৯১-৯৫. জাহাজের নির্জন কেবিনে

জাহাজের নির্জন কেবিনে শুয়ে বোজ একটা দৃশ্য কল্পনা করত বাপ্পা। তাকে দেখা মাত্র খুশিতে তিড়িংবিড়িং লাফাচ্ছে তিতির, মার বরফ মুখ গলে আনন্দের ঝর্না হয়ে গেল, বাবার তৃষ্ণার্ত চোখে আলো জ্বলে উঠল ঝিকঝিক…। আশ্চর্য, সে রকম কিছুই হল না! তার চকিত আগমনে তিতির চমকাল বটে, কিন্তু সে যেন মঙ্গলগ্রহ থেকে খসে পড়া কোনও জীবকে দেখে অবাক হওয়া। বাবা হাসল কি হাসল না বোঝাই গেল না, ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে আছে। মার মুখেও খুশি ছিল কি? হয়তো ছিল, বাপ্পা তেমন কিছু বুঝতে পারেনি। মাঝখান থেকে তুচ্ছ কারণে ঝগড়া বেধে পুরোপুরি হাঁড়িমুখ হয়ে গেল মা। এমন একটা অভ্যর্থনাই কি প্রাপ্য ছিল বাপ্পার!

তার নিজেরই বা কি হল! ওসাকা থেকে প্লেনে ওঠার সময়ে যেমন তড়াক তড়াক লাফাচ্ছিল হৃৎপিণ্ডটা, বাড়ি পৌঁছে তার ছিটেফোঁটাও রইল না। তিতিরকে দেখে মনে হল আট মাস পরে নয়, এই যেন কলেজ থেকে ফিরে দেখল তিতিরকে। মা যেন স্কুলে গিয়েছিল, ফিরল এই মাত্র। বাবার কথা ভাবলেই যে একটা সর্ষেদানা পাক খেত বুকে সেটাই বা গেল কোথায়!

দূর কাছে এলে কি টান কমে যায়! জাহাজে দিনরাত মন হুহু করাটাও কি মিথ্যে ছিল।

 হিসেব মেলে না। অনেক হিসেবই মেলে না বাপ্পার। কস্মিনকালে স্কুল আর মানিকতলা ছাড়া কোথাও যায় না মা, বাপ্পা ফিরে দেখল সেই মা উধাও। কখন? না, যখন বাবা হসপিটাল থেকে ফিরেছে এবং মোটেই তেমন সুস্থ নয়। এ সময়ে দাদু-দিদাকে নিয়ে দুম করে মা বেড়াতে যায় কী করে! তিতির তো আরও স্ট্রেঞ্জ। রেশন করে হাসছে, মাকে ছেড়ে বাবার ঘরে ঘাঁটি গেড়েছে, সারা দিনে একবার উঁকি পর্যন্ত দেয় না মার দরজায়। অত বাধ্য মেয়ের ঘাড় এমন ট্যাড়া হয়ে গেল কেন? আর বাবাকে দ্যাখো, আট মাসে যেন আশি বছরের হয়ে গেছে। চব্বিশ ঘণ্টা ঝিমোচ্ছ তো ঝিমোচ্ছে। এক পা বেরোল তো চার ঘণ্টা ঢুলবে। যে বাবা চান্স পেলেই সুটসাট উড়ে যেত তার এ কী দশা! এই এঁদো পচা বাড়িটাতে এসে সবাই কেমন বদলে গেছে। ছোটকা যে ছোটকা, ভাঁড়স্য ভাঁড়, তার মধ্যেও কি রকম হেক্কড় হেক্কড় ভাব! কিহ বাপ্পাহ্, হাউ ইজ লাইফ। আমার তো খাটতে খাটতে জীবন বেরিয়ে গেল!

বাপ্পা ভুল বাড়িতে এসে পড়ল না তো! তার চেনা লোকের ছদ্মবেশে অন্য কেউ বাস করছে না তো এ বাড়িতে!

মা দিঘা থেকে ফেরার দিন দুয়েক পর একদিন ছোটকাকেই ধরল বাপ্পা, কেসটা কি বলল তো? মা তিতির সবাই এমন স্টোনফেস নিয়ে ঘোরাফেরা করছে কেন?

একটা ফিল্ম ম্যাগাজিনে নিজের ছবি মোহিত হয়ে দেখছিল ছোটকা। পুকুরপাড়ে গেঁয়ো নায়িকার সঙ্গে বোকা বোকা মুখে দাঁড়িয়ে থাকা ছবি। পাতাটা খুলে রেখে কায়দা করে হাসল, তুইও টের পেয়ে গেছিস?

–পাব না? এ বাড়িতে এক ঘণ্টা থাকলেই বোঝা যায় সামথিং রং। একটা কোনও আন্ডারকারেন্ট চলছে। তিতির আর মার কি জোর ফাইট হয়েছে? ইস্যুটা কি?

–কিছুই না। সেই পুরনো ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগানের লড়াই। তোর বাবা যা কেলোটা করল।

–কিন্তু ড্রিঙ্ক করে বাবার হসপিটালে যাওয়া কী আর এমন নতুন?

–তা ঠিক। তবে বউদি এবার সাংঘাতিক ফিউরিয়াস। আর তিতিরকে তো জানিসই, তোর বাবার ব্লাইন্ড চামচি। সে এবার পুরো জার্সি-টার্সি পরে ডিফেন্সে নেমে পড়েছে। হসপিটাল এপিসোডটা তো একা ওই সামলাল। তোর মা দেখতেও যায়নি।

–তাই?

–তাই। ছোটকা খাটে হেলান দিয়ে ঠোঁটে সিগারেট চাপল, মাঝে তোর বাবা সন্নিসি হওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিল সে খবর রাখিস?

না তো।

–ইয়েস। এই কাশী চলে যায় আর কি। পেটে ব্যথাটা না বাধালে অ্যাদ্দিনে হরিশচন্দ্র ঘাটে গায়ে ছাই মেখে ধুনি জ্বালিয়ে বসে থাকত। ওসব ভ্যানগাড়ার জন্যই তো বউদি খচে ব্যোম। এখন চুপ থেকে দাদাকে জাঁতা দিচ্ছে। বলতে বলতে ছোটকার চোখ ঢুলু ঢুলু, বুঝলি বাপ্পা। উঁহু, তুই বুঝবি না, সাইলেন্সই হল মেয়েদের সব চেয়ে বড় ওয়েপন।

বাপ্পা যেন একটু ধন্দে পড়ে গেল। ছোটকার কথা পুরো বিশ্বাস হল না। আবার হলও। নীরবতাই যে মেয়েদের অমোঘ অস্ত্র তা হাড়ে হাড়ে টের পায় বাপ্পা। ঠিকানা নিয়েও বিষ্ণুপ্রিয়া একটাও চিঠি লেখেনি, ব্যথাটা খচখচ করে ফোটে বুকে। এসেই যে বিষ্ণুপ্রিয়ার বাড়ি ছুটতে পা সরল না, সে তো খানিকটা ওই কারণেই। নীরবতার তীর হেনে তার কলজেটা ফালা ফালা করে দিয়েছে ওই মেয়ে।

মা কি একই পদ্ধতিতে রগড়াচ্ছে বাবাকে!

 দুর দুর, মার অত প্রেম ভালবাসা নেই বাবার ওপর। না হলে বাবার হয়ে দুটো কথা বলতেই মা অত চটিতং হয়ে যায়! বাবার জন্য মার যা আছে তা শুধুই এক ধরনের হতাশা। বিরক্তি। মার টান ভালবাসা তো অন্য আরেক জনের জন্যে। বাপ্পা জানে।

তেতো চিন্তাটা আসতেই বাপ্পার বুক হিম। বিষ্ণুপ্রিয়ারও অন্য কারুর ওপর টান এসে যায়নি তো!

.

ঝটপট দু দিনে দুটো কর্তব্য সেরে ফেলল বাপ্পা। এক দিন পিসির বাড়ি আর মানিকতলা ঘুরে এল। আর এক দিন বড়কাকা।

পিসির বাড়ি গেল দুপুরবেলায়। ভেবেচিন্তে। যাতে পিসেমশাইয়ের সঙ্গে না দেখা হয়। ভারি অদ্ভুত তির্যক ভঙ্গিতে কথা বলে পিসেমশাই, বাপ্পার একটুও পছন্দ হয় না। দুর্ভাগ্যক্রমে ঝান্টু তখন বাড়িতে ছিল, সে জিনিস পেয়ে যত না খুশি, তার থেকে দশগুণ তার বিটকেল বিটকেল কৌতূহল। বাপ্পা একেবারে জেরবার হয়ে গেল। সমুদ্রের মাঝখান থেকে দূরবীন দিয়ে মহাদেশ দেখতে পাওয়া যায় বাপ্পাদা? তোমাদের জাহাজ কখনও চড়ায় আটকেছে? ক্যানিং-এর বিদ্যেধরীতে আমাদের ভুটভুটি একবার আটকে গিয়েছিল। তোমরা সমুদ্রে থাকো, অথচ সমুদ্রস্নান করো না? …পিসি তাকে আদরযত্ন করল খুব, কিন্তু বাপ্পা ও বাড়ি থেকে বেরিয়ে নাক কান মুলে প্রতিজ্ঞা করেছে, যে কদিন কলকাতায় আছে, মরে গেলেও আর কেষ্টপুরমুখো হচ্ছে না।

ফেরার পথে মানিকতলায় গিয়ে অবশ্য মন ভরে গেল। দাদু একবার আদর করে, একবার দিদা, বারবার ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখে বাপ্পাকে। সমুদ্র নিয়ে কৌতূহলের থেকেও বাপ্পা কেমন ছিল তা জানার আগ্রহই তাদের বেশি। খাওয়া-দাওয়া ঠিকমতো হয় কিনা, ডাক্তার ফাক্তার থাকে কিনা জাহাজে, বাপ্পার সময় কাটে কী করে, সঙ্গীসাথীরা কি রকম, এইসব। বাপ্পার আনা ডান্সিং ডল আর সাবানঘড়ি দেখে-বুড়োবুড়ি দুজনেই কী খুশি! কোথায় রাখলে সুন্দর দেখাবে তাই নিয়ে দুজনের ঝগড়া বেধে যায় যায়। দাদু-দিদার মনমরা ভাবটাও অনেক কেটে গেছে, বাপ্পা বহুক্ষণ প্রাণ খুলে গল্প করল তাদের সঙ্গে। একটাই শুধু খটকা লাগল। বাবার শরীরস্বাস্থ্য নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রশ্ন করছিল দিদা। মা তো প্রায়ই এখানে আসে, বাবার কথা কি কিছুই বলে না?

বড়কাকার বাড়িতে অভ্যর্থনা তো রীতিমতো রাজকীয় হল। সন্ধে সন্ধে গিয়েছিল ও বাড়ি, বড়কাকাকে আগেই অফিসে ফোন করা ছিল, তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে এসেছিল বড়কাকা। এত্ত খাবার নিয়ে। বিরিয়ানি চাঁপ মিষ্টি…। বড়কাকার কাছ থেকেই কথায় কথায় জানতে পারল বাবা নাকি আরেকটা খ্যাপামি শুরু করেছিল মাঝে। পুরনো বাড়িটা ভাঙার সময়ে রোজ নাকি গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত বাবা, জোরে শাবল গাঁইতি চালালে মিস্ত্রিদের বকাবকি করত। কাকিমা কত দুঃখ করল, মা নাকি একবারও আসেনি এ বাড়িতে। ছোট্ট বাড়িটা কাকিমা কী সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছে! ক মাসে কাকিমা মুটিয়েছেও বেশ। অ্যাটম তাকে দেখে পিড়িং পিড়িং নাচছিল, সে উঠে পড়তেই অ্যাটমের চোখ ছলছল।

–আবার আসবে তো দাদাভাই?

নিশ্চয়ই আসব।

–দিদিভাইও এরকম বলে, আসে না।

–দুর পাগলা, দিদিভাইয়ের সামনে পরীক্ষা না!

এর পর তুমি যখন কলকাতায় আসবে, তখন তো আমরা নতুন বাড়িতে চলে যাব, তাই না? তখন আবার আমরা এক সঙ্গে থাকব, কি বল?

–থাকব তো।

-খুব মজা হবে, না? আমরা সবাই আবার… এক সঙ্গে… আমাকে তখন একদিন জাহাজ দেখাতে নিয়ে যাবে দাদাভাই?

ভারী বুকে বেরিয়ে এল বাপ্পা। সামনে ঢাকুরিয়া লেক, জলের ধারে এসে বসে রইল কিছুক্ষণ। বাতাস বইছে মৃদু মৃদু, পাড়ে এসে আলতো ধাক্কা খাচ্ছে জল। অন্ধকার জলের মাঝে ছায়া ছায়া দ্বীপ দেখা যায়। আপাতচোখে মনে হয় দ্বীপেরা বুঝি পরস্পরের থেকে বিচ্ছিন্ন, যে যার একা, কিন্তু সত্যিই কি তাই? জলের তলায়, অনেক তলায়, একই মাটির ওপর তো দাঁড়িয়ে আছে তারা। ওই গোপন যোগটার নামই বুঝি সম্পর্ক।

ফেরার পথে বাপ্পা হাঁটছিল এলোমেলো। অন্যমনস্ক মনে। মন্থর পায়ে। হঠাৎ চমকে উঠল। এ কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে সে! সেলিমপুর না গিয়ে পুরনো রায়বাড়ি…! দীর্ঘকালের অভ্যেসই কি ভুল করে তাকে এ পথে নিয়ে এল!

ভুরু কুঁচকে বাড়িটাকে দেখছিল বাপ্পা। কাজ অনেক দূর এগিয়েছে। চারতলা অবধি ঢালাই কমপ্লিট, ইটের খাঁচা মোটামুটি তৈরি, এবার দরজা জানলা বসবে। নির্মীয়মাণ অট্টালিকার গায়ে আশপাশ থেকে আলো এসে পড়েছে, আঁধারে আলোয় কাঠামোটাকে কেমন যেন এক বিষণ্ণ অবয়বের মতো লাগে। দরজা জানলার খোপগুলো জমাট কালো, রহস্যময়।

কী এক কৌতূহলে বাপ্পা বাউন্ডারির ভেতর ঢুকে পড়ল। একতলায় সারি সারি অপূর্ণ থাম, এখানটায় বোধহয় গ্যারেজ-ট্যারেজ হবে। দারোয়ানের ঘরে আলো জ্বলছে, সে দিকে একবার তাকিয়ে নিল বাপ্পা, তারপর পায়ে পায়ে নিঃসাড়ে উঠে এসেছে দোতলায়। বিশাল ফাঁকা থামঅলা জায়গা, এখনও পার্টিশান ওয়াল পড়েনি, ইট বালি সুরকি দাঁত বার করে আছে। ঘুরে ঘুরে জায়গাটা দেখছিল বাপ্পা, হাঁটছিল, আন্দাজ করার চেষ্টা করছিল ঠিক কোন জায়গাটাতে ছিল তাদের আগের ঘর। বড়কাকারা যেন কোনখানটায় থাকত? নতুন ফ্ল্যাটের ঘরগুলোই বা ঠিক কি রকম হবে?

–খুব খুশি, অ্যাঁ?

 একা বাপ্পা আমূল কেঁপে উঠল। কে? ঘুরে আলোছায়ায় চোখ চালাল দ্রুত। কেউ কোথাও নেই।

বাড়ি ভাঙতে পেরে খুব আহ্লাদ?

 বাপ্পার সারা শরীর থরথর। চেনা গলা। সেই বুড়ো।

হাঁটুর জোর কমে গেল বাপ্পার। ফ্যাকাসে হয়ে গেছে মুখ। পড়িমড়ি করে সিঁড়ির দিকে ছুটে গেল। দু দিক খোলা এবড়ো-খেবড়ো ধাপি বেয়ে দুপদাপ নামছে। দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে প্রায় দৌড়চ্ছে বাড়ির দিকে।

দরজা খুলতে এসে তিতির অবাক, হাঁপাচ্ছিস কেন এত? কোত্থেকে এলি?

উত্তর দিল না বাপ্পা। বোনকে ঠেলে সরিয়ে বাবার ঘরে ঢুকেছে। দু-এক সেকেন্ড চোখ বন্ধ করে রইল। বাঁ হাতে কপালের ঘাম মুছছে।

জুলজুল চোখে দাদাকে দেখল তিতির, — হল কি তোর? কোথাও মারপিট করে এলি নাকি?

বাপ্পা কষ্ট করে হাসল। প্রাণপণে স্বাভাবিক করছে নিজেকে। এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। জয়মোহনের ছবিতে চোখ আটকে গেল। হাঁ করে তাকিয়ে আছে, তাকিয়েই আছে।

তিতির মুখের সামনে এসে হাত নাড়ল, অ্যাই, কী দেখছিস?

বাপ্পা ফ্যাসফেসে গলায় বলল, দাদুর ছবিটাকে রোজ একবার করে মুছিস না কেন?

মুছি তো। মাঝে হয়তো কটা দিন…

ছাই মুছিস। কবে একটা মালা পরিয়েছিলি, শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। ফ্রেশ একটা মালা দিতে পারিস না?

বিছানায় আধশোয়া আদিত্য উঠে বসেছে। বাবা মেয়ে চোখ চাওয়া-চাওয়ি করছে। বাপ্পা ঘর থেকে সরে এল।

রাতে ঘুম হল না বাপ্পার।

.

আরও কটা দিন কেটে গেল।

নিছক আলস্যে দিন কাটছে বাপ্পার। শুয়ে। বসে। মা জিজ্ঞাসা করে, তিতির কৌতূহল দেখায়, বাপ্পার একই উত্তর, ধুস ভাল্লাগে না। বিশ্রাম নিচ্ছি।

বন্ধুবান্ধবদের ফোন আসে মাঝে মাঝে। এসেই শেখরকে ফোন করেছিল, তার মুখ থেকে খবর পেয়ে অনেকেই বাপ্পার খোঁজখবর নেয়। শুধু একটা ফোনই এখনও এল না! ফোনটার প্রতীক্ষায় আছে বাপ্পা। শেখর ধীমানদের পার্ট টু পরীক্ষা এসে গেল, কলেজ বন্ধ, তারা এখন কোচিং টিউটোরিয়াল নিয়ে মহা ব্যস্ত। তারই মধ্যে তারা ইন্দ্রনীলকে ডাকাডাকি শুরু করেছে। কোন কোন বন্দরে বাপ্পার কটা গার্লফ্রেন্ড হল, কোথায় কী নিষিদ্ধ আনন্দ ভোগ করল, তার সবিস্তার কাহিনী শুনতে চায় তারা। হাহ, কী সব আজগুবি ধারণা! জাহাজিদের যেন চরিত্রের ঠিকঠিকানা থাকতে নেই! বিষ্ণুপ্রিয়াও কি এ রকমই ভাবে!

শেখর বলছিল বিষ্ণুপ্রিয়া নাকি পার্ট ওয়ানে দারুণ রেজাল্ট করেছে। ধীমানের মুখে শুনল কম্পিউটারে ভর্তি হয়েছে বিষ্ণুপ্রিয়া। এণাক্ষী উচ্ছ্বসিত হয়ে খবর দিল ইন্টার কলেজ কুইজ কম্পিটিশানে তাদের কলেজের মুখ পুড়িয়েছে বিষ্ণুপ্রিয়া, গোবেড়েন হেরেছে। সবই প্রাণহীন তথ্য, বাপ্পার নাইট স্কাই-এর খবর দেয় কে! সেলিমপুরের এই বাড়ি থেকে বিষ্ণুপ্রিয়ার বাড়ি আর কপা, তবু মনে হয় ছায়াপথের ওপারে। নীল সমুদ্রে বিষ্ণুপ্রিয়া অনেক অনেক কাছে ছিল।

ক্যাপেল নক্ষত্র কি খবর দেয়নি বাপ্পা এ শহরে ফিরে এসেছে?

এক-আধ দিন বিকেলে হাই পাওয়ার চশমা রোগাসোগা ওই মেয়েটা চুম্বকের মতো টানতে থাকে বাপ্পাকে, মোহগ্রস্তের মতো বাপ্পা বেরিয়ে পড়ে। দু-দশ গজ গেলেই অদৃশ্য এক নেভিগেটার হুইলটা ঘুরিয়ে দেয়, একদম উল্টো পথে চলে যায় বাপ্পা। ঝিল রোড ধরে হাঁটে, যাদবপুরের দিকে। আগে এ দিকটায় অনেক পুকুর-টুকুর ছিল, এখন সব বুজে গেছে। রোজ বাড়ি উঠছে নতুন নতুন। বাপ্পা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে বটে, মস্তিষ্কে কোনও ছবিই রেখাপাত করে না। জাহাজে থাকতে শহরটার ওপর যা একটু মায়া জন্মেছিল তাও যেন ফিকে হয়ে আসছে ক্রমশ। ভাল লাগে না, কিচ্ছু ভাল লাগে না। চোখের সামনে মরে যায় হলুদ বিকেল, সন্ধ্যা নামে। এতাল-বেতাল ঘুরে কোটরে ফেরে বাপ্পা।

বাড়ির হাল একই রকম। গয়ংগচ্ছ। ঘরের বদ্ধ বাতাসে সময়ের ঘোরাফেরা সেই শামুকের মতো। তিতির বাবা মা ছোটকা সবাই যে যার বৃত্তে ঘুরছে। বড়কাকা দু-দিন এক দিন পরপর সন্ধের দিকে আসে, খানিক গল্পটল্প করে চলে যায়। রবিবার বিকেলে কাকিমা আর অ্যাটমও এসেছিল। তিতিরের পরীক্ষা বলে বেশিক্ষণ রইল না, তার মধ্যেও একটা মলয় বয়ে গেল বাড়িতে। ছোটকা পিছনে লাগছে সকলের, তিতির হাসছে, কাকিমা হাসছে, কলকল করছে অ্যাটম। এমনকী মার গোমড়া মুখেও হঠাৎ হঠাৎ আলগা হাসি। তার পরেই অবশ্য বাড়ি আবার যে-নিঝুম সে-নিঝুম। ডাক্তার আঙ্কলও আজকাল খুব কম আসে। বসে না বেশিক্ষণ, কথাবার্তাও বলে না বিশেষ। বাবা মারা যাওয়ার পর ভারী চুপচাপ হয়ে গেছে মানুষটা।

সে রাতে ভয় পাওয়ার নেপথ্য কাহিনীটা গল্পচ্ছলেও কাউকে বলেনি বাপ্পা। দুঃস্বপ্ন বা মনের ভুল ভেবে নিজেকে উড়িয়ে দিয়েছে। তবে হ্যাঁ, সেই খোচো বুড়োটার জন্য এক ফোঁটা কষ্ট জমেছে বাপ্পার বুকে। ট্রাঙ্ক ঘেঁটে ঘেঁটে দাদুর একটা ছবি বার করল একদিন। ভরে রেখেছে নিজের স্যুটকেসে। জাহাজে নিয়ে যাবে। বুড়ো তার পিছনে লাগত খুব, কিন্তু তার দৌলতেই না বাপ্পা আজ…

হঠাই বাপ্পা ওশান লাইনারসের বম্বে অফিস থেকে একটা চিঠি পেল। সার্ভিস রেকর্ডে তার কি একটা ডিক্লারেশান দেওয়া বাকি আছে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একবার কলকাতা অফিসে গিয়ে দেখা করতে হবে। কী সব নমিনি-টমিনি করার ব্যাপার, যত দূর মনে হয় ইনসিওরেন্সের।

পর দিন দশটা নাগাদ বেরোনোর উদ্যোগ করছিল বাপ্পা। কন্দর্প সকাল কাল বেরিয়ে গেছে, ইন্দ্রাণী স্কুলে, তিতিরও একটু আগে নোটসের খোঁজে বন্ধুর বাড়ি গেল। সন্ধ্যার মাকে ভাতের তাড়া লাগিয়ে বাপ্পা দাড়ি কামাতে বসল। বিলিতি টিউব টিপে দেখে ফোম শেষ। ইশ, কালকেই এখান থেকে একটা কিনে নেবে ভেবেছিল। ভুলে গেছে। বেরিয়ে নিয়ে আসবে? পাঠাবে সন্ধ্যার মাকে?

কি ভেবে বাপ্পা পাশের ঘরে এল, তোমার শেভিং ক্রিমটা দাও তো বাবা।

আদিত্য কাগজ পড়ছিল। আমেরিকা ইরাকের যুদ্ধে মশগুল। বাপ্পার কথায় শশব্যস্ত হয়ে উঠল, ক্রিম তো নেই রে। আমি তো কেক ব্যবহার করি। নিবি?

–অ্যাঁ। বাপ্পা মাথা চুলকোল, দাও।

 তাড়াতাড়ি উঠে নিজের দাড়ি কামানোর বাক্স ঘাঁটছে আদিত্য। মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল, যেন ছেলে কিছু চেয়ে তাকে ধন্য করে দিয়েছে।

বাপ্পা সাবানটা নেড়েচেড়ে দেখল। হাসিমুখে বলল, – তোমার জন্য আজ একটা ভাল শেভিং ক্রিম কিনে আনব। কী যে মান্ধাতার আমলের জিনিস ব্যবহার করো।

–আমার এই ভাল রে। ..রোজগারপাতির ক্ষমতা নেই, মিছিমিছি আরেকটা শৌখিন অভ্যেস করি কেন?

বাবা এ রকমই কথা বলে আজকাল। আগে হলে বাপ্পা রেগে যেত, এখন কেমন করুণা হয়। মাথা নেড়ে বলল, – রোজগারপাতি করো না কেন? তোমার রঘুবীরবাবু তো প্রায়ই এসে ঘুরে যাচ্ছে, কী সব করছিলে আবার শুরু করে দাও।

দুর, ও হবে না রে।

 বাপ্পা চোখ কুঁচকে ভাবল একটু, বিজনেস না পারো চাকরি-বাকরির চেষ্টা করো।

এই বয়সে?

–এর চেয়ে বেশি বয়সে লোকে চাকরি জোটাতে পারে বাবা। তুমি ছোটকাকে একবার বলে দ্যাখো।

–চাঁদু!

–হ্যাঁঅ্যা। ছোটকা মুস্তাফিবাবুকে বললেই কিছু ছোটখাট বন্দোবস্ত হয়ে যাবে। তোমার তো আর সংসার চালানোর জন্য চাকরি করতে হবে না, জাস্ট পাসটাইম। চুপচাপ ঘরে বসে আছ…

আদিত্য কাঁচুমাচু মুখে বলল, – তোর মা পছন্দ করবে না।

–কি? চাকরি করা?

না। মুস্তাফিবাবুকে বলা।

 বাপ্পা হা হা করে হেসে উঠল, – ও তোমার মনগড়া ধারণা। …শোনো, মাথাটাকে এবার একটু ঠাণ্ডা করো। আবোল-তাবোল কাণ্ড আর না ঘটিয়ে কিছু একটা নিয়ে থাকো। শরীরও ভাল থাকবে, মনও ভাল থাকবে। ডোন্ট অ্যাকট লাইক এ ডেকাডেন্ট বুর্জোয়া। চাকরির ব্যাপারটা নয় আমিই বলব ছোটকাকে, তুমি করবে তো?

আদিত্য হ্যাঁ না কিছুই বলল না। যেন তার সম্মতি মূল্যহীন এমন একটা মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে।

বাপ্পা চলে আসছিল। বাবার ডাক শুনে ঘুরে দাঁড়াল, -বলবে কিছু?

আদিত্য ফ্যালফ্যাল করে দেখছে বাপ্পাকে।

–কী হল?

–না..কদিন ধরেই তোকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব ভাবছিলাম।

–কী?

বাড়ি ছেড়ে সমুদ্রে ঘুরে বেড়াতে তোর ভাল লাগে?

বাপ্পা কাঁধ ঝাঁকাল, চাকরি ইজ চাকরি।

–তা ঠিক। তবে কিনা..তুই আর ডাঙায় ফিরবি না বাপ্পা?

ভেতরে ভেতরে একটা নিশ্বাস পড়ল বাপ্পার। মনে মনে বলল, – ডাঙা ভাল, না জল ভাল এখনও বুঝতে পারিনি বাবা। মুখে বলল, – কটা বছর যাক। পরীক্ষা-টরীক্ষাগুলো দিয়ে প্রোমোশানগুলো পাই। ক্যাপ্টেন না হই চিফ অফিসার তো হতেই হবে।

তার মানে তুই ফিরবি না?

–তা কেন, প্রতি বছরই আসব। ছুটিতে…পরীক্ষা দিতে…আমার চিন্তা ছেড়ে নিজের কথা ভাব। আমি কিন্তু বলব ছোটকাকে।

খেতে বসেও বাবার কথাগুলো ঘুরছিল মনে। আরও যেন ভিতু জড়সড় হয়ে গেছে বাবা। চূড়ান্ত অসফল মানুষের কি শেষ পর্যন্ত এই পরিণতিই হয়? কীভাবে আর সাহায্য করা যায় লোকটাকে? মনে হয় হাতে এখন কিছুই নেই, হাতখরচা বলে টাকা দিয়ে দেবে কটা? দেওয়াই যায়। ছেলে হিসেবে বাপ্পারও তো কিছু কর্তব্য আছে। মা যখন তার একটা পয়সাও ছোঁবে না…

দিল বাপ্পা। বেরোনোর মুখে। দুশো টাকা। ভেবেচিন্তে কমই দিল, বেশি টাকা পেলে যদি আবার মতি বিগড়োয়! হেসে বলল, উল্টোপাল্টা খরচা কোরো না। লাগলে বোলো, আবার দেব।

একটু বুঝি কিন্তু কিন্তু ছিল আদিত্যর। শেষ পর্যন্ত নিয়েও নিল। সামান্য দুশো টাকা পেয়ে কোনও মানুষের মুখ যে এমন উদ্ভাসিত হতে পারে বাপ্পা জন্মে দেখেনি।

হালকা মেজাজে বেরিয়ে পড়ল বাপ্পা। দেওয়াতেও এত আনন্দ!

বাস স্টপে অনীকের সঙ্গে দেখা। অনীক তাকে খেয়াল করেনি, ব্যস্ত চোখে ঘড়ি দেখছে ঘন ঘন। বাপ্পাই কাছে গেল, কি রে, কি খবর?

অনীক অকৃত্রিম মুখে হাসল, –তুই! কবে এসেছিস?

–এই তো দশ বারো দিন।…তারপর বল, আছিস কেমন?

দুই বন্ধুতে কথা হল খানিকক্ষণ। কলেজে শেষের দিকে অনীক তাকে এড়িয়ে এড়িয়ে চলত, আজ মোটেই সে তেমনটা করছে না। তবে শুধু নিজের কথাই বলে চলেছে এই যা। …শিগগিরই চাটার্ড অ্যাকাউন্টেন্সির ফাউন্ডেশান কোর্সে ভর্তি হচ্ছে… অবশ্য সি-এ টি-এ হওয়া তার পছন্দ নয়…জামাইবাবুর ভাই অস্ট্রেলিয়া থেকে জব ভাউচার পাঠাচ্ছে…ঘ্যামচ্যাক চাকরি..ইমিগ্রেশান নিয়ে ওখানেই সেট করে গেলে মন্দ হয় না..ইত্যাদি ইত্যাদি। বাপ্পার জাহাজ, চাকরি, দেশবিদেশ কোনও কিছু নিয়েই তার কোনও প্রশ্ন নেই।

কি প্রসঙ্গে আলগা জিজ্ঞাসা করল, – গত মাসে আটলান্টিকে একটা জাহাজ ডুবে গেছিল না? তোরা তখন কোথায় ছিলি?

মিনিবাসে উঠেও আপন মনে হাসছিল বাপ্পা। অনীকের হৃদয়ের ক্ষতটা শুকোয়নি, বারফাট্টাই মেরে জ্বালা জুড়োতে চায়! অনীকের জামাইবাবুর ভাই অস্ট্রেলিয়া থাকে বলে তো কস্মিনকালে শোনেনি!

ঢিকুর ঢিকুর এগোচ্ছে ভিড়ে ঠাসা মিনিবাস। আট মাসে কলকাতায় যানবাহনের গতি যেন আরও কমে গেছে। বিড়লা প্ল্যানেটোরিয়াম পার হয়ে লম্বা জ্যামের পিছনে আটকে গেল। নিথর। অধৈর্য অফিসবাবুরা উঁকিঝুঁকি মারছে জানলা দিয়ে, বিরক্ত হয়ে উঠছে। মন্তব্য শোনা গেল, আমেরিকান এম্ব্যাসির সামনে আজ র‍্যালি আছে না?

-কিসের? কাদের?

হবে একটা কোনও পার্টির। লাল নীল হলদে সবুজ।

–গালফ ওয়ার নিয়ে?

–হ্যাঁ হ্যাঁ। ইরাককে একদম পেড়ে ফেলেছে না।

–শালা ইরাক গভর্নমেন্ট যদি জানত এখানে তাদের এত সাপোর্টার আছে, তাহলে এখান থেকেই লোক ধরে ধরে যুদ্ধে পাঠিয়ে দিত।

ইরাককেই তো সাপোর্ট করা উচিত। বাঘের বাচ্চার মতো লড়ছে। ওরা হারলে তেলের দাম চড়চড় করে বেড়ে যাবে।

–তাতে আপনার কি মশাই? চড়েন তো মিনিবাসে।

ইত্যাকার শব্দের ফুলঝুরির মাঝে হঠাই বাইরে একটা হট্টগোল। পাঁই পাঁই করে লোক ছুটে এল পার্ক স্ট্রিটের দিক থেকে। এক জায়গায় থেমে গেল। জটলা করছে।

বাস থেকে একজন চেঁচিয়ে উঠল, কী হয়েছে দাদা?

উত্তরের আগেই আধলা ইট উড়ে এল, ঝনঝন শব্দে ভেঙে পড়ল একটা জানলার কাচ। যাত্রীরা শিউরে উঠেছে, দুদ্দাড়িয়ে নেমে যাচ্ছে। আরও ইটের টুকরো ছুটে এল, সশব্দে আছড়ে পড়ছে প্রাইভেট গাড়ির চালে, ট্যাক্সির বনেটে। সে এক বিদিকিচ্ছিরি দৃশ্য।

বাপ্পার ব্রহ্মতালু জ্বলে গেল। সাধে কি শহরটাকে সে সহ্য করতে পারে না! একটা কাজও কি এখানে শান্তিতে করা যায়! কি যে করে? পাতাল রেল স্টেশনের দিকে ছুটবে? এসপ্ল্যানেড়ে নেমে বাকিটা পথ নয় হেঁটেই…। যাবে যাবে করছে, হঠাই ধোঁয়া ধোঁয়া হয়ে গেছে চারদিক। নির্ঘাত টিয়ার গ্যাসের শেল ছুঁড়ছে পুলিশ। মারাত্মক চোখ জ্বালা করছে। ইচ্ছে অনিচ্ছের পরোয়া না করেই বাপ্পার চোখ জলে ভরে গেল।

তখনই পুরনো একটা দিন এসে দাঁড়িয়েছে সামনে। সে আর বিষ্ণুপ্রিয়া অন্ধের মতো ছুটছে। বইয়ের দোকানে ঢুকেও লাফাচ্ছে হৃৎপিণ্ড। নাইট স্কাই কিনে দিল বিষ্ণুপ্রিয়া…

সব বন্ধুদের ছেড়ে বিষ্ণুপ্রিয়া কেন বাপ্পাকেই খুঁজেছিল সে দিন!

টিয়ার গ্যাসের শেলই কি বার্তা এনে দিল বিষ্ণুপ্রিয়ার? বার্তা, না আমন্ত্রণ? অফিসে নয় কালই যাবে বাপ্পা!

.

মুহূর্তের জন্য চমকেছিল বিষ্ণুপ্রিয়া। পরক্ষণেই কপালে ইয়া ইয়া ভাঁজ। চোয়াল শক্ত। টেরচা চোখে তাকিয়েছে, তুই! তুই কি মনে করে?

বাপ্পা বিবর্ণ মুখে হাসল, – এলাম।

–ও। বিষ্ণুপ্রিয়া গটগট করে ঢুকে গেল।

বাপ্পা কিংকর্তব্যবিমূঢ়। ভেতরে যাবে, কি যাবে না!

হনহন করে আবার দরজায় এসেছে বিষ্ণুপ্রিয়া, তোর কি কিছু বলার আছে?

বাপ্পা আরও নার্ভাস হয়ে গেল। বিষ্ণুপ্রিয়া কি তাকে দেখে খুশি হল না? দরজা থেকেই বিদায় করতে চায়?

থতমত মুখে বলল, না, নেই। মানে..হ্যাঁ হ্যাঁ আছে।

–তাড়াতাড়ি বল। আমি একটু ব্যস্ত আছি।

বাপ্পা মিইয়ে গেল, ভেতরে যেতে বলবি না?

আসবি আয়।

বাপ্পার যাওয়ার ইচ্ছে চলে গিয়েছিল। তবু পায়ে পায়ে ভেতরে ঢুকেছে। বিষ্ণুপ্রিয়ার ঘরে এসে চেয়ার টেনে বসল, আমি ছুটিতে এসেছি। সামনের মাসে চলে যাব।

বিষ্ণুপ্রিয়া যেন শুনেও শুনল না। পড়ার টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে বইখাতা গোছাচ্ছে। যেন এটাই এখন ভীষণ জরুরি কাজ।

বাপ্পা কথা খুঁজছিল, মাসিমা মেসোমশাই কেমন আছেন?

–ভাল।

–অফিস গেছেন?

যাওয়ারই তো কথা।

–আমি এখন এসে পড়াতে তোর কি অসুবিধে হল?

বিষ্ণুপ্রিয়া উত্তর দিল না। কটমট তাকিয়ে আছে।

তখনই বাপ্পা ভাল করে নজর করল বিষ্ণুপ্রিয়াকে। গাল দুটো একটু ভরাট হয়েছে বিষ্ণুপ্রিয়ার। মাজা রঙে অল্প চিকন আভা। না মিডি না ম্যাক্সি একটা লতরপতর পোশাক পরে আছে, কেমন যেন পাগলি পাগলি লাগে। পুরুষছাঁট চুল বেশ বড় এখন, মুখ বেয়ে ঝুলছে থোকা থোকা।

চশমার ব্রিজ তুলল বিষ্ণুপ্রিয়া, হাঁ করে দেখছিস কি?

-কিছু না। বাপ্পা চটপট মাথা নাড়ল। মনে হচ্ছে এসে তোকে ডিসটার্ব করলাম…

করেছিসই তো। বিষ্ণুপ্রিয়া ফোঁস করে উঠল, এখানে আসার কি দরকার ছিল? বারো দিন ধরে যেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছিস ঘোর না।

–তুই জানতিস আমি এসেছি? তবু খবর নিসনি?

-কেন খবর নেব? তুই আমাকে গিয়ে চিঠি দিয়েছিস?

জমানো চিঠিগুলো এখনও খামে ভরা আছে। বাপ্পা একটা শ্বাস গোপন করল। ফিস ফিস করে বলল, তুইও তো দিসনি।

–বেশ করেছি দিইনি। তুই চলে যা এখান থেকে। বলতে বলতে হঠাৎ বিস্ফোরিত হল বিষ্ণুপ্রিয়া। ড্রেসিং টেবিলের দিকে ছুটে গেছে। পাউডার লিপস্টিক চিরুনি ক্লিপ যা হাতের কাছে পাচ্ছে ছুঁড়ছে বাপ্পার দিকে। টেবিল থেকে বইখাতা নিয়ে ছুঁড়ে মারতে শুরু করল, যা বলছি। চলে যা। চলে যা।

উড়ন্ত মিসাইলগুলো দু হাতে আটকানোর চেষ্টা করছে বাপ্পা। নির্বোধের মতো হাসছে, কী হচ্ছে কী? কী হচ্ছে কি? থাম। …তোকে অনেক গল্প বলার ছিল…জানিস বসফরাস পার হওয়ার সময়ে সে কী ফগ…সামনে একটা ডুবোপাহাড়…

-চুপ। কে তোর কাছে গল্প শুনতে চায়! বালিশ তুলে সজোরে বাপ্পার মাথায় আছাড় মারল বিষ্ণুপ্রিয়া। লালচে মুখে ভাঙচুর হচ্ছে ক্রমশ। গলা ভেঙে এল। ঠোঁট কামড়ে ধরেছে। চোখের কোণে কী যেন চিকচিক করছে। জল, না বিদ্যুৎ?

বালিশ ফেটে পেঁজা তুলোয় ভরে গেল গোটা ঘর। ফাল্গুনের হাওয়ায় ভাসছে তুলো। স্বপ্নের মতো।

.

৯২.

সময় এক উদাসীন স্রোত। মানুষের সুখ-দুঃখ আনন্দ-বিষাদ উল্লাস-অবসাদ কোনও কিছুতেই তার কৌতূহল নেই। সে চলে আপন খেয়ালে। জীবন কখনও কখনও থমকে যায়, সময় দাঁড়ায় না। কোথায় কোন এক ইন্দ্রাণী নিজের ঊর্ণনাভে নিজেকে আরও জড়িয়ে নিল, অথবা কে এক আদিত্য রোগশয্যা ছেড়ে সুস্থ মানুষের মতো আবার পথে বেরোচ্ছে, সময় তার কোনও খবরই রাখে না। দেখতে দেখতে বাপ্পার ছুটি ফুরিয়ে এল। দেখতে দেখতে শুরু হয়ে গেছে তিতিরের হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা।

তিতিরের সিট পড়েছে শেয়ালদায়, লরেটো হাউসে। কন্দর্প বা বাপ্পা কেউ এসে পৌঁছে দিয়ে যায় তাকে। আদিত্য আসে টিফিন টাইমে, পরীক্ষা শেষে মেয়েকে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্বও তার। দায়িত্বটা সে স্বেচ্ছায়ই নিয়েছে। বন্ধুবান্ধবদের ছেড়ে বাবার সঙ্গে ফিরতে তিতির লজ্জা পায় খুব, আবার খুশিও হয়। মেয়ের খুশিটুকুতেই আদিত্য খুশি।

আজ তিতিরের ইতিহাস পরীক্ষা। টিফিনের পর মেয়ে আবার হলে ঢুকে যেতে রঘুবীরের কাছে গেল আদিত্য।

সম্প্রতি বউবাজারের এক সোনার দোকানে বসছে রঘুবীর। দোকানটা তেমন বড় নয়, তবে অনেক কালের পুরনো, প্রায় আশি-নব্বই বছরের। একসময়ে যখন এ-পাড়ায় নিষিদ্ধ আনন্দের রমরমা ছিল তখন খুব চালু ছিল দোকানটা, এখন অবস্থা পড়তির দিকে। দোকান-মালিক দমদম নাগেরবাজারে প্রকাণ্ড এক টিভি ফ্রিজ ওয়াশিং মেশিনের শোরুম খুলেছে, তিন পুরুষের এই কারবারে তার তেমন মতি নেই। তবে ইদানীং গ্ৰহরত্নের কারবারে ঈষৎ আগ্রহ জমেছে তার, কয়েকজন জ্যোতিষীকে এনে বসিয়েছে দোকানে। পিছন দিকে চেম্বার করে দিয়েছে একটা। ছোট্ট, চার বাই ছয়। সন্ধের দিকটা নামী দামি ভাগ্যগণকের জন্য বরাদ্দ, রঘুবীরের ভাগে দুপুর। দুটো থেকে চারটে। খদ্দেরদের কপাল বিচার করা ছাড়াও আর একটা বাঁধা কাজ পেয়েছে রঘুবীর। সহজ কাজ। ভাল-মন্দ মিশিয়ে দৈনিক রাশিফল লিখে প্রতিদিন দোকানের সামনে টাঙিয়ে রাখা। মাস গেলে এর জন্য একটা মাইনে মতো পায়। দু ঘণ্টার চেম্বারে তার খদ্দের আর কত হয়, ওই টাকা কটাই যা লাভ।

আজ রঘুবীরের চেম্বার ফাঁকা নেই, এক মহিলা বসে। বছর পঁয়ত্রিশেক বয়স। স্কয়াটে রূপের মলিন দীপ্তি লেগে আছে মহিলার মুখে, চোখের তলায় কালি, ফর্সা গালে ফুট ফুট বাদামি ছোপ। দরজায় উঁকি দিয়ে ঢুকতে ইতস্তত করছিল আদিত্য, রঘুবীরের ইশারায় পিছনে গিয়ে বসল। চৈত্রের তাপে ঝলসানো শরীর জুড়োচ্ছে আস্তে আস্তে।

রঘুবীরের পরনে গেরুয়া, খালি গা, কপালে রক্তচন্দনের ফোঁটা, সাদা পৈতে কাঁধে ঝকঝক। কাগজে কী সব আঁকিবুকি কাটায় মগ্ন রঘুবীর। হঠাৎ নাক কুঁচকে চোখের কোণ দিয়ে দেখল মহিলাকে, — মেয়ের বয়স কত বললেন যেন?

জুলাইয়ে ষোলো পুরবে। তেইশে আষাঢ়।

–হুঁ। রঘুবীর মুখ নামাল। আবার কাগজে চোখ। ইয়া বড় মাথাখানা আপনমনে দোলাচ্ছে। একটু পরে পরিপূর্ণ চোখে তাকাল মহিলার দিকে, আপনার মেয়ের এখন তো কোনও বিবাহের যোগ নেই। অন্তত সাত বছর তিন মাস।

সাআআত বছর! মহিলা প্রায় আর্তনাদ করে উঠেছে, ওটা একটু তাড়াতাড়ি করা যায় না ঠাকুর?

যায়। তবে সমস্যা আছে।

–কী সমস্যা?

-সেটা অবশ্য একটা পোখরাজ দিয়ে সামাল দেওয়া যায়। তাতে কিন্তু আপনার মেয়ে সুখী হবে না। মাতার প্রভাব পড়বে। আপনার মেয়ের মাতৃস্থান, মানে চন্দ্রের স্থানও একটু দুর্বল।

–তাহলে?

 –আপনি আগে একটা মুক্তো ধারণ করুন। তিন রতির।

মহিলা কি যেন ভাবছে। আবার কি বলতে গিয়ে থেমে গেল, আড়ে দেখল আদিত্যকে।

আদিত্য অস্বস্তি বোধ করল। তার কি এখন উঠে যাওয়া উচিত?

রঘুবীর দাড়ি চুমরে হাসল, এঁকে দেখে সঙ্কোচ করবেন না। ইনি হলেন আমার গুরুদেবপ্রতিম। …বলুন আর কি? পাত্র কেমন হবে জানতে চান?

মহিলা মাথা নাড়ল।

–আপনার মেয়ের পতিস্থানে বুধের যোগ আছে। ছেলে ভালই হবে।

–গৃহী হবে তো?

হা হা হেসে উঠল রঘুবীর, আপনি গৃহী চান?

মহিলার মুখ আচমকা পাংশু হয়ে গেল।

রঘুবীর হাসি থামিয়ে বলল, আপনার মেয়ে আপনার চেয়ে অসুখী হবে না এটুকু আমি বলে দিতে পারি। মুক্তো ধারণ করার পর ছ মাস অপেক্ষা করুন, তারপর আমার কাছে আসবেন। মেয়েকেও তখন সঙ্গে নিয়ে আসবেন।

–সে তো এখানে নেই ঠাকুর।

জানি। হোস্টেলে আছে। পড়াশুনো করছে।

-কী করে জানলেন ঠাকুর? আমি তো বলিনি।

রঘুবীর চোখ বুজে হাসল, কপালের লিখন পড়াই তো আমার কাজ। …যাক গে শুনুন, মেয়ের পিতা যখন থেকেও নেই, সব ভাবনা আপনার। রত্ন ধারণের সময়ে কার্পণ্য করবেন না। মুক্তোটি কিনুন, আমি শুদ্ধ করে দেব। মন্ত্রধারণের দিন দেহ মন সব শুচি রাখবেন। না হলে হিতে বিপরীত হবে। ….এই দোকান থেকেই কিনতে হবে তার কোনও মানে নেই। তবে এখান থেকে নিলে আমি মুক্তোটি পরীক্ষা করে দিতে পারব। ..অনেক ঠক প্রবঞ্চক তো আছে এই লাইনে…

মহিলা পার্স খুলে একটা কুড়ি টাকার নোট রাখল টেবিলে। ঘুরে গিয়ে রঘুবীরকে প্রণাম করল। আদিত্যরও পায়ে হাত দিতে যাচ্ছিল, প্রায় হাঁ হাঁ করে উঠল আদিত্য।

মহিলা চলে গেল।

রঘুবীর হাঁক পাড়ল, রবি, দুটো চা দিয়ে যাও দেখি। রায়বাবু এসেছেন।

আদিত্য মিটিমিটি হাসছিল, খুব জপালেন যা হোক?

রঘুবীর চেয়ারে বাবু হয়ে বসেছে, — আরে রায়দা, এদের হল গিয়ে কাঁচা টাকা। দুইয়ে না নিলে হয়!

-মানে?

–চেহারা দেখে বুঝলেন না? আঙুলে একটি চার রতির বৈদুর্যমণি রয়েছে। বৈদুর্যমণি কেন ধারণ করে?

-কেন?

 –গুপ্ত শত্রু থাকলে… রঘুবীর চোখ টিপল, আর গুপ্ত রোগ থাকলে। কী বুঝলেন?

বুঝলাম না।

মেয়েটা ভাল নয়। …হাঁটার সময়ে কোমরের দুলুনিটা লক্ষ করেছিলেন? বাইজি। এখন তো আর ওইসব কত্থক-ফত্থক হয় না, খেমটা নাচে, আর আলু পটলঅলা ধরে। লাইনে নামাবে না বলে মেয়েকে সরিয়ে রেখেছে, তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে পার করে দিতে চায়।

–আহা রে বেচারা। আদিত্য সামান্য উদাস হল, যতই হোক মায়ের প্রাণ তো।

হুঁহ, মায়ের প্রাণ! রঘুবীরের ঠোঁট বেঁকে গেল, মেয়ের বিয়ে দিয়ে নিষ্কণ্টক হয়ে ব্যবসা– করতে চায়। …অত সহজে পার পাওয়া যায়? পাপ করছিস, একটু ভোগ। মাল খসা।

–ওভাবে বলছেন কেন? মার কত যাতনা বোঝেন?

ছাড়ন তো। মার যাতনা! মা-ফা আমার দেখা আছে। মেয়েছেলেরা সব এক। মা কেমন। হয় আমি দেখিনি?

রঘুবীরের জ্বালাটা কোথায় একটু একটু বুঝতে পারছিল আদিত্য। কোমল স্বরে বলল, একজনের ওপর অভিমান করে নারী জাতির ওপর আপনি অবিচার করতে পারেন না ভাই। আপনার মাসিও তো মহিলা, নয় কি?

রঘুবীর পলকের জন্য গুম। তারপর জোরে হেসে উঠেছে, — আপনি মাসি দেখিয়ে আমার দুর্বল করে দিতে চাইছেন? আরে মশাই, মাসি কপালদোষে আমার সঙ্গে এক জাঁতাকলে পেষাই হচ্ছে। আরে বাবা, সেই ব্যাটা হারামির পো মাসিকে ছেড়ে না গেলে মাসি হোড়াই আমায় আপন বলে ভাবত! আমার মাসিকে যতটা দরকার ছিল, মাসিরও আমাকে ততটাই দরকার ছিল। আর এটাই হল গিয়ে সম্পর্ক। ঘরসংসার, আপনার লোক, মা বাবা ছেলেমেয়ে সব বোগাস। সব হল গিয়ে দিবে আর নিবে। সব সম্পর্কই তৈরি হয় শুধুই প্রয়োজনে, বুঝলেন?

আদিত্যর বুকে খুট খুট বাজছিল কথাগুলো। এত চাঁছাছোলাভাবে তো না বললেও হয়। সম্পর্কের ব্যাখ্যা কি এতই নীরস? সম্পর্কে তো যন্ত্রণাও থাকে, সুখ আনন্দ থাকে, আর থাকে এক অনন্ত হাহাকার। প্রয়োজনের খড়ির গণ্ডিতে তাকে বেঁধে ফেললে মানুষ বাঁচে কী করে? তাছাড়া সম্পর্কের সংজ্ঞা বোধহয় অত সরলও নয়। ছকে বাঁধাও নয়। না হলে হাসপাতালে আদিত্যর বেডের পাশে দাঁড়িয়ে বিজলি চোখ মোছে কেন? ইন্দ্রাণী তাকে কীটাণুকীট ভাবা সত্ত্বেও কেন সম্পর্কের সুতো ছিঁড়তে চায় না? যে মার মুখটাও মনে নেই, কেন তার প্রসঙ্গ উঠলে জ্বলে ওঠে রঘুবীর?

আদিত্য মিন মিন করে বলল, আপনি বড্ড নিরাশাবাদী হয়ে যাচ্ছেন রঘুবীরবাবু।

–মোটেই না। প্লাস্টিকের হাত দিয়ে পিঠ চুলকোচ্ছে রঘুবীর, আমি কড়োয়া সচ বলি। আরও কঠিন সত্যি শুনবেন? মানুষ এই পৃথিবীতে কিস্যুটি নিয়ে আসে না, আবার কোনও কিছুই তার এখানে রেখে যাওয়ার জো নেই। যা যা ভাল কাজ করবে তার ফল এখানেই পাবে। মন্দ কাজ করলে তার সাজাও এখান থেকেই পেতে হয়। কড়ায়গণ্ডায় সব বুঝিয়ে দিয়ে তবে আপনার ছুটি। মানেন তো?

–তুঠাৎ এ কথা এসে গেল কেন?

কারণ ওই যে মেয়েটার দুঃখে আপনার প্রাণ কাঁদল। আরে, খবর নিয়ে দেখুন এককালে কাকে দাগা দিয়ে কার সঙ্গে ভেগে পড়েছিল মেয়েটা। তার জন্য ঘানি টানতে হবে না? আমার মা ছাড়ান পেয়েছে? এই যে আমি, পেট পিঠের যন্ত্রণায় সাত দিনে এক দিন কেতরে পড়ে থাকি, সে কি কোনও পূর্ব জন্মের পাপে?

আদিত্যর আর শুনতে ভাল লাগছিল না। বড্ড মায়ামমতাহীন নির্দয় কথা বলে রঘুবীর। বড় বেশি অনুভূতিহীন। মেয়েটা তো জন্মসূত্রেও খারাপ পথে এসে পড়তে পারে। অনেক সময়ে তো ভালবাসার টোপ দিয়েও এদের এনে ফেলে দেয়। জোর করেও তো ধরে আনা হয় কতজনকে। পেটের টানেও আসে কেউ কেউ। রঘুবীর এসব কিছুই বোঝে না। বোঝে না, না বুঝতে চায় না?

তেতো হেসে রঘুবীর বলল, – সবই তো বুঝলাম চাটুজ্যেমশাই। কিন্তু এত সত্যি জেনে, এত সত্যি বুঝে আপনি করলেনটা কী? এখানে বসে যে কাজটি করছেন সেটাই তো মিথ্যের বেসাতি।

–মোটেই না। রঘুবীর পিঠ চুলকোনো থামাল। গমগম হেসে বলল, – মিথ্যের ব্যবসা তো আমি করি না। আমি মানুষের কাছে স্বপ্ন বেচি। আশা বেচি। দুঃখ কষ্ট ভুলবার সুলুকসন্ধান বেচি। মানুষের কপালের সামনে একটা খুড়োর কল ঝুলিয়ে দিই, কলে বাঁধা স্বপ্নটার পেছনে দৌড়য় মানুষ। তার জন্য তারা একটা মূল্য ধরে দেয়।

স্বপ্ন বেচারও কত রকমফের! দুর্লভের কথা মনে পড়ল আদিত্যর। তিতিরের কাছে শুনেছে সেও নাকি পাঁচ-দশ পয়সায় স্বপ্ন বেচত কচিকাঁচাঁদের। দুর্লভের স্বপ্নও বানানো, কিন্তু তা মনে আনন্দ দেওয়ার জন্যে, কল্পনার জগতে তুলি বোলানোর জন্যে। আর এই লোকটা নির্জলা মিথ্যে বেচে তাতে স্বপ্নের লেবেল মেরে দিতে চায়।

দোকানের কর্মচারীটা চা এনেছে। ভাঁড় হাতে তুলে চুমুক দিল রঘুবীর। কালি ভঙ্গিতে বলল, যাক গে যাক, ছাড়েন। আপনার মেয়ের পরীক্ষা কেমন হচ্ছে বলুন।

–ভালই তো হওয়া উচিত। এবার খেটেছে খুব।

বলছে না কেমন হচ্ছে?

-মেয়েরা বলে না। আদিত্য অনেকক্ষণ পর সহজ হল। হাসছে, কলেজে ক্লাসের মেয়েগুলোকে তো দেখতাম, পরীক্ষার পর সবার মুখ বেজার, এদিকে রেজাল্ট যখন বেরোল…

-কলেজে আপনার মেয়ে বন্ধু ছিল?

 –তা ছিল।

তাদের মধ্যে থেকে একটাকে জপাতে পারেননি?

–জপাতে আমি কারুকেই পারি না ভাই। এটাই তো আমার মহা দোষ।

–দোষই বটে। রঘুবীর হ্যা হ্যা হাসছে, তা এই বুড়োবয়সে কি সেই দোষ কাটানোর চেষ্টা করছেন নাকি?

–কেন?

-না, মানে আজকাল যা-সব চকরাবকরা ড্রেস মারছেন!

-ওহ। আপনি আমার সেই চকোলেট রঙের শার্টটার কথা বলছেন? ওটা আমাকে বাপ্পা দিয়েছে।

–ছেলে! আপনার তো কপাল খুলে গেল মশাই। আর কি, এবার টেরিটি কেটে, নবকার্তিকটি সেজে, চোখে একটা গগলস হাঁকিয়ে গড়িয়াহাটের মোড়ে ছিপ ফেলে বসে থাকুন।

যাহ। আদিত্য ভীষণ লজ্জা পেল।

–যা নয়, হ্যাঁ। কাজকর্ম করতে হবে না, এখন থেকে ছেলেমেয়েই খাওয়াবে, বউদিকেও পরোয়া করার দরকার নেই… আপনার তো এখন সুখই সুখ।

আদিত্য ঘাড়ে হাত বোলাল, কাজ বোধহয় একটা করব।

–ওই অনিলটার সঙ্গে? রঘুবীরের মুখ বদলে গেল, কন্ট্রাক্টরি শিকেয় তুলে ওই ফিরিওলার কাজ আপনার মনে ধরল?

না না না, অনিল-ফনিল নয়। আদিত্য জিভ কাটল। লাজুক মুখে বলল, আমি বোধহয় আবার একটা চাকরি করব।

রঘুবীরের ঠিক বিশ্বাস হল না কথাটা। একটু হাঁ হয়ে থেকে বলল, – বোধহয় বলছেন কেন?

বাপ্পা চাঁদু ঠিক করছে তো, তাই। দেখা যাক কী হয়। নইলে আপনি তো রইলেনই।

রঘুবীরের মুখটা বিমর্ষ দেখাল। টুক করে একটা বিড়ি বার করে ঘষল তেলোয়। ধরানোর আগে একবার উঠে কিউবিকলের বাইরেটা উঁকি দিয়ে দেখে এল। ধোঁয়া ছেড়ে বলল, না। আপনার সঙ্গে আমার কাট্টি হয়ে গেল। হাসপাতালে যে মানুষটার সঙ্গে আমি যেচে আলাপ করেছিলাম, সে ছিল আমারই মতো। তফাত, আমি ছিলাম ষণ্ডাগণ্ডা, আপনি ছিলেন দুবলা। তবে মনটায় আপনার অ্যাডভেঞ্চার ছিল। আমারই মতো। কিন্তু আপনি ছাপোষা গেরস্থ হয়ে গেলে আপনার সঙ্গ আমার ভাল লাগবে কেন?

–তা কেন! অবরে-সবরে আমরা একসঙ্গে বসব, একটু খাব-টাব…

–আবার খাবেন?

–ছেলে বলেছে মাসে দু মাসে এক আধদিন খেলে ক্ষতি কিছু নেই।

খুব ছেলে ছেলে করছেন! ছেলে ফিরে এসে আপনাকে বশ করে ফেলেছে দেখছি।

 আদিত্য চুপ হয়ে গেল। সত্যিই ছেলের সামান্য মিষ্টি কথা, একটু দরদ কেমন যেন বদল ঘটিয়ে দিয়েছে ভেতরে। একটা অপার স্নেহ, একটা নিঃশর্ত বাধ্যতা টিপটিপ নড়াচড়া করে বুকে। ইন্দ্রাণীর তীক্ষ্ণ কটু বাক্য, হাসপাতালে একটি দিনের তরেও দেখতে না যাওয়া, ফিরে আসার পরেও নিঃশব্দ অবহেলা তাকে যে গভীর আচ্ছন্নতার দিকে ঠেলে দিয়েছিল তা যেন কেটে যাচ্ছে ক্রমশ। বরং এখন করুণা হয় ইন্দ্রাণীর জন্য। নিজের জেদে ছেলেমেয়েদের হারাচ্ছে ইন্দু।

বাপ্পার ওপর আদিত্যর এই টানটা যে ঠিক কিরকম! তিতিরের প্রতি আদিত্যর যে ভালবাসা, তার তীব্রতার সঙ্গে কোনও কিছুরই তুলনা চলে না। কিন্তু বাপ্পা যেন পরতে পরতে ঘিরে থাকা এক অদৃশ্য মায়া। চিরকাল ছেলের একটু ভালবাসার কাঙাল ছিল আদিত্য, এতদিনে বুঝেছে ছেলে। হঠাৎ কুড়িয়ে পাওয়া এই সুখটুকু যে কোথায় রাখে আদিত্য!

রঘুবীর ফোঁস করে শ্বাস ফেলল, বুঝলাম, আপনি এখন মৌজে আছেন। আমারও আর ভাল লাগে না। কটা টাকা যদি জমাতে পারি, এই খুঁটে খুঁটে খাওয়া জীবনটাকে শেষ করে দেব।

–ওমা, ও কি কথা! আদিত্য আঁতকে উঠল, — জীবন শেষ করে দেবেন…

না না মশাই, মরব না। রঘুবীর চাটুজ্যে লড়তে এসেছে, পালিয়ে যেতে নয়। ভাবছি মাসিকে নিয়ে কুলগাছিয়ার দিকে চলে যাব। হাতে কিছু টাকা থাকল, বাড়িখানা বেচেও কিছু এল, মাসি বোনোর শান্তিতে কেটে যাবে জীবনটা। বলেই ফিক করে হাসল লোকটা, কিন্তু তা হওয়ার নয়, আমি জানি। …আমি যাই বঙ্গে, আমার কপাল যায় সঙ্গে। লোকের কপাল দেখার ছল করতে গিয়ে কখন যে নিজের কপালটা পুড়ে গেছে! ওই শান্তি-মান্তির জীবন বোধহয় আমার পোষাবে না। গাঁয়ে গেলেও হয়তো…

রঘুবীরের মধ্যেও দ্বিধাদ্বন্দ্বের চোরা রেখা! পাহাড়ের মতো মানুষেরও তবে ভাঙচুর চলে! এই ভাঙচুরের নামই কি বেঁচে থাকা!

রঘুবীরের কাছে আর একটা ক্লায়েন্ট এসে গেছে আজ। বোধহয় জমি বাড়ি বা ব্যবসা সম্পর্কে গণনা করাতে চায়। রঘুবীরের পীড়াপীড়ি সত্ত্বেও বেরিয়ে এল আদিত্য। চৈত্রের নোর পড়ে এসেছে খানিকটা, কিছুক্ষণ এলোমেলো ঘুরল রাস্তায়। লেবুতলা পার্কে এসে ছায়া দেখে বসেছে। ধুলো মাঠে ফুটবল খেলছে বাচ্চারা, ছোট ছোট ঘূর্ণি উঠছে হাওয়ায়, ক্ষণে ক্ষণে ধোঁয়া ধোঁয়া হয়ে যায় মাঠ, আবার স্বচ্ছ, স্বাভাবিক। কৃষ্ণচূড়ার গাছে গাছে আগুন লেগেছে যেন, লাল ফুলকি ঝরে পড়ে মাঝে মাঝে। একটা মজুর মতো লোক নিশ্চিন্তে নিদ্রা যাচ্ছে ছায়ায়, একটা ঘেয়ো কুকুর তার পাশে গিয়ে বন্ধুর মতো শুয়ে পড়ল। রঘুবীরের রাহু-কেতুর বিচার দেখার চেয়ে এই দৃশ্য ঢের বেশি সুন্দর। ভাল লাগে, বেঁচে থাকাটা সার্থক মনে হয়।

পাঁচটা নাগাদ পরীক্ষার হলের সামনে পৌঁছে গেল আদিত্য। একটু দাঁড়াতে না-দাঁড়াতেই তিতির হাজির। পরীক্ষা আজ মন্দ হয়নি মেয়ের, ঝরনার মতো কলকল করছে।

হাঁটছে দুজনে। মৌলালি থেকে বাস ধরবে।

ক পা গিয়ে আদিত্য জিজ্ঞাসা করল, — খাবি কিছু?

-কী খাওয়াবে? …আগের দিনের মতো রোল-টোল নয়, অন্য কিছু।

–তুইই বল কি খাবি?

বাবার হাত ধরে টানল তিতির, ফুচকা খাওয়াবে বাবা?

–তাহলে তো আবার উল্টোদিকে ফিরতে হয়।

চলো না বাবা। কতদিন আমরা দুজনে ফুচকা খাইনি।

 ফিরতে গিয়ে একটা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে গেল আদিত্য। শোকেসে একটা গাঢ় মেরুন টিশার্ট ঝুলছে। গায়ে তার টানা টানা হরফে লেখা, রিমেমবার মি।

তিতির, ওই শার্টটা কেমন রে?

রঙটা চলেবল। সাদা দিয়ে লেখাটা ক্যাটক্যাট করছে।

–আমার তো বেশ লাগছে। কিনব? কিনে ফেলব?

–ওমা, কেন?

–তোর দাদার জন্য।

ফালতু কিনবে কেন? দাদার কি টিশার্টের অভাব? এই তো সেদিন নিউ মার্কেট থেকে এককাঁড়ি কিনে আনল।

–তা হোক। আমি নয় একটা দিলাম। পরশু ছেলেটা চলে যাচ্ছে… শ খানেক-শ দেড়েকের মধ্যে হয়ে যাবে না?

–হতে পারে। বলেই তিতিরের চোখ ছোট, তুমি টাকা কোথায় পেলে বাবা?

আদিত্য মুচকি হাসল, বাপ্পারই টাকা। আমায় দিয়েছিল।

-দাদার টাকায় দাদাকেই… স্ট্রেঞ্জ তো!

টাকা নয়, এ যে কুড়িয়ে পাওয়া ভালবাসা। আদিত্য মনে মনে বলল কথাটা। এই ভালবাসা লেনদেন করাতে যে কী তৃপ্তি!

.

বাপ্পার ফ্লাইট ছটায়। দমদম থেকে মুম্বাই হয়ে সে চলে যাবে লঙবিচ, সেখানেই এখন অপেক্ষা করছে মার্মেড। তারপর আবার সেই বন্দরে বন্দরে ঘোরা, আবার সেই সাগর-মহাসাগরে ভেসে চলা অবিরাম।

মনটা খারাপ লাগছিল বাপ্পার। শেষদিকে ছুটিটা যেন আলোর গতিতে কেটে গেল। বিষ্ণুপ্রিয়ার সামনে পরীক্ষা, তবু একদিন বাপ্পার দেখা না পেলে তার মুখে কালবৈশাখীর মেঘ থমথম। বকবকম চলছে তো চলছেই। কত কথা যে জমে ছিল দুজনের বুকে, একই কথা কতবার বলল তারা। কিছু না হলেও কমসে কম পনেরোটা সিনেমা দেখা হয়ে গেল। সেলুলয়েডের পর্দায় অরুচি ধরলে হাঁটো কলকাতার রাস্তায় রাস্তায়। চলো লেকের পাড় কিংবা গঙ্গার ধার। নদীর কিনারই বাপ্পার বেশি প্রিয়। এখানে বসে অনেক একা সন্ধে কেটেছে বাপ্পার। এখন বিষ্ণুপ্রিয়াকে সেসব কথা গল্প করতে ভারি ভাল লাগে। বিষ্ণুপ্রিয়া কথা দিয়েছে এবার শুধু রাতের আকাশে নয়, দিনের আলোতেও সে কাছাকাছি থাকবে বাপ্পার।

বন্দরের গন্ধ নিয়ে প্রথম যে সীগালটা মার্সেডে এসে বসবে সেটাই হবে বিষ্ণুপ্রিয়া। পাগলি কোথাকার।

বিষ্ণুপ্রিয়াকে চিঠিগুলো দেওয়া হয়নি। বাপ্পা দিতে চেয়েছিল, বিষ্ণুপ্রিয়াই নেয়নি। বলেছে তারা যখন বুড়ো হবে, পাকা চুল আর বাঁধানো দাঁত নিয়ে দিনরাত খিটিমিটি করবে দুজনে, তখনই ওই চিঠি একটা একটা করে নেবে বিষ্ণুপ্রিয়া।

আদিত্য ট্যাক্সি ডেকে এনেছে। সুদীপ ভাইপোর অনারে অফিস ডুব মেরেছে, অ্যাটমকে নিয়ে আদিত্যর সঙ্গে সেও আজ বাপ্পাকে এয়ারপোর্টে সি-অফ করতে যাবে। তিতিরেরও যাওয়ার খুব ইচ্ছে ছিল। উপায় নেই। পরীক্ষা।

মা কাকিমাকে প্রণাম সেরে ডিকিতে ঢাউস সুটকেস দুখানা তুলল বাপ্পা। তিতির ছলছল চোখে তাকিয়ে, তার মাথায় একটা আলগা চাঁটি মেরে নিল, — ঠিকঠাক থাকিস।

সুদীপ ট্যাক্সিতে বসে ডাকছে, আয় রে। এক ঘণ্টা আগে তোকে রিপোর্ট করতে হবে।

 বাপ্পা বলল, – যাই।

ট্যাক্সি ছাড়ছে। ঘুরে গ্রিল বারান্দার দিকে তাকাল বাপ্পা। এই মাত্র বারান্দায় ছবির মতো দাঁড়িয়ে ছিল মা কাকিমা আর তিতির, মা গেল কোথায়! ট্যাক্সি ছাড়ার আগেই ঘরে ঢুকে গেল!

গলির শেষে ব্যাক করে ট্যাক্সি আবার বাড়ির সামনে দিয়ে যাচ্ছে। কাকিমা তিতিরকে হাত নাড়ল বাপ্পা। তখনই মার ঘরের জানলায় চোখ আটকে গেছে। পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছে মা। বাইরে বিকেলের আলো, ঘরের ভেতরটা অন্ধকার, ছায়া ছায়া মাকে কী ভয়ঙ্কর একা লাগছে!

একটা অজানা আতঙ্কে, কে জানে কেন, বাপ্পার বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল।

.

৯৩.

-কিরে চাঁদু, একেবারে ডুমুরের ফুল হয়ে গেছিস, অ্যাঁ?

গাড়ির তেলট্যাঙ্কির ঢাকনা হাতে নিয়ে কন্দর্প এদিক-ওদিক তাকাল। পেট্রল পাম্পের সামনের ফুটপাথ থেকে চেঁচাচ্ছে শ্যামল। রাসবিহারীর চা-আড্ডার বন্ধু।

পাম্পের কর্মচারীকে গাড়িতে দশ লিটার তেল দিতে বলে শ্যামলকে হাত নেড়ে ডাকল কন্দর্প। কাছে আসতেই বলল, – একদম সময় পাই না রে।

হুঁ, সে তো জানি। তুই এখন বিগ স্টার…

ধুস, স্টার না কচু! তারপর বল, তোদের সব খবর কি? পঞ্চদা আসছে রোজ? রবিনের টুপি দেওয়ার অভ্যেস কমল?

–সে জেনে তোর আর কি লাভ! তোর কাছে আমরা তো এখন নন-এনটিটি। …এখনও এই গাড়ি চড়ছিস যে? মারুতি-ফারুতি লাগা।

ঠাট্টার সুর, কিন্তু যেন চাপা ক্ষোভও আছে সঙ্গে। থাকাটা অসঙ্গত নয়। এককালে এই শ্যামলের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে স্টুডিওপাড়া চষে বেরিয়েছে কন্দর্প, পা রাখার মাটি খুঁজেছে, একই ডিরেক্টরের কাছে একই ভাষায় গলাধাক্কা খেয়েছে দুজনে। যেভাবেই হোক, ছবিটা আজ বদলে গেছে তো! শ্যামল তার চেয়ে কোনও অংশে খারাপ অভিনেতা নয়, চেহারাতে মোটামুটি জৌলুস আছে, কী ভরাট কণ্ঠস্বর, অথচ শ্যামল সেভাবে সুযোগই পেল না। আজকাল অবশ্য স্টুডিও পাড়ায় আসাই ছেড়ে দিয়েছে।

তেল ভরা হয়ে গেছে। ট্যাঙ্কির ক্যাপ আটকে কর্মচারীকে তিনটে পঞ্চাশ টাকার নোট দিল কন্দর্প। ঘুরে তাকিয়ে বলল, তুই কী করছিস এখন?

আগে যা করতাম। চাকরি। এল ডি থেকে ইউ ডি হয়েছি।

–নাটক করছিস না?

সময় পাই না রে।

–সেকি!

–বিয়ে করেছি। যতই নন-এনটিটি হই, সামওয়ানের কাছে স্পেশাল কেউ তো বটে। তাকে অনেকটাই সময় দিতে হয়।

কন্দর্প আহত হল। নাকি আহত ভাব ফোটাল মুখে? বলল, – বিয়ে করলি, আমাকে জানালি? একটা কার্ড ড্রপ করতে পারতিস?

–আসতিস তুই?

–খবর দিয়েই দেখতিস যাই কি না।

ছাড়। শ্যামল মুখে একটা দূরত্ব মাখানো হাসি ফুটিয়ে রেখেছে, শুনলাম ফ্ল্যাট বুক করেছিস?

–আমি!

–কেন চেপে যাচ্ছিস বাপ? সব খবর পাই। ঢাকুরিয়াতে বিশাল ফ্ল্যাট নিচ্ছিস….

কী যে বলিস না! ও তো আমাদের নিজেদের বাড়ি ভেঙে ফ্ল্যাট হচ্ছে। বাড়ির ছেলে হওয়ার সুবাদে আমারও একটা জুটছে।

–শুনলাম অশোক মুস্তাফি করছে?

 কন্দর্প প্রসঙ্গটা চেপে গেল। কোন কথা কিভাবে পল্লবিত হয়ে ছড়াবে, ঠিক কি! তাদের রাসবিহারীর চা-আড্ডাটা নিন্দুকে ছেয়ে থাকে, সেখানে এর মধ্যেই মুস্তাফির চামচা বলে তার বদনাম রটেছে, আর নতুন কোনও খোরাক জোগানোর মানেই হয় না।

পিছনে একটা গাড়ি তেল নিতে এসে গেছে। হর্ন দিচ্ছে। চটপট দরজা খুলে ড্রাইভিং সিটে বসল কন্দর্প। ডাকল বন্ধুকে, আয়। কোনদিকে যাবি?

সন্ধে নামছে। এদিকে রাস্তাটা তেমন চওড়া নয়, যানবাহনের ভিড় লেগেই থাকে। আজ ভিড় একটু বেশি, প্রচুর লোক বেরিয়েছে রাস্তায়। চারদিকের দোকানপাটে উৎসব উৎসব ভাব, গান। বাজছে কোথাও কোথাও।

মন্থর গতিতে গাড়ি চালাচ্ছিল কন্দর্প। কায়দা করে বুকপকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বার করল। এগিয়ে দিল শ্যামলকে, — দুটো ধরা। আমাকে একটা দিস।

প্যাকেটটা নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করল শ্যামল, এখনও দিশি খাচ্ছিস? বিলিতি ধরিসনি?

কন্দর্প অকারণে জোরে হেসে উঠল, ভাবিস কী বল তো? আমি কি উত্তমকুমার গোছের কিছু হয়ে গেছি নাকি? কপাল ভাল, দুটো-একটা চান্স পাচ্ছি, করে খাচ্ছি। লাইনটা তো জানিস। চোরাবালি। আজ আছি কাল ডুবতে কতক্ষণ? চালবাজির অভ্যেস করে শেষে মরব নাকি!

শ্যামল বুঝি খুশি হল সামান্য। সিগারেট ধরিয়ে বন্ধুর ঠোঁটে গুঁজে দিল। ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে দেখছে বন্ধুকে, কপালে ফোঁটা লাগিয়েছিস কেন রে? ঠাকুরদেবতায় ভক্তি বেড়েছে খুব?

-বারে, আজ পয়লা বৈশাখ না! … একটা মহরত ছিল।

শ্যামল আবার একটু শক্ত হয়ে গেল। ক্ষণিক চুপ থেকে বলল, -কার বই? ডিরেক্টর কে?

ও তুই চিনবি না। জগদীশ সামন্ত। যাত্রা-ফাত্রা লিখত এক সময়ে। কিছুদিন রুনুবাবুর অ্যাসিস্ট্যান্ট ছিল। ফিলম-টিলমের কিস্যু বোঝে না। প্রোডিউসার পাকড়েছে, ধরে লাইনে নামিয়ে দিয়েছে।

আর তুইও তার হিরো হয়ে গেলি! কিসের রোল? গাঁ থেকে শহরে আসা বোকাসোকা নায়ক? নাকি কোমর নাচানো ধুমধাড়াক্কা প্রেমিক? নাচ-টাচ শিখে নিয়েছিস?

কন্দর্প এবার সত্যি সত্যি আহত হল। আয়না থাকলে দেখত পেত পোজটা এবার ভীষণ ন্যাচারাল। অভিমানী সুরে বলল, – লাইনে টিকতে গেলে সব কিছুই করতে হয় রে শ্যামল, অনেক আপোস করতে হয়। মনের সঙ্গে, নিজের সঙ্গে, কনসেন্সের সঙ্গে। চান্স পেলে ভাল রোলও তো আমি করি। তুই আমার বনেদ ছবিটা দেখেছিলি?

–স্মরজিৎ লাহিড়ির? তার বই তো এ দেশে রিলিজ হয় না! ও তো ছবি করে ফরেন ফেস্টিভালের জন্য। বিদ্রূপ লেপটে গেল শ্যামলের মুখে, শালা প্রগতিবাদের নামে দেশের পভার্টি বেচে খাচ্ছে! যাদের নিয়ে ছবি করে তারা ওর ছবি দেখতে সিনেমাহলে মুততেও আসে না। শালা সল্টলেকে কী ঘ্যামা একটা বাড়ি বানিয়েছে! গরিবি বেচে বেচে! একেই বলে শালা কপাল। যার ফুটপাথেও জায়গা হওয়ার কথা নয়, সুড়সুড়ি মেরে মেরে সে ব্যাটা ইন্টারন্যাশনাল আঁতু বনে গেল!

শ্যামলের ব্যঙ্গের লক্ষ্যটা কে, কন্দর্প সঠিক বুঝতে পারছিল না। স্মরজিৎ লাহিড়ি, না তার বইতে অভিনয় করা কন্দর্প? স্মরজিৎ সম্পর্কে শ্যামলের ধারণাটা খুব ভুল নয়, তবে লোকটা ফিলম বোঝে, তাকে দিয়ে কাজও করিয়ে নিয়েছে সুন্দর করে। শ্যামলের কথার ঝাঁঝে বোঝা গেল না ছবিটা সে আদপেই দেখেছে কিনা। সত্যি সত্যি হলে রিলিজ করেনি তা তো নয়, দু হপ্তা তো চলেছিল।

আনোয়ার শা রোডে পড়তে শ্যামল বলল, আমাকে নবীনার সামনে নামিয়ে দে।

বাড়ি ফিরছিস এখন?

বললাম না, তার জন্য এখন আমাকে অনেক সময় দিতে হয়। শী ইজ ক্যারিইয়িং।

বাহ, এ তো ভাল খবর। বাঁ দিক ঘেঁষে কন্দর্প গাড়ি দাঁড় করাল।

শ্যামল নামতে গিয়েও থমকেছে, যাবি নাকি আমার বাড়িতে?

কন্দর্প আলগোছে মাথা নাড়ল, – নারে, আজ থাক।

চল না। আমার বউ-এর সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে। বিয়ের খাওয়াটা মিস করেছিস, সে দুঃখটাও ঘুচিয়ে দেব …।

থ্যাংক ইউ, আজ থাক রে। রিয়েলি এখন আমার একটা আরজেন্ট কাজ আছে। লেক গার্ডেনসে। আই অ্যাম টু মিট সামওয়ান। অলরেডি আমি লেট।

শ্যামল ফিচেলের মতো হাসল, কেন তোকে নেমন্তন্ন করিনি, বুঝেছিস? … মাঝে মাঝে আমাদের রাস্তাঘাটে দেখা হবে, তুই আমায় একটু গাড়ি চড়িয়ে দিবি, দু-দশ মিনিট গল্প করবি, এই ভাল। চলি রে।।

দু-এক সেকেন্ড হতবুদ্ধি বসে থেকে গাড়ি স্টার্ট দিল কন্দর্প। কেউ একটু নাম করে গেলে পুরনো লোকজন ভাবে তার বুঝি একটা লেজ গজিয়ে গেছে। সে যাই করুক, ভাববে দেমাকে মটমট করছে। শ্যামল তো অনেক দিন তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবে মিশেছে, সে পর্যন্ত …। কেউ বোঝে না। কাজ থাকলে যে কন্দর্পকে কাজটা সময়ে করতেই হবে। বাপ্পা যাওয়ার দিন কন্দর্প রইল না বলে ঠোঁট ফোলাল তিতির, কথা শোনাল রুনা। ভাইপো চলে যাচ্ছে বলে শুটিং ক্যানসেল করে দিতে পারে কন্দর্প? হয় তা? এই মুহূর্তে অশোক মুস্তাফির কাছে যাওয়াটা তার কর্তব্যের অঙ্গ, ফি বছরের মতো সে লোকটার অফিসে সকালে যেতে পারেনি, এ কথা বোঝালেও শ্যামল বুঝবে? তুই নিজে কিছু করে উঠতে পারিসনি সেটা কার দোষ? তোর উদ্যোগ কম, লেগে থাকার ধৈর্য নেই, এ কথা খোলাখুলি মেনে নে। তা নয়, শুধুই হিংসে! বন্ধুর সাকসেসটাই শুধু দেখলি, অধ্যবসায়টা দেখেছিস? কী হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতে হয় তার খবর রাখিস? ফালতু কমপ্লেক্স।

ভাবতে গিয়ে কন্দর্প হঠাৎ ঠোক্কর খেল একটা। সে নিজে মুস্তাফির সঙ্গে লাইন করেছে, শ্যামলকেও তো অনায়াসে তার কাছে নিয়ে যেতে পারত, যায়নি কেন? যেচে প্রতিদ্বন্দ্বী আহ্বান করে আনতে চায় না, তাই? এটা বুঝি কমপ্লেক্স নয়?

চোরকাঁটাটা লেগেই রয়েছে বুকে। একটু বিস্বাদ মনে মুস্তাফির লেক গার্ডেন্সের ফ্ল্যাটে এল কন্দর্প। বচ্ছরকার দিন মুস্তাফি এখানেই রাতটা কাটায়।

মণিকা দরজা খুলেছে। পরনে ঢোলা ঢোলা কাফতান, শ্যাম্পু করা ফোঁপানো চুল হাওয়ায় উড়ছে। মিষ্টি হেসে বলল, আরে কন্দর্পদা, আপনি!

কন্দর্প বিশেষ অবাক হল না। মাস কয়েক হল মণিকা মাঝে মাঝেই মুস্তাফির ফ্ল্যাটে থাকে রাতে, জানে কন্দর্প। জিজ্ঞাসা করল, অশোকদা নেই?

–আছে। ফোন করছে। আসুন না।

রীতিমাফিক কার্পেটে গ্লাস বোতল। থেবড়ে বসতে বসতে কন্দর্প লক্ষ করল তিনটে নয়, পাঁচটা গ্লাস রয়েছে আজ। একটা নয় মণিকার, কিন্তু আরও একটা বাড়তি কেন? আবার কোনও নতুন বিজনেস ফাঁদছে অশোক মুস্তাফি?

মণিকা ভেতরে যেতে গিয়ে দাঁড়াল, গরম গরম ফিশ চপ ভাজছি কন্দর্পদা, খাবেন তো?

–ও শিওর।

সঙ্গে সস, না মাস্টার্ড?

সসই ভাল। না না মাস্টার্ড। কন্দর্প হেসে ফেলল, – দুটোই দাও।

নিজের গ্লাসটা তুলে নিয়ে রান্নাঘরে গেল মণিকা। মনে মনে হাসি পাচ্ছিল কন্দর্পর। শয্যাসঙ্গিনীদের হাতের রান্না খেয়ে কি বিশেষ কোন সুখ পায় অশোকদা? নাকি অপারিবারিক ফ্ল্যাটে একটা পরিবার পরিবার ভাব আনতে চায়?

বিশাল হলঘরের কোণে বসে টেলিফোনে কথা বলছে মুস্তাফি। কন্দর্পকে দেখে একবার আঙুল নাড়ল, কথা বলে চলেছে নিচুগ্রামে।

হঠাৎ স্বর চড়ে গেল। একেবারে নীচের সা থেকে ওপরের সা। কাকে ধমকাচ্ছে অশোকদা? চোখা চোখা শব্দ বুলেটের মতো ছিটকে ছিটকে এল। … ইউ ডার্টি বীচ!… আই উইল টিচ ইউ আ লেসন!… ভাব কী তুমি, তোমার বিষদাঁত আমি উপড়ে নেব! …।

ঘটাং রিসিভার নামিয়ে রাখল মুস্তাফি। দু আঙুলে রগ টিপে বসে আছে। মণিকা একবার সভয়ে উঁকি দিয়ে চলে গেল। কন্দর্প হতবাক।

লুঙ্গি পরা মুস্তাফি ধীরে ধীরে উঠল, কার্পেটে এসে বসেছে। সিগারেট ধরাল। গ্লাস তুলে চুমুক দিল অল্প। প্রায় গোটা সিগারেটটা ঘষে ঘষে নেবাল, দুমড়ে মুচড়ে ঢুকিয়ে দিল ছাইদানে।

হিম হিম গলায় বলে উঠল, তুমি এসেছ ভালই হয়েছে। নইলে আমিই তোমায় ডেকে পাঠাতাম।

নববর্ষের দিন আপনার সঙ্গে একবার দেখা করব না, এ হয়? মহরতের পরে খাওয়া দাওয়ায় আটকে গেলাম, সেনবাবু ছাড়লেন না, নয়তো আপনার অফিসেই …।

–হুম। আরেকটা সিগারেট ধরাল মুস্তাফি। গ্লাসে চুমুক দিয়ে ঠোঁট টিপল, তুমি আজকাল অনেক লায়েক হয়ে গেছ।

কন্দর্প একটু ঘাবড়ে গেল। কার নাকার সঙ্গে ঝগড়া করে তার ওপর ঝাল ঝাড়ছে কি অশোকদা? ঢোক গিলে বলল, – এ কথা কেন দাদা?

–কেন কি, তুমিই আমার সর্বনাশ করে ছেড়েছ। তোমার ভ্যানতাড়ার জন্যই ..

–আমি কী করলাম? কন্দর্প হাঁ।

বাবুরামের সঙ্গে পার্টনারশিপে তোমায় ব্যবসায় নামতে বলেছিলাম? বলেছিলাম, কি বলিনি?

—হ্যাঁ … কিন্তু … আপনি তো জানেন দাদা আমার সিচুয়েশানটা। সময় দিতে পারব না, দেখাশুনা করতে পারব না। মোরওভার এই উঠতির সময়ে একটা মদের দোকান খুললে …

–হ্যাঁ, তোমার কাছে তো আবার হিরো হওয়াটা আগে। সিচুয়েশান দেখাচ্ছ, অ্যাঁ? মুস্তাফির গলা একটু চড়ল, আমি তোমায় পর্দায় না ফেললে ওই থোবড় কেউ চিনত কোনওদিন?

মণিকা ফিশ চপের প্লেট হাতে দাঁড়িয়ে। কন্দর্পর কান ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল, আমি যে আপনার কাছে কৃতজ্ঞ এ কথা কি কখনও অস্বীকার করেছি?

–গান গেয়ো না। মুস্তাফি আড়ে মণিকাকে দেখল একবার, ইশারায় প্লেট নামিয়ে রেখে চলে যেতে বলল। গেল না মণিকা, খানিক তফাতে গিয়ে সোফায় বসেছে। মুস্তাফি গ্লাসে আরেকটা চুমুক দিয়ে মুখ বিকৃত করল। ফ্যাসফেসে গলায় বলল, – ফোনে কার সঙ্গে কথা হচ্ছিল জানতে চাইলে না?

কন্দর্প চুপ করে রইল। অশোক মুস্তাফি রেগে থাকলে কৌতূহল প্রকাশ করতে তার সাহস হয় না, এ কথা শুনলে কি খুশি হবে অশোকদা?

মুস্তাফি গরগর করে উঠল, তোমাদের ঋতুশ্রীর সঙ্গে কথা হচ্ছিল। ডু ইউ নো ওই বীচটা আমার কী করেছে? আমার ছেলেটার মাথা চিবিয়ে খাচ্ছে। পরশু বাবুরামকে নিয়ে একটা রিসর্টে ফুর্তি করতে গিয়েছিল। ডায়মন্ডহারবারের রাস্তায়। শুধু পরশুই নয়, লাস্ট ওয়ান মানথে এই ঘটনা চারবার ঘটেছে। কাল বাবুরামকে ধরলাম, সে বলে ঋতু আমার রক্তে মিশে গেছে বাবা! ওকে বিয়ে করতে চাই! ভাবতে পারো, একটা নষ্ট মেয়েছেলে … বলতে বলতে মণিকার দিকে তাকাল মুস্তাফি, -তুড়ি মারলে যার-তার সঙ্গে শুয়ে পড়ে, সে হবে আমার পুত্রবধূ!

এই তবে ব্যাপার! কন্দর্প মিউ মিউ করে বলল, — কিন্তু ঋতুর সম্পর্কে তো তেমন কোনও বদনাম শুনিনি!

–হোয়াট ননসেন্স! এতক্ষণে ফেটে পড়ল মুস্তাফি, — এ লাইনের সব মেয়ে সমান। ওই যে বসে আছে, আমি যদি হুকুম করি এক্ষনি ও কাপড় খুলে দাঁড়িয়ে যাবে। তুমি আমাকে মেয়েছেলে চেনাচ্ছ, অ্যাঁ?

কন্দর্পর কান লাল হয়ে গেল, আগুন বেরোচ্ছে। মণিকার দিকে তাকাতে পারল না। কী ভাবে নিজেকে লোকটা! যাদের সঙ্গে ওঠাবসা, যাদের কাছ থেকে সব সুখ আনন্দ নিংড়ে নেয়, তাদের মানুষ পর্যন্ত জ্ঞান করে না! মণিকারা যদি চরিত্রহীন হয়, তাহলে এই ভাল্লুকটা কি?

ঝাঁ করে কন্দর্প বলে উঠল, এ রকম একটা জেনারেল মন্তব্য করা ঠিক নয় অশোকদা। স্টুডিও পাড়ায় তো আমার কম দিন হল না, আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি ঋতু খুব সাচ্চা মেয়ে। অ্যাটলিস্ট আপনি যা বলছেন তা নয়।

–চোপ। একটা কথা নয়। জানো, কী আস্পর্ধা, মেয়েটার! ইমাজিন করতে পারো আমায় কি বলল? চামড়ার বকলস্ কিনে দেব, ছেলেকে গলায় পরিয়ে বেঁধে রাখবেন! আপনি কার সঙ্গে শোন তাই নিয়ে আমি মাথা গলাই না, আপনিও আমার পারসোনাল ব্যাপারে ছড়ি ঘোরাতে আসবেন না! আই উইশ আই কুড কিল হার।

কন্দর্পর শরীর বেয়ে বিদ্যুৎ খেলে গেল। মোক্ষম জবাব পেয়েছে মুস্তাফি। লোকটা ভাবে টাকা ছড়িয়ে যাকে যেভাবে খুশি অসম্মান করা যায়।

অনেকটা রাগ উগরে একটু যেন থিতু হয়েছে মুস্তাফি। গোঙা গলায় বলল, শোনো, যদি তোমার এতটুকু কৃতজ্ঞতাবোধ থাকে, ডু সামথিং ফর মি। এটাই হাই টাইম। তোমার দাদার চাকরির একটা বন্দোবস্ত করে ফেলেছি। একটা নতুন কোম্পানি ফ্লোট করছি, শেয়ার কেনাবেচার। তোমার দাদাকে দেখে মনে হয় তোমার মতোই বিশ্বাসী হবে, চুরিচামারি করবে না, ওঁকে ওখানেই ফিড করে দেওয়া যাবে। বাট অন ওয়ান কন্ডিশান। তুমি তো বাবুরামের কোনও দেখভালই করলে না, এবার কাজটা তোমায় করতেই হবে। ওই মেয়েছেলেটার ক্লাচ থেকে আমার ছেলেটাকে ছাড়িয়ে আনতে হবে।

কন্দর্প আকাশ থেকে পড়ল, আমি কী করে করব?

–সে তুমি জানো। আমি তোমাকে লাগিয়ে দিলাম, এবার তুমি ভাব কী ভাবে কী করবে। ফ্লার্ট করো। আমি জানি ওই হারামজাদী তোমায় খুব পছন্দ করে। ভজিয়ে-ভাজিয়ে বিয়ে করো, তারপর চার-ছ মাস বাদে ছেড়ে দেবে। বাট আই ওয়ান্ট দা জব টু বি ডান।

কান থেকে আগুনটা এবার কন্দর্পর মাথায় ছড়িয়ে গেল। একটু একটু করে পূর্ণ মহিমায় বিকশিত হয়েছে মুস্তাফি। লোকটার কাছে সিনেমায় একটা চান্স চাইতে গেল, বিনিময়ে বাড়ি ভাঙার ঠিকাদারি চাইল লোকটা। সুতো ছেড়ে বসে রইল, ঠিক কব্জা করে নিল এক সময়ে। কন্দর্পকে একটা সুযোগ করে দিয়ে তাকে পোষা কুকুর করে রাখতে চাইল। কেন রে, আমি কি তোর ছেলের মাসমাইনে করা দারোয়ান? তোর কালো টাকার জিম্মাদার? সুগন্ধী বিরিয়ানির প্লেট সাজিয়ে আত্মাকে কিনে নিতে চাস তুই? ধাপে ধাপে এগোয়! এখন কন্দর্পকে নোংরা দালাল বানাতে চায়। এ রকমটাই হয় বোধহয়। জো-হুজুর শিল্পীর বোধহয় এটাই পরিণতি।

নিজের ওপর ঘেন্না হচ্ছিল কন্দর্পর। এই লোকটার ছায়ায় থেকে থেকে ছায়াটাই গ্রাস করে নিয়েছে তার সত্তাকে। এই হাঙর কুমির-শেয়াল-ভাল্লুকের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ঋতুশ্রী যা বলে দিতে পারে, সেটুকুনিও কি বলার ক্ষমতা নেই কন্দর্পর!

ঘাড় ফিরিয়ে সোফার দিকে তাকাল কন্দর্প। মণিকা নেই, উঠে গেছে।

ওই অসহায় মেয়েটা প্রতিবাদ না করতে পারুক, অন্তত লজ্জা পেতে জানে। কন্দর্প কি ওর চেয়েও হীন দশায় আছে? একবার অন্তত মনের আড় ভাঙা দরকার। অন্তত একবার।

কন্দর্প শান্ত স্বরে বলল, সরি অশোকদা, পারলাম না। আপনি বরং আমার থেকেও স্পাইনলেস কাউকে ট্রাই করে দেখতে পারেন। রূপেন-টুপেনকে বলে দেখুন না। ঋতু যদি ওদের কাউকে পছন্দ করে।

মুস্তাফির কুতকুতে চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেল, তুমি জানো কি বলছ? তোমার মতো একটা পাখা-ওঠা-পিঁপড়েকে টিপে মারতে আমার সাতটা দিনও সময় লাগবে না। মনে রেখো, তোমরা এখনও ফ্ল্যাটে এনট্রি পাওনি। হাজার একটা ঝামেলা বাধিয়ে দুটি বছর কনস্ট্রাকশান স্টপ করে দিতে পারি। আই হ্যাভ দ্যাট পাওয়ার!

নাফা ছেড়ে দেবে লোকটা! হাহ। মহীনবাবুর ছুরি চমকানো দেখা হয়ে গেছে কন্দর্পর। হেসে বলল, আপনি কিছু পারবেন না। আয়নায় নিজেকে দেখেছেন? রাগলে আপনাকে একটা ভাঁড়ের মতো লাগে। ওই মেয়েটা, মণিকা, আপনার দুর্গন্ধে সারা রাত বমি করবে। চলি। নববর্ষের সন্ধেটা বেশ কাটল।

ফ্ল্যাটের বাইরে এসে বিশাল বড় একটা নিশ্বাস ফুসফুসে ভরে নিল কন্দর্প। অবরোধটা সরে গেছে, মুছে গেছে দ্বিধাদ্বন্দ্ব। এক্ষুনি মধুমিতার কাছে যেতে হবে। আত্মায় পুরু শ্যাওলা জমে গিয়েছিল, তাই কি মধুমিতাকে নিয়ে এত দোলাচল ছিল এতদিন।

নীচে নেমে কন্দর্প গাড়িতে স্টার্ট দিল। ছুটছে পক্ষীরাজ।

.

অনেক অনেক রাতে সেতার নিয়ে বসেছে কন্দর্প। ইমন কল্যাণ বাজাচ্ছে। বিলম্বিত পেরিয়ে দ্রুত ধরেছে। আলাপ থেকে ক্রমে ক্রমে ঝালায় পৌঁছে গেল। অস্থির মেজরাফ আলোড়ন তুলছে তন্ত্রীতে। বাড়ির প্রতিটি ঘরে, প্রতিটি দরজায়, জানলায়, মেঝেতে, আসবাবে অনুরণিত হচ্ছে ধ্বনি। আনন্দের রেণু প্লাবিত করে দিল রাতের বাতাস।

সহসা কন্দর্পর ধ্যান ভাঙল। আধভেজা দরজার ওপারে ছায়া!

 কন্দর্প বাজনা থামাল, কে? তিতির?

সাড়া নেই।

কী হল, কিছু বলবি?

দরজায় ধাক্কা খেয়ে ফিরে এল কথাটা।

 বিছানায় সেতার নামিয়ে দরজায় এল কন্দর্প, বউদি তুমি! ঘুমোওনি?

ইন্দ্রাণীর মুখটা ভাল দেখা যাচ্ছে না। অন্ধকারে যেন ছায়ামানবী বলে ভ্রম হয়।

–কী বলছ বউদি?

–তুমি এত রাতে ইমন কল্যাণ বাজাচ্ছ কেন? ইন্দ্রাণীর গলাটা কেমন ভাঙা ভাঙা শোনাল।

–দোষ কী?

ভুল সময়ে ভুল জায়গায় ভুলভাল রাগ বাজাতে নেই চাঁদু।

ছায়ামানবী সরে গেল।

.

৯৪.

শায়িত রুগীর পেটের ওপর দিকে আলগা চাপ দিল শুভাশিস, — লাগছে?

মধ্যবয়স্ক হাটুরে মানুষটার মুখ যন্ত্রণায় বিকৃত হয়ে গেল, – উইফফ।

শুভাশিসের হাত আর একটু নীচে সরল, এখানে?

–অতটা নয়।

 –এখানে?

ননা।

–জিভ দেখি। উঁহু, ওইটুকু নয়। পুরোটা। অ্যাঅ্যাঅ্যা।

মোটা সাদা সর পড়া জিভ বেরিয়ে এল।

-হুম। উঠে বসুন।

শুভাশিস চেয়ারে ফিরল। এই সেদিনও শিবসুন্দর যে চেয়ারে বসতেন সেই চেয়ারে। মাস দুয়েক হল মাধবপুরের চেম্বারটা আবার চালু করেছে শুভাশিস, এক রবিবার ছাড়া নিয়ম করে এসে বসছে এখানে। ভোর ভোর রামদেওকে নিয়ে কলকাতা ছাড়ে, সাড়ে নটা নাগাদ পৌঁছে যায়। আধ ঘণ্টাটাক জিরিয়ে নিয়ে শুরু হয়ে যায় রুগী দেখা। আজ তার এই চেম্বারে পঞ্চম দিন।

শুভাশিস প্যাড টানল, এমন ব্যথা আগে কখনও হয়েছে?

–হয়েছে দু-এক বার। তবে ঠিক এরকম নয়।

–কী রকম?

–সে হল গিয়ে কুনকুনে ব্যথা। এ যেন একেবারে বিষফোঁড়া চরকি খাচ্ছে। কাল থেকে কিছু মুখে তুলতে পারিনি ডাক্তারবাবু, বিশ্বাস করেন। যা খাই বমি হয়ে যায়।

মামুলি গ্যাসের পেইন। মাত্রা একটু বেশির দিকে, তবে আলসার-ফালসার হয়েছে বলে মনে হয় না। প্রেসক্রিপশান লিখে তুফানের দিকে বাড়িয়ে দিল শুভাশিস। তুফানই রুগীদের বুঝিয়ে দেয় কিভাবে কখন কোন ওষুধটা খেতে হবে। আনুষঙ্গিক পথ্যের নির্দেশও তুফানই দেয়, শিবসুন্দরের সঙ্গে থেকে থেকে সে অনেক কিছু শিখে গেছে।

পরের রুগীর জন্য ঘন্টি বাজিয়ে ঘড়ি দেখল শুভাশিস। একটা বাজতে দশ। এখনও বাইরে জনা তিন-চার বসে, উঠতে উঠতে আজ দেড়টা বেজে যাবে। প্রথম এক-দুটো রবিবার চেম্বার বলতে গেলে প্রায় ফাঁকাই ছিল, গত দিন থেকে রুগী সমাগম বেড়ে গেছে অনেক। কারণটা কী? শিব ডাক্তারের ছেলে বসছে বলে? নাকি কলকাতা থেকে, মারুতি হাঁকানো বড় ডাক্তার আসছে, তাই? কে জানে!

শুভাশিস আজ একা নয়। টোটোর উচ্চ মাধ্যমিকের প্র্যাকটিকাল পরীক্ষা গত বুধবার শেষ হয়েছে, সে আর ছন্দাও আজ এসেছে মাধবপুর। রুগী দেখতে দেখতে টোটোর গলা শুনতে পাচ্ছিল শুভাশিস। টুকির সঙ্গে কি যেন খুনসুটি করছে ছেলে, হাসছে জোর জোর। কলকাতায় আজকাল টোটোর এই উচ্ছ্বাস বড় একটা দেখাই যায় না, অথচ মাধবপুরে এলে সে যেন আগের মতো ছেলেমানুষ হয়ে যায়। মাধবপুরের বাতাসে কি কোনও জাদু আছে? কে জানে!

শেষ রুগীটিকে পার করে শুভাশিস সিগারেট ধরাল। ভারী ক্লান্ত লাগছে। কাল রাতে ভাস্করের বাড়িতে পার্টি ছিল, অনেক রাত অবধি প্রমত্ত হইহুল্লোড় হয়েছে, পর্যাপ্ত ঘুম হয়নি, শরীর ম্যাজম্যাজ করছে কেমন। গাড়িতেও যে একটু চোখ বুজে নেবে তার উপায় আছে? পথের যা হাল! এই খানা, এই খন্দ! পিঠ কোমর খসে যাওয়ার দশা। এক দিন যাতায়াত করেই গাড়ি গ্যারেজে পাঠাতে হয়। কেন যে আবেগের ঝোঁকে তুফানের কথায় রাজি হয়েছিল? সারা সপ্তাহ গাধার খাটুনি খেটে এতটা রাস্তা ট্যাঙোস ট্যাঙোস করে নিয়মিত আসা কি সোজা কাজ? নাহ, খেয়ে উঠে ঘণ্টা দুই গড়িয়ে নিতে হবে।

তুফান বাক্স খুলে টাকা গুনছে। বেশির ভাগই দশ টাকা বিশ টাকার নোট। পাঁচ টাকাও আছে। টাকাগুলো সাজিয়ে গার্ডারে বাঁধল। খুশি খুশি মুখে বলল, – আজ বেশ ভালই হয়েছে দাদা।

কত? শুভাশিস চোখ কুঁচকোল।

–একশো পঁচাশি। বাবার সময়ে এরকমই আসত। বাক্স বন্ধ করে চেম্বারের কোণে রেখে দিল তুফান। উঠে জানলা বন্ধ করতে করতে বলল, – চেম্বারটা তাহলে জমে গেল, কি বলো?

কথাটায় শুভাশিস মোটেই উদ্দীপ্ত হল না। তার মাত্র দুটো পেশেন্টেই এর থেকে বেশি পয়সা আসে। এই সামান্য টাকা নিয়ে ছুঁচো মেরে হাতে গন্ধ করার এতটুকু ইচ্ছে ছিল না শুভাশিসের, সে চেয়েছিল এটা বরং একটা দাঁতব্য চিকিৎসালয় হোক। তুফান আপত্তি তুলল। বলল, – বিনে পয়সায় চিকিৎসা তো বাবাই করতে পারত দাদা, কিন্তু করেনি। টাকার প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও করেনি। প্রথাটা কি উঠিয়ে দেওয়া উচিত হবে দাদা? বাবা বলত, বিনে পয়সার ডাক্তারদের ওপর লোকে তেমন ভরসা করতে পারে না রে তুফান।

সত্যি সত্যি বাবা এ কথা বলত কিনা কে জানে! হয়তো বাবার নাম করে নিজেদের সংসার খরচের টাকাটা তুলে নিচ্ছে তুফান। জানে দাদা এ টাকা ভুলেও ছুঁয়ে দেখবে না। অথচ মুখ ফুটে দরকারের কথাটা বললে এর থেকে বেশি টাকা তো মাসে মাসে পাঠিয়েই দিতে পারে শুভাশিস।

ছি ছি, এ সব কী ভাবনা! শুভাশিস ধমকাল নিজেকে। তুফান অলকা যে মার এত সেবাশুশ্রূষা করছে, ডানা মেলে আগলে রেখেছে মাকে, তার কোনও বৈষয়িক মূল্য নেই? সে তো শুধু মাসে দু দিন মার শারীরিক চেক-আপ করেই খালাস, তুফান-অলকাই তো…। বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত তুফান কটা টাকা নিয়েছে শুভাশিসের কাছ থেকে? মার খরচা বলে শুভাশিস তো টাকা দিতে গিয়েছিল, তুফান নিল এক পয়সা? সবিনয় জানিয়ে দিল, তোমার কাছ থেকে তো টাকা নিতে হবেই দাদা, যখন লাগবে ঠিক চেয়ে নেব! তুফান চালাচ্ছেই বা কী করে? মার খরচ তো কম নয়! ওষুধ-বিষুধ মিলিয়ে মাসে আট নশো টাকা তো হবেই। তবে কি বাবার সঙ্গে তুফানের কোনও জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট ছিল? যথেচ্ছ টাকা তুলছে সেখান থেকে?

ছিহ, আবার সেই বিশ্রী ক্লিন্নতা। শুভাশিস আবার ধমকাল নিজেকে। মাধবপুরে এলেই কেন এসব কূটচিন্তা আসে মাথায়? মাধবপুরের বাতাসে কি বিষ আছে? একই বাতাসে বিষ আর জাদু মিশে থাকতে পারে? হয়তো পারে। কে জানে!

কিংবা হয়তো এও হতে পারে মার জন্য যে এত করছে তুফান, এটা মনে মনে মেনে নিতে পারছে না শুভাশিস। মাঝে মাঝেই একটা চিন্তা বঁড়শির মতো বেঁধে তাকে, সুতীক্ষ হুল হয়ে খোঁচা দেয়, কীট হয়ে দংশন করে। মনোরমা কার মা? তুফানের, না শুভাশিসের? তার কর্তব্য তুফান যেচে করছে বলেই কি সে তুফানকে মনে মনে…..?

সিগারেট অ্যাশট্রেতে নিবিয়ে শুভাশিস তেতো গলায় ডাকল, – তুফান…..

শিবসুন্দরের কাচের আলমারিতে ঝাড়ন বোলাচ্ছে তুফান। ঘুরে তাকাল, –কিছু বলছ দাদা?

শুভাশিস মাথা ঝাঁকাল, নাহ। চল, চান-টান সেরে খেতে বসি।

–হুঁ, চলো। তুফান দরজার কাছে গিয়েও ফিরে এল, তোমায় একটা কথা বলব ভাবছিলাম।

কী কথা?

–পুকুরধারে তো অনেকটা জায়গা পড়ে আছে, তুমি যদি অনুমতি দাও ওখানে আমি একটা পোলট্রি খুলতে পারি।

–হাহ, অনুমতি দেওয়ার কী আছে! এ বাড়িতে তোর কি কম অধিকার!

–ওটা তো কথার কথা। তুমিই সব দাদা।…. তোমার তাহলে আপত্তি নেই?

–বিন্দুমাত্র না। উঠে তুফানের পিঠে হালকা চাপড় দিল শুভাশিস, হঠাৎ পোলট্রি খোলার বাসনা হল?

কিছু তো একটা করতে হবে। এই বয়সে কি আর চাকরি জুটবে আমার? লেখাপড়াতেও তো আমি তেমন….।

–একটা মাস্টারি-ফাস্টারি দ্যাখ না। সেকেন্ডারি স্কুলে না হয় প্রাইমারি স্কুল-টুলে। যেমনই হোক, তোর একটা গ্র্যাজুয়েশানের ডিগ্রি তো আছে।

কী যে বলো না দাদা! তুফান লাজুক হাসল, কত আচ্ছা আচ্ছা ছেলে একটা মাস্টারির জন্য ফ্যা-ফ্যা করে ঘুরছে। ষাট-সত্তর হাজার টাকা সেলামি না দিতে পারলে আজকাল আর কেউ কলকে পায় না। তাও পার্টির ব্যাকিং চাই, ওমুক চাই, তোমুক চাই। এই তো, দুধগঞ্জ সেকেন্ডারি স্কুলে কী কেচ্ছাটাই না হয়ে গেল। সিঙ্গুর থেকে একটা ছেলে ইন্টারভিউ কল পেয়ে এসেছিল, কোয়ালিফায়েড ছেলে, ইতিহাসে এম. এ, হাই সেকেন্ড ক্লাস, স্কুলেরই সেক্রেটারি লোক দিয়ে পিটিয়ে তাকে আউট করে দিল।

–তাই! কেন?

–এখন এরকমই চলছে দাদা। হয় মাল ফেলো, নয় পার্টি শো করো, ওসব এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জ-টেক্সটেঞ্জ চলবে না।

–গাঁয়ে-গঞ্জেও এই অবস্থা?

সর্বত্র। তোমাদের শহরের তাও একটু পালিশ-টালিশ আছে। এখানে বলম যস্য ফলম– তস্য। তার চেয়ে আমার বাবা মুরগির ব্যবসাই ভাল। মুরগিরাও দানা খুঁটে খাবে, আমারও ভাত জুটে যাবে। অলকার এক কাকার পোলট্রি আছে, অলকা এসব মোটামুটি জানে বোঝে। আমিও একটু-আধটু…তুফান একটুক্ষণ চুপ থেকে বলল, – আর একটা প্রবলেম আছে দাদা। সেটাও তোমাকেই সলভ করতে হবে।

-কী?

টাকা। ক্যাপিটাল। মূলধন। আমার যা জমানো আছে তাতে তো…..

অনেকক্ষণ পর শুভাশিস অনাবিল হাসল, কত চাই? দশ? পনেরো? বিশ? যা লাগে নিয়ে নে।

–তুমি বাবার টাকা থেকেও আমাকে লোন দিতে পারো।

–মানে?

–মানে বাবার তো এখানে ব্যাংকে কিছু টাকা আছে, হাজার চল্লিশ মতন। এখন তুমি হাজার কুড়ি টাকা আমায় দাও, বাবার সাকসেশন সার্টিফিকেটটা বেরিয়ে গেলে তুমি পুরো টাকাটাই তুলে নিয়ো।

–আমি কেন নেব? ও টাকা সবটাই তোর।

দুর, তা হয় নাকি! তুফান কথাটাকে আমলই দিল না, জমি বাড়ি ভোগ করছি এই না কত!… তাহলে তুমি টাকাটা দিচ্ছ তো দাদা?

–দিতে পারি, কিন্তু লোন হিসেবে নয়। শুভাশিসের ভেতরে তেতো ভাবটা ফিরে আসছিল। একটু রুক্ষ স্বরেই বলল, – তুই কৃতজ্ঞতা দেখাতে পারিস, আমি পারি না?

–ওভাবে বলছ কেন?

কীভাবে বলব? উদারতা দেখাচ্ছিস বলব? প্রমাণ করতে চাস তুই মহৎ, আর আমি চশমখোর?

তুফান থতমত খেয়ে গেল। এতটা কড়া কথা সে বোধহয় আশা করেনি। মাথা নিচু করে বলল, আমি ঋণ শোধ করছি দাদা।

–তিরিশ বছর বাড়ির ছেলে হয়ে থাকার পর এসব ঋণ-টিনের কথা আসে কী করে? ফারদার আমি যেন এসব কথা না শুনি। বাবার জমি বাড়ি টাকাকড়ি যা আছে সব আমাদের দুজনের। দুই ভায়ের সমান সমান। ইন্সিডেন্টালি আমার অনেক আছে, এবং আমার পক্ষে এখানে এসে পারমানেন্টলি বসবাস করা সম্ভব নয়, তাই আমি তোমাকে সবটাই দিয়ে দিচ্ছি। দরকার হলে দানপত্র করে দেব। তুমি যদি না নাও আমি সেটাকে পারসোনাল ইনসাল্ট বলে মনে করব। অ্যান্ড আই শ্যাল নেভার টাচ দা সয়েল অফ মাধবপুর। বুঝেছ?

তুফান করুণ চোখে তাকাল, তুমি যে একেবারে আইনের কথায় চলে গেলে দাদা।

এ ছাড়া অন্য কথা কি তুই বুঝবি! শুভাশিস দালান ধরে এগোল, আমার বিশ্বাস বাবার আত্মা এই ব্যবস্থাতেই শান্তি পাবে। বাবা এরকমই চেয়েছিল।

সঙ্গে সঙ্গে সিঁড়ি পর্যন্ত এসেছে তুফান। এতক্ষণে ঠোঁটের কোণে তার মিটিমিটি হাসি, বাবা কিন্তু অন্য রকমও চেয়েছে দাদা। বাবার শেষ ইচ্ছের কথা ধরতে গেলে তো…..তাতে কিন্তু তুমিও পিকচারে থাকো না, আমিও সিনে নেই।

শুভাশিসের ভুরু জড়ো হল।

–শেষ দিকে বাবা কি বলত জানো? শুভ আর তুফানে তো মিলমিশ থাকবেই, সম্পত্তি বরং টুকি আর টোটোর নামে থাক। এই জমি বাড়ি দিয়েই ওরা যেন এক সুতোয় বাঁধা থাকে। অর্থাৎ বাবার শেষ ইচ্ছে ধরতে গেলে তোমার দানপত্র করারও কোনও অর্থ হয় না। হাসছে তুফান। হাসতে হাসতেই বলল, আমি অবশ্য কথাটাকে একদমই ধরিনি। বাবা কত সময়ে কত রকম কথাই তো বলেছে। তা মুখে যাই বলুক, প্র্যাকটিকালি দেখতে গেলে বাবার যেখানে যা-কিছু আছে সবই তোমার। তোমারই।

তুফানের শেষ কথাগুলো কানে যাচ্ছিল না শুভাশিসের। মন্থর পায়ে সিঁড়ি ভাঙছে। অলকা স্নান করার জন্য তাগাদা লাগাচ্ছে, আবছা শুনতে পাচ্ছিল শুভাশিস। বুকটা হঠাৎ ভারী হয়ে আসছিল তার। আবার মত বদলেছিল বাবা! নিজের উত্তরাধিকারটা দান করে দেওয়ার সুখটুকুও দিতে চায়নি শুভাশিসকে!

এ কি শুধুই অভিমান!

বৈশাখের প্রখর তাপে পুড়ছে পৃথিবী। মাঝে মাঝে বাতাস বইছে এলোমেলো। শুকনো। গরম। রোদমাখা ধরণী দুলে ওঠে হাওয়ায়, কাঁপে তিরতির। দূরের গাছগাছালি এ সময়ে মরীচিকা বলে ভ্রম হয়।

শিবসুন্দরের দোতলা বাড়ির ফাঁক-ফোকরেও ঢুকে পড়েছে ঝাঁঝ। উত্তাপ এখন চরমে। বাথরুমে ঢুকে ধড়াস ধড়াস গায়ে জল ঢালল শুভাশিস, একটু বুঝি শীতল হল শরীর। নীচে নেমে দেখল টোটো টুকির খাওয়া শেষ, তুফান ছন্দা অলকা তারই প্রতীক্ষায় বসে। ছন্দার শতেক অনুরোধেও এক সঙ্গে খেতে বসল না অলকা। সবাইকে খাইয়ে তবে খাবে। সে এখনও শিবসুন্দরের আমলের প্রথা বজায় রাখতে চায়।

খেতে বসে কথা হচ্ছিল টুকটাক। গ্রামের কথা, শহরের কথা, রাজনীতির কথা। কদিন পরেই পার্লামেন্টের মধ্যবর্তী নির্বাচন, তাই নিয়ে গ্রামের হাওয়া বেশ তপ্ত হয়ে উঠেছে, বলছিল তুফান। এ সবে শুভাশিস কোনও কালেই বিশেষ উৎসাহ বোধ করে না, মাধবপুর প্রসঙ্গে তো নয়ই, সে শুধু হু হ্যাঁ করে যাচ্ছে মাঝে মাঝে। মাধবপুর এখনও তার কাছে ভিনদেশ।

কথায় কথায় অলকা বলল, -মায়ার কথা শুনেছেন দাদা?

কী হয়েছে? ওকে তো বড় একটা আর দেখি না!

–খুব ছুটোছুটি করছিল কলকাতায়। ওর বদলির অর্ডার এসে গেছে। ইলেকশানটা হয়ে গেলেই চলে যাবে।

–তাই? কোথায় পোস্টিং হল?

–ওর বাড়ির কাছাকাছিই। বালির ওদিকে কোন হাসপাতালে।….. অনেক ধরাকরা করতে হয়েছে।

ছন্দা ফস করে বলে উঠল, এই ধরাকরাটা ছ মাস আগে করলেই পারত। তাহলে হয়তো বাবা….।

ছন্দা থেমে গেল, তবু যেন কথাটা দুলতে থাকল চারদিকে। একটু বুঝি গোমড়া হয়ে গেল বাতাস। পলকের জন্য শুভাশিসের মনে হল ছন্দা ভুল বলেনি। কোথাকার কোন মায়া কোত্থেকে এসে ত্বরান্বিত করে দিল বাবার মৃত্যু। কিন্তু মৃত্যু তো একটা অমোঘ পরিণতি, তাকে কি কোনও মায়া বা ছায়া এসে ত্বরান্বিত করতে পারে? অথবা বিলম্বিত? তবু কখনও কখনও কেউ কেউ বুঝি নিমিত্ত হয়ে যায়। জয়মোহনের মৃত্যু নিয়ে ইন্দ্রাণীরও এরকম একটা ধারণা আছে না?

 দোতলার ঘরে চোখ বুজে শুয়েও ঘুম আসছিল না শুভাশিসের। হালকা তন্দ্রা আসছে, ছিঁড়ে যাচ্ছে। খানিক এপাশ-ওপাশ করে উঠে মনোরমার ঘরে এল। ঘুমোচ্ছেন মনোরমা। ইদানীং মনোরমার শরীরে আর শাড়ি জড়িয়ে রাখা হয় না, ছন্দা বেশ কয়েকটা নাইটি কিনে দিয়েছে, তাই বদলে বদলে পরায় অলকা। বাদামি রঙ ঢোল্লা আলখাল্লার ভেতরে গুটিসুটি পড়ে থাকা শীর্ণ শরীরটাকে কেমন যেন বিকৃত পুতুলের মতো লাগছে এখন। মাথার পাতলা চুল কগাছা ধ্বধবে সাদা, কপালের কোঁচকানো চামড়ায় অসংখ্য কাটাকুটি, বন্ধ চোখের দুই পাতা সামান্য ফোলা ফোলা। এই কমাসে কি আরও বেশি বুড়িয়ে গেল মা? নাকি এখন অনেক গভীরভাবে নিরীক্ষণ করে বলেই শুভাশিসের চোখে বেশি বেশি করে লাগে? মা কি বাবাকে খোঁজে আর? মনে হয় না। এমনি মানুষই নতুন অভ্যাসে রপ্ত হয়ে গেলে পুরনোকে দিব্যি ভুলে যায়, সেখানে মা তো নিছকই এক জড় বস্তু।

মাকে নিয়মমতো পরীক্ষা করে নিল শুভাশিস। নাড়ি, রক্তচাপ, শ্লেষ্মা কফ, রক্তে শর্করার মাত্রা…। ঘুমন্ত অবস্থাতেই মনোরমা চোখ খুললেন, বুজলেন, আবার খুললেন, আবার বুজলেন। সরে এল শুভাশিস। বাবার ড্রয়ার খুলে ডায়েরিগুলো বার করল। এ ঘরে এলে উল্টোয় মাঝে মাঝে। বিশেষণহীন ছোট ছোট তথ্য, তাতেই স্মৃতিরা ঝঙ্কার তোলে হঠাৎ হঠাৎ। বেশ লাগে।

একটা বিবর্ণ হয়ে যাওয়া ডায়েরি হাতে সরু তক্তাপোশে আধশোওয়া হল শুভাশিস। মার সঙ্গে এক খাটে শুতে বোধহয় অস্বস্তি হয় অলকার, তাই এ ঘরে তক্তাপোশটা ঢুকেছে আজকাল। পাতা উল্টোতে উল্টোতে কোত্থেকে একটা হলদেটে দিন সামনে উঠে এল। পঞ্চান্ন সালের ডিসেম্বর মাস, তেইশ তারিখ।…. শুভ পরীক্ষায় থার্ড হয়েছে। অঙ্কে সাতাত্তর, ইংরিজিতে অষ্টআশি, বাংলায় চুরাশি… মনোর মাথায় আজ একটা গাঁদাফুল লাগিয়ে দিয়েছিল হিমি…।

দৃশ্যটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে শুভাশিস। রেজাল্ট হাতে দৌড়তে দৌড়তে বাড়ি ফিরছে, কোয়ার্টারের সামনে এসে থমকে গেল, বারান্দার বেতের চেয়ারে বসে আছে মা, গায়ে টুকটুকে লাল শাল, কপালে বড় সিঁদুরের টিপ, খোঁপায় এক ইয়া হলুদ গাঁদা। সূর্যের আলো পড়েছে মার মুখে, কী অপরূপ যে দেখাচ্ছে মাকে! পাশে দাঁড়িয়ে হিমিপিসি হাসছে মিটিমিটি! দ্যাখ শুভ, তোর মাকে সাজালে কেমন দুগগা প্রতিমার মতো দেখায়!

শুভাশিসের বুকটা টনটন করে উঠল। একে কি সুখস্মৃতি বলে? চোখ বুজে আরও এরকম দৃশ্য মনে করার চেষ্টা করল শুভাশিস। কিছুই আর আসছে না মনে। এই দৃশ্যটাই বা কোথায় ছিল? বাঁকুড়ায়? মালদায়? নাকি রামপুরহাটে?

তীক্ষ্ণ স্বরে একটা পাখি ডাকছে বাইরে, চিন্তার সুতো ছিঁড়ে গেল। পাখির ডাকটাও কেমন চেনা চেনা! একটা মন-কেমন করা শৈশব যেন মিশে আছে ডাকটায়! কোন পাখি ওটা? পাপিয়া? বসন্তবৌরি?

উঠে বারান্দায় এল শুভাশিস। একটুখানি থেমে ছিল, আবার ডাকছে পাখিটা। সামনের ঝাঁকড়া আমগাছ কচি কচি আমে ভরে আছে, সবুজ পাতা আর ফলের মাঝে কোথায় লুকিয়ে আছে পাখি?

শুভাশিস পাখিটাকে খুঁজছিল। দুপুর ক্রমে বিকেল হয়ে এল।

.

ছন্দা ফ্লাস্কের ঢাকনায় চা ঢালল, – খাবে নাকি একটু?

চলন্ত গাড়ির জানলা থেকে চোখ ফেরাল শুভাশিস, -নাহ। তুমিই খাও।

–খেতে পারো। অলকা ফ্লাস্ক ভর্তি করে দিয়েছে।

 –ভাল লাগছে না।

ছন্দা ভুরু কুঁচকে তাকাল, তোমার চায়ে অরুচি!

শুভাশিস উত্তর দিল না। আবার চোখ ফিরিয়েছে বাইরে।

–তোমার কী হয়েছে বলে তো? শরীর খারাপ? টায়ার্ড? থেকে গেলেই পারতে। কাল ভোরে নয় রওনা দিতাম।

এবারও উত্তর দিল না শুভাশিস, আড়চোখে সামনের সিটে রামদেওর পাশে বসে থাকা টোটোকে দেখে নিল। চোখের খুব কাছে একটা ইংরিজি ম্যাগাজিন ধরে আছে টোটো। আলো কমে এসেছে, চলন্ত গাড়িতে এভাবে বই পড়াটাও ঠিক নয়, বলতে গিয়েও বলল না শুভাশিস। ছেলের সঙ্গে কথা বলতে আজকাল কেমন যেন স্নায়ুর চাপ অনুভব করে, কেবলই মনে হয় এই বুঝি তর্ক বেধে গেল।

গাড়ি সবে তারকেশ্বর পেরিয়েছে, কলকাতা পৌঁছতে কম পক্ষে আরও দু ঘণ্টা। এদিকের রাস্তাঘাট তবু মোটামুটি চলনসই, খানিক পরেই ভাঙাচোরা পথে গাড়ির গতি অনেক কমিয়ে ফেলতে হবে। তবে আজ রবিবার বলে গাড়িঘোড়া একটু কম আছে এইটুকুই যা ভরসা। শুভাশিস সিটের পিছনে মাথা রেখে চোখ বুজল।

ছন্দা চা শেষ করে ফ্লাস্ক বন্ধ করছে। টেরচা চোখে শুভাশিসকে দেখে নিয়ে বলল, –মাধবপুরে এলে তোমার কি হয় বলো তো? মুখ তোলো হাঁড়ি করে রাখো?

শুভাশিস অল্প হাসার চেষ্টা করল, কই, না তো!

করো করো। আয়নায় নিজের মুখ দেখতে পাও না তো, তাই টের পাও না।… আমার কিন্তু আজকাল মাধবপুর খুব ভাল লাগে।

তার মানে আগে লাগত না?

–তা কেন? ছন্দা মুখ টিপে হাসছে, বাবা যখন ছিলেন তখন আসাটা ছিল শ্বশুরবাড়ি আসা। সে ভাল লাগাটা এক রকম। এখন এ হল গিয়ে নিজেদের ঘরবাড়ি নিজেরা এসে দেখে যাওয়া। তার একটা আলাদা চার্ম নেই? সুন্দর একটা ডে-স্পেন্ট হচ্ছে, এবাড়ি ওবাড়ি গিয়ে গল্প করছি, আমার তো এলে ফিরতেই ইচ্ছে করে না।

টোটো টুকিকে নিয়ে বাবার শেষ ইচ্ছে, তুফানের ভাগ, তার ভাগ, এসবের মধ্যে গেল না শুভাশিস। লঘু স্বরে বলল, – থেকে গেলেই পারো।

–আহা, আমার বুঝি কলকাতায় কাজ নেই! কাল সকালে নীপা ফোন করবে। ওর সঙ্গে কাল বরানগর যেতে হবে।

সমীরণের বউটাও তোমাদের দলে ভিড়েছে নাকি?

ভিড়েছে আবার কী কথা! ও তো আমার আগে থেকেই উইমেন্স ফোরামে আছে। লাস্ট ইয়ারে ও দু-দুটো ডেস্টিটিউড মেয়েকে স্পনসর করেছিল।

বাহ, সমীরণ এক হাতে কামাচ্ছে, নীপা এক হাতে ওড়াচ্ছে!

–ওভাবে বলছ কেন? সমীরণদার কি কম আছে? আর নীপা তো একটা ভাল কজের জন্য খরচা করছে। ছন্দা হঠাৎ উদাস, আমাদের দেশের মেয়েদের সত্যিই যে কী অবস্থা চোখে দেখলেও বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। এত টরচারড! এত অসহায়! বাচ্চাসুদ্ধ বউকে ঘাড় ধরে বের করে দিয়ে পতিদেব দিব্যি আবার আর একটিকে ধরছেন! বাপের বাড়ি ফেরত নেবে না, শ্বশুরবাড়িতে জায়গা নেই, শেয়াল-কুকুরে ছিঁড়েখুঁড়ে খাবে..

ইদানীং নারীকল্যাণে আগ্রহ জন্মেছে ছন্দার। ভাল, কোনও একটা কিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকাটা সংসারের পক্ষে শান্তির। অন্তত অবসাদগ্রস্ত হয়ে ঠাকুরঘরে পড়ে থাকার থেকে তো ভাল বটেই। যাদের পেট সব সময়ে ভরাভর্তি থাকে, টুসকি মারলে বিলাসের উপকরণের কমতি থাকে না, সমাজসেবাই তো তাদের শ্রেষ্ঠ বিনোদন। লেক গার্ডেন্সের জমিটা তো নেওয়া হয়েই গেছে, মিউটেশানের বখেড়াটা মিটে গেলে ছন্দাকে এর পর আর্কিটেক্ট প্ল্যান বাড়ি তৈরি এসবে লাগিয়ে দেওয়া যাবে। না হোক আরও এক-দু বছরের জন্য নিশ্চিন্ত।

হালকা গলায় শুভাশিস একটু খোঁচাল ছন্দাকে, তোমাদের এইসব দুঃস্থ মেয়েগুলো কেঁউ কেঁউ করে পড়ে থাকেই বা কেন? তোমরা উদ্ধার করবে এই আশায়?

-মোটেই না। এক একজন এমন হেলপলেস সিচুয়েশনে থাকে…

বকোয়াস। আসল কথা হল কনশাসনেসের অভাব। প্রপার শিক্ষার অভাব।

–শিক্ষা যাদের আছে তারা যে কী আমি জানি। ছন্দা ফস করে বলে বসল।

কথাটার প্রছন্ন ঝাঁঝে সামান্য ঘাবড়ে গেল শুভাশিস। গলা নামিয়ে বলল, আমি বলছিলাম প্রতিটি মেয়ের সেলফ সাফিশিয়েন্ট হওয়ার জন্য কনশাসনেস থাকা দরকার। সে কি গরিব, কি বা বড়লোক, কি মধ্যবিত্ত।

ছন্দা আবারও কি একটা ঝেঁঝে উঠে বলতে যাচ্ছিল, তার আগে টোটো ঝট করে ঘুরে তাকিয়েছে, — উইল ইউ স্টপ দিস বাজে টপিক?

শুভাশিস হেসে ফেলল, আমরা একটু খুনসুটি করছি, তাতেও তোর আপত্তি?

আমার ভাল লাগে না।

শুভাশিস অপ্রস্তুত মুখে সিগারেট ধরাল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই একটা গর্ত পার হল গাড়িটা। হঠাৎ ঝাঁকুনিতে হাত থেকে খসে গেছে সিগারেট। তড়িঘড়ি সিট থেকে জ্বলন্ত সিগারেটটা তুলে নিল শুভাশিস। রামদেওকে ধমকাতে গিয়েও সামলে নিল। টোটোকে প্রসন্ন করার জন্য তোষামোদের ভঙ্গিতে বলল, – টোটো, আমি একটা কথা ভাবছিলাম, জানিস। টুকিটার তো এবার স্কুলে ভর্তি হওয়ার সময় হয়ে এল, তুই তো এক সময়ে টুকিকে আমাদের কাছে এনে রাখার কথা বলেছিলি, ভাবছিলাম এখন থেকে যদি এনে রাখি? একটা ভাল কনভেন্টে যদি ওর অ্যাডমিশানের ব্যবস্থা করে দিই… .

ঘাড় ফেরাল না টোটো। অত্যন্ত ঠাণ্ডা গলায় বলল, – মে মাস পড়ে গেছে বাবা। সব স্কুলে এখন সেশান শুরু হয়ে গেছে।

স্বর যেন বিদ্রূপের ছুরি। ছেলে যেন তার কথার ফাঁকি ধরে ফেলেছে। হার মানল না শুভাশিস, হাসতে হাসতেই বলল, – সো হোয়াট? সেশানের মাঝে কি কেউ ভর্তি হয় না? আই ডু হ্যাভ দ্যাট পাওয়ার। আমার কানেকশানস আছে। দরকার হলে মোটা ডোনেশান দেব।

তুমি চাইলেই কাকা কাকিমা রাজি হবে ভাবছ কী করে?

–আলবত হবে। গাঁয়ে পড়ে থাকলে মেয়েটা প্রপার এডুকেশান পাবে?

 –আমারও ওরকম চাইল্ডিশ ধারণা ছিল বাবা। বাংলা মিডিয়ামে, মফস্বলের স্কুলে পড়েও অনেকেই আখছার ভাল রেজাল্ট করছে। আমাদের মাধ্যমিকের রেজাল্ট তো তুমি ভাল করে স্টাডি করোনি, তুমি জানো না। আমাদের ফার্স্ট টোয়েন্টির মধ্যে আটটা তোমার সোকলড মফস্বল ছিল।

–ওগুলো সব এক্সেপশন। শুভাশিস যুক্তি দিয়েই চলেছে, তুমি যে রকম এডুকেশান পেয়েছ, তোমার বোনেরও সেরকম পাওয়া উচিত।

–থাক না বাবা। টোটোর স্বর আরও শীতল, টুকি একটা হ্যাপি ফ্যামিলিতে একটা হ্যাপি বাবা-মার কাছে রয়েছে, সেখান থেকে ওকে উপড়ে আনার কোনও দরকার নেই।

টোটোর বন্দুকের নিশানা একেবারে সোজাসুজি। শুভাশিসের মুখ কালো হয়ে গেল। পথের দু ধারে থোকা থোকা অন্ধকার জমে আছে, সে দিকে তাকিয়ে আছে নির্নিমেষ। চোখের কোণে জ্বালা জ্বালা ভাব, তবু পাতা ফেলতে পারছে না।

নিঃশব্দে বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস গড়িয়ে এল শুভাশিসের। গরম। ভিজে। তিতিরের জন্য ছটফট করতে গিয়ে কি টোটোকে লালন করায় কোনও গাফিলতি হয়ে গেছে? তাদের স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের শূন্যগর্ভ রূপ ছেলের কাছে আর এতটুকু গোপন নেই, তাই কি বারবার মাধবপুরে ছুটে যায় টোটো? একটা ভরাট সম্পর্ক দেখার জন্য? টোটোর জন্যই তো শুভাশিসের সব কিছু। এই বেঁচে থাকা, এই পরিশ্রম, এই প্রাণান্তকর জোড়াতালি দিয়ে চলা। কেন তবু ছেলে সরে যায় দূরে!

কী করে যে ছেলেকে নিজের হৃদয়টা দেখায় শুভাশিস!

.

পরদিন থেকে আবার সেই অভ্যস্ত জীবন শুরু হয়ে গেছে শুভাশিসের। আবার সেই চোখে ঠুলি এঁটে অন্তহীন ছোটা, অবিরাম ছুরি কাঁচি ফরসেপ, অপারেশন থিয়েটারের চড়া আলো, পুঁজ রক্ত ব্যান্ডেজ, মুখহীন রুগীর মিছিল।

এর মধ্যেই স্যাস ক্লিনিকে একটা বিশ্রী দুর্ঘটনা ঘটে গেল। শালিনীর এক পেশেন্ট সাড়ে সাত মাসের মাথায় অপরিণত এক শিশু প্রসব করেছিল, মায়ের এখনও বুকে দুধ আসেনি, অরূপের নির্দেশে রাতের নার্স বাচ্চাটাকে বোতলে দুধ খাওয়াতে গিয়ে একটা মারাত্মক ভুল করে ফেলল। বাচ্চাটার গলায় দুধ আটকে গেছে, হেঁচকি তুলছে বাচ্চা, কাশছে, তবু তার মুখে ঠুসে আছে বোতল। পরিণাম, মিনিট দশেকের মধ্যে বাচ্চাটা শেষ। খবর পেয়ে, রাত পোয়ানোর আগেই, বাড়ির লোক চড়াও হয়েছে নার্সিংহোমে। চিৎকার চেঁচামেচি হল্লা ভাঙচুর, সে এক ভয়ঙ্কর অবস্থা। শুভাশিস পড়িমরি করে ছুটে এল, অরূপ শালিনীও হাজির। প্রাণপণে শান্ত করার চেষ্টা করছে সকলকে, নার্স মেয়েটা ঠক ঠক কাঁপছে ভয়ে, ক্ষমা চাইছে, তবু মারমুখী ভিড় নরম হয় না। শেষে পুলিশই ডাকতে হল। তাতেও নিস্তার নেই, বাচ্চার বাবা নার্স আর অরূপ দুজনের বিরুদ্ধেই কর্তব্যে অবহেলার অভিযোগ এনে এফ আই আর করে বসল। অরূপ তার চৌকশ কথাবার্তা দিয়ে, প্রিম্যাচিওর বেবির এমন ঘটনা ঘটতেই পারে, বাচ্চার কন্ডিশান প্রথম থেকেই খুব খারাপ ছিল, এরকম সাতসতেরো বুঝিয়ে-টুঝিয়ে ওসিকে অনেক নরম করে ফেলল বটে, কিন্তু খবরটা গোপন রইল না, পরদিন ফলাও করে বেরিয়ে গেছে কাগজে। কোনও এক কাগজে আবার ফুটুস করে মন্তব্য করে বসল নার্সটা ট্রেন্ড নার্স নয়, ব্যস সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে গেল আর এক দফা এনকোয়ারি। সকাল বিকেল পুলিশ আসছে, এই কাগজ ঘাঁটছে, ওই ফাইল দেখছে। গভর্নমেন্টের লোক যাদের কোনও সময়ে টিকি দেখা যায় না, তারাও এসে জেরার পর জেরা করে চলেছে নার্সিংহোমের প্রতিটি স্টাফকে। শালিনীর মতো লৌহমানবীরও নার্ভাস ব্রেকডাউন হওয়ার জোগাড়।

দিন পাঁচ-সাত পর ব্যাপারটা ক্রমশ থিতিয়ে এল। নার্স মেয়েটাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে স্যাস ক্লিনিক থেকে, লালবাজারে পুলিশের কয়েকজন বড় কর্তাকে ধরে করে স্থানীয় থানাকে প্রশমিতও করা গেছে। কেস একটা হয়েছে অরূপ আর নার্সের বিরুদ্ধে, তবে পুলিশের এনকোয়ারি রিপোর্ট অনুযায়ী অভিযোগ খুব একটা ধোপে টিকবে না। অরূপের বিরুদ্ধে তো নয়ই। তবে বাচ্চাটার বাবার পয়সা আছে, মামলা সে চালাবে।

মাঝখান থেকে স্যাস ক্লিনিকের সুনামে খানিকটা চিড় খেয়ে গেল, টাকাপয়সাও কম ছড়াতে হল না। সব দিক দিয়ে অরূপ শালিনী শুভাশিস একেবারে জেরবার। কী টেনশান! কী টেনশান!

ধাক্কাটা একটু সামলে ওঠার পরে ইন্দ্রাণীর কাছে গেল শুভাশিস। ক্লান্ত বিধ্বস্ত চেহারা, মুখের খাঁজে খাঁজে এখনও উদ্বেগের ছাপ।

ইন্দ্রাণী মাধ্যমিকের খাতা দেখছিল। ঠিক দেখছিল না, ট্যাবুলেশান শিটের সঙ্গে উত্তরপত্র ধরে ধরে রোল নম্বর দেখে মার্কস মেলাচ্ছিল। পরশু তার প্রধান পরীক্ষকের কাছে খাতা জমা দেওয়ার কথা।

শুভাশিসকে দেখে ইন্দ্রাণীর মুখে তেমন ভাবান্তর হল না। একই রকম পাথরের মতো মুখ, একই রকম ভাষাহীন চোখ। যেন জানতই ওই অশান্তির পর শুভাশিস যখন আসবে তাকে ঠিক এরকমটাই দেখাবে।

শুভাশিসই কথা শুরু করল, বাড়ি এত চুপচাপ? আদিত্যবাবু তিতির কেউ নেই?

–আছে হয়তো। হয়তো নেই। ইন্দ্রাণী শুকনো জবাব দিল, যার যার কাছে চাবি থাকে, যে যার মতো আসে, যায়। হোটেলখানায় রান্না রেডি থাকে, খায়। শুয়ে পড়ে।… তোমাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে, চা কফি কিছু খাবে? করব?

–থাক।

–তা হলে দু মিনিট বোসো। হাতের কাজটা সেরে নিই।

 শুভাশিস বসেই আছে। খাট থেকে একটু তফাতে, চেয়ারে। বিছানায় ঝুঁকে খাতা কাগজে ডুবে আছে ইন্দ্রাণী। চোখে একটা রিডিং গ্লাস পরেছে, থেকে থেকে বাঁ হাতের তর্জনী তুলে ঠিক করছে চশমা, কপালে আঙুল বোলাচ্ছে। কাজে নিমগ্ন ওই ইন্দ্রাণী এখন এক ভিন্ন মানবী। তাকে এখন আর আগের মতো অপরূপা মনে হয় না শুভাশিসের। দৃঢ় চোয়াল, ঈষৎ বসে যাওয়া চোখ, ঠেলে ওঠা কণ্ঠার হাড় ইন্দ্রাণীর মুখমণ্ডলকে বড় বেশি কঠিন করে দিয়েছে। এই ইন্দ্রাণীকে দেখে শুভাশিসের মনও আর উথাল-পাথাল হয় না তেমন। একটাই শুধু অনুভূতি জাগে। এই নারীই তার একমাত্র আশ্রয়। শত অবহেলায় তাকে ফিরিয়ে দেওয়া পরও।

এই নারীই তার অদৃশ্য নিয়তি।

অনন্তকাল, সময়ের হিসেবে মিনিট পাঁচেক পর, খাতা কাগজ সরিয়ে রাখল ইন্দ্রাণী। চশমা খুলে চোখ রগড়াচ্ছে, তোমাদের ঝঞ্ঝাট সব মিটল?

শুভাশিসের বুকটা কনকন করে উঠল। ভুল করে তাও তবু আজ খোঁজ নিল ইন্দ্রাণী! গলাটাকে উদাস করার চেষ্টা বলল, — ওই এক রকম।

–অরূপকে কি বেল টেল নিতে হল?

–নাহ, প্রয়োজন হয়নি।

শালিনীর শরীর এখন ঠিক আছে?

শুভাশিস সোজাসুজি তাকাল, –শালিনীর কথা তোমায় কে বলল?

অতি মৃদু এক হাসি ফুটল ইন্দ্রাণীর ঠোঁটে, –কে আর বলতে পারে? একজনই তো আছে।

 –মধুমিতা?

ইন্দ্রাণী খুব আস্তে মাথা নাড়ল।

 শুভাশিস সিগারেট ধরিয়ে অ্যাশট্রে খুঁজল, মধুমিতার দাদার আসার কথা ছিল, এসেছিল?

–হুঁ।

কথাবার্তা হল?

–ওরা খুব ঘটাপটা চাইছে না। … চাঁদু নিজেও রেজিষ্ট্রি করার পক্ষপাতী।

–সে কী কথা! বিধবার বিয়ে বলে ঘটা হবে না, এ কেমন চিন্তা?

–আমিও তো চাঁদুকে তাই বললাম। মধুমিতাও নাকি রাজি নয়।  

কবে করছে বিয়ে?

–এখন হয়তো রেজিস্ট্রিটা করে রাখবে। পরে নতুন ফ্ল্যাটে গিয়ে বন্ধুবান্ধব ডেকে ছোট অনুষ্ঠান করবে।

–ও। … মধুমিতা মেয়েটা কিন্তু বড় ভাল। কী ঠাণ্ডা মাথায় নার্সিংহোমের কেসটা ফেস করল।

একটু ক্ষণ ইন্দ্রাণী চুপ। খানিক পরে বলল, তোমাকে কদিনেই খুব রোগা দেখাচ্ছে।

দুম করে শুভাশিসের বুকে অভিমানটা ফিরে এল। ভার গলায় বলল, কীভাবে ছিলাম, কেমন ছিলাম, কদিনে একটি বারের জন্যও তো খোঁজ করলে না!

ইন্দ্রাণী স্থির চোখে শুভাশিসকে দেখল, তুমি যে পেশায় নেমেছ তাতে তো এগুলো অবভিয়াস হ্যাজার্ড। আমি অনর্থক উতলা হয়ে কী করব?

–তা হলে আর এখন এত খোঁজ করছ কেন?

–তোমার পছন্দ হচ্ছে না?

–না।

–বেশ, আর করব না। বলে ইন্দ্রাণী ঝুম হয়ে গেল।

 বিচিত্র এক নৈঃশব্দ্য জমাট বাঁধছে ঘরে। মাথার ওপর পাখা ঘুরছে। বনবন, পতপত উড়ছে ক্যালেন্ডারের পাতা, তবু নৈঃশব্দ্য ভাঙে না।

একটু পরে ফোঁস করে শ্বাস ফেলল শুভাশিস, একটি বারের জন্যও ভাবলে না আমি কত একা! বিপদে আপদে তুমি পাশে থাকলে আমি কত ভরসা পাই।

–সে তো আমিও একা। ইন্দ্রাণীর স্বর নীরস, তুমি তোমার মতো একা, আমি আমার মতো একা। তুমি যখন নার্সিংহোমের ব্যবসায় নেমেছিলে, আমার পরামর্শ নিয়ে নেমেছিলে? ঝামেলা হলে তো তোমাকেই সামলাতে হবে।

আমি শুধু নার্সিংহোমের কথা বলছি না রানি। শুভাশিসের স্বর অসহায় শোনাল, -ইন অল রেসপেক্ট আমি অ্যাবসোলিউটলি লোননি এখন। ঘরে, বাইরে, সর্বত্র। কে আছে আমার দুনিয়ায়? টোটো পর্যন্ত আমাকে কী হিউমিলিয়েটিং ভাষায় …

হয়তো এটাই আমাদের ভবিতব্য। একা হয়ে যাওয়া। ক্রমশ আরও একা হয়ে যাওয়া।

ইন্দ্রাণী যেন অনেকটা স্বগতোক্তির মতো বলল কথাটা। ধীর পায়ে নামল বিছানা থেকে। আলমারি খুলে একটা খাম বার করে এগিয়ে দিয়েছে।

কী এটা?

–বাপ্পার চিঠি। পড়ো।

চিঠিটা খুলল শুভাশিস। ছোট্ট চিঠি, আট-দশ লাইনের।..

…শ্রীচরণেষু মা, আশা করি তোমার শরীর ভাল আছে। কলকাতা থেকে চলে আসার দিন তোমায় জানলায় একা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে খুব খারাপ লাগল। কেমন যেন দেখাচ্ছিল তোমাকে। জাহাজে আসার পর থেকে বারবার তোমার ওই মুখটা মনে পড়ে যাচ্ছে। রিজন দিয়ে ভাবার চেষ্টা করছি তোমার প্রবলেমটা কী? একটাই উত্তর পাচ্ছি। তুমি কিন্তু নিজের দোষে নিজে সব হারিয়েছ মা। তুমি কোনওদিন কাউকে এতটুকু বোঝার চেষ্টা করোনি, আর তাই তোমার এত কষ্ট। এখনও সময় আছে, নিজেকে বদলানোর চেষ্টা করো। …

শুভাশিস ফ্যাল ফ্যাল তাকাল, — এ চিঠির অর্থ?

ইন্দ্রাণী দু দিকে মাথা নাড়ল। হঠাৎই তার দু চোখ ভরে গেছে জলে। ঠোঁট কামড়ে ধরে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করছে। টকটকে লাল হয়ে গেল মুখ।

শুভাশিসের গলা কেঁপে গেল, তুমি কাঁদছ রানি?

মুহূর্তে লম্বা একটা বাতাস বুকে ভরে নিল ইন্দ্রাণী। ঢোঁক গিলে বলল, উঁহু। ইন্দ্রাণীর কি কাঁদার উপায় আছে? শুধু ভাবছি সত্যিই আমার কী করা উচিত ছিল? আমার কি অনেক দিন আগেই তোমার সঙ্গে চলে যাওয়া উচিত ছিল? বাবা মা সবাইকে অগ্রাহ্য করে আমি কি তোমার জন্য অপেক্ষা করতে পারতাম না? বাপ্পা ঠিকই লিখেছে। আমি তো নিজের দোষেই নিজে সব হারিয়েছি।

শুভাশিস বিহ্বল চোখে তাকাল, এখন আর এসব ভেবে কী লাভ রানি?

লাভ নেই, না?… টাইম, দা এন্ডলেস ক্যারাভ্যান গোজ অন … ইন্দ্রাণীর গলা আবার ধরে এল-হলটস ফর নান, ফিলস ফর নান, উইপস ফর নান…শুধু মানুষই পড়ে থাকে।

শুভাশিস কপাল টিপে ধরল, তোমার আজ কী হয়ে গেল রানি? এরকম করছ কেন?

ইন্দ্রাণী অস্থিরভাবে মাথা ঝাঁকাচ্ছে, কী পেলাম বলো? কী পেলাম? উল্টে সবাই এখন আমার দিকে আঙুল দেখায়। আমাকেই দোষী সাব্যস্ত করে। তিতির যখন পেটে এসে গেল, তখনই যদি সংসারটাকে লাথি মেরে চলে যেতে পারতাম! তুমি আমি আর আমাদের একমাত্র মেয়ে…তিন জনে মিলে একটা অন্য ধরনের জীবন…! হলটা কি? কাউকেই সুখ দিতে পারলাম না। মাঝখান থেকে তোমার মেয়ে আমাকেও শ্রদ্ধা করতে পারল না, তোমাকেও না।

রানি!

–আমায় বলতে দাও শুভ। টোটো তোমার হল? বাপ্পা আমার হল? আদিত্য ছন্দার কথা বাদই দাও। কী ভুল! কী ভুল! তুমি তো জানো না শুভ, আমি কতবার আমার পেটের মধ্যে তোমার তিতিরকে মেরে ফেলতে চেয়েছি। হয়তো আজ সেই জন্যই তোমার মেয়েও…

সহসা ইন্দ্রাণী নির্বাক হয়ে গেল। কোন এক ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের তাড়নায় শুভাশিসও চমকে তাকিয়েছে পিছনে।

দরজায় তিতির!

.

৯৫.

থানার সেরেস্তায় বসা ডিউটি অফিসার ডায়েরি লিখতে লিখতে প্রশ্ন ছুঁড়ল, বয়স কত বললেন যেন? –আঠেরো। না না, সতেরো। সুদীপ টেবিলে ঝুঁকল। –ঠিকঠাক বলুন। আঠেরো, না সতেরো? আঠেরো সতেরোয় বিস্তর ফারাক। আঠেরোয় অ্যাডাল্ট, সতেরোয় মাইনর। দুটো কেস সম্পূর্ণ আলাদা লাইনে চলে যাবে। যদি আপনাদের মেয়ে কারুর সঙ্গে ভেগে থাকে তাহলে নাবালিকা হরণের চার্জে সে ছোকরার পেছনে হুড়কো চলে যাবে। কি বুঝলেন?

সুদীপ আর কন্দর্প মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। তিতির তো তাদের কাছে তিতিরই, সে সাবালিকা হয়ে গেছে কি না এ চিন্তা মাথাতেই আসেনি কোনওদিন। কিন্তু এখন তো ভাবতেই হয়।

ঘাড় ঘুরিয়ে আদিত্যর দিকে তাকাল সুদীপ, দাদা, তিতিরের কি আঠেরো হয়েছে? নাকি এই। জুনে…

আদিত্য যেন এ জগতেই নেই। পিছনের একটা চেয়ারে বসে শুন্য চোখে তাকিয়ে আছে ঝুলপড়া একটা সাদা দেওয়ালের দিকে। সুদীপের কথা কি তার কানে গেল? নাকি তিতিরের নাম শুনে কেঁপে উঠল একটু!

ডিউটি অফিসার এক চোখের কোণ দিয়ে দেখছে আদিত্যকে, অন্য চোখ কন্দর্পর দিকে, ইনিই তো বাবা?

-হ্যাঁ। ..খুব আপসেট…।

টুসকি বাজিয়ে ছোট্ট একটা হাই তুলল ডিউটি অফিসার। নাক কুঁচকে বলল, তাহলে কি লিখব? মাইনর?

কন্দর্প মাথা চুলকোল, হিসেব মতে তাই তো হয়। সামনের মাসের আট তারিখে আঠেরো হওয়ার কথা।

-হুম। এবার বলুন কি হয়েছে, কি বৃত্তান্ত, কখন মেয়ে পালাল..

ইলেকশানের আর দু দিন বাকি, গভীর রাতের থানা এখন অস্বাভাবিক রকম কলরবমুখর। আর্মড পুলিশ, আধা সামরিক বাহিনীর লোকজন ভিড় করে আছে বাইরে, মাঝে মাঝেই হাঁকাহাঁকি চলছে, সেরেস্তা ঘরে বসেও তাদের গলা শোনা যায়। কনস্টেবল কিছু কম বটে, তবে তেমন টের পাওয়া যায় না। পাশেই সাব ইন্সপেক্টরদের ঘরে কে যেন জোরে চেঁচিয়ে উঠল। সামনে দাঁড়ানো কনস্টেবলটা বেরিয়ে গেল বাইরে। নিরীহ চেহারার আট-দশ জন সদ্য নিযুক্ত হোমগার্ড নার্ভাস মুখে ইতিউতি উঁকিঝুঁকি মারছে। দরজায় দাঁড়ানো একজনের সঙ্গে চোখাচোখি হতে মুখ ঘুরিয়ে নিল কন্দর্প।

ডিউটি অফিসার আবার কলম ধরেছেন, বলুন।

কী বলব?

 –সে আপনারাই জানেন। …কটা নাগাদ মেয়েকে শেষ দেখা গেছে?

–তা ধরুন আটটা-সাড়ে আটটা হবে। সুদীপ সোজা হয়ে বসল।

–আজ সন্ধে সাড়ে আটটা? চারদিকে খুঁজে দেখেছেন?

–হ্যাঁ।

–কোনও আত্মীয় টাত্মীয়র বাড়ি চলে যায়নি তো? বন্ধুবান্ধব?

-নাহ্। তিতির আমাদের ওরকম মেয়েই নয়। না বলে কোথাও যায় না। ভীষণ ইনোসেন্ট… খুব শাই।

ঘরের এক পাশে বেঞ্চিতে বসে থাকা একজন, সম্ভবত কনস্টেবল, ফুট কাটল, নিজেদের বাড়ির মেয়েদের সবাই ওরকম ভাবে মশাই।

সুদীপ কটমট চোখে তাকাল, দেখেননি ওকে। দেখলে বুঝতেন।

–ঠিক আছে, ঠিক আছে। লম্বা সিঁড়িঙ্গে বছর পঁয়তাল্লিশের মাছি গোঁফ ডিউটি অফিসার কলম উল্টে ঘাড় চুলকোচ্ছে, তা সেই মেয়ে আপনাদের পালাল কেন? বাপ মার সঙ্গে কোনও ঝগড়াঝাঁটি হয়েছিল?

পিছন থেকে আদিত্য প্রায় ককিয়ে উঠল, আজ্ঞে না।

মেয়ে যে পালিয়েই গেছে, তাহলে বুঝলেন কী করে?

আদিত্যকে নিরুত্তর দেখে সুদীপ আবার হাল ধরল। সেকেন্ডের জন্য ইন্দ্রাণীর পাথর হয়ে বসে থাকা চেহারাটাও বুঝি স্মরণে এল তার। নিচু স্বরে বলল, বউদি, মানে মেয়ের মা-ই প্রথম ধরতে পারল।

–তিনি তখন কোথায় ছিলেন?

বাড়িতে। নিজের ঘরে। …হঠাৎ কি কাজে যেন পাশের ঘরে গিয়েছিল …বলতে গিয়ে সুদীপ একটু যেন হোঁচট খেল। সত্যিই বউদি কি করে আবিষ্কার করল তিতির পালিয়েছে, তা তার জানা নেই। সবটাই অনুমান। আন্দাজে আন্দাজে বলল, তারপর দেখল বাইরের গেট হাট করে খোলা…. প্রথমে ভেবেছিল কাছেপিঠেই কোথাও গেছে। দশটা বাজে, সাড়ে দশটা বাজে, মেয়ে ফেরে না, তখন আমাদের…

–আপনারা সব কোথায় ছিলেন?

–আমি মানে… আমি বড়কাকা, আমি আলাদা থাকি… ওদের কাছ থেকে খবর পেয়ে… আমার দাদা আজ একটু রাত করে ফিরেছিল… বিজনেসের কাজ ছিল… আমার এই ছোট ভাই ওদের সঙ্গেই থাকে, ফিলম টিভিতে অ্যাক্টিং করে… শুটিং ফুটিং-এর জন্য প্রায়ই ওর রাত হয়… আজও…

–আপনি ফিল্ম স্টার? ঝট করে কন্দর্পর দিকে ফিরল ডিউটি অফিসার, নামটা জানতে পারি?

কন্দর্প রায়।

কয়েক সেকেন্ড কন্দর্পর আগাপাশতলা দেখল ডিউটি অফিসার, হুঁ, তাই মুখখানা চেনা চেনা লাগছিল। পোস্টার ফেস। বলেই চোখ আবার সুদীপের দিকে, হ্যাঁ, তারপর বলুন।

দৃষ্টিটা যেন বড় বেশি তীক্ষ্ণ, অন্তর্ভেদী। সুদীপ অস্বস্তি ভরা মুখে বলল, অ্যাই চাঁদু, তুইই তো এসে ডাকলি আমায়, আমি তো… তুই ডিটেলে বল না।

–ডিটেল আবার কি! আমি ফিরেছি অ্যারাউন্ড ইলেভেন। তখন দেখি দাদা বাড়ির সামনে হানটান করছে, বউদি ঘরে মাথায় হাত দিয়ে বসে। সঙ্গে সঙ্গে আমি ওর বইখাতা ডায়েরি ঘেঁটে স্কুল-টুলের যত বন্ধুবান্ধবের নাম-টাম পেয়েছি, সকলকেই ফোন করেছি। কোনও আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে তেমন যেত না, এক নিজের দাদু দিদিমার বাড়ি ছাড়া। মানিকতলায়। তা সেখানেও আমরা খোঁজ নিয়ে দেখেছি।

বয়ফ্রেন্ড টয়ফ্রেন্ড ছিল? তার সঙ্গে হাওয়া হয়নি তো?

কতবার তো বলছি, তিতির ওরকম মেয়ে নয়। সুদীপ ঝেঁঝে উঠল।

–অত জোর দিয়ে বলবেন না। ওই বয়সের মেয়ে বাড়ি থেকে যখন কেটেছে, তখন একটা ল্যাঙবোট নিয়েই কেটেছে। বাড়িতে কিছু মিসিং হয়েছে কি না দেখেছেন? টাকা? গয়না?

বলছি তো তিতির ওরকম মেয়ে নয়! সুদীপ টেবিলে হাত ঠুকল।

উত্তেজিত হবেন না। ভাবুন। চিন্তা করুন।

নিমেষে ঘর নিস্তব্ধ হয়ে গেল। যেন আলপিন পড়লেও শব্দ শোনা যাবে। চিড়িক চিড়িক বিদ্যুৎ-তরঙ্গ খেলে যাচ্ছিল কন্দর্পর মাথায়। তিতির কি সেই ছেলেটার সঙ্গেই পালাল? কথাটা আগেই মাথায় এসেছে, তিতিরের খাতাপত্তর ঘেঁটে নামটা খোঁজার চেষ্টা করেছিল। নেই। কি যেন নাম বলেছিল তিতির? সুব্রত? সুজিত? মনে পড়ছে না। পুলিশকে বলবে ছেলেটার কথা? না। যদি সত্যিই তিতির তার সঙ্গে পালিয়ে গিয়ে থাকে, মিছিমিছি আর কেচ্ছা বাড়িয়ে কি লাভ। পুলিশ টানাটানি করবে… চতুর্দিকে জানাজানি হয়ে যাবে…। যদি সংশয়টা অমূলক হয়, সন্দেহের কথাটা পুলিশকে বলে ফেলে কন্দর্প, তিতিরের পক্ষেও মোটেই সেটা মঙ্গলের হকে না। বরং তিতিরকে খুঁজে বার করে, বুঝিয়ে শুনিয়ে…। কিন্তু তিতির এভাবে পালাবেই বা কেন! বোকা মেয়েটা কি ফেঁসে গেল! হয়তো নিরুপায় হয়ে লজ্জায় ঘেন্নায়…। ছি ছি, তিতির সম্পর্কে এসব কী ভাবছে সে! তিতিরের সঙ্গে ওই ছেলেটার সত্যিই যদি হৃদয়ঘটিত কোনও সম্পর্ক গড়ে উঠে থাকে, তিতিরের বন্ধুরা কি একটু আঁচ দিত না! অনেক সময়ে বন্ধুরা অবশ্য মুখ খুলতে চায় না… কিন্তু তিতির কি এত সেয়ানা হয়ে গিয়েছিল! সকালেও কন্দর্পর সঙ্গে তিতিরের কথা হয়েছে, তখনও ওই মেয়ে দিব্যি সহজ স্বাভাবিক, আর সেই মেয়ে কিনা রাত আটটার পরে, বলা নেই কওয়া নেই, একটা ছেলের সঙ্গে হাপিস! একটা কিছু তো আভাস ইঙ্গিত থাকবে! উঁহু, কন্দর্প ঠিক মেনে নিতে পারছে না।

ঘরের একদিকে সার সার সবুজ আলমারি। উঠে গিয়ে একটা আলমারির মাথা থেকে গোটাকতক ধুলো মাখা ফাইল নামাল ডিউটি অফিসার। চটাস চটাস ঝাড়ছে। পাখার হাওয়ায় ধূলিকণা ছড়িয়ে গেল ঘরময়। একটা আঁধছেঁড়া মোটা ফাইল নিয়ে টেবিলে ফিরল। সরু ফিতে খুলতে খুলতে বলল, ছবি এনেছেন মেয়ের?

সুদীপ ঝটিতি পকেট থেকে একটা ছোট্ট খাম বার করল। পাসপোর্ট সাইজের ছবি, হায়ার সেকেন্ডারির অ্যাডমিট কার্ডের জন্য তোলা। বুদ্ধি করে খুঁজে পেতে এনেছে।

চোখ কুঁচকে ছবিখানা দেখছে ডিউটি অফিসার, এ তো বেশ সুন্দরী দেখছি। এসব মেয়ে একবার উধাও হয়ে গেলে তো আর…। হুঁউ, অ্যাপারেন্টলি মুখটাও বেশ ইনোসেন্ট।

–অ্যাপারেন্টলি নয়, ও সত্যিই ইনোসেন্ট।

–থাক। হাত তুলে উত্তেজিত সুদীপকে দমিয়ে দিল লোকটা, পূতপবিত্র মুখ তো জীবনে কম দেখলাম না! এর থেকে ঢের ইনোসেন্ট ফেস ঠাণ্ডা মাথায় মা বাপকে জবাই করে পিরিতের নাগরের সঙ্গে কদম্বতলায় বসে থাকে।

আহ্ অফিসার, হোয়াই ডোন্ট ইউ বিলিভ আস? আমাদের মেয়ে ডিফারেন্ট, একদম অন্যরকম। আমি বলছি সে স্বেচ্ছায় কোথাও যায়নি। শি হ্যাজ বিন কিডন্যাপড।

যাহ্ শালা! এ যে ফ্রেশ চার্জ। সেকশান থ্রিসিক্সটিসিক্স! না না, এ তো মাইনর গার্ল। মানে! থ্রিসিক্সটিসিক্স-এ!

–তাহলে তাই লিখুন। সুদীপ ক্রমশ ধৈর্য হারাচ্ছে, কোনও কারণে রাস্তায় বেরিয়েছিল, কেউ মুখে কাপড় চাপা দিয়ে তুলে নিয়েও যেতে পারে।

একটা হোমগার্ড কেটলিতে চা এনেছে। ইলেকশানের দৌলতে থানায় আজ রাতে চা-অলাদেরও মোচ্ছ। গরম ভাঁড়ে চুমুক দিয়ে ডিউটি অফিসার ঠাণ্ডা চোখে তাকাল, আপনারা কি চান বলুন তো? যদি কোনও ছেলের সঙ্গে ভেগে থাকে তাকে হাতকড়া পরাতে চান?

–মানে?

–গরমকালের ভর সন্ধেবেলা একটা মেয়ে নিজে নিজে বাড়ি থেকে বেরিয়ে কিডন্যাপড হয়ে গেল! সাক্ষী আছে?

সুদীপ দু দিকে মাথা নাড়ল, না।

–তাহলে শুধু মিসিংই লিখছি। …ঠিক কোন সময়ে মেয়ে পালিয়েছিল? স্পেসিফিক টাইম বলুন।

–আবার পালিয়েছে বলছেন? লিখুন, খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কন্দর্প আহত মুখে বলল।

স্থান-কাল-পাত্র ভুলে হো হো হেসে উঠল ডিউটি অফিসার, কেন ভাবের ঘরে চুরি করছেন। মশাই! মানুষ উবে যায় না। হয় নিজেই চলে যায়, নয় কেউ ফুসলে নিয়ে যায়। বলতে বলতে ঝপ করে গম্ভীর হয়ে গেল লোকটা, ধরে নিলাম আপনাদের মেয়ে অতি সুশীল। পেয়ার মোহব্বত দিল্লাগি কিছুই বোঝে না। সুতরাং কারুর সঙ্গে পালায়ওনি। তাহলে অন্য যে ব্যাপারটা ধরে নিতে হয় সে তো আরও মারাত্মক। আপনাদের মেয়ে স্বেচ্ছায় বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। কেন গেছে? নিশ্চয়ই কারণটা আপনাদের বাড়ির ভেতরেই আছে, আপনারা চেপে যাচ্ছেন। নিশ্চয়ই ওই মেয়েকে আপনারা বকাবকি করেছেন, নয়তো মারধর করেছেন। অথবা এমন কিছু বলেছেন যাতে ওই বয়সের মেয়ে…। আপনাদের মেয়ে সবে তো হায়ার সেকেন্ডারি দিয়েছে, রেজাল্টের এখনও ঢের বাকি, এটাও মোটেই পরীক্ষায় ফেল মেরে গঙ্গার ঘাট কি রেলের লাইনের দিকে দৌড়নোর সিজন নয়… অতএব বলা যায় মেয়ে যদি ছুপকে চুপকে লটঘট করে না কেটে পড়ে থাকে, অর্থাৎ আপনাদের কথামতো মেয়ে যদি সত্যিই ভাল হয় তাহলে আপনাদের মধ্যেই একটা বড়সড় গলতি রয়ে গেছে। আপনাদের সংসারের মধ্যে। মধ্যবিত্ত বাড়ির কেচ্ছার তো শেষ নেই! কী খুঁড়তে যে কী বেরোবে! কি বুঝলেন?

লোকটার অযাচিত মন্তব্যে নতুন করে তপ্ত হয়ে উঠছিল সুদীপ, গলা চড়াতে যাচ্ছিল, তার আগেই আদিত্য হাউহাউ কেঁদে উঠেছে, আমি কিছু বুঝতে চাই না দারোগাবাবু, আপনি শুধু আমার মেয়েটাকে ফেরত এনে দিন। ওর কিছু হয়ে গেলে আমি মরে যাব। মেয়েটা আমার…

আহ্ দাদা, শান্ত হও। কন্দর্প কাতর মুখে অফিসারের দিকে তাকাল, আপনার যা লেখবার লিখুন। অ্যান্ড প্লিজ ডু সামথিং।

লোকটাও একটু যেন থমকেছে। পুলিশের উর্দি থেকে একটা মানুষ মানুষ ভাব দেখা দিয়েছে এতক্ষণে। ঈষৎ নরম গলায় বলল, দেখছি কি করা যায়। কাল বাদে পরশু ইলেকশান, পুলিশ ফোর্সের এখন দম ফেলার ফুরসত নেই, কে কোথায় যায়… এর মধ্যে এর সিকিউরিটি, তার সিকিউরিটি… তার মধ্যে আপনারা এমন একটা ঝামেলা নিয়ে এলেন… আমি মিসিং পারসনস স্কোয়াডকে এখনই মেসেজ দিয়ে দিচ্ছি। নিয়ার বাই পি এস-গুলোকেও ওয়ারলেসে ইনফর্ম করে দিচ্ছি। বাই দা বাই, আপনারা কি হসপিটালগুলোতে খোঁজখবর করেছেন? বাইচান্স যদি অ্যাক্সিডেন্ট…

আদিত্য বেভুলের মতো ভাইদের দিকে তাকাল।

ডিউটি অফিসার বলল, আমি দেখছি। আপনারাও খোঁজ করে দেখুন। ও, একটা পয়েন্ট নোট করা হয়নি। কি ড্রেস ছিল মেয়ের?

এটা তো কারুর জানা নেই! সুদীপ ঢোঁক গিলে বলল, – সম্ভবত সালোয়ার কামিজ।

-এই তো মুশকিল, স্পেসিফিক বলতে পারছেন না। মেয়ের কোনও বন্ধুবান্ধবের অ্যাড্রেস ফোন নাম্বার আছে?

বাড়িতে আছে। লাগলে বাড়িতে গিয়ে ফোনে…।

–ঠিক আছে, আপনাদের ফোন নাম্বার তো রইল। লাগলে আমি নিজেই চেয়ে নেব।

ডায়েরির কপি নিয়ে যন্ত্রচালিতের মতো থানা থেকে বেরিয়ে এল তিন ভাই। নির্বাক। কিংকর্তব্যবিমূঢ়। ক্যাঁচ করে সামনে একটা পুলিশ ট্রাক এসে থামল। একের পর এক সশস্ত্র উর্দিধারী নেমে আসছে। নির্বাচনের প্রস্তুতি। ভারী বুটের শব্দে গমগম করে উঠল রাত।

কন্দর্পর চোখ করকর করছে। এত পুলিশে ছেয়ে আছে থানা, নিশ্চয়ই শহর জুড়েও আজ পুলিশের কমতি নেই, কিন্তু তাদের মেয়েটাকে খোঁজার জন্য একজনও নেই কোত্থাও। কত মহৎ কাজে ব্যস্ত থাকবে এরা, কোথায় কোন সংসারে এক নগণ্য মেয়ে হারিয়ে গেছে তাতে কার কি আসে যায়! সাধে কি নকশালরা রাষ্ট্রযন্ত্র শব্দটা উচ্চারণ করতে গিয়ে থুতু ছেটাত!

পকেট থেকে ডায়েরির কপি বার করল সুদীপ। খুলল, ভাঁজ করল, আবার পকেটে রাখল। হঠাৎ চমকে তাকিয়েছে, এই চাঁদু, দাদা কোথায় গেল রে?

কন্দর্প এদিক ওদিক তাকিয়ে আদিত্যকে দেখতে পেল না। এই তো পাশে ছিল, গেল কোথায়!

আধো অন্ধকার রাস্তায় উদভ্রান্তের মতো এগিয়েছে দু ভাই। কয়েক পা গিয়েই দেখতে পেল আদিত্যকে। নির্জন পথে হাঁটছে দ্রুত গতিতে।

সুদীপ চেঁচাল, দাদা? অ্যাই দাদা? কোথায় যাচ্ছিস?

 আদিত্য তাকাল না।

কন্দর্প দৌড়ে গিয়ে ধরেছে– এদিকে হাঁটছ কোথায়?

আদিত্য আচ্ছন্নের মতো তাকাল, পুলিশ আমাদের খুঁজে দেখতে বলল যে! যদি তিতির এদিকেই গিয়ে থাকে।

খ্যাপামি কোরো না। চলো, বাড়ি চলো।

–তোরা যা। আমি একটু দেখি। এই রাত্তিরে মেয়েটা কোথায় একা একা ঘুরছে। মেয়েটার তো আজ খাওয়াও হয়নি!

এমন একটা ভারী মুহূর্তে তিতিরের খাওয়ার কথা মনে পড়ল দাদার! এমনটাও হয়! কন্দর্পর বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল। এই প্রথম তিতিরের ওপর রাগ হচ্ছিল কন্দর্পর! দাদার মতো মানুষকে কষ্ট দিয়ে চলে গেল তিতির! পারল যেতে!

দাদাকে টানল কন্দর্প, চিন্তা কোরো না। তিতির চলে যাবেটা কোথায়? ঠিক ফিরে আসবে। আমরা ঠিক ওকে খুঁজে বার করব।

আদিত্য ফ্যালফ্যাল মুখে বলল, – ও কি রাগ করে চলে গেল চাঁদু?

কার ওপর রাগ?

–ওই যে দারোগাবাবু বলল …তোর বউদি হয়তো সত্যিই ওকে খুব বকাঝকা করেছে!

ইশ, কন্দর্পর মাথায় এ চিন্তাটা এতক্ষণ আসেনি কেন? তিতির আর বউদির আজকাল সাপে-নেউলে সম্পর্ক, অহরহ খিটিমিটি চলছে, কিন্তু তার জন্য তিতির গৃহত্যাগ করবে এ কথাও তো ঠিক বিশ্বাস হয় না।

জবাবটা এড়িয়ে আদিত্যকে নিয়ে গাড়িতে ফিরল কন্দর্প।

আদিত্য পিছনের সিটে বসেছে। সামনে কন্দর্প সুদীপ। রাস্তাঘাট একদম ফাঁকা, তবু গাড়ি চলছে ধীরে, বেশ ধীরে। মৃদু একটা শব্দ উঠছে ইঞ্জিন থেকে, ঠিক যেন হৃদয়ের শব্দ। গুমরোচ্ছে। বহুকাল পর বড় ঘনিষ্ঠ হয়েছে তিন ভাই, কিন্তু তিনজনের চিন্তা ছুটছে তিন দিকে। কন্দর্প ভাবছিল অশোক মুস্তাফিকে একটা ফোন করলে কেমন হয়? অশোকদার তো কলকাতা পুলিশের অনেক বিগ শটের সঙ্গে চেনাজানা। সে চেষ্টা করলে পুলিশ কি একটু বেশি উদ্যোগী হবে না! কিন্তু সেদিন যে বিশ্রী ঝগড়াটা হয়ে গেল, তারপর কি অশোকদা আর তাকে সাহায্য করবে। ফিলম লাইনের আর কাকে ধরা যায়? লালবাজারের ক্রাইম ব্রাঞ্চে বিপ্লব ছিল আগে, কলেজের বন্ধু, এখনও কি সে ওখানেই আছে? অনেককাল তো আর যোগাযোগ নেই। কাল সক্কালবেলা কি একবার যাবে লালবাজারে? এই ইলেকশানের ডামাডোলে লাভ হবে কোনও? সুদীপের মনে প্রশ্ন জাগছিল, শুভাশিসদাকে খবর দেওয়া হয়েছে কি? দাদা আর চাঁদু যেভাবে দৌড়ে এল, মনে হয় শুভাশিসদার কথাটা ওদের মাথায় আসেনি। হাসপাতাল টাসপাতালে খবরাখবর নিতে গেলে শুভাশিসদাই ফিটেস্ট পারসন। কিন্তু রাত এখন দেড়টা, এখন কি শুভাশিসদাকে ডাকাডাকি করাটা উচিত হবে? রায়বাড়ির কারুর বিপদ হয়েছে শুনলে যত রাতই হোক শুভাশিসদা কিন্তু ছুটে আসবেই।

আদিত্য অবশ্য এসব কিছুই ভাবছিল না। তার বুক জুড়ে এখন শুধুই তিতির। ছোট্ট তিতির, পুতুল তিতির, লাজুক তিতির, হাস্যমুখী তিতির, অভিমানী তিতির, সেবিকা তিতির, রাগে গরগর তিতির। একটার পর একটা তিতির। কোথায় গেলি তিতির? ফিরে আয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *