৮৬-৯০. হোয়াট আ সারপ্রাইজ

দরজা খুলে হিয়া বলল, – ওয়াও! হোয়াট আ সারপ্রাইজ! তুই না এই উইকে আসবি না। বলেছিলি!

টোটো কাঁধ ঝাঁকিয়ে হাসল, চলে এলাম।

টিউটোরিয়াল যাসনি?

 –আজ তো টিউটোরিয়াল ছিল না। ফিজিক্স স্যার ছিল।

নতুন স্যার?…কেমন পড়ান রে?

 উত্তর দিতে গিয়ে টোটো সামান্য ধাঁধায় পড়ে গেল। তার নতুন শিক্ষকটি বেহালার ওদিকের এক কলেজের অধ্যাপক। তিনি ভাল পড়ান, না খারাপ পড়ান, এখনও ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি টোটো। আগের স্যার রোজ কিছু না-কিছু নোট দিতেন, মেপেজুপে কঠিন কঠিন প্রবলেম সলভ করাতেন, ইনি ওসবের ধার দিয়েও যান না। এক একটা টপিক ধরে একটানা অনেকক্ষণ বুঝিয়ে চলেন, অনেক খুঁটিনাটি কৌতূহল তৈরি করেন নিজে, আপন মনেই উত্তর দিয়ে দেন। কিন্তু একদমই কিছু লেখান না। প্রশ্নোত্তর ফর্মে প্রিপেয়ার না করলে এই স্যারকে দিয়ে কি উপকার হবে? তবে হ্যাঁ, এই স্যার তাঁর মনে ফিজিক্সের প্রতি একটা গভীর আগ্রহ তৈরি করে দিয়েছেন। বিশেষত অ্যাটম মলিকিউল নিউক্লিয়াস ইলেকট্রন প্রোটন নিউট্রনের জগৎ নিয়ে। কত বিচিত্র কণার নাম জানছে সে। পাই-মেশন, মিউ-মেশন, নিউট্রিনো…।

অত কথায় গেল না টোটো। হেসে বলল, চলতা হ্যায়।

হিয়া এখনও ধীরে ধীরে হাঁটে। স্টিচের জায়গায় এখনও তার ব্যথা আছে, হাঁটা দেখলেই বোঝা যায়। তার পিছন পিছন ঘরে গিয়ে বসল টোটো। কায়দা করে হেলান দিল খাটে, পড়াশুনো শুরু করেছিস?

কাল চেষ্টা করেছিলাম। বেশিক্ষণ টানা বসতে পারছি না রে।

 শুয়ে শুয়ে পড়।

–তাও চেষ্টা করেছিলাম। ঘুম এসে যায়।

–তাহলে আর তোর ডাক্তার হওয়া হল না। নিউ ইয়ার পার হয়ে গেল, এখনও তুই ফিট হলি না…এর পর তুই জয়েন্টের প্রিপ্যারেশন করবি কবে?

হিয়া মিষ্টি করে হাসল, –তোর দেখছি আমার চিন্তায় ঘুম হচ্ছে না!

দু পলক হিয়াকে দেখে চোখ সরিয়ে নিল টোটো। হিয়া কি সত্যি জানে না তার চিন্তায় টোটোর ঘুম হয় না? বই খুললেই হিয়ার মুখ, কলম আঁচড় টানলেই হিয়ার অবয়ব, ঘরের জানলা দিয়ে আকাশের দিকে তাকালে হিয়া, টেবিল ল্যাম্পের আলো নেবালে হিয়া…সবই কি মুখ ফুটে বলতে হবে টোটোকে?

সন্ধে নেমে গেছে বহুক্ষণ। হিয়ার ঘরের সব জানলা বন্ধ, তবু কোথা থেকে যেন একটা চোরা বাতাস আসছে। ভীষণ ঠাণ্ডা। শীত এবার অনেকদিন ঘাঁটি গাড়ল কলকাতায়। দিনের বেলা সূর্যের পাহারাদারিতে তাও একটু হাত-পা ছড়ায় তোকজন, বাইরে বেরোয়। সন্ধে হলেই যে যার নিজস্ব কোটরে।

টোটো তালুতে তালু ঘষল, বাড়িতে সাড়াশব্দ নেই কেন?

বাবা আজ ঠাম্মার হোমে যাবে। আর উনি তো সেই পুরুলিয়ায়। ছেলেকে হোস্টেলে পৌঁছতে। পরশু বোধহয় ফিরবে।

তার মানে তুই একা?

 বাসন্তীদি আছে। কেন রে?

টোটো হেসে ফেলল, -না এমনিই।

–হাসলি কেন? হিয়া চোখ পিটপিট করল।

–তুই বুঝবি না। টোটো হাতে মাথা রেখে চিত হয়ে শুল, তোর বাসন্তীদিকে বল কিছু খাওয়াতে। স্যারের কাছে ফ্লেমিং লেফট্‌হ্যান্ড রুল বুঝতে বুঝতে পেট খালি হয়ে গেছে।

কী খাবি? প্যানকেক চলবে?

–এনিথিং এনিথিং।

হিয়া রান্নাঘর থেকে ঘুরে এসে বলল, এই জানিস, আজ একটা খারাপ খবর শুনলাম।

টোটো ঘাড় ফেরাল, –কী রে?

–তোকে বলব না। তুই চটে যাবি।

বল না। ঝোলাচ্ছিস কেন?

হিয়া খাটের অন্য প্রান্তে বসল। নখ খুটতে খুঁটতে বলল, তিতিরের বাবার খুব অসুখ। হসপিটালে আছেন।

টোটোর চোয়াল মুহূর্তের জন্য শক্ত হল। পরক্ষণে হেসে ফেলেছে, এতে আমি রাগব কেন? কোথায় কার অসুখ হয়েছে তাতে আমার কী এসে গেল। বাই দা বাই, হয়েছে কী? অ্যামিবায়োসিস্?

না রে, ওর বাবা তো খুব…হিয়া থেমে গেল। একটু পরে বলল, –কী অসুখ ঠিক জানি না। শুনলাম লিভারের গণ্ডগোল।

টোটো চোখ কুঁচকোল, খুব বুজিং চলে?

হবে হয়তো। আমি জানি না।

–আমি জানি। লোকটা এর আগেও একবার হসপিটালাইজড হয়েছিল। ড্রিঙ্ক-ফিঙ্ক করেই…টোটো উঠে বসল, তোকে বলেছি না, ওদের ফ্যামিলিটা ভাল না! লোকটার লাইফটা খুব স্যাড। ওয়াইফের জন্য। মানে ওই তোর তিতিরের মা।

–তুই বড্ড বাজে কথা বলিস রাজর্ষি। তিতিরের মাকে আমি ছোট্টবেলা থেকে জানি। কী রিজার্ভড, কী পারসোনালিটি, দারুণ গ্রেসফুল লেডি।

টোটো মনে মনে বলল, – ওই জন্যই তো আমার বাবা ওখানে পড়ে থাকে।

হিয়া আবার বলল, – আমরা যখন ছোট ছিলাম, ওদের বাড়িতে গেলেই মাসিমা মুঠো মুঠো চকোলেট দিতেন আমাদের।

টোটো আবার নিঃশব্দে বলল, – ওই চকোলেট আমার বাবার পয়সাতেই কেনা।

হিয়া পা গুটিয়ে বসল, – ওর মা কী স্ট্রাগল করেছেন জানিস? ওর বাবা তো বরাবরই একটু বোহেমিয়ান টাইপ, উনি একা চাকরি করে…স্কুলে পড়ান, নিজে একটা প্রেস চালাতেন…আমরা নিজের চোখে দেখেছি।

টোটোর গা কিশকিশ করে উঠল। বিরক্ত মুখে বলল, – টপিকটা থামাবি?

–এই দ্যাখ, তুই কিন্তু রেগে গেলি। টোটো আরও রাগত মুখে বলল, আমার এনিথিং রিলেটেড টু ওই তিতির শুনতে ভাল লাগে না। বেসিকালি একটা বাজে মেয়ে, অত্যন্ত রটন্ একটা ছেলের সঙ্গে ঘোরে…ওর জীবনে অনেক দুঃখ আছে দেখে নিস।

যাহ, অভিশাপ দিচ্ছিস কেন? ও আমার অনেক দিনের বন্ধু। ঝগড়া করুক আর যাই করুক, আমি নার্সিংহোমে শুনে দৌড়ে দেখতে এসেছিল তো।

টোটো আবার চোখ কুঁচকোল, তোর সঙ্গে ঝগড়া করেছে?

না না, তেমন কিছু না। এমনিই বললাম।

–চেপে যাচ্ছিস?

 হিয়া উত্তর দিল না। কথা ঘুরিয়ে বলল, – এই, আমাদের স্পেশাল ক্লাস কবে থেকে শুরু হচ্ছে

টোটো গুম হয়ে গেল। হিয়া কথা গোপন করছে। বন্ধুর ওপর হিয়ার খুব টান, তার সম্পর্কে কোনও কথাই খুলে বলে না। টোটো নিজেও কি সব বলে হিয়াকে? কেন বলে না? হিয়ার সঙ্গে তার এখন যা সম্পর্ক, তাতে পরস্পরের কাছে কোনও কথাই লুকোনো উচিত নয়। তবু থাকে। তবে কি দুটো ছেলেমেয়ে যখন কাছাকাছি আসে, তাদের মধ্যে কিছু কিছু গোপনীয়তা থেকেই যায়? কেন থাকে?

খাবার এসে গেছে। খেয়েদেয়ে আরও কিছুক্ষণ আড্ডা মারল টোটো, পৌনে আটটা নাগাদ উঠে পড়ল।

হিয়া দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে, কাল আসবি?

-কেন রে?

হিয়া মুচকি হাসল, কিছু না। এমনিই।

–হাসলি কেন? টোটো চোখ পিটপিট করল।

 –তুই বুঝবি না।

বুঝেছে টোটো। মুখটা খুশিতে ভরে গেল। হাসতে হাসতে গাড়িতে উঠে রামদেওকে বলল গাড়ি একদম তেজ চালাবে না। ম্যাক্সিমাম ফরট্টি। বুঝেছ?

রামদেও অবাক হয়ে গেছে। এ তো একেবারে ভূতের মুখে রাম নাম! চোখ গোল গোল করে বলল, – কেন?

টোটো ঠেটি টিপে হাসল, এমনিই।

হাসছ কেন?

 –তুমি বুঝবে না। রামদেও গাড়ি স্টার্ট দিচ্ছে। গম্ভীর গলায় বলল, -বুঝেছি।

হো হো হেসে উঠল টোটো। মনটা হঠাৎ পালকের মতো হালকা হয়ে গেছে। অতি ধীরে চলছে গাড়ি, শীতকাতুরে বিরল পথচারী জবরজঙ পোশাকে ঠাণ্ডার ভয়ে হেঁটে চলেছে হনহন, শীতল বাতাস ভোঁতা ছুরি হয়ে ঘষা খাচ্ছে নাকে মুখে, ফুটপাথে আগুন জ্বেলে শরীর সেঁকছে গরিব লোকেরা, ট্রাফিক কনস্টেবলগুলো হিহি কাঁপছে, সবই যেন দারুণ মজার।

 বাড়ি ফিরে খুশিটা আরও বেড়ে গেল। মাসি এসেছে। তাকে দেখেই মাসি হই হই করে উঠল, এই টোটো, তুই কদিন তোর বাবাকে সামলাতে পারবি?

বাবাকে সামলানো! টাফ জব। টোটো ভুরু নাচাল, -কদিনের জন্য?

 –দিন আট-দশ।

 –কেসটা কি?

–আমি আর তোর মা জলপাইগুড়ি যাব ভাবছি। বাবা অনেক দিন ধরে লিখছে..

টোটো আশ্চর্য হয়ে গেল। তাকে একা ছেড়ে তার মা বাবা কোথাও যাবে তা তার কল্পনাতেও ছিল না, এখন বাবাকে একা রেখে মা যেতে চাইছে! মার হলটা কি! বাবার সঙ্গে হানিমুন গোছের একটা ভ্রমণ সেরে এসে মা যেন অন্য মানুষ। বাবার সঙ্গে কথায় কথায় ফাটাফাটি নেই, বাবা বেশি রাত করে ফিরলে মুখ ভার নেই, টোটো পড়ছে কি না জানার জন্য আড়ি পাতা নেই, দিব্যি রামদেওকে নিয়ে গাড়ি করে মার্কেটিং-এ বেরিয়ে যাচ্ছে, এখানে যাচ্ছে, ওখানে যারে সেদিন তো একা একা অ্যাকাডেমিতে কি একটা নাটক দেখে এল!..ডাক্তারগিন্নির হঠাৎ এত বড় পরিবর্তন যে। মা যেন কেমন নির্লিপ্ত নিরাসক্ত ধরনের হয়ে গেছে। তেনসা না টেনশা কোথায় গিয়ে বাবা কি বশীকরণ বাণ মারল!

টোটো এক হাত ঘাড় বেঁকিয়ে দিল, কুছ পরোয়া নেই। তোমরা নিশ্চিন্তে চলে যাও। ডক্টর শুভাশিস সেনগুপ্তকে আমি চোখে চোখে রাখব।

ছন্দা উদাসিনীর মতো বলল, কে কাকে চোখে চোখে রাখে।

 মাকে একঝলক দেখে নিয়ে শিস ভাঁজতে ভাঁজতে নিজের ঘরে চলে গেল টোটো। বইখাতা খুলে বসেছে। অঙ্ক কষছে। ট্রিগোনোমট্রি। টেস্টপেপার দেখে দেখে। তারই মধ্যে শুনতে পেল বিদায় নিয়ে চলে গেল মাসি। মা টিভি খুলেছে। কার সঙ্গে যেন ফোনে কথা বলল মা, হাসছিল। সবিতা রাতের খাবার তৈরি করছে, ছ্যাঁক-ছোঁক শব্দ আসূছে রান্নাঘর থেকে।

সাড়ে নটা নাগাদ ছন্দা ডাকল, – টোটো, খাবি আয়।

 টোটোর একটা অঙ্ক মিলছিল না। চিন্তিতভাবে বলল, একটু পরে মা।

উঁহু, খেয়ে নিয়ে পড়ো।

অগত্যা উঠল টোটো। মা-ছেলেতে খেতে বসেছে মুখোমুখি। গলদা চিংড়ির মালাইকারি হয়েছে রাত্তিরে, টোটোর প্রিয় ডিশ। গোবিন্দভোগ চালের ভাতের সঙ্গে মালাইকারি মেখে গপাগপ খাচ্ছে টোটো।

খেতে খেতে প্রশ্ন করল। অনেকটা গার্জেনের ভঙ্গিতে, এই জানুয়ারির শীতে হঠাৎ জলপাইগুড়ি যাওয়ার প্ল্যান করছ যে?

ছন্দা বলল, – এমনিই।

টোটো সদ্য গজানো গোঁফে আঙুল বোলাল, হাসলে না তো?

-মানে?

–মানে কথাটা বলতে বলতে তো হাসতে হয়।

–কেন?

–তুমি বুঝবে না। বলেই গলা ছেড়ে হেসে উঠল টোটো।

 ড্রয়িং স্পেসে ফোন বাজছে। খাওয়া ফেলে উঠতে যাচ্ছিল টোটো, তাকে বসিয়ে দিল ছন্দা। নিজে গিয়ে টেলিফোন তুলেছে। কানে রিসিভার চাপার ক্ষণ পরেই আর্তনাদ করে উঠল, কবে? কখন?

কথা বলতে বলতে বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে ছন্দার মুখ। ঠকঠক কাঁপছে। ফোন রাখতেই টোটো দৌড়ে এল, কী হয়েছে মা?

ছন্দা কথা বলতে পারছে না। ভীষণ বিভ্রান্ত দেখাচ্ছে তাকে।

 টোটো অধৈর্য ভাবে বলল, -কার ফোন বলবে তো?

-তোর তুফানকাকার।

হঠাৎ?

–তোর দাদুর স্ট্রোক হয়েছে। ইমিডিয়েটলি আমাদের যেতে বলল। ছন্দা টোটোর হাত চেপে ধরল, –কী হবে রে টোটো? তুফান টেলিফোনে হাউমাউ কাঁদছিল।

টোটো মুহূর্তের জন্য কিংকর্তব্যবিমূঢ়। ফ্যাসফেসে গলায় বলল, দাদু বেঁচে আছে তো মা?

–কিছু তো বলল না। বোধহয় আছেন।

বাবাকে তাহলে এক্ষুনি খবর দিতে হয়। টোটো নার্ভাস হাতে টেলিফোন তুলল, বাবাকে এখন কোথায় পাওয়া যাবে?

ছন্দা বসে পড়েছে। কপাল টিপে মাথা নাড়ল, জানি না।

টোটোর বুকের মধ্যিখানটা হু হু করে উঠল। শেষবার যখন গেছিল, দাদু যেন কেমন মিইয়ে ছিল। টুকি দুজনকেই ফোঁটা দিল। টোটোকে, দাদুকেও। টোটো খেলনাটা দিল, দাদু বলল, – ওই এরোপ্লেন করে আমায় উড়িয়ে নিয়ে যাবি টুকি? দৃরে, অনেক দূরে?

কাঁপা হাতে বোতাম টিপল টোটো। নার্সিংহোমে। ওপারে শালিনী।

-বাবা আছে আন্টি?

না তো। সন্ধেবেলা আসেনি আজ। সকালে এসেছিল।

–কোথায় পাওয়া যাবে আন্টি?

সানশাইনে একবার দেখতে পারিস। ওখানে একটা পেশেন্ট সিরিয়াস বলছিল।…কেন রে? কিছু হয়েছে?

টোটোর গলা বুজে এল, মাধবপুর থেকে ফোন এসেছিল। দাদুর হার্ট অ্যাটাক হয়েছে।

–ও নো। তুই সানশাইনে দ্যাখ। আমি দেখছি আর কোথাও পাওয়া যায় কি না।

দ্রুত হাতে টোটো সানশাইনের নম্বর টিপল। রিঙ হয়ে যাচ্ছে, রিঙ হয়ে যাচ্ছে, অধৈর্য হয়ে পড়ছে টোটো। বহুক্ষণ পর একটা ঘুমন্ত গলা ফোন তুলেছে।

টোটো গর্জে উঠল, আপনাদের নার্সিংহোমে এত দেরি করে ফোন তোলে কেন? ফাজলামি হচ্ছে?

ও প্রান্ত নির্বিকার, -কী চাই বলুন?

–ডক্টর সেনগুপ্ত আছেন?

–আপনি কে বলছেন?

 –তাঁর ছেলে।

 দূরভাষী একটু সচকিত হয়েছে এবার, এসেছিলেন স্যার। বেরিয়ে গেছেন।

উদভ্রান্ত হয়ে গেছে টোটো। একের পর এক নার্সিংহোমের নম্বর টিপে চলেছে, কোথাও নেই শুভাশিস। প্রতিটি চেম্বারে ফোন করল, নেই। ব্লু হেভেন শুধু এনগেজড টোন শুনিয়ে যাচ্ছে, ল্যান্সডাউনের চেম্বারে অবিরল রিঙ বেজে গেল।

হতাশ মুখে বসে পড়েছে টোটো, – কি হবে মা?

ছন্দা সামলেছে অনেকটা। চঞ্চল পায়ে পায়চারি করছে। হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, ঢাকুরিয়ায় একবার ফোন করে দ্যাখ তো।

কী অদ্ভুত নির্বিকার স্বর! এই প্রচণ্ড উদ্বেগের মধ্যেও স্বরটা কানে লেগেছে টোটোর। মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বলল, ওখানে আমি করতে পারব না।

ছন্দা সাইডটেবিল থেকে টেলিফোনের ইনডেক্স বইটা তুলল, – বেশ, আমিই করছি।

–না। কক্ষনও না। টোটো হঠাৎ গর্জে উঠেছে।

ছেলের এই অকস্মাৎ রুদ্র মূর্তিতে থমকে গেছে ছন্দা। কেমন করে যেন তাকিয়ে আছে টোটোর দিকে। ঠিক অসহায় নয়, করুণও নয়, এ-এক বিচিত্র বিস্মিত দৃষ্টি।

টোটো থমথমে গলায় বলল, – দাও, নাম্বারটা বার করে দাও।

টেলিফোন বাজছে ঢাকুরিয়ায়। অজান্তেই টোটোর শরীর শক্ত হয়ে গেল।

.

৮৭.

লেলিহান চিতার দিকে অপলক তাকিয়ে ছিল শুভাশিস। দেখতে দেখতে কী ভয়ানক হয়ে উঠল আগুন! সহস্র ফণা তুলে হিসহিসিয়ে নাচছে শিখা। পুট পুট শব্দ বাজিয়ে পুড়ছে কাঠ। ছোট ছোট অগ্নিকণা ছিটকে উঠছে চিতা থেকে, মিলিয়ে যাচ্ছে দিনের আলোয়। নীলচে ধোঁয়ায় শ্মশানভূমি ছেয়ে গেল।

নিঃশেষ হচ্ছেন শিবসুন্দর।

একটা মানুষ নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে এত আগুন লাগে!

শুভাশিসের চোখ দুটো জ্বালা করে উঠল। কষ্টে নয়, পথশ্রমের ধকলে নয়, রাত্রি জাগরণের ক্লান্তিতে নয়, নিছকই ধোঁয়ায়। ছাই উড়ছে বাতাসে, সঙ্গে কি বিশ্রী একটা পোড়া গন্ধ! চিতার সামনে থেকে সরে এল শুভাশিস। শ্মশানে এখনও ছোট ছোট জটলা। ভোরে সাত গাঁয়ের মানুষ ভেঙে পড়েছিল বাড়িতে, তারই রেশ। দু-চারজন প্রতিবেশী আত্মীয় ছাড়া সবাই প্রায় অচেনা। অবয়বহীন এই জনতাকে দেখে কেমন যেন ঘোর ঘোর লাগে। এত অজস্র মানুষের ভালবাসা পেয়েও কোন শক্তিতে একা হয়ে ছিল বাবা!

বটতলার বাঁধানো বেদিতে বসে আছে তুফান, পাশে টোটো। তুফানের মুখ হাঁটুতে গোঁজা, গরম চাদর মোড়া দেহটাকে অতিকায় পুঁটুলির মতো দেখায়। টোটোর পরনে জিনস পুলওভার, কাল রাতের মাফলারটাও সে এখনও খোলেনি গলা থেকে।

পায়ে পায়ে তুফানের পাশে এল শুভাশিস। ভেতরটা থম মেরে আছে, দু ভায়ে কথা বললে খানিকটা হালকা হবে হয়তো। ঘড়ঘড়ে গলায় ডাকল, তুফান?

–উ।

–ডি.সি-টা তোর কাছে আছে না? দে তো একটু।

মাথা তুলল না তুফান, পাঞ্জাবির পকেট থেকে কাগজটা বার করে দিল।

মৃত্যুর শংসাপত্রে আরেকবার চোখ বোলাল শুভাশিস। আপন মনে মাথা দোলাল। লেফট ভেন্ট্রিকিউলার ফেলিওর। এমনটাই যে হবে বাবার, আন্দাজ করা উচিত ছিল। করেই বা কী হত, বাবা কি বদলাত জীবনধারা! অন্য কিভাবেই বা বাঁচতে পারত বাবা!

কাটাছেঁড়ার সময় নেই, কাগজটা পকেটে ঢুকিয়ে তুফানের কাঁধে হাত রাখল শুভাশিস, মন শক্ত কর, এখনও অনেক কাজ বাকি।

মুখ তুলেছে তুফান। করমচার মতো লাল চোখ চাদরের খুঁটে মুছল।

–এখানে যা দেওয়ার দিয়ে দিয়েছিস?

ঘাড় নাড়ল তুফান।

–অলকাকে বলেছিস শ্মশানবন্ধুদের জন্য মিষ্টি আনিয়ে রাখতে?

রাখবে মনে হয়। নয়তো ফিরে… তুফানের গলা বুজে গেল।

শুভাশিস আর কথা খুঁজে পেল না। একটু পরে ছেলেকে বলল, – এই টোটো, এদিকের কাজ তো সব মিটে এল। তুই এবার চলে যা না।

টোটো উত্তর দিল না, ফিরেও তাকাল না। টাপু কি যেন বলছে ডোমকে, ডোমটা বাঁশ দিয়ে চিতাটা খুঁচিয়ে দিল, সেদিকেই টোটোর চোখ স্থির। কাল রাতে শুভাশিস বাড়ি ফেরার পর থেকেই ছেলের চোয়াল শক্ত হয়ে আছে, মুখ থমথমে, গাড়িতে গোটা পথ একটাও কথা বলেনি। এত দাদু অন্ত প্রাণ ছিল টোটো, আশ্চর্য! নাকি এই প্রথম কোনও প্রিয়জনের মৃত্যু দেখছে তাই..!

অলকার বাবা কাকা এসেছেন শ্মশানে, দাদাও। নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে এদিকে আসছেন। কাছে এসে অলকার বাবা বললেন, এবার তো অসীমকে একটু রামনগরে পাঠাতে হয় শুভ।

–কেন মেসোমশাই?

–তোমাদের কাপড়চোপড়গুলো এবার আনিয়ে নিই। স্নান করে তো পরতে হবে। বউমার, অলকার লালপেড়ে শাড়ি…

শুভাশিস কলের পুতুলের মতো ঘাড় নাড়তে যাচ্ছিল, তার আগেই তুফান বলে উঠল, আমাদের ওসব কিছু লাগবে না।

–সে কি! কেন?

বাবা অশৌচ শ্রাদ্ধশান্তি কিছু মানতেন না। ওসব অনুষ্ঠান হবে না বাড়িতে।

 কথাটা এমন জোরের সঙ্গে বলল তুফান, শুভাশিসও হতবাক।

অশেষ চোখ বড় বড় করে বললেন, তিনি না মানতে পারেন, তুমি তো মানো।

–আমার মানা না-মানায় কিছু এসে যায় না। বাবার ইচ্ছেই আমার কাছে আদেশ।

–বাবা কি তোমাকে বলেছিলেন কিছু?

-বলেননি, তবে তাঁর বিশ্বাসটা আমি জানি। তাতে আঘাত করব এমন স্পর্ধা আমার নেই।

এইসব আচার-বিচার, পারলৌকিক ক্রিয়াকর্মে শুভাশিসেরও গভীর আস্থা নেই। তবু শোক জ্ঞাপনের রেওয়াজ হিসেবে এসব তাকে মানতে হবে এমনটাই ধারণা ছিল তার। তাকে টপকে তুফানের এত দৃঢ়ভাবে কথা বলাটা তার পছন্দও হল না। বাবার কাজ হবে কী হবে না এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার তুফান কে!

অলকার বাবা কাকা সরে গেছেন। শুভাশিস চাপা স্বরে বলল, ফট করে তুই মতামত দিয়ে দিলি যে! আমার সঙ্গে আলোচনা করারও প্রয়োজন মনে করলি না?

তুফান নাক টানল, তুমি কি চাও এসব হোক?

শুভাশিস অস্বস্তিতে পড়ে গেল। বিশ্বাস অবিশ্বাসের মাঝখানে থাকা মানুষের এটাই তো সমস্যা। একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল, আমার চাওয়া না-চাওয়াটা বড় নয়। রিলেটিভরা রয়েছে, প্রতিবেশীরা রয়েছে, গাঁয়ে নানান কথা উঠবে…

তুমি তো জানো দাদা, বাবা কখনও এসব কেয়ার করত না।

কিন্তু বাবা তো আর নেই। গ্রামে তুই থাকবি, তোকে কথা শুনতে হবে।

–ছাড়ো তো। বাবাকে দুদণ্ড গাঁয়ে কেউ সুখে তিষ্ঠোতে দিল না, এখন তাদের কথার ভয়ে আমি…

তুফান…!

 তুফান চুপ করে গেল। আবার হাঁটুতে মুখ গুঁজেছে।

শুভাশিস একবার আড়চোখে দেখল টোটোকে। যেন কিছু দেখছেও না, শুনছেও না, এমন ভাবলেশহীন মুখে বসে আছে ছেলে। মুখ ফিরিয়ে নিল শুভাশিস, জ্বলন্ত চিতার দিকে তাকাল। আগুন প্রায় নিবু নিবু, সরু ধোঁয়া উঠছে এঁকেবেঁকে। তুফানের কথা ভাবছিল শুভাশিস, তার মনোবেদনাটা অনুভব করার চেষ্টা করছিল। গ্রামীণ কোন্দল রাজনীতি দলাদলি এসবের মধ্যে কোনওদিন মাথা গলাতে চায়নি বাবা, তবু যেন কিভাবে জড়িয়ে পড়েছিল। আর এটাই বাবার মৃত্যু ত্বরান্বিত হওয়ার সব থেকে বড় কারণ। কালকেও কি একটা ওরকম উত্তেজনা থেকেই বাবা…! তুফান এত হাউহাউ করে কাঁদছিল তখন, ভাল করে শোনা হয়নি। বাড়ি ফিরে জানতে হবে।

সহসা শুভাশিসের শরীর ঝিনঝিন করে উঠল। কী সব তুচ্ছ কথা সে ভাবছে এখন। কী করে ভাবতে পারছে! বাবার মৃত্যুতে যে সর্বগ্রাসী সর্বপ্লাবী দুঃখে আপ্লুত হওয়ার কথা ছিল তার কিছুই তো হচ্ছে না! যার মা থেকেও নেই, যাকে বাবা প্রায় এক হাতে বড় করে তুলেছে, তার তো বাবার মৃত্যুতে সব থেকে বেশি ভেঙে পড়ার কথা। বাবা তার খুব প্রিয় ছিল না, তাদের পিতাপুত্রের সম্পর্ক কোন স্বার্থের দ্বন্দ্বে চিড় খেয়েছিল- এমনও তো নয়! তা হলে? নীতির প্রশ্নে তাদের মধ্যে একটা ব্যবধান গড়ে উঠেছিল ঠিকই, শুধু তাতেই কি হৃদয়ের সম্পর্কে পলি পড়ে গেল? সে কি তবে এক আবেগহীন যন্ত্রে পরিণত হয়েছে? একটা রোবট ছাড়া আর কিছু নয়?

দুঃখ না হওয়ার জন্য দুঃখ হচ্ছিল শুভাশিসের। পুড়ছিল।

.

দুপুরের খাওয়া সারা হতে বেলা গড়িয়ে গেল। শ্মশান থেকে শুভাশিসরা ফেরার পরও জ্ঞাতি-পরিজনরা ছিল অনেকক্ষণ, একটু অসন্তুষ্ট হয়েই চলে গেছে। ছেলে কাছা নিল না, অশৌচ মানা হবে না, শ্রাদ্ধ নেই, এ কেমন ছিরির কথা! পাড়ার বিধবাদের ডেকে এনে, কান্নার রোল তুলে এক অথর্ব বৃদ্ধার হাতের শাঁখা পর্যন্ত ভাঙা হল না, অলকা নিঃশব্দে হাত থেকে খুলে নিল, কোনও মানে হয়! আড়ালে অনেকেই বলাবলি করল, অলকার কপাল পুড়বে।

টোটো অনেকটা সহজ হয়েছে যেন। কথা বলছে। সে এখন নীচে, অলকা আর টুকির সঙ্গে। তুফান এসেই শুয়ে পড়েছে ঘরে, ওঠেনি এখনও। দুটি ভাতে-ভাত রান্না হয়েছিল, তাও খেল না। মনোরমার সেবাযত্ন আজ নিজের হাতে করছে ছন্দা। স্নান করানো, খাওয়ানো, ঘুম পাড়ানো সব। একটা কাজ অবশ্য কম আজ। মনোরমাকে সাজিয়ে সিঁদুর পরাতে হয়নি।

শুভাশিস দোতলার বারান্দায়। স্নান খাওয়ার পর শরীর একদম ছেড়ে গেছে, ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে জিরিয়ে নিচ্ছে একটু। পৌষের নরম দুপুরে জড়িয়ে আসছে চোখ, কিছুতেই খুলে রাখা যায় না।

 ছন্দা পাশে এসে বসল। মুখ চোখ এখনও ফোলা ফোলা, সকালে আজ কেঁদেছে খুব।

 তন্দ্রা কাটাতে শুভাশিস সিগারেট ধরাল, — মা ঘুমিয়েছে?

হুঁ। সকাল থেকে আজ খুব বেশি ঘুমোচ্ছন।

 মার সুগারটা কি বাড়ল আবার? শেষ কবে চেক করেছিল বাবা? তুফান বলতে পারবে।

 ছন্দা ছোট্ট নিশ্বাস ফেলল, কী অদ্ভুত ব্যাপার, তাই না? মা কিছু বুঝতে পারলেন না।

হুঁ।

কার যাওয়ার কথা, কে চলে যায়!

 শুভাশিসের হঠাৎ খুব তেতো লাগছিল সিগারেটটা, ছুঁড়ে উঠোনে ফেলে দিল। মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, -হুঁ, বড্ড হঠাৎ হয়ে গেল।

ছন্দা সোজা হয়ে বসল, হঠাৎ বলছ কেন? … অলকা বলছিল ইদানীং হাঁটাচলা একটু বেশি হয়ে গেলেই বাবা নাকি খুব হাঁপাতেন। গত মাসে অলকার বোনের বিয়ে গেল না, …. সেই যে তুফান এসে আমাদের কার্ড দিয়ে গেল… বাবা তো গেছিলেন অলকাদের বাড়ি।

তাই! স্ট্রেঞ্জ!

–হ্যাঁ গো, এসে কদিন জ্বরেও পড়েছিলেন। শরীর তখন থেকেই আরও দুর্বল হয়েছিল। তারপর কাল অমন একটা কাণ্ড ঘটে গেল…

–এগজ্যাক্টলি কি ঘটেছিল? বলেছে অলকা?

বলেছে। মায়াকে নিয়েই তো গণ্ডগোল।

–কে মায়া?

–ওই যে, সকাল থেকে যে মেয়েটা ছিল… আমাদের ভাত ফুটিয়ে দিয়ে গেল… এখানকার হেলথ সেন্টারের নার্স।

–ও। শুভাশিসের কপালে ভাঁজ পড়ল, গণ্ডগোলটা কী?

–একা একটা মেয়ে থাকলে যা হয়। লোকজন উৎপাত করত খুব। মেয়েটা পালিয়ে পালিয়ে এখানে চলে আসত। তুফান আর বাবা গার্ড দিত ওকে, লোকাল গার্জেনের মতো। হেলথ সেন্টারে একটা ইয়াং ডাক্তার এসেছিল, তাকে নিয়ে বদনাম রটেছিল মেয়েটার। লোকাল লোকজনই রটিয়েছিল। সেই ছেলেটা এ মাসের এক তারিখে বদলি হয়ে চলে গেছে, তারপর থেকেই কিছু লোকজন আবার বাড়াবাড়ি শুরু করেছিল। কাল বিকেলে মেয়েটা রামনগর বাজারে গেছে, ওকে তখন কয়েকটা বজ্জাত ছেলে হেকল করে, কুপ্রস্তাব দেয়। মেয়েটা ভীষণ ভয় পেয়ে তুফানকে খবর দিতে এসেছিল, তুফান ছিল না। বাবা শুনে একদম ফায়ার, তক্ষুনি থানায় যাবেন। অলকা বলেছিল, অন্ধকার হয়ে গেছে বাবা, একটু অপেক্ষা করুন, আপনার ছেলে আসুক। উনি কিছুতেই শুনবেন না, বেরিয়ে হানটান করছেন, … তখনই ফার্স্ট অ্যাটাকটা…। … তুফান তার দশ-পনেরো মিনিট পরেই ফিরেছে। … ফিরেই দৌড়ে ডাক্তার ডেকে এনেছিল…

–হ্যাঁ, লোকাল ডাক্তার। শুভাশিস বিড়বিড় করে উঠল।

–না, না, লোকাল ডাক্তার নয়। তারকেশ্বরের ডাক্তার। রামনগরে একদিন-দুদিন নাকি চেম্বার করে। সে এসে ইসিজি করেছিল, বাড়িতেই। ইনজেকশান-ফিনজেকশানও দিয়েছিল। তারপর তো…

ইসিজি রিপোর্ট, প্রেসক্রিপশান এখানে এসেই দেখেছে শুভাশিস। তখন আর নেই শিবসুন্দর, তবুও। গ্লোবাল ইনফার্কশান। ইসিজি-তে কিউ ওয়েভ আর এস টি এলিভেশান পরিষ্কার। সঙ্গে সঙ্গেই ফর্টউইন আর ক্যামপোজ পুশ করা হয়েছে। ঠিকই আছে, কিন্তু…

শুভাশিস বিমর্ষ স্বরে বলল, তুফানের উচিত ছিল তক্ষুনি বাবাকে হাসপাতাল নার্সিংহোম কোথাও রিমুভ করা।

–সে কথা ডাক্তারও বলেছিল। বাবা রাজি হননি। কিছুতেই বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাবেন না। বলতে বলতে ফুঁপিয়ে উঠল ছন্দা, – সেই তো যেতে হল…

ক্ষণিকের জন্য পেশাদারি ভাবনায় ডুবে গেল শুভাশিস, আরেকটা সিগারেট ধরাল। ল্যাসিকস ডেরিফাইলিন পুশ করা হয়নি কেন? এল ভি এফ যখন অকার করেছে, তখন নিশ্চয়ই অ্যাকিউট ব্রেথলেসনেস ছিল। কখন থেকে? ডাক্তার চলে যাওয়ার পর? অক্সিজেন সিলিন্ডার তো পড়ে আছে নীচে, তুফান বলল তারকেশ্বর থেকে নিয়ে এসেছিল। দেওয়া গিয়েছিল কি? ডেথ সার্টিফিকেটে বাবার মৃত্যুর সময় লেখা আছে বারোটা তিরিশ। অর্থাৎ আরেকবার ডাক্তারকে আনা হয়েছিল। তখন কি বাবার সেন্স ছিল?

 হঠাৎ শুভাশিসের মনে পড়ল কাল রাতে ঠিক ওই সময়ে তারা হাওড়ার ব্রিজ পার হচ্ছে। ফাঁকা ব্রিজ, তবু একটা লরি সামনে রাস্তা আটকে আটকে যাচ্ছিল, বারবার হর্ন দিচ্ছিল শুভাশিস, ঘড়ি দেখছিল ঘন ঘন। তখনই কি মনে মনে কোনও মৃত্যুর সংকেত পেয়েছিল সে?

ছন্দা যেন মনের কথা পড়ে ফেলেছে। আঁচলে চোখ মুছে বলল, – কাল ফোন পেয়েই আমার মনটা কেমন কু গাইছিল। খালি মনে হচ্ছিল বাবাকে এসে আর দেখতে পাব না।

শুভাশিসের বুকে টুক করে লাগল কথাটা। কাল রাতেই সে বেরোনোর পক্ষপাতী ছিল না, আজ ভোরে রওনা হতে চেয়েছিল, ছন্দাই তক্ষুনি তক্ষুনি বেরোনোর জন্য জেদ করল। রাতে এতটা পথ গাড়ি চালানোর আদৌ অভ্যেস নেই শুভাশিসের, ড্রাইভার বাড়ি চলে গেছে তাকে ডেকে আনা অসম্ভব, কোনও যুক্তিই শুনতে চায়নি ছন্দা। শুভাশিস কেন তেমন তীব্র টান অনুভব করেনি সে সময়? ছন্দা টের পেল, শুভাশিস কেন পেল না?

ছন্দা আবার কি বলতে যাচ্ছিল, শুভাশিস হাত তুলে থামাল। বিস্বাদ গলায় বলল, ছন্দা প্লিজ, আমাকে একটু একা থাকতে দাও।

.

বিকেলে একা হাঁটতে হাঁটতে রামনগর গেল শুভাশিস। কাল তাড়াহুড়োয় অনেক কিছু গুছিয়ে নিয়ে বেরোনো হয়নি, টুকিটাকি কয়েকটা জিনিস কেনা দরকার। ছন্দা টুথব্রাশের কথা বলছিল, কিনল তিনটে। গেঞ্জি কিনল, হাওয়াই চপ্পল কিনল। দুপুরে অনেক দিন পর গামছা ব্যবহার করে গা কুটকুট করছিল, তোয়ালে কিনল একটা। বাজারের সারের দোকানের মালিকটি শুভাশিসের মুখ চেনা, তার দোকান থেকে স্যাস ক্লিনিকে একটা ফোন করল। এ সপ্তাহে অনেকগুলো অপারেশন ছিল, সব জায়গায় জানিয়ে ডেট পিছিয়ে দিতে বলল। অরূপ শালিনী নার্সিংহোমে নেই, দুজনকেই পৌঁছে দিতে বলল বাবার মৃত্যুসংবাদ। তেমন কোনও এমারজেন্সি কেস এলে কী করতে হবে তারও নির্দেশ দিয়ে দিল।

টেলিফোন রেখে এক সেকেন্ড ভাবল শুভাশিস। আবার রিসিভার তুলেছে, ডায়াল ঘোরাল।

-হ্যালো, কে তিতির? আমি ডাক্তার আঙ্কল বলছি। মাধবপুর থেকে।

 তিতির চুপ।

–হসপিটালে যাসনি আজ?

 –এই ফিরেছি।

তাড়াতাড়ি চলে এলি? আদিত্যবাবু কেমন আছেন?

–-ওই এক রকম।

–ডেক্সট্রোজ এখনও চলছে?

–না। সকালে অফ করেছে।

কী নিস্পৃহ স্বর! শুভাশিসের পাঁজরটা চিনচিন করে উঠল। কাল রাতে তিতিরই ফোন ধরেছিল, শুনেছে শিবসুন্দরের হার্ট অ্যাটাকের কথা, অথচ তিনি কেমন আছেন, আদৌ আছেন কি নেই, সেটুকু জানারও কৌতূহল নেই মেয়ের। শুভাশিস বলবে নিজে থেকে? হাজার হোক শিবসুন্দর সেনগুপ্তই তিতিরের ঠাকুর্দা, জয়মোহন রায় নন।

তখনই তিতিরের স্বর শুনতে পেল, ধরো। মাকে ডেকে দিচ্ছি।

ইন্দ্রাণীর গলা পেয়ে শ্বাস নিল শুভাশিস। গলা নামিয়ে প্রায় ফিসফিস করে দুঃসংবাদটা দিল।

 ইন্দ্রাণী দু-এক সেকেন্ড নীরব। একটা ভারী নিশ্বাসের শব্দ শোনা গেল শুধু। উষ্ণ বাতাস প্রতিফলিত হল শুভাশিসের কানের পর্দায়।

আরও চাপা গলায় শুভাশিস বলল, হার্টের সব কটা দেওয়ালই চৌচির হয়ে গেছিল।  

ইন্দ্রাণী যেন শুনল না কথাটা। শুকনো গলায় বলল, উনিই চলে গেলেন?

কপাল।

 বলে থেমে রইল শুভাশিস। বলতে পারল না শেষ সময়ে বাবার কাছে পৌঁছতে পারেনি সে। প্রাণপণ চেষ্টা করেছিল, তবুও না। শুনলে হয়তো ইন্দ্রাণী হাসবে মনে মনে। শুভাশিস কি কখনও কোথাও যথাসময়ে পৌঁছতে পেরেছে!

আবারএকটা শ্বাস পড়ল ইন্দ্রাণীর। বলল, – তোমরা কি কাজকর্ম সব সেরে ফিরছ?

কাজ-টাজ কিছু হচ্ছে না। বাবা বারণ করেছিলেন তাই আমরা আর… তুফানের কথাটা এড়িয়ে গেল শুভাশিস, তবে থাকব কয়েক দিন।

–মার এখন কী হবে?

–কি হবে মানে?

–ওখানেই থাকবেন, না নিয়ে আসছ?

 চিন্তাটা শুভাশিসের মাথাতেই আসেনি। মাকে তো এখন নিয়ে যাওয়াই উচিত। বাবা নেই, এখন মার দায়িত্ব শুভাশিসের ওপরই বর্তায়। চব্বিশ ঘণ্টার জন্য নার্স আয়া রেখে দিলেই মোটামুটি ম্যানেজ করা যাবে মনে হয়। কিন্তু তুফানরা কি রাজি হবে?

শুভাশিস অস্পষ্ট স্বরে বলল, দেখি, কি করা যায়। … ছাড়ছি।

টেলিফোন রেখে পকেট থেকে পার্স বার করল শুভাশিস, দুটো কল করলাম। কলকাতায়। কত দেব?

দোকান মালিক জিভ কাটল, ছি ছি, কী বলছেন! আপনি আমাদের ডাক্তারবাবুর ছেলে… সদ্য তিনি গত হয়েছেন… আমি আপনার কাছ থেকে সামান্য…

শুভাশিস জোর করল না। পার্স পকেটে রেখে দিল।

লোকটা আপন মনে বলে চলেছে- কী বড় মাপের মানুষ ছিলেন ডাক্তারবাবু! ক্ষণজন্মা। মহাপুরুষ। এই মদন দত্তর বাড়িতে কম বার পায়ের ধুলো দিয়েছেন তিনি। বকাবকি করেছেন, চিকিৎসা করবেন না বলে ভয় দেখিয়েছেন, আবার নিজেই ডেকে…। এমন একটা মহান মানুষের মৃত্যু ডেকে আনল, দিবাকরের ছেলেগুলোর হাতে হাতকড়া পরানো উচিত…।

সংবাদটা গ্রামে মোটামুটি চাউর হয়ে গেছে। শুভাশিস বিশেষ কথায় গেল না, টুপ করে বেরিয়ে এল দোকান থেকে। গঞ্জ মতো জায়গাটা পেরিয়ে ফিরছে মাধবপুর। সন্ধে নেমে গেছে, মাত্র সাড়ে পাঁচটাতেই ঘোর অন্ধকার চারদিক। রাস্তাতেও আলো বড় কম, খানাখন্দও আছে বেশ, সাবধানে পা ফেলে হাঁটছে শুভাশিস। শীত করছিল। শালটা ভাল করে জড়িয়ে নিল গায়ে। মাকে এখানে ফেলে রাখার কিছু প্র্যাকটিকাল সমস্যাও আছে। রোজগার তো টু-, মার খরচাপাতি কেমন করে চালাবে তুফান? বাবা ছিল, ঝঞ্ঝাট ছিল না। পেনশান ছাড়াও নয় নয় করে চার-পাঁচ হাজার টাকা উপার্জন করত বাবা, মার ওষুধপত্রের খরচা সামলানো কোনও ব্যাপারই ছিল না। কিন্তু এখন…? তুফান যদি জেদ করে মাকে রাখে মাসে মাসে একটা টাকা দিয়ে দেবে শুভাশিস? হাজার পাঁচেক মতো? তুফানদেরই বা চলে কিসে? মার নামে ফ্যামিলি পেনশনের টাকাটা বার করা যায়, তুফান মাস মাস তুলে নিতে পারে। তারও তো শতেক বখেড়া। বাবার ব্যাংকে কিছু টাকা থাকার কথা, সবটাই নয় দিয়ে দিল তুফানকে, কিন্তু তাতেই বা কদ্দিন? মাধবপুরের পাটটা তুলে দিলে কেমন হয়? লেক গার্ডেন্সের জমি তো কেনা হয়েই গেছে, নয় তুফান অলকা টুকি তাদের সঙ্গেই রইল। ছন্দার একাকিত্বটাও কাটে তাহলে। দোতলা বাড়ি যদি তুলে নেওয়া যায়…! মারও অনাদর হয় না, টোটো খুব টুকি টুকি করে, টুকিটাকেও একটা ভাল স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া যায়। তুফানকেও নার্সিংহোমে নিয়ে নেওয়া যেতে পারে। বাবার সঙ্গে থেকে থেকে অনেক কিছু শিখেছে তুফান, কেয়ারটেকার ধরনের কাজ মোটামুটি ভালই চালাতে পারবে।

ফের সেই কেজো ভাবনা! বাবা মারা গেছে এখনও চব্বিশ ঘণ্টাও হয়নি, এখন কি এসব ভাবার সময়! মনকে শাসনে আনতে চাইল শুভাশিস। বাবার অনুষঙ্গগুলো মনে করার চেষ্টা করল। সবই চোখের সামনে ভারী জীবন্ত। বাবার হাঁটা-চলা, হাসি, গমগমে স্বরে কথা বলা, বাবার ব্যক্তিত্ব, মাথা উঁচু ভাব, বাবার শাসন অনুশাসন, সবই। এই প্রায় বিজন অন্ধকারেও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে বাঁশের সাঁকোর ওপর দাঁড়িয়ে আছে ছোটখাট মানুষটা, স্বচ্ছ চোখ পড়ন্ত সূর্যের দিকে স্থির। এক চাপা অপ্রসন্ন ভাব খেলে বেড়াচ্ছে মুখে, বিষাদও।

তবু কেন ওই ঋজু মানুষটার জন্য শোকে মুহ্যমান হচ্ছে না শুভাশিস। ওই মদন দত্ত না কে, সেও তো…!

শুভাশিস খরখরে চোখে ওপর পানে তাকাল।

আকাশের কোণে এক পাণ্ডুর চাঁদ। ক্ষয়াটে, হিম মাখা। যেন তারই প্রতিবিম্ব।

.

পাঁচটা দিন গড়িয়ে গড়িয়ে চলে গেল। বাড়ি থেকে শোকের ছায়া এখনও এতটুকু মোছেনি। দিন আসে, দিন যায়, বাতাসের ভারী ভাব কাটে না কিছুতেই। একটা মানুষের অভাব গোটা বাড়িটাকেই শুন্য করে দিয়েছে। কেউ জোরে কথা বলে না, উচ্চকিত স্বরে হাসে না, প্রতিটি কথায় তাঁর কথা এসে পড়ে, তাঁর অদৃশ্য উপস্থিতি এখনও যেন প্রতি মুহূর্তে অনুভব করা যায়। তুফান তারকেশ্বর থেকে শিবসুন্দরের কয়েকখানা ফটো বাঁধিয়ে এনেছে, নিজের ঘরে টাঙিয়েছে একটা, আরেকটা মনোরমার ঘরে। অলকা সকাল-বিকেল প্রদীপ জ্বালায় ছবির সামনে, ধূপ জ্বালে, মালা দেয়।

দু দিন দুটো শোকসভা হয়ে গেল গ্রামে। সোমেনরাও করল, দিবাকররাও করল। এ বাড়ির সকলকে আন্তরিকভাবে ডেকেছিল তারা। তুফান যেতে রাজি হয়নি, অগত্যা শুভাশিসকেই এ বাড়ির প্রতিনিধি সেজে হাজিরা দিতে হল। সে ভারি অপ্রীতিকর পরিস্থিতি। শিবসুন্দর যা করেছেন, যা করেননি, যা করার কথা স্বপ্নেও ভাবেননি, সবই আবেগ থরথর গলায় বলে চলেছে বক্তারা, জড়সড় হয়ে বসে গিলতে হচ্ছে শুভাশিসকে। শিবসুন্দর যে দু দলেরই একনিষ্ঠ সমর্থক ছিলেন, এ কথাও শোকসভাতে প্রথম জানল শুভাশিস। এবং আশ্চর্যের কথা, কিংবা হয়তো এটাই স্বাভাবিক, মায়া নামের মেয়েটির নাম কোথাও একবারও উচ্চারিত হল না।

ছন্দা আর টোটোর উদ্যোগে বাড়িতেও একটা স্মরণসভা হল। গতকাল বিকেলে। খুবই ছোট আয়োজন, যেসব আত্মীয়দের সঙ্গে ছন্দা অলকার কিছু ঘনিষ্ঠতা আছে তাদেরই শুধু ডাকা হয়েছিল। অলকার বাপের বাড়ি থেকেও এসেছিলেন কয়েকজন। নীরস কথার কচকচি নয়, সবাই মিলে তাঁর কথা ভাবা, তাঁকে শ্রদ্ধা জানান, আর কিছু ঘরোয়া স্মৃতিচারণা। মায়াও ছিল, সে পর পর কয়েকটা গান গাইল। রবীন্দ্রসঙ্গীত। ভরা থাক স্মৃতিসুধায় গাইতে গিয়ে তার সুরেলা সতেজ স্বর কান্নায় বিধুর হয়ে গেল।

শিবসুন্দরের চেম্বার কদিন ধরে তালাবন্ধ। মাঝে একদিন শুধু অলকা খুলে ঝাড়পোঁছ করেছিল। বিকেলের দিকে খালপাড় ধরে একটু হেঁটে এসে শুভাশিস দেখল আজ চেম্বারে আলো জ্বলছে, ভেতরে তুফান আর সোমেন।

শুভাশিস বিস্মিত হল। তুফান গ্রামের লোকজনের সঙ্গে একদমই দেখা করছিল না, আজ হঠাৎ..!

ভেতরে এসে অলকাকে জিজ্ঞাসা করল, ব্যাপারখানা কী? ওই ভদ্রলোক আবার এসেছেন যে?

অলকা লেপের ওয়াড় সেলাই করছিল। ভেতর দাওয়ায় বসে। চোখ তুলে, বলল, ঠিক বলতে পারব না দাদা। কি সব দিবাকর টিবার বলছিল।

দিবাকর মানে সেই অন্য পার্টির ছেলেটা?

হুঁ। অলকা আলতো ঘাড় নাড়ল।

শুভাশিস দাদাসুলভ স্বরে বলল, তুফান যেন সোমেন-টোমেন কাউকে পাত্তা না দেয়। নতুন করে আর ঘোঁট পাকানোর কি প্রয়োজন?

অলকার নিষ্প্রভ মুখ আরও মলিন দেখাল, আপনার ভাই সোমেন দিবাকর কাউকেই পাত্তা দেয় না দাদা। বাবাও দিতেন না।

শিবসুন্দরের নাম উঠতেই এক পলক আনমনা হল শুভাশিস। অলকার সবজি বাগানে ফুলকপি ফুটে আছে, শেষ বিকেলের আধো অন্ধকারে সাদা সাদা কপি কেমন মায়াবী দেখায়। সেদিকে চোখ রেখে দাওয়ায় বসল শুভাশিস। ভার গলায় বলল, – ওই মায়া মেয়েটি সম্পর্কেও তোমাদের সাবধান হওয়া উচিত।

–কেন দাদা?

–ওই তো যত গণ্ডগোলের মূল। গাঁ-গঞ্জে বদনাম এমনি রটে না, পেছনে কিছু না-কিছু কারণ থাকে। তাছাড়া সে খুবই ইরেসপন্সিবল। নইলে সেদিন বাবার শরীর খারাপ জেনেও বাবাকে ওভাবে উত্তেজিত করে দিত না।

অলকা একটুক্ষণ চুপ থেকে বলল, ওর সম্পর্কে রটনাগুলো নির্জলা মিথ্যে দাদা। বাবাও সে কথা জানতেন। মেয়েটা বড় দুঃখী।

–কিসের দুঃখ? কয়েকটা বদমাইশ ছেলের উপদ্রব? এখান থেকে চলে গেলেই পারত।

–ট্রান্সফারের চেষ্টা করেছিল। পায়নি।

–চাকরি ছেড়ে দিতে পারত। গভর্নমেন্টের নার্স, মানে নার্সিং-এর ডিগ্রি আছে, কলকাতার কত নার্সিংহোমে চান্স পেয়ে যেত।

–হুট করে চাকরিটা ছাড়া ওর পক্ষে কঠিন ছিল দাদা। একটা গোটা সংসার ওর ওপর নির্ভর করে আছে। ও একটা দিন বেকার থাকলে বাড়িতে হাঁড়ি চড়বে না। উঁচ গেঁথে ওয়াড়টাকে ভাঁজ করল অলকা। উঠে ঘরের দিকে এগোতে গিয়েও থামল, ওর খুব ইচ্ছে ছিল আপনার নার্সিংহোমে চাকরি করার।

–আমার নার্সিংহোমে?

–হ্যাঁ। বাবাকে বলেছিল। বাবা পছন্দ করেননি।

–কেন?

জানি না। তবে মেয়েটার অসুবিধেটা বুঝতেন। তাই ওর ওপরে একটা দুর্বলতা এসে গিয়েছিল। ওর বিপদ-আপদ নিয়ে খুব চিন্তিত থাকতেন।

আশ্চর্য! আমার কাছেও পাঠাবে না, আবার তাকে নিয়েও ওরিড থাকবে, আমি তো কিছুই। বুঝতে পারছি না। শুভাশিস হাত উল্টোল, তোমরাই বা কি? তোমরা আমায় বলতে পারতে। তুমি তো কলকাতায় ছিলে, তখনও তো কিছু উচ্চবাচ্য করনি।

অলকা কোনও উত্তর দিল না। মাথা নামিয়ে ঘরে চলে গেল।

বিকেলের কাঁচা অন্ধকার গলে গলে মিশে যাচ্ছে সন্ধের সঙ্গে। পুকুরের দিক থেকে হিমেল বাতাস আসছে একটা, হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে যায়। শুভাশিস চুপ করে বসে রইল কিছুক্ষণ। দোতলার বড় ঘর থেকে টোটো আর টুকির গলা উড়ে আসছে মাঝে মাঝে। ছন্দা মনে হয় মার ঘরে। সবাই কেন শুভাশিসের থেকে এত দূরে দূরে থাকে। বাবারও কী উদ্ভট জেদ! তুফান অলকাও তাকে আপন ভাবে না! অলকা নয় পরের ঘরের মেয়ে, কিন্তু তুফান?

বাতাসের হিমকণা শুভাশিসের শরীরে সেঁধিয়ে যাচ্ছিল ক্রমশ। মায়া কলকাতায় চলে গেলে বাবা বেঁচে যেত। মায়াকে তার কাছে না পাঠিয়ে বাবা কি শুভাশিসকেও তার মৃত্যুর জন্য এক কণা দায়ী করে গেল!

অলকা চা রেখে গেছে। কাপে চুমুক দিয়ে একটু বুঝি তাপ এল শরীরে। সোমেন চলে যাওয়ার পরও তুফান বসে আছে চেম্বারে, শুভাশিস উঠে গেল সেখানে।

বাবার ফাঁকা চেয়ারে বসে সরাসরি বলল, – মায়া মেয়েটা কলকাতায় চাকরি চেয়েছিল, তুই আমাকে জানাসনি কেন তুফান?

তুফান চোখ পিটপিট করল-বাদ দাও। ও নিয়ে আর ভেবে কি হবে!

-না তুই বল। আমার জানা দরকার।

 তুফানের ঠোঁটের ফাঁকে রহস্যময় হাসি ফুটে উঠল, — কারণটা তো খুব সিম্পল। বাবা তোমার নার্সিংহোম করাটা মেনে নিতে পারেননি, তাই সেখানে কারুর জন্য সুপারিশও করতে চাননি।

–আমি বাবার কথা জিজ্ঞেস করছি না। তোর কথা বল।

 তুফানের মুখটা করুণ হয়ে গেল, বাবা যা চাননি, সেটা আমি করব, তুমি ভাবলে কী করে দাদা?

শুভাশিস যেন থাপ্পড় খেল একটা। বাবার ক্রিয়াকর্ম কিছু হবে না, এটা প্রায় মালিন্যহীন মনে মেনে নিতে পেরেছে এত দিনে, কিন্তু তুফানের এই কথাটা যেন তার মর্মমূলে নাড়া দিল।

গোমড়া মুখে বলল, – এটা কিন্তু বাড়াবাড়ি। তুই বাবাকে নিয়ে একটু বেশি নীতিবাগিশপনা করিস।

তুফানের মুখটা এবার বড় অসহায় দেখাল, কী করব দাদা? তুমি বাবাকে জন্মসূত্রে পেয়েছ, তাকে মানতেও পারো, অগ্রাহ্যও করতে পারো। তাতে তোমাদের বাপবেটার সম্পর্কের সুতো ছিঁড়বে না। কিন্তু আমাকে প্রতিটি কাজে প্রতিটি পদে প্রমাণ করতে হবে আমি বাবার ছেলে। বাবা আমায়। ভালবাসতেন, তার বিনিময়ে তিলে তিলে আমায় বাবাকে অর্জন করতে হয়েছে। তাই তাঁর ইচ্ছে অনিচ্ছে আমার কাছে এত মূল্যবান।

হঠাৎ শুভাশিসের ভয়ানক কষ্ট হচ্ছিল। তুফান যেভাবে অনুভব করেছে বাবাকে তার এক বিন্দুও তো শুভাশিস পারেনি! আজ অনেক কথা বলবে ভেবেছিল তুফানকে। মাকে কলকাতায় নিয়ে যাওয়ার কথা, তুফানের চাকরি বাকরির কথা, টুকির ভাল স্কুলে পড়াশুনো করার কথা…। থাক, এই মুহূর্তে ওসব কথা তুললে তুফানকে অপমান করা হয়। বাবা মা অলকা টুকি মাধবপুর সব কিছু নিয়ে সম্পৃক্ত হয়ে আছে তুফান, এখানে শুভাশিসের অনুপ্রবেশ করার কোনও অধিকার নেই। না হয় শুভাশিস অন্য কোনও ভাবে তুফানকে বুঝিয়ে কিছু টাকা পাঠিয়ে দেবে মাসে মাসে।

পকেট হাতড়ে সিগারেট বার করল শুভাশিস। ধরাল। নীলচে ধোঁয়ায় ভরে যাচ্ছে ঘর, ভরে যাচ্ছে শুভাশিসের ফুসফুস।

অনেকটা সময় নিয়ে শুভাশিস বলল, – যাক গে। পাস্ট ইজ পাস্ট। তোর সঙ্গে আরেকটা কথা ছিল।… আমি কাল চলে যাব ভাবছি। অনেক কাজ পড়ে আছে। তোর বউদি এখানে কদিন থাকতে চায়, থাকুক। টোটোকে নিয়ে যেতেই হবে… সামনে পরীক্ষা… বলতে বলতে উঠল শুভাশিস, দশ-পনেরো দিন পরে আমি একবার আসব।

তুফানও উঠে দাঁড়িয়েছে। দাদার সঙ্গে চেম্বারের বাইরে এল। দরজায় তালা লাগাতে লাগাতে বলল, তোমাকে একটা রিকোয়েস্ট করব দাদা? রাখবে?

বল।

–আপত্তি থাকলে কিন্তু সরাসরি না করে দিয়ো। তুফান শুভাশিসের মুখোমুখি দাঁড়াল, এই চেম্বারটা বাবার প্রাণ ছিল। এটা চিরকালের মতো বন্ধ হয়ে যাবে ভাবতে কেমন লাগছে। তুমি যদি মাসে একটা-দুটো রোববারও এখানে এসে বসো… তুমি তো জানো বাবা আত্মা-টাত্মায় বিশ্বাস করতেন, কিন্তু আমি করি। তুমি চেম্বারটা চালু রাখলে বাবার আত্মা শান্তি পাবে। বাবার খুব ইচ্ছে ছিল তুমি…। সোমেন চাইছিল তমালডাক্তার এখানে বসুক, আমি না বলে দিয়েছি।

ঠিক মিনতি নয়, কেমন যেন গভীর আকুতি থেকে কথাগুলো বলছে তুফান। শুভাশিস তুফানের কাঁধে হাত রাখল। চাপ দিল মৃদু।

শিবসুন্দরের মত্যুর পর এই প্রথম অমলিন হাসল তুফান।

এই প্রথম শুভাশিসের বুকে কান্না জমছিল। বাবার জন্য।

.

ছন্দা বারান্দায় এসে বলল, তোমরা কাল কখন বেরোচ্ছ?

অন্ধকারে সিগারেট খাচ্ছিল শুভাশিস। তুরীয় শীতে শরীর কেমন অবশ অবশ লাগে, তবু বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে। গ্রিলে হাত পড়তেই সরিয়ে নিল হাত, ঠাণ্ডা বরফ হয়ে আছে লোহা। মুখ ফিরিয়ে বলল, দেখি, টোটো কখন বেরোয়।

–খেয়েদেয়ে দুপুরে বেরোনই ভাল। সন্ধের আগে পৌঁছে যাবে, তারপর রেস্ট নিয়ে কাল থেকে…

–হুঁ। … মাকে শুইয়ে দিয়েছ?

–অনেকক্ষণ। ছন্দা হাই তুলল, তুমিই তাহলে মার ঘরে থাকছ আজ?

থাকি। অলকা আজ টুকির কাছে শুক।

–সে নয় আজ অলকাকে রিলিফ দিলে। সারা বছর কী হবে? যে কদিন আমি আছি তাও নয় কেটে যাবে কোনও রকমে। তারপর?

–সে তুফান বুঝবে। মনে করলে একটা লোক রেখে নেবে।

ছন্দা চোখের কোণ দিয়ে দেখল শুভাশিসকে। চোখে কোনও প্রশ্ন আছে কিনা বুঝতে পারল না শুভাশিস। মগজটা ইদানীং ভাল কাজ করে না। টোটো ঘুমিয়ে পড়েছে কিনা জিজ্ঞেস করতেও ভুলে গেল। সিগারেট ফেলে মনোরমার ঘরে যেতে গিয়েও থামল, –তুমি ফিরছ কবে?

-তুমি এসো ঘুরে। তুফান অলকা ততদিনে একটু সামলে নিক। অলকা আমার অসুখের সময় যা করেছিল…

ও, এখানেও বিনিময় প্রথা! শুভাশিস মনে মনে হাসল। ছন্দার ঔদাসীন্য আজকাল তাকে মাঝে মাঝে পীড়িত করে, কিন্তু তার কর্তব্যজ্ঞানটা যে টনটনে আছে এটাই শুভ লক্ষণ। তৃপ্তিদায়কও বটে।

মার ঘরে ঢুকে দরজা ভেজিয়ে দিল শুভাশিস। মশারির গায়ে এসে কয়েক পল দেখল মনোরমাকে। লেপের তলায় নিঃসাড়ে ঘুমোচ্ছেন শুভাশিসের বোধহীন মা, নিশ্বাস পড়ছে কিনা তাও বোঝা যায় না। গ্লুকোজ স্টিকে কাল মার সুগারটা দেখেছিল শুভাশিস। একটু বেশির দিকে, তবে ঠিকই আছে মোটামুটি। সন্ধেবেলা প্রেশার মেপেছে, অনেকটা লো। আরেকবার দেখবে এখন? থাক। যদি মা জেগে যায়!

কোথায় শোবে তাই নিয়ে শুভাশিস একটু ধন্দে পড়ে গেল। মার পাশে শুলে তার ঘুম আসবে, পুরনো আতঙ্কের স্মৃতি হয়তো তাড়িয়ে বেড়াবে সারা রাত। তাছাড়া অনভ্যাসটাও একটা কারণ বটে। মার পাশে কবে আর শুয়েছে শুভাশিস!

সন্তর্পণে বিছানা থেকে দ্বিতীয় লেপটা বার করে বাবার ইজিচেয়ারে গা ছড়াল শুভাশিস। একটা তো রাত, ঠিক কেটে যাবে। হাত বাড়িয়ে বাবার টেবিল থেকে একটা মেডিকেল জার্নাল টানল। উল্টোচ্ছে। পাতায় পাতায় পেনসিলের দাগ দিয়েছে বাবা, মার্জিনের ধারে ছোটখাট মন্তব্য লিখে রেখেছে। করত তো সাধারণ জ্বরজারির চিকিৎসা, এত পড়াশুনো করে কী লাভ হত বাবার!

শুভাশিস ঘড়ি দেখল। দশটা পঞ্চাশ। জানাল টেবিলে রাখল শুভাশিস, অন্যমনস্ক হাতে বাবার ড্রয়ারটা খুলল। কত কী হাবিজাবি জিনিস! আধ খালি ওষুধের শিশি, ছোট একটা ছুরি, কাঁচি, সুতোর রিল, এক পাতা সরবিট্রেট, শুধু দুটো খাওয়া হয়েছে। অজান্তেই শুভাশিসের ভুরু কুঁচকে গেল। হাতড়ে হাতড়ে আরও কয়েকটা ওষুধের ফয়েল বার করল। হার্টের। প্রেশারের। তুফানের মুখে শুনে কতবার শুভাশিস জিজ্ঞাসা করেছে, প্রতিবারই হেসে উড়িয়ে দিয়েছে বাবা। কেন? জীবনে কি স্পৃহা ছিল না বাবার! ভাবতেই কোথায় যেন খোঁচা লাগে। হাতড়ে একটা কার্ড পেল। টোটোর পাঠানো, নিউ ইয়ারস গ্রিটিংস। কার্ডের পিছনে ক্ষুদি ক্ষুদি অক্ষরে কি যেন লিখে রেখেছে বাবা, পড়া যাচ্ছে না। শ্বশুরমশাই-এর চিঠি রয়েছে গোটা কতক। কলকাতারও কোনও ডাক্তারবন্ধুর কাছে থেকে আসা মনোরমার কিছু প্রেসক্রিপশন। এক রাশ ডায়েরিও আছে, অবিন্যস্তভাবে ছড়ানো। বাবা ডায়েরি লিখত? মোটা একটা ডায়েরি খুলল শুভাশিস। প্রতিটি পাতায় বিনা মন্তব্যে ঘটনার উল্লেখ। তার মধ্যেই যেন ছবি পাওয়া যায় অনেক। … শুভ সকালে এসেছিল। থাকল না, বিকেলে চলে গেল। … মনো মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এল আবার। … শুভ ছন্দা আজ খুব ঝগড়া করছিল। … ছন্দা নাকি পুজো করে খুব, তুফান বলছিল। ছোট ছোট তীক্ষ্ণ বিবরণী থেকে কেমন যেন অব্যক্ত যন্ত্রণা ফুটে ওঠে। তাদের নিয়ে এত ভাবত বাবা? পাতার পর পাতা উল্টোচ্ছে শুভাশিস। এক জায়গায় চোখ গেঁথে গেল। কোন এক গেঁয়ো খেলুড়ে ট্রেনে কি বিপজ্জনক খেলা দেখায় তার অনুপুঙ্খ বর্ণনা। লোকটা বলেছে, বেঁচে থাকাটাই তো সুখ, তাও লিখে রেখেছে বাবা।

শুভাশিসের মাথা দুলে উঠল। এটাই কি বাবার মনের কথা? তাহলে কেন ব্যাধি নিয়ে এত গোপনীয়তা ছিল বাবার? অভিমান? বিতৃষ্ণা?

ঘরে খুট করে একটা শব্দ হল। চমকে তাকিয়ে শুভাশিস দেখল লেপ ছেড়ে উঠে বসেছেন মনোরমা। এদিক ওদিক চোখ ঘোরাচ্ছেন। শুভাশিসের দিকে ক্ষণিকের জন্য স্থির হল অক্ষিগোলক, সরে গেছে। অস্থির, একটু যেন চঞ্চল।

শুভাশিসের গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। টেবিলে রাখা বাবার ছবির দিকে এবার বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে আছে মা। বাবাকে কি মা চিনতে পারত? নাকি শুধুই অভ্যাসের বশে রোজ দেখা মানুষকে…!

না। মার চোখ বাবাকেই খুঁজছে! হাত দিয়ে দিয়ে হাতড়াচ্ছে পাশের বিছানা! উঠে গিয়ে মাকে শুইয়ে দেবে? শুভাশিসের পা পাথর, নড়ে না। বুকের থম ধরা ভাবটা ফেটে বেরিয়ে এল, কান্না হয়ে। দু হাতে মুখ ঢেকে ফেলল শুভাশিস। জড়বুদ্ধি মা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে বাবা নেই।

বাবা আর কোথাও নেই।

.

৮৮.

হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষার আর মাত্র সাতষট্টি দিন বাকি, তিতির জোরকদমে লেগে পড়েছে পড়াশোনায়। সারা দিন বই-খাতায় ডুবে থাকে, রাতেও ঘণ্টা চারেকের বেশি ঘুমোয় না। ঘড়ি মেপে শোয়, ঘড়ির পাগলাঘণ্টিতে জেগে ওঠে, ঘড়ি ধরে স্নান, ঘড়ি ধরে খাওয়া, ঘড়ি ধরে বাইরে বেরোনো, ঘড়িই এখন তার দিন রাতের নিয়ন্তা। ডাক্তার আঙ্কল একদিন ঠাট্টাচ্ছলে টোটোর সঙ্গে প্রতিযোগিতার কথা বলেছিল, কথাটা তিতিরের মনে গেঁথে আছে। টোটোর মতো নম্বর না পাক, টোটো আর টোটোর বাবা দুজনকেই পরীক্ষার ফল দেখিয়ে উচিত জবাব দিতে হবে। দিতেই হবে।

কদিন ধরে ঠাণ্ডাটা আবার বেশ বেড়েছে। পৌষ সংক্রান্তির পর পর শীত অনেকটা কমে গিয়েছিল, মাঘের মাঝামাঝি জাঁকিয়ে ফিরে এল। থার্মোমিটারের পারাই শুধু নামেনি, একটা জোর হাওয়াও চলছে দিনভর। এলোমেলো, ঝোড়ো বাতাস। এমন বাতাস, দরজা জানলা বন্ধ রেখেও হাড়গোড় হিম হয়ে যায়।

আষ্টেপৃষ্ঠে শাল জড়িয়ে চেয়ারে বসেছে তিতির। গুটিসুটি মেরে। সামনে টেবিল ল্যাম্পের আলো, খোলা খাতাবই টেবিল জুড়ে ছড়ানো, আঙুলে ডটপেন। বিকেলে ঝুলন অসহযোগ আন্দোলনের ওপর একটা নোট দিয়ে গেছে। তিতির টুকছে মন দিয়ে। টুকতে ঢুকতে পড়ছে বার বার, মাঝে মাঝে বই থেকেও দু-একটা পছন্দমতো পয়েন্ট যোগ করে নিচ্ছে, বিষয়টাকে মগজে সাজিয়ে নিচ্ছে ভাল করে। অন্ধকার ঘরের কোণে এক টুকরো ফুটে ওঠা আলোয় তাকে এখন ধ্যানমগ্ন তপস্বিনী বলে মনে হয়।

মৃদু একটা শব্দ হল ঘরে। বিছানায়। অস্ফুট ধ্বনি যেন। উজ্জ্বল আলো থেকে ছায়া ছায়া অন্ধকারে মুখ ফেরাল তিতির।

নিচু স্বরে ডাকল, কিছু বলছ বাবা?

 আর সাড়াশব্দ নেই।

 চাপা কিন্তু তীক্ষ্ণতর হল তিতিরের স্বর, বাবা..ঘুমোওনি এখনও?

 কোনও উত্তর নেই।

 তিতিরের হাসি পেল। বাবা জেগে আছে, জানাতে চায় না। তিতিরের কান্নাও পেল একটু। রাতের পর রাত ঘুমোয় না বাবা, ঠিক টের পেয়ে যায় তিতির। বাবা কি জেগে জেগে নিজের সঙ্গে কথা বলছিল? বলে মাঝে মাঝে। স্বচক্ষে বাবার ঠোঁট নড়া দেখেছে তিতির। রাতে, দিনে, বহু সময়ে। কখনও বা চোখের কোলে জল জমে বাবার, গাল বেয়ে গড়িয়ে আসে। এখনও কি কাঁদছিল বাবা!

দিন পনেরো হল হাসপাতাল থেকে ফিরেছে আদিত্য। শরীর এখন অনেক সুস্থ, তবু সারাক্ষণ কেমন নির্জীব হয়ে পড়ে থাকে। সেবারও হাসপাতাল থেকে ফিরে আদিত্য দুর্বল ছিল খুব, কিন্তু এমন নিষ্প্রভ, এত নিরানন্দ ছিল না। ফাঁক পেলেই ফুড়ুৎ ফাড়ুৎ বেরিয়ে যেত, নিষেধ মানত না, উল্টোপাল্টা খাবার খেয়ে নিত, আর কারুর সঙ্গে না হোক তিতিরের সঙ্গে তালবেতাল কথা বলত কত। আর এবার সে প্রায় নির্বাক, স্বেচ্ছাবন্দি, খাট ছেড়ে নড়তেই চায় না বড় একটা।

হাসপাতালেও প্রায় এমনটাই ছিল। মলিন শয্যায় শুয়ে আছে, চোখ বিবর্ণ দেওয়ালে স্থির সারাক্ষণ। সিস্টারদের সঙ্গে কথা নেই, আশপাশের বেডের মানুষজনের সঙ্গে বাক্যালাপে তিলমাত্র আগ্রহ নেই, এমনকী রঘুবীরের সামনেও পুরোপুরি নিরুচ্ছ্বাস। তিতির কতদিন দেখেছে আদিত্যর বিছানার পাশে টুল টেনে একা একা গলা ফাটাচ্ছে রঘুবীর, কিছুই শুনছে না আদিত্য। সুদীপ কন্দর্প বা জয়শ্রী শংকর গেলে কয়েকটা রুটিন সংলাপ, আবার চোখ বন্ধ, আবার সেই মুখ ফিরিয়ে নেওয়া।

তিতির ভেবে পায় না সত্যিই কি বাবা তখন এত অসুস্থ ছিল? কী করে হয়, অসুখ তো সেই একই! অ্যালকোহলিক হেপাটাইটিস। যার ওষুধ বলতে শুধু ডেক্সট্রোজ আর বিশ্রাম। প্রথম দিকে নয় সিডেটিভে আচ্ছন্ন থাকত, তারপর? এবার হাসপাতালে নতুন করে শরীরের ওপর কোনও অত্যাচারও করেনি বাবা। তবু তিন সপ্তাহ থাকতে হল হসপিটালে। কেন?

তিতির আনমনে চোখ রগড়াল। জোর করে মন বসাতে চেষ্টা করছে পড়ায়। পারছে না। খোলা পাতার চেনা অক্ষরগুলো যেন কালো কালো পিঁপড়ের সারি, নড়াচড়া করছে আপন খেয়ালে। লাখো চিন্তা সূক্ষ্ম তন্তুজাল নির্মাণ করছে মস্তিষ্কে। অসহযোগ আন্দোলন গভীর কুয়াশায় ঢেকে গেল। হাই উঠছে। বসে বসেই গরম শালে সেঁধিয়ে থাকা দু হাত বার করে ছোট্ট আড়মোড়া ভাঙল তিতির, আবার দ্রুত গায়ে সাপটে নিয়েছে গাঢ় নীল শাল। বড় শীত। পায়ে চটি গলিয়ে ছুট্টে বাথরুম থেকে ঘুরে এল। ফেরার পথে আড়চোখেও মার দরজার দিকে তাকাল না। কন্দর্পর ঘর থেকে ফরর ফরর নাক ডাকার আওয়াজ আসছে। দার্জিলিংয়ে শুটিংয়ে গিয়েছিল কন্দর্প, প্রবল সর্দি নিয়ে ফিরেছে। আদিত্যর পাশের খাটে মশারির তিনটে খুঁট লাগানো আছে, চতুর্থটা পেরেকে আটকাল তিতির। নীল রাতবাতি জ্বালিয়ে নেবাল টেবিল ল্যাম্প, পায়ে পায়ে বাবার মশারির পাশে এল।

বাবা?

 সাড়া নেই।

তিতির ঝুঁকে বাবার মুখ দেখার চেষ্টা করল। আবছায়ায় ঠিক ঠাহর হয় না, থুতনি পর্যন্ত লেপে ঢাকা শীর্ণ মুখখানা ভারী রহস্যময় লাগে। আধচেনা আধচেনা।

মশারির ওপর দিয়ে আদিত্যর কপাল ছুঁল তিতির। ঘরের আলোর মত নরম স্বরে ডাকল, জল খাবে না বাবা?

একটু বুঝি চমকে চোখ খুলল আদিত্য, কেএএ?…ও, তুই। আমি ভাবলাম…

কী ভাবলে?

–কিছু না। …কে যেন এসেছিল না ঘরে?

 ও, বাবা তাহলে স্বপ্ন দেখছিল এতক্ষণ? রোজকার নিয়মে বাবাকে জল খাওয়াতে যাওয়াটা কি তবে ভুল হয়ে গেল?

তিতির মৃদু স্বরে বলল, – এত রাতে আবার কে আসবে? তুমি ঘুমোও। চোখ বোজো।

চোখের পাতা বন্ধ হল না আদিত্যর। লেপ ঠেলে উঠে বসেছে, একটু জল দে। তালুটা শুকিয়ে গেছে।

টেবিলে রাখা জগ থেকে গ্লাসে জল ঢালল তিতির। সন্তর্পণে মশারি তুলে এগিয়ে দিল গ্লাস। এক-দু চুমুক খেল কি খেল না, আদিত্য গ্লাস হাতে বসে আছে।

কী হল? খাও।

–সত্যি কেউ আসেনি? আদিত্য বিড়বিড় করল, আমি যে স্পষ্ট দেখলাম।

কাকে দেখেছ? কে?

আদিত্য উত্তর দিল না। নিশ্চুপ ভাবছে।

নতুন উপসর্গ। তিতিরের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। বাবার হাত থেকে গ্লাস নিয়ে টেবিলে রেখে মশারি খুঁজছে। আদিত্যর ছায়া ছায়া অবয়বের দিকে চোখ। বলল, -মা এ ঘরে আসে না বাবা।

আদিত্য নিঃসাড়। লেপ টেনে ঠাণ্ডা আটকাচ্ছে।

তিতির পাশের খাটের মশারির ভেতর ঢুকে পড়ল। শাল খুলে বালিশের পাশে ভাঁজ করে রাখছে। হিম ভাবটা ঝাপটে এল গায়ে তবু লেপের দিকে হাত বাড়াল না। নিচু স্বরে বলল, -মার কথা কেন ভাব বলো তো বাবা? আমি তো আছি।

আদিত্য কিছু একটা বলল, শোনা গেল না।

তিতির সামান্য গলা ওঠাল, এই যে তোমার এতদিন টালমাটাল সিচুয়েশান গেল, আমি তোমার কোনও অসুবিধে হতে দিয়েছি? মা তো একদিনও হসপিটালে যায়নি, তার জন্য তোমার ট্রিটমেন্টে কোনও অবহেলা হয়েছে? নাকি বাড়ি ফেরার পর তোমার নার্সিংয়ে কোনও ত্রুটি হয়েছে? একটা কথা মাথায় রেখো, তুমি আর এখন একা নও। তিতির সব সময়ে তোমার পাশে আছে।

আদিত্য চুপচাপ শুয়ে পড়ল। একটুক্ষণ নৈঃশব্দ্য। মার মুখটা মনে করার চেষ্টা করছিল তিতির। রুক্ষ রাগী নিষ্ঠুর মুখ, মায়াদয়ার লেশমাত্র নেই। বিজলি নামের ওই মেয়েটাকে দেখে আরও যেন স্টিফ হয়ে গেছে মা। কী হাস্যকর আচরণ! রঘুবীরের ঘরে বসে ড্রিঙ্ক করতে করতে সেন্সলেস হয়ে গিয়েছিল বাবা, রঘুবীর ছিল না, মেয়েটা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বাবাকে ডাক্তার দেখিয়েছে, বাড়ি পৌঁছে দিয়ে গেছে, এতে মার এত মানে লাগার কী আছে? মহিলা হসপিটালে বাবাকে দেখতেও এসেছিল, তিতিরের সঙ্গে তার আলাপও হয়েছে। একটু অমার্জিত ঠিকই, মাঝে মাঝে শালা-ফালা বলে ফেলে, তা বলে মোটেই শয়তানি ডাইনি টাইপ নয়। বাবাকে যথেষ্ট রেসপেক্ট করে, মিস্ত্রির ঘরের মেয়ের যেমন করা উচিত। ওই রকম একটা মহিলাকে জড়িয়ে বাবাকে সন্দেহ করে মা? ছি। যাদের নিজেদের মনে পাপ তারাই বুঝি এমনটা পারে।

ও পাশের খাট থেকে সহসা একটা দীর্ঘশ্বাসের শব্দ ভেসে এল। মাত্র একটা শ্বাস পতনের শব্দে ঘরের ঠাণ্ডা বাতাস হঠাৎ যেন একটু ভারী হয়ে গেছে।

তিতির বিরক্তমুখে গায়ে লেপ টানল, তুমি দিন দিন বড় ছেলেমানুষ হয়ে যাচ্ছ বাবা। মাকে অত পাত্তা দেওয়ার দরকার কী শুনি? লক্ষ করে দেখেছ তোমার কথা ভেবে মাকে আমি কেমন একঘরে করে দিয়েছি? যেচে মার সঙ্গে একটা কথা বলি? ঢুকি মার ঘরে? শুই মার পাশে? কেনকরি এসব? তোমাকে মা নেগলেক্ট করে বলেই না!

এতক্ষণে আদিত্যর স্বর ফুটেছে। বিনবিন করে বলল, তুই মার ওপর বড় বেশি রেগে আছিস তিতির।

আঁধারে তিতিরের চোখ দিয়ে আগুন ঠিকরোল। মনে মনে বলল, কেন রাগব না? মার জন্য কমবার অপমানিত হয়েছি আমি? কাকে টোটো ঘাড়ধাক্কা দিয়ে গাড়ি থেকে নামিয়ে দিয়েছিল? কার জন্যে? এই কদিন আগে ডাক্তার আঙ্কলের বাবার হার্ট অ্যাটাক হল, টোটো ফোনে কী বিশ্রী ভাষায় কথা বলল আমার সঙ্গে! মার ওপর ঘেন্নাগুলো কেন আমার দিকে ছিটকে আসবে?

টোটোর কথা মনে পড়তেই একটা অচেনা কষ্টে কুঁকড়ে গেল তিতির। অনেককাল আগে, কোন ছোটবেলায়, এক পাহাড়ে বেড়াতে গিয়েছিল। ঠিক পাহাড় নয়, ছোট ছোট সবুজ টিলায় ভর্তি ছিল জায়গাটা। বোধহয় হাজারিবাগের দিকে কোথাও, জায়গাটার নাম এখন আর মনে নেই। দাদু ঠাম্মা সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিল, দাদুর এক বন্ধুর বাড়ি ছিল পাহাড়ের কোলে। আর কিছু মনে নেই, শুধু মনে আছে রাতভর অঝোর ধারায় বৃষ্টি ঝরেছিল একদিন। ভোরে যখন ঘুম ভাঙল বৃষ্টি তখন থেমে গেছে, কিন্তু কী বিচিত্র এক ধ্বনি বাজছে চারদিকে! পাহাড়ের জল অজস্র সরু সরু স্রোত হয়ে নেমে আসছে, বয়ে যাচ্ছে, নুড়ি পাথরে ধাক্কা খেয়ে আওয়াজ তুলছে ঝমঝম!

আজ সহসা বুকে যেন সেই ধ্বনি। শুনে শিউরে উঠছিল তিতির, শীতার্ত অন্ধকারে মথিত হচ্ছিল। লেপ জড়িয়ে শুয়ে পড়ল, তবু কাঁপছে। বন্ধ চোখের ওপর থেকে ছুটে আসছে অজস্র রঙিন কাচের টুকরো, বিঁধে যাচ্ছে শরীরে। উফ, কী কষ্ট।

পোস্তদানা মনটা কুনকুন করে উঠল, তিতির সাবধান, তোর কিন্তু দুঃখ আরও বাড়বে।

 তিতির হাঁটু মুড়ে বুকের কাছে নিয়ে এল, আরও দুঃখ? কেন?

–টোটোকে যে তুই ভুলতে পারছিস না।

বাজে কথা। ওই নাকউঁচু ছেলেটাকে আমি দু চক্ষে দেখতে পারি না।

কার কাছে লুকোস নিজেকে? তুই মরেছিস।

–মরেছি তো মরেছি, তোর কি?

–আমার আর কি। বিপদ তো তোরই। আরও অনেক বড় ধাক্কা খাবি তুই। ভেঙে চৌচির হয়ে যাবি।

-চোপ।

তিতির ধড়মড়িয়ে উঠে বসল। হাঁপাচ্ছে অল্প অল্প। এই ঠাণ্ডাতেও নাকের ডগায় ঘাম জমেছে।

নীলাভ আঁধারে আবার আদিত্যর ক্ষীণ গলা শুনতে পেল, উঠে পড়লি যে বড়?

তিতির কথা বলল না।

কষ্ট পাচ্ছিস তো? কিছু কিছু মানুষ আছে যাদের ওপর রাগ করলে শুধু দুঃখই বাড়ে রে। তোর মাও সেরকম।

তিতির থ হয়ে গেল। এত অপমান, এত অনাদর, এত অবহেলার পরেও মায়ের কথা ভেবে চলেছে বাবা! কিসের প্রত্যাশায়?

.

৮৯.

ইন্টারন্যাশনাল সার্কাসে একটা খেলা দেখাত। গেম অফ সিক্স নাইভস্। একটা বড়সড় কাঁসির কিনার ধরে লাগানো থাকত ছ ছখানা ছুরি। এক সাকার্স কন্যা রঙিলা বাজনার তালে তালে বাঁশের ডগায় তুলে ধরত কাঁসিটাকে। উঁচুতে দোলাত। ক্রমশ চড়া হত বাজনা, উদারা মুদারা পেরিয়ে তারায়। তারপর ঝাং শব্দ, পরক্ষণে এক বিপুল নিস্তব্ধতা। সার্কাস কন্যা শুন্যে ছুঁড়ে দিল কাঁসি, উৎক্ষিপ্ত কাঁসি থেকে তীরবেগে নেমে আসছে ছুরিগুলো, চিত হয়ে ভূমিতে শুয়ে পড়েছে সার্কাস কন্যা, আধডজন ছুরি তার মুখ ঘিরে পলকে মাটিতে গেঁথে গেল। এক সেকেন্ড দু সেকেন্ড পাঁচ সেকেন্ড। পুট পুট সবকটা ছুরি তুলে নিয়ে সার্কাস কন্যা উঠে দাঁড়াল, যান্ত্রিক হেসে অভিবাদন গ্রহণ করল দর্শকদের।

বেশ কয়েকবার খেলাটা দেখেছে ইন্দ্রাণী। কৈশোরে। গায়ে কাঁটা দিত, বাড়ি ফিরে রাতে ঘুমোতে পারত না।

আজকাল অহরহ খেলাটার কথা মনে পড়ে। তবে তেমন রোমাঞ্চ জাগে না। শুধু সেই অচেনা সার্কাস কন্যার জন্য ফোঁটা ফোঁটা দুঃখ জমা হতে থাকে বুকে। ইন্দ্রাণী বেশ টের পায় খেলাটা চলছে এখনও।

শুধু খেলোয়াড়টা বদলে গেছে।

সে নিজেই এখন সেই সার্কাস কন্যা।

অস্তিত্বের কাঁসি মাদক বাজনার তালে নাচল কিছুক্ষণ। উঁচুতে উঠল, আরও উঁচুতে, সংসার-তাঁবুর কানাত ছুঁড়ে ছিটকে মহাশূন্যে চলে গেল। কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য–ছ ছখানা ধারালো ছুরি শূন্য থেকে ধেয়ে আসছে, আসছে, যে-কোনও মুহূর্তে বেষ্টন করে ফেলবে ইন্দ্রাণীকে।

কোন রিপুকে কুড়িয়ে নিয়ে অভিবাদন গ্রহণ করবে ইন্দ্রাণী? প্রতিটি রিপু তাকেই যে রক্তাক্ত করে চলেছে অবিরাম।

খেলাটায় বড় ভুল হয়ে গেছে। ইন্দ্রাণীর এখন মঞ্চের কোণে দীনহীন মুখে বসে থাকার পালা।

তাই-ই আছে। নিজেকে এক পাশে ফেলে রেখে। শুকনো মুখে জোয়াল ঠেলছে সংসারের, ভারিক্কি দিদিমণি হয়ে ক্লাসে পড়াচ্ছে, কর্তব্যপরায়ণ কন্যা হয়ে নিয়মিত ছুটে যাচ্ছে মানিকতলায়। যাদের কাছে সে যতটুকুনি প্রয়োজনীয়, সেটুকুনিই এখন তার গণ্ডি। অধিকারের সীমানা।

প্রায় সন্ধেতেই আসে শুভাশিস, সুখদুঃখের গল্প করে। দুঃখের পাল্লাই ভারী বেশি, তার কাছে সুখ এখন এক জটিল ধাঁধা। টোটোকে নিয়ে শুভাশিসের ইদানীং দুশ্চিন্তা বেড়েছে খুব। ছেলে নাকি বাবার সঙ্গে তির্যক ভঙ্গিতে কথা বলে। অথবা বলেই না। বাপছেলেতে মাধবপুর থেকে একসঙ্গে ফিরেছিল, গোটা পথ নাকি টুঁ শব্দটি করেনি টোটো। ফেরার সময়ে কামারকুণ্ডুর আগে গাড়ির সামনে একটা গর্ভিনী ছাগল এসে পড়ে, তাকে বাঁচাতে প্রাণপণে ব্রেক কষেছিল শুভ। তেমন চোট লাগেনি ছাগলটার, বেঁচে গেল, কিন্তু কোত্থেকে উড়ে এল বিশ-পঁচিশ জন গ্রামবাসী। উত্তেজিত, মারমুখী, গাড়ি-চড়া মানুষদের ওপর তাদের বিষম রাগ। গাড়ি থেকে নেমে তাদের ঠাণ্ডা করার চেষ্টা করছিল শুভ, ক্ষমা চাইছিল, অথচ টোটো সিট থেকে নড়লই না। বসে আছে উদাস, গম্ভীর। যেন কোনও আকর্ষণহীন চলচ্চিত্রের শুটিং দেখছে। বাবার মৃত্যু নিয়েও শুভ খুব ভাবে আজকাল, মাকে নিয়ে চিন্তায় থাকে।

শুভাশিসের এসব কোনও দুঃখই তেমনভাবে ছুঁতে পারে না ইন্দ্রাণীকে। কেমন দূরের জগতের কাহিনী বলে মনে হয়। তবু সে এলে তাও সময় কাটে, বিবর্ণ সন্ধে একটু বুঝি দ্রুত গড়ায়।

একদিন মুস্তাফি এল বাড়িতে। ছুটির সকালে। একাই। কত উৎসাহ নিয়ে পীড়াপীড়ি করল, বউদি একবার চলুন, নিজের চোখে দেখে আসবেন কতটা এরিয়া নিয়ে আপনাদের ফ্ল্যাট হচ্ছে। এরপর তো পার্টিশান ওয়াল বসে যাবে, তখন কিন্তু একটু ছোট ছোট লাগবে। দেওয়ালে কোথায় আলমারি করবেন, কোথায় কটা তাক তাও একবার দেখিয়ে দেবেন চলুন। মিস্তিরিদের সেইমতো তো ডিরেকশান দিতে হবে। বাথরুমে কি আপনাদের দুটো সিস্টেমই রাখব? আপনার দুই দেওর কিন্তু শুধু ইংলিশই পছন্দ করছে। শান্ত মুখে তাকে ফিরিয়ে দিল ইন্দ্রাণী। বাড়ি ছেড়ে বেরোলই না। ভাল লাগে না, কিছু ভাল লাগে না। মাসখানেক-মাসদেড়েক বাপ্পারও কোনও চিঠি নেই, তারও ফেরার সময় প্রায় হয়ে এল, এসব নিয়েও ইন্দ্রাণী এতটুকু চিত্তচাঞ্চল্য বোধ করে না। কোনও কিছুতেই মন উচাটন হয় না আর। বিচিত্র এক ক্ষয়রোগ যেন বাসা বেঁধেছে তার ফুসফুসে, কুরে কুরে খেয়ে নিচ্ছে জীবনীশক্তি।

মাঘের শীত হপ্তাখানেক দাপট দেখিয়ে পাততাড়ি গুটোতে শুরু করেছে। কনকনে বাতাসটা কোথায় যেন চলে গেল। কদিন ধরেই আকাশে মেঘ-মেঘ ভাব। একদিন হঠাৎ তেড়ে বৃষ্টি হল, স্কুল থেকে ভিজে জাব হয়ে ফিরল ইন্দ্রাণী। সেদিন থেকেই জোর সর্দিকাশি, সঙ্গে একটা বিশ্রী ঘুষঘুষে জ্বর। নড়তে ইচ্ছে করে না, হাঁটতে চলতে ইচ্ছে করে না। পাছে বাড়ির লোক কিছু বুঝতে পারে জোর করে স্কুলে গেল রোজ। স্টাফরুমে কপাল টিপে বসে থাকে, ইরাক আমেরিকার যুদ্ধ নিয়ে সহকর্মীরা কলকল করে চলে, শুনেও শুনতে পায় না ইন্দ্রাণী। বাড়ি ফিরেই দরজা বন্ধ। শুয়ে আছে। শুয়েই আছে।

নিস্তরঙ্গ জীবন। শ্বাসহীন বেঁচে থাকা। উদ্যমহীন অস্তিত্ব।

ইন্দ্রাণীর বাড়ি এখন বদ্ধ ভোবা। পানায়-পানায় হেজে-মজে যাচ্ছে। তার মধ্যেই কোনও কোনও রাতে কন্দর্পর সেতার বেজে ওঠে।

ওই সুরঝংকারটুকুই যা একটু ব্যতিক্রম।

.

সেদিন বদ্ধ ডোবায় ছোট্ট ঢিল পড়ল। হালকা একটা ঢেউ উঠল।

 বিকেলবেলা হঠাৎ উমা ধীরাজ এসে হাজির। ট্যাক্সিতে।

ইন্দ্রাণী প্রশ্ন করার আগেই উমা বললেন, জামাইকে দেখতে এলাম।

অবাক ইন্দ্রাণীর কথাটা তেমন বিশ্বাস হল না। আদিত্য হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত বার দশেক মা বাবার কাছে গেছে সে, কখনও তো জামাইকে দেখতে আসার বাসনা কেউ প্রকাশ করেনি!

নিস্পৃহ স্বরে বলল, – এসো। …বাড়ি চিনতে অসুবিধা হয়নি?

রেললাইন পার হয়ে হচ্ছিল সামান্য। তো মোড়ের পানের দোকানে তোর ছোট দেওরের নাম করতেই এককথায় দেখিয়ে দিল।

ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়ে সিঁড়িতে এসেছেন ধীরাজ। বারান্দায় উঠতে উঠতে ব্যস্তমুখে বললেন, হ্যাঁরে ইনু, তোর নাকি শরীর খারাপ?

–আমার!

–আদিত্য বলল যে। …হ্যাঁ গো, কবে যেন তুমি এ বাড়িতে ফোন করলে?

উমা যেন ঈষৎ অপ্রস্তুত হলেন। ঢোঁক গিলে হাসলেন, – এই তো পরশু। কেন জামাই বলেনি? ..কদিন তুই যাচ্ছিস না, খোঁজখবর নেই….

ও, এটাই তাহলে আসল কথা। ইন্দ্রাণী মনে মনে হিসাব করল। মাত্র আট দিন মানিকতলায় যায়নি সে। কতবার তো এর থেকেও বেশিদিন যাওয়া হয়নি, করছি করব করে টুনুমাসির বাড়িতে ফোন করাও হয়নি, কবে এভাবে ছুটে এসেছে মা বাবা! সম্পর্কে শীতলতা এসে গেলে বোধহয় এমনটাই হয়। টান ভালবাসা দেখাতে হয়।

তিতির বেরিয়ে এসেছে ঘর থেকে। দাদু-দিদাকে দেখে মুখোশে অনাবিল হাসি ফুটল, ওমা, কী কাণ্ড! তোমরা কখন এলে?

–এই তো। …তুই দাদু-দিদাকে একেবারে ভুলে গেলি রে দিদিভাই?

–ওমা, আমার পরীক্ষা না!

–সে তো ঢের দেরি।

 –দেরি কোথায়! আর মাত্র বাহান্ন দিন।

নাতনির সঙ্গে কথা বলতে বলতে আদিত্যর ঘরে ঢুকলেন ধীরাজ। উমা ঘুরে ঘুরে দেখছেন বাড়িটাকে। উঁকি দিলেন রান্নাঘরে, বাথরুমে, মেয়ের ঘরেও। এ বাড়িতে আজ তাঁর প্রথম পদার্পণ। জয়মোহনের বাৎসরিকের দিন আসার একটা সম্ভাবনা ছিল, আদিত্য হাসপাতালে থাকায় অনুষ্ঠানটা নমো নমো করে সারা হয়েছে, সুদীপই কাজ করেছে বাবার, কাউকেই আর তেমনভাবে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি।

সন্ধ্যার মা আটা মাখছে। হাতের কাজ রেখে তাকে একটু ময়দা মাখতে বলল ইন্দ্রাণী। নিজেই গ্যাসে কেটলি বসাল। মা কোথাও গেলে আগে একটু চা খেতে ভালবাসে।

উমা রান্নাঘরের দরজায় এসেছেন, ঘরগুলো সত্যিই বড় ছোট ছোট রে ইনু।

ইন্দ্রাণী আলগা হাসল, চলে তো যাচ্ছে।

–হ্যাঁ, হলেই হল। আর তো কটা মাত্র মাস।

ইন্দ্রাণীর বলতে ইচ্ছে হল ফ্ল্যাটের ঘরও আগের মতো বড় বড় হবে না মা। না বলে ঘাড় নাড়ল অল্প।

–তবে এখানে স্যাঁতসেতে ভাবটা কম। যাই বল, তোদের ও বাড়ির একতলাটা একদম ড্যাম্প ধরে গিয়েছিল।

হুঁ। …তোমার জামাইকে দেখতে গেলে না?

এই যাই। দু পা এগিয়েও থামলেন উমা, তোর কি জ্বর এসছিল?

–অত কিছু নয়। গা ম্যাজম্যাজ ধরনের।

–তোর বাবা খুব ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠেছিল। জানিসই তো তোর বাবাকে। একবার যদি মাথায় ঢোকে তো…। আমি তো ভয়ে মরি। ওই ভুলো মানুষকে নিয়ে একা একা রাস্তায় বেরোনো…। ঠিকই করেছিলাম, চিনতে না পারলে ট্যাক্সি ঘুরিয়ে আবার ফেরত চলে যাব।

এত কৈফিয়ত দিচ্ছে কেন মা? মেয়ের কাছে আসতে গেলে এত কারণ দেখাতে হয় নাকি? নাকি ইন্দ্রাণীর নিজের মনই প্যাঁচালো হয়ে গেছে, সোজা কথা সরল মনে নিতে পারছে না?

ও-ঘর থেকে তিতিরের হাসি উড়ে আসছে। অনেক দিন পর জোরে জোরে হাসছে মেয়ে। ধীরাজের কথার পিঠে আদিত্যর গলাও শোনা গেল। নিশ্চয়ই একটা সুখী সুখী পরিবেশ তৈরি হয়েছে। ভাল।

উমা হঠাৎ জিভ কাটলেন, –এই দ্যাখো, তোদের জন্য একটু কড়া পাকের সন্দেশ এনেছিলাম। তোর বাবার ফোলিও ব্যাগে নিশ্চয়ই এতক্ষণে পাউডার হয়ে গেল। বলতে বলতে প্রায় ছুটে গেছেন আদিত্যর ঘরে।

ইন্দ্রাণী একটু স্বস্তি বোধ করল। এ বাড়িতে কেউ মুখের সামনে দাঁড়িয়ে তার ভালমন্দ ভাবছে, ড্যাব ড্যাব করে দেখছে কতটা শুকিয়েছে ইন্দ্রাণী, ভাবতেই শরীরের পেশি কেমন শক্ত হয়ে আসে। সুখের চেয়ে স্বস্তি ভাল। একাকিত্বে অশান্তি নেই।

কেটলির ঢাকনা খুলে ফুটন্ত জলে চা-পাতা ফেলল ইন্দ্রাণী। গ্যাসটা নিবিয়ে দিল। খানিক আগে একবার চা হয়েছিল, দুধ এখনও গরম আছে, কাপ সাজিয়ে চামচে করে দুধ তুলছে। হাত বাড়িয়ে চিনির বয়াম তাক থেকে নামাল।

তিতির মিষ্টির বাক্স হাতে খাওয়ার জায়গায় এসেছে। হাসি উবে গিয়ে অভ্যস্ত ভাবলেশহীন স্বর, এটা কোথায় রাখব? ফ্রিজে?

রাখো।

–দোকান থেকে খাবার আনতে হবে?

না। সন্ধ্যার মা লুচি ভাজছে।

–ও। এক পা এগোল তিতির, চা নিয়ে যাব?

ইন্দ্রাণী পলকের জন্য ভাবল, থাক। আমিই নিয়ে যাচ্ছি।

 তিতির মুখ ঘুরিয়ে চলে গেল। আত্মীয়স্বজন আদিত্যকে দেখতে এলে ভদ্রতা করে ওঘরে একবার যেতে হয় ইন্দ্রাণীকে। বেশিক্ষণ থাকে না, টুকটাক দুটো-একটা কথা বলে চলে আসে। তিতির জানে। মার এই ভান ভনিতা মেয়ের চোখে গোপন থাকার কথা নয়। কী আর করা, সঙ সাজার জন্যই তো সংসার।

সন্ধ্যার মাকে ছোটখাট কয়েকটা নির্দেশ দিল ইন্দ্রাণী। লুচির সঙ্গে কী হবে, কোন প্লেটে মা বাবাকে খেতে দেবে, কন্দর্প কাল রসগোল্লা এনেছিল, ফ্রিজে পড়ে আছে সেগুলোকে বার করে দিতে হবে, এই সব।

ট্রেতে চা-বিস্কুট সাজিয়ে ঘরে এসে দেখল শ্বশুর-জামাই বসে আছে পাশাপাশি। জামাই বাবু হয়ে, শ্বশুর পা ঝুলিয়ে। পাশের খাটে দিদিমার কোল ঘেঁষে নাতনি। দিদিমার হাত নাতনির কাঁধে। সকলের মুখেই হাসির ছোপ। কী মনোরম পারিবারিক দৃশ্য! ছবি তুললেই হয়।

ধীরাজ বলে উঠলেন, অ্যাই ইনু, তুই একটু বল না আদিত্যকে। ও তো কিছুতেই যেতে চাইছে না।

ইন্দ্রাণী অপেশাদার অভিনেত্রীর মতো হাসল, কোথায়?

–একটু সমুদ্র দেখতে যাব ভাবছিলাম। ঠাণ্ডা তো কমেই গেছে…

উমা বললেন, হ্যাঁ, জামাইয়েরও শরীরটা সারত ভাল করে। বেশি দূর নয়, দিঘা থেকে ঘুরে আসি।

ধীরাজ বললেন, আদিত্য সঙ্গে থাকলে আমরা অনেক বলভরসা পাই। সেবার কি চমৎকার আমাদের বেড়িয়ে নিয়ে এল কাশীতে। কি বড় বড় বেগুন কিনে আনত।

তিতির মিটিমিটি হাসছে, – হ্যাঁ বাবা, যাও না বাবা। ঘুরে এসো না কটা দিন। আমার যে পরীক্ষা, নইলে আমিও ঠিক যেতাম।

আদিত্য চোখ বুজে দু দিকে ঘাড় নাড়ল, পারব না রে। শরীরে জুত নেই।

–খুব পারবে। যাও, গেলেই ফিট হয়ে যাবে। সমুদ্রের ঢেউ গায়ে লাগলে সব উইকনেস ভ্যানিশ।

নারে বাবা না। আমার এই গৃহকোণই ভাল। ওই ছ ঘণ্টা-আট ঘণ্টা বাস জার্নি… অত ধকল আমার সইবে না।

ধীরাজের মুখ মলিন হয়ে গেল, না-গেলে যে আমাদের যাওয়া হয় না আদিত্য!

উমা বললেন, -বড় আশা ছিল তুমি যাবে।

বাবা মার হঠাৎ এত দিঘা যাওয়ার বাসনা জাগল কেন বুঝতে পারছিল না ইন্দ্রাণী। এটা বলতেও কি আজ আসা এখানে? আগ্রহটা কার বেশি? বাবার, না মার? তনুময়ের কথায় সেদিন হঠাৎ উত্তেজিত হওয়ার পর থেকে অদ্ভুত রকমের চুপচাপ হয়ে গেছে মা, ছেলের কথা আর ভুলেও তোলে না। অন্তত ইন্দ্রাণীর সামনে। মা কি তবে ভেতরে ভেতরে হাঁপিয়ে উঠেছে? কদিন একটু মুক্ত হাওয়া চায়? নাকি মা-মেয়ের এই শীতল ব্যবধান বাবার সহ্য হচ্ছে না?

আদিত্য মাথা চুলকোচ্ছে। একবার উমার দিকে তাকাচ্ছে, একবার ধীরাজের দিকে। ইন্দ্রাণীর খারাপ লাগছিল। কাশীতে মা বাবাকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে ফাঁপরে পড়েছিল বলে এবার বোধহয় এড়াতে চাইছে আদিত্য। না হলে তিন দিনের জন্য দিঘা ঘুরে আসতে পারবে না এমন অসুস্থ তো সে নয়।

নিরস গলায় ইন্দ্রাণী বলল, – যে যেতে চাইছে না তাকে জোর করছ কেন বাবা? চলো, আমি তোমাদের সঙ্গে যাচ্ছি।

–তুই!

–কেন, আমি যেতে পারি না? ইন্দ্রাণী কাষ্ঠহাসি হাসল, আমারও শরীরটা ভাল লাগছে না, নয় কদিন সমুদ্রের হাওয়া খেয়ে এলাম।

আদিত্য দেখছে ইন্দ্রাণীকে। তিতিরও। ইন্দ্রাণী চোখ সরিয়ে নিল, কবে যাবে বলো? এই শনিবার যেতে চাও?

উমা আড়ষ্ট স্বরে বললেন, — তোর কোনও অসুবিধে হবে না তো?

-একটুও না। আমি কালই স্কুল থেকে ফেরার সময়ে বাসের টিকিট করে আনছি। শুক্রবার রাত্তিরে মানিকতলায় থাকব, শনিবার ভোরে বেরিয়ে যাব। মঙ্গল, বুধ সরস্বতী পুজোর ছুট আছে, বৃহস্পতিবার ফিরে আসব।

উমা কি ঘাড় নাড়লেন? ধীরাজ?

ইন্দ্রাণী দেখতে পেল না। দেখতে চাইলও না।

.

হোটেলটা সমুদ্রের ধারে। উপনগরীর এদিকটায় সমুদ্র খানিকটা খাঁড়ির আকারে নিয়েছে, একটু ভেতর পর্যন্ত ঢেউ চলে আসে। বোল্ডার দিয়ে বাঁধানো আছে পাড়, সেখান থেকে বালি মাড়িয়ে বিশ তিরিশ গজ হাঁটলেই হোটেল। বারান্দায় বসে সারাদিন সমুদ্র দেখা যায়, এটাই এই হোটেলের সব থেকে বড় আকর্ষণ।

দিঘাতে আগে একবারই এসেছে ইন্দ্রাণী, সেও প্রায় পনেরো-ষোলো বছর হয়ে গেল। তিতির তখন হাঁটছে সবে, এক-দেড় বছর বয়স। বাপ্পা তখনও নার্সারিতে। বাড়িসুদ্ধ সবাই এসেছিল। সুদীপ কন্দর্প, সবাই। জয়মোহন শোভনাও। দিঘাও নাকি লোকে বছরে পাঁচবার করে আসে, কমলিকা শেফালিরাই তো কথায় কথায় উইকএন্ড করে, ইন্দ্রাণীই শুধু…। কোথায়ই বা কবে গেছে ইন্দ্রাণী? ছোটবেলায় পুরী, দার্জিলিং, শিমূলতলা, মধুপুর। বিয়ের পর ধর্মের মধ্যে কর্ম, আদিত্যর সঙ্গে একবার মুসৌরি দেরাদুন। সে স্মৃতি তো দুঃস্বপ্নের মতো, কবেই তা ভুলে গেছে ইন্দ্রাণী। তারপর থেকে তো যাবজ্জীবন মেয়াদ খেটে চলেছে। কদিনের জন্য তাও প্যারোলে বেরোনো হল।

পৌঁছনোর দিনই বাবা-মাকে নিয়ে ইন্দ্রাণী সন্ধেবেলা হাঁটতে বেরিয়েছিল। জায়গাটা কেমন বদলে গেছে। আগে বেশ নির্জন ছিল, এত বাড়িঘর ছিল না, এখন চতুর্দিকে শুধু হোটেল আর হোটেল, টুরিস্টদের ভিড় আর যানবাহনের চিৎকার। পা হাঁটলেই মুখচেনা কারুর সঙ্গে দেখা হয়ে যায়, বিরক্ত লাগে। সমুদ্রর ধারে পাড় বাঁধিয়ে একটা রাস্তা বানানো হয়েছে, সেই পথটুকুই যা একটু নিরালা। উমা, ধীরাজেরও ভিড়ভাট্টা বেশি পছন্দ নয়, নিরালা পথের ধারে বাঁধানো ধাপিতে তাঁরা বসে রইলেন সারা সন্ধে। অন্ধকার সমুদ্রকে সামনে রেখে। পাশে ইন্দ্রাণী। নীরব নিথর। সমুদ্রের রূপসুধা পান করছে।

রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জায়গাটার চেহারা যেন একদম বদলে গেল। পথশ্রমে শ্রান্ত উমা ধীরাজ হোটেলে ফিরে খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন, বারান্দার বেতের চেয়ারে এসে বসল ইন্দ্রাণী। তখনই শহরের আলোগুলো সব নিবে গেল হঠাৎ। চতুর্দিক গাঢ় অন্ধকার, সামনে এক গাঢ়তর কালির আধার। উথাল পাথাল হাওয়া বইছে, হঠাৎ হঠাৎ থমকে যাচ্ছে হাওয়া, ঝাউবনে শব্দ বাজিয়ে ফিরছে আবার। কোটি কোটি তারা বুকে নিয়ে ঘন আকাশ নেমে গেছে সমুদ্রে, অসংখ্য ঢেউ নিয়ে সমুদ্র ছুটে আসছে তীরে, আকাশ, মাটি, সমুদ্র একাকার হয়ে গেল। ইন্দ্রাণীর বুকের ভেতরটা মুচড়ে মুচড়ে উঠছিল। যেন তার সামনে বারিরাশি নয়, এক অনন্ত হাহাকার। যেন ঢেউ নয়, অবিরল উত্তাল অশ্রুধারা। অবিরাম কান্না আছড়ে পড়ছে বোল্ডারে। নাকি পাঁজরায়? কখন দ্বিতীয়ার ফালি চাঁদ উঠল, অস্ত গেল, দেখতে পেল না ইন্দ্রাণী। চকিতে ঢেউয়ের মাথায় নীলাভ দ্যুতি ঝলসে উঠছে, কেঁপে কেঁপে উঠছে ইন্দ্রাণী। কেন আদিত্যর কথা মনে পড়ে এ সময়ে? আদিত্যকে একটি বারের জন্য হাসপাতালে দেখতে গেল না, মানুষটা বাড়ি ফেরার পরও একটা কথা বলল না–কেন? আদিত্য শুধু সারাজীবন তাকে যন্ত্রণা দিয়েছে, তাই? শ্বশুরমশাইয়ের মৃত্যুর জন্য তার দিকে আঙুল তুলেছিল, তাই? নাকি অন্য কোনও গূঢ় কারণ আছে? অভিমান? যে-মানুষটার সঙ্গে তেমন কোনও সম্পর্কই কখনও তৈরি হয়নি, তার ওপর অভিমান কিসের? অপমান? যে-মানুষটাকে ইন্দ্রাণীই চিরকাল উপেক্ষা করেছে, তার উপেক্ষায় ইন্দ্রাণীর কিসের অপমান? ঈর্ষা? যাকে কোনওদিন মনপ্রাণ দিয়ে চায়নি ইন্দ্রাণী, তাকে অন্যের বাহুতে দেখে কি অসূয়া মানায়? নাকি এ কিছুই নয়? আদিত্যর সরাসরি আক্রমণ, একটা অতি সাধারণ মেয়ের কোলে মাথা রেখে আদিত্যর বাড়ি ফেরা, ইন্দ্রাণীর অহংবোধকে তোলপাড় করে দিয়েছে। আদিত্য চিরকাল তার বশংবদ হয়ে থাকবে, উঠতে বললে উঠবে, বসতে বললে বসবে, তার ভয়ে থরথর কাঁপবে, এরকমই কি চেয়েছিল ইন্দ্রাণী?

অসীম সমুদ্রকে সামনে রেখে ইন্দ্রাণী নিজেকে পরপর প্রশ্ন করে যাচ্ছিল, কুলকিনারা পাচ্ছিল না। আদিত্যর কথা সে এত ভাবছেই বা কেন? চোখ বুজে ইন্দ্রাণী শুভাশিসকে মনে করার চেষ্টা করল। আবছা ধোঁয়ার শরীর গড়ে উঠছে, মিলিয়ে যাচ্ছে। তবে কি ইন্দ্রাণী তার শুভর প্রতি আর একনিষ্ঠ নয়?

কান্না পাচ্ছিল ইন্দ্রাণীর। বহুকাল পর। সমুদ্রের হুঙ্কার কান্নাকে বাড়িয়ে দিচ্ছিল আরও।

.

কটা দিন গড়িয়ে গড়িয়ে কেটে গেল। এখানেও এক বাঁধা রুটিন। খাওয়া, ঘুম, হাঁটা, বসে থাকা। উমা, ধীরাজ নিয়ম করে ভোর ভোর উঠেছেন, সমুদ্রের পাড়ে গিয়ে বসে থেকেছেন দুটিতে। ভোরের বর্ণহীন সমুদ্রে শান্ত ঢেউয়ের লুটোপুটি দেখে তাঁদের কী তৃপ্তি! বেলা বাড়লে সূর্য যখন হিরের কুচি ছড়ায় সমুদ্রে, তখন তাঁরা ফিরে আসতেন ঘরে। সমুদ্রস্নানে তাঁদের কোনও আগ্রহ নেই, ইন্দ্রাণীরও না। দূর থেকে সে দেখত ঢেউয়ের ধাক্কায় কেমন ছিটকে পড়ছে রঙিন মানুষ, উঠে দাঁড়াচ্ছে, আবার তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছে জলে। সমুদ্রও যে কতবার রঙ বদলায়! এই দ্যাখো ধূসর, তো এই নীল, এই সবজে। কাছে গেলে ফেনা দোলায়, বাষ্প ছড়ায়, দূরে গেলে চুম্বকের মতো কাছে টানে।

আগেরবার সমুদ্রকে ঠিক এভাবে উপলব্ধি করেনি ইন্দ্রাণী। দলের সঙ্গে আসা, হুড়োহুড়ি, বাপ্পা-তিতিরকে সামলানো…, এবার যেন সবই অন্যরকম। ফেরার দিন ভারী মন খারাপ হয়ে গেল। জীবন যে কেন সমুদ্রের মতো হয় না! কেন যে শুধুই একরঙা! ধূসর!

ফেরার দিন সকালে অল্পস্বল্প কিছু কেনাকাটি করলেন উমা। শাঁখের আংটি, ঝিনুকের মালা, কাজুবাদাম। আশপাশের বাড়িতে দেবেন, জামাই-নাতনিকেও পাঠাবেন। তিতিরের জন্য সুন্দর একজোড়া ঝিনুকের দুল কিনল ইন্দ্রাণী। মেয়েকে দেওয়া যাবে কিনা জানে না, তবু কিনল।

বাজারে রাতুলের সঙ্গে দেখা। মেয়ে বউ নিয়ে গতকাল দিঘায় এসেছে, এক-দু দিন থাকবে। ইন্দ্রাণীকে দেখে রাতুলের একগাল হাসি, ভাল আছ ইনুদি?

ইন্দ্রাণীও হাসল, আছি একরকম। তোর কী খবর?

রাতুল কাঁধ ঝাঁকাল, কেটে যাচ্ছে।

সি এম ডি এ-তে আছিস এখনও?

নাহ্। পিটারসন অ্যান্ড পিটারসনে জয়েন করেছি। খুব বড় অফার পেলাম। নেক্সট ইয়ার হয়তো কানাডা পাঠাবে।

–বেশ আছিস, অ্যাঁ? তরতর উঠছিস?

তাও তো কতগুলো বছর সরকারি চাকরিতে নষ্ট হয়ে গেল। রাতুল দাঁত ছড়িয়ে হাসছে, যত সব পেটি মীন লোকজন নিয়ে কাজ, রাস্তায় মজুর খাটানো…কোনও জব স্যাটিসফ্যাকশান ছিল না।

কথাগুলো কোথায় যেন ফুটছিল ইন্দ্রাণীকে। এই ছেলেটা তনুর বন্ধু ছিল? এক রাজনীতি করত?

আলগাভাবে বলল, –মাসিমা কেমন আছেন?

–জানো না, মা তো নেই! এই লাস্ট অক্টোবরে…ওহহো, তারপর তো মানিকতলার দিকে আর যাওয়া হয়নি। খানিক দূরে রাতুলের বউ ঝিনুকের পর্দা দর করছে, সঙ্গে মেয়ে, সেদিকে একঝলক তাকিয়ে রাতুল বলল, ওর আর কিছু খবর পেলে না, তাই না?

ইন্দ্রাণী চুপ করে রইল।

রাতুল আপন মনে বলল, খ্যাপা ছেলে। কি করল! কোথায় যে গেল! …এখন তো আবার নতুন করে তখনকার শহিদদের লিস্ট হচ্ছে, সেখানে খোঁজ করে দেখেছ? …মানে তা হলেও ওর একটা ট্রেস হয়… মানে বলছিলাম…

পলিথিন ব্যাগ হাতে উমা আসছেন এদিকে, রাতুল কথা থামিয়ে দিল। দু-আড়াই বছর পর রাতুলকে দেখে উমা খুব খুশি, নতুন করে খবর দেওয়া-নেওয়ার পালা চলল। বউ-মেয়েকে ডাকল রাতুল, তাদের সঙ্গেও খানিক কথা বললেন উমা। রাতুলের মার মৃত্যুসংবাদ শুনে থম মেরে রইলেন একটুক্ষণ।

হোটেলে এসে ইন্দ্রাণীরা দেখল ধীরাজ ব্যাগট্যাগ গুছিয়ে স্নান-টান সেরে রেডি। আজকাল বেশ সপ্রতিভ হয়ে গেছেন ধীরাজ। দিব্যি গুছিয়ে কাজকর্ম করেন, কথাবার্তাতেও এলোমেলো ভাব অনেক কম। কাশীতে স্ত্রীর ওই পাগলামি দেখার পর টিভি খবরের কাগজে নিরুদ্দেশের খবর খোঁজাও একরকম বন্ধ করে দিয়েছেন, এককথায় না বলে বেরিয়ে পড়েন না। সত্যি বলতে কি, এবার বেড়ানোর সময়ে তাঁকে এতটুকু সামলাতে হয়নি।

ফেরার বাসে ইন্দ্রাণীর পাশে বসেছেন উমা, পিছনের সিটে ধীরাজ। উমা কথা বলছিলেন না বিশেষ, বোধহয় রাতুলের মার কথা ভাবছিলেন। মানিকতলার বাড়িতে থাকতে রাতুলের মা তাঁর খুব বন্ধু ছিল।

হঠাৎ এক সময়ে বললেন, রাতুল তখন তোকে কী বলছিল রে? আমাকে আসতে দেখে চুপ করে গেল?

কই, কিছু না তো। ইন্দ্রাণী তড়িঘড়ি বলল।

উমার ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি, তনুর কথা বলছিল, না?

অজান্তেই মাথা দুলিয়ে ফেলল ইন্দ্রাণী, হুঁ।

কী বলছিল?

বাদ দাও না ওসব কথা।

 একটু চুপ থেকে মেয়েকে দেখলেন উমা। তারপর বললেন, তুই কি আমার ওপর এখনও রাগ করে আছিস ইনু?

–কেন মা?

উদাস চোখে জানলার বাইরে তাকিয়ে রইলেন উমা। ছুটন্ত গাছগাছালি দেখছেন। মেয়ের দিকে না ফিরেই বললেন, তোর রাগটা আমি বুঝি রে ইনু। আমার রাগটা তুই বুঝিস না। আমি নিজেও বুঝতাম না। তাই মন শান্ত করতে এবার…সমুদ্র আমাকে অনেকটা জুড়িয়ে দিয়েছে রে। ভাগ্যিস তোর বাবা জোর করে নিয়ে এল।

মা তবে অশান্ত মনকে জুড়োতে এসেছিল! বাবা ভোলাতে এনেছিল মাকে! ইন্দ্রাণী ফ্যালফ্যাল চোখে তাকাল উমার দিকে।

উমা মেয়ের হাতে চাপ দিলেন, হ্যাঁ রে। বিশাল সমুদ্রের সামনে দাঁড়ালে নিজেদের সুখ-দুঃখ কেমন তুচ্ছ হয়ে যায়। ভেবে দেখলাম তনু যদি বেঁচেও থাকে, এতদিনেও তো সে ফিরে আসেনি। তার মানে, হয় তার আসার ইচ্ছে নেই, নয় তার আসার উপায় নেই। আমরা তো তাকে তেমনভাবে বাঁধতেও পারিনি, যার টানে সে…ঠিক কিনা বল? বেঁচে যদি থাকে ভাল থাকুক, আর কি চাই আমরা? তোর বাবাও বলছিল, যার মুখটা আমরা ঠিকমতো মনেও করতে পারি না তার কথা ভেবে আর কতদিন কাঁদব? যদি তনু ফিরেও আসে, সে কি আর একই তনু আছে? যে-ঢেউটা সমুদ্রে চলে যায়, সেই ঢেউটাই কি আর ফেরে?

ইন্দ্রাণীর বুকটা ধকধক করছিল। বাবা-মা কি জেনে গেছে তনুর কথা? তনু কি চিঠি-ফিটি লিখেছে কোনও? কাউকে দিয়ে খবর পাঠিয়েছে?

জিজ্ঞাসা করতে সাহস হল না। কথাই ফুটল না মুখে। শুকনো চোখে কাঠ হয়ে বসে রইল।

উমা ধীরাজকে মানিকতলায় নামিয়ে একা ট্যাক্সিতে আচ্ছন্নের মতো ফিরছিল ইন্দ্রাণী। ফাল্গুন পড়ে গেছে, বাতাসে এখনও চোরা ঠাণ্ডা। সন্ধের বাতাস নাকে মুখে বিঁধছে। মানিকতলাতেই কটা দিন থেকে গেলে হত। এ কোন ঘরে ফিরছে সে? কার কাছে ফিরছে? ক্ষীণ স্মৃতির মতো কালি ঢালা সমুদ্রটাকে মনে পড়ল একবার। বিষণ্ণ থেকে বিষণ্ণতর হয়ে গেল মন।

রাস্তা জুড়ে সরস্বতী পুজোর প্যান্ডেল। ইন্দ্রাণী লাইনের এপারে ট্যাক্সি ছেড়ে দিল। বাড়ি ফিরে ক্লান্ত হাতে বেল বাজাচ্ছে।

প্রায় অচেনা একটা স্বরে চমকে গেল ইন্দ্রাণী, – ওয়েলকাম হোম।

.

৯০.

ইন্দ্রাণী অবাক চোখে তাকাল, তুই!

ইয়েস। মি।… ইন্দ্রনীল রায়। হাঁটুঝুল শটস, ঢোল্লা টিশার্ট পরা বাপ্পা হাসছে মিটিমিটি, পরশু ইভনিং-এ ক্যালকাটা ল্যান্ড করেছি।

আগে কিছু জানাসনি তো?

 –সুইট সারপ্রাইজ।

 মিঠে চমকই বটে। ইন্দ্রাণীর বুক ক্ষণিকের জন্য তিরতির করে উঠল। এ যেন বাপ্পা নয়, অনন্ত মেঘ ঢাকা আকাশে হঠাৎ এক ফালি রোদের ঝিলিক।

শুধু ওই মুখখানি দেখে কতবার যে কত সন্তাপ ভুলেছে ইন্দ্রাণী!

ঘরে এসে ইন্দ্রাণী খাটে পা ঝুলিয়ে বসল। দেখছে ছেলেকে। অনেক বদলে গেছে বাপ্পা। চোয়ালে একটা দৃঢ় ভাব এসেছে, কাঁধ আরও চওড়া লাগে, শরীরের পেশি অনেক শক্তপোক্ত, মোটা গোঁফের আড়ালে মুখের নরম-সরম ভাবটা প্রায় নেইই। পুরোদস্তুর একটা লোক হয়ে গেছে বাপ্পা। কবে হল!

ইন্দ্রাণীর পাশে এসে বসল বাপ্পা। এক হাতে আলতো জড়িয়ে ধরেছে মাকে, টায়ার্ড?

–একটু। ইন্দ্রাণী হাসল, এতটা পথ বাসে আসা…

–মজাসে বেড়ালে?

–ওই এক রকম। তোর দাদু দিদা ধরল খুব… কটা দিন হাওয়া বদল…

–দাদু দিদা আছে কেমন? দাদুর ইর‍্যাটিকনেস একটু কমেছে?

–হুঁ। সংক্ষিপ্ত উত্তরে প্রসঙ্গটা এড়াতে চাইল ইন্দ্রাণী। একটু এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল, তিতির কোথায় রে?

–ঘর বন্ধ করে পড়ছে। ডাকব?

না, ডাকতে হবে না। মেঘটা আবার আকাশ ঢাকছে, ইন্দ্রাণী শ্বাস চাপল।

–এবার এসে তোমার মেয়ের অনেক চেঞ্জ দেখছি। বাপ্পা চোখ নাচাচ্ছে, হেভি সিরিয়াস টাইপ হয়ে গেছে।

হুঁ, সামনে পরীক্ষা। টেস্ট প্রিটেস্টের রেজাল্টও খুব ভাল হয়নি…

–নট ওনলি দ্যাট। সব ব্যাপারেই। কী ঠানদি-ঠানদি মুখ করে বাবার নার্সিং করে! কী শাসনের বহর! সন্ধেবেলা বাবা একটু বেরোল, একদম স্টপওয়াচ টিপে ছাড়ল বাবাকে! দু ঘণ্টার মধ্যে ফিরবে, নইলে খারাপ হয়ে যাবে! তিতিরের গলা নকল করে জোরে হেসে উঠল বাপ্পা, জানো, তোমার মেয়ে ও ঘর থেকে আমায় চাক আউট করে দিয়েছে!

অজান্তেই ভুরু কুঁচকে গেল ইন্দ্রাণীর, সেকি!

তবে আর বলছি কী! ও ঘরে না থাকলে ওর নাকি টেনশান হয়। রাত জেগে পড়ে… বাবা বার বার ওঠে… বাবার সঙ্গে সঙ্গে থাকতে হয়…।

ভালই তো। তুই এ ঘরেই থাক। অসুবিধে হবে?

 বাপ্পার যেন কানে গেল না কথাটা। হাত ইন্দ্রাণীর পিঠ থেকে সরিয়ে নিয়ে বলল, আচ্ছা মা, তুমি আমাকে জানাওনি কেন বলো তো?

কী?

–এই বাবার অসুখ… হসপিটালাইজড হওয়া…

 ইন্দ্রাণীর বুকে ঠুং করে বাজল কথাটা। বুকেই বাজল, না আরও গভীরে? আগেরবার হাসপাতালে থাকার সময়ে এই ছেলে না দেখতেই যেতে চাইত না বাবাকে।

একটু অপ্রস্তুত মুখে ইন্দ্রাণী বলল, – এ তো আর নতুন কিছু নয়। আর জেনে তুই করতিসই বা কি, বল?

–কিছুই হয়তো করতে পারতাম না। তবুও… বাপ্পা খুঁতখুঁত করছে, বাবা নাকি আজকাল মাঝে মাঝেই খুব ডিপ্রেশানে ভোগে?

-কে বলল? তিতির? ইন্দ্রাণীর স্নায়ু টান।

না। তিতির কিছু বলেনি। শুনছিলাম।

বাপ্পার কথায় কি কোনও অনুযোগের সুর? সেই বাপ্পার? ইন্দ্রাণী ঠিক বুঝতে পারল না। খাট থেকে নেমে আলমারি খুলে একটা ধোওয়া শাড়ি বার করল। শাড়ি সায়া ব্লাউজ নিয়ে ঘর থেকে বেরোতে গিয়েও দাঁড়াল একটু। চাপা গলায় বলল, তোর বাবা তো সারাটা জীবনই ডিপ্রেশানে ভুগে গেল বাপ্পা। আর আমি সারাটা জীবন মনের সুখে তাথৈ তাথৈ নেচে গেলাম।

বাপ্পা হো হো হেসে উঠল, – আরে আরে, তুমি হঠাৎ এত সেন্টিমেন্টাল হয়ে পড়লে কেন মা?

কেন পড়ল তা যদি সত্যি-সত্যি বোঝানো যেত! কে বুঝবে! কে বোঝে ইন্দ্রাণীকে!

 বাথরুমে গিয়ে মুখেচোখে জল থুপল ইন্দ্রাণী। ফাল্গুন পড়ে গেছে, জলের ছোঁয়া ভাল লাগে বেশ, তবু যেন ঠিক জুড়োচ্ছে না শরীর। স্নান করে নেবে? থাক, কদিন আগেই জ্বর জ্বর মতো হয়েছিল। একটু আগের ভাল লাগা ভাবটা মরে আসছে ক্রমশ। কেন আসছে?

আদিত্যর ঘরের দরজা এখনও বন্ধ। তিতির একবারও বেরোল না। আড়চোখে সেদিকে তাকিয়ে নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকল ইন্দ্রাণী। গ্যাস জ্বালিয়ে গলা ওঠাল, বাপ্পা, চা খাবি?

কফি করো না। কফি নেই?

আছে। চাঁদু গত সপ্তাহেই এনেছিল। তিতির কি এখন কফি খাবে? ভাবতে ভাবতে কেটলির ঢাকা খুলে আর এক কাপ জল বাড়িয়ে দিল ইন্দ্রাণী।

বাপ্পা রান্নাঘরের দরজায়, তিতির আজ একটা ফ্যান্টাসিক চিঁড়ের পোলাও বানিয়েছিল। ঝড়তি-পড়তি আছে বোধহয়, টেস্ট করে দেখতে পারো।

খাবারের কথা শুনে যেন ক্ষিধেটাকে টের পেল ইন্দ্রাণী। বিকেলে মেচেদায় চায়ের সঙ্গে একটা আলুর চপ খেয়েছিল। তারপর থেকে কিছুই পেটে পড়েনি। খেলে হয়। সঙ্গে সঙ্গেই এক উদ্ভট অভিমান ধেয়ে এল বুকে। খাবে না। মেয়ের মেজাজ আছে, তার নেই!

বাপ্পার হাতে দু কাপ কফি ধরিয়ে দিল ইন্দ্রাণী। নিজেরটা নিয়ে এসেছে ঘরে। তিতিরকে কফি দিয়ে ও ঘর থেকে ইয়া এক বিলিতি ঝোলা নিয়ে ফিরেছে বাপ্পা। মেঝেতে থেবড়ে বসে ঝোলা থেকে পরের পর জিনিস বার করে চলেছে। সঙ্গে চলছে রানিং কমেন্টারি। এই কসমেটিকসগুলো কাকিমা আর পিসির জন্য এনেছি মা। লিপস্টিকের শেডগুলো দ্যাখো, ভাল নয়? তিতির একটা পারফিউম আর দুটো নেল পালিশ আগে বেছে আলাদা করে নিয়েছে। … ডিওডোরেন্টের গন্ধটা শোঁকো। খুব ম্যাচো স্মেল। ছোটকার।… আর অ্যাটমের জন্য এই টিটি ব্যাট। দু সাইডে দু রকম সারফেস। দু রকম স্পিন করবে। …রিস্টওয়াচটা তোমার পছন্দ হয়েছে মা? ডেট্রয়েট থেকে কিনেছি। …সকলের জন্যই মনে করে কিছু না-কিছু এনেছে বাপ্পা। আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব কেউ বাপ্পার লিস্ট থেকে বাদ নেই। এমনকী সন্ধ্যার মাও।

ব্যাগ হাতড়ে একটা লাইটার বার করল বাপ্পা, — এটা দ্যাখো। তিন রকম মিউজিক প্রোগ্রাম করা আছে। মিউজিকের রিদমে নীল ফ্লেম নাচে। শুনবে বাজনা?

ক্লান্তিটা আবার ফিরে আসছিল ইন্দ্রাণীর বলল, –পরে শুনব।

–পরে কেন? শোনো না। বলেই জ্বালাল লাইটারটা। মিষ্টি যান্ত্রিক বাজনায় ভরে গেল ঘর। একটার পর একটা সুর বাজছে।

বাপ্পা চোখ নাচাল, –কী, কেমন?

-খুব ভাল। …বাবার জন্য?

ভাবছিলাম ডাক্তার আঙ্কলকে দেব। বাবার জন্য একটা অন্য জিনিস এনেছিলাম। ম্যারিকান ব্র্যান্ডি। বাবার যা হাল দেখছি শরীরের… ব্র্যান্ডিটা ডাক্তার আঙ্কলকে দিয়ে দিলে কেমন হয়? বাবাকে নয় লাইটারটাই দিলাম। ডাক্তার আঙ্কল তো খায়। খায় না?

কথার ভঙ্গিটা ইন্দ্রাণীর পছন্দ হল না। গম্ভীরভাবে বলল, – ছোটরা বড়দের ড্রিঙ্কসের বোতল দিচ্ছে এটা আমার একটুও ভাল লাগে না বাপ্পা।

বাপ্পা হেসে উঠল, দুর, ব্র্যান্ডি আবার ড্রিঙ্কস নাকি? ও তো ওষুধ।

ইন্দ্রাণী আরও বিরক্ত মুখে বলল, – সে তোমার ধারণা। আমার যা মনে হয় বললাম।

–তুমি না মা এক্কেবারে পিউরিটান। ডাক্তার আঙ্কল মোটেই তোমার মতো মরালিস্ট নয়। দেখো, ঠিক খোলা মনে নিয়ে নেবে।

নেবে হয়তো। যা ইচ্ছে করো।

ইন্দ্রাণী গুম হয়ে গেল। একটু যেন বেশি বেশি সাবালকত্ব দেখাচ্ছে ছেলে। এটা ভাল না মন্দ? নিজেকে মনে মনে ধমকাল ইন্দ্রাণী। দেশবিদেশে ঘোরার সময়েও ডাক্তার আঙ্কলের কথা ভেবেছে ছেলে, তার জন্য কিছু আনার কথা চিন্তা করেছে, এতেই তো তার প্রফুল্ল হওয়ার কথা। বিশ বছরের ওপর মাতাল নিয়ে ঘর করার পর ব্রান্ডি দেখে নাক কুঁচকোনও কোনও মানে হয় না। তবু কেন প্রসন্ন মনে মেনে নিতে পারছে না ইন্দ্রাণী!

ঘরে যেন কোথায় সুর কেটে গেছে। ঝোলা কাঁধে ও ঘরে উঠে গেল বাপ্পা। তিতিরের সঙ্গে কি সব কথা বলছে। স্পষ্ট বোঝা যায় না, মাঝে মাঝে বাপ্পার গমগমে স্বর ঠিকরে ঠিকরে আসে। আদিত্যও ফিরল। তার সঙ্গেও কথা বলছে বাপ্পা। হাসছে। ভাল, ক মাস বাইরে থেকেই বাবার ওপর টান বেড়েছে ছেলের। এমনটাই হোক এক সময়ে মনে মনে চেয়েছিল ইন্দ্রাণী, কিন্তু আজ কেন ওই আনন্দের কলরোল সহ্য হয় না? অংশীদার হতে পারছে না বলে? নিজেকে বিচ্ছিন্ন লাগছে? বাপ্পা এখন ডাকলেও কি ও ঘরে যাবে ইন্দ্রাণী? কক্ষনও না।

খাওয়াদাওয়ার পর মশারি টাঙিয়ে শুয়ে পড়েছিল ইন্দ্রাণী। মাথাটা ভার ভার লাগছে। কন্দর্পর সঙ্গে খানিক আড্ডা মেরে ঘরে এল বাপ্পা। গুঁড়ি মেরে ঢুকল বিছানায়। শুয়েছে।

হঠাৎই ইন্দ্রাণী একটু আড়ষ্ট হয়ে গেল। কত কাল পর ছেলে শুয়েছে পাশে! সেই তিতির হওয়ার পর থেকেই তো ছেলে পাশ ছাড়া। এক সময়ে বাপ্পা গুটি গুটি উঠে আসত মার কাছে, ঝগড়া করে তিতিরকে সরিয়ে দিত, অথবা নিঃসাড়ে শুয়ে পড়ত মার গা ঘেঁষে। কিন্তু এখন যে পাশে এসে শুল, এই বাপ্পা কি সেই বাপ্পা? একটা চাপা পুরুষালি গন্ধ নাকে এসে ঝাপটা মারছে। ইন্দ্রাণীর। অস্বস্তি হচ্ছে। বড্ড কাছ ঘেঁষে শুয়েছে বাপ্পা, একটু সরে যেতে বলবে?

বাপ্পা কথা বলে উঠল, – ঘুমোলে?

ইন্দ্রাণী সাড়া দিল, না।

মশারিটা খুলে দিলে হয় না?

মশা কামড়াবে। কেন?

–মশারিতে শোওয়ার হ্যাবিটটা একদম চলে গেছে। কেমন চাপা চাপা লাগছে। বাপ্পা চিত হয়ে শুল, এ বাড়ির ঘরগুলোও খুব খুপরি খুপরি মা। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। আরেকটু বড় বাড়ি পেলে না?

–এরই ভাড়া দু হাজার।

–তো কি আছে! নয় প্রোমোটারের টাকার সঙ্গে আরও হাজার খানেক অ্যাড করে নিতে। ছোটকার কথা শুনে মনে হয় ছোটকা আজকাল ভালই কামায়। সে না দিলেও তোমার ইন্টারেস্টের টাকা আছে, আমার টাকাও আছে..

কটা তো মাত্র মাস। জুলাই অগাস্টে তো চলেই যাব।

কটা মাস বলেই তো ভাল করে হাত পা ছড়িয়ে থাকা উচিত ছিল।

দীপুর বাড়ি তো এখনও দেখিসনি। ওদের ঘর দুটো আরও ছোট।

ওদের সঙ্গে তুলনা করছ কেন? বড় কাকার ফ্যামিলি মেম্বার কম। আড়াই জন। তাছাড়া বড় কাকা একা ইনকাম করে, সেখানে ফ্যামিলিতে কোনও বাপ্পাও নেই।

ছেলের স্বরটা ভারী অহঙ্কারী শোনাল। নিজেকে জাহির করার প্রবণতা চিরকালই একটু বেশি ছিল বাপ্পার, স্বভাবটা এখনও যায়নি! দেওয়ালের দিকে ঘুরে শুয়ে ইন্দ্রাণী বলল, – নতুন ফ্ল্যাটের ঘরগুলোও এমন কিছু বড় হচ্ছে না বাপ্পা, সেগুলোও তোমার পায়রার খোপের মতো লাগবে।

–তবু সে হল নিজের জিনিস। তিনতলার ওপর, কত আলো-হাওয়া পাওয়া যাবে… অনেক মর্ডানাইজড ঘর। আগে থেকে বলে দিলাম আমার জন্য একটা আলাদা ঘর রাখবে। সাউথ ফেসিং।

ইন্দ্রাণী উত্তর দিল না। চোখ বুজেছে। রাতের দিকে ফ্যানের হাওয়ায় হালকা সিরসিরে ভাব, যেন ফাল্গুনের বাতাসে মাঘের স্মৃতি লেগে আছে। সামনের রাস্তা দিয়ে ঝনঝন করে একটা সাইকেল রিকশা চলে গেল। একঘেয়ে শব্দ তুলে মালগাড়ি যাচ্ছে একটা, যাদবপুরের দিকে চলে যাওয়ার পরও অনেকক্ষণ ধ্বনিটা লেগে রইল কানে।

এ পাশ ফিরে শুয়েও ইন্দ্রাণী টের পাচ্ছিল বাপ্পা উসখুস করছে বিছানায়। মনে মনে হাসল ইন্দ্রাণী। বাপ্পা একটুও বদলায়নি। সামান্য কোনও সুখের ব্যত্যয় সহ্য করতে পারে না ছেলে। বাপ্পা যখন এইটুকুনি ছিল, তনু বলত তোর ছেলেকে আমার হাতে ছেড়ে দিস দিদি। ভাগ্নেকে আমি আমার মতো করে গড়েপিটে নেব! হায় কী দুরাশা!

তনুর কথা মনে পড়তেই ইন্দ্রাণীর নিশ্বাস ভারী হয়ে এল। বাপ্পার কি একটুও মনে নেই তনুর কথা? তনুরই কি মনে আছে? বাপ্পা তো নিশ্চয়ই এখন কদিন থাকবে, ছেলেকে পাঠাবে একবার তনুর কাছে? চুপিচুপি?

ও ঘরে ঘঙঘঙ কাশছে আদিত্য। রাতটা বুঝি ছিঁড়ে গেল কাশির আওয়াজে। কি যেন বলছে তিতির, জলটল দিচ্ছে বোধহয়। থেমে গেছে কাশি। ইন্দ্রাণী আরও একটুক্ষণ কান পেতে রইল। বাপ মেয়েতে আরও কিছু কথা হয় কিনা শোনার চেষ্টা করছে।

অন্ধকারে বাপ্পা নড়ে উঠল, বাবা কিন্তু এবার খুব উইক হয়ে গেছে মা।

–হুঁ। অন্যমনস্কভাবে উত্তর দিল ইন্দ্রাণী।

–একটা কথা বলব? রেগে যাবে না?

–কী?

–হসপিটালে না পাঠিয়ে বাবাকে এবার একটা ভাল নার্সিংহোমে রাখলে পারতে। আরও বেটার চেকআপ দরকার ছিল।

বাপ্পা কি শোনেনি আদিত্যর চিকিৎসায় ইন্দ্রাণী এবার বিন্দুমাত্র অংশগ্রহণ করেনি? নাকি জেনেশুনে মাকে বাজাতে চাইছে? কতটুকু জানে? জানে তার দাদুর মৃত্যুর জন্য মাকে দায়ী করে বাবা? জানে একটা সস্তা মেয়েছেলে এসে বাবাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে গিয়েছিল? চাঁদু বলছিল মেয়েটার সম্পর্কে ইন্দ্রাণীর ধারণা নাকি ঠিক নয়! রঘুবীর ছিল না বলেই মেয়েটা নাকি দেখভাল করছিল দাদার! হুঁহু, দাদার হয়ে সাফাই গায়! তাও যদি না নিজের চোখে দেখত ইন্দ্রাণী!

সেই মানুষটার চেকআপ! ইন্দ্রাণীর ঝামরে উঠতে ইচ্ছে হল, কোনও চেকআপেই তোমার বাবার কিচ্ছু হবে না। আগে তার কুঅভ্যেসগুলো ছাড়াও।

মুখে শুকনো গলায় বলল, কেন হসপিটালে তো ভালই ট্রিটমেন্ট হয়েছে। নার্সিংহোমে এর বেশি কী হত?

–তাও ডিফারেন্স একটা আছে।

–কী ডিফারেন্স? খালি গাদা খানেক খরচা ছাড়া?

খরচার কথা তোমায় কে ভাবতে বলেছে? আমার টাকা তো ছিল।

ইন্দ্রাণী থমকাল সামান্য। ছেলে কী বলতে চায়? তার বাবার চিকিৎসা তার টাকায় করা হয়নি কেন?

মাথা ঠাণ্ডা রেখে বলল, বলছি তো তোর বাবার ট্রিটমেন্টের কোনও ত্রুটি হয়নি। দীপুকে জিজ্ঞেস করে দেখিস, চাঁদুকে জিজ্ঞেস করে দেখিস।

বাপ্পা একটুক্ষণ চুপ থেকে বলল, – বুঝেছি। আমার রোজগারের টাকায় তুমি হাত দিতে চাও না।

সত্যিই তো চাই না। ইন্দ্রাণী ছেলের দিকে ফিরল। আলগা হাত রাখল বাপ্পার মাথায়, তোর একটা ভবিষ্যৎ নেই? আজ বাদে কাল তোর বিয়ে হবে, ঘরসংসার হবে, ছেলেপুলে হবে, তখন তোর এই জমানো টাকা তোর কত কাজে লাগবে বল তো?

–তোমার বড় জেদ মা। ইন্দ্রাণীর হাত সরিয়ে দিল বাপ্পা। উল্টোদিকে ফিরল, শুধু তোমার এই জেদের জন্য কারুর সঙ্গে তোমার কোনওদিন বনিবনা হল না। সাধে কি বাবা কষ্ট পায়!

— কী বলে বাপ্পা! আচম্বিতে ইন্দ্রাণীর বুক শুন্য হয়ে গেল। ফাঁকা, বেবাক ফাঁকা। ছেলে তো দূরে ছিলই, তাকে আর মায়ার বাঁধনে বাঁধতে পারবে না কোনওদিন এও তো জানাই ছিল ইন্দ্রাণীর। তা বলে এত দূরে! মার বিষাদ যন্ত্রণা লড়াই কোনওদিনই কি দেখেনি বাপ্পা! কোন মন্ত্রবলে তার বাবা আজ তাকে এত জাদু করে ফেলল!

তিতির তো সরেই গেছে কবে, বাপ্পাও একটু থাকল না!

তোর টাকায় কেন হাত দেয়নি মা তাও একটু তলিয়ে ভাবলি না! খরখরে চোখে অন্ধকারকে দেখছিল ইন্দ্রাণী। দূরে দূরে তো ভালই ছিলি বাপ্পা, কেন আবার এলি!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *