২.১ শীতকালের ফিঙেপাখি

দ্বিতীয় পর্ব

শীতকালের ফিঙেপাখি কেমন করে ওড়ে!

নদীর ঢেউয়ের মতন! একবার আকাশের দিকে ওঠে, একবার নামে শস্যমাঠের দিকে। ওড়ার তালে ডানা কাঁপে তার, লেজ নাচে। কখনও কখনও মৃদুস্বরে ডাকে পাখি।

আজও মাঠ পাথালে উড়ছে এক ফিঙে। সেই পাখির ডানা থেকে সড়কপারে ছিটকে আসে একটুখানি ছায়া, নূরজাহানের চোখের তারায় এসে লাগে। তারপর যেন নিজেকে চিনতে পারে নূরজাহান, তারপর যেন নিজের মধ্যে ফিরে আসে।

ছোবল মারার আগে ভয়ংকর কালজাত (কালো গোখরো) যেমন করে ফণা তোলে, যেমন করে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে শিকারের দিকে, মান্নান মাওলানার মুখের দিকে তেমন করে তাকিয়ে থেকে, ওই ঘৃণিত মুখ দেখতে দেখতে যেন বা আশ্চর্য এক ঘোর লেগে গিয়েছিল নূরজাহানের চোখে। যেন বা নিজের অজান্তেই থুতুটা সে ছিটিয়ে দিয়েছিল। যার জন্য এই ঘৃণা ক্রোধ, সেই মানুষটার কথাও মনে ছিল না। মাকুন্দা কাশেম।

মানুষজন স্তব্ধ হয়ে যাওয়ার পর ঘোর কেটে যায় নূরজাহানের। বুকের ভিতর ফুঁসে ওঠা। কালজাত বুকের ভিতরই মুখ লুকায়। শরীর হিম হয়ে আসে।

খানিক আগে, এই শীতসকালেও নূরজাহানের শরীর জুড়ে ছিল চুলার ভিতরকার নাড়ার তলায় লুকিয়ে থাকা আগুনের মতন ধিকিধিকি উষ্ণতা। ধাউন্না মরিচ (ধেনোমরিচ) চিবিয়ে খেলে কান মুখ যেমন ঝাঁ ঝাঁ করে, তেমন ঝাঁ ঝাঁ করছিল কান মুখ। দুরন্ত বেদের ফাঁদে আটকা পড়া পানকৌড়ি যেমন হাঁসফাঁস করে, বুক জুড়ে নূরজাহানের ছিল তেমন হাঁসফাসানি। হাত পায়ের তলা ছিল তার ওমে বসা মুরগির পেটের মতন। গরম পানি ঢেলে দেওয়ার পর গর্ত থেকে যেমন করে বেরিয়ে আসে বিষাক্ত কালজাত, মাথার তালু ফুটা করে তেমন করে তার বেরুতে চেয়েছিল মগজের কোষে আটকা পড়া ভয়াবহ এক উষ্ণতা। পাখির ডিমের মতন ফেটে যেতে চাইছিল দুইচোখ। নদীর চোরাস্রোতের মতন শিরায় শিরায় বইছিল যে রক্তস্রোত, আশ্চর্য কোন এক মন্ত্রবলে যেন রুদ্ধ হয়েছিল সেই স্রোতধারা।

এখন চোখের পলকে উধাও হয়েছে সব।

এই এতক্ষণ প্রকৃতি ছিল প্রকৃতির মতন উদাস, নির্বিকার। এখন নূরজাহানের মনে হয় প্রকৃতি আর উদাস, নির্বিকার নাই। প্রকৃতির শিরায় শিরায় বহতা রক্তস্রোত যেন জটিল এক পানির স্রোতে রূপান্তরিত হয়েছে। হিমশীতল সেই স্রোত যেন গভীর পানির তলায় ডুবিয়ে দিচ্ছে প্রকৃতিকে। শীতের বেলা তেজালো হচ্ছিল, তীক্ষ্ণরোদ উষ্ণ করে তুলছিল দেশগ্রাম। কিন্তু নূরজাহানের মনে হয় বেলা অবেলা বলে কিছুই যেন নাই, রোদ বুঝি উঠেইনি। উষ্ণতা বলেও কিছু যেন নাই কোথাও। চারদিক পানিরতলার কাদার মতন থিকথিকে, হিম।

স্বচ্ছ আকাশ ছুঁয়ে দূর নদীচরের দিকে উড়ে যাচ্ছিল যেসব ভিনদেশি পাখি, নূরজাহানের মনে হয়, ডানা যেন অবশ হয়েছে তাদের। ওড়ার শক্তি হারিয়ে আকাশেই যেন স্থির হয়েছে তারা। পথপাশের হিজল ছায়ায় বসে একাকী ডাকছিল যে ডাহুকি, এইমাত্র যেন তার ঢের (স্বরনালি) কামড়ে ধরেছে চতুর এক পাতিশিয়াল। আর বহুদূরের অচিনলোক থেকে আসছিল যে উত্তরের হাওয়া, হু হু করে বইছিল, আচমকাই যেন বন্ধ হয়েছে তার চলাচল। দুনিয়ার কোথাও যেন এখন কোনও হাওয়া নাই, দুনিয়ার সবখানেই যেন এখন এক শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা।

হাওয়াহীন দুনিয়াতে কেমন করে বাঁচে মানুষ! শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় কেমন করে বাঁচে! হাওয়ার আশায়, বাঁচার আশায় নূরজাহান তারপর শস্যের চকমাঠ ভেঙে ছুটতে থাকে। মাকুন্দা কাশেমের কথা শুনে যেমন করে ছুটে আসছিল ঠিক তেমন করেই ছুটে যায়। পিছনে স্তব্ধ হয়ে থাকে সারা গ্রামের মানুষ, থানার পুলিশ আর কুকুরের মতন মার খাওয়া মাকুন্দা কাশেম।

.

ছোঁকরিটা কে?

স্তব্ধ হয়ে থাকা মান্নান মাওলানা বুঝতেই পারলেন না প্রশ্নটা কে করেছে। তবে এই প্রথম মাথাটা নড়ল তার। ফ্যালফ্যাল করে এর ওর মুখের দিকে তাকাতে লাগলেন। দুই ঠোঁটের ঠিক মাঝখানে তখনও লেগে আছে নূরজাহানের ছিটিয়ে দেয়া থুতু।

একজন কথা বলেছে দেখে সবারই যেন স্তব্ধতা ভেঙেছে। মোতালেব ছিল মান্নান মাওলানার কাছাকাছি। আরও কাছে এগিয়ে সে খুবই সহানুভূতির গলায় বলল, মোকে অহনতির ছ্যাপ (থুতু) লাইগ্যা রইছে হুজুর। আমার কাছে নুমাইল (রুমাল) আছে। ধোয়া নুমাইল। কাইলঐ আপনেগো বউ সাপান দিয়া ধুইয়া দিছে। দিমু আপনেরে? মোকখান পোছেন।

এবার ঘটনাটা যেন মনে পড়ল মান্নান মাওলানার। সঙ্গে সঙ্গে চঞ্চল হয়ে উঠলেন তিনি, ছটফট করে উঠলেন। যেন পায়ের কাইয়া লোউঙে (কড়ে আঙুলে) আচমকা কামড় দিয়েছে বিষাক্ত চ্যালা। কিন্তু কথা বললেন না তিনি। ডানহাতের চেটোয় ঠোঁটে লেগে থাকা থুতু দুই-তিন ঘষায় মুছলেন।

আতাহার ছিল দলের পিছন দিকে। তার সঙ্গে আলী আমজাদ, সুরুজ আলমগীর নিখিল। যেন ভারী আমোদ আহ্লাদের কাণ্ড হচ্ছে গ্রামে এমন ভঙ্গিতে ইয়ার দোস্তদের সঙ্গে চাপা গলায় ঠাট্টা মশকরা করতে করতে, আলী আমজাদের টানতে থাকা সিগ্রেট তার হাত থেকে নিয়ে গোপনে টানছিল সে, গোপনে ধোয়া ছাড়ছিল। আতাহার জানে মান্নান মাওলানা জানেন তার ছেলে সিগ্রেট তো বেদম খায়ই, মদও খায়। তবু অত লোকের মধ্যে তার সিগ্রেট খাওয়াটা বাবার চোখে যাতে না পড়ে সেই চেষ্টা আতাহার প্রাণপণে করছিল। কাণ্ডটা ঘটে যাওয়ার পর অন্য সবার মতন আতাহারও এতক্ষণ স্তব্ধ হয়ে ছিল। এখন লোকজনের কথা শুনে, বিশেষ করে মোতালেবের কথায় সিগ্রেট খাওয়ার কথা ভুলে, ইয়ার দোস্তদের ফেলে বাবার কাছে এগিয়ে এল। যেন হঠাৎ করেই বাবার বাবা হয়ে গেছে এমন। স্বরে বলল, পুকরে গিয়া মোক ধুইয়াহেন বাবা। তাড়াতাড়ি যান।

সড়কপারে জাহিদ খাঁ-র ছোট্ট পুকুর। আতাহারের কথা শুনে মনমরা ভঙ্গিতে সেই পুকুরের দিকে নেমে গেলেন মান্নান মাওলানা। আঁজলা ভরা পানিতে তিন-চারবার মুখ বেশ ভাল করে ধুলেন। তারপর পাঞ্জাবির খুঁটে মুখ মুছতে মুছতে আগের জায়গায় ফিরে এলেন। তখুনি তাঁর পাশে পাশে চলা পুলিশের হাবিলদার হাতের সিগ্রেটে শেষটান দিয়ে বলল, কথার উত্তর দিলেন না যে?

তারপর সিগ্রেট পায়ের কাছে ফেলে বুট দিয়ে চেপে দিল।

মান্নান মাওলানার যেন কিছুই মনে নাই এমন গলায় বললেন, কোন কথার?

জিজ্ঞেস করলাম না ছোঁকরিটা কে?

এবার যেন সবকিছুই মনে পড়ল মান্নান মাওলানার। সামান্য লজ্জিত হলেন তিনি। কথাডা তাইলে আপনে জিগাইছেন?

তবে কে?

আমি বোজতে পারি নাই।

হাবিলদার ঠাট্টার গলায় বলল, এখন পারছেন তো?

হাবিলদারের ঠাট্টা গায়ে মাখলেন না মান্নান মাওলানা। সরল গলায় বললেন, জি হ, পারতাছি।

তা হলে বলেন।

ছেমড়ির নাম নূরজাহান।

নূরজাহান? বা বা, একেবারে মোগল সম্রাজ্ঞী!

তার পরই ঠাট্টার সুর বদলাল সে। পুলিশি গলায় বলল, বাপের নাম কী? থাকে কোথায়?

আমগো গেরামেরঐ মাইয়া। বাপের নাম দবির, দবির গাছি।

চলুন ধরে নিয়াসি।

কথাটা যেন বুঝতে পারলেন না মান্নান মাওলানা। অবাক গলায় বললেন, ক্যা?

মান্নান মাওলানার কথা শুনে তার চেয়েও বেশি অবাক হল হাবিলদার। আপনি বুঝতে পারছেন না, কেন? ওর মেয়ে একটি চোরের জন্য গ্রামের সব লোকের সামনে আপনার মুখে থুথু ছিটিয়ে দিয়েছে। অতিবড় অপমান করেছে আপনাকে। বাপটাকে বেঁধে নিয়েসে, ভাল করে প্যাদানি দিলে মেয়েটা সোজা হয়ে যাবে।

অফিসারের কথার সঙ্গে তাল মিলিয়ে মোতালেব বেশ উৎসাহের গলায় বলল, পুলিশ সাহেব ঠিক কথাঐ কইছে। লন, ধইরা লইয়াহি শালার পো শালারে।

মান্নান মাওলানা ক্রুদ্ধ গলায় বললেন, অরে ধইরা লাব কী? অরে মাইরা লাব কী?

হাবিলদার বলল, কিন্তু অতটুকু মেয়েকে তো ধরা সম্ভব না, মারা সম্ভব না।

ক্যা?

আইনের প্যাঁচ আছে। আপনি বুঝবেন না।

সামান্য সময় কিছু ভাবলেন মান্নান মাওলানা। তারপর শান্ত গলায় বললেন, তাইলে বাদ দেন।

মোতালেব কিছু একটা বলতে চাইল তার আগেই আতাহার বলল, বাদ দিব ক্যা? এমুন একখান কাম করছে ছেমড়ি……

আতাহারের কথা শেষ হওয়ার আগেই হাত তুলে তাকে থামালেন মান্নান মাওলানা। শীতল চোখে ছেলের দিকে তাকিয়ে বুক হিম করা গলায় বললেন, কী করছে না করছে হেইডা পাওয়া যাইবোনে। অহন এই হগল লইয়া চিন্তা করনের কাম নাই। টাইম আছে।

হাবিলদারের দিকে তাকালেন তিনি। গলার স্বর একেবারেই বদলে, হাসিহাসি মুখ করে বললেন, নাদান মাইয়া। কিছু না বুইজ্জা কামডা করছে। আল্লায় কইছে নাদানরে মাপ কইরা দিয়ো। অরা অবুজ। আমি আল্লাপাকের খাসবান্দা। এর লেইগা আমি অরে মাপ কইরা দিলাম। আপনেরা অহন আপনেগো কাম করেন। গোরুচোররে লইয়া যান। মেদিনমণ্ডল গেরামে চোর হ্যাঁচ্চরের জাগা নাই।

মান্নান মাওলানার শেষ কথায় মাকুন্দা কাশেমের কথা মনে পড়ল সবার। এতক্ষণ যেন সবাই তার কথা ভুলে ছিল। সবাই তারপর একসঙ্গেই যেন সড়কের মাটিতে লেছড়ে পেছড়ে বসে থাকা কাশেমের দিকে তাকাল।

কাশেম তখন মরণদশায় আচ্ছন্ন ঘেয়ো কুকুরের মতন ঝিম মেরে আছে। দুনিয়ার কোথায় কী ঘটছে কিছুই যেন টের পাচ্ছে না।

.

দাঁড়কাকের মুখ থেকে ছিনিয়ে রাখা মুরগির ছা-টা বেশ গা ঝাড়া দিয়ে উঠেছে। বুকের ক্ষত একেবারেই মিলিয়ে গেছে। ক্ষতের জায়গায় সাদা কালোয় মিশানো ফুরফুরে সুন্দর ফইর (পালক) গজিয়েছে। দেখতে বেশ লাগে। বাড়ির অন্যান্য মোরগ মুরগির তুলনায় সে খুবই অন্যরকম। অন্যগুলোর সঙ্গে খুবই অমিল। সাধারণ মোরগ মুরগির তুলনায় একটু বেশি পরিপাটি, একটু বেশি ছিমছাম। একটু যেন বেশি লম্বা। ঠোঁট দুইখান একটু বেশি লাল, পা দুইখান একটু বেশি ফরসা। লেজের গঠনটাও অন্যরকম। হঠাৎ করে তাকালে মুরগি মনে হয় না। মনে হয় অচেনা এক পাখি। দূর কোনও বনভূমি থেকে আচমকাই যেন এসে নেমেছে গৃহস্থ বাড়ির নির্জন আঙিনায়।

দেখতে যেমন অন্যরকম স্বভাব চরিত্রও তেমন অন্যরকম ছা-টার। মোরগ না সে, মুরগি, তবু এই বয়সেই বেশ ডাকাবুকা। নিজের বয়সিগুলোকে তো নয়ই, বাড়ির ধাড়িগুলোকে পর্যন্ত তোয়াক্কা করে না, পাত্তা দেয় না। বেশ মেজাজি, বেশ রাশভারী ভঙ্গিতে চলাফেরা করে। অন্যান্য মোরগ মুরগির সঙ্গে বিন্দুমাত্র বনিবনা নাই। কারও দিকেই ফিরে তাকায় না সে, কাউকেই পছন্দ করে না। একা, নিজের মেজাজ মর্জিমতো চরে বেড়ায়। একাকী আধার খায়। অন্যান্য মোরগ মুরগিগুলো তাকে বেশ সমীহ করে।

ভোরবেলা আগেরদিন রাখা ফ্যানের সঙ্গে কুঁড়া মিশিয়ে খাদা ভরতি করে মোরগ মুরগিদের খেতে দেয় মরনি। গোলা ছাতুর মতো থকথকে সেই খাবার দেখেই ঝাঁপিয়ে। পড়ে মোরগ মুরগিগুলো। অনেকক্ষণ ধরে খেয়ে গলা পেট ফুলিয়ে ফেলে। খাবারটা যেন খুবই পছন্দ তাদের। রাতভর যেন এই খাবারের অপেক্ষায়ই থাকে। কখন সকাল হবে, কখন ফ্যানে গোলা কুঁড়া খাবে তারা।

আশ্চর্য ব্যাপার, সেই ছা-টা কুঁড়া মুখে দেয় না। তাকে দিতে হয় চাউল খুদ আর নয়তো ধান কাউন। কুঁড়ার খাদার অদূরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিতে হয়। সে বেশ রাজকীয় ভঙ্গিতে একাকী খুঁটে খুঁটে খায়। অন্যান্যদের কেউ যদি কুঁড়ার খাদা ফেলে ভুল করে তার খাবারে ভাগ বসাতে আসে, যদি ঠোঁটে তুলে নেয় একটি দানা, বড় ছোট যেই হোক, তার আর রক্ষা নাই। সঙ্গে সঙ্গে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। ঠোকরে ঠোকরে আর জোড় পায়ের লাথিতে লাথিতে নাস্তানাবুদ করে দেবে তার খাবারে ভাগ বসাতে আসা শত্রুকে।

দিনে দিনে তার এই স্বভাবের কথা জেনে গেছে বাড়ির অন্য মোরগ মুরগিগুলো। ফলে তারা ভয়ে তার ছায়া মাড়ায় না। তারা সব এক হয়ে চরে বেড়ায়। সে চরে তার মতন, একা।

অন্যান্যদের সঙ্গে খোয়াড়েও থাকে না সে। থাকে বড়ঘরে। মরনির সঙ্গে। মরনি চৌকিতে আর সে পাটাতনের এককোণে, পলোর ঘেরে।

প্রথমদিন মরোমরো অবস্থা দেখে ছা-টাকে মরনি খোঁয়াড়ে রাখেনি। এমনিতেই নড়াচড়ার শক্তি নাই, একপাল মোরগ মুরগির সঙ্গে খোঁয়াড়ে রাখলে জান যেটুকুই বা আছে, ড্যাকরাগুলোর পায়ের চাপে সেটুকুও থাকবে না ভেবে তাকে মরনি ঘরে এনে রেখেছিল। অতিযত্নে পাটাতন ঘরের এককোণে বসিয়ে পলো দিয়ে আটকে রেখেছিল। যদিও হাঁটাচলার শক্তি ছিল না তবু পলো দিয়ে আটকে রেখেছিল মরনি। যেন বা নিজের অজান্তেই রেখেছিল।

পরদিন সকালে দেখা গেল দশা একটু ভালর দিকে। ঠিকঠাক মতন দাঁড়াতে পারে না ঠিকই, তবে দাঁড়াবার চেষ্টা করছে। বুকের ক্ষতে হলুদ চুন বেশ চেপে বসেছে। শুকিয়ে খুঁটে লাগবার দশা।

মরনির মন ভাল হয়ে গিয়েছিল। দুইহাতে কোলের কাছে ধরে, অথর্ব পোলাপানকে যেমন করে ঘর থেকে বাইরে আনেন মা, ঠিক সেই কায়দায় বাইরে এনে রান্নাচালার সামনে আবার আটকে দিয়েছিল পলোর ঘেরে। মুখের সামনে ছড়িয়ে দিয়েছিল একমুঠ ভাতের চাউল। কোনওরকমে খুঁটে খুঁটে তাই খেয়েছিল ছা-টা। এইভাবে কয়েকদিনের চেষ্টায়, মরনির সেবাযত্নে প্রাণ ফিরে পেল সে। গা ঝাড়া দিল, উঠে দাঁড়াল।

মরনি তখন ভেবেছে এবার দলের সঙ্গে মিশে যাবে ছা-টা। দলের সঙ্গে কুঁড়া খাবে, দলের সঙ্গে খোয়াড়ে থাকবে। ড্যাকরি হয়ে ওঠার পর নিয়ম মতন ডিম দিবে।

কিন্তু মরনির ভাবনা উলটোপালটা করে দিল সে। কুঁড়ার খাদায় কিছুতেই মুখ দিল না, খোয়াড়ে কিছুতেই ঢুকল না।

সন্ধ্যার মুখে মুখে অন্যান্য মোরগ মুরগি যখন খোয়াড়মুখী হয়ে, আপন ইচ্ছায় খোয়াড়ে ঢোকে, কোনওটা কোনওটাকে তাড়া দিয়ে ঢোকাতে হয়, তখন সে চলে যায় বড়ঘরের সামনে। লাফ দিয়ে ওঠে ঘরের সামনের তক্তায়, সাবধানি ভঙ্গিতে অন্ধকার জমে ওঠা ঘরের ভিতর গলা বাড়িয়ে দেখে তারপর খোলা দরজা দিয়ে পায়ে পায়ে ঢুকে যায় ঘরে।

প্রথম দুই তিনদিন এই দেখে কীরকম এক অপত্যস্নেহ যেন নিজের অজান্তেই নিজের ভিতর জেগে উঠতে দেখল মরনি। ছা-টাকে আর খোঁয়াড়ে রাখার কথা ভাবল না। ঘরেই রাখল। সন্ধ্যার মুখে মুখে অন্যান্য মোরগ মুরগি খোয়াড়ে আটকে ঘরে এসে কুপি জ্বালে, জ্বালিয়ে দেখে পাটাতন ঘরের অন্ধকার কোণে নিজের জায়গায় বেশ গুছিয়ে বসে আছে সে। দেখে বুকের ভিতরটা যে কেমন করে ওঠে মরনির! বুকের শিশুটির মতন তার সঙ্গে আধো স্বরে কথা বলে। ওলে আমাল সোনালে, কুনসুম ঘরে আইছো তুমি? আমি দিহি তোমালে দেখলাম না!

ছা-টা কুনকুন করে মৃদু একটা শব্দ করে। আর মরনির মনে হয় সে যেন তার কথারই জবাব দিচ্ছে।

তারপর উঠানে ফেলে রাখা পলো ঘরে এনে পলোর ঘেরে তাকে আটকে রাখে মরনি। পলোর মুখে বসিয়ে দেয় ছোট্ট জলচৌকি। কী জানি কখন পাটাতনের কোন ভাঙাচোরা দিয়ে ঘরে এসে ঢুকবে আততায়ী বিড়াল। পলোর মুখ বন্ধ না করলে সেই মুখ দিয়ে ভিতরে ঢুকে পলোর ঘেরের ভিতর বসেই হয়তো নিঃশব্দে সাবাড় করবে ছা-টাকে। এক শত্রুর হাত থেকে বাঁচিয়ে আরেক শক্রর হাতে তুলে দেওয়া হবে অবোলা একটি প্রাণ।

এখনও কোনও কোনওদিন পলোটা ঘর থেকে বের করবার কথা মনেই থাকে না। মরনির। ভোরবেলা ছা-টাকে ছেড়ে দেওয়ার পর যেমন থাকে পলো তেমনই পড়ে থাকে। শুধু মুখ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় জলচৌকিটা। আর রাতভর যে দুই-চারবার বিষ্ঠা ত্যাগ করে ছা-টা, হাতের মুঠায় খড়নাড়ার পুঁটলি নিয়ে দুই-চার ঘষায় তা পরিষ্কার করে মরনি। সন্ধ্যাবেলা দেখা যায়, ঘরে ঢুকে নিজেই ছা-টা লাফিয়ে ওঠে পলোর মুখে। তারপর পলোর মুখ গলে লাফিয়ে নামে নীচে। জায়গা মতন গুছিয়ে বসে। মরনি শুধু জলচৌকি দিয়ে মুখটা আটকে দেয়। দুই-চারটা আদুরে কথা বলে।

এই কারণেই কিনা কে জানে, আশ্চর্য এক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে দুটি প্রাণীর। একজন মা আর একজন যেন তার শিশু। বাড়ির অন্যান্য মোরগ মুরগির সঙ্গে না মিশে ছা-টা ঘুরে বেড়ায় মরনির পায়ে পায়ে। বাড়ির যেখানেই যাক মরনি সে আছে তার সঙ্গে। বাধুক কুকুর বিড়াল ছাগলছানার মতন।

এই যেমন এখনও মরনির পায়ের কাছে ঘুরঘুর করছে। মরনি তার দিকে তাকিয়েও দেখছে না।

কোনও কোনওদিন সকাল গড়িয়ে যাওয়ার পরও, দুপুর হয়ে আসা পর্যন্ত সংসারের দিকে ফিরে তাকাতে ইচ্ছা করে না মরনির। সকাল হওয়ার পর, ঘুম ভাঙার পর পলো তুলে ছা-টাকে ছেড়ে দেয় ঠিকই, ঘর থেকে বেরোয়, সকালবেলার জরুরি কাজগুলোও সারে কিন্তু কোনও কিছুতেই যেন প্রাণ থাকে না। একেবারেই নিষ্প্রাণ ভঙ্গিতে কাজগুলো করে যায়, তারপর উদাস হয়ে ঘরের সামনের তক্তায় বসে থাকে।

আজও তেমন করে বসে আছে।

এই বাড়িতে যে আরেকজন মানুষ থাকে, পুরুষমানুষ, তার কথা যেন মনেই থাকে না। মরনির। মানুষটা দূরের কেউ না, কাছেরই। তার বড়বোনের জামাই, মজনুর বাপ। মরনি নিজেই তাকে বাড়িতে জায়গা দিয়েছে। সড়কে মাটি কাটার কাজ করতে এসেছিল, এসে একখান গোড়ার আশায় আসছিল মরনির কাছে। সেই ফাঁকে বলেছিল নিজের দুর্দশার কথা। শুনে মায়া মমতায় বুক ভেসে গিয়েছিল মরনির। গোড়া তো দিয়েই ছিল, সব ভুলে বাড়িতে থাকার জায়গাও দিয়েছে।

সেই মানুষের নাম আদিলউদ্দিন। কামারগাঁওয়ের সচ্ছল গিরস্ত, কপালের ফেরে (চক্রে) আজ মাটিয়াল। বাড়ির দক্ষিণের ভিটির দোচালা ঘরখানায় থাকে। মাটির ওপর খড়নাড়া, তার ওপর একখান ছোঁড়াখোঁড়া মোটা কাঁথা ফেলে আরেকখান গায়ে দিয়ে রাত কাটায় সে। রাতের অন্ধকারে কখন এসে ওই ঘরে ঢোকে, ভোরের আলো ফুটে ওঠার আগে কখন বেরিয়ে যায় টের পায় না মরনি। কোথায় খায়, কোথায় গোসল করে কিছু জানে না। এত কাছে থেকেও যেন বা ইচ্ছা করেই মরনির চোখের আড়ালে থাকতে চাইছে আদিলউদ্দিন। যেন বা একদার গৃহস্থ মুখ মাটিয়াল হওয়ার লজ্জায় এতটাই ম্লান হয়েছে, এই মুখ মরনিকে সে দেখাতে চায় না।

আজ ঘরের সামনের তক্তায় বসে মরনি কি সেই মানুষটার কথা ভাবছিল? নাকি ভাবছিল তার ফেলে আসা জীবনের কথা, তার নিজের মানুষটার কথা। নাম ছিল নুরু হালদার। নাকি পেটের না হয়েও যে পেটের ছেলে, নাড়িছেঁড়া ধন না হয়েও যে জড়িয়ে আছে পেটের ভিতরকার সব নাড়ি, শরীরের পরতে পরতে লেগে আছে যে, হৃদয় মন, জীবন মরণ, স্বপ্ন বাস্তব মাখামাখি করে আছে যে, সেই মজনুর কথা ভাবছিল মরনি?

তখনই পাগলের মতন ছুটতে ছুটতে হালদার বাড়িতে এসে উঠল নূরজাহান। কখন, কোন ফাঁকে যে মজনুদের সীমানায় এল, টের পেল না।

.

নূরজাহানকে ছুটে আসতে দেখে মগ্নতা ভাঙল মরনির। নূরজাহানের মুখের দিকে তাকিয়ে নূরজাহানকে দেখতে পেল না সে। তার মনে পড়ল কতক্ষণ ধরে এইভাবে বসে আছে, বেলা কতটা হল। দুপুর হয়ে আসা রোদ বাড়ির আঙিনায়, ঘরের চালায় এবং গাছগাছড়ার ডালপালায় কী রং মেলে বসেছে, উত্তরে হাওয়া আছে কি নাই, এসব মনে পড়ল মরনির।

এখনই দুপুরের রান্না চড়ানো দরকার। এখন চড়ালেও শেষ হতে হতে মধ্যদুপুর। এমনকী দুপুর গড়িয়েও যেতে পারে। যদিও একজন মানুষের রান্না, কিন্তু রান্না তো! আয়োজন আছে তো! পোয়াখানেক চাউলের ভাত ঠিকই, কিন্তু চাউলটা তো মেপে তুলতে হবে! ভাল করে ধুয়ে হাঁড়িতে পরিমাণ মতো পানি দিয়ে চড়াতে হবে। তারপর আছে তরকারি। তরকারি ছাড়া ভাত লোকে খায় কেমন করে!

যদিও সকালবেলা উঠেই তরকারির ভাবনাটা আজ ভেবে রেখেছিল মরনি। সেচিশাক আর টাকিমাছ। বাড়ির নামার দিকে ছোট্ট একখান কোলা (টুকরো জমি) আছে। কোলার চারপাশে বেশ ঘন হয়ে সেচিশাক জন্মেছে। একমুঠ তুলে আনলেই হবে। তারপর সেই সেচিশাক সিদ্দ করে, কয়েক ফোঁটা সরিষার তেল আর এক-দুইখানা শুকনা মরিচের সঙ্গে কড়াইতে নিয়ে কাঠের হাতায় খানিক থেঁতলে নিলেই শাকটা হয়ে গেল। তারপর থাকে। মাছ। ঘরের কোণে, মুরগির ছা-টা থাকে যেখানে তার পাশে মাটির বড় একখানা ঘোপায় জিয়ানো আছে দুই-তিনটা টাকিমাছ। তার একটা কুটে, খাদায় করে ঘাটপারে ধুতে গিয়ে, ফিরার সময় বাড়ির নামার দিককার ঝকা থেকে কয়েকটা বাত্তি (পরিণত) আবাত্তি (অপরিণত) যাই হোক উসি (শিৗম) ছিঁড়ে এনে সেই উসৃসি দিয়ে চচ্চড়ি, তা হলে মাছও হয়ে গেল। ভাত আর শাক মাছ হলে হয়েই তো গেল রান্না!

রান্না শেষ হলে থাকে গোসল করা, খাওয়া। সেটা আর এমন কী কাজ!

রান্না শেষ করে শাড়ি গামছা একহাতে আরেক হাতে বহুকালের পুরানা, ভারী ধরনের পিতলের বদনা নিয়ে ঘাটপার যাবে মরনি। পাঁচ-সাত বদনা পানি তুলে মাথায় দেবে। শীতকাল বলে, পুকুরের পানি বেজায় ঠান্ডা বলে ওই পাঁচ-সাত বদনায়ই গোসল শেষ। তারপর পরনের শাড়ি বদলে, সেই শাড়ি ধুয়ে চিপড়ে, বাড়ি ফিরে উঠানে টাঙানো তারে মেলে দিবে। ভিজাচুলে জড়ানো থাকবে গা মাথা মোছার পর চিপড়ে নেওয়া গামছা। তারপর ঘরে এসে একা একা ভাত খাবে মরনি। দিনের বেশির ভাগ কাজের এই তো চেহারা।

নূরজাহানের মুখের দিকে তাকিয়ে সংসারকর্মের এই চেহারাটাও যেন দেখতে শুরু করেছিল মরনি। কেন কে জানে!

নূরজাহান তখন এমন ভঙ্গিতে হাঁপাচ্ছে যেন সে কোনও মানুষ না, যেন সে কোনও অবোলা জীব। যেন গৃহস্থের আথাল (গোয়াল) থেকে হঠাৎ করেই ছুটে যাওয়া কোনও দামড়ি (বকনা) বাছুর সে। হঠাৎ মুক্তি পাওয়ার আনন্দে যেন বিভোর ছিল। যখন চারপাশ থেকে জাপটে ধরার জন্য ছুটে এসেছে গিরস্ত বাড়ির পোলাপান, ভয় পেয়ে মাঠ পাথালে ছুটতে শুরু করেছে সে। ছুটতে ছুটতে একসময় যেন পড়েছে চতুর মানুষের কবজায়। ধরা পড়ার পর ক্লান্তিতে যেন বুক ফেটে যাচ্ছে তার। কামারবাড়ির উঠানের কোণে দিনভর পড়ে থাকা ব্যস্ত হাপরের মতো যেন বুক তার ওঠানামা করছে। অযথা যেন নূরজাহানের বুকের ভিতর বসে অদৃশ্য এক কামার অবিরাম টেনে যাচ্ছে তার হাপর।

সড়কপার থেকে হালদার বাড়ি, এই পথখানি ছুটে আসার কোন ফাঁকে যে এলোমেলো হয়েছে নূরজাহানের মাথার চুল, চোখের দৃষ্টি কোন ফাঁকে যে হয়েছে বিষাক্ত সাপ ছোবল দিয়ে ধরবার পর সাপের মুখে অর্ধেক শরীর ঢুকে যাওয়ার পর যেমন চোখ হয় মেঠোহঁদুর আর কোলাব্যাঙের, তেমন। নাকের তলায়, ঘাড়ে গলায় কখন যে তার জমেছে নদীতীরের বালুকণার মতো ঘামকণা, শীতের তেজালো রোদে বালুকণার মতোই ঝিলিক দিচ্ছে যা, নূরজাহান জানে না। পা দুইখানা ধুলায় ধূসর। ঠোঁট দুইখানা শুকনা, কালচে। যেন ঠোঁট আর ঠোঁট নাই নূরজাহানের, যেন ঠোঁট দুইখানা তার শুকনা গাবের বিচি।

নূরজাহানের মুখের দিকে তাকিয়ে নিজের সংসারকর্মের চেহারা দেখা শেষ করেই যেন। নূরজাহানের চেহারাটা দেখতে পেল মরনি। দেখে চমকে উঠল। নিজের অজান্তে কখন যে তক্তা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল, টের পেল না। আকুল গলায় বলল, কী হইছে রে? এমুন করতাছস ক্যা? কই থিকা আইলি?

যেন বহুকাল জনমনিষ্যিহীন কোনও প্রান্তরে নির্বাসিত থাকার পর মানুষের সমাজে ফিরে এসেছে নূরজাহান, যেন বহুকাল পর মানুষের শব্দ পাচ্ছে, এমন উতলা হয়ে মরনির দিকে তাকাল সে। তারপর থাবা দিয়ে মরনির একটা হাত ধরল। ঘরে লন। কইতাছি।

মরনি অবাক হল। ঘরে যামু ক্যা? এহেনে কইতে অসুবিধা কী?

এবার দুইহাতে মরনির হাতটা ধরল নূরজাহান। গায়ের সব শক্তি এক করে পাগলের মতো টানতে লাগল। অসুবিধা আছে। আপনে ঘরে লন। কইতাছি।

মরনি তবু নড়ল না। যেন তার বয়সও নূরজাহানের মতোই, যেন সেও হঠাৎ করে নূরজাহান হয়ে গেছে এমন জেদি গলায় বলল, না তুই আগে ক।

এবার নূরজাহান কেমন ভেঙে পড়ল। মরনির হাত ছেড়ে দিয়ে অসহায়, কাতর চোখে তার দিকে তাকাল। চোখ ভরে পানি এল। তখনও হাঁপাচ্ছিল। তবে ছলছল চোখ আর মুখময় অসহায়ত্বের ছায়ায় ঢাকা পড়ে গেছে হাঁপানো।

কান্নাকাতর গলায় নূরজাহান বলল, আমার খুব বিপদ।

বিপদ কথাটা শুনে বুকটা ধক করে উঠল মরনির। তীক্ষ্ণচোখে নূরজাহানের দিকে তাকিয়ে বলল, কীয়ের বিপদ? কী অইছে তর?

এহেনে খাড়ইয়া কইতে পারুম না। ঘরে লন, কইতাছি।

ক্যা, এহেনে খাড়ইয়া কইলে কী অইবো?

তারা মনে অয় আমার পিছে পিছে দোড়াইয়া আইতাছে। এহেনে খাড়ইয়া থাকতে দেখলেঐ ধইরা লইয়া যাইবো।

মরনি তবু নড়ল না। বলল, কারা তর পিছে পিছে দোড়াইয়া আইতাছে? কারা তরে ধইরা লইয়া যাইবো?

এবার শিশুর মতন ঠোঁট ফুলিয়ে কেঁদে ফেলল নূরজাহান। ঘরে লন। বেবাক কথা আপনেরে আমি কইতাছি।

নূরজাহানের কান্না দেখে বুকটা হু হু করে উঠল মরনির। কেমন যেন দিশাহারা হল সে। নূরজাহানের পিঠের কাছটা একহাতে জড়িয়ে গভীর মমতার গলায় বলল, ল।

ঘরে ঢুকে নূরজাহান বলল, দুয়ারডা লাগায় দেন।

মরনি বলল, দুয়ার লাগান লাগব না। তুই ক।

না, আপনে লাগান। নাইলে আমারে বাঁচাইতে পারবেন না। মৃত্যুর কথা শুনলে বুকটা হঠাৎ করেই গ্রাম প্রান্তরের নির্জনে একাকী পড়ে থাকা মাঠের মতো হয়ে যায় মরনির। মজনুর মায়ের কথা মনে পড়ে, নুরু হালদারের কথা মনে পড়ে। কিছুদিন ধরে এই দুইজন মানুষের পাশাপাশি মনে পড়ে আরেকজন মানুষের কথা। ছনুবুড়ি। একমুঠো ভাতের আশায় গ্রামের এইবাড়ি ওইবাড়ি ঘুরে বেড়াত। এর কথা ওকে, ওর কথা তাকে বলে কূটনামি করত ভাতের আশায়। ছোটখাটো চুরিচামারি করত, সেও ওই ভাতের আশায়।

ছনুবুড়ি নাই। মৃত্যু তাকে কোথাকার কোন অচিন জগতে নিয়ে গেছে। সেই জগতে ভাতের আশায় এইবাড়ি ওইবাড়ি ঘুরতে হয় না। এর কথা ওকে, ওর কথা তাকে বলে কূটনামি করে ভাত জোটাতে হয় না। ভাতই যদি না জোটাতে হয় তা হলে আর চুরিচামারি কেন?

ছনুবুড়ি নাই, মরনির মতন মেদিনীমণ্ডলের আরও অনেকেরই কি যখন তখন মনে পড়ে না তার কথা? ছনুবুড়ির কথা ভেবে কি দীর্ঘশ্বাস ফেলে না কেউ? মনে মনে বলে না, আহা রে, বুড়িডা একদিন আছিল, বুড়িডা আইজ নাই।

ছনুবুড়ির মতো নুরজাহানও যদি মরে যায়, নুরজাহানও যদি না বাঁচে তা হলে কি মরনির হঠাৎ হঠাৎ মনে পড়বে না তার কথা? এই যে তার কাছে এসে এমন অনুনয়ের স্বরে বলছে বাঁচা মরার কথা, এমন করে আর কে বলবে!

মরনি আনমনা হয়ে আছে দেখে নূরজাহান কাতর গলায় ডাকল, আম্মা, ও আম্মা।

মরনি যেন নিজের মধ্যে ফিরল। উঁ।

দুয়ারডা লাগান।

এবার আর কথা বাড়াল না মরনি। দরজা লাগাল। ভয়ার্ত ভাব তখনও আছে নূরজাহানের চেহারায়। চোখের ছলছলানো অবস্থাটা নাই। তবে শরীরটা যেন কীরকম কাঁপছে। যেন হু। হু করা উত্তরের হাওয়ায় আকুল হয়ে কাঁপছে গয়া (পেয়ারা পাতা) পাতা।

নিজেকে সামলাবার জন্যে যেন চৌকিতে বসল নূরজাহান।

নূরজাহানের চোখের দিকে তাকিয়ে মরনি বলল, এইবার ক আমারে কী অইছে?

নূরজাহান কোনওরকমে বলল, মাওলানা সাবের মোকে আমি ছ্যাপ ছিড়াইয়া দিছি।

কথাটা যেন বুঝতে পারল না মরনি। বলল, কী করছস?

নূরজাহান আবার বলল।

শুনে মরনি হতভম্ব হয়ে গেল। কোন মাওলানা সাবের মোকে?

মান্নান মাওলানার।

এবার এতটাই দিশাহারা হল মরনি, যেন ভাতের ফ্যান গালতে বসে গরম ফ্যান তার পায়ে পড়েছে। এমন আচমকা পড়েছে, মরনি ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না কী করবে। ফ্যালফ্যাল করে নূরজাহানের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল সে। তারপর ছটফটা ভঙ্গিতে নূরজাহানের একটা হাত থাবা দিয়ে ধরল। হায় হায়, করছস কী তুই? ক্যান করছস, ক্যান করছস এমুন কাম?

মরনির আচরণে ভয়টা যেন আরও বেড়ে গেল নূরজাহানের। শরীরের কাঁপন বেড়ে গেল। চোখ ফেটে জোয়ারের পানির মতো নামল কান্না। থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে, কান্না কাতর জড়ানো গলায়, ভেঙে ভেঙে নূরজাহান বলল, কাশেম কাকার কথা হুইন্না, কাশেম কাকারে দেইক্কা আমার আর কিছু খ্যাল (খেয়াল) আছিল না। আমি য্যান পাগল অইয়া গেছিলাম।

মরনি উতলা গলায় বলল, কোন কাশেমের কথা কচ তুই?

মাকুন্দা কাশেম।

অর আবার কী হইছে?

দুইহাতে চোখ মুছতে মুছতে নূরজাহান বলল, আপনে জানেন না?

না।

কান্নার মাঝখানে বড় করে একটা শ্বাস ফেলল নূরজাহান। আগের মতনই কাঁপছে সে, আগের মতনই কান্নায় জড়িয়ে যাচ্ছে গলা। তবু মাকুন্দা কাশেমের কথা মরনিকে বলল সে। যতটা সম্ভব খুলেই বলল। শুনে মরনি তেমন ভারাক্রান্ত হল না। যদিও খুবই নরম। মনের মানুষ সে, মানুষের জন্যে খুব মায়া তবু যেন মাকুন্দা কাশেমের জন্যে তার তেমন মায়া হল না। বহুদিনের পরিচিত হওয়ার পরও মাকুন্দা কাশেমের মুখটাই যেন তার মনে। পড়ল না। সে উতলা হল নূরজাহানের জন্যে। বোধহয় দূরের মানুষের চেয়ে চোখের। সামনের মানুষের কষ্ট বেদনা মানুষকে বেশি নাড়া দেয়। মাকুন্দা কাশেমের কষ্ট বেদনার চেয়ে নূরজাহানের ভয়টা যেন, কান্নায় ভেঙে পড়াটা যেন বেশি নাড়া দিচ্ছে মরনিকে। নূরজাহানের মতো সেও যেন আচ্ছন্ন হচ্ছে গভীর আতঙ্কে।

সব শুনে মরনি আবার বলল, করছস কী তুই? সব্বনাশ তো কইরা লাইছস (ফেলেছিস)। এতো মাইনষের সামনে, দারগা পুলিশের সামনে মান্নান মাওলানার মোকে দিছস ছ্যাপ ছিডাইয়া! মান্নান মাওলানা তো তরে ছাড়বো না। হ্যায় ছাড়লেও তার পোলা আতাহার তরে ছাড়বো না। তর মা-বাপের ক্ষতি করবো, তর ক্ষতি করবো। কোন ভূত সোয়ার (সওয়ার) অইছিল তর মাথায়? এমুন কাম তুই ক্যান করলি?

নূরজাহানের কাঁপুনি তখন আরও বেড়েছে, কান্না আরও বেড়েছে। কাঁদছে সে পৃথি। বীর সবচেয়ে দুঃখী অসহায় মানুষের মতো। কান্নায় বিকৃত হয়েছে তার শ্যামলবরণ মিষ্টি মুখখানি। গলার স্বর গেছে পিছন থেকে কালজাত সাপে থাবা দিয়ে ধরবার পর অসহায়। ব্যাঙের গলার স্বর যেমন হয় তেমন হয়ে।

নূরজাহানের এই অবস্থা দেখে বুকটা উথাল পাথাল করে উঠল মরনির। যেন নূরজাহানের মতো অসহায় এখন সে নিজেও। কী করবে মরনি এখন? নূরজাহানের জন্যে কী করবার। আছে তার?

এদিকে ঘরের বাইরে তরতর করে বাড়ছিল শীতের বেলা। গাঁদাফুলের পাপড়ির মতো রংধরা রোদ গাঢ় থেকে গাঢ়তর হচ্ছিল। উঠানের শীতল মাটি উষ্ণ হচ্ছিল। পেয়ারার ডালে বসে থেকে থেকে শিস দিচ্ছিল এক অচিন পাখি। আর কোথাও কোনও শব্দ ছিল না। সংসারের কাজ সবই পড়ে ছিল মরনির। সেসব কথা এখন তার মনে নাই। এখন তার মন জুড়ে নূরজাহান, এখন তার চোখ জুড়ে নূরজাহান। নূরজাহানকে নিয়ে কী করবে সে এখন?

নূরজাহানের শরীরের কাঁপন কি তখন আরও বেড়েছে? যেন হঠাৎ করেই ব্যাপারটা খেয়াল করল মরনি। সব ভুলে বলল, এমনে কাপতাছস ক্যা?

কান্নার হেঁচকি তুলে নূরজাহান বলল, কইতে পারি না। শীত করতাছে।

কচ কী?

হ।

শীতটা অইতাছে শইল্লের ভিতরে। বাইরে না। হাত পাও বেঁকা অইয়া আইতাছে।

কথা বলার ফাঁকে দাঁতে দাঁত ঠুকে গেল নূরজাহানের। ঠোঁট বাঁকা হয়ে এল।

হায় হায় শীতে মরে যাবে নাকি মেয়েটা!

মরনি পাগলের মতো জড়িয়ে ধরল নূরজাহানকে। শিশুর মতো পাঁজাকোলে করে নূরজাহানকে তুলল চৌকিতে। কোনওরকমে তাকে শুইয়ে দিয়ে মাথার কাছ থেকে হাছড় পাছড় করে টেনে আনল ভাঁজ করে রাখা পুরানা মোটা কাঁথা। কথায় ঢেকে দুইহাতে চেপে ধরল নূরজাহানকে। কাঁপিয়ে জ্বর আসার পর সন্তানকে কাঁথা কাপড়ে ঢেকে যেমন করে জড়িয়ে ধরেন মা, ঝড়বৃষ্টির হাত থেকে অসহায় ছানাকে ডানার আড়ালে লুকিয়ে যেমন করে রক্ষা করে মা পাখি, তেমন করে যেন নূরজাহানকে রক্ষা করতে চাইল মরনি। ভুলে গেল কী করেছে নূরজাহান। কোন অপরাধে অপরাধী সে। কী শাস্তি হবে তার।

কাঁথার তলায়ও নূরজাহান তখন ঠকঠক করে কাঁপছে। কান্নাটা এখন আর নাই। শরীরের ভিতরকার প্রবল কাঁপুনি যেন চোখের পানি শুষে নিয়েছে।

নিজের অজান্তেই নূরজাহানের পাশে শুয়ে পড়ল মরনি। কথার আবরণে ঢাকা নূরজাহানকে একহাতে জড়িয়ে ধরে টেনে আনল বুকের কাছে। কাঁথার উষ্ণতার সঙ্গে নিজের বুকের উষ্ণতা মিলিয়ে আরও উষ্ণ করে তুলতে চাইল নূরজাহানকে। কাঁপুনি বন্ধ করতে চাইল।

কতক্ষণ, এভাবে কতক্ষণ কে জানে!

একসময় কাঁপুনি কমে এল নূরজাহানের। কাঁথার ভিতর থেকে একটা হাত বের করে, অসহায় শিশু যেমন করে আঁকড়ে ধরে মায়ের গলা, তেমন করে মরনির গলা আঁকড়ে ধরল সে। কোত্থেকে আগের সেই কান্নাটা ফিরে এল। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ভাঙাচোরা গলায় নূরজাহান বলল, আম্মা, আম্মাগো, আপনে আমারে বাঁচান আম্মা, আপনে আমারে বাঁচান। তারা আমারে মাইরা ফালাইবো।

নূরজাহানের কথা শুনে অদ্ভুত এক ঘোরের মধ্যে পড়ে গেল মরনি। তার মনে হল নূরজাহান যেন নূরজাহান না, নূরজাহান যেন তার সেই মুরগি ছানাটি। আততায়ী দাঁড়কাকের মতো মান্নান মাওলানা যেন থাবা দিয়ে ধরেছে তাকে। ঠোকরে ঠোকরে, তীক্ষ্ণ নখের আঁচড়ে আঁচড়ে নূরজাহানকে যেন ফালা ফালা করছে। বুকের কচিমাংস যেন খাবলে খাবলে তুলছে। এই আততায়ীর হাত থেকে কেমন করে নূরজাহানকে বাঁচাবে মরনি! কেমন করে রক্ষা করবে!

কতটা সময় এসব ভাবে মরনি, কে জানে। তারপর নিজের অজান্তেই একসময় আরও গভীর করে বুকে জড়িয়ে ধরে নূরজাহানকে। যেন বহু চেষ্টার পর এইমাত্র দাঁড়কাকের তীক্ষ্ণ ঠোঁট থেকে, পায়ের ধারালো নখের থাবা থেকে ছিনিয়ে নিতে পেরেছে মুরগি ছানাটিকে। এখন বুকের ক্ষতে হলুদ বাটার সঙ্গে চুন মিশিয়ে প্রলেপ দিলেই যেন সেরে উঠবে সে।

.

হামিদা বলল, ভাত বাভুম?

কথাটা যেন কানেই গেল না দবির গাছির। সে বসে আছে ঘরের সামনে, যেখানে শীতদুপুরের রোদ পুরানা কাঁথার ওমের মতো, যেখানকার মাটি খড়নাড়ার আগুনজ্বলা চুলার পারের মতো। বসে থাকলে পৌষ মাঘের বেজায় শীত কিছুতেই কাবু করতে পারে না কাউকে।

শীতের হাত থেকে বাঁচার আশায়ই এখানে বসে আছে দবির। খানিক আগে পুকুরে নেমে চার-পাঁচখানা ডুব দিয়েছে। তাতেই গোসল সারা। উঠে ঠক ঠক করে কাঁপতে কাঁপতে শরীর মাথা মুছেছে। লুঙ্গি বদলে, ভিজা লুঙ্গি চিপড়ে বাড়ির উঠানে মেলে দিয়ে শরীরে আঁট করে সরিষার তেল মেখেছে।

শীতকালে বেজায় খড়ি ওঠে শরীরে। গোসল করে সরিষা তেল মাখলে খড়ি কমে, শরীর গরম হয়।

আজও হয়েছে। তবে সেটা ওই তেল মাখার সময়, হাত পা দাপড়ানোর সময়। তারপরই বাড়ির ঘরদোরের আনাচ কানাচ থেকে, গাছগাছড়া ঝোঁপঝাড়ের ডালপালা থেকে, বাড়ির নামার দিককার চকমাঠ থেকে হাড় কাঁপানো শীত এসে জাপটে ধরেছে। মোটা একখানা গেঞ্জি আছে ঘরে, গেঞ্জিখানা গায়ে দিয়ে গাছি তারপর রোদে এসে বসেছে। ভারী একখানা আরামে সে এখন ডুবে আছে।

এইরকম আরামে কার কথা কার কানে যায়!

দবিরের পায়ের কাছে পড়ে আছে বাঁশের তেল চকচকা ভার, ভারের দড়াদড়ি, রসের কয়েকখানা খালি হাঁড়ি আর গাছ ঝুরার সময়, গাছ থেকে রসভরা হাঁড়ি নামাবার সময় কোমরে বাধার মোটা দড়ি।

শীতকালে দিনেরবেলা এসব জিনিস ঘরে তোলার সময় হয় না। ঘরে তোলা থাকে শুধু ছ্যান কাটাইল আর হাতুড়ি রাখার ঠুলই। দুপুরের পর ফুলই মাজায় বেঁধে, দড়ি এককাঁধে, আরেক কাঁধে ভার, ভারের দুইপাশে রসের খালি ঘড়ি নিয়ে বাড়ি থেকে বেরোয় দবির। খেজুরগাছ আছে যেসব বাড়িতে সেইসব বাড়িতে যায়। ঝুরাগাছে চড়ে, কোমরে দড়ি বেঁধে গাছের গলার কাছে বাঁকা হয়ে দাঁড়ায়। ছ্যান কাটাইলে অতিযত্নে, অতি মায়ায় ঝুরাগাছ নতুন করে পরিপাটি করে, হাঁড়ি পাতে। মনে মনে টুকটাক কথা বলে গাছেদের সঙ্গে। গাছেদের কথাও যেন শোনে।

গাছি তার কথা শুনতে পায়নি দেখে ঘর থেকে বেরিয়ে এল হামিদা। ছনছায় দাঁড়িয়ে আবার বলল, ভাত বাডুম?

মুখ ফিরিয়ে হামিদার দিকে তাকাল দবির। আটু পরে বাড়ো। মাইয়াডা আহুক। একলগেই খাই।

একলগে কেমতে খাইবা? তোমার মাইয়ায় তো অহনতরি নায় (গোসল করা) নাই। বাইত্তে আইয়া নাইয়া ধুইয়া তয় সেন ভাত খাইবো।

দবির চিন্তিত গলায় বলল, মাইয়াডা অহনরি আইতাছে না ক্যা? কই গেল?

আর কই যাইবো! মাকুন্দারে দেখতেঐ গেছে।

মাকুন্দা অহনতরি আছেনি? দারগা পুলিশে লইয়া গেছে না!

তয় মাইয়াডা গেল কই?

তারপরই মুখটা রুক্ষ হল হামিদার, গলাটা রুক্ষ হল। তোমার লাইতে এমুন অইতাছে মাইয়াডা! বড় অইতাছে হেই খ্যাল মাইয়ারও নাই, মাইয়ার বাপেরও নাই। ওই যে একদিন কইছি এই মাইয়ার লেইগা কপালে শনি আছে তোমার! দেকবা আমার কথা ঠিকই ফলবো। তহন কাইন্দাও কূল পাইবা না তুমি।

দবির বিরক্ত হল। এতো প্যাচাইল পাইড়ো না।

আমি কথা কইলেঐত্তো প্যাচাইল মনে অয় তোমার! মাইয়াডা য্যান একলা তোমারঐ। আমার না। আমি য্যান তোমার মাইয়ার শতরু। মায় কোনওদিন মাইয়ার শতরু অয় না। মায়ঐ অয় মাইয়ার আসল বন্দু। মায়ঐ মাইয়ারে আলগাইয়া রাখে, বাপে রাখে না।

দবির সরল গলায় বলে, মাইয়া আলগাইয়া রাখতে তোমারে আমি না করছিনি? রাখো না ক্যা?

তোমার লেইগাঐত্তো পারি না

ক্যা, আমি কী করছি?

এই যে বাইত্তে আইয়া আইজ মাকুন্দার সম্বাতটা দিলা, হুইন্না মাইয়া দিল দৌড়, আমি না করতে চাইলাম, তুমি না করতে দিলা না।

হেইডা তো দেই নাই অন্য একহান কথা ভাইব্বা। এই যে মাকুন্দারে আইজ পুলিশে ধইরা লইয়া গেল, মাকুন্দা তো আর কোনদিন ফিরত আইবো না। আইলেও মাইয়াডার লগে অর আর কুনোদিন নাও দেহা অইতে পারে।

ক্যা ফিরত আইলে দেহা অইবো না ক্যা?

হেতদিনে (ততদিনে) মাইয়াডা আরও ডাঙ্গর অইয়া যাইবো। বিয়াশাদি অইয়া যাইবো। কোনদেশের কোন গেরামে বিয়া অইবো কে জানে! মাকুন্দা যহন আইবো তহন দেহা গেল মাইয়াডা রইছে হৌরবাড়ি (শ্বশুরবাড়ি)।

হামিদা একটু চুপ করে রইল। তারপর বলল, কোনও কোনও মাইনষের লগে তাগো আপনা রক্ত সম্পর্কের মাইনষের লগেই দেহা অয় না। জীবন কাইট্টা যায় একজন আরেকজনরে দেহে না। হেতে কী অয়? এতো আহ্লাদ ভাল্ না।

দবির সরল মুখ করে বলল, আমার আহ্লাদ ইট্টু বেশি। কী করুম কও?

কিছু করনের কাম নাই। মাইয়ার লেইগা রইদ্রে বইয়া থাকো, বেইল যাউক তারবাদে বোজবানে! নাকে মোকে ভাত হান্দাইয়াঐ দৌড় দেওন লাগবনে গাছ ঝোরতে।

না মাইয়া দেখবা অহনঐ আইয়া পড়ছে। মাকুন্দার ওই দশা দেইক্কা মনে অয় কানছে। মন খারাপ অইছে, এর লেইগা ইট্টু ঘুইরা ঘাইরা আইতাছে।

তয় তুমি অহন কী করবা? এমনে মাইয়ার লেইগা ভাত না খাইয়া বইয়া থাকবা না। মাইয়া বিচড়াইতে যাইবা?

দবির হাসিমুখে বলল, আটু বইয়া থাকি। রইদ্রে বইয়া থাকতে আরামঐ লাগতাছে।

হামিদা আর কোনও কথা বলল না। রান্নাচালার ওদিক থেকে একখানা পিঁড়ি এনে সেও বসে রইল দবির গাছির অদূরে।

.

আজিজ আজ গাওয়ালে বেরুল দুপুরের ভাত খেয়ে।

মাকুন্দা কাশেমের হইহল্লায় সকালটা মাটি হয়েছে। সড়কপার থেকে বাড়ি ফিরতে ফিরতে ভরদুপুর। এরকম দুপুরে ভাত না খেয়ে বাড়ি থেকে বেরোয় কোন গিরস্তে! বাড়ির

বউঝিরা বেরুতে দেয় না। বানেছাও বেরুতে দিচ্ছিল না।

তখন থেকেই মনের তলায় চিকন একখান হায়আপশোস ডাইয়া পিঁপড়ার (ভেঁয়ো পিঁপড়ে) মতন ঘোরাফেরা করছিল। কুটুস কাটুস করে কামড়ও দিচ্ছিল মনে। মনটা ছ্যাড়াভ্যাড়া হয়ে যাচ্ছিল আজিজের।

একটা দিন মার গেল।

একটা পুরাদিন মার গেলে, গাওয়ালে না বেরুলে সত্তর-আশি টাকার ছাক্কা রোজগার খতম। য্যানতেন কথা! এতবড় সংসার আজিজের, এতগুলি এন্দাগেন্দা! সত্তর-আশি টাকার মারটা আজিজ কেমন করে সামলায়!

মনের ভিতর ডাইয়া পিঁপড়ার কামড় নিয়েই ভাতটা খেয়েছে আজিজ। মাসখানেকের ব্যবধানে দুইটা দিন নষ্ট। ছনুবুড়ি মরল, ওই একটা দিন আর আজ। ছনুবুড়ির মৃত্যু দিনটা না হয় ঠিক আছে, আপন মা, মা মারা গেছে তার লাশ উঠানে ফেলে রেখে তো আর গাওয়ালে বেরুনো যায় না! ওই নিয়া হায়আপশোসও ঠিক না।

কিন্তু আজ?

মাকুন্দা কাশেমের কী হল না হল তাতে আজিজের কী?

দেশগ্রামের সাতেপাঁচে কখনই থাকে না আজিজ। তবু আজ তাকে যেতে হয়েছিল। মেন্দাবাড়ির মোতালেব ভাল একখানা পট্টি দিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। সকালের নাস্তাপানি করে আজিজ যখন তার তামা-পিতলের ভার ঘর থেকে মাত্র বের করেছে, উঠানের মাটি থেকে কাঁধে তুলে কোলাপাড়ার দিকে মেলা দিবে, সড়কপারে যাওয়ার রাস্তা শর্টকাট করার জন্য মোতালেব তার বাড়ি পাথালে হাঁটা দিয়েছিল। আজিজকে দেখে অতি আপনজনের কায়দায় মাকুন্দা কাশেমের ঘটনাটা বলল। মান্নান মাওলানার পক্ষ নিয়ে চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করল মাকুন্দার। তারপর পট্টিটা দিল আজিজকে। তোমার মা’র জানাজা মাওলানা সাবে পড়ে নাই। ক্যান পড়ে নাই তুমি-আমি বেবাকতেই জানি। শ্যাষ পইর্যন্ত মৌউজনা গিয়া খাইগো বাড়ির মলবি সাবরে লইয়াইলো। হেয় পড়লো জানাজা। এর লেইগা মান্নান মাওলানা সাবে তোমার উপরে বেদম চেইত্তা রইছে। কথায় কথায় আমারে একদিন কইছে। তুমি তো জানঐ মাওলানা সাবে আমারে বহুত মহব্বত করে। পেডের কথা বেবাকঐ আমারে কয়। এর লেইগাঐ কইতাছি গাওয়ালে আইজ যাইয়ো না। আমার লগে লও।

আজিজ অবাক হয়ে বলেছে, কই যামু তোমার লগে?

মাওলানা সাবের বাইত্তে।

ক্যা?

এমুন বিপদের দিনে তার পাশে গিয়া খাড়ইলে হেয় খুশি অইবো।

মোতালেবের কথায় সরল সোজা আজিজ পর্যন্ত বুঝতে পারল না মান্নান মাওলানার বিপদটা কী? বিপদ তো মাকুন্দা কাশেমের!

কথাটা সে বলেও ফেলল।

শুনে মোতালেব বলল, ঠিক কইছো। আসল বিপদ মাকুন্দার। মাইর তো খাইছে, অহন জেলেও যাইবো। তয় মাওলানা সাবের বিপদও কম না। থানায় দোড়াদোড়ি, পুলিশ দারগাগো চা পানি খাওয়ানো, হাতের কাছে মানুষজন থাকলে বলভরসা পায়। তোমারে দেখলেও বল পাইবো। তুমি তার চোক্কের সামনে থাইক্কো, পরে একদিন মাওলানা সাবরে আমি বুঝাইয়া কমুনে যে আইজ্জারে আপনে মাপ কইরা দেন। লও। গাওয়ালে একদিন না গেলে কিছু অইবো না, মাওলানা সাবের পাশে গিয়া না খাড়ইলে ক্ষতি অইবো।

সবশুনে মনের ভিতর একটা প্যাঁচঘোচ লেগে গিয়েছিল আজিজের। খানিক দোনোমোনো করে তামা পিতলের ভার ঘরে রেখে মোতালেবের সঙ্গে হাঁটা দিয়েছিল।

ফিরে আসার পর থেকে মনটা কামড়াচ্ছে। সত্তর-আশি টাকার শোকে গলা দিয়ে ভাত নামছিল না। পোলাপানগুলি শীতের উঠানে হইচই করছিল। মেজোছেলেটা বাড়ির নামার দিককার বউন্নাগাছে বসে গলা ছেড়ে গান গাইছিল,

দুয়ারে আইসাছে পালকি
নাইওরি মাও তোলো রে, তোলো মুখে
আল্লাহ রসুল সবে বলো।

বানেছা বসেছিল আজিজের সামনে। আট-সাড়ে আট মাসের পেটখানা তার যতটা না বড় বসার ভঙ্গিতে আরও বড় দেখাচ্ছিল। ওই তো আরেকজন এই সংসারে আসার ফিকির করছে। একটা মুখ বাড়ল। খাদ্যে ভাগ বসাবার মুখ।

এই অনাগত মুখের কথা ভেবে শোকটা যেন আরও উথলে উঠল আজিজের। একেক লোকমা ভাতের সঙ্গে একেক ঢোক পানি খেতে লাগল সে। দেখে বানেছা বলল, কী অইছে তোমার? এমুন করতাছো ক্যা?

পানির গেলাস নামিয়ে রেখে আজিজ বলল, মনডা ভাল না।

ক্যা?

গাঁওয়ালে গেলাম না।

গেলা না ক্যা?

মোতালেইব্বার কথায়।

গিয়া কী কাম অইলো?

কী কাম অইবো? ওই যে মোতালেইব্বা যেই হগল কথা কইয়া লইয়া গেল!

কিছু তো বোজলাম না।

বানেছা অবাক হল। ক্যা, বোজো নাই ক্যা?

মাওলানা সাবে তো আমার মিহি চাইলঐ না। হেয় আছিল দারগা পুলিশ লইয়া, মাকুন্দারে লইয়া।

বানেছা খুবই বুঝদারের ভঙ্গিতে বলল, তারবাদেও তো বুজা যায়।

মুখে দেওয়া ভাত গিলে আজিজ বলল, কেমতে?

মোক দেইক্কা। কেঐ যুদি তোমার উপরে চেইত্তা থাকে তয় তার মোক দেইক্কাঐ হেইডা বুজা যায়।

আমি বুজি নাই।

বানেছা একটু রাগল। তুমি তো ভোঁদাই। তুমি বোজবা কেমতে!

বউর মুখে এরকম একটা গাল খেয়েও রাগল না আজিজ। একে মনের ভিতর পিঁপড়ার কামড় তার ওপর এখন যদি বানেছার সঙ্গে লেগে যায় তা হলে অশান্তির আর শেষ থাকবে না।

নিরীহ মুখ করে আজিজ বলল, তয় আমার একখান ভুল অইছে আইজ।

কীয়ের ভুল?

মোতালেইব্বার কথা বিশ্বাস কইরা। ও তো মানুষ ভাল না। মা’র মরণের দিন দেকলা কেমুন পট্টি দিয়া টেকাড়ি আমার খাইলো!

হ। ও একটা পিচাশ। কাফোনের কাপড় থিকাও চুরি করে।

শেষ লোকমা ভাত খেয়ে শেষ টেক পানি খেল আজিজ। তারপর লুঙ্গির খুঁটে মুখ মুছল। আইজও মোতালেইব্বা আমারে এমুন একখান পট্টি দিয়াঐ লইয়া গেছিলো।

কথাটা বুঝতে পারল না বানেছা। বলল, আইজ মোতালেইব্বা তোমারে পট্টি দিবো ক্যা? আইজ তো কেঐ মরে নাই, আইজ তো কাফোনের কাপড় কিনতে যাওন লাগবো না! আইজ তো অর কোনও লাবও নাই!

আছে।

কী লাব?

আমার একটা দিন মাইর দিলো।

তোমার দিন মাইর দিয়া অর লাব কী?

এইডাও অর এক রকমের লাব। অন্যের ক্ষতি কইরা কোনও কোনও মানুষ শান্তি পায়। নিজের নাক কাইট্টা পরের যাত্রাভঙ্গ।

এবার বানেছা আবার রাগল। এইডা যে অহন বোজতাছ, আগে বোজো নাই ক্যা?

ম্লান মুখে হাসল আজিজ। এইডাঐত্তো ভুল।

লুঙ্গির কেঁচড় থেকে তারপর কুম্ভিপাতার বিড়ি বের করে ধরাল আজিজ। যেখানে বসে খাচ্ছিল সেখান থেকে সরে এসে দুয়ারের সামনে বসে উদাস হয়ে বিড়ি টানতে লাগল।

বানেছা তখন স্বামীর জুডা (খাওয়া শেষ করা, ধোয়া হয়নি এমন) থালা গেলাস, তরকারির বাটি এসব গোছগাছ করছে। ভারী শরীরে নড়াচড়া সে কম করে। যেখানে বসে সেখানে এমন আঁট করে বসে যেন সহজে উঠতে না হয়, যেন এক জায়গায় বসেই অনেকক্ষণ ধরে অনেকগুলো কাজ করতে পারে।

এখনকার ভঙ্গিটাও তেমন।

বানেছা পিঁড়িতে বসেছে, বড়ঘরের দক্ষিণ দিককার বেড়া ঘেঁষে। এদিকটায় খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা। রান্নাচালা থেকে রান্না সেরে, ভাতের ফ্যান গেলে হাঁড়িখানা লুচনি (গরম হাঁড়ি ধরার ন্যাকড়া) দিয়ে ধরে এই ঘরে নিয়ে আসে সে। তরকারির কড়াই, ডাল দুধের হাঁড়িও একই কায়দায় আনে। বড়ঘরের দক্ষিণ দিককার বেড়া ঘেষে কয়েকখানা মাটির জলকান্ধা (যার ওপর ভাত তরকারির হাঁড়ি কড়াই রাখা হয়। পাতা আছে। হাঁড়ি কড়াই সেই সব জলকান্ধায় বসিয়ে পিড়ি আর নয়তো হোগলা পেতে পোলাপান আর পোলাপানের বাপকে ভাত বেড়ে দেয় সে। অনেক সময় সবার সঙ্গে বসে নিজেও খায়।

আজও তেমনভাবে গুছিয়েই বসেছে। এখন এখান থেকে অনেকক্ষণ না নড়লেও হবে। স্বামীর খাওয়া শেষ হয়েছে। এখন পোলাপানে খাবে। তারপর খাবে বানেছা। অনেকটা সময় পার হয়ে যাবে।

কিন্তু বানেছার এত ক্ষুধা লাগছে কেন আজ? এখনও তো ভাল করে দুপুর হয়নি!

তারপরই ব্যাপারটা বুঝল বানেছা। পেটের ভিতর আছে যেজন সেজন বেশ বড় হয়ে উঠেছে। দুই-দশদিনের মধ্যেই নাজেল হবে। বানেছার ক্ষুধার সঙ্গে তার ক্ষুধাটাও যে যোগ হয়েছে! এক বানেছা এখন আসলে দুইজন। একের ক্ষুধা এখন আসলে দুইজনের।

মনে মনে পেটের অন্ধকারে লুকিয়ে থাকা সন্তানটির উদ্দেশে বানেছা বলল, কী রে, এতো খিদা লাগে ক্যা তর? বোজছ না, তর খিদা লাগলে আমারও খিদা লাগে! জাইন্না হুইন্না আমারে তুই জ্বালাছ ক্যা? ঠিক আছে জ্বালা! আর কয়দিন জ্বালাবি! পেট থিকা বাইর হওনের পর তো আর এই জ্বালানডা জ্বালাইতে পারবি না!

বিড়ি টানতে টানতে উদাস চোখে বানেছার দিকে তাকিয়েছে আজিজ। তাকিয়ে দেখে বানেছা নিঃশব্দে কথা বলছে কিন্তু ঠোঁট মৃদু মৃদু নড়ছে তার। মুখখানা হাসিহাসি। নিজের দিনটা মাটি হয়ে যাওয়ার কথা ভুলে বানেছাকে সে জিজ্ঞেস করল, কী কও?

বানেছা চমকাল। কো কী কই?

মনে মনে?

বানেছা হাসল। মনে মনে কওয়া কথা অন্যে হোনেনি?

না হোনে না। তয় তোমার ঠোঁড লড়তাছিল।

বানেছা আবার হাসল। আসলে কিছু কই না। ঠোঁড এমতেই লড়তাছিল।

ব্যস্ত হাতে পাঁচখানা থালায় ভাত বাড়তে লাগল বানেছা।

তখনই যেন হঠাৎ মনে পড়েছে এমন ভঙ্গিতে আজিজ বলল, হায় হায় তোমারে তো একখান কথা কওয়া অয় নাই।

চোখ তুলে স্বামীর দিকে তাকাল বানেছা। কী কথা?

আইজ একখান কাম অইছে।

হেইডা তো জানি। মাকুন্দার কথা কইতাছো না?

আরে না। নূরজাহান একখান কাম করছে। হুজুরের মোকে ছ্যাপ ছিড়াইয়া দিছে।

কথাটা যেন বুঝতে পারল না বানেছা। ভুরু কুঁচকে বলল, কী?

হ। কেমতে?

ঘটনা খুলে বলল আজিজ। শুনে পোলাপানের জন্য ভাত বাড়তে ভুলে গেল বানেছা। হতবাক হয়ে আজিজের মুখের দিকে তাকিয়ে কোনওরকমে বলল, কও কী?

হ।

এতবড় সাহস অর অইলো কেমতে?

হেইডাঐত্তো কেঐ বোজতে পারে নাই।

কামডা ও করলো ক্যা?

কে কইবো?

খানিক চুপ করে থেকে বানেছা বলল, মরণে টানছে অরে। নিজের মরণ ও নিজে ডাইক্কা আনলো। মাথায় মনে অয় শয়তানে আছড় করছে। এর লেইগা মাথা বিগড়াইয়া গেছিলো। নাইলে এমুন কাম করে মাইনষে?

মাকুন্দার দশা দেইক্কা মনে অয় মাথা ঠিক রাখতে পারে নাই?

ক্যা, মাকুন্দা অর ভাতার অয়নি?

কে জানে?

এই ছেমড়ির কপালে যে অনেক বিপদ আছে অরে দেইক্কাঐ আমি হেইডা বোজতাছিলাম। অর চালচলন ভাল না। বেড়াগো লাহান। যা মনে লয় করে, যেহেনে মনে লয় যায়গা। এইবার বোজবো। হুজুরের মোকে ছ্যাপ ছিড়াইয়া দেয় ওইড় ছেমড়ি, হুজুরে অরে কিছু কইলেও, হুজুরে অরে ছাইড়া দিলেও হুজুরের পোলা আতাহারে অরে ছাড়বো না। আতাহারে অরে ঠিকঐ দেইক্কা লইবো। রাইত দোফরে বাইত থিকা ধইরা আইন্না দোস্তগো লইয়া আকাম কুকাম করবো। তারবাদে ল্যাংটাচোংটা কইরা ধানখেতে হালাইয়া রাখবো। গেরামের বেবাক মাইনষে অরে দেকবো।

আজিজ কথা বলল না। বিড়ি অনেক আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিল, কখন ফেলে দিয়েছে মনে নাই। এখন আবার একটা বিড়ি ধরাতে ইচ্ছে করল তার।

তখনই বানেছা বলল, নূরজাহান অহন কো?

হেইডা কইতে পারি না। দৌড় দিয়া কোনমিহি গেল কে জানে?

মনে অয় বাইত্তেঐ গেছে। আর কই যাইবো!

হ।

উঠে দাঁড়াল আজিজ। যাই, বাইতথন বাইর অই। খোঁজখবর লইয়া দেহি কারবার কী অইলো।

বানেছা বলল, বাইর যহন অইতাছো ভারখান লইয়াঐ বাইর অও।

আজিজ অবাক হল। ক্যা?

গাওয়ালডাও করলা।

কই গাওয়াল করুম? দুফইরা ভাত খাইয়া কোলাপাড়া মিহি যাওন যাইবো? আইজ মনে করছিলাম উত্তরমিহি যামু। উত্তর মেদিনমণ্ডল, সীতারামপুর, দোকাছি, কোলাপাড়া অইয়া বাইত আমু।

হেইডা যহন হইলো না নিজের গেরামেঐ গাওয়াল করো। নূরজাহানের সম্বাতও লইলা, গাওয়ালও করলা।

হ বুদ্দিডা খারাপ না। তয় কারবার অইবো বইলা মনে অয় না। তবু তুমি যহন কইছো, যাই।

তারপর ভার কাঁধে বাড়ি থেকে বেরিয়েছে আজিজ। সে যখন বাড়ির নামায় বানেছা তখন চিৎকার করে পোলাপানদের ডাকছে। খাইতে আয় তরা। ভাত বাড়ছি।

.

বাড়ি থেকে বেরিয়ে আজিজের মনে হল গ্রামখানি কীরকম যেন স্তব্ধ হয়ে আছে। কোথাও যেন কোনও শব্দ নাই, প্রাণের সাড়া নাই। গাছপালায় নাই হাওয়ার চলাচল, পাখির ডাক। মানুষের ঘরবাড়ি সব রাতদুপুরের মতো নির্জন হয়ে আছে। যেন কেউ কোথাও জাগনা (জেগে) নাই, যেন সবাই ডুবে আছে গভীর ঘুমে।

এমন হয়েছে কেন?

দুপুরের পর এমনিতেই নির্জন হয় গ্রাম। গৃহস্থলোক খেতখোলার কাজ সেরে, হাটবাজার সেরে বাড়ি ফিরে। তারপর নাওয়াখাওয়া সেরে ঘণ্টাখানেক জিরায়। তখন চারদিকে প্রাণের সাড়া কম থাকে। এখন যদিও সেই সময়, কিন্তু এমন নির্জন হয়েছে যেন হাওয়াও বইছে না। হাওয়ার হয়েছে কী! হাওয়া কেন বইছে না!

পাখিদের হয়েছে কী! কেন ডাকাডাকি করছে না তারা!

তবে একটা শব্দ সব সময়ই জেগে থাকে গ্রামদেশে, নির্জনতার শব্দ, স্তব্ধতার শব্দ। গাছের পাতায়, ঘাসের বনে, শস্যের চকেমাঠে গভীর নির্জনতায়ও জেগে থাকে এক ধরনের ঝিমমারা শব্দ। সূক্ষ্মভাবে খেয়াল না করলে সেই শব্দকে শব্দ মনে হয় না।

আজ সেই স্তব্ধতার শব্দও শুনতে পেল আজিজ।

এমন হয়েছে কেন আজ! মানুষের পাপে কি লজ্জায় মুখ লুকিয়েছে প্রকৃতি! বইতে ভুলে গেছে হাওয়া! গাইতে ভুলে গেছে পাখিরা! উড়তে ভুলে গেছে!

নাকি সাত আসমানের উপর বসে তার তৈরি দুনিয়ার দিকে, মানুষের দুনিয়ার দিকে সারাক্ষণ চোখ মেলে তাকিয়ে থাকা মহান আল্লাহপাকের ইচ্ছায় আজ এমন হয়েছে। কাল রাত থেকেই আল্লাহ যখন দেখেছেন দুনিয়ার এককোণে, বাংলাদেশের একখানি গ্রামে তার তৈরি এক নিরীহ অবোলা বান্দার ওপর ভয়াবহ অত্যাচার করছে শক্তিমান আরেক বান্দা, জীবন ছারখার করছে সেই মানুষের, আর মিথ্যার আশ্রয়ে মহান করে তুলছে নিজেকে, সেই মানুষের পাপে দুনিয়াকে তিনি স্তব্ধ হতে বলেছেন। এ জন্যই কি এমন হয়েছে আজ!

নাকি এর পিছনে আছে মানুষের তৈরি সমাজব্যবস্থার অতি সাধারণ কোনও ভয়ভীতি! নূরজাহানের প্রতিবাদী আচরণে, মান্নান মাওলানার মুখে থুতু ছিটিয়ে দেওয়া দেখে পার্থিব ভয়ে কি মানুষের মতন প্রকৃতিও স্তব্ধ হয়েছে!

আজিজ কিছু বুঝতে পারে না। মনের ভিতর, মাথার ভিতর নিরন্তর কাজ করতে থাকা সূক্ষাতিসূক্ষ্ম সুতা প্যাঁচ লেগে যায়। খানিক চেষ্টা করে প্যাঁচটা ছুটাতে চায় সে। পারে না। তখন হতাশ হয়ে এসব চিন্তা বাদ দেয়। মনের ভিতর জাগিয়ে তুলতে চায় নিজের একটি দিন মাটি হয়ে যাওয়ার বেদনা। জীবনের অদৃশ্য খেরোখাতার একটি পাতায় হিসাবের যোগ বিয়োগ গুণ ভাগ করে চলে।

হিসেব মিলে না আজিজের। গ্রাম পাথালে তামা পিতল অ্যালুমিনিয়ামের ভার কাঁধে হাঁটতে হাঁটতে সেই অদৃশ্য খেরোখাতায় জীবন হিসাবের আশ্চর্য একটা জট সে একসময় খুলে যেতে দেখে। জীবন থেকে যে সময় হারিয়ে যায় সেই সময়ের কাজটুকু, সেই সময়ের লাভ লোকসান এক জীবনে আর কখনও পূরণ হয় না। পেরিয়ে যাওয়া সময়ের পর যে সময় আসে বোকা মানুষ সেই সময়কে আগের সময়ের সঙ্গে মিলিয়ে সুদে আসলে পেরিয়ে যাওয়া সময়ের লোকসানটা পুষিয়ে নিতে চায়। তাতে লাভের জায়গায় জীবনশক্তির ক্ষয়কর্মে যে লোকসানটা হয় সেই লোকসান যে এক জীবনে আর লাভের মুখ দেখে না, সময়ের আসল মারপ্যাঁচটা যে এখানেই, আজ দুপুরের আগে আজিজ যেন তা টেরই পায়নি। তবে টের পেয়ে মনটা কীরকম ভার হয়ে গেল তার। একটা দিনের বেশ কিছুটা সময় মাটি করে দেওয়ার জন্য মোতালেবের ওপর খুব রাগ হল। মনে মনে খুব গালাগাল করতে ইচ্ছে করল তাকে। কিন্তু গালাগালটা আজিজ করল না। একসময় নিজের ভিতর জেগে উঠতে দেখল আশ্চর্য এক অভিমান। মোতালেবের কথায় সে ভুলেছিল কেন! চতুররা তো কত কথাই বলে! চতুরদের কথায় ভাল মানুষরা ভুলবে কেন!

আজিজ কেন ভুলেছিল!

এই অভিমানে কাঁধ থেকে আজিজের ছুঁড়ে ফেলতে ইচ্ছা করল তামা পিতলের ভার। মুহূর্তের জন্য যেদিকে দুইচোখ যায় চলে যেতে ইচ্ছা করল।

তারপরই মনে হল, এ বোধহয় মহান আল্লাহপাকেরই ইচ্ছা। তার ইচ্ছা ছাড়া গাছের পাতাও নড়ে না। মোতালেবের কারণে আজিজের একটা দিন যে মাটি হবে এটা আল্লাহপাকের ইশারাতেই হয়েছে। তিনি যা করেন মানুষের মঙ্গলের জন্যই করেন। এই মাটি হওয়া দিনের ভিতরই হয়তো মঙ্গলের কোনও ইঙ্গিত আজিজের জন্য রেখে দিয়েছেন তিনি। ভবিষ্যতে তার ফল পাবে আজিজ।

এসব ভেবে ভার হওয়া মন হালকা হয়ে গেল আজিজের। কোঁচড় থেকে বিড়ি বের করে ধরাল সে। ততক্ষণে আজিজ এক্কেবারে দবির গাছির বাড়ির কাছে।

উঠানের রোদে তখনও গা ছেড়ে বসে আছে দবির গাছি, তার মুখোমুখি পিঁড়িতে বসে আছে হামিদা। রান্নাচালার সামনে নিঃশব্দে খাবার খুঁজে ফিরছে তিনটা ভাতশালিক। রসের হড়িকুড়ি, ভার পড়ে আছে মানুষ আর পাখিদের আশপাশে।

এই বাড়ির কাছাকাছি এসে যেন হঠাৎ করেই বাড়িটা দেখতে পেল আজিজ গাওয়াল, মানুষ আর শালিক পাখি দেখতে পেল। রসের হাঁড়ি ভার দেখতে পেল। যেন বা এতক্ষণ সে ছিল ঘুমে। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে হেঁটেছে এতটা পথ। ফলে কিছুই যেন দেখতে পায়নি, কিছুই যেন চোখে পড়েনি। অথবা দিনদুপুরেই তাকে যেন ধরেছিল রাতদুপুরের কানাওলা। আপন গ্রামেই যেন পথ হারিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে সে। পথ চিনতে পারেনি। কার কোন বাড়ি, চিনতে পারেনি। এইমাত্র যেন কানাওলা ছেড়ে গেছে তাকে, এইমাত্র যেন সব চিনতে পারছে। তারপরই সেই অদৃশ্য খেরোখাতার একটি পৃষ্ঠা আবার খুলে গেছে আজিজ গাওয়ালের চোখে। একটি দিনের হিসাব গরমিল হয়ে গেছে। যদি হিসাবটা খানিক মিলানো যায়, লোকসানের জায়গায় যদি এসে দাঁড়ায় দুই-চার টাকার লাভ তা হলে কিছুটা অন্তত পোষায়! এই ভেবে দবির গাছির উঠানে এসে উঠল আজিজ।

রসের দিনে টাকাপয়সার আকাল নাই দবির গাছির। কোঁচড়ে টাকাপয়সা থাকলে এইসব টুকটাক জিনিস গিরস্তে বেশ কিনে। ঠিকঠাক মতো বুঝতে পারলে দবিরও কিনবে। তামা পিতলের জিনিস তো তার দরকারই। মেয়ে বড় হয়েছে। মেয়ের বিয়েতে পিতলের জগ কলসি, পানদান চিলমচি, তামার থালা গ্লাস এসব না লেগে পারে না। যদিও লোকে আজকাল কাঁচের জিনিসপত্র কিনে, চিনামাটির জিনিসপত্র কিনে, মেলামাইন বলে একটা জিনিস বেরিয়েছে তাও কিনে, তবু তামা পিতলের জিনিসের কদর কমেনি। যারা কেনার তারা এখনও এসব জিনিসই কিনে। তা ছাড়া গ্রাম গেরস্তে তামা পিতলের জিনিসপত্র কেনে অন্য একটা কারণেও। এক দুই জনমে তামা পিতলের জিনিসের কোনও ক্ষতি হয় না। ফেলিয়ে ছড়িয়ে রাখলেও নষ্ট হয় না। সবচেয়ে বড়কথা হল জিনিসগুলি সোনা রুপার মতন। আকালের দিনে গিরস্তকে বাঁচিয়ে রাখে। ঘরে চাল না থাকলে এক-দুইখানা তামা পিতলের জিনিস বাজারে নিয়ে গেলেই হয়। নগদ দামে কিনে নিবে ভাঙারিরা। এ জন্যে বছরের যে সময়টায় টাকাপয়সা হাতে থাকে গিরস্তের সেই সময় অনেকেই এইসব জিনিস কিনে রাখে। টাকাপয়সা না জমিয়ে এইসব জিনিস জমায়।

টাকা হচ্ছে গাছের শুকনা পাতার মতো। যখন তখন ফরফর করে উড়ে যায়। এজন্য টাকা না জমিয়ে তামা পিতল জমানো ভাল। খুব বেশি ঠেকায় না পড়লে, অভাবের ঝড় কালবৈশাখীর মতন প্রবল না হলে ঘর থেকে তামা পিতল কখনও উড়ে যায় না। ঘরের জিনিস ঘরেই থাকে।

আর একখানা সুবিধা হল তামা পিতলের জিনিস ক্ষয় হয়ে গেলেও, ভেঙেচুরে লন্ডভন্ড হয়ে গেলেও কদরটা তার থেকেই যায়। ভাঙারিরা সের দরে কিনে নেয়। এমনকী ভাঙারি আর গাওয়ালরা পুরনো, ক্ষয় হয়ে যাওয়া কিংবা, ভাঙাচোরা জিনিসের বিনিময়ে নতুন জিনিসও দেয়। তিন-চারখানা ভাঙা জিনিসের বিনিময়ে হয়তো বা নতুন, ভাল একখানা জিনিস পাওয়া গেল।

কায়দাটা একেবারে সোনা রুপার মতন।

কোনও কোনও বোকা গিরস্ত এসব বুঝতে চায় না। তারা মনে করে তামা পিতল হচ্ছে আদ্যিকালের বস্তু। এই বস্তুর কদর আজকাল নাই। আজকাল হচ্ছে কাঁচের যুগ, কাঁচের জিনিসের কদর আর কদর চিনামাটির। থালা বাসন গেলাস বাটি জগ সবই কাঁচের, সবই চিনামাটির। কিন্তু বস্তুগুলো যে মানুষের সম্পর্কের মতন, প্রেম পিরিতির মতন যখন তখন ভাঙে সেদিকে কারও নজর থাকে না।

এসব ভেবে আজিজ গাওয়াল ভিতরে ভিতরে বেশ উত্তেজিত হল। গিরস্ত লোকের বাড়ি গিয়ে আজ থেকে যদি এই ধরনের কথা আজিজ বুঝিয়ে বলতে পারে তা হলে তামা পিতলের কদরটা আবার আদ্যিকালের মতন বাড়বে। কাঁচ মাটি ফেলে লোকে নিশ্চয় তামা পিতলের দিকে ঝুঁকবে। মানুষ হচ্ছে লোভী জীব। যেদিকে লাভ সেদিকেই ঝুঁকবে। কথা হল কোনখানে লাভ সেটা তাদের বুঝিয়ে দিতে হবে, চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে হবে।

তারপর আরেকটা বিষয় আবিষ্কার করল আজিজ গাওয়াল। লোকে যে বলে আল্লাহ যা। করেন মানুষের মঙ্গলের জন্যে করেন, কথাটা ঠিক। এই যে জীবনের একটি দিন মাটি হয়ে যাওয়ার পরও তামা পিতল আর কাঁচ মাটির প্রভেদের যে জটটা আজ অন্যরকমভাবে খুলল আজিজ, এ তো আল্লার ইশারাতেই হল। এই জট খোলার ব্যাপারটা যখন গিরস্তলোককে বুঝিয়ে বলতে পারবে আজিজ তখন তার মালসামানের বিক্রি বেড়ে যাবে। হাতে টাকা আসবে দেদারসে। আজিজ আর আজিজ থাকবে না।

দবির গাছির বাড়ি থেকেই কি এই কাজটা আজ শুরু করবে আজিজ গাওয়াল!

রান্নাচালার সামনে চরে বেড়ানো তিনটা শালিকের একটা আনমনা ভঙ্গিতে উঠানের মাঝামাঝি চলে এসেছিল। দবির গাছি এবং হামিদা চুপচাপ বসে আছে দেখে, নড়াচড়া করছে না দেখে ভয়টা সে পায়নি। উড়াল দেওয়ারও দরকার হয়নি। কিন্তু তামা পিতলের ভার কাঁধে চকের দিক থেকে আজিজকে এই উঠানে উঠে আসতে দেখে পাখিটা তার স্বভাব মতো চঞ্চল হল। দবির হামিদার মাঝখান দিয়ে বড়ঘরের চালার দিকে উড়াল। দিল। শালিক পাখির উড়ে যাওয়ার কারণেই যেন আজিজকে দেখতে পেল দবির গাছি, হামিদা। আর দবির হামিদার মুখ দেখে খানিক আগের ভাবনাটায় তালগোল পাকিয়ে গেল আজিজ গাওয়ালের। যে বাড়ির ওইটুকু মেয়ে আজ সকালেই এমন একটা কাজ করেছে সেই বাড়ির মানুষের, মেয়ের মা-বাবার মন মেজাজ আজ কেমন হতে পারে তা অনুমান করা হদ্দবোকার পক্ষেও সম্ভব। সেই বাড়িতে আর যাই হোক গাওয়াল করা সম্ভব না, সেই বাড়িতে আর যাই হোক তামা পিতলের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্যাচাল পাড়া সম্ভব না। পাড়তে গেলে গিরস্তলোক বিরক্ত হবে। কাজ না হয়ে অকাজ হবে। শুরুর দিনেই মার খেয়ে যাবে আজিজ, বিমুখ হয়ে যাবে।

তা হওয়া ঠিক হবে না। যে-কোনও ভাল কাজের শুরুও ভাল হওয়া উচিত।

তা হলে আজিজ এখন কী করবে? দবির গাছির বাড়িতে যখন এসেই পড়েছে কিছু একটা তাকে করতেই হবে। দুই-একটা ভালমন্দ কথা অন্তত বলতে হবে। গৃহস্থের খোঁজখবরটা নিতে হবে। তা ছাড়া যে বাড়ির মেয়ে আজ এমন একখানা কাজ করেছে সেই মেয়ের মা-বাবার সঙ্গে কত রকমের কথাই তো বলা যায়! কত রকম ভাবেই তো সান্ত্বনা দেওয়া যায় তাদের আর সেটাই তো মানুষের ধর্ম। যদিও আজিজ কারও সাতেপাঁচে থাকে না, থাকে শুধু নিজেকে নিয়ে, ছেলেমেয়ে এবং ছেলেমেয়ের মা’কে নিয়ে। কিন্তু কোনও কোনও সময় অন্যকে নিয়েও তো থাকতে হয়। আজকের দিনটা যখন মাটি হয়েই গেছে, সকালটা যখন মান্নান মাওলানার সঙ্গে থেকেছে, এখন না হয় দবির গাছির সঙ্গে থাকল। একটা দিন না হয় এইসব কাজেই গেল। আল্লাহ হয়তো এরকমই ইশারা করছেন। আর একফাঁকে মনের ভিতর গাওয়ালটা অন্যভাবে করার একখানা মন্ত্র ঢুকিয়ে দিয়েছেন। ওই মন্ত্রের বলে মাটি হয়ে যাওয়া দিন সোনা হয়ে ফিরে আসবে আজিজের।

আজিজ গাওয়াল কাঁধের ভার নামাল।

ততক্ষণে দবির হামিদা দুইজনেই তাকে দেখতে পেয়েছে। দুইজনেই হাসিমুখে তাকিয়েছে তার দিকে।

দবির বলল, সঘাত কী গাওয়াল? আইজ দিহি নিজ গেরামে?

দবিরের গলার স্বর, কথা বলার ধরন আর মনের ভিতরকার আমুদে ভাব দেখে বেশ বড় রকমের একখানা ধাক্কা খেল আজিজ। এ কী করে সম্ভব! যার মেয়ে গ্রামের সবচাইতে ক্ষমতাবান মানুষের মুখে থুতু ছিটিয়ে দিয়েছে সে এমন আমুদে ভঙ্গিতে কথা বলে কী করে! এমন নির্বিকার ভঙ্গিতে বউর সঙ্গে নিজের উঠানে বসে থাকে কী করে! বসার ভঙ্গিতে মনে হচ্ছে আয়েশ করে রোদ পোহাচ্ছে। এমন হয় নাকি! এমন হয়!

হামিদার মুখও তো নির্বিকার। মুখ দেখে মনেই হচ্ছে না তার পেটের মেয়ে এমন কাজ করেছে। একমাত্র মেয়ের অন্যায় অপরাধের কথা জেনে কোন মা-বাবা পারে এমন নিশ্চিন্তে থাকতে! শক্তিটা কোথায় তাদের! কারা আছে দবিরের মতন মানুষের পাশে দাঁড়াবার! আর মান্নান মাওলানার বিরুদ্ধে দাঁড়াবার শক্তিই বা এই গ্রামে কাদের আছে!

যাদের আছে তারা কেউ সেভাবে গ্রামে থাকেন না। খানবাড়ির লোকজন। তারা কেউ মান্নান মাওলানা কিংবা গ্রামের লোকজনের কথা সেভাবে ভাবেন না। ভাবেন গ্রামে যারা যেভাবে আছে থাকুক। আমাদের কী! আমরা আমাদের মতো আছি, গ্রামের লোকজন তাদের মতো থাকুক।

এই অবস্থায় তা হলে কারা আছে দবির নূরজাহানের সঙ্গে, কোন শক্তিবলে এমন নির্বিকার হয়ে আছে নূরজাহানের মা-বাবা! নূরজাহানই বা কোথায়!

দুপুর ফুরিয়ে আসা রোদে তখন শিমুলের ঝরে যাওয়া ফুলের রং ধরেছে। শীতের হাওয়ায় খুব ভিতর থেকে লেগেছে তীব্র এক টান। মাটি গাছপালা আর মানুষের শরীরে জমে থাকা খেজুর রসের মতো রস গাছির ওপর ক্ষুণ্ণ হয়ে থাকা গাছ যেভাবে ভিতর দিকে শুষে নেয় ঠিক সেইভাবে শুষে নিচ্ছে চিরকালীন প্রকৃতি। এই টানে এখনই বুঝি ফেটে চৌচির হবে অনাদিকালের মাটি, ইরল চিরল দাগে জর্জরিত হবে গাছের বাকল আর পাতারা। মানুষের চামড়া হবে আরজিনার (গিরিগিটি) চামড়ার মতন। পিপাসায় কাতর হবে মানুষ। পানির অভাবে ছাতি ফাটবে।

আজিজ গাওয়ালেরও কি ছাতি ফাটার উপক্রম! গলা বুক শুকিয়ে আসছে কেন!

আজিজ সেঁক গিলল। তারপর রান্নাচালার দিকে তাকাল। দুইটা শালিক এখনও চরছে ওদিকপানে। হাওয়ার টানে ঘাড়ের রোয়া একদিকে ঝুঁকে আছে একটি পাখির। অন্যটা আছে হাওয়ার দিকে মুখ করে। ফলে ঘাড়ের রোয়া পিঠের উপর ঝুঁকেছে।

রান্নাচালার পিছন দিককার বাঁশবন আকুলি বিকুলি করছে উত্তরের হাওয়ায়। শনশন শব্দে মুখর হয়েছে বাঁশবন। বাঁশবনের মাথায় একটুখানি ঝুঁকে আছে নীলসাদা আকাশ। ঘুমাতে যাওয়ার আগে যেমন ফ্যাকাশে হয় কোনও কোনও মানুষের মুখ, আকাশ এখন তেমন। খানিক পরই যেন ঘুমিয়ে পড়বে আকাশ, ফুরিয়ে যাবে দিনের আলো। কুয়াশার জালে বন্দি হবে মানুষের দুনিয়া।

আজিজ গাওয়াল একবার আকাশের দিকে তাকাল। পলকের জন্যে তার মনে হল সাত আশমানের উপর বসে থাকা মহান আল্লাহপাকের কথা। কী ক্ষমতাবান তিনি। একই সঙ্গে দেখতে পান দুনিয়ার প্রতিটি মানুষ, মানুষের মনের ভিতর লুকিয়ে থাকা রহস্যময়তা তাঁর কাছে পানির মতন পরিষ্কার। একই সঙ্গে তিনি দেখতে পান মানুষের জন্ম এবং মৃত্যুকে, মানুষের অতীত বর্তমান এবং ভবিষ্যৎকে। মানুষের জীবন, জীবিকা, নিয়তি সব তাঁর আঙুলের ডগায়। অদৃশ্য এক সুতায় দুনিয়ার প্রতিটি মানুষকে বেঁধে রেখেছেন তিনি। যেমন ইচ্ছা তেমন করে খেলাচ্ছেন মানুষকে। হয়তো দবির গাছি আর তার বউকেও খেলাচ্ছেন। আর তাদের খেলার দর্শক করে দিয়েছেন আজিজ গাওয়ালকে। এই যে এতবড় একটা ঘটনা ঘটে গেছে গ্রামে, ঘটনা ঘটিয়েছে যে মেয়ে তার মা-বাবা এমন নির্বিকার হতে পারে। কেবল আল্লার ইশারায়ই।

আজিজ গাওয়াল চুপচাপ হয়ে আছে দেখে তার দিকে তাকাল দবির। হাসিমুখে বলল, কী অইলো গাওয়াল? কথা কও না ক্যা?

আকাশের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে দবিরের দিকে তাকাল আজিজ। কী কমু?

একখান কথা জিগাইলাম তার দিহি জব দিলা না? অনেকক্ষুন অইয়া গেল!

হামিদা বলল, হ। কথার জব না দিয়া আশমানের মিহি চাইয়া রইলেন। আশমানের মিহি চাইয়া কী জানি চিন্তা করছিলেন।

আজিজ হাসল। আপনে বোজলেন কেমতে?

আমি আপনেরে খ্যাল করছি। আপনে চাইয়া আছিলেন আশমানের মিহি আর আমি চাইয়া আছিলাম আপনের মিহি।

আজিজ আবার হাসল। তারপরই মুখটা ব্যাজার করল। আইজ আপনে আমার লগে এমুন পর পর ব্যাভার করতাছেন ক্যা মামানি আম্মা?

হামিদা একটু থতমত খেল। কীয়ের পর পর ব্যাভার?

এই যে আপনে আপনে করতাছেন আমারে?

দবির বলল, হ আমিও খ্যাল করলাম। আজিজরে তুমি আপনে আপনে করতাছো ক্যা? ছনুবুজির পোলা। ও তো আমার ম্যালা ছোড।

হামিদা বলল, ছোড বড়র কথা না। কথাডা অন্য। আজিজ মামারে আমি সব সময় আপনে কইরাঐ কই।

কও কী? আমি তো কোনওদিন হুনি নাই।

হোনছ। খ্যাল করো নাই।

আজিজ বলল, আমিও খ্যাল করি নাই। আমার য্যান মনে অয় আপনে আমারে সব সমায়ই তুমি কইরা কন। আর গাছি মামায় কয় তুই কইরা।

না, আপনে কইরা কই। আপনের লগে দেখাসাক্ষাৎ কম অয় তো, এর লেইগা মনে নাই আপনের।

দবির বলল, তয় আমি যে তুই কইরা কইতাম এইডা আমার মনে আছে।

আজিজ বলল, তয় আইজ তুমি কইরা কইতাছেন ক্যা?

কী জানি!

একটু থেমে, একটু ভেবে দবির বলল, আইজ তোমারে দেইখা কেমুন জানি অন্যরকম লাগতাছে গাওয়াল। মনে অইতাছে তুমি ছনুবুজির পোলা আজিজ না। তুমি য্যান অন্য মানুষ। ভিনগাওয়ের গাওয়াল। আমগো গেরামে আইছ গাওয়াল করতে।

আজিজ বলল, আপনেগ দুইজনেরও আমার জানি কেমুন অন্যরকম লাগতাছে আইজ। মনে অইতাছে আপনেরা আপনেরা না, আপনেরা য্যান অন্যমানুষ। নাইলে এইরকম একখান ঘটনা ঘইটা যাওনের পর কেমতে বাড়ির উডানে বইয়া রইছেন আপনেরা? কেমতে রইদ পোয়ান, কেমতে মাইনষের লগে কথা কন? কে আছে আপনেগো পিছে? কার সাহসে এতো সাহস আপনেগো?

আজিজের কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারল না দবির, কিছুই বুঝতে পারল না। হামিদা। দু’জনেই অবাক হয়ে তাকাল আজিজের মুখের দিকে।

দবির বলল, কী কচ তুই? কিছু তো বোজতাছি না।

হামিদা বলল, হ। কী ঘটনা ঘইট্টা গেছে? কীয়ের সাহস আমগো? কী কন আপনে?

একবার হামিদার মুখের দিকে আর একবার দবিরের মুখের দিকে তাকাল আজিজ। পট পট করে চোখে কয়েকটা পলক ফেলল। আমার কথা আপনেরা বোজেন নাই?

দবির বলল, না।

মামানি আম্মা, আপনেও বোজেন নাই?

হামিদা সরল গলায় বলল, না।

কন কী?

দবির বলল, তর লগে আমরা মিছা কথা কমুনি?

মিছা কথা না কইলেন, ফাইজলামি তো করতে পারেন!

তর লগে আমার ফাইজলামি চলে না। কোনওদিন করিও নাই। তর লগে আমার ফাইজলামির সমন্দ না। তর মা’রে আমি বুজি কইতাম। আপনা না অইলেও, রক্তের সমন্দ

অইলেও তুই আমার ভাইগ্না। ভাইগ্নার লগে ফাইজলামি করার লাহান মানুষ আমি না।

হ, আমিও তো আপনেরে অমুনঐ মনে করি। তয় এইডা তো আবার বিশ্বাসও অইতাছে না।

কোনডা?

নূরজাহানের কামড়া।

এবার উতলা হল হামিদা। নূরজাহানের কোন কামডা? কী করছে নূরজাহান?

আপনেরা জানেন না?

দবির হামিদা দুইজন একসঙ্গে বলল, না।

কন কী?

দবির বলল, হ। কী করছে নূরজাহান?

এবার ধপ করে মাটিতে বসে পড়ল আজিজ। হায় হায় করে উঠল। আমিও তো হেইডাঐ কই! এতবড় একখান কাম যেই বাড়ির অতড় (এতটুকু) মাইয়ায় করছে হেই বাড়ির মাইনষে, মাইয়ার মা-বাপে কেমতে এমুন চুপচাপ থাকে? অহন সেন্না বোজলাম ঘটনাড়া মা-বাপে জানে না।

আজিজ বসে পড়েছে আর কোন ফাঁকে যেন উঠে দাঁড়িয়েছে দবির হামিদা। গভীর দুশ্চিন্তা আর উত্তেজনায় যেন ভিতরে ভিতরে ফেটে পড়ছে দুইজনে। দুপুর ফুরিয়ে গেছে। খানিক পরই ঠুলইয়ে ছ্যান কাটাইল নিয়ে, কোমরে কাছি প্যাচিয়ে, ভারের দুইদিকে ছোট ছোট মাটির হাঁড়ি নিয়ে গাছ ঝুড়তে বেরুবে দবির। বেজায় খিদে পেয়েছে। দুপুরে ভাত খাওয়ার সময় পেরিয়ে গেছে অনেকক্ষণ আগে। মেয়ের জন্য অপেক্ষা করে করে খাওয়া হয়নি। এখন খেলে জিরাবার আর সময় পাওয়া যাবে না। ভারী পেট নিয়ে বেরুতে হবে কাজে। ফলে কাজ হবে ধীর, চলন হবে ধীর।

রসের দিনে এমন কখনও হয় না দবির গাছির। সকাল সকাল রসের কারবার সেরে বাজারহাটে যায় সে। বাড়ির নামায় ছোট্ট দুইখানা কোলা আছে। কলুই সরিষা, তিল কাউন আর আউশ ধানটা হয়। হাতে সময় থাকলে কোলা দুইটোর তদারকও করে কোনও কোনওদিন। তারপর দুপুরের মুখে মুখে নেয়ে ধুয়ে ভাতটা খায়। খাওয়াদাওয়ার পর খানিক তামাক টানে। চৌকিতে চিত হয়ে শুয়ে আধঘণ্টা একঘণ্টার ঘুম দেয় কখনও, কখনও বা বসেই কাটায় সময়। দুপুর ফুরিয়ে এলে যখন বাড়ি থেকে বেরোয় তখন আর কোনও ক্লান্তি নাই। যেন আজই প্রথম গাছ ঝুড়তে বেরুচ্ছে এমন আমোদ ফুর্তি ঘোরাঘুরি করে শরীরে। আজিজের কথা শুনে আজ সেইসব অনুভূতি কোথায় উধাও হয়েছে দবির গাছির। ক্ষুধা বলতে কিছুই যেন এখন আর নাই। বুকের ভিতর লুকিয়ে থাকা আত্মা যেন জায়গা ছেড়ে ঠেলে উঠেছে গলার কাছে। ফলে আত্মার শূন্যস্থানে একসঙ্গে বাজছে হাজারটা ঢাকের বাদ্য।

হামিদার অবস্থাও একই রকম। মুহূর্তে চোখের পলকে যেন মরে গেছে ক্ষুধা। চোখের পলকেই যেন ম্লান হয়েছে বাড়ির ঘর আঙিনা, গাছপালা। মাথার উপরকার আকাশ যেন অসময়ে নামাতে শুরু করেছে কুয়াশা। কুয়াশায় যেন আচ্ছন্ন হয়েছে উঠানে বসে থাকা আজিজ গাওয়ালের মুখ। মুখ যেন অস্পষ্ট তার, দেখা যায় না।

কী করেছে নূরজাহান? কোন সর্বনাশ ঘটিয়েছে? কেন এমন হায় হায় করছে আজিজ গাওয়াল?

তা হলে কি হামিদার কথাই ঠিক হল? এই যে আজই খানিক আগে মেয়ে নিয়ে দবিরকে বলেছিল, এই মাইয়া লইয়া কপালে শনি আছে তোমার। অহন শাসন না করলে একদিন হায় হায় কইরা কূল পাইবা না, কাইন্দা কূল পাইবা না। কপালে শনি কি তা হলে আজই ঘনিয়েছে তাদের। আজ কি সেই হায় হায় করার দিন! কেঁদে কূল না পাওয়ার দিন!

হামিদা কোনওরকমে আবার বলল, কী করছে নূরজাহান?

আজিজ বলল, মাওলানা সাবের মোকে ছ্যাপ ছিড়াইয়া দিছে।

চিৎকার করে উঠতে গিয়ে গলা চাপাল দবির। কচ কী?

হ। সড়কে। গেরামের বেবাক মাইনষের সামনে, দারগা পুলিশের সামনে।

হামিদা ছটফটা গলায় বলল, তারবাদে?

তারবাদে খেতের উপরে দিয়া দৌড় দিছে।

দৌড় দিয়া কই গেছে?

হেইডা কইতে পারি না। আমি তো মনে করছি বাইত্তে আইয়া পড়ছে। আপনেরা বেবাকতে জাইন্না গেছেন। জাইন্না গেরামের ময়মুরব্বি ধইরা, মাওলানা সাবের হাতে পায়ে ধইরা মাইয়ারে বাঁচাইছেন।

এবার গলা আর চাপিয়ে রাখতে পারল না দবির। চিৎকার করে বলল, না না।

ভয়ে উত্তেজনায় গলা ভেঙে গেল তার।

স্বামীর দিকে তাকিয়ে দিশেহারা গলায় হামিদা বলল, হায় হায় সব্বনাশ অইছে। মাইয়া তো বাইত্তে আহে নাই। মাইয়ারে তো মনে হয় আতাহাররা ধইরা লইয়া গেছে। এইডা কী অইল, হায় হায় এইডা কী অইল?

আর কোনওদিকে তাকাল না হামিদা। পাগলের মতন বাড়ির নামার দিকে দৌড় দিল। শাড়ির আঁচল চকের মাটিতে লুটাতে লাগল, খেয়াল করল না। যেন এখনই ছুটে গিয়ে মেয়ের সামনে না দাঁড়াতে পারলে নয়মাস দশদিন গর্ভের অন্ধকারে লুকিয়ে রাখা মেয়েটিকে সে রক্ষা করতে পারবে না। যেন তার ওইটুকু মেয়েকে ছিঁড়েখুঁড়ে খাবে আকাশ থেকে নেমে আসা শকুনের দল। যেন বহুকাল অনাহারে ছিল তারা, যেন বহুকাল পর খাদ্যের সন্ধান। পেয়েছে।

হামিদার ছুটে যাওয়া দেখল দবির তারপর নিজেও ছুটল তার পিছু পিছু।

দবিরের উঠানে আজিজ গাওয়াল তখন মাটির মতন নিথর হয়ে আছে।

.

কাঁথার উপর দিয়ে কতক্ষণ নূরজাহানকে বুকে জড়িয়ে রেখেছিল মরনি কে জানে। কোন তাড়নায় কাজটা সে করেছিল কে জানে। বাইরে কতটা গড়িয়ে যাচ্ছিল দুপুর মরনি টের পায়নি। তার শুধু মনে ছিল ভয়ে আতঙ্কে মরোমরো মেয়েটিকে বাঁচাতে হবে। ঘরের অন্ধকারে, কাঁথার তলায় লুকিয়ে বুকের তাপে বাঁচিয়ে তুলতে হবে। তারপর দেখা যাবে কোথায় কী ঘটে। সময় কিছুটা কেটে গেলে রাগক্রোধ কমে আসবে মাওলানা সাহেবের। গ্রামের দুই-চারজন ময়মুরব্বি নিয়ে মাওলানা সাহেবের বাড়ি গিয়ে তার পা জড়িয়ে ধরলেই হবে। পায়ের উপর কেঁদে পড়লে মানুষ মানুষকে মাফ না করে পারে না। দরকার হলে মরনিও যাবে মান্নান মাওলানার বাড়িতে। নূরজাহানের হয়ে, নূরজাহানের মা-বাবার হয়ে। সেও না হয় মাফ চাইবে মাওলানা সাহেবের কাছে। নিজের অপরাধী সন্তানের জন্য যেমন করে অনুনয় করবে নূরজাহানের মা-বাবা, মরনিও নাহয় তেমন করেই করবে। মান্নান। মাওলানার হাতে পায়ে ধরে সেও না হয় বলবে, পোলাপান মানুষ, কিছু না বুইজ্জা কামড়া কইরালাইছে। অরে আপনে মাপ কইরা দেন। অর কোনও ক্ষতি আপনে কইরেন না। আপনের পোলা আতাহাররে কইয়া দেন হেয়ও য্যান অরে মাপ কইরা দেয়, হেয়ও য্যান অর কোনও ক্ষতি না করে। যতদিন বাইচ্চা থাকবো এমুন কাম নূরজাহান আর কুনোদিন। করবো না।

বাইরের গড়িয়ে যাওয়া দুপুরের নির্জনতায় তখন ঝিমধরা ভাব। গয়াগাছের ওদিক থেকে ভেসে আসছিল ক্লান্ত এক কাকের ডাক। থেকে থেকে ডাকছিল কাকটা। সেই ডাকের মাঝখানেই যেন নিজের মধ্যে ফিরে এল মরনি। কাঁথার তলায় লুকিয়ে থাকা নূরজাহান তখন কেমন স্থির হয়েছে। শরীরের কাপনটা নাই। ভয়ে আতঙ্কে ফেলা শ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ বদলে গেছে। এখন শব্দটা কেমন ধীর, গম্ভীর। গভীর ঘুমে ডুবে যাওয়া মানুষের শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দের মতন।

কাঁথার আড়ালে লুকিয়ে থাকা নূরজাহানের শরীর থেকে আলগা হল মরনি। দুহহাতে জড়িয়ে রাখা নূরজাহানকে ছেড়ে দিল। কিন্তু নূরজাহানের কোনও সাড়া নাই। একেবারেই নিথর হয়ে আছে, নিঃসাড় হয়ে আছে।

হঠাৎ এমন বদলে গেল কী করে নূরজাহান! কেমন করে সামলাল নিজেকে! এরকম কাজ করার পর এইটুকু মেয়ে কী করে এত সহজে পারল নিজেকে সামলাতে! নাকি মরনির কারণে হল এমন! ঘরের অন্ধকারে লুকিয়ে, কাঁথার তলায় লুকিয়ে, বুকের ওমে আশ্রয় দিয়ে মরনি কি বাঁচিয়ে তুলতে পারল মেয়েটিকে!

চট করে একবার মুরগির ছাওটার কথা মনে পড়ল মরনির। বুকের ক্ষতে হলুদ বাটা আর চুন মিশিয়ে, পলোর ঘেরে আটকে কিছুক্ষণ পর পর যেমন করে দেখছিল ছাওটাকে, কতটুকু সেরে উঠল ছাওটা বোঝার চেষ্টা করছিল, নূরজাহানের ব্যাপারটাও তেমন করে বুঝতে চাইল সে। নূরজাহানের শরীর থেকে আলগা হয়ে আস্তে করে তার মুখ থেকে কাঁথাটা সরাল মরনি। সরিয়ে অবাক হল। কখন, কোন ফাঁকে যেন ঘুমে একেবারে তলিয়ে গেছে নূরজাহান। চোখ মুখ দুশ্চিন্তাহীন। যেন মায়ের বুকে পরম নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে অবোলা শিশু।

নূরজাহানের এই মুখ দেখে বুক তোলপাড় করে উঠল মরনির। নূরজাহানের মুখে সব শোনার পর যা হয়নি এখন তাই হল। চোখ পানিতে ভরে এল। মরনির শুধু মনে হল বাড়ির আঙিনা থেকে, মায়ের বুক থেকে মুরগির ছাওটাকে যেমন থাবা মেরে নিয়ে গিয়েছিল। দাঁড়কাক তেমন করে যদি মান্নান মাওলানা কিংবা আতাহার থাবা মেরে নেয় নূরজাহানকে, তাদের মুখ থেকে নূরজাহানকে কোনও না কোনওভাবে যদি ফিরিয়ে আনা যায়, তারপরও নূরজাহানের এই নির্মল মুখ আর নির্মল থাকবে না। এই নির্মল শরীর আর নির্মল থাকবে না। মানুষের সঙ্গে দাঁড়কাক আর মুরগির অনেক ব্যবধান। যে ধরে সে যদি পুরুষ হয়, যাকে ধরে সে যদি হয় নারী তা হলে নারীর যে ক্ষতিটা হয়, যে ক্ষত হয় তার শরীরে, দুনিয়ার কোনও অষুদে সেই ক্ষত সারানো যায় না। সেই ক্ষতের চিহ্ন জীবনভর ফুটে থাকে চেহারায়। হাজার চিকিৎসায়ও তা সারে না। এইটুকু মেয়ের ওপর আল্লাহতালায় কেন চাপিয়ে দিলেন এরকম এক আতঙ্কের বোঝা! কেন তাকে দিয়ে করালেন এমন এক কাজ! আল্লাহর ইশারা ছাড়া কি মানুষ কিছু করে!

তারপর আল্লাহর কথা ভেবেই যেন উঠে দাঁড়াল মরনি। নূরজাহানকে দিয়ে ওই কাজ করিয়ে মরনির কাছে আল্লাহই নিশ্চয় পাঠিয়েছেন নূরজাহানকে। মানুষের বিপদে মানুষ কতটা তার পাশে দাঁড়ায় সাত আসমানের উপর বসে এরকম পরীক্ষায় মাঝে মাঝে মানুষকে ফেলেন আল্লাহতালায়। নূরজাহানকে দিয়ে মরনিকেও হয়তো সেরকম এক পরীক্ষায়ই। ফেলেছেন। নয়তো গ্রামে এত মানুষজন থাকতে, এত বাড়িঘর থাকতে নূরজাহান কেন হালদার বাড়িতেই এল! নরু হালদারের অংশে, মরনির কাছেই সে এল কেন! আল্লাহ। নিশ্চয় দেখতে চাইছেন নূরজাহানের বিপদে কেমন করে তার পাশে দাঁড়ায় মরনি, কেমন করে রক্ষা করতে চায় নূরজাহানকে।

চৌকি থেকে নেমে পাটাতনের ওপর খানিক স্থির হয়ে দাঁড়াল মরনি। কাঁথার তলায় ঘুমিয়ে থাকা নূরজাহানের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল, তুই ঘুমা মা, তুই নিশ্চিন্তে ঘুমা। আমি আছি তর লেইগা। আল্লায় তরে বাঁচাইবো।

ঘরের কোণে রাখা কাঠের পুরানা সিন্দুকের ওপর থেকে লোহার ভারী তালাটা নিয়েছে। মরনি, তালার পেটে গেঁথে রাখা চাবিটা নিয়েছে। নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়েছে। দরজার বাইরে যে শিকল আছে সেটা আছে দরজার নীচের দিকে। শিকল লাগাবার যে আংটা সেটা আছে চৌকাঠের সঙ্গে। তালাটা সেখানে লাগাতে যাবে মরনি, সংসারের কথা মনে পড়ল। কিছুই করা হয়নি আজ। অথচ সকালবেলাই দুপুরের রান্নার ভাবনাটা ভেবে রেখেছিল মরনি। সেচিশাক আর টাকিমাছ। সেইমতো কি এখন আর কাজ করা যাবে!

দুপুর হেলে গেছে। এখন কোন ফাঁকে সেচিশাক তুলতে যাবে মরনি, কোন ফাঁকে ঘরের ভিতরকার ঘোপা থেকে টাকিমাছ তুলে নিবে! কোন ফাঁকে মাছ কুটবে, কোন ফাঁকে ধোয়া পালা শেষ করে তরকারি রাধবে! চুলা তো একখানা। ভাতটাই বা রাঁধবে কখন! আর গোসল!

চিন্তাভাবনায় প্যাঁচ লেগে গেল মরনির।

কিন্তু রান্না তো কিছু করতেই হবে! পেট তো কোনও কথা শুনবে না। ক্ষুধা লাগবেই। তা ছাড়া নূরজাহানের ঘুমও তো একসময় ভাঙবে। ক্ষুধা তারও লাগবে। মরনির আশ্রয়ে যখন আছে, মরনি নিজে খেলে নূরজাহানকেও খাওয়াতে হবে। অবশ্য একজন আর দুইজন মানুষের রান্নার মধ্যে তেমন ব্যবধান কিছু নাই। নিজের ভাত তরকারির পরিমাণ সামান্য বাড়ালে নূরজাহানের খাবারটাও হয়ে যাবে। একই পরিশ্রমে দুইজনের খাবার।

কিন্তু খেতে কি নূরজাহান চাইবে?

না চাইলেও খাওয়াতে হবে। জোর করে হলেও খাওয়াতে হবে। স্বাভাবিক করে তুলতে হবে মেয়েটিকে। পরে দেখা যাবে কী হয়।

তারপরই ভাত তরকারি রান্নার ইচ্ছাটা বাদ দিয়েছে মরনি। তারচেয়ে খিচুড়ি আর নয়তো বউয়া রানলে কেমুন অয়! ঘরে ঢেঁকিছাটা আলাচাউল (আতপ চাল) আছে। জামির চাল। একটু লালচে ধরনের। খিচুড়ি বউয়া যাই রান্না হোক, খেতে খুব স্বাদ হবে। কিন্তু খিচুড়ি রাঁধতে গেলে সময় একটু বেশি লাগবে। জামিরের আলাচাউল তাড়াতাড়িই ফুটে যাবে, ডাল ফুটতে দেরি করবে। বহুদিন ধরে শিকায় তোলা পটে পড়ে আছে। পুরানা মুশারি ডাল ফুটতে সময় লাগে। তারচেয়ে বউয়া রাধা ভাল। সময় লাগবে না। চাউলটা ধুয়ে কয়েক ফোঁটা তেল, কয়েক চাকলা পিয়াজ আর দুই-তিনটা শুকনা মরিচ দিয়ে একবারে চুলায় তুলে দিলেই হল। পানির পরিমাণটা কাঁটায় কাঁটায় দিতে পারলে, সরার ঢাকনার তলায় অতি স্বাদের বউয়া হয়ে যাবে। চুলা থেকে নামাবার আগে কিছু সময় সরার ঢাকনা তুলে রাখলে পানিটা টানবে তাড়াতাড়ি।

এসব ভেবে টিনের জের (বড় পট) থেকে আধসের খানেক আলাচাউল বের করল মরনি। আঁচলে সেই চাউল নিয়ে, তেলের ছোট্ট শিশি আর দুই-তিনখান পিঁয়াজ, দুই তিনখান শুকনা মরিচ নিয়ে ঘর থেকে বেরুল। বেরিয়ে তালা লাগিয়ে দিল দরজায়। এখন বাইরে থেকে দেখে কারও বোঝার উপায় নাই ঘরে কোনও মানুষ আছে। ঘরে মানুষ রেখে বাইরে থেকে কেউ তালা দেয় না।

কিন্তু তালা দেওয়ার কথাটা মরনির মনে হয়েছে কেন!

দ্রুত হাতে চুলায় বউয়া বসাবার পর এই কথাটা মরনির মনে হয়েছে। চাবিটা আছে। আঁচলে বাঁধা। একহাতে চাবিটা একবার ছুঁয়ে দেখল সে। সারাগ্রাম তন্নতন্ন করে খুঁজে নূরজাহানকে যখন কোথাও পাবে না আতাহাররা তখন হয়তো হালদার বাড়িতেও আসবে। অন্য শরিকদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করে হয়তো এই সীমানায় আসবে। মরনিকে জিজ্ঞাসা করবে নূরজাহানের কথা। এই বাড়িতে যখন তখন আসে নূরজাহান একথা গ্রামের অনেকেই জানে। আতাহাররাও নিশ্চয় জানে। যদি এসে তারা পড়েই ভাবখানা মরনি। এমন করবে যেন বহুদিন এই বাড়িতে আসে না নূরজাহান, যেন বহুদিন নূরজাহানকে মরনি দেখেনি। যেন মান্নান মাওলানার সঙ্গে কী করেছে নূরজাহান তাও সে শোনেনি, জানে না। তারপরও আতাহারদের বিশ্বাস অর্জনের জন্য তালাবদ্ধ ঘরটা না হয় দেখিয়ে দিবে।

কিন্তু মরনির কথা যদি আতাহাররা বিশ্বাস না করে! যদি তালা খুলতে বলে মরনিকে! যদি তার সামনে থেকে ধরে নিয়ে যায় নূরজাহানকে তা হলে নূরজাহানকে সে কেমন করে রক্ষা করবে!

এসব ভেবে বুক হিম হয়ে এল মরনির। চুলার হাঁড়িতে তখন টগবগ টগবগ করে ফুটছে বউয়া। উতরে উঠে সরার ঢাকনা ঠেলছে। শোঁ শোঁ শোঁ শোঁ করে শব্দ হচ্ছে। এই শব্দ কানে যায় না মরনির। একহাতে আঁচলে বাঁধা চাবিটা মুঠা করে ধরে মনে মনে আল্লাহকে ডাকে সে। ইয়া হে আল্লাহ, তোমার রহমতের দরজা নূরজাহানের লেইগা খুইল্লা দেও। অরে তুমি বালা মসিবত থিকা রক্ষা করো। অরে তুমি জালিমের হাত থিকা রক্ষা করো।

.

চারদিক থেকে মার খাওয়া নিরীহ কুত্তা বিলাইয়ের মতন দিশাহারা ভঙ্গিতে ছুটতে ছুটতে নিজের অজান্তেই যেন মান্নান মাওলানার বাড়ির সামনে চলে এল হামিদা। তার পিছু পিছু ছুটছিল দবির, সেও এল। বাড়ির সামনে এসে আচমকাই থমকে দাঁড়াল দুইজন। উত্তরের হাওয়ার বেগে ছুটে আসার ফলে বুকের ভিতর দুইজনেরই জমেছিল অপরিসীম ক্লান্তি। থমকে দাঁড়াবার পরও যেন সেই ক্লান্তি টের পেল না তারা। তবে হাঁ করে শ্বাস টানতে লাগল। কামারবাড়ির হাপরের মতন ওঠানামা করতে লাগল বুক। শরীর ফেটে বেরুতে লাগল চইত বইশাখের খরতাপ। দুইজন মানুষ একসঙ্গে তাকাল মাওলানা সাহেবের বারবাড়ির সামনে নিথর হয়ে থাকা নাড়ার পালার দিকে। কিন্তু নাড়ার পালাটা যেন তারা দেখতে পেল না, তাদের চোখে পড়ল পালা ফুটা করে আকাশের দিকে উঠে যাওয়া বাঁশের মাথায় ঘোর কালো বর্ণের যে হাঁড়ি বসানো সেই হাঁড়ির দিকে। এই হাঁড়ি হাঁড়ি না, কাকতাড়ুয়া। খড়িমাটি দিয়ে বিশাল দুইখানা চোখ আঁকা হয়েছে হাঁড়ির পেট বরাবর। সেই চোখ এখন যেন একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে হামিদা আর দবির গাছির দিকে। যেন মান্নান মাওলানার হয়ে নূরজাহানের অন্যায়ের জন্য বকাবাজি করছে তার মা-বাবাকে।

কাকতাড়ুয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে বুকের কাঁপন আরও বাড়ল হামিদার। ক্লান্তি ভয় মিলেমিশে বুকের ভেতর ডুগডুগ, ডুগডুগ শব্দ হতে লাগল। যেন পহেলা বৈশাখে কালীরখিলের গলুইয়া (মেলা) থেকে ডুগডুগি কিনেছে দুরন্ত নূরজাহান। হামিদার বুকের কাছে দাঁড়িয়ে অক্লান্ত হাতে বাজাচ্ছে। মেয়ের হাতে বাজানো ডুগডুগির শব্দ হাড় পাজরা ভেঙে বুকের ভিতর ঢুকে আঁট করে যেন বসেছে হামিদার। এখন শুধুই বাজছে, বাজছে।

নিজের বুকের ভিতরকার শব্দে আচ্ছন্ন হয়ে গেল হামিদা। ধুলায় লুটাচ্ছিল শাড়ির আঁচল, ভয়ার্ত ভঙ্গিতে আঁচল বুকে তুলল সে। মাথায় ঘোমটা দিল, তারপর স্বামীর দিকে তাকাল।

শীতের হাত থেকে বাঁচবার আশায় ছেঁড়াফাড়া মোটা গেঞ্জিখান পরেছিল দবির। উঠানের রোদে জবুথুবু হয়ে বসেছিল, তবু যেন উষ্ণ হচ্ছিল না শরীর, তবু যেন ছেড়ে যাচ্ছিল না শীত। আর এখন দবিরের দুইপাশের কান ছোঁয়া তেলতেলে জুলপির ফাঁক দিয়ে নেমেছে ঘামস্রোত, নাকের তলায় আর ঘাড়ে গলায় বিজবিজা ঘাম। বুকের কাছে, পিঠের কাছে ভিজে উঠেছে মোটা গেঞ্জি। এ কি হাওয়ার বেগে ছুটে আসার ফল, নাকি মেয়ের অপরাধের কথা ভেবে, ভয়ংকর পরিণতির কথা ভেবে নাড়ার আগুনের চেয়েও ভয়াবহ কোনও তাপ উত্তাপ শরীর ভেঙে বেরুচ্ছে তার!

হামিদাকে তার দিকে তাকাতে দেখে ভাঙাচোরা গলায় দবির বলল, এহেনে আইলা ক্যা?

হাঁ করে শ্বাস টানছে বলে গলা শুকিয়ে চৈত্রদিনের মাঠের মতন হয়ে গেছে হামিদার। স্বামীর কথা শুনে সেঁক গিলল সে। তারপর কোনওরকমে বলল, তয় কই যামু?

নূরজাহানরে বিচড়াইতে যাইবা না?

বিচড়াইতেঐত্তো আইছি।

দবির বুঝল তারচেয়ে অনেক বেশি দিশাহারা হয়েছে হামিদা। মাথার ঠিক নাই। এজন্য এলোমেলো কথা বলছে। পলকের জন্য নূরজাহানের কথা ভুলে গেল সে। হামিদার জন্য আশ্চর্য এক মমতায় বুক ভরে গেল। মেয়ের ভয়াবহ বিপদে মেয়ের মায়ের জন্য এরকম মমতা দবিরের কোত্থেকে এল! কেন এল! চোখ বা কেন ছলছল করে উঠল তার!

হাত বাড়িয়ে হামিদার একটা হাত ধরল দবির। চোখের পানি সামলাবার জন্য অন্যদিকে তাকিয়ে বলল, এহেনে বিচড়াইয়া লাভ নাই। এহেনে ও আহে নাই। গাওয়ালে কইলো…

দবিরের কথা শেষ হওয়ার আগেই ঝটকা মেরে তার হাত ছাড়িয়ে দিল হামিদা। মাজায় বাড়ি খাওয়া জাতসাপের মতন তেড়ে উঠল। তোমার লেইগাই এমুন অইছে। লাই দিতে দিতে মাইয়াডারে তুমি মাথায় উঠাইলাইছো। আমার কথা তুমি হোন নাই। আমি তোমারে কত কইছি এই মাইয়ার লেইগা কপালে অলক্কি (অলক্ষ্মী, বিপদ অর্থে) আছে। আইজ হেই অলক্কিতে ধরছে। আমি অহন মাওলানা সাবরে গিয়া কমু আমার মাইয়ার কোনও দোষ নাই, দোষ এই বেডার। এই বেডায় নষ্ট করছে মাইয়াডারে। এই বেডারে আপনে। পিডান। পিডাইয়া সোজা করেন।

প্রথমে চাপা গলায় শুরু করেছিল হামিদা, কথা বলতে বলতে কখন যে গলা খুলে গেছে তার, টের পায়নি। শেষদিকে মনে হচ্ছিল হামিদা যেন চিৎকার করছে। মান্নান মাওলানার বাড়ি থেকে তো বটেই, তার বাড়ির পিছন দিককার শরিকরা, তারও পিছন দিককার মুকসেইদ্দা চোরার (মুকসেদ চোর) বাড়ি থেকে, দক্ষিণ দিককার ওহাবদের বাড়ি থেকে, দক্ষিণ-পশ্চিম কোণের হুমাদের বাড়ি থেকেও লোকে হামিদার গলা শুনছে।

এই গলা শুনে ব্যতিব্যস্ত হল দবির গাছি। কান্না কাতর অসহায় গলায় বলল, কও কী তুমি? আ, কও কী?

আগের মতনই রূঢ় গলায় হামিদা বলল, ঠিকঐ কই। একদোম ঠিক কথা কই। তোমার লেইগাই আমার মাইয়ার আইজ এই দশা। আমার মাইয়ারে এমুন বানকাউর (বাঁদর অর্থে) বানাইছো তুমি। তুমি অরে আমার হাতে ছাইড়া দেও নাই। আমার লাহান কইরা আমি অরে ডাঙ্গর করতে পারি নাই। আমি অরে শাসন করতে চাইছি, পাড়া বেড়াইতে দিতে চাই নাই, রান্নঘরের খুডির লগে বাইন্দা থুইছি, তুমি আইয়া আহ্লাদ কইরা হেই মাইয়ারে ছাইড়া দিছো। আমার কথা তুমি হোন নাই। আইজ মাইয়ায় যা করছে হেই দোষ আমার মাইয়ার না, দোষ তোমার। তোমার দোষের শাস্তি যুদি আমার মাইয়ায় পায়, যুদি আমার মাইয়ার কোনও ক্ষতি অয়, মাওলানা সাবে আর তার পোলায় যুদি আমার মাইয়ার কোনও ক্ষতি করে, তয় কেঐরে কিছু কমু না আমি। আমি ধরুম তোমারে। যেই ছ্যান দিয়া তুমি খাজুরগাছ ঝোরো, হেই ছ্যান দিয়া তোমার কল্লা আমি কাড়ম। তোমার রক্ত আমি রসের লাহান বাইর করুম।

হামিদার কথা শুনতে শুনতে আবার নূরজাহানের কথা ভুলে গেল দবির। হামিদার চেহারা দেখতে দেখতে চোখ থেকে তার মুছে গেল চারপাশের অন্যসব দৃশ্য। এ কী চেহারা হয়েছে হামিদার! এতকালের পুরানা নিরীহ মানুষটার এরকম চেহারা তো কোনওদিন দেখেনি দবির! এমন গলাও শোনেনি কখনও। কিছুক্ষণ আগেও যে মানুষটা বাড়ির উঠানে স্বামীর পাশে বসে মেয়ের জন্য অপেক্ষা করছিল সে আর এ কি একই মানুষ! সামান্য সময়ের ব্যবধানে এমন করে বদলে যেতে পারে মানুষ! এমন ভয়ংকর রূপ ধরতে পারে! মেয়ের কথা ভেবে কি বদ্ধ পাগল হয়ে গেল হামিদা! স্বামীর গলা কেটে ফেলতে চাইছে মেয়ের জন্য!

হতভম্ব হয়ে হামিদার মুখের দিকে খানিক তাকিয়ে রইল দবির তারপর দুইহাতে হামিদার একটা হাত ধরতে চাইল। খাজুরের শুকনা পাতা খসে পড়ার মতন অসহায় ভঙ্গিতে বলল, এমুন বিপদের সমায় তুমি আমার লগে কাইজ্জা করতাছো? মাইয়াডা কই গেছে গা হেইডা তুমি চিন্তা করতাছো না? মাওলানা সাবের বাড়ির সামনে আইয়া এমুন করতাছো? কাইজ্জা করতে অয় আমার লগে তুমি পরে করো। অহন লও মাইয়াডারে বিচড়াই, মাওলানা সাবের গিয়া হাতে পায়ে ধরি। আগে মাইয়াডারে বাঁচাই, তারবাদে যত ইচ্ছা কাইজ্জা তুমি আমার লগে কইরো। ফুলই থিকা ছ্যান আমি নিজের হাতে তোমারে বাইর কইরা দিমু। আমার কল্লা তুমি কাইট্টালাইয়ো।

শেষ কথাটা বলতে বলতে গলা একেবারেই ভেঙে গেল দবির গাছির। কেঁদে ফেলল সে।

স্বামীর অসহায়ত্ব দেখেই কি না, না কি তার কথা শুনে, হামিদা যেন নিজের মধ্যে ফিরে এল। ফ্যালফ্যাল করে স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

মান্নান মাওলানার বাড়িটি তখন বারবাড়ির সামনের নাড়ার পালার মতন স্তব্ধ হয়ে আছে।

বাড়ির কোথাও কোনও শব্দ ছিল না। আথালের গাই গোরুগুলি ভোরবেলাই চরতে গেছে। বিলে। মাকুন্দা কাশেমের জায়গায় নতুন গোমস্তা রাখা হয়েছে হাফিজদ্দিকে। গোরু নিয়ে সকালবেলাই বেরিয়ে গেছে সে। পশ্চিমের ভিটির ঘরটি বাংলাঘর। ঘরটা আতাহারের। ইয়ার দোস্তদের নিয়ে দিনরাত এই ঘরে আড্ডা দেয় সে। হাসি মশকরা করে। আতাহার বাড়িতে থাকলে সড়ক দিয়ে চলাচল করা পথিকরা বুঝতে পেরে যায় মাওলানা সাহেবের ছেলে বাড়িতেই আছে।

আজ এই সময় আতাহারের বাংলাঘর তাদের গোয়ালঘরের মতোই নিস্তব্ধ। আতাহার বাড়ি নাই।

ভিতর বাড়িতেও কারও ছায়া চোখে পড়ে না। এইঘর ওইঘর করে না বাড়ির বউঝিরা কেউ। বড়ঘর থেকে রান্নাঘরে যায় না, রান্নাঘর থেকে ফিরে আসে না বড়ঘরে।

বাড়ির লোক সব গেল কোথায়?

অনেকক্ষণ ধরে হামিদা কোনও কথা বলছে না দেখে তার দিকে মুখ তুলে তাকাল দবির। তাকিয়ে চমকে উঠল। অপলক চোখে তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে হামিদা, চোখের দৃষ্টি একেবারেই অচেনা। হামিদার এরকম দৃষ্টি আগে কখনও দেখেনি দবির। আর চোখের রং কেমন ঘোলাটে। পেকে সাদা হয়ে যাওয়া জামরুলের মতো।

এমন চোখ হয়েছে কেন হামিদার! মেয়ের বিপদের কথা ভেবে অন্যরকমের কোনও ক্ষতি হয়ে যায়নি তো তার! সত্যি সত্যি গন্ডগোল হয়ে যায়নি তো মাথায়! মাথার গন্ডগোলে চোখের দৃষ্টি নাকি বদলে যায় মানুষের!

মেয়ের কথা ভুলে মেয়ের মা’কে নিয়ে চিন্তিত হল দবির। কাতর ভঙ্গিতে আর্তনাদ করে উঠল। কী অইছে তোমার? এমুন কইরা চাইয়া রইছো ক্যা?

হামিদা কথা বলল না। চোখে পলক পড়ল না তার।

এবার দুইহাতে হামিদার দুইকাঁধ খামছে ধরল দবির। বেশ জোরে ঝাঁকুনি দিল। কথা কও না ক্যা? এক বিপদের মইধ্যে আরেক বিপদ বাজাইলা নি?

এবার এমন করে নড়ে উঠল হামিদা যেন পানির তলায় অনেকক্ষণ কেউ তাকে চুব দিয়ে রেখেছিল। দম মাত্র ফুরিয়েছে এমন সময় ছেড়ে দিয়েছে, লগে লগে পানির তলা। থেকে মাথা তুলেছে, বুক ভরে শ্বাস নিচ্ছে। অবিকল এই ভঙ্গিতেই দম নিল হামিদা। পানি থেকে ডুব দিয়ে ওঠা মানুষের মতো চোখ করে স্বামীর দিকে তাকাল। সঙ্গে সঙ্গে যেন নূরজাহানের কথাও মনে পড়ল তার। দিশাহারা গলায় হামিদা বলল, আমার মাইয়া কো?

হামিদাকে স্বাভাবিক হতে দেখে বুকে বল পেল দবির। তবু অস্থিরতা কমল না তার। বলল, আমি কেমতে কমু? মাইয়া বিচড়াইতে বাইরইয়া এহেনে আইলা তুমি। আমার লগে কাইজ্জা লাগাইয়া দিলা। লও মাইয়া বিচড়াই।

হামিদা শীতল গলায় বলল, অন্যহানে বিচড়াইয়া লাভ নাই। মনে লয় এই বাইত্তেই আছে মাইয়া।

পায়ে যেন ঘচ করে খেজুরকাঁটা বিঁধল দবির গাছির। কোনওরকমে বলল, কও কী? কেমতে বোজলা?

দেহ না বাড়িটা কেমুন নিটাল অইয়া রইছে?

তাতে কী অইছে?

মাইয়া এই বাইত্তে আছে দেইক্কাঐ বাড়িডা এমুন নিটাল। মাওলানা সাবরে ছ্যাপ ছিডাইয়া যেই মিহিঐ দৌড় দেউক নূরজাহান, আতাহাররা অরে ঠিক বিচড়াইয়া বাইর করছে, ঠিকঐ ধইরা লইয়াইছে এই বাইত্তে। তারবাদে মোকে গামছা বাইন্দা কোনও ঘরে তালা দিয়া রাখছে।

অমুন হইলে আতাহাররা বাইত্তে নাই ক্যা?

বাইত্তে থাকলে মাইনষে বুইজ্জা যাইবো দেইক্কা বাড়িত থন গেছে গা।

কথাগুলি এমন স্বাভাবিকভাবে বলছিল হামিদা যেন সত্যি সত্যি এমন হয়েছে। যেন। হামিদা সব জানে।

হামিদা যত স্বাভাবিকভাবে কথা বলছিল ততই অস্বাভাবিক হয়ে উঠছিল দবির। গলা চড়ে যাচ্ছিল তার। এমুন অইলে মাইয়া আমরা ছাড়ামু কেমতে?

আশ্চর্য রকম দৃঢ় গলায় হামিদা বলল, আমার মাইয়ারে কেঐ আটকাইয়া রাখতে পারবো না। তুমি আহো আমার লগে।

হামিদা তারপর কোনওদিকে না তাকিয়ে দৌড়ে উঠে যায় মান্নান মাওলানার বাড়িতে। তার পিছু পিছু ওঠে দবির।

কিন্তু এই নিঝুম হয়ে থাকা বাড়ির কোন ঘরে বন্দি হয়ে আছে নূরজাহান! মুখে গামছা গুঁজে, দুইহাত পিঠমোড়া করে বেঁধে কোন ঘরে নূরজাহানকে ফেলে রেখেছেন মান্নান। মাওলানা! বাইরে থেকে শিকল তোলা কিংবা তালামারা কোন ঘরের দরজা!

মান্নান মাওলানার উঠানে দাঁড়িয়ে এসব ভাবতে লাগল হামিদা। দিশাহারা চঞ্চল চোখে প্রতিটি ঘরের দরজার দিকে তাকাতে লাগল। তার দেখাদেখি দবিরও তাকাচ্ছিল।

বাড়ির কোনও ঘরেরই দরজায় শিকল তোলা নাই, তালা মারা নাই। পশ্চিম ভিটির বাংলাঘরের দরজা হাট করে খোলা, ভিতরে কেউ নাই। পুব আর উত্তরের ভিটির ঘরের দরজা আবজানো (ভিড়ানো)। পুবের ঘরটা নিঝুম। পুব-উত্তর কোণের মোতাহারের ঘরেরও একই অবস্থা। শুধু উত্তরের ঘরে নিচুগলায়, ফিসফিস করে কথা বলছে দুইজন মেয়েমানুষ। চারদিক নিঝুম হয়ে আছে বলেই যেন ওই ফিসফিসানি কানে এল হামিদার। সঙ্গে সঙ্গে কীরকম নড়েচড়ে উঠল সে। দবিরের মুখের দিকে তাকাল। উত্তরের ঘরের মানুষ দুইটার মতো ফিসফিসা গলায় বলল, হুনছো?

দবিরও স্ত্রীর মতোই ফিসফিস করল। হ।

কারা কথা কয়?

কেমতে কমু!

এই ঘরেঐ নাই তো নূরজাহান?

মনে অয় না।

ক্যা?

তুমি যে কইলা…

দবির কথা শেষ হওয়ার আগেই হামিদা বলল, আমি যেমুন কইছি হেমুন নাও অইতে পারে। অন্যরকমও অইতে পারে।

কেমুন?

খোলা ঘরেঐ নূরজাহানরে হালায় থুইছে মাওলানা সাবে। বাড়ির কামের বেডিগো বহাইয়া রাখছে অর সামনে। বেডিরা অরে পাহারা দিতাছে আর নিজেরা হাকিহুকি (ফিসফাস) করতাছে।

আমার মনে অয় না।

আমার অয়।

তোমার মনে অইলে তুমি গিয়া ঘরডা দেহে।

কেমতে দেহুম?

আমি এহেনে খাড়াইয়া চাইরমিহি চকু রাখি, তুমি গিয়া দুয়ারের ফাঁক দিয়া ভিতরে চাও (তাকাও)। টিনের বেড়ায় বিন (ছিদ্র। ফুটো) আছে। বিন দিয়া চাইলেও ঘরের ভিতরের বেবাক কিছু দেখতে পারবা।

কেঐ যুদি আমারে দেইক্কালায়?

দেখলে মিছাকথা কইবা।

কী কমু?

কইবা আতাহারের মারে বিচড়াইতাছো। তার কাছে তোমার কাম আছে।

হ। ঠিক কথা কইছো।

পা টিপে টিপে উত্তরের ভিটির দিকে এগিয়ে গেল হামিদা। কিন্তু কয়েক পা গিয়েই ফিরে এল। চিন্তিত গলায় বলল, নূরজাহানরে যুদি এই ঘরে দেহি তাইলে কী করুম?

এই ভাবনাটা দবিরের মাথায় আসেনি। সেও চিন্তিত হলো। কী করবা?

তুমি কও।

আমিও তো জানি না।

কয়েক মুহূর্ত থেমে থাকল হামিদা। তারপর বলল, মাইয়া যুদি এই ঘরে দেহি তাইলে কইলাম দিকপাশ চামু না আমি। ঘরে হাইন্দা যামু। মাইয়ার হাত পায়ের বান খুইলা, মোকের বান খুইলা মাইয়া লইয়া দৌড় দিমু। তারবাদে যা অওনের অইবো।

দবির কোনও কথা বলল না। চিন্তিত চোখে হামিদার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

হামিদা আর কোনওদিকে তাকাল না। পা টিপে টিপে উত্তরের ঘরের আবজানো দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। দাঁড়িয়ে দরজার ফাঁক দিয়ে ভিতরে তাকাল।

ঘরের একপাশে বিশাল চৌকি আরেক পাশে মাঝারি মাপের ডোল (ধানের গোলা)। চৌকিতে হোগলা পাতা। মাথার কাছে তেল চিটচিটা দুইটা বালিশ, সবুজ রঙের ছোঁড়াখোঁড়া একখানা কথা ভাজ করে রাখা। আর কিছু নাই।

ডোলের পাশে দুইখানা আগোল (ধামা) আর একখানা বড় কুলা পড়ে আছে। একপাশে বেড়ার সঙ্গে থাক থাক করে ফেলা তিনখানা ভরা বস্তা। বস্তাগুলি ধানের। এই বস্তার গায়ে ঢেলান (হেলান) দিয়ে বসে আছে বাড়ির পুরানা ঝি রহিমা। তার কোলের কাছে বসে আছে বড়ভাইয়ের মেয়ে হাসু। পিছন থেকে ভাঙা কালো রঙের কাকুই দিয়ে অতিযত্নে ভাইঝির মাথা আঁচড়ে দিচ্ছে রহিমা। মাথা আঁচড়ানোর আরামে চোখ বুজে আছে হাসু কিন্তু ফুফু যে কথা বলছে ফিসফিস করে সেসব কথার জবাব দিয়ে যাচ্ছে। চোখ বন্ধ রেখে নিজেও বলছে কোনও কোনও কথা। তখন ভাইঝির কথার জবাব দিচ্ছে রহিমা। ভাইঝির কথার পিঠে কথা বলছে।

বাইশ-তেইশ বছর বয়স হবে হাসুর। আট বছর বয়সে মা মারা গেল। বউ মরতে না মরতেই বাপ কানা দলিল আবার বিয়া করে ফেলল। আগের ঘরে বাচ্চাকাচ্চা বলতে এই এক মেয়ে, হাসু। কিন্তু পরের ঘরে তিন-চার বছরের মাথায় তিনটা হৃষ্টপুষ্ট বাচ্চাকাচ্চা পয়দা করে ফেলল কানা দলিল। সংসারে বেশি বাচ্চাকাচ্চা থাকলে কোনওটার দিকেই তেমন নজর থাকে না। তার ওপর হাসু হচ্ছে মা-মরা মেয়ে। কথায় আছে মা মরলে বাপ হয় তালুই। কানা দলিলও আর হাসুর বাপ রইল না, তালুই হয়ে গেল। হাসুর দিকে ফিরেও তাকায় না। দ্বিতীয় পক্ষের বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। আর স্বামীর এই ভাব দেখে বউটাও যায় লাই পেয়ে। সজ্ঞায়ের আসল রূপ ধরতে সময় লাগে না তার। ফলে কানা দলিলের সংসারে টিকে থাকা আর সম্ভব হচ্ছিল না হাসুর। একওক্ত ভাত খায়। তো আরেক ওক্ত গঞ্জনা, মারধর। এই অবস্থায় রহিমা তাকে নিয়ে এল নিজের কাছে। কিন্তু মান্নান মাওলানার বাড়িতে তাকে রাখল না। কাজে লাগিয়ে দিল মৌছামান্দ্রার এক বাড়িতে। কিন্তু কিছুদিন ধরে সেই বাড়িতে টিকতে পারছে না হাসু। মাস দুইমাস পর পরই ফুফুর কাছে চলে আসছে। কারণ জিজ্ঞাসা করলে একটা কথাই বলে, বাড়ির বেডারা আমারে বহুত জ্বালায়।

কী ধরনের জ্বালানো হাজার বার জিজ্ঞাসা করলেও সেই কথা বলে না। বেশি জোরাজোরি করলে শুধু কাঁদে আর বলে, ফুফু, আমারে তুমি তোমার কাছে লইয়াহো। আমি এই বাইত্তে থাকুম, তোমার কাছে থাকুম। দরকার অইলে একওক্ত খামু, দরকার অইলে না খাইয়া থাকুম, তাও তুমি আমারে তোমার কাছে থাকতে দেও। আর নাইলে আমার বাপরে খবর। দেও। যেমতে পার আমার বিয়া দিয়া দেও। এই জীবন আমার আর ভাল্লাগে না।

হাসুর বিয়ার চেষ্টা যে দুই-চার বার না হয়েছে তা নাই। ষোলো-সতেরো বছর বয়স থেকেই চেষ্টা রহিমা করছিল। দুই-চারবার কানা দলিলের সঙ্গেও কথা বলেছে। সে তেমন আগ্রহ দেখায়নি। হাসু নামে তার নিজের ঔরসের যে একটি মেয়ে আছে, দূর গ্রামে ঝিয়ের। কাজ করে যে মেয়ে, দুই-চার বছরে একবার বাপের সংসারে এলে যে মেয়ের দিকে ফিরেও তাকায় না দলিল সে কি আর মেয়ের বিয়ের কথা ভাববে? ফলে একার চেষ্টায় রহিমা বেশিদূর আগাতে পারেনি। দিনের মতো দিন কেটে যাচ্ছে। হাসুর কোনও গতি হচ্ছে না। দিনে দিনে চেহারা ভাঙতে শুরু করছে তার।

দেখতে একসময় মন্দ ছিল না হাসু। মাঝারি ধরনের গড়ন। মুখোন চলনসই ধাচের, গায়ের রং মাজা মাজা। সব মিলে খারাপ লাগত না দেখতে। কিন্তু এখন আর সেই অবস্থা নাই। যৌবন আসতে না আসতেই যেন তাতে ভাটা পড়ে গেছে। চোখের কোলে কাজলের মতো কালি, মুখ প্রচণ্ড খরায় গিরস্তবাড়ির খড়ের চালায় শুকিয়ে যাওয়া চালকুমড়ার মতন, শরীরে নদীতীরের ভাঙন।

মাথার চুল একসময় ঘনই ছিল হাসুর। পিঠ ছাপানো ছিল। আজ আর সেই চুল নাই। নাড়া সাফ করা ধানি জমির মতন চোয়া হয়ে গেছে। ঘাড়ের তলায় পড়ে থাকা হাসুর চুল এখন বাচ্চা ঘোড়ার লেজের মতন। ভাল করে তেলপানি দিলেও চুলের দশা ফিরে না।

বুক হাসুর এখন আর মেয়েমানুষের বুক না। যৌবনবতী মেয়েমানুষের বুক তো নাই। কী যেন কী কারণে হাসুর বুক এখন জোয়ানমর্দ পুরুষমানুষের বুকের মতন। পেটের তুলনায় সামান্য উঁচু। হাসু যে মেয়েমানুষ, শাড়ি না পরলে তা মনেই হবে না। এমনকী গলার স্বরও আগের তুলনায় বদলে গেছে। মেয়েমানুষের স্বর নাই। আড়াল থেকে শুনলে মনে হবে পুরুষমানুষ কথা বলছে। যদিও এখন সে কথা বলছে ফিসফিস করে, ফলে গলার আসল স্বর একেবারেই বোঝা যাচ্ছে না।

কিন্তু এই ঘরে নূরজাহান নাই!

ফিরে এসে উদ্বিগ্ন গলায় দবিরকে কথাটা বলল হামিদা। শুনে চোখমুখ যেন আরও ফ্যাকাশে হয়ে গেল দবিরের। তয় তুমি যে কইলা!

এবার আগের মতন রেগে উঠল না হামিদা। কইছি আন্তাজে। ঘরে নূরজাহান নাই। রহিমা আর একটা ছেমড়ি।

আমার মনে অয় আন্তাজ তোমার ঠিক না। এই বাইত্তে নূরজাহান নাই।

থাকতেও পারে। ঘর তো বাইত্তে একখান না।

যেই কয়খান ঘর তার দুইখান তো দেখলামঐ।

দুইখান কো? দেখলাম তো একখান।

বাংলাঘরডা দেখতাছো না?

হামিদা বিহ্বল চোখে দরজা খোলা বাংলাঘরটার দিকে তাকাল। বিকাল হয়ে আসা। শীতের নির্জনতা ছাড়া ঘরে কেউ নাই, কিছু নাই।

তারপর পুবের ঘরটার দিকে তাকাল হামিদা। এই ঘরটা বাড়ির বড়ঘর। চৌচালা। চারদিকে ঢেউটিনের বেড়া। কাঠের কারুকাজ করা দরজা জানালার কপাটে ঘন কালো আলকাতরা দেওয়া।

এই ঘরের দিকে হামিদাকে তাকাতে দেখে দবির বলল, এই ঘরে হুজুরে থাকে।

হামিদা বলল, জানি। তুমি মনে করছো এই বাইত্তে আমি কোনওদিন আহি নাই!

তারপর একটু থেমে বলল, হুজুর অহন কো?

আমি কেমতে কমু? মনে অয় বাইত্তেঐ আছে।

এই ঘরে আমার মাইয়ারে আটকাইয়া থোয় নাই তো?

আরে না। দেহো না দুয়ার খোলা।

খোলা কো? আউবজাইন্না (ভিড়িয়ে রাখা)।

দুয়ার আউবজাইন্না ঘরে মানুষ মানুষরে আটকাইয়া থোয় কেমতে?

থুইতে পারে। যাতে দুয়ার দেইক্কা মাইনষে কিছু সন্দ না করে।

তয় যাও, এই ঘরেও উঁকি দেও। ঘরে কইলাম হুজুরে আছে, আতাহারের মায় আছে। মাইয়া বিচড়াইতে আইয়া হুজুরের ঘরে উঁকি দিছো এইডা লইয়া কইলাম আরেক ভেজাল লাগবো।

কীয়ের ভেজাল?

দবির একটু রাগল। তুমি বোজো না কীয়ের ভেজাল? বেবাক কথা তোমারে বুজাইয়া কওন লাগবো? দুইফর বেলা হুজুরে তার বউয়ের লগে হুইয়া রইছে না কী করতাছে ঘরে উক্কি দিয়া তুমি হেইডা দেখলা। হুজুরে এইডা জানলে ভেজাল লাগবো না?

হামিদা বিব্রত হল। হ হ বুজছি। তয় আমার মাইয়া?

দবির কথা বলবার আগেই সড়ক থেকে হনহন করে হেঁটে বাড়িতে এসে ঢুকল আতাহার আর নিখিল। উঠানে এসে দাঁড়াল। দুইজনের হাতেই সিগ্রেট জ্বলছে। নিখিলের সিগ্রেট ধরে রাখার ভঙ্গিটা নমনীয়। যে-কোনও সময় ময়মুরুব্বির সামনে পড়লে সিগ্রেট যেন সে লুকাতে পারে এমন ভাবে সিগ্রেট ধরে রেখেছ। আতাহারের সিগ্রেট ধরার ভঙ্গি বেপরোয়া ধরনের। যেন ময়মুরুব্বি কাউকেই তোয়াক্কা করে না সে। যে ইচ্ছা দেখুক আতাহারের সিগ্রেট খাওয়া, আতাহারের যেন কিছুই যায় আসে না। আতাহারের সব কিছুতেই অবশ্য বেপরোয়া ভঙ্গি। পরনের লুঙ্গিটাও বাঁহাতে এমন করে খানিকটা তুলে ধরে রেখেছে, এই ভঙ্গিতেও তার উদ্ধতভাবটা ধরা পড়ে। ওদিকে তার দোস্ত নিখিল নরম সরম, বিনয়ী ভদ্র। চোখে সারাক্ষণই এক তোয়াজের ভাব তার।

বাড়িতে ঢুকেই দবির আর হামিদাকে দেখতে পাবে আতাহার নিখিল কেউ তা ভাবেনি। দুইজনেই চমকাল। নিখিল ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল তাদের দিকে, হাতের সিগ্রেট ঠোঁটে তুলে টান দিতে ভুলে গেল। কিন্তু আতাহারের হল উলটা। মাথায় রক্ত লাফিয়ে উঠল, চোখ কোটর থেকে ঠেলে বেরুতে চাইল ক্রোধে, মুখের ভিতর দাঁতে দাঁত চাপার ফলে কড়মড় করে শব্দ হল। হঠাৎ করেই যেন এমন হল আতাহারের। তবে ভাবটা সামাল দিতে চাইল সে। সামাল দেবার জন্যই যেন পর পর দুইবার ফুক ফুক করে বেশ দীর্ঘ টান। দিল সিগ্রেটে। দবির হামিদার দিকে সাপের চোখে তাকিয়ে শীতল কুদ্ধ গলায় বলল, কী চাই?

দবির হামিদা কথা বলতে পারল না। ভয়ার্ত ভঙ্গিতে একটা টোক গিলল দবির আর হামিদা কাঁপা হাতে মাথায় ঘোমটা দিল।

এই অবস্থা থেকে তাদেরকে বাঁচিয়ে দিল নিখিল। আস্তে করে সিগ্রেটে টান দিয়ে বলল, এগ লগে পরে কথা ক আতাহার। আগে আমারে বিদায় কর।

দবির হামিদার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিখিলের দিকে তাকাল আতাহার। চিন্তিত গলায় বলল, বিদায় করুম মাইনি? তরে জানি কির লেইগা আনলাম?

নিখিল হাসল। ভুইলা গেলিনি?

হ। এই দুইডারে দেইক্কা বেবাক ভুইলা গেছি। মাথা খারাপ অইয়া গেছে আমার।

হেইডা খারাপ অওনের কথাঐ। তয় তুই আমারে কীর লেইগা আনছছ হোন। তর লগে টেকা আছিলো না দেইক্কা…।

নিখিলের কথা শেষ হওয়ার আগেই আতাহার বলল, আর কওন লাগবো না। মনে অইছে। তুই ইট্টু খাড়ো (দাঁড়া)।

দবির হামিদার দিকে তাকাল আতাহার। তোমরাও খাড়োও। আইতাছি।

সিগ্রেট টানতে টানতে আতাহার গিয়ে বাংলাঘরে ঢুকল। বিছানার তলায়, কেউ কল্পনাও করবে না এমন জায়গা থেকে একশো টাকার একটা নোট হাতে নিয়ে ফিরে এল। নোটটা নিখিলের হাতে দিয়ে বলল, যা। এই টেকায় যেহেন থিকা পারচ ডেকরা দুইডা মোরগ কিনবি। ফুলমতিরে কবি বেশি কইরা তেল মেশলা দিয়া, ঝাল ঝাল কইরা কষাইতে। ওই টাইমে ঝাল গোস্ত ছাড়া আরাম লাগে না।

টাকাটা হাতে নিয়ে মুখ কালো করল নিখিল। সিগ্রেটে শেষটান দিয়ে ছুঁড়ে ফেলল।

নিখিলের কালোমুখ খেয়াল করে আতাহার বলল, কী অইলো?

নিখিল স্নান গলায় বলল, কিছু না।

তয় যে মোক কালা করলি?

তর কথায়।

কী কইছি আমি?

দিদিরে ফুলমতি কইলি।

তর দিদির নাম ফুলমতি না?

হ। তয় হেয় আমার বড়।

বড় অইছে কী অইছে?

হেরে তুই নাম ধইরা কইলি?

আতাহার একটু রাগল। তয় কি চ্যাট (লিঙ্গ) ধইরা কমুনি?

নিখিল গম্ভীর হল। মোক খারাপ করি না। আমার দিদিরে তরও দিদি কওন উচিত। হেয় তরও বড়।

হোক। দিদি আমি কমু না। হিন্দু কথা আমি কই না।

তাইলে ফুলমতিও কইচ না। ফুলমতি তো হিন্দু নাম।

নিখিলাও তো হিন্দু নাম।

নিখিলা না, নিখিল।

অইছে। অতো প্যাচাইল পারি না। যা। মন মিজাজ খারাপ আছে।

নিখিল আর কথা বলল না। মন খারাপ করে বারবাড়ির দিকে পা বাড়াল।

আতাহার তাকে ডাকল। হুইন্না যা নিখিলা।

নিখিল ফিরে এল। কী?

মন খারাপ করছছ নি?

না।

করিচ না। আমার মন মিজাজ ভাল না।

একটু থেমে বলল, আরেকখান কথা কই তরে? ফুলমতি তর বড় অইলেও অরে মনে হয় তর ছোড। সব সময় সাদা কাপড় ফিন্দা থাকে। বাইল্য বিধবা। তারবাদেও চেহারাখান কী সোন্দর! গন্ধরাজ ফুলের লাহান। এর লেইগাঐ অরে আমার দিদি কইতে মন চায় না। মনে অয় ও তর ছোড বইন, আমারও ছোড বইন। এর লেইগাঐ নাম ধইরা কই। আর কিছু না।

নিখিল কথা বলল না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বারবাড়ির দিকে চলে গেল।

তারপর আতাহার এসে দাঁড়াল দবির গাছি আর হামিদার সামনে।

দুইজন মানুষের সামনে আতাহার দাঁড়াল ঠিকই কিন্তু হামিদার দিকে সে তাকাল না, তাকাল দবির গাছির দিকে। চোখ পাকিয়ে, নাক ফুলিয়ে, ঝাঁঝালো গলায় বলল, কীর লেইগা আইছস এই বাইত্তে? কী চাই?

দবিরকে তুমি করে বলে আতাহার। আজ বলল তুই করে। এই অবস্থায়ও আতাহারের তুই বলাটা কানে লাগল দবিরের। এই অবস্থায়ও মনটা খারাপ হল। আতাহার সামনে এসে দাঁড়াবার পর তোয়াজের ভঙ্গিতে মুখটা হাসিহাসি করেছিল। সেই মুখ রোদে পোড়া পাতার মতো ম্লান হল। মুখ নিচু করে কোনওরকমে বলল, মাইয়াডা এতবড় একখান অন্যাই করছে…।

দবিরের কথা শেষ হবার আগেই তেড়ে ওঠা মর্দা কুত্তার মতন খাউ খাউ করে উঠল আতাহার। অন্যাই? এইডারে তুই অন্যাই কইতাছছ? আরে এইডা তো অন্যাইয়ের বাপ। মোকে পিছা (ঝাড়ু) মারন আর ছ্যাপ ছিডান এক কথা। তাও শয়ে শয়ে মাইনষের সামনে। পুলিশ দারগার সামনে। আর এমুন একজন মাইনষের মোকে যে অইলো আল্লার এক্কেরে খাসবান্দা। মাওলানা। যার মোকের এহেকখান দাড়িতে সইত্তর কইরা ফিরিসতা বইয়া থাকে। ছ্যাপ তো হেই ফিরিসতাগো মোকেও লাগলো।

দবির কথা বলল না, মুখ নিচু করে রাখল।

আতাহার বলল, এত সাহস তর মাইয়ার অইল কেমতে? কই পাইলো এত সাহস?

দবির তবু কথা বলল না, কথা বলল হামিদা। পোলাপান মানুষ, বোজতে পারে নাই।

এবার আগের চেয়েও জোরে চেঁচাল আতাহার। হামিদার মুখের দিকে তাকিয়ে পারলে যেন তার গলা টিপে ধরে এমন ভঙ্গিতে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বলল, কী কইলি? পোলাপান মানুষ? তর মাইয়ায় পোলাপান মানুষ? বিয়া দিয়া দেখ পোলাপান না কী? একমাসও লাগবো না প্যাট বাজাইতে।

নূরজাহানকে নিয়ে অশ্লীল কথাগুলি তো কানে লাগলই দবিরের, কানমুখ ঝ ঝ করতে লাগল, এমনকী হামিদাকে তুইতুকারি করাটাও কানে লাগল। তাকে করছে করুক, হামিদাকে কেন তুইতুকারি করছে আতাহার? কিন্তু এসব নিয়ে কথা বলার মুখ নাই দবিরের। নূরজাহান তাকে বোবা করে দিয়েছে।

এতক্ষণের উৎকণ্ঠা তারপর যেন কেটে গেল দবিরের। নূরজাহানকে নিয়ে পাওয়া ভয়টা যেন কমে গেল। কিন্তু ভিতরে ভিতরে মেয়ের ওপর প্রচণ্ড রাগ হল তার। মান্নান মাওলানাকে রাজাকার বলে দবিরকে একবার বেদম অপমান করিয়েছে সে। গালাগাল খাইয়েছে, ঘাড় ধাক্কা খাইয়েছে। সেই অপমান সইতে না পেরে বাড়ি ফিরে কেঁদেছিল দবির। কিন্তু সেদিনের অপমানটা ছিল তার একার, আজ অপমান হচ্ছে স্বামী-স্ত্রী দুইজনে মিলে। সেদিনকার ছেলে আতাহার তাদেরকে তুই-তুকারি করছে। মা-বাবার সামনে মেয়েকে নিয়ে অশ্লীল কথা বলছে। এসবের জন্য অন্য কেউ দায়ী না, দায়ী তাদের মেয়েটা। নূরজাহান। এরকম মেয়ের ওপর রাগ না হবে কোন বাপের?

দবিরের মনে হল এ বাড়ির যে ঘরে আছে নূরজাহান সেই ঘর থেকে টেনে হিঁচড়ে নূরজাহানকে সে বের করে আনে। এনে চড়চাপড় কিল ঘুসি আর লাথি মারতে মারতে ফেলে দেয় উঠানের মাটিতে। মারের চোটে দুই-একটা দাঁত খসে পড়ুক নূরজাহানের, ঠোঁট কেটে যাক, জিভ কেটে যাক। মুখ থেকে থুতুর সঙ্গে বেরোক তাজা রক্ত, নাক দিয়ে গলগল করে পড়ুক জবাই করা মুরগির গলা থেকে পড়ার মতো রক্ত। মান্নান মাওলানার সাদা উঠান লাল হোক। তারপরও উঠানে পড়া মেয়ের গলা পাড়া দিয়ে ধরবে দবির। দম একেবারেই রুদ্ধ করবে মেয়ের। জোর করে কেউ না ফিরালে মেয়েকে যেন সে মেরেই ফেলবে।

কিন্তু দবিরের ক্রোধের কণামাত্রও যেন জাগল না হামিদার গায়ে। আতাহার তাকে তুই তুকারি করছে তা যেন সে শুনতেই পেল না। মেয়ে নিয়ে অশ্লীল কথা বলছে তা যেন সে। বুঝতেই পারল না। অতি নরম, অতি বিনয়ের গলায় বলল, অরে আমি শাসন করুম। এই অন্যাইয়ের লেইগা অরে আমি বহুত মারুম। অরে আমি বাইতথন বাইর অইতে দিমু না। অর মোক আপনেরা আর দেখবেন না। এই মেদিনমণ্ডল গেরামের কেঐ দেখবো না।

আতাহারকে কি আপনি করে বলে হামিদা! কোনওদিন শোনেনি দবির। বলবার কথা না। আজ বলছে কেন? ভয়ে নাকি মেয়েকে বাঁচাবার জন্য, মেয়েকে উদ্ধারের জন্য! নরম হয়ে আতাহারের মতো হাঁটুর বয়সি ছেলেকে আপনি আপনি করে, তোয়াজ অনুনয় করেও কি নূরজাহানকে বাঁচাতে পারবে হামিদা! এই বাড়িতে যদি সত্যি নূরজাহানকে বেঁধে রাখেন মান্নান মাওলানা, এসব করে কি তাকে ছাড়িয়ে নিতে পারবে।

দবির কিছুই বুঝতে পারে না। তার মন মাথা ফাঁকা হয়ে যায়।

কিন্তু হামিদার কথা শুনে তখন আরও রেগেছে আতাহার। তিন শরিকের পুরা বাড়ি কাঁপিয়ে চিৎকার করে উঠেছে। তর শাসনের খেতাপুড়ি আমি। তর মাইরের খেতাপুড়ি। তর মাইয়ারে তুই বাইত থন বাইর অইতে দিবি কি দিবি না তাতে আমার ধন (পুরুষাঙ্গ অর্থে) অইব। মেদিনমণ্ডলের মাইনষে তর মাইয়ার মোক না দেখলে কোন বাল হালানি (যৌনকেশ ফালানো) যাইবো! আমার বাপরে যে চুতমারানির ঝিয়ে অপমান করলো হেইডা কি ফিরত আইবো?

আতাহারের চিৎকার চেঁচামেচিতে মোতাহারের বউ পারুল তাদের ঘরের উঠানের দিককার দরজা খুলে দাঁড়িয়েছে। তার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে দুইপাশে দুই ছেলেমেয়ে আর দুইপায়ের মাঝ বরাবর ছোটটা। উত্তরের ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে রহিমা আর হাসু। ওটার (ঘরে ওঠার সামান্য উঁচু মাটির বেদি) সামনে গায়ে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে ফুফু ভাইঝি। মুখে উৎকণ্ঠা, চোখে ভয়ার্ত ভাব। মন্তাজদের বাধা ঝি ফিরোজা ছিল তাদের বড়ঘরে। মন্তাজের অথর্ব মায়ের মাথাটা এই শীতকালেও দুপুরের পর গরম হয়। তালু ফেটে বেরোয় অদ্ভুত উষ্ণতা। মায়ের মাথা ঠান্ডা রাখার জন্য ঢাকা থেকে বোতল বোতল কদুরতেল পাঠায় মন্তাজ। বুড়িকে বিছানায় তুলে দুই-তিনটা বালিশ দুই-তিনদিক দিয়ে ঠেস দিয়ে কোনওরকমে তাকে বসিয়েছে ফিরোজা, বোতল খুলে তেলটা মাত্র দেবে, আর খুলল না। বোতল আর বুড়িকে ফেলে দৌড়ে বেরুল। দেখে বুড়ি প্রথমে হতভম্ব হল তারপর খোঁচা খাওয়া উমা মুরগির মতন কক কক করে উঠল। শুধু ফিরোজাই বোঝে তার ভাষা এমন জড়ানো গলায় বলল, ও ফিরি, কই যাচ? কী হইছে?

ফিরোজা কোনও কথা বলল না। ছুটে এসে মান্নান মাওলানার পুবের ভিটির বড় ঘরখানার পিছন দিককার কোণে দাঁড়াল। এখান থেকে উঠোনে দাঁড়ানো সবাইকে দেখা যাচ্ছিল। ফিরোজা উৎকণ্ঠিত মুখে তাকিয়ে রইল।

মান্নান মাওলানার বাংলাঘর আর উত্তরের ভিটির ঘরখানার মাঝমধ্যিখান দিয়ে বিশকদম আগালে রান্নাঘর। সেই ঘরের পিছনে একখানা আমগাছ। এই আমগাছের আগডালে বসে একটা কাক থেকে থেকে ডাকছিল। আতাহারের চিৎকারে বেশ ভড়কাল সে। ডাক বন্ধ করে, চঞ্চল চোখে উঠানের দিকে তাকাতে লাগল। অবস্থা বেগতিক দেখলে যখন তখন উড়াল দিবে।

কিন্তু এত যে কাণ্ডকারখানা ঘটছে বাড়িতে, উঠানের লাগোয়া পুবের বড়ঘরে আছেন মান্নান মাওলানা তার কানে যেন যাচ্ছেই না কিছু। তিনি যেন কিছু টেরই পাচ্ছেন না। তিনি কি ঘুমিয়ে আছেন? কিন্তু যত গভীর ঘুমেই থাকুক মানুষ, এত কাছে দাঁড়িয়ে এরকম চিৎকার চেঁচামেচি করছে এতবড় ছেলে, এই শব্দে ঘুম না ভাঙে কী করে? এই শব্দ লোকের কানে না যায় কী করে? এত কিছু শোনার পরও লোকে ঘর থেকে না বেরোয় কী করে?

নাকি মাওলানা সাহেব জেগেই আছেন! বিছানায় উঠে বসেছেন কিন্তু ইচ্ছা করেই ঘর থেকে বেরুচ্ছেন না! তিনি হয়তো চাইছেন যত ইচ্ছা গালাগাল দবির দবিরের বউকে করুক আতাহার। গালাগাল শেষ করে, শরীরের ঝাল মিটাবার পর তিনি বেরুবেন। ভাবখানা এমন করবেন যেন এই এতক্ষণের কোনও কিছুই তার কানে যায়নি। এখনই ঘুম ভাঙল তার, ঘুম ভাঙার পরই ছেলের চিল্লাচিল্লি শুনে ঘর থেকে বেরিয়েছেন। ব্যাপার কী, কাকে গালাগাল করছে আতাহার উদ্বিগ্ন মুখে তা দেখত চাইছেন।

আগের মতোই গলার জোর বজায় রেখে আতাহার তখন বলছে, এই অপমানের শোধ কেমতে লইতে অয় আমি জানি। শোধ আমি লমু। এমুন কইরা লমু, লওনের পর উদিস পাবি শোধ কারে কয়।

হামিদা কাতর গলায় বলল, না শোধ আপনে লইয়েন না। রহম করেন, আমার মাইয়াডারে আপনে রহম করেন। আমি আপনের হাতে ধরি, আমি আপনের পায়ে ধরি।

বলেই আতাহারের হাত ধরবার জন্য এগিয়ে গেল হামিদা। আতাহারের হাতের কাছে যাবার আগেই লাফ দিয়ে সরে গেল আতাহার। খবরদার শইল্লে হাত দিবি না। সামনে আবি না আমার। বাইর হ, বাইর হ আমগো বাইতথন। অহন বাইর হবি। এক মিনিট আর খাড়বি না। যা ভাগ।

আতাহারের ভঙ্গিভঙ্গি আর হামিদার অসহায় মুখ দেখে বুক তোলপাড় করতে লাগল দবির গাছির। চোখ ছলছল করে উঠল। অতি দীনদরিদ্র সংসার দবির গাছির। খেয়ে না খেয়ে কত কষ্টে হামিদাকে নিয়ে জীবনের এতটা পথ পেরিয়ে এসেছে। জীবনে কত দুঃখ কষ্টের সময় গেছে, অসহায় নিরুপায় সময় গেছে, স্বামী স্ত্রীর কত মান অভিমান ঝগড়াঝাটি, ছোটখাটো কত অশান্তি, তারপরও একটি মাত্র মেয়েকে মাঝখানে রেখে দুইজন মানুষের মধ্যে আছে গভীর টান। সেই টানেই মান্নান মাওলানা যেদিন অপমান করেছিল দবিরকে, দবিরের মাথা দুইহাতে বুকে জড়িয়ে তাকে সান্ত্বনা দিয়েছিল হামিদা। স্বামীর বেদনা নিজেও ভাগ করে নিয়েছিল। আজ এই মুহূর্তে হামিদার অসহায় মুখ দেখে দবিরের ইচ্ছা করে এগিয়ে গিয়ে হামিদার হাতটা সে ধরে, হামিদাকে টেনে নেয় বুকে। দুইহাতে তার মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে বলে, তুমি এমুন ভাইঙ্গা পইড়ো না। আমি তো আছি। তোমার মাইয়ারে আমি রক্ষা করুম। কেঐ কিছু করতে পারবো না।

করা হয় না কিছুই। বুকের আবেগ বুকে রেখে, চোখের পানি সামলে আগের মতোই মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে দবির। আর হামিদা তার মতো করে অনুনয় করে যায় আতাহারকে। আপনে আমার বাপ হন। আমার আপনা বাপ। খালি হাতে না, আমি আপনের পায়েও ধরতাছি। একবার না শতবার ধরতাছি। আমার মোক চাইয়া আমার মাইয়াডারে আপনে মাপ কইরা দেন।

আতাহার খুবই শ্লেষের হাসি হাসল। তর মোক চাইয়া? তর মোক কি চামুরে? মোক তো পেতনির লাহান। এমুন মোকের মিহি আমি চাই না।

আতাহারের কথা শুনে রহিমার পাশে দাঁড়ানো হাসু ফিক করে একটু হাসল। সেই হাসি দেখে ফেলল আতাহার। চোখ পাকিয়ে এমন করে তাকাল হাসুর দিকে, ভয়ে মুখ শুকিয়ে গেল হাসুর। চট করেই উঠানের দিক থেকে চোখ সরাল সে। আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল।

হামিদা এসবের কিছুই খেয়াল করল না। আগের মতোই কাতর গলায় বলল, আপনে আমারে যা করতে কন তাই করুম, আমার মাইয়াডারে ছাইড়া দেন।

আতাহার গম্ভীর গলায় বলল, না, অর কোনও ছাড়াছাড়ি নাই।

কথাটা শুনে চমকে উঠল দবির। চট করে আতাহারের মুখের দিকে তাকাল, হামিদার মুখের দিকে তাকাল। হামিদাও তখন তাকিয়েছে দবিরের মুখের দিকে। চোখে এমন দৃষ্টি তার, যেন নিঃশব্দে বলছে, কী, কইছিলাম না এই বাইত্তে আছে নূরজাহান! এই বাইত্তেঐ মাইনষের চোক্কের আঐলে (আড়ালে) অরে বাইন্দা ধুইছে মাওলানা সাবে! অহন সত্য অইল আমার কথা!

মুখে হামিদা বলল, তুমি এমুন থোম (থম) ধইরা রইছো ক্যা? ও নূরজাহানের বাপ, কও না, আতাহার বাজানরে কও না মাইয়াডারে ছাইড়া দিতে। শাসন যা করনের এই বাইত্তেঐ কইরা যাই মাইয়ারে। হুজুরের পায়ে ধইরা মাপ লওয়াই। আতাহার বাজানের পায়ে ধইরা মাপ লওয়াই। মাইয়ার লগে আমরা দুইজনেও ধরুম নে তাগো পাও। এইডা ছাড়া আর কী করনের আছে আমগো! যুদি আর কিছু করনের থাকে, কইতে কও। তারা যা কইবো তাই করুম। আমার মাইয়াডারে ছাইড়া দেউক।

দবির কথা বলবার আগেই পুবের ঘরের আবজানো দরজা আস্তে করে খুললেন মান্নান মাওলানা। নিঃশব্দে দাঁড়াতে চাইলেন দরজার সামনে কিন্তু ঘন করে আলকাতরা দেওয়া কপাটে করর করে শব্দ হল। সেই শব্দে উঠানের তিনজন মানুষ একসঙ্গে তাকাল পুবের ঘরের দরজার দিকে। ব্যস্ত হাতে মাথায় দেয়া ঘোমটা আবার টানল হামিদা। যেন দেওয়া ঘোমটাই আবার দিতে চাইল মাথায়। দবির কীরকম লজ্জিত হল। একবার মান্নান মাওলানার। মুখের দিকে তাকিয়েই চোখ উঠোনের মাটিতে নামাল সে। আতাহারের রুক্ষমুখ সামান্য কমনীয় হল। উত্তরের ঘরের ওটার সামনে দাঁড়ানো রহিমা আর হাসু ছটফটে ভঙ্গিতে চলে গেল রান্নাঘরের দিকে। পারুল নিঃশব্দে তার ছেলেমেয়েদের সরিয়ে দরজা বন্ধ করল। শুধু ফিরোজারই কোনও ভাবান্তর নেই। সে আগের মতোই ঘরের পেছন দিককার কোণে দাঁড়িয়ে উঁকি মেরে আছে উঠানের দিকে। মান্নান মাওলানাকে সে দেখতে পায়নি। মান্নান মাওলানা যখন গম্ভীর গলায় বললেন, কী অইছে? এত চিল্লাচিল্লি কীয়ের? শোনার সঙ্গে সঙ্গে বিষপিঁপড়ার কামড় খাওয়া মানুষের মতো আঁতকে উঠল ফিরোজা। কোনওদিকে না তাকিয়ে এক দৌড়ে মন্তাজদের বড়ঘরের দিকে চলে গেল।

কিন্তু মান্নান মাওলানার প্রশ্নের উত্তর দবির-হামিদা দিল না। দিল আতাহার। রুক্ষগলা নরম করে বলল, দউবরা আর অর বউ আইছে মাইয়ার লেইগা মাপ চাইতে। আমি অগো লগে কথা কইতাছি।

কথা কওনের কিছু নাই। যাইতে ক গা।

কইছি, যায় না।

ক্যা?

খালি প্যাচাইল পাড়ে।

প্যাচাইল পাইড়া লাব নাই।

আমিও কইছি। হোনে না। দউবরা কথা কয় না, কয় খালি বউডা। ভারী প্যাচাইলা বেডি।

যাইতে ক। আমার নমজের সমায় অইছে। আয়জান দিয়া নমজ পড়ুম অহন।

পিছন ফিরে তাকালেন মান্নান মাওলানা। আতাহারের মা, রহিরে কও আমার অজুর পানি দিতে।

বাইরে থেকে আতাহারের মা তহুরা বেগমকে দেখা যাচ্ছিল না। স্বামীকে কী বললেন তিনি তাও শোনা গেল না। তবে মান্নান মাওলানা তার সঙ্গে আর কথা বললেন না। আতাহারকে বললেন, রহিরে ক অজুর পানি দিতে।

রান্নাঘরের দিকে তাকিয়ে গলা উঁচিয়ে রহিমাকে ডাকল আতাহার, অজুর পানি দিতে বলল। তারপর তাকাল দবিরের দিকে। বাবার কথা তো হুনলিঐ। যা অহন।

দবির কথা বলবার আগেই হামিদা কীরকম আবদারের গলায় বলল, মাইয়া না লইয়া। যামু না।

মান্নান মাওলানার দিকে তাকাল সে। মাথার ঘোমটায় মুখের অনেকখানি ঢেকে বলল, হুজুর, বহুত আশা কইরা আপনের কাছে আইছি আমি। আপনেরে আমার কওনের কিছু নাই। খালি একখান কথা কই, না বুইজ্জা কেঐ কোনও অন্যাই করলে আল্লায়ও তারে মাপ করে। আপনে অইলেন আল্লার খাসবান্দা। আমার নাদান মাইয়াডারে আপনে মাপ কইরা দেন।

হামিদার সবকথা মান্নান মাওলানা বোধহয় শুনলেন না। শুনলেও পাত্তা দিলেন না। পাত্তা দিলেন একটি মাত্র কথা। না বুইজ্জা অন্যাই মাইনি কী?

কথাটার উত্তর দিতে গেল হামিদা তার আগে হাত তুলে তাকে থামালেন মান্নান। মাওলানা। তুমি চুপ কর। বেগানা মাইয়া ছেইলার লগে কথা আমি কই না। গুণা অয়। দউবরা, তুই ক। অন্যাইডা কি তর মাইয়ায় না বুইজ্জা করছে?

দবির মাথা নিচু করে বলল, হ হুজুর।

না। বুইজ্জাই করছে। বড় বানকাউর মাইয়া। আমারে একদিন রাজাকার কইছিলো। হেইডাও বুইজ্জাই কইছিলো। বুইজ্জা যে অন্যাই করে তারে কইলাম আল্লায় মাপ করে না। এইডা তর বউরে ক।

কওন লাগবো না। হেয় হোনছে।

তয় আর খাড়ঐ রইলি ক্যা? যা গা।

হামিদা হঠাৎ কীরকম ফুঁসে উঠল। মান্নান মাওলানার মুখের দিকে তাকিয়ে দৃঢ় গলায় বলল, মাইয়া না লইয়া যামু না।

হামিদার ভঙ্গি দেখে মান্নান মাওলানা একটু থতমত খেলেন। না লইয়া যাইবা না মাইনি? কে বাইন্দা থুইছে তোমার মাইয়ারে?

আপনেরা।

কী? কই বাইন্দা থুইছি?

এই বাইত্তেই।

কে কইছে?

পয়লা আমি আন্তাজ করছি। তারবাদে আতাহারে স্বীকার করছে।

হামিদার কথা শুনে আতাহার একেবারে বেকুব হয়ে গেল। কী স্বীকার করছি আমি?

এবার আতাহারকে আর আপনি করে বলল না হামিদা। তুমি করে কঠিন ভঙ্গিতে বলল, ওই যে আমি যহন কইলাম মাইয়াডারে ছাইড়া দেও, তুমি কইলা, না, অর কোনও ছাড়াছাড়ি নাই। কও নাই?

হ কইছি। তয় হেইডা আর এইডা তো এক কথা না। কয় কথা?

দুই কথা।

আমি মনে করছি অর উপরে য্যান শোধ না লই, অরে য্যান মাপ কইরা দেই, ছাইড়া দেই।

না এইডা তুমি কও নাই। কথার তালে আসল কথা কইছো। আমার মাইয়া এই বাইত্তেঐ আছে। কোন ঘরে অরে তোমরা বাইন্দা থুইছো কও। তোমগো মতলব আমি বুঝছি। মাইয়া না লইয়া এই বাইতথন আমি যামু না। দরকার অইলে হারারাইত এই উড়ানে আমি বইয়া থাকুম। দরকার অইলে গেরামের বেবাক মাইনষেরে এই বাইত্তে ডাইক্কা লইয়ামু। কমু মাইয়ায় অন্যাই করছে তার বিচার করেন আপনেরা, কিন্তুক ডাঙ্গর মাইয়া বাইত্তে বাইন্দা থুইবো হেইডা অইব না। যদি আমার মাইয়ার অন্য রকমের কোনও খেতি হয়?

হামিদার কথা শুনে মান্নান মাওলানা এবং আতাহার দুইজনেই বিব্রত হল। দুইজন দুইজনার মুখের দিকে তাকাল। মান্নান মাওলানা কপাট ছেড়ে উঠানে নেমে এলেন। পায়ে খড়ম। খড়মে চটর পটর করে শব্দ হল।

উঠানে নেমে লুঙ্গি একটুখানি তুলে পরলেন তিনি। পেটের কাছে টাইট হয়ে থাকা ফ্লানেলের পাঞ্জাবি তুলে নাভির কাছে গিঁট দিলেন লুঙ্গি। তারপর পাঞ্জাবি ছেড়ে প্রথমে হামিদার দিকে পরে দবিরের দিকে তাকালেন। তর পরিবারের কি মাথা খারাপ অইছে। নিরে দউবরা? আবল তাবল প্যাচাইল পাড়ে। অন্যাই তর মাইয়ায় করছে, বেদম অন্যাই করছে, এই অন্যাইয়ের কোনও মাপ নাই, হের লেইগা তর মাইয়ারে আমি বাইত্তে আইন্না বাইন্দা থুমুনি?

দবির কথা বলবার আগেই, আগের মতো তেজালো গলায় হামিদা বলল, হ থুইছেন।

এবার গলা আর আগের মতো গম্ভীর রইল না মান্নান মাওলানার। চড়ল। হামিদাকে তিনি তুই-তোকারি শুরু করলেন। তুই কইলেঐ অইবোনি?

হামিদাও কম গেল না। হ আমি কইলেঐ অইবো।

না অইবো না।

অইবো।

যদি তর মাইয়া এই বাইত্তে না থাকে তাইলে কী অইবো?

আমার মাইয়া এই বাইত্তেঐ আছে।

আগে ক, যুদি না থাকে তাইলে তুই কী করবি?

তয় আমার মাইয়া গেল কই?

হেইডা জানন আমার কাম না। আমার মোকে ছ্যাপ ছিড়াইয়া দৌড় দিছে। কই গেছে তরা সেন জানচ।

না জানি না। মাইয়া বাইত যায় নাই। হেই টাইমে দৌড় দিছে ঠিক তারবাদে আপনেরা আমার মাইয়ারে ধইরা আনছেন।

কই থিকা?

আমি কেমতে কমু?

এত কিছু কইতে পারতাছস এইডা কইতে পারবি না? কই থিকা ধইরা আনছি ক?

মান্নান মাওলানার এসব কথার ধার দিয়েও গেল না হামিদা। আপন মনে বলল, যহন ছ্যাপ ছিড়াইয়া দৌড় দিছে তহন আপনেরা অরে কিছু কন নাই। দৌড়াইয়া গিয়া ধরেন নাই অরে। মাকুন্দারে পুলিশ দারগায় লইয়া যাওনের পর বিচড়াইয়া বাইর করছেন আমার মাইয়ারে। ধইরা আইন্না এই বাইত্তে বাইন্দা থুইছেন।

হামিদার কথা শুনে বাঘের চোখের মতো ধক ধক করে জ্বলতে লাগল মান্নান মাওলানার চোখ। সেই চোখে পলক না ফেলে খানিক হামিদার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন তিনি। ধীর শান্ত কঠিন গলায় বললেন, তুই কইলাম সীমানা ছাইড়া যাইতাছস! আমার মোকে ছ্যাপ ছিড়াইয়া তর মাইয়ায় যেই অন্যাই করছে তুই করতাছস তার থিকা বড় অন্যাই। যেই কামনা করছি হেই কামের লেইগা দোষারোপ করতাছস। বেবাক মাইনষের সামনে কইছিলাম তর মাইয়া নাদান, অরে আমি মাপ কইরা দিলাম। তর লেইগা মাপটা আমি করুম না। না ধইরা আইন্না যহন বদলাম অইছে তয় তর মাইয়ারে কইলাম ঠিকই আমি ধইরা আনুম। ঠিকঐ বাইন্দা থুমু বাইত্তে।

সঙ্গে সঙ্গে ধাক্কা মেরে হামিদাকে সরিয়ে দিল দবির। নিজে হাতজোড় করে দাঁড়াল মান্নান মাওলানার সামনে। অর কথা আপনে ধইরেন না হুজুর। ডরে ভয়ে অর মাথা খারাপ অইয়া গেছে। কী কইতে কী কইতাছে বোজতে পারতাছে না।

না বেবাক কথা বুইজ্জাঐ কইতাছে। এইডা তগো দুইজনের ষড়যন্ত্র।

কীয়ের ষড়যন্ত্র হুজুর?

মাইয়া তগো বাইত্তেঐ আছে। তারবাদেও তরা আমার কাছে আইয়া উলটা দোষ দিয়া আমারে ফাঁপরে হালানের চেষ্টা করলি। এই হগল কায়দা আমি বুজি। তরা তিনডাঐ বদমাইশ। তর থিকা তর পরিবারে ইট্টু বেশি, তার থিকা বেশি মাইয়াডা। তর পরিবারের কথা হুইন্না আইজ আমি বুঝছি তর মাইয়াডা নষ্ট অইছে এই মাগির লেইগা। মা নষ্ট না অইলে মাইয়া নষ্ট অয় না।

পিতলের বদনা ভরা গরম পানি নিয়ে রহিমা তখন দ্রুত পায়ে উঠান পেরুচ্ছে। বারবাড়ির পশ্চিমকোণে চ্যাপটা পাথরখানার ওপর বদনা রাখবে। সেখানে বসে অজু করবেন মান্নান। মাওলানা। বদনার মুখ দিয়ে নল দিয়ে হু হু করে বেরুচ্ছে সাদা বাষ্প। সেদিকে একবার তাকিয়ে মান্নান মাওলানা বললেন, তয় মনে যহন মাগির অইছে যে অর মাইয়া আমি এই বাইত্তে বাইন্দা থুইছি, বাড়ির বেবাক ঘর আমি খুইল্লা দিতাছি, দেক কোন ঘরে আছে মাইয়া।

ছেলের দিকে তাকালেন তিনি। আতাহার, পুরা বাড়ি অগো দেহা। বেবাক ঘর দেহা। তয় মাইয়া যুদি এই বাইত্তে না পাঁচ তয় তগো কপালে শনি লাগলো। তগো আমি খাইয়ালামু।

মান্নান মাওলানা আর দাঁড়ালেন না। খড়মে চটর পটর শব্দ তুলে বারবাড়ির দিকে চলে গেলেন। দবির-হামিদার দিকে তাকিয়ে আতাহার বলল, আয় আমার লগে। বাড়ির বেবাক ঘর দেক।

দবির বলল, দেহনের কাম নাই। হুজুরে কি মিছা কথা কইবোনি?

হামিদা কিছু একটা বলতে চাইল, চোখ পাকিয়ে দবির তার দিকে তাকাল। আর একটাও কথা না, ল বাইত্তে ল।

হামিদা কাতর গলায় বলল, আমার মাইয়া?

মাইয়া জাহান্নামে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *