৫৬-৬০. বাপ্পা চেঁচাচ্ছে

বাপ্পা পাশের ঘর থেকে চেঁচাচ্ছে, তিতির, অ্যাই তিতির, আমার টেপের জ্যাকটা কোথায়?

তিতির ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে সাজগোজ করছিল। বেরোবে। দাঁতে চাপা হেয়ার ক্লিপ হাতে নিয়ে গলা ওঠাল, — তোর টেবিলের ড্রয়ারে রাখা আছে।

হুঁহ, রাখা আছে!… আমার রবার্ট মাইলস-এর ক্যাসেটটা কোথায় গেল? বন জোভিগুলোও দেখছি না!

–আমি কি ওসব ক্যাসেট শুনি? দ্যাখ না এদিক ওদিক। ওখানেই আছে।

–শিট। কে যে এসবে হাত দেয়! এদিকে আয়, বের করে দিয়ে যা।

উফ, আর পারা যায় না। তিতির আয়নার দিকে তাকিয়ে মুখ ভেংচাল। ট্রেনিং শেষ করে পরশু ফিরেছে দাদা, তার পর থেকেই সবার মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড়। অনর্গল কমেন্ট্রি চলছে শিক্ষানবিশির। এই বন্ধুর গল্প হচ্ছে, ওই বন্ধুর গল্প হচ্ছে, কে কীভাবে হিন্দি বলে, কে কীভাবে ইংরিজি বলে ক্যারিকেচার করে দেখাচ্ছে সেসব। এক কেরালাইট বন্ধু কী করে সম্বর খায় তার নকল দেখে অ্যাটম তো হেসে খুন। বাড়ির বাইরে কদিন থেকে অনেক বদলে গেছে দাদা। তা যাক। একটা রামগরুড় যদি তিন মাস ম্যাড্রাস ঘুরে এলে হাসিখুশি হুল্লোড়বাজ হয়ে যায়, মন্দ কি! তবে হুকুমের পর্বটিও বেড়েছে খুব। শুনতে শুনতে কানের পোকা বেরিয়ে গেল তিতিরের। আগেও জল গড়িয়ে খেত না, এখন শুলেও পাশ ফিরিয়ে দিতে পারলে ভাল হয়। হোস্টেলে তো অনেক কাজই নিজেকে করতে হয়েছে, তবু এই নবাবিয়ানা কেন যে ঘুচল না!

ছোটকা একটা ভাল আইলাইনার এনে দিয়েছে। সূক্ষ্ম তুলি দিয়ে চোখের পাতায় সরু আঁচড় টানল তিতির। সন্তর্পণে শিশির মুখ বন্ধ করে উঠে গেল ওঘরে। বাপ্পার ক্যাসেটের বাক্সতে আঙুল চালাচ্ছে দ্রুত। গোটা তিন-চার ক্যাসেট বার করে ছুঁড়ে দিল, এগুলো কী?

বাপ্পার কোনও হিলদোল নেই। ঝকঝকে কামানো গাল হাসিতে ভরে গেছে।

–তার মানে তুই রেখেছিলি!

–মোটেই না। তোর বাক্সেই ছিল।

–তা হবে। বাপ্পা ফুঁ দিয়ে টেপ রেকর্ডারের ধুলো ওড়াচ্ছে। তিতিরকে একবার আপাদমস্তক দেখে নিয়ে টেপে ক্যাসেট ঢোকাল, এত সেজেগুজে চললি কোথায় রে? টিউটোরিয়াল?.. তোদের টিউটোরিয়ালে আজকাল সাজগোজের কম্পিটিশান হয় নাকি?

কী কথার স্টাইল! নিজে যেন বয়োবৃদ্ধ জ্যাঠামশাই! তিতির রাগ রাগ মুখে বলল, – প্রথমত বলি, আমি মোটেই তেমন সাজগোজ করিনি। দ্বিতীয়ত, আমি টিউটোরিয়ালে যাচ্ছি না। তৃতীয়ত, তোদের কলেজেই অনেক মেয়ে আমার থেকে অনেক বেশি ড্রেস মেরে যায়।

বাহ, আমার অ্যাবসেন্সে তোর অনেক উন্নতি হয়েছে দেখছি! একেবারে জিওমেট্রির মতো কথা বলছিস! বাজনার সুইচ টিপে অল্প অল্প দুলছে বাপ্পা, ওখানে মার্চেন্ট নেভির এক অফিসারের বাড়িতে গিয়েছিলাম বুঝলি। ন্যারির খুব ক্লোজ। তার মেয়েটাও তোর মতো পয়েন্ট সাজিয়ে সাজিয়ে কথা বলছিল…

–তোরা তার নাম দিয়েছিলি হাইপোথিসিস। কথা কেড়ে নিয়ে তিতির ফিক করে হাসল, গল্পটা ঠোঙা হয়ে গেছে রে দাদা। এই নিয়ে ফোর্থ টাইম বলছিস।

বলেছি বুঝি? হা হা।

পিঠে ছড়ানো খোলা চুল আলগা ঝাঁকাল তিতির, এসে অব্দি তোর কী হয়েছে রে দাদা? বিকেলে ঘরে বসে আছিস, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে দেখা করতে গেলি না! বিষ্ণুপ্রিয়াদি এই কমাসে কত বার তোর খোঁজ করেছে…

করেছিল বুঝি? কবার?

–অনেক বার। যখনই দেখা হয় শুধু তোর কথা।

–ঠিকানা চায়নি? বাপ্পার দুলুনি থেমেছে।

 –চেয়েছিল। আমার তখন ঠিক মুখস্থ ছিল না বলে বলতে পারিনি।

–হুঁউউ। বুঝিলাম।

–কী বুঝলি?

-তা জেনে তোর কী হবে রে? বাপ্পা টেপ থামিয়ে খাটে উঠে বসল। ঝট করে তিনটে আঙুল বাড়িয়ে দিল তিতিরের দিকে, অ্যাই, একটা আঙুল ধর তো।

কী হবে?

ধর না।

আঙুল তিনটে এক সেকেন্ড দেখে নিয়ে অনামিকাটা ধরল তিতির। বাপ্পা বলল, ধুস। সব কেঁচে গেল।

তিতির ফ্যালফ্যাল তাকাল, তোর কোনও ক্ষতি হয়ে গেল নাকি?

–হলই তো। ফোরফঙ্গারটা ছিল লঙ বিচ, মাঝেরটা ইয়োকোহামা, আর রিঙ ফিঙ্গারটা সিডনি। তুই শেষ পর্যন্ত সিডনি চুজ করলি! কোথায় আমি ভাবছি স্টেটস বা জাপান থেকে প্রথম সেইল শুরু করব!

তিতিরের বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল। এবার দাদা সত্যি সত্যি ভেসে বেড়াবে! দূরে দূরে। সাগরে। মহাসাগরে। শুকনো মুখে বলল, – তোর কবে জয়েনিং রে দাদা?

–এনি ডে। দু-তিন মাসের মধ্যে যে কোনও দিন। আমার কোর্স কমপ্লিশান সার্টিফিকেট কোম্পানিতে চলে গেছে, এখন তারা যবে কল দেয়। একেবারে প্লেনের টিকিট সমেত ডাক পাঠাবে। তারপর সাঁইইই। যেখান থেকে বলবে সেখান থেকে আমায় জাহাজে উঠতে হবে।

তিতির মনে মনে বলল, বেশ আছিস রে দাদা। এই বাড়ি ভাঙা, বাড়ি বদল, কিছুর মধ্যেই তোকে থাকতে হবে না।

বাপ্পা বুঝি তিতিরের মনের কথাটা টের পেয়েছে। বলল, কবে ভাড়া বাড়িতে উঠে যাওয়া হচ্ছে রে?

-জানি না। মা বলতে পারবে।

–এত দিনে এ বাড়ির লোকরা একটা গুড ডিসিশান নিয়েছে। স্ক্র্যাপ দা ওল্ড, বিল্ড দা নিউ।

 তিতির ম্লান হেসে বলল, – তোর এই জিনসের প্যান্টগুলোর মতো, তাই না?

–অফকোর্স। এখন আমাকে কতগুলো প্যান্ট বানাতে হবে জানিস? শার্ট ভাবছি রেডিমেডই কিনে নেব। মাকে বলেছি। মা বলেছে…।

টেলিফোন বাজছে প্যাসেজে। রুনা দিবানিদ্রার আমেজ মেখে ফোন তুলেছে। অলস গলায় ডাকল, –তিতির, তোর ফোন।

তিতির তড়িঘড়ি টেলিফোনের দিকে ছুটল। নির্ঘাত সুকান্ত। দুদিন তিতিরের দর্শন না পেলেই তৃতীয় দিন দূরভাষে হামলা চালায়। কথাবার্তায় মস্তানের মতো হাবভাব, কিন্তু একেবারে ছেলেমানুষ।

রিসিভার কানে চেপে তিতির এদিক ওদিক তাকিয়ে নিল। যা ভেবেছে তাই। সুকান্তই। কী মরতে যে টেলিফোন নাম্বারটা দিয়েছিল তিতির!

গলা নামিয়ে তিতির বলল, –হল কী? ফোন কেন?

–হল কি তুমি তো বলবে। স্কুলে যাচ্ছ না, টিউটোরিয়ালে বেরোচ্ছ না…

–একটু ব্যস্ত আছি।

 –এখন কিসে বিজি? পরীক্ষা তো নামিয়ে দিয়েছ।

আমার দাদা এসেছে।

–দাদা মানে জাহাজি দাদা?

–ওকি ভাষা! আমার দাদা এখন ডেক ক্যাডেট। তিতির একটু জ্ঞান জাহির করল।

–ওই হল। সুকান্ত একটু চুপ থেকে বলল, – বেরোও না। কতদিন দেখিনি তোমায়।

–লায়ার। তোমার সঙ্গে আমার লাস্ট উইকেই দেখা হয়েছে। বলেই গলায় একটু ঝাঁঝ আনল তিতির, –রোজ রোজ তোমার সঙ্গে আমি দেখা করবই বা কেন?

সুকান্ত চুপ। উত্তর ভাঁজছে বোধহয়।

 তিতির কড়া গলায় বলল, –তোমারই বা এত রাস্তায় রাস্তায় ঘোরা কিসের? বই নিয়ে বসতে পারো না? তোমার না সামনের মাসে পরীক্ষা?

ইল্লি রে, বই নিয়ে বসি আর ফিউচার ডুম হয়ে যাক। বি.কমটা পাশ করে গেলে বাপ আমায় ছাড়বে? দোকানে জুতে দেবে না?

ভাল তো। বসবে দোকানে।

ধ্যাৎতেরি, আমার ভাল লাগে না। বাবা শকুনের মতো পাহারা দেবে, ইচ্ছেমতন কাটা যাবে না…

পলকের জন্য আদিত্যর মুখটা মনে পড়ল তিতিরের। শুধু কাজ না করে করেই তো কুঁড়ে হয়ে গেল বাবা। আর তার থেকেই বাড়িতে এত ঝামেলা। কাশী থেকে ফিরে বাবা অবশ্য আবার গা-ঝাড়া দিয়েছে। রঘুবীরবাবুর সঙ্গে বেরোচ্ছে রোজ। সেদিন পাড়ার অনিলকাকুর সঙ্গে বড় ঘরে বসে কিসব এজেন্সি খোলার পরামর্শ করছিল। কদিন উৎসাহ থাকবে কে জানে!

সুকান্ত অধৈর্য, -বোম মেরে গেলে কেন? বেরোবে?

না। টুক করে মিথ্যে বলে বেশ মজা পেল তিতির। গলায় একটা অভিভাবকের ভাব এনে বলল, -তুমি যদি পড়াশুনো না করো, পরীক্ষায় না বসো, তাহলে আর কোনওদিনই দেখা হবে না। বলেই নামিয়ে রাখল রিসিভারটা।

বেরোবার আগে একবারটি দাদার দরজায় এল তিতির। শুয়ে আছে দাদা, মাথার নীচে হাত, কি যেন ভাবছে। বোধহয় লঙ বিচের কথা কিম্বা ইয়োকোহামা। পুরনো কড়ি বরগার নীচে, ঢক ঢক করে ঘুরতে থাকা পাখার তলায়, বিবর্ণ দেওয়ালের খাঁচায়, শেষ বিকেলের আলো-ছোঁয়া বিছানায় কেমন যেন দূরের মানুষ দূরের মানুষ লাগছে দাদাকে। আগের তেতে থাকা দাদাটাই যেন ভাল ছিল অনেক, আপন ছিল।

তিতির গলা ঝাড়ল, পাশের ঘর খোলা রইল রে, আমি বেরোচ্ছি।

বাপ্পা আলগা ঘাড় ঘোরাল, — যাচ্ছিস কোথায় বললি না?

–সম্রাটদের বাড়ি একটা গেট-টুগেদার আছে।

 –কোথাকার সম্রাট?

–এলগিন রোডের। আমার ক্লাসমেট।

হুঁ। তোর খুব হাইফাই বন্ধু হয়েছে দেখছি!

এইসব টিজিং কমেন্ট করবে বলেই দাদাকে কিছু বলতে ইচ্ছে করে না তিতিরের। নতুন স্কুলের বন্ধুদের কার বাড়িতে কবার গেছে তিতির! অ্যানুয়াল পরীক্ষার শেষের দিন সবাই এমন করে ধরল, কেমন করে না বলে। সত্যি কথা বলতে কি, এরা তার তেমন বন্ধুও নয়, যেমনটি হিয়া ঝুলন দেবস্মিতারা। এক সঙ্গে ক্লাস করে, আড্ডা মারে, মাঝে মাঝে একটু-আধটু ঘোরে এদিক সেদিক ব্যস। তাতেই কি বন্ধুত্ব হয়ে যায়? বন্ধুত্ব জিনিসটা অনেক ভেতরকার ব্যাপার, প্রকৃত বন্ধুর জন্য একটা আলাদা ধরনের টান থাকে।

প্রেসঘরে বসে মা কিসব হিসেব নিকেশ করছে মেশিনদাদুর সঙ্গে। প্রেস বিক্রি হয়ে গেছে, তবে মেশিন এখনও নিয়ে যায়নি নতুন মালিক, বোধহয় সামনের মাসের গোড়ায়…। কম্পোজিটার দুটো চলে গেছে, কিন্তু মেশিনদাদু এখনও আসে রোজ। এর পর মেশিনদাদুও..। স্বপ্ন বেচার ফেরিঅলার দিন ফুরিয়ে এল। সেদিন বলছিল ছোট মেয়ে-জামাই নাকি দেশে নিয়ে যাওয়ার জন্য খুব জোরাজুরি করছে। জামাই বুঝি ঘাটাল না কোথায় যেন চাকরি পাচ্ছে, তার ইচ্ছে শ্বশুর এসে এবার জমিজিরেত দেখুক।

সূর্য অস্তগামী। এখনও রোদের কী তেজ! পথঘাট যেন ঝলসে খাক। মোটা মোটা দেওয়ালঅলা বাড়ি থেকে বেরিয়ে গরমটা যেন আরও বেশি লাগছিল তিতিরের। এক বিন্দু হাওয়া নেই, বিশ্রী থমথমে গুমোট। বাড়ি থেকে বাসস্টপ আর কতটুকুনি, তাতেই তিতির একেবারে ঘামে ভিজে সপসপ।

সম্রাটদের বাড়ি প্রায় নেতাজির বাড়ির কাছাকাছি। পাঁচিলঘেরা ব্রিটিশ প্যাটার্নের দোতলা বাড়ি, দেখলে পুরনো কলকাতার ছবি মনে পড়ে। সামনে ছোট্ট বৃত্তাকার লন, মধ্যিখানে একটা পাথরের ভাঙা পরী। গেটের গায়ে মালি চাকরদের থাকার জায়গা, বাড়িটা ঘিরে বেশ খানিকটা বাগানবাগান জমি। সম্রাটের বাপ-ঠাকুরদাদের তিন পুরুষের আইনের ব্যবসা। দাদুর বাবা ছিলেন হাইকোর্টের জাস্টিস, তাঁর আমলেই নাকি তৈরি হয়েছিল বাড়িটা। সম্রাটের বাবাও নামজাদা ক্রিমিনাল লইয়ার, হাইকোর্টেরই।

গাড়ি বারান্দায় এসে তিতির অস্ফুটে ডাকল, সম্রাট, এই সম্রাট..

বিশাল বাদামি দরজা খুলে মিতেশ বেরিয়ে এল, -হাই মঞ্জিমা! তুই এত দেরি করলি?

আড়ষ্ট তিতির সপ্রতিভ হওয়ার চেষ্টা করল, সবাই এসে গেছে?

কখন! ঝুলন তো এসে চলে গেল।

–কেন?

 –কে সব আসবে ওর বাড়িতে। সাম রিলেটিভস।

 কথা বলতে বলতে ভেতরে যাচ্ছে দুজনে। সামনেই এক বড়সড় প্যাসেজ, অনেকটা ড্রয়িংরুম ধাঁচের। ইয়া ইয়া সোফা পাতা, মাঝখানে পায়ায় কারুকাজ করা গোল শ্বেতপাথরের টেবিল, কোনায় কালো পাথরের নারীমূর্তি। ব্ল্যাক ভেনাস? হতেও পারে। দুই দেওয়ালে বড় বড় পেন্টিং। প্যাসেজ থেকেই দুদিক দিয়ে দুটো সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায়, পালিশ করা কাঠের রেলিঙ মোম চকচক। মেঝেও একেবারে তেল চুকচুক, মনে হয় এখনই পা পিছলে যাবে। ডুমো ডুমো আলো জ্বলছে চতুর্দিকে। ঠিক যেন সিনেমার সিন। দরজা-জানলার মাথায় লাল সবুজ কাচের বাহারটুকুই যা তিতিরদের বাড়ির সঙ্গে মেলে একটু একটু।

কোথায় যেন বাজনা বাজছে মৃদু। স্বপ্নের মতো। তিতির মন্ত্রমুগ্ধের মতো সিঁড়ি দিয়ে উঠতে যাচ্ছিল, মিতেশ হাত ধরে টানল, এদিকে আয়।

প্যাসেজের ডানপাশে ভেজানো দরজা। ঠেলতেই উচ্চকিত বাজনা ঝাঁপিয়ে পড়ল গায়ে। বিরাট হলঘরে মিটমিটে বাতি জ্বলছে। নাচছে বন্ধুরা। সম্রাটের হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। ওকি পাঞ্চালীর হাতেও!

তিতির সিঁটিয়ে গেল। আরও কী একটা গন্ধ যেন ঘরে! সেই গন্ধ যা বাবার মুখ থেকে পেতে পেতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে নাক!

কুলজিৎ নাচছে না। ঘরের এককোণে দাঁড়িয়ে ক্লাসের আরও পাঁচ-সাতটা ছেলেমেয়েকে উত্তেজিতভাবে কি যেন বোঝাচ্ছে। ভীষণ সরল ছেলে, যখনই কথা বলে ওভাবেই হাত-পা ছোঁড়ে।

তিতির কুলজিতের দিকে এগিয়ে গেল। সঙ্কুচিতভাবে জিজ্ঞাসা করল, কিসের একটা স্মেল পাচ্ছি রে কুলজিৎ?

কুলজিৎ জোরে জোরে নাক টানল, কই, আমি তো কিছু পাচ্ছি না।

–আমি পাচ্ছি। হুঁউউ।

 কুলজিৎ কাঁধ ঝাঁকাল, –ড্রিঙ্কসের গন্ধ হবে। দুটো বিয়ার আর একটা হুইস্কি আনা হয়েছিল, সকলে ভাগ করে খেয়েছে। ঘরটা স্টাফি হয়ে গেছে তো, তুই বাইরে থেকে এলি….

সম্রাট নাচ থামিয়ে কথা শুনছিল। ধোঁয়া না গিলে দু-তিনটে টান দিল সিগারেটে। কায়দা করতে গিয়ে খকখক কাশল একটু। বোধহয় গলায় চলে গেছে ধোঁয়া। কাশি সামলে বলল, –একটু আছে, খাবি? খেয়ে নে, গন্ধটা আর নাকে লাগবে না।

তিতির সভয়ে বলল, তোদের বাড়িতে কেউ নেই এখন?

বাবা কলকাতায় নেই, একটা কেসের ব্যাপারে দিল্লি গেছে। লেজ ধরে ধরে মাও। আমিই এখন লিটেরালি বাড়ির সম্রাট।

–সেই সুযোগে তোরা বাড়িতে মদ এনে খাচ্ছিস?

সম্রাট মিতেশ কুলজিৎ পাঞ্চালী টিনা বুলবুল সবাই মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে। রঙ্গন বলল, –মদ খাওয়া কি ক্রাইম নাকি?

পাঞ্চালী তিতিরের মুখের কাছে এসে ধোঁয়া ছাড়ল, স্মোকিং, ড্রিঙ্কিং ছাড়া কি গেটটুগেদার জমে? এই তো দ্যাখ না, আমি কীরকম সব টেস্ট করছি।

আমাদের বাড়িতে পার্টি হলে তো ড্রিঙ্কসের ফোয়ারা বয়ে যায়। বাবা ট্যাক্সি থেকে ক্রেট ক্রেট বোতল নামায়।

–মিতেশ যে মিতেশ, অর্থোডক্স ঘাসপাতা খাওয়া ভেজ, সে পর্যন্ত সিপ দিল…

–দেব না কেন? লিকার তো আর মাটন চিকেন দিয়ে তৈরি হয় না। সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে লিকার তো ভেজ আইটেমই।

তিতিরের বুকটা কেমন মুচড়ে উঠছিল। এই দুনিয়ায় তার বাবাটাই শুধু মোদো-মাতাল, আর সকলে অভিজাত গেরস্থ! কেন? বাবা তেমন সফল মানুষ নয় বলে? ব্যর্থ মানুষের সবই দোষ। বাবাটারও অবশ্য মাত্রাজ্ঞান বড় কম।

পাঞ্চালী গ্লাসে খানিকটা সোনালি পানীয় ঢেলে এনেছে, নে, চোখ বুজে চুমুক দে।

তিতির ঠেলে গ্লাস সরিয়ে দিল, না, আমি খাব না।

–এত ট্যাবু কেন? আমরা তো মাতাল হচ্ছি না। এই তো ঝুলন দিব্যি চুমুক মেরে চলে গেল।

তিতির ঈষৎ ক্ষিপ্তভাবে বলল, বলছি তো খাব না। কেন জোর করছিস?

সম্রাট হাহা হাসল, তুই দেখি আমাদের ডাম্পির মতো করছিস। ডাম্পি মানে আমাদের স্পিৎজসটা। ওকে যেদিন মা প্রথম জিন খাওয়াতে গেল, সেদিন কী অবস্থা! এদিকে পালায়, ওদিকে পালায়। এখন মার হাতে গ্লাস দেখলেই সুড়সুড় করে লেজ নাড়তে নাড়তে এসে বসে। আজ মা নেই, সারাদিন হাই তুলছে। দে দে, একবার চুমুক দে মঞ্জিমা, তোরও ঠিক ওই অবস্থা হবে। নেক্সট কোনও গেটটুগেদার হলেই মনে হবে ড্রিঙ্কসের অ্যারেঞ্জমেন্ট নেই কেন!

তিতিরের গা গুলিয়ে উঠছিল। মদ শুনলেই কী যে এক আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে শরীরে! ফ্যাকাসে মুখে বলল, আমার শরীরটা ভাল লাগছে না রে, আমি আজ যাই।

–ঠিক আছে বাবা, ঠিক আছে। তোকে ছুঁতে হবে না।

 –দেখালি বটে। তুই মঞ্জিমা, না বড়পিসিমা!

 –ও কী রে, ওর যদি ইচ্ছে না হয়…

–ইচ্ছে না হতেই পারে।

–তোর অ্যাটিচিউডটা কিন্তু খুব ইনসাল্টিং মঞ্জিমা।

বন্ধুদের মধ্যে একটা বাকবিতণ্ডা শুরু হতে যাচ্ছিল, সম্রাট থামাল। তিতিরকে বলল, –এই মঞ্জিমা, চলে যাস না প্লিজ। পার্কস্ট্রিট থেকে চাইনিজ আনিয়েছি, খেয়ে যা।

তিতির কাতর মুখে বলল, আমার একদম খেতে ইচ্ছে করছে না রে। বিলিভ মি, শরীরটা আজ সত্যিই খারাপ। আসবই না ভাবছিলাম, নেহাত তোর বাড়ি বলে…

–প্লিজ মঞ্জিমা, একটু কিছু টেস্ট কর। সম্রাট তিতিরের হাত চেপে ধরল, নইলে সবাই খুব হার্ট হবে। প্লিজ।

তিতির ছোট্ট শ্বাস ফেলল। উপায় নেই। এসে পড়েছে যখন, এখন আর সিনক্রিয়েট করে যাওয়া যায় না।

কোণে একটা টেবিলে খাবার রাখা আছে। একটা প্লেটে অল্প চিলি প্রন আর সামান্য মিক্সড চাউমিন তুলে নিল তিতির। খাচ্ছে।

মাঝে একটু তাল কেটেছিল আবার শুরু হয়েছে পাশ্চাত্য গান। নাচছে বন্ধুরা। দাদার ঘরে শুনেছে টিউনটা। ফিল কানন্স কি? না এলটন জন?

টিনা এসে টানল তিতিরকে, কাম অন। নাচ অ্যাট লিস্ট।

প্লেট হাতে একটু একটু দুলল তিতির। নিজেকে কেমন বোকা বোকা লাগছিল। এই সব বন্ধুরা তার তেমন খারাপ নয় সম্রাট আর কুলজিৎ ছাড়া কেউ তেমন বড়লোকও নয়, শুধু শখগুলো সকলের কেমন উদ্ভট রকমের রঙিন। ইশ, দাদু যদি তাকে এই পরিবেশে দেখত!

একটু পরে তিতির সম্রাটকে বলল, –চলি রে।

যাবি? শরীর খারাপ বলছিলি? ড্রাইভারকে বলব তোকে ছেড়ে আসতে?

–নো থ্যাঙ্কস। আমি এখন ঠিক আছি। খাবারটা খুব ভাল ছিল রে। তিতির সকলের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ল, বাই ফোকস।

— সমস্বরে সবাই বলে উঠল, বাই মঞ্জিমা। নো হার্ড ফিলিংস।

তিতিরের মনটা যেন ভরে গেল। এতক্ষণে ঘরের সকলকে একটু একটু বন্ধু মনে হচ্ছে তার। একটু রাগ, একটু বিবাদ, একটু হাসি, একটু ভালবাসা, এর মধ্যে দিয়েই তো গড়ে ওঠে সম্পর্ক। আরেকটু থাকলে হত। মাকে তো বলাই আছে ফিরতে দেরি হবে।

আমোদিত কলরব ফেলে রাস্তায় এল তিতির। হাঁটছে। রাস্তাটা অপেক্ষাকৃত নির্জন, অন্ধকার অন্ধকার। হু হু করে পাশ দিয়ে গাড়ি ছুটে যাচ্ছে। মন্দ লাগে না হাঁটতে।

সহসা বাতাস ঠাণ্ডা হয়ে গেল। গুমোট ছিঁড়ে একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল যেন। রাস্তার শুকনো পাতা, ছেঁড়া কাগজের টুকরো ধুলোয় নেচে উঠল ঝমঝম। চোখে মুখে ঢুকে যাচ্ছে ধুলিকণা। এলগিন রোডের মোড় বেশ খানিকটা দূর, সেখানে পৌঁছনোর আগেই প্রমত্ত ঝড় উঠে গেল। ঘোড়ার খুরের মতো দাপিয়ে আসছে বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা। কালবৈশাখী।

তিতির জোরে পা চালাল। ওড়না দিয়ে আড়াল করছে মুখ। একটা গাছের নীচে দাঁড়াল একটু। এগোবে, না অপেক্ষা করবে? ভাবতে ভাবতেই ঝড়ের মাথায় চেপে জোর বৃষ্টি এসে গেছে। আরও দু-একটা লোক গাছের তলায় এসে আশ্রয় নিয়েছে। অন্ধের মতো দৌড়চ্ছে কেউ কেউ। এক মহিলার ছাতা উল্টে গেল।

ছুটন্ত এক মারুতি ঝপ করে ফুটপাত ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে। খানিকটা এগিয়ে। সোঁ করে ব্যাক করে এল। জানলার কাচ নামিয়ে ডাকছে ব্যস্ত স্বর, উঠে এসো। উঠে এসো।

তিতিরের হাঁটু কেঁপে গেল। টোটো।

.

৫৭.

গাড়ির ড্যাশবোর্ডে হিন্দি গান বাজছে। এসি মেশিনের নিঃশব্দ ক্রিয়ায় হিম হয়ে আছে ভেতরটা। সামনের কাঁচে পাশাপাশি দুটো ওয়াইপার জল কাটছে ছপছপ। নিমেষে আলোকিত হচ্ছে পথঘাট, নিমেষে ঝাপসা।

পিছনের সিটে কাঠ হয়ে বসেছিল তিতির। ভেবে পাচ্ছিল না কেন কেবলুসের মতো উঠে পড়ল গাড়িতে। মুখের ওপর না বলে দিলে উচিত শিক্ষা হত টোটোর। কী করবে, তিতিরের মাথাটাই যে কাজ করল না তখন। আশপাশের লোকগুলোও বড্ড ড্যাবড্যাব করে দেখছিল যে! আশ্চর্য, তিতিরকে এত অপছন্দ তবু তাকে টোটো ডাকল কেন!

পায়ের ওপর পা তুলে বসে আছে টোটো। পাশেই বাঁ হাত মালিকি কেতায় সিটের মাথায় ছড়ানো। চকিত বৃষ্টিতে মোড়ে একটা যানজট হয়েছে, উদাস মুখে তাকিয়ে আছে সেদিকে।

 তিতির গলা ঝাড়ল, আমাকে তুমি যে কোনও একটা বাস স্টপে নামিয়ে দিতে পারো।

টোটো যেন শুনতেই পেল না। গম্ভীর গলায় ড্রাইভারকে বলল, রামদেও, টেপটা অফ করে দাও।

বাজনা থামতে অস্বস্তিটা যেন বেড়ে গেল দুগুণ। অধৈর্য মুখে তিতির বলল, থ্যাঙ্কস ফর দা লিফট। এখানে নামিয়ে দিলেও আমি বাড়ি চলে যেতে পারব।

ঘুরল টোটো। চোখ কুঁচকে দেখল তিতিরকে, তুমি ভিজে গেছ।

না না, তেমন কিছু ভিজিনি। আমি তো গাছের নীচে ছিলাম। বলতে বলতে আর একটু জবুথবু হল তিতির। গাড়িটা কি ডাক্তার আঙ্কল নতুন কিনেছে? নিশ্চয়ই নতুন। সিটের প্লাস্টিক এখনও ছেঁড়া হয়নি। আচমকা বৃষ্টির ছাটে সত্যিই তিতিরের সালোয়ার-কামিজ ভিজে গেছে অল্প অল্প, এত দামি গাড়ির নতুন সিটটা…!

টোটো তিতিরের আড়ষ্টতা লক্ষ করছিল। বলল, কুঁকড়ে আছ কেন? রিল্যাক্স।

 তিতির আরও গুটিয়ে গেল, না না, আমি ঠিক আছি।

কিছু ঠিক নেই। তুমি কাঁপছ।… রামদেও এসিটা অফ করে দাও।

 টোটোর হাবভাব, কথা বলার ধরন-ধারণ, হুবহু বড়দের মতো। কী দাপটে হুকুম চালায় রে বাবা! মাঝবয়সী ড্রাইভারকে অবলীলায় নাম ধরে ডাকছে! মিনতি সন্ধ্যার মাকে তিতির কখনও দিদি মাসি ছাড়া ডাকতে পারবে? ডাক্তার আঙ্কলকে প্রাণপণে নকল করার চেষ্টা করছে টোটো, কিন্তু কোথায় যেন বাবা ছেলের মধ্যে একটা তফাত রয়ে গেছে। বোধ হয় এই ধরনের আচার আচরণেই। টোটোটা বেশ পাকা আছে।

যানজট বেয়ে শামুকের গতিতে এগোচ্ছে গাড়ি। একটা বাস খারাপ হয়েছে সামনে, লোকজন জোগাড় করে তাকে ঠেলে সরাচ্ছে কন্ডাকটাররা, ইয়া ছাতি হাতে এক ট্রাফিক পুলিশ পর্যবেক্ষণ করছে দৃশ্যটা। বৃষ্টির ছাট কমে এল।

তিতির একটু সহজ হওয়ার চেষ্টা করল, আমি কিন্তু সত্যিই চলে যেতে পারতাম। অসুবিধে হত না।

–পৌঁছে দিলে আপত্তি আছে?

–তা নয়। তুমি কেন মিছিমিছি অতটা ঘুরবে! কোথায় সাদার্ন মার্কেট, কোথায় ঢাকুরিয়া!

 টোটো উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করল না। নরম গদিতে শরীর ছেড়ে দিয়েছে। গার্জেন সুলভ ভঙ্গিতে জিজ্ঞাসা করল, এদিকে এসেছিলে কোথায়?

কাছেই। বন্ধুর বাড়ি।

–তোমার সেই বয়ফ্রেন্ড? মোটরসাইকেলঅলা?

পলকে তিতিরের মুখ ভার। তাকে কি টিজ করার জন্যই গাড়িতে তুলেছে টোটো।

টোটোর মুখে হঠাৎ এক গাল হাসি, চটে গেলে?

বন্ধ জানলার কাছে মুখ ঘুরিয়ে নিল তিতির।

–খুব রেগে আছ মনে হচ্ছে? আমি কিন্তু তোমাকে কখনও ইচ্ছে করে ইনসাল্ট করিনি।

 –সে তো ব্যবহারেই বোঝা যায়। তিতিরের নিস্পৃহ উত্তর।

 দু-এক সেকেন্ড চুপ করে রইল টোটো। আবার হেসে উঠেছে জোরে, যদি কিছু বলেও থাকি সে তো কাটাকুটি হয়ে গেছে। উই ক্যান বি ফ্রেন্ডস নাউ।

তিতিরের রাগটা পড়ে আসছিল। তবু যে কেন বুকে এক ড্রাম বেজে চলে অবিরাম। নিজেকে স্বাভাবিক করার আপ্রাণ চেষ্টা করল তিতির, এখানে আমার এক ক্লাসের বন্ধু থাকে, সম্রাট। চেনো তুমি?

–হ্যাঁ হ্যাঁ সম্রাটকে চিনব না? ক্লাস সিকস অবধি এক সেকশানেই পড়েছি আমরা। আগে কতবার গেছি ওদের বাড়ি। …বাড়ি বটে একখানা! কী অ্যান্টিক কালেকশান! …ওদের বাড়ি এসেছিলে?

–আমাদের আজ গেট টুগেদার ছিল।

সম্রাটদের দেওয়ালের সব পেন্টিংগুলো দেখেছ? ব্যাটল অফ ওয়াটারলু? লাস্ট সাপারের কপি? ওদের দোতলায় একটা স্কালপচার আছে, ওটা নাকি প্যারিস থেকে আনা।

কথায় কথায় পরিবেশ খানিকটা সহজ। তিতির ভদ্রতা করে জিজ্ঞাসা করল, তুমি কোত্থেকে আসছ?

-স্যারের বাড়ি। মাঝে কদিন পড়তে আসা হয়নি..

তিতিরের আচমকা মনে পড়ে গেল কদিন আগে অপারেশন হয়েছে ছন্দা আন্টির। বাড়ি ফেরার পরও নাকি আন্টির শরীর ভাল যাচ্ছে না। ছি ছি, কথাটা আগেই তোলা উচিত ছিল।

তিতিরের স্বর উদ্বিগ্ন হল, ছন্দা আন্টি এখন হাঁটচলা করছেন?

টোটো একটু থমকাল যেন। হাসিতে পর্দা টেনে নিল। সামান্য সময় নিয়ে বলল, করছে অল্পস্বল্প। আমরা বিছানা থেকে বেশি উঠতে দিচ্ছি না। স্টিচটা পাকিয়ে ফেলেছিল…

–তোমাদের খুব টেনশন গেল কদিন।

–তা গেল। এখন একটু সামলানো গেছে। দেশ থেকে কাকিমা এসে গেছে…।

এ কথাটাও জানে তিতির। সোমবার ডাক্তার আঙ্কল এসেছিল বাড়িতে, মার সঙ্গে কথা হচ্ছিল, তিতির শুনেছে তখন। ছন্দা আন্টির অপারেশনের দিন ডাক্তার আঙ্কলের বাবাও এসেছিলেন কলকাতায়। টোটোর কাকাও কলকাতা-মাধবপুর করেছেন কদিন। ডাক্তার আঙ্কলের তো নাস্তানাবুদ অবস্থা। এক দিকে ছন্দা আন্টি, এক দিকে নিজের রুগী, অপারেশান, চেম্বার…। ও টিতেও নাকি ছন্দা আন্টির কিসব প্রবলেম হয়েছিল। জ্ঞান ফিরতে দেরি হচ্ছিল, আঙুল-টাঙুল নীল হয়ে গিয়েছিল…।

ছন্দা আন্টির মুখটা মনে করার চেষ্টা করছিল তিতির। ডাক্তার আঙ্কলের কাছে ছবিতে দেখা মুখ নয়, সেই ছোটবেলায় দেখা মুখটা। আবছা আবছা মনে পড়ে। কেমন সুন্দর করে ঠোঁট টিপে হাসত আন্টি! টোটো একবার তিতিরের হাত থেকে চকোলেট কেড়ে নিয়েছিল, একবারই, ছন্দা আন্টি খুব বকেছিল টোটোকে। ভারি মিষ্টি একটা গন্ধও বেরোত ছন্দা আন্টির গা থেকে। ঠিক ফুলেরও নয়, তেলেরও নয়। চেনা চেনা, আবার অচেনাও।

তিতির আনমনে বলে উঠল, কতদিন আন্টিকে দেখিনি।

টোটো ভুরু কুঁচকে তাকিয়েছে। তিতিরকে দেখতে দেখতে মিলিয়ে গেল ভাঁজ। বলল, যাবে মাকে দেখতে?

-আজ! এখন!

–হোয়াটস হার্ম? চলো না।

 তিতির নার্ভাসভাবে ঘড়ির দিকে তাকাল, আজ যে অনেক দেরি হয়ে গেছে!

সবে তো আটটা। ইচ্ছে হলে যেতে পারো।

তিতিরকে বাড়িতে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে টোটো! এতবার করে! নিজের কানকে বিশ্বাস হচ্ছিল না তিতিরের। টোটোর ঔদাসীন্যে বুকের গভীরে জমে ওঠা অভিমান, হিয়ার সঙ্গে টোটোর ঘনিষ্ঠতার সম্ভাবনায় গজিয়ে ওঠা গোপন ঈর্ষার অরণ্য কোথায় যেন মিলিয়ে যাচ্ছে। দুর্দম এক ইচ্ছেয় ছটফট করছে মন। বুকের ভেতর আর ড্রাম নয়, এক ঘণ্টা বেজে উঠল ঢং ঢং। নিষেধের। যেয়ো না তিতির। কেন যাবে তিতির? যাবে নাই বা কেন? মাকে ভয়? মা ছন্দা আন্টিকে পছন্দ করে না, তার সঙ্গে কবে কোনকালে কি মন কষাকষি হয়েছিল মার, কিন্তু সেসব তো মার ব্যাপার, তার সঙ্গে তিতিরের কী? ডাক্তার আঙ্কল তো দিব্যি নিউট্রাল, তিতিরই বা তা হবে না কেন? ছন্দা আন্টি ফোনে যথেষ্ট মিষ্টি করেই কথা বলে তিতিরের সঙ্গে। মার সবেতেই বাড়াবাড়ি। কাকিমা পিসি কবে কি বলল, তাও বছরে পর বছর পুষে রেখে দেয় মনে। দিদা মারা যাওয়ার পর পিসি বুঝি একবার দিদার গয়নার কথা জিজ্ঞাসা করেছিল, এখনও সুযোগ পেলেই মা তাই নিয়ে কথা শোনায় বাবাকে।

কাকিমার তো সব কথাতেই দোষ। তিতিরকে সামান্য একটা দোপাট্টা কিনে দিলেও বাঁকা চোখে দেখে মা। তিতির ছন্দা আন্টির কাছে গেলে মার খারাপ লাগবে? মা যেন কত তিতিরের ভাল লাগা মন্দ লাগার মূল্য দেয়! দাদার টাকার জন্য হুট করে প্রোমোটারের হাতে বাড়িটা তুলে দিল মা, তখন কার খারাপ লাগার পরোয়া করেছে? দাদু কি যেচে বাড়ি ভাঙার কাগজে সই করেছিল? কক্ষনও না। বাড়ি ছিল দাদুর প্রাণ। দাদু তো সেই দুঃখেই…। সব জানে তিতির, সব জানে।

টোটো আবার প্রশ্ন করল, রামদেওকে তাহলে সোজা বাড়ি যেতে বলি?

তিতির দ্বিধা ঝেড়ে ফেলল। ছন্দা আন্টি অসুস্থ, তাকে দেখতে যাওয়া মোটেই গর্হিত অপরাধ নয়। তাও যেচে যাচ্ছে না তিতির, যাচ্ছে টোটোর উপরোধে।

তিতির অস্ফুটে বলল, চলো, তবে বেশিক্ষণ কিন্তু বসব না।

বৃষ্টি ধরে গেছে। কালবৈশাখীর ঝমাঝম দশ মিনিটেই শেষ। ওয়াইপার থেমে গেল। সামনের স্বচ্ছ কাচের ওপারে স্পষ্ট হয়েছে পৃথিবী, আলোর বিচ্ছুরণ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে চোখ।

অল্প অল্প গরম লাগছিল তিতিরের। টোটোর দিকে ফিরে বলল, কাচটা নামিয়ে দেওয়া যায় না?

–ও শিওর। হোয়াই নট? একদম বাবার মতো করে কাঁধ ঝাঁকাল টোটো। দু পাশের দুটো জানাই খুলে দিল সটাসট। গাড়ির বাইরে আলগা হাত চালিয়ে বলল, গরমটা অনেক কমে গেল।

–হ্যাঁ, বৃষ্টিটার দরকার ছিল খুব। গরমকাল আমার একটুও ভাল লাগে না।

–আমারও। উইন্টার ছাড়া সব সিজনই বোগাস। শীতে বেড়িয়ে আরাম, অনেক এনার্জি নিয়ে পড়াশোনা করা যায়…

–তুমি খুব পড়ো, তাই না?

টোটো আবার কাঁধ ঝাঁকাল, –পড়তে তো হয়ই।

–তুমি এবার হায়ার সেকেন্ডারিতে স্ট্যান্ড করে যাবে।

–হ্যাহ। অত সহজ?

-তুমি কত ভাল ছেলে। মাধ্যমিকেও তোমার র‍্যাংক ছিল। ফরট্টি সেকেন্ড না ফরটি থার্ড কি হয়েছিলে যেন?

–ওরকমই কিছু একটা হবে। সেভাবে দেখতে গেলে তো সবারই র‍্যাংক আছে। যে কজন পাস করে প্রত্যেকেরই।… তুমি হিউম্যানিটিজে গেলে কেন? ম্যাথস ভাল লাগে না?

কথা বলতে বলতে তিতির অনেক স্বচ্ছন্দ এখন। শৈশবের পর থেকে বহুকাল সম্পর্ক ছিল না, সঙ্কোচের পলি জমেছিল মনে, কেটে যাচ্ছে। এলোমেলো কথার ফাঁকে কখনও স্কুলের কথা উঠে পড়ে, কখনও বা ছোটখাট ভাল লাগা মন্দ লাগার কথা, কখনও বা বন্ধুবান্ধবদের কথা। শুধু হিয়ার প্রসঙ্গটাই সন্তর্পণে এড়িয়ে যাচ্ছিল তিতির। দেখছিল টোটো নিজে থেকে তোলে কি না। তুলল না। টোটো ডাক্তার হতে চায় না শুনে তিতির ভারি অবাক। টোটোর নাকি সিভল সারভিসে জয়েন করার শখ। ভাল ভাল। যা হুকুমদারি মেজাজ, ওটাই মানাবে। তিতির কি বলবে সে কী হতে চায়! সাদা পোশাক পরা সন্ন্যাসিনী! সিস্টার ভেরোনিকা সিস্টার সুজানের মতো! বলল না। যদি হাসে টোটো।

রাসবিহারীর মোড়ে ট্রাফিক সিগনালে দাঁড়িয়েছে বাদামি মারুতি। হাওয়া বইছে ফুরফুর। মেট্রো স্টেশনের সামনে এক বিরাট হোর্ডিং। সিনেমার।

জয়-পরাজয়। আরে, ছোটকার সেই ফিলমটা না!

বিশাল টিনের পাতে রঙচঙে নায়ক-নায়িকা পিঠে পিঠ লাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের প্রায় পদতলে, একেবারে কোনা ঘেঁষে ফুটে আছে এক টেরিকাটা মুখ, চেনা লোকরাই শুধু কন্দর্প বলে আন্দাজ করতে পারবে তাকে। নায়ক-নায়িকার নামের নীচে নামও আছে কন্দর্পর, অপেক্ষাকৃত ছোট হরফে।

আশ্চর্য, বইটা রিলিজ হচ্ছে অথচ তিতির খবর পায়নি! ভেতরে একটা খুশি গুনগুনিয়ে উঠল তিতিরের। বারবার দেখছে ছবিটা। কী ত্যাড়াবেঁকা করে এঁকেছে ছোটকাকে! তা হোক, তবু এঁকেছে তো!

টোটো তিতিরের দৃষ্টি অনুসরণ করার চেষ্টা করল, কী দেখছ?

উদগত উচ্ছ্বাসটাকে দমিয়ে ফেলল তিতির। টোটো যা হাইফাই ছেলে, হয়তো তিতিরের ছোটকা বাংলা ফিলমে অ্যাক্টিং করে শুনলে মুখ বেঁকাবে। দরকার কি বাবা, তিতিরের ছোটকা তিতিরেরই থাক।

তিতির হেসে বলল, কিছু না।….. তোমাদের বাড়ি আর কদ্দূর?

–এই তো এসে গেছি। আমাদের এই ফ্ল্যাটটায় তুমি আগে আসোনি, তাই না?

টোটো হওয়ার পরই চেতলার বাড়ি ছেড়েছিল শুভাশিস, উঠে এসেছিল মনোহরপুকুর রোডে। বাড়িটা বড়ই ছিল, খোলামেলা। কিন্তু পাশে ছোটখাট বস্তিও ছিল একটা। সাদার্ন মার্কেটের এই ফ্ল্যাট বছর পাঁচেক আগে কেনা। তার কত আগে থেকেই তো আসা-যাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে তিতিরদের।

ফ্ল্যাটের বন্ধ দরজার সামনে মুগ্ধ চোখে ডাক্তার আঙ্কলের নেমপ্লেটটা দেখছিল তিতির। চকচকে বাদামি কাঠের গায়ে সোনালি অক্ষরে জ্বল জ্বল করছে আঙ্কলের নাম। তিতিরদের বাড়ি যে আঙ্কল যায়, সেই আঙ্কল কি এই আঙ্কল! কেমন যেন অচেনা অচেনা লাগছে। সিরসির করছে তিতিরের বুক। ডাক্তার আঙ্কল কি বাড়িতে আছে এখন? থাকার অবশ্য কথা নয়। যদি থাকে, তিতিরকে দেখে ভীষণ চমকে যাবে।

টোটোর কাকিমা দরজা খুলেছে। সাদামাটা চেহারা, কপালে একটা বড় সিঁদুরের টিপ। পিছনে তার এক ছোট্ট ফুটফুটে মেয়ে।

টোটোকে দেখে মেয়েটা কলকল করে উঠল, তোমার সঙ্গে আড়ি। তোমার সঙ্গে আড়ি।

 মেয়েটাকে শূন্যে ছুঁড়ে লুফে নিল টোটো, কেন রে?

তুমি এত দেরি করলে কেন?

 বিশ্রী একটা নরওয়েস্টার এল না! তাতেই তো …

 তিতির অবাক চোখে দেখছিল ফ্ল্যাটখানা। কী সুন্দর করে সাজানো গোছানো! দামি দামি ফার্নিচার, প্লাস্টিক পেন্ট করা দেওয়াল, মেঝেতে নরম গালচে, অপরূপ সব শেডঅলা আলো চারদিকে। ডাক্তার আঙ্কল যে বড়লোক তিতির জানত, এত বড়লোক! নিত্যদিন যে সাদাসাপটা হাসিখুশি মানুষটাকে দেখে তিতির, সে এমন একটা বাড়িতে বাস করে!

কাকিমার সঙ্গে তিতিরের পরিচয় করিয়ে দিল টোটো। ঝুপ করে একটা প্রণাম করল তিতির। টোটো বাচ্চাটাকে দেখিয়ে বলল, আর এই হল আমার বোন। মাই ওনলি সিস্টার। মাদাম টুকি।

উঁহু, মাদমোয়াজেল। তিতির টুকির গাল টিপে দিল, ভারি সুইট তো।

 টোটোর কাকিমা বলল, তুমিই বা কম কি! আহা, কী সুন্দর মুখখানা! টোটোর সঙ্গে পড়ো বুঝি?

তিতির টুক টুক ঘাড় নাড়ল।

টোটো সোজা ডান দিকের ঘরটায় ঢুকে গেছে। ডাকছে তিতিরকে, — এসো। মা এখানে।

রাজার বাড়ির বিছানায় যেন দুখিনী রানির মতো শুয়ে আছে ছন্দা আন্টি। দেওয়ালের দিকে মুখ, পাতলা একটা চাদরে গলা অবধি ঢাকা। কাটগ্লাসের টেবিল ল্যাম্প জ্বলছে ঘরে, হালকা একটা দ্যুতি ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। বেডসাইড টেবিলে অজস্র ওষুধ। জলের জগ। একটা দুটো ম্যাগাজিনও রাখা আছে।

টোটো বিছানার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে, মা, দ্যাখো কে এসেছে।

ছন্দা আন্টি ঘুরল কষ্ট করে। দেখছে তিতিরকে, চিনতে পারছে না।

টোটো টিউবলাইট জ্বেলে দিল। বালিশে ভর দিয়ে সামান্য ওঠার চেষ্টা করল ছন্দা আন্টি। ঝট করে একবার তাকাল দরজার দিকে, যেন আরও কাউকে খুঁজছে। তারপর কেমন অদ্ভুত চোখে তাকাল ছেলের দিকে। বিড়বিড় করে বলল, তিতির না!

এতদিন পরেও তাকে দেখে চিনতে পেরেছে আন্টি! কী করে চিনল! তিতির হাসল আলগা, শরীর এখন কেমন?

আন্টি যেন শুনেও শুনল না। টোটোর দিকেই চোখ, তুই ওকে কোত্থেকে পেলি!

রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছিল, ধরে আনলাম। ….. সারপ্রাইজ প্যাকেজ, কী বলো?

পলকের জন্য দৃষ্টিটা তীব্র হয়ে উঠল আন্টির। ভয়ানক তীব্র। এত তীব্র যে তিতিরের গা ছমছম করে উঠেছে। শীর্ণ মুখের ওই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বুকে গেঁথে যাচ্ছে যেন। আন্টি কি তিতিরকে দেখে খুশি হয়নি! নাকি কোনও কষ্ট হচ্ছে শরীরে!

ক্ষণপরেই ছন্দার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটেছে। এক বিচিত্র নির্লিপ্তি সেই হাসিতে। চোখ বুজে ফেলল। বলল, –ওকে এখানে দাঁড় করিয়ে রাখলি কেন? যা, তোর ঘরে নিয়ে গিয়ে বসা।

টোটো বলল, ও তোমাকেই দেখতে এসেছে।

–তাই! … আমি খুব ভাল আছি তিতির। তোমাদের খবর ভাল তো?

 –ওই এক রকম। তুমি শুয়ে পড়ো আন্টি।

–শুয়েই তো আছি সারা দিন। তা তোমার পড়াশুনো কেমন চলছে?

চলছে।

রুগীর ঘরে বেশিক্ষণ থাকতে হবে না। যাও, টোটোর ঘরে গল্প করো গিয়ে। … টোটো, তোর কাকিমাকে বলেছিস তিতির এসেছে? ওকে একটু মিষ্টিটিষ্টি দিতে বল।

আন্টি কি একটু পাশে বসতে বলতে পারত না তিতিরকে! একবার নয় তিতিরের গায়ে হাত রাখত! আন্টির কথাগুলোও কেমন দায়সারা গোছের। তিতিরের মনটা খারাপ হয়ে যাচ্ছিল।

ছন্দার ঘর থেকে বেরিয়ে তিতির বলল, এবার আমি যাই।

টোটো হাসছে বিচ্ছুর মতো, কাকিমা তোমায় না খাইয়ে ছাড়বেই না।

–আমার কিন্তু দেরি হয়ে যাবে। … সম্রাটদের বাড়ি অনেক খেয়েছি, এখন আর কিছু খাব না প্লিজ।

একটা কোল্ড ড্রিঙ্কস অন্তত খেয়ে যাও। বলতে বলতে গলা ওঠাল টোটো, কাকিমা, তিতির কিছু খাবে না বলছে। ফ্রিজে ঠাণ্ডা কিছু আছে কিনা দ্যাখো না।

–আছে। অলকা রান্নাঘর থেকে উত্তর দিল, কিন্তু ওর ছিপি আমি খুলতে পারি না।

–ও কে। নো প্রবলেম। তিতিরকে হাতের ইশারায় উল্টো দিকের ঘরটা দেখাল টোটো, তুমি এক সেকেন্ড আমার ঘরে বোসো। আমি আসছি।

বিরস মুখে টোটোর ঘরে ঢুকল তিতির। সঙ্গে সঙ্গে মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠেছে। টোটোর ঘরের দেওয়ালে এ কিসের ছবি! গোলাপ ক্ষেতের মাঝখানে ছোট্ট এক দোতলা কাঠের বাড়ি। আশ্চর্য, এই ছবি তো তিতির নিজের দেওয়ালে টাঙাতে চায়, এ ছবি এখানে এল কী করে!

বহু যুগ পর হঠাৎই তিতিরের পোস্তদানা মনটা পিনপিন করে উঠল, তিতির পালা। এখানে আর এক মুহূর্ত নয়।

তিতির ঘাড় বেঁকাল, কেন? এটা আমার ডাক্তার আঙ্কলের বাড়ি।

–মোটেই না। এটা টোটোর বাড়ি।

–সো হোয়াট? তা বলে পালাব কেন?

–তর্ক করিস না। যা বলছি শোন। শিগগিরই তোর সঙ্গে টোটোর ঝগড়া হবে।

–মোটেই না। টোটো এখন আমার বন্ধু।

টোটো দু হাতে দুটো গ্লাস নিয়ে ঘরে এল। ব্যস, পোস্তদানা মন চুপ।

তিতির গ্লাসে চুমুক দিল, –এই পোস্টারটা কে লাগিয়েছে?

–আমার ঘরে আবার কে লাগাবে! আমিই।

–তুমি বুঝি নেচার খুব ভালবাস?

–ভীঈঈষণ। নতুন একটা ক্যামেরা পেয়েছি, তা দিয়ে এখন তো শুধু নেচারেরই ছবি তুলছি। বাড়িতে একটা ক্রাইসিস হয়ে গেল, নইলে একদিন বোটানিক্সে যাব ভাবছিলাম। প্রকাণ্ড বটগাছটার ছবি তুলে রাখা দরকার। নানান অ্যাঙ্গেল থেকে। শয়ে শয়ে ঝুরি নেমেছে গাছ থেকে, মেন ট্রাঙ্কটা তো আর এগজিস্টই করে না। দারুণ ফ্যাসিনেটিং, তাই না?

কথায় কথায় খানিকটা সময় গড়িয়ে গেল। নটা বেজে গেছে।

 টোটো বলল, –চলো, তোমায় এগিয়ে দিয়ে আসি।

তুমি আবার কেন বেরোবে!

–তা বললে হয় নাকি! আমি তোমার দেরি করিয়ে দিলাম। রামদেও দশটা অবধি থাকে, চলো আমারও একটু ঘুরে আসা হবে।

পোস্তদানা মনের সাবধানবাণী বেবাক ভুলে গেল তিতির, চলো।

সাদার্ন অ্যাভিনিউ ধরে জেট প্লেনের মতো ছুটছে গাড়ি। শনশন হাওয়ায় উড়ছে তিতিরের চুল। বাতাসে ভারি নরম এক সোঁদা গন্ধ। আলোছায়ায় মাখামাখি গোটা পথ।

টোটো হঠাৎ বলল, তোমার সেই বয়ফ্রেন্ডটাকে একদিন দেখলাম।

তিতির অন্যমনস্ক ছিল। বলল, কে বয়ফ্রন্ড?

–সেই মোটরসাইকেলঅলা। আনোয়ার শাহ রোডে আমাদের আগের গাড়িটার ক্লাচ অ্যাডজাস্ট করতে গিয়েছিলাম, দেখি গ্যারেজের কয়েকটা মেকানিকের সঙ্গে বসে হেভি গুলতানি করছে। ওরা বুঝি সব তোমার বয়ফ্রেন্ডের দোস্ত?

কথাটা ফুটল তিতিরের গায়ে। আবার একটু মজাও পেল যেন। টোটো কি সুকান্তকে হিংসে করে! নইলে সামান্য সুযোগ পেলেই সুকান্তর কথা তোলে কেন!

তিতির বলল, হতেই পারে। এক এক জনের কত লেভেলের বন্ধু থাকে।

–ওর লেভেলটা ভাল না।

হতে পারে। তিতির উলটো ঘা দিতে চাইল টোটোকে। ঝুপ করে হিয়ার প্রসঙ্গ টানল, –তোমার হিয়ার খবর কী? অ্যানুয়াল কেমন দিল?

টোটো নড়ে চড়ে বসল, আমার হিয়া কেন হবে, হিয়া তো তোমার বন্ধু।

–ছিল। এখন নেই। স্কুলে তো সবাই বলে হিয়া রাজর্ষি আইসোটোপ বনে গেছে।

–হ্যাঁ। আই ফিল ফর হিয়া। এত স্যাড লাইফ হিয়াটার!

হঠাৎই হিয়াকে যেন জাতশত্রু মনে হল তিতিরের। গোমড়া গলায় বলল, –মোটেই স্যাড লাইফ না। বহুকাল আগে বাবা-মার ডিভোর্স হয়ে গেছে, তারপর দিব্যি জলি ছিল, এখন আবার বেশি প্যানপ্যানানি শুরু করেছে।

জানো, হিয়ার বাবা আবার বিয়ে করেছে?

–তো কি? ওর মা তো আরও আগে বিয়ে করেছে। ওর ভাই সেখানে অ্যাডজাস্ট করে থাকে না? বাবা-মার লাইফ হল বাবা-মার লাইফ। তাই নিয়ে ছেলেমেয়েদের কাঁদতে বসার কী আছে! হিয়ার বাবা হিয়াকে যথেষ্ট ভালবাসে। মোটেই নেগলেক্ট করে না।

টোটো একটু চুপ থেকে বলল, হিয়ার ঠাকুমা বাড়ি থেকে চলে গেছেন, জানো?

তিতির জোর একটা ঝাঁকুনি খেল। যা ভাবে না, যা বিশ্বাস করে না, প্রিয় বান্ধবীর সম্পর্কে তাই বলতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠছিল সে। কিন্তু এই ধাক্কা যে তার চেয়েও বেশি।

তিতির থম মুখে বলল, — কোথায় গেছেন ঠাকুমা?

আপাতত হিয়ার কোনও এক দূরসম্পর্কের পিসির বাড়ি। ওখান থেকে ওল্ডহোম, আশ্রম কোথাও একটা জায়গা খুঁজছেন। পেলেই চলে যাবেন।

তিতিরের চোখে জল এসে গেল। নাক টানছে। হিয়ার ওপর কেন এত নিষ্ঠুর হয়ে পড়ছে সে! তিতিরের মনটা কি খুব ছোট হয়ে গেল!

.

ঢাকুরিয়া ব্রিজ থেকে নেমে তিতিরদের বাড়ির কাছে পৌঁছে গেছে গাড়ি। তিতির বাড়ির রাস্তাটা চিনিয়ে দিচ্ছিল ড্রাইভারকে। আর বিশ-তিরিশ গজ বাকি। হঠাৎই টোটো চিৎকার করে উঠল, রামদেও, থামো। গাড়ি ঘোরাও।

তিতির বলতে যাচ্ছিল, কী হল? তার আগে টোটোই হাত বাড়িয়ে দরজা খুলে দিয়েছে তিতিরকে, – নেমে যাও।

–এখানে কেন? বাড়ি অবধি আসবে না?

-না। তোমরা যে ক্লাসের মেয়ে, তারা কোনওদিনই হিয়ার কষ্ট বুঝতে পারবে না। টোটোর চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে। চোখ দুটো জ্বলছে দপ দপ। দাঁতে দাঁত চেপে বলল, –নাউ গেট ডাউন।

তিতির নামতেই সোঁ করে পাক খেল গাড়িটা। দ্রুতগামী সরীসৃপের মতো চলে গেল পিছলে।

হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তিতির। টোটোর ওই আকস্মিক রূঢ় ব্যবহারের কার্যকারণ খুঁজে পাচ্ছে না কোনও। হিয়াকে নিয়ে একটু কঠিন কঠিন কথা বলেছে বলে এত রাগ! টোটোর এখন এত প্রেম হিয়ার ওপর!

তিতির অন্ধের মতো হাঁটছিল। দু-তিন পা হেঁটেই পাথর হয়ে গেছে। কৃষ্ণচূড়া গাছের নীচে ডাক্তার আঙ্কলের সাদা মারুতিটা দাঁড়িয়ে আছে।

একটা কুয়াশা কেটে যাচ্ছিল তিতিরের মন থেকে। সে এত বোকা ছিল এতদিন!

.

৫৮.

দুলালের সামনে আজ ইয়া ইয়া অন্ধ্রের কাতলা। কন্দর্প নাক কুঁচকে জিজ্ঞাসা করল, –আর কিছু নেই রে?

দুলাল একটা মাছের পেট থেকে তেল বার করছিল। কন্দর্পর দিকে একবার চোখ তুলেই নামিয়ে নিল। অর্থাৎ উত্তরের প্রয়োজন নেই।

–চেতল-ফেতল রাখছিস না?

নেবেন? পেটি দেড়শো, গাদা একশো। কাল এনে রাখব।

কাল কি আর আসা হবে? আজ যদি হত

আজ অন্য একটা রাজা মাছ আছে। চন্দন, নীচের ঝুড়ি থেকে বার কর তো।

প্যান্ট শার্ট পরা কেতাদুরস্ত চন্দন লাফিয়ে নামল দোকানের ঝাঁপি থেকে। তলার খাঁজ থেকে টেনে বার করে আনল এক রুপোলি ইলিশ। বরফে বরফে কাঠের মতো হয়ে আছে মাছটা, –নেবেন? পদ্মার মাল। তেলে কড়া ভেসে যাবে।

কন্দর্প ঈষৎ বিপদের গন্ধ গেল। লঘু সুরে বলল, কত করে যাচ্ছে?

–চন্দন, মাছটা ঢুকিয়ে রাখ। দুলাল কাটা কাতলার আঁশ ছাড়াচ্ছে।

ফ্যাকাসে হাসল কন্দর্প, — দাম শোনাও কি বারণ?

–শুনে কী করবেন দাদা? আমার বঁটি আমারই গলায় মারবেন।

–তবু শুনি।

দুলাল গলা নামাল, একশো ষাট।

আঁতকে এক পা পিছিয়ে গেল কন্দর্প, ওই দামে কেউ কিনবে?

কিনবে মানে? মালা পরিয়ে নিয়ে যাবে। দেখুন না একটু দাঁড়িয়ে। এ মাছের খদ্দেররা এসে দরদাম করে না। শুধু বলে পিস ছোট কোরো না দুলাল। ছোট পিস খেলে মানুষের মন ছোট হয়ে যায়।

শালা, লোকজনের হাতে কাঁচা পয়সাও আসছে বটে! টাকা যেন উড়ছে! অশোকদাকে দেখেই চোখ টাটায়, আর এখন যেন সবাই অশোকদা। ঘুষের টাকা বাঁই বাঁই নাচছে। সরকারি ঘুষ, বেসরকারি ঘুষ, ব্যবসায়িক ঘুষ, হাত্তা, কমিশন, দালালি ….। একেই কি শাস্ত্রে কলিকাল বলেছিল!

বেজার মুখে চারশো কাটা পোনা নিয়ে সরে এল কন্দর্প। সবজির বাজারেও এ সময়ে ঘুরে সুখ নেই। শুধু পটল আর ঝিঙে, ঝিঙে আর পটল। সঙ্গে দড়কচা মারা বেগুন, নয় পানসে কুমড়ো। তবু খানিক্ষণ বাজারটা চরকি মারল কন্দর্প। দেড়েমুশে বাজারখানা চষতে তার মন্দ লাগে না। ডিমওলি শাকওলির সঙ্গে রঙ্গরসিকতা জোড়ে, সবজিঅলার সঙ্গে অকারণ দরদস্তুর চালায়, ফলঅলার দোকানে গিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আম কলা। সবটাই যে কেনার অনুষঙ্গ তা নয়, লোকগুলোর সুঙ্গে কথা বলতে কন্দর্পর বেশ লাগে। প্রত্যেকেরই এক একটা বিশেষ বাচনভঙ্গি আছে, নিজস্ব মুদ্রাদোষ আছে, এ সবই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে কন্দর্প। সাত টাকার বেগুনকে পাঁচ টাকা বললে কেউ বেজায় চটে যায়, কেউ বা হা-হা করে হাসে, কেউ কেউ সন্ন্যাসীর মতো উপেক্ষা করে কন্দর্পকে। সবই ভারি মজার, সবই ভারি শিক্ষার। মনের নোটবুকে কন্দর্প টপাটপ নোট নিয়ে চলে, ডায়ালগ ডেলিভারির কায়দাগুলো তুলে নেয় মস্তিষ্কে।

এবার আমের ফলন ভাল। বৈশাখের গোড়াতেই হিমসাগরে ছেয়ে গেছে বাজার, একটা দুটো ল্যাংড়াও উঁকি মারছে। কারবাইড মারা বোধ হয়, তবু কেজি খানেক ল্যাংড়াই নিল কন্দর্প। বাপ্পাটা এসেছে, কবে চলে যায়, মাছ খেয়ে সুখ না হোক, একটু আম খেয়েই তৃপ্তি পাক।

বাজার থেকে বেরিয়ে একটা বাংলা কাগজ কিনল কন্দর্প। এই কাগজে আজ সিনেমা টিভির পাতা আছে, একটু চোখ বোলাতে হবে। আরও কয়েকটা টুকিটাকি সওদা করল বাইরের দোকান থেকে। নিজের পয়সায়। একটা গায়ে মাখার সাবান, শ্যাম্পুর শ্যাশে, শেভিং ক্রিম। গোটা কয়েক নুডলসের প্যাকেটও কিনল, তিতিরটা খেতে ভালবাসে।

কেনাকাটা শেষ করে তৃপ্ত মুখে একটা সিগারেট ধরাল কন্দর্প। ঠিক তখনই বাপ্পাকে দেখতে পেল। হনহন করে বাপ্পা হেঁটে আসছে স্টেশনের দিকে। কন্দর্পকে দেখেই দাঁড়িয়ে পড়ল, তাড়াতাড়ি বাড়ি যাও ছোটকা। দুজন ভদ্রলোক তোমার জন্য ওয়েট করছে।

–কে? নাম কী?

–একজন কি সাম কুণ্ডু। প্রোডিউসার-ফোডিউসার মনে হয়।

রতন কুণ্ডু?

হতে পারে। ঠিক মনে পড়ছে না। যাও যাও, অনেকক্ষণ বসে আছে।

কন্দর্প একটু টাল খেয়ে গেল। রতন কুণ্ডু নামী প্রোডিউসার, সে হঠাৎ তার বাড়িতে কেন! আর এলও যদি, তো এই সময়ে! দাড়ি-টাড়ি কামানো নেই, দু-হাতে দুই বাজারের থলি .. কী ইম্প্রেশানটা হবে কন্দর্পর সম্পর্কে! থলি দুটোরও যা চিটচিটে দশা! দোষটা অবশ্য নিজের। বউদি রোজই বদলাতে বলে, কন্দর্পরই মনে থাকে না। এখনই কিনে ফেলবে নাকি দুটো প্লাস্টিক ব্যাগ!

কন্দর্প চোখ সরু করে তাকাল, কোন ঘরে বসেছে রে?

–কোথায় আবার। বড়ঘরে। বাপ্পা হনহনিয়ে চলে গেল।

 প্রশ্নটারই কোনও মানে হয় না। বড়ঘরে বসবে না তো কি রান্নাঘরে যাবে! কন্দর্প পা চালাতে চালাতে একটা হিসেব ছকে নিল। ব্যাগ দুটোকে এক হাতে নিয়ে পাঞ্জাবির আড়ালে ধরে সুড়ৎ করে বড়ঘর পার হয়ে যাবে। ভেতরে ঢুকে ব্যাগ নামিয়েই ফিরে আসবে ঝ্যাট করে। যেন ঢোকার সময়ে খেয়ালই করেনি, এমন ভাবে বলবে, আপনারা!

ছেলেকে স্কুলে নিয়ে যাওয়ার পথে এক মহিলা ঘুরে ঘুরে দেখছে কন্দর্পকে। মাথা ঝাঁকিয়ে একগুছি চুল কপালে এনে নিল কন্দর্প। সকালের দিকে যেমন তেমনভাবে বেরিয়ে পড়ে রাস্তায়, কিন্তু এটা বোধ হয় ঠিক নয়। নিজের পাড়ায় চেনা বামুনের পৈতে লাগে না ঠিকই, তবু কন্দর্প রায় এখন একটা ফিগার, লোকজন এখন চিনতে পারে তাকে, এভাবে ফেকলুর মতো রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো শোভা পায় না তার।

বাড়ি ঢুকতে গিয়েই কন্দর্প ধরা পড়ে গেল। রতন কুণ্ডু বারান্দায় পায়চারি করছে। বছর ষাটেকের সৌম্য চেহারা, পরনে ভাঁজভাঙা ধুতি-পাঞ্জাবি, গলায় সরু সোনার চেন।

কন্দর্পকে দেখে একগাল হাসল রতন কুণ্ডু, অ্যাই যে। এসে গ্যাচো? তোমার প্রিতিক্ষাতেই দাঁড়িয়ে আছি।

–আসুন আসুন, ভেতরে আসুন। কন্দর্প শশব্যস্ত, আজ একটু বাজার যাওয়ার শখ হয়েছিল ….. আপনাদের চা-টা দিয়েছে?

–সে হবেখন। তুমি এসো চটপট।

 ঘরে ঢুকে অন্য প্রাণীটিকেও দেখতে পেল কন্দর্প। জীবন ভটচাজ। বছর চারেক আগে একটা ফিচার ফিলম ডাইরেক্ট করেছিল, চলেনি, এখন টিভির লাইনে ঘুর ঘুর করছে। রতন কুণ্ডু কি সিরিয়াল ধরছে! স্টুডিওপাড়ায় খবর নেই তো!

রান্নাঘরে বাজার নামিয়ে সন্ধ্যার মাকে চা করতে বলল কন্দর্প। মিষ্টি আনানোর জন্য ব্যাগ থেকে দশ টাকা বার করেও রেখে দিল। বড় মানুষদের কথায় কথায় খাওয়াতে নেই। ওতে লোকে খেলো ভাবে। তাছাড়া আজকাল মাঝে মাঝেই ডিরেক্টর প্রোডিউসার আসছে বাড়িতে, বেশির ভাগই টিভির খুচরো রোলের জন্য, এদের বেশি আমল দিতে নেই। তবে রতন কুণ্ডু অবশ্য উঁচু জাতের মাল, ওকে একটা ওমলেট খাওয়ানো যায়।

কন্দর্প সন্ধ্যার মাকে বলল, -ফ্রিজে ডিম আছে? থাকলে চায়ের সঙ্গে ভেজে দিয়ো। আর কটা কুচো নোনতা বিস্কুট …

সিগারেট দেশলাই হাতে বড়ঘরে এসে বসল কন্দর্প। প্যাকেটটা হালকাভাবে ছুঁড়ে দিল টেবিলে, বলুন রতনদা, হঠাৎ আপনার দর্শন?

রতন কুণ্ডু ডিবে থেকে নস্যি নিল শব্দ করে। রুমাল বার করে নাক মুছল, — আমি একটা ফিচার শুরু করচি, বুইলে। গ্রাম-শহর মেশানো। জীবনবাবুই স্টোরিটা লিকেচেন।

জীবন ভটচাজ বলল, একটু মিউজিক বেসড গল্প। হিরো গ্রামে যাত্রাদলে গান গাইত, শহরে এসে নাম করল। গ্রামে তার প্রেমিকা আছে, আবার শহরেও একটা মেয়ে তার প্রেমে পড়ে গেল …

কন্দর্প সিগারেট ধরাল, তা আমার কি রোল?

 রতন বলল, রোল মানে! তুমি হিরো।

কোঁৎ করে খানিকটা ধোঁয়া গিলে ফেলল কন্দর্প। কঠিন আয়াসে সামলাল চমকটা। কার মুখ দেখে উঠেছিল আজ! দরজা খোলার সময়ে মিনতি বারান্দা ঝাঁট দিচ্ছিল না! ওকে একটা শাড়ি কিনে দিতে হবে।

কন্দর্প উঠে সিগারেটের প্যাকেটটা এগিয়ে দিল জীবনকে। জীবন বলল, নো থ্যাঙ্কস। আমার চলে না।

রতনদা আপনি?

–আমার তো দিনে দুটো। একটা ভোরবেলা বাথরুম করতে লাগে, আর একটা রাতে খাওয়াদাওয়ার পর।

কন্দর্প সোফায় হেলান দিয়ে বসল, আপনাদের কবে থেকে শুটিং শুরু হচ্ছে?

রথের দিন মহরত হবে। এখন থেকেই সব সইসাবুদগুলো করিয়ে নিতে চাই।

কন্দর্প উসখুস করতে করতে প্রশ্ন করে ফেলল, হিরোইন কে কে?

–দুটো মেয়েই নতুন নেব ভাবছি। একটা অবশ্য একদম নতুন নয়, তুমি তার সঙ্গে কাজ করেচ। মণিকা। রতন গলা নামাল, আমার একটু লো বাজেট, বুইলে?

–তাতে কি? মণিকা তো অভিনয় ভালই করে। ও কি গ্রামেরটা করছে?

না না, ও শহরের। গ্রামের জন একদম নিউ ফেস। মেয়ে দেকা চলচে, এখনও ফাইনাল হয়নি।

–ও। তা স্ক্রিপট-টিপট শোনাবেন না?

নিশ্চয়ই। জীবন তোমাকে কপি দিয়ে দেবে।

কেমন যেন একটু আশঙ্কা হল কন্দর্পর। সত্যি সত্যিই তাকে হিরো করতে চাইছে রতন কুণ্ডু! তার কি বক্স আছে কোনও! গাঁয়েগঞ্জে তো একটা মানুষও তাকে তেমন করে চেনে না। অবশ্য জয় পরাজয় রিলিজ করলে অবস্থা একটু বদলে যাবে, কিন্তু তাও কত ভাল!

কন্দর্প পলকা কৌতূহল ছুঁড়ল, –মেল আর কে লিডে আছে?

আমার ছবিতে দুটো-তিনটে হিরোর কারবার নেই। তুমি একাই হিরো। ফার্স্ট টু লাস্ট তুমিই ছবি টানবে।

ধুস, স্বপ্ন। কন্দর্প নির্ঘাত জেগে নেই। নাকি লোক দুটো পাগল! ঠিক যেরকমটি নায়কের ব্রেক সে আশা করে এসেছে এতদিন, সেরকমটিই ঘটছে, এও কি সম্ভব?

বাইরে একটা গাড়ি হর্ন দিচ্ছে। সুদীপের অফিস আজকাল গাড়ি দিচ্ছে সুদীপকে। ব্রিফকেস নিয়ে হন্তদন্ত মুখে বেরিয়ে গেল সুদীপ। রুনা অ্যাটমও বেরোচ্ছে পিছন পিছন। সন্ধ্যার মা চা ডিমভাজা রেখে গেল।

কন্দর্প বিগলিত মুখে বলল, — খেয়ে নিন আগে।

জীবন ভটচাজ গম্ভীর মুখে প্লেট টানল, গম্ভীর মুখে খাচ্ছে। রতন কুণ্ডু অন্যমনস্ক মুখে প্লেট টানল, অন্যমনস্ক মুখে খাচ্ছে। টুকটাক কথা চলছে তিন জনের। কোন কোন টেকনিশিয়ান কাজ করবে ছবিতে, কবে থেকে আউটডোর শুরু হবে, কোথায় আউটডোরের প্ল্যান, ইনডোরেই বা কদিনের কাজ এই সব।

এক সময়ে আসল কথাটা উঠল। জীবন ভটচাজ চায়ে চুমুক দিতে দিতে বলল, রতনদা, টাকা-পয়সার কথাটা সেরে নিন।

-হ্যাঁ বলি। সোফায় সোজা হয়ে বসল রতন, – দ্যাকো কন্দর্প, বড় বড় নায়কদের কাছে আমি যেতে পারছি না। প্রথমেই বলেচি টাকা বেশি নেই।

জীবন বলল, কিন্তু গল্পটা খুব সিরিয়াস। তুমি আমার গোলাপকুঁড়ি নিশ্চয়ই দেখেছিলে। বুঝেছ তো আমি একটু অফ বিট ভঙ্গিতে কাজ করি। এ রোল তোমাকে লাইম লাইটে এনে দেবে।

কন্দর্পর রক্ত চঞ্চল হয়ে উঠল। অশোকদা একবার বলেছিল ছোটামোটা রোল করেই নাকি জীবন কাটবে কন্দর্পর! এখনই চাকা ঘুরতে শুরু করেছে। তা অশোকদা যাই বলুক, তার কাছে কৃতজ্ঞতার শেষ নেই কন্দর্পর। জয় পরাজয়ে চান্স না পেলে কে কন্দর্পর দরজায় আসত।

রতন বলল, তুমি বলো তুমি কীরকম আশা করচ?

কন্দর্প ডান হাতটা চুলকোল। যা হয় একটা কিছু বলে দেবে নাকি! শুনেই যদি ভেগে যায়!

 ঢোঁক গিলে কন্দর্প বলল, এ আমি কী বলব? আপনি পুরনো মানুষ …।

রতন কুণ্ডু জীবনের দিকে তাকাল। চোখে চোখে কি যেন কথা হল দুজনের। জীবন বলল, আমরা মোটামুটি হিরোর জন্য তিরিশ ধরেছি।

একটা ছবিতে তিরিশ হাজার! কন্দর্পর হৃৎপিণ্ড লাফিয়ে উঠল। তবে ভাবটা ফুটতে দিল না মুখে। মাথা চুলকে বলল, — আর দশ বাড়ানো যায় না?

জীবন কি একটা বলতে যাচ্ছিল। রতন ইশারায় থামাল, ঠিক আছে, আর পাঁচ বাড়ালাম। আজই হাজার এক টাকা সাইনিং অ্যামাউন্ট দিয়ে যাচ্ছি। মহরতের আগে আরও দশ। বাকিটা শুটিং-এর মধ্যে ক্লিয়ার হয়ে যাবে। তুমি আর না বোলো না। এটা চেকেই দিচ্ছি, বাকিটা চেক ক্যাশ ফিফটি ফিফটি করে দেব। ঠিক আছে?

ঘোর ঘোর স্বপ্নের মধ্যে গোটা সকালটা ঘরে শুয়ে রইল কন্দর্প। বারোটা নাগাদ উঠল বিছানা ছেড়ে। দাড়ি কামিয়ে স্নানখাওয়া সেরে বেরিয়ে পড়ল। স্কুটার নিল না সঙ্গে, স্টুডিওপাড়ায় যাবে না আজ। সোজা একটা ট্যাক্সি ধরে নামল স্যাস ক্লিনিকের সামনে।

বাইরে প্রখর উত্তাপ, নার্সিংহোমের ভেতরে পাহাড়ি ঠাণ্ডা। আহা, শুভাশিসদা খাসা বানিয়েছে জায়গাটা!

মধুমিতার রিসেপশান কাউন্টারেই থাকার কথা, নেই। এদিক ওদিক চোখ চালিয়ে খুঁজল কন্দর্প। পাশের অফিসঘরে গেল। কী সব ফাইলপত্র ঘাঁটাঘাটি করছে মধুমিতা। কন্দর্পকে দেখে বরিয়ে এল বাইরে। অবাক মুখে বলল, আজ হঠাৎ! কাল যে বললেন আসবেন না।

কীভাবে ভীষণ খুশির খবর দিতে হয় ভেবে পাচ্ছিল না কন্দর্প। ধেই ধেই করে নেচে দেবে! হৃদয় আমার নাচে রে বলে গান জুড়বে!

কিছুই করতে হল না। মধুমিতাই বলে উঠল, –ভাল খবর আছে মনে হচ্ছে?

কন্দর্পর কথা জড়িয়ে গেল, আমি বাজি মেরে দিয়েছি।

– কীসের বাজি?

একটা হিরোর রোল পেয়ে গেছি। আজ সকালে কনট্র্যাক্ট হল। হাফ হিরো কোয়ার্টার হিরো নয়, পুরোদস্তুর নায়ক।

মধুমিতাকে তেমন একটা ছুঁল না খবরটা, –তাই বলুন। আমি ভাবলাম কি না কি!

কেমন সুখবর আশা করে মধুমিতা কন্দর্পর কাছ থেকে! কন্দর্প সামান্য আহত হল, তুমি এটাকে গ্র্যান্ড নিউজ বলো না?

-আপনি শাইন করছেন। ভালই তো। … খাওয়াচ্ছেন কবে?

ব্যস, এইটুকুই শুধু বলার আছে মধুমিতার! কপালে একটা ছোট্ট নীল টিপ পরেছে মধুমিতা, সেদিকে তাকিয়ে কন্দর্প দীর্ঘশ্বাস লুকোল, –যেদিন বলবে। যদি বলো আজই।

–আজ হবে না। সন্ধেবেলা মা বেরোবে, একটু তাড়াতাড়ি ফিরতে বলেছে।

কন্দর্প চুপ করে গেল। কত কথার বুদবুদ ঠেলে উঠছে বুকে, কিছুই বলতে ইচ্ছে করল না। টাকা হাতে এলে স্কুটার বেচে দিয়ে একটা সেকেন্ডহ্যান্ড গাড়ি কেনার মতলব ঘুরছে মাথায়। মধুমিতার সঙ্গে একটু আলোচনা করবে ভেবেছিল। থাক। তার খুশিতে জগৎসংসার উল্লসিত হয়ে উঠবে এটা ভাবাও তো মুর্খামি।

ঘরের ভেতর থেকে ডাক এল, মিসেস সিনহা, সাত নম্বরের বিলটা রেডি হয়েছে?

–আসি বীরেশদা, এই এক মিনিট। মেডিকেল টেস্টের ভাউচারগুলো যে কোথায় গেল!

ফাইলে নেই?

–দেখছি না তো।

–কোথায় মিসপ্লেসড হল? ওরা কিন্তু চারটের সময়ে পেশেন্ট নিতে আসবে।

 –দেখছি। কোথাও ঢুকে আছে নিশ্চয়ই।

মধুমিতা যেতেও পারছে না, আবার যেন সামনে দাঁড়িয়ে থাকতেও অস্বস্তি। কন্দর্পই মুক্তি দিল তাকে, –চলি।

কাল আসছেন তো?

–দেখি।

 পথের ঝাঁঝালো রোদ্র গায়ে লাগছিল না কন্দর্পর। অন্যমনস্ক মনে হাঁটছিল। কোনও এক চিন্তাতে স্থিত হতে পারছে না মাথা, পরের পর পিছলে যাচ্ছে চিন্তারা। একা একা বেশিক্ষণ খুশিও থাকা যায় না, আনন্দ কেমন যেন ম্যাড়মেড়ে হয়ে যায়। এই যে আকাশ থেকে একটা সুযোগ ঝরে পড়েছে কন্দর্পর ঝুলিতে, এ খবরে কেন মন ভরে না মধুমিতার! একটা একটা করে নিশ্চিন্ততার সোপান তৈরি হবে, তার পরেই না কন্দর্প …!

খানিক এদিক-সেদিক ঘুরে অশোক মুস্তাফির অফিসে এল কন্দর্প। খুশি হোক আর না হোক, খবরটা অশোকদাকে দেওয়া তার কর্তব্য। অন্য কারুর মুখ থেকে শুনলে সেটা খুব বিশ্রী ব্যাপার হবে।

মুস্তাফির ঘরে আরও দুটো ষণ্ডামার্কা লোক বসে আছে। কন্দর্পকে দেখে খিক খিক হাসল মুস্তাফি, লাক খুলছে, অ্যাঁ?

এবার কন্দর্পর চমকানোর পালা। অপ্রস্তুত মুখে বলল, –কীসের লাক?

কুণ্ডুদা তোমায় হিরো বানিয়ে ফেলল!

 –আপনি জানলেন কী করে?

ইনটিউশান। মুস্তাফি শরীর কাঁপিয়ে হাসছে, পরশু কুণ্ডুদা রূপেনের কাছে তোমার অ্যাড্রেস খুঁজছিল। কাল জীবন আমায় তোমার জয়-পরাজয়ের কাজ নিয়ে জিজ্ঞেস করছিল। আজ তুমি যে তুমি, যে দশ বারো দিন ধরে আমার অফিস মাড়াচ্ছ না, হঠাৎ খারপোশের মতো মুখ করে আমার চেম্বারে ঢুকে পড়লে … এরপর জানতে কি বাকি থাকে!

–সবই আপনার আশীর্বাদ অশোকদা।

–মারব এক রদ্দা। এতটুকু সেলফ কনফিডেন্স নেই! কতয় সই করলে?

কন্দর্প ষণ্ডা লোক দুটোকে এক ঝলক দেখে নিল। পঁয়ত্রিশ বলতে গিয়ে কি ভেবে বাড়িয়ে নিল একটু। বলল, -চল্লিশ।

মুস্তাফি প্রায় লাফিয়ে উঠল চেয়ার থেকে, –মাত্র চল্লিশ! তুমি একটা গাড়ল। তুমি একটা পাঁঠা। তোমার টেংরি খুলে নেওয়া উচিত। কিন্তু লাভ নেই, বাজারে বিক্রি হবে না। জানো, কুণ্ডু কী চিজ! দুটো ফ্লাওয়ার মিল আছে ব্যাটার। সালকেরটা তো রমরমিয়ে চলে। মিনিমাম এক লাখ নেওয়া উচিত ছিল।

–এক লাখ কে আমায় দেবে অশোকদা?

-তোমার কলজের জোর থাকলে ওই কুণ্ডুটাই দিত। তোমার নজরটা এখনও নিচুই রয়ে গেল কন্দর্প।

এখানেও আনন্দটা ঠিক বাঁটা গেল না। কন্দর্প আরও বিমর্ষ হয়ে পড়ল। মুস্তাফি ভাবলেশহীন মুখে ষণ্ডা লোক দুটোকে কার যেন ঠিকানা দিচ্ছে। কোন এক কাস্টমার মুস্তাফির ফিনান্স কোম্পানি থেকে গাড়ি কেনার জন্য লোন করেছিল, কমাস ধরে নাকি গঙ্গায় ডুব দিয়ে বসে আছে, তাকে একটু চমকাতে মাসলম্যান দুটোকে পাঠাচ্ছে মুস্তাফি। লোক দুটো নির্দেশ নিয়ে উঠে গেল। শেষ মুহূর্তে মুস্তাফি তাদের আর একবার স্মরণ করিয়ে দিল লোকটার যেন ফিজিকাল ইনজুরি না হয়।

চেম্বার ফাঁকা হতেই মুস্তাফি বলল, তারপর বউদির খবর কী বলো? দাদা কাশী থেকে ফিরেছেন তো?

ফিরেছে।

 –মেজদা কী করছে? বাড়িটাড়ি দেখা শুরু করেছে?

 –দেখছে বোধহয়। রোববার তো একটা দালালের সঙ্গে বেরোল।

–দেখো, আমার কিন্তু প্ল্যান জমা পড়ে গেছে, দু-দশ দিনের মধ্যে বেরিয়ে যাবে। বাই জুন আমি বাড়ি ভাঙা শুরু করব।

–এত তাড়াতাড়ি?

তাড়াতাড়ি কোথায়! চার-পাঁচ মাস তো হয়েই গেল। পুজোর আগে কাজটা না শুরু করতে পারলে আমার অনেক টাকা ব্লক হয়ে যাবে। ..বাই দা বাই, তুমি তোমার বড় বউদির সঙ্গেই থাকছ তো?

-হুঁ। তাই তো কথা হয়েছে।

–দ্যাটস গুড। তোমার মতো ধম্মের ষাঁড়ের বউদির মতো একজনের ছত্রছায়ায় থাকাই ভাল। নইলে কোথায় কি করে বেড়াবে! এখন তোমার ডানা গজাচ্ছে… একটা বিধবা মেয়েছেলের পেছনে লাইন লাগাচ্ছ, ফি রোববার বাগুইহাটিতে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকছ…।

কন্দর্পর গলা শুকিয়ে গেল। অশোকদা কি অন্তর্যামী! ভগবানের মতো সহস্র চক্ষু আছে লোকটার।

আরও যেন কাদের অজস্র চোখ থাকে! কন্দর্প ঠিক মনে করতে পারল না।

.

৫৯.

সওয়া পাঁচটায় শো ভাঙল। হল থেকে সদলবলে বেরিয়ে এল বাপ্পা। বাইরে এখনও ঝাঁঝাঁ রোদ্র। ঘণ্টা দুয়েক ঠাণ্ডা ঘরে কাটিয়ে চড়া তাপে ঝলসে যাচ্ছে গা।

ধীমান কায়দা করে সিগারেট ধরাল, –একটা চ্যাপ্টার তো হল, এবার নেক্সট চ্যাপ্টারটা কোথায় শুরু হবে?

শেখর বলে উঠল, আগে তোমরা মেন্যুটা ঠিক, করো। চাইনিজ, না মোগলাই না কন্টিনেন্টাল?

ভাবনা বলল, – আই প্রেফার চাইনিজ।

এণাক্ষী নাক সিঁটকোল, –দুর দুর, চাইনিজ খেয়ে খেয়ে পেটে চড়া পড়ে গেছে। তার চেয়ে পার্ক স্ট্রিট চল, আজ আমরা স্টেক খাব। বাই দা বাই, ইন্দ্রনীল তোর বাজেট কত?

বাপ্পা ভেতরে ভেতরে একটু বিপন্ন বোধ করছিল। মা আজ দু হাজার টাকা দিয়েছে বটে, কিন্তু তা দিয়ে সওদাও করতে হবে অনেক কিছু। দুটো ভাল টিশার্ট তো লাগবেই, একটা রেডিমেড ফুল স্লিভও কেনা দরকার। নিউ মার্কেটের একটা দোকানে দারুণ দারুণ জিনস এসেছে, কী অপূর্ব নীল রঙ, সমুদ্রের সঙ্গে নিখুঁত ম্যাচ করে যাবে, ওই একটা কেনারও খুব ইচ্ছে ছিল। একটা ভাল ব্লেজার হলেও মন্দ হয় না। ন্যারি ডিক্রুজ পিল্লাইরা সব কী সুন্দর সুন্দর ব্লেজার পরত, বাপ্পাই কেমন অড ম্যান আউট হয়ে ঘুরে বেড়াত এদিক ওদিক। এত সব কি দু হাজারে সামাল দেওয়া যাবে? তার ওপর এই রাবণের গুষ্টিকে গেলানো?

তবে বাপ্পাও কিছুধুর পাবলিক নয়। এ সব সিনে চোটপাট করে কাজ হয় না, বাপ্পা জানে। ধুর্তের মতো হেসে বলল, বাজেট তো যা ইচ্ছে করা যায়, কিন্তু কোয়েশ্চেন একটাই। আমি তোদের খাওয়াব কেন?

–সে কি রে! এত বড় চাকরি পেলি, তার পরও বলছিস খাওয়াবি কেন? এণাক্ষীর চোখ বড় বড়।

উঁহু, চাকরি পাইনি, অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার পেয়েছি। হ্যাভ আই জয়েনড দা জব? ধর যদি এখন চাকরিটা না নিই …। অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারের অনারে তোদের একটা সিনেমা দেখিয়ে দিলাম, সেটাই কি কাফি নয়?

শেখর ধীমান খানিকটা বিমূঢ় হয়ে গেল। পরস্পর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে।

বিষ্ণুপ্রিয়া নীরবে হাঁটছিল। সে কথা বলে উঠল হঠাৎ, ইন্দ্রনীল তো ঠিকই বলেছে। আমাদের ওকে ওভারট্যাক্স করা উচিত নয়। ওকে আগে ওর স্যালারিটা পেতে দে।

–তখন আমরা ওকে পাব কোথায়? ও তো উড়ে যাবে।

উড়ে যাবে না, বল ভেসে যাবে।

 –ওই হল। যাহাই ওড়া, তাহাই ভাসা।

বাপ্পা অর্কেস্ট্রা পরিচালনার ভঙ্গিতে দু হাত দোলাল, –ওকে ওকে, আজ আমি তোমাদের একটা টোকেন ফিস্ট দিচ্ছি। রোল আর কোল্ড ড্রিঙ্কস। ডোন্ট আসক ফর মোর। গ্র্যান্ড ফিস্ট হবে আমার ফার্স্ট ভয়েজ থেকে ফিরে আসার পর। তখন মেন্যু উইল বি ইওরস্। এগ্রিড?

ভাবনা চোখ টিপল, –নেই মামার চেয়ে কানা মামা ভাল। আই এগ্রি।

বিষ্ণুপ্রিয়া হাত তুলল, আমি তো আগেই এগ্রি করেছি।

ধীমান কাঁধ ঝাঁকাল, –অগত্যা।

শেখর বেশ মুষড়ে পড়েছে। হতাশ ভাবে বলল, – যাহ্ শালা। পাঁচ মিনিটও তোরা ইউনিটি রাখতে পারলি না! এইসব হেংলুরা কোনওদিন কোথাও প্রাপ্য আদায় করতে পারবে না। নেশানটা একদম ফিনিশ হয়ে গেছে।

বাপ্পা বলল, বেশ তো, একজন অন্তত প্রোটেস্ট করুক। তুই না হয় অন প্রোটেস্ট কিছু খাস না।

ইল্লি রে, আমি বরং দুটো কোল্ড ড্রিঙ্কস খাব। একটা আমার জেনুইন প্রাপ্য হিসেবে, আর একটা তুই খাওয়াবি আমার প্রোটেস্টকে অনার দিতে।

ধীমান চটাং চাটি কষাল শেখরের মাথায়, –তুমি বস পুরো ট্রেড ইউনিয়ান লিডারদের মতো কথা বলছ। মালিকেরও খাম খাবে, আবার ..

বাপ্পার মজা লাগছিল বেশ। গত সপ্তাহে ওশান লাইনার্স থেকে চিঠি এসে গেছে। তারপর থেকে একটা গা-শিউরোনো ভাব আঠার মতো লেগে রয়েছে শরীরে, হৃৎপিণ্ড ধুকপুক করে চলেছে অবিরাম। স্বপ্ন এতটা খাপে খাপে মিলে যায়! অস্ট্রেলিয়ার সিডনি নয়, বাপ্পা জাহাজ ধরবে জাপানের ইয়োকোহামায়। প্লেনের টিকিটও যথারীতি পাঠিয়ে দিয়েছে কোম্পানি, এই শুক্রবারই উড়োজাহাজে চেপে ইয়োকোহামা পাড়ি দেবে বাপ্পা। জাহাজে রিপোর্ট করার আগে পর্যন্ত মনে স্বস্তি নেই। এখনও সব কেমন অলীক অলীক ঠেকছে। জীবনে এই প্রথম প্লেনে চড়বে বাপ্পা, বিদেশযাত্রাও তার এই প্রথম, সবই একেবারে একা একা …! তবে ঠিক এই মুহূর্তে অস্বস্তির অনুভূতিটা নেই। উচ্ছলতার মধ্যেও বন্ধুদের চোখেমুখে হঠাৎ হঠাৎ চোরা ঈর্ষার ঝলক ফুটে উঠছে, বান্ধবীদের চোখে ঝরে পড়ছে সুতি, এতেই যেন মেঘের ওপর দিয়ে ভেসে চলেছে মন। আহা বেচারারা! সারা জীবন এই শহরের বদ্ধ কূপেই পচতে হবে এদের। যখন একটা ছোটমোট চাকরির খোঁজে জুতোর সুকতলা ক্ষয়াবে এরা, তখন হয়তো মার্সেই-এর পথে হেঁটে বেড়াবে বাপ্পা। পুওর সোলস!

সিনেমা হলের সামনে নিউ মার্কেটের গা ঘেঁষে রোলের দোকান। খাবারের অর্ডার দিয়ে বাপ্পা হালকা স্বরে বলল, – দেখলি তো, অনীকটা কেমন ইনসাল্ট করল আমায়। কত বার করে সাধলাম, কিছুতেই এল না।

–নিজেই ঠকল। বিষ্ণুপ্রিয়া চটজলদি বলে উঠল, –তুই পারিসনি, ইন্দ্রনীল পেরেছে, এতে এত হিংসে করার কি আছে! যা, বাড়িতে গিয়ে এখন এক থালা বেশি ভাত খা।

ভাবনা এক চোখে বাপ্পাকে দেখল একবার, এক চোখে বিষ্ণুপ্রিয়া আর এণাক্ষীকে, –আর ইন্দ্রনীলের বিরহে কে কে তিন দিন উপোস করবে?

এণাক্ষীর মুখটা করুণ হয়ে গেল, ইন্দ্রনীল যে সত্যি সত্যি চলে যাবে, আমি ভাবতেই পারছি না। এই ইন্দ্রনীল, তুই আমাকে জাহাজ থেকে চিঠি লিখবি তো?

–লিখব লিখব। তোর ঠিকানাটা যেন কি?

–কেন, তোর কাছে নেই?

–ডায়েরিতে আছে বোধহয়। দেখতে হবে। কত নম্বর ফার্ন রোড যেন?

বিষ্ণুপ্রিয়া চশমার ব্রিজ ঠেলল আঙুল দিয়ে। ভারি মুখে বলল, – ইন্দ্রনীল যদি তোকে একটাও চিঠি লেখে আমি তোকে একশো টাকা দেব। ট্রেনিং-এ গিয়েই কাউকে ভুলে এক লাইন লিখল না… ফিরেও কত দিন বাড়িতে ডুব মেরে বসে রইল!

এণাক্ষী আর বিষ্ণুপ্রিয়ার পুরনো রেষারেষিটা শুরু হয়ে গেছে। এ সময়ে নিজেকে বেশ নায়ক নায়ক লাগে বাপ্পার। তিতির বলছিল বিষ্ণুপ্রিয়া নাকি তার ঠিকানা জানতে চেয়েছিল অনেকবার, বিষ্ণুপ্রিয়া অবশ্য মুখে সে কথা স্বীকার করে না। একি শুধুই বিষ্ণুপ্রিয়ার খেয়ালিপনা, নাকি আরও কিছু!

হাতে হাতে রোল পৌঁছে গেছে। ধীমান কাগজ ছিঁড়ে রোলে কামড় বসাল, –হ্যাঁ রে ইন্দ্রনীল, তোদের জাহাজ ইন্ডিয়ার কোন কোন পোর্টে আসবে?

ইন্ডিয়ায়! দুর, ইন্ডিয়ায় আসবে কেন?

–আসবে না?

–নো স্যার। ইটস আ কার কেরিয়ার। জাহাজের খোলে জাপান থেকে মোটরগাড়ি ভরে আমেরিকা ইউরোপে ডেলিভারি দিতে ছুটবে। জাপানেরই তিন-চারটে পোর্ট থেকে বোধহয় গাড়ি উঠবে। কোবে, নাগোয়া, টোকিও, ওসাকা …

জাহাজে মোটরগাড়ি! শেখরের চোখ গোল গোল, জাহাজে কটা গাড়ি ধরবে?

ধন্দটা বাপ্পার মনেও রয়েছে। জাহাজ কোম্পানির কলকাতা অফিসে এর মধ্যে গিয়েছিল বারকয়েক, সেখানেও মুখ ফুটে প্রশ্নটা করতে পারেনি। তবে এখন তাকে হারলে চলবে না, আন্দাজ মতো একটা উত্তর দিয়ে দিল, দু-পাঁচশো তো ধরবেই।

–তোদের রুটটা কী হবে?

এটাও সঠিক জানা নেই বাপ্পার। আবার আন্দাজ ভাসিয়ে দিল, –মোটামুটি ধর আমরা গোড়াতে প্যাসিফিক দিয়েই মুভ করব। আমেরিকার ওয়েস্টার্ন কোস্ট হয়ে এসে পড়ব ইস্টার্ন সাইডে।

— থ্রু পানামা ক্যানাল, তাই তো? বিষ্ণুপ্রিয়া প্রায় কথা কেড়ে নিল, তারপর ক্যারিবিয়ান সি হয়ে অ্যাটলান্টিক। সেই মহাসাগরের এপার থেকে ওপার গেলেই ইউরোপ।

–তুই জানলি কী করে রে? এণাক্ষী খোঁচা মারল, –এটাও কি কুইজ করতে করতে জেনেছিস?

–আমাদের রিসোর্স স্টাডিজের ক্লাসে কি একটুও ভূগোল পড়ায় না? তুই অবশ্য টি. এম-এর ক্লাসে ক্যান্টিনে বসে থাকিস …।

-সত্যি, ভূগোল পড়লে কত কি জানা যায়। এণাক্ষী বিদ্রূপ ছুঁডল, –অ্যাটলান্টিক মহাসাগরের এক পারে ইউরোপ, এক পারে আমেরিকা! কী হাই ফাণ্ডা!

আর মাঝখানে হাজার হাজার মাইল নীল জল! ভাবনা খিলখিল হেসে উঠল, –সে জল আবার নোনতা। কান্নার মতো।

দূরে পুট পুট কী সব শব্দ হচ্ছে। বাজি ফাটার মতো। বাপ্পা রোল শেষ করে কাগজটা গোল্লা করে পাকাল, ছুঁড়ল খানিক দূরে। একটু যেন অন্যমনস্ক হওয়ারও চেষ্টা করছিল বাপ্পা। বিষ্ণুপ্রিয়াকে নিয়ে এই শ্লেষ, এই আক্রমণ খারাপ লাগছে তার। কেন লাগছে!

খাবারের দাম চুকিয়ে বাপ্পা খুচরো ফেরত নিল, তখনই চোখাচোখি হয়ে গেল বিষ্ণুপ্রিয়ার সঙ্গে। অজান্তেই জ্বালা জ্বালা করে উঠল চোখটা। এ কি, চোখে জল এসে যাচ্ছে কেন! আবেগ! ছি বাপ্পা।

পরমুহূর্তে ভুল ভাঙল বাপ্পার। চারদিক কেমন ধোঁয়াটে হয়ে এসেছে। নীলচে ধোঁয়ায় জ্বলে যাচ্ছে চোখ। চাপা একটা কোলাহল ভেসে এল চৌরঙ্গির দিক থেকে। পলকে বদলে গেছে গোটা তল্লাটের ছবি। হই হই করে লোক ছুটে আসছে এদিকে। দুমদাম ইটপাটকেল পড়ছে যত্রতত্র। একটা দোকানের কাচ ভেঙে পড়ল ঝনঝন। সার সার শরবতের দোকান থেকে আম মুসম্বি লুট হয়ে যাচ্ছে, ঘটাং ঘটাং শাটার পড়ে যাচ্ছে দোকানের।

মেয়েরা সিঁটিয়ে গেছে ভয়ে। চোখে ওড়না চাপছে ঘন ঘন। এণাক্ষী সভয়ে বলল, আমরা এখন কী করব?

শেখর বলল, – দাঁড়া না, দেখি আগে কেসটা কী! বলেই একটা ছুটন্ত লোককে চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করল, কী হয়েছে দাদা? কেস কী?

–এসপ্ল্যানেডে জোর গণ্ডগোল। পুলিশ টিয়ার গ্যাস ছুঁড়ছে।

ভাবনা ত্বরিত পায়ে নিউ মার্কেটের দিকে এগোল, হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকিস না, চলে আয়।

প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই এক বিশাল জনতা ঢুকে পড়েছে রাস্তাটায়। উদভ্রান্তের মতো যে যেদিকে পারে দৌড়চ্ছে। পিছন পিছন ধেয়ে এল পুলিশ। এক হাতে ঢাল, অন্য হাতে লাঠি, মাথায় লোহার শিরস্ত্রাণ। সোঁ সোঁ লাঠি চালাচ্ছে চারদিকে।

চকিত জনস্রোতের ধাক্কায় বাপ্পাও টালমাটাল। বুকে আছড়ে পড়ছে নেই। এখন যদি তার কিছু ঘটে যায় তাহলে জাহাজ ভবিষ্যৎ মহাসমুদ্র …!

কোনওদিকে দৃকপাত না করে বাপ্পা ছুটতে শুরু করল। চোখ খোলা যাচ্ছে না, জ্বলছে অসম্ভব, অন্ধের মতো ছুটছে বাপ্পা। দুই সিনেমা হলের মাঝখানে খানিক ফাঁকা গলি, সেই পথে খানিকটা ছুটে সাঁ করে বাঁয়ে বেঁকল। সামনে এক মদের দোকান, কোলাপসিবল গেট বন্ধ। বাপ্পা গেট ধরে ঝাঁকাল, খুলুন না, খুলুন না।

উত্তর নেই। ছটফট করছে বাপ্পা। গলি দিয়ে বিক্ষিপ্ত লোক ছুটছে। পুলিশ কি গলিতেও ঢুকে পড়ল! আচমকা কে যেন টানল বাপ্পার জামা ধরে, বাপ্পা কষ্ট করে তাকাল। বিষ্ণুপ্রিয়া। চোখে পাতলা ওড়না জড়ানো। পাশে এক বইয়ের দোকান, একটু দরজা ফাঁক হয়ে আছে তার, বাপ্পাকে হেঁচকা টেনে দোকানটায় ঠুকে পড়ল বিষ্ণুপ্রিয়া। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে, ঘামছে দরদর।

বাপ্পা কম্পিত স্বরে বলল, ওরা কোথায়?

ধীমান আর ভাবনা তো মার্কেটের দিকে দৌড়ল। শেখরও বোধহয় ওই দিকে …

–আর এণাক্ষী?

–এণাক্ষী! চশমা খুলে ওড়নায় চোখ ঘষছে বিষ্ণুপ্রিয়া, –আমি কি বেরিয়ে খুঁজে আনব ওকে?

–তা নয়, এক সঙ্গে এসেছিলাম তো …

–একা তবে দৌড়ে পালিয়ে এলি কেন? কাওয়ার্ড কোথাকার।

উহ্, খুব সাহস! বাপ্পা দাঁত কিড়মিড় করে উঠল। কবে যে এই শহর থেকে মুক্তি পাবে! ওফ, আরও তিন দিন। হট্টমেলায় ফালতু সাহস দেখাতে বাপ্পার ভারি বয়ে গেছে। যেখানে সাহস দেখানোর সেখানে বাপ্পা ঠিকই দেখাবে।

দোকানের ঘেরাটোপের নিরাপত্তায় এতক্ষণে একটু নিশ্চিন্ত বাপ্পা। আরও দু-তিনজন লোক ঢুকে পড়েছে দোকানে, উত্তেজিত মুখে গণ্ডগোল নিয়ে আলোচনা করছে, উদ্বিগ্ন মুখে তাদের কথা শুনছে বিষ্ণুপ্রিয়া।

–পুলিশ ফালতু আগে লাঠি চালাল।

–মোটেই না। পুলিশ অনেক পরে লাঠি চালিয়েছে। মিছিল থেকে পুলিশের ওপর বোম ফেলল, তারপরই তো টিয়ার গ্যাস ছুঁড়ল পুলিশ।

-উফ, চোখটা জ্বলে যাচ্ছে। … দাদা, ও দাদা, একটু জল হবে?

–ওই তো কোণে জগ রাখা আছে, নিন না।

–দাদা কি স্পটে ছিলেন?

–স্পটে মানে! একদম সামনে।

 –মিছিলটা কাদের ছিল?

হবে কারুর একটা। অত খবর রাখি না।

রোজই তো একটা না একটা মিছিল বেরোচ্ছে।

–কোনও মানে হয়! ডালহৌসি পাড়ায় একটা ইম্পর্ট্যান্ট কাজ ছিল। এখন ইঁদুরের মতো গর্তে ঢুকে বসে থাকো।

–আছেন কেন? বেরিয়ে পড়ুন না।

ফোলিও ব্যাগ হাতে বছর চল্লিশের লোকটা চোখ কুঁচকে তাকাল, ভয় পাই না মশাই। ইয়াং বয়সে এসব অনেক দেখেছি। পুলিশ ইউনিভার্সিটির সামনে টিয়ার গ্যাসের শেল ছুঁড়ছে, আমরা সেই শেলের মুখ তুলে ঘুরিয়ে দিচ্ছি, পুলিশগুলো কাঁদতে কাঁদতে পালানোর রাস্তা পাচ্ছে না। … সেই সেভেনটিজের কথা ভাবুন, কী সময় গেছে …!

যত সব বাকতাল্লা। বাপ্পা দোকানের এক কোণে সরে জলের ছিটে দিল চোখে। বিষ্ণুপ্রিয়াকে ডাকল, – এই, ওড়না ভিজিয়ে চোখ একটু চেপে চেপে ঘষে নে। বিষ্ণুপ্রিয়া নার্ভাসভাবে বলল, – আমরা বাড়ি ফিরব কী করে?

বয়স্ক দোকানদার প্রাজ্ঞের মতো বলল, – ঘাবড়ানোর কিছু হয়নি। কলকাতা কোনও ঘটনাই বেশিক্ষণ মনে রাখে না। পনেরো-বিশ মিনিট পরে দেখবে সব নরমাল হয়ে গেছে।

লোকটার কথায় একটু যেন আশ্বস্ত হল বিষ্ণুপ্রিয়া। চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বই দেখছে। প্রায়ান্ধকার দোকানে আলো ছড়াচ্ছে অজস্র রঙিন মলাট।

র‍্যাক থেকে একটা বই টানল বিষ্ণুপ্রিয়া। উল্টেপাল্টে দেখে প্রশ্ন করল, – সুলিভানের এই বইটার দাম কত?

টকটক ক্যালকুলেটার টিপে হিসেব করল দোকানদার। ডলার থেকে টাকায় বদলাচ্ছে দাম। অধীরভাবে দরজায় উঁকি মেরে এল বাপ্পা।

কী বই ওটা?

নাইট স্কাই।

–ফিকশান?

বিষ্ণুপ্রিয়া উত্তর দিল না। কাউন্টারে ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, – কত হল?

–ওয়ান নাইনটিফাইভ।

 দু-এক সেকেন্ড কি যেন ভাবল বিষ্ণুপ্রিয়া। কাঁধঝোলা ব্যাগের মুখ খুলল, –দিয়ে দিন।

 বাপ্পা বইটা হাতে নিয়ে দেখল একটু, –এ তো বই ভর্তি তারার ছবি। এই বই নিয়ে তুই কী করবি?

বিষ্ণুপ্রিয়া কাঁধ ঝাঁকাল সামান্য।

–তুই দুশো টাকা দিয়ে বইটা কিনে ফেললি?

–কিনলাম।

কুইজ? জি কের স্টক বাড়াচ্ছিস?

–আমার আর কুইজে ইন্টারেস্ট নেই। ওসব ছেড়ে দিয়েছি। বিষ্ণুপ্রিয়া চশমা নাকের ওপর। ঠেলল, – তোর কি আজ কেনার আছে বলছিলি না?

–আর কেনা! আগে বেরোই তো!

বেরোতে অবশ্য কোনও সমস্যা হল না। মিনিট পনেরোর মধ্যেই বাইরেটা শান্ত হয়ে গেছে। দেখতে দেখতে চতুর্দিক আবার আগের মতো স্বচ্ছ, স্বাভাবিক। ফুটপাথে দাঁড়িয়ে ফুচকা ভেলপুরি খেতে শুরু করেছে মেয়েরা, নিউ মার্কেটের সামনে কর্কশ স্বরে হর্ন বাজাচ্ছে গাড়ি। টিয়ার গ্যাসের যেটুকু ঝাঁঝ এসেছিল মিলিয়ে গেছে পুরোপুরি, পোড়া পেট্রল ডিজেলের কটু গন্ধে আবার ভরে গেছে বাতাস। পথে এখন এক মরা হলুদ আলো। বিকেল ফুরিয়ে এল।

বাপ্পা আর নিউ মার্কেটে ঢুকল না। খুশির মেজাজ ছানা কেটে গেছে। থাক, কেনাকাটা কাল হবে। সকালের দিকে একবার এসে একা একা….। সব কিছুই তো একা একা করছে বাপ্পা, মিছিমিছি এই গণ্ডগোলের মধ্যে বিষ্ণুপ্রিয়াকে নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর কোনও মানে হয় না।

ঝাঁ করে একটা ট্যাক্সি ধরে নিল বাপ্পা। সিটে হেলান দিয়ে হুকুম ছুঁড়ল, ঢাকুরিয়া।

বিষ্ণুপ্রিয়া আপত্তি জানানোর সময় পেল না। উঠে এল পিছন পিছন। মৃদু অনুযোগের সুরে বলল, আবার ট্যাক্সি ধরতে গেলি কেন? গুচ্ছের টাকা খরচা!

–তোদের এই শহরকে আমার বিশ্বাস নেই। কোথায় আবার কি বেধে যাবে…।

কবে রোজ রোজ তুই গণ্ডগোলে পড়িস রে? একদিন একটা ঝামেলা হয়ে গেছে..

–থাক, এখন আর কপচাস না। মুখ তো শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গিয়েছিল। বরং অফিস ফেরতা গরু-ছাগলদের সঙ্গে তোগুতি করতে হল না, এর জন্য আমাকে ধন্যবাদ দে।

বিষ্ণুপ্রিয়া চুপ করে গেল। একে একে আলো জ্বলছে পথে। উজ্জ্বল এক সন্ধ্যা ফুটে উঠছে। শহরে। চারদিকে আলো আর শব্দের হেঁয়ালি। পার্ক স্ট্রিটের মোড়ে ট্রাফিক সিগনালে থেমেছে গাড়ি, এক ধুলোমাখা ভিখিরি মেয়ে কোলে রিকেটি শিশু নিয়ে হাত গলিয়ে দিল জানলা দিয়ে। ওপাশের জানলায় ফুলঅলা এসে দাঁড়িয়েছে। বিষ্ণুপ্রিয়ার দিকে ফুলের গোছা এগিয়ে দিয়ে চেঁচাচ্ছে, গোলাপ নেবেন? টাটকা গোলাপ?

বাপ্পা গজগজ করে উঠল, হরিবল্। একটা নিউক্লিয়ার বোমা মেরে যদি এই শহরটাকে উড়িয়ে দেওয়া যেত!

বিষ্ণুপ্রিয়া চুকচুক শব্দ করল মুখে, – তোর ব্যাড লাক। তার কোনও সম্ভাবনা নেই।

কী করে যে তোরা এই শহরে থাকবি! এই মারপিট, দাঙ্গাহাঙ্গামা, মিটিং মিছিল, রাস্তা ভর্তি ভিখিরি….! আবার এই শহরে ফিরতে হবে ভাবলেই আমার দম বন্ধ হয়ে আসে।

বিষ্ণুপ্রিয়ার মুখে চোখে আর ভয়ার্ত ভাবের চিহ্ন নেই। স্বচ্ছন্দ ভঙ্গিতে জোরে নিশ্বাস টানল, আমার তো বাবা কলকাতা ছেড়ে কোথাও থাকতে হবে ভাবলেই গা-হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে যায়। এখানে সব কিছু কত জ্যান্ত। এই যে কেঅষ্টা হয়ে গেল, এটাও কী দারুণ ফিলিং!

-প্লিজ বিষ্ণুপ্রিয়া…

–বিলিভ মি, আমি আজকের কথা ভুলতেই পারব না।… তুই জানিস না ইন্দ্রনীল, সেবার তিন সপ্তাহের জন্য সাউথ ইন্ডিয়া টুরে গেলাম, দশ দিন পর থেকে মন কেমন করতে শুরু করল। শেষমেশ ট্রেন যখন হাওড়া স্টেশনে ইন্ করল, নেমে আমরা ব্রিজটা পার হচ্ছি… ভোর বেলা.. এমন একটা ফিলিং হল না….

হুঁহ্ ফিলিং! আমার তো মনে হয় একটা ল্যাভেটরিতে ঢুকছি।

একটু থমকে থেকে বিষ্ণুপ্রিয়া বলল, – এই শহরের কোনও কিছুই কি তোকে টানে না?

বললাম তো আমি এই শহরটার ধ্বংস চাই।

 –যখন জাহাজে থাকবি তখনও এই শহরের কোনও স্মৃতি তোর মনে পড়বে না?

হয়তো পড়বে। দুঃস্বপ্নের মতো।

কোলের ওপর বইটা নাড়াচাড়া করছে বিষ্ণুপ্রিয়া। লঘুভাবে বলল, প্রিয়জনদের কথা ভেবেও মন খারাপ লাগবে না?

–আমার কথা ভেবে কে মন খারাপ করে রে? তুই করবি?

–আমি কেন করব, তোর এণাক্ষী করবে। বিষ্ণুপ্রিয়া জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল।

বিষ্ণুপ্রিয়ার স্বরে চাপা অসূয়া। বাপ্পা খেপাতে চাইল বিষ্ণুপ্রিয়াকে, হুঁ, এণাক্ষীর অবশ্য মন খারাপ হবে। আমার চিঠির জন্য চাতকপাখির মতো বসে থাকবে।

তীব্র এক দৃষ্টি হেনে মুখ ঘুরিয়ে নিল বিষ্ণুপ্রিয়া। খোলা জানলা দিয়ে হাওয়া ঢুকছে হু হু, উড়ছে বিষ্ণুপ্রিয়ার চুল। সেদিকে চোখ রেখে বাপ্পা বলল, – সত্যি, বেচারা যে আজ কোথায় গেল! হয়তো এখনও নিউ মার্কেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে, নয়তো রাস্তায় রাস্তায় খুঁজছে আমাদের।

বিষ্ণুপ্রিয়া ফিরল বাপ্পার দিকে, ট্যাক্সি ঘোরাতে বলব?

বাপ্পার গা সিরসির করে উঠল। বিষ্ণুপ্রিয়ার চোখ হঠাৎ বদলে গেছে। হিংসে নয়, কি যেন এক রহস্যের ছায়া পড়েছে চোখে। বাপ্পা অস্ফুটে বলল, – তুই একটা পাগলি।

ট্যাক্সিতে বিচিত্র নৈঃশব্দ্য। ইথার কণা ভেসে বেড়াচ্ছে বাতাসে। বাপ্পার মনে হচ্ছিল এই মুহূর্তে তার আরও কিছু বলা উচিত বিষ্ণুপ্রিয়াকে। কিন্তু কী বলবে?

ট্যাক্সি ঢাকুরিয়ায় পৌঁছল। নেমে ভাড়া মেটাচ্ছে বাপ্পা। বিষ্ণুপ্রিয়াকে বলল, তোকে এগিয়ে দিয়ে আসব বাড়ি অবধি?

–থাক। বিষ্ণুপ্রিয়া একটু গিয়েও থামল, কাল কী করছিস? একবার আসবি আমাদের বাড়ি?

-কাল তো হবে না রে। মানিকতলায় যেতে হবে। দিদা খেতে বলেছে। কখন ফিরি …

পরশু?

–দেখি। …টুকিটাকি গোছগাছ আছে, একবার কোম্পানির সিটি অফিসে যেতে হবে। পারলে আসব।

খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে বিষ্ণুপ্রিয়া। হঠাৎ পায়ে পায়ে কাছে এল। হাতের বইটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, – এটা রাখ।

বাপ্পা ঠিক বুঝে উঠতে পারল না। বলল, – এ বই দিয়ে আমি কী করব?

রাখ না। বইটা আমি তোকে প্রেজেন্ট করলাম। জাহাজে নিয়ে যাস।

তা নয় নিয়ে গেলাম, কিন্তু কেন? তুই তো জানিস আমার বইটই পড়ার অভ্যেস নেই!

–তবু নিয়ে যাস।

–আমার নলেজ বাড়াতে চাইছিস?

 দ্যাখ কি বাড়ে। মনে কর তোকে একটা কুইজের আনসার বার করতে দিলাম। চলি।

.

বাপ্পা ঘরে ঢুকছিল, ইন্দ্রাণীর ডাক শুনে দাঁড়াল, –আমাকে কিছু বলছ মা?

ইন্দ্রাণীর সামনে খাতার স্তূপ। চোখে রিডিং গ্লাস, সদ্য নিয়েছে। ঘরের কোণটা টেবিল ল্যাম্পের আলোয় বেশি উজ্জ্বল। লো ভলিউমে টিভি চালিয়ে একটা হিন্দি সিরিয়াল দেখছে তিতির।

ইন্দ্রাণী চোখ থেকে চশমা নামাল, – তোর কেনাকাটা হল?

-কাল করব।

–অত হাড়ে আদা দিয়ে টাকা নিয়ে গেলি, আজ কিনলি না?

বললাম তো কাল কিনব। এসপ্ল্যানেডে গণ্ডগোলের কথাটা বলতে গিয়েও চেপে গেল বাপ্পা। বলল, -কলেজে গেছিলাম, বন্ধুবান্ধবরা জোর করে সিনেমা নিয়ে গেল …

ইন্দ্রাণী খাতা মুড়ে রাখল, যাক গে, তাড়াতাড়ি ফিরেছিস ভালই হয়েছে। নীচে ছোটকা রয়েছে, ওর সঙ্গে একবার বেরো।

–কোথায়?

–এক্ষুনি দালাল আসবে, সেলিমপুরের দিকে দু-একটা বাড়ি দেখতে যাবে চাঁদু, তুই একটু সঙ্গে যা।

–আমি বাড়ি দেখে কী করব? তোমরা থাকবে, তোমরাই ভাল করে দেখে নাও।

ইন্দ্রাণী যেন একটু বিরক্ত হল। চাপা গলায় বলল, হ্যাঁ, তোমাদের কারুরই তো দায় নেই। তোমার বাবার টিকি দেখা যাচ্ছে না, তুমি উড়ছ, চাঁদুই একা চুরির দায়ে ধরা পড়েছে।

বাপ্পা হেসে ফেলল, তোমার মেয়েটা কী করছে? সে তো ছোটকার ল্যাঙবোট, সে যাক না।

 তিতির গম্ভীর মুখে ঘাড় ঘুরিয়ে দাদাকে দেখে নিল একবার, আবার চোখ ফেরাল পর্দায়।

ইন্দ্রাণী গোমড়া মুখে বলল, থাক, তোমাদের কাউকেই কিছু করতে হবে না। পারলে আমিই চাঁদুর সঙ্গে বেরোব।

–সব সময়ে আজকাল তেতে থাকো কেন মা? কোনও মানে হয়। বাপ্পা টেবিলের কাছে এসে মার কাঁধে হাত রাখল, খাতা দেখে দেখে তোমার প্রেশার বেড়ে যাচ্ছে। এই জঞ্জাল কবে শেষ হবে?

ইন্দ্রাণী কড়া গলায় বলল, এই জঞ্জালের মধ্যে একসময়ে তোমার খাতাও ছিল বাপ্পা। এগুলো মাধ্যমিকের খাতা।

–মাধ্যমিকের খাতা তুমি নিয়েছ কেন? সেবার বললে আর এসব ঝামেলা ঘাড়ে নেবে না …

বছর চারেক আগে মাধ্যমিকের খাতা নিয়ে ভারি বিপদে পড়ে গিয়েছিল ইন্দ্রাণী। দেখতে দেখতে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছিল খুব, তাগাদার পর তাগাদা আসছিল বোর্ড থেকে, অনেক অনুরোধ উপরোধ করে লাস্ট ডেটের তিন দিন পরে খাতা জমা দিতে পেরেছিল, তখনই ঘোষণা করেছিল এই শেষ।

সে কথা মনে করেই ছোট্ট নিশ্বাস পড়ল ইন্দ্রাণীর, না দেখে উপায় কি! প্রেসটা বন্ধ হয়ে গেল …সংসারের খরচ তো আর কমেনি!

বাপ্পা ঠোঁট বেঁকাল, –ওই প্রেস থেকে তোমার ক’টাকা আসত?

–তাও তো আসত। দু টাকা হোক, পাঁচ টাকা হোক …

 –সে তো তোমার প্রেস বেচেও কিছু এসেছে। বাপ্পা ফস করে বলে ফেলল।

ভুরু কুঁচকে ছেলের দিকে তাকাল ইন্দ্রাণী। চোখে রিডিং গ্লাস লাগিয়ে আবার মন দিচ্ছে খাতায়।

বাপ্পা আড়চোখে তিতিরকে দেখে নিয়ে জড়িয়ে ধরল মাকে, — তুমি এত দুশ্চিন্তা করছ কেন বলো তো? এই আদ্যিকালের বাড়িটা ভাঙা হচ্ছে বলে তুমি তো কিছু জলে পড়ছ না। প্রোমোটার যে লাখ টাকা দেবে, সেটা ফিক্সড ডিপোজিটে রেখে দাও, একটা ইন্টারেস্ট আসবে। এখন মার্কেট খুব চড়া, ভাল দালাল ধরে শেয়ারেও লাগিয়ে দিতে পারো। প্রেস বেচার টাকাটা তো এক্সট্রা, যেভাবে ইচ্ছে ইউজ করো। তারপর ধরো আমি আছি, আমি তো তোমায় টাকা পাঠাবই। বলোতো পুরো অ্যামাউন্টটাই পাঠিয়ে দিতে পারি।

–থাক। ইন্দ্রাণী সরিয়ে দিল বাপ্পার হাতটা, তুমি তোমার ফিউচার গড়ো।

–এ তোমার অভিমানের কথা মা। আমার ফিউচার তো ফ্যামিলিরই ফিউচার। আমি তো তোমার পাশে আছিই।

–হয়তো আছ। আমি কারুর ওপর ভরসা করি না।

 বাপ্পা আহত মুখে নিজের ঘরে এসে শুয়ে পড়ল। কেন যে মা তাকে বিশ্বাস করে না, অকৃতজ্ঞ ভাবে? এই শহরটাকে সে ঘৃণা করে বটে, এ বাড়ির প্রতিও তার তেমন প্রীতি ভালবাসা নেই, কিন্তু যেটুকুনি কর্তব্য তা তো সে করবেই। মাত্র কুড়ি বছর বয়সে সে প্রায় সতেরো হাজার টাকা মাইনের চাকরি পেতে চলেছে, যা এই পরিবারের কেউ স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেনি। তবু বাড়িতে কোনও খুশির জোয়ার নেই। মা বাবা তিতির সকলে যেন বাপ্পাকে একঘরে করে দিয়েছে! অথচ জন্মসূত্রে এরাই বাপ্পার প্রিয়জন!

বিষ্ণুপ্রিয়ার কথাটা মনে পড়ল বাপ্পার।… কোনও প্রিয়জনের জন্য তোর মন খারাপ হবে না ইন্দ্রনীল! … কথাটা যেন এক নির্ভেজাল ঠাট্টা।

বিষণ্ণ বাপ্পা খাটে পড়ে থাকা বইটা হাতে নিল। পাতায় পাতায় আর্ট প্লেটে রঙিন ছবি। রাতের তারারা ফুটে আছে আকাশে। রাশি রাশি তারা।

.

৬০.

বাপ্পা চলে যাওয়ার জন্যই এসেছিল। চলেও গেল। ইন্দ্রাণীর জন্য রেখে গেল এক নতুন শুন্যতা। এক অবিমিশ্র হাহাকার। বাপ্পার ট্রেনিং-এ চলে যাওয়াটা সেভাবে উপলব্ধি করতে পারেনি ইন্দ্রাণী। জয়মোহনের মৃত্যুর শোক তো ছিলই, সঙ্গে ছিল এক সুপ্ত অপরাধবোধের নিরন্তর দংশন। বাড়িতে লোকজনের তখন আসা-যাওয়াও খুব, আদিত্যও শিশুর মতো আচরণ করছিল, সেগুলোকেও কারণ বলা যায়। বাড়ি যখন খালি হল তখনও এক আশ্চর্য ঘোরে আচ্ছন্ন রয়েছে। ইন্দ্রাণী, ছেলেমেয়ের জন্য পা ছড়িয়ে কাঁদতে বসার তার সময় ছিল কই!

সেই সময় এখন অঢেল। অফুরান। স্কুলে গরমের ছুটি চলছে, মাধ্যমিকের খাতা জমা দিয়ে এল কদিন আগে, পরশুদিন বউবাজারের ধরবাবু এসে মেশিনপত্র নিয়ে গ্যারেজটা খালি করে দিয়ে চলে গেল। সময়ের পাহাড় এখন জমে থাকে ইন্দ্রাণীর বুকে। জগদ্দল পাথরের মতো। আদিত্যও এখন পুরো স্বাভাবিক, অল্পস্বল্প মদ্যপানও শুরু হয়েছে তার। শুভাশিসও নিয়মিত আসে এখন, তার জন্যও গালে হাত দিয়ে বসে থাকতে হয় না ইন্দ্রাণীকে। তাই বুঝি বাপ্পার চলে যাওয়াটা বড় বেশি ভাবায়। বাজে। শুকনো কুয়োর মতো হা-হা করে বুকটা। ছেলে বড় হলে দূরে সরে যাবে, নিজের বৃত্ত রচনা করে নেবে, এ তো জানা কথাই। কিন্তু জানা আর অনুভব করায় এত তফাত। তিতিরের সঙ্গে কথা বলে যে দুদণ্ড কাটাবে সে উপায়ও নেই, মেয়ে আজকাল মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকে। কী যে হয়েছে! সেই বাড়ি ভাঙার সিদ্ধান্তটা শোনার পর থেকে! মাঝে একদিন শুভর ছেলের সঙ্গে তাদের ফ্ল্যাট থেকে ঘুরে এল, কথাটা এসে বলল না পর্যন্ত মাকে! বারবার খোঁচাখুচিতে হা-হুঁ করল শুধু। তাও কেমন কাঠ কাঠ ভাবে। নিষ্প্রাণ পুতুলের মতো। আজকাল তিন হাত ব্যবধানে শুয়ে থাকে মা-মেয়ে। নিঃশব্দে। ইন্দ্রাণীর ফাঁকা বুকে সোঁ-সোঁ বাতাস বয়, মেয়ে আঁচও পায় না সেই বাতাসের।

বাতাস কি শুধু বাপ্পার কথাই বলে? উহু। বাতাস আরও বলে মা-মেয়ের সম্পর্ক কিছু স্বতঃসিদ্ধ নয় ইন্দ্রাণী, একে গড়তে হয়, বুনতে হয়। মমতার ফোঁড়ে সম্পর্কের জমিতে নকশা ফুটে ওঠে। মৃত্যুকামনায় যে সম্পর্কের শুরু তার জমিন তো ধূসর হয়ে আছে চিরকাল। ইন্দ্রাণী ভেতরে ভেতরে মানে সে কথা। তাতেই বুকের শুকনো কুয়োটা আরও গম্ভীর হয়ে যায়। মনে হয় তিতিরের ওই  বয়সে উমা অনেক বেশি বন্ধু ছিল ইন্দ্রাণীর।

কাঁহাতক আর ইন্দ্রাণী মানিকতলা-ঢাকুরিয়া করে পালিয়ে পালিয়ে বেড়ায়!

গরমটা আজ খুব বেশি পড়েছে। দুপুরবেলার তেজি সূর্য ঢুকে পড়ছে দেওয়াল ফুঁড়ে। দরজা-জানলা বন্ধ করেও উগ্র তাপের হাত থেকে রেহাই নেই।

বিছানায় খানিকক্ষণ উসখুস করে ইন্দ্রাণী উঠে বসল। পাশের ঘরে তিতির আর অ্যাটম কথা বলছে। অ্যাটমের গলাই শোনা যাচ্ছে বেশি। কান পেতে একটুক্ষণ শোনার চেষ্টা করল ইন্দ্রাণী, বুঝতে পারল না। খাট থেকে নেমে টেবিলে রাখা জগ তুলে ঢক ঢক জল খেল খানিকটা। বাথরুমে গিয়ে মুখেচোখে জল ছেটাল, যদি তাতে শরীর একটু জুড়োয়। ঘরে ফিরতে গিয়েও কি ভেবে নেমে এল একতলায়।

নীচের তলা নিস্তব্ধ। সুনসান। মিনতি বড় ঘরের মেঝেয় চিৎপাত হয়ে ঘুমোচ্ছ। ইন্দ্রাণী পায়ে পায়ে জয়মোহনের ঘরে ঢুকল। কতদিন হাত পড়েনি ঘরখানায়! দেওয়ালে ঝুল ভর্তি হয়ে গেছে, এক কোণে বড় খাটখানা খুলে রাখা আছে, তাতেও ধুলোর আস্তরণ। মাথার ওপরের টানা তাকে কাগজপত্রের ডাঁই। মাকড়সার জালে ঢেকে গেছে তাকটা।

ইন্দ্রাণী হাঁক দিল, মিনতি, এই মিনতি…।

মিনতির সাড়া নেই। এক ডাকে উঠবে এমন ঘুম মিনতি ঘুমোয় না।

বার কয়েক ডাকাডাকির পর মিনতি চোখ মুছতে মুছতে ঘরে এল, কী হল বউদি?

–এ ঘরের চেহারাটা দেখেছিস? একটু ঝাড়পোঁছও করতে পারিস না?

–আমি তো মেঝে মুছি। ওগুলো সন্ধ্যার মা করলে পারে।

 ইন্দ্রাণী ঈষৎ ধাক্কা খেল। জয়মোহন যতদিন ছিলেন ততদিন দীপুদের কাজের লোক হিসেবে এ ঘরের পুরো দায়িত্বই মিনতির ছিল। শ্বশুরমশাইয়ের অবর্তমানে এ ঘর এখন এজমালি সম্পত্তি। রুনা-দীপুর কাজের লোক এ ঘর একা সাফসুরত করবে কেন?

ইন্দ্রাণী কথা বাড়াল, নিজেই গাছকোমর বেঁধে নেমে পড়ল কাজে। মিনতিকে বলল, আমাকে একটা ঝ্যাঁটা এনে দে তো। আর একটা ছেঁড়া ন্যাকড়া।

এনে দিল মিনতি, কিন্তু হাত লাগাল না। হাই তুলে বলল, কেন মিছিমিছি খাটছ বউদি?

 মুখে আঁচল পেঁচিয়ে কপালে ভাঁজ ফেলল ইন্দ্রাণী।

-না, মানে বলছিলাম কদিন বাদে তোমরা তো উঠেই যাবে। এই ছিস্টির ময়লা ঘাঁটার কি দরকার?

–আছে দরকার। তুমি বুঝবে না। তুমি ঘুমোও গিয়ে।

 মিনতি বিনা বাক্যব্যয়ে চলে গেল। প্রেস উঠে যাওয়ার পর দুপুরে ঘুমোনোর বহর খুব বেড়েছে মিনতির। রুনা নেমে এসে না তুললে গতরই নাড়ায় না।

পরিপাটি করে খাটের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো মুছল ইন্দ্রাণী। ইজিচেয়ারটা ঝাড়ল ভাল করে, কোণের কুঁজোয় কত দিনের বাসি জল পড়ে আছে, উঠোনে ঢেলে এল জলটা। একটু অবাকও হল, কাজের দিনেও কি কুঁজোটা সরানো হয়নি! বড়ঘর থেকে চেয়ার এনে ইন্দ্রাণী ঝাঁটা চালাল দেওয়ালে, টানা তাকের ধুলো পিটিয়ে পিটিয়ে ওড়াল। তাক জুড়ে গোছ গোছা কাগজ। পাড়ল টেনে টেনে। মাটিতে বসে ঘাঁটতে শুরু করল কাগজগুলো। কত কী রয়েছে! কবেকার ইলেকট্রিকের বিল, টেলিফোনের বিল, জয়মোহনের কোম্পানির বিল-চালান। কয়েকটা বইও রয়েছে সঙ্গে। কিনোর হস্তবিচার, রোগেভোগ হোমিওপ্যাথি, পুরনো গোটাকতক পাঁজি। ডেল কারনেগির হাউ টু উইন ফ্রেন্ডস অ্যান্ড ইনফ্লুয়েন্স পিপলের বঙ্গানুবাদ, সম্ভবত আদিত্যর। দুধের ডিপো করার সময়ে গ্রাহকদের জন্য কার্ড ছাপিয়েছিল আদিত্য। তাও আছে এক তাড়া। এত অদরকারি কাগজ! সন্ধ্যার মাকে দিয়ে দিলেই হয়। বেচারা বাড়িতে একটু জ্বালানি নিয়ে যাওয়ার জন্য আঁকুপাঁকু করে।

কাগজের সঙ্গে একটা ছোট ভাঙা চামড়ার সুটকেসও নেমে এসেছে, ইন্দ্রাণী খুলল ডালাটা। খুলেই চমকেছে। বাক্স বোঝাই পুরনো রেসের বই! আদিত্য কি রেস খেলত একসময়ে! উঁহু, অনেকগুলো বইয়ের ওপর জয়মোহনের হস্তাক্ষর রয়েছে। আশ্চর্য, শ্বশুরমশাইয়ের রেসের নেশা ছিল! সুটকেসের একদম তলায় একরাশ চিঠি। কোনওটা শ্বশুরমশাইয়ের, কোনওটা শাশুড়ি ঠাকরুনের। চিঠিগুলো খুলে দেখার লোভ সামলাতে পারল না ইন্দ্রাণী। কালি প্রায় আবছা হয়ে এসেছে, উঠে আলোটা জ্বালল। শোভনার চিঠি সবই প্রায় নিয়মরক্ষার, বাপের বাড়ি বেলডাঙা থেকে লেখা। জয়মোহনের চিঠিতেই আবেগের আধিক্য বেশি। কত নামে যে সম্বোধন করেছেন স্ত্রীকে! কখনও শোভা, কখনও শোভু, কখনও সোনামণি, কখনও আকাশমণি..! ইন্দ্রাণী চিঠিগুলো পড়তে গিয়েও পড়ল না, কাজটা শোভন নয়। ছোট ছোট চিরকুটও চোখে পড়ল গোটাকতক। …রামদুলাল জোর করে ধরে নিয়ে গেল। বিশ্বাস করো, আমি ওসব ছাইপাঁশ খেতে চাইনি। শোভু, আমাকে ক্ষমা করে দাও। …আমার সঙ্গে আর কতদিন তুমি কথা বন্ধ রাখবে? তোমার গা ছুঁয়ে বলছি আর কোনওদিন মাতাল হয়ে ফিরব না। শচীনের সঙ্গে আমার সম্পর্ক শেষ। …ইন্দ্রাণী ফিক করে হেসে ফেলল। পরমুহূর্তেই বিজন দুপুর ভারী করে দিল বুক। এ ঘরটায় উত্তাপ কম, কেমন যেন শীত শীত করে উঠল। চিরকুটগুলোতে জয়মোহন যেন বড় বেশি আদিত্যর বাবা। বাপ-ছেলেতে এত সংঘাত ছিল, তা কি এক ধারার মানুষ বলেই! বাপ্পার ভেতরেও কি আদিত্যর ছায়া পড়বে! তিতির কি কি গুণ পাবে শুভর!

অজানা ধাঁধা কিলবিল করতে থাকে ইন্দ্রাণীর মস্তিষ্কে। অন্যমনস্ক হাতে কুটিকুটি করে চিরকুটগুলো, চিঠির গোছ ভরে রাখে পুরনো প্লাস্টিকের মোড়কে। রেসের বই সব চালান করে দেয় বাজে কাগজের গাদায়। চিন্তার এক সরু স্রোত মাথায় বইতে থাকে। বইতে থাকে, বইতেই থাকে।

সুতোটা ছিঁড়ল অ্যাটমের ডাকে।

–জেম্মা, ও জেম্মা, কী করছ?

 ইন্দ্রাণী সুটকেস বন্ধ করে তাকে তুলে দিল, এই একটু ঘরদোর গোহাচ্ছি বাবা।

–তোমরা কি আমাদেরও আগে চলে যাবে জেম্মা?

ইন্দ্রাণী নরম করে হাসল, — আগে কিনা জানি না, তবে যেতে তো হবেই।

-আমরা তো ঘর পেয়ে গেছি। অ্যাটম ইন্দ্রাণীর সামনে এসে দাঁড়াল, কাল রাত্তিরে বাবা মাকে বলছিল, এবার তো সব গোছগাছ শুরু করতে হয়। জানো জেম্মা, আমরা যেখানে যাব তার সামনে একটা পার্ক আছে।

দীপু তো কিছু বলেনি ইন্দ্রাণীকে! কাল অবশ্য মানিকতলা থেকে ফিরতে ইন্দ্রাণীর বেশ রাত হয়েছিল, কিন্তু রুনা তো আজ সকালে ঘরে এসেছিল, জানাল না তো!

 কে জানে, এখনও হয়তো পাকাপাকি কথা হয়নি। এখন তো আর উঠে যাওয়ার ব্যাপারে কোনও লুকোচুরি নেই। চাঁদুও তো হন্যে হয়ে বাড়ি খুঁজছে। দু-তিনটে বাড়ি হতে হতেও হল না। বছরখানেকের জন্য ভাড়া নেবে তাতেও বাড়িঅলাদের কত বায়নাক্কা। মহারাজ ঠাকুর রোডের একটা ফ্ল্যাট তো পাকাই হয়ে গিয়েছিল, বাড়িঅলা শেষ মুহূর্তে বলে বসল অ্যাডভান্সের টাকাটা সিকিউরিটি ডিপোজিট হিসেবে রাখতে হবে, মাসে মাসে কাটানো চলবে না। অর্থাৎ ওই টাকাটারও সুদ তিনি খাবেন! আবদার! আজ সকালে দালাল আর একটা বাড়ি দেখিয়েছে চাঁদুকে, একবার দেখে আসার জন্য ইন্দ্রাণীকে খুব পীড়াপীড়ি করছিল। ইন্দ্রাণীর দেখার কী দরকার! কদিনের জন্য মাথা গোঁজা বই তো নয়।

অ্যাটম দু পকেটে হাত ঢুকিয়ে ঘুরছে ঘরে, তোমরা, তো আমাদের সঙ্গে যাবে না, তাই না জেম্মা?

ইন্দ্রাণী মৃদু ঘাড় নাড়ল, হুঁ।

–তা হলে দিদিভাইয়ের সঙ্গে দেখা হবে কী করে?

–আমরা তোমাদের বাড়ি যাব। তোমরা আমাদের বাড়ি আসবে।

–তবে যে দিদিভাই বলল আমাদের বাড়ি যাবে না?

বলেছে বুঝি? তোকে খ্যাপানোর জন্য বলেছে। আমি ওকে কান ধরে নিয়ে যাব।

অ্যাটম যেন একটু সান্ত্বনা পেল। হঠাৎ কী একটা কথা মনে পড়ায় চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে পড়ল, আচ্ছ জেম্মা, দাদাভাইয়ের কী হবে?

ইন্দ্রাণী প্রশ্নটা বুঝতে পারল না, কিসের কী হবে?

–তোমরাও এখানে থাকবে না, আমরাও এখানে থাকব না, তা হলে দাদাভাই জাহাজ থেকে এলে আমাদের কী করে খুঁজে পাবে?

বাহ্, আমরা তো আগেই দাদাভাইকে আমাদের ঠিকানা জানিয়ে দেব।

কী করে জানাবে? দাদাভাই তো জাহাজে থাকবে।

কোম্পানিতে চিঠি পাঠালে জাহাজের গন্তব্যস্থল বুঝে বন্দরে বন্দরে চিঠি পাঠিয়ে দেয় কোম্পানি। কিসব কুরিয়ার-ফুরিয়ারের সিস্টেম আছে। ইন্দ্রাণী অবশ্য অত জটিল প্রসঙ্গে গেল না। বলল, ও ঠিক চিঠি পেয়ে যাবে। জাহাজে যারা থাকে তারা কি বাড়ির খবর পায় না? দেখবি তোর দাদাভাই সমুদ্র থেকে চিঠিও লিখবে।

অ্যাটমকে আরও চিন্তিত দেখাল, সমুদ্রে কি পোস্ট অফিস থাকে?

 ইন্দ্রাণী হেসে উঠল, উফ, আমি আর তোর প্রশ্নের উত্তর দিতে পারি না। সর, ধুলোগুলো সব ঝেটিয়ে নিই।

অ্যাটম তবু দাঁড়িয়ে আছে, আচ্ছা জেম্মা, আমরা তো আবার এই বাড়িতে ফিরে আসব, তাই না?

ইন্দ্রাণী মেঝেতে ঝাঁটা চালাল, — ঠিক এই বাড়ি নয়, নতুন বাড়ি।

হ্যাঁ হ্যাঁ নতুন বাড়ি। ফ্ল্যাট। আমি জানি। সে বাড়িতে তো আমরা আবার একসঙ্গে থাকব, কি বলো?

–হ্যাঁ, একসঙ্গেই তো। পাশাপাশি। বড়জোর ওপর-নীচে।

–তবে যে দিদিভাই বলল আমরা আর এক হব না?

বলল?

বলল তো। বলল ভাঙা জিনিস আর কখনও জোড়া লাগে না।

তিতিরটার কি একটুও জ্ঞানগম্যি নেই! এইসব কথা বলছে অ্যাটমকে! নাহ্, মেয়েটাকে একটু বকাঝকা করা দরকার, তবে যদি সিধে হয়।

কিন্তু কথাটা তো নিষ্ঠুর সত্যি। ইন্দ্রাণীই বা কি স্তোকবাক্য শোনাতে পারে অ্যাটমকে! ইন্দ্রাণীর বুকটা ভারী হয়ে আসছিল আবার।

.

সেলিমপুরের বাড়িটাই ঠিক করে এসেছে কন্দর্প। তিনটে ঘর আছে, রান্নাঘর বাথরুম পায়খানা নিয়ে মোটামুটি কমপ্যাক্ট ফ্ল্যাট। ছোট মতন একটা খাবার জায়গাও আছে। সবচেয়ে বড় সুবিধে চব্বিশ ঘণ্টা জল। বাস স্ট্যান্ড স্টেশন সবই প্রায় পায়ে হাঁটা দূরত্বে। ভাড়া দু হাজার। আগাম-টাগামেরও বালাই নেই, মাত্র এক মাসের ভাড়া সিকিউরিটি ডিপোজিট রাখতে হবে। এখন বাড়িটায় ভাড়াটে আছে, তারা উঠবে সামনের মাসের সাত তারিখে। তারপর চুনকাম-টুনকাম করবে বাড়িঅলা। ইন্দ্রাণীদের যেতে যেতে সেই সামনের মাসের মাঝামাঝি।

এই নিয়েই আলোচনা হচ্ছিল রবিবার দুপুরে। খাওয়াদাওয়ার পর। আদিত্যর ঘরে বসে।

 কথায় কথায় ইন্দ্রাণী বলল, সামনের মাসের পনেরো তারিখ হয়ে গেলে মুস্তাফিবাবু আবার কিছু মনে করবে না তো চাঁদু?

আদিত্য খাটে শুয়ে পা দোলাচ্ছিল। ফট করে উঠে বসল, তার আবার মনে করার কি আছে?

আমাদের বাড়ি আমরা কবে ছাড়ব সেটাও কি সে ঠিক করে দেবে?

–থামো তো। যা জানো না তাই নিয়ে কথা বোলো না। এক-দু তারিখ থেকে মুস্তাফিবাবুর এ বাড়িতে হাত দেওয়ার কথা, তাঁর একটা সুবিধে-অসুবিধে নেই?

–ও ঠিক আছে। আমি ম্যানেজ করে নেব। কন্দর্প অ্যাশট্রেতে ছাই ঝাড়ল, – আমি অন্য কথা ভাবছিলাম।

-কী কথা?

–সেলিমপুরের বাড়িটার ঘরগুলো তেমন বড় নয়। বড় নয় বলি কেন, ছোট। বেশ ছোট। আজকাল কি সব সাইজ হয়েছে না, দশ ফুট বাই দশ ফুট, ওই সাইজ।

–এ বাড়ির মতো বড় বড় ঘর তুই কোথায় পাবি চাঁদু? ইয়া মোটা দেওয়াল, এত উঁচু সিলিং, তোর ঘরটা তো গরমকালে পুরো এয়ার কন্ডিশন্ড হয়ে থাকে। তবে কি হ্যাঁ, চাপা ছোট ঘরে থাকলে মানুষের মনটাও ছোট হয়ে যায়। যাক গে, কদিনের তো ব্যাপার।

কন্দর্প তবু খুঁতখুঁত করছিল। আদিত্য আবার বলল, অত যদি হেজিটেশন, তা হলে ফাইনাল করে এলি কেন? আরও কয়েকটা বাড়ি দেখে…. নয় কদিন পরে…।

–অ্যাই, তুমি বেশি ল্যাজ নো না তো। চাঁদু যা ঠিক করেছে সেটাই সব থেকে ভাল। নিজে একদিন একটা বাড়ি দেখতে বেরোলে না…

ইন্দ্রাণীর ধমক খেয়ে দু গাল ছড়িয়ে হাসল আদিত্য, — আমি বেরোইনি তোমায় কে বলল?

–বেরিয়েছিলে! ফল তো কিছু দেখলাম না।

–দেখবে কী করে। শালা যে বাড়িতেই যাই বলে, ওমা আপনি বাঙালি! আমি তো মাদ্রাজি ছাড়া ভাড়া দেব না! আমি তো মারোয়াড়ি ছাড়া ভাড়া দেব না! আমি তো পাঞ্জাবি ছাড়া ভাড়া দেব না! শালা কলকাতা শহরে বাঙালি হয়ে দাগী ক্রিমিনাল হয়ে গেলাম! কথা বলতে বলতে চাঁদুর দিকে ঘুরল আদিত্য, বুঝলি চাঁদু, এক বাড়িতে বলে আমি তো কোনও লোককে ভাড়া দেব না, কোম্পানি লিজ দিতে পারি। তা আমিও একটা প্যাঁচ কষলাম। বললাম, হ্যাঁ কোম্পানি আমার আছে। ত্রিমূর্তি এন্টারপ্রাইজ। বললে আমার কোম্পানিই লিজ নিতে পারে। শুনে লোকটার কী হাসি! আমি অবশ্য ওই বাড়ি এমনিতেই নিতাম না।

-কেন? কন্দর্প টেরচা চোখে ইন্দ্রাণীকে দেখে নিল একবার।

দুর, ও বাড়ির দরজা পশ্চিমমুখো। রঘুবীরবাবু দেখেই বলেছিল, ও বাড়ি নেবেন না রায়দা। পশ্চিমের দরজাঅলা বাড়িতে শনির অধিষ্ঠান।

এই মানুষকে কী বলা যায় ভেবে পাচ্ছিল না ইন্দ্রাণী। সেই সময়েই সুদীপ রুনা ঘরে ঢুকল।

 রুনা বলল, দিদি, তোমরা নাকি কাছেই বাড়ি পেয়ে গেছ?

ইন্দ্রাণীর আগে কন্দর্পই উত্তর দিল, হ্যাঁ, সেলিমপুরে। লাইনটা পার হয়েই একটু পরে যে কবরখানাটা আছে, ঠিক তার আগেই।

সুদীপ ঘাড় চুলকোল, — আমরাও পেয়ে গেছি। একটু অবশ্য দূর হয়ে গেল। কেয়াতলায়।

রুনা তড়িঘড়ি বলে উঠল, আমার দিদি-জামাইবাবুই দেখে দিল। ওদের বাড়ির থেকে দু-তিনটে বাড়ি পরে।

ইন্দ্রাণী যে আগেই অ্যাটমের মুখে শুনেছে কথাটা, সেটা ভাঙল না। আলগা মন্তব্য করল, ভালই হল। তোদের যাওয়া কবে?

–তিরিশ তারিখ শনিবার আছে, ওই দিনই যাব ভাবছি। পরদিন রোববার, গোছগাছের সুবিধে হবে। তোমার দেওর তো ছুটির দিন ছাড়া ঘরের কুটোটি নাড়বে না, অফিসে ছুটিও নেবে না।

–ওসব ফালতু কথা ছাড়ো। সুদীপ চেয়ার টেনে বসল। কন্দর্পর প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট নিয়ে ধরাল, যে কথা বলতে এসেছিলাম, …এখানে দাদাও আছে, …ভালই হয়েছে চাঁদুও আছে, সবার সঙ্গেই কথাটা হয়ে যাক।

আদিত্য নড়েচড়ে বসল, কী কথা রে?

বলছিলাম কি, এ বাড়িতে তো প্রচুর মালপত্র, সেগুলোর কী হবে?

আদিত্য বলল, কি আর হবে! যার যার মাল সে নিয়ে যাবে।

–সেসব তো নিজেদের ঘরের জিনিস। যাবেই। বাকি যা আছে? ধরো, বাবার ঘরে যা আছে, তারপর বড়ঘরের ওই বিশাল বিশাল সোফা, কাঠের আলমারি, অত বড় একটা শোকেস… তারপর সিন্দুকের ওই সব গাদা গাদা বাসন…. কিরে চাঁদু, তোদের বাড়িতে এসব ঢুকবে? আমার ফ্ল্যাটে তো ঢুকবে না। ছোট্ট টু রুম পেয়েছি, তাই আঠেরো শো পড়ে গেল। তাও চেনাজানার মধ্যে বলে। তোর মুস্তাফি তো হাজারের বেশি ঠেকাবে না।

কন্দর্প উদাসভাবে বলল, তুমি তো অফিস থেকে হাউস রেন্ট পাবে মেজদা।

সুদীপ মুহূর্তের জন্য থমকাল। যেন সে বলতে চাইছিল আদিত্য কন্দর্প এক সঙ্গে থাকার সুবাদে মুস্তাফির কাছ থেকে অনেক বেশি সুবিধে পাচ্ছে। অবশ্য অভিযোগটা টিকল না বলেও খুব একটা হিলদোল হল না। যেন কথাটা শুনিয়ে রাখার জন্যই শুনিয়ে রাখা। হাসি মুখেই বলল, যাক গে, লেটস কাম টু দা পয়েন্ট। ওই মালপত্তরগুলোর কি হবে?

কন্দর্প একটু চিন্তা করল, বড় বড় সোফাগুলো অবশ্য আমাদের ফ্ল্যাটে ঢুকবে না। বাবার খাটটা নিয়েই বা আমরা কী করব?

আদিত্য অধৈর্যভাবে বলল, শোকেস তো আমরা নিয়ে যেতে পারি। কত কাপ মেডেল আছে, আমাদের বাড়ির সব ঐতিহ্য…

–সে নাও গিয়ে। কিন্তু ওই ঢাউস আলমারি? বাবার ঘরেরটা? বড়ঘরের দুটো? ওগুলোর ওয়েট দেখেছ? বার করতে গেলে চিড়িয়াখানা থেকে হাতি ভাড়া করে আনতে হবে।

কন্দর্প চোখ কুঁচকে তাকাল, তুমি কি বেচার কথা ভাবছ মেজদা?

–সে ডিসিশান সকলে মিলে নাও।

 আদিত্য বলল, আমি একটা প্রস্তাব দেব? শঙ্করের বাড়িতে তো অনেক জায়গা, ওকে বললে ও এসব মাল নিয়ে রাখতে পারবে না? তারপর ফ্ল্যাট হলে আমরা ভাগাভাগি করে রেখে দেব।

— কী সরল প্রস্তাব! সুদীপ শব্দ করে হেসে উঠল, তোমার ওই গন্ধমাদন শঙ্কর টেনে নিয়ে যাবে? নো চান্স। যদি বাসনকোসনগুলো চার ভাগ করে এক ভাগ ওর হাতে দিয়ে দাও, ও গ্ল্যাডলি নিয়ে আলমারিতে পুরবে। শুধু রাখার জন্য ও কোনও জিনিস নেওয়ার বান্দা নয়।

তা হলে আর কী। সেল দেম। কন্দর্প কাঁধ ঝাঁকাল, তোমার হাতে কোনও কাস্টমার আছে?

নেইও বটে। আবার আছেও বটে। সুদীপ গোটা ঘরটাকে দেখে নিল। যেন মেপে নিতে চাইছে পরিবেশটাকে। বলল, — অকশনে পাঠিয়ে দিতে পারি। রাসেল স্ট্রিটে আমার চেনা দোকান আছে, ওরা এসব অ্যান্টিক জিনিস লুফে নেবে। বললে নিজেরাই এসে তুলে নিয়ে যাবে বাড়ি থেকে।

আদিত্য কেমন মিইয়ে গেছে। ঘড়ঘড়ে গলায় বলল, জয়িকে একবার খবর দিলে হত না?

-সব ব্যাপারে ওদের অত খবর দেওয়ার কী আছে? ঘরের আলপিন বেচতে গেলেও ওদের পারমিশান নিতে হবে নাকি?

না না, ওদের জানাও। রুনা অনেকক্ষণ পর কথা বলল, -পরে কখন আবার কি কথা ওঠে! …দাদাও বলছেন….

বলছ যখন জানাব। সুদীপ একটু বিরক্ত যেন, আমি তো আর বাসন বেচতে বলিনি, সেগুলো নয় ভাগজোখ করা যাবে। কাচের আলমারি যখন দাদা রাখতে চাইছে… অ্যান্টিক ফার্নিচারের কিন্তু ভাল দাম পাওয়া যায়। তাই না রে চাঁদু?

হুঁ, তা সব মিলিয়ে চল্লিশ পঞ্চাশ হাজার তো হবেই। ইফ নট মোর। বাবার খাটটা তো মেহগিনি কাঠের। বড় আলমারিটাও। ল্যাজারাসের মাল। ও জিনিস এখন কলকাতাতে কোথায়?

আরও কত কথা হচ্ছে। দরকারি। অদরকারি। স্বার্থমাখা। নিঃস্বার্থ। কেউ উচ্ছল। কেউ স্রিয়মাণ। শব্দের ফুলকি অদৃশ্য সেতু রচনা করছে ঘরের লোকদের মাঝে।

গোটা দৃশ্যটাই ইন্দ্রাণীর চোখে যেন বিমূর্ত ছবি। জয়মোহন টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছেন, খণ্ড খণ্ড হচ্ছেন কালীমোহন-হেমলতা, খণ্ড খণ্ড হচ্ছেন শোভনা। এবার তাঁদের মিলিয়ে যাওয়ার পালা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *