আবার যদি ইচ্ছা কর – ১৩

প্রায় বছর দুয়েক পরের কথা।

এ দু বছরের ভিতর আমার জীবনে গগন বা চন্দ্রভান কোন ছায়াপাত করেনি। ওদের খবরই জানতাম না। বরিশাল থেকে মাঝে মাঝে বটুকের চিঠি আসত। পাটোয়ারি ব্যবসা তার ভালই চলছে। একদিন আমার সঙ্গে ডাক্তারখানায় দেখা করতে এলেন এক ভদ্রলোক। বলিষ্ঠ সুগঠিত শরীর। যুবাপুরুষ। বলেন, আমায় চিনতে পারলেন না দীপুদা? আমি সূরয!

–আরে তাই তো? কত বড় হয়ে গেছ সূরয! কী খবর? কী করছ, কোথায় আছ?

সূরযভান তার সব খবর জানায়। দিল্লীতে কমিসেরিয়েটে চাকরি করে। প্রথম কলকাতাতেই চাকরিতে ঢুকেছিল। যে বছর মোহনবাগান শীল্ড পেল, সে বছরই ভারতের রাজধানী চলে গেল দিল্লীতে। সূরযও ঐ সময় দিল্লী চলে যায় বদলি হয়ে। সে আজ বছর পনের আগের কথা। ইতিমধ্যে প্রথম যুদ্ধ এসেছে এবং গেছে। সূরযের বয়স এখন বছর তেত্রিশ। বিবাহ করেনি। একাই আছে দিল্লীতে। পৈতৃক সম্পত্তি সে পায়নি। সে একা নয়, ওরা দু ভাই বঞ্চিত হয়েছিল পৈতৃক সম্পত্তি থেকে। কাকা একটি উইল বার করে তাঁর নিরঙ্কুশ অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছেন। উইলটা জাল কি সাচ্চা যাচাই করবার মত আর্থিক সঙ্গতি ছিল না সূরযভানের। আর তার দাদা তো আগে থেকেই নেপথ্যে সরে গেছে। ফলে সূরয কোন দাবী করেনি; নীরবে মেনে নিয়েছে দুর্ভাগ্যকে। দুঃখ নেই তার। নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে আবার।

জিজ্ঞাসা করি, –তোমার দাদা কোথায়?

কলকাতাতেই আছে। সেই দাদার ব্যাপারেই এসেছি আপনার কাছে। দাদা আমার কাছে দিল্লীতে গিয়ে থাকতে চায় না। তাছাড়া–মানে, সে অনেক কথা। মোট কথা দাদা বরাবরই কলকাতাতেই আছে। একাই। আমিই মাসে মাসে তাকে খরচ পাঠাই। ও আপন মনে ছবি এঁকে যায় শুধু। দাদার ছবি এখনও লোক নেয়নি।

আবার প্রশ্ন করি, তোমার দাদা একা থাকে মানে? তোমার বউদি কোথায়?

–বৌদি দাদার কাছে থাকে না। দাদাকে ছেড়ে চলে গেছে।

একটু ইতস্ততঃ করে বলি, তোমার বৌদিকে নিয়ে চন্দ্রভান বছর দুই আগে আমার কাছে এসেছিল, তখন তাঁর সন্তান সম্ভাবনা ছিল। বাচ্চাটা–

-হ্যাঁ, জানি। দাদা বলেছে। একটি মেয়ে হয়েছিল তাঁর।

সুস্থ সবল?

হ্যাঁ।

–ও! তারপর?

 সূরযভান একটা সঙ্কোচকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে বলে, –আপনাকে বরং খোলাখুলি সব কথা বলি। ডাক্তারের কাছে কোন কিছু গোপন করা ঠিক নয়। দাদা ঐ মেয়েটিকে বিয়ে করেনি; একসঙ্গে ওরা থাকত। মেয়েটি খুব ভাল ঘরের নয়। সে যাই হোক, সে দাদাকে ছেড়ে চলে গেছে। দাদা শ্যামবাজারের ওদিকে একাই থাকে। নিজে হাতে রান্না করে খায়। আপনার কাছে যে জন্য এসেছি তা এবার বলি। আজ মাস দুয়েক হল দাদার একটু মস্তিষ্কবিকৃতির লক্ষণ দেখা দিয়েছে। এমনি ভালই থাকে, কিন্তু মাঝে মাঝে সে কেমন যেন অদ্ভুত আচরণ করে বসে। হঠাৎ ভীষণ উত্তেজনা অনুভব করে। তখন ও এমন সব কাজ করে বসে যার কোন মানে হয় না। ও নিজেই পরে অনুতপ্ত হয়। নিজের কাছে নিজেই কোন কৈফিয়ৎ দিতে পারে না। গত এক বছরে এমন বার-তিনেক হয়েছে। প্রথমটা আমাকে সে কিছু জানায়নি। গোপন করতে চেয়েছিল; কিন্তু এবার সে ভয় পেয়ে আমাকে জানায়। আমি ছুটি নিয়ে চলে এসেছি। আপনি একবার দাদাকে পরীক্ষা করে দেখবেন?

কি জবাব দেব বুঝে উঠতে পারি না। রতিজ রোগ থেকে মস্তিষ্ক বিকৃতি হওয়া অসম্ভব কিছু নয়। কিন্তু এসব কথা কি সূরযকে বলা উচিত? আবার গোপন করাও ঠিক নয়; বস্তুত সেই তো এখন রোগীর গার্জেন। শেষে বলি, –সূরয, তোমার দাদার সঙ্গে বছর দুই আগে আমার একটা মনোমালিন্য ঘটেছিল

জানি, দাদা সব কথা বলেছে আমাকে। তাই তো সে আজ আমার সঙ্গে এল না।

-তুমি এক কাজ কর। আমি একজন ডাক্তারকে একখানা চিঠি লিখে দিচ্ছি। তুমি প্রথমে তাকে দিয়ে চন্দ্রভানকে দেখাও। তারপর আমাকে রিপোর্টটা দেখিও। আমি পরবর্তী ব্যবস্থা করব।…আচ্ছা সূরয, একটা কথা বল তো! তোমাদের বংশে কারও উপদংশ অথবা প্রমেহ অসুখ ছিল বলে শুনেছ?

না। একথা কেন জিজ্ঞাসা করছেন?

-মস্তিষ্ক বিকৃতির কারণ হিসাবে বংশানুক্রমিক ইতিহাসটাও তো বিবেচনা করতে হয়।

সূরয দিন তিনেক পরে আমার নির্বাচিত ডাক্তারের রিপোর্ট নিয়ে এল। চন্দ্রভান কোন দৈহিক অসুখে ভুগছে না। তার ওজন কম, রক্তচাপ অস্বাভাবিক, অন্যান্য উপসর্গ নেই; আর সবচেয়ে বড় কথা, যে অসুখের কথা আমি আশঙ্কা করেছিলাম সে অসুখ তার নেই, কখনও হয়নি।

কিমাশ্চর্যমতঃপর!

চন্দ্রভান কিন্তু কিছুতেই আমার কাছে আসতে রাজী হল না। অগত্যা সূরযকে সঙ্গে নিয়ে আমিই তার বাসায় গিয়েছিলাম। অভিমান করার হক্ আছে বইকি চন্দ্রভানের!

অপমানটা তো সেদিন আমি কম করিনি!

শ্যামবাজার অঞ্চলে একটা এঁদোস্য-এঁদো কানা গলি। দুজন লোক পাশাপাশি চলতে পারে না। আগু-পিছু হাঁটতে হয়। তারই ভিতর একটা খোলার চালের ঘর। দু-অংশে ভাগ করা। ও-অংশে কতকগুলি মেহনতী মানুষের বাস। দিনের বেলায় কেউ ঠেলা চালায়, কেউ রিকশা। কেউ বা ঝকা নিয়ে চলে যায় শ্যামবাজার অথবা হাতিবাগানের বাজারে মোট বইতে। অপর অংশে বাস করে শিল্পী ভিন্সেন্ট ভান গর্গ। একটা চৌকি, খানকয় এনামেল আর অ্যালুমিনিয়ামের বাসন। একটা স্টোভ আর ইন্দুমাধব মল্লিক মশায়ের নব-আবিষ্কৃত একটা অদ্ভুত যন্ত্র। ওতে নাকি একসঙ্গে ভাত-ডাল-আলুসেদ্ধ রান্না হয়ে যায়। আর আছে তার আঁকবার নানান সরঞ্জাম। রঙ, তুলি, ক্যানভাস। সে গৃহস্থালীর সঙ্গে তুলনা করা চলে একমাত্র বরানগরে দেখা গগ্যার ঘরখানার।

চন্দ্রভান কিন্তু আমাকে আদর করে বসালো। আমি প্রথমেই বললাম, কিরে, রাগ করে আছিস নাকি?

ও পুরাতন প্রসঙ্গটাকে আমলই দিল না। বললে, –আয় আয়, বস!

চৌকির উপর তেলচিটে মাদুরটা পেতে দেয়।

.

চন্দ্রভানের চিকিৎসার পূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলাম আমি।

বন্ধুকৃত্য ছাড়া আরও দুটি কারণ ছিল সে সিদ্ধান্তের পিছনে। প্রথমত, কেমন একটা অপরাধবোধে অনুশোচনা জেগেছিল আমার। দু বছর আগে ওভাবে যদি আমি তাকে তাড়িয়ে না দিতাম, তাহলে হয়তো চন্দ্রভান এ রোগে পড়ত না। সকলের কাছ থেকে ক্রমাগত অপমান, আঘাত আর প্রত্যাখ্যান পেতে পেতে ও বোধহয় মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলতে বসেছে। দু বছর আগে সে অনেক আশা নিয়ে তার পুরনো বন্ধুর কাছে এসেছিল একটু সহানুভূতির আশায়। সেখানে আবার প্রত্যাখ্যাত হয়ে সে মানসিক স্থৈর্য হারিয়ে বসে থাকতে পারে। অর্থাৎ পরোক্ষভাবে আমি হয়তো ওর মানসিক ব্যাধির অন্যতম কারণ। দ্বিতীয়ত, আমার দুরন্ত কৌতূহল হয়েছিল চিকিৎসা বিজ্ঞানী হিসাবে। ডক্টর মিসেস্ স্মিথ-এর রিপোর্টটার কথা আমি ভুলতে পারিনি। যার স্ত্রীর যৌনব্যাধি অমন শোচনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছিল সে কেমন করে এমন সুস্থ সবল থাকল দৈহিক নিরিখে?

মনোবিজ্ঞানের চর্চা তখনও ভারতবর্ষে খুব ব্যাপকভাবে শুরু হয়নি। গিরীন্দ্রশেখর বসু মহাশয়ের গবেষণাপ্রসূত জ্ঞান তখনও আমরা জানতাম না। কিছু কিছু আধুনিক বিলাতী ম্যাগাজিনে সাইকোঅ্যানালিসিসের পদ্ধতি মোটামুটিভাবে জানা ছিল। দুএকজন চিকিৎসক এ নিয়ে পড়াশুনা করছেন, গবেষণা করছেন কিন্তু তাদের সাহায্য পাওয়ার মত আর্থিক সামর্থ্য ছিল না আমার বন্ধুর। ও যে একজন মস্তবড় শিল্পী এমন ধারণা আমার আদৌ ছিল না, তবে ও যে আমার বন্ধু এ তো অস্বীকার করতে পারি না! তাই নিজেই যেটুকু সম্ভব তা করব বলে স্থির করি। মনের অসুখের বিষয়ে বই এনে পড়তে শুরু করলাম। একজন অস্ট্রিয়ান বৈজ্ঞানিকের সম্প্রতি প্রকাশিত একটি বই পেয়ে গেলাম লাইব্রেরীতে। বইটি সবেমাত্র ইংরাজিতে অনুবাদ করা হয়েছে। তার চিকিৎসা-পদ্ধতির মূল কাঠামো এবং কয়েকটি কেস হিস্ট্রিও লেখা আছে। বৈজ্ঞানিকের বয়স পঁয়ষট্টি, নাম দেখলাম সিগমুণ্ড ফ্রয়েড–চিকিৎসা-পদ্ধতির নাম সাইকোঅ্যানালিসিস। রাত জেগে পড়ে ফেললাম বইটা। স্থির করলাম, চন্দ্রভানই এ পদ্ধতিতে আমার প্রথম রোগী হবে। ফ্রয়েড নামধেয় ডাক্তার সাহেব বলেছেন, মানসিক ব্যাধির মূল মানুষের অবচেতন মনে বাসা বাঁধে। কোন একটা গোপন কামনা তার অন্তস্তল কুরে কুরে খায়। রোগী যদি তার অতীত জীবনের সমস্ত ঘটনা অকপটে কোন বন্ধুর কাছে অথবা ডাক্তারের কাছে খুলে বলতে পারে তাহলে অনেক সময় তার রোগের নিরাময় হয়। সেকথা ফ্রয়েড সাহেবকে বলতে হবে কেন? এ তো আমরাও জানি। মনের ভার নামিয়ে দেওয়ার একমাত্র উপায় কাউকে সব কথা খোলাখুলি বলে ফেলা। এ-ক্ষেত্রে সুবিধা এই-যে ডাক্তার সেই হচ্ছে ওর বাল্যবন্ধু। সুতরাং ও নিশ্চয় নিঃসঙ্কোচে সব কথা বলতে পারবে। আমাকে শুধু ধৈর্য ধরে শুনতে হবে, ওকে উৎসাহিত করতে হবে, আগ্রহ দেখাতে হবে, সহানুভূতি জানাতে হবে।

সূরযভান আমার কাছে দাদাকে বুঝিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্তভাবে ছুটির শেষে তার কর্মস্থলে ফিরে গেল। মাসান্তে সে মনি-অর্ডার করে দাদার সংসার-খরচ পাঠায়। চিকিৎসার যাবতীয় খরচ সে যোগাবে বলে প্রতিশ্রুত হল।

চন্দ্রভানের সঙ্গে নূতন করে বন্ধুত্ব হল। প্রতিদিন সন্ধ্যার পর সে আমার কাছে আসত। তার অতীত জীবনের সমস্ত ঘটনা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বর্ণনা করে যেত। তার গৃহত্যাগের কথা, বাওয়ালীতে আগমন, সেখানে ঊর্মিলা শারদাঁর প্রতি তার আকর্ষণ, তার ধর্মান্তর গ্রহণ। তারপর ধর্মপ্রচারক হিসাবে তার জোড়-জাঙ্গাল কোলিয়ারিতে আবির্ভাব, গীর্জার সংস্কার। যোসেফ মুর্মু-এককড়ি সরখেল–পাঁচু হালদারের দল জীবন্ত হয়ে উঠল আমার কাছে। ফাদার মার্লো, ব্রাদার দাভিদ অথবা নাথানিয়াল সাহেবদের আমি চোখ বুজলেই দেখতে পেতাম। তারপর সে এল পাঁচু হালদারের বোনঝির প্রসঙ্গে। এবার আর আমার নির্বাক শ্রোতা হয়ে থাকা সম্ভবপর হল না। বলি, চিত্রলেখা! কেমন দেখতে মেয়েটা? তার বাপ-মা কোথায় গেল?

চন্দ্রভান জানায়, মেদিনীপুরে বন্যায় এক রাত্রে কিভাবে চিত্রলেখার বাপ-মা-ভাই ভেসে গিয়েছিল। চিত্রলেখার একটা নিখুঁত আলেখ্য আঁকল সে কথার জাল বুনে। একহারা লম্বা ছিপছিপে শ্যামলা মেয়ে, চোখ দুটি উজ্জ্বল, চিবুকটা নিখুঁত। আমি চিনতে পারলাম তাকে। বুঝতে পারি চন্দ্রভান ভুল বলছে দামোদরের জলে ডুবে মরেনি ওর সেই চিত্রলেখা, মরেছে অক্সালিক অ্যাসিড খেয়ে। আমি নিজে হাতে তাকে পুড়িয়েছি কেওড়াতলার শ্মশানঘাটে। সেকথা জানে না চন্দ্রভান। সেকথা আমিও জানাই না। কী লাভ ওকে নতুন করে আঘাত দিয়ে?

চন্দ্রভান বলে, –ঐ জোড়-জাঙ্গাল ছেড়ে আসার সময়েই আমার প্রথমবার অ্যাটাক হয়।

–অ্যাটাক হয়! কিসের অ্যাটাক?

–পাগলামির। একটা খণ্ডমুহূর্তে আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলাম। আমি কী করছি তা আমি জানতাম না। সেই মুহূর্তে আমার মনে হয়েছিল আমার ডান হাতখানা বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, তাকে শাস্তি দিতে হবে। কঠিন শাস্তি দিয়েছিলাম হাতটাকে। এই দেখ–সে প্রায়শ্চিত্ত আমার আজীবনের সঙ্গী হয়ে আছে।

ডান হাতখানা আলোর সামনে মেলে ধরে সে। হাতের তালুতে প্রকাণ্ড একটা পোড়া দাগ। বিধাতা ওর হাতে আয়ু-রেখা, ভাগ্য-রেখা, যশ-রেখা কী লিখেছিলেন তা আর কোনদিন পড়া যাবে না। বিধাতার দেওয়া সে হস্তরেখার সমস্ত চিহ্ন চন্দ্রভান পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে। বিধাতাকে সে মানে না। বিধাতার দেওয়া হস্তরেখার নির্দেশও সে মানবে না। সে আপন দুর্ভাগ্য আপনি গড়ে তুলেছে অতঃপর। বললে, মোমবাতির শিখায় আধ মিনিট হাতখানা কেমন করে ধরে রেখেছিলাম আজও ভেবে পাই না! কিন্তু যতদূর মনে আছে আমি তখন একতিলও কপিনি, যন্ত্রণায় একটি আর্তনাদও করিনি! আমি ঐ এক মিনিট ধরে পাগল হয়ে গিয়েছিলাম।

এবার যে আমার পাগল হওয়ার পালা! ওর সে পাগলামির বর্ণনা শুনে মুহূর্তে আমার চোখের উপর থেকে একটা পর্দা সরে গেল। বহুদিনের একটা সমস্যার সমাধান হয়ে গেল। বটুক বলেছিল বটে–যীশুখ্রীষ্টের ডান হাতের তালুতে পেরেকের দাগটার বিষয়ে সুলেখার মনে একটা অবসেশান ছি। বটুকের ডান হাতের তালুতে একবার সামান্য একটু কেটে যাওয়ায় ফিট হয়ে গিয়েছিল সুলেখা। মনে পড়ল শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালের সেই নার্সটির কথাসুলেখার মূৰ্ছিত দেহের কাছে কোন প্রদীপ জ্বলছিল না। তবু তার হাতে একটা ফোস্কা হয়েছিল। চিত্রলেখা কি মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তে চন্দ্রভানের যন্ত্রণার অনুভূতিটাকে হাত বাড়িয়ে ধরতে চেয়েছিল?

জোড়-জাঙ্গাল কলিয়ারি ছেড়ে আসার পরের ইতিহাসটা এবার সে বলতে শুরু করে।

সূরযভান তখন কলকাতার একটি মেসে থাকে। মাত্র উনিশ কুড়ি বছর বয়স তখন তার। সবে চাকরিতে ঢুকেছে ম্যাট্রিক পাস করে। মেসে দাদাকে এনে তুলতে পারল না। বাধা ছিল। চন্দ্রভান খ্রীষ্টান, মেসবাবুরা সবাই হিন্দু। বাধ্য হয়ে চন্দ্রভান একটি ঘর ভাড়া নিল। প্রতিদিন অফিস ছুটির পর সূরয এসে দাদার খবরদারি করত। ক্রমে ওর হাতের

ঘা সারল। চন্দ্রভান লেগে থাকল তার ছবি আঁকার সঙ্কল্পে। সূরয ছবির কিছুই বোঝে। না; কিন্তু ওর দৃঢ় ধারণা দাদার ছবি একদিন না একদিন সমাদর পাবেই। এর কিছুদিন পর সূরয বদলি হয়ে গেল দিল্লীতে। একা পড়ে গেল চন্দ্রভান। দিনরাত সে ছবি এঁকে বেড়ায়। ঘরেবাইরে। দুজনের সঙ্গে তার পত্রালাপ চলত। চিঠি যেত দিল্লী-মুখো আর আসানসোল-মুখো। জবাব আসত সূরযের কাছ থেকে, আসত দেবনারায়ণবাবুর কাছ থেকে। সূরয অন্ধ বিশ্বাসে ওকে উৎসাহ যোগাতো, আর দেবনারায়ণবাবু ওকে যে। আশীর্বাদ করতেন তার পিছনে থাকত দক্ষ শিল্পীর ধ্যান-ধারণা।

ল্যাণ্ড স্কেপ আর স্টিল-লাইফ আঁকার দিকে ঝোঁক। মানুষজনের কিছু কিছু স্কেচ করেছে, পেনসিলে বা ক্রেয়নে। পোর্ট্রেট আঁকবার সুযোগ কই? কে ওর জন্য ধৈর্য ধরে সময় নষ্ট করবে? জোড়-জাঙ্গালের মালকাটারা তবু ওর খেয়াল চরিতার্থ করবার সুযোগ দিত। হাজার হোক সে ওদের ফাদারদা। কলকাতা শহর সে হিসাবে নিতান্ত উদাসীন। কাজের চাকায় বাঁধা এর লক্ষ বাসিন্দা।

এই সময় আরও একটা ধারণা অঙ্কুরিত হয়ে ওঠে শিল্পীর মনে। তার মনে হত যে জগন্টা সে দেখতে পাচ্ছে সেটা সত্য নয়। এ যেন প্রেক্ষাগৃহের সামনে প্রলম্বিত একটা প্রকাণ্ড যবনিকা। রূপরস-শব্দ-গন্ধ-স্পর্শের চিত্র বিচিত্র করা ঐ পর্দাটা টাঙানো আছে চোখের সামনে, কারণ দর্শকদের কে যেন আড়াল করে রাখতে চায় ভিতরের গোপন আয়োজন থেকে। ঐ পর্দাটা যখন উঠে যাবে তখন শুরু হবে আসল অভিনয়। ভিন্সেন্ট তার ক্যানভাসে পথ-ঘাট, গাছ-পালা আঁকে কিন্তু তার মন ভরে না; তার মনে হয়–এহ বাহ্য। ঐ পথ যেন কী একটা কথা বলতে চায়, ঐ গাছ যেন তার প্রাণের কথা শোনাতে চায়—-ঐ বর্ষণোম্মুখ মেঘ, ঐ সান্ধ্য আকাশের অস্তরবিচ্ছটার যেন আরও কিছু বক্তব্য আছে কিন্তু তারা সে কথা বলতে পারছে না। ওর ক্যানভাসে সেই গোপন কথা ফুটে উঠছে না। দৃশ্যমান জগতের অন্তরের নিবিড় বাণী যদি তার ক্যানভাস মূর্ত না হয়ে ওঠে তবে আর কী ছবি আঁকল সে? সেটা তো ফটোগ্রাফ।

আর সৃষ্টির সবচেয়ে বড় রহস্য-মানুষ! তার সামনে যে আবার ডবল পদা! সে কথা বলে মনের ভাব ব্যক্ত করতে নয়, গোপন করতে! সে হাসে কান্না লুকোতে! সে কাঁদে-ধরা পড়ে যাবার ভয়! তার উপর সে চড়িয়েছে আবরণ। শুধু মন নয়, দেহের উপরেও টেনে দিয়েছে পর্দা! ভিন্সেন্ট ঈশ্বরে বিশ্বাস হারিয়েছে কিন্তু বাইবেল বর্ণিত ঈশ্বর ও-ভুল করেননি। তিনি আদিম আদম আর ঈভকে অনাবৃত রেখেছিলেন। তাই রেনেসাঁস যুগের শিল্প-ঋষির দল টেনে খুলে ফেলেছিলেন ঐ নির্মোক!

চন্দ্রভান স্থির করল–তাকে ন্যুড স্টাডি করতে হবে।

 কিন্তু কে সিটিং দেবে? কে বসবে ঐ নিলজ্জ ভঙ্গিতে?

রঙ-তুলি ক্যানভাস নিয়ে চন্দ্রভান অবশেষে অবতীর্ণ হল রূপোপজীবিনীদের পাড়ায়।

দুঃসাহস বলতে হবে। কিন্তু দুঃসাহসে ভিন্সেন্ট কোনদিনই বা পিছ-পাও হয়েছে? সে নীতি মানে না, ধর্ম মানে না, ঈশ্বর মানে না। মানে বিবেক। সেই বিবেকের নির্দেশে সে এসে হাজির হল দেহের তীর্থে!

পাৎলুন আর হাফসার্ট পরা অদ্ভুতদর্শন মানুষটাকে দেখে খিল খিল করে হেসে উঠেছিল ওরা। সরু গলি। আধো-আলো আধো-অন্ধকার। ডিমের ডালনা না কঁকড়ার তরকারি কিসের একটা উৎকট রসুন-মিশ্রিত গন্ধের সঙ্গে মিশেছে বেলফুলের সৌরভ। খোলা দরজার ওপাশে একটা জোরালো বাতি–তারই এক প্রস্থ আলো আছাড় খেয়ে পড়েছে গলি-পথটায়। নেপথ্যে হারমনিয়াম তবলা সহযোগে ভেসে আসছে আবহ গজল। দেওয়াল-সেঁটে দাঁড়িয়ে আছে সাত-আটটি মেয়ে। মাথায় বেলফুলের মালা, চোখে কাজলচড়া রঙের রুজ মেখেছে গালে। কপালে কাঁচ পোকার টিপ। সদর। দ্বারের কাছে ঐ খোঁচাখোঁচা দাড়িওয়ালা বিচিত্র জীবটাকে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়তে দেখে ওরা এ-ওর গায়ে লুটিয়ে পড়ে হাসতে হাসতে। কে একজন বলে, কি গো ভাল মানুষের পো? ভির্মি যাবে নাকি?

পিছন থেকে বর্ষীয়সী একজন স্থূলকায়া রমণী ওদের ধমক দিয়ে ওঠে, কী ছেনালি করিস তোরা? আসতে দে না ওরে! পথ আটকে আছিস কেন?

সামনের মুখরা মেয়েটি বলে ওঠে, –ওমা, কি যে বল মাসি? পথ আটকাবো কোন্ দুঃখে গো? কারে নজরে ধরল তা তো ও বলবে? না কি ও তোমার কাছেই যেতে চায়?

আবার খিল্ খিল্ হাসি।

ভিন্সেন্ট অপ্রস্তুত হয়নি মোটেই। ইতিমধ্যে তার নজর পড়েছিল আর একদিকে। ভীড়ের পিছনে দেওয়াল-সেঁটে দাঁড়িয়ে আছে একটি মেয়ে। মধ্যবয়স্কা। উৎকট প্রসাধন করেছে সে। কুচকুচে কালো গায়ের রঙ। কিন্তু মেয়েটি মাতৃত্বের ভারে আনত! ভিন্সেন্ট তৎক্ষণাৎ মনস্থির করে ফেলে। জীবন রহস্যের মর্ম উদ্ঘাটনে সে অভিযাত্রী-আর জীবন-রহস্যের মূল তো সৃষ্টিতত্ত্বে! এই পঙ্কিল দুনিয়ার পঙ্কিলতম অন্ধকারে পিতৃ পরিচয়হীন যে শিশু আবির্ভাবের জন্য প্রহর গুনছে-আঁকতে হয় তারই মায়ের ছবি আঁকবে ভিন্সেন্ট! ঐ অনাগত শিশুর সম্মুখেও মাতৃজঠরের আবরণ–কিন্তু নিরাবরণ জননীতত্ত্বের ছবিই বা কে কবে এঁকেছে? ভিন্সেন্ট মনে মনে তার চিত্র-অভিজ্ঞতার পাতা উল্টে যায়। প্রাচ্য বা প্রতীচ্য–কে কবে নিরাবরণা মাতৃত্বের ছবি এঁকেছে? ন্যুড স্টাডি হাজার বছর ধরে করেছে শিল্পীদল; কিন্তু সেখানে বিষয়বস্তু নারী, জননী নয়! কেন? শিল্পীর চক্ষে কি এতাবৎকাল স্ফীতোদর জননীর চিত্রটা সুন্দর মনে হয়নি? সত্য কি সুন্দর নয়? সৃষ্টিই কি সত্য নয়? সুন্দর নয়? মুহূর্তমধ্যে মনস্থির করে ভিন্সেন্ট; ভীড় ডিঙিয়ে ঐ মেয়েটিকে প্রশ্ন করে, তোমার ঘর কোষ্টা?

-ওমা আমি কোথায় যাব! তা হ্যাঁগা ভাল্ মানুষের পো! ওর মুখখানাই শুধু দেখলে তুমি-কেঁচড়ে যে মুড়ির মোয়র পুঁটুলি বেঁধেছে সেটা নজর হল নি?

–তুই চুপ যা দেখি চামেলি! ধমকে ওঠে বর্ষীয়সী বাড়ি-উলি। এগিয়ে এসে সে

ভিন্সেন্টের হাতখানা ধরে, বলে, তুমি ভিতরে এস বাছা; নইলে অরা তোমারে ছিঁড়ে খাবে!

ভিন্সেন্টকে বাড়িউলি মাসি হাত ধরে ভিতরে নিয়ে যায়। তাকে বসিয়ে দেয় একটা ঘরে। এটা বোধহয় মাসির নিজস্ব ঘর। বলে, -কিছু মনে কর না ভাই। নতুন যারা আসে তাদের নিয়ে ওরা এমনি মস্করা করে। কিন্তু তাও বলি ভাই তুমি ঠিক বুদ্ধির পরিচয় দাওনি।

তারপর মুখটা কানের কাছে এনে বলে, বুঝতে পারনি তুমি? ওর বাচ্চা হবে!

–তাহলে ওখানে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলে কেন?

–কোথায় যাবে বল ভাই? ঐ তো, এক অন্ধকূপ কুটুরি! সাঁঝের বেলা একটু নিঃশ্বাস নিতে দাঁড়ায় ওখানে! ও কি এখন তোক বসাতে পারে?

ভিন্সেন্ট কি একটা কথা বলতে যায়; কিন্তু তার আগেই দ্বারের কাছে এসে কে। ডাকে, মাসি!

-কি রে?

মাসি দ্বারের কাছে সরে আসে। আগন্তুক সেই আসন্নজননী মেয়েটি। সে নিম্নস্বরে কি বললে তা শোনা গেল না; কিন্তু মাসির আপত্তিটা শোনা গেল। মাসি কিছুতেই রাজী হতে চায় না। শেষ পর্যন্ত সে হাল ছেড়ে দিয়ে ফিরে আসে। ভিন্সেন্টকে বলে, কি জানি বাপু! ও আবাগিরও দেখি তোমারে মনে ধরেছে। তা বেশ। তিন টাকা লাগবে বাপু। দু-ট্যাকা অর, এক টাকা আমার! প্রথম দিন, কম করেই ধরলাম। আর শোনো

মুখটা কানের কাছে এনে ভিন্সেন্টকে একটু সাবধান করে দেয়। দু-একটা উপদেশ দেয়। ভিন্সেন্টের খরগোশের মত খাড়া কান দুটো লাল হয়ে ওঠে।

ছোট্ট ঘর। সেখানে ঘর জোড়া চৌকি। পরিষ্কার বিছানা পাতা তাতে। নরম গদি। দুটি বালিশ। দেওয়ালে কালীঘাটের একটি পট। অন্নপূর্ণা ভিক্ষা দিচ্ছেন ভোলানাথকে। কুলুঙ্গিতে একটি লক্ষ্মীর পট। কাল বৃহস্পতিবার গেছে। ফুলের মালাটা পটের উপর এখনও শুকিয়ে যায়নি। দেওয়ালে টাঙানো একটা হাত-আয়না। কোণায় একটা হাতলহীন চেয়ার। ভিন্সেন্ট চেয়ারে গিয়ে বসল। মেয়েটিও ঢুকেছে ঘরে।

ভিন্সেন্ট তখনও মুখ তুলে মেয়েটিকে ভাল করে দেখেনি। কাঁধের ঝোলা ব্যাগ। থেকে সে রঙ-তুলি ক্যানভাস বার করতে থাকে। ঘরে আলো বড় কম। বললে, একটা ভাল লণ্ঠন আনতে পার?

মেয়েটি নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল এবং একটা লণ্ঠন এনে নামিয়ে রাখে মেঝেতে। ভিন্সেন্ট সেটা ঠিক করে বসিয়ে দিল। মেয়েটি দরজাটায় খিল এঁটে চুপচাপ গিয়ে বসল খাটের উপর। এবার মুখ তুলে ভিন্সেন্ট দেখে মেয়েটি ওকে অবাক দৃষ্টিতে দেখছে! চোখাচোখি হতেই চমকে ওঠে ভিন্সেন্ট। ঐ রূপোপজীবিনীকে সে আগে কখনও দেখেছে? চেনা চেনা লাগছে কেন ওকে? না! মেয়েটি তার পূর্ব-পরিচিত হতেই পারে না। এ পাড়ায় সে কখনও আসেনি। কত বয়স হবে ওর। উত্তীর্ণ-যৌবনা বলা যায় না। তাকে। কুচকুচে কালো গায়ের রঙ। মুখে বসন্তের দাগ। মাথায় বেলফুল জড়ানো। খোঁপা। গায়ে সস্তা ব্রোকেডের জ্যাকেট। পরনে হলুদ রঙের তাঁতের শাড়ি। দু-হাতে দুটি গিল্টি করা বালা, কানে পিতলের ঝুমকো দুল।

ভিন্সেন্ট হঠাৎ বলে বসে, –একটা কথা জিজ্ঞাসা করা হয়নি। কতক্ষণ থাকতে দেবে আমাকে?

মেয়েটি মুখ নিচু করে বলে, আপনার যতক্ষণ ইচ্ছে। ভাল লাগলি তামাম রাত!

-ও আচ্ছা! তবে তাড়াহুড়ো করার কিছু নেই। শোন আমি তোমাকে কোন কষ্ট দেব না। তুমি খাটে শুয়ে থাকবে, আমি তোমার একখানা ছবি আঁকব শুধু। যে ভঙ্গিতে অনেকক্ষণ শুয়ে থাকতে তোমার অসুবিধে হবে না সেভাবে শুয়ে পড়।

মেয়েটি বোধহয় ওর কথাগুলো ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। সে ডাগর চোখ মেলে শুধু তাকিয়েই থাকে।

কী আশ্চর্য! ওকে এত চেনা-চেনা লাগছে কেন? ঐ রকম মুখ সে কোথায় দেখেছে? বত্তিচেল্লি-পেরুজিনোকরেজজো? না হোলবাইন ব্ৰখেল-ফ্র্যাঞ্জ হ্যাঁলস? না কি আরও পরের যুগের দেলাক্রোয়ে-মানে-এগার-দেগা-রেনোয়? কোন এক দিকপাল শিল্পী নিশ্চয় ঐ রকম একখানা মুখের ছবি এঁকেছিলেন–সেই ছবি-দেখার স্মৃতিটাই ওকে এই বিভ্রমের মধ্যে ফেলছে–মনে হচ্ছে ওকে আগেও দেখেছি।

–ছবি আঁকবেন? অস্ফুটে প্রশ্ন করে মেয়েটি।

 বেশ্যাপল্লীতেও ভদ্রতার এই রীতি নাকি? দেহদানের পূর্ব মুহূর্তেও অপরিচিত পুরুষকে আপনি সম্বোধন!

–হ্যাঁ। শুয়ে পড় তুমি। ছবিই আঁকব তোমার।

তারপর ইতস্তত করে বলে, -ভেবেছিলাম ন্যুড-স্টাডি করব; কিন্তু থাক, তোমার অসুবিধা হবে।

-কি করবেন?

 –ও কিছু নয়, থাক।

 –শুব?

–হ্যাঁ, তাই তো বলছি তখন থেকে।

জামা কাপড় খুলবনি?

খুলবে? বেশ, তাই কর।

চেয়ারটা অন্যদিকে সরিয়ে ভিন্সেন্ট দেওয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে বসে। উপায় নেই। এতটুকু ঘরে স্থানান্তরে সে যাবে কোথায়? কোন ভদ্রমহিলা বেশ পরিবর্তন করতে চাইলে যেটুকু শালীনতা বজায় রাখতে হয় সেটুকু রাখতেই বেচারির কপালে ঘাম ফুটে ওঠে।

দীর্ঘ তিন ঘন্টা ধরে পোর্ট্রেটখানা আঁকল ভিন্সেন্ট। মেয়েটি ওর দিকে ফিরেই শুয়েছিল। হাতখানা আলো আড়াল করতে রেখেছিল চোখের উপর। ভিন্সেন্ট ছবি আঁকে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে। ঘন্টা তিনেক পরে ও বললে অনেক কষ্ট দিলাম তোমাকে। এবার জামা কাপড় পরে নাও। আমার ছবি শেষ হয়ে গেছে।

আবার পিছন ফিরে বসে। মেয়েটি তার পরিধেয় বস্ত্রটা গায়ে জড়িয়ে নিয়ে বলে, — ই- চায় আপনি এই পেরথম আসিছেন, লয়?

ভিন্সেন্ট জবাব দেয় না। পকেট থেকে তিনটি টাকা বার করে সে রাখে খাটের উপর। বলে, -এবার যাই আমি?

মেয়েটি চট করে উঠে দাঁড়ায়। ভিন্সেন্টের হাতখানা চেপে ধরে। গুঁজে দেয় টাকা তিনটে। সে নেবে না ওর দান। ভিন্সেন্ট চমকে ওঠে। এতক্ষণ স্পর্শ বাঁচিয়ে চলছিল সে। হাতখানা চেপে ধরায় বিব্রত বোধ করে। হাতটা ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করে; কিন্তু মেয়েটি দৃঢ়মুষ্টিতে ধরে রাখে তাকে। বলে, -হাই বাবা গ! তুমি আমারে চিনতে লারলেক ফাদারদা?

অবাক বিস্ময়ে এবার তাকিয়ে থাকে ভিন্সেন্ট। বিস্মৃতির যবনিকা উঠে যায় তার চোখের উপর থেকে। কী আশ্চর্য! একে চিনতে পারেনি সে? বলে, তুই? বাতাসী?

বারবনিতারও, তা হলে লজ্জা থাকে? দু হাতে মুখ ঢেকে বাতাসী বলে, হাই!

তুই এখানে কেমন করে এলি? মুখে ওসব কি দাগ? বসন্ত হয়েছিল তোর? এ কী চেহারা করেছিস?

বাতাসী ওকে ছাড়ে না। অনেক, অনেক কথা জমে আছে ওর পেটে। ভিন্সেন্ট জোড়-জাঙাল কোলিয়ারি ছেড়ে আসার পর কত কথা! দূরন্ত মারীরোগে মরতে বসেছিল সে। কিন্তু যম তাকে নিল নাফিরিয়ে দিল। মরল মুর্মুর মেয়েটা। মুখে বিশ্রী দাগ, চুল উঠে গেছে। বাতাসী উঠে বসল অসুখ থেকে কিন্তু জোড়-জাঙালে তার মন বসল না। নানুক চলে গেছে। যোসেফের মেয়েটাও থাকল না। শুনল তাদের ফাদারদাও কোথায় চলে গেছে। আর চ্যাতরা দিদিমণি? সেও ডুবে মরেছে। দামোদর খেয়েছে তার বাপকে, মাকে, ভাইকে। সেই দামোদরই জুড়িয়েছে চ্যাতরা দিদিমণির জ্বালা। তারপর অনেক ঘাট ঘুরে বাতাসী এসে পড়েছে এখানে। মাসি তাকে ঠাই দিয়েছে। তার উপার্জনের এক-তৃতীয়াংশ চুক্তিতে তাকে খেতে দেয়, পরতে দেয়, থাকতে দেয়। কত মানুষ দেখেছে বাতাসীকত বিচিত্র মানুষ। গরীব গুর্বো, হঠাৎ বড়লোক, বাবু মশাইরা বাঙালি বিহারী-মাড়োয়ারী, মায় কাবুলিওয়ালা! বহুভোগ্যা বাতাসী আজও বেঁচে আছে। বসন্তের দাগ? ওসব ওরা দেখে না। ওরা যা চায় তার সম্বল আজও নিঃস্ব হয়ে যায়নি বাতাসীর। যেদিন তা ফুরাবে? সেদিন ভিক্ষে করতে বসবে।

সেরাত্রে ভিন্সেন্ট আর বাড়ি ফেরেনি। সারা রাত ছিল ওখানে।

তার পর থেকে সে প্রায়ই যেত ওখানে। বাতাসীর কাছে। ওর ভাল লাগত বাতাসীকে। অন্তত কথা বলার লোক তো পেল এতদিনে। মাঝে মাঝে খরচ করতে হত–না হলে মাসির রসনা মুখর হয়ে উঠবে। ভিন্সেন্ট বাতাসীর অনেক ছবি আঁকল। কিন্তু শুধু ছবি এঁকে ওর তৃপ্তি নেই। নতুন চিন্তা ঢুকেছে তার মাথায়। এভাবে বাতাসীকে সে মরতে দেবে না।

বাতাসী রাজী হয়ে গেল। মাসির সঙ্গে তুমুল ঝগড়া করে একদিন বের হয়ে এল ঐ নরককুণ্ড থেকে। এসে উঠল ভিন্সেন্টের এক কামরার ঘরে। নৃতন পরীক্ষায় মেতেছে। ভিন্সেন্ট। মাসান্তে সে যে কটা টাকা পায়, সমঝে চললে তা থেকে দুজনে আধ-পেঠা খেয়ে বাঁচতে পারে। তারপর যদি দু-একখানা ছবি বেচতে পারে তখন আর তাকে পায় কে? সংসারধর্ম তার পক্ষে সম্ভবপর নয়। বাতাসীই তার সহধর্মিণী। বাতাসী তাকে বুঝেছে। তাকে স্নেহের চোখে, শ্রদ্ধার চোখে দেখেছে। বাতাসী রান্না করতে পারে, ঘরদোর গুছিয়ে রাখতে জানে। ওর এক কামরার গৃহস্থালী নৃতন রূপ নিল। প্রতিবেশীরা সব সাড়ে বত্রিশ ভাজা। রিকসা-আলা ঠেলাওয়ালা ভাজিওয়ালা। তারা নাক গলাতে এল না। বাতাসী হল এ গৃহের ঘরণী। সমস্ত কথা খোলাখুলি লিখে জানালো সূরযকে। সে যখন চিঠির জবাব দিল তখন এ-প্রসঙ্গের উচ্চবাচ্য পর্যন্ত করল না।

বাতাসীর মাসির পরামর্শ ছিল বাচ্চাটাকে পৃথিবীর মুখ দেখতে না দেওয়া; কিন্তু ভিন্সেন্ট কিছুতেই রাজী হল না। পাখি-পড়া করে সে বাতাসীকে বোঝালো। শেষে বাতাসী রাজী হল ডাক্তারের কাছে যেতে। ঐ সময়েই সে দীপু-ডাক্তারের কাছে আসে। কিন্তু ওর বাল্যবন্ধুও ওকে দরজা থেকে হাঁকিয়ে দিল। তা দিকজাগতিক বিধান কারও নীতিবাক্যে থেমে থাকে না। যথাসময়ে বাতাসীর একটি কন্যাসন্তান হয়েছিল। ভিন্সেন্টের সে কী আনন্দ। কে মেয়ের বাপ তা বাতাসী জানে না। কিন্তু পিতৃপরিচয়হীন অনেক মহাপুরুষই তো অক্ষয় কীর্তি রেখে গেছেন দুনিয়ায়। ভিন্সেন্টই বেশি মাতাল মেয়েকে নিয়ে। 

একেবারে নির্ভেজাল আনন্দ কিছু নেই এ দুনিয়ায়। দেবনারায়ণবাবু ওর সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করলেন। তিনি কি কারণে কলকাতায় এসেছিলেন। ঠিকানা খুঁজে ভিন্সেন্টের বাসায় এসে মর্মাহত হয়েছিলেন। ভিন্সেন্ট মিথ্যার আশ্রয় নিতে পারেনি। স্বীকার করেছিল, বাতাসী তার বিবাহিতা স্ত্রী নয়। দেবনারায়ণবাবু তৎক্ষণাৎ চলে গিয়েছিলেন। ত্যাগ করেছিলেন শিষ্যকে।

সূরযভান কিন্তু ওকে ত্যাগ করেনি। প্রতি মাসে দাদাকে মনিঅর্ডার করে গেছে। জানতে চেয়েছে সে নূতন কি আঁকল। সকল আঘাত সইতে প্রস্তুত ছিল ভিন্সেন্ট। বাতাসীকে সে বিবাহ করতে চেয়েছিল। রাজী হয়নি বাতাসী। বলে কী বুলছিস রে তুই? বেবুশ্যের কি বিয়া হয়?

কে বোঝাবে ওকে? ভিন্সেন্ট অনেক কথা বলেছে। সমাজতত্ত্বের কথা, দেশ বিদেশের নরনারীর সম্পর্কের কথা, দেশাচার ভেদে বিবাহের নিয়মাবলী কেমনভাবে বদলায়; কিন্তু বাতাসী ওসব কথায় কর্ণপাত করে না। বলে, –তু কি পাগল হয়ে গেলি ফাদারদা? চ্যাহ্বা দিদিমণি তুরে কেনে বিয়া করতে লারলেক, সি কথাটো বুঝা মোরে।

বিচিত্র যুক্তি বাতাসীর। চ্যাতরা দিদিমণি লেখাপড়াজানা ভদ্র ঘরের মেয়ে। এমন অশুচি অবস্থায় বিবাহ যদি বিধিসম্মত হত তা হলে কেন চ্যারা দামোদরে ডুবে মরতে যাবে? ফাদারদা তো তাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল। চ্যাতরা দিদিমণি যে ফাদারদাকে। ভালবেসেছিল এটুকুও কি বোঝেনি বাতাসী? তাহলে? বাধা তো ঐখানে। ফাদারদা আর চ্যাতরা দিদিমণির মাঝখানে সেদিন মূর্তিমান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল লম্পট নাথানিয়েল। এই যদি সত্য হয়, তাহলে এবার? ঐ ফাদারদা আর বাতাসীর মাঝখানে আছে কয়েকশ মূর্তিমান বাধা বিভিন্ন দেশের, বিভিন্ন জাতের। বাঙালি বিহারী-মারোয়াড়ী-পাঞ্জাবী, মায় কাবুলিওয়ালা। না, না, ছি ছি!

ঈশ্বর না মানো, নাই মানলে–একটা কিছু মানতে হবেই। তাকে ভাগ্যই বল, নিয়তিই বল, আর যাই বল। না হলে চন্দ্রভানের পিছনে অতন্দ্রভাবে কে এমন করে লেগে আছে? সে যা কিছুতে হাত দেয় তাই ছাই হয়ে যায়। সারা জীবনে কোথাও সে সফল হতে পারল না। বাতাসীকে নিয়ে এই অদ্ভুত পরীক্ষাতেও শেষ পর্যন্ত হার স্বীকার করতে হল তাকে। কী আশ্চর্য! কী অপরিসীম আশ্চর্য! বাতাসী এখানে টিকতে পারল না। ভিন্সেন্টের অভাবের সংসারনুন আনতে পান্তা ফুরায়; কিন্তু বাতাসী কিছু রূপার চামচ-মুখে জন্মায়নি। অভাব কাকে বলে বাতাসী তা ভাল মতই জানে। সেজন্য তো নয়। তাহলে কেন? বোধহয় অমিতাচারেই বাতাসী অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল-সাত্ত্বিক জীবনযাত্রা সহ্য হল না তার।

প্রথম প্রথম এ-পাড়ায় এসে বাতাসী আদপেই বাড়ির বার হতে চাইত না। নেহাৎ পথে নামতে হলে একগলা ঘোমটা দিত। তার জীবনে যে অসংখ্য পুরুষ এসেছে। তাদের কাছ থেকে ও আত্মগোপন করতে চাইত। পথে-ঘাটে কেউ যেন না হঠাৎ বলে বসে, -আরে, বাতাসী যে!

কিন্তু শেষদিকে সে বেপরোয়া হয়ে পড়ল। ভিন্সেন্ট বেরিয়ে গেলে মেয়ে কোলে নিয়ে সেও কোথায় বেরিয়ে যেত। ভিন্সেন্ট টের পেত, প্রশ্ন করত কিন্তু বাতাসী কোথায় যায় তা বলে না। একদিন ভিন্সেন্ট বলে বসল, তুমি কি মদের নেশায় বাড়ির বাইরে যাও বাতাসী? তার প্রয়োজন কি? তুমি বাড়িতে বসেই খেও!

–ঈ বাবা গ! কী বলছিস্ তু? মদ আমি খাই না গ!

ডাহা মিথ্যে কথা। জোড়-জাঙালেও বাতাসী হাঁড়িয়া খেত, বেশ্যাপল্লীতেও নিশ্চয় খেয়েছে। অথচ এখন এমন ভাব দেখাচ্ছে যেন মদ কাকে বলে সে জানেই না!

বাতাসী যে কোথায় যায় তা টের পাওয়া গেল অচিরেই। একদিন সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে এসে ভিন্সেন্ট দেখে বাড়িউলি বসে আছে তার ঘরে। বাতাসী স্টোভে খাবার করছে। সুজির মোহনভোগ। বাতাসী পয়সা পেল কোথায়? না কি মাসিই সুজি আর চিনি কিনে দিয়েছে? ভিন্সেন্টের মুখটা কালো হয়ে ওঠে। বাতাসী যদি তার ঐ জীবনকে একেবারে না মুছে ফেলতে পারে তবে কোনদিনই তার পরীক্ষা সাফল্যলাভ করবে না।

–এস জামাই। বস। আহা, সারাদিনমানে মুখখানা যে রাঙা হয়ে গেছে গো!

ভিন্সেন্ট জবাব দেয় না। খুকিকে কোলে তুলে নিয়ে পার্কের দিকে চলে যায়।

এই নিয়েই বিবাদ। ভিন্সেন্টের স্পষ্ট নিষেধ সত্ত্বেও মাসি এ বাড়িতে ঘন-ঘন আসতে। শুরু করল। শেষে সে অন্য কাউকে সঙ্গে নিয়ে আসা আরম্ভ করে। কখনও ময়না, কখনও চাপা, কখনও পদ্ম। ভিন্সেন্ট ওদের চেনে। সে মনে মনে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এটা ভদ্রপল্লী। বাতাসীর বিষয়ে কেউ কৌতূহলী হয়নি। তার সাজ-পোশাক সে পাটে ফেলেছিল এ পাড়ায় এসে; কিন্তু ওদের যে দেখলেই চেনা যায়!

ভিন্সেন্ট বাতাসীকে বললে, -তুমি কি চাও স্পষ্ট করে বল তো? আমি কিন্তু বেঁধে। রাখিনি তোমাকে। এখানে যদি ভাল না লাগে তুমি সোজাসুজি ও পাড়ায় চলে যাও। এ রকম দু-নৌকোয় পা দিয়ে চলতে পারবে না।

-কী করলাম আমি? হাই বাবা গ! ধমকাইছ কেনে?

–তোমাকে বারণ করেছি তবু তুমি ওদের এখানে কেন নিয়ে আসছ?

–উরা আমারে এত বছর খাওয়াইলেক, দেখভাল করলেক, সিটি কি ভুলি যাব?

–হ্যাঁ, ভুলে যাবে। ওরা খেতে দিয়েছে, পরতে দিয়েছে–তুমিও গতরে খেটে শোধ দিয়েছ। সে সব চুকেবুকে গেছে। আর ভুলতে যদি না পার তো স্পষ্টাস্পষ্টি সেখানে চলে যাও। এ অধ্যায়টা ভুলে যেও।

–আমারে তাড়াই দিছিস ফাদারদা?

 হঠাৎ চমকে ওঠে ভিন্সেন্ট ওর সম্বোধনে। তাই তো! ও এখনও বাতাসীর ফাদারদা। দেড় বছর সে বাতাসীর সঙ্গে ঘর করছে–তবু সে আজও আছে তার সম্মানের উচ্চ আসনে। এক ঘরে দুজনে রাত কাটায়। বাতাসীর একাধিক ন্যুড স্টাডি এঁকেছে সে–তবু বাতাসীর চোখে আজও ভিন্সেন্টফাদারদা! ফাদার অথবা দাদা!

কথা বলছিস না কেনে রে, তাড়ায়ে দিছিস?

তাড়িয়ে আমি দিচ্ছি না, তুই আমাকে ছেড়ে যাচ্ছিস বাতাসী?

এবার ঝর ঝর করে কেঁদে ফেললে প্রায়-প্রৌঢ় বাতাসী। ভিন্সেন্ট কি বুঝবে বাতাসীর যন্ত্রণা? আপনভোলা উদাসীন মানুষটার সংসারের কোন খোঁজ রাখে? সব কিছু বাতাসীর হাতে তুলে দিয়ে সে নিশ্চিন্ত হয়েছে। এতদিন ধরে সে মেতে আছে তার রঙ-তুলি নিয়ে। সারাটা দিনভর বাইরে বাইরে ছবি এঁকে বেড়ায়, ঘরে ফিরলে মেয়েকে নিয়ে পড়ে। এক বছরের মেয়েটার সঙ্গে তখন তার কত গল্প, কত আলাপ! কিন্তু বাতাসী? তাকে এই হালভাঙা পালছেঁড়া নৌকোটাকে বেয়ে নিয়ে যেতে হয় এক মাস পয়লার ঘাট থেকে পরের মাসের মাস-পয়লায়। সূরযভানের মাসিক বরাদ্দ আছে অপরিবর্তিত। অথচ সংসারে মানুষ এক থেকে দুই হল, তারপর দুই থেকে আড়াই। কিন্তু বাঁধা বরাদ্দ অপরিবর্তিত। একদিকে এই অবস্থা, অপরদিকে বাড়িউলি মাসির ক্রমাগত প্রলোডন! আকৈশোর যে-জীবনে সে অভ্যস্ত হয়ে আছে সেই জীবনের ডাক শুনতে পেত-চামেলি, চাপা, ময়নাদের কণ্ঠে! মনকে শক্ত করত বাতাসী–না, সে ঐ জীবনে আর ফিরে যাবে না। কিন্তু মন কি কারও পোষা পাখী? আর পাখীও তে শিকল কেটে পালায়? ভিন্সেন্টের চোখ এড়িয়ে দু-পাঁচ টাকা রোজগার শুরু করতে বাধ্য হল বাতাসী। না হলে তিনজনকেই উপোস করে থাকতে হত! এমন সরল আত্মভোলা মানুষটা-সে ভেবে দেখল না, কিভাবে সংসারটা চলছে!

আকৈশোর পুরুষের সোহাগ পেয়েছে বাতাসী–কিন্তু সত্যিকারের স্নেহ ভালবাসা কাকে বলে তা জানত না। সে অভিজ্ঞতাটাই কি কম? একটা আত্মভোলা মানুষের জন্য ঘুম-ঘুম চোখে ভাত আগলে বসে থাকার যে আনন্দ সেটা সে কবে পেয়েছে? নিজের পাতের মাছখানা হাতসাফাই করে ওর পাতে চালান করে দিয়ে, নিজের ভাতের থালা ওর পাতে ঢেলে দিয়ে উপবাসে থাকার যে কষ্ট, সে আনন্দ সে কবে পেয়েছে? এ এক অনাস্বাদিতপূর্ব জীবনমাধূর্য! এটাকেও বাতাসী ছাড়তে চায়নি। তাই এতদিন দু-নৌকোয় পা দিয়ে সে চলেছিল কোনক্রমে। আজ ধরা পড়ে গেল নাকি?

ভিন্সেন্ট তাগাদা দেয়, কই, জবাব দিলি নে যে? আমি তোকে তাড়িয়ে দিচ্ছি, না তুই আমাকে ছেড়ে যাচ্ছিস?

–আমি কেনে যাব? টুক বাইরে না গেলি চলবে কেমনে, বল কেনে?

-কেন? সংসার তো চলছে। উপোস তো করতে হচ্ছে না কাউকে। সেদিন তো সুজি করলি; ভাতের পাতে আজকাল তো মাছও দিচ্ছিস?

বাতাসী অশ্রুসিক্ত মুখটা তুলে বলে, –তুরে কেনে বুঝাই ফাদারদা? কী বুলব তুকে?

বিদ্যুদস্পৃষ্টের মত চমকে ওঠে ভিন্সেন্ট। তাই তো! বাতাসী আসার আগে তার সংসার চলতে চাইত না। মাসের বিশ তারিখের পর তাকে একবেলা আহার বন্ধ করতে হত। মাসের শেষ, তিন-চারটে দিন ঐ একবেলাও সে অর্ধাহারে থাকত। পরের মাসে ডাকের গণ্ডগোলে মনি-অর্ডার আসতে দেরি হলে মাস-পয়লার প্রথম কদিন উপবাসেও থাকতে হয়েছে। কিন্তু কই, গত এক বছর ধরে এমন অবস্থা তো একবারও হয়নি! অথচ সংসারে মানুষ বেড়েছে। তার একটিমাত্র অর্থই হয়। বাতাসী উপার্জন করছে। তাই মাঝে-মাঝে বাড়িউলি-মাসি আসে এখানে। তাই মাঝে মাঝে বাতাসী কোথায় যেন চলে যায়! একটা তীব্র আত্মগ্লানিতে ওর সর্বাঙ্গ অবশ হয়ে আসে। সে অশক্ত, অসহায়, উপার্জনহীন! তাই বাতাসী–

ভিন্সেন্ট বসে পড়ে চৌকির প্রান্তে। ক্লান্তভাবে বলে, কতদিন এভাবে দেহ বেচে আমাকে খাওয়াচ্ছিস বাতাসী?

ঈ বাবা গ! আমি কেনে খাওয়াব তুকে? ভগবান খাওয়ায়,

–চুপ কর! ভগবান নেই!

–ঈ কথাটো তু বুললি ফাদারদা! তু?

-হ্যাঁ, বললাম। শোন! ও-ভাবে তোকে রোজগার করতে হবে না। দরকার হয় আমরা তিনজনেই উপোস করব। বুঝলি?

বাতাসী তর্ক করে না। ঘাড় নেড়ে সায় দেয়। মেনে নেয়। এবার ভিন্সেন্ট সজাগ হয়েছে। সে টের পায় বাতাসী তার পথ পরিবর্তন করেনি। এখন আর লুকোছাপার প্রয়োজন বোধ করে না। চক্ষুলজ্জাটা ঘুচে গেছে। সন্ধ্যাবেলা ভিন্সেন্ট ঘরে ফিরে এলে মেয়েকে তার কাছে বসিয়ে দিয়ে বলে, –অ্যারে টুক রাখ দিকিন ফাদারদা। আমি টুক ঘুর‍্যা আসি।

তার শাড়ি জ্যাকেটের পুটুলি বেঁধে নিয়ে সন্ধ্যার অন্ধকারে বেরিয়ে যায়। ফিরে আসে রাত গভীরে। ভিন্সেন্টের হৃৎপিণ্ডটা কে যেন পিষতে থাকে।

শেষ পর্যন্ত সে বাধ্য হয়ে বিদায় দিল বাতাসীকে। প্রায় দু বছর ঘর করার পর। হ্যাঁ, তাড়িয়েই দিল। চোখের জলে ভাসতে ভাসতে ভেসে গেল বাতাসী ফিরে গেল তার। অভ্যস্ত জীবনে। রূপোপজীবিনীর উপার্জনে জীবনধারণের গ্লানি সহ্য করতে পারল না ভিন্সেন্ট। ছবি তার কেউ কেনে না। বহু চেষ্টা সে করেছে। দোকানে দিয়েছে, বাড়ি বাড়ি ফেরি করেছে, হেদোর ধারে ছবি টাঙিয়ে অপেক্ষা করছে কেউ ফিরে তাকায়নি। দু পাঁচ টাকা দিয়েও কেউ একখানা ছবিও নেয়নি। আর্ট-একজিবিশানের কর্মকর্তাদের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছে লাভ হয়নি। একবারও তার কোন ছবি নির্বাচিত হয়নি। কিন্তু অন্য কোন জীবিকার কথা তার মনে আসেনি। সূরয তাকে চাকরির সন্ধান দিয়েছিল–ও সেখানে চেষ্টাই করেনি। পাশেই আছে এক চানাচুরওয়ালা। মাঝে সে অসুস্থ হয়ে দেশে চলে যায়। ভিন্সেন্টকে বলেছিল আঁকাটা নিয়ে সে ফেরি করতে পারে। ভিন্সেন্ট রাজী হয়নি। আত্মসম্মানে লেগেছে বলে নয়–তার দৃঢ় বিশ্বাস সে ও-সব কাজ করার জন্য পৃথিবীতে আসেনি। সে শিল্পী, সে আর্টিস্ট। আজ পৃথিবী তাকে যতই অসম্মান করুক, একদিন কড়া-ক্রান্তিতে সব শোধ দিতে হবে। আজকের এই উপেক্ষিত, অবহেলিত, অনাহার-ক্লিষ্ট ভিন্সেন্ট হয়তো সেদিন থাকবে না। কিন্তু এ একেবারে ধ্রুব সত্য যে, পৃথিবীকে একদিন নতমস্তকে সলজ্জে স্বীকার করতে হবে–পৃথিবীরই ভুল হয়েছিল, ভিন্সেন্ট ভান গর্গকে সে চিনতে পারেনি। বলতে হবে ভিন্সেন্ট যা সৃষ্টি করে গেছে তা মহত্তম শিল্প! কিন্তু সে কবে? কোন্ অনাগত প্রভাতে?

বাতাসী চলে গেল। আবার নিঃসঙ্গ জীবন। আবার ইকমিক্‌কুকার! আবার একা!

মাঝে মাঝে পুরনো কথা মনে হয়। ঊর্মিলা এ জীবন সহ্য করতে পারত না। ঊর্মিলা তার জীবনের সঙ্গে নিজেকে জড়ায়নি, ভালই করেছে। কিন্তু চিত্রলেখা? সে কি। ভিন্সেন্টের সঙ্গে এ দুঃখীর জীবন ভাগ করে নিতে পারত না? হয়তো একটু মানসিক শান্তি পেলে, একটু দৈহিক আরাম পেলে ও এতটা ব্যর্থ হত না। বাতাসী ওকে ভাতের থালা, কাঁচা কাপড় আর পাতা বিছানা জুগিয়েছেদু বছর শান্তিতে রেখেছে। তাতেই অনেকটা তৃপ্তি পেয়েছে ভিন্সেন্ট। কিন্তু চিত্রলেখা তাকে আরও কিছু বেশি দিতে পারত। চিত্রলেখার বাবা ছিলেন স্কুল-মাস্টার-সে লেখাপড়া জানা মেয়ে। সে উৎসাহ দিয়ে, সান্ত্বনা দিয়ে হয়তো ওকে গড়ে তুলতে পারত সার্থক শিল্পীরূপে। বাতাসী শিল্পীর মডেল হতে পারে, জীবনসঙ্গিনী হতে পারে না–সে উপাদানে বাতাসীকে গড়েননি সৃষ্টিকর্তা। চিত্রলেখা হয়তো পারত। চিত্রলেখা কখনও এভাবে তাকে ফেলে পালাত না। বাতাসীর মত নেমকহারামের মত।

নেকহারাম? কিন্তু বাতাসী কি সত্যিই অকৃতজ্ঞ? কেন সে পারল না এই নতুন জীবনকে স্বীকার করে নিতে? নিদারুণ দারিদ্র্যই কি তার একমাত্র কারণ? ভিন্সেন্ট যদি দু-চারখানা ছবি বিক্রি করতে পারত–তাহলে কি বাতাসী উপেক্ষা করতে পারত বাড়িউলি-মাসির আকর্ষণ? হয়তো না। উচ্ছলতা তার রক্তের মধ্যে বাসা বেঁধেছিল। আকৈশোর সে পুরুষমানুষের সংস্পর্শে এসেছে প্রায় বিশ বছরের অভ্যাস। রাতারাতি তা কি ত্যাগ করা যায়? আর তাছাড়া?

হ্যাঁ, আরও একটি নিদারুণ হেতু অনস্বীকার্য! ভিন্সেন্ট বাতাসীকে উদ্ধার করেছে, আশ্রয় দিয়েছে। প্রতি মাসে মনি-অর্ডারের টাকা ওর হাতে ফেলে দিয়েছে, হিসাব চায়নি। এক ঘরে রাত্রিবাস করেছে, এক শয্যায় শুয়েছে, অসংখ্য ছবি এঁকেছে। কিন্তু তবু একটা প্রকাণ্ড কিন্তু রয়ে গেছে। বাতাসীর নারীত্বকে সে স্বীকার করে নেয়নি। বাতাসীর চোখে ভিন্সেন্ট এক আত্মভোলা আর্টিস্ট! এক বিচিত্র জীব! পুরুষমানুষ নয়! বাতাসীর চোখে সে-ফাদারদা!

হয়তো এটাই সহ্য হল না উত্তীর্ণ-যৌবনা মেয়েটির। এতে সে অভ্যস্ত নয়। সে হেরে গেছে। নত মস্তকে যে ফিরে গেল সে বাতাসী নয়–অবমানিতা নারীত্ব!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *