৫১-৫৫. রাত নিশুত

রাত নিশুত। নীচের ঘরে এখনও সেতার বাজাচ্ছে কন্দর্প। ওস্তাদ-ফোস্তাদ তো কবেই ছেড়েছে, নিয়মিত রেওয়াজও করে না, তবু হাতটা এখনও ভারি মিঠে। হঠাৎ হঠাৎ এক এক রাতে কী যে সুরের নেশায় পায় কন্দর্পকে! বাজিয়েই চলে, বাজিয়েই চলে, সময়ের জ্ঞান থাকে না।

ইন্দ্রাণী খোলা চোখে সুর শুনছিল। চেনা রাগ। ললিত। এই গভীর রাতে মালকোষ না বাজিয়ে ললিত বাজায় কেন? ললিতই কি বাজায়? প্রায় নিঝুম পৃথিবীতে চেনা রাগও বড় অচেনা লাগে এ সময়ে। বুকের ভেতর কোথায় যেন বৃথাই পাক খেয়ে চলে তার ধ্বনি। কলজেটাকে নিয়ে দুমড়োয়, মুচড়োয়। বড় কষ্ট।

তিতির ঘুমোচ্ছ। অঘোরে। বিয়েবাড়িতে হইচই করে খুব ক্লান্ত মনে হয়, এসেই শুয়ে পড়ল। মাথা পর্যন্ত মুড়ি দিয়ে। কী নিশ্চিন্ত জীবন। হাসি খেলা বন্ধুবান্ধব। বেশ আছে মেয়ে, বেশ আছে। তা থাকুক, শুধু ইন্দ্রাণী যদি একটু ঘুমোতে পারত!

পাতলা কম্বল সরিয়ে বিছানা থেকে নামল ইন্দ্রাণী। মাঘ ফুরিয়ে এল, বাতাসে ফাল্গুনের আভাস, নরম শীতের রাত ভারি মায়াবী এখন। অথচ কী নিষ্করুণ, ইন্দ্রাণীকে ঘুমোতে দেয় না। গায়ে চাদর জড়িয়ে ইন্দ্রাণী বেরোল ঘর থেকে। মাজারীর পায়ে পাশের ঘর। কাঁপছে, বুকে এক বিচিত্র চাপা অস্বস্তি। কত যুগ পর যে নিশীথরাতে এ ঘরে এল!

নীলচে অন্ধকারে ডুবে আছে ঘর। মশারির মধ্যে মানুষটাকে ঠিক ঠিক ঠাহর হয় না। একটুক্ষণ কান পেতে শোনার চেষ্টা করল ইন্দ্রাণী। নাহ, নিশ্বাসের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। জেগে আছে কি? মানুষটার ঘুম একদম কমে গেছে আজকাল। রাতে ঘন ঘন ওঠে, বাথরুম যায়, সিগারেট খায়, এটা সেটা কি যেন নাড়াচাড়া করে, পাশের ঘর থেকে টের পায় ইন্দ্রাণী। কিছু খোঁজে কি? কী খোঁজে?

এ ঘরে এখন একটা রাতবাতি আছে। বাপ্পার লাগানো। ট্রেনিং-এর চিঠিটা আসার পর সারা সন্ধে মৃদু আলো জ্বেলে বন্ধ ঘরে গোঁসা করে শুয়ে থাকত ছেলে। ইন্দ্রাণী পায়ে পায়ে গিয়ে বাতিটা জ্বালাল। টিমটিমে সবজে আলোয় ছেয়ে গেছে ঘর, অন্ধকার আরও রহস্যময় যেন।

বাপ্পার ফাঁকা খাটে বসল ইন্দ্রাণী। স্তিমিত স্বরে ডাকল, –শুনছ?

নড়ল না আদিত্য। দেওয়ালের দিকে মুখ করে শুয়ে আছে।

 ইন্দ্রাণী আবার চাপা স্বরে ডাকল, –শুনছ? এই?

আদিত্য যেন সামান্য কেঁপে উঠল।

ইন্দ্রাণী মশারির গায়ে এসে দাঁড়াল। আলতো ঠেলল, –ঘুমোচ্ছ? এই?

এবার চমকে উঠে বসেছে আদিত্য, –কে? কেএএ?

–আমি।

–তুমি! তুউমি!

–হুঁ, একটু কথা ছিল।

 আদিত্য ফ্যালফ্যাল তাকাল। চোখ থেকে এখনও বিস্ময় কাটেনি তার। ইন্দ্রাণী খোলা দরজার দিকে একবার তাকিয়ে নিল। সুদীপদের ঘর অনেকক্ষণ বন্ধ হয়ে গেছে, কেউই এখন এদিকে আসবে না, তবু ভেজিয়ে দিয়ে এল দরজাটা। মশারি তুলে আদিত্যর বিছানায় এল। বসেছে মুখোমুখি।

আদিত্যর মুখে অদ্ভুত সন্ত্রস্ত ভাব। হাঁ করে দেখছে ইন্দ্রাণীকে।

ইন্দ্রাণী নরম করে হাসার চেষ্টা করল, কী দেখছ?

আদিত্য বোবা। বোধহয় বুঝতে পারছে না, এ স্বপ্ন না সত্যি। আরও গুটিয়ে-মুটিয়ে বসেছে। তাকিয়ে আছে অপলক।

এ কি শুধুই এক অবসাদগ্রস্ত রুগীর চোখ? ঘোরে আচ্ছন্ন? নাকি ওই দৃষ্টি আরও কিছু বলতে চায়?

কথা বলতে গিয়ে ইন্দ্রাণীর গলা দুলে গেল, কী হয়েছে তোমার বলো তো?

আদিত্য নীরব।

ইন্দ্রাণী আলগাভাবে আদিত্যর হাঁটু ছুঁল, –এত ভেঙে পড়েছ কেন? বাবা কি কারুর চিরকাল থাকে?

এইটুকু কথা কি আরও আগে আশা করেছিল আদিত্য? নইলে তার ভুরু কাঁপে কেন? কেনই বা ওই গলার শিরায় দপদপানি?

মমতা মাখা স্বরে ইন্দ্রাণী বলল, -শোক নিয়ে বসে থাকলে কি মানুষের চলে? বেশ কাজকর্ম শুরু করেছিলে, সব তো লাটে উঠল!

আদিত্য অস্ফুটে বলল, কী করব? মন বসে না যে।

–জোর করে বসাও।

 –আমাকে দিয়ে আর কিছু হবে না।

–কেন হবে না? এই তো উদয়নারায়ণপুর না কোথায় যেন কন্ট্রাক্ট পেয়েছিলে।

আদিত্য মাথা নাড়ছে দু দিকে।

কী না? কাজ পাওনি?

–পাওয়ার থেকেও খারাপ। দু হাজার টাকা গচ্চা দিয়ে চোদ্দশো ফিরল। তোমার কাছে দেনা বাড়ল আরও।

–আমি কি টাকা ফেরত চেয়েছি?

না চাইলেই বা! তোমার কষ্টের রোজগার…। আদিত্য বড় মলিন হাসল, –আমি কারুরই কোনও কাজে আসি না। প্যারাসাইটের জীবন আমার। কীটপতঙ্গের জীবন। জোঁকের জীবন। অন্যের রক্ত চুষে বেঁচে আছি।…বুড়ো মানুষটাকেও শান্তিতে বাঁচতে দিলাম না।

আদিত্যর হাত কোলের ওপর পড়ে আছে। বিচ্ছিন্ন দুটো শুকনো ডালের মতো। ইন্দ্রাণী একটা ডাল হাতে তুলে নিল, –ভেবে দ্যাখো, বাবা অসুখ বিসুখে কত কষ্ট পাচ্ছিলেন…। বলতে বলতে ঢোঁক গিলল, –এক দিক দিয়ে ভালই হয়েছে। ঘুমের মধ্যে, বিনা যন্ত্রণায়..

জানলে কী করে বাবা বিনা যন্ত্রণায় মারা গেছে? আদিত্য চোখ পিটপিট করল।

–তেমন হলে তো ডাকতেন কাউকে! চাঁদু পাশের ঘরে ছিল…

–হয়তো ডেকেছে। কেউ শুনতে পায়নি। আমরা কে কার ডাক শুনতে পাই।

আদিত্যর স্বরে জান্তব গোঙানি। ইন্দ্রাণীর ভয় করছিল।

 আদিত্য আবার বলল, আমি জানি বাবা আমাকে খুঁজেছিল। অথচ আমি বাড়ি থেকে বেরোনোর আগেও তাকে…

বাবার সঙ্গে তোমার ঝগড়া তো নতুন নয়! ওই ঝগড়ার সঙ্গে মৃত্যুটাকে মেলাচ্ছ কেন?

কারণ আমি সেদিন বাবাকে মরতে বলেছিলাম।

ইন্দ্রাণীর মাথা ঝনঝন করে উঠল। এতদিনে মানুষটার অবসাদের কারণ যেন স্পষ্ট হচ্ছে। আহা রে, কী ভারটাই না বইছে বেচারা!

আশ্চর্য, নিজের নিশ্বাসের কষ্টটাও যেন কমে গেল আচমকা! অপরাধবোধ ভাগাভাগি হয়ে গেল বলেই কি?

ইন্দ্রাণী সান্ত্বনার সুরে বলল, -মৃত্যু কি কারুর বলার অপেক্ষায় বসে থাকে? তুমি বললে, আর সঙ্গে সঙ্গে বাবার মৃত্যু এসে গেল?

বাবাকে আমি সে কথা কী করে বোঝাব?

–তোমার কি ধারণা বাবা তোমার কথা ধরে বসেছিলেন? কবেই বা তোমার কোন কথা বাবা মনে পুষে রাখতেন! সেদিনও রাখেননি। সন্ধেবেলাও আমার সঙ্গে কত কথা হল, বেশ হাসিখুশি ছিলেন, নিজের জন্মদিনের কথা বলছিলেন…। ইন্দ্রাণী ঝুপ করে থেমে গেল। বুঝি বা নিজেই নিজের কণ্ঠরোধ করল। মিথ্যে আর সত্যির মধ্যে পার্থক্য এত সূক্ষ্ম! অথচ এত গভীর!

আদিত্য অস্থিরভাবে মাথা ঝাঁকাচ্ছে, –তোমরা জানো না, কিচ্ছু জানো না। আমি যেদিন হাসপাতাল থেকে ফিরলাম, সেদিন থেকেই বাবার দিন ঘনিয়ে আসছিল। তবু আমি নিজেকে শোধরাতে পারলাম না। আমি কি একটা মানুষ।

বাবার মৃত্যুর দায় একা নিজের ঘাড়ে নিচ্ছ কেন? দায়ী তো আমরা সবাই। তুমি আমি দীপু রুনা চাঁদু বাপ্পা..আমরা সকলেই তো বাবাকে অবহেলা করেছি।

কথাটা বলে তৃপ্তি হচ্ছিল ইন্দ্রাণীর। যেন আদিত্যকে নয়, নিজেকেই ভোলাচ্ছে।

আদিত্য চুপ করে কি যেন ভাবছে। অন্ধকার অনেকটা স্বচ্ছ এখন। অন্ধকারের আদিত্যও। মায়া হচ্ছিল ইন্দ্রাণীর। বয়সের ছাপ পড়ে গেল লোকটার মুখে, কণ্ঠার হাড় ঠেলে এসেছে, ঢুকে গেছে গাল। এত শীর্ণ কি ছিল আদিত্য।

ইন্দ্রাণী অল্প চাপ দিল আদিত্যর হাতে, –আমার একটা কথা শুনবে?

উঁ?

কদিন একটু বাইরে থেকে ক্ষুরে এসো। মনটা থিতু হবে।

–কোথায় যাব?

বাবা মা বেলামাসিদের সঙ্গে কাশী যাচ্ছে, তুমিও ঘুরে এসো না। তুমি থাকলে ওরাও ভরসা পাবে, তুমিও ওদের চোখে চোখে রাখতে পারবে!

–দেখি।

 –দেখি নয়। বাবা মা খুব আশা করে আছে।

হঠাৎ ইন্দ্রাণীর চোখের দিকে সোজাসুজি তাকাল আদিত্য, –তুমি কি এই কথা বলতেই এসেছ এখন?

না। অন্য কথা আছে। ইন্দ্রাণী আড়ষ্ট হয়ে গেল, –কথাটা ঠিক কীভাবে বলব বুঝতে পারছি না।

বলা যদি খুব কঠিন হয়, থাক।

না। ইন্দ্রাণী আদিত্যর হাত ছেড়ে দিল। মুখ গুঁজল হাঁটুতে। কন্দর্প সেতারে তান তুলছে, শুনল কয়েক সেকেন্ড। অমনোযোগী শ্রোতার মতো। আদিত্যর চাদরের এক জায়গায় সুতো উঠে গেছে, সুতোটাকে পাকাল একটু। তারপর বলল, –তোমাদের ভাইবোনদের তো এবার একদিন এক সঙ্গে বসতে হয়।

–মানে?

বাহ, বাবা মারা গেলেন, এ বার সম্পত্তি ভাগ হবে না?

আদিত্য শ্বাস ফেলল, বাবার তো ব্যাঙ্কে ফুটো কড়িও নেই।

বাড়ি আছে।

–সে তো কবেই ভাগাভাগি হয়ে গেছে।

–তোমার বোন নেই? জয়িকে বাড়ির ভাগ দেবে না?

আদিত্য এক সেকেন্ড ভাবল, জয়ি বাবার ঘরটা নিক। বড় ঘরটা কমন থাকুক।

–চাঁদু বিয়ে থা করবে না? ওর ওই একটা ঘরেই হবে?

–তাও তো বটে। তা হলে চাঁদু নয় বড় ঘরটাও…আদিত্য মাথা চুলকোল, –এই সব ভাগাভাগির জন্য ভাইবোনেদের বসতে হবে?

ইন্দ্রাণী সামান্য অসহায় বোধ করল। আদিত্য কি সত্যিই কিছু বুঝতে পারছে না! এত দিন ধরে বাড়িতে এত ফিসফাস চলছে, শংকর তো প্রায় প্রকাশ্যেই শ্রাদ্ধের দিন বাড়ি ভাঙা নিয়ে আলোচনা করছিল, মুস্তাফি লোকটা অত বার এল গেল, তবু মানুষটার কিছুই মাথায় ঢোকেনি! ফ্ল্যাট, প্রোমোটার কিছুই কি লোকটার মগজে নেই! কথাটা বোধহয় এখন পাড়তে আসাই ভুল হল। দীপু চাঁদুরা যা আশঙ্কা করছে যদি তাই ঘটে! কথাটা শুনেই যদি রাতদুপুরে হাউমাউ শুরু করে দেয়! ছি। ছি, সে বিশ্রী কেলেঙ্কারি হবে।

একটুক্ষণ শামুকের খোলে ঢুকে রইল ইন্দ্রাণী। তারপর মনঃস্থির করে ফেলল। হয় এসপার, নয় ওসপার, এখনই বলবে। বঁড়শি যখন গলায় গেঁথেই গেছে, তখন আর পিছিয়ে গিয়ে লাভ নেই। বরং দিনের চেয়ে রাতই ভাল। দিন বড় উলঙ্গ, এই তরল অন্ধকারকে পর্দা করে অনেক কিছুই বলে ফেলা যায়।

ইন্দ্রাণী হাঁটু থেকে মুখ তুলল। পাকদণ্ডী ধরে এগোল, বাপ্পার দুটো চিঠি এসেছে, দেখেছ?

-তিতির বলছিল। আদিত্য মুখ ঘুরিয়ে নিল। সিগারেট হাতড়াচ্ছে বালিশের নীচে। পেল না। তবু হাতড়াচ্ছে।

বাপ্পা তো ওখানে ভীষণ হ্যাপি।

–স্বাভাবিক।

 –একবারও তো খোঁজ নিলে না, বাপ্পাকে পাঠানোর টাকাটা এল কোত্থেকে?

–অক্ষম বাপের বেশি কৌতূহল থাকা ভাল নয়।

–এ তো অভিমানের কথা। ইন্দ্রাণী আদিত্যর কাঁধে হাত রাখল, টাকা তো বলতে গেলে তুমিই জোগাড় করেছ।

–আমি! আদিত্যর চোখ বিস্ফারিত।

–হ্যাঁ গো হ্যাঁ, তুমি। সরাসরি নয়, তবে বলতে গেলে তোমার জন্যই টাকাটা পাওয়া।

 আদিত্য চঞ্চল হয়ে উঠল, বুঝলাম না। স্পষ্ট করে বলল।

ইন্দ্রাণী একটু তোতলাল, বা রে, একবার বাড়ি ভেঙে ফ্ল্যাট হওয়ার কথা উঠেছিল না, সেটাই তো হতে চলেছে। বাড়িটা যদি ভাঙা হয়, তা হলে তো তোমার প্রেসটাও চলে যাবে। তার জন্যই প্রামোটার ক্ষতিপূরণ বাবদ পঞ্চাশ হাজার টাকা আগাম দিয়েছে তোমাকে।…প্রোমোটারকে তো তুমি চেনো, চাঁদুর ওই মুস্তাফিবাবু। যদি তুমি এক সময়ে প্রেসটা না করতে, তা হলে কি টাকাটা পেতাম! তাই বলছিলাম…।

আদিত্য হতবাক। আদিত্য নিস্পন্দ। আদিত্য নিষ্পলক।

ইন্দ্রাণীর কেমন শীত শীত করে উঠল। চাদরটা জড়িয়ে নিল গায়ে। দম নিল খানিক, হাঁ করে দেখছ কী? বাবার কথা ভাবছ? বাবা নিজে রাজি হয়েছিলেন। এগ্রিমেন্টে সইও করেছিলেন। কবে সই করেছিলেন সে কথা কি আদিত্যকে বলার দরকার আছে? থাক, পরে জানলে জানবে। আলোছায়ার বর্ম পরে কথার পর কথা সাজিয়ে চলল ইন্দ্রাণী, –কোনওভাবে টাকাটা জোগাড় হল না, মরিয়া হয়ে বাবাকে গিয়েই বাপ্পার কথা বললাম। চাঁদুও মুস্তাফিবাবুর প্রস্তাবটা নিয়ে এসেছিল, বাবাও তাই…। ইন্দ্রাণী সত্যি-মিথ্যে একাকার করে দিল, তবে এখন তো মুশকিল হয়ে গেছে। বাবা নেই, ওই এগ্রিমেন্টেরও আর কোনও ভ্যালু নেই। আমারও টাকাটা বাপ্পাকে দেওয়া হয়ে গেছে, এখন তোমরা নতুন করে বসে আলোচনা না করলে…ওখানে ফ্ল্যাট হলে কে কী পাবে, কত টাকা নগদ হলে সেটা যুক্তিযুক্ত হবে, এই সব আর কি।

আদিত্য কি শুনছে না ইন্দ্রাণীর কথা! অমন তীব্র চোখে তবে তাকিয়ে থাকে কেন? জ্বলছে মণি, কাঁপছে ঠোঁট, হল কী আদিত্যর!

ইন্দ্রাণী ঢোঁক গিলল, আগেই তোমার সঙ্গে কথা বলা উচিত ছিল। তুমি তোমার কন্ট্রাক্টরির কাজ নিয়ে তখন এমন ব্যস্ত ছিলে…সে দিন রাতে ফিরলে না, তারপর তো..

আদিত্য সজোরে মাথা ঝাঁকাচ্ছে দু দিকে।

-রাগ করলে? বিশ্বাস করো, বলার সুযোগই পাইনি। এত তাড়াতাড়ি ব্যাপারটা হয়ে গেল! দীপু চাঁদুকে জিজ্ঞেস করে দেখো…

ইন্দ্রাণীর কথা শেষ হল না। ঘরে যেন ভূমিকম্প ঘটে গেল। সহসা। ইন্দ্রাণী কিছু বোঝার আগেই তাকে জড়িয়ে ধরেছে আদিত্য। উন্মাদের মতো মুখ ঘষে চলেছে ইন্দ্রাণীর কাঁধে গালে কপালে চোখে।

প্রাণপণে নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টা করল ইন্দ্রাণী। পারছে না, ছটফট করছে। আদিত্যর দু হাত সাঁড়াশির মতো পিষছে তাকে। এই বুঝি গুঁড়িয়ে গেল হাড়পাঁজর।

নিজের ওপর বিতৃষ্ণা জাগছিল ইন্দ্রাণীর। বমি পাচ্ছিল। জীবনে একটার পর একটা ভুল করবে, মাঝরাতে ছুটে আসবে আদিত্যর কাছে, আর এভাবেই তার শরীর থেকে সমস্ত অপরাধের গ্লানি শুষে নেবে আদিত্য–এই কি তবে তার ভবিতব্য! ক্ষীণভাবে একবার ঈশ্বরকে ডাকল ইন্দ্রাণী। এই বিনিময় বিনা কি তার মুক্তি নেই!

ইন্দ্রাণীর শরীর ক্রমে শিথিল হয়ে এল। সবুজ আলোয় ঘাস হয়ে যাচ্ছে। অথবা পুতুল। ঠিক তখনই কেন যে আদিত্য ফুঁপিয়ে উঠল! মুখ গুঁজে দিয়েছে ইন্দ্রাণীর বুকে। বাচ্চা ছেলের মতো কাঁদছে। কি যেন বিড়বিড় করে চলেছে।

ঠিক কাম নয়, এ যেন অন্য কিছু! ইন্দ্রাণীর বুক সিরিসির করে উঠল। যেন ইন্দ্রাণী নয়, একটা গাছকে এবার আঁকড়ে ধরেছে আদিত্য। তার চোখের জলে বুক ভেসে যাচ্ছে ইন্দ্রাণীর। কেন কাঁদে আদিত্য? বাড়িটা আর টিকবে না, এই দুঃখে? কাঁদুক তবে। বাড়ি ভাঙার দুঃখে যদি বাবার শোক ভোলে, ভুলুক না। ইন্দ্রাণী বাচ্চা ভোলানোর মতো করে আদিত্যর মাথায় হাত বোলাল। পাগল, এক্কেবারে পাগল।

কন্দর্পর বাজনা থামল। আদিত্যও ঝিমিয়ে এসেছে। ইন্দ্রাণীর কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল। হেঁচকি উঠছে মাঝে মাঝে। তার মাথায় হাত রেখে ইন্দ্রাণী নিথর।

সামনের রাস্তা মাড়িয়ে একটা ভারী ট্রাক চলে গেল। বিকট শব্দ করে। কোত্থেকে যেন একটা কোকিল ডেকে উঠল হঠাৎ। রাত্রিকে ফালা ফালা করে ডাকছে।

থামতেই গাঢ় নৈঃশব্দ্য। বাইরে। ঘরেও।

দুজনের মধ্যে এক গোপন বোঝাপড়া চলছে এখন। নাকি এক গহীন লুকোচুরি!

.

৫২.

রাতে ডাইনিং টেবিলে ছন্দা বলল, –তোমার সেই জমির দালালটা আজ এসেছিল।

শুভাশিস প্লেট থেকে চোখ তুলেছে, কে? রবি?

-রবি নয়, আরেকটা যে আসে। লম্বা মতন। বুড়োটে।

 –ও, বিশ্বনাথ! শুভাশিস চামচ করে কাস্টার্ড তুলল মুখে, –কি বলে? খবর আছে?

–ওর হাতে তো প্রচুর জমি। নিউ বালিগঞ্জে একটা সাত কাঠা প্লট আছে, গলফ ক্লাবে সাড়ে পাঁচ কাঠা, যোধপুর পার্কেও একটা আছে বলছিল, কাঠা চারেক।

–দামও নিশ্চয়ই বড় বড় হেঁকে গেছে?

–ভাল জায়গায় দাম তো একটু বেশি পড়বেই! বিশ্বনাথবাবু বলছিল, এখন কিনে না ফেললে আর সোনার দামেও জমি পাওয়া যাবে না। ওর কাছে নাকি অনেক পার্টি আসছে। নেহাত তুমি ডাক্তার মানুষ, পাড়ার লোক…। জানো, গত সপ্তাহেই ওর এক পার্টি নাকি গলফ গার্ডেনে সাড়ে চার কাঠা জমি কিনেছে। নয় বলেছিল, বলে কয়ে ও নাকি সাড়ে সাত লাখে নামিয়েছে।

–দুর, যত সব বারফাট্টাই! ওর হাত দিয়ে সাড়ে সাত লাখ টাকার জমি কেনাবেচা হলে ও কত কমিশন পেত জানো? কম করে এক পারসেন্ট। মাসে ও রকম একটা-দুটো জমি বেচতে পারলে ওকে আর ও রকম ভিখিরি-নিকিরির দশায় ঘুরতে হত না।

–ও টাকা কি ও একা পায়! লোকাল দালালেরও তো ভাগ থাকে।

–ওর কিস্যু হয় না। ও একটি অপদার্থ। সাব-দালালের সাব-দালাল। আমাদের নার্সিংহোমের জন্য বাড়ি দেখতে বলেছিলাম, যত সব এঁদো পচা বাড়ি দেখাত। গলির গলি তস্য গলি। ও লোকটাকে একদম এন্টারটেইন করবে না।

–আমি কেন এন্টারটেন করব? তোমার লোক, তোমাকেই খবর দিতে আসে। খাওয়া শেষ করে খাবারের পাত্রগুলো একটা একটা করে ঢাকছে ছন্দা, বলছে যখন, একবার দেখতে দোষ কী!

–ওর কাছে খবর তো শুধু আট-দশ কাঠার। অত জমি নিয়ে আমরা কী করব? আমাদের তো দরকার কাঠা তিনেক।

–সে রকম খবরও আছে। নিউ আলিপুরে। লাখ আস্টেক পড়বে।

কথা না বাড়িয়ে শুভাশিস উঠে পড়ল। অনেকটা সময় নিয়ে কুলকুচি করল বেসিনে। জমি একটা কিনে ফেলতে পারলে ভালই হয়, কিন্তু এই মুহূর্তে সাত-আট লাখ টাকা বার করাটা মুশকিল। কিছু না হোক অর্ধেক টাকা তো সাদাতে দেখাতেই হবে। নতুন মারুতিটা কিনল, সে টাকা তো লুকোছাপা করার উপায় নেই। নার্সিংহোমের পিছনেও সাদাকালো মিলিয়ে থোক একটা বেরিয়ে গেছে, এস্টিমেটের চেয়ে অনেক বেশি, এখন আর অত টাকাই বা কোথায়!

ড্রয়িং স্পেসে এসে সোফায় হেলান দিল শুভাশিস। আয়েশ করে পাইপ ধরাল। রাতের দিকে আজকাল সিগারেটে তেমন আর মৌজ আসে না, পাইপের দামি তামাকের সুগন্ধটা তাও মন্দ নয়।

মনোরম এক বাতাস আসছে ঘরে। ব্যালকনির দিক থেকে। ফাল্গুন কি পড়ে গেল? সিজন চেঞ্জের সময়, আবার কিছু অসুখবিসুখ বাড়বে। শুভাশিস খবরের কাগজটা টানল অলসভাবে। উল্টোচ্ছে। এখন দশটার মধ্যেই বাড়ি ফিরছে রোজ। স্বেচ্ছাবন্দিত্ব। ছন্দার সঙ্গে টুকিটাকি কথা হয়, ইদানীং অনেক রাত অবধি পড়ে টোটো, তার ঘরে ঢুকে গল্প জোড়ে, বেশ লাগে। তবু কেন যে বুকটা হঠাৎ হঠাৎ চিনচিন করে ওঠে!

একটা খবরে চোখ আটকে গেল শুভাশিসের। চাইবাসার কাছে পুলিশ-উগ্রপন্থী সংঘর্ষ, তিন জন নিহত, আহত বারো। তথাগত ও দিকেই কোথাও আছে না? সিংভূম, না কোথায় যেন? চাইবাসা কি সিংভূম ডিস্ট্রিক্টে পড়ে? দুৎ, তথাগত সংঘর্ষে পড়তে যাবে কেন? সে তো এখন আর তেমন রাগী নয়! শিক্ষা দিচ্ছে! চেতনা বিলোচ্ছে! কী চেতনা যে আসছে গ্রামে কে জানে!

পুরনো ছবিগুলো মনে পড়ছিল শুভাশিসের। মাস দেড় দুই গ্রামবাসের স্মৃতি। তেমন দগদগে নেই আর, আবছা হয়ে এসেছে। কেমন যেন স্বপ্ন স্বপ্ন মনে হয়। স্বপ্নই তো ছিল, টিকল না। স্বপ্ন আর বাস্তবে এত ফারাক! গ্রাম বলতে যে মুগ্ধতা ছিল প্রথম দিকে, কদিনেই তা উবে গেল। কাজে নেমে ধ্যানধারণা ভেঙে চুরচুর। পার্টির ক্লাসে যা শুনেছে তেমন তো নয়! দয়ালগঞ্জ, নকিবপুর, সিঁড়িন্দার ভূমিহীন কৃষকমাত্রই এমন কিছু মহান প্রোলেতারিয়েত নয়, তাদের অনেকেই শঠতা ছলনায় কলকাতার ঝানু ঠগদের হার মানাতে পারে। কী যে চায় তারা নিজেই জানে না, অথচ অনেক কিছু চায়। যাদের কিচ্ছুটি নেই তারা হয় ভয়ে কাঁপে, নয়তো বোঝে খুনখারাপি। দু-চার বিঘে জমি যাদের আছে তারা সেটুকু সামলাতে পারলেই খুশি। যাদের জমি আরও বেশি তারা নিজেরাই জোতদার বনতে চায়। তার জন্য দরকার হলে দু-চারটে জোতদার খুন করিয়ে আন্দোলনে মদত দিতে পিছপা নয় তারা। মণ্ডলবাড়ির ছেলেটা মানিক বিশ্বাসকে খুন করাতে চায়নি? অথচ ওই ছেলেটা আর মানিক বিশ্বাস দুজনেই মকবুল শেখ, পরান দাস, রজব আলিদের কুকুর বেড়ালের চেয়েও হীন চোখে দেখত। এমন অবস্থায় কেই বা হতে পারে বিপ্লবের বন্ধু? কাকেই বা আঙুল দেখানো যাবে শ্রেণীশত্রু বলে? যাদের জন্য বিপ্লবের আলো জ্বালাতে চেয়েছিল শুভাশিসরা, শহর ছেড়েছিল, তারাই বা কজন সহজ চোখে দেখেছিল শুভাশিসদের!

কেন এ সব কথা ভাবছে শুভাশিস! স্মৃতি রোমন্থন! জাবর কাটা! হাহ। সে কি বুড়োচ্ছে নাকি! দুর দুর, লাইফ বিগিনিস অ্যাট ফরটি। সে তো সবে তেতাল্লিশ প্লাস। সবে ডিঙি মেরে মেরে হাঁটছে। এখন কি তার পিছন ফিরে তাকানোর সময়!

কাগজ রেখে শুভাশিস টিভি চালাল। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের অনুষ্ঠান চলছে। দক্ষিণী। পুরনো লোকটার বদলে নতুন একটা কাজের মেয়ে এসেছে, তাকে কী যেন বলছে ছন্দা। টোটোর সামনেই অ্যানুয়াল, শুভাশিস ফেরার আগেই খাওয়া-দাওয়া সেরে পড়ছে নিজের ঘরে।

ছন্দা কথা শেষ করে সোফায় এল, কি গো, দেখে আসব জমিটা?

শুভাশিস পাইপটা হাতে নিল, –দেখো। তাড়া কিসের?

আছে তাড়া। আমার আর এই ফ্ল্যাটে থাকতে ভাল লাগছে না। হাঁপ ধরে যায়।

ফ্ল্যাট কিন্তু তুমিই কিনিয়েছিলে। আমি কিন্তু বলেছিলাম দু-চার বছর ওয়েট করা, একেবারে বাড়ি করে উঠে যাব। তোমার তর সইল না।

যখন বলেছিলাম, তখন বলেছিলাম। ভাড়া বাড়ির চেয়ে তো ফ্ল্যাট বেটার।

 ফ্ল্যাটের চেয়ে আপনা মকান। শুভাশিস দাঁতে পাইপ চেপে ধোঁয়া ছাড়ল। পাইপ দাঁতে চেপে কথা বলার অভ্যাসটা রপ্ত করছে। এতে খানিকটা ব্যক্তিত্ব বাড়ে। চিবিয়ে চিবিয়ে হাসল, দুধের চেয়ে ক্ষীর ভাল, ক্ষীরের চেয়ে মালাই।

ক্ষমতা থাকলে মালাই খাব না কেন?

-খাও না যত খুশি, কে বারণ করছে। বাট হোয়াটস রঙ উইথ দিস ফ্ল্যাট ম্যাডাম? এত স্পেসাস, তিনজন মাত্র লোক আমরা…

রান্নাঘরের সামনে মাদুর বিছোচ্ছে কাজের মেয়েটা। শোওয়ার তোড়জোড়। ভুরু কুঁচকে সেদিকে কয়েক পলক তাকিয়ে রইল ছন্দা। শুভাশিসের দিকে ফিরে বলল, –ফ্ল্যাটে একটুও সবুজ থাকে না। একটু বাগান না হলে মানুষের ভাল লাগে?

টবের বাগানে খুশি নও?

ইশ, ও তো লাইফলেস! ফুলগুলোকে কেমন প্লাস্টিকের ফুল প্লাস্টিকের ফুল মনে হয়।

হুঁউম। ছন্দার স্বপ্নটাকে উসকে দিতে চাইল শুভাশিস, কী রকম বাগান হলে গিন্নিমা খুশি হবেন?

ধরো গেটে একটা মাধবীলতার ঝাড় থাকবে।

–গেটটা বাগান নয়।

ধরো একটামেক্সিকান ঘাসের লন থাকবে। এলোমেলো, ফাঁপা ফাঁপা, ঢেউ খেলানো।

লনটাও বাগান নয়।

–আহা, বাগানে ফুল তো থাকবেই। ছন্দা হেসে ফেলল, –মালি রেখে বাগান করব। বাগানের এক পাশে একটা গন্ধরাজ থাকবে, আরেক পাশে কাঁঠালি চাঁপা। মাঝখানে বেল গোলাপ মল্লিকার বেড। শীতকালে সিজন ফ্লাওয়ার। একেক বছর একেক ফুল। এ বছর ডালিয়া, তো সামনের বছর চন্দ্রমল্লিকা। কোনও বার ভ্যারাইটিজ অফ গাঁদা।

ছন্দাকে দেখে শুভাশিস বিস্মিত হচ্ছিল। কটা মাত্র দিন সঙ্গ পেয়েই মনমরা ভাব অনেকটা কেটে গেছে ছন্দার। কত অল্পেই উচ্ছল! রোগব্যাধি যেন মুখ লুকিয়েছে। চিত্ত প্রফুল্ল থাকলে কি হিমোগ্লোবিন বেড়ে যায়! ছেলের অ্যানুয়াল হয়ে গেলে অপারেশনটা করাবে বলেছে, মনে হয় আর মত বদলাবে না।

টিউব নেবানো, জ্বলছে স্ট্যান্ডল্যাম্প। কারুকাজ করা কাঠের স্ট্যান্ডের মাথায় বাহারি ঘোমটা। নরম আলোয় ভারি সিন্ধ হয়ে আছে ঘর।

মধুর পরিবেশকে আর একটু তরল করতে চাইল শুভাশিস। বলল, –শুধু ফুলগাছে বাহার পুরো খুলবে না। তুমি অন্য গাছও লাগাতে পারো।

-যেমন?

–একটা কাঁঠাল গাছ লাগাতে পারো। গুঁড়ি থেকে, ডাল থেকে, ইয়া ইয়া এঁচোড় ঝুলবে।…তুফান শীতে কপি বেগুন পালংশাক নিয়ে আসে, আমরা গ্রীষ্মে ওর হাতে এঁচোড় ধরিয়ে দেব। তারপর ধরো লেবুগাছ, পেয়ারাগাছ..

–আম জামই বা বাকি থাকে কেন? কিনবে তো তিন কাঠা জমি…

ফোন বাজছে। শুভাশিস উঠে গিয়ে ফোন ধরল।

–হ্যালো, কে শুভাশিসদা? আমি দীপু বলছি। ঢাকুরিয়া থেকে।

শুভাশিসের কয়েক সেকেন্ড বাক্যস্ফুর্তি হল না। পাইপটা পড়ে যাচ্ছিল ঠোঁট থেকে, হাত দিয়ে ধরে নিল।

–শুয়ে পড়েছিলেন নাকি? সরি টু ডিসটার্ব ইউ।

না না, ঠিক আছে। ডাক্তারদের কি আর ঘড়ি ধরে শুতে যাওয়ার উপায় আছে রে ভাই?…এই একটু জার্নাল উল্টোচ্ছিলাম।…তারপর হঠাৎ! এত রাত্রে! সব ভাল তো?

চলছে একরকম। আপনি অনেক দিন আসছেন না…।

শুভাশিসের কৌতূহল হচ্ছিল, কিন্তু কোনও প্রশ্ন করল না। শুধু যায় না বলেই মাঝরাতে খবর নিচ্ছে সুদীপ, এটা ঠিক বিশ্বাসযোগ্য নয়। সুদীপের হিসেবি স্বভাবের সঙ্গে মেলে না। দু-এক পলক ভাবনার মধ্যেই উত্তরটা এসে গেল। ওপার থেকেই।

–শুভাশিসদা, আপনাকে একটু দরকার ছিল।

বলো। শুভাশিসের স্বর সামান্য সতর্ক।

–আপনি কাল একবার আসতে পারবেন? বিকেলের দিকে?

–হঠাৎ?

কাল তো রোববার, ছুটির দিন, কাল বিকেলে আমরা ভাইবোনেরা সব একসঙ্গে বসছি। আমাদের বাড়িটা একটা প্রোমোটারের হাতে দেওয়ার কথা চলছে, এগ্রিমেন্টটা ভাবছি কালই ফাইনাল করে ফেলব। আপনি যদি একটু প্রেজেন্ট থাকতে পারেন তো খুব ভাল হয়।…বউদি বলছিল।…আপনি অবশ্য খুব ব্যস্ত মানুষ…

শুভাশিসের কণ্ঠনালী শুকিয়ে এল। মানস চক্ষে দেখতে পাচ্ছে দোতলার প্যাসেজে রিসিভার হাতে দাঁড়িয়ে আছে সুদীপ, তিন-চার পা দূরে নিজের ঘরের দরজার সামনে ইন্দ্রাণী। সুদীপের কথা শুনতে শুনতে ভুরুতে অল্প ভাঁজ পড়ছে তার, পলকে মিলিয়ে যাচ্ছে, টেপা ঠোঁট ফাঁক হচ্ছে সামান্য, ধীর লয়ে নিশ্বাস ফেলছে, চোখ ভেসে আছে দূরে।

আচমকা এক তীব্র অভিমানে স্নায়ু বিকল হয়ে গেল শুভাশিসের। ফোনটা কি ইন্দ্রাণী নিজেই করতে পারত না! এই যে এক মাসের ওপর যাচ্ছে না শুভাশিস, কই এক বারও তো তার খোঁজ নিল না ইন্দ্রাণী! হয়তো উটকো আপদ ঘাড় থেকে নেমে গেছে বলে সে ভারি নিশ্চিন্ত এখন। যদি তাই হয় তবে ডাকা কেন?

জোরে শ্বাস টেনে ফুসফুসে বাতাস ভরল শুভাশিস। জিভ বুলিয়ে টাগরা ভিজিয়ে নিল। নিচু স্বরে বলল, –কাল? কাল তো হবে না ভাই। আমি তো কাল থাকছি না।

–দেশে যাচ্ছেন?

–না, মানে ওইরকমই।…একটু বাইরে যাচ্ছি। ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যাবে।

–একটু তাড়াতাড়ি ফেরা যায় না? আমরা পাঁচটা-ছটায় বসব। আপনাকে আমরা খুব এক্সপেক্ট করছি।

হু ইজ আমরা! ও বাড়ির কোনও আমরা কে শুভাশিস সেনগুপ্ত চেনে না। যাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল, তাদের কাছে সে এখন পরিত্যক্ত মানুষ।

শুভাশিস অপাঙ্গে ছন্দাকে দেখল। চলন্ত টিভির দিকে চোখ নেই ছন্দার, এখনও তার সুখী চোখ স্বপ্নের জাল বুনছে।

শুভাশিস বলল, –পারব কি? মনে হয় না।

–দেখুন না চেষ্টা করে। উই উইল রিয়েলি মিস ইউ শুভাশিসদা।

–দেখি। না’ই ধরে রাখো। রিসিভার ক্রেডলে রেখেও আবার কানে তুলল শুভাশিস। একটানা যান্ত্রিক শব্দ। মুছে গেছে ও বাড়ি। ফোনটা পাকাপাকি রেখে সোফায় ফিরল।

ছন্দা জিজ্ঞাসা করল, নার্সিংহোম?

-ওই আর কি। শুভাশিস নিবে যাওয়া পাইপটা ধরাল।

–সিরিয়াস কিছু?

নাআ।

আচ্ছা, যদি গোলাপ মল্লিকা বেল হেন-তেনর বেড না করে শুধুই গোলাপ লাগাই বাগানে? ছন্দা সোফায় হেলান দিল, আমাদের বাড়ির চারদিকে শুধু গোলাপ ফুটে থাকবে। লাল হলুদ সাদা গোলাপি, ব্ল্যাক প্রিন্স…

হুঁ, ভালই হয়। কিছুই শুনছিল না শুভাশিস, অন্যমনস্কভাবে বলল, আমি একটা অন্য কথা ভাবছিলাম।

–কি, নারকোল গাছ লাগাবে কি না?

–আমাদের নতুন গাড়িটা তো এখনও পরখ করা হয়নি। যাবে নাকি কাল একটা লঙ ড্রাইভে?

তুমি যাবে বেড়াতে!

–হোয়াই নট? তাজা বাতাস কার না ভাল লাগে! শুভাশিস সোজা হয়ে বসল, –কোথায় যাওয়া যায় বলো তো?

-সত্যি যাবে? ছন্দার চোখের তারা জ্বলে উঠল, –টোটো, অ্যাই টোটো!

বার কয়েক ডাকার পর অলস পায়ে এসেছে টোটো, কী হল, চেঁচামিচি করছ কেন?

-তোর বাবা কাল আমাদের নিয়ে বেড়াতে যাবে বলছে। প্লেসটা তুই চুজ কর।

বারমুডা টিশার্ট পরা টোটো তেমন উৎসাহ দেখাল না, যাও, মাধবপুর ঘুরে এসো।

মাধবপুর!

–মন্দ কি! বহুদিন যাওনি।

মাধবপুর কি একটা বেড়ানোর জায়গা? অন্য কোথাও চল।

–আমি কোথায় যাব? এগজাম দরজায় নক করছে, এখন আমার বেড়ানোর সময়!

–এক দিনে তোমার প্রিপারেশানের কিছু ক্ষতি হবে না। আমি বলছি, তুমি যাবে।

–আমার কাল অসুবিধে আছে মা। তোমরা দুজন ঘুরে এসো।

–থাক, আমরাও তা হলে যাব না। প্রোগ্রাম ক্যানসেল করে দাও।

শুভাশিস সামান্য চঞ্চল হল। কাল বাড়ি থেকে না বেরিয়ে সারাদিন বিছানায় শুয়ে থাকলেও ইন্দ্রাণীরা কেউ খোঁজ করবে না, তবু যেন চোরকাঁটা ফুটছে কোথাও। কারণ ছাড়াই। কাকুতির সুরে ছেলেকে বলল, চল না বাবা। ও রকম করছিস কেন? কতদিন আমরা এক সঙ্গে বেড়াতে যাইনি!

টোটো একবার মাকে দেখল, একবার বাবাকে। তারপর কাঁধ ঝাঁকাল, –কোনও মানে হয়! কাল আমার কত কাজ ছিল!

–কিছু ক্ষতি হবে না। লেটস ফিক্স আওয়ার ডেসটিনেশান।

–কোলাঘাট যাওয়া যায়। টোটো আড়মোড়া ভাঙল, নদীর ধারে বেড়ানো যাবে।

 ছন্দা বলল–কোলাঘাটে কিছু নেই। আমরা মায়াপুর ঘুরে আসতে পারি।

–সেই ঘুরে ফিরে তোমার গোপাল ঠাকুর! একটা ভাল নিরিবিলি জায়গার কথা ভাবতে পারছ না? অ্যাই টোটো, বকখালি গেলে কেমন হয় রে? একটা মিনি সমুদ্র, ঝাউবন…ফার ফ্রম দা ম্যাডিং ক্রাউড!

টোটো বিশেষ উচ্চবাচ্য করছে না, বসে আছে বেজার মুখে। ছোটখাট বাকবিতণ্ডার পর বকখালিই স্থির হল। বেরোবে সাতটায়, নতুন গাড়ির সঙ্গে এক ড্রাইভারও বহাল হয়েছে, তাকে রবিবার পাওয়া যাবে না, শুভাশিসই গাড়ি চালাবে।

রাতদুপুরেই তোড়জোড় শুরু হয়ে গেল ছন্দার। গুছোচ্ছে।

পরদিন সময় মতো বেরোনো হল না, বেরোতে বেরোতে সেই আটটা। টোটো এত দেরি করে উঠল! মুখটাকে প্যাঁচার মতো করে রেখেছে, যেন বাবা মা দ্বীপান্তরে নিয়ে যাচ্ছে তাকে।

ছুটির দিন, রাস্তা বেশ ফাঁকাই, তবু ডায়মন্ডহারবার পৌঁছতেই দশটা বেজে গেল। শেষের দিকে গাড়ি চালাতে চালাতে বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়ছিল শুভাশিস। মাত্র গোটা ষাটেক কিলোমিটার পথ, নতুন গাড়ি বালিহাঁসের মত উড়ছে, তবু কেন যে এত ক্লান্তি!

ডায়মন্ডহারবারে খানিকক্ষণ জিরোল সবাই। ছন্দা ফ্রিজ থেকে যা পেয়েছে বার করে নিয়েছে। বড় একটা চিজের কৌটো, বেশ খানিকটা হ্যাম, মার্মালেডের ছোট শিশি, এক দলা আচারও। সকালে উঠে ডিমও সেদ্ধ করে নিয়েছে গোটা আস্টেক, কলা নিয়েছে, রাস্তায় কিনেছে পর্বতপ্রমাণ পাঁউরুটি। গঙ্গার ধারে গাড়ি দাঁড় করিয়ে খাওয়া হল এক প্রস্থ।

টোটোর আহারেও রুচি নেই। একটা ডিম-সেদ্ধ খেল কি খেল না, কলা দু কামড় দিয়ে ফেলে দিল, হ্যাম চিজ ছুঁয়েও দেখল না।

ছন্দা বলল, -ব্যাপার কী তোর? খাচ্ছিস না কেন?

টোটো গাড়ি থেকে নেমে হাত পায়ের খিল ছাড়াচ্ছে। উদাস চোখে দেখছে বিস্তৃত গঙ্গাকে। দু-চারটে নৌকো ঘুরছে, গেরুয়া জল কেটে এগিয়ে যাচ্ছে একটা লঞ্চ। দূরে তাকালে হলদিয়ার আভাস দেখা যায়। সে দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে টোটো বলল, আমার খেতে ইচ্ছে না করলে কী করব!

–এখনও রাগ? এই আমাদের সঙ্গে আসতে হল বলে? আমাদের সঙ্গে বেড়াতে তোর আর ভাল লাগে না, তাই না রে?

–আমি কি তাই বলেছি! টোটো আরও গম্ভীর হয়ে গেল।

শুভাশিস ছেলেকে দেখছিল। ছেলে বড় দ্রুত বদলাচ্ছে, ক্রমশ ঝরে যাচ্ছে কোমলতা। বাপ-মার গণ্ডিতে যে সহজ ঘোরাফেরা ছিল, তা যেন আর নেই। টিন এজ সিনড্রোম। ওই বয়সে কেমন ছিল শুভাশিস? মা তো ধর্তব্যের মধ্যেই পড়ে না, বাবার সঙ্গেও কি নৈকট্য ছিল? বাড়িতে কথা বলার লোক তখন তো শুধু তুফান। তাও সে বয়সে ছোট, অনেকটা ভক্ত অনুচরের মতো, তার সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠার প্রশ্নই আসে না। বাবার বদলির চাকরি, কোথাও শিকড় গজাতে পারেনি, স্কুলজীবনেই বা তেমন সঙ্গী পেল কই! নিখিল প্রতুল দু-একটা নাম ভাসা ভাসা মনে পড়ে। শুভাশিস একা, চিরকালই একা। তুলনায় টোটো তো অনেক বেশি মনোযোগ পায় বাড়িতে, তবু কেন এই দূরত্ব? লোকে বলে অভাবী বাপ মার সঙ্গে সন্তানের সম্পর্ক অনেক নিবিড় হয়। এই দূরত্ব কি অভাবহীনতার পরিণাম!

শুভাশিস গাড়ি থেকে নেমে ছেলের কাঁধে হাত রাখল, –ওদিকে গঙ্গার ধারে একটা পুরনো ভাঙা কেল্লা আছে, দেখতে যাবি?

–এখন! বকখালি পৌঁছতে দেরি হয়ে যাবে না?

–হোক না, আমাদের কিসের তাড়া? চল একটু হেঁটে আসি। কেল্লা না দেখিস, লাইটহাউস দেখবি চল।

–সব আমার দেখা বাবা। মনে নেই, ক্রিসমাসের সময়ে বন্ধুদের সঙ্গে আমি এখানে পিকনিক করতে এসেছিলাম?

–সে তো হইহল্লা। এবার নয় আমার সঙ্গে ঘুরলি। ধর তুইই আমাকে দেখাতে নিয়ে যাচ্ছিস।

তুমি বলছিলে তুমি টায়ার্ড…এই চড়া রোদ্দুর…আবার এতটা পথ ড্রাইভ করবে…

শুভাশিস বুঝতে পারছিল, টোটো ঈষৎ আড়ষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ছেলের কাঁধ থেকে হাত নামিয়ে স্টিয়ারিং-এ গিয়ে বসল।

চলো, আর কি।

 চলো, তুমিই তো সময় নষ্ট করছ।

নষ্ট কোথায়, একটু রেস্ট নিচ্ছিলাম।

খবর পাঠিয়ে রামদেওকে ডেকে নিলেই হত।…শরীরে না কুলোলে বরং ছেড়ে দাও, এখানেই দিনটা স্পেন্ট করি।

শুভাশিস করুণ হেসে গাড়ি স্টার্ট দিল। তাকে এখন কলকাতা থেকে আরও দূরে যেতে হবে, অনেক দূর।

ফাল্গুনের রোদ চড়চড় বাড়ছে। বাতাসে চোরা উষ্ণতা। নোনতা হাওয়া ঝাপটা মারছে মুখে। সাঁ সাঁ ছুটছে নতুন বাদামি মারুতি থাউজেন্ড, পার হচ্ছে জনপদের পর জনপদ।

টোটো যেন একটু স্বাভাবিক। টুকটাক কথা বলছে ছন্দার সঙ্গে। একটা জায়গার নাম দেখে মা-ছেলে খুব হাসাহাসি করল। কি, না উকিলের হাট! নামখানায় এসে খানিকক্ষণ অপেক্ষা করতে হল শুভাশিসদের। জোড়া নৌকোয় সন্তর্পণে গাড়িসন্ধু পার হল এক সরু নদী। এ দিকটায় টোটো-ছন্দা আগে আসেনি। নদীর নামটাও ভারি মিঠে লাগল তাদের। হাতানিয়া দোয়ানিয়া।

নদী পার হয়েই ভীষণ ক্ষিধে পেয়েছে টোটোর। পাঁউরুটি হ্যামে হবে না, এক্ষুনি তার মাংস-ভাত চাই।

ছোট্ট জনপদ। খুঁজে খুঁজে একটা মোটামুটি পরিষ্কার হোটেল বার করল শুভাশিস। চেয়ার-টেয়ারের বালাই নেই, বেঞ্চি টেবিলে খাওয়া, তাইই সই। হোটেলে ঢুকেই নাক কুঁচকোচ্ছে ছন্দা, তার ধারণা এখানে খেলে নির্ঘাত কলেরা হবে।

শুভাশিস হাসছে, কি রে টোটো, তোরও কি ঘেন্না করছে?

টোটো জিনসের জ্যাকেট খুলে রেখেছে গাড়িতে। শুধু শার্টেও ঘামছে অল্প অল্প। কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, –চলতা হ্যায়। ক্ষিদের সময়ে অত বাছবিচার করলে চলে না।

রাইট। আমি যখন গ্রামে ছিলাম, ইন দা ইয়ার নাইন্টিন সিক্সটিনাইন, তখন যে আমি কী পরিবেশে থেকেছি, কী পরিবেশে খেয়েছি…!

–সেই গ্রামের হোটেল কি আরও খারাপ ছিল বাবা?

–সিড়িন্দায় হোটেল! হা হা। আমি তো খেতাম মকবুল শেখের বাড়িতে। ইয়া মোটা মোটা চাল আর শাকপাতা দিয়ে একটা চচ্চড়ি।

-তুমি তা হলে গ্রামে গিয়ে খুব কষ্ট করেছিলে?

–হ্যাড টু। ফর আ নোবল কজ। উইথ আ নোবল আইডিয়া।

যদি সত্যি সত্যি তোমাদের বিপ্লব সফল হত, তা হলে কি তুমি গ্রামেই থেকে যেতে বাবা?

–হয়তো। কিন্তু পৃথিবীর তাতে একটা লস হয়ে যেত।

–কি লস?

-তোমার মার সঙ্গে তা হলে আমার বিয়েই হত না। অ্যান্ড আওয়ার প্ল্যানেট উড হ্যাভ মিসড রাজর্ষি।

টোটো আজকাল বাবা-মার সামনে জোরে হাসে না। লাজুক মুখে তাকাল একটু। খাওয়া দাওয়ার পালা শেষ করেই আবার যাত্রা শুরু। বকখালি পৌঁছতে প্রায় একটা। ট্যুরিস্টের ভিড় নেই এখন, গভর্নমেন্টের লজ প্রায় ফাঁকা, একটা ভাল দেখে ঘর ভাড়া নিয়ে নিল শুভাশিস। হাত মুখে জল ছিটিয়ে তিনজনেই মিনিট পনেরো শুয়ে রইল টান টান। তারপর গাড়ি রেখে বেরিয়ে পড়েছে।

এখানে সমুদ্র বড় শান্ত। জলে নীল আভার চিহ্নমাত্র নেই, বড় জোর একটা সবজেটে ভাব। নিরীহ বাধ্য ঢেউরা মাথা নিচু করে খেলা করছে কিনারে, জল আসছে, ফিরে যাচ্ছে, বালি আর কাদার মিশেলে গড়ে ওঠা তটে ছাপ রেখে যাচ্ছে ক্ষণিকের। এদিক ওদিকে টুকুস করে মাথা তুলছে কাঁকড়া। জোলো বাতাসে আঁশটে গন্ধ।

পাড় ধরে হাঁটছে শুভাশিসরা। ডান দিকে মিহি ঝাউবন, বাঁয়ে শব্দমাখা জলরাশি। এক দিকে বাতাসের সোঁ সোঁ ধ্বনি, অন্য দিকে একঘেয়ে চাপা গুঞ্জন। সব আওয়াজ ছাপিয়ে একটা দূরাগত শব্দ শুনতে পাচ্ছিল শুভাশিস। ছটফট করছিল, বিচলিত বোধ করছিল।

টোটো ছন্দা খানিকটা এগিয়ে গেছে। একটা খালি গা কালো মতো তাগড়াই লোকের সঙ্গে কথা বলছে। হাত নেড়ে বাবাকে ডাকছে টোটো। শুভাশিস কাছে যেতেই টোটো বলল, বাবা, আমরা নৌকো চড়ব?

–এই সমুদ্রে নৌকো! শুভাশিস যেন শিউরে উঠল।

 –এটা আবার একটা সমুদ্র নাকি! ট্যালট্যাল করছে জল, ঢেউ নেই, কিছু নেই, চলো না বাবা।

 তাগড়াই লোকটা নৌকোর মাঝি। ঝকঝকে সাদা দাঁত ছড়িয়ে হাসল লোকটা, চলেন বাবু, ছই দেওয়া লৌকো, মোটে তাপ টের পাবেননি।

–নৌকো চড়ে যাবটা কোথায়?

 ছন্দা খুশিতে ঘাড় দোলাচ্ছে, –কেন, ওই যে দূরে দেখা যাচ্ছে দ্বীপটা, ওখান থেকে ঘুরে আসতে পারি।

–দুর, ওটা দ্বীপ নাকি?

–হ্যাগো, ওটার নাম জম্বু দ্বীপ। ওখানে নাকি বনবিবির থান আছে, চিংড়ির আড়ত আছে…চলো না গো, আমি কখনও দ্বীপ দেখিনি।

শহরের লোককে কি দ্বীপ খুঁজতে হয়! সে নিজেই তো একটা আস্ত দ্বীপ। তলিয়ে যায়, ভাসে, তলিয়ে যায়।

বিষণ্ণতা লুকিয়ে শুভাশিস জিজ্ঞাসা করল, –যেতে আসতে কতক্ষণ লাগবে?

মাঝি মাথা চুলকোল, –তা ধরেন ঘণ্টা দুই-আড়াই। হাওয়া যদি ঠিকঠাক বয়, পাল খাঁটিয়ে আরও আগেও ফিরতে পারি। ফাল্গুন মাস, বাতাসের তো এখন ঠিক ঠিকানা নাই!

ঠেলে ঠেলে নৌকো জলে ভাসাল মাঝি। আরও দূরে চলেছে শুভাশিস। মৃদু মৃদু দোলে নৌকো, শুভাশিসও দোলে। একবার কি ওবাড়ি যাওয়া উচিত ছিল আজ? দীপু কি আর নিজে ডেকেছে, ইন্দ্রাণীরই আহ্বান তো দীপু পৌঁছে দিয়েছিল টেলিফোনে! প্রবল হাওয়ায় পতপত কাঁপছে পাল, ফুলে উঠছে। কত দিন তিতিরকে দেখেনি শুভাশিস! মাঝদরিয়ায় ভাসছে নৌকো। বকখালি রেখা হয়ে এল। টোটো বকবক করে চলেছে মাঝির সঙ্গে। অজানা দ্বীপের দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে আছে ছন্দা। এগোচ্ছে নৌকো। চড়া রোদে ঝলসাচ্ছে পাটাতন। ঠিকরে ওঠা জলকণা শুকিয়ে যাচ্ছে মুহূর্তে।

দ্বীপ কাছে এসে গেল। মাঝি পাল নামাচ্ছে।

পিছনের মূল ভূখণ্ডের দিকে চিত্রার্পিতের মতো চেয়েছিল শুভাশিস, সামনে ফিরেছে। সঙ্গে সঙ্গে চমকেছে ভীষণ। এ কী অপার্থিব দৃশ্য! দ্বীপ থেকে জলে নেমে এসেছে অসংখ্য গাছ, জল-অরণ্যের ফাঁক দিয়ে দিয়ে পথ করে চলেছে নৌকো। আদিম আলোছায়া নেচে বেড়াচ্ছে জলে। বিশাল আকাশ ভেঙে খানখান।

শুভাশিসের শরীর হিম। এ কোন পথে চলেছে সে? জলের মধ্যে একা হয়ে পরপর দাঁড়িয়ে আছে এরা কারা? গাছ, না রাশি রাশি অভিশপ্ত মানুষ? এদের মাঝে সে কেন?

শুভাশিস স্থান কাল গুলিয়ে ফেলছিল। আর্তনাদ করে উঠেছে হঠাৎ-মাঝি, আর এগিয়ো না। মাঝি, নৌকো ঘোরাও।

ছন্দা অবাক, –সে কি! কেন? আমরা তো এসে গেছি।

–কোথায়? শুভাশিসের চোখে ঘোর।

–দ্বীপে! উফ, কী সুন্দর জায়গা!

–হোক সুন্দর। আর যাব না।

–তোমার ভয় করছে নাকি বাবা? টোটো হাসছে, আমার কিন্তু ফ্যান্টাস্টিক লাগছে। না এলে রিয়েলি খুব মিস করতাম। একটা দ্বীপে পা রাখছি…আমি ভাবতেই পারছি না!

কী যেন কানাকানি করছে জলডুবি গাছেরা! শুভাশিস শুনতে পাচ্ছিল। অবসন্ন মুখে হেলান দিল ছইতে। আপনমনে বিড়বিড় করে উঠল। ফিরলেই হত। এখনও ফেরা যায়।

.

দেড়শো কিলোমিটার দূরে ঢাকুরিয়ার রায়বাড়ির রঙ্গমঞ্চে তখন অন্য নাটক। কুশীলবরা হাজির হয়েছে একে একে। শংকর-জয়শ্রী নিজেদের গাড়িতে চড়ে এসে গেছে দুপুর দুপুর। বিকেলের মুখে এল অশোক মুস্তাফি। রঘুবীর তো সকাল থেকেই এ বাড়িতে। দুপুরে চাট্টি খেল, আদিত্যর সঙ্গে গুজগুজ করে গেল সমানে।

ঠিক সাড়ে পাঁচটায় আলোচনা-সভা বসল। বড় ঘরে।

আদিত্য এখন অনেক স্বাভাবিক। ভাইবোনদের সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলল, মন দিয়ে প্রতিটি অক্ষর শুনল এগ্রিমেন্টের, বিনা প্রতিবাদে সইও করল। পঞ্চাশ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণের প্রসঙ্গে ক্ষণিকের জন্য থমথম করে উঠেছিল ঘর, কয়েক লহমাতেই সে ভাবটা মিলিয়ে গেল। সই সাবুদের পালা শেষ।

ইন্দ্রাণীর ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল। আদিত্য তাকে ডোবায়নি, কথা রেখেছে। শংকর-জয়শ্রীও ঝামেলা করল না বিশেষ, বন্দোবস্তে তারা প্রসন্ন বলেই মনে হয়।

রুনা রান্নাঘরে মিনতির সঙ্গে সকলের চা জলখাবারের আয়োজন করছে। পায়ে পায়ে দোতলায় এল ইন্দ্রাণী। ঘরে ঢুকেই থমকে গেছে। বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে ফুলে ফুলে কাঁদছে তিতির।

কাছে গিয়ে মেয়ের পিঠে হাত রাখল ইন্দ্রাণী, কাঁদছিস কেন রে? কী হল?

তিতির ঝট করে মুখ তুলল। ফর্সা মুখ টুকটুকে লাল, গাল ভিজে গেছে জলে।

ইন্দ্রাণী হাসার চেষ্টা করল, বাড়ি ভাঙা হচ্ছে বলে মন খারাপ?

তিতির উত্তর দিল না। ছিটকে সরে গেছে খাটের ও প্রান্তে। তার সজল চোখ মার চোখে স্থির।

মেয়ের ওই দৃষ্টি ঠিক পড়তে পারছিল না ইন্দ্রাণী।

.

৫৩.

ফাল্গুনের শেষাশেষি পর পর কদিন বৃষ্টি হয়ে গেল মাধবপুরে। তেমন ঝমঝমিয়ে দশ দিক কাঁপিয়ে নয়, ধুলো মারা বৃষ্টি। সারাদিন ধোঁয়া ধোঁয়া মেঘে ছেয়ে থাকে আকাশ, কখনও-সখনও টিপটিপ ঝরে। ঠাণ্ডার একটা রেশও ছিল বাতাসে। দু দিন হল আকাশ বেশ নীল হয়ে গেছে, তাপও বাড়ছে ক্রমশ।

বিকেলে একটু বেরোনোর তোড়জোড় করছিলেন শিবসুন্দর। আজ কোনও কল আসেনি এখনও, খালপাড় থেকে খানিক ঘুরে আসবেন। আলো থাকতে থাকতে। ছুটিছাটা আজকাল প্রায় জোটেই না, রুগীর ভিড়ে সকালের চেম্বারই একটা-দেড়টা অবধি গড়িয়ে যায়। বিকেলের দিকে দু দিন করে চেম্বার রাখতে বলছে তুফান, শিবসুন্দর রাজি নন। এখন এক-দু মাস রোগব্যাধির প্রকোপ একটু বাড়বেই, তা বলে কি এতদিনের নিয়ম বদলালে চলে!

আলমারি খুলে শিবসুন্দর একটা ঘিয়ে রঙের বুশশার্ট বার করলেন। ছন্দা পুজোয় পাঠিয়েছিল, এখনও একদিনও পরা হয়নি। দেখতে সাদামাটা হলেও শার্টটা বেশ দামি বোঝা যায়, কি এক বিদেশি কোম্পানির লেবেলও রয়েছে। নির্ঘাত পাঁচ-ছশো হবে। এত দামি শার্ট পরা ধাতে নেই শিবসুন্দরের, তা ছাড়া শীতকালটা তো ফুলহাতা পোশাকেই কেটে গেল।

মনোরমা ঘুমোচ্ছন। এই অবেলাতেও। ঘুমটা ইদানীং খুব বেড়ে গেছে মনোরমার, সদাই আচ্ছন্ন ভাব। মাঝে প্রেশার খুব নেমে গিয়েছিল, প্রোটিন ডায়েট বাড়িয়ে বাড়িয়ে এখন মোটামুটি স্বাভাবিক। শুধু আচ্ছন্ন ভাবটাই যাচ্ছে না। ওষুধপত্র আর তেমন বদলাচ্ছেন না শিবসুন্দর। পুরনো বন্ধু হরনাথের এখনও কলকাতায় রমরমা পশার, কলকাতা যাওয়ার সময়ে ভেবেছিলেন একবার হরনাথের সঙ্গে দেখা করে মনোরমাকে নিয়ে আলোচনা করে আসবেন, তা সে আর হল কই! যাক গে যাক, হাইপো গ্লাইসিমিয়ার অ্যাটাকটা না হলেই হল।

কদিন হল বেশ মশা বেড়েছে। জানলাগুলো টেনে টেনে বন্ধ করলেন শিবসুন্দর। বারান্দায় এসে সিগারেট ধরাতে গিয়েও ধরালেন না। ঘুম ভাঙার পর থেকেই বুকটা কেমন চাপ হয়ে আছে। চা খাওয়ার পর বেড়ে গেল চাপটা, হয়তো হাঁটলে কাটবে।

নীচে অলকার গলা শোনা যাচ্ছে। সঙ্গে আর একটি নারীকণ্ঠ। বিকেলের দিকে রোজই কেউ না কেউ আসে অলকার কাছে। চারপাশে শিবসুন্দরের অনেক জ্ঞাতিগুষ্টি, তাদের বাড়ি কালেভদ্রে যান শিবসুন্দর। সময় পান না, ভালও লাগে না। কী কথা বলবেন তাদের সঙ্গে! সমবয়সী যাঁরা, তাঁরাও তাস দাবা গ্রাম্য রাজনীতি নিয়ে আছেন, শিবসুন্দরের সঙ্গে একটু সমীহ ভরা দুরত্বই পছন্দ করেন তাঁরাও। তুফানেরও এদের সঙ্গে বিশেষ ভাবসাব নেই। শুধু অলকাই দিব্যি জমিয়ে নিয়েছে। টিভি সিরিয়াল নিয়ে গল্প, সিনেমা নিয়ে আলোচনা, শাড়ি, গয়না, রান্না। মেয়েরা দিব্যি সহজে বৃত্ত রচনা করে নিতে পারে। ছন্দা যে ছন্দা, রীতিমতো শহুরে গিন্নি, সেও তো এলেই। এবাড়ি ওবাড়ি ছোটে। ন মাসে ছ মাসে হলেও।

একতলায় নেমে থমকালেন শিবসুন্দর। রামনগর হেলথ সেন্টারের নার্স মেয়েটি না! মায়া, না ছায়া কি যেন নাম! এখানে কী করছে!

শিবসুন্দরকে দেখেই অলকাদের গল্প থেমে গেছে। মেয়েটি আড়ষ্ট মুখে হাসল।

হাসলেন শিবসুন্দরও। মেপে ভদ্রতা করে বললেন, –তোমাদের হেলথ সেন্টার তো আবার বিজি হয়ে উঠল।

-হ্যাঁ। নতুন ডাক্তারবাবু এসেছেন।

–খুব ইয়াং না?

–হুঁ। মেয়েটি ঘাড় নাড়ল, ফার্স্ট পোস্টিং।

–থাকবে কদিন? কী মনে হয়?

মেয়েটি উত্তর দিল না। অলকার দিকে তাকাচ্ছে। অলকাও কি যেন চোখে চোখে ইশারা করল। দ্রুত ঘাড় নাড়ল মেয়েটি।

শিবসুন্দর ভুরু কুঁচকোলেন। এ সব ইশারা-ইঙ্গিত ঠারেঠোরে কথা তাঁর পছন্দ নয়। গম্ভীরভাবে বললেন, কী ব্যাপার বল তো?

অলকা বলে উঠল, –মায়া আপনাকে কি বলবে। তার জন্যই এসেছে।…কি হল, বাবাকে কি বলবে বলছিলে বলো।

মেয়েটি তবু ইতস্তত করছে। নীল ছাপা শাড়ি পরেছে, আঁচলের খুঁট পাকাচ্ছে আঙুলে। শেষে বলেই ফেলল, –স্যার, আপনি যদি আমার একটা উপকার করেন…

–আমি? উপকার? তোমার?

–আমি এই চাকরিটা ছাড়তে চাই স্যার।

–তো?

মানে…আমি…স্যার..অলকাবউদিও বলছিল..না মানে বউদিও ঠিক বলেনি, আমি শুনেছি

 –অত কিন্তু কিন্তু করছ কেন! স্পষ্ট করে বলো।

মেয়েটি কয়েক পল থেমে থেকে বলল, কলকাতায় আপনাদের নার্সিংহোমে যদি আমার একটা চাকরি হয়ে যায়…। আমার স্যার খুব উপকার হয়।

এ রকম একটা আবেদনের জন্য আদৌ প্রস্তুত ছিলেন না শিবসুন্দর। থতমত খেয়ে গেলেন, কলকাতায় আমাদের আবার নার্সিংহোম কোথায়? তুমি কি আমার ছেলের নার্সিংহোমের কথা বলছ?

–হ্যাঁ স্যার।

গ্রামের চাকরি ছেড়ে কলকাতা যেতে চাও?

আমার খুব সুবিধে হয় স্যার। …ডানকুনিতে মা আর বোন থাকে, ওখানেই আমাদের বাড়ি। কলকাতায় একটা ভাল কাজ পেলে বাড়ি থেকে যাতায়াত করতে পারি। বোনটা কলেজে পড়ছে, মা অসুস্থ, বাড়িতে কোনও গার্জেন নেই…।

শিবসুন্দর সোজা চোখে দেখছিলেন মায়াকে। বছর আঠাশ-উনত্রিশ বয়স, তেমন সুন্দরী না হলেও মুখে বেশ লাবণ্য আছে মেয়েটির। শরীরের বাঁধুনিও সুন্দর। সিঁথি সাদা। কানে পাথর বসানো ছোট্ট ছোট্ট ঝোলা দুল। মুখে হালকা প্রসাধনের ছাপ। অর্থাৎ যথেষ্ট শখ শৌখিনতাও আছে। মা বোনের অজুহাত দেখিয়ে শহরে যেতে চায়।

শিবসুন্দর ভারিক্তি স্বরে বললেন, সরকারি চাকরি যখন নিয়েছিলে, তখন তো জানতেই, এ সব জায়গায় এসে থাকতে হবে। জানতে না?

মেয়েটি চুপ।

–কবছর চাকরি হল?

–সাত বছর স্যার। আমার ও.টি ট্রেনিংও আছে।

শিবসুন্দর দ্বিতীয় বাক্যটি যেন শুনলেন না। বললেন, সাত বছরেই হাঁপিয়ে গেলে?

মেয়েটি আবার চুপ।

–এর আগে ছিলে কোথায়?

–এগরায়। মেদিনীপুরে।

 –এখানে তো বেশিদিন আসোনি?

না স্যার। মে মাসে এক বছর হবে।

সরকারি চাকরি করছ, মাইনে ভাল পাও, কোয়ার্টার আছে… জানো তো, নার্সিংহোম টার্মিংহোম ভাল মাইনে দেয় না!

–আমার বেশি মাইনে লাগবে না স্যার। আমি শুধু বাড়ির সঙ্গে থাকতে চাই।

 মেয়েটির অলকার দিকে তাকাল একবার। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। অলকা কিছু বলার আগেই শিবসুন্দর গলা ঝাড়লেন, –শোনো, আমি আমার ছেলের নার্সিংহোমের কোনও ব্যাপারে কখনও ইন্টারফিয়ার করি না। আমাকে দিয়ে তোমার কোনও কাজই হবে না।

মেয়েটির দিকে আর দৃকপাত না করে বেরিয়ে পড়লেন শিবসুন্দর। হাঁটছেন হনহন করে। সামান্য উত্তেজিত ভঙ্গিতে। মায়া মেয়েটিকে সাহায্য করতে পারলে ভালই লাগত, কিন্তু কোথায় যে বাধল! ছেলেকে অনুরোধ করতে দ্বিধা? তুফান তো কলকাতায় যায়ই, তাকে দিয়েই শুভকে বলাতে পারত অলকা, শিবসুন্দরকে জড়ানো কেন? অবশ্য তাঁকে জিজ্ঞাসা না করে তুফান শুভকে কোনও অনুরোধ করবেই না। আশ্চর্য, অলকাও তো একটা চিঠি লিখে মায়াকে কলকাতায় পাঠিয়ে দিতে পারে, সেটাই বা করে না কেন?

নিজের ওপর হঠাৎ একটা ক্রোধ এল শিবসুন্দরের। তুফান অলকা এরা তাঁর অনুমতি বিনা যে কিছু করতে পারে না, এর জন্য কি তিনিই দায়ী নন? তাঁরই ব্যক্তিত্বের চাপে পিষ্ট হচ্ছে দুজনে, তাঁরই ইচ্ছে অনিচ্ছের তর্জনী হেলনে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে দুটো স্বাধীন জীবন, এ কি কোনও ভাল কথা! কেন এ রকম হবে? এ কি শুধুই তাঁর প্রতি তুফান অলকার শ্রদ্ধা? নাকি এ ভীতি? ভয় থেকে কি কখনও প্রকৃত সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে? শুভ তো কবেই দূরের হয়ে গেছে, এরা এত কাছে থেকেও দূর দূর কেন? তুফানের মনে কি হীনম্মন্যতা বোধ রয়ে গেছে, সেটাই চারিয়ে গেছে অলকায়? কেন? কেন? সেই ছোট্টটি থেকে মানুষ করার সময়ে শুভ আর তুফানে কি কোনও পার্থক্য রেখেছেন শিবসুন্দর? কখনও না। প্যান্ট জামা জুতো বই খাতা সব তো সমান দিয়েছেন দুজনকে। তুফানের মাথা থাকলে তুফানও ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হতে পারত। শিবসুন্দর মোটেই বাধা দিতেন না। তা হলে?

মনের মধ্যে কোনও কথাই একটানা বেশিক্ষণ চলে না, একটু পরেই কোত্থেকে যেন আর একটা কণ্ঠ উঁকি দেয়। নিজেরই। সেই কণ্ঠ বলে উঠল, এতে তোমার কী করার আছে শিবসুন্দর? ভেবে দ্যাখো, তুমি যদি উদ্ধার না করতে, তা হলে কোথায় থাকত তুফান? সেই তুফানগঞ্জের হেলথ সেন্টারের দাওয়ায় পড়ে থাকা শীর্ণ অনাথ ছেলেটা হয়তো এতকাল বেঁচেই থাকত না! থাকলেও তার হত এক কুকুর-বেড়ালের জীবন। চাকরবাকরের জীবন। অথবা কোনও অসামাজিক জীবন। তাকে এমন একটা সুস্থ সুন্দর জীবন দেওয়ার জন্য সে যে কৃতজ্ঞতায় ক্রীতদাস হয়ে থাকবে, এটাই তো স্বাভাবিক। আর গরিব কেরানির মেয়ে অলকাও কি ভেবেছিল এ রকম একটা সচ্ছল ঘর বর সংসার পাবে? তা হলে?

শিবসুন্দরের গলা দিয়ে গর্জন বেরিয়ে এল, চোপ। তোমার মনেও ওই ভাবনা রয়ে গেছে! ছিহ। ওই ভাবনা রয়ে গেছে বলেই কি নিঃসঙ্গ শিবসুন্দর?

শিবসুন্দর স্থাণুবৎ দাঁড়িয়ে পড়লেন। এ কোথায় এসে পড়েছেন তিনি! সাঁকো পেরিয়ে শ্মশানের দিকে হাঁটতে চাওয়া মন তাঁকে ছুটিয়ে এনেছে পোড়ো রাজবাড়িটার সামনে। একদম সামনে। ঝোপজঙ্গল ইটপাথর হাঁ হাঁ করছে। এখানে কেন তিনি?

সহসা বুকে এক প্রবল যন্ত্রণা অনুভব করলেন শিবসুন্দর। একশোটা নেকড়ে এক সঙ্গে আঁচড় টানছে হৃৎপিণ্ডে। ফালা ফালা হয়ে যাচ্ছে ভেতরটা। মাথার ওপর নীল আকাশ পলকে ধূসর, পলকে পাঁশুটে, পলকে কালোলা। কে যেন হাতের মুঠোয় চেপে নিবিয়ে দিচ্ছে শেষবেলার সূর্যকে।

শিবসুন্দর নিস্পন্দ হয়ে গেলেন। ঘামছেন। সশব্দে ছোটাছুটি করছে নিশ্বাস। শরীরে আর শক্তি নেই, ধপ করে বসে পড়লেন মাটিতে। কান বুজে গেছে সম্পূর্ণ, তার মধ্যেই একটা ঘণ্টাধ্বনি শুনতে পেলেন। বহু দূর থেকে বেল বাজছে, তৈরি হও শিবসুন্দর, আমি এসে গেছি।

হার্ট অ্যাটাকের সমস্ত উপসর্গ শিবসুন্দরের মুখস্থ, কিন্তু ব্যাপারটা যে ঠিক এই এ তো কোনও বইতে লেখা নেই! মৃত্যু কি এরকমই চরম অন্ধকার!

শিবসুন্দর মাটি খামচে ধরলেন। এক দলা ঘাস উঠে এল মুঠোয়। একটু যেন হালকা হল বুকটা। হা হা করে নিশ্বাস নিচ্ছেন। নেকড়ের আঁচড়ও কমে এল ক্রমশ। একটু একটু করে আলো ফুটছে।

এক দল ছেলে আসছে আলপথ বেয়ে। মাটিতে ওভাবে শিবসুন্দরকে বসে থাকতে দেখে দৌড়ে কাছে এল, কী হয়েছে ডাক্তারবাবু? কী হয়েছে ডাক্তারবাবু?

শিবসুন্দর ছেলেগুলোকে চিনতে পারলেন। মুসলমানপাড়ার ছেলে। ইয়াসিন, খালেক, মইদুল…

শরীর খারাপ লাগছে ডাক্তারবাবু?

বাড়ির কাউকে ডাকব?

কাকে আবার ডাকবি? ধর ধর, ডাক্তারবাবুকে তোল।

–এই ইয়াসিন, একটু পানি নিয়ে আয় না।

 শিবসুন্দর হাত তুলে থামালেন ছেলেগুলোকে। কষ্ট করে হাসির মতো কিছু একটা ফোঁটালেন ঠোঁটে, –আমি ঠিক আছি। একটু বসে আছি।

ছেলেগুলোর চোখ থেকে তবু যেন সংশয় যায় না। কেমনভাবে যেন দেখছে শিবসুন্দরকে।

 শিবসুন্দরের অস্বস্তি হচ্ছিল। কথাটা যদি এখন তুফান অলকার কানে ওঠে, ওরা কেঁদে-কেটে অনর্থ করবে। সত্যি তো এই মুহূর্তে আর তত কষ্ট নেই, তবে কেন শুধু শুধু মানুষকে বিব্রত করা?

মোচড়ানো ফুসফুসে অনেকটা বাতাস ভরে নিলেন শিবসুন্দর। বললেন, আরে বাবা, কিছু হয়নি আমার। এমনিই মাটিতে বসে ছিলাম। ডাক্তার বলে কি আমার একটু ঘাসের ওপর বসতে ইচ্ছে করে না?…তা তোমরা দল বেঁধে চলেছ কোথায়?

ইয়াসিনরা হইহই করে উঠল, কাল কলকাতায় মিটিং আছে, দিল্লিতে বন্ধু সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলছে তার প্রতিবাদে…

–সে তো কাল। শিবসুন্দর ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন। পা দুটো কাঁপছে, ভারী পাতা দিয়ে চেপে আছেন মাটি, কী কাণ্ড! এখন থেকেই তোমরা রওনা হবে নাকি?

–আমরা এখন সোমেনদার কাছে যাচ্ছি। সন্ধেবেলা রামনগরে পার্টি অফিসে মিটিং আছে। কাল কখন বেরোনো হবে, কোথায় জড়ো হবে সবাই…

-ও।

শিবসুন্দর বাড়ির পথে এগোলেন। হাঁটছেন। ধীরে, পা টিপে টিপে। যুবকের দল কথা বলতে বলতে মিলিয়ে যাচ্ছে, শিবসুন্দর বারেক তাকালেন সেদিকে। একটু আগের সর্বনাশা অনুভূতি থেকে ফেরাতে চাইলেন মনটা। কত কিছু ঘটে চলেছে পৃথিবীতে। কোথাও বন্ধু সরকার, কোথাও শত্রু সরকার, কোথাও বিক্ষোভ, কোথাও মিলন। গোটা দুনিয়ার রাজনীতিতেই কত ছবি উল্টেপাল্টে গেল। পূর্ব ইউরোপে একের পর এক কমিউনিস্ট সরকার ভেঙে পড়ছে, আমেরিকান মিলিটারি আক্রমণ করল পানামা, রাশিয়ান সেনা চেকোস্লোভাকিয়া থেকে দেশের পথে রওনা হচ্ছে, দক্ষিণ আফ্রিকায় মুক্তি পেল নেলসন ম্যান্ডেলা, ঝুরঝুর খসে পড়ছে বার্লিনের দেওয়াল, পূর্ব জার্মানি পশ্চিম জার্মানি এক হতে চলেছে সব খবরই রাখেন শিবসুন্দর, অথচ কোনও ঘটনাই সে ভাবে স্পর্শ করে না তাঁকে। এই বিচ্ছিন্নতাও কি এক ধরনের আত্মকেন্দ্রিকতা নয়!

সাঁকো পেরোলেন শিবসুন্দর। বাড়ি এত দূর!

গেটের সামনে লোক দাঁড়িয়ে। দুধগঞ্জের হারান। শিবসুন্দর শ্রান্ত চোখে তাকালেন, কী? হারান হাত কচলাল, –মেয়ের খবরটা দিতে এসছিলাম ডাক্তারবাবু। জ্বর আর নাই। বেদনা কমে গেছে।

জলবসন্ত আর কদিন থাকে!…মামড়ি ওঠা শুরু হয়েছে?

হয়েছে ডাক্তারবাবু। শুকাচ্ছে।

এই সময়টা সাবধান। ঠাণ্ডা লেগে যেতে পারে। মেয়েকে সারাক্ষণ মশারির মধ্যে রেখো। পায়ে পায়ে দাওয়ায় উঠলেন শিবসুন্দর। জোরে জোরে দম নিলেন, নখ দিয়ে যেন না চুলকোয়, নিমডাল বুলোতে বোলো।

–খাবে কী ডাক্তারবাবু?…মেয়ের তো খুব ক্ষিধে।

 প্রোটিন ডায়েট। বলতে গিয়ে থেমে গেলেন শিবসুন্দর। বইয়ের কথা গ্রামদেশে চলে, অন্তত হারানদের মতো গরিব চাষিদের ঘরে তো না-ই। বললেন,যা মেয়ের ভাল লাগে তাই দিয়ো। পারলে একটু মুসুর ডাল সেদ্ধ, চারা মাছ…

–মাছ দেব? লোকে যে বলে…

–হ্যাঁ দেবে। আমি তো বলছি। কুসংস্কারকেই যেন ধমকে উঠলেন শিবসুন্দর। আড়চোখে তুফানদের ঘরের দিকে তাকালেন একবার। আলগাভাবে আগল টানা। অলকা কাছেপিঠে কোথাও গেছে বোধহয়।

শিথিল পায়ে দোতলায় উঠছেন শিবসুন্দর। রেলিঙ ধরে ধরে সিঁড়ি ভাঙছেন। ঘরে পৌঁছে পায়ের জোর নিঃশেষ। মশারি তুলে শুয়ে পড়লেন মনোরমার পাশে। আলগা হাতে ছুঁলেন স্ত্রীকে। নাহ, এখনই মরা চলবে না। মনোরমা যদি…!

শিবসুন্দরের চোখ বুজে এল। একবার শুধু মনে হল, পাখাটা চললে বেশ হত। কখন যেন একটা আলগা স্বপ্ন নেমে এল চোখে। কাঁসাই-এর ধারে হাঁটছেন দুজনে। হাওয়ায় উড়ছে যুবতী মনোরমার কেশরাশি, আঁচল পতপত নাচছে, গুনগুন গান গাইছেন মনোরমা। হঠাৎ এক কালো মেঘ এসে ঢেকে দিল চতুর্দিক, আঁধারে ছেয়ে গেল পৃথিবী।

শিবসুন্দর স্বপ্নের মধ্যেও চিনতে পারলেন মেঘটাকে। মৃত্যু।

ঘুম ভেঙে গেছে। নিঃসাড়ে শুয়ে আছেন শিবসুন্দর। ভাবছেন। পরজন্মেও কি মনোরমা তাঁর স্ত্রী হবে? ইশ, কেন যে পরজন্মে বিশ্বাস নেই শিবসুন্দরের!

তুফানের ডাকে সংবিৎ ফিরল, –অসময়ে শুয়ে আছ কেন? নিশ্চয়ই শরীর খারাপ?

শিবসুন্দর উঠে বসে চোখ রগড়ালেন, –গাটা একটু ম্যাজ ম্যাজ করছিল রে। শুলাম, চোখটা কখন জড়িয়ে এল।

–কেন লুকোচ্ছ বাবা? তোমার চোখ মুখ ভাল লাগছে না। তুফানের চোখ মশারির জালে সাঁটা, বাইরে এসো তো, প্রেশারটা মাপি।

–পাকামি করিস না। বাজে কটা? রাতের খাওয়া-দাওয়া হবে না?

–অলকা তো কখন থেকে বাবা বাবা করে ডাকছে। সাড়া না পেয়ে আমিই উঠে এলাম।

–যা। আমি আসছি।

 তুফান তবু দাঁড়িয়ে। চোখ সরু, সন্ধিগ্ধ।

শিবসুন্দর চোখ সরিয়ে নিলেন, –এক কাজ কর, অলকাকে তোর মার খাবারটা দিয়ে যেতে বল। তোর মাকে খাইয়ে আমি আসছি।

মনোরমাকে খাওয়ানোর পালা সাঙ্গ করে একটুক্ষণ ভাবলেন শিবসুন্দর। বুকের চিনচিন ভাবটা আর নেই, আবার সিঁড়ি ভাঙাটা কি খুব বিপজ্জনক হয়ে যাবে? মনে হয় না। নিশ্বাসের কষ্টটাও তো চলে গেছে। হয়তো সত্যিই তেমন কিছু হয়নি। দুপুরে চিংড়িমাছ রেঁধেছিল অলকা, হয়তো তাই খেয়ে বায়ু ধাক্কা মেরেছে হৃৎপিণ্ডে। বরং নীচে না নামলে তুফানের সন্দেহ বাড়বে আরও। ঘাবড়ে গিয়ে শুভকে খবর পাঠিয়ে দেওয়াও কিছু বিচিত্র নয়।

সাবধানী পায়ে নামলেন শিবসুন্দর। খাচ্ছেন। দুধ রুটি।

তখনই অলকা কথাটা তুলল, বাবা, মায়ার জন্য সত্যিই কি কিছু করা যায় না?

–কী করব?

মেয়েটা যা বলছিল…যদি দাদার ওখানে কিছু করে দেওয়া যায়। ও তো কাজকর্ম জানে না, তা নয়। ট্রেনিং আছে, অভিজ্ঞতা আছে..

–এক কথা আমাকে কেন বারবার বলছ? জানোই তো নার্সিংহোমের ব্যাপারে শুভকে আমি রিকোয়েস্ট করতে পারব না। একটা দুটো রুগী পাঠাই, শুভও তাদের কাছ থেকে পুরো টাকা নিতে পারে না, তাতেই আমার কী খারাপ লাগে।

তুফান খাওয়া থামিয়ে কঠোর চোখে তাকিয়ে আছে অলকার দিকে। অলকা তেমন গ্রাহ্য করল না। বলল, মেয়েটা সত্যিই কিন্তু খুব বিপদে পড়েছে বাবা। আপনি বেরিয়ে যাওয়ার পর কাঁদছিল।

শিবসুন্দর বিস্মিত হলেন, কী বিপদ?

কয়েকটা ছেলে ওকে খুব উত্যক্ত করছে। রামনগরের। হেলাবটতলায় স্টেশনারি দোকানটা আছে, তার সামনে আড্ডা মারে ছেলেগুলো। ওদের মধ্যে একজন তো কোয়ার্টারেও হানা দিয়েছিল। রাত্তিরবেলায়…মদ খেয়ে…বেচারা একা কোয়ার্টারে একটা বুড়িকে নিয়ে থাকে, সে আবার রাতের বেলা কেমন জবুথবু মেরে যায়…।

তুফানের চোখ ঝলসে উঠল, তুমি তো আমাকে আগে এ কথা বলেনি? কোন ছেলেটা? মায়া নাম বলেছে?

–তুমি জেনে কী করবে? মাথা-গরম মানুষ!

–কেটে রেখে দেব। পুঁতে ফেলব। মেয়েছেলের পেছনে লাগা! বিদেশ বিভূঁইয়ে একা থাকে…। ফোঁস ফোঁস শ্বাস ফেলছে তুফান, –আমি কালই সোমেনকে বলছি। এ সব কী ইল্লুতেপনা হচ্ছে!

–দেখেছেন তো বাবা কেন একে বলি না?

 শিবসুন্দর প্রমাদ গুনলেন। হাত তুলে বললেন, ঠিক আছে, দেখছি কী করা যায়। তুমি বরং মেয়েটাকে আমার সঙ্গে আর একবার দেখা করতে বলো।

–কিচ্ছু করতে হবে না বাবা। মায়া এখানেই চাকরি করবে। আমরা কি সব মরে গেছি! শিবসুন্দরের বুকটা আবার একটু চিনচিন করে উঠল। তুফানগঞ্জে শুনেছিলেন তুফানের বাবা নাকি জমি নিয়ে কার সঙ্গে লাঠালাঠি করতে গিয়ে মারা যায়। স্বামীকে বাঁচাতে গিয়ে তুফানের মাও জখম হয়েছিল জোর। তুফানগঞ্জের হেলথ সেন্টারে সেও…। বাবার গরম রক্ত কি ছেলের মধ্যে বইছে এখনও! এত কাল পরেও!

শিবসুন্দর তুফানকে শান্ত করতে চাইলেন। আলগা হেসে বললেন, –তোর তো দেখি খুব তেজ বেড়েছে রে! আমার ছেলে হয়েও এত রগচটা হলি কী করে বল তো? বয়স বাড়ছে, না কমছে?

তুফান মিইয়ে গেল। অপ্রস্তুত মুখে হাসছে।

টুকি খিলখিল হেসে উঠল, –আরও বকো বাবাকে। আরও বকো।

শিবসুন্দরও হাসছেন, –কেন রে বেটি?

বাবা বিকেলে হাটে গেল, আমাকে নিয়ে গেল না।

হাসিঠাট্টায় প্রসঙ্গটা তখনকার মতো চাপা পড়ে গেল। কিন্তু চিন্তাটা রয়েই গেল শিবসুন্দরের। অত রাগী চোখ ভাল নয়।

.

৫৪.

সূর্য সবে জেগেছে। এরই মধ্যে দশাশ্বমেধ ঘাট বেশ প্রাণচঞ্চল। কাঠের ছাতার নীচে বসে গায়ে তেল ডলছে ইয়া গুধারী দুই উত্তরপ্রদেশি। একটি রাজস্থানি পরিবার নেমে গেল জলে, কতা-গিন্নি বালবাচ্চা সমেত। তিন বাঙালি বিধবা গামছা কাঁধে বসে আছে ধাপিতে। এক মাদ্রাজি বৃদ্ধ স্নান সেরে নিবিষ্ট মনে কপালে ফোঁটা কাটছে। কোমর জলে দাঁড়িয়ে সূর্যস্তোত্র পাঠ করছে কয়েকজন। খানিক দূরে হেঁটমুণ্ড উপদ এক কৌপিনধারী সন্ন্যাসী। একজন মাথা পায়ে ঢুকিয়ে বসেছে হটযোগে। তিন-চারটে সাধু একটা নোংরা বোঁচকা খুলে কি যেন ঘাঁটছে। উত্তরবাহিনী গঙ্গার মধ্যিখান দিয়ে দুলতে দুলতে এগোচ্ছে এক বজরা, গেরুয়া জল সোনালি হয়ে কাঁপছে তিরতির। বজরার চালে বসে জনাকয়েক বিদেশি বিদেশিনী ছবি তুলছে মুভিতে। নিষেধ জেনেওঁ।

আদিত্য পাতলা চাদরটা গায়ে সাপটে উঠে দাঁড়াল। কাশীতে শীত এখন প্রায় নেইই, তবু ভোরবেলা গঙ্গার ধারে গা বেশ সিরসির করে, চাদর জড়ালে ভারি মিঠে আমেজ আসে একটা। উঠতে ইচ্ছে করে না আদিত্যর, কিন্তু উঠতেই হয়। তার হাতে এখন অনেক কাজ। গরম গরম মালাই-চা খেয়ে জিলিপির পাহাড় নিয়ে ফিরতে হবে হলিডে হোমে। ইরাদি মীরাদিরা এতক্ষণে জলখাবারের আয়োজন শুরু করে দিয়েছে। স্টোভ জ্বেলে, ময়দা মেখে, আলু কুটে রেডি। বাথরুম আর জলখাবারের পাট চুকিয়েই থলি হাতে বেরিয়ে পড়বে আদিত্য। হলিডে হোমের বাচ্চা চাকরটাকে দিয়েই বাজার সেরে ফেলা যায়, কিন্তু জামাই না করলে উমার মন ওঠে না। আটটা-সাড়ে আটটার মধ্যে বাজার না এসে পড়লে আদিত্যর শাশুড়ি আর মাসিশাশুড়ি উতলা হয়ে পড়েন খুব। রান্নাবান্না তাড়াতাড়ি শেষ না হলে কোথাও বেরোনোর প্রোগ্রামও করা যায় না। শাশুড়িদের এই কাজটুকু করে দিতে পারলে আদিত্য অনেকটা ঝাড়া হাত-পা।

ঘাটের লাগোয়া চা-দোকান। উনুনে আঁচ পড়ে গেছে বহুক্ষণ, অতিকায় এক কড়াইয়ে দুধ জ্বাল চলছে। শব্দ উঠছে বগবগ।

আদিত্য বাইরের বেঞ্চিতে বসে হাঁক পাড়ল, –চা লাগাও ভাই। সাত দিনেই আদিত্যকে চিনে গেছে দোকানদার। হেসে বলল, -মালাইঅলা চা তো?

–হাঁ। জাদা মালাইদার।

–সামোসা লিবেন? ইয়া নমকিন?

না না, তুমহারা নিমকি বহুত ঠাণ্ডা হ্যায়। বাসি। কাল খেয়ে অম্বল হয়ে গেছিল।

–তো সামোসাই লিন। বিলকুল গরম আছে।

পালোয়ান চেহারার দোকান-মালিক হুকুম ছুঁড়ছে বালক কর্মচারীকে। আদিত্য উদাস চোখে গঙ্গার দিকে তাকাল। রামনগর রাজবাড়ি এখনও আবছা। আলো পড়ে জল থেকে একটা ভাপ উঠছে। কলকাতার গঙ্গাতেও কি এ রকম ওঠে? দেখা হয়নি কোনওদিন। কাশীতে এসে ভোরে ওঠার অভ্যেস হয়েছে। কলকাতা ফিরেও অভ্যেসটা বজায় রাখতে হবে। ভোরবেলা একদিন ঘুরে আসবে বাবুঘাট থেকে। নিশ্চয়ই মন্দ লাগবে না।

চা-সিঙাড়া এসে গেছে। গ্লাসে চুমুক দিল আদিত্য। আহ সুখ! গায়ের কাছেই গেরুয়া পরা এক শ্মশ্রুগুধারী লোক, কেমন চোখে যেন দেখছে আদিত্যকে। নির্ঘাত হাত পাতবে।

আদিত্য বিরক্ত মুখে বলল, –কেয়া মাংতা ভাই?

দাড়িঅলা মুখ হাসিতে ভরে গেল, –তুই আদিত্য না?…আমাকে চিনতে পারছিস না? আমি পরিতোষ।

আদিত্য হাঁ করে তাকিয়ে।

–সেই যে রে, রামচন্দ্র স্কুলে পড়তাম…মনে পড়ছে না? তুই আমি আর শোভন রোজ টিফিনে… হাত থেকে চা চলকে গেল আদিত্যর। তাদের ক্লাসের সব চেয়ে বখাটে ছেলেকে এই চেহারায় দেখবে, এ কি ভাবা যায়! টিফিনে স্কুল পালিয়ে সিনেমা দেখার পাণ্ডা, বন্ধুদের বিড়ি সিগারেটের দীক্ষাগুরু কিনা গেরুয়া পরে কাশীর দশাশ্বমেধ ঘাটে!

আদিত্য উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল, তুই সাধু হলি কবে?

এ দিক ও দিক তাকিয়ে বেঞ্চিতে বসল পরিতোষ, ধূস, সাধু হব কেন? আমি তো এখানে চাকরি করি। রেলে।…রোববার রোববার সকালে এসে বসি এখানে। রামচরিত মানস পড়ি। দু চারটে ভক্ত আসে, শোনে, প্রণামীটনামি দেয়।

তাই বল। তুই তা হলে বদলাসনি! আদিত্য চোখ টিপল।

মানুষ কি আর বদলায় রে! সময় খোলসটাকে নিয়েই যা একটু..তা তুই এখানে উঠেছিস কোথায়?

কাছেই একটা চা কোম্পানির হলিডে হোমে। ওই হরসুন্দরী ধর্মশালার পাশে।

–উইথ ফ্যামিলি?

–ওই এক রকম। বউ আর ছেলেমেয়ে ছাড়া। পরিতোষকে কথার চালে একটু অবাক করে দিয়ে মজা পেল আদিত্য। হাসতে হাসতে বলল, শ্বশুর শাশুড়ি মাসিশাশুড়ি, দুই বয়স্কা শালী…

পরিতোষ ঘাটের দিকে তাকিয়ে উসখুস করছে। উঠে দাঁড়াল, –আমার লোকজন আসতে শুরু করেছে রে। চলি।…বিকেলে কি করছিস? চলে আয় না আমার বাড়ি। সোনেপুরায়।

আদিত্য নাক কুঁচকোল, –আজ বোধহয় হবে না রে। আজ একবার সকলকে নিয়ে সারনাথ যাওয়ার কথা আছে।

কাল আয়। অফিস থেকে ফেরার পথে আমি পাঁড়ে ধর্মশালার সামনে ওয়েট করব। চিনিস তো?

-হ্যাঁ। চিনি। কটায়?

–ছটা-সাড়ে ছটায়। দু পা এগিয়ে দাঁড়াল পরিতোষ, –আসিস কিন্তু। কত কথা যে জমে আছে। বন্ধুবান্ধব সব কোথায় বিছড়ে গেল…

পরিতোষ খাড়া হেঁটে একটা ছাতার তলায় গিয়ে বসল। পাঁচ-ছজন মহিলা পুরুষ প্রণাম করছে, পরিতোষ অস্বস্তিভরা চোখে আদিত্যর দিকে তাকিয়ে হাসছে মিটিমিটি। আদিত্যও দেখছিল পরিতোষকে। এ জীবনটা মন্দ না। বেশ কেমন বন্ধনহীন বন্ধনহীন ভাব। পরিতোষ কি বিয়ে করেছে? মনে হয় না। সংসারী মানুষ কি এভাবে হুট করে এসে গঙ্গার ধারে রামায়ণ খুলে বসে পড়তে পারে? আদিত্য পারবে? পারলে বোধহয় ভালই হত। তাও দু-চার পয়সা বাঁধা রোজগার থাকত।

বেলা বাড়ছে। ঘাটেও ভিড় বাড়ছে ক্রমশ। আদিত্য জিলিপির ঠোঙা নিয়ে উঠে পড়ল। হলিডে হোমে ফিরে দেখল ছোটখাট এক বিভ্রাট ঘটে গেছে। ইন্দ্রাণীর বেলামাসি ঘুমচোখে বাথরুমে যেতে গিয়ে পা মুচকে বসে আছেন, তাঁকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন উমাধীরাজ। আজকের মতো সারনাথ যাওয়ার দফা রফা।

আদিত্যর আফসোস হচ্ছিল। আগে জানলে আজ বিকেলেই পরিতোষের সঙ্গে চরকি মারা যেত! কোনও মানে হয়! এখন এদিক ওদিক ঘুরেফিরেই কাটাতে হবে বিকেলটা। একা একা একটু নৌকো চড়ে এলে কেমন হয়! শ্বশুরমশাইয়ের জলে বড় ভয়, রামনগরের রাজবাড়ির দিকে এখনও যাওয়া হয়নি। দেখা যাক। দেখা যাক।

হলিডে হোমে দুটো ঘর নেওয়া হয়েছে। এক ঘরে উমা ধীরাজ আর আদিত্য, অন্য ঘরে বেলামাসি ইরাদি মীরাদি। বেলা উমার আপন বোন নন, জাঠতুতো দিদি। বিধবা। ইরা মীরা তাঁরই ভাসুরের মেয়ে। দুজনেরই পঞ্চাশের ওপর বয়স, দেখতে একটু বেশি লম্বা চওড়া বলে দুই বোনের কারুরই বিয়ে হয়নি। ইরা এক প্রাইমারি স্কুলের হেড মিস্ট্রেস, মীরা রাইটার্সের সেকশান অফিসার। দুজনের চোখেই পৃথিবীর তাবৎ পুরুষমানুষ অপদার্থ। নেহাত ইনুর বর বলে আদিত্যকে খানিকটা ক্ষমাঘেন্না করে চলে তারা।

ধীরাজ স্থানীয় একটা ইংরিজি কাগজ উল্টোচ্ছেন। আদিত্য বাথরুম সেরে খাটে ফিরতেই জলখাবার হাতে ইরা হাজির, কি গো, তুমি শুয়ে পড়ছ কেন? বাজার যাবে না?

আদিত্য আড়মোড়া ভাঙল, –তাড়া কিসের দিদি? আজ তো আর বেরোনো নেই।

–কেন? আমরা তো বেরোতে পারি। কাকিমারা বাড়ি থাক, তুমি আমি আর মীরা সারনাথ ঘুরে আসতে পারি।

আদিত্যর আলস্য কেটে গেল। এই আশঙ্কার কথাটা তার মাথায় আসেনি। অথচ আসা উচিত ছিল। বুধবার চুনার যাওয়া হল, বেশি হাঁটাহাঁটি করতে হবে বলে ধীরাজ উমা আর বেলা থেকে গেলেন ডেরায়, এই দুই মহিলাকে নিয়ে ছুটতে হয়েছিল আদিত্যকে। বাপস, সে কী যন্ত্রণা! অত সুন্দর একটা দুর্গ, তিন দিক দিয়ে বয়ে যাচ্ছে গঙ্গা, সেদিকে দু বোনের নজর নেই, অবিরাম শুধু প্রশ্নবাণ আর প্রশ্নবাণ। বলো তো এই ফোর্ট প্রথম কে তৈরি করেছিল! তারপর কার হাতে আসে! তারপর কার হাতে আসে! আরে বাবা আদিত্য যদি অতই জানত, তাহলে কি আর বাপ্পা তিতিরের ইতিহাস ভূগোলের টিউটর লাগত! সারনাথ নিয়ে গিয়ে আদিত্যকে বোধহয় গেঁথেই ফেলবে দুই প্রৌঢ়া শ্যালিকা। আচ্ছা, সারনাথ কি বুদ্ধের জন্মস্থান? উঁহু, অন্য কি একটা কাজে যেন এসেছিলেন বুদ্ধ। কী কাজ? কী কাজ? দুর ছাই।

আদিত্য কাতর মুখে বলল, –বেলামাসিকে ছেড়ে যাব? ওঁর সারনাথ দেখার এত শখ!

কাকিমাদের নিয়ে নয় আর এক দিন যাবে। বেড়াতে এসে চুপচাপ বসে থাকার কোনও মানেই হয় না।

বসে আছে, না ঘেঁচু! ফাঁক পেলেই দিনে সাত বার করে বিশ্বনাথের মন্দিরে ছুটছে!

আদিত্য হাসি হাসি মুখে বলল, আজ আর কাল দুটো দিন নয় দেখি। পরশুও যদি বেলামাসি সুস্থ না হন… ।

ধীরাজ ফস করে বলে উঠলেন, –অত ছুটোছটি করারই বা কী আছে? দুটো দিন জিরোও না। আমারও আজ গা ম্যাজ ম্যাজ করছে।

আদিত্য টুক করে বলে উঠল, –আপনারা আজ বরং বিড়লা মন্দিরটা ঘুরে আসুন। রাজুকে বলে দিচ্ছি, ও বিকেলে আপনাদের রিকশা ডেকে দেবে।

ইরা কথা না বাড়িয়ে চলে গেল। শ্বশুরমশাইকে মনে মনে ধন্যবাদ জানিয়ে লুচি ছিঁড়ল আদিত্য। প্রশ্ন করার জন্যই প্রশ্ন করল, আপনার জন্য আজ কী আনব বাবা?

–যা ভাল বোঝো এনো। তুমি হলে গিয়ে এখন আমাদের গার্জেন।

–তবু আপনার কী খেতে সাধ যায়?

–বেগুন আনতে পার। কাশীর বেগুন খুব ভাল।

–সে তো আনবই। মাছ কী খাবেন?

–ছোট ছোট পুঁটি কি পাওয়া যাবে এখানে?

আদিত্য একটু বিপাকে পড়ল। জন্মে কোনওদিন বাজারে যায়নি সে, রুই কাতলা ইলিশ চিংড়ির বাইরে অন্য কোনও কাঁচা মাছ সে চেনেই না। তবু ভারিক্কি চালটা বজায় রাখল, –দেখি, পেলে আনব।

ধীরাজ কাগজ মুড়ে পাশে রাখলেন, –আচ্ছা বাবা, তোমাকে কদিন ধরেই একটা কথা জিজ্ঞেস করব ভাবছি, রোজই ভুলে যাই।

কী বলুন তো?

–তোমাদের বাড়ি তো ভাঙা পড়ছে, যদ্দিন না নতুন বাড়ি হয় তদ্দিন তোমরা থাকবে কোথায়?

উমা থলি হাতে ঘরে ঢুকলেন। প্রশ্নের শেষ অংশ তাঁর কানে গেছে। বললেন, –মাঠে থাকবে। গাছতলায়। হল তো?

-যাহ, এক বছর ধরে গাছতলায় থাকবে? অত মালপত্র নিয়ে? ওদের বাড়ির দিকে তো তেমন মাঠও দেখিনি!

আদিত্য হেসে ফেলল, না বাবা। মা আপনার সঙ্গে ঠাট্টা করছেন। আমরা তদ্দিন বাড়ি ভাড়া করে থাকব।

তাই বলো। ধীরাজ নিশ্চিন্ত। জানলার ওপারে খানিকটা ফাঁকা জমি। ঘেরা। ব্যায়ামের আখড়া। দশ-বারো জন ডন বৈঠক করছে সেখানে। ঝুরোমাটিতে কুস্তি লড়ছে দুই পালোয়ান। কয়েক জন মুগুর ভাঁজছে। সে দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছেন ধীরাজ।

উমার সঙ্গে অন্য ঘরে উঠে এল আদিত্য। বেলামাসি আধশোয়া হয়ে কোঁকাচ্ছেন। মীরা কোমরের ব্যথায় ভোগে, হটওয়াটার ব্যাগ রাখে সঙ্গে। গরম জল ভরছে সেই ব্যাগে।

আদিত্য বলল, –আপনার জন্য একটা মলম আনব মাসি?

–কি মলম?

 –আয়ুর্বেদিক। দু-তিনবার লাগালেই যন্ত্রণা একদম কমে যাবে।

–এনো। বিদেশ বিভূঁইয়ে এসে অচল হয়ে পড়লে যে কী বিশ্রী লাগে!

সাধ্য মতো পরিপাটি বাজার সেরে দশটা নাগাদ ফিরল আদিত্য। আজ মেয়েদের কারও গঙ্গাস্নানে যাওয়ার ইচ্ছে নেই, আদিত্য নিশ্চিন্তে বেরিয়ে পড়ল রাস্তায়। ইন্দ্রাণীকে পৌঁছনো সংবাদ লেখা চিঠিটা কদিন ধরেই পকেটে পকেটে ঘুরছে, মনে করে পোস্টবক্সে ফেলল। তারপর আর কাজ নেই। প্রাণের সুখে টোটো করে বেড়াও। এ শহর তার সম্পূর্ণ অচেনা নয়, কলেজে পড়ার সময়ে চার বন্ধু হরিদ্বার দেরাদুন মুসৌরি বেড়াতে গিয়েছিল, ফেরার পথে ব্রেক জার্নি করে নেমেছিল এখানে। ছিল দিন তিনেক। ধর্মশালায়। তখন সে ছিল মুক্ত বিহঙ্গের মতো স্বাধীন, অথচ তেমনভাবে তখন ঘোরা হয়নি শহরটা। তাদের দলপতি হিতেশ ছিল মহা তাসাড়। সারাদিন ধর্মশালার ঘরে বসে তাস খেলত। আদিত্যরও নেশা ধরেছিল খুব, সেও মহানন্দে স্বেচ্ছাবন্দি সারাদিন। এবার বুড়োবুড়িদের দায়িত্ব ঘাড়ে নিয়েও আদিত্য অনেক খোলামেলা রয়েছে। কী খাওয়া হবে, কোথায় যাওয়া হবে, সব কিছু নিয়েই ধীরাজ উমা তার সঙ্গে পরামর্শ করেন, তাকে মান্য করেন, তার ওপর নির্ভর করেন, এতেই বুকটা ভারি হালকা লাগে আদিত্যর। কেউ নির্ভর করছে ভাবলে কি মুক্তির স্বাদ বাড়ে? জীবনে একটি বারের জন্য যদি বুঝতে পারত ইন্দ্রাণী তার ওপর নির্ভর করতে চায়, তা হলে কি তার জীবনের চেহারাটা এমন হত!

আদিত্য ভেবে পায় না। ভাবতে ভালও লাগে না তার। ইন্দ্রাণীর ওপর অভিমান, বাবার মৃত্যুর আঘাত, কটা দিন তাকে নিশ্চেতন করে রেখেছিল। সে দশা কেটে গেছে অনেকটাই। ইন্দ্রাণীর স্পর্শেই এত জাদু! হঠাৎ সে রাতে ইন্দ্রাণী যেন গহীন এক খাদ থেকে আলোয় উঠিয়ে নিয়ে এল আদিত্যকে।

এটা কি স্থায়ী হতে পারে না!

রাস্তায় দাঁড়িয়ে নাদা ছড়াচ্ছে বাবা বিশ্বনাথের ষাঁড়। নিস্পৃহ চোখে দেখছে আদিত্য। দুটো দেহাতি লোক কি নিয়ে যেন হাতাহাতি করছে রাস্তায়। নিরুত্তাপ চোখে দেখছে আদিত্য। হাঁটছে। দেখছে। হাঁটছে। এলোমেলো রাস্তা বেয়ে ঢুকে পড়ছে অন্ধকার গলিতে। কোনও এক নির্জন ঘাটে গিয়ে বসে আছে চুপচাপ।

সকাল গড়িয়ে দুপুর। মাথার ওপর ঠাঠা সূর্য।

 ফেরা। ক্লান্ত ফেরা। অবসন্ন ফেরা।

.

বিকেলে একটা ছোট্ট নাটক ঘটে গেল। নাটক, না দুর্ঘটনা তাও ঠিক বুঝতে পারল না আদিত্য।

বিকেলে উমা ধীরাজকে নিয়ে বেরিয়েছিল। এমনিই হাঁটা। কেদার ঘাটে গিয়ে বসে ছিল তিনজনে। ঘাটটা নিরিবিলি। পুণ্যার্থী ভ্রমণার্থীর ভিড় বিশেষ নেই। ঘাটের ধারে বাঁধা এক নৌকো, মাঝিবিহীন। এক সন্ন্যাসী পিছন ফিরে স্নান করছে নদীতে, উঠছেই না। মৃদুমন্দ বাতাস বইছিল।

তিনজনে কথা বলছিল টুকটাক। অসংলগ্ন কথা। অদরকারি কথা। সংসারের কথা। ছেলেমেয়ের কথা। আদিত্য মাঝেমাঝেই অন্যমনস্ক। নাকি দূরমনস্ক?

আলো কমে আসছিল।

হঠাৎই উমার বাগবোধ হয়ে গেল। আচম্বিতে দৃষ্টি স্থির। পরক্ষণেই বিস্ফারিত চোখে চিৎকার করে উঠেছেন, –ও কে? ও কে আদিত্য?

আদিত্য ঘুরে দেখল সাধুটি জল থেকে উঠে গা মুছছে। খানিকটা নীচে দাঁড়িয়ে। অবাক মুখে

বলল, কার কথা বলছেন?

–ওই যে ও! ও তো তনু। আমার তনু। বলেই উঠে দাঁড়ালেন উমা। কম্পিত স্বরে ডাকলেন, –তনুউ…অ্যাই তনু?

ধীরাজও চমকে তাকিয়েছেন সন্ন্যাসীর দিকে। সন্ন্যাসীর কোনও ভ্রূক্ষেপই নেই। ঝোলা থেকে শুকনো কাপড় বার করছে।

আদিত্যকে হতচকিত করে দিয়ে উমা দ্রুত ছুটে গেলেন তার দিকে। টলমল পায়ে সিঁড়ি ভাঙছেন। সন্ন্যাসীর কাছে গিয়ে তার দুই বাহু চেপে ধরলেন, আমায় চিনতে পারছিস না তনু? আমি তোর মা।

সন্ন্যাসী প্রাণপণে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। পারছে না।

আদিত্য তরতরিয়ে নেমে এল। ভাল করে দেখল সাধুটিকে। একেবারে বাচ্চা। বড় জোর বাপ্পার বয়সী হবে। মুখে একটা তনুর আদল আছে বটে। অনেকটা সেরকমই লম্বাটে মুখ, চওড়া কপাল, গালভরা দাড়ি, মাথায় ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া বাদামি চুল।

আদিত্য টেনে সরাতে চাইল উমাকে, আপনি ভুল করছেন মা। এ তনু হতে যাবে কেন?

–আমার ছেলেকে আমি চিনতে ভুল করব? তনু লক্ষ্মী বাবা, ঘরে ফিরে চল। আমি, তোর বাবা, কত দিন ধরে তোর পথ চেয়ে আছি। ওই যে তোর বাবা, ওই দাঁড়িয়ে। দ্যাখ তোর শোকে কেমন হয়ে গেছে!

ছোকরা সন্ন্যাসী নির্ঘাত অবাঙালি। এক বর্ণ ভাষা বুঝছে না উমার। ফ্যালফ্যাল তাকাচ্ছে।

উমা আবার তার হাত আঁকড়ে ধরলেন, –আর আমাদের কষ্ট দিস না তনু। একবার দ্যাখ ভাল করে।

এক বয়স্কা মহিলা তরুণ সাধুর হাত ধরে টানাটানি করছে, সাধু জোর করে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। নিজেকে, এমন দৃশ্যে মাটি খুঁড়ে ভিড় জমে যায়। গেছেও। কৌতূহলী চোখে দেখছে সকলে। ধীরাজ কিংকর্তব্যবিমূঢ়।

আদিত্য বিচলিত বোধ করছিল। নিজে অজস্র সিন ক্রিয়েট করেছে জীবনে, কিন্তু এমন দৃশ্য তার পছন্দ নয়। মরিয়া হয়ে ধমক লাগাল, কী হচ্ছে কি মা! আপনি একটু শান্ত হন। বুঝছেন না, এ তনু হতে পারে না। তনু যদি আজ বেঁচেও থাকে, সে কি আর এমন খোকাটি আছে? তারও তো অ্যাদ্দিনে পঁয়ত্রিশ ছত্রিশ বছর বয়স হয়ে গেছে। ছেড়ে দিন ওকে।

ধমকে কাজ হল। সন্ন্যাসীকে ছেড়ে দিয়ে ধাপিতে বসে পড়লেন উমা। দু হাতে মুখ ঢেকে বসে আছেন। শরীর কাঁপছে থরথর।

ছোকরা সন্ন্যাসী ছাড়া পেয়েই বোঁচকাকুঁচকি নিয়ে দৌড় লাগিয়েছে। ভিড় ক্রমে পাতলা হয়ে গেল। এক পা এক পা করে নামছেন ধীরাজ। উমার পাশে গিয়ে বসে পড়লেন। আলগা হাত রাখলেন স্ত্রীর মাথায়। মৃদু স্বরে বললেন, –তবে যে বলো তুমি উতলা হও না! তুমি ওকে ভুলে গেছ!

সন্তানহারা বাবা-মা বসে আছেন পাশাপাশি। সূর্য ডুবে এল। ছায়ায় ঢেকে যাচ্ছে ঘাট। গঙ্গার জলে একটা শব্দ হচ্ছিল চাপা। গোঙানির মতো।

হলিডে হোমে ফিরেই উমার ধুম জ্বর। কুটোটি কাটলেন না দাঁতে, চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়েছেন। বেলামাসি ইরাদি মীরাদিরাও শশব্যস্ত। আদিত্যরও চোখে ঘুম নেই সারা রাত। জলপট্টির পর জলপট্টি পাল্টাচ্ছে। পাশে আর এক জন মানুষও নিশূপ। মাঝে মাঝে শুধু এক উদ্বিগ্ন স্বর শোনা যায়, –কেমন বুঝছ আদিত্য?

সকালে ডাক্তার ডাকতেই হল। ওষুধ ইঞ্জেকশান পড়তে দুপুর নাগাদ নেমে এল জ্বরটা। ঘুমিয়ে পড়লেন উমা।

সন্ধেবেলা পরিতোষের সঙ্গে দেখা করার কথা মনেই রইল না আদিত্যর। ইরা মীরা সেবা করছে বয়স্ক মানুষদের, আদিত্য একা বেরিয়ে পড়ল পথে। ভার বুকে হাঁটতে হাঁটতে সোজা কখন মণিকর্ণিকার ঘাট।

শ্মশানে আজ শবদেহের লাট লেগে গেছে। সার সার জ্বলছে চিতা। লালচে আগুন দুলছে হাওয়ায়। পুটপুট আওয়াজ উঠছে। হঠাৎ হঠাৎ ঠিকরে যাচ্ছে আগুনের ফুলকি। মানুষপোড়া গন্ধে ম ম করছে জায়গাটা।

কেন এখানেই এসে বসল আদিত্য? এই সার সার জ্বলন্ত চিতার মাঝে? আদিত্য জানে না। অসাড় মনে বসে আছে শুধু। তনুময় কি সত্যিই বেঁচে আছে? বেঁচেই যদি থাকে, এই আঠেরো বছরে একটাও কি খবর পাঠাত না? কেন চলে গিয়েছিল তনুময়? শুধুই রাজনৈতিক ব্যর্থতার যন্ত্রণা! এ কেমন ধরনের স্বার্থপরতা! বাবা-মার কথাও একবারও মনে পড়ে না!

তনুময়ের মুখটা মনে করার চেষ্টা করছিল আদিত্য। আশ্চর্য, তনুময়ের মুখ ভাবতে গেলে বাপ্পার মুখ চোখে ভাসে কেন! ওটা কি বাপ্পারই মুখ, নাকি ওটা আদিত্য নিজেই! গুলিয়ে যাচ্ছে, সব গুলিয়ে যাচ্ছে।

পাশেই ছোট্ট জটলা। এক সাধু কলকে ফাটাচ্ছে, তাকে ঘিরে গুটিকতক চ্যালাচামুণ্ডা। আদিত্য ঝট করে উঠে তাদের পাশে গিয়ে বসল। হাতে হাতে নিঃশব্দে ঘোরা কলকেতে টান লাগিয়েছে জোর। গাঢ় ধোঁয়া ঘুরে ঘুরে চরকি মারছে মাথায়। কোত্থেকে যেন একটা রাগ কুণ্ডলী পাকাচ্ছে বুকে। তনুময়ের ওপর রাগ। বাপ্পার ওপর রাগ। নিজের ওপর রাগ।

পরপর কয়েকটা টানে মাথা সম্পূর্ণ ফাঁকা হয়ে গেল। গনগনে আগুন সামনে রেখে আদিত্য নিষ্পলক বসে আছে। লাল চোখে। রাত বাড়ছিল।

.

৫৫.

সকাল থেকে বেশ গরম পড়েছে আজ। চিড়বিড়ে, শুকনো গরম। তেমন একটা ঘাম হয় না, শুধু তাপেই শরীর ঝলসে যায়। ফাল্গুনের শেষাশেষি কদিন খুব মেঘ করেছিল, বৃষ্টিও হয়েছিল দু-তিন দিন। মুষলধারে নয়, আবার একেবারে টিপটিপও নয়। সেই যে মেঘের পাল ঝরে মরে চলে গেল, দু হপ্তা ধরে আকাশও ফুটন্ত কড়াই। সন্ধেবেলা এ শহরে এখন একটা মনোরম বাতাস বওয়ার কথা, সেই দখিনা বাতাসও যে এবার কোথায় গেছে! ঘোট ঘোট ধুলোর ঘূর্ণি ওঠে হঠাৎ হঠাৎ, কিন্তু তাতে তাপ কমে কই!

গড়িয়ার চেম্বারে বসে রুগী দেখছিল শুভাশিস। চেম্বার মানে আট বাই আট পার্টিশান করা খুপরি। প্রতিটি খুপরিতে ডাক্তার আর রুগীর জন্য গোটা তিনেক চেয়ার, মাঝারি সাইজের একটা টেবিল। পিছন দিকের রুগী পরীক্ষা করার বেঞ্চি-মতন টেবিল লম্বায় এত ছোট যে হঠাৎ কোনও জবরদস্ত পাঠান এলে প্লাইউডের পার্টিশান সরাতে হবে। ডান দিকের পার্টিশানের ওপারে আজ এক ডারমাটোলজিস্টের বসার দিন, সে রুগী দেখে চলে গেছে বিকেলে। বাঁয়ে জেনারেল ফিজিশিয়ান রতিকান্ত পাইন, তার চেম্বার রুগীতে থিক থিক করছে।

শুভাশিসের আজ পেশেন্টের সংখ্যা মাত্র চার। এই চেম্বারটায় ইদানীং তেমন আর পেশেন্ট হচ্ছে না শুভাশিসের। কোনওদিন তিন, কোনওদিন দুই। সে তুলনায় নর্থের চেম্বার এখনও বেশ পয়মন্ত, ছ সাতজন তো হয়ই। কিছুদিন ধরেই এই চেম্বারটা উঠিয়ে দেওয়ার কথা ভাবছে শুভাশিস। তাতেও সমস্যা। রাতারাতি উঠিয়ে দিলে পশারের ক্ষতি হতে পারে। এক সময়ে দুদিন করে বসত এখানে, বছর খানেক হল কমিয়ে সপ্তাহে একদিন করেছে। এবার পনেরো দিনে একদিন করতে হবে। তারপর মাসে একদিন। তারপর ধীরে ধীরে…

দু নম্বর পেশেন্টের এক্সরে প্লেট ভিউবক্সে মেলে ধরল শুভাশিস। রাজপুরের ডাক্তার অরবিন্দ গুহর পাঠানো কেস। ক্রনিক কোলেসিসটাইটিস। পিত্তাশয়ের বারোটা বাজিয়ে ফেলেছেন মহিলা। শুভাশিস একবার অপাঙ্গে দেখল মহিলাকে। প্রৌঢ়া বিধবা। নির্ঘাত মাসে আঠাশটা উপোস করার অভ্যেস। কেন যে করা!

ভিউবক্সের বাতি নিবিয়ে মহিলার সঙ্গী যুবকটির মুখোমুখি হল শুভাশিস, আপনার মা?

আজ্ঞে হ্যাঁ ডাক্তারবাবু।

বাবা কদ্দিন মারা গেছেন?

–এই জুনে চার বছর হবে।

 অর্থাৎ চার বছর হল মাছ মাংস ছেড়েছেন মহিলা। নিশ্চয়ই আমিষ খেতে খুব ভালবাসতেন এক সময়ে। কী যে সংস্কার! অনর্থক শরীরকে কষ্ট দেওয়া। অস্থিমজ্জায় মিশে যাওয়া অভ্যেস হঠাৎ পালটাতে গেলে শরীর তো তার বদলা নেবেই। কোনও না কোনওভাবে। শুধু শরীর কেন, মনই কি ছাড়ে! তিন মাস ধরে যে অনভ্যস্ত অভ্যাসে রপ্ত হতে চাইছে শুভাশিস, মন কি তার জন্য ছেড়ে কথা বলছে!

শুভাশিস আলট্রাসোনোর ফিলমে চোখ রাখল, খাওয়ার টাইমের খুব অনিয়ম করেন নিশ্চয়ই?

 মহিলার মুখে অপ্রতিভ হাসি, সংসারে কাজকর্ম তো থাকেই। ছেলে, ছেলের বউ দুজনে অফিস বেরিয়ে যায়, নাতিটা স্কুল থেকে ফেরে সেই দুটোয়, তারপর তাকে নাইয়ে খাইয়ে…

–তোমাকে কে অতক্ষণ বসে থাকতে বলে মা? আগে খেয়ে নিলেই পারো।

–আহা, ওইটুকু শিশুর আগে আমি খেয়ে নেব?

যত সব ফালতু অজুহাত। কথা না শুনে এখন যে রোগটা বাধিয়ে বসে আছ, তার কী হবে! অপারেশানের ধাক্কা সামলাও এখন।

কঠোর মুখে যুবকটিকে দেখল শুভাশিস। চেম্বারের মধ্যে এই সব কথার চাপান উতোর তার একদম পছন্দ নয়। অপারেশানের ধাক্কা বলতে কী বোঝাতে চায় ছোকরা? মার শরীর নিয়ে ভাবছে, না টাকা?

ভারী মুখে শুভাশিস প্রশ্ন করল, — ডক্টর গুহ যে ওষুধগুলো দিয়েছিলেন তাতে পেন কমেছে?

মহিলা সোজা হয়ে বসেছেন, – ব্যথা এখন অনেক কমে গেছে ডাক্তারবাবু। শুধু খাওয়া দাওয়ার পরই যা একটু…

ঝুপ করে আলো নিবে গেল। লোডশেডিং। গরম পড়ার পর থেকেই ঘন ঘন কারেন্ট যাওয়া শুরু হয়েছে। শহরটার আর কোনও উন্নতি হল না, জঙ্গলই রয়ে গেল। মার্চ না ফুরোতেই যদি এই দশা হয়, মে-জুনে কী হবে?

মৃদু হট্টগোল হচ্ছে বাইরে। রতিকান্তর রুগীদের বৃন্দরব। হঠাৎ আঁধারে নিজেকে কেমন অন্ধ মনে হচ্ছিল শুভাশিসের। হাঁক পাড়ল, কার্তিক, অ্যাই কার্তিক…?

কার্তিক এই খুপরিঅলা চেম্বারগুলোর পাহারাদার। সময়মতো খোলে, বন্ধ করে, ঝাড়পোঁছ করে, ছোটখাট ফাইফরমাশও খাটে ডাক্তারদের। সে বাইরে থেকে সাড়া দিল, –আসছি স্যার।

–এসে কী হবে? জেনারেটার কী হল?

স্টার্টিং-এ প্রবলেম হচ্ছে স্যার। দেখছি।

কোনও মানে হয়! গরমে পচে মরো। শুভাশিসের মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে গেল। পাশের খুপরিতে টুকুস করে আলো জ্বলে উঠেছে। রতিকান্তর এমার্জেন্সি লাইট। নিজস্ব। বেকবাগান ল্যান্সডাউন চেম্বারের মতো এখানেও শুভাশিসের একটা আলো রাখা উচিত ছিল। কেন যে রাখেনি!

রতিকান্ত পাইন গাঁক গাঁক করে কথা বলছে রুগীর সঙ্গে, রাতে কবার পেচ্ছাপ হয়? … দুবার? মাত্র? … স্টুলের কালারটা দেখেছেন? … হলদেও নয়, ব্ল্যাকও নয়! তার মানে বাদামি! … ইয়্যাঁ, কালচে বাদামি! … কবার যান দিনে? … আম পড়ে?…

শুভাশিসের মেজাজ আরও বিগড়ে গেল। পাইনটা চাষাড়েই রয়ে গেল। রুগীর চিকিৎসা করছিস, না পাড়াপ্রতিবেশীর খবর নিচ্ছিস! নাহ, চেম্বারটা ছাড়তেই হবে। অধৈর্যভাবে নিজের টর্চটা বার কয়েক জ্বালাল নেবাল শুভাশিস। ঘড়ঘড়ে গলায় চেঁচাল, মোমবাতি আনছিস? নাকি তাও জুটবে না?

ঘরে মোমবাতি জ্বলার পর স্নায়ুকে নিয়ন্ত্রণে আনল শুভাশিস। ছোকরাটি স্যাস ক্লিনিকেই মায়ের অপারেশন করাতে চায়, সাত দিন পরে সেখানে নিয়ে আসতে বলল পেশেন্টকে। জরুরি নির্দেশও দিয়ে দিল কয়েকটা। কিছু রুটিন ব্লাড টেস্ট, ই সি জি, চেস্ট এক্সরে, এই সব। টেটভ্যাকও নিয়ে নিতে বলল। পরের রুগীটি পোস্ট অপারেটিভ চেকআপে এসেছে, পাঁচ মিনিটে ছেড়ে দিল তাকে। শেষজনের রেকারেন্ট অ্যাপেনডিসাইটিস। অল্পবয়সী ছেলে, মাঝে মাঝেই পেটের ডান দিকে সাব অ্যাকিউট পেন হচ্ছে, ছেলেটাকে বেরিয়াম মিল এক্সরে করে আনতে বলল, ওষুধও লিখে দিল কয়েকটা।

রুগীদের বিদায় করে একটা সিগারেট ধরাল শুভাশিস। এবার উঠবে। এখন নার্সিংহোম ছুঁয়ে বাড়ি ফেরা। তার আগে চার পেশেন্টেরই নামঠিকানা স্লিপ থেকে তুলে নিচ্ছে ডায়রিতে। অভ্যেস।

খুপরিতে ছায়া পড়ল। সুইংডোর ঠেলে ঢুকেছে কে যেন। চোখ তুলতেই শুভাশিসের হৃৎপিণ্ড চলকে উঠল। তুমি!

সাদা খোলের ওপর ছোট ছোট বুটিঅলা তাঁতের শাড়ি পরেছে ইন্দ্রাণী। সম্ভবত নীল বুটি, আঁধারে কালচে লাগে। ঘাড়ের কাছে ভাঙা খোঁপা, কপালে চাকা টিপ। মোমবাতির কাঁপা আলোয় কেমন যেন অলৌকিক লাগছে ইন্দ্রাণীকে। জীবনে এই প্রথম শুভাশিসের কোনও চেম্বারে এল ইন্দ্রাণী।

ইন্দ্রাণীকে বসতে বুলতেও ভুলে গেছে শুভাশিস। ইন্দ্রাণী নিজেই চেয়ার টেনে বসল, — চমকে গেছ তো?

এই মুহূর্তে চমকে যাওয়া শব্দটা কি খুব অকিঞ্চিৎকর নয়? যে প্রমত্ত গতিতে রক্তকণিকারা ছুটে বেড়াচ্ছে শুভাশিসের শরীরে, তাকে ঠিক কী বলে এখন?

–তুমি আসছ না কেন? কী হয়েছে তোমার?

–কিছু না তো। শুভাশিস সামলে উঠছে ধীরে ধীরে। চোয়ালে চোয়াল চেপে হাসল, সময় পাচ্ছি না। … এত কাজের চাপ। … এই তো লাস্ট উইকের আগের উইকে কদিনের জন্য চণ্ডীগড় যেতে হল। কনফারেন্সে। মাঝে অরূপ-শালিনী ছিল না, একা নার্সিংহোম সামলাতে হচ্ছিল…

–এত ব্যস্ত, একটা ফোন করারও সময় পাচ্ছ না?

 হাস্যকর অজুহাত বেশিক্ষণ টিকিয়ে রাখা যায় না। ইন্দ্রাণীকে না জানিয়ে কবে কোন কাজটা করেছে শুভাশিস! এই সতেরো বছরে! এক দিনের জন্য মাধবপুর গেলেও ফোন করে জানাতে ভুল হয়নি।

শুভাশিস চোখ নামিয়ে নিল। গলার স্বর অস্বাভাবিক নেমে গেছে হঠাৎ, – তুমিও তো ফোন করে একটা খোঁজ নাওনি।

–নিইনি? তুমি শিওর?

শুভাশিস একটু ধাঁধায় পড়ে গেল। হোঁচট খেয়ে বলল, দীপু অবশ্য একদিন ফোন করেছিল।… বিলিভ মি, পরদিন আমি খুব বিজি ছিলাম। একটা জরুরি কাজে কলকাতার বাইরে…। পলকের জন্য নদীতে নেমে আসা গাছগুলো মনে ভেসে উঠল শুভাশিসের। বাতাসের একটা সর সর ধ্বনিও শুনতে পেল যেন। ছবিটা বুক থেকে মুছতে চেয়ে হাসল একটু, তোমাদের বাড়ি ভাঙার ব্যাপারে আমি থেকেই বা কী হত? ওটা তোমাদের ফ্যামিলি ম্যাটার। সেখানে কি অ্যাম আই দ্যাট ইম্পর্টেন্ট?

–ইম্পর্টেন্ট নও?

–হু দা হেল আই অ্যাম? বলব না বলব না করেও কথাটা মুখ থেকে বেরিয়ে গেল শুভাশিসের, তোমাদের ফ্যামিলিতে কী হচ্ছে না হচ্ছে, তোমার ছেলে কী ভাবে ট্রেনিংএ গেল, তার টাকা জোগাড় করতে গিয়ে তুমি তোমাদের বাড়ি স্টেক করলে কি না করলে, এ সবে আমার ইনট্রুড করার সত্যিই কি কোনও অধিকার আছে?

ইন্দ্রাণী নিষ্পলক দেখছে শুভাশিসকে। বেশ কয়েক সেকেন্ড স্থির তাকিয়ে থেকে বলল, তুমি কি আমার ওপর রাগ করেছ শুভ?

শুভাশিস মনে মনে বলল, তোমার ওপর রাগ করে কী লাভ রানি? তুমি তো একটা পাথর। ইট কাঠ পাথরের ওপর রাগ করলে রাগটা আঘাত হয়ে নিজের কাছেই ফিরে আসে। মুখে বলল, কীসের রাগ? তোমার ওপর রাগ করার আমি কে?

ইন্দ্রাণী চুপ। মোমের আলো তার চিবুক ছুঁয়ে আছে, পাণ্ডুর বিভায় ছেয়ে গেছে মুখমণ্ডল। বড় শুকনো, বড্ড রোগা দেখাচ্ছে ইন্দ্রাণীকে।

কেন এখনও টানে ওই নারী? কেন?

সম্মোহিত শুভাশিস মুখ ঘুরিয়ে নিল, তোমার কি আর কোনওভাবেই প্রয়োজন আছে আমাকে? আমি তো তোমার কাছে সিম্পলি একটা আউটসাইডার।

–এভাবে বলছ কেন?

বলছি। বলার মতন কারণ ঘটেছে, তাই। তোমার ছেলের জন্য টাকা দরকার সেটুকু আমাকে জানাতেও তোমার ইগোতে লাগে। অথচ ইউ ক্যান অ্যাপ্রোচ অ্যা টম ডিক হ্যারি।

–আমি তোমার সঙ্গে ঝগড়া করতে আসিনি শুভ।

ঝগড়া নয়, লেট মি সে সাম হার্ড ফ্যাক্টস। তুমি শ্বশুরবাড়িতে স্বামী দেওর ছেলেপুলে নিয়ে পবিত্র গণ্ডির মধ্যে বসে আছে, আর আমি ব্যাটা রাবণ কেন ভণ্ড সন্ন্যাসী সেজে অনন্তকাল সেখানে হানা দিয়ে যাব?

–শুভ প্লিজ, তোমার আমার সম্পর্কের মধ্যে আর কাউকে টানছ কেন? একটু বোঝার চেষ্টা করো। তোমাকে আমি কিছুই দিতে পারি না, আমি কী করে বার বার তোমার কাছে হাত পাতি?

ভালবাসার মধ্যেও কি বিনিময় প্রথা আছে? শুভাশিস ভেবে পাচ্ছিল না। নিজেকে খুঁড়ে বুঝতে চাইছিল কোথায় লুকিয়ে আছে এই ধারণার বীজ? প্রত্যাশাহীন আত্মসমর্পণ কি ভালবাসার শর্ত নয়? কিন্তু নিজেও কি সে তা মানে? তার নিজের মধ্যেও তো এক চতুর হিসেবি মানুষ অবিরাম নিক্তি ধরে দাঁড়িয়ে আছে। পাল্লা কোনও দিকে এতটুকু হেলবার উপায় নেই। এই অহংবোধই তাকে মানুষ করেছে। এখানেই সে পশুদের থেকে আলাদা। তাই যদি হয় তবে ইন্দ্রাণীর অহংবোধকে, অস্বীকার করার তার উপায় কোথায়?

রতিকান্ত বাজখাঁই গলায় দাবড়াচ্ছে কোনও রুগীকে। অন্ধকার যেন খানখান হয়ে যাচ্ছে চিৎকারে। কেঁপে কেঁপে উঠছে পার্টিশান। বাইরে জেনারেটারটা একবার ঢ ঢ শব্দ করেই বন্ধ হয়ে গেল। মোমবাতি গলে গলে প্রায় শেষ।

ইন্দ্রাণীর স্বর আরও খাদে নেমে গেছে, কটা দিনে তুমি অনেক বদলে গেছ শুভ। এতক্ষণ এসেছি, একবারও তো কই তোমার মেয়ের কথা জিজ্ঞেস করলে না?

শুভাশিস দু হাতে মুখ ঢেকে ফেলল। চোখের সামনে আবার সেই নদী। নদী, না সমুদ্র? জলে তার অর্ধেক ডুবে থাকা গাছ। সর সর বাতাস। ঘন কালো ছায়া। ছায়া, না গুহা? কোথায় চলেছে– নৌকো?

চোখে কেন জল আসে শুভাশিসের? কেন যে এক ডুবডুব ভয়ে হৃৎপিণ্ড থরথর?

মুখ থেকে হাত সরাতেই অযুত ভোল্টের শক খেয়েছে শুভাশিস। সামনের চেয়ার ফাঁকা! সুইংডোর কি দুলছে? কই না তো! ইন্দ্রাণী গেল কোথায়!

শুভাশিস উদভ্রান্তের মত রাস্তায় বেরিয়ে এল। চতুর্দিকে অসংখ্য দোকানপাট, পথের মাঝখানেও পসার সাজিয়ে বসেছে সার সার হকার। এলোপাথাড়ি মানুষের ভিড় আর দোকানপাটের ফাঁদে আটকে পড়ে বুনো জন্তুর মতো ছটফট করছে গাড়িঘোড়া। পোড়া ডিজেলের কটু গন্ধে গা গুলিয়ে ওঠে। এই ভয়াবহ জনস্রোত আর যানস্রোতের মাঝে ইন্দ্রাণীকে কোথায় খুঁজে পাবে শুভাশিস? পাগলের মতো তাও ভিড় ঠেলে ঠেলে এদিক ওদিক খুঁজল কিছুক্ষণ, বাসস্টপের দিকে ছুটল, দৌড়ে রাস্তা পার হয়ে উল্টো দিকে চোখ চালাল খানিক। নাহ, কোথাও দেখা যাচ্ছে না, ইন্দ্রাণী যেন উবে গেছে পলকে।

শরীরটা ক্রমশ ছেড়ে আসছে। সব কেমন ঝাপসা। শ্লথ পায়ে ফিরল শুভাশিস। আধো অন্ধকার বারান্দার এক ধারে রতিকান্তর রুগীদের জটলা, অন্য প্রান্তে কার্তিক জেনারেটারের সামনে উবু হয়ে বসে খুটখাট করছে।

খুপরিতে ঢুকতে গিয়ে থামল শুভাশিস, কার্তিক?

–হ্যাঁ স্যার।

–এই মাত্র এক ভদ্রমহিলা আমার চেম্বার থেকে বেরোলেন, কোন দিকে গেলেন রে?

–দেখিনি তো স্যার।

–দেখিসনি! শুভাশিসের গলাটা আর্তনাদের মতো শোনাল।

চেয়ারে ফিরে দু-চার সেকেন্ড থম শুভাশিস। চোখ রগড়াচ্ছে। নাক টানছে। যদি ইন্দ্রাণীর কোনও অস্তিত্ব থেকে থাকে বাতাসে। নেই। প্রায় নিবে আসা মোমবাতির আলোয় আধিভৌতিক লাগছে ঘরটাকে। যেন পাশে রতিকান্তর হুমম চিৎকার নেই, রুগীদের কোলাহল নেই, যেন এক নিবিড় নৈঃশব্দ্যে ডুবে গেছে চারদিক। ইন্দ্রাণী কি সত্যিই এসেছিল? নাকি এতক্ষণ হ্যাঁলুসিনেশান দেখছিল শুভাশিস? এক অলীক মায়ার সঙ্গে কথা বলছিল একা একা? এতকাল পর ইন্দ্রাণী যেচে এসে তাকে তিতিরের বাবা বলে স্বীকার করে যাবে, এও কি সম্ভব!

যন্ত্রের মতো ব্রিফকেস গুছিয়ে শুভাশিস উঠে পড়ল। এলোমেলো গাড়ি চালাচ্ছে। এ রাস্তা, ও রাস্তা। গঙ্গার ধারে গিয়ে ঠায় বসে রইল বহুক্ষণ। অনন্তকাল ধরে স্রোত বয়ে চলেছে গঙ্গায়। অবিরাম। এই মাত্র যে স্রোতটা চলে গেল শুভাশিসের সামনে দিয়ে, সে কি আর ফিরবে কোনওদিন? ফেরে কি? ফেরে ফেরে। ভাঁটার টানে যে ঢেউ চলে যায় মোহনার দিকে, জোয়ারে সেই তো আবার…।

কত কাল পর ইন্দ্রাণী এল। শুভাশিস ফিরিয়ে দিল তাকে! এই আশঙ্কা কি ইন্দ্রাণীর মনে ছিল? তাই কি তার চোখে তিতিরের বাবা হয়ে উঠতে পারেনি শুভাশিস? আর সে কথাই কি আজ চোখে কাঁটা বিঁধিয়ে বুঝিয়ে দিয়ে গেল ইন্দ্রাণী?

ছটফট করছে শুভাশিস। ঢাকুরিয়াতে এক্ষুনি যাবে একবার? আবার ছুটছে শুভাশিস। গাড়ি কখন আনমনে পৌঁছে গেছে চেতলার সেই পুরনো বাড়িটার সামনে। পুরনো বাড়ি জীর্ণ হয়েছে আরও। একতলার সব দরজা-জানলা বন্ধ, চুঁইয়েও একটু আলো আসছে না বাইরে। বন্ধ বাড়িটার সামনে তবু অল্পক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল শুভাশিস। মনে মনে বিড়বিড় করছে, ক্ষমা করো রানি, ক্ষমা করো।

বাড়ি ফিরতে অনেক রাত হয়ে গেল শুভাশিসের। ছন্দা টিভি দেখছিল, শুভাশিসকে দেখে উঠে এল, কি হল, এনেছ?

শুভাশিসের কানে অস্পষ্ট ভাবে পৌঁছল কথাটা। ঘোরের মধ্যে বলল, কি আনব?

 বারে, সকালে অত কথা হল! তুমি বললে তোমাকে আজ লোকটা এনে দেবে!

কী বলো তো?

–এই না হলে বাবা! ভুলে মেরে দিয়েছ?

কথা বলতে ভাল লাগছিল না শুভাশিসের। বিরক্ত মুখে বলল, – অত হেঁয়ালি ভালো লাগে না। সাত কাজে থাকি, সব কথা মনে থাকে না।

মুহূর্তের জন্য থমকাল ছন্দা। তারপর বলল, তোমার আজ টোটোর জন্য ক্যামেরা আনার কথা ছিল।

সেই মাধ্যমিকের পর থেকেই টোটোকে একটা বিদেশি ক্যামেরা কিনে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে যাচ্ছে শুভাশিস, বছর ঘুরতে চলল এখনও কেনা হয়ে ওঠেনি। কদিন ধরেই চেঁচামেচি করছে ছন্দা, এবার জন্মদিনে যেন অন্তত টোটোর হাতে পৌঁছয়। কাল ফ্যান্সি মার্কেটে খবর পাঠিয়েছিল শুভাশিস, আজ ইয়াসিন সন্ধেবেলা নার্সিংহোমে দিয়ে যাবে বলেছিল।

শুভাশিস নীরস গলায় বলল, পরশু তো ফার্স্ট এপ্রিল। কাল এসে যাবে।

–দেখো, ভুলো না। টোটো কিন্তু খুব হার্ট হবে। ছন্দা ডাইনিং স্পেসের দিকে যেতে গিয়েও দাঁড়াল, কী বিচ্ছিরি ব্যাপার বলো তো, টোটো এবার কোনও বন্ধুবান্ধবকে ডাকতে চাইছে না।

–কেন, পরীক্ষা তো কাল শেষ হয়ে যাচ্ছে!

কি জানি বাবা, তোমার ছেলের থই পাই না আজকাল। গত বছর অত হইচই হল, এবার দিনটা পুরো মরা মরা কাটবে। কোনও মানে হয়? আমি অবশ্য দিদি জামাইবাবুকে নেমন্তন্ন করেছি।

–বেশ তো।

কী করি বলো তো? বাইরে থেকে খাবার আনাব?

–যা তোমার ইচ্ছে। আমাকে জিজ্ঞেস করছ কেন? বাইরের ধরাচুড়ো ছেড়ে পাজামা-পাঞ্জাবিতে নিজেকে বদলাচ্ছে শুভাশিস। লাগোয়া বাথরুমে গিয়ে মুখেচোখে জল দিয়ে এল।

ছন্দা এখনও নড়েনি। তাকে দেখে খেঁকিয়ে উঠল শুভাশিস, হল কী? আরও কিছু বলার আছে নাকি?

ছন্দা ঘাড় ঝাঁকাল, না তো! খাবে চলো।

–খাব না। খিদে নেই।

–সেকি! আমি তোমার জন্য না খেয়ে বসে আছি।

 –আছ কেন? কে বলেছে থাকতে? এমনিই রোগের ডিপো, আরও রোগ বাধানো!

ছন্দার ভুরুতে ভাঁজ পড়ল কী হয়েছে বলো তো? প্রবলেম হয়েছে কোনও? কাল সানশাইনে কোনও পেশেন্টের কন্ডিশান সিরিয়াস বলছিলে…

–হোয়াই কান্ট ইউ লিভ মি অ্যালোন? সব সময়ে ফেউএর মতো লেগে আছ, একটু একা থাকার উপায় নেই?

ছন্দার মুখ থমথমে হয়ে গেল। কথা না বাড়িয়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

রাতে বরাবরই ঘুম গাঢ় হয় শুভাশিসের। সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রমের পর বিছানায় পড়লেই দু মিনিটে কাদা। আজ তেমনটি হল না। ভেঙে যাচ্ছে বার বার। ছেঁড়া ছেঁড়া স্বপ্ন আসছে খালি। উকট। অর্থহীন। কখনও একটা সাদা হাঁস লোমশ ভাল্লুক হয়ে যাচ্ছে, কখনও বা গুম গুম ধস নামছে পাহাড়ে। মেডিকেল কলেজে শুভাশিসদের হোস্টেলের সামনে একটা কাঁঠালি চাঁপার গাছ ছিল, সেটাকেও যেন আবছাভাবে দেখল এক-আধবার। কলেজ স্ট্রিটও এল স্বপ্নে। প্রেসিডেন্সি কলেজের সামনে দুমদাম বোমা পড়ছে, তার মাঝখান দিয়ে এঁকেবেঁকে ছুটছে ইন্দ্রাণী, সপ্লিনটার বিধে পড়ে গেল মুখ থুবড়ে। ইউনিভার্সিটি থেকে বেরিয়ে আসছে ফ্রক পরা তিতির, কোত্থেকে এক সি আর পি এসে চুলের মুঠি চেপে ধরল তিতিরের। আরও কত কী যে দেখল!

পরদিন সারাক্ষণ একটা চাপ চাপ ভার লেগে রইল বুকে। যান্ত্রিক হাতে অপারেশন সারল গোটা তিনেক। সন্ধেবেলা ল্যান্সডাউনের চেম্বার সেরেই নিশিতে পাওয়া মানুষের মতো ছুটল ঢাকুরিয়ায়।

নীচের সদর দরজাটা আগে খোলাই থাকত, আজ বন্ধ। বেল শুনে দরজা খুলেছে মিনতি। বড়ঘরে পা দিয়ে শুভাশিস পলকের জন্য স্থবির। নিত্যদিন সোফায় বসে থাকা মানুষটা উঠে গেছেন দেওয়ালে। হা হা করছে ঘরটা। বাড়িটাও যেন বড় বেশি নিস্তব্ধ।

পায়ে পায়ে সিঁড়ি ভাঙছে শুভাশিস। নিজের পদশব্দে নিজেরই অস্বস্তি লাগছে। অথচ এক চোরা আনন্দও কুলকুল বইছে ধমনীতে। ঠিক যেন ঘরে ফেরার অনুভূতি।

তিতির খাটে উপুড় হয়ে শুয়ে বই পড়ছে। খাতার গোছ নিয়ে টেবিলে ইন্দ্রাণী। দরজায় দাঁড়াতেই শুভাশিসের বুক মুহূর্তে পেঁজা তুলোর মতো হালকা। জুতো খুলতে খুলতে পুরনো অভ্যস্ত ভঙ্গিতে বলে উঠল, তিতিরের কি পরীক্ষা শেষ?

তিতির ধড়মড়িয়ে উঠে বসল। চোখে বিস্ময়, – ওমা ডাক্তার আঙ্কল! তুমি অ্যাদ্দিন ছিলে কোথায়?

–আর বলিস না, এক হাজার ঝামেলা। ওদিকে তোর আন্টির শরীরটাও ভাল যাচ্ছে না। মাঝে কলকাতার বাইরেও চলে গেলাম…। শুভাশিস আড়চোখে ইন্দ্রাণীকে দেখে নিল একবার। ইন্দ্রাণীর চোখ কি উদ্ভাসিত একটু? বোঝা গেল না। কাল সন্ধের ইন্দ্রাণী আজ আবার মুখোশ এঁটে নিয়েছে মুখে। কোনও বিকার নেই। যেন জানতই শুভাশিস আজ আসবে।

শুভাশিস খাটে বসে লঘু স্বরে বলল, ওসব খাতা-টাতা রাখো। এত দিন পর এলাম, একটু চা-ফা খাওয়াও। নাকি তিতির চা খাওয়াবে?

কয়েক মিনিটেই পরিবেশ সহজ হয়ে গেল। ঘরোয়া কথাবার্তা চলছে। টুকিটাকি খবর নিচ্ছে শুভাশিস।

–দীপুদের ঘর বন্ধ দেখলাম, সব গেল কোথায়?

কাকিমা বাপের বাড়ি গেছে। অ্যাটমের বড়মামা এসেছে, খুব হইচই চলছে সেখানে।

বড়মামা মানে কোন জন? যে এয়ার ইন্ডিয়ায় আছে? বোম্বেতে পোস্টেড?

–না না, সে তো, মেজমামা। বড়মামা তো কোলিয়ারির ম্যানেজার।

ও হ্যাঁ। দীপু একবার আলাপ করিয়ে দিয়েছিল।

 কথার মাঝে তিতির হঠাৎ ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলল, জানো আঙ্কল, আমাদের প্রেসটা বিক্রি হয়ে গেছে।

-সেকি! কবে? কেন?

প্যাসেজ থেকে চা তৈরি করে ঘরে এসেছে ইন্দ্রাণী। কাপটা শুভাশিসের হাতে ধরিয়ে বলল, ওটা আর রেখে কী হবে? নতুন ফ্ল্যাটবাড়িতে প্রেসের জায়গা হবে না।

–একেবারে বেচে দিলে? অন্য কোথাও সরিয়ে নিতে পারতে।

–দুৎ, বাড়িতে চলছিল সে একরকম। অন্য জায়গায় কে ছোটাছুটি করবে? তিতিরের বাবা তো আর ভুলেও দেখবে না। তার চেয়ে যে কটা টাকা আসে.. ভাবছি তিতিরের জন্য কটা গয়না গড়িয়ে রাখব।

শুভাশিসের বুকে দ্রিম করে বাজল কথাটা। তিতির আজ আবার আদিত্যর মেয়ে হয়ে গেছে। একটু ব্যঙ্গের সুরে বলল, তিতিরের বাবা কোথায়? ব্যবসার কাজে বেরিয়েছে?

বাবা তো এখানে নেই। কাশীতে।

কাশীবাসী! শুভাশিস হেসে ফেলল, তোর বাবা সন্ন্যাসী হয়ে গেল?

–হিহি তা কেন? দাদু-দিদার সঙ্গে বেড়াতে গেছে। পরশু ফেরার কথা ছিল। ওখানে দিদার শরীরটা একটু খারাপ হয়েছে, আরও কয়েকদিন দেরি হবে।

–তাই বল। তা সেই ভদ্রলোকের খবর কি? রঘুবীরবাবু? তিনিও সঙ্গে গেছেন?

না। তবে বাবাকে খুব মিস করছেন। উইকে চোদ্দবার করে খবর নিয়ে যাচ্ছেন বাবা কবে ফিরবে। বাবার বিরহে খুব কাতর। তিতির খাটের বাজুতে হেলান দিল, আমারও ভাল লাগছে না।  বাবা না থাকলে সব কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে।

হুঁহ, তোর বাবা যেন কত বাড়িতে থাকে! ইন্দ্রাণী শুভাশিসের পাশে এসে বসল, আমিই জোর করে পাঠালাম। এমন ডিপ্রেশনে ভুগছিল।

–ভালই করেছ। বেড়ালে মন ফ্রেশ হয়ে যাবে।

তিন মাস পর হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে বাড়ি ফিরছিল শুভাশিস। ফ্ল্যাটে ঢোকার আগে সহসা সিঁটিয়ে গেল। আজও ক্যামেরার কথা ভুলে গেছে। ইয়াসিনটাও দুপুরে এল না। কী কৈফিয়ত দেবে ছন্দাকে?

আশ্চর্য, ছন্দা কিছুই জিজ্ঞাসা করল না।

পরদিন আর ভুল করল না শুভাশিস। নিজেই সময় করে ফ্যান্সি মার্কেটে ছুটল, দরদস্তুর করে ক্যামেরা কিনল, সন্ধেবেলা নার্সিংহোম ছুঁয়েই সোজা বাড়ি।

টোটো ক্যামেরা পেয়ে দারুণ খুশি। বিদেশি এস এল আর ক্যামেরা, উল্টেপাল্টে দেখে আশ মেটে না, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লিটারেচার পড়ছে, পারলে রাতেই ফিল্ম কিনতে ছোটে।

শুধু ছন্দারই কোনও তাপ-উত্তাপ নেই।

ছন্দার দিদি-জামাইবাবু রাত্রে খেয়ে চলে যাওয়ার পর ছন্দাকে একা পেল শুভাশিস। হালকা ভাবে বলল, – ছেলের জন্মদিনে এমন মিইয়ে আছ কেন?

-কই না তো।

শরীরে কোনও প্রবলেম হচ্ছে?

না।

–শালিনীর সঙ্গে কিন্তু কথা হয়ে গেছে। আর কোনও এক্সকিউজ নয়, পয়লা বৈশাখের পরেই তুমি অপারেশান করাচ্ছ।

–দেখা যাবে।

–আয়রন ক্যাপসুলগুলো খাচ্ছ নিয়মিত?

 ছন্দা উত্তর দিল না।

–তোমার এই উইকে একটা হিমোগ্লোবিন করার কথা ছিল না? কাল ক্লিনিক থেকে লোক পাঠিয়ে দেব?

ছন্দা উল্টো দিকে পাশ ফিরে শুল।

 ঠিক চারদিন পর হঠাৎ ধুম জ্বর এল ছন্দার। সঙ্গে অসহ্য পেটের যন্ত্রণা। ঝাঁ ঝাঁ চৈত্রের দুপুরে স্যাস ক্লিনিকে নিয়ে আসতে হল ছন্দাকে। বৈশাখ অবধি আর অপেক্ষা করা গেল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *