৬১-৬৫. টোটোর চোখের পাতা

আজকাল দিবারাত্র টোটোর চোখের পাতায় লেগে থাকে গাড়িটা। বাবার সাদা মারুতি দাঁড়িয়ে আছে তিতিরদের বাড়ির দরজায়। এক বুনো রাগ দপদপ করে ওঠে টোটোর পাঁজরে। গোটা দুনিয়াটা তেতো লাগে। বাবাকে নিয়ে মার যে সন্দেহ, তাহলে সত্যি!

জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই মাকে কখনও সুখী দেখেনি টোটো। সে অর্থে বাবাকেও নয়। বাবা-মার মাঝে সর্বদাই যেন এক ধোঁয়ার আবরণ। কখনও কখনও দুজনে যে হাসিখুশি উচ্ছল হয় না তা নয়, কিন্তু সে যেন বড় কৃত্রিম। দুজনেই যেন পাল্লা দিচ্ছে অভিনয়ের। কারণটা যে এ বাড়ির হাওয়ায় ভেসে বেড়াত, টুকরো-টাকরা কথা চালাচালি থেকে অনুমান করত টোটো। কখনও মনে হত মা বড় বেশি সন্দেহপ্রবণ, হিস্টেরিক। কখনও ভাবত বাবাই বড্ড বেশি উপেক্ষা করে মাকে। মনে হত অবাস্তব এক সমস্যাকে ঘিরে অকারণ যুদ্ধের মহড়া চালায় দুজনে, এ যেন এক খেলা। যেন অসুখী হওয়ার জন্যই সুখী না হওয়ার পণ করেছে দুজনে। রাগ হত সেই অদৃশ্য মহিলার ওপর, যে আড়াল থেকে অবিরাম তীর ছুঁড়ে চলেছে তাদের সংসারে। তবে সে রাগটা ছিল অনেক ফাঁপা। তিতির নামের মেয়েটাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেই মিটে যেত সে ক্ষোভ। পরে আবার খারাপও লাগত। মনে হত নিজের মনটাই বড় ছোট হয়ে গেছে টোটোর।

কিন্তু সেদিন কী দেখল টোটো! কেন মার অত শরীর খারাপের সময়েও বাবার গাড়ি গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে তিতিরদের বাড়ির সামনে!

ভাবলেই টোটোর ব্রহ্মতালু জ্বলে ওঠে। অনুমান সত্য প্রতিপন্ন হওয়ার পরও এক সংশয় কুরে কুরে খায় টোটোকে। তার বাবা কি তবে সত্যিই চরিত্রহীন মানুষ? মাই বা কি? যে স্নেহার্দ চেহারাটা টোটোর সামনে তুলে ধরে মা, তার আড়ালে কি লুকিয়ে আছে এক আত্মসুখী মহিলা? যে সামান্য জাগতিক স্বাচ্ছন্দ্যের মোহে আত্মসম্মান বিকিয়ে আঁকড়ে আছে সংসার? নাকি শুধুই এক বিতৃষ্ণার শিকলে আটকা পড়ে আছে বাবা-মা?

হ্যাঁ, টোটোর এসব ভাবনা আসে আজকাল। সতেরো বছর বয়সে এত সব ভাবনা আসার কথা নয়, তবুও আসে। বনবন চরকি খায় মাথায়। তাদের বাতাসহীন ফ্ল্যাট তাকে যেন খুব তাড়াতাড়ি বড় করে দিচ্ছে।

রবিবারের সকাল। আকাশে আজ অল্প অল্প মেঘ জমেছে। একটু আগে ব্রেকফার্স্ট সেরে বেরিয়ে গেছে শুভাশিস, তার ফিরতে ফিরতে দুপুর হবে। রাঁধুনি মেয়েটির সঙ্গে রান্নাঘরে ঢুকল অলকা। ছন্দার এখনও বেশি তেলমশলা খাওয়া বারণ, তার রান্নাটা অলকা নিজের হাতেই করে। ড্রয়িং স্পেসে টিভিতে কার্টুন ফিলম চলছে, চোখ বড় বড় করে দেখছে টুকি, নিজের মনেই হঠাৎ হঠাৎ হাততালি দিচ্ছে, হেসে উঠছে খলখল। ছন্দা দাঁড়িয়ে আছে ব্যালকনিতে, তার শরীর এখনও পুরোপুরি সারেনি। শালিনী তাকে বহুদিন আগেই হাঁটাচলা করতে বলেছে, কিন্তু সে পারতপক্ষে বিছানা ছেড়ে উঠতেই চায় না। শুধু এই সকালটুকু ছাড়া।

টোটো অরগ্যানিক কেমিস্ট্রির বইটা উল্টোচ্ছিল। অ্যালডিহাইড কিটোনের ওপর কয়েকটা প্রশ্ন দিয়েছেন স্যার, পাঠ্যবই আর নোট মিশিয়ে উত্তর তৈরি করতে হবে। মন বসছে না, বারবার সহজ কেমিক্যাল ইকুয়েশানগুলো ভুল হয়ে যাচ্ছে। কী যে হয়েছে আজকাল! কালি-কলম-অক্ষরের দুনিয়ায় আর তেমন করে মন বসে না কিছুতেই। ধ্যাৎতেরি বলে উঠে পড়ল টোটো। জিনস টিশার্ট চড়াল গায়ে। ঘর থেকে বেরিয়ে গলা ওঠাল, কাকিমা… ও কাকিমা, আমি একটু বেরোচ্ছি।

অলকা খুব একটা অবাক হয়নি। টোটো আজকাল হুটহাট বাড়ির থেকে বেরিয়ে যায়, দেখেছে। অলকা। বলল, ফিরছ কখন?

টোটো গম্ভীর মুখে বলল, – দেখি। তবে বাবা আসার আগেই।

–দেরি কোরো না। তুমি না ফিরলে দিদি খেতে চায় না।

 টোটো উত্তর দিল না, হাসল সামান্য। এই কাকিমা মহিলাটিকেও ঠিক বুঝে উঠতে পারে না টোটো। এমনিতে কালেভদ্রে কলকাতায় আসে, এলেও ফেরার জন্য ছটফটানি। বাবা ওখানে একা আছেন, কি হবে! বাবা ওখানে একা আছেন, কি হবে! এবার নয় নয় করে এক মাস পার হয়ে গেল, অথচ ফেরার কথা মনেই নেই! দিনরাত সেবা করে চলেছে মার, এখানে কারুর যেন একটুও অসুবিধে না হয় সেদিকে কী সজাগ দৃষ্টি, অথচ মাধবপুরে যে একটা সংসার পড়ে আছে তা নিয়ে কোনও মাথাব্যথাই নেই! স্ট্রেঞ্জ! মাধবপুরের বাড়িতে কাকিমার কোনও এক নার্স বান্ধবী নাকি এসে মাঝে মাঝে রান্নাবান্না করে দিয়ে যায়। রাত হয়ে গেলে কাকা নাকি তাকে আবার মোপেডে করে কোয়ার্টারে পৌঁছে দিয়ে আসে। এই নিয়ে মা কাকিমার কথা হচ্ছিল কদিন আগে।

মা বলছিল, মেয়েটার বয়স কীরকম রে অলকা?

কাকিমা বলল, কত আর। আঠাশ-তিরিশ হবে।

–ওই বয়সের মেয়ে, তার হাতে সব ছেড়ে দিয়ে এলি?

–সব আর কী দিদি। ঘরদোর তো টুকির বাবাই সামলাচ্ছে।

–তা নয়, তবু ওই বয়সের মেয়ে, তুফানের সঙ্গে যখন-তখন মোপেড করে আসে যায়… মাধবপুর তো কলকাতা হয়ে যায়নি, এই নিয়ে কথা তো উঠতে পারে।

–তোমার দেওরকে তো তুমি চেনো দিদি। ও কি এসব কেয়ার করে? বাবাও করেন না, ছেলেও না।

–তা নয় হল, কিন্তু…। মা গলা নামিয়েছিল হঠাৎ তোর মন খচখচ করে না?

–আমার! কেন?

বাহ, তুফান পুরুষমানুষ না! সে একটু আলাভোলা ঠিকই, কিন্তু…. পুরুষমানুষের মতি বিগড়োতে কতক্ষণ!

কাকিমা হেসে উঠেছিল, স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কে কি পাহারাদারি চলে দিদি? খোলা-ছাড়া থাকলেই বরং মানুষের বন্ধন বেড়ে যায় গো। তেমন যদি কিছু তোমার দেওরের মনে থাকে, আমি কি মাধবপুরে থেকেও তাকে আটকে রাখতে পারব? বাবা বলেন, বিশ্বাস… বিশ্বাসই হল সংসারের ভিত। …কথাটা আমি খুব মানি দিদি।

কাকিমা হাসতে হাসতে কথা বলে যাচ্ছে, আর মার মুখ কালো হয়ে উঠছে ক্রমশ। টোটোরও বুক ভারী হয়ে গিয়েছিল সেদিন। তার বাবা-মার সম্পর্কও তো এমনটা হতে পারত। কোত্থেকে এত মনের জোর এসেছে কাকিমার? অথচ মার তুলনায় কাকিমা তো নেহাতই এক গেঁয়ো মহিলা, কলকাতার রাস্তায় ফুটপাথ দিয়ে হাঁটতেও ঘাবড়ে একশা হয়! স্ট্রেঞ্জ!

টুকির মাথায় আলগা চাঁটি দিয়ে ক্যাবিনেটের ড্রয়ার খুলে বাদামি মারুতির চাবি বার করল টোটো। দেখেই অলকা হাঁ-হাঁ করে ছুটে এসেছে, – ওকি! তুমি একা একা গাড়ি বার করবে নাকি! আজ তো রামদেও আসেনি!

টোটো ঠোঁটে আঙুল চেপে ইশারা করল, চুপ। মা শুনতে পাবে।

অলকা একবার ব্যালকনিতে দাঁড়ানো ছন্দাকে দেখে নিল, এটা কিন্তু ঠিক হচ্ছে না টোটো। গত রোববারও দাদা কিন্তু খুব রাগ করেছিলেন।

টোটো ফিসফিস করে বলল, -কাম অন কাকিমা, গাড়ি চালানো এখন আমার জলভাত হয়ে গেছে। তুমি রামদেওকে জিজ্ঞেস করে দেখো। গাড়ি বেরোলে ও আর এখন কতক্ষণ চালায়! চালাই তো আমিই।

জানি না বাবা। কাজটা তুমি ভাল করছ না।

–তোমায় জানতে হবে না। রিস্ক ইজ মাইন। তুমি কাইন্ডলি মাকে একটু ব্যালকনি থেকে সরিয়ে নাও। এমন জুলজুল করে তাকিয়ে আছে।

ঝড়ের গতিতে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল টোটো। আঠেরো বছর না হলে সে ড্রাইভিং লাইসেন্স পাবে না, এখনও তার আঠেরো বছর হতে দশ-এগারো মাস বাকি, তার জন্য কোনও পরোয়া নেই টোটোর। রামদেওর কাছে তালিম তার মন্দ হয়নি, মাসখানেকের শিক্ষাতেই সে বেশ দক্ষ হয়ে গেছে, মাত্র দশ মিনিটেই সাত-আট কিলোমিটার পথ উজিয়ে পৌঁছে গেল সন্তোষপুর।

হিয়ার ঠাকুমা দরজা খুলেছেন। টোটো বেশ অবাক হল, আপনি! কবে ফিরলেন?

হিয়ার ঠাকুমাকে খুবই শীর্ণ দেখাচ্ছে। উজ্জ্বল চোখ জ্যোতিহীন। ম্লান হেসে বললেন, পরশু।

–আপনার মুখচোখ এত খারাপ লাগছে কেন ঠাকুমা? শরীর খারাপ?

–আর শরীর।… তুমি ভাল তো? যাও না, হিয়া ঘরেই আছে।

 হিয়ার ঠাকুমা দ্রুত ভেতরে চলে গেলেন। যেন পালিয়ে বাঁচলেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই হিয়া ছুটে এসেছে দরজায়। অন্য দিন টোটোকে দেখলে চোখ জ্বলে ওঠে হিয়ার, আজ যেন তেমনটি ঘটল না। ফ্যাকাসে হেসে বলল, – ও তুই! আয়।

গাড়ির চাবি আঙুলে ঘোরাচ্ছে টোটো, উঁহু, তুই আয়।

হিয়া একটুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। নখ খুঁটছে আঙুলের। একবার দরজা দিয়ে বাইরে তাকাল। দেখছে টোটোর গাড়িখানা। ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে বলল, তুই বোস গাড়িতে, আমি আসছি।

চলছে গাড়ি। আগের মতো ঝোড়ো গতিতে না হলেও বেশ জোরেই। শহরের পূর্ব দিকে যে নতুন রাস্তা গড়ে উঠেছে, সেদিকে। হিয়া বসে আছে নির্বাক। তার খোলা চুল ভাসছে হাওয়ায়। মেঘলা আকাশে চাপা বিষণ্ণতা।

ছোট্ট একটা ব্রিজ পেরিয়ে টোটো বলল, –তোর ঠাকুমা ফিরে এসছেন তুই বলিসনি তো?

 হিয়া অন্যমনস্কভাবে বলল, -হয়নি বলা।

উঁহু, সামথিং রঙ মনে হচ্ছে!….ঠাকুমা হঠাৎ ফিরে এলেন কেন?

বাঁ হাতে খোলা চুল চাপল হিয়া, রঙ আবার কী। পিসির বাড়িতে ঠাম্মার খুব অসুবিধে হচ্ছিল, বাবা গিয়ে নিয়ে এল।

টোটো ঝট করে হিয়াকে দেখে নিল, এটা হাফ ট্রুথ। শুধু এটুকুনি যদি ঘটত তা হলে তোর মুখটা এরকম পেঁচার মতো হয়ে থাকত না।

হিয়া চুপ।

–তুই আমার কাছে কথা লুকোচ্ছিস হিয়া? মনে আছে আমরা কি প্রমিস করেছিলাম?

–আমি কোনও প্রমিস করিনি।

–অফকোর্স করেছিলি। আমরা হাতে হাত রেখে বলেছিলাম কেউ কারুর কাছে কিছু লুকোব না। বলতে গিয়ে গলা একটু কেঁপে গেল টোটোর। নিজের ফ্যামিলির কথা সে কতটুকু বলেছে হিয়াকে? বাবা-মার কথা ভাবতে গিয়ে তার যে বুকের ভেতর ব্লিডিং হয় অবিরাম, এ কথা কি হিয়াকে বলা উচিত ছিল না? কিন্তু সে বলেনি। বলতে পারেনি। মুখে বেধে গেছে।

টোটো সহজভাবে বলল, – ঠিক আছে না হয় নাই বললি। একটু ইজি হ। একটু রিল্যাক্সড হ।

হিয়া নাক টানল, তুই রাগ করছিস?

না, রাগের কি আছে।

কী বলি বল তো। যে পিসির বাড়ি গিয়েছিল ঠাম্মা, সেখানে খুব বিচ্ছিরিভাবে হিউমিলিয়েটেড হয়েছে। প্রায় পথে বসার দশা হয়েছিল। যে আশ্রমের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল, তারা মোটা টাকা ডোনেশান চায়। ঠাম্মা কোত্থেকে দেবে? বাবা শুনে হাঁচোড়-পাঁচোড় করে নিয়ে এল, অমনি বাড়িতে অশান্তি। কাল যখন বাবা বাড়ি ছিল না তখন ওই মহিলা, দ্যাট বিচ, ঠাম্মাকে বলেছে, অত তেজ দেখিয়ে কি হল! সেই তো ছেলের কাছে ফিরতে হল! শুনেই ঠাম্মা আবার বেরিয়ে যাচ্ছিল বাড়ি থেকে, অনেক কষ্টে আটকেছি। রাতে ওই মহিলার সঙ্গে বাবার ফাটাফাটি হয়ে গেল। সক্কালবেলা তিনি ছেলে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে গেছেন। এক ঘরে বাবা গুম হয়ে বসে আছে, এক ঘরে ঠাম্মা। ঠাম্মা বলছে, আমায় তুই ছেড়ে দে। বাবা বলছে, তুমি গেলে আমি আত্মহত্যা করব। এর মধ্যে কোনও মানুষ হাসি মুখে থাকতে পারে?

হিয়া ফোঁপাচ্ছিল। টোটো পরিবেশটা হালকা করতে চাইল, এ তো গুড নিউজ। এতে এত মন খারাপ করার কি আছে? ভদ্রমহিলা যদি আর না ফেরে তো সব প্রবলেম সলভড।

-তাই কি হয়! বাবার বিয়ে করা বউ, সে তার রাইট অত সহজে ছেড়ে দেবে? আমি তো ডিসাইড করেছিলাম মার কাছে পারমানেন্টলি চলে যাব। মার সঙ্গে কথাও হয়েছিল। কিন্তু এখন ঠাম্মাকে ছেড়ে আমি যাই কি করে?

–ও ভেবে লাভ নেই। মার কাছে গিয়েও তুই শান্তি পেতিস না।

–কেন নয়?

–বিকজ তোমার মারও একটা গণ্ডি হয়ে গেছে। তোর স্টেপ ফাদারকে তুই কি বাবা বলে অ্যাকসেপ্ট করতে পারবি?

রনি তো পেরেছে।

রনি গেছে অনেক ছোটবেলায়। ইউ আর নট দ্যাট চাইল্ড নাউ। টোটো নিজের জ্ঞান বুদ্ধি মতো বোঝানোর চেষ্টা করল, তোর এক ধরনের লাইকিংস ডিজলাইকিংস হ্যাবিটস গ্রো করে গেছে। অচেনা এনভায়রনমেন্টে তুই সেটলই করতে পারবি না।

-বাট ওই ভদ্রমহিলার থেকে দ্যাট ম্যান ইজ ফার বেটার। অনেক অ্যাফেকশনেট। রনিকে তো একদম নিজের ছেলে করে নিয়েছে।

–মে বি। কিন্তু তোকে আমি চিনি, তুই ওখানে মোটেই থাকতে পারবি না।

–পারার তো আর প্রশ্নও ওঠে না। আমি এখন সবসময় ঠাম্মার সঙ্গে থাকব। জানিস ঠাম্মা কাল কী বলছিল আমাকে? বলছিল আমার চোখ দুটো ভাল থাকলে শত উপরোধেও ফিরতাম না। আবার সেলাই করে….। ঠাম্মার কী পারসোনালিটি ছিল, কদিনে কী হয়ে গেছে ঠাম্মা! আ রুইন। ভাবাই যায় না এই ঠাম্মাই একদিন একা কষ্ট করে ছেলেকে মানুষ করেছে!

হিয়ার সান্নিধ্যে এলে টোটোর বুকের ভেতরের বুনো রাগটা পোষা কুকুরের মতো লেজ গুটিয়ে শুয়ে পড়ে। এই মুহূর্তে গাঝাড়া দিয়ে উঠল কুকুরটা, ঝপ করে অ্যাক্সিলেটারে পা চাপল টোটো, সাঁই করে পার হয়ে গেল এক জগদ্দল লরি। সামনের আয়নায় চোখ রেখে বলল, – আমাদের বাবা-মার জেনারেশানটাই বড় বিটকেল। সব সেলফিশ। নিজেদেরটুকু ছাড়া পৃথিবীতে আর কিছু বোঝে না। আই জাস্ট হেট দেম।

টোটো আচমকা উত্তেজিত হয়ে পড়েছে। সামনে সামনে একটা অ্যাম্বাসাডার যাচ্ছে, রাস্তার মাঝখান দিয়ে, জোরে জোরে হর্ন কয়েকবার বাজাল। গাড়িটা তবু পথ ছাড়ছে না। সবেগে, প্রায় গাড়িটার গায়ে গা লাগিয়ে, সামনে এগিয়ে গেল টোটো। জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে অ্যাম্বাসাডারের ড্রাইভার অশ্রাব্য গালাগাল দিল একটা।

হিয়া সভয়ে জানলা থেকে হাত সরিয়ে নিল। এক দৃষ্টে দেখছে টোটোকে।

টোটো নির্বিকার মুখে গাড়ির গতি বাড়াচ্ছে। দু পাশে বিস্তীর্ণ মাঠ। জায়গায় জায়গায় নতুন শহরতলির পত্তন হয়েছে। মাঝের কালো রাস্তা ছুটছে খরস্রোতা নদীর মতো। চার চাকার খেলনা চিরছে নদীর বুক।

ঝাঁ করে অনেকটা পথ চলে গিয়ে ঘাড় ঘোরাল টোটো, –কী দেখছিস?

–তোর হঠাৎ কী হল রে রাজর্ষি?

–কিছু না। ফান। টোটো হঠাৎ গাড়ির স্টিয়ারিং ছেড়ে দিল, এই হল লাইফ। কারুর তোয়াক্কা কোরো না। দু হাত ছেড়ে বাঁচো।

রাজর্ষি প্লিজ, ওরকম করিস না। আমার বুক কাঁপছে।

–ইজ ইট? ফিল করে দেখব?

 –অসভ্যতা করিস না। ঠিকভাবে চালা।

 –ঠিকভাবেই তো চালাচ্ছি।

–আমি আর তোর সঙ্গে কোনওদিন গাড়িতে উঠছি না।

–তুই তো তোর নেকু বন্ধুটার মতো কথা বলছিস রে!

 –কোন বন্ধু?

–ওই যে বোকা সেজে থাকে। বেসিকালি ন্যাকার ডিম।

কার কথা বলছিস?

–তোর বেস্ট ফ্রেন্ড। তিতির। অত সরল সেজে থাকা ঘোড়েল মেয়ে আমি আর দুটো দেখিনি। আবার স্টিয়ারিং আঁকড়ে ধরেছে টোটো। আবার দৃশ্যটা ভাসছে চোখের সামনে। বাবার সাদা মারুতি। অন্ধকারে ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে আছে তিতিরদের দরজায়। গোপন পাপের মতো। ল্যাম্পপোস্টের গায়ে সাঁটা রগরগে কুৎসিত বিজ্ঞাপনের মতো।

হিয়া সোজা হয়ে বসেছে, তিতিরের সঙ্গে তোর দেখা হয়েছিল? কবে?

হয়েছিল একদিন। সম্রাটদের বাড়ি ফুর্তি মারতে গিয়েছিল, ফেরার পথে অন্ধকার রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভিজছিল বৃষ্টিতে। তোর বন্ধু বলে গাড়িতে একটা লিফট দিলাম। বুক ভরে তাজা বাতাস টানল টোটো। অদৃশ্য ওই মহিলার কথা ভাবতে গেলেই কেন যে সব রাগ গিয়ে তিতিরের ওপর পড়ে! তিতির কি বোঝে না কিছু? নাকি বুঝেও না বোঝার ভান করে? গলার স্বর আরও রুক্ষ করে টোটো বলল, তুই তো খুব বন্ধু বন্ধু করিস, তোর সম্পর্কে কী আজেবাজে কথা বলছিল জানিস?

–তিতির আমার নামে বাজে কথা বলছিল! হতেই পারে না।

–আমি মিথ্যে বলছি? দেখা হলে জিজ্ঞেস করে দেখিস। ওই মেয়েটা তোকে সহ্যই করতে পারে না।

হিয়ার পলক পড়ছে ঘন ঘন। যেন বিশ্বাস-অবিশ্বাস একই সঙ্গে খেলা করে চলেছে। ভুরু কুঁচকে বলল, কী বাজে কথা বলেছে তিতির?

–সে আর শুনে কী করবি? মিছিমিছি মন খারাপ হবে।

–তবু বল শুনি।

বাদ দে, ও একটা স্ক্যান্ডাল মঙ্গার। টোটো চিবিয়ে চিবিয়ে কথা বলছে, আফটার অল ওর ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ডটা তো ভাল নয়। বাপটা ড্রাঙ্কার্ড, মারও ক্যারেকটারে গণ্ডগোল আছে… ওই জন্যই তো ওদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখি না।

হিয়া নিথর। একটু পরে নিচু গলায় বলল, কিন্তু ও তো বলে তোর বাবা ওদের বাড়িতে যান।

টোটো দাঁতে দাঁত ঘষল। হঠাৎ গাড়ির গতি বাড়িয়েই কমিয়ে দিল পরমুহূর্তে। আবার বাড়াল, আবার কমাল। যেন খেলা করছে গাড়িটাকে নিয়ে। মুখে একটা অদ্ভুত হাসি ফুটিয়ে বলল, — ছাড় তো তোর তিতিরের কথা। ওর সঙ্গে তোর আর বেশি মেশামিশি করার দরকার নেই।

হিয়া তবু কী যেন ভাবছে।  

এই ক মাসেই হিয়ার ওপর যেন অধিকার জন্মে গেছে টোটোর। সে গম্ভীর মুখে বলল, –কথাটা কানে ঢুকল? শুনছিস কী বললাম?

–শুনছি তো।

–শোনা নয়, টেক ইট ইন্টু হার্ট। যে তোর সম্পর্কে আড়ালে খারাপ-খারাপ কথা বলে তার সঙ্গে তোর সম্পর্ক রাখা আর চলবে না। মনে থাকবে?

হিয়া নিঃশব্দে দুদিকে মাথা নাড়ল।

বিকৃত আনন্দে পলকের জন্য উদ্ভাসিত হল টোটোর মুখ, পরক্ষণেই বুকটা মোচড় দিয়ে উঠেছে। তিতির কি খুব আঘাত পেয়েছিল সেদিন! টোটো তো তিতিরের বন্ধুই হতে চেয়েছিল, কেন যে সেদিনই সাদা মারুতিটা…!

একটা ম্যাটাডোর ভ্যান সামনে এসে গেছে। ঢকর-কর করে চলছে রাস্তা জুড়ে। অস্থির আঙুলে হর্ন বাজাল টোটো। সরছে না গাড়ি। বারবার টোটোর রাস্তায় কেন যে এত প্রতিবন্ধকতা!

ক্ষিপ্র গতিতে টোটো পিছনে ফেলতে চাইল ম্যাটাডোরকে। গাড়িটাও গতি বাড়িয়েছে অকস্মাৎ। পাল্লা দিচ্ছে। একটু আগের অ্যাম্বাসাডারের ড্রাইভারটার গালাগাল মনে পড়ল টোটোর। সঙ্গে সঙ্গে আরও তেতে গেছে মাথা। আরও জোরে অ্যাক্সিলেটারে চাপ দিল টোটো।

হিয়া চিৎকার করে উঠল, এই রাজর্ষি, কি করছিস কী? আস্তে। আস্তে।

টোটো ধমকে উঠল, চুপ করে বোস তো। সোয়াইনটার এত বড় সাহস, রাজর্ষি সেনগুপ্তর সঙ্গে কম্পিটিশান দেয়! দেখাচ্ছি মজা।

স্পিডোমিটারের কাঁটা ঝলকে নব্বই ছাড়িয়েছে। বিদ্যুদবেগে ম্যাটাডোরটাকে পার হয়ে গেল টোটো।

আর ঠিক তখনই টোটো বুঝতে পারল গাড়ি আর তার বশে নেই। ব্রেকে পা আনতেও ভুলে গেল টোটো।

অন্ধকার। চারদিকে চাপ চাপ অন্ধকার।

.

৬২.

নার্সিংহোমে খবরটা পেল শুভাশিস। স্যাস ক্লিনিকের চেম্বারে শেষ রুগীটিকে দেখে সে যখন ওঠার তোড়জোড় করছে, তখনই বাড়ি থেকে ফোন এল। অলকার।

মুহূর্তের জন্য হৃৎস্পন্দন থেমে গিয়েছিল শুভাশিসের। শরীর অবশ, হিম। মাথা যেন একলহমায় সম্পূর্ণ ফাঁকা। এখন কী করবে সে? এক্ষুনি তার কি করা উচিত? চিন্তা যুক্তি বুদ্ধি সব লণ্ডভণ্ড হয়ে যাচ্ছে। কোনওক্রমে ভাঙা গলায় ডাকল, – অরূপ…এই অরূপ…।

রবিবার অরূপের নার্সিংহোমে চেম্বার থাকে না, তবু আসে। রাউন্ড দেয়, টুকিটাকি লেখাপত্রের কাজ সারে, চারদিক দেখাশুনো করে, দরকারি কোনও ফাইল থাকলে বসে সেসব নিয়ে। আজ অফিসঘরে একটা চিঠি টাইপ করাচ্ছিল। শুভাশিসের আর্ত ডাক শুনে ছুটে এল সে, কী হয়েছে?

শুভাশিসের আর গলা দিয়ে স্বর বেরোচ্ছিল না। বিবর্ণ মুখে ফোনের দিকে আঙুল দেখাল।

অরূপ সন্দিগ্ধ চোখে তাকাল, হল কী তোর? ফিলিং সিক?

শুভাশিস জোরে জোরে মাথা ঝাঁকাল। মুঠো শক্ত করে শাস টেনে বাতাস ভরল বুকে। ঘড়ঘড়ে গলায় বলল, – টোটো অ্যাক্সিডেন্ট করেছে।

–সে কী! কোথায়? কখন? কী অ্যাক্সিডেন্ট?

–খানিক আগে। বাইপাসে। নতুন গাড়িটা নিয়ে বেরিয়েছিল…। পুলিশ তুলে হসপিটালে নিয়ে গেছে।

–কোন হসপিটাল?

এন আর এস। …কী হবে অরূপ?

 শুভাশিস কাঁপছে ঠক ঠক। অরূপ এগিয়ে এসে তার পিঠে হাত রাখল, কুল কুল। তুই নাভার্স হয়ে গেলে চলবে কেন? ওঠ দেখি, চল।

শুভাশিস পায়ে জোর পাচ্ছিল না। টলতে টলতে উঠেছে।

অরূপ বলল, এক সেকেন্ড দাঁড়া। এন আর এস-এ একটা ফোন করে নিই। যদি লাহিড়িকে পেয়ে যাই…। ফোনের বোম টিপতে গিয়েও অরূপ হাত সরিয়ে নিল, ধুস, আজ তো রোববার। কোনও শালা সিনিয়ারকে পাওয়া যাবে না। চল চল বেরিয়ে পড়ি। কুইক।

শুভাশিসকে নিজের গাড়িতে তুলে নিয়ে অরূপ স্টিয়ারিং-এ বসল। টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। বড় মলিন হয়ে গেছে দিনটা। ছুটির বেলা, রাস্তাঘাটে লোকজনও বেশ কম। গাড়ি চালাতে চালাতে অরূপ নিচু গলায় প্রশ্ন করল, – ইনজুরির নেচার নিয়ে কিছু বলল?

শুভাশিসের মাথা এখনও ঠিকঠাক কাজ করছে না। বিড়বিড় করে বলল, – টোটোর যদি আজ কিছু হয়ে যায়…।

–আগেই খারাপটা ধরে নিচ্ছিস কেন? হয়তো দেখবি তেমন কিছুই হয়নি।

তা হলে পুলিশ হসপিটালে নিয়ে গেল কেন?

 –সে তো মাইনর ইনজুরিতেও নিয়ে যেতে হয়।… স্টেডি শুভ। ইউ আর এ ডক্টর।

শুভাশিস তবু ঠিক সান্ত্বনা পাচ্ছিল না। টোটো তার কাছে কতখানি এ কথা অরূপ কী করে বুঝবে! আর ডাক্তার বলে সে তো আর অতিমানব কিছু হয়ে যায়নি। বরং এই মুহূর্তে তার পেশাদারি নিস্পৃহতা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। তীব্র এক পিপাসায় শুকিয়ে আসছে কণ্ঠনালী। বাবা শুভাশিস ছাপিয়ে গেছে ডাক্তার শুভাশিসকে।

অরূপ আবার প্রশ্ন করল, ফোনটা কে করেছিল? পুলিশ? হসপিটাল?

না, বাড়ি থেকে এসেছিল। পুলিশ বাড়িতে জানিয়েছে।

তার মানে তোকে ছন্দা খবরটা দিল?

নাহ। অলকা। তুফানের বউ। শুভাশিস সিগারেট ধরাতে গিয়ে দু-তিনটে কাঠি নষ্ট করল। ধোঁয়াটা না ছেড়ে জমিয়ে রাখল বুকে। এক আত্মগ্রাসী উদ্বেগের চাপে এতক্ষণ ছন্দার কথা মনেই হয়নি। মনে পড়তেই ডুব-ডুব শঙ্কা। এমনিই তো অপারেশানের পর থেকে কেমন মূহ্যমান হয়ে থাকে ছন্দা, খবরটা পেয়ে কী করছে এখন! উথাল-পাতাল! আছাড়ি-পিছাড়ি! পাথর! অলকাকে নিয়ে জোর করে চলে আসবে না তো হাসপাতালে!

শুভাশিস অধৈর্যভাবে বলে উঠল, কতবার ছেলেটাকে বলেছি তোর এখন গাড়ি চালানোর বয়স হয়নি, গাড়িতে হাত দিবি না…গাড়িতে হাত দিবি না!… ওফ, ওই গাড়িটা কেনাই আমার ভুল হয়ে গেছে।

–এখন ওসব ভেবে লাভ আছে। মাথা ঠাণ্ডা রাখ। হাত বাড়িয়ে শুভাশিসের সিগারেটটা নিয়ে নিল অরূপ, ওই বয়সের ছেলে হাতে গাড়ি পেলে চালাতে চাইবেই।

–আমি কালই ওই রামদেওটাকে তাড়াব। বায়না ধরছে বলেই ড্রাইভিং শেখাতে হবে! যদি আমার ছেলের কিছু হয়ে যায় ওকে আমি ছাড়ব না। পুলিশে দেব। ঘানি টানাব।

শুভাশিস অর্থহীন গজগজ করে চলেছে। যেন ওভাবেই ভুলিয়ে রাখা যায় নিজেকে। যেন দুর্বলতর কাউকে শাস্তি দিলেই প্রশমিত হবে উদ্বেগ। হায় রে, তা কি হয়?

হাসপাতালে পৌঁছে তীরবেগে এমারজেন্সির দিকে ছুটল শুভাশিস। এমারজেন্সি টেবিলেই শুয়ে আছে টোটো। মাথা জোড়া ব্যান্ডেজ, নাকে স্টিকিং প্লাস্টার, বাঁ চোখের নীচে বড় একটা কালশিটে, থুতনিতে ছোপ ছোপ মারকিউরোক্রোম। ডান হাতের কনুই কেতরে ভাঁজ হয়ে আছে বুকে, হাতেও বেশ চোট লেগেছে বোঝা যায়। টোটোর পাশে ভীষণ শুকনো মুখে বসে আছে একটি মেয়ে, তার হাতে-মুখেও ছোট ছোট আঘাতের চিহ্ন।

শুভাশিস খানিকটা আকুল স্বরে বলল, — এ কী করলি রে তুই টোটো!

টোটো তাকাল।

কথাটা নিজের কানেই যাত্রার ডায়ালগের মতো শোনাল শুভাশিসের। নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করে হাসল একটু।

টোটোর ঠোঁটের কোণেও এক ফালি হাসি ফুটে উঠেছে। হাসিটা যেন ঠিক হাসি নয়, তবু হাসিই বাবাকে দেখে কি আশ্বাস পেল ছেলে? নাকি দুষ্টুমি ধরা পড়া অপ্রস্তুত হাসি ওটা? শুভাশিস ঠিক বুঝতে পারল না। তবে স্বস্তি পেল। যাক, ফাঁড়াটা অল্পের ওপর দিয়ে গেছে।

শুভাশিস ঢোঁক গিলে জিজ্ঞাসা করল, কটা স্টিচ হল?

–বোধহয় পাঁচটা। টোটো সামান্য মুখ ফাঁক করল, তেমন কিছু হয়নি।

–সে তো দেখতেই পাচ্ছি। বমি-টমি হয়েছিল?

 –না।

–বাবার কথা না শোনার ফল দেখছিস তো?

–পুরো দেখা হল কই। টোটো আবার হাসল। অদ্ভুত এক মর্ষকামী হাসি।

এ কেমন হাসি ছেলের! বুকের খাঁচাটা কেঁপে উঠল শুভাশিসের। গোমড়া মুখে বলল, অ্যাক্সিডেন্টটা হল কী ভাবে?

পরে শুনো।… এই আমার বন্ধু হিয়া। আমার ক্লাসমেট। ও আমার সঙ্গে ছিল। ওর বাড়ি ফেরার একটা অ্যারেঞ্জমেন্ট করে দাও।

এক সঙ্গে এতগুলো কথা বলে হাঁপাচ্ছে টোটো। শুভাশিস ব্যস্ত হয়ে পড়ল, তোর রিব-টিবে চোট লাগেনি তো?

–আহ বাবা, তুমি আগে হিয়াকে দেখো। ওর বাড়িতে ফোন নেই, খবর দেওয়া যায়নি।

শুভাশিসের যেন হুঁশ ফিরল এতক্ষণে। ভাল করে দেখল মেয়েটিকে। মাথা নিচু করে বসে আছে। বোধহয় ভয় পেয়ে কাঁদছিল খুব, গাল থেকে জলের রেখা এখনও শুকোয়নি। দায়িত্বশীল অভিভাবকের মতো হিয়ার চোট-আঘাতের খবর নিল শুভাশিস, বাড়ির ঠিকানা জেনে বসিয়ে এল অরূপের গাড়িতে। নিজেদের পরিচয় দিয়ে অরূপ এক তরুণ হাউস স্টাফের সঙ্গে কথাবার্তা সেরে নিচ্ছে। হাউস স্টাফ ছেলেটি বেশ সসম্ভ্রমে কথা বলছে অরূপের সঙ্গে, বুঝিয়ে দিচ্ছে আঘাতের পরিমাণ। আজ রবিবার, এক্সরে করা যায়নি, যেন বাড়ি গিয়ে কনুইয়ের এক্সরে করে নেওয়া হয় টোটোর, হেয়ার লাইন ফ্র্যাকচার হলেও হয়ে থাকতে পারে।

অরূপের কাঁধ ধরে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বেরোচ্ছে টোটো, শুভাশিস পাশে পাশে হাঁটছিল। দিঘির ধারে দাঁড়িয়ে আছে অরূপের লাল ক্রস মারা গাড়ি, সেদিকে এগোচ্ছে, মাটি খুঁড়ে এক কনস্টেবল এসে হাজির। টোটোকে দেখিয়ে বলল, এ কার গাড়ি চালাচ্ছিল?

শুভাশিস কপাল কুঁচকোল, — আমার গাড়ি। হি ইজ মাই সান।

-অ। কিন্তু গাড়ির তো পুলিশ কেস হয়ে গেছে। আপনাদের একবার থানায় যেতে হবে।

এক্ষুনি?

নইলে আপনি ছেলেকে নিয়ে যাবেন কী করে? ওকে তো আপনাদের বেল বন্ডে ছাড়াতে হবে। বিনা লাইসেন্সে গাড়ি চালাচ্ছে, অ্যাক্সিডেন্ট করেছে… এলেন আর ওমনি নিয়ে চলে গেলেন?

কাউকে চাপা দিয়েছে নাকি?

–দিতেই পারত। যা র‍্যাশ চালাচ্ছিল! দেয়নি, রাস্তার লোকের কপাল।… আপনি একবার বড়বাবুর সঙ্গে দেখা করে যান।

অরূপ টোটোকে গাড়িতে ছেড়ে দিয়ে ঘুরে এসেছে। পকেট থেকে একটা সিগারেট বাড়িয়ে দিল কনস্টেবলের দিকে, ফালতু ঝামেলা করছেন কেন বলুন তো? আমরা কি পালিয়ে যাব? হি ইজ আ ডক্টর।… অ্যাই শুভ, তোর একটা কার্ড দিয়ে দে না।

শুভাশিসের কার্ডে আলগা চোখ বোলাল ছোকরা কনস্টেবল। সিগারেট আর কার্ড এক সঙ্গে পকেটে রেখে দিল। একটু নরম সুরে বলল, আপনাকে একবার থানায় যেতেই হবে ডাক্তারবাবু। সইসাবুদ করতে হবে…

করব, সব করব। বিকেলে যাব থানায়। বাই দা বাই, আমার গাড়িটা কোথায়?

–গাড়ি বোধহয় এতক্ষণে থানায় এসে গেছে।

কী অবস্থা গাড়ির?

–সে গেলেই দেখতে পাবেন। অত জোরে ধাক্কা মেরেছে…। কপাল ভাল, ছেলে আপনার হেঁটে চলে যাচ্ছে।

–বিকেলে গ্যারেজ থেকে মিস্ত্রি নিয়ে যাব? গাড়ি আনা যাবে?

–অ-আজ! কনস্টেবল দাঁত বার করে হাসল, কবে গাড়ি ছাড়া পাবে তার ঠিক আছে! মেকানিকাল হবে… আপনারা তো বলতেও পারেন গাড়ির ব্রেক ফেল ছিল। তারপর ধরুন…

ঠিক আছে, ঠিক আছে। যা হবার হবে। বলেই অরূপ কাঁধে হাত দিয়ে এক পাশে সরিয়ে নিয়ে গেল কনস্টেবলকে। মিনিটখানেক পরে ফিরে এল দুজনে। ফিরেই কনস্টেবলের অন্য মূর্তি। হাসিমুখে বলল, আচ্ছা স্যার, নিয়ে যান ছেলেকে। বিকেলে কিন্তু আসবেন স্যার, নইলে কিন্তু প্রবলেম হয়ে যাবে। বলতে বলতে ঘোলাটে আকাশের দিকে তাকিয়ে আড়মোড়া ভাঙল বড় করে, আসলে স্যার এখানে আমার একটা অন্য কেস আছে। পরশু রাতে আমাদের লকআপে এক শালা ড্রাগ কেস গলায় ব্লেড চালিয়েছিল। এখন এখানে ভর্তি আছে। ওর ডিউটি আমার ওপর। তার সঙ্গে বড়বাবু আপনার ছেলেকে ট্যাগ করে দিল। আমি কিন্তু আপনাদের নিজের রিসকে ছেড়ে দিলাম। কথাটা মনে রাখবেন স্যার।

–মনে তো রেখেছি। রাখিনি? পকেটে তো এখনও নোটের লেজটা দেখা যাচ্ছে। অরূপ ঝেঁঝে উঠল সামান্য।

কনস্টেবলটা মানে মানে সরে পড়ল।

পিছনের সিটে বসে আছে টোটো আর হিয়া। টোটো শরীর ছেড়ে দিয়েছে পিছনপানে, চোখ দুটি বোজা। হিয়া ঈষৎ জড়সড়।

সামনের দরজা খুলে শুভাশিস অরূপকে জিজ্ঞাসা করল, ব্যাটা কত নিল রে?

–ওর আর কত নেওয়ার দৌড়! ভিখিরির ভিখিরি। বিশ টাকা ধরিয়ে দিয়েছি।

শুভাশিস সঙ্গে সঙ্গে পার্স থেকে টাকা বার করছিল, অরূপ বাধা দিল, রিল্যাক্স ম্যান। তোর এখন অনেক গুনাগার যাবে। বউনিটা জাস্ট আমার হাত দিয়ে হল। টোটো-মাস্টার জম্পেশ একটা কাণ্ড বাধিয়েছে। হা হা।

হুঁ। শুভাশিস মাথা নাড়ল, ইনসিওরেন্সের টাকাটাও বোধহয় পাওয়া যাবে না। রিপেয়ারিং-এও ভালই গচ্চা যাবে।

পিছন থেকে টোটোর বিস্বাদ স্বর শোনা গেল, -সরি ফর দা লস বাবা।

শুভাশিস ঘুরে বসল, টাকার লস নিয়ে আমি ভাবি না টোটো। আই ক্যান অ্যাফোর্ড ইট। কিন্তু আজ কত বড় একটা বিপদ হতে পারত, সে তুমি বুঝেছ? আমার প্রফেশনাল টেনশান আছে, তোমার মাকে নিয়ে অ্যাংজাইটি আছে…

-প্লিজ বাবা…

উঁহু, তোমার শোনা উচিত। তুমি এখন আর শিশু নও।

–জানি আমি শিশু নই। তাই তো বলছি স্টপ ইট।

টোটোর স্বরের তীব্রতায় একটু হকচকিয়ে গেল শুভাশিস।

অরূপ বলল, কী বাপ ছেলেতে তর্ক শুরু করলি! পাশে একটা মেয়ে বসে আছে, ওর কথাটাও ভাব। বেচারার মুখটা একেবারে পেল হয়ে গেছে।

শুভাশিস ক্ষুব্ধ স্বরে বলল, হ্যাঁ, নিজে নয় বেরিয়েছ নিজের দায়িত্বে, ওই মেয়েটার আজ কোনও ক্ষতি হয়ে গেলে ওর বাবা-মার কাছে মুখ দেখানো যেত?

অনেকক্ষণ পর হিয়া নড়ে উঠল, আমি ঠিক আছি মেসোমশাই।

শুভাশিস শান্ত করে নিল নিজেকে। টোটোর বন্ধুর সামনে সিন ক্রিয়েট করা কোনও কাজের কথা নয়। ছেলে তাতে আরও বেশি উত্তেজিত হবে। দুটো বাজে, মেয়েটাকেও আগে বাড়ি পৌঁছে দেওয়া দরকার। ওদিকে ছন্দাও নির্ঘাত ছটফট করছে, এতক্ষণে না জানি কী হচ্ছে বাড়িতে? ভাগ্যিস তাও অলকা আছে এখন! ঠাণ্ডা মাথায় আশু কর্তব্য স্থির করে নিল শুভাশিস। অরূপ বাড়ি নিয়ে যাক টোটোকে, শুভাশিস বরং মেয়েটাকে পৌঁছোনার জন্য ট্যাক্সি ধরে নিক একটা। বন্ধুর বাবা হিসেবে হিয়ার বাড়ি যাওয়া এখন তার কর্তব্যও বটে।

ট্যাক্সিতে উঠে হিয়াকে ভাল করে লক্ষ করছিল শুভাশিস। মায়াকাড়া মিষ্টি মুখ, বেশ একটা বুদ্ধির ছাপও আছে চোখে মুখে। তবে এই মুহূর্তে বড় শঙ্কাতুর হয়ে আছে মুখটা। চুপটি করে কি যেন ভাবছে।

কথায় কথায় মেয়েটাকে স্বাভাবিক করতে চাইল শুভাশিস। অপারেশান করার আগে যেভাবে কথা বলে অন্যমনস্ক করে থাকে রুগীদের। সিগারেট ধরিয়ে বলল, – সন্তোষপুরের কোন দিকটায় থাকো?

ভাসা ভাসা চোখ তুলল হিয়া, মিনিবাস স্ট্যান্ডের কাছে। আপনি চেনেন সন্তোষপুর?

এক সময়ে খুব যেতাম ওদিকে। ওখানে একটা দিঘি মতন আছে না… একটা ট্র্যাঙ্গুলার পার্ক..ওখানে।

–লেকটার কথা বলছেন?

–তোমরা ওটাকে লেক বলো বুঝি? হা হা। অবশ্য বিশ বছরে ওদিকটা অনেক বদলে গেছে শুনেছি। তখন তো ছিল রেফিউজি এরিয়া। এক দিকে গড়ফা, এক দিকে সন্তোষপুর…। তোমাদের ওই লেকের ধারে তখন একটা-দুটো বড় বাড়ি উঠেছে কি ওঠেনি… ধরো সেই লেট সিক্সটিজের কথা। তখন ডাক্তারি পড়ছি।

ওদিকে আপনার বন্ধু ছিল বুঝি?

–উউউ, বন্ধু নয়। কমরেড। একসঙ্গে সব পার্টি করতাম।

আপনি পার্টি করতেন মেসোমশাই!

প্রিয় প্রসঙ্গটা তুলতে পেরে আত্মপ্রসাদ বোধ করছিল শুভাশিস। হাসি হাসি মুখে কাঁধ ঝাঁকাল, করতাম বইকি। আমাদের স্টুডেন্ট লাইফে আমাদের একটা ওয়াইড ভিসান ছিল। সোশাল ডিসপেয়ারিটিগুলো আমাদের খুব হন্ট করত। আজকালকার ছেলেমেয়েদের মধ্যে সেই মানসিকতা আর দেখাই যায় না। এই যে নেলসন ম্যান্ডেলা মুক্তি পেল, তাই নিয়ে তোমাদের স্টুডেন্টদের মধ্যে কোনও আলোড়ন হল? আমাদের সময় হলে শহর উত্তাল হয়ে যেত।

হিয়ার মুখে হাসি ফুটেছে। কথা বলছে টরটর। চারপাশের জগৎ সম্বন্ধে বেশ জ্ঞান আছে মেয়েটির, শুভাশিসের ভাল লাগছিল। হঠাৎ ফাঁক বুঝে জিজ্ঞাসা করল, হাউ ডিড ইট হ্যাপেন হিয়া?

-কী?

–এই অ্যাক্সিডেন্ট?

 হিয়া চুপ।

কত স্পিড তুলেছিল টোটো? আই মিন রাজর্ষি? নব্বই? একশো?

 হিয়া মাথা নিচু করে আছে।

–তোমাকে তো বেশ ঠাণ্ডা মাথার মেয়ে বলে মনে হয়, তুমি ওকে বারণ করতে পারোনি?

রাজর্ষি ভীষণ ইর‍্যাটিক মেসোমশাই। হঠাৎ হঠাৎ রেগে যায়, হাসতে হাসতে স্পিড বাড়িয়ে দেয়, কখন যে কী মুডে থাকে বোঝাই যায় না।

ইজ ইট?

-হ্যাঁ মেসোমশাই। কেউ ওকে ওভারটেক করলে ও সহ্য করতে পারে না। বিশেষ করে যখন ওর মুড অফ থাকে।

–আজ মুড অফ ছিল?

–না, মানে…।

শুভাশিস একটু আড়ষ্ট বোধ করল। টোটোর সঙ্গে মেয়েটির বিশেষ কোনও ঘনিষ্ঠতা আছে কি? এই বয়সে তা অসম্ভবও নয়। শুভাশিস কি বেশি টিকটিকিপনা দেখাচ্ছে? সিগারেট বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বলল, তোমার অসুবিধে থাকলে বোলো না। আমরা অন্য কিছু নিয়েও কথা বলতে পারি।

হিয়া হেসে ফেলল, আপনি যা ভাবছেন তা নয় মেসোমশাই। উই আর গুড ফ্রেন্ডস। রাজর্ষি আমাকে খুব পছন্দ করে, আমিও রাজর্ষিকে। আমাদের কমন পয়েন্ট অফ ইন্টারেস্ট আছে, উই শেয়ার আওয়ার ভিউজ সরোজ অ্যান্ড হ্যাপিনেস।

শুভাশিসের খুব মিষ্টি লাগল কথাটা। আজকালকার ছেলেমেয়েদের মধ্যে সম্পর্ক কত সুন্দর! কত স্বাভাবিক! হয়তো এদের জীবনে জটিলতাও কম হবে। তাদের সময়ে জীবন অনেক প্যানপেনে ছিল। অকারণ আবেগে জ্যাবজেবে হয়ে থাকত।

মুখে হাসি মাখিয়ে শুভাশিস বলল, তা হলে শোনাই যাক তোমার বন্ধুর মুড অফ ছিল কেন।

–আমিও ঠিক বুঝতে পারিনি মেসোমশাই। আসলে..আসলে…। হিয়া ইতস্তত করছে। একটু দম নিয়ে বলল, আমার এক বন্ধু আছে। তিতির। আপনি বোধহয় তাকে চেনেন। ঢাকুরিয়ায় থাকে। কী জানি কেন রাজর্ষি ওকে স্ট্যান্ড করতে পারে না। ওর কথা যেই উঠল ওমনি…।

আবার মাথাটা ফাঁকা হয়ে গেল শুভাশিসের। কোন দিক থেকে যেন হাওয়া ছুটে আসছে বুঝতে পারছে না। মনে হচ্ছে এক গোপন গুহায় পা বাড়িয়ে ফেলেছে, যার সামনে অন্ধকার না খাদ কিছুই তার জানা নেই। টোটো তিতিরকে তাদের বাড়ি নিয়ে এসেছিল, তার চেয়েও এ যেন গভীর ধন্দ। ছন্দা কি ছেলের মধ্যে বিষটা ঢুকিয়ে দিয়েছে?

গোটা পথ আর সহজ হতে পারল না শুভাশিস। কথা বলল, – ছাড়া ছাড়া। অসংলগ্ন। ঠোঁটে এক ফোঁটা হাসি ফুটিয়ে রাখাও যে কখনও কখনও এত কঠিন! ভদ্রতা করে হিয়ার বাড়িতে নামতে চাইল শুভাশিস, হিয়া একবার দরকার নেই বলতেই কী নিশ্চিন্ত।

বাড়ি ফিরতেই অলকা ছুটে এসেছে, টোটোর মাথায় খুব যন্ত্রণা হচ্ছে দাদা।

শুভাশিস খুব একটা অবাক হল না। বলল, – ঘরে কোনও পেন কিলার নেই?

–আছে। আপনাকে না জিজ্ঞেস করে দিইনি।

–ঠিক আছে, আমি দেখছি। বিকেল থেকে একটা অ্যান্টিবায়োটিকের কোর্স চালু করে দিতে হবে।… খেয়েছে কিছু?

অরূপবাবু হরলিকস দিতে বলেছিলেন, ওইটুকুই যা খেল। বলল গা গুলোচ্ছে।

–হুঁ। কালকে একটা স্ক্যান করিয়ে নিতে হবে। শুভাশিস বিড়বিড় করল, তোমার দিদি কোথায়? টোটোর ঘরে?

না। ঠাকুরঘরে।

–খুব কান্নাকাটি করেছে?

–ফোনটা আসার পর প্রথমে কেমন থম মেরে গিয়েছিল। অলকা হঠাৎ গলা নামাল, দিদি একদম কাঁদেনি। চুপচাপ শুয়েছিল। টোটো ফেরার পর একবার শুধু টোটোর ঘরে গিয়ে দাঁড়াল, তারপর থেকে তো ওই ঠাকুরঘরে বসে আছে।

–আশ্চর্য! খাওয়াদাওয়া করেছে?

–খেয়েছে। না খাওয়ারই মতো। কেমন যেন ঠাণ্ডা মেরে গেছে। কথাই বলছে না। এমন কি টোটোর কোথায় লেগেছে তাও ভাল করে জিজ্ঞেস করল না। দিদিকে দেখে আমার গা ছমছম করছে দাদা।

চারপাশের পৃথিবীতে এ কী সব জটিল ক্রিয়াকলাপ চলছে! মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছে না শুভাশিস। ছেলেঅন্ত প্রাণ ছন্দ টোটোর জন্য ছটফট করছে না! মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটিয়েও ছেলের তিলমাত্র অনুশোচনা নেই! তিতিরকে সহ্য করতে পারে না, অথচ তিতিরকে নিয়ে আসে টোটো!

কেন?

মাথার ওপর পাখা ঘুরছে শুভাশিসের, স্যাঁতসেঁতে দিনে গরমও আজ কম, তবু দরদর ঘামছে শুভাশিস। পুট পুট রোতাম খুলে দিল বুশশার্টের। তেষ্টায় ছাতি ফেটে যাচ্ছে, জল চাইবে অলকার কাছে? ইচ্ছে করছে না। টোটোকে উঠে দেখে আসবে একবার? ইচ্ছে করছে না। ছন্দার কাছে যাবে? ইচ্ছে করছে না। ইন্দ্রাণীকে ফোন করে জানাবে টোটোর দুর্ঘটনার কথা? ইচ্ছে করছে না।

অলকা ডাইনিং টেবিল থেকে ডাকল, – দাদা, খাবার দিয়েছি। আসুন।

শুভাশিস চোখ বুজল, ইচ্ছে করছে না।

.

৬৩.

এক শনিবার সকালে লরি বোঝাই লটবহর নিয়ে সুদীপরা উঠে গেল। কেয়াতলায়। বাড়ি বদলের হ্যাপা কম নয়, প্রায় দক্ষযজ্ঞের মতো ব্যাপার। এ বাড়ির কেউই এ কাজে তেমন পারদর্শী নয়, তবু সকলেই হাত লাগিয়েছিল। আদিত্য কন্দর্প ইন্দ্রাণী তিতির। এমনকী সন্ধ্যার মাও। তবে আদিত্যর উত্তেজনাই সব থেকে বেশি। সে যত না কাজ করে, শোরগোল তোলে একশো গুণ। এই কুলিদের হুকুম করছে, এই লরিঅলাদের ধমকাচ্ছে, তার নির্দেশমতো আলমারি নামাতে গিয়ে বেচারা কুলিরা আয়নায় ফাটল ধরিয়ে ফেলল। রুনার বিয়ের আলমারি, মুখ ভার করতে গিয়েও সামলে নিল রুনা। রান্নাঘরের জিনিসপত্র গোছানোর সময়েও সে এক কাণ্ড। পারলে আদিত্য নিজেদের বাসনকোসনও বেঁধে দেয় সুদীপদের। শোভনার আমলের ঢাউস মিটসেফটা তো প্রায় লরিতে তুলেই ফেলেছিল, সুদীপ করুণ মিনতি করে জানাল ওই জিনিস তার ভাড়া বাড়ির রান্নাঘরে ঢুকবে না। মাত্র বছর খানেকের জন্য বিচ্ছেদ, তাও শেষ মুহূর্তে সকলেরই চোখে ছলছল ভাব। প্রথম কেঁদে ফেলল তিতির, দেখাদেখি অ্যাটমও। আবেগ সামলাতে সুদীপ বারবার ঠোঁট কামড়াচ্ছে, কন্দর্প ইন্দ্রাণী গম্ভীর, রুনা আঁচল চাপছে চোখে। সেই সজল বাতাবরণও টিকল না, অত্যুৎসাহী আদিত্য দ্যাখ-না-দ্যাখ সুদীপকে ফেলেই লরি নিয়ে ধাঁ। ফিরে এল ঢাকুরিয়া ব্রিজ থেকে। সুদীপদের নতুন বাড়ির ঠিকানাটা তার জানা নেই।

সেই বাড়ি থেকে ঘুরে এসে অবশ্য আদিত্যর চেহারা অন্যরকম। ঝুম হয়ে গেছে। ঘর অন্ধকার করে শুয়ে রইল সারা সন্ধে, কারুর সঙ্গে বাক্যটি নেই।

কী করবে আদিত্য! সে যে এরকমই। সুদীপদের ফাঁকা ঘর দুটোর দিকে সে তাকাতে পারে না, বুক ফেটে যায়। দক্ষিণের বারান্দার ছিটকিনি প্রায় তোলাই হয় না, আলো ঢোকে না ঘর দুটোতে, এ পার থেকে অন্ধকার দুটো গহুর মনে হয় তাদের। আদিত্য মাঝে মাঝেই শুন্য ঘরে গিয়ে দাঁড়ায়। একা। কালো জোব্বা পরে স্মৃতিরা হেঁটে বেড়ায় চারদিকে। মায়া, বড় মায়া। হাফপ্যান্ট পরা দীপু কাটা ঘুড়ির পিছনে দৌড়চ্ছে। হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল। হাঁটু ছড়ে গেছে, থুতনি বেয়ে রক্ত ঝরছে। কাঁদতে কাঁদতে আদিত্যর হাত ধরে চলেছে ডাক্তারখানায়। তনুপুকুরের মাঠে ফুটবল খেলে কাদা থসথস হয়ে ফিরছে দীপু। বাবার বকুনির ভয়ে কুঁকড়ে দাঁড়িয়ে আছে সদরে। আদিত্যকে ঢাল করে সুড়ৎ বড়ঘর পার হয়ে গেল। নতুন বউ নিয়ে দীপু জোড়ে প্রণাম করছে দাদাকে। কে যেন বলল, – আশীর্বাদ কর খোকন। মাথায় হাত রাখ ওদের। বিয়েবাড়ির ক্যাটারিং সেরে এসে গাদা ফিশফ্রাই রুনার হাতে তুলে দিল আদিত্য, রাতদুপুরে ছুটে ছুটে বিলি করছে নতুন বউ। আরও কত কুয়াশার মতো স্মৃতি। অফিসফেরতা সুদীপ বিবর্ণ মুখে দাঁড়িয়ে আছে এই ঘরেই, গ্যারেজটা কি তা হলে দাদার একার মা? আদিত্য লাথি মারছে সুদীপদের দরজায়। ঘেন্না ঘেন্না মুখে বেরিয়ে এল রুনা। অ্যাটম কাঁদছে। নিজের হুঙ্কার নিজেরই কানের পর্দা ফাটাচ্ছে আদিত্যর।

আমাকে ঠকানো চলবে না!…

কে কাকে ঠকায়! হাসপাতালে আদিত্যর বেডের সামনে চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে থাকা দীপু! নাকি অ্যাটমের হামজ্বরে বারবার মাঝরাতে দীপুর দরজায় ছুটে যাওয়া আদিত্য! স্মৃতিতাড়িত আদিত্য ঘুরে ঘুরে হাত বোলায় দীপুর ফেলে যাওয়া দেওয়ালে। শৈশব যে মসলিন বুনে দেয়, বড় হয়ে তাকেই কী নিষ্ঠুরভাবে ছেড়ে মানুষ! কেন ছেঁড়ে? ছিঁড়ে কী পায়? কথায় বলে, স্মৃতি সতত সুখের। কথাটা যে কী ভয়ঙ্কর মিথ্যে!

তিতির পরশু মানিকতলায় গেছে, দাদু দিদার কাছে থাকতে চায় কটা দিন। কন্দর্প কখন আসে, কখন যায়, ঠিক নেই। ইন্দ্রাণী তো নিজের মনেই আছে। চার দিনের মাথায় পুরোপুরি হাঁপিয়ে উঠল আদিত্য।

ইন্দ্রাণীর টেবিলে বাপ্পার চিঠি পড়ে আছে। কাল এসেছে। ওসাকা থেকে। খেয়ে উঠে শার্ট গলাতে গলাতে চিঠিটা আরেকবার পড়ল আদিত্য। ইয়োকোহামা কোবে নাগোয়া টোকিও ওসাকা থেকে পাঁচ হাজারখানা গাড়ি জাহাজের খোলে ভরেছে বাপ্পারা। তাদের জাহাজ মার্মেড এখন চলবে লস এঞ্জেলেসের পথে। সেখান থেকে গাড়ি নামাতে যাবে সানফ্রানসিসকোতে। তারপর হাউস্টন বোস্টন। তারপর পাড়ি জমাবে ইউরোপ। ছোট্ট একটা খাস পড়ল আদিত্যর। কত দূরে চলে গেল ছেলেটা! কোন অথৈ সাগরে ভাসছে এখন! হয়তো এই মুহূর্তে মারিয়ানা ট্রেঞ্চের পাশ দিয়ে চলেছে বাপ্পার মার্মের্ড। সেখানে কি এখন দিন, না রাত? বাপ্পা কি জেগে আছে এখন? বাপ্পা লিখেছে জাহাজে খুব সুন্দর একটা কেবিন পেয়েছে বাপ্পা, সবার সঙ্গে আলাপ-পরিচয়ও হয়ে গেছে ভাল। জাহাজের চিফ অফিসার মানুষটি বাঙালি। নাম সুজিত পোদ্দার। বাড়ি বেহালায়। সস্ত্রীক আছেন জাহাজে। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই বাপ্পাকে আপন করে নিয়েছেন। বাকি সব অফিসাররাও নাকি খুব ভাল। ওদের হেড ক্রু-কে ওরা বোসান বলে। ওদের জাহাজের বোসান মালয়েশিয়ান। নাম লিয়েম। তার কাছে আকাশের তারা চিনে নেভিগেশান শিখছে বাপ্পা। লিয়েম নাকি কম্পিউটারাইজড নেভিগেশানকেও হার মানায়। বাপ্পা ভাল আছে, খুউব ভাল আছে।

আবার একটা নিশ্বাস পড়ল আদিত্যর। বড়সড়। চিঠিটা মাকে লিখেছে বাপ্পা। তলায় ছোট করে লেখা, তোমরা ভাল থেকো। এই তোমরা কারা? এই তোমরার মধ্যে আদিত্য আছে কি?

ইন্দ্রাণী স্নান সেরে ঘরে এল। তোয়ালেতে চুল মুছছে। শ্যাম্পুর সুগন্ধ ভুরভুর করছে শরীরে। ভেজা চুল একটু ঝাঁকিয়ে বলল, – তাড়াতাড়ি খেয়ে নিলে? বেরোচ্ছ কোথায়?

আদিত্য চিঠিটা মুড়ে রাখল, দেখি। অকম্মার মতো বাড়িতে বসে থাকতে ভাল্লাগে না।

–কাজে বেরোচ্ছ?

—ভাবছি।

কদিন ধরে তোমার রঘুবীরবাবু তো আসছে না?

ব্যস্ত বোধহয়।

-হ্যাঁ, তিনি তো তোমার থেকেও বিজি। ইন্দ্রাণী আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলে চিরুনি টানছে, দেখা হলে একবার চাঁদুর সঙ্গে দেখা করতে বোলো।

-কেন?

–গত বেস্পতিবার চাঁদুর কাছ থেকে দেড়শো টাকা নিয়ে গেছে।

–সে কি! আদিত্য থতমত খেয়ে গেল, কেন?

আয়না দিয়ে টেরচা চোখে তাকাল ইন্দ্রাণী, তুমি জানো না?

–মাইরি না। আপ অন গড।

চাঁদুকে কিসব স্টোন-টোন দেবে বলেছে। তার অ্যাডভান্স।

কী স্টোন?

–তা আমি কী করে বলব!

–চাঁদু এসব বিশ্বাস করে?

ইন্দ্রাণী ঘুরে তাকাল, তুমি করো না?

আমার কথা ছাড়ো। মৃদু হাসার চেষ্টা করল আদিত্য, আমার কপাল গ্রানাইট পাথরে চাপা। ওসব ছোটখাট পাথর…হুঁহ। চাঁদুর তো আর তা নয়। ওর এখন কপাল ফিরেছে, মাসে এখন ছত্রিশ দিন শুটিং, ওর এখন আর স্টোন ধারণ করার কী দরকার?

ইন্দ্রাণী যেন উদাস হল সামান্য, মানুষ কখন পাথর দৈব এসবে নির্ভর করে জানো? হয় অসময় কাটাতে, নয় সুসময় ধরে রাখতে। যখন হাত থেকে সব পিছলে যায় তখন। যখন দু হাত উপচে পড়ে তখন।

হুঁ। বুঝদারের মতো ঘাড় নাড়ল আদিত্য। ঠিক কথা। মনের দুর্বলতাই মানুষকে কোনও অজানা শক্তির ওপর নির্ভর করতে বাধ্য করে। কিন্তু অলৌকিক তো সেও চায়, চায় অফুরন্ত টাকার বিস্ফোরণ, চায় এক পরম নির্ভরতা, তবে কেন সে কোনও অপ্রাকৃত অবলম্বন খোঁজে না! তবে কি তার পিপাসা নেই! শুধু আছে স্বপ্ন দেখার এক অচিন সুখ! নাকি সে ব্যর্থ, চরম ব্যর্থ, এই পরিণতি সে মনে মনে মেনে নিয়েছে!

পলকের জন্য কন্দর্পর মুখখানা মনে পড়ে আদিত্যর। ঝলমলে টগবগে ছেলেটাকে ইদানীং কেমন ম্রিয়মাণ দেখায়। এই সুসময়েও। ফিলম লাইন বড় গোলমেলে জায়গা, সেখানে কি পা কাটে চাঁদুর! মধুমিতা নামের মেয়েটাকে নাকি ভালবাসে চাঁদু, সেখানেই কি কোনও কাঁটা বিঁধে আছে!

ইন্দ্রাণীকে জিজ্ঞাসা করতে স্পৃহা হল না আদিত্যর, মন্থর পায়ে দরজার দিকে এগোল।

ইন্দ্রাণী আবার বলল, –মনে করে বোলো রঘুবীরবাবুকে।

বলব।

তুমি কি রঘুবীরবাবুর কাছেই যাচ্ছ?

না। অনিলের কাছে যাওয়ার একটু ইচ্ছে আছে। তার আগে এখন একবার দীপুদের ওখানে যাব ভাবছি।

–এই ভরদুপুরে দীপুদের বাড়ি!

–ওরা একা একা সংসার পাতল, কেমন আছে গিয়ে তো দেখে আসা উচিত।

দীপু তো গতকালই এসেছিল। ইন্দ্রাণী আলতো সিঁদুর ছোঁয়াল সিঁথিতে, রুনা এখন গোছগাছ করছে, খাটাখাটুনি যাচ্ছে, হয়তো দুপুরবেলা একটু জিরোবে। এই সময়ে তোমার না গেলেই নয়?

ইন্দ্রাণী কি চায় না আদিত্য বেরোক? ইন্দ্রাণীও কি তার মতো হাঁপিয়ে উঠেছে? সঙ্গী খুঁজছে কথা বলার? মুহূর্তের জন্য বিদ্যুৎ ঝলসে উঠল আদিত্যর মাথায়। এই নিঝুম বাড়িতে এখন শুধু তারাই দুটো প্রাণী!

ইন্দ্রাণীর পরের কথায় ভুল ভেঙে গেল, হাতে যদি সময় থাকে, একটা কাজের কাজ করে এসো না।

এক ফোঁটা সিঁদুর জ্বলজ্বল করছে ইন্দ্রাণীর সিঁথিতে। সেদিকে একপলক তাকিয়ে রইল আদিত্য। ঢোঁক গিলে বলল, কী কাজ?

ফার্নিচার আর বাসনকোসন বিক্রির টাকাটা তো পড়ে আছে, জয়িদের ভাগটা দিয়ে এসো।

 –কোথায় দিয়ে আসব? শংকরের অফিসে?

–মোটেই না। ওদের বাড়িতে গিয়ে দেবে। জয়ির হাতে দেবে।

আজ হবে না। কাল যাব। আদিত্য বায়নার সুরে বলল, – আজ একটু অ্যাটমটাকে দেখে আসি। ছেলেটার জন্য বড্ড মন কেমন করছে।

ইন্দ্রাণীকেও যেন ছুঁল কথাটা। এক দৃষ্টে প্যাসেজের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, – সত্যি, ছেলেটা নেই, বাড়িটা যেন খাঁ খাঁ করে। সারাক্ষণ চেঁচাত হাসত লাফাত কাঁদত…

–তুমি তো তিতিরকেও পাঠিয়ে দিলে। আদিত্যর গলা বিষণ্ণ শোনাল।

–আমি পাঠালাম! মেয়ে তো নিজেই গেল।

 সবাই নিজে যায়। সবাই নিজে যায়। হোক সে ওই চিঠির তরুণ, কি এই ঘরের ফুলপরী। ইন্দ্রাণী কিচ্ছুটি জানে না!

আদিত্য আর বৃথা অনুযোগ জানাল না। উল্টে বলল, তুমি বা ভূতের মতো বাড়িতে বসে থেকে কী করবে? আজ নয় অনিলের কাছে নাই গেলাম, দুজনে দীপুদের বাড়ি থেকে ঘুরে আসি চলো। না হয় বেলা পড়লেই বেরোব।

–তা হয় না। বাড়ি খালি থাকবে। সন্ধ্যার মা রুটি করতে আসবে, বাসন পড়ে আছে, চাঁদুও ফিরতে পারে…। তুমি বরং তাড়াতাড়ি ফিরো।

–নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই। আজ আর কোথাও যাবই না। আদিত্য ঝটপট বলে উঠল, – তুমি একা আছ, আমি দেরি করবই না।

–কোরো না। তুমি বিকেল বিকেল ফিরলে আমি বেরোব।

 আদিত্য মিইয়ে গেল সামান্য, – কোথায় যাবে?

–ভাবছি মানিকতলা গিয়ে মেয়েটাকে নিয়ে আসি। তুমি যেরকম ছটফট করছ।

আদিত্যর ঠোঁটে হাসি ফুটল। তিতিরের জন্য ইন্দ্রাণীরও তবে প্রাণ কাঁদছে! মুখে বলল, – তাড়া কিসের? থাক না এক-দু দিন। ওখানে বাবা-মাও একা একা থাকেন… এখানে থাকলে মেয়েটাও গাল ফুলিয়ে বসে থাকে…

ইন্দ্রাণী কথা বলল না। কি যেন ভাবছে। অন্যমনস্ক মুখে বন্ধ করছে জানালাগুলো। প্রখর দুপুরের তাত রুখছে। আপন মনে বলল, না, নিয়েই আসি। সৃষ্টির বাঁধাছাঁদা পড়ে আছে, একা হাতে কি সব হয়! আমাদেরও তো যাওয়ার সময় হল, না কি? আর যেন কদিন?

–এই রোববারের পরের রোববার। …তা হলে ধরো গিয়ে হল দশ দিন।

–মাত্র দশ দিন? ইন্দ্রাণী যেন ঈষৎ ভাবিত, না, না, তিতিরকে আজই নিয়ে আসব। শনিবার তো ওর আবার জন্মদিন।

তাই তো! মাথাতেই ছিল না। ভালই হল, এ বাড়িতে ওর শেষ জন্মদিনটা একটু ঘটা করে করা যাক। আমি দীপুদের আসতে বলে দিচ্ছি, কাল জয়িদের বাড়ি গেলে ওদেরও বলে দেব, তুমি ডাক্তারকেও নেমন্তন্ন করে দিয়ো।

–অত কিছুর দরকার নেই। ঘর থেকে বেরিয়ে এল ইন্দ্রাণী। একতলায় নামছে।

আদিত্য পিছু পিছু এগোল, করো না একবার। কোনওবারই তো কিছু হয় না। বড়ঘরটা বেশ বেলুন দিয়ে সাজাব, কেক কিনে আনব, মোমবাতি জ্বালব। কটা মোমবাতি লাগবে বলো তো? ষোলোটা?… না না সতেরোটা।

–একটাও না। আমার ওসব পছন্দ হয় না। আদিত্যর উৎসাহে জল ঢেলে দিল ইন্দ্রাণী, ধাড়ি মেয়ের আবার জন্মদিন কি? শুধু পায়েস হবে। বড় জোর একটু অ্যাটমকে নিয়ে আসতে পারো ব্যস।

নিবে যাওয়া দেশলাই কাঠির মতো বড়ঘরে এসে দাঁড়াল আদিত্য। আসবাব বোঝই ঘর এখন ফাঁকা ময়দান। পড়ে আছে শুধু মলিন কাচের আলমারি। আর ইজিচেয়ারটা বুড়ো পাহারাদারের মতো ঝিমোচ্ছে কোনায়। বাবার অত সাধের জন্মদিন তো এবার হলই না, না হয় তিতিরেরটাই হত। মেয়েকে ঘিরে একটা আনন্দের অনুষ্ঠান হলে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত! সবাই একত্র হওয়া যেত, একটু হইহুল্লোড় হত বাড়িতে! সেটাই হত এ বাড়ির শেষ অনুষ্ঠান। ইন্দ্রাণীটা যেন কী!

জৈষ্ঠ্যের রাগী সূর্য ঝলসাচ্ছে রাস্তায়। পিচ গলে গেছে। গরম একটা ভাপ উঠছে পথ থেকে। কৃষ্ণচূড়া গাছ রক্তচোখে দেখছে সূর্যকে। বিরল পথচারী ছায়া খুঁজে হাঁটছে। ফাঁকা চায়ের দোকানের বেঞ্চির নীচে শুয়ে আছে নেড়ি কুকুর, ওপরে দোকানদার। হাওয়া বইছে। শুকনো, গনগনে।

গলা পিচে চটি সামলে হাঁটছিল আদিত্য। বাস স্টপের কাছাকাছি এসে থমকে দাঁড়াল। রঙিন ছাতা মাথায় এক স্থূলাঙ্গী থপথপ এগিয়ে আসছে। চোখে সানগ্লাস, মাথার চুল চুড়ো করে বাঁধা। ইন্দ্রাণীর বান্ধবী শেফালি না!

ভাবতে ভাবতেই রাগী রাগী মুখ শেফালি এসে গেছে সামনে। তলোয়ার খোলার মতো করে সানগ্লাস খুলল, – ইন্দ্রাণী আছে বাড়িতে?

আদিত্য প্রমাদ গুনল। এই মহিলা একবার গল্প করতে বসলে ছ ঘণ্টার আগে ওঠে না। তার মানে তিতিরকে আনতে যাওয়ার দফারফা। আদিত্য জোরে জোরে ঘাড় নেড়ে দিল, না তো। নেই তো।

–নেই! সরু চোখে তাকাল শেফালি, এই রোদ্দুরে বেরোল কোথায়?

আদিত্য পটাপট উত্তর দিয়ে যাচ্ছে, আমার ভাইয়ের বাড়ি। ওরা উঠে গেল তো, ওদের গোছগাছ করে দিতে গেছে।

–কোনও মানে হয়! কত দরকারি কথা ছিল। ফিরবে কখন? স্ত্রীর বান্ধবীর সঙ্গে সামান্য রসিকতা করার চেষ্টা করল আদিত্য, আপনি কি ততক্ষণ দরজায় বসে থাকবেন?

তা হলে একটু ঘুরে আসি। বেনের মাঠে আমার বোন থাকে…। শেফালি রিকশার দিকে এগোচ্ছে, ফেরার পথে না-হয় ঢুঁ মেরে যাব।

আদিত্য মরিয়া হল, লাভ নেই। ওর আসতে আসতে সেই রাত। খেয়েদেয়ে ফিরবে।

–তা হলে বলবেন আমি এসেছিলাম। আবার সানগ্লাস চড়িয়ে নিল শেফালি। রিকশায় বসে হুড টানছে, নামছে না। রিকশা মোড় ঘুরে গেল।

আদিত্যর মন ঈষৎ ফুরফুরে হয়ে গেল। দশ মিনিটে পৌঁছে গেল কেয়াতলায়। গ্রিল দরজায় বেল বাজাতেই বেরিয়ে এসেছে অ্যাটম। পিছনে চোখ রগড়াতে রগড়াতে রুনা, ওমা, দাদা আপনি!

–এলাম। অ্যাটমের চুল ঘেঁটে দিল আদিত্য, কিরে, নতুন বাড়িতে কেমন লাগছে?

–বিচ্ছিরি। ছাদ নেই, খেলার জায়গা নেই, ছোটার জায়গা নেই…।

–ও কী কথা অ্যাটম! রুনা মৃদু ধমক দিল, কালকেই তো তুমি পার্কে গেলে।

–পার্ক আর বাড়ি এক হল?

 আদিত্য হাসতে হাসতে একচিলতে ড্রয়িংরুমটাকে দেখে নিয়ে বলল, তোদের জন্য ছাদ-টাদ আর থাকবে না রে। একটা পার্ক পেয়েছিস এই না কত।

বলুন দাদা বলুন। কটা পাড়া এমন খোলামেলা! ওই তো হাত বাড়ালেই লেক। …কে বোঝে! …এসে অবধি তো আপনার ভায়েরও মুখ ভার। …নিজেদের একটা ছাদ থাকলে অবশ্য মন্দ হত না। কাপড় মেলা নিয়ে যা সমস্যা হচ্ছে! কী করা যাবে, সব কি আর পাওয়া যায়! এমন মোজাইক ফ্ল্যাট, রান্নাঘরে টাইলস, বাথরুমে টাইলস…। আপনি দাঁড়িয়ে রইলেন কেন দাদা? বসুন না।

কথার স্রোত থেকে শুধু সুদীপের কথাটুকুই ছেঁকে নিল আদিত্য। বেতের সোফায় বসে কলার তুলে ঘাম ঝাড়ল। ফুল স্পিডে পাখা ঘুরছে তবু ঘরটা কী গরম! দীপু মোটে গরম সইতে পারে না। রায়বাড়ির দোতলাও কত ঠাণ্ডা থাকে।

আদিত্য গলা ঝেড়ে নিল, তারপর? তোমার গোছানোর কাজ শেষ?

-কই আর। খেলনা শো-পিস সব এখনও প্যাকিং বাক্সে পড়ে। বাড়িঅলা পেরেক পুঁততে দিচ্ছে না, বাবা-মার ছবি, ক্যালেন্ডার কিছুই টাঙাতে পারছি না।

–হুঁউ, পরের বাড়িতে বাস। আদিত্য একটা নিশ্বাস চাপল। বড়ঘরের অয়েল পেন্টিংগুলো নতুন বাড়িতে নিয়ে গিয়ে কী করে যে টাঙাবে ইন্দ্রাণী!

রুনা বুঝি পড়ে ফেলল ভাবনাটা। বলল, কি আর করা। একটা বছরের তো ব্যাপার, কোনও রকমে চোখ কান বুজে কাটিয়ে দিই।

–ফ্ল্যাটে গেলে সব সমস্যা মিটে যাবে বলছ?

–কিছুটা তো যাবেই।

–তা বটে। আদিত্য এদিক ওদিক তাকাল, মিনতি বাড়ি নেই?

–আর বলবেন না, দেশে গেছে।

 –ফিরবে কবে?

–রোববারের মধ্যে তো ফিরবে বলেছে, দেখি কি করে। এদিকে আমি একা হাতে…। আপনি খুব ঘামছেন দাদা। শরবত করে দেব?

না না, লাগবে না। তুমি বোসা।

–না দাদা, আজ আপনি প্রথম এলেন…

–কেন, শনিবারই তো এসেছিলাম।

–ওটা কি আসা! হুড়ুদ্দুম করে মাল নামানো। …আমার দিদি কত করে সেদিন আপনাকে খেয়ে যেতে বলল… ঠিক আছে, শরবত না খান, চা করে দিই। আপনি তো চা খেতে ভালবাসেন।

–আরে না, এখন চা খাব না। তুমি বরং আমায় এক গ্লাস জল দাও।

সঙ্গে একটা পেসট্রি দিই দাদা? ঘরেই আছে।

রুনার আপ্যায়নে আদিত্য বিচলিত। নিজেকে কেমন অতিথি অতিথি লাগছে। কই, আগে তো কখনও এভাবে যত্ন করেনি রুনা!

আদিত্য অপ্রস্তুত মুখে বলল, এই তো একটু আগে খেয়ে উঠলাম, এখন আবার পেসট্রি-ফেসট্রি কেন?

–ও বললে চলবে না। কিছু অন্তত মুখে দিতেই হবে। বলেই রুনা ফ্রিজ থেকে দুটো ঠাণ্ডা সন্দেশ বার করে এনেছে, এটা খান দাদা, আমি আপনার জন্য শরবত করে আনছি।

অ্যাটম ঘুরঘুর করছে সামনে। লাজুক লাজুক হেসে দেখছে জেঠুকে। আদিত্য তাকে কোলে টানল, কি অ্যাটমবাবু, চলবে নাকি?

মার গমনপথের দিকে টুক করে তাকিয়ে নিয়ে একটা সন্দেশ মুখে চালান করল অ্যাটম। গপ গপ গিলে নিয়ে পকেট টিপছে আদিত্যর, তুমি আমার জন্য কী এনেছ?

–ওই যাহ, কিছু তো আনা হয়নি।

–লোকের বাড়ি এলে বাচ্চাদের জন্য হাতে করে কিছু আনতে হয় জানো না? পরশুদিন বাবার বন্ধু স্বদেশকাকু এল, আমার জন্য জায়েন্ট চকোলেট এনেছিল।

কথাটা সূঁচ হয়ে ফুটল আদিত্যকে। মিকসির ঘরঘর শব্দ ভেসে আসছে ভেতর থেকে। ভায়ের বাড়িতে সত্যিই আদিত্য পর হয়ে গেল! ও বাড়িতে দীপুদের সঙ্গে কত লাঠালাঠি মারামারি, কত মান অভিমান, হাঁড়ি ভিন্ন হয়েছে, তবু এই রুনা অ্যাটম যেন অনেক কাছের ছিল। আজ এই শশব্যস্ত আয়োজনে দূরত্ব বেড়ে গেল বহু যোজন। অ্যাটমের আর দোষ কী, যা দেখছে, যা শুনছে…

আদিত্য ম্লান মুখে বলল, – ভুল হয়ে গেছে বাবা। এরপর ঠিক আনব।

 পাকা আমের শরবত নিয়ে ঢুকল রুনা। টুকটাক দু-চারটে কথা বলে আদিত্য উঠল। আগের দিন বাড়িটাকে ভাল করে দেখা হয়নি, আজ একটু ঘুরে-ফিরে দেখবে ভেবেছিল, ইচ্ছে হল না।

দরজায় এসে রুনা বলল, আজ আপনি তিতিরকে নিয়ে আসতে পারতেন দাদা, ওর তো এ বাড়ি দেখাই হয়নি।

–আসবে।

–দিদি চাঁদু সবাইকে আসতে বলবেন।

বলব।

রাস্তায় নেমে বারেক পিছন ফিরল আদিত্য। দোতলা বাড়ির একতলার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে রুনা। পাশে অ্যাটম। রুনা হাত নাড়ল। পশ্চিম আকাশের সূর্য রুনার মিষ্টি মুখখানায় আলো ফেলছে, ভারি পরিপূর্ণ দেখাচ্ছে রুনাকে। রায়বাড়িতে এতদিন একটা মহীরুহের ডাল হয়েই ছিল রুনা, এখন সে একটা আলাদা গাছ।

বাড়ির কাছাকাছি এসে কথাটা মনে পড়ল আদিত্যর। অ্যাটমকে শনিবার পাঠানোর কথা বলা হল না।

ইন্দ্রাণী শাড়ি পরে তৈরি ছিল। বেরোনোর সময়ে পই পই করে বলে গেল যেন বাড়ি খালি রেখে কোথাও না বেরিয়ে পড়ে আদিত্য। ফ্লাসকে চা করে রেখে দেবে সন্ধ্যার মা, চায়ের দোকানে যাওয়ারও দরকার নেই।

সন্ধ্যার মা আটা মাখছে। আদিত্য ওপর গিয়ে প্যান্ট-শার্ট বদলাল। দীপুদের ঘর দিয়ে বারান্দায় যেতে গিয়েও দাঁড়িয়ে পড়ল। টেলিফোন বাজছে।

আদিত্য রিসিভার তুলল, হ্যালো।

 সাড়া নেই।

দু-একবার হ্যালো হ্যালো করার পর কেটে গেল লাইনটা। বারান্দায় না গিয়ে আদিত্য ছাদে উঠল। আবার ফোন বাজছে। আবার নেমে এসে ফোন ধরল। কেটে গেল লাইন। সিগারেট ধরিয়ে নিজের ঘরে ঢুকতে গিয়েও আদিত্য ফিরে এল। নামিয়ে রাখল রিসিভারটা। যত সব উটকো ঝামেলা।

আরও খানিক পর আদিত্য নেমে এল একতলায়। বড়ঘরে ঢুকে পায়চারি করছে। কোণের ইজিচেয়ারে বসল। আলমারির কাছে অস্পষ্ট ছায়া। লম্বা, কুঁজোটে। যেন জয়মোহন।

আলো কমছিল।

.

৬৫.

এক ভরা বর্ষার সকালে তুফান কলকাতায় এল। শুভাশিসের সংসারে সে আসে একঝলক টাটকা বাতাসের মতো। দামাল মানুষটা দাদার কাছে এলে ভারি প্রগলভ হয়ে ওঠে। তার হাঁকডাকে ফ্ল্যাটের গুমোট ভাবটা যেন ঝুপ করে উবে যায়। কত যে হাবিজাবি গল্প তার ঝুলিতে! মাধবপুরের কোন লোক কী নতুন ধান্দা শুরু করল, বেতিয়ায় কার বউ ফলিডল খেয়েছে, রামনগরে কার সঙ্গে শিবসুন্দরের খটাখটি বাধল, সবই তার সবিস্তারে বর্ণনা করা চাই। যেন ওখানকার প্রতিটি খুঁটিনাটি দাদাকে জানানো তার কর্তব্য। যেন বাবা-মার সঙ্গে সঙ্গে গোটা অঞ্চলটার দায়ও তার ওপর চাপিয়ে রেখেছে শুভাশিস।

বড় সোফায় ফ্রেঞ্চ টোস্ট নিয়ে জমিয়ে বসেছে তুফান। টোটো টুকি ছন্দা অলকা ডাইনিং টেবিলে। সামনে সেঁকা রুটির পাহাড়, চিজ মাখন জ্যামের শিশি, সেদ্ধ ডিম, কলার ছড়া। ব্রেকফার্স্ট সারছে সকলে, শুনছে তুফানের গল্প। মাধবপুরে ডায়েরিয়ার প্রকোপ বেড়েছে হঠাৎ। সমিতি অফিসে বীজধান বিলি নিয়ে ছোটখাট সংঘর্ষ হয়ে গেল। বেলপুকুরে মদন দত্তর বাড়িতে ডাকাত পড়েছিল, মুখোশ পরা ছ-সাত জন ডাকাত, প্রত্যেকের হাত চাইনিজ রিভলবার, বাড়ির হাঁড়ি-কলসি পর্যন্ত ঝেটিয়ে নিয়ে গেছে। দারোগা এসে মদন দত্তর তিরিশ বছরের পুরনো রাতকানা চাকরটাকে ধরে নিয়ে গিয়ে কেস দিল। মাধবপুরে এবার সাপেদের মোচ্ছব চলছে, পরশুই সবজি বাগানে একটা দাঁড়াশ মেরেছে তুফান।

শুভাশিস দাড়ি কামাতে কামাতে তুফানের কথা শুনছিল। ঠিক শুনছিল না, কানে আসছিল। এ সময়ে তার বেজায় তাড়া থাকে, কোনও কথাই ঠিকঠাক মাথায় ঢোকে না। তবু তার মধ্যে সাপ। শব্দটা কানে বাজল তার। একটু উদ্বিগ্ন গলায় বলল, বাড়িতে সাপটাপ ঢুকছে, এ তো ভাল কথা নয় রে।

অলকা বলল, – সাপ তো প্রতি বর্ষাতেই বেয়োয় দাদা। পুকুরধারে ঘোরাফেরা করে, সবজি বাগানে চলে আসে, তবে বসতবাড়িতে ঢোকে না।

ঢুকতে কতক্ষণ! তোমাদের দাওয়ায় তো আর সাপেদের জন্য নো এন্ট্রি বোর্ড ঝোলানো নেই! না না, সাপ বড় মারাত্মক জিনিস।

–কিছু মারাত্মক না। সাপ হল সব থেকে ভিতু প্রাণী। ফণা তো তোলে ভয়ে।

–একবার ছোবলটা মেরে দিলে সামলাবে কে?

–তার জন্য তো অ্যান্টি ভেনাম আছে। আর আছে আমার হেঁতালের মন্ত্রপূত লাঠি। গত বছরের আগের বছর আমাকে এক সাধু দিয়ে গিয়েছিল।

টোটো ঘুরে বসেছে, মাধবপুরে কী কী সাপ আছে কাকা?

–কেউটে আছে, কালাচ আছে, চন্দ্ৰবোড়া আছে… রাজবাড়ির দিকটায় তো শঙ্খচূড়ও আছে। এ ছাড়া লাউডগা হেলে চিতি জলঢোড়া এ সব সারাক্ষণ ঘুরছেই।

শুভাশিস প্রায় আঁতকে উঠল, –তোর হেঁতালের লাঠিফাটি ছাড়, কার্বলিক অ্যাসিড ছড়াচ্ছিস তো?

–না ছড়ালেও চলত, তবে ছড়াই। বাবার হুকুম। রাতবিরেতে রুগী আসে, যখন তখন বাবাকে বেরোতে হয়…

–এই বর্ষাতেও বাবা রাতে বেরোচ্ছে?

কম। এসে হাউমাউ কান্না জুড়ে দিলে যায়। ডাক্তার মানুষ, উপায় কি? তুফানের মুখে হঠাৎই একটা হালকা ছায়া পড়ল। কী যেন ভাবল দু-এক সেকেন্ড, তোমাকে একটা কথা বলব কি না ভাবছিলাম দাদা।

কথা বলতে গিয়ে তুই ভাবিস নাকি?

 তুফান হাসল না। বলল, বাবার শরীরটা কদিন ধরে ভাল যাচ্ছে না দাদা। মুখ ফুটে তো কিছু বলবে না, তবু বোঝা যায়। অল্পেই ক্লান্ত হয়ে পড়ে, মাথা গরম হয়ে যায়, এত দিনের নেশাটা দুম করে ছেড়ে দিল…

শিবসুন্দরের সিগারেট ছাড়ার কথাটা আগেই শুনেছিল শুভাশিস। মনে হয়েছিল যাক, বাবা তবে তার সতর্কবাণী শুনেছে। আজ তুফানের কথায় একটু অন্যরকম মনে হল। তোয়ালেতে মুখ মুছতে মুছতে বলল, – বাবার প্রেশারটা রেগুলার চেক করছিস?

করতে দেয় না। নিজেই নাকি করে।

–সে কি কথা!

অলকা টেবিল ছেড়ে উঠে এসেছে। চোখে মুখে উদ্বেগ, হঠাৎ তুমি বাবার শরীরের কথা বললে কেন?

প্রাণবন্ত তুফান অনেকটাই নিবে গেল। সামান্য ইতস্তত করে বলল, বাড়ির পেছনটায় ঝোপ হয়ে গিয়েছিল। বাবা-মার জানলার ঠিক নীচে। গেল রোববার সাফ করছিলাম, তখন কতগুলো ওষুধের ছেঁড়া ফয়েল পেলাম। হার্টের ওষুধ। সরবিট্রেট অ্যানজিনেক্স, নিকার্ডিয়া…। এ সব ওষুধ তো আর মার লাগে না, লাগলেও আমি জানতাম।

–তুই বাবাকে ধরিসনি?

ধরেছিলাম। বাবা হেসে উড়িয়ে দিল। বাবার ড্রয়ারে নাকি অনেক দিন ধরে খালি ফয়েলগুলো পড়ে ছিল, ফেলে দিয়েছে।

–স্ট্রেঞ্জ!

টোটো প্রশ্ন করল, দাদু ওসব ওষুধ কেনে কোত্থেকে?

মাঝে মাঝে তো একা একাই তারকেশ্বরে চলে যায়। তখনই হয়তো..

–তুই একা ছাড়িস কেন?

তুফান মাথা নামাল, — তুমি তো বাবাকে চেনো দাদা। বাবা কি নজরদারি মেনে নেওয়ার লোক?

অলকা আচমকা বিচলিত হয়ে পড়েছে, এ সব আমার একটুও ভাল লাগছে না। আমি আজই বাবার কাছে ফিরে যাব।

–তা কী করে হয়! বউদির শরীর এখনও ভাল করে সারেনি। তুফান অপ্রস্তুত মুখে ছন্দার দিকে তাকাল।

-না না, দিদি তো এখন অনেকটাই ভাল। অলকাও ঘুরেছে ছন্দার দিকে, কিগো দিদি, আমি চলে গেলে তোমার খুব অসুবিধে হবে?

ছন্দা নিঃশব্দে ঘাড় নাড়ল। হবে না।

–কি দাদা, তুমি কী বলো? তুফান সোজা হয়ে বসল, বাবা অবশ্য সত্যিই খুব একা হয়ে গেছে।

অলকা তড়িঘড়ি বলল, দাদা দিদির কিচ্ছুটি অসুবিধে হবে না। আমি কাজের লোকেদের সব ভাল করে বুঝিয়ে দিয়ে যাব।

– দ্যাখো যা ভাল বোঝো। শুভাশিস স্নানে ঢুকে গেল।

সাড়ে আটটা বেজে গেছে। স্নান সেরে বেরোনোর জন্য চটপট তৈরি হয়ে নিল শুভাশিস। টোটো অলকা তুফান কথা বলছে, কলকল করছে টুকিও, বাবাকে দেখলে ভারি খুশি হয় মেয়েটা। ব্রিফকেস গোছানোর সময়ে পলকের জন্য নিজের বাবার মুখটা মনে পড়ল শুভাশিসের। ছন্দার অপারেশানের খবর শুনে নার্সিংহোমে এসেছিল বাবা, তখন কি মুখে কোনও অসুস্থতার ছাপ ছিল? শুভাশিস লক্ষ করেনি ভাল করে। নিজেই সে তখন এত তটস্থ। টেনশানে সেদিন ঘন ঘন সিগারেট খাচ্ছিল শুভাশিস, তাই নিয়েও কি যেন ঠাট্টা করেছিল বাবা। কি যেন বলেছিল? মনে পড়ছে না। বাবাকে কি একবার মাধবপুরে গিয়ে দেখে আসা উচিত?

বাড়ি থেকে বেরোনোর আগে শুভাশিস একটু দাঁড়াল ড্রয়িং স্পেসে, আমাকে কি একবার মাধবপুরে যেতে হবে রে?

–গেলে তো ভালই হয়। অনেক দিন যাওনি। তবে বউদিকে একা ফেলে যাবেই বা কী করে?

হুম। দেখি যদি পারি তবু এর মধ্যে…। তুই বাবাকে একটু ওয়াচে রাখিস।

 দুশ্চিন্তার এক অস্পষ্ট সিগনাল মাথায় নিয়ে নীচে এল শুভাশিস। গাড়ি স্টার্ট করতে গিয়ে মেজাজ খিঁচড়ে গেল। সেলফ নিচ্ছে না। কাল বিকেল থেকে এই এক বখেড়া শুরু হয়েছে। দারোয়ানকে দিয়ে হাত পনেরো গাড়িটাকে ঠেলাল শুভাশিস। প্রাণ এল যন্ত্রযানে।

বেশ জোরে বৃষ্টি নেমেছে। পুরোপুরি বর্ষা এবার শহরে একটু দেরিতে এল। মেঘলা আকাশ, টিপটিপ বৃষ্টি, ছিরছির বৃষ্টির কাল শেষ। আকাশ আজকাল সারা দিন গাঢ় স্লেটবর্ণ হয়ে থাকে, ঝমঝমিয়ে ভেঙে পড়ে যখন-তখন, বল্লমের ফলা হয়ে জলকণারা ছিন্নভিন্ন করে শহরটাকে। রাস্তাঘাট এখন ক্ষতচিহ্নাঞ্ছিত, যেখানে সেখানে জল থই থই, শহরের নিকাশি ব্যবস্থা প্রায় ভেঙে পড়ার মুখে।

ব্লু হেভেনে আজ এগারোটায় পর পর দুটো অপারেশান। যাওয়ার পথে একবার কোম্পানির গ্যারেজে ঢুকল শুভাশিস। রামদেও গ্যারেজে বসে আছে, ধোঁয়া উড়িয়ে গল্প করছে এক মেকানিকের সঙ্গে। এই গ্যারেজেই মেরামতি চলছে নতুন মারুতিটার, রামদেওর এখন এখানেই ডিউটি।

শুভাশিসকে দেখে সিগারেট নিবিয়ে দৌড়ে এল রামদেও, কী হয়েছে স্যার?

–হরবিন্দার কোথায়? আমার সেলফটা একটু চেক করে দিতে বলল।

ডাকছি স্যার। রামদেও ছুটে প্রকাণ্ড গ্যারেজটার একদম ভেতরে চলে গেল।

নতুন মারুতিটা পড়ে আছে এক ধারে। বনেটখানা ভালই তুবড়ে গিয়েছিল, পিটিয়ে পিটিয়ে দুরন্ত করেছে মিস্ত্রিরা। সামনে কাচ চুরচুর হয়ে গিয়েছিল, বদলেছে। ড্যাশবোর্ডও লাগাতে হল নতুন করে। পুটিং-টুটিং লাগানো, প্রাইমার মারা হয়ে গেছে, এবার রঙ করলেই কাজ সম্পূর্ণ হয়।

শুভাশিস রাগ রাগ চোখে গাড়িটাকে দেখছিল। উফ, গাড়ি না শনি! থানা থেকে ছাড়াতে তিন হাজার খসল, মেকানিকাল রিপোর্ট ম্যানেজ করতে গেল আরও দেড়। আরে বাবা, সামান্য একটু ব্রেক ফেল লিখে দিবি তার জন্য এত! মুহূর্তের জন্য ব্রেক ফেল করতেও তো পারে। টেম্পোরারি হার্ট ব্লকের কেসে পালস বিট অফ হয়ে যায় না! এখন এই গ্যারেজের বিল কত হয় কে জানে! সার্ভেয়ারের পিছনেও তো কিছু ঢালা হল, তাতেও সে ব্যাটা এগারো হাজারের বেশি এস্টিমেট মানল না। ইনসিওরেন্স কোম্পানির গর্ভ থেকে টাকা প্রসব করানো যে কী কঠিন!

হরবিন্দার সাদা মারুতির কাজ শুরু করে দিয়েছে। শুভাশিস জিজ্ঞাসা করল, রঙ মারতে দেরি হচ্ছে কেন হরবিন্দার? আর কত দিন আটকে রাখবে?

–মউসমের হাল দেখছেন না স্যার? এতে রঙের কাজ হয়? গাড়ি আপনার ফুলে ফুলে থাকবে স্যার। টিউমারের মাফিক।

কী জানি বাবা। তোমরা যা বোঝাবে তাই বুঝব।

তবিয়তের বেপারে আপনারা যা বোলেন, আমরা তা মেনে নিই স্যার।

শুভাশিস আলগা হাসল। হরবিন্দার একটু ঠোঁটকাটা আছে। মিনিট পনেরো থুম দাঁড়িয়ে রইল শুভাশিস। বারকয়েক ঘড়ি দেখল। দেরি হয়ে যাচ্ছে। তা হোক, আগে সেলফটার একটা ফয়সালা করা দরকার। শহরজোড়া নদীতে কোথাও ফেঁসে বসে থাকলে বিচ্ছিরি ব্যাপার হবে। রামদেওকে আজ নিয়ে নেবে নাকি? ব্যাটা বসে বসে মাইনে খাচ্ছে!

কাজ শেষ। ব্লু হেভেনে পৌঁছে ছুরি-কাঁচির জগতে ডুবে গেল শুভাশিস। ব্লু হেভেন থেকে সান শাইন। সেখান থেকে স্যাস ক্লিনিক। দিনভর শরীর কাটাছেঁড়ার যান্ত্রিক রুটিন। এত কিছুর মাঝে বাবার কথা তেমন আর মনে পড়ল না। ছোট্ট একটা সিগনালের মতো শুধু বিব বিব করল দু-একবার, ব্যস।

বিকেলের দিকে বৃষ্টি অসম্ভব বেড়ে গেল। কোটি কোটি ঘোড়সওয়ার শহরকে মথিত করছে। তাদের ক্রুদ্ধ গর্জনে শিউরে উঠছে দশ দিক। রাস্তায় প্রচুর জল জমেছে, বেকবাগানের চেম্বারে যেতে আর ভরসা পেল না শুভাশিস, সন্ধে সন্ধে বাড়ি ফিরে এল।

বাড়ি বড় নিঝুম আজ। অলকা টুকি চলে গেছে বলেই কি! গেল কখন! দুপুরবেলা! এই দুর্যোগে আজ না গেলেও পারত। ফ্ল্যাটের চারদিকে একটু উঁকিঝুঁকি মারল শুভাশিস। রাতদিনের কাজের মেয়েটি রান্নাঘরে, কী যেন বসিয়েছে কড়ায়। ব্যালকনির কাচের দরজা বন্ধ, এ পারে একটা মোড়া টেনে বসে আছে ছন্দা। টোটো নেই।

সোফায় বসে জুতো-মোজা ছাড়ছিল শুভাশিস। কাজের মেয়েটা সামনে এল, আপনাকে চা কফি কিছু দেব দাদাবাবু?

শুভাশিস অন্যমনস্কভাবে বলল, – দেবে? দাও। না থাক।

–ভেজিটেবিল স্যুপ খাবেন? গরম করে দেব?

–থাক, একেবারে রাতেই…। তুমি বরং একটু জল দিয়ে যাও।

ঠাণ্ডা দেব, না গরম?

–ঠাণ্ডাই দাও। না না, এমনি দাও। না না, দুটো মিশিয়ে দাও।

সোফায় হেলান দিয়ে বসে শুভাশিস এক দৃষ্টে দেখছিল ছন্দাকে। ছন্দা মূর্তির মতো স্থাণু। স্বচ্ছ কাঁচে জমেছে বারিবিন্দু, ওপারে বৃষ্টিমাখা পৃথিবীর আলো ঝাপসা, আঁধারে প্রায় বিলীয়মান। ওই অস্পষ্টতায় কি খোঁজে ছন্দা? শুভাশিস যে ফিরেছে তাও কি একবার তাকিয়ে দেখার প্রয়োজন নেই?

শুভাশিস ছন্দার পাশে উঠে এল, তোমার ছেলে গেল কোথায়?

 ছন্দার দৃষ্টি নড়ল না, তুফানদের সঙ্গে মাধবপুর গেছে।

–সে কি! হঠাৎ! শুভাশিস আকাশ থেকে পড়ল।

 –গেল। ইচ্ছে।

শুভাশিসের চোখের সামনে অসংখ্য সাপ হিলহিল করে উঠল। চন্দ্ৰবোড়া, কেউটে, শঙ্খচূড়…। রাগত স্বরে বলল, – ইচ্ছে হল, ওমনি চলে গেল! একি কথা? এই ঝড়বাদলে অজ গাঁয়ে ছুটল… তুমি মানা করলে না?

ছন্দা উত্তর দিল না।

শুভাশিসের নিজেকে কেমন বিভ্রান্ত লাগছিল। গোমড়া মুখে প্রশ্ন করল, ফিরবে কবে?

বলেনি।

আজ বাদে কাল স্কুল খুলে যাবে…। আশ্চর্য, তোমরাও কেউ আমাকে একবার জানানোর প্রয়োজন বোধ করলে না!

প্রশ্নটা শুধু শুধুই ঘুরতে লাগল।

অসহায় মুখে ঘরে ফিরে প্যান্ট-শার্ট বদলাল শুভাশিস। কার ওপর রাগ করবে, কার ওপর বিরক্ত হবে, ঠিক ঠাহর করতে পারছে না। আবছাভাবে সকালটাকে মনে পড়ল। তুফান অত কথা বলছিল, বাবার শরীর খারাপের কথা উঠল, অলকা চলে যেতে চাইল, তখনও কী আশ্চর্য রকম নীরব ছিল ছন্দা! এত কেন নির্লিপ্তি! নাকি ছন্দাও তার মতোই আহত! তারই মতো বিভ্রান্ত! তার থেকেও বেশি অসহায়!

শুভাশিস ড্রয়িং স্পেসে ফিরল। কথা বলতে চাইল ছন্দার সঙ্গে, ছেলে চলে গেছে বলে মন খারাপ?

উত্তর নেই।

–তোমার কী হয়েছে বলে তো? এদিকে এসো। আমার পাশে এসে বসো।

ছন্দা উদাসীন মুখে সোফায় এসে বসল। বড় শীর্ণ, কালচে দেখাচ্ছে ছন্দাকে। কপালে সব সময়ে একটা ছোট টিপ পরে ছন্দা, সেটাও নেই। আরও বেশি শুকনো শুকনো লাগছে মুখটা। রুগণ। অথচ এত দিনে ছন্দার সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠার কথা। অলকা দেখছিল বলে ছন্দাকে নিয়ে সেভাবে ভাবা হয়নি, এবার ভাবতে হবে।

ভয়ঙ্কর শব্দে বাজ পড়ল কোথাও। ভেজা কাচের দরজায় ঝলসে উঠেছে মেঘজ্যোতি। বৃষ্টির দমক আচমকা বেড়ে গেল। শব্দের দাপটে কানে তালা লাগার জোগাড়।

শুভাশিস ক্যাবিনেট থেকে গ্লাস বোতল বার করল, আজ মনে হয় পৃথিবীটা ভেসেই যাবে।

 ছন্দা স্তিমিত স্বরে বলল, — হুঁ, ক্রমশ বাড়ছে।

মনে আছে সেই সেবার আটাত্তরে কি হয়েছিল? আমাদের গোয় বেড়াতে যাওয়ার টিকিট-ফিকিট সব কাটা, বৃষ্টিতে ট্রেন ক্যানসেল হয়ে গেল…। তিন দিন ধরে মনোহরপুকুরের বাড়িতে বসে আমরা শুধু খিচুড়ি খাচ্ছি…। বৃষ্টি থামার সাত দিন পরে তুফান হাঁচোড়পাচোড় করে খবর নিতে এল…।

ছন্দা উদাসভাবে বলল, তুমি মাধবপুরে খবর নিতে যাওনি।

শুভাশিসের উচ্ছ্বাসটা হোঁচট খেয়ে গেল। কলকাতার থেকেও মাধবপুরের অবস্থা অনেক অনেক খারাপ হয়েছিল সেবার। বাড়ি প্রায় ভেসে যায় যায়, একতলা ডুবে গেছে, বাবা মা তুফান তিনজনই জলবন্দি। বাবা-মার জন্য শুভাশিসের সে সময়ে দুশ্চিন্তা হয়নি তা নয়, কিন্তু চিন্তা আর উতলা হওয়ার মধ্যে তো ফারাক থাকেই। বাবা-মার জন্য কেন যে তেমন করে উদ্বিগ্ন হতে পারে না শুভাশিস!

ঢোঁক গিলে শুভাশিস প্রশ্ন করল, তোমার কি মনে হয় বাবার কন্ডিশান সত্যিই খুব সিরিয়াস?

ছন্দা শুভাশিসের দিকে তাকাল না, হতে পারে। নাও হতে পারে।

–অলকার এভাবে হুট করে চলে যাওয়াটা ঠিক হল না।

–দু মাস তো হল, আর কত দিন থাকবে!

রোববার গেলে আমি পৌঁছে দিয়ে আসতাম।

পলকের জন্য চোখ তুলল ছন্দা। আবার নামিয়ে নিয়েছে।

 শুভাশিস গ্লাসে কিছুটা হুইস্কি ঢালল। বিরক্তিমাখা গলায় বলল, বাবার শরীর খারাপটা অজুহাত। তুফানকে ছেড়ে অলকার আর এখানে মন টিকছিল না।

হতে পারে।

কী নীরস, কী নিরুত্তাপ স্বর! সাধে কি অলকা চলে গেছে। এ বাড়ির গুমোট আবহাওয়া থেকে বাঁচার জন্য পালিয়েছে।

হুইস্কিতে লম্বা চুমুক দিল শুভাশিস, তোমাকে এক পেগ তৈরি করে দেব?

না।

–অমৃতে অরুচি হঠাৎ! এক সময়ে তো পেলেই টানতে।

–আর ভাল লাগে না।

–কেন লাগে না? শুভাশিস অল্প অধৈর্য হল, তোমার ঠাকুরদেবতারা বুঝি বারণ করে দিয়েছে?

ছন্দা উঠে দাঁড়াল। ঘরের দিকে যেতে গিয়ে থামল, – আমি একটু শুচ্ছি। যখন খাবে, ডেকো। আর হ্যাঁ, বিকেলে তোমার বন্ধু বিজন এসেছিল। সিভিল রাইটস নিয়ে নতুন অরগানাইজেশান করেছে, তার জন্য তোমাকে ডোনেশান দিতে বলছিল।

–সিভিল রাইটস, না গুষ্টির পিণ্ডি। আমি তো এখন বুর্জোয়া। রেনিগেড। আমার কাছে টাকা চাইতে আসে কেন?

ছন্দা মুখ ঘুরিয়ে নিল।

গ্লাস হাতে ব্যালকনির দরজায় এল শুভাশিস। কাচের পাল্লা ফাঁক করল সামান্য। বৃষ্টির তোড় কিছুটা কমেছে। হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির ফোঁটা ছুঁল শুভাশিস। গায়ে একটুক্ষণ জল মাখল। জল নয়, জলের ভাপ। ভাল লাগছে। মাথায় ভোঁ ভোঁ ভাব, তবু জুড়িয়ে আসছে শরীর।

আরও খানিকটা পানীয় গলায় ঢেলে ঘরে এল শুভাশিস। চোখ বুজে শুয়ে আছে ছন্দা, গায়ে পাতলা চাদর। তিন পয়েন্টে পাখা ঘুরছে, ঘরে বাতাসে স্যাঁতসেঁতে ভাব, অল্প অল্প শীত করে যেন।

শুভাশিস নিচু গলায় ডাকল, ছন্দা…

উঁ?

সাড়া পেয়ে খাটের কোণে বসল শুভাশিস। বলল, তোমাকে একটা কথা বলতে ভুলে গেছি। পরশু দালাল লেক গার্ডেন্সে একটা জমি দেখাল। সুন্দর প্লট। তিন কাঠার কিছু কম, কিন্তু একদম স্কোয়্যার। পজিশানটাও বেশ ভাল।

ও।

–তুমি কি একবার দেখে নেবে?

–আমি! ছন্দার স্বরে অসীম শ্রান্তি।

–হ্যাঁ তুমি। তুমি তো কত কিছু প্ল্যান করছিলে। বাগান, লন, এই গাছ, সেই গাছ, তুমি না দেখলে হবে!

বুঝি একটা নিশ্বাস পড়ল ছন্দার। বাতাস আরও স্যাঁতসেঁতে হয়ে গেল। ক্ষীণ স্বরে বলল, যদি চাও যাব। আমার ইচ্ছে নেই।

কেন ইচ্ছে নেই ছন্দা? প্রশ্নটা করতে পারল না শুভাশিস। কথাটা বুকের ভেতর গুমরোতে লাগল। তার নিজের আজকাল কিছু ইচ্ছে করে না, ছন্দার কিছু ইচ্ছে করে না, ছেলে বেঁচে থাকে এক বিচিত্র ইচ্ছে অনিচ্ছের খেলায়–এ কোন সংসারে বাস তার! কোন কীটের দংশনে মরে যাচ্ছে ইচ্ছের কুঁড়ি! এই দিনের আশাতেই কি সংসার টিকিয়ে রাখা! প্রাণপাত পরিশ্রম!

রাতে ঘুম আসছিল না শুভাশিসের। তন্দ্রা আসে, কেটে যায়। গভীর রাতে বৃষ্টি থামার পর, পৃথিবী যখন অদ্ভুত রকমের নিস্তব্ধ, ছন্দাকে ছুঁল শুভাশিস। অঘোরে ঘুমোচ্ছ ছন্দা, জাগল না। শুভাশিসের ভারি আশ্চর্য লাগছিল। তার একটুখানি ছোঁয়া পেলেই আলোর মালা হয়ে জেগে ওঠে ছন্দা, আজ তার কী হল! অবসাদ! এত অবসাদ!

পরদিনও সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে এল শুভাশিস। তার পরদিনও। একই নিষ্প্রাণ ফ্যাকাসে মুখ, একই অভিব্যক্তিহীন চোখ, একই শীতল শরীর। অলকা চলে গিয়ে, টোটো না থেকে ভারি মুশকিল হয়ে গেছে। এখন আর তাদের মাঝে কোনও আড়াল নেই। এ যেন আরও অস্বস্তির।

শুভাশিসের জেদ চেপে যাচ্ছিল। যাকে সে চিরকাল উপেক্ষা করে এসেছে, তার উপেক্ষা সহ্য করা বড় কঠিন।

শনিবার রাতে অরূপদের বাড়ি গেল শুভাশিস। অরূপ চেম্বার থেকে ফেরেনি, শালিনী সবে ঢুকেছে। শুভাশিসকে দেখে ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলে বলল, – ওয়েলকাম। ওয়েলকাম। সুরজ কি আজ পশ্চিম দিকে উঠেছে?

শুভাশিস সামান্য হাসল, – আকাশ কি দ্যাখো না ম্যাডাম? সুরজ আজ সাত দিন ধরে উঠছেই না।

–তাই কি তোমার পায়ের ধুলো পড়ল? সচ বাত, নার্সিংহোমে হয়ে তুমি এ বাড়ির রাস্তাই ভুলে গেছ।

কথাটা মিথ্যে নয়। নার্সিংহোমে অরূপ শালিনীর সঙ্গে দেখা হয়ে যায় বলে আলাদা করে এ বাড়িতে আর আসাই হয় না। শেষ এসেছিল ছন্দার অপারেশানের আগে, পিপির জন্মদিনে।

হাসিটা ধরে রেখে শুভাশিস বলল, তোমার কাছে একটা দরকারে এসেছি শালিনী। পারসোনাল দরকার। ভেরি পারসোনাল।

শালিনী কিছু একটা আঁচ করল। বলল, এক মিনিট। পিপিকে দেখে আসছি।

এক মিনিটেরও কম সময়ে ফিরে এল শালিনী। ভুরুতে ভাঁজ ফেলে বসল, হোয়াটস রঙ?

শুভাশিস বড় শ্বাস ফেলল, আমি তো তোমাকে সে কথাই জিজ্ঞেস করতে এসেছি। হোয়াটস রঙ? হোয়াটস রঙ উইথ ছন্দা?

–তার আবার নতুন কী হল? লাস্ট উইকে আমার সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছে! শী টোলড মী শী ইজ ফাইন!

–ছাই ফাইন! শী ইজ অলওয়েজ সো ডিপ্রেসড! কথা বলে না, সে না, হাঁটাচলা করতে চায়, সারা দিন শুধু শুয়ে থাকে…

-ছেলের সঙ্গেও কথা বলে না?

টোটোর মাধবপুরে যাওয়ার কথাটা তুলল না শুভাশিস। বলল, – সেটাই তো স্ট্রেঞ্জ। ছেলের সঙ্গেও কথা বলে না। আরও সারপ্রাইজিং কি জানো? সারপ্রাইজিং বলব না, বলব অ্যালার্মিং। তোমাদের আমি বলিনি, টোটোর অ্যাক্সিডেন্টের খবর শুনেও শী ওয়াজ সো ড্যাম কুল। অ্যাজ ইফ আমার কোনও পেশেন্টের কিছু হয়েছে। ছেলে বাড়ি ফেরার পরও…।

হুঁ। অরূপ একটু একটু বলছিল বটে। শালিনীকে চিন্তান্বিত দেখাল, টোটোর সঙ্গে কি ছন্দার কোনও ফাইটিং হয়েছিল? আই মিন টু সে, টোটোর অ্যাক্সিডেন্টের আগে..

–মনে হয় না। অন্তত আমার নলেজে নেই।

–দেন হোয়াট? শালিনী থুতনি টিপছে। খানিকটা সময় নিয়ে বলল, ছেলের কোনও কাজে শকড হয়ে থাকতে পারে। আদারওয়াইজ…। শালিনী আবার ভাবল, তোমাকে তো আগেই বলেছিলাম তোমাকে নিয়ে ছন্দার একটা মেন্টাল কমপ্লেক্স আছে। আই ডোন্ট নো হোয়াই। তুমি হয়তো রিজনটা বলতে পারবে। এনি ওয়ে, এটা তোমাদের ব্যাপার। ওর যে সাডেন রেড ডিজেনারেশানটা হল, তার কারণও কিন্তু ওই মেন্টাল প্রবলেম। অ্যাজ ফার মাই মেডিকেল নলেজ গোজ, ওর ওরকম এমারজেন্সি হওয়ার মতো ফিজিকাল কন্ডিশান ছিল না। তা ছাড়া তুমি তো জানোই, হিস্টেরেকটোমির পর অনেক পেশেন্টই ডিপ্রেশনে ভোগে। ওনলি টাইম ক্যান হিল ইট। অফকোর্স তুমি যদি ওকে প্রপার কম্পানি দিতে পারো।

–বিলিভ মি, আমি ওকে সঙ্গ দিতে চাই। কিন্তু ও আমাকে পছন্দ করছে না। শুধু আমি কেন, কোনও ব্যাপারেই ওর উৎসাহ নেই।

–আমার একটা সাজেশান নেবে? ওকে নিয়ে চেঞ্জে চলে যাও।

–এখন! কাজকর্ম শিকেয় তুলে?

 শিকেয় তোলা কথাটা দু-তিন বার উচ্চারণ করে বোধহয় মস্তিষ্কে ভরে নিল শালিনী। হাসতে হাসতে বলল, কিসের জন্য তোমার কাজ ভাই? ফ্যামিলি লাইফের পিলারগুলোই যদি ক্র্যাক করে যায়, তবে পয়সা কামিয়ে কী হবে! সো… কাম কো গোলি মারো। একটা সলিটারি জায়গা দেখে বউকে নিয়ে ভেগে যাও। ছেলেকেও সাথ নেবে না, এনজয় ইওর সেকেন্ড হানিমুন। যদি গ্রিন সিগনাল দাও, আমি প্লেসও অ্যারেঞ্জ করে দেব। রাউরকেল্লা থেকে অ্যারাউন্ড বিশ মাইল দূর একটা আয়রন মাইন আছে। আমার বড় দাদা ওখানে চিফ ইঞ্জিনিয়ার। বিলকুল পাহাড়ি এলাকা। ফাইন একটা বাংলো আছে, তোমাদের জন্য সেটা বুক করে দিতে পারি।

–দেখি কটা দিন। বলব তোমাকে। ভাবছি ওকে অ্যান্টি ডিপ্রেশান ড্রাগ দিয়ে দেখি। দেব?

–দিতে পারো। বাট লাভ ইজ দা বেস্ট স্টিমিউলেটার।

 ভালবাসাই মনের শ্রেষ্ঠ উদ্দীপক! রাতে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে কথাটা ভাবছিল শুভাশিস। মেঘ কিছুটা কেটেছে, মাথার ওপর এক পাণ্ডুর চাঁদ। ছন্দাকে বেড়াতে নিয়ে গেলে যদি উন্নতি হয়, তবে তো শুভাশিসের যাওয়াই উচিত। যাবে?

হাওয়া নেই। গুমোট। ইন্দ্রাণীর কথা মনে পড়ল শুভাশিসের। শুধু ছন্দাকে নিয়ে বেড়াতে যাচ্ছে শুভাশিস, এ কথা ইন্দ্রাণীকে সে বলবে কী করে!

চাঁদ আবার মেঘে ঢেকে গেল। আকাশ লাল। রক্তের মতো লাল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *