আবার যদি ইচ্ছা কর – ১৫

মাসখানেক ভিন্সেন্টকে হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল। ওখান থেকে ছাড়া পাওয়ার আগে মিসেস ঊর্মিলা ডেভিডসনের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়েছিল। বোধকরি না হলেই ভাল হত। মিসেস ডেভিডসন যে ফিরে এসেছেন তা ওর জানা ছিল না। সঙ্কোচে প্রশ্নটা সে কাউকে করতে পারেনি, ডক্টর ডেভিডসনকে তো নয়ই।

একদিন নার্স এসে জানালো ভিন্সেন্টকে বড় সাহেব ডেকে পাঠিয়েছেন। হাসপাতাল থেকে অদূরে, ডক্টর ডেভিডসনের কোয়ার্টার্স। সাহেব সেখানেই ছিলেন। বাগানটা পার হয়ে ওঁর ঘরে গিয়ে পৌঁছতেই ডাক্তার সাহেব ওকে আহ্বান করেন, আসুন, আসুন মিস্টার ভান গর্গ। আপনার জন্য একটি সুসংবাদ আছে।

ভিন্সেন্ট মুখ তুলে দেখতে পায় ডাকপিয়ন রঘু দাঁড়িয়ে আছে। বলে, আপকো এক মনি-অর্ডার আসেছে। চালিশ রূপেয়া।

মাসের মাঝখানে এমন মনি-অর্ডার পেতে অভ্যস্ত নয় ভিন্সেন্ট। কুপনটা পড়ে দেখে দিল্লী থেকে সূরয টাকাটা পাঠিয়েছে। মনি-অর্ডার কুপনে লিখেছে, তোমার একটি ছবি বিক্রি হয়েছে। চল্লিশ টাকায়। টাকাটা পাঠালাম।

অদ্ভুত একটা আনন্দ পেল ভিন্সেন্ট। এই তার জীবনের প্রথম সাফল্য। দশ-পনের বছর ধরে সে একটি ফুলগাছের পরিচর্চা করে চলেছে। জল দিয়েছে, গোড়া খুঁড়ে দিয়েছে, সার দিয়েছে আর দিনের পর দিন লক্ষ্য করেছে ফুলগাছে কুঁড়ি এল কিনা! আজ তার সেই চারা গাছে প্রথম ফুল ফুটল। এর পর শুরু হবে তার জয়যাত্রা। স্বাবলম্বী হয়ে উঠবে ভিন্সেন্ট।

রঘুর কাছ থেকে টাকাটা হাত পেতে নিয়ে প্রথমেই তাকে এক টাকা বসশিশ দেয়। তারপর ডাক্তার সাহেবের দিকে একখানা দশ টাকার নোট বাড়িয়ে ধরে বলে, মিষ্টি আনতে দিন, সবাই খাবে!

একেবারে দশ টাকা? সবিস্ময়ে প্রশ্ন করেন ডক্টর ডেভিডসন।

–পুরো টাকাটাই দিতাম। কিন্তু বাকি টাকায় কিছু রঙ আর ক্যানভাস কিনতে হবে। বলেন কি ডাক্তার সাহেব? আজ আমার কতবড় আনন্দের দিন জানেন! আজ প্রথম আমার ছবি বিক্রি হল!

এর আগে কখনও হয়নি বুঝি?

না, এই প্রথম।

প্রায় নাচতে নাচতে ভিন্সেন্ট ফিরে আসে তার কেবিনে। সামনে যাকে পায় খবরটা জানায়। কোবাল্ট ব্লু, সিপিয়া, আর ক্রোম ইয়ালোর টিউবগুলো ফুরিয়েছে। ওগুলো আনাতে হবে। আর কিছু ক্যানভাস। প্রথমেই ধরবে একটা সেলফ-পোর্ট্রেট। আচ্ছা, কোন্ ছবিখানা বিক্রি হল? সূরযের কাছে দশ-পনেরখানা ছবি আছে। তার ভিতর কোনখানা? সূরযটা চিরকালই একটা ক্যাবলা। আসল কথাটাই জানাতে ভুলেছে। কোষ্টা বিক্রি হল, কে কিনল তা তো লিখবি! অজ্ঞাত আর্টিস্টের একখানা ছবি নগদ চল্লিশ টাকায় হুট করে কেউ কেনে না। লোকটার নিশ্চয়ই সেটা বিশেষ কারণে ভাল লেগেছে। কী বলেছিল সে? ক্রেতার নামটা পর্যন্ত বলেনি। দিল্লীর কোন ছবির দোকানে সে কি ভিন্সেন্টের ছবিগুলো বিক্রয়াৰ্থে দিয়েছে? তখনই একটি চিঠি লিখতে বসল ভিন্সেন্ট। ব্যাপারটা জানতে হবে।

কুপনের লেখাটা পুনর্বার দেখবার জন্য সে পকেটে হাত দেয়। তারপর মনে পড়ে সে শুধু টাকাটাই নিয়ে এসেছে-কুপনটা পড়ে আছে ডাক্তার সাহেবের টেবিলে। তখনই উঠে পড়ে। আবার ফিরে যায় ডাক্তার সাহেবের খাস কামরায়। কুপনটা ফিরিয়ে আনতে।

ওঁর দ্বারের সামনে হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে। কথোপকথন কানে আসে। ঊর্মিলা বলছিল, সত্যি সত্যি ওর ছবি কেউ নগদ চল্লিশ টাকা দিয়ে কিনেছে? আমি তো দেখছি ওর অনেক ছবি

বাধা দিয়ে ডাক্তার সাহেব বলেন, –ক্ষেপেছ? এটা বোধহয় ওর ভাইয়ের একটা কারসাজি। দাদার জন্যই সেই তো সব খরচপত্র করছে। এভাবে একটা চল্লিশ টাকার মনি-অর্ডার করে দাদাকে সান্ত্বনা দিতে চায়। সত্যি সত্যি বিক্রি হলে সে নিশ্চয় সব কথা লিখত। কোন্ ছবিটা বিক্রি হল, কে কিনল

–সে-সব কথা বলেনি?

—অনর্গল কত আর মিথ্যে কথা লিখবে বল?

 একটা তীক্ষ্ণ ছুঁচ কে যেন আমূল বিদ্ধ করে দিয়েছে ভান গর্গের মাথায়। ছি ছি ছি! এমন সহজ সরল কথাটা সে বুঝতে পারেনি! সত্যি সত্যি ছবি বিক্রি হলে সূরয লম্বা। চিঠি লিখত না? দাদার মত সেও তো আজ পনের বছর ধরে এই দিনটির প্রতীক্ষা করে আছে। একটা নিদারুণ হাহাকারে ওর মনটা ভরে গেল। চোখ ফেটে জল বার হয়ে আসে। কী মূর্খ সে! ও থেকে আবার দশ টাকা সে সকলকে মিষ্টি খেতে দিল।

লজ্জা! কী অপরিসীম লজ্জা! কেবিনে ফিরে এসে আপাদমস্তক মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ে।

ভিন্সেন্ট ভান গর্গের জীবদ্দশায় তার একখানি মাত্র ছবি বিক্রি হয়েছিল। কিন্তু করুণাময় ঈশ্বরের ব্যবস্থাপনায় সেকথা সে জেনে যেতে পারেনি।

এর দিন তিনেক পরে। কেবিনে একা শুয়ে আছে ভিন্সেন্ট, মনে হল কে একখানা হাত রাখল তার কপালে। নার্স এভাবে মাঝে মাঝে ওর কপালে হাত দিয়ে জ্বর দেখত, তাই অভ্যস্ত স্পর্শে চোখ মেলে তাকায়। দেখে ওর শয্যাপার্শ্বে দাঁড়িয়ে আছেন মিসেস ডেভিডসন। অত্যন্ত অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে। অপরাধীর মত।

ভিন্সেন্ট স্লান হাসে। বলে, কবে ফিরলেন?

ঊর্মিলা ওর শয্যাপার্শ্বে বসে পড়ে। বলে, -ঘরে আর কেউ নেই ভিন্সেন্ট।

ভিন্সেন্ট চারদিক তাকিয়ে দেখে। বিকেল হয়ে এসেছে। খোলা জানালা দিয়ে পড়ন্ত রোদ এসে কেবিনের মেঝেতে চতুষ্কোণ একটা আলোর আলপনা এঁকেছে। ঊর্মিলা মেমসাহেবের পোশাকেই সেজেছে; আজকাল সে শাড়ি পরে না বোধহয়। ভিন্সেন্ট তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে ঊর্মিলার সেই চুলের গুচ্ছে অনেকখানি অংশ সাদা হয়ে গেছে। অস্তসূর্য-উদ্ভাসিত পশ্চিমাকাশে যেভাবে সোনালী মেঘের কোনায় কোনায় এসে লাগে প্লাটিনাম ব্লণ্ড সাদা মেঘের আস্তর। চোখের কোলেও বয়সের ছাপ পড়তে শুরু করেছে।

ভিন্সেন্ট বলে, দেখুন তো কাণ্ড! পাগলামি করলাম আমি, আর পালিয়ে বেড়ালেন আপনি!

মিসেস ডেভিডসন একটু ঝুঁকে পড়েন সামনের দিকে। ভিন্সেন্টের হাতখানা তুলে নিয়ে অস্ফুটে পুনরুক্তি করেন, তুমি আমার কথাটা শুনতে পাওনি, ঘরে আর কেউ নেই!

–শুনেছি। কিন্তু তাতে কি?

তাহলে এখনও আপনি-আপনি বলছ কেন ভিন্সেন্ট?

তবে কি বলে ডাকব? ঊর্মিলা?

না! পঁচিশ বছর আগেই তো একদিন আমার নামের লাটা কোন গাঙে ডুবে গিয়েছিল।

ভিন্সেন্ট হাসতে হাসতে বলে, কী বোকা ছিলাম আমি! তাই নয়!

ঊর্মিলা বলে, –এভাবে কেন শাস্তি দিলে নিজেকে? আমি ঠাট্টা করেছিলাম, সেটা বুঝলে না তুমি?

–ঈশপের গল্প পড়েছ ঊর্মি? তোমার কাছে যা ছিল ঠাট্টা আমার কাছে তাই সেদিন ছিল জীবনমরণের সমস্যা।

মাথাটা নিচু হয়ে গেল ঊর্মিলার। কোন জবাব যোগালো না মুখরা মেয়েটির মুখে। ভিন্সেন্টই পুনরায় বলে, তোমার দোষ দিচ্ছি না, ভুল বুঝো না আমাকে। তুমি স্বভাবতই চপল ছিলে। সব কিছুতেই ঠাট্টা-রসিকতায় উড়িয়ে দিতে। তাছাড়া তুমি বারে বারে আমাকে সাবধানও করেছ। স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছিলে–আমি আকাশকুসুম। রচনা করছি। জেনেবুঝে আগুনে হাত দিয়েছিলাম আমি। আগুন তার স্বধর্ম অনুযায়ী কাজ করে গেছে। দোষ দেব কাকে? দোষ আমি কাউকে দিচ্ছি না।

নিজের ডান হাতের তালুটার দিকে নির্নিমেষ নেত্রে তাকিয়ে থাকে ভিন্সেন্ট।

-কী দেখছ হাতে?

হাতটা মেলে ধরে ঊর্মিলার সামনে। বলে, জীবনে দুটি নারীকে ভালবেসেছিলাম। তাদের প্রণয়চিহ্ন নিত্যসাথী হয়ে রইল আজীবন! আয়নায় নিজের চেহারাটা দেখলেই তোমাদের দুজনের কথা মনে পড়বে।

–সেও কি তোমাকে প্রত্যাখ্যান করেছিল?

–হ্যাঁ। কারণ সে তখনই বুঝেছিল–আমি পাগল, বদ্ধ উন্মাদ।

 –তখনই কি তোমার মস্তিষ্ক বিকৃতির লক্ষণ দেখা দিয়েছে?

না হলে স্বেচ্ছায় হাতটা এভাবে প্রদীপ-শিখার উপর কেউ ধরে রাখতে পারে?

ঊর্মিলা ধীরে ধীরে ওর হাতের তালুতে হাত বুলিয়ে দেয়।

–আর কোন নারী আসেনি তোমার জীবনে? বিবাহ হয়নি?

–এসেছিল। বাতাসী। সাঁওতাল মেয়ে। দু বছর ঘর করেছি তার সঙ্গে। কিন্তু যে অর্থে তোমাদের দুজনকে ভালবেসেছিলাম সে অর্থে তাকে ভালবাসিনি।

আমরা দুজনেই তাহলে ব্যর্থ করে দিয়েছি তোমার জীবন! আজ এ অবস্থায় আমার ক্ষমা চাওয়াটা প্রহসনের মত শোনাবে! না ভিন্সেন্ট?

হঠাৎ উঠে বসে উত্তেজিত শিল্পী। ঊর্মিলার হাতখানা জোরে চেপে ধরে। উত্তেজিত কণ্ঠে বলে, -কে বলেছে, আমার জীবন ব্যর্থ! করুণা করতে এসেছ ঊর্মিলা? দুটো মিঠে কথা বলে সান্ত্বনা দিতে এসেছ আমাকে? শুনে যাও–তোমাদের হাসি, তোমাদের ব্যঙ্গ, তোমাদের বিদ্রূপ আমাকে স্পর্শ করেনি! আমি যা দেখেছি, যা যা বুঝেছি, রঙে আর রেখায় তা বন্দী করে ভবিষ্যতের জন্য রেখে গেলাম! আমার সে সৃষ্টির মূল্য একদিন কড়ায়-গণ্ডায় শোধ করতে হবে পৃথিবীকে! আমার জীবন ব্যর্থ নয়!

ডক্টর ডেভিডসনের স্ত্রীর হাতটা আলগা হয়ে যায়। এ যে এখনও বদ্ধউন্মাদ!

ভিন্সেন্ট ওর আতঙ্ক-তাড়িত দৃষ্টি দেখে বুঝতে পারে ঊর্মিলা কি ভাবছে। কিন্তু থামতে পারে না। সে পুনরায় বলে, -মিসেস ডেভিডসন! একটা কথা মনে রাখবেন। আজ থেকে একশো বছর পরে যদি আপনার নাম কেউ উচ্চারণ করে তবে তা করবে এজন্য নয় যে, আপনি অপরূপ সুন্দরী ছিলেন, এজন্য নয় যে, আপনার বাড়ি-গাড়ি সম্পত্তি ছিল, এজন্য নয় যে, আপনি প্রখ্যাত ডাক্তারের সহধর্মিণী ছিলেন, তারা আপনার নাম স্মরণ করবে, কারণ আপনি ছিলেন শিল্পী ভিন্সেন্ট ভান গর্গের প্রথম প্রেম!

ভিন্সেন্টের মুঠি আলগা হয়ে যায়। আবার শুয়ে পড়ে সে। চোখ দুটো বুজে যায় তার। মিসেস ডেভিডসন ধীরে ধীরে নিষ্ক্রান্ত হয়ে যায় ঐ বদ্ধউন্মাদের কেবিন থেকে।

মাসখানেক সে ছিল ঐ উন্মাদাশ্রমে। সেখান থেকে ছাড়া পেয়ে এসে উঠল আমার বন্ধুর বাড়িতে। সূরযের সনির্বন্ধ অনুরোধ সত্ত্বেও সে দিল্লীতে গেল না। সূরযও শেষ পর্যন্ত বুঝতে পারে আসল সমস্যা কোথায়! সত্যিই দাদাকে এনে সে কোথায় রাখবে? তাছাড়া সাময়িক উত্তেজনায় সে যে-কোন মুহূর্তে একটা বিশ্রী কাণ্ড করে বসতে পারে। মাসখানেকের মধ্যেই যে সুরযের বিবাহ হয়েছিল এ সংবাদ আমি কলকাতায় বসে পেলাম। সূরয নিমন্ত্রণ পত্র পাঠিয়েছিল আমাকে।

সূরষের দাদা সেদিন সমস্তদিন একখানা ছবি এঁকেছিল!

নিজের কান নিজের হাতে কেটে ফেলার পর আরও তিন মাস বেঁচে ছিল ভিন্সেন্ট। তার প্রথম মাসটা কাটে হাসপাতালে। বাকি দু মাস আমার বন্ধুর বাড়িতে–ভগলু, রঘুবীর আর সরযুপ্রসাদের তত্ত্বাবধানে। ভিন্সেন্টের সারাটা জীবনই একটানা একটা ব্যর্থতার করুণ ইতিহাস। কোথাও সে দুদণ্ড শান্তি পায়নি। এক ঘাট থেকে অন্য ঘাটে তরী ভিড়িয়েছে; টিকতে পারেনি–আবার ভেসে পড়েছে। কিন্তু শেষের এই দু মাস নিঃসন্দেহে সবচেয়ে বেদনাদায়ক।

রাঁচি তখন আর মোটেই ফাঁকা নয়। পশ্চিমের বায়ুবিলাসী ডেংচিবাবুর দল ক্রমাগত আসছেন। ভিন্সেন্টের বাড়ির আশেপাশে যেসব বাড়ি এতদিন তালাবন্ধ পড়ে ছিল একে একে তার দ্বার খোলা হল। কলরব-মুখরিত পুরুষ-নারী-শিশুর দলে ভরে গেল পাড়াটা। সকাল-বিকাল একঝাক প্রজাপতির মত তারা হাওয়া খেতে বার হয়। কখনও দল বেঁধে যায় হুডু, কখনও জোহা। এ তো আনন্দেরই কথা। কিন্তু কারও পৌষ মাস, কারও সর্বনাশ! দুর্ভাগা ভিন্সেন্টের বরাতে ঐ কৌতুকপ্রিয় কলরব-মুখরিত আগন্তুকরাই দেখা দিল নিষ্ঠুররূপে। ইতিমধ্যে পাগল আর্টিস্টের মুখরোচক ইতিকথা পাড়ায় কারও জানতে বাকি ছিল না। ওর নাম হল কানকাট্টা!

ভিন্সেন্ট তার রঙ-তুলি ক্যানভাস নিয়ে বার হয় আর দূর থেকে চেঞ্জারবাবুদের কৌতুকপ্রিয় ছেলের দল ফেউ লাগে। হাততালি দিয়ে ওরা ডাকে, কানকাট্টা। এই কানকাট্টা।

ভিন্সেন্ট প্রথম প্রথম ভ্রূক্ষেপ করত না, মাথা নিচু করে দ্রুত-পায়ে পরিচিত পাড়ায় গণ্ডিটা অতিক্রম করে যেত। কিন্তু ও-পক্ষও নাছোড়বান্দা-তারাও পিছু পিছু চলতে থাকে পাড়া থেকে বে-পাড়ায়। ক্রমে সমস্ত শহর জেনে গেল কানকাট্টা সেপাইয়ের। মজাদার ইতিহাস! সবাই হাসে, কৌতুকবোধ করে। কখনও বয়ঃজ্যেষ্ঠ কেউ হয়তো বালকদলকে হাসতে হাসতে ভর্ৎসনা করে।

ভিন্সেন্ট রাগ করছে না, পাগলামোর কোনও বহিঃপ্রকাশ দেখাচ্ছে না দেখে ছেলের দল হতাশ হয়। ওরা আরও এক ধাপ এগিয়ে যায়। দূর থেকে ঢিল মারে, ধুলো ছিটিয়ে দেয় পিছন থেকে ধাক্কা মেরে ছুটে পালিয়ে যায়। নিরুপায় ভিন্সেন্ট ওদের সঙ্গে ভাব করবার চেষ্টা করে। ও যে পাগল নয় এটা প্রমাণ করতে আপ্রাণ চেষ্টা করে-ভাব জমাতে চায়, ছবি এঁকে দিতে চায়, গল্প শোনাতে চায়। কিন্তু শিশু দৈত্যের দল তাতে খুশি হয় না। আশাভঙ্গে তারা আরও মরিয়া হয়ে ওঠে। রাঁচিতে এসে পাগল দেখার আনন্দকে ওরা ছাড়বে কেন? ভিন্সেন্ট যেন বিশ্বাসঘাতকতা করছে–তার পাগলামিকে প্রচ্ছন্ন রেখে!

বাধ্য হয়ে আউট-ডোর পেইন্টিং বন্ধ করে দিল ভিন্সেন্ট। ঘরে বসেই আঁকতে শুরু করে। অবশ্য শীতকালেই আউট-ডোর ল্যাণ্ডস্কেপ জমে ভাল। কিন্তু উপায় কি? ওরা যে সত্যিই পাগল করে ছাড়বে তাকে।

তা ঘরের ভিতরেই কি শান্তিতে আঁকতে দেবে ছেঁড়াগুলো?

শিশুদলের মধ্যে কবিযশপ্রার্থী কেউ ইতিমধ্যে একটা ছড়া বেঁধে ফেলেছে। সাত সকালে ওরা এসে হাজির হয় বাড়ির আশেপাশে। ক্রমাগত ছড়া কাটেঃ

কানকাট্টা কানকাট্টা ডান কানটা কই?
কোন্ পেত্নী গাছে তুলে কেড়েছে তোর মই?
কানটা নিয়ে ভাগল বুঝি!
বৃথাই তারে মরিস খুঁজি!
বাঁ কানটা দে না কেটে, খেতে দেব দই।

 ভিন্সেন্ট বুঝতে পারে–এ শুধু শিশুর চাপল্য নয়, এর পিছনে পরিণত বয়সের ছাপ আছে। না হলে হঠাৎ পেত্নীর প্রসঙ্গ উপস্থাপিত হত না। এই বালখিল্যদলের হাত থেকে কি করে নিস্তার পাওয়া যায়? সরপ্রসাদ, ভগলু অথবা রঘুবীর মাঝে মাঝে এসে ওদের তাড়িয়ে দেয়। ওরা ছুটে পালায়। আবার যেই ভগলুরা দূরে সরে যায় ওরা ঘনিয়ে আসে। হাততালি দিয়ে শুরু করে যৌথ-সঙ্গীত : কানকাট্টা কানকাট্টা, ডান কানটা কই?

দিবারাত্র এই ছড়া শুনতে শুনতে ভিন্সেন্টের মাথা ঝিমঝিম্ করে উঠত। ওর মনে। পড়ে যেত জোড়-জাঙালের সেই যোসেফ মুর্মুর কথা। যোসেফ মৃত্যুকে অস্বীকার করেছিল, যোসেফ মরতে চায়নি; তাই তার ভাগ্যবিধাতা তাকে এমন অবস্থার মধ্যে। এনে ফেলেছিলেন যখন মৃত্যুই তার একমাত্র কাম্য ছিল। আজ ভিন্সেন্টের অবস্থাও সেই রকম। মস্তিষ্কবিকৃতির সম্ভাবনাকে সে ঠেকাতে চেয়েছিল, সে পাগল হতে চায়নি আজ তার ভাগ্যবিধাতা তাকে এমন অবস্থায় পেড়ে ফেলেছেন তার মনে হচ্ছে ঐ। বালখিল্যদের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার একমাত্র উপায় সত্যি পাগল হয়ে যাওয়া। তখন আর ওদের বিদ্রূপ তার গায়ে লাগবে না।

–কানকাট্টা কানকাট্টা, ডান কানটা কই?

আর তো পারা যায় না! ভিলেন্ট দরজা-জানালা বন্ধ করে দেয়। দু হাতে কান চেপে । ধরে বসে থাকে। এ কী বিড়ম্বনা! শিশুর দল কী অপরিসীম নিষ্ঠুরই না হতে পারে!

মাঝে মাঝে ওরা ছন্দ বদলায়। অন্য কোন শিশুকবি একটি ব্যঙ্গ কবিতা লিখে বৈচিত্র্যের সন্ধান করেছে বোধহয়। সেদিন ওরা হাততালি দিয়ে নতুন সুরে শুরু করেঃ

গর্গমশাই গর্গমশাই করছ তুমি কি?
এই দেখ না আমি কেমন ছবি এঁকেছি!
বন্ধু ছিল, নাকটা তাহার কাটতে গিয়েছি;
কচাৎ করে ভুলেই নিজের কানটা কেটেছি!

হল না, কিছুই হল না। অথচ চেষ্টার কোন ত্রুটি করেনি ভিন্সেন্ট নিষ্ঠায় তার কোন ফাঁকি ছিল না। জীবনে কী পেল সে? শুধুই উপেক্ষা, অবহেলা আর বিদ্রূপ! কিন্তু কেন? সে তো এমন প্রকাণ্ড কিছু দাবী করেনি! সে শুধু চেয়েছিল তার অন্তরের আকুতিকে রঙ আর রেখায় মূর্ত করতে। এই দুনিয়ার আলো বাতাস, গাছপালা, ফুল-ফল-পাখি তার ভাল লেগেছিল–দুনিয়াদারী করতে গিয়ে যে হতভাগা-দলের মেরুদণ্ড বেঁকে গেছে তাদের জন্য ও দু ফোঁটা চোখের জল ফেলতে চেয়েছিল; অমর্ত্যলোকের বার্তা পেয়ে যখন তার অন্তর অনির্বচনীয় আনন্দে বিভোর হয়ে গিয়েছিল তখন সে সেই কথা জানাতে চেয়েছিল তার কাগজে আর ক্যানভাসে। তোমাদের তা ভাল লাগেনি। বেশ কথা। তোমরা তা তোমাদের ঘরে সাজিয়ে রেখ না। তার সৃষ্টি না হয় স্রষ্টার সঙ্গে মুছে যাবে। কিন্তু কেন উপেক্ষার সঙ্গে অপমান যোগ করছ? কেন প্রত্যাখ্যানের সঙ্গে বিদ্রুপের কষাঘাত চাপিয়ে দিচ্ছ? কী ক্ষতি আমি করেছি তোমাদের?

‘–বাঁ কানটাও দে না কেটে খেতে দেব দই!’

দই খাওয়ার লোভে নয়, ওদের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার লোভে মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় দ্বিতীয় কানটাও ওদের ছুঁড়ে দেয়! তাহলে কি থামবে ওরা? সত্যিই থামবে? পালিয়ে যাবে ওর ঘরের সামনে থেকে? যেমন করে পালিয়ে গিয়েছিলেন মিসেস ডেভিডসন?

‘–কোন্ পেত্নী গাছে তুলে কেড়েছে তোর মই?’

সংযমের সব বাঁধন ভেঙে যায়। দুরন্ত ক্রোধে দরজা খুলে হঠাৎ বেরিয়ে আসে ভিন্সেন্ট। ওদের তাড়া করে ধরতে যায়। ওরাও ছুটে পালায়। চিৎকার করে ওঠে, — পাগলা ক্ষেপেছে রে!

ছুটতে ছুটতে চলে যায় ওর নাগালের বাইরে। সেখান থেকে ঢিল ছুঁড়তে শুরু করে। দ্বিগুণ উৎসাহে ওখান থেকে আবার ছড়া কাটে।

–কানকাট্টা কানকাট্টা, ডান কানটা কই?

রাগে অপমানে ভিন্সেন্ট থরথর করে কাঁপতে থাকে।

 হঠাৎ একটা আধলা ইট এসে লাগে ওর মাথায়।

হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায় ধুলোর উপর। দু হাতে মাথাটা চেপে ধরে। ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে ভিন্সেন্ট। আরও কয়েকটা ঢিল এসে পড়ে-মাথায়, মুখে, পিঠে। ভিন্সেন্ট। কী করছে জানে না। সে ধুলোর উপরেই হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। দু হাত উর্দ্ধ আকাশের দিকে তুলে চিৎকার করে ওঠে, –হে ঈশ্বর! আমাকে সত্যিই পাগল করে দাও তুমি!

পরক্ষণেই ওর সম্বিৎ ফিরে আসে। এ কী করল সে! সে না নাস্তিক? সে না ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী? আজ মর্মান্তিক যন্ত্রণায় সব ভুল হয়ে গেল তার। না! ভিন্সেন্ট ভান গর্গ যোসেফ মুর্মু নয়! হার সে মানবে না! আবার উঠে দাঁড়ায়। টলতে টলতে ফিরে যায় তার ঘরের দিকে।

অমনি গুটিগুটি এগিয়ে আসে বালখিল্যের দলঃ

গর্গমশাই, গর্গমশাই করছ তুমি কি?
এই দেখ না আমি কেমন ছবি এঁকেছি!
 বন্ধু ছিল নাকটা তাহার কাটতে গিয়েছি।
 কচাৎ করে ভুলেই নিজের কানটা কেটেছি!

.

পরদিন ভিন্সেন্ট বসেছিল একখানা সেলফ-পোর্ট্রেট আঁকতে। আয়নায় নিজের মুখখানা দেখে আঁকবে। নিজের মুখটা দেখেই মনটা খিঁচড়ে যায়। ডান কানটা কাটা! কানকাটা সেপাই! ক্ষণিক উন্মাদনায় সে নিজেই নিজের কান কেটেছে। সে লজ্জার কথা দুনিয়া ভুলে যাবে দুদিন পরে–যেদিন মাটির তলায় ওরা শুইয়ে দেবে ব্যর্থ-আর্টিস্ট ভান গর্গকে। কিন্তু একথা তো নিশ্চিত যে, একদিন পৃথিবী নতমস্তকে স্বীকার করবে তার সৃষ্টিকে। আজ সে যদি সেলফ-পোর্ট্রেট আঁকে তাহলে ওর লজ্জার ইতিহাসটাও শাশ্বত হয়ে থেকে যাবে পৃথিবীতে। সে ভুল ও করবে না। নিজের ছবি সে আর আঁকবে না। আচ্ছা, কতদিন বাঁচবে সে? তা কে বলতে পারে? মিকেলাঞ্জেলো বা তিশান নব্বই বছরের কাছাকাছি বেঁচে ছিলেন। ক্লোদ, গোইয়া, কোরো আশী বছরের চেয়েও বেশিদিন এঁকে গেছেন ছবি। প্রথম দরের শিল্পীদের মধ্যে সবচেয়ে কম বয়সে মারা যান রাফাইল, মাত্র সাঁইত্রিশ বছর বয়সে। অর্থাৎ ভিন্সেন্টের বর্তমান বয়সে। কিন্তু এত কম বয়সে নিশ্চয় মারা যাবে না সে! মৃত্যুর পদধ্বনি এখনও শোনা যাচ্ছে না। অনেক দূরে সে দিন। দশ-বিশ-ত্রিশ-পঞ্চাশ বছর! অনেক, অনেক ছবি আঁকতে হবে ইতিমধ্যে। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ চিত্রকরের ছবির পাশে থরে থরে একদিন সাজানো হবে সেসব ছবি। আচ্ছা, সেই পরিণত বয়সে ভিন্সেন্টকে কেমন দেখতে হবে? দাড়িওয়ালা লিওনার্দোর মত, না কি তোবড়ানো গাল মিকেলাঞ্জেলোর মত?

হঠাৎ ওর মাথায় একটা আইডিয়া এসে গেল। নিজের প্রতিকৃতি তো সব বড় জাতের আর্টিস্টই এঁকেছেন! লিওনার্দো, মিকেলাঞ্জেলো, তিশান, রেমবান্ট, মায় গগনেন্দ্রনাথ, নন্দলাল পর্যন্ত সেলফ-পোর্ট্রেট এঁকেছেন দর্পণে প্রতিবিম্ব দেখে। ভিন্সেন্ট নূতন কিছু করবে। মনের মুকুরে সে দেখবে অনাগত ভবিষ্যতে নিজের পরিণত রূপ! আজ থেকে তেতাল্লিশ বছর পরে ওর অশীতিতম জন্মদিনে ওকে কেমন দেখতে হবে তাই ফুটিয়ে তুলবে রঙে আর রেখায়। ততদিনে সে নিশ্চয়ই স্বীকৃতি পাবে।

কল্পানায় ভিন্সেন্ট দেখতে থাকে ছবিটা। ভিন্সেন্টের অশীতিতম জন্মোৎসবে সমবেত হয়েছেন দেশের জ্ঞানীগুণী শিল্পীবৃন্দ। মাঝখানে একটা পিঠ-উঁচু ভিক্টোরিয়ান চেয়ারে বসে আছেন জ্ঞাননিধূর্তকল্মশ অশীতিপর ভান গর্গ; তার কপালে চন্দনের ফোঁটা, গলায় থরে থরে শ্বেতপদ্মের মালা। একপাশে ভক্তের দল সারি দিয়ে দাঁড়িয়েছে, আর পাশে কয়েকটি তরুণী এসেছে মাঙ্গলিকী নিয়ে। শঙ্খধ্বনি করছে, বরণ করছে, শ্রদ্ধার্ঘ্য নামিয়ে রাখছে। চিত্রের কেন্দ্রবিন্দু ঐ জ্ঞানবৃদ্ধ শিল্পী! না! ছবিটা সে তিন ধাপে আঁকবে। তিনতলা ছবি। অজন্তার সপ্তদশ বিহারে অন্তরালের বাঁ-দিকের প্রাচীরে যেমন আছে বুদ্ধদেবের ত্রিতল চিত্র-সম্ভার। একতলায় সিংহাসনে আসীন বুদ্ধদেব। তাঁর দক্ষিণে রাজন্যবর্গ–বিম্বিসার, অজাতশত্রু, প্রসেনজিৎ, আর বামে শিষ্যের দল সারিপুত্র, মহা মোগল্ল্যায়ন, আনন্দ প্রভৃতি। দ্বিতলে দেখা যায় বুদ্ধদেব ত্ৰিত্রিংশস্বর্গের সোপান বেয়ে মর্তে নেমে আসছেন, আর ত্রিতলে সর্বোচ্চস্তরে অজন্তা শিল্পী এঁকেছেন স্বর্গের দৃশ্য। সুরসুন্দরী এবং দেবগণের মাঝখানে সদ্ধর্মের ব্যাখ্যা করেছেন গৌতম বুদ্ধ।…. ঐ রকম ত্রিতল চিত্রের মাধ্যমে ভিন্সেন্ট ভান গর্গ রেখে যাবে এক শাশ্বত কীর্তি–তার অনাগত ভবিষ্যৎ জীবনের এক আলেখ্য। সর্বনিম্ন স্তরে শিল্পীর অশীতিতম জন্মোৎসব, দ্বিতীয় স্তরে ভিন্সেন্টের মৃত্যু! মাঝের ছবিটার কম্পোজিশান হবে অজন্তার উনবিংশতিতম গুহায় মহাপরিনির্বাণ বাসরিলিকের মত। অনুগ্রাহী ভক্তের দল হাহাকার করছে। আর সর্বোচ্চস্তরে দেখা যাবে, স্বর্গে একদল দেবদূত মেঘের উপর থেকে ঝুঁকে পড়ে দেখছেন। মর্তের দৃশ্য। তারা অপেক্ষা করছেন নূতন আগন্তুক অতিথির! তারা কারা?-ঐ লিওনার্দো, মিকেলাঞ্জেলো, তিশান, এল গ্রেকো, রেমব্রান্ট, রুবেন্স, ভেলাসকেথ, গোইয়া, মানে, মনে, দেগা… ।

ভিন্সেন্ট ছবি আঁকে আত্মহারা হয়ে। তৎক্ষণাৎ সে নিয়ে বসে রঙ-তুলিক্যানভাস। সর্বনিম্ন স্তরের ছবিখানা তখনই আঁকতে বসে। অশীতিপর বৃদ্ধ ভিন্সেন্ট ভান গর্গের সম্বর্ধনাসভার চিত্র। সাফল্যের সর্বোচ্চ চূড়ায় উঠেছেন শিল্পী, সকলের স্বীকৃতি পেয়েছেন, শ্রদ্ধা পেয়েছেন বিদ্বান সর্বত্র পূজ্যতে!

কিন্তু ওরা কি দেবে অনাগত ভবিষ্যতের সে রঙিন কল্পনায় মগ্ন হতে? ভবিষ্যতের সাফল্যকে পিছন থেকে টেনে ধরে বর্তমানের বিদ্রূপঃ

কানকাট্টা কানকাট্টা ডান কানটা কই?
কোন্ পেত্নী গাছে তুলে কেড়েছে তোর মই?

একাগ্রতা নষ্ট হয়ে যায় বারে বারে। বারান্দায় বেরিয়ে এসে হাত দুটি জোড় করে বলে, অন্তত একটা দিন আমাকে রেহাই দাও ভাই! আজ আমাকে একটা ছবি আঁকতে দাও! কাল এসে আমাকে খেপিও; আমি কিছু বলব না!

ওরা হাততালি দিয়ে উল্লাস প্রকাশ করে।

–পাগলা ছবি আঁকবে রে! গর্গমশাই করছ তুমি কি? এই দেখ না আমি কেমন ছবি এঁকেছি।

হতাশ হয়ে ফিরে আসে ভিন্সেন্ট। জানালাটা বন্ধ করে দেয়। যতটা এড়ানো যায় ঐ মর্মভেদী শব্দ! কিন্তু জানালা বন্ধ করলে আলোও কমে যায়। সু উপায় নেই।

সমস্ত দিন ধরে ভিন্সেন্ট ছবি আঁকল। শেষ করল তার অশীতিতম জন্মদিনের চিত্র! সমস্ত দিনই ওরা ছড়া কাটল তীক্ষ্ণ স্বরে, পালা কবে। ভিন্সেন্ট স্বজ্ঞানে কিছু আঁকেনি। আচ্ছন্নের মত মন যা চেয়েছে তাই এঁকে গেছে। ডান হাতের উপর তার অধিকার হারিয়ে গেছে যেন।

সন্ধ্যাবেলায় ছেলের দল ক্লান্ত হয়ে ফিরে গেল। ভিন্সেন্টও ক্লান্ত হয়ে উঠে পড়ে। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। সমস্ত দিনমান যেন একটা ঘোরের মধ্যে ছিল। যেন আজই তার অশীতিতম জন্মোৎসব পালন করা হল। যেন সারাটা দিনমান ওর অন্ধ ভক্ত আর স্তাবকের দল বাইরের বাগানে ওর জয়ধ্বনি দিয়েছে। এখন উৎসব-শেষে শ্রান্তদেহে ও বিশ্রাম খুঁজছে।

লণ্ঠনটা জ্বেলে নিয়ে সরযূপ্রসাদ ঢুকল ঘরে। সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে বাইরে। হঠাৎ লণ্ঠনটা তুলে ধরে সরযূপ্রসাদ সদ্য সমাপ্ত ছবিখানা দেখল। ওর মহোত্তম শিল্পের প্রথম দর্শক। ভিলেন্ট অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করে। সরযু কী বলে শুনতে হবে। অনেকক্ষণ ছবিটা নিরীক্ষণ করে অবশেষে সরযূপ্রসাদ তার মতামত প্রকাশ করে, ইয়ে বুঢ়া রোতে কেঁও?।

— রোতে কেঁও? কাঁদছে? কে? সাফল্যের আনন্দে অশীতিপর বৃদ্ধ ভিন্সেন্ট ভান গর্গ কি কেঁদে ফেলেছেন? অসংখ্য ভক্ত আর স্তাবকের মাঝখানে সে অশীতিতম জন্মদিনে বৃদ্ধ ভান গর্গের চোখে আনন্দাশ্রু এঁকেছে নাকি? ভিন্সেন্ট জবাবে বলে, দূর বোকা! কাঁদবে কেন? ও তো হাসছে! দ্যাখ না ভাল করে

-আপ দেখিয়ে না?

আলোটা উঁচু করে ধরে সরযুপ্রসাদ।

হুমড়ি খেয়ে পড়ে ভিন্সেন্ট। যেন ছবিটা এই প্রথম দেখছে সে! কী আশ্চর্য! কী অপরিসীম আশ্চর্য! এ কী এঁকেছে ভিন্সেন্ট! কোথায় তার ভক্ত স্তাবকের দল? সেই বরণমালা হাতে, শঙ্খ হাতে, চন্দনের বাটি হাতে মেয়ের দল কোথায় গেল? এ ছবি কে এঁকেছে?

ক্যানভাস জুড়ে একটি মাত্র বৃদ্ধের ছবি। হাতলহীন চেয়ারে বসে আছে দু হাতে মুখ ঢেকে। নিরতিশয় ব্যর্থতায়, অপমানে ভেঙে পড়েছে বৃদ্ধ। পরনে তার কয়েদীর পোশাক। কয়েদী? না। ওটা উন্মাদাগারের সেই বিচিত্র নিকার-বোকার! বৃদ্ধ উন্মাদ দু হাতে মুখ ঢেকে হাউ হাউ করে কাঁদছে। ঘরে আর কেউ নেই, কিছু নেই! শুধু ধিকিধিকি জ্বলছে ফায়ার-প্লেসে ফেলে আসা জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতার তুষানল!

একটা আর্তনাদ বের হয়ে এল সাঁইত্রিশ বছর বয়সে ভিন্সেন্টের কণ্ঠনালী থেকে অশীতিপর ভিন্সেন্টের দুর্দশা সে সইতে পারল না!

সমস্ত রাত ঘুম এল না ভিন্সেন্টের। পায়চারি করে ফিরল বারান্দায়। এভাবে বেঁচে থেকে কী লাভ? আজ সে সুস্থ সবল আছে, কিন্তু পূর্ণিমা আসতে আর মাত্র দিন সাতেক বাকি। তিন মাসের মেয়াদ ফুরিয়ে এসেছে। এবার মানসিক স্থৈর্য হারিয়ে সে কি করবে? উলঙ্গ হয়ে বেরিয়ে যাবে রাস্তায়? আত্মহারা হয়ে কি খুন করে বসবে প্রতিবেশীর ঐ সাত বছরের বাচ্চাটাকে? বিচিত্র নয়! সাতদিন পরে সে হয়তো ওদের বিদ্রুপে উন্মাদ হয়ে ছুটে বেরিয়ে আসবে বাগানে। ঐ ফুটফুটে বাচ্চাটা হয়তো ছুটে পালাতে পারবে না, হুমড়ি খেয়ে পড়বে লাল কাঁকরের রাস্তার উপর। আর বদ্ধ উন্মাদ ভিন্সেন্ট ভান গর্গ ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের মত ছুটে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়বে তার উপর। হয়তো দুহাতে টিপে ধরবে ওর সরু কণ্ঠনালী, হয়তো উপড়ে নেবে ওর চোখ দুটো, হয়তো–আঃ!

-ঈশ্বর! এ কী করলে তুমি? আমি শিল্পী হতে চেয়েছিলাম! তুমি আমাকে নররাক্ষস করে তুলেছ!

না না! ঈশ্বর নেই! ঈশ্বরকে অভিশাপ দিয়ে লাভ নেই! সে একটা ব্যাধিতে ভুগছে। সাতদিন পরে নিজের উপর তার কোন অধিকার থাকবে না। সে কী করবে, কী বলবে সে জানে না। আজই বা তাই জানে নাকি? এই যে সারাটা দিনমান সে যে ছবিখানা এঁকেছে, তা কি স্ব-ইচ্ছায়? এখন তো সে উন্মাদ নয়, তবু তার ডান হাতখানা তো স্বেচ্ছাচারিতা করে গেছে, নির্বিচারে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। সে আঁকতে চেয়েছিল তার পরিণত জীবনের সাফল্যের চিত্রতার ব্যভিচারী হাত এঁকে বসল চরম ব্যর্থতার ছবি! শিল্পী যদি নিজের ইচ্ছানুসারে শিল্পসৃষ্টি করতে অসমর্থ হয়ে পড়ে তবে তার বেঁচে থাকার কী অর্থ? এর পর স্বেচ্ছাচারী ডান হাতখানা তার নির্দেশ অমান্য করে হয়তো এমন সব ছবি এঁকে যাবে–যা সে আঁকতে চায় না, যার বিষয়বস্তু তার অন্তরের নির্দেশে রূপায়িত নয়! লোকে বলবে, ভান গর্গের ভীমরতি হয়েছে–এত নিম্নস্তরের ছবি সে এঁকেছে? আলুর ভোজ, সিঙারণের সেতু, জোড়-জাঙাল গীর্জা, সূরযমুখী, পোস্টম্যানের আলেখ্য, পাগলাগারদের প্যারেডের দৃশ্য এঁকেছে যে হাত, সেই হাতই এমন অশ্লীল কদর্য ছবি আঁকতে পারে!

না, না, না! সে দুর্ঘটনা ঘটতে দেবে না ভিন্সেন্ট! কিছুতেই নয়!

সূরয তুমি আমাকে ক্ষমা কর। বিশ্বাস কর, মরতে আমি চাইনি, মরতে আমি চাই! কিন্তু আমার উপায় নেই। ডান হাত অন্যায় করলে তাকে আমি শাস্তি দিতে পারি– কিন্তু মনকে আমি ধরব কোন্ প্রদীপ শিখায়? তাই বদ্ধ উন্মাদ হয়ে যাবার আগে আমি সজ্ঞানে নিজে হাতে টেনে দিতে বাধ্য হলাম এ-জীবনের যবনিকা! মিকেলাঞ্জেলো, তিশান, গোইয়ার মত পরিণত বয়সে শিল্পসৃষ্টি করার ভাগ্য নিয়ে আমি আসিনি। ক্ষতি কি তাতে? রাফাইল তো সাঁইত্রিশ বছর বয়সেই অমর হয়ে আছেন। আমিও তাই থাকব।

বিদায় সূরয! বিদায় পৃথিবী!

যথানিয়মে সকালবেলা সেজেগুজে গরম জামা পরে বালখিল্যের দল এল পাগলাকে খেপাতে। কিন্তু ছড়া কাটার সুযোগ পেল না তারা। আজকের লুকোচুরির খেলায় পাগলা তাদের ফাঁকি দিয়ে পালিয়েছে। প্রতিবেশীর সেই সাত বছরের ছেলেটা–যাকে বাঁচাতে ভিন্সেন্ট এই শেষ সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেই প্রথম আবিষ্কার করল তার দেহটা। চিৎকার করে উঠল সে।

বারান্দার উপর উপুড় হয়ে পড়ে আছে ভিন্সেন্ট। মাথাটা ঝুলছে বারান্দার ধার থেকে। আর ঝুলে পড়েছে তার বিশ্বাসঘাতক ডান হাতখানা। সেই হাতের একটা শিরা পেন্সিল কাটা ছুরি দিয়ে কেটে ফেলছিল ভিন্সেন্ট। রক্তের ধারা নেমে এসেছে সান বাঁধানো মেঝে থেকে সিঁড়িতে বাগানের ফুলে-ভরা সূরযমুখী ফুলের গাছগুলোর দিকে বিসর্পিল রেখায়। ক্রমাগত রক্তক্ষরণে নিস্তেজ হয়ে সে লুটিয়ে পড়েছে মেঝের উপর। মাঘের শীতে তার শরীর হিম হয়ে পড়ে আছে!

তবু দুর্জয় তার প্রাণশক্তি! এর পরেও তিনদিন বেঁচে ছিল। খবর পেয়ে দিল্লী থেকে আবার ছুটে এসেছিল ওর ছোটভাই সূরযভান।

দেড়দিন পরে জ্ঞান ফিরে পেয়ে ভিন্সেন্ট দেখতে পেল তাকে। স্নান হাসল ভিন্সেন্ট। অস্ফুটে বললে, –আশ্চর্য সূরয! যখনই তোর জন্যে প্রাণ কেঁদে উঠেছে তখনই চোখ মেলে দেখি তুই বসে আছিস! সেই কান কাটার দিনটার কথা মনে আছে সূরয?

শেষ বারো ঘন্টা সূরয একাই বসে ছিল মৃত্যুপথযাত্রীর শয্যাপার্শ্বে।

শিশুদৈত্যের দল আর ছড়া কাটতে আসেনি। তারাও ওকে মুক্তি দিয়েছিল। ভীষণ দুর্বল হয়ে পড়েছিল ভিন্সেন্ট কিন্তু শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত জ্ঞান ছিল তার। সূরযকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করেছিল? দুঃখ করিস না রে! এই ভাল হল! এ ছাড়া পথ ছিল না!

উচ্ছ্বসিত কান্নায় ভেঙে পড়েছিল সূরয। প্রতিবাদের ভাষা খুঁজে পায়নি।

–আমার ছবিগুলো সব যত্ন করে রেখে দিস! বিশ্বাস রাখিস্যাবার আগে বলে গেলাম–একদিন না একদিন ওর দাম পৃথিবীকে কড়া-ক্রান্তি হিসাবে মিটিয়ে দিতে হবে!

সূরয ওর হাতখানা ধরে শুধু বলেছিল, চুপ কর, দাদা!

-এখনই চুপ করব রে। শুধু একটা কথা কানে কানে বলে যাই। এ আমার অন্তিম ইচ্ছা। তোর ছেলে হলে তার নাম রাখিস ভিন্সেন্ট ভান গর্গ। আমি আবার ফিরে আসব; তোর ছেলে হয়ে জন্মাব, নামটাও তাই রাখিস।

সূরয ওর হাতখানা ধরে শুধু বলেছিল, চুপ কর, দাদা!

প্রদীপ নেববার আগে একবার শেষবারের মত দপ্ করে জ্বলে ওঠে। মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তে তেমনি হঠাৎ উঠে বসতে চেয়েছিল ভিন্সেন্ট। শূন্য দ্বারপথে সে কোন অপার্থিব মূর্তি দেখতে পেয়েছিল। বললে, –ঐ, ঐ ওরা এসেছে।

সূরয সচকিত হয়ে দ্বারের দিকে তাকায়। কেউ নেই সেখানে। ভিন্সেন্ট চিৎকার করে ওঠে, কোথায় নিয়ে যাবে আমাকে?..শিবলোক, বৈকুণ্ঠ? ওসব আমি বিশ্বাস করি না। না, আমি যাব না!…এরা আমাকে যন্ত্রণা দিয়ে থাকে তাতে তোমাদের কি?…হা হা, কতবার বলতে হবে?…আমি এই পৃথিবীতেই আবার জন্মাতে চাই। আবার এই নরক যন্ত্রণা সইতে চাই সর্বাঙ্গ দিয়ে!…তাতে তোমাদের কি? ঐ সূরযের বৌয়ের কোলে ফিরে আসব আমি! যাব না! না, আমি কিছুতেই যাব না তোমাদের সঙ্গে!

এই তার শেষ কথা।

যাব না, যাব না, বলতে বলতেই চলে গেল সে!

 কাহিনী শেষ করে অনেকক্ষণ চুপ করে বসে ছিলে দ্বৈপায়নদাদু।

বুঝতে পারি, বেশ অভিভূত হয়ে পড়েছেন বৃদ্ধ। চোখ থেকে চশমাটা খুলে কঁচটা মুছতে মুছতে বলেন, নরেন, তুমি কি ভান গর্গের জীবনী লিখবে, না উপন্যাস?

না, জীবনী নয়, উপন্যাসই লেখবার ইচ্ছে আছে আমার। কেন বলুন তো? 

–তাহলে এবার যে কথাটা বলছি সেটা তোমার বইতে লিখ না। ভিন্সেন্টের শেষ ইচ্ছাটাও করুণাময় পূরণ করেনি! ভিন্সেন্টের মৃত্যুর শোক সহ্য করতে পারেনি সূরয। সে উন্মাদ হয়ে যায়। মাত্র ছ মাসের মধ্যে বদ্ধ উন্মাদ অবস্থায় সে মারা যায়। ওর সদ্য বিবাহিত স্ত্রী তার চিতাভস্ম নিয়ে এসে ভিন্সেন্টের কবরের পাশে প্রোথিত করে। দুই ভাইয়ের সমাধিক্ষেত্রে একটি আইভিলতা রোপন করে দেয়। তাই বলছিলাম, ভিন্সেন্ট ভান গর্গের নামটা পর্যন্ত টিকে থাকতে দেননি ঈশ্বর।

আমি অবাক হয়ে বলি, –একথা আমার বইতে লিখতে বারণ করছেন কেন?

কারণ তোমার পাঠক হয়তো বিশ্বাস করবেন না-টুথ ইস স্ট্রেঞ্জার দ্যান। ফিকশান; ভাববেন ছ মাসের মধ্যে সূরযের উন্মাদ অবস্থায় মৃত্যুটা সাহিত্যের বিচারে করুণরসের একটা ওভারডোস! যদি জীবনী লিখতে তাহলে কোন কথা ছিল না–কারণ ভিন্সেন্ট ভান গর্গের ভাইয়ের এটাই হচ্ছে সত্য ইতিহাস।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *