৮১-৮৫. দুপুরে বিছানায় শুয়ে

খাওয়াদাওয়ার পর দুপুরে বিছানায় শুয়ে চিঠিটা পড়ছিলেন শিবসুন্দর। কমলেশের চিঠি, সকালের ডাকে এসেছে। শিবসুন্দরকে একবার জলপাইগুড়ি যাওয়ার জন্য সনির্বন্ধ অনুরোধ করেছেন কমলেশ। শুধু শিবসুন্দরের জন্যই দোতলায় একটা ঘর তুলে ফেলেছেন, শিবসুন্দর পা রাখলে তবেই নাকি সে নির্মাণ সার্থক হবে। স্মৃতিকণাকে নিয়ে এ বছর আর দক্ষিণবঙ্গে নামা হবে না কমলেশের, স্ত্রীর বাতের ব্যথা বেড়েছে খুব। শিবসুন্দরের শেখানো ব্যায়ামগুলো আর নাকি তেমন কাজ করছে না, এক বৃদ্ধ কবিরাজের সন্ধান পেয়েছেন মাটিগাড়ায়, স্মৃতিকণা এখন তাঁরই চিকিৎসাধীন। একটাই আশার কথা, স্মৃতিকণা নাকি ঈষৎ কৃশ হয়েছেন, এখন তাঁর ঢলঢলে মুখের লাবণী দেখে শিবসুন্দর নিশ্চয়ই মোহিত হয়ে যাবেন! চিঠির শেষে ছোট মেয়ে-জামাইকে নিয়ে একটু অভিমানও প্রকাশ করেছেন কমলেশ। অপারেশনের পর ছন্দাকে বার বার লিখেছিলেন কদিন এসে থেকে যাওয়ার জন্য, এল না ছন্দা। বড় মেয়ে-জামাই তবু আসে মাঝে মাঝে, ছোট জামাই নৈব নৈব চ। শেষবার সেই এসেছিল….। ওড়িশায় বেড়াতে গেল দুটিতে, জলপাইগুড়িতেও তো আসতে পারত। কমলেশের বহুকালের সাধ দুই মেয়ে-জামাই নাতি-নাতনি বেয়াই-বেয়ান সবাইকে একত্রে জলপাইগুড়িতে পাওয়া, আর কি এ জীবনে পূর্ণ হবে সে সাধ।

এরকমই অজস্র আক্ষেপোক্তিতে ভরা চিঠি। পড়তে পড়তে হাসিখুশি প্রাণখোলা মানুষটার জন্য মায়া হচ্ছিল শিবসুন্দরের। মায়া, নাকি অনুকম্পা? কমলেশ বোঝেন না এ পৃথিবীতে কারুর জন্য প্রতীক্ষা করে থেকে লাভ নেই, প্রতিটি মানুষকেই নিজের জীবন নিজেকেই যাপন করতে হয়। নিজেকেই খুঁজে নিতে হয় সুখটুকু, দুঃখকে মেনে নিতে হয়। এখন কমলেশ কর্মহীন জীবন কাটান বলেই কি একাকিত্বের বেদনাটা বেশি বাজে বুকে? চিনে বুড়োরা নাকি মহল্লা পরিষ্কার করা, নাগরিকদের সুখসুবিধা স্বাচ্ছন্দ্য দেখা, স্বাস্থ্যবিধির দিকে কড়া নজর রাখা, এইসব কাজ করে দল বেঁধে। তেমন একটা কিছু গড়ে নিতে পারেন না কমলেশ?

শিবসুন্দর ক্ষণিকের জন্য ভাবলেন এই উপদেশটা পাঠালে কেমন হয়, পরক্ষণে ঝেড়ে ফেললেন চিন্তাটা। উপদেশ দান, নীতিবাক্য শোনানো, পরামর্শ দেওয়া, এসব তাঁর ধাতে সয় না। তবু কমলেশের জন্য একটু কষ্ট বুঝি রয়েই যায়। পিনপিন করে বুকে। ঠিক দুঃখও নয়, এক ধরনের সমবেদনা। ছোট মেয়ে-জামাই-এর বিবাহিত জীবন যে তেমন সুখের নয়, এ কথা কি কমলেশের অজানা? বোধহয় না। তাই হয়তো চিঠি জুড়ে এত অভিমান, এত অভিযোগ।

কার্তিক মাসের আর কটা দিন বাকি। দুপুরের বাতাসেও তেমন তাপ নেই, পাখার হাওয়ায় একটু শীত শীত করে। বিছানা থেকে উঠে পাখা দু পয়েন্ট কমিয়ে দিলেন শিবসুন্দর। পাশে মনোরমা সামান্য গুটিয়ে ঘুমোচ্ছন, পাতলা একটা চাদর টেনে দিলেন স্ত্রীর গায়ে। পুজোর পর হঠাৎ সুগার আবার চড়ে গিয়েছিল মনোরমার, অ্যাটাক যে হয়নি এটাই ভাগ্য। শরীরের মেটাবলিজম নষ্ট হয়ে গেছে, এখন থেকে এটা বোধহয় আরও ঘন ঘন হবে। সুগার অবশ্য নামানো গেছে, তবে মনোরমার ঘুম বেড়েছে খুব। বিকেলে বারান্দায় বসিয়ে দিলেও ঢুলে ঢুলে পড়ে। গত সপ্তাহে ছোট্ট একটা বেডসোর মতন দেখা দিয়েছিল কোমরে, বারে বারে প্রলেপ লাগিয়ে সারিয়েছেন শিবসুন্দর। এই শয্যাক্ষত অসুখটিকে শিবসুন্দরের বড় ভয়, সতর্ক থেকেছেন চিরদিন। কী করে যে হঠাৎ এমনটি হল!

বিছানায় ফিরে শিবসুন্দর চোখ বুজলেন। কমলেশের চিঠি তাঁকে টানছে অল্প অল্প। বহুকাল উত্তরবঙ্গে যাওয়া হয় না, প্রায় ষোলো বছর। এখনও সেখানকার মাটি গাছপালা জঙ্গল বাড়িঘরদোর সবেরই স্মৃতি বড় উজ্জ্বল। উত্তরবঙ্গের অনেক জায়গাই তাঁর ঘোরা। কর্ম উপলক্ষে। শিলিগুড়ি জলপাইগুড়ি আলিপুরদুয়ার কুচবিহার….। তুফানগঞ্জ তাঁকে এক সন্তান উপহার দিয়েছে, বালুরঘাট পুত্রবধু, সেই সুত্রে উত্তরবঙ্গের সঙ্গে তাঁর যেন নাড়ির যোগ। একবার তো ভেবেও ছিলেন শিলিগুড়ি জলপাইগুড়ি কোথাও সেটই করে যাবেন পাকাপাকি। হঠাৎ পুরনো ভিটেটার কথা মনে না পড়ে গেলে হয়তো এখন তিনি….। কী সুন্দর আকাশ ছিল উত্তরবঙ্গে, এখানকার থেকেও যেন অনেক বেশি নীল। এক দিকে কালচে ধোঁয়ার মতো দিগন্ত ব্যেপে হিমালয়, শীতের টোকায় বাদামি শালপাতা ঝরে ঝরে পড়ছে, বিছিয়ে যাচ্ছে পায়ের তলায়, ইউক্যালিপটাসের সরু পাতা শব্দ বাজাচ্ছে ঝুম ঝুম, কালো কালো মাটি, সবুজ ভেলভেটের মতো চা বাগান, আকাশছোঁয়া চিরহরিৎ বৃক্ষের মিছিল, তামাকের ক্ষেত, চ্যাপ্টা চ্যাপ্টা টিনের চালঅলা ঘরবাড়ি…..নাহ, ওখানকার সৌন্দর্যই আলাদা। কী দাপট ছিল বৃষ্টির! কত নদী, কত নদী! মানসাই কালজানি তিস্তা তোসা মহানন্দা জলঢাকা সকলেই উচ্ছল, সকলেই চঞ্চল।…..দুর, এই বাড়িঘর ফেলে শিবসুন্দরের এখন ছোটার উপায় কোথায়! এই নস্টালজিয়াও খুব ভাল কথা নয়, স্মৃতি রোমন্থন বার্ধক্যকে ত্বরান্বিত করে। বেঁচে থাক বাবা শিবসুন্দরের মাধবপুরের রুগীরা, বেঁচে থাক এই সুস্থিত গৃহকোণ।

ঘুমে চোখ জড়িয়ে এল শিবসুন্দরের। রোজই আসে। ঘণ্টা খানেকের মতো। আজ বরাদ্দটা পুরো হল না, টুকির ডাকে ঘুম ভেঙে গেল।

–দাদু, ও দাদু…দাদু গো….

চোখ রগড়ে উঠে বসলেন শিবসুন্দর, -কী হল? ঠেলছিস কেন?

–আমার এরোপ্লেনটা ভেঙে গেল।

–সেকি! কী করে?

জানি না। আমার এবোপ্লেন আর উড়ছে না। টুকির চোখ ছলছল।

 আবিষ্ট চোখে টুকিকে দেখছিলেন শিবসুন্দর। হেমন্তের নরম বিকেলে ঘুম ভেঙেই ওই কোমল মুখখানা, তাতে আবার বিষাদের আভাস, এ যে কী মধুর! বড্ড মিষ্টি দেখতে হয়েছে টুকি। চ্যাপ্টা নাক, ছোট ছোট চোখে যেন জীবন্ত পুতুল। আবার এক নতুন মায়া, গাঢ় মায়া।

শিবসুন্দর টুকির চুল ঘেঁটে দিলেন, তোর বাবাকে গিয়ে বল না। সে তো অনেক খুটখাট জানে, ঠিক করে দেবে।

বাবা নেই গো।

 –গেল কোথায় এখন?

–মায়াপিসিকে নিয়ে বেরোল।

কথাটা কানে লাগল শিবসুন্দরের। বললেন, তুই আগে মায়ামাসি বলতিস না?

মা পিসি বলতে বলেছে।

 শিবসুন্দরের ঠোঁটের ফাঁকে হাসি ফুটে উঠল। অলকার মধ্যেও এই ছেলেমানুষি কেন! তুফানকে কি চেনে না অলকা! নাকি গাঁ-গঞ্জের মুখরোচক আলোচনা এড়াতেই এই পন্থা।

উঠলেন শিবসুন্দর। সিঁড়ি দিয়ে নামছেন পায়ে পায়ে, টুকির হাত ধরে। টুকি সমানে আশঙ্কা প্রকাশ করে চলেছে, দাদা খুব রেগে যাবে, না দাদু?

-কেন? ওটা তো তোর জিনিস।

বারে, দাদা দিয়েছে না!

 –দিয়ে দেওয়ার পরে এখন তো তোর।

–দাদা বলেছিল, তুই দশটা দিনও জিনিসটা টেকাতে পারবি নারে টুকি। হাত নেড়ে নেড়ে টুকি বলছে, দাদার কথাটাই ফলে গেল।

উউহ্, পাকা বুড়ি! নাতনির গালে আলগা চিমটি কাটলেন শিবসুন্দর, তা কদিন টেকাতে পারলি?

–দাদা এসেছিল সোমবার। আঙুলের কড় গুনছে টুকি। এক থেকে একশো মুখস্থ আছে তার, অলকা ছোটখাট যোগবিয়োগও শেখাচ্ছে তাকে, এখন দাদুর কাছে তার অঙ্ক পরীক্ষা।

দাওয়ায় পা ঝুলিয়ে বসলেন শিবসুন্দর, হিসেব পারছিস না তো? আট দিন।…দে, যন্তরটা দে। আমিই এর চোদ্দটা বাজাই।

দৌড়ে ঘর থেকে খেলনাটা নিয়ে এসেছে টুকি। মিনি উড়োজাহাজটা নাড়াচাড়া করছেন শিবসুন্দর। ভাইফোঁটার দিন হঠাৎ এবার টোটো এসে উপস্থিত, একা একাই। হাতে ওই মহার্ঘ খেলনা। ব্যাটারি চালিত। সুইচ টিপে ছেড়ে দিলেই সাঁ করে উড়ে যায় প্লেন, আট-দশ সেকেন্ড শুন্যে পাক খেয়ে ফিরে আসে স্বস্থানে। এরকমই প্লেন চেয়েছিল টুকি, ঠিক মনে ছিল টোটোর। একটু একটু যেন মাধবপুরের ওপর টান জন্মেছে টোটোর। বোনের ওপরেও। কলকাতার সুখস্বাচ্ছন্দ্য কিছুই নেই মাধবপুরে, তবু হুটহাট এখানে চলে আসে। একটা কি দুটো রাত থেকেই অবশ্য পালাই পালাই। তা যাক, টানটা তৈরি হয়েছে, এটাই অনেক। শুভ আর ছন্দা তো সুতো ক্রমশ ঢিলে করে চলেছে।

শিবসুন্দর মাথা ঝাঁকালেন। এও তো কমলেশের মতো ভাবনা! খেলনা উল্টে ব্যাটারিগুলো বার করে ফেললেন শিবসুন্দর, — তোর বাবার টর্চের ব্যাটারিগুলো নিয়ে আয় তো।

টুকি লাফিয়ে উঠে ঘরে গেল। চার সেলের আস্ত টর্চখানা ঘাড়ে করে হাজির।

ধুস, এ টর্চটা কেন, পেনসিল টর্চ নিয়ে আয়।

টুকির মুখ করুণ হয়ে গেল, ওটা কোথায় আমি তো জানি না গো।

শিবসুন্দর উঠতে গিয়েও থেমে গেলেন। সচরাচর তিনি তুফানদের ঘরে ঢোকেন না। অলকা বোধহয় আছে ঘরে, কাজকর্ম সেরে শুয়েছে। গলা খাঁকারি দিয়ে শিবসুন্দর বললেন, তোর মাকে বল না, মা বার করে দেবে।

কাজ হল। অলকা কাঁধে আঁচল গোছাতে গোছাতে বেরিয়ে এসেছে। চোখ ছোট করে বলল, নষ্ট করে ফেলেছে তো? ওই অলবচ্ছি মেয়ের হাতে কিছু দেওয়া উচিত নয়।

টুকি পিটপিট তাকাচ্ছে মার দিকে। দাদুর গা ঘেঁষে বসল।

 শিবসুন্দর আলতো হাতে জড়ালেন টুকিকে, –ওকে বোকো না। ব্যাটারিটা বদলে দেখি।

চার ব্যাটারির খেলনা, দুটো পেনসিল টর্চ লাগল। লাগাতেই ম্যাজিক। মিনি উড়োজাহাজ আবার সচল। সোঁ করে উঠোনের দিকে উড়ে গেল, কামিনী ফুলের গাছটাকে ছুঁয়ে ফিরে এল দাওয়ায়। সিঁড়ির দিকে গেল, ছোট্ট একটা গোঁত্তা খেয়ে সোজা নেমে এল টুকির পায়ের ওপর। টুকি হাততালি দিয়ে লাফাচ্ছে, ঘুরে ঘুরে কাঁচকলা দেখাচ্ছে মাকে। উড়ছে উড়োজাহাজ, উড়ছে উড়ছে, ফিরছে। দেখছেন শিবসুন্দর, দেখছে অলকা।

আনমনে অলকা বলল, — জিনিসটা ভারী অদ্ভুত, তাই না বাবা?

হুঁ।

জাপানি জিনিস তো, বেশ মজবুতও আছে। কত ঠোক্কর খাচ্ছে, কিন্তু ভাঙছে না।

শিবসুন্দর শুনছিলেন না, অন্য কথা ভাবছিলেন। মানুষও যদি এই খেলনাটার মতো হত! সুইচ টিপলেই উড়ে যেত যত্রতত্র, আবার আপনা-আপনি ফিরে আসত ঘরে! প্রথম প্রথম ওই খেলনাটার মতো ফেরে হয়তো, ক্রমে ওড়াটাই নেশা হয়ে যায়। তখন সে হয় উড়তেই থাকে, নয়তো মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে এই দাওয়ায়। এর মাঝামাঝি কিছু নেই। কোন দশা হবে শুভর?

অলকা রান্নাঘরের দিকে এগোল, চা খাবেন বাবা?

–এত তাড়াতাড়ি? বেশ, করো।…আমার চায়ে দুধ দিয়ো না।

ইদানীং দুধ-চা খাওয়া কমিয়ে দিয়েছেন শিবসুন্দর। এক-আধবার অভ্যাসবশে পান করেন বটে, কিন্তু লিকারই এখন তাঁর বেশি পছন্দ। আমেজও আসে বেশ, অম্বলও কম হয়। হৃদ্যন্ত্রে মৃদুতম আঘাতও আর শিবসুন্দর চান না। ইদানীং জীবনের প্রতি তাঁর তীব্র তৃষ্ণা বেড়েছে। মৃত্যুকে তিনি ভয় পান তা নয়, তবুও।

টুকি নতুন উদ্যমে উড়োজাহাজ নিয়ে মেতেছে উঠোনে। শিবসুন্দর সেদিক থেকে চোখ সরিয়ে অল্প গলা ওঠালেন, তুফান নাকি মায়ার সঙ্গে বেরিয়েছে? গেল কোথায়?

রসপুর।

–হঠাৎ?

–একটা বউয়ের হাসপাতালে সিজার হয়েছিল। স্টিচ পেকে গেছে, ডেকেছে মায়াকে। মায়া আজকাল ছোটখাট এসব কাজে যায় এদিক সেদিক, কানে আসে শিবসুন্দরের। সরকারি নার্সদের এ ধরনের কাজে যাওয়ার নিয়মও নেই, প্রয়োজনও নেই, গ্রামসেবিকারাই এসব সামলে দিতে পারে। তবু যায় মায়া। রোজগার বাড়াচ্ছে।

শিবসুন্দর রুষ্ট মুখে বললেন, তা তুফান সেখানে কী করবে?

–আমিই মোপেডে নিয়ে যেতে বললাম। পথ তো অনেকটা।

–এমনকী দূর! মায়ার কোয়ার্টার থেকে বড় জোর তত সাত-আট কিলোমিটার।

 –তাই বা কম কি বাবা? ওদিকটা রাস্তাও তো ভাল নয়।

শিবসুন্দর আরও রুষ্ট হলেন, পার্টির যখন ঠেকা পার্টি নিজে ব্যবস্থা করত। তুফান মিছিমিছি মোপেডের তেল পোড়াবে কেন?

অলকা উত্তর দিল না। চা এনে রেখেছে সামনে।

অলকার দিকে একবার দেখলেন শিবসুন্দর, মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। অলকার অত মায়ার জন্য টেনে বলার কী আছে! খুব সখীর জন্য দরদ, ওদিকে তো মাসি নয়, পিসি! তুফানও ছাগলের ছাগল। অঞ্চলে যখন কথা ওঠে, ওই মেয়েকে পিঠে করে তোর সতেরো জায়গায় বেড়ানোর দরকার কী!

দাওয়ার কোণে দাঁড়িয়ে অলকা চা খাচ্ছে। প্লেটে ঢেলে চা খায় অলকা, একটু একটু শব্দ করে মুখে। কানে লাগে।

শিবসুন্দর সামান্য কড়া সুরে তাকে আদেশ করলেন, – ওপরে একবার তোমার মাকে দেখে এসো তো। যদি জেগে উঠে থাকেন চা দিয়ে দিয়ো।

–যাই বাবা।

আর শোনো। যদি ঘুমিয়ে থাকেন তো পাশ ফিরিয়ে দিয়ে। অনেক কষ্ট করে সোর কমানো গেছে, নতুন করে আর যেন কিছু না হয়।

কাপ-ডিশ রেখে প্রায় দৌড়ে ওপরে উঠে গেল অলকা। তার গমনভঙ্গি দেখে রাগটা নিবে এল শিবসুন্দরের। কেন যে তুচ্ছ কারণে আজকাল স্নায়ুর নিয়ন্ত্রণ হারান? তুফান তো অকারণেই তেল পোড়ায়, তেলের খোঁটাটা না দিলেই হত। ইদানীং প্রেশারের ওষুধ নিয়মিতই খাচ্ছেন তবু যেন খিটখিটে ভাব বেড়েই চলেছে। মায়ার কি উপকার তিনি করেছেন যে মায়াকে নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করেন? খুব খারাপ, ঘোরর অন্যায়। উল্টে তাঁরই তো মেয়েটির কাছে কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। সে এক সময়ে যেচে এ সংসারের হাঁড়ি ঠেলে গেছে। তখন তিনি খুব কাছ থেকে তো দেখেছিলেন মেয়েটিকে, মায়াকে কি খুব লোভী বলে মনে হয়? মোটেই না। প্রত্যাশা হয়তো ছিল, কিন্তু…..। শুধু টাকার লোভে যে ছুটে ছুটে যাচ্ছে মায়া এ তো নাও হতে পারে। হয়তো নিজের নিরাপত্তা আরও দৃঢ় করার জন্য চতুর্দিকে ঘুরে ঘুরে মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করে মায়া। গাঁগঞ্জে এটাও কাজে লাগে বইকি। ধীরে ধীরে মায়া এখানে নিজেকে অনেকটাই মানিয়ে নিয়েছে, নয় কি? চলে যাওয়ার কথা বলে না আজকাল। শুভর নার্সিংহোমে চাকরির কথা তো নয়ই। কিন্তু সোমেনরা কি মায়াকে তিষ্ঠোতে দেবে? পুজোর মরসুম গেল, ওষুধ বিক্রি করে দেওয়া নিয়ে পরোক্ষ বিবাদটা এখন যেন ধামাচাপা পড়ে আছে, কোনওদিন ফুঁসে উঠলেই হল।

অলকা নেমেছে। রান্নাঘরে গেল না, উঠোনের তারে মেলা, কাপড়-চোপড় তুলছে। মনো ওঠেনি নিশ্চয়ই। প্রশ্নটা তাই অলকাকে করলেন না শিবসুন্দর, পিছনের সবজিবাগানে নেমে গেলেন মন্থর পায়ে। কপি পালং কিছুই এখনও বোনেনি অলকা। জমি ঝুরো ব্যুরো করা আছে, এবার বোধহয় চারা পুঁতবে। এত দেরিতে কেন? বেগুন নিয়ে তুফানকে সেদিন কি যেন বলছিল অলকা, এবার কি বেগুন ফলাবে? বেগুনের চারা পুঁতবে, না বীজ? কীভাবে ক্ষেতে বেগুনগাছ হয়? চারা থেকে, না বীজ থেকে?

আপন মনে হা হা হেসে উঠলেন শিবসুন্দর। মানুষের শরীরের কলকবজা ছাড়া আর কিছুই শেখা হল না জীবনে। তাই বা কতটুকু জানেন? প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছর ধরে প্রতিনিয়ত দেখা মনোরমার মস্তিষ্কের রহস্যই ভেদ করতে পারলেন না এখনও। মনোরমার সামনে নিজেকে কখনও কখনও এত অসহায় মনে হয়! আরও কত জানতে হবে মানুষকে, আরও কত শিখতে হবে।

অলকার সবজিবাগান পেরিয়ে পিছনের পুকুরধারে এলেন শিবসুন্দর।, বসতে গিয়েও বসলেন না, পাড় ধরে হাঁটছেন। অনেকটা ভরে আছে পুকুর, সবজেটে জল প্রায় স্থির এখন। না তো, কাঁপছে থির থির। ছোট ছোট অসংখ্য জাফরি দুলছে জলে। জলপোকারা হঠাৎ হঠাৎ রচনা করছে বৃত্ত, একটা জলজ সাপ এঁকেবেঁকে ভেসে গেল। আকাশের ছায়া পড়েছে পুকুরে, কিন্তু মেঘ নেই বলে কিছুই বোঝা যায় না। নিমগাছের ডাল থেকে একটা পাখি ডেকে উঠল। কি পাখি ওটা? ডাকটা যেন চেনা চেনা, অথচ চেনা নয়। কয়েক সেকেন্ড কান খাড়া করে রইলেন শিবসুন্দর। উঁহু, পাখিটা ভারী চালাক। তার নির্জন ডাক শুনবে একজন, সে চায় না বোধহয়। নারকেল গাছ থেকে একঝাঁক টিয়া শুন্যে তুলি বুলিয়ে কোথায় যেন উড়ে গেল। মাঝে মাঝে মৃদু আওয়াজ ছুটে আসছে একটা, টুকির উড়োজাহাজের। ওই ধ্বনিটুকুই যা নিসর্গশোভার ছন্দপতন।

এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে কারুর কি মন চায়!

অলকা খিড়কির দরজায় এসেছে, বাবা, ও বাবা….

শিবসুন্দর ঘুরে তাকালেন।

দিবাকরবাবু এসেছেন। সঙ্গে আর এক জন লোক।

এমন অসময়ে দিবাকরের হানা! শিবসুন্দর ভুরু কুঁচকোলেন, বসতে বলল। আসছি।

চেম্বারের সামনের বেঞ্চিতে বসে আছে দিবাকররা। শিবসুন্দরকে দেখে সসম্ভ্রমে উঠে দাঁড়াল, একটু বিরক্ত করতে এলাম ডাক্তারবাবু।

ভুরুর ভাঁজ এখনও মেলায়নি শিবসুন্দরের। বললেন, –কী ব্যাপার বলল।

জানি আপনি বিকেলে চেম্বার করেন না…এই আমার পিসির দেওরপোপরশু এসেছে, কাটোয়া থেকে। এসেই ধুম জ্বর। চলে যাবে বলে জোরাজুরি করছিল। আমি বললাম, না, ডাক্তারবাবুকে না দেখিয়ে আমি ছাড়ব না।

সঙ্গীটিকে ভাল করে নজর করলেন শিবসুন্দর। বয়স বেশি নয়, বছর পঁচিশ। মুখ লাল হয়ে আছে ছেলেটার, চাপা নিশ্বাসের কষ্ট হচ্ছে বোঝা যায়।

ইচ্ছে হলে শিবসুন্দর এদের সরাসরি ভাগিয়ে দিতে পারেন। দিবাকর তাঁর নামে আড়ালে অনেক নিন্দামন্দ করে। পুকুরটা লিজ চেয়েছিল, পায়নি বলে ভারী তেতে ছিল কিছুকাল। রাস্তায় দেখা হলে অন্যমনস্ক মুখে হেঁটে যেত। ইদানীং ব্যবহার বদলেছে, সামনা-সামনি মাথা নোয়ায়। আজ পিসির দেওরপোকে ভাগিয়ে দিলে কাল থেকে আবার কুচ্ছো গাওয়া শুরু হয়ে যাবে। রাজনীতির লোক, এরা সাপেরও বেহদ্দ। তাছাড়া ছেলেটা ধুঁকছে….

শিবসুন্দর হাঁক পাড়লেন, — অলকা, স্টেথোটা দিয়ে যাও তো। সঙ্গে আমার টর্চটাও।

স্টেথো আসার আগেই ছেলেটাকে নিয়ে পড়লেন শিবসুন্দর। নাড়ি পরীক্ষা করলেন। জ্বর ভালই আছে, দুই-টুই হবে। গলার গ্ল্যান্ড দুটো দেখলেন টিপে টিপে। ফুলেছে বেশ, জিজ্ঞাসা করলেন, কাশি আছে?

দিবাকর বলে উঠল, — তেমন নয়।

-ঠাণ্ডা লেগেছে। ওষুধ-টোষুধ খাওয়া হয়েছে কিছু?

আজ্ঞে না ডাক্তারবাবু। এবারও দিবাকরের উত্তর, ওরা হোমিওপ্যাথির ভক্ত। ট্যাবলেট দিতে চেয়েছিলাম, খায়নি।

-তাহলে আমার কাছে আসা কেন? আমার ওষুধও তো খাবে না।

–সে আমি ঘেঁটি ধরে খাওয়াব। আপনার ওষুধ না খাওয়া মানে মাধবপুরকে অসম্মান করা। সে আমি সইব কেন?

তেল মারা কথাবার্তা! শিবসুন্দর মৃদু ধমক দিলেন, এই, তুমি চুপ করো তো। রুগী কে, অ্যাঁ?

দিবাকর থতমত খেয়ে থেমে গেল।

স্টেথো এসে গেছে। বুক পিঠ দেখে নিলেন শিবসুন্দর। টর্চ জ্বেলে দু চোখের কোনা দেখলেন, হাঁ করিয়ে ফ্যারিঙ। যা ভেবেছেন তাই। সিজন চেঞ্জের জ্বর।

চেম্বার খুলে চেয়ারে বসেছেন শিবসুন্দর। প্রেসক্রিপশান লিখছেন। দিবাকর বেশিক্ষণ চুপ থাকতে জানে না। গলা ঝেড়ে বলল, – আজ দুপুরের খবরটা শুনেছেন ডাক্তারবাবু?

–কেউ মারা-টারা গেল নাকি?

–এমন অফসিজনে কেউ মারা যায়? মরবে তো সব শীতে, পটাপট লাইন পড়ে যাবে। দিবাকর কথা বলতে শুরু করেছে, এখন তাকে থামানো কঠিন। চোখেমুখে এক অদ্ভুত ব্যঞ্জনা ফুটিয়ে বলল, আজ আবার আমাদের গভর্নমেন্ট ফর্ম হল।

কাগজে শিবসুন্দর দেখছিলেন বটে আগের রুলিং পার্টির একটা ভগ্নাংশ বেরিয়ে এসে সরকার গড়তে চাইছে দিল্লিতে, কিন্তু দিবাকর তো সে পার্টির লোক নয়!

শিবসুন্দরের মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল, তোমরা গভর্নমেন্ট করেছ?

–ঠিক আমরা নই। আবার আমরাই। পেছন থেকে আমরাই সরকার চালাব। যখন চাইব রাখব, যখন চাইব না উল্টে দেব।

— শিবসুন্দর আড়ে একবার দেখে নিলেন দিবাকরকে, কোনও মন্তব্য করলেন না। ছেলেটিকে বললেন, – ওষুধ বুঝে নাও। প্রথমটা ক্যাপসুল, দিনে তিন বার, পাঁচ দিন। খালি পেটে নয়, মোটামুটি আট ঘণ্টা ছাড়া-ছাড়া। ভিটামিনটা সকালে খাবে। ভাত খাও, কিন্তু চান নয়। মানে যতক্ষণ গায়ে জ্বর আছে। আর সব এমনি খাওয়া দাওয়া। নরমাল। তেলমশলা কম খাওয়াই ভাল। প্রেসক্রিপশান ছেলেটার দিকে বাড়িয়ে দিলেন শিবসুন্দর, গলায় একটা ইনফেকশান হয়েছে। তিন নম্বর ওষুধটা উষ্ণ উষ্ণ জলে ফেলে দিনে অন্তত চার বার গার্গল করবে…

দিবাকর আবার বলে উঠল, এবার সোমেনদের খুব টাইট দিয়ে দেব।

শিবসুন্দর এড়াতে চাইলেন প্রসঙ্গটা। বললেন, হুউ।

— হুঁ না ডাক্তারবাবু। এবার ওদের ছুঁড়ে বঙ্গোপসাগরে ফেলে দেব।

দিয়ে?

 দিবাকর যেন একটু ফাঁপরে পড়ে গেল। তার কথায় অনেকে হাঁ হাঁ করে ওঠে, অনেকে ভীষণ খুশি হয়, তবে এই প্রশ্নটা বুঝি কেউ করেনি কোনওদিন। মাথা চুলকে বলল, – দেখবেন, দেখবেন কী হয়। ধান কাটার সিজন এল বলে, সোমেনদের পাটুটিবাজি করা বার করে দেব। নিজের লোক দি ক্ষেতের ধান তুলিয়ে যাবে, আর আমরা বসে বসে বুড়ো আঙুল চুষব, এবার আর সেটি হচ্ছে না।

দিবাকরের কথা বলার ভঙ্গিটি প্রায় তামসিক। কিন্তু কথাগুলো পুরোপুরি মিথ্যে নয়। গ্রামের অবস্থা অনেকটা বদলে গেছে ঠিকই, তবু কোথায় যেন আগের সঙ্গে একটা মিল ঘোচেনি। জোতদার-মহাজনরা ঠিক আগের চেহারায় নেই বটে, আবার যেন আছেও। পঞ্চায়েতের কেষ্টবিষ্ণুরাই যেন এখন অপ্রত্যক্ষ জোতদারের ভূমিকায়। আগে জোতদাররা টাকা ধার দিয়ে সুদে বাঁধত গরিবগুরবোদের, আর এরা এখন সার বীজ কৃষিঋণ দিয়ে ভোটের বাক্সে বেঁধে রাখে। প্রতিবাদহীন আনুগত্য চাই। আমার বাক্সে যদি বাঁধা থাকো, তো আছ। নাহলে তুমি কোথাও নেই। সার চাইতে গেলে হয়রানি, বীজ চাইতে গেলে হয়রানি, কর্জ চাইতে গেলে হয়রানি। সোমেনরা বোঝে না এতে তারা নিজেরাই ক্ষয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। একদিন হয়তো এদের জোতদার জমিদারদের থেকেও বেশি ঘেন্নার চোখে দেখবে মানুষ।

তবু দিবাকরকে আমল দিতে রাজি নন শিবসুন্দর। উঠে পড়লেন।

দিবাকর ফিসফিস করে বলল, – সোমেন একটা কালার টিভি কিনেছে, জানেন ডাক্তারবাবু।

 শিবসুন্দর বিরস মুখে বললেন, সে তো তোমারও আছে।

দিবাকরের বাদামি চোখের মণি পলকের জন্য জ্বলে উঠেই নিবে গেল। যেন শাটার টিপে মন ক্যামেরায় ছবিটা তুলে রাখল শিবসুন্দরের। ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল, – আমাদের তো তিন পুরুষের পয়সা ডাক্তারবাবু। শুধু কালার টিভি কেন, ভিসিপি-ভিসিআর সবই আমাদের ঘরে আছে। আমরা তো আর ইঁদুরের মতো গর্তে একটা একটা করে ধান সরিয়ে পয়সা করিনি।

শিবসুন্দরের বলতে ইচ্ছে হল, তোমরা মরাইকে মরাই ধান সাফ করতে পারো, তাই তো? না বলে ছেলেটির পিঠে আলগা চাপড় দিলেন, যাও, বাড়ি গিয়ে শুয়ে পড়ো। কালও হয়তো খুব একটা উন্নতি হবে না শরীরের, তবে পরশু থেকে…।

দিবাকররা চলে যাওয়ার পর দোতলায় এলেন শিবসুন্দর। বিকেল পড়ে আসছে, পশ্চিম দিগন্তে গোলাপি হয়ে গেছে আলো। একটা কাক খুব নিচু দিয়ে ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে চলে গেল, বাসাটা ঠিক ঠাহর করতে পারছে না বোধহয়। দূরের হলুদ হয়ে আসা ধানক্ষেত এবার ধীরে ধীরে ঢেকে যাবে কুয়াশায়। কালস্রোতে আর একটা দিন ভেসে গেল।

শিবসুন্দরেরও আয়ু থেকেও খসে গেল একটা দিন। গতানুগতিক দিন। সেই চেম্বার, রুগী, সেই মনোরমা, একটু বিশ্রাম, একটু ভাবনা, অলকা তুফান টুকি, সেই অপছন্দের তর্কবিতর্কে ঢুকে যাওয়া….ক্লান্তি আসে শিবসুন্দরের, বড় ক্লান্তি আসে আজকাল। বিকেলের পিপাসা মরে আসে সন্ধেয়।

অন্ধকার নামার পর তুফান ফিরল। শিবসুন্দর তখন দোতলার বারান্দায় ইজিচেয়ারে বসে নোতা সুজি খাচ্ছেন। মাদ্রাজি রান্না, খবরের কাগজের পাতা দেখে শিখেছে অলকা। পিছনের বাগানে কারিপাতার গাছ লাগিয়েছে অলকা, পাতা ছিঁড়ে দিয়েছে রান্নায়।

মোপেডের গর্জন থামিয়ে দুপ দুপ ওপরে উঠে এল তুফান।

 শিবসুন্দর টেরিয়ে তাকালেন, – তোর রসপুর ভ্রমণ হল?

–সে তো কখন ফিরেছি। মোড়া টেনে বসল তুফান, শ্মশানের সেই সাধুটার কাছে গেছিলাম বাবা।

–কোনটা? যেটা কালীপুজোর দিন আড্ডা গেড়েছে?

–একটাই তো আছে এখন। বাবাটা অদ্ভুত এক যোগ দেখাল। পদ্মাসনে বসে কীভাবে শরীরটাকে….

–অ্যাই, কদ্দিন না বলেছি, আমার সামনে তুই সাধুদের বাবা বাবা বলবি না! আমি আইডেনটিটি ক্রাইসিসে ভুগি।

তুফান হেসে ফেলল। পা মুড়ে মুড়ে হাঁটুর আড় ছাড়াচ্ছে। বলল, -বাবা, খবর শুনেছ?

কী, দিল্লির নতুন গভর্নমেন্ট? শুনেছি।

–তুস, ও খবরে আমার ইন্টারেস্ট নেই।

 ক্ষণিক রাজনৈতিক উন্মাদনা বহুকাল আগেই কেটে গেছে তুফানের। বাবার সামনে রাজনীতির কথা তুলতে এখন সে লজ্জা পায়। হাসতে হাসতে বলল, পলাশ ডাক্তার তো চলল।

-তাই নাকি? মাত্র তো মাস কয়েক হল এসেছে।

–তলে তলে ট্রান্সফারের চেষ্টা করছিল। হেলথ ডিপার্টমেন্টের এক মুরুব্বিকে ধরেছিল, কলকাতার দিকে পোস্টিং পেয়ে গেছে। বারুইপুরে।

-তোকে কে বলল? মায়া?

 ঘাড় দোলাল তুফান, মায়া খুব চিন্তায় পড়ে গেছে বাবা। পলাশ ডাক্তার ছিল, তাও একটা বল ছিল মেয়েটার।

কারুর ভরসায় বল তৈরি হলে সে বল টেকে না রে।

–সবাই তো তোমার মতো ডাকাবুকো নয় বাবা।

–আমি ডাকাবুকো! হা হা। শব্দ করে হাসছেন শিবসুন্দর। আধো অন্ধকার বারান্দা যেন আলোকিত হয়ে উঠছে হাসিতে। বললেন, বড়জোর বলতে পারিস আমি কখনও কাউকে তেলটেল মারিনি। তার জন্য সাফার যা করার সে আমিই করেছি, কাউকে ব্লেম দিয়েছি কখনও? দু বছর-তিন বছরের বেশি কোনও জায়গায় আমায় রাখেনি, কখনও ওপরতলার সঙ্গে ঝগড়া করতে পেরেছি? ডাকাবুকোই বল আর সাহসীই বল, মানুষ কখন সেটা হতে পারি জানিস? যখন মানুষ নিজের চাহিদাকে ছোট করে নিতে পারে। বাঁকুড়া মেডিকেল কলেজে পড়াতে গেলাম, সেখানেও সেই দুটো বছর….

–ঠিক আছে বাবা তাই। মানছি। তোমার মনের জোর ছিল। কিন্তু সবার তো সে জোর না থাকতেও পারে। তুফান অন্ধকার আমগাছটার দিকে তাকাল, –মায়া আবার অ্যাপ্লিকেশান করছে।

করুক। ও-ও হয়তো পেয়ে যাবে। শিবসুন্দর হাসলেন, সোমেনদের গিয়ে ধরতে বল, আরও তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে।

–তুমি বড় জিদ্দি বাবা।

শিবসুন্দরের হাসিটা মিলিয়ে গেল। নিয়ম মেনে চলাটাকে কেন যে এরা অন্য চোখে দেখে? শুভর নার্সিংহোমে গড়াটাকেই তিনি কখনও সমর্থন করেননি, সেখানে তিনি মায়ার চাকরির জন্য বলেন কী করে? এতটা আপোস কি তাঁর পক্ষে সম্ভব? বরং মেয়েটার যদি কোনও বিপদ হয়, এখানেই তিনি মেয়েটাকে প্রাণপণে আগলানোর চেষ্টা করবেন। পলাশ ছেলেটাই বা কী রকম? এত সৎ সৎ শুনতেন, সে মুরুব্বি ধরে পালায় কেন? নিজের গাটুকু বাঁচিয়ে সতোর আভরণ পরে থাকা, এও তো কাপট্য! এক ধরনের পলায়নী মনোবৃত্তি!

ভার গলায় শিবসুন্দর বললেন, তোরা আমার দিকে আঙুল দেখাস কেন, নিজেরা শুভকে বলতে পারিস না?

তুফান উত্তর দিল না। নখ খুটছে। চলে যাচ্ছিল, শিবসুন্দর পিছু ডাকলেন, বিকেলে দিবাকর এসেছিল। এক আত্মীয়কে দেখাতে। …. খুব খোশমেজাজে আছে দিবাকর।

থাকবে না! কটা দিন যেতে দাও, ধানকাটার সময় তো আসছে….দিবাকররা এবার খুব বড় গণ্ডগোল পাকাবে। জগদীশ পাড়ই, শ্যামা মুখুজ্যে, সবার জমিতে নতুন বগা রেকর্ড করিয়েছে সোমেনরা, দিবাকর তেতে আগুন হয়ে আছে। লাঠি সড়কি ছেড়ে এবার না গুলিগোলা চলে।

–আমার তো লাভই রে। সকাল বিকেল চেম্বারে কেস আসবে।

 –না। ওসব কেস তুমি করবে না। হাসপাতালে পাঠিয়ে দেবে। ফালতু টেনশান নেওয়া…. উত্তরের অপেক্ষা না করে নেমে গেল তুফান। শিবসুন্দরও উঠে ঘরে এলেন। গত সপ্তাহে দুটো বিদেশি জানাল এসেছে, বসলেন সে দুটো নিয়ে। সন্ধ্যাবেলা আজ কল নেই, একটু পড়াশুনোর সময় পাওয়া গেছে। হেপাটাইটিস বি-র ওপর কিছু গবেষণা হয়েছে, ডুবে গেলেন তাতে।

অলকার সাড়া পেয়ে মগ্নতা ভাঙল। মনোরমার খাবার এনেছে অলকা। সযত্নে শাশুড়িকে খাইয়ে পরিপাটি করে শুইয়ে দিল। দরজায় গিয়েও দাঁড়িয়ে আছে।

শিবসুন্দর তাকালেন।

অলকা অস্ফুটে বলল, সামনের মাসে দু-তিন দিনের জন্য বাপের বাড়ি যাব ভাবছি।

শিবসুন্দরের ভুরুতে ভাঁজ।

অলকা আবার বলল, আমার খুড়তুতো বোন….শ্যামলীর বিয়ে।

–ও। যেয়ো।

কাকা চিঠি দিয়েছে। নেমন্তন্ন করতে আসবে। আপনাকেও যেতে বলবে। একবার যাবেন বাবা?

–আমি! কী করে যাব?

–একবার গিয়ে দাঁড়িয়ে চলে আসবেন। সবাই ভীষণ খুশি হবে।

অলকাকে মুখের ওপর না বলতে বাধল শিবসুন্দরেরচাপাডাঙা এমন কিছু বিলেত আমেরিকা নয়, তুফানকে রেখে একবেলার জন্য যাওয়াই যায়। অলকার বাপের বাড়ির লোকের সুক্ষ্ম অভিমান আছে তুফানের বাবা খুব নাকউঁচু মানুষ। এ ধারণাটা ভেঙে দিয়ে আসা দরকার। অলকার দাদার বিয়েতেও যাব যাব করে যাওয়া হয়নি।

শিবসুন্দর ঘাড় নাড়লেন, দেখি, তখন তোমার মার শরীরস্বাস্থ্য কেমন থাকে।

খাওয়াদাওয়া সারতে সাড়ে নটা বেজে গেল। ওপরে উঠে আসার আগে শিবসুন্দর দেখলেন ঘুমিয়ে পড়েছে টুকি, ঘুমন্ত হাতে আঁকড়ে ধরে আছে খেলনা এরোপ্লেনটাকে। দৃশ্যটা ক্ষণিকের জন্য ছুঁয়ে গেল হৃদয়কে।

সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে শিবুসুন্দরের মনে নতুন এক ভাবনা এল। মাধবপুরের বাড়ি-জমি টুকি, আর টোটোর নামে লিখে দিলে কেমন হয়! তুফান অলকাই নয় সারা জীবন দেখাশুনা করল। শুভর সঙ্গে তুফানের গ্রন্থিটা পুরোপুরি ছিঁড়বে না কোনওদিন, জানেন শিবসুন্দর। টুকি আর টোটোকে এমন একটা বাঁধনে বেঁধে ফেললে কেমন হয়!

আইডিয়াটা শিবসুন্দরের মাথায় বহুক্ষণ নড়াচড়া করল।, মন্দ নয়, এমনটি করাই যায়। শুভর মনেও যদি কোনও আহত ভাব এসে থাকে, সেটাও হয়তো এই বন্দোবস্তে কেটে যাবে।

রুটিন মতো মনোরমার রক্তচাপ মাপছেন শিবসুন্দর। ভাবছেন। মশারি টাঙিয়ে দিলেন। ভাবছেন। নিজের ওষুধগুলো খেলেন একে একে। লিখলেন দিনপঞ্জি।

একটা জানলার পাট খোলা। দ্রুত ঠাণ্ডা হয়ে আসছে ঘর। জানলাটা বন্ধ করতে গিয়েও করলেন না শিবসুন্দর, পাখা অফ করে দিলেন। এসেছেন বিছানায়। বেডসুইচ নিবিয়ে আলগা হাত রাখলেন মনোরমার মাথায়। ফিসফিস করে বললেন, – শুভকে তো আমরা কাছে টানতে পারলাম না, শুভর ছেলেটাকে একবার চেষ্টা করে দেখব? তুমি কী বলো?

শরীরে একটা বস্তুর স্পর্শ পেয়ে নড়ে উঠেছেন মনোরমা।

শিবসুন্দরের স্বর গাঢ় হল, কষ্টের কথা তুমি ছাড়া আর কাকে বলি মনো? বুকটা হঠাৎ হঠাৎ কেমন খামচে ধরে। শ্বাস আটকে আসে। আমি কি ফুরিয়ে যাচ্ছি মনো? শুভরা যদি ঘন ঘন একটু আসত…..। আমার কাছে নয় নাই এল, তোমার ছেলে তোমার কাছে তো আসতে পারে।

.

ঠিক সেই সময়ে একশো কিলোমিটার দূরে সেলিমপুরের এক ছোট্ট ঘরে বসে আছে শুভাশিস। রাত প্রায় পৌনে এগারোটা। এখনও সে নিচু স্বরে বিনবিন করছে। সামনে ইন্দ্রাণী, দু চোখ তার বিস্ফারিত।

.

৮২.

ক্ষণিকের জন্য সমস্ত স্নায়ু অসাড় হয়ে গিয়েছিল ইন্দ্রাণীর, ক্ষণ পরে চেতনা ফিরল। সঙ্গে সঙ্গে এক তীব্র অভিমানে ছেয়ে গেছে বুক। বিপ্লব কি শুধু নিষ্ঠুরতা শেখায়! আসতে হবে না তনুময়কে, পা রাখতে হবে না এই শহরে। হৃদয়ের একটা কুঠুরি চিরকালের মতো বন্ধ করে দেবে ইন্দ্রাণী, ভুলেও আর তনুময়ের কথা মনে আনবে না। বাবা-মার কাছেও যেমন জীবত আছে, তেমনই না হয় থাক তনু। কেন আবার তাদের নতুন করে আঘাত দেওয়া!

শুভাশিস বসে আছে চেয়ারে, সিগারেট ধরিয়েছে। আঁকাবাঁকা ধোঁয়ার রেখা পাখার বাতাসে একটু দুলে উঠেই মিলিয়ে যাচ্ছে, হারিয়ে যাচ্ছে। তবু যেন রয়ে যায় ধোঁয়া, অদৃশ্য উপস্থিতি তার ভারী করে তোলে বাতাস। কার্তিকের শেষ এখন, রাতের দিকে এ সময়ে পাখার হাওয়ায় শীত শীতও করে বেশ, তবু এই হাওয়াটুকু না থাকলে ইন্দ্রাণীর বুঝি দম বন্ধ হয়ে যেত।

ঘরের দরজা খোলা। ডাইনিং টেবিলে খেতে বসেছে তিতির, একাই। নীরবে। এখান থেকে মেয়ের শুধু পিঠটুকু দেখা যায়। প্রায় সোজা হয়ে বসে আছে তিতির, ঝুঁকছে না টেবিলে। আদৌ খাচ্ছে কি? অজান্তেই দেওয়াল ঘড়ির দিকে চোখ গেল ইন্দ্রাণীর, এগারোটা বাজতে যায়।

শুভাশিস নড়েচড়ে বসল। গলা খাদে নামিয়ে বলল, কিছু একটা বলো রানি।

কী বলব?

ভাবছটা কী?

–কিছু না। ইন্দ্রাণী আবার ঘড়ির দিকে তাকাল, রাত অনেক হল, তুমি বাড়ি যাবে না?

শুভাশিসের দৃষ্টি বুঝি মুহূর্তের জন্য ভেদ করে গেল ইন্দ্রাণীকে। একটু পরে নিশ্বাস ফেলে বলল, আমার বোধহয় তাকে জোর করে ফিরিয়ে আনা উচিত ছিল। আসলে আমি নিজেই এত মেন্টালি এক্সাইটেড হয়ে গেলাম। …জানো, আমাদের চলে আসার দিনও ও গেস্টহাউসে দেখা করতে এসেছিল। বলেছিল চাইলে ও দুকলম লিখে দিতে পারে। তোমাকে।

ইন্দ্রাণী ভুরু কুঁচকে তাকাল।

বুঝলে না, বিবেকের তাড়না। আফটার অল সে তো একটা এসকেপিস্ট ছাড়া কিছু নয়।

ইন্দ্রাণীর মনে হল শুভাশিসের কথায় তেমন প্রত্যয়ের ছাপ নেই। যেন নিজেই নিজেকে শব্দের ভিটামিনে উজ্জীবিত করতে চাইছে শুভ। যত অভিমানই হোক, এখনও তনুকে ঠিক পলায়নবাদী ভাবতে মন যেন সায় দেয় না। পালিয়ে যাওয়া কাকে বলে? যে বিশ্বাসে স্থির থেকে জাগতিক মায়ামমতাকে দু পায়ে মাড়িয়ে যায় সে পলাতক? নাকি যে বেঁচে থাকার জন্য বিশ্বাসহীনতাকেই দুহাতে আঁকড়ে থাকে, সে?

শুভাশিস বিড়বিড় করে বলল, সে চিঠি আমি রিফিউজ করেছি রানি। বলেছি দরকার হলে তুমি নিজে আসবে। আমি কি ভুল করেছি?

নিঃশব্দে দু দিকে মাথা নাড়ল ইন্দ্রাণী।

–যদি চাও তোমাকে সেখানে নিয়ে যেতে পারি। … একাও যেতে পারো।

–দেখি।

দ্যাখো ভেবে।

শুভাশিস উঠে পড়ল। খাওয়ার জায়গায় গিয়ে মেয়ের কাঁধে হাত রেখে কি যেন বলছে হেসে হেসে। মাথা তুলল না মেয়ে, আড়ষ্টভাবে কি একটা উত্তর দিল। দরজায় দাঁড়িয়েও ওদের কথা শুনতে পাচ্ছিল না ইন্দ্রাণী। অথবা তার শ্রবণেন্দ্রিয় ঠিক ঠিক কাজ করছিল না। মাস খানেক পরে এসেছে শুভ, মেয়ে তার সামনে সামান্যতম সৌজন্যও দেখাচ্ছে না, এ ঘটনাও তাকে নতুন করে আহত করছে না আজ। পলকের জন্য শুধু মনে হল তনুর অভিমান তিতিরেও চারিয়ে গেল!

উঁহু, এ বুঝি নিছকই মনের ভুল। এক পাপবোধ থেকে মুক্তি পেলেই বোধহয় আর একটা পাপবোধের জন্ম হয়। অথচ তনুময় চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে এসব পাপবোধের সব কারণই মনগড়া। অলীক। তিতিরের আচার-আচরণ বদলে গেছে ঠিকই, কিন্তু তার আরও অজস্র হেতু থাকতে পারে। এই বয়সের মেয়েদের পছন্দ-অপছন্দের বোধ হঠাৎ তীক্ষ্ণ হয়ে যায়। হয়তো কোনও আপন কারণে শুভকে আর ভাল লাগছে না তিতিরের। হয়তো আদিত্যর সঙ্গে শুভর এত অমিল বলেই…।

কোন আপনজনের সঙ্গই বা আজকাল পছন্দ করে তিতির? এক আদিত্য ছাড়া? মানিকতলায় এবার বিজয়ার প্রণাম পর্যন্ত করতে গেল না। চাঁদুও কত দুঃখ করছিল সেদিন। তিতিরটা কেমন চোয়াড়ে হয়ে যাচ্ছে বউদি, কোনও কথার সোজা জবাব দেয় না! দীপুর বাড়িই কি যায়? অ্যাটমকে পর্যন্ত ভুলে গেছে! ভাইফোঁটার দিন জয়িরা এসেছিল, কী দায়সারাভাবে ঝান্টুকে ফোঁটা দিল তিতির! দাদার জন্য মন কেমন করছিল তিতিরের? বাজে কথা। দাদাকে তাহলে দু লাইনও চিঠি লেখে না কেন?

গ্রিলদরজায় তালা লাগিয়ে এসে ইন্দ্রাণী দেখল তিতিরের খাওয়া শেষ, আবার সেঁধিয়ে গেছে বাবার ঘরে। আদিত্যবাবু আজ সন্ধে সন্ধে ফিরে এসেছেন, বিছানায় এখন নিমীলিত চক্ষু, তাঁর সামনে বইখাতা ছড়িয়ে বসেছে তিতির। টেস্টের প্রস্তুতি। কী ছাই পড়ে কে জানে, প্রিটেস্টে ওই তো রেজাল্টের ছিরি! টিউটোরিয়ালটা কি খুবই ওঁচা, নাকি তিতিরই ফাঁকিবাজ হয়ে গেছে? কতকাল তার কাছে বইখাতা নিয়ে বসে না তিতির, এবার কড়াভাবে চেপে ধরতে হবে মেয়েকে।

নিজের চিন্তায় নিজেই ইন্দ্রাণী শিহরিত হল সহসা। এই মুহূর্তে তিতিরকে নিয়ে এত কেন ভাবছে সে? তনুময়ের ভাবনা এড়াতে চায় বলেই কি? চেষ্টাটা কি বেশি হাস্যকর হয়ে যাচ্ছে না? কোথায় সে ঠাণ্ডা মাথায় স্থির করবে উড়ে আসা আগুনের ফুলকিটা চিরতরে বুকের গোপন প্রকোষ্ঠে চালান করে দেবে কিনা, তা নয়…। বাবা-মাকে কিছুই না জানানো উচিত হবে কি? তাঁদের এত লম্বা প্রতীক্ষা বিফলে যাবে? কিন্তু জানলে তাঁরা…?

উচিত অনুচিতের দ্বন্দ্বে জীর্ণ হচ্ছে ইন্দ্রাণী, একা ঘরে ছটফট করছে। এক সময়ে গলা চড়াল, তিতির, শোন।

তিতির অলস পায়ে দরজায় এসেছে।

–তোর বাবার খাওয়া হয়েছে?

না।

–ঘুমিয়ে পড়েছে?

–বোধহয় না।

বল মা খেতে ডাকছে।

থালা সাজিয়ে খেতে বসেছে দুজনে। এক সঙ্গে। এ বাড়িতে এই দৃশ্য এখন অতি বিরল। আদিত্য বসেছে সঙ্কুচিতভাবে, কিন্তু খাচ্ছে গপগপিয়ে। ইন্দ্রাণী অনাড়ষ্ট, অথচ তার মুখে কিছু রুচছে না। কপির ডালনায় রুটির টুকরো ডুবিয়ে গরাস তুলল। মুখে কচকচ ডেলা পাকিয়ে যাচ্ছে রুটি, ঢকঢক জল খেয়ে নিল খানিকটা। আদিত্যর নিরুদ্বেগ খাওয়া দেখে ঈর্ষা হচ্ছিল ইন্দ্রাণীর। ওই গা-ছাড়া দেওয়া মানুষটা কী সুখী!

ইন্দ্রাণী ভার গলায় বলল, আজ ছাইপাঁশ গিলে আসোনি যে বড়?

আদিত্য মুচকি হাসল। লাস্ট বেঞ্চের মেয়ে কোনও একদিন প্রশ্নের উত্তর দিয়ে ফেলতে পারলে যেমনটি হাসে, অবিকল সেই হাসি।

ওই হাসিতেই ইন্দ্রাণী যেন একটু সহজ হল। মনের চিন্তাটা একপল নাড়াচাড়া করে বলল, আচ্ছা, তুমি না বলেছিলে কাশীতে কোন সাধুকে দেখে মা খুব আপসেট হয়ে গিয়েছিল?

-হুঁ। সেই সামলাতে যা ধকল গেছে! জ্বর, ডিলিরিয়াম, বাপস্।

 –আচ্ছা.. ধরো, সেদিন যদি সাধুটা সত্যি সত্যি তনু হত, তাহলে মার কী রিঅ্যাকশন হত?

–মানে? আদিত্য ফ্যালফ্যাল চোখে তাকাল।

-আমি কি গ্রিক ল্যাটিন কিছু বলেছি? প্রশ্ন ঠিকমতো বোঝাতে না পেরে অল্প তেতে গেল ইন্দ্রাণী। পরক্ষণে সামলে নিয়ে বলল, মানে বলছিলাম সাধুটা সত্যি সত্যি তনু হলে সে তো আর মার আঁচল ধরে সুড়সুড় করে ফিরে আসত না, তখন মা কী করত?

এমন কঠিন প্রশ্ন বুঝি জন্মে শোনেনি আদিত্য। মুখভাব আমূল বদলে গেছে তার। বুড়ো আঙুল ঘষে ঘষে থালার মধ্যিখানটা চকচকে করে ফেলল। ভুরু ভাঁজ হচ্ছে, খুলছে। পিটপিট করছে। চোখ। ঘ্যাস ঘ্যাস মাথা চুলকে বলল, আমার মনে হয় সেটা খুব খারাপই হত।

–কেন?

–বারে, রবি ঠাকুর পড়োনি? পেয়ে হারানোর চেয়ে না পাওয়া ঢের ভাল।

রবীন্দ্রনাথ কোথায় এমন উক্তি করেছেন মনে পড়ল না ইন্দ্রাণীর। সামান্য ঝেঁঝে বলল, রবীন্দ্রনাথের কথা জানতে চাইনি। তোমার মত বলল।

–আমারও সেই মত। আবার মুচকি হাসল আদিত্য, আমার মত বললে তো তুমি মানবে না, তাই রবি ঠাকুরের নাম করলাম।

উফ, এই মানুষের সঙ্গে আলোচনা করাই বৃথা। তবু মতামতটা পুরো ঝেড়ে ফেলল না ইন্দ্রাণী। হয়তো নিজের সঙ্গে মিলে গেছে বলেই। উমাকে অনেক শক্তপোক্ত বলে মনে হত ইন্দ্রাণীর, কাশীর ঘটনাটায় সে ধারণা চুরচুর হয়ে গেছে। নির্ঘাত মা নতুন ধাক্কা সইতে পারবে না।

ইন্দ্রাণী চোখের কোণ দিয়ে দেখল আদিত্যকে, আর বাবা হলে ওই পরিস্থিতিতে কী করত?

–এটা বলা বেজায় শক্ত। বাবা তো কথাই শুরু করেন র‍্যাম্পার্ট-এর ওপার থেকে, চিন্তা হয়তো গঙ্গার ওপার থেকে শুরু হবে। এমন মানুষের মনের তল পাওয়া ভার। বলতে বলতে উঠল আদিত্য। বেসিনে গিয়ে আঁচাচ্ছে। কুলকুচি করতে করতে বলল, হঠাৎ তোমার আজ কাশীর কথা মনে হল কেন?

–এমনিই।

বলে চুপ করে গেল ইন্দ্রাণী। তনুময়ের কথাটা আদিত্যকে বলতে খুব ইচ্ছে করছিল, একজনকে জানালেও বুকের ভার কিছুটা নামে। থাক। শুনেই হয়তো আদিত্য ধেই ধেই নাচতে শুরু করবে, ছুট্টে গিয়ে সকালেই খবরটা দিয়ে আসবে বাবা-মাকে। যা বুদ্ধি! বলে অবশ্য বারণ করে দিলে হয়। শুনবে।

এত ভেবেও ইন্দ্রাণী শেষ পর্যন্ত কিছুই বলতে পারল না। গোপন কথা আদানপ্রদান না করে করে কেমন যেন কুণ্ঠা এসে গেছে, সম্পর্কের মাঝের অবরোধটাকে তার বড় দুর্লঙ্ঘ্য মনে হয়। মাস খানেক আগে কাশী যাবে বলে জোর ঢক্কানিনাদ তুলে হঠাৎ চুপ মেরে গেছে আদিত্য, সেই নিয়েও কি কোনও প্রশ্ন করতে পেরেছে ইন্দ্রাণী? রোজই ঘুরে ফিরে লেটারবক্স হাতড়ায় আদিত্য, কোনও চিঠি এসেছে কিনা চাঁদু তিতিরকে জিজ্ঞাসা করে। কাশী থেকে কোনও ডাকের প্রতীক্ষায় আছে কি? কদিন ধরে নেশার মাত্রাও যেন কম, মাতাল হোক আর যাই হোক বাড়ি ফিরছে, মনে মনে আবার কী ভাঁজছে কে জানে!

কন্দর্পর আজ খাওয়ার পাট নেই। সে গেছে ফিলমি পার্টিতে, ফিরতে রাত হবে বলেই গেছে। এঁটো বাসন-কোসন রান্নাঘরে নামিয়ে দিল ইন্দ্রাণী, আলগা হাতে খাবার টেবিল মুছে নিল। আবার সেই অবরুদ্ধ তনুময় কামড় বসাচ্ছে মাথায়, ইন্দ্রাণী অন্যমনস্ক হওয়ার চেষ্টা করল। শুভ ফিরেছে হপ্তাখানেক আগে, মাঝে বারকয়েক ফোনও করেছে, একটি বারও ভুল করে তনুর কথা উচ্চারণ করেনি, আজ এসে খবরটা দিল কেন? সেও কি দ্বিধায় ছিল এ কদিন? শুভ তো এখন প্রায় বাইরের মানুষ, ইন্দ্রাণীর ভাল-মন্দ থেকে সে অনেকটা বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছে নিজেকে, সেই শুভরই যদি এত সংশয় থাকে, ইন্দ্রাণী কি তুড়ি মেরে সিদ্ধান্ত নিতে পারে?

অনেক ভাবা দরকার, অনেক ভাবা দরকার।

টিফিনে নীলিমার ঘরে ডাক পড়ল ইন্দ্রাণীর। দুরাত পর পর ঘুম হয়নি, মাথা ছিঁড়ে পড়ছে, হাফ-ডে সি এল নিয়ে ইন্দ্রাণী বাড়ি চলে যাবে ভাবছিল, এমন সময়ে এই আহ্বান!

অনিচ্ছা সত্ত্বেও ইন্দ্রাণী উঠল। স্টাফরুম থেকে নীলিমার ঘরে পৌঁছেই চমক। স্কুলের সেক্রেটারি বসে আছেন ঘরে। মানুষটি ইন্দ্রাণীর পরিচিতই। শুধু রেবার দাদা বলেই নয়, অম্বরীশবাবু ঢাকুরিয়ারই পুরনো বাসিন্দা, পথে-ঘাটে কখনও সখনও দেখা হলে হেসে কথা বলেন। পেশায় অধ্যাপক, রাজনীতির সঙ্গেও খানিকটা যোগ আছে অম্বরীশ ব্যানার্জির, জানে ইন্দ্রাণী।

ইন্দ্রাণীকে দেখে হাত তুললেন অম্বরীশবাবু, আসুন দিদিমণি, নীলিমাদি আপনাকে একটা সুখবর শোনাবেন।

ইন্দ্রাণী চেয়ার টেনে বসল। তার স্নায়ু এত শিথিল যে সুংবাদের প্রত্যাশাও তাকে টানটান করতে পারছে না। তবু হাসল, একজন পরিচিত লোকের সামনে যেমন হাসতে হয়।

নীলিমার মুখ নিয়মমাফিক রাশভারী। কেজো স্বরে বললেন, তোমার কনফার্মেশনের ডেটের ভুলটা রেকটিফাই করা হয়েছে। নেসেসারি অর্ডারও বেরিয়ে গেছে, তবে এখনও আমার হাতে আসেনি। আশা করি এবার তোমার গ্রিভান্স মিটে যাবে।

ইন্দ্রাণী অল্প মাথা দোলাল, থ্যাংক ইউ।

ধন্যবাদ আমাকে নয়, অম্বরীশবাবুকে দাও। গভর্নমেন্টে ওঁর চেনা লোক আছে, তাকে দিয়ে উনি তোমার পোপোজালটা থু করিয়েছেন।

ইন্দ্রাণী অম্বরীশের দিকে ফিরে আসার চেষ্টা করল, থ্যাংক ইউ।

–তাহলে বুঝতে পারছ তো ম্যানেজিং কমিটি মানেই কিছু শয়তান বদমাইশ নয়?

–আমি তো সে কথা কখনও বলিনি।

–তোমার লেটার ইমপ্লায়েড সো। তোমার ল্যাংগুয়েজ ইমপ্লায়েড সো।

–আমি সত্যিই এমন কিছু মিন করতে চাইনি নীলিমাদি। আপনারা যদি হার্ট হয়ে থাকেন, আই অ্যাম সরি।

এতক্ষণে নীলিমার মুখে হাসি ফুটল, ঠিক এই কথাটাই তোমার কমিটিকে লিখে জানানো উচিত। অম্বরীশবাবুও তাই চান। এটা স্কুলের ডিসিপ্লিনের জন্য অত্যন্ত জরুরি। আমি আশা করব তুমি ওঁকে ডিজ্যাপয়েন্ট করবে না।

ইন্দ্রাণী টান হল, অর্থাৎ মুচলেকা?

নীলিমা কি যেন বলতে যাচ্ছিলেন, অম্বরীশ থামালেন তাঁকে, আপনি ওভাবে নিচ্ছেন কেন দিদিমণি? আপনি তো আর পারসোনাল কারুর কাছে ক্ষমা চাইছেন না, অথরিটির সঙ্গে সামান্য ভুল বোঝাবুঝি মিটিয়ে নিন। এ কথা তো মানবেন, ম্যানেজিং কমিটির যথেষ্ট ভিডিটিভ হওয়ার স্কোপ ছিল। কিন্তু তারা আপনার সঙ্গে যথেষ্ট ম্যাগনানিমাস আচরণ করেছে।

ইন্দ্রাণী ঝটিতি ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াগুলো এঁচে নিল। যদি অর্ডার বেরিয়ে গিয়ে থাকে, তবে এখন বুড়ো আঙুল দেখালেও এদের কিছু করার নেই। কিন্তু যদি অর্ডার না বেরিয়ে থাকে? গোটা ঘটনাটাই যদি সাজানো হয়? নীলিমাদি এক পয়লা নম্বর মিথ্যেবাদী, ম্যানেজিং কমিটিতে নীলিমাদির চেয়েও ক্রূর লোক আছে কয়েকজন, তবে সেক্রেটারি লোকটা রেবার দাদা হওয়া সত্ত্বেও মন্দ নয়, স্টাফরুমে রেবার অসাক্ষাতেই শুনেছে কথাটা। সত্যিই যদি তিনি ইন্দ্রাণীর জন্য কিছু করে থাকেন, তাহলে ইন্দ্রাণীই বা অকৃতজ্ঞ হবে কেন? এতে যে ইন্দ্রাণী নিজের কাছে নিজে হীন হয়ে যাবে।

বড় করে বুকে বাতাস টানল ইন্দ্রাণী। ঘরে যুদ্ধ, বাইরে যুদ্ধ, হৃদয়ে যুদ্ধ, শয়নে স্বপনে যুদ্ধ, আর ভাল লাগে না।

মাথা নেড়ে ইন্দ্রাণী বলল, — তাই হবে।

–চিঠিটা তাহলে ড্রাফট করে ফেলি? নীলিমা উৎসুক চোখে তাকালেন, ছুটির পর এসে সই করে দিয়ো।  

–না। চিঠি আমি নিজেই করব। আপনিই তো বলেন ইংরিজি আমি ভাল জানি।

 বলেই ইন্দ্রাণী উঠে পড়েছিল। অম্বরীশ ডাকলেন, – দিদিমণি এক সেকেন্ড। কথা ছিল।

 ইন্দ্রাণী ঘুরে দাঁড়াল।

–আপনাদের বাড়ি ভেঙে যে ফ্ল্যাটগুলো হচ্ছে, সেগুলো কি অল সোল্ড?

ইন্দ্রাণী সে রকমই শুনেছে, তবু কথাটা ভাঙল না। বলল, আমি তো ঠিক জানি না। যে প্রোমোটার ভদ্রলোক প্রোজেক্টটা করছেন, সবই তাঁরই হাতে।

ও। …তাঁকে পাওয়া যাবে কোথায়?

–বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটে অফিস। বলেন তো ঠিকানা এনে দিতে পারি।

প্লিজ। আমার মেয়ে-জামাই হন্যে হয়ে একটা ফ্ল্যাটের চেষ্টা করছে। দরে বনে তো জায়গা পছন্দ হয় না। জায়গা পছন্দ হলে দাম লাফিয়ে আয়ত্তের বাইরে চলে যায়। সেদিক থেকে ঢাকুরিয়াই ওদের অপটিমাম চয়েস।

–ভালই তো। মুস্তাফিবাবুর সঙ্গে কথা বলুন।

–আপনি একটু কাইন্ডলি বলে দিন না। অম্বরীশের হাসিটা ছড়িয়ে গেল, বোঝেনই তো, চেনা লোকের থ্রু দিয়ে গেলে বারগেন করতে একটু সুবিধে হয়। কত করে যেন দিচ্ছে স্ক্যোয়ার ফিট?

–আমি ঠিক জানি না, বিশ্বাস করুন। ইন্দ্রাণী এড়াতে চাইল।

–আমি শুনেছি। ছশো করে। আপনার রেফারেন্সে যদি পঁচিশ টাকাও স্কোয়্যার ফিটে কমে…

প্রচণ্ড বিরক্ত হচ্ছিল ইন্দ্রাণী। অদ্ভুত এক দোলাচলে আচ্ছন্ন হয়ে আছে মন, তার মধ্যে এইসব আমড়াগাছি ভাল লাগে! অথবা আমড়াগাছি নয়, এটাই অম্বরীশ ব্যানার্জির মূল কথা। তদ্বিরের বিনিময়ে তদ্বির! ভাবলে ঘেন্নায় রি-রি করে ওঠে গা। লোকটার সম্বন্ধে ধারণা বদলে গেল!

বিরস স্বরে ইন্দ্রাণী বলল, – দেখব।

–প্লিজ দেখুন। কাজ তো রমরমিয়ে চলছে। পরশু দেখলাম দোতলার ঢালাই হচ্ছে। এখনও বাইচান্স দু-একটা যদি পড়ে থাকে তো গিয়ে কথা বলা যায়।

টিফিন শেষ হতে এখনও মিনিট কয়েক বাকি। স্টাফরুমে ফিরে ইন্দ্রাণী চিঠির মুসাবিদা করতে বসল। চোখ টানছে, মনও বিক্ষিপ্ত, কিছুতেই গুছিয়ে দু লাইন লেখা যাচ্ছে না। অম্বরীশবাবুর খবর, ফ্ল্যাটের কাজ পুরোদমে এগোচ্ছে। এদিকে চাঁদু বলছিল অশোক মুস্তাফি নাকি বড় ঝামেলায় ফেঁসেছে, ফ্ল্যাটের কাজ হয়তো কয়েক দিন বন্ধ থাকবে। কে ঠিক, কে ভুল বুঝে ওঠা ভার। পরশু শুভকে দেখে মনে হল তনুকে নিয়ে সে চিন্তিত খুব। যেন খানিকটা মানসিকভাবে বিপর্যস্তও। অথচ কাল সন্ধেবেলা সে দিব্যি হেসে হেসে নার্সিংহোমের এক উদ্ভট পেশেন্ট নিয়ে গল্প করে গেল। যাওয়ার আগে ছোট্ট প্রশ্ন, খবরটা দিয়েছ মানিকতলায়! শুভ কি প্রকৃতই উদ্বিগ্ন ছিল, নাকি…? কোনটা সত্যি, কোনটা মিথ্যে কে বিচার করবে! ইন্দ্রাণীই বা তেমন প্রফুল্ল হতে পারছে না কেন? তনু ফিরতে চায় না বলে? না কি সে মনে মনে তনুময়ের কোনও সংবাদই চায়নি? নিজের মনকে পড়াও যে মাঝে মাঝে এত কঠিন হয়ে যায়!

যা হয় একটা খাড়া করে চিঠিটা হেড মিস্ট্রেসের ঘরে দিয়ে এল ইন্দ্রাণী। নীলিমা আলগা চোখ বোলালেন, মন্তব্য করলেন না। কোনও মতে বাকি তিনটে ক্লাস নিয়ে ইন্দ্রাণী যখন স্টাফরুমে এসে বসল, তখন তার শরীরের সব শক্তি নিঃশেষ।

সহকর্মিণীরা চলে গেল একে একে। ফাঁকা স্টাফরুমে বসে আছে ইন্দ্রাণী। একা। হেমন্তের মিঠে কড়া রোদ্র জানলা বেয়ে গড়িয়ে এসেছে ঘরের এক প্রান্তে। ওইটুকুই যা আলো ঘরে, বাকিটা ছায়াচ্ছন্ন।

বুড়ো ছবিলাল এসেছে দরজায়, – ঘর যাবেন না দিদি?

ইন্দ্রাণীর চোখ ছায়াতেই স্থির, যাব।

চাবির গোছা বাজিয়ে ঘরে ঢুকল ছবিলাল, বন্ধ করছে জানলা। আলোর রেখাটুকুও মুছে গেল। এখন শুধু আঁধার, পাতলা আঁধার।

.

দরজা খুলেই উমার মুখে মধুর হাসি, জানতাম তুই আজ আসবি।

ইন্দ্রাণী ভেতরে ঢুকে চটি ছাড়ল, কী করে জানলে?

নতুন একটা রান্না করেছি যে। তুই না চাখলে হয়!

কী রান্না?

–ছোলার ডালে পালং দিয়ে, ছানা দিয়ে… রাতুলদের বাড়িতে যে বউটা ভাড়া এসেছে, সে কাল শিখিয়ে গেল। তোর বাবা তো খেয়ে আঙুল চাটছিল।

বাবা কোথায়?

–এই তো শুলো।

ব্যাগ রেখে ইন্দ্রাণী সোজা বাথরুমে চলে গেল। উমার বালতির জল বেশ ঠাণ্ডা এখন, এতটা পথ রোদে এসে গায়ে মুখে ছেটালে ভারী আরাম হয়।

তোয়ালেয় মুখ মুছতে মুছতে ইন্দ্রাণী পিছনের বারান্দায় এল। উমা রান্নাঘরের দিকে এগোচ্ছেন। ফিরে তাকিয়ে বললেন, খেতে দিই?

ইন্দ্রাণীর ইচ্ছে করছিল না। মনে সর্বক্ষণ জগদ্দল পাথর চেপে থাকলে ক্ষুধা-তৃষ্ণার বোধ জাগে! তবু ইন্দ্রাণী না করল না, তার খাওয়া হলে মা নিশ্চিন্তে বিশ্রাম নিতে পারে।

ভাত বেড়ে উমা বললেন, – ও হরি, তোকে তো আসল খবরটা দেওয়াই হয়নি। বাপ্পা আমাদের একটা চিঠি দিয়েছে। ইংল্যান্ড থেকে। আমাকে আলাদা লিখেছে, তার দাদুকে আলাদা।

ইন্দ্রাণীর বিস্ময়বোধ ইদানীং মরে গেছে। তবু যেন সামান্য নাড়া খেল। বাপ্পার মধ্যে একটা সূক্ষ্ম পরিবর্তন এসেছে, প্রতি চিঠিতেই টের পায় ইন্দ্রাণী। দূরে চলে গিয়ে কি টান বাড়ল বাপ্পার? হয়তো প্রথম প্রথম এমনটাই হয়। দূরে থাকাটা রক্তে মিশে গেলে তনুর মতোই নিস্পৃহ হয়ে যাবে বাপ্পা!

ইন্দ্রাণী জিজ্ঞাসা করল, –কী লিখেছে বাপ্পা?

— সে অনেক গল্প। তার জাহাজের গল্প, সমুদ্রের গল্প। লিখেছে ফেব্রুয়ারি মাসে যখন আসবে, দাদুর জন্য একটা মেমপুতুল নিয়ে আসবে। জাপানি। সামনে গিয়ে দাঁড়ালেই সে পুতুল নাকি দুলে দুলে নাচে।

ইন্দ্রাণী একটু রসিকতা করার চেষ্টা করল, দেখো, মেমসাহেব পেয়ে বাপ্পার দাদু যেন দিদাকে না ভুলে যায়।

–যেতেই পারে। উমা ভঙ্গি করলেন, তার এখন শরীর মন খুব তরতাজা। বলতে নেই সিজন চেঞ্জের সময়ে এবার তেমন কষ্ট-টষ্টও নেই। এখন তো আবার বায়না জুড়েছে ভোরবেলা হেদো অবধি হাঁটতে যাবে।

–ভালো তো। যাক না।

–হ্যাঁ, তারপর পথে কোথাও মাথা ঘুরে পড়ে থাকুক আর কি। বলতে বলতে উমা হঠাৎ চোখ কোঁচকালেন, – এ কি, তুই খা। শুধু শুধু ভাত চটকে যাচ্ছিস!

-কই না। খাচ্ছি তো। তোমার সেই ডাল পালং কই? দাও।

 উমার মুখে হাসি ফিরল। হাতায় বেশি করে ছানার টুকরো তুলে বললেন, হ্যাঁরে, তোর ছোট দেওরের বিয়ের কদ্দূর? সেই কার সঙ্গে নাকি ঠিকঠাক হয়ে আছে…

এ তথ্য আদিত্য সম্প্রচার করে গেছে। লক্ষ্মীপুজোর দিন আসব না আসব না করেও এসেছিল শেষ পর্যন্ত, তখনই এসব গল্পগাছা করে গেছে। এদিকে সাধু হওয়ার শখ, ওদিকে সংসারের সব ব্যাপারেই আগ্রহ ষোল আনা! পেটে কথাও থাকে না। তাও ভাল, কাশী যাওয়ার ঘোষণাটা এ বাড়িতে করে যায়নি।

ইন্দ্রাণী বলল, চাঁদু কী করবে চাঁদুই জানে। এখনও বলেনি তো কিছু। বোধহয় নিজের ফ্ল্যাট-ট্যাট হলে তবে করবে।

–মেয়েটা কিন্তু প্রকৃত সুন্দরী। তোর শ্বশুরের কাজের দিন ঘর আলো করে ছিল।

হুঁ।

–তোর দেওরও অবশ্য কম সুন্দর নয়। দুটিতে মানাবে বেশ।

হুঁ।

অভাগা মেয়েটাকে বিয়ে করলে ছেলেটা একটা কাজের মতো কাজ করবে।

হুঁ।

–খালি হুঁ হুঁ করছিস কেন? হয়েছেটা কী তোর?

–অ্যাঁ?

–তোর কি শরীর খারাপ? উমা ঝুঁকে মেয়ের কপালে হাত ছোঁয়ালেন, খাচ্ছিস না তো কিছু?

ইন্দ্রাণী দ্রুত হাত চালাল, তোমার ডাল-পালং দারুণ হয়েছে।

উমা তীক্ষ্ণ চোখে তাকালেন। যেন মেয়ের স্বরের কৃত্রিমতা ধরে ফেলেছেন। স্নেহা কণ্ঠে বললেন, ক্লান্ত? স্কুলে খুব খাটুনি গেছে?

ইন্দ্রাণীর বলতে ইচ্ছে করল মনে স্ফুর্তি থাকলে খাটুনিতে ক্লান্তি আসে না মা। আর যত ক্লান্তই হোক এই শ্রান্তি তাকে জীবনভর বয়ে চলতে হবে। অন্যথা হওয়ার ক্ষীণ আশাটুকু নিবে গেছে।

ইন্দ্রাণী কষ্ট করে হাসল, ঠিক আছি মা।

উমা আর কথা বাড়ালেন না। মেয়ে যে শতেক ঝঞ্ঝাটে থাকে সে তো তিনি জানেনই। বুঝি তাই মায়া হল। কোমল চোখে দেখছেন মেয়েকে। স্বামী ছেলে মেয়ে বাবা মা স্কুল সংসার সব মিলিয়ে বড় নাগপাশে বাঁধা পড়ে আছে মেয়ে।

বড় খাটে ঘুমোচ্ছেন ধীরাজ, পাশের ঘরে এসে শুয়ে পড়ল ইন্দ্রাণী। এটা তার ছেলেবেলার ঘর, যৌবনের ঘর। এ ঘরখানাই সব থেকে ছোট, তবু ভারী স্মৃতিময়। দুটো সিঙ্গল বেড খাট আছে। এখানে, আছে কাঠের আলমারি, ছোট আলনা, চেয়ার টেবিল। সবেতেই কী ওম! বিষণ্ণতা মাখা! পারতপক্ষে এ ঘরে ঢোকে না ইন্দ্রাণী, আজ শুয়ে শুয়ে কান্না পাচ্ছিল। চেয়ার টেবিলে বসে পড়তে পারত না ইন্দ্রাণী, খাটে পা ঝুলিয়ে দুলে দুলে পড়ত, আর ছোট্ট তনু গুঁড়ি মেরে খাটের তলা দিয়ে এসে চিমটি কাটত পায়ে। তনু একটু বড় হতেই চেয়ার টেবিল তনুর দখলে, দূর থেকে কাগজ পাকিয়ে ছুঁড়ত তখন। ইন্দ্রাণী ধরতে গেলেই পিছলে পিছলে পালাচ্ছে। একবার যদি বাগে পেয়ে গেল ইন্দ্রাণী, তো চিলচিৎকারে বাড়ি মাত। আবার এই তনুই… একবার তুচ্ছ কারণে ভাইকে ও-খাটে ফেলে খুব পিটিয়েছিল ইন্দ্রাণী। কেন আমার পেনের নিব ভেঙেছিস, কেন ভেঙেছিস! নতুন পেলিকান পেন, খাঁটি বিদেশি, ক্লাস টেনে ভাল রেজাল্ট করার জন্য সেবার মেয়েকে কিনে দিয়েছিল বাবা। চোরের মার খেয়েও এতটুকু প্রতিরোধ নেই তনুর। চোখ দিয়ে জল পড়ছে টসটস, মুখে তবু এক বুলি। মার, যত খুশি মার, মেরে ফ্যাল, কিছুতেই আমাকে দিয়ে বলাতে পারবি না আমি তোর পেনে হাত দিয়েছি। হল্লা শুনে মা ছুটে এসেছে রান্নাঘর থেকে। অ্যাই ইনু, করিস কী! তনু তোর পেনে হাত দেবে কেন, আমি ধোপার হিসেব লিখতে নিয়েছিলাম, হাত থেকে পড়ে…। প্রহারের জ্বালা ভুলে তনুর ঠোঁটে তখন বাঁকা হাসি। মিছিমিছি নিজের হাত ব্যথা করলি তো!

ইন্দ্রাণীর চোখ কর কর করে উঠল। দ্বিরাগমনে এসে এই খাটে চোখ ঢেকে শুয়ে ছিল ইন্দ্রাণী, ও-খাটে এসে বসল তনু। কচি ঘাসের মতো গাল ভরা দাড়ি, এক ঝোড়া গোঁফ, চুল উসকো-খুসকো। তোর বিয়ে হয়ে বড় কেলো হয়ে গেছে রে দিদি, ঘরগুলো একেবারে গড়ের মাঠ! আদিত্যদাকে ঘরজামাই করে নেওয়া যায় না!

সেই তনু এত নির্মম হয়ে যায় কী করে?

মাগোঃ।

কার্তিকের দুপুর দৌড়ে দৌড়ে এগোয়, আজ যেন হঠাৎ স্থির হয়ে গেছে। শুকনো বাতাস ঝাপটা মারে মাঝে মাঝে। কাছেপিঠে কোথাও একটা ঘুঘুপাখি ডেকে উঠল, বোধহয় গলির ক্রোটন গাছটায়। ওই ডাকে দুপুরটা যেন আরও দুঃসহ হয়ে যাচ্ছে।

উমা এসেছেন, এ ঘরে তো ফ্যান নেই, এখানে শুলি কেন?

–শুলাম। ইন্দ্রাণী পাশ ফিরল, — আমার ফ্যান লাগবে না।

হঠাৎ ভূতের মুখে রাম নাম! তুই তো পারলে পোষ-মাঘেও ফ্যান চালাস! ইন্দ্রাণী উত্তর না দিয়ে উঠে বসল। যেন ঘুম কাটাচ্ছে এভাবে আঁচলে চোখ মুছে বলল, – মা, তুমি এখনও সেই স্বপ্নটা দ্যাখো?

–কোন স্বপ্ন?

 –সেই যে, তনু খাঁকি প্যান্ট-শার্ট পরে পাহাড়ি রাস্তায় হাঁটছে!

 উমা যেন থমকালেন সামান্য। দু ঠোঁট ঈষৎ ফাঁক হল, হঠাৎ ও কথা মনে পড়ল?

–পড়ল। বলল না, দ্যাখো?

–দেখি ক্কচিৎ কখনও। এই তো সেদিনই দুপুরে…

যদি স্বপ্নটা সত্যি হয়ে যায়, কেমন লাগবে মা?

–তা কি কখনও হয়!

যদি হয় মা?

উমা দুদণ্ড চুপ। তারপর বললেন, তুই কি আমায় নিয়ে ঠাট্টা করছিস?

-ঠাট্টা নয় মা। আমি যদি এখন তোমায় বলি সত্যি তনু বেঁচে আছে! সে একটা ওরকমই পাহাড়ি দেশে থাকে, খাঁকি ইউনিফর্ম পারে চাকরি করতে যায়, খুব হাট্টাকাট্টা চেহারা হয়েছে তার…

-চুপ কর। চুপ কর। চোখ বুজে হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলেন উমা, আমাকে তুই পরীক্ষা করছিস?

না মা…

–না মা আবার কি? মাকে নিয়ে মজা করতে লজ্জা করছে না তোর? চকিতে উমা কেমন পাগলপারা। ইন্দ্রাণীর একটি কথাও শুনতে তিনি রাজি নন আর, চিৎকার করে অভিশাপ দিচ্ছেন মেয়েকে। মাকে শান্ত করার চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিল ইন্দ্রাণী। মাথা নত, বসে আছে স্থাণুবৎ।

হট্টগোলে ধীরাজের ঘুম ভেঙে গেছে। উঠে এসেছেন, হল কী তোমার? এমন করছ কেন? তুই কখন এলি ইনু?

ইন্দ্রাণীকে কথা বলার ফুরসত দিলেন না উমা। হাউমাউ করে উঠলেন, তোমার মেয়েকে তুমি সাবধান করে দাও।

ধীরাজ ভোঁতা চোখে তাকালেন, কী করেছে ইনু?

–ওকেই জিজ্ঞেস করো। ওর দয়ায় বেঁচে আছি বলে আমাদের নিয়ে যা-খুশি খেলা করছে।

 ইন্দ্রাণী মাকে থামাতে চাইল, স্বর ফুটল না।

উমা বিকারগ্রস্তের মতো ফোঁসফোঁস করছেন, মায়ের দুঃখ তুই কী বুঝবি? নিজেকে তো কখনও ছেলেমেয়ে হারাতে হয়নি!

ইন্দ্রাণী উঠে দাঁড়াল। পাশের ঘর থেকে ব্যাগ নিয়ে সোজা বেরিয়ে এসেছে রাস্তায়। ঝাঁ ঝাঁ করছে মাথা, চুলের পাশের রগ দুটো ছিঁড়ে পড়তে চাইছে। মার সব কটা কথাই কি প্রলাপোক্তি? রাগের মাথায় মানুষ তো সত্যি কথাই বলে, মনের জমা ক্লেদ উগরে দেয়, নয় কি? মা মেয়ের সম্পর্কের মাঝেও এত নিষ্করুণ রঙ থাকে! ক্ষোভ, ঈর্ষা, হীনম্মন্যতাবোধ…! বাবা-মার প্রতি কর্তব্য করতে করতে ইন্দ্রাণীর মনে বুঝি সূক্ষ্ম অহং জন্মেছিল। সেই অহংবোধ বুঝতে দেয়নি যাদের প্রতি মানুষ কর্তব্য পালন করে তাদের মধ্যেও এক বিপরীত ক্রিয়া চলতে থাকে অহর্নিশি। তাদের কাছে গ্রহণ করাটাও ক্রমশ গ্লানিময় বোঝা হয়ে যায়। অন্তত গ্রহীতার মধ্যে যদি আত্মসম্মানবোধ থাকে। তা বলে তার শান্ত নিরীহ মা…!

কী করবে ইন্দ্রাণী? মা-বাবার সংসার থেকে একটু একটু করে দূরে সরিয়ে নেবে নিজেকে? ধ্যুৎ, তা হয় না। দু-দশ মিনিট পরেই স্বাভাবিক হবে মা, নিজের ভেতরের কালো ছায়াগুলোকে দেখতে পেয়ে কুঁকড়ে যাবে লজ্জায়, হয়তো বা অসুস্থ হয়ে পড়বে। বরং সে সহজ ভাবে আসা-যাওয়া করলে, ধীরে ধীরে স্বচ্ছন্দ হবে মা, অন্তত সে রকমটা ভান করবে। ওই অসহায় বৃদ্ধ বৃদ্ধার আর কষ্ট বাড়িয়ে কী লাভ!

বাড়ি ফিরে ঘর অন্ধকার করে শুয়ে রইল ইন্দ্রাণী। কতক্ষণ ইন্দ্রাণী জানে না। কে বাড়িতে টুকছে, কে বেরোচ্ছে হুঁশ নেই। কখন বিকেল পেরিয়ে সন্ধে এল, সন্ধে গড়িয়ে রাত, ইন্দ্রাণী জানে না। অস্থির অস্থির লাগছে। তনুর কথাটাও শেষ পর্যন্ত বলা হল না বাবা-মাকে। এক দিক দিয়ে ভালই হল। মা তার স্বপ্নের তনুময়কে নিয়েই থাক। বাবা খুঁজুক ছেলেকে, কাগজ আর টিভি-র পর্দায়। এও হয়তো এক ধরনের সুখ। যদি কখনও তনু আসেও, তার সঙ্গে বোঝাপড়া হোক বাবা-মার। শুধু ইন্দ্রাণীই যে কেন বাতাসহীন জালে আটকে গেল? সে মা বাবার পাশে থাকলে তারা কৃতজ্ঞতার ভারে হাঁসফাঁস করবে, আবার ইন্দ্রাণীকেই গিয়ে গিয়ে সে বোঝা লাঘবের চেষ্টা করতে হবে–এ এক বিচিত্র অলাতচক্র। তনুর মৃত্যুসংবাদ এলে কি ছবিটা অন্য রকম হত?

খুট শব্দ। আলো জ্বলেছে ঘরের। ইন্দ্রাণী চোখ কুঁচকে তাকাল। তিতির। ড্রয়ার খুলে কি যেন ঘাঁটাঘাঁটি করছে।

কী করছিস ওখানে?

 –ওষুধ খুঁজছি। তিতির ফিরে তাকাল না, পেইন কিলার।

–পেইন কিলারে কী দরকার?

 –আছে। খুঁজছি যখন, তখন নিশ্চয়ই দরকার আছে।

 চড়াং করে রক্ত উঠে গেল মাথায়, ঢ্যাঁটামো করবি না। যা জিজ্ঞেস করছি উত্তর দে।

তিতির সোজা হল, বাবার লাগবে। পেটে ব্যথা হচ্ছে।

আবার গিলে এসেছে বুঝি?

জবাব দিল না তিতির, ওষুধ নিয়ে বেরিয়ে গেছে।

 পুঞ্জীভূত যন্ত্রণা যেন ঝাঁকি মেরে দাঁড় করিয়ে দিল ইন্দ্রাণীকে। দুমদাম পায়ে আদিত্যর, ঘরে এসেছে।

ছত্রখান হয়ে বিছানায় শুয়ে আছে আদিত্য, মুখ বিকৃত হচ্ছে মাঝে মাঝে। ঘরময় উগ্র দিশি মদের গন্ধ। আদিত্যর সামনে তিতির, হাতে জলের গ্লাস।

ঝাপটা দিয়ে মেয়ের হাত থেকে গ্লাসটা ফেলে দিল ইন্দ্রাণী। তীক্ষ্ণ গলায় চিৎকার করে উঠেছে, মরতে পারো না তুমি! একটু শান্তি দাও আমাকে, একটু শান্তি দাও।

.

৮৩.

হল থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামছিল তিতির। মন্থর পায়ে। টেস্ট চলছে, আজ ফিলজফি হয়ে গেল, আর মাত্র একটা পরীক্ষা বাকি। ইকনমিক জিওগ্রাফি। আজকের পেপার দুটো মন্দ হয়নি, এখন শেষ দিনটা ভালয়-ভালয় কাটলে হয়। এবার তার অর্থনৈতিক ভূগোলের প্রস্তুতি ভালই হয়েছে, কিন্তু তাকে আত্মতুষ্ট হলে চলবে না। প্রিটেস্টে ওই ফোর্থ সাবজেক্টে সে মাত্র চুয়াল্লিশ পেয়েছিল। ছিহ।

তিতির…অ্যাই তিতির?

 দুদ্দাড়িয়ে নেমে আসছে ঝুলন। হাঁপাচ্ছে, হিয়ার খবর শুনেছিস? হিয়া হাসপাতালে..না না, নার্সিংহোমে।

নিমেষে তিতিরের মুখ পাংশু, কেন?

–অপারেশান হয়েছে। অ্যাপেনডিসাইটিস।

–কোত্থেকে শুনলি?

-ওদের সেকশানের পৌলোমী বলল। ইশ, বেচারার টেস্টটা দেওয়া হল না। বছর না নষ্ট হয়ে যায়!…একদিনও এগজামের পর ওকে দেখতে পাই না, আমার আগেই কেমন সন্দেহ হয়েছিল…

অল্প অল্প ভাললাগা মন ঝুপ করে নিবে গেল তিতিরের। নীরবে সিঁড়ি ভেঙে স্কুলের চাতালে এসে দাঁড়াল। দেওয়ালের গা ঘেঁষে সার সার টবে ক্রিসেনথিমাম ডালিয়া জিনিয়া গাঁদা, সেদিকে চোখ পড়তেই বুক সিরসির। নিজেকে কেমন যেন অপরাধী অপরাধী লাগছে। মনে হচ্ছে হিয়ার এই শারীরিক বিভ্রাটের জন্য সেই যেন দায়ী! তিতির কি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবে, সে মনে মনে হিয়ার অমঙ্গল কামনা করেনি! অথচ এই হিয়া এককালে তার কত প্রাণের বন্ধু ছিল!

ঝুলনেরও সদা উজ্জ্বল মুখে ছায়া, আমাদের তো একদিন দেখতে যাওয়া উচিত, কী বল?

হুঁ।

কাল এগজামের পর যাবি?

 তিতিরের চোখ আবার টবের দিকে। কত রঙের ফুল ফুটেছে! লাল সাদা খয়েরি হলুদ গোলাপি…আইসক্রিম পালারের ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে উঠে এল টোটো আর হিয়া! লাল-সাদা ডালিয়া হাসছে হাওয়ায়…টোটোর হাতে ম্যাজিক মুন, হিয়ার হাতে পিঙ্ক অ্যাফেয়ার! রঙিন আইসক্রিম দুটো থেকে আহ্লাদের বাষ্প উঠছে!

তিতির ঝট করে মুখ ফেরাল, তুই ঘুরে আয়। আমার যাওয়া হবে না।

একা যাব?

কাউকে একটা সঙ্গে নিয়ে নে। দেবস্মিতার সঙ্গে কনট্যাক্ট কর। আমাকে কাল পরীক্ষার পর দিদার বাড়ি যেতে হবে।

ঝুলন আর পীড়াপীড়ি করল না। মাথা দুলিয়ে বলল, – হিয়ার লাইফটা খুব কমপ্লেক্স হয়ে গেছে রে।

–সে তো ছিলই। নতুন কি হল? তিতিরের গলা ভার ভার।

বা-রে, ওর ঠাকুমা ওল্ড এজ হোমে চলে গেছেন না!

তিতির ছোট্ট ধাক্কা খেল। এ খবরটাও রাখে না সে!

 মনের ভাব যথাসম্ভব গোপন রেখে বলল, – তো?

–বেচারাকে এখন একসঙ্গে তিন দিক ব্যালেন্স করতে হচ্ছে। একবার ঠাকুমার কাছে ছোটে, একবার মা ভাই, এদিকে বাড়ি তো আছেই।

তিতিরের হাসি পেয়ে গেল। আর একটা দিকও আছে হিয়ার, ঝুলন জানে না।

ঝুলন ব্যাগটাকে ডান কাঁধ থেকে বাঁ কাঁধে সরাল, জানিস তো, হিয়াদের ফোন এসে গেছে?..মাঝখানে একদিন ফোন করে অনেক গল্প করল।

সঙ্গে সঙ্গে বেড়ালের মতো সতর্ক হয়েছে তিতির, –কী গল্প?

ঠাকুমার কথাই বেশি বলছিল। ঠাকুমার জেদের কাছে হার মেনে হিয়ার বাবা নাকি বাধ্য হয়ে ওল্ড হোম অ্যারেঞ্জ করে দিয়েছেন। নাউ শি ইজ হ্যাপি দেয়ার। আমাদের সকলের কথা নাকি খুব জিজ্ঞেস করেন। হিয়ার বাবাও নাকি এখন হিয়াকে চোখে হারান। স্টেপমাদারের ওই ফান্টুস ছেলেটা, সে নাকি হোস্টেলে চলে গেছে। স্টেপমাদারও এখন ওর ওপর বেশ আফেকশনেট।

–তাহলে আর প্রবলেম কি? সূক্ষ্ম বিদ্রূপ ছুঁড়ল তিতির।

–আছে। ঝুলন চোখ টিপল, – সেই চুড়েলের নাকি আবার বাচ্চা হবে।

–যাহ। এই বয়সে?

 –হতেই পারে। মেনোপজ তো হয়নি। হয়তো সেকেন্ড হাজব্যান্ডকে বলেছে আমি তোমারও একটা সন্তান ধারণ করতে চাই! হিহি। একটু হেসেই গম্ভীর হল ঝুলন, হিয়া এই নিয়ে ভীষণ মনমরা ছিল। জানিসই তো, বাবার ব্যাপারে ও কেমন পজেসিভ। হয়তো অ্যাপেনডিসাইটিসটাও সেই কারণে…জানিস তো, মেন্টাল টেনশানে অ্যাপেনডিসাইটিস বাড়ে।

অপরাধবোধের পাথরটা একটু যেন সরল তিতিরের, ঈর্ষার জ্বালাও যেন কমল সামান্য। চাপা বিষাদে ভরে গেল বুক। হিয়ার জন্য, শুধু হিয়ার জন্য। পড়ন্ত বিকেলে তাদের ছাদে এসে আগুন উগরে ছিল হিয়া, বৃষ্টির মতো কেঁদেছিল। সেই বিকেলের মুখটা মনে পড়ে যাচ্ছে। ছোট্ট থেকে হিয়ার যত কথা তিতিরের কাছে। তিতিরও কি কম ভালবাসত হিয়াকে! হঠাৎ সেই সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার জন্য কে দায়ী? টোটো? হিয়া? নাকি তিতির নিজেই? হিয়া কী করে বুঝবে টোটোর সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতাটা কোথায় বাজে তিতিরের? মুখ ফুটে কোনওদিন তিতির তাকে বলেছে কিছু? শুধুমুদু ওই দুঃখী মেয়েটার ওপর রাগ দেখাচ্ছে তিতির।

গেটের মুখে ঝুলনের নতুন বয়ফ্রেন্ড। অনির্বাণ। এবার শুশুনিয়া পাহাড়ে গিয়ে আলাপ হয়েছে, এখন সে ঝুলনের ছায়াসঙ্গী। যাদবপুরে ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে, সেকেন্ড ইয়ার। অনির্বাণের বাবা বাড়িতে পাজামা-পাঞ্জাবি পরে। লুঙ্গি পরে অনির্বাণের মা, মাঝে মাঝে। এতে অবশ্য ঝুলনের একটুও আপত্তি নেই।

ঝুলন উসখুস করছে, তা হলে যাই রে। কাল..

তিতির পিছন থেকে চেঁচিয়ে উঠল, কোন নার্সিংহোমে আছে রে হিয়া?

সাদার্ন ক্লিনিক।

–সেটা কোথায়?

যাদবপুর। স্টেট বাস গুমটির পেছনটায়।

তিতির অন্যমনস্ক হয়ে বাড়ি ফিরছিল। সেলিমপুরে বাস থেকে নেমে তাকাল এদিক ওদিক। নিজের অজান্তেই। অভ্যেসমতো। সুকান্ত নেই আজ। বাঁচা গেছে। ছেলেটার বকবক আজ ভাল লাগত না। বুক আবার ভারী হয়ে যাচ্ছে তিতিরের। যাবে একবার হিয়াকে দেখতে নার্সিংহোমে? উচিত, খুবই উচিত। কিন্তু চোরকাঁটাটা যে খচ খচ করেই বুকে, মিলিয়েও মেলাতে চায় না। ঠিক আছে বাবা ঠিক আছে, তিতিরই হিংসুটে। কিন্তু তুই কি করেছিস হিয়া! মনে যদি তোর পাপ না থাকে, তিতিরকে দেখলে মুখ ঘুরিয়ে নিস কেন! ঝুলন এখন প্রিয় বন্ধু হল, তিতির মন থেকে ভ্যানিশ! ওই অভদ্ৰ দাম্ভিক ছেলেটা তোকে কি এমন জাদু করল যে তিতিরের কাছে কিছু না জানতে চেয়ে…! যাবে না তিতির, মোটেই দেখতে যাবে না হিয়াকে। তুই পেট কেটে পড়ে থাক, তোর একটা বছর নষ্ট হোক, সৎমার বাচ্চাকে দেখে পা ছড়িয়ে বসে বসে কাঁদ, মনের দুঃখে মরে যা, তিতির খুশি, খুব খুশি। তোর আর এত দুঃখই বা কিসের, তোর না রাজর্ষি আছে!

আকাশের রঙ মরে আসছে, সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। ডিসেম্বরের শুরুতেই বেশ শীত পড়ে গেছে এবার, দিনমানেও তার কামড় স্পষ্ট টের পাওয়া যায়। হঠাৎ হঠাৎ বাতাস উঠছে একটা। শুকনো। এলোমেলো। নগরীর ক্ষীয়মাণ সবুজ বাদামি হচ্ছে ক্রমশ, এবার তাদের পাতা ঝরানোর পালা।

বাড়ি পৌঁছে তিতিরের তিতকুটে মনটা তিরিক্ষি হয়ে গেল। বাইরে থেকে মা আর সন্ধ্যার মার গলা পাওয়া যাচ্ছে, জোর চেঁচামেচি করছে দুজনে। কাপড় কাঁচা নিয়ে বিকৃত ফ্যাসফেসে স্বরে কি যেন বলছে মা, সন্ধ্যার মা সমানে টক্কর দিয়ে চলেছে। আজকাল বড্ড মেজাজ বেড়েছে মার! সর্বক্ষণ শিরা ফুলিয়ে একে শাসাচ্ছে, ওকে ধমকাচ্ছে…! কদিন আগে সামান্য খাবার ঢাকা নিয়ে ছোটকাকে ছার ছার করে কথা শুনিয়ে দিল। বাবা আর তিতির তো রোজকার খদ্দের, তাদের তো যখন তখন গালাগাল করছে। কারণে, অকারণে, নিজের তৈরি করা কারণে। বাবার অ্যালকোহলিক হেপাটাইটিসটা বাড়ছে দিন দিন, প্রায়ই ব্যথা নিয়ে শুয়ে থাকে, ভয়ে টুঁ শব্দটি পর্যন্ত করে না। মা চেঁচালে পরদিন আরও বেশি করে খেয়ে আসে। মাঝে তো রোজ বেশ ফিরছিল বাড়িতে, আবার গায়েব হওয়া শুরু হয়েছে। কোন দিন না কিছু অঘটন ঘটে যায়! যদি ঘটে, তার জন্য সম্পূর্ণ দায়ী হবে ওই মা। যার পথ চেয়ে সারা সন্ধে বসে থাকত, সে এলেও আজকাল মার বাক্যবাণ বন্ধ হয় না! স্ট্রেঞ্জ!

বেল বাজাতেই ঝুপ করে ঝগড়া থেমে গেছে। দুই যুযুধান প্রতিপক্ষের মাঝখান দিয়ে তিতির সুড়ৎ করে ঢুকে পড়ল ঘরে, দড়াম করে দরজা ভেজাল, ইউনিফর্ম বদলে বেরিয়ে এসেছে। খাবার টেবিলে বসে নিস্পৃহ স্বরে বলল, – পেটে কিছু ফেলা যাবে?

যেন এমনই একটা কোনও ইন্ধন চাইছিল বাড়ি। মুহূর্তে রান্নাঘর থেকে হাঁ হাঁ ছুটে এল সন্ধ্যার মা, তোমার খাবারই তো করতেছিলাম, তোমার মা করতে দিল কই! সাঁঝের বেলা তার চাদর কাচানোর বাই উঠল!

–নোংরা থাকলে বলব না? ঝামরে উঠেছে ইন্দ্রাণী, এখানে কাদা, ওখানে দাগ, সাবানগুলো কি মাগনা আসে?

–অত যদি পিটপিটিনি, কাচার জন্য আলাদা লোক রেখে নাও। আমি পারবনি। আছড়ে আছড়ে কাঁধে ব্যথা ধরে যায়, তবু কাউর মন ওঠে না!

আবার রান্নাঘরে ঢুকে গেছে সন্ধ্যার মা, ছ্যাঁকছোক কি যেন ছাড়ছে কড়ায়, বোধহয় ডিম-পাঁউরুটি। সেখান থেকেই গজগজ করে উঠল, সন্ধ্যার মা ছিল বলে তরে গেলে, অন্য কেউ এত মুখ ঝামটানি সহ্য করত না।

উত্তরে কিছু একটা বলল ইন্দ্রাণী, তার উত্তরে সন্ধ্যার মা, তার জবাবে ইন্দ্রাণী…। তিতিরের অসহ্য লাগছিল। গটমট করে উঠে আদিত্যর ঘরে এল, আবার দড়াম করে দরজা বন্ধ। টানটান শুয়ে পড়েছে। এত তুচ্ছ কারণে মার মতো একজন সন্ধ্যার মার সঙ্গে ঝগড়া করছে, ভাবা যায়। কিন্তু মা এরকমই করে আজকাল, প্রায়শই করে। আগে মা কথা বলত কম, কিন্তু তার চোখে চোখ রাখলে রক্ত হিম হয়ে যেত। আর এখন মার দাপাদাপি নিষ্ফল আস্ফালন ছাড়া আর কিছু মনে হয় না। কেন এত খেলো হয়ে যাচ্ছে মা!

দরজায় গুমগুম কিল পড়ছে, দিদি, তোমার খাবার।

–আমার ক্ষিধে নেই। টেবিলে ঢাকা দিয়ে রাখো।

 বন্ধ দরজার ওপার থেকে এবার ইন্দ্রাণীর গলা, -ন্যাকামো করতে হবে না, খেয়ে উদ্ধার করো।

বলছি তো আমি খাব না।

–তবে আর কি, ঢঙ করে পড়ে থাকো। দুনিয়াসুদ্ধু লোকের ঢঙ সহ্য করাই আমার কপাল-লিখন। এক্ষুনি না গিললে ওই খাবার আমি টান মেরে নর্দমায় ফেলে দেব।

আবার একটা নাটক আরম্ভ হতে চলেছে! থমথমে মুখে খাবার টেবিলে এসে বসল তিতির। মাথা নত করে কচকচ চিবোচ্ছে ডিম-পাঁউরুটি, জিভে কোনও স্বাদ পাচ্ছে না, তবুও। চোখ থেকে টুপ করে একফোঁটা জল প্লেটে ঝরে পড়ল। আর একটা ফোঁটা। আর একটা ফোঁটা। আগে আগে পরীক্ষা দিয়ে ফিরলে কোয়েশ্চেন ধরে ধরে জেরা করত মা, আজ পেপারটা কেমন হল তাও একবার জিজ্ঞাসা করল না! উল্টে মেজাজ মেজাজ মেজাজ। গলায় মণ্ড হয়ে আটকে যাচ্ছে পাঁউরুটি, চেষ্টা করেও গিলতে পারছে না তিতির। বাবার পক্ষ নিয়ে কথা বলে তিতির এত চক্ষুশূল হয়ে গেল।

সন্ধ্যার মা চা এনেছে, আর এক পিস রুটি দেব?

তিতির চোখ মুছে দ্রুত দুদিকে মাথা নাড়ল।

সন্ধ্যার মা ফিসফিস করে উঠল, তোমাদের মায়াতেই পড়ে আছি দিদি। নইলে কবে এই কাজের মুখে লাথি মেরে চলে যেতাম।

বড় একটা শ্বাস ফেলল তিতির। এবাড়ি থেকে সকলের চলে যাওয়া উচিত। কোনও জনমনিষ্যি যেন এ বাড়ির ছায়া না মাড়ায়।

একটা পাতলা চাদর গায়ে জড়িয়ে বই-খাতা খুলে বসল তিতির। আদিত্যর খাটে। মন বসে না। কখনও মা, কখনও হিয়া, কখনও টোটো হানা দেয় অক্ষরের ছদ্মবেশে, ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় একাগ্রতা। তবু তিতির জোর করে ঢুকে পড়ল ভূগোলের পাতায়। নিত্যদিনের মতো কেটে গেল সময়টা।

রাত তখন সাড়ে নটা। দরজায় পরিচিত স্বর, পরীক্ষা আজ কেমন হল ম্যাডামের?

একবার শুভাশিসের দিকে চোখ তুলেই চোখ নামিয়ে নিল তিতির, ভাল।

-কোয়েশ্চেন কেমন ছিল?

 –মোটামুটি।

–ফিলজফি তো? ইন্ডিয়ান, ওয়েস্টার্ন…

তিতির একটু চোয়াল ফাঁক করল।

কী পড়ায় তোদের ওয়েস্টার্নে? হেগেল মার্কস আছে? মেটিরিয়ালিজম? ডায়লেকটিকস?

ডাক্তার আঙ্কলের কৌতূহলটা অনেক দিন পর হঠাৎ ভাল লাগছিল তিতিরের। সঙ্গে একটা সন্দেহ উঁকি মারছে। মা জানতে পাঠায়নি তো! হেসে অল্প মাথা নাড়ল তিতির, না হ্যাঁ-এর মাঝামাঝি।

শুভাশিস খাটের দিকে এগিয়ে এল, এইচ এসে জব্বর একটা রেজাল্ট কর তো। টোটোকে একদম ডাউন দিয়ে দে।

যেন কাঁটা ফুটল সর্বাঙ্গে, তবু হাসিটা অমলিন রাখল তিতির। তেরচাভাবে বলল, – সায়েন্সের সঙ্গে কি হিউম্যানিটিজের কম্পিটিশন হয়?

শুভাশিস বসেছে পাশে, তোকে আমি দশ পারসেন্ট গ্রেস দেব।

চ্যালেঞ্জ দিচ্ছে, না বিদ্রূপ করছে! তিতির শক্ত হয়ে গেল, আমার গ্রেস চাই না ডাক্তার আঙ্কল।

শুভাশিস আলগা ঘেঁটে দিল তিতিরের চুল, পাগলি মেয়ে।

সহসা তিতির আড়ষ্ট। ডাক্তার আঙ্কলের এই স্পর্শটুকু ভাল লাগছে, আবার এই স্পর্শই তৈরি করছে এক তীব্র বিতৃষ্ণা। যেন টোটোর বাবা টোটোর হয়ে মজা করছে তার সঙ্গে। তিতির জানে ডাক্তার আঙ্কলের তাকে ভালবাসায় কোনও খাদ নেই, তবু এমনটা মনে হচ্ছে। আরও কি যেন একটা চিনচিনে অনুভূতি! কি যেন!

তিতিরের পিঠে হাত রেখেছে শুভাশিস, দেখতে দেখতে তুই কত বড় হয়ে গেলি রে তিতির! মনে আছে, যখন ছোট্ট ছিলি, তোকে কত্ত ওপরে ছুঁড়ে দিয়ে আমি লোফালুফি খেলতাম! তুই খিলখিল হাসতিস, আর ছোঁড়া থামালেই কান্না জুড়ে দিতিস! আমাকে আরও ওপরে তুলে দাও আঙ্কল, আরও ওপরে!

এ ধরনের কথা আজকাল প্রায়ই বলে ডাক্তার আঙ্কল। কেন বলে? তার প্রতি তিতিরের ঔদাসীন্য টের পেয়েছে বলেই কি?

তিতির মনে মনে বলল, – তখন অনেক কিছু বুঝতাম না যে।

শুভাশিস হাত সরিয়ে নিল, সত্যিই তুই বড় হয়ে গেছিস তিতির।

তিতির আবার নিঃশব্দে বলল, – হয়েছিই তো। তোমার ছেলেই আমাকে চোখে আঙুল দিয়ে বড় করে দিল।

উঠে পড়ল শুভাশিস। তিতিরের কাঁধে হাত রেখে খুব আস্তে আস্তে মাথা দোলাচ্ছে। দু ঠোঁট কামড়ে দাঁড়িয়ে রইল একটুক্ষণ। ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে বেরিয়ে যাচ্ছে ঘর থেকে।

তিতির ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছিল শুভাশিসকে। ইশ, ডাক্তার আঙ্কল যদি মার কেউ না হয়ে, টোটোর কেউ না হয়ে, শুধুই ডাক্তার আঙ্কল হত!

.

দ্বিধাদ্বন্দ্ব ঝেড়ে ফেলে হিয়াকে দেখতে গেল তিতির। একাই। পরের পরের দিন।

নার্সিংহোম খুঁজে পেতে অসুবিধে হল না, হিয়ার কেবিনও না। একতলার বোর্ডে সার সার কেবিনের নম্বর লেখা আছে, সঙ্গে রুগীর নাম। ভিজিটিং কার্ডেরও তেমন কড়াকড়ি নেই, সোজা তিতির তিনতলায় উঠে গেল।

কেবিনের পর্দা সরিয়েই অপ্রস্তুত। কাঁদছে হিয়া, ঘাড় নিচু করে চোখ মুছছে। সামনে হিয়ার মা আর ভাই। মা হাত বোলাচ্ছে মেয়ের মাথায়।

তিতিরের দিকে চোখ পড়তে সেকেন্ডের জন্য থমকেছে হিয়া, পরক্ষণে তার ভেজা চোখের মণি জ্বলজ্বল। হাত তুলে ডাকল, – আয়। মা দ্যাখো কে এসেছে।

হিয়ার মা ইন্দ্রাণীরই সমবয়সী প্রায়, জোর এক-আধ বছরের বড় হবে। কিন্তু চেহারায় বেশ বয়সের ছাপ পড়ে গেছে, ফর্সা লম্বাটে মুখে এখনই উঁকি দিচ্ছে বলিরেখা। তিতিরকে চিনতে বুঝি কয়েক সেকেন্ড সময় লাগল তার।

তিতিরই বলে উঠল, মাসিমা, আমি তিতির।..রনি, তুমি আমায় চিনতে পারছ? সেই যে তোমার ইয়া লম্বা বেলুনটা আমার হাতে লেগে ফেটে গেছিল, তুমি রেগেমেগে আমায় কামড়ে দিয়েছিলে!

দিদির কাছে আসার জন্য আজ ফুলপ্যান্ট পরেছে রনি, নিজের গুণপনার কথা শুনে লজ্জায় ধরণীতে মিশে গেল।

হিয়ার মা হাসছে, কতকাল পর তোমায় দেখলাম। তুমি কী সুন্দর হয়েছ তিতির।

হিয়ারও কান্না-মোছা মুখে হাসি, আগে বুঝি তিতির খুব কুৎসিত ছিল?

–আহা, তাই বলেছি? হিয়ার মা তিতিরের চিবুক ছুঁল, তখনকার সৌন্দর্য একরকম, এখনকার সৌন্দর্য একরকম।…তুমিও তো রেজাল্ট ভাল করেছিলে তিতির, হিয়ার সঙ্গে সায়েন্স নিয়ে পড়লে না কেন?

–ওরেব্বাস, অঙ্ককে ও যমের মতো ভয় পায়।

-তাই বুঝি?..অবশ্য হিউম্যানিটিজই বা মন্দ কি! ইংলিশ নিয়ে পড়তে পারো, হিস্ট্রি নিয়ে পড়তে পারো…

আরও দুটো-চারটে কথা বলে আবার মেয়ের মাথায় হাত রেখেছে মা, তোর তো বন্ধু এসে গেছে, এবার তা হলে আমরা আসি মুন্নি? মন খারাপ করিস না, আমি আবার কাল আসব।

তাড়াতাড়ি আসবে কিন্তু। রনি, তুইও আসবি।

দিদির দিকে একটুকরো লাজুক হাসি ছুঁড়ে দিয়ে মার সঙ্গে বেরিয়ে যাচ্ছে রনি, হিয়া দেখছে তাকিয়ে তাকিয়ে, কেমন আকুল চোখে। তিতিরের বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল। আহা রে হিয়া।

হিয়ার বিছানার কাছ ঘেঁষে টুল টেনে বসল তিতির। নরম গলায় বলল, – মাসিমা তাড়াতাড়ি চলে গেলেন যে? ভিজিটিং আওয়ার শেষ হতে তো ঢের দেরি!

-বাবা আসবে যে। হয়তো মিসেস বাবাও।

ও।

তিতির চুপ করে গেল। হিয়ার সমস্যাটা পুরোপুরি বোঝে না সে, আবার অনেকটা বোঝেও। তার বাবা-মার বিচ্ছেদ ঘটেনি বটে, তবে নৈকট্যও তো নেই বড় একটা। বাবা-মাকে কি কখনও একত্রে বাড়ির বাইরে দেখেছে সে? চট করে মনে করতে পারল না।

পাতলা সবুজ কম্বলে হিয়ার বুক পর্যন্ত ঢাকা। সাদা বিছানার চালচিত্রে ভারি পবিত্র দেখাচ্ছে হিয়াকে। একটু বুঝি শীর্ণ মুখ, ঠোঁটে ফ্যাকাসে ভাব, গালে এখনও লেগে আছে জলের রেখা, সবই যেন এ ঘরের সঙ্গে মানানসই।

হাত বাড়িয়ে তিতিরের হাত ধরল হিয়া, — এলি তবে! আমি জানতাম তুই আসবি।

 তিতির ঢোঁক গিলল, ওমা, আসব না কেন? আগেই আসতাম, খবরটা পেলাম এই পরশু।

ঝুলনের কাছে?

 ঘাড় নাড়ল তিতির। জিজ্ঞাসা করল, হঠাৎ এমনটা হল কেন?

কী জানি রে ভাই, পরীক্ষার আগের আগের দিন রাত্তির থেকে কী পেইন। আগেও ব্যথা হত, মাঝে মাঝে। বাবাকে বলিনি। ভেবেছি বাবা বাবাকে নিয়ে থাকুক, আমি আমাকে নিয়ে…নয় কষ্ট পেলামই। সেদিন এমন মাত্রা ছাড়িয়ে গেল!

কতটা কেটেছে পেট?

–বেশি না, চার-পাঁচ সেন্টিমিটার। হাতের আঙুলের মাপে বোঝাতে চেষ্টা করল হিয়া।

–স্টিচ আছে?

 –নেই! বাপস, কী টান লাগে।

কাটবে কবে?

কাটবে না। এ স্টিচ শরীরে মিলিয়ে যায়।… পরশু ছেড়ে দেবে।

–টেস্ট তো দিতে পারলি না, কী হবে?

–রেক্টর ম্যাডামের সঙ্গে বাবা কথা বলে এসেছে। উনি তো বলেছেন প্রিটেস্টের বেসিসে অ্যালাও করে দেবেন। তবু একটা ইনফরমাল টেস্ট নিতে পারেন। জানুয়ারিতে। জাস্ট প্রিপারেশানটা দেখার জন্য।

–পারবি?

–দেখি। দিতেই হবে।

কথা বলতে বলতে হঠাৎ হঠাৎ থেমে যাচ্ছিল দুজনেই। যেন বুঝতে পারছিল এইসব নগণ্য কথা বলার জন্য তারা মুখোমুখি হয়নি আজ, যেন অন্য কিছু কথা আছে। মনে হতেই আরও বেশি তুচ্ছ কথায় জড়িয়ে পড়ছে দুই বন্ধু। দু বিনুনি বেঁধে হিয়াকে কেমন ছোট্টমেয়ে ছোট্টমেয়ে মনে হচ্ছে, এই নিয়ে তিতির হাসাহাসি করল খানিক, তিতিরের সালোয়ার কামিজটার প্রশংসা করল হিয়া। ডাক্তারির জন্য হিয়া জয়েন্টে বসছে কিনা প্রশ্ন করল তিতির, হিয়া মজা করল তিতিরের প্রায়বিস্মৃত নান হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে। ঠাম্মার কথা বলে হিয়া ঘরের বাতাস ভারি করে দিল একটুক্ষণ, ঠাম্মার ওল্ড এজ হোমের ঠিকানা চেয়ে নিল তিতির।

বড় দ্রুত ফুরিয়ে যায় কথারা। পলকের নৈঃশব্দ্য তীব্র হিমেল বাতাস হয়ে শীতল করে দেয় ছোট্ট কেবিন।

মানসিক চাপ বাড়ছে ক্রমশ। যেন অতল সমুদ্রের নীচে বসে কথা বলছে দুজনে, প্রবল চাপে ফেটে যাচ্ছে ফুসফুস।

ভুস করে যেন ভেসে উঠল তিতির। মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল, তোদের সেকশানের কেউ দেখতে আসছে না?

সাদা দেওয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে নিল হিয়া, তুই সেদিন গঙ্গার ধারে ওরকম সিন করছিলি কেন রে?

তিতির গম্ভীর হল, – রাজর্ষি আসে না এখানে?

হিয়া চোখ বুজল, নাম কী রে ছেলেটার? ওকেই সিনেমা হলের সামনে ঝুলন একদিন ঝাড় দিয়েছিল না?

তিতির ক্রূর চোখে তাকাল, — জয় রাইডে বেরিয়ে তো মরতে বসেছিলি, তবু শিক্ষা হয়নি?

হিয়ার চোখ স্থির হয়ে থাকা পাখার ব্লেডের দিকে, তুই শেষে ওই বোকা বোকা ছেলেটাকে পছন্দ করলি?

তিতির টুল ছেড়ে উঠে দাঁড়াল, তুই কী করে জানলি সুকান্ত বোকা বোকা? ওই পাকা স্নব ছেলেটা তোকে বুঝিয়েছে বুঝি?

হিয়া হিসহিসিয়ে উঠল, তুই জানলি কী করে রাজর্ষি স্নব? তুই বুঝি ওর সঙ্গে ফ্লার্ট করতে গিয়েছিলি? তাই রাজর্ষি তোর নাম সহ্য করতে পারে না।

তিতির দপ করে জ্বলে উঠল, জানিস, আমি তোর রাজর্ষির ছাল ছাড়িয়ে নিতে পারি? একবার সুকান্তকে বললেই…

তিতিরের মুখ লাল হয়ে গেছে। পশ্চিমের জানলা দিয়ে অস্তগামী সূর্যের আলো আসছে ঘরে, সোনালি আভায় আগুনের মতো জ্বলছে তিতিরের মুখ। তীরবেগে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

হিয়া কাতর স্বরে ডাকল, তিতির, যাস না। শোন। রাজর্ষি সুকান্তকে নিয়ে আমরা কেন ঝগড়া করে মরব? আবার কি আমরা আগের মতো বন্ধু হতে পারি না?

হিয়ার রুগণ স্বর শুনতে পেল না তিতির। চলে গেছে অনেকটাই।

.

৮৪.

কনকনে শীতে দুপুরভর লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে আদিত্য। নেহাত মৌজ করে নয়, অনেকটা দায়ে পড়ে। অঘ্রান সংক্রান্তির দিন সন্ধে থেকে হঠাৎ বৃষ্টি নামল খুব, ভিজে ন্যাতা হয়ে মাঝরাতে বাড়ি ফিরল, তারপর থেকে টানা চার দিন সর্দি কাশি জ্বর। কাল থেকে জ্বর আর নেই, তবে শরীর বড় দুর্বল। খেতে ইচ্ছে করে না, উঠতে ইচ্ছে করে না, বাথরুমে পর্যন্ত যেতে ইচ্ছে করে না, সারা দিন এই লেপের ওমে শুয়ে থাকাটাই যা আরাম। পেট ব্যথা তো সঙ্গী হয়ে আছেই, সর্বক্ষণ আছে। চিনচিন দুঃখের মতো, আধচেনা কষ্টের মতো। সকাল থেকে আজ ব্যথাটাও বেশ কম, দু-এক মুহূর্তের জন্য যেন হারিয়েও যাচ্ছে কোথায়। সঙ্গে সঙ্গে উতলা হয়ে পড়ছে আদিত্য, যেন অতি ঘনিষ্ঠ বন্ধুর ক্ষণিক বিরহও সহ্য হয় না। যন্ত্রণাও কি এক মাদক নেশা!

আদিত্য গোদা পাশবালিশটাকে কাছে টানল। খানিক আগে তন্দ্রার ঘোর ছিঁড়ে গেছে। তিতিরের এক বন্ধু এল, তার কলিংবেলের ডাকে। দুটিতে এতক্ষণ কলকল করছিল বারান্দায়, শুনতে পাচ্ছিল আদিত্য। কলকলানি থেমে গেছে, গেটে একটা শব্দ মতন হল যেন, তিতির কি বন্ধু নিয়ে বেরিয়ে গেল! যাক, মেয়ের বেরোনোই ভাল। কেন দিনরাত এই পুন্নাম নরকে বন্দি থাকবে মেয়ে!

ঘোর না থাকলে মনে নানান ভাবনা আসে। চিত্তাকাশে পেঁজা পেঁজা মেঘের মতো ওড়ে ভাবনারা, ফেনা ফেনা ঢেউ হয়ে দোলে। পরিতোষটা একেবারে পথে বসিয়ে দিল! এত দিন পর টাকাটার প্রাপ্তিস্বীকার করেছে, কিন্তু আদিত্যর যাওয়া নিয়ে চিঠিতে উচ্চবাচ্যটি নেই! ভাষার কী ছিরি! কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তোকে ছোট করতে চাই না রে! ভবিষ্যতে সাহায্যের প্রয়োজন হলে এই দীনদরিদ্র আবার তোর কাছে হাত পাতবে, মনে থাকে যেন! ব্যাটা গাঁটে গাঁটে জোচ্চোর, গঙ্গার ধারে ওর ছদ্মবেশ দেখেই আদিত্যর সাবধান হওয়া উচিত ছিল। রঘুবীর বলছিল, দ্যাখেন গে যান আপনার হাজার টাকা গাঁজার কলকেয় এখনও বুম বুম ফাটছে! যদি তাই হয় ইন্দ্রাণী তো গায়ে থুতু ছেটাবে। পরিতোষ অবশ্য অতটা ফেরেববাজ নাও হতে পারে। মুখ ফুটে সে তো না লেখেনি, আদিত্য গিয়ে পড়লে সে কি ফিরিয়ে দেবে? হয়তো হেসে বলবে, তোর মন পরীক্ষা করছিলাম রে! সাধু-সন্নিসির আশ্রমে আবাহনও নেই, বিসর্জনও নেই, এসেছিস যখন থাক তবে! যাবে চলে, চোখ কান বুজে গোটাবে তল্পিতল্পা? এই শহরে বড় অপমান, শুধু অপমান…! অপূর্ব পর্যন্ত সেদিন কী হেনস্থাই না করল! ত্রিমূর্তি এন্টারপ্রাইজ উঠে গেছে শুনে শেয়ালদা স্টেশনের জনসমুদ্রের মাঝে খ্যাক খ্যাক হাসি! পকেট হাতড়ে পড়ে থাকা তেত্রিশটা টাকা বার করে নিল! তিন টাকা ফেরত দিয়ে বলল, মনে আছে সত্তর টাকা বাকি রেখেছিলি! বাকি চল্লিশ টাকা দিয়ে যাস! আর ওই তিন টাকা দিয়ে বউকে ঝালমুড়ি কিনে খাওয়াগে যা! নাহ, মোহমুদগর ঝেড়ে ফেলে ওই কাশীতেই বডি ফেলতে হবে। আশ্রম খুলেও তো জীবনে শাইন করা যায়, না কি? পরিতোষ আর সে মিলে রামকৃষ্ণ মিশন, ভারত সেবাশ্রমের মতো দেশে-বিদেশে শাখা খুলবে, প্লেনে চড়ে আমেরিকা ইউরোপের ভক্তদের কাছে ছুটবে, কাগজে কাগজে নাম উঠবে, ছবি বেরোবে…তখন যদি অপূর্বদের শিক্ষা হয়! গেরুয়া বসন পরে সে যখন সামনে এসে দাঁড়াবে, ইন্দ্রাণীও কি গলায় আঁচল দিয়ে তাকে প্রণাম করবে না!

ব্যথাটা চড়াং করে চাগিয়ে উঠল। অজান্তেই লেপের মধ্যে কুঁকড়ে গেল আদিত্য। ধীরে ধীরে টান করছে পা, ডান কাত থেকে চিত হল আস্তে আস্তে। চাপ সরতেই কমছে ব্যথা। আবার শুধু চিনচিন, কাছের বন্ধুর মতো।

কলিংবেল বাজছে আবার। ঘন ঘন। তিতির ফিরল কি? আদিত্য কান খাড়া করল। উঁহু, তিতির নয়, তবে চেনা গলা। পুরুষ নারীর। জয়ি না? সঙ্গে কে, শংকর?

মুখ থেকে লেপ সরাল আদিত্য। ইন্দ্রাণীর গলা শুনতে পাচ্ছে, তোমরা হঠাৎ?

শংকর বলল, আপনারা নয় আমাদের ভুলে যেতে চান বউদি, আপনার ননদ রক্তের টান কী করে মুছে ফেলে বলুন? দাদা চাঁদু কেউ নেই?

–আছে। বলেই ইন্দ্রাণী আদিত্যর ঘরে এসেছে।

পুট করে চোখ বন্ধ করে ফেলেছিল আদিত্য, অমনি ইন্দ্রাণীর চাপা স্বর শুনতে পেল, মটকা মেরে পড়ে থেকো না। তোমার বোন ভগ্নীপতি এসেছে।

লেপটা কোমর পর্যন্ত সরাল আদিত্য, কায়দা করে আড়মোড়া ভাঙছে। অতি সাবধানে, যেন পেটের ডান দিকে বেমক্কা টান না পড়ে। হাতের ভরে আধশোওয়া হয়ে বাড়ির অভিভাবকের সুরে বলল, – এসো শংকর। …দুজনেই এসেছ? ঝান্টু এল না?

ঝান্টু এখন দামড়া ছেলে, সে কি আর বাবা-মার সঙ্গে বেরোয়! শংকর বাপ্পার খাটে বসল, পাড়ায় টেনিস বলের টুর্নামেন্ট চলছে, আপনার ভাগ্নে এখন সুব্রত মনা হওয়ার বাসনা ছেড়ে কপিলদেব হতে চায়।

শংকরের পরনে গলাবন্ধ বিদেশি পুলওভার, দামি কাশ্মীরি শালে ঝলমল করছে জয়শ্রী। উগ্র পারফিউম মেখেছে জয়শ্রী, গন্ধটা নাকে লাগে।

কন্দর্প ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে। দাড়ি কামাচ্ছিল, বেরোবে বোধহয় মুখে এখনও ফোঁটা ফোঁটা সাদা ফেনা। তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে জয়শ্রীকে জরিপ করল। হালকাভাবে বলল, শংকরদার এদিকে কোনও ক্লায়েন্ট আছে নাকি?

জয়শ্রী ভ্রূভঙ্গি করল, অ্যাই, টিজ করবি না। গাড়িটা ছুটির দিন পড়েই থাকে, ভাবলাম দাদা বউদির কাছ থেকে ঘুরে আসি। মেজবউদিও তোর শংকরদার কাছে দুঃখ করে, জয়ি আসে না, জয়ি আসে না..বলতে বলতে টুপ করে ইন্দ্রাণীর দিকে তাকিয়ে নিল জয়শ্রী, – ও বাড়িতে আগে গেছিলাম, ওখান থেকে…। তোর কী হয়েছে রে চাঁদু, অনেক দিন যাচ্ছিস না?

–হেববি বিজি। পর পর শুটিং চলছে।

–আমাকে একদিন শুটিং দেখালি না?

 –যাবি? ভীষণ বোরিং কিন্তু। বসে থাকতে থাকতে মাথা ধরে যাবে।

-আহা, কাটাচ্ছ কেন? শংকর ফুট কাটল, ডিরেক্টরের চোখে পড়ে গেলে ও-ও তো একটা রোল-টোল পেয়ে যেতে পারে। নায়িকা না হোক নায়িকার মাসি-পিসি।

–অথবা কোনও মুটকি কমেডিয়ান।

চাঁদু, খারাপ হয়ে যাবে। আমার কিন্তু তিন কেজি ওজন কমেছে।

 –পাহাড় থেকে এক খাবলা মাটি গেলে কী বা কমে রে!

–মারব এক থাপ্পড়। বলে ভাইকে চিমটি কাটল জয়শ্রী, অ্যাই চাঁদু, একদিন আয় না সময় করে। আমাদের পাড়ায় একটা নতুন ভাড়াটে এসেছে, তাদের বাড়ির মেয়েটা তোর খুব ফ্যান। তোকে দেখার জন্য পাগল হয়ে আছে।

বয়স কত? পাঁচের নীচে নয় তো?

–তার ওপরে হলেই বুঝি তুই প্রেম করিস? ছি ছি।

 আদিত্য খাড়া হয়ে বসল। বহুকাল পর ভাইবোনের খুনসুটি দেখতে বেশ লাগছে। জয়ি এসে বাড়ির হুঁকোমুখো ভাবটা যেন পলকে মিলিয়ে দিল।

হাসি হাসি মুখে আদিত্য বলল, চাঁদুর এখন কী ডিমান্ড তুই জানিস না জয়ি। দিনে কতগুলো মেয়ের ফোন আসে তোর বউদিকে জিজ্ঞেস কর।

দরজায় দাঁড়িয়ে আছে ইন্দ্রাণী। ছোট্ট শব্দ করল, –হুঁ। …জয়ি, তোমাদের চা বসাই?

–শুধু চা কিন্তু। মেজবউদি আজ প্রচুর খাইয়েছে। চিকেন ফ্রাই, ফিশ ফিঙ্গার, পেস্ট্রি, সন্দেশ…

–ও। চায়ের সঙ্গে দুটো বিস্কুটও খাবে না?

ইন্দ্রাণীর স্বর এত রসকষহীন, ঘরে যেন তাল ভঙ্গ হল। কন্দর্প টুক করে চলে গেল নিজের কুঠুরিতে, জয়শ্রী আঙুলে আঁচল পাকাচ্ছে, আদিত্যর চোখ সরে গেছে জানলায়, শংকর সিগারেট টুকছে প্যাকেটে।

অদ্ভুত এক শব্দহীনতা বিরাজ করছে ঘরে। জয়শ্রী একবার বলার চেষ্টা করল, তিতির নেই?

–বেরিয়েছে। ইন্দ্রাণী দরজা থেকে সরে গেল।

আবার নীরবতা। কথা নেই।

এবার শংকর বরফ ভাঙল, শুধু চাঁদু চাঁদু করছ কেন? দাদাও তো অনেক দিন আমাদের বাড়ি যাচ্ছেন না। সেই গত রোববারের আগের রোববার শেষ বসেছিলাম…

–শশশশরীরটা ভাল নেই। তটস্থ আদিত্য তোতলা হয়ে গেল। এত চেঁচিয়ে কথা বলে কেন শংকর!

শংকরের কোনও তাপ-উত্তাপ নেই। টেবিল থেকে অ্যাশট্রে নিয়ে এল। সিগারেট ধরিয়ে বড় বড় টান দিচ্ছে। চোখ টিপে বলল, ঘরে বসে থাকলে শরীর ভাল থাকবে কি করে? একটু সুখ-দুঃখের কথা হোক, দেখবেন..শীতের বিকেলে শুধু শুধু লেপের তলায় ঢুকে থাকলে চলবে?

আহ শংকর! আদিত্য ত্রস্ত চোখে দরজার দিকে তাকাল।

শংকর থামার বান্দা নয়। ফিক ফিক হাসছে, কেন দাদা, সুখ-দুঃখের কথা বলা কি খারাপ কাজ? না আমি আপনি সুখ-দুঃখের কথা বলি না?

এই শংকরের দোষ। কথা বলতে শুরু করলে ইচ্ছে করে স্থান-কাল-পাত্র ভুলে যায়।

জয়শ্রী বুঝি দাদার মুখ দেখে আন্দাজ করল কিছু। মৃদু ধমক দিল শংকরকে, ওসব কথা এখন ছাড়া তো।…হ্যাঁ দাদা শোনো, যে জন্য আসা। বাবার বাৎসরিকের সময় তো এসে গেল, খেয়াল আছে?

চকিতে প্রবল নাড়া খেয়ে গেল আদিত্য। উল্কাগতিতে মন ছুটে গেছে এক শীতার্ত রাতে। পুকুরের জলে চাঁদটা নেই, মধ্যরাতে একা এক নারকেল গাছ ছায়া কাঁপাচ্ছে সরসর। অন্ধকার ছাদে ফিসফিস ঘুরছে শব্দটা! খোকন! খোকন!

এক বছর হয়ে গেল!

আদিত্যর আবার খুব শীত করছিল। জ্বরটা কি ফিরে আসছে!

জয়শ্রী বলল, কি করবে কিছু ভেবেছ?

 আদিত্য দুদিকে মাথা নাড়ল।

–মাসে মাসে কিছু করলে না, তিন মাসেরটা করলে না, বাৎসরিকটা অন্তত বড় করে করো।

করো বলছ কেন? তুমি কি ছেলেমেয়ের মধ্যে নেই? শংকর সুখটান দিয়ে নেবাল সিগারেট, তোমাদের চার ভাইবোনেরই তো উচিত ঘটা করে বাবার কাজটা করা।

–সে তো করবই। মেজদাও তত বড় করেই করতে চায়।

 –শুধু তোমার মেজদা বললেই তো হবে না, দাদা চাঁদু কী চায় সেটাও আলোচনা করে নাও।

 –আহা, তাই তো করছি।…দাদা, তুমি কিছু বলো।

ইন্দ্রাণী চা নিয়ে এসেছে। একটু বুঝি শশব্যস্ত হল স্বামী-স্ত্রী। জয়শ্রী বলল, তুমি কী বলল বউদি, বাবার প্রথম বাৎসরিক বড় করে করা উচিত নয়?

আমি কী বলব? কাজ তো তোমাদের।

-মেজদা বলল তোমার সঙ্গে নাকি আলোচনা করে গেছে?

–সে বলেছে, আমি শুনেছি।

তার মানে তুমি ঘটা-পটা চাও না?

ইন্দ্রাণী যেন ঈষৎ তপ্ত হল, এ কথা কখন বললাম? যা করবে তোমরা ডিসাইড করো, আমাকে জড়াচ্ছ কেন?

শংকর চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিল। ইন্দ্রাণীর দিকে না তাকিয়ে বলল, আপনি না বললে কি এই ফ্যামিলির বাতাস নড়ে বউদি?

–খুব নড়ে। যে নাড়ায় সে ঠিক জানে কোথায় কতটা ফুঁ দিলে কতটা বাতাস নড়বে।

 শংকর খোঁচাটা গায়ে মাখল না। আদিত্যর দিকে ফিরে বলল, – দাদা, আপনার তা হলে আপত্তি নেই তো? আমরা এস্টিমেট শুরু করে দিই?

আদিত্য অস্ফুটে ঘাড় নাড়ল, করো।

জয়শ্রী কন্দর্পকে ডেকে এনেছে। নিজের কাপটি হাতে তুলে সে সব শুনল মন দিয়ে। এবং ব্যাগড়া দিল, এসব ডিসকাশান কি এভাবে হয়! মেজদা নেই!

জয়শ্রী বলল, আমরা মেজদার সঙ্গে কথা বলে এসেছি।

-তুই বললে হবে কেন? কাজ তো রায় ফ্যামিলির। উই থ্রি ব্রাদারস উইল সিট টুগেদার অ্যান্ড ডিসাইড। তোরা ডেলিগেট মেম্বার হিসেবে সেখানে থাকতে পারিস, কিন্তু তোদের ভোটিং রাইট থাকবে না। হ্যাঁ, লেট জয়মোহন রায় তোরও বাবা, মেয়ে হিসেবে তুই যদি কিছু কনট্রিবিউট করতে চাস, ওয়েলকাম।

কথাটা হালকা ছলে বলা, তবু বড় রূঢ় শোনাল এই মুহূর্তে। জয়শ্রীর মুখ কালো হয়ে গেছে।

আদিত্যর বোনকে দেখে মায়া হল। গলা ঝেড়ে বলল, মুস্তাফিবাবুর সঙ্গে থেকে থেকে তুই তো বেশ কথা শিখে গেছিস চাঁদু!

–আমি চিরকালই ন্যায্য কথা বলি। ঠিক কিনা শংকরদা?

পলকে শংকর ম্যানেজ করে নিয়েছে পরিস্থিতিটা। বলল, ঠিকই তো।

–মেজদার অ্যাবসেন্সে কথা বলা উচিত, কি উচিত না?

কক্ষনও না। তবে কিনা তোমার মেজদাই…

আদিত্য কড়া গলায় বলল, খালি মেজদা মেজদা করছ কেন? আমি এখন এ ফ্যামিলির হেড, আমিই তো ডিসিশান নিতে পারি।

–হ্যাঁ ঠিকই। তুমিই পারো। কন্দর্প আড়চোখে ইন্দ্রাণীর দিকে তাকিয়ে নিল, আফটারঅল কাজটা তো তুমিই করবে। আমরা তো শুধু সেজেগুজে ঘুরে বেড়াব। এমনকী শংকরদাও।

পেটের ব্যথাটা চিড়িক চিড়িক লাফাচ্ছে আবার। আদিত্য কষ্টটাকে ভুলে থাকতে চাইল। ভারিকি মুখে বলল, – কি রে জয়ি, তা হলে তো হাতে আর সময় নেই!

জয়শ্রী চুপ।

-কি রে, কিছু বল।

–আমি কী বলব?

–আহা, চাঁদুর ওপর রাগ করিস কেন? চাঁদু তো সব সময়েই তোর পেছনে লাগে।

অভিমান ভাঙল জয়শ্রীর। চোখ পিটপিট করে বলল, – তিথি ধরে করবে, না ডেট ধরে?

–তিথি ধরেই তো করে সবাই, না রে চাঁদু?

–এ ডিসিশানটা দিদিই নিক। কিরে দিদি, ডেট না তিথি? কোন দিন আমাদের পুরুতঠাকুর ফ্রি থাকবে?

–মানে?

–আমি তো জানি পুরুতরা ওসব নিজেদের সুবিধে মতো ফিক্স করে।

জয়শ্রী হেসে ফেলল, – তোর সব কথাই বড় বাঁকা বাঁকা চাঁদু।

–মেনে নিলাম। তোরা কি এখন সোজা পথে যাবি?

শংকর আর জয়শ্রী মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে। কন্দর্প অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল, নাভার্স হয়ে গেলি তো? সোজা পথে না চলে চলে তোদের এই অভ্যেস হয়েছে। আমি তোদের বাড়ির দিকেই যাব, তোরা সরাসরি ফিরলে আমি আর গাড়িটা বার করি না। কি, মাথায় ঢুকল কিছু?

বাড়ি ফাঁকা হয়ে যাওয়ার পর বিছানা ছেড়ে উঠল আদিত্য। বিকেল ফুরিয়ে যেতেই শীত আরও জেঁকে বসেছে, আলোয়ান জড়িয়ে নিল গায়ে। বৃষ্টি পড়ার পর থেকে ঠাণ্ডাটা এবার হঠাৎ বেড়ে গেছে, সন্ধে হলেই গা হাত পা হিম হয়ে আসে।

বারান্দায় একটু বসার জন্য ঘর থেকে বেরোচ্ছিল আদিত্য, দরজায় ইন্দ্রাণী। শীতমাখা বাড়িতে আর একটু ঠাণ্ডা যোগ করে বলল, তোমাকে একটা কথা আমি স্পষ্ট বলে দিতে চাই।

আদিত্য ভয়ে ভয়ে তাকাল, কী কথা?

বাবার বাৎসরিকে ক’শো লোক গাণ্ডেপিণ্ডে খাবে, মাছ করবে না মাংস করবে, বিরিয়ানি রাঁধবে পোলাও বানাবে, সে তোমাদের ব্যাপার। আমি কিন্তু দশ বারো হাজার টাকার বেশি দিতে পারব না।

–তুমি টাকা দেবে কেন? টাকা তো আছে।

না। নেই।

আদিত্য ফ্যালফ্যাল তাকাল, মুস্তাফিবাবুর দেওয়া লাখ টাকা তাহলে গেল কোথায়?

–যেখানে থাকার সেখানেই আছে। ও টাকায় আমি হাত দিতে দেব না।

–কেন জানতে পারি?

–ও টাকা তিতিরের বিয়ের জন্য তোলা থাকবে।

–তিতিরের বিয়ে! আদিত্য হেসে ফেলল, সে তো এখন ঢের দেরি। তখনকার কথা তখন ভাবা যাবে।

ইন্দ্রাণীর মুখ বিদ্রুপে বেঁকে গেল, তার মধ্যে তুমি মনে হচ্ছে লাখ লাখ টাকা রোজগার করবে?

এসব ব্যঙ্গ আদিত্যকে আজকাল একটুও বেঁধে না, তবু আজ যেন সামান্য বিরক্ত হল, — কথাটা আমায় আগে বলতে পারতে। তা হলে আমি ঘটা করার ব্যাপারে যেতামই না।

–আমি বলব কেন? তোমার একটা আক্কেল বিবেচনা নেই? লোকের সামনে আমাকেই কেন যেচে মন্দ হতে হবে? যার রোজগার করার সামর্থ্য নেই, তার অত ওড়ানোর শখ আসে কোত্থেকে?

চিনচিন ভাবটা বাড়ছে ক্রমশ। আদিত্য দাঁতে দাঁত চাপল, এটা ওড়ানো নয়, ছেলে হিসেবে এটা আমার ডিউটি।

উউহ, কর্তব্য করনেওয়ালা রে! বাবা জীবিত থাকতে অনেক তো কর্তব্য করেছ, এবার মরার পরে তাঁকে একটু ক্ষ্যামা দাও।

পেটের ব্যথা সারা শরীরে যেন ছড়িয়ে পড়ল আদিত্যর, সর্বাঙ্গে কাঁটা হয়ে ফুটছে। উদ্যত ক্রোধকে কোনওক্রমে পোষ মানাল, বাবার সঙ্গে আমার কি রিলেশান, তুমি তার কী জানো? ও টাকা বাবার। বাবার অকেশনে আমি ও টাকা খরচ করব। প্রতি বছর করব।

–তাই বুঝি তাঁর মৃত্যুকামনা করেছিলে?

বড় গভীর ক্ষতয় হাত দিয়ে ফেলেছে ইন্দ্রাণী, ভেতরে জমাট পুঁজ রক্ত গলগল করে বেরিয়ে এল। বিস্ফোরিত হল আদিত্য, আর তুমি কী করেছিলে? আমি যদি মৃত্যুকামনা করে থাকি, তুমি তো খুনি। কেউ কিছু জানে না ভেবেছ, অ্যাঁ? চারদিকে ঢি ঢি পড়ে গেছে। জোর করে বাবাকে দিয়ে সই করানোর সঙ্গে সঙ্গে বাবা মারা যায়নি?

সহসা যেন বাকরোধ হয়েছে ইন্দ্রাণীর। এত বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে, মনে হয় চোখ দুটো এক্ষুনি ফেটে বেরিয়ে আসবে। ফোঁস ফোঁস শ্বাস ফেলছে, আহত নাগিনীর মতো।

হাত থেকে ঢিল ছুটে গেছে আদিত্যর, আর ফেরানোর উপায় নেই। এই কথা কি আদিত্য বলতে চেয়েছে কোনওদিন? কেন বলে ফেলল? ওই শংকরটাই যত নষ্টের গোড়া, ওর মুখ দেখলেই অনর্থ হয় বাড়িতে।

আলোয়নের আড়ালে পেট চেপে ইন্দ্রাণীর দিকে একটু এগোল আদিত্য। মিনতির সুরে বলল, – কেন আমায় রাগিয়ে দাও ইন্দু? কি কথা বলতে কী বলে ফেলি!

ইন্দ্রাণী পিছোচ্ছে পায়ে পায়ে, -তুমি আমায় ইন্দু বলে ডাকবে না। কক্ষনও না।

ইন্দু…

–ফের? আমি নিষেধ করছি। কোন অধিকারে তুমি ইন্দু বলল আমায়? বোঝার বুদ্ধি নেই তোমার সঙ্গে আমি দয়া করে ঘর করছি এতকাল?

এ কথা আদিত্যর চেয়ে কে বেশি বোঝে! তবু যেন আদিত্যর শরীরের সব শক্তি উবে গেল সহসা। সত্য জানার চেয়ে সত্যের অভিঘাত সহ্য করা অনেক বেশি কঠিন।

মাথা নিচু করে কয়েক পল দাঁড়িয়ে রইল আদিত্য। এক-পা দু-পা করে ফিরে এসেছে ঘরে। বোধহীন চৈতন্যের মাঝে প্যান্ট-শার্ট পরল, বিবশ মস্তিষ্কে বেরিয়ে এসেছে পথে। সেলিমপুরের মোড়ে এসে তিতিরকে দূরে দেখতে পেল, উল্টো দিকের ফুটপাথে একটা ছেলের সঙ্গে হাত-পা নেড়ে কথা বলছে। মেয়েকে যেন চিনতেই পারল না আদিত্য, ভাঙাচোরা উঁচুনিচু ফুটপাথ ধরে হাঁটছে। ঠোক্কর খেল দু-তিনটে, পড়তে পড়তে সামলে নিল, হাঁটছে। এই বিশাল পৃথিবীতে যেন তার কোনও ঠাঁই নেই, কোথায় যাচ্ছে এই মুহূর্তে তাও সে জানে না, হাঁটছে। কত আদিত্য যে কিলবিল করছে খাঁচায়! এক আদিত্য তাকে ঠেলে পার করাল রাস্তা, আর এক আদিত্য হেঁচকা টানে তুলে নিল বাসে।

হঠাৎ প্রচণ্ড শীত করে উঠল আদিত্যর। তাকাল এদিক-ওদিক, প্রায় আলো নেই এই এবড়ো-খেবড়ো পথে সে চলেছে কোথায়! এটা তো রেললাইন! কখন সে শেয়ালদা পৌঁছল, কখন নামল দমদমে? একটা হাফহাতা সোয়েটারও গায়ে নেই, কনকনে বাতাস ছুরির মতো শরীরে কেটে বসছে। আলোর ঝলক দেখিয়ে অবিরাম ছুটে যাচ্ছে ট্রেন। এ-পাশ দিয়ে, ও-পাশ দিয়ে। কিসের হাতছানি? মিথ্যে জেনেও মনের গভীরে একটা ক্ষীণ বিশ্বাস ছিল, তাও আজ নিবে গেল। এর পরও মানুষ বেঁচে থাকে!

আকাশ জোড়া হিমেল অন্ধকারে সহসা ভেসে উঠেছে এক আশ্চর্য জিমন্যাস্টের মুখ। প্রায় জনহীন ট্রেনের কামরায় শরীরটাকে দোমড়াচ্ছে মোচড়াচ্ছে…!

তীব্র আলো ফেলে খুব কাছে এসে পড়েছে একটা ট্রেন। ট্রেন নয়, যেন একচক্ষু মৃত্যুদূত।

ছিটকে লাইন থেকে সরে এল আদিত্য। ট্রেন চলে যাওয়ার পরই নিকষ অন্ধকার, তার মধ্য দিয়েই অভ্যস্ত ঢাল বেয়ে নেমে এল দ্রুত।

মাথা ঘুরছে, টলছে দুর্বল দেহ। আশ্চর্য, সেই কুকুরটা ঠিক চলেছে আদিত্যর পিছু পিছু। ঘেয়ো নেড়িকুত্তা লেজ নাড়ছে, তাকাচ্ছে জুলজুল।

আদিত্য বিড়বিড় করে বলল, – বেঁচে থাক ব্যাটা।

.

৮৫.

রঘুবীরের দরজায় বড়সড় তালা ঝুলছে। যৎসামান্য বাসন-কোসন থাকে দালানে, তাও আজ নেই। উনুন নিথর, স্টোভ নীরব, দেখেই বোঝা যায় এ-ঘরের বাসিন্দারা কাছেপিঠে কোথাও নেই।

আদিত্য ধপ করে দালানে বসে পড়ল। অদ্ভুত ঘোরে এতটা পথ চলে এসে শরীর এখন একেবারে ছেড়ে যাচ্ছে। অজান্তেই গুটিয়ে এল দেহ, কুঁকড়ে গেল হাত-পা। ডান পেটে ব্যথাটা চিড়িক দিয়ে উঠল একবার, ঝিমিয়ে গেল। বারবার ঘুরে তালাখানা দেখছে আদিত্য, যেন বিশ্বাস হচ্ছে না। এখানেও দরজা বন্ধ! আশপাশের ভাড়াটেদের ঘরে বাতি জ্বলছে, কথা ভেসে আসে, রান্নার গন্ধ পাওয়া যায়। কাছাকাছি এত মানুষ তবু যেন এ এক জনহীন লোকালয়।

কী হবে এখন! কোথায় যাবে! নিজের ঘরেও বুঝি এত নিরাশ্রয় লাগে না কখনও।

–কে রে? ওখানে অন্ধকারে কী হচ্ছে?

আদিত্য চমকে তাকাল। সুবল মিস্ত্রি। লো পাওয়ারের বাঘটাকে পিছনে রেখে ছায়ার মতো এগিয়ে আসছে লোকটা। একটু বা টলছে। সামনে এসে ঝুঁকল, অ, আপনি। রায়বাবু।

আদিত্য শূন্য চোখে তাকাল, এরা গেল কোথায়?

–ফুড়ৎ। তারাপীঠ গেছে। মাসি বোনপো দুজনেই।

শ্বাস ফেলল আদিত্য, ফিরবে কবে?

বলি কী করে? সকালেই তো বেরুল।

–ও। আদিত্য দেওয়াল ধরে ধরে উঠে দাঁড়াল, চলি তবে।

 এক মাথা সাদা চুল ছোট্টখাট্টো মানুষটা একটু কার্নিক মেরে দাঁড়িয়েছে। পরনে মলিন জোব্বা সোয়েটার, গায়ে তার শতেক ফুটো। চোখ টিপে বলল, -শরীরটা আপনার জুত নেই মনে হচ্ছে?

নাহ, ঠিক আছি।

বললেই হল! দেখেই বোঝা যাচ্ছে ফিউজ উড়ে গেছে। একটু বুঝি অন্তরঙ্গ হওয়ার চেষ্টা করল সুবল, চলেন আমার ঘরে। বডিতে একটু চার্জ দিয়ে নিন।

বিজলিকে ডাকাডাকি শুরু করেছে সুবল। একই জায়গায় দাঁড়িয়ে ষাঁড়ের মতো চেলাচ্ছে।

রোখা মেজাজে বাবাকে গাল পাড়তে পাড়তে বেরিয়ে এল বিজলি। আদিত্যকে দেখেই মুখভাব আমূল বদলে গেছে, এ কি রায়দা, কী হয়েছে আপনার? এমন দেখায় কেন?

সুবল মিনমিন স্বরে বলল, রঘু নেই দেখে রায়বাবু বড় ভেঙে পড়েছে।

থামো তো। আধ পাঁইট গিলেই চোখের মাথা খেয়ে বসে আছ? দেখছ না, মানুষটা কেমন কাঁপছে।

আদিত্য অস্ফুটে বলল, -বড় শীত।

আহারে মরে যাই। গায়ে সোয়েটার নেই কেন?

 ভুলে গেছি।

–দু পাত্তর চড়িয়ে নিন, জাড় কেটে যাবে। সুবল দাঁত বার করে হাসল, রায়বাবুকে ঘরে নিয়ে বসা রে বিজলি। আর কটা টাকা দে….

–চুপ, একদম চুপ। ঘরদোর তো তোমার ছেলেরা পায়খানা করে রেখেছে। ওখানে এমন মানী লোককে বসানো যায়!….দাঁড়ান রায়দা, আসছি।

বলেই মিনিট খানেকের জন্য উবে গেল বিজলি। ফিরেছে চাবির গোছা হাতে। তালা খুলছে।

আদিত্য একটু স্বস্তি বোধ করল। সুবল তার অচেনা নয়, লোকও খারাপ নয়, তবে বড্ড বেশি প্যানর-প্যানর করে। মাঝে মাঝে পয়সাকড়িও চায়। এখন ঘরে নিয়ে গেলে নির্ঘাত অতীতে কত বড় বড় কাজ করেছে তার ফিরিস্তি দিতে দিতে হাত পাতত। পকেটে আজ মানিব্যাগও নেই, টাকা না পেলে নেশার ঘোরে কি মুখখিস্তি করত সুবল কে জানে! বেচারা সুবল, বোঝে না যার কাছে টাকা চায় সে তার চেয়েও বড় ভিখিরি।

দরজা খুলে বিজলি ঘরের আলো জ্বেলেছে। ডাকল, – আসুন রায়দা, আপনার কথা ভেবেই। রঘুদা আমার কাছে চাবি রেখে গেছে।

আদিত্য ফ্যালফ্যাল তাকাল, জানত আমি আসব!

–আনদাজ করেছিল। সুবল গুটি গুটি পায়ে ঘরে ঢোকার চেষ্টা করছে, সেদিকে চোখ পড়ে গেছে বিজলির। ভুরু পাকিয়ে বলল, না। যাও তুমি।

–একটু বসি। গলাটাও ভাল করে ভেজেনি….

না, যাও। রঘুদা তোমায় এ ঘরে পা দিতে বারণ করেছে।

–তাহলে দশটা টাকা দে।

 বাবার দিকে কুট চোখে তাকাল বিজলি। আঁচলের খুঁট থেকে দুমড়ানো একটা নোট বার করে ছুঁড়ে দিল, রোজগারের মুরোদ নেই, গেলার শখ ষোলো আনা! বাপ, না মুদ্দোফরাস। নিঘিন্নের নিঘিন্নে। মেয়ের রক্তখেকো….

চলে যাচ্ছে সুবল। ভাঙাচোরা পায়ে। একটু যেন কুঁজো হয়ে। বুকটা হঠাৎ কুয়াশায় ভরে গেল আদিত্যর। ঝুম হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

বিজলির ঝনঝনে মুখ পলকে আবার স্বাভাবিক। খাটের চাদর ঝাড়তে ঝাড়তে বলল, বসুন রায়দা। রেস্ট করে নিন।

আদিত্য বিড়বিড় করে উঠল, মানুষটা বড় দুঃখী।

–দুঃখী, না কচু। শয়তানের জাণ্ড। ঘরাঞ্চি ধরতে গেলে হাত কাঁপে, লোকের ঘটিবাটি সরানোর বেলায় হাত একেবারে এতখানি লম্বা! বেলচা হয়ে আছে! ওই ছোঁচা লোকের জ্বালায়। আমি এখন আর কোথাও মুখ দেখাতে পারি না, জানেন। এই পরশু এঘর থেকে একখানা কাঁসার গেলাস চুরি করতে গেছিল, রঘুদা হাতেনাতে ধরেছে।

আদিত্য আবার বিড়বিড় করে বলল, অভাব বড় জ্বালা।

–আপনি আর ধুনো দেবেন না তো রায়দা। আমি বলে জ্বলেপুড়ে মরে গেলাম। কই, কখনও আমার জ্বালাটা তো দেখেন না?

আদিত্যর স্বর আরও নেমে গেল, হ্যাঁ, তুমিও বড় দুঃখী।

বিজলি হেসে ফেলল, – বোঝেন?

বুঝি বৈকি।

কী করে বোঝেন?

–দেখেই বুঝি।

বিজলি খিলখিল হেসে উঠল, রঘুদা ঠিকই বলে। আপনি হলেন গিয়ে দুঃখের গুরুঠাকুর।

বলে?

বলে গো বলে। ঝুপ করে হাসি নিবল বিজলির, বলে আমাদের সকলের দুঃখ এক ঝুড়িতে ভরলে যতটা হয়, আপনি তার থেকেও বেশি দুঃখী। বলে, মানুষটা বড় একলা রে বিজলি, সব থেকেও কেউ নেই। নইলে কি আর সংসার ফেলে সন্নিসি হতে চায়! এই তো যাওয়ার আগেও বলে গেল, রায়দা এলে ঘর খুলে দিস বিজুলি। এখানে একটু জুড়োতে আসে মানুষটা, এসে যেন ফিরে না যায়।

আদিত্যর শরীরে কাঁপুনিটা ফিরে আসছিল। এক বিস্তারিত যন্ত্রণায় বিকৃত হয়ে গেল মুখ। কষ্টের উৎসটা যে ঠিক কোথায়? পেটে? বুকে? নাকি কোন গহীন অবচেতনায়?

হতচকিত বিজলি ছুটে এসেছে, কি হল রায়দা? অমন করেন কেন?

আদিত্য বিজলির হাত খামচে ধরল, -কষ্ট।

–ইশ, গা যে একেবারে হিম গো!

আদিত্য আবার বলল, -বড় কষ্ট।

আদিত্যকে ধরে ধরে বিছানায় নিয়ে এল বিজলি। শুইয়ে দিয়েছে। নিজের সস্তা দামের চাদরখানা খুলে বিছিয়ে দিল গায়ে। ঠকঠক কাঁপছে আদিত্য, দাঁতে দাঁত লেগে যাচ্ছে। চাদরের ওপর কম্বল চাপাল বিজলি। হাতে হাত ঘষে ঘষে উত্তাপ আনার চেষ্টা করছে।

চোখ বুজে ফেলল আদিত্য। এই উষ্ণতাটুকুর জন্যই কি এতক্ষণ তৃষিত ছিল হৃদয়!

আদিত্যর চোখের কোলে এক বিন্দু জল জমেছে। আঁচল দিয়ে মুছে দিল বিজলি। মাথার নীচে একটা বালিশ দিয়ে বলল, চা খান একটু করে দিচ্ছি।

আদিত্য দু দিকে মাথা নাড়ল। চা আর বেশি কী উত্তাপ সঞ্চার করবে!

–খাওয়া-দাওয়া জুটেছে কিছু?

 আদিত্যর ঠোঁট নড়ল। শব্দ নয়, বাতাস বেরোল শুধু। সে বাতাস বুঝি বলতে চাইল যার জীবনে ক্ষিধেই ক্ষিধে, তার ক্ষিধে কি শুধুমাত্র খাবারে মেটে! নাড়িভুড়ি পাক খাক, অগ্ন্যাশয় হাহাকার করুক, কোনও খাবারেই আদিত্যর আর রুচি নেই।

বিজলি হাত বুলিয়ে দিচ্ছে মাথায়। কোমল সতেজ স্পর্শ। যেন বড় বড় দানার বৃষ্টিফোঁটা মাটি ভিজিয়ে দিল, রোমে রোমে অঙ্কুরিত হচ্ছে প্রাণ।

আরও কাছে নেমে এল বিজলির মুখ। তার গাঢ় নিশ্বাস আদিত্যর গালে এসে ঠেকছে। আদিত্য হারিয়ে গেল ধীরে ধীরে, ডুবে গেল। বাতাসহীন নিমজ্জন নয়, এক অনন্ত সম্মোহক স্রোতে মিশে যাচ্ছে চেতনা। দিন মাস বছর টপকে উল্টোপানে ধেয়ে গেল মন। কুলু কুলু ধ্বনি শুনছে একটা। গভীরে, অনেক গভীরে। সময়ের নিবিড় অরণ্য পেরিয়ে সে তবে এতদিনে এল!

দু হাতে বিজলিকে আঁকড়ে ধরল আদিত্য, ইন্দু..ইন্দু…আমার ইন্দ্রাণী…

কাচভাঙা ঝনঝনে হাসিতে ভেঙে পড়েছে বিজলি, ইন্দু কে গো রায়দা? আপনার বউ? হিহি আমি কিন্তু আপনার বউ নই।

সপাং করে চাবুক খেল আদিত্য। বিজলিকে ছেড়ে ধড়মড়িয়ে উঠে বসেছে। মেকি কেয়াফুলের গন্ধ এতক্ষণে ঝাপটা মেরেছে নাকে। গা গুলিয়ে উঠল।

কিগো, রাগ হয়ে গেল?

আদিত্য নিঃশব্দে মাথা নাড়ল।

বউয়ের কথা মনে পড়ছে?

ইন্দ্রাণীর বিকেলের মুখটা ক্ষীণ মনে পড়ল আদিত্যর। গত জন্মের স্মৃতির মতো। জোরে জোরে মাথা দোলাল। না।

–মনে পড়া তো উচিত নয়। যে বউ সকাল-সন্ধে তোমায় খেদায়, তার কথা তুমি ভাববে কেন?

–ভাবব না?

–মোটেও না। বলতে বলতে অবলীলায় আদিত্যর কাঁধে হাত তুলে দিল বিজলি, তোমাকেও বউ নেয় না, আমাকেও বর নেয় না। আমাদের দুজনের খুব মিল, তাই না গো?

–হুঁ, অনেকটা তাই বটে।

অনেকটা নয় গো, পুরোটাই। আমাদের অৰ্দেষ্টই খারাপ। তুমিও বজ্জাত লোক নও, আমিও খুব হারামী মেয়েছেলে ছিলাম না। অথচ দ্যাখো, দুজনেরই কেমন কপালটা পোড়া। এর কি কোনও বিহিত নেই সংসারে?

আদিত্য বিমূঢ় চোখে বিজলির দিকে তাকিয়ে আছে। অসংকোচে তাকে তুমি তুমি করছে সুবল মিস্ত্রির মেয়েটা, কই তেমন খারাপ লাগছে না তো! নাকের পাটা ফুলছে বিজলির, চোখের মণি কাঁপছে ডাইনে বাঁয়ে। বিজলির আগুন নিশ্বাসে পুড়ে গেল আদিত্য।

তীব্র মেয়েলি স্বরে বিজলি বলল, – বিহিত তো একটাই গো। আজ রাতে তুমি না হয় আমার বর হলে, আমি তোমার বউ।

বলেই উঠে গেছে বিজলি। উঁকি মেরে বাইরেটা দেখে নিল একবার। বেমালুম দরজায় খিল তুলে দিল। প্রায় কোল ঘেঁষে বসেছে আদিত্যর। বুক থেকে আঁচল খসে গেছে। সাপিনীর মতো বেষ্টন করল গলা। ঘন হচ্ছে আরও। গরম ঠোঁট শুষে নিচ্ছে শীতলতা। স্খলিত স্বর হিসহিস করে উঠল, নাও গো। শান্তি নাও।

অচেনা নারীদেহের নিষ্পেষণে ছটফট করে উঠল আদিত্য। দুর্বল হাতে সরানোর চেষ্টা করল মেয়েটাকে। পারছে না। নাকি চাইছে না?

মেকি কেয়াফুলের গন্ধ ক্রমশ তীব্র, আরও তীব্র। গন্ধ এখন আর গন্ধ নয়, ঝাঁঝ। কানের কাছে পোষা বেড়ালের মতো আদুরে শব্দ করছে বিজলি। ঝিমঝিম করে উঠল মাথা।

বিবশ আদিত্য ইচ্ছে অনিচ্ছের মধ্যিখানে। কত বছর পর একটা আস্ত মেয়েমানুষ তাকে আহ্বান করছে! শেষ সেই তিতির হওয়ার আগে ইন্দ্রাণী…

মস্তিষ্কে ভূমিকম্প হয়ে গেল আদিত্যর। এ কে তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধে! মাংস মাংস মাংস! শুধুই রিরংসা!

আদিত্য ক্লান্ত গলায় বলল, তেষ্টা তেষ্টা।

বিজলি ফিসফিস করল, মিটছে না?

বড় গলা শুকিয়ে গেছে।

বুঝিবা সামান্য মায়া হল বিজলির। আলগা আঙুল বোলাল আদিত্যর নাকে গালে কণ্ঠায়। ভূতুড়ে গলায় বলল, বাবার একটা পাঁইট লুকিয়ে রেখেছি। চলবে?

আদিত্য পেটে হাত বোলাল। অনেকক্ষণ ঘাপটি মেরে আছে ব্যথাটা। ধরা গলায় বলল, একটু খাই।

আঁচল গুছিয়ে কি যেন ভাবল বিজলি। হয়তো অদৃষ্টের কথা। হয়তো যে লোকটা তাকে ছেড়ে একটা ক্ষয়াটে মেয়ে নিয়ে ঘর করছে, তার কথা। কিংবা দেহে জ্বালা পোড়া ধরানো এই মুহূর্তটার কথা। নিঃসাড়ে খিল খুলে বেরিয়ে গেল।

নিশ্বাস নেওয়ার অবকাশটুকু পেয়ে আদিত্য খাট থেকে নামল। ঘোর কাটেনি এখনও, ঘোলাটে চোখে শ্রীহীন ঘরখানা ছায়াচ্ছন্ন লাগে। হলদেটে আলো পড়েও আলমারি ট্রাঙ্ক পালঙ্কের খাঁজে খাঁজে কালির পোঁচ। আদিত্যও কি এই আঁধারেরই অংশ? দেওয়াল থেকে হাত-আয়নাখানা পাড়ল আদিত্য। মাথা ঝাঁকিয়ে দেখছে নিজের মুখ। কদিন দাড়ি কামানো হয়নি, খোঁচা খোঁচা আগাছায় ভরে গেছে গাল। চোখ দুখানা গর্তে ঢুকে গেছে, ঠেলে উঠেছে হনু, কেমন যেন চোরের মতো লাগছে নিজেকে। এ কি মুখেরই প্রতিবিম্ব? না মনেরও?

কোঁচড়ে বোতল নিয়ে ফিরল বিজলি। আবার দরজায় খিল তুলছে, তোমার ভাত বসিয়ে দিয়ে এলাম। রঘুদার মতো মাছ মাংস খাওয়াতে পারব না। শুধু আলুকপির তরকারিতে হবে তো?

আদিত্যর ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটল। মেয়েটা খ্যাপা বাঘিনী হয়ে আছে, তবু যত্নআত্তির কথা ভোলেনি। এই মেয়েটাকে দেখে এখন আর একটুও কাম জাগছে না, বরং যেন স্নেহ করতে সাধ। হয়।

বিজলি কৌটোবাটা ঘেঁটে ছোলাভাজা বার করল কিছুটা। গ্লাসে ঢকঢক পানীয় ঢালল। ডিশ গ্লাস খাটে সাজিয়ে বলল, জল দেব?

হাতের ইশারায় বারণ করল আদিত্য। বিছানায় ফিরে বিজলির পাশটিতে বসেছে, তুই বড় ভাল মেয়ে রে বিজলি।

বিজলি কাঁধে মাথা রাখল, কতটা ভাল? তোমার বউয়ের চেয়েও?

–সে তার মতো। তুই তোর মতো।

তার মানে সেও ভাল?

–মানুষ কখনও খারাপ হয় না রে বিজলি। যাকে তুই খুব মন্দ ভাবিস তাকেও ঝেঁকে দ্যাখ। দেখবি তারও অনেক জ্বালা।

বিজলি কয়েক পল ভাবল কি যেন। ঘাড় টেরা করে আদিত্যকে দেখল, সেই লোকটাকেও তবে তুমি ভাল বলো?

-কোন লোকটা? কে?

–আমার বর গো। সাত পাকে বাঁধা সোয়ামী। বিনে দোষে দূর দূর করে তাড়াল আমায়, অন্যের বউ ভাগিয়ে এনে ঘর বাঁধল। কি? না আমাকে বিয়ে করার আগেই কোথায় নাকি তার সঙ্গে আশনাই হয়েছিল। ভাল ভাল। তাতেই যদি মজেছিলি, পিরীত দেখিয়ে আমাকে বিয়ে করতে যাওয়া কেন? একেও তুমি ভাল লোক বলবে?

আদিত্যর গায়ে কাঁটা দিল। এক সঙ্গে অনেকখানি তরল ঢেলে দিয়েছে গলায়। জোর একটা হেঁচকি উঠল। বুকের মধ্যে শত শত বিষফোঁড়া জানান দিচ্ছে অকস্মাৎ। ঘুমিয়ে থাকা ব্যথাটা লাফিয়ে উঠল জোর। বল্লমের খোঁচা দিচ্ছে পেটে। যন্ত্রণায় বেঁকেচুরে গেল মুখমণ্ডল, দাঁতে দাঁত চাপল আদিত্য।

বিজলি বুকে হাত রেখেছে, কি হল গো? কী কষ্ট?

পলকের জন্য মনে হল বিজলি নয়, এ বুঝি তিতিরেরই ছোঁয়া। পরক্ষণে ইন্দ্রাণী আঙুল নাচাচ্ছে। তোমার সঙ্গে এতকাল দয়া করে ঘর করেছি, বুঝতে পারো না!

এক চুমুকে গ্লাস শেষ। গলা বেয়ে দৌড়ে গেল তরল, খাদ্যনালী জ্বলে উঠল দাউ দাউ। পেট থেকে যন্ত্রণাটা ঠিকরে এল ওপরে। একটা বল্লম হাজারও খণ্ড হয়ে বিধে যাচ্ছে যকৃতে। দুমড়ে গেল শরীর, তবু আবার বোতলের দিকে হাত বাড়াল আদিত্য।

বিজলি বোতলটা কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। পারল না। সবটুকু দিশি মদ নিমেষে চালান হয়ে গেল আদিত্যর পেটে। যন্ত্রণায় কোঁকাচ্ছে, নীল হয়ে গেছে মুখ। পাগলের মতো মাথা ঝাঁকাছে। দু হাত মুঠো করে আছাড় মারছে বিছানায়।

বিজলি দরজা খুলে হাউমাউ চিৎকার জুড়ল, এ কি সব্বোনাশ হল গো! কে কোথায় আছ গো! মানুষটা যে বেঘোরে প্রাণ হারাচ্ছে গো!

মুহূর্তে ঘরে ভিড় জমে গেছে। কিলবিল করছে মুখ, অজস্র কোলাহল। কিছু দেখতে পাচ্ছে না আদিত্য, শুনতে পাচ্ছে না। নিকষ এক অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে সে, তলিয়ে যাচ্ছে, তলিয়ে যাচ্ছে …।

চৈতন্যের শেষ সীমায় পৌঁছোনোর আগে একটাই শুধু স্বর শুনতে পেল আদিত্য।

মরতে পারো না তুমি!

.

হিমেল ভোর। বাড়িতে ইন্দ্রাণী ছাড়া এখনও কেউ জাগেনি। রাতভর যার ঘুমই হয় না তার আর জাগরণে অসুবিধে কি!

স্কুলের জন্য তৈরি হচ্ছিল ইন্দ্রাণী। কমলা-সবুজ ডুরে সাদা শাড়ির আঁচল কাঁধে ক্লিপ করে ঠোঁটে একটু ক্রিম লাগাল, ছোট ব্যাগ খুলে দেখে নিল খুচরো পয়সা আছে কিনা। গাটা ম্যাজম্যাজ করছে খুব, মাথা টিপ টিপ, তবু যাবে স্কুলে। অলস শুয়ে বসে থাকলে চিন্তারা বেশি কামড় বসায়, তার থেকে স্কুলই ভাল। কিছুক্ষণ অন্তত মন অন্য দিকে রাখা যায়।

বাড়ির ভেতরে এখনও চাপ চাপ অন্ধকার। রান্নাঘরের আলো জ্বেলে গ্যাসে চায়ের জল চড়াল ইন্দ্রাণী। ফ্রিজ থেকে দুধের ডেকচি বার করে ঢিমে আঁচে বসাল। শীত করছে খুব, ঘর থেকে শাল এনে জড়াল গায়ে।

তখনই শব্দটা পেল। ট্যাক্সি থামার। কে যেন চেঁচাচ্ছে, ওই বাড়ি ওই বাড়ি।

কে জানে কেন ইন্দ্রাণীর বুকটা হঠাৎ ছ্যাঁত করে উঠল। আদিত্য ফিরল কি? কিন্তু সে তো ট্যাক্সিতে ফেরে না কখনও, এত সকালে তো নয়ই। কাল দুম করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল, সবে জ্বর থেকে উঠেছে, এই ঠাণ্ডায় সারা রাত কোথায় ছিল কে জানে! তার কিছু হয়ে গেল না তো!

বারান্দায় উঁকি মারতে এসে হকচকিয়ে গেল ইন্দ্রাণী। ট্যাক্সি তার দরজাতেই থেমেছে, বন্ধ কাচের জানলায় একটা উসকোখুসকো চুল মেয়ের মুখ দেখা যায়। মাঝবয়সী একটা লোক গ্রিলগেটের ওপারে দাঁড়িয়ে ডোরবেল হাতড়াচ্ছে। দেখে মনে হয় মিস্ত্রি-মজুর ক্লাসের।

ইন্দ্রাণী বেরিয়ে এল, -কাকে চাই?

–আদিত্য রায় এ বাড়িতে থাকেন?

–হ্যাঁ। কেন? ইন্দ্রাণীর গলা কেঁপে গেল।

–উনি খুব অসুস্থ। ওই ট্যাক্সিতে রয়েছেন।

 ইন্দ্রাণী প্রায় আর্তনাদ করে উঠল, –কী হয়েছে?

নোংরা মাফলার জড়ানো, মলিন ফুলহাতা সোয়েটার পরা লোকটা ঘাড় চুলকোচ্ছে, কাল ইয়ে খাচ্ছিলেন, হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে গেলেন। পেটে হেভি পেন। বিজলি একা আনতে ভরসা পাচ্ছিল না…

ইন্দ্রাণী ঝটিতি তালা খুলল। দৌড়ে নেমে গেছে ট্যাক্সির কাছে। জানলায় চোখ পড়তেই পাথর হয়ে গেল। একটা সস্তা উগ্র মেয়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে আদিত্য, মেয়েটা এক হাতে বেড় দিয়ে আছে তাকে।

ইন্দ্রাণীকে দেখেই জানলার কাচ নামাল মেয়েটা, পৌঁছে দিতে এলাম বউদি। ডাক্তারবাবু বলছিল সোজা হাসপাতালে নিয়ে যেতে, আমি ভাবলাম…। খুব বেদনা হচ্ছিল বউদি। ডাক্তারবাবু এসে ইনজেকশান দিয়েছে।

ঝাঁকুনি খেয়ে সংবিতে ফিরল ইন্দ্রাণী। ছি ছি ছি, শেষ পর্যন্ত একটা নোংরা মেয়ের সঙ্গে আদিত্য…! কত দিনের সম্পর্ক? এর ঘরেই রাত কাটায়? মেয়েটার সাহস কী! দাঁত বার করে বউদি বউদি বলছে! এক্ষুনি ঢুকে গিয়ে ইন্দ্রাণী দরজা বন্ধ করে দেবে! চিৎকার করে বলবে, যেখান থেকে এসেছ সেই নরকেই নিয়ে চলে যাও!

ঘৃণায় অপমানে বিতৃষ্ণায় লজ্জায় মুখে কথা ফুটছে না ইন্দ্রাণীর। অসাড় পায়ে ফিরে এল বাড়িতে। কন্দর্পর দরজায় ধাক্কা দিল।

চোখ রগড়াতে রগড়াতে উঠে এসেছে কন্দর্প, –হল কী? হল্লা কিসের?

–তোমার দাদা ফিরেছে। তাকে ট্যাক্সি থেকে নামাও গে।

–কেন? কী হয়েছে দাদার?

 ইন্দ্রাণীর স্বর হিমাঙ্কের নীচে নেমে গেল, নিজে গিয়ে দ্যাখো।

 কন্দর্প পড়িমরি করে ছুটল। তিতিরেরও ঘুম ভেঙে গেছে, বিস্ফারিত চোখে দাঁড়িয়ে আছে বারান্দায়। দাদাকে নামাচ্ছে কন্দর্প, লোকটা আর মেয়েছেলেটার সঙ্গে কথা বলছে টুকটাক। টেনে হিঁচড়ে দাদাকে এনে শোওয়াল ঘরে। ছুটে গিয়ে ট্যাক্সিভাড়া দিয়ে দিল লোকটাকে।

ট্যাক্সি চলে গেল।

কাঠ হয়ে নিজের ঘরে দাঁড়িয়ে ছিল ইন্দ্রাণী। নড়ল এতক্ষণে। ঘিনঘিনে দুঃস্বপ্নটা চোখের সামনে থেকে সরে যেতেই ব্যাগ তুলে নিয়েছে কাঁধে। চটি পরে আদিত্যর ঘরে ঢুকল। তিতির আর কন্দর্প কথা বলছিল নিচু গলায়, তাকে দেখেই চুপ।

আদিত্যর দিকে তাকিয়েও চোখ সরিয়ে নিল ইন্দ্রাণী। কঠিন গলায় বলল, চাঁদু, এ ঘরে ওকে রাখবে না। হাসপাতালে ফেলে দিয়ে এসো। স্কুল থেকে ফিরে এখানে যেন না দেখি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *