আবার যদি ইচ্ছা কর – ৩

বটুকেশ্বর দেবনাথের কথাটাই আগে বলি। চার বন্ধুর মধ্যে একমাত্র সে-ই পেয়েছিল আর্টস্কুলের ছাড়পত্র। কেতাদুরস্ত আর্টিস্ট হয়েছিল বরিশালের ছেলে বটুকেশ্বর। পূর্বভারতের সবচেয়ে বড় তিনটি নদী– পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র, আর মেঘনা যেখানে মিলিত হয়ে সমুদ্রে মিশেছে সেই বদ্বীপে বরিশাল নদীর পশ্চিমতীরে এই বরিশাল। নদীমাতৃক ভূখণ্ড যেমন উর্বর, ওখানকার মানুষগুলোও তেমনি দুর্বার। জোয়ারের সময় মেঘনার মুখে প্রবল বান আসে তখন প্রচণ্ড জলোচ্ছ্বাসের সঙ্গে সমুদ্রের দিক থেকে ভেসে আসে এক কামান গর্জনের মত গুরুগম্ভীর শব্দ। ইংরেজরা তার নাম দেয় বরিশাল গানস। তিন-চার শ বছর আগে থেকেই মগ জলদস্যুরা এদেশে মাঝে মাঝে লুণ্ঠন করে যেত। ব্রহ্মরাজ যখন আরাকান দেশ আক্রমণ করেন তখন অনেক মগ এই জেলায় পালিয়ে আসে। এখানেই তারা স্থায়ী বাস্তু বাঁধে। পুরুষানুক্রমে এই জেলাতেই থেকে যায়। ধর্মে এরা ছিল বৌদ্ধ। অনেকেই হিন্দুধর্ম গ্রহণ করে অবশ্য। বটুকেশ্বরের পদবী ছিল দেবনাথ; বোধকরি তার পূর্বপুরুষ এক কালে ছিল নাথ-পন্থী বৌদ্ধ। সে ইতিহাস বটুকেশ্বর জানত না; কিন্তু এটুকু জানত যে তার রক্তের মধ্যে আছে মেঘনার পথে ছুটে আসা বঙ্গোপসাগরের রোষ; ঐ বরিশাল গানস।

বটুকের বাবা দীননাথ দেবনাথ ছিলেন ছাঁ-পোষা ভালমানুষ। বরিশাল স্টিমার ঘাটে গঞ্জের সবচেয়ে বর্ধিষ্ণু অঞ্চলে তাঁর ছিল পাটোয়ারি গুদাম আর ব্যবসা। ছেঁচা বাঁশের বেড়া দেওয়া দেওয়াল আর টালির ছাদ। দীননাথ লেখাপড়া শেখেন নি বেশি, শিখেছেন শুভঙ্করীর হিসাব, যা তাঁর কাজে লাগে পাটোয়ারী ব্যবসায়ে। কিন্তু ছেলেকে তিনি লেখাপড়া শেখাতে চেয়েছিলেন। ওঁদের পাড়ার ছোট ছোট ছেলেগুলো সব বখাটে আর বদমায়েস। তাই শহর কলকাতাতে রেখেছিলেন বটুককে, তার মামা বাড়িতে। ওর মামা ইংরাজ কুঠিয়ালের মুচ্ছুদ্দি। করিৎকর্মা লোক। ভাগ্নেকে মানুষ করে তোলার ভরসা দিয়েছিলেন বলেই দীননাথ বামন হয়ে চাঁদের দিকে হাত বাড়িয়েছেন।

কিন্তু লেখাপড়া শিখতে বসেও বটুক মনে শান্তি পায় না। ইংরাজি, অঙ্ক অথবা ইতিহাস-ভূগোলে সে মনোনিবেশ করতে পারে না। তার সখ সে ছবি আঁকবে। বরিশালের গ্রামে আসন্ন বর্ষার যে পট সে দেখেছে শিশুকালে, মেঘনার বুকে প্রকৃতির যে ভীমসূন্দর রূপ দেখেছে ভাদ্রের সাঁড়াসাড়ি বানে, সেটাকে সে রঙে আর রেখায় ধরতে চায়। ম্যাট্রিক পাস করে তাই সে বায়না ধরল আর্টস্কুলে ভর্তি হবে। এবার কিন্তু দীননাথ রাজী হতে পারেন না। ছবি আঁকা কেউ আবার পয়সা দিয়ে শেখে নাকি? ছবি এঁকে কোন্ চতুর্বর্গ লাভ হবে? ছেলেকে আর কলকাতায় ফিরতে দিলেন না। নিয়ে এলেন বরিশালের ব্রজমোহন কলেজে ভর্তি করে দিতে।

বরিশাল ব্রজমোহন কলেজের অধ্যক্ষ তখন স্বনামধন্য রজনীকান্ত গুহ। সব কথা শুনে তিনি বলেন, দীননাথবাবু, আপনার পুত্রকে যদি আমার কলেজে ভর্তি করে দেন তাহলে তার দায়িত্ব আমি নিতে পারি, কিন্তু সে ক্ষেত্রে জলপানির টাকা কিন্তু বটুকেশ্বর পাবে না।

-কেন? পাবে না কেন? প্রশ্ন করেছিলেন দীননাথ দেবনাথ।

স্যার ব্যামফিল্ড ফুলার ফরমান জারি করেছেন যে, বরিশালের ব্রজমোহন কলেজে ভর্তি হলে কোন ছাত্র সরকারী বৃত্তি পাবে না।

ব্যামফিল্ড ফুলার কে? জিজ্ঞাসা করেছিলেন বরিশালের পাটোয়ারী দেবনাথ।

ফুলারের নাম শোনেন নি? তিনি নবগঠিত পূর্ববঙ্গ আর আসামের ছোটলাট। ডন ম্যাগাজিনে দেখেন নি, তিনি প্রকাশ্যে বহু স্থানে বলে বেড়িয়েছেন, তার দুই স্ত্রী–হিন্দু স্ত্রী দুয়োরাণী আর মুসলমান বিবি হচ্ছেন সুয়োরানী। এখানকার বানরিপাড়ায় গুর্খা সৈন্যদের কাণ্ড শোনেন নি?

দীননাথ তাঁর মাথাটা নেড়ে জানিয়েছিলেন তিনি কিছুই জানেন না।

একটা দীর্ঘশ্বাস পড়েছিল রজনীকান্তের। এতবড় কাণ্ডটা ঘটে গেল সদর বরিশালের বুকের উপর, অথচ এখানকার একজন বর্ধিষ্ণু ব্যবসায়ী তার কোন খোঁজ রাখেন না। এ দেশকে জাগাবেন সুরেন্দ্রনাথ আর অশ্বিনীকুমার।

বটুকেশ্বর উপস্থিত ছিল সেখানে। ভর্তি হয়ে এসেছিল। বললে–আমি জানি স্যার! বরিশালের বিদ্রোহ দমন করতে ফুলার এখানে গুর্খা সৈন্য মোতায়েন করেছিল। আমাদের মা-বোনেদের উপর তারা অকথ্য অত্যাচার করে–

রজনীকান্ত বলেন–তুমি জান? তুমি কেমন করে জানলে?

জানি স্যার! এও শুনেছি আমার বয়সী একদল ছেলে তাই ফুলারকে হত্যা করবে বলে প্রতিজ্ঞা করে। সুরেন্দ্রনাথই নাকি–

–থাক বটুকেশ্বর! ওসব কথা প্রকাশ্যে আলোচনা করতে নেই।

বটুকেশ্বর চুপ করে যায়। রজনীকান্ত তখন দীননাথকে বলেন–আপনি যদি জলপানির মায়াটা ত্যাগ করেন তাহলে আমি একে ভর্তি করে নিতে পারি।

চকিতে ওঁর মনে হয়েছিল সুরেন্দ্রনাথ আর অশ্বিনীকুমার তো দিবাস্বপ্ন দেখছেন না। প্রৌঢ় ব্যবসায়ী দীননাথ খবর রাখে না এটাই তো একমাত্র সংবাদ নয়; তার নাবালক পুত্র সবই খবর রাখে এটাও তো সত্য!

আগুন জ্বলছে। এ আগুন নিভবে না।

বটুকেশ্বর ভর্তি হল ব্রজমোহন কলেজে।

কিন্তু টিকতে পারে নি সেখানে; ফিরে এসেছিল কলকাতায়। কেন তা বলিঃ

সরকার ঘোষণা করলেন ষোলোই অক্টোবর উনিশ-শ পাঁচে বাঙলা দেশকে কেটে দু খানা করা হবে। বাঙলা হিসাবে সেটা ত্রিশে আশ্বিন। অমনি দিকে দিকে এই দিনটিকে ক্ষোভ আর দুঃখের প্রতীক করে তোলার আয়োজন পূর্ণ করে তুললেন দেশের নেতৃবৃন্দ। রবীন্দ্রনাথ প্রস্তাব করলেন দুই বঙ্গের মিলনের প্রতীক হিসাবে এদিন অনুষ্ঠিত হবে রাখীবন্ধন উৎসব। রামেন্দ্রসুন্দর বললেন, ঐ সঙ্গে সারা দেশে হবে অরন্ধন। সুরেন্দ্রনাথ অখণ্ড বঙ্গভবন গড়ে তোলার প্রস্তাব করলেন। সমস্ত দেশে সে কী ভাবের জোয়ার! কোন বাঙালীর ঘরে সেদিন উনানে আগুন জ্বলে নি। ব্যবসাবাণিজ্য সব বন্ধ, রাস্তায় ঘোড়ার গাড়ি, পাল্কি অথবা গোরু-গাড়িও চলে নি। সেই প্রথম সারা দেশব্যাপী হরতাল।

বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের অন্যতম প্রধান ভূমিকা ছিল বরিশালের। বড়লাট কার্জন গোটা বরিশাল জেলাকেই প্রোক্লেমড ডিস্ট্রিক্ট বা আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গকারী জেলা বলে চিহ্নিত করলেন। অশ্বিনীকুমারের স্বদেশ বান্ধব সমিতি বিলাতি জিনিসের বহ্ল্যুৎসবে মাতলো– দেশী জিনিস বিদেশী জিনিস যার দোকানে রাখা হত তাদের বয়কট করতে শেখালো। চারণকবি মুকুন্দদাস বরিশালের পথে পথে প্রাণ মাতানো গান গেয়ে বেড়ান। অশ্বিনীকুমারের সহযোগী মনোমোহন চক্রবর্তীর লেখা গানও মুকুন্দদাস গেয়েছেন–ছেড়ে দাও কাচের চুড়ি, বঙ্গনারী, কভু হাতে আর পর না! জাগ গো ভগিনী, ও জননী, মোহের ঘোরে আর থেক না।

সেবার কংগ্রেসের একবিংশতিতম অধিবেশন বসল কাশীতে। সভাপতিত্ব করলেন গোপালকৃষ্ণ গোখলে। সভাপতির ভাষণে তিনি বললেন–বঙ্গের অঙ্গচ্ছেদের ফলে বঙ্গদেশের এই বিপুল জনজাগরণ আমাদের জাতীয় ইতিহাসে এক বিশিষ্ট স্থান অধিকার করবে। ব্রিটিশ রাজত্বে এই প্রথম জাতি ও ধর্মের বৈষম্য ভুলে বাঙালী জাতি বাইরের কোন সাহায্যের অপেক্ষা না রেখে স্বাভাবিক প্রেরণার বশে অন্যায়ের প্রতিরোধে অগ্রসর হয়েছে। প্রধান লক্ষণীয় বিষয় এই যে, জনসেবার উচ্চ আদর্শ থেকে বাঙলা এ কাজ করেছে, আর সমগ্র ভারতবর্ষ এই আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্যে বাঙলা দেশের কাছে ঋণী। আজ বাঙলা যে কথা চিন্তা করছে, আগামীকাল সারা ভারতবর্ষ সে কথা চিন্তা করবে।

বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের সম্মেলন সেবার হবে বরিশালে। প্রথম সম্মেলন হয়েছিল বহরমপুরের, বৈকুণ্ঠনাথ সেনের আগ্রহাতিশয্যে। তারপর, কৃষ্ণনগর, চুঁচুড়া, চট্টগ্রাম, নাটোর, বর্ধমান প্রভৃতি স্থানেও প্রাদেশিক সম্মেলন হয়েছে। এ বছর স্থির হয় এপ্রিলের চোদ্দই ও পনেরই অধিবেশন বসবে বরিশালে। স্বদেশী আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ব্যারিস্টার আবদুল রসুল হবেন সভাপতি। রসুলসাহেব মেম বিয়ে করেছিলেন; কিন্তু সেই বিদেশী মহিলাও মনে-প্রাণে সমর্থন করলেন স্বাধীনতা আন্দোলনকে। সে বৎসর বাখরগঞ্জ জেলায় ফসল ভাল হয় নি। দুর্ভিক্ষই হয়েছিল বলা চলে। তবু জেলার বিভিন্ন অংশে যখন প্রচারে বের হলেন বরিশালের নেতা অশ্বিনীকুমার দত্ত, সুরেন্দ্রনাথ সেন, সতীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, অথবা শরকুমার রায় তখন অভূতপূর্ব সাড়া জাগল সারা জেলায়। দলে দলে স্বেচ্ছাসেবক সমবেত হল জেলা সদর বরিশালে। ব্রজমোহন কলেজের ছেলেদেরই উৎসাহ বেশী। কলকাতা থেকে সম্মেলনে যোগ দিতে আসছেন দেশবরেণ্য নেতারা। ওরা দিবারাত্র পরিশ্রম করে প্রচার চালায়। এই স্বদেশী আন্দোলনে ওতপ্রোত ভাবে যোগ দিয়েছিল প্রথম বার্ষিক ফার্স্ট-আর্টসের ছাত্র বটুকেশ্বর দেবনাথ।

সরকার থেকে ইতিপূর্বেই একটা সার্কুলার জারি করা হয়েছে–প্রকাশ্যে রাস্তার কেউ বন্দেমাতরম ধ্বনি দিতে পারবে না। অনেকে এ আদেশ মানতে স্বতঃই রাজী হল না। বন্দেমাতরম ধ্বনি দিতে গিয়ে অসংখ্য যুবক বেত্রদণ্ডে দণ্ডিত হল। সম্মেলনের অভ্যর্থনা সমিতির কর্মকর্তারা জেলা-শাসকের কাছে এই সর্তে আবদ্ধ হলেন যে, প্রতিনিধিদের অভ্যর্থনা করার সময় প্রকাশ্য স্থলে বন্দেমাতরম্ ধ্বনি করা হবে না। ফলে সম্মেলন শুরু হওয়ার আগেই একটা দলাদলির সৃষ্টি হল। চরমপন্থীরা কর্মকর্তাদের এই প্রতিশ্রুতি দেওয়ায় ক্ষুব্ধ হল। যাইহোক সম্মেলনের আগের দিন সন্ধ্যায় কলকাতা, ঢাকা, চট্টগ্রাম প্রভৃতি অঞ্চল থেকে বহু প্রতিনিধি বরিশালের স্টিমার ঘাটে এসে উপস্থিত হলেন। সুরেন বাঁড়ুজ্জে, মতিলাল ঘোষ, ভূপেন্দ্রনাথ বসু, বিপিনচন্দ্র পাল, ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়, কালীপ্রসন্ন কাব্য বিশারদাঁ এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বটুকেশ্বর স্টিমার ঘাটে দাঁড়িয়ে দেখল। চোখ ফেটে জল এল তার। এমন মহা মহা অতিথিরা এলেন তার মাতৃভূমিতে অথচ বন্দেমাতরম্ ধ্বনি দিয়ে তাদের বরণ করে নেওয়া গেল না। উপায় নেই। স্বয়ং অশ্বিনীকুমার বারণ করে রেখেছিলেন। অশ্বিনীকুমার ছিলেন ব্রজমোহন কলেজের প্রতিষ্ঠাতা। এ-ক্ষেত্রে কিন্তু অশ্বিনীকুমারের সঙ্গে বর্তমান অধ্যক্ষ রজনীকান্ত গুহ একমত হতে পারেন নি। তবু নেতৃত্বের নির্দেশ অগ্রাহ্য করেন নি তিনি। তাঁর ছাত্ররা তাই মুখ বুজে মেনে নিলেন ওঁদের আদেশ।

স্টিমার থেকে নেমে এসে এ বিষয়ে প্রথম প্রশ্ন তুললেন কৃষ্ণকুমার মিত্রঃ ছেলেরা বন্দেমাতরম্ বলছে না কেন?

রজনীকান্ত হেসে বললেন–ছেলেরা গোরা চাবুককে অগ্রাহ্য করতে শিখেছে, কিন্তু দলপতির আদেশকে অমান্য করতে শেখে নি বলে!

কৃষ্ণকুমার, বিপিনচন্দ্র, ব্রহ্মবান্ধব প্রভৃতি এ ব্যাপারে সন্তুষ্ট হতে পারেন নি। কিন্তু অভ্যর্থনা-সমিতির নেতৃবৃন্দের সিদ্ধান্তকে তারা অগ্রাহ্যও করতে পারলেন না। ব্রহ্মবান্ধব বললেন, এ সিদ্ধান্ত আমরা যে মনে-প্রাণে মেনে নিতে পারিনি তার একটা নীরব প্রতিবাদ রাখতে চাই রজনীবাবু। আমরা কজন অভ্যর্থনা সমিতির নির্ধারিত আবাসে উঠব না। আপনার কলেজে একটু স্থান হবে?

রজনীকান্ত হাত দুটি জোড় করে বলেন, ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় মশায়ের স্থান হবে না এমন বাড়ি শুধু বরিশাল কেন গোটা বাঙলা দেশে নেই। আমার কলেজ ধন্য হয়ে যাবে আপনাদের পদধূলি পড়লে।

তৎক্ষণাৎ তিনি ছাত্র-স্বেচ্ছাসেবকদের ডেকে ব্যবস্থা করতে বললেন। বটুকেশ্বরের দল তো হাতে স্বর্গ পেল। অ্যান্টি-সার্কুলার সোসাইটির সভ্যদের সসম্মানে নিয়ে গিয়ে তুলল ওদের কলেজে।

অল্প পরেই ওঁরা এলেন, বলেন–এ কী! সম্মেলন শুরু হবার আগেই শিবির দু ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে যে?

কৃষ্ণকুমার বলেন–বন্দেমাতরম ধ্বনি যদি আপনারা ত্যাগ করতে মনস্থ করে থাকেন, তবে ঐ সঙ্গে আমাদেরও ত্যাগ করতে হবে।

তা তো হতে পারে না। ফলে রফা হল–পরদিন সকাল সাতটায় দুই শিবির থেকে সকলে এসে সমবেত হবেন রাজাবাহাদুরের হাবেলীতে। সেখানে সর্বপ্রথমে বন্দেমাতরম্‌ ধ্বনি দিয়ে তারপর শোভাযাত্রা করে সভামণ্ডপে যাওয়া হবে।

সে রাত্রে সে কী উন্মাদনা! সারা শহরটা সে রাত্রে ঘুমায় নি। প্রভাত হলেই রাজাবাহাদুরের হাবেলীতে বরিশালবাসী বন্দেমাতরম্ ধ্বনি দেবে। দেবে কার সঙ্গে? সুরেন বাঁড়ুজ্জে, রবীন্দ্রনাথ, বিপিন পাল, ব্রহ্মবান্ধবের সঙ্গে গলা মিলিয়ে। কিন্তু নাটকের সে তো শেষ নয়, সেই যে শুরু। জেলা-ম্যাজিস্ট্রেট এমার্সন আর পুলিস সুপার কেম্পকে না চেনে কে? বরিশালের কণ্ঠনালী ছিঁড়ে ফেলতে এই দুই ইংরাজ শাসকও সে রাত্রে রুদ্ধ আক্রোশে ফুঁসছিল–তা কি জানতে বাকি আছে কারও?

চোদ্দই এপ্রিল, ১৯০৬। কোম্পানির বাগানে ধ্রুবানন্দের কাছে ধর্ণা দেওয়ার ঠিক এক বছর পরের দিনটি। সূর্যোদয়ের আগেই হাবেলী ময়দানে এসে হাজির হয়েছে বটুকেশ্বর। তার হাতে বন্দেমাতরম্ লেখা একগোছা ব্যাজ। এগুলি হাতে বাঁধবে অ্যান্টি-সাকুলার সমিতির সভ্যবৃন্দ। মাঠে এসে দেখে তার আগেও এসেছে অনেকে। পতাকা দণ্ডটা খাটানো হয়ে গেছে। মাননীয় অতিথিরা তখনও কেউ আসেন নি।

–এই তো বটুকদা! কোথায় ছিলেন এতক্ষণ?

–একি সুশীল! তুই কোত্থেকে?

কাল রাতের স্টিমারে এসেছি। কত খুঁজেছি আপনাকে। একবার ব্রজমোহন কলেজে, একবার স্টিমার ঘাটে।

রাত্রে কোথায় ছিলি?

–কলেজেই।

সুশীল সেন কলকাতা থেকে পালিয়ে এসেছে। এতবড় সম্মেলনটা দেখবার লোভ সামলাতে পারে নি। বটুক ওকে ডেকে নেয়। বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়, বলে–এ হলো শ্রীসুশীলকুমার সেন। কলকাতার আর্যমিশনে পড়ে।

সুশীল খুব মিশুকে ছেলে। বরিশালের ছেলেদের ভাষাটা একটু অন্যরকম। ও কিন্তু হাসি চেপে থাকে। কলকাতায় ওদের বাঙাল বলে খেপানো চলে। এখানে ওকথা বললে ঠেঙিয়ে মুখের জিওগ্রাফি পালটে দেবে।

বটুক বলে–হ্যাঁরে, ওদের সব খবর কি? দ্বৈপায়ন, সূরয, গগনরা কেমন আছে?

-সূরয তো আমার সেক্শানেই পড়ছে, গগ্যাদা পড়াশুনা ছেড়ে দেশে চলে গেছে। দীপুদা প্রেসিডেন্সিতে পড়ছে।

–আর চন্দ্রভান?

–সে বিবাগী হয়ে গেছে।

বিবাগী হয়ে গেছে! মানে? বাজে কথা?

না বটুকদা, সত্যিই। সে অনেক কাণ্ড

কিন্তু অনেক কাণ্ড শুনবার সময় নেই তখন বটুকেশ্বরের। ভলান্টিয়ারদের ফল-ইন করা নির্দেশ এসে গেছে। পিক পিক করে বাঁশি বাজছে। বটুক ছুটে গিয়ে সামিল হয় স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীতে।

একটু পরেই এসে পড়লেন দেশবরেণ্য নেতারা। দু-দলেরই। এখন আর অবশ্য দু দল নন। সবাই এক দলের। এখানে কোন বক্তৃতা হবে না, কোন ভাষণ হবে না। আগে থেকেই তাই স্থির হয়ে আছে। শুধু বন্দেমাতরম্ ধ্বনি দিয়ে ওঁরা শোভাযাত্রা করে এগিয়ে যাবেন সভামণ্ডপে। এতক্ষণে সূরয উঠেছে। কাতারে কাতারে মানুষ জমায়েত হয়েছে রাজাবাহাদুরের হাবেলীতে। শুধু মানুষই নয়, অমানুষও। লাল-পাগড়ি মাথায় অসংখ্য দেশীয় পুলিস, গুর্খা আর বালুচি রেজিমেন্টের বন্দুকধারী, আর লালমুখো অশ্বারোহী সার্জেন্ট।

কিন্তু পুলিস আর গোরার আবির্ভাবের কথা কি আর ওরা জানতো না? সব জেনে বুঝেই তো এসেছে ওরা। তাই আকাশ বিদীর্ণ করে সহস্র কণ্ঠে ওরা মাতৃবন্দনা ধ্বনি করল-বন্দেমাতরম্।

বার বার তিনবার। না, পুলিস লাঠি নিয়ে তেড়ে এল না। আইন-অমান্য করা হল আনুষ্ঠানিকভাবে। তবু তেড়ে এল না। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এমার্সন শহরে প্রাদেশিক সম্মেলন করার অনুমতি দিয়েছিলেন একটি মাত্র শর্তে–প্রকাশ্য স্থানে বন্দেমাতরম্ ধ্বনি দেওয়া হবে না। প্রকাশ্য স্থানেই সে শর্ত ভেঙে ফেলা হল।

রওনা হল শোভাযাত্রা। প্রথম গাড়িতেই চলেছেন মূল সভাপতি ব্যারিস্টার আব্দুল রসুল সাহেব। তার পাশে বসেছেন তার ইউরোপীয় স্ত্রী। বাদবাকি সবাই পদব্রজে। সভাপতিকেই শুধু গাড়ি করে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছিল। অভ্যর্থনা সমিতির তরফ থেকে অন্যান্য দেশবরেণ্য নেতাদের জন্যও গাড়ির ব্যবস্থা করা হয়েছিল; কিন্তু সুরেন্দ্রনাথ রাজী হন নি। বলেছিলেন, আমরা সেবক, আমরা নেতা নই। পায়ে হেঁটেই যাব আমরা।

এঁরা বলেছিলেন, কিন্তু জোড়াসাঁকোর রবিবাবু অথবা টাকীর জমিদার যতীন্দ্রনাথ কি এতটা হেঁটে যেতে পারবেন? হাজার হোক ওঁরা হলেন—

সুরেন্দ্রনাথ বলেন, যা বলেছেন তা আর দ্বিতীয়বার উচ্চারণ করবেন না! রবিবাবু কি যতীনবাবু যদি একথা শুনতে পান তবে রাগ করে এখনই ফিরে যাবেন। রসুল সাহেবকে আমরা গাড়ি করে নিয়ে যাচ্ছি এজন্য যে, তিনি আজ সভাপতি। ওঁর বদলে বরিশাল শহরের কোন গাড়োয়ান সভাপতি হলে তাকেই আমরা গাড়ি করে নিয়ে যেতাম; রসুল সাহেব হেঁটে যেতেন।

শোভাযাত্রা এগিয়ে চলে। সভাপতির গাড়ির পিছনেই আছেন সুরেন্দ্রনাথ। অমৃতবাজারের সম্পাদক মতিলাল আর ভূপেন্দ্রনাথ বসু। তার পরের সারিতে বিপিনচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ আর ব্রহ্মবান্ধব। এমনি করে এক এক সারিতে তিনজন। পিছনে বন্দেমাতরম্ ব্যাজ পরিহিত স্বেচ্ছাসেবক দল। আর শোভাযাত্রার সবশেষে চলেছেন তিনজন–অ্যান্টি-সার্কুলার সোসাইটির সভাপতি কৃষ্ণকুমার মিত্র, ব্রজমোহন কলেজের অধ্যক্ষ রজনীকান্ত গুহ, আর হাওড়া হিতৈষীর সম্পাদক গীতি কাব্যতীর্থ। দীর্ঘ শোভাযাত্রা, এ-মাথা থেকে ও-মাথা দেখা যায় না। শোভাযাত্রা হাবেলী থেকে রাস্তায় পড়ে–শোভাযাত্রার মাথা পথের বাঁকে হারিয়ে যায় । কিন্তু বন্দেমাতরম্ ব্যাজ পরা স্বেচ্ছাসেবকের দল যেই রাস্তায় পড়েছে অমনি একজন লালমুখো বললে–চার্জ!

শুরু হল লাঠি চার্জ! এলোপাথাড়ি মার। বড় লাঠির প্রহার, ব্যাটন নয়। লাঠি চার্জের পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত শোভাযাত্রায় কেউ বন্দেমাতরম ধ্বনি দেন নি। সেই হাবেলী মাঠে যা দেওয়া হয়েছিল তাই প্রথম, তাই শেষ। কিন্তু যষ্টি প্রহার শুরু হতেই সহস্র কণ্ঠে ওরা ধ্বনি দিয়ে ওঠে বন্দেমাতরম্।

বটুকেশ্বরের পাশেই ছিল সুশীল। লাঠি চার্জ শুরু হতেই শোভাযাত্রার লাইন ভেঙে গিয়েছিল। বটুক হাত বাড়িয়ে চেপে ধরে সুশীলের কামিজ। বলে–এই হাঁদা! রাস্তা ছেড়ে রকে উঠে দাঁড়া। ওখানে থাকলে মাথা ফেটে যাবে। টানতে টানতে ওকে নিয়ে আসে রাস্তার ধারে। দু-পাশের বাড়ির দরজা জানালা দুড়দাড় করে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। একটা পাকা বাড়ির রকে উঠে দাঁড়াল বটুক ঠেলে তুলল সুশীলকে। কিন্তু ও কী?

পুলিসের লাঠি চার্জ শুরু হতেই মিছিলের সারি বাঁধা শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছিল। উঁচু রকের উপর দাঁড়িয়ে ও দেখতে পেল লাঠি পেটার বীভৎসতা। ঐ পড়ে গেলেন ফণীবাবু,-ফণীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। বেচারাম লাহিড়ীর কাঁধে নামল একটা লাঠি! আর সবচেয়ে শোচনীয় অবস্থা নবশক্তির মনোরঞ্জনবাবুর ছেলে চিত্তরঞ্জন গুহ ঠাকুরতার। লাঠির ঘায়ে অচৈতন্য হয়ে পড়ে গেলেন রাস্তার ধারের একটা পুকুরে। উদ্যত লাঠি মাথার উপরে দেখেও তিনি আত্মরক্ষার চেষ্টা করেন নি। শুধু চিৎকার করে বলেছিলেন বন্দেমাতরম্।

বটুক বললে-চিত্তদা কি ডুবে মারা যাবে নাকি?

জবাব না পেয়ে পাশে ফিরে দেখে সুশীল তার পাশে নেই। সে ঐ রাস্তায় নেমে পড়েছে আবার। পুলিসের পায়ের ফাঁক দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে চলেছে রাস্তার পাশে–যেখানে পুকুরের জলটা লাল হয়ে উঠেছে চিত্তরঞ্জনের রক্তে। আর যেখানে তার দেহটা এইমাত্র ডুবে গেল।

বটুক কি করবে স্থির করে উঠতে পারে না। কর্তব্যবুদ্ধি বলছে এখন তাকেও যেতে হবে রাস্তার ওপারে–ঐ যেখানে আহত মানুষটার দেহ ডুবে গেল পুকুরের জলে, কিন্তু শুভবুদ্ধি ওর পা-দুটি বেঁধে ফেলেছে এই নিরাপদ মালভূমিতে! ওর চোখের সামনেই আবার লাঠির ঘায়ে লুটিয়ে পড়লেন ব্রজেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলী মশাই। দু হাতে মুখ ঢেকে বসে পড়ল বটুকেশ্বর।

ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেললে সে।

হাঙ্গামা মিটে গেলে বাড়ি ফিরে এল বটুকেশ্বর। একটা প্রচণ্ড আত্মগ্লানিতে ভরে গেছে তার অন্তঃকরণ। নাঃ! স্বদেশবান্ধব সমিতির সভ্য হওয়ার মত মনের জোর তার। নেই। দীননাথ ওকে বন্ধ করে রাখলেন ঘরের ভিতর। শিকল তুলে দিয়ে। কোন প্রতিবাদ করে নি বটুক। ও বুঝেছে, এ পথ ওর নয়। চমরমুহূর্তে আতঙ্কে ও দিশেহারা হয়ে পড়েছিল। চিত্তরঞ্জন গুহ ঠাকুরতাকে ও দাদা ডাকে। তাঁর বাবা ব্ৰতীসমিতির মনোরঞ্জনকে জেঠামশাই বলে। ওঁরা তার আপনজন। তবু ঐ চিত্তরঞ্জনকে বাঁচাবার। জন্য মৃত্যুভয় তুচ্ছ করে সে এগিয়ে যেতে পারে নি। অথচ সুশীল? ওর চেয়ে বয়সে অন্তত তিন-চার বছর ছোট হবে। চোদ্দ-পনের বছরের কিশোরমাত্র। সে চিত্তরঞ্জনদাকে চেনে না। তার চোখে সে দেখেছিল একজন বিপন্ন দেশবাসীকে! লজ্জায় অনুশোচনায় বটুক সমস্ত দিন পড়ে থাকল তার ঘরের মধ্যে। খবর পেল ক্রমে ক্রমে। চিত্তরঞ্জন ডুবে মারা যান নি। পুলিস সুপার একমাত্র সুরেন্দ্রনাথকেই গ্রেপ্তার করেছিলেন। আরও শুনল, পুলিস যখন সুরেন্দ্রনাথকে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এমার্সনের বাড়িতে নিয়ে গেল তখন তাঁর সঙ্গে গিয়েছিলেন মহাত্মা অশ্বিনীকুমার, বিহারীলাল রায় আর ভারতীয় সম্পাদক। কালীপ্রসন্ন কাব্য বিশারদাঁ। ম্যাজিস্ট্রেট সরাসরি বিচারে বে-আইনী শোভাযাত্রা পরিচালনার দোষে সুরেন্দ্রনাথকে দুশ টাকা জরিমানা করলেন। সুরেন্দ্রনাথ একখানা চেয়ারে বসতে উদ্যত হয়েছিলেন বলে আদালত অবমাননার দায়ে তাঁর আরও দুশ টাকা জরিমানা হল। গ্রেপ্তারের সময় সুরেন্দ্রনাথ ভূপেন্দ্রনাথ বসুকে সম্মেলনের কাজ চালিয়ে। যেতে বলেছিলেন। সভা যথারীতি অনুষ্ঠিত হয়েছে। অশ্বিনীকুমার ও অমৃতবাজারের সম্পাদক ওজস্বিনী ভাষায় বক্তৃতা করেন। সভাপতি রসুল সাহেব বলেন, ধর্ম যাই হোক, আজ হিন্দু-মুসলমান-খ্রীস্টান সহযাত্রী।

সুশীলের সঙ্গে বটুকেশ্বরের আর দেখা হয় নি। যেমন নিঃশব্দে সে এসেছিল তেমন নিঃশব্দেই সে চলে গেছে কলকাতায়। বটুককে আর কিছু করতে হল না। ওর বাবাই গিয়ে একদিন ওর নাম কাটিয়ে আনলেন ব্রজমোহন কলেজ থেকে। ছেলে ছবি আঁকা শিখতে চায়, তাই শিখুক। বরিশালে থাকলে শেষে কি বোমা-পিস্তলের দলে ভিড়বে। স্বদেশী করার চেয়ে ছবি আঁকা ভাল–অন্তত দীননাথ দেবনাথের পাটোয়ারী বুদ্ধি তাই বলে।

এক বছর বরিশালে কাটিয়ে বটুকেশ্বর দেবনাথ ফিরে এল কলকাতায়। ভর্তি হল সরকারী আর্টস স্কুলে। উনিশ-শ ছয় সালে। রজনীকান্ত গুহর অগ্নিস্রাবী রাজনীতির প্রখর রৌদ্র থেকে অবনীন্দ্রনাথের স্নিগ্ধ শিল্পচ্ছায়ায়। মাত্র এক বছর হল জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির ছেলে অবনীন্দ্রনাথ সরকারী আর্টস স্কুলের সহকারী অধ্যক্ষরূপে কর্মভার বুঝে নিয়েছেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *