আবার যদি ইচ্ছা কর – ১১

তারিখটা মনে আছে। চব্বিশে ডিসেম্বর। ক্রিস্টমাস ঈভ। এতদিনে বাবা গত হয়েছেন। আমিই সংসারের কর্তা। আমাদের তখনও ছিল একান্নবর্তী পরিবার। আমার মেজ ভাইয়ের মেয়ের বিয়ে স্থির হয়েছে। দূর দূর থেকে আত্মীয়-স্বজনে বাড়ি ভরে গেছে। আমার মরবার ফুরসৎ নেই। কি একটা কাজে চৌরঙ্গীর দিকে গিয়েছিলাম, ভাবলাম বটুকের দোকানে একবার যাই। ওকে নিমন্ত্রণ করে আসি। সেদিন একজিবিশানে হাটের মাঝে ইচ্ছে করেই নিমন্ত্রণ করিনি। সেটা শোভন হত না। ওর দোকানে যেতেই বটুক একেবারে লাফিয়ে উঠল—

আরে ব্বাস রে! তোর কথাই ভাবছিলাম। আয় আয়। শোন, কাল তোর নেমন্তন্ন! আমার বাড়িতে, রাত্রে। লেখা হাঁড়িকাবাব খাওয়াবে। জমিয়ে বড়দিন করা যাবে।

আমি বলি, আপাততঃ সে গুড়ে বালি ভাই। আমার ভাইঝির বিয়ে। দোসরা মাঘ। তোকে নিমন্ত্রণ করতে এসেছি। এখন আমার মরবার ফুরসৎ নেই—

আরে সে তো পরে বছরের কথা। ঢের দেরী আছে। কাল তোকে আসতেই হবে।

বলি, হ্যাঁরে বটুক, চন্দ্রভানের খবর রাখিস?

না। শুনেছি সে খ্রীষ্টান হয়ে গেছে। ওর ভাই সূরযের সঙ্গে বছরখানেক আগে দেখা হয়েছিল। সে আজকাল দিল্লীতে থাকে। তার কাছেই শুনেছিলাম। স্কুল ছাড়ার পর আর তার সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। কোথায় আছে জানি না।

চন্দ্রভান কলকাতাতেই আছে। দিন তিনেক আগে তার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে।

বলিস কি? বল, তার ঠিকানা বল। কাল তাহলে তাকেও নিমন্ত্রণ করি বরং।

আমি বাধা দিয়ে বলি, না রে! প্রথমত, তার ঠিকানা আমি জানি না, দ্বিতীয়ত, তার সঙ্গে নতুন করে বন্ধুত্ব স্থাপন না করাই মঙ্গল। চন্দরটা একেবারে গোল্লায় গেছে–

-মানে? কী বলছিস তুই?

আমি আদ্যোপান্ত ইতিহাসটা ওকে শোনাই। বটুক ধৈর্য ধরে সবটা শুনল, তারপর বললে, –ঐ তোর বড় দোষ দীপু। বড় সহজে তুই কনক্লুশানে আসিস। চন্দ্রভানের ভি. ডি, হয়েছে শুনেই তুই শুচিবায়ুগ্রস্তের মত নাক সিটকালি। তুই না ডাক্তার?

আমি বলি, দ্যাখ বটুক, সেজন্য আমি রাগ করিনি। রাগ করেছি ওর ন্যাকামি দেখে। ওর নিজের স্ত্রীর ঐ অসুখের কথা শুনে আকাশ থেকে পড়ল। রোজার কাছে মামদোবাজি। আমি বুঝি না কিছু? আর কী লম্বাই-চওড়াই বুলি!

যাক, ঠিকানা যখন রাখিসনি, তখন চন্দ্রভান আবার হারিয়ে গেল। একবার হেদোয় গিয়ে খবর নেব বরং। হাজার হোক, আমরা একই প্রফেশানের মানুষ। দেখি যদি ওকে কিছু সাহায্য করতে পারি।

আমি ওকে বারে বারে বারণ করলাম; কিন্তু বটুক মনে হল কথাটা কানে তুলল না। সে কতকগুলো মালপত্র গুছিয়ে তুলছিল। দেখি, বটুক অনেক জিনিসপত্র কিনেছে। ক্রিস্টমাস প্রেজেন্টস্! ফুল, কেক, মায় একটা ক্রিস্টমাস ট্রি।

আমি ঠাট্টা করে বলি, –হগমার্কেটে দোকান দিয়ে তুই যে একেবারে সাহেব হয়ে গেছিস দেখছি! মায় ক্রিস্টমাস ট্রি? অ্যাঁ?

বটুক দড়ি দিয়ে কি একটা প্যাকেট বাঁধছিল। মুখ তুলে বললে, –এসব সুলেখার জন্যে। ও ধর্মে হিন্দু, কিন্তু মনেপ্রাণে ক্রিশ্চিয়ান। একজন ফাদার ওর জীবনে খুব প্রভাব বিস্তার করেছিল। তখন ওর বয়স বছর পনের। ও নাকি তার কাছে খ্রীষ্টানধর্মে দীক্ষা পর্যন্ত নিতে গিয়েছিল। তিনি ওকে দীক্ষিত করেননি-অপ্রাপ্তবয়স্কা বলে বোধহয়। সুলেখার কাছে শিব বা কালীর চেয়ে যীসাস্ অথবা মেরীর কদর বেশি! দেখ না, ওর জন্য কি প্রেজেন্ট নিয়ে যাচ্ছি!

ক্রুশবিদ্ধ যীশুর একটি তৈলচিত্র বটুক নিজে এঁকেছে।

বলি, বটুক, সেদিন তুই তোর স্ত্রীর প্রসঙ্গে কি একটা কথা বলতে গিয়ে থেমে গিয়েছিলি। আজ বলবি?

–আজ নয় ভাই। আজ একটু তাড়া আছে। শীগগির করে বাড়ি ফিরতে হবে।

 –তোর স্ত্রীর দেশ কোথায়? বাপের বাড়িতে কে আছেন?

–ওর বাপ-মা কেউ নেই। বাড়ি ছিল মেদিনীপুরে। বন্যায় এক রাত্রে বাপ মা ভাই সবাই ভেসে যায়। ও আশ্রয় পেয়েছিল দূরসম্পর্কের এক মামার কাছে। লোকটা চামার। ওর আসল নাম চিত্রলেখা-কিন্তু কি জানি কেন আমাকে ও নামে ডাকতে বারণ করে। আমি ওকে ডাকি সুলেখা বলে। কিন্তু এখন সে মহাভারত শোনাতে পারব না ভাই।

বাইরে এসে বলে, –এ কি রে? তোর গাড়ি? কিনেছিস? বাঃ! তাহলে যোগেশ মিত্তির রোড পর্যন্ত পৌঁছে দে না ভাই! এতগুলো মালপত্তর নিয়ে–

ভাবলাম সেই ভাল। ওর বাড়িতে গিয়েই সস্ত্রীক নিমন্ত্রণ করে আসি। সুলেখা ইতিমধ্যে আমাদের বাড়ি একদিন এসেছিল। আমার স্ত্রীর সঙ্গে তার আলাপ হয়েছে।

ওদের বাড়িতে গিয়ে দেখি সুলেখা এলাহি আয়োজন করেছে। বেলুন আর কাগজের শিকল দিয়ে বাইরের ঘরটা সাজিয়েছে। ক্রিস্টমাস ট্রি-টা যেখানে থাকবে সে জায়গাটা সাফা করে রেখেছে। আমাকে দেখেই বললে, -ডাক্তারবাবু! আসুন আসুন। কাল আপনাকে হাঁড়িকাবাব খাওয়াব। কাল রাত্রে। মিসেসকেও নিয়ে আসবেন।

বললাম আমার অবস্থার কথা। বাড়ি ভরতি আত্মীয়-স্বজন। আমার স্ত্রীর পক্ষে এখন আসা সম্ভবপর হবে না। দোসরা মাঘ নিমন্ত্রণও করলাম।

বটুক আমাকে জনান্তিকে বললে, –গগ্যাকে আজ নিমন্ত্রণ করবার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু বউ রাজী হচ্ছে না। তুই একটু বলে দেখ না!

আমি বলি, বটুক, এটা অন্যায় বলছিস। আনন্দটা ওঁর। এখানে কেন মিছিমিছি অশান্তি টেনে আনবি?

সুলেখা ছিল পাশের ঘরেই। কথাটা তার কানে যায়। ওর ঘর থেকেই বলে, বলুন তো ডাক্তারবাবু! তুমি তোমার বন্ধুকে নিয়ে হৈ-চৈ করতে চাও, কর না। আমি তো আপত্তি করছি না। এখানে কেন?

বটুক বললে, তাহলে কাল সকালে ওর জন্যে কিছু কেক আর মিষ্টি নিয়ে যাব। সে বেচারি বরানগরের বস্তীতে বড়দিনের দিন হয়তো পেটে কিল মেরে পড়ে থাকবে।

সুলেখা এ-ঘরে এসে বলে, যাও না, যত ইচ্ছে কেক খাইয়ে এস। আমার কি?

একটুখানি বসে গেলাম। ক্রিস্টমাস ট্রি-টা সাজাতে সাহায্য করলাম। সুলেখা যেন ছেলেমানুষ হয়ে গেছে। ত্রিশ বছরের রাশভারী মহিলা যেন সে নয়, যেন আজ আবার সে তার কৈশোরে ফিরে গেছে। দিব্যি হুকুম চালাচ্ছে আমাকেও, দেখুন তো ডাক্তারবাবু, লাইনটা সোজা হল কিনা?

বটুক বলে, আমি তো বলছি, সোজা হয়েছে।

-তোমার লাইনজ্ঞান নেই!

হা হা করে হেসে ওঠে বটুক। সে একজন লব্ধপ্রতিষ্ঠিত আর্টিস্ট। তার লাইনজ্ঞান নেই।

বিদায় নিয়ে উঠে পড়তে হল। দ্বার পর্যন্ত এগিয়ে দিল সুলেখা। আগামীকাল সন্ধ্যায় আসার কথা আবার মনে করিয়ে দিল।

পরদিন সন্ধ্যায় নয়, দ্বিপ্রহরেই যেতে হয়েছিল ওদের বাড়ি। সে আর এক কাণ্ড।

পরদিন সকালে–এই বেলা দশটা নাগাদ হন্তদন্ত হয়ে বটুক এসে হাজির। চুল উসকো-খুসকো। মুখ শুকনো। গলার টাইটা আলগা, কোটের বোতাম উল্টো ঘরে। লাগান।

কী হয়েছে রে? এমনভাবে ছুটে এসেছিস?

দীপু, শীগগির আয়। সর্বনাশ হয়েছে! গগ্যা খুন হয়েছে!

খুন হয়েছে! কী বলছিস পাগলের মত?

বটুক বললে, সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠেই সে বরানগরে গিয়েছিল। বড়দিনের জন্য গগ্যাকে কিছু কমলালেবু, কেক আর মিষ্টি দিয়ে আসতে সেখানে গিয়ে সে যা দেখে এসেছে তা অকল্পনীয়।

বস্তীতে ওর খাটিয়ায় গগন শুয়েছিল চিৎ হয়ে। তার মাথায় প্রকাণ্ড একটা ব্যাণ্ডেজ বাঁধা। আওডিন আর ডেটলের গন্ধে ঘরটা ম-ম করছে। হাট করে খোলা আছে দরজা। ঘরে আর কেউ নেই। ওর খাটিয়ার নিচে মাটিতে শালপাতা ঢাকা দেওয়া এক গ্লাস জল। পাশের ঘরে যে হিন্দুস্থানী লোকটা সপরিবারে থাকে তার কাছে পাওয়া গেছে কতকগুলো অসংলগ্ন সংবাদ। গগন দুদিন ঐভাবেই পড়ে আছে–অজ্ঞান অচৈতন্য অবস্থায়! মাঝে মাঝে তার জ্ঞান হয়েছে বটে, তবে সে কিছু খায়নি। লোকজন দেখলেই মারতে উঠছে। বটুক জিজ্ঞাসা করেছিল, –এমন করে মাথা ফাটল কেন?

হিন্দুস্থানী লোকটা ভাল। যতটা জানা ছিল তার, শুনিয়ে দেয় বটুককে। এ বস্তীর অধিকাংশই বেহারী। চটকলে কাজ করে। তার ভিতর এই উটকো বাঙালিবাবুকে কেউই বড় একটা সুনজরে দেখত না। বাঙালিবাবু কোন কাজ কাম করে না। কারও সাথে মেশে না। সন্ধ্যে থেকে পড়ে পড়ে দারু খায়। তা দারু আর কে না খায়? সেজন্যে কিছু নয়। আসল কথা হল, বাঙালিবাবুর নজরটা খারাপ। ওদের বস্ত্রীর জীবন কারখানার সিটি দিয়ে বাঁধা। প্রহর নয়, সিক্ট দিয়ে বাঁধা ওদের জীবনযাত্রা। সকালে কারখানার প্রথম ভে পড়লেই বস্তীতে আর জোয়ান মানুষ থাকে না। তখন সেটা প্রমীলারাজ্য। থাকে কিছু পঙ্গু, বৃদ্ধ, শিশু আর ঔরৎ-লোক। এই বাঙালিবাবু সেই শান্তির রাজ্যে মূর্তিমান বিঘ্নের মত এসে অবতীর্ণ হয়েছে তার রঙ-তুলিকাগজ-পেনসিল নিয়ে। যখন-তখন যেখানে-সেখানে আঁকবার সরঞ্জাম নিয়ে বসে যায়। দু-একবার বস্তীর জোয়ানরা এসে শাসিয়েছিল। বাঙালিবাবু ভ্রূক্ষেপ করেনি। অবস্থা একদিন চরমে উঠল দুপুর বেলা। রাস্তার ধারে একটি মাত্র কর্পোরেশনের কল ওদের পানীয় জলের উৎস। জল নিতে আসে সারা বস্তীর লোক। লাইন পড়ে যায় মানুষের নয়, পাত্রের। ঘড়া, কলসী, বালতি, ক্যানেস্তারা টিন। মেয়েরা সার দিয়ে অপেক্ষা করে। ওরা কদিন ধরেই লক্ষ্য করছে বাঙালিবাবু একটা চৌকোমতন পিঁড়িতে মেয়েদের ছবি আঁকে। কথাটা কানাকানি হতেই প্রতিবাদে মুখর হয়ে পড়ল ভিখন, রঙলাল আর রামাবতার। ওরা জোর করে উঠিয়ে দিল বাঙালিবাবুকে। বললে, এমন বেসরমের কাজ যদি আবার তাকে করতে দেখা যায়, তবে তারা শেষ করে ফেলবে ওকে। এরপর কদিন আর বাঙালিবাবুকে দেখা যায়নি। সে বোধহয় দূরে কোথাও ছবি আঁকতে যেত। তারপর এই তো সেদিন, তিন নম্বর শেডের রঙলাল সপ্তাহান্তের টাকাটা ভাটিখানায় নিঃশেষ করে ফিরে আসতেই ওদের মরদ-ঔরতে প্রচণ্ড ঝগড়া হয়ে গেল। এমন তো নিত্য হয়ে থাকে। কে আর তাতে কান দেয়। সেদিন কিন্তু রঙলাল দারু পান করে টং হয়ে ছিল–আচ্ছা করে ধর্মপত্নীকে চেলাকাঠ পেটা করে তাকে ঘরের বার করে দেয় এবং অর্গলবদ্ধ ঘরে নেশাগ্রস্ত মানুষটা দিব্যি শুয়ে পড়ে। অনেক রাত পর্যন্ত ওর বউ রুদ্ধদ্বারের কাছে বিনিয়ে বিনিয়ে কাঁদে আর মিনতি করে। রঙলাল সেসব জানে না–সে তখন নেশার ঘোরে অচৈতন্য। ওর বউ অবশেষে বাইরের দাওয়াতেই গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়ে। তার ঘুম ভাঙে ভোররাতে। উঠে দেখে, তার দাওয়া থেকে হাত দশেক দূরে বাঙালিবাবু বসে আছে, আর রঙ-তুলি দিয়ে তার ছবি আঁকছে। অসংবৃত বেসবাস সামলে রঙলালের বউ মড়াকান্না জুড়ে দেয়বাঙালিবাবু তার ইজ্জত নষ্ট করেছে, ততক্ষণে রঙলালের নেশা ছুটে গেছে। দ্বার খুলেই সে দেখে বাঙালিবাবু দ্রুতহাতে তখনও এঁকে চলেছে তার ডবকা বউয়ের যৌবনপুষ্ট দেহের ছবি। রঙলাল আর স্থির থাকতে পারেনি। ছুটে এসে প্রচণ্ড একটা চড় মেরে বসে বাঙালিবাবুকে। বউয়ের ইজ্জত নিয়ে কথা! না হয় বিয়ে করা বউ নাই হল–ওর ঘরেরই তো সে! তারই বিবি! একটা কথা শুধু রঙলাল খেয়াল করেনি-সেটা এই যে, ঐ বাঙালিবাবুর দেহে ছিল মত্তহস্তীর বল। চড় খেয়েও তসবিরওয়ালাবাবু কিছু বলেনি। গুটিয়ে তুলছিল তার আঁকার সরঞ্জাম। আর ঐ সুযোগে রঙলাল এক লাথি মেরে ছবিটাকে ফাঁসিয়ে দেয়। অমনি ঐ বাঙালিবাবু রঙলালকে দুহাতে মাথার উপর তুলে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল ছাইগাদায়। একে বউয়ের ইজ্জত গিয়েছে, তায় সকাল বেলাতেই আঁস্তাকুড়ে পড়েছে সে-রঙলাল দিক্‌বিদিক জ্ঞান হারায়। তার সবচেয়ে রাগ হয়েছিল বাঙালিবাবু, তাকে ছুঁড়ে ফেলায় তার বউ খিলখিলিয়ে হেসে উঠেছিল বলে। রঙলাল লোকজন ডেকে আনে। ততক্ষণে বাঙালিবাবু তার ডেরায় চলে গেছে। ওরা পাঁচ-সাতজনে লাঠি নিয়ে এসে সেখানে চড়াও হয়। বাঙালিবাবু তার ভিতর তিন-চারজনকে ঘায়েল করেছে বটে, কিন্তু নিজেও সে ধরাশায়ী হয়। রঙলাল ভূপতিত মানুষটার মাথায় বসিয়ে দেয় মোম এক ডাণ্ডার বাড়ি!

পরে অবশ্য বস্তীর মাতব্বরেরা সব কয়টি আহতকে ধরাধরি করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করে। থানা-পুলিস পর্যন্ত ব্যাপারটা গড়ায়নি। কারণ কোন পক্ষই থানায় যায়নি। আহতদের ওরা নিজ নিজ ছাপড়ায় পৌঁছে দিয়ে এসেছে। বস্তীর আইন অনুসারে এখানেই মাতব্বরদের দায়িত্ব খালাস।

এই হচ্ছে গগ্যার মাথাফাটার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।

আমি আর বটুক যখন গিয়ে পৌঁছলাম তখনও তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে আছে গগন। গায়ে হাত দিয়ে দেখি জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে, থার্মোমিটার সঙ্গেই ছিল। জ্বরতাপ দেখলাম; একশ তিন। চোখ দুটো জবাফুলের মত লাল। ঘুমের মধ্যে ভুল বকছে।

পাশের ঘরে লোকটি বললে, –ওরাকে লে যাইহ বাবু, ইহা রহনেসে মর যাই।

বটুক বললে, তিনদিন ধরে একটা মানুষ পাশের ঘরে বেহুঁস হয়ে পড়ে আছে, তোমরা দেখ না কেন?

লোকটি হতাশার ভঙ্গি করে বলে, -ক্যা কিয়া যায়? বহু না খাতে, না পিতে। ভরদিন বে-হোঁস! ঔর হোঁস হোনেসে হামলোগকে মার ডালনে চাতা।

বললাম, বটুক, একে এখনই হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।

কিন্তু হাসপাতালে গিয়ে ও কি বেঁচে উঠবে? ও তো নার্সদেরও মারধোর করতে চাইবে!

আমি বলি, –তা ঠিক। আঘাতটা কতদূর গভীর না বুঝে কিছুই বলতে পারছি না। তাছাড়া শক্ থেকে জ্বর হয়েছে। মাথার আঘাত তো–ব্রেনটা না অ্যাফেটেড হয়। সেক্ষেত্রে ওষুধের চেয়ে নার্সিংটাই এখন বড় কথা। ওর জীবনীশক্তি প্রচুর–একটু যত্ন পেলে ও নিশ্চিত বেঁচে উঠত।

বটুক আমার হাত দুটি জড়িয়ে ধরে বলে, –আমরা কি ওকে এভাবে মরতে দিতে পারি দীপু?

আমি ইতস্ততঃ করে বলি, আমার বাড়িতে বিয়ের হাঙ্গামা না থাকলে আমি ওকে আমার বাড়িতেই নিয়ে যেতাম। ও ঠিক বেঁচে উঠত। এখানে এ অবস্থায়–

বটুক তখনও আমার হাতটা ছাড়েনি। বললে, কিন্তু আমার বাড়িতে তো বিয়ের হাঙ্গামা নেই। আমি ওকে আমার বাড়িতে নিয়ে যাই। আমার তো দুখানা ঘর; ও বাইরের ঘরে থাকবে। তোর গাড়িতেই ওকে নিয়ে যাই।

কিন্তু বটুক, গগ্যাকে তোর বউ কি চোখে দেখে তা তো জানিস—

–কী পাগলের মত বকছিস! লোকটা মরতে বসেছে–

আমি বাধা দিয়ে বলি, –তা হোক। তুমি বরং আগে তোমার স্ত্রীর সঙ্গে একবার কথা। বলে নাও। তোমার অন্য বন্ধু হলে আমি এ কথা বলতাম না; কিন্তু গগ্যার ক্ষেত্রে

ও দৃঢ়স্বরে প্রতিবাদ করে, -লেখাকে তুই জানিস না! ওর মন শিশুর চেয়ে কোমল। একটা মানুষ মরে যাচ্ছে শুনলে…আজ বড়দিনের দিন…

–তা হোক। আমি বলছি–তুই একবার কথাবার্তা বলে আয়। আমি না হয় অপেক্ষা করছি।

বটুক চুপ করে খানিকক্ষণ কী ভাবলে। তারপর বলে, –তুই ঠিকই বলেছিস রে। বউকে না জিজ্ঞেস করে গগ্যাকে হুট করে নিয়ে যাওয়াটা ঠিক হবে না। তবে তোকেও আসতে হবে…মানে ডাক্তার হিসাবে তোর অভিমতটাই জোরদার হবে তো!

দুজনে গেলে এখানে কে থাকবে? রোগীর কাছে?

পাশের ঘরের হিন্দুস্থানী লোকটি দাঁড়িয়ে ছিল পিছনেই। আমাদের কথাবার্তা সে কিছু কিছু বুঝতে পেরেছে। তার দেহাতী ভাষায় বললে, -যান বাবুমশাইরা, ব্যবস্থা করে এসে নিয়ে যান। ততক্ষণ আমরাই দেখ ভাল্ করব।

বটুক কয়েকটা কমলালেবু প্রথমবারেই নিয়ে এসেছিল।

একটু জলও গরম করা গেল। বটুক একটা ফিডিং কাপ কিনে নিয়ে এল বরানগরের বাজার থেকে। একটু একটু করে আধো ঘুমের মধ্যে গগনকে খানিকটা ফলের রস খাইয়ে দিলাম। এখন করণীয় কিছু নেই। রোগী অঘোরে ঘুমোচ্ছে। ঘুমোক। ঘুমই ওষুধ। আমরা ওকে প্রতিবেশীর জিম্মায় রেখে আবার রওনা হলাম বরানগর থেকে ভবানীপুর।

আমিই চালাচ্ছি গাড়ি। বটুক বসে আছে আমার পাশে। হঠাৎ বললে, –লেখার হাতে ও ঠিক বেঁচে উঠবে, দেখে নিস। জানি তো লেখাকে। শীস এ ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল! আমার অসুখের সময়

বাধা দিয়ে বলি, বটুক, তোর স্ত্রী চোদ্দ বছর আগে একবার মা হতে বসেছিল, অথচ এ দীর্ঘদিনে আর সন্তান হয়নি। ব্যাপারটা কি, আজ বলবি? না, নেহাৎ কৌতূহলের জন্য এমন অশোভন প্রশ্নটা বারে বারে করছি না। ডাক্তার হিসাবেই জানতে চাইছি। কেন এতদিনে সে মা হয়নি?

বটুক অনেকক্ষণ জবাব দিল না। জানালার বাইরে অপসৃয়মান রাস্তার দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে থাকে চুপ করে। তারপর তেমনিভাবেই ওধারে চেয়ে বলে, সুলেখা মা হতে পারেনি, কারণ আমি নিশ্চয়ই বাপ হওয়ার উপযুক্ত নই! দোষটা আমারই, ওর নয়!

তার মানে? চোদ্দ বছর আগে বিয়ের আগেই কি—

সুলেখা আমার বিবাহিতা স্ত্রী নয়। তার বিয়েই হয়নি!

এবার আমার নীরব হবার পালা।

এতক্ষণে আমার দিকে ফিরে বলে, -বেচারি কোন্ সাহসে তোর মত বামুনকে রেঁধে খাওয়াবে বল? বিয়ের আগেই মা হয়েছে, আর মা হবার পরেও বিয়ে হয়নি।

–তা হোক; কিন্তু ওর গর্ভে যে সন্তান এসেছিল, তার বাপ তাহলে –

সে রাস্কেলটা যে কে, তা আজও আমি জানি না।–

তোর সঙ্গে ওর কোথায় দেখা হয়? লেখাপড়া জানা মেয়ে?

আগেই বলেছি ও অফান। মানুষ হচ্ছিল দুরসম্পর্কের এক মামার কাছে। লোকটা কোন এক কোলিয়ারিতে কাজ করত। ভাগ্নীকে সে আশ্রয় দিয়েছিল বটে, কিন্তু তার উদ্দেশ্য ছিল সাংঘাতিক। চাকরিতে উন্নতির জন্য ও লেখাকে টোপ হিসাবে ব্যবহার করত। সে এক বীভৎস ব্যাপার। বিস্তারিত আমি জানতেও চাইনি, লেখাও নিজে থেকে বলেনি। কোলিয়ারিতে ছিলেন এক ক্রিশ্চিয়ান ফাদার। তাকে খুব শ্রদ্ধা করত লেখা তিন ওকে বাঁচাবার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। অবাঞ্ছিত সন্তান আর নিজেকে মুক্তি দিতে একদিন লেখা বাড়ি ছেড়ে পালায়। ওখান থেকে দামোদর তিন মাইল। সিধে তিন মাইল হেঁটে চলে এসেছিল সে। আমি ওর সাক্ষাৎ পাই দামোদরের এক ঘাটে। ঘাটে নয়, আঘাটায়।

বটুক পকেট থেকে একটা সুদৃশ্য সিগারেট কেস বার করে। একটা সিগারেট ধরায়। আমাকেও বার করে দেয় একটা। বলে, -তোর চেয়ে বড় বন্ধু আমার নেই। এসব কথা কখনও কাউকে বলিনি। বলা যায় না; কিন্তু তোকে বলব।

আমি বললাম, –শুধু বন্ধু বলে নয়, বটুক। আমার ধারণা, সুলেখা ভুগছে একটা মানসিক ব্যাধিতে। সেদিন বলেছিলাম, ছেলেপুলে না হলে ওর ফিটের ব্যারাম সারবে না। আজ মনে হচ্ছে ব্যাপারটা আরও জটিল। তাই শুনতে চাইছি। মনে হয়, ও একটা মানসিক অবদমনে ভুগছে। তুই সব কথা খুলে বল্ আমাকে–

সংক্ষেপেই বলেছিল বটুক। সব কথা সে বলেনি। সঙ্কোচে অথবা অন্য কোন কারণে হবে হয়তো। বটুকের সঙ্গে দেশের সম্পর্ক চুকে গেছে। ওর বাবা এখনও জীবিত। সুলেখার ব্যাপারে তিনি ছেলেকে ত্যাজ্যপুত্র করেছেন। বটুক একটি খ্রীষ্টান মেয়ে বিয়ে করেছে এইটুকুই জানেন তিনি। বিয়ে যে বটুক করেনি, মেয়েটি খ্রীষ্টান নয়, তা তিনি জানেন না। সুলেখার সাক্ষাৎ সে পেয়েছিল নদীর ধারে। বটুক একদিন একখানা ল্যাণ্ডস্কেপ আঁকছিল নির্জন এক আঘাটায়। নদীবক্ষে সূর্যাস্তের দৃশ্য। হঠাৎ তার নজরে পড়ল একটি মহিলা ঘড়ায় করে জল নিয়ে যেতে এসেছেন। এখানে কোন ঘাট নেই। দামোদরের পার তিন-চার ফুট খাড়া উঠে গেছে। সন্ধ্যা তখন হয়-হয়। এই অবেলায় অমন আঘাটায় মেয়েটি কেন জল নিতে এসেছে বটুক বুঝে উঠতে পারেনি। মেয়েটি ঘড়ায় একটি দড়ি বেঁধে যখন নামিয়ে দিল তখনও সে চুপ করে ছিল। ভেবেছিল, ঐভাবেই সে দু-তিন হাত নিচু খাড়া পাড় থেকে জল ভরতে চায় বুঝি। কিন্তু দড়ির অপর প্রান্ত যখন সে নিজের মাজায় বাঁধতে শুরু করে তখন বিদ্যুৎ চমকের মতো ওর মনে হল, মেয়েটি আত্মহত্যা করতে এসেছে! ও চিৎকার করে ওঠে, –ও কী করছেন আপনি? মেয়েটি তখন পাড়ে দাঁড়িয়ে উদ্দেশ্যে কাকে যেন নমস্কার করছিল। ওর চিৎকার তার কানে যায়। মেয়েটি ঘুরে ওকে দেখতে পায় এবং তৎক্ষণাৎ জলে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে। বটুকেশ্বর ছোট্ট মানুষ। দৈহিক ক্ষমতা তার সীমিত। কিন্তু সে বরিশালের বাঙাল! মেঘনায় সাঁতার শিখেছে সে। তৎক্ষণাৎ সেও ঝাঁপ দিয়ে পড়ে। এরপর আর তার ভাল মনে নেই।…একটা নরম নারীদেহ…অজগর সাপের মত দুটি বাহুর কঠিন বেষ্টনী: ফুসফুঁসে প্রচণ্ড যন্ত্রণা…মৃত্যুভয়! আর কিছু মনে নেই তার। সাঁতারে সে ওস্তাদ কিন্তু ঐ দীর্ঘদেহী যুবতী মৃত্যুযন্ত্রণায় ওকে এমন নিবিড়ভাবে আলিঙ্গনবদ্ধ করেছিল যে, ক্ষুদ্রকায় বটুক নিজেকে মুক্ত করতে পারেনি। নিমজ্জমান শুধু ওরা দুজনই তো নয়, ঐ সঙ্গে ছিল জলভরা ঘড়ার একটা জগদ্দল পাহাড়! মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিল বটুক দামোদরের গভীরে।

জ্ঞান ফিরে আসে মিশনারী হাসপাতালে। নিতান্ত ঘটনাচক্রে বলতে হবে, অথবা বাপ-দাদার আশীর্বাদও বলতে পারঐ সময় একজন খেজুরগাছ ঝোড়াই করতে নদীতীরের একটা খেজুর গাছে উঠেছিল। বটুকের চিৎকার শুনে সে সচকিত হয়ে এদিকে তাকায়। পরবর্তী ঘটনা সে দেখেছিল গাছের উপর থেকেই। দুর্জয় সাহসী লোকটা। খেজুরগাছ কাটা ধারালো কাস্তেখানা মাজায় খুঁজে সে অকুতোভয়ে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে দামোদরে। জলভরা ঘড়াটা সে প্রথমেই কেটে বাদ দেয়, আর সংজ্ঞাহীন দুজনকে টেনে তোলে ডাঙায়।

ব্যাখ্যা করতে কারও দেরি হয়নি। ব্যর্থ প্রেমিক দুজন। যুগলে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল। ডাক্তারবাবু পুলিস-কেস করেননি। নিতান্ত দুর্ঘটনা বলে খাতায় লিখে প্রেমিক যুগলকে বিদায় দিয়েছিলেন।

এর পরে অনিবার্য একটি রোমান্টিক অধ্যায় নিশ্চয় ছিল সন্দেহাতীতভাবে। যুগল প্রেমিক হিসাবে যারা হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে এল, সেই অপরিচিত ছেলে ও মেয়ের মধ্যে কীভাবে মন জানাজানি হল, সেকথা বটুক আমাকে বলেনি। শুধু বলেছিল, অবাঞ্ছিত মাতৃত্বের অভিশাপ থেকে অব্যাহতি পাওয়ার জন্যই মেয়েটি আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল। বটুক স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে ঐ অজাত শিশুর পিতৃত্বের দায় নিতে রাজী হয়। মেয়েটি আত্মহত্যার চেষ্টা আর করেনি। ওর ঘরে এসে আশ্রয় নিয়েছিল। সৌভাগ্য কি দুর্ভাগ্য বলতে পারে না বটুক—-শিশুটি বাঁচেনি।

উপসংহারে বটুক বলল, –এমন নাটকীয় ঘটনা না ঘটলে আমার মত চেহারার মানুষের ঘরে ওর মত মেয়ে হয়তো কোনদিনই আসত না। না রে?

আমি ধমক দিই, –কেন তুই নিজের সম্বন্ধে এইসব কথা ভাবিস?

ম্লান হেসে ও বলে, মিথ্যে সান্ত্বনা কেন দিচ্ছিস? আমি কি জানি নাও আমার বাঁদরের গলায় মুক্তোর মালা? বিউটি অ্যাণ্ড দি বীস্ট!

–পাগলা কোথাকার! মানুষের চেহারাটাই কি সব? সুলেখা তো তোকে খুব ভালবাসে। এখন বিয়ে করলেই পারিস?

বটুক বোকার হাসি হেসে বললে, বউ রাজী হয় না।

যোগেশ মিত্তির রোডে ওর বাসায় এসে যখন পৌঁছলাম তখন ঠিক দুপুর। সুলেখা দরজা খুলে দিল। আমাকে দেখতে পেয়ে ঘোমটা তুলে দিল মাথায়। আমাকে সে প্রত্যাশা করেনি, বলে, কী ডাক্তারবাবু, চাখতে এসেছেন নাকি? হাঁড়ি কাবাব এখনও নামেনি।

আমি কী জবাব দেব ভেবে পাই না। ক্রিস্টমাস ট্রিটা সাজানো হয়েছে, সাজগোছ সব শেষ। কোণায় টেবিলের উপর দাঁড় করানো রয়েছে তৈলচিত্রটি। ক্রুশবিদ্ধ যীশু। সুলেখা বললে, –আপনার বন্ধুর ক্রিস্টমাস প্রেজেন্ট। অপূর্ব হয়েছে ছবিটা, তাই না?

আমি জবাব দেবার আগেই বটুক বলে ওঠে, -লেখা, তোমার কাছে একটা ভিক্ষা আছে।

সুলেখা ভিতরে যাবার জন্য পা বাড়িয়েছিল। ঘুরে দাঁড়িয়ে মোহিনী হাসি হাসল। আমার মনে হল-কালো হলেও সুলেখা সত্যিই সুন্দরী। দ্রৌপদীও তো কালো ছিলেন অজন্তাগুহার যাবতীয় নারীরত্নও তো ঘোর রঙে আঁকা! কৃষ্ণা-অপ্সরা, কৃষ্ণা কুমারী, মাদ্রী, সীবলী, সুমনা এমন কি রাহুল-জননী! মুচকি হেসে সুলেখা বললে, –অত ভনিতা করতে হবে নাচা না কফি বলে ফেল!

বটুক আমতা আমতা করে বলে, না, ঠাট্টা নয়, ইয়ে হয়েছে..আমার একটি বন্ধু মরণাপন্ন অসুস্থ…তাকে..মানে এখানে নিয়ে আসতে চাই।

এখানে? এখানে কেমন করে–

-কেন, এখানে তো দুখানা ঘর আছে। ও এই স্টুডিও ঘরে থাকবে। বেচারির কেউ নেই। গুণ্ডায় ওর মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে–এখনও জ্ঞান হয়নি।

-ও! তা সঙ্গে করে নিয়ে এলে না কেন?

এবার জবাব দিতে বটুক ইতস্ততঃ করে। করুণভাবে আমার দিকে তাকায়। সুলেখা হঠাৎ কি যেন বুঝতে পারে। বলে, ব্যাপার কি বল তো? বন্ধুটি কে? তোমার গগ্যা নয় তো?

–গগ্যাই। সে মরণাপন্ন অসুস্থ। পড়ে আছে বরানগরের একটা বস্তীতে। কেউ দেখবার নেই। এখানে তাকে না নিয়ে এলে সে বাঁচবে না।

সুলেখা হঠাৎ পাষাণে পরিণত হয়ে গেল। একটিমাত্র শব্দ উচ্চারণ করল সেঃ

না!

লক্ষ্মীটি লেখা, তুমি অমত কর না। যে অবস্থায় তাকে রেখে এসেছি তাতে এই গদির খাটে আমি ঘুমোতে পারব না।

–বেশ তো, তুমি গিয়ে সেই বস্তীতেই থাক। যতদিন না তোমার বন্ধু ভাল হয়। আমি আপত্তি করব না। এখানে আমি একাই চালিয়ে নেব।

সুলেখার স্বরে অহেতুক কাঠিন্য।

-তা হলে ও নির্ঘাৎ মরে যাবে, লেখা।

 বটুক পকেট থেকে রুমাল বার করে মুখটা মুছে নেয়। এই মাঘের শীতেও তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। একবার আমার দিকে তাকায়। এ বিপদে আমি তাকে কিভাবে সাহায্য করব বুঝে উঠতে পারি না। বটুক আবার শুরু করে, তুমি তো জান লেখা, গগ্যা একজন মস্ত আর্টিস্ট

না, জানি না। আর জানলেই বা কি? আমার কি? আমি তোমার বন্ধুকে ঘৃণা করি।

 এরপর স্পষ্টই উত্তেজিত হয়ে ওঠে বটুক। এক পা এগিয়ে যায় তার স্ত্রীর দিকে। মিনতিমাখা কণ্ঠে বলে, –আমি তো তোমার কাছে কখনও কিছু চাইনি লেখা। আমি ভিক্ষা চাইছি। অমনভাবে তুমি বল না। আমি জানি, ওটা তোমার মনের কথা নয়। তুমি। দেবী, করুণার অবতার। একটা মানুষ ঐভাবে মরে যাবে আর তোমার করুণা হবে না, এ আমি ভাবতেই পারি না। …তুমি রাজী হয়ে যাও, ওকে আমি নিয়ে আসি। তোমার খাটুনি কিছুই বাড়বে না। যা করবার তা আমিই করব। তুমি এ-ঘরে এস না বরং…

-ওকে হাসপাতালে পাঠিয়ে দিলেই হয়?

–হাসপাতাল? সেখানে ওকে কে দেখবে বল? দীপু বলছে, ওষুধের চেয়ে নার্সিংই এক্ষেত্রে বড় কথা। সরকারী হাসপাতালে কে ওকে যত্ন নিয়ে নার্সিং করবে বল?

সুলেখা আমাদের দিকে পিছন ফিরে চৌকির উপর ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত রঙের টিউবগুলো গুছিয়ে তুলছিল। বেশ বোঝা যায় ওর হাতটা কাঁপছে। এতটা বিচলিত হল কেন সে? আমাদের দিকে পিছন ফিরেই ও বললে, আর যদি উল্টোটা হত? তোমার মাথা যদি গুণ্ডায় ফাটিয়ে দিত তাহলে তোমার ঐ বন্ধু কি কুটোগাছটা নেড়ে সাহায্য করত?

–তাতে কি এসে যায়? আমি তো ওর মত হতভাগা নই। আমার কিছু হলে তুমি দেখবে। তাছাড়া ওর সঙ্গে আমার তুলনা? আমি একজন সামান্য নক্সানবিশ, আর ও হল জাত-আর্টিস্ট!

বটুক যেন পিছন থেকে ধাক্কা মেরেছে ওকে। চমকে ঘুরে দাঁড়ায়। ওর চোখে সেদিন কী দেখেছিলাম? অপরিসীম ঘৃণা! কিন্তু কার উপর? গগ্যা, বটুক, না তার নিজের উপর? দাঁতে দাঁত চেপে সুলেখা বললে, -ঐজন্যেই তোমার কিছু হল না। তুমি দিনরাত নিজেকে ছোট ভাব!

বটুক কিন্তু হেসে উড়িয়ে দিল সে কথা। বললে, আমি কী ভাবি, তাতে কিছু এসে যায় না সুলেখা; কথাটা নির্জলা সত্য। গগ্যার মত ছবি আমি সাতজন্মেও আঁকতে পারব না।

সুলেখা জবাব দিল না। নিরুদ্ধ আক্রোশে সে ফুঁসতে থাকে। যেন বটুক নিজেকে ছোট করছে না, যেন সুলেখার আঁকা ছবিকেই সে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলেছে। সুলেখা যীশুখ্রীষ্টের ছবিখানার দিকে একবার তাকিয়ে দেখল। ছবির নিচে একটা ধূপকাঠি জ্বলছিল। সেটাকে একটু দূরে সরিয়ে দিল, যেন জ্বলন্ত কাঠিটা ছবিতে না লাগে। তারপর স্বাভাবিক স্বরেই বললে, –তাই বুঝি তোমার বন্ধুর ছবি প্রদর্শনীতে সিলেকশান পায় না, আর তুমি প্রাইজ পাও?

-হ্যাঁ, তা সত্ত্বেও। আমি আঁকি তোমাদের জন্যে, আর গগ্যা আঁকে আমাদের মত আর্টিস্টের জন্যে।

সুলেখা রাগ করে না। হেসে বলে, অরিজিনাল কিছু বল। ওটা ধার করা কথা। শরৎচন্দ্র বলেছেন সম্প্রতি রবীন্দ্রনাথের প্রসঙ্গে।

ব্যাপারটা অন্যদিকে মোড় নিচ্ছে। এতক্ষণ আমি কোন কথা বলিনি। বলি, তুমি ব্যাপারটা গুলিয়ে ফেলছ বটুক। গগ্যাকে এখানে কেন নিয়ে আসতে চাইছ তা নিজের মনকেই আগে জিজ্ঞাসা করে দেখ। সে তোমার বন্ধু বলে, না জাত আর্টিস্ট বলে?

বটুক আমার দিকে ফিরে বলে, দুটোই সত্যি দীপু। গগ্যা যদি আজ ঐ অবস্থায় ওখানে মারা যায়, আমি সমস্ত জীবনভর নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না। …আর আমি তো চোদ্দ বছর ধরে লেখাকে জানি। ও রাগের মাথায় এসব কথা বলছে। ও মোটেই এত নিষ্ঠুর নয়।

সুলেখা এবার স্পষ্ট গলায় বললে, -বেশ, তোমার বন্ধুকে নিয়ে এস। কিন্তু একটা কথা। আমাকে বিদায় দাও।

তার মানে? তুমি কোথায় যাবে?

-সে তোমাকে ভাবতে হবে না। তোমার বন্ধু যে কদিন এ বাড়িতে থাকবে সে। কদিন আমি অন্য কোথাও থাকব। তিনি তাঁর বস্তীতে ফিরে গেলে আমিও ফিরে আসব।

বটুক হতাশার ভঙ্গি করে। অত্যন্ত উত্তেজিত হয়েছে ছোট্ট মানুষটা। সুলেখা যে এমন একটা চাল চালতে পারে এটা সে আশঙ্কাই করেনি। আমার দিকে ফিরে বললে, এর পর আর কথা চলে না। অগত্যা আমি নিরুপায় দীপু। মরুক, গগ্যা ঐখানেই মরুক। বন্ধুর খাতিরে বউকে তো আমি বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিতে পারি না। আবার সুলেখার দিকে ফিরে বলে, –এই তো তোমার শেষ কথা?

সুলেখা দাঁত দিয়ে ঠোঁটটা কামড়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। বললে, বাড়ি তোমার, শেষ কথা বলার আমি কে?

হঠাৎ নাটকীয় ভঙ্গিতে বটুক সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে। হাত দুটি জোড় করে একেবারে থিয়েটারি ঢঙে। দৃশ্যটা রীতিমত মেলোড্রামাটিক। বটুকের ফোলা ফোলা গাল আর কুতকুতে চোখে মিনতি মাখানো। আমার মনে হল–ও বুঝি কোন পৌরাণিক যাত্রার আসরে বিদূষকের অভিনয় করছে! বললে, –ওহ! লেখা…লেখা…আমি যে তোমাকে দেবী বলে পূজা করতাম!

সুলেখার ভূতে জেগেছে কুঞ্চন। এবার আর রাগ অভিমান নয়, বিরক্তি। বললে, ভুল করতে! আমি নিতান্ত মানুষ। রক্ত-মাংসের মানুষ।

আমার দিকে ফিরে বললে, একটু বসুন, চা করে আনি।

বেশ স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে সে। মনে হল ব্যপারটা এখানেই মিটে গেল। মাথার আঁচলটা কখন উত্তেজনার মুহূর্তে খসে পড়েছিল। এবার সেটা তুলে দেয়। ধীর গতিতে ভিতরের দিকে এগিয়ে যাবার জন্য পা বাড়ায়। কিন্তু না, নাটকটা তখনও শেষ হয়নি। বটুক আবার বলে ওঠে, –ও! রক্তমাংসের মানুষ! তা যে লোকটা মরতে বসেছে সেও তো রক্তমাংসের মানুষ! তার কথা এ-ভাবে উপেক্ষা করছ কি করে?

আবার দাঁড়িয়ে পড়ে সুলেখা। ঠিক দ্বারের কাছে। আবার ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে, — নিতান্ত জীবনধারণের তাগিদে। কে বলতে পারে, হয়তো তোমার বন্ধুকে বাঁচাতে গেলে আমারই মৃত্যু হবে!

কথাটা অসংলগ্ন। যুক্তিহীন। অন্ততঃ আমার মনে হল, সুলেখা নেহাৎ কথার পিঠে কথা বলার তাগিদে এঁড়ে-তর্ক করছে। গগ্যা এখানে এলে, একটা ঘর আটকে রাখলে সুলেখার অসুবিধার চূড়ান্ত হবে–কিন্তু সে অসুবিধাটাকে এভাবে আকাশচুম্বী করে তোলাটা নেহাত্ব বাড়াবাড়ি! কথাটা বলে সেও অপ্রস্তুত হয়। শুধু আমি আর বটুক নয়, সে নিজেও তার ঐ অসংলগ্ন কথাটার অর্থ খুঁজে পায় না। আবার প্রস্থানের জন্য পা বাড়ায়।

এবারও বটুক ফস্ করে বলে বসে, তবু ঐটাই তো রক্তমাংসের মানুষের শেষ কথা নয়। নিজের মৃত্যুকে তুচ্ছ করেও মানুষে তো নিমজ্জমান বিপন্নকে বাঁচাবার জন্য জলে ঝাঁপ দেয়? না কি, এমন কোন ঘটনা ঘটতে পারে বলে বিশ্বাসই হয় না তোমার?

সুলেখা তার কথা শেষ করে পিছন ফিরেছিল। এ কথায় তার প্রতিক্রিয়া কী হল তা আমি দেখতে পাইনি। সে কোন জবাব দিল না। এগিয়েও গেল না। হাত বাড়িয়ে চৌকাঠটা ধরল। তারপর মনে হল যেন টলছে। পরমুহূর্তেই সংজ্ঞা হারিয়ে মাটিতে আছড়ে পড়ল সুলেখা।

মিনিট দশেক পরে ওর জ্ঞান ফিরে এল। আমরা ধরাধরি করে ওকে খাটে শুইয়ে । দিয়েছিলাম। মাথায় মুখে জলের ঝাঁপটা দিয়েছিলাম। সুলেখার এমন মাঝে মাঝে ফিট। হয়। জ্ঞান ফিরে এলে সে গায়ের কাপড় ঠিক করে নেয়। আমি ধীরে ধীরে উঠে যাই। বাইরে গিয়ে দাঁড়াই। দেখতে না পেলেও শুনতে পাচ্ছিলাম ওদের কথা, টুকরো টুকরো । কথার ছিটে। সুলেখা কাঁদছে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। তার অশ্রুআর্দ্র গুমরানির মাঝে মাঝে বটুকেশ্বরের অসংলগ্ন কয়েকটা আদরের ডাক।

খানিক পরে বটুক আমাকে ডাকতে এল। বললে, ওর স্ত্রী রাজী হয়েছে, সম্মতি দিয়েছে।

আমি ঘরে ফিরে এলাম। আমাকে দেখে সুলেখা উঠে বসতে যায়। আমি বারণ করি। একটু গরম দুধ খাইয়ে দিলে ভাল হয়। বটুক রান্নাঘর থেকে দুধটা গরম করে আনতে গেল। সুলেখা শুয়ে আছে। আমি একটু দূরে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসলাম। ও বললে, -একটা সীন ক্রিয়েট করলাম।

সান্ত্বনা দিয়ে বলি, –এ আপনার একটা অসুখ সুলেখা দেবী। লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই।

ভিতরের দরজার দিকে চকিত দৃষ্টিপাত করে সুলেখা নিম্নকণ্ঠে আমাকে বললে, ও বুঝতে পারছে না। আপনি ওকে বারণ করুন ডাক্তারবাবু। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি একটা প্রকাণ্ড সর্বনাশ হতে চলেছে!…কিছু মনে করবেন না, আমি আপনাদের ঐ বন্ধুটাকে ভীষণ ঘৃণা করি। …আমি ওকে সহ্য করতে পারব না। আপনার বন্ধু যদি কোন কুষ্ঠ রোগীকে এখানে এনে তুলত, বিশ্বাস করুন, আমি আপত্তি করতাম না। কিন্তু…কিন্তু ঐ লোকটা..ব্লুট!

আমি বলি, আপনার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তো কিছু হতে পারে না। আপনার যদি সত্যিই এত তীব্র অনিচ্ছা থাকে তবে সেকথা বলুন।

–আমি তো বলছি। ও শুনছে না যে।

দুধের বাটি নিয়ে বটুক ফিরে এল। সুলেখাকে খাইয়ে দিল দুধটা।

বললাম, বটুক, গগ্যাকে এখানে আনা বোধহয় ঠিক হবে না।

বটুক খিঁচিয়ে ওঠে, তোকে আবার নতুন করে পোঁ ধরতে হবে না। বউ তো রাজী হয়েছে। আবার এখন কেন কেঁচে-গণ্ডুষ করছিস?

-না, উনি মন থেকে সায় দেননি!

–ও! ওর মনের খবর তুই আমার চেয়ে বেশি জানিস?

আমি সুলেখার দিকে তাকাই। তার ঠোঁট দুটো কেঁপে ওঠে। তারপর হঠাৎ সে বলে বসে, –আজ ক্রিস্টমাস। তোমার কাছে আমি ভিক্ষা চাইছি। আমার এত বড় সর্বনাশ তুমি কর না। আমি মিনতি করছি।

বটুক প্রথমটা থতমত খেয়ে যায়। একবার সুলেখার, একবার আমার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে। তারপর বোকার মত হেসে ওঠে। হাসতে হাসতেই বলে, —ও হো! তাই তো! কথাটা আমার খেয়ালই ছিল না। আজ ক্রিস্টমাস!তাই নয়? আজ কেউ কিছু চাইলে তাকে নিরাশ করতে নেই।

ধীরে ধীরে বটুক উঠে গেল ঘরের ও-প্রান্তে। উঁচু টুলের উপর যীশুখ্রীষ্টের যে ছবিখানা ছিল–যেখানা সে আজ উপহার দিয়েছে সুলেখাকে, সেই ছবিখানার উপর একটা তোয়ালে চাপা দিয়ে দিল। আমার দিকে ফিরে বললে, বাড়ি যা দীপু। রাত্রে আসিস। আমি ভুলেই গিয়েছিলাম, আজ ক্রিস্টমাস। রাত্রে চুটিয়ে পোলাও-মাংস দিয়ে বড়দিন করতে হবে।

আমার দৃষ্টি এক মুহূর্তের জন্যও সুলেখার মুখ থেকে সরে যায়নি। আমি এক দৃষ্টিতে দেখছিলাম তাকে। অপমানে, অভিমানে তার মুখটা টকটকে লাল হয়ে উঠেছে। দাঁতে দাঁত চেপে বললে, –ছবিটা ঢেকে দিলে যে?

জুতোজোড়া খুলছিল বটুক। যেন কিছুই হয়নি; বললে, –ছবিটা ঠিকমত আঁকতে পারিনি। যীসাসের ডান হাতের তালুতে ভুলে এক ফোঁটা লাল রঙ পড়ে গেছে। কাল ওটা মুছে দেব।

সামান্য কথা। হয়তো সত্যিই এক ফোঁটা বাড়তি রঙ পড়েছিল ছবিটায়। কিন্তু না, ওর ভিতর একটা গূঢ় অর্থ আছে। কী একটা নিবিড় ব্যঞ্জনা। সুলেখার মুখটা ছাইয়ের মত সাদা হয়ে গেল। দাঁতে দাঁত চেপে সে নিজেকে সংযত করল। তারপর বললে, — আমায় ক্ষমা কর। যাও, নিয়ে এস তোমার বন্ধুকে। আমি আর বাধা দেব না।

বটুক এবার নির্লিপ্তর মত বললে, কী দরকার? থাক না।

সুলেখাই এবার দৃঢ়স্বরে বললে, না! এতবড় কথাটা যখন তুমি বললে, তখন আর কোন কথা নেই। আমার সব আঘাত সইবে। যাও, নিয়ে এস গগনবাবুকে।

এবার খুশিয়াল হয়ে ওঠে বটুক। আমার উপস্থিতির কথা ভুলে সুলেখার গালটা টিপে দিতে যায়। সুলেখা হাতের ধাক্কায় তাকে সরিয়ে দিয়ে বলে, অসভ্যতা কর না।

আমি পালিয়ে আসি।

 পথে নেমে বলি, ব্যাপারটা কি রে বটুক?

-ওটাই ছিল আমার ট্রাম্প কার্ড! ব্যাপারটা কী, তা আমি জানি না। লেখার একটা অবসেশান আছৈযীসারের হাতের ঐ পেরেকের দাগটায়। একবার পেন্সিল কাটতে গিয়ে আমার হাতের তালুতে কেটে যায়। সেদিন তাই দেখে ফিট হয়ে গিয়েছিল সুলেখা।

মাথামুণ্ডু সেদিন কিছুই বুঝতে পারিনি। চিত্রলেখার কৈশোরের কথা তখন আমি জানতাম না।

.

বড়দিনের আনন্দটা কিন্তু সেদিন করা গেল না। রান্না করার সুযোগই পেল না সুলেখা। গগনকে নিয়ে আসতে গিয়েই হল মুশকিল। নড়াচড়ায় ওর অবস্থা খারাপের দিকে গেল। সারারাত পালা করে জেগে থাকতে হল ওদের স্বামী-স্ত্রীকে। আমিও অনেক রাত পর্যন্ত বসেছিলাম। রাত বারোটা নাগাদ বিপদের সম্ভাবনাটা কাটল। কোনরকমে কিছু মিষ্টি আর পাঁউরুটি-কেক খাইয়ে ওরা নিমন্ত্রণের মর্যাদা রক্ষা করল।

এরপর ভাইঝির বিয়েতে আমি খুব ব্যস্ত হয়ে পড়ি। বটুক প্রতিদিন এসে খবর দিয়ে যেত। ওষুধ আর পথ্যের ব্যবস্থা জেনে যেত। গগনকে ওরা আশ্রয় দিয়েছিল বাইরে স্টুডিও ঘরে। প্রথম দিন-তিনেক সম্পূর্ণ আচ্ছন্নের মত পড়ে ছিল সে। তারপর ওর পুরো জ্ঞান ফিরে এল। জ্বরটা ত্যাগ হল; কিন্তু ভীষণ দুর্বল হয়ে পড়ল গগন। বটুক দিবারাত্র ওর সেবা করে। দোকান বন্ধ। আর আশ্চর্য মানুষ ঐ সুলেখা! কে বলবে এই রোগীটাকে বাড়িতে আনায় তার প্রচণ্ড আপত্তি ছিল। দক্ষ নার্সের মত সে সব কিছু করে যায় নিরলস নিষ্ঠায়। মুখে কথা নেই। ওষুধ খাওয়ায়, পথ্য খাওয়ায়, গা স্পঞ্জ করিয়ে দেয় গরম জলে তোয়ালে ভিজিয়ে, বেডসোর যাতে না হয় তাই ওর লোমশ বুকে-পিঠে পাউডার মাখিয়ে দেয়। এমন কি ইউরিনাল-পট, বেডপ্যান পর্যন্ত সাফা করে। বটুক একেবারে মুগ্ধ হয়ে গেল তার ব্যবহারে। আমি মাঝে মাঝে ওদের ওখানে গিয়ে দু-দণ্ড বসতাম। রোগীর দায়িত্ব আমার কিন্তু ঐ পর্যন্তই। মানুষ হিসাবে গগ্যাকে আমি শ্রদ্ধা করতে পারিনি। শান্তি দেবীর প্রতি তার ব্যবহারটা আমি ভুলতে পারিনি। কিন্তু রোগীর জাত নেই। তাই ডাক্তার হিসাবে যেটুকু করার করে আসি।

আরও দিন-সাতেক কাটল। এখন বটুক বাধ্য হয়ে দোকান খুলেছে। বিকেলবেলা আগের মত সে বেরিয়ে যায়। সুলেখা এখন একা নয়। সে কাজকর্ম করে আর রোগীর দেখাশোনা করে। রাতে আর রোগীর ঘরে কাউকে জেগে বসে থাকতে হয় না। গগ্যার পুরো জ্ঞান আছে; কিন্তু একটি কথাও সে বলে না। না বটুকের সঙ্গে, না তার স্ত্রীর সঙ্গে, না আমার সঙ্গে। কৃতজ্ঞতা বলে একটা শব্দ যে অভিধানে আছে, গগ্যা বোধকরি সেটা জানে না। একবারও বটুককে বলে না দুটো কৃতজ্ঞতার কথা।

কি রে, আজ কেমন আছিস?

গগ্যা ওপাশ ফিরে শোয়। যেন সে বটুকের ঘরে অন্তরীণ এক বন্দী। যেন ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাকে ধরে রাখা হয়েছে। এমন কি বটুক পর্যন্ত মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়ে ওঠে।

–ও কথা বলে না কেন? ও কি রাগ করেছে ওকে নিয়ে আসায়? ও কি বুঝতে পারে না, আমরা ওকে না নিয়ে এলে ও মরে যেত?

সুলেখাই বরং বলে, –গগনবাবু অসুস্থ। ওঁর ব্যবহার এখন স্বাভাবিক নয়।

গগ্যা কথা না বললেও সুলেখা বুঝতে পারে, কখন তার কি চাই। ওর চোখে আলোটা লাগছে, তাই আড়াল করে দেয়। ওর বালিশটা সরে গেছে ঠিক করে দেয়। ওর জলতেষ্টা পেয়েছে ফিডিং কাপটা বাড়িয়ে ধরে। গগ্যা খুশি হয় কিনা বোঝা যায় না। তার কণ্ঠস্বরে তো নয়ই, এমন কি চোখের তারাতেও কোন কৃতজ্ঞতার আভাস নেই।

একদিন বটুক আমাকে জনান্তিকে বলল, আশ্চর্য! ওরা দুজন ঘন্টার পর ঘন্টা মুখোমুখি বসে থাকে। কেউ কোন কথা বলে না।

একদিন দৃশ্যটা আমারও নজরে পড়ল। গগ্যা চিৎ হয়ে শুয়ে ছিল। আমি আর বটুক ভিতরের বারান্দায় বসে কথা বলছিলাম। ঘরের ভিতরটা আমি দেখতে পাচ্ছি। সুলেখা বসে একটা সার্টে বোম লাগাচ্ছিল। আমার হঠাৎ খেয়াল হল, এটা গগ্যার সেই রক্তমাখা সার্টটা। কাঁচা হয়েছে কিন্তু রক্তের দাগটা ঠিকমত ওঠেনি। লক্ষ্য করে দেখি, গগ্যা একদৃষ্টে সুলেখার দিকে তাকিয়ে আছে। সুলেখার গায়ে যেন সে দৃষ্টিটা বিধল। সে চোখ তুলে তাকালো ওর দিকে। দুজনে দুজনের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। কেউ কথা বলে না। সুলেখার চোখের ভাষা আমি বুঝতে পারিনি। মনে হল কেমন যেন। আতঙ্ক মেশানো। পরমুহূর্তেই গগ্যা কড়িকাঠ গুনতে শুরু করে; কিন্তু সুলেখার দৃষ্টি তখনও রোগীর দিকে। এখন তার দৃষ্টিতে ভয় নয় কি যেন একটা মিশে গেছে।

কিছুদিন পরেই গগ্যা উঠে বসল, কিন্তু সে আমাদের সেই চিরপরিচিত দানব-গগ্যা নয়। নিতান্তই একটা কঙ্কাল। একমুখ দাড়ি, একমাথা চুল–একটা হাড়-জিরজিরে শীর্ণকায় মানুষ। এখন সে দু-একটা কথা বলে–কী তার চাই, কী অসুবিধা হচ্ছে, জানায়। বিছানা থেকে নেমে নিজেই বাথরুমে যায়। কখনও বটুকের হাত ধরে, কখনও। সুলেখার কাঁধে ভর দিয়ে।

এরর বেশ কিছু দিন আমি ওদের খোঁজ-খবর আর নিইনি। বটুকও আর আসে না। ওষুধ বন্ধ হয়েছে। মাথার ঘাটা শুকিয়ে গেছে। ড্রেসিং-এর দরকার হয় না। এখন পথ্যই একমাত্র ওষুধ। বটুক ফল নিয়ে আসে, মাংস-ডিম নিয়ে আসে। গগ্যা দিন দিন তার স্বাস্থ্য ফিরে পায়। আমি নিজের প্র্যাকটিসে ফিরে আসি। ওদের খবর আর রাখিনি।

মাসখানেক পরে চৌরঙ্গী দিয়ে গাড়ি নিয়ে যাচ্ছি, হঠাৎ মনে হল মনোহরদাস তড়াগের কাছে একটা লোক বসে ছবি আঁকছে-ঠিক বটুকের মত দেখতে। হ্যাঁ, বটুকই তো। গাড়ি থামিয়ে আমি নেমে আসি। বটুক ইদানিং আর ল্যাণ্ডস্কেপ আঁকে না। এতদিন পরে হঠাৎ নৈসর্গিক চিত্র আঁকতে বসেছে কেন জানবার কৌতূহল হল।

-কি রে বটুক? আবার ল্যাণ্ডস্কেপ শুরু করলি নাকি?

আমাকে দেখতে পেয়ে ও চমকে ওঠে। ম্লান হাসে। বোকার হাসি। আমতা আমতা করে বলে, -হা, –আবার কিছুদিন ধরে আউট-ডোর ধরেছি।

-গগ্যা ফিরে গেছে বরানগরে?

না; ও আমার বাসাতেই আছে।

কেমন যেন খটকা লাগল।

–একেবারে ভাল হয়ে যায়নি সে? কী করে আজকাল?

–হ্যাঁ, ভাল হয়ে গেছে। ও আমার স্টুডিওতে আঁকে তো। তাই আমি আবার আউট-ডোর ধরেছি।

–সে আবার কি রে?

বটুকের মুখ-চোখ কেমন যেন লাল হয়ে ওঠে। বলে, –দোষটা আমারই। ভেবেছিলাম দুজনে একই সঙ্গে কাজ করব আমার স্টুডিওতে। গগ্যার এখন এমন ক্ষমতা নেই যে বরানগরে ফিরে যায়। অথচ সারাদিন সে করেই বা কি! তাই ভেবেছিলাম, দুজনে একসঙ্গে ছবি আঁকলে ভালই হবে। গগনেন্দ্রনাথ আর অবনীন্দ্রনাথ যেমন পাশাপাশি বসে আঁকেন। ওর জন্যে ক্যানভাস, তুলি সব এনে দিলাম। কিন্তু মানুষ ভাবে এক আর হয় আর।

তার মানে? আমি যে কিছুই বুঝতে পারছি না।

 ঘরে অন্য লোক থাকলে গগ্যা আঁকতে পারে না!

আমি চাপা গর্জন করে উঠি, চুলোয় যাক গগ্যা! বাড়িটা কার? ঘাড় ধরে বার করে দিতে পারিসনি এতদিনেও?

হঠাৎ অবাক হয়ে দেখি বটুকের দু চোখ জলে ভরে উঠেছে। কী ব্যাপার?

বটুক মাথাটা নীচু করে কোনক্রমে বললে, -ও আমাকে বাড়ি থেকে বার করে দিয়েছে।

আমি আকাশ থেকে পড়ি। বটুক বলে কী? তার বাড়ি থেকে তাকে বার করে দিয়েছে মানে? ওর কাধ ধরে একটা ঝকানি দিয়ে বলি, তুই মানুষ, না কি রে? তোর বউ কি বলে?

ও কিছুই বলে না। ওকে বলেছিলাম, তাতে বললে, আমি তো ওকে এখানে আনিনি। তুমি পার তো তাড়াও!

আমি বলি, উঠে আয় আমার গাড়িতে। আপদ কি করে বিদায় করতে হয়, চল্ তোকে দেখিয়ে দিই!

ও আমার হাত দুটি ধরে বললে, –প্লীজ দীপু! তুই এর ভিতর নাক গলাস না। ও আমিই ম্যানেজ করে নেব।

বেশ বুঝতে পারি, ও আমার কাছ থেকে কিছু লুকোতে চাইছে।

সেদিন যেটা বুঝতে পারিনি; সেটা বোঝা গেল আরও দিন সাতেক পরে। সকালবেলা ডাক্তারখানায় বসে আছি, একটি লোক এসে বললে, মুচিপাড়া থানার ও. সি. তাকে পাঠিয়েছেন। কী ব্যাপার? ব্যাপার আর কিছুই নয়, গতকাল রাত থেকে হাজতে একটি লোক আটক আছে। নাম বটুকেশ্বর দেবনাথ। সে নাকি ঠিকানা বলছে না। শেষ পর্যন্ত আমার নাম বলেছে।

তখনই গাড়ি নিয়ে চলে গেলাম মুচিপাড়া থানায়। বটুক কাল রাত থেকে থানার হাজতে পড়ে আছে? কী করেছে সে? ও. সি.র সঙ্গে দেখা করতে তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বললেন, পোশাক-পরিচ্ছদ দেখেই বুঝতে পেরেছি ভদ্রঘরের ছেলে। কিন্তু কী করব বলুন?

ঘটনা যা শোনা গেল, তা হচ্ছে এইঃ

কাল রাতে বটুককে একটি রিকশায় চাপিয়ে থানায় নিয়ে এসেছে একজন মদের লাইসেন্সড ভেণ্ডার। সন্ধ্যারাত্রি থেকে সে দোকানে বসে মদ্যপান করেছে। দোকান বন্ধ হবার সময় সে সম্পূর্ণ বে-এক্তিয়ার। পকেট তালাস করে দেখা গেছে, তার পকেটে। একটি পয়সা নেই। ঘড়ি-আংটি খুলে নিলে অবশ্য মদের দামের দশগুণ আদায় হত; কিন্তু দোকানদার ভদ্রলোক সে চেষ্টা করেননি। ওকে থানায় পৌঁছে দিয়ে গেছেন। সঙ্গে তার মদের একটি বিলও আছে। দারোগাবাবু কাহিনী শেষ করে বলেন, -দেবনাথবাবু কি রেগুলার ড্রিঙ্কার?

আমি বলি, –ও আমার স্কুলের বন্ধু। ত্রিশ বছর ধরে জানি। ওকে একদিনও মদ খেতে দেখিনি। খেলে আমি নিশ্চয়ই জানতে পারতাম।

দারোগাবাবু বলেন, আপনি ওঁর মদের দামটা মিটিয়ে ওঁকে খালাস করে নিয়ে যেতে চান? ভদ্রলোকের ছেলে বলে বুঝতে পারায় আমি এখনও কেসটা ডায়েরি করিনি।

আমি তৎক্ষণাৎ মদের বিল মিটিয়ে বটুককে উদ্ধার করলাম। মাত্র সাতদিন আগে যে বটুককে মনোহরদাস তড়াগে ছবি আঁকতে দেখেছি, এ যে সেই লোক কে বলবে?

আমাকে দেখে ও হাউমাউ করে কেঁদে একটা সীন করল থানার ভিতরেই। এতক্ষণে তার নেশা ছুটে গেছে। এ মাতালের কান্না নয়। গাড়িতে তুলে বলি, -খালি পকেটে মদ খেতে এসেছিলি কেন?

ও রুমাল দিয়ে চোখ দুটো মুছতে মুছতে বললে, খালি পকেটে আসিনি। মানিব্যাগটা কেউ মেরে দিয়েছে।

কত ছিল তাতে?

–তা জানি না। কিন্তু কোথায় যাচ্ছিস?

–কোথায় আবার? তোর বাড়িতে? যোগেশ মিত্র রোডে।

বটুক এমনভাবে আমার হাত চেপে ধরেছে যে আর একটু হলে অ্যাকসিডেন্ট হয়ে যেত। পথের পাশে গাড়ি দাঁড় করিয়ে বলি, কী ব্যাপার?

-ওখানে আমি যাব না।

–তবে কোন্ চুলোয় যাবি?

বটুক একটু ভেবে নিয়ে বলে, বরানগরে চল্।

-বরানগর? গগ্যার ওখানে? গগ্যা কি তাহলে ফিরে গেছে?

 বটুক বললে, –কোথাও গিয়ে বসে তোকে সব বলি।

একগাদা রুগী বসিয়ে রেখে এসেছি। খোশগল্প করার সময় আমার নেই। কিন্তু বটুকের অবস্থা দেখে করুণা হল। প্রচণ্ড একটা সাইক্লোন যেন বয়ে গেছে এ কদিনে। ওর ব্যাপারটা জানা দরকার। বটুকের অবশ্য চরিত্রগত একটা ঝোঁক আছে মেলোড্রামাতে বিদূষকের ভূমিকায় অভিনয় করার। সেই ফর্মূলা অনুসারে যথারীতি মনের দুঃখে সে মদ খেয়েছে। তবে ঐ–একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে। মানিব্যাগটা কখন খোয়া গেছে টের পায়নি। তাই এক রাত হাজতবাস।

গাড়িটাকে রাস্তার একপাশে রেখে একটা পার্কে ঢুকি। বেঞ্চির উপর লোকজন; আমরা ফাঁকা দেখে ঘাসের উপর এসে বসলাম। বলি, -এবার বল, কী হয়েছে?

বটুক ঘাসের শিষ ছিঁড়তে ছিঁড়তে মুখ নিচু করে জবাব দিল, বউ আমাকে ছেড়ে চলে গেছে।

ঐ কটা কথা বলতেই ওর গলা বুজে এল। সুলেখাকে তো চিনি! যা একরোখা মেয়ে! গগ্যাকে ওদের বাড়িতে নিয়ে আসায় তার ঘোরতর আপত্তি ছিল। বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার কথা সে প্রথম দিনেই বলেছিল; কিন্তু শেষ পর্যন্ত বটুকের পীড়াপীড়িতে ঐ জংলী মানুষটাকে বরদাস্ত করতে রাজী হয়েছিল। আমার মনে হল, সুলেখা নিশ্চয় বটুককে বলেছে এবার তার বন্ধুকে বিদায় দিতে; আর নপুংসক বটুক সে সাহস সঞ্চয় করে উঠতে পারেনি। তাই বোধকরি সুলেখা সহ্যের সীমা পার হওয়ায় বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। গেলেই বা কতদূর যাবে? গগ্যাকে এবার তার স্ব-স্থানে পাঠিয়ে দিলে নিশ্চয় সুলেখা ফিরে আসবে। বটুকের টোবা গাল বেয়ে দু ফোঁটা জল ঝরে পড়ল। আমি হাসতে পারলাম না অমন হাস্যকর দৃশ্যটা দেখে; বলতে পারলাম না–দুঃখ করিস না বটুক, অভাগার ঘোড়া মরে, আর ভাগ্যবানের বউ মরে! বরং বললাম, -আরে বন্ধু, কাঁদছিস কেন? ও ফিরে আসবে। রাগের মাথায় অমন সবাই বলে রইল তোমার ঘরদোর, আমি চললাম।

বটুক মুখটা তোলে না। মাটিতে আঁচড় কাটতে কাটতে অস্ফুটে বলে, তুই বুঝতে পারছিস না। বউ ওকে ভালবাসে–ঐ গগ্যাকে।

-কী! প্রথমটা ভীষণ চমকে উঠেছিলাম; কিন্তু পরমুহূর্তে নিজেই নিজের উপর রাগ করি। এতটা চমকে ওঠার কি আছে? এ যে নিতান্ত অসম্ভব! ও পাগলটা বলছে বলেই বিশ্বাস করতে হবে? বলি, –তোর খোঁয়াড় কি এত বেলাতেও ভাঙেনি রে বটুক? এখনও নেশার ঘোরে আছিস? গগ্যাকে হিংসে করতে তোর লজ্জা হচ্ছে না? তুই নিজে চোখে দেখিসনি–গগ্যাকে কী ভীষণভাবে ঘৃণা করে তোর বউ!

বটুক বাঁ হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে চোখ দুটো মুছে নিয়ে বললে, তুই বুঝছিস না।

-না, আমার বুঝে কাজ নেই। কাল রাতে তো পাঁট পাট মদ গিলেছিলি, সলিড খাবার সঙ্গে কিছু খেয়েছিলি?

এতক্ষণে ও মুখ তুলে তাকায়। বলে, –শুধু কাল রাতে নয়, দিনেও কিছু খায়নি।

তবে চল্‌, দ্বারিকের দোকানে চল্। খালি পেটে অমন উদ্ভট চিন্তা হয়। মনে হয়, ঘরের বউ বুঝি বাইরের লোকের সঙ্গে প্রেম করছে। সকালবেলা গরমাগরম হিঙের কচুরি ভাজে। আর আলুরদম। ভাল করে খেয়ে নে-দুঃস্বপ্ন ছুটে যাবে। তারপর তোকে যোগেশ মিত্তির রোডে পৌঁছে দিয়ে তবে আমার ছুটি।

-বললাম যে, ওখানে আমি যেতে পারব না। ওরা ওখানে আছে। আমি ওবাড়ি ছেড়ে দিয়ে বেরিয়ে এসেছি।

তাই বল্! তার মানে তোর বউ গৃহত্যাগ করেনি; তুই নিজেই তাকে ত্যাগ করে চলে এসেছিস!

দীপু, প্লীজ ওভাবে বলিস না।

আমি বলি, -বেশ, আর ওভাবে বলব না। নে, ওঠ, চল, তোকে কিছু খাইয়ে আনি

–আমার ক্ষিদে পায়নি। বস্, তোকে সবটা আগে বলি।

 ধমক দিয়ে উঠি, কাল সারাদিন কিছু খাসনি, ক্ষিদে পায়নি কি রকম?

প্লীজ দীপু, আগে আমার সব কথা শোন্। মনটা হালকা না করলে আমি কিছু খেতে পারব না।

অগত্যা আবার বসে পড়ি। হয়তো ঠিক কথাই বলছে বটুক। মনটা খালি না হলে পেটটা সে ভরাতে পারবে না।

কাল সকালবেলা আর মেজাজ ঠিক রাখতে পারিনি। আমি গগ্যাকে বললাম তোর শরীর তো একেবারে ভাল হয়ে গেছে। এবার তুই নিজের ডেরায় যা—

আমি বলি, একথা অনেক আগেই বলা উচিত ছিল তোর। তারপর?

–গগ্যা হেসে উঠল। ওর হাসি তো জানিস–গা জ্বালা করে। অবজ্ঞার হাসি। বললে, –সে তখনই চলে যাবে। ও নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে নেয়। তুই তো জানিস, ইতিমধ্যে বরাগনগর থেকে আমি ওর জিনিসপত্র কিছু নিয়ে এসেছিলাম। ও একটা পোঁটলা বাঁধে। লেখাকে বলে একটা দড়ি নিয়ে আসতে।

বটুক হঠাৎ থেমে পড়ে। একটু দম নেয়। ওর চোখে জল এসে যাচ্ছিল বোধহয়। অনেক কষ্টে সেটাকে ঠেকিয়ে রাখে। মুখটা নিচু করে আবার শুরু করে, বউ একটা দড়ি এনে দিল। গগ্যা আপন মনে পোঁটলা বাঁধতে থাকে আর গুনগুন করে একটা সুর ভঁজে। আমি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করি। গগ্যা খাটের নিচে থেকে তার জুতোজোড়া বার করে যখন পায়ে দিচ্ছে তখন হঠাৎ ফস্ করে বউ বলে ওঠে–আমি ওর সঙ্গে যাচ্ছি। আমি এখানে আর থাকব না। আমি কথা বলতে গেলাম, কিন্তু স্বর ফুটল না। গগ্যার কোন ভাবান্তর নেই। সে নিচু হয়ে জুতোর ফিতে বাঁধছিল, আর গুনগুন করে গান গাইছিল– ।

বটুক আবার চুপ করে। কোঁচার খুঁটে মুখটা মুছে নেয়। চোখ দুটোও। এতক্ষণে আমার মনে হল ব্যাপারটা সত্যিই অত্যন্ত বিশ্রী মোড় নিয়েছে। বটুকের কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু সব কথা না বলেও তার পরিত্রাণ নেই। বুকটা হাল্কা করতে হবে। অরুদ্ধ কণ্ঠে ভাঙা ভাঙা কথায় ও ঘটনাটা বিবৃত করে ।

বটুক তার স্ত্রীকে বোঝাতে যায়, বাধা দিতে চায়, এমন ভয়ঙ্কর সিদ্ধান্ত থেকে বিরত করতে চায়; কিন্তু সুলেখা যেন পাষাণ দিয়ে গড়া। কোন কথাই তার কানে যায় না। বটুক তার ভালবাসার দোহাই পাড়ে, চোদ্দ বছরের সহবাসের কথা বলে, হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এসে সে কেমন করে ওর হাত ধরে প্রতিজ্ঞা করেছিল সে কথা মনে করিয়ে দেয়। সুলেখার কোন ভাবান্তর নেই। দামোদরের জলে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তারা কীভাবে পরস্পরকে অবলম্বন করে ডুবতে বসেছিল সে কথা শুনেও অবিচল থাকে সুলেখা। ক্রুশবিদ্ধ যীশুর ডান হাতের তালুতে জমে-ওঠা রক্তের বিন্দুটাও ব্যর্থ হয়ে যায়। বটুক শেষে বলে, –গগ্যার ঘরদোর বলে কিছু নেই। ও বস্তীতে থাকে। সেখানে তোমার মত মেয়ে থাকতে পারবে না। এ তুমি কী বলছ লেখা?

এতক্ষণে সুলেখা জবাব দেয়, খাল কেটে তুমিই তো এ কুমীর এনেছিলে একদিন?

বটুক মরিয়া হয়ে তখন গগ্যার দিকে ফিরে বলে, তুই ওকে বারণ কর গগ্যা!

গগ্যা এতক্ষণ কোন কথা বলেনি। জুতো পরা হয়ে গিয়েছিল তার। উঠে দাঁড়ায়। বলে, –আমি ওকে আসতে বলিনি। আমি ওকে বাধাও দেব না।

-কিন্তু তোর ঐ বস্তীতে গিয়ে লেখা বাস করবে কি করে? এখানে ও কীভাবে আছে আর ওখানে কীভাবে থাকতে হবে! তুই তো অন্তত সেকথা বুঝবি।

গগ্যা বললে, –আমার কাছে এটা কেমন করে আশা করছিস মটকু? আমি নিশ্চিন্ত আরামের আশ্রয় ছেড়ে নিজেই তো একদিন ওখানে আশ্রয় নিয়েছিলাম

–তুই আর্টিস্ট। তোর কথা আলাদা। ও কিসের আকর্ষণে–

ঝাঁট দে–সেকথা ও বলবে। আমি নয়। পোঁটলাটা তুলে নেয় হাতে।

সুলেখা একবস্ত্রেই বেরিয়ে আসে। গগ্যার পাশে এসে দাঁড়ায়। বটুক আর নিজেকে সামলাতে পারে না। দুরন্ত ক্রোধে সে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। হঠাৎ ঝাঁপ দিয়ে পড়ে গগনের উপর। দু হাতে কিল-চড়-ঘুষি চালাতে থাকে। গগন প্রথমটা হকচকিত হয়ে যায়। এ আক্রমণের জন্য সে প্রস্তুত ছিল না। কিন্তু মুহূর্ত মধ্যে সে নিজেকে সামলে নেয়। অসুখে সে দুর্বল হয়ে পড়েছে বটে, তবু বটুকের তুলনায় সে দুর্বলতা কিছুই নয়। পরমুহূর্তেই ছোট্ট মানুষটা মেজের উপর উল্টে পড়ে যায়। গগ্যা তার দিকে ফিরে ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে বলে, -মটকু কোথাকার!

বটুক উঠে বসে। প্রথমটা কিছুই দেখতে পায় না। চোখ থেকে তার চশমাটা ছিটকে কোথায় পড়ে গেছে। ও খুঁজে পায় না। সুলেখা নিঃশব্দে সেটা কুড়িয়ে এনে ওর হাতে দেয়। একটি কথাও বলে না। চটিজোড়া পায়ে দেয়।

সুলেখা দৃঢ়স্বরে বলে, আর ন্যাকামি কর না। উঠে দাঁড়াও। আমাকে যেতে দাও।

ন্যাকামি!-বটুক উঠে দাঁড়ায়। বলে, –গগ্যার একটি পয়সা নেই। সে তোমাকে কি খাওয়াবে? তোমরা দুজনেই যে না খেয়ে মরবে

-সে তোমাকে ভাবতে হবে না।

বটুক দৃঢ়ভাবে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, না! আমাকেই ভাবতে হবে। তুমি সে বস্তীর ঘরখানা দেখনি। সেখানে চারদিকে শুধু ময়লা আর কাদা। মোদোমাতালের আড্ডা। তুমি কিছুতেই সেখানে থাকতে পারবে না।

–সে সব তোমাকে ভাবতে হবে না। গগ্যা যেখানে যাবে আমিও সেখানে যাব।

-হ্যাঁ হ্যাঁ, জানি। বেশ, কোথাও তোমাদের যেতে হবে না। সুলেখা, তুমি আমাকে বিয়ে করতে রাজী হওনি। হয়তো আমার মত বাঁদরকে ভালও বাসতে পারনি কোনদিন। আমি কিন্তু তোমাকে চোদ্দ বছর ধরে স্ত্রীর মর্যাদাই দিয়ে এসেছি। তুমি মানো আর না মানো, আমার যা কিছু আছে তার আধখানা তোমার। বেশ, গগ্যাকে ছেড়ে তুমি যদি না থাকতে পার, তবে তোমরা দুজনেই থাক এখানে। যেতে হয় আমিই চলে যাচ্ছি।

এবার গগ্যা বললে, তার মানে?

তার মানে সুলেখা মানুক আর না মানুক সে আমার স্ত্রী। ঐ বস্তীতে তাকে আমি থাকতেও দেব না। তোমরা দুজনেই এখানে থাক, আমি চলে যাচ্ছি। কাল এসে আমার জামা কাপড় নিয়ে যাব। আমিই থাকব বরানগরের বীতে।

এবার আর গগ্যা কথা খুঁজে পায় না। সুলেখাও নির্বাক।

ঝড়ের বেগে বেরিয়ে এসেছিল বটুক। সারাদিন কোথায় কোথায় ঘুরেছে তা মনে নেই। সন্ধ্যেবেলা ঢুকেছিল একটা মদের দোকানে। তারপর তার যখন জ্ঞান ফিরে আসে তখন নিজেকে আবিষ্কার করে মুচিপাড়া থানার হাজতে।

.

বটুককে পৌঁছে দিয়ে এলাম বরানগরের সেই বস্তীতে। গগ্যার খাটিয়ায় বসল সে আমার মুখোমুখি। আসবার পথে কিছু খাবারও কিনে এনেছিলাম। বটুক খেল আমার সামনে বসে। রাস্তার কলে খনও জল ছিল। মুখটা ধুয়ে এল সেখানে গিয়ে।

বললাম, –এবার আমি যাই?

যাবি? তা যা। হ্যাঁ, তুই আর কতক্ষণ থাকবি এখানে!

তুই সারাদিন কি করবি?

ছবি আঁকব। বোধহয় এবার আমার ছবি উৎরোবে—

 খাটিয়ার নিচে গগ্যার ফেলে-যাওয়া রঙ-তুলিগুলো সে টেনে টেনে বার করছিল। হঠাৎ মুখ তুলে বলে, -আচ্ছা তুই-ই বল্ দীপু, এখানে এসে সুলেখার মত মেয়ে থাকতে পারে? তাকে কি এখানে আসতে দিতে পারি?

আমি বলি, –সে তোমার স্ত্রী। তুমি বুঝবে।

–তুই হলে কী করতিস?

–আমি সোজা তাকে খোলা দরজা দেখিয়ে দিতাম। জেনে বুঝে কেউ যদি আগুনে হাত দেয় তাহলে হাত তার পুড়বেই।

বটুক বললে, হ্যাঁ, তুই তো ওকথা বলবিই!

–কেন?

 কুতকুতে চোখ দুটো আমার দিকে তুলে বটুক বললে, তুই তো আর সুলেখাকে ভালবাসিসনি!

–তা বটে! কিন্তু তুই কি এখনও তাকে ভালবাসিস?

নিশ্চয়! আগের চেয়ে বেশি! লেখা তো আর সজ্ঞানে নেই, সে এখন মোহগ্রস্ত হিপনোটাইসড়! এ আর কদিন? গগ্যা দুদিন পরেই ওকে ছুঁড়ে ফেলে দেবে–পড়া-শেষ বইয়ের মত।

কৌতূহল হল। বললাম, তখন কি আবার তুই ছুঁড়ে দেওয়া বইখানা তুলে ঘরে নিতে চাস?

সুলেখা যদি কোনদিন ফিরে আসে আমি তাকে আবার ডেকে নেব। জানি সে তখন আমাকে নতুন করে ভালবাসতে পারবে না। আর সে কথা কি? ও হয়তো কোনদিনই আমাকে ভালবাসেনি। আমার মত বাঁদরকে আর কে ভালবাসবে ব? একটা ছেলেও যদি দিতে পারতাম তার কোলে! তা হোক! আমি তো তাকে ভালবেসেছিলাম! আমার প্রেমকে তো সে স্বীকার করে নিয়েছিল, বাধা দেয়নি। সেই ই যথেষ্ট।

আমি আর বিরক্তি চেপে রাখতে পারলাম না। আপনা থেকেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, -তোর মত ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্সের মানুষ জীবনে দুটি দেখিনি!

ইনফিরিয়র টু হোয়াট? টু লাভ! তুই জীবনে কখনও ভালবাসিসনি দীপু! তাই জানিস না। প্রেমের বাজরে ভ্যানিটির স্থান নেই। আত্মসচেতন মানুষ ভালবাসতে জানে না।

এ আলোচনা আমার ভাল লাগছিল না। কথা ঘোরাবার জন্য বলি, –তুই কি একেবারেই কিছু সন্দেহ করিসনি?

বটুক একটুক্ষণ চুপ করে থাকে। কী যেন ভাবতে থাকে। জবাব দেয় না।

আমি বলি, –এ সব কথা যদি তোর ভাল না লাগে তবে থাক।

-না না। আমি বলতেই চাই। বললেই মনটা হালকা হয়ে যাবে। হ্যাঁ, আমি টের পেয়েছিলাম। বোধহয় লেখা তার মনকে বুঝতে পারার আগে আমি তার মন বুঝতে পেরেছিলাম।

-তাহলে তখনই গগ্যাকে বিদায় করিসনি কেন?

আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। মনে হয়েছিল এ অসম্ভব। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারিনি। লেখা ওকে দুচক্ষে দেখতে পারত না। এ আমি কেমন করে বিশ্বাস করব, ব? আমার মনে হল অহেতুক ঈর্ষার ভুল দেখছি আমি। ব্যাপারটা কি জানিস, আজ চোদ্দ বছর ধরেই এ কাণ্ডটা ঘটছে। সুলেখাকে আমি সব সময় সন্দেহের চোখে দেখতাম। আমার কোন বন্ধুর সঙ্গে ও হেসে কথা বললে আমার বুকটা ধড়াস। করে উঠত। তোর মনে আছে দীপু-তুই প্রথম দিন বলেছিলি পূজারিণী ছবিতে আমি কল্পনার আশ্রয় না নিলেই ভাল করতাম? তখনও আমার বুকটা ধড়াস করে উঠেছিল। কারণ আমি দেখেছিলাম, ঐ কথা শুনে লেখা রাঙিয়ে উঠেছিল। আমি তোকেও ঈর্ষা করতাম। তাই যখন দেখলাম, লেখা ঐ বর্বর জানোয়ারটাকে অন্য দৃষ্টিতে দেখছে, তখন মনে হল এবারও দৃষ্টিভ্রম হচ্ছে আমার। আমি ভুল দেখছি। কিন্তু এবার ভুল হয়নি আমার।

আমি বলি, –আচ্ছা, লোকে যে বলে ভাল করলে ভাল হয়, সে সব একেবারে বাজে কথা, নয়? তুই তো গগ্যার ভাল করতেই চেয়েছিলি। ক্রিসমাসের দিনে একটি ভাল কাজ করেছিলি। তার ফল কি হল?

বটুক বললে, ওসব বাজে কথা। ভাল করলে ভাল হয়, আর মন্দ করলে মন্দ! তাহলে শ্রীরামকৃষ্ণ কখনও ক্যান্সারে ভুগে ভুগে মারা যান?

একটু হাসি মিলিয়ে বলি, তার মানে, তোর এ গল্পের মরাল হচ্ছে-দুনিয়ায় কারো ভাল করতে নেই? কেমন-না?

ছোট্ট মানুষটা তার ছোট ছোট চোখ দুটো আমার দিকে মেলে বললে, ভুল করলি দীপু। ওটা এ গল্পের মরাল নয়। এ গল্পের মরাল হচ্ছে–তা সত্ত্বেও ভাল কাজ করাই মনুষ্যত্ব।

–তার ফল খারাপ হতে পারে জেনেও?…

হ্যাঁ, তাই। ফলটা তের হাতে নয়, কাজটা তোর। পাকা খুঁটি যেমন কেঁচে আসে সেভাবে আজ যদি আবার আমি সেই ক্রিসমাস ডে-তে পৌঁছাই তাহলে জেনে বুঝে আবার ঐ একই ভুল আমি করব। মুমূর্য গগ্যাকে আবার নিয়ে আসব আমার বাসায়।

আমি জবাব দিতে পারিনি। বটুক ছেলেটা জীবনে কিছুই করতে পারেনি, কিছুই করতে পারবে না। সব দিক থেকেই সে বিদূষক! সে বউকে ধরে রাখতে পারে না, নিজেকে সে বাঁদর বলে, যেখানে-সেখানে ছোট ছেলের মত ভ্যা করে কেঁদে ফেলে। একটা বাফুন! কিন্তু এমন কথা এমন সুরে কটা মানুষ বলতে পারে?

আবার কথা ঘোরাবার জন্য বলি, সুলেখার মত মেয়ে এমন বদলে যাবে এটা এখনও আমি বিশ্বাস করতে পারছি না।

বটুক বললে, –কিন্তু এটাই তো জগতের নিয়ম দীপু। তোর ভুল কোথায় হচ্ছে জানিস? তুই উপন্যাস পড়া বিদ্যে দিয়ে জগতের বিচার করতে চাইছিস। ভাবছিস এ দুনিয়ার মানুষ সব বঙ্কিমের উপন্যাসের চরিত্র। যে নায়ক সে উদার মহৎ সাহসী ধীরোদাত্ত; যে খলনায়ক সে কুটিল কুচক্রী ভীরু। কিন্তু সত্যিকারের জগৎ এমন বাঁধা ফর্মুলায় চলে না। এই আমার কথাই ধর না। একদিন বরিশালে যখন লাঠিচার্জ হচ্ছে। তখন একজন নিমজ্জমান মানুষকে বাঁচাবার সাহস আমার হয়নি। অথচ তাঁকে চিনতাম, ভালবাসতাম, শ্রদ্ধা করতাম। তখন আমার কিশোর বয়স, মানুষের যখন ভয়-ডর বলে কিছু থাকে না। কিন্তু ওটাই তো আমার শেষ কথা নয়। সেই আমিই আবার একদিন দামোদরের জলে ঝাঁপ দিয়ে পড়েছিলাম আর একজনকে বাঁচাতে–যাকে আমি চিনি না, জানি না! এতবড় কন্ট্রাডিকশানটা যদি আমার জীবনে সত্য হতে পারে তাহলে সুলেখার বেলাতেই বা তা হবে না কেন?

বলি, তুই কিছুদিন বরং বাইরে থেকে ঘুরে আয়! এ বস্তীর জীবন তুই নিজেও সহ্য করতে পারবি না।

বটুক বললো–না না, আমাকে এখন কলকাতাতেই থাকতে হবে। ভবানীপুরের বাড়িওয়ালাকে আমার ঠিকানাটা জানিয়ে রাখতে হবে। মাসান্তে ভাড়া না দিলে ওদের উচ্ছেদ করবে

–সে তো বাইরে থেকে মনি-অর্ডার করেও পাঠাতে পারিস!

–তুই বুঝছিস না। যে-কোন দিন গগ্যা ওকে ফেলে পালাতে পারে। আমাকে হাতের কাছেই থাকতে হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *