৬৬-৭০. একটা ঘনিষ্ঠ দৃশ্য

মণিকার সঙ্গে টানা দেড় মিনিটের একটা ঘনিষ্ঠ দৃশ্য একবারেই ও.কে. করে ফেলল কন্দর্প। ঘনিষ্ঠ দৃশ্য মানে ঘনিষ্ঠ দৃশ্যই। ছুঁয়ো না শ্যাম, ওহে নাগর, এই ছুঁয়ে দিলাম ওগো নাগরী গোছের সিন নয়, এ একেবারে যাকে বলে রগরগে বেড সিন। তপ্ত নিশ্বাস, আসঙ্গ লিপ্সা সব একদম মাপে মাপে পড়েছে। কাট বলার পরই জীবন ভটচাজের মতো খুঁতখুঁতে পরিচালকও চেঁচিয়ে উঠল, এক্সেলেন্ট! সুপার্ব!

প্রেমের দৃশ্যে অভিনয় কন্দর্পর কাছে এখন জলভাত। পর পর দুটো ছবিতে ঋতুশ্রী তার অনেকটাই আড় ভেঙে দিয়েছে, অশোকদার চিমটি কাটা মন্তব্য বাড়িয়ে দিয়েছে তার জেদ। কিন্তু মোদ্দা কারণটা হল সাফল্য। আষাঢ়ের গোড়ায় রিলিজ করেছে জয়পরাজয়, শ্রাবণ শেষ হতে চলল এখনও গ্রামেগঞ্জে রমরমিয়ে চলছে ছবিখানা। স্মরজিৎ লাহিড়ির অনুভবও সেনসারের ছাড়পত্র পেয়ে গেছে, সম্ভবত সামনের বছর জানুয়ারির ফিল্মেৎসবে মাদ্রাজে দেখানো হবে। এই সব খবরই কন্দর্পর মাথায় টনিকের মতো কাজ করে। সফলতা মানুষকে অনেক সপ্রতিভ করে দেয়।

মণিকার শট চলছে। একার। কন্দর্প সেটের বাইরে এল। আকাশে পাঁশুটে ডেলা ডেলা মেঘ। ফাঁকে ফাঁকে যে আকাশটুকু দেখা যায় তার রঙ চড়া নীল। সেই আকাশ ছিঁড়ে ঝলসাচ্ছে সূর্য, জ্বলন্ত চাটু হয়ে।

–তোমার এখন কাজ নেই কন্দর্পভাই?

কন্দর্প নতুন কেনা বিদেশি সানগ্লাসটা চোখে চড়িয়ে ঘুরে তাকাল। রূপেন। ইদানীং ক্যাংলা রূপেন কন্দর্পর সঙ্গে বেশ সমীহ করে কথা বলে।

ঠোঁটের কোণে একটা ঢেউয়ের মতো হাসি ফোটাল কন্দর্প। নদীর ঢেউ নয়, চোরা হাওয়ায় চলকে ওঠা পুকুরের ঢেউ। বলল, চলছে। একটু রিল্যাক্স করছি।

–তোমার তো এখন দারুণ কাজের চাপ।

কই আর। ওই একটু-আধটু। ভোলাদার ছবিটা এখনও শুরু হল না… জলিবাবু অবশ্য সামনের মাস থেকে টানা ডেট চাইছেন…

–জলিবাবুর ছবিতেও তুমি হিরো?

কাইন্ড অব। আমিই পিভট। কন্দর্প একটু চালবাজি করে নিল। উত্তমকুমারের স্টাইলে সিগারেটের প্যাকেট আলগা বাড়িয়ে দিল, চলবে?

আগে হলে দুটো নিত, এখন দেঁতো হেসে একটাই সিগারেট তুলল রূপেন। লম্বা ঠ্যাং-এ দু পা এগিয়ে থেমে গেল, অশোকদার সঙ্গে তোমার এর মধ্যে দেখা হয়েছিল?

-কেন বলুন তো?

–পরশু না তার আগের দিন কবে যেন অশোকদা তোমায় খুঁজছিল। এবার এক পা এগিয়ে থামল রূপেন। চোখ চালিয়ে চতুর্দিক দেখে নিয়ে নিচু গলায় বলল, তোমার কাছে কটা টাকা হবে ভাই?

কত?

–এই ধরো শতখানেক মতো। মেয়েটার ধুম জ্বর, টাইফয়েড কিনা বোঝা যাচ্ছে না, ডাক্তার একগাদা টেস্ট-মেস্ট করতে বলেছে…

গত মাসে আপনার মেয়ের ম্যালেরিয়া হয়েছিল না?

–সেটা বড় মেয়ের। এবার ছোটটা…। গোটা পঞ্চাশ হলেও চলবে।

 চড়াবে তো পাঁইট, তার কত বাহানা। কেন যে মেয়ের অসুখ বানায়! কন্দর্প কথা না বাড়িয়ে একটা কুড়ি টাকার নোট বার করে দিল। লোকটা তার জন্য জয়পরাজয়ে একটা রোল তৈরি করে দিয়েছিল, সেই সূত্রেই এই লাইনের চোরাবালিতে একটু মাটি খুঁজে পেয়েছে কন্দর্প, বিনিময়ে মাঝে মাঝে বিশ-পঞ্চাশ টাকা মাশুল কি আর এমন বেশি!

বকের মতো পা ফেলে ফেলে স্টুডিও গেটের দিকে মিলিয়ে যাচ্ছে রূপেন, তাকে ভুলে মুস্তাফির কথা ভাবছিল কন্দর্প। অশোকদা খুঁজছে তাকে? সৃষ্টিছাড়া বর্ষার দাপটে ঠিক সময়ে বাড়ি ভাঙার কাজটা শুরু করতে পারেনি অশোকদা, সবে এই দিন পনেরো হল হাত লাগিয়েছে। সেখানেই কি কোনও সমস্যা হল? তেমন কিছু হওয়ার তো কথা নয়। পার্টি ফান্ড, ওপাড়ার বিলা, রোবে সকলকেই তো প্রণামী দেওয়া সারা। নতুন করে যদি কিছু ঝঞ্ঝাট বাধেও, সেখানে কন্দর্প কি করবে? মেজদার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু পুরনো কড়িবরগা, দরজা-জানলা বিকিকিনি করে, কথায় কথায় একদিন তার কথা বলেছিল কন্দর্প, তাই নিয়েই কি কিছু আলোচনা করতে চায় অশোকদা? হতে পারে। আবার অন্য কিছুও হতে পারে। হয়তো দিল্লির টিভি সিরিয়ালটা এতদিনে সবুজ আলো দেখতে পেয়েছে! দিল্লিতে অশোকদার তো লোক ফিট করাই আছে, হয়তো সে টেলিফোনে..! উঁহু, রূপেন তা হলে একটু কেশে যেত।

কোনও ভাবনারই গভীরে ঢুকল না কন্দর্প। ঢোকা মানে উত্তেজনা, ঢোকা মানেই টেনশান, ঢোকা মানেই মনঃসংযোগ নষ্ট। পরশু পর্যন্ত রোজ দেড় শিফট করে কাজ। সারাক্ষণ এখন চরিত্রটাতেই ডুবে থাকার সময়, যম এত্তেলা পাঠালেও মন চঞ্চল করার উপায় নেই। মধুমিতার সঙ্গেই যে কতকাল দেখা হয় না! পাঁআআচ দিন। ফাইভ লঙ লঙ ডেজ। যাক গে, কি আর করা। অশোকদার সঙ্গে বরং রাতের দিকে টেলিফোনে যোগাযোগ করা যাবে।

সেদিনও হল না, পরের দু দিনও না। সেই সাতসকালে বেরিয়ে গভীর রাতে ফেরা, বাড়িতেও এখন টেলিফোন নেই, রাতদুপুরে কার আর বুথে ছোটা পোষায়।

চতুর্থ দিন ভোরে ঘুম থেকে উঠেই বেরিয়ে পড়ল কন্দর্প। সোজা লেক। অশোক মুস্তাফি এখনও আসেনি। একা একাই কৃত্রিম হ্রদখানাকে বারকয়েক চক্কর দিল কন্দর্প। কদিন খুব ধকল গেল, খুব নিঙড়েছে জীবন ভটচাজ, ভাল করে হাত-পায়ের খিল ছাড়ানো দরকার। বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে তার লেকে আসাটা কমে গেছে, ভাড়াবাড়িতে উঠে যাওয়ার পর তো আর এমুখোই হয়নি। একে লেক একটু দূর হয়ে গেছে, তায় বৃষ্টির কাল, খুপরি ঘরেই সে আজকাল ফ্রি হ্যান্ড সারে। বড়জোর ঝিল রোড ধরে একটু হেঁটে আসে ভোরবেলায়।

আজ ভোরে লেকের হাওয়াটা বড় মনোরম লাগছিল কন্দর্পর। খানিকক্ষণ বেঞ্চে হাত-পা ছড়িয়ে বসে রইল। সূর্য পুবের হাইরাইজগুলোর দোতলা পার হয়ে গেছে, তবু অশোক মুস্তাফির দেখা নেই। অশোকদা কি লেকে আসে না আজকাল? বাড়ি যাবে অশোকদার? সারা সপ্তাহের বাজার ফ্রিজে রাখা আছে, আজ একটু হাত খালি ছিল, টাটকা মাছ মাংস নিয়ে গেলে হত…।

সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে মুস্তাফির বাড়ির দিকেই গেল কন্দর্প। অশোকদার এই পারিবারিক ফ্ল্যাটে বড় একটা আসা হয় না। বড়জোর বার পাঁচ-ছয় এসেছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অশোকদার গুণধর ছেলেটিকে ঘরে পৌঁছে দিতে।

আজ সেই দরজা খুলল। গাল ভর্তি জংলা দাড়ি, খালি গা, পরনে শুধু এক জাঙ্গিয়ার মতো ছোট্ট প্যান্ট।

ছেলেটিকে দেখলে কন্দর্প একটু ভেতর থেকে কেঁপে যায়। তলপেট চিনচিন করে। এ ছেলের দর্শন পাওয়া কদাচ শুভ নয়। তবু মুখে একটা ইলাস্টিকের মতো হাসি টানল, কি খবর বাবুরাম? ভাল আছ তো?

আমি তো ভালই থাকি।

 কন্দৰ্প মনে মনে বলল, – তা বটে। শুধু তোমার বাবা-মারই পিলেটা মাঝে মাঝে চমকে যায়। গত মাসেও ছোকরা বাড়িতে কিছু না বলে হাপিশ হয়ে গিয়েছিল। চিন্তায় চিন্তায় অশোকদার শয্যা নেওয়ার দশা। সাতদিন পর খোকাবাবু প্রত্যাবর্তন করলেন। সমুদ্র দর্শনে গিয়েছিলেন তিনি। দিঘায়। চেলাচামুণ্ডা সমভিব্যাহারে।

প্রকাণ্ড ড্রয়িংরুমে হাল ফ্যাশানের বড় বড় সোফাসেট। গোল কাচের সেন্টার টেবিল। একধারে প্রকাণ্ড অ্যাকোয়ারিয়াম, সবুজেটে জলে রঙিন মাছেরা ঘুরছে। পিতলের হরিণ বিশ্রাম নিচ্ছে কাশ্মীরি কার্পেটে। দেওয়ালৈ এক ফোলা ফোলা রমণীর বিশালকায় পেন্টিং। মাথার ওপর সাবেকি ঝাড়লণ্ঠন, অজস্র বালব লাগানো।

বাবুরাম এক ফালি খবরের কাগজ নিয়ে সোফায় আধশোওয়া হয়েছে। কন্দর্প অন্য ফালিটা হাতে নিয়ে বসল, অশোকদা কই?

-পিতাশ্রী পুজোয় বসেছে। বাবুরাম চোখের কোণ দিয়ে কন্দর্পকে দেখল, সকালে তুমি হঠাৎ পিতাশ্রীর দরজায়?

–এলাম। অনেকদিন দেখা হয় না। কন্দর্প সোফায় হেলান দিল, — তা বাবুরামের আর কোথাও বেড়াতে যাওয়া-টাওয়া হচ্ছে না?

–কোথায় যাই বলো তো?

এবার পাহাড়ে যেতে পারো।

–পাহাড়মে কেয়া রাখো হ্যায়! ইয়া ইয়া ঢিপি, আর কনকনে শীত। কাগজ কার্পেটে ফেলে দিয়ে আড়মোড়া ভাঙল বাবুরাম, অবশ্য সিকিম ভুটান মেরে এলে হয়। সিকিমে বসে সিকিমিজ রাম, ভুটানেরও কি একটা যেন আছে না? রকসি তো ভুটানেরই, তাই না?

কন্দর্প প্রমাদ গুনল। বাবুরামের সঙ্গে কথা বলাটাই বিপজ্জনক। এ ছোকরা যদি সত্যি সত্যি পাহাড়ে ছোট, আর অশোকদা যদি জানতে পারে পাগলকে সেই সাঁকো নাড়াতে বলেছে, তবে তাকেই হয়তো ঘাড় ধরে ছোকরাকে ফিরিয়ে আনতে পাঠিয়ে দেবে।

কন্দর্প ঝটিতি প্রসঙ্গ ঘোরাল, ওড়াউড়ি তো অনেক হল, এবার একটু বাবার কাজকর্ম দ্যাখো।

কী কাজ করব?

বাবার অফিসে বসো। অশোকদা একা আর কত দিক সামলাবে?

ধুস, ওগুলো আবার কাজ নাকি? শুধু পিতাশ্রীর প্যান্ট পরে চেয়ারে বসে থাকা। তাও যদি বাবা ফিলমের দিকটা আমার ওপর ছাড়ত। কথা বলতে বলতে জিভ চাটছে ছোকরা, তোমরা মাইরি মস্তিতে আছ। ডেলি নিউ নিউ হিরোইন…। পিতাশ্রী একাই মধু চাটছে, আমাকে ও লাইনে ভিড়তে দিচ্ছে না।

কী ভাষা! পিতা সম্পর্কে কী মহৎ ধারণা! এ ছেলে ফিলম লাইনে গেলে বাপকেও টেক্কা মারবে। কাপ্তানি করে ছ মাসে সব খুঁকে দেবে। শেষে একটিই সম্পদ থাকবে ছোকরার। এইডস।

অশোকদার স্ত্রী চা নিয়ে ঘরে এসেছে। পৃথুলা, গ্রাম্য ধরনের মহিলা, কন্দর্পর সামনে এখনও মাথায় ঘোমটা টেনে রাখে। ব্যক্তিত্ব বলে কিছুই নেই, পতি ধর্ম, পতিই দেবতা, এই বিশ্বাসে স্বামীর পদতলে লুটিয়ে আছে। স্বামীকে ভয় পায়। ছেলেকে ভয় পায়। ছেলের বিগড়োনোর মূলে এর লাইও কম নেই। গা ভরা গয়না পরে থাকে সব সময়ে, সিঁথিতে জ্যাবজেবে সিঁদুর, নাকে হিরের নাকছাবি।

চায়ের কাপ নামিয়ে ভদ্রমহিলা মাথার আঁচলটাকে টানল আর একটু, আপনি ভাই ওকে একটু বোঝান তো। বাপ ছেলেতে কদিন ধরে শুধু যুদ্ধ চলছে।

বাবুরাম পলকে খেপে গেল, ব্যাজব্যাজ কোরো না তো। কোনও কাজেকম্মে নেই… যাও তো এখান থেকে। নিজের চরকায় তেল দাও।

মহিলা তবু দাঁড়িয়ে আছে। ফিসফিস করে বলল, আপনি ওর বাবাকেও একটু বলুন না ভাই। ছেলে নিজে একটা ব্যবসা খুলতে চাইছে, তাই নয় করতে দিল। মাথাটাও ওর ঠাণ্ডা হয় তবে।

-মাথা আমার ঠাণ্ডাই আছে। যাও, আমার ব্রেকফার্স্ট রেডি করো। বেরোতে হবে।

কন্দর্প দুজনকেই দেখে নিল একঝলক। ইলাস্টিক হাসিটাকে আর একটু টেনে বাড়াল। বলল, কি ব্যবসা করতে চাইছে বাবুরাম? জ্যান্ত হাতি কিনে মেরে মেরে বেচবে? নাকি খাল কেটে কুমির এনে পুষবে? কুমিরের চামড়ার কিন্তু হেভি দাম।

–সে বাবুরামকেই জিজ্ঞেস করুন। মহিলা দ্রুত অন্দরে ঢুকে গেল।

 প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ভেতরে বেজে উঠেছে ভয়ঙ্কর হুঙ্কার। আরাধনা শেষে মা মা শব্দে ফ্ল্যাট ফাটাচ্ছে অশোক মুস্তাফি। সঙ্গে মিউজিক দিচ্ছে পিতলের ঘণ্টি। বাজনা থামল। আবার পর পর আর্ত ডাক। মমা… মমাআ…মমাআআ….

বাবুরাম তড়াক করে উঠে দাঁড়াল, তোমার প্রভু আসছে। আমি কাটি।

রক্তলাল বসনে আবির্ভূত হল মুস্তাফি। কপালে ইয়া সিঁদুরের টিপ। বিঘূর্ণিত হচ্ছে অক্ষিগোলক, সেই আঁখিতে জল। চোখ মুছে বলল, – শুয়োরের বাচ্চাটা কী গুজগুজ করছিল এতক্ষণ?

কন্দর্প কাগজ ভাঁজ করে টান টান, কি একটা ব্যবসা করবে বলছিল… আপনি নাকি তাতে আপত্তি করছেন…

ব্যবসা, না আমার শ্রাদ্ধ! হারামজাদা ফরেন লিকার শপ খুলতে চায়।

 –মন্দ কি। করুক না। দুটো ব্যবসায় এখন মার নেই। মদ আর ওষুধ।

–থামো তো। নির্বোধের মতো কথা বোলো না। লিকারের ব্যবসা করা কি সহজ কথা! সাত্ত্বিক প্রকৃতির মানুষ হতে হয়। ওই হারামজাদা তো নিজেই দোকানে বোতল হয়ে গড়াবে।

কন্দর্প আরও যুক্তিজাল বিস্তার করতে পারত। বলতে পারত মদের দোকান না খুলেই কি আপনার ছেলে বারে-হোটেলে গড়াগড়ি কম খাচ্ছে! বরং নিজে একটা স্বাধীন ব্যবসা পেলে অন্যরকম হলেও হতে পারে। টাকার এক প্রবল মাদকশক্তি আছে, এ নেশায় পেলে মদের নেশাও কত সময়ে তুচ্ছ হয়ে যায়। বলল না। যদি অশোকদা আরও চটে যায়! কন্দর্পকে এখন অশোকদার বাঁয়া হয়ে না থাকলেও চলে। তার সঙ্গে অশোকদার লেনাদেনা কাটাকুটি হয়ে গেছে, দুজনেরই পাল্লা লাভের দিকে। তবু কেন যেন কন্দর্প এখনও অশোকদাকে বেশ ভয় পায়। ভয়, না এ এক আবিল মোহ?

মুস্তাফি অ্যাকোয়ারিয়ামের কাছে গিয়ে মাছ দেখছে। আলগা টোকা দিচ্ছে কাচের গায়ে। সরে সরে যাচ্ছে মাছেরা।

কন্দর্প কাজের কথায় এল, আপনি আমাকে খুঁজছেন অশোকদা?

–তোমাকে! কেন বলো তো?

রূপেনদা বলল…

–ও হাঁ, সে এক কীর্তি হয়েছে। মুস্তাফি হাসতে হাসতে সোফায় এল, আচ্ছা, তোমার বড়দার মাথায় কি ছিট-ফিট আছে?

-কেন দাদা?

–আমার মিস্ত্রিরা বলছিল। তোমার দাদা নাকি রোজ বাড়ি ভাঙার সময়ে সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। মাঝে মাঝে রাবিশের মধ্যে উবু হয়ে বসে কিসব ঘাঁটাঘাঁটি করে, আর গজাল পেরেক যা পায় তুলে পকেটে পোরে। দুমদাম আধভাঙা সিঁড়ি বেয়ে উঠে যায়, মিস্ত্রিরা ডাকাডাকি করেও নামাতে পারে না, ডেঞ্জারাসলি এদিক ওদিক ঘোরাফেরা করে। কবে যেন একদিন ইয়াকুবের সঙ্গে খুব ঝগড়াও বেধে গেছিল। তোমার দাদা নাকি খুব দাবড়েছে ইয়াকুবকে। এভাবে হাতুড়ি মারছেন কেন? ওভাবে গাঁইতি চালাচ্ছেন কেন?

কন্দর্প একটু-আধটু শুনেছে বটে। তিতির বলছিল। দাদার নাকি আজকাল দুপুরে খাওয়াদাওয়ারও ঠিক থাকে না। বুকটা অল্প চিনচিন করে উঠল কন্দর্পর। দাদাটার একদম বাস্তব বোধ নেই, বড় বেশি আবেগে চলে। দিন দু-তিন আগে রাত্তিরবেলা হঠাৎ তার ঘরে ঢুকেছিল দাদা। মুখ দিয়ে ভকভক বাংলা মদের গন্ধ। গুম হয়ে খানিকক্ষণ বসে রইল তার বিছানায়। কিছু বলবে দাদা? উত্তর না দিয়ে দাদা উঠে চলে গেল। এসব করছে দাদা? বাড়ি বদল করার পরও বেশ কটা দিন তো ঠিকঠাকই ছিল। নাহ, দাদার কাজের পারম্পর্য পাওয়া কঠিন।

মুস্তাফি সোফায় বাবু হয়ে বসেছে। হাঁটু কাঁপাচ্ছে ঘন ঘন, -তুমি একটু বউদির সঙ্গে কথা বলো তো। আর কিছু না, বড় বড় চাঁইটাই পড়ছে, কখন কি অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে যায়!

বউদিকে এসব কথা কী বলবে কন্দর্প! বউদি নিজেই সারাক্ষণ এমন মনমরা হয়ে থাকে।

 মেজাজটা কষটে হয়ে গেল কন্দর্পর। ভুরুতে ভাঁজ ফেলে বসে আছে।

 মুস্তাফি বলল, – তা হ্যাঁ হে কন্দর্প, অনেক তো টাকাকড়ি পেলে, লাখ টাকা নিয়ে করলে কি?

আছে। ব্যাঙ্কে ফিক্সড ডিপোজিট করে দিয়েছি।

ব্যাঙ্কে! ছোঃ। তুমি একেবারে পাঁঠাই রয়ে গেলে। আমার ফিনান্স কোম্পানিতে রাখলে মাসে মাসে দু পার্সেন্ট সুদ পেতে।

–আগে তো বলেননি অশোকদা?

–সব কথা কি বলা যায়! আগে বললে ভাবতে টাকাটা তোমায় দিয়ে আবার নিজের গর্তে ঢুকিয়ে ফেলতে চাইছি। নিদেনপক্ষে টাকাটা তো শেয়ার মার্কেটেও রাখতে পারতে। এখন চড়চড় বাজার উঠছে, টাকা তোমার ছ মাসে ডবল হয়ে যেত।

শেয়ার মার্কেটের আমি কী বুঝি দাদা?

–তুমি কিসুই বোঝে না। তাই না কুণ্ডু তোমায় বেগার খাটাচ্ছে। মুস্তাফি হাঁটুর নাচন থামাল, তোমার কথা আলাদা। তুমি এখন হিরো হয়ে কোটিপতি হচ্ছ। তবে বউদির কথা তোমার ভাবা উচিত ছিল। আমার ওপর বিশ্বাস করে টাকাটা ছেড়ে দিলে তোমাদের লাভ বই ক্ষতি হত না।

কন্দর্প খুব একটা উৎসাহ দেখাল না। আলগা বলল, –বলব বউদিকে।

–হ্যাঁ বোলো। তার সঙ্গে এও বোলো, বাজার এরকম বেশিদিন থাকবে না। দেশে প্রোডাকশন বাড়ছে না, অথচ চড়চড় করে শেয়ারের দাম চড়ছে, এ বড় অমঙ্গলের লক্ষণ। তবে এই সময়েই বুদ্ধি করে একটু ঘর গুছিয়ে ফেলতে পারলে…. তোমার শঙ্করদা তো আমার ওখানে টাকা রেখে গেছে, সে খবর রাখো?

কন্দর্প সামান্য অবাক হল। তবে সামান্যই। শঙ্করদার চোখে সব টাকাই উপরির মতো। মাইনেটাও। আর এই পড়ে পাওয়া টাকা শঙ্করদার গেলেই বা কি, থাকলেই বা কি? তাকে বা বউদিকে পাইপয়সা হিসেব করে চলতে হয়। ঝুঁকি নিতে গেলে ভাবতে হয় দশবার। মুস্তাফির চিট ফান্ড, থুড়ি, ফিনান্স কোম্পানিতে টাকা রাখবে সে? নৈব নৈব চ।

কন্দর্প ঘড়ি দেখল, আজ তবে চলি দাদা। দুপুরে একটা ডাবিং-এর কাজ আছে… আপনিও বেরোবেন….

–রোসো রোসো। শুনলাম তুমি নাকি স্মরজিতের লজঝড়ে ফিয়াটটা কেনার কথা ভাবছ?

এ সংবাদও পাওয়া হয়ে গেছে! কন্দর্প ঘাড় চুলকোল, -স্মরজিৎদা বেচে দেবে বলছিল…

–তাহলে সব টাকা তুমি ফিক্সডে রাখোনি?

সরাসরি জবাব না দিয়ে কন্দর্প বলল, – ফাইনাল কিছু হয়নি দাদা। সস্তায় দিচ্ছে শুনে…ভাবছিলাম…

কত চাইছে?

বাইশ।

আচমকা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল মুস্তাফি, ওই আদ্যিকালের ইটালিয়ান মডেলটা তুমি বাইশে কিনছ! ও ব্যাটা নিজে কতয় কিনেছিল জানো? আঠেরো। কদিন ধরে বেচার ধান্দা করছিল, অ্যাদ্দিনে তোমায় মুরগি পেয়েছে।

কন্দর্প নিরীহ মুখে বলল, তা হলে নেব না বলছেন?

নাও। আর একটু দরদস্তুর করে নাও। তোমার এখন বাজার হচ্ছে, ওই টিকটিকির পিঠে চড়ে দোরে দোরে ঘুরলে মান থাকবে না। মুস্তাফি একটু ভারিক্কি হল, গাড়ি চড়ার শখ যখন হয়েছে, আমার ওখান থেকে একটা নতুন নিয়ে নাও। ধীরে ধীরে শোধ কোরো।

পলকের জন্য অশোকদার অফিসে বসে থাকা ষণ্ডামার্কা লোক দুটোর চেহারা মনে পড়ল কন্দর্পর। দেনদারদের চমকানোর জন্য পুষেছে অশোকদা। ঢোঁক গিলে বলল, – থাক দাদা। কদিন পুরনোই চড়ি।

যা ভাল বোঝো করো।

কন্দর্প আর গড়িমসি না করে উঠে পড়ল। মুস্তাফি দরজা পর্যন্ত সঙ্গে সঙ্গে এসেছে। ঘাড় ফিরিয়ে একবার দেখে নিল ফ্ল্যাটের ভেতরটা। গলা একটু নামিয়ে বলল, -একটা কথা ভাবছিলাম, বুঝলে। শুয়োরটাকে একটা ফরেন লিকারের দোকান করে দেওয়া যায়। গড়িয়াহাটের কাছে যে মাল্টি স্টোরেডটা তুলছি তার গ্রাউন্ডে আমার কিছুটা স্পেস ধরে রাখা আছে। ভাবছিলাম একটা ইলেকট্রনিক গুডসের দোকান দেব। তা নয় মালের দোকানই দিলাম। লাইসেন্স-ফাইসেন্সের পেছনে বড় খরচা আছে, তাও নয় হোক। বাট অন ওয়ান কন্ডিশান। মুস্তাফি কন্দর্পর কাঁধে হাত রাখল, -ইউ উইল বি বাবুরামস ওয়ার্কিং পার্টনার।

কন্দর্প ছিটকে সরে গেল, তা কী করে হয়! আমার শুটিং আছে, দেখছেনই তো আমার অল্প অল্প রোল আসছে, মাসে কটা দিনই বা ফ্রি থাকি।

–তুমি তোমার কাজ করো না। রোজ একবার দুবার যাবে, ওয়াচ-টোয়াচ রাখবে…। ছেলেটা তোমায় লাইক করে…। মুস্তাফি আবার হাত ঘাড়ে তুলে দিল, প্রায় থাবার মতো। মুখ বেঁকিয়ে হাসছে, – আরে ভাই, তুমি তো আর অমিতাভ বচ্চন রাজেশ খান্না হচ্ছ না, দোকান থাকলে তোমারও একটা স্টেডি ইনকাম হয়। …তোমাকে ভালবাসি বলেই বলছি। নইলে আমার কি লোকের অভাব!

কন্দর্পর গা রি রি করে উঠল। লোকটা কী ভাবে তাকে? তার নিষ্ঠা সাধনা স্বপ্ন কোনও কিছুরই এতটুকু মূল্য নেই লোকটার কাছে? নিজের সুবিধে, স্বার্থের জন্য ইচ্ছেমতো ঘুঁটি সাজাবে, আর কন্দর্প হবে তার দাবার বোড়ে? তার আগে এই সাততলা থেকে ঝাঁপ দেবে কন্দর্প।

একটা কথাও না বলে কন্দর্প নেমে এল। ফেরার পথে তাদের পুরনো বাড়িটার সামনে গিয়ে দাদাকে খুঁজল ইতিউতি, দেখতে পেল না। মিস্ত্রি-মজুররা এখনও কাজে হাত লাগায়নি, চারদিকের কোলাহলের মাঝে কেমন একঘরে হয়ে দাঁড়িয়ে আছে খাঁচাটা। পিছনের দিকের অনেকটাই ভাঙা হয়ে গেছে, ইট বালি দরজা জানলা স্তূপ হয়ে আছে যেখানে সেখানে।

সামনেটা এখনও অটুট, মূর্তিমান ব্যঙ্গের মতো।

এখানে কী দেখে দাদা! দেখার কী আছে!

.

বিকেলে ডাবিং-এর পর স্যাস ক্লিনিকে এল কন্দর্প।

সম্প্রতি মধুমিতার চাকরিতে পদোন্নতি হয়েছে। রিসেপশানে সে কমই বসে, অফিসঘরে কম্পিউটার নিয়েই বেশি কাজ থাকে তার। মাইনে বেড়েছে, সঙ্গে সঙ্গে দায়িত্বও। রুগীদের বিলপত্র করে, রেকর্ড রাখে। বাইরের দু-চার জন ডাক্তার আজকাল স্যাস ক্লিনিকের অপারেশন থিয়েটার ব্যবহার করছে, তাদেরও হিসেবপত্রের ভার এখন মধুমিতার ওপর। অরূপ শালিনীর সে এখন বেশ স্নেহের পাত্রী। নার্সিংহোমের আর-এম-ও মেট্রনরাও তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ।

স্কুটার বাইরে রেখে কন্দর্প সোজা অফিসঘরে ঢুকল। মধুমিতা নেই। রিসেপশানে আর একটি নতুন মেয়ে বসে আজকাল। অল্পবয়সী মেয়ে, আনাগোনার সুত্রে কন্দর্পের সঙ্গে মুখ চেনা হয়ে গেছে। কন্দর্পকে দেখে মেয়েটি মুচকি হাসল, মিতাদি আসেনি।

কন্দর্প মেয়েটির সামনে এল, ছুটি নিয়েছে?

পরশু জ্বর নিয়ে বাড়ি গেল। আজ সকালে ফোন করেছিল। কাল, নয়তো সোমবার জয়েন করবে।

নিরানন্দ মুখে কন্দর্প নার্সিংহোমের পোর্টিকোর নীচে এসে দাঁড়াল। কি করবে ঠিক ভেবে পাচ্ছিল না। কালকের দিনটা দেখে রোববার মধুমিতার বাড়ি যাবে? গত দেড় বছরে মধুমিতাকে কখনও অসুস্থ হতে দেখেনি কন্দর্প, আজ কী করে সে নিশ্চিন্ত থাকে?

বেলা পড়ে এসেছে। পৃথিবী জুড়ে সোনাঝুরি আলো। আসন্ন শরতের ছোঁয়ায় সে আলো আজ ভারি মায়াময়।

কন্দর্পর একটুও ভাল লাগছিল না, চোখ বুজে ফেলল। স্পষ্ট দেখতে পেল মধুমিতার ফর্সা মুখ এখন অস্বাভাবিক লাল, চোখ বসে গেছে, গোলাপি ঠোঁট শুকনো, সাদাটে। বিস্রস্ত চুল লুটোপুটি খাচ্ছে শয্যায়। জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে মধুমিতা, ছটফট করছে বিছানায়। একা কাশফুল মলিন, বিবর্ণ।

পলকে বাতাস ভরে গেল এক তীব্র সুগন্ধে। কন্দর্পর বুকে পারফিউম ছিটিয়ে দিল মধুমিতা। রিন রিন হাসিতে বধির হয়ে যাচ্ছে কন্দর্পর কান।

কন্দর্প স্কুটারে স্টার্ট দিল। বেরোনোর মুখে দেখল শুভাশিসের গাড়ি ঢুকছে নার্সিংহোমে। দূর থেকে হাত নাড়ল কন্দর্প, –দাঁড়াল না।

.

৬৭.

বাড়ি আজ ফাঁকা যে! স্মার্ট হতে গিয়েও কন্দর্পর স্বর দুলে গেল, মাসিমা মউ সব কোথায়?

–আপনি বুঝি আমার মা মেয়ের খোঁজ নিতে এসেছেন?

–তা নয়, ভরসন্ধেবেলা ভুতের মতো বসে আছ….

–ভুত নয়, পেত্নি। শাঁকচুন্নিও বলতে পারেন।

কন্দর্প হাসল। এ যদি পেত্নি হয় তবে রানি কে! কপালে আজ একটা লম্বাটে টিপ পরেছে মধুমিতা, খয়ের রঙের। পিঠ বেয়ে নেমেছে মোটা বেণী। চোখেও বুঝি হালকা কাজলের ছোঁয়া। মুখেচোখে কোনও শুকনো ভাবই নেই। বরং যেন অল্প ফোলা ফোলা, দুপুরে ঘুমোলে যেমনটি হয়। পরনে মেঘবরণ শাড়ি, অঙ্গে স্থির বিদ্যুৎ। এ যদি শাঁকচুন্নি হয় তবে পরী কে!

চোখ নামিয়ে বেতের চেয়ারে বসল কন্দর্প, — এক গ্লাস জল খাওয়াবে?

মধুমিতা জল নিয়ে এল। অনেকটা পথ স্কুটারটাকে প্রায় উড়িয়ে এনেছে কন্দর্প, তৃষ্ণার্ত কণ্ঠনালী শুকিয়ে গেছে, এক চুমুকে জল শেষ।

মধুমিতা হাত থেকে গ্লাস নিল, আর দেব?

না থাক।

মধুমিতা রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে বলল, মা মউকে নিয়ে দাদার বাড়ি গেছে। দাদার ছোট ছেলের আজ জন্মদিন।

–তুমি গেলে না?

উঁহু। ফিরে এসে মোড়া টেনে সামনে বসল মধুমিতা। ঠোঁটে কুয়াশা মাখা হাসি, ভাবলাম একজন যদি দূর থেকে এসে ফিরে যায়!

কথাটা টুঙ করে বাজল। জলতরঙ্গের মতো। একটু প্রগলভ হওয়ার চেষ্টা করল কন্দর্প, — দূর থেকে এসে একজন ফিরে যাবে কেন? তার তো কাছেই দিদির বাড়ি, সেখানে গিয়েই সন্ধেটা কাটাত।

–তা হলে সে সেখানেই যাক। এখনও হাতে সময় আছে, আমি দাদার বাড়ি রওনা হয়ে যাই।

কন্দর্পর বুকে একটা কুবো পাখি ডেকে উঠল। অনেককাল ধরেই নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে পাখিটা, আজ স্পষ্ট শুনতে পেল তার ডাক। কুব কুব ধ্বনি চারিয়ে যাচ্ছে শিরা-উপশিরায়। অস্ফুটে প্রশ্ন করল, তুমি জানতে আমি আসব?

না জানার কি আছে! কাল আপনার শুটিং শেষ হওয়ার কথা, আজ আপনি নিশ্চয়ই নার্সিংহোমে…।

মধুমিতা কথা সম্পূর্ণ করল না। অসম্পূর্ণ কথা নির্বাক তরঙ্গ হয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে ঘরে। মাথার ওপর পাখা ঘুরছে বনবন। ক্যালেন্ডারের পাতা ফরফর উড়ছে, জানলা দিয়ে একঝলক বাতাস ঢুকল, শেষ শ্রাবণের বাতাস, বাষ্পের ছোঁয়াচ মাখা।

কন্দর্প সোজা চোখে মধুমিতার দিকে তাকাল, তোমার জ্বর এখন কেমন?

-মুখ দেখে কী মনে হয়?

–মুখ দেখে কি জ্বর বোঝা যায়?

ফস করে হাত বাড়িয়ে দিল মধুমিতা, তা হলে পালস দেখুন।

 কন্দর্প মোহগ্রস্তের মতো ধরল হাতটা। কবজির নীল শিরা দপদপ করছে, কিন্তু কী শীতল! সত্যিই শীতল, নাকি তার নিজেরই তাপ বেড়ে গেছে আচমকা!

হাতখানা ছেড়ে দিল কন্দর্প, এখন তো মনে হচ্ছে জ্বরটা নেই।

–নেইই তো। পরশু খুব ছিল। যখন বাড়ি ফিরলাম, মাথা একেবারে ছিঁড়ে পড়ে যাচ্ছিল। কাল বিকেল থেকে কমে গেছে।

তা হলে আজ ডুব মারলে যে?

–ইচ্ছে হল। পরখ করে দেখছিলাম একজন আমার খবর নেয় কিনা।

 পরখ, না খেলা! পরখ, না সংশয়! পরখ, না বিশ্বাস!

কন্দর্প মৃদু স্বরে বলল, -কী বুঝলে?

–যা বোঝার তাই বুঝলাম। মধুমিতা হঠাৎ খুব গম্ভীর হয়ে গেল। মোড়া ছেড়ে জানলায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। আধফেরানো মুখে কি যেন দেখছে বাইরে। তীব্র অথচ চাপা স্বরে বলল, আমার ওপর আপনার অসীম করুণা।

ছি ছি, এ কী বলছ! তোমার অসুখ হয়েছে, আমি দেখতে আসব না? এ তো আমার কর্তব্য।

বুঝলাম আপনি একজন কর্তব্যপরায়ণ মানুষ।

মধুমিতার স্বরে কি বিদ্রূপ? কন্দর্প কি বলবে ঠিক ভেবে পাচ্ছিল না। চুপ করে বসে রইল খানিকক্ষণ। মুখস্থ করা সংলাপ বলতে তার সমস্যা হয় না। ডিরেক্টর তালিম দিয়ে নেয়, স্পট বয়রা কিউ ধরিয়ে দেয়, একবার ভুল হয়ে গেলে দ্বিতীয়বার সুযোগ আসে, তৃতীয়বার সুযোগ আসে। কিন্তু বাস্তব বড় গোলমেলে জায়গা। একটা ভুলেই সব শেষ।

তবু উঠল কন্দর্প। পায়ে পায়ে মধুমিতার পিছনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে, তুমি আজ এভাবে কথা বলছ কেন?

–ঠিকই তো বলছি। মধুমিতা মুখ ফেরাল না, আপনার দয়ার প্রাণ। অন্যের দুঃখে আপনার হৃদয় বিগলিত হয়। অন্যের উপকার করতে আপনি জীবন উৎসর্গ করেন।

কন্দর্প মনে মনে আর্তনাদ করে উঠল, তুমি তো অন্য কেউ নও মধুমিতা।

মধুমিতা ঝট করে মুখ ঘোরাল, একটা কথা জিজ্ঞেস করব?

-কি?

–আমার উপকার করা তো আপনার হয়ে গেছে, চাকরিও মোটামুটি আমার টিকেই গেল, সংসারটাও গড়িয়ে গড়িয়ে চলে যাবে। এখনও কিসের জন্য আমার কাছে আসেন? বন্ধুর বিধবা স্ত্রীর রক্ষণাবেক্ষণের দায় বজায় রাখতে?

কন্দর্প নিশ্চুপ। কথাটা এত বড় মিথ্যে যে কোনও প্রতিবাদই চলে না।

মধুমিতার চোখ জ্বলছে। ঠোঁট কাঁপছে। নাকের পাটা ফুলছে ঘন ঘন। ফোঁস ফোঁস নিশ্বাস ফেলে বলল, — জবাব দিন। কিছু অন্তত বলুন।

কত কথাই তো বলতে পারে কন্দর্প। কিন্তু কীভাবে বলবে? কতটা বলবে? পৃথিবীতে হাজার হাজার বছর ধরে কোটি কোটি মানুষ অর্বুদবার যে কথা বলেছে, সে কথা তো সহজেই উচ্চারণ করা যায়। মাত্র তো তিনটে শব্দ। আমি তোমাকে ভালবাসি। কিন্তু কথাটা বললেই সব ফুরিয়ে যায় না। অনেক কথা বাকি থেকে যায়, অনেক কথা। দীপঙ্করের বউ মধুমিতাকে কি প্রথম দর্শনেই ভালবেসেছিল কন্দর্প? না। দীপঙ্করকে ঈর্ষা হয়েছিল তার, তবে সেই ঈর্ষার হেতু মধুমিতার প্রতি কোনও দুর্বলতা নয়। মধুমিতাকে শোকার্ত বিহ্বল দেখেই কি তার ভালবাসা জেগেছিল? কক্ষনও না। তখন ছিল নিছক সহানুভূতি, হয়তো বা করুণাও। তারই বশে অসহায় মেয়েটাকে একটা স্থিতি দিতে চেয়েছিল। সঙ্গে একটা চোরা লালসাও ছিল হয়তো, ছিল সঙ্গসুখ ভোগ করার এক গোপন আনন্দ। কিন্তু কি থেকে কী ঘটে গেল! কখন যেন মধুমিতার কষ্টগুলো আসন গাড়ল কন্দর্পর বুকে। একজনের ব্যথা যখন আর একজনকে ছেয়ে ফেলে, তখন তার ভেতরে আর কোনও সহানুভূতি থাকে না, করুণা থাকে না। লালসা কামনাও কেমন অন্য ধরনের চেহারা পেয়ে যায়। জন্ম নেয় এক মুক্তোদানা। যার নাম প্রেম।

কিন্তু মধুমিতা কি এসব কথা বিশ্বাস করবে? মধুমিতার জায়গায় কন্দর্প থাকলে করত? ভাবত না ত্রাতার ছদ্মবেশে কন্দর্প এক বাসনাতাড়িত পুরুষ? উপকার করে প্রতিদান চাইছে? দেনাপাওনার কারবার ফাঁদছে? দীপঙ্কর নাকি মধুমিতাকে বলত বিপদে পড়লে কন্দর্পকে ডেকো। কন্দর্পর ওপর নাকি আস্থা রাখা যায়। উফ, আস্থা শব্দটার কী ভয়ঙ্কর ওজন! আস্ত পাহাড় হয়ে হঠাৎ হঠাৎ বুকে চেপে বসে শব্দটা। যেন মনে করিয়ে দেয় বাড়ি ফাঁকা পেয়ে সিঁধ কেটে ঢুকেছে কন্দর্প। নিজেকে কেমন চোর চোর লাগে, পাপী মনে হয়।

এত কথা যে কী করে সাজায় কন্দর্প!

কন্দর্প ঘড়ঘড়ে গলায় বলল, তোমার মাথা গরম হয়ে গেছে মধুমিতা। শান্ত হও।

মধুমিতার চোখের মণি আরও কালো দেখাল। বলল, আমি শান্তই আছি। আপনি আমার কথার জবাব দিন। কেন আসেন আপনি?

সংলাপ ভুলে যাওয়া অভিনেতার মতো কন্দর্প বলে উঠল, তুমি আর দীপঙ্করকে ভালবাস না মধুমিতা?

–এটা জবাব নয়, প্রশ্ন।

কন্দর্প মনে মনে বলল, – এই প্রশ্নের মধ্যেই আমার জবাব লুকিয়ে আছে মধুমিতা।

মধুমিতা আবার জানলার দিকে ফিরল। আপনমনে বলল, – মরা মানুষকে ভালবাসা যায় না কন্দর্পদা। তার ছবির দিকে তাকিয়ে কাঁদা যায়, তার মৃত্যুর দিনে কয়েকটা ফিকে হয়ে আসা স্মৃতি নিয়ে আকুল হওয়া যায়। সে তো ছেলেবেলার কথা ভাবলেও হয়, পুরনো অ্যালবাম উলটোলেও হয়। ভালবাসার জন্য একটা অন্য কিছু লাগে। এমন কিছু যাকে ধরাছোঁয়ার মধ্যে পাওয়া যায়, যার ওপর রাগ অভিমান ফলানো যায়। দীপঙ্কর আমার মৃত স্বামী। মৃত। মৃতই। একটা হারিয়ে যাওয়া বসন্তকাল। একটা স্মৃতি। স্মৃতিকে ভালবাসা আর টাটকা বসন্তকালের জন্য উতল হওয়া এক নয় কন্দর্পদা।

মধুমিতার কথায় কোনও লুকোচুরি নেই। তবু যে কেন মন অসাড় হয়ে আসে কন্দর্পর! যাকে ভীষণভাবে আকাঙ্ক্ষা করে মানুষ, সে হঠাৎ আপনা থেকে ধরা দিলে কি এমনটাই হয়! অনুভবে তো এরকমই একটা সিন ছিল ঋতুশ্রীর সঙ্গে, সেখানে তো এই অনুভূতি আসেনি।

আলোর দিকে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে মধুমিতা। তার ঘাড়ে, পিঠের একটুখানি অংশে পিছলে যাচ্ছে বৈদ্যুতিক বিভা। বেণীর পাশেই, কাঁধের কাছে, রক্তদানার মতো একটা তিল ফুটে আছে। কন্দর্প ভূতগ্রস্তের মতো তিলটা ছুঁতে যাচ্ছিল, তার আগেই এক আশ্চর্য কাণ্ড করে বসল মধুমিতা। আচমকা ঘুরে দু হাতে খামচে ধরেছে কন্দর্পকে। দুম দুম কিল ঘুষি মারছে বুকে। দপদপ করছে মধুমিতার স্বর, আপনি একটা কাওয়ার্ড। আপনি একটা ভণ্ড। বাজে লোক, বাজে লোক…

কন্দর্প পুরোপুরি বোকা হয়ে গেল। এখন ঠিক কি করা উচিত বুঝে উঠতে পারছে না। শুধু এটুকু বুঝল এ সময়ের জন্য কোনও নির্দিষ্ট সংলাপ থাকে না, নির্দেশ থাকে না। তবে কি ওই তিনটে শব্দই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে…!

অন্ধের মতো মধুমিতাকে জড়িয়ে ধরল কন্দর্প। ধীরে ধীরে শান্ত হচ্ছে মধুমিতা। অথবা হচ্ছে না, আরও উত্তাল হয়ে উঠছে ক্রমশ। সাপিনীর মতো বেষ্টন করছে কন্দর্পকে। সাপিনী, না, রোহিণী? কন্দর্প দু হাতে তুলে ধরল মধুমিতার মুখ। টিপ ঝরে গেছে ছোট্ট কপাল থেকে, সাদা সিঁথির দু পাশে ঝুরো চুল এলোমেলো, কান্নায় ভেসে যাচ্ছে মধুমিতা। কান্নাই কি শ্রেষ্ঠ সমর্পণ?

সারা জীবনে কয়েক সহস্র ইংরিজি ছবি দেখেছে কন্দর্প, কত রোমান্টিক সিন, কত আবেগ থর থর দৃশ্য, সব আজ বেমালুম ভুলে গেল কন্দর্প। বেহেড আনাড়ির মতো ঠোঁট রাখল মধুমিতার ঠোঁটে, ওষ্ঠ দিয়ে শুষে নিচ্ছে সমস্ত অশ্রু। এত নুন থাকে মেয়েদের চোখে! মৃদু এক সুরভিতে ভরে গেছে ঘর। চেনা চেনা। কন্দর্পর দেওয়া সেই পারফিউম কি আজ মেখেছিল মধুমিতা! ঘরে ঢুকেই কেন গন্ধটা পায়নি কন্দর্প! গন্ধটা আজ এত বুনো বুনো লাগে কেন!

মুহূর্ত কাটছে। একটা একটা করে মুহূর্ত কাটছে। বড় দ্রুত।

কন্দর্পর আলিঙ্গন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল মধুমিতা। নিজেকে বিন্যস্ত করল। আঁচলে মুখ মুছছে, গুছিয়ে নিচ্ছে চুল। শ্লথ পায়ে মোড়ায় বসল আবার। মাথা নিচু। অপলক চোখে ভাবছে কি যেন। ফর্সা মুখে টকটকে রক্তাভা।

কন্দর্পর কেমন বিবশ লাগছিল নিজেকে। জানলাতেই দাঁড়িয়ে আছে, মনে হয় কেউ যেন গেঁথে দিয়েছে তার পা দুখানা। এক্ষুনি যে ঘটনা ঘটে গেল, সেটা ঘটা কি উচিত হল? মধুমিতার কি অনুশোচনা হচ্ছে? অমন বিমর্ষ মুখে তবে বসে আছে কেন?

মুহূর্ত কাটছে। একটা একটা করে মুহূর্ত কাটছে। বড় দীর্ঘ হয়ে। অশরীরী ছায়া হয়ে।

মধুমিতাই কথা বলল। প্রথম কথা। স্তিমিত স্বরে প্রশ্ন করল, চা করব?

 কন্দর্প চমকে তাকাল। শূন্য মস্তিষ্ক ধাক্কা খেয়ে সজাগ হল যেন, থাক না, আবার চা কেন?

–একটু করি। আমিও খাব।

 উত্তরের অপেক্ষা না করে রান্নাঘরে চলে গেল মধুমিতা। জল বসিয়েছে, টুং টাং শব্দ পাওয়া যাচ্ছে কাপ-ডিশের। বিজন ফ্ল্যাটে ওই শব্দটুকুই কী মুখর এখন!

শরীরটাকে টেনে এনে বেতের চেয়ারে বসাল কন্দর্প। সিগারেট ধরাল। আঙুল এখনও টিপ টিপ কাঁপছে। ছোট্ট কাঠের টেবিলে আজকের কাগজ রাখা আছে। পড়া কাগজ, তবু টানল কন্দর্প। বাংলা অক্ষর যেন দুর্বোধ্য খরোষ্ঠি লিপি।

চা হাতে ফিরেছে মধুমিতা। মোড়াটা একটু দূরে সরিয়ে বসল। শুকনো চোখ অন্য দিকে, মলিন দেওয়ালে।

নীরবে চা শেষ করে কন্দর্প বলল, আমি আজ উঠি।

এবার মধুমিতা চমকে তাকিয়েছে, এখনই যাবেন?

–যাই।

 –মউয়ের সঙ্গে দেখা করে যাবেন না?

–আজ থাক।

দরজায় পোঁছে তবু দাঁড়াল কন্দর্প। বুঝতে পারছে যাওয়ার আগে কিছু একটা বলা উচিত মধুমিতাকে। ওই তিনটে শব্দ ছাড়া অন্য কিছু। কি বলবে? এমন একটা মুহূর্তে বলার মতন কি কথা থাকে?

মধুমিতাই আবার কথা বলল, – সোমবার আসছেন তো নার্সিংহোমে?

 এতক্ষণ পর মধুমিতার চোখে চোখ রাখতে পারল কন্দর্প, — আসব?

কান্নার মতো একটুকরো হাসি ফুটল মধুমিতার মুখে, ইচ্ছে হলে আসবেন। আমি কাউকে জোর করব না।

কন্দর্প ফিরছিল। স্কুটার শম্বুক গতিতে চলছে। যেন কেউ চালাচ্ছে না, আপনিই চলছে দ্বিচক্রযান। কখন যেন ভি আই পি ছেড়ে বাইপাসে এসে গেল। মুখোমুখি একটা বাতাস ঝাপটা মারছে। একদম মুখোমুখি নয়, একটু টেরচাভাবে। ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা হাওয়া শার্ট ফুড়ে ঢুকে যাচ্ছে। কন্দর্পর বুকে। মসৃণ পথ, উজ্জ্বল আলো, রাত বড় মোহিনী এখন।

বিচিত্র এক অনুভূতি হচ্ছিল কন্দর্পর। এই মুহূর্তে সেই বোধহয় পৃথিবীর সব থেকে সুখী মানুষ, অথচ ঠিক তেমনটি তো বোধ হচ্ছে না! কোথা থেকে এক অচেনা যন্ত্রণা এসে ভার করে দিচ্ছে মন। কেন যন্ত্রণা তাও ঠিক বোঝা যায় না। তবু যেন অস্পষ্ট চিনচিন ব্যথা…! কন্দর্পর জীবনে মধুমিতাই প্রথম নারী নয়, আগেও এসেছে কয়েকজন। তবে তারা ছিল যৌবনের খেলা। দায়হীন, ভারহীন, লঘু বাতাসের মতো এসেছে, উড়ে গেছে। কৃষ্ণকলির সঙ্গে সম্পর্কটাই যা একটু বেশি গড়িয়েছিল। একসঙ্গে ডায়মন্ডহারবার বেড়াতে গিয়েছিল দুজনে, সারা দুপুর গঙ্গার পাড়ে ফস্টিনস্টিও হয়েছিল অনেক। তবে তাতে যতটা শরীর ছিল, ততটা আবেগ ছিল না। সেই কৃষ্ণকলি এখন দিব্যি এক ডব্লু বি সি এস-কে বিয়ে করে সুখী গৃহিণী হয়েছে। বছর দুয়েক আগে গড়িয়াহাটে বরকে নিয়ে পুজোর বাজার করছিল কৃষ্ণকলি, কন্দর্পকে দেখে কী উচ্ছল! বরকে বলল, এই দ্যাখো দ্যাখো এই হল কন্দর্প, যার জন্য একসময়ে আমি ফিদা ছিলাম। হিহি হিহি। এই কন্দর্প, চলো না আমরা একসঙ্গে লাঞ্চ করি আজ। কৃষ্ণকলির বিয়ের দিন যেটুকু বা কষ্ট হয়েছিল কন্দর্পর, সেদিন সেটুকুও হয়নি। কৃষ্ণকলির বরের সঙ্গে গল্প করতে করতে ভরপেট চাইনিজ খেয়েছিল, মৌরি চিবোতে চিবোতে উঠেছিল স্কুটারে।

মধুমিতা কৃষ্ণকলি নয়, মধুমিতা যে কোনও এক নারী নয়, মধুমিতা সবার থেকে আলাদা, সম্পূর্ণ আলাদা। মধুমিতা একটা একা কাশফুল, মধুমিতা কন্দর্পর বুকের জমাট বাতাস।

তবে কি খুব বেশি সুখের আর এক নাম কষ্ট!

নাকি কোনও গোপন অপরাধ বোধে পীড়িত হচ্ছে কন্দর্প! কীসের অপরাধ বোধ? দীপঙ্কর তো মরে ভূত হয়ে গেছে। যে মরে গেছে সে তো মরেই গেছে, যারা বেঁচে আছে তাদের বাঁচার অধিকার থাকবে না কেন?

সামনে খানিকটা পথ অন্ধকার। রাস্তা এবড়ো-খেবড়ো, দোল খাচ্ছে স্কুটার। পথের ধারে তিন-চারটে লোক সন্দেহজনকভাবে ঘোরাফেরা করছে। উল্টোদিক থেকে রাতের টহলদার পুলিশি জিপ তীব্র আলো ফেলে চলে গেল। চোখ ধাঁধিয়ে গেল কন্দর্পর। একটু হলেই টাল খেয়ে যাচ্ছিল স্কুটার, সামলে নিল কোনওক্রমে।

বাকি পথ সজাগ স্নায়ু নিয়ে ফিরল কন্দর্প। তিতির গ্রিলের দরজা খুলে দিয়ে চলে গেল ঘরে। প্রিটেস্ট চলছে, পড়ছে বোধহয়, মুখখানা ভারি অন্যমনস্ক। টেনে টেনে ছোট্ট ঘেরা বারান্দায় স্কুটার তুলল কন্দর্প। স্কুটারেই বোঝাই হয়ে যায় বারান্দাটা।

ঘরে ঢোকার আগে চিলতে খাওয়ার জায়গাটার দিকে কন্দর্পর চোখ পড়ল। টেবিলটা মোটেই খুব বড় নয়, তবু তাতেই জায়গাটুকু জবরজঙ। কন্দর্প দেখল প্লাস্টিকের ঢাকা দিয়ে চাপা রয়েছে তার রাতের খাবার। দশটাও তো বাজেনি, এর মধ্যে খেয়ে নিল বউদিরা!

কন্দর্পর ঘরখানা এ বাড়িতে সব থেকে ছোট। কন্দর্প বলে কুঠরি, সত্যিই কুঠরি। খাট আলমারি চেয়ার টেবিল আর সেতারেই নড়াচড়ার রাস্তা বন্ধ। ভাগ্যিস তাক আছে দেওয়ালে, না হলে ভিসিপি, বই সবই খাটের তলায় ঢোকাতে হত।

জামাকাপড় না বদলেই কন্দর্প শুয়ে পড়ল। কোত্থেকে একটা গান ভেসে আসছে। রবীন্দ্রসঙ্গীত। রূপে তোমায় ভোলাব না, ভালবাসায় ভোলাব। এসব গান তো এখন আর টিভিতে বিশেষ হয় না, কেউ বোধহয় টেপ-ফেপ চালাচ্ছে।

গানের কলিগুলো ছুঁয়ে যাচ্ছিল কন্দর্পকে। চোখে জল এসে গেল। ভেজা চোখে মধুমিতাকে মনে করার চেষ্টা করল কন্দর্প। ছোট্ট কপাল থেকে টিপ সরে গেছে, পাতলা ঠোঁট প্রাণপণে টিপে আছে মধুমিতা, বোজা চোখের পাতা বেয়ে বৃষ্টির মতো কান্না ঝরছে। রিনরিনে মেয়েলি স্বর কেঁপে কেঁপে ঢুকল ঘরে। জানবে না কেউ কোন তুফানে তরঙ্গদল নাচবে প্রাণে…। ভেতরটা কেউ নিংড়ে নিচ্ছে কন্দর্পর। মধুমিতার দু চোখের জল শুষে নিল কন্দর্প। …চাঁদের মতো অলখ টানে জোয়ারে ঢেউ ভোলাব…। কী পরম নির্ভরতায় কন্দর্পকে আঁকড়ে ধরল মধুমিতা। ঘুম আসছে কন্দর্পর, ঘুম আসছে। কন্দর্প ফিসফিস করে বলল, ঢেউ তোলাব… ঢেউ তোলাব…

ইন্দ্রাণীর ঠেলায় ধড়মড়িয়ে উঠে বসল কন্দর্প, কি হল, তুমি খেলে না?

কন্দর্প চোখ রগড়াল, –কটা বাজে?

–পৌনে বারোটা।

–এত রাত হয়ে গেছে! কন্দর্প বিছানা থেকে নামল, ডাকোনি কেন?

–দুবার এসে ফিরে গেছি। তুমি অকাতরে ঘুমোচ্ছিলে। ভাবলাম হয়তো…। খাবে, না ফ্রিজে তুলে দেব?

-না না, খাব। পেটে ছুঁচো ডন মারছে। কন্দর্প শার্ট খুলে আলমারির দিকে এগোল।

ইন্দ্রাণীর গলা হঠাৎ থমথমে, তোমার দাদা এখনও ফেরেনি চাঁদু।

কন্দর্প ঘুরে তাকাল, গেছে কোথায়?

–কি জানি। বলে তো যায় না।

রঘুবীরবাবুর সঙ্গে সাইট-ফাইটে চলে যায়নি তো?

–ওসব তো কবেই শিকেয় উঠেছে।

 এ তো মহা ঝামেলা হল। পলকের জন্য মুস্তাফির কথাটা মনে পড়ল কন্দর্পর। বলি বলি করেও বলল না ইন্দ্রাণীকে। ভুরু কুঁচকে আবার শার্ট গায়ে গলাল, – যাই, একটু দেখে আসি।

–কোথায় খুঁজবে? ওর আড্ডা-ফাড্ডা চেনো?

কন্দর্প উত্তর দিল না। পথে বেরিয়ে সিগারেট ধরাল। দুটো টান দিতেই তেতো হয়ে গেল জিভ। খালি পেটে মোচড় দিচ্ছে ধোঁয়া। রাস্তাঘাট প্রায় নির্জন হয়ে এসেছে, মোড়ের পান-বিড়ির দোকানটায় তালা লাগাচ্ছে বিরজু। একপাল কুকুর রাগী রাগী চোখে চষে বেড়াচ্ছে পাড়া। রিকশা স্ট্যান্ডও একেবারে ফাঁকা।

স্টেশনের কাছে এসে কন্দর্প একটু দাঁড়াল। শেষ ট্রেন বোধহয় যায়নি এখনও, বেশ কিছু ব্যাপারি ঘোরাফেরা করছে প্ল্যাটফর্মে। এক মুখ দাড়ি, টেরা পাগলটা শালপাতা থেকে কি যেন খাচ্ছে চেটে চেটে। প্ল্যাটফর্মবাসীদের শয্যাতেও রাত্রি নেমেছে। সার সার শুয়ে আছে মানুষ, হাঁড়ি কড়া, কুকুর। সংখ্যায় এরা বাড়ছে রোজ।

স্টেশনের ওপারে একটা চুল্লুর ঠেক আছে, সেদিকে গেল কন্দর্প। নেই আদিত্য। লাইন ধরে খানিক এগোলে ছোট বস্তি পড়ে একটা, সেখানেও দিশি মদের কারবার চলে, কন্দর্প একবার সেদিকেও দেখে এল। নেই। ব্রিজের নীচেও একটা বড় আড্ডা আছে, সেদিকে এগোচ্ছিল, কি ভেবে তাদের আধভাঙা বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে গেল। বাড়ির ফাঁকা জমিতে ইট গেঁথে একটা কাঁচা ঘর বানানো হয়েছে, রাতে পাহারাদার থাকে, আলো জ্বলছে ঘরখানায়।

কন্দর্প ঘরটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল, অ্যাই শুনছ? কে আছে?

লুঙ্গি গেঞ্জি পরা এক ঢ্যাঙা মতন লোক বেরিয়ে এল, -কী চাই?

–আমি মুস্তাফিবাবুর লোক। কথাটা বলে একটু অপেক্ষা করল কন্দর্প।

একটু যেন প্রতিক্রিয়া হল লোকটার, হ্যাঁ বলুন, কী ব্যাপার?

–আমি একজনকে খুঁজছি। মানে এ বাড়ির যিনি মালিক ছিলেন। যিনি আসেন, রোজ দাঁড়িয়ে থাকেন।

–ও পাগলাবাবু! তিনি তো বিকেলে এসেছিলেন।

কখন গেছেন?

–খেয়াল করিনি।

–ও।

ফেরার আগে আর একবার ভাঙা বাড়িটার দিকে তাকাল কন্দর্প। অন্ধকারে আরও যেন ছন্নছাড়া লাগছে বাড়িটাকে। শুধু রায়বাড়ি কেন, রায়বাড়ির মানুষগুলোরও যেন একই দশা।

বাস স্ট্যান্ডের দিক থেকে টলতে টলতে আসছে এক মাতাল। ছায়ামূর্তির মতো। দাদা কি? কন্দর্প মাঝরাস্তা ধরে দু পা এগোল। নাহ, অন্য লোক।

কন্দর্পর চিন্তা হচ্ছিল। যত মাতালই হোক, যেখানেই থাকুক দাদা ঠিক বাড়ি ফিরে আসে। একদিনই ফেরেনি শুধু।

কোথায় গেল দাদা!

.

৬৮.

ইন্দ্রাণীদের স্টাফরুমের টয়লেটটা ভারি অপরিচ্ছন্ন। বুড়ি জমাদারনির রোজই পরিষ্কার করার কথা, নিয়ম মাফিক ঝাড় বুলিয়েও যায়, কিন্তু বড় আলগা আলগা। জন্মে ফিনাইল পড়ে না, ব্লিচিং পাউডার ছড়ানো হয় না, শ্যাওলা আর দুর্গন্ধ ভরা ঘরটায় ঢুকলেই অন্নপ্রাশনের ভাত উঠে আসে। ইন্দ্রাণীরা ঠাট্টা করে বলে ও ঘরে তাদের বিশ্বরূপ দর্শন হয়।

আজ ইন্দ্রাণীর কোনও অনুভূতিই নেই। হলদেটে ছোপ ধরা বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে জোর জোর জলের ঝাপটা দিচ্ছে মুখে। কখনও যা হয়নি আজ ক্লাসে তাই ঘটে গেল, আগের পিরিয়ডে চেয়ারে বসে ঢুলছিল ইন্দ্রাণী। মেয়েরা নিশ্চয়ই হাসাহাসি করছে নিজেদের মধ্যে! ছি ছি, কী বিশ্রী! ঢুলুনির আর দোষ কি, কাল সারা রাত দু চোখের পাতা এক হল কই! যতবার একটু তন্দ্রা নামে, সামান্যতম শব্দে ঘোর ছিঁড়ে যায়। মানুষটা ফিরল কি! তিতিরও রাতে কতবার যে বিছানা ছেড়ে উঠল। বারবার বাথরুমে যায়, বারান্দায় গিয়ে দেখে আসে, শুয়ে শুয়ে এপাশ ওপাশ করে। এই টেনশানের মাঝে কী পরীক্ষা যে দেবে! আদিত্যর কি কোনও কালে আক্কেল বুদ্ধি বিবেচনা হবে না! মাতাল হোক, বেভুল হোক, খোঁয়াড়ে তো ফিরে আসেই, হঠাৎ কোন খেয়ালে নিপাত্তা হল সারা রাত!

সেলিমপুরে আসার পর থেকেই আদিত্যর আচার-আচরণ সুবিধের ঠেকছে না ইন্দ্রাণীর। কথাবার্তা প্রায় বলেই না, যখন তখন বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়, যে টুকুনি সময় বাড়িতে থাকে নিজের ঘরের দরজা বন্ধ। খাওয়া-দাওয়ারও ঠিক নেই, মদ আবার নিত্যসঙ্গী হয়েছে, এবার পেটে ব্যথাটা উঠলেই মোলো কলা পূর্ণ হয়। তাও ইন্দ্রাণী এসবে অভ্যস্ত, অনেক কাল আগেই কপালের লিখন হিসেবে মেনে নিয়েছে সব কিছু। কিন্তু কাল রাতের ব্যাপারটা…! ফিরলই না!

কেন এমন করছে লোকটা! বাবার শোকে? বাড়ি ভাঙার দুঃখে? ওসব শোক দুঃখ তো দিব্যি সামলে নিয়েছিল, আবার নতুন করে উথলে উঠল কেন? ভাবে কী আদিত্য? চার পাশের মানুষরা সবাই অপার সুখের সাগরে ভাসছে, শুধু সে একাই ভাজা ভাজা হচ্ছে দুঃখে? বয়স তো অনেক হল, এখনও এই খোকামো কেন? স্বার্থপর, ভীষণ স্বার্থপর, নিজেরটুকু ছাড়া দুনিয়াতে আর কারুর কথাই ভাবতে শেখেনি লোকটা।

তোয়ালে রুমালে মুখ মুছে ইন্দ্রাণী একটু সময় আয়নার দিকে তাকিয়ে রইল। মলিন দর্পণে বিম্বিত হয়েছে এক বিষণ্ণ মুখ। চোখের নীচে কালির আভাস, সিঁথির কাছে উঁকি দিচ্ছে একটা দুটো রুপোলি চুল। জীবনের অনেকটা পথ তো পার হয়ে এল ইন্দ্রাণী, প্রায় চল্লিশটা বছর। তার অর্ধেকটাই তো কাটল ওই বাউণ্ডুলে মানুষটার সঙ্গে। কেন কাটল? বহু কাল আগেই তো আদিত্যর সঙ্গে সম্পর্ক ছিঁড়ে ফেলতে পারত ইন্দ্রাণী। কেন ছেড়েনি? সংস্কার? তার তো তেমন কোনও প্রথাগত সংস্কার নেই! পুজো প্যান্ডেলে সুন্দর প্রতিমা দেখে হাত জোড় করা ছাড়া আর তো কখনও কোনও ঈশ্বরের কাছে মাথা নোয়ায়নি ইন্দ্রাণী! তার কোনও অন্ধ ভক্তি নেই, সমাজের নীতি নিয়ম তাকে শিকল পরাতে পারে না। চলে গেলেই হত। তিতির হওয়ার পরেও তো তার চলে যাওয়ার কোনও বাধা ছিল না। ছেলেমেয়ে নিয়ে একাই নয় কাটাত জীবনটা। কেন গেল না? তিতির হওয়ার পর তার তো চাকরিও জুটে গিয়েছিল, তবু পড়ে রইল কেন? শুভর ওপর অভিমানে, ক্ষোভে? শুভকে শিক্ষা দিতে চেয়েছিল? শুভকে যন্ত্রণা দিতে চেয়েছিল? শাস্তি দিতে চেয়েছিল? কীসের শাস্তি? দুর্বল ভীরু শুভকে সে তো অনেক আগেই ক্ষমা করে দিয়েছিল, নিজেই নতুন করে ধরা দিয়েছিল শুভর কাছে, তাহলে? তবে কি অপরাধবোধ? শুধু আদিত্যকে কেন, তাদের গোটা পরিবারকেই প্রতারণা করেছিল ইন্দ্রাণী, সেটাকেই চোখে আঙুল বিধিয়ে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিল তনুময়, তাই কি ইন্দ্রাণী আর নড়তে পারল না? বাজে কথা। এর উল্টোটাই ছিল স্বাভাবিক। তাতে প্রতারণার মাত্রাটা কিছু কম হত। নাকি ইন্দ্রাণী ভয় পেয়েছিল? আদিত্যকে ছেড়ে চলে যেতে গেলে স্বপক্ষে কিছু যুক্তি সাজাতে হয়। বলতে হয় আদিত্য অকর্মণ্য অপদার্থ, তার সঙ্গে আর বনল না। কিন্তু তনু ফিরে এলে ওই যুক্তিও ফাঁপা হয়ে যেত না কি?

দুর, এ ভাবনারও কোনও অর্থ হয় না। তনু তার মরাল গার্জেন নয়। তার কাছে আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনও দায় নেই ইন্দ্রাণীর। কারও সঙ্গে কোনও সম্পর্ক না রেখেও একা জীবন কাটানোর মতো মনের জোর ইন্দ্রাণীর আছে।

তা হলে সে রয়ে গেল কেন? কিসের মায়ায়? কার ওপর টানে?

পৃথিবীর কোথাও কোনও এক গোপন কোণে পড়ে আছে এক তেজস্ক্রিয় কণা। তার আশ্চর্য বিকিরণে নিঃসাড়ে দগ্ধ হচ্ছে মানুষ। যে দগ্ধ হচ্ছে সে কি নিজেও টের পায়!

আজ শনিবার। টিফিনেই স্কুল ছুটি হয়ে গেছে। স্টাফরুমে ফিরে ইন্দ্রাণী দেখল ঘর প্রায় ফাঁকা। শুধু এক কোণে বসে নিবেদিতা আর শেফালি নিচু গলায় কথা বলছে।

ব্যাগ কাঁধে তুলেও ইন্দ্রাণী চেয়ারে বসল। সকালে কি একবার থানাতেই যাওয়া উচিত ছিল? কিংবা হাসপাতালে? যদি কোথাও অ্যাক্সিডেন্ট করে পড়ে থাকে! মাতাল-দাঁতালরা অবশ্য সহজে গাড়ি চাপা পড়ে না, অন্তত ইন্দ্রাণী শোনেনি। কালকেও কি আকণ্ঠ গিলেছিল লোকটা? চাঁদু একবার রাতে থানার কথা তুলেছিল বটে, ইন্দ্রাণী বিশেষ গা করেনি। কি দরকার, নতুন পাড়ায় দু দিনের জন্য থাকতে এসে যদি একটা লোকসানো কাণ্ড ঘটে যায়! শ্বশুরমশাই মারা যাওয়ার রাতেও তো…। এখন মনে হচ্ছে চাঁদুকে খোঁজ নিতে বললেই হত। দুম করে স্কুলে বেরিয়ে পড়াটাও আজ বোধহয় ঠিক হয়নি।

কমলিকা হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকল, – একি, তুমি এখানে! মাইনে নেবে না?

–এই যাই।

তাড়াতাড়ি যাও। শনিবারের ব্যাপার, দেরি করলে কথা শোনাবে।

ইন্দ্রাণী অফিসঘরের দিকে এগোল। কমাস ধরে ঠিক দিনে মাইনে হচ্ছে না, প্রতিবারই কোনও কোনও ফ্যাকড়া বাঁধছে। কখনও ডি আই অফিস থেকে টাকা আসে না, কখনও বা বিলে অবজেকশান পড়ে। এবারও ঘষটে ঘষটে মাসের বারো তারিখ করে দিল। মাঝে এক-দু বছর বেশ নিয়মিত হচ্ছিল মাইনেটা, আবার যে কী শুরু হল! মাইনে না পেলে যে ইন্দ্রাণীর হাঁড়ি চড়বে না তা নয়, মাস গেলে হাজার টাকার ওপর সুদ আসে, চাঁদুও আজকাল মোটামুটি ভালই টাকা দেয়, ভাড়ার টাকাও মুস্তাফির কাছ থেকে এসে যায়, তবু নিজের মাইনের টাকা কটা হাতে না আসা পর্যন্ত কেমন নিঃসম্বল লাগে নিজেকে।

অফিস ঘরে এখনও দিব্যি জটলা চলছে। অণিমা আর রেবা রথীনের টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে। রথীন কি সব বলছে হাত নেড়ে, সবাই মন দিয়ে শুনছে। মনোহরবাবুর হাঁড়িমুখ ভাবটা নেই আজ, বরং বেশ প্রসন্নই। মাইনের দিন বুঝি এমনটাই হয়!

ইন্দ্রাণীকে দেখে রথীন গাল ছড়িয়ে হাসল, –একটু দাঁড়াতে হবে যে দিদিমণি।

 ইন্দ্রাণী ঘড়ি দেখল, কতক্ষণ?

যতক্ষণ না এই কাজটা সারতে পারি। তারপর এই দিদিমণিরা রয়েছেন।

 গল্প করাটাও কাজ! ইন্দ্রাণী বিরক্তি সামলে মনোহরবাবুর টেবিলে এসে বসল। গলা নামিয়ে বলল, আপনার ছেলের একটা ভাল খবর শুনছিলাম…

–ভাল মানে মন্দের ভাল। পড়াশুনো তো আর হবে না, ভায়রাভাইকে ধরে সেলস লাইনে ঢুকিয়ে দিলাম। মাইনেপত্র বেশি না, ছোট চাকরি। তাও কোনও একটা কাজে তো এনগেজড থাকুক।

–তাহলে আপনার বড় চিন্তাটা ঘুচল?

–মনে তো হয়। দেখি। আবার মতি বিগড়োতে কতক্ষণ! কদিন অবশ্য খুব ব্রিফকেস নিয়ে বেরোচ্ছে, ফিরছে সেই রাতে। মুখ চোখও এখন অনেক ঝকঝকে। দেখা যাক, যদি এভাবেই কেরিয়ার করে নিতে পারে। এখন তো বেচনেঅলাদেরই যুগ।

অন্যের একটা ভাল খবর শুনলে মন যেন অনেকটা হালকা হয়ে যায়। মনোহরবাবুকে দেখছিল ইন্দ্রাণী। রামগরুড় লোকটা কী অদ্ভুত বদলে গেছে। এই তৃপ্তিটুকুর আশাতেই বুঝি মানুষ সংসার গড়ে। হাসি মুখে ইন্দ্রাণী বলল, তাহলে একদিন মিষ্টি খাওয়ান।

–নিশ্চয়ই খাওয়াব। কবে খাবেন বলেন।

রথীন টাকা গোনা থামিয়ে টিপ্পনী ছুঁড়ল, বড়বুরটা পরে হবে দিদিমণি। আপনি কবে আমাদের মাংসভাত খাওয়াচ্ছেন?

অণিমা প্রায় নেচে উঠল, ঠিকই তো, ঠিকই তো। তোরই আগে খাওয়ানো উচিত। ছেলে বিদেশ থেকে ডলার পাঠাচ্ছে…।

–শুধু কি ছেলের ডলার! রেবা চোখ ঘোরাল, প্রোমোটার ফ্ল্যাট বানিয়ে দিচ্ছে না? তারপর ধরো ইন্দ্রাণীদির দেওর তো এখন উত্তমকুমার।

-সত্যি ইন্দ্রাণী, তোর এখন তুঙ্গে বৃহস্পতি।

ইন্দ্রাণী মুখ টিপে হাসল। বৃহস্পতি, কি শনি, বাইরের লোক কি বুঝবে! তবে শনিও চড়চড়িয়ে সমৃদ্ধি বাড়িয়ে দেয়, বাপ্পার ডলার তো এখনই টাকা হয়ে বাপ্পার অ্যাকাউন্টে জমতে শুরু করেছে। শেষ চিঠিতেও ইন্দ্রাণীর সঙ্গে একটা জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট খোলার জন্য ফর্ম পাঠাতে বলেছে বাপ্পা। যাতে দরকার মতো ইন্দ্রাণী টাকা তুলতে পারে। ছেলের চিঠির উত্তর দিয়েছে ইন্দ্রাণী, ফর্ম পাঠায়নি। বাপ্পার যে উগ্র আত্মসর্বস্ব রূপ দেখেছে, মনে হয়েছে তার টাকাতে হাত না দেওয়াই ভাল। হয়তো হাত পুড়ে যাবে। এই যে চিন্তা ঘোরে মাথায়, এ কার মহিমায়? বৃহস্পতি, না শনির?

ইন্দ্রাণী স্মিত মুখে বলল, খাওয়াব তো বটেই। কিন্তু এখন না।

কবে? কবে?

নতুন ফ্ল্যাটে আগে যাই, তারপর।

–সে তো ঢের দেরি। এক দুবছর লেগে যাবে।

–তোমার ছেলে এর মধ্যে আসবে না? সে এলে খাওয়াও।

ইন্দ্রাণী মনে মনে হিসেব করল। আট মাসের আগে জাহাজ থেকে ছুটি পাবে না বাপ্পা, তার মানে সেই জানুয়ারির শেষ। আলগাভাবে বলল, – তাই হবে। ফিরুক তো ছেলে।

–দেখো, ফাঁকি দেওয়ার মতলব কোরো না যেন।

.

রাস্তায় ঝাঁঝাঁ রোদ। বড় বড় সাইজের সাদা মেঘ হেলে দুলে হাঁটছে আকাশে। হাওয়া নেই, চিটচিটে গরম। দু পা চললেই ঘামে শরীর জবজবে হয়ে যায়। সেলিমপুর বাস স্ট্যান্ড থেকে বাড়ি এখন অনেকটাই পথ, অন্য দিন হেঁটে ফেরে ইন্দ্রাণী, আজ রিকশা নিয়ে নিল। বেল বাজানোর আগে সন্দিগ্ধ বুকে আঁচ করার চেষ্টা করল, ফিরেছে কি লোকটা!

সন্ধ্যার মা দরজা খুলেছে। এ বাড়ি থেকে তার গোবিন্দপুর বস্তি বেশ দূর, দুপুরে তাই আর বাড়ি ফেরে না, রুটিটুটি সেরে একেবারে সন্ধেবেলা চলে যায়। একদিক থেকে ভালই হয়েছে, বাড়িটা পাহারায় থাকে।

ইন্দ্রাণী প্রশ্ন করার আগেই সন্ধ্যার মা বলে উঠল, -বড়দা এসে গেছে।

খবরটাতে ইন্দ্রাণীর স্বস্তি পাওয়ার কথা। পেলও। মুহূর্তের জন্য। পরক্ষণে অসংখ্য প্রশ্ন বিজবিজ করে উঠেছে মাথায়। আদিত্য রাতে ফেরেনি এ কথা সন্ধ্যার মা কার কাছে শুনল? ইন্দ্রাণী যখন স্কুলে বেরোয় তখনও তো সন্ধ্যার মা আসেনি! তিতির, চাঁদু কি খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল? সন্ধ্যার মার সামনে একটু সতর্ক থাকা উচিত। রাজ্যের কাজের মেয়েদের সঙ্গে সন্ধ্যার-মার ভাব। কাকে কি বলবে, পাড়ায় কি রটে যাবে তার ঠিক আছে!

গ্রিলের গেট পেরিয়ে বারান্দায় উঠল ইন্দ্রাণী। আলগোছে প্রশ্ন করল, –কটায় ফিরল?

–এই ধরো গিয়ে আটটায়। ছোড়দা তখন চা খাচ্ছিল।

 –কোথায় এখন? আবার খেয়েদেয়ে বেরিয়ে গেছে?

না না, এসে ইস্তকই তো শোওয়া। দিদিমণি বেরিয়ে যাওয়ার পর থেকেই তো ঘুমোচ্ছেন।

তিতিরের আজ পরীক্ষা নেই। কোন বন্ধুর বাড়ি যাওয়ার কথা, একসঙ্গে কজন মিলে পড়াশুনো করবে। সেখানেই খাবেদাবে, ফিরবে বিকেলে। পরীক্ষার মাঝে এসব যে কী ঢঙ-এর পড়া! ইন্দ্রাণী জিজ্ঞাসা করল, দিদিমণি কটায় বেরোল?

–এই তো খানিক আগে। সন্ধ্যার মা গলা নামিয়েছে, মেয়ের সঙ্গে বাপের আজ জোর ঝগড়া হয়েছে। রাগ করে দিদিমণি খেয়ে বেরোয়নি।

ইন্দ্রাণী কথা বাড়াল না। সোজা আদিত্যর ঘরে ঢুকেছে। চিত হয়ে শুয়ে গাঁক গাঁক নাক ডাকাচ্ছে নোকটা। পরনে এখনও কালকের পোশাক। গোড়ালিতে কাদার দাগ, শুকনো।

পিত্তি জ্বলে গেল ইন্দ্রাণীর। দুহাতে ঠেলল আদিত্যকে, এই যে, ওঠো ওঠো।

আদিত্য একটা হাই তুলে পাশ ফিরল, হাঁটু নেড়ে নেড়ে পাশবালিশ খুঁজছে।

কী হল কি, উঠতে বলছি না!

আদিত্য জড়ানো গলায় কি যেন শব্দ করল। আবার নাক ডাকছে। বিরক্ত মুখে হাল ছেড়ে দিল ইন্দ্রাণী। ঘরে ফিরে খানিকক্ষণ ঝুম হয়ে বসে রইল পাখার তলায়, তারপর শাড়ি বদলে বাথরুম।

এ বাড়িতে স্নানের ঘরটা বড্ড ছোট, হাত ছড়ালে দেওয়ালে হাত ঠেকে যায়। শাওয়ার একটা লাগিয়ে দিয়েছে বাড়িঅলা, কিন্তু সেটা চালালে রডে ঝোলানো তোয়ালে শাড়ি জামা ভিজে সপসপে হয়ে যায়। কলের তলায় বালতি বসিয়ে হড়াস হড়াস গায়ে জল ঢালল ইন্দ্রাণী। শরীর জুড়োল না। কলের তলায় মাথা রেখে জল থুপল মাথায়, তবু আগুন নেভে না। চেপে চেপে গা হাত পা মুছল, তবু যেন দেহ শুকোয় না।

একাই খেতে বসেছে ইন্দ্রাণী, কন্দর্প ফিরল। হাত ধুয়ে বসে গেছে ইন্দ্রাণীর পাশে, বস কি এখনও ঘুমের সিন দিচ্ছে?

রান্নাঘরের দিকে তাকিয়ে ন্ধ্যার মাকে একবার দেখে নিল ইন্দ্রাণী। চাপা কঠিন স্বরে বলল, তোমার মজা লাগছে মনে হচ্ছে!

কন্দর্পর উচ্ছ্বাস যেন ঈষৎ কমল। তবু লঘু ভাবেই বলল, – যাই বলো, বড় সাহেবের কিন্তু গাটস আছে। সারা রাত আমাদের ঘুম চটকে দিয়ে কেমন নাক বাজিয়ে নিদ্রা যাচ্ছে। তোমার মতো কেউ ঘরে থাকলে আমি তো বাপু এসেই খাটের তলায় ঢুকে বসে থাকতাম।

ইন্দ্রাণী শীতল চোখে তাকাল, বাবু রাত্তিরে ছিলেন কোথায়?

রঘুবীর চাটুজ্যের প্রাসাদে। সেখানে খুব টানুস-টুনুস হয়েছে।

বলল?

বলে কি আর! তিতির টেনে পেট থেকে বার করল। দেখেও বোঝা যাচ্ছিল। চোখ একেবারে জবাকুসুমসঙ্কাশ…

–তুমি কিছু বলনি?

বাপস, তোমার মেয়ে একাই যা ঝাড় দিল! তিতির আমাদের আর মুখচোরাটি নেই, বেশ প্যাটর প্যাটর শোনাতে পারে।

বাপও শুনলাম খুব ঝগড়া করছিল?

-ঝগড়া ঠিক নয়। ডিফেন্স নিচ্ছিল।

–কী ডিফেন্স?

 –আমার ভাল লাগে না। … যেখানে খুশি যাব।… তোরা বসে থাকিস কেন?

 ইন্দ্রাণীর হাত অন্যমনস্ক, ভাতে ঝোল মাখছে। সন্ধ্যার মাকে ডেকে কন্দর্প আর একটু আলুভাজা নিল। খেতে খেতে বলল, আমার কি মনে হয় জানো বউদি, বড়সাহেবের অ্যান্টেনাটা বোধহয় আবার লুজ হয়ে গেছে।

কচু হয়েছে। মাঝে কটা মাস বেশ ছেড়েছুড়ে ছিল, ভাল ছিল। এখন আবার নেশাড়ু হওয়ার বাহানা খুঁজছে।

— না বউদি, এবার কেসটা ঠিক জলবৎ নয়। কন্দর্প হঠাৎ সিরিয়াস, জানো, দাদা আজকাল কি সব কাণ্ডকারখানা করছে! আমাদের বাড়িটা ভাঙা চলছে, ওখানে গিয়ে সারাদিন…

কন্দর্প সবই খুলে বলল। ইন্দ্রাণী শুনল মন দিয়ে। একটু যেন ছায়াও ঘনাল মুখে। কাল সকলকেই বদলায়, লোকটাই চিরকাল এক রয়ে গেল। নিজেই নিজের মধ্যে দুঃখ রচনা করে, শোক পালে পোষে, নিজেরই সৃষ্টি করা বৃত্তে অবিরল ঘুরপাক খায়। অন্য কারুর মনে কী চলছে তা নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই।

কন্দর্প দু-এক সেকেন্ড চুপ থেকে বলল, – দাদাকে কি একবার সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাবে?

হবেটা কী? এ সব কি আর নতুন? ইন্দ্রাণী উঠে বেসিনে গেল, মা চলে গেলেন, অন্ন জল ত্যাগ করল। বাবা মারা গেলেন, দেওয়ালে মাথা ঠুকল। অথচ তাঁরা বেঁচে থাকতে তাঁদের দগ্ধে দন্ধে মেরেছে। ওসব যখন সামলেছে, এটাও সামলে যাবে। সবেতেই ওভার রিঅ্যাক্ট করা ওর স্বভাব।

–তবু একবার দেখিয়ে নিলে পারতে।

ইন্দ্রাণী উত্তর না দিয়ে ঘরে চলে এল। অতই যদি দাদাকে নিয়ে ভাবনা, নিজেরা একটু দায় ঘাড়ে নাও না! ডাক্তার দেখালে যদি কিছু উপকার হয়, ইন্দ্রাণী তো বেঁচে যায়। তবে ইন্দ্রাণী আর যেচে ওই মানুষের বোঝা ঘাড়ে নেবে না। অনেক হয়েছে, অনেক শিক্ষা হয়েছে। ওই লোকের মুখ চেয়ে চাকরি সংসার সামলে প্রেসের জোয়ালটা পর্যন্ত কাঁধে তুলেছিল, তাতেই বা কী লাভ হয়েছে! নিজের শোক কেটে যাওয়ার পর ওই লোকই প্রেস বন্ধ করতে উঠে পড়ে লেগেছিল। বাড়ি ভাঙা নিয়েও যথেষ্ট বুঝিয়েছে ইন্দ্রাণী, তার পরও উনি যদি ঘোরে ডুবে যান, ইন্দ্রাণীর কি করণীয় আছে! আর নয়, আর নয়। এবার ওই মানুষটা মরুক পচুক গলুক হেজে যাক, ইন্দ্রাণী আর ফিরেই তাকাবে না।

কন্দর্প পর্দার ওপাশ থেকে ডাকছে, শুয়ে পড়লে?

না। এসো।

–তোমাকে একটা কথা বলার ছিল।

বলো।

কন্দর্প ইন্দ্রাণীর মুখের দিকে একটু তাকিয়ে রইল। একবার খাটে গিয়ে বসল, আবার উঠে পড়ল।

ইন্দ্রাণী অধৈর্যভাবে বলল, -কী বলবে বলল।

 কন্দর্প চুলে হাত বোলাল, আমি একটা গাড়ি কিনছি বউদি। নতুন না, সেকেন্ড হ্যান্ড।

ভাল। তোমার কাজকর্মে সুবিধে হবে।

–শুধু ভাল বলছ কেন? উইক এন্ডে আমরা বেড়াতে যেতে পারি।

–হুঁ। ইন্দ্রাণী হাই তুলল। আলগোছে একটা বালিশ ফেলল বিছানায়।

কন্দর্প তাও দাঁড়িয়ে আছে। ভাবছে কি যেন।

ইন্দ্রাণী বলল, – আর কিছু বলবে?

না থাক, পরে বলব। দরজায় গিয়ে তিলেক দাঁড়াল কন্দর্প।

–হেঁয়ালি করছ কেন? কিছু বলার থাকলে বলে ফেলল। আমি এবার শোব। ঘুম পাচ্ছে।

কন্দর্পর ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি, থাক গে। তোমার আজ মনমেজাজ ভাল নেই। পরেই শুনো। … আমি বেরোচ্ছি।

কন্দর্প চলে গেল। তার আচরণের মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝল না ইন্দ্রাণী। কি বলতে চাইছিল? গাড়ি কেনার কথাটা তো ভূমিকা, অন্য কী কথা ছিল? মরুক গে যাক।

এতাল বেতাল ভাবতে ভাবতে কখন চোখ জড়িয়ে এসেছিল, ঘুম ভাঙল সন্ধ্যার মার ডাকে, চা খাবে না বউদি?

চোখ কচলে উঠে বসল ইন্দ্রাণী। হাত বাড়িয়ে কাপ নিল। কান পেতে এক সেকেন্ড শোনার চেষ্টা করল পাশের ঘরে এখনও নাক ডাকার শব্দ হচ্ছে কিনা। বুঝতে পারল না। জিজ্ঞাসা করল, -বড়দা উঠেছিল? খেয়েছে?

–ওমা, কখন। উনি তো চ্যান করে খেয়ে দেয়ে বেরিয়ে গেলেন।

চড়াং করে মাথায় রক্ত চড়ে গেল ইন্দ্রাণীর, তুমি আমায় ডাকলে না কেন?

সন্ধ্যার মা অবাক চোখে তাকাল। যেন এমন অদ্ভুত কথা সে সাতজন্মে শোনেনি। তোতলা স্বরে বলল, -বড়দা বেরোচ্ছে বলে তোমায় ডাকব?

ইন্দ্রাণী দাঁতে দাঁত ঘষে রাগটা সামলাল। ভেবেছে কি লোকটা? এটা চিড়িয়াখানা, না হোটেল? এ যেন সব সীমা পার হয়ে যেতে চায়। তাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে, প্রায় অপমান করে বেরিয়ে গেল লোকটা! এত স্পর্ধা!

ডিশে চা ঢেলে তিন চুমুকে কাপ নিঃশেষ করল ইন্দ্রাণী। ক্রূর চোখে পাখাটার দিকে তাকাল। ঘুরছে পাখা, হাওয়া লাগছে না। উঠে গ্রিল বারান্দায় মোড়া নিয়ে বসেছে। অর্থহীন চোখে দেখছে বাইরের পৃথিবী। রাস্তা দিয়ে অবিরাম রিকশা চলেছে, হর্নের শব্দে কানে তালা লাগার জোগাড়। বুনো রাগে সেই শব্দও দূরাগত ধ্বনির মতো লাগছিল ইন্দ্রাণীর। উল্টো দিকেই একটা ল্যাম্পপোস্ট, তার নীচে দাঁড়িয়ে কথা বলছে তিনটে ছেলে। তাদেরকেও যেন বিন্দুর মতো লাগে। যেন বায়নোকুলার উল্টে দেখছে ইন্দ্রাণী। পোকা মাকড়ের মতো হাঁটছে মানুষ। চলমান ফুটকিতে ভরে আছে রেখার মতো রাস্তা। আকাশে ক্লান্তির ছাপ, দিন বুঝি ফুরিয়ে এল।

সংবিৎ ফিরল তিতিরকে দেখে। গ্রিল দরজায় দাঁড়িয়ে আছে মেয়ে। খোলা চুল উমনো ঝুমনো, মুখে কালচিটে ভাব, কুঁচকে আছে ভুরু।

কী হল, দরজাটা খোলো না। বাথরুম পেয়েছে।

ইন্দ্রাণী উঠে দরজা খুলতেই সাঁ করে তিতির অন্দরে ঢুকে গেছে। দু মিনিটে বেরিয়ে এল। আরও দ্রুত পায়ে, বাবা নেই?

ইন্দ্রাণী ঘুরে তাকাল। মেয়ের চোখে যত না বিস্ময়, তার থেকে বেশি ঝাঁঝ। তীক্ষ্ণ স্বরে ইন্দ্রাণী বলল, — আছে কিনা দেখতে পাচ্ছিস না?

–বেরিয়ে গেল? তিতির যেন কৈফিয়ত চাইছে, বারণ করতে পারলে না? আটকালে না?

–তোর বাবা কি শিশু, যে বেঁধে রাখব!

জানো বাবার কী শরীর খারাপ? মাথার যন্ত্রণা হচ্ছিল, আমার কাছ থেকে ট্যাবলেট নিয়ে খেল?

এর সঙ্গে নাকি ঝগড়া হয়েছে! যত সব ন্যাকামো কথা! ইন্দ্রাণী চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, – নিকুচি করেছে অমন শরীর খারাপের।

–সে তো তুমি বলবেই। আমি কি তোমাকে চিনি না!

কী বললি তুই? কী বললি?

–ঠিকই বলেছি। তুমি চাও বাবা রাস্তায় রাস্তায় ঘুরুক। বাবা বাড়ি ফিরবে কেন? কী আছে এই বাড়িতে?

–ফেরার দরকার নেই। নর্দমায় পড়ে থাক। মুদ্দোফরাশে টেনে নিয়ে যাক।

বটেই তো। তবেই না তোমার…

 সহসা তিতির থেমে গেল। সঙ্গে সঙ্গে যেন চারপাশের সব আওয়াজও ঝুপ করে থেমে গেছে। অনন্ত এক নৈঃশব্দ্যের পাথর পিষে ফেলছে সমস্ত কোলাহল। রাস্তার আলোরা জ্বলে উঠছে দ্যুতিহীন। এত তাড়াতাড়ি অন্ধকার নেমে গেল!

.

৬৯.

রামনগরে আজ রই রই কাণ্ড। কাতারে কাতারে মানুষ জড়ো হয়েছে ফুটবল মাঠে। মাঠের ঠিক মধ্যিখানে বানানো হয়েছে এক বিশাল মঞ্চ, চতুর্দিক মাইকে মাইকে ছয়লাপ। গোটা মঞ্চ মোড়া হয়েছে গেরুয়া সবুজ কাপড়ে, পাশেই জ্বল জ্বল করছে প্রকাণ্ড এক পদ্মফুল। পিচবোর্ডের। এমন সভা এ-অঞ্চলের মানুষ আগে কখনও দেখেনি। দিল্লি কলকাতা থেকে বেশ কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা এসেছেন, তাঁদের সঙ্গে মঞ্চে বসে আছেন দু-তিনটি সাধু। গেরুয়া বসন পরা এক মুণ্ডিত মস্তক মহিলা হিন্দিতে বক্তৃতা করছেন। তার বক্তৃতার বিষয়টিও ভারী অভিনব। শ্রীরামচন্দ্রের জন্মভূমি অযযাধ্যায় সাড়ে চারশো বছরেরও আগে হানা দিয়েছিল এক মুসলমান বাদশা, ঠিক যে জায়গাটিতে রামচন্দ্র জন্মেছিলেন সেইখানে নাকি এক মসজিদ বানিয়ে ছিলেন তিনি, সেই বিধর্মীর মসজিদ ধ্বংস করে রাম মন্দির প্রতিষ্ঠাই সন্ন্যাসিনীর অভিলাষ। জনসমুদ্র মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছে তার ওজস্বিনী বক্তৃতা। দু-চার জন বয়স্ক মানুষ কানাকানি করছেন, সতেরো বছর আগে একবার দেশের প্রধানমন্ত্রী এসেছিলেন তারকেশ্বরে, তার পরে হুগলি জেলার আর কোনও মিটিংয়েই এত জনসমাগম দেখা যায়নি। একই মঞ্চে দেশনেতা আর সাধুদের দেখার অভিজ্ঞতাও এ অঞ্চলে এই প্রথম।

তুফানও গেঁথে আছে মিটিংএ। শেষ দুপুরে মনোরমার জন্য একটা হটওয়াটার ব্যাগ কিনতে এসেছিল রামনগরে, ফিরতে পারেনি, কৌতূহলে থেকে গেছে। রাজনৈতিক দলের মিটিং-এ সে বড় একটা যায় না, ভোটের মিটিং-এও না। আজ তারও নট নড়ন চড়ন দশা।

শিবসুন্দর বাড়িতে বসে ছটফট করছিলেন। ঘড়ি দেখছিলেন ঘন ঘন। বিকেল বিকেল দুধগঞ্জ থেকে ঘুরে আসতে পারলে হত। পরশু হরি গুছাইতের বাড়ি কলে গিয়েছিলেন, হরির ছেলেটার জ্বর ছাড়ছে না কিছুতেই। রক্ত পরীক্ষা করিয়েছিল, ম্যালেরিয়ার জীবাণু পাওয়া যায়নি। কাঁপুনি-টাপুনিও দিচ্ছে না বিশেষ। তবু শিবসুন্দরের সন্দেহ যায়নি। তার ধারণা ওটা ম্যালেরিয়াই, রক্তে নিশ্চয়ই ফ্যালসিপেরাম আছে, খুব হাই টেম্পারেচারে রক্ত পরীক্ষা না করালে রোগ ধরা যাবে না। তেমনভাবে কি রক্ত পরীক্ষা করা যায় এই গ্রামদেশে! তারকেশ্বরেও কি হয়! এই ম্যালেরিয়াটার প্রাদুর্ভাব কম, তবে ইদানীং দু-চারটে কেসের কথা পড়ছেন কাগজে। রোগটা প্রায় নির্মূল হয়ে গিয়েছিল, আবার ফিরে এল। মনে পড়ে এই রুগী তিনি শেষ পেয়েছিলেন মালদা জেলায়, হবিবপুরে। অসুখটা একেবারে শক্তি নিঃশেষ করে দেয়, ব্রেন অ্যাটাক করে, চিকিৎসার সামান্য দেরি হলে পরিণাম অবশ্যম্ভাবী মৃত্যু। ব্লাড রিপোর্ট অগ্রাহ্য করেই হরির ছেলেকে পরিমাণ মতো কুইনিন দিয়েছেন শিবসুন্দর। আজও যদি জ্বর না ধরে তবে জলদি জলদি বাচ্চাটাকে কলকাতা পাঠাতে হবে।

দাওয়ায় সাইকেল রাখা আছে। চেন দিয়ে আটকানো। উঠোনে খেলা করছে টুকি, অপরাজিতার লতা থেকে ফুল ছিঁড়ে ছড়াচ্ছে। শিবসুন্দর ডাকলেন, – টুকি, আই টুকি…

টুকি দৌড়ে এল, কি দাদু?

 –তোর মা কোথায় গেল?

–মা তো পুকুরপাড়ে। হাঁসেদের ঘর ধুচ্ছে। ডাকব?

এক পলক থমকালেন শিবসুন্দর। মাত্র তিন দিনের মড়কে সব কটা হাঁস মরে গেছে, অলকার কদিন ধরে তাই খুব মন খারাপ। আজ আবার খাঁচা পরিষ্কার করতে বসল কেন? আবার পুষবে হাঁস! উঁহু, শিবসুন্দর তা আর হতে দেবেন না। এক সময়ে ভাবতেন মৃত্যু দেখে দেখে বুঝি তার হৃদয় কঠিন হয়ে গেছে। চোখের সামনে অবলা জীবগুলোর ওই অসহায় মৃত্যু প্রমাণ করে দিয়েছে তিনি ভুল। এখনও মৃত্যু তাকে আহত করে।

শিবসুন্দর বললেন, ডাকতে হবে না। মাকে জিজ্ঞেস করে আয় সাইকেলের চাবিটা কোথায়।

 টুকির পিছু পিছু অলকা এসেছে, সাইকেল দিয়ে আপনার কী হবে বাবা?

 তুফান তো এখনও ফিরল না, ভাবছি একবার দুধগঞ্জ থেকে ঘুরে আসি।

–অতটা পথ আপনি সাইকেলে যাবেন! একা! আপনার ছেলে আপনাকে একা সাইকেল নিয়ে বেরোতে বারণ করেছে না!

তুফান বারণ করেছে, না তুমি তুফানকে উসকেছ?

অলকার দুঃখ-মাখা মুখখানায় হাসি ফুটল, ধরুন তাই। টুকির বাবা ফিরুক না।

–এ কিন্তু খুব অন্যায়। অন্য দিকে এখন কল এসে গেলে আমার আর দুধগঞ্জ যাওয়া হবে?

 –ওমা, কল নেই! তবু যাবেন! কেন?

–প্রয়োজন আছে। শিবসুন্দর ঈষৎ গম্ভীর।

–থাকুক। সন্ধে নামছে, এখন আমি আপনাকে একা একা বেরোতে দেবই না।

–এই করে করে তোমরা কিন্তু আমাকে অথর্ব করে দিচ্ছ।

অমন করছেন কেন বাবা? ও এক্ষুনি এসে যাবে।

শিবসুন্দর ক্ষুব্ধ হতে গিয়েও হেসে ফেললেন। অলকা তুফান আজকাল বড় বেশি নিষেধের বেড়াজাল তৈরি করেছে। সকালে সাড়ে এগারোটা বাজলেই চেম্বারের দরজায় অলকার গলা খাঁকারি শুরু হয়, বিকেলে কিছুতেই তুফান দুটোর বেশি কলে যেতে দেয় না, সকাল বিকেল হাঁটতে বেরোলেও এঁটুলির মতো লেগে থাকে তুফান, তারকেশ্বরে ছুটছাট যাওয়াটাও এদের চেঁচামিচিতে বন্ধ হয়ে গেল। সব সময়ে ভাল লাগে না, আবার হঠাৎ হঠাৎ কেন কে জানে চলকেও ওঠে মনটা। এই নিষেধগুলোর জন্যই বুঝি এতদিন পিপাসিত ছিল হৃদয়। কতকাল যে তাঁকে শাসন করার কেউ নেই!

এক পা এক পা করে শিবসুন্দর গেটের বাইরে এলেন। হাঁটছেন ধীর পায়ে। আমগাছের ওপারে ডুবে যাচ্ছে সূর্য। অপূর্ব এক রঙিন আলো ঠিকরোচ্ছে দিগন্তে। দূরের সাঁকো কমলা আলো মেখে কাঁপছে তিরতির। পুবের আকাশ প্রায় বর্ণহীন। এক শীতল চাঁদ ছায়ার মতো লেপটে আছে তার গায়ে। পৃথিবীতে শব্দ উঠছে খুব। মধুর শব্দ। পাখিরা নীড়ে ফিরছে।

খানিকটা পথ এগিয়ে শিবসুন্দর ফিরে তাকালেন। বাড়ির দিকে। সঙ্গে সঙ্গে শিহরন খেলে গেছে শরীরে, ধমনীতে রক্ত ছলাৎ করে উঠল। আলো-ছায়া মাখা দোতলার বারান্দায় ইজিচেয়ারে বসে আছেন মনোরমা। মনোরমা, না খড়ের প্রতিমা! বিশুষ্ক ওই শীর্ণ মুখের আভাস, স্থির অবয়ব, কৌণিক আলো-পড়া ছায়া-মাখা ওই বারান্দা, গারদের মতো সার সার রেলিং-এর শিক–যেন এক অলৌকিক স্থির চিত্র। প্রকৃতির রূপ দেখে কি এই মুহূর্তে কোনও বোধ জাগছে মনোরমার? মস্তিষ্কের কোনও কোষ কি চঞ্চল হল?

অসম্ভব। ছোট্ট শ্বাস ফেললেন শিবসুন্দর। এমনটি ঘটে না। তাও তো অনেকটাই উন্নতি হয়েছে, চব্বিশ ঘণ্টা আর শুইয়ে রাখতে হচ্ছে না। সকাল বিকেল নিয়ম করে বারান্দায় এনে বসানো হয়, বসেও থাকে মনো। একদিন অলকা হাঁটানোর চেষ্টাও করেছিল, খুব একটা সাড়া পাওয়া যায়নি। বছর দুয়েক আগেও দিব্যি হাঁটালে হাঁটত, দোতলা ওঠার আগের কমাস তো ধরে ধরে বাইরেও নিয়ে গেছেন শিবসুন্দর। আর কি পারবে? সব পেশিই তো শিথিল এখন। যতদিন বাঁচে, এই দশাটুকুই বা মন্দ কি! মনোরমা না পৃথিবী দেখুক, পৃথিবী অন্তত দেখুক মনোকে।

মনোরমার বাঁচা মরা নিয়ে আর ভাবতে ইচ্ছে করে না শিবসুন্দরের, তবু ভাবনাটা এসেই যায়। আরেকটা ভাবনাও ইদানীং টোকা দিচ্ছে শিবসুন্দরকে। টোটো এসে এবার মাথায় ঢুকিয়ে দিয়ে গেছে চিন্তাটা।

ছেলেটা বলছিল, দাদু, তুমি তো ঠাকুমার এত যত্ন করো, তুমি না থাকলে ঠাকুমার কী হবে?

শিবসুন্দর প্রশ্নটা বুঝতে পারেননি। বলেছিলেন, সে তো আমি কত সময় থাকিই না। তোর কাকা কাকিমা সামলায়।

–ঠিক তেমন নয়। টাচ উড, ধরো তোমার যদি কিছু একটা হয়ে যায়?

শিবসুন্দর হাসতে হাসতে ঘাড় নেড়েছিলেন, হুম, এটা একটা প্রবলেম বটে। তোর বাবা মা কাকা কাকিমা কেউ দেখবে না বলছিস?

হু ক্যান অ্যাশিওর? আর তোমার মতন করে কেনই বা দেখবে? সকলেরই তো ইনডিভিজুয়াল লাইফ আছে।

কথাটা এখনও শিবসুন্দরের কানে বাজে। মানুষের ইনডিভিজুয়াল লাইফের গণ্ডি কতটুকুনি, যার মধ্যে চিররুগণ মাও পড়ে না! ছেলেরা তার অবর্তমানে মনোরমাকে দেখবে কিনা এ নিয়ে টোটোর সংশয়ই বা এল কোত্থেকে! এ কি আত্মকেন্দ্রিক সংসারে বাস করার পরিণাম! তা হলে বৃদ্ধ বয়সে শুভ ছন্দার কি হবে! অলকা তুফানও কি একই গোত্রে পড়ে! এমনও তো হতে পারে ওরা তেমন নয়, তবু যদি কখনও কোনও মুহূর্তে মনে হয় তারা কলুর বলদের মতো অন্যের ঘানি পিষছে! অধিকার না থাকলে প্রিয়জনের কাজও তো বেগার খাটা মনে হতে পারে!

যদি হয়! যদি হয়!

কদিন ধরেই মনে কথাটা নাড়াচাড়া করছিলেন শিবসুন্দর। দিন পনেরো আগে শুভ এল। একাই। একবেলার জন্য। সেদিন দুপুরে খেতে বসে শিবসুন্দর হঠাৎ বলে ফেলেছিলেন, – শুভ, আমি একটা কথা ভাবছিলাম। একটা উইল করে ফেললে কেমন হয়?

শুভ অবাক হয়ে তাকিয়েছিল, কেন বাবা?

-এমনিই। ভাবছিলাম তোর তো অনেক আছে, এই বাড়িটা বরং তুফানের নামে লিখে দিই।

তুফান হাঁ হাঁ করে উঠেছিল, কক্ষনও না, কক্ষনও না। দাদা থাকতে আমার নামে কেন করবে?

–তুই চুপ কর। থাকবি তো তোরা, তোর দাদা তো আর থাকতে আসবে না।

তা হলে তুমি মার নামে উইল করে দিয়ে যাও। নয়তো উইল ফুইল করতে হবে না, আমি আর দাদা বুঝে নেব।

শুভর মুখ যেন পলকের জন্য পাংশু। তারপর হেসে বলেছিল, গাধার মতো কথা বলিস না। বাবা ঠিক কথাই বলেছে। যে বসবাস করে, বাড়িঘর তার নামেই থাকা উচিত। তোর নামে জমি বাড়ি থাকলে আমরা বেড়াতে এলে তুই কি আমাদের ঢুকতে দিবি না?

কথাটা কি শুভ খুব স্বতঃস্ফূর্তভাবে বলেছিল! শুভর কথাটা কি শিবসুন্দরকেও বিধেছিল একটু। ছেলে সত্যিই উত্তরাধিকার চায় না! তার কিছুই চায় না ছেলে!

টিকটিক শব্দ হচ্ছে মোপেডের, ফিরছে তুফান। পিছনের সিটে বিপুল, নতুন পাড়ায় থাকে। মোড়ের সদ্যবসানো টিউবওয়েলটার কাছে নেমে গেল।

শিবসুন্দর গোমড়া মুখে গেটে ফিরে এলেন, – আড্ডা শেষ হল?

–আড্ডা কোথায়, আমি মিটিং শুনছিলাম। কী জগঝম্প ব্যাপার গো বাবা।

–থাম। হরির বাড়ি যেতে হবে সে খেয়াল আছে?

হরিদার ছেলে ভাল আছে। তোমার কুইনিন খেয়ে কোঁ কোঁ করছে, কিন্তু কাল রাত থেকে আর জ্বরটা নেই। তুফান মোপেডটাকে সামনের উঠোনে দাঁড় করাল। স্ট্যান্ডে তুলছে, মিটিং শুনতে হরিদাও এসেছিল।

–তবু আমার একবার তো যাওয়া উচিত।

–যেয়ো। কাল বিকেলে নিয়ে যাব। তুফান হাত ঝাড়ছে, খুব মিস করলে বাবা।

জীবনে তো অনেক কিছুই মিস করলাম। তোদের যাত্রা থিয়েটার সিনেমা টিভি। না হয় একটা মিটিংও মিস হল।

-ঠাট্টা করছ? আজ গেলে অনেক খাঁটি কথা শুনতে পেতে। এমন কথা এত স্পষ্টভাবে আর কোনও পলিটিকাল পার্টি বলে না।

–পলিটিকাল পার্টিরা তো স্পষ্ট কথাই বলে রে। শুধু কাজগুলোই ধোঁয়াটে হয়, এই যা। সিঁড়িতে বসলেন শিবসুন্দর, তা কী বলল তোর স্পষ্টবক্তারা?

–সে অনেক কথা। বলছি। বলেই গলা চড়াল তুফান, অলকা, অলকা, একটু চা দিয়ে যাও না। বাবা, তুমি চা খাবে?

সিগারেট ছাড়ার পর থেকে চা খাওয়ার তৃষ্ণা বেড়েছে শিবসুন্দরের। বিকেলের দিকে জিভ বড় শুলোয়, মাথা ভার হয়ে থাকে। বললেন, একটু আগে খেয়েছি এক কাপ। আবার হলে মন্দ হয় না।

বাবাকেও দিয়ো। হুকুম ছুঁড়ে জমিয়ে বসল তুফান, ওই যে রামের জন্মস্থানে হিন্দুদের মন্দির ভেঙে বাবর একটা মসজিদ বানিয়েছিল না, তাই নিয়েই বলছিল। এক সন্ন্যাসিনী এসেছিলেন, কি যেন নাম….

দাঁড়া দাঁড়া। ব্যাপারটা একটু বুঝে নিই। মন্দির ভেঙে মসজিদ বানানো হয়েছে কে বলল?

 –সবাই জানে। বাচ্চা কাচ্চারাও জানে। উনিও তো বলছিলেন।

–সবাই বললেই কি সত্যি হয়ে যায়। এক সময়ে তো লোকে বলত সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে, কথাটা কি সত্যি? তুই আমার কাছে মানুষ হয়েও এই কথা বলছিস!

তুফান কপাল কুঁচকোল, তুমি বলতে চাও মুসলমানরা হিন্দুদের মন্দির ভাঙেনি?

–এ কথা তো আমি বলিনি। ভাঙতেও পারে। যারা যখন রাজা হয় তারা অনেক সময়েই অন্যের ধর্মস্থান ভেঙে দেয়। হিন্দুরা বৌদ্ধদের ভেঙেছে, বৌদ্ধরা হিন্দুদের ভেঙেছে, ক্রিশ্চানরা মুসলমানদের ভেঙেছে, মুসলমানরা ক্রিশ্চানদের ভেঙেছে…। এখন তো শুনি তিরুপতি জগন্নাথ মন্দিরও নাকি বৌদ্ধদের ধর্মস্থান ছিল। অতীতে কে কি ন্যায় অন্যায় করেছিল, কি করেনি, তার ওপরে এখনকার পৃথিবী চলবে? তা ছাড়া অযযাধ্যা তো ছিল বৌদ্ধদের পুণ্যভূমি, সেখানে এখন শুনি শয়ে শয়ে মন্দির, সেগুলো গজালো কোত্থেকে? তারপর ধর, ওই অযোধ্যাতে তুলসীদাস থাকতেন, যিনি রামচরিতমানস লিখেছেন, তিনিও তো ওই সিক্সটিনথ সেনচুরির লোক? কই, তিনি তো কোথাও মন্দির ভেঙে মসজিদ হয়েছে এই গপ্পো ফাঁদেননি।

তুফান একটু যেন ধাঁধায় পড়ে গেল। শিবসুন্দর তর্ক করেন কম, কিন্তু করলে তার যুক্তির কাছে তুফান প্রায়শই অসহায় হয়ে যায়। হাঁপাঁক করে বলে উঠল, উনি শুধু মন্দির মসজিদের কথাই বলছিলেন না। আরও অনেক কথা বলছিলেন।

–যেমন?

–যেমন ধরো, মুসলমানরা এ দেশটাকে নিজের দেশ ভাবে না। এখানেই খাবে দাবে, ওদিকে পাকিস্তানের গুণ গাইবে।

শিবসুন্দর অট্টহাসিতে ভেঙে পড়লেন, তুই বলতে চাইছিস ইয়াসিন মঈদুলরা দিনরাত পাকিস্তানের নাম করে করতাল বাজায়?

সোমেন সাইকেলে যাচ্ছিল, গেটের সামনে নেমে পড়েছে- এত হাসির কি হল ডাক্তারবাবু?

–এই তো দ্যাখো না তুফান কী বলে! তোমার পার্টির ইয়াসিন মঈদুলরা নাকি দেশকে ভালবাসে, পাকিস্তান বলতে পাগল।

সোমেন এক ঝলক দেখল তুফানকে। বলল, আপনি মিটিং-এ গিয়েছিলেন বুঝি?  

-তাইতেই তো এসব বদহজম হয়েছে।

সোমেনও হাসল, তবে তেমন উচ্ছ্বসিতভাবে নয়। বলল, – হওয়ারই কথা। মহিলা জব্বর বক্তৃতা দেন। আমি তো পঞ্চায়েত অফিসে ছিলাম, মাইকের আওয়াজ কানে আসছিল…। তবে বেশির ভাগই অসত্য ভাষণ, বোঝেনই তো লোক জড়ো করার মতলব।

–সে কথাই তো তুফানকে বোঝাতে চাইছি। গরম বক্তৃতা শুনেই নাচিস না।

 তরল আঁধার নেমে গেছে। বাইরের আলো জ্বালিয়ে দিয়েছে অলকা, চাও দিয়ে গেছে। টুকি কোমরে হাত দিয়ে বিজ্ঞের মতো দাঁড়িয়ে আছে সামনে, চোখ গোল গোল করে কথা গিলছে।

দাওয়ার কোণে পা ঝুলিয়ে বসল সোমেন। চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, – তবে, কি জানেন ডাক্তারবাবু, এক আধটা কথা সত্যিও বটে। পার্টি অফিসে বলতে পারব না, আপনাকেই বলছি… এই যে ধরুন মুসলমানরা চারটে করে বিয়ে করে, কথায় কথায় তালাক দেয়, খোরপোশ দেয় না…।

–এই কথা তুমি বলছ সোমেন! তুমি! শিবসুন্দর এক লহমা হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন, –তোমাদের না কি সব ইজম আছে? তোমরা না ধর্মই মানো না? হিন্দু মুসলমান তোমাদের চোখে আলাদা হয় কী করে?

–হওয়া উচিত নয়। কিন্তু কথাগুলো তো এক দিক দিয়ে সত্যি।

-মোটেই সত্যি নয়। সত্যির রাংতা পরানো মিথ্যে। একটা মুসলমান ছেলে যদি চারটে করে বিয়ে করে তাহলে ওদের সমাজে পুরুষের চার গুণ মেয়ে থাকতে হয়। হয় কি না? তুমি তো মুসলমান পাড়ায় গিয়ে কাজ করো, তোমার কি মনে হয় ও পাড়ায় একটা পুরুষ পিছু চারটে মেয়ে আছে? কটা মুসলমান ছেলের একটার বেশি বউ দেখেছ? আর কটা হিন্দুর তুমি একটার বেশি বউ দেখতে চাও? আর তালাক! খোরপোশ! আমাকে হাসিও না সোমেন। ওই যে তোমাদের হেলথ সেন্টারের নার্স মেয়েটি, মায়া, আমাদের বাড়িতে আসে, ও বলছিল কত যে হিন্দু বউ ওদের হেলথ সেন্টারে আসে যাদের বর লাথি মেরে তাড়িয়ে দিয়েছে! তারা তো তালাক শব্দটাও উচ্চারণ করে না, খোরপোশের কথা বলতে গেলে বাঁশপেটা করে, রাস্তার মাঝখানে নিজের বউয়ের কাপড় খুলে নেয়। আসল কথাটা তো বোবঝা। পভার্টি। অশিক্ষা। তা কিবা হিন্দুর, কিবা মুসলমানের। আর তার ফায়দা ললাটে পলিটিকাল পার্টিরা। ফর এ মাইনর গেইন। ভোট। তার এফেক্টটা কী হয়? মানুষে মানুষে ঘেন্না বাড়ে। আরও খারাপ কী লাগে জানো? তোমার মতো শিক্ষিত লোকও ওই সব ধারণা মনে পুষে রাখে। তুমি না ছাত্র পড়াও সোমেন?

সোমেন যেন সামান্য বিরক্ত হল। তেতো হেসে বলল, আপনি কোনওদিন সাফার করেননি, আপনি বুঝবেন না। আমার মামার বাড়ির সব আত্মীয়স্বজনকে রাতারাতি ওপার থেকে চলে আসতে হয়েছিল। এক বস্ত্রে। যারা ভুক্তভোগী তারা জানে।

অকস্মাৎ শান্ত হয়ে গেলেন শিবসুন্দর। চোখের সামনে ভেসে উঠছে বহুকাল আগের স্মৃতি। সোমেনের গলায় আবার সেই সুর, যার পরিণাম আজকের মনোরমা। আবার কি ঘরে ঘরে মনোরমা তৈরি হবে। অথবা আমিনা! মেহেরুন্নিসা!

শিবসুন্দর হিমেল কণ্ঠে বললেন, তুমি আমার কতটুকু জানো সোমেন? ওই যে দোতলায় আমার স্ত্রী চুয়াল্লিশ বছর ধরে সেন্সলেস ভেজিটেবল হয়ে পড়ে আছে, তার কারণ তুমি জানো? ছেচল্লিশের দাঙ্গা। আমার স্ত্রীর দাদা খুন হয়েছে, সারা রাত মৃত্যু ভয়ে কেঁপেছে আমার স্ত্রী, পরদিন সকাল থেকে তার এই দশা। কিন্তু তবু আমি জানি যারা দাঙ্গা করে তারা কোনও ধর্মে বিলঙ করে না। আমার বন্ধু নাজিমের বাবাকে পৈতেকাটা-মারে ছিন্নভিন্ন করা হয়েছিল। তারাও রাতারাতি পালাতে বাধ্য হয়েছিল কলকাতা ছেড়ে। আমি তো ভেবে পাই না, ধর্মের কাজ নাকি ধারণ করা, সেই ধর্ম কেন মারণাস্ত্রের মতো ব্যবহার করা হবে? মানুষের মধ্যে যে অ্যানিমাল ইনসটিংক্ট আছে তাকে ধর্মের নামে তাতিয়ে দেওয়া বড় সহজ সোমেন। এই ধর্ম যুক্তি বুদ্ধিকে হত্যা করে। সব জেনেও তোমরা এই ফাঁদে কেন পা দাও?

–আপনি আমার দিকে আঙুল দেখাচ্ছেন কেন? আমি এসবের বিরুদ্ধে। আমার পার্টিও এ সবের বিরুদ্ধে।

কী জানি কে কার বিরুদ্ধে! তোমাদের মতো পলিটিকাল পার্টিরাই তো দেখি মানুষকে এক্সসাইট করে তাদের দিয়ে খুনোখুনি করায়। তখন তোমরা সব রিজন ভুলে ক্রিশ্চান মুসলমান হিন্দু বৌদ্ধ বনে যাও। শিবসুন্দর শুকনো হাসলেন, অথচ দুর্বলদের টচার করার ব্যাপারে তোমরা কেউই কম না। যে যখন পাওয়ারে থাকে, সেই সিংহ। আর যে পাওয়ারে থাকে না, সে ক্ষমতায় আসার জন্য ভেড়ার পাল জড়ো করে। তোমরা একে বলো গণতন্ত্র, আমি বলি উচ্ছিষ্টতন্ত্র। ক্ষমতায় এলে আমার খাওয়া মাংসের হাড়গোড় তোমায় দেব এই লোভ দেখিয়ে একটা বাক্সকে বাজে কাগজ দিয়ে ভর্তি করো। যে-দেশের মানুষ হাজার বছর পাশাপাশি থেকেও কেউ কাউকে চেনে না, বিশ্বাস করে না, সুযোগ পেলে এ ওকে ছুরি মেরে দেয়, সে দেশের আর কী হবে! একটা সেকশান থাকবে, যারা চিরকাল লুটেপুটে খাবে। আর তাদের হাত ধরে থাকবে তোমার মতো নেতারা, যারা মুখে এক, কাজে এক, মনে আর এক।

–আপনি কিন্তু আমাকে অপমান করছেন ডাক্তারবাবু। সোমেনের স্বরও চড়েছে। উঠে দাঁড়িয়ে আঙুল নাড়ছে।

শিবসুন্দর গ্রাহ্যই করলেন না। ধমকের সুরে বললেন, বোসো।

সোমেন বসল না। গোঁয়ারের মতো দাঁড়িয়ে আছে।

শিবসুন্দর বললেন, তোমাকে অপমান করার আমার এতটুকু ইচ্ছে নেই। কিন্তু কথাগুলো আমায় বলতেই হচ্ছে। দাঙ্গায় আমার অত বড় একটা ক্ষতি হওয়ার পরও আমি ভেঙে পড়িনি। কারণ, আমার মানুষের ওপর বিশ্বাস ছিল। তোমরা, ইউ পিপল, আমার সেই বিশ্বাসটুকুও নষ্ট করে দিচ্ছ।

–আমার সঙ্গে কেউ এভাবে কথা বলে না ডাক্তারবাবু। আপনি লিমিট ক্রস করে যাচ্ছেন।

–আমি আমার লিমিট জানি সোমেন। কিন্তু তুমি তোমার সীমা জানো না। তুমি কি আমাকে বলতে পারবে ওই যে মায়া বলে মেয়েটা, ওকে যারা ওই রামনগরের হেলাবটতলায় উত্ত্যক্ত করে, তাদের তুমি চেনো না?

–ওরা আমাদের পার্টির ছেলে নয়।

বাহ্, এই তো জননেতার মতো কথা। … তোমাকে তো এই অঞ্চলের লোক মান্যিগন্যি করে, একটা মেয়ে এখানে কাজ করতে এসে অসুবিধেয় পড়ছে, তুমি ইন্টারফিয়ার করবে না কেন?

এতক্ষণ মাথা নিচু করে বসেছিল তুফান। অল্প অল্প ঘাড় নাড়ল, আপনাকে কিন্তু অনেক দিন ধরে আমি ছেলেগুলোর কথা বলছি।

–ও মেয়েটাও ভাল না। সোমেন টপ করে বলে উঠল, হেলথ সেন্টারের নতুন ডাক্তারের সঙ্গে ওর একটা খারাপ সম্পর্ক আছে।

–তুমি যে দেখছি জনসভায় সন্ন্যাসিনী যা বলে গেছেন তার থেকেও সরেস মিথ্যে কথা বলতে পারো হে! একটা মেয়ের বদনাম করাটা সব থেকে সহজ রাস্তা, তাই না?

সোমেনের মুখ লাল হয়ে গেল, আপনাদের সঙ্গে ওর সম্পর্ক ভাল, আপনারা তো ওর গুণ গাইবেনই। তাও তো তুফানভাই আর মায়াকে জড়িয়ে যেকথা উঠেছিল, সে সবে আমরা কান দিইনি।

তুফান স্প্রিং দেওয়া পুতুলের মতো লাফিয়ে উঠল, কে বলছে এ কথা? আমি তার জিভ ছিঁড়ে নেব।

শিবসুন্দর হাত তুলে থামালেন তুফানকে। বললেন, আসল কথাটা তো অন্য সোমেন। মেয়েটাকে কেন তোমরা প্রোটেকশান দিতে চাও না, আমি জানি। পলাশ নামের নতুন ডাক্তার ছেলেটিকেও আমি চিনি। জেম অফ আ বয়। তোমাদের হেলথ সেন্টারে সামান্য খুঁদকুড়ো ওষুধ আসে, সেটাও চলে যায় রামনগরের মানিকের দোকানে। অন্তত এতকাল যেত। মায়া আর পলাশ এ ব্যাপারটা অনেকটা আটকেছে। মানিক কোন পার্টি করে সোমেন? দিবাকরের ছেলেরা তো গুণ্ডাই, তোমার লোকেরা কি ধোওয়া তুলসী পাতা?

সোমেন দাঁতে ঠোঁট চাপল, আপনার অভিযোগের সত্যতা আমাকে যাচাই করে দেখতে হবে।

-দেখো। মানিকের দোকানে যখন সন্ধেবেলা আড্ডা মারো, তখন আলোচনা করে দেখো।

সোমেন আর কোনও কথা বলল না। সোজা গিয়ে সাইকেলের প্যাডেলে পা রেখেছে, আপনার কথাগুলো আমার মনে থাকবে ডাক্তারবাবু। আপনি সাতে পাঁচে থাকতে চান না, অন্তত মুখে তাই বলেন। অথচ কাজে দেখা যাচ্ছে আপনি সব ব্যাপারেই বেশি ইন্টারফিয়ার করছেন।

সোমেন কি সতর্কবাণী শুনিয়ে গেল! শিবসুন্দর পায়ে পায়ে দোতলায় উঠছেন। মায়া তাঁকে বিশ্বাস করে যেসব গোপন কথা শুনিয়ে গেছিল, তা উগরে দেওয়া কি ঠিক হল? মেয়েটা এখান থেকে চলে যেতে চেয়েছিল, শুভকে একবার বললেই বন্দোবস্ত হয়ে যেত, কিন্তু তিনি তা হতে দেননি। কেন হতে দেননি সেকথা মায়াও বুঝেছে। এখন মায়াকে রক্ষা করার দায়িত্বও তাঁর ওপর বতায় না কি? মাস দুয়েক আগে কালিয়ার বিলে এক স্কুল মিস্ট্রেসের লাশ ভেসে উঠেছিল। ধর্ষিত। ক্ষতবিক্ষত। কত সামান্য কারণে যে আজকাল প্রাণ চলে যায়! থানায় কি একটা খবর দিয়ে রাখবেন? লাভ কি! সোমেন দিবাকরদের হাত অনেক অনেক লম্বা। তবে কি শুভরই দ্বারস্থ হবেন? নীতি ভেঙে মায়াকে পাঠিয়ে দেবেন শুভর কাছে?

শিবসুন্দর গভীর শ্বাস ফেললেন। যদি তাই পারতেন! যদি তাই পারতেন!

.

৭০.

তিতির দু হাতে থুতনি চেপে ক্লাসে বসে আছে। সামনে প্রিটেস্টের মার্কশিট, আগের পিরিয়ডে ধৃতিকণা ম্যাডাম দিয়ে গেছেন। পরীক্ষা তিতিরের ভাল হয়নি ঠিকই, তা বলে এত খারাপ! এ সব কী নম্বর পেয়েছে সে! ফিলজফিতে তেতাল্লিশ, পল সায়েন্সে সাঁইত্রিশ, ইতিহাসে উনপঞ্চাশ! ল্যাঙ্গুয়েজ গ্রুপে ভাল বলে তিতিরের মনে মনে গর্ব ছিল, মাধ্যমিকে লেটার পেয়েছিল ইংরিজিতে, সেই ইংরিজিতে চুয়ান্ন, বাংলায় সাতচল্লিশ! প্রিটেস্টের কোয়েশ্চেন খুব কঠিন হয়েছিল, অনেকটা কোর্স নিয়ে একটা করে পেপার পরীক্ষা হয়েছে, তিন-চার জন ছাড়া তাদের সেকশানের কেউই তেমন সুবিধে করতে পারেনি। কিন্তু এগুলো কি কোনও যুক্তি হল? অত্ত সোজা যে সাবজেক্ট ইকনমিক জিওগ্রাফি, শুধু মার্কস তোলার জন্যই যেটাকে ফোর্থ সাবজেক্ট নিয়েছে তিতির, তাতেও সাকুল্যে চুয়াল্লিশ! নাহ তিতির, তোর একেবারে বারোটা বেজে গেছে।

ফিলজফির ক্লাস চলছে। সিলেবাস প্রায় শেষ, পাশ্চাত্য দর্শন নিয়ে একটা সাধারণ আলোচনা করছেন ত্রিদিব স্যার। প্রকাণ্ড এক ডায়াগ্রাম এঁকেছেন ব্ল্যাকবোর্ডে, লেবনিজ দেকার্তে স্পিনোজা কানট হেগেল নামগুলো ঝুলছে ডায়াগ্রামে। ত্রিদিব স্যারের পড়ানোর ঢঙটি ভারি সুন্দর, কণ্ঠস্বরটিও ভরাট, গমগম করছে গোটা ক্লাস, খসখস নোট নিচ্ছে অনেকে, সবাই প্রায় টানটান, শেষ পিরিয়ডেও।

ঝুলন পেনের খোঁচা দিল তিতিরকে, — এই, ভেবলুর মতো বসে আছিস কেন? লেখ।

 তিতিরের সংবিৎ ফিরল। ভার ভার গলায় বলল, -কী লিখব! সবই তো পুরনো পড়া।

–তোর এখনও রেজাল্টের হ্যাঙওভার কাটেনি? গুলি মার।

কাকে?

–প্রিটেস্টকে। মার্কশিটটাকে। বাড়িতে বলবি প্রিটেস্টে একটু কম কম নম্বর দেয়।

মনে মনে হাসল তিতির। বাড়িতে কাকে বলবে? কী বলবে? কে শুনবে? ঝুলন জানে না তিতির এখন এক নির্জন দ্বীপে বাস করে। দ্বীপে মাঝে মাঝে এসে নৌকো ছোঁয়ায় বাবা, আবার চলে যায়। বাড়িতে আর একদণ্ড থাকতে চায় না বাবা। তিতির বোঝালে বোঝে, বাধ্য ছেলের মতো মাথাও নাড়ে, তারপর সব শপথ বেমালুম ভুলে যায়, কী এক চৌম্বক টানে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে পথে। মেয়ে কী পড়ে, আদৌ পড়ে কি না তা নিয়ে তার কণামাত্র ভাবনা নেই। কবেই বা ছিল! যার ছিল সে তো এখন উদাসিনী চিরদুখিনী সেজে বসে আছে। দিনান্তে তিতিরের সঙ্গে একটাও কথা বলে কি না সন্দেহ। যেচে রেজাল্ট দেখালে সে হয়তো দেখবে একবার, ভুরুতে মোটা ভাঁজ ফেলে তিতিরের দিকে তাকালেও তাকাতে পারে, কোনও মন্তব্য করবে বলে মনে হয় না।

কথাটা মনে হতেই তিতিরের চোখে বাষ্প জমল অকারণ। কেন মন্তব্য করবে মা, তিতির মার কে? কবেই বা মা তিতিরের সঙ্গে মিষ্টিমুখে দুটো কথা বলেছে? আজীবন তিতিরের জন্য শুধু বকুনি, আর দাদার জন্য আদর। এক দিন তিতির রুখে দাঁড়াতেই ওমনি দোষ হয়ে গেল? কত যন্ত্রণায় যে কথাটা বলে ফেলেছিল তিতির, একবারও কি অনুভব করার চেষ্টা করেছে মা? বদলেছে জীবনযাপন? মেয়েকে কোন কাঁটা বিঁধছে তা ভেবে কি একটুও সচেতন হল মা? সেই ডাক্তার আঙ্কল আসছে, বসে থাকছে, দুঃখের খোলস পরে গুজগুজ চলছে দুজনের, অথচ ওই দুজনের জন্যই কী ভীষণভাবে মাথা হেঁট হয়ে গেছে তিতিরের।

মা তিতিরের কথাও ভাবে না। বাবার কথাও ভাবে না।

তিতিরের এবার পরীক্ষা কেন খারাপ হল, তা কি একটুও তলিয়ে দেখবে মা? বড়জোর মনগড়া একটা ধারণা করে নেবে, বাবা অমন তাথৈ তাথৈ কাণ্ড করছিল বলে মেয়েটার পড়াশুনোয় বিঘ্ন ঘটেছে। তিতিরের যে আজকাল বই উল্টোতে গেলেই কান্না পায়, তার খোঁজ কে রাখে!

ঝুলন আবার চাপা স্বরে ডাকছে, এই তিতির, কাঁদছিস কেন?

 তিতির সচকিত হয়ে নাক টানল, কই, না তো।

–এত সেন্টিমেন্টাল কেন, অ্যাঁ? এটা কি জীবনের শেষ পরীক্ষা?..খাতা দেখাতেও পারশিয়ালিটি আছে। এই স্কুলের ছেলেমেয়েদের স্যার-ম্যাডামরা ঢেলে নম্বর দেয়। ভেবে দ্যাখ, তুই আমি পাঞ্চালী আর দেবোপম এক সঙ্গে বসে এক নোট পড়লাম, ওরা পেল ছয়ের ঘরে, আমাদের পঞ্চাশও দিল না। পল সায়েন্স আমি যা লিখেছিলাম মিনিমাম সেভেনটি পাওয়ার কথা। পেয়েছি কত? টুয়লভে ওঠার পরীক্ষাতেও তো…

ঝুলন ফিসফিস করে কথা বলছে, তবু গুনগুন ধ্বনি ভাসছে বাতাসে। সম্রাট আর মিতেশ ফিরে তাকাচ্ছে মাঝে মাঝে। ত্রিদিব স্যার বারকয়েক দেখলেন আড়চোখে। তিতির ঠোঁট নাড়ল, চুপ।

থিয়োরি অফ নলেজ, থিয়োরি অফ রিয়ালিটি বোঝাচ্ছেন ত্রিদিব স্যার, আলোচনা করছেন কজালিটি নিয়ে। জ্ঞান আর বাস্তবতার তত্ত্বে তিতিরের উৎসাহ নেই, কার্যকারণের তত্ত্বও তাকে একটুও টানছে না, সে নোট নেওয়ার ভান করে কাগজে আঁকিবুকি কাটছে। ডটপেনের আঁচড়ে কখন যেন একটা মুখ তৈরি হয়ে গেল। ঠিক মুখও নয়, মুখের মতন একটা কিছু। চেনা চেনা লাগছে! টোটো কি? টোটোর মুখ কেন আঁকবে তিতির? উঁহু, এ টোটো নয়, টোটোর মুখ আর একটু লম্বাটে। তবু যেন মিল আছে। খুচ খুচ করে মুখটাতে তিতির একটু দাড়ি লাগিয়ে দিল। ইশ, এ যে আরও টোটো হয়ে গেল! সামার ভেকেশানে অ্যাক্সিডেন্ট করেছিল টোটো। হিয়ার সঙ্গে জয় রাইডে বেরিয়ে নাক-মুখ ফাটিয়ে সোজা হাসপাতাল। হাতও নাকি ভাঙতে ভাঙতে বেঁচে গেছে। ঠিক হয়েছে। ডেঁপো ছেলের উচিত শিক্ষা। হুঁহু, ড্রাইভারকে নাম ধরে ডাকে! হিয়াটাও কী বজ্জাত মেয়ে, এর মধ্যে কতবার স্কুলে দেখা হল, ভুলেও অ্যাক্সিডেন্টের কথা উচ্চারণ করল না! হিয়া যেন এড়িয়ে চলতে চায় তিতিরকে! কেন চায়? তিতির কি তোদের জাবপাত্রে কুকুর হতে যাবে? ফোঃ, তিতিরকে এখনও চিনিস না হিয়া।

তিতির জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল। স্কুলের গায়েই এক অতিকায় স্কাই স্ক্র্যাপার, সামনের ব্যালকনিতে রঙিন শাড়ি মেলছে এক বুড়ি। ভেজা শাড়ি হাওয়ায় লতপত। চোখ নামিয়ে তিতির দাঁতে ডটপেন চাপল। কলম নামল খাতায়, ফুটে উঠছে হিয়ার আদল। টোটোর পাশে হিয়ার মুখখানাকে ক্ষণেক দেখল তিতির, ভুরু কুঁচকোল, ঠোঁট বেঁকাল। সর সর কলম চালিয়ে টোপা টোপা করে দিল হিয়ার দু গাল, চোখ সামান্য টেরা করে দিল। থেবড়ে দেবে হিয়ার নাকটা? দিলে হয়। বুঁচি বুঁচি, তুই একটা বুঁচি।

বেল পড়ে গেছে। ফরফর করে কাগজটাকে ছিঁড়ে দলা পাকাল তিতির, জানলার কাছে গিয়ে মুঠো খুলল, কুচিগুলোকে আলাদা আলাদা করে ভাসিয়ে দিল শূন্যে। উড়ছে। উড়ুক। যুগলে টুকরো টুকরো হয়ে উড়ক মহাশূন্যে।

ক্লাস শেষে নীচের সিমেন্টের চাতালে এসে জড়ো হয়েছে বন্ধুরা, জোর গজল্লা চলছে। রেজাল্ট নিয়ে কথা তেমন জমল না। প্রিটেস্ট এমন কিছু হাতি-ঘোড়া পরীক্ষা নয়, তবু সহজে কেউ নিজের নম্বর জানাতে চায় না। যেন তার নম্বর অন্য কেউ জানতে পারলেই সে ঘোড়দৌড়ে অনেকটা পিছিয়ে পড়বে। অথচ মজা হল, প্রত্যেকের নম্বরই প্রত্যেকের জানা।

কথায় কথায় অনুশার কথা উঠে পড়ল। তিতিরদের সেকশানের অনুশা প্রিটেস্টে বসেনি, এ বছর মিস ক্যালকাটা প্রতিযোগিতায় নাম লিখিয়েছে সে, ক্লাসেও অনুশা আসছে না বেশ কিছুদিন। দেহচর্চা, ত্বক পরিচর্যার তালিম চলছে তার, বাচনভঙ্গি মাজাঘষা করার একটা ক্র্যাশ ট্রেনিং কোর্স করছে, হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষার মতো তুচ্ছ ব্যাপারে তার আপাতত কোনও আগ্রহ নেই। বন্ধুদের যে কোনও আসরেই অনুশা এখন হট টপিক।

পাঞ্চালী বলল, ঝুলন, তুই রিসেন্টলি অনুশাকে দেখেছিস? মুখের পিমপল-টিমপলগুলো একদম মিলিয়ে গেছে। স্কিন কী হয়েছে রে! একেবারে ওয়াক্স পালিশ।

টিনা বলল, – ও কিন্তু মুখে শশা, ডিম আর বেসন ছাড়া আর কিছু লাগায় না।

ঝুলন অনুশাকে একটুও পছন্দ করে না। বলল, – মাখে কেন? খেলেই পারে।

–ডিম বেসন কী করে কাঁচা খাবে রে?

-বেসনের কথা জানি না, ডিম তো কাঁচা খাওয়াই যায়। মহম্মদ আলি তিরিশটা করে কাঁচা ডিম খেত।

কুলজিৎ হা হা হাসল, অনুশা কি বক্সার হতে যাচ্ছে নাকি? ওকে হতে হবে সফট, টেন্ডার।

–আমার তো সেখানেই আপত্তি। ঝুলন প্রায় চেঁচিয়ে উঠল, একপাল লোক চুল আর চামড়া দেখে মেয়েদের সৌন্দর্য বিচার করবে, আইডিয়াটিই ভীষণ ডেরোগেটরি। ভাবলেই কেমন গা ঘিনঘিন করে, না রে তিতির?

তিতির অন্যমনস্ক মুখে শুনছিল। যেমনভাবে দূরের রাস্তা থেকে বাস-ট্রামের হর্নের শব্দ ভেসে আসে, তেমনভাবে টুকরো-টাকরা সংলাপ উড়ে আসছিল কানে। তর্কে না গিয়ে চটপট ঘাড় নেড়ে দিল, বটেই তো। কী বিশ্রী।

সম্রাট যেন ভীষণ অবাক, বিশ্রীর কি আছে? সুন্দর হওয়াটাই সব নয়, সৌন্দর্যকে বিশেষভাবে প্রোজেক্ট করতে পারাও একটা আর্ট।

ঝুলন ঝামরে উঠল, মেয়েদের মধ্যে সব সময়ে তোরা সৌন্দর্যই খুঁজিস কেন বল তো? সৌন্দর্য ছাড়া কি মেয়েদের আর কিছু নেই?

–কেন, পারসোনালিটি টেস্টও তো নেওয়া হয়।

–হয়। কয়েকটা থিক লোক সাজানো-গোছানো প্রশ্ন করে, মেয়েরাও ঠোঁট চেপে সাজানো-গোছানো মিথ্যে কথা বলে। ঝুলনের ঠোঁটের ডগায় যেন উত্তর ঝুলছে। ভুরু নাচিয়ে বলল, – ছেলেদের জন্য এ রকম কনটেস্ট হয় না কেন?

-কে বলেছে হয় না? হয় তো।

–হয়। ছেলেদের বেলায় দেখা হয় মাসল আর পাওয়ার। আর মেয়েদের হতে হয় কচি লবঙ্গলটি। কেন রে?

–ইশ, ছেলেরা যেন মডেল হয় না! বুলবুল তর্কে নামল, ছেলেদেরও তো স্যুট বুট পরে ফিগার দেখাতে হয়।

–যাই বলিস, চেহারা নিয়ে ওই সব ফ্যাশান কায়দা আমার ভাল লাগে না। আই হেট ইট।

 –তুই এত কনজারভেটিভ কেন রে?

কনজারভেটিভ শব্দটা শুনলেই ভীষণ রেগে যায় ঝুলন। রক্ষণশীল কথাটা যেন তাকে গালাগালির মতো ফোটে। কটমট করে তাকাল সে, আমি মানুষের চেহারা বিচার করি না, ব্রেনকে রেসপেক্ট করি, তার কাজকে রেসপেক্ট করি। আমার চোখে মাদার টেরিজাই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুন্দরী।

–তোর ভীষণ পিসিমা পিসিমা ভাব। বুলবুল খিলখিল হেসে উঠল, প্রেজেন্ট ট্রেন্ড-এর সঙ্গে চলার চেষ্টা কর। আমি তো বাবা ঠিকই করে ফেলেছি, এই ফিগারে তো মডেল হওয়া হল না, আমি ফ্যাশান ডিজাইনার হব। ঠিকমতো মার্কেট ধরতে পারলে টাকার ফ্লাড হয়ে যাবে।

তার মানে ডিগনিফায়েড দর্জি হবি?

–যে যা ভাবে। বুলবুল চুল দোলাল, দর্জি হওয়া কি খারাপ?

–একটুও না। আমাদের এক বন্ধুর ঠাকুমা তো জামাকাপড় সেলাই করেই ছেলেকে মানুষ করেছেন। তিতিরের দিকে ঘুরল ঝুলন, – হিয়ার কথা বলছি রে। ওর ঠাকুমা ট্রেনিং না নিয়েও কোন ফ্যাশান ডিজাইনারের থেকে কম ছিলেন? কী সুন্দর সুন্দর ড্রেস পরত হিয়া বল। বাট সেটা ছিল তাঁর স্ট্রাগল। আমি তার জন্য তাঁকে অ্যাডমায়ার করি। আর বুলবুলেরটা হল শখ। আমি এটাকে বলি ন্যাকামো।

পলকের জন্য তিতির উদাস। কত কাল হিয়ার বাড়ি যাওয়া হয় না। হিয়ার ওপর রাগ করে হিয়ার ঠাকুমাকে একটি বারের জন্য না দেখতে যাওয়া কি উচিত হয়েছে তিতিরের? তিনি নাকি বড় মনোকষ্টে আছেন, ঝুলন বলছিল।

বন্ধুদের মধ্যে রীতিমতো কাজিয়া বেধে গেছে। ফ্যাশান ডিজাইনিং শখ না প্রফেশান, স্ট্রাগল কাকে বলে, আধুনিকতা কী তাই নিয়ে গলার শির ফোলাচ্ছে সকলে।

তিতিরের বিরক্ত লাগছিল। অনেক ঝগড়াঝাঁটি দেখা হল এ জীবনে, আর ভাল লাগে না। বন্ধুদের হাত নেড়ে বলল, আমি চলি রে।

–এক সেকেন্ড। আমিও যাব।

বলেই ঝুলন আর একটা চোখা মন্তব্য ছুঁড়ল বুলবুলের দিকে। বুলবুল তেড়ে ওঠার আগেই তিতিরের সঙ্গে হাঁটা শুরু করেছে। বিজয়ীর মতো বীর দর্পে লম্বা লম্বা পা ফেলে এগোচ্ছে। খানিকটা গিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে বন্ধুদের দেখল একঝলক। তারপর একগাল হাসল, বুলবুলটাকে একটু শিক্ষা দেওয়ার দরকার ছিল। বড্ড বেশি অনুশাকে নিয়ে আহ্লাদীপনা করে। অনুশার চেহারায় আছেটা কি? ওই পাতিলেবুর মতো বুক, হাড় জিরজিরে কণ্ঠা…

–এই ঝুলন, হচ্ছেটা কি? তিতির চাপা ধমক দিল।

 কাছেই গড়িয়াহাটের মোড়, বিকেলের ভিড়ে থিকথিক করছে রাস্তা। ফুটপাথ হকারদের দখলে, বিকিকিনির হাট ঠেলে এখন দু পা চলা দায়। জেনারেটারের কালো ধোঁয়া আর যানবাহনের উৎকট আওয়াজে শরীর খারাপ লাগে।

তার মধ্যে তিতিরের দিকে ঘুরে ঘুরে তাকাচ্ছে ঝুলন, – তুই এত পিউরিটান কেন রে? বুক কি খারাপ কথা? হাত পা মুখ চোখ পিঠ পেট বললে তো দোষ নেই? পাতিলেবু শব্দটাই বা কি এমন অশ্লীল? উপমা হিসেবে এখানে পাতিলেবুটাই তো…

–আহ ঝুলন, চুপ করবি?

–এমা, তুই ব্লাশ করছিস! হি হি। তোর কানটাও তো লাল হয়ে গেছে রে! সুড়ৎ সুড়ৎ ভিড় কাটাচ্ছে ঝুলন, তোকে দেখে মাঝে মাঝে আমার নাল পড়ে, জানিস! আমি যদি ছেলে হতাম, চকাম করে তোকে খেয়ে ফেলতাম।

তিতির আরও রক্তিম হয়ে গেল। এই মুহূর্তে ঝুলনকে আর কিছু বলে লাভ নেই, ক্ষীণতম প্রতিবাদ করলেই বেশি বেশি অসভ্য কথা বলবে।

চার মাথার মোড়ে এসে ঝুলন দাঁড়াল, – এই জানিস, একটা গ্র্যান্ড নিউজ আছে।

 তিতির অনুচ্চ স্বরে বলল, – আবার প্রেমে পড়েছিস?

ফুঃ, ওটা একটা খবর নাকি! ঝুলন ঠোঁট ওল্টাল, পুজোর ছুটিতে আমি শুশুনিয়া যাচ্ছি। —

কি নিয়া?

-শুশুনিয়া। বাঁকুড়ায়। পাহাড়। টু উইকসের একটা রক ক্লাইম্বিং-এর ট্রেনিং হবে, আমি তাতে নাম এনরোল করেছি।

–চেনা গ্রুপ?

–গিয়ে চেনা হয়ে যাবে। সাতটা ছেলে আছে টিমে, আমি একাই মেয়ে। তুই যাবি? এখনও নাম দেওয়াও যায়। বলেই তিতিরকে যেন দ্রুত মেপে নিল ঝুলন, – ওহো, তোকে বলে লাভ নেই, তুই তো মিস পুতুপুতু। পাহাড়ে চড়ার মতো রাগেড ব্যাপারে তো তোর ইন্টারেস্ট নেই। তুই তো সন্ন্যাসিনী হবি।

তিতির একটা দীর্ঘ নিশ্বাস চাপল। এক সময়ে সন্ন্যাসিনী হওয়ার শখ ছিল, এখন মনে হয় সেটাই জীবনের ভবিতব্য। কত দুঃখে যে এ কথা মনে হয় ঝুলন তার কি বুঝবে! বন্ধুরাও যেন আলাদা আলাদা দ্বীপে বাস করে। দ্বীপে, না নিজের নিজের স্বপ্নের ঘোরে!

শ্লেষ গায়ে না মেখে তিতির নিস্পৃহ স্বরে প্রশ্ন করল, একা মেয়ে যাবি, বাড়ি থেকে তোকে ছাড়বে?

না ছাড়ার কি আছে! আমি তো আর শশা বেসন মেখে গা দেখাতে যাচ্ছি না! খানিক আগে স্কুলে ফেলে আসা বুলবুলকে যেন এখান থেকেই বিষমাখা তীর ছুঁড়ল ঝুলন, আমি বা আমার বাবা-মা কেউই কনজারভেটিভ নই। আমরা কেউই ভাবি না সাতটা ছেলের সঙ্গে অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টে বেরোলে একটা মেয়ের ক্যারেক্টার নষ্ট হয়ে যায়। নিজেকে শুধু শরীরসর্বস্ব মেয়েছেলে না ভেবে গোটা একটা মানুষ ভাবতে পারলে ওসব ছুঁতমার্গ আসেও না।

ঝুলন চলে গেল। টালিগঞ্জে পিসেমশাই অসুস্থ, দেখতে যাবে। কোনাকুনি পার হচ্ছে চওড়া রাস্তা। তিতির অপস্রিয়মাণ ঝুলনকে দেখছিল। চুল ঝাঁকিয়ে ঝুলনের ওই দ্রুত হেঁটে যাওয়া, জনস্রোতের মাঝে ঘাড় উঁচু করা অকুতোভয় ভঙ্গিমা, সব কিছুর মধ্যেই কী দৃপ্ত ভাব! অথচ এই মেয়েই যে কি করে একজন মানুষকে শুধু লুঙ্গি পরে বলে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে, গড়ে ওঠা সম্পর্ক ভেঙে দেয় হেলায়? মেলে না, কিছুই মেলে না। মার শীতল ব্যক্তিত্বের সঙ্গেই কি ডাক্তার আঙ্কলের গোপন সম্পর্কটাকে মেলানো যায়? তিতির তো বাবার প্রাণ, তবু কী নির্মম উপেক্ষায় তিতিরের কথা ঠেলে ফেলে দেয় বাবা, স্বেচ্ছাচারী জীবন কাটায়। ডাক্তার আঙ্কল স্নেহ মমতা কর্তব্যের মূর্ত প্রতীক, কিন্তু কী অদ্ভুত ঔদাসীন্যে ছন্দা আন্টিকে অবহেলা করে বান্ধবীর কাছে চলে আসে ডাক্তার আঙ্কল!

এ সব কথা মনে করতে চায় না তিতির, তবু মনে এসে যায়। বুকটা টনটন করে ওঠে। জ্বরো রুগীর মতো তাপ এসে যায় গায়ে। সোনালি বিকেলও বড় মলিন, বড় নিষ্প্রভ লাগে। মনের মধ্যে এক ঘুরঘুরে পোকা বাসা বেঁধেছে তিতিরের, পোকা কুরে কুরে খায় হাড় পাঁজর। খুব কান্না পায় তিতিরের। আবার কি এক জটিল প্রক্রিয়ায় কান্না জমে বরফ হয়ে যায়। বরফ, না হিমবাহ! চিরতুষার!

কাছেই এক পরিচিত স্বর। নাড়া খেল তিতির, ঘুরে তাকাল। একটু তফাতে ভিড়ে দাঁড়িয়ে কাচের বাসনের দর করছে কাকিমা, একা। দর কষাকষিতে এত নিবিষ্ট যে তিতিরকে দেখতে পায়নি। অ্যাটম গেল কোথায়? তাকে ছাড়া তো কাকিমা বড় একটা বেরোয় না? অ্যাটমের টিটি ক্লাস, নাকি ড্রয়িং? গিয়ে কথা বলবে কাকিমার সঙ্গে? কী বলবে? আসো না কেন, আসিস না কেন, যাব, সময় পেলেই যাব রে–এই তো কয়েকটা বাঁধাধরা গৎ এখন। দিন তিন-চার আগে সন্ধেবেলা বড়কাকা এসেছিল, বাবার কথা ভাসাভাসা শুনে গেছে, যদি কথায় কথায় বাবার কথা ওঠে!

ছুট্টে একটা ভিড়-ভিড় মিনিবাসে উঠে পড়ল তিতির। মন-মেজাজ তিতকুটে হয়ে আছে। রেজাল্টটাও যদি একটু ভাল হত! বাড়ি গিয়ে এখন চুপচাপ কিছুক্ষণ শুয়ে থাকবে।

ভাবলেই কি হয়! তিতিরের কপালে শান্তি নেই। সেলিমপুর বাস স্ট্যান্ডে সুকান্ত যথারীতি দণ্ডায়মান। বত্রিশটা দাঁত বার করে এগিয়ে এল, স্কুল থেকে ফিরছ?

অন্য দিন এ সময়ে সুকান্তর সঙ্গে দেখা হল দু-চারটে কথা বলে তিতির। টিউটোরিয়ালে গেলে ফেরার সময়ে এক-আধ ঘণ্টা গল্পও হয় দুজনের। গল্প মানে সুকান্তরই একটানা বকবক করে যাওয়া। সিনেমা, জামাকাপড়, নিজের বাড়ির কিসসা, আরও শতসহস্র হাবিজাবি। হুঁ হাঁ করতে করতে শোনে তিতির, তাও যা হোক কাটে বিকেলটা।

আজ তিতির খিঁচিয়ে উঠল, তোমার কি মনে হয় স্কুল ইউনিফর্ম পরে চিড়িয়াখানায় গিয়েছিলাম?

সুকান্ত সামান্য থতমত, -না, মানে তোমার আজ দেরি হল তো, তাই ভাবছিলাম…

–আমার দেরি হল, কি না হল, তাতে তোমার কি? কে তোমায় ভাবতে বলেছে?

–যাহ শালা, এত তেতে আছ কেন? স্কুলে ঝাড় খেয়েছ?

–ফের মুখ খারাপ করছ?

–যাহ শালা। শালা কথাটা খারাপ হল? বউয়ের ভাই তো শালা হয়। যেমন তোমার দাদা আমার শালা হবে।

তিতির আগুন হয়ে গেল, তোমার সাহস তো কম নয়! যা খুশি তাই বলে যাচ্ছ! তোমার জিভ একদিন যদি আমি ছিঁড়ে না নিই…

–একদিন কেন, আজই নাও। সুকান্তর চোখমুখে কোনও লজ্জার ছাপ নেই। জিভ ঝুলিয়ে দিয়েছে তিতিরের সামনে, এই নাও, ছিঁড়ে টিফিন বক্সে রেখে দাও। কাল টিফিনে বাটার টোস্টের সঙ্গে খেয়ো। অবশ্য আমার জিভ তেমন স্বাদের হবে না। ষাঁড়ের জিভ হলে তাও..

তিতির হনহনিয়ে হাঁটছে। লম্বা লম্বা ঠ্যাঙে তাকে ধরে ফেলল সুকান্ত, এত খেপে যাচ্ছ কেন?

–তুমি আমার সঙ্গে কথা বলবে না।

–আমি তো তোমার সঙ্গে জোক করছিলাম।

–ও সব ডার্টি জোক আমি ঘেন্না করি। সরো, সরে যাও।

ঘাড় ঝুলিয়ে আবার পথ আটকাল সুকান্ত, ভুল করে বলে ফেলেছি।

–এমন ভুল হয় কী করে? রাস্তায় দাঁড়িয়ে দুটো কথা বলি বলে খুব বাড় বেড়ে গেছ, না?

 সরি। আর বলব না। ক্ষমা করে দাও।

–আমার দাদা তোমার চোদ্দ পুরুষের কেউ হবে না, এ কথাটা যেন মাথায় থাকে।

 সুকান্ত নিশ্চুপ। নিবে যাওয়া মুখে পা চালাচ্ছে। একটা উচ্চণ্ড সাইকেল রিকশা গায়ের ওপর এসে পড়ছিল, কোমর বেঁকিয়ে বাঁচাল নিজেকে। ঘুরে রিকশাঅলাকে তেড়ে উঠতে গিয়েও উঠল না। মিইয়ে আছে।

তিতিরের রাগ পুরোপুরি পড়েনি। একটু তেরিয়া গলায় বলল, আমার জন্য রোজ ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকার দরকারটাই বা কী? ভাল লাগে না।

সুকান্ত মিনমিনে গলায় বলল, তোমায় দেখতে ইচ্ছে করে যে।

বাড়াবাড়ি।

বাড়াবাড়ি নয়, আপ অন গড। তিতিরের হাত ছুঁতে গিয়েও সরিয়ে নিল সুকান্ত, আগে দেখা না হলেও ফোন করা যেত। এ বাড়িতে এখনও তোমাদের ফোনই এল না।

ভাগ্যিস আসেনি। এলেই তো তোমার জ্বালাতন শুরু হবে।

জ্বালাতন আর করতে পারি কোথায়? অনেকক্ষণ পর সুকান্ত আবার দাঁত ছড়িয়ে হাসছে, দশবার ফোন করলে আটবারই তো তোমার বাবা ধরত। তোমার বাবা ফোনের কাছে ঘাপটি মেরে থাকে নাকি?

-মোটেই না। আমার বাবা বাড়ি থাকার সময়ে ইন্সিডেন্টালি তুমি ফোন করেছিলে।

 –এক দিন নয়, তিন-চার দিন এ রকম হয়েছে।

সৎ সাহস থাকলে বাবাকে বলতে। বাবা আমায় ডেকে দিত।

উরে বাবা রে, আমার ভয় করে।

গোমড়ামুখ তিতিরকে যেন কাতুকুতু দিল কেউ। যেমনটি দিত তার বাবা, সেই সে ছোট্টটি থাকার সময়ে। দাদার গাঁট্টা খেয়ে থুম হয়ে বসে থাকত তিতির, আর বাবা তখন মজার মজার কথা বলে হাসাতে চাইত তিতিরকে, রাগ ভুলে বিছানায় লুটোপুটি খেত তিতির।

তবে তিতির এখন হাসল না। ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল, আমার মা কাকিমাকে ভয় করে না, আমার বাবাকে ভয় করে?

-আপ অন গড। দুনিয়ার সব বাবাকেই আমার ভয় করে। তোমার বাবাকেও।

নিমেষে তিতির শরতের আকাশ হয়ে গেল। যাক, পৃথিবীতে তাও একজনও আছে যে তার বাবাকে ভয় পায়। মুখে শেষ বিকেলের আলো ফুটিয়ে তিতির বলল, আমার বাবা কিন্তু সত্যিই খুব রাগী।

–সে আমি টেলিফোনে গলা শুনেই বুঝেছি।

মনে মনে বাবার এক দীপ্ত বলশালী রূপ বানাল তিতির। সর্বাঙ্গ থেকে যেন তেজ বিচ্ছুরিত হচ্ছে বাবার, ব্যক্তিত্ব ফেটে পড়ছে। নেতিয়ে পড়া বাবার রোগাসোগা মুখটাকে মুছে ফেলল চোখ থেকে। ভুরু নাচিয়ে বলল, আমার বাবাকে তো চেনো না, আমার সঙ্গে তোমায় কোনও দিন দেখলে তোমাকে একেবারে কাঁচা খেয়ে ফেলবে। ওই যে বাংলা সিনেমায় একজন কমল মিত্র আছেন না, ঠিক তাঁর মতো। আমাদের বাড়িতে সবাই বাবার ভয়ে কাঁপে।

–তুমিও কাঁপো? সুকান্ত যেন দমেছে একটু।

–আমি ছাড়া। তিতির ঠোঁট টিপল।

–তুমি বাবাকে ভালবাসো?

 –পৃথিবীতে সব থেকে বেশি।

আমার বাবাকে আমি ভালবাসি না। তবে ভয় পাই।

তিতির গোয়েন্দার চোখে তাকাল, তবে যে খুব মস্তানের মতো বলো, বাবাকে এই করব, বাবাকে সেই করব…!

-ওটা তো রাগে বলি। দুঃখে বলি। ঘেন্নায় বলি। সুকান্তর মুখ আবার ম্লান হয়ে গেছে, তোমার বাবা খুব সাচ্চা মানুষ, তাই না?

সাচ্চা কাকে বলে তিতির ঠিক বোঝে না। অস্পষ্টভাবে ঘাড় নাড়ল বাবার বাইরেটা দেখে লোকে…বাবার ভেতরটা খাঁটি সোনা দিয়ে মোড়া।

–আমার বাপ ঠিক উল্টো। বাইরেটা শালা আটচল্লিশ ক্যারেট, ভেতরে ভর্তি সালফিউরিক অ্যাসিড।

–ছিহ, ওভাবে বলতে নেই।

–কেন বলব না? আমার বাবার ক্যারেক্টার কী তুমি তো জানো।

তবু তিনি তো তোমাকে ভালবাসেন। বাসেন না? যা চাও তাই দেন। টাকা চাইলে টাকা, গাড়ি চাইলে গাড়ি, কী না পাও?

–সে কি সাধে দেয়? বংশে বাতি দেব, সেই আশায় দেয়। মরার সময়ে আমি মুখে গঙ্গাজল না দিলে ভূত হয়ে ঘুরে বেড়াতে হবে, সেই দুর্ভাবনায় দেয়। মুখে শালা ছেলে ছেলে, এ দিকে মাকে শ্মশানে পাঠিয়ে দু দুটো মেয়েছেলে নিয়ে ফুর্তিতে আছে। আরও কোথায় কী করে বেড়ায় কে জানে!

–অত যদি জানো, তা হলে বাবাকে ভয় পাও কেন?

সুকান্ত চুপ হয়ে গেল। সামনে লেভেল ক্রসিং, রিকশা সাইকেল ট্যাক্সি গাড়ির লাট লেগে গেছে। রাস্তায়। যান্ত্রিক সংকেতধ্বনি বাজছে রেল গেটে, করুণ সুরে। শরতের বিকেল মরে এল।

ঝমঝমিয়ে ট্রেন চলে গেল একটা। শহর ছেড়ে শহরতলির দিকে ছুটছে। পিছনে ভাঁটার মতো এক লাল চোখ, সেও মিলিয়ে গেল ক্রমশ।

সুকান্ত আচমকা বলে উঠল, তুমি খুব লাকি তিতির।

লেভেল ক্রসিং-এর গেট উঠছে। তিতির এগোচ্ছিল, ঘুরে দাঁড়াল, কেন?

সুকান্ত উত্তর দিল না। কেমনভাবে যেন তাকিয়ে আছে। কিসের যেন এক আর্তি চোখে। আর্তি, না তৃষ্ণা? চোখ নামিয়ে নিল। ফিরে যাচ্ছে।

তিতিরের মায়া হচ্ছিল ছেলেটাকে দেখে। হাসিও পাচ্ছিল। কী বোকা, কী বোকা। তিতিরকেও লাকি বলে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *