৫. কথা বলার অনুমতি

দুইদিন পর জারাস আমার কাছে এসে কিছু কথা বলার অনুমতি চাইল।

কখন থেকে তোমার আবার কথা বলার জন্য অনুমতির দরকার পড়লো? এর আগে তো অনুমতির কারণে আমার সাথে কথা বলা বন্ধ থাকেনি? এবার তাকে একটু বিব্রত মনে হল।

রাজকুমারী তেহুতি আমার কাছ থেকে অস্ত্র চালনার নিয়ম-কানুন আর তরবারি চালানো শিখতে চাচ্ছেন। আমি তাকে বলেছি এর জন্য আমাকে আপনার কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে।

এটা খুব একটা বুদ্ধিমানের কাজ হলো না জারাস। মহামান্য রাজকুমারী যা চান, তা তিনি পান।

সে আমাকে নিশ্চয়তা দিয়ে তাড়াতাড়ি বললো, আমি তাকে কোনো অসম্মান করার জন্য একথা বলছি না। তার অবস্থা দেখে আমার হাসি পেল।

আমি বললাম, রাজকুমারী অত্যন্ত দক্ষ একজন তীরন্দাজ। খুব দ্রুত তীর ছুঁড়তে পারেন। তার দৃষ্টিশক্তি প্রখর আর বাহুতেও খুব জোর আছে। আমি নিঃসন্দেহ তিনি শিঘ্রই খুব ভালোভাবে তলোয়ার চালানো শিখতে পারবেন। আর এই দক্ষতা তার ভবিষ্যৎ জীবনে কোনো না কোনো সময় অবশ্যই কাজে আসবে। কে জানে? এটা হয়তো এক সময় তার জীবন বাঁচাতে পারে। আমি জানিনা কেন একথাটা বললাম। তবে ঘটনা যেভাবে গড়াচ্ছে তাতে মনে হয় আমার এই কথাটাই আমার জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উক্তি হয়ে দাঁড়াতে পারে।

তার এই অনুরোধ রাখতে তোমার কি কোনো অসুবিধা আছে জারাস?।

জারাস আবার আমাকে নিশ্চয়তা দিয়ে বললো, না, না মোটেই না। কোনো অসুবিধা নেই প্রভু। বরং এটাকে আমি বিরাট একটি সম্মান আর বিশেষ অনুগ্রহ মনে করবো।

তাহলে শুরু করে দাও। আমার খুব কৌতূহল হচ্ছে জানতে যে, তুমি তাকে দিয়ে কি করতে যাচ্ছ। এনিয়ে আর চিন্তা করার দরকার নেই, তবে কথাটা আক্ষরিক অর্থে ঠিক ছিল না। বরং এটা ছাড়া অন্য বিষয়ে খুব কম চিন্তা করেছি। পরবর্তী সপ্তাহগুলোতে জারাস আর তেহুতিকে নিয়ে খুবই দুশ্চিন্তায় কাটালাম।

জারাস প্রতিদিন আরও শক্তিসঞ্চয় করতে লাগলো।

রোজ সকালে সূর্য উঠার সময় থেকে শুরু করে দুপুর পর্যন্ত তার লোকদেরকে নিয়ে উঁচুনিচু ময়দানে দৌড়াত। আমিও ওদের সাথে দৌড়াতাম। আমার অসাধারণ শক্তি এবং সহিষ্ণুতা ছিল আর আমি আমার চেয়ে বয়সে অর্ধেক লোকদের সাথে প্রতিযোগীতা করতে পারতাম।

প্রথম প্রথম আমি দেখতাম সে কি পরিমাণ কষ্ট সহ্য করছে আর অবাক হলাম লক্ষ করে যে, আমি ছাড়া আর সবার কাছ থেকে সে তার কষ্ট লুকিয়ে রাখতে পেরেছে। তবে কিছুদিন পরই আমার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আর তার পল্টনের লোকদেরকে নেতৃত্ব দিয়ে গান গাইতে গাইতে দৌড়াতে লাগলো। অনেক সময় আমার রসিকতায় মনখুলে হাসতেও লাগলো।

তার অধ্যবসায় আর আত্ম-উন্নতির ক্রমাগত প্রচেষ্টাকে সমর্থন করলাম। তবে সবকিছুরই একটা পরিমিতি বোধ থাকা দরকার। সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে যে আচরণ স্বাভাবিক, তা আমাদের মতো সমাজের উপরের স্তরের মানুষের জন্য শোভনীয় নয়।

যখন আমার সাথে পরামর্শ না করে সে সিদ্ধান্ত নিল যে, এখন থেকে প্রতিদিন সকালে সবাই পিঠে একটা করে বালুর বস্তা নিয়ে দৌড়াবে, তখন আমি বুঝতে পারলাম অন্য আরও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব আমি অবহেলা করে চলেছি। মরুভূমির মধ্য দিয়ে নির্বোধের মতো ছুটাছুটি করে কতগুলো তরুণ ষণ্ডার সাথে প্রতিযোগীতা করার চেষ্টা না করে, আমাকে রাজকুমারীদেরকে গণিতের বিজ্ঞান আর জ্যোতিষতত্ত্ব শিক্ষা দিতে হবে। এছাড়া দেবতাদের বংশবৃত্তান্ত নিয়ে রচিত গবেষণাকর্মটির শেষ অধ্যায়গুলো রচনার কাজটিও সমাপ্ত করা দরকার।

তাছাড়া আমি মনে করি পেশিশক্তির চেয়ে মনকে সবসময় প্রাধান্য দেওয়া উচিত।

.

সেনাপতি রেমরেম জয়নাব মরুদ্যানের উদ্দেশ্যে চলে যাওয়ার পর, ময়াগুহায় অপেক্ষা করার সময় আমি পড়াশুনা আর ব্যবিলনে পৌঁছার আগে সমস্ত পরিকল্পনা সেরে নিচ্ছিলাম। সময় সুন্দরভাবে দ্রুত বয়ে যাচ্ছিল।

তবে এসময়ে আমাদের দলের মধ্যে বেশ উল্লেখযোগ্য আর বিস্ফারোন্মুখ কিছু ঘটনা ঘটে চলেছিল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল রাজকুমারী বেকাথা আর কর্নেল হুইয়ের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের অবসান।

বেকাথার অনুরোধে কর্নেল হুই রোজ বিকেলে তাকে অশ্বক্রীড়ার বিভিন্ন কলাকৌশল শেখাচ্ছিল। তার প্রশিক্ষণে বেকাথা দ্রুত একজন অসমসাহসিক অশ্বারোহীতে পরিণত হচ্ছিল। সে সবসময় নির্ভীক ছিল। ভারসাম্য বজায় রাখা আর ঘোড়ার জিনে বসা, এই সবদিকে দিয়ে সে হুইয়ের সেনাদের থেকে অনেক পারদর্শীতা অর্জন করেছিল। এরা বেশিরভাগ ছিল রথের চালক, তাই ঘোড়ার পিঠে চড়ার চেয়ে বরং ঘোড়ার পেছনে থাকতেই পছন্দ করতো।

অন্যদিকে বেকথা ঘোড়ায় চড়ার সময় দাঁড়িয়ে থাকতে পছন্দ করতো। এটা আমিই তাকে শিখিয়েছিলাম। ঘোড়ার চড়ার সময় সে সবসময় তার দক্ষতা দেখাতে পছন্দ করতো আর কোনো দর্শক থাকলে, তার কলাকৌশলগুলোও দেখাতে ভালোবাসতো।

এক বিকেলে হুই তাকে একটা গোলক নিয়ে খেলা শেখাচ্ছিল। গোলকটি ছিল ওজনে ভারী আর কাঁচা চামড়ার ফালি দিয়ে বানানো একটা বড় বল। এই খেলায় দুই দলে চারজন করে ঘোড়সওয়ার থাকে আর দুজন ঘোড়সওয়ার ডগা বাঁকানো একটি লাঠির ডগায় গোলকটা ধরে মাঠের শেষ প্রান্তে একটি চিহ্নিত করা জায়গায় নিয়ে যাবে। আর ওদের প্রতিদ্বন্দ্বিরা ওদেরকে বাধা দেবে। এটি ছিল হৈচৈ আর জোর জবরদস্তি করে খেলার মতো একটি প্রতিযোগীতা। অনেক দর্শকের চিৎকার আর হৈ হুল্লোড়ের মধ্যে এটা চলতো।

সেদিন বিকেলে হুই বেকাথাকে শেখাচ্ছিল কীভাবে ঘোড়ার পিঠ থেকে নিচু হয়ে বালুতে গড়ানো বলটা তুলে নেওয়া যায়। রোজকার মতো গোটা পঞ্চাশেক সৈন্য আর শিবিরের অলস কিছু লোক মাঠের দুইধারে সারবেঁধে দাঁড়িয়ে খেলাটা উপভোগ করছিল।

বেকাথার ঘোড়া টগবগিয়ে মাঠে ঢুকলো। তার দুই হাত মুক্ত ছিল আর সে হাঁটুর গুঁতো দিয়ে ঘোড়াকে সামলাচ্ছিল।

হুই মাঠের একপাশে দাঁড়িয়ে গোলকটা নিয়ে অপেক্ষা করছিল। বেকাথা মাঠে ঢুকতেই সে গোলকটা তার সামনে মাটিতে ছুঁড়ে মারলো। বেকাথা ঘোড়ার গদি থেকে একদিকে ঝুঁকে নিচু হয়ে গোলকটা তুলতে চেষ্টা করলো; তার দেহের সমস্ত ওজন জিনের একপাশের রেকাবের উপর ছিল। আমার মতে এটা ছিল অতি চমৎকার একটি ক্রীড়াশৈলী। সমস্ত দর্শক চিৎকার করে তাকে উৎসাহ দিয়ে চললো, আমিও তাদের সাথে যোগ দিলাম।

বিশাল ঘোড়াটির পিঠে বেকাথাকে দেখতে ডাইনিসুলভ মনে হলেও সে অনায়াসে নিচের দিকে ঝুঁকে মাটিতে গড়ানো গোলকটির চারটি পালকের হাতলের একটি ধরে ফেললো। খুশিতে আত্মহারা হয়ে সে বলটি তুলতে শুরু করলো।

তারপর হঠাৎ তার জিনের রেকাবের চামড়া ছিঁড়ে গেল আর সে ঘোড়ার জিন থেকে শূন্যে ছিটকে পড়লো। তবে সে মাটিতে পড়ার আগেই আমি তার দিকে ছুটে গেলাম। ভাবলাম হয় সে মরেই গেছে আর নয়তো সাংঘাতিকভাবে আহত হয়েছে। অন্যদিকে হুই আমার আগেই দ্রুত তার দিকে ছুটে গেল।

তারপর আমি স্বস্তি পেলাম যখন দেখলাম বেকাথা মাটিতে দুপায়ের উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে আর প্রচণ্ড রাগে আর লজ্জায় কাঁপছে। আসলে সে মাটিতে এক জায়গায় স্তূপ করা ঘোড়ার বিষ্ঠার উপর পড়েছিল। একারণে ছুটন্ত ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়লেও তার হাতপা ভাঙেনি আর সম্ভবত এজন্যই তার জীবন রক্ষা পেয়েছে। তবে ঘোড়ার নাদি মাখামাখি হয়ে তার চেহারা বিশ্রী হয়ে এক অপমানকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।

তার পা থেকে মাথার লাল চুল পর্যন্ত ঘোড়ার সবুজ নাদিতে মাখামাখি হয়ে রয়েছে। হুই ছুটে তার কাছে পৌঁছাবার পর কেবল তার দিকে তাকিয়ে রইল। সে বুঝে উঠতে পারছিল না এ পরিস্থিতিতে তার কী করা দরকার। আর বেকাথাকে সান্ত্বনা দেবার জন্য আমি তার কাছে পৌঁছার আগেই, হুই এমন একটি কাজ করলো যাতে বিষয়টা জটিল হয়ে দাঁড়াল। সে বেকাথার অবস্থা দেখে হেসে ফেললো।

সাথে সাথে বেকাথা তার স্বভাবসুলভ প্রতিক্রিয়া দেখাল। প্রচণ্ড রাগে সে প্রায় উন্মাদ হয়ে গেল। তখনও তার ডান হাতে গোলকটা ধরা ছিল। সে সোজা এটা হুইয়ের মাথা লক্ষ্য করে ছুঁড়ে মারলো। হুই হঠাৎ এ-ধরনের আক্রমণ আশা করেনি, তাই সে নিজেকে বাঁচাতে পারলো না। ভারী গোলকটার চামড়া রোদে শুকিয়ে হাড়ের মতো শক্ত হয়ে ছিল। এটা তার চওড়া নাকের বাঁশির উপর আঘাত হানতেই ফিনকি দিয়ে রক্ত ঝরতে শুরু করলো। এতেও বেকাথা ক্ষান্ত হলো না।

সে যে ঘোড়ার বিষ্ঠার গাদার উপর দাঁড়িয়েছিল সেখান থেকে নিচু হয়ে দুই হাত ভরে নাদি তুলে নিয়ে হুইয়ের দিকে ছুটে গিয়ে তার ভাঙা নাকের উপর ঘসে দিল।

তারপর শীতল কণ্ঠে বললো, তুমি যদি মনে কর আমাকে দেখে তোমার হাসি পাচ্ছে, তাহলে এবার নিজের চেহারাটা দেখো কর্নেল হুই। তারপর সে ঘুরে মাঠ থেকে বের হয়ে সোজা রাজকীয় শিবিরের দিকে হেঁটে চললো। দর্শকদের মধ্যে কেউ আর হাসার সাহস করলো না, এমনকি আমিও না।

হুইকে আর কখনও রাজকীয় খাবার টেবিলে আমন্ত্রণ করা হয়নি আর রাজকুমারীদের ঘোড়ায় চড়া শেখানোর জন্য ডাকা হয়নি।

এর কয়েকদিন পর যখন বেকাথা আর লক্সিয়াস নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল তখন আড়াল থেকে আমি তাদের কথা শুনে ফেললাম। রাজকুমারীদের লেখাপড়ার জন্য শ্রেণিকক্ষ হিসেবে একটা তাঁবু আলাদা করে রাখা হয়েছিল। ওরা সেখানে মিনোয়ান ভাষায় কথা বলছিল। আমি এই তাবুর পেছনে দাঁড়িয়ে বাইরে পাহাড়চূড়াগুলোর বিভিন্ন রঙের দৃশ্য উপভোগ করছিলাম। অবশ্যই আমি আমার ছাত্রীদের কথোপকথন আড়ি পেতে শুনছিলাম না। তবে তাঁবুতে ঢোকার মুখে এই জায়গায় এসে একটু থামতেই ওদের কিছু কথা অসাবধানতাবশত আমার কানে এলো।

লক্সিয়াস বেকাথাকে জিজ্ঞেস করলো, তুমি কি এখনও কর্নেল হুইকে ক্ষমা করোনি?

বেকাথা উগ্রকণ্ঠে উত্তর দিল, আমি কোনোদিনই তাকে ক্ষমা করবো না। সে একজন অসভ্য গেয়ো ভূত। যখন আমি ক্রিটের রানি হব তখন তার মাথা কেটে ফেলার নির্দেশ দেবো।

ইস কী মজা হবে। আমাকে দেখতে দেবে?

এটা ঠাট্টা নয় লক্সিয়াস। আমি সত্যিই বলছি।

কিন্তু তুমি তো আমাকে আর তেহুতিকে বলেছিলে যে এই পৃথিবীতে সেই তোমার উপযুক্ত একমাত্র লোক?

এবার বেকাথার গলায় অহঙ্কারের সুর, আমি মত পাল্টেছি। তার মতো একজন বয়স্ক লোক দেখতে বিশ্রী, যে আচার ব্যবহার জানে না তার সাথে। আমার কী? যার আবার চল্লিশটা বিশ্রী চেহারা বউ আছে।

সে তেমন বয়ষ্ক নয় বেকাথা আর সে দেখতেও বেশ সুন্দর। আমি যদুর জানি থিবসে তার কেবল পাঁচজন বউ আছে আর ওরা দেখতেও বেশ সুন্দর।

বেকাথা দৃঢ়কণ্ঠে বললো, সে খুবই বুড়ো, এমনকি তায়তার চেয়েও বুড়ো। ভাঙা নাক আর মুখে ঘোড়ার নাদিসহ তাকে আমার মোটেই সুন্দর মনে হয় না। তার পাঁচ বউ তাকে নিয়ে থাকুক। আমার আর তাকে দরকার নেই।

বেকাথার এ-ধরনের রুঢ় শব্দ চয়ন আর আমার বয়স নিয়ে মানহানিকর মন্তব্য করাটা আমি ক্ষমা করলাম। এবার অন্তত একটা সমস্যার সমাধান হয়েছে। এখন থেকে তার বড় বোনের সাথে সাথে তারও কুমারীত্ব রক্ষা করতে আমাকে আর পাহারা দিতে হবে না।

আমি একটু গলা খাঁকারি দিতেই ওদের কথা থেমে গেল। তাবুর দরজা দিয়ে মাথা নিচু করে ঢুকে দেখলাম দুজনেই টেবিলে মাথা ঝুঁকে খুব মনোযোগ দিয়ে কিছু লিখছে। আমি ওদেরকে প্যাপিরাসে লেখা মিসরের ইতিহাসের কয়েকটি অধ্যায় দিয়েছিলাম, সেগুলো ওরা ক্রেটান ভাষায় অনুবাদ করছে। আমি পাশে এসে দাঁড়ালেও বেকাথা মাথা তুলে আমার দিকে তাকাল না।

তোমার অধ্যবসায় আর প্রাচীন মিসরীয় লিপিতে চমৎকার হাতের লেখা দেখে আমি সত্যি খুশি হয়েছি রাজকুমারী। তবে তোমার বোন তোমার সাথে নেই কেন?

সে তার তুলিটি সামনের দিকে তুলে বললো, সে ওদিকে খুব ব্যস্ত রয়েছে। আমাকে বললো একটু পরেই এখানে আসবে। একথা বলেই সে আবার তার লেখার কাজে মনোনিবেশ করলো।

শিবিরের শেষ প্রান্তে কুচকাওয়াজের ময়দান থেকে রক্ষীদের গুঞ্জন আমি শুনছিলাম, তবে খুব একটা খেয়াল করিনি। এবার বেকাথার কথা শুনে আমার একটু কৌতূহল জাগতেই বিষয়টা কি জানার জন্য তাঁবু থেকে বের হয়ে সেদিকে চললাম। কুচকাওয়াজের ময়দানের চারপাশ ঘিরে বেশ কয়েকজন ঘোড়ার সহিস, পেশাদার চিত্তবিনোদনকারী, চাকরবাকর, ক্রীতদাস আর অন্যান্য অসামরিক লোক দল বেধে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ওরা এমন মগ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছিল যে, আমার লোকজন কনুই দিয়ে ধাক্কা মেরে ভীড় সরিয়ে আমার এগোবার জন্য পথ করে দিল। ময়দানের কিনারায় দাঁড়িয়ে আমি চারদিকে তাকিয়ে সাথে সাথে তেহুতিকে দেখতে পেলাম না।

সেখানে জারাস তার অধীনস্থ লোকদের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিল। ওরা সবাই অর্ধেক বর্ম পরেছিল, তবে শিরস্ত্রাণের মুখের ঢাকনি উপরের দিকে উঠানো থাকায় সবার মুখ দেখা যাচ্ছিল। তলোয়ার খাড়া করে ঠোঁটে চুঁইয়ে ওরা সবাই ঋজু আর স্থির হয়ে অভিবাদনের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

জারাস গর্জে উঠলো, লড়াই শুরু! সামনের বারোজন তলোয়ার হাতে দ্রুত সামনে বামদিকে ঝুঁকে পড়। এক

লোকগুলো সমস্বরে চিৎকার করে উঠলো, এক! তারপর নিখুঁতভাবে সকলে তলোয়ার বাগিয়ে একযোগে সামনে বামদিকে শরীর বাঁকিয়ে ঝুঁকে পড়লো, তারপর আবার আগেকার অবস্থানে ফিরে এলো। রোদে তলোয়ারের পাতগুলো সোনার মত চকচক করে উঠলো।

তারপর হঠাৎ সামনের সারির মধ্যখানে একটি ছোটখাট মানুষের দিকে আমার নজর পড়লো। প্রথমে আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না আমি কী দেখছি। তারপর বুঝলাম না ঠিকই দেখেছি, এটা তেহুতি। সে রক্ষীবাহিনীর আঁটোসাটো পোশাক পরে রয়েছে। তার নুবিয় উপজাতীয় পরিচারিকাদের মধ্যে অন্তত তিনজন সূচিশিল্পে পটু ছিল, ওরা নিশ্চয়ই এক বেলাতেই পোশাকটা সেলাই করে দিয়েছে। আর সেনাবাহিনীর সাথে থাকা কামার তার হালকা পাতলা গড়নের সাথে খাপ খাইয়ে বর্মটি তৈরি করে দিয়েছে। সেনাবাহিনীর নিয়মিত একটি ভারী তলোয়ার হাতে ধরে রয়েছে, যা বিশেষত তার জন্যই তৈরি করা হয়েছে।

মুখে রক্তিমাভা, ঘামে ভেজা চুল লেপ্টে রয়েছে আর গায়ে সেঁটে থাকা আঁটো জামাটাও ঘামে ভেজা। আমি আতঙ্কিত হলাম। তাকে দেখে মনে হচ্ছিল একটি চাষার মেয়ে, যে সারাদিন তার স্বামীর ক্ষেতে কাস্তে হাতে ফসল কেটেছে কিংবা নিড়ানি দিয়েছে। তাকে ঘিরে রয়েছে একদল রুক্ষ চেহারার সৈন্য। আর সে এমন আচরণ করছিল যেন, তার চেহারা বা রাজকীয় পদমর্যাদা নিয়ে এদের মাঝে থেকে সে মোটেই লজ্জিত নয়।

আমি অবশ্য তাকে জারাসের কাছ থেকে তলোয়ার চালানো শিখতে বলেছিলাম। এমনকি এই পরিকল্পনায় উৎসাহও জুগিয়েছিলাম। তবে আমার ধারণা ছিল সাধারণ মানুষের চোখের আড়ালে নিভৃতে এই প্রশিক্ষণ চলবে আর কেউ তা দেখতে পাবে না।

দেবতারা সাক্ষী দেবেন যে, সাধারণ মানুষদের আমি অবজ্ঞার চোখে দেখি না। কিন্তু তাই বলে এতো উচ্চ মর্যাদার আসন থেকে নিচে নেমে সাধারণ মানুষের কাতারে এসে তাদের প্রতি সৌজন্য দেখানোরও একটা সীমা আছে।

আমার প্রথমে ইচ্ছা হচ্ছিল কুচকাওয়াজের ময়দানের মধ্য দিয়ে ছুটে গিয়ে তেহুতির ঘাড় ধরে টেনে রাজকীয় শিবিরের ভেতরে নিয়ে যাই। আর তাকে ধমক দিয়ে বলি যেন সে যথাযথ পোশাক পরে আর জনসাধারণের মাঝে গেলে তার আচরণ যেন আরও শোভন হয়।

তারপর আমার মাঝে সুবুদ্ধির উদয় হল। আমি জানি পুরো পল্টনের মাঝেও আমার কথা অমান্য করতে সে মোটেই ইতস্তত করবে না, যার ফলে ওরা যে সম্মানের চোখে আমাকে দেখতো তা ম্লান হয়ে যাবে।

আমি লক্ষ করলাম অস্ত্রধারীদের মধ্য দিয়ে সে এমন সাবলিল আর নিপুণতার সাথে মসৃণভাবে এগিয়ে চলেছে যে, তার চারপাশের শক্তিশালী যোদ্ধাদেরকে মনে হচ্ছিল হেঁচড়িয়ে চলা হাল চাষ করা কৃষক। সে একবারও ভুল পদক্ষেপ ফেলেনি কিংবা ছন্দ হারায়নি। সাবলীলভাবে তলোয়ারটি এক হাত থেকে অন্য হাতে নিচ্ছে আর লাফ মেরে অত্যন্ত নির্ভুলভাবে দ্রুত তলোয়ার চালাচ্ছে। বাম আর ডান, দুই হাতেই সমানতালে তলোয়ার চালাচ্ছে। তার চোখেমুখে পূর্ণ মনোযোগ এবং দৃঢ় সংকল্প ফুটে উঠেছে। সে অত্যন্ত চমৎকার এবং উচ্চপর্যায়ের দক্ষতা প্রদর্শন করছিল। ভারী তলোয়ার ধরা সরু হাতে যে প্রচণ্ড শক্তি আছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। তলোয়ার ঘুরাবার সময় বাতাসে সাঁই সাঁই শব্দ উঠছে। সবশেষে সে তলোয়ারটি এমনভাবে সামনে বাড়িয়ে ধরলো, যেন এটি পালকের মতো হালকা, ভারী কোনো ধাতু নয়। তারপর একটি হাতির দাঁতের মূর্তির মতো স্থির হয়ে দাঁড়াল।

জারাস নির্দেশ দিল, আরামে দাঁড়াও! সাথে সাথে দর্শকরা খুশিতে ফেটে পড়ে একযোগে হাততালি দিয়ে আর পা মাটিতে দাপিয়ে আনন্দ প্রকাশ করতে লাগলো। তারপর একটি কণ্ঠ তার নামের প্রতিটি অক্ষর আলাদা আলাদাভাবে উচ্চারণ করলো:

তে-হুঁ-তি! সাথে সাথে আর সবাই তার সাথে গলা মিলিয়ে ডেকে উঠলো, তে-হুঁ-তি!

তারপর শুরু হল সম্মিলিত কণ্ঠে স্তব। আমিও এই বীর বন্দনায় সামিল হলাম। তে-হুঁ-তি।

প্রশান্ত গাম্ভীর্য আর পদমর্যাদা ভুলে গিয়ে আমিও ওদের সাথে গলা মিলিয়ে স্তব শুরু করলাম।

.

পরিশেষে উত্তর থেকে একজন বার্তাবাহক উটে চড়ে ময়াগুহায় এলো। সে সেনাপতি রেমরেমের কাছ থেকে বার্তা নিয়ে এসেছে যে, দুই সপ্তাহ বিশ্রাম নেওয়ার পর তার অগ্রবর্তী দলটি জয়নাব মরুদ্যান থেকে সামনের দিকে যাত্রা শুরু করার জন্য প্রস্তুত হয়েছে।

সে জানিয়েছে সবকিছু ঠিক আছে। তার দলের কারও কোন ক্ষতি হয়নি কেবল একটি উট সে হারিয়েছে। সে আমাকে তাড়াতাড়ি জয়নাব মরুদ্যানের দিকে রওয়ানা হওয়ার জন্য আহ্বান জানিয়ে বলেছে মরুদ্যানটি এখন খালি এবং এর মাটির নিচের ঝরণা থেকে প্রচুর পানি এসে জলাধারটি পূর্ণ হয়েছে।

যথারীতি আমি জারাসকে নির্দেশ দিলাম, তবে শিবির উঠিয়ে সমস্ত মালামাল ভারবাহি পশুর উপর তুলতে দুইদিন লেগে গেল। এর ফাঁকে জারাসকে আমার তাঁবুতে ডেকে পোশাক খুলে তার ক্ষতটা পরীক্ষা করলাম। দেখলাম সে শারীরিকভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়েছে। যে জায়গায় অস্ত্রোপচার করা হয়েছিল সেজায়গাটি ঘন কালো লোমে ঢাকা পড়ে অদৃশ্য হয়ে গেছে। সে আমাকে আশ্বস্ত করলো যে পেটের ভেতরে ক্ষত সৃষ্টি হলেও এখন তার পাকস্থলী ঠিক আগের মতো কাজ করছে। সেদিন সকালেই আমি দেখেছিলাম সে পুরো বর্ম পরে আর কাঁধে একটি বালুর বস্তা নিয়ে দশ লিগ লম্বা একটি দৌড় থেকে সবার আগে ফিরে এসেছিল।

বিকেলে সূর্যের তাপ কমে আসার পর আমরা ময়াগুহা থেকে যাত্রা শুরু করলাম। ক্ষয়িষ্ণ চাঁদের আলোয় পথ দেখে সারারাত চললাম। তারপর সকালে রোদের তাপ বেড়ে যাওয়ার পর আবার তাঁবু খাটালাম। ইতোমধ্যে বিশ লিগ দূরত্ব অতিক্রম করে এসেছি। মন প্রফুল্ল হল। নিজে বিশ্রাম নেবার আগে পুরো শিবিরের সবকিছু ঠিকঠাক আছে কিনা ঘুরে দেখলাম। আমি সবসময় অবাক হতাম শুধু দুএকটা ভালো কথায় কীভাবে দলের সবচেয়ে নিম্নস্তরের সদস্যও কি-রকম খুশি হয়। একজন মানুষ অনেক সময় ভুলে যায় যে, তার চেয়ে কম বুদ্ধিমান লোক তাকে কীরকম সম্মান করে।

কিন্তু রাজকীয় শিবিরে ফিরে আসার সাথে সাথে মনের সমস্ত প্রশান্তি ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। আসলে একটু দূর থেকেই আমি শোরগোল আর চিৎকার চেঁচামেচি শুনতে পাচ্ছিলাম। অবিরাম ক্রন্দন, কিছু হারাবার বিলাপ সবকিছু পরিষ্কার মরুর বাতাসে ভেসে আসছিল। সাথে সাথে ছুটতে শুরু করলাম, না জানি কী অঘটন ঘটেছে। নিশ্চয় কোন মৃত্যু কিংবা তেমন কোনো বিয়োগান্তক ঘটনা ঘটেছে।

রাজকীয় শিবির এলাকায় ঢুকে দেখলাম সমস্ত দাসদাসি আতঙ্কে হতভম্ব হয়ে রয়েছে। তারা আমার প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে পারলো না। ওদের বোকামী দেখে অধৈর্য হয়ে একজন নুবিয় পরিচারিকার কাধ ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে তার স্বন্বিত ফেরাবার চেষ্টা করলাম, কিন্তু এতে কোনো কাজ হলো না। বরং চারপাশের হট্টগোল এখন একটি পাগলাগারদে পরিণত হল।

তাড়াতাড়ি আমি মেয়েটিকে ছেড়ে দিয়ে তাকে আশ্বস্ত করলাম যে, আমি তার সতীত্ব হানি করতে যাচ্ছি না, তারপর দ্রুত তেহুতির তাবুর দিকে গেলাম। তাঁবুর ঢোকার মুখে উচ্চস্বরে বিলাপরত বেশ কয়েকজন মেয়েকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে রাজকুমারীর কাছে পৌঁছলাম। সে তার বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে রয়েছে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার দমকে তার পুরো শরীর কেঁপে উঠছিল।

আমার গলার আওয়াজ শোনার সাথে সাথে সে লাফ দিয়ে বিছানা থেকে উঠে আমার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো।

কী হয়েছে বাছা? কে মরেছে? এমন কী হয়েছে যে, তুমি কাঁদছো?

আমার আংটি! আমি আংটিটা হারিয়ে ফেলেছিনিশ্চয়ই কেউ এটা চুরি করেছে।

প্রথমে আমি তার কথা বুঝতে না পেরে বললাম, কোন আংটি?

আড়ষ্টভাবে আঙুলগুলো ছড়িয়ে বামহাত সামনে বাড়িয়ে বললো, আমার আংটিটা নেই। যেটা তুমি আমাকে দিয়েছিলে। সেই জাদুর হীরার আংটিটা, যেটা তুমি তামিয়াত দুর্গ থেকে আমার জন্য এনেছিলে।

সমস্যাটি তেমন গুরুত্ব নয় বুঝতে পেরে আমি বললাম, ঠিক আছে তুমি শান্ত হও। আমরা এটা খুঁজে বের করবো।

কিন্তু যদি খুঁজে না পাও? এটাই একমাত্র জিনিস যা আমি পৃথিবীতে সবচেয়ে ভালোবাসি। এটা হারিয়ে গেলে আমি আত্মহত্যা করবো।

প্রথমে এই মেয়েগুলোকে এখান থেকে তাড়াতে হবে, তারপর আমরা শান্তভাবে নিজেদের মধ্যে বিষয়টা নিয়ে কথা বলতে পারবো। হাতের ছড়ি আর মুখের সুন্দর ভাষা ব্যবহার করে ওদের সবাইকে তাবু থেকে বের করলাম। তারপর বিছানায় তেহুতির পাশে বসে ওর এক হাত ধরে বললাম,

এখন বল কখন, কোথায় এটা শেষ দেখেছ। আমার প্রশ্নটা শুনে সে একটু ভাবতে লাগলো। আমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম, এতো কান্নাকাটি, ফুপানো আর আত্মহত্যার হুমকি ইত্যাদি সত্ত্বেও তার সুন্দর চোখদুটো পানি শূন্য। এখন আমরা দুজন একা হওয়ার পর তাকে বেশ নিরুদ্বেগ মনে হচ্ছে। এমনকি মনে হচ্ছে যেন বিষয়টা সে বেশ উপভোগ করছে। সাথে সাথে আমার মনে সন্দেহ জাগলো।

বেশ নাটকীয় ভঙ্গিতে তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠতেই সে বললো, হ্যাঁ, এবার ঠিক মনে পড়েছে! কোথায় হারিয়েছে এবার মনে পড়েছে। কাল বিকেলে ময়াগুহা ছেড়ে আসার আগে লক্সিয়াস, বেকাথা আর আমি শেষবারের জন্য জলাধারে সাঁতার কাটতে গিয়েছিলাম। মনে পড়েছে পানিতে নামার আগে আমি আংটিটা খুলে যে পাথরটার উপর সবসময় রাখতাম তার উপরে রেখেছিলাম। নিশ্চয়ই সেখানেই আংটিটা ফেলে এসেছি।

তার গুল মারা আর কল্পনার সাথে তাল মিলিয়ে বেশ গম্ভীরভাবে আমি জিজ্ঞেস করলাম, ঠিক বলছো তো? অন্য কোথাও ফেলোনি তো?

সাথে সাথে সে আমাকে আস্বস্ত করে বললো, হ্যাঁ, আমি নিশ্চিত। অন্য কোথাও অবশ্যই পড়েনি।

এবার আমি তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললাম, তাহলে তো ব্যাপারটা বেশ সহজ হয়ে গেল। তোমার দুশ্চিন্তা শেষ তেহুতি। আমি কর্নেল হুইকে ময়াগুহায় পাঠাবো। সে তার সবচেয়ে দ্রুতগামী ঘোড়ায় চড়ে সেখানে গিয়ে কাল সকালের আগে ফিরে আসতে পারবে।

একথায় সে হঠাৎ হতচকিত হয়ে গেল। সঙ্কটে পড়ে হাত কচলাতে কচলাতে বললো, কিন্তুনা, তুমি হুইকে সেখানে পাঠাতে পারবে না।

আমি সরলভাবে বললাম, কিন্তু কেন? হুইতো ভালো লোক।

সে একটু ইতস্তত করে তারপর বললো, জিনিসটা কোথায় ফেলে এসেছি সেটা হুইকে ঠিকমতো বুঝিয়ে বলতে পারবো না। হুই একজন বিদেশী। সে ভালোভাবে মিসরীভাষা বলতে পারে না।

আমি তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকালেও সে আমার চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারছিল না। উচ্চারণ বিদেশি ঢংয়ের হলেও একটি পল্টনকে নেতৃত্ব দেবার মতো মিসরি সে ভালোই বলতে পারে। সে যে ওজর দেখিয়েছে আমি তা খন্ডন করা সত্ত্বেও তেহুতি বললো, আমি হুইকে বিশ্বাস করি না। মনে নেই সে কীভাবে আমাদের ছোট্ট বেকাথাকে নাজেহাল করেছিল। সে আংটিটা চুরি করে ফেলতে পারে। তাকে কোন কিছু দিয়ে আমি বিশ্বাস করতে পারি না।

তাহলে তোমার নিজেকেই ঐ গুহায় গিয়ে আংটিটা খোঁজ করা উচিত।

এতক্ষণ নিজে যে কথাটা সে ভাবছিল সেটার দিকে আমাকে ঠেলে দিয়ে এবার সে বেশ উৎসাহ নিয়ে বললো, আরে একথাটা তো আমি আসলেই ভাবিনি! তুমি ঠিকই বলেছো তায়তা। আমারই যাওয়া উচিত।

কিন্তু তুমি তো একা যেতে পারো না। তোমার সাথে আমার কাউকে পাঠাতে হবে। হুই তো অবশ্যই নয়, কেননা তুমি তো আবার বিদেশিদেরকে বিশ্বাস করো না। তারপর বিষয়টা নিয়ে একটু চিন্তা করার ভান করে বললাম, সেনাপতি রেমরেমকে পাঠানো যেত, কিন্তু সে তো এখন এখানে নেই। অন্য সময় হলে আমি যেতাম, কিন্তু আমার পিঠ ব্যথা করছে আর আমার বিশ্রাম নেওয়া দরকার। একথাটা বলে আমি কোমরের পেছনের দিকে হাত রেখে ব্যথায় কঁকিয়ে উঠলাম।

সে আমার দিকে উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, আহা, আমার তায়তা! আমি আর তোমাকে শরীরে কোনো ধরনের কষ্ট নিতে দেবো না।

আমি বললাম, পেয়েছি পেয়েছি! ক্যাপ্টেন জারাসকে তোমার সাথে পাঠাব।

কথাটা শোনার সাথে সাথে সে চোখ নামিয়ে নিল। বুঝতে পেরেছে। আমি তাকে পরীক্ষা করছিলাম। এবার সে আমার দিকে তাকিয়ে ভান করা ছেড়ে দিয়ে হেসে উঠলো, তারপর আমার গলা জড়িয়ে ধরে ফিসফিস করে বললো।

আমি তোমাকে ভালোবাসি, সত্যি সত্যিই তোমাকে ভালোবাসি তায়তা।

আমিও তাকে জড়িয়ে ধরে ফিসফিস করে বললাম, ব্যাপারটা আরও পরিষ্কার হয় যদি সেই দুষ্টু আংটিটা আমার কাছে রেখে যাও, কারণ এবার হয়তো সত্যিই এটা তোমার আঙুল থেকে পড়ে যেতে পারে।

সে তার আস্তিনে হাত ঢুকিয়ে যখন আবার বের করলো তখন হাতটা মুষ্টিবদ্ধ ছিল। তবে নিরাপদ দূরত্বে রেখে বললো, এটা ছাড়া আর সবকিছু দিয়ে আমি তোমাকে বিশ্বাস করতে পারি।

তারপর মুঠোটা খুলতেই সেই বিখ্যাত হীরার আংটিটা তার তালুতে দেখা গেল।

যখন আমি ফিরে আসবো তখন এটা আমার হাতের আঙুলে থাকবে আর কখনও আঙুল থেকে খুলবো না। এটা সবসময় জারাসের প্রতি ভালোবাসার চিহ্ন হয়ে থাকবে। এমনকি কর্তব্যের খাতিরে যদি তাকে চিরদিনের জন্য ত্যাগ করতে হয়, তারপরও এই আংটি তার স্মৃতি হয়ে আমার কাছে থাকবে।

ঘন্টাখানেকের মধ্যে সে আর জারাস দুটো ঘোড়ায় চড়ে দক্ষিণদিকে ছুটে চললো। তাদের দেহরক্ষীদলও একটু পর তাদের অনুসরণ করলো।

কর্তব্য থেকে এ-ধরনের গহিত বিচ্যুতি আমার মনে একটু অপরাধ বোধ জাগাল। তারপর যখন মনে পড়লো আমার অতি প্রিয় দুইজন তরুণ মানুষকে খুশি হওয়ার সামান্য সুযোগ দিতে পেরেছি তখন মন থেকে এই অপরাধবোধ ভাবটি ম্লান হয়ে গেল।

.

আমি আশা করিনি যে ওই দুইজন খুব শিঘ্রই ময়াগুহা থেকে ফিরে আসবে। তবে ওরা আমাকে হতাশ করেনি। জয়নাব মরুদ্যানে প্রায় এক সপ্তাহ অপেক্ষা করার আগেই ওরা ফিরে এল।

আমার তাঁবুর সামনে পৌঁছে ঘোড়া থেকে নামার সময় তেহুতি ফিসফিস করে জারাসকে বললো, তুমি এখানে অপেক্ষা কর। আমাকে তার সাথে একা কথা বলতে হবে।

ওরা রৌদ্রে দাঁড়িয়েছিল আর তাই আমি যে তাঁবুর ছায়া থেকে ওদের লক্ষ্য করছিলাম, তা ওরা দেখতে পায় নি। সেজন্য তেহুতির ঠোঁট নড়া দেখে আমি তার কথা বুঝতে পারছিলাম।

সে দৌড়ে তাবুতে ঢুকলো। আমি তার দিকে এগিয়ে যেতেই সে খুশিতে অস্ফুট চিৎকার করে আমার বাহুর মাঝে এলো। তাকে জড়িয়ে ধরার পর আমি বুঝতে পারলাম এই অল্প সময়ের মধ্যেই সে অলৌকিকভাবে শৈশব অবস্থা থেকে পূর্ণ নারীতে পরিণত হয়েছে, অপরিশোধিত ধাতু থেকে রাজকীয় স্বর্ণ হয়েছে।

তাকে চেপে ধরেই আমি জিজ্ঞেস করলাম, যা খুঁজতে গিয়েছিলে তা কি পেয়েছো?

ও হ্যাঁ, পেয়েছি। এই কথা বলে তার হাতের মুঠো আমার সামনে খুলে ধরলো। হীরাটা চমকাচ্ছে, তবে তার চোখের মতো উজ্জ্বল নয়। আমি এটা ভালোবাসি, তবে গুহায় অন্য যে সম্পদ পেয়েছি তা আরও ভালোবাসি।

তারপর সে অকপটভাবে বললো, আমি তোমাকে সবকিছু খুলে বলবো। যা যা হয়েছে সব বলবো।

তাঁবুর ফাঁক দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখলাম বেচারি জারাস তখনও সেখানে চাপা আর লজ্জিত মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ঠিক একটি ছোট্ট ছেলের মতো যে, আপেল বাগানে আপেল চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েছে আর এখন মার খাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। আমি এটা নিয়ে আর কথা না বাড়িয়ে তাকে যেতে দিলাম।

পুরো শিবিরটি হাসি ঠাট্টায় ভরে গিয়ে এখন একটি আনন্দের জায়গা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি বেশ অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম যে, জারাস আর তেহুতি বেশ সতর্কতার সাথে তাদের রোমান্সের বিষয়টি লুকিয়ে রেখেছে। মনে হল আমি ছাড়া সম্ভবত আর কেউ তা জানেনা। এমনকি বেকাথাও নয়। মনে বেশ পরিতৃপ্তি অনুভব করলাম যে, এই দুজনের ভালোবাসার আমি অভিভাবক হয়েছি। মনে পড়লো অনেক আগে তেহুতির বাবা-মার ব্যাপারেও একই ভূমিকা আমি পালন করেছিলাম।

জয়নাব মরুদ্যানে আমাদের বেশিদিন থাকা হয়নি। আমরা এগিয়ে চললাম। বিশাল এই ধু-ধু প্রান্তরে রেমরেম আর দলবল আমাদের জন্য যে পথ নির্দেশনা রেখে গিয়েছিল তা অনুসরণ করে সপ্তাহের পর সপ্তাহ চলতে লাগলাম। মরুভূমিতে এমন এক সৌন্দর্য আর মহিমা আছে যা, পৃথিবীর অন্য কোথাও নই। এই স্থান উত্তেজিত মনে প্রশান্তি এনে দেয় আর দেবতার কাছাকাছি আসার সুযোগ করে দেয়। এটা ছিল আমার জীবনের অত্যন্ত স্মরণীয় আর তৃপ্তিদায়ক একটি সময়।

এভাবে উত্তরে যেতে যেতে একসময় আমরা রেমরেম আর দলের অন্য অংশের দেখা পেলাম। পূর্ব পরিকল্পনামতো ইউফ্রেটিস নদীর কেবল দশ লিগ দক্ষিণে আমাদের দুই দলের মিলন হল। অবশ্য এতো কাছে যে এরকম বিশাল একটি নদী রয়েছে তার কোনো চিহ্ন এখনও দেখা যাচ্ছে না। এখনও আমাদের চারপাশ ঘিরে রয়েছে রুক্ষ পাথরের পাহাড় আর ধূলিধূসর রোদে পোড়া উপত্যকা।

আমাদের এক চোখওয়ালা পথ নির্দেশক, আল-নামজু এবার আমাদেরকে শেষ মরুদ্যানে নিয়ে এলো। এই জায়গাটির নাম ধ্রুস। এখানে পনেরোটি কূপ রয়েছে, সবগুলোতে পরিষ্কার মিঠে পানি। এখান থেকে একটি জনবহুল গ্রাম, একটি খেজুর বাগান আর অন্যান্য কৃষিখামারে পানি সরবরাহ করা হয়। আমাদের এতো বড় একটি কাফেলার কয়েকদিনের প্রয়োজন মেটাবার মতো যথেষ্ট পরিমাণ পানি এখানে রয়েছে।

এখানে শিবির স্থাপন করার কিছুক্ষণ পর আল-নামজু আমার সামনে এসে নতমস্তকে দাঁড়াল।

তারপর বললো, পরম শ্রদ্ধেয় প্রভু তায়তা। এখান থেকে ইউফ্রেটিস নদীর তীরে শালদিসে উর নগরীর কাফেলা চলার পথটিতে প্রচুর লোকচলাচল হয় আর এপথে পরিষ্কার দিক নির্দেশনা রয়েছে। নদীও কাছে। এপথে যেতে আপনাদের তেমন অসুবিধা হবে না।

সেক্ষেত্রে চুক্তি মোতাবেক উর পর্যন্ত পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে তোমারতো কোনো অসুবিধা হবার কথা নয় আল-নামজু, তাই না?

হে মহান প্রভু তায়তা। আপনার উপলব্ধি আর অনুকম্পার মিনতি করছি। আমার উর নগরীতে ঢোকার সাহস নেই, সেখানে আমার শত্রু রয়েছে। এখানকার আক্কাদিয়রা ভীষণ প্রতিহিংসাপরায়ণ আর বিপজ্জনক লোক। আমি আপনার কাছে প্রার্থনা করছি দয়া করে আমাকে এখানেই ছেড়ে দিয়ে দক্ষিণে জুবায় ফিরে যাবার অনুমতি দিন। সেখানে আমার বড় ছেলে হারানোর শোক পালন করবো। একথা বলার পর তার শূন্য চোখের কোটর থেকে এক বিন্দু চোখের পানি মুছলো। দৃশ্যটা দেখতে বেশ বিসদৃশ।

আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তাহলে কি তুমি চুক্তি মোতাবেক পুরো পারিশ্রমিক দাবী করছো? একথা শোনার সাথে সাথে সে আমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো।

আপনি আমার বাবা এবং প্রভু। যা আপনার মর্জি। আমি একজন গরীব মানুষ, আমাকে আমার ছেলে হারুন আর তার পুরো পরিবারের ভরণ-পোষণ করতে হবে। এটা আমার দুর্ভাগ্য।

তার দুঃখদুর্দশার ফিরিস্তি শুনতে শুনতে তার অনুরোধটি বিবেচনা করলাম। এটা সত্যি যে সে একজন বিশ্বাসঘাতক ছেলের বাবা আর একটি ছেলে তার জনকের মতো একই ছাঁচে হয়ে থাকে। অন্যদিকে তার নিজের ছেলেকে হত্যা করতে আমি তাকে বাধ্য করেছিলাম। এতেই কি তার ঋণ শোধ হয়নি? নিজেকে জিজ্ঞেস করলাম। মনে হয় সে যথেষ্ট ভুগেছে।

চরিত্রগতভাবে আমি একজন দয়ালু মানুষ, তবে এটা হয়তো গুণের চেয়ে একটা দোষই হবে। আমি তাকে বললাম, তুমি আমাদের জন্য অনেক ভালো কাজ করেছে আল-নামজু। আমার আশীর্বাদ নিয়ে তুমি এবার যেতে পার। তারপর আমার থলে থেকে দুটি রূপার মেম মুদ্রা নিয়ে তার বাড়ানো হাতে তুলে দিলাম। তারপর সে আমার পায়ে চুমু খেয়ে চলে গেল।

চারদিন পর আমি শালদিসের উর নগরীর উপরে নিচু পাহাড়ে দাঁড়িয়ে এই প্রথমবারের মতো নিচে নগর আর সবুজ ইউফ্রেটিস নদীর দিকে তাকালাম। এই নদীটি যে আমাদের মা নীল নদের চেয়েও চওড়া এই সত্যিটি উপলব্ধি করতে পেরে আমি একটু বিরক্তি বোধ করলাম। কেননা এর আগে আমি মনে করতাম নীল নদই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় নদী।

ইউফ্রেটিস নদীর দুই তীরে যতদূর চোখ যায় গভীর বনানী দেখা যাচ্ছে। বন কেটে বড় বড় কৃষি জমি তৈরি করা হয়েছে। রুক্ষ মরুভূমি পার হওয়ার পর প্রচুর গজিয়ে উঠা এই বিশাল শ্যামলিমা দেখে আমার মন ভরে গেল। আমি যেখানে দাঁড়িয়েছিলাম ঠিক তার নিচেই নদীর তীরে উর নগরীর অবস্থান। এর ঠিক কেন্দ্রস্থলে রয়েছে ইশতার দেবীর বিশাল মন্দির। ইনি সুমেরিয় আর আক্কাদিয়দের প্রধান দেবী। এটি একটি পিরামিড আকৃতির ইমারত। একটির উপর একটি পাঁচটি চত্বর ধাপে ধাপে উপরের দিকে ছোট হয়ে চলে গেছে। এটি শুধু একটি মন্দির নয়, বন্যার সময় যখন নদীর কূল ছাপিয়ে নগরী আর আশপাশের সবজায়গা প্লাবিত হয়ে যায় তখন মন্দিরের পুরোহিত আর যাজিকারা এখানে আশ্রয় নেন।

আমরা নগরীর দিকে রওয়ানা দিলাম। দলের সবার আগে রেমরেম আর রাজকুমারীদের নিয়ে আমি ঘোড়ায় চড়ে চললাম। পাহাড়ের পাদদেশে পৌঁছার আগেই লাল কাদামাটির ইটের তৈরি শহরের প্রধান ফটকের ভেতর থেকে একদল নারী পুরুষ পুরোহিত আমাদের অভ্যর্থনা জানাতে সামনে এগিয়ে এলো।

নদীর উজানে ব্যবিলন আর মাত্র একশো বিশ লিগ সামনে রয়েছে। সবেমাত্র বিশাল মরুভূমি পার হয়ে এসেছি, আর এখুনি রাজা নিমরদের রাজধানীতে পৌঁছাতে চাচ্ছিনা। আমি চাই আমাদের সম্পদ আর জাঁকজমক দেখিয়ে সুমেরিয়দের মাত করে দিতে। দীর্ঘ সফরের ক্লান্তির পর আমাদের চেহারার যে অবস্থা হয়েছে তাতে পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ এবং সম্পদশালী রাষ্ট্রের প্রতিনিধির বদলে আমাদেরকে মরুভূমির একটি বেদুঈন যাযাবরের দল মনে হচ্ছে।

শোভাযাত্রাটি কাছে আসতেই আমি সামনের সারিতে পুরোহিত আর যাজিকাদের মাঝে রাষ্ট্রদূত ফাট তুরকে দেখেই চিনতে পারলাম। ফাট তুর হচ্ছেন সুমেরিয়ায় মিসরের রাষ্ট্রদূত। তার বর্তমান পদে আসার অনেক আগে থেকে আমরা পরস্পরকে চিনতাম। একজন পরিশ্রমী আর বিশ্বস্ত রাজকর্মকর্তা। সুতরাং আমি নিশ্চিত হলাম যে, ব্যবিলনে আমাদের পৌঁছার জন্য সমস্ত বন্দোবস্ত ঠিক মতোই করা হয়েছে। তাকে স্বাগত জানাবার জন্য আমি ঘোড়ার পিঠ থেকে নামলাম। তারপর দুজনে একসাথে নগরীর ফটকের দিকে হাঁটতে হাঁটতে পুরোনো বন্ধুর মতো কথা বলে চললাম।

আপনার অনুরোধ মতো নদীপথে যাওয়ার জন্য আমি দশটি বড় আর আরামদায়ক বজরা ভাড়া করেছি। যাত্রার জন্য আপনি যখনই তৈরি হবেন তখনই এই বজরাগুলো রাজকুমারী আর আপনার প্রতিনিধি দলের বর্ষীয়ান সদস্যসহ আপনাকে নিয়ে নদীর উজানে ব্যবিলনের দিকে রওয়ানা দেবে। স্বভাবতঃ আমিও আপনাদের সাথে যাবো। তবে অত্যন্ত সম্মানের সাথে আমি আপনাকে জানাতে চাই, কাফেলার বড় অংশটির আগেই হাঁটাপথে ব্যবিলনে পৌঁছে সেখানে আপনার আগমনের জন্য অপেক্ষা করা উচিত।

ফাট তুর সেই বিশাল জিগুরাট অর্থাৎ সিঁড়ি-পিরামিড আকৃতির মন্দির এলাকায় আমাদের থাকার ব্যবস্থা করেছিল। সেখানে পৌঁছে সবাই স্থির হতে না হতেই সূর্যাস্তের সময় হল। থিবস থেকে যেসব সুন্দর পোশাক-আশাক, অলংকার ইত্যাদি সাজগোজের জিনিসগুলো আনা হয়েছে, আমি রাজকুমারী আর মেয়েদেরকে এবার সেগুলো বাক্স থেকে বের করতে বললাম। ব্যবিলনে রাজা নিমরদের দরবারে হাজির হওয়ার প্রস্তুতি হিসেবে ওরা এবার পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন আর ফিটফাট হওয়ার সুযোগে পেয়েছে।

রাজকুমারীদেরকে বুঝিয়ে বললাম, ওদের সাজসজ্জা আর সুন্দর চেহারা দিয়ে রাজা নিমরদ আর ক্রিটের রাষ্ট্রদূতকে মুগ্ধ করে দেওয়াটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। কেননা এই রাষ্ট্রদূতই আবার সমস্ত বিষয় তার প্রভু সর্বাধিরাজ মিনোজের কাছে তুলে ধরবে।

সুবিশাল মন্দির চত্বরে বসে তারাভরা আকাশের নিচে ফাট তুর আর রেমরেমের সাথে নৈশভোজ করলাম। সকালেই ইউফ্রেটিস নদী থেকে ধরা এক হাত লম্বা পার্চ মাছ দিয়ে উদর পূর্তি করলাম। সেই সাথে নদীর তীরবর্তী বাগানের আঙুর চোলাই করে তৈরি করা লাল মদ পান করলাম।

খাওয়াদাওয়ার পর আমাদের মূল উদ্দেশ্য–হাইকসোদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের পরিকল্পনার আলোচনায় মনোযোগ দিলাম।

আপনারা জানেন আমার উদ্দেশ্য হচ্ছে রাজা নিমরদ আর সর্বাধিরাজ মিনোজ, উভয়কেই যেকোনো ভাবেই হোক ভুলিয়ে ভালিয়ে ফারাওয়ের সাথে একটি সামরিক মিলনের মধ্যে আনা। এটা অর্জন করতে পারলে আমরা রাজা গোরাবকে কামারের নেহাইয়ে ফেলে তিনটি হাতুড়ি দিয়ে পিষে তাকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে পারবো।

রেমরেম বললো, আপনার কথাগুলো শুনতে ভালো লাগলেও আমার নৈতিক উন্নতি হল না তায়তা। আমি পরিষ্কার বুঝতে পারলাম না কামারের। নেহাইটি কে আর হাতুড়িগুলোইবা কারা। আমি মনে মনে একটা দীর্ঘশ্বাস নিলাম। অনেক সময় রেমরেমের সাথে আলোচনা করার সময় মনে হয়, যেন একজন পঙ্গুকে পর্বতের উপরে টেনে নিয়ে যাচ্ছি। প্রতিটি পদক্ষেপে তাকে সাহায্য করতে হয়।

দয়া করে আমাকে ক্ষমা করবেন। আমি একটি রূপক ব্যবহার করছিলাম। বিষয়টা আমার আরও পরিষ্কার করে বলা উচিত ছিল। এখানে কামারের নেহাই হচ্ছে সাহারা মরুভূমি আর ক্রিট, সুমেরিয়া আর আমাদের মিসরের সেনাবাহিনী হচ্ছে হাতুড়ি।

রেমরেম বললো, তাহলে আপনার বলা উচিত ছিল গোরাবকে আমরা চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলবো। এই হাতুড়ি আর নেহাইয়ের কথা বলার বিষয়টা বেশ বিভ্রান্তিকর মনে হচ্ছিল। সরলভাবে সোজাসুজি কথা বললেই সবসময় ভালো হয়, তাই না?

কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে আমি বললাম, আপনার পাণ্ডিত্যপূর্ণ উপদেশের জন্য ধন্যবাদ রেমরেম। তারপর প্রসঙ্গ পালটে বললাম, আসলে আমি যে বিষয়টা বলতে চাচ্ছি তা হল, হাইকসোদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে আমরা যেরকম অঙ্গীকারবদ্ধ সেরকম মনোভাব ক্রিট কিংবা সুমেরিয়ার নাও থাকতে পারে। তারপর ফাট তুরের দিকে ফিরে বললাম, আপনার কাছ থেকে এ-বিষয়ে রাজা নিমরদের অবস্থান জানতে পারলে আমি খুশি হব। সম্ভবত আপনি এব্যাপারে আরও কিছু আলোকপাত করতে পারবেন।

ফাট তুর সায় দিয়ে মাথা কাত করে বললো, আমি অত্যন্ত আগ্রহের সাথে আপনার মুখোমুখি হয়ে বিষয়গুলোর বিস্তারিত ব্যাখ্যা করার এই সুযোগের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। কেননা কবুতরের পায়ে বেধে যে বার্তা পাঠানো হয় তাতে সবকিছু খুলে বলা যায় না। আপনি নিশ্চয়ই জানেন যে, ১৪ বছর আগে তারা বাবা রাজা মারদক মারা যাওয়ার পর নিমরদ উত্তরাধিকার সূত্রে সিংহাসনের অধিপতি হয়েছেন।

আমি বললাম, হ্যাঁ, আমি তা জানি।

রাজা মারদকের রাজত্বের শেষ ত্রিশ বছর ব্যবিলন পুণর্নির্মাণের কাজে কেটে যায়। তিনি একে সৃষ্টির সবচেয়ে সুন্দর আর জমকালো নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন।

আসলেই আমি শুনেছিলাম যে মারদক বিশাল একটি কাজ করেছেন। তবুও আমার সন্দেহ থিবসের সৌন্দর্যের সাথে এর তুলনা চলে না।

এবার ফাট তুর মৃদু হেসে বললো, তাহলে আপনি সত্যি এবার অবাক হবেন। শোনা যায় রাজা মারদক এই পুনর্নির্মাণ কাজে ছয় লাখের উপর রূপা ব্যয় করেছেন। তবে এটি নিশ্চিত তার এই বাতিকের খরচ মেটাতে গিয়ে রাজকোষ প্রায় শূন্য হয়ে যায়।

একথা শুনে আমি অবাক হয়ে তার দিকে তাকালাম। উত্তর দিতে আমার একটু দেরি হয়ে গেল। তারপর সন্দিগ্ধভাবে মাথা নাড়তে নাড়তে বললাম, আমি তো ভেবেছিলাম সুমেরিয়া ক্রিটের চেয়েও সম্পদশালী একটি রাষ্ট্র।

হ্যাঁ, অধিকাংশ লোক তাই মনে করে। আমি গত পাঁচ বছর ধরে ব্যবিলনে বসবাস করছি আর প্রথম প্রথম আমিও সুমেরিয়ার অতুল সম্পদের কাহিনী বিশ্বাস করতাম। মাত্র কিছুদিন হল আসল সত্যিটা জেনেছি। মন্ত্রীদের বেতন দেওয়ার মতোও যথেষ্ট পরিমাণ অর্থ রাজা নিমরদের নেই। তার বেসামরিক শাসন ব্যবস্থা ছিন্নভিন্ন। অস্ত্রশস্ত্র আর প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের অভাবে সামরিক বাহিনী অথর্ব হয়ে রয়েছে। বেতন না পেয়ে সেনাবাহিনীর সদস্যরা দলে দলে পালিয়ে যাচ্ছে। তিনি হয়তো হাইকসোদের বিরুদ্ধে আক্রমণের জন্য যথাযথ সৈন্য সমাবেশ করতে পারবেন না, যদিও তিনি ভালোভাবেই জানেন তার দেশে বিপদের আশঙ্কা আছে।

রেমরেম আর আমি উভয়েই নির্বাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম।

রেমরেমের মুখের ভাব বদলে গেল। আমি জানি সে বুঝতে পেরেছে তার সমস্ত আশা ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। সে নিশ্চিত ছিল যে সুমেরিয়ার রাজা নিমরদ আমাদের একজন শক্তিশালী মিত্র হবে। তার সে আশায় ফাট তুর পানি ঢেলে দিয়েছে।

এদিকে আমি অবশ্য অনুপ্রাণিত হলাম। আমার কাছে এখন সামনে যাওয়ার পথ পরিষ্কার হয়েছে। নিমরদ এখন দেউলিয়া হয়েছে। সে তার দেশ আর সেনাবাহিনী হারাবার পথে। নিদারুন হতাশায় সে নিশ্চয়ই এখন ভয়ভাবনাহীন এবং যেকোনো পদক্ষেপ গ্রহণে অকুণ্ঠিত। আমার কাছে প্রায় দশ লাখ রূপা আছে। চারচাকার ঘোড়ার গাড়ির পাদানিতে কাঠের নকল তক্তার নিচে আর উটের দুইপাশে ঝুলানো থলেতে এগুলো লুকানো রয়েছে। এছাড়া রাজার উপত্যকায় ফারাওয়ের রাজকোষে শত শত লাখ রূপা মজুত রয়েছে। সুতরাং রাজা নিমরদ আর সুমেরিয়া এখন আমাদের। আমি তাকে যে কোনো দাম হাঁকতে পারবো, সে তা প্রত্যাখ্যান করতে পারবে না।

প্রথম হাতুড়িটি এখন আমার হাতে এসে গেছে। যদিও আমার শব্দচয়নে রেমরেম বেশ কিছুক্ষণ গাইগুই করলো। অন্য হাতুড়িটি ক্রিট দ্বীপে আমার জন্য অপেক্ষা করছে। রূপার বিনিময়ে এর মূল্য সামান্য। তবে কৃপণতা আর হৃদয়বিদারণের মূল্য অনেক বেশি হতে পারে।

.

পরদিন সকালে নতুন প্রেরণা নিয়ে ঘুম থেকে উঠলাম। আমার প্রধান ক্রীতদাস রুস্তি প্রাতরাশ নিয়ে এল। আর সেই সাথে আমার প্রিয় মদও আনলো। মদের গোলাপজল মিশিয়ে চত্বরে পায়চারি করতে করতে গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে নিচের বিশাল নদীর দিকে তাকালাম। সময়ের শুরু থেকেই এই নদীটি ছিল ইতিহাসের একটি কেন্দ্রবিন্দু।

রাজা নিমরদের আর্থিক দূরবস্থার সংবাদ, চোখের সামনে বিশাল নদী আর দূরের বরফাচ্ছাদিত পর্বত চূড়ার সৌন্দর্য আর হাতে সুস্বাদু মদের গ্লাস থাকা সত্ত্বেও আমি অনুভব করলাম আমার মনের ফুর্তি উবে যাচ্ছিল। আমি জানি অতি গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় আমার চোখ এড়িয়ে গেছে। মাথার চারদিকে একটা মশার মতো এটি গুঞ্জন করছে তবে আমি তাড়াতে চেষ্টা করেও তা করতে পারছিলাম না।

অরেকবার পায়চারি করে ঘুরতেই দেখলাম রুস্তি আমার দিকে আতঙ্কিত চোখে তাকিয়ে রয়েছে। সে বললো, কিছু হয়েছে প্রভু?

আমি তাকে আস্বস্ত করে বললাম, এমন কিছু নেই যা সামলানো যায় না। তারপর লেখার টেবিলে গিয়ে এক টুকরা প্যাপিরাসে কিছু লিখলাম। কাগজটা ভাঁজ করে রুস্তির হাতে দিয়ে বললাম, এখুনি এটি মহামান্য রাজকুমারী তেহুতির কাছে গিয়ে শুধু তার হাতে দেবে। তারপর প্রধান সহিসের কাছে গিয়ে বলবে দুটো ভালো ঘোড়ার পিঠে জিন চড়িয়ে বাইরে উঠানে প্রস্তুত করে রাখতে। আমি এখুনি সেখানে যাচ্ছি, সে যেন আমাকে অপেক্ষা করিয়ে না রাখে। রুস্তি আমার নির্দেশ পালন করতে ছুটে গেল।

আমি যা করতে চাই তা এই মন্দির এলাকায় সম্ভব নয়। কোনো সন্দেহ নেই এখানে পাথরের দেয়ালে ছোট ছোট কুঠরি, গোপন জানালা আছে আর কথা শোনার মতো গুপ্ত স্থানে রাজা নিমরদের শান্তিরক্ষী বাহিনীর সদস্যরা, নিদেন পক্ষে পুরোহিতদের চরেরাও কান পেতে রয়েছে।

পেয়ালার বাকি মদটুকু শেষ করে দ্রুত পাশের কামরায় গিয়ে ঘোড়ায় চড়ার পোশাকটা পরলাম। তারপর নিচে নেমে ভবনটির পেছনে আস্তাবলে গেলাম। তেহুতি প্রায় আধা ঘন্টা পর এলো। তাকে বেশ খুশি খুশি লাগছিল। হাসি হাসি মুখে তার সুন্দর চেহারায় এমন একটি রূপ ধারণ করেছে যা আর কখনও দেখা যায় নি। সে দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো, তারপর পায়ের আঙুলের ডগায় ভর দিয়ে আমার কানে কানে ফিস ফিস করে বললো, রুস্তি বললো, তুমি নাকি আমাকে একটা গোপন কথা বলবে। তাই সে জানাল অন্য মেয়েদেরকে যেন না জানাই যে আমি তোমার সাথে দেখা করতে যাচ্ছি। তারপর সে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে বললো, এবার বল! কী বলবে তায়তা। তুমি তো জানো গোপন বিষয় জানার জন্য আমি বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে পারি না।

সে বার বার অনুরোধ করলেও আমি তার কথায় কান না দিয়ে বললাম, চল এমন কোথায় যাই যেখানে আমরা একা হতে পারি। তারপর তাকে ঘোড়ার পিঠে চড়িয়ে দিলাম। দুজনে ঘোড়ায় চড়ে ইউফ্রেটিস নদীর তীরে পৌঁছার পর আমি ঘোড়ার গতি কমিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে চললাম। দুজন পাশাপাশি চলতে লাগলাম।

তুমি এমন নিষ্ঠুর কেন হচ্ছো? আমি জানি তুমি আমার জন্য একটা উপহার এনেছো। অসিরিসের দিব্যি আমি আর এক মুহূর্ত দেরি সহ্য করতে পারছি না।

এবার তোমার জন্য আমি কোনো উপহার আনিনি। আমার শুধু একটা সহজ প্রশ্ন আছে। ময়াগুহা থেকে তুমি আর জারাস ফিরে আসার কত দিন হল?

ওহ, এটা তো বেশ সহজ প্রশ্ন। তারপর মাথার উপরে সূর্যের উচ্চতা অনুমাণ করে বললো, তেতাল্লিশ দিন আর প্রায় নয় ঘন্টা।

আমি মাথা নেড়ে বলো, তারপর কখন তুমি কিছু হারিয়েছ?

না তো এই যে দেখো! আংটিটা এখনও আমার আঙুলে রয়েছে। এই কথা বলে সে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। হীরাটা তার আঙুলে জ্বলজ্বল করছে।

আমি কোনো কথা না বলে ভাবলেশহীন চোখে তার দিকে তাকালাম। আমি চুপ করে থাকায় কিছুক্ষণ পর তার মুখ থেকে হাসি মুছে গিয়ে একটি বিভ্রান্তিকর অভিব্যক্তি ধারণ করলো। তারপর হঠাৎ সে বুঝতে পারলো আমার প্রশ্নটা কোনদিকে যাচ্ছে। এবার সে চোখ নামিয়ে নিল।

একটু কঠিন স্বরে আমি বললাম, তুমি আমাকে বলতে ভুলে গেছ যে তাই না তেহুতি? প্রায় এক মাস হল তোমার রজঃস্রাব হয়নি, অথচ আমাকে কথা দেওয়া সত্ত্বেও তুমি এই সত্যটা আমার কাছে গোপন রাখার চেষ্টা করেছ।

সে ফিসফিস করে বললো, আমি তোমার সাথে প্রতারণা করতে চাই নি। আমি শুধু আর কিছুদিন বাচ্চাটাকে আমার ভেতরে জীবিত রাখতে চেয়েছি। আমি অবশ্যই তোমাকে বলতাম তায়তা। বিশ্বাস কর সত্যি বলতাম।

হ্যাঁ, অবশ্যই বলতে, তবে অনেক দেরি করে। তোমার এই হঠকারিতা আর স্বার্থপরতা দিয়ে তুমি নিজের জীবন আর মিসরের রাজপরিবারকে বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছ।

বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে সে বললো, আর কখনও এরকম করবো না তায়তা। তারপর চোখের পানি লুকাতে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল।

আমি রাগত স্বরে বললাম, তা তো বলবেই। এসো আমার সাথে।

কোথায় যাবো?

মন্দির প্রাঙ্গণে আমার কামরায়।

নিচে আস্তাবলে তার সাথে দেখা করতে যাওয়ার আগে আমি একটা আরক তৈরি করে রেখেছিলাম। এক ধরনের বুনো কাটা গাছের শুকনো ছাল পানিতে ফুটিয়ে রেখে গিয়েছিলাম। এটা নীল নদীর উৎসের ওপারে অনেক দূরের পতিত জায়গা থেকে এনেছিলাম। ফিরে আসার পর দেখলাম বিষাক্ত রসটা ইতোমধ্যে ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। তেহুতিকে শোবার ঘরের একটা কৌচে বসতে বললাম। তারপর পেয়ালাটা এনে কালো চোলাইকরা রস পুরোটা তাকে খাওয়ালাম। রসটা পিত্তকোষের মত তিক্ত কিন্তু তারপরও রেহাই দিলাম না। তিনবার সে বমি করে রসটা উগড়ে ফেলতে চেষ্টা করলো কিন্তু আমি শক্ত রইলাম।

পেয়ালাটা শূন্য হওয়ার পর তার চেহারা দেখে মায়া হল। ইতোমধ্যে তার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে প্রায় সাদা হয়ে গেছে, চোখদুটো রক্তলাল আর পানিতে টলটল করছে।

আমি সত্যি দুঃখিত তায়তা। খুব বোকামি করেছি। আমি তোমার বিশ্বাস ভঙ্গ করেছি, জানি আর কখনও তুমি আমাকে ক্ষমা করবে না।

তার পাশে বসে তাকে জড়িয়ে ধরলাম, তারপর তার কান্না থামা পর্যন্ত তাকে ধরে দোলাতে থাকলাম। যখন সে ঘুমিয়ে পড়লো তখন একটা পশমি কম্বল দিয়ে তার শরীর ঢেকে দিলাম। তারপর নিচে গিয়ে বাকি দুটি মেয়ের সাথে দেখা করলাম। ওদেরকে বুঝিয়ে বললাম তেহুতি হঠাৎ একধরনের সংক্রামক আর ক্ষতিকারক জ্বরে আক্রান্ত হয়েছে। ছোঁয়াচে এই জ্বর যাতে ওদের মধ্যে সংক্রমণ না হয় তাই তেহুতি সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত তার সাথে দেখা করা যাবে না।

তারপর তেহুতি যেখানে শুয়েছিল সেখানে ফিরে গেলাম। এরপরের যন্ত্রণাদায়ক দুটি দিন তার পাশেই কাটালাম। দিনের বেলা গল্প বলে, বীণা বাজিয়ে আর তার প্রিয় গানগুলো গেয়ে শোনালাম। আর রাতে একটা অসুস্থ শিশুর মতো তার সেবাশুশ্রূষা করতে লাগলাম যতক্ষণ না অষুধের প্রভাবে সে ঘুমিয়ে পড়ে।

তৃতীয় রাতে তার গোঙানী আর প্রচণ্ড ব্যথায় কাতরানি শুনে আমি ঘুম থেকে জেগে উঠলাম। আমি তাকে দুহাতের মধ্যে জড়িয়ে ধরে দোলাতে লাগলাম আর নানারকম প্রবোধবাক্য শোনাতে লাগলাম। তারপর একসময় অনুভব করলাম তার গর্ভে মোচড়ানি শুরু হয়েছে। আমি তার পেট মালিশ করতে লাগলাম যাতে ব্যথা কম হয় আর মরা জিনিসটি বের করাতে ভালো দেবতার কাজে সহায়তা করে।

শেষ পর্যন্ত হঠাৎ তীব্রবেগে এক ঝলক রক্ত আর শ্লেষ্মর সাথে এটা বের হতেই সে কোনোমতে কনুইয়ে ভর দিয়ে উঠে বসে এটা দেখতে চাইল।

গর্ভের ফুলের সাথে শ্লেষ্ম আর রক্তমাখা এমন নোংরা একটি ছোট্ট মানব স্ক্রন লেগে রয়েছে যে, এটা দেখলে সে সারা জীবন দুঃস্বপ্ন দেখবে। তার অনুরোধ উপেক্ষা করে প্রাণহীন ছোট্ট জিনিসটি কাচিয়ে নিয়ে আমার রূপার মদের পাত্রে ভরলাম। তারপর রাত হতেই গোপনে আস্তাবলে গিয়ে ঘোড়ায় চড়ে নদীর তীরে গভীর জঙ্গলে গেলাম। সেখানে নদীর তীরে একটি বড় গাছের নিচে সেই ছোট্ট রূপার শবাধারে ভ্রুণটি মাটি চাপা দিলাম। তারপর সেখানেই হাঁটু গেড়ে বসে এই ছোট্ট আত্মাটির মঙ্গল কামনা করে শিশুদের দেবী আইসিসের কাছে প্রার্থনা করলাম।

আমার কামরায় ফিরে গিয়ে ভাবলাম তেহুতি নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে আছে। কিন্তু তার পাশে গিয়ে দেখলাম সে তখনও কাঁদছে। আমি তাকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিতে লাগলাম।

.

এরপর আর বারোটি রাত উরের মন্দির এলাকায় কাটালাম। ইতোমধ্যে তেহুতি তার ধকল সামলে সুস্থ হয়েছে আর চেহারায় আগের সৌন্দর্য ফিরে এসেছে।

শেষদিন রেমরেমকে নিয়ে আমি নগরীর ফটক দিয়ে বের হলাম। তাঁবুগুলো গুটিয়ে সবকিছু গোছগাছ করে ভারবাহি পশুগুলোর পিঠে তুলে ফেলা হয়েছে। এখন আমরা ব্যবিলনের পথে দীর্ঘ সফরের শেষ অংশ পাড়ি দেবার জন্য তৈরি।

রেমরেমের দেহরক্ষী দল তার জন্য অপেক্ষা করছিল। আমি তাকে বিদায় জানালাম। সে একজন দক্ষ সেনানায়ক এবং ভদ্রলোক।

আমি দাঁড়িয়ে দেখলাম সে তার কাফেলার একেবারে সামনে গিয়ে অন্যান্য সেনানায়কদের মাঝে অবস্থান নিল। তারপর ডান হাত উপরে তুলতেই সামনে এগোবার নির্দেশ দিয়ে শিঙা বেজে উঠলো। ঢাক পেটাবার তালে তালে ওরা হেঁটে চললো। ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে আমি উরের দিকে ফিরে চললাম।

নদীর তীরে এসে দেখলাম রাজকুমারীরা দলের অন্যান্য সঙ্গীদের নিয়ে জাহাজঘাটে আমার জন্য অপেক্ষা করছে। ফাট তুর আমাদের জন্য যে বজরাগুলো ভাড়া করেছিল সেগুলো মাঝ নদীতে নোঙর করা রয়েছে। রঙিন পতাকা আর কাগজ দিয়ে এগুলো সজ্জিত করা হয়েছে। ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে আমি রাজকুমারীদেরকে জড়িয়ে ধরার সাথে সাথে প্রথম বজরাটি নোঙর তুলে জাহাজঘাটে এলো। ফাট তুর পেশাগত দক্ষতার সাথে মাঝিমাল্লাদের যথাযথ নির্দেশ দিয়ে তৈরি করে রেখেছিল। সে রাজকুমারীদেরকে প্রথম বজরায় উঠিয়ে পেছনের দিকে একটি চমৎকার ডেকে বসাল। পরিচারকরা সোনার পাত্রে তাদেরকে শীতল মধূর শরবত পরিবেশন করলো। বিশেষভাবে সংরক্ষিত তাপনিরোধক বাক্সে জাগরোস পর্বতচূড়া থেকে দ্রুতগামি রথে করে বরফ এনে এই শরবত ঠাণ্ডা করা হয়েছে। রাজকুমারী কখনও এরকম সুশীতল এবং সুমিষ্ট শরবত পান করেনি। ওরা খুশিতে মাতোয়ারা হল।

জোর হাওয়া এসে পাল ফুলিয়ে নিয়ে বিশাল নদীর বুকে বজরাটি দ্রুত ভেসে চললো। খোলা ডেকে শিল্পীরা যন্ত্রসঙ্গীত পরিবেশন করতে লাগলো, ভাঁড় আর হাতের ভেল্কি দেখিয়ে অন্যান্য পেশাদার বিনোদনকারীরাও তাদের পরিবেশনা সুন্দরভাবে উপস্থাপন করলো। বেকাথা আমাকে বাও খেলায় হারাল আর জারাস তেহুতিকে তার সাম্প্রতিক কবিতা আবৃত্তি করে শোনাল। এসব কবিতা অবশ্য যুদ্ধ জয়ের বর্ণনা আর মৃত্যুর কথা ছিল না। এতে ছিল ভগ্ন হৃদয় আর প্রতিদানহীন আবেগের কথা, যা রাজপরিবারের অন্তত একটি সদস্যের চোখে অশ্রু এনে দিয়েছিল।

বিনোদনের পাশাপাশি আমি ফাট তুরের সাথে পরামর্শ করতে লাগলাম কীভাবে রাজা নিমরদের সেনাবাহিনী আর রথীদের কাজে লাগানো যায়।

.

আমার জীবনে এমন অবাক খুব বেশি হই নি। নগরীর যে বর্ণনা শুনে আমি মনে করেছিলাম অতিশয়োক্তি এখন মনে হল তা আসলে কম বলা হয়েছিল।

নদীর দুই তীর জুড়ে বিস্তৃত এই উজ্জ্বল চকচকে নগরীর তুলনায় একশো ফটকসহ আমার সুন্দর থিবসকে একটি সাদামাটা গ্রাম মনে হল। এর আগে বিভিন্ন অট্টালিকার যেসব চিত্র আর স্কেচ আমি দেখেছিলাম এখন সেই স্থাপনাগুলো দেখে চিনতে পারলাম। তবে এই বিস্ময়বহ কর্মগুলোকে প্যাপিরাসে তুলে ধরাটা অনেকটা এক বালতি লোনা পানিতে মধ্য সাগরকে দেখানোর মতো মনে হল।

চকচকে সাদা মার্বেল পাথরে তৈরি মারদুকের প্রাসাদটি নদীর দক্ষিণ তীরে অবস্থিত। ফাট তুর গলুইয়ে আমার পাশে দাঁড়িয়ে আমার সন্দেহ নিরসন করে তা নিশ্চিত করলো।

পুব থেকে পশ্চিমে প্রাসাদটি অর্ধলিগ পর্যন্ত বিস্তৃত আর থিবসের ফারাওয়ের প্রাসাদের তিনগুণ উঁচু। এর সামনের দিকে নদীর উত্তর দিকে রয়েছে ঝুলন্ত উদ্যান। মারদুক এমনভাবে এটি তৈরি করেছে যাতে প্রাসাদের প্রত্যেক অলিন্দ আর বারান্দা থেকে এই চমৎকার জিনিসটি সম্পূর্ণভাবে দেখা যায়।

প্রাসাদের সামনে অনেক উঁচুতে কতগুলো খোলা গ্যালারির সমন্বয়ে বাগানটি গড়ে উঠেছে। মারদুকের স্থপতিরা তাদের সৃজনী ক্ষমতা দিয়ে এমন একটি দৃষ্টিবিভ্রম সৃষ্টি করেছিল যেন বাগানগুলো মাটির উপর দাঁড়িয়ে নেই, এগুলো অলৌকিকভাবে আকাশ থেকে ঝুলে রয়েছে। এগুলো এমন কোণে কাত করা রয়েছে যে, নদীর বিপরীত তীরে প্রাসাদ থেকে একজন পর্যবেক্ষক গ্যালারি জুড়ে একটি অরণ্য সৃষ্টি করা প্রতিটি গাছ আর চারা দেখতে পাবে।

নীল নদীর তীরে মেশিরে বিরাট এলাকা জুড়ে ফারাও আমাকে যে জমি দান করেছিলেন, তারপর থেকেই বৃক্ষরোপনের বিষয়ে আমার আগ্রহ আচ্ছন্নতার পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। এখন আকাশের বুকে এই চমৎকার বাগানটি দেখে আমার নিজের উর্বর জমিগুলোকে নগণ্য মনে হল।

শূন্যে এই বাগানগুলো দেখে আমি ফাট তুরকে বললাম, আমি গাছ আর সবুজ বনানী ভালোবাসি। এটি আমার মনে আনন্দ দেয় আর আত্মার প্রশান্তি এনে দেয়।

ফাট তুর শুষ্ক মন্তব্য করলো, রাজা মারদুক নিশ্চয়ই আপনার মতোই গাছপালা ভালোবাসতেন। তবে এই লক্ষ্য অর্জন করতে গিয়ে তিনি তার জাতিকে দারিদ্রের মুখে ঠেলে দেন।

ভাবলাম প্রসঙ্গটা এখন পরিবর্তন করলেই ভালো হবে। রাষ্ট্রদূত জানে না যে আমার উটের হাওদার থলেগুলোতে বিশাল রূপার ভান্ডার আছে। তার একটি অসতর্ক মন্তব্য রাজা নিমরদকে এর অস্তিত্ব সম্পর্কে সাবধান করে দিতে পারে। প্রত্যেক শাসকই অর্থের জন্য ভেতরে ভেতরে লোলুপ দস্যু আর হিংস্র শিকারী হয়ে উঠে। আর নিমরদও যে সেরকম হয়ে উঠবে না তা ভাবার কোনো কারণ নেই।

আমি ফাট তুরকে জিজ্ঞেস করলাম, ওরা এই গাছগুলোতে কীভাবে পানি দেয়?

নদীর বুক থেকে বাগানের উপরের গ্যালারির সর্বোচ্চ বিন্দুতে বাঁকা হয়ে উঠে যাওয়া ব্রোঞ্জের স্তম্ভগুলো দেখিয়ে সে বললো, রাজা মারদকের প্রকৌশলীরা ঐ পানির প্যাঁচকলগুলো বানিয়েছে। আমি আরও ভালোভাবে লক্ষ্য করে দেখলাম স্তম্ভগুলো আসলে কতগুলো ফাপা নল, ধীরে ধীরে ঘুরছে।

এগুলো কীভাবে ঘুরছে?

ফাট তুর ব্যাখ্যা করলো, আপনি তাকালে দেখতে পাবেন, এগুলোর উপরে বাতাস কল রয়েছে। আর নদীতে পানি চালিত পাম্প আছে। নলের মধ্যে যে প্যাঁচগুলো আছে নদীর স্রোতের টানে তা ঘুরতে থাকে। ঘূর্ণায়মান প্যাঁচগুলো হাতার মতো পানি উপরের দিকে নলের একেবারে মাথায় উঠিয়ে নেয়। তারপর উপরের দিকে নির্দেশ করে বললো, ঐ যে দেখতে পাচ্ছেন?

আমি উপরে তাকিয়ে দেখলাম নদীর পানি উপরে উঠে নলের মাথার শেষ প্রান্ত থেকে একটি নালার মাধ্যমে থেকে নিচে গ্যালারীর সবজায়গায় ছড়িয়ে পড়ছে। কী সহজ পরিকল্পনা অথচ কি সুন্দর। এই বুদ্ধিটা আমার মাথায় কেন আসেনি ভেবে আমি লজ্জিত হলাম। মেশিরে আমার বাগানে ফেরার সাথে সাথে এই পরিকল্পনাটি কাজে লাগাবো। আমার জমিতে সার ব্যবহার করে উৎপাদন চারগুণ বাড়িয়েছি। আর এরকম পাঁচকলের মাধ্যমে জমিতে পানি ঢেলে তা আরও দ্বিগুণ করে তুলতে পারি। অবশ্য থিবসে কাউকেই বলার দরকার নেই যে এটা আমার আবিষ্কার নয়। মিসরে সবাই আমার সৃজনী ক্ষমতাকে সম্মানের চোখে দেখে। তাদের এই ধারণা বদলে দেবার কোনো দরকার নেই।

খুব উঁচু একটা পাথরের অট্টালিকা দেখিয়ে আমি বললাম, বাগানের পেছনে ঐ অট্টালিকাটা কী? এটা এতো উঁচু যেন পারস্য উপসাগর থেকে ভেসে আসা মেঘের পেটের সাথে এটা ঘষা খাচ্ছে।

এটা হচ্ছে দেবী ইশতারের পবিত্র মেঘের অট্টালিকা। নিজেকে দেবত্বের পর্যায়ে উন্নিত করার পর রাজা মারদুক এটি বানিয়েছিলেন। তিনি দেবী ইশতারকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন। আপনিতো জানেন তায়তা, ইশতার হচ্ছেন ভালোবাসা, যৌনতা এবং যুদ্ধ জয়ের দেবী। এগুলোই মারদকের সবচেয়ে আকাঙ্খিত বস্তু ছিল। তিনি এই সূউচ্চ অট্টালিকাটি নির্মাণের নির্দেশ দেন যাতে ইশতার তার সম্পদ এবং ক্ষমতায় মুগ্ধ হয়ে নিচে নেমে এই অট্টালিকার মাথায় অবতরণ করেন আর তিনি তাকে বিয়ে করতে পারেন। তারপর স্বামী স্ত্রী হিসেবে ওরা দুজন সমস্ত সৃষ্টিকে শাসন করতে পারেন। তবে দুঃখের বিষয়, এই অট্টালিকা এর পরিকল্পিত উচ্চতায় পৌঁছাবার আগেই মারদক মৃত্যু বরণ করেন। অতএব ইশতারেরও আর পৃথিবীর বুকে নামা হল না। অদৃষ্টের এই পরিহাসের কথা চিন্তা করে ফাট তুর জিহ্বা চুক চুক করলো আর আমিও মৃদু হাসলাম।

আমি বললাম, এখন এই অট্টলিকার কি হবে?

মারদক এটি তার ছেলে, বর্তমান রাজা নিমরদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। একটু পরই তার সাথে আপনার দেখা হবে। তবে নিমরদের এতো সম্পদও নেই আর ইচ্ছাও নেই, যে তার বাবার পরিকল্পনা অনুযায়ী ইশতারকে প্রলুব্ধ করে তার স্বর্গীয় আবাস থেকে নিচে নামিয়ে আনে।

আমি বললাম, আমি শুনেছি লোকে বলাবলি করছে যে, নিমরদ একজন মস্ত শিকারী। তিনি নাকি জাগরোস পর্বতে একশো সিংহ আর একশো বিশাল বাইসন মেরেছেন। এতো বড় একজন শিকারী হলে তো তার নিশ্চয়ই নারীর প্রতিও আকর্ষণ আছে? তাহলে তিনি কেন দেবীর সাথে প্রেমবিলাসের এই সুযোগটি ছেড়ে দিলেন?

আমার বিশ্বাস দেবীকে শয্যা সঙ্গিনী হিসেবে পেতে তিনি নিশ্চয়ই ভালোবাসবেন। শোনা যায় একজন দক্ষ শিকারীর মতো একাজেও তিনি একজন ভালো খেলোয়াড়। তবে অত্যন্ত দুঃখের বিষয় তার কোষাগারের অর্থের পরিমাণ তার বিশেষ অঙ্গের মতো প্রসারিত হয় না।

রাজা নিমরদের প্রাসাদটি ভালোভাবে দেখার জন্য আমি ফাট তুরের হাত ধরে তাকে বজরার অন্য পাশে নিয়ে গেলাম। বিশাল ভবনটির আকার আর জাকজমক দেখে আমি কিছুক্ষণ মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম। তারপর একটু সামনে প্রাসাদের পাশেই একটি বিশাল মন্দিরের দিকে আমার চোখ পড়লো।

ইউফ্রেটিস নদীর তীরে পৌঁছার পর শালদিসের উরের যে মন্দির চত্বরে আমরা থেকেছিলাম তার চেয়ে তিনচারগুণ বড়। পিরামিড আকৃতির না হয়ে এটি গোলাকার। মূল ভবনটির চতুর্দিক ঘিরে চত্বর মাটি থেকে একেবারে চূড়া পর্যন্ত উঠে গেছে।

আমার নজর এই ভবনটির দিকে লক্ষ্য করে ফাট তুর বললো, এটি হচ্ছে ইশতার দেবীর মন্দির। তবে দেবীর অট্টালিকার সঙ্গে এটাকে মিলিয়ে ফেলবেন না। এটি একটি চমৎকার স্থান। এর চারদেয়ালের মাঝে যে ধরনের উৎসব হয় তা বর্ণনা করা যায় না। বরং আমি আমি প্রথম সুযোগেই এর ভেতরে নিয়ে যাবো যাতে আপনি তা চাক্ষুষ উপভোগ করতে পারেন।

আমি বললাম, আপনি আমার মাঝে বেশ কৌতূহল জাগিয়ে তুলেছেন ফাট তুর।

সে রহস্যজনকভাবে হেসে বললো, আপনার কৌতূহলে সন্তুষ্টি জোগাতে পারলে আমি খুশি হব। তারপর সে প্রাসাদের দেয়ালের নিচে নদীর তীরে পাথরের জেটিতে ভীড় করে থাকা জমকালো পোশাক পরা একদল লোককে দেখিয়ে বললো:

ফারাওয়ের দূত এবং রাজকীয় বাজপাখির সিলমোহরের ধারক হিসেবে আপনাকে অভ্যর্থনা জানাতে রাজা নিমরদের রাজদরবারের প্রধান ব্যক্তি সম্মানিত রাজসদস্য তুগার্টা আর অন্যান্য বিশিষ্ট সভাসদগণ সমবেত হয়েছে। এটি অত্যন্ত সম্মানসূচক একটি ঘটনা। মহামান্য রাজা নিজে আপনাকে স্বাগত জানাতে প্রাসাদের রাজদরবারে অপেক্ষা করছেন।

আমি দ্রুত হেঁটে ডেকের অন্যধারে যেখানে রাজকুমারীরা তাদের ক্রীতদাস-দাসীদের দ্বারা ঘিরে ছিলেন সেখানে গেলাম। জেটিতে অভ্যর্থনা দলের সদস্যদের দেখাবার জন্য আমি বেশ নিচু হয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে তাদেরকে অভিবাদন করলাম আর সেই সাথে ফিসফিস করে মনে করিয়ে দিলাম মিসরের ফারাও রাজপরিবারের প্রতিনিধি হিসেবে যথাযথ আচরণ করতে যা, আমি তাদেরকে শিখিয়ে দিয়েছিলাম। তারপর আমি ফাট তুরকে পাশে নিয়ে তাদের পেছনে অবস্থান নিলাম।

বজরা জেটির কাছাকাছি আসতেই আমি সুমেরিয় অভিজাত দলটির সদস্যদের লক্ষ্য করার সুযোগ পেলাম।

প্রথমেই আমার চোখে পড়লো মেয়েরা এমনকি বয়স্করাও তাদের পুরুষ সহযোগীদের চেয়ে বেশ সুন্দর। তাদের তামাটে রংয়ের চামড়া উজ্জ্বল চকচকে এবং মসৃণ। গভীররাতের মতো কালো চুল আর নীলচে-কালো দুইচোখে রঙ মাখা। সবার মাঝে একধরনের সহজাত মর্যাদা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

কঠিন চেহারার পুরুষেরা বেশ লম্বা। লম্বা নাক বাঁকা। উঁচু চিবুক। আর কালো চুল ঘাড় পর্যন্ত নেমে এসেছে। দীর্ঘ ঢেউ খেলানো দাড়ি কোমর পর্যন্ত নেমে এসেছে। নারী পুরুষ সবাই গোড়ালি পর্যন্ত লম্বা বিভিন্ন ধরনের নকশা করা পশমী পোশাক পরে রয়েছে।

কোনো ভুল নেই এখানে অভিজাত, যোদ্ধা এবং শক্তিশালী নারী পুরুষের সমাবেশ হয়েছে।

পাথরের জেটি থেকে একটি সুসজ্জিত কাঠের সিঁড়ি বজরায় নামিয়ে দেওয়া হল। আমরা সিঁড়ি বেয়ে তীরে নেমে রাজসদস্য তুগার্টার সামনে এলাম। ফাট তুর আমাদের দোভাষী হিসেবে কাজ করলো। আমি প্রশান্ত গাম্ভীর্য বজায় রেখে পেছনেই রইলাম। আমি চাই না যে আমাদের আতিথ্যকর্তারা জানুক যে, আমি তাদের ভাষা জানি। সামনে অনেক কঠিন দর কষাকষির ব্যাপার আছে কাজেই যতটুকু সম্ভব সুবিধা পাওয়া যায় তা আদায় করতে হবে।

জেটি থেকে তুগার্টার নেতৃত্বে শোভাযাত্রা করে আমরা প্রাসাদের রাজদরবার কক্ষের দিকে এগোলাম। উঁচু ছাদওয়ালা গুহার মতো একটা কামরা। যুদ্ধক্ষেত্র এবং শিকারের বিভিন্ন স্মৃতিচিহ্ন দেয়ালে ঝুলানো রয়েছে। এসব প্রদর্শনী থেকে আপাত বুঝা যাচ্ছে যে, রাজা নিমরদ একশোরও বেশি সিংহ এবং বাইসন শিকার করেছেন। শিকারের পশুর মাথা ও চামড়া আর মানুষের ঘাম মিশ্রিত দুর্গন্ধে কামরাটির পরিবেশ দুর্গন্ধময় হয়ে রয়েছে। ফাট তুর অবশ্য আমাকে আগেই বলেছিল যে, সুমেরিয়রা স্নান করাটাকে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর মনে করে।

রত্নখচিত সাদা মার্বেল পাথরের বেদীর উপর সোনা ও হাতির দাঁতের সিংহাসন থেকে রাজা নিমরদ উঠে দাঁড়াতেই আমি লক্ষ্য করলাম, তার প্রজাদের চেয়ে তিনি অনেক লম্বা। চওড়া কাঁধ, পেশিবহুল হাত। প্রত্যেক আঙুলে আংটিপরা ডান হাত উঠিয়ে তিনি আমাদেরকে স্বাগত জানালেন। চওড়া হাতটি দেখে আমার মনে হল এই হাত দিয়ে তিনি আমার মাথা ঢেকে ফেলতে পারবেন। আমার দুই রাজকুমারীর দিকে যখন তাকালেন, তখন তার কালো চোখে লালসা ফুটে উঠলো। সাথে সাথে আমি বুঝতে পারলাম সে যেমন একজন শক্তিশালী শিকারী সেই সাথে একজন লম্পটও বটে।

পরবর্তী কয়েক ঘন্টা দোভাষীর মাধ্যমে আমরা কেবল গতানুগতিক আর কৃত্রিম সৌজন্যসূচক কথা এবং শুভেচ্ছা বিনিময় করে কাটালাম। তারপর রাজা নিমরদ বিশ্রামের জন্য চলে যাওয়ার পর আমাদেরকে প্রাসাদে আমাদের থাকার জায়গায় নিয়ে যাওয়া হল।

আমার থাকার জন্য যে কামরাগুলো নির্দিষ্ট করা হয়েছিল, তা দেখে আমি বুঝতে পারলাম ওরা আমার গুরুত্ব এবং পদমর্যাদা বুঝতে পেরে যথাযথ স্বীকৃতি দিয়েছে। বড় বড় কামরাগুলো নদীর দিকে মুখ করা, যথেষ্ট আলো বাতাস চলাচল করতে পারে। আর সামনেই ইশতার দেবীর মন্দির। দামী কাঠের আসবাব দিয়ে কামরাগুলো সজ্জিত। পর্দাগুলো পশমী এবং দামী রেশমি কাপড়ের। বিশাল আর অস্বাভাবিক আকারের বিছানাটি দেখে আমি ঠিক করলাম অন্য কোথাও শোবো।

ফাট তুরের সাহায্য নিয়ে প্রাসাদের কয়েকজন কর্মীকে দিয়ে গরম পানির বড় বড় কয়েকটা বালতি ঘরের বাইরে বারান্দায় আনার ব্যবস্থা করলাম। তারপর পোশাক খুলে সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে বসতেই আমার ক্রীতদাসেরা আমার মাথা আর শরীরে পানি ঢালতে শুরু করলো। স্নান শেষ করতেই সূর্য পশ্চিম দিগন্তে ঢলে পড়লো। তারপরও গরম তখনও কমেনি। সন্ধ্যায় পূর্ব দিগন্তে বরফে ঢাকা জাগোস পর্বত চূড়া থেকে মিষ্টি শীতল বাতাস বইতে শুরু করলো।

স্নান সমাপনের পর ক্রীতদাসদের বিদায় দিয়ে আমি নগ্ন অবস্থায়ই আরও কিছুক্ষণ বারান্দায় বসে রইলাম। অস্তমান সূর্য আর নিচে নদীর বুকে আলোর খেলা দেখে আনন্দে সময় কাটালাম।

হঠাৎ মনে হল কেউ আমাকে লক্ষ্য করছে। দ্রুত ঘুরে সামনে রাজপ্রাসাদের পাশেই উঁচু মন্দিরের দিকে তাকালাম। মন্দিরের চত্বরগুলো আমার খুব কাছ দিয়ে ঘুরে ঘুরে মাটি থেকে চূড়া পর্যন্ত উঠে গেছে। এতো কাছে যে আমি বেশ সহজেই এর উপর একটা পাথর ছুঁড়ে মারতে পারি।

আমার ঠিক উল্টো দিকে চত্বরে আপাদ মস্তক আলখাল্লায় ঢাকা একটি মূর্তি দাঁড়িয়ে রয়েছে। মাথা ঢাকা কাপড়ের ছায়ায় চোখদুটো দেখা না গেলেও অনুভব করলাম সে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। এভাবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আমাকে দেখা সত্ত্বেও আমি স্বচ্ছন্দেই রইলাম। তবে অচেনা মানুষটির পরিচয় জানতে আমার ভীষণ কৌতূহল হল। আমি যথেষ্ট সচেতন যে, অনেক আগের কয়েকটা ক্ষতের দাগ ছাড়া আমার দেহ দীর্ঘ এবং অত্যন্ত সুগঠিত। প্রচুর ঘোড়দৌড় আর ব্যায়ামের ফলে দেহের পেশিগুলো শানানো রয়েছে। বিনয়ের কারণে সাধারণত আমি নিজেকে সুন্দর হিসেবে বর্ণনা করি না, তবে সতোর কারণে এই মুহূর্তে নিজেকে তাই বলা দরকার।

অচেনা মানুষটি আর আমি দুজনেই শান্ত ভাবে দাঁড়িয়ে পরস্পরকে লক্ষ্য করতে লাগলাম। তারপর আপাদমস্তক আলখাল্লা ঢাকা মূর্তিটি দুই হাত তুলে মাথা ঢাকা কাপড়টি কাঁধের চারদিকে ফেলে দিল। প্রথমে আমার ধারণা ছিল লোকটি একজন পুরুষ, কিন্তু এই ধারণা ভুল প্রমাণিত হল।

আমার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে অপূর্ব সুন্দরী একজন নারী। দিব্যকান্তি অপরূপ সুন্দর মুখটি দেখে আমার তীব্র মানসিক কষ্ট হল। এই রূপ বর্ণনা করার কোনো ভাষা খুঁজে পেলাম না। আমাদের মহান ভাষার অতিশয়ার্থবাচক সমস্ত শব্দ এর সামনে ম্লান আর গতানুগতিক মনে হল। এমন হৃদয় বিদীর্ণ করা ভাবোচ্ছ্বাস আমি কখনও অনুভব করিনি। এযাবত যার জন্য ক্ষুধার্ত ছিলাম কিন্তু কখনও তা পাই নি তা এখানেই রয়েছে। অমূল্য যে বস্তুটি ভাগ্য সবসময় আমার ধরাছোঁয়ার বাইরে রেখেছিল। নারীত্বের মহত্তম রূপটি এখানে উপস্থিত।

নিষ্ফল প্রয়াস জেনে বুঝেও ধীরে ধীরে তার দিকে হাত বাড়ালাম। ভালো করেই জানি এমন অপূর্ব বস্তু সবসময় আমার ধরাছোঁয়ার অনেক দূরে রয়ে যাবে। তবে চিরদিন আমার স্মৃতিতে অম্লান থাকবে।

তিনি আমার দিকে তাকিয়ে কষ্টের হাসি হাসলেন। আমার প্রতি যে কষ্ট আর গভীর অনুতাপ বয়ে এনেছেন তার জন্য সমবেদনার বহিঃপ্রকাশ ঘটালেন। তারপর আবার মুখমাথা ঢাকা কাপড়টা দিয়ে মাথা ঢেকে আমার দিক থেকে ঘুরে মন্দিরের ভেতরে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। আমাকে শোকে নিমজ্জিত করে চলে গেলেন।

.

ভাবলাম আর কখনও হয়তো ঘুমাতে পারবো না। এখন থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রতিটি রাত সেই মাথা ঢাকা নারীর প্রতিমূর্তি চোখে ভেসে থাকবে। অবশ্য তা হল না।

সেই সন্ধ্যায় তারাভরা আকাশের নিচে বারান্দায় পাতা বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে চোখ বুজার সাথে সাথেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম। তারপর ফাট তুর হাত দিয়ে ধাক্কা দিয়ে আমার ঘুম ভাঙালো।

আমি উঠে বসে বুঝলাম সূর্য দিগন্তের উপরে এসেছে। ফাট তুরের পেছনে আমার পরিচর্যার সমস্ত জিনিসপত্র নিয়ে চাকরবাকর আর ক্রীতদাসেরা সার বেঁধে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

ফাট তুর বললো, উইন তায়তা! রাজা নিমরদ তার সমরপরিষদ ডেকেছেন আর সেখানে আপনাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।

সকালের উজ্জ্বল রোদে আমার চোখ পিট পিট করে উঠলো। গতরাতের বেদনাময় স্মৃতির পরও আমার সারা শরীর ঝরঝরে হয়ে রয়েছে।

মহামান্য রাজা যদি আমার জন্য অপেক্ষা করে থাকেন তাহলে এখানে আর সময় নষ্ট করে লাভ কী ফাট তুর? চলুন কাজে লেগে পড়ি। আসলে এমন সময়ে একটুখানি রসিকতা করে আমি বুঝাতে চেয়েঠিলাম যে আমার মন হালকা হয়ে আছে।

সমরপরিষদ কক্ষে পৌঁছার পর দেখলাম বেশির ভাব সুমেরিয় সামরিক নেতৃবৃন্দ পুরোদস্তুর সামরিক পোশাক এবং বুকে বিভিন্ন সম্মানসুচক পদক লাগিয়ে উপস্থিত হয়েছেন। কেবল রাজা নিমরদ এখনও এসে পৌঁছাননি।

যথারীতি সম্ভাষণের পর অভ্যর্থনামূলক বক্তৃতার জবাবে আমি উত্তর দিলাম, তবে দোভাষি ফাট তুরের মাধ্যমে। আমি এখনও অপর পক্ষকে জানাতে প্রস্তুত নই যে তাদের ভাষা আমার ভালোভাবেই জানা আছে। তারপর আলোচনা শুরু করলাম।

ভদ্রমহোদয়গণ, আমি সম্পূর্ণরূপে অবগত যে আপনাদের নৌবাহিনী সমস্ত সাগরের মাঝে অজেয়। আপনাদের রণতরীগুলো মহাশক্তিশালী, আপনাদের নৌবাহিনীর সদস্যরা অত্যন্ত দক্ষ এবং সাহসী। মনে হল এসব প্রশংসাসূচক কথাবার্তা শুনে ওরা সবাই খুশি হয়েছে, যদিও তা অতিশয়োক্তি ছিল। ক্রিটের সর্বাধিরাজ মিনোজের এর চেয়েও শক্তিশালী নৌবহর রয়েছে। তাদের সমুদ্র বাণিজ্যের পরিমাণ সুমেরিয়দের চেয়ে অনেকগুণ বেশি। তারপর আমি আমার প্রস্তাবটি উপস্থাপন করলাম, আমি আপনাদের ছয়টি বড় জাহাজ কিনে নিয়ে হাইকসো ভণ্ড জবরদখলকারি গোরাবের বিরুদ্ধে যুদ্ধে কাজে লাগাতে চাই।

সুমেরিয় নৌবাহিনীর প্রধানের নাম নৌ-অধ্যক্ষ এলোরাস। লম্বা ছিপছিপে দেহের অধিকারি এই ব্যক্তিটির দাড়ি সযত্নে পাকানো। চোখের নিচে কালি আর দাঁতে ক্ষয়ের দাগ। আমার অনুরোধ শুনে লোকটি ভ তুলে মুখে চুকচুক করলো। যেন খুব একটা মজা পেয়েছে।

তারপর সে বললো, সম্মানিয় তায়তা, আমি জানি আমাদের উভয়েরই সাধারণ শত্রুর বিরুদ্ধে আপনার যুদ্ধের সদিচ্ছাকে রাজা নিমরদ প্রশংসা করেন। তবে রাজা নিমরদের হয়ে আমি আপনাকে জানাচ্ছি একটি মাত্র জাহাজের দামই অনেক। আর ছয়টি জাহাজ এখানে সে থেমে গেল।

আমি তার সাথে একমত হয়ে জানালাম, যুদ্ধের কোনো উপকরণই সস্তা নয়। রাজা নিমরদের মতো আমাদের ফারাও তা ভালো করেই জানেন। মিসর একটি অনাকাঙ্খনীয় অবস্থানে রয়েছে। হাইকসোরা উত্তরে আখেনতন থেকে মধ্যসাগর পর্যন্ত নীল নদী নিয়ন্ত্রণ করছে। হাইকসো জবরদখলকারি গোরাবের বিরুদ্ধে লড়ার মতো সমুদ্রগামি যুদ্ধ জাহাজ আমাদের কাছে নেই। আমাদের আছে কেবল নদীপথে চলাচলকারী বড় নৌকা। এগুলো নীল নদীতে আটকে রয়েছে। খোলা সাগরে যদি আমরা তার নৌবহরে আকস্মিক হামলা করতে পারি তাহলে আমরা কী ধরনের ধ্বংসযজ্ঞ সৃষ্টি করতে পারবো, ভেবে দেখুন।

জামার হাতার ভাঁজ থেকে একটা প্যাপিরাসের টুকরা নিয়ে টেবিলের উপর রাখলাম। এডমিরাল প্রথমে কাগজটার উপর চোখ বুলালেন কিন্তু যখন বুঝতে পারলেন এতে আমি সুমেরিয় ছয়টি প্রধান যুদ্ধ জাহাজের নামধাম আর পুরো বিবরণ লিখে রেখেছি, তখন কাগজটা টেবিল থেকে ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে নিবিষ্টভাবে দেখতে শুরু করলেন। তারপর কাগজের উপর দিয়ে আমার দিকে তাকালেন।

তারপর জানতে চাইলেন, এসব গোপনীয় তথ্য আপনি কোথায় পেলেন? আমি মাথা নেড়ে বোঝাতে চাইলাম যে, তার কথা আমি বুঝতে পারিনি। আসলে ফাট তুরের চরেরা এই তালিকাটা আমার জন্য তৈরি করেছিল।

বরং আমি ভদ্রভাবে তাকে বললাম, আপনারা এই জাহাজগুলো বিক্রি করতে পারবেন? আর কত দামে বলুন?

এলোরাস উঠে দাঁড়িয়ে আমার দিকে মাথা ঝুঁকিয়ে বললো, মার্জনা করবেন। এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দেবার আগে আমাকে অবশ্যই মহামান্য রাজার সাথে পরামর্শ করতে হবে। একথা বলে সে দ্রুত পরিষদ কক্ষ থেকে বের হয়ে গেল। তারপর দেয়ালে দাঁড় করানো পানির ঘড়িতে প্রায় এক ঘন্টা পার হওয়ার পর ফিরে এলো।

তারপর এডমিরাল এলোরাস বললো, রাজা নিমরদ আপনাকে জানাতে বলেছেন, যে জাহাজগুলোর কথা আপনি বলেছেন সেগুলো প্রতিটি নির্মাণ করে পানিতে ভাসাতে একশো পঞ্চাশ রূপার ডেবেন পড়েছে। এখন যদি তিনি এগুলো বিক্রিও করতে চান, যার হয়তো কোনো সম্ভাবনা নেই, সেক্ষেত্রে এর চেয়ে কম দাম হতে পারে না। সে যে দর হেঁকেছে ফাট তুর তা তর্জমা করতে করতে আমি দ্রুত একবার হিসাব করে নিলাম। এক লাখ রূপায় দশ হাজার ডেবেন হয়। আমার উটের পিঠে যে থলেগুলো আছে তা দিয়ে চল্লিশটা যুদ্ধ জাহাজ কেনা যায়। কিন্তু আমি এলোরাসকে বললাম প্রতিটি জাহাজের জন্য আমি পঁচাত্তর রূপার ডেবেন দিতে পারবো।

রাজার সাথে কথা বলার জন্য এলোরাস দ্বিতীয়বার কামরা ছেড়ে চলে গেল। আর ফেরার সময় রাজা নিমরদ তার সাথে এলে আমি বুঝলাম আমার দামে জাহাজগুলো বিক্রির জন্য তার আগ্রহ আছে।

এরপর সারা সকাল আর বিকেলের শেষ প্রহর পর্যন্ত রাজা নিমরদ আর আমি দুজনে আরবি ঘোড়ার ব্যবসায়ীর মতো দর-কষাকষি করলাম। শেষপর্যন্ত আমরা ছয়টি জাহাজের দাম পাঁচশো রূপার ডেবেনে একমত হলাম। ফামেনথ মাসের শেষে মধ্যসাগরের পূর্ব উপকুলে সুমেরিয় বন্দর সিডনে জাহাজগুলো হস্তান্তর করা হবে।

তুঘোড় একটি ব্যবসা করতে পেরেছেন এই খুশিতে রাজা নিমরদ আমাদের চুক্তি উদ্যাপন করার উদ্দেশ্যে আমাদের সকলকে সন্ধ্যায় একটি বিশেষ ভোজে আমন্ত্রণ জানালেন।

.

পরিষদ কক্ষ বের হয়ে আসার পর ফাট তুর আমার পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে আমাকে বেশ জোরে বললেন, আমি আপনাকে কথা দিয়েছিলাম ইশতারের মন্দির দেখাতে নিয়ে যাবো। মন্দিরটি কখনও বন্ধ হয় না, কাজেই আপনি যখন ইচ্ছা সেখানে যেতে পারেন। সন্ধ্যায় রাজকীয় ভোজের আগে আমাদের হাতে কাটাবার মত কয়েক ঘন্টা সময় আছে।

নিমরদ যেরকম বিক্রি ব্যবসায়ে খুশি হয়েছিল তেমনি আমিও যুদ্ধ জাহাজগুলো অর্জন করতে পেরে বেশ খুশি হয়েছিলাম। আসলে আমি এর দ্বিগুণ দাম দিতে প্রস্তুত ছিলাম। ফলে আমার মনে খুশি খুশি ভাব থাকায় আমি তার প্রস্তাবে রাজি হয়ে বললাম, আপনি যেরকম বলছেন যে, মন্দিরটি বেশ চমৎকার আর এটা দেখে শেখার মতো কিছু আছে তাহলে চলুন এখুনি সেখান থেকে ঘুরে আসি।

প্রাসাদ থেকে বের হয়ে নদীর তীর দিয়ে হেঁটে আমরা ইশতার দেবীর মন্দিরের দিকে এগোলাম। যেতে যেতে ফাট তুর এর ইতিহাস বর্ণনা করলো, আমি আগেই আপনাকে বলেছি রাজা মারদুকের একশোরও বেশি স্ত্রী এবং রক্ষিতা ছিল, তারপরও দেবী ইশতারের প্রতি তার প্রচণ্ড আকর্ষণ ছিল। তার মন জয় করার জন্য প্রথমে এই মন্দিরটি নির্মাণ করলো। কিন্তু এতেও দেবীকে প্রলুব্ধ করতে না পেরে নদীর অপর তীরে বিশাল অট্টালিকাটি নির্মাণ শুরু করলো। দুজনেই ঘুরে অট্টালিকাটির অসমাপ্ত চূড়াটির দিকে তাকালাম, যা সেই চমকপ্রদ শূন্যদ্যানের সর্বোচ্চ মঞ্চের উপরে দেখা যাচ্ছে। আমি আপনাকে ইতোমধ্যে বলেছি দেবীকে লাভ করার ইচ্ছা চরিতার্থ করার আগেই মারদুক মৃত্যুবরণ করে। রাজা মারদুকের একটি বস্তুর প্রতি আকর্ষণ কেন্দ্রীভূত হলেও তার পুত্র রাজা নিমরদের আকর্ষণ ছিল বিভিন্ন দিকে। সে গর্ব করে বলে মৃত্যুর আগে সে সুমেরিয়ার সমস্ত আবেদনময়ী নারীর সাথে তার কামবাসনা মেটাবে: সে তরুণি হোক কিংবা বয়ষ্ক হোক, বিবাহিতা হোক কিংবা কুমারি হোক।

আমি মন্তব্য করলাম, একজন রাজার পক্ষে এ-ধরনের ইচ্ছা পোষণ করা খুব একটা অযৌক্তিক বলা চলে না। তবে তার শিকার করার ব্যাপারটি দেখে মনে হচ্ছে রাজা নিমরদ গুণগত মানের চেয়ে সংখ্যার প্রতি বেশি মনোযোগ দেন। তবে তার চোখ দুটো কি দেহের অন্যান্য অঙ্গের চেয়ে খুব বেশি বড় না?

ফাট তুর মাথা নেড়ে বললো, এটি সুবিদিত যে রাজা নিমরদ সদা অতৃপ্ত।

আমি বললাম, কিন্তু এর সাথে তার বাবার মন্দিরের সম্পর্ক কি?

সিংহাসনে আরোহণ করার ছয় মাসের মধ্যে রাজা নিমরদ একটি নির্দেশ জারি করলেন যে, তার রাজ্যের প্রত্যেক নারী জীবনে একবার মন্দিরে এক দিন কাটাবে। সেখানে শত্রু মিত্র কিংবা অচেনা যে পুরুষ তার সাথে যৌন মিলন করতে চাইবে সে তা করতে বাধ্য। কোনো নারী এই আদেশ অমান্য করতে পারবে না আর কোনো স্বামী তার স্ত্রীকে এই মিলনে বাধা দিতে পারবে না।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, তার মানে রাজা নিমরদ কী তার প্রজাদের সাথে এক সারিতে দাঁড়িয়ে তার সঙ্গিনী বাছাই করবেন? ফাট তুর মৃদু হেসে মাথা নাড়লো।

রাজকীয় ফরমান অনুযায়ী মেয়েরা সূর্যোদয়ের আগে মন্দিরে তাদের জায়গায় বসে পড়বে, তবে কেবল একজন পুরুষ তার সঙ্গিনী বাছাই করতে দুপুরের আগে মন্দিরে ঢোকার অনুমতি পাবে। নিঃসন্দেহে এবার আপনি আন্দাজ করতে পারছেন সেই লোকটি কে হতে পারে। তারপর সে আবার মৃদু হেসে বললো, দুপুরের পর অবশ্য যে কোনো সুমেরিয় পুরুষ মন্দিরে ঢুকে তার পছন্দমতো সঙ্গিনী বাছাই করতে পারবে।

মন্দিরের সামনের প্রবেশ পথে পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেল। পবিত্র অঙ্গনের মূল দ্বারে ঢোকার জন্য পঞ্চাশ জনেরও বেশি পুরুষ সার বেঁধে অপেক্ষা করছে। সৈনিক, নাবিক থেকে শুরু করে সাদাটুপি পরা আইনবিদ এবং রক্ত মাখা কালো আলখাল্লা পরা শল্য চিকিৎসকও সারিতে রয়েছে।

এক দিকে আঙুল তুলে ফাট তুর বললো, দেবীর পুরোহিত এবং যাজিকারা সবুজ আলখাল্লা পরে আলাদা রয়েছেন। ঐ যে একজন পুরোহিত এদিকে আসছেন। তার নাম অনিওস। তিনি আমাদেরকে সবকিছু ঘুরিয়ে দেখাবেন। আর এর রহস্য ব্যাখ্যা করবেন।

অনিওস বেশ সম্মান দেখিয়ে আমাদের স্বাগত জানালেন, তারপর মূল ফটকের পাশে একটি ছোট বন্ধ দরজার দিকে নিয়ে গেলেন। আমরা এগোতেই দরজাটা ভেতর থেকে কেউ খুলে দিতেই আমরা মন্দিরের মূল অংশে ঢুকলাম।

এটি এতো বিশাল যে মাথার উপরে সূউচ্চ ছাদ অন্ধকারে ঢেকে রয়েছে। ছাদ থেকে কেবল এক ফালি সূর্য রশ্মি নিচে নেমে এসে মেঝের কেন্দ্রস্থলে দেবীর সোনালি মূর্তিটিকে আলোকিত করেছে।

আমার মনের প্রশ্নটি বুঝতে পেরে ফাট তুর বললো, মন্দিরের ছাদের উপরে একটি বিশাল ব্রোঞ্জের আয়না স্থাপন করা আছে। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সূর্যের চলার পথ অনুসরণ করে দশজন ক্রীতদাস চাকার উপর দিয়ে এটি টেনে নিয়ে যায়। যার ফলে সূর্যরশ্মি মূর্তির উপর প্রতিফলিত হয়। এর উদ্দিষ্ট পরিণতিটি ছিল অত্যন্ত চমকপ্রদ। আলোকচ্ছটায় প্রজ্বলিত মূর্তিটির গা থেকে চলমান আলোক রশ্মি চারপাশের দেয়ালে ঠিকরে পড়ে এক অপূর্ব আবহ সৃষ্টি করেছে।

ফাট তুর জিজ্ঞেস করলো, প্রাচীরচিত্রগুলো লক্ষ্য করেছেন তায়তা? এখানে লেখা রয়েছে দুইশো শিল্পী বিশ বছরে এগুলো এঁকেছে।

আমি বললাম, সত্যি আশ্চর্যজনক। আমি যত মন্দির দেখেছি কোনোটাই এর সাথে তুলনা হয় না, এমনকি ফারাও ম্যামোসের সমাধি মন্দিরও নয়।

বিষয়বস্তুটি অপূর্ব তাই না, আপনি নিশ্চয়ই আমার সাথে একমত? ফাট তুর এমন গর্বভরে কথাগুলো বলছিল যেন সেই এগুলোর মালিক। তারপর সে আঙুল তুলে দেখিয়ে বললো, দেবী ইশতারের জ্বলন্ত অনুভূতি এখানে তুলে ধরা হয়েছে।

মন্দিরের উঁচু দেয়ালে যুদ্ধসাজে সেনাদল হেঁটে চলেছে। ধূলির ঝড় উড়িয়ে রথ ছুটে চলেছে। আকাশ জুড়ে উড়ন্ত তীর ছড়িয়ে রয়েছে। লোকালয় আগুনে পুড়ছে আর যুদ্ধংদেহী সৈন্যদের আগে আগে শরণার্থীরা প্রাণভয়ে পালাচ্ছে। মৃত শিশু কোলে নিয়ে ক্রন্দনরত নারী বিজয়ী সেনাদলের কাছে করুণা ভিক্ষা করছে। বিশাল যুদ্ধজাহাজ ব্রোঞ্জের হাল দিয়ে ছোট ছোট নৌযানের পাশে গুতো মারছে আর ধ্বংসপ্রাপ্ত নৌযানের নাবিকেরা সাগরে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। পানিতে মৃতদেহ আর ভাঙা নৌযানের টুকরা ভাসছে। যুদ্ধক্ষেত্রের উপরে দেবী উড়ে বেড়াচ্ছেন আর বিজয়ীর দিকে আঙুল তুলে দেখাচ্ছেন আর পরাভূত শক্তিকে নিন্দা করছেন।

ফাট তুর ধীরে ধীরে ঘুরে অন্যান্য দেয়াল আর তারপর তার শরীর পেছনে বাঁকিয়ে পঞ্চাশ কিউবিট উপরে ধনুকাকৃতির খিলান আর ছাদের দিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললো, যুদ্ধ, প্রেম আর যৌনতাআর কোনো মন্দিরে এ ধরনের যৌনসংসর্গঘটিত দেয়াল চিত্র আছে কি না আমি জানিনা।

আমি তাকিয়ে দেখলাম নারী ও পুরুষের অন্তরঙ্গ এবং আলিঙ্গনবদ্ধ দৃশ্য। দেবদেবীর যৌনলীলার দৃশ্য।

সবকিছুর উপরে উজ্জ্বল সাদা ডানাসহ দেবী ইশতার মাথার চারপাশে অগ্নিবৃত্ত নিয়ে তাদের উপর ঝুঁকে রয়েছেন।

আমি আর ফাট তুর ধীরে ধীরে গির্জার মূল অংশটি ঘুরে ঘুরে দেখলাম। দুইশোজন প্রশ্নসাপেক্ষ শিল্পীর বিশ বছর ধরে আঁকা এই বিশাল কাল্পনিক চিত্রকর্ম দেখে অত্যন্ত বিস্মিত হলাম।

প্রতিটি দেয়ালের একটু পর পর চারদিক দেয়ালঘেরা বড় বড় কামরা রয়েছে। আমি গুণে দেখলাম, একেক দিকে সাতটি করে দুই দিকের দেয়াল মিলে মোট চৌদ্দটি কামরা রয়েছে। ভেতরে কি আছে দেখা যাচ্ছে না, কেননা দরজায় অনেক নারী পুরুষ ভীড় করে রয়েছে।

আমি জানি ভেতরে কী হচ্ছে তা জানতে চেয়ে আমার প্রশ্নের জন্য ফাট তুর অপেক্ষা করছে, কিন্তু আমি আমার পদমর্যাদা বজায় রেখে নিচুপ থাকলাম। পরিশেষে সে সবুজ আলখাল্লা পরা একজন পুরোহিতের সাথে কথা বললো, সে তার সঙ্গিসাথীদের নিয়ে কাছের কামরার দরজার সামনে জটলা বেঁধে থাকা লোকজনদের হটালো। স্পষ্ট বিরক্তি নিয়ে মুখ কালো করে লোকেরা আমাদের জন্য পথ করে দেওয়ার পর আমরা ভেতরে ঢুকলাম।

গোলাকার কামরাটির দেয়াল ঘেঁসে মেঝেতে উজ্জ্বল রঙের চাদর দিয়ে ঢাকা বিছানা পাতা রয়েছে।

ফাট তুর ব্যাখ্যা করলো, চৌদ্দটি আলাদা আলাদা কামরায় চৌদ্দটি বিছানায় চৌদ্দজন নারী অবস্থান করছে। চৌদ্দ হচ্ছে দেবী ইশতারের ঐন্দ্রজালিক সংখ্যা, যার উদ্দেশ্যে এই ক্রিয়াকর্মটি উৎসর্গ করা হচ্ছে।

আমি উঁকি দিয়ে দেখলাম সংখ্যাটি সঠিক। সেখানে চৌদ্দজন মধ্য বয়ষ্কা অসুখি চেহারার নারী রয়েছে। সবার মাথায় লাল গোলাপের মুকুট, পরনে আর কিছু নেই। সবাই মাথা নিচু করে বসে রয়েছে।

ফাট তুর আবার ব্যাখ্যা করলো, লাল গোলাপ দেবী ইশতারের ফুল।

আমার পেছনে দাঁড়ান একজন নাবিক আমাকে কনুই দিয়ে ধাক্কা মেরে হটিয়ে ভেতরে ঢুকলো। গোলাপের মুকুট পরা একজন মহিলার সামনে গিয়ে সে বললো, আমি তোমাকে দেবীর ঋণ শোধ করার আহ্বান জানাচ্ছি। এই কথাটি বলে সে একটি মুদ্রা মহিলার দিকে ছুঁড়ে মারলো। মহিলাটি ঘৃণাভরে তার দিকে তাকাল।

এরপর আমি আর সেখানে থাকতে পারলাম না, ফাট তুরের হাত ধরে টেনে নিয়ে সেখান থেকে বের হয়ে এলাম। সুন্দর একটি বিষয়কে এই নোংরা লোকগুলো এমন বিকৃত রূপ দিয়েছে, যা আমার মনকে আনন্দের বদলে বিষণ্ণ করে তুলেছে।

.

পরদিন বিকেলে রাজা নিমরদ ইশতার দেবীর মন্দির থেকে নিত্যদিনের পূজা শেষে ফিরে আসার পর আমি তার সাথে আলোচনায় বসলাম। রাজার সাথে তার সামরিক কর্মকর্তা এবং জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টারা উপস্থিত ছিলেন।

সেনাপতি রেমরেম আর আমি দুজনে মিলে হাইকসোদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাবার জন্য তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করছিলাম।

সবকিছু আটকে রয়েছে নিমরদের অর্থাভাবের কারণে। ছয়টি যুদ্ধ জাহাজ কেনা বাবদ যে টাকা আমি দিয়েছিলাম, তা তার প্রয়োজনের তুলনায় কিছুই ছিল না। প্রজাদের কাছ থেকে অতিরিক্ত কর আদায়ের পরও গত দুই বছরে সেনা আর নৌবাহিনীর বেতন মেটানো যায় নি। অস্ত্রশস্ত্র, রথ থেকে শুরু করে অন্যান্য সামরিক সরঞ্জাম নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। আর অন্যান্য সেনারা বিদ্রোহের পথে রয়েছে।

ফারাও আর মিসরের জন্য পরিস্থিতি বিপর্যয়ের দ্বারে টলমল করছে। সুমেরিয়া ব্যর্থ হলে আমাদের পূর্ব সীমান্ত সম্পূর্ণ উন্মুক্ত হয়ে পড়বে। যে করেই হোক রাজা নিমরদকে এই সঙ্কটাবস্থা থেকে বের করে আনতে হবে। তার জন্য নয়, বরং আমার জাতির অস্তিত্বের স্বার্থে এটা করতে হবে।

আমি হিসেব করে দেখেছি সুমেরিয়াকে আবার একটি সামরিক শক্তি হিসেবে দাঁড় করাতে রাজা নিমরদের কমপক্ষে ত্রিশ লাখ রূপা লাগবে।

আমাকে দ্বিমুখি সঙ্কট এড়াতে হবে। নিমরদ হচ্ছে এই দ্বিমুখি সঙ্কটের একটি কাঁটা আর দ্বিতীয়টি হচ্ছেন আমার প্রিয় ফারাও। নিমরদ নিঃস্ব আর এদিকে মেমনন ত্যামোস রূপার সমুদ্রে গড়াগড়ি দিচ্ছেন। তিনি প্রায় ছয়শো লাখ রূপার সম্পদের উপর বসে রয়েছেন। একা আমি যে আর কারও সহায়তা ছাড়াই তার জন্য এই সম্পদ এনেছি তার কোনো অর্থ নেই। কোষাগার তার, তবে আমি আমার মেমকে ভালোকরেই জানি। ছোটবেলা থেকে আমিই তাকে মানুষ করেছি আর তিনি যা কিছু জানেন তা সমস্ত আমিই তাকে শিখিয়েছি। আমিই তাকে শিখিয়েছি রূপা অর্জন করা অত্যন্ত কঠিন তবে খরচ করা বড়ই সহজ। এখন যে করেই হোক তাকে আমার এই শিক্ষা ভুলাতে হবে। তাকে রাজি করাতে হবে যাতে তিনি ত্রিশ লাখ রূপা এমন একজন মানুষকে দেন যাকে তিনি চেনেন না এবং বিশ্বাস করেন না। জানি আর কোনো উপায় নেই। মিসরকে বাঁচাতে হলে তাকে আমাদের বিশ্বাস করতে হবে।

সারাদিন রাজা নিমরদ আর তার সভাসদদের সাথে আলোচনার পর সন্ধ্যায় আমার ঘরে ফিরে এলাম। খুব একটা খিদে না থাকায় একটি পাকা ডুমুর, একটু পনির আর শক্ত রুটি দিয়ে একা রাতের খাবার সেরে নিলাম। কয়েক ফোঁটা মদ ঢেলে নিলাম তবে প্রথম চুমুকটি ভিনেগারের স্বাদের মতো মনে হল। গ্লাস সরিয়ে মেমকে পাঠাবার জন্য একটা বার্তা মুসাবিদা করার দিকে মনোযোগ দিলাম। এমন একটি বার্তা যা কবুতরের পায়ে বাধা পাতলা একটি পার্চমেন্টে জায়গা হয়। এমন একটি বার্তা লিখতে হবে যা ফারাও ত্যামোসের মনে এমন একটি কাজ করতে বিশ্বাস যোগায় যা করাটা তিনি পুরোপুরি নির্বুদ্ধিতা মনে করেন।

অনেক ঘন্টা পার হয়ে গেল, ইতোমধ্যে আমি ছয়টি খসড়া ছিঁড়েছি। তারপরও কাজ হচ্ছে না। বুঝতে পারলাম শুরু করার আগেই আমি ব্যর্থ হয়ে বসেছি। ভাঁজ করা পা সোজা করে লেখার টেবিল থেকে উঠে দাঁড়ালাম। দরজার সামনে গিয়ে বারান্দার বাইরে তাকালাম। নতুন চাঁদের উচ্চতা দেখে বুঝলাম মাঝরাত পার হয়ে গেছে।

হঠাৎ ছোট এক টুকরা মেঘ ভাসতে ভাসতে এসে চাঁদকে ঢেকে ফেললো। আমার চতুর্দিক সম্পূর্ণ অন্ধকার হয়ে গেল। ভেবেছিলাম চাঁদের আলো চলে যাওয়ায় আমার কষ্ট হয়তো আরও বেড়ে যাবে। তবে অলৌকিকভাবে বরং উল্টোটি হল। অনুভব করলাম এক মুহূর্ত আগেই আমার মনে যে অশান্তি ছিল তা দূর হয়ে গভীর প্রশান্তিতে মন ভরে গেছে।

তারপর শুনলাম কেউ আমার নাম ধরে ডাকছে। পরিষ্কার কন্ঠে কেউ আমাকে ডেকেছে, চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম কে ডাকছে। কিন্তু কেউ নেই, আমি একা।

তারপর হঠাৎ আমার সঙ্কটের একটি সমাধান আমার সামনে ভেসে উঠলো। আমি ভেবে পেলাম না কেন আমি এতোক্ষণ ইতস্তত করেছি।

আমার কাছে বাজপাখির সিল মোহর রয়েছে। আমার হাতে ফারাওয়ের সমস্ত ক্ষমতা রয়েছে। আমি জানি বিপদ থেকে দেশকে উদ্ধার করতে আর ধ্বংসের হাত থেকে ফারাওকে রক্ষা করতে আমাকে এই ক্ষমতা প্রয়োগ করতেই হবে। এমনকি তা ফারাওয়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধে হলেও করতে হবে।

সিদ্ধান্তটি নেওয়ার পর আমি ভাবলাম কোথা থেকে আর কে আমাকে পথ দেখিয়েছে। আমার গভীর আনুগত্যের বিপরীতে স্বভাব বিরোধি এই সমাধানটি এমন যে, আমি বুঝতে পারলাম এই সিদ্ধান্তটি আমার একার ছিল না।

ছোট্ট মেঘটি সরে গিয়ে নরম চাঁদের আলো মধ্যরাতের পৃথিবীকে নরম আলোয় স্নাত করলো। ইশতারের মন্দিরের মার্বেল পাথরের দেয়ালে আলো পড়ে জ্বল জ্বল করে উঠলো।

আলখাল্লা ঢাকা নারী মূর্তিটি আবার আমার উল্টোদিকে মন্দিরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন, ঠিক যেখানে এর আগে তাকে দেখেছিলাম। আগের মতোই রূপালি-ধূসর আলখাল্লায় তার মুখ ঢাকা। এবার আমি জেনেছি কোথা থেকে আমার অনুপ্রেরণা এসেছে।

আবার তার মুখ দেখতে আমার খুব ইচ্ছা হল। মনে হল কোন অলৌকিক বলে তিনি তা বুঝতে পেরেছেন। মাথা একবার হেলাতেই মুখ-মাথা ঢাকা আলখাল্লার অংশটি কাঁধের উপর খসে পড়তেই তার মুখ অনাবৃত হল। মুখটি চাঁদের চেয়েও স্নিগ্ধ। তাকে আগের চেয়েও সুন্দর দেখাচ্ছে, এর আগে এমন সুন্দর কোনোকিছু আমি আর দেখিনি।

আমি শূন্যে তার দিকে দুই হাত বাড়িয়ে দিলাম। তবে তার চেহারা দেখে মনে হল তিনি মনে দুঃখ নিয়ে আরও দূরে চলে যাচ্ছেন। আস্তে আস্তে পিছিয়ে গেলেন। ধীরে ধীরে রাতের অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেলেন আর তার সাথে চাঁদের আলোও ম্লান হয়ে এলো।

.

পরদিন সকালে আমি পোশাক পরে সম্পূর্ণ তৈরি হবার পর ফাট তুর আমার কামরায় এলো। পূর্ণ শক্তি আর দৃঢ়সংকল্প মনোভাব নিয়ে আর আত্মবিশ্বাসে বলিয়ান হয়ে আমি প্রস্তুত। লঘু পায়ে খুশিতে এমন দ্রুত হেঁটে চললাম যে, আমার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে রেমরেম, ফাট তুর আর দলের অন্যান্য সদস্যদের রীতিমতো ছুটে চলতে হচ্ছিল।

পরিষদ কক্ষে ঢোকার পর দেখলাম নিমরদের সিংহাসন তখনও শূন্য। তবে অন্যান্য সভাসদ আর পদস্থ সামরিক কর্মকর্তারা উপস্থিত রয়েছেন। তারা সবাই উঠে দাঁড়িয়ে আমাদেরকে স্বাগত জানিয়ে লম্বা টেবিলে বসালো। একটু পরই মূল দরজার বাইরে তূর্য ধ্বনি শোনা গেল।

ধীর ভাবগাম্ভীর্য পদক্ষেপে রাজা নিমরদ কামরায় ঢুকলেন। এতো সকালে তাকে এখানে দেখার সাথেই সাথেই আমার প্রথম চিন্তা ছিল, তিনি নিশ্চয়ই ইশতার দেবীর মন্দিরে তার নিত্যকার প্রেমলীলা বাদ দিয়ে আমাদের সাথে দেখা করতে এসেছেন।

তার প্রতি আমার যে সম্মান দেখানো প্রয়োজন সে বিষয়ে আমি সচেতন হলাম আর এতে আরাধ্য কাজটি শুরু করতে আমার আত্মবিশ্বাস আরও বেড়ে গেল। যথারীতি রাজকীয় সৌজন্য প্রদর্শনের পর আমি দাঁড়িয়ে সরাসরি রাজার উদ্দেশ্যে কথা বলতে শুরু করলাম।

মহামান্য, আমি এমন একটি স্পর্শকাতর এবং গোপনীয় প্রস্তাব দিতে চাই যা কেবল আপনি এবং আপনার একান্ত একজন বিশ্বস্ত ব্যক্তির কাছে বলা যেতে পারে। আমি আপনাকে নিশ্চয়তা দিচ্ছি যে, আমার প্রস্তাবটি আমাদের পারস্পরিক উপকারে আসবে এবং সেই সাথে এই মুহূর্তে আমরা যে সঙ্কটাবস্থার সম্মুখীন হয়েছি তা দূর করতে সূদূর প্রসারী প্রভাব ফেলবে।

একথা শোনার পর নিমরদ একটু থমকে গেলেন এবং মনে হল সিদ্ধান্ত নেওয়াটা এড়াবার চেষ্টা করছেন। কিন্তু আমি হাল ছাড়লাম না এবং অন্য কোনো বিকল্পে রাজি হলাম না। শেষ পর্যন্ত তিনি আমার সনির্বন্ধ অনুরোধে রাজি হলেন।

আমি সেনাপতি রেমরেমকে আমার ডান দিকে আর দোভাষি হিসেবে ফাট তুরকে বামে নিলাম। নিমরদ এডমিরাল এলোরাসকে টেবিলে থাকতে ইশারা করলেন, বাকিরা কামরা ছেড়ে চলে গেল।

কামরায় যখন কেবল আমরা পাঁচজন রইলাম তখন আমি রাজকীয় বাজপাখির সিলমোহরটা বের করে টেবিলে আমাদের মাঝে রাখলাম।

আমি নিশ্চিত মহামান্য নিশ্চয়ই এই বস্তুটির গুরুত্ব সম্পর্কে অবগত আছেন।

যদিও এই প্রথম এটা দেখলাম তবে আমি বুঝতে পেরেছি এই সিলমোহর নিশ্চিত করছে যে আপনি মিসরের ফারাও ত্যামোসের কণ্ঠ এবং কর্তৃত্ব নিয়ে কথা বলছেন।

আপনি ঠিকই বলেছেন মহামান্য।

রাজা নিমরদ তার ঠাণ্ডা কালো চোখ আমার উপর নিবদ্ধ করলেন। আর কিছু না বললেন না, কেবল পানির দিকে শিকারের আসা টের পেয়ে একটি চিতাবাঘের তীক্ষ্ণতা নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন। আমিও সেভাবে তার দিকে লক্ষ্য রাখলাম।

মহামান্য, আপনি এবং আমি দুজনেই অভিজ্ঞ যোদ্ধা। অভিজ্ঞতা আর জ্ঞান থেকে আমরা জানি শুধু মনোবল আর ক্ষুরধার তলোয়ারের পাত দিয়ে যুদ্ধ জয় করা যায় না, এর সাথে প্রয়োজন কী পরিমাণ রূপা আমরা শত্রুপক্ষের দিকে ছুঁড়ে মারতে পারি।

নিমরদ বললেন, বিষয়টি এভাবে কাউকে কখনও প্রকাশ করতে শুনিনি, তবে আপনি একজন বিবেচকের মতো সত্যি কথাটিই বলেছেন।

মিসরের ফারাও ত্যামোসের নামে আর যে বাজপাখির সিলমোহরটি আমি বহন করছি তার কর্তৃত্ববলে আমি আপনাকে ত্রিশ লাখ রূপা অর্পণের প্রস্তাব করছি শুধুমাত্র এই শর্তে যে, আপনি মিসরের সাথে একটি সামরিক চুক্তিতে আসবেন আর এই পরিমাণ অর্থ কেবল রাজা গোরাব এবং হাইকসো গোত্র বিনাশের কাজে ব্যবহার করবেন।

আমি শুনতে পেলাম আমার পাশে বসে রেমরেম একবার দ্রুত নিঃশ্বাস নিল। সে জানে আমি এই প্রস্তাবের জন্য ফারাওয়ের অনুমোদন নেই নি আর এও জানে এতে আমি কী ধরনের ঝুঁকি নিচ্ছি। তবে আমি মোটেই তার দিকে তাকালাম না। এদিকে নিমরদ সিংহাসনে বসে সামনে পেছনে দুলতে লাগলেন আর অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। লক্ষ্য করলাম তার মুকুটের নিচে কপাল থেকে বিন্দু বিন্দু ঘাম নিচে পড়ছে।

শেষ পর্যন্ত যখন তিনি কথা বললেন তখন চরম অবিশ্বাস আর ধনতৃষ্ণায় তার গলার স্বর ফ্যাসফ্যাস করে উঠলো, এতোগুলো টাকা দিয়ে দেবার মতো সম্পদ কি আসলেই আপনার ফারাওয়ের কাছে আছে?

আমি আপনাকে নিশ্চয়তা দিচ্ছি মহামান্য যে, হ্যাঁ সে পরিমাণ সম্পদ তার আছে। আমাদের দুই রাষ্ট্রের মধ্যে এই বন্ধন সুনিশ্চিত করার জন্য এই মুহূর্তে আপনার হাতে তিন লাখ রূপা তুলে দেবার জন্য ফারাও আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন। এরপর যা আসছে এটি তার সামান্য একটি নিদর্শন মাত্র।

কোনো কথা না বলে রাজা নিমরদ বেশ কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর অকস্মাৎ লাফ দিয়ে উঠে কামরার এক দিক থেকে অন্যদিকে পায়চারি শুরু করলেন। মুখ কুঁচকে রুষ্ট চেহারা নিয়ে এতোজোরে ঠোঁট কামড়ে ধরলেন যে এক ফোঁটা রক্ত চিবুক থেকে এমব্রয়ডারি করা রাজপোশাকে পড়লো।

তারপর হঠাৎ আমার সামনে এসে থেমে জ্বলন্ত চোখে আমার দিকে তাকালেন। তারপর বললেন, এখন তিন লাখ আর আরও সাতাশ লাখ এক বছরের মধ্যে? কথাটা ফাট তুর তরজমা করার পর আমি মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানালাম।

মহামান্য যা বলেন। তবে বাকি রূপা গ্রহণ করার জন্য আপনার সবচেয়ে চৌকশ একটি সেনা-পল্টন থিবসে পাঠাতে হবে। এতো রূপা ফারাও তার নিজের লোক দিয়ে পাঠাবার ঝুঁকি নেবেন না।

নিমরদ আবার ঘুরে পায়চারি শুরু করলেন। তার স্যান্ডেলের নিচে ব্রোঞ্জের তলি হাঁটার তালে খটখট শব্দ করছিল। এবার তিনি সুমেরিয় ভাষায় নিজের সাথে তর্ক শুরু করলেন।

কেমন করে আমি এই চতুর খোঁজা লোকটিকে বিশ্বাস করবো? একথা আর গোপন নেই যে, সে শেঠ আর অন্ধকারের অন্যান্য দেবতার সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। আবার কেউ কেউ এমনও বলে যে, সে নিজেও শূন্যতার ওপারের অন্ধকার আত্মার একজন। এতোটুকু বিড়বিড় করে বলার পর যখন বুঝলেন তিনি কী বলেছেন তখন ঘুরে ফাট তুরের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বললেন, আমার কথাগুলো তরজমা করলেই তোমার সর্বনাশ ডেকে আনবে! যদি করো তবে তোমার নিজের নাড়িভূড়ি দিয়ে পেঁচিয়ে তোমাকে শ্বাসরোধ করে মারবো, বুঝতে পেরেছো?

ফাট তুরের মুখ ফ্যাকাশে হল, সে দৃষ্টি নিচে নামিয়ে বললো, মহামান্য যা হুকুম করেন। নিমরদ আবার পায়চারি শুরু করলেন আর নিজের মনে বিড়বিড় করে কথা বলতে লাগলেন। তারপর আবার সামনে এসে থামলেন।

ফাট তুরকে নির্দেশ দিলেন, বল আমি তাকে বিশ্বাস করি। তবে কোনো মৈত্রিবন্ধনে আবদ্ধ হতে রাজি হওয়ার আগে আমি মিসরের ফারাও ত্যামোসের কাছ থেকে একটি অঙ্গিকার নামা চাই। এই শর্তটি বলার সময় আমি লক্ষ্য করলাম তার চোখে লালসাপূর্ণ ধুর্তামি ফুটে উঠেছে।

সরাসরি জবাব এড়িয়ে আমি সতর্কতার সাথে বললাম, যদি আদৌ তা সম্ভব হয়, আমি জানি ফারাও তা মেনে নেবেন।

তারপর নিমরদ বললেন, আমি আমার নিজের পরিবারের সাথে মিসরের রাজপরিবারকে একত্রিত করতে চাই। আমি ফারাওয়ের দুই বোন তেহুতি আর বেকাথাকে আমার স্ত্রী হিসেবে পেতে চাই। তাহলে ফারাও আর আমি পরস্পরের ভগ্নিপতি হব।

তার লোভ, ধৃষ্টতা আর কামুকতার সীমা দেখে আমি হতবাক হলাম। পাজি লোকটি টাকা আর খাবার দুটোই চায়। এই নোংরা জীবটি আমাকে উদ্দেশ্য করে যথেষ্ট অপমানজনক কথা বলেছে আর এখন খোলাখুলিভাবে আমার আদরের রাজকুমারীদের দিকে লালসাপূর্ণ হাত বাড়িয়েছে।

রাগ দমন করে যথাসম্ভব স্বাভাবিক কণ্ঠে আমি বললাম, এই প্রস্তাবটি করে মিসরের প্রতি আপনি অশেষ সম্মান দেখিয়েছেন। অন্য যেকোনো পরিস্থিতিতে আমি জানি ফারাও আপনার প্রস্তাব গ্রহণ করতে একমুহূর্ত দ্বিধা করতেন না। তবে ফারাও ইতোমধ্যেই আমাদের দুই জাতির সামরিক মৈত্রি নিশ্চয়তা করার উদ্দেশ্যে তার দুই বোনের সাথে ক্রিটের সর্বাধিরাজ মিনোজের বিয়ে দেবার কথা দিয়েছেন। মিনোয়ানরা এই অপমান সহ্য করবে না।

নিমরদ কাঁধে একটি ঝাঁকি দিয়ে বিড়বিড় করে একটা অশ্লীল মন্তব্য করলেন।

তবে আমি বুঝলাম আমার প্রত্যাখ্যানে তিনি খুব একটা বিরক্ত হননি। আমরা দুজনেই জানতাম আমাদের চুক্তি থেকে যতটুকু সম্ভব সুবিধা হাতিয়ে নেওয়ার এটি একটা শেষ প্রচেষ্টা ছিল। আসলে কিছু কিছু মানুষ আছে, তাদেরকে যতই দেওয়া হোক না কেন ওরা আরও কিছু পেতে চায়।

নিমরদ আরেকবার কামরার চতুর্দিকে চক্কর দিয়ে আমার সামনে এসে থামলেন তারপর শেষ একবার চেষ্টা করে বললেন, আপনি যে তিনলাখ রূপার কথা বলেছেন তা আমি স্বচক্ষে দেখতে চাই। কেননা আমি বিশ্বাস করি না যে, আপনি আর আপনার ফারাও চুক্তির প্রতি সম্মান দেখাবেন। তবে আমি শুধু দেখতে চাই কীভাবে রূপাগুলো এতোক্ষণ পর্যন্ত আপনি লুকিয়ে রেখেছেন…. কথাগুলো নিমরদ সরাসরি আমার দিকে তাকিয়ে বলছিলেন এই আশায় যে, হয়তো আমি তার ফাঁদে পা দিয়ে ফাঁস করে দেই যে আমি সুমেরিয় ভাষা জানি। তবে আমি তাকে আবার হতাশ করে কথাগুলো তরজমা করার জন্য ফাট তুরের দিকে তাকালাম। নিমরদের ফাঁদগুলো এড়িয়ে যাওয়াটা আমি বেশ উপভোগ করছিলাম। অনেকটা এটনের সাথে বাও খেলার মতোই মনে হচ্ছিল।

নগরীর দেয়ালের বাইরে আমাদের পল্টনের শিবির থেকে রূপা আনার জন্য জারাস আর হুইকে পাঠালাম। পঞ্চাশজন লোক দুটি চার চাকার গাড়িতে রূপাগুলো আনলো। শেষ পর্যন্ত সভা কক্ষের মেঝেতে যখন এগুলো স্তূপ করে রাখা হল তখন দৃশ্যটি দেখতে বেশ সুন্দর লাগছিল। চকচকে রূপার স্কুপটির চারদিকে ঘুরে ঘুরে নিমরদ পিণ্ডগুলো ছুঁয়ে দেখতে লাগলেন আর এমনভাবে এগুলোর সাথে কথা বলতে লাগলেন যেন এগুলো তার পোষা প্রিয় কোনো প্রাণী।

সেই সন্ধ্যায় আবার নিমরদ আমাদের সম্মানে একটি ভোজের আয়োজন করলেন। এবার মদটি আগের চেয়ে অনেক ভালো ছিল। তবে এই মদ খাওয়ার ফলে অতিথীকর্তা আর তার সাঙ্গপাঙ্গদের আচরণ খুব একটা প্রশংসার যোগ্য ছিল না। ভোজে যেসব মহিলা অংশগ্রহণ করেছিলেন তাদের অর্ধেকেই নিমরদ আর তার লোকদের বিকৃত কামনার শিকার হল।

সৌভাগ্যবশত আমার দুই রাজকন্যাকে তাদের কামরায় তালা বন্ধ করে রেখেছিলাম আর জারাস বারোজন সৈন্য নিয়ে তাদের দরজায় পাহারায় ছিল।

.

যে ছয়টি রণতরী নিমরদের কাছ থেকে কেনা হয়েছিল, সিডন বন্দরে সেগুলোর মেরামত কাজ চলছিল। ফামেনথ মাসের শেষে ওগুলো আমাদের হাতে আসবে।

এই সময়টুকু আমি রাজা নিমরদ আর তার উপদেষ্টাদের সাথে হাইকসোদের বিরুদ্ধে আসন্ন যৌথ হামলার বিষয়টি নিয়ে পরিকল্পনা চালিয়ে গেলাম। আমি সেনাপতি রেমরেমকে ব্যবিলনে ফারাওয়ের সামরিক দূত হিসেবে থাকার জন্য মনোনীত করেছিলাম।

অনিচ্ছাসত্ত্বেও কর্নেল হুইকে রেমরেমের সহকারী হিসেবে থাকার জন্য সম্মতি দিয়েছিলাম। আমার অভিভাবকত্বে হুই রথযুদ্ধের বিজ্ঞানে সবচেয়ে দক্ষ নায়ক হয়ে উঠেছিল। আমি জানি যখন মধ্যসাগরের উপকূল জুড়ে উত্তর মিসরে আমরা হাইকসোদের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করবো তখন তার অভাব খুব অনুভব করবো। কিন্তু বেকাথা তার প্রতি যেরকম বিরূপতা দেখাচ্ছে সেক্ষেত্রে তাকে আমাদের সাথে ক্রিটে নিতে গেলে সে হৈ চৈ শুরু করে দেবে।

.

রূপাগুলো পাওয়ার কয়েক সপ্তাহের মধ্যে নিমরদের সেনাবাহিনীর কারখানাগুলোতে পুনর্দোমে কাজ চলতে লাগলো। নতুন বর্ম আর অস্ত্রশস্ত্র উৎপাদন শুরু হল, পুরোনো রথগুলো মেরামত করা হল আর আমার দেওয়া নকশা মোতাবেক উন্নত প্রযুক্তির শত শত নতুন রথ তৈরি হতে লাগলো। নতুন যোগদান করা সেনাসদস্যদের পদচারণায় ব্যবিলনের রাস্তাগুলো প্রকম্পিত হয়ে উঠলো হল আর বাজারগুলোও ক্রেতা-বিক্রেতার দরকষাকষিতে মুখরিত হল।

ফাট তুর এবং তার গুপ্তচরদের কাছ থেকে আমি জানতে পারলাম সুমেরিয়ার প্রতিটি শহরে একই রকম সমর প্রস্তুতি নতুন জীবন দান করেছে। বেকার প্রাক্তন হাজার হাজার সুমেরিয় যোদ্ধা আবার রাজার সেনাদলে যোগ দিতে ফিরে এলো।

যে কাজটি আমি শুরু করেছিলাম তা অত্যন্ত কঠিন এবং জটিল ছিল, আর সুমেরিয়া ভাষা না জানার ভান করায় বিষয়টি আরও কঠিন হয়ে পড়লো। কাজেই আমি আমার আতিথ্যকর্তাদের সাথে শিশুর মতো ভাঙা ভাঙা সুমেরিয় বলতে শুরু করলাম। দিনে দিনে তা আরও সাবলিল এবং ব্যাকরণগতভাবে সঠিক হতে লাগলো। এমনকি রাজা নিমরদও সভাসদদের সাথে কথা বলার সময় আমার উপস্থিতিতে আমাকে লক্ষ্য করে অপমানজনক উক্তি করা থেকে বিরত হলেন। শিঘ্রই আমিও তাদের ভাষায় তাদের সাথে বিভিন্ন রকম শব্দ কৌতুক আর শব্দের খেলা শুরু করলাম।

বিকেলগুলোতে আবহাওয়া একটু ঠাণ্ডা হয়ে এলে আমি আমার দুই রাজকুমারীকে সাথে নিয়ে ইউফ্রেটিস নদীতে সাঁতার কাটতে যেতাম কিংবা শহরের সীমানার বাইরে দক্ষিণ দিকে পাহাড়ি এলাকায় ঘোড়ায় চড়ে বেড়াতাম। অনেক সময় অনেক দূবরর্তী জায়গায় এসেও হঠাৎ জারাসের মুখোমুখি হলে আমার বেশ মজা লাগতো। মনে হত কেউ যেন তাকে আগে থেকেই জানিয়ে দিয়েছে যে আমরা এখানে আসবো। তবে এটা অবশ্যই তেহুতি হতে পারে না। কেননা তাকে আমাদের পথে দেখতে পেয়ে সে আমার থেকেও বেশি অবাক হত বা অবাক হওয়ার ভান করতো।

সন্ধ্যায় প্রায়ই আমাদের আতিথ্যকর্তা কিংবা আমার সেনাপতিদের সাথে নৈশভোজের আমন্ত্রণ থাকতো। এই সব ভোজে নিমরদ উপস্থিত থাকলে আমি দুই রাজকন্যাকে আমার কাছাকাছি বসাতাম যাতে তাদের উপর নজর রাখতে পারি।

সমস্ত কাজকর্ম সারার পর রাতে বারান্দায় একা বসে সেই ঘোমটায় ঢাকা নারীমূর্তির ফেরার অপেক্ষা করতাম। রাতের পর রাত তিনি আমাকে হতাশ করলেন।

ব্যস্তভাবে দিনগুলো দ্রুত কেটে যাচ্ছিল। তারপর একদিন সিডন বন্দরের নৌঘাঁটি থেকে খবর এলো নিমরদের কাছে কেনা ছয়টি রণতরী বেঁধে দেওয়া সময়সীমার বিশদিন আগেই পানিতে ভাসাবার জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। লটবহরসহ আমাদের কাফেলা মধ্য সাগরের উপকূলে সিডন বন্দর পৌঁছাতে প্রায় দশ দিন লেগে যেতে পারে। আমি জারাস আর হুইকে ব্যবিলন থেকে উপকূল যাত্রার প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ দিলাম।

সেদিন সন্ধ্যায় রাজকুমারীদেরকে প্রাসাদের পূর্ব পাশে তাদের কামরায় পৌঁছে দিয়ে চাঁদ ডুবে যাওয়ার আগে আমার কামরায় ফিরে এলাম আমি। ক্রীতদাসেরা কামরায় আর বারান্দায় বিছানার পাশে তেলের প্রদীপে জ্বালিয়ে রেখেছিল। আমার নির্দেশমতো ওরা প্রদীপের তেলে ভেষজ মিশিয়ে দিয়েছিল। এতে যেমন মশা আর অন্যান্য কীটপতঙ্গ দূরে রইল তেমনি আমার সুনিদ্রা আর সুখস্বপ্ন দেখায় সহায়ক হল।

রুস্তি বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। সে পরনের পোশাক খুলে নিয়ে একটি রূপার পানপাত্র বিছানার পাশে রাখলো।

দীর্ঘদিনের সঙ্গী ক্রীতদাস রুস্তি আমার সেবাযত্নের ভার নিজ হাতে তুলে নিয়েছিল। সে আমাকে মনে করিয়ে দিল গত এক সপ্তাহ আমি রাতে কয়েক ঘন্টার বেশি ঘুমাই নি। সূতরাং আমার বেশি রাত জাগা ঠিক নয়।

সে চলে যাবার পর বারান্দার বিছানার কাছে গিয়ে মদের পানপাত্রটি তুলে নিয়ে এক চুমুক দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে তৃপ্তির শ্বাস নিলাম। মেশিরে আমার জমিদারিতে নিজের আঙুর বাগান থেকে চোলাই করা আনা দশ বছরের পুরোনো উৎকৃষ্ট মদ। তারপর ফিরে দেবীর মন্দিরের বারান্দার দিকে তাকালাম। তবে সেখানে কেউ নেই। ঘোমটায় মুখ ঢাকা সেই নারীমূর্তিটিকে দেখার পর কয়েক সপ্তাহ পার হয়ে গেছে।

মার্বেল পাথরের মেঝের উপর পায়চারি করতে করতে সেদিন সন্ধ্যায় রাজার সাথে যে আলোচনা হয়েছিল তার বিশেষ দিকগুলো মনে মনে ভাবতে লাগলাম।

হঠাৎ মাঝপথে থেমে পড়লাম। চাঁদের আলোর রং বদলে গিয়ে অতিসূক্ষ সোনালি জ্যোতি ছড়িয়েছে। মুখ তুলে চাঁদের দিকে তাকালাম। সাথে সাথে বুঝতে পারলাম এখানে কোনো অনৈসর্গিক শক্তি কাজ করছে, তবে তাৎক্ষণিকভাবে নিশ্চিত হতে পারলাম না এই শক্তি মঙ্গলকর না ক্ষতিকর। অমঙ্গল এড়াতে দুই আঙুলে হোরাসের চিহ্ন আঁকলাম, তারপর এই রহস্যময় শক্তির নিজেকে প্রকাশিত করার জন্য নীরবে অপেক্ষা করে রইলাম।

ক্রমশ সচেতন হলাম রাতের উষ্ণ বাতাসে একটি অতিসুক্ষ এবং বিস্মৃতিপ্রবণ সুগন্ধি ছড়িয়ে পড়ছে। এ-ধরনের সুগন্ধ এর আগে কখনও অনুভব করিনি। তারপরও আমার সমস্ত ইন্দ্রিয় জেগে উঠছে। অনুভব করলাম আমার ঘাড় আর কাঁধ থেকে অস্বাভাবিক কিন্তু প্রীতিকর একটি চাঞ্চল্য জেগে উঠে মেরুদণ্ড বেয়ে নিচে নেমে যাচ্ছে। এটি আমার কাছেই একটি শক্তির উপস্থিতি সম্পর্কে সচেতন করলো।

আমি ঘুরে এর মুখোমুখি হতেই চমকে উঠতেই আমার হাত থেকে মদের পানপাত্রটি সশব্দে মেঝেতে পড়ে গেল। একটি মুহূর্তের জন্য আমার হৃৎস্পন্দন স্তব্ধ হল, তারপর আবার একটি ছুটন্ত ঘোড়ার খুরের শব্দের মতো ধকধক করে উঠলো।

মন্দিরের সেই রহস্যময়ী নারীটি আমার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন; এতো কাছে যে মাথা ঢাকা কাপড়ের ছায়ার নিচে আমি তার চেহারা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলাম। হাত বাড়ালেই তাকে ছুঁতে পারবো, কিন্তু আমি কোনো নড়াচড়া করলাম না।

শেষপর্যন্ত কথা বলার শক্তি ফিরে পেয়ে গভীর শ্রদ্ধা নিয়ে চাপাস্বরে বললাম, আপনি কে?

আমার নাম ইনানা।

তার উত্তর শুনে আমার সারা শরীর অবশ হয়ে গেল। তার কণ্ঠের আওয়াজটি আমার কানে স্বর্গীয় সঙ্গীতের মতো অনুরণিত হল। আমি সাথে সাথে বুঝতে পারলাম এতো সুন্দর শব্দ কোনো মানব কণ্ঠ থেকে বের হতে পারে না। আর যে কথাটি তিনি বলেছিলেন তার অর্থও অত্যন্ত লক্ষণীয়। ইনানা ছিল সেই সময়ের শুরু থেকে দেবী ইশতারের প্রাচীন নাম।

আমি শুধু বললাম, আমার নাম তায়তা।

নাম ছাড়া নিজের সম্পর্কে আর কিছু জানো তুমি? এমনকি তোমার বাবা মারও নাম জানো না। একথাটি বলে সহানুভূতি সহকারে মৃদু হাসলেন।

আমি বললাম, না জানি না। সমবেদনা নিয়ে তিনি আমার দিকে এক হাত বাড়ালেন আর কোনো ইতস্তত না করে আমি তার হাত ধরলাম। সাথে সাথে অনুভব করলাম তার দেহ থেকে উত্তাপ আর শক্তি আমার দেহে সঞ্চারিত হল।

ভয় পেয়োনা তায়তা। আমি তোমার বন্ধু, আর বন্ধুর চেয়েও বেশি।

না, আমি ভয় পাইনি ইনানা। তিনি আরেক হাত বাড়িয়ে দিলেন আর হাতটি ধরতেই আমাদের মাঝে রক্ত এবং মনের একটি শক্তিশালী বন্ধনের অস্তিত্ব অনুভব করলাম।

সবিস্ময়ে বলে উঠলাম, আমি আপনাকে চিনি! মনে হচ্ছে সেই শুরু থেকেই চিনি। বলুন আপনি কে।

আমার সম্পর্কে বলার জন্য এখানে আসিনি। তোমার সম্পর্কে বলার জন্য এসেছি আমি। আমার সাথে এসো তায়তা। তখনও আমার দুই হাত ধরে তিনি আমাকে নিয়ে পিছিয়ে যেতে যেতে বারান্দা থেকে আমার শয়নকক্ষের দিকে চললেন। তার পায়ের চলার শব্দ শোনা যাচ্ছিল না। কেবল তার পরনের ঘাগরার মৃদু খসখস শব্দ শোনা যাচ্ছিল। আমার মনে হল তার পা মাটি ছুঁয়ে চলছে না, মাটি থেকে একটু উপরে শূন্যে তিনি ভেসে চলেছেন।

গত কয়েক সপ্তাহ ধরে লণ্ঠনের আলোয় আলোকিত সুন্দর যে কামরায় আমি থেকে এসেছি তার প্রতি ইঞ্চি জানতাম। তবে এখন দেখলাম বিপরীত দিকের দেয়ালে একটি দরজা দেখা যাচ্ছে যা এর আগে আমার চোখে পড়েনি। ইনানা আমাকে নিয়ে দরজাটির দিকে এগোতেই এটি আপনাআপনি খুলে গেল। দরজার ওপাশে ভীষণ অন্ধকার। তারপরও হাত ধরাধরি করে আমরা অন্ধকারে ঝাঁপিয়ে পড়তেই অন্ধকার চারদিক থেকে আমাদেরকে গ্রাস করে ফেললো। আমরা নিচের দিকে নামতে লাগলাম, তবে তিনি আমার হাত ধরে রইলেন আর আমার মনে কোনো ভয় এলো না। নিচের দিকে নামার সময় এতো জোর বাতাস আমার মুখে ঝাঁপটা মারছিল যে আমাকে চোখ বন্ধ করে রাখতে হল। মনে হল যেন অনন্তকাল ধরে আমরা অন্ধকারে উড়ে চলেছি, তবে আমি জানি সময় এখানে একটি মায়া। তারপর একসময় পায়ের নিচে শক্ত মাটি অনুভব করলাম, আর নড়াচড়া করছি না। সেখানে প্রথমে একটু মৃদু আলো দেখা গেল। আমি আবার ইনানার মাথার আকার দেখতে পেলাম, তারপর ধীরে ধীরে এর নিচে তার পুরো অবয়ব ফুটে উঠলো। দেখলাম আমার মতো তিনিও পুরোপুরি নগ্ন।

আমার দীর্ঘ জীবনে আমি অনেক সুন্দরি নারীর শরীর দেখেছি। তবে ইনানা তাদের সকলকে অনেক দূর ছাড়িয়ে গেছেন। চওড়া নিতম্বের উপর সরু কোমর তার সুগঠিত দৈহিক সৌন্দর্যকে মনোরম করে তুলেছে। তিনি আমার মতোই লম্বা আর তার সারা দেহের অঙ্গপ্রতঙ্গ এমন নিটোল আর মসৃণ যে আমি হাত বাড়িয়ে তাকে না ছুঁয়ে পারলাম না। হালকাভাবে তার কোমরের কাছ থেকে বাহু বেয়ে আমার আঙুলের ডগা কাঁধ পর্যন্ত বুলিয়ে নিলাম। রেশমের মতো মসৃণ চামড়া তবে তার নিচের পেশি অনমনীয়।

চুল উঁচু করে ঝুঁটি বাঁধা ছিল, তবে মাথা একবার ঝাঁকাতেই ঢেউ খেলানো লম্বা চুল কাঁধের দুপাশ দিয়ে ঝলমলিয়ে হাঁটু পর্যন্ত নেমে এলো। সারা দেহে কোনো পশম নেই।

আলো তখনও বেড়ে চলছিল আর এবার আমি বুঝতে পারলাম আমরা ব্যবিলন নগরীর বাইরে অনেক উঁচুতে শূন্যোদ্যানের উপর দাঁড়িয়ে রয়েছি। চতুর্দিকে চমৎকার লতাগুল্ম আর ফুলগাছ আমাদেরকে জড়িয়ে রয়েছে, তবে ইনানার সৌন্দর্যের কাছে এগুলো ম্লান হয়ে রয়েছে। তিনি কাঁধ থেকে আমার হাত নিয়ে একটার পর একটা হাতে চুম্বন করলেন। আবেশে আমার সারা দেহ শিহরিত হল।

আপনি আমার কাছ থেকে কী চান, ইনানা? কণ্ঠস্বরটি শুনে মনে হল এটি আমার নয়।

আমি তোমার সাথে মিলিত হতে চাই।

আমি লজ্জায় ফিসফিস করে বললাম, আপনি নিশ্চয়ই জানেন আমি একজন পূর্ণ মানুষ নই। অনেক দিন আগেই আমাকে খোঁজা করা হয়েছে।

শান্ত ভাবে সমবেদনার স্বরে তিনি বললেন, হ্যাঁ। যখন এটা করা হয় তখন আমিও সেখানে ছিলাম। তুমি যেমন ছুরির ধার অনুভব করছিলে তেমন আমিও তা অনুভব করছিলাম। আমি তোমার জন্য কেঁদেছিলাম তায়তা। তবে নিজের জন্য আনন্দিত হয়েছিলাম। যুগলে হওয়া মানে মিলিত হওয়া নয়। আমি শুধু ক্ষণস্থায়ী দৈহিক মিলনের কথা বলছি না।

তাহলে আর কিসে একজন নারী আর পুরুষের মধ্যে মিলন হয় ইনানা?

দেহের পরিবর্তে আত্মার মিলনের কথা বলছি। দুটি উচ্চতর মনের মিলেমিশে একাকার হয়ে যাওয়ার কথা বলছি। আর তাই হচ্ছে অস্তিত্বের একটি প্রকৃত অলৌকিক দৃষ্টান্ত–যা খুব কমই পূর্ণতা পায়।

তিনি আমাকে রহস্য উদ্যানের সবুজ ঘাসের আচ্ছাদনে টেনে নামালেন। রেশমের মতো নরম। তিনি দ্রুত সপীল ভঙ্গিতে আমার উপর এলেন আর আষ্টেপিষ্টে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। আমাদের দুজনের দেহ এক হয়ে মিশে গেল। আমার বুকে তার হৃৎস্পন্দন অনুভব করলাম।

ক্রমশ আমাদের দুটি হৃদপিণ্ড একটি অঙ্গ হয়ে স্পন্দিত হতে লাগলো। দুজনের মিলিত নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস ঐকতানে দুটি ফুসফুসকে ধারণ করলো। এরকম আবেগ জনিত এবং তৃপ্তিদায়ক অনুভূতি আমি আর কখনও অনুভব করিনি। আরও গভীরভাবে তার দেহের সাথে আচ্ছন্ন হয়ে আমার দেহের মাঝে তাকে সম্পূর্ণ গ্রাস করে ফেলতে চাচ্ছিলাম যাতে আমরা দুজন একটি মাত্র দেহে পরিণত হই।

অনুভব করলাম তার মন আমার মনকে নিয়ন্ত্রণ করছে, এই অনুভূতি আমাকে আতঙ্কগ্রস্ত করে তুললো, আমি অসহায়বোধ করতে লাগলাম। বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলাম, তবে বুঝতে পারলাম তার মতো আমিও তার মনের দখল নিতে চেষ্টা করছি। তিনি আমার সকল স্মৃতি নিয়ে নিতেই আমিও তারগুলো সঞ্চিত করলাম। দুজনের মাঝে কোনোকিছুই আর হারালো না কিংবা মন থেকে মুছে গেল না। আমরা এমন একটি অস্তিত্বের অংশীদার হলাম যা সুদূর অতীত থেকে শুরু হয়েছে।

ফিসফিস করে বললাম, এখন আমি জেনেছি কে আমার বাবা?

তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তিনি কে? প্রশ্নটি করলেও তিনি উত্তরটি জানতেন। আর উচ্চারণ না করলেও আমি প্রশ্নটি শুনেছিলাম।

স্বর্গীয় নীরবতার মাঝে আমি উত্তর দিলাম, তিনি হচ্ছেন রাগ এবং নৈতিকতার দেবতা, মেনিওটস।

ইনানা জিজ্ঞেস করলেন, তাহলে তোমার মা কে?

আমরা দুজনে যে একটি মাত্র মনের অংশীদার ছিলাম, সেই মন থেকে উত্তরটি খুঁজে নিয়ে আমি বললাম, সেলিয়া ছিলেন আমার মা। তিনি একজন মরণশীল মানুষ ছিলেন। আমাকে জন্ম দেওয়ার পর তিনি মারা যান।

তুমি একজন নর-দেবতা তায়তা। পুরোপুরি মানুষও নও আবার সম্পূর্ণ দেবতাও নও। দীর্ঘজীবি হলেও তোমাকে একদিন মরতে হবে। তিনি শক্ত করে তার আত্মা দিয়ে আমার আত্মাকে চেপে ধরে বললেন, যদিও তার অনেক দেরি। যেদিন এটা হবে তখন আমি তোমাকে ধরে রাখবো। তারপর তুমি চলে যাবার পর হাজার বছর তোমার জন্য শোক করবো।

তুমি কে ইনানা? কেন আমি তোমাকে দেহমনে এতো আপন মনে করছি? তোমারা বাবা কে?

এবার তিনি সরাসরি উত্তর দিলেন, আমার বাবা হলেন আলোর দেবতা, হাইপেরিয়ন। তিনি মেনিওটসের ভাই। কাজেই তুমি আর আমি, দুজনেই একই দেবসূলভ রক্তধারার।

আমি নীরবে উত্তর দিলাম, প্রশ্নটি করার আগেই উত্তরটি আমি পেয়েছি। আর তোমার মা? তিনি কী একজন মরণশীল মানবী না দেবী ছিলেন?

ইনানা উত্তর দিলেন, আর্টেমিস আমার মা।

আমি বললাম, আর্টেমিস হচ্ছেন শিকার এবং সমস্ত বন্য প্রাণীর দেবী। আবার তিনি একজন কুমারী দেবী এবং কুমারীদেরও দেবী। কী করে তিনি একজন কুমারী আবার সেই সাথে তোমার জন্মদাত্রী মা হতে পারলেন?

তুমি তো জানো তায়তা, আমাদের মতো দেবদেবী এবং উপ-দেবতার পক্ষে সবকিছুই সম্ভব। আমার জন্মের এক ঘন্টা পর আমার বাবা হাইপেরিয়ন আমার মায়ের কুমারীত্ব ফিরিয়ে দেন।

তার বাবা যে চমৎকার সমাধান দিয়েছিলেন তার বাস্তবতার কথা ভেবে আমি মৃদু হাসলাম আর অনুভব করলাম ইনানাও মৃদু হেসেছেন। তারপর বললেন, তবে আমার মায়ের মতো আমিও একজন কুমারী এবং সকল দেবতার পিতা জিউসের এক অধ্যাদেশ বলে আমি চিরকাল কুমারীই থাকবো। এটা হচ্ছে আমার জন্য একটি শাস্তি, কেননা আমার পিতামহ জিউস যখন আমার সাথে অজাচারী হয়ে যৌনসঙ্গম করতে চেয়েছিলেন তখন আমি তাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলাম।

আমি তাকে সমবেদনা জানিয়ে বললাম, সামান্য অপরাধে এটি একটি নিষ্ঠুর শাস্তি।

কিন্তু আমি তা মনে করি না তায়তা। আমার মনে হয় এটি অত্যন্ত সদয় এবং মধুরতম একটি শাস্তি। আর নয়তো এতোগুলো বছর যে চলে গেল আর আগামী আরও অনেক বছর কীভাবে আমরা প্রেমিক-প্রেমিকা থাকবো। আর তারপরও আমাদের কৌমার্য আর পবিত্রতা অক্ষুণ্ণ রেখে?

কে আমাদের ভবিতব্য বলতে পারবে ইনানা? তুমি যে সময়ের কথা বলছো সেই সুদূর অতীতে তো আমার জন্মও হয় নি।

তোমার যখন জন্ম হয় তখন আমি সেখানে ছিলাম তায়তা। আর যখন তোমার পুরুষত্ব তোমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয় তখনও আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম। আমি তখন কেঁদেছিলাম, যদিও জানতাম সেই ভয়ঙ্কর কর্মটির কারণে হাজার বছর ধরে আমরা কীভাবে উপকৃত হব।

তুমি হাজার বছরের কথা বলছো? এতোকাল কি আমরা একসাথে থাকবো ইনানা?

তিনি সরাসরি আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বললেন, তুমি হয়তো জানেনা, তবে তোমার জন্মের পর থেকেই আমি খুব কাছে থেকেই তোমার গতিবিধি অনুসরণ করেছি। তোমার জীবনে যা কিছু হয়েছে তা সবই আমি জানি। তোমার ছোটখাট প্রতিটি আনন্দ-বেদনা আমি লক্ষ্য করেছি।

কিন্তু কেন আমি, ইনানা?

কারণ আমরা এক সত্তা তায়তা। আমরা একই রক্তের এবং আমাদের নিঃশ্বাস একই।

আমি বললাম, তোমার কাছে লুকাবো না। তোমার মতো আমি কিন্তু বিশুদ্ধ নই। আমার জীবনে আমি অন্য নারীর সাথে দৈহিকভাবে মিলিত হয়েছি।

ইনানা দুঃখভারাক্রান্ত হয়ে মাথা নেড়ে বললেন, তুমি একজন নারীর সাথেই মিশেছো তায়তা। যখন এটা হয় তখনও আমি সেখানে ছিলাম। আমি তোমাকে সাবধান করতে পারতাম, কেননা এই ক্ষণিকের আনন্দের কারণে তুমি চরম মূল্য দিয়েছে, তোমার উপর খোঁজা করার ছুরি চালানো হয়েছিল। তার নিঃশ্বাস আমার মুখে অনুভব করছিলাম আর আমার হৃদয়ে তার মনের দুঃখ অনুভূত হল। তারপর তিনি বলে চললেন, আমি এই কষ্ট থেকে তোমাকে রেহাই দিতে পারতাম। কিন্তু যদি তা করতাম, অর্থাৎ এর পরিণতি কী হবে তা তোমাকে জানাতাম, তাহলে এখন তুমি আর আমি অনন্তকাল ধরে যে স্বর্গীয় শুদ্ধতায় যুগল হতে পেরেছি তা কখনও পারতাম না।

তার কথাটি শুনে আমি একটু ভাবলাম তারপর একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম, তিনিও আমার সাথে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।

আমি স্বীকার করলাম, এটা অনেকদিন আগে ঘটেছিল, মেয়েটার চেহারাও আমার মনে নেই। এমনকি তার নামটাও মনে পড়ছে না।

তিনি ফিসফিস করে বললেন, এর কারণ আমি তোমার মন থেকে সেই স্মৃতি মুছে ফেলেছি। যদি তুমি চাও, তবে সেই স্মৃতি আবার ফিরিয়ে দিতে পারি আর তুমি পরবর্তী পাঁচ হাজার বছর তা তোমার মনে রাখতে পারো। তবে তা তোমার মনে কোনো খুশি বয়ে আনবে না। তুমি কি তা চাও?

সেই দুঃখি বেচারিকে আমি এখন অস্বীকার করে বললাম, তুমি জানো যে আমি তা চাই না। একসাথে ভাগাভাগি করে দুঃখকষ্টের দিনগুলো কাটাবার সময় আমরা একে অপরকে একটু স্বস্তি দিয়েছিলাম। সে আমাকে ভালোবাসা দিয়েছিল। তবে অনেকদিন আগে স্থান ও কালের অতল গহ্বরে সে হারিয়ে গিয়েছে। যেখানে সে চলে গেছে সেখানে কেউ তাকে অনুসরণ করতে পারে না; এমনকি একজন খোঁজা উপদেবতাও নয়।

এই মুহূর্তটির কাছে নিজেকে পুরোপুরি আত্মসমর্পণ করলাম। দুজনের দেহ আর মন পরস্পর সংবদ্ধ হওয়ার পর সময় আর নদীর মতো শ্বাসরুদ্ধ হয়ে প্রবাহিত হচ্ছে না। এটি একটি প্রশান্ত সমুদ্রে পরিণত হল, যেখানে আমরা একত্রে ভেসে বেড়াতে লাগলাম; প্রতিটি মুহূর্তের আমেজ উপভোগ করতে লাগলাম যেন তা অনন্তকালের একটি অংশ। তিনি আমার আত্মার প্রতিরোধকে সমর্থন দিয়ে অশুভের বিরুদ্ধে একে আরও জ্ঞানী এবং অভেদ্য করে তুললেন।

দুজনে মিলে আমরা একটি আধ্যাত্মিক মর্যাদার অবস্থান অর্জন করলাম।

এক অনন্তকাল পর আমার আত্মা তার সাথে কথা বললো, এটা শেষ হোক, তা আমি চাই না ইনানা। আমি এভাবেই তোমার সাথে চিরকাল থাকতে চাই।

তারপর আমি আমার ভেতর থেকে তার কণ্ঠস্বরকে উত্তর দিতে শুনলাম:

তুমি আমার একটি অংশ আর আমিও তোমার একটি অংশ তায়তা। তবুও একই সাথে আমরা আলাদা এবং নিজেকে নিয়ে সম্পূর্ণ। আমাদের নিজেদেরও স্বতন্ত্র অস্তিত্ব আছে, যেখানে আমাদেরকে অবশ্যই ফিরে যেতে হবে। আমাদের নিজেদের আলাদা আলাদা নিয়তি রয়েছে আর তা আমাদের একাই সমাপন করতে হবে।

আমি মিনতি করে বললাম, দয়া করে আমাকে ছেড়ে চলে যেও না।

এবার আমার কাছ থেকে আলাদা হয়ে তিনি বললেন, এখন আমি তোমাকে ছেড়ে যাচ্ছি। এখন আমার যাওয়ার সময় হয়েছে।

আবার কি ফিরে আসবে?

হ্যাঁ আসবো।

আমি বললাম, কোথায়?

যেখানেই তুমি থাক।

কখন ইনানা? কখন আবার তোমাকে দেখতে পাবো?

একদিন, এক বছর কিংবা হাজার বছর পর। অনুভব করলাম আমার আলিঙ্গন থেকে তার বাহু আলাদা হল।

আমি আবার অনুনয় করলাম, আরেকটু থাকো। কিন্তু তিনি ততক্ষণে চলে গেছেন। আমি উঠে বসলাম। হতবুদ্ধি হয়ে চারপাশে তাকিয়ে দেখলাম প্রাসাদের বারান্দায় ছোট খাটে আমি শুয়ে আছি। এক লাফে উঠে দৌড়ে শয়নকক্ষে গেলাম। বড় কামরাটির মাঝখানে দাঁড়িয়ে উল্টোদিকের দেয়ালে দরজাটা খুঁজলাম, যার মধ্য দিয়ে সেই রহস্যময় উদ্যানে ইনানা আর আমি উড়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু এখন সেখানে কোনো দরজা দেখতে পেলাম না।

ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে তন্ন তন্ন করে দেয়ালটা পরীক্ষা করতে শুরু করলাম। আঙুল বুলিয়ে দরজার ফাঁক খুঁজার চেষ্টা করলাম। দেয়ালে মসৃণ পলেস্তারা করা রয়েছে। মনে পড়লো ইনানা কী বলেছিলেন।

তোমাকে জানতে হবে তায়তা, আমাদের মতো দেবতা আর উপ-দেবতার পক্ষে সবকিছু সম্ভব।

মনে হল শেষ যখন এই জায়গায় দাঁড়িয়েছিলাম তারপর অনেক বছর পার হয়ে গেছে। সময়ের মাঝে এমন কী কোনো মাত্রা আছে, সুদূর সেই যে জায়গায় ইনানা আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন? ভাবলাম, যদি তেমন কোনো জায়গা থাকে, যখন আমি সেই জগতে ছিলাম তখন কি এই পৃথিবীতে সময় নিশ্চল হয়ে ছিল?

যখন বাস্তবতা থেকে কল্পনা আর মিথ্যা থেকে সত্যকে আলাদা করার চেষ্টা করছিলাম, তখন আমার চোখ পড়লো কামরার ঠিক মাঝখানে মেঝেতে দাঁড় করে রাখা বড় একটি ব্রোঞ্জের কলসের মতো আকৃতির ফুলদানির দিকে। ফুলদানিটিতে বড় এক গুচ্ছ গোলাপফুল সাজিয়ে রাখা হয়েছে। সামনে এগিয়ে কাঁটাওয়ালা উঁটিতে ফুটন্ত গোলাপগুলো পরীক্ষা করলাম। শেষ যেরকম তাজা দেখেছিলাম, এখনও সেরকমই রয়েছে।

আমি জোরে জোরে বলে উঠলাম, আমার অবর্তমানে হয়তো এগুলো বেশ কয়েকবার বদলানো হয়েছে। তারপর নিচে তাকালাম। মার্বেল পাথরের মেঝেতে একটি লাল গোলাপ পড়ে রয়েছে। মনে পড়লো গত সন্ধ্যায় ফুলের সুগন্ধ নেবার জন্য গোলাপের গুচ্ছ থেকে এই ফুলটি বোঁটা থেকে ছিঁড়েছিলাম, তারপর এটা মেঝেতে ফেলে দিয়েছিলাম যাতে পরে প্রাসাদের পরিচারকেরা তা পরিষ্কার করতে পারে।

আমি মেঝে থেকে ফুলটা তুলে গন্ধ শুঁকে দেখলাম আগের মতোই সুগন্ধ। তারপর আরও ভালোভাবে পরীক্ষা করে দেখলাম পানি না দেওয়া সত্ত্বেও ফুলটি বোঁটা থেকে ছেঁড়ার সময় যেরকম ছিল এখনও ঠিক সেরকমই তাজা আর অমলিন রয়েছে।

তাহলে আমি যে ধারণা করেছিলাম স্বর্গীয় আলিঙ্গনে আমি আর ইনানা এক জীবন কাটিয়েছি, আসলে তার বদলে কেবল এক রাত কাটিয়েছি? ভাবলাম, এটি কী করে সম্ভবপর। হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে ভাবতে থাকলাম।

দরজার বাইরে মিসরি ভাষায় মানুষের কথা বলার আওয়াজ পাওয়া গেল। আমি চিৎকার করে বলে উঠলাম, বাইরে কে?

রুস্তির কণ্ঠ শোনা গেল, আমি রুস্তি প্রভু।

কয়েক মুহূর্ত পর সে দরজার কাছে উদয় হল।

আমি বললাম, তুমি কোথায় ছিলে?

সে বললো, আপনি তো আমাকে বলেছিলেন সূর্য দিগন্তের উপরে উঠার পর আপনাকে জাগাতে।

কখন একথা বলেছি?

কেন গতরাতে আমাকে বিদায় দেবার সময় বলেছিলেন? তার মানে আমি কেবল এক রাত দূরে ছিলাম। কিংবা হয়তো এটা আদৌ ঘটেনি। হয়তো পুরোটাই একটি স্বপ্ন ছিল, তবে আমি মরিয়া হয়ে আশা করছিলাম এটা তা হতে পারে না। এর মধ্যেই আমার আবার ইনানার সাথে অভিসারের আকাঙ্খ হচ্ছে, অবশ্য যদি সে আমার মনের অলীক কল্পনা না হয়ে আসলেই বাস্তব হয়। কল্পনা না বাস্তব, ইনানা কি আর সে কে; এই রহস্যের উত্তর কি কখনও পাবো?

আমি ভুলে গিয়েছিলাম রুস্তি, আমাকে ক্ষমা কর।

অবশ্যই প্রভু। তবে আপনি নন বরং আমিই ক্ষমা চাইবো। রুস্তি চমৎকার একজন মানুষ আর আমি তাকে সত্যি ভালোবাসি। যাইহোক তাকে আবার মনে করিয়ে দিয়ে বললাম, ভুলো না, আর পাঁচ দিনের মধ্যে আমরা সিডন রওয়ানা দিচ্ছি। সবকিছু গোছগাছ করে আবার সফরের প্রস্তুতি নাও।

আমি বেশিরভাগ জিনিসপত্র গাড়িতে তুলে দিয়েছি। এক ঘন্টার মধ্যেই আমি রওয়ানা দিতে প্রস্তুত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *