আবার যদি ইচ্ছা কর – ৫

আসানসোল মেথডিস্ট চার্চের প্রধান যাজক রেভারেণ্ড জোশেফ মার্লো পরিচয়পত্রখানি পড়ে খুশি হলেন। চন্দ্রভানকে আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বলেন, আপনাকে আমরা সাদরে গ্রহণ করছি। পাশেই বসেছিলেন তার সহকারী ব্রাদার দাভিদ। তাঁকে বলেন, এ ভালই হল-জোড় জাঙ্গাল কোলিয়ারিতে খ্রীষ্টধর্মের প্রচার আজ পনের বছর ধরে বন্ধ আছে। ফাদার শারদাঁ ঐ কোলিয়ারি থেকে ফিরে আসার পর ওখানে কোনও কাজ হয় নি।

ব্রাদার দাভিদ ভিন্সেন্টকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে দেন। জোড়-জাঙ্গাল কয়লাখনি একটি পাণ্ডববর্জিত দেশ। কেউ সেখানে ধর্মপ্রচারের ব্রত নিয়ে যেতে চায় না। কয়েক ঘর খ্রীষ্টান সেখানে আছে, একটি পরিত্যক্ত চার্চও । আছে। আপাততঃ ঈভানজেলিস্ট হিসাবে সেখানে কাজ করতে যাবে; ভিন্সেন্ট তার কাজে সন্তুষ্ট হলে পরে তাকে প্রীস্ট করে দেওয়া হবে।

চন্দ্রভান প্রশ্ন করেছিল,ঈভানজেলিস্ট আর প্রীস্টের তফাত কি?

–এই দেখুন। তাও জানেন না আপনি! আপনাকে শিক্ষানবিশী হিসাবে দীর্ঘদিন ট্রেনিং নিতে হবে কাজ শিখতে হলে। হোমে ঈভানজেলিস্ট হিসাবে কাজ করতেও পরীক্ষায় পাস করতে হয়। অতটা কড়াকড়ি অবশ্য এখানে আমরা করি না। আপনি খ্রীষ্টান শ্রমজীবীদের সেবা করবেন, ধর্মপথে যাতে ওদের মতি হয় তা দেখবেন, প্রতি রবিবারে বাইবেল থেকে ওদের পড়ে শোনাবেন ও ব্যাখ্যা করে বোঝাবেন। কিন্তু মনে। রাখবেন, আপনি প্রীস্ট নন, ঈভানজেলিস্ট মাত্র। তাই কারও কফেশন আপনি শুনতে পারবেন না। সে প্রয়োজনে আমাদের খবর পাঠাবেন। আমি অথবা ব্রাদার দাভিদ আপনাকে সাহায্য করতে যাব।

-আমি থাকব কোথায়? খাব কী?

–সে আমাদের দায়িত্ব। ওখানে কয়েক ঘর খ্রীষ্টান আছেন। তাঁদের কারও বাড়িতে আপনার বাসাহারের ব্যবস্থা করে দেব। এ ছাড়া মাসে মাসে আপনাকে নগদ পাঁচ টাকা পকেট অ্যালাউন্সও দেওয়া হবে।

চন্দ্রভান রাজী হল। যাত্ৰামুহূর্তে ফাদার মার্লো ওকে ডেকে বললেন, একটা কথা মিস্টার গর্গ। মনে রাখবেন, ওখানকার শ্রমিকেরা মানুষ নয়। ক্রিশ্চিয়ান অর নো ক্রিশ্চিয়ান, দে আর অল হীদেনস!

চন্দ্রভান অবাক হয়ে যায়। বুঝতে পারে না। খ্রীষ্টান হলে আর কেমন করে মানুষে হীদেন থাকতে পারে? ফাদার মার্লো বুঝিয়ে দিলেন,–ওরা প্রভু যীসাস, বোঙা মাঈ আর কুডুংতুল্লার মধ্যে কোন প্রভেদ বুঝতে পারে না। মা মেরীর পূজা দেয় মুরগী বলি দিয়ে। অল-সেন্টস-ডে উদযাপন করে শুয়োর বলি দিয়ে, মাদল বাজিয়ে নাচ-গান করে, আর হাঁড়িয়া খেয়ে! মানুষ নয় ওরা–পশু!

চন্দ্রভান বিজ্ঞের মত মাথা নাড়ে।

আজ কদিন হল চন্দ্রভান এসে উঠেছে জোড়-জাঙ্গাল কোলিয়ারিতে। জায়গাটা সত্যই পাণ্ডববর্জিত। আসানসোল থেকে প্রায় চৌদ্দ ক্রোশ। এতটা পথ অবশ্য তাকে হেঁটে আসতে হয়নি। ফাদার মার্লো ওকে টিকিট কেটে ট্রেনে তুলে দেবার ব্যবস্থা করেছিলেন। বরাকর স্টেশন থেকে হাঁটাপথে মাঠামাঠি পাড়ি দিয়েছে পাক্কা সাত মাইল। এক বগলে বিছানার বাণ্ডিল, অপর হাতে ক্যাম্বিসের ব্যাগ।

এখানকার সবকিছুই অজানা, অচেনা। অবাক হতে হয় সব কিছুতেই। লাল কাঁকরে বন্ধ্যা মাটি-মাথা খুঁড়লেও কোদালের মাথায় মুঠভর মাটি ওঠে না, ঘাসের চাপড়া ঠেকে না। মাঝে মাঝে পাথুরে আউটক্রপ; কিছু দূরে দূরে বিরাট গর্ত। মুরাম-মাটি উঠিয়ে নিয়ে গেছে শাহী সড়কের পাড় বাঁধতে। বিরাট অজগরের মত শাহী সড়ক চলে গেছে পুব থেকে পশ্চিমে। লালে লাল। এই রাঙামাটির সমুদ্রের মাঝখানে নিকষকালো জোড়-জাঙ্গাল কয়লাকুঠি যেন পলাশফুলের মাঝখানে একটি কালো ভোমরা। এর চৌহদ্দির মধ্যে যদি একবার ঢুকে পড়, দেখবে তোমার রঙিন স্বপ্ন নিঃশেষে মুছে গেছে কয়লার কালিমায়।

একধারে কয়লাতোলার আয়োজন, কাঁটা তারের বেড়া দেওয়া। বিরাট লোহার ফটক, তার সামনে গাদা বন্দুক হাতে পাহারা দেয় গুর্খা সেপাই। ত্রিসীমানায় গেলেই হাঁকাড় পাড়ে, হুঁশিয়ার! কাঁটা তারের বাইরে মালকাটাদের বাস। বেশ কিছু দূরে। সার দিয়ে বানানো হয়েছে তাদের কুলি-ধাওড়া। ওরা অন্তেবাসী, ওদের এলাকাটা স্বতন্ত্র। এ-পাশে খানকতক খাপরাটালির ঘর। কোম্পানির কর্মচারী বাবুদের আস্তানা। ওভারম্যান, হিসাববাবু, আমিনবাবু, টাইপবাবু, খাজাঞ্চিবাবুদের আস্তানা। ওঁরা ঐসব মালকাটা মজদুরদের জীবনযাত্রা থেকে স্বাতন্ত্র রক্ষা করে টিকে আছেন খাপরাটালির পাকাবাড়িতে। আবার এদের মহল্লা থেকে বেশ কিছুটা দূরে টিলার মাথায় দুটিমাত্র পাকাবাড়ি। বাগান ঘেরা সুন্দর ছিমছাম সাহেব কুঠি। ওদিকপানে তোমার-আমার যাওয়া মানা। ত্রিসীমানায় কেউ গেলেই পেডিগ্রিওয়ালা বিলাতী কুকুর তারস্বরে প্রতিবাদ জানাবে। ও দুটি বাড়ির ছোটটিতে থাকেন অ্যাসিস্টেন্ট ম্যানেজার নাথানিয়াল সাহেব। কালো কুচকুচে গায়ের রঙ-গোয়ানিজ ক্রিশ্চিয়ান। দশাসই চেহারার মধ্যবয়সী মানুষ। মোম দিয়ে পাকানো একজোড়া কাঁচা-পাকা গোঁফ। পরনে হাফপ্যান্ট, ঊর্ধ্বাঙ্গে খাকি সার্ট, হাতে ব্যাটন। সাহেব একাই থাকেন। মেমসাহেব ছেলেমেয়েদের নিয়ে বাস করেন কলকাতায়। ওবাড়িতে আছে কিছু মালি, পাঁচক, বেয়ারা, খিদমদগার। আর ছিল একটা ঘোড়া। সেটা মরে বেঁচেছে। সাহেব হিন্দি বলতে পারেন ভাঙাভাঙা। ফাদার মার্লোর চিঠিখানি পড়ে খুশি হয়েছিলেন সাহেব। বলেছিলেন, আমি অ্যারেঞ্জমেন্ট করিয়া ডিবে। আয়াম হ্যাপী দ্যাট য়ু হ্যাভ কাম টু ওয়ার্ক ফর দীজ হীদেনস বাবু!

ভিন্সেন্টকে বাবুই বলেছিলেন। বঙ্গবাসী ঐ অষ্টাদশবর্ষীয় নেহাৎ চ্যাঙড়া মানুষটা যাতে খ্রীষ্টধর্মের বিশ্বভ্রাতৃত্বের অজুহাতে বেশি ঘনিষ্ঠ না হতে পারে তাই প্রথম থেকেই তিনি সজাগ হলেন।

খোদ ম্যানেজারসাহেবের বাঙলোটি তালাবন্ধ হয়ে পড়ে আছে। সে বাড়িটা আরও বড়, আরও ভাল, আরও সাজানো-গোছানো। ম্যানেজারসাহেব খাঁটি ইংরাজ-রাজার জাত। বর্তমানে ছুটিতে। হোমে। তাই গোয়ানিজ নাথানিয়ালই এখন এ-অঞ্চলের হর্তাকর্তা এবং বিধাতা। কোম্পানির একমাত্র প্রতিভূ। তার একান্তসচিবকে ডেকে তিনি বলে দিলেন চন্দ্রভানের আহার ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করতে। তা ভালই ব্যবস্থা হয়েছে। কয়লাকুঠিতে ভদ্দরলোকদের ভিতর একমাত্র খোদ নাথানিয়ালই খ্রীষ্টান। বাবুদের মধ্যে আর কেউ খ্রীষ্টান নেই। সব হীদেন! কুলি-ধাওড়ায় যারা বাস করে– বাগদি, সাঁওতাল, মুণ্ডা, গোণ্ড, ভুঁইহার ওদের ভিতর অনেকেই এককালে সদ্ধর্মে দীক্ষা নিয়েছিল, পনের-বিশ বছর আগে। তখন তারা উপাসনাও করত, বড়দিনও করত, প্রতিদিন আহারে বসে বিড়বিড় করে মন্ত্রোচ্চারণ করত, গীর্জায় সমবেত হত প্রতি রবিবার সকালে, হাটে যাবার পথে। তারপর পাদরি সাহেব চলে গেলেন, ওরাও সে-সব কথা ভুলে মেরে দিল। গীর্জাটা উপেক্ষিত হয়ে পড়ে আছে এক যুগ। জানালার পাল্লাগুলো খুলে গেছে, ফাটল দেখা দিয়েছে পাকা-ইটের-দেওয়ালে, বট-অশ্বত্থের চারা গজিয়েছে সেখানে, কেউ ভ্রূক্ষেপ করে নি। বছরে বছরে রৌদ্র বৃষ্টিতে তারা দিব্যি বেড়ে উঠেছে। দু-চারটে শেয়াল ছাড়া ওদিকে বড় কেউ যায় না। গীর্জার দরজার চালাটায় মরচে ধরে গেছে। কুলি-ধাওড়ার কয়েকটি পরিবার যে খ্রীষ্টান তা শুধু বোঝা যায় তাদের নামগুলি শুনে। যোসেফ মুর্মু, ডেভিড মাহাতো, কিংবা ঈশাক রুহিদাস। ওরা বোঙামায়ের পূজা চড়ায়, বাবা কুড়ুংতুল্লার কাছে শুয়োর বলি দেয়, দোলের দিনে আবীর মাখে। তবু বড়দিনের উৎসবে পরধান যখন বোঙামায়ের নামে জোড়া কুঁকড়া বলি দিয়ে বোঙামায়ের জয়ধ্বনি দিয়ে ওঠে তখন প্রৌঢ় যোসেফ মুর্মু নিমীলিত নেত্রে সায় দেয়,-আমিন! বুকের উপর ক্রুশচিহ্ন এঁকে বোঙামায়ের পূজা সমাপ্ত করে।

অ্যাসিস্টেন্ট ম্যানেজার নাথানিয়াল সাহেব তার বিচিত্রভাষায় বলেছিলেন, বাবু, এই জানোয়ারগুলোকে তুমি মানুষ কর। দে আর অল হীদেন নিগারস্!

চন্দ্রভান সেই ব্রত গ্রহণ করেই এসেছে। সে ঘাড় নেড়ে সায় দেয়।

কুলি-ধাওড়ায় তার পক্ষে থাকা চলে না। আবার বাবুদের কারও ডেরায় খ্রীষ্টানের ঠাঁই হবে না। তাই ম্যানেজার ওর আশ্রয়ের ব্যবস্থা করলেন নিজ আস্তাবলে। আস্তাবল পবিত্র স্থান। দুহাজার বছর আগে অমন এক স্থানেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন সদ্ধর্মের আদি পুরুষ। সাহেবের ঘোড়াটি মারা গেছে। অভাগা তিনি নন, সাহেব সম্প্রতি একটি হাওয়া গাড়ি কিনেছেন। কলের গাড়ি। ঘোড়া নেই, সহিস নেই, কোচম্যান নেই– সাহেব চাকা ঘোরান আর পাঁই পাঁই করে ছোটে কলের গাড়ি। আধঘন্টায় বরাকর, একঘন্টায় আসানসোল। অবাক গাড়ি। নাম মটোর!

তাই ঐ আস্তাবলেই আশ্রয় পাওয়া গেল। সাহেবের নির্দেশ এল বাবুইঘাসে বোনা দড়ির খাটিয়া। এনে দিল লণ্ঠন। বরাদ্দ হল কেরোসিনের। মায় সাহেব নিজের বাতিল করা একখানা টেবিল আর চেয়ারও পাঠিয়ে দিলেন। পাকা ঘর, পাকা মেঝে, মাথার উপর রাণীগঞ্জ টালির পাকা ছাদ। এ তো স্বর্গ! ঘোড়ার জল খাওয়ার বিরাট পাত্রটা ওর স্নানের চৌবাচ্চা। সাহেবের মালি সেটা ধুয়ে-মুছে সাফা করে জলে ভরে দিল।

আহারের আয়োজন অবশ্য বাবুদের কোয়ার্টার্সে। এখানে নয়। সে ব্যবস্থাও হল। তিন নম্বর পিটের মেট-মুন্সি পাঁচু হালদারের বাড়ি দু-বেলা দুমুঠো খেয়ে আসতে হবে। পাঁচু মেট-মুন্সি বাবু-শ্রেণীর লোক নয়। কুলির সর্দার। কয়লা কুঠির আইন-মোতাবেক তার থাকার কথা কুলি-ধাওড়ায়। কিন্তু ব্যতিক্রম আছে বলেই না আইনটাকে আইন বলে মানি? আর দুটি পিটের মেট-মুন্সির যে সৌভাগ্য হয় নি, পাঁচুর তা হয়েছিল। সে ভদ্রসন্তান। অন্যান্য মেট মুন্সিদের মত সে টিপছাপ দেয় না। রীতিমত সই করে মাইনে নেয়। বাঙলায় নয়, ইংরাজী সই। লেখাপড়া-জানা মানুষ। অনেক দিন থেকে আছে এখানে। কোন্ সুদূর অতীতে ঐ লেখাপড়া-জানা মানুষটা একদিন এসেছিল মালকাটা কুলি হিসাবে নাম লেখাতে। মালকাটা হতে হয় নি তাকে–সে চাকরি শুরু করে। গিনতিদার হিসাবে। কটা টব কোন্ গ্যাং ভর্তি করল তার গুতি রাখত। তা গঙ্গার ঢেউ গুণেও বুদ্ধিমান মানুষ টাকা কামায়, আর এ তো কালো হীরে। পঞ্চানন দু-হাত্তা কামিয়েছে সে আমলে। লোকটা সকলের উপকার করে, সকলের ফাইফরমাস খাটে। সকলের প্রিয়। মায় সামান্য গিনতিদারটা খোদ ম্যানেজারের পর্যন্ত নজরে পড়ে যায়। কর্তৃপক্ষ এই কাজের মানুষটাকে না পারে রাখতে, না পারে তাড়াতে। শেষমেষ বাধ্য হয়ে ওকে প্রমোশন দিয়ে দেওয়া হল। গিনতিদার থেকে মেট-মুন্সি। আর তোমাকে টব গুণতে হবে না বাবা, এবার রেহাই দাও। বরং কুলি খাটাও এবার। পঞ্চানন তাতেও খুশি। টবের বদলে এখন মানুষ গোনে–রোজগার তার ঠিক আছে। সব দেবতার থানেই সেলাম বাজিয়ে চলে। সকলকেই খুশি রাখে। তাই ওর ক্ষেত্রে এ ব্যতিক্রমটা সম্ভবপর হয়েছে। মেট-মুন্সি টালির কোয়ার্টার্স পেয়েছে। আছে বাবুপাড়ায়।

বেঁটে-খাটো মোটা মানুষ। কদমছাঁট কাঁচা-পাকা চুল, চোখ দুটো ছোট ছোট। ধূর্ত সন্ধানী দৃষ্টি। মুখটা সূচালো–দেখলে কি জানি কেন মূষিকের কথা মনে পড়ে যায়। নাকে রসকলি, গলায় কণ্ঠী। পঞ্চানন ধর্মে বৈষ্ণব। ছেলেপুলে নেই। মালাচন্দন হয়েছিল যে ভাগ্যবতীর সঙ্গে, তিনি বাঁজা খাজা মানুষ। সেদিক থেকে নির্ঝঞ্ঝাট সংসার। কিন্তু সব সুখ কি ভগবান কারও কপালে লেখেন দরাজ হাতে? বৈষ্ণবী চিররুগ্না। সারাক্ষণ তার মাথা ঘুরছে, খক্‌ খক্ করে কাশছে, আর থুথু ফেলছে। শুয়েই থাকে দিনমান। তবে সংসারটা দেখে কে? দেখে ওর দূর সম্পর্কের বোনঝি, ছ্যাতরা। বাপ-মা মরা অভাগীটাকে নিয়ে এসেছে আজ বছর কয়েক। সে রয়ে গেছে এ সংসারে। দিবারাত্র কাজ করে যায় মুখ বুজে। জুতো সেলাই আর চণ্ডীপাঠ ছাড়া বাদবাকি সব কাজ করে যায়। পাঁচক, ঝি, মালি ও ধোপানি। প্রথম দিন চন্দ্রভান ভেবেছিল ঐ ছ্যাতরা বুঝি হালদারমশায়ের মেয়ে। ও আপন মনে ভেবেছিল দেশে এত পাখি থাকতে পাঁচুবাবু ছাতারে পাখিকে এতটা প্রাধান্য দিলেন কেন? পাপিয়া, মুনিয়া, টুনটুনি, বুলবুল, টিয়া, ময়না কি দোষ করল? মেয়েটি যখন পঞ্চাননকে মামা বলে ডাকল তখন চন্দ্রভান বুঝতে পারে ছাতরা ওর মেয়ে নয়, নামকরণটা পাঁচুবাবু করেন নি। তা এই পাঁচুবাবুর সংসারেই ওর আহারের আয়োজন।

কাজ শুরু করেছে চন্দ্রভান। সাহায্য পাচ্ছে আশাতীতভাবে। প্রথম কাজ হচ্ছে গীর্জাটা সাফা করে ফেলা। সেটা পরিদর্শন করতে গিয়ে অবাক হয়ে গেল। দশ বিশজন মানুষ ইতিমধ্যে লেগে গেছে সেটা সাফা করতে। কোদাল চালিয়ে আশপাশের ফণিমনসা, আশশ্যাওড়া আর বনতুলসীর জঙ্গল সাফা করে ফেলেছে; ভাঙা ইটের স্তূপ সরিয়ে ফেলেছে; উইয়ের ঢিবি নির্মূল করে ফেলেছে। এখন উপড়ে ফেলা হচ্ছে দেওয়ালের ফাটল-বেয়ে গজিয়ে ওঠা অশ্বত্থের চারা। চন্দ্রভান খুশিয়াল হয়ে ওঠে ওদের উৎসাহ দেখে। বলে,- কী মুর্মু, তোমরা যে একদিনেই এটার চেহারা পালটে দিলে?

যোসেফ মর্মু কোদালটা নামিয়ে রেখে সেলাম করে। একগাল হেসে বলে, হাঁ আজ্ঞা। আজ আমরা কজন কেউ খাদে নামি নাই। ওভারম্যান সাব বললেন–যা তুরা, হুই গীরজা ঘরটো সাফা করি দে–হাজিরা মিলবে লগদালগদ!

ও, তাহলে ওরা ধর্মের টানে আসে নি। তা হোক, ওদের না থাক, কর্তৃপক্ষের ধর্মজ্ঞান আছে। চন্দ্রভানও লেগে যায় ওদের সঙ্গে কাজ করতে। সমস্ত দিনের পরিশ্রমে জায়গাটা বেশ সাফসুতরো হয়ে ওঠে। একটা সাপ মারা পড়ল। দুটো শেয়াল ছুটে পালাল। প্রভু যীশুর পরিত্যক্ত মন্দির আবার ভদ্র রূপ ফিরে পেল। আগামী রবিবার থেকে সে উপাসনা শুরু করবে এখানে। …

গীর্জাটা সুন্দর। লম্বাটে ধরনের। তা শ দুয়েক লোক একসঙ্গে বসতে পারে। মাঝখানের নেভ-অংশটা অপেক্ষাকৃত উঁচু-রাণীগঞ্জ টালির দোচালা। দুপাশে দুটি লিন-টু একচালা আইল। কয়েকটা ধাপ বেয়ে উঠে আসতে হয় স্যাচুয়ারিতে। কয়ার স্টলটা ভেঙে গেছে। রুডলফটটাও অক্ষত নেই। তার উপর ক্রুশবিদ্ধ যীশুর মূর্তিটা কিন্তু অক্ষত! অল্টার পীসের কাছে তিনভাঁজওয়ালা একটা কাঠের Teiptych। কাঠের ব্যাটেন, কাঠের প্যানেল–তাতে তেলরঙের ছবি; পনের-বিশ বছরেও একেবারে মুছে যায় নি। সম্ভবত ফাদার শারদাঁর হাতের কাজ। এ-পাশে অ্যানানসিয়েশান, ওপাশে ডিসেন্ট-ফ্রম-দ্য-ক্ৰশ আর মাঝখানে দ্য হোলি ফ্যামিলি। চন্দ্রভান খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে সেই শিল্পকর্ম। রুডের দু-পাশে আরও দুটি ফ্রেসকো–মাতা মেরি এবং সেন্ট জন দি ঈভানজেলিস্ট। ছাদের উপর ফিনিয়াল আর ব্যাটলমেন্টগুলি ভেঙে গেছে এখানে-ওখানে। ও আর মেরামত করানো যাবে না, তবে মাঝখানের মূল ক্রুশকাঠটা সারাতে হবে। চন্দ্রভান তার চার্চের প্রেমে পড়ে গেল প্রথম দর্শনেই।

কুলি-ধাওড়ার অনেকের সঙ্গেই আলাপ হয়েছে, ভাব জমেছে। ওরা ওর একটা অদ্ভুত নামকরণ করেছে-ফাদারদা! চন্দ্রভান বারে বারে প্রতিবাদ করে বোঝাবার চেষ্টা করেছে–সে পাদ্রী নয়, ফাদার নয়। কিন্তু ওরা শোনে নি। আগে যে দাড়িআলা সাহেব এখানে থাকতেন তাঁকে ওরা বলত ফাদার। তা তাঁর বয়স হয়েছিল। চন্দ্রভান নেহাৎ নাবালক। বেশ তো, ফাদার যদি না হতে চায়, নাই হল–দাদা হতে তার আপত্তি কিসের? ওদের কুলি-ধাওড়াতেও গিয়েছে চন্দ্রভান। ধাওড়া তো নয়, শুয়োরের খোঁয়াড়। পাশাপাশি গাদাগাদি করে বানানো ছাপড়া–নরক। এক পশলা বৃষ্টি হলে শুধু ছাদ দিয়ে নয়, মেজে ফুঁড়েও জল আসে। একেবারে নন্দোৎসব। তবে ভরসা এটুকু যে, বর্ষার জল এখানে দাঁড়ায় না। বৃষ্টি থামলেই গেরুয়া রঙের জলের স্রোত হুড় হুড় করে ছুটে চলে নামালের দিকে, সিঙারণ নদীর দিকে সেখান থেকে শেষমেষ তিন মাইল দূরের দামোদরে।

চোরে কামারে দেখা হয় না। ভোর না হতেই মেট-মুন্সি পঞ্চানন তার ধড়াচূড়ো পরে বেরিয়ে যায়। খাকি হাফপ্যান্ট, ফিতে বাঁধা কোম্পানির দেওয়া জুতো, মাথায় টুপী। সূর্যোদয়ের আগেই নামে খাদে। দুপুরে তার খাবার নিয়ে যায় কোন কামিন। পঞ্চানন ফিরে আসে সন্ধ্যার পর। চন্দ্রভান যখন দুপুরবেলায় খেতে আসে তখন বাড়ির মালিক পাতালরাজ্যে। এক প্রহর রাতে আবার যখন আসে নৈশ আহারের সন্ধানে, পাঁচুবাবু তখন বারাঙ্গনা পাড়ার স্বর্গে। মর্ত্যের সঙ্গে পঞ্চাননের সম্পর্কটা সামান্যই– রাত দশটা থেকে ভোর রাততক। তখন মড়ার মত ঘুমায় মানুষটা। সূরযদেবের সঙ্গে তার মোলাকাত হয় হপ্তায় একদিন–ঐ রবিবার। অচেনা এই খেষ্টান ছোঁড়াটাকে দু বেলা দুটো খেতে দেবার এ উটকো ঝামেলা ঘাড়ে নিত না পাঁচুনিয়েছে দুটি কারণে। এক নম্বর, নাথানিয়াল সাহেবকে খুশি করতে। সাহেব নিজে তাকে ডেকে অনুরোধ করেছিলেন। আর দু নম্বর, ওর খোরাকিবাবদ অনেকগুলি মুদ্রা সে আদায় করবে কায়দা করে। কি খাওয়াচ্ছে, কতটা খাওয়াচ্ছে তা আর নিক্তি ধরে কে ওজন বুঝে নেবে?

আপত্তি করেছিল আন্নাকালি। বলেছিল–ঘরে তোমার সোমত্ত মেয়ে, আমি দেখভাল করনে লারি, এমন একটা উটকো জোয়ান মানুষ

মুখ ভেঙচে জবাব দিয়েছিল পাঁচু,আরে থও বাপু! চ্যাতরা তো আর চিরটাকাল দাঁড়ে বসে থাকবে না? ও এমনিতেই একদিন উড়বে। ওড়ে উড়ুক! ভাগনির বে দিল না বলে কেউ তো আর দুষবে না!

 চন্দ্রভান অবশ্য স্বকর্ণে এ আলাপচারি শোনে নি।

রোজ সে এসে বসে বাইরের দাওয়ায়। চ্যাতরা কলাই করা থালায় ভাত বেড়ে নিয়ে আসে। ভাতের মধ্যেই মুরাম-পিটের গর্তের মত ছিদ্র করে ঢেলে দেয় দু-হাতা ডাল। সঙ্গে থাকে ধোঁধল কিংবা মেটে-আলুর তরকারি, কখনও বা পুঁইয়ের ডাঁটা, মুখি কচুর তরকারি, কিংবা কুমড়ো সিদ্ধ। চন্দ্রভান মুখ নিচু করে খেয়ে যায় লাল চালের ভাত। মুখ তুলে পরিবশেনকারিণীকে দেখে নি কোনদিন। আহারান্তে পাতকুয়োর জলে মুখ-হাত ধুয়ে নেয়। এঁটো থালাটা মেজে রোয়াকের ওপরে কাত করে রেখে দেয়। হাত দিয়ে এঁটো জায়গাটা মুছেও নেয়। খ্রীষ্টানের সকড়ি না হলে ফেলবে কে?

একদিন মেয়েটি নিজে থেকেই হঠাৎ জিজ্ঞাসা করে বসল, আপনার ভাতে কম পড়ে না তো?

–উঁ?–মুখ তুলে তাকায় চন্দ্রভান।

বছর পনের-ষোলো বয়স। একটু বাড়ন্ত গড়ন। একমাথা কোঁকড়ানো চুল, পিঠ ছাপিয়ে পড়েছে। গায়ের রঙটি কালো। তা কালো হোক–মেয়েটি সুশ্রী। নাকটা টিকালো, চিবুকটা নিখুঁত। বন্য হরিণীর মত কাজলকালো দুটি চোখের দৃষ্টি।

না, কম পড়ে না। আমি অল্পই খাই।

–মাছ-মাংস হয় না আমাদের বাড়িতে। আপনার নিশ্চয় খুব অসুবিধা হয়।

পঞ্চানন বৈষ্ণব বলে কি এ বাড়িতে মাছ আসে না? কর্তার নাম শৈব, গিন্নির নাম শাক্ত, যত গোঁসাইগিরি কি কেবল খাওয়ার পাতে? না কি এটা ওর মিতব্যয়িতার আয়োজনে? জমিদারের বাড়ির আদুরে গোপাল এককালে আমিষ ছাড়া এক গ্রাস ভাত মুখে দিতে পারত না। চন্দ্রভান মাথা নেড়ে বললে, পেট ভরানো নিয়ে কথা।

মেয়েটি কী কথা বলতে গিয়েও বলল না। চন্দ্রভান বলে,–এতদিন আসছি, কিন্তু আপনার ভাল নামটাই জানি না।

মেয়েটি মুখ টিপে হাসে। হাসলে ওর গালে দিব্যি টোল পড়ে তোর বললে,— ভাল নাম জানেন না, অর্থাৎ খারাপ নামটা জানেন। সেটা কী?

–আপনার মামীমা সেদিন আপনাকে ছ্যাতরা বলে ডাকছিলেন মনে হল।

–হ্যাঁ, ঐটাই আমার নাম। ছ্যাতরা নয়, চ্যাতরা।

ভাল নাম নিশ্চয় একটা আছে। সেটা কী?

–এককালে আমার নাম ছিল চিত্রলেখা। এখন সেটা নিজেই ভুলে গেছি।

তখনও চন্দ্রভান মেয়েটির গোটা ইতিহাসটা জানত না। চিত্রলেখা-চিত্ৰা–চ্যাতরায় কিভাবে রূপান্তরিত হল। সেটা জেনেছিল অনেক পরে। চিত্রলেখার বাবা ছিলেন স্কুলমাস্টার। মেয়েকে রীতিমত স্কুলে পড়িয়ে শিক্ষা দিতে চেয়েছিলেন তিনি। দুর্ঘটনাটা না ঘটলে এ বছর সে এন্ট্রাস পরীক্ষা দিত। ঐ দুর্ঘটনাটাই চিত্রলেখাকে চ্যাতরা করেছে। দামোদরের বন্যায় এক রাত্রে ভেসে গিয়েছিল ওর বাপ-মা, ছোটভাই। ও যে কেমন করে বেঁচে গেল তা সে আজও ভেবে পায় না। মেয়েটি বললে,আপনি আমাকে নাম ধরেই ডাকবেন।

–তা ডাকব, তবে চ্যাতরা নয়, চিত্রলেখা বলে ডাকব।

 –আমি কি বলে ডাকব আপনাকে?

—আমার নাম শ্রী–

হঠাৎ থেমে পড়ে চন্দ্রভান। এখনও শ্ৰী? আশৈশবের অভ্যাসবশে পৈতৃক নামটাই বলতে যাচ্ছিল, ভুলে গিয়েছিল তার নামের বি-শ্রী পরিবর্তনের কথা। কিন্তু কথাটা তাকে শেষ করতে হল না। চিত্রলেখা বলে ওঠে,আপনার নাম আমি জানি। আমিও কিন্তু সে নামে ডাকব না। আমি ঐ মালকাটাদের দেওয়া নামেই ডাকব আপনাকে–ফাদারদা।

চন্দ্রভান দৃঢ় আপত্তি জানায়। বলে,–ওরা অশিক্ষিত মানুষ; কিন্তু আপনি কেন এ ভুল করবেন? আমি পাদ্রী নই, ফাদার নই। তাছাড়া ফাদার হলে কেউ দাদা হতে পারে?

চিত্রলেখা খিল খিল করে হেসে ওঠে ওর অসহায় ভঙ্গি দেখে।

চ্যাতরা! ওর খাওয়া হয়েছে? অত হাসি কিসের বাপু? কালই তোর মামাকে বলব–এসব–ছেনালিপনা চলবেনি আমার বাড়িতে।

চিত্রলেখা তাড়াতাড়ি ঢুকে যায় ভিতরে। চন্দ্রভানও মরমে মরে যায়।

.

সান্ধ্য আড্ডাটা বসেছিল ইয়াকুব মিঞার ভাঁটিখানার সামনে। পৌষ মাস পড়েছে। অথচ এখনও শীতটা তেমন জাঁকিয়ে নামে নি। তা হলেও খোলা মাঠের মাঝখানে সন্ধ্যার পর থেকে হিমেল হাওয়ায় একটা কাঁপুনি ধরে। খাদের নিচে সারাটা দিনমান উলঙ্গ মানুষগুলো উত্তাপে ঝলসাতে থাকে, দরদর করে ঘাম ঝরে তখন; তারপর খাদ ভসকার খাঁচা বেয়ে সাঁই সাঁই করে সেই জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ড থেকে হঠাৎ হিমেল সন্ধ্যার । মর্ত্যলোকে উঠে এলে কার না হাড়ে কাঁপন জাগে? সারাটা দিন ওরা যে সর্বাঙ্গে রেণু রেণু কয়লার পাউডার মেখেছে এখন কি ঠাণ্ডা জলে তাই ধুতে বসবে? ক্ষেপেছ? কয়লার আস্তর–ও তো অঙ্গের ভূষণ! কর্ণের সহজাত কবচকুণ্ডলের মত ছয়-সাত বছর বয়সে ঐ ভূষণ অঙ্গে চড়ে, নামে চিতায় চড়লে। ভিখু বলে-সাবুন কি হে, গাইতা চালালেও এ শালার কয়লা গা থিকে ছাড়বেনি! ওরা বড় জোর হাত দুটি ধুয়ে ফেলে, ভিজে হাতটা বুলিয়ে নেয় মুখে-চোখে। তা সেদিন সাঁঝ-বেলায় ঐ রকম। কালিমাখা একসার মানুষ বসেছিল ইয়াকুবের ভাটিখানার সামনে। আগুনের চারপাশ ঘিরে।

শাল আর অর্জুন গাছে ছাওয়া নিরালা পরিবেশ। বস্তী থেকে কিছুটা দূরে, নামালের দিকে। সিঙারণের খাদের ধারে ইয়াকুব মিঞার চোলাই মদের ভাটিখানা। পাশেই একটা তেলেভাজার দোকান। সাতবাসি-ছোলা-ভাজা, কলাই-সিদ্ধ, প্যাঁজি, ফুলুরি সাজানো আছে একটা কাঠের বারকোশে। নগদ পয়সা ফেললেই শালপাতার ঠোঙায় চাট হিসেবে পাওয়া যায়। সন্ধ্যাবেলাটা ইয়াকুবের মরবার সময় নেই। মাটির ভাঁড়ে ক্রমাগত সরবরাহ করে যেতে হয় অমৃতরস-পচাই, ধেনো, মহুয়ারস, কালিমার্কা।— আজও ওরা গুটি গুটি এসে বসেছে। তিন নম্বরের ভিখন, বুধন, যোসেফ, ঈশাক। আন্টুনির বেশ নেশা হয়েছে। মাথাটা দোলাচ্ছে, আর আপন মনে বিড়বিড় করে কি বকে চলেছে। এসেছে ওভারম্যান এককড়ি সরখেল। মালকাটার দলে মিশে মদের আসর জমাতে তার আপত্তি নেই। ওর পদমর্যাদার স্বাতন্ত্র্যবোধটা বোধহয় পাতাল রাজ্যের অতলেই সীমাবদ্ধ-উপরের এই নীল আকাশের নিচে মালকাটার যে দুঃখ, ওভারম্যানের তাই। একহারা মানুষ, মজবুত গড়ন। কিন্তু ভিতরটা বিলকুল ফোঁপড়া। হবে না? পাতালরাজ্যেই যে সে বিকিয়ে দিয়ে এসেছে জীবনের শেষ শক্তিটুকু। নবছর বয়সে ঢুকেছিল ওখানে, এখন ওর বয়স বেয়াল্লিশ। মালকাটা থেকে ধাপে ধাপে উঠে এসে আজ হয়েছে ওভারম্যান। ইয়াসিন মিঞা ওর জন্যে একখানা থান ইট বাড়িয়ে দিয়েছে। সেটাতেই জাঁকিয়ে বসেছে এককড়ি। মুখে বিড়ি, হাতে ধেনো।

–আরে ফাদারদা যে? কুথা চলিছেন গ ইদিক পানে?

চন্দ্রভান এগিয়ে আসে। বলে,-ধাওড়ায় গিয়েছিলাম যোসেফ, তোমাদের খোঁজে। তা দেখলাম তোমরা কেউ নেই। তোমার স্ত্রী বললেন, সাঁঝের বেলা মরদরা কি আর ঘরে থাকে? দেখেন তালাশ করে ইয়াকুবের উখানে; সিখানে না দেখতি পেলি–

সঙ্কোচে থেমে পড়ে চন্দ্রভান।

ঠা ঠা করে হাসল যোসেফ। বললে,–বাতটো খতম করেন কেনে ফাদারদা? সে মাগী বলে নাই–সিখানে না দেখতি পেলি ছুকরি পাড়ায় তালাশ লিবেন?

ঐ রকমই একটা বক্র ইঙ্গিত করেছিল বটে যোসেফ মুর্মুর ধর্মপত্নী। ইয়াকুব একটা বাবুই ঘাসে বোনা জলচৌকি বাড়িয়ে দেয়। চন্দ্রভান বসে।

যোসেফের নেশা হয় নি। ক-পাঁট গিলেছে তার হিসেব নেই। নেশা আজকাল ওর হয় না। ইয়াকুব বড় জল মেশাচ্ছে ইদানীং। না হলে তিন ভাঁড় কালিমার্কায় নেশা লাগে না? বলে,না ফাদারদা, যোসেফরে ও-পাড়ায় পাবেননি। দিন ভোর গাঁইতা হাতে লড়াই করি, সাঁঝের বেলা ইয়াকুব-দোস্তের অমর্ত খাই আর রাতভোর পড়ি থাকি কিষ্টোর মায়েরে আঁকড়ে। ব্যস্! বে-লাইনে যোসেফরে দেখবেননি কখনও।

হা-হা করে ঠারে ঠারে হেসে ওঠে কয়লা কালো ভূতটা। কিষ্টো হচ্ছে যোসেফ তনয়। কৃষ্ণ নয়, কিষ্টোফার-এর অপভ্রংশ।

মাতাল আন্টুনি মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দেয়,হক কথা, ল্যায্য কথা! যোসেফ ভাই রে বেলাইনে পাবেন লাই। ও-শালা ধাম্মিক! মরলে ও-শালা সগগে যাবে!

অ্যাইও!–চিৎকার করে ওঠে যোসেফ মুর্মু। বলে, –খবদ্দার আনি! মরণ কাঁড়বি না কিন্তুক! মরণ কেনে রে? মরণ অত সোজা, লয়?

মৃত্যুর কথায় যোসেফের ঘোর আপত্তি। মৃত্যুকে সে মানে না। তামাম কুলি ধাওড়ায় সে বয়ঃজ্যেষ্ঠ। উনিশশ সাত সালের কয়লাকুঠি। মেয়ে-মদ্দ বুড়ো বাচ্ছা সবাই নামে খাদে। বয়সের বাধা নেই। মেয়ে-পুরুষে ফারাক নেই। আট-ন বছর বয়স হলেই শুরু হাতে কালি। কি মেয়ে, কি মদ্দ। অবশ্য বুড়ো মানুষ তুমি দেখবে না কয়লাকুঠির ত্রিসীমানায়। ঐ শিশু বয়স থেকেই কয়লার রেণু পাকাপাকিভাবে বাসা বাঁধে ওদের ফুসফুঁসে। বিশ বাইশ-পঁচিশ যতদিন তাগদ আছে লড়ে যাও। মাদল বাজাও, পচাই খাও, নাচো গাও ফুর্তি কর। তারপর? শুরু হয় খুক খুক কাশি, ঘুস ঘুস জ্বর, হাপরের মত বুকটা ওঠে নামে। কফের সঙ্গে দু-এক ফোঁটা রক্তের ছিটে। ব্যস! তারপর হাজরির খাতায় একটা লম্বা ঢেরা। আসে একটা নতুন মানুষ, উঠতি জোয়ান– নাম লেখায় খাতায়। বাঁ-হাতের বুড়ো আঙুলে লাগায় প্রথম কালির ছোপ। কালিমালিপ্ত জীবনের প্রথম হাতে কালি। খাজাঞ্চিবাবু খুশি হয়। নয়া ভর্তি মানেই কিঞ্চিৎ নগদ নজরানা। বাঁধা ব্যবস্থা। এভাবেই জোড়-জাঙ্গাল কয়লাকুঠি জাবর কেটে চলেছে চিরটাকাল। এখানে এলে খনা বোধহয় নতুন করে হিসাব কষতেন–নরাগজার হিসাবটা পালটে লিখতেন–মালকাটার বয়সের ঊর্ধ্বসীমা হচ্ছে দুকুড়ি। এ-হেন কয়লাকুঠি আইনের মূর্তিমান প্রতিবাদ–যোসেফ মুর্মু। কালো কষ্টিপাথরে কোঁদা মানুষটা আড়াইকুড়ি পাড়ি দিয়েছে। একটা পা একবার জখম হয়েছে কয়লার চাঙড় ভেঙে পড়ায়; একটু খুঁড়িয়ে চলে তাই। কপালে প্রকাণ্ড একটা কাটা দাগ। খাদভসকার খাঁচার পাটাতন খুলে একবার সাতজন মালাকাটর সঙ্গে আছড়ে পড়েছিল পিটের চাতালে। একমাত্র সেই বেঁচে ফিরেছিল। মৃত্যুকে তাই জয় করেছে মুর্মু। খাদের দৈত্যটা নানান অস্ত্র নিয়ে বারে বারে আক্রমণ করেছে তাকে আগুনের বেড়াজালে আটকাতে চেয়েছে, বিষাক্ত গ্যাসে বধ করতে চেয়েছে, কয়লার চাঙড়ে সমাধিস্থূপ রচনা করতে চেয়েছে কিন্তু হার মানে নি যোসেফ মুর্মু। একখানা গাঁইতা সম্বল করে সে আশৈশব লড়াই করে গেছে। মৃত্যুকে সে তাই মানে না। তাই জোর ধমক দেয় আন্টুনিকে, -মরণ কাঁড়বি না কিন্তুক! মরণ কেনে রে! মরণ অত সোজা, লয়?

এককড়ি ওদের ঝগড়া থামিয়ে দিয়ে বলে, –আপনিই লোতুন পাদরি সাহেব বটেন, লয়? কাল গীর্জা ঘরে বক্তিমে করিছেন?

চন্দ্রভান বলে, -না ভাই, আমি পাদ্রী নই–

মুখের কথা কেড়ে নিয়ে যোসেফ বলে, উনি হলেন গে ফাদারদা!

বস্তুত গতকাল রবিবার ভিন্সেন্ট ভান গর্গ তার জীবনের প্রথম সামন দিয়েছে। লোক মন্দ হয় নি। কাঠের বেঞ্চিগুলো সবই প্রায় ভেঙে গেছে। সেগুলিকে হটিয়ে মাটিতেই বসার ব্যবস্থা করেছিল। শুধু পিছনের দিকে দুটি কাঠের বেঞ্চি। তা অনেকেই এসেছিল প্রথম দিন। শুধু খ্রীষ্টান নয়-সাঁওতাল, বাগদি ভূঁইহাররাও। দু-চারজন ভদ্দরলোক বাবুমশাইও এসেছিলেন বৈচিত্রের সন্ধানে। কয়লাকুঠির জীবন বড় একঘেয়ে। নমাসে ছমাসে আসে যাযাবর বেদেবেদিনীর দল। নাচ দেখায়, ভানুমতীর খেল দেখায়। কদাচিৎ আসে বাঁদরনাচওয়ালা। গীর্জায় অনেক অনেকদিন পর বাতি জ্বলতে দেখে তাই অনেক কৌতূহলী জীব সমবেত হয়েছিল প্রথম রবিবারে। সবচেয়ে অবাক করা খবর–স্বয়ং নাথানিয়াল সাহেব এসেছিলেন ওর সামন শুনতে। বসেছিলেন সামনের একখানা চেয়ার দখল করে। সেটাও নিয়ে এসেছিল তাঁর খিদমদগার। তা সেই প্রথম দিনের সামনের কী প্রতিক্রিয়া হয়েছে জানবার উদ্দেশ্য নিয়েই চন্দ্রভান বেরিয়েছে এখন। বললে, কাল আমার বক্তৃতা কেমন লাগল বল?

মাতাল আর্টুনি বলে, এক্কেরে ফাস্টু কেলাশ!

বুধন বলে, হর রোব্বারেই উয়ারা মুড়িকদমা বিলাইবে নাকি ফাদারদা?

 ভিন্সেন্ট বলে, -না। আমি বারণ করে দিয়েছি।

ব্যবস্থাটা ভাল লাগে নি তার। তাকে জানিয়ে ব্যবস্থাটা করা হয় নি আদপে। ও শুধু লক্ষ্য করে দেখেছিল, গীর্জার সামনে বসেছিল একজন দেহজীবিনী শ্রেণীর সাঁওতাল মেয়ে, বাতাসী। নিটোল স্বাস্থ্য, ইঙ্গিতময় হাসি, মাথার খোঁপায় গোঁজা ফুল। এক ধামা মুড়ি আর এক ঠোঙা কদমা নিয়ে বসে ছিল। যারা বক্তৃতা শুনতে এসেছে তাদের প্রত্যেককে এক কুনকে মুড়ি আর দুটো করে কদমা বিলিয়েছে। প্রাপক জোয়ান বয়সের মরদ হলে উপরি পাওনা মিষ্টি হাসি বা কটাক্ষ। ভিন্সেন্টের এ ব্যবস্থা একেবারেই ভাল লাগে নি। খোঁজ নিয়ে জেনেছিল, ব্যবস্থাটা খোদ নাথানিয়াল সাহেবের। সে আপত্তি জানিয়েছে। ভবিষ্যতে এ ব্যবস্থা যেন না করা হয়, এটাই তার অনুরোধ। মুড়ি-কদমার লোভে ওরা উপাসনায় যোগ দিক, এটা সে চায় না।

মাতাল আনি পুনরায় মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, বড় জবর বক্তিমে হয়েল ফাদারদা। আমি কিশ্যু বুঝি নাই। তা হোক! বক্তিমে যারে বলে, –এক্কেরে ফাস্টু কেলাশ!

যোসেফ বলে, আমি কিন্তুক ল্যায্য কথাটো বুলব ফাদারদা। মোর ভাল লাগেক নাই।

ভিন্সেন্ট অবাক হয়ে বলে, –ভাল লাগে নি? তাই নাকি? কেন?

যোসেফ ইয়াকুবের দিকে ভাড়টা বাড়িয়ে দিয়ে বলে, –টুক অমর্ত দাও কেনে য়াকুব ভাই। কালিমার্কা—

চন্দ্রভানের দিকে ফিরে বলে–লিখাপড়া শিখি নাই ফাদারদা; কিন্তুক মনে লাগে– বাতটো তুমি ঠিক বুল নাই! উঁহু! কিতাবটো পড়লে বুলতে পারতম! বাতটো বেবাক ভুল হই গেছে!

চন্দ্রভান কৌতূহলী হয়ে বলে, –কোন কথাটা তোমার মনে লাগে নি যোসেফ?

আরে হুই যে তুমি বললে না, জীবনভর কষ্ট করি যা, এ কষ্ট কষ্ট লয়, মরণের পর তুরা বেহেস্তে যাবি-ই বাতটো উ কিতাবে লিখে নাই। মরণের বাতটো কেনে লিখবে? মরণ কি সোজা! না কি বুলছ ওস্তাদ?

প্রশ্নটা এককড়িকে। সে একটা বিড়ি ধরাতে ব্যস্ত ছিল। বলে, –আবার আমারে কেন সালিশ মানো বড়ভাই? আমি শালা হিঁদুর ছেলে, বাইবেল পড়েছি নাকি? তায় তুমার ফাদারদা কাল কি বুলিছে তাও তো আমি শুনি নাই

যোসেফ বলে, –মোদের ওস্তাদ বড় এলেমদার মানুষ বটে। আচ্ছা অরেই শুনাও কেনে বিত্তান্তটো! লও ওস্তাদ, শুন্যা মোরে বুঝাই দাও।

এককড়িও ভিন্সেন্টের দিকে ফিরে বলে, –বিত্তান্তটা কি?

মোমবাতিজ্বলা গীর্জায় দাঁড়িয়ে যে কথা অত লোকের সামনে কাল বলেছিল, আজ এই ইয়াকুব মিঞার ভাটিখানায় একদল মাতাল শ্রোতার সামনে সে কথাটা উচ্চারণ করতে কেমন যেন সঙ্কোচ হল ভিন্সেন্টের। কিন্তু সঙ্কোচকে সে জোর করে ঝেড়ে ফেলে। ফাদার শারদাঁর মন্ত্রশিষ্য সে। ও জানে গীর্জার পাদপীঠের চেয়ে এই ক্লেদাক্ত ভাটিখানাতেই মথীকথিত সুসমাচারের বেশী প্রয়োজন। ভিন্সেন্ট বলে, কাল আমি বলেছিলাম, এই পৃথিবীটা আমাদের সত্যিকারের ডেরা নয়, আমরা এখানে দুদিনের জন্য মুসাফিরের মত এসেছি। মৃত্যুর পরে আমরা আমাদের পৈতৃক বাস্তুভিটায় ফিরে যাব–সেটা হচ্ছে স্বর্গরাজ্য। প্রভু যীশু বলেছেন, সুখের চেয়ে দুঃখই বড়, কারণ দুনিয়াদারির সুখ আমাদের শুধু দুঃখই এনে দেয়। পরমপিতাকে যে চিনেছে তার কাছে। দুঃখটা বড় কথা নয়। সে দুঃখকে জয় করবেই; কারণ সে জানে মৃত্যুর পরে আমরা সেই অনন্ত স্বর্গে ফিরে যাব। তাই বলেছিলাম-Father, we pray Thee to Keep us from evil. Give us neither poverty nor riches, but feed us with bread approprite to us.

যোসেফ ভক্তিভরে মদের ভাঁড়টা নামিয়ে রাখে। চোখ দুটো বুজে যায়। গম্ভীরভাবে বুকে একটা ক্রুশচিহ্ন এঁকে বলে, -আমিন!

তারপর চোখ খুলে তাকায়। ভাঁড়টা হাত বাড়িয়ে তুলে নিয়ে বলে, ইঞ্জিরিটা কিশশু বুঝি নাই। তবু হলপ করি বুলব, ফাদারদা ইটো এক্কেরে ছেঁদো বাত! বিলকুল ভুল! 

এককড়ি প্রশ্ন করে, ইঞ্জিরি লব্জটার মানে কি দাঁড়াল?

ভিন্সেন্ট অনুবাদ করে, –হে পরমপিতা, শয়তানের হাত থেকে আমাদের তুমি বাঁচাও। আমাদের হা-ভাতে করে রেখ না, আমরা সোনাদানাও চাই না। দু-বেলা দুমুঠা খেতে পেলেই আমরা খুশি।

শ্রীরামপুর চার্চের অনুমোদিত অনুবাদ নয়, তবু ভিন্সেন্টের মনে হল এ ভাষায় অনুবাদ হলেই ওরা বুঝবে। বুঝলেও ওরা। এককড়ি জোর দিয়ে বলে, –এর ভিতরে ছেঁদো কথা কুনটো বড়ভাই। এ তো সাচ্চা কথা। দু-বেলা দুমুঠো খাতি পেলি আর কি চাই?

আন্টুনি পুনরুক্তি করে, -হক কথা। ল্যায্য কথা। এক্কেরে ফাস্ট কেলাশ।

যোসেফ তাকে প্রচণ্ড ধমক দেয়, তু চুপ যা কেনে!

ওস্তাদের দিকে ফিরে বলে, উ বাত লয়। পরথম বাতটো আমারে বুঝাও। আমি বুলছি, হেই ভগবান, আমারে শয়তানের হাত থিকে বাঁচাও; শয়তানও বুলতিছে আমারে যোসেফের হাত থিকে বাঁচাও। এখন ভগবান কি করবে আমারে বুঝাও। সে তো আমারও ভগমান, শয়তানেরও ভগমান। লয়?

কঠিন প্রশ্ন! ভিন্সেন্ট জবাব দেবার জন্য প্রস্তুত হয়। কিন্তু তার আগেই এককড়ি বলে ওঠে, তুমার ঐ স্বৰ্গৰ্টা দেখি নাই ফাদারদা, তয় নরকটারে হাড়ে হাড়ে চিনি। চাও তো তুমাকেও দেখাই দিতি পারি। দেখবে পাতালরাজ্যটা?

ভিন্সেন্ট তৎক্ষণাৎ রাজী হয়ে যায়। কয়লাকুঠির মূলকেন্দ্র হচ্ছে ঐ পাতালরাজ। ওটাকে কেন্দ্র করেই ঘুরছে এখানকার জীবনচক্র–ঐ পিট-হেডগিয়ারের আবর্তন ছন্দে। ওটার সঙ্গে এখনও তার পরিচয় হয়নি।

.

এককড়ি সরখেল তার কথা রেখেছে। পরদিনই ওকে নিয়ে দেখিয়ে আনল পাতালরাজ্যটা।

অদ্ভুত অভিজ্ঞতা একটা। লোহার খাঁচায় আর দশজন মালকাটার সঙ্গে এককড়ি ওকে নিয়ে উঠল খাদ-ভসকার মাথায়। ঘন্টা বাজল, হঠাৎ দুলে উঠল খাঁচাটা। ঝাঁপ দিয়ে পড়ল পাতকুয়োর গর্তে। নাগরদোলায় নাতির মুখে হঠাৎ যেমন পেটের মধ্যে গুলিয়ে ওঠে সেই অনুভূতিটাই চতুর্গুণ হয়ে জেগেছিল প্রথমে। দু-পাশে খাড়া পাথরের দেওয়াল। তির তির করে জল ঝরে পড়ছে শ্যাওলাধরা দেওয়াল বেয়ে। কখনও অঝোর ধারে ঝরে পড়ছে খাঁচার উপরে। ঘনিয়ে আসে অন্ধকার। ঘোর অন্ধকার। কিছু ঠাওর হয় না। অবশেষে খাঁচাটা এসে থামল পাতালপুরীর একপ্রান্তে। সেটা আসলে শেষপ্রান্ত নয়, পাতালরাজ্যের সেটাই শুরু। সুরঙ্গ দিয়ে উপর পানে তাকিয়ে দেখলে এ পাতালরাজ্যের হিসাবে অতবড় আকাশটার দাম স্রেফ এক আধলা। অতি ক্ষুদ্র গোলাকৃতি একটা সাদা বিন্দু।

দুমুখো দুটো রাস্তা। গোলাকার টানেল, চলে গেছে সামনের দিকে। নিশ্চিদ্র অন্ধকারের বুক চিরে। জোনাকি পোকার মত নীলাভ আলোর খাঁচালণ্ঠন নিয়ে এককড়ি রওনা হল একদিকে, বলে, পিছন পিছন এস ফাদারদা।

রাস্তাটা প্রথমে বেশ চওড়া, খাড়াই অনেকটা। দু-জোড়া ছোট রেলের লাইন চলে গেছে সাপের মত এঁকেবেঁকে। একটু পরেই পথটা আরও সরু হয়ে গেল। দুটো মানুষ পাশাপাশি যেতে পারে না। মাথা নিচু না করলে ঠুকে যাবে পাথরের দেওয়ালে। চন্দ্রভান কিছুই দেখতে পায় না; এই আলো-আঁধারে দেখতে সে অভ্যস্ত নয়। বারে বারে ঠোক্কর খাচ্ছে ঢালু পথে। একটু পরেই একটা ফাঁকা মত জায়গা। দু-তিনটে সুরঙ্গ । পথ এসে মিশেছে এখানে। এককড়ি বলে, –দেওয়াল সিঁটে দাঁড়াও কেনে ফাদারদা। কয়লা বোঝাই টব যাবে কিন্তুক এই রেলের লাইন বরাবর।

অসহ্য গরম। দরদর করে ঘাম ঝরছে। পায়ের নিচে জল। এত জল কোথা থেকে আসছে এ পাতালপুরীতে? অন্ধকারে আবছা নজর হল সুরঙ্গপথে কজন মানুষ গাঁইতা চালাচ্ছে। মেয়েরাও কাটছে কয়লার চাই–বোঝাই দিচ্ছে লোহার টবগাড়িতে। ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। বাচ্চারাও আছে–আট-দশ বারো বছরের ছেলে ও মেয়ে। ওরা কয়লা বোঝাই দিচ্ছে টবে, ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে হলারের দিকে।

দৈত্যটারে দেখতি আসছি ফাদারদা? তা দেখি লও কেনে! বড় জবর লড়াই করে শালা। তা করুক। মর্মও কম যায় না এ দৈত্যটারেও টুক্ দেখি লও। হঁ!

গাঁইতাটাকে কাঁধের উপর তুলে দৈত্যের মত দু-পা ফাঁক করে খাড়া হয়ে দাঁড়ায় যোসেফ মুর্ম–যেন ফটো তোলাচ্ছে। ভেডিস-ল্যাম্পের নীলাভ আলোয় জখম ঠ্যাঙাখানায় ভর দিয়ে ওর সোজা হয়ে দাঁড়াবার ভঙ্গিটা অদ্ভুত। সর্বাঙ্গ মিশ কালো, শুধু দু-চোখের সাদা অংশটুকু চকচক করছে।

ওভারম্যান এককড়ি হাতের লণ্ঠনটাকে পরীক্ষা করে দেখল। তারপর শিকারী কুকুরের মত নাক উঁচু করে কি যেন শুঁকে বলে, –গ্যাস যান বেশি মনে লাগে বড়ভাই! এ পিটে কাম বন্ধ করি দাও বরং। গাইতার মুখে ফুকি উঠলি বিতিকিচ্ছিরি কাণ্ড হই যাবে।

মুর্মু হেসে উড়িয়ে দেয়; বলে, –ওস্তাদ, খালিটব হলারে পাঠালি হাজরিটো লিখে লিবে তো তুমি?

এ কথার জবাব নেই।

এককড়ি অসহায়ের মত মাথা নাড়ে। অনুনয়ের সুরে বলে, একটো দিন বই তো লয়। আমি আজই বড় সাহেবরে বলি। এ পিটে পেরথমে হাওয়া পাম্প করতে হবেক।

আমিনবাবু ছিল পিছনে। বললে, ইটা তো যোসেফদার কথার জবাব লয় ওস্তাদ? খালিটব পাঠালি উয়াদের হাজরির কি হবে?

হঠাৎ ধমকে ওঠে এককড়ি, আর অগ্নিকাণ্ড হই গেলে হাজরিটো মিলবে? সওয়া শ মালকাটা এখন খাদের ভির রইছে। সিটো খেয়াল আছে?

মুর্মু একগাল হেসেছে। মিশ্বালো মুখে একঝাঁক সাদা দাঁত ভুট্টার দানার মত। বলে, –দেড়শ মালকাটার হিসাবটো তুমার, মোর লয় ওস্তাদ। মোর স্রেফ সাত পেটের হিসাব বটে! মাগভাতার আর পাঁচটো বাচ্ছা! ব্যস্! একদিনের খোরাকি দিবে তুমি?

এককড়ি জবাব দিতে পারে না। ওর অসহায় অবস্থাটা দেখে যোসেফ বোধহয় দুঃখিত হয়। এগিয়ে এসে কয়লামাখা হাতখানা রাখে এককড়ির কাঁধে। বলে, ডরাও কেনে গ ওস্তাদ? খাদের ভিৎরি জনম কাটল মোর। এ্যারে চিনি না? আগুনের ফুলকি ছুটতে দিব কেনে? গাঁইতা চালাইব যান মাগের মুখে চুমু খাইছি!

চুক করে অদ্ভুত একটা শব্দ করে ভেঙায়। ভিখু, বুধন আর আন্টুনি হাহা করে হেসে ওঠে। ওপাশ থেকে বাতাসী বলে ওঠে, -মরণ

এককড়িও রাগ করে বলে, –মর তা হলে।

অ্যাই খবদ্দার! গাঁইতা উঁচিয়ে রুখে দাঁড়ায় মুর্মু। দুতরফা মরণ-ডাক সে সইতে পারে না। এককড়িও ঘুরে দাঁড়ায়। এটা ইয়াকুবের ভাটিখানা নয়। এখানে সে ওভারম্যান। পাঁচটা মালকাটার সামনে সে আপন মর্যাদা ভুলে থাকতে পারে না। সুরঙ্গ থেকে লীলায়িত ছন্দে বেরিয়ে আসে বাতাসীদাঁড়ায় দুই প্রতিযোগীর মাঝখানে। যোসেফের দিকে ফিরে বলে, হাই বাবা! কারে কি বুলছিস্ বড়ভাই! উ হল গে ওস্তাদ!

যোসেফ এক হাতে তাকে সরিয়ে দেয়। ওভারম্যানের দিকে এগিয়ে এসে বলে, মরণ কেনে কড়ছিস ওস্তাদ? মরণ কাড়লি মোর সব ভুল হই যায়, তু তো জানিস। লে ভাই, খৈনি লে–

এ জতুগৃহে বিড়ি খাওয়া মানা। তামাকপাতা চিবায় ওরা সারা দিনমান।

 এককড়ি হেসে ফেলে। হাত বাড়িয়ে তামাকপাতা নিয়ে ডলতে থাকে।

এককড়ি আর যোসেফ। প্রভু আর ভৃত্য। মৃত্যুরাজ্যে রোজগারের ধান্দায় ওরা। আজ স্বগোত্র, বন্ধু!

.

পঙ্খিরাজ! হো পঙ্খিরাজ! উঠ! গো-রসটুক্ খাইকরি আমারে রেহাই দাও কেনে! ঐ এসেছে বাতাসী। রোজ এমন কাকডাকা ভোরে সে এসে ডেকে তোলে ভিন্সেন্টকে। কতবার বারণ করেছে। মেয়েটা শোনে না। বাতাসী সাঁওতালের মেয়ে। কারও স্ত্রী নয়, অথচ নানকুর জননী। নানকুর বয়স আট। এ বছরই হাতে কালি হয়েছে। বাবুদের যে বয়সে হাতে-খড়ি হয় প্রায় ঐ বয়সেই ধাওড়ার ছেলেমেয়েদের হাতে কালি উৎসব হয়। জীবনে প্রথম সে খাদে নামে, বাপ অথবা মায়ের হাত ধরে। নানকু আজ এক বছর হল খাদে নামছে। হাজরির খাতায় নানকুর নাম উঠেছে মাতৃ পরিচয়ে। খাজাঞ্চিবাবু ঋষি গৌতম নন, আর কোলিয়ারির কাজ কিছু ব্ৰহ্মবিদ্যাও নয়— তাই নানকুর পিতৃ-পরিচয় প্রসঙ্গটা ওঠেনি আদৌ! বয়সে বাতাসী ভিন্সেন্টের চেয়ে বছর পাঁচেকের বড়ই হবে। এক সন্তানের জননী; কিন্তু স্বাস্থ্যটি নিটোল। কুচকুচে কালো রঙ, মাথায় সব সময় একটি লাল ফুল, ঠোঁট দুটি পানের রসে রাঙা, ঊরুনিতম্ব, পীনোদ্ধত উরস। মূর্তিমতী কামনা। কবে কার হাত ধরে প্রথম এ জোড়-জাঙ্গালে এসেছিল মনে নেই কিন্তু জোড় ভেঙে গেছে অচিরেই। বাতাসী ক্ষীণকবাদিনী। তা ছাপড়ায় সে একাই থাকে নানকুকে নিয়ে। মাঝে মাঝে অভিসারে বার হয়। ফেল কড়ি-মাখ-তেলের আসন পেয়েছে। বয়ঃজ্যেষ্ঠরাও ঐ অষ্টদশবর্ষীয় ধর্মপ্রচারককে সমীহ করে চলে। একমাত্র ব্যতিক্রম ঐ বাতাসী। সবাই ওকে ডাকে ফাদারদা, ও ডাকে পঙ্খিরাজ। আস্তাবলে বাস করে বলে ঐ নামকরণ। সূর্যোদয়ের আগেই বাতাসী ছেলের হাত ধরে খাদে নামে। তার আগেই ভিন্সেন্টকে খাইয়ে যায় এক ঘটি গরম দুধ। বাতাসীর একটি গোরু আছে। রূপোপজীবিনীর পক্ষেই সম্ভব এ জাতীয় বিলাসিতা। সকালে দুধটা খাইয়ে বাড়ি বাড়ি বেচে আসে। নানকুকেও খাওয়ায়। দুধ খাওয়ার মত সামর্থ্য অবশ্য ভিন্সেন্টের ছিল না; বাতাসী ওকে বলেছিল–দুধের টাকা কোম্পানি দেবে। কোম্পানির নির্দেশেই সে নাকি ঐ এক পোয়া দুধের নিত্য যোগান দিয়ে যায়। সেটা যে ডাহা মিথ্যা কথা এটা ভিন্সেন্ট জানতে পেরেছিল অনেকদিন পরে। এটা ছিল বাতাসীর শ্রদ্ধার অর্ঘ্য, ভালবাসার দান!

-হেই পঙ্খিরাজ! উঠ কেনে! গো-রসটুক্ খাই লও!

 দরজা খুলে বাইরে আসে ভিন্সেন্ট। বলে, কেন রোজ আমাকে বিরক্ত করতে আসিস বল্ তো? কাল থেকে আর আসবি না!

বাতাসী চোখ দুটি বড় বড় করে বলে, ঈ বাবা! পঙ্খিরাজ ক্ষেপি গেছে আজ। তা হেই বাবা পঙ্খিরাজ, তুর টু দয়া হয় না গ? গো-রস বেচি দুটি পয়সা কামাই ইটো তুর মন মানে না? একা মাইয়া লোগ বটি, মরদ লাই–তুর দয়া হয় না?

একা থাকতে কে তোকে মাথায় দিব্যি দিয়েছে? বিয়ে করলেই পারিস?

–ঈ বাবা! আমাকে কে বিয়া করবে বল? আমি তো সোন্দর নই–

ন্যাকামি করিস না! মরদগুলোর মাথা না খেয়ে কারও ঘরে পাকাপাকিভাবে যা–

.

খিলখিল্ করে হেসে একেবারে লুটিয়ে পড়ে বাতাসী। বলে, –মনের মানুষ না হলি কি পাকাপাকি কুথাও থাকা যায় রে?

–তা ধাওড়ায় এত মরদ রয়েছে, বেছে নে তোর মনের মানুষ!

হঠাৎ হাসি থামিয়ে গম্ভীর হবার ভান করে। লাস্যময়ী কটাক্ষ নিক্ষেপ করে বলে, একটো মরদরে তো মনে ধরিছে গো পঙ্খিরাজ কিন্তু সি যে মোরে কিবল খিঁচায়!

প্রগলভা মেয়েটির মুখের কোন আড় নেই। ভিন্সেন্ট ওর বাঁকা ইঙ্গিতটা বুঝতে পারে ঠিক, কিন্তু এ নিয়ে কথা বাড়ায় না। সে জানে ঐ ক্ষণিকবাদিনী রূপোপজীবিনী সকলেই ওকথা বলে সময়বিশেষে। ওর হাত থেকে ঘটিটা নিয়ে, ঢক্‌ করে দুধটা খেয়ে ফেলে।

বাতাসী উঠে পড়ে। চলতে গিয়েও কি ভেবে হঠাৎ ফিরে দাঁড়ায়। বলে, -তা হেই পঙ্খিরাজ, তু বিয়া করিস না কেনে? কারও নজরে ধরে না তুর?

-তাতে তোর কি? যা ভাগ, পালা!

–মনের মত বউ পাস লাই, লা রে? তু যদি রাজি হস একটো সম্বন্ধ করি। খুব সোন্দর বটে! কী? করবি বিয়া?

ভিন্সেন্ট হেসে ফেলে। বলে, -মেয়েটি কে? বাতাসী সুন্দরী তো?

–ঈ বাবা! অমন বাতটো আমি মুখে আনবার পারি? আমি তো সাঁওতাল বটি! লিখাপড়া শিখি নাই! আমি হুই পাঁচু-সর্দারের বুইঝির বাতটো বুলতেছিলম! হ!

ভিন্সেন্ট একটা ছড়ি উঠিয়ে ওকে ছদ্মতাড়না করে, যা ভাগ, হতচ্ছাড়ি!

ঈ বাবা গ!—ছদ্ম আতঙ্কের অভিনয় করে বাতাসী ছুটে পালায়। কেমন যেন দিশেহারা হয়ে পড়েছে চন্দ্রভান। কোথাও কিছু একটা ভুল হচ্ছে। কী ভুল, তা সে জানে না, কিন্তু বিশ্বাসের ভিতটাই টলে উঠেছে। ফাদার শারদাঁর সঙ্গে একবার কথা বলতে পারলে হত।

কয়লাকুঠির জীবন রহস্যের আরও গভীরে প্রবেশ করেছে ইতিমধ্যে। দেখেছে মালকাটাদের জীবন আরও নিবিড় করে, আরও নিকট থেকে। ওদের সেবা করতেই এসেছে এখানে। ঘরে ঘরে তার অবারিত দ্বার। ওদের সঙ্গে মিশেছে একাত্মভাবে। ওরাও ভিন্সেন্টকে আপনজন করে নিয়েছে। কাছে এসে ও দেখলকী অপরিসীম দারিদ্র্য, জীবনের কী অতলান্তিক অবক্ষয়ী রূপ। দু-মুঠো অন্নের জন্য কোথায় নেমে গেছে মানুষগুলো। তবু কি দু-বেলা দুমুঠো অন্ন জুটছে? সূর্যোদয়ের আগে নেমে যায় পাতালে, উঠে আসে দশ বারো ঘন্টা পরে পুঁকতে ধুঁকতে, আর কাশতে কাশতে। সপ্তাহান্তে নামমাত্র হাজরিতাও কাটা যায় নানান ছুতায়। টবে মাল কম হয়েছে, কয়লার বদলে টেরিল বেশি দেওয়া হয়েছে, হ্যাঁন হয়েছে, ত্যান হয়েছে। আসলে মেট-মুন্সি গিনতিদার-হলারম্যান-ওভারম্যানের দস্তুরি ঠিক মত না হলেই হাজরি কাটা যাবে। আবার সব ঘাটে দস্তুরি দিতে গেলেও নগদ প্রাপ্তিটা দাঁড়ায় শূন্যে! মরদগুলো সন্ধ্যা থেকেই পড়ে থাকে পচাইয়ের আড্ডায়। মেয়েগুলো কে কার খোয়াড়ে রাত কাটায় হিসাব থাকে না। বাচ্চাগুলো বেওয়ারিস। শুয়োরের ছানা যেন। অর্ধেকের উপর মালকাটা একা থাকে। বউ পুষবার খরচে কুলায় না। হপ্তায় একবার জৈবিক প্রয়োজনে যায় ও-পাড়ায়। ব্যবসায়ী মেয়ের দল একটা স্বতন্ত্র চালা জমিয়ে বসেছে। এ ছাড়াও আছে বাতাসীর মত সুখের পায়রা-ফ্রি লানসার! যাদের পয়সা নগদ কিছু জমেছে তারা আবার মাঝে মাঝে চলে যায় বরাকর, মুখ বদলাতে। হাঁটতে হয় না। জোড়-জাঙ্গাল থেকে বরাকর পর্যন্ত পাতা আছে ছোট রেলের লাইন। ক্রমাগত টব চলেছে তাতে। মানুষে ঠেলে নিয়ে যায়। দুটো বিড়ি ঘুষ দিলেই তারা উঠিয়ে নেয় টবের উপর। ওতে চড়ে শহর বাজারের বেশ্যাপল্লী ঘুরে এস। সপ্তাহে একদিন বৈ তো নয়?

এ কোন্ নরকে পবিত্র খ্ৰীষ্টধর্মের প্রচার করতে এসেছে ভিন্সেন্ট? এদের সে কোন্ মুখে বলবে–দুঃখটা মায়া, ওটা কিছু নয়, ওকে অস্বীকার কর! মৃত্যুর পরে স্বর্গরাজ্যে যাবে তোমরা, আর রক্তচোষা মালিকগুলো যাবে নরকে। কেমন করে এই থিওরিটা গলাধঃকরণ করবে ওরা? পৌষ পার হয়ে মাঘ শুরু হয়েছে। হাড়কাঁপানো শীত। নেংটি-সার-মানুষগুলো কেমন করে লড়বে ঐ শীত দৈত্যের সঙ্গে? বাচ্চগুলো? কয়লার রাজ্য, অথচ একফোঁটা কয়লা পায় না ওরা। কুড়িয়ে আনে ঝরা শালপাতা, কাঠকুটো; তাই জ্বেলে আগুন করে। কুকুরছানার মত উলঙ্গ বাচ্চাগুলো শুয়ে থাকে সেই আগুনের চারপাশে। সর্দিজ্বর আর কাশি তো আছেই- নিমুনিয়ায় মারা গেল কটা বাচ্চা। চন্দ্রভান মরিয়া হয়ে শেষ-মেষ দরবার করতে গিয়েছিল খোদ নাথানিয়াল সাহেবের এজলাসে। এমনভাবে চলতে পারে না। জীবনধারণের জন্য একটা সর্বনিম্ন স্তর আছে কয়লাকুঠির স্বার্থেই অন্তত সেই সমতলে ঐ মালকাটাদের উন্নীত করতে হবে। দয়া ভিক্ষা নয়, কোম্পানির প্রয়োজনে। কোম্পানির খরচে একজন ডাক্তার থাকা উচিত, বিনামূল্যে ঔষধ দেওয়া উচিত, জ্বালানির কয়লা ওদের বিতরণ করা উচিত। হাজরির হার এমন হওয়া চাই যাতে খেটে খাবার মত শারীরিক সামর্থ্য ওদের বজায় থাকে।

ভ্রূকুঞ্চিত হয়েছিল সাহেবের। কড়া সুরে তাঁর বিচিত্র ভাষায় বলেছিলেন, তুমি এখানে ট্রেড ইউনিয়নিস্ট হিসাবে আসনি বাবু, এসেছ ধর্মপ্রচার করতে। ওসব ব্যাপারে তোমাকে নাক গলাতে হবে না।

মাথা নিচু করে ফিরে এসেছিলে ভিন্সেন্ট।

খবরটা তার পরদিনই পেল। যোসেফ মুর্মুর মেজ ছেলে প্রবল জ্বরে বেহুঁস। খবর পেয়েই যোসেফের ছাপরায় ছুটে যায়। যোসেফ ছিল না; তার বড় ছেলেও অনুপস্থিত। খাদে নেমেছে ওরা। যোসেফের বউ বাধ্য হয়ে কামাই করেছে। অচৈতন্য কিষ্টোর শিয়রে বসে আছে নির্বাক। বাকি বাচ্চা তিনটে কুঁকড়ি মেরে বসে আছে খড়ের বিছানায়। একটা কথা নেই, একটা ছেঁড়া কম্বল নেই। চট বিছিয়েছে হিমশীতল মাটির মেঝেতে। ভিন্সেন্ট বুঝতে পারে, বাচ্চাটার নিমুনিয়া হয়েছে। ওকে বাঁচাতে হলে ঔষধ নয়, সবার আগে ওকে শোয়াতে হবে একটা তোশকের উপর, গায়ে চাপাতে হবে একখানা কম্বল।

সন্ধ্যা হয়ে এসেছিল। একটু পরেই যোসেফ আর রবার্ট ফিরে এল। বিনা ভূমিকাতে ভিন্সেন্ট বলে ওঠে, –আমার একটা কাজ করে দেবে যোসেফভাই?

সমস্ত দিনমান খাদ-দৈত্যের সঙ্গে লড়াই করেছে যোসেফ মুর্মু। ক্লান্তিতে এখন ভেঙে পড়তে চাইছে তার দেহ। এদিকে ঘরে তার অচৈতন্য সন্তান কিষ্টো। তবু। ফাদারদার কথায় সে বিরক্ত হল না কিছুমাত্র। বলে, কী কাজ ফাদারদা?

তুমি একটু এস আমার সঙ্গে। বাইরে দুরন্ত হিমেল হাওয়া। যোসেফ বিনা প্রতিবাদে ওর পিছন পিছন নেমে আসে পথের উপর। কোথায় যেতে হবে, কেন যেতে হবে একবারও জানতে চায় না। ভিন্সেন্টের গায়ে একটা খদ্দরের হাফ-সার্ট, মোটাসূতোর আলোয়ান; আর একপ্রস্থ কয়লার পলেস্তারা ছাড়া যোসেফের গায়ে কোন আবরণ নেই। ওরা নীরবেই পথটি অতিক্রম করে। নিজের আস্তাবলের ডেরায় পৌঁছে চন্দ্রভান বলে, তুমি ঐ খাটিয়াটার ওধারটা ধর যোসেফ ভাই; একা আমি এটা বয়ে নিতে যেতে পারছি না।

যোসেফ শুধু বলে, –ও! অ্যাই বিত্তান্ত!

লোকটা ঘুরে দাঁড়ায়। আর কিছু বলে না। চলতে শুরু করে তার জখম ঠ্যাখানা টানতে টানতে।

একি হল যোসেফ? চলেছ কোথায়? এটা ধর!

যোসেফ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে। হঠাৎ উচ্চকণ্ঠে হেসে ওঠে আচমকা। বলে, — কিতাবের বুলিটো এক্কেরে ভুলি গেল ফাদারদা? এ দুনিয়ায় আমরা তো মুসাফির গ? দুশক কষ্ট কিছু লয়! মরি গেলি কিষ্টো তো সিরেফ বেহেস্তে যাবেগ গ!

চন্দ্রভান ছুটে এসে চেপে ধরে ওর ক্লয়লামাখা হাতখানা। আর্তকণ্ঠে বলে, -না না যোসেফ! সে অর্থে আমি ওকথা বলিনি! কিষ্টোকে আমরা মরতে দেব না। মরণ কি অত সোজা?

ওরই বাঁধা বুলি। তাতে কোন ভাবান্তর হয় না যোসেফের। হাতখানা ধীরে ধীরে ছাড়িয়ে নেয়। অনুচ্চকণ্ঠে বলে, ভগবান কিষ্টোর মায়েরে পাঁচ-পাঁচটো বাচ্চা দিছে। একটো মরি গেলি চারটো বাকি থাকবে, লয়? সে দুকু কিষ্টোর মায়ের সইব, আমারও সইবে। কিন্তুক, গোটা জোড়-জাঙ্গালের লেগে ঐ কিপটে ভগমান দিছে একটি মাত্তর ফাদারদা! সেটি নিমুনিয়া হই মরি গেলি আমাদের সইবে না। পথ ছাড় কেনে।

চন্দ্রভানের চোখ দুটি সজল হয়ে ওঠে।

হাত বাড়িয়ে মৃত্যুঞ্জয়ী খঞ্জ মানুষটা ন্যাংচাতে ন্যাংচাতে অন্ধকারের মধ্যে মিলিয়ে যায়।

কর্তৃপক্ষের সঙ্গে একটা বিরোধ যে অনিবার্যভাবে অলক্ষ্যে ঘনিয়ে উঠছে এটা ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় দিয়ে বুঝতে পারছিল ভিন্সেন্ট। অনেকেই সাবধান করে দিয়েছে তাকে। এককড়ি ওভারম্যান বলেছেনাথানিয়াল সাহেব ভিন্সেন্টের পিছনে গুপ্তচর নিয়োগ করেছে। সে কোথায় যায়, কি করে, কোথায় কি বলে তার রিপোর্ট সংগ্রহ করছে। আনি একদিন পূর্বতন পাদ্রীসাহেবের বিতাড়নের কাহিনীটা সবিস্তারে ওকে শুনিয়ে দিল। আগেকার পাদ্রীসাহেবও ঐ একই দোষ করেছিলেন–মালকাটাদের ভাল করতে চেয়েছিলেন। এমন কি পাঁচু পর্যন্ত ওকে অবাঞ্ছিত কিছুটা উপদেশ বর্ষণ করল। জলে বাস করে কুমীরের সঙ্গে বিবাদ করাটা যে নীতিশাস্ত্র বিরোধী এ সংবাদটা ওকে শুনিয়ে দিল। কিন্তু চন্দ্রভান নিরুপায়। তার নিজের অন্তরেই একটা সংশয় জেগেছে। প্রভু যীশুর বাণী সে কি ভুল বুঝেছে? এ দুনিয়ার হাটে সব দুঃখ কষ্টকে নতমস্তকে স্বীকার করে নেওয়াই কি প্রকৃত খ্রীষ্টানের একমাত্র কাজ? মৃত্যুর পর স্বর্গবাসের পুরস্কার কি শুধুমাত্র একটা ধোঁকাবাজি? অন্যায়ের বিরুদ্ধে যাতে ওরা দল বেঁধে রুখে না দাঁড়ায়। তাই কি ও এসেছে এখানে? প্রতি রবিবার এক এক ডেলা আফিং খাইয়ে ওদের ঘুম পাড়িয়ে রাখাই কি তার ধর্মপ্রচারের মূখ্য উদ্দেশ্য?

প্রসঙ্গটা একদিন হঠাৎ চিত্রলেখাও তুলে বসে। প্রতিদিন আহার্য পরিবেশনের অবকাশে দু-চারটে কথাবার্তা হয়। পাশের ঘরে আন্নাকালী উৎকর্ণ হয়ে পড়ে থাকে। চিত্রলেখা অবশ্য তাকে ভ্রূক্ষেপ করে না। মামীর মুখঝামটা তার গা-সওয়া। সে যেন সারাটা দিনমান প্রতীক্ষা করে থাকে অভুক্ত মানুষটার জন্য। সেদিন হঠাৎ বলে বসে, — একটা কথা বলব ফাদারদা? আপনার পিছনে নাথানিয়াল টিকটিকি লাগিয়েছে, জানেন?

ভিন্সেন্ট মৃদু হাসে।

আপনি জানেন, তা বুঝতে পারি। কিন্তু গোয়েন্দাটা কে তা জানেন?

 না, কে?

–আমার মামা।

-ও।

 চন্দ্রভান আর কথা বাড়ায়নি। নীরবে আহার-পর্ব সমাধা করে যায়। চিত্রলেখা অন্য প্রসঙ্গের অবতারণা করে, আর একটা কথা। আপনি ঐ বাতাসীর কাছ থেকে দুধ নেওয়া বন্ধ করুন।

-কেন বল তো?

–মেয়েটা ভাল নয়।

-আমি জানি। কিন্তু দুধ তো আমি পয়সা দিয়ে কিনি না। কোম্পানি ওকে পয়সা দেয়।

চিত্রলেখা আকাশ থেকে পড়ে। বলে, মামাকে জিজ্ঞাসা করব তো! তা পয়সা যেই দিক দুধ তো অন্য লোকের কাছেও পাওয়া যায়

চন্দ্রভান হেসে বলে, তুমি ওর উপর কোন কারণে রেগে আছ। ও কিন্তু তোমার উপকারই করতে চায়। বিশ্বাস না হয় ওকেই জিজ্ঞাসা করে দেখ–

-কী জিজ্ঞাসা করব?

–ও আমার কাছে তোমার নামে কি বলেছে!

আপনার কাছে আমার নামে লাগিয়েছে। ভারী আস্পর্ধা তো! আচ্ছা!

সাবধান কিন্তু শেষ পর্যন্ত হতে পারেনি চন্দ্রভান। বরং পাঁচজনের কাছে বারে বারে শোনা সাবধানবাণী ওকে আরও বেপরোয়া করে তোলে। কিসের ভয়, কাকে ভয়? সে ঈশ্বরের দূত, এসেছে যীশুর বাণী প্রচার করতে। ফাদার শারদাঁর মন্ত্র শিষ্য সেভয় করবে কেন? কাকে?

পরের রবিবার। সান্ধ্য উপাসনাসভায় ভিন্সেন্ট লক্ষ্য করে দেখে পিছনের সারিতে বসে আছে সপার্ষদ পঞ্চানন হালদার। নাথানিয়াল কেবলমাত্র সেই প্রথম দিনই এসেছিলেন। পাঁচুবাবু কখনও আসেনি। সন্ধ্যাবেলাটা সে অন্যত্র ব্যস্ত থাকে। ছুকরি পাড়ার একটি ঘরে সে বাঁধাবাবু। চন্দ্রভান বুঝতে পারে, সে আকর্ষণ ছেড়ে ওকে আজ এই উপাসনাসভায় যোগ দিতে হয়েছে নিতান্ত প্রয়োজনবোধে। সাহেবের কাছে চুলি কাটতে হবে। ভিন্সেন্ট কি বলে, কি করে সব তাকে জেনে যেতে হবে। তাই পিছনের সারিতে গা-ঢাকা দিয়ে বসে আছে চুপচাপ।

যেন প্রতিশোধ নিতেই ভিন্সেন্ট বেছে নিল সেন্ট মার্কের দশম অধ্যায়ের সেই অনবদ্য গল্পটি। বললে

প্রভু যীশুর সামনে হঠাৎ একজন বণিক ছুটে এসে নতজানু হয়ে বললে, মহান প্রভু, আপনি বলুন, কী করলে আমি সেই অনন্ত স্বর্গলোকে যেতে পারব? শুনে প্রভু বললেন, আমাকে কেন মিছিমিছি মহান প্রভু বলছ? একমাত্র ঈশ্বরই মহান। তাঁর দশটি আদেশ তো শুনেছ–পরের বউকে মায়ের মত দেখবে, কাউকে হিংসা করবে না, চুরি করবে না, মিথ্যা সাক্ষী দেবে না, অন্যায় করবে না, বাপ-মাকে ভক্তি করবে। শুনে বণিকটি বললে, এ সবই তো আমি ছেলেবেলা থেকে মেনে চলেছি প্রভু। তাহলে আমার। উদ্ধারের আর কোন বাধা নেই তো? প্রভু বললেন, না, আছে। তোমার একটিমাত্র দোষ। তুমি অনেক টাকার মালিক। যা কিছু সম্পদ তুমি জমিয়ে তুলেছ তা গরীব দুঃখীদের মধ্যে বিলিয়ে দাও। এস, আমার সঙ্গে এই ক্রুশকাষ্ঠের ভার ভাগ করে নাও। আমাকে অনুসরণ কর। একথা শুনে লোকটি সরে পড়ল। অনেকের রক্ত-জলকরা অনেক টাকা সে জমিয়েছে। তার মায়া সে ছাড়তে পারল না।…তখন প্রভু তাঁর শিষ্যদের দিকে ফিরে বললেন, ছুঁচের ফুটো দিয়ে একটা উটের পক্ষে গলে যাওয়া অসম্ভব, কিন্তু তার চেয়ে অসম্ভব কোন ধনী ব্যক্তির পক্ষে এ স্বর্গরাজ্যে প্রবেশ করা!

— ঈশাক রুহিদাস দাঁড়িয়ে উঠে প্রশ্ন করে, ফাদারদা, সগ্‌গে কয়লাকুঠি আছে?

এমন প্রশ্নের জবাব বাইবেলে খুঁজে পায়নি ভিন্সেন্ট; কিন্তু এ-জাতীয় প্রশ্নের জবাবও তাকে দিতে হয়। সে জানে ঐ সব নিরক্ষর বাগদি, ভূঁইহার, সাঁওতাল, কোল মুণ্ডাদের কাছে বাইবেল বর্নিত স্বর্গরাজ্য ধারনার বাইরে। হিংসা দ্বেষ মাৎসর্যশূন্য একটা চিরশান্তির অমরধাম ওরা কল্পনা করতে পারবে না। তাই বলে, –থাকতে পারে, কিন্তু সেখানকার মালকাটারা দু-বেলা ভরপেট খেতে পায়, তাদের গায়ে জামা আছে, তাদের বাড়ির ছাদ দিয়ে জল পড়ে না, আর তারা কয়লার আগুনে রান্না করে।

আন্টুনি বলে, –ঈ বাবা! তা হেই ফাদারদা, সিখানকার খাদের লিয়মটো কি? সেলাম বাজাতে ভুল হই গেলি সিখানে কি হাজরি কাটা যাবেক লাই?

বোধহয় এ-জাতীয় অপরাধে আন্টুনির এ সপ্তাহে হাজরি কাটা গেছে। তাই ওটাই তার বেদনার স্থল। ভিন্সেন্ট বলে, না। সেখানে অমন ঘড়ি ঘড়ি সেলাম বাজানোর কানুন নেই। সেখানকার মালকাটারা কাউকে সেলাম করে না–মুন্সি সর্দার-গিনতিদার হলারম্যান-ওভারম্যান মায় ম্যানেজারকে পর্যন্ত সেলাম করে না। একমাত্র সেলাম বাজায় ভগবানকে, ঈশ্বরকে।

শ্রোতৃবৃন্দের চোখ বড় বড় হয়ে যায়। এ বড় আজব কয়লাকুঠি তো! এবার উঠে দাঁড়ায় যোসেফ। বলে, বেহেস্তের বাতটো ছাড়ান দেন কেনে ফাদারদা। সিধে হিসাবটা আমারে বুঝায়ে দেন। ইখানে আমরা কারে সেলাম বাজাব? ভগমানরে, না ঐ উয়াদের?

নাটকীয়ভাবে হাতখানা সে বাড়িয়ে দেয় ওদিক পানে, যেখানে আঁধারে ঘাপটি মেরে বসে আছে পাঁচু হালদারের দল। ভিন্সেন্ট ইতস্ততঃ করে। এ-প্রশ্নের জবাব দেওয়া মানে প্রত্যক্ষ বিদ্রোহ–সে এখানে এসেছে ওদের আত্মার উন্নতি কামনায়। বিদ্রোহের আগুন জ্বালতে নয়। কী জবাব দেবে ভেবে পায় না। ওর দ্বিধা-দ্বন্দ্ব অন্তর্হিত হল যোসেফের পরবর্তী প্রশ্নে, উ কিতাবটোর ভিতর ই-কথা কিছু লিখে নাই? দেখেন কেনে?

হ্যাঁ, এ-প্রশ্নের জবাবে ঈভানজেলিস্ট ভান গর্গ তার অধিকার সীমা লঙ্ঘন করবে না। বলে, –আছে যোসেফ। সন্ত মার্ক লিখে গেছেন, প্রভু যীশুর জীবনের একটি ঘটনা। শোন বলি। যীশু তার শিষ্যদের বলতেন, একমাত্র ঈশ্বরকেই সেলাম বাজানো উচিত। তাই তাঁকে ফাঁদে ফেলবার জন্যে একবার দুজন পুলিসের অনুচর তাঁর কাছে এসে বললে, প্রভু, তাহলে আমরা কি সীজারের জয়গান গাইব না? সীজার কে তা বুঝেছ তো যোসেফ? প্রভু যীশুর আমলে সে ছিল জমিদার, মানে খোদ মালিক আর কি! ওরা ফন্দি করেছিল, যেই যীশু বলবেন না, সীজারকে সেলাম করার দরকার নেই, অমনি তারা ওঁকে বন্দী করবে। প্রভু ওদের সেই ফন্দিটা বুঝতে পেরেছিলেন। তাই বললেন, আমাকে একটা পয়সা দাও দেখি! ওরা একটা পয়সা এনে দিল। প্রভু বললেন, এর উপর এই মুন্ডুর ছাপটা কার? ওরা বললে, মহামান্য সীজারের। তখন প্রভু বললেন, তাই তো! সীজারের মহিমা দেখছি একটা পয়সার উপর চকচক করছে, অথচ ঈশ্বরের মহিমা পয়সা দিয়ে মাপা যায় না। ফলে সীজারের যেটুকু প্রাপ্য তা সীজারকে দিতে হবে, আর ঈশ্বরের প্রাপ্য ঈশ্বরকে দিতে হবে!

সেন্ট মার্কের সুসমাচারের দ্বাদশ অধ্যায়ে এ কাহিনীটা পড়া ছিল ভিন্সেন্টের। হুবহু অনুবাদ সে ইচ্ছা করেই করেনি। ও জানত, এটুকু অদলবদল না করলে ওর শ্রোতার দল এ কাহিনীর অন্তর্নিহিত সত্যটা ধরতে পারবে না।

যোসেফ বিজ্ঞের মত মাথা নেড়ে বলে, হুঁ! বুঝলম।

পরদিন খোদ নাথানিয়াল সাহেবের এজলাস থেকে আহ্বান এল ভিন্সেন্টের। মালিক তাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। এটা আশঙ্কা করাই ছিল। ভিন্সেন্ট প্রস্তুত হয়েই ছিল। মাথা সোজা রেখে সে এসে হাজির হল বড়সাহেবের খাস কামরায়। প্রকাণ্ড টেবিলের ও প্রান্তে গদি-আঁটা চেয়ারে বিশাল দেহটা এলিয়ে দিয়ে বসেছিলেন নাথানিয়াল। কী একটা রিপোর্ট দেখছিলেন। পরনে নিখুঁত সাহেবি-স্যুট, মুখে পাইপ। পিছনে ফায়ার-প্লেসে কয়লার ধিকি ধিকি আগুন। ম্যান্টেলপীসের উপর পোর্সেলিনের ত্রৈী ছোট্ট একটা যীশুর মূর্তি। তার উপর দেওয়ালে ঝোলানো আছে ইংলণ্ডেশ্বর সপ্তম এডওয়ার্ডের একটি প্রকাণ্ড চিত্র।

আর্দালি ভিন্সেন্টের আগমন ঘোষণা করার পরেও সাহেব মুখ তুলে চাইলেন না। একমনে রিপোর্টটা দেখতে থাকেন। ভিন্সেন্ট ঝকঝকে টেবিলের অপরপ্রান্তে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকে। তাকে বসতে বলা হয়নি। হঠাৎ মুখ তুলে সাহেব ওকে দেখতে পান। তাঁর বিচিত্র ভাষায় যা বলেন তা এই, –ও, তুমি এসেছ? মিস্টার গর্গ, এর আগেও তোমাকে আমি সাবধান করে দিয়েছিলাম, কিন্তু তুমি কর্ণপাত করনি। তুমি ধর্মপ্রচারের নামে আমার কোলিয়ারিতে বিদ্রোহ প্রচার করছ। অতএব তোমাকে আমি বরখাস্ত করতে বাধ্য হচ্ছি। তুমি অবাঞ্ছিত ব্যক্তি।

ভিন্সেন্ট বুঝতে পারে তাকে বসতে বলা হবে না। নিজেই সে চেয়ারটা টেনে নিয়ে বলে, –মিস্টার নাথানিয়াল, আপনি একটু ভুল করছেন না কি? আমি আপনার বেতনভুক কর্মচারী নই। আমাকে কি আপনি বরখাস্ত করতে পারেন?

-বাজে কথা বল না! তোমার যাবতীয় খরচ যোগাচ্ছে কোম্পানি। দুধকলা দিয়ে কালসাপকে আর আমরা পুষব না; আমি আজই ফাদার মার্লোকে লিখব তোমাকে এখান থেকে উইড্ৰথ করে নিতে। তোমার খাওয়া-থাকার বাবদে কোম্পানি আর একটি পয়সাও খরচ করবে না, বুঝেছ?

-না বোঝার তো কিছু নেই, কারণ এবার আপনি আইনসঙ্গত কথা বলেছেন। বেশ, আমি আজই আপনার আস্তাবল ছেড়ে দিচ্ছি।

হঠাৎ ক্ষেপে ওঠেন নাথানিয়াল। বলেন, -হ্যাঁ হ্যাঁ, সূর্যাস্তের আগে এই কোলিয়ারির ত্রিসীমানা ছেড়ে চলে যাবে। আমি তোমার মুখদর্শন করতে চাই না।

ভিন্সেন্ট শাঙ্কণ্ঠেই জবাব দেয়, আবার আপনি ভুল করছেন, মিস্টার নাথানিয়াল। এখানকার মাটির নিচেটাই আপনারা ইজারা নিয়েছেন, মাটির উপরের অংশটার মালিক আপনি নন–ঐ উনি, যাঁকে আপনি যীসাস ক্রাইস্টের উপরে স্থান দিয়েছেন-ভারত সম্রাট! আমার মুখদর্শন করতে না চাইলে আপনাকে নিজগৃহে অন্তরীণ হয়ে থাকতে হবে।

সাট আপ, য়ু পিগ হেডেড আর্চিন! এ কোলিয়ারির ত্রিসীমানায় তুমি ঢুকবে না। যাও!

ভিন্সেন্ট নীরবে উঠে চলে যাচ্ছিল। আবার তাকে ফিরে ডাকে নাথানিয়াল।

–তুমি এখনই চলে যাচ্ছ তো?

–আপনার আস্তাবল থেকে তো নিশ্চয়। কোলিয়ারি থেকে নয়। আমি ঐ গীর্জায় গিয়ে আশ্রয় নিচ্ছি।

উঠে দাঁড়ায় নাথানিয়াল। চিৎকার করে ওঠে, আমার ধৈর্যের একটা সীমা আছে মিস্টার ভান গর্গ! এক কথা কতবার বলব? ঐ গীর্জাটা আমার এলাকার, ওটা কোম্পানির পয়সায় তৈরী, ওটার মালিক আমি। ওখানে তোমার স্থান হবে না। জাস্ট ক্লিয়ার আউট অব মাই টেরিটারি।

ভিন্সেন্ট কিন্তু উত্তেজিত হয়নি। একই ভাবে বলে, –আপনি ক্রমাগত বে-আইনী কথা বলে চলেছেন। আপনার দলিলপত্র ভাল করে পড়ে দেখুন। গীর্জাটা কোম্পানির পয়সায় তৈরী হয়েছে, কোম্পানির জমিতে নির্মিত হয়েছে এটা কোন কথাই নয়–তার চেয়ে বড় কথা কোম্পানি নিঢ় স্বত্বে মেথডিস্ট চার্চকে একদিন ওটা দান করেছিল। একটা কোলিয়ারির অ্যাসিস্টেন্ট ম্যানেজার হয়ে আপনি এই সামান্য আইনের কথাটা বুঝতে পারছেন না? ওর মালিক আপনি নন, ওর মালিক মেডডিস্ট চার্চ, যার তরফে আমি কথা বলছি।

জোড়-জাঙ্গাল কোলিয়ারির চতুঃসীমার ভিতরেই কোন দ্বিপদী জীব যে এ-ভাষায় সর্বশক্তিমান অ্যাসিস্টেন্ট ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলতে পারে এ ছিল নাথানিয়ালের দুঃস্বপ্নেরও অগোচর। ভিন্সেন্ট আর দাঁড়ায়নি। দ্বারের দিকে এগিয়ে যায়। হঠাৎ পুনরায় পিছন থেকে ডাক শুনতে পায়।

দাঁড়াও হে আইন-বিশারদাঁ ছোকরা!

ভিন্সেন্ট চৌকাঠের উপরে দাঁড়িয়ে পড়েছে। ঘুরে তাকায়। উত্তেজনায় নাথানিয়াল হাঁপাচ্ছে। দাঁতে দাঁত চেপে সে বললে, –আইনের কেতাব তুমি অনেক পড়েছ দেখছি! ইতিহাস কিছু পড়েছ? নীলকুঠির সাহেবের ইতিহাস? ঐ গীর্জার চৌহদ্দির মধ্যেই তোমাকে কেটে খণ্ড খণ্ড করে আমি সিঙারণে ভাসিয়ে দেবার ক্ষমতা রাখি, এটুকু কি জানা আছে তোমার?

এবার হাসল ভিন্সেন্ট। বলে, আছে। তা ইতিহাসের কথাই যখন তুললে নাথানিয়াল, তখন আমিও জিজ্ঞাসা করি–তুমি হেনরি দি সেকেন্দ্রে ইতিহাস পড়েছ? তোমার চেয়ে নোকটার ক্ষমতা আর দম্ভ কোনটাই কম ছিল না। তোমার মত কোন কোম্পানির চাকুরে ছিল না সে, ছিল একটা দেশের রাজা! গীর্জার চৌহদ্দির মধ্যে সেও একটা কুকর্ম করে বসেছিল ঠিক যেমন ইঙ্গিত তুমি এই মাত্র দিলে। ফল কি হয়েছিল জান? তিনশো আটানব্বই ঘা চাবুক খেতে হয়েছিল ইংলণ্ডেশ্বরকে নতজানু হয়ে, নগ্ন গাত্রে! উলঙ্গ অবস্থায় ঐ যোসেফ মুর্মুর মত মানুষের হাতে ক-ঘা চাবুক তুমি সহ্য করতে পারবে নাথানিয়াল?-কি হল? বুঝলে না? আমি সেন্ট টমাস বেকেটের ইতিহাসটা তোমাকে পড়ে দেখতে বলছি। আইনের বই নয়, ইতিহাস!

ধীরপদে বেরিয়ে গেল ভিন্সেন্ট।

 নাথানিয়াল তখনও ভাষা খুঁজে পায়নি।

নিজের ডেরায় এসে মালপত্র বেঁধে-ছেঁদে নেয়। অন্ধকারের মধ্যে গুটিগুটি এসে দাঁড়ায় লেংটিসার কতকগুলি উলঙ্গ মানুষ–মালকাটার দল। ওরা সব খবর রাখে। ওরা জানে ওদের ফাদারদার ডাক পড়েছিল বড়সাহেবের ঘরে; জানে, সাহেব ওকে চলে যেতে বলেছে। তাই অন্ধকারের মধ্যে সার দিয়ে দাঁড়িয়েছে ওরা–ঈশাক, ভিখু, বুধন, নবা, এককড়ি, আন্টুনি। যোসেফ বলে, তুমার ব্যবস্থা হই গেছে ফাদারদা। ইখানে তুমি থাকতে পারবে, তা আমরা তখনই বুঝছি। চল কেনে, ব্যবস্থা হই গেছে।

না, মালকাটার কুলি-ধাওড়ায় নয়। ওরা জানে সেখানেও ওদের ফাদারদাকে থাকতে দেবে না কোম্পানির সেপাইরা। ইতিমধ্যে ওরা বিকল্প ব্যবস্থা করে ফেলেছে। ওরা ফাদারদাকে রাখবে জোড়-জাঙ্গাল কোলিয়ারির চৌহদ্দির বাইরে। সিঙারণ নদীর ওপারে তেঁতুলডাঙা মাঠের মাঝখানে একটি পরিত্যক্ত কুটিরে। ঐ জোড়া-অশ্বত্থের তলায় গতবছর বর্ষার আগে এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন একজন ভবঘুরে সন্ন্যাসী মৌনীবাবা। বরাকরের এক বর্ধিষ্ণু ব্যবসায়ী লালাজী ঐ সন্ন্যাসীর জন্য একটি পর্ণকুটির তৈরী করে দিয়েছিলেন কিছু পুণ্য সঞ্চয়ের লোভে। সন্ন্যাসী কবে চলে গেছেন, পড়ে আছে শূন্য কুটির। ওটা কোলিয়ারি সীমানার বাইরে, আর ওর মালিক লালাজী। ভিন্সেন্ট বলে, -অতদূরে যাওয়ার কোন দরকার নেই যোসেফ। আমি ঐ গীর্জায় গিয়ে আশ্রয় নেব। গীর্জার মালিক নাথানিয়াল নয়–যীসাস্ নাজারেথ!

সে রাত্রেই ওরা ওর মালপত্র গীর্জায় পৌঁছে দিয়ে এল। যোসেফ বলেছিল, এমন একা একা তার এখানে থাকাটা ঠিক হবে না। ভিন্সেন্ট কর্ণপাত করেনি। একাই সে আছে গীর্জায়। আশ্চর্য, কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে কোন আপত্তি হল না, কোন উপদ্রব হল না। পরদিন থেকে পাঁচু হালদারের বাড়ি খেতেও আর গেল না। অসুবিধা নেই কিছু। মালাকাটর দল ওর দায়িত্ব নিল যৌথভাবে। কি হিন্দু, কি মুসলমান, কি খ্রীষ্টান। ওকে খাবার দিয়ে যায়, লণ্ঠন দিয়ে যায়, খাবার জল ভরে দিয়ে যায়। সামর্থ্যে যেটুকু না কুলায় সহানুভূতিতে পুষিয়ে দেয়। ভিন্সেন্ট যথারীতি কুলিবস্তীতে ঘুরে ঘুরে তার সেবাধর্মের কাজ করে যায়। এখানেও কর্তৃপক্ষ থেকে কেউ বাধা দিতে এল না। ভিন্সেন্টের উনিশ বছরের তারুণ্য একটা প্রত্যক্ষ সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হয়ে বসেছিল; কিন্তু ও-পক্ষ একেবারে উদাসীন। এমন তো হবার কথা নয়? অ্যাসিস্টেন্ট ম্যানেজার নাথানিয়াল এতবড় অপমানটা বেমালুম হজম করে যাবে এটা যে অবিশ্বাস্য। ভান গর্গ সতর্ক হয়, তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় দিয়ে সে অনুভব করে আঘাত ঘনিয়ে উঠছে নেপথ্যে।

হয়তো ওর আশঙ্কা অমূলক নয়, হয়তো ওর উপর গোপন আঘাত হানবার আয়োজন সত্যই ঘনিয়ে উঠছিল নেপথ্যে; কিন্তু তার আগেই এল একটা প্রকাণ্ড ঝড় একেবারে অপ্রত্যাশিত দিক থেকে। জোড়-জাঙ্গাল কোলিয়ারীটা সে ঝড়ের ক্ষ্যাপামিতে একেবারে তছনছ হয়ে গেল। এমন দুর্ঘটনা সব কোলিয়ারিতেই হয়–পাঁচ-দশ বছর অন্তর। সেবার হল জোড়-জাঙ্গালে। সাতান্নজন মালকাটা নিঃশেষে মুছে গেল সে। দুর্ঘটনায়। উনিশশো আট সালের সতেরই জানুয়ারী। কোলিয়ারির ইতিহাসে একটা চিহ্নিত তারিখ।

কিন্তু দুর্ঘটনা যেদিন ঘটল তার আগের দিন রাত্রে গীর্জার ভিতরে ঘটেছিল আর একটি নাটকীয় ঘটনা, যেটার কথা আগে বলা দরকার ।

রাত তখন কত হবে? ঘড়ি নেই ওর, প্রথম প্রহরের যাম-ঘোষণা হয়ে গেছে। শীতের রাত। জোড় জাঙ্গাল কোলিয়ারিতে এমন মাঘের রাতে এক প্রহরেই মধ্য রাত্রি। কয়লা কাটার কাজ অবশ্য দিবারাত্রি চলে; কিন্তু কাঁটাতারের বাইরের জীবনে সেই কয়লা কাটার স্পন্দন শোনা যায় না। চারদিক নিযুতি। খড়ের বিছানায় সতরঞ্চি পেতে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে পড়েছিল চন্দ্রভান। গীর্জার দরজাটা ভিতর থেকে বন্ধ। হঠাৎ ওর মনে হল কে যেন ধীরে ধীরে সেই রুদ্ধদ্বারে টোকা মারছে। চট করে উঠে বসে। এত রাত্রে কে এল? লণ্ঠনটা নিবিয়ে রেখেছিল, সেটা জ্বেলে দেয়। সাড়া দেয়, কে?

–আমি! দরজা খুলুন!

–স্ত্রীলোকের কণ্ঠস্বর। বাতাসী? সে তো এমন রাতে আসে না কখনও? সকালবেলা যথারীতি এসে দুধ দিয়ে যায়। বারণ করলেও শোনে না।

–আমি কে?

দরজা খুলে দিন, আমি চিত্রলেখা!

 বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে যায় চন্দ্রভান। দ্বার খুলে দিতেই খোলা দরজা দিয়ে গীর্জায় ঢুকে পড়ে এক ঝলক ঠাণ্ডা হিমেল হাওয়া, আর সেই সঙ্গে একটি ভয়ত্রস্তা অভিসারিকা! একেবারে চন্দ্রভানের পায়ের উপর।

-ও কি করছ চিত্রলেখা? কী হয়েছে? এত রাত্রে তুমি কেমন করে এলে?

–আপনি আমাকে বাঁচান ফাদারদা!

বাঁচান? কেন, কী হয়েছে তোমার?

–আপনাকে ওরা মেরে ফেলবে। আপনি পালান!

তার মানে? ওঠ, উঠে বস তুমি। আমাকে ওরা মেরে ফেলবে, তাই তোমাকে বাঁচাতে হবে-কী আবোলতাবোল বকছ?

ওর কাধ ধরে টেনে তুলে দাঁড় করিয়ে দেয়। লণ্ঠনের ম্লান আলোয় দেখে চিত্রলেখার মুখে একবিন্দু রক্ত নেই। ভয়ে সাদা হয়ে গেছে। থর থর করে একবার কেঁপে ওঠে সে। পরক্ষণেই ঝাঁপিয়ে পড়ে ভিন্সেন্টের বুকের উপর। সবলে আঁকড়ে ধরে ওকে। বলে, –তুমি এখনই পালাও ফাদারদা, আজ রাত্রেই। আমাকেও নিয়ে চল!

সমস্ত শরীর অবশ হয়ে যায় চন্দ্রভানের। ওর উনিশ বছরের জীবনে এমন অভিজ্ঞতা এই প্রথম। কোমল একটি নারীদেহের অমন অতর্কিত আলিঙ্গনে ভিন্সেন্ট একেবারে বিহ্বল হয়ে পড়ে। ওর বুকে মুখ লুকিয়ে চিত্রলেখা তখন ফুলে ফুলে কাঁদছে।

ধীরে ধীরে আত্মবিশ্বাস ফিরে পায়। আস্তে আস্তে নিজেকে আলিঙ্গনমুক্ত করে মেয়েটিকে বসিয়ে দেয় খড়ের বিছানায়। বলে, –এত উতলা হচ্ছ কেন চিত্রলেখা? কী হয়েছে বল?

দুহাতে মুখ ঢেকে চিত্রলেখা বলে, –যা বলার তা তো বলেছি।

না, কিছুই বলনি তুমি। কেন আমি পালাব? কাকে ভয় করি আমি? আর তুমিই বা কেন যাবে আমার সঙ্গে? কোন্ অধিকারে তোমাকে আমি নিয়ে যাব? আমি খ্রীষ্টান, তুমি–

–আমিও যদি খ্রীষ্টান হয়ে যাই?

–তা কেন হবে চিত্রলেখা? কেন ধর্মত্যাগ করবে? আমার জন্য?

একটু চুপ করে থাকে মেয়েটি। কী ভাবে জবাব দেবে বুঝে উঠতে পারে না। শেষকালে যে জবাবটা দেয়, তার অর্থ ঠিকমত বোধগম্য হয় না চন্দ্রভানের। সে নিজেই যদি অতটা উত্তেজিত না হয়ে থাকত তাহলে হয়তো বুঝবার চেষ্টা করত। চিত্রলেখা বললে, -মেয়েদের ধর্ম অন্য জিনিস! সেই ধর্ম বাঁচাতেই আমি ধর্ম ত্যাগ করতে চাইছি। তুমি আমাকে খ্রীষ্টান করে নাও।

-আমি যাজক নই। কাউকে ব্যাপটাইস করবার অধিকার আমার নেই।

একথা চিত্রলেখার উত্থাপিত প্রসঙ্গের পুরো জবাব নয়। চিত্রলেখার বক্তব্যের ভিতর কী একটা গূঢ় ব্যঞ্জনা ছিল, তার আত্মসমর্পণের ভঙ্গিটায়, তার ভাষায় সে আর কিছু একটা বলতে চাইছিল। সেটা নজর এড়াল চন্দ্রভানের। কেন? ওর কি তখন মনে পড়ে গিয়েছিল তার নিজের ধর্মত্যাগের ইতিকথা? এই কৃষ্ণসার অভিসারিকার ভিতর সে কি আর একটি গোরোচনা গোরিকে দেখতে পেয়েছিল তখন? বর্তমানের কি গলা টিপে ধরেছিল অতীত?

এতক্ষণে মুখ থেকে হাতখানা সরালো মেয়েটি। পূর্ণ দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে বলে, জানি, অত্যন্ত নিলজ্জের মত ব্যবহার করছি। কিন্তু জীবনে এমন পর্যায় আসে যখন মানুষ নিলর্জ হতে বাধ্য হয়। তাই জিজ্ঞাসা করছি, আমি কি আপনাকে ভুল বুঝেছিলাম?

তুমি কী বুঝেছিলে তা আমি জানি না। কিন্তু একটা কথা বিশ্বাস কর। এখন আমি কিছুতেই এ কোলিয়ারি ছেড়ে যেতে পারব না। এভাবে পালাতে আমি রাজী নই। আমি শেষ পর্যন্ত লড়ে দেখতে চাই। কোলিয়ারির মালিকের কাছে এভাবে হার স্বীকার করাটা হবে যীসাসের অপমান! সে আমি পারব না। তুমি আমাকে মাপ কর।

চিত্রলেখা উঠে দাঁড়ায়। গায়ের কাপড়টা ঠিক করে নেয়। নিজের প্রগলভতায়, নিজের নির্লজ্জ ব্যবহারে এতক্ষণে সে যেন মরমে মরে যায়। বলে, মাপ করবেন। আমাকে। আপনি আপনার লড়াই করুন। আজ রাতে আমার এ নির্লজ্জতার কথাটা যদি ভুলে যেতে পারেন খুশি হব।

ধীরপদে চিত্রলেখা বেরিয়ে যায় হিমেল হাওয়ার অন্ধকারে।

–তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসব?

–থাক, দরকার হবে না। ফেরার পথ আমার জানা।

দুর্ঘটনাটা ঘটল তার পরদিন দুপুরে। উনিশশো আট সালের সতেরই জানুয়ারী বেলা এগারোটা দশে। জোড়-জাঙ্গাল কোলিয়ারির প্রাচীন নথিপত্র ঘেঁটে দেখতে পার, দেখবে ঐদিন এগারজন মালকাটাকে জীবন্ত কবর দিয়েছিল ঐ কয়লাখনির দৈত্যটা। কর্তৃপক্ষ চেষ্টার ত্রুটি করেননি। তিন শিফটে নিরবচ্ছিন্নভাবে উদ্ধারকার্য চালানো হয়েছিল কিন্তু মৃতদেহগুলি উদ্ধার করা যায়নি। আর উদ্ধার করা হলেই বা কি লাভ হত? কবর টেনে বার করে আর এক কবরে শুইয়ে দিতে হত তাদের। ধাওড়ার মালকাটারা অবশ্য অন্য কথা বলে। তাদের হিসাবমত ঐদিন কুলি-ধাওড়া থেকে নিরুদ্দেশ হয়েছিল সাতান্নজন মানুষ–মেয়ে-মদ্দ বাচ্চা ছেলেমেয়ে। ঐ সাতান্নজন মানুষকে আর কোনদিন কেউ দেখেননি খোলা আকাশের নিচে। কর্তৃপক্ষের নথীপত্র সেকথা বলে না। তাঁদের হিসাবে বাকি ছেচল্লিশজন মানুষ আদৌ কোন দুর্ঘটনায় মারা যায়নি। তারা তারপরেও কাজ করে গেছে, কেউ তিনদিন, কেউ সাত-দশদিন। বিশ্বাস হয় কোলিয়ারির খাতাপত্র দেখতে পার। হাজিরা খাতায় তাদের নাম আছে। পিট অ্যাটেন্স রেজিস্টারে তাদের নাম উঠেছে, বাতিঘরের হিসাব খাতায় তাদের নামে লণ্ঠন ইসু করা হয়েছে; সপ্তাহান্তে রীতিমত টিপ ছাপ দিয়ে তারা হাজরির টাকাও নিয়ে গেছে। তারপর তারা কোথায় গা-ঢাকা দিয়েছে, কেন চলে গেছে তা কে জানে? কোলিয়ারির হিসাবে সাতান্ন নয়, এগারোজন মারা যায় ঐদিন।

চন্দ্রভান খবর পেয়ে যখন খাদ-ভসকার সামনে এসে দাঁড়াল, তখন সেখানে চাপ ভীড়। অসহায় মানুষগুলো ছোটাছুটি করছে, আর্তকণ্ঠে বিলাপ করছে, খাদে নামতে চাইছে। গুর্খা সেপাইয়ের দল কাঁটাতারের বাইরে ওদের ঠেকিয়ে রেখেছে। ভিতরে কাউকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। ভীড় হঠাও-তফাৎ যাও!

চন্দ্রভান হঠাৎ দেখতে পায় বাতিঘর থেকে লণ্ঠন নিয়ে এককড়ি এদিকেই আসছে ছুটতে ছুটতে। চন্দ্রভান ছুটে এসে চেপে ধরে ওর বাহুমূল। বলে, কতজন আছে খাদের ভিতরে?

-বারোটা সেল। প্রতি সেলে পাঁচজন।

–ওদের বাঁচানো যাবে না?

–তা কেমনে বলব? হাত ছাড়ুন, আমি নিচে যাব।

আমাকেও সঙ্গে নাও সরখেল।

না। এলেমদার না হলে চলবে না। আপনি উপরে থাকুন। আরও চারজন এক্সপার্ট হেল্পারের সঙ্গে এককড়ি সরখেল নেমে গেল অগ্নিগর্ভ খাদের ভিতরে।

কাঁটাতারের ওপারে একটা অবর্ণনীয় দৃশ্য। ভয়ে আতঙ্কে হতাশায় মানুষগুলো দিশেহারা। শিশু আর নারীর দল বীভৎস চিৎকার জুড়েছে। কারও মরদ, কারও জেনানা, কারও বাচ্চা নিচে আছে। গুর্খা সেপাইয়ের শাসন ওরা মানছে না, কাঁটাতারের বাধা মানছে না, ভীড় ঠেলে বারে বারে এগিয়ে আসছে।

-মুনিয়া রে! এ মেরা মুনিয়া!

কারও মুনিয়া, কারও না, কারও বুলাকি। মায়ের প্রাণ, ওরা মানবে কেন?

একটু পরেই খাঁচাটা উঠে এল উপরে। খাঁচা থেকে ধরাধরি করে তিনটি অচৈতন্য অগ্নিদগ্ধ দেহ নামিয়ে আনে হেল্পারের দল। দুটি বাচ্চা, একটা পূর্ণদেহী মানুষ। সর্বাঙ্গ পুড়ে গেছে।

-কৌন হ্যয়? কৌন? জিন্দা ইয়ে মুর্দা?

–নাম বুলছ না কেনে গ তুমরা?

নাম বলবে কেমন করে? চিনতেই কি পেরেছে ছাই! খাদের আগুনে শুধু রূপ নয়, নাম ও রূপ দুই-ইবিসর্জন দিয়ে এসেছে যে ওরা। সনাক্তের অতীত। মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত এমনভাবে ঝলসে গেছে যে, তারা এখন-পরিচয়ের বাইরে। গেটের সামনে ওদের নামিয়ে দিয়ে রেসকিউ-পার্টির ছেলেগুলো আবার ছুটে ফিরে গেল খাঁচায়। আবার নিচে যাবে ওরা।

আতঙ্কের যে তুঙ্গশীর্ষে উঠলে মানুষের হিতাহিত বোধ হারিয়ে যায় ওরা সেখানে এসে পৌঁছেছে। আত্মীয়-বিয়োগব্যথা ভুলে মানুষগুলো ক্ষণিকের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায় ঐ অগ্নিদগ্ধ বীভৎস মূর্তি তিনটি দেখে। চন্দ্রভান চিৎকার করে ওঠে, কি দেখছিস তোরা? তেল, তেল, কিছু নারকেল তেল নিয়ে আয় শীগগির! ঢেকে দে পোড়া ঘাগুলো, হাওয়া না লাগে!

গায়ের সুতির চাদরটা খুলে সে প্রথমেই ঢেকে দেয় পূর্ণাবয়ব মানুষটির সর্বাঙ্গ।

চারদিকে তাকিয়ে দেখে ভীড়ের মাঝখানে যারা আছে তাদের সঙ্গে লেংটি অথবা খাটো ধুতি। মেয়েদের একটি করে লাজবস্তু। একেবারে উলঙ্গ না হলে ওরা একটুকরো কাপড় দিয়েও সাহায্য করতে পারবে না। তাছাড়া ওদের কাপড় কয়লায় ভর্তি, ময়লায় ভরা। ঐ কাপড়ে অগ্নিদগ্ধ অঙ্গগুলি ঢেকে দিলে সেপটিক হয়ে যেতে পারে। ইতিমধ্যে কে বুঝি কোথা থেকে এক বোতল নারকেল তেল এনে ফেলেছে। চন্দ্রভান নিজের হাফসার্টটা খুলে ফেলে, গেঞ্জিটাও। ফালা ফালা করে ব্যাণ্ডেজ বানায়। তেলে ডুবিয়ে বাচ্চা দুটোকে আপাদমস্তক বেঁধে ফেলে।

সমস্ত দিনরাত এবং তার পরের পুরোটা দিন উদ্ধারকারীর দল কাজ করে গেল। বরাকর, আসানসোল থেকে গাড়ি করে সাহেবরা এলেন। খাদের ত্রিসীমানায় মালকাটাদের যেতে দেওয়া হল না। সর্বসমেত এগারোটি মৃতদেহ উঠিয়ে আনতে পেরেছিল ওরা। প্রথম খেপে যে তিনজন উঠেছিল তার ভিতর বাচ্চা দুটি বাঁচেনি। শুধু বেঁচেছিল তখনও ঐ পূর্ণাবয়ব মানুষটা। দুর্জয় প্রাণশক্তি তার। শেষ পর্যন্ত, অবশ্য তাকে সনাক্ত করা গেছে। দেহটা তিন নম্বর পিটের মালকাটা যোসেফ মুর্মুর। একমাত্র সেই বেঁচে ফিরেছে। তবে এবার সেজন্য তাকে অভিনন্দন জানাবার কেউ নেই। যোসেফের বউ, বড় ছেলে এবং কিষ্টো রয়ে গেছে খাদের নিচে!

আটচল্লিশ ঘন্টা একটানা উদ্ধারকার্য চালানোর পর এ ব্যর্থ প্রয়াস বন্ধ হল। এখন আর ওদের উদ্ধারের চেষ্টা করা পণ্ডশ্রম। এতক্ষণ ওরা বেঁচে থাকতে পারে না। পারা সম্ভবপর নয়। আগুনে যদি নাও পুড়ে থাকে, বাতাসের অভাবে এতক্ষণে মারা গেছে নিশ্চয়।

শেষ মৃতদেহ যেটি ওরা উঠিয়ে আনল সে দুর্ঘটনায় মরেনি। কারণ সে পিটে নেমেছিল বিস্ফোরণের আধ ঘন্টা পরে। লোকটা ওভারম্যান এককড়ি সরখেল।

নিদারুণ শোকের আঘাতে স্তব্ধ হয়ে গেল জোড়-জাঙ্গাল কোলিয়ারির জীবন-যাত্রা। বলয়ার হাউসে আগুন নিভল, পিট-হেড গিয়ারের বিরাট চাকাটা থেমে রইল, সিটি বাজল না সকাল সন্ধ্যায়। ঘরে ঘরে শুধু মড়াকান্না। কারও মরদ, কারও স্ত্রী, কারও বা সন্তান। ইনিয়ে বিনিয়ে কাদা ছাড়া আর কি জানে ওরা? যোসেফ মর্মু বেঁচে আছে। এখনও, জ্ঞান আছে, কথা বলতে পারে না। হাসপাতাল বলে কোন কিছু নেই জোড় জাঙ্গালে। যোসেফ আছে তার নিজের ছাপরায়। একাই পড়ে আছে। ওর একটা বাচ্চা আশ্রয় পেয়েছে ঈশাকের কাছে; দ্বিতীয়টা নিয়ে গেছে বাতাসী। আশ্চর্য মেয়েটা! মান্ধুর মৃত্যুতে আছাড় খেয়ে পড়েছিল প্রথমটায়। কিন্তু সামলে নিতে সময় লাগেনি তার। দুদিনেই উঠে বসেছে আবার। তার শূন্য ঘর আবার পূর্ণ করেছে যোসেফের মা মরা শিশুটিকেই আশ্রয় দিয়ে। ভিন্সেন্ট ঘরে ঘরে-ঘুরে মরে। কী সান্ত্বনা জানাবে ভেবে পায় না। ঈশাক রুহিদাসের মেয়ে যোসেফের সেবার ভার নিয়েছে। বাতাসীর ছাপরায় ভিন্সেন্ট যখন গিয়ে দাঁড়াল, মেয়েটা ছুটে এসে লুটিয়ে পড়ল তার পায়ের উপর। ওর পায়ের উপর মুখ ঘষতে ঘষতে বললে, কেনে? কেনে? কেনে? তু তো বুতিস ভগবান দয়াময়? তাইলে কেনে উ মোর নানকুরে পুড়ায়ে মারলে? তু বল্ ফাদারদা– কী এ্যান্যায়টো করছিলম মোরা?

পঙ্খিরাজ নয়, আজ ফাদারদা বলেই ডাকল ওকে।

কোনদিন বাতাসীর গাত্রস্পর্শ করেনি। আজ ঐ কুলটা মেয়েটির বাহুমূল ধরে ভিন্সেন্ট ওকে উঠিয়ে বসায়। কোঁচার খুঁটি দিয়ে ওর কয়লামাখা মুখটা মুছিয়ে দেয়, রুক্ষ চুলে হাত বুলায়। কী সান্ত্বনা দেবে ভেবে পায় না।

চারদিনের দিন আবার সিটি বাজছে কারখানার হাজরি-ঘরে। শোকসম্বরণের নির্দেশ। যে-যার কাজে যাও। মৃত্যু যেন জীবনের পথরোধ করে না দাঁড়ায়। পৃথিবীর বুক থেকে কালো-হীরে আহরণের এ বিরাট উদ্যোগ তো চিরকাল বন্ধ হয়ে থাকবে না কজন মালকাটার অকাল মৃত্যুতে। পেট বড় অবুঝ। সেই পেটের দায়ে ফিরে এসো আবার। চোখের জল মোছ, তুলে নাও গাঁইতা আর খাঁচিয়া। আর ডেভিস-ল্যাম্পের ক্ষীণ আলোকবর্তিকা। নেমে যাও গুটিগুটি অবক্ষয়ী জীবনের ঐ অতল খাদে!

ওরা সে নির্দেশ মানল না। কেউ হাজিরা দিতে এল না।

স্ট্রাইক কাকে বলে ওরা জানে না, ধর্মঘট কথাটা ওরা শোনেনি। কেউ কোন নির্দেশ দেয়নি, মিটিং করেনি, কারও পরামর্শ অথবা প্রচারের প্রয়োজন হল না। কলয়াখনির হাজিরার ভেঁা বেজেই গেল। ওরা কাজে এল না কেউ।

কোলিয়ারির কাজ বন্ধ রইল। একদিন। দুদিন।

পাঁচু হালদারের দল এল ধাওড়ায়। বোঝালো। শাসালো। নতুন মালকাটা আমদানি করার হুমকি দেখালো। এরা কোন জবাব দিল না। জবাবদিহি করল না। ভিন্সেন্ট ওদের কাজ বন্ধ করার কথা বলেনি, সে কথা ওর মনেও আসেনি। ও শুধু ওদের সকলকে ডাক দিল গীর্জায়। সন্ধ্যাবেলা সকলকে সমবেত হতে বলল। যে আটান্নজন মানুষ ঐ দুর্ঘটনায় মারা গেল, যাদের আর দেখা যাবে না এই জোড়-জাঙ্গাল কয়লাকুঠিতে তাদের আত্মার সঙ্গতি কামনায় ওরা সমবেত প্রার্থনা করবে। ব্যাপারটা ওরা বুঝতে পারল না ঠিক। এমন কথা ইতিপূর্বে ওরা শোনেনি। আত্মার সঙ্গতি কামনা আবার কি? নিদারুণ শোকে এমনিতেই ওরা বিহ্বল। তবে নাকি ওদের ফাদারদার আহ্বান। তাই সাড়া দিল ওরা। সন্ধ্যাবেলা গুটিগুটি এসে হাজির হল শোকবিহ্বল শীর্ণকায় নগ্নগাত্র কজন মানুষ। সাঁওতাল, উঁইহার, কুর্মি, কোল, বাগদি, নমশূদ্র। হিন্দু-মুসলমান এবং খ্রীষ্টান। উবু হয়ে বসল গীর্জার ভিতর।

দুর্ঘটনা ঘটার পর পাঁচদিন কেটে গেছে। এ কদিন বস্তুত চন্দ্রভানের পেটেও কিছু অন্নজল পড়েনি। পাঁচু হালদারের বাড়ির ব্যবস্থা তো অনেকদিন ঘুচে গেছে। এতদিন মালকাটারাই তাদের মুখের গ্রাস থেকে যা তোক কিছু দিয়ে যেত। এখন তাও বন্ধ। তাদের মাথার ঠিক নেই। বাতাসীও তার সকালের দুধের যোগান দিতে আসে না। নানকুর মৃত্যু আর যোসেফের শিশুর ব্যাপারে সেও ভুলে গেছে ফাদারদার কথা। এ কদিন কি খেয়েছে মনে নেই ওর। কোথাও কারও ছাপরায় কেউ যদি হাত বাড়িয়ে কিছু দিয়ে থাকে অভ্যাসবশে মুখে পুরেছে। চোখদুটো তার কোটরে বসে গেছে। গালে গজিয়েছে কদিনের না কামানো খোঁচা খোঁচা দাড়ি। খালি গা, খালি পা। কোঁচার খুটটা জড়িয়েছে গায়ে। খ্রীষ্টান শোকাঁচার নয়-মহাগুরুনিপাতের অশৌচ পালন করছে যেন নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ।

উঠে দাঁড়াবার ক্ষমতা নেই। খড়ের বিছানাতেই আধশোয়া অবস্থায় সামন দিল ভিন্সেন্ট ভান গর্গ। জোড়-জাঙ্গাল কোলিয়ারির ঈভানজেলিস্ট। খাদের ভিতর অগ্নিদগ্ধ হয়ে, দম বন্ধ হয়ে যারা মারা গেছে তাদের আত্মার সদ্গতি কামনা করল। এ দুনিয়ায় এসে সেই হতভাগ্য মানুষগুলো শুধু বঞ্চনাই সয়ে গেছে, যন্ত্রণাই ভোগ করে গেছে যে করুণাময় ঈশ্বর! এবার তুমি তাদের কোলে টেনে নিয়েছ, তোমার স্বর্গরাজ্যে তারা যেন শান্তি পায়।

কালি-ওঠা লণ্ঠনের ভূতুড়ে আলোয় মানুষগুলো উবু হয়ে বসে আছে। যোসেফ রোগশয্যায়। অনুপস্থিত। না হলে হয়তো শোনা যেত, –আমিন! ওরা কেউ কিছু বলল না। মাথা নিচু করে বসেই রইল।

হঠাৎ তীব্র একটা আলোর ঝলকানি। জোরালো একটা আলোর ধুমকেতু সমস্ত চত্বরটার উপর ঝাটা বুলিয়ে গেল। গীর্জার সামনে এসে দাঁড়ায় একটা হাওয়া গাড়ি। তারই হেডলাইটের আলো। মম ভারি জুতোর শব্দ। লোক লো ভয়ে কুঁকড়ে যায়। টর্চের আলো এসে পড়ে ভিন্সেন্টের মুখে। হাত দিয়ে সে চোখটা আড়াল করে। চিনতে পারে সে। কোনক্রমে টলতে টলতে উঠে দাঁড়ায়। আগন্তুকদল বিশিষ্ট অতিথি। ওঁদের পথ দেখিয়ে নিয়ে এসেছে পাঁচু হালদার। ভিন্সেন্ট কোনক্রমে বলে, –আসুন রেভারেণ্ড মার্লো, আসুন ব্রাদার দাভিদ। আপনারা ঠিক সময়েই এসে পৌচেছেন। জোড়-জাঙ্গাল কোলিয়ারির আজ বড় দুর্দিন। দুর্ঘটনায় যে আটান্নজন দুর্ভাগা মানুষ মারা গেছে–

ওকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে ভীড়ের পিছন থেকে নাথানিয়াল বলে ওঠে, — আটান্নজন নয়, এগারোজন!

তাকেও থামিয়ে দেন রেভারেণ্ড মার্লো। বলেন, আপনি শান্ত হন মিস্টার নাথানিয়াল। লেট মি ট্যাকল দ্য সিচুয়েশন।

রেভারেণ্ড দাভিদের দিকে ফিরে বলেন, –এ যে অবিশ্বাস্য! আমরা কি ভারতবর্ষে আছি, না আফ্রিকার জঙ্গলে এসে পৌঁছেছি?

মাথা নেড়ে দাভিদ বলেন, জানি না কতটা ক্ষতি ও করেছে। এ মানুষগুলোকে আবার কোনদিন ক্রিশ্চিয়ান করা যাবে কিনা তাই ভাবছি আমি।

রেভারেণ্ড মার্লো পঞ্চাননকে বলেন, ঐ লোকগুলোকে চলে যেতে বল।

ইংরাজি আদেশটা অনুবাদ করা প্রয়োজন হল না। লোকগুলো বুঝতে পারে। তারা উঠে দাঁড়ায়। আতঙ্কতাড়িত মানুষগুলো দ্বারের দিকে এগিয়ে যায়।

ভিন্সেন্ট আপত্তি তোলে, -সে কি! আমাদের ফিউনারাল সার্ভিস এখনও শেষ হয়নি!

-তুমি থাম তো হে ছোকরা!–ধমক দিয়ে ওঠেন রেভারেণ্ড মার্লো।

মালাকাটর দল সদলবলে বেরিয়ে যায়।

ঘর খালি হতে রেভারেণ্ড মার্লো মুখোমুখি দাঁড়ালেন অনশনক্লিষ্ট কঙ্কালসার মানুষটার সামনে। রেভারেণ্ড সাহেবের নিখুঁত পাদ্রীর পোশাক। ভিন্সেন্টের অনাবৃত দেহটা আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বলেন, –তোমার লজ্জা হয় না! হ্যাভ য়ু নো সেন্স অফ ডিসেন্সি অর ডেকোরাম? খালি পা, খালি গা, তুমি সার্মন দিচ্ছ শুয়ে শুয়ে মেথডিস্ট চার্চে! প্রভু যীসাসের মহিমা তুমি কোন্ আস্তাকুড়ে লুটিয়ে দিয়েছ বুঝতে পার না? তুমি কি পাগল?

-পাগল নয়, শয়তান! ডেভিল!–ফোড়ন কাটে নাথানিয়াল।

ভিন্সেন্ট কি যেন বলতে যায়, পারে না।

রেভারেণ্ড মার্লো গম্ভীরস্বরে বলেন, মঁসিয়ে ভান গর্গ, আমি দুঃখিত; কিন্তু এই মুহূর্তে আমি আপনাকে বরখাস্ত করছি। পবিত্র মেথডিস্ট চার্চের সঙ্গে অতঃপর আপনার আর কোন সম্পর্ক থাকবে না। আপনি আপনার মালপত্র নিয়ে এ চার্চ ছেড়ে এখনই চলে যান। একে আর অপবিত্র করবেন না।

এবারেও কোন জবাব দিল না ভিন্সেন্ট।

–ওয়েল, মঁসিয়ে ভান গর্গ, আত্মপক্ষ সমর্থন করে আপনার কি কিছুই বলার নেই?

একমাথা রুক্ষচুল সমেত মাথাটা নেড়ে ভিন্সেন্ট জানায়, না!

আপনাকে ফিরে যাবার ট্রেন ভাড়াটা দিয়ে যাব কি?

নিচু হয়ে বিছানাটা গুটিয়ে তুলছিল সে। এবারও মুখ না তুলে মাথা নেড়ে অস্বীকার করে।

রেভারেণ্ড এবার নাথানিয়ালের দিকে ফিরে বলেন, এ লোকটি বেরিয়ে গেলে দরজায় তালা দিতে বলুন। যতদিন আমরা পুনরায় কোন ক্রিশ্চিয়ান মিনিস্টার পাঠাতে না পারছি ততদিন চার্চ বন্ধ থাকবে।

নাথানিয়াল একটি অভিবাদন করে বলেন, –যথা আজ্ঞা ফাদার। এবার দয়া করে আমার গরীবখানায় চলুন। ওখানে সব ব্যবস্থা হয়েছে।

ওঁরা সদলবলে বেরিয়ে গেলেন।

চন্দ্রভানও তার বিছানার বাণ্ডিল ও ক্যাম্বিসের ব্যাগ হাতে আবার পথে নামে।

সামনে নীরন্ধ্র অন্ধকার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *