৭১-৭৫. পথ যে আর ফুরোয় না

বাড়ি কি আজ আপনার দূরে সরে গেল রঘুবীরবাবু? পথ যে আর ফুরোয় না।

পথের আর দোষ কী রায়দা। যা টিকিটিকি হাঁটছেন।

কী করি। পা যে চলে না।

–তবু এই বিদঘুটে পথ ধরে হাঁটা চাই! বলিহারি খেয়াল বটে। দিব্যি সুন্দর গড়গড়ে রাস্তা রয়েছে নীচে, কোথায় সেখান দিয়ে ঝটাসে বাড়ি পৌঁছে যাব তা নয়..রোজ এই লাইন ধরে হাঁটো!

–আপনার বুঝি ভয় লাগে?

–লাগারই তো কথা। চারদিক লাইনে লাইনে ছয়লাপ, সামনে পেছনে জনমনিষ্যি নেই, ভাঙা পাথরে টাল খেয়ে খেয়ে আমরা দুই পাষণ্ড হাঁটছি, কান ঘেঁষে হুমহাম ট্রেন ছুটে যাচ্ছে..এতেও মানুষের গা ছমছম করবে না? রঘুবীর চোখ চালিয়ে নিকট ব্রহ্মাণ্ডটুকু দেখে নিল, তায় আবার আঁধার নামছে। চলেন, নীচে নেমে যাই।

–ওই হট্টমেলার পথ আমার ভাল লাগে না। এই তো বেশ ফুরফুর হাওয়া দিচ্ছে, লাইন থেকে শব্দ উঠছে ঝিনঝিন, কোনও চেল্লামিল্লি নেই, ঝুটঝামেলা নেই… বেশ লাগছে।

–তাহলে আর কি। হাঁটুন মনের সুখে।

হাঁটছি তো। শুধু আপনার বাড়িটা যদি একটু কাছে এসে যেত!

সব সুখ এক সঙ্গে হয় না রায়দা। তাড়াতাড়ি পৌঁছতে চান, অথচ যাবেন ঘুরপথে…

–এ পথ যে আমায় টানে রঘুবীরবাবু। এই যে ডাউন লাইন দিয়ে গুমগুম করে ট্রেনটা চলে গেল, অনেকটা মৃত্যুদূতের মতো…একটু এদিক ওদিক হলে আমি তো ট্রেনটায় কাটা পড়তেও পারতাম। কিন্তু পড়লাম না। এই যে মৃত্যুর পাশে পাশে হাঁটা, এক চুলের জন্য বেঁচে থাকা, এটা ভারি মজার না?

–আপনি ভাবুক মানুষ, আপনার কত কি মনে আসে।

 –আগে এমনটা হত না। আজকাল মনে হয়।

–আপনার মধ্যে কি মৃত্যু-ইচ্ছে জাগল রায়দা?

–না তো। সেভাবে তো ভাবিনি কোনওদিন।

–তবে এই মৃত্যুর পাশ দিয়ে হাঁটা, বেঁচে থাকা, এ সব চিন্তা আসে কেন? আপনাকে তো কখনও কোনও ঝুঁকি নিয়ে জীবন কাটাতে হয়নি। টুপ করে রইস ফ্যামিলিতে জন্মেছেন, অন্নকষ্ট টের পাননি… ভাতের থালার সামনে বাবুটি হয়ে বসেছেন ওমনি চোৰ্য্যচোষ্য এসে গেছে.ভাল জামাকাপড়টি পরেছেন, আতরটি মেখেছেন, টেরি কেটেছেন…রোদে পোড়েননি, জলে ভেজেননি…আপনি তো মশাই সুখী মানুষ… বাঁচা-মরার আপনি জানেন কী? জানি আমি। আমার মাসি। আমরা।

তা বটে। রঘুবীরের মতো বর্ণময় জীবন আদিত্যর নয়। বর্ণময়, না বিবর্ণ? কোন শৈশবে পিতৃহীন হয়েছে রঘুবীর। পুরুত বাপ যজমানবাড়ি থেকে ফেরার পথে সর্পাঘাতে প্রাণ হারিয়েছিল বেঘোরে। তখন রঘুবীর কতটুকু? বড়জোর সাত, কি আট। কুলগাছিয়ায় মনিহারি দোকান ছিল কাকার, পিসি পিসের তো রমরমা অবস্থা। সত্তর বিঘে জমি, কোঠা বাড়ি, মাছ ভর্তি পুকুর, গোয়ালে গরু। তা কাকা পিসি কেউ ঠাঁই দিল না, পেটের জ্বালায় মায়ে-পোয়ে চলে এল মাসির দরজায়। এই মধুগড়ে। মেসোর তখন নাকি জ্যোতিষে খুব পশার। দমদম বেলঘরিয়া ব্যারাকপুর বারাসত কোখকে না লোক আসে মেসোর কাছে। বিশ পঞ্চাশ মাইল দূরের লোকরাও নাকি এক ডাকে চিনত রমেশ ঠাকুরকে। সেই মেসোই আশ্রয় দিল। এক দুটো বছর পেটে কোনও টান পড়েনি, মেসো স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছে রঘুবীরকে, মাস্টাররা বলে রঘুবীরের নাকি অঙ্কে খুব মাথা, বড় সুখে কাটছিল দিন। বছর দুয়েকের মাথায় হঠাৎ একদিন রঘুবীরের মাকে নিয়ে নিপাত্তা হয়ে গেল রমেশ ঠাকুর। আশ্চর্য, মাসি কপাল চাপড়াল না, রঘুবীরকে গালমন্দ করল না, উল্টে দশ বছরের ছেলেটাকে দু হাতে আঁকড়ে ধরল। হয়তো মহিলার ছেলেপুলে ছিল না বলেই অমনটা হয়েছিল। হয়তো বোনের ওপর শোধ নিতেই বেশি বেশি করে দখল করার চেষ্টা করেছিল রঘুবীরকে। কিন্তু মাসি বোনগোর তখন চলে কিসে? ঘরের টাকা সবই তো চেঁচেপুঁছে নিয়ে গেছে রমেশ ঠাকুর। প্রাণের দায়ে পনেরো-বিশ টাকা ভাড়ায় তখনই নাকি রিফিউজিদের এনে ঘরে ঘরে বসিয়েছিল মাসি। তা ওই পাঁচঘর ভাড়াটে থেকে আর কটা পয়সা আসে? একশো টাকাও হয় কি হয় না। ঘরে বসে বড়ি আচার বানাতে শুরু করল মাসি। তার হাতের বড়ি আচার এখনও লোকে কিনে নিয়ে যায়, আদিত্যও দেখেছে। রঘুবীরও বসে থাকেনি। স্কুলের বই নর্দমায় ফেলে দিয়ে সেই দশ বছর বয়স থেকে নেমে পড়েছে রোজগারের ধান্দায়। পুওর সোল! দুটো পয়সার জন্য কী করেছে! মাটি কেটেছে, রাস্তা কুপিয়েছে, বড়লোকদের বাড়িতে গিয়ে ফাইফরমাশ খেটেছে। একবার নাকি কোন এক বাবুর বোতল থেকে মাল চুরি করে খেয়েছিল, ধরা পড়ে পিটুনিও খেয়েছিল খুব। তারপর খানিক বড় হয়ে ড্রাইভিং শেখার সাধ জাগল। মাসি খেয়ে না-খেয়ে পয়সা দিল, ট্যাক্সি চালাতে গিয়ে অ্যাক্সিডেন্ট ঘটিয়ে লাইসেন্স খেয়াল রঘুবীর। আবার বেনামে লাইসেন্স করাল, ট্রাক চালাবে। বেলডাঙার কাছে রঘুবীরের ট্রাক লুঠ হল, লোহার ডাণ্ডা দিয়ে শিরদাঁড়ায় মেরেছিল ডাকাতরা, আট মাস হাসপাতালে পড়ে রইল রঘুবীর। আবার সিধে হল। আবার স্টিয়ারিং ধরল। পারল না, থকে গেল। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ড্রাইভিং সিটে বসে থাকা শিরদাঁড়া বেগড়বাঁই শুরু করল। লাভের মধ্যে লাভ, মদের নেশায় আরও চোস্ত হয়ে উঠল রঘুবীর, পেটের ব্যথাটাও মোটামুটি সঙ্গী হয়ে গেল। মাঝে মাঝেই হাসপাতালে যায়, সুস্থ হয়ে ওঠে, আবার ফিরে নেশা শুরু হয়। এদিকে মাসিরও আর শরীর চলে না, ওই বকাসুরকে সেই বা আর কতদিন বসিয়ে বসিয়ে খাওয়ায়! একদিন রমেশ ঠাকুরের পুঁথিপত্রের ধুলো ঝেড়ে, তিলক কেটে রঘুবীর বসে পড়ল জ্যোতিষচচায়। যা দু-চার পয়সা আসে। ভাত না জুটুক, মাল তো জুটবে।

এ সব কষ্টের কথাও হালকা চালে বলে রঘুবীর। রসিয়ে রসিয়ে। যেন নিজের নয়, অন্য কারুর জীবনকাহিনী শোনাচ্ছে।

একদিন আদিত্য চেপে ধরেছিল, তবে যে আপনি বলতেন, আপনার জ্যোতিষ তন্ত্রমন্ত্র সব আপনার বাবার কাছে শেখা?

রঘুবীর খ্যাঁক খ্যাঁক হেসেছিল, এই লাইনে ওসব বলতে হয়, নইলে বাজার ধরা যায় না।

আমি আপনার বাজার? আপনি আমায় মিথ্যে বলেছিলেন?

–হাসপাতালে যখন আপনার সঙ্গে প্রথম পরিচয়, তখন তো আপনি আমার বাজারই ছিলেন রায়দা। তা ছাড়া মিছে কথা তো বলিনি। মায়ের নাগর বাপ ছাড়া আর কি? তার দেখানো রাস্তাতেই পেট পালছি, মহাগুরুই বা সে আমার নয় কেন?

সত্যি মিথ্যে যাই বলুক, লোকটা কথার জাদু জানে বটে। ভাগ্য গণনা করে কত প্রভাবশালী মানুষকেও জপিয়ে ফেলে। টেকনিকও কী বিচিত্র! কমবয়সী ছেলেমেয়ে এলে সমস্যা দুটো। প্রেম আর পরীক্ষা পাস। বড়জোর চাকরি চাই। মাঝবয়সী মেয়ে হলে বিপথগামী স্বামী, সন্তানহীনতা। মাঝবয়সী পুরুষ মানে চাকরিতে পোমোশান, বদলি, কখনও সখনও জমিবাড়ি মামলা বিবাদ। প্রৌঢ়ের সমস্যা মেয়ের বিয়ে, ছেলের দুর্মতি। আর অবাঙালি খদ্দের যদি আসে, এই মারোয়াড়ি কি গুজরাটি, তাদের জগতে তিনটি প্রবলেম, শেয়ার, ব্যবসা, নাফা। কোন গ্রহ কিসের কারক, একাদশপতি, লগ্নাধিপতি, অষ্টম স্থান, পঞ্চম স্থান, শনির সাড়ে সাতি, কোন গ্রহকে ঠাণ্ডা করতে কোন পাথর ধারণ জরুরি, সব বেশ ভালই আয়ত্ত করে রেখেছে রঘুবীর। নিজের ঘরে বসেই টুকটাক ব্যবসা চালিয়ে যায়। সোনার দোকান বাঁধা আছে, খদ্দের পাঠালে কমিশানও বাঁধা। তবে তার মধুগড়ের আস্তানায় তেমন শাঁসালো পার্টি আর আসে কটা! আর্জেন্টিনার কাট পান্না বা বৈদূর্যমণিই বা কজন ধারণ করতে পারে! কিংবা বসরাই মুক্তো!

এ সব কথাও বলে ফেলতে রঘুবীরের এতটুকু সংকোচ নেই। উঞ্ছবৃত্তির ওপরেও পদা নেই কোনও। এক মাস ধরে তার ঘরে আদিত্যর নিত্য আসাযাওয়া, এখন আর তেমন ঢাকঢাক গুড়গুড়ও নেই। শুধু একটা কথা উঠলেই রঘুবীরের মুখ ভারী ছোট হয়ে যায়, ভাঁটার মতো চোখ দুটো চিকচিক করে ওঠে। রঘুবীরের মা রমেশ ঠাকুরের সঙ্গে পালিয়ে মোটেই সুখী হয়নি। দেওঘর না দুমকা কোথায় গিয়ে যেন বাসা বেঁধেছিল দুজনে, সেখানেও নাকি রমেশ ঠাকুর এক বিহারি মেয়ের প্রেমে পড়ে। মনের দুঃখে আত্মহত্যা করে রঘুবীরের মা। খবরটা এনে দিয়েছিল মাসিরই কোন এক দেওর পো।

লোকটা কি দুঃখী? আদিত্যর চেয়েও? হাত তিন-চার সামনে হাঁটতে থাকা পাহাড়ের মতো রঘুবীরকে এক দৃষ্টে খানিকক্ষণ দেখল আদিত্য। লোকটা তার মতো করে দুঃখী, আদিত্য নিজের মতো করে। প্রতিটি মানুষেরই কষ্টের কুয়ো আলাদা আলাদা। আদিত্যর সামনে দিয়ে, পিছন দিয়ে, দু ধার দিয়ে এখন যে সারসার রেলের লাইন, যারা কেউ কোনওদিন পরস্পরের সঙ্গে মেলে না, কখনও বা একটু ছুঁয়েই যে যার পথ ধরে, এদের দেখে কি বুক মোচড়ায় রঘুবীরের? চিনতে পারে এরা সব আদিত্যরই পরিজন? এদের মাড়িয়ে ওই যে রেলগাড়ি আসছে, যাচ্ছে, তারা তো শুধু গাড়ি নয়, জীবনের এক একটা করাল মুহূর্ত। এমন মুহূর্ত যাতে হঠাৎ বিলীন হয়ে যেতে পারে যে কেউ। যে কোনও সময়ে। মা বাবা বউ ছেলে মেয়ে ভাই বোন বন্ধু, এমনকী বেড়ে ওঠার আশ্রয়ও। এই সম্ভাবনার গা ঘেঁষে হাঁটাকে মৃত্যু-ইচ্ছে বলে না। এ হল এক ধরনের শিহরন। জীবনেরই।

আবার শব্দ বাজিয়ে দুটো ট্রেন যাচ্ছে। সমান্তরাল পথে দুজন দু মুখে চলে গেল। আঁধার এখনও জেঁকে বসেনি, আলো অন্ধকারের এক সন্ধিক্ষণ এখন। তবে এর মধ্যেই কামরাগুলোতে বাতি জ্বলে গেছে। আলোর ঝলক মিলিয়ে যেতেই আবার নিম অন্ধকারে খাঁ খাঁ দশ দিক। একটা দিগভ্রান্ত কাক খুব নিচু দিয়ে ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে উড়ে গেল।

রঘুবীর দাঁড়িয়ে পড়েছে। টকাটক লাইন টপকে ঢালের কিনারে চলে গেল। ডাকছে আদিত্যকে, আসুন, আপনার পথ শেষ হয়েছে। এবার নামতে হবে।

আদিত্য ধীর পায়ে রেললাইন পার হল। অথবা পরিজনদের। একটু দম নিয়ে বলল, – এসে গেলাম? রোজ এই জায়গা দিয়েই নামি?

-নাহ্ রায়দা, সত্যিই আপনাকে ভূতে ধরেছে। ওই তো দ্যাখেন না, পাতাল রেলের শেড তৈরি হচ্ছে, চিনতে পারছেন?…দেখবেন, নামতে গিয়ে আজ যেন আবার আছাড় খাবেন না।

আনমনে হাঁটুতে হাত ছোঁয়াল আদিত্য। পরশু অনেকটা ছড়ে গিয়েছিল। বোতল থেকে খানিকটা সুরা ঢেলে দিয়েছিল রঘুবীর, শুকিয়ে এসেছে ক্ষতটা। ভাগ্যিস তিতিরের নজরে পড়েনি।

তিতিরের কথা মনে পড়তেই বুকটা ঈষৎ খচখচ করে উঠল আদিত্যর। সন্তর্পণে নামতে নামতে বলল, – আজ কিন্তু আমি বাড়ি ফিরে যাব রঘুবীরবাবু।

যাবেন। আমি কি আপনাকে আটকাই? আপনিই তো…

না না, আজ আপনি আমাকে জোর করে পাঠিয়ে দেবেন।

ফার্লং মতো সরু পায়ে চলা পথ। দু পাশে ঘন বসতি, ভাঙাচোরা। কবেকার রিফিউজি কলোনি, এখনও প্রায় নরক। ছোট্ট ডোবা জল থইথই, দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। তোলা উনুনে আঁচ পড়েছে সন্ধের, ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় থমকে আছে বাতাস। ঘেয়ো বাদামি কুকুরটা আজও হাঁটছে আদিত্যদের সঙ্গে সঙ্গে। একদিন ভাঙা কেকের টুকরো ছুঁড়ে দিয়েছিল আদিত্য, তার পর থেকে কুকুরটা চিনে গেছে তাকে।

রঘুবীর একটা ঢিল কুড়িয়ে হেঁকে উঠল, হ্যাট হ্যাট।

হাত তুলে নিরস্ত করল আদিত্য, — আহা থাক না, আসছে আসুক।

পথটুকু পেরিয়ে ডান দিকে আরও মিনিট পাঁচেক হাঁটলে রঘুবীরের একতলা বাড়ি। জীর্ণ, শ্রীহীন। পাঁচঘর ভাড়াটের কোলাহলে সদা মুখর।

বাড়ির পিছনে পানে মাসি বোনগোর ঘর। আগল খোলা। লাল মেঝেতে কালো স্কার্টিং দেখে মনে হয় এক কালে আভিজাত্য ছিল ঘরখানার। চুন বালি খসা দেওয়ালে অসংখ্য দেবতার ছবি। গোটা চারেক এক পাতার ক্যালেন্ডার, সেও ঠাকুর-দেবতার। দেওয়ালের তাকে বাসন-কোসন, ছোট টাইমপিস, হাত আয়না, চিরুনি, মান্ধাতার আমলের রেডিও সহাবস্থান করছে। কাঠের একটা আলমারিও আছে, চটলা ওঠা। দরজার পাশে জলচৌকির ওপর ট্রাঙ্কের পাহাড়, কালো সবুজ হলুদ। ঘরের প্রায় আধখানা জুড়ে এক মলিন পালঙ্ক, বিছানা বালিশ চাদরের হালও বেশ জরাজীর্ণ। কারুকাজ করা পালঙ্কের বিড ভারী দেখনদার ছিল এক সময়ে, এখন সেটাই এ ঘরের আলনা।

আদিত্য কোনওদিনই পালঙ্কতে ওঠে না। মেঝেতে থেবড়ে বসেছে। সিগারেট ধরিয়ে ইতিউতি তাকাল, –ও রঘুবীরবাবু, গেলেন কোথায়?

–এই আসি। বলতে বলতে দু হাতে দুটো দিশি মদের বোতল নিয়ে ঢুকল রঘুবীর। মেঝেতে নামিয়ে রেখে গ্লাস নিয়ে এল, চাট চলবে?

–আবার মাসিকে খাটাবেন?

–সে আপনাকে দেখতে হবে না।…মাসিইই, ও মাসি…

ক্ষয়াটে চেহারার ছোটখাট বৃদ্ধা মন্থর পায়ে ঘরে এসেছেন। পরনে সাদা থান, স্বামীর মৃত্যুসংবাদ না পেয়েও পরছেন বহুকাল। এক সময়ে খুব ফর্সা ছিলেন বোঝা যায়, এখন রঙ তামাটে। চুল উঠে কপাল চওড়া হয়ে গেছে।

অনুজ্জ্বল চোখে তাকাচ্ছেন বিমলা, – এসেই দুটিতে বসে পড়লি?

ছিপি খুলে গ্লাসে গ্লাসে কোয়ার্টারটাক ঢালল রঘুবীর, দু হাত বালবের দিকে তুলে দেখল মাপ। সমান হয়েছে কি না। উল্টো প্রশ্ন করল, ছিলে কোথায়? ঘর খোলা?

–ঝিনিদের ঘরে গেছলাম। ঝিনির বাপটার মাইনের দিন কারখানা লকআউট হয়ে গেল, কাল থেকে মিলের গেটে বসে আছে। কী আতান্তর।

–হুম। রঘুবীর দাঁতে বিড়ি চাপল, ক খানা পেঁয়াজি ভেজে ফ্যালো দিকিনি। বেশি করে কুচি কুচি লঙ্কা দেবে। ছাঁকা তেলে ভাজবে, যাতে মুচমুচে হয়।

-উউহ্, জিভের খুব স্বোয়াদ। অত তেল নেই।

 –কিনে আনো।

টাকা নেই।

কাল পঞ্চাশ টাকা দিলাম সব ফুড়ৎ? নাকি ওই ঝিনিদের ঘরে ঢেলে এসেছ?

–সকালে ইলিশ মাছটা কে খেল?

-ঠিক আছে, ঠিক আছে। পোড়া তেলেই ভাজো। রঘুবীর শার্ট খুলে পালঙ্কে ছুঁড়ে দিল। পৈতে দিয়ে ঘষঘষ চুলকোচ্ছে লোমশ ঘাড় পিঠ। বলল, – জল দিয়ে যাও তো আগে। গোড়াতেই নিট ঠিক জুত হয় না। লিভার শুলোয়।

–মর মর। এবার তোর লিভারের পচন ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর এলেও আটকাতে পারবে না।

–পচার হলে কবে পচত। ফুঃ। দেখলে তো কতবার। ওষুধ পড়লেই বাবু আবার চাঙ্গা হয়ে যায়।

বারান্দার ঘেরাটোপে রান্নাঘর, সেখান থেকে জল আনলেন বিমলা, –নিজে মর ক্ষতি নেই, ভালমানুষের ছেলেটাকে মারছিস কেন?

-হাহ, কে কাকে মারে! রায়দা এ লাইনে আমার থেকে অনেক সিনিয়ার। তাই না রায়দা?

 আদিত্য আলগা হাসল। গ্লাস মুখের কাছে এনেও নামিয়ে রাখল কি ভেবে। সেই কোন দশটায় খেয়ে বেরিয়েছে, পেট একদম খালি, শুধু শুধু গলায় মদ ঢালাটা তার পক্ষেও শুভ নয়। দমদম স্টেশনে নেমে কিছু খেয়ে নিলে হত। ভাল লাগে না। জিভও যেন অসাড় হয়ে আছে।

বিমলা চলে গেছেন। পা বাড়িয়ে দরজাটা একটু ঠেলে দিল রঘুবীর। গ্লাসে পেল্লাই চুমুক দিল, তা হলে কী ভাবলেন রায়দা?

-কীসের কি?

বা রে, সারাটা দিন ধরে কি বোঝালাম? এবার বড় কাজ বেরোচ্ছে। আধ মাইলটাক রাস্তা চওড়া হবে। তিলকেরই সরাসরি পাওয়ার কথা, আমি ভেতর থেকে কলকাঠি নেড়ে দিয়ে এসেছি। সুজিত মণ্ডল আরও পাঁচ পারসেন্ট বেশি নেবে, অর্ডার বেরোবে আমাদের নামে। তিলকটার খুব মেজাজ, কথায় কথায় এম এল এ-এম পি দেখায়, অফিসসুদু লোক ওর ওপর চটে আছে।

–শুনলাম তো অনেকবার। এক কথা কেন বার বার বলছেন? রঘুবীর ভুরু কুঁচকোল। বুঝি পড়ে নিতে চাইল আদিত্যর গলায় বিরক্তি বেশি, না ঔদাসীন্য। মাথার ওপর আদ্যিকালের চার ব্লেডের পাখা ঘুরছে, তবু ঘরে মশা উড়ছে এলপাথাড়ি। চটাস করে এক চাপড়ে পায়ের ডগায় বসা একটা মশাকে মারল রঘুবীর। রক্তটা আঙুলে ঘষে নিল, শোনালেই কি সব শেষ হয়? কী ঠিক করলেন সেটা তো বলবেন।

–ঠিক করাকরির আছেটা কী। আদিত্য এড়ানোর ভঙ্গিতে বলল, – কাজ করা মানে আবার তো আপনার তিলকের গর্তে গিয়ে পড়া।

–আপনি কাজটা করবেন না?

–নাহ। ও কাজ আপনিই করুন।

–আমি? আমার ক্যাপিটাল কোথায়? হাতে টাকা থাকলে রঘুবীর চাটুজ্যে আপনাকে থোড়াই সাধত।

–আমারই বা ক্যাপিটাল কোথায়?

হাসালেন রায়দা। ওই দেখুন, আপনার কথা শুনে ক্যালেন্ডারের সিদ্ধিদাতাও হাসছেন। রঘুবীর গ্লাসে একটু জল ঢালল। দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, – আপনার লাখ টাকা তো ব্যাঙ্কে খেলা করছে রায়দা। মাগুরগুলোকে পুষে না রেখে কাজে লাগান, ডিম পেড়ে ঘর ভরিয়ে দেবে। দু-চার পয়সা যদি শর্টও পড়ে, আমার খুড়তুতো ভায়ের সঙ্গে কথা হয়ে গেছে, তারক টাকা হাওলাত দেবে।

–আগেই তো বলেছি রঘুবীরবাবু, ও টাকায় হাত দেওয়া যাবে না। ও আমার গিন্নির টাকা।

কী করে? ওটা তো সেন্ট পারসেন্ট আপনারই টাকা। মুস্তাফির পো টাকাটা আপনাকে দিয়েছে, না বউদিকে দিয়েছে?

যাকেই দিক, ও আমার গিন্নির সঞ্চয়। আদিত্য দু দিকে মাথা নাড়ছে, মেয়ে বড় হচ্ছে, তার বিয়ে দিতে হবে…

–আপনাদের এখন টাকার অভাব! মাসে মাসে হু হু করে ডলার আসছে, ছেলেই তো আপনাদের কোটিপতি করে দেবে। তার ওপর নিজের টাকা ঢেলে যদি কন্ট্রাকটারিটা করেন…দেখেছেন তো তিলক কেমন মুখের ওপর ফিফটিন পারসেন্ট ছুঁড়ে দেয়…তার মানে লাভ কত আন্দাজ করুন। টাকা তো আপনাকে শেষে সুইস ব্যাঙ্কে রাখতে হবে মশাই। আপনার খুকির জন্য গলায় গামছা দিয়ে কি যেন বলে, আর এন আই না এন আর আই, সেই পাত্র ধরে আনবেন। নতুন ফ্ল্যাট ইচ্ছে, ছোট ভাই গাড়ি কিনল, এমন সুখের সময়ে ওই লাখ টাকা কি বউদি যখের ধনের মতো সামলাবে? মোটেই না। আপনি চাইলেই বউদি দেবে।

আদিত্য বিষণ্ণ হাসল। সুখ যে কী অদ্ভুত চিজ! বুক শূন্য করে দিয়ে ভোজবাজির মতো মিলিয়ে গেল একটা বাড়ি, ওমনি সংসারে সুখ ছেয়ে গেল! নিজের হাড়পাঁজরা চিরে বাপ্পার কেরিয়ার তৈরি করে দিল বাড়িটা। আক্ষরিক অর্থেই আদিত্য এখন লাখপতি, ওই বাড়িরই মেদ মাংস মজ্জা চুষে। ওই বাড়ির পেট ফুড়ে আলাদিনের পোষা দৈত্যের মতো অট্টালিকা বানাবে মুস্তাফি, নতুন ঝকঝকে স্বাধীন নীড় পাবে দীপু চাঁদুরা। আদিত্যরাও। একটা মাত্র বাড়ির বিনিময়ে এত সুখ এসে গেল!

এক অস্তিত্বহীন ইট কাঠ চুন বালি সুরকির কাঠামো আকুল করতে থাকে আদিত্যকে। সব কথা ভুলে গিয়ে শূন্য হয়ে যায় মস্তিষ্ক। হাত পা শিথিল হয়ে আসে। চোখ বুজে যায়। বোবায় ধরা মানুষের মতো গ গঁ শব্দ করে আদিত্য, অতি কষ্টে জিভ বোলায় টাগরায়। কাঁপা কাঁপা হাতে গ্লাস তোলে মুখের কাছে, লম্বা চুমুক দেয়, অনেকটা যেন রোবটের মতো। আরও ফাঁকা হয়ে যায় মাথা। ঝাপসা চোখে আদিত্য দেখে রায়বাড়িটা একটা গাছ হয়ে গেল। বটগাছ। অতিকায়। আদিম। গাছ বেয়ে হু হু করে ঝুরি নামছে। যেখানেই মাটিতে ঢুকছে ঝুরি, সেখানেই ফিনকি দিয়ে উঠছে রক্ত। ওই রক্তের ফোয়ারাই কি সুখ?

–ও রায়দা, হল কি? এর মধ্যেই নেশা চড়ে গেল? আদিত্যর হাঁটুতে চাপড় দিল রঘুবীর, নিন, পেঁয়াজি এসে গেছে।

আদিত্য ঘোর কাটাতে সোজা হয়ে বসল, কামড় বসাল পেঁয়াজিতে। খুনে ঝাল, এক কামড়েই ঘিলু চলকে যায়, তবে কষটে মুখে ভালও লাগছে বেশ। আচ্ছন্ন ভাব অনেকটা কেটে গেল।

রঘুবীর কুঁকে পড়েছে, জয় গঙ্গা বলে নেমে পড়ুন রায়দা। আর এই খুঁটে খাওয়া জীবন ভাল লাগে না।

তাতেও তো জীবন দিব্যি কেটে যায়। যায় না?

বুঝেছি। রঘুবীর সরু চোখে তাকাল, আপনাদের পাড়ার ওই চামচিকেটা আপনার মগজ ধোলাই করে দিয়েছে। অনিলবাবুর সঙ্গে বিজনেসে আপনার ক টাকা হবে? কন্ট্রাকটারির চেয়েও বেশি?

এতক্ষণে অনাবিল হাসল আদিত্য, আপনি কি কিছুতেই বিশ্বাস করবেন না, আমি আর কারুর সঙ্গেই বিজনেস করছি না? হ্যাঁ, অনিল আমায় অনেক বুঝিয়েছে। আট-দশটা মেয়ে আছে ওর হাতে, তাদের নিয়ে সেলস টিম করে ফেলবে। কোম্পানির সঙ্গে এগ্রিমেন্ট করে কমিশনে ডোর-টু ডোর মাল বেচবে। সাবান শ্যাম্পু পাউডার কসমেটিক্স। লাভ খুব বেশি না হলেও ভালই। কিন্তু আমি তাকে সোজা না বলে দিয়েছি। আমার আর কোনও ব্যবসাতেই কোনও স্পৃহা নেই রঘুবীরবাবু।

তা হলে আপনি করবেনটা কী? মুস্তাফির বাড়ি যত দিন না ওঠে, ইট বালি পাহারা দিয়ে যাবেন? তাও নয় দিলেন, কিন্তু তার পর?

আদিত্য দেওয়ালে হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে বসল। শূন্য গ্লাস দু হাতের তালুতে ঘোরাচ্ছে, ভাবছি কাশী চলে যাব।

কাশী? বোতল উপুড় করতে গিয়ে রঘুবীরের হাত থেকে খানিকটা তরল ছিটকে গেল। হাঁ হয়ে বলল, কাশী তো বিধবারা যায়! বউদি বেঁচে থাকতে আপনি কাশী যাবেন কেন?

–ওখানে আমার এক পুরনো বন্ধু অছে। স্কুলের। পরিতোষ। রেলে চাকরি করে।

–ও হাঁ, তার কথা তো আপনি বলেছেন। বিয়ে-থা করেনি, ঘাটে বসে মেয়েছেলেদের রামলীলা শোনায়।

-হুঁ, সেই পরিতোষ। ও একটা আশ্রম খুলছে। ফেরার আগের দিন সোনেপুরায় ওর বাড়িতে গিয়েছিলাম, তখনই আভাস দিয়েছিল। আমার তো ধর্মেকর্মে তেমন মতি নেই, আমল দিইনি। কাল ওর একটা চিঠি পেলাম। পুরনো ঠিকানায় পাঠিয়েছিল, মুস্তাফির দারোয়ানটা দিল। কিছু টাকা ডোনেশান পাঠাতে বলেছে। ভারছি সব ছেড়েছুঁড়ে ওর আশ্রমের কাজে ভিড়ে গেলে কেমন হয়?

–আপনি জটা ঝুলিয়ে সাধু হবেন?

মন্দ কি। সংসারের চেয়ে আশ্রম ঢের ভাল জায়গা। অনেক শান্তি।

আজ্ঞে না দাদা, আশ্রমেরও বহুত হ্যাপা আছে। আশ্রম হল একটা প্রতিষ্ঠান, চালাতে হয়। লোকজন এলে তাদের তত্ত্বতদারক করতে হয়, ভক্ত জোগাড় করতে হয়, ভিক্ষের ঝুলি নিয়ে দোরে দোরে ঘুরতে হয়, …বেদবেদান্ত পাঠ করে তার মানে বলতে হয়।

–সে কি আমি পারব না? দরকার হলে পড়াশুনো করে নেব। আপনি পুঁথি পড়ে জ্যোতিষী হয়ে গেলেন, আর আমি সাধু হতে পারব না?

–এ দিকে বউদির কী হবে? খুকির কী হবে?

 –আমি থাকতেই বা তাদের কী হয়েছে? তাদের কাছে আমি একটা আপদ বই তো নই।

–এ হল অভিমানের কথা। রঘুবীর ঘাড় দুলিয়েই চলেছে, ব্যাটাছেলে সংসারের মাথায় না থাকলে চলে?

আদিত্য মনে মনে বলল, খুব চলে। রমরমিয়ে চলে।

 পোড়া বিড়ি থেকে ধোঁয়া উঠছে। দিশি মদের গন্ধ ম ম করছে ঘরে। রঘুবীর মেঝেতে আধশোওয়া হল, খুকির কথাটা ভেবেছেন? সে বেচারা তো কেঁদে কেঁদে কানা হয়ে যাবে।

আদিত্য আবার মনে মনে বলল, ওই একটাই তো মায়া। একটাই তো বন্ধন। তা মায়া বন্ধন কাটাতে না পারলে মানুষ কি আর সাধুসন্ন্যাসী হতে পারে? মেয়েরও ঠিক সয়ে যাবে। বাপকে নিয়ে যন্ত্রণার হাত থেকে তো মুক্তি পাবে মেয়ে!

রঘুবীর আরও কিম্ভুত যুক্তি দেখাচ্ছে, ধরুন খুকির একটা ভাল সম্বন্ধ এল, ছেলের বাড়ি থেকে যদি মেয়ের বাপের খোঁজ করে, তখন বউদি কি জবাব দেবে? বর গেরুয়া লটকে সন্ন্যাসী হয়ে গেছে শুনলে বউদির নিলে হবে না? স্বামী যার মনের দুঃখে বিবাগী হয়, তাকে কি লোকে সতী বলবে?

আদিত্যর মাথা ঝিমঝিম করে উঠল। কেন এসব কথা তোলে রঘুবীর? কেন অন্ধকার গুহায় হাত ঢোকায়? কেন আদিত্যর যাতনা বাড়ায়?

আদিত্য প্রাণপণে অন্য চিন্তায় ডুবতে চাইল। কত টাকা পাঠানো যায় পরিতোষকে? দুশো? পাঁচশো? হাজার? আদিত্য যদি ওখানেই ডেরা বাঁধে, হাজারের কমে মান থাকে না। কিন্তু সেও তো ইন্দ্রাণীর কাছে চাইতে হবে। ও, আবার সেই ইন্দ্রাণী ইন্দ্রাণী ইন্দ্রাণী। এক ঢোঁকে অনেকটা তরল আগুন গিলে নিল আদিত্য। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। হেঁচকি উঠছে। ঘামছে কুলকুল। চাঁদুর কাছে টাকাটা চাইলে কেমন হয়? সে তো এখন শাহেনশা মানুষ, দাদাকে হাজারটা টাকা দিতে পারবে না? দীপুও দিতে পারে। দীপু নয় পাঁচশো দিল, চাঁদু পাঁচশো। একবারই তো দেবে ভাইরা। শেষবার।  

রঘুবীর আবার পাত্র পূর্ণ করছে। আদিত্য চোখ বুজে হাত বাড়াল। আরও নেশা চাই, আরও। নেশাতেই সুখ, নেশাতেই এখন বিস্মৃতি।

কাচের চুড়ির রিনরিন আওয়াজ হচ্ছে। মদের গন্ধ ছাপিয়ে সস্তা উগ্র সেন্টের গন্ধ ঝাঁপিয়ে এল ঘরে। কেয়া ফুলের মেকি সৌরভ।

–ও মা রঘুদা, তুমি যে একেবারে লেটে গেছ গো? রায়দা, আপনিও আউট?

আদিত্য তড়িৎ বেগে ঘাড় ঘোরাল। দরজায় বিজলি। মুখে আঁচল চেপে হাসছে খিলখিল।

.

৭২.

মেয়েটাকে দেখলে শরীর টনকো হয়ে ওঠে, রক্তস্রোত চঞ্চল হয়। অল্প চ্যাপ্টা নাক, মোটা মোটা চোখ, ভরাট লম্বাটে গাল, দাঁতের কাছটা সামান্য উঁচু। বয়স বড়জোর তিরিশ, মাজা অঙ্গে মসৃণ ঔজ্জ্বল্য, বয়সেরই, দেখে মনে হয় মাছি বসলেও পিছলে যাবে। হাসলে পরে দেহখানা এঁকেবেঁকে দোলে, ঠোঁট খুললে লাল পাথরের নাকছাবি নেচে ওঠে ঝিকমিক, ভ্রুকুটিতে আঁধার নামে। উদ্ধত বুক, নিটোল ঊরু, ভারী নিতম্ব, বিজলিরানির মাংসল শরীর জুড়ে যৌবনই যৌবন। প্রাচীন কালে এমন মেয়েরা মহারানির প্রধান সহচরী হত। কপালদোষে সুবল মিস্ত্রির ঘরে জন্মেছে বিজলি। এমন মেয়েকেও বর নেয় না, সেও কপালের দোষ ছাড়া আর কি!

রঘুবীর পরনের লুঙ্গিখানা পায়ের বুড়ো আঙুল অবধি টেনে দিল, আয় বোস। এই ফিরলি বুঝি?

বিজলি দুই মাতালকে টপকে খাটে পা ঝুলিয়ে বসল। মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে বলল, বা রে, আজ বোনাসের ডেট ছিল না! ছুটির পর বসেই আছি, বসেই আছি, মালিকটা শালা এলই না।

আদিত্য চোরা চোখে দেখে নিল বিজলিকে। মেয়েদের মুখে শালা শুনতে তার ভাল লাগে না। বারকয়েক বলেছে মেয়েটাকে। শোনে না। বলে ওটা নাকি তার কথার মাত্রা।

রঘুবীর দ্বিতীয় বোতলের ছিপি খুলল। নাকের কাছে এনে বোতলটা শুকল একটু। গ্লাসে ঢালতে ঢালতে বলল, – তোর মালিককে এখনও তুই চিনলি না রে বিজলি! একের নম্বরের ফোর টোয়েন্টি। বিষ্টু দাস তোদের বোনাস দেবে! ফুঃ!

বিজলির দুলুনি থেমে গেল, দেবে না মানে? ইল্লি রে। গতর খাঁটিয়ে কাজ করি, পাওনা টাকা দিলে ওর বাড়ি গিয়ে দা-এর কোপ মেরে আসব না! শালা কত প্রফিট মারে জানো? কাডবোর্ডের ব্যবসায় দশ টাকায় দশ টাকা লাভ। এখন কত বড় বড় কোম্পানির অর্ডার ধরেছে। ওই যে গো লাইট বালব বানায়, রেডিও টিভি বানায়, বিদেশে ফ্যাক্টরি আছে, তাদের এখন একচেটিয়া বাসকো দিচ্ছে। তিন তিনটে ওষুধ কারখানাতেও মাল দেয়। বলতে বলতে টেরচা চোখে আদিত্যর দিকে তাকাল। আবার দুলতে শুরু করেছে, ও রায়দা, একটা কথা বলি শুনবেন?

আদিত্য বিরস স্বরে বলল, কী কথা?

অনেক কারবার তো করেছেন শুনি। সৰ্বোত্রই তো ঝাড় খেয়েছেন। এবার একখানা কাডবোর্ডের কারখানা খুলুন দিকিনি। রঘুদা হবে ম্যানেজার, আমি মেয়ে খাটাব, আর আপনি সাঁ করে গাড়ি চড়ে ঢুকবেন, সাঁ করে গাড়ি চড়ে বেরিয়ে যাবেন।… বলেন তো শেট দেখি, মেশিং দেখি।

আদিত্য হাত তুলল, থাক।

–থাকবে কেন। খুলুন না, ও রায়দা। লালে লাল হয়ে যাবেন। শুধু হুইস্কি আর রাম খাবেন। মাইরি বলছি, দাসীর কথা বাসি হবে না।

আহ বিজলি, ফ্যাচর ক্যাচর বন্ধ কর। রায়দার আজ মনমেজাজ খারাপ।

 –আহা, কী হয়েছে গো?

সংসার থেকে রায়দার মন উঠে যাচ্ছে। সন্নিসি হবে ভাবছে। রঘুবীর বিড়ি ধরাতে গিয়ে গোটা দু-তিন কাঠি নষ্ট করল, রায়দা এবার কাশীবাসী হবে।

বালাই ষাট, কাশী যাবে কি মরতে? বিন্দাবন নবদ্বীপ গেলে নয় তাও কথা ছিল। সাধনসঙ্গিনী জুটত… যাবেন নাকি গো নবদ্বীপ? তা হলে আমিও বোষ্টুমি হতে পারি। হিহি হিহি।

বিজলি, তুই বড় বেশি ফাজিল হয়েছিস। এই সেদিনের মেয়ে, বড় বড় দাদাদের নিয়ে ইয়ার্কি মারিস? দাঁড়া, তোর বাপকে গিয়ে বলছি।

আদিত্য জানে এটা নেহাত কথার কথা। মেয়েকে সুবল মিস্ত্রির কিছু বলার ক্ষমতাই নেই। এক সময়ে নাকি ইলেকট্রিক লাইনের নামী মিস্ত্রি ছিল, হাই ভোল্টের শক খেয়ে এখন তার আধা পঙ্গু দশা। টেনে টেনে টলে টলে হাঁটে, এলাকার ছোকরা মিস্ত্রিরা দয়া করে কালেভদ্রে হেল্পারের কাজে নিয়ে যায় সুবলকে। যে মেয়ের রোজগারে পেট চলে, তার ওপর কী দাপট দেখাবে বাবা!

বিমলা ঘরে এসেছেন, অ্যাই বিজুলি, অনেক হয়েছে, তুই এবার এখান থেকে যা তো। আমি এখন এদের খেতে দেব।

বিজলির নড়ার লক্ষণ নেই, দাও না, আমি কি মুখ থেকে কেড়ে নেব!

না, তুই যা। লোকের ঘরে খাওয়ার সময়ে থাকতে নেই।

গা মুচড়োতে মুচড়োতে হাই তুলল বিজলি। মোটা বিনুনি ঝট করে টেনে ফেলে দিল পাহাড়ি উপত্যকায়। দরজায় দাঁড়িয়ে বেণী নাচাতে নাচাতে বলল, – কথাটা কিন্তু ভেবে দেখবেন গো রায়দা। হয় কাডবোর্ড, নয় নবদ্বীপ।

সস্তা কেয়া ফুলের গন্ধ মিলিয়ে গেল।

আশপাশের কোনও ঘরে তুলকালাম ঝগড়া বেধেছে। তারস্বরে চেল্লাচ্ছে এক মহিলা, তার ওপরে গলা তুলছে এক পুরুষ। রঘুবীরের আস্তানার নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা, আজ তাও একটু কম আছে। চিৎকারে আদিত্যর নেশা কেটে যাচ্ছিল। হাঁড়িকড়ার আওয়াজ হচ্ছে বারান্দায়, শুনতে পেল আদিত্য।

আদিত্যর হুঁশ ফিরল। উঠে দাঁড়িয়েছে।

রঘুবীর হাঁ হাঁ করে উঠল, চললেন কোথায়? মাসি ভাত বাড়ছে।

আদিত্য জোরে জোরে মাথা ঝাঁকাল, ফিরতেই হবে। মেয়েকে কথা দেওয়া আছে।

যাবেন। খেয়ে যান। মাসির হাতের ভাপা ইলিশ আছে আজ।… কী স্বোয়াদ!

–না না, দেরি হয়ে যাবে। আদিত্য ঘড়ি দেখল, ট্রেন পাব তো এখন?

পাবেন না কেন! সবে তো সাড়ে নটা। … এই, বসুন না।

বিমূঢ় বিমলাকে পিছনে ফেলে বেরিয়ে এল আদিত্য। হাঁটছে। সরু রাস্তার বাঁকে এসে থমকে দাঁড়াল। সেই কুকুরটা বসে আছে। তাকে দেখে উঠে দাঁড়াল, চলেছে সঙ্গে সঙ্গে।

স্টেশনে এসে টিকিট কেটে ডাউন প্ল্যাটফর্মের একটা বেঞ্চিতে গিয়ে বসল আদিত্য। ঝিমঝিম করছে মাথাটা, চারদিকের আলো কেমন ঘোলাটে, নিস্তেজ। পেটেও একটা চিনচিনে ব্যথা, অচেনা দুঃখের মতো। একটা ট্রেন এল, চলে গেল, উঠতে ইচ্ছে করল না আদিত্যর। ভাল লাগে না, কিছুই ভাল লাগে না। ঘরে ফিরতে মন লাগে না, বাইরে থাকলেও আনন্দ নেই। রঘুবীরের ডেরায় বিবমিষা জাগে, বেরিয়ে এলে মনে হয় বেশ তো ভোঁ হয়ে ছিলি, উঠলি কেন!

দূরের টি স্টলে রেডিও বাজছে। চেনা গান। কোই হমদম না রহা, কোই সাহারা না রহা…। কতকালের পুরনো গান, শুনলে এখনও বুকটা মুচড়ে ওঠে, চোখে জল এসে যায়। এখনই কেন বাজল গানটা! কার হমদম আছে দুনিয়ায়! এ জগতে কে কার সাহারা! আদিত্য দু হাতে কান চেপে ধরল, শুনবে না গান। হাত যখন সরাল, গান তখন থেমে গেছে। আবার অতৃপ্তি। আবার বিষাদ। কেন গানটা থেমে গেল!

আর একটা ট্রেন ঢুকছে। আলোর ঘরগুলো মন্থর হতে হতে নিশ্চল। সামনেই যে কামরাটা দাঁড়াল, তাতেই টলমল পায়ে উঠে পড়ল আদিত্য।

ফাঁকা কামরা। গুটিকতক লোক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে আছে। আদিত্য জানলার ধারে বসল, ছুটন্ত বাতাসে মৌতাত জমে। ট্রেন ছাড়তেই একটা গাঁট্টাগোট্টা ছেলে তড়াং করে লাফিয়ে উঠল কামরায়। দাড়ি মুখ, হাফ প্যান্ট, স্যান্ডো গেঞ্জি। জুলজুল চোখে দেখছে যাত্রীদের। যেন হিসেব কষছে কিছু। লোকজন নার্ভাস, অন্যমনস্ক হওয়ার চেষ্টা করছে, আড়ে আড়ে তাকাচ্ছে ছেলেটার দিকে।

আদিত্য ঈষৎ মজা পেল, যা সে এখন কদাচ পায়। ছেলেটা কি চোর, ছিনতাইবাজ! হলে মন্দ কী, তাও তো একটু রোমাঞ্চ আসবে জীবনে। কিন্তু যার নিজেরই প্যান্টজামা নেই, সে কি তেমন রোমহর্ষক কিছু ঘটাবে!

হঠাৎ ছেলেটা হেঁকে উঠল, খেলা দেখুন বাবু, খেলা দেখুন। সার্কাস দেখুন। এ সার্কাস কোনওঁ তাঁবুতে মিলবে না।

বলেই ছেলেটা ঝুলন্ত হ্যান্ডেল ধরে দুলতে শুরু করল। মাঝের প্যাসেজটুকুতে কতটাই বা জায়গা, সেখানে শরীর ঝুলিয়ে দুলছে সাঁই সাঁই। দক্ষ ট্রাপিজ খেলোয়াড়ের মতো এ হ্যান্ডেল থেকে ও হ্যান্ডেলে উড়ে যাচ্ছে। থামল হঠাৎ। হ্যান্ডেলে চাড় দিয়ে ওঠাচ্ছে শরীর। উঠতে উঠতে কোমর হ্যান্ডেলের লেভেলে চলে এল। একবার গুটোল শরীরটা, ডিগবাজি খাচ্ছে শুন্যে, পুঁটলি হয়ে বনবন ঘুরছে একটা মানুষ।

আদিত্যর গায়ে কাঁটা দিল। পাগল নাকি!

যাত্রীরা নিশ্চিন্ত, মজাসে খেল দেখছে। চক্রাকারে পাক খেতে খেতে দড়ামসে কামরার পাটাতনে পড়ল ছেলেটা, ব্যালেন্স করে দাঁড়িয়ে পড়ল। বড় বড় শ্বাস ফেলছে। ঘাম মুছছে। একটু জিরিয়ে শীর্ষাসন করল, দু হাতে ভর দিয়ে চলন্ত কামরায় হাঁটছে। একটা উল্টো মানুষ গুট গুট ঘুরছে কামরায়। সিগনালে ট্রেন থেমেছে, হঠাৎ চলতেই ঝাঁকুনিতে ঠোক্কর খেল সিটে, তবু পড়ল না। ঝপ ঝপ দুটো ভল্ট দিয়ে দাঁড়িয়েছে সটান।

খেল খতম। কামরায় ঘুরে ঘুরে পয়সা চাইছে ছেলেটা। উল্টোডাঙায় নামার আগে একজন দু টাকার নোট দিয়ে গেল। বাকিরা কেউ দিচ্ছে, কেউ উদাসীন।

আদিত্য পকেট হাতড়াতে হাতড়াতে ডাকল, এই যে ভাই, শোনো।

ছেলেটা সামনে এল।

খুঁজেপেতে ছেলেটার হাতে আদিত্য কয়েন দিল একটা, তুমি তো বড় আজব চিজ হে ভাই! রাতদুপুরে সার্কাস দেখাও!

ছেলেটা বিমর্ষ মুখে বলল, –করব কী? আজ যে ভাল কামাই হয়নি।

-হুম। তা থাকা হয় কোথায়?

–নিবাস হুগলি জেলা। তারকেশ্বরের ওদিকে।

–অদ্দূর থেকে এদিকে কেন?

–ও লাইনে খেলা পুরনো হয়ে গেছে। আর তেমন পয়সা ওঠে না।

–এ লাইনে ওঠে?

 –উঠছে… উঠছে না। কদিন পরে আর এক লাইনে চলে যাব।

আদিত্যর কথা বলতে ভাল লাগছিল। ঢুলু ঢুলু চোখে বলল, এত রাতে তো আর বাড়ি ফেরা হবে না, থাকবে কোথায়?

ইস্টিশনে থেকে যাব। ঘরও তো একটা ইস্টিশন, কী বলেন?

–বেশ বলেছ তো! আদিত্য মাথা দোলাল, ঘর হল ইস্টিশন। তা তোমার বাড়িঘরের টান নেই?

–আছে। তবে আগে পেট, না আগে ঘর?

–এ খেলা দেখিয়ে পেট চলে?

–বেঁচে তো আছি। ছেলেটা খুচরো পয়সা গুনছে, বেঁচে থাকাটাই লাভ।

তুমি তো বেশ ফিলজফার আছ হে! বলছ, বেঁচে থাকাই লাভ? কেন, মরে গিয়ে লাভ নেই?

 –মরে কি লাভ বলুন। মরা মানুষের সুখ আছে? আনন্দ আছে?

 –সে তো ভাই দুঃখও নেই। আছে? বলো।

–মরে যাওয়াটাই তো দুঃখ। মরে গেলে মানুষ বেঁচে থাকবে না, এটাই তো দুঃখ।

ভারি অদ্ভুত কথা! কথাটায় যেন কেমন নেশা আছে, মোহ আছে। বেঁচে থাকাই যদি সুখ হয়, তবে কষ্টেসিষ্টে না মরে বেঁচে থাকলেই তো চলে। কার জন্য বাঁচা, কী ভাবে বাঁচা, কী উদ্দেশ্যে বাঁচা, সব ভাবনাই তো তবে অর্থহীন।

শেয়ালদা স্টেশনে নেমে ছেলেটা অন্য দিকে চলে গেল। সাউথ সেকশান খানিকটা পথ, মাঝে অনেকটা ভোলা চাতাল। আলোয় আলোয় দিন হয়ে আছে জায়গাটা। এদিক-সেদিক মেয়েরা চরে বেড়াচ্ছে, সস্তা শাড়ি, ঠোঁটে রঙ। তিতিরেরই সমবয়সী প্রায়, একটা হাড় জিরজিরে মেয়ে সামনে এসে আঁচল ফেলে দিল, বেশি নয়। কুড়ি টাকা।

আদিত্য চোখ সরিয়ে নিল। এও বেঁচে থাকা! আহা রে মেয়ে!

খোলা আকাশের নীচে সার সার শুয়ে আছে মানুষ। এও বেঁচে থাকা! সাউথ সেকশানে একটা ট্রেন ভোঁ দিল, দুদ্দাড়িয়ে ছুটছে তিনটে লোক। এও বেঁচে থাকা! এক অন্ধ ভিখিরি বাটির জলে শুকনো রুটি চটকাচ্ছে। এও বেঁচে থাকা!

শেষ ক্যানিং লোকাল ছাড়েনি এখনও। ধীরেসুস্থে উঠে বসল আদিত্য। নেশা আজ চড়েনি তেমন, বেঁচে থাকাটা জানান দিচ্ছে।

চলছে ট্রেন। খোলা জানলা দিয়ে হু হু হাওয়া আসছে, শরতের মিঠে বাতাস। পার্ক সার্কাস কবরখানায় টিমটিমে বাতি জ্বলছে কয়েকটা, ফিকে অন্ধকারে শুয়ে আছে মৃত মানুষ। ওরা কি দুঃখী? চিন্তা আর চোখ একসঙ্গে জড়িয়ে এল আদিত্যর। মৃতেরা দুঃখী, জীবিতরা নয়। আদিত্য কাশীতে আছে, না মধুগড়ে, সেলিমপুরে আছে, না ট্রেনের কামরায়, কি আসে যায়!

আদিত্য ঘুমিয়ে পড়ল। ঢাকুরিয়া পার হয়ে গেল ট্রেন।

.

আদিত্যর ঘরে এখন অনেক রাত অবধি আলো জ্বলে। তিতির পড়ে এ ঘরে বসে। পড়াটা বাহানা, মার কাছে শুতে এখন তার ভারী অস্বস্তি। একটু পর পরই বেডসুইচ টিপে আলো জ্বালায় মা, চমকে চোখ বন্ধ করতে হয় তিতিরকে। বাবা না ফিরলে তিতিরের যে ঘুম আসে না, তিতির করবেটা কী!

তার চেয়ে এই ভাল। পড়াশুনোর নাম করে বই ছড়িয়ে বসে থাকা। আদিত্যর পায়ের আওয়াজ পেলেই ছুট্টে গিয়ে দরজা খুলে দেয় তিতির, শব্দ না করে। খেতে দেয় বাবাকে, মশারি টাঙিয়ে দেয়, তারপর বেড়াল-পায়ে মার বিছানায়। বাবা না ফিরলে এ ঘরেই কাটিয়ে দেয় রাত। এ বন্দোবস্ত বেশ কিছুদিন ধরেই চলছে।

আজ তিতিরের সামনে ইতিহাস বই। জালিয়ানওয়ালা বাগে গুলি চালিয়েছে ব্রিটিশ, পড়ে পড়ে তার খুঁটিনাটি নিয়ে নোট বানাচ্ছে। তুচ্ছ শব্দে ভেঙে যাচ্ছে নিবিষ্টতা, খাড়া হয়ে উঠছে কান।

খুট করে একটা শব্দ হল। কন্দর্প বাথরুমে যাচ্ছে, তিতির দেখল। খানিকক্ষণ আগে সেতার নিয়ে বসেছিল ছোটকা, ভৈরবী বাজাচ্ছিল। কী যে ভুলভাল সময়ে উল্টোপাল্টা রাগ বাজায়! তবু ধ্বনিটা যেন ঝঙ্কৃত করছিল বাড়িটাকে, কাঁপছিল বাতাস।

বাথরুম থেকে ঘরে না ফিরে তিতিরের দরজায় এল কন্দর্প, তুই এখনও শুসনি? কটা বাজে খেয়াল আছে?

আদিত্যর ঘরে ঘড়ি নেই। এ ঘরে সময় বড় মূল্যহীন। তিতির ছোট্ট একটা হাই তুলল, -কটা বাজে গো?

বারোটা চল্লিশ। … তুই এত লক্ষ্মী মেয়ে হলি কবে থেকে রে? এত রাত অবদি পড়ছিস রোজ?

কী করব! রেজাল্ট খারাপ হয়েছে যে।

হয়েছে তো হয়েছে। রাত জাগতে হবে না। শো গিয়ে। কন্দর্প একটু থামল, আমি এখনও কিছুক্ষণ জেগে আছি।

বই খাতা কলম টেবিলে গুছিয়ে রাখল তিতির। ভাবল একটুক্ষণ। বাবার খাবার কি ফ্রিজে তুলে দেবে, না আর একটু দেখবে? পরশু রাত একটায় ফিরেছিল বাবা।

তিতির ঘুরে তাকাল, লাস্ট ট্রেন কি চলে গেছে ছোটকা?

কন্দর্প মৃদু হাসল, — যেতে পারে। অনেকক্ষণ তো আওয়াজ শুনছি না। তবে ট্যাক্সি সারা রাত চলে। আর জানিস তো, মাতালদের ট্যাক্সি রিফিউজ করে না।

কথাটা যেন সুতীক্ষ্ণ সূঁচ হয়ে বিধল তিতিরকে, মুখ পলকে কালো হয়ে গেল। একটি কথা না বলে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। খাবারদাবারগুলো ফ্রিজে তুলছে।

কন্দর্পও বাইরে এল। অপ্রস্তুত স্বরে বলল, চটে গেলি?

না, ঠিকই তো বলেছ। গলায় আটকে থাকা একটা শক্ত ডেলা গিলে নিল তিতির, মাতালকে তো মাতালই বলে।

–দুর পাগলি। কত দুঃখে যে বলি। তোর বাবা আমার দাদা হয় না? কন্দর্প আলগা চাপড় মারল তিতিরের মাথায়। একটু ভারী স্বরে বলল, – খারাপ লাগে কি জানিস? …গোড়াতেই বউদিকে বলেছিলাম ওই ফেরেববাজটার পাল্লায় পড়তে দিয়ো না। না বউদি শুনল, না তুই কিছু বললি দাদাকে।

–তুমি মাকে বলেছিলে?

বলিনি! নিশ্চয়ই বলেছিলাম।

-মা কেয়ার করেনি, তাই তো? তিতিরের গলায় শ্লেষ, কিন্তু তুমি কি করেছ ছোটকা? লোকটা ফেরেববাজ জেনেও তো তার দেওয়া আংটি পরে ঘুরছ!

কন্দর্প আবার অপ্রতিভ হল, তুই এই স্টার রুবিটার কথা বলছিস? খুব বেশি জক দিতে পারেনি রে। ওনলি পাঁচশো টাকা। ব্যাটা আমায় একটা আসলি রুবি ধরাতে চেয়েছিল। পাঁচ হাজারের।

–পাঁচ হাজারই হোক, পাঁচশোই হোক, তুমিও পাল্লায় পড়েছ তো?

কন্দর্প জোর করে হেসে উঠল, তুই দিনে দিনে একদম তোর মার কার্বন কপি হয়ে যাচ্ছিস। টোনটা পর্যন্ত..

–তুমি কথা ঘোরাচ্ছ ছোটকা।

কন্দর্প ঢোঁক গিলল। অল্পক্ষণ চুপ থেকে বলল, ঠিকই বলেছিস। আমাদের সকলেরই অ্যালার্ট হওয়া উচিত ছিল।

তিতির আর কোনও কথা বলল না। নিঃশব্দে বাথরুমের দিকে যাচ্ছে।

কন্দর্প হঠাৎ বলে উঠল, একটা কাজ করলে হয় না? চল না, তুই আর আমি মিলে সংসারটাকে একটু রিপেয়ার করার চেষ্টা করি।

তিতির তির্যক চোখে তাকাল, –কী ভাবে?

ধর, বাড়িতে যদি একটু খুশি খুশি অ্যাটমসফিয়ার তৈরি করা যায়। যেমন ধর, আমি একদিন বাজনা বাজালাম, কয়েক জন বন্ধুকে নেমন্তন্ন করলাম…তুই মধুমিতাকে তো দেখেছিস, ধর ও-ও বাচ্চা নিয়ে এল…তুই দাদাকে জোর করে আটকে রাখবি… বউদিও থাকবে… একটা বাচ্চা বাড়িতে সারা দিন হই হই করলে বাড়ির মুডটাও বদলাবে। কি, প্ল্যানটা খারাপ? তুইও ইচ্ছে হলে তোর বন্ধুদের ডাকতে পারিস।

তিতির হাঁ করে কন্দর্পর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। ছোটকার পরিকল্পনার যেন কিছু অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য আছে, বোঝা যাচ্ছে না! উদ্দেশ্য না থাকলে কেউ এরকম হাস্যকর পরিকল্পনা করে। বাড়ির ভেতরকার দম-চাপা ভাবের কারণটাকে দূর না করে বাইরে থেকে খুশি আমদানি করতে চায় ছোটকা! সাফল্য কি ছোটকাকে ভোঁতা করে দিচ্ছে!

কন্দর্প যেন তিতিরের কাছ থেকে সবুজ সংকেত পাওয়ার আশায় দাঁড়িয়ে আছে। যেন তিতির ঘাড় নাড়লেই কাল থেকে…। তিতির উচ্চবাচ্য করছে না দেখে একটু যেন নিরাশ হল।

তবু নিবল না। আবার বলল, – আরও একটা কাজ করা যায়। চল, আমরা একদিন গাড়িটা নিয়ে, দাদা বউদিকে নিয়ে হোলডে আউটিং-এ বেরিয়ে পড়ি। কোলাঘাটের দিকে যেতে পারি, ডায়মন্ডহারবার যেতে পারি, মায়াপুর যেতে পারি, বলিস তো দিঘা-টিঘাও…। আমরা কখনও এক সঙ্গে কোথাও বেরোই না তো, বদ্ধ লাইফে থেকে থেকে সবার মনে জং পড়ে গেছে।

তিতির উদাসভাবে বলল, মাকে তোমার প্ল্যানটা বলে দেখো। বলেই সোজা বাথরুমে চলে গেছে। বেরিয়ে দেখল কন্দর্প ঘরে যায়নি, বসে আছে খাওয়ার চেয়ারে। কী ভাবছে ছোটকা? সব মুশকিল আসানের আরও কোনও নয়া টোটকা?

বাবার খাটে মশারি টাঙিয়ে আলো নিবিয়ে শুয়ে পড়ল তিতির। চোখ বুজে শুনতে পেল ঘর থেকে বেরিয়েছে মা, চাপা তীব্র স্বরে কথা বলছে ছোটকার সঙ্গে। উৎকর্ণ হল তিতির, পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে না। মিন মিন করে কি বলল ছোটকা, জবাবে মাও কি বলছে।

ছোটকার দরজা বন্ধ হয়ে গেল।

 আবার গাঢ় নৈঃশব্দ্য। ছমছমে নীরবতা।

সহসা পেট কাঁপিয়ে হাসি ছিটকে এল তিতিরের। মার কুকুরের কান, নির্ঘাত সব শুনেছে, জোর ঝাড় দিল ছোটকাকে। বেচারা ছোটকা! ক্রনিক ডিজিজে কি সহজ টোটকা-টুটকি চলে। রোগটার মূল কোথায় জানতে হবে না! অনেক দিনের পুরনো টিবি রোগে কি কুইনাইন চলে।

হাসতে-হাসতে কেঁদে ফেলল তিতির।

.

৩.

ধীরাজ বললেন, এত দামি পাঞ্জাবি কেন কিনতে গেলি রে ইনু?

দামি-অদামি দেখতে হবে না। তোমার পছন্দ কি না বলো।

–খুব ভাল। ভীষণ ভাল। কত পড়ল রে? 

–ফের দামের কথা? গায়ে দিয়ে দ্যাখো ফিট করে কি না। বড় হলে আবার সাইজ চেঞ্জ করতে হবে।

নয় একটু ঢোলাই হল। তবে এসব সিলক গরদ কি আর আমি পরি রে? ধীরাজের খুঁতখুঁত ভাব যাচ্ছিল না, মিছিমিছি টাকা অপচয় করলি।

ইন্দ্রাণী হঠাৎ রুক্ষ হল, পরতে হয় পরো, না পরতে হয় ফেলে দিয়ো। বছরকার দিনে বাবা-মাকে একটা জিনিস দেব, তাতে অপচয়ের কথা আসে কোত্থেকে?

উমা বিছানায় বসে মেয়ের আনা শাড়িটা দেখছিলেন, চওড়া নকশা পাড় তসরের শাড়ি। মেয়ের আকস্মিক রূঢ়তায় ঘুরে তাকালেন। বুঝিবা মেয়েকে সন্তুষ্ট করতেই লঘু স্বরে ঝামরে উঠলেন স্বামীকে, তোমার সবেতেই বাড়াবাড়ি। মেয়ে ভালবেসে এনেছে, চুপচাপ পরে নেবে, তা নয়…। এখন ওর হাতে টাকা আছে, তাই এনেছে।

টাকা আছে মানে? ইন্দ্রাণীর বিরক্তি বেড়ে গেল, আমি কি তোমাদের ভাল জিনিস দিই না?

–ওমা, আমি কি তাই বললাম! তুইই তো দিস। উমা আরও নরম করলেন গলা, তবে এখন তো তোর বেশি আনন্দের সময়, তুই আরও দিবি। নতুন বাড়ি হচ্ছে, হাতে মোটা টাকা এসেছে, ছেলেটা দাঁড়িয়ে গেল…

–তাতে আমার কি মা? টাকা বাড়ি সবই তোমার জামাইয়ের। আর ছেলের টাকা? তার নামে অ্যাকাউন্ট হয়ে গেছে, সব ব্যবস্থা করে দিয়েছি… তার টাকা এখন তার নামেই জমা পড়ছে। ওসব টাকায় আমি হাতও দিই না।

–ও কি কথার ছিরি! ওদের টাকা কি তোর টাকা নয়?

ময়ই তো। একটা কথা পরিষ্কার জেনে রাখো মা, তোমার মেয়ে অন্যের টাকায় মা বাবাকে দামি উপহার দেয় না। ইন্দ্রাণীর গলা চড়ে গেল, আমি দিই আমার রোজগারের টাকায়।

–আচ্ছা বাবা তাই। অত রেগে যাচ্ছিস কেন?

–রাগাচ্ছ বলেই রাগছি। আজেবাজে কথা বলছ বলে রাগছি।

–এমন কিছু তোমায় বলা হয়নি ইনু। উমা অপ্রসন্ন মুখে শাড়িটা ভাঁজকরলেন, তোর আজকাল কথায় কথায় গায়ে বড় ফোঁসকা পড়ে। তুই তো এমন ছিলি না ইনু!

কথাটা শুনেই আরও পিত্তি জ্বলে গেল ইন্দ্রাণীর। কেমন ছিল ইন্দ্রাণী? হাস্যময়ী, লাস্যময়ী, বিভঙ্গময়ী? কথায় কথায় গলে গলে ঢলে ঢলে পড়ত? বিয়ের পর থেকে কবে মেয়েকে তরল খুশি প্রাণবন্ত দেখেছে মা? এখনই বা ইন্দ্রাণী কিসে পরিণত হয়েছে? প্রজ্জ্বলিত অগ্নিকুণ্ড? খিটখিটে, ঝগড়টে, মুখরা? কেন মেয়ে হাসতে ভুলে গেছে, কেন সর্বক্ষণ তার মাথা জ্বলে, কখনও কি মা ভাবার চেষ্টা করে? ভাববেই বা কেন? মা বাবা তো সংসার গড়ে দিয়েই খালাস, মেয়ের জীবন তো তার কপাল, তাতে তাদের কিসের দায়!

ইন্দ্রাণী গোঁজ হয়ে বসে আছে। তার রাগ যে অক্ষমের আস্ফালন, এ কথা তার থেকে বেশি আর কে জানে! না হলে যে কথা বলতে গিয়েও সেদিন থেমে গেল তিতির, যে ইঙ্গিত দিল, তার পর কি ওই মেয়ের হাড় গুঁড়ো গুঁড়ো করে দেওয়া উচিত ছিল না! কোন সাহসে মেয়ে ও কথা বলে? সারা জীবনে কখনও কি মাকে অসংযত, বেসহবত দেখেছে? যে-মেয়ের জন্য চিত্ত মেঘলা হয়ে রইল চিরকাল, সেই কি না মার দিকে আঙুল তোলার স্পর্ধা পায়? অথচ তাকে কিছুই বলতে পারল না ইন্দ্রাণী। কতবার শুভকে কথাটা বলার চেষ্টা করল, জিভ যেন সাঁড়াশি দিয়ে চেপে ধরল কেউ। শুভর সঙ্গেও এখন মেয়ে কী ব্যবহারটাই না করছে! ডাকলে সাড়া দেয় না, দেখলে ছিটকে অন্য ঘরে চলে যায়, সামনাসামনি পড়ে গেলে উচ্ছে খাওয়া মুখে বাঁকা বাঁকা জবাব দেয়। কার সঙ্গে তুই অমন করিস মেয়ে? যে লোকটা ঘরের সুখ জলাঞ্জলি দিয়ে, কাজকর্ম ফেলে, শুধু তোকে দেখার জন্য ছুটে ছুটে আসে, তার সঙ্গে?

সব বেমালুম হজম করতে হবে ইন্দ্রাণীকে! তাকে রাগলে চলবে না! তাকে হতে হবে আকাশের মতো উদার, বসুন্ধরার মতো সর্বংসহা, নদীর মতো সদা বেগবতী। অপরাধ? তার জীবনে কাঁটা বিধে আছে। একজনকে ভালবাসার কাঁটা। একজনকে না ভালবাসার কাঁটা। আরও অপরাধ, একটা সাজানো সংসারে সে বিন্দুমাত্র ক্লেদ লাগতে দেয়নি। আরও আরও অপরাধ, আর একটা মেয়ের সংসার চুরমার করে দেয়নি ইন্দ্রাণী।

সাজা তো ইন্দ্রাণীকে পেতেই হবে! তাকে তো রাগলে চলবে না!

ধীরাজ টিভি চালিয়েছেন। রাগবি খেলা চলছে পর্দায়। একটা লোক বল আঁকড়ে দৌড়চ্ছে, একঝাঁক প্রতিপক্ষ হেঁকে ধরেছে তাকে, বুনো জন্তুর মতো ঝাঁপিয়ে পড়ছে তার ওপর। লোকটা কাদায় মাখামাখি, বারবার আছাড় খাচ্ছে, তবু বল ছাড়ছে না।

ইন্দ্রাণী টিভি থেকে চোখ সরিয়ে নিল। অনুচ্চ স্বরে ডাকল, -মা…

উমা অন্দরে। উত্তর দিলেন, ডাকছিস ইনু?

তুমি কি চা করছ?

বসাচ্ছি। ঘুগনিটা গরম করে নিই…। পুজোর বাজার কি তুই আজই করলি?

উমার স্বর অনেক প্রশান্ত এখন, ইন্দ্রাণী স্বস্তি পেল। নিজের যন্ত্রণা নিজেরই থাক, এ দুটো জীবমৃত মানুষকে পীড়ন করার কোনও অর্থ হয় না।

ইন্দ্রাণী রান্নাঘরে উঠে গেল, না গো, বাজার করাই ছিল। কালই আসব ভাবছিলাম, রুনারা এসে গেল।

–তাই! কেমন আছে তারা?

 –দিব্যি আছে। খারাপ থাকার তো কথা নয়।

–ওদের বাড়ি একদিনও গিয়েছিলি?

–সময় পাইনি।

 –ওরা মাঝে মাঝে আসে?

–দীপু আসে। রুনাও আসে, দরকার পড়লে।

–যাই বলিস, মেয়েটাকে আমার বেশ লাগে। কী মিষ্টি কথাবার্তা। তোর শ্বশুরমশাইয়ের কাজের দিন আমাদের খুব আদরযত্ন করেছিল।

ইন্দ্রাণী অন্যমনস্ক হয়ে গেল। কে যে কী, ইন্দ্রাণীই জানে।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেছে। রান্নাঘরে কাচের শার্সি, আধখোলা। পশ্চিমমুখো আলোর ফালি টেরচাভাবে ঢুকছে ভেতরে। মধ্য আশ্বিনের আলো বিকেল নামতেই কাঁচা সোনা। পিছনের গলির ক্রোটন গাছের পাতারা আঁকাবাঁকা ছায়া ফেলেছে জানলায়। বাতাসে কাঁপছে ছায়ারা। মৃদু মৃদু।

উমা স্টিলের বাটিতে খানিকটা ঘুগনি তুললেন, এ বছর তোর জায়ের ছেলের জন্য জামাকাপড় কিনেছিস তো?

ইন্দ্রাণী রাগতে গিয়েও হেসে ফেলল, কিনব না কেন? ওরাও বদলে তিতিরকে সালোয়ার কামিজ দিয়ে গেছে।

–এ বছর জা-কেও একটা শাড়ি দিতে পারতিস। বাপ্পার একটা অত ভাল চাকরি..উমা মাঝপথে কথাটা গিলে নিলেন, না মানে, বলছিলাম…

–কিছু বলছিলে না। ইন্দ্রাণী ঘুগনি শেষ করে বাটি নামিয়ে রাখল, শাড়ি দেওয়া-নেওয়ার সিস্টেমটা যখন উঠেই গেছে, ওটাকে আর নতুন করে চালু করতে চাই না।

–এটা আবার তোর বাড়াবাড়ি। উমা চায়ের কাপ বাড়িয়ে দিলেন, তুই না বড়? মন না চাইলেও বড়দের অনেক দায়িত্ব পালন করতে হয়।

অনেকক্ষণ মাথা ঠাণ্ডা রেখেছিল ইন্দ্রাণী, আর পারল না। তপ্ত স্বরে বলল, – ডিউটি কি শুধু বড়দেরই থাকে মা? ছোটদের নেই? তাদের কোনও জ্ঞানগম্মি থাকতে নেই? বলব না বলব না করেও ইন্দ্রাণীর মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, জানো, রুনা কী করেছে? তোমার জামাই দীপুর কাছে টাকা চাইতে গিয়েছিল, দীপু ছিল না উনি দয়ার প্রাণ হয়ে ভাসুরকে পাঁচশোটি টাকা দাতব্য করেছেন।

–অন্যায় কী করেছে?

–অন্যায় নয়? সে জানে না তার ভাসুরঠাকুরটি কেমন? ইন্দ্রাণীর আঁচে ব্যঙ্গ ঝরল, কাল আবার আহ্লাদ করে শোনাতে এসেছিল! রাগ কোরো না দিদি, দাদা এত করে চাইলেন! তোমার দেওর শুনে আমায় খুব বকেছে!

–আহা, জামাইয়ের নিশ্চয়ই খুব দরকার ছিল। বলতে বলতে মেয়ের মুখভাব দেখে কিছু বুঝি অনুভব করলেন উমা। ত্রস্ত স্বরে বললেন, অবশ্য ওদের কাছে গিয়ে চাওয়াটাও ঠিক নয়। তোর কাছে চাইলেই তো পেয়ে যেত।

ইন্দ্রাণী কথা না বলে মনে মনে ফুঁসতে লাগল। যথেষ্ট অপমান করে গেছে কাল রুনা। টাকা যদি দিয়েই থাকিস, আমাকে এসে শোনানো কেন? মজা দেখার জন্য? তোর ভাসুরঠাকুর টাকা নিয়ে কী করে তুই জানিস না? আবার কৌতূহল কত! কী এত টাকার দরকার পড়ল গো দাদার। মুস্তাফিবাবুর টাকাটা কি দাদার নামে নেই! মাত্র পাঁচশো টাকার জন্য রুনার কাছে এত কথা শুনতে হল! একবার মানুষটাকে ধরতে পারুক ইন্দ্রাণী…! রাত্তিরে তো কাল বাবু ফিরলেন ওই অবস্থায়! ঊর্ধ্ব-অধ জ্ঞান নেই, কাটা ঘুড়ির মতো লাট খাচ্ছেন! তারপর সকালে ভোঁস ভোঁস নাক ডাকা, দুপুরে ভ্যানিশ! ইন্দ্রাণীকে ছোট করে কী সুখ পায় লোকটা!

বাইরে একটা কোলাহল হচ্ছে, বোধহয় প্যান্ডেলে ঠাকুর এল। দেবীমূর্তি নামানোর তোড়জোড় চলছে, তরুণদের নিনাদে কেঁপে উঠছে পাড়া।

উমা ছুটে বাইরের ঘরের জানলায় গেছেন। ইন্দ্রাণী পাশে এসে দাঁড়াল। খানিক দুরে, রাস্তার উল্টো পারে, কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দিলু। ভারী গম্ভীর, ভারী ব্যস্তসমস্ত ভাব। অপারেশন প্রতিমা নামানোর তদারকি করছে। একটা ছেলেকে হাত-পা নেড়ে কি সব নির্দেশ দিল দিলু। বোধহয় মৈত্র বাড়ির ছেলে। দিলুকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে সিগারেট ধরাল ছেলেটা। দিলু কটমট তাকাচ্ছে, সরে গেল ওদিকে। ইন্দ্রাণীর ঠোঁটে একটা ভাঙা হাসি ফুটল। ক্লাবের ছেলেরা পোছে না বলে দিলুদার খুব অভিমান, তবু নাক গলানোর অভ্যেসটা ছাড়তে পারল না। পুজোর কদিন প্যান্ডেলে চেয়ার নিয়ে বসেও থাকবে।

এও এক বন্ধন। বৃত্তে গেঁথে থাকা। চরকি খাওয়া। নিজেকে অপ্রয়োজনীয় জেনেও সরিয়ে নিতে না পারা।

ধীরাজ আচমকা বলে উঠলেন, এই শুরু হল। এখন সাত দিন ধরে কান ঝালাপালা হবে।

 ইন্দ্রাণী জানলা থেকে সরে এল, হ্যাঁ, মাইকটাও লাগিয়েছে একেবারে এ বাড়ির দিকে মুখ করে।

উমা বললেন, ছেলেপুলেরা কদিন আনন্দ করছে, করুক না।

এর পর আবার ঢাক শুরু হবে। ধীরাজ তবু গজ গজ করছেন, গত বছর কার্তিক মাসে পুজো পড়ল, পাঁজিরও কোনও ছিরিছাঁদ নেই, দুটো সপ্তমী, দুটো অষ্টমী..

উমা ধীরাজকে থামালেন, বুঝেছি। একদিন-দুদিন নয় বেশিই ঢাক বেজেছে, তাতে কি এমন তুমি বদ্ধ কালা হলে!

–আমার ভাল লাগে না।

–আমারও ভাল লাগে না। ইন্দ্রাণী ব্যাগ কাঁধে তুলল, এত আনন্দ লোকের আসে কোত্থেকে! চারদিকে এত ডামাডোল! দিল্লি উত্তরপ্রদেশে ছেলেগুলো সব গায়ে আগুন লাগাচ্ছে, এখানে দাঙ্গা, সেখানে দাঙ্গা…।

কলকাতায় তো কিছু হয়নি।

আজ হয়নি, কাল হবে। কলকাতা তো ভারতবর্ষের বাইরে নয় মা।

কিচ্ছু হবে না। কেন হবে? এখানে যখন গণ্ডগোল হয়েছিল, তখন কোন দিল্লি বম্বেতে তার আঁচ পড়েছিল? উঁহ, ভারতবর্ষ! শুধু আমাদের ছেলেগুলোই..

উমা আনমনা। ইন্দ্রাণীও ম্লান। মা ভুল বলেনি। কোন জাতের ছেলে ক পারসেন্ট চাকরি পাবে তাই নিয়ে উত্তর ভারত আজ উত্তাল, দিল্লি পাঞ্জাব কাশ্মীরে যত্রতত্র বোমা ফাটে, যখন তখন গরু-ছাগলের মতো মানুষ মরে, বম্বেতে মাফিয়ারা প্রকাশ্য দিবালোকে বন্দুক পিস্তল চালায়, অথচ ঘুণধরা সমাজকে বদলানোর স্বপ্ন দেখতে গিয়ে, শয়ে শয়ে তাজা প্রাণ খুইয়ে, এই শহরটা বদনামী হয়ে গেল!

মনের কথাটা অবশ্য মুখে উচ্চারণ করল না ইন্দ্রাণী, পাছে ঘরের হাওয়া আরও ভারী হয়ে যায়। টিভির ভল্যুম বাড়িয়ে দিয়ে ধীরাজকে বলল, তোমারই বা বাইরে কান দেওয়ার দরকার কি? খেলা দ্যাখো।

উমা বললেন, চললি?

–যাই। রাস্তাঘাটে এখন যা ভিড়, কখন পৌঁছব কে জানে!

–তোদের স্কুল কাল বন্ধ হচ্ছে না?

–হুঁ। কাল হয়ে।

–আর তিতিরের?

–ওদের হয়ে গেছে। মহালয়ার দিন থেকে। খুলবে অবশ্য আমাদেরই সঙ্গে। ভাইফোঁটার পর।

আরও দু-চারটে টুকিটাকি কথা বলে ইন্দ্রাণী রওনা দিল। আঁধার নেমে গেছে, উৎসবের সাজে শহর আলোয় আলোময়। দোকানে দোকানে জোর কেনাবেচা চলছে, লোকজন উপচে পড়ছে রাস্তায়। মুমূর্ষ নগরী আজ বুঝি সত্যিই তিলোত্তমা। শুধু ইন্দ্রাণীর হৃদয়েই যে কেন বাতি জ্বলে না!

.

আদিত্য ডাইনিং টেবিলে। দুধে পাঁউরুটি ডুবিয়ে খাচ্ছে।

ইন্দ্রাণী দাঁড়িয়ে পড়ল। দেখছে। কী নিশ্চিন্ত নিমগ্ন ভঙ্গি। জগৎসংসার রসাতলে গেলেও লোকটার যেন কিছু যায় আসে না! শুধু সামনের থালাবাটিটুকুই একমাত্র পৃথিবী।

ব্যাগ বিছানায় ছুঁড়ে ঘুরে এল ইন্দ্রাণী। হিম স্বরে জিজ্ঞাসা করল, ফিরলে কখন?

আদিত্য মুখ তুলল না। পাঁউরুটি ছিঁড়তে ছিঁড়তে বলল, – ঘড়ি তো দেখিনি।

–আবার কখন বেরোনো হবে?

আদিত্যর জবাব নেই।

-কি হল? আমি তোমার সঙ্গে কথা বলছি।

–শুনছি তো।

–জিজ্ঞেস করছি, আবার বেরোবে কখন?

আবার জবাব নেই। দুধে কি পড়েছে, চামচে দিয়ে তুলে নিরীক্ষণ করছে।

ইন্দ্রাণী স্নায়ু নিয়ন্ত্রণে রাখল। আড়চোখে দেখে নিল আদিত্যর ঘর, তিতির নেই। সন্ধ্যার মা-ও চলে গেছে। ক মাস ধরে লোকটার অনাচারের ডাঙশ অনেক হজম করছে ইন্দ্রাণী, আজ একটা হেস্তনেস্ত হওয়া দরকার।

কড়া গলায় ইন্দ্রাণী বলল, – ভেবেছটা কী? তুমি কি মরার সময়েও শুধরোবে না?

কী করলাম?

আবার জিজ্ঞেস করছ, কী করলাম? ইন্দ্রাণী বহুকাল পর ধৈর্য হারাল, –দু হাত তুলে গৌরাঙ্গ হয়ে নেচে বেড়াচ্ছ, ইচ্ছে হলে ফিরছ.. ফিরছ না… এটা ভদ্রলোকের বাড়ি, না তোমার ভাটিখানা?

–আমি তো বাড়িতে মদ খাই না।

–তা হলে আর কি! আমি তরে গেলাম। ইন্দ্রাণী প্রায় ভেংচে উঠল, শোকের দোহাই পেড়ে এসব বেলেল্লাপনা আর কত দিন চলবে?

–আমার ভাল লাগে না। চামচ প্লেটে রাখল আদিত্য।

কী ভাল লাগে না?

আদিত্য আবার চুপ।

কী হল? উত্তর দাও।

–কিচ্ছু ভাল লাগে না। এই বাড়ি না। এই সংসার না। এই শহর না।

 আদিত্যর স্বরে গভীর বিষাদ। কিন্তু এক বিষণ্ণ মানুষের স্বর আর এক বিষণ্ণ মানুষের কাছে পৌঁছয় না। সে আরও তেতে ওঠে, ঝলসায়।

ইন্দ্রাণী দাঁত কিড়মিড় করল, শুধু ভাল লাগে লোকের কাছে টাকা ভিক্ষে করে মদ গিলতে, তাই তো?

–আমি কারুর কাছে ভিক্ষে করে মদ খাই না। লোকে আমায় খাওয়ায়।

বাহ চমৎকার। গুছিয়ে মিথ্যেও বলতে শুরু করেছ! ইন্দ্রাণী চোখ কুঁচকোল, রুনার কাছ থেকে টাকা নিয়েছ কোন আক্কেলে?

রুনার টাকা না তো! দীপুর টাকা।

যারই হোক, তুমি ওখানে হাত পাততে গিয়েছিলে কেন?

অন্য দরকার ছিল।

কী দরকার?

আদিত্য খাওয়া ফেলে ঘরে উঠে গেল। একটা পোস্টকার্ড এনে ধরিয়ে দিল ইন্দ্রাণীকে।

অবাক হয়ে আদিত্যর মুখের দিকে তাকাল ইন্দ্রাণী। পড়ছে চিঠিটা। আবার তাকাল। আবার পড়ছে। তার পড়া শেষ হতেই আদিত্য ছোঁ মেরে চিঠিটা নিয়ে পকেটে রেখে দিল।

ইন্দ্রাণী হাঁ হয়ে বলল, এই পরিতোষ না কে, তাকে তুমি টাকা পাঠাচ্ছ?

–পাঠানো হয়ে গেছে। হাজার। বাকি পাঁচশো চাঁদু দিয়েছে।

তুমি চাঁদুর কাছ থেকেও টাকা নিয়েছ! ইন্দ্রাণীর বাক্যস্ফুর্তি হচ্ছিল না, একজন কে না কে চাইল, ওমনি হাজার টাকা পাঠিয়ে দিলে! তুমি কী!

ছোট্ট শ্বাস ফেলল আদিত্য, তোমাদের শাস্তি দেওয়ার জন্যই পাঠিয়েছি।

আদিত্য উঠে আর একখানা পোস্টকার্ড নিয়ে এল। ধরিয়ে দিয়েছে ইন্দ্রাণীকে।

 পাঁচ-সাত লাইনের চিঠি। ভাই পরিতোষ, আশা করি আমার পাঠানো হাজার টাকা পেয়ে গেছিস। তোর আশ্রমের কথা শুনে আমার বড় ভাল লাগল। কাশী জায়গাটিও আমার ভারী সুন্দর লাগে। তোর আশ্রমেই বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেব মনস্থ করেছি। আপত্তি না থাকলে জানাস…

ইন্দ্রাণীর হাত থেকে চিঠিটা খসে পড়ল। ঠোঁট ফ্যাকাসে, তুমি আশ্রমে চলে যেতে চাও?

আদিত্য নত মুখে ঘাড় নাড়ল।

–এতকাল পর হঠাৎ এই নতুন মতলব?

–পরিতোষের চিঠি পেয়ে কেন যেন…ভেবে দেখলাম এতেই সকলের মঙ্গল।

আদিত্যর স্বর অত্যন্ত মৃদু। প্রায় স্বগতোক্তির মতো। ঘাড় হেঁট করেই বলল, আমি তো কারুর কোনও কাজে লাগি না ইন্দু। আমার থাকাই বা কি, না থাকাই বা কি!

ইন্দ্রাণীর চোখে পলক পড়ছিল না। কাছেই চড়া সুরে মাইকে হিন্দি গান বাজছে, কান ঝিমঝিম। তার মধ্যেই ভাসছে আদিত্যর স্বর–আমার অনেক দোষ। আমি একটা সেন্টিমেন্টাল হ্যাজার্ড। তোমাদের মতো সব কিছু মানিয়ে নিতে পারি না, মেনেও নিতে পারি না। আমার সংযম নেই, উদ্যম নেই…শুধু জ্বালাই, আর কষ্ট দিই…আমার মতো লোকের সংসার করাটাই বিড়ম্বনা। নিজেরও, অন্যেরও। তুমি বিশ্বাস করবে না জানি, তবু বলি…আগে যদি নিজেকে চিনতে পারতাম, কক্ষনও বিয়ে-থা, ঘরসংসার, কোনও কিছুর মধ্যেই নিজেকে…বিশ্বাস করো, কক্ষনও না..

ইন্দ্রাণী বিড় বিড় করে বলল, তিতিরকে বলেছ?

আদিত্য এক মুহূর্ত থেমে থেকে বলল, – বলিনি। বলব।

-ও।

-সত্যি বলছি ইন্দু, মনের মধ্যে এই টানাপোড়েন আমি আর সইতে পারি না। দেখো…আমি চলে গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে।

ইন্দ্রাণীর ভেতরটা অসাড় হয়ে আসছিল। কী যেন একটা কন কন করছে বুকে। কান্না পাচ্ছে কি? আনন্দ হচ্ছে? ক্রুদ্ধ হচ্ছে ইন্দ্রাণী? স্বস্তি পাচ্ছে? অথবা ক্ষোভ..অভিমান…? প্রথম দিন থেকে মনে মনে ওই লোকটার হাত থেকে মুক্তি চেয়েছে, কিন্তু ঠিক এইভাবে কি? এত দিন পর?

ইন্দ্রাণী নিজের ভাবনাটাকেও চিনতে পারছিল না।

.

৭৪.

সম্বলপুর এক্সপ্রেস হাওড়া স্টেশন ছাড়ে রাত নটায়। আজ বেশ দেরি করে ছাড়ল, প্রায় পৌনে দশটায়। রেল কোম্পানির টাইমটেবিল, স্টেশনের সুদৃশ্য আলোলাকিত বোর্ড, যন্ত্রগণকে ছাপা ট্রেনের টিকিট, সর্বত্রই ঘটা করে একটা সময় লেখা থাকে বটে, তবে বাস্তবের সঙ্গে ইদানীং তার কদাচ মিল। এখন আবার পুজোর মরসুম, রোজ গাদা গাদা পুজো স্পেশাল রওনা দিচ্ছে দিকে দিকে, এই ব্যস্ততার সময়ে রেলের নিয়মানুবর্তিতার কথা উচ্চারণ করাও গর্হিত অপরাধ! দূরপাল্লার গাড়ি আপন মর্জিতে চলবে এটাই তো স্বীকৃত রীতি!

শুভাশিসের মেজাজ খাট্টা হয়ে গিয়েছিল। গতিময় যুগে এই ছোট্ট ছোট্ট বিশৃঙ্খলা তার একদম বরদাস্ত হয় না। আজ বিজয়া দশমী, প্রতিমা নিরঞ্জনের ঝঞ্ঝাটে পথে ট্রাফিক জ্যাম হতে পারে ভেবে সাততাড়াতাড়ি বাড়ি থেকে বেরিয়েছে, অথচ রাস্তাঘাট আজ আশ্চর্য রকমের ফাঁকা, মাত্র আধ ঘণ্টায় হাওড়া পৌঁছে গেল। তারপর এই শবরীর প্রতীক্ষা, কখন ট্রেনের বাঁশি বাজবে। ঘড়ি ধরে, ঘড়ির কাঁটা মেপে যার দিন চলে, তার কি এত সময়ের অপচয় সহ্য হয়! এই দু-আড়াই ঘণ্টায় শুভাশিসের অন্তত দশটা রুগী দেখা হয়ে যেত, অথবা একটা মেজর অপারেশন। কেন যে মানুষ সময়কে টাকার মূল্যে দেখে না!

শহরতলি পেরিয়ে ট্রেন অনেকটা গতি বাড়িয়েছে। চলার তালে দুলছে মৃদু মৃদু, ঝম ঝম শব্দ তুলছে। মেজাজ জুড়িয়ে আসছিল শুভাশিসের, স্বস্তি বোধ করছিল। যাব যাব করে এতদিন পর তবে বেরোনো হল! ছন্দার শরীর-মন কতটা কি সারবে কে জানে, শুভাশিসের নিজের জন্য কিন্তু এই বেড়ানোটার প্রয়োজন ছিল খুব। সংসার মন আর কাজের সাঁড়াশি আক্রমণ ঝাঁঝরা করে দিয়েছে শুভাশিসকে, এই শহর থেকে কটা দিন সত্যিই পালিয়ে থাকা দরকার।

কাল সন্ধেবেলা ইন্দ্রাণীর কাছে গিয়েছিল শুভাশিস। একাই ছিল ইন্দ্রাণী, বসে ছিল বারান্দায়। যেন তার জন্যই অপেক্ষা করছিল। মলিন ফিরোজা রঙ শাড়ি পরেছিল ইন্দ্রাণী, কপালে টিপ ছিল না, ভারি শুকনো দেখাচ্ছিল ইন্দ্রাণীকে। শহর জোড়া আলোর রোশনাইয়ের মাঝে যেন এক ক্ষয়াটে চন্দ্রমা।

শুভাশিস রসিকতা করে বলেছিল, গাঁক গাঁক মাইকের মাঝে অমায়িক হয়ে বসে আছ কী করে?

ইন্দ্রাণী উত্তর না দিয়ে হাসল। ঘরে নিয়ে গিয়ে বসাল শুভাশিসকে। রান্নাঘর থেকে চা করে নিয়ে এল। কথা বলছিল কম, শুনছিল বেশি। কি এক পলকা চিন্তায় আনমনা বারবার।

শুভাশিসের বুকের ভেতর মেঘ ডাকছিল। যে কথা বলার জন্য আসা, সেকথা আটকে যাচ্ছে গলায়। অথচ কথাটা ইন্দ্রাণীর একদম অজানা তো নয়!

হাবিজাবি কথা শুরু করল শুভাশিস, তোমাদের ফ্ল্যাটের তো ভিত কমপ্লিট শুনলাম।

–কে বলল?

–চাঁদু বলছিল। ষষ্ঠীর দিন নার্সিংহোমে চাঁদুর সঙ্গে দেখা, তখনই কথায় কথায়…চাঁদুর সঙ্গে কি মধুমিতার সিরিয়াস অ্যাফেয়ার চলছে?

–বোধহয়।

উঁহু, বোধহয় নয়, আমি ডেড শিওর। চাঁদুকে দেখলেই মধুমিতার মুখচোখ যা গ্লো করে ওঠে।… মধুমিতা আজকাল সাজগোজও করে খুব।

তাই বুঝি?

ইয়েস। চাঁদু আর মধুমিতা দারুণ পেয়ার হবে। যদি অবশ্য সব স্মুথলি রান করে।…আমার কি ভয় লাগে জানো? মেয়েটার একটা স্যাড পাস্ট আছে তো, নতুন করে আবার ধাক্কা না খায়। আশা করি চাঁদু মেয়েটার সঙ্গে ফ্লার্ট করছে না।  

–কে ফ্লার্ট করে, কে করে না, বোঝা খুব মুশকিল।

–আমি অন্তত করিনি। শুভাশিস হাসতে চাইল, আই ওয়াজ নট এ ফ্লার্ট। আই ওয়াজ কনফিউজড।

ইন্দ্রাণী তাকাল না। শাড়ি পাট করছে। অপ্রয়োজনীয় কাজ সারছে।

শুভাশিসের পেট থেকে ঠেলে উঠছে কথার বুদবুদ। অর্থহীন ফেনা হয়ে ফুটে বেরোচ্ছে, চাঁদু কিন্তু গাড়িটা কিনেছে বেশ। মডেল পুরনো, কিন্তু বেশ শক্তপোক্ত আছে। তবে কালারটা বড্ড ডাল। মাটি মাটি রঙ যে ও কী করে স্ট্যান্ড করছে!..ওকে রঙটা বদলে নিতে বলছ না কেন?

ইন্দ্রাণী আলমারি খুলল। আলমারি বন্ধ করল। খালি চায়ের কাপ তুলে দরজার দিকে এগোচ্ছে।

শুভাশিস অসহায় বোধ করছিল। নিজের কথা নিজের কানেই প্রলাপের মতো ঠেকছে। দুর, এই ছেলেমানুষির কোনও অর্থ হয় না। পুজোর পর বেড়াতে যাবে এ-ইঙ্গিত তো দেওয়াই ছিল ইন্দ্রাণীকে, তবু কেন এত দ্বিধা! দিন পনেরো আগে ট্রাভেল এজেন্টকে দিয়ে টিকিট কাটিয়েছে, তার পরও বার তিন-চার এসেছে এখানে, কিন্তু কিছুতেই কথাটা বলে উঠতে পারেনি। বলেনি বলে কি ইন্দ্রাণী আহত হবে? নাকি ইন্দ্রাণী আহত হবে ভেবে বলাটা হয়ে ওঠেনি?

দুটো আপাতবিরোধী চিন্তার টানাপোড়েন চলছিল শুভাশিসের মাথায়। মরিয়া হয়ে শেষে বলেই ফেলল, আমরা কাল বেরোচ্ছি রানি।

ইন্দ্রাণী যেন ভুলেই গেছে কথাটা। ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, – কোথায়?

–ওই যে বলেছিলাম শালিনী সব অ্যারেঞ্জমেন্ট করে দিচ্ছে। বলতে বলতে অকারণে একটা মিথ্যে যোগ করল শুভাশিস, অরূপ জোর করে পরশু দিন টিকিট ধরিয়ে দিয়ে গেল। যেতেই হবে।

সেকেন্ডের জন্য ইন্দ্রাণী নিষ্পলক। পরক্ষণে বেরিয়ে গেছে ঘর থেকে। ফিরে এসে বলল, যাও ঘুরে এসো। ফিরছ কবে?

–আমার তো বেশি দিন চেম্বার বন্ধ রাখার উপায় নেই। দেখি, দেওয়ালির আগেই ফিরব।

 –এতদিনের জন্য যাচ্ছ, টোটোর পড়ার ক্ষতি হবে না? সামনে ফাইনাল…

–টোটো যাচ্ছে না। শুভাশিস মাথা নামিয়ে আবার একটা অর্ধ সত্য বলল, বোঝোই তো, আজকালকার ছেলে..বড় হয়েছে…বাবা-মার সঙ্গে আর বেরোতে চায় না।

–ও। কি যেন নাম বলেছিল জায়গাটার?

–টেনশা। রাউরকেল্লার কাছে।

বাহ, ভাল। খুব ভাল।

 ইন্দ্রাণীর স্বর এতটুকু প্রকম্পিত হল না। যেন ছন্দার সঙ্গে বেড়াতে যাবে শুভাশিস, এটাই সত্য, এটাই স্বাভাবিক। ইন্দ্রাণীর এই অচঞ্চল ভাবটা কি নিখাদ! মনে হলেই শিরায় শিরায়, কোষে কোষে দাবানল জ্বলে ওঠে শুভাশিসের। সংসারে তো ইন্দ্রাণী সংপৃক্ত ছিলই, তবু তার মধ্যেও শুভাশিস ছিল। আজ কেন সে এত তুচ্ছ হয়ে গেল!

গুম গুম শব্দে কোলাঘাট ব্রিজ পার হচ্ছে ট্রেন। পাশের সেতুর আলো প্রতিফলিত হচ্ছে রূপনারায়ণে, আঁধার মাখা জলে কাঁপছে আলোর জাফরি। বড় বিমর্ষ, বড় ক্লান্ত দেখায় এখন নদীকে। নদী কি মানুষের মন বোঝে!

শুভাশিস চোখ সরিয়ে নিল। ভারী সুটকেসটা পায়ের কাছেই পড়ে আছে, ঠেলে ঠেলে সিটের তলায় ঢোকাল। ছন্দা এখনও ব্যাক সিটে মাথা ঠেকিয়ে বসে, আঁখি দুটি বোজা। দুজনের মাঝখানে ঢাউস ট্রাভেল ব্যাগ। প্রাচীরের মতো। সামান্য নাড়াচাড়া করে ব্যাগটাকে মাঝেই রেখে দিল শুভাশিস। ট্রেনে দেওয়া বেড রোল খুলে দুই যুবক সহযাত্রী ঘুমের তোড়জোড় করছে। হাওড়া স্টেশনে ছেলে দুটোর সঙ্গে অল্প আলাপ হয়েছিল শুভাশিসের। দুজনেরই বয়স বছর পঁচিশ, চোখা চেহারা, সি-এ পড়ছে, অডিট করতে যাচ্ছে রাউরকেল্লা স্টিল প্ল্যান্টে। ট্রেনে ওঠা ইস্তক কাজের গল্প করছিল ছেলে দুটো। খেলা নয়, সিনেমা নয়, রাজনীতি নয়, সারাক্ষণ শুধু সিংগল এনট্রি, ডবল এনট্রি, ক্রস এনট্রি, ব্যাংক রিকনসিলিয়েশান। একটু আগে কাগজের মোড়ক বগলে পালা করে বাথরুম থেকে ঘুরে এল দুজনে। সেও প্রায় রুটিনের মতো। পা টলছে না, গলা দুলছে না, শুধু একটা হালকা হুইস্কির গন্ধ ছড়িয়ে দিয়েছে কুপে। টোটোও কি এরকম হবে? বাজে কথা না বলা নিষ্প্রাণ রোবট।

সিগারেট ধরিয়ে শুভাশিস ছন্দার দিকে ফিরল, শুনছ?

চোখ খুলল ছন্দা, মুখ ফেরাল না। বলল, –উঁ?

এদিকে এসে বসবে, জানলার ধারে?

না, এখানেই ঠিক আছি।

এসো না, ভাল লাগবে। হাওয়া পাবে।

ছন্দা চুপচাপ এসে বসল। প্রাচীরটা ওপরের বার্থে উঠে গেছে।

 দরজায় গিয়ে শুভাশিস করিডোরে উঁকি দিয়ে এল। সুনসান। উজ্জ্বল বাতি নিবে রাতআলো জ্বলছে। আলোআঁধারে একা একা ছুটছে বাতাস, পাক খাচ্ছে। আশ্বিন চলছে, বাতাস এখনও তেমন ধারালো নয়। পাশের বন্ধ কুপ ফুঁড়ে একটা মেয়েলি হাসি ঝটপট করে উড়ে এল। কান পেতে দু-চার সেকেন্ড আওয়াজটা শুনল শুভাশিস। তারপর ছন্দার পাশে এসে বসেছে।

–ভাবছ কী তখন থেকে? মন খারাপ?

না তো।

–গুল মেরো না। টোটোর জন্য তোমার মন কেমন করছে না?

–মন কেমনের কি আছে? টোটো আসবে না, এ তো জানাই ছিল।

 জানা আর জানা জিনিসটা ঘটে যাওয়া দুটো কি এক! শুভাশিস অবাক মুখে বলল, – টোটোর জন্য তোমার উদ্বেগ হচ্ছে না? এই পনেরোটা দিন টোটো কীভাবে থাকবে, কী খাবে, কোনও ব্যাপারে তোমার দুশ্চিন্তা নেই?

–দুশ্চিন্তা করে কিছু লাভ আছে?

কথাটা কেমন যেন ভাসতে ভাসতে এল, ছেঁড়া ছেঁড়া ভাবে। বাতাসের ছোঁয়াচ লেগে আরও যেন হিমেল শোনাল। হিমেল, না বিষণ্ণ? বিষণ্ণ, না হতাশ? হতাশ, না অভিমানী? অপারেশানের পর থেকে ছেলের ওপর একটা সূক্ষ্ম অভিমান জন্মেছে ছন্দার, টের পায় শুভাশিস, রহস্যটা বোঝে না। ছেলে আর ছন্দার শক্ত খোলায় আদ্যন্ত ঢাকা পড়ে নেই, এটাই কি কারণ! নাকি ছেলে বড় হলে মার সঙ্গে আপনা-আপনি দূরত্ব তৈরি হয়ে যায়, মারা ঠিক মেনে নিতে পারে না! ইন্দ্রাণী বাপ্পার মধ্যেও তো এমনই এক মান-অভিমানের খেলা চলে এখন। এই বয়সের ছেলের কাছে মার যে ঠিক কী ধরনের প্রত্যাশা থাকে?

সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বুকে একটুক্ষণ ধোঁয়া জমিয়ে রাখল শুভাশিস। চাপ বাড়ছে ক্রমশ। ফার্স্ট ইয়ার মেডিকেলের শুভাশিস গরমের ছুটিতে বালুরঘাট ফিরছে, রাত জেগে ট্রেনে বাসে জার্নি করে হতশ্রান্ত দশা। কোয়ার্টারের সবুজ লনে চোখ চেয়ে বসে আছেন মনোরমা, ইজিচেয়ারে। বাড়ি ঢোকার আগে মার সামনে দাঁড়াল শুভাশিস। সঙ্গে সঙ্গে সুতীক্ষ্ণ চিৎকার। সরু, এক অপ্রাকৃত স্বর। সাইরেনের মতো।

অজান্তেই দু কান চাপল শুভাশিস। একটু একটু করে ধোঁয়া ছাড়ল। বুক হালকা করে বলল, টোটোকে নিয়ে তোমার তা হলে চিন্তা নেই বলছ?

ছন্দা জানলার কাচ নামিয়ে দিয়েছে, তার অপলক দৃষ্টি বন্ধ কাচে স্থির। বাইরের আলোয়, বাইরের অন্ধকারে। নিচু গলায় বলল, আমার কাউকে নিয়েই চিন্তা নেই।

মুহূর্তে শুভাশিসের মুখ পাংশু। জোর করে হাসল, এতদিনে তবে তোমার বোধোদয় হল। টোটোর জন্য সত্যিই ভাবনা করার কিছু নেই। তোমার কাজের মেয়েটি আজকাল ভালই রান্না করে, তোমার ছেলের খাওয়া-দাওয়ার কোনও অসুবিধে হবে না।….

–জানি।

–তারপর ধরো তোমার দিদি জামাইবাবু রোজ খোঁজ নিয়ে যাবে।… অরূপরা আছে..তুমিও টেনশা থেকে ফোন করে খবর নিতে পারো।

জানি।

কিচ্ছু জানো না। ছেলেকে নিয়ে আদত ভয় তো একটাই। ওই গাড়ি। ছন্দার মুখে কোনও রেখা ফোটে কিনা বোঝার চেষ্টা করল শুভাশিস। একটু চুপ থেকে বলল, কাল আমি টোটোকে দিয়ে প্রমিস করিয়ে নিয়েছি, আমাদের অ্যাবসেন্সে ও স্টিয়ারিং-এ হাত ছোঁয়াবে না।

–শুনেছি।

–কোত্থেকে শুনলে?

–টোটোই একটু আগে স্টেশনে বলছিল।

–ও, তুমিও তা হলে ছেলের কাছ থেকে কথা আদায় করেছ?

না। টোটো বলল, শুনলাম।

–ও।

শুভাশিস আবার ম্রিয়মাণ। ছন্দার নিস্তেজ অভিব্যক্তিগুলো শিথিল করে দিচ্ছে শরীর। কী যে আবার হল ছন্দার! অ্যান্টি ডিপ্রেশান ড্রাগে মাঝে তো ভাল উন্নতি হয়েছিল। বেশ হাসত, কথা বলত, রান্নাঘরেও ঢুকছিল, পুজোর আগে পর পর কদিন মার্কেটিং-এও বেরোল, কদিন ধরে হঠাৎ আবার..! তবে কি ছেলে ফেলে বেড়াতে যাওয়া ছন্দাকে যতটা নির্লিপ্ত দেখাচ্ছে তার অনেকটাই অভিনয়! এই পাথরপ্রতিমা নিয়ে কি করে পনেরোটা দিন কাটাবে শুভাশিস?

সামনে বোধহয় সিগনাল হয়নি, ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ করে দাঁড়িয়ে পড়ল ট্রেন। হুইসিল বাজাচ্ছে জোর জোর। যেন রাতকে আঁচড়ে কামড়ে অসহায় আর্তনাদ করছে। কানে লাগে বড়।

ডাক্তার শুভাশিস ছন্দার স্থৈর্য নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানোর চেষ্টা করল। টোটোর কথাই তুলল আবার। বলল, তোমার ছেলে হঠাৎ ফিজিক্স টিচারের কাছে যাওয়া বন্ধ করল কেন?

-স্যারের পড়ানো ভাল লাগছিল না।

–হঠাৎ? অনেক দিন তো ওই স্যারের কাছে পড়ছিল!

–আমি কী করে বলব?

–তুমি জিজ্ঞেস করোনি?

করেছিলাম। তাতেই তো ওই উত্তর দিল।

–এখন কী হবে? এই কমাসের জন্য ভাল টিচার পাওয়া যাবে?

–তোমারও তো দেখছি ছেলেকে নিয়ে ভাবনা কম নয়! ছন্দার ঠোঁটের ফাঁকে হাসির রেখা ফুটল। অগভীর রেখা, কিন্তু হাসিই।

স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল শুভাশিস। তরলভাবে বলল, — আই নো টোটো ইজ এ মাদার্স সান, স্টিল আমারও তো…

-ছেলের কথা ছাড়ো। ছন্দা থামিয়ে দিল শুভাশিসকে, খাবে কিছু?

শুভাশিসের অল্প অল্প ক্ষিধে পাচ্ছিল। কোন সন্ধেয় ডিনার সেরেছে, এখন রাত সাড়ে এগারোটা। ছোট্ট একটা হাই তুলে বলল, -কী আছে?

–চিকেন স্যান্ডুইচ খাবে?

উঁহু, হেভি হয়ে যাবে। লাইট কিছু নেই?

ছন্দা কথা না বলে ট্রাভেল ব্যাগটা পাড়ল। তার ভাড়ার কখনও শুন্য থাকে না, একে একে প্যাকেট বেরোচ্ছে। লাড্ডু, সন্দেশ, কাজুবাদাম, ক্রিম বিস্কুট, চানাচুর।

শুভাশিস দুটো বিস্কুট তুলে নিল হাতে, সঙ্গে একটা সন্দেশ। বিস্কুটে কামড় দিয়ে বলল, তুমি কিছু খাবে না?

না। আমি এবার শোব। অনেক রাত হয়েছে।

ছন্দা উঠে দাঁড়াল, বাথরুমে যাচ্ছে।

দুই সহযাত্রী যুবকের ঘুম এখন মাঝরাতে। শুভাশিস একটা সিগারেট ধরাতে গিয়েও ধরাল না, করিডোরে বেরিয়ে এল। ধাতব ঝঙ্কার তুলে উদ্দাম ছুটছে ট্রেন। ফার্স্ট ক্লাস কামরার সুখী মানুষরা সবাই এখন যে-যার প্রকোষ্ঠে। একটা খোপের দরজা আধখোলা, আলগা কৌতূহল নিয়ে সামনে দিয়ে একবার হেঁটে এল শুভাশিস। তিন মধ্য বয়সী লোক তাস খেলছে, পাশে বোতল গ্লাস। একজন ভাবলেশহীন চোখে শুভাশিসের দিকে তাকাল, আবার ডুবে গেছে খেলায়।

সরে এল শুভাশিস, কুপে ফিরে দ্রুত বড় স্যুটকেস খুলল। ট্রেনে সচরাচর সে মদ্য পান করে না, আজ যেন তৃষ্ণা জাগছে। বোতল বার করে বেশ খানিকটা হুইস্কি সরাসরি চালান করে দিল মুখে। তরল আগুন নামছে গলা দিয়ে, তপ্ত হয়ে উঠছে জিভ। ভাল লাগছে, পলকা আমেজ আসছে একটা। আলোকদ্যুতি যেন কমে এল সহসা, স্বপ্ন স্বপ্ন ঘোর নামছে চোখে।

ছন্দা ফিরল, ম্যাগো, বাথরুমটা কী নোংরা।

কন্ডাকটারকে ডেকে দেখিয়েছ?

–কোথায় কন্ডাকটার! সে হয়তো কোথাও ভোস ভোস ঘুমোচ্ছে। এত টাকা খরচ করে লোকে ফার্স্ট ক্লাসে যাবে, সেখানেও যদি বাথরুমে এত দুর্গন্ধ হয়…

এরকম গজগজ না করলে কি ছন্দাকে মানায়! নিজের বাড়ি ছাড়া সর্বত্রই বাথরুমে যাওয়ার ব্যাপারে ছন্দা ভীষণ খুঁতখুঁতে। ইদানীং রীতিমতো বাতিকগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল। অন্য সময়ে শুভাশিস বিরক্ত হয়, আজ মজা লাগছিল। নাহ্, ছন্দার সেরে ওঠা ঠেকায় কে?

শুভাশিস চটুলভাবে বলল, দেখুন ছন্দা দেবী, ফার্স্ট ক্লাসই হোক, আর সেকেন্ড ক্লাসই হোক, ট্রেনের বাথরুম গন্ধ ছড়াবেই। এ তো আর স্যাস ক্লিনিকের টয়লেট নয়, ঘন ঘন ফিনাইল পড়ছে, ব্লিচিং পাউডার ছড়ানো হচ্ছে…

–হুঁ। ছন্দা সব পেয়েছি ঢাউস ব্যাগ থেকে চাদর বার করল। বার্থে বিছোচ্ছে। বলল, তোমাদের নার্সিংহোমে আমার দেখা আছে।

–তবে? মেঝেতে মুখ দেখা যায় কিনা বলো? জানো তো, একটা নতুন সিস্টার সেদিন পেশেন্টের নোংরা জামাকাপড় দরজার কোণে একটু রেখেছিল, কী ঝাড় যে দিল শালিনী!

–ঠিক করেছে। দেওয়াই উচিত। ছন্দার হঠাৎ যেন কি মনে পড়ে গেল, হ্যাঁ গো, শালিনী বলছিল তোমাদের নার্সিংহোম নাকি ভাল চলছে না?

–ভাল চলছে না! শালিনী বলেছে এ কথা?

বলল তো। বলছিল তোমাদের নাকি তেমন প্রফিট হচ্ছে না, আরও বেটার রিটার্ন নাকি আশা করেছিলে।

কথাটা ফুৎকারে উড়িয়ে দিতে পারল না শুভাশিস। দিন পনেরো আগে স্যাস ক্লিনিকের হিসেবপত্র নিয়ে বসেছিল তিন জনে, চুলচেরা পাই-পয়সার হিসেব নয়, মোটামুটি একটা লাভ-ক্ষতি নিরূপণের চেষ্টা। দারুণ আশাপ্রদ কিছু মনে হয়নি। টাকা থাকলে একটা প্রতিষ্ঠান গড়ে ফেলা যায়, কিন্তু তাকে টিকিয়ে রাখা, চালিয়ে নিয়ে যাওয়া, ধীরে ধীরে আরও উঁচুতে ঠেলে তোলা রীতিমতো শক্ত কাজ। এতে অনেক সূক্ষ্ম কৌশল লাগে, বহু ছোটখাট চালাকির আশ্রয় নিতে হয়। অরূপের মতে স্যাস ক্লিনিকের বেড চার্জ অনেক বেশি, কয়েকটা ঘর কেটে ছোট ছোট কিউবিক করে দিলে চার্জও কমে, রুগীর অভাবটাও সামলানো যায়। শুভাশিস মন খুলে প্রস্তাবটায় সায় দিতে পারেনি। সানশাইনের পাঁচ বাই আট অস্বাস্থ্যকর খোপগুলো দেখে কতবার সে নাক কুঁচকেছে, আজ যদি তাদের নিজেদেরই নার্সিংহোমে..! তবু হয়তো মেনে নিতে হবে। একেই বুঝি বাবার ভাষায় আপোস করা বলে। হাঃ, বাবারা যেন আপোস করেনি! আজ সব হাসপাতালগুলো যে নরকের দরজায় পরিণত হয়েছে, তার মূলটা কোথায়? বাবাদেরই তো গা-ছাড়া মনোভাব। একটু একটু করে ক্লেদ জমতে দেখেও বাবারা কি চোখ বুজে থাকেনি! সংঘর্ষ দূরস্থান, সেভাবে প্রতিবাদও তো করেনি কেউ।

শুভাশিস ভারিক্কি ভঙ্গিতে বলল, –এটা একটা টেম্পোরারি ফেজ। যে কোনও বিজনেস জমে উঠতে একটু তো সময় লাগবেই। আমাদের এখনও কিছু খামতি রয়ে গেছে।

ছন্দার চোখে প্রশ্ন।

শুভাশিস সোজা হয়ে বসল, যেমন ধরো, একটা মাত্র ওটিতে কুলিয়ে ওঠা যাচ্ছে না। আমাদের ওখানে এখন অনেক ডক্টর আসছে, কেউই ঝট ঝট ওটির ডেট পাচ্ছে না। এই তো লাস্ট উইকে আমাদের ওটিতে বুকিং না পেয়ে ভাস্কর সাদার্ন পয়েন্টে পেশেন্ট পাঠিয়ে দিল।

–ভাস্করদা স্যাস ক্লিনিকে আসছে! ছন্দা হাওয়া বালিশ ফোলানো থামাল, তুমি না ভাস্করদাকে নার্সিংহোমে এন্ট্রি দেবে না বলেছিলে!

–তুৎ, তা পারা যায় নাকি! চামার হোক, কি কসাই হোক, আমরা বার্ডস অফ দা সেম ফেদার তো বটে। বেওসা করতে গেলে ছোটামোটা ইগো প্রবলেম ঝেড়ে ফেলতে হয় ভাই। এবার ও শালা নার্সিংহোম খুললে আমায় কন্ট্যাক্ট করবে।

ব্যাগ থেকে দুটো ট্যাবলেট বার করল ছন্দা, টক টক মুখে ফেলে জল গিলল, – আর তোমাদের আই সি ইউ খোলার কী হল?

হবে। দেওয়ালিটা যাক। দোতলার একটা পোরশান নিয়ে প্ল্যান ছকা আছে, ফিরে এস্টিমেটে বসব। স্টার্টিং-এ চারটের বেশি বেড রাখব না।

মাত্র চারটে?

অনেক টাকার ধাক্কা ম্যাডাম। কত ইনমেন্ট লাগবে জানো? এবার বোধহয় ব্যাঙ্ক লোন নিতেই হবে। বলতে বলতে ছন্দার দিকে একটু ঝুঁকল শুভাশিস, অরূপ শালিনী আর একটা সাজেশানও দিচ্ছে।

কী?

খুব সাবধানে কথাটা পাড়ল শুভাশিস। আলতো হাত তুলে দিল ছন্দার কাঁধে, ওরা বলছিল টোটো তত বড়ই হয়ে গেছে, ওকে নিয়ে তোমার এখন তেমন হানটান ছোটাছুটি নেই, সুতরাং তুমি তো স্বচ্ছন্দে একটু-আধটু নার্সিংহোমে আসতে পারো।

কেন?

কাজ করবে। আই মিন আমাদের হেলপ করবে। শুভাশিস ছন্দার কাঁধে মৃদু চাপ দিল। মনে মনে বলল ট্রিটমেন্ট বাই কমপ্যানিয়নশিপ। মুখে বলল, – যেমন ধরো প্যানট্রির দেখভাল করলে, পেশেন্টদের ডায়েটে একটু হোমলি টাচ পড়বে… তারপর ধরো রুম সব প্রপারলি মেনটেন হচ্ছে কিনা ওয়াচ রাখলে.. মানে ওভারঅল সুপারভিশান আর কি। তোমারও হু হু সময় কাটবে শুভাশিস ঠোঁট টিপে হাসল, মাগনায় খাটাব না গো। ভাল রেমিউনারেশান পাবে।

ছন্দা হুঁ না কিছুই করল না। একটু বুঝি অন্যমনস্ক হয়ে গেল। নাকি উদাসীন? থাক, এক দিনে আর বেশি ডোজ না দেওয়াই ভাল।

ট্রেন দাঁড়িয়েছে। সাত-আট মিনিটের স্টপেজ। অন্য কামরা থেকে দু-চার জন যাত্রী নেমেছে প্ল্যাটফর্মে, এত রাতেও খাবার কিনছে। পুরি সবজি ডিম সেদ্ধ। অবসন্ন সুরে কলসি কাঁধে হেঁকে বেড়াচ্ছে চাঅলা। লটবহর নিয়ে হন্তদন্ত কিছু মানুষ কামরা খুঁজছে, ভেতর থেকেও তাদের পদধ্বনি শোনা যায়। স্বামী-স্ত্রী বাচ্চার একটা ছোট ফ্যামিলি শুভাশিসদের কামরায় উঠল, তরুণী মার কোলে ঘুমোচ্ছে বাচ্চাটা।

জীবনের এই চলমান ছবিগুলো দেখতে ভাল লাগে শুভাশিসের, কিন্তু সময় কই! শুধু কাজ কাজ আর কাজ। কেন কাজ, কার জন্য কাজ সেসবও ভাবার সময় নেই, যন্ত্রমানবের মতো শুধু ঘাড় খুঁজে খেটে যাওয়া। সুখহীন। আনন্দহীন। তৃপ্তিহীন। কোন ছোটবেলায় স্কুলে পড়া একটা কবিতার লাইন গুনগুনিয়ে উঠল শুভাশিসের মাথায়।

নো টাইম টু স্ট্যান্ড বিনিথ দা বাউজ।
অ্যান্ড স্টেয়ার অ্যাজ লঙ অ্যাজ শিপ অর কাউজ
নো টাইম টু সি হোয়েন উডস্ উই পাস
হোয়্যার দা স্কুইরিলস্ হাইড দেয়ার নাটস্ ইন গ্রাস

কেন যে মনে পড়ছে! সত্যিই কি সে গরু-ভেড়ার জীবন চায়! আবার যে-জীবন সে যাপন করছে তার সঙ্গে গরু-ভেড়ার পার্থক্যই বা কতটুকু।

ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। গুটিসুটি মেরে নীচের বার্থে শুয়ে পড়েছে ছন্দা।

 বাথরুম থেকে প্যান্ট-শার্ট বদলে পাজামা-পাঞ্জাবি পরে এসে ওপরের বার্থে উঠে পড়ল শুভাশিস।

…এ পুওর লাইফ দিস ইফ ফুল অফ কেয়ার… লাইনগুলো ঘুরেই চলেছে। সম্পূর্ণ ভাবনাচিন্তাবিহীন হয়ে কাটাতে হবে কটা দিন।

ট্রেনের দুলুনিতে ঘুমিয়ে পড়েছিল শুভাশিস, শেষরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। কোথায় যেন থেমে আছে ট্রেন। মুখ বাড়িয়ে বাইরেটা দেখার চেষ্টা করল, ঘুটঘুট করছে অন্ধকার। মনে হয় কোনও মাঠেঘাটে দাঁড়িয়েছে।

গলা শুকিয়ে গেছে, জল খাওয়ার জন্য নীচে নামল শুভাশিস। অন্যমনস্ক চোখ ছন্দার দিকে পড়তেই চমকে উঠেছে।

–এ কি, তুমি ঘুমোওনি!

–ঘুম আসছে না। …আমাকেও একটু জল দাও তো।

জলের জায়গাটা ছন্দার হাতে দিল শুভাশিস, তুমি আজ ঘুমের ট্যাবলেট খাওনি?

–খেয়েছি। তবু…। একটা কথা ভাবছিলাম।

কী কথা?

–এই প্রথম আমরা দুজনে শুধু কোথাও বেড়াতে যাচ্ছি, তাই না? বিয়ের আঠেরো বছর পর! বিকট হুইসিল বাজিয়ে পাশ দিয়ে একটা ট্রেন ছুটে যাচ্ছে। উল্টো মুখে। কান বধির করা শব্দ। আর ছুটন্ত আলো দেখিয়ে নিমেষে মিলিয়ে গেল।

আবার নৈঃশব্দ্য। আবার অন্ধকার। আরও গাঢ়, আরও ঘন।

শুভাশিসের গা ছমছম করে উঠল।

.

৭৫.

ভাড়াবাড়িতে এসে সুদীপের দিনছন্দ অনেকটাই বদলে গেছে। সে চিরকালই একটু ধুসর ধরনের মানুষ, তেমন মিশুকে নয়, ভাল আড্ডা জমাতে পারে না, স্কুলে কলেজে অফিসে কোথাও তার কারুর সঙ্গে তেমন বন্ধুত্ব গড়ে ওঠেনি। অল্প দু-চারজন সঙ্গীসাথী আছে বটে, কিন্তু তারা কেউ বন্ধু নয়, তাদের কাছে নিজেকে উন্মোচিত করা যায় না। হয়তো ন মাসে ছ মাসে কারুর বাড়ি গেল, কি কোথাও দেখা হয়ে একটু হইচই করল, ব্যস ওইটুকুনিই। অফিসের কাজ আর বাড়ির নিভৃত কোণটুকুই সুদীপের বেশি পছন্দ। চার ভাইবোনের মধ্যে সে ছিল লেখাপড়ায় সব থেকে চৌখস, মাত্র সাত নম্বরের জন্য এম. কম.-এ ফার্স্ট ক্লাস পায়নি, তাড়াতাড়ি চাকরিতে ঢুকেছে, অফিস বদলে বদলে সে এখন এক মাঝারি ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানির চিফ অ্যাকাউন্টস অফিসার। অফিস তার দিনের বেশির ভাগ সময়টাই গিলে নেয়, বাড়ি ফিরে বাকি সময়টুকু নিশ্চিন্তে জিরোনো তার অভ্যাস। একটু হয়তো টিভি দেখল, কিংবা একটু ম্যাগাজিন উল্টোল, কখনও বা অলস শুয়ে টেপ শুনল, খুব শ্রান্ত লাগলে এক-আধদিন মেডিকেল ডোজে মদ্যপান করল, আর আহার নিদ্রা মৈথুন–এই নিয়েই রায়বাড়িতে বেশ সুখে ছিল সে। চরম ভোঁতা জীবনেও উত্তেজনার কিছু খোরাক ছিল ওই বাড়িতে। আদিত্য তো ছিলই, ছিল তার সহস্র ট্যানট্রাম, রুনাও প্রায়দিনই তুচ্ছাতিতুচ্ছ কারণে অগ্নিগর্ভ হয়ে থাকত, এ ছাড়াও ছিল অসংখ্য সূক্ষ্ম সুতো টানাটানির খেলা। ছিল চোরা বিবাদ, গোপন নির্ভরতা। ছিল অদৃশ্য মায়াতন্তুতে জড়িয়ে থাকা এক পরিবার। বেশ ছিল সুদীপ।

কিন্তু এখন দৃশ্যপট অন্যরকম। রুনা এখন সর্বদাই খুশিতে ফুটছে। সুদীপ অফিস থেকে ফিরলেই এখন আর অভিযোগের ঝাঁপি খুলে বসে না, ছেলের দুধ আসতে দেরি হল বলে চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করে না, কারণে অকারণে বেধড়ক পেটায় না ছেলেকে, সুদীপকেও যখন তখন ব্যঙ্গবিদ্রুপে জর্জরিত করে না। মাঝে মাঝে সুদীপের সন্দেহ হয়, এই রুনাই কি সেই রুনা যে একদিন রাগ করে বারান্দা থেকে ঝাঁপ দিতে গিয়েছিল! রান্নার বই দেখে আজকাল নিত্যনতুন রান্না করে রুনা, মিনতিকে না পাঠিয়ে নিজেই বাজার ঘুরে সেরা ফলটা, সেরা মাছটা নিয়ে আসে, কোনও পরিশ্রমেই তার মেজাজ তিরিক্ষি হয় না। বাড়িতে এখন আর কোনও চাপা টেনশান নেই, অশান্তি নেই, চেঁচামিচি নেই। এ সবই তো সুখ।

এত সুখেও তবু যেন একটা কাটা বিঁধে গেছে সুদীপের। নতুন কাটা। তার নিরালা গৃহকোণটুকু হারিয়ে গেছে। ফি-সন্ধেয় রুনার দিদি জামাইবাবুর পদধূলি পড়ছে এ বাড়িতে, নটা-দশটা অবধি আসর চলছে জোর। আসর বলতে রুনার জামাইবাবুর অসহ্য হামবড়া বকবকানি, আর বোকা বোকা জোকস্। সুদীপ সেখানে শুধুই অসহায় শ্রোতা। নিয়মিত মদ্যপানে অভ্যস্ত নয় সুদীপ, কিন্তু অনিরুদ্ধর আহ্বানে রোজই তাকে বোতল গ্লাস সাজিয়ে বসতে হয়। হাজার হোক ভায়রাভাই বলে কথা, তাকে প্রত্যাখ্যান করলে রুনার যে অসম্মান হবে! রুনাও আজকাল টুকুস-টুকুস চুমুক দিতে শিখে গেছে। দিদির দেখাদেখি। সঙ্গদোষ, না সঙ্গগুণ? কথায় কথায় মীনা উচ্চকিত স্বরে হাসছে, সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে রুনাও। সুদীপের বিশ্রামের তো দফা রফাই, অ্যাটমের পড়াশুনোও ডকে উঠতে চলেছে। আসরের কোণে এসে অ্যাটম বসে থাকে চুপটি করে। ও বাড়িতে সন্ধেবেলা বাপ্পা জোরে একদিন টেপ বাজালে রুনা রেগে কাই হয়ে যেত, ছেলের পড়ার ক্ষতি হচ্ছে বলে গজগজ করত! কি আর করা! একা থাকার, আলাদা থাকার সুখ কুড়োতে এই উপদ্রবটুকু সুদীপকে মেনে নিতেই হয়।

সুখ কুড়োয় সুদীপ, না স্বস্তি কুড়োয়!

সুদীপ জানে না। সুদীপ বুঝে উঠতে পারে না। ঢাকুরিয়ার নতুন ফ্ল্যাটে চলে গেলে গৃহের চেহারাটা হয়তো বদলাবে, এই আশায় আশায় থাকে সে।

লক্ষ্মীপুজোর আগের দিন বাড়ি ফিরে সুদীপ দেখল অনিরুদ্ধ পাজামা-পাঞ্জাবি শোভিত হয়ে বসে আছে ড্রয়িংরুমে, রুনা আর মীনা রান্নাঘরে চিকেন পকোড়া ভাজছে, রান্নাঘর আর ড্রয়িংরুমের মাঝে শাটল কর্কের মতো ছুটছে অ্যাটম।

হাতমুখ ধোওয়ার অবকাশ পেল না সুদীপ, তার আগেই রুনা উড়ে এল, – এই শোনো শোনো, জামাইবাবু কী দারুণ একটা প্ল্যান করেছে!

কীসের প্ল্যান?

–বেড়ানোর। মিরিক দার্জিলিং গ্যাংটক ছাংগু… চলো না গো।

সুদীপ সিঁটিয়ে গেল। বছর চারেক আগে অনিরুদ্ধদের সঙ্গে একবার দিঘা গিয়েছিল, অভিজ্ঞতা খুব সুখের হয়নি। অনিরুদ্ধর বড় বেশি নবাবি চাল। দামি হোটেল চাই, ঘরে শীতল আমেজ চাই, ঘুরতে ফিরতে ইয়া ইয়া বাগদা চিংড়ি ভাজা, ড্রিঙ্কসের সঙ্গে মুঠো মুঠো কাজুবাদাম…। চাকরি তো করে গভর্নমেন্টের সেরিকালচার, না পিসিকালচার কোন ডিপার্টমেন্টে, সেখানেও এত দু-হাত্তা লোটা যায়! তাও যদি ডিরেক্টর-টিরেক্টর গোছের কিছু হত। ভায়রাভায়ের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে তিন দিনের ট্যুরেই সুদীপের লেজেগোবরে দশা।

আবার তাদের সঙ্গে!

চোয়ালে একটুকরো হাসি ঝুলিয়ে অনিরুদ্ধর পাশে এসে বসল সুদীপ, — কি অনিদা, শালীকে আবার কী তাতালেন?

–আমি তাতাচ্ছি! হাহ। তোমার গিন্নিই আমার হাটু আঁকড়ে ধরেছে। পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই অনিরুদ্ধ চোখ টিপে হাসল, বলছে আমাকে ছেড়ে ও নাকি থাকতে পারবে না।

ধ্যাৎ, কী অসভ্য রে বাবা। আমি কখন তাই বললাম?

মনে মনে বলেছিলে। শালীর মনের কথা পড়তে না পারলে আমি জামাইবাবু হয়েছি কি জন্যে! তোমরা হলে রেশমের গুটি, তোমাদের সেদ্ধ করে সুতো ছাড়ানোই আমাদের কাজ। হা হা হা হা।

ওফ, ওই মুখে যদি একটা টেনিস বল পুরে দেওয়া যেত! সুদীপ কান চুলকোল, কিন্তু আমরা যাব কী করে অনিদা? অ্যাটমের স্কুল খুলে যাবে…

–ওর স্কুল তো ভাইফোঁটার পর খুলবে। রুনা কথা কেড়ে নিল, আমার তো দশ-বারো দিনের ট্যুর, তাই না জামাইবাবু?

গরম পকোড়ার প্লেট হাতে মীনা ঘরে এসেছে। মাথা দুলিয়ে বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ, সামনের সোমবার স্টার্ট করব, প্রতিপদ কি ভাইফোঁটার দিন ব্যাক। একটু হেকটিক হয়ে যাবে, তা হোক।

সুদীপ রুনার দিকে ফিরল, — আর স্কুল খুললেই যে অ্যাটমের পরীক্ষা তার কী হবে?

 রুনা গাল ফোলাল, কেন? ওখানে পড়বে। আমি বইখাতা নিয়ে যাব।

–বেড়াতে গিয়ে পড়া হয়? তুমি ওকে বসাতে পারবে?

–অ্যাই সুদীপ, তুমি অত পড়া পড়া কোরো না তো। অনিরুদ্ধ কেশর ফোলাল, সন্তান মানুষ আমরাও করি, আর তারা ইন্সিডেন্টালি তোমার ছেলের থেকে হায়ার ক্লাসে পড়ে। এবং ফর ইওর ইনফরমেশান, তাদেরও স্কুল খুললে পরীক্ষা। এবং তারাও যাচ্ছে।

সুদীপ মনে মনে বলল, কিন্তু তারা তো এই সময়টায় পড়াশুনো করছে। তোমরা যখন কর্তা-গিন্নিতে মোচ্ছব করতে বেরোও, তখন যে তোমাদের বাড়িতে টিউটর আসে সে খবর কি আমি রাখি না!

হতাশভাবে বলল, – রুনা যদি মনে করে ঠিক আছে, তো ঠিক আছে। …অফিসটা যে কীভাবে ম্যানেজ করি! বলা-কওয়া নেই…

সব ম্যানেজ করতে পারবে। তুমি লাফড়া কোরো না। দুটো চিকেন পকোড়ায় এক সঙ্গে টোম্যাটো সস্ মাখাল অনিরুদ্ধ। সসটা আগে চুষে চুষে খেল। পকোড়ার কোণ কামড়াচ্ছে। দু আঙুলের মুদ্রায় প্রশংসা উপহার দিল রুনাকে। খাওয়া থামিয়ে হঠাৎ চোখের কোণ দিয়ে দেখল সুদীপকে, শোনো ম্যান, ট্রাভেল এজেন্টকে বলে দিয়েছি, পরশু অফিস খুললেই টিকিট আমার টেবিলে পৌঁছে যাবে। সোমবার যদি নাও পাই, মঙ্গলবার শিওর বুকিং পেয়ে যাচ্ছি। হোটলের রেসপন্সিবিলিটি আমার। তুমি শুধু নিতবরটি সেজে তৈরি থেকো।

–হোটেল কেন, দার্জিলিঙ-এ আপনাদের হলিডে হোম আছে না?

মনটা ছোট কোরো না সুদীপ। ওতে বেড়ানোর আনন্দ মাটি হয়ে যায়। হোটেল সম্রাট আমাকে মিনিমাম টুয়েন্টি পারসেন্ট ডিসকাউন্ট দেবে। তার মানে আটশোর রুম সিক্স ফিফটিতে হয়ে যাচ্ছে। ইউ ক্যান নট এক্সপেক্ট এনিথিং চিপার। নিউ জলপাইগুড়ি থেকে একটা গাড়ি নিয়ে নেব, এই ধরো জিপ বা ল্যান্ডরোভার, দার্জিলিঙ-এ তিন দিন, গ্যাংটকে চার দিন। মিরিক ছাংগু ওর মধ্যেই…

বাই দা বাই, তুমি ছাংগু কি জানো তো?.. ইটস্ আ লেক। অ্যারাউন্ড পনেরো হাজার ফিট অলটিচিউড। … নাথুলা পাস, যেখানে ইন্ডিয়া চায়না ওয়ার হয়েছিল… ওফ, হোয়াট এ

সাইট! সেবার চোগিয়ালের ইনভিটেশানে যখন একটা গাভমেন্ট টিম গেল, আমিও তো…।

অনিরুদ্ধর কথা কানে ঢুকছিল না সুদীপের। দ্রুত মস্তিষ্কের কমপিউটার চালিয়ে হিসেব কষছিল খরচের। দশ দিনে মিনিমাম ষোলো-সতেরো হাজার ধসে যাবে। সঙ্গে এই অভব্য সংসর্গ। হে ঈশ্বর, কেন এই পাড়াতে আসতে রাজি হয়েছিল সুদীপ! দাদাদেরই মতন ওদিকে কোথাও…! এই সময়ে একটা ম্যালেরিয়া ফাইলেরিয়া গোছের কিছু হলেও বাঁচা যেত। ডেংগু এনকেফেলাইটিস হওয়াও বোধহয় এই ভ্রমণের থেকে খারাপ কিছু নয়।

টিং টিং কলিংবেল বাজছে।

 সুদীপ ঘড়ি দেখল। আটটা দশ। পাড়ার ইস্ত্রিঅলা ছেলেটা এল নাকি!

মীনা উঠতে যাচ্ছিল, তার আগে রুনাই উঠে দরজা খুলেছে, ওমা, শংকরদা আপনি!

ঘরে ঢুকে শংকর শ্যেন দৃষ্টিতে দেখছে চারদিক। মীনা অনিরুদ্ধকে আড়চোখে দেখে নিয়ে বলল, – আপনারা তো আমায় আসতে বলবেন না, এই গরিবের বাড়িতে পায়ের ধুলোও দেবেন না, তাই অগত্যা…।

কোলাকুলির পালা সাঙ্গ হল। আড্ডার সুর কেটে গেছে। টুকটাক কথা বলছে অনিরুদ্ধ, কিন্তু কেমন যেন অসহজ ভাব। রুনা ছুট্টে কটা পকোড়া ভেজে এনে দিল শংকরকে, ফ্রিজ থেকে সন্দেশ। শংকর খাচ্ছে তারিয়ে তারিয়ে, ধীরেসুস্থে। দেখেই বোঝা যায় এখনই নড়ার ইচ্ছে নেই। . একটু পরে মীনা অনিরুদ্ধ উঠে পড়ল। দরজার গিয়ে হাত তুলল অনিরুদ্ধ, তা হলে ওই কথাই রইল সুদীপ। তুমি অফিস থেকে ছুটিটা অ্যারেঞ্জ করে ফ্যালো। আমি কাল আসছি না। জানোই তো লক্ষ্মীপুজোর দিন আমাদের শ্যামবাজারের বাড়িতে একটা ফ্যামিলি গ্যাদারিং হয়… তা হলে পরশু, অ্যাঁ?

সুদীপ কোনওকালেই শংকরকে দেখতে পারে না, কিন্তু এই মুহূর্তে শংকরকে অনেক সহনীয় ঠেকছিল তার। আরাম করে সিগারেট ধরিয়ে বলল, কদিন ধরে জয়ির কথা খুব মনে পড়ছিল। এলেই যখন, ওদের নিয়ে এলে না কেন? ঝাটার সঙ্গেও কতকাল দেখা হয় না।

–বোন ভাগ্নের কথা তোমার মনে পড়ে দীপু?

–সে কি কথা! নিজের বোন, মনে পড়বে না! কাজেকম্মে থাকি, যাওয়া হয় না…

 কথাটায় তেমন জোর ফুটল না। শংকরও হাসছে, হুম, তোমরা তো খুব ব্যস্ত মানুষ।…আমি এসে পড়ে তোমাদের কোনও অসুবিধে করলাম না তো?

না, তা কেন! রুনা প্রায় হাঁ হাঁ করে উঠল, বেশ করেছেন এসেছেন। রাত্তিরে এখানে খেয়ে যান।

–আজ আর পেটে জায়গা নেই বউদি, ওবাড়িতে বড়বউদি প্রচুর খাইয়েছে। লুচি আলুর দম মিষ্টি, তারপর আপনাদের বাড়ির এই চিকেন…। ডিউ রইল বউদি, শিগগিরই এসে খেয়ে যাব।

–তা হলে একটু কফি করে আনি!

–আপনি করবেন? ওই মেয়েটা নেই, মিনতি?

–ওমা, জানেন না? সে তো সেই কবেই দেশে যাচ্ছি বলে পালিয়েছে, আর ফেরেনি। কে জানে বরের সঙ্গে বোধহয় আবার ভাব হয়ে গেছে। ওদের ব্যাপার তো, ঝগড়া হতেও যতক্ষণ, মিলমিশ হতেও ততক্ষণ।

–তা যা বলেছেন। ওদের মধ্যে কোনও রাখঢাক গুড়গুড় নেই। যা হয় সরাসরি। যত সব পরকীয়া, লুকোচুরি আমাদের এই মিডল ক্লাসের মধ্যে।

সুদীপ ভুরু কুঁচকে তাকাল। রুনার প্রিয় প্রসঙ্গে ঢুকে পড়ছে শংকর। তড়িঘড়ি বলে উঠল, যাও না, কফিটা করে আনো না। আমার জন্যও কোরো। একটু কড়া করে।

রুনা যাওয়ার পর সুদীপের প্যাকেট থেকে সিগারেট ধরাল শংকর। চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে ঘরখানা। বলল, বাহ, বউদির রুচির তারিফ করতে হয়। বেড়ে সাজিয়েছে।

সুদীপ আলগোছে দেখল শংকরকে, হ্যাঁ, এসব দিকে ওর খুব ন্যাক। অ্যাটমটা এতদিন ছোট ছিল, ওর অত্যাচারে তেমন সাজাতে গোছাতে পারত না। ছেলে এখন বড় হচ্ছে..

–শুধু ছেলের দোষ দিচ্ছ কেন ভায়া? ওবাড়িতে সাজানোর মতো তো পরিবেশও ছিল না।

 আবার কর্ড লাইনে চলে যাচ্ছে শংকর। প্রাণপণে স্টিয়ারিং ঘোরাতে চাইল সুদীপ, তার আগে শংকরই চলে গেছে অন্য কথায়, তোমার ভায়রা ভদ্রলোক কিসব ছুটি-ফুটি নেওয়ার কথা বলছিল, তোমরা কোথাও যাচ্ছ নাকি?

অ্যাটম সোফায় ঘাপটি মেরে বসে কথা গিলছিল। পুট করে বলে উঠল, আমরা তো দার্জিলিং যাচ্ছি পিসেমশাই। মেসো নিয়ে যাচ্ছে।

কী শিক্ষা যে হচ্ছে অ্যাটমের! টাকা খসাবে সুদীপ রায়, গার্জেন সাজবে মেসো!

সুদীপ ছেলেকে হালকা ধমক দিল, — অনেক আড্ডা হয়েছে অ্যাটম, এবার ও-ঘরে গিয়ে হোম টাসক শুরু করো।

যাচ্ছি। অ্যাটম গা মোচড়াচ্ছে।

যাচ্ছি না। যাও।

দুঃখী মুখে উঠে গেল অ্যাটম। আবার সামান্য ছুতোয় ফিরে আসবে, সুদীপ জানে।

শংকর পিটির পিটির হাসছে, কপাল জোরে শ্বশুরবাড়ি পেয়েছিলে ভায়া। আমাদের তো কেউ কোনওদিন স্যুটকেস বইবার জন্যও নিয়ে গেল না।

সুদীপের কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না। লম্বা ধোঁয়া ছেড়ে বলল, – যে যেমন ভাগ্য নিয়ে আসে।

–তা বটে, তা বটে। তোমাদের তিন ভায়ের মধ্যে তোমার ভাগ্যই সব থেকে সরেস। চাঁদুরও অবশ্য এখন চড়চড় করে কপাল খুলছে। শুধু তোমার দাদাই… বলতে বলতে শংকর কি যেন একটু চিন্তা করল। তারপর বলল, একটা কথা জিজ্ঞেস করব ভায়া? ওই দুঃখী মানুষটাকে শেষে তোমরা দু ভাই মিলে চিরতরে কাশী পাঠিয়ে দিচ্ছ?

দাদা…! চিরতরে! কাশী…! সুদীপ ফ্যালফ্যাল তাকাল। বিড়বিড় করে বলল, বুঝলাম না। দাদা আবার কাশী যাচ্ছে?

–সবই তো জানো ভায়া। আমাকে বাইরের লোক ভেবে কেন লুকোছাপা করছ?

–আরে! সত্যিই আমি কিছু জানি না। কই, পরশু ওবাড়ি গেলাম, বউদিও তো কিছু বলল না!

–তিনি মানী মানুষ, হয়তো অভিমানে কিছু বলেননি।

সুদীপের স্থৈর্য খানখান হয়ে গেল, সত্যিই কিছু জানি না। কি হয়েছে খুলে বলো তো।

–আমার মুখ দিয়েই বলাবে? দাদা সেদিন আমাদের বাড়িতে বলে এল কোন বন্ধুর আশ্রমে চলে যাচ্ছে, তুমি আর চাঁদু টাকা দিয়েছ…

সুদীপের কাছে একটু একটু করে যেন পরিষ্কার হচ্ছিল ব্যাপারটা। স্বর গম্ভীর করে বলল, – দাদা তোমাদের ওখানে কবে গেছিল?

–প্রায়ই তো যায়। চুর হয়ে পড়ে থাকে, কত মনের দুঃখের কথা বলে …নবমীর দিন তো ঠেলে ঠেলেও বাড়ি পাঠাতে পারলাম না। তোমার বোনও বলল, আহা অভাগা মানুষটা আছে থাক…। জয়ি তোমাদের ওপর খুব রেগে আছে ভায়া, এত করে বললাম তবু আজ বিজয়া করতে এল না।

সুদীপ গুম মেরে গেল।

শংকর চোখ ছোট করে দেখল সুদীপকে। গলা নামিয়ে বলল, তোমাদের বউদি নয় অন্য ধাতুর মানুষ, ভাঙবেন তবু চমকাবেন না। কিংবা কে জানে তিনি হয়তো দাদাকে ঝেড়ে ফেলতে পারলেই বাঁচেন। কিন্তু তোমরা তো ভাই, মামাতো, পিসতুতো, জাঠতুতো নয়, এক মায়ের পেটের ভাই, তোমরা কী করে দাদাকে না আটকে উসকে দিলে? আমি তো এক নম্বরের পাষণ্ড, আমারও ভাবলে কান্না পায়।

রুনা কফি এনেছে। শংকর নীরব হয়ে গেল। সুদীপও নিথর। ভাবছে। অঙ্ক মেলাচ্ছে।

শংকর চলে যেতেই রুনাকে ধরল সুদীপ, দাদা সেদিন পাঁচশো টাকা-চাইল, কেন দরকার কিছু বলেছিল?

না তো। শুধু বলছিল টাকাটা খুব দরকার, দীপু যদি দেয়…

–তুমি দিলে কেন? আমার জন্য কেন অপেক্ষা করলে না?

–আবার সে কথা উঠছে কেন? রুনা সামান্য ঝেঁঝে উঠল, কতবার করে বলব, ভুল হয়ে গেছে, ভুল হয়ে গেছে!

সুদীপ অস্থিরভাবে মাথা ঝাঁকাল। গটগট করে বেরিয়ে এল রাস্তায়। কী করে রুনাকে বোঝাবে এক-একটা ভুল আজীবন কপালে কালো দাগ এঁকে দেয়। ক্ষত হয়ে দংশায় সে দাগ, আগুন হয়ে পোড়ায়, পুঁজ রক্ত হয়ে দুর্গন্ধ ছড়ায় জীবনভর। আজ যদি সত্যিই দাদা গৃহত্যাগ করে, সুদীপ কি তার নিমিত্ত হয়ে থাকবে না! যেমনভাবে বাবার মৃত্যুর নিমিত্ত হয়ে গেল বউদি! পরশু বউদি বড় আড়ষ্ট ছিল, রুক্ষ ছিল, সে কি এই জন্যই! দাদা যে আবার চূড়ান্ত মদ খাওয়া শুরু করেছে, মাঝে মাঝেই বাড়ি ফেরে না, এসব কথা বউদি বা তিতির কেউই ভুলেও বলে না সুদীপকে। চাঁদুর কাছে একদিন শুনেছিল, হালকাভাবে গল্প করছিল চাঁদু। পরশুও তিতিরের সঙ্গে দেখা হল, দাদার ওই আশ্রমবাসের অভিলাষের কথাটাও সুদীপকে বলল না তিতির, শুধু একটা প্রণাম ঠুকে সরে গেল। অথচ ওই তিতিরই একদিন সুদীপের কাছে…।

আজ কেন এই দূরত্ব? কে এতখানি দূরত্ব গড়ে দিল? সুদীপ? রুনা? আদিত্য? ইন্দ্রাণী? তিতির? জয়মোহন? কে? সম্পর্কের মাঝের এই পরিখা কি কোনও ভাবেই আর পার হওয়া যায় না? দাদার দুঃখের উৎস কি খুঁজতে পারে না সুদীপ? বুঝিয়ে সুঝিয়ে নিবৃত্ত করতে পারে না দাদার খ্যাপামো? বউদির মনে যদি কোনও চোরকাঁটা বিঁধে থাকে, তা কি উপড়ে ফেলতে পারে না সুদীপ? তিতিরের মাথায় আগের মতো হাত বোলাতে পারে না?

কিছু পারে না সুদীপ, কিচ্ছু পারে না। দূরে চলে যেতে শুরু করলে কাছে ফেরা বড় কঠিন, সুদীপ অনুভব করতে পারছিল।

পাড়ার পুজোর প্যান্ডেলের কাঠামোটা এখনও রয়ে গেছে। হাড়পাঁজরা বার করা বাঁশের খাঁচায় ঝুলছে ছেঁড়া দড়িদড়া। উৎসবের মলিন স্মৃতির মতো। উজ্জ্বল আলো জ্বলছে পথে, সে আলোও যেন প্রভাহীন। যেন আলোগুলোর গায়ে রোঁয়া গজিয়েছে অসংখ্য, তারাই ঢেকে দিচ্ছে দীপ্তি।

উদ্দেশ্যহীন হাঁটছিল সুদীপ। দশটা বাজে, রাস্তাঘাটে এখনও বেশ লোকজন চলাফেরা করছে। তবু শহরটাকে বড় নির্জন ঠেকছিল সুদীপের।

নির্জন, না নিঃসঙ্গ!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *