১. চর্বির ভাঁজে

ডেজার্ট গড – উইলবার স্মিথ
ভাষান্তর : কাজী আখতারউদ্দিন

চর্বির ভাঁজে থাকা ছোট ছোট চোখদুটো পিট পিট করে, এটন বাও খেলার ছক থেকে মাথা তুলে একপাশে তাকালো। একটু দূরে ত্যামোস রাজবংশের দুই রাজকুমারি উদোম গায়ে উপহ্রদের স্বচ্ছ পানিতে খেলা করছিল। নিরাসক্তভাবে ওদের দিকে তাকিয়ে সে মন্তব্য করলো, ওরা আর ছোটটি নেই।

নীল নদের ভাটিতে একটি উপহ্রদের পাশে পামপাতার ছাউনির নিচে আমরা মুখোমুখি বসেছিলাম। আমাদের দুজনের মাঝে একটা বাও খেলার ছক পাতা ছিল। খুঁটির পরবর্তী চাল থেকে আমার মনোযোগ অন্য দিকে সরিয়ে দেবার উদ্দেশেই সে মেয়েগুলো সম্পর্কে ওই মন্তব্য করেছে তা বুঝতে পারলাম। এটন হারতে পছন্দ করে না, কাজেই কীভাবে জিতবে সে বিষয়ে তার খুব একটা মাথা ব্যথা নেই।

এটন আমার সবচেয়ে পুরোনো এবং প্রিয় বন্ধু। আমার মতো সেও একজন খোঁজা, সেও এককালে ক্রীতদাস ছিল। তবে তার অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা ও মানসিক দৃঢ়তার কারণে, কৈশোরেই তার প্রভু তাকে অন্যান্য ক্রীতদাসের কাছ থেকে আলাদা করে নিয়েছিলেন। এটন সবসময় তার এই অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করতো, তবে সবধরনের কামনাবাসনা থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতো। সে ছিল বহুমূল্য সম্পদের মতো। তাই তার প্রভু তাকে খোঁজা করার জন্য মিসরের সবচেয়ে বিখ্যাত চিকিৎসককে নিযুক্ত করেছিলেন। এখন সে থিবসে ফারাও রাজপ্রাসাদের ব্যবস্থাপনার প্রধান ব্যক্তি। একইসাথে গুপ্তচরদেরও প্রধান। সমস্ত সভ্য জগতজুড়ে ছড়িয়ে থাকা সংবাদবাহক আর গুপ্তচরদের এক বিশাল চক্রকে সে পরিচালনা করছে। কেবল আরেকটি সংগঠন এর চেয়ে শ্রেষ্ঠ, আর সেটি হচ্ছে আমার সংগঠনটি। আর প্রায় সবকিছুর মতো এই ক্ষেত্রেও আমরা পরস্পরের সাথে বন্ধুত্বমূলকভাবে প্রতিযোগিতা করি আর একজন আরেকজনকে টপকাতে পারলে যে পরিমাণ আনন্দ লাভ করি, তা আর কোনো কিছুতে পাই না।

তার সঙ্গ আমি খুব পছন্দ করি। তার সুপরামর্শ আর উপলব্ধি ক্ষমতা অনেক সময় আমাকে বেশ অবাক করে। আবার মাঝে মাঝে বাও খেলার ছকে সেও আমার দক্ষতা পরীক্ষা করে। সাধারণত উদারভাবেই সে আমার প্রশংসা করে, তবে বেশিরভাগ সময় আমার বুদ্ধির কাছে হার মানে।

এই মুহূর্তে আমরা দুজনেই বেকাথাকে লক্ষ্য করছিলাম। দুই রাজকুমারির মাঝে সে বড় বোনের চেয়ে দুই বছরের ছোট। তবে বয়সের তুলনায় বেশ লম্বা আর ইতিমধ্যেই তার বুক দুটো সামান্য উঁচু হয়ে উঠেছে। মেয়েটি বেশ চটপটে আর সবসময় হাসিখুশি। বেশ উপস্থিতবুদ্ধিও আছে। কাটাকাটা চেহারায় সোজা আর খাড়া নাক, কঠিন চিবুক আর পাতলা ঠোঁট। তামাটে ঘন চুল রোদে ঝিলিক দিচ্ছে। ওর বাবার কাছ থেকে সে এসব পেয়েছে। এখনও তার রজোদর্শন হয়নি, তবে মনে হয় আর বেশি দিন নেই।

আমি তাকে খুব ভালোবাসি, তবে সত্যি বলতে কী তার বড় বোনটিকে একটু বেশি ভালোবাসি।

দুজনের মধ্যে বড়-বোন তেহুতি আরও সুন্দর। যখনই আমি তার দিকে তাকাই তখনই আমার মনে হয় যেন আমি আবার তার মাকে দেখছি। রানি লসট্রিস ছিল আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ ভালোবাসা। হ্যাঁ, একজন পুরুষ যেমন একজন নারীকে ভালোবাসে সেরকমই আমি তাকে ভালেবাসতাম। আমার বন্ধু এটনকে যেমন ছোট থাকতে খোঁজা করা হয়েছিল, আমার বেলায় তা হয়নি। আমাকে যখন খোঁজা করা হয় তখন আমি পুরোপুরি যৌবনে পৌঁছে নারী দেহের আনন্দ বুঝতে শিখেছি। তবে এটা সত্যি, রানি লসট্রিসের সাথে আমার ভালোবাসা কখনও সে পর্যায়ে পৌঁছাতে পারেনি, কেননা তার জন্মের আগেই আমাকে খোঁজা করা হয়েছিল। তবে কখনও কামনা-বাসনা মেটাতে না পারলেও তার প্রতি আমার প্রবল ভালোবাসা ছিল। শৈশবে আমি তাকে লালন পালন করেছি, তারপর বড় হওয়া পর্যন্ত দীর্ঘকাল তার চলার পথে উপদেশ দিয়েছি। কোনো ধরনের কার্পণ্য না করে নিজেকে উজাড় করে ঢেলে দিয়েছি। সবশেষে আমার হাতে মাথা রেখেই সে মারা যায়।

নিচের পৃথিবীতে যাওয়ার আগে লসট্রিস ফিসফিস করে আমাকে কিছু কথা বলেছিল, যা আমি কখনও ভুলতে পারবো নাঃ আমি জীবনে কেবল দুজন পুরুষকে ভালোবেসেছি। আর তার মাঝে তায়তা, তুমি হলে একজন।

এরকম মিষ্টি কথা আমি আর কখনও শুনিনি।

তার রাজকীয় সমাধির পরিকল্পনা আর নির্মাণের তত্ত্বাবধান আমিই করেছিলাম। তারপর সমাধির মাঝে সেই সুন্দর নিথর দেহটি রেখে আমার ইচ্ছা হচ্ছিল আমি নিজেও সেই নিচের পৃথিবীতে চলে যাই। তবে জানতাম তা হবার নয়; কেননা আমাকে তার সন্তানদের দেখাশুনা করতে হবে, যেরকম তারও করেছিলাম। সত্যি বলতে কী এই দায়িত্বটি গুরুভার ছিল না, কেননা এই পবিত্র দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আমার জীবন আরও সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল।

ষোল বছর বয়সে তেহুতি একজন পুরোপুরি নারীতে পরিণত হয়েছে। তার গায়ের ত্বক চকচকে আর মসৃণ। সরু, নিটোল বাহু আর পাদুটো ছিল একজন নৃত্যশিল্পীর মতোই সুগঠিত। কিংবা বলা যায় তার বাবার সেই বিখ্যাত যুদ্ধের ধনুকের মতো, যা আমি নিজে বানিয়েছিলাম আর তার মৃত্যুর পর সেটা তার শবাধারের ঢাকনির উপর রেখে সমাধিটি সিলমোহর করে দিয়েছিলাম।

তেহুতির নিতম্ব চওড়া হলেও কোমর ছিল একটি সুরার জগের গলার মতো সরু। বুকদুটো গোলাকার আর নিটোল। মাথাজুড়ে সোনালি কোঁকড়া চুল ছিল তার সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য। মায়ের মতো তার চোখদুটোও ছিল সবুজ। তার সৌন্দর্যের কথা বলে শেষ করা যাবে না আর যখনই সে আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসতো আমার বুক ধক করে উঠতো। তার স্বভাব ছিল কোমল, সহজে রাগতো না তবে একবার রেগে উঠলে সে অকুতোভয় আর কঠিন হয়ে উঠতো।

আমি তাকে প্রায় সেরকমই ভালোবাসি যেমনটি তার মাকে এখনও ভালোবাসি।

এটন মুক্তকণ্ঠে আমার প্রশংসা করে বললো, তুমি ভালোভাবেই ওদের মানুষ করছো তায়তা। ওরাই হচ্ছে সেই সম্পদ যা আমাদের মিসরকে বর্বরদের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে।

এই বিষয়টিসহ আরও অনেক বিষয়ে এটন আর আমি সম্পূর্ণ একমত ছিলাম। আর এটিই আসল কারণ যেজন্য আমরা দুজন এই সূদুর নির্জন স্থানে এসেছি। যদিও স্বয়ং ফারাওসহ রাজপ্রাসাদের সবাই জানে আমরা এখানে বাও খেলার প্রতিযোগিতা করছি।

তার এই মন্তব্যের তাৎক্ষণিক কোনো উত্তর না দিয়ে আমি চোখ নামালাম বাও ছকের দিকে। আমি যখন মেয়েদের দিকে তাকিয়ে ছিলাম, তখন এটন ওর শেষ চালটা দিয়েছিল। মিসরের এই ভীষণ সুন্দর খেলায় সে ছিল অত্যন্ত কুশলি একজন খেলোয়াড়, কিংবা সমগ্র সভ্য জগতেরও একজন শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড় বলা চলে। শুধু আমি ছাড়া। আমি সাধারণত চারটি খেলার মধ্যে তিনটিতেই তাকে হারিয়ে দিতাম।

এখন একবার নজর দিয়েই বুঝতে পারলাম সেই তিনটি জিতের একটি এবার হতে যাচ্ছে। তার শেষ চালটা বেশ দুর্বল ছিল, খুঁটির বিন্যাস

এলোমেলো হয়ে পড়েছিল। কোনো কোনো সময় যখন সে ভাবতে শুরু করে যে, এই দানে তার জয় নিশ্চিত হবে তখন প্রায়ই সে এই ভুলটি করে ফেলতো। বাতাসে তার অসাবধানতা টের পাওয়া যেত আর তখন সে সাতটি খুঁটির নিয়ম মেনে চলতো না। এরপর সে দক্ষিণ দিকের নৌকা থেকে পূর্ণ আক্রমণে মনোযোগ দিতে গিয়ে পুর্ব কিংবা পশ্চিম দিকের দখল নিতে আমাকে সুযোগ করে দিত। এবার পূর্বদিক ভোলা ছিল। আমি আর দ্বিতীয় সুযোগের জন্য অপেক্ষা না করে গোখরা সাপের মতো একটা ছোবল মারলাম।

আমার আচমকা এই চালটা যখন সে বুঝতে পারলো তখন হতবাক হয়ে পেছন দিকে হেলে পড়তেই টুলের পেছন দিকে প্রায় উল্টে পড়লো। আমার এই চাতুরিটি বুঝতে পেরে রাগে তার মুখ কালো হয়ে গেল। কথা বলতে গিয়ে তার গলা ভেঙে গেল, আমার তোমাকে ঘৃণা করা উচিত তায়তা। আগে না করলেও এখন অবশ্যই করা উচিত।

আমি যদুর সম্ভব আবেগ দমন করে বললাম, শোন তুমি আমার পুরোনো বন্ধু। আসলে আজ আমার ভাগ্য ভালো ছিল। যাইহোক এটাতো শুধু একটা খেলা।

সে রাগে গাল ফুলিয়ে বললো, এ যাবত যত ফাঁকাবুলি তোমার কাছ থেকে শুনেছি, তার মধ্যে এটা হচ্ছে সবচেয়ে মোটাদাগের। এটা শুধু খেলা নয়। এটা হচ্ছে বেঁচে থাকার একটা কারণ। এবার সে আসলেই রেগে গেছে। মনে হল।

আমি টেবিলের নিচে থেকে তামার মদের জগটা বের করে তার কাপটা ভরে দিলাম। এটা সর্বোৎকৃষ্ট মদ, পুরো মিসরের মধ্যে সেরা। আমি নিজে ফারাওর প্রাসাদের নিচের মদ্য-ভান্ডার থেকে সরাসরি নিয়ে এসেছিলাম। এটন আবার গাল ফুলিয়ে রাগটা আমার উপর ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করতে যাবে, কিন্তু তার আগের মোটা মোটা আঙুল দিয়ে কাপের হাতলটা ধরতেই সে কাপটা ঠোঁটের কাছে তুললো। দুই ঢোক গিলতেই সুখের আমেজে তার চোখ মুদে এল। তারপর কাপটা নামিয়ে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।

তারপর বাও খেলার খুঁটিগুলো চামড়ার থলেতে ভরতে ভরতে বললো, হয়তো তোমার কথাই ঠিক তায়তা। বেঁচে থাকার আরও ভালো কারণ নিশ্চয়ই আছে। উত্তরদিক থেকে কী খবর পেলে? তোমার গোয়েন্দা বুদ্ধির চমক আরেকবার আমাকে দেখাও দেখি।

এবার আমাদের এই সাক্ষাতকারের আসল উদ্দেশ্যে আমরা পৌঁছেছি। উত্তরদিকটা সবসময়ই বিপজ্জনক ছিল।

একশো বছর আগে বিশ্বাসঘাতকতা আর বিদ্রোহের কারণে শক্তিশালী মিসর বিভক্ত হয়ে পড়ে। লাল দাবীদার নকল ফারাও, ইচ্ছে করেই আমি তার নাম নিচ্ছি না–অনন্তকাল সে অভিশপ্ত হোক। এই বিশ্বাসঘাতক লোকটি আসল ফারাওয়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে আসিউতের উত্তরে পুরো অংশ দখল করে নেয়। তারপর থেকে আমাদের এই মিসরে একশো বছর ধরে গৃহযুদ্ধ চলছে।

পরবর্তীতে এই লাল দাবীদারের উত্তরাধিকারী সিনাইয়ের ওপারের তৃণভূমি থেকে আসা বন্য এবং যোদ্ধা এক উপজাতির আক্রমণের শিকার হল। ঘোড়া আর রথের সাহায্যে এই বর্বররা পুরো মিসর জয় করে নিল। এমন অস্ত্রের কথা আমরা আগে কখনও শুনিনি। লাল দাবীদারকে পরাজিত করার পর এরা মধ্য সাগর থেকে শুরু করে আসিউত পর্যন্ত মিসরের সম্পূর্ণ উত্তরাংশ দখল করে নিল। তারপর এই হাইকসোরা দক্ষিণে আমাদের উপর হামলা চালাল।

আমরা অর্থাৎ আসল মিসরীয়রা তাদের হামলা প্রতিহত করতে পারলাম। আমরা নিজ ভূমি থেকে বিতাড়িত হলাম। তারপর আরও দক্ষিণে নীলনদের জলপ্রপাতের ওপারে এলিফ্যান্টিনি দ্বীপ আর পৃথিবীর শেষ সীমানার জঙ্গলে পালিয়ে গেলাম। যখন আমরা ক্রমশ নির্জীব আর অবসন্ন হয়ে পড়ছিলাম তখন আমাদের প্রভু, রানি লসট্রিস নতুন করে সেনাবাহিনী পুনর্গঠন করছিলেন।

এই নবজন্মলাভে আমার ভূমিকাও খুব একটা তুচ্ছ ছিল না। নিজের ব্যাপারে আমি সাধারণত বেশি বলি না, তবে অন্তত এটুকু বলতে পারি যে, আমার পরামর্শ আর পথনির্দেশ ছাড়া আমার প্রভু এবং তার পুত্র যুবরাজ মেমনন, যিনি এখন ফারাও ত্যামোস হয়েছেন, কোনদিন তাদের উদ্দেশ্য সাধন করতে পারতেন না।

প্রভুর জন্য আমি যেসব কাজ করেছিলাম, তার মধ্যে প্রথমটি ছিল স্পোকওয়ালা চাকা দিয়ে তৈরি উন্নত প্রযুক্তির রথের গাড়ি। হাইকসোদের নিরেট কাঠের চাকা থেকে এগুলো অনেক হালকা আর দ্রুতগামি ছিল। এই রথ টেনে নেবার জন্য ঘোড়া খুঁজে আনলাম। তারপর যখন আমরা পুরোপুরি প্রস্তুত হলাম, তখন নতুন ফারাও নবযুবা ত্যামোসের নেতৃত্বে আমাদের সেনাবাহিনী জলপ্রপাতের মধ্য দিয়ে উত্তরে মিসর অভিযানে বের হল।

হানাদার হাইকসো নেতা নিজেকে রাজা স্যালিটিস নামে পরিচয় দিত, তবে সে মোটেই রাজা ছিল না। বড়জোর সে ছিল একজন দস্যুসর্দার এবং একজন অপরাধী। তবে তার সেনাবাহিনী সংখ্যায় মিসরীয়দের দ্বিগুণ ছিল। এরা ছিল অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত এবং দুর্ধর্ষ প্রকৃতির।

আমরা হঠাৎ থিবস আক্রমণ করে ওদের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড লড়াই করলাম। ওদের রথগুলো চুর্ণবিচুর্ণ করে প্রচুর সৈন্য হত্যা করলাম। আর বাদবাকিদেরকে উত্তরদিকে তাড়িয়ে দিলাম। যুদ্ধক্ষেত্রে দশহাজার মৃতদেহ আর দুই হাজার ভাঙা রথ ফেলে ওরা পিছু হটে গেল।

তবে আমাদেরও অনেক ক্ষয়ক্ষতি হল। আর সেজন্যই তাদেরকে অনুসরণ করে পুরোপুরি ধ্বংস করতে পারলাম না। তখন থেকেই হাইকমোরা নীলনদের বদ্বীপে লুকিয়ে থাকতে শুরু করলো।

সেই লুটেরা রাজা স্যালিটিস এখন মৃত। যুদ্ধক্ষেত্রে একজন মিসরীয় যোদ্ধার তরবারির আঘাতে সে মারা যায়নি, যা তার জন্য সঠিক বিচার হত। চারপাশে একগাদা অতিকুৎসিৎ স্ত্রী আর বীভৎস অগুণতি সন্তান নিয়ে বার্ধক্যের কারণে সে মারা গিয়েছিল। এর মধ্যে তার সবচেয়ে বড় ছেলে বিওনও ছিল। এই বিওন এখন নিজেকে রাজা বিওন নামে উচ্চ এবং নিম্ন মিসর সাম্রাজ্যের ফারাও ঘোষণা করেছে। আসলে সে একজন হত্যাকারী ছাড়া আর কিছুই নয়, সে তার বাবার চেয়েও নিকৃষ্ট। আমার গুপ্তচরেরা নিয়মিত আমাকে জানাতে যে, থিবসের যুদ্ধে বিধ্বস্ত হয়ে যাওয়া হাইকসো সেনাবাহিনীকে সে আবার পুনর্গঠন করছে।

এই খবরগুলো বেশ অস্বস্তিকর ছিল, কেননা একই যুদ্ধে আমাদের যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল তা পুষিয়ে উঠার রসদ সংগ্রহ করতে আমাদের বেশ কষ্ট হচ্ছিল। চতুর্দিকে স্থলবেষ্টিত আমাদের দক্ষিণ রাজ্যটি বিশাল মধ্যসাগর থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ছিল আর সভ্যজগতের বিভিন্ন দেশ এবং নগর রাষ্ট্রের সাথেও বাণিজ্য হচ্ছিল না। যুদ্ধ করার জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ চামড়া, কাঠ, তামা, খাদ, টিন এবং শক্তির অন্যান্য উৎস এই দেশগুলোতে প্রচুর ছিল, অথচ আমাদের এগুলোর অভাব ছিল। এছাড়া আমাদের মানবসম্পদেরও কমতি ছিল। আমাদের এখন মিত্র প্রয়োজন।

অন্যদিকে আমাদের শত্রুপক্ষ হাইকসোদের নীল নদের মোহনায় চমৎকার বন্দর ছিল। এছাড়া আমার গুপ্তচরেরা আমাকে আরও জানিয়েছে যে, হাইকসোরাও অন্য যোদ্ধা দেশের সাথে মিত্ৰতা করার চেষ্টা করছে।

এসব বিষয় নিয়ে আলাপ করতেই এটন আর আমি এই নির্জন জায়গায় মিলিত হয়েছিলাম। আমাদের প্রিয় মিসরের অস্তিত্ব এখন তরবারির ডগায় ঝুলছে। এটন আর আমি এনিয়ে অনেকবার দীর্ঘ আলাপ করেছি, তবে এই শেষবার আলাপআলোচনা করে একটা সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ফারাওর সামনে তুলে ধরবো।

তবে রাজকুমারিদের উদ্দেশ্য ছিল অন্যরকম। ওরা লক্ষ্য করেছিল এটন বাও খেলার খুঁটি তুলে নিচ্ছে আর এটাকেই ওরা একটা ইঙ্গিত হিসেবে ধরে নিয়েছিল যে, এবার আমাকে পুরোপুরি ওদের দখলে নিতে পারবে। আমি ওদের দুজনের প্রতি আত্মনিবেদিত হলেও ওদের চাহিদা ছিল খুব বেশি। উপহৃদের পানি চতুর্দিকে ছিটিয়ে ওরা দ্রুত আমার দিকে ছুটে আসতে লাগলো। বেকাথা ছোট হলেও সে ছিল খুব দ্রুত আর দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। কোনো কিছু পাওয়ার জন্য সে যে কোনো কিছু করতে পারত। তেহুতিকে পেছনে ফেলে সে ভেজা আর ঠাণ্ডা শরীর নিয়ে আমার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়লো।

তারপর আমার গলা জড়িয়ে ধরে আমার গালে ওর লাল চুলো মাথাটা খুঁজে ধরে চেঁচিয়ে উঠলো, আমি তোমাকে ভালোবাসি তাতা। আমাদেরকে একটা গল্প শোনাও, তাতা।

এদিকে তেহুতিও ছুটে এলো, তবে সে জায়গা পেল আমার পায়ের কাছে। ভেজা শরীরে মাটিতে বসে সে আমার পা তার বুকে চেপে ধরলো, তারপর আমার হাঁটুর উপর থুতনি রেখে উপরের দিকে মুখ তুলে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললো, হ্যাঁ, তাতা। আমাদের মায়ের কথা বল। বল, মা কীরকম সুন্দরী আর বুদ্ধিমতি ছিল।

আমি প্রতিবাদের সুরে বললাম, আগে আমাকে এটন চাচার সাথে কথা বলতে হবে।

বেকাথা বললো, আচ্ছা ঠিক আছে। তবে বেশি সময় নিও না। এটা খুবই বিরক্তিকর।

ঠিক আছে, কথা দিলাম, বেশি সময় নেব না। তারপর এটনের দিকে ফিরে হাইকসো ভাষায় কথা বলতে শুরু করলাম। আমরা দুজনেই আমাদের শত্রুর ভাষায় স্বচ্ছন্দে কথা বলতে পারতাম।

আমি সবসময় আমার শত্রুকে জানার চেষ্টা করতাম। শব্দ আর ভাষার ব্যাপারে আমার বেশ পটুত্ব ছিল। থিবসে ফেরার পর লেখাপড়ার জন্য আমি অনেক বছর সময় পেয়েছিলাম। এটন নুবিয়ার শরণার্থীদলের সাথে যোগ দেয় নি। অভিযানের প্রতি তার খুব একটা আগ্রহ ছিল না। সে মিসরেই রয়ে যায় আর হাইকসোদের অত্যাচার সহ্য করে। তবে ভাষাসহ হাইকসোদের কাছ থেকে শেখার যা কিছু ছিল সব শিখে নেয়। রাজকুমারিরা এই ভাষার এক বর্ণও বুঝতে পারে না।

বেকাথা রেগে ঠোঁট ফুলিয়ে বললো, তোমাদের এই বিশ্রী ভাষায় কথা বলা শুনলে আমার ঘেন্না করে। তেহুতিও মাথা নেড়ে তার সাথে সুর মিলিয়ে বললো, যদি তুমি আমাদের ভালোবাস তাহলে মিসরি ভাষায় কথা বল তায়তা।

আমি বেকাথাকে জড়িয়ে ধরে তেহুতির মাথায় হাত রেখে আদর করলাম। তবে তারপরও এটনের সাথে সেই ভাষায় কথা বলে চললাম, যা মেয়েরা ভীষণ অপছন্দ করে। বাচ্চাদের কথায় কান না দিয়ে যা বলার বলে যাও বন্ধু।

এটন হাসি চেপে বললো, তাহলে সেই কথাই রইল তায়তা। আমাদের মিত্র প্রয়োজন আর সেই মিত্রদের সাথে বাণিজ্য করতে হবে। তবে সেই সাথে এসব বিষয় হাইকসোদের কাছে গোপন রাখতে হবে।

আমি মাথা নেড়ে গম্ভীরস্বরে বললাম, সবসময়ের মতো তুমি সঠিক জায়গায় পৌঁছেছ আর সত্যিকার সমস্যাটির কথাও উল্লেখ করেছ। মিত্র এবং বাণিজ্য। খুব চমৎকার বলেছ। তাহলে বল বাণিজ্য করার মতো কী আছে আমাদের কাছে, এটন?

জলপ্রপাতের ওধারে নুবিয়ায় নির্বাসিত জীবন কাটাবার সময় আমরা খনি থেকে যে সোনা পেয়েছি সেগুলো আছে। যদিও এটন কখনও মিসর ছেড়ে যায়নি, কিন্তু তার কথা শুনে মনে হচ্ছে যেন সে সেই দলবদ্ধ অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছিল। ভেতরে ভেতরে আমার হাসি পেলেও আমি গাম্ভীর্য বজায় রাখলাম। তারপর সে বললো, যদিও এই হলুদ ধাতুটি রূপার মতো তেমন মূল্যবান নয় তবুও মানুষ এর জন্য লালায়িত। ফারাও যে পরিমাণ সোনা তার কোষাগারে জমা করেছেন তা দিয়ে আমরা সহজেই বন্ধু আর মিত্র কিনতে পারবো।

আমি একমত হয়ে মাথা নাড়লাম। যদিও আমি জানতাম এটন কিংবা ওর মতো অন্য যারা আমার মতো রাজার এত কাছাকাছি নয়, তারা ফারাওয়ের সম্পদ সম্পর্কে বাড়িয়ে বলে। বিষয়টার আরও ব্যাপ্তি দেবার জন্য আমি তাকে মনে করিয়ে দিয়ে বললাম, তবে প্রত্যেকবছর প্লাবনের সময় আমাদের মা নীলনদ থেকে যে কালো দোঁআশলা মাটি আমরা দুই তীরে পাই সেকথা ভুলে যেও না। মানুষকে খেয়েপড়ে বাঁচতে হবে এটন। ক্রিট, সুমেরিয় আর হেলেনিয় নগর রাষ্ট্রগুলোর চাষযোগ্য জমির পরিমাণ খুব কম। ওদের জনগণের মুখে খাবার তুলে দেবার মতো শস্য জোগাতে ওদের খুব ভোগান্তি পোহাতে হয়। আর আমাদের প্রচুর শস্য রয়েছে।

আরে তাইতো তায়তা। বাণিজ্য করার মতো আমাদের কাছে শস্য আর ঘোড়া আছে। আমাদের ঘোড়া পৃথিবীর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। এছাড়া এর চেয়েও আরও দুর্লভ এবং মূল্যবান কিছু বস্তু আমাদের কাছে আছে। এই কথা বলে এটন একটু থামলো, তারপর আমার কোলে বসা যে শিশুটিকে আমি আদর করছিলাম আর আমার হাঁটুর কাছে বসা সুন্দর শিশুটির দিকে সে তাকাল।

এই বিষয়ে আর কিছু বলার প্রয়োজন ছিল না। টাইগ্রিস আর ইউফ্রেটিস নদীর মাঝের এলাকার ক্রিট আর সুমেরিয়রা ছিল আমাদের সবচেয়ে কাছের এবং অত্যন্ত শক্তিশালী প্রতিবেশি। এই দুই জাতের মানুষেরাই সাধারণত শ্যামবর্ণ হত আর ওদের মাথার চুলও ছিল কালো। ওদের শাসক গোষ্ঠির কাছে এজিয়ান গোত্র আর মিসরের রাজপরিবারের সুন্দর চুল আর ফর্সা ত্বকের মেয়েদের ভীষণ কদর রয়েছে। তবে ফ্যাকাসে চেহারার কাঠখোট্টা হেলেনিয় মেয়েদের সাথে আমাদের নীল নদের অববাহিকার উজ্জ্বল রত্নের মতো লাবণ্যময়ী মেয়েদের কোনো তুলনাই করা যায় না।

আমার এই দুই রাজকুমারির বাবা তানুসের ছিল আগুনে রঙের কোঁকড়ানো চুল আর মা রানি লসট্রিস ছিলেন উজ্জ্বল স্বর্ণকেশি। তাদের বংশধর, এই দুই রাজকন্যার সৌন্দর্যের খ্যাতি সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছিল। দূরদূরান্ত থেকে বিভিন্ন দেশের দূতেরা ইতিমধ্যেই অতিকষ্টে বিশাল মরুভূমি এবং গভীর সমুদ্র পেরিয়ে থিবসের রাজপ্রাসাদে এসে ফারাও ত্যামোসের কাছে তাদের প্রভুদের আগ্রহ প্রকাশ করে জানিয়েছে যে, তারা ত্যামোস রাজপরিবারের সাথে বৈবাহিক সম্পর্কে স্থাপন করতে আগ্রহী। সুমেরিয় রাজা নিমরদ এবং ক্রিটের সর্বাধিরাজ মিনোজ তাদের দূত পাঠিয়েছিলেন।

আমার পরামর্শ মোতাবেক ফারাও এই দুই রাজ্যের দূতকে সাদরে বরণ করেছিলেন। রূপা আর সিডার কাঠের যেসব চমৎকার উপহারসামগ্রী ওরা এনেছিল তিনি তা গ্রহণ করেছিলেন। তারপর মনোযোগ দিয়ে তার একজন কিংবা উভয় বোনের সাথে বিয়ের প্রস্তাবের কথা শুনলেন। তবে ফারাও জানালেন দুই বোনই এখনও অনেক ঘোট, সুতরাং বিয়ের ব্যাপারে কোনো কথা এখনই বলা যাবে না। বরং ওরা প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর আবার এ-বিষয়ে আলাপ করা যেতে পারে। তবে এটা বেশ কিছুদিন আগের কথা আর এখন পরিস্থিতি বদলেছে।

সে-সময় ফারাও আমার সাথে সুমেরিয় কিংবা ক্রিটের সাথে মিসরের সম্ভাব্য মৈত্রী বন্ধন নিয়ে আলাপ করেছিলেন আর আমি তাকে সুকৌশলে ইঙ্গিত দিয়েছিলাম যে, সুমেরিয়দের চেয়ে ক্রিটের সাথে মৈত্রি করাটাই বরং ভালো হবে।

প্রথমত সুমেরিয়রা সমুদ্রগামি জাতি নয়। অশ্বারোহী সেনা এবং রথসহ ওদের শক্তিশালী এবং সুসজ্জিত সেনাবাহিনী থাকলেও তাদের তেমন কোনো নৌবাহিনী ছিল না। আমি ফারাওকে মনে করিয়ে দিয়েছিলাম যে, আমাদের সাগরে যাওয়ার কোনো পথ নেই। হাইকসো শত্রুরা উত্তর দিকে নীল নদের যাওয়ার পথটি নিয়ন্ত্রণ করছে আর আমরা মূলত একটি ভূ-বেষ্টিত দেশ।

সুমেরিয়দেরও সমুদ্রপথের যাত্রা সীমিত ছিল আর তাদের নৌবহরও ছিল অন্যান্য দেশ, যেমন ক্রিট এবং পশ্চিমের মরিতানিয়দের তুলনায় বেশ ছোট। সুমেরিয়রা জাহাজবোঝাই মালামাল নিয়ে সমুদ্রপথে যাওয়ার ঝুঁকি নিতে সবসময় অনিচ্ছুক ছিল। ওরা জলদস্যু এবং সমুদ্রঝড়ের তাণ্ডবে আতঙ্কিত ছিল। তাছাড়া দুইদেশের মাঝে স্থলপথও বিপদসঙ্কুল ছিল।

মধ্য এবং লোহিত সাগরের মধ্যেকার যোজকটি হাইকসোদের নিয়ন্ত্রণে ছিল আর মিসরের সাথে উত্তরে সিনাই মরুভূমির সংযোগ ছিল। সেক্ষেত্রে সুমেরিয়দের সিনাই মরুভূমির মধ্য দিয়ে হেঁটে আরও দক্ষিণে গিয়ে জাহাজে চড়ে লোহিতসাগর পার হয়ে আমাদের কাছে আসতে হবে। এই পথ পাড়ি দিতে গিয়ে তাদের সেনাবাহিনীকে অনেক ঝামেলা পোহাতে হবে, এছাড়া পানির কষ্ট আর লোহিতসাগরে জাহাজ চলাচলের অপ্রতুলতার কথা ছেড়ে দিলেও এই পথে যাত্রা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে।

ইতিপূর্বে যে প্রস্তাবটি আমি ফারাওকে দিয়েছিলাম, এখন এটনকে তার কিছুটা ধারণা দিলাম, সেটা হল মিসর আর ক্রিটের সর্বাধিরাজ মিনোজের মাঝে একটি মৈত্রি চুক্তি। বংশপরম্পরায় ক্রিটের শাসকের উপাধি ছিল সর্বাধিরাজ মিনোজ। তিনি ছিলেন আমাদের ফারাওয়ের সমকক্ষ। অবশ্য তাকে আমাদের ফারাওয়ের চেয়ে বেশি শক্তিশালী বলাটা বিশ্বাসঘাতকতা হবে। তবে এটুকু অন্তত বললে যথেষ্ট হবে যে, তার নৌবহরে দশহাজারেরও বেশি রণতরী এবং এমন উন্নত ধরনের বাণিজ্যপোত ছিল যে, আর কোনো জাহাজ তাদেরকে সাগরে ধরতে কিংবা পরাজিত করতে পারতো না।

ক্রিটবাসীরা যা চায় তা আমাদের কাছে আছে: শস্য, সোনা এবং সুন্দরী বিয়ের কনে। আর আমাদের যা প্রয়োজন ক্রিটে তা আছে: অত্যন্ত দুর্ধর্ষ রণতরী বহর। যার সাহায্যে নীলনদের বদ্বীপের মোহনায় হাইকসোদের বন্দরগুলো অবরোধ করা যায়। আর সৈন্য বোঝাই সুমেরিয় জাহাজগুলোকে পাহারা দিয়ে মধ্য সাগরের দক্ষিণ উপকূলে পাঠিয়ে হাইকসোদের উপর একটি ভয়ঙ্কর সাঁড়াশি আক্রমণ করে, এই দুই শক্তির মাঝে ওদের সেনাবাহিনীকে চেপে ধরে পিষে ফেলা যায়।

এটন করতালি দিয়ে আমাকে অভিনন্দন জানিয়ে বললো, চমৎকার পরিকল্পনা! প্রায় নির্ভুল একটি পরিকল্পনা। তবে প্রিয় তায়তা, একটা ছোট বিষয় তোমার নজর এড়িয়ে গেছে। সে দাঁত বের করে হাসতে লাগলো আর একটু আগে বাও খেলায় আমি যে তাকে হারিয়ে দিয়েছিলাম তার একটা শোধ নিতে পেরেছে ভেবে বেশ আত্মতৃপ্তির ভাব দেখাতে লাগলো। আমি কখনও প্রতিহিংসা পরায়ণ ছিলাম না, তবে এই ঘটনার সুবাদে একটু নির্দোষ আনন্দ নেবার সুযোগও হারালাম না। একটু হতবাক হবার ভঙ্গি : করে বললাম।

আহা, দয়া করে বলনা কী সেটা! আমিতো খুব সাবধানে সবদিক ভেবে এই পরিকল্পনা করেছি। এতে ভুলটা কোথায় বল?

এটন জিহ্বায় চুকচুক শব্দ করে তার হাতির মতো বিশাল এক উরুতে চাপড় মেরে বললো, তুমি অনেক দেরি করে ফেলেছো বন্ধু। ক্রিটের সর্বাধিরাজ মিনোজ ইতিমধ্যেই হাইকসো রাজা বিওনের সাথে একটা গোপন মৈত্রিচুক্তি করে ফেলেছে। একথা বলে এটন মনে করেছে সে আমার পরিকল্পনায় একটা বিরাট খুঁত বের করে ফেলেছে।

উত্তরে আমি বললাম, হ্যাঁ ঠিকই বলেছো! আমার মনে হয় পাঁচমাস আগে তামিয়াতে ক্রিটরা বিওনের সাথে বাণিজ্য করার জন্য যে দুর্গ স্থাপন করেছে তুমি তার কথা বলছে। এটাতো নীল বদ্বীপের একেবারে পূর্বদিকের মোহনায় অবস্থিত, তাই না?

এবার এটনের হতাশ হবার পালা। তুমি কখন এটা জানলে? কীভাবে জানলে?

আমি দুই হাত দুদিকে মেলে বললাম, এটন! তুমি নিশ্চয়ই এটা আশা করতে পারো না যে আমার গোপন খবরের সমস্ত সূত্রগুলো আমি প্রকাশ করে দেব?

এবার এটন দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, সমর চুক্তি না হলেও সর্বাধিরাজ মিনোজ আর বিওনের মধ্যে ইতিমধ্যেই একটা গোপন সমঝোতা হয়েছে। সবাই জানে তুমি খুব বুদ্ধিমান তায়তা। তবে এখানে তুমি তেমন কিছু করতে পারবে না।

আমি রহস্যময়ভাবে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, আর যদি বিওন প্রতারণা করার পরিকল্পনা করে থাকে?

সে হা করে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, প্রতারণা মানে? বুঝতে পারলাম না তায়তা। এখানে কী ধরনের প্রতারণা হবে?

তোমার কোনো ধারণা আছে এটন, ক্রিটের সর্বাধিরাজ মিনোজ কী পরিমাণ রূপা হাইকসো এলাকার মাঝে তাদের এই নতুন দুর্গে জমা করেছে?

নিশ্চয়ই অনেক বেশি হবে। যদি সর্বাধিরাজ মিনোজ বিওনের কাছ থেকে আগামী মৌসুমের বেশিরভাগ শস্য কিনতে চান তাহলে তাকে প্রচুর পরিমাণে রূপা হাতে রাখতে হবে। তারপর এটন একটু সাবধানে হিসেব করে বললো, সম্ভবত দশ কিংবা বিশ লাখও হবে।

তোমার কল্পনাশক্তি খুবই ভালো বলতে হয়, প্রিয় বন্ধু। তবে সর্বাধিরাজ মিনোজ যে সমস্যাগুলোর সম্মুখিন হতে যাচ্ছেন, তুমি তার সামান্য অংশ বলেছ। ঝড়ের মৌসুমে তিনি খোলা সাগরে এত সম্পদ বোঝাই জাহাজ পাঠাবার ঝুঁকি নেবেন না। কাজেই বছরের পাঁচমাস তিনি মধ্য সাগরের দক্ষিণ উপকূলে রূপার পিণ্ডগুলো পাঠাতে পারছেন না। আর শীতকালে তার দ্বীপ থেকে পাঁচশো লিগেরও বেশি দূরত্ব অতিক্রম করতে হবে।

এটন দ্রুত বলে উঠলো, হ্যাঁ, ঠিক বলেছ! আমি তোমার যুক্তিটা বুঝতে পেরেছি। তার মানে সেই সময়ে সর্বাধিরাজ মিনোজ বিশাল সমুদ্রে আফ্রিকার উপকূলের দেশগুলোর সাথে বাণিজ্য করতে পারবেন না!

আমি একমত হয়ে বললাম, পুরো শীতকালে অর্ধেক পৃথিবীর সাথে তার কোনো সম্পর্ক থাকবে না। তবে যদি তিনি মিসরীয় উপকুলে একটি নিরাপদ নৌঘাঁটি স্থাপন করতে পারেন তবে তার নৌবহর শীতকালের ঝড়ের ধাক্কাটা সামলাতে পারবে। তারপর সারা বছর ধরে স্থলভূমির নিরাপদ আচ্ছাদনে তার জাহাজগুলো মেসোপটেমিয়া থেকে মরিতানিয়া পর্যন্ত বাণিজ্য করে যেতে পারবে। একটু থেমে আমি তাকে সর্বাধিরাজ মিনোজ কী পরিকল্পনা করতে যাচ্ছেন তার বিশালত্ব পুরোপুরি বুঝার সুযোগ দিলাম। তারপর বললাম, এই ধরনের কার্যক্রমের একশোভাগের এক অংশও বিশ লাখ রূপার বাটে পোষাবে না। কমপক্ষে পাঁচশো লাখ রূপা তাকে তামিয়াতের নতুন দুর্গে জমা রাখতে হবে যদি তাকে শীতকালে বাণিজ্য চালিয়ে যেতে হয়। তোমার কী মনে হয় এই বিপুল পরিমাণ রূপার জন্য যে কোনো লোক কি প্রতারণা করতে পারে না? বিশেষত সেই লোক যদি হয় বিওনের মতো বিশ্বাসঘাতক, লুণ্ঠনকারী এবং অসৎ একজন মানুষ?

আমার কথাগুলো শোনার পর পুরো বিষয়টা উপলব্ধি করে এটন কিছুক্ষণ নির্বাক হয়ে রইল। তারপর আবার ফ্যাসফ্যাসে কণ্ঠে আমাকে জিজ্ঞেস করলো, তাহলে তোমার কাছে প্রমাণ আছে যে, সর্বাধিরাজ মিনোজের সাথে করা প্রাথমিক মৈত্রি চুক্তি উপেক্ষা করে বিওন তামিয়াত দুর্গ আক্রমণ করবে আর সর্বাধিরাজ মিনোজের সমস্ত সম্পদ লুট করে নেবে? এই কথাই কি তুমি আমাকে বলতে চাচ্ছ তায়তা?

আমি এটা বলিনি যে, বিওন একাজ করবে তার কোনো প্রমাণ আমার কাছে আছে। আমি শুধু তোমাকে একটা প্রশ্ন করেছি। আমি কোনো উক্তি করিনি। এবার তার হতভম্ব চেহারা দেখে আমি মুখ টিপে হাসলাম। একটু বেশি নির্দয় হয়ে গেছে, তবে দুষ্টুমিটা করা থেকে নিজেকে সামলাতে পারিনি। আমাদের এতদিনের পরিচয়ে এই প্রথম দেখলাম আমার কথার পিঠে সে কিছুই বলতে পারছে না। এবার সত্যি তার জন্য আমার করুণা হল।

দেখ এটন, আমরা দুজনেই জানি বিওন একজন জংলি আনাড়ি-গেঁয়ো ভূত। সে রথ চালাতে পারে, তলোয়ার ঘোরাতে পারে, তীর ছুঁড়তে পারে আর একটা নগরে লুটতরাজ করতে পারে। তবে আমার মনে হয়, গদাইলস্করি চাল আর যন্ত্রণাদায়ক ধীরগতি ছাড়া সে গোপন কোনো জায়গায় অভিযান চালাতে পারবে না।

এটন বললো, তাহলে কে সর্বাধিরাজ মিনোজের কোষাগার আক্রমণ করবে? তার কথার তাৎক্ষণিক কোনো উত্তর না দিয়ে আমি টুলে আরাম করে বসে মৃদু হাসলাম। এরপর সে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, নিশ্চয়ই তুমি নও তায়তা! সর্বাধিরাজ মিনোজের পাঁচলাখ রূপা লুট করার পরিকল্পনা করে কীভাবে তুমি ক্রিটের কাছে সহায়তা আর মৈত্রী আশা করবে?

আমি তাকে বললাম, অন্ধকারে কে হাইকসো আর কে মিসরী তা বুঝা বেশ কঠিন। বিশেষত মিসরীয়রা যদি হাইকসো যোদ্ধার পোশাক পরে, হাইকসো অস্ত্র হাতে নিয়ে হাইকসো ভাষায় কথা বলে। সে মাথা নাড়লো, মুখে কোনো কথা জোগাল না। তারপরও আমি আবার বললাম, তুমি নিশ্চয়ই একমত হবে যে, এ-ধরনের একটা বিশ্বাসঘাতক আক্রমণের পর আমাদের বিরুদ্ধে ক্রিট আর হাইকসোদের মাঝে কোনো ধরনের সমঝোতা হবার আদৌ আর কোনো আশা থাকবে?

এবার এটন মৃদু হেসে বললো, তুমি সত্যিই খুব চতুর, তায়তা। ভাবছি তোমাকে কখনও বিশ্বাস করতে পারবো না। তারপর সে জিজ্ঞেস করলো, আচ্ছা তামিয়াতে ক্রিটের গ্যারিসন কত বড় হবে?

এ-মুহূর্তে সৈনিক আর তীরন্দাজ মিলিয়ে হাজার দুয়েক হবে। তবে এদের বেশিরভাগই ভাড়াটে সৈনিক।

এবার সে আগ্রহ দেখিয়ে বললো, আচ্ছা! তারপর একটু থেমে বললো, তোমার কত লোক লাগবে কিংবা এভাবেও বলতে পারি, বিওনের কত লোক লাগবে এই কাপুরুষচিত পরিকল্পনা কাজে লাগাতে?

আমি বাধা দিয়ে বললাম, যথেষ্ট হয়েছে। সবকিছু আমি এটনকে বলতে পারি না আর সেও তা বুঝতে পেরে আর চাপাচাপি করলো না। তবে ঘুরিয়ে আরেকটা প্রশ্ন করলো।

তামিয়াত দুর্গে তুমি কাউকে জীবিত রাখবে না? সবাইকে মেরে ফেলবে?

তার এই প্রশ্নের উত্তরে বললাম, ওদের বেশিরভাগকেই পালিয়ে যাবার সুযোগ দেব। আমি চাই যেন বেশিরভাগ লোক ক্রিটে ফিরে গিয়ে সর্বাধিরাজ মিনোজকে বিওনের বিশ্বাসঘাতকতার কথাটা জানিয়ে তাকে সাবধান করে।

এটন বললো, আর ক্রিটের সম্পদ? ঐ পাঁচ লাখ রূপার কী হবে?

ফারাওয়ের সিন্দুক প্রায় খালিই বলা চলে। সম্পদ ছাড়া আমরা মিসরকে রক্ষা করতে পারবো না।

তারপর সে জিজ্ঞেস করলো, এই অভিযান কে চালাবে? তুমিই কি নেতৃত্ব দেবে তায়তা?

আমি চেহারায় দুঃখ নিয়ে বললাম, তুমি জানো আমি যোদ্ধা নই, এটন। আমি একজন চিকিৎসক, কবি এবং একজন শান্তিপ্রিয় দার্শনিক। যাইহোক যদি ফারাও নির্দেশ দেন তবে অধিনায়কের একজন উপদেষ্টা হিসেবে অভিযানে অংশ গ্রহণ নেবো।

তাহলে কে নেতৃত্ব দেবে? ক্রাটাস?

ক্রাটাসকে আমি পছন্দ করি, সে একজন ভালো সৈনিক। তবে লোকটা বুড়ো, মাথামোটা আর কোনো ধরনের যুক্তি কিংবা মতামতের ধার ধারে না।

এবার এটন চুক চুক করে বললো, হে শান্তিপ্রিয় কবি! তুমি জেনারেল ক্রাটাসের একেবারে সঠিক বর্ণনা দিয়েছ। সে না হলে ফারাও কাকে নিযুক্ত করবেন?

সম্ভবত জারাসকে নিযুক্ত করবেন।

ও আচ্ছা! রাজকীয় রক্ষিবাহিনীর নীল কুমির ডিভিশনের সেই বিখ্যাত ক্যাপ্টেন জারাস? তোমার পছন্দের লোক, তাই না তায়তা?

আমি তার কথায় টিটকারির সুর উপেক্ষা করে বললাম, আমার কোনো বিশেষ পছন্দের লোক নেই। তবে এই কাজের জন্য জারাস সবচেয়ে উপযুক্ত।

.

ফারাওকে আমার এই পরিকল্পনা জানালাম, কীভাবে ক্রিটের সর্বাধিরাজ মিনোজের কাছে রাজা বিওনকে অবিশ্বাসি করে তোলা হবে আর দুজনের মাঝে এমন সন্দেহের বীজ ঢুকানো হবে, যার ফলে ওরা পরস্পরকে অবিশ্বাস করবে। অথচ এই দুজনই পৃথিবীতে আমাদের চরম শত্রু। আমার এই চমৎকার আর অত্যন্ত সহজ পরিকল্পনা শুনে ফারাও ভীষণ অবাক হয়ে গেলেন।

আমি একান্তে তার সাক্ষাত প্রার্থনা করতেই তিনি সাথে সাথে রাজি হয়েছিলেন। আমরা দুজনে তার সিংহদরবারের চারপাশ ঘিরে থাকা দুপাশে পামগাছশোভিত চওড়া বারান্দায় হাঁটছিলাম। দক্ষিণ মিসরের নীল নদের সবচেয়ে চওড়া তীরে এর অবস্থান। অবশ্য আসিউতের পরই নদী আরও চওড়া হয়ে যখন হাইকসোদের অধিকৃত অঞ্চলের মধ্য দিয়ে বয়ে যায় তখন এর স্রোত প্রবাহ ধীর হয়ে আসে। তারপর বদ্বীপের মধ্য দিয়ে নদী মধ্যসাগরে উপনীত হয়।

শক্ৰমিত্র কেউই যাতে আমাদের দেখতে কিংবা আমাদের কথা শুনতে না পারে তা নিশ্চিত করার জন্য বারান্দার দুই মাথায় প্রহরী নিযুক্ত রয়েছে। এরা বিশ্বস্ত কর্মকতার সরাসরি অধীনস্থ ছিল, তবে এরা ফারাও আর আমার দৃষ্টির আড়ালে অবস্থান নিয়েছিল। মার্বেল পাথরে ছাওয়া পায়ে চলা পথ দিয়ে আমরা পায়চারি করছিলাম। এখন যেহেতু আমরা দুজন একা, তাই তার কাঁধে-কাঁধ মিলিয়ে চলা আমার জন্য সম্ভব ছিল। কেননা তার জন্ম মুহূর্ত থেকেই আমি তার সাথে খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলাম।

প্রকৃতপক্ষে আমার হাতেই তার জন্ম হয়। যখন রানি লসট্রিস এক টানে তাকে গর্ভ থেকে বের করে আনেন তখন আমিই প্রথম এই নবজাত শিশুর দেহটি হাতে ধরেছিলাম। আর প্রথম যে কাজটি এই রাজকুমার করেছিলেন, তা হল আমার গায়ে প্রস্রাব করা। এই কথা মনে পড়তেই আমি মৃদু হাসলাম।

সেদিন থেকেই আমিই ছিলাম তার শিক্ষক এবং গুরু। আমিই তাকে শিখিয়েছিলাম কীভাবে শৌচকর্ম করতে হয়, তারপর লেখাপড়া, তীর ঘোড়া আর যুদ্ধরথ চালনা শিখিয়েছিলাম। আমার কাছ থেকেই তিনি শিখেছেন কীভাবে একটি জাতিকে শাসন করতে হয়। অবশেষে এখন তিনি একজন চমৎকার যুবক, সাহসী ও বলবান যোদ্ধা আর এই মিসরের একজন পরিশীলিত শাসক হয়েছেন। তবে আমরা এখনও খুব ভালো বন্ধু। অন্তত এতটুকু আমি বলতে পারি, ফারাও আমাকে একজন পিতার মতো ভালোবাসেন, যে পিতাকে তিনি কখনও দেখেননি। আর আমিও তাকে সেই পুত্রের মতো ভালোবাসি যে পুত্র আমার কখনও ছিল না।

শত্রুসৈন্যকে বোকা বানাবার জন্য আমি যে কৌশল উদ্ভাবন করেছি, তার বিবরণ শুনতে শুনতে তিনি পায়চারি করা থামিয়ে অবাক বিস্ময়ে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। আমার বলা শেষ হলে তিনি তার ইস্পাত কঠিন হাত দিয়ে আমার দুই কাঁধ চেপে ধরলেন। তলোয়ার ঘুরিয়ে, তীর ছুঁড়ে আর একটি চার ঘোড়ার রথের লাগাম সামলিয়ে তার হাতদুটো কঠিন আর ব্রোঞ্জের মতো শক্ত হয়ে গিয়েছিল।

তারপর আমার মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি চিৎকার করে বলে উঠলেন, তায়তা, তুমি একটি বুড়ো পাজির পা ঝাড়া! সবসময় আমাকে অবাক করে দাও। তুমি ছাড়া আর কেউ এ-রকম সাংঘাতিক পরিকল্পনা করতে পারে না। আমার মনে আছে যখন তুমি আমাকে হাইকসো ভাষা শেখার জন্য জোরজবরদস্তি করেছিলে তখন আমার খুব রাগ হয়েছিল; আর এখনতো এটা ছাড়া আমি কিছুই করতে পারতাম না। এ-ধরনের অভিযানে আমাদের শত্রুদের একজন হিসেবে চলতে না পারলে তো আমি কখনও এই অভিযানে নেতৃত্ব দিতে পারতাম না।

এরপর আমার কয়েকঘন্টা লাগলো তাকে বুঝাতে যে ইতিহাসের এরকম চরম একটি মুহূর্তে একজন নেতার মিসর ছেড়ে যাওয়াটা অত্যন্ত বিপজ্জনক হতে পারে আর তামিয়াতে মিনোজের দুর্গ দখল কিংবা সেখানকার সম্পদের চেয়ে তার দেশে থাকাটা অনেক জরুরী। আমি হোরাসকে ধন্যবাদ দিলাম এজন্য যে, তার বয়স কম হওয়ায় তার মত বদলাতে অসুবিধা হয় না, আবার অন্যদিকে ভালোমন্দ বুঝার মতো বয়সও তার হয়েছে। অনেক আগে থেকে আমি শিখেছি কীভাবে তাকে বুঝতে না দিয়ে তার মত আমার দিকে ফেরাতে হয়। পরিশেষে প্রত্যেকবারই আমি আমার মতো করতে পারি।

যাইহোক আমার প্রস্তাব মতো ফারাও জারাসকেই এই অভিযানে নেতৃত্ব দিতে নির্দেশ দিলেন। ফারাওয়ের মতো জারাসের বয়সও মাত্র পঁচিশ বছর হলেও–সে ইতিমধ্যেই তার সামরিক পদবী অনুযায়ী যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছে। আমি ইতিপূর্বে বেশ কয়েকবার তার সাথে কাজ করেছি এবং জানতে পেরেছি যে তার সুনাম যথার্থ। সবচেয়ে বড় কথা সে আমাকে শ্রদ্ধা করে।

যাইহোক বিদায় নেবার আগে ফারাও ত্যামোস আমার হাতে রাজকীয় বাজপাখির সীলমোহরটা তুলে দিলেন। এর মানে হচ্ছে এটি বহনকারীর হাতে ফারাও তার পূর্ণ ক্ষমতা তুলে দিচ্ছেন। এই সীলমোহর যার হাতে থাকবে সে কেবল ফারাওকে জবাবদিহি করবে। রাজকীয় দায়িত্ব পালনকালে কোনো মানুষ মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতর হলেও সীলমোহরধারীকে কোনো প্রশ্ন করতে পারবে কিংবা তার কাজে বাধা দিতে পারবে না।

প্রথানুযায়ী ফারাও কেবলমাত্র যথাযথ পবিত্র অনুষ্ঠানের মাধ্যমে রাজদরবারের জ্যেষ্ঠ সদস্যদের উপস্থিতিতে কারও হাতে এই সীলমোহর তুলে দেন। তবে আমি বুঝতে পারলাম এ-ধরনের একটি সংবেদনশীল বিষয়ে তিনি সম্পূর্ণ গোপনীয়তার মধ্যে এটি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। যাইহোক আমার প্রতি তার এই আস্থা দেখানোর কারণে আমি অত্যন্ত বাধিত হলাম।

হাঁটুগেড়ে বসে তার সামনে মাটিতে কপাল ঠেকালাম। তবে ফারাও নিচু হয়ে আমাকে ধরে দাঁড় করালেন।

তারপর আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, তুমি আমাকে কখনও বিফল করনি, তায়তা। জানি এবারও করবে না।

.

আমি জারাসকে খুঁজে বের করে তাকে এই মিশনের গুরুত্ব বুঝিয়ে বললাম। আর এও বললাম ফারাওয়ের কাছে নিজের সম্পর্কে উচ্চ ধারণা তুলে ধরার এটি একটি সুযোগ। এই মিশনের সফলতা তাকে উন্নতির সোপানে দৃঢ় পদক্ষেপ রাখা আর রাজার সুনজরে থাকার পথ খুলে দেবে। আমার কথা শুনে সে অভিভূত হল।

অভিযানের জন্য আমরা দুজন মিলে দুইশোজনের একটি তালিকা ঠিক করলাম। প্রথম দিকে জারাস প্রতিবাদ করেছিল যে, এত কম লোক দিয়ে ক্রিট সেনা ছাউনির প্রায় দুই হাজার সেনার মোকাবেলা করা সম্ভব হবে না। তখন আমি তাকে মিশনের বিশেষ অংশটি বুঝিয়ে বললাম, যা এটন আর ফারাওকেও বলিনি। তারপর সে আমার পরিকল্পনা পুরোপুরি বুঝতে পেরে তা গ্রহণ করলো।

আমি তাকে নিজের পছন্দ মত লোক বেছে নেবার সুযোগ দিয়েছিলাম। শুধু একটা বিষয়ে জোর দিয়েছিলাম, আর তা হল যাদেরকে সে পছন্দ করবে তাদের প্রত্যেককে হাইকসো ভাষা জানতে হবে। হাইকমোরা যখন দক্ষিণ মিসর আক্রমণ করেছিল তখন জারাস খুব ছোট ছিল, তাই সে অন্যান্যদের সাথে নির্বাসনে নুবিয়ায় যায়নি। প্রকৃতপক্ষে তার যখন ষোল বছর বয়স তখন তাকে জোর করে হাইকসো সেনাবাহিনীতে ভর্তি করা হয়েছিল। ফলে সে এত চমৎকার হাইকসো ভাষায় কথা বলতে শিখেছিল যেন সে তাদেরই একজন। যাইহোক সে একজন প্রকৃত মিসরী ছিল। আর তাই ফারাও ত্যামোস যখন আমাদের সেনাদের নেতৃত্ব দিয়ে জলপ্রপাতের মধ্য দিয়ে এসে থিবসের যুদ্ধে হাইকসোদের আক্রমণ করে তাড়িয়ে দেন, তখন সেই প্রথম তার আসল

জাতির কাছে ফিরে আসে।

জারাস যে লোকগুলোকে বেছে নিয়েছিল, তারা বেশিরভাগই তার অধীনস্থ প্রশিক্ষিত এবং কুশলী যোদ্ধা ছিল। তারা যেমন নাবিক ছিল তেমনি যোদ্ধাও ছিল। আর যখন ওরা যুদ্ধের রথ টানতো না তখন নদীর বুকে নৌযোদ্ধা হিসেবে সময় কাটাত। জারাসের তাদেরকে আর কিছুই শেখাবার বাকি ছিল না।

আমি তাকে বললাম লোকগুলোকে পনেরো বিশজনের ছোট ছোট দলে ভাগ করে নিতে, যাতে থিবস শহর থেকে বের হবার সময় কারও দৃষ্টি আকর্ষণ না হয়।

নগরের মূল ফটকে রাজকীয় বাজপাখির সীলমোহর দেখাতেই প্রহরীদলের অধিনায়ক আমাকে কোনো প্রশ্ন করলো না। পরপর তিন রাত ধরে জারাসের বাহিনীর লোকগুলো ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে শহর থেকে বের হয়ে পূর্বদিকের জঙ্গলের দিকে চললো। ওরা প্রাচীন আকিতা নগরীর ধ্বংসাবশেষ এলাকায় এসে আমার সাথে মিলিত হল। আমি ওদের জন্য সেখানে অপেক্ষা করছিলাম।

আমি সেখানে কয়েকগাড়ি বোঝাই আসল হাইকসো শিরস্ত্রাণ, বর্ম, যুদ্ধের পোশাক আর অস্ত্র এনে রেখেছিলাম। থিবসের যুদ্ধে শত্রুর কাছ থেকে আমরা যেসব যুদ্ধ উপকরণ দখল করেছিলাম, এগুলো তার সামান্য কিছু অংশ ছিল।

আকিতা থেকে পুবে লোহিত সাগরের উত্তরদিকের শেষ মাথায় সুয়েজ উপসাগরের সৈকতের দিকে আমরা হাঁটা শুরু করলাম। উর্দি আর অস্ত্রের উপর সবাই বেদুইন আলখাল্লা পরে নিল।

জারাস আর আমি ঘোড়ায় চড়ে মূল দলের আগেই রওয়ানা দিয়েছিলাম। আমরা দুজন উপসাগরের সৈকতে আল নাদাস নামে একটি ছোট্ট জেলে পল্লীতে ওদের জন্য অপেক্ষা করছিলাম, দলের বাকিরা সেখানে এসে আমাদের সাথে যোগ দিল।

জারাস তার পূর্বপরিচিত বিশ্বস্ত একজন পথপ্রদর্শক নিযুক্ত করেছিল। লোকটির নাম আল-নামজু। একচোখবিশিষ্ট দীর্ঘদেহী লোকটি অধিকাংশ সময় নীরব থাকতো। সে আল নাদাসে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল।

আমাদেরকে পুবদিকের সৈকতে নিয়ে যাবার জন্য আল-নামজু গ্রামের সমস্ত মাছ ধরা নৌকা ভাড়া করেছিল। এই জায়গায় উপসাগর বিশ লিগেরও কম চওড়া, আমরা ওপারে সিনাই এলাকার নিচু পাহাড়গুলো দেখতে পাচ্ছিলাম।

রাতে তারার আলোয় পথ দেখে ওপারে গেলাম। উপসাগরের পূর্বসৈকতে আরেকটা ছোট জেলে পল্লীর কাছে পৌঁছলাম। জুবা নামে এই গ্রামটিতে আল নামজুর ছেলেরা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। ভারী মালপত্রগুলো বহন করার জন্য ওরা একশো গাধা ভাড়া করেছিল। উত্তরদিকে মধ্যসাগরে পৌঁছাতে আমাদেরকে আরও দুইশো লিগ পথ হেঁটে যেতে হবে। তবে আমাদের লোকেরা যে কোনো পরিস্থিতিতে চলার মতো প্রশিক্ষিত ছিল, কাজেই আমরা দ্রুত চলতে শুরু করলাম।

হাইকসো সেনাচৌকি এড়াতে আল নামজু আমাদেরকে নিয়ে আফ্রিকা আর এশিয়ার সংযোগকারী সিনাই যোজকের পূর্ব প্রান্তের কাছাকাছি থাকতে চেষ্টা করলো। শেষপর্যন্ত আমরা মধ্যসাগরের দক্ষিণ তীরের ফোনিশিয় বন্দর উশুর কাছে পৌঁছলাম। এই স্থানটি সুমেরিয় সীমান্ত আর হাইকসো হানাদারদের অধিকৃত উত্তর মিসরের প্রায় মাঝামাঝি অবস্থানে ছিল।

বন্দরের বাইরে জারাস আর তার লোকজনদের রেখে আমি দুটি গাধার পিঠে শস্য আর গমের চামড়ার থলেতে সোনার বাট লুকিয়ে নিয়ে সামনে এগিয়ে চললাম। সাহায্য করার জন্য সাথে চারজন লোক বেছে নিলাম। বন্দরের বণিকদের সাথে তিনদিন দরকষাকষির পর তিনটি মাঝারি মাপের একতলা পাল তোলা জাহাজের ব্যবস্থা করলাম। জাহাজ ফোনিশিয় মেলকার্ট মন্দিরের নিচে সমুদ্র সৈকতে আনার ব্যবস্থা করা হল। প্রচুর অর্থ ব্যয় হল, থিবস থেকে শস্যের থলেতে লুকিয়ে আনা আর কয়েকটা মাত্র সোনার বাট অবশিষ্ট রইল।

স্থলভাগের দিক থেকে আসা হালকা বাতাস আমাদেরকে সামনে এগিয়ে নিল। বড়পালগুলো খাঁটিয়ে মাল্লাদের মাঝে মাঝে বিশ্রাম দেওয়া হল। আবার উশু পার হলাম, তবে এবার বিপরীত দিকে। আমি নৌকাগুলো দিগন্তসীমার নিচে আর বন্দরের নজরের বাইরে রাখার চেষ্টা করলাম।

এক একটা নৌকায় সত্তর জনেরও বেশি মানুষ বসলেও আমরা বেশ দ্রুত গতিতেই এগিয়ে চললাম। পরদিন বিকেলে আমি হিসাব করে দেখলাম তামিয়াতের ক্রিট দুর্গ সামনে একলিগেরও কম দূরত্বে রয়েছে।

আমি অবশ্য জারাসের সাথে সামনের নৌকাতেই ছিলাম। এবার তাকে জানালাম যেহেতু উশু অনেক পেছনে ফেলে এসেছি, কাজেই এখন আমরা সবাই কাছাকাছি হয়ে সৈকতের দৃষ্টিসীমার মধ্যেই থাকতে পারি। কেননা স্থলভূমি দেখে আমার পক্ষে অবস্থান নিশ্চিত হয়ে নৌকা চালানো সুবিধা ছিল। শেষবেলায় সূর্য সামনের সাগরের পানি ছুঁতেই আমি কান্ডারীকে একটা নির্জন বালুকাবেলা দেখালাম। নৌকার তলভাগ মাটি ছুঁতেই লোকজন লাফিয়ে নেমে বালুর উপর দিয়ে নৌকাটি টেনে নিয়ে গেল।

থিবস থেকে এত দূর আসতে অনেক কষ্ট হলেও আমরা আমাদের লক্ষ্যের বেশ কাছাকাছি চলে এসেছি। সন্ধ্যায় আমাদের শিবিরের সবার মাঝে বেশ উত্তেজনা, উদ্দীপনা জেগে উঠলো।

জারাস তার সবচেয়ে চৌকশ দুইজন লোকের উপর অন্যান্য জাহাজের নেতৃত্বের ভার দিয়েছিল। প্রথমজনের নাম দিলবার। দীর্ঘদেহী সুন্দর চেহারার এই লোকটির পেশিবহুল, শক্তিশালী দুটি হাত ছিল। প্রথম সাক্ষাতেই সে আমার মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল আর আমিও তাকে পছন্দ করেছিলাম। তার কালো চোখদুটো তীব্ৰভেদী হলেও ডানদিকের গালে আড়াআড়িভাবে তলোয়ারের একটা দগদগে ক্ষত ছিল। এতে অবশ্য তার সুন্দর চেহারায় বিরূপ প্রভাব রাখেনি। সে কোনো আদেশ দিলে লোকজন সাথে সাথে তা পালন করতো।

তৃতীয় জাহাজের অধিনায়ক ছিল গাট্টাগোট্টা চেহারার বৃষকন্ধ এক লোক। এর নাম আকেমি। হাসিখুশি এই লোকটি উচ্চকণ্ঠে কথা বলতো। তার পছন্দের হাতিয়ার ছিল লম্বা হাতলওয়ালা একটা কুঠার। সবার খাওয়াদাওয়া শেষ হওয়ার পর আকেমি আমার কাছে এলো।

আমাকে অভিবাদন করে সে বললো, প্রভু তায়তা। লোকজন আমাকে বলেছে আজ রাতে আপনি কি গান গেয়ে আমাদেরকে সম্মানিত করবেন? প্রথম প্রথম লোকজন আমাকে এই সম্বোধন করায় আমি মৃদু প্রতিবাদ করেছিলাম, কেননা আমি এর যোগ্য নই। কিন্তু কেউ তা মানেনি আর আমিও আর এরপর থেকে বিষয়টা নিয়ে তেমন মাথা ঘামাইনি।

আমার কণ্ঠস্বর ছিল অসাধারণ আর আমার হাতের আঙুলে বীণাও প্রায় স্বর্গীয় সুর নিয়ে বাজতো। আমি খুব কমই এ-ধরনের অনুরোধ ফিরিয়ে দিতাম।

সেই রাতে তামিয়াত যুদ্ধের আগে আমি তাদের জন্য বেছে নিলাম রানি লসট্রিসের শোকসঙ্গীত। এটা ছিল আমার বিখ্যাত একটি রচনা। আমার চারপাশে সবাই আগুন ঘিরে বসলো। আমি পুরো ১৫০টি চরণই গেয়ে শোনালাম। ওদের মধ্যে যারা ভালো গান গাইতো ওরা আমার সাথে কোরাসে গলা মেলাল আর অন্যরা গুণগুণ করলো। গানের শেষে সবার চোখ সজল হল। আমার চোখের জল অবশ্য আমার গান গাওয়ায় কোনো ব্যাঘাত ঘটায় নি।

.

পরদিন ভোরে প্রথম আলো ফোঁটার সাথে সাথেই আমাদের শিবিরে কর্মচাঞ্চল্য জেগে উঠলো। এখন আমাদের লোকজন বেদুঈন পোশাক আর মাথার আবায়া খুলে হাইকসো উর্দি, বর্ম আর অস্ত্রশস্ত্রভরা গাটরি খুললো। বর্মটি মূলত চামড়ার তৈরি তবে শিরস্ত্রাণটি ছিল ব্রোঞ্জের আর নাকের উপরিভাগ ধাতুর টুকরা দিয়ে ঢাকা। প্রত্যেকে একটা করে শক্তিশালী বাঁকা ধনুক আর তূণ ভর্তি চকমকি পাথরের মাথাওয়ালা তীর নিয়ে সজ্জিত হল। তীরগুলোর গোড়ায় হাইকসো রীতিতে বিভিন্ন রঙের পালক লাগানো ছিল। তলোয়ারগুলো পিঠের খাপে ভরা ছিল, হাতল ছিল উপরের দিকে যাতে সহজে হাত দিয়ে টেনে বের করা যায়। তলোয়ারের পাতগুলো মিসরীয় তলোয়ারের মতো সোজা ছিল না, এগুলো প্রাচ্যের রীতিতে বাঁকা ছিল।

বর্ম আর অস্ত্রগুলো খুব ভারী ছিল আর প্রচণ্ড রোদে খুব গরম হয়ে যাওয়ায় এগুলো পরে দাঁড় বাওয়া খুব কষ্টকর ছিল। কাজেই আমাদের। লোকেরা পরনের কাপড় খুলে শুধু লেঙটি পরলো আর যুদ্ধের পোশাক-আশাক সবকিছু পায়ের কাছে ডেকে বিছিয়ে রাখলো।

এদের বেশিরভাগেরই গায়ের রঙ ফর্সা আর চুল সোনালি। আমি ওদের সকলকে বলালাম চুলার ছাই নিয়ে মুখে আর দাড়িতে মেখে নিয়ে কালো করতে যাতে ওদের দেখে হাইকসো সৈন্য মনে হয়।

তিনটি জাহাজ সৈকত থেকে উপসাগরের পানিতে ভাসলো। আমি জারাসের সাথে সবার আগের জাহাজে থাকলাম। কাণ্ডারীর পাশেই দাঁড়ালাম, সে লম্বা হাতটা ধরেছিল। উশু বন্দরে যে ব্যবসায়ীর কাছ থেকে জাহাজগুলো কিনেছিলাম, তার কাছ থেকে একটা প্যাপিরাস মানচিত্রও সাথে নিয়েছিলাম। এতে জেবেল আর ওয়াদি আল নিলামের মাঝে মধ্য সাগরের দক্ষিণাংশের বিশদ বিবরণ তুলে ধরা ছিল। লোকটি দাবী করেছিল সে তার প্রত্যক্ষ

অভিজ্ঞতা থেকে নিজ হাতে মানচিত্রটি তৈরি করেছে। মানচিত্রটা ডেকে বিছিয়ে চারকোণায় চারটি নুড়ি পাথর দিয়ে চাপ দিলাম। আর সাথে সাথে সৈকতের কিছু বৈশিষ্ট দেখে মানচিত্রের সাথে মেলাতে পারলাম। দেখে মনে হল মানচিত্রটা নিভরযোগ্য।

সকালে দুইবার আমরা দিগন্ত রেখার কাছে অন্যান্য জলযানের পাল দেখতে পেলাম। তবে আমরা সরে গিয়ে ওগুলোকে চলে যাওয়ার সুযোগ দিলাম। তারপর সূর্য যখন ঠিক মাথার উপর তখন জাহাজের সামনের গলুই থেকে দাঁড়ি চিৎকার করে সকলকে সাবধান করে সামনের দিকে দেখাল। আমি চোখে হাত দিয়ে রোদ ঢেকে সে যেদিকে দেখিয়েছিল সেদিকে তাকালাম। অবাক হয়ে দেখলাম দিগন্তজুড়ে সাগরের পানি সাদা হয়ে ভারী ঝড়ো বাতাসের মতো আমাদের উপর আছড়ে পড়তে যাচ্ছে। কিন্তু এখনতো ঝড়ের ঋতু নয়।

আমি জারাসকে বললাম, পাল নামিয়ে ফেলতে বল! দাঁড়গুলো তুলে ভেতরে রেখে নোঙর তৈরি করে রাখতে বল।

প্রচণ্ড বেগে পানি আমাদের দিকে ছুটে আসছিল। বাতাসের ধাক্কা সামলাবার জন্য আমরা তৈরি হলাম। সাদা পানি প্রচণ্ড গর্জন করে এদিকে ছুটে আসছে। আমি শক্ত হাতে নৌকার একপাশ ধরে থাকলাম। সাগরের ঢেউ পাটাতনের উপর আছড়ে পড়লো। লোকজনের চিৎকার-চেঁচামেচি আর জাহাজের দুইধারে ঢেউ ভেঙে পড়ার হট্টগোলে কানে তালা লেগে গেল। কিন্তু কোন হাওয়া নেই দেখে অবাক হলাম। সাথে সাথে আমার মনে হল হাওয়া ছাড়া ঝড় মানে নিশ্চয়ই অতিপ্রাকৃতিক কোনো ব্যাপার। এই বিপদ থেকে আমাদের রক্ষা করার জন্য আমি চোখ বুজে মহান দেবতা হোরাসের কাছে প্রার্থনা করতে লাগলাম।

তারপর একটি হাত আমার কাঁধ ধরে জোরে ঝাঁকাতে লাগলো আর সেই সাথে কানের কাছে প্রচণ্ড চিৎকার শুনতে পেলাম। আমি জানি এটা জারাসের গলা কিন্তু তারপরও চোখ খুললাম না। আমি অপেক্ষা করছিলাম দেবতা আমাদেরকে রক্ষা করার ব্যবস্থা নেবেন। কিন্তু জারাস অনবরত আমাকে ধরে ঝাঁকিয়েই চলেছে, আমি সাবধানে চোখ খুললাম কিন্তু সেই সাথে প্রার্থনাও করে চললাম। তখনই বুঝলাম জারাস কিছু বলতে চাচ্ছে আর তখন একপাশে সাগরের দিকে তাকালাম।

সাগর জীবন্ত হয়ে উঠেছে তীরের ফলার মতো বিশাল চকচকে কতগুলো দেহ নিয়ে। তারপর একমুহূর্ত পর বুঝতে পারলাম এগুলো জীবন্ত প্রাণী আর এক একটা প্রাণী একটা ঘোড়ার সমান আকৃতির। দানবাকৃতির এই মাছগুলো এতঘন হয়ে এক সাথে ছিল যে, নিচেরগুলো উপরেরগুলোকে ঠেলে উপরের দিকে ভেসে উঠতে চেষ্টা করায় বিশাল ঢেউ সৃষ্টি করে পানি ছিটিয়ে চলছিল।

জারাস চেঁচিয়েই চলেছে, টুনা! এগুলো টুনা মাছ।

উচ্চ মিসর একটি স্থলবেষ্টিত দেশ হওয়ায় খোলা সাগরে যাওয়ার আমার তেমন সুযোগ হয়নি। আর এত বিশাল পরিমাণে টুনা মাছও দেখিনি। তবে এগুলো সম্পর্কে অনেক লেখা পড়েছি, তাই আমার বুঝা উচিত ছিল কী হচ্ছে। সাথে সাথে চোখ খুলে আমিও জারাসের মতো চিৎকার করে উঠলাম। অবশ্যই এগুলো টুনা মাছ! হারপুন নিয়ে লোকজনকে তৈরি হতে বল!

জাহাজে উঠার সময়েই আমি হারপুন লক্ষ্য করেছিলাম। এগুলো দাঁড়িদের বসার বেঞ্চের নিচে রাখা ছিল। আমার ধারণা ছিল জলদস্যুদের হামলা ঠেকাতে এগুলো ব্যবহৃত হয়। একজন মানুষের দ্বিগুণ দৈর্ঘ্যের সমান লম্বা বল্লম। ডগা ধারালো সংকর ধাতুর। ডগার পেছনে একটা চোখের মতো ছিদ্র দিয়ে নারিকেলের ছোবড়ার আঁশের দড়ি ঢোকানো ছিল। আর দড়ির অপর প্রান্তে একটা বাঁকা কাঠের ফাত্না বাঁধা ছিল।

আমার নির্দেশের সাথে সাথে সবচেয়ে আগে জারাস কাজে লেগে পড়লো। তারপর অন্যরা তাকে অনুসরণ করলো।

সে লম্বা অস্ত্রটা বেঞ্চের তলা থেকে তুলে নিয়ে দড়ির গিঁট খুলে রশি ছাড়তে ছাড়তে জাহাজের এক পাশে ছুটে চললো। লম্বা হারপুনটা কাঁধে রেখে রশিবাধা মাথাটা নিচে ঝাঁক বেঁধে চলা টুনার চকচকে রূপালি স্রোতের দিকে তাক করলো। বিশাল গোল গোল চোখ নিয়ে মাছগুলো মনে হচ্ছে আতঙ্কিত হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে।

আমি লক্ষ্য করলাম, সে লক্ষ্য স্থির করে হারপুনের মাথা নিচু করে সোজা পানিতে ছুঁড়ে মারলো। ভারী হারপুনের ডগাটা বিশাল মাছের শরীরে সজোরে বিধতেই মাছটি একটা ঝটকা মারতেই হারপুনটা একটু কেঁপে পানিতে তলিয়ে গেল।

জারাস এক লাফে ডেকে নেমে লম্বা রশিটা ধরে ফেললো। আরও তিনজন নাবিক এগিয়ে এলো ওর সাহায্যে, তারপর সবাই মিলে রশিটা সামলে টানতে টানতে মাছটা টেনে তুললো।

চারজন লোক জারাসকে অনুসরণ করে বেঞ্চের নিচ থেকে হারপুন তুলে নিয়ে জাহাজের একপাশে ছুটে গেল। একটু পর জাহাজের দুইপাশেই লোকজন ছুটাছুটি করে হারপুন গেঁথে বিশাল মাছগুলো জাহাজের ডেকে টেনে উঠাতে লাগলো। লোকজনের উত্তেজিত চিৎকার, চেঁচামেচি, নির্দেশ আর হট্টগোলের শব্দে জাহাজের পুরো পরিবেশে কর্মচাঞ্চল্য জেগে উঠলো।

একটার পর একটা মাছ ডেকে উঠিয়ে হাতুড়ির আঘাতে মেরে ফেলা হল। হারপুনে গেঁথে শেষ মাছটা তুলে কেটে ফেলার পর বাদবাকি মাছের দল হঠাৎ যেরকম উদয় হয়েছিল সেরকম হঠাৎ আবার গভীর পানির নিচে অদৃশ্য হয়ে গেল।

সেই রাতে আমরা আবার সৈকতে নামলাম, তারপর বেলাভূমিতে আগুন জ্বেলে মাছ রান্না করে খেলাম। এটি ছিল সাগরের সবচেয়ে সুস্বাদু মাছ। স্বাদ বাড়াবার জন্য ওরা একটু লবন মেখে নিল। সবাই পেটপুরে খেল তারপর চামড়ার মশক থেকে মদ খেল।

আমি জানতাম শক্তি সঞ্চয়ের পরদিন সকালে ওরা শত্রুর মোকাবেলা করার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকবে। মাংস খেলে একজন যোদ্ধার মনে যে দানবটি থাকে তা জেগে উঠে।

সেই রাতে আমি গাইলাম তানুস এবং নীল তরবারির গাথা। এটা ছিল সাগরের রণসঙ্গীত। আর এই গান ওদের মনে চরম উদ্দীপনা জাগিয়ে তুললো। সবাই আমার সাথে গলা মিলিয়ে গানটা গাইতে লাগলো, এমনকি যার গলা একেবারে বেসুরো সেও বাদ গেল না। তারপর আমি লক্ষ্য করলাম ওদের চোখে লড়াই করার মানসিকতা তীব্র হয়ে উঠেছে। এখন ওরা যেকোনো শত্রুর মোকাবেলা করতে প্রস্তুত।

.

পরদিন ভোরের আলো ফোঁটার সাথে সাথে আমরা জাহাজগুলো পানিতে ভাসালাম। হালকা আলোয় পানির নিচে ডুবো পাহাড়ের চূড়া সামলে নিরাপদ পথ বেছে নিয়ে চলতে লাগলাম।

নীলনদের বদ্বীপের মুখের কাছাকাছি আসতেই আমি আমার অবস্থান সম্পর্কে আরও নিশ্চিত হলাম। শেষবিকেলে একটা মোহনা পার হলাম, এর পূর্বপাশে নিচু জঙ্গল আর পশ্চিমে খোলা মাটির তীর। একটু ভেতরে সাগরের দিকে মুখ করা জঙ্গলাকীর্ণ স্থানটিতে একটি কাদামাটির ইটের তৈরি চুনকামকরা দুর্গ দেখা গেল। দুর্গের চূড়াটা প্রায় ভেঙে পড়েছে আর সাগরের দিকের অধিকাংশ দেয়ালেরও ভগ্ন দশা। তবে আমি বুঝতে পারলাম এটা হচ্ছে তামিয়াত প্রণালীর নৌচলাচলের সংকেত কেন্দ্র। সম্ভবত অনেক আগে মৃত কোনো মিসরী নাবিক এটা তৈরি করেছিল।

আমি একছুটে আমাদের জাহাজের একমাত্র মাস্তুলের কাছে গিয়ে খুঁটি বেয়ে উপরে উঠতে শুরু করলাম। উপরে পালের খুঁটি পা দিয়ে আঁকড়ে ধরে সামনে তাকালাম। এখান থেকে সামনে তীরভূমি পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। দূরে তীরভূমির আরও ভেতরে গাছের মাথার উপর দিয়ে একটি আয়তাকার স্থাপনা পরিষ্কার দেখা গেল। এটাও সাদা চুনকাম করা। এবার আমি নিঃসন্দেহ হলাম মিনোয়ানদের যে বাণিজ্য-দুর্গ আর কোষাগার আমরা খুঁজছি এগুলো তার সূরক্ষিত পর্যবেক্ষণ চৌকি। আমি মাস্তুলের খুঁটি বেয়ে সর সর করে নিচে নেমে চিৎকার করে কাণ্ডারীকে বললাম, জলদি হাল ধর! জাহাজ সামনের ডানদিকে তিন পয়েন্ট ঘোরাও!

জারাস দৌড়ে কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো, তাই করবো?

আমি মৃদু হেসে কাণ্ডারীর দিকে ঘাড় কাত করে বললাম, হ্যাঁ, তাই করতে বল। আমরা আবার সাগরের দিকে ঘুরে চললাম। অন্য জাহাজ দুটোও আমাদের অনুসরণ করলো। এখন আমরা সৈকত থেকে বেশ দূরে সরে চলতে লাগলাম। তারপর কিছুদূর সামনে গিয়ে তামিয়াত দুর্গের পাহারা চৌকির নজর এড়ালাম। আবার গতিপথ বদলালাম। এরপর সোজা বদ্বীপের গোলকধাঁধার মতো জলাভূমির দিকে এগোলাম।

মানচিত্র থেকে আমি জেনেছিলাম কোথায় নোঙর বাধার মতো নিরাপদ স্থান পাওয়া যেতে পারে। পালগুলো নামিয়ে ডেকে বিছিয়ে রাখা হল, তারপর প্যাপিরাস আর নলখাগড়ার ঘন বনের মধ্য দিয়ে পথ করে আমার পছন্দমতো একটা উপদের দিকে চললাম। এখানে পৌঁছে আমরা গাছপালার ঘন জঙ্গলে পুরোপুরি ঢাকা পড়লাম। অগভীর পানিতে নোঙর ফেলা হল, জাহাজের তলা সাগরের নিচে কাদার একটু উপরে রইল। থুতনি পর্যন্ত শরীর পানিতে ডুবিয়ে আমরা এক জাহাজ থেকে অন্য জাহাজে আসা যাওয়া করতে লাগলাম।

সূর্যাস্তের পর চাঁদ উঠতেই সবাই অবশিষ্ট টুনা মাছ দিয়ে রাতের খাবার খেলাম। জারাস নিঃশব্দে তিন জাহাজ থেকে আট জন লোক বেছে নিল। ওদেরকে জানাল পরদিন ভোরে সূর্য ওঠার সাথে সাথে আমাদের সাথে শত্রুপক্ষের অবস্থান পরীক্ষা করার অভিযানে যেতে হবে।

ভোর হবার ঘন্টা খানেক আগে আমরা সবাই দুটো এক বৈঠার ডিঙিতে চড়লাম। এদুটো জাহাজের পেছনে বেঁধে আনা হয়েছিল। চওড়া উপহ্রদের মধ্য দিয়ে বৈঠা বেয়ে অন্তরীপের যে জায়গায় দুৰ্গটা দেখেছিলাম তার একটু কাছে পৌঁছলাম।

অন্ধকারে মাথার উপর দিয়ে উড়ে যাওয়া জলাভূমির পাখির ডাক আর ডানা ঝাঁপটানোর শব্দ শোনা যাচ্ছে। অন্ধকার হালকা হতেই আবছা আলোয় জলচর জংলি হাঁস, রাজহাঁস, লম্বা ঠ্যাং আর গলার বক, সুন্দর পালক আর লেজ বিশিষ্ট বিভিন্ন ধরনের অন্তত পঞ্চাশটারও বেশি সারসজাতীয় পাখি দেখা গেল। আমরা উপহ্রদের মধ্য দিয়ে ডিঙ্গি বেয়ে এগোতেই হাঁসগুলো ঝাঁক বেঁধে ডানা ঝাঁপটাতে ঝাঁপটাতে পানির উপর থেকে শূন্যে উড়াল দিল। দিগন্তের উপর সূর্য উঠতেই দেখা গেল চারপাশের জায়গাটি পুরোপুরি জংলি আর মনুষ্যবসতির অনুপযোগী একটি স্থান।

শক্ত মাটিতে পৌঁছার পর ডিঙি দুটো টেনে নিয়ে নলখাগড়ার ঝোঁপের আড়ালে লুকিয়ে রাখলাম। তারপর ঘন ঝোঁপের মধ্য দিয়ে সাবধানে এগিয়ে চললাম।

তারপর হঠাৎ একটা গভীর খালের কাছে এসে পৌঁছলাম। প্যাপিরাসের মধ্য দিয়ে খালটা দক্ষিণ দিকে সোজা সাগরের দিকে চলে গেছে। প্রায় একশো কদম চওড়া খালটা বেশ গভীর, হেঁটে পার হওয়া সম্ভব নয়। খালের অপর তীরে পাহারা চৌকির সমতল ছাদ দেখা যাচ্ছে। ছাদের পাচিলের উপরে কমপক্ষে তিনজন পাহারাদারের শিরস্ত্রাণপরা মাথা দেখা যাচ্ছে।

এরপর হঠাৎ সাগরের দিক থেকে একটা জলযান আসার পরিষ্কার শব্দ শোনা গেল। আমি সবাইকে সাবধান করলাম। জাহাজ চলার কাঁচকোচ, মাঝিমাল্লাদের বৈঠা বাওয়ার শব্দ বেড়ে চলেছে। তারপর হঠাৎ খালের বাঁকে একটা সমুদ্রগামি বিশাল জাহাজ দেখা গেল।

এত বড় আর এ-ধরনের জাহাজ আমি কখনও দেখিনি। তবে আমার গুপ্তচরদের পাঠানো বর্ণনা থেকে আমি নিশ্চিত হলাম এটা ক্রিটদের তিন সারিতে দাঁড় বাওয়া একটা রণতরী। এতে যেমন মাল বহন করা যায়, তেমনি যুদ্ধজাহাজ হিসেবেও ব্যবহার করা যায়। একটার পর একটা তিনতলা ডেকে তিন সারি দাঁড় রয়েছে।

জাহাজের সামনের লম্বা সরু ডগাটি ব্রোঞ্জের পাত দিয়ে মোড়ানো, যাতে শত্রুপক্ষের জাহাজকে গুঁতো দেওয়া যায়। দুটি মাস্তুলে বেশ বড় জায়গা জুড়ে পাল খাটানো যায়। তবে পালগুলো এখন গোটানো রয়েছে, যেহেতু সংকীর্ণ খালের মধ্য দিয়ে দাঁড় বেয়ে আসতে হচ্ছে। জাহাজটি বেশ সুন্দর, দড়িদড়া পরিষ্কার আর উঁচু বরগা। এই জাহাজটি দেখে সহজেই বুঝা যায় ক্রিটের নৌবাহিনী কেন পৃথিবীর মধ্যে সেরা। মাল বোঝাই হওয়ার কারণে এখন একটু নিচু হলেও অন্য কোন জাহাজই এর মোকাবেলা করতে পারবে না। ভাবলাম জাহাজের খোলে কি মাল বোঝাই করা হয়েছে কে জানে।

নলখাগড়ার ঝোঁপের যে জায়গায় আমরা লুকিয়েছিলাম, জাহাজটি তার সমান্তরাল হতেই আমি নাবিকদের চেহারা দেখতে পেলাম। সামনের দিকে তিনজন নৌ-কর্মকর্তা দাঁড়িয়ে রয়েছে আর পাশেই চারজন মাঝি লম্বা দাঁড় সামলাচ্ছে। তিন নৌযোদ্ধার মুখের বেশিরভাগ বর্ম দিয়ে ঢাকা থাকলেও বুঝা যাচ্ছে লোকগুলো গড়পরতা মিসরীয়দের চেয়ে বেশ লম্বা আর বলিষ্ঠ। ওরা যে বাণিজ্যপোতের নাবিক নয় বরং যোদ্ধা, তা সহজেই বুঝা যায়।

জাহাজটি আমাদের পাশ কাটাবার সময় লক্ষ করে বুঝতে পারলাম, সবচেয়ে উপরের সারিতে যারা লম্বা দাঁড় বাইছে তারা মোটেই ভারবাহী পশুর মতো মাঝিমাল্লা নয়, ওরা অবশ্যই যোদ্ধা। অধিনায়কের নির্দেশ পাওয়ার সাথে সাথেই দাঁড় ছেড়ে দিয়ে পায়ের কাছে রাখা অস্ত্র নিয়ে লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে।

তবে নিচের সারিগুলোতে শিকলে বাঁধা ক্রীতদাসেরা দাঁড় বাইছিল। ওদের শরীরের গন্ধ থেকে আমি বুঝতে পারলাম ওরা সেই হতভাগ্যের দল যারা সারা জীবন এই দাঁড় বাওয়ার বেঞ্চেই জীবন কাটিয়েছে। যেখানে ওরা বসে রয়েছে, সেখানে বসেই দাঁড় টানে, খায়, ঘুমায়, মল ত্যাগ করে আর শেষপর্যন্ত সেখানেই মারা যায়।

জাহাজটি আমাদের পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় নৌকর্মকর্তাদের চেঁচিয়ে নির্দেশ দিতে শোনা যাচ্ছিল। উপরের সারির দাঁড়গুলো একটা রূপালি চিলের ডানার মতো এক সাথে পানি থেকে উঠছিল আর নামছিল। আর নিচেরগুলো ঝপঝপ করে পানিতে পড়ছিল আর পেছনে টানছিল। খালের শেষমাথার বাঁক পার হয়ে জাহাজটি একটু দূরে চকচকে চুনকাম করা দুর্গের দিকে ভেসে চললো।

তারপর একটা আশ্চর্য ঘটনা ঘটলো, যার জন্য আমি মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। ঠিক প্রথমটির মতোই আরেকটি জাহাজ সাগর থেকে মোহনার মধ্য দিয়ে খালে ঢুকলো, তারপর আমাদের পাশ কাটিয়ে একই পথে সামনে চলে গেল। এই জাহাজটিও মাল বোঝাইয়ের কারণে নিচু ছিল।

তারপর আবার হতবাক আর আনন্দে আত্মহারা হয়ে লক্ষ্য করলাম ঠিক একই রকম তৃতীয় আরেকটি জাহাজ খাল বেয়ে এসে আমাদের পাশ কাটিয়ে গেল। এটিও আগের দুই জাহাজকে অনুসরণ করে দুর্গের পথে চলে গেল।

এবার আমি বিষয়টা বুঝতে পারলাম। তিনমাস আগে আমার চর আমাকে খবর দিয়েছিল যে, ধনরত্ন বোঝাই তিনটি জাহাজ ক্রিটের প্রধান সমুদ্র বন্দর আগাফের থেকে রওয়ানা দেবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে এই খবরটা আমার কাছে পৌঁছতে পৌঁছতে কয়েক মাস লেগে যায়। ইতিমধ্যে কোনো কারণে এই নৌবহরের সমুদ্র যাত্রা বিলম্বিত হয়ে যায়, সম্ভবত প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে এটা হয়েছে। তবে দেরি হওয়ার খবরটা গুপ্তচরেরা আমাকে জানাতে পারেনি।

আমার ধারণা ছিল, জাহাজগুলো তামিয়াত দুর্গে মাল খালাস করে আবার ফিরতি যাত্রায় আগাফের বন্দরের দিকে রওয়ানা দেবার অনেক পরে আমি তামিয়াতে পৌঁছাবো।

কিন্তু এই জাহাজগুলো যখন তামিয়াতে পৌঁছাবে তখন আমিও সেখানে পৌঁছব এরকম আশা আমি করিনি, সম্ভবত কোন দেবতার অনুগ্রহে এটা সম্ভব হয়েছে। ছোটকাল থেকে আমি জেনে এসেছি যে আমি দেবতার প্রিয়পাত্র। বিশেষত প্রধান দেবতা হোরাসের, যার কাছে আমি সবসময় প্রার্থনা করি। তা নাহলে জন্মের পর থেকেই আমার মধ্যে এত বুদ্ধি আর গুণের সমন্বয় কী করে হল? কী কারণে আমি এতবার ভয়ঙ্কর বিপদ থেকে রক্ষা পেয়েছি, যেখানে অন্য কোনো সাধারণ মানুষ হলে অবশ্যই ধ্বংস হয়ে যেত? কী করে আমি এত তরুণ আর সুন্দর থাকতে পারলাম আর এত তীক্ষ্ণধী থাকলাম। অথচ আমার আশেপাশের সবারই বয়সের সাথে সাথে চামড়া কুঁচকে গেল, চুল সাদা আর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল? নিশ্চয়ই আমার মাঝে এমন কিছু আছে যা, অন্যান্য সাধারণ মানুষ থেকে আমাকে আলাদা করেছে।

এটাও নিশ্চয়ই হোরাস দেবতার অনুগ্রহের আরেকটি দৃষ্টান্ত। আমি মনে মনে তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে প্রতিজ্ঞা করলাম প্রথম সুযোগেই তার কাছে একটি বড় ধরনের উৎসর্গ নিবেদন করবো। তারপর হামাগুড়ি দিয়ে জারাসের কাছে গিয়ে তার জামার হাত ধরে টান দিয়ে বললাম,

খাল পার হয়ে আমাকে ক্রিস্টানদের দুর্গের কাছে যেতে হবে।

আমাদের এই মিসরের দুটো বিষয় আমার কাছে বেশ হেঁয়ালিপূর্ণ মনে হয়, যার কোনো অর্থ আমি খুঁজে পাই না। প্রথমটি হল ঘোড়াকে আমরা মাল বহন করার জন্য আর যুদ্ধের প্রধান অস্ত্র, রথ টানার কাজে ব্যবহার করলেও প্রায় কোনো মিসরিই ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয় না। আর দ্বিতীয় ধাঁধাটি হল বিশাল একটি নদীর তীরে বাস করলেও কেউ সাঁতার কাটতে জানে না। কাউকে এ-বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে কেবল কাঁধে একটা ঝাঁকি দিয়ে বলবে, এ ধরনের আচরণ দেবতাদের পছন্দ নয়।

তবে আমি আগেই বলেছি অন্যদের চেয়ে আমি আলাদা। অবশ্য একথা বলবো না যে, সবদিক দিয়েই আমি শ্রেষ্ঠ। শুধু এটুকু বলতে পারি, আমি একজন চৌকস ঘোড়সওয়ার আর সেই সাথে একজন শক্তিশালী এবং অক্লান্ত সাঁতারু।

আমি জানতাম জারাসের এদুটো গুণের কোনোটাই নেই, তবে রথের রশি যখন তার হাতে থাকে, তখন তাকে হারাবার মতো কেউ নেই। তাই তাকে আমি নির্দেশ দিলাম কর্ক গাছের ছাল দিয়ে বয়া বানিয়ে নিতে যার সাহায্যে সে পানিতে ভেসে থাকতে পারবে। তারপর আমরা দুজনে কোমর পর্যন্ত পোশাক খুলে খালের পানিতে নেমে পড়লাম। জারাস ওর তলোয়ারটা কর্কের বয়ার সাথে বেঁধে নিয়েছিল, আমি আমারটা পিঠে বেঁধে নিলাম। একটা ভোঁদড়ের মতো দ্রুত সাঁতার কেটে আমি খালের অপর তীরে পৌঁছে গেলাম, এদিকে জারাস তখনও দম নিতে নিতে কেবল অর্ধেক পথ পার হয়েছে।

সে খালের এপারে পৌঁছার পর আমি তাকে তীরে উঠতে সাহায্য করলাম। তারপর সে একটু ধাতস্থ হওয়ার পর আমরা নলখাগড়ার জঙ্গলের মধ্য দিয়ে চুপিসারে ক্রিটান দুর্গের দিকে রওয়ানা দিলাম। তারপর একটা সুবিধামতো জায়গায় পৌঁছে দালানটা পরিষ্কার দেখতে পেলাম। বুঝতে পারলাম ওরা কেন এই জায়গাটা বেছে নিয়েছিল। চুনাপাথর পাহাড়ের একটা লম্বা আর সরু চূড়ার উপর শক্ত ভিত্তির উপর দুৰ্গটা খাড়া করা হয়েছে।

মূল খালটা ভাগ হয়ে দুর্গের চারপাশ ঘিরে একটা দুর্গপরিখা তৈরি করেছে। দুর্গের চতুর্দিকে নদীর প্রবাহটি যে পোতাশ্রয় সৃষ্টি করেছে সেখানে বিভিন্ন ধরনের বেশ কয়েকটি জলযান নোঙর করা রয়েছে। বেশিরভাগই বজরা, যা দিয়ে সম্ভবত ক্রিটানরা নির্মাণ সামগ্রী বয়ে নিয়ে এসেছে। এর মধ্যে একটিও সমুদ্র চলাচলের উপযোগী জাহাজ নয়। কেবল সেই তিনটি চমৎকার তিনতলা দাঁড় বাওয়া জাহাজ রয়েছে, যেগুলো আমাদের পাশ কাটিয়ে এসেছে।

এই জাহাজগুলো তামিয়াত দুর্গের মূল ফটকের ঠিক নিচে একটা পাথরের জেটিতে নোঙর করা রয়েছে। ফটকটি ভোলা আর নবাগতদের স্বাগত জানাতে কয়েকজন উর্দিপরা সৈন্য সেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে। পালকদিয়ে সাজানো শিরস্ত্রাণ আর সোনার সাজসজ্জা দেখে আমি বুঝতে পারলাম সেখানে বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তাও রয়েছে।

আমি আর জারাস সাঁতার কেটে খাল পার হয়ে এখানে পৌঁছার আগেই প্রথম জাহাজের নাবিকেরা জাহাজের খোল থেকে মাল নামানোর কাজ শুরু করে দিয়েছিল। শিকলে বাঁধা একদল অর্ধনগ্ন ক্রীতদাস জাহাজ থেকে মাল নামিয়ে ভেতরে নিয়ে যাচ্ছিল। অর্ধেক বর্মপরা আর কোমরবন্ধে গোঁজা ছোট তরবারি নিয়ে কয়েকজন তত্ত্বাবধায়ক এদের কাজ দেখাশুনা করছিল। এদের সবার হাতে কাঁচা চামড়ার বিনুনি করা চাবুক রয়েছে।

লম্বা একটা তক্তার উপর দিয়ে ক্রীতদাসেরা একইরকম ভারি কাঠের সিন্দুকগুলো নিয়ে তীরে যাচ্ছিল। খুব বড় না হলেও সিন্দুকগুলো বেশ ভারি, তাই এর ওজনের ভারে ক্রীতদাসেরা টলমল করে হাঁটছিল। পুরো প্রক্রিয়াটি হচ্ছিল বেশ ধীরগতিতে আর বিরক্ত তত্ত্বাবধায়করা কর্মরত ক্রীতদাসদেরকে চিৎকার করে তিরস্কার করছিল।

তারপর আমরা লক্ষ্য করলাম একজন ক্রীতদাস কাঠের তক্তা থেকে তীরে নামার সময় পা ফসকে নিচে পড়ে গেল আর মাথার উপর থেকে ভারি কাঠের সিন্দুকটা নিচে পাথরের স্ল্যাবের উপর পড়তেই এর ডালা ভেঙে খুলে গেল আর ভেতরের রূপার বাটগুলো মাটিতে ছড়িয়ে পড়লো। মাটিতে স্তূপ হয়ে পড়া চকচকে উজ্জ্বল রূপার বাটগুলোর উপর রোদ পড়ে ঝিকমিক করে উঠলো। দৃশ্যটি দেখে আমার বুক ধক করে উঠলো। এক হাতের চেয়ে ছোট দৈর্ঘ্যের রূপার চারকোণা প্রায় কুড়িটা বাট কাঠের সিন্দুকটিতে ঠেসে ভরা ছিল। যে জাহাজে এই সিন্দুকগুলো মধ্য সাগর দিয়ে বয়ে আনা হয়েছে, সেরকম একটি বিশাল জাহাজ তৈরি করার খরচ এক সিন্দুক ভরা এই রূপার বাট দিয়ে মেটানো যাবে। আমার সমস্ত আশা পূর্ণ হয়েছে। এটিই সেই বিশাল ধনভাণ্ডার যা আমি প্রত্যাশা করেছিলাম।

তিনজন তত্ত্বাবধায়ক একযোগে মাটিতে পড়ে যাওয়া ক্রীতদাসের ঘর্মাক্ত শরীরের উপর চাবুক মারতে শুরু করলো। লোকটা চিৎকার করে ছটফট করছিল আর দুইহাত দিয়ে মুখ ঢাকতে চেষ্টা করছিল। একটা চাবুকের আঘাতে তার মুখে পড়তেই লোকটির ডান চোখটি কোটর থেকে ছিটকে বের হয়ে স্নায়ুতন্ত্রির সাথে গালের উপর ঝুলতে লাগলো। ছটফট করতে করতে শেষপর্যন্ত ক্রীতদাসটি জ্ঞান হারালো, আর নিজেকে বাঁচাবার শক্তি অবশিষ্ট রইল না। একজন সৈন্য তার এক পা ধরে টানতে টানতে জেটির কিনারায় নিয়ে এক টানে নদীতে ফেলে দিল। ঝপ করে কাদাভরা পানিতে পড়ে দেহটা নিচে তলিয়ে গেল।

এই ঘটনার পর কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে অর্ধনগ্ন অন্যান্য ক্রীতদাসরা মুখ বুজে কাজ করে যেতে লাগলো, যেন কিছুই হয়নি।

জারাসের কাঁধে টোকা দিয়ে আমি তার মনোযোগ আকর্ষণ করলাম। তারপর দুজনে আবার নলখাগড়ার গভীর জঙ্গলের মধ্যে ফিরে গেলাম। এবার ঘুরে দুর্গের অন্যধারে নদীর অপর তীরের কাছে পৌঁছলাম। একঘন্টা ধরে সাবধানে চতুর্দিক লক্ষ্য করার পর একটা জায়গা খুঁজে পেলাম, যেখান থেকে দুর্গ আর আশপাশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাটি বুঝা যায়। দুর্গ সম্পর্কে আমার গুপ্তচরেরা যেসব তথ্য দিয়েছিল এবার তা সরেজমিনে যাচাই করতে পারলাম।

দুর্গ ঘিরে থাকা দেয়ালগুলো দুর্ভেদ্য মনে হলেও এলাকাটা খুব বেশি বড় নয়। যেটুকু জায়গা রয়েছে তাতে কেবল কোষাগার আর একটা ব্যারাকের স্থান সংকুলান হবে। সাগর থেকে খাল দিয়ে এসে ছোট আকারের আক্রমণ হলে তা প্রতিহত করার মতো কিছু সংখ্যক সৈন্য সেখানে থাকতে পারবে।

তবে ক্রিটানরা নিশ্চয়ই ভেবে রেখেছিল, বড় ধরনের শত্রুর আক্রমণ হলে অন্তত কয়েকহাজার সেনা হাতে রাখতে হবে। আর এই সমস্যার সমাধানের জন্য ওরা নদীর উপর দিয়ে পন্টুন সেতু তৈরি করেছিল, যাতে নদীর মাঝখানে দ্বীপে অবস্থিত দুর্গ রক্ষার জন্য নদীর যেকোনো তীর থেকে সেনারা দ্রুত নদী পার হয়ে দুর্গের দিকে ছুটে যেতে পারে।

আমি মাটিতে যেখানে শুয়েছিলাম, সেখান থেকে পূর্বদিকের একেবারে শেষ মাথায় নদীর তীরে ক্রিটানরা তাদের সৈন্যদের মূল শিবির স্থাপন করেছিল। শিবিরের চারপাশ ঘিরে দুই মানুষ সমান উচ্চতার কাঠের খুঁটি দিয়ে প্রতিরক্ষা বেড়া তৈরি করেছে। কাঠের খুঁটিগুলোর মাথা কেটে চোখা করা হয়েছে। আন্দাজ করলাম এখানে দুই থেকে তিনহাজার সৈন্য থাকতে পারে।

শিবির এলাকার চারকোণে উঁচু পাহারা মাচা স্থাপন করা হয়েছে। লক্ষ্য করলাম খুঁটি দিয়ে ঘেরা জায়গাটির মাঝে দালানের ছাদ নদীতীরের শুকিয়ে শক্ত হয়ে যাওয়া কালো মাটি দিয়ে ঘন করে লেপা হয়েছে। দেয়ালের উপর দিয়ে শত্রুসেনারা অগ্নিবাণ ছুঁড়লে এটি তা প্রতিরোধ করবে।

ফটক থেকে নদী তীরের যে জায়গায় পন্টুন সেতুটি রয়েছে সে জায়গা পর্যন্ত ক্রিটানরা শুকনো কালো মাটি দিয়ে ইটের রাস্তা তৈরি করেছে। এটাও শত্রুর তীরের আক্রমণ থেকে ক্রিস্টানদের রক্ষা করবে।

ওরা একটার পর একটা লম্বা নৌকা পাশাপাশি বেঁধে নদীর দুই খালের উপর পন্টুন সেতুটি তৈরি করেছে। সেতুর উপর তক্তা ফেলে একটা পথ করা হয়েছে। যাতে প্রয়োজন মতো অনেক সৈন্য শিবির থেকে ছুটে যেতে পারে।

পুরো প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাটা পর্যবেক্ষণ করার পর জারাস মন্তব্য করলো, ওরা সবদিক বিবেচনা করেই পরিকল্পনা করেছে।

আমি একমত পোষণ করে বললাম, এর জন্যই ক্রিটানরা বিখ্যাত সবদিক বিবেচনা করা। তারপরও আমি জায়গাটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিলাম, ক্রিটানদের এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় কোনো দুর্বল দিক বের করা যায় কি না। অনেক খুঁজে একমাত্র পন্টুন সেতুটাই আমার মনে হল একমাত্র পথ যা আমি সামলাতে পারবো।

এরপর মনোযোগ ফেরালাম জেটির দিকে, সেখানে তখনও জাহাজ তিনটি নোঙর করা রয়েছে। ক্রিটানরা যে পদ্ধতিতে প্রথম জাহাজটি থেকে মাল নামাচ্ছিল, তা বিবেচনা করে বুঝতে পারলাম পদ্ধতিটা খুব একটা কার্যকর নয়। আমি হলে জাহাজের খোলের মুখে তেপায়া টেবিল আর কপিকল লাগিয়ে সিন্দুকগুলো ডেক বরাবর বারকোশের উপর রাখতাম। তারপর সেখান থেকে ঠেলাগাড়িতে সিন্দুকগুলো জেটির মধ্য দিয়ে দুর্গের ফটক পর্যন্ত নিয়ে যেতাম।– অথচ ক্রিটান ক্রীতদাসগুলো একটা একটা করে কাঠের সিন্দুক জাহাজের নিচের খোল থেকে বের করে মই বেয়ে উপরে ডেকে নিচ্ছিল। এভাবে কাজ শেষ করতে কয়েকদিন লেগে যেতে পারে।

এবার আমি একটু দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হলাম। কাজটা যে এমন বিশাল আকার ধারণ করবে তা আমি আগে বুঝে উঠতে পারিনি। লাখ লাখ রূপার বাট নাড়াচাড়া করার কথা বলা সহজ, তবে এই বিপুল পরিমাণ সম্পদের আসল ওজন আর পরিমাণ এখন চোখে দেখার পর এগুলো এখান থেকে জব্দ করে সমুদ্র, পর্বত আর মরুভূমির উপর দিয়ে শত শত লিগ দূরত্ব পার করে নিয়ে যাওয়ার কাজটা সম্পূর্ণ অন্য ব্যাপার। তার উপর পেছন পেছন থাকবে একটি প্রতিহিংসাপরায়ণ সেনাবাহিনী।

এবার সত্যিই দুশ্চিন্তায় পড়লাম, মনে হচ্ছে কাজটা অসম্ভব। একবার ভাবলাম কোনোমতে সিন্দুকগুলো কজা করতে পারলে সাগরে ডুবিয়ে দেব। সর্বাধিরাজ মিনোজ কিংবা রাজা বিওন-কেউ আর তার নাগাল পাবে না। তারপর ক্রিস্টানদের প্রতিশোধ থেকে পালিয়ে আমার লোকজনদের নিয়ে আমি থিবসে ফিরে যেতে পারি। হয়তো সর্বাধিরাজ মিনোজকে বুঝিয়ে বলতে পারবো যে, রাজা বিওনই হচ্ছে মূল অপরাধী। তবে এতে আমার সন্দেহ হচ্ছে।

সমস্যাটির তাৎক্ষণিক কোনো সমাধান মনে এলো না। প্রায় ঘন্টাখানেক আমি আর জারাস ঘাসের উপর শুয়ে সমস্যাটা নিয়ে ভাবতে লাগলাম। তারপর হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকের মতো আমার মাথায় একটা সমাধানের সূত্র ভেসে এলো। এত সহজ আর সুন্দর একটা সমাধান কীভাবে আমার মাথায় এলো ভেবে আমি অবাক হয়ে গেলাম।

ভাবলাম সবকিছু জারাসকে খুলে বলি। তারপর আবার একটু চিন্তা করে থামলাম।

সূর্যের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, মধ্য গগন পার হয়ে পশ্চিমে প্রায় অর্ধেক পথে ঢলে পড়েছে। এবার তিনটি যুদ্ধ জাহাজের দিকে তাকিয়ে মনে মনে হাসলাম। অনুভব করলাম জারাস নিবিষ্টমনে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। মনে হল সে বুঝতে পেরেছে, আমার মনে নিশ্চয়ই কোনো একটা পরিকল্পনা এসেছে। যাইহোক এখনও সবকিছু তাকে বলার সময় আসেনি।

শেষপর্যন্ত বললাম, যথেষ্ট হয়েছে। এবার চল যাই।

কোন দিকে, তায়তা?

আমাদের নৌকায় ফিরে যেতে হবে। রাতের আগেই অনেক কাজ সারতে হবে।

.

উপহ্রদের যে জায়গায় আমাদের ছোট নৌকা তিনটা ছেড়ে এসেছিলাম, সাঁতার কেটে সেখানে ফিরতে ফিরতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এলো। বাকি লোকজন আমাদের দুজনকে ফিরতে দেখে খুব খুশি হল। ওরা হয়তো ভেবেছিল আমরা শত্রুর হাতে ধরা পড়ে গিয়েছিলাম আর ওরা আমাদের মেরে ফেলেছে। যাইহোক এখন ওরা আমার নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করে রইল।

সবার আগে যে কাজটা নিয়ে আমি ভাবছিলাম, তা হল ভারি বর্ম আর অস্ত্রশস্ত্র সজ্জিত আমার সৈন্যদেরকে কীভাবে এই গভীর খাল পার করিয়ে দুর্গের কাছে নিয়ে যাবো। অথচ এদের বেশিরভাগই সাঁতার জানে না।

এটা করতে গিয়ে প্রথমে সবচেয়ে ছোট আর হালকা নৌকাটা বেছে নিলাম। তারপর আমার লোকদের বললাম অন্যদুটোর তলা ফুটো করে উপহ্রদের সবচেয়ে গভীর অংশে ডুবিয়ে দিতে। একবার অবশ্য আগুন জ্বেলে পুড়িয়ে দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু পরে ভাবলাম ধুয়া চোখে পড়লে ক্রিটানদের সন্দেহ হলে বিষয়টা তদন্ত করার জন্য ওরা খোঁজ নিতে কাউকে পাঠাতে পারে।

তারপর ছোট নৌকাটা অগভীর পানির উপর দিয়ে টেনে দুর্গের কাছাকাছি উপহ্রদের পূর্বতীরে পৌঁছলাম। তারপর ডাঙার উপর দিয়ে নৌকাটা টেনে খালের কাছে নিয়ে যাবার কাজে সমস্ত লোক নিযুক্ত করলাম। অন্য নৌকা দুটো থেকে যে দড়িগুলো খুলে নিয়েছিলাম সেগুলো দিয়ে বেঁধে নৌকাটা টানার ব্যবস্থা করা হল।

এক একটা রশি একশোজন করে টানার কারণ নৌকার তলি একটা পিছলের মতো হল আর নৌকার কাঠামোর ওজনের ভারে প্যাপিরাসের ঘাস চ্যাপ্টা করে তার উপর দিয়ে সহজেই চলতে লাগলো। যাইহোক নদীর মূল প্রণালীতে পৌঁছতে আমাদেরকে প্রায় অর্ধেক লিগ ডাঙা পার হতে হল। এই কাজ শেষ করতে করতে প্রায় মাঝরাত হয়ে গেল আর আকাশের অনেক উপরে কুঁজো চাঁদ দেখা গেল।

কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে সবাই কিছু ঠাণ্ডা খাবার খেলাম আর সৈন্যদেরকে বর্ম আর উর্দি পরার সময় দিলাম। তারপর যতদুর সম্ভব নিঃশব্দে দাঁড় বেয়ে একেক বার পঞ্চাশজন লোক নৌকায় নিয়ে খাল পার হলাম।

একশো পঞ্চাশ জনের বড় দলটি নিয়ে জারাসকে নলখাগড়ার জঙ্গলের মধ্য দিয়ে পাহারা চৌকির নজর এড়িয়ে যতদূর সম্ভব দুর্গের মূল ফটকের কাছাকাছি পাঠালাম। আমার কাছ থেকে সংকেত না পাওয়া পর্যন্ত ওরা সেখানেই লুকিয়ে থাকবে।

দুজন আলাদা হওয়ার আগে জারাসকে আমার পরিকল্পনাটা বুঝিয়ে বললাম। পঞ্চাশজন লোকসহ আমি নৌকা নিয়ে উজানের দিকে যাব। আমার উদ্দেশ্য হল পন্টুনসেতুটা ধ্বংস করা। এটাই শক্রর মূল শিবিরের সাথে যে দ্বীপে কোষাগারটি রয়েছে সেখানে যাওয়ার একমাত্র পথ। আলাদা হওয়ার আগে জারাসকে আলিঙ্গন করে আবার কয়েকবার আমার নির্দেশগুলো তাকে বুঝিয়ে বললাম, যাতে কোনো ধরনের ভুলবুঝাবুঝি না হয়।

তাকে পাঠিয়ে দেওয়ার পর আমি নৌকায় বসে মাল্লাদের দাঁড় বাওয়ার নির্দেশ দিলাম। খরস্রোতা হলেও আমার মাল্লারা প্রাণপণে দাঁড় বেয়ে চললো। বেশ দ্রুত আমরা উজানের দিকে এগিয়ে চললাম। একটুপরই চাঁদের আলোয় চকচকে সাদা চুনাপাথরের দুর্গের চূড়াটা নজরে পড়লো। দুর্গ চোখে পড়ার সাথে সাথেই আমার লোকেরা দ্বিগুণ উৎসাহে দাঁড় বাইতে লাগলো।

এবার শেষ বাকটার কাছে পৌঁছলাম, এরপর সামনেই দুর্গ। তিনতলা জাহাজ তিনটি এর আগে যেরকম দেখে গিয়েছিলাম সেরকম এখনও পাথরের জেটিতে নোঙর করা রয়েছে। উজ্জ্বল চাঁদের আলোয় পরিষ্কার দেখতে পেলাম দুটো জাহাজ এখনও পানিতে একটু দেবে রয়েছে। তার মানে এখনও এগুলোর খোলে রূপার বাটভরা রয়েছে। তৃতীয় জাহাজটা একটু উঁচু মনে হল। এর বেশিরভাগ মাল হয়তো খালাস করা হয়েছে। তারপরও আমার আন্দাজ মতো এটিরও অর্ধেকের বেশি মাল এখনও জাহাজে রয়ে গেছে।

আশেপাশে কোন ক্রিটান পাহারাদার দেখা গেল না। বিশাল জাহাজগুলোতেও কোনো আলো নেই। যাইহোক জেটির এক মাথায় একটা অগ্নিকুণ্ড জ্বেলে রাখা হয়েছে। আর দুর্গের ফটকের দুই পাশে দুটো ব্রাকেটের মধ্যে মশাল জ্বলতে দেখা গেল।

মাথা থেকে ব্রোঞ্জের শিরস্ত্রাণটা খুলে কোলের উপর রাখলাম। তারপর গলায় পেঁচানো উজ্জ্বল হলুদ কাপড়ের টুকরাটা দিয়ে মুখের নিচের অংশ ঢাকলাম। এটা অত্যন্ত দামি অসাধারণ একটি কাপড়, যাকে রেশমি কাপড় বলা হয়। অত্যন্ত দুর্লভ এই কাপড়টি রূপার চেয়েও দামী। পৃথিবীর অন্য এক কোণ থেকে এটা আসে। সেখানে মানুষ নয়, গুটিপোকা এই কাপড় বুনে। এর ঐন্দ্রজালিক ক্ষমতা রয়েছে। এটি অশুভ শক্তিকে দূর করে, এছাড়া প্লেগ আর হলুদ ফুলের মতো রোগকে দূরে রাখে। যাইহোক এখন এটা দিয়ে আমি আমার মুখ ঢাকলাম।

আমার চেহারায় এমন বৈশিষ্ট্য রয়েছে যে, শত্রু মিত্র যে কেউ আমাকে চিনে ফেলতে পারে। আসলে সৌন্দর্যের জন্য মূল্য দিতে হয়। ফারাওয়ের পর সম্ভবত আমার মুখই সারা বিশ্বে সুপরিচিত। অবশ্য বিশ্ব বলতে আমি মিসরকে বুঝাচ্ছি। এবার শিরস্ত্রাণটি আবার মাথায় পরতেই অন্যান্য সৈন্যদের মাঝে আমি মিশে গেলাম।

স্বভাবতই আমরা ধরে নিয়েছিলাম ক্রিস্টান সেনাকর্মকর্তারা এত লোকজনের ভীড়ে এই দুর্গে নিশ্চয়ই রাত কাটাবে না। সন্ধ্যা হওয়ার সাথে সাথেই ওরা বেশিরভাগ সেনাসহ সেতু পার হয়ে খালের অন্য তীরে তাদের আরামদায়ক শিবিরে রাত কাটাতে চলে গেল।

তারপরও জেটি থেকে যতদূর সম্ভব দূরত্ব বজায় রেখে আমরা নিঃশব্দে নোঙর বাঁধা জাহাজগুলো আর দুর্গের দেয়াল পার হলাম। এগুলো পেছনে ছেড়ে আসার পর সামনে দূরে সারিবধা লম্বা নৌকাগুলো দেখা গেল, এগুলো পাশাপাশি বেঁধে পন্টুন সেতুটা তৈরি করা হয়েছে।

আমরা দাঁড় বেয়ে উজানের দিকে এগিয়ে পন্টুন সেতুর প্রায় দুইশো গজের মধ্যে পৌঁছলাম। তারপর স্রোতের দিকে নৌকা ঘুরিয়ে সরু লম্বা পন্টুন সেতুর দিকে তীর তাক করলাম। দাঁড়িদের বললাম দাঁড় ছেড়ে দিয়ে কোনো নড়াচড়া না করে স্রোতের হাতে নৌকা ছেড়ে দিতে। স্রোত আমাদেরকে সেতুর কেন্দ্রে নিয়ে যাবে।

শেষ মুহূর্তে আমি হাল ঘুরিয়ে দিয়ে সেতুর গায়ে নৌকা ঠেকালাম।

আমার লোকেরা প্রস্তুত ছিল। তিনজন তিনজন করে ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে ওরা নৌকা থেকে লাফ দিয়ে নেমে সেতুর দিকে ছুটলো। বাদবাকিরা কুঠার আর তলোয়ার নিয়ে পন্টুন সেতুর দিকের জাহাজের পাশে দাঁড়াল। আর কোন নির্দেশের অপেক্ষা না করে ওরা একটার সাথে আরেকটা বেঁধে রাখা লম্বা নৌকাগুলোর রশির বাঁধন কাটতে শুরু করলো।

কুঠারের আঘাতের শব্দ নিশ্চয়ই খালের অন্য তীরে শত্রু শিবিরে পৌঁছে গিয়েছিল, কেননা প্রায় সাথে সাথেই শুনলাম সৈন্যদের অস্ত্র হাতে তুলে নেওয়ার আহবান জানাতে ক্রিটানরা ঢাক পিটানো শুরু হয়েছে। শত্রু শিবিরে হৈ চৈ, হট্টগোল শুরু হল, সার্জেন্টরা চিৎকার করে নির্দেশ দিতে লাগলো, ঢালের সাথে তলোয়ারের ঝনঝনানি, বর্মের ঠোকাঠুকি, খটখট আর ঢাকের শব্দ এখানেও পৌঁছে গিয়েছে। তারপর মশাল জ্বালতেই চারদিক আলোয় ভরে গেল, পলিশকরা ধাতব ঢাল আর বুকের বর্মের উপর আলো প্রতিফলিত হল।

ঘুমচোখে পদাতিক সেনার দীর্ঘ একটি সারি খুঁটির বেড়ার মাঝখানে যে পথটি ছিল তার মুখ থেকে বের হয়ে পন্টুন সেতুর গোড়ায় এসে দাঁড়াল। প্রথম চারজন ক্রিটান সেনা একযোগে সরু সেতুটির উপর লাফিয়ে পড়তেই তাদের পায়ের স্যান্ডেলের চাপে সেতুটি দুলে উঠলো।

শত্রু সেনার প্রথম সারিটি আমাদের উপর আক্রমণ করতে এগিয়ে এলো। মশালের আলোয় পুরো দৃশ্যটি পরিষ্কার দেখা গেল। তখনও পন্টুন সেতুর কয়েকটা রশি কাটা বাকি ছিল। পঞ্চাশ পা দূরত্ব থাকতেই শুনলাম আক্রমণের নেতৃত্বে থাকা ওদের একজন সেনাকর্মকর্তা চিৎকার করে কিছু একটা নির্দেশ দিল। ভাষাটা পরিষ্কার না বুঝলেও তার অর্থটা সাথে সাথেই পরিষ্কার হল।

ছুটন্ত অবস্থাতেই ক্রিটান সৈন্যরা পেছনে দিকে হেলে এক যোগে বল্লম ছুঁড়লো। বল্লমগুলো আমার লোকজনের মাঝে এসে পড়লো, ওরা তখনও কুঠার দিয়ে লম্বানৌকাগুলো বেঁধে রাখা দড়ির বাঁধন কাটছিল। আমি দেখলাম একটা বল্লম আমার একজন লোকের পিঠ দিয়ে ঢুকে ডগাটা সামনের দিকে প্রায় একগজ বুক থেকে বের হল। সে নৌকাটির একপাশ দিয়ে নদীতে পড়ে গেল আর কালো পানিতে দেহটা তলিয়ে গেল। তবে তার সাথে কাজ করে যাওয়া অন্যান্য সেনারা একবারও কাজ ছেড়ে তার দিকে ফিরে তাকাল না। ওরা একমনে পন্টুন বেঁধে রাখা রশির উপর কুঠার চালিয়ে গেল।

রশিটা ছিঁড়তেই বেশ জোরে কট করে একটা শব্দ শুনলাম, তারপর কাঠের সাথে কাঠ ঘসাঘসির শব্দ শোনা যেতে লাগলো। আরও রশি ছিঁড়ে বিচ্ছিন্ন হতেই লম্বা নৌকাগুলো আলাদা হতে শুরু করলো।

তারপর একসময় সেতুটা খণ্ডবিখণ্ড হয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। তবে বিচ্ছিন্ন অংশ দুটি আমাদের নৌকার দুইপাশে লেগে থাকলো। আমি চিৎকার করে আমার লোকদের নৌকায় উঠে আসতে বললাম। নিজের নিরাপত্তা নিয়ে আমি মোটেই চিন্তিত ছিলাম না, আমার দুর্ভাবনা ছিল কেবল আমার দুঃসাহসী লোকদের নিরাপত্তা নিয়ে।

বর্মপরা ক্রিটানরা কোন ধরনের বাধা ছাড়াই ঝড়ের মতো পন্টুনের উপর দিয়ে ছুটে এল। যুদ্ধংদেহী আর গগন বিদারি চিৎকার করতে করতে ওরা বল্লম ছুঁড়তে লাগলো। আমার লোকেরা নৌকার পাটাতনের আড়ালে বসে পড়লো। সড়কিগুলো নৌকার কাঠের গায়ে এসে বিঁধলো।

সেতুর দুই অংশের মাঝখানে বেঁধে রাখা আমাদের নৌকার দড়িগুলো কাটার জন্য চিৎকার করে আমি নির্দেশ দিলাম। তবে হৈচৈ আর প্রচণ্ড কোলাহলের মাঝে কেউ আমার নির্দেশ শুনতে পেল না। আমার একজন লোকের হাত থেকে একটা কুঠার কেড়ে নিয়ে আমি নৌকার সামনের দিকে ছুটে গেলাম।

একজন ক্রিস্টান সৈন্যও আমার দিকে ছুটে এল। আমরা দুজনে একইসাথে নৌকার সামনের দিকে পৌঁছলাম। ছুটতে ছুটতে সে তার হাতের বল্লমটা আমার দিকে ছুঁড়লো, তারপর কোমরের খাপ থেকে তলোয়ারটা বের করার চেষ্টা করতে লাগলো। আমরা মুখোমুখি হতেই সে তলোয়ারটা খাপ থেকে বের করে হাতে নিল।

দেখলাম শিরস্ত্রাণের নিচে সে দাঁত বের করে হাসছে। হয়তো ভাবছিল আমার আর রক্ষা নেই, এবার নিশ্চয়ই আমাকে হত্যা করবে। তারপর তলোয়ারটা একবার পিছিয়ে আগাটা সোজা আমার বুক বরাবর চালাল। তবে তার চোখের দিকে তাকিয়ে আমি তার উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে ঠিক সময়মতো শরীরে একটা মোচড় দিলাম। ফলে তলোয়ারের ডগাটা আমার বগলের নিচ দিয়ে চলে গেল। সাথে সাথে আমি এক হাতে তার তলোয়ার ধরা হাতটির কনুই চেপে ধরলাম।

তারপর তাকে শক্ত করে সামনে খাড়া করে ধরে রাখলাম। সে ছাড়া পেতে আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগলো। কিন্তু নড়াচড়ার কারণে তার পায়ের নিচে পন্টুনের অংশটা দুলে উঠতেই সে ভারসাম্য হারাল। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই আমি তার তলোয়ার ধরা হাতটা ছেড়ে দিলাম। এর জন্য সে মোটেই প্রস্তুত ছিল না, সাথে সাথে পেছনের দিকে ঢলে পড়তেই দুই হাত সামনে বাড়িয়ে তাল সামলাতে চেষ্টা করলো।

সাথে সাথে আমি তার তলোয়ার ধরা ডান হাতের কব্জির উপর কুড়ালের এক কোপ মারলাম, শরীরের শুধু এই অংশটাই ধাতব বর্ম দিয়ে ঢাকা ছিল না। নৌকার দুলুনির কারণে আমিও ঠিকমতো দাঁড়াতে পারছিলাম না, তাই কোপটা ঠিক জায়গায় পড়েনি। তলোয়ার ধরা হাতটা সম্পূর্ণ কাটা না পড়লেও কব্জির হাড় কেঁটে গিয়ে আঙুলগুলো আলগা হয়ে পড়লো। হাতের আঙুলগুলো খুলে যেতেই তলোয়ারটা তার হাত থেকে নিচে কাঠের তক্তার উপর পড়তেই ঠনঠন ধাতব শব্দ হল। টলমল পায়ে সে তার পেছনের সঙ্গির গায়ের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়লো। জড়াজড়ি অবস্থায় দুজনেই পন্টুন সেতু টপকে ঝপাং করে নিচে পানিতে পড়ে গেল। পরনের ভারী বর্মের ওজনের কারণে সাথে সাথেই দুজনেই পানির নিচে তলিয়ে গেল।

কুড়ালটা তখনও আমার হাতে ধরা ছিল, আর যে দুটো মুরিং রশি দিয়ে আমাদের নৌকাটা পন্টুন সেতুর সাথে বাঁধা ছিল, সেগুলো ঠিক আমার সামনে শক্ত হয়ে টান টান হয়েছিল। রশির গিটের উপর দিয়ে পানির স্রোত বয়ে যাচ্ছিল। আমি কুড়ালটা মাথার উপর তুলে সর্বশক্তি দিয়ে সবচেয়ে মোটা রশিটার উপর লক্ষ স্থির করে এক কোপ দিলাম। ধনুকের ছিলার মতো রশিটা কেটে দুই টুকরা হয়ে গেল। তারপর আবার কুড়ালটা তুলে অন্য রশিটার উপর কোপ মারতেই এটিও কেটে গেল। রশিগুলো আলাদা হতেই ওজন আর টান ছুটে যেতেই নৌকার মাথাটা একবার উপরের দিকে উঠেই আবার নামলো। আর আমরা বাঁধন মুক্ত হয়ে স্রোতের অনুকূলে ভেসে চললাম।

এর ফলে ভাঙা সেতুর উপরে নাটকীয় প্রতিক্রিয়া দেখা গেল। সেতুর প্রত্যেকটি অংশ তখনও নদীর তীরে বাঁধা ছিল। তবে নদীর মাঝে অন্য দুই অংশ সংযুক্ত ছিল না আর স্রোত দুই মাথাকে আরও দূরে সরিয়ে দিল। লক্ষ্য করলাম একসাথে দল বেঁধে থাকা বেশ কয়েকজন ক্রিটান সৈন্য টলমল অবস্থায় ভাঙা সেতুর উপর দাঁড়িয়ে তাল সামলাতে চেষ্টা করছে।

ভারী ওজন নড়াচড়ার কারণে ভাসমান পন্টুন স্থিতিশীলতা হারাতে শুরু করলো। ওজনদার বর্মপরা লোকগুলো ভারসাম্য হারিয়ে মাতালের মতো একজন আরেকজনের গায়ে ঢলে পড়তে লাগলো, তারপর পন্টুন থেকে ছিটকে পানিতে পড়তে শুরু লাগলো।

আতঙ্কিত হয়ে লক্ষ্য করলাম একটা পন্টুন পানিতে ডুবে যেতেই প্রায় বিশজন মানুষ একধার দিয়ে খালের পানিতে ছিটকে পড়ে গেল। কয়েকমিনিটের মধ্যে বেশিরভাগ ক্রিটান সৈন্য কালো পানিতে হাবুডুবু খেতে খেতে ইঁদুরের মতো পানির নিচে তলিয়ে গেল।

বিষয়টা আরও বেদনাদায়ক মনে হল, কেননা এরাতো আসলে আমাদের শত্রুও ছিল না। আমি ইচ্ছা করে কারসাজি করে এদেরকে আমাদের মিত্র বানিয়েছিলাম। আমার দেশ মিসর আর ফারাওয়ের জন্য একাজটা করছি জেনেও মনে কোন সান্ত্বনা পেলাম না। আমার কৃতকর্মের এই ভয়ঙ্কর পরিণতি দেখার পর আমি মর্মাহত হলাম।

যাইহোক অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে আমার মনের অপরাধবোধ আর বিবেকদংশন একপাশে সরিয়ে দিলাম। জানি যা ঘটেছে তা আর ফিরিয়ে আনা যাবে না। ডুবে যাওয়া মানুষগুলোর কথা মন থেকে দূর করবার চেষ্টা করে নিজেদের মানুষের কথা ভাবতে শুরু করলাম। আর কী কী ক্ষতি হয়েছে তার হিসাব শুরু করলাম। ঘুরে দাঁড়িয়ে যেখানে রশিগুলো কেটেছিলাম সেদিকে এগোলাম। অকারণে চিৎকার করে আমার লোকদের উপর রাগ ঝাড়তে শুরু করলাম। ওদেরকে বললাম দাঁড় নিয়ে বেঞ্চে বসতে, কাউকে কাউকে ঠেলা দিলাম, লাথি দিলাম আর ইতস্তত করার কারণে দুএকজনকে চড়চাপড়ও দিলাম। ওরা সবাই হতবাক হল আমার কাজকারবার দেখে।

অবশেষে আমি নৌকার হাল নিজের হাতে তুলে নিলাম। দাঁড়িরা একসাথে দাঁড় বেয়ে চললো। এরপর দুর্গের মূল ফটকের নিচে পাথরের জেটির দিকে নৌকার মুখ ঘুরালাম। সেখানেই রূপার বাটভরা জাহাজগুলো নোঙ্গর করা ছিল।

.

আমাদের ছোট্ট নৌকাটির গলুই পাথরের জেটির সিঁড়ির গায়ে ঠেকতেই আমি এক লাফে নেমে পড়লাম। খোলা তরবারি হাতে জারাস সেখানে দাঁড়িয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। উত্তেজনায় সে হাঁপাচ্ছিল আর দাঁত বের করে বোকার মত হাসছিল।

রক্তমাখা তরবারি ডগা দুর্গের খোলা ফটকের দিকে নির্দেশ করে সে বললো, রত্নভাণ্ডার ভরা তিনটা জাহাজ আর দুর্গটাও আমরা দখলে নিয়েছি! পন্টুন সেতুর কাছে আপনি যে গোলমাল সৃষ্টি করেছিলেন তাতে বেশ চমৎকারভাবে ওদের মনোযোগ সেদিকে আকৃষ্ট হয়েছিল। দুর্গের রক্ষীরা যখন আপনাদের লড়াই দেখছিল, তখন আমরা আচমকা আক্রমণ করে ওদেরকে কাবু করে ফেলি। আমাদের আসা ওরা মোটেই টের পায়নি। মনে হয়না কেউ পালাতে পেরেছে আর পালাতে চেষ্টা করলেও বেশি দূর যেতে পারবে না। তারপর একটু থেমে দম নিয়ে আবার বললো, সেতুর কাজটি আপনি কীভাবে সামলালেন তায়তা? আমি বেশ খুশি হলাম শুনে যে, লড়াইয়ের উত্তেজনার মধ্যে আর বিজয়ের পরও হাইকসো ভাষায় কথা বলার কথা তার মনে আছে।

আমি তাকে সংক্ষেপে জানালাম, সেতু ভেঙে ফেলা হয়েছে আর অর্ধেকের বেশি শত্রুসেনা নদীতে ডুবে গেছে। তারপর পেছন দাঁড়িয়ে থাকা আকেমির দিকে তাকিয়ে বললাম, এই নৌকাটি আর দাঁড় বাওয়ার জন্য বারোজন লোক সাথে নাও। তারপর একটু দূরে একসারিতে নোঙর করা ছোট ছোট কয়েকটা নৌকা দেখিয়ে বললাম, মশাল আর আগুনের পাত্র নিয়ে ওগুলো সব পুড়িয়ে ফেল। নইলে ক্রিটানরা ওগুলো দখল করে ওদের সৈন্যদের খাল পার করিয়ে আবার আজ রাতে আমাদের উপর আক্রমণ চালাতে পারে।

আকেমি উত্তর দিল, এখুনি আপনার নির্দেশ পালন করা হবে, প্রভু।

আমি বললাম, সবচেয়ে বড় নৌকাটা রেখে দিও। সারির একেবারে শেষ মাথায় ঐ চতুষ্কোণ পাল-বিশিষ্ট ছোট জাহাজটা পুড়িও না। ওটা এখানে নিয়ে এস, আমরা যখন চলে যাবো তখন এটা জেটিতে বেঁধে রেখে যাবো।

আকেমি আর জারাস, উভয়েই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল। শুধু জারাস সাহস করে আমার এই নির্দেশ সম্পর্কে জানতে চেয়ে বললো, ক্রিটানদের জন্য এটা এখানে রেখে যাবো? কেন এটা করবো আমরা?

এটা এজন্য রেখে যাবো, যাতে ক্রিস্টানদের সেনা কর্মকর্তারা ক্রিট দ্বীপে ফিরে গিয়ে তাদের রাজাকে হাইকসো মিত্রদের বিশ্বাসঘাতকতার কথা জানাতে পারে। ক্রিটের সর্বাধিরাজ মিনোজ এই পাঁচলাখ রূপার বাট হারিয়ে নিশ্চয়ই মনে খুব কষ্ট পাবেন। তারপর আবার যখন এই ঘটনার সংবাদ পাবেন, তখন তিনি রাজা বিওনের রক্ত পান করতে চাইবেন।

তারপর আমি জেটিতে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আকেমি আর তার লোকজনের নদীর মোহনার দিকে যাওয়া লক্ষ্য করলাম। সে চারজন লোককে বড় চারকোণা পালওয়ালা জাহাজে তুলে দিল। ওরা একটা তিনকোণা পাল তুলে জাহাজটা জেটির নিচে যে জায়গায় আমি আনতে বলেছিলাম, সেখানে এনে রাখলো।

তারপর দেখলাম আকেমি আমাদের ছোট্ট নৌকাটির সামনের গলুইর কাছে দাঁড়িয়ে আছে, আর তার লোকেরা দাঁড় বেয়ে তাকে সারিবদ্ধ ছোট ছোট নৌকাগুলোর কাছে নিয়ে গেল। যেতে যেতে সে একটা একটা জ্বলন্ত মশাল প্রত্যেক নৌকার উপর ছুঁড়ে ফেলতে লাগলো। সবগুলো ভালোভাবে জ্বলতে শুরু করার পর আমি সন্তুষ্ট হলাম। তারপর ফিরে জারাস যেখানে বোকার মতো দাঁড়িয়ে ছিল সেখানে ফিরে গেলাম।

তাকে বললাম, বাকি লোকজনদের নিয়ে আমার সাথে এসো। তারপর সবচেয়ে কাছে ধনভাণ্ডারভরা ক্রিস্টানদের তিনতলা বড় জাহাজটার দিকে ছুটতে ছুটতে বললাম, এই জাহাজটা দখল করো জারাস। আমি তোমার সাথেই যাব।

সে উত্তর দিল, অবশ্যই, প্রভু। আমার কিছু লোক ইতোমধ্যেই এই জাহাজে চড়েছে।

দ্বিতীয় তিনতলা জাহাজটা দেখিয়ে বললাম, দিলবার এটা তার অধীনে নেবে। আর আকেমি তৃতীয় জাহাজটা নেবে।

আপনার নির্দেশ যথারীতি পালন করা হবে, প্রভু। মনে হচ্ছে শুধু তায়তা হতে জারাস এবার আমাকে প্রভুর পর্যায়ে উন্নীত করেছে। যাইহোক আমার সাথে তার এখনও তেমন সখ্যতা রয়েছে যাতে সে এখনও উল্টোপাল্টা প্রশ্ন করতে পারে। আর সাথে সাথে করলোও তাই।

খোলা সাগরে পৌঁছার পর আমরা কোনদিকে যাব? আমরা কি পূর্বদিকে সুমেরিয়া না পশ্চিমদিকে মরুতানিয়া উপকূলের দিকে যাবে? তারপর সে আগবাড়িয়ে একটু উপদেশ দিতে চেষ্টা করলো। এই দুইদেশেই অবশ্য আমাদের মিত্র আছে। পুবে আছে দুই নদীর রাজ্যের রাজা নিমরদ। আর পশ্চিমে মরিতানিয়াতে আনফার রাজা শান-ডাকির সাথে আমাদের একটা মৈত্রী চুক্তি রয়েছে। আপনি কোনদিকে যেতে চাচ্ছেন তায়তা?

আমি সাথে সাথে তার কথার কোন উত্তর দিলাম না। বরং তাকে আমি আমার নিজের প্রশ্নটাই করলাম, আচ্ছা তুমিই বল জারাস। এই পৃথিবীর কোন রাজাকে তুমি এই পাঁচ লাখ রূপার সম্পদ নিয়ে বিশ্বাস করবে?

জারাস একটু হতবুদ্ধি হল। এ-ধরনের প্রশ্নের কথা সে ভাবেনি। সম্ভবত না, শান-ডাকিকে অবশ্যই বিশ্বাস করা যায় না। তার লোকেরা সবাই জলদস্যু আর তিনি হচ্ছেন চোরদের রাজা।

আমি বললাম, আর নিমরদ সম্পর্কে কি বলবে? আমি অবশ্য তাকে আমার বুড়ো আঙুলের সমান একটা রূপার টুকরা দিয়েও বিশ্বাস করতে রাজি নই।

সে প্রতিবাদ করে বললো, কিন্তু কাউকে না কাউকে তো আমাদের বিশ্বাস করতেই হবে। আর নয়তো রূপাগুলো আমরা কোনো নির্জন সৈকতে বালুর নিচে চাপা দিয়ে রেখে, পরে সুবিধামতো সময়ে এসে আবার উদ্ধার করতে পারি।

আমি তাকে মনে করিয়ে দিলাম, পাঁচ লাখ রূপার বাট? এতবড় একটা গর্ত করতে তো প্রায় একবছর লেগে যাবে আর এগুলো ঢাকতে পর্বত পরিমাণ বালু লাগবে। তার হতবুদ্ধি অবস্থা দেখে আমি বেশ মজা পাচ্ছিলাম। তারপর তার জন্য যে জাহাজটা বরাদ্দ করা হয়েছে, সেটার মাস্তুলের মাথায় ক্রিটের সোনালি আঁড়ের ছবিওয়ালা মিনোজের পতাকার দিকে তাকিয়ে বললাম, বাতাস আমাদের অনুকূলে আছে! আর দেবতা সবসময় সাহসী এবং উচ্চভিলাষী মানুষকে পছন্দ করেন।

সে আমার কথার প্রতিবাদ করে বললো, না তায়তা। বাতাস আমাদের অনুকূলে নেই। এটা সাগর থেকে খালের উপর দিয়ে সরাসরি এদিকে আসছে। বাতাসটা আমাদেরকে ডাঙার দিকে চাপ দিচ্ছে। মধ্য সাগরের খোলা পানিতে যেতে আমাদেরকে সবগুলো দাঁড় বাইতে হবে। আর আপনি যদি শান-ডাকি আর নিমরদকে বিশ্বাস না করেন, তাহলে কাকে বিশ্বাস করেন? কার কাছে যাব আমরা?

আমি তাকে বললাম, আমি শুধু ফারাও ত্যামোসকে বিশ্বাস করি। এই প্রথম সে সত্যি আমার উপর হতাশ হল।

তারপর একটু অবজ্ঞাভরে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, তবে যে পথ ধরে আমরা এখানে এসেছি, সেই পথেই আপনি ফারাওয়ের কাছে ফিরে যেতে চান? তাহলে কি উশু থেকে মাথায় করে রূপার পেটিগুলো আমরা বয়ে নিয়ে যাব। তারপর সাঁতার কেটে লোহিত সাগর পার হব? অবশ্য সেখান থেকে থিবস অল্প হাঁটা দূরত্বে রয়েছে। ফারাও কিন্তু আপনাকে দেখে বেশ অবাক হবেন, এ-বিষয়ে আপনি নিশ্চিত হতে পারেন।

আমি একটু প্রশ্রয়ের হাসি হেসে তাকে বললাম, না জারাস। এখান থেকে আমরা দক্ষিণে নীল নদী দিয়ে যাব। বিশাল এই তিনটি ক্রিস্টান জাহাজ আর এগুলোর খোলে যে রূপা আছে তা সবশুদ্ধ নিয়ে সরাসরি আমরা থিবসে ফিরে যাব।

এবার সে হাসি থামিয়ে বললো, আপনি কি পাগল হয়েছেন তায়তা? এখান থেকে আসিউত পর্যন্ত নীলনদের প্রতিটি ইঞ্চি বিওনের অধীনে। হাইকসোদের মধ্য দিয়ে তিনশো লিগ আমরা নদী পথে যেতে পারবো না। এটা সত্যি পাগলামি। উত্তেজনার চোটে সে হাইকসো ভাষা বাদ দিয়ে মিসরী ভাষায় কথাটা বলছিল।

আমি এ কথার প্রতিবাদে তাকে তিরস্কার করে বললাম, তুমি যদি হাইকসো ভাষায় কথা বল, তাহলে সবকিছু সম্ভব হবে। যাইহোক আমাদের দুটো নৌকাতো আগেই ডুবিয়ে দিয়েছি আর তামিয়াত ছাড়ার আগে তৃতীয়টাও পুড়িয়ে যাব। নিশ্চিত করে যাব, যাতে আমাদের প্রকৃত পরিচয়ের কোনো ধরনের চিহ্ন এখানে না থাকে।

এবার সে আবার দাঁত বের করে হেসে বললো, মহান মাতা আসিরিস আর তার প্রিয় পুত্র হোরাসের নামে শপথ করে বলছি তায়তা, আমার মনে হয় আপনি যা বলছেন তা আপনি বিশ্বাস করেন। আবার সে দুইগাল হাসিতে ভরিয়ে দিয়ে বললো, তার মানে আপনার পরিকল্পনা ছিল যে, এসব কথা বলে আমাকে আপনার মতোই পাগল বানিয়ে ছাড়বেন, যাতে আমিও পাগল হয়ে আপনার কথায় রাজি হই, তাই না?

যুদ্ধের সময় পাগলামিই হয়ে যায় মতিস্থিরতা। আমার পিছু পিছু এসো। আমি তোমাকে দেশে নিয়ে যাব। একথা বলে আমি সিঁড়ি বেয়ে সামনের জাহাজের ডেকে উঠলাম। জারাসের বিশজন লোক সেখানে আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। ওরা ইতোমধ্যেই নাবিকসহ পুরো জাহাজটি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। ক্রিটান জাহাজটির নাবিকেরা ডেকের উপর এক সারিতে মাথা নিচু করে বসে রয়েছে, হাত পেছন দিকে বাঁধা। বেশিরভাগেরই শরীরের ক্ষত থেকে রক্ত ঝরছে। মোট ছয়জন ক্রিটান নাবিকের পেছনে জারাসের লোকেরা খোলা তলোয়ার নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

আমি ওদেরকে উৎসাহ দিয়ে বললাম, ভালো কাজ করেছ। তারপর জারাসের দিকে ফিরে বললাম, তোমার লোকদের বল, বন্দীদের সবার পরনের উর্দি আর বর্ম খুলে নিতে। সে নির্দেশ জারি করতে করতেই আমি ডেক থেকে সিঁড়ি দিয়ে সবচেয়ে উপরের দাঁড় বাওয়া ডেকে নামতে শুরু করলাম। বেঞ্চে কেউ নেই আর লম্বা দাঁড়গুলো এমনি পড়ে রয়েছে। তবে এই দাঁড়গুলো বাওয়ার জন্য আমার কাছে পঞ্চাশজন মানুষ আছে। এখানে সময় নষ্ট না করে সিঁড়ি বেয়ে নিচে ক্রীতদাসদের ডেকে নামলাম। সাথে সাথে প্রচণ্ড দুর্গন্ধ নাকে এল। দুর্গন্ধটা এমন শক্তিশালী যে প্রায় দম বন্ধ হয়ে এলো। তারপরও নামতে লাগলাম।

নিচু ছাদে আটকানো ব্রাকেটে তেলের প্রদীপ টিমটিম করে জ্বলছে। এই আলোয় দেখতে পেলাম সারিবদ্ধ প্রায় অর্ধনগ্ন ক্রীতদাসেরা বেঞ্চে বসে ওদের সামনের লম্বা দাঁড়ে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে। যারা জেগেছিল, তারা শূন্য দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল। ওদের নড়চড়ার সাথে সাথে শিকলের ঝনঝন শব্দ শোনা যাচ্ছিল।

ভাবলাম একটা ছোটখাট বক্তৃতা দিয়ে বলি, যদি ওরা ভালোভাবে দীর্ঘক্ষণ দাঁড় বেয়ে চলে, তবে থিবসে পৌঁছে ওদেরকে মুক্তি দেব। কিন্তু এই চিন্তাটা বাদ দিলাম, কেননা ওরা এখন আর পুরোপুরি মানুষের পর্যায়ে নেই। জঘন্য বন্দী জীবন আর নির্মম ব্যবহারের ফলে ওরা প্রায় পশুর পর্যায়ে নেমে এসেছে। আমার ভালো কথা ওদের কাছে কোনো অর্থই বয়ে আনবে না। চাবুক ছাড়া আর কিছুই ওরা এখন বুঝে না।

নিচু ছাদ থেকে মাথা বাঁচাতে প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে ক্রীতদাসের সারির মধ্য দিয়ে হেঁটে শেষমাথায় একটা দরজার কাছে গেলাম। নিশ্চিত এটাই মাল রাখার খোল। দরজায় একটা ভারি পিতলের তালা ঝুলছিল। জারাস আমার পিছু পিছু আসছিল। আমি একপাশে সরে তাকে জায়গা করে দিতেই সে তলোয়ার দিয়ে খুঁচিয়ে তালাটা খুলে এক লাথি মেরে দরজাটা খুললো।

ব্রাকেট থেকে একটা তেলের প্রদীপ নিয়ে আমি মালখানায় ঢুকলাম। মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত রূপার বাক্সগুলো সাজানো রয়েছে। অবশ্য মাঝখানে একটা বড় ফাঁক দেখা যাচ্ছে। মনে মনে একটা হিসাব কষে বুঝলাম ক্রিটানরা প্রায় একশোটা বাক্স এখান থেকে দুর্গে নিয়ে গেছে।

একবার ভাবলাম, এই বিশাল ধনভাণ্ডারের এই সামান্য অংশটুকু ফেলে রেখে তিনটি জাহাজে আর যা আছে তা নিয়ে চলে যাই। তারপর ভাবনাটা সরিয়ে দিলাম। মনে মনে ভাবলাম, দেবতা মৃদু হেসেছেন তায়তা, এখন এর পুরোপুরি সুযোগ নাও, কখন আবার দেবতা ভ্রুকুটি করে কে জানে। তারপর জারাসের দিকে ফিরে বললাম, এসো আমার সাথে। তোমার কাছে যতলোক আছে, সেখান থেকে যতজন পার নিয়ে এসো।

এবার কোথায় যাব?

আমি সারিবদ্ধ করে রাখা রূপার বাক্সগুলোর মাঝখানের ফাঁকটা দেখিয়ে বললাম, দুর্গে গিয়ে আমরা খুঁজে বের করবো বাদবাকি রূপার পেটিগুলো ক্রিটানরা কোথায় লুকিয়ে রেখেছে। ওখানে যত রূপা আছে তা দিয়ে একটা পুরো সেনাবাহিনীকে সজ্জিত করে যুদ্ধক্ষেত্রে নামানো যায়। যে করেই হোক বিওনের হাতে যেন এটা না পড়ে তা আমাদের নিশ্চিত করতে হবে।

এরপর আমরা দ্রুত ডেকে ফিরে গেলাম। সিঁড়ি বেয়ে জেটিতে নামলাম, জারাসও তার দশজন লোক নিয়ে আমাকে অনুসরণ করলো। সাথে সে বন্দী ক্রিটান নাবিকদেরও নিয়ে এলো। ওদের পরনের সমস্ত পোশাক খুলে প্রায় নগ্ন করেছে। দুর্গের ফটকের ভেতরে আমরা দিলবার আর তার ত্রিশজন লোকের দেখা পেলাম। তীরে যেসব শত্রুদেরকে ওরা বন্দী করেছিল তাদেরকে পাহারা দিয়ে রেখেছে।

আমি দিলবারকে নির্দেশ দিলাম তার অধীনস্থ বন্দীদেরও পোশাক খুলে নিতে। ক্রিটান সৈন্যদের পোশাক আর বর্ম যতবেশি পাওয়া যায় তা আমাদের প্রয়োজন হবে। মিনোয়ান সেনা কর্মকর্তারা রূপা, সোনা আর মূল্যবান পাথরের নেকলেশ, আংটি, বাজুবন্ধ, বালা পরেছিল।

আমি দিলবারকে নির্দেশ দিলাম ওগুলোও খুলে নিতে। সেখান থেকে দুটো অসাধারণ ধরনের অলংকার তুলে নিয়ে আমি আমার চামড়ার থলেতে ভরে নিলাম। বেশিরভাগ মেয়েদের মতো আমার দুই ছোট রাজকুমারিও সুন্দর আর চকচকে ছোটখাট গহনা পছন্দ করে।

তারপর নজর ফেরালাম শিকলে বাঁধা বন্দীর সারির দিকে। ওরা  সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এক নজর দেখেই বুঝলাম এখানে বিভিন্ন জাতের মানুষ রয়েছে, যার মাঝে লিবিয়, হুরিয়, সুমেরিয় আছে। তবে বেশিরভাগই মিসরী। সম্ভবত হাইকসোরা এদের বন্দী করেছিল, তারপর এই দুর্গ নির্মাণ করার কাজে সাহায্য করার জন্য ওরা এদেরকে ক্রিস্টানদের হাতে তুলে দিয়েছিল। এদের মধ্যে একজন আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। লোকটির বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা দেখে মনে হচ্ছে সে এখনও হতাশায় ভেঙে পড়েনি।

দিলবারকে বললাম, এই লোকটাকে পাশের কামরায় নিয়ে যাও। সে লোকটাকে জাপটে ধরে টানতে টানতে পাশের ছোট কামরায় নিয়ে গেল। সেখানে গিয়ে আমি তাকে বললাম আমাদের দুজনকে একা রেখে কামরা ছেড়ে চলে যেতে। তারপর কিছুক্ষণ নিরবে ক্রীতদাসটির দিকে তাকিয়ে রইলাম। হাল ছেড়ে দেওয়ার মতো আচরণ করলেও তার চোখে একটু অবাধ্য ভাব  আছে যা সে লুকাতে চেষ্টা করছিল।

ভালো! আমি ভাবলাম, তার মানে সে এখনও মানুষ আছে।

তারপর আমি আমাদের নিজেদের সুমিষ্টভাষায় নরম সুরে তাকে বললাম, তুমি একজন মিসরী। কথাটা শুনেই সে চমকে উঠল, বুঝলাম সে আমার কথা বুঝেছে। তারপর জিজ্ঞেস করলাম, কোন পল্টন? কিন্তু কোনো উত্তর না দিয়ে সে শুধু কাঁধ ঝাঁকালো। এমন ভান করলো যেন আমার কথা বুঝতে পারেনি, তারপর নিচে তার পায়ের দিকে তাকিয়ে রইল।

এবার তাকে হুকুমের সুরে বললাম, তাকাও আমার দিকে! একথা বলে শিরস্ত্রাণ খুলে মুখের নিচের অংশ ঢাকতে যে হলুদ কাপড়টা পেঁচিয়ে রেখেছিলাম, সেটা খুলে ফেললাম। তারপর আবার বললাম, তাকাও আমার দিকে!

লোকটি মাথা তুলে আমার দিকে তাকিয়েই চমকে উঠল।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, আমি কে?

সে অবাক বিস্ময়ে ফিসফিস করে বললো, আপনি তায়তা। ছোটবেলায় আমি আপনাকে লুক্সরের হাথোর মন্দিরে দেখেছিলাম। বাবা বলেছিলেন জীবিত মিসরীয়দের মধ্যে আপনি অন্যতম শ্রেষ্ঠ। তারপর সে আমার পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়লো। আমার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাবার এই ধরন দেখে আমি অভিভূত হলাম। তারপরও কণ্ঠস্বর যথাসম্ভব স্থির রেখে বললাম,

হ্যাঁ সৈনিক, আমি তায়তা। তুমি কে?

আমি ছাব্বিশতম রথবাহিনীর রহিম। পাঁচবছর আগে হাইকসো কুকুরগুলো আমাকে বন্দী করে।

আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কি আমাদের প্রিয় মিসরে ফিরে যেতে চাও? উত্তরে সে মৃদু হাসতেই দেখা গেল তার একটা দাঁত নেই আর মারের চোটে মুখে কালশিটে দাগ পড়েছে। প্রচুর মার খেলেও সে একজন মিসরীয় যোদ্ধা, দৃঢ়ভাবে উত্তর দিল, যতক্ষণ প্রাণ থাকে ততক্ষণ আমি আপনার লোক!

গতকাল ক্রিটানরা জাহাজ থেকে যে সিন্দুকগুলো তোমাদেরকে দিয়ে নামিয়ে এনেছে সেগুলো কোথায় রেখেছে?

সিঁড়ির নিচে ইস্পাতের ভারি দরজাওয়ালা একটা গোপন কুঠরিতে রেখেছে। তবে দরজায় তালা দেওয়া আছে।

চাবি কার কাছে?

কাঁধে সবুজ পট্টি দেওয়া মোটা লোকটার কাছে। সে ক্রীতদাসদের তত্ত্বাবধায়ক।

লোকটাকে আমি অন্যান্য বন্দীদের সাথে হাঁটু গেড়ে বসে থাকতে দেখেছি। তার কাছে কি তোমাদের শিকলের তালার চাবি আছে, রহিম? এগুলো তোমাদের দরকার পড়বে, কারণ এখন থেকে তুমি আবার মুক্ত মানুষ। কথাটা মনে করে সে দাঁত বের করে হাসলো।

সমস্ত চাবি সে তার কোমরে একটা শিকলে ঝুলিয়ে রাখে। তার পোশাকের নিচে চাবির গোছাটা লুকিয়ে রাখে।

রহিমের কাছ থেকে জানতে পারলাম আশিজনেরও বেশি মিসরীয় তিরন্দাজ আর রথীসেনা ওরা বন্দী করেছে। ওদের পায়ের শিকল খুলে দিতেই ওরা খুশিমনে রূপার বাক্সগুলো দুর্গ থেকে জারাসের জাহাজের খোলে বয়ে নিয়ে চললো।

রূপার বাক্সগুলো যখন স্থানান্তর করা হচ্ছিল তখন রহিম আমাকে দুর্গের অস্ত্রভাণ্ডারে নিয়ে গেল। দরজা ভেঙে ভিতরে ঢুকে থরে থরে সাজানো সামরিক উর্দি, বর্ম আর বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র দেখে আমার আনন্দ হল।

সবকিছু জাহাজে নিয়ে গিয়ে মূল ডেকে রাখার নির্দেশ দিলাম যাতে প্রয়োজনে সহজেই হাতের নাগালে পাওয়া যায়।

সবশেষে বন্দী ক্রিটানদের তাদের নিজেদের ক্রীতদাস ব্যারাকে তালা বন্ধ করে রেখে আমরা অপেক্ষামান তিনটি তিনতলা জাহাজে চড়লাম।

.

সমস্ত লোকজনকে আমি তিনটি জাহাজে সমানভাবে ভাগ করে দিয়েছিলাম, যাতে সবগুলো বৈঠা চালানো যায়। আমার নিদের্শে নিচের ডেকে শিকলে বাঁধা ক্রীতদাসদেরকে শক্ত রুটি, শুকনো মাছ আর বিয়ার খেতে দেওয়া হল। এগুলো আমরা দুর্গের ভাঁড়ার ঘরে পেয়েছিলাম। ময়লা কড়াপরা হাত দিয়ে ওদের গোগ্রাসে খাওয়ার দৃশ্যটা খুবই করুণ ছিল। খাবার আর ভালো ব্যবহার ওদেরকে পুনরুজ্জীবিত করেছে। আমি জানি ওরা খুশিমনে আমার কাজে লাগবে।

পুবআকাশে ভোরের আলো দেখা দিতেই আমাদের যাত্রার সময় হল। সবচেয়ে আগের জাহাজের হালে জারাসের পাশে আমি আমার জায়গা করে নিলাম। মাথায় হাইকসো শিরস্ত্রাণ পরলাম আর সিল্কের হলুদ স্কার্ফটা দিয়ে মুখের নিচের অংশ ঢাকলাম।

জারাস নোঙর তুলে ফেলার নির্দেশ দিতেই প্রত্যেক দাঁড় বাওয়া ডেকে ঢাক পেটানো শুরু হল। ঢাক পেটানোর তালে তালে লম্বা দাঁড়গুলো পানিতে একবার ডুবিয়ে আবার তুললো, এভাবেই দাঁড় বাওয়া শুরু হল। একটু পরই আমরা নদীর মূল ধারায় এলাম। বাকি দুটো জাহাজও আমাদের অনুসরণ করলো। আমরা সোজা দক্ষিণদিকে হাইকসো রাজধানীর দিকে ভেসে চললাম, এরপরই সামনে দুশো লিগ নদীপথ শত্রুর অধীনে রয়েছে।

এদিকে আগুনে জ্বলতে থাকা নৌকাগুলো থেকে বয়ে আসা ঘন ধুয়া নদীর উপর দিয়ে দুরে ক্রিটান সেনাশিবির ঢেকে ফেলছিল। তবে উত্তর দিক থেকে বয়ে আসা বাতাসে ধুয়ার পর্দাটা সরে যেতেই আমরা হতবাক হয়ে দেখলাম যেসব ক্রিস্টান সৈন্য পন্টুন সেতুর ধ্বংসের হাত থেকে বেঁচেছিল, ওরা সবাই নদীর তীরে যুদ্ধসাজে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

ওদের সেনাপতিরা সৈন্য নিয়ে নদীর তীর ঘেঁষে অবস্থান নিয়েছিল। তীরন্দাজরা উদ্যত তীর-ধনুক নিয়ে নদীর তীরের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে রয়েছে। আমরা উত্তর দিকে খোলা সাগরের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করলেই ওরা বিপদের ঝুঁকি নিয়ে আমাদেরকে আক্রমণ করার জন্য প্রস্তুত হয়ে রয়েছে। প্রত্যেক তীরন্দাজের ধনুকের ছিলা টান টান হয়ে আছে আর ধনুকে তীর জোতা রয়েছে। ওরা কেবল তীর ছুঁড়ার জন্য অপেক্ষা করছে।

ওদের উচ্চপদস্থ চারজন সেনানায়কের শিরস্ত্রাণে লম্বা পুচ্ছ আর বুকে কাঁধে অনেক পদক চকচক করছে। তীরন্দাজদের সারির পেছনে ঘোড়ার পিঠে বসে ওরা আক্রমণের নির্দেশ দেবার জন্য অপেক্ষা করছে।

তবে ওরা হতবাক হয়ে গেল, যখন দেখলো আমরা দক্ষিণ দিকের খালের দিকে মোড় ঘুরে ওদের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। প্রথমে ওদের তরফ থেকে কোন প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। তারপর যখন দিলবারের অধীনে দ্বিতীয় তিনতলা জাহাজটিও মোড় ঘুরে আমাদের জাহাজকে অনুসরণ করতে শুরু করলো, তখন ওরা আক্রমণে এলো। এরপর বহরের শেষ জাহাজটি আকেমির অধীনে খালের মোড় ঘুরতেই ক্রিটান সেনানায়কদের নিদেশের রাগি চিৎকার শোনা গেল। তীর ঘেঁষে ঘোড়া ছুটিয়ে ওরা আমাদের পিছু নিল। দৃশ্যটা দেখে আমার হাসি পেল।

ক্রিটান সৈন্যরা শৃঙ্খলা ভেঙে ছত্রভঙ্গ হয়ে তাদের সেনানায়কদের পিছু পিছু ছুটতে শুরু করলো। কিন্তু যখন দেখলো আমরা কিছু না বলে চলে যাচ্ছি, তখন ওরা থেমে দাঁড়িয়ে আমাদের দিকে একনাগাড়ে উঁচু করে তীর ছুঁড়তে শুরু করলো। তবে কোনটাই আমাদের কাছে পৌঁছাতে পারলো না।

অশ্বারোহী সেনানায়করা অবশ্য হাল ছেড়ে দিল না, ওরা ঘোড়া ছুটিয়ে আমাদের নৌবহরকে ধরার চেষ্টা করতে লাগলো। যখন আকেমির জাহাজ বরাবর এলো তখন ওরা তলোয়ার কোষমুক্ত করলো। তারপর ঘোড়ার পাদানির উপর দাঁড়িয়ে অজস্র গালিগালাজ করতে করতে আকেমির লোকজনের উদ্দেশ্যে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়তে শুরু করলো।

আকেমির প্রতি আমার কঠোর নির্দেশ ছিল মিনোয়ানদের লক্ষ্য করে তীর না ছোঁড়ার। তিনতলা জাহাজের উপরের ডেক থেকে ওরা আকেমির তীরন্দাজদের সহজ লক্ষ্য ছিল, কিন্তু ওরা তাদেরকে পুরোপুরি উপেক্ষা করলো। এতে মিনোয়ানরা আরও ক্রদ্ধ হল। ওরা নদীর তীর দিয়ে আরও দ্রুত ঘোড়া ছুটিয়ে প্রথমে আকেমি তারপর দিলবারের জাহাজ পার হয়ে আমার জাহাজের কাছাকাছি এলো।

আমার নির্দেশ মোতাবেক আমার লোকজন লুকোবার কোনো চেষ্টাই করলো না। আমাদের জাহাজের সাথে তাল মিলিয়ে নদীর তীর ঘেঁষে ঘোড়া ছুটতে ছুটাতে সেই চার সেনানায়ক মাত্র একশো পা দূরত্ব থেকে আমাদের পরনে আসল হাইকসো সামরিক উর্দি আর সাজসরঞ্জাম পরিষ্কার দেখতে পেল।

আমাদের অনুসরণ করে ইতোমধ্যে ওরা প্রায় তিনলিগ দূরত্ব চলে এসেছে। ঘোড়াগুলোও পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছে। এরপর তীর থেকে জোর বাতাস বইতেই আমাদের জাহাজগুলো ওদের কাছ থেকে দ্রুত সরে পড়লো। নদীর তীর এবার জলাভূমিতে পরিণত হয়েছে। কালো কাদায় ঘোড়াগুলোর পা দেবে যেতেই ওরা ঘোড়ার রাশ টেনে থামাতে বাধ্য হল। আর আমরা বেশ দ্রুত ওদের কাছ থেকে ভেসে চললাম ভোলা সাগরের দিকে।

পুরো ঘটনাটা যেভাবে ঘটলো, তা দেখে আমি বেশ খুশি হলাম। মিনোয়ান সেনানায়করা দেখেছে, যা আমি ওদের দেখাতে চেয়েছিলাম–অর্থাৎ হাইকসো জলদস্যুরা তিন জাহাজ ভর্তি সর্বাধিরাজ মিনোজের পাঁচ লাখ রূপার বাঁট নিয়ে দক্ষিণ দিকের নদী হয়ে রাজা বিওনের রাজধানী মেমফিসের দিকে ভেসে চলেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *