০৬. উপদেষ্টা হুমায়ূন

উপদেষ্টা হুমায়ূন

জাতিসংঘে বাংলাদেশ অফিসের জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা হিসেবে হুমায়ূন আহমেদ অবৈতনিকভাবে নিযুক্ত হয়েছিলেন। ২০১১ সালের ৩০ নভেম্বর থেকে তাঁর এই নিয়োগে অনেকের মতো আমিও অবাক হয়েছিলাম। কেননা হুমায়ূন আহমেদ একুশে এবং বাংলা একাডেমী পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক হিসেবে আমেরিকায় বাংলাদেশ মিশন বা কনস্যুলেট থেকে কিছু সার্ভিস এমনিতেই পেতে পারেন। কিন্তু ১৯৯১ সালের পর হুমায়ূন আহমেদ যতোবার আমেরিকায় এসেছেন কখনো তাঁকে কোনো সুযোগ-সুবিধা নিতে দেখিনি। বরং হুমায়ূন আহমেদ যখন ২০১১ সালে ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য আমেরিকায় আসেন সেদিন নিউইয়র্ক কনস্যুলেটের কনসাল জেনারেল উপস্থিত ছিলেন বিমানবন্দরে তাঁকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য। হুমায়ূন অতি বিনয়ের সাথে তাকে ধন্যবাদ জানান। এ প্রসঙ্গে পরবর্তীতে তাঁর লেখা ‘নিউইয়র্কের নীলাকাশে ঝকঝকে রোদ’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘নিউইয়র্কে পৌঁছালাম বিকেলে। অ্যাম্বেসি থেকে আমাকে রিসিভ করতে এসেছে দেখে চমকালাম। ‘অ্যাম্বেসি মণিহার আমার নাহি সাজে। হুমায়ূন আহমেদ ঠিকই লিখেছেন, অ্যাম্বেসি থেকে রিসিভ করতে এসেছে দেখে তিনি চমকালেন! আগে আরো বহুবার এসেছেন আমেরিকায়। কখনোই তাঁকে রিসিভ করতে অ্যাম্বেসি থেকে কেউ আসেননি। আর হুমায়ূন আহমেদ নিজেই অ্যাম্বেসিকে ‘মণিহার’ বলে উল্লেখ করেছেন সেখানে তিনি কীভাবে জাতিসংঘে বাংলাদেশ মিশনের সিনিয়র উপদেষ্টা হলেন এটা রহস্যাবৃত। হুমায়ূন আহমেদ কি চেয়েছেলেন আওয়ামী লীগের নিয়োগ নিয়ে উপদেষ্টা হতে? তিনি কি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সমর্থক ছিলেন? তা বোধ হয় কেউ বলবেন না? ১৯৯০ সালে স্বৈরশাসক এরশাদের পতনের পর তত্বাবধায়ক সরকারের আমলে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে হুমায়ূন আহমেদ ধানের শীষে ভোট দিয়েছেন বলে সাংবাদিকদের বলেছিলেন। তাহলে হঠাৎ করে কেন তাকে উপদেষ্টা নিয়োগ দেওয়া হলো।

কারও কারও ধারণা, হুমায়ূন আহমেদের স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওনের মা তহুরা আলী আওয়ামী লীগের মহিলা সংসদ সদস্য। জামাতার অসুস্থতা লাঘবে হয়তো তিনিই তার প্রভাব খাঁটিয়ে সরকারি সাহায্যের ব্যবস্থা করেছিলেন। আর তাই এয়ারপোর্টে উপস্থিত ছিলেন কনসাল জেনারেল। পরবর্তীতে মেমোরিয়াল হাসপাতালে এক একটি থেরাপি নিতে যখন বড় অঙ্কের টাকা লাগছিলো তখন জাতিসংঘ স্থায়ী মিশনে অবৈতনিক নিয়োগ দেখিয়ে চিকিৎসার খরচ সাশ্রয়ের জন্য ইস্যুরেন্সের উদ্যোগ নেওয়াই ছিলো উদ্দেশ্য কিন্তু সেটা কোনো কাজে আসেনি। কারণ আমেরিকায় কোনো রোগ ধরা পড়ার পর আর সেই রোগের জন্য বা রোগীর ইস্যুরেন্স করা যায় না। এই নিয়মটি বোধহয় তাদের জানা ছিলো না। নভেম্বরের শুরুর দিকে নিউইয়র্কের একজন বাঙালি ইস্যুরেন্স এজেন্ট আমার সাথে যোগাযোগ করেছিলেন। বাংলাদেশ মিশনের একজন কর্মকর্তার কথা উল্লেখ করে আমার সাথে কথা বলতে এসেছিলেন। বিষয়টি আর এগোয়নি।

এরপর সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের অধিবেশনে যোগ দিতে এসে হুমায়ূন আহমেদকে তাঁর জ্যামাইকার বাসায় দেখতে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর আগে অর্থমন্ত্রী, পররাষ্ট্র মন্ত্রীসহ সরকারের মন্ত্রিসভার আরও কয়েকজন সদস্য তাঁকে দেখতে যান। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী দেখতে যাওয়ায় হুমায়ূন আহমেদ বেশি খুশি হয়েছিলেন। ২০১১ সালে জাতিসংঘের অধিবেশনে যোগ দিতে এসে কবি নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা, আবদুস সামাদ তাঁকে দেখতে এসেছিলেন। একসাথে তিন কবি। জাতিসংঘের পুরস্কার নেওয়ার সময় সীমিত সংখ্যক অতিথির মধ্যে কবি নির্মলেন্দু গুণকে নিয়ে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী সবাইকে অবাক করে দেন। হুমায়ূন আহমেদ বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক, তাঁর জনপ্রিয়তাকে আওয়ামী লীগ মূল্য দিয়েছিলো। ঐ সময়কার কাগজগুলোতে এ নিয়ে অনেকেই প্রধানমন্ত্রীর মানবিক গুণের প্রশংসা করেছেন। এরপর পারিবারিক অনুরোধে হুমায়ূন আহমেদ নভেম্বরের ৫ তারিখে জাতিসংঘের স্থায়ী প্রতিনিধি বরাবর উপদেষ্টা পদের জন্য আবেদন করেন। বাংলাদেশ মিশনে নিযুক্ত ফাস্ট সেক্রেটারি ইকবাল আহমেদ এবং হুমায়ূন আহমেদ স্বাক্ষরিত ৩০ নভেম্বর, পিএমএন/লোকাল/১৫/২০১১ এক প্রজ্ঞাপনে দেখা যায় লোকাল বেইসড হুমায়ূন আহমদকে সিনিয়র উপদেষ্টা হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। (ক) হুমায়ূন আহমেদ কোনো অর্থনৈতিক সুবিধা নেবেন না। (খ) বাংলাদেশ মিশন হুমায়ূন আহমেদের জন্য মেডিকেল ইস্যুরেন্স-এর আবেদন করবে। এর যাবতীয় খরচ বহন করবেন হুমায়ূন আহমেদ। (গ) বাংলাদেশ মিশন প্রয়োজনে হুমায়ূন আহমেদের ভিসা স্ট্যাটাস পরিবর্তন করবে। (ঘ) এছাড়া অন্য কোনো সুবিধা গ্রহণ করবেন না। (ঙ) কোনো কারণ দর্শাও নোটিশ ছাড়া ৩০ দিনের মধ্যে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা যাবে। একইভাবে ৩০ দিনের নোটিশে হুমায়ূন আহমেদও পদত্যাগ করতে পারেন। (চ) বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক তার চাকরি সংক্রান্ত শর্তাবলি তিনি মেনে চলবেন। (ছ) বাংলাদেশ সরকারের সকল নিয়মাবলি মেনে চলবেন। এভাবেই হুমায়ূন আহমেদ ও মিশনের ফার্স্ট সেক্রেটারির স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে চুক্তি ভিত্তিক এই নিয়োগপত্র প্রদান করা হয়। এই নিয়োগের পর দৈনিক প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে বলা হয়: ‘জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদকে জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী দূতাবাসের জ্যেষ্ট উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, এই নিয়োগের পর হুমায়ূন আহমেদ প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে বেসরকারি টিভি চ্যানেল আইকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, দুটি জিনিস খুবই অপছন্দ করতাম- উপদেশ শোনা ও উপদেশ দেওয়া। কিন্তু শেষ বয়সে উপদেশ দেওয়ার চক্করে পড়ে গেছি। তিনি বলেন, এটা তার কাছে অপ্রত্যাশিত ছিলো। হুমায়ূন আহমেদ বলেন, সরকারও জানে, এই নিয়োগ সম্মান দেওয়া ছাড়া আর কিছু নয়। অসুস্থ অবস্থায় বিশাল দায়িত্ব পালন করতে পারব বলে মনে করার কোনো কারণ নেই। তবে সব সময় দেশে, বিশেষ করে আমাদের দেশে সম্মান জানানোর ব্যাপারে এক ধরনের কৃপণতা দেখা যায়। কিন্তু সরকার যে এই কৃপণতা দেখায়নি, তাতে আমি যথেষ্ট অবাক ও খুশি হয়েছি। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়: জ্যেষ্ট উপদেষ্টা হিসেবে হুমায়ূন আহমেদের সুযোগ সুবিধা সম্পর্কে জানতে চাইলে জাতিসংঘের স্থায়ী প্রতিনিধি আব্দুল মোমেন বলেন, তাকে কোনো টাকা পয়সা দেওয়া হবে না। তবে বিভিন্ন সময় তিনি আমাদের সাথে কথা বলবেন। আমরা তার মূল্যবান পরামর্শ ও উপদেশ কাজে লাগানোর চেষ্টা করবো। এ প্রসঙ্গে জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি আরো বলেন, কৃতি বাংলাদেশিরা দূতাবাসের কর্মকাণ্ডে যুক্ত হতে চাইলে তাঁদের কাজে লাগানোর নজির অতীতেও রয়েছে। এক্ষেত্রে কৃতি বাংলাদেশি তরুণদের শিক্ষানবিশ এবং বিশিষ্টজনদের জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়ে থাকে। দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসা করানোর প্রয়োজনে যাতে ৬ মাস পর আবার যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে যেতে না হয় সে চিন্তা করেই সরকার তাঁকে এই পদে নিয়োগ করেছে। বলে জানা যায়। এ ব্যাপারে পররাষ্ট্র সচিবেরও বিশাল অবদান রয়েছে বলে হুমায়ূন আহমেদের কাছে শুনেছি। তবে ৩ সপ্তাহ দেশ থেকে ঘুরে আসার পর হুমায়ূন আহমেদ যখন কূটনৈতিক পাসপোর্ট নিয়ে এলেন, তখন একদিন এই বিষয়ে কথা ওঠে। তিনি বেশ ফুরফুরে মেজাজে বিষয়টি উপভোগ করছেন বলেই মনে হয়েছে। তবে কোনোভাবেই হুমায়ূন আহমেদ সরকারি সাহায্য বা আনুকূল্য নিজে থেকে চেয়েছেন সেটা কখনো মনে হয়নি। আমার এখনও মনে আছে বিভিন্ন সময় হুমায়ূন আহমেদের সাথে সাক্ষাৎ ও সহযোগিতা করার জন্য জাতিসংঘের স্থায়ী প্রতিনিধিসহ ও কনসাল জেনারেল মাঝে মাঝে যোগাযোগ করতেন। হুমায়ূন আহমেদ বিনয়ের সাথে এড়িয়ে যেতেন। দুয়েকবার দেখা হয়েছিলো জ্যামাইকার বাসায়। হুমায়ূন আহমেদ ৩ সপ্তাহের জন্য দেশ থেকে। ফেরার পর এয়ারপোর্টে কোনো সরকারি কর্মকর্তাকে দেখা যায়নি। এমনকি ২৬ মার্চের অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ মিশনে গিয়েছিলেন, সেদিনও সরকারি গাড়ি বা সহযোগিতা হুমায়ূন আহমেদ নেননি। ‘অ্যাম্বেসি মণিহার আমার নাহি সাজে’-র মধ্যেই তিনি ছিলেন। শেষবারের জন্য হুমায়ূন আহমেদ ২১ জুন জ্যামাইকা হাসপাতাল থেকে বেলভ্যু হাসপাতালে স্থানান্তর হলেন, জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে, অবচেতনভাবে দিন। অতিবাহিত করছিলেন তখনই (২৬ জুন থেকে মরদেহ দেশে পাঠানো পর্যন্ত) নিয়মিত গাড়ি দিয়ে সহযোগিতা করতে থাকে বাংলাদেশ মিশন। রাতে হুমায়ূন আহমেদের কাছে থাকার জন্য একজন লোকও নিয়োগ করা হয়। তবে ভাগ্যবান হুমায়ূন আহমেদ। তাঁকে এ দৃশ্যগুলো দেখে যেতে হয়নি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *