০৯. আটলান্টিক সিটিতে হুমায়ূন আহমেদ

আটলান্টিক সিটিতে হুমায়ূন আহমেদ

আমাদের কক্ষে ঢুকলেন হুমায়ূন আহমেদ। সাথে আসলেন মেহের আফরোজ শাওন। নিষাদ, নিনিত, মাজহারুল ইসলাম, স্বর্ণা ইসলাম ও তাদের পুত্র অমিয়। আটলান্টিক সিটিতে বসবাসকারী নাসিম রেজা। সাথে আরো ছিলেন হুমায়ূন আহমেদের বাসার সাহায্যকারী ফিরোজা খাতুন। ঘরের সব আলো নেভানো। শুধু একটি মোমবাতি জ্বলছিলো। ঘরে প্রবেশের সাথে সাথেই আমরা স্বাগত জানালাম। আর সঙ্গে সঙ্গেই রিমোর্ট দিয়ে পুরো স্যুটের সবকটা জানালার পর্দা খোলা হলো। বাম দিকে কিচেন, ডানদিকে লিভিংরুম, গেস্ট রুম এবং পরবর্তীতে স্লিপিংরুম এবং জাকুজি সমেত বাথরুম। এক একটি দরজা খুললেন আর এক একটি রুমে মোমবাতি জ্বলছিলো। রুম দেখে সোফায় বসার পর বারটেন্ডার এসে ড্রিংকস ও জুসের অর্ডার নিয়ে গেলো। দেখে হুমায়ূন আহমেদ মুগ্ধ। বিমোহিত। পুরো স্যুটটি ঘুরে দেখলেন। অনেকটা স্তব্ধ। পৃথিবীর অনেক দেশে হুমায়ূন আহমেদ ঘুরেছেন। আমেরিকার বিভিন্ন স্টেটে অনেক বড় বড় হোটেলে ছিলেন। কিন্তু এই রুমের আভিজাত্যই আলাদা। আমি আর রুমা আগে থেকেই এভাবে ঘরটি তৈরি করে রেখেছিলাম। কেননা সবসময় হুমায়ূন আহমেদ তাঁর প্রিয়জনকে মুগ্ধ এবং বিমোহিত করতে ভালোবাসতেন। ‘হারাস’-এর ওয়াটারফ্রন্টের ২০১২ সালের ১৬ জানুয়ারি ১৬১১ নং স্যুট কক্ষে হুমায়ূন আহমেদকে আপ্যায়ন করা হলে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তিনি পরেরবার আসলে এরকম একটি কক্ষে থাকার কথা ব্যক্ত করেন। সেদিন তিনি স্মৃতিরোমন্থন করেন ১৯৮৫ থেকে ১৯৮৭ সালের ঢাকার দিনগুলোর কথা। প্রথম কবে আমার সাথে দেখা হয় হুমায়ূন আহমেদের। সে ময়কার আমাদের বন্ধু-বান্ধবরা কে কোথায়। আমার সহকর্মী অভিনেতা মাহফুজ আহমেদের কথা। মাহফুজ আহমেদ ও আমি তখন মোস্তফা জব্বার সম্পাদিত সাপ্তাহিক ‘আনন্দপত্র’-এ সাংবাদিকতা করতাম। অনেকক্ষণ ধরে ২৫/২৬ বছর পর আমরা কে কোথায় অবস্থান করছি হুমায়ূন আহমেদ সেসব স্মৃতিচারণ করেন। বাংলা ভাষার সবচেয়ে মুডি লেখকও সেদিন নষ্টালজিয়ায় আক্রান্ত হলেন। চেয়ারের উপর পা তুলে দীর্ঘক্ষণ গল্প করলেন উপস্থিত সবার সাথে।

প্রায় দেড়ঘণ্টা সেদিন হুমায়ূন আহমেদ ও মাজহারুল ইসলামের পরিবার ছিলেন আটলান্টিক সিটিতে আমাদের কক্ষে। আমরা এসে পৌঁছেছি আগের দিন ১৫ জানুয়ারি ২০১২। মেহের আফরোজ শাওনের সাথে আগের দিনের কথানুযায়ী আমরাও দুদিন আগে শোবোটেই আমাদের রুম বুকিং করে রেখেছিলাম। আসার আগের দিন জানতে পারলাম তারা অন্য একটি হোটেলে রুম বুক করেছেন। রিজোর্স-এ। আমরাও তাই শোবোর্ট পরিবর্তন করে গত কয়েকবছর যে হোটেলে থাকি ‘হারাস’-এ আমাদের রুম বুক করলাম। মেহের আফরোজ শাওন বললেন, ইন্টারনেটে হ্রাসকৃত মূল্যে রুম পেয়েছেন, তখন আমি বললাম, তাহলে তো ভালোই হলো। তিনি আবার কোথাও যাওয়ার আগে গুগলস– সবকিছু দেখে শুনে, মোটামুটি তৈরি হয়ে যান। তাই ঐ বিষয়ে আমাদের আর কোনো চিন্তা ছিলো না।

রিজোর্স হোটেলটি বোর্ডওয়াক থেকে খুব কাছে। পাশাপাশি রয়েছে শোবোট, তাজমহল ও সিজারর্স। এক একটি ক্যাসিনো বা হোটেল থেকে ভেতর দিয়েই আর একটিতে যাওয়া যায়। বোর্ডওয়াক এ হাঁটতে খুব ভালোবাসেন হুমায়ূন আহমেদ। আটলান্টিক সিটি বোর্ডওয়াকের বিরাট ইতিহাস আছে। ১৮৭০ সালে সিটি কাউন্সিলে পিটিশন দিয়ে ৪ ফুট চওড়া এবং সমুদ্রপাড়ে মাইলব্যাপী বোর্ডওয়াক শুরু করে। ১৩ বছর পর ১৮৮৩ সালে ১০০০ ডলার খরচ করে সমুদ্রের পাড়ে এই হাঁটার রাস্তার পরিসর বড় করা হয়। ১৮৮৪ সালে রেলিং লাগানো হয়। ১৮৮৯ সালে এটি বাড়িয়ে ২৪ ফুট চওড়া করা হয়। ১৯২০ সাল থেকে বোর্ডওয়াক হলো আটলান্টিক সিটির সবচেয়ে রোমান্টিক স্থান। প্রেমিক-প্রেমিকা, স্বামী-স্ত্রী, পরিবার-পরিজন আটলান্টিক আসলেই এই এলাকায় হাটবেন, ঘুরবেন ও বেড়াবেন। ১৯৫০ থেকে ১৯৬০ সালে বোর্ডওয়াক হয়ে উঠে আমেরিকার সকল স্টারদের মিলনস্থল। এই দশকে মেরলিন মনরো, জিমি ডারনেট, এড সালভান, মিলটন ব্যারেল ও বিং কসবির মতো সুপার স্টাররা ভ্রমণে আসলেই বোর্ডওয়াকে হাঁটতেন। সত্তর দশক থেকে সবগুলো ক্যাসিনো থেকে বোর্ডওয়াকে যাওয়ার রাস্তা করা হলে এটি আরো জমজমাট হয়ে ওঠে। এখন আরো যুক্ত হয়েছে শিশু-কিশোরদের জন্য বিভিন্ন রাইড ও খেলার স্থান। একপাশে সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গ আর এক পাশে ক্যাসিনোর ঝন ঝন আওয়াজ। দুয়ে মিলে সে এক অন্যরকম আবহ। আগে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে হুমায়ূন আহমেদ বড় আরাম করে সিগারেটে টান দিতেন। এখন তো আর সিগারেট খান না। কেউ যদি সিগারেট খান, তা মুগ্ধ হয়ে দেখেন।

আমি ও মাজহারুল ইসলাম নিউইয়র্ক থেকে বাসে করে আটলান্টিক সিটিতে। হুমায়ূন আহমেদ, মেহের আফরোজ শাওন, নিষাদ-নিনিত, স্বর্ণা ইসলাম, মাজহারের ছেলে ও কাজের ভদ্রমহিলাকে নিয়ে রুমা ড্রাইভ করে আসছে। এমনিতেই ৭ জনের সিটে ৮ জন। আর একটি গাড়ি নিয়ে যাওয়ার কথা ছিলো। পরে সেটি না হওয়ায়, আমি আর মাজহারুল ইসলাম ৪২ স্ট্রিট গ্রান্ড সেন্ট্রাল থেকে বাসে রওয়ানা হলাম। বাস জার্নিও চমৎকার। ক্যাসিনোগুলোতে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য, অনেকটা ফ্রি বাসে করে নিউইয়র্ক থেকে আটলান্টিক সিটি যাওয়া যায়। যা ভাড়া, ক্যাসিনোতে নামার পর কুপন জমা দিলে প্রায় পুরোটাই ফেরত পাওয়া যায়। মাঝখানে রুমা ফোন করেছে। ওরা রাস্তায়। হোয়াইট ক্যাসেলে ঢুকেছে খাবার জন্য। সাথে ছোট ছোট তিনটি শিশু। কিছুক্ষণ পর আবার ফোন করলাম। রুমা ফোন ধরছে না। চিন্তা হলো। একটু পর রুমার ফোনে সব চিন্তা দূর হয়ে গেল। বাস থেকে নাসিম রেজাকে ফোন করলাম। তিনি আটলান্টিক সিটিতে থাকেন। হুমায়ূন আহমেদের একনিষ্ঠ ভক্ত ও ভালোলাগার মানুষ। স্ত্রী শিল্পী রেজা, শাশুড়ি ময়োফুলি নেওয়া ও ৩ সন্তান ফয়সল ১২, ফাহিম ৮ ও আবিদ ৩ কে নিয়ে নাসিম রেজার সংসার। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই কাজ করেন। হুমায়ূন আহমেদ আটলান্টিক সিটিতে আসলে তার ছুটি নিয়ে হুমায়ূন আহমেদের জন্য নানা খাবার তৈরি করে প্রিয় লেখককে তার পছন্দের খাবার খাওয়াতে ভালোবোসতেন। গত কয়েক বছর ধরে হুমায়ূন আহমেদ আটলান্টিক সিটিতে গেলে নাসিম রেজাকে সব সময়ই জানানো হয়। কথা হলো এরকম। আমি আর মাজহারুল ইসলাম বাস থেকে নেমে হোটেলে যাবো। আর রুমা এবং হুমায়ূন আহমেদসহ সকলে হোটেল রিজোট-এ পৌঁছে যাবে। হোটেলে আমরা রুমাদের কিছুক্ষণ আগেই পৌঁছে গেলাম। ক্যাসিনোর ঝনঝন শব্দ শুনলেই খেলার জন্য মাথা ঘুরে। সিজার্স দিয়ে পার হতেই ১০ ডলার খেলোম। মেশিন খেয়ে নিল। রুমার ফোন পেয়ে, খেলা বন্ধ। তাড়াতাড়ি পৌঁছালাম রিজোর্ট-এর সামনে। হুমায়ূন আহমেদদের রুমা হোটেলের সামনে নামিয়ে দিলো। ও গেল গাড়ি পার্ক করতে। রিজোট-এ অনেক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো রুম নেওয়ার জন্য। আমেরিকাতে এ এক সমস্যা। রুম খালি হয় দুপুর ১টায়। তারপর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে রুম পেতে পেতে বিকেল ৪টা। ব্যস্ত হোটেলগুলোতে আরো সমস্যা। এর উপর কম্পিউটার সিস্টেম ডাউন থাকলে তো আরো বিড়ম্বনা। এখানেও রিজার্ভেশন অনুযায়ী রুমই পাচ্ছিল না। পরে ইন্টারনেট বুকিং এর ডকুমেন্ট দেওয়া হলো, তারপর রুম পাওয়া গেলো। হুমায়ূন আহমেদ ও মাজহারুল ইসলাম দুই পরিবারের জন্য পাশাপাশি দুটি কক্ষও পাওয়া গেল না। একটি উপরে আর একটি নিচে। এবার ক্রেডিট কার্ড দিয়ে পে করতে গিয়ে দেখা যায় বাংলাদেশের। ক্রেডিট কার্ডে হোটেলটি রুম দিচ্ছে না। মাজহারুল ইসলাম তখন বললেন। আমাকে ক্রেডিট কার্ড দিতে। আমি দিলাম। রেজিস্ট্রেশন শেষে আমরা হুমায়ূন আহমেদকে উপরে উঠিয়ে দিয়ে আমাদের হোটেলের দিকে গাড়ি নিয়ে রওয়ানা হলাম। এর মধ্যে অবশ্য চলে এসেছেন হোটেলের লবিতে হুমায়ূন আহমেদের ভক্ত নাসিম রেজা। নাসিম রেজাও চলে যাবেন। আসবেন রাতে। রাতের। খাবারের আয়োজন তার বাসায়। গত কয়েকবার হুমায়ূন আহমেদ এই শহরে আসলেই নাসিমদের বাসায় খেতে যান। পরম মমতায় নাসিম রেজার স্ত্রী ও শাশুড়ি খাবার তৈরি করে রাখেন তাদের প্রিয় লেখকের জন্য। আমরা হোটেলে যাচ্ছি। সেখান থেকে ফ্রেশ হয়ে এই হোটেলে আসবো। তারপর একসাথে ক্যাসিনোতে যাবো। ক্যাসিনো থেকে নাসিম রেজার বাসায়। ওদের বাসা আটলান্টিক সিটিতেই। হোটেল থেকে ১০ মিনিটের পথ। আমরা আমাদের বুক করা হোটেলে উঠলাম। রুমাকেও আমার চমক দিলাম। এই ধরনের স্যুট রুমে রুমাকে নিয়েও আগে কখনো উঠিনি। আমেরিকার ২০/২২টি স্টেটে আমরা ঘুরেছি। বিভিন্ন পাঁচ তারা, সাত তারা হোটেলে আমাদের থাকার সুখস্মৃতি রয়েছে। এমনকি লাস ভেগাসের প্যারিস হোটেল বা আটলান্টিক সিটির বোরগাটা স্যুটেও থেকেছি। কিন্তু ‘হারাস’-এর স্যুটটা একেবারে ভিন্ন ও অত্যাধুনিক। রুমা রুমে ঢুকে আনন্দে পাখির মতো উড়ছে। ওর খুশি দেখে আমিও প্রচণ্ড আনন্দিত। এরপর আমরা রুম থেকে বেরিয়ে গরম জলে নিজেদের ডুবালাম। সাঁতার কাটলাম। প্রায় এক ঘণ্টা পর রুমে আসলাম। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে গাড়ি নিয়ে বের হলাম, হুমায়ূন আহমেদের হোটেলের উদ্দেশ্যে। ভাবলাম আমাদের দেরি হয়ে গেছে। না। হুমায়ূন আহমেদ দাবা খেলছেন। মেহের আফরোজ শাওনের সাথে। আমি যাওয়ার কিছুক্ষণ পর এক গেম শেষ হলো। হুমায়ূন আহমেদ জিতলেন। শাওন বাইরে যাওয়ার প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য উঠে গেলেন। রুমাও চলে গেল তার সাথে সাথে।

আমাকে হুমায়ূন আহমেদ বললেন, এক গেম খেল বিশ্বজিত। আমি বললাম, স্যার আমি অনেকদিন খেলি না। আমার ছেলের সাথে কয়েক বছর আগে খেলেছি। কোনো প্রাকটিস নেই। খেলা শুরু হলো। হুমায়ূন আহমেদ প্রথমে ৫ চালে খেলা শেষ করার চেষ্টা করলেন। আগে থেকেই আমি সে ফাঁদে না পড়ার ব্যবস্থা নিলাম। একসময় খেলা তুঙ্গে। আবার আসলেন হুমায়ূন আহমেদের নিত্যদিনের দাবা খেলার সঙ্গী মেহের আফরোজ শাওন। একবার আমাকে সাহায্যের জন্য একটা চাল দেওয়ার কথাও বললেন। একসময় খেলা শেষ হলো। হুমায়ূন আহমেদ আমার কাছে পরাজিত হলেন। জীবনে এক গেম দাবাই আমি খেলেছি, হুমায়ূন আহমেদের সাথে। এরপর তিনি আরো এক গেম খেলার কথা বলেছিলেন। আমার আর খেলা হয়নি। তবে আমি হাসতে হাসতে বলতাম, যদি আবার খেলি, তাহলে তো আমি হেরে যাবো। তাই আর খেলছি না। এর মধ্যে মাজহারুল ইসলাম, স্বর্ণা ইসলামও রুমে চলে এসেছেন। আমরা। সবাই নিচে নামছি। হুমায়ূন আহমেদ ঘোষণা করলেন, ওনার শ্বশুর আটলান্টিক সিটিতে খেলার জন্য ৫০০০ ডলার পাঠিয়েছেন। সে টাকা খেলে সেলিব্রেট করা হবে। আমরা গেলাম খেলতে। সবাই কিছু না কিছু খেলোম। কেউ তেমন জিতেনি। তেমন বেশি কিছু কেউ হারায়ওনি। ঠান্ডা, বরফ পড়ছে। এরপর নাসিমসহ সকলে মিলে দুই গাড়িতে ওনার বাসায় রাতের খাবারের জন্য যাত্রা। দরজা খোলা মাত্রই রান্নার সুবাস। হুমায়ূন আহমেদের পছন্দের মাছ, ভাত, পোলাও, ভর্তা, গরুর ভূনাসহ বিভিন্ন খাবার। খাওয়া-দাওয়া শেষ। আবার সবাই মিলে হুমায়ূন আহমেদের হোটেলে যাত্রা। কিছুক্ষণ ক্যাসিনোতে খেলা হলো। তারপর আমরা আমাদের হোটেলে রাত্রি যাপন করি। নাসিম রেজা তাঁর বাসার উদ্দেশ্যে যাওয়ার সময় বলে গেলেন হুমায়ূন আহমেদকে, সকালে নাস্তা নিয়ে আসবেন। জানতেন পরোটা, ডিম আর ভাজি হুমায়ূন আহমেদ সকালে পছন্দ করেন। তাই নিয়ে আসবেন সকালে। আমরা দেরিতে উঠবো। তাই যাওয়ার সময় বলে গেছি সকালে ব্রেকফাস্ট আমাদের মতো করবো। দেখা হবে দুপুরে, লাঞ্চের সময়। আমাদের হোটেলে নিমন্ত্রণ ছিলো সকলের। মাজহারুল ইসলাম জানালেন, হুমায়ূন আহমেদের এখন আসা হবে না। আমাদেরকে বললেন চলে আসতে। আমরাও চলে এলাম। মাজহারুল ইসলামের একটা জ্যাকেট কেনা হয়েছিলো আগেরবার আটলান্টিক সিটি থেকে। সেটি তিনি পরিবর্তন করবেন। এরপর সবাই মিলে আটলান্টিক সিটি আউটলেট-এ গেলাম আমরা। নাইকি, ওল্ড নেভি, বার্মিটন কোর্ট ফ্যাক্টরি, নওটিকা, পাকসন, পুমা, রিবোক, পলো। কি নাই সেখানে। আটলান্টিক সিটির ট্যাঙ্গার আউটলেট এর খুব সুনাম আছে ক্রেতাদের কাছে। প্রায় সবসময় কিছু না কিছু সেলে থাকে। আর আমেরিকার বিশেষ বিশেষ দিনের সেলগুলো থাকলে তো আর কথা নেই। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ৩০০ ডলারের জিনিস ১০০ ডলারেও পাওয়া যায়। বিশেষ করে থ্যাঙ্কস গিভিং ডেতে। মাজহারুল ইসলাম তার সোয়েটার চেঞ্জ করলেন। সকলে আরো কেনা। কাটা করলেন। রাতে আবার খাওয়া নাসিম রেজার বাসায়। বিরিয়ানী, ভাত, মাছ, ভর্তা, গরুর মাংস ইত্যাদি। খেতে খেতে অনেক গল্প হলো। খাবার টেবিলে হুমায়ূন আহমেদ অনেক গল্প করলেন। খেতে বললেন তার পছন্দের খাবার। তা নিয়ে আবার খুনসুটি। এর মধ্যে স্বর্ণা ইসলামের বাক্যালাপ। মেহের আফরোজ শাওনের বুদ্ধিমত্তা, হাসাহাসি এবং একসময় আমার কিছু কথা বলা। সব মিলিয়ে অন্য এক আবহ। আগে আমরা আটলান্টিক সিটিতে গেলে বোরগাটা’তে থাকতাম। ২০০৯ সাল পর্যন্ত হুমায়ূন আহমেদও তখন আটলান্টিক সিটিতে আসলে থাকতেন বোরগাটায়। বিশেষ করে নাসিম রেজার স্ত্রী শিল্পী রেজা ও তাঁর মা ময়োফুলি নেছার আন্তরিকতা কখনোই ভোলার মতো নয়। এছাড়া অমিয়, ফয়সল, নিষাদ, ফাহিম, আবিদ, নিনিত মিলে ৭টি শিশুর কলকাকলিতে ঘরটি আনন্দে ভরে ওঠে। চিকিৎসা করাতে এসে ২০১১ সালের অক্টোবরের ১৭ তারিখ গিয়েছিলেন তারা প্রথমবার আটলান্টিক সিটিতে। হুমায়ূন আহমেদ, মেহের আফরোজ শাওন, নিষাদ, নিনিত, মাজহারুল ইসলাম, সিঙ্গাপুরের খোকন ও বাসার সাহায্যকারী ফিরোজা খাতুন। তারা সেসময় পোর্ট অব অথরিটি বাস টার্মিনাল থেকে বাসে করে গিয়েছিলেন। বোর্ডওয়াক শাওনের খুব পছন্দ। তাই বোর্ডওয়াকের সাথে শোবোটে ছিলেন তারা সেসময়। সেবছর আমাদের যাওয়া হয়নি। আমাদের বাচ্চাদের স্কুল। মেয়ে বহতা সাহা, ১১ শ্রেণিতে পড়ে। ছেলে বিজিত সাহা। নবম শ্রেণিতে পড়ে। সকাল সাড়ে ৬টায় স্কুলে যায় বিকেল ৫টায় একজন সাড়ে ৬টায় আর একজন বাসায় ফেরে। এরপর শনি ও রোববার আমার মুক্তধারা নিয়ে ব্যস্ততা। আমরা নিউইয়র্কে বসবাস করি নিজেদের কাজ সবই নিজেদের হাতে করতে হয়। আর এছাড়া অন্যান্য কিছুতো লেগেই আছে। প্রতি সপ্তাহ বা পক্ষে আমাদের বন্ধু-বান্ধব কেউ না কেউ বাংলাদেশ, কলকাতা বা ইউরোপ থেকে আসছেই। আমরাও খুব উপভোগ করি বন্ধুসঙ্গ। বোর্ড ওয়াক দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে গল্প করছিলেন মেহের আফরোজ শাওন। ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি পড়ছে, আমরা একটি রেস্তোরাঁয় ঢুকলাম কফি খেতে। খাওয়া হলো সাথে কিছু স্ন্যাকস। একটু বৃষ্টি বন্ধ হতেই, ছোটদের নিয়ে শাওন গেলেন খেলার ঘরে। শিশুদের জন্য বিভিন্ন রকম রাইড ও খেলার ব্যবস্থা রয়েছে। অনেকটা ডিজনি ওয়াল্ড স্টাইলে। আকৃষ্ট করার সব উপাদান রয়েছে। ঘণ্টা দুয়েক কাটানোর পর নিষাদ পেল অনেকগুলো টিকেট। মাজহারের ছেলেও পেল অনেকগুলো। নিনিতকে নিয়ে রুমা ব্যস্ত। এভাবেই কেটে গেল আটলান্টিক সিটির দ্বিতীয় দিন। দুদিন পরে হুমায়ূন আহমেদ কেমো নেবেন। আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি নিউইয়র্কে ফেরার। তারপরও ছোটদের খেলাধূলা এবং কেনাকাটা করতে গিয়ে রওয়ানা হতে বিকেল হয়ে গেল। ১৮ জানুয়ারি ২০১২ নিউইয়র্কের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। দুদিন পরেই ৮ম কেমোথেরাপি। একসময় তিনটি দিনও পার হয়ে গেল। কীভাবে যে কেটে গেল সময়, ৪টি পরিবারের মধ্যে, তা শুধু তারাই জানে। আমি আর মাজহারুল ইসলাম বাসে রওয়ানা হয়ে গেলাম নিউইয়র্কের উদ্দেশ্যে। হুমায়ূন আহমেদ, মেহের আফরোজ শাওন, স্বর্ণা ইসলাম,অমিয়, নিষাদ, নিনিত, সাহায্যকারী ফিরোজা। খাতুনকে নিয়ে রুমা আমাদের গাড়ি নিয়ে রওয়ানা হয়ে গেল নিউইয়র্কের উদ্দেশ্যে। আমরা ওদের আগেই পৌঁছালাম। পোর্ট অব অথরিটি টার্মিনাল থেকে আমি আর মাজহারুল ইসলামই ট্রেনে করে চলে এলাম। মাজহারুল ইসলাম নেমে গেল ‘বেস্ট বাই’ নদার্ন বুভার্ড। আর আমি নেমে গেলাম জ্যাকসন হাইটসে মুক্তধারায়। প্রায় একঘণ্টা পর রুমারা পৌঁছালো জ্যামাইকাস্থ হুমায়ূন আহমেদের বাসভবনে। সেখানে আবার আড্ডা। রুমা একা গাড়ি চালিয়ে টায়ার্ড। সবাই গল্পে মত্ত। হুমায়ূন আহমেদ নিজে চায়ে জল বসিয়ে সেদিন রুমাকে চা বানিয়ে খাওয়ালো। সেকথা রুমা আমাকে এসেই বললো। আরো বললো, ওদের আড্ডার কথা, জোকসের কথা। যা হুমায়ূন আহমেদের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যারা মিশেছেন শুধুমাত্র তারাই জানেন। গল্প করতে হুমায়ূন আহমেদ যেমন ভালোবাসেন। তেমনি যাদেরকে তিনি পছন্দ করতেন, তাদেরকে আন্তরিকভাবে খাওয়াতেও ভালোবাসতেন।

আটলান্টিক সিটিতে শেষ যাওয়া

আটলান্টিক সিটি ছিলো হুমায়ূন আহমেদের খুবই প্রিয় জায়গা। আমেরিকায় যতবার এসেছেন প্রতিবারই তিনি আটলান্টিক সিটি গিয়েছেন। বাংলাদেশে ফেরার আগে ১৮ এপ্রিল ২০১২ আমরা রওয়ানা হলাম আটলান্টিক সিটির উদ্দেশ্যে। ১২টি কেমোথেরাপি দেওয়া শেষ। সে এক অন্যরকম আনন্দ তাঁর। আস্তে আস্তে চুল উঠা বন্ধ হয়ে গেছে। দেখতে অনেক ফ্রেশ লাগছে হুমায়ূন আহমেদকে। দেশে ফেরবেন। মাকে দেখতে। প্রিয়জনকে দেখতে পাবেন। নুহাশ পল্লীতে যাবেন। সে অন্যরকম আনন্দ। হুমায়ূন আহমেদ, মেহের আফরোজ শাওন, নিষাদ, নিনিত, তাদের সাহায্যকারী ফিরোজা খাতুন, আমি ও রুমা। আমাদের গাড়িতে। গাড়ি ড্রাইভ করছিলো রুমা। নিউইয়র্ক থেকে রওয়ানা হওয়ার আগের দিনই হোটেল বুকিং করা হয়। কয়েকদিন আগে। থেকেই হুমায়ূন আহমেদ বলছিলেন, বিশ্বজিত আটলান্টিক সিটিতে চলো, দেশে যাওয়ার আগে। আমিও ভেবে রেখেছি হুমায়ূন আহমেদকে সারপ্রাইজটা এবার দিয়ে ফেলা উচিত। পরপর ২বার কেমোথেরাপির সময় আমার দেশে থাকার কারণে যাওয়া হয়নি। পথিমধ্যে প্রচুর ট্রাফিক। হল্যান্ড টানেল পার হতেই ঘণ্টা দেড়েক চলে গেছে। অবশ্য নিষাদ-নিনিতকে শাওনের এ্যাঙ্গা-ব্যাঙ্গার গল্প শুনানো এবং হুমায়ূন আহমেদের জোকস শুনলে আর কখনোই বোরিং হতো না কেউ। টানেল থেকে রুমা নিউজার্সি টানপাইক নেয়নি। কি কারণে ঐদিন রুট ১ সাউথ ধরে গাড়ি চালাচ্ছিল। আমি রুমার সাথে সামনের সিটেই বসেছিলাম। সাধারণত আমাদের গাড়িতে করে যখন আমরা হাসপাতালে যাতায়াত করি মেহের আফরোজ শাওন বসেন সামনের। সিটে রুমার সাথে। আমি আর হুমায়ূন আহমেদ বসি মাঝখানের সিটে। আর যেদিন মেহের আফরোজ শাওন থাকেন না কখনো হুমায়ূন আহমেদ সামনের সিটে বসেন। সেদিন ওনারা মাঝখানের সিটে বসেছেন। আর পেছনে বসেছিলো নিষাদ, ও কার সিটে নিনিত আর অন্য সিটে সাহায্যকারী মহিলা। রুট ৯ সাউথ এক্সিট না নিয়ে রুমা রুট ১ সাউথ ধরে গাড়ি চালাচ্ছিল। মাঝখানে আমি একবার বললাম। এক্সিট নেওয়ার কথা। গল্প চলছে। আমি আর একবার বললাম, দেখলাম রুমা খুব বিরক্ত হচ্ছে। হয়তো মনে করছে গাড়ি চালাচ্ছে ও, আর ডিরেকশন দিচ্ছি আমি। এ নিয়ে আমাদের অনেক খোঁটাখুঁটি হয়। বলা যায় প্রায়ই লেগে থাকে। আমি আর কিছু বললাম না। রুমা রুট ১ সাউথ ধরে গাড়ি চালাচ্ছে। টার্ন নিয়ে ফিরে ১ নর্থ ধরে আবার ৯ সাউথ ধরবে তাও দেখছি না। এরমধ্যেই দেখছি ১ সাউথ আমাদের নিউজার্সি বাড়ির যে এক্সিট নিতে হয় সেটা ক্রস করে চলে যাচ্ছে রুমা। এরপর ফারুক আজমের বাসার এক্সিটও ক্রস করলো। ডা. ফারুক আজম। আমাদের বন্ধু। কবিতা লেখেন, আবৃত্তি করেন, নাটক করেন। এরপর ড. নূরন নবীর এক্সিটও রুমা ক্রস করলো। আমি হাসতে হাসতে বললাম, রুমা এবার এক্সিট নিলে কিন্তু নবী ভাই’র বাসায় যাওয়া যায়। ড. নূরন নবী ও জিনাত নবী দুজনেই বিজ্ঞানী। ড. নবীর সাথে আমাদের সম্পর্ক ১৯৯১ সালে আমেরিকায় আসার পর থেকে। ড. নূরন নবী আবার হুমায়ূন আহমেদেরও বন্ধু। ড. জাফর ইকবাল এবং ড. নূরন নবীর একই সংগঠন করতেন। দীর্ঘদিন ছিলেন প্রতিবেশী। এখনো রয়েছে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। হুমায়ূন আহমেদ চিকিৎসা করাতে আসার আগে ড, নবীর কাছেও চিকিৎসার কাগজপত্র পাঠিয়েছিলেন ড. জাফর ইকবাল। আমরা রাস্তা পার হতে হতে ড. নূরন নবীর গল্প করলাম। রুমাকে তখন ড. নূরন নবীর বাসায় রেখে আমি মিশিগানে শহীদ জননী জাহানারা ইমামকে শেষবারের মতো দেখতে যাই ড. নূরন নবীর সাথে।

১৯৯৩ সালে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের মৃত্যুর আগে আমরা শেষবারের মতো তাঁকে দেখতে মিশিগান গিয়েছিলাম। ভ্যানে করে ড. জাফর ইকবাল, ড. নূরন নবী, নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ‘প্রবাসী সম্পাদক সৈয়দ মোহাম্মদ উল্লাহ, সাবেক গণতন্ত্রী পার্টির নেতা ও বর্তমানে এনআরবি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ফরাশত আলী, দিলীপ নাথ ও আমি। তখন আমি নিউইয়র্কের সাপ্তাহিক ‘প্রবাসী’তে সহ-সম্পাদক হিসেবে কাজ করতাম। শহীদ জননী জাহানারা ইমামও ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মিশিগানে চিকিৎসা করিয়েছিলেন। আমি আর ঐদিন এই গল্পটি হুমায়ূন আহমেদকে বলিনি। কেননা হুমায়ূন আহমেদও ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা করাতে এসেছেন। যদি ওনার মন খরাপ হয়, তাই গল্পটা কাট করে রুমাকে ড. নবীর বাসায় রেখে যাওয়ার কথা বলে শেষ করি। রুমা অবশ্য যোগ করে ড. নবীর ছেলেটা খুব ভালো। মাকে নাকি মেয়ের মতো সবকিছুতে সাহায্য করে।

এর মাঝে হুমায়ূন আহমেদ বলেন, ড. নূরন নবী এসেছিলেন, ওনাকে দেখতে। ওনার বুলেট ৭১’ বইটি দিয়ে গেছেন। এর মাঝে রুমা রুট ১ শেষ প্রান্তে প্রিন্সটন সাইন দেখাচ্ছে। আমি বললাম ভালোই হলো, এবার মীনাক্ষি দত্তের ছেলের বাড়িতে গিয়ে বিশ্রাম নিয়ে গেলে কেমন হয়? গাড়ির সবার মধ্যে হাসির রোল পড়লো। রাস্তা পার হতে হতে আমি আবার হুমায়ূন আহমেদকে মনে করিয়ে দিই- ডা. ফারুক আজম কয়েকবার ফোন করেছিলেন। মীনাক্ষি দত্ত ও জ্যোতির্ময় দত্তসহ তারা একবার হুমায়ূন আহমেদের সাথে দেখা করতে চেয়েছিলেন। মীনাক্ষি দত্ত বুদ্ধদেব বসু ও প্রতিভা বসুর জ্যেষ্ঠ কন্যা। তাদের জামাতা একসময়ের তুখোড় সাংবাদিক ও কবি। ড. জ্যোতির্ময় দত্তের বাংলা ও ইংরেজি বলার শৈলী মুগ্ধ হয়ে শোনার মতো। কথিত আছে একসময় বাংলাদেশের স্বৈরশাসক এরশাদ মুগ্ধ হয়ে নাকি জ্যোতির্ময় দত্তকে কলকাতা থেকে ঢাকা আসার জন্য প্লেন পর্যন্ত পাঠিয়েছিলেন। রুমা হাইওয়ে ধরে পেনসেলভেনিয়া (Pennsylvania) টানপাইক ধরে আটলান্টিক সিটির সাইনে এগুচ্ছে। ১২ ডলারের টোল দিয়ে খুব দ্রুতই আমরা আটলান্টিক সিটির ঝলমল আলো দেখতে পেলাম। তখন হুমায়ূন আহমেদ বলে উঠলেন, তাহলে আমরা শেষ পর্যন্ত আটলান্টিক সিটি আসতে পেরেছি। আমি বললাম, এসেছি। তবে নিউইয়র্ক, নিউজার্সি এবং পেনসেলভেনিয়া তিনটা স্টেট দেখে অবশেষে আটলান্টিক সিটিতে।

এ নিয়ে আবার সবার মধ্যে হাসি। হুমায়ূন আহমেদ বললেন, তবে রুমা ভালো গাড়ি চালায়। ১৯৯৫ সালে নায়েগ্রা ফলস ঘুরে এসে হুমায়ূন আহমেদ তার গাড়ি চালাবার প্রশংসা করেছিলেন। এরপর অভিনেতা মাহফুজ আহমেদ এবং সেলিম চৌধুরীসহ যখন আবার আমরা নায়েগ্রা ফলস-এ যাই। তখন সবাই ঘুমিয়ে পড়লেও রুমা ড্রাইভ করে নায়েগ্রা নিয়ে যায়। সে সুখ্যাতি রুমার আগেই ছিলো। যেবছর আমরা টেক্সাসের ডালাস গিয়েছিলাম হুমায়ূন আহমেদসহ সাহিত্য সম্মেলনে সেবছরও রুমা ঘণ্টার পর ঘণ্টা একা গাড়ি চালিয়েছিলো। রুমা গাড়ি পার্ক করাল ‘হারাস’-এ। গাড়ি পার্ক করে সাথে আনা ব্যাগেজ নিয়ে আমরা রুম রেজিস্ট্রেশন করার জন্য দাঁড়ালাম। মিনিট দশেক লাগলো। আমরা রুমের চাবি নিয়ে ‘হারাস’-এর ওয়াটারফ্রন্ট এর দিকে রওয়ানা হলাম। এলিভেটরে ১৯ তলায় উঠলাম। রুম নম্বর ১৯১১। হারাস-এর ওয়াটারফ্রন্টের প্রত্যেক ফ্লোরের স্যুট রুমের শেষ সংখ্যা ১১। হুমায়ূন আহমেদের হাতে চাবি দেওয়া হলো। তিনি দরজা খুলে মেহের আফরোজ শাওন ও দুই সন্তান নিষাদ ও নিনিতকে নিয়ে ভেতরে গেলেন। ঢুকেই ‘কুসুম’, ‘কুসুম’ বলে আনন্দে তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রীকে ডাকতে থাকেন। হুমায়ূন। আহমেদ বেশিরভাগ সময় শাওন ডাকলেও অত্যন্ত আনন্দঘন মুহূর্তে এবং একান্তে অথবা চৈতন্যেও মেহের আফরোজ শাওনকে ‘কুসুম’ বলে ডাকতেন। গতবার যা দেখে গেছেন। একই রকম কক্ষ, যেমনটি তিনি পছন্দ করেছিলেন। একই সুযোগ-সুবিধা। রুমে ঢুকে ভীষণ তৃপ্ত হুমায়ূন। আহমেদ। আরাম করে বসলেন। আমি আর রুমা পাশের রুম দিয়ে ঢুকে। ওনাদের স্যুট রুমের দরজা খুলে হঠাৎ করে প্রবেশ করে হুমায়ূন আহমেদকে কিছুটা চমকে দিই। বললাম, ‘ভয় নেই, আমরা পাশের রুমে আছি। দুই পাশ থেকেই দরজা বন্ধ করার ব্যবস্থা রয়েছে। খোলা রাখার ব্যবস্থাও রয়েছে। হুমায়ূন আহমেদ খুব খুশি হলেন। আমি আর নাসিম রেজা সবকিছু গোছগাছ করছিলাম। নিনিতের খাবারের দুধ নেই। দুধ আনা হলো। হুমায়ূন আহমেদ আরাম করে পায়ের উপর পা তুলে বসে গল্প করছেন। অসম্ভব সব মজার গল্প।

সেসব গল্প শুধু বলেই ক্ষান্ত ছিলেন না। চেয়ার থেকে উঠে অভিনয় করেও দেখালেন। এরই মাঝে মাজহারুল ইসলামের ঢাকা থেকে ফোন এলো মেহের আফরোজ শাওনের ফোনে। কথা বললেন, হুমায়ূন আহমেদও। কিন্তু যখন তিনি বললেন, ‘মাজহার কী খবর? বিশ্বজিত বলেছে, তোমার আর মাসুম-এর মধ্যে নাকি ভাগ হয়ে গেছে? তুমি নাকি অন্যমেলা’র অংশ নিচ্ছ আর অন্যপ্রকাশ’র অংশ মাসুম নিচ্ছে? অন্যমেলায় লাভ বেশি তাই তুমি অন্যমেলার অংশ নিচ্ছ। নাসির আর কমল এর মধ্যে, তোমার পক্ষে কমল। আর নাসির মাসুমের পক্ষে। আমাদের সামনেই হুমায়ূন আহমেদ কথাগুলো বলছেন। আমি একটুও অবাক হইনি। যাকে বলছিলো, সেও নিশ্চয়ই অবাক হননি। কেননা হুমায়ূন আহমেদ কীভাবে কথা বলেন তার তো আরো বেশি জানার কথা। ফোনে কথা শেষ করে হুমায়ূন আহমেদ আমাকে বললেন, তুমি কয়েকদিন আগে বাংলাদেশ থেকে এসেছ। আর মাজহার গেছে বাংলাদেশে। মাসুম আর মাজহার ছিলো বন্ধু। এরপরে হলো মাজহারের ভগ্নিপতি মাসুম। এখন আর নেই সেই পারিবারিক সম্পর্ক। চলছে টানাপড়ন। দুইয়ে দুইয়ে চার। আমি বললাম, মাঝখান থেকে কোত্থেকে আসলাম। আমি তো কিছুই জানি না। আসলে হুমায়ূন আহমেদ সব খবরই জানতেন। খবরটি আমার নাম করে মাজহারুল ইসলামকে দেওয়া হলো। এর মধ্যে নাসিম রেজাসহ আমি গল্প করছি। নিষাদ ও নিনিতও বড় ঘর, টিভি পেয়ে খুশি। সবাই ফ্রেশ হয়ে নিচে নামার জন্য অপেক্ষা। নিষাদ, নিনিত সুইমিং করবে। মেহের আফরোজ শাওন ও রুমাও সুইমিংয়ের পোশাক পরে নিষাদ ও নিনিতকে নিয়ে জলে নামলো। আমি আর হুমায়ূন আহমেদ সুইমিংয়ের পাশে চেয়ারে বসে রোদ পোহাচ্ছিলাম। গল্প করছিলাম হুমায়ূন আহমেদের কাছে। বিজিত বড় হওয়ার সময়, আমার সময় দিতে না পারার কথা। ও কীভাবে বড় হয়ে উঠলো সেসব কথা। দুয়েকদিন পর হাত ধরলে, মনে হতো আজ বুঝি আরো বড় হয়ে গেছে। নানা বিষয়ে হুমায়ূন আহমেদের কথা হয় আমার সাথে। হুমায়ূন আহমেদ সব শুনতেন। আর মাঝে মাঝে ছোট ছোট করে নিষাদ, নিনিতের কথা বলতেন। হঠাৎ কিছু ভেবে আবার চুপ হয়ে যেতেন। এরই মাঝে হুমায়ূন আহমেদের নামে ‘এবাস্টেন’ নামে ওষুধের কোম্পানি থেকে আমার কাছে ফোন এলো। কেমোথেরাপির পর ভ্যাক্সিনটা বেল্যু হাসপাতালের চিকিৎসক জেইন হুমায়ূন আহমেদকে দিচ্ছেন। এতে ভালো উপকারও হচ্ছে। কিন্তু ওষুধটি অত্যন্ত দামি। ওষুধটি সবসময় হাসপাতালে মজুত থাকে না। তাই দুসপ্তাহ আগেই কোম্পানি থেকে বিনামূল্যে ওষুধটি পাওয়ার জন্য আবেদন পাঠিয়েছিলাম। তারই প্রেক্ষিতে তারা খোঁজখবর নিয়ে জন্য ফোন করেছিলো। প্রায় ১৫ মিনিট বিভিন্ন প্রশ্ন করেন তারা। একসময় উত্তরে তারা সন্তুষ্ট। আমার পাঠানো ফ্যাক্সও তারা নির্দিষ্ট সময় পেয়েছে। অপ্রতুলতা সত্ত্বেও কোম্পানি হুমায়ূন আহমেদের জন্য বিনামূল্যে ওষুধটি সরবরাহ করে যাবে এমন আশ্বাস পাওয়া গেল। আমি বিষয়টি তখনি হুমায়ূন আহমেদ ও মেহের আফরোজ শাওনকে জানাই। তখন হুমায়ূন আহমেদ চিয়ার্স বলে উল্লাস করেন।

অনেকটা আনন্দে হুমায়ূন আহমেদ ঘোষণা করলেন শ্বশুর ৫০০০ ডলার পাঠিয়েছেন ক্যাসিনোতে আনন্দ করার জন্য। আজ সেলিব্রেট করা হবে। মাথায় হ্যাট, কোট, প্যান্ট পরে হুমায়ূন আহমেদ, মেহের আফরোজ শাওন, আমি ও রুমা নিচে নামছি ক্যাসিনোতে খেলার জন্য। সেখানে যাওয়ার পর তখনও পর্যন্ত খেলা হয়নি। পোকার টেবিলে বসা হলো। হুমায়ূন আহমেদ এবং আমি খেলছিলাম। পরপর অনেকগুলো জিতলেন হুমায়ূন আহমেদ। যখনি জিততেন, সেগুলো মেহের আফরোজ শাওনের কাছে রাখতেন। আর তাঁর বাজেট থেকে ক্রমাগত খেলেই চলেছেন। এটি ছিলো খেলার নতুন কৌশল। যা জিতলেন তা আলাদা রাখার কৌশল। আগে এই কৌশলটি দেখিনি। যেমন- এক ঘরে খেলা। দুঘরেও খেলতেন তিনি। আমি কখনো এক ঘর, কখনো দুঘরে খেলোম। কিন্তু কোনোভাবেই পাচ্ছিলাম না। তাই রুমাকে দিলাম খেলতে। ওরও আমার অবস্থা। অনেক্ষণ খেলা হলো। নাসিম রেজা এসেছেন। খেতে যেতে হবে। রুম থেকে ছোটদের নিয়ে নাসিম রেজার বাসায় খেতে রওয়ানা হলাম। যথারীতি হুমায়ূন আহমেদের প্রিয় খাবারগুলোর সমাহার। সেদিন খাবার শেষে রুমা উপস্থিত সবাইকে পরের দিন হারাস-এ ডিনারের আমন্ত্রণ জানায়। সবাই আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন। খাবার-দাবার শেষ। গল্প-গুজব চললো। রাতে সবাই রুমে চলে গেলো।

আমি আর রুমা কিছুক্ষণ খেলোম, এবারো হারলাম। তারপর রুমে ফেরা। সকালে যথারীতি নাসিম রেজা হুমায়ূন আহমেদসহ সবার জন্য সকালের খাবার নিয়ে হাজির। দুরুমের দরজা খোলা। নিনিত অধিকাংশ সময় রুমার কাছেই ছিলো। রুমা নিনিতকে খুব আদর করে। আবার নিনিতও রুমার সাথে খুব খেলে। নাশতা শেষে, আমরা গেলাম নিচে। হুমায়ূন আহমেদ, মেহের আফরোজ শাওন, আমি ও রুমা। সকলে সুইমিং কস্টিউম পরে প্রথমে গরম জলে। পরবর্তীতে সুইমিং করা হলো। প্রায় ২ ঘণ্টার অধিক সময় ধরে সেদিন আমরা ওয়াটার ক্লাবে ছিলাম। বেশকটি ছবি তুললেন নাসিম রেজা। সেসময় ড্রিংকস নেওয়া হলো বুলেগুন। প্রায় ৩ ঘণ্টা সময় কীভাবে চলে গেল, ঘড়ি দেখার পর বুঝতে পারলাম। সুইমিং শেষে আমরা চলে এলাম রুমে। এরমাঝে নাসিম রেজাকে তাঁর স্ত্রী ও তিন পুত্রকে আনতে যাওয়ার জন্য রুমা তাগাদা দিলেন। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় ডিনারে যেতে হবে। শত শত আইটেম। সে এক এলাহী ব্যাপার-স্যাপার। মাছ, মাংস, ডিম, সবজি, চাইনিজ, জাপানিজ, কাঁকড়া, চিংড়ি, শামুক,

স্প্যানিশ, ভারতীয় এমন কোনো ডিশ নেই যার ব্যবস্থা এখানে নেই। শতাধিক আইটেম। ডিনার শেষে পঞ্চাশ রকমের ওপর মিষ্টি জাতীয় খাবারের ব্যবস্থা রয়েছে। প্রেজেন্টেশনই আলাদা। যা খাবেন জনপ্রতি ৩৫ ইউএস ডলার। যত ইচ্ছে খাওয়া যায়। যতবার ইচ্ছে নেওয়া যায়। রয়েছে নানা জাতীয় ড্রিংকসের ব্যবস্থা। তবে সফট ড্রিংকস। খুব আনন্দ করে হুমায়ূন আহমেদ, মেহের আফরোজ শাওন, নিষাদ, নিনিত, নাসিম রেজা, তাঁর স্ত্রী শিল্পী রেজা, তিন সন্তান ফয়সল, ফাহিম, আবিদ, আমি আর রুমা একসাথে ডিনার করলাম। এরপর কিছুক্ষণ ক্যাসিনোতে খেলে, আমরা রুমে গেলাম। হুমায়ূন আহমেদের আড্ডার বিষয়বস্তু, কখনো জোকস, কখনো অতীত কোনো স্মৃতিচারণ। সেখানে চলে দীর্ঘ আড্ডা। যখন বসার মতো আর অবস্থা নয়, তখনি বিশ্রাম নিতে গেলেন হুমায়ূন আহমেদ। নাসিম দম্পতি চলে গেলেন নিজ বাসার উদ্দেশ্যে। আমরা মাঝখানের দরজা খোলা রেখেই শুভরাত্রি বলে বিদায় নিলাম হুমায়ূন আহমেদ ও মেহের আফরোজ শাওন থেকে। পরদিন ব্রেকফাস্ট হলো। কেমো নিতে হবে দুদিন পর। নিউইয়র্কে ফেরার সব গোছগাছ চলছে। ২১ এপ্রিল ২০১২ আমরা নিউইয়র্কের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। আনন্দঘন তিন দিন কীভাবে যে অতিবাহিত হলো! আনন্দের ফল্পধারার প্রধান মানুষ ছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। কতভাবে যে সঙ্গীদের আনন্দ দিতে পারতেন। তিনি, সেটা যারা তাঁর একান্ত সঙ্গী হয়েছিলেন তারাই জানেন। হুমায়ূন আহমেদের সাথে আটলান্টিক সিটিতে এবং লাস ভেগাসে বহুবার আমাদের বেড়াবার সুযোগ হয়েছিলো। ১৯৯৪ সালে হুমায়ূন আহমেদ যখন ছোট ভাই ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবালের বাসায় এসেছিলেন প্রথম স্ত্রী গুলতেকিন আহমেদ, নোভা, শীলা, বিপাশা ও নুহাশকে নিয়ে, সেসময় পুরো পরিবার বেড়াতে গিয়েছিলেন আটলান্টিক সিটির তাজমহল ক্যাসিনোতে। নিউইয়র্ক থেকে জামাল আবেদীন ও জলি আবেদীনও সেসময় আটলান্টিক সিটিতে গিয়েছিলেন।

২০১১ সালে হুমায়ূন আহমেদ, মেহের আফরোজ শাওন, নিষাদ, নিনিত এবং জামাল ও জলি আবেদীন যখন আটলান্টিক সিটিতে গিয়েছিলেন তখন মুক্তধারার কর্মী শাহীন মিয়াকেও তারা নিয়ে গিয়েছিলেন মূলত নিষাদকে রাখার জন্য। হুমায়ূন আহমেদ ম্যাজিক মুনশী বইতে লিখেছেন নিষাদকে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে শাহীন সিলেটি ভাষা শিখিয়ে ফেলেছে। জুন ও জুলাইয়ের সে সময়টা আমরা খুব ব্যস্ত থাকি। জুন মাসের শেষ সপ্তাহে বইমেলা শেষে আমরা চলে গেলাম বঙ্গ সম্মেলনে। তাই আমাদের আর তখন যাওয়া হয়নি। তবে এর আগে ১৯৯৬ সাল থেকে যতবারই হুমায়ূন আহমেদ নিউইয়র্কে এসেছেন বেশিরভাগ সময়ই জামাল আবেদীনকে নিয়ে হুমায়ূন আহমেদ ও তাঁর পরিবারকে বিভিন্ন জায়গায় যেতে দেখেছি। আমরাও বেশ কয়েকটি জায়গায় একসাথে বেড়াতে গিয়েছি।

আটলান্টিক সিটি অথবা লাস ভেগাস ছিলো তার খুবই পছন্দের জায়গা। ১৯৯৬ ও ১৯৯৭ সালে যখন এসেছিলেন প্রকৌশলী বন্ধু এফ করিমকে নিয়ে তখন আমরা আটলান্টিক সিটি ছাড়া কানেকটিকাট-এর ক্যাসিনো মোহিগানসানও গিয়েছিলাম। ক্যাসিনোর প্রতি হুমায়ূন আহমেদের ছিলো ভীষণ আকর্ষণ। একসময় তিনি কোনো ড্রিংকস পছন্দ করতেন না। তখনও যেতেন আটলান্টিক সিটিতে। আবার পরবর্তীতে যখন ড্রিংকসে আসক্ত হলেন তখনও পছন্দের তালিকা ছিলো ক্যাসিনোতে বেড়ানো। আমেরিকায় না গেলে সিঙ্গাপুর এবং মালয়েশিয়ার ক্যাসিনোতে যেতেন সে গল্পও হুমায়ূন আহমেদ থেকে অনেক শুনেছি।

.

পাদটীকা নিউইয়র্কে ফেরার আগে হুমায়ূন আহমেদ মেহের আফরোজ শাওনকে উদ্দেশ্য করে আমাদের সামনে বলেন আগামীবার এলে মেহের আফরোজ শাওনের বাবাকে রাখবেন তিনি এই কক্ষে। প্রকৌশলী মোহাম্মদ আলী সার্জারি শেষে আসবেন আমেরিকায় মেয়ে ও জামাইকে দেখতে। তাঁর আর আসা হলো না। হুমায়ূন আহমেদের ইচ্ছেও পূরণ হলো না। কিন্তু আমরা যারা সেদিন শুনেছি তার ইচ্ছের কথা, তারাতো কখনো তা ভুলতে পারবো না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *