসো রথটি নদীর বুক থেকে উঠে এলো। এটি হল পঁচাশিতম রথ যা নদী পার হয়েছে। এখন হাইকসো সেনারা প্রায় সমান দুইভাগে বিভক্ত হয়েছে। এখন কোনো অংশই অন্য দলকে সহায়তা করার অবস্থায় নেই।

যুদ্ধের কলাকৌশল সম্পর্কে রচিত আমার বিশাল পুস্তকে আমি লিখেছিলাম: ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শত্রু মানে কোনঠাসা হওয়া শত্রু। এখন আমার এই শিক্ষার কার্যকারিতা প্রদর্শনের সুযোগ এসেছে।

গাছের ডালে ভারসাম্য বজায় রেখে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালাম, তারপর উজ্জ্বল হলুদ রুমালটা তিনবার মাথার চারপাশে দোলালাম। নদীর অপর তীরে জারাস সাথে সাথে উঠে দাঁড়াল। মুষ্ঠিবদ্ধ হাত আমার দিকে তুলে সেও উল্টো ইশারা করলো। রণধনুকে তীর জুড়ে সে অন্য হাতে ধরে রয়েছে।

রাস্তার দুই পাশের ঘন ঝোঁপের আড়াল থেকে তীরন্দাজ বাহিনীর সবাই বের হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম। ওরা সবাই একযোগে তীরধনুক তুলে নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করে রইল।

প্রথমে জারাস তীর ছুঁড়লো। শূন্যে উঠে তীরটা নিচের দিকে নামার আগেই আমি বুঝতে পারলাম কাকে লক্ষ্য করে তীরটা ছোঁড়া হয়েছে। হাইকসো অধিনায়ক তখনও জারাসের দিকে পেছন ফিরে নদীর তীরে দাঁড়িয়েছিল। তীরের প্রচণ্ড আঘাতে সে সামনের দিকে হুমড়ি খেয়ে পড়লো, তারপর নদীর খাড়া পাড় বেয়ে পড়ে নিচে অদৃশ্য হয়ে গেল।

জারাস ইতোমধ্যেই দ্রুত আরও তিনটি তীর ছুঁড়ে মারলো। তার সেনারা তাকে অনুসরণ করলো। এক ঝাঁক তীর দ্রুত কালো মেঘের মতো শূন্যে উড়লো তারপর দুই পাশের তীরন্দাজদের মাঝে রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হাইকসো রথীবাহিনীর উপর আঘাত হানলো।

গরমে বেশিরভাগ হাইকসো রথীসেনারা শিরস্ত্রাণ আর বর্ম খুলে রেখেছিল। ঘোড়াগুলোর পিঠে কেবল মোটা কম্বল ছাড়া বাকি শরীর আর পেছন খোলা ছিল। তীরের পাথুর ফলার নরম মাংসে আঘাত হানার পরিষ্কার উফ! উফ্! শব্দ আমি শুনতে পেলাম।

এরপর পরই আহত মানুষের আর্তচিৎকার আর তীরের আঘাতে আহত ঘোড়াগুলোরও দীর্ঘ চিৎকার শোনা গেল। কাছাকাছি ভীড় করে থাকা শত্রুপক্ষের সেনাদের মধ্যে হৈচৈ আর চরম বিশৃঙ্খলা শুরু হল।

আতঙ্কিত ঘোড়াগুলো লাগাম টেনে ছিঁড়ে ছুটে যেতে চাচ্ছিল। যেসব ঘোড়ার পেছনে তীর আঘাত করেছিল যন্ত্রণায় সেগুলো পেছনের পা ছুঁড়ে রথের গায়ে আঘাত করে রথিসেনাদের রথ থেকে ফেলে দিল।

রথচালকরা নিয়ন্ত্রণ হারাতেই যন্ত্রণায় প্রায় উম্মাদ ঘোড়াগুলো ছুটে পালাতে চেষ্টা করলো। কিন্তু বের হবার কোনো পথ না পেয়ে তাদের সামনের রথের গায়ে আছড়ে পড়লো। ফলে দ্রুত একের পর রথগুলো উল্টে পড়লো, চাকা খুলে গেল, ঘোড়া আর চালক যখম হল আর এইভাবে সামনের সারির রথগুলোর উপর গিয়ে পড়লো। ফলে এগুলোও নিচে নদীর গর্ভে পড়ে গেল।

নদীর কোমর পানিতে ডুবে থাকা ঘোড়া, রথ আর মানুষের গায়ে উপর থেকে আরও ঘোড়া, রথ আর মানুষ গড়িয়ে পড়তে লাগলো। সবাই আপ্রাণ। চেষ্টা করছে নদী পার হয়ে অপর তীরে উঠতে। উম্মাদ ঘোড়া, মানুষ আর বিধ্বস্ত ভাঙা রথ মিলে নদীর পথ বন্ধ করে দিয়েছে। সেদিকে যাওয়ার আর কোনো উপায় নেই।

জারাসের তীরন্দাজদের প্রত্যেকের কাছে পঞ্চাশটা তীর ছিল আর এতো কাছের লক্ষ্যে খুব কমই লক্ষভ্রষ্ট হয়েছিল। আমি দেখলাম একটি শত্রু সৈন্য রথ থেকে বের হয়ে ছুটে পালাতে চেষ্টা করছিল, তবে কয়েক কদম যেতেই তিনটি তীর তার পেছনে আঘাত করতেই সে মাটিতে পড়ে গেল।

আমার দিকে নদীর পাড়ে যেসব হাইকসো রথিসেনারা মাটিতে শুয়ে বসেছিল বা রান্না করছিল, ঘটনার আকস্মিকতায় ওরা লাফিয়ে উঠে আতঙ্কিত দৃষ্টিতে অপর তীরে তাদের সহযোদ্ধাদের দিকে তাকিয়ে রইল।

আর দেরি না করে আমি গাছ থেকে নেমে আমার রথের দিকে ছুটলাম। আমার দলের একজন সহযোদ্ধা ঝুঁকে আমার হাত ধরে রথে উঠালো। ঘোড়ার লাগাম হাতে নিয়েই আমি যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ দিলাম। দল সামনে এগোও। আক্রমণ কর! আমার রণহুঙ্কার সারির সবার মাঝে ছড়িয়ে পড়লো।

রথ টানা ঘোড়াগুলো টগবগিয়ে রথ টেনে নিয়ে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এলো। হুই আর আমি মাঝখানে পাশাপাশি ছিলাম। একটা তীরের আকৃতিতে রথগুলো ছুটে চললো।

আমাদের সামনে বেশিরভাগ হাইকসো সেনা, যারা মাটিতে অলসভাবে শুয়ে বসেছিল ওরা সবাই নদীর তীরের দিকে ছুটে গিয়েছিল। এখন ওরা আতঙ্কিত হয়ে নিচে নদীর বুকে আর অপর তীরে জঙ্গলের রাস্তায় সহযোদ্ধাদের দুরবস্থার দিকে তাকিয়ে রইল। জারাসের তীরন্দাজবাহিনী তখনও তাদের উপর তীর বৃষ্টি নিক্ষেপ করে চলছিল।

নদীর এপারে হাইকসোদের একটিও রথে কোনো রথিসেনা ছিল না। আর রথ টেনে নেওয়ার মত কোন ঘোড়াও লাগামে জোতা ছিল না। ঘোড়াগুলো মাঠে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘাস খাচ্ছিল। ওদের বেশিরভাগ রথচালক নদীর তীর থেকে ছুটে এসে ঘোড়াগুলো ধরবার ব্যর্থ চেষ্টা করতে লাগলো। হঠাৎ আক্রমণে হতচকিত হয়ে ঘোড়াগুলো দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে এদিক ওদিক ছুটাছুটি করতে লাগলো।

আমি আর হুই দুজনেই হেসে উঠলাম। চাকার সাথে চাকা লাগিয়ে একটি দুর্ভেদ্য ব্যুহ সৃষ্টি করে আমরা তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম। মাঝখানে কোনো জায়গা নেই যার মধ্য দিয়ে হাইকসোরা পালাতে পারবে। তখনও মনে হচ্ছিল ওরা আমাদের আক্রমণ সম্পর্কে সচেতন নয়। বেশির ভাগই অন্যদিকে তাকিয়ে ছিল। যারা দেখলে তারা আতঙ্কিত হয়ে আমাদের দিকে স্থির হয়ে তাকিয়ে ছিল। ওরা বুঝলো আমাদের আক্রমণ ওরা ঠেকাতে পারবে না। আমরা ধনুকে তীর জুড়ে ধনুক উঁচু করে রেখেছিলাম।

সত্তর কদম আগে থাকতেই আমি তীর ছোঁড়ার নির্দেশ দিলাম। চলন্ত রথ থেকেও আমার ছেলেরা পঞ্চাশ কদম দূরত্ব থেকে একজন ছুটন্ত মানুষের গায়ে তীর লাগাতে পারে। রথে পৌঁছার আগেই অধিকাংশ শত্রু সেনা মাটিতে লুটিয়ে পড়লো।

শুধু একজনকে দেখলাম যে তার রথের কাছে পৌঁছতে পেরেছিল। সে রথের ভেতর থেকে একটা ধনুক আর এক মুঠো তীর তুলে নিল। তারপর আমাদের দিকে ফিরলো। লোমশ শরীরের বিশালদেহী লোকটি রাগে উন্মুক্ত হয়ে একটা বুনো ভালুকের মতো কুঁসছিল। আমরা তাকে আঘাত করার আগেই সে ধনুক তুলে একটা তীর ছুঁড়লো। আমার সারির তৃতীয় রথচালকের গায়ে তীরটি আঘাত করলো। সে ছিল জেনারেল ক্রাটাসের ছেলে। চমৎকার ছেলেটি তার বাবার মতোই সাহসী আর পঞ্চাশ গুণ বেশি সুন্দর ছিল। সে ছিল আমার অত্যন্ত প্রিয়পাত্র। তীরের আঘাতে সাথে সাথে সে মারা গেল।

হাইকসো পশুটি আরেকটি তীর ধনুকে জোতার আগেই আমি তিনটি তীর ছুঁড়লাম। তারপর তার সারা দেহে সজারুর কাটার মতো তীর বেঁধা পর্যন্ত আমাদের তীরন্দাজদের প্রায় সবাই তার গায়ে তীর ছুঁড়লো। তারপর সে দুপায়ের উপর দাঁড়িয়ে আমার দিকে একটা তীর ছুঁড়লো। তীরটা আমার শিরস্ত্রাণের কপালে লেগে টং শব্দ করে একপাশে ছিটকে চলে গেল। তবে আঘাতের ধাক্কায় আমি পেছনের দিকে টলে রথ থেকে প্রায় পড়ে যাচ্ছিলাম।

আমি কখনও বলিনি যে হাইকসেরা কাপুরুষ, তবে এই লোকটিকে মারতে সতেরোটি তীর ছুঁড়তে হয়েছিল। এর মধ্যে পাঁচটি ছিল আমার, পরে গুণে দেখেছিলাম।

তারপর কসাইয়ের মতো কচুকাটা চললো। এরকম পরিস্থিতিতে সুযোগ এলে আমি সামান্য কশাইগিরির বিরুদ্ধে নই। তবে কশাইগিরির চেয়ে দাস বানানো অনেক লাভজনক। কাজেই আমি পলায়নরপর হাইকসোদের উদ্দেশ্যে তাদের ভাষায় চিৎকার করে বললাম, গোরাবের কুকুরেরা আত্মসমর্পণ করো, আর নয়তো মরো!

আমার দলের সবাই আমার সুরে চেঁচিয়ে উঠলো, আত্মসমর্পণ করো নয়তো মরো! আত্মসমর্পণ করো নয়তো মরো!

বেশিরভাগ হাইকসো সেনা মাটিতে হাঁটুগেড়ে বসে আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে দুই হাত তুললো। কয়েকজন তখনও ছুটে পালাতে চেষ্টা করছিল, তবে আমাদের রথিবাহিনী চতুর্দিক থেকে তাদেরকে ঘিরে ফেললো। ভয়ে আর ছুটাছুটির ক্লান্তিতে ওরা হাঁপাতে শুরু করলো। চারদিকে তাকিয়ে যখন দেখলো উদ্যত ধর্নবাণ তাদের দিকে তাক করে রয়েছে তখন ওরা ভেঙে পড়ে মাটিতে হাঁটুগেড়ে বসে চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করলো, সকল দেবতার নামে দয়া করো! আমাদেরকে প্রাণে মেরো না হে মহান প্রভু তায়তা। আমরা তোমার কোনো ক্ষতি করবো না। দেবতা হোরাসের দিব্যি আমি যশের কাঙাল নই। তবে সত্যি বলতে কী যুদ্ধের ময়দানে শত্রুর তরফ থেকে এরকম স্বীকৃতি লাভ করে একটু খুশি অবশ্যই হয়েছি।

হুইকে নির্দেশ দিলাম, এদের সবাইকে রশি দিয়ে বাঁধো। আর ময়দান থেকে ঘোড়াগুলো নিয়ে এক জায়গায় জড়ো করো। কেউ যেন পালাতে না পারে।

এদিকে জারাসের লড়াইও শেষ হয়েছে আর সে যুদ্ধবন্দীদেরকে বেঁধে রেখে লুষ্ঠিত মালামাল একত্রিত করছিল। এক নজর দেখে বুঝতে পারলাম তাদেরও আমাদের মতো নামমাত্র ক্ষয়ক্ষতিও হয়েছে। জারাস নিজে অক্ষত রয়েছে, সে বন্দীদের আর ঘোড়াগুলো সামলানোর কাজ তত্ত্বাবধায়ন করছে। ঘোড়াগুলোও মানুষের মতো মূল্যবান।

হঠাৎ এদিকে আমাকে দেখে জারাস অভিবাদন জানিয়ে মুখে দুইহাত দিয়ে চোঙা বানিয়ে চিৎকার করে বললো, আপনার তরবারিতে আরও শক্তি সঞ্চিত হল প্রভু তায়তা! সত্যি চমৎকার শিকার হল আজ। শিঘ্রই আমি ঘরে বউ আনতে পারবো।

এটি একটি হালকা রসিকতা। তামিয়াত দুর্গে অভিযানের পর পুরষ্কারের অর্থে তাকে আগেই আমি ধনী বানিয়েছি। যাইহোক প্রত্যুত্তরে আমিও মৃদু হেসে হাত নাড়লাম।

জাহাজগুলো যেখানে লুকিয়ে ছিল সেই অন্তরীপের কাছে গিয়ে নীল পতাকা উড়িয়ে ওদেরকে ডেকে আনতে একজন ঘোড়সওয়ারকে পাঠালাম।

এবার বিজয়ানন্দ দ্রুত উবে যেতে শুরু করলো, কেননা দিনের সবচেয়ে খারাপ কাজটি এখন বাকি রয়ে গেছে। আহত হাইকসো ঘোড়াগুলোর একটা ব্যবস্থা করতে হবে। এই প্রাণীগুলোর প্রতি সবসময় আমার গভীর ভালোবাসা রয়েছে। মিসরে আমিই প্রথম একটি বুনো ঘোড়াকে পোষ মানিয়েছিলাম।

দশটি ভালো ঘোড়ার খালি পিঠে চড়ে আমাদের সহিসরা অন্যান্য বেশি আহত ঘোড়াগুলো থেকে এদেরকে আলাদা করলো। তারপর এদেরকে উপকূলের রাস্তা ধরে সিডনের দিকে পাঠিয়ে দিলাম। প্রশিক্ষপ্রাপ্ত এই রথের ঘোড়াগুলো যথেষ্ট মূল্যবান।

যেসব ঘোড়া মারাত্মক আহত হয়েছিল সেগুলোর যন্ত্রণা লাঘব করার জন্য সাথে সাথে ব্যবস্থা গ্রহণ করলাম। প্রথমে এগুলোর মুখের সামনে গুড়োকরা বজরা ধরলাম। তারপর যখন মাথা নিচু করে একমুঠো বজরার দানা মুখে পুরলো তখন আমার লোক ব্রোঞ্জের মাথাওয়ালা একটা ভারী মুগর পশুটির দুই কানের মাঝে মাথায় জোরে আঘাত করে মাথার খুলি গুঁড়িয়ে দিল। এতে এদের দ্রুত শান্তিপূর্ণ মৃত্যু হল।

বীভৎস এই কাজটি শেষ করার পর হাইকসো বন্দীদের দিকে নজর ফেরালাম। ঘোড়া ভালোবাসলেও এগুলোর মালিকদের প্রতি আমার প্রবল ঘৃণা ছিল। বন্দীদের সারির মাঝ দিয়ে হেঁটে তাদের অবস্থা দেখলাম। যারা আহত হয়নি কিংবা সামান্য আহত হয়েছে তাদেরকে সৈকতে পাঠালাম আমাদের জাহাজগুলো সেখানে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে।

তবে অনেক বন্দী মারাত্মভাবে আহত হয়েছিল, তাদেরকে দাস হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। বুকের গভীরে তীর বেঁধা অবস্থায় একজন মানুষ বৈঠা বাইতে পারবে না। এদেরকে ছায়ায় নিয়ে সামান্য পানি দিতে বললাম। আর বেশিক্ষণ এরা বাঁচবে না। এদের সময় ঘনিয়ে এসেছে।

একেবারে শেষে আমার নিজের আর রাজকুমারীদের কথা ভাবার এক মুহূর্ত সময় হল। আবার রথে চড়ে নদী পারাপারের উঁচু তীরের কাছে গিয়ে রথ থামালাম। ঘোড়ার লাগামে রথ চালকের হাতে দিয়ে গিরিখাতের ধারে হেঁটে গেলাম। যুদ্ধক্ষেত্রের এই জায়গায় কেউ জীবিত নেই। শত্রু বাহিনীর অধিনায়কের মৃতদেহটি কোথায় খুঁজতে হবে ঠিক জানতাম। তারপর নদীর অপর তীরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা লাশ, ভাঙা রথের অংশ আর অন্যান্য সরঞ্জামের মাঝে খুঁজতে খুঁজতে নীল রঙের আলখাল্লাটি দেখতে পেলাম। নদীর একেবারে কিনারায় দেহটি পড়ে রয়েছে।

সাবধানে খাড়া পাড় বেয়ে নামতে শুরু করলাম। নিচে নেমেই নদীর পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে হেঁটে ওপাশের তীরে চললাম।

দুটো বড় পাথরের মাঝে হাইকসো অধিনায়কের লাশটি খুঁজে পেলাম। নিচু হয়ে তার এক পা টেনে পাথরের মাঝ থেকে দেহটি বের করলাম। আলখাল্লাটি রক্তে মাখামাখি হয়ে রয়েছে, তবে আমার চাকর ধুয়ে নিতে পারবে। তাই এটা ভাঁজ করে একপাশে রাখলাম। তারপর শিরস্ত্রাণটি খুঁজতে লাগলাম। ঢাল বেয়ে একটু উপরে উঠে একটি ভাঙা রথের পেছনে জিনিসটা পেলাম।

মাটিতে বসে শিরস্ত্রাণটি কোলে নিয়ে মুগ্ধদৃষ্টিতে এর কারুকার্য দেখলাম। এর গালের অংশে মিসরীয় দেবতা হাথোর আর অসিরিসের চমৎকার প্রতিমূর্তি খোদাই করা রয়েছে আর কপালে রয়েছে হোরাসের প্রতিকৃতি। হাইকসো অধিনায়ক নিশ্চয়ই অন্য কোনো যুদ্ধক্ষেত্র থেকে আমাদের মিসরীয় বাহিনীর উচ্চপদস্থ কোনো সামরিক কর্মকর্তার কাছ থেকে এটা নিয়েছিল। এটি একটি অমূল্য সম্পদ। এ তুলনায় আমার শিরস্ত্রাণটিকে খুবই সাধারণ মানের মনে হচ্ছে। এছাড়া হাইকসো তীরের আঘাতে এর এক জায়গা বিশ্রীভাবে চ্যাপ্টা হয়ে গেছে।

কিছু না ভেবে আমার শিরস্ত্রাণটি ফেলে দিয়ে সোনা আর রূপার তৈরি এই সুন্দর জিনিসটি তুলে নিলাম। ভেতরে চামড়ার আস্তরণ দেওয়া আছে আর বেশ সুন্দরভাবে খাপে খাপে আমার মাথায় লেগে যেতেই মনে হল যেন এটি আমার জন্যই তৈরি করা হয়েছে। এখন একটি আয়না পেলে ভালো হত।

আবার হাইকসো অধিনায়কের মৃতদেহের কাছে গিয়ে দেখলাম গলায় তিনটি সুন্দর হার ঝুলছে। তবে একটা হারে স্ফটিক পাথরের তৈরি দেবতা শেঠের মাথা ঝুলছিল, এটা নদীতে ছুঁড়ে ফেললাম। অন্যদুটোয় সাদা পাথরের তৈরি হাতি আর উটের চমৎকার প্রতিকৃতি ঝুলছিল। রাজকুমারীরা এগুলো খুব পছন্দ করবে, যদিও ওরা কখনও হাতি দেখেনি।

আবার নদীর খাড়া তীর বেয়ে উপরে আমার রথের কাছে গেলাম। আমার রথচালক নতুন শিরস্ত্রাণটি দেখে হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। তাড়াতাড়ি আমরা সৈকতে ফিরে গেলাম। সবাই হাতের কাজ ফেলে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমাকে নিশ্চয়ই আজব দেখাচ্ছিল।

.

আমার নৌবহরের জাহাজগুলো অন্তরীপ হয়ে উপসাগরে ঢুকলো। জাহাজের পেছন দিক সৈকতের দিকে মুখ করে তীরে ভিড়লো। তারপর মালামাল উঠানামার ঢালু র‍্যাম্পটি নামিয়ে দিল।

বন্দীদেরকে হটিয়ে জাহাজে উঠানো হল, তারপর সবচেয়ে নিচের ডেকে নিয়ে দুই পায়ে শিকল বেঁধে দাড়ির বেঞ্চে বসিয়ে দেওয়া হল। ওরা সেখানেই থাকবে যতক্ষণ ওদের দেবতা শেঠ তার অন্ধকারের দেবদুত পাঠিয়ে ওদেরকে কয়েদ থেকে মুক্ত না করে।

সূর্যাস্তের ঘন্টাখানেক আগেই সমস্ত লোকজন আর রথ জাহাজে তুলে আমরা সিডন যাত্রার জন্য প্রস্তুত হলাম। তোরান উপরের ডেকে আমার পাশে দাঁড়িয়েছিল। সে তীরের দিকে তাকাল আর সৈকতের যেখানে আমি আহত হাইকসোদেরকে রেখে এসেছিলাম সেদিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে বললো, দেখা যাচ্ছে আহত শত্রুদেরকে আপনি জীবিত রেখে এসেছেন। আমি কখনও শুনিনি কোনো বিজয়ী সেনাপতি এরকম ক্ষমাশীলতা দেখিয়েছে।

আপনাকে হতাশ করেছি সেজন্য দুঃখিত। তবে ওদেরকে ওখানে রেখে এসেছি যাতে আর কেউ তাদের ব্যবস্থা নিতে পারে। ঐ দেখুন ওরা আসছে।

হাইকসো রথগুলো আসার আগে গ্রামের যে বাসিন্দাদেরকে জঙ্গলে লুকিয়ে থাকতে বলেছিলাম ওরা এখন ফিরে এসেছে। লোকগুলোর হাতে তখনও সেই কাঠের কোদাল আর নিড়ানি রয়েছে যা দিয়ে আমাদেরকে ভয় দেখাতে এসেছিল।

এবার ওরা আমাদের দিকে একবারও তাকাল না। আমরা লক্ষ্য করলাম ওদের মধ্যে যে লোকটি নেতা ছিল সে একজন আহত হাইকসো সৈন্যের কাছে এসে দাঁড়াল। তারপর হাতের কোদালটা দুহাতে ধরে মাথার বেশ উপরে তুললো, যেন চুলার জন্য লাকড়ি ফাড়ছে। এতোদূর থেকেও আমরা শুনতে পেলাম পাথরের মেঝেতে পাকা তরমুজ থপ করে পড়ে যাওয়ার মতো শব্দ করে লোকটির মাথার খুলি ফেটে গেল। তারপর কোদাল হাতে লোকটি সামনে এগিয়ে গেল। মৃত্যু যন্ত্রণায় হাইকসো যোদ্ধার দেহটি ঝুঁকি মেরে চললো আর কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগলো।

পরবর্তী আহত যোদ্ধাটি কোদাল হাতে লোকটিকে আসতে দেখে কনুইয়ের উপর ভর দিয়ে সরে যেতে চেষ্টা করলো। তার বুক ভেদ করে একটা তীরের ফলা পিঠ দিয়ে বেরিয়ে রয়েছে। লোকটির পক্ষাঘাতগ্রস্ত একটি পা তার পেছনে পিছলে পিছলে আসছিল। সে একজন সন্তান প্রসবের যন্ত্রণায় কাতর নারীর মতো চিৎকার করছিল। কৃষকটি তার দিকে তাকিয়ে জোরে হেসে উঠলো, তারপর হাতের কোদালটি দিয়ে ঠেলে সুবিধামতো কোদালের কোপ মারার জন্য কাত করলো।

তাদের পেছন পেছন নোংরা চেহারার মহিলা আর বাচ্চাগুলো হাইকসো মৃতদেহের উপর মাছির মতো হেঁকে ধরলো। রক্তমাখা পরনের কাপড়চোপড় থেকে শুরু করে সামান্য দামি যা পেল সব ছিনিয়ে নিল। তাদের উত্তেজিত হাসির শব্দ আমরা এতোদূরের জাহাজ থেকে পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছিলাম।

তোরান আমার দিকে শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, প্রভু তায়তা, এখন বুঝা যাচ্ছে চেহারা যাই হোক আপনার মতো মানুষের সাথে হেলাফেলা করা যাবে না।

.

পরদিন দুপুরের ঘন্টাখানেক আগে যখন সিডন বন্দরে আমার জাহাজ নির্মম ভিড়লো, তখন আমার দুই রাজকুমারীই জেটিতে উপস্থিত ছিল। দুজনেই হাত নাড়ছিল আর আনন্দে আর উত্তেজনায় নাচছিল। যখনই আমি বেশিদিন বাইরে থেকে ফিরে আসি তখনই ওদের মধ্যে প্রতিযোগিতা হয় কে আগে আমাকে স্বাগত জানাবে। তেহুতি সাধারণত নিজেকে একটু গম্ভীর রেখে আবেগ নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করতো, তবে আজ সে আমাকে আর তার বোনকে অবাক করে দিল। সম্প্রতি জারাস তাকে প্রশিক্ষণ দিয়ে একজন অসাধারণ মক্রীড়াবিদ এবং অসিচালনায় সুদক্ষ ব্যক্তি হিসেবে গড়ে তুলেছিল।

এবার তার প্রশিক্ষণের কিছু নমুনা সে দেখাল। জাহাজ জেটিতে ভেড়ার আগেই লাথি দিয়ে পা থেকে স্যান্ডেল ছুঁড়ে ফেলে সামনের পাথরের জমিনের উপর দিয়ে খালি পায়ে প্রায় উড়ে কিছু দূর এগিয়ে জাহাজ আর জেটির মাঝখানের ফাঁকের উপর দিয়ে এক লাফ মারলো। পুরো পাঁচ গজ হবে দূরত্বটা। একবার পা ফসকালেই সে জাহাজের কাঠামো আর জেটির মাঝে পিষ্ট হয়ে ডুবে মরতো।

যখন সে শূন্যে ঝাঁপ দিল তখন আমার জান প্রায় বেরিয়ে গেল। তবে যখন সে জাহাজের ডেকে দুপা রেখে দাঁড়াল তখন আতঙ্ক চলে গিয়ে স্বস্তি ফিরে এলো। এ-ধরনের অশোভন আচরণ করার কারণে তাকে কষে বকে দেবার জন্য আমি ডেকের উপর দিয়ে ছুটে গেলাম।

তবে সে এক নিঃশ্বাসে বলা শুরু করলো, ইশ তায়তা, নতুন আলখাল্লা আর শিরস্ত্রাণে তোমাকে কী সুন্দর দেখাচ্ছে। কোথায় পেলে এগুলো? তোমাকে তো একজন রাজার মতো দেখাচ্ছে! আমাদের জন্য কোনো উপহার এনেছো? সাথে সাথে আমার সমস্ত রাগ পানি হয়ে গেল, আমি তাকে বুকে জড়িয়ে ধরলাম।

অবশ্যই তোমার জন্য একটা উপহার এনেছি। তবে আগে বল, যে কদিন আমি ছিলাম না তখন ঠিক ছিলে তো?

সে দুষ্টুমির হাসি দিয়ে জাহাজের উপর বন্দরের দিকে তাকাল। তুমি তো তার কোনো সুযোগ রেখে যাওনি। আমার সমস্ত প্রলোভন সাথে নিয়ে গিয়েছ। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে আমি দেখলাম দূরে চালকের ডেকে জারাস দাঁড়িয়ে রয়েছে। আর এতো দূরত্ব সত্ত্বেও তাদের দুজনের মাঝে বিদ্যুত চমকের মতো দৃষ্টি বিনিময় হল।

ক্রিটের কুনুসসের উদ্দেশ্যে শেষ সমুদ্র যাত্রা শুরু করার সমস্ত প্রস্তুতি শেষ করতে আরও চারদিন লেগে গেল। তোরান আমাদেরকে তার জাহাজে চড়ার আমন্ত্রণ জানালো। সুবিশাল তিনস্তরের দাঁড়বাহী জাহাজটি আকারে আমার সুমেরিয় জাহাজগুলোর দ্বিগুণ বড়।

সে বললো, আপনার ঐ চারকোণা পালের ছোট্ট জাহাজের তুলনায় আমার এই বড় জাহাজ পবিত্র ষাঁড়ে চড়ে আপনি আর রাজকুমারীরা অনেক আরাম পাবেন। ওহ আচ্ছা জাহাজটির নামটি তাহলে এই। ভাবলাম গালভরা নামটি থেকে বেশ দম্ভ ফুটে উঠছে। তবে একটু আগেই আমার যে যুদ্ধ জাহাজের কৃতিত্বে আমরা হাইকসোদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্রথম গুরুত্বপূর্ণ বিজয় অর্জন করেছি, সেটি সম্পর্কে তার এই তাচ্ছিল্যভাব দেখানোটা আমার পছন্দ হয়নি। তাই আমি একটু ইতস্তত করতে লাগলাম।

সে বলেই চললো, আমরা এক সাথে গেলে কুনুসসে পৌঁছে আপনারা যে ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হবেন সে সম্পর্কে আমরা বিশদভাবে আলোচনা করার সময় এবং সুযোগ পাবো। সর্বাধিরাজ মিনোজের রাজদরবারের কূটনীতি এবং আদব-কায়দা অত্যন্ত জটিল আর সেগুলো অবশ্যই মানতে হবে। তারপরও আমাকে ইতস্তত করতে দেখে সে বললো, আমার প্রধান পাঁচক হেলেনিয় জগতে সর্বশ্রেষ্ঠ। এছাড়া আপনাকে আরেকটি কথা বলতে চাই, এই জাহাজে সাইক্লেড থেকে আনা বিশ পিপা সর্বোৎকৃষ্ট লাল মদ রয়েছে। আমি জানি দুই সপ্তাহ আমার সাথে কাটাতে আপনার জন্য এগুলো কিছুই না, তবে আপনার বুদ্ধিমত্তা, গভীর জ্ঞান এবং পাণ্ডিত্য আমাকে মুগ্ধ করেছে। অনুগ্রহ করে আমার আতিথ্য গ্রহণ করে আমাকে বাধিত করুন প্রভু তায়তা। এরকম অনুরোধের পর আমি আর না করতে পারলাম না।

তার প্রস্তাবে রাজি হয়ে আমি বললাম, আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ মহামান্য রাষ্ট্রদূত। তবে মনে মনে ভাবলাম, আসলেই কী সে আমার সঙ্গ এতো দাম দিচ্ছে নাকি আমার রাজকুমারীদের মিনোয়ান পরিচারিকা লক্সিয়াসের জন্য এতোসব করছে।

তবে তেহুতি আর বেকাথা দুজনেই তোরানের সাথে তার জাহাজে যাওয়ার বিষয় নিয়ে আপত্তি তুললো। ওরা আমার জাহাজে এসে আমার কাছে তাদের আপত্তির এক বিশাল তালিকা তুলে ধরলো। তবে সবগুলোই ছিল খুব দুর্বল ধরনের।

সমস্ত কথা অত্যন্ত ধৈর্য সহকারে শোনার পর আমি ওদের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, দুজনেই কাতর দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে।

তাহলে তোমরা কি রাষ্ট্রদূত তোরানকে বিশ্বাস করো না? তোমাদের কি ধারণা তিনি তোমাদেরকে ভুলিয়ে ভালিয়ে তার জাহাজে নিয়ে গিয়ে ঘুমন্ত অবস্থায় তোমাদের হত্যা করবেন? দুজনেই বিব্রতভাবে গা মোচড়াতে লাগলো।

আর কী করে এই ধারণা তোমাদের মাথায় এলো যে পবিত্র ষাঁড়ের মতো বিশাল আকারের জাহাজ পানিতে ভাসবে না আর আমাদের সকলকে নিয়ে ডুবে যাবে?

দুজনেই চুপ করে রইল। আর হঠাৎ বেকাথার চোখ ভরে পানি দুই গাল বেয়ে পড়তে লাগলো। আমি আতঙ্কিত হয়ে তাকিয়ে রইলাম। এতো দুঃখ পাবে জানলে এমন কঠিন প্রশ্ন করতাম না। আমি লাফ দিয়ে টুল থেকে উঠে ওকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য ওর কাছে এগিয়ে গেলাম। কিন্তু সে হাত দিয়ে ঠেলে আমাকে সরিয়ে দিয়ে মুখ অন্য দিকে ঘুরিয়ে রাখলো।

ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলতে শুরু করলো, আর তাকে কখনও দেখতে পাবো না। তার কথা শুনে আমি অবাক হবার ভান করে বললাম, কাকে আর কখনও দেখতে পাবে না? তুমি কি রাষ্ট্রদূত তোরানের কথা বলছো?

সে আমার প্রশ্ন এড়িয়ে গড়গড়িয়ে বলে যেতে লাগলো, তুমি তেহুতিকে কথা দিয়েছিলে অন্তত ক্রিটে পৌঁছা পর্যন্ত আমরা একসাথে থাকতে পারবো। তারপরই আমাদেরকে সর্বাধিরাজ মিনোজের হারেমের অন্দরে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু তুমি কথা দিয়েছিলে যতক্ষণ আমরা সতর্ক থাকবে ততক্ষণ আমরা ক্রিটে পৌঁছানো পর্যন্ত মেলামেশা করতে পারবো। কিন্তু আর কখনও ওদের দেখা পাবো না। আমার জীবন এখানেই শেষ হচ্ছে।

তাকে থামিয়ে আমি বললাম, ব্যাপারটা আমার বুঝা দরকার বেকাথা। তুমি কার কথা বলছো এখানে?

বেকাথা আবার আমার দিকে মুখ ঘোরালো, তবে এবার সে রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে রয়েছে। তুমি খুব ভালো করেই জানো আমরা কার কথা বলছি। আমরা আমার হুইয়ের কথা বলছি।

তেহুতিও তার ছোট বোনের মতো পরিষ্কার কণ্ঠে বললো, আর আমার জারাসের কথা বলছি।

আসলেই আমার পরিকল্পনা ছিল ক্রিটে পৌঁছে মিনোজের রাজপ্রাসাদে থাকতে শুরু করার আগে ওরা যে ভয়ঙ্কর সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল তা থেকে ধীরে ধীরে ওদেরকে সরিয়ে আনা। তবে আমার সমস্ত পরিকল্পনা ভেস্তে যাচ্ছে।

আমি বার বার নানানভাবে চেষ্টা করলাম ওদেরকে খুশি করতে, তবে ওরা মোটেই তাতে মন বসালো না। শেষ পর্যন্ত আমি ওদের কাছে হার মানলাম।

শেষ পর্যন্ত সিডন বন্দর ছাড়ার সময় জারাস আর হুই দুজনেই পবিত্র ষাঁড় নামে জাহাজটিতে চড়লো।

.

সাতটি জাহাজ নিয়ে নৌবহরটি গঠিত। পবিত্র ষাঁড় ঠিক মাঝখানে রয়েছে। চারকোণা পালের যে দুটি জাহাজ আমার আর জারাসের অধীনে ছিল সে দুটো দুপাশে পাহারা দিয়ে চললো। তবে এখন দিলবার আর আকেমির নেতৃত্বে এগুলো ভেসে চলেছে।

আমার বাকি চারটি জাহাজও এই নৌবহরের পেছনে পাহারাদার হিসেবে অনুসরণ করছে। জাহাজগুলো একে অন্যের সাথে সম্পর্ক রেখে চলেছে। এভাবে ওরা চারদিকে সাগরের ষাট লিগ ব্যাপী নজর রাখতে পারবে। আমি একটি সহজ পতাকা দিয়ে সঙ্কেত দেবার পদ্ধতি প্রবর্তন করলাম, যাতে কোনো ধরনের বিপদ দেখা দিলেই প্রধান জাহাজ থেকে আমি তা জানতে পারি।

এসব সাবধানতার প্রয়োজন ছিল। কেননা মধ্যসাগর ছিল সাগরের মানুষের বিচরণ কেন্দ্র। এরা ছিল সমস্ত সভ্যজগত থেকে বিচ্ছিন্ন দলত্যাগী এবং সমাজ তাড়িত ব্যক্তি। নির্বাসিত হওয়ার পর এরা সকলে মিলে জলদস্যুর দল তৈরি করেছে। কেউ কারও অধীনে নয়, কাউকেই এরা প্রভু মানে না। কোনো ধরনের নৈতিকতা বোধ, বিবেক কিংবা অনুতাপের বালাই নেই। ওরা ক্ষুধার্ত সিংহ, বিষাক্ত সাপ কিংবা বৃশ্চিকের মতোই ভয়ঙ্কর। সাগরের ডুবন্ত পাহাড় কিংবা মানুষ খেকো হাঙ্গরের চেয়েও ওদের বিচরণ বেশি ছিল। মিসরে আমরা ওদের নাম দিয়েছিলাম, ইয়ামের সন্তান। ইয়াম হচ্ছে উত্তাল হয়ে সাগর যখন ফুঁসে উঠে তখন সেই সাগরের দেবতার নাম। এই দেবতা অত্যন্ত নিষ্ঠুর।

তবে বছরের এই সময়টি সাগরের এই অংশে পাড়ি দেবার জন্য সবচেয়ে অনুকূল ছিল। মধ্যসাগরের এই অংশের মিসরীয় নাম বিশাল সবুজ। আবহাওয়া শান্ত প্রকৃতির, সুন্দর বাতাস আর সাগরও শান্ত। পবিত্র ষাঁড়ের যাত্রীরা সবাই সমুদ্র যাত্রা উপভোগ করছিল।

জারাস তেহুতিকে অস্ত্র চালনা প্রশিক্ষণ দিয়ে চললো। সে তেতির তীর ছোঁড়ার জন্য ভাসমান লক্ষ্য বস্তু তৈরি করেছিল। জাহাজের পেছনে বিভিন্ন দৈর্ঘ্যের দড়িতে বেঁধে পানিতে ভাসিয়ে দিয়েছিল।

এছাড়া প্রশিক্ষণের জন্য সে কাঠের তরবারিও নিয়ে এসেছিল। এর পাতগুলো ছাগলের চামড়া দিয়ে মোড়ানো ছিল আর কাঠের ঢালও এনেছিল। খোলা ডেকে ওরা মহড়া দিত। মাঝে মাঝে তেহুতির বিজয়োল্লাস শুনে বুঝা যেত সে লড়াইয়ের মহড়ায় জিতেছে। প্রচণ্ড জোরে আঘাত করতে সে মোটেই পিছপা হত না। সে এমন জোরে আঘাত করতো, যা সামলাতে জারাসের মতো একজন দক্ষ অসিচালকও তা হিমশিম খেয়ে যেত। তবে সে কখনও তার তরবারি দিয়ে উল্টো তেহুতির উপর আক্রমণ চালাতো না।

বেকাথা তীর ছোঁড়া প্রশিক্ষণে অংশ নিত। তবে সে তার বড় বোনের মতো একই ওজনের ধনুকের ছিলা টানতে পারতো না, ফলে সে তার বোনের মতো অনেক দূরে সঠিক লক্ষ্য বস্তুতে তীর ছুঁড়তে পারতো না। তাই সারা দিন মুখ গোমড়া করে রইল। তারপর তেহুতিকে তার সাথে কাঠের তরবারি দিয়ে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান জানালো। তবে বোনের তরবারির আঘাতে তার গায়ে যে কালশিরে দাগ পড়েছিল তা মেলাতে এক সপ্তাহ লাগলো।

এবার এই অস্ত্র প্রতিযোগীতা থেকে সরে গিয়ে সে কর্নেল হুইকে বাও খেলা শেখাতে শুরু করলো। তবে হুই ছাত্র হিসেবে ব্যর্থ প্রমাণিত হল। বেকাথা নির্দয়ভাবে তাকে পেটাতে শুরু করলো। শেষ পর্যন্ত এই অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে হুই বিদ্রোহ করতে চাইলো, তখন বেকাথা তাকে নাচ, গান আর ধাঁধা শেখাতে শুরু করলো।

তবে হুইয়ের কণ্ঠস্বর ছিল চমৎকার আর নাচেও সে বেশ পারদর্শিতা দেখালো। প্রথম দুটো নাচ শিখতে গিয়ে সে বেশ কুশলতার পরিচয় দিল। তবে ধাঁধায় সে সবচেয়ে দক্ষতা দেখাল। বেকাথাকে তার সাথে তাল সামলাতে কষ্ট হত।

একবার সে বেকাথাকে প্রশ্ন করলো, দুই জন মা আর তিনজন মেয়ে ঘোড়ায় চড়তে বের হল। ওরা কয়টি ঘোড়া নিয়েছিল?

অবশ্যই পাঁচটি।

হুই বললো, ভুল। ওদের তিনটি ঘোড়া দরকার ছিল। ওরা ছিল দাদিমা, মা এবং মেয়ে।

বেকাথা অর্ধেক খাওয়া ডালিমটি তার মাথা লক্ষ্য করে ছুঁড়ে মেরে বললো, উহ তুমি একটা বোকা লোক! হুই ডালিমটা ধরে এক কামড় দিয়ে ফের তার দিকে ছুঁড়ে মারলো।

রাষ্ট্রদূত তোরানের প্রধানপাঁচক তার কথামতোই চমৎকার আর সুস্বাদু খাবার পরিবেশন করলো। জাহাজের পেছনের খোলা ডেকে ক্যানভাসের ছাউনির নিচে আমরা একের পর এক সুস্বাদু খাবার খেয়ে চললাম, সেই সাথে চললো বাঁশি এবং অন্যান্য বাদ্যযন্ত্রের সমাহারে চারজনের বাদকদলের সঙ্গীত পরিবেশনা।

দিনগুলো আনন্দেই কেটে চললো আর বাধাবন্ধনহীন ছোট ছোট বাচ্চার মতো আমরা হাসিখুশিতে মেতে রইলাম।

অবশ্য সবকিছুই একেবারে নিখুঁত ছিল না। রাতে এই জাহাজে ভীষণ ইঁদুরের উৎপাত হত। যখনই আমরা বাংকে শুয়ে পড়তাম তখনই শোনা যেতে কেবিনের বাইরের পথ দিয়ে কিচ কিচ আর ছুটাছুটির শব্দ। তবে মেয়েরা গভীর ঘুমে তলিয়ে যেত।

এমনকি রাষ্ট্রদূত তোরানের প্রধান কেবিনেও এই উৎপাতের কমতি ছিল না।

.

সাগরে আমরা চৌদ্দদিন কাটালাম। একদিন জাহাজের সামনের ডেকে বড় পালের ছায়ার নিচে আমি আর তোরান বসেছিলাম। মদের গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে আমরা গভীর আলোচনায় ব্যস্ত ছিলাম। এমন সময় পেছনের ডেক থেকে হঠাৎ গণ্ডগোল শুনে আমাদের আলাপে ব্যাঘাত ঘটলো।

আমি তাকিয়ে দেখলাম পবিত্র ষাঁড়ের ক্যাপ্টেন হাইপ্যাটস মাস্তুলের ডগায় সঙ্কেতের পতাকা উড়িয়েছে। সাথে সাথে তোরানের কথা মাঝপথে থামিয়ে আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, মনে হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ কিছু একটা ঘটেছে। তারপর দুজনেই দ্রুত পেছনের ডেকে গিয়ে এক জায়গায় জড়ো হওয়া জাহাজের কর্মকর্তাদের কাছে গেলাম। ওরা সবাই সামনের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।

তোরান ক্যাপ্টেনকে জিজ্ঞেস করলো, কী ব্যাপার হাইপ্যাটস? সে সামনের দিকে দেখিয়ে বললো, আমাদের সাথে আসা ছোট একটা জাহাজ থেকে সঙ্কেত বার্তা এসেছে। তবে বেশি দূরত্বের কারণে সঙ্কেতটি বুঝা যাচ্ছে না।

আমি তাকিয়ে দেখলাম দীগন্ত রেখার কাছে আমার নির্মম জাহাজটি দেখা যাচ্ছে। এখন আকেমি এর নেতৃত্বে রয়েছে। পতাকার সঙ্কেত বার্তার অর্থ বিশ্লেষণ করে আমি ওদেরকে জানালাম, ওরা জানাচ্ছে ওদের সহযোগী জাহাজটির উপর একটি জলদস্যু জাহাজ হামলা করেছে আর জলদস্যুরা ওদের জাহাজে চড়েছে। আকেমি এখন দিলবারকে সাহায্য করার জন্য ওর জাহাজের দিকে যাচ্ছে।

হাইপ্যাটস অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, এসব কথা আপনি কী করে বুঝতে পারলেন প্রভু তায়তা?

আমি ধৈর্য সহকারে তাকে বুঝিয়ে বললাম, আমি কেবল আকেমির সঙ্কেত বার্তাটি পড়েছি।

তোরান বললো, এতোদূর থেকে? এটা তো আমার কাছে ভেল্কিবাজি মনে হচ্ছে তায়তা।

আমি হালকাভাবে বললাম, বাজপাখি হচ্ছে আমার ব্যক্তিগত গূঢ়লিপির প্রতিকৃতি। ঐ পাখি আর আমার, উভয়েরই সূক্ষ দৃষ্টিশক্তি রয়েছে। এখন দয়া করে হাইপ্যাটসকে বলুন পাল তুলে দাঁড়িদের পূর্ণ শক্তিতে বৈঠা বাইতে।

ঘন্টা খানেক পর আমরা আমাদের পাহারাদার জাহাজের কাছে পৌঁছলাম। সেখানে পৌঁছে দেখলাম ওরা দাঁড় উঠিয়ে আর পাল গুটিয়ে জাহাজ থামিয়ে রেখেছে। আর একটি আরবী ধাউয়ের সাথে লড়াই করছে। এই জাহাজটি আমার জাহাজের চেয়েও বড়, এর দুটো ছোট আর বড় একটি পাল পেছন দিকে হেলে এলোমেলো হয়ে রয়েছে। স্পষ্টই বুঝা যাচ্ছে লড়াই প্রায় শেষের পথে, কেননা ধাউয়ের নাবিকেরা তাদের হাতের অস্ত্র ফেলে আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে হাত উপরে তুলে ধরেছে।

গায়ে গায়ে লেগে থাকা জাহাজদুটোর কাছে এসে আমি দেখলাম আরবী জাহাজটির গায়ে এর নাম মিসরীয় লিপিতে লেখা রয়েছে। নামটি হল শান্তির প্রতীক। মনে মনে হাসলাম। সে মোটেই শান্তির প্রতীক পায়রা নয়।

হাইপ্যাটসকে নির্দেশ দিলাম, শত্রুর জাহাজের পাশে আমাদের জাহাজ ভেড়াও! সে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে বিশাল জাহাজটি ঐ আরবী ধাউয়ের গায়ে লাগাতেই আমি দড়ির সিঁড়ি বেয়ে ধাউটির ডেকে নামলাম। জারাস আমাকে অনুসরণ করলো। আমি অনুভব করলাম লড়াইয়ে সামিল হতে না পেরে সে বেশ হতাশ হয়েছে। এদিকে দিলবার আর আকেমি খোলা তলোয়ার হাতে আমার কাছে এলো।

ওরা আমাকে অভিবাদন করতেই আমি জিজ্ঞেস করলাম, এখানে এখন কী অবস্থা? রক্তমাখা তরবারি তুলে দিলবার দেখালো ডেকের উপর বন্দীরা হাঁটু গেড়ে বসে রয়েছে। হাত পেছনে বাঁধা, ঘাড় আর মাথা ডেকের তক্তার গায়ে ঠেকানো।

দিলবার বললো, ঐ বদমাশগুলো মনে করেছে আমরা সাগরে একা রয়েছি। ওরা এসে বললো সাগরে ওরা পথ হারিয়েছে তাই আমাদের সাহায্য কামনা করছে। ডেকে তখন কয়েকজন মাত্র লোক দেখা যাচ্ছিল। যে মুহূর্তে আমরা ওদের পাশাপাশি হলাম সাথে সাথে যারা নিচে লুকিয়ে ছিল ওরা লাফ দিয়ে বের হয়ে আমাদের জাহাজের গায়ে হুক ছুঁড়ে মারলো। তারপর সবাই আমাদের জাহাজে চড়লো। অবশ্য আমরাও তৈরি ছিলাম। আকেমি পৌঁছা পর্যন্ত ওদেরকে আটকে রাখলাম তারপর দুজনে মিলে ওদেরকে কাবু করলাম।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, কতজনকে বন্দী করেছ?

আকেমি ক্ষমা চেয়ে বললো, দুঃখিত, কয়েকজনকে মেরে ফেলতে বাধ্য হয়েছিলাম। তারপর অবশ্য ওরা সবাই আত্মসমর্পণ করেছে। যাইহোক তারপরও আটত্রিশজনকে বন্দী করতে পেরেছি। সে জানে আমি মৃত লোকের চেয়ে বন্দী ক্রীতদাস পছন্দ করি।

দুজনেই ভালো কাজ দেখিয়েছে। এখন এদেরকে দুইভাগ করে তোমাদের জাহাজে দাঁড় টানার কাজে লাগাও।

আমার লোকেরা বন্দীদেরকে দাঁড় করিয়ে তাদেরকে আমার জাহাজের ক্রীতদাস বেঞ্চে তাদের নতুন কর্মক্ষেত্রের দিকে ঠেলে নিয়ে যাওয়া শুরু করতেই পেছনের সারিতে একজন বন্দীর দিকে আমার নজর পড়লো। তার পোশাক-পরিচ্ছদ দেখে বুঝা যাচ্ছিল সে এই জলদস্যু দলের নেতা। আর তার চেহারায় এক ধরনের আত্মবিশ্বাসের ছাপ ফুটে উঠেছে। লোকটি আমার চোখেচোখে না তাকাতে চেষ্টা করছিল।

আমি তার দিকে তাকিয়েই ডেকে বললাম, তুমি নাকাতি! সাথে সাথে সে পিঠ সোজা করে চিবুক তুলে আমার দিকে তাকাল।

তারপর আমাকে বললো, প্রভু তায়তা, আমি আশা করিনি যে আবার আপনার দেখা পাবো।

আমি বললাম, দেবতা সবসময় আমাদের প্রার্থনার দিকে মনোযোগ দেন না।

আমাদের কথার মাঝে দিলবার এসে বললো, আপনি এই জানোয়ারটাকে চেনেন, প্রভু?

সে ছিল ফারাওয়ের রক্ষী বাহিনীর লাল ব্যাটালিয়নের একজন ক্যাপ্টেন। পাঁচ ছয় বছর আগে সে আবিডসের একটি গুঁড়িখানার একজন প্রমোদবালাকে নিয়ে কলহ করার সময় তার কর্নেলকে ছুরিকাঘাত করে মেরে ফেলে। তারপর তাকে ধরে ফাঁসি দেবার আগেই সে পালিয়ে যায়।

এখন কি তাকে মেরে ফেলবো?

আমি মাথা নেড়ে বললাম, আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা কর, দেখা যাক কী হয়। এটা পরেও করা যাবে। ততক্ষণ তাকে দাঁড় টানার কাজে লাগাও।

একসময় নাকাতি একজন দুর্ধর্ষ সেনাকর্মকর্তা ছিল। তার অনেক উপরের দিকে পদোন্নতি হবার সুযোগ ছিল।

তাকে কি চাবুক মারবো না?

নিয়মমাফিক যা করার কর দিলবার। তবে দেখো সে যেন একজন ক্রীতদাসের খাবার পুরোপুরি পায়।

তারপর একজন নৌকর্মকর্তাকে ইশারা করলাম তাকে অন্যান্য বন্দীদের সাথে এখান থেকে নিয়ে যেতে।

তারপর শান্তির পায়রা জাহাজটির মূল খোলের দিকে গেলাম।

দিলবারকে বললাম, তোমার লোক দিয়ে এই খোলের দরজাটা খুলে ফেল। খোলের দরজাটা ভেঙে খুলে ফেলার পর ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখলাম, পুরো খোলটি তামা আর টিনের পিণ্ড দিয়ে ভর্তি। বুঝা গেল আমাদের আগে নাকাতি অন্য কোনো জাহাজ লুট করেছে।

দিলবারকে নির্দেশ দিলাম, সমস্ত মাল আমার জাহাজে নির্মম-এ নেবার ব্যবস্থা করো। তারপর আমাদের বিজয়ী নাবিকদের দিয়ে জলদস্যুদের জাহাজটি আমাদের সাথে ক্রিটে নিয়ে চলো। মনে মনে আমি একটা পরিকল্পনা করছিলাম। তবে তার আগে নাকাতি কিছুক্ষণ দাঁড় টানার কাজ করে নিক, তারপর সে ঠিকই আমার প্রস্তাব পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে শুনবে।

ক্রিট দ্বীপে পৌঁছার চার পাঁচদিন আগে নাকাতিকে আমার কেবিনে নিয়ে আসার নির্দেশ দিলাম।

এতোদিনে তার অবস্থা পালকখসা ঝড়োকাকের মতো হয়েছে। পরনে কেবল একটি নেংটি আর পায়ে শিকল বাঁধা। উদ্ধতভাবটি আর নেই। পিঠে চাবুকের আঘাতে ঘা হয়েছে। একটানা দাঁড়টানার কাজ করতে করতে বাহুদুটো শক্ত হয়ে রয়েছে। একটা ক্ষুধার্ত কুকুরের মতো পেট ভেতরের দিকে ঢুকে রয়েছে। পেটে আর চর্বি নেই।

তবে বুঝা গেল চাবুক পেটালেও মারধোর করা হয়নি। এখনও তার চোখে মুখে গর্বিত ভাবটি লুকিয়ে রয়েছে। সে আমাকে হতাশ করেনি।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, তোমার বউ কী এখন থিবসে আছে নাকি আর কারও সাথে ভেগে গেছে? সে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। চোখের চাউনি কঠিন আর চোখদুটো উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে।

ছেলেমেয়ে কয়জন? ছেলে না মেয়ে? তারা কি তোমার কথা মনে করে? তুমি কি তাদের কথা ভাবো?

সে বললো, আপনি জাহান্নামে যান! আমি মৃদু হাসি চাপলাম। তার বড়াই ভাবের প্রশংসা করলাম। তার কথাটি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করলাম, যেন সে এটি বলেনি।

আমার ধারণা মনে মনে তুমি এখনও মিসরের একজন সন্তান; একজন সভ্য মানুষ এবং জলদস্যু নও। একথা শুনে সে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। তারপরও আমি বলে চললাম, তুমি একটি ভুল করেছে আর তার মাশুল দিতে গিয়ে অনেক কিছু হারিয়েছ। এবার সে মুখ কুঁচকাল, ঠিক জায়গাতেই ঘা দিয়েছি।

রেগে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, তাতে আপনার কী?

আমি বললাম, আমার কিছুই আসে যায় না। তবে আমার মনে হয়। তোমার স্ত্রী আর সন্তানদের অবশ্যই কিছু আসে যায়।

এবার তার গলার স্বর পাল্টে গেল, এক সমুদ্র হতাশা নিয়ে সে বললো, এখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। এখন কেউ আর এর কিছু করতে পারবে না।

আমি বললাম, আমি তোমাকে ক্ষমা করার ব্যবস্থা করতে পারি। সে একটি তিক্ত হাসি হেসে বললো, আপনি ফারাও নন।

না, তা নই আমি। তবে আমি বাজপাখির সীলমোহর বহন করছি। আমার যেকোনো কথাই এখন ফারাওয়ের কথা। এবার তার চোখে আশার আলো দেখা দিল। আর এটা দেখে বেশ ভালো লাগলো।

এবার সে বেশ নরম হয়ে ক্ষমাপ্রার্থীর সুরে বললো, আপনি আমাকে কী করতে বলেন প্রভু তায়তা?

হাইকসোদের কবল থেকে মিসরকে মুক্ত করতে আমি তোমার সাহায্য চাই।

আপনি একথাটি বেশ সহজভাবে বলছেন, অথচ এই নিষ্ফল প্রয়াসে আমি আমার জীবনের অর্ধেকের বেশি সময় কাটিয়েছি।

এটা স্পষ্ট যে থিবসে থেকে পালিয়ে যাবার পর তুমি সাগরের মানুষের রাজা হয়েছ। আমি নিশ্চিত তোমার সাথীদের অনেকেই দেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া মিসরীয়। স্বদেশে ফিরে আসার সুযোগ পেতে ওরা নিশ্চয় লড়াই করবে।

নাকাতি সায় দিয়ে মাথা নেড়ে বললো, সামান্য রূপা আর চাষ করার মতো একটুখানি কালো মিসরীয় জমির জন্য আরও কঠিন লড়াই করবে।

এবার আমি তাকে নিশ্চয়তা দিয়ে বললাম, কথা দিচ্ছি তোমরা সবাই এই পুরষ্কার পাবে। তোমার এই শান্তির পায়রা জাহাজের মতো পঞ্চাশটি জাহাজ আর লড়াই করার মতো লোকজন নিয়ে এসো, আমি তোমাদের হারানো সম্মান আর মুক্ত জীবন ফিরিয়ে দেবো।

আমার কথাটি শুনে সে কিছুক্ষণ ভাবলো, তারপর মাথা নাড়তে নাড়তে বললো, পঞ্চশটা জাহাজ আনতে পারবো না। তবে আমাকে আমার লোকজনসহ আমার শান্তির পায়রা জাহাজটা ফিরিয়ে দিন, তিনমাসের মধ্যে আমি এরকম আরও পনেরোটা জাহাজ নিয়ে ফিরে আসবো। ঈশ্বরের নামে শপথ করছি।

আমি কেবিনের দরজার কাছে গিয়ে দরজাটি খুললাম। জারাস তার তিনজন লোকসহ আমাকে উদ্ধার করার জন্য উদ্যত তলোয়ার নিয়ে অপেক্ষা করছিল।

আমার জাহাজে গিয়ে পাঁচককে খাবার আর মদ নিয়ে আসতে বল।

যখন জারাস ফিরে এলো তখন আমি নাকাতিকে নিয়ে টেবিলে বসে রয়েছি। আমার কেবিনের বেসিনে হাতমুখ ধুয়ে সে চুল আঁচড়ে নিয়েছিল। আমি যে পোশাক দিয়েছি তা পরেছে। সে বেশ লম্বাচওড়া হলেও আমার পোশাক তার গায়ে মোটামুটি মানানসই হয়েছে।

জারাসের পিছু পিছু কেবিনের পরিচারক এক বোল শুকরের লোনা মাংস নিয়ে এসে নাকাতির সামনে রাখলো আর আমি একটা গ্লাসে একটু লাল মদ ঢেলে জারাসকে পাশে বসতে ইশারা করলাম। আমরা কথা শুরু করলাম, কথা বলতে বলতে রাত পেরিয়ে ভোর হয়ে গেল।

.

ক্যাপ্টেন হাইপ্যাটস পাল নামালো আর আমাদের বিজয়ী নাবিকেরা শান্তির পায়রা জাহাজটি এর পাশে ভেড়ালো। নাকাতি তার জাহাজের ডেকে নেমে গেল, তারপর এর কর্তৃত্ব নিয়ে আমাদের যে জাহাজদুটোতে তার লোকদেরকে বন্দী করে রাখা হয়েছিল সেখানে গেল। সেই জাহাজদুটোর নিচের ক্রীতদাসদের ডেকে গিয়ে বেঞ্চে শিকল দিয়ে বাঁধা তার লোকদেরকে তুলে নিয়ে এলো। তারপর ওদেরকে বাইরে রোদে নিয়ে এলো।

লোকগুলো বেশ শোচনীয় অবস্থায় ছিল। পরনে একটি নেংটি আর নাকাতির মতো সারা গায়ে চাবুকের দাগ। আমার নির্দেশ মোতাবেক আকেমি আর দিলবার ওদের উপর কড়া চাবুক চালিয়েছিল। ওরা হতাশা আর আত্মসমর্পণের সমস্ত সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। আমি জানি একমাত্র নাকাতিই ওদেরকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে পারবে।

শান্তির পায়রার পেছনের ডেক থেকে নাকাতি আমাকে অভিবাদন জানাল। তারপর সে জাহাজের হাল ঘুরিয়ে উত্তরমুখি রওয়ানা হল। জলদস্যুদের জাহাজগুলো সেদিকেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এজিয়ান উপসাগরের নির্জন দ্বীপগুলোতে লুকিয়ে রয়েছে।

জারাস জিজ্ঞেস করলো, আর কখনও কি তার দেখা পাবেন? উত্তরে আমি কেবল কাঁধ ঝাঁকালাম। এর ইতিবাচক উত্তরের জন্য অন্ধকারের দেবতাদের কাছে ধন্না দেবোনা। যাইহোক নাকাতির সাথে আমার একটি চুক্তি হয়েছে আর আমি একজন মানুষের ভালোমন্দ বিচার করে তার উপর আস্থা রাখতে পারি যে, সে তার কথা রাখবে।

একটি বিষয় প্রমাণ করে আমি সন্তুষ্ট হয়েছি যে, হাইকসোদের যে কোনো দুর্বল অবস্থানে অনেকগুলো রথ জাহাজ থেকে নামিয়ে গোরাবের সেনাবাহিনীর উপর প্রবল আক্রমণ করে তাদের মরণ দশা এনে দিতে পারি। তারপর শত্রু প্রতিআক্রমণ করার আগেই রথগুলো নিয়ে আবার আমার জাহাজে ফিরে যেতে পারি। অবশ্য আমার এই ক্ষুদ্র বাহিনী দিয়ে এই স্বৈরাচারীর বিরুদ্ধে পূর্ণাঙ্গ লড়াই চালানো সম্ভব নয়, তবে আমি তার মূল বাহিনীর বড় একটি অংশকে বিচ্ছিন্ন করে মিসরের দক্ষিণ সীমান্ত থেকে সরিয়ে উত্তর সীমান্ত রক্ষা করার জন্য সরিয়ে নিয়ে আনতে পারবো।

আমি নাকাতিকে কথা দিয়েছিলাম, যদি তারা লুটতরাজের কাজ ছেড়ে আমার অধীনে সাগরে অভিযানে যায়, তাহলে তার দলের প্রত্যেককে এক হাজার রূপার মেম পুরষ্কার দেবো। তারপর হাইকসোদের বিরুদ্ধে বিজয়ী হয়ে সম্পূর্ণ মিসর মুক্ত করার পর জলদস্যুতা আর খুনসহ তার লোকদের সমস্ত অপরাধ ক্ষমা করা হবে। প্রত্যেককে সম্মানজনকভাবে নৌ-বাহিনীর চাকুরি থেকে অব্যাহতি দিয়ে মিসরের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। এছাড়া এদের প্রত্যেককে থিবস নগরীর দক্ষিণে নীল নদ বরাবর তায়তার মেশির এস্টেটে পাঁচশো কাঠা উর্বর এবং সেচযোগ্য জমি দেওয়া হবে।

শান্তির পায়রা জাহাজটির চলে যাওয়া দেখতে দেখতে আমি ভাবলাম নাকাতিকে যে উদার দানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছি তার কতোটুকু ফারাওয়ের কোষাখানা থেকে পাওয়া যাবে আর কতোটুকুই বা আমার নিজের সঞ্চয় থেকে যোগাড় করতে পারবো। নিঃসন্দেহে ফারাও কৃতজ্ঞ হবেন, তবে সেই কৃতজ্ঞতা অর্থের ভাষায় প্রকাশ করবেন কি না, সে ব্যাপারে আমি খুব একটা আশাবাদি নই। আমার মেম আর তার রূপা এতো সহজে বিচ্ছিন্ন হবার নয়।

.

আমি জানি ক্যাপ্টেন হাইপ্যাটর এর আগে সুমেরিয়া আর ক্রিটের মাঝে বেশ কয়েকবার যাতায়াত করেছেন। কিন্তু যখন তাকে জিজ্ঞেস করলাম কখন কুনুসসে পৌঁছাবো বলে আশা করি, তখন সে উত্তরটি একটু এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করে বললো।

অবশ্যই সবকিছু নির্ভর করে বাতাস আর স্রোতের উপর, তবে আমার ধারণা ষোল দিনের মধ্যে আমরা পবিত্র ক্রিট দ্বীপে পৌঁছতে পারবো।

তার অনুমান জানার পর আমি খুশি হলাম। আমাদের রথের ঘোড়াগুলো দীর্ঘদিন যাবত খাঁচার মাঝে আটকা রয়েছে। দিন দিন তাদের অবস্থার অবনতি হচ্ছিল। গায়ের পশম উঠে যাচ্ছিল আর ওজন কমে গিয়ে উদাসী হয়ে যাচ্ছিল। হুই অত্যন্ত চিন্তিত হয়ে পড়েছিল আর সেই সাথে আমিও।

চৌদ্দতম দিনে নৈশভোজের সময় আমি তাকে ষোল দিনের অনুমানের কথাটি স্বরণ করিয়ে দিতেই সে বললো:

প্রভু তায়তা আপনি নিশ্চয়ই জানেন সমস্ত নাবিক মহান দেবতা পসেইডনের মর্জি আর খেয়াল খুশির উপর নির্ভরশীল। আমি হিসাব করেছিলাম ষোল দিন আর সেটা খুব ভালো একটি হিসাব ছিল।

একটি বিষয়ে হাইপ্যাটস আর আমি মোটামুটি নিশ্চিত ছিলাম যে, আর হয়তো জলদস্যুর আক্রমণ হবে না। কোনো জলদস্যু জাহাজই সাগরের সবচেয়ে শক্তিশালী নৌবহরের মূল বন্দরের এতো কাছে ঘেঁষার ঝুঁকি নেবে না। কাজেই আমি আমার জাহাজগুলোর কাছে সঙ্কেত বার্তা পাঠালাম, যেন ওরা পবিত্র ষাঁড় জাহাজটির কাছাকাছি অবস্থান নেয়।

পরদিন ভোরের বেশ আগে আমি কেবিন থেকে বের হয়ে মাস্তুলের ডগায় চড়লাম। ভোরের আগের কুয়াশাচ্ছন্ন ধূসর আলোয় দিগন্তের চতুর্দিক লক্ষ্য করে কিছুই দেখা গেল না, ডাঙার কোনো চিহ্নই নেই।

মাস্তুলের উপর থেকে নেমে কেবিনে ফিরতে যাব এমন সময় দেখলাম একটি অ্যালবাট্রস পাখি কুয়াশার ভেতর থেকে বের হয়ে আমার মাথার উপরে দুই ডানা মেলে ভেসে বেড়াতে লাগলো। মাথা এদিক ওদিক করে পাখিটা আমাকে দেখার চেষ্টা করছিল। সবধরনের পাখি আমার পছন্দ আর এতো কাছ থেকে এমন সুন্দর একটি পাখি দেখার সুযোগ এই প্রথম পেলাম। পাখিটিরও মনে হল আমার প্রতি আগ্রহ জন্মেছে আর তাই সে এতো কাছ থেকে আমার মাথার উপর চক্কর দিচ্ছে। চকচকে কালো দুচোখ দিয়ে আমাকে লক্ষ্য করছিল। আমি তার দিকে এক হাত বাড়াতেই পাখিটি দ্রুত সরে গিয়ে আবার সেই কুয়াশার মাঝে অদৃশ্য হয়ে গেল, যেখান থেকে সে এসেছিল।

মাস্তুল থেকে নামতে শুরু করার আগে নিচে ডেকের দিকে তাকাতেই আমি অবাক হয়ে দেখলাম, যখন আমি বিশাল পাখিটিকে নিয়ে নিমগ্ন ছিলাম তখন দুজন মানুষ নিচের ডেক থেকে এসে জাহাজের রেলিংএর কিনারায় দাঁড়িয়ে দূরে দিগন্তের দিকে তন্ময় হয়ে তাকিয়ে রয়েছে। ঠিক বুঝতে পারলাম তারা কে, কেননা ভোরের ঠাণ্ডা হাওয়ায় ওদের দেহ ভারী পশমি পোশাকে ঢাকা ছিল আর মুখও আমার দিক থেকে অন্য দিকে ফেরানো ছিল।

অবশেষে যখন ওরা ঘুরে মুখোমুখি হল তখন আমি চিনতে পারলাম ওরা হল জারাস আর তেহুতি। ওরা ডেকের চারপাশ চোখ বুলালেও মাস্তুলের উপরের দিকে চোখ তুলে তাকায়নি। যখন বুঝলো কেউ ওদেরকে লক্ষ্য করছে না, তখন জারাস তাকে দুই বাহুর মাঝে টেনে নিয়ে চুম্বন করলো। পায়ের বুড়ো আঙুলের উপর ভর দিয়ে উঁচু হয়ে তেহুতিও তাকে জড়িয়ে ধরলো। আমি নিশ্চুপ রইলাম। তবে আমি চোখ ফেরাবার আগেই তেহুতি একটু পিছিয়ে কথা বলা শুরু করতেই আমি তার ঠোঁট নাড়া পড়তে পারলাম।

তায়তা ঠিকই বলেছেন। ডাঙার কোনো চিহ্নই দেখা যাচ্ছে না। চিরদিনের জন্য আমাদেরকে বিচ্ছিন্ন করার আগে একসাথে থাকার জন্য দেবতা আমাদেরকে আরও একটি মূল্যবান দিন দিয়েছেন। তার প্রকাশভঙ্গিটি খুবই করুণ ছিল।

জারাস তাকে মনে করিয়ে দিল, তুমি একজন রাজকুমারী আর আমি একজন যোদ্ধা। যে কোনো মূল্যেই হোক আমাদের দুজনকেই পবিত্র দায়িত্ব পালন করতে হবে। আমাদেরকে সহ্য করতেই হবে।

তেহুতি আবার এগিয়ে তাকে চুম্বন দিয়ে বললো, আমি জানি তুমি যা বলছো তা সত্যি, তবে যখন তুমি চলে যাবে তখন আমার হৃদয় আর বেঁচে থাকার বাসনা তোমার সাথে নিয়ে যাবে। আমাকে সম্পূর্ণ শূন্য করে তুমি চলে যাবে।

আমি মুখ ফিরিয়ে নিলাম। আর একমুহূর্তও তাদের এই আকুতির গভীরতা সহ্য করতে পারলাম না। আমাকেও একটি পবিত্র দায়িত্ব পালন করতে হবে। দেবতারা যে বিশাল জাল আমাদের জন্য বুনেছেন আমরা তাতে আটকা পড়া কীটাণুকীট। এখান থেকে পালাবার কোনো উপায় নেই।

ওরা ডেকে থেকে চলে যাবার পর আমি মাস্তুলের ডগা বেয়ে নেমে আমার কেবিনে চলে গেলাম।

তেতির মায়ের মৃত্যুর পর দীর্ঘদিন আমি কাঁদিনি। তবে আজ আমার কান্না পেল।

.

পরদিন ভোরে আবার মাস্তুলের ডগায় চড়লাম। এবার হতাশ হলাম না। ভোরের আলোয় দিগন্তরেখায় নিচু আর নীল ক্রিট দ্বীপ দেখা যাচ্ছে। তবে এখানে নয় আমি আরও পঞ্চাশ লিগ সামনে এবং আরও উত্তরে দ্বীপটি দেখবো বলে আশা করেছিলাম।

তবে এতে তেমন অখুশি হই নি। সর্বাধিরাজ মিনোজের সাথে সাক্ষাতের জন্য আমি খুব তাড়াহুড়া করতে চাচ্ছি না, কারণ এতে আমার আদরের রাজকুমারীদেরকে আরও কয়েকটি আনন্দের দিন থেকে বঞ্চিত করা হবে। অপ্রত্যাশিতভাবে এই সুযোগ পেয়ে কল্পনা আর রূপকথার এই রাজ্যটি যতটুকু পারা যায় দেখার সিদ্ধান্ত নিলাম।

কেউ বাধা দেবার আগেই দৃশ্যটি পুরোপুরি উপভোগ করতে চেয়েছিলাম, তবে তা হল না। আমাদের সামনে ভেসে চলা আমার জাহাজ থেকে চিৎকার ভেসে এলো, ঐ যে ডাঙা দেখা যায়!

সাথে সাথে আমার নিচে ডেক আনন্দ উৎসাহে মানুষের ভীড়ে মুখরিত হয়ে উঠল। ওরা জাহাজের রেলিংয়ে ঝুঁকে আরও ভালোভাবে ডাঙা দেখার চেষ্টা করলো।

একটু পরই রাষ্ট্রদূত তোরানও মাস্তুল বেয়ে উপরে উঠে আমার পাশে এল। তাকে আমার চেয়েও বেশি অনুপ্রাণিত মনে হল।

সে বললো, দীর্ঘদিন ডাঙা না দেখে পানিতে ভেসে থেকে সাগরে সঠিক যাত্রাপথ নির্ধারণ করতে গিয়ে হাইপ্যাটস যে ভুল করেছে তা ক্ষমাযোগ্য। এছাড়া বাতাস আর স্রোতের ব্যাপারও আছে। সাগরে যাত্রাপথ সঠিকভাবে পরিচালনা করা কখনও সঠিক বিজ্ঞান নয়। এটা অনেকটা অনুমান নির্ভর। আসলে হাইপ্যাটসের ভুলটি আমাদের জন্য শুভ হতে পারে।

আমি তার দিকে তাকিয়ে বললাম, দয়া করে একটু খুলে বলবেন? আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে যখন আমরা সিডন থেকে যাত্রা শুরু করি তখন আপনাকে বলেছিলাম, সর্বাধিরাজ মিনোজের একটি অধ্যাদেশ অনুসারে রাজ্যের উত্তর উপকূলে কুমুসস বন্দরে কোনো বিদেশি যুদ্ধজাহাজ ঢোকা নিষেধ। সেখানে আমাদের যুদ্ধ জাহাজের ঘাঁটি রয়েছে।

হ্যাঁ ঠিক মনে পড়েছে। আপনি বলেছিলেন আমাদের জাহাজগুলো দক্ষিণ উপকূলে ক্রিমাদ বন্দরে নোঙর করবে। আসলে এই অবস্থানটি আমাদের জন্য বরং আরও সুবিধাজনক হবে। এখান থেকে নীল নদীর ব-দ্বীপে হাইকসো অবস্থানে যেতে বেশি দূরত্ব পার হতে হবে না।

এরপর দূরে স্থলভূমির দিকে আমার মনোযোগ আকর্ষণ করে তোরান বললো, ইডা পর্বতের নিচে ঐ সাদা দালানগুলো দেখতে পাচ্ছেন? ওগুলো হল ক্রিমাদ বন্দরের জাহাজঘাটা। আপনি এখুনি আপনার নৌবহরকে সেখানে গিয়ে যার যার নির্দিষ্ট জায়গায় নোঙর করতে বলুন। ক্যাপ্টেন হাইপ্যাটসের একজন নৌকর্মকর্তা তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে।

আমি বললাম, চমৎকার! সর্বাধিরাজ মিনোজ কি আমাকেও আমার নৌবহরের সাথে ক্রিমাদে থাকতে বলেছেন?

সে আমাকে আস্বস্ত করে বললো, না না তায়তা! সর্বাধিরাজ মিনোজ খুব ভালো করেই জানেন যে, আপনি ফারাও ত্যামোসের প্রতিনিধি আর তাই সর্বোচ্চ সম্মানের অধিকারী। একান্তভাবে আপনার বসবাসের জন্যই কুমুসস নগরীর উপরে ইডা পর্বতের ঢালে একটি সুরম্য প্রাসাদ আলাদা করে রাখা হয়েছে। তারপর একটু থেমে সে বললো, তবে এই জাহাজে আপনার দলের মধ্যে কিছু সদস্য আছেন যাদের থাকার ব্যবস্থা কুনুসসের বদলে ক্রিমাদে করলেই ভালো হবে।

কিছু না জানার ভান করে আমি বললাম, তাই নাকি! এরা কারা বলবেন একটু?

আমি বলতে চাচ্ছি না যে কেউ খারাপ আচরণ করেছেন, তবে এদের মধ্যে কিছু কিছু মানুষ সর্বাধিরাজ মিনোজের ভবিষ্যৎ স্ত্রীদের সাথে একটু বেশি মেলামেশা করছেন।

আপনি নিশ্চয়ই রাজপরিচারিকা লক্সিয়াসের কথা বলছেন না? একথা শুনে তোরান সাথে সাথে তার চোখ নামিয়ে ফেললো। আমি তাকে কৌশলে মনে করিয়ে দিলাম আমাদের উভয়েরই কিছু কিছু গোপন ব্যাপার আছে যা আমরা লুকিয়ে রাখি।

সুচতুরভাবে এই আলোচনা থেকে সরে গিয়ে তোরান বললো, সবকিছু আমি আপনার নিখুঁত বিবেচনার উপর ছেড়ে দিলাম।

.

মূল ডেকে নামতেই ক্যাপ্টেন হাইপ্যাটস কাছে এসে হাসিমুখে বললো, শেষ পর্যন্ত ষোল দিনই হল তাহলে, প্রভু তায়তা।

আমি তাকে প্রশংসা করে বললাম, সত্যি, চমৎকার জাহাজ পরিচালনার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ হাইপ্যাটস। দয়া করে আমার জাহাজের ক্যাপ্টেনদের এখুনি এখানে আসার জন্য সঙ্কেত পাঠান।

হাইপ্যাটস সমস্ত ক্যাপ্টেনদের উদ্দেশ্যে সঙ্কেত বার্তা পাঠাবার নির্দেশ দিল।

আমার নৌ-বহরের সমস্ত অধিনায়ক যার যার জাহাজ থেকে ডিঙ্গি নামিয়ে পবিত্র ষাঁড়ের পাশে এলো। প্রথমে দিলবার আর আকেমি, তারপর ওদের পেছন পেছন অন্যরা এলো। আমি সামনে ক্রিমাদ বন্দর দেখিয়ে ওদেরকে বললাম, এরপর এটাই হবে তাদের ভবিষ্যতে সমস্ত অভিযান পরিচালনার প্রধান কেন্দ্র।

এরপর জারাস আর হুই তাদের নিজ নিজ জাহাজের নেতৃত্ব নিয়ে এই জাহাজ থেকে চলে যাবার জন্য তৈরি হল। ওদের সমস্ত জিনিসপত্র ডিঙিতে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে।

আমি ইচ্ছা করেই খুব অল্প সময় দিয়ে ওদেরকে বদলি করা কথা বলেছিলাম; আর বলেছিলাম তেহুতি আর বেকাথাকে একথা না জানাতে। যে কোনো উপায়ে হোক আমি চাচ্ছিলাম সবার সামনে অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে।

তবে আমার মেয়েদেরকে এতো সহজে বোকা বানানো যায় না। ওরা সাথে সাথে বুঝেছিল কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। দুজনেই ওদের কেবিন থেকে বের হয়ে কী হচ্ছে দেখতে পেছনের ডেকে এলো। দুজনেই হালকা মেজাজে ছিল, তবে জারাস আর হুইকে মূল ডেকে ওদের লোকদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখার সাথে সাথে ওদের মুখের ভাব বদলে গেল।

তেহুতির চেহারা একটি লাশের মত ফ্যাকাশে হয়ে গেল, বেকাথার ঠোঁট কাঁপছিল আর সে চোখের পাতা মিটমিট করে চোখের পানি সামলাতে চেষ্টা করলো।

এদিকে মূল ডেকে জারাস তার লোকদের মনোযোগ আকর্ষণ করতেই ওরা পেছনের ডেকের দিকে তাকিয়ে অভিবাদন করলো। আমি দেখলাম বেকাথা এতো জোরে ওর বড় বোনের হাত চেপে ধরলো যে, ওর আঙুলের গাঁটগুলো সাদা হয়ে গেল।

তেহুতির ঠোঁট নাড়া দেখে আমি বুঝতে পারলাম সে ফিসফিস করে তাকে বলছে, বুকে সাহস আনো বেকাথা। সবাই আমাদেরকে দেখছে।

লক্সিয়াস ওদের পেছনেই দাঁড়িয়েছিল। এবার সে সামনে এসে বেকাথার পাশে দাঁড়িয়ে তার অন্য হাত চেপে ধরলো।

জারাস ক্যাপ্টেন হাইপ্যাটসকে উদ্দেশ্য করে আনুষ্ঠানিকভাবে বললো, জাহাজ থেকে নামার অনুমতি দিন ক্যাপ্টেন? আর হাইপ্যাটসও আনুষ্ঠানিকভাবে উত্তর দিল, অনুমতি দেওয়া হল, ক্যাপ্টেন।

জারাস জাহাজের কিনারায় গিয়ে তার লোকজনদের নিয়ে দড়ির সিঁড়ি বেয়ে ডিঙিতে নামলো। হুই তাকে অনুসরণ করলো। কেউ লক্ষ্য করেনি যে মেয়েরা পেছনের ডেকে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ওরাও পেছন ফিরে তাকায়নি।

হুইকে চলে যেতে দেখে বেকাথা একটু টলে উঠেছিল আর মৃদু স্বরে কাতরে উঠেছিল। তারপর তিনজনই হাতধরাধরি করে তাদের কেবিনের দিকে চলে গেল। বেকাথা প্রথম পদক্ষেপে একবার হোঁচট খেলেও তেহুতি তাকে ধরে তার পতন থামাল।

তোরান আমার উল্টোদিকে ডেকের অন্যধারে দাঁড়িয়েছিল। মেয়েরা নিচে নেমে যেতেই সে আমার দিকে একবার তাকিয়ে সমর্থনসূচকভাবে সামান্য মাথা নাড়লো।

এই সামান্য ইঙ্গিত থেকেই আমরা পরস্পরের সহযোগী হলাম। আমি জানি ভবিষ্যতে আমরা একে অন্যের উপর আস্থা রাখতে পারবো।

.

ডিঙ্গিগুলো পবিত্র ষাঁড়ের পাশ থেকে সরে গিয়ে আমার নৌ-বহরের দিকে

চলে যেতেই হাইপ্যাটস তার জাহাজের দিক পরিবর্তন করে দ্বীপের পূর্বদিকের অন্তরীপের দিকে রওয়ানা দিল।

আমি ক্রিমাদ বন্দরের দিকে সরাসরি চলে যাওয়া আমার জাহাজগুলোর দিকে রইলাম। আমার মেয়েদের কষ্টের কথা ভেবে তখনও আমার মন ভারাক্রান্ত হয়ে ছিল, তাই তোরানের কাছে গিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করে মন হালকা করার চেষ্টা করলাম।

ক্রিমাদ থেকে কুনুসসের দূরত্ব কত?

তোরান বললো, মূল দূরত্বটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। এটা মোটোমুটি চল্লিশ লিগের কাছাকাছি হবে। তবে সমস্যা হল ইডা পর্বতের পাদদেশ ঘুরে যাওয়া পথটি খাড়া এবং বিপদসঙ্কুল। ঘোড়ায় যেতে দুই দিন লাগবে। এর চেয়ে দ্রুত যাওয়ার চেষ্টা করলে ঘোড়াগুলো টিকে থাকতে পারবে না।

আমি জানি আমার জাহাজের লোকদের সাথে যোগাযোগ রাখতে হলে আমাকে নিয়মিত এই পথ ব্যবহার করতে হবে। এছাড়া রাজার হেরেমে আমার মেয়েদের সাথেও যোগাযোগ রাখতে হবে। আবার তোরান পথে যে দেরি হবার কথা বলেছে তা আমার পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম দ্বীপের মধ্য দিয়ে আমাকে একটি সরবরাহ শৃঙ্খলের মতো ব্যবস্থা নিতে হবে। এই পথের মাঝে দশ লিগ পর পর সরবরাহ চৌকিতে তাজা ঘোড়া অপেক্ষামান রাখতে হবে যাতে ঘোড়াগুলো জোরে ছুটতে পারে। এইভাবে সাত ঘন্টা কিংবা তার চেয়েও কম সময়ে দ্বীপ পার হতে পারবো। মেয়েদেরকে তাদের নতুন বাড়িতে তুলে দেবার পর এটিই হবে আমার প্রথম কাজ।

মেয়েদেরকে সান্ত্বনা দেবার জন্য নিচে তাদের কেবিনে গেলাম। কিন্তু ওরা আমার সাথে উপরে আসতে রাজি হল না। গভীর দুঃখে কাতর হয়ে ওরা একে অপরকে জড়িয়ে ধরে এক বাঙ্কে বসেছিল। আমার কোনো প্রশ্নের উত্তরে মুখ খুলতে চাচ্ছিল না। লক্সিয়াস ওদের পায়ের কাছে আসন পেতে বসেছিল। এই মিনোয়ান মেয়েটির বিশ্বস্ততা দেখে আমি আবারও মুগ্ধ হলাম।

নিয়তির নিষ্ঠুরতা আর দেবতার হৃদয়হীনতার সাথে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে ওদেরকে আরও সময় দিতে হবে। তরুণ বয়সে জীবনের দাবী শতগুণ বেড়ে যায়, তবে বয়সের সাথে সাথে তা কমে আসে। কীভাবে সহ্য করতে হয় তা অবশ্যই আমাদেরকে শিখতে হবে।

ওদেরকে ছেড়ে আমি ডেকে ফিরে এলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *