২. পরবর্তী ভূমিকা

এখন আমাদের পরবর্তী ভূমিকা পালন করার সময় হয়েছে। তামিয়াত দুর্গ থেকে ক্রিটানদের যেসব সামরিক উর্দি আর অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করেছি, সেগুলো ডেকে এনে রাখার নির্দেশ দিলাম। তারপর হাসি তামাশার মধ্য দিয়ে আমাদের লোকেরা হাইকসো উর্দি খুলে মিনোয়ান সামরিক উর্দি পরলো। ওদের চকচকে শিরস্ত্রাণ আর কারুকাজ করা তলোয়ার থেকে শুরু করে হাঁটু পর্যন্ত লম্বা পাতলা নরম চামড়ার বুট জুতা পরলো।

আকেমি আর দিলবার উভয়ের উপর আমার কড়া নির্দেশ ছিল, ওদের লোকেরা যেন হাইকসো উর্দি আর সাজসরঞ্জামের একটা টুকরাও নদীতে ছুঁড়ে

ফেলে। স্রোতে ভাসতে ভাসতে এগুলোর কোনো একটি টুকরাও যদি তামিয়াত দুর্গের মিনোয়ান সেনাদের হাতে পড়ে তাহলে আমার সব কৌশল ফাঁস হয়ে যাবে।

ক্রিটানরা সহজেই বুঝতে পারবে কীভাবে তাদের বোকা বানানো হয়েছে। কাজেই খুলে ফেলা সমস্ত হাইকসো সামরিক উর্দি আর অন্যান্য সাজসরঞ্জাম বোঁচকা বেঁধে নিচের ডেকে লুকিয়ে রাখা হল।

পেছন থেকে অনুকুল বাতাস পেয়ে আমাদের পালগুলো ফুলে উঠেছে, সারিবদ্ধ দাঁড় চালিয়ে বেশ দ্রুত আমরা দক্ষিণদিকে ভেসে চললাম। মিনোয়ানদের এই জাহাজ তিনটি ছিল সমুদ্রের বুকে সবচেয়ে দ্রুতগামী জাহাজ। এতো মানুষ আর রূপার বিশাল ওজন সত্ত্বেও জাহাজগুলো বেশ দ্রুত চলছিল।

বদ্বীপ আর অসংখ্য শাখানদী পেছনে ফেলে শেষ পর্যন্ত আমাদের জাহাজ তিনটি মূল নদীতে চলে এলো। তিনটি জাহাজ একটি অন্যটির সাথে পাল্লা দিয়ে ভেসে চললো। এক জাহাজের নাবিকেরা অন্য জাহাজের নাবিকদের উদ্দেশ্যে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে মারতে লাগলো আর রসিকতা করতে লাগলো।

নোঙর করা মাছধরা নৌকা আর মালামাল বোঝাই ছোট ছোট নৌকার পাশ কাটিয়ে আমরা সামনে এগিয়ে চললাম। নৌকাগুলো পাশ কাটিয়ে যাবার সময় আমি উপরের ডেক থেকে নিচে নৌকাগুলো দেখতে পাচ্ছিলাম। মাঝিমাল্লাদের মধ্যে হতবাক চেহারার কয়েকটা মিসরীয় মুখ চোখে পড়লেও বেশিরভাগই ছিল হাইকসো।

এই দুই জাতির পার্থক্য আমি সহজেই ধরতে পারি। আমার মিসরীয় ভাইদের সুন্দর বুদ্ধিদীপ্ত মুখ, উঁচু কপাল, বড় বড় চোখ আর নিখুঁত চেহারা। অর্থাৎ একবার তাকালেই বুঝা যায় এরা উচ্চ জাতি।

আর হাইকসোদের মধ্যে এই ধরনের চেহারা খুব কম দেখা যায়। অবশ্য আমি শুধু শুধু পক্ষপাতিত্ব করে ওদের বিরুদ্ধাচরণ করছি না। তবে ওদেরকে ঘৃণা করার আমার অনেক কারণ আছে। ওরা সবাই চোর-ডাকাত। নিষ্ঠুরতা আর অত্যাচার করাতেই ওদের আনন্দ। ওদের নিকৃষ্টমানের আর অশ্লীল ভাষা শুনলে যেকোনো সভ্য মানুষের কানে শ্রুতিকটু মনে হবে। ওরা সবচেয়ে বিশ্রী দেবতা শেঠের পূজা করে। আমাদের দেশ দখল করে ওরা আমাদের দেশের মানুষদের ক্রীতদাস বানিয়েছে।

তবে আমার মধ্যে কোনো গোঁড়ামি নেই। যাদের তা আছে তেমন লোকদের আমি ঘৃণা করি। আসলে আমি অনেক চেষ্টা করেও হাইকসো জাতির মধ্যে প্রশংসনীয় কোনো চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাই নি। দেবতারা জানেন এটা আমার দোষ নয় যে, আমি তেমন কিছু ওদের মাঝে খুঁজে পাইনি।

এই জাতির মানুষগুলোর দিকে তাকাতে তাকাতে আমার মনে একটা ভাবনা জাগলো যে, ভবিষ্যতে কোনো এক সময় ওদের প্রতি আমার বিরাগ ভাবটি আরও সঠিক আর দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রকাশ করাটাই সঠিক হবে। কিছু একটা করে ওদেরকে এমন শিক্ষা দিতে হবে যাতে রাজা বিওনও বুঝতে পারবে কাজটা সঠিক হয়েছে।

সেই দিনটি হবে সকল মিসরীয়দের জন্য একটি খুশির দিন। কথাটা ভাবতেই আমার ঠোঁটে মৃদু হাসি খেলে গেল। চিন্তাটায় আরেকটু শান দিয়ে ভাবলাম আর দেরি করে লাভ কি? পুরো পরিকল্পনার ছকটা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আমার মনে ভেসে উঠলো।

নিচের ডেকে ক্যাপ্টেনের কেবিনে একটা লেখার টেবিল আর কিছু পাকানো প্যাপিরাস কাগজ দেখেছিলাম। ক্রিটানরা শিক্ষিত জাতি। ওরা কীলককার হস্তলিপি পদ্ধতি ব্যবহার করে যা সুমেরিয়দের সাথে মিলে না। এই সঙ্কেতগুলো আমি পড়তে আর চিনতে পারলেও সেসময়ে মিনোয়ানদের ভাষার সাথে পরিচিত ছিলাম না।

জানা কথা হাইকসোরা পুরোপুরি অশিক্ষিত। তবে আমার গুপ্তচরেরা আমাকে জানিয়েছিল ওরা কয়েকজন মিসরীয় লেখককে বন্দী করে ক্রীতদাস বানিয়ে, তাদেরকে দিয়ে আমাদের লিপি পড়ে, লিখে আর অনুবাদ করিয়েছে।

আমি আরও জেনেছি ওরা এই লিপিকারদের কাছ থেকেই শিখেছে, কীভাবে পাখির সাহায্যে অনেক দূরে বার্তা পাঠানো যায়। বানরের মতো হাইকলোরাও নকল করতে পটু। কোনো উদ্ভাবনী চিন্তা দিয়ে ওরা কোনো সমস্যার সমাধান করতে পারে না। অন্য লোকের মহৎ ভাবনাকে ওরা নিজেদের বলে চালিয়ে দেয়।

জারাসের সাথে কথা শেষ করে আমি দ্রুত মূল ডেকের নিচে কেবিনে গেলাম। লেখার সরঞ্জামগুলো আমি যেখানে দেখে গিয়েছিলাম সেখানেই রয়েছে। সুন্দর কারুকাজ করা একটা কাসকেটের মধ্যে এগুলো রাখা ছিল। কাসকেটের উপরে আইবিস পাখির মাথাওয়ালা লেখার দেবতা থথের একটা ছোট চিত্র আঁকা রয়েছে।

আমি ডেকে আসন গেড়ে বসে লেখার বাক্সটা খুললাম। খুশি হয়ে দেখলাম, ভেতরে বিভিন্ন আকারের প্যাপিরাস কাগজ ছাড়াও বেশ কয়েকটি তুলি আর কালির ব্লক রয়েছে। এছাড়া ঘোড়ার কেশর বুনে তৈরি করা চারটে ছোট ছোট গুটলিও বাক্সটায় রয়েছে। খাওয়ার জন্য আমরা যে-ধরনের সাধারণ কবুতর পালন করি তার পায়ে এই গুটলিগুলো বাঁধা যায়। এই কবুতরগুলোর আশ্চর্য ধরনের একটি অভ্যাস আছে, যে-জায়গায় ওরা ডিম ফুটে বের হয় সেখানে ওরা ফিরে যেতে পারে। আর পায়ে ছোট্ট বার্তাবহনকারী গুটলি বেঁধে দিলে তাও বহন করে নিয়ে যায়।

আমি দ্রুত হাতে কবুতরের পায়ের বার্তাবহনকারী গুটলিতে বাধার মত ছোট একটা প্যাপিরাসের টুকরা নিলাম। তারপর একটা সরু তুলি আর লেখার কালি গুড়া করে নিলাম।

লেখার বিষয়টিবস্তু আমার মনেই ছিল, তাই নতুন করে ভাবনা চিন্তা করার দরকার পড়েনি। খুব ছোট ছোট অক্ষরে পরিষ্কার লেখার হাত ছিল আমার।

শুরু করলাম যথারীতি সম্ভাষণ দিয়ে, উচ্চ ও নিচের মিসরের ফারাও হে, মহাপরাক্রমশালী বিওন। যদিও সে এই ধরনের কিছু নয়, তবুও এই ধরনের পদমর্যাদার প্রতীক সে পছন্দ করে। আমি, ক্রিটের সর্বাধিরাজ মিনোজ আপনাকে সম্ভাষণ জানাচ্ছি। আমাদের বন্ধুত্বের নিদর্শন স্বরূপ আমি মহামান্যের জন্য রূপাভর্তি তিনটি বিশাল জাহাজ পাঠাচ্ছি। এপিফি মাসের দ্বিতীয় দিনে নীল নদের বদ্বীপে তামিয়াতে আমার ঘাঁটি থেকে জাহাজগুলো রওয়ানা দেবে। আশা করি একই মাসের পঞ্চম দিনে মেমফিসে আপনার রাজধানীতে এগুলো পৌঁছে যাবে। এই ঘটনার খবর আপনার নজরে আসার আগে যাতে কোনো দুষ্ট লোকের হাতে না পড়ে সেজন্য শেষ মুহূর্তে খবরটি বিলম্বিত করা হয়েছে। আমার বিশ্বাস যে সম্মান প্রদর্শন করে এই উপহারসামগ্রীগুলো আপনার বরাবর পাঠানো হয়েছে, তা আপনি যথাযথ আগ্রহের মনোভাব নিয়ে গ্রহণ করবেন।

কালি শুকাবার সাথে সাথে কাগজটা পাকিয়ে কবুতরের পায়ে বাঁধার গুটলিতে রেখে এরাবিক আঠা দিয়ে সিল করলাম। তারপর কেবিন থেকে বের হয়ে নিচের ডেকে নেমে মালামাল রাখার খোলের দরজায় কাছে গেলাম।

জারাস লাথি মেরে দরজার তালা ভেঙে ফেলার পর আর মেরামত করা হয়নি। হাতে ঠেলতেই দরজাটা খুলে গেল। পেছন ফিরে দরজাটা বন্ধ করলাম। যে সিন্দুকটা খুলে ভেতরের মালামাল দেখছিলাম, সেটার ডালা তখনও পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। আমার ড্যাগার দিয়ে চাড় দিয়ে ডালাটা খুললাম। তারপর সিন্দুকটার পাশে হাঁটু গেড়ে বসে ভেতর থেকে একটা রূপার বাঁট বের করলাম। ভারি বঁটটা আমার কোমরবন্ধের সাথে বাঁধা ছোট থলের ভেতরে ঢুকিয়ে রাখলাম। তারপর উপরে ডেকে গিয়ে জারাসের পাশে আমার জায়গায় পৌঁছলাম। চুপিচুপি তার সাথে কথা বললাম যাতে কেউ না শুনতে পারে।

এক ঘন্টার মধ্যেই আমরা কুনটুস নদীবন্দরে পৌঁছে যাবো। সেখানে বিওনের শুল্ক ফাঁড়ির লোকেরা চলাচলকারী সমস্ত জাহাজ থেকে শুল্ক আদায় করে

জারাস আমার কথা থামিয়ে দিয়ে বললো, এসব নিয়ে আপনি চিন্তা করবেন না প্রভু তায়তা। আমাদের ওরা দেরি করাতে পারবে না। আমরা মশা তাড়াবার মতো ওদেরকে তাড়িয়ে দেব

না, জারাস। তুমি তোমার বৈঠা আর পাল গুটিয়ে রাখবে। আর শুল্কদপ্তরের নৌকা কাছে আসতে স্বাগত জানাবে। ওরা কাছে এলে যথাযথ সম্মান দেখাবে। শুল্ক কর্তাকে বায়না দিয়ে রাখতে হবে। কেননা তার সহযোগিতা প্রয়োজন পড়বে। তারপর জারাসকে কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়ে আমি জাহাজের অন্যপাশে সরে গেলাম। আসলে আমি নিজেও নিশ্চিত নই কুনটুসে পৌঁছার পর কী হতে পারে।

নদীতে ভাসমান সমস্ত নৌকা পাশ কাটিয়ে আমরা দ্রুত এগিয়ে চললাম। এই নীল নদীর বুকে আমরাই সবচেয়ে দ্রুতগামি জলযান ছিলাম। আশেপাশের সমস্ত নৌকা আমাদের জন্য পথ ছেড়ে দিয়ে সরে পড়লো। ওরা কেউ জানেনা আমরা কে, তারপরও তখনকার অস্থিতিশীল অবস্থায় যে কোনো শান্তিপ্রিয় মানুষ কোনো ধরনের ঝুঁকি নিতে চাইবে না।

নদীর আরেকটা চওড়া বাঁক পেরোতেই সামনে পূর্বদিকের তীরে কুনটুস নদীবন্দর দেখা গেল। শহরের উপরে একটা পাহাড়ে উঁচু পাথরের পাহারা একটা চৌকি টাওয়ার দেখেই আমি চিনতে পারলাম। টাওয়ারের মাথায় বড় এটা কালো পতাকা উড়ছে। এটা হচ্ছে শুল্কদপ্তরের প্রতীক। আমি জানি টাওয়ারের উপরে নজরদারি লোক থাকবে লক্ষ্য রাখতে যেন কোনো জলযান শুল্ক না দিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে না পারে।

আমরা বন্দরের কাছাকাছি হতেই বন্দরের পাথরের জেটি থেকে কালো পতাকা উড়িয়ে একটা শুল্ক নৌকা আমাদের পথ আটকাতে এগিয়ে এলো। আমি জারাসকে নির্দেশ দিলাম পাল আর বৈঠা গুটিয়ে নিচে নামিয়ে রাখতে যাতে ওরা আমাদের কাছে পৌঁছতে পারে। শুল্ক নৌকার ডেকে ভারী অস্ত্রে সজ্জিত কয়েকজন হাইকসো সেনা দাঁড়িয়েছিল। নৌকাটা জাহাজের কাছে ভিড়তেই জারাস একপাশে ঝুঁকে চিৎকার করে ওদের একজনের সাথে আলাপ শুরু করে জানতে পারলো, লোকটার নাম গ্রাল–সে প্রাদেশিক শুল্ক কর্মকর্তা।

আলাপচারিতা হাইকসো ভাষায় হতে দেখে আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। গ্রাল নামে এই লোকটি মিনোয়ান ভাষায় কথা বললে, আমরা কীভাবে ওদেরকে বুঝাতাম যে একটি মিনোয়ান জাহাজে কেন কেউ তাদের ভাষায় কথা বলতে পারছে না। ঠিক তখনই আমি সিদ্ধান্ত নিলাম প্রথম সুযোগেই এই ভাষা শিখে নেবো। বিদেশি ভাষা শেখার ব্যাপারে আমার বিশেষ দক্ষতা রয়েছে। আমি স্থির নিশ্চিত যে, কয়েকমাসের মধ্যেই ক্রিটের অধিবাসীদের মতোই ওদের ভাষায় আমি কথা বলতে পারবো।

শুল্ক নৌকার ডেক থেকে রাজা বিওনের নামে গ্রাল দাবি করলো, তাকে যেন আমাদের জাহাজে উঠার অনুমতি দেওয়া হয়। আমার শেখা মতো জারাস কোনো আপত্তি না করে নাবিকদের নির্দেশ দিল একটা দড়ির মই নামিয়ে দিতে যাতে গ্রাল জাহাজে উঠতে পারে। ছোটখাট লোকটি একটা বানরের মতো ক্ষিপ্রগতিতে দড়ির মই বেয়ে উঠতে লাগলো।

জারাসকে সে জিজ্ঞেস করলো, আপনিই কি এই জাহাজের ক্যাপ্টেন? আমার দায়িত্ব আপনাদের মালামালের তালিকা পরীক্ষা করা।

জারাস সম্মতি জানিয়ে বললো, অবশ্যই স্যার। তবে এর আগে দয়া করে আমার কেবিনে এসে আমাদের চমৎকার মিনোয়ান ওয়াইনের স্বাদ নিন, তারপর আপনার কাজ শুরু করুন। তারপর সে বন্ধুসুলভভাবে ছোটখাট লোকটির বাহু ধরে তাকে সিঁড়ি বেয়ে নিচে মাস্টারের কেবিনে নিয়ে চললো।

এ পর্যন্ত আমি নিজেকে ওদের কাছ থেকে আড়ালে রেখেছিলাম। নিচে কেবিনের দরজা বন্ধ হওয়ার জোরে শব্দ পাওয়ার পর আমি সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামলাম।

জারাস আর আমি এই সাক্ষাতকারের ব্যাপারে আগেই পরিকল্পনা করেছিলাম। কেবিনের দেয়ালে একটা ছিদ্র করেছিলাম, যাতে ভেতরে কী কথাবার্তা হয় তা দেখা আর শোনা যায়। এখন দেখলাম আমার উঁকি দেবার ছিদ্রটার দিকে মুখ করে জারাস লোকটিকে বসিয়েছে। লোকটির সারা মুখে আঁচিল। জারাসের দেওয়া ওয়াইন মুখ ভরে পান শুরু করতেই তার গলা এমনভাবে ফুলে গেল যেন একটি বিশাল ব্যাঙ তার প্রিয় খাবার, জল-ইঁদুর গিলে খাচ্ছে। এই দৃশ্যটি দেখে আমি হতবাক হয়ে গেলাম।

জারাস অত্যন্ত ভদ্রতা দেখিয়ে তাকে বললো, আপনি নিশ্চয়ই জানেন রাজা বিওন আমাদের জাহাজের চলাচলের জন্য শুল্ক মওকুফ করেছেন।

গ্রাল তার মদের গ্লাস নামিয়ে বললো, সেটা আমি বিবেচনা করবো, ক্যাপ্টেন। তবে সেক্ষেত্রেও আমি আমার খরচ দাবি করবো। তারপর একটা ধূর্ত হাসি দিয়ে বললো, অবশ্য পরিমাণটা নগণ্য, এব্যাপারে আমি আপনাকে নিশ্চয়তা দিচ্ছি।

জারাস ঘাড় নেড়ে সায় দিয়ে বললো, অবশ্যই। আমাদের সকলকে বাঁচতে হবে। তবে আপনার সাথে একান্তে আলাপ করার সুযোগ পেয়ে আমি সত্যি কৃতজ্ঞ। আমাদের আসার খবর দিয়ে মেমফিসে রাজা বিওনের কাছে আমার একটা বার্তা পাঠানো দরকার। তাকে জানাতে হবে সর্বাধিরাজ মিনোজের কাছ থেকে আমি উপহার হিসেবে বিপুল পরিমাণে রূপার বাট নিয়ে যাচ্ছি। একথা বলে জারাস টেবিলের নিচ থেকে একটা রূপার বাঁট বের করলো। এটা আমি তাকে আগেই দিয়ে রেখেছিলাম। টেবিলের উপর বাঁটটা রেখে সে বললো, এটা তার একটা নমুনা।

গ্রাল ধীরে ধীরে হাতের মগটা টেবিলে রেখে রূপার বাটটির দিকে একদৃষ্টিতে তাকালো। তার চোখদুটো মনে হচ্ছে কোটর বের হয়ে আসছে। মুখ হা করতেই তার চোয়াল ঝুলে পড়লো। খোঁচা খোঁচা দাড়ি বেয়ে মুখ থেকে মদ চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়তে লাগলো। মনে হল সে কথা বলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। সম্ভবত জীবনে কখনও সে এ-ধরনের সম্পদ চোখে দেখেনি।

জারাস বলে চললো, এখানে কুনটুসে কি আপনার কাছে বার্তাবহনকারী কবুতর আছে? যে পাখি মেমফিসে উড়ে গিয়ে রাজা বিওনের কাছে আমার আগমন সংবাদ নিয়ে যেতে পারবে?

গ্রাল ঘোৎ ঘোৎ করে মাথা নাড়লো। তার উত্তর দেবার মতো অবস্থা ছিল না আর চকচকে রূপারপিণ্ডটি থেকে সে চোখও সরাতে পারছিল না।

জারাস রূপারপিণ্ডটি আরেকটু তার দিকে ঠেলে দিয়ে বললো, এই পিণ্ডরূপাটিকে আপনার অমূল্য সেবার পারিশ্রমিক হিসেবে ধরে নিতে পারেন। আমাদের মহান দুই জাতির মধ্যে যে মতৈক্য রয়েছে এটা তার একটি নিদর্শন। তারপর সে আমার পত্রসহ পায়রার পায়ে বাধার গুটলিটা পিণ্ডরূপার পাশে রাখলো। এই বার্তাটি দয়া করে রাজা বিওনের কাছে পাঠাবার ব্যবস্থা করুন।

একটা বড় মাকড়সার মতো হাত বাড়িয়ে সে টেবিলের উপর থেকে পিণ্ডটা তুলে নিয়ে তার দাগেভরা চামড়ার জ্যাকেটের সামনে দিয়ে ভেতরে গলিয়ে দিল, তারপর কোমরের দড়িটা কষে বাঁধলো। প্রচণ্ড আবেগে তার হাত কাঁপছিল। পিণ্ডরূপারটার কারণে জ্যাকেটের পেটের নিচের দিকটা ফুলে রইল, তবে সে এক হাত দিয়ে সেটা বুকের কাছে আঁকড়ে ধরে রইল।

টলমলে পায়ে কোনো মতে উঠে দাঁড়াল আর অন্য হাতে আমার পত্রটা নিল। জারাসের দিকে ঝুঁকে অভিবাদন করে বললো, এবার আমি বুঝতে পেরেছি মহামান্য, আপনি উচ্চপর্যায়ের রাষ্ট্রিয় কর্মকাণ্ডে জড়িত আছেন। আমার এই অনধিকার চর্চার জন্য ক্ষমা করুন। তবে এই পত্রটি আমার একটি বার্তাবহনকারী পাখির মাধ্যমে রাজা বিওনের কাছে পাঠাবার সুযোগ পেয়ে আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করছি। আজ সূর্যাস্তের আগেই এটি রাজার হাতে পৌঁছে যাবে। আর আপনাদের এই চমৎকার জাহাজেও আপনারা পরশুর আগে মেমফিস পৌঁছতে পারবেন না।

আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ। আসুন আপনাকে নিরাপদে আপনার নৌকায় ফিরিয়ে নিয়ে যাই। এই কথা বলে জারাস তার দিকে হাত বাড়াবার আগেই সে সিঁড়ি বেয়ে উপরের ডেকের দিকে চলতে শুরু করলো।

জারাস আর আমি লক্ষ করলাম নৌকাটা কুনটুসের দিকে চলেছে। আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে দেখলাম গ্রাল তার নৌকা থেকে নেমে গ্রামের দিকে হাঁটতে শুরু করেছে। এরপর আমি জারাসকে ইশারা করতেই সে পাল তুলে বৈঠা হাতে নিয়ে মাল্লাদের দক্ষিণের পথে যাবার জন্য তৈরি হতে বললো।

আমি পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলাম কুনটুসের দালান কোঠার মধ্য দিয়ে একজন ঘোড়সওয়ার উপরে পর্যবেক্ষণ টাওয়ারের দিকে ছুটে চলেছে। আমি চোখে হাত দিয়ে রোদ আড়াল করে দেখলাম সে টাওয়ারের নিচে অপেক্ষামান সহিসের হাতে ঘোড়ার রাশটা দিয়ে উঁচু ভবনের ভেতরে অদৃশ্য হল।

একটু পরই একই লোককে দেখা গেল ভবনের চূড়ায় প্লাটফর্মে। সে দুই হাত উপরের দিকে তুলতেই তার হাত থেকে একটা বেগুনি রঙের পায়রা ডানা পতপত করতে করতে আকাশে উড়ে গেল।

তিনবার টাওয়ারটি চক্কর দিয়ে পাখিটি দক্ষিণমুখি উড়তে শুরু করলো। উপরের দিকে দ্রুত উড়তে উড়তে নদীর মাঝখানে এল। আমাদের একটা জাহাজের ঠিক উপর দিয়ে যাওয়ার সময় আমার মনে হল এর একটি পায়ে সেই পত্রসহ গুটলির আকৃতির কিছু একটা বাঁধা রয়েছে।

.

সারাবিকেল আমরা দক্ষিণমুখি চলতে লাগলাম। তারপর পশ্চিমতীরের পাহাড়গুলোর পেছনে সূর্য ডুবে যেতেই একটা নিরাপদ জায়গায় রাতের জন্য জাহাজ নোঙর করতে জারাসকে নির্দেশ দিলাম। সে একটা বাঁক পেরিয়ে নদীর একটা অগভীর জায়গা খুঁজে নিল।

আমি জানতাম গ্রাল ঠিকই হিসেব করে বলেছিল। মেমফিস থেকে আমরা এখনও প্রায় দেড়দিনের দূরত্বে রয়েছি। নোঙরের দিকে লক্ষ্য রাখতে জারাস প্রতি জাহাজে একজন করে লোক বসাল আর রাতের আঁধারে যাতে কোনো দস্যুদল হামলা করতে না পারে সেজন্য তীরেও পাহারা বসাল।

রাতে অগ্নিকুণ্ডের চারপাশে বসে খাবার খেতে খেতে আমি আমার তিন অধিনায়কের সাথে কীভাবে আমাদের জাহাজের মাথায় স্থাপিত ব্রোঞ্জের তীক্ষ্ণ ঠোঁট দিয়ে শত্রুর একটা জাহাজ গুঁতা মেরে ফুটো করা যায়, সেই কৌশল নিয়ে আলোচনা করলাম। নৌযুদ্ধের কলাকৌশল সম্পর্কে আমার রচিত বিখ্যাত গবেষণামূলক প্রবন্ধ রচনার সময় আমি এই কৌশলটি নিয়ে গবেষণা করেছিলাম। আমি তাদেরকে বিশদ ভাবে ব্যাখ্যা করলাম, কীভাবে নিজেদের জাহাজ আর লোকজনের ক্ষতি না করে শত্রুর জাহাজের ব্যাপক ক্ষতি করা যায়। আরও বললাম, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে সংঘর্ষের আগে নিজেদের লোকদেরকে আত্মরক্ষার কৌশল শেখাতে হবে।

কোনোধরনের অঘটন ছাড়াই শান্তিতে রাত কেটে গেল। ভোরের আলো ফোঁটার আগেই আমার প্রস্তুতি নিতে শুরু করলাম আর ভোর হতেই নোঙ্গর তুলে পাল তুলে আবার নদীতে ভাসলাম। আগের রাতে উত্তর পূর্ব থেকে জোর বাতাস বইতে শুরু করেছিল, সেই বাতাসের তোড়ে আমাদের জাহাজ আরও দ্রুতবেগে চলতে লাগলো। আমাদের লোকদের মাঝে প্রবল উৎসাহ জেগে উঠলো। এমনকি শিকলে বাধা ক্রীতদাসেরাও ভালো খাবার আর থিবসে পৌঁছার পর মুক্তি পাওয়ার আশ্বাসে দ্বিগুণ উৎসাহে দাঁড় বাইতে লাগলো। জাহাজের হালে দাঁড়িয়ে আমিও শুনতে পেলাম ওরা গান গাইছে।

আমার মনে হল জাহাজে একমাত্র আমার মনেই আমাদের এই দুঃসাহসিক উদ্যোগের ব্যাপারে কিছু সন্দেহ ছিল। থিবস ছেড়ে আসার পর সবকিছু এত মসৃণভাবে হয়ে চলেছিল যে, সবাই ভাবতে শুরু করেছিল আমি সকল ভুলভ্রান্তির উর্ধ্বে আর ওরাও অপরাজেয়। আমি জানতাম দুটি ধারণাই মিথ্যা। এমনকি আমিও জানিনা মেমফিস পৌঁছে কি দেখবো। মনে মনে অনুতপ্ত হয়ে ভাবতে শুরু করলাম, কেন বিওনকে আমাদের আসার আগাম খবর দেওয়ার মতো দুঃসাহস দেখালাম। হয়তো এটাই ভালো হতো যদি চুপি চুপি রাতের অন্ধকারে নিঃশব্দে দাঁড় বেয়ে তার রাজধানীতে পৌঁছাতে পারতাম। জাহাজের একপাশে দাঁড়িয়ে বিষয়টা নিয়ে চিন্তায় এতো মগ্ন ছিলাম যে জারাস পাশে এসে আমার পিঠে জোরে একটা চাপড় দিতেই চমকে উঠলাম।

আপনার সম্পর্কে অনেক কিছু শুনেছি তায়তা, কিন্তু কখনও বুঝতে পারিনি যে আপনি এতো বেপরোয়া। আমি জানি আপনি ছাড়া আর কেউ এই ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ দুঃসাহসিক কাজ করার কথা কল্পনাও করতে পারবে না। আপনার এই বীরত্বপূর্ণ কর্মকাণ্ড উদযাপন করার জন্য আপনার একটা বীরত্ব। গাঁথা রচনা করা উচিত। আর আপনি না করলে আপনার হয়ে আমি তা করবো। এই কথাটি শেষ করে সে আবার আমার পিঠ চাপড়ালো।

এই জায়গাটা মিসরীয় এলাকা হলেও অনেক বছর আগে শত্রুরা এটা দখল করে নিয়েছিল। ছোটবেলার পর আর কখনও আমি এখানে আসিনি। তাই সবকিছু আমার কাছে অচেনা মনে হচ্ছিল, আর বাকি সবাইও তাই ভাবছিল কেবল একজন ছাড়া।

সে ছিল ছাব্বিশতম রথীবাহিনীর মিসরীয় ক্রীতদাস রহিম, যাকে আমি তামিয়াত দুর্গেই মুক্তি দিয়েছিলাম। পাঁচ বছর আগে হাইকসোরা তাকে বন্দী করেছিল আর তারপর বাকি সময়ের অর্ধেক সে শেকলে বাঁধা অবস্থায় এই এলাকায় নৌকায় দাঁড় বাইতো।

আমার আর জারাসের পাশে দাঁড়িয়ে সে আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চললো। নদীপথের প্রতিটি বাঁক আর পানির নিচে লুকানো প্রতিবন্ধকতা সে আমাদেরকে দেখিয়ে নিয়ে চললো।

রাত হতেই আবার আমরা নোঙ্গর ফেলে সেখানেই থামলাম। তবে পরদিন সূর্য উঠার সাথে সাথেই আবার পাল তুলে নীল নদী বেয়ে এগিয়ে চললাম। আজ এপিফি মাসের পঞ্চম দিন, আমাদের আসার খবর দিয়ে এদিনটির কথাই আমি বিওনকে আগাম জানিয়েছিলাম।

ঘন্টা চারেক চলার পর উঁচু দুই তীরের মধ্যে একটা সরু বাঁকের ভেতরে ঢুকলাম। এর ভেতর থেকে বের হয়ে সামনে দুই লিগ পর্যন্ত বয়ে যাওয়া শান্ত প্রণালীরপানির প্রবাহের মধ্যে চলে এলাম।

রহিম বললো, মেমফিস পৌঁছার এটাই শেষ পর্ব। নদীর বামদিকের বাকের পর সামনের দুই তীর জুড়ে মেমফিস নগর ছড়িয়ে রয়েছে।

আমি জারাসকে নির্দেশ দিলাম, জাহাজ থামাও। যারা বৈঠা বাইছে তাদেরকে বল, সামনের বাঁকে পৌঁছা পর্যন্ত বিশ্রাম নিতে আর একটু পানি খেয়ে নিতে। এরপর আমি যখন গোত্তা মারার জন্য জোরে বাইতে বলবো তখন ওরা প্রস্তুত হবে। বাকি দুটি জাহাজও আমাদের নির্দেশ অনুসরণ করলো। তিনটি জাহাজই এখন প্রণালীর মধ্য দিয়ে কেবল পালের সাহায্যে ভেসে চলেছে।

নদীতে বিভিন্ন ধরনের জলযান দেখা যাচ্ছে। ছোট ডিঙি থেকে শুরু করে চেটালো একতলা পাল-তোলা জাহাজ, চারকোণা পালের জাহাজ আর এর সাথে বাধা বড় নৌকা পর্যন্ত। এর আগে নদীতে যেসব নৌকা আমরা পাশ কাটিয়ে এসেছি, তা থেকে এদের ব্যবহারর সম্পূর্ণ অন্যরকম মনে হচ্ছে। যদিও সম্মান দেখিয়ে আমাদের পথ ছেড়ে দিচ্ছে, তবে ভয়ে পালিয়ে যাচ্ছে না। আমাদের দেখে এই নৌকাগুলোর মাঝিমাল্লারা হাত উঠিয়ে স্বাগত জানালো।

আমি জারাসকে বললাম, আমাদের আগমন ওদের কাছে প্রত্যাশিত ছিল। মনে হয় কবুতরটি ঠিকই পথ চিনে ফিরে এসেছে।

জারাস আমার দিকে হতবাক হয়ে তাকিয়ে বললো, এটাই তো আপনি পরিকল্পনা করেছিলেন তাই না? অন্য কিছু তো আপনি আশা করেননি, প্রভু? তার কথা শুনে আমি মাথা নেড়ে অন্যদিকে তাকালাম। আমি জানি অধিকাংশ মানুষের তুলনায় আমি অনেক বিচক্ষণ আর কূটবুদ্ধিসম্পন্ন, তবে বুদ্ধির চেয়ে ভাগ্য আমার কাছে পছন্দনীয়, তবে ভাগ্যদেবী খুবই চঞ্চল। কখন কাকে ছেড়ে ভাগ্যদেবী চলে যান কেউ তা জানে না।

আমি নিচে দাঁড়ীদের বসার বেঞ্চের দিকে নামলাম। ওরা সবাই আমার দিকে হাসি মুখে তাকালো। কেউ কেউ দুএকটা হাসিখুশি মন্তব্য করলো, আমিও প্রত্যুত্তরে মৃদু হাসলাম। তবে এখানে আসার মূল লক্ষ্য ছিল বেঞ্চের নিচে লুকানো ধনুকগুলোতে গুণ লাগান আছে কি না আর তূণভর্তি তীর আছে কি না তা দেখা।

পেছন দিক থেকে বয়ে আসা জোর বাতাসের তোড়ে আমরা নদীর বুক চিরে দ্রুত এগিয়ে চললাম আর এদিকে সামনের বাঁকও দ্রুত এগিয়ে আসছে। কোনো ধরনের অস্থিরতা না দেখিয়ে সবার সাথে হাসিমুখে কথা বলতে বলতে আবার জাহাজের হালে আমার জায়গায় ফিরে গেলাম।

দুপাশে তাকিয়ে নিশ্চিত হলাম আকেমি আর দিলবার আমাদের জাহাজের পেছনে দুইপাশে একটা তীরের ফলার মতো আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে রয়েছে। ওরা দুজনেই হাত তুলে আমাকে সম্মান জানাল আর সংকেত দিল যে আক্রমণের জন্য ওরা প্রস্তুত রয়েছে।

বাঁকে পৌঁছার সাথে সাথেই আমি জারাসের দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে নির্দেশ দিলাম, বৈঠা হাতে নাও!।

সাথে সাথে আমাদের দুই পাশে রূপালি ডানা গজাল-বৈঠার পাতলা ডগাগুলো পানির উপরে চকচক করে উঠলো।

তারপর নির্দেশ দিলাম, বাওয়া শুরু কর! বলার সাথে সাথে একসাথে সমস্ত বৈঠা পানিতে নামলো আর বৈঠা টানা শুরু হল দ্বিগুণ বেগে। ঢাক বাদকরা বৈঠা বাওয়ার তালে তালে দ্রুতলয়ে ঢাক বাজিয়ে চললো।

হঠাৎ বাঁক পার হয়ে নদীর দুই তীরে বিস্তৃত মেমফিস নগরীর মুখোমুখি হলাম। মার্বেল পাথরের দেয়াল আর সুউচ্চ দালানের ছাদ থেকে সূর্য কিরণ ঠিকরে পড়ছে।

জাঁকালো রাজপ্রাসাদ আর মন্দিরগুলো দেখে মনে হল আমাদের প্রিয় থিবসের মতোই জমকালো একটি নগরী।

নদীর উভয় তীরেই তিন থেকে চার সারি নৌযান দেখা যাচ্ছে। আর প্রতিটি নৌযানে মানুষ দেখা যাচ্ছে। বেশিরভাগ নৌযান সাদা আর লাল পতাকা দিয়ে সাজানো। আমি জানতাম এটা হচ্ছে হাইকসোদের আনন্দ আর উৎসবের প্রতীক। উৎফুল্ল জনতা পামপাতা নেড়ে আমাদের স্বাগত জানাচ্ছে। সবার কণ্ঠে উজ্জ্বলতা আর উম্মাতাল গানে ভরপুর।

তবে আমাদের জাহাজ সামনে এগোবার জন্য নীল নদীর মাঝ বরাবর জায়গাটি সম্পূর্ণ খালি রাখা হয়েছে। জলপথের শেষ মাথায় সুসজ্জিত আর রং করা বেশ কয়েকটি বজরা আর ছোট ছোট নৌকা নোঙর করা রয়েছে। আর মাঝখানে রয়েছে সবচেয়ে বড় রাজকীয় বজরা। তবে এটিও আমাদের তিন জাহাজের তুলনায় ছোট।

জনতার কোলাহলের মাঝে আমি চিৎকার করে জারাসকে বললাম, আঘাত করার জন্য আরও জোরে বৈঠা বাইতে বল। মাঝখানের লাল বজরাটি বিওনেরই, এটা লক্ষ্য করে জাহাজ চালাও।

দুইহাত তুলে আমি রেশমি কাপড়ের টুকরাটি দিয়ে চোখের নিচ পর্যন্ত মুখ ঢেকে ব্রোঞ্জের শিরস্ত্রাণটা মাথায় পরলাম। আমি পুরোপুরি নিশ্চিত হতে চাই। যেন অসতর্ক কোনো মুহূর্তে বিওনের রাজদরবারের কেউ আমাকে চিনতে না পারে।

আমাদের জাহাজের হাল ধরে রাখা দুই নাবিক জাহাজের ব্রোঞ্জের ডগাটা রাজা বিওনের রাজকীয় বজরা বরাবর লক্ষ্য স্থির করে রয়েছে। পেছনে বাকি দুই জাহাজ অর্ধেক জাহাজ দূরত্বে রয়েছে যেন আমরাই প্রথম আঘাত হানতে পারি। বাদকরা ঢাকের ছন্দ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে আর আমি অনুভব করলাম ঢাকের তালে তালে আমার হৃৎস্পন্দনও চলেছে।

আমাদের সাথে লাল বজরার দূরত্ব দ্রুত গতিতে চারশো থেকে দুইশো কদম কমে এসেছে। আমি দেখতে পেলাম বজরারি চওড়া দিকটা নদীর স্রোত বরাবর রেখে নোঙর করা। উপরের ডেকে উঁচু ধাপের একটা পিরামিডের চারপাশে তাঁবুর মতো শামিয়ানা টানানো হয়েছে। শামিয়ানার নিচে একটা সিংহাসন আর তার উপর বসা একটা মানুষের মূর্তি দেখতে পেলাম। তবে এতদূর থেকে সবকিছু পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না।

সিংহাসনের চতুর্দিকে বর্শাধারী পাইক-বরকন্দাজ দাঁড়িয়ে রয়েছে। সবাই বর্ম আর অস্ত্রসজ্জিত। তাদের শিরস্ত্রাণ আর বুকের বর্ম দেখে মনে হচ্ছে রণসাজে সজ্জিত হয়ে প্রদর্শনী করছে।

রাজকীয় বজরার দুই পাশে আরও কিছু ছোট জলযান সারিবদ্ধভাবে নোঙর করা রয়েছে। এগুলোতে বিওনের সভাসদরা ভীড় করে রয়েছে। মনে হচ্ছে কয়েকশো হবে, তবে এত গাদাগাদি করে রয়েছে যে, প্রকৃত সংখ্যা গণনা করার কোনো উপায় নেই। মেয়েরা বেশিরভাগ দীর্ঘদেহী পুরুষের পেছনে ঢাকা পড়ে গেছে। সবাই হাসিখুশিতে মত্ত আর উল্লাসে হাত নাড়ছিল। কিছু কিছু পুরুষ উৎসব উপযোগী বর্ম আর ধাতব শিরস্ত্রাণ পরে রয়েছে। আর অন্যদের পরনে বিভিন্ন ধরনের রঙিন পোশাক।

বিশাল রাজকীয় তরীর পাশেই একটি ছোট জলযানে বাদকদল বর্বর ধরনের হাইকসো সুর বাজিয়ে চলেছে। ঢোলক, বীণা, ক্লারিওনেট, পশুর শিং, তুর্য, কাঠের বাঁশি সবমিলিয়ে বেসুরো আর বিকট আওয়াজ করে চলেছে।

আমরা এতো দ্রুত রাজকীয় তরীর দিকে ছুটে চলছিলাম যে, কাছাকাছি আসার পর এখন প্রায় সবকিছু পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলাম। পিরামিড আকৃতির মঞ্চের উপর রঙিন শামিয়ানার নিচে পেটানো রূপার সিংহাসনে বিওন বসে রয়েছে। তার পিতা রাজা সালিটিসের মৃত্যুর পর সে এই সিংহাসন দখল করেছে।

দেখার সাথে সাথেই আমি তাকে চিনতে পারলাম। এর আগে থিবসের যুদ্ধক্ষেত্রে তাকে আমি দেখেছিলাম। সে ছিল হাইকসো সেনাবাহিনীর বামবাহু, তার অধীনে চল্লিশ হাজার পদাতিক আর তিরন্দাজ ছিল। এমন লোককে সহজে ভোলো যায় না।

বিশালদেহী লোকটির বিরাট ভূড়ি জুড়ে বিপুলায়তন সাদা আল্লাখাল্লাটা একটা তাঁবুর মতো ফুলে রয়েছে। বেণি পাকানো কালো দাড়ি লম্বা হয়ে কোমর পর্যন্ত নেমে গেছে। বেণি পাকানো দাড়িতে উজ্জ্বল রূপা আর সোনার অলংকার লাগানো রয়েছে। সে একটা উঁচু মুকুটসহ পলিশ করা রূপার শিরস্ত্রাণ পরে রয়েছে, যাতে বিভিন্ন ধরনের উজ্জ্বল রত্ন লাগানো আছে। তাকে দেখতে একজন দেবতার মতো মনে হচ্ছিল। হাইকসোদের সবকিছু ঘৃণা করলেও তার সাজসজ্জা দেখে আমিও অবাক হলাম।

রাজা বিওন একহাত উঁচু করে হাতের তালু সামনের দিকে মেলে সম্ভবত আমাদের স্বাগত কিংবা আশীর্বাদ জানাচ্ছে। সঠিক বুঝা মুশকিল, তবে সে মৃদু হাসছিল।

আমি জারাসকে সংক্ষেপে কয়েকটা শব্দে রাজকীয় বজরার সবচেয়ে দুর্বল দিকটা দেখালাম। সেটা ছিল উঁচু মঞ্চের একটু সামনে।

ঐ জায়গাটা লক্ষ্য করে আঘাত হানবে।

এখন আমরা এতো কাছে এসে পড়েছি যে, এবার দেখতে পেলাম রাজা বিওনের মুখে আর হাসি নেই। মুখ হা করাতে তার চোয়াল নিচের দিকে ঝুলে পড়েছে, বাদামি ছোপ ছোপ ময়লা সামনের দাঁত দেখা যাচ্ছে। তারপর হঠাৎ সে মুখ বন্ধ করলো। শেষ মুহূর্তে সে আমাদের বৈরী মনোভাব টের পেয়েছে। লোমশ দুই থাবা সিংহাসনের হাতলে ঠেস দিয়ে উঠতে চেষ্টা করলো। কিন্তু সে খুব ধীরে উঠছিল।

রাজকীয় তরীর দুইপাশে নৌকাগুলোর উপর ভীড় করে থাকা সভাসদরা হঠাৎ তাদের দিকে ছুটে আসা জাহাজগুলোর ধাক্কার বিপদ সম্পর্কে সচেতন হল। মেয়েদের ভয়ার্ত চিৎকার আমাদের কানে ভেসে এলো। কিছু কিছু পুরুষ বজরার কিনারায় যাওয়ার জন্য ঠেলাঠেলি করতে করতে তরবারি কোষমুক্ত করে আমাদের উদ্দেশ্যে রণহুঙ্কার দিতে শুরু করলো। যারা সামনে ছিল তারা পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়লো। তাদের এই বিশৃঙ্খল অবস্থার মাঝে পর্বতের তুষারধ্বসের মতো আমরা তাদের উপর এসে পড়লাম।

হাইকসোদের সমস্ত চিৎকার আর হট্টগোল ছাপিয়ে জারাসের নির্দেশ শোনা গেল, বৈঠা সামলাও! আমাদের জাহাজের দুইপাশের দাড়ীরা পানি থেকে বৈঠা তুলে খাড়া করে জায়গামত সামলে রাখলো যাতে জাহাজের সংঘর্ষে এগুলো ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। নদীর শেষ কয়েকগজ খোলা জায়গা আমরা একই গতিতে পার হলাম।

আমি জারাসকে যে জায়গাটা দেখিয়েছিলাম ঠিক সেই জায়গাটি লক্ষ্য করে আমরা রাজকীয় বজরায় আঘাত হানলাম। বিকট মচমচ আওয়াজ তুলে ব্রোঞ্জের বিশাল ডগাটা সামনের বজরাটির কাঠ ভেদ করে ভেতরে ঢুকে পড়লো। সংঘর্ষের সাথে সাথেই দাড়ী বেঞ্চে বসা আমাদের বেশিরভাগ লোক ডেকে ছিটকে পড়লো। আমি শক্ত কাঠের বেঞ্চ ধরে নিজেকে সামলালাম। আমার চারদিকে কী ঘটছে সব আমি দেখতে পেলাম।

লক্ষ্য করলাম আমাদের জাহাজের পুরো শক্তি আর ওজন রাজকীয় বজরার এক পাশে ছোট একটি জায়গায় কেন্দ্রিভূত হয়ে আঘাত করেছে। একটা ভারি কুড়ালের ফলা যেমন এবটি কাঠের গুঁড়ি ফেড়ে ফেলে সেরকমভাবে আমরা এটা ফেড়ে ফেললাম। আমাদের জাহাজের ডগা বজরাটি চাপা দিতেই এর হালের কয়েক টুকরা আমাদের জাহাজের সামনের অংশের নিচে তলিয়ে গেল।

আমাদের জাহাজ ওদের উপর চড়াও হতেই আমি দেখলাম, শীতকালের ঝড়ো বাতাসের তোড়ে যেমন চিনার গাছের উঁচু ডাল থেকে পাতা ঝরে পড়ে, ঠিক তেমনি হাইকসো প্রহরীদলের সদস্যরা রাজকীয় পিরামিডের সিঁড়ির ধাপ থেকে ছিটকে পড়লো। আর রাজা বিওন সবচেয়ে উঁচু থেকে পড়লো। তার বিশাল দেহজুড়ে আলখাল্লাটা ফুলে গেল আর জটপাকানো দাড়ির বেণিগুলো মুখে আছড়ে পড়তে লাগলো। শূন্যে হাত পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে সে নদীতে পড়লো। আমাদের থেকে ত্রিশ কদম সামনে সে পানিতে ভাসছিল, পানি আটকে থাকায় তার আলআল্লাটা ফুলে গিয়ে তাকে ভাসিয়ে রেখেছিল।

আমার দুই পাশে বাকি দুটি জাহাজও হাইকসোদের অন্যান্য ছোট ছোট বজরাগুলোর গায়ে ধাক্কা মেরেছে। ওরা বেশ সহজেই বজরাগুলোর কাঠ চিড়ে ফেললো, বজরার উপরের যাত্রীরা আতঙ্কে চিৎকার করে ডেক থেকে পানিতে পড়ে গেল।

রাজকীয় বজরার ভাঙা অংশগুলো আমাদের তিনতলা জাহাজের দুইপাশ দিয়ে ছড়িয়ে পড়লো। পাল ঘেঁড়ার প্রচণ্ড চড়চড় শব্দ, দড়ি ছিঁড়ে ফট ফট শব্দ, কাঠ ফেটে যাওয়ার শব্দ আর জাহাজের হালের ধাক্কায় পিষে যাওয়া মানুষের আতঙ্কিত চিৎকার শোনা যাচ্ছে। আমাদের জাহাজের ডেকও একপাশে হেলে যাওয়ায় মানুষজন আর ডেকের উপরের বিভিন্ন জিনিসপত্র একদিকে সরে গেল।

তারপর আমাদের সুন্দর জাহাজটি ভাঙা বজরার ভাঙা অংশগুলো থেকে ছাড়া পেয়ে আবার ভারসাম্য ফিরে পেল এবং পানির উপর সোজা হয়ে দাঁড়াল।

জারাস আবার চিৎকার করে উঠলো, বৈঠা হাতে নাও! আমাদের লোকেরা আবার বেঁধে রাখা বৈঠাগুলো তুলে নিয়ে বাওয়ার জন্য আংটায় বসালো। জারাস আবার বলে উঠলো, পেছনে বাইতে শুরু কর! কেবল পেছনের বেঞ্চিতে বসা দাঁড়িরা বৈঠা পানিতে পৌঁছাতে পারছিল। সামনের বেঞ্চিতে বসা দাঁড়িরা রাজকীয় বজরার ভাঙা অংশগুলোর কারণে দাঁড় বাইতে পারছিল না।

যারা দাঁড় বাইতে পারছিল, তারা জোরে জোরে কয়েকবার বৈঠা চালিয়ে আমাদেরকে আটকে থাকা ভাঙা বজরার অংশ থেকে ছাড়িয়ে আনলো। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ভাঙা টুকরাগুলো পানিতে তলিয়ে গেল।

আমি অন্য তিনতলা জাহাজ দুটোর দিকে তাকালাম। দিলবার আর আকেমি তাদের অধীনস্থ লোকদের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে নির্দেশ দিচ্ছিল। ওদের জাহাজের নাবিকরাও ঢাক পেটানোর তালে তালে দ্রুত বৈঠা চালিয়ে জাহাজদুটোকে জায়গামত ফিরিয়ে নিয়ে আসছিল।

নদীর পানিতে হাবুডুবু খেতে থাকা মানুষের মাথা দেখা যাচ্ছে, বাঁচার জন্য আপ্রাণ চেষ্টারত মানুষ আর ভাঙা টুকরায় নদী ভরে রয়েছে। ডুবন্ত নারী পুরুষের মরণপণ চিৎকার আর আর্তনাদ চারপাশে এক করুণ পরিবেশ সৃষ্টি করেছে।

দীর্ঘ এক মিনিট আতঙ্কিত হয়ে আমি এই বিভিষিকাময় হত্যাযজ্ঞ লক্ষ্য করলাম। অপরাধবোধ আর অনুতাপে আমি প্রায় বিধ্বস্ত হয়ে পড়ছিলাম। বিপর্যস্ত এই প্রাণীগুলোর দিকে শুধু হাইকসো পশু মনে করে আর তাদের দিকে তাকাতে পারছিলাম না। এরাও মানুষ, যারা নিজেদের জীবন বাঁচাবার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে।

তারপর রাজা বিওনের দিকে নজর পড়ার সাথে সাথেই আমার এই অনুভূতি বদলে গেল। মনে পড়ে গেল নাকুয়াদার যুদ্ধে হাইকসো পশুরা যখন আমাদের চমৎকার আর সাহসী দুইশো তিরন্দাজকে বন্দী করেছিল তখন বিওন তাদের সাথে কী আচরণ করেছিল। যুদ্ধক্ষেত্রের উপরে শেঠ দেবতার মন্দিরের ভেতরে ওদেরকে আটকে রেখে জীবন্ত আগুনে পুড়িয়ে সেই দানবীয় দেবতার উদ্দেশ্যে অর্ঘ্য নিবেদন করেছিল।

এখন বিওন রাজকীয় বজরার একটা কাঠের তক্তা একহাতে ধরে রেখেছে আর অন্য হাতে তার রত্নখচিত তলোয়ার নিয়ে তার হেরেমের যে সব নারী কাঠের টুকরাটিতে আশ্রয় নিতে চেষ্টা করছিল তাদের মাথায় কোপ মারছিল। নির্দয়ভাবে সে তাদেরকে তাড়াচ্ছিল, কাউকেই সেই কাঠের খণ্ডটি ধরে ভেসে থাকার সুযোগ দিতে রাজি নয়। আমি লক্ষ্য করলাম সে আমার আদরের বেকাথার সমবয়সি একটি শিশুর মতো মেয়ের উপর তলোয়ার দিয়ে আঘাত করলো। তলোয়ারের ধারাল ফলার আঘাতে পাকা ডালিমের মতো মেয়েটির মাথা কেটে গেল। দরদর রক্ত ঝরতে লাগলো, তারপরও বিওন অশ্লীল ভাষায় মেয়েটিকে গালি দিয়ে আবার তলোয়ার দিয়ে কোপ মারলো।

আমি দ্রুত নিচু হয়ে সামনের বেঞ্চির নিচে রাখা গুন লাগান ধনুকটি তুলে নিলাম। তীরগুলো তূণ থেকে মাটিতে ছড়িয়ে পড়েছিল, একটা তীর নিয়ে ধনুকের ছিলায় লাগিয়ে ছিলাটা টেনে টান টান করলাম, তারপর সোজা হয়ে পূর্ণশক্তিতে তীর ছুঁড়লাম। যেকোনো নিপুণ তিরন্দাজের মতো ধনুকের ছিলা আমার ঠোঁট ছুঁতেই সেটা ঢিল করে দিতাম। কিন্তু আজ প্রচণ্ড রাগে আমার হাত কাঁপছিল, তাই তীরটা ছুঁড়ার সময় বাঁকা হয়ে ছুটলো।

লক্ষভ্রষ্ট হয়ে তীরটা বিওনের গলার বদলে কাঠের টুকরাটা ধরে রাখা হাতে বিধলো।

জারাস আর অন্যান্য যারা এটা লক্ষ করছিল, তারা উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠলো। ওরা ভেবেছিল আমি ইচ্ছা করে বিওনের হাতটা কাঠে বিধিয়েছি। এবার আরেকটা তীর তুলে নিয়ে ওদেরকে দেখাবার জন্য লক্ষ্য স্থির করে বিওনের অন্য হাতটাও কাঠের খণ্ডটার গায়ে বিধলাম। ক্রুশবিদ্ধ হবার মতো অবস্থা হয়ে সে একটা নেকড়ের মতো চিৎকার করে উঠলো।

মুলত আমার স্বভাব করুণাময়, তাই তাকে আর কষ্ট না দিয়ে তৃতীয় তীরটা ছুঁড়তেই তার গলা ভেদ করে চলে গেল।

আমার জাহাজের নাবিকেরাও আমাকে অনুসরণ করলো। ওরাও ধনুকে তীর জুড়ে জাহাজের পাশে দাঁড়িয়ে নিচে পানিতে শক্রর উদ্দেশ্যে বৃষ্টির মতো তীর ছুঁড়তে শুরু করলো।

যা ঘটছিল তা থামাবার মতো শক্তি আমার ছিল না। আমার লোকদের অনেকে এই জঘন্য হাইকসোদের হাতে তাদের বাপ আর অনেকে ভাই হারিয়েছে। তাদের মা বোনদের এরা বলাৎকার করেছিল।

কাজেই কিছুক্ষণ হাইকসো অভিজাতদের এই দুর্দশা তাকিয়ে দেখলাম, তারপর তীরবিদ্ধ শেষ মৃতদেহটা স্রোতে ভেসে যাওয়ার পর আমি আমার লোকদের থামতে বললাম।

অনুতপ্ত না হয়ে আমার লোকেরা উল্লাসে চিৎকার করতে করতে আবার দাঁড় হাতে নিল। হাইকসোদেরকে তাদের জঘন্য শেঠ দেবতার করুণায় ছেড়ে দিয়ে আমরা দক্ষিণদিকে থিবসে আমাদের আসল মিসর রাজ্যের দিকে এগিয়ে চললাম।

.

আমাদের বর্তমান মিসর রাজ্য আর হাইকসো গোত্র আমাদের দেশের যে এলাকা দখল করেছিল তার মাঝে কোনো পরিষ্কার সীমানাচিহ্নিত করা ছিল না। প্রায় প্রতিদিন সীমান্তে দুই পক্ষের মাঝে আক্রমণ, প্রতিআক্রমণ আর লড়াই হতো।

পেয়াইনি মাসের পঞ্চম দিনে আমরা থিবস ছেড়ে এসেছিলাম। এর মধ্যে সেনাপতি ক্রাটাস হাইকসো হামলাকারীদেরকে শেখ আবাদা নগরী থেকে বিশ লিগ দূরত্বে হটিয়ে দিয়েছিলেন। যাইহোক এখন এপিফি মাস চলছে, আমাদের অবর্তমানে অনেক পরিবর্তন নিশ্চয়ই ঘটেছে। তারপরও ওদেরকে অবাক করে দেবার মতো ব্যাপার আমরা ঘটিয়েছি।

হাইকসোদের সামনের সারির সৈন্য কিংবা সেনাপতি ক্রাটাসের অধীনে যুদ্ধরত আমাদের সৈন্যদের কেউ আশা করবে না যে মধ্যসাগরের তীর থেকে চারশো লিগ নদীপথ পাড়ি দিয়ে একটি মিনোয়ান রণ-নৌবহর হঠাৎ এসে হাজির হবে। তাই পরিচিত এলাকায় পৌঁছার পর তিনতলা জাহাজগুলোর মাস্তুলের ডগায় হাতে বানানো ফারাও ত্যামোজের নীল পতাকা উড়িয়ে দিলাম।

নীল নদীর দক্ষিণপ্রান্তে আমাদের তিনতলা জাহাজগুলোর মোকাবেলা করার মতো হাইকসো কিংবা মিসরীয় কোনো জাহাজই নেই। আমরা প্রমাণ করেছি যে, কেউ আমাদেরকে থামাতে পারবে না। অবশ্য হাইকসোরা পায়রা উড়িয়ে খবর পাঠিয়ে আমাদের আর মিসরের মাঝে অবস্থান করা তাদের সেনাবাহিনীকে সাবধান করে দিতে পারে। তবে পায়রা শুধুমাত্র তাদের ডিম থেকে ফোঁটার স্থানেই ফিরে যেতে পছন্দ করে, অন্য কোথাও কেউ পাঠাতে চাইলে তারা সেখানে যাবে না।

.

হাইকসসারা যখন আমাদেরকে নিজ ভূমি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল তার আগে আমাদের শাসক ছিলেন ফারাও ম্যামোজ। সে-সময়ে আমি, তায়তা ছিলাম প্রধান উজির ইনতেফের ক্রীতদাস। তিনি ছিলেন কারনাক মন্দিরের নোমার্ক বা প্রধান তত্ত্বাবধায়ক এবং উচ্চ মিসরের সকল বাইশটি নোম বা প্রদেশের প্রধান উজির। এছাড়াও তিনি নেক্রোপলিস এবং রাজকীয় সমাধিসৌধের রক্ষণাবেক্ষণের প্রশাসক ছিলেন।

জীবিত এবং মৃত সকল ফারাওয়ের সমাধি দেখাশোনার দায়িত্ব তার উপর ছিল। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল তিনি ফারাও ম্যামোজের সমাধিরও সরকারি স্থপতি ছিলেন।

তবে প্রভু ইনতেফের জন্মগত কোনো সৃষ্টিশীল প্রতিভা ছিল না। তিনি বরং ধ্বংসাত্বক কাজে পটু ছিলেন। তিনি একটি গরুবাছুরের খোয়াড় কিংবা কবুতরের খোপও তৈরি করতে পারতেন কিনা আমার সন্দেহ। তিনি শুধু রাজকীয় সেবায় সময় কাটাতেন আর কঠিন যে কাজগুলো নিজে করতে পারতেন না সেগুলো আমার কাঁধে চাপিয়ে দিতেন।

প্রভু ইনতেফের সাথে আমার তেমন সুখকর স্মৃতি ছিল না। তার অধীনস্থ লোকদের একজন গোলাম আমার উপর খোঁজা করার ছুরিটা চালিয়েছিল। সে ছিল একজন নিষ্ঠুর, নির্দয় মানুষ। তবে শেষপর্যন্ত অবশ্য আমি তার সাথে শেষ বোঝাঁপড়াটা করতে পেরেছি।

তবে সেই খুশির দিনটির অনেক আগে আমিই ফারাও ম্যামোজের চমৎকার সমাধিসৌধের সমস্ত কক্ষ, গুহাপথ আর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া ঘরের নকশা করেছিলাম। তারপর এই বিশাল সৌধ নির্মাণ কাজে শ্রম দেওয়ার জন্য যেসব নির্মাতা, রাজমিস্ত্রি, শিল্পী আর কারিগরদের ডাকা হয়েছিল, তাদের সকলের কাজ আমি তত্ত্বাবধান করেছিলাম।

ফারাও ম্যামোজের বিশালাকায় পাথরের শবাধারটি একটি মাত্র গ্রানাইট পাথরখণ্ড কেটে তৈরি করা হয়েছিল। এর ভেতরে অনায়াসে একটির মাঝে আরেকটি, এভাবে মোট সাতটি রূপার কফিন রাখার জায়গা ছিল। সবচেয়ে মাঝখানের কফিনে ফারাওয়ের মমিকরা দেহটি রাখার কথা ছিল। এতে পুরো জিনিসটা অনেক ভারি আর বড় হয়ে যেত। এই জিনিসটি যথাযথ শ্রদ্ধার সাথে নীল নদীর তীরে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া মন্দির থেকে দুইশো গজ দূরত্বে রাজার উপত্যকার পাদদেশে সমাধিসৌধে নেওয়ার কথা ছিল।

এই স্থানান্তরের কাজটি করার জন্য আমি নীল নদীর তীর থেকে কালো মাটির সমতল জমির উপর দিয়ে তীরের মতো সোজা একটা খাল খনন করেছিলাম। ফারাওয়ের বজরা চলার মত খালটা যথেষ্ট চওড়া আর গভীর করা হয়েছিল।

দুর্ভাগ্যবশত হাইকসোরা আমাদেরকে আমাদের দেশ থেকে বিতাড়িত করার আগে ফারাও ম্যামোজ একদিনের জন্যও তার সমাধিতে শুয়ে থাকতে পারেন নি। যখন আমরা দেশ ত্যাগ করে দীর্ঘ যাত্রা শুরু করেছিলাম, তখন তার স্ত্রী রানি লসট্রিস আমাদেরকে ফারাওয়ের মমিকরা দেহটি সাথে নিয়ে যেতে নির্দেশ দিয়েছিলেন।

এর অনেক বছর পর রানি লসট্রিস আরও দক্ষিণে কয়েক হাজার লিগ দূরে জঙ্গল এলাকা নুবিয়ানে আরেকটি সমাধিসৌধ নির্মাণের নকশা বানাতে নির্দেশ দিলেন। এখন সেখানেই ম্যামোজ শায়িত রয়েছেন।

এতোবছর যাবত রাজার উপত্যকায় মূল সমাধিসৌধটি শূন্য পড়ে রয়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হল, আমার নকশা অনুযায়ী নীল নদীর তীরে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া মন্দির থেকে রাজকীয় সমাধি পর্যন্ত যে খালটা আমি খনন করিয়েছিলাম, তা এখনও চমৎকার অবস্থায় রয়েছে। আমি এটা জানতাম, কেননা মাত্র কিছুদিন আগে আমি আমার ছোট্ট দুই রাজকুমারিকে তাদের বাবার শূন্য সমাধি দেখাবার জন্য নদীর তীরে বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিলাম।

এতোগুলো বছর কেটে যাবার পরও আমি ম্যামোজের শবাধারবাহী বজরার সঠিক আয়তন মনে করতে পেরেছি। আমার স্মৃতিশক্তি অত্যন্ত প্রখর। আমি কখনও কোনো বিষয়, সংখ্যা কিংবা মুখ ভুলি না।

এবার আমি মিনোয়ান সম্পদবাহী তিনতলা জাহাজ তিনটির আয়তন পরিমাপ করলাম। তারপর জারাসকে বললাম জাহাজগুলো শান্ত পানিতে নোঙর করতে। এরপর সাঁতার কেটে জাহাজের তলায় গিয়ে অনুমান করলাম খোলে মূল্যবান সম্পদের ওজনসহ জাহাজটির কতটুকু পানি প্রয়োজন পড়বে। এই পরিমাপটি এক জাহাজ থেকে অন্য জাহাজে একেক রকম হল।

সবকিছু দেখার পর খুশিমনে পানির উপরে ভেসে উঠলাম। এখন আমি ফারাও ম্যামোজের শববাহী বজরার সাথে আমাদের জাহাজের আয়তন মেলাতে পারবো। এই খালে আমাদের সবচেয়ে বড় জাহাজটি চলাচলের সময় দুই পাশে দশ কিউবিট জায়গা আর তলদেশে পনেরো কিউবিট জায়গা খালি রাখতে পারবে। আরও স্বস্তিদায়ক ব্যাপারটা হল এতো বছর ধরে আমি খালের দুইপাশে গ্র্যানাইট পাথরখণ্ড লাগিয়েছিলাম আর খালে সবসময় নীল নদীর পানি প্রবাহ নিশ্চিত করার জন্য একধরনের জলকপাট আর পানি উত্তোলনের জন্য সেচযন্ত্র-শাডুফ তৈরি করেছিলাম।

আমার অভিজ্ঞতা থেকে আমি জেনেছি, যদি তুমি পরিপূর্ণ শ্রদ্ধার সাথে দেবতাকে সম্মান করে তার কাছে কিছু আশা কর, তাহলে তুমি নিশ্চয়ই তার প্রতিদান পেতে পার। যদিও দেবতারা অনেকসময় খামখেয়ালি হন, তবে এবার তারা ঠিকই আমাকে মনে রেখেছেন।

ঠিক করলাম সূর্যাস্তের পর খালে ঢুকবো। অন্ধকারে ফারাও ম্যামোজের অন্ত্যেষ্টি মন্দিরের নিচে পাথরের জেটিতে জাহাজ বেঁধে রাখলাম। অবশ্য ম্যামোজ এখন একজন দেবতা আর তার নিজের মন্দিরও নীল নদীর তীরে রয়েছে। এখান থেকে হেঁটেই জেটিতে পৌঁছা যায়।

মন্দিরটা বেশি বড় নয়। যখন আমরা থিবসের যুদ্ধে হাইকসোদের পরাজিত করে ফিরে এসেছিলাম তখন রানি লসট্রিস তার প্রয়াত স্বামীর স্মৃতির সম্মানে একটি মন্দির নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন। তার উদ্দেশ্য ছিল তার স্বামীর প্রতি সম্মান দেখান আর নির্বাসন থেকে দেশে ফেরার জন্য দেবতার প্রতি ধন্যবাদ জ্ঞাপন করা।

নিশ্চিতভাবে আমাকেই তিনি এই মন্দির নির্মাণের আহ্বান জানালেন। তার ইচ্ছা ছিল এমন একটি বিশাল আর জমকালো মন্দির নির্মাণ করা, যা মিসরের আর সবকিছুকে ম্লান করে দেবে। তিনি চেয়েছিলেন মন্দিরটিতে চারশো পুরোহিত থাকবে, তবে আমি অনেক বলে তাকে সংখ্যাটি কেবল চারজন পুরোহিতে নামিয়ে এনেছিলাম।

এখন আমি আর জারাস কাউকে না জানিয়ে নদী থেকে মন্দিরের পেছন দিক দিয়ে চক্রনাভি বা মূল অংশে ঢুকলাম। সেখানে পৌঁছে আমরা আবিষ্কার করলাম সেই চার পুরোহিত পাম থেকে তৈরি সস্তা মদ পান করে একটু মাতাল হয়ে আছেন। ওদের সাথে আরও দুইজন অল্পবয়সী নারীও ছিলেন। ওরা সবাই নগ্ন হয়ে একসাথে কাদামাটির ইটের তৈরি মেঝেতে গোল হয়ে হাঁটছিলেন আর পুরোহিতরা হাততালি দিয়ে জোরে জোরে কিছু মন্ত্রোচ্চারণের মতো চিৎকার করছিলেন।

আমরা পৌঁছার কিছুক্ষণ পর তারা আমাদের উপস্থিতি টের পেলেন, মেয়েদুটো দ্রুত দেবতা ম্যামোজের মূর্তির পেছনের গোপন দরজা দিয়ে ছুটে অদৃশ্য হয়ে গেল। এরপর আর তাদের আমরা দেখিনি।

ম্যামাজের এই চার পুরোহিতের আমার প্রতি যথেষ্ট ভক্তি রয়েছে। রানি লসট্রিসের মৃত্যুর আমি তাদের মাসিক মাসোহারা নিশ্চিত রেখেছিলাম। ওরা চারজনই আমার সামনে হাঁটুগেড়ে বসে আমাকে ভক্তিশ্রদ্ধা জানিয়ে দেবতার নামে আমার মাথায় আশীর্বাদ বর্ষণ করলো।

ওদের হাঁটু গেড়ে বসে থাকা অবস্থায় আমি রাজকীয় বাজপাখির সিলমোহরটা বের করে ওদের দেখালাম। এটা দেখে ওদের মুখে আর কথা জোগাল না। প্রধান পুরোহিত হামাগুড়ি দিয়ে সামনে এগিয়ে আমার পায়ে চুমু খাওয়ার চেষ্টা করলো। আমি পিছিয়ে গেলাম আর জারাস তাকে আর সামনে এগোতে দিল না।

তারপর আমি ঐ চার পুরোহিতকে সংক্ষিপ্তভাবে আর কঠোরভাবে বললাম ফারাও ত্যামোস ছাড়া আর কাউকেই যেন ঘুণাক্ষরেও এই তিনতলা ট্রাইরেম জাহাজ সম্পর্কে কিছু না বলা হয়। এছাড়া সারা দিনরাত মন্দিরে, শূন্য সমাধিসৌধ আর খালের দুইপাশে সশস্ত্র প্রহরা থাকবে। এরপর থেকে এই পবিত্র স্থানে কেবল ক্যাপ্টেন জারাসের অধীনস্থ লোকেরা ঢুকতে পারবে। আর একই প্রহরীরা নিশ্চিত করবে যেন এই চার পুরোহিত এই জায়গার মধ্যেই নিজেদেরকে অবরুদ্ধ করে রাখে।

পরিশেষে আমি প্রধান পুরোহিতকে সমাধি আর অন্যান্য স্থাপনায় ঢোকবার সমস্ত চাবির গোছা আমার হাতে দিতে নির্দেশ দিলাম। তারপর আমি আর জারাস জাহাজে ফিরে গেলাম।

রাজার উপত্যকার প্রবেশ পথ থেকে নদীর তীর পর্যন্ত জায়গাটি বিশ হাত ঢালু ছিল। তবে আমাদের প্রত্যেকটা জাহাজ এই উচ্চতায় তুলতে চারটি আলাদা জলকপাট বা গ্লুইস গেট প্রয়োজন। তারপরই এগুলোকে সমাধিসৌধে আনা যাবে। আমরা প্রথম জাহাজটি দাঁড় বেয়ে মন্দিরের নিচে জলকপাটের মধ্যে এনে এর দরজাটা বন্ধ করে দিলাম। এই জলাধারের মধ্যে পানির উচ্চতা বাইরের খালের চেয়ে পাঁচ হাত নিচু ছিল।

আমি আমার তিন জাহাজের অধিনায়কদের দেখালাম কীভাবে মাটির কপাটটি খুলতে হয়। উপরের খাল থেকে নিচের জলাধারে পানি নেমে ধীরে ধীরে বিশাল জাহাজটিকে উপরের জলাধারের সমান উচ্চতায় তুলে আনলো। কপাটটি বন্ধ হয়ে যাবার পর গুণ টেনে জাহাজটিকে পরবর্তী জলাধার পর্যন্ত নিয়ে যাবার জন্য আমাদের পঞ্চাশজন মানুষ অপেক্ষা করছিল। এর পেছনে দ্বিতীয় জাহাজটি উপরে তোলার জন্য একই প্রক্রিয়ায় কাজ শুরু হল।

এ-ধরনের কোনোকিছু আমার লোকেরা কখনও দেখেনি, অবশ্য এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই, কেননা এই পদ্ধতি আমিই আবিষ্কার করেছিলাম। সারা পৃথিবীতে এরকম পদ্ধতি আরেকটিও নেই। ওরা এতো অবাক হয়ে গিয়েছিল যে, ওদের মনে হয়েছিল এটা একধরনের জাদুকরী ব্যাপার।

সৌভাগ্যবশত এই কাজের জন্য আমার কাছে দুইশো মানুষ ছিল। মিনোয়ানরা যে ক্রীতদাসদের শিকলে বেধে নিচের ডেকে রেখেছিল ওরাও ছিল এদের মধ্যে। অবশ্য ওরা এখন মুক্ত মানুষ, তবে ওরা কৃতজ্ঞতাবশত সব কাজ করে যাচ্ছিল।

জাহাজটি উপরে তোলার জন্য উপরের জলাধার থেকে যে পানি সরানো হয়েছিল তা আবার ভর্তি করার প্রয়োজন ছিল। কয়েকটা সেচ করার শাদুফ যন্ত্র দিয়ে আমি নদী থেকে নতুন পানি পাম্প করে তোলার ব্যবস্থা করলাম। এগুলো ছিল দুই বিপরীত প্রান্তে ওজন রাখা বাকেট শিকল বা কপিকল, যা দুইজন মানুষ চালাতে পারে। এটি একটি পরিশ্রম সাধ্য কাজ যা, প্রত্যেক জাহাজের জন্য চারবার করে করতে হয়েছিল।

প্রথম জলকপাটের মধ্যে তোলার আগে প্রত্যেক জাহাজের পাল আর মাস্তুল উপরের ডেকে সমান করে বিছিয়ে রাখা হয়েছিল। তারপর জাহাজটি নলখাগড়া দিয়ে বুনা মাদুর দিয়ে ঢেকে ফেলা হয়েছিল, যাতে দেখে মনে হচ্ছিল এটা একটি আকৃতিহীন ময়লার স্তূপ। পরদিন সকালে থিবসের লোকজন ঘুম থেকে উঠে নদীর এপারে তাকালে অস্বাভাবিক তেমন কিছু দেখতে পাবে না। তিনটি তিনতলা জাহাজই অদৃশ্য হয়ে গেছে, যেন কখনও এগুলোর অস্তিত্ব ছিল না।

পরদিন সূর্যোদয়ের সময় আমরা সমতল ভূমির উপর দিয়ে জাহাজগুলো টেনে নিয়ে ম্যামোজের সমাধিসৌধের প্রবেশ পথের কাছে এসে বাঁধলাম। লোকগুলো এত পরিশ্রমের পর ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল, তাই আমি জারাসকে নির্দেশ দিলাম ওদের সবার খাবারের পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়ে আরও কিছু শুকনো মাছ, বিয়ার আর রুটি দিতে আর দিনের বাকি গরম সময়টা বিশ্রাম নিতে বললাম।

পায়ে চলার পথ দিয়ে হেঁটে আমি মন্দিরে ঢুকলাম। মনে হল পুরোহিতরা গত সন্ধ্যার কষ্টসাধ্য যাবতীয় ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের ধকল কাটিয়ে উঠেছে। মন্দিরের ডিঙিতে করে ওরা আমাকে নদীর উপর দিয়ে নিয়ে চললো। আমার অভিযানের সফলতার খবর দেবার জন্য আমি ফারাওয়ের কাছে যাচ্ছি।

এই দায়িত্বটি আমি খুবই পছন্দ করি। ফারাওয়ের প্রতি আমার পরম ভক্তি ছিল, তবে এর চেয়েও বেশি ছিল তার মা লসট্রিসের প্রতি। তবে এইটুকুই শুধু বলবো যে, রাজপরিবারের সকল সদস্যের প্রতি আমার ভক্তি ছিল।

আমার অনুগত পুরোহিতরা আমাকে শহরের বাজারের কাছে নদীর তীরে সিঁড়ির কাছে নামিয়ে দিল। সকাল হলেও বাজারে লোক সমাগম যথেষ্ট ছিল। সরু গলি দিয়ে প্রাসাদের ফটকের দিকে হেঁটে চললাম। ভাঙাচোরা শিরস্ত্রাণ আর মুখ ঢাকা ময়লা মুখোশের কারণে কেউ আমাকে চিনতে পারেনি।

প্রাসাদের ফটকে পৌঁছার পর মুখ থেকে ছদ্মবেশ সরাতেই প্রাসাদ রক্ষীদলের অধিনায়ক সাথে সাথে আমাকে চিনতে পেরে শ্রদ্ধার সাথে অভিবাদন জানালো।

আমি তাকে বললাম, আমাকে এখনি ফারাওয়ের সাথে দেখা করতে হবে। একজন বার্তাবাহক পাঠিয়ে তাকে জানাও আমি তার সাথে দেখা করার জন্য আনন্দের সাথে অপেক্ষা করছি।

ক্ষমা করুণ প্রভু তায়তা। ফারাও থিবসে নেই। খুব শিগ্রি ফিরে আসবেন বলে মনে হয় না।

আমি মাথা নাড়লাম। একটু হতাশ হলেও খুব একটা অবাক হই নি। জানতাম ফারাও অধিকাংশ সময় উত্তরে হাইকসোদের বিরুদ্ধে অন্তহীন অভিযানে সময় আর শ্রম ব্যয় করেন। তাহলে আমাকে প্রাসাদ সরকার প্রভু এটনের কাছে নিয়ে চল।

এটনের কামরার দরজায় পৌঁছতেই সে ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। তারপর বললো, কী খবর বন্ধু? তোমার অভিযান কেমন হয়েছে?

আমি মুখ অন্ধকার করে বললাম, খবর বেশ গুরুতর। তামিয়াত দুর্গে সর্বাধিরাজ মিনোজের ধনভাণ্ডার লুট হয়েছে। আর রাজা বিওনকে হত্যা করা হয়েছে।

সে আমাকে দুই হাতে ধরে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বললো, তুমি আমার সাথে মজা করছো, তায়তা। যেকোন সৎলোক এটা শুনলেই কেঁদে ফেলবে! এমন জঘন্য কাজটা কে করলো?

আমি একটি হাত তার মুখের সামনে তুলে ধরে বললাম, হায়! একই হাত দুটো কাজই করেছে, এটন। যে হাতটি দেখলে তুমি চিনতে পারবে। সে

ধোকা খাওয়ার মত ভান করে হাতটার দিকে অবাক হয়ে তাকালো। এতোকাল। প্রাসাদ সরকার পদে টিকে থাকতে গেলে একজনকে অবশ্যই পাকা অভিনেতা হতে হয়।

তারপর সে মাথা নাড়তে নাড়তে প্রথমে মৃদুভাবে চুকচুক করলো, তারপর তার খুশির মাত্রা বেড়ে যেতেই হাসিতে ফেটে পড়লো। তার ভুড়ি থেকে শুরু করে শরীরের প্রতিটা অঙ্গ হাসির দমকে কাঁপতে শুরু করলো। তারপর হঠাৎ হাসি থামিয়ে পাশের প্রস্রাবখানায় ঢুকলো। প্রথমে একটু নীরবতা, তারপর জলপ্রপাত থেকে নীলনদের উপর পানির প্রবাহ পড়ার মতো শব্দ শুরু হল। বেশ কিছুক্ষণ এরকম চলার পর এটন ফিরে এলো।

তোমার ভাগ্য ভালো বন্ধু যে, আমি সময়মত প্রস্রাবখানায় পৌঁছতে পেরেছিলাম, আর নয়তো রাজা বিওনের মত তুমিও ডুবে মরতে।

তুমি কীভাবে জানলে যে, বিওন পানিতে ডুবে মরেছে?

তুমি সামনে যা দেখছো, তা ছাড়াও আমার অন্য কান আর চোখ আছে।

এতোই যদি জানো তবে মিনোজের সম্পদ সম্পর্কে কিছু বল?

সে অনুতপ্তভাবে মাথা নেড়ে বললো, এ-সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। তুমি হয়তো জানো।

আমি শুধু জানি যে, তুমি ভুল বলেছিলে।

কী ধরনের ভুল সেটা?

তুমি বলেছিলে এই সম্পদের পরিমাণ এক লাখ হবে, তাই না? সে মাথা নেড়ে সায় দিল।

পরিমাণটা দুঃখজনকভাবে ভুল বলেছিলে।

সে বললো, একথা প্রমাণ করতে পারবে?

আমি তাকে নিশ্চয়তা দিয়ে বললাম, এর চেয়েও ভালো কিছু বলতে পিরবো, এটন। আমি তোমাকে এটি ওজন করতে দেবো। যাইহোক প্রাসাদ ছেড়ে যাওয়ার আগে আমি ফারাওকে একটা বার্তা পাঠাতে চাই।

কামরায় এককোণে রাখা লেখার সরঞ্জামের দিকে দেখিয়ে এটন বললো, তুমি তোমার বার্তাটা লিখে ফেল, সন্ধ্যার আগেই ফারাও তার হাতে এটা পাবেন।

আমার বার্তাটি ছিল ছোট আর সাংকেতিক ভাষায় লেখা। এটনের হাতে বার্তাটা দিয়ে তাকে বললাম, কিছু মনে করো না। প্রায় দুই সপ্তাহ যাবত আমি স্নান করিনি আর পোশাক বদলাইনি। আমাকে এখনি নিজের ঘরে একটু পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হতে হবে।

নিজের ঘরে পৌঁছাবার সাথে সাথে আমি একজন ক্রীতদাসকে রাজকীয় জেনানা মহলে পাঠালাম রাজকুমারিদের কাছে একটা বার্তা পৌঁছাতে।

মাত্র আমি উষ্ণ পানির চৌবাচ্চায় পা দেব, ঠিক তখনই দুই রাজকুমারি মরুর খামসিন ঝড়ের বেগে এসে পৌঁছাল। এই পৃথিবীতে একমাত্র তাদের সামনেই আমি পোশাক না পরা অবস্থায় দাঁড়াই। আর আমার ক্রীতদাসদের সামনে, ওরা অবশ্য আমার মতোই খোঁজা।

এখন তেহুতি আর বেকাথা আমার মার্বেল পাথরের স্নানের চৌবাচ্চার কিনারায় পা ঝুলিয়ে বসলো। বেকাথা তার ছোট্ট সুন্দর পাদুটো দোলাতে দোলাতে অনুযোগ করলো, তুমি যাওয়ার পর সবকিছু একেঘেয়ে লাগছিল। কী এমন তুমি করছিলে যে এতো দেরি হল ফিরতে তোমার? এখন কথা দাও, এরপর কোথাও গেলে আমাদের সাথে নিয়ে যাবে। এই কঠিন প্রতিজ্ঞা এড়াতে আমি গরম পানি মাথায় ঢালতে শুরু করলাম।

এবার তেহুতি কথা শুরু করলো, আমাদের জন্য কোনো উপহার এনেছো তায়তা? নাকি আমাদের কথা ভুলে গিয়েছিলে? বড়বোন হিসেবে খাঁটি জিনিসের মূল্য সে ঠিকই বুঝে।

আমি উত্তর দিলাম, অবশ্যই এনেছি। কী করে আমি আমার ছোট্ট দুই রাজকুমারির কথা ভুলে যেতে পারি। আমার কথা শুনে দুজনেই খুশিতে হাততালি দিয়ে উঠলো।

বিকাথা কিচমিচ করে বললো, দেখাও।

যাও পাশের কামরায় কৌচের উপর থেকে আমার ব্যাগটা নিয়ে এসো। বেকাথা একছুটে চলে গেল, তারপর নাচতে নাচতে চামড়ার ব্যাগটা হাতে ঝুলাতে বুলাতে ফিরে এলো।

তারপর ব্যাগটা কোলে নিয়ে মার্বেলের মেঝেতে আসন গেড়ে বসলো।

আমি বললাম, খোল! আমার রাজকুমারিদের কথা মনে রেখেই আমি তামিয়াত দুর্গে বন্দী মিনোয়ান সেনাকর্মকর্তাদের কাছ থেকে পাওয়া অলংকার থেকে দুটি অলংকার বেছে নিয়েছিলাম।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, দেখোত লাল কাপড়ে মোড়া একটা জিনিস আছে কি না?

হ্যাঁ, আছে তায়তা, এটা কি আমার? লালটা কি আমার জন্য এনেছ?

হ্যাঁ, অবশ্যই তোমার জন্য।

ছোট কাপড়ের পুটলিটা খুলতে গিয়ে উত্তেজনায় ওর হাত কাঁপছিল। সোনালি হারটা তুলে ধরতেই তার চোখ খুশিতে ঝিকমিক করে উঠলো। ফিসফিস করে সে বলে উঠলো, এতো সুন্দর জিনিস আমি কখনও দেখিনি।

হারটি থেকে ছোট ছোট দুটি মূর্তি ঝুলছে। ছোট হলেও মূর্তিদুটোর খুঁটিনাটি সবকিছু পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে। বড়টি ছিল একটি আক্ৰমণদ্যোত ষাঁড়ের মূর্তি। শিং দুটো বাঁকা করে আক্রমণের ভঙ্গিতে মাথা নোয়ান। সবুজ পাথরের ছোট ছোট দুটো চোখ। বঁড়টি একটি সুন্দর মেয়ের মূর্তিকে আক্রমণ করছিল। ভয়ংকর শিংদুটোর আওতার বাইরে মেয়েটি নাচছে। মাথায় ফুলের মালা আর বুকে দুটো লাল রুবি। মাথা পেছনে হেলিয়ে মেয়েটি হাসছিল।

হারটা দুই হাতে দোলাতে দোলাতে বেকাথা বললো, মেয়েটি এতো দ্রুত ছুটছে যে ষাঁড়টি কখনও তাকে ধরতে পারবে না।

ঠিক বলেছ তুমি। ভয়ঙ্কর বিপদের বিপরীতে মেয়েটি হল সৌন্দৰ্য্য। তুমি এটা পরলে বিপদ তোমাকে ছুঁতে পারবে না। এটা তোমাকে সবধরনের বিপদ থেকে রক্ষা করবে। ওর হাত থেকে হারটা নিয়ে ওর গলায় পরিয়ে পেছনের হুকটা লাগিয়ে দিলাম। সে নিচের দিকে তাকিয়ে কাঁধে ঝাঁকুনি দিতেই মূর্তিদুটো নেচে উঠলো। হেসে উঠতেই তাকে আরও সুন্দর দেখালো।

তেহুতি এতোক্ষণ ধৈর্য ধরে চুপ করে বসেছিল। আমি একটু অপরাধবোধ করে তার দিকে ফিরে বললাম, রাজকুমারি, তোমার উপহারটা ঐ নীল কাপড়ে মোড়ানো আছে।

সাবধানে কাপড়ের ভাঁজটা খুলতেই একটা আংটি ঝিকমিক করে উঠলো। সে দম আটকে চেঁচিয়ে উঠলো। এতো উজ্জ্বল জিনিস আমি কখনও দেখিনি।

আমি বললাম, এটা তোমার মধ্যমায় পর।

এটা খুব বড়। খুলে যায়।

তার কারণ এটা একটা বিশেষ ধরনের পাথর। তুমি এটা কোনো পুরুষকে দেখাবে না, শুধু...

শুধু কি?

শুধু যদি তুমি চাও সে তোমার প্রেমে পড়ক। আর নয়তো এটা তোমার হাতের তালুতে লুকিয়ে রাখবে। মনে রেখো এর জাদু শুধু একবারই কাজে আসবে। কাজেই খুব সাবধানে এটা কাউকে দেখাবে।

সে আঙুল দিয়ে আংটিটা শক্ত করে চেপে ধরে রাখলো। তারপর দৃঢ়কণ্ঠে উত্তর দিল, আমি চাই না কোনো পুরুষ আমাকে ভালোবাসুক।

কেন?

কারণ, ওরা শরীরে একটা বাচ্চা ঢুকিয়ে দিতে চেষ্টা করে। আর একবার বাচ্চাটা ভেতরে ঢুকলে আর বের হতে চায় না। আমি হেরেমে অনেক মহিলাকে চিৎকার করে আর্তনাদ করতে শুনেছি। আমি এরকম করতে চাই না।

আমি মৃদু হেসে বললাম, একদিন তুমি তোমার মত বদলাবে। তবে এই পাথরের আরও কিছু গুণের কারণে এটা বিশেষ ধরনের হয়েছে। বেকাথা বলে উঠলো, বল, কী এমন বিশেষ গুণ আছে এটার তায়তা?

একটা গুণ হল এটা পৃথিবীর সবচেয়ে শক্ত জিনিস। কোনো কিছু দিয়ে এটা কাটা যায় না, আর সবচেয়ে ধারালো ব্রোঞ্জের ড্যাগার দিয়েও এটার গায়ে আঁচড় কাটা যায় না। এজন্য এটাকে বলা হয় হীরা–সবচেয়ে কঠিন জিনিস। পানিতে ভিজে না। তবে যে মেয়ে এটা পরবে তার গায়ে এটা জাদুর মতো লেগে থাকবে।

সন্দেহের সুরে তেহুতি বললো, তোমার কথা আমি বিশ্বাস করি না তায়তা। এটা তোমার বানানো আরেকটা গল্প।

ঠিক আছে, দেখো আমার কথা ঠিক হয় কি না। তবে মনে রেখো, যদি তুমি কাউকে সত্যিকার ভালোবাস আর চাও যে সেও তোমাকে সারাজীবন ভালোবাসুক, তাকে ছাড়া আর কোনো পুরুষকে এটা দেখাবে না। জানি না কেন তাকে একথা বললাম, তবে মেয়েদুটো আমার কাছে গল্প শুনতে পছন্দ করে আর আমি কখনও তাদের হতাশ করি না।

টাব থেকে উঠে গা মুছার জন্য আমার প্রধান দাস রুস্তিকে ডেকে একটা তোয়ালে আনতে বললাম।

এবার তেহুতি অনুযোগ করে বললো, তুমি আবার চলে যাচ্ছো তায়তা। এখন সে বেশ বড় হয়েছে আর একজন সাবালিকার মতোই ভেবেচিন্তে কথা বলতে শিখেছে। মাত্র এক ঘন্টার জন্য এসে আবার চলে যাচ্ছ। এবার হয়তো চিরদিনের জন্য চলে যাচ্ছ। তার চোখে পানি চলে এসেছে।

আমি তোয়ালেটা ফেলে তাকে জড়িয়ে ধরে বললাম, না! না! এটা সত্য নয়। আমি শুধু পূর্ব তীরে তোমার বাবার শূন্য সমাধি পর্যন্ত যাচ্ছি।

বেকাথা বললো, যদি এ কথা সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে আমাদেরকেও সাথে নিয়ে চল।

কথাটা শুনে ভেবে দেখলাম প্রস্তাবটা মন্দ নয়। ওদের মতো আমারও ভালো লাগবে।

ছদ্ম অনিচ্ছা দেখিয়ে বলো, একটা সমস্যা আছে। আমরা খুব গোপন একটা কাজ করতে যাচ্ছি। তোমাদেরকে কথা দিতে হবে যা দেখবে তা কাউকে বলতে পারবে না।

কথাটা শুনে বেকাথার দুচোখ জ্বলজ্বল করে উঠলো, সে বললো, গোপন ব্যাপার! সমস্ত দেবতার নামে আমি শপথ করছি তায়তা, কাউকে কিছু বলবো না।

.

দুই রাজকুমারি, এটন আর আমি যখন ফারাও ম্যামোজের সমাধির ফটকের কাছে পৌঁছলাম, তখনও রত্নবোঝাই জাহাজ তিনটি এর কাছেই জেটিতে বাঁধা ছিল।

আমার অনুপস্থিতিতে জারাস ওর লোকজন নিয়ে কাজ করে চলছিল। আশেপাশের পাহাড়গুলো থেকে যেন আমাদেরকে না দেখা যায়, সেজন্য ওরা সমাধির চারপাশ ঘিরে নলখাগড়ার বেড়ার পর্দা দিয়ে ঢেকে রেখেছিল। আমার ইচ্ছা ছিল রাত জেগে সমস্ত জাহাজগুলো থেকে রতুগুলো নামিয়ে ফেলা। রাতের অন্ধকারের আড়ালে হাইকসো গুপ্তচরেরা এসে উঁকিঝুঁকি দিতে পারে। তাছাড়া আমাদেরকে মশাল জ্বালিয়ে কাজ করতে হবে, কাজেই গোপনীয়তা রক্ষার জন্য পর্দা খুবই জরুরী।

তামিয়াতে আমি যে অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলাম, তা কাজে লাগিয়ে এখনকার মাল খালাসের বিষয়টা পরিকল্পনা করলাম। দিলবার আর তার লোকজনকে প্রথম জাহাজের ডেক থেকে কাঠের তক্তা খুলে বারকোশের মত কাঠামো বানাতে বললাম। আট হাত চওড়া এই কাঠামোটি জাহাজের খোলের মুখে এঁটে যাবে। তারপর প্রতিটি জাহাজের খোলের মুখের ঠিক উপরের ডেকে তেপায়া টুল আর কপিকল স্থাপন করলাম। সেখান থেকে আমার লোকেরা ভারি কাঠের বারকোশগুলো নিচে নামিয়ে জাহাজের খোলে ঢুকালো। আর খোলের ভেতরে থাকা অন্য দল সিন্দুকগুলো কাঠের বারকোশের উপর সাজিয়ে রাখলো।

বিশটা করে সিন্দুক এভাবে খোল থেকে বের করে উপরে ডেকে তোলা হল, তারপর সেখান থেকে ঝুলিয়ে জেটিতে নামিয়ে রাখা হল।

তেহুতি জিজ্ঞেস করলো, এই সিন্দুকগুলোতে কী আছে তায়তা? আমি নাকে হাত রেখে খুব গোপনীয়তার ভাব দেখিয়ে বললাম, এটাই সবচেয়ে বড় রহস্য। তবে শিঘ্রই আমি তোমাদেরকে দেখাবো কী আছে এগুলোর ভেতরে। আর একটু ধৈর্য ধরে অপেক্ষা কর।

বেকাথা আমাকে মনে করিয়ে দিল, আমি কিন্তু বেশিক্ষণ ধৈর্য ধরতে পারবো না।

সার বেঁধে থাকা অনেক মানুষ সিন্দুকগুলো বারকোশ থেকে তুলে নিল। জেটি থেকে শুরু করে মানুষের সারি সমাধির প্রবেশ পথ দিয়ে চারধাপ সিঁড়ি নেমে রং করা সুসজ্জিত সুড়ঙ্গে ঢুকলো, তারপর বিশাল তিনটি কামরা পার হয়ে চারটি ধনাগারে পৌঁছলো। ফারাওয়ের শূন্য সমাধির চারপাশ ঘিরে ধনাগারগুলো স্থাপন করা হয়েছিল। বিশাল একটি পাহাড় কেটে আমি বিশ বছর ধরে দুই হাজার শ্রমিক লাগিয়ে এই প্রশস্ত দালানটি নির্মাণ করেছিলাম। কাজটি করতে পেরেছি বলে আমি এখনও গর্ববোধ করি।

দুই রাজকুমারিকে উদ্দেশ্য করে আমি বললাম, এই যে মেয়েরা, তোমরা আমাকে আর এটন চাচাকে সাহায্য করতে পারো। তোমরা দুজনেই গুণতে আর লিখতে পারো, যা এই বোকা লোকগুলোর একশো জনের মধ্যে একজনও পারে কি না সন্দেহ। কথাটা বলে আমি মাথা ঝাঁকিয়ে কাজ করা সারিবদ্ধ অর্ধনগ্ন লোকগুলোর দিকে দেখালাম।

এবার দুই বালিকাই হিসাব রক্ষকের কাজে লেগে পড়লো, যেন এটা একটা খেলা।

আমার নির্দেশ অনুযায়ী জারাস প্রথম ধনাগারে দুটো ভারী দাড়িপাল্লা স্থাপন করেছিল। আমি আর এটন এই দুটো পাল্লার ব্যবস্থাপনায় বসলাম। একটা একটা সিন্দুক পাল্লায় ঝুলাতেই আমি ওজনটা উচ্চারণ করতেই মেয়েরা লিখে রাখতে শুরু করলো। বেকাথা এটনের সাথে আর তেহুতি আমার সহকারী হিসেবে কাজ করতে লাগলো। ওরা একটা একটা সিন্দুকের ওজন একটা লম্বা প্যাপিরাস কাগজে লিখতে লাগলো আর দশটা সিন্দুকের ওজন হতেই সবগুলোর ওজন যোগ করে লিখতে লাগলো।

প্রথম কোষাগারে মোট ২৩৩ লাখ খাঁটি রূপা রাখা হল। এরপর আমি লোকজনদের একঘন্টা বিশ্রাম নিয়ে খাওয়াদাওয়া সেরে নিতে উপরে পাঠিয়ে দিলাম। আমরা একা হবার পর আমি আমার প্রতিজ্ঞামতো মেয়েদেরকে সিন্দুকের ভেতরে যে ধনরত্ন আছে তা দেখালাম। একটা সিন্দুকের ঢাকনা খুলে একটা রূপার পিণ্ড দেখার জন্য ওদের হাতে তুলে দিলাম।

বেকাথা ওরা গলার হারটায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো, এটা আমার গলার হারের মত সুন্দর নয়।

চারপাশের সিন্দুকগুলোর দিকে তাকিয়ে তেহুতি জিজ্ঞেস করলো, এগুলো সব তোমার তায়তা?

আমি গম্ভীরভাবে উত্তর দিলাম, এগুলো সব ফারাওয়ের। আমার কথা শুনে সে মাথা নাড়লো। তারপর চারপাশে চোখ বুলিয়ে পরিমাণটা আন্দাজ করতে লাগলো। গণনা শেষ হওয়ার পর তার ঠোঁটে মৃদ হাসি দেখা গেল। তারপর সে বললো, আমরা তোমার কাজে খুবই খুশি তায়তা!

.

লোকজন আবার ফিরে এলে আবার ওদেরকে কাজে লাগালাম। ওরা

দাঁড়িপাল্লাটা দ্বিতীয় কোষাগারে নিয়ে চললো। এটা আগেরটার চেয়ে একটু ছোট, এতে আমরা আরও ২১৬ লাখ রূপা রাখলাম।

এমন সময় জারাস জেটি থেকে ফিরে এসে জানাল প্রথম দুটি তিনতলা ট্রাইরেম জাহাজের মাল সম্পূর্ণ খালাস করা হয়ে গেছে। এখন কেবল শেষ জাহাজে কিছু রূপা রয়ে গেছে।

সে একটু সতর্কসুরে বললো, ভোর হয়ে আসছে তায়তা। লোকজন সবাই ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। আসলে কাজ করতে করতে আমার খেয়ালই ছিল না যে কখন রাত শেষ হয়ে এসেছে। আমিও ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম, তবে অধিকাংশ লোকের তুলনায় আমার কর্মক্ষমতা অনেক বেশি ছিল।

তোমরা সবাই বেশ ভালো কাজ করেছ জারাস। তবে আমি তোমাদেরকে আরেকটু থাকতে বলবো। এখন জেটিতে গিয়ে দেখতে চাই আর কতটুকু কাজ বাকি আছে।

আর তখনই আমি একটা মারাত্মক ভুল করে ফেললাম।

পেছন ফিরে দেখলাম তেহুতি টুলে বসে মাথা নুইয়ে প্যাপিরাস কাগজ নিয়ে হিসেবের কাজ করছিল। একমাথা সোনালি চুল ঢেউয়ের মত নিচে নেমে তার মুখ ঢেকে ফেলেছিল। কাজের চাপে সে চুল আঁচড়াবারও সময় পায় নি।

তাকে বললাম, তেহুতি, তুমি একজন ক্রীতদাসির মতো অনেক পরিশ্রম করেছ। এখন আমার সাথে উপরে চল। রাতের শীতল বাতাসে একটু সতেজ হয়ে নেবে।

তেহুতি উঠে দাঁড়াল। মাথা ঝাঁকিয়ে মুখ থেকে চুল সরিয়ে জারাসের দিকে তাকাল। জারাসও তার দিকে তাকাল।

মশালের আলোয় আমি দেখলাম তেহুতির সবুজ চোখের মনিদুটো বড় হয়ে উঠেছে। আর একই সাথে শুনতে পেলাম অন্ধকারের দেবতার হাসি।

ওরা একজোড়া মার্বেল পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইল।

আমি তেতির চোখ দিয়ে জারাসের দিকে তাকালাম। যদিও আমি পুরুষের চেয়ে একজন নারীর সৌন্দর্য্যের সঠিক পরিমাপ করতে পারি, তবে আজ প্রথম লক্ষ্য করলাম যে, জারাস সাধারণের চেয়ে অনন্য। তার বংশ পরিচয় তেমন আহামরি না হলেও তার চতুর্দিক ঘিরে একধরনের কর্তৃত্বব্যঞ্জক আভা রয়েছে। তার ভাবভঙ্গি এবং আচরণ অভিজাত শ্রেণীর।

আমি জানি তার বাবা থিবসের একজন বণিক, নিজ প্রচেষ্টায় বিশাল ভাগ্য গড়ে তুলেছেন। ছেলেকে মানুষ করতে যথাসাধ্য করেছেন। জারাস বুদ্ধিমান। এবং রসজ্ঞান সম্পন্ন। একজন ভালো সৈনিক। তারপরও তার বংশ পরিচয়ের কারণে সে ত্যামোস রাজবংশের একজন রাজকুমারির সমকক্ষ হতে পারে না। যাইহোক ফারাও সিদ্ধান্ত নেবেন কে হবে রাজকুমারির উপযুক্ত পাত্র, তবে

আমার কাছ থেকে অবশ্যই এ বিষয়ে উপদেশ নেবেন।

অতিদ্রুত আমি ওদের দুজনের মাঝে দাঁড়িয়ে তাদের চোখাচোখি হওয়ার সুযোগটা ভেঙে দিলাম। তেহুতি এমনভাবে আমার দিকে তাকাল যেন আমি একজন আগন্তুক, যাকে সে আগে কখনও দেখেনি। তার হাত ছুঁতেই সে কেঁপে উঠে এবার আমার চোখে চোখ রাখলো।

আমি বললাম, এসো আমার সাথে তেহুতি। তারপর তার মুখের দিকে লক্ষ্য করলাম, সে অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে আমাকে বললো,

হ্যাঁ, অবশ্যই যাবো তায়তা। ক্ষমা কর, আমি একটু অন্যমনষ্ক হয়ে পড়েছিলাম। চল যাই।

আমি পথ দেখিয়ে তাকে কোষাগার থেকে বের করে আনলাম, জারাসও অনুসরণ করলো। তার প্রতিটি পদক্ষেপে মনে হচ্ছিল যেন, সে একটা ঘোরের মধ্যে রয়েছে। আমি তাকে ভালোকরেই জানতাম, তবে তার এরকম অবস্থা কখনও দেখিনি।

আবার আমি সেই তরুণ যুগলের মাঝখানে বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে বললাম, তুমি নয় ক্যাপ্টেন জারাস। তুমি দাঁড়িপাল্লাটা পরের কামরায় নেবার ব্যবস্থা কর। তারপর তোমার লোকজন একটু বিশ্রাম নিতে পারে।

কেবল এখন বুঝতে পারলাম এদের দুজনের এর আগে কখনও দেখা হয়নি। তেহুতি রাজপ্রাসাদের হেরেমের ছোট্ট পৃথিবীতে বিচরণ করতো। সেখান থেকে সে উপযুক্ত সহচরী পরিবেষ্টিত হয়ে বাইরের জগতে পা রাখতো। সম্ভবত আমিই ছিলাম সেই প্রতিরক্ষামূলক শৃঙ্খলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

একজন সুন্দরী হিসেবে তার কুমারীত্ব রাজা এবং রাজ্যের জন্য অমূল্য। হয়তো কোন রাজকীয় অনুষ্ঠানের সময় দূর থেকে জারাস তাকে দেখেছে। তবে সে কখনও রাজপ্রাসাদের রক্ষীবাহিনীর দায়িত্বে ছিল না। তার সমস্ত সামরিক জীবন কেটেছে দূর রণাঙ্গণে কিংবা সামরিক প্রশিক্ষণে। আমি নিশ্চিত আজকের আগে এতো কাছ থেকে রাজকুমারির অসামান্য সৌন্দর্য্য দেখার সুযোগ তার কখনও হয়নি।

আমি তাকে দ্রুত নির্দেশ দিলাম, তোমার লোকজনদের খাওয়া দাওয়া করতে বল আর প্রত্যেককে অতিরিক্ত এক মগ বিয়ার দাও। আমি আবার নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত ওদেরকে বিশ্রাম নিতে বল। একথা বলে আমি দুই রাজকুমারিকে নিয়ে উপরে চললাম। জারাস পেছন থেকে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইল।

.

সমাধিগর্ভের ফটক থেকে বের হয়ে একটু থেমে পূর্বদিকে তাকিয়ে দেখতে পেলাম, ভোরের গোলাপি লাল আভা পুব আকাশে ফুটে উঠেছে। তারপর নিচে তাকিয়ে দেখলাম জারাস ঠিকই বলেছিল, সমস্ত লোকজন পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছে।

দ্রুত পায়ে তৃতীয় জাহাজটির সিঁড়ি বেয়ে ডেকে উঠতেই নদীর ওপার থেকে তুর্যধ্বনী শোনা গেল, আর সেই সাথে দ্রুতবেগে এগিয়ে আসা রথের চাকার শব্দও শোনা গেল। আমি জাহাজের রেলিং ধরে সামনে অন্ধকার নদীর তীরের দিকে তাকালাম।

অগুণতি মশালের আলো আর হট্টগোল থেকে বুঝা গেল ফারাও ফিরে এসেছেন। আমার বার্তা পেয়ে তিনি থিবসে ফিরেছেন। রাজার কাছাকাছি হলেই আমার বুক খুশিতে নেচে উঠে। আমি দ্রুত জাহাজের কাঠের সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে নামতে আরও মশাল জ্বালতে আর রাজকীয় সম্মানের জন্য সৈন্যদের প্রস্তুত হতে নির্দেশ দিলাম।

একটুপরই অনুচরদের অনেক পেছনে ফেলে অন্ধকার ভেদ করে ফারাও নিজে রথ চালিয়ে উপস্থিত হলেন। আমাকে দেখার সাথে সাথে উল্লাসে চিৎকার করে আমাকে সম্ভাষণ জানিয়ে রথের রাশে হেলান দিলেন।

রাশটা তার সহকারীর হাতে ছুঁড়ে দিয়ে চাকা চলন্ত অবস্থায় রথ থেকে একলাফ দিয়ে মাটিতে নেমে বললেন, খুব ভালো লাগছে তায়তা তোমাকে দেখে। অনেক দিন দেখা হয় নি তোমার সাথে। তারপর একজন দক্ষ রথীর মতো মাটিতে পা ফেলে দ্রুত কয়েক পদক্ষেপে আমার কাছে পৌঁছালেন। সমস্ত লোকজনের সামনেই আমাকে বুকে জাপটে ধরে শূন্যে তুললেন। তার ছেলেমি দেখে আমার হাসি পেল।

একেবারে সত্যি কথা মহামান্য। অনেক দিন হয়ে গেল। এক ঘন্টা আপনি না থাকলে মনে হয় এক সপ্তাহ সূর্য উঠেনি।

এবার তিনি আমাকে মাটিতে নামিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। দেখলাম তার সারা দেহ ধূলিধূসরিত আর ময়লায় মাখামাখি হয়ে রয়েছে। বুঝা যাচ্ছে কষ্টকর একটি অভিযান থেকে সদ্য এসেছেন। তবে তার মাঝেও ফারাওয়ের মর্যাদা পরিস্ফুট হয়ে রয়েছে। পাশেই অপেক্ষারত বোনদের দেখে একের পর এক দুজনকেই বুকে জড়িয়ে আদর করার পর আবার আমার কাছে এলেন।

জেটিতে বাঁধা বিশাল তিনতলা জাহাজ তিনটে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এগুলো কি জাহাজ? মাস্তুল আর দাঁড় ছাড়াই এগুলো আমার দেখা যে কোনো জাহাজের চেয়ে দ্বিগুণ বড় মনে হচ্ছে। এগুলো কোথায় পেলে তায়তা? তাকে আমি যে বার্তা পাঠিয়েছিলাম তা ছিল সাংকেতিক আর সেখানে বিশদ বর্ণনা ছিল না। যাইহোক আমার উত্তরের জন্য অপেক্ষা না করে সাথে সাথে আবার বললেন, ষণ্ডা-গুণ্ডার মতো চেহারার ওই লোকগুলোর পরিচয় কী? আমি তোমার সাথে মাত্র কয়েকজন লোক দিয়েছিলাম, আর এদিকে তুমি দেখছি তোমার নিজস্ব ছোট্ট একটা সেনাবাহিনী নিয়ে ফিরে এসেছ তায়তা।

তিনি জেটি থেকে সমাধির ফটক পর্যন্ত সারিবদ্ধ দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলোর দিকে তাকালেন। তার কাছাকাছি যারা ছিল তারা কাঁধের বোঝা মাটিতে নামিয়ে নতজানু হয়ে তার প্রতি সম্মান দেখাতে শুরু করলো।

এদের চেহারা দেখে ভুল বুঝবেন না, মহামান্য। এরা ষণ্ডা-গুণ্ডা নয়। এরা মিসরের সাহসী তোক আর প্রকৃত যোদ্ধা।

আবার জাহাজ তিনটির দিকে তাকিয়ে বললেন, কিন্তু এই জাহাজগুলোর বিষয়টা কী? এগুলো সম্পর্কে কী বলবে?

আমি তাকে অনুরোধ জানিয়ে বললাম, দয়া করে আমার সাথে আসুন, নিরালায় বসে সবকিছু খুলে বলছি।

ঠিক আছে তায়তা। তুমিতো আবার সবসময় গোপনীয়তা পছন্দ কর, তাই না? তারপর তিনি সমাধির প্রবেশপথের দিকে এগিয়ে চললেন। আমিও ফারাও ত্যামোসকে অনুসরণ করে তার বাবার অনুমিত সমাধির দিকে এগোলাম।

প্রথম কোষাগারে ঢুকে কামরাভর্তি সারি সারি সাজানো কাঠের বাক্সগুলোর দিকে তাকালেন। তবে কোনো মন্তব্য করলেন না।

দ্বিতীয় কামরায় যাওয়ার আগে কেবল বললেন, আশ্চর্য, সমস্ত বাক্সের গায়ে সর্বাধিরাজ মিনোজের মার্কা মারা রয়েছে দেখছি। তৃতীয় কামরায় পৌঁছতেই এটন তাকে দেখে হাঁটুগেড়ে সম্মান জানাল।

আরও অবাক লাগছে তায়তা, আমার রাজপ্রসাদের পরিচালকও দেখছি তোমার এই গোপন ক্রিয়াকলাপের সাথে নিজেকে জড়িয়েছেন। তারপর ফারাও একটা কাঠের বাক্সের উপর বসে দুপা সামনে ছড়িয়ে দিয়ে বললেন, এবার বল তায়তা। সবকিছু খুলে বল।

আমি বললাম, তার চেয়ে ভালো হবে জিনিসটা আপনাকে দেখালে। তারপর আমি একটা বাক্সের ডালা খুলে চকচকে রূপার একটা পিণ্ড বের করে এক হাঁটু গেড়ে বসে রূপার পিন্ডটা তার হাতে তুলে দিলাম। তিনি জিনিসটা আমার হাত থেকে নিয়ে আস্তে আস্তে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলেন। আঙুলের ডগা দিয়ে ধাতুর উপর ছাপমারা চিহ্নটার উপর বুলিয়ে দেখলেন। ক্রিটের প্রতীক আক্রমণোদ্যত ষাঁড়ের মূর্তি আঁকা রয়েছে।

তারপর মৃদু কণ্ঠে বললেন, জিনিসটার চেহারা আর ওজন দেখেতো মনে হচ্ছে আসল রূপা। আসলেই কি তাই?

অবশ্যই এটা তাই ফারাও। এখানে আপনি যে-কটি সিন্দুক দেখছেন তার সবকটি এই রূপার বাটে ভরা।

আবার বেশ কিছু সময় চুপ করে রইলেন। তার ধূলিধূসরিত মুখের নিচে আমি দেখতে পেলাম প্রচণ্ড আবেগ। তারপর রুদ্ধকণ্ঠে বললেন।

এখানে কতটুকু আছে তাতা? এবার তিনি আমার সেই ছোটবেলাকার পুরোনো নাম ব্যবহার করলেন। যখনই আমার প্রতি ভালোবাসা আর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতেন তখন এই নামে ডাকতেন।

আমিও আবার তার শিশুকালের নামে ডেকে বললাম, প্রত্যেকটা সিন্দুক ভরা, মেম। আমি ছাড়া আর কারও এই নামে ডাকার অধিকার নেই।

এসব কথা ছেড়ে আসল কথা বল তায়তা। বল কতটুকু রূপা তুমি আমার জন্য এনেছ? তার গলায় বিস্ময়ের সুর।

আমি উত্তর দিলাম, এটন আর আমি দুজনে মিলে এর বেশিরভাগ অংশ ওজন করেছি।

এতে আমার কথার উত্তর পাওয়া গেল না তাতা।

আমরা প্রথম দুটি জাহাজের পুরো অংশ আর তৃতীয়টার কিছু অংশ ওজন দিয়েছি। হিসেব করে মোট চার শো ঊনপঞ্চাশ লাখ পাওয়া গেছে। সম্ভবত আরও এক লাখের ওজন নিতে হবে। অবশ্য দেড়লাখও হতে পারে।

আবার তিনি চুপ করে মাথা নেড়ে ভ্ৰ কুঁচকালেন। তারপর বললেন, প্রায় ছয়শো লাখ। এতে থিবসের চেয়ে দ্বিগুণ বড় একটা নগরী গড়ে তোলা যাবে এর সমস্ত মন্দির আর প্রাসাদসহ।

একমত হয়ে আমিও মৃদুকণ্ঠে বললাম, আর দশ হাজার জাহাজ নির্মাণ করার পরও বেশ কয়েকটা যুদ্ধের খরচ যোগানোর মতো যথেষ্ট রূপা রয়ে যাবে মহামান্য ফারাও। এই পরিমাণ সম্পদ দিয়ে আপনি বর্বর হাইকসোদের কবল থেকে মিসরকে ফিরিয়ে আনতে পারবেন।

বিষয়টা উপলব্ধি করতে পেরে ফারাও একমত হলেন, আবেগে তার কণ্ঠস্বর উঠানামা করতে লাগলো, তুমি আমাকে প্রয়োজনীয় অর্থ দিয়েছ, যা দিয়ে আমি বিওন আর তার পুরো শক্তি ধ্বংস করতে পারবো।

এটন উঠে আমাকে আড়াল করে ফারাওয়ের সামনে দাঁড়িয়ে বললো, আপনি অনেক দেরি করে ফেলেছেন ফারাও। হাইকসোর বিওন ইতোমধ্যেই পানিতে ডুবে মরেছে। তারপর এক পাশে সরে গিয়ে আমার দিকে আঙুল তুলে বললো, তায়তা তাকে মেরে ফেলেছে।

এবার ফারাও আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, এটন যা বললো তা সত্যি? দেশের জন্য এতোকিছু করার পর তুমি বিওনকেও মেরে ফেলেছে?

আমি মাথা ঝুঁকে সায় দিলাম। গর্ব করাটা আমি ঘৃণা করি, বিশেষত আমার নিজের মধ্যে তা নেই।

সবকিছু খুলে বল তায়তা। ঐ দানবকে কীভাবে মারলে তার সবকিছু আমি জানতে চাই।

আমি উত্তর দেবার আগেই এটন মাঝখান থেকে বলে উঠলো, দয়া করে আর একবার আমার কথা শুনুন ফারাও। তারপর সে রাজার সামনে মাথা ঝুঁকিয়ে বললো, এই কাহিনী আপনার পুরো রাজদরবারের সবার শোনা উচিত। জালিম হাইকসোদের উপর পূর্ণ বিজয়ের পর এটা আমাদের গৌরবময় সামরিক ইতিহাসের একটি অংশ হয়ে থাকবে। পরবর্তী প্রজন্ম তাদের সন্তানদের এই কাহিনী শোনাবে। আপনি যদি আমাকে অনুমতি দেন তাহলে আজ বিকেলে একটা বিজয়োৎসবের আয়োজন করবো। এতে রাজ্যের সমস্ত সভাসদ আর রাজপরিবারের সমস্ত সদস্য উপস্থিত থাকবেন। আর এই বিজয়োৎসব আমাদের ইতিহাসের এমন একটি সামরিক বিজয়কে সম্মান জানাবে যা আর কখনও হয়নি।

আপনি ঠিক বলেছেন এটন। তায়তা আমার জন্য এমন একটি কাজ করেছে যার প্রতি যথাযথ সম্মান দেখাতে হবে। এই অভূতপূর্ব সৌভাগ্যের কথা আমি এখুনি আমার সভাসদদেরকে জানাবো। আটজন সভাসদ এখন থিবসেই আছেন। সেনাপতি ক্রাটাস শিঘ্রই উত্তর থেকে আসছেন। আর আপনারা দুজনেই আছেন। আশা করি তিন চার ঘন্টার মধ্যেই রাজদরবারের সমস্ত সদস্যকে একত্রিত করতে পারবো।

ফারাওয়ের পোশাকের বিধ্বস্ত অবস্থা দেখে আমি বললাম, এই সময়ের মধ্যে মাহামান্য ফারাও স্নান সেরে একটু বিশ্রাম নিয়ে নিতে পারবেন।

ঠিক বলেছ তায়তা। তবে গায়ের এই ময়লা কিন্তু পরিশ্রম আর হাইকসোদের রক্তের মূল্যে হয়েছে। যাইহোক দাসদের বল স্নানের পানি গরম করতে।

.

মিসরের পুরো রাজদরবার এক হওয়ার আগেই তৃতীয় তিনতলা জাহাজটি থেকে সমস্ত রূপার বাঁট নামিয়ে এনে দাঁড়িপাল্লায় ওজন করা হয়েছে। বিজয়োৎসবের প্রস্তুতি শেষ করার সাথে সাথে সূর্য অস্ত গেল।

আমি ফারাওকে খবরটা দিতে এলাম যে, অনুষ্ঠানের সমস্ত আয়োজন প্রস্তুত। প্রাসাদে ফিরে যাবার কষ্ট লাঘব করার জন্য আমি তার বাবার সমাধি কক্ষেই তার থাকার জন্য একটি অস্থায়ী ব্যবস্থা করেছিলাম। এই কক্ষে কখনও কোনো মৃতদেহ আনা হয়নি, তাই এখানে মৃত্যুর গন্ধও নেই। শীতল এই জায়গাটি বেশ নীরব আর আরামদায়ক। তার দাসেরা তার জন্য বিছানা আর বহনযোগ্য কিছু আসবাবপত্রের ব্যবস্থা করেছিল।

তবে কোনো ধরনের বিশ্রাম না নিয়ে তিনি কামরায় পায়চারি করছিলেন আর তার তিনজন সচিবকে পত্রের তলিপি করছিলেন। পরিষ্কার পোশাকের উপর বুকে পোলিশ করা ব্রোঞ্জের বর্ম পরেছেন। এর উপরে সোনার কাজ করা। পরিষ্কার আর আঁচড়ানো কোঁকড়ানো চুল দেখে তাকে তার মায়ের মতোই সুন্দর দেখাচ্ছিল।

আমি নতজানু হতেই আমার কাঁধে এক হাত রেখে বাধা দিয়ে বললেন, না তায়তা। আমার একান্ত ইচ্ছা তোমাকে একজন মহান সদস্য করে আমার ভেতরের সভাসদদের একজন করে নেওয়া। তুমি আর আমার সামনে নতজানু হবে না।

আমি আমার নিজস্ব ভূমিকা নিয়ে বললাম, ফারাও অত্যন্ত দয়াশীল। আমি এমন সম্মানের যোগ্য নই।

তিনি একমত হয়ে বললেন, অবশ্যই তুমি তা নও। তবে আমি শুধু আমার সামনে তোমার এই নিচু হওয়াটা বন্ধ করতে চাই। শেঠের দিব্যি দিয়ে বলছি, তোমার এই কাজ দেখলে আমার মাথা ঝিম ঝিম করে। সোজা হয়ে দাঁড়াও তারপর বল মোট কত রূপা আমার জন্য এনেছ।

আমি আপনাকে বলেছিলাম ৬০০ লাখ ফারাও। তবে গণনার পর এই পরিমাণ থেকে বিশ লাখ কম পাওয়া গেছে।

আমার রাজ্য ফিরে পাবার জন্য আর তোমার মাথা উঁচু করার জন্য এটা অনেক বেশি। দরবারের সবাই কি এসেছেন?

সেনাপতি ক্রাটাসসহ সকলেই এসেছেন। তিনি এক ঘন্টা আগে থিবসে পৌঁছেছেন।

আমাকে সেখানে নিয়ে চল।।

সমাধিক্ষেত্রের ফটক থেকে বের হতেই আমি বুঝতে পারলাম এটন আমার সম্মানে কী বিশাল আয়োজন করেছে। উৎসবের পোশাক পরা রাজকীয় রক্ষিবাহিনীর মধ্য দিয়ে ফারাও আমাকে নিয়ে খালের তীরে স্থাপন করা বিশাল তাঁবুর দিকে এগিয়ে চললেন।

সেখানে পৌঁছেই দেখলাম রাজদরবারের সকল সদস্য সেখানে আমাদেরকে স্বাগত জানাতে উপস্থিত রয়েছেন। সেখানে পুরো রাজপরিবার ছিল: তার দুই বোন, তার বাইশজন স্ত্রী আর ১১২ জন উপপত্নী। এছাড়া আরও ছিল অভিজাত সভাসদগণ, সেনাপতি, রাজ্য সদস্য আর অন্যান্য উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারি।

আমরা ঢুকতেই সবাই উঠে দাঁড়াল আর পুরুষরা তাদের তরবারি উঁচু করে আমার আর ফারাওয়ের যাওয়ার পথে একটা খিলান রচনা করলো। একইসাথে তাঁবুর বাইরে বাদকদল বীণা আর বাঁশির সমন্বয়ে একটি বিজয় সঙ্গীতের সুর বাজাতে শুরু করলো।

নির্দিষ্ট আসনে গিয়ে বসতে আমাদের বেশ সময় লাগলো। সমবেত প্রত্যেকে চাচ্ছিল আমাকে স্পর্শ করতে, আমার হাত ধরতে আর আমাকে অভিনন্দন জানাতে।

তাঁবুর ভেতরের দেয়ালের চারপাশে একটু পর পর এক মানুষ সমান উঁচু বিরাট মদের পাত্র সাজানো রয়েছে। সবাই যার যার আসনে বসার পর ভৃত্যরা লম্বা জার থেকে বড় বড় গ্লাসে লাল মদ ভরে দিল। একটা বড় মদ ভর্তি গ্লাস ফারাওয়ের সামে রাখতেই তিনি হাত দিয়ে সেটা ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বললেন।

এখানে আমরা তায়তাকে সম্বর্ধনা জানাতে এসেছি। তাকে ভালো লালমদ পরিবেশন কর, আজ গ্লাসে সেই প্রথম চুমুক দেবে।

আমি উঠে দাঁড়িয়ে গ্লাস হাতে নিয়ে ফারাওয়ের উদ্দেশ্যে তুলতেই বিশাল তাঁবুর মাঝে সবার চোখ তখন আমার দিকে ফিরলো।

সকল প্রশংসা ফারাওয়ের। তিনিই আমাদের মিসর। ফারাও আর মিসর ছাড়া আমরা কেবল ধূলোবালু। এছাড়া কোনো কিছুই সুন্দর নয়। তারপর গ্লাসটা ঠোঁটের কাছে নিয়ে বড় একটি চুমুক দিলাম। সমবেত নারীপুরুষ সবাই দাঁড়িয়ে আমার নামে হর্ষধ্বনি দিল। এমনকি ফারাও মৃদু হাসলেন।

আমি অনুভব করলাম আমি যত কম বলবো ওরা ততই আমাকে ভালোবাসবে, কাজেই আমি ফারাওয়ের উদ্দেশ্যে মাথা নুইয়ে সম্মান জানিয়ে আমার আসনে বসে পড়লাম।

ফারাও উঠে দাঁড়িয়ে ডান হাত আমার কাঁধে রেখে পরিষ্কার দৃপ্ত কণ্ঠে তার বক্তব্য শুরু করলেন।

তিনি কেবল বললেন, সম্মানিত রাজ-সদস্য তায়তা আমাকে অনুগ্রহ করেছেন। তিনি আমার এবং মিসরের জন্য বিরাট একটি কাজ করেছেন, এতো বড় কাজ তার আগে আর কেউ করেনি। আমিসহ প্রত্যেক জীবিত মিসরীয় আর পরবর্তী প্রজন্ম জন্ম গ্রহণ করবে তাদের সবার উচিত তাকে সম্মান জানানো।

আমি তাকে রাজকীয় উচ্চমর্যাদাপূর্ণ আসন দিয়েছি। এখন থেকে তিনি মেসিরের জমিদার তায়তা নামে পরিচিত হবেন। একথা বলার পর ফারাও একটু থামলেন। সবাই ভদ্রভাবে নীরব হয়ে রয়েছে। মেসির হচ্ছে নীল নদীর পুবতীরে একটি গ্রাম। থিবস থেকে ৩০ লিগ দক্ষিণে। কতগুলো মাটির কুঁড়েঘর আর সাধারণ কিছু মানুষ সেখানে বসবাস করছে। ফারাও এই ধাঁধাটা নিয়ে সবাইকে কিছুক্ষণ ভাবতে দিলেন।

এছাড়া আমি তাকে চিরকালের জন্য নীলনদের পূর্বতীর আর থিবসের দক্ষিণ দেয়ালের মাঝে যত রাজকীয় জমিদারি আছে সব কিছুর মালিকানা তাকে দিলাম।

এটা শোনার পর সমবেত সবাই অবাক হল আর সকলের মধ্য থেকে একটা গুঞ্জন উঠলো। মেসিরের নদীর তীর থেকে থিবস পর্যন্ত ত্রিশ লিগ জমি হচ্ছে পুরো রাজকীয় জমিদারির মধ্যে সবচেয়ে উর্বর।

তার এই মহৎ কর্ম দেখে আমি হতবাক হলাম। যাইহোক তার ডান হাতে চুম্বন দেবার সময় আমার মনে একটা দুষ্ট চিন্তা জাগলো যে, যেহেতু আমি তাকে পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী রাজা বানিয়েছি কাজেই আমার প্রতি এই অনুগ্রহ দেখিয়ে তিনি কোনো মন্দ কাজ করেননি।

এবার ফারাও রূপার মদের গ্লাসটি হাতে তুলে নিয়ে সমবেত সবার উদ্দেশ্যে বললেন, আমার রানি, আমার রাজকুমার আর রাজকুমারি, সম্মানিত সভাসদ এবং ভদ্রমহিলাগণ, আমি তায়তার প্রতি কৃতজ্ঞতা। তার প্রতি সম্মান দেখিয়ে আর তার দীর্ঘ জীবন কামনা করে এই সুরা পান করছি।

সবাই উঠে দাঁড়িয়ে পেয়ালা হাতে নিয়ে সমস্বরে বলে উঠলো, প্রভু তায়তার প্রতি কৃতজ্ঞতা, সম্মান আর দীর্ঘজীবন কামনা করছি।

মিসরের ইতিহাসে এটা সম্ভবত প্রথম কোন ঘটনা যে, মিসরীয় একজন ফারাও তার এক প্রজাকে সম্মান দেখিয়ে পান করলেন। তারপর তিনি নিজ আসনে বসে সকলকে বসার ইঙ্গিত করলেন।

খ্যাতি সবসময় সবার জন্য আসে না। এটন ভালো তবে শ্রেষ্ঠ নয়। নীল নদের পার্চ মাছের যে কাটাহিন পেটি পরিবেশন করা হয়েছিল, তাতে লবণ কম ছিল। আর মরুভূমির পাখির মাংসের কাবাব বেশি পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল। তাছাড়া রাজকীয় পাঁচককে সে বাহারাত মশলা খুব বেশি ব্যবহার করার অনুমতি দিয়েছিল। আমি হলে কাজটা আরও ভালো হত, যাই হোক মদটি মোটামুটি ভালো হওয়ায় খুব একটা অসুবিধা হয়নি।

ভোজের পর যখন সবাই ফুরফুরে মেজাজে রয়েছে তখন চারণকবির নাম ঘোষণা করার জন্য এটন উঠে দাঁড়াল। আমি মনে মনে ভাবতে লাগলাম এ জায়গায় আমি হলে কোন কবির নাম বলতাম। যেহেতু কবিতার বিষয়বস্তুই আমি নিজে, সুতরাং কবি পছন্দ করার কাজটা স্বভাবতই আমার করার কথা নয়। কাজেই আমি ধারণা করলাম রেজা কিংবা থোইয়াককেই এটন এই সম্মানসুচক কাজের জন্য বেছে নেবে।

কিন্তু সে সকলকে হতবাক করে দিল। প্রথমে সে মিসরের প্রখ্যাত চারণিকদের প্রশংসা করলো, তারপর বললো সে এমন একজনকে বেছে নিয়েছে যে আসল ঘটনার একজন চাক্ষুস সাক্ষী। অবশ্যই এটি একটি উদ্ভট চিন্তা। কখন এই ঘটনার বিবরণ একটা ভালো কাহিনীর উপাদান হিসেবে গুরুত্ব লাভ করেছে?

মহান ফারাও এবং উপস্থিত রাজপরিবারের সম্মানিত নারী সদস্যগণ, অনুগ্রহ করে সামনে এগিয়ে আসুন আর নীল কুমির রক্ষীবাহিনীর একজন সাহসী সেনাকর্মকর্তার কথা শুনুন, যিনি প্রভু তায়তার সাথে সাগরপাড়ি দিয়েছিলেন। তারপর সে একটু থেমে নাটকীয় ভঙ্গিতে বললো, এবার আসছেন ক্যাপ্টেন জারাস।

তাঁবুর পর্দা সরিয়ে জারাস ভেতরে ঢুকে ফারাওয়ের সামনে এসে নতজানু হল। সমবেত সকলেই নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে রইল, এমনকি অন্যান্যদের মতো ফারাও নিজেও অবাক হলেন। আমি ভেবেছিলাম সমবেত সবার মাঝে একমাত্র আমিই নীল কুমির রক্ষীবাহিনীর ক্যাপ্টেন জারাসকে চিনতাম। তারপর হঠাৎ বিদ্যুৎচমকের মতো একটা কথা আমার মনে এলো।

আমি দ্রুত রাজকুমারী তেহুতির দিকে তাকালাম। সে সেনাপতি ক্রাটাস আর ফারাওয়ের কোষাধ্যক্ষ ম্যাডালেকের মাঝে বসেছিল। এখন সে টুলে বসে একটু সামনের দিকে ঝুঁকে অত্যন্ত আগ্রহসহকারে আর উজ্জ্বল চেহারা নিয়ে জারাসের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। সে এমন বোকা নয় যে, হাততালি দিয়ে বা তেমন কিছু করে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করবে যাতে বুঝা যায় যে, এটনের এই পছন্দে তার হাত আছে। তবে আমি ঠিকই বুঝতে পারলাম এটা তারই কাজ। যে কোনোভাবেই হোক সে এটনকে বাধ্য করেছে এই অদ্ভুত সিদ্ধান্ত নিতে।

আমি কখনও আমার দুই রাজকুমারির কূটনৈতিক দক্ষতাকে ছোট করে দেখিনি, কিন্তু এটা তো রীতিমতো ডাকিনীবিদ্যা। বেকাথার দিকে দৃষ্টি ফিরাবার সাথে সাথে বুঝতে পারলাম সেও এতে জড়িত রয়েছে।

ভোজ টেবিলের উল্টোদিকে বসে সে চোখ ঘুরিয়ে আর নানারকম অঙ্গভঙ্গি করে তার বড়বোনের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করছিল। কিন্তু তেহুতি তাকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে চলেছে।

আমার বেশ রাগ হল। আবার জারাসের জন্য করুণাও হল। সে একজন চমৎকার যুবক, ভালো সৈনিক আর বাবা যেমন একজন ছেলেকে ভালোবাসে তেমনি তাকে আমি ভালোবাসতাম। আর এখন সে পুরো দুনিয়ার সামনে নিজেকে হাস্যাস্পদ করে তুলতে যাচ্ছে। হৃদয়হীনা দুই রাজকীয় শৃগালী এই ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর ফন্দী এঁটেছে।

জারাসের দিকে ফিরে তাকালাম। যে ভয়ঙ্কর বিপদে সে পড়তে যাচ্ছে সে সম্পর্কে তাকে উদাসীন মনে হল। সৈনিকের সাজ পরে সে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বেশ সুন্দর লাগছে দেখতে। আমার ইচ্ছা হচ্ছিল কিছু একটা করে তাকে এই বিপদ থেকে বাঁচাই, কিন্তু আমি অসহায়। হয়তো একটা স্কুল ছাত্রের মতো হোঁচট খেতে খেতে সে আবৃত্তি করে যাবে, তবে তার সমস্ত প্রচেষ্টা এই কঠিন বিচারক কিংবা সমজদাররা রেজা কিংবা থোইয়াকের সাথে তুলনা করবে।

তারপর হঠাৎ আমি সচেতন হলাম মেয়েলি কণ্ঠের গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে, যেন আমার বাগানে বসন্তের ফুলের কেয়ারির উপর মৌমাছির ঝাঁক মধু আহরণ করতে করতে গুণগুণ করছে। ফিরে তাকিয়ে দেখলাম শুধু তেতি নয়, আরও অনেক বয়স্ক মহিলাও খোলাখুলি তার প্রতি আগ্রহ দেখাচ্ছে। হাতপাখার আড়ালে ওরা মৃদু হাসছিল আর ফিসফিস করছিল। জারাস কখনও রাজদরবারে আসেনি, তাই ওরা কখনও ওদের কামুক নজর তার উপর ফেলতে পারেনি।

তারপর জারাস একবার কেশে প্রস্তুত হওয়ার ইঙ্গিত করতেই তাঁবুর মাঝে সবাই নিশ্চুপ হল। আমি দূরে মরুভূমি থেকে একটা শেয়ালের ডাক শুনতে পেলাম।

জারাস বলতে শুরু করলো। আমি জারাসকে যুদ্ধক্ষেত্রে তার অধীনস্থ লোকদেরকে নির্দেশ দিতে শুনেছি, কিন্তু কখনও তার কণ্ঠস্বরের গভীরতা কিংবা সুরেলা বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে কোনোকিছু বুঝতে পারিনি। তার কণ্ঠস্বর একটা ঘন্টাধ্বনির মতো আর মরুভূমির বালুর ঢিবির উপর উড়ে বেড়ানো পাখির মতো ভেসে উঠলো। সমুদ্রতীরের পাথরের গায়ে ঝড়ের মতো আছড়ে পড়লো, আর উঁচু সিডার গাছের শাখায় হাওয়ার ঝাঁপটার মতো শোনাল।

প্রথম কয়েকটা স্তবক বলেই সে সকলকে মোহাবিষ্ট করে ফেললো।

তার শব্দচয়ন ছিল অপূর্ব। এমনকি আমি নিজেও হয়তো তেমন করতে পারতাম না। তার সময়জ্ঞান আর বর্ণনা ছিল দুর্নিবার। জলদগম্ভীর স্বরে সে নীলনদের বন্যার পানির মতো সবকিছু ধুয়েমুছে নিয়ে চলেছে।

যখন আমি হাইকসো ভণ্ড বিওনকে তিনটি তীর ছুঁড়ে মেরে ফেড়ে ফেলেছিলাম, সেই তিনটি তীর ছোঁড়ার ঘটনার বর্ণনা দেবার সময় মিসরের সমস্ত সভাসদ আসন ছেড়ে লাফিয়ে উঠে উল্লাসে হর্ষধ্বনি দিয়ে উঠলেন। আর ফারাও এমন জোরে আমার বাহু চেপে ধরলেন যে, এরপর অনেকদিন তার দাগ রয়ে গিয়েছিল।

বাকি সবার সাথে আমি নিজেও হাসি আর কান্নার মাঝে রইলাম আর সবশেষে উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দিলাম।

সমাপ্তিতে পৌঁছার সময় সে বিশাল প্রবেশ পথের দিকে ঘুরে দুই হাত দুই দিকে মেলে ধরে বলতে লাগলো।

তারপর মহান তায়তা মিসরের সমস্ত দেবতা আর ফারাও ত্যামোসের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে কেঁদে বলতে শুরু করলেন, এটা কেবল সামান্য একটি নমুনা আমি আপনার জন্য অর্জন করেছি। সেই সম্পদেকেবল এক হাজার ভাগের একভাগ আমি আপনার সামনে হাজির করেছি। হে ফারাও ত্যামোস, আপনার প্রতি আমার ভালোবাসা আর কর্তব্যের এটি একটি প্রমাণ।

বাইরে মরুভূমিতে একটি মাত্র ঢাক বাজতে শুরু করলো আর তাঁবুর প্রবেশ পথ দিয়ে শিরস্ত্রাণ আর বর্মপরা দশজন সৈন্য ভেতরে ঢুকলো। ওরা একটা কাঠের তক্তা বহন করে নিয়ে এলো, যার উপর কতগুলো চকচকে রূপার বাট পিরামিড আকারে সাজিয়ে রাখা হয়েছে।

সবাই একযোগে উঠে দাঁড়িয়ে প্রশংসা আর হর্ষধ্বনি করতে লাগলো।

ওরা চিৎকার করে বলে উঠলো, জয় হোক ফারাও রাজার! সকল প্রশংসা তায়তার!

জারাসের বলা শেষ হওয়ার পর তাকে ওরা যেতে দিচ্ছিল না। ফারাও কয়েকমিনিট তার সাথে কথা বললেন। পুরুষেরা তার সাথে হাত মেলালো আর কেউ কেউ তার পিঠ চাপড়ালো। আর কয়েকজন মহিলা যারা মদ পান করেছিল তারা ফিক ফিক করে হেসে তার গায়ের সাথে বেড়ালের মতো নিজেদের গা ঘসতে লাগলো।

যখন সে আমার সামনে এলো, আমি তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে তার প্রশংসা করে বললাম, খুব ভালো লিখেছ আর চমৎকার বলেছো, জারাস। তুমি একজন যোদ্ধা আবার একজন কবিও বটে।

সে উত্তরে বললো, আপনার মতো একজন বিখ্যাত কবির কাছ থেকে একথা শুনে আমার খুবই আনন্দ হচ্ছে। আন্তরিকভাবে তার এই কথা বলাটা আমার মন ছুঁয়ে গেল। তারপর সে সমবেত দর্শকশ্রোতার মধ্য দিয়ে এগিয়ে চললল। সবশেষে রাজকুমারি তেহুতির সামনে এসে মাথা ঝুঁকিয়ে দাঁড়াল।

ওরা তাঁবুর অন্য প্রান্তে আমার কাছ থেকে বেশ দূরে ছিল। তবে কারও ঠোঁট নাড়া দেখে আমি তার কথা বুঝতে পারি, যেরকম একটা প্যাপিরাস থেকে পড়তে পারি।

তেহুতির প্রথম কথাটা ছিল, ধিক আপনাকে ক্যাপ্টেন জারাস! আপনার কবিতা শুনে আমার কান্না পেয়েছিল। তার এই কথার সাথে সাথে জারাস তার সামনে হাঁটুগেড়ে বসে পড়লো। তার মুখ আমি দেখতে পাচ্ছিলাম না, তাই তার কথাও বুঝতে পারিনি। তবে তার কথা শুনে তেহুতি হেসে উঠলো।

আপনি একজন বীর, ক্যাপ্টেন। তবে এক শর্তে আমি আপনাকে ক্ষমা করতে পারি। তাহল, কথা দিতে হবে যে আরেকদিন আপনি আমাদেরকে গান গেয়ে শোনাবেন। একথার উত্তরে জারাস হয়তো সম্মতি জানিয়েছিল, তাই তেহুতি আবার বললো, তাহলে এই কথাই রইল। এরপর জারাস উঠে দাঁড়িয়ে অত্যন্ত সম্মান দেখিয়ে পেছন দিকে হটলো।

হায় ঈশ্বর! আমি ভাবলাম! হায় রে বোকা ছেলে, ফিরে এসো ওখান থেকে। তুমি ওদের সমকক্ষ নও। যুদ্ধের ময়দান থেকেও ভয়ঙ্কর বিপদে তুমি এখন পড়েছ। কিন্তু তেহুতি আবার তাকে থামাল।

আমি ওর ঠোঁট নাড়া দেখে কথাগুলো বুঝতে পারলাম, কী ঝামেলা হল। আমার আংটিটা মনে হয় মাটিতে পড়ে গেছে। একটু আগেই এটা আমার আঙুলে ছিল। দয়া করে একটু খুঁজে দেখুন না ক্যাপ্টেন জারাস?

একাজ করার জন্য সে এক পায়ে খাড়া ছিল। তেতির সামনে আবার মাটিতে ঝুঁকে সে আংটিটা খুঁজতে শুরু করলো আর প্রায় সাথে সাথে ওটা পেয়ে উঠে দাঁড়িয়ে এক হাত সামনে বাড়িয়ে ধরে বললো, এটাই কি আপনার হারানো সেই আংটি, মহামান্য? এবার সে আমার দিকে একটু ঘুরে দাঁড়াতে আমি তার ঠোঁট নাড়া পড়তে পারছিলাম।

হ্যাঁ, এটাই তো। একজন বিশেষ মানুষ আমাকে এটা উপহার দিয়েছেন। যার প্রশংসা আজ সন্ধ্যায় আপনি করেছেন। তবে সে সাথে সাথে আংটিটা জারাসের হাত থেকে ফেরত নিল না।

আপনি প্রভু তায়তার কথা বলছেন? 

সে মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বললো, অবশ্যই! আপনার হাতে ধরা আংটিটার পাথরটার দিকে তাকিয়ে দেখুন তো। দেখুন কী স্বচ্ছ।

কাছাকাছি একটা মশালের কাছে আংটিটা নিয়ে সে সায় দিয়ে বললো, পানির মতো পরিষ্কার। তেহুতি তাকে বাধ্য করলো আংটিটা খুঁটিয়ে দেখতে, তারপর সে হাত বাড়িয়ে বললো।

ধন্যবাদ, ক্যাপ্টেন জারাস। তারপর জারাস আংটিটা তেহুতির বাড়ানো হাতে তুলে দিতেই তেহুতি তার মুঠো বন্ধ করলো।

আমি মনে মনে ভাবলাম, আংটিটার মধ্যে কোনো যাদু না থাকলেও, রাজকুমারি তেহুতি, তোমার হাসিতে যে জাদু আছে তাতে মেমফিস আর থিবসের দেয়াল দুপাশ থেকে চেপে পিষ্ট করে ফেলতে পারবে। জারাসের মতো একজন অপরিপক্ক যুবক কী করে তোমার ছলনা ঠেকাতে পারবে?

.

এখন সবচেয়ে প্রথম আর জরুরী কাজটি হল, কোনো ধরনের চিহ্ন না রেখে এই বিশাল তিনটি ক্রেটান তিনতলা জাহাজ গায়েব করে ফেলা। সর্বাধিরাজ মিনোজের মনে যেন বিন্দুমাত্র সন্দেহ না থাকে যে, হাইকসো বিওনই তার রত্নভাণ্ডারসহ জাহাজগুলো চুরি করেছে। ক্রোধে সে উম্মুক্ত হয়ে যাবে যখন জানবে যে, তার কথিত মিত্ৰই আসল অপরাধী।

প্রথমে ভাবলাম জাহাজ তিনটা পুড়িয়ে ছাইগুলো নীলনদে ভাসিয়ে দিই। যাতে এগুলো অদৃশ্য হওয়ার রহস্যটা চিরকালের জন্য মুছে যায়। তারপর আবার বিপুল পরিমাণে কাঠ বিনষ্ট হওয়ার বিষয়টা বিবেচনা করলাম।

মিসরে বনাঞ্চল খুব বেশি নেই। আমাদের কাছে কাঠ, সোনা রূপার মতোই মূল্যবান। এই বিপুল পরিমাণ কাঠ থেকে কতগুলো যুদ্ধ জাহাজ আর রথ তৈরি করা যাবে, এই বিষয়টা ভাবতেই এরকম দামি জিনিস পুড়িয়ে ফেলার চিন্তা থেকে নিজেকে বিরত রাখলাম।

বিষয়টা নিয়ে ফারাও আর আমাদের সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক প্রভু কাটাসের সাথে আলোচনা করলাম।

ক্রাটাস বললো, কিন্তু তায়তা, মিসরের কোথায় তুমি এতো কাঠ লুকিয়ে রাখবে? এই কথাটা কি ভেবে দেখেছো?

ফারাও আমার পক্ষ নিয়ে বললেন, একটা বিষয় আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন, ক্রাটাস। সেটা হল তায়তা নিশ্চয়ই তা ভেবে রেখেছে। তায়তা সবসময় সবকিছু ভেবে নিয়ে বলে।

আমি বিড়বিড় করে বললাম ফারাও আমার প্রতি অতি দয়াশীল। তবে আমি যথাসাধ্য বিনীতভাবে চেষ্টা করি। একথা শুনে ক্রাটাস হাসিতে ফেটে পড়লো।

ফারাও ঠিক বলেছেন। এ-বিষয়টা নিয়ে আমার কিছু চিন্তাভাবনা আছে। তবে আসল কথা হচ্ছে রূপারর্বাটগুলো পাহারা দেবার জন্য আপনার দেবত্বপ্রাপ্ত বাবা প্রয়াত ফারাও ম্যামোজের শূন্য সমাধিতে পুরো এক পল্টন সৈন্য রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। আর এই সৈন্যদেরকে দুই কাজে ব্যবহার করা যাবে।

এবার ক্রাটাসও মনোযোগ দিয়ে আমার কথা শুনতে লাগলো।

ফারাও বললেন, বলে যাও।

দেখুন, আমি সমাধিকক্ষের পাশের কামরাগুলোর আয়তন আবার মেপে দেখেছি।

তিনতলা জাহাজগুলো ভেঙে যে কাঠের তক্তা পাওয়া যাবে সেগুলো সবই এই মাটির নিচের কুঠরিগুলোতে লুকিয়ে রাখা যাবে। তারপর সুবিধামতো যুদ্ধের প্রয়োজনে এগুলো আবার ব্যবহার করা যাবে। তারপর আমি ক্রাটাসের দিকে তাকিয়ে একটু টিটকারির সুরে বললাম, হয়তো প্রভু ক্রাটাসের এ-বিষয়ে আরও ভালো কোনো প্রস্তাব থাকতে পারে। তিনি হয়তো কাঠের তক্তাগুলো শুধু তার মুখের কথার ভারে লোহিত সাগরের নিচে ডুবিয়ে রাখতে পারবেন।

কিন্তু ক্রাটাস হাসতে হাসতে গর্জন করে বললো, তায়তা, তুমি আমার সাথে ভালোই রসিকতা করলে।

অর্ধেক পল্টন সৈন্যের কয়েক সপ্তাহ খাটুনির পর জাহাজগুলোর সমস্ত তক্তা খুলে প্রতিটার গায়ে সংখ্যা দেওয়ার পর মাটির নিচের কামরাগুলোয় সাজিয়ে রাখা হল। শেষপর্যন্ত আমার কৌশল কাজে লেগে গেল, বিশাল জাহাজগুলো সম্পূর্ণরূপে গায়েব হয়ে গেল।

এতে অবশ্য অতিরিক্ত একটা ঝামেলা এড়ানোর কাজের সুবিধা পেলাম। ফারাওকে দিয়ে আমি জারাসকে এই জাহাজ ভাঙার কাজের নেতৃত্বের ভার দিয়েছিলাম। কড়া নির্দেশ ছিল সম্পূর্ণ কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাকে এই সমাধি এলাকার মধ্যেই থাকতে হবে। কাজেই যখন দুই রাজকুমারি, তেহুতি আর বেকাথা তার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলো তখন আমি ভালোমানুষের মতো বলতে পারলাম যে, ফারাও তাকে একটি গোপন সামরিক অভিযানে পাঠিয়েছেন। তার ফিরতেও আরও বেশ কিছুদিন লাগবে।

হাইকসো যুদ্ধক্ষেত্রের চেয়েও থিবসের রাজপ্রাসাদ জারাসের জন্য অনেক ভয়ঙ্কর। আমি রাতে শুয়ে আমার অনুগ্রহভাজন এই ছেলেটির কথা ভেবে আতঙ্কে ঘামতে লাগলাম। তাকে আমি একজন বিশ্বস্ত বন্ধু ভাবতাম, যে আমার প্রাণ বাঁচিয়েছে, এছাড়াও সে ছিল একজন অকুতোভয় সেনানায়ক, একজন শিক্ষিত মানুষ আর এখন নিজেকে একজন কবি হিসেবে পরিচিত করেছে। আমাদের দুজনের মধ্যে অনেক মিল রয়েছে। তবে তার সমবয়সী অন্যান্য যুবকের মতো তার মধ্যেও কিছু দুর্বলতা রয়েছে যা সে এড়াতে পারে না।

আমি এটাও জানতাম একজন যুবতি মেয়ের কামনা তাকে কী রকম নির্মম আর বেপরোয়া করে ফেলে। তাকে প্রথম দেখার সাথে সাথে আমার আদরের তেহুতির দেহ-মনে আগুন জ্বেলেছে। এই আগুন নেভাবার আর কোনো পথ আমি ভেবে পেলাম না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *