৪৬-৫০. ইনল্যান্ড লেটার

টেবিলে একটা ইনল্যান্ড লেটার পড়ে রয়েছে। খোলা। কাঁধ থেকে স্কুলব্যাগ নামিয়ে ভুরু কোঁচকাল তিতির। দাদার চিঠি!

ডিয়ার মা, পৌঁছেই একটা চিঠি দিয়েছিলাম, নিশ্চয়ই পেয়েছ। এখানে এভরিথিং ইজ ফাইন। আমার ট্রেনিং মানে প্রি সি কোর্স ফুল সুইয়িং-এ চলছে। হেভি খাটুনি। ইন্দ্রনীল রায় তাতে অবশ্য ঘাবড়ায় না। সানরাইজের আগে সে ঘুম থেকে ওঠে, একপ্রস্থ পিটি করে, ব্রেকফার্স্ট সারে, তারপর হোল ডে ক্লাস আপ টু বিকেল। মাঝে অবশ্য লানচ ব্রেক আছে। এত খাটাচ্ছে কেন জানো? তিন মাসে শিপিং-এর আটটা কোর্স কমপ্লিট করে সার্টিফিকেট পেতে হবে। ফায়ার ফাইটিং, সারভাইভাল অ্যাট সি, ওশিওনোগ্রাফি এইসব। আমি খাটুনিটা খুব এনজয় করছি। এ নিউ লাইফ। শুধু এখানকার রান্নাবান্নাগুলো যদি একটু ভাল হত! মাছ মাংস নিরামিষ সব এক টেস্ট। টক দই কমপালসারি। যাচ্ছেতাই। এই খেয়েই আমি ওয়েট গ্যাদার করছি মা। ফ্যাট নয়, সলিড হেলথ। আগের চিঠিতে যে ওড়িয়া রুমমেটের কথা বলেছিলাম, সে আর একটা ওড়িয়া ছেলের রুমে শিফট করে গেছে। আমার প্রেজেন্ট রুমমেট একজন তামিল। তার পুরো নাম কুম্ভকনম শ্রীনিবাসরাঘবন সৌম্য নারায়ণ। তিতিরকে নামটা মুখস্থ করতে বোলো, আমি গিয়ে ধরব। আমরা অবশ্য ওকে ন্যারি বলে ডাকি। ন্যারি খুব নার্ভাস টাইপের ছেলে। অথোডক্স ভেজ। আমাকে ভীষণ মানে।

আর কী? ক্লাস থেকে ফিরে সুইমিং-এ যাবার আগে হারিডলি চিঠি লিখছি। এখানে ঠাণ্ডা বেশ কম, ভোরের দিকেই যা একটু শীত করে। আশা করি দাদুর কাজকর্ম সব ভালয় ভালয় চুকে গেছে। তোমরা বড়রা আমার প্রণাম নিয়ো, ছোটদের ভালবাসা দিয়ো। ইতি। বাপ্পা।

এন বিঃ কাল আমাদের একটা রিয়েল শিপে ট্রেনিং হবে। দারুণ এক্সসাইটমেন্ট হচ্ছে। রাতে ঘুম হবে না।

হুঁহ, শুধু নিজের কথা আর নিজের কথা। দাদাটা কেন যে এমন স্বার্থপর হল! আগেও আমি আমি ভাবটা ছিল। আমার জামা। আমার জুতো। আমার টেপ। আমার ক্যাসেট। দূরে চলে গিয়ে এখন যেন নিয়মরক্ষার সম্পর্ক রাখছে। একবারের জন্যও কারুর খোঁজখবর করল না। তিতির নয় ছিচকাঁদুনি ঝগড়টি, মা কেমন আছে তাও জানার ইচ্ছে নেই! আশ্চর্য! অথচ এই দাদার জন্য ছোটকার বন্ধুর কাছ থেকে টাকা ধার করে আনল মা!

ফোঁস ফোঁস কয়েকটা শ্বাস ফেলল তিতির। ভরাবিকেলেও কেমন সেঁতিয়ে আছে বাড়িটা। আগেও যে এ বাড়ি অহোরাত্র মুখর থাকত তা নয়, তবু যেন এমন পাষাণপুরী ছিল না। অশৌচের কদিন বাড়িতে তাও একটা অন্য ধরনের প্রাণ ছিল। লোকজন আসছে, কথা বলছে, বাবা হঠাৎ হঠাৎ ডুকরে উঠছে, এই কথা, সেই কথা… ক্রিয়াকর্ম মিটতেই সব কেমন ধুধু। খকখক কাশির শব্দটা নেই, অ্যাটমের হুড়দুম নেই, কাকিমাও আজকাল ফিসফিসিয়ে বকাবকি করে অ্যাটমকে, মিনতি সন্ধ্যার মাও কথা চালাচালি করে নিচু পর্দায়। এমন নিঝুম বাড়িতে দু দণ্ড তিষ্ঠোনো যায়? সপ্তাহে সাত দিনই যে কেন তিতিরের টিউটোরিয়াল থাকে না!

জলখাবার খেতে নীচে যাওয়ার আগে বাবার ঘরে ঢুকল তিতির। ঘর সুনসান, শয্যা নিভাঁজ, বাবা নেই। কি যেন সন্দেহ হওয়াতে পায়ে পায়ে ছাদে এল। যা ভেবেছে তাই। কালকের মতোই ছাদের মধ্যিখানে বেদিতে বসে আছে বাবা। পশ্চিম আকাশ থেকে সূর্যরশ্মি এসে পড়েছে মাথায়। মলিন রোদমাখা দেহটাকে আরও যেন শীর্ণ দেখায়।

তিতির পিছন থেকে ডাকল, বাবা।

আদিত্য সাড়া দিল না। কী যেন ভাবছে অথচ ভাবছে না।

তিতির কাছে এল। সদ্য চুল গজানো কদম্ব ফুলের মতো মাথায় গভীর মমতায় হাত রাখল, –রোদ মুখে বসে আছে কেন বাবা?

আদিত্য বিড়বিড় করল, রোদ্র! কই, লাগে না তো!

কাল যে বললে আজ থেকে বেরোবে, তার কী হল?

–ইচ্ছে করল না।

রঘুবীরবাবু আজ আসেননি?

–সে তো রোজই আসে।

–বেরোলে না কেন?

–ওই যে বললাম, ইচ্ছে হল না।

–ইচ্ছে না হলে চলবে? কাজকর্ম করতে হবে না?

কী হবে? জীবন তো দেখলাম। আজ সকালে ছিল, কাল সকালে নেই। বসে বসে এই বিকেল দেখাই ভাল।

বুকে বাতাস চেপে তিতির বুলল, তুমি কাজে না বেরোলে দাদুর আত্মা শান্তি পাবে না বাবা।

বলছিস? সুতির র‍্যাপারখানা গায়ে জড়িয়ে তিনঠেঙে হয়ে বসল আদিত্য, তবে বেরোব।

 তিতির বলল, দু সপ্তাহ ধরে এক কথা শুনছি। তুমি আর বেরিয়েছ!

-মার মতো অত কেজো হোস না রে তিতির। একটু শান্তিতে থাকতে দে।

এত শোক ভাল লাগে না তিতিরের। দাদুর মৃত্যুতে সেও কম কষ্ট পায়নি। বাবার মতো না হলেও দাদুও তো তার কম আপন ছিল না। এ বাড়িতে তিতির ছাড়া কার সঙ্গেই বা মনের প্রাণের কথা বলত দাদু? ঠাকুমার চলে যাওয়াটা ভাল মনে নেই তিতিরের, সেভাবে ভাবতে গেলে এটাই তার জীবনের প্রথম মৃত্যুশোক। প্রথম প্রথম কদিন বুকটা ফেটে যেত তিতিরের, চোখ ভেঙে জল আসত, তারপর তো এক সময়ে থিতিয়েও এল কষ্ট। বন্ধুদের সঙ্গে হাসিগল্প করার সময়ে এখনও হঠাৎ হঠাৎ দাদুর মুখটা স্পষ্ট দেখতে পায় তিতির। তোবড়ানো গাল, পিটপিট চোখ, ঘুগনি খাওয়ার জন্য ছটফট করছে! মনটা ভার হয়ে আসে তিতিরের, অজান্তে ভিজে যায় চোখ। তা বলে কি দিবারাত্র দুঃখ আঁকড়ে থাকলে চলে? কাকিমা ঠিকই বলে, রোগব্যাধির জ্বালা থেকে মুক্তি পেয়ে এক দিক থেকে বেঁচে গেছে দাদু।

বাবা বোঝে না। বাবাটা বড্ড ইমোশনাল।

বাবা এত ভেঙে পড়ল কেন? দাদুর মৃত্যুর রাতে বাড়ি ফেরেনি, তাই? থাকলেও তো মৃত্যুটা টের পেত না।

এত ডিপ্রেশানের কোনও মানে হয়?

তিতির সিঁড়িতে গিয়েও ফিরে এল, দাদার আজ চিঠি এসেছে।

–তাই?

–দাদা খুব মজায় আছে।

হুঁ।

কত কি ট্রেনিং নিচ্ছে, নতুন নতুন বন্ধু হয়েছে। এনে দেব চিঠিটা, পড়বে?

আদিত্য রা কাড়ল না। আবার সেই নীরব অবসন্নতার খোলে ঢুকে যাচ্ছে। নীচে ফোন বেজে উঠল। কাকিমা নেই, দ্রুত নেমে এসে ফোন ধরল তিতির।

ঝুলনের গলা। ভীষণ উত্তেজিত ঝুলন। প্রায় চেঁচাচ্ছে, এই জানিস, দারুণ এক্সাইটিং নিউজ। এইমাত্র দেবস্মিতা আমাদের বাড়ি এসেছিল।

বন্ধুর গলা পেয়ে তিতিরও মুহূর্তে চনমনে, এতদিন পর হঠাৎ? লেডি ব্রেবোর্নের গল্প শুনিয়ে ফাট মারতে এসেছিল বুঝি?

–আরে না। ওর দিদিটার বিয়ে। ফেব্রুয়ারির টেনথ। এখান থেকে হিয়ার বাড়ি গেল। কাল বোধহয় তোকে কার্ড দিতে যাবে। যাক, এতদিনে দেবস্মিতাটার হাড়ে বাতাস লাগবে।

সুস্মিতাদি কোন একটা কলেজে পার্টটাইম করছিল না?

–ওই কলেজেরই ফুলটাইমারকে বিয়ে করছে।

–মানে লটঘট কেস? সুস্মিতাদি প্রেমে পড়ল! এ যে দেখি জলে ভাসে শিলা!

–পৃথিবীতে এখনও অনেক কিছু দেখা তোমার বাকি আছে খুকুমণি। শুধু প্রেমেই পড়েনি, দেবস্মিতা বলছিল সুস্মিতাদি হবু বরের সামনে নাকি একেবারে চুচুর মুচুর হয়ে থাকে। তার নাকি সুস্মিতাদির থেকেও বেশি ফান্ডা।

–ঠিক হয়েছে। সারা জীবন জাঁতায় থাকবে।

–তাই যেন হয়। …এখন রাখি রে। কাল স্কুলে গিয়ে হিয়ার সঙ্গে কথা বলে কি গিফট দেওয়া যায় ফাইনাল করে নেব, কেমন?

ছটফট করছিস কেন? বেরোচ্ছিস কোথাও? অর্ণবের সঙ্গে অ্যাপো?

 কয়েক সেকেন্ড থেমে রইল ঝুলন, –তোকে কথাটা বলার চান্স পাইনি। অর্ণবের সঙ্গে আমার কাট অফ হয়ে গেছে।

-সে কি! কবে? কেন?

–অর্ণবের ফ্যামিলিটা ভাল নয় রে।

–ওর বাবা গভর্নমেন্ট অফিসার না?

হতে পারে। তবে টেস্টটা খুব লো। বাড়িতে লুঙ্গি পরে বসে থাকে।

তিতির প্রায় বিষম খেল, সে তো আমার বাবাও মাঝে মাঝে লুঙ্গি পরে। দাদুও পরত।

–তোদের কথা আলাদা। তোর বাবা তো কোনওদিন আমার শ্বশুর হতে যাচ্ছে না। লুঙ্গি আমি একদম স্ট্যান্ড করতে পারি না রে। একটা লুঙ্গি পরা লোক খালি গায়ে বসে বসে বগল চুলকোবে, সে হবে আমার শ্বশুর? ইমপসিবল।

তিতির হাঁ হয়ে গেল, তা হলে তোদের এতদিনের রিলেশান…!

রিলেশান আবার কি। একটা ফ্রেন্ডশিপ ছিল, সাত-দশ দিন এক সঙ্গে ঘুরেছি, ও আমাকে দুটো চুমু খেয়েছে, আমি ওকে দুটো চুমু ফেরত দিয়েছি ব্যস। রিলেশান ইজ ওভার।

তিতিরের গা সিরসির করে উঠল। এত সহজে সম্পর্ক গড়ে ওঠে? এত তুচ্ছ কারণে ভেঙেও যায়? চুমু খাওয়া কি কোল্ড ড্রিঙ্কস কুলপি খাওয়ার মতো নিছকই একটা নগণ্য আইটেম? সেখানে মনের কোনও ভূমিকা নেই?

একতলাটাও খাঁ খাঁ করছে। স্মরজিৎ লাহিড়ির ছবির কাজ শুরু হয়েছে, পরশুদিন মুর্শিদাবাদে শুটিং-এ গেছে কন্দর্প। তার দরজায় ইয়া বড় তালা। মিনতিও নেই। রান্নাঘরে একা মনে রুটি বেলছে সন্ধ্যার মা।

তিতির তার পাশে গিয়ে উবু হয়ে বসল, মা কখন বেরিয়েছে গো?

–এই তো ঘণ্টাখানেক আগে। পেরেসের বুড়োবাবুকে নিয়ে বেরোল।

কখন ফিরবে কিছু বলে গেছে?

-বউদি কি এখন কারুর সঙ্গে কথা বলে? সারাক্ষণ হাঁড়িমুখ। শ্বশুর মরলে কাউকে এমন পেঁচায় পায়, এ আমি জন্মে দেখিনি। আপন মনে গজগজ করছে সন্ধ্যার মা। হঠাৎ চোখ ঘোরাল, –হ্যাঁ গো দিদিমণি, তোমাদের পেরেস নাকি উঠে যাচ্ছে?

–প্রেস! উঠে যাচ্ছে! যাহ। তোমায় কে বলল?

–মিনতিই বলছিল। পেরেসের ট্যারাটার সঙ্গে নাকি বুড়োবাবুর কথা হচ্ছিল। মিনতি সকন্নে শুনেছে।

–ভুল শুনেছে। তিতির উড়িয়ে দিল কথাটাকে, গরম গরম দুটো রুটি দাও তো। চাও করো একটু। বাবা ছাদে আছে, দিয়ে এসো এক কাপ।

জলখাবারের থালা এগিয়ে দিয়ে গ্যাসে কেটলি বসাল সন্ধ্যার মা। ফেলে আসা কথাটাকে আবার ধরে নিল, না গো দিদিমণি, মিনতিকে তোমরা যত হাবাকালা ভাবো, ততটা কিন্তু নয়। মাগীর কান খুব স্যায়না। কাল নাকি বুড়োবাবু ট্যারাকে বলছিল, ধীরেসুস্থে একটা কাজকম্মো দেখে নাও ভাই। এ পেরেসের আউস্কাল শেষ। বউদিও নাকি আর নতুন কাজ নিচ্ছে না হাতে।

তিতির তর্কে গেল না। কথাটা অবিশ্বাসও করা যায় না পুরোপুরি। মা কি ধার শোধ করার জন্য প্রেস বেচে দিতে চায়? হতেও পারে। মার কার্যধারার তল পাওয়া ভার। দাদু মারা যাওয়ার পর থেকেই এ বাড়ির বাতাসে কী একটা কথা যেন ভেসে বেড়াচ্ছে। পিসি আর কাকিমা বারান্দায় দাঁড়িয়ে কী একটা সেদিন বলাবলি করছিল, তিতির যেতেই চুপ করে গেল। নিয়মভঙ্গের দিন ঝান্টুদা বলছিল, আর কি! রায়বাড়ি তো এবার ভাঙল! দাদু মারা যাওয়ার পর বাড়ি যে ভাঙা পড়বে, এ আর এমন নতুন কথা কি! ঘটনাটা কি খুব তাড়াতাড়ি ঘটতে চলেছে? পিসি কাকিমা কি তাই নিয়েই আলোচনা করছিল? তিতিরকে দেখে চেপে গেল কেন? উঁহু, অন্য কি একটা ব্যাপারও আছে।

তিতিরের পোস্তদানা মনটা অনেককাল ধরে থম মেরে আছে। সেই দাদার জাহাজ কোম্পানির চিঠি আসার পর থেকেই।

তিতির তাকেই শুধোল, কি গো, তুমি কিছু বলছ না যে?

কী বলব?

বুড়ো মানুষটা হুট করে মরে গেল, দাদা জেদ করে চলে গেল ম্যাড্রাস, প্রেস নাকি উঠে যাচ্ছে, বাড়িও ভাঙা পড়বে, তবু তোমার কিচ্ছু বলার নেই?

মন পিনপিন করে উঠেও নীরব হয়ে গেল।

তিতির অধৈর্যভাবে বলল, কী হল? বলো কিছু।

টুঁ শব্দটি নেই। নো মেসেজ।

 ধ্যাততেরি, ভাল্লাগে না। ছটফট করতে করতে বড়ঘরে এল তিতির। ঢুকেই বুকটা ছ্যাঁত করে উঠেছে। ছায়ামাখা ঘরে দাদু বসে আছে না সোফায়! টেবিলে তাস ছড়িয়ে পেশেন্স খেলছে! দুর, কোথায় কে! ঘর যেমন শূন্য, তেমনই শুন্য। সোফা টেবিল কার্পেট আলমারি সব যে যার জায়গায় বসে আছে ঘাপটি মেরে। বদলের মধ্যে বদল দাদুর বাবার পাশে আর একটা ছবি এসে গেছে। বড় জ্যান্ত ছবিটা। ছোটকার এক বন্ধু তুলেছিল গত বছর।

নাহ, এ ঘরে একা দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। দৌড়ে ওপরে উঠে গেল তিতির। ছোট পার্সটা নিয়ে চটি পরে সিঁড়ি দিয়ে নামছে। এক্ষুনি বেরিয়ে পড়বে বাড়ি থেকে। এক্ষুনি।

বাড়ির ভেতর আলো-আঁধার ছিল, বাইরে তার চিহ্নমাত্র নেই। অপরূপ এক মায়াবী বিকেল খেলা করছে রাস্তায়। ঝাপুর-ঝুপুর ছোটাছুটি করছে রিকশা সাইকেল, শব্দ করে হাসছে। গাড়িঘোড়া। যত্রতত্র ঝিকমিক পড়ন্ত সূর্যের আলো। মাঝগগনে চাঁদের আভাস স্পষ্ট ক্রমশ।

বড় রাস্তায় এসে পুরনো স্কুলের দিকে হাঁটছিল তিতির। এ পথ দিয়ে এখন সে টিউটোরিয়ালে যায়। এমনি এমনি হাঁটতে বেরোলেও এই পথটাই তার বেশি পছন্দ। শৈশব থেকে গড়ে ওঠা অভ্যাসে এ পথেই ভারি নিশ্চিন্ত বোধ করে সে। স্কুলের কাছে এলে গতি থেমে যায় তার, গেটের এপাশ থেকে তৃষ্ণার্ত চোখে সবুজ মখমলের মতো মাঠটাকে দেখে। পুরো দেখা যায় না, আধভেজানো গেটের ফাঁক দিয়ে যতটুকু দৃষ্টি যায়, ততটুকুই নয়নের সুখ। বৈজু দারোয়ান দেখতে পেয়ে বেশ কয়েকবার ডেকেছে তিতিরকে, তবু সে ভেতরে ঢোকেনি। কী হবে গিয়ে? সবই তো অন্য মুখ, তিতিররা কেউই নেই সেখানে। ফেলে আসা জায়গায় আর কি সেভাবে ফিরতে পারে কেউ?

আজ স্কুলের সামনে গিয়ে তিতির দেখল গেট পুরো বন্ধ হয়ে গেছে। বৈজু দারোয়ানও ধারেকাছে নেই।

হাই, কী খুঁজছ?

তিতির চমকে উঠল। গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে সুকান্ত। পরনে ফুল হাতা স্টোনওয়াশ জ্যাকেট, ব্যাগি ট্রাউজার। মাঝে তো কোথায় উড়ে গিয়েছিল, আবার মহাপুরুষের আবির্ভাব হল যে হঠাৎ?

ঝটিতি ভুরুতে কাঠিন্য এনে ফেলল তিতির, তোমার কী দরকার?

খেপছ কেন? আমি কখন থেকে তোমার পাশে পাশে হাঁটছি, তুমি একবারও ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছ না!

রাস্তার রোমিওদের দেখা আমার স্বভাব নয়। এদিক ওদিক চোখ চালাল তিতির।

–টু হুইলারটা নেই। গ্যারেজে গেছে।

দাঁড়িয়ে থাকার কোনও মানে হয় না, তিতির হাঁটা শুরু করল।

সুকান্তও হাঁটছে পাশে পাশে, কেন গ্যারেজে গেছে জিজ্ঞেস করলে না?

প্রয়োজন নেই।

–জোর ভিড়িয়ে দিয়েছিলাম। মিনিবাসের সঙ্গে। এক চুলের জন্য জানে বেঁচে গেছি।

 তিতির আকাশ দেখল।

–ঘাড়ে হেব্বি চোট লেগেছিল। কনুইতে তিনটে স্টিচ, মাথায় চারটে…। ফস করে জ্যাকেটের হাতা গোটাল সুকান্ত, দ্যাখো দ্যাখো, ক্রেপ ব্যান্ডেজ জড়ানো আছে।

একবার তাকিয়েই চোখ ঘুরিয়ে নিল তিতির।

–পুরো একুশ দিন বিছানায় লেটে ছিলাম। শুয়ে শুয়ে তোমার জন্য খুব মন কেমন করত, বুঝলে?

চলমান তিতির ঠোঁট বেঁকাল।

বাবা ফতোয়া জারি করে দিয়েছে, আমাকে আর টু হুইলার চড়তে দেবে না। গ্যারেজ থেকেই ডিজপোজ করে দেবে। ভালই হল, কি বলো? তুমি আমার ওই গাড়িটাকে সহ্য করতে পারতে না।

–আমি তোমাকেও সহ্য করতে পারি না।

–সে কি আমি বুঝি না? মগর কিউ? আমাকে কি তোমার বাজে ছেলে মনে হয়?

–ভাল তো কিছু দেখি না।

–আমার কিন্তু তোমার সব কিছুই ভাল লাগে। সেই যে সিনেমা দেখতে গিয়ে তোমায় দেখলাম…! ফ্রাঙ্কলি বলছি, প্রথমে তোমার ওই ঝুলন বলে বন্ধুটাই টারগেট ছিল। হেভি ড্যাশি। কিন্তু তোমায় দেখেই সব কেমন গুবলেট হয়ে গেল। আর কাউকে চোখেই লাগে না।

কী অকপট স্বীকারোক্তি! তিতির যেন একটু একটু গলছিল। কেন গলছিল নিজেই জানে না।

সুকান্ত বলল, –তোমার মতো এত সুন্দর মেয়ে আমি আর লাইফে দেখিনি। হাসলে কোথায় লাগে জুহি মাধুরী! আর রেগে গেলে…তুমি শ্রীদেবীর চালবাজ দেখেছ?

স্তুতিটুকু ওড়নায় মেখে নিল তিতির, তবে মুখের রামগরুড় ভাবটা কমাল না। বলল, এখন তোমার চালবাজি দেখছি। বেশি মসকা মেরো না, সুবিধে হবে না। আমার মনমেজাজ ভাল নেই।

–সেই দাদু মরেছে বলে এখনও শোক?

–ওভাবে বলবে না। দাদু আমার কতখানি ছিল তুমি বুঝতে পারবে না। তিতির ফস করে বলে ফেলল কথাটা।

সুকান্ত দাঁড়িয়ে গেল। তিতির একটু এগোতেই বড় বড় পা ফেলে ধরে ফেলল তাকে। গলা যথাসম্ভব মিহি করে বলল, সরি।

–শুড বি।

–আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে দেখো। আমার মা যখন মরে গেল আমার তো মনে হয়েছিল আমি আর বাঁচবই না। তার পরেও তো দেখো দিব্যি হেসেখেলে আছি। এক এক দিন রাত্তিরে মার কথা খুব মনে পড়ে, তখন হেভি মোচড় মারে বুকটা। একা একা কাঁদি। …মাইরি কাঁদি। তুমি হাসছ না তো?

ছেলেটা কি পাগল? না বেশি সরল?

তিতির ফিরে তাকাল, তোমার মা নেই আগে বলোনি তো?

–নেই কে বলল? দুটো আছে। একটাকে বাবা নিউ আলিপুরে ফ্ল্যাট দিয়ে রেখেছে, আর একটা কারনানি ম্যানসনে থাকে।

এবার তিতিরের দাঁড়িয়ে যাওয়ার পালা। তীক্ষ্ণ চোখে দেখছে সুকান্তকে। বিষাদ নেই, বিদ্বেষ নেই, ঘৃণা নেই, কী নিস্পৃহ ভঙ্গিতে উন্মোচিত করছে নিজের বাবাকে।

সুকান্তর মুখে সাদা হাসি, সে যাই হোক, আমি কিন্তু আমার বাবার চোখের মণি। আমার জন্য বাবা জান দিয়ে দিতে পারে।

তিতির প্রায় বিড়বিড় করে প্রশ্ন করল, কবে মারা গেছেন তোমার মা?

–অনেক দিন। তখন আমি দশ বছরের। স্কুল থেকে ফিরে দেখি মা নেই। দুপুরবেলা নিজের গায়ে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল মা। আমার মামা মাসিরা অবশ্য অন্য কথা বলে। বাবাই নাকি একা বাড়িতে…

তিতির শিউরে উঠল। অজান্তে কখন কবজি চেপে ধরেছে সুকান্তর, ব্যস, চুপ করো তুমি। অন্য কথা বলো।

.

৪৭.

বিনতা স্নেহার্দ স্বরে বললেন, বাড়ির খবর সব ভাল ভো?

কন্দর্প চেয়ারে সোজা হয়ে বসল, ওই। চলছে একরকম।

বিনতা অন্যমনস্কভাবে বললেন, হ্যাঁ। চলে তো যায়ই। এ পৃথিবীতে কার জন্য কী থেমে থাকে! কত বয়স হয়েছিল বাবার?

–এই তো কদিন পরেই পঁচাত্তর হত।

–তবে আর এমন কী!

–হ্যাঁ। বয়স খুব সাংঘাতিক হয়নি। তবে বাবা ভুগছিলেন খুব। প্রায় সাত-আট বছর। শ্বাসকষ্ট, হার্টের প্রবলেম… ইদানীং তো একরকম অথর্বই হয়ে পড়েছিলেন।

–তা হোক। তবু ছিলেন তো। বাবা হল গিয়ে বাবা। সংসারের বটগাছ। সংসারের ছায়া।

ঠিক। ঠিকই তো। বাবার অস্তিত্ব নিয়ে কোনওদিন তেমন করে মাথাই ঘামায়নি কন্দর্প। মানুষটা যেন ছিলেন বাড়ির এক জীর্ণ আসবাবের মতো। ব্যবহার করতে অস্বস্তি, আবার ফেলেও দেওয়া যায় না। অথচ তাকে পোড়াতে গিয়ে শ্মশানে মনে হচ্ছিল মাথার ওপর থেকে আকাশটাই বুঝি সরে গেল। ইলেকট্রিক চুল্লির গনগনে আগুনে ঢুকে গেল বাবা, থরথর করে হাঁটু কাঁপতে লাগল কন্দর্পর। এরকমই হয়। খুব আপন জিনিস না হারানো পর্যন্ত মানুষ তার মূল্য বুঝতে পারে না।

কন্দর্প একটা বড় শ্বাস ফেলল।

বিনতা বললেন, বোসো বাবা। চা খাবে তো?

–খাই। তবে শুধু চা। কন্দর্প আলগা ঘাড় নাড়ল। ছোট্ট ঢোঁক গিলে বলল, মউদের কি ফিরতে দেরি হবে মাসিমা?

–না, না, অনেকক্ষণ গেছে। ফেরার সময় হয়ে এল। … মেয়েটা তো সারা সপ্তাহ মাকে পায় না, রোববারটা তাই দিনভর আঁকড়ে থাকে।

বিনতার স্বরে অনুযোগ নেই। কন্দর্পকে দেখে আজকাল আর তেমন অসন্তুষ্টও হন না বিনতা। খুব খুশিও যে হন, তাও নয়। কন্দর্প বোঝে এ হল গিয়ে নিরাপত্তার সঙ্গে সংশয়ের মিশেল। মহিলার মনে সদাই দোলাচল। এর পর কী? ভাল, না খারাপ? মেয়ে যদি নতুন করে ঘরসংসার পায় তাতে তো মার অসুখী হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু কন্দর্প যদি শুধুই ফস্টিনস্টি করে কেটে পড়ে, তখন মেয়ের কী হবে! ওপর ওপর যতই সাধু তপস্বীর ভাব থাক, কন্দর্প তো আদতে অভিনেতাই! আর দুনিয়ায় কে না জানে সিনেমা থিয়েটারের লোকদের চরিত্রের কোনও বালাই নেই!

মনে মনে মৃদু হাসল কন্দর্প। সত্যিই কি মধুমিতাকে নিয়ে কোনও জাল বুনেছে সে! স্বপ্নের! কিংবা মাকড়সার!

ভাবতেই বুক সিরসির করে উঠল কন্দর্পর।

চেয়ার ছেড়ে উঠল, উঁকি মেরে দেখল রান্নাঘরটা। বিনতা গ্যাস জ্বালাচ্ছেন। জানলার ধারে সরে এসে সিগারেট ধরাল কন্দর্প। সূর্য প্রায় ডুবে এল। পুবের আকাশ বর্ণহীন। মাথার ওপর পাতলা একটা মেঘ সরের মতো ছড়িয়ে আছে। বাতাস উঠছে ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা। হঠাৎ হঠাৎ। মুর্শিদাবাদের মতো অত কনকনে নয়, তবু হিমের ছোঁয়াটুকু এখনও দিব্যি টের পাওয়া যায়। উফ, কিছু ঠাণ্ডা ছিল বটে। ঋতুশ্রী তো গিয়েই হেঁচেকেশে একসা। পুরো দুদিন লেটে রইল বিছানায়। শুটিং বনধ। নায়িকার কাছে ঘেঁষার উপায় নেই, বুলডগের মতো পাহারা দিচ্ছে দিদি। ডায়ালগ কী! বোনের যদি ব্রঙ্কাইটিস নিউমোনিয়া হয়ে যায়, কমপেনসেশান দেবেন! স্মরজিতের মাথায় হাত। বসে বসে টাকা গুনতে হচ্ছে টেকনিশিয়ানদের, মুস্তাফি সাহেব না চেঁচামেচি করে! প্রোডিউসার বলে কথা! হয়তো বলে দিল প্যাকআপ! মুর্শিদাবাদের শুটিং মধ্যমগ্রামে সেরে নাও! ভাঙাচোরা বাগানবাড়িকে সিরাজউদ্দৌলার প্যালেস বানিয়ে ফেলো! শেষমেশ অশোকদা কলকাতা থেকে অভয়বাণী পাঠানোর পর ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল স্মরজিতের। ঋতুশ্রীও অবশ্য পরে খেটেখুটে পুষিয়ে দিল অনেকটা।

বিনতা চা এনেছেন। তাড়াতাড়ি সিগারেট ফেলে কন্দর্প ফিরল চেয়ারে।

ঠিক তখনই ফিরেছে মধুমিতারাও। কন্দর্পকে দেখে মধুমিতা ঝলমল করে উঠল, আপনি! কবে ফিরলেন?

কাল।

কাল নয়, আজই ফিরেছে কন্দর্প। বেলার দিকে। এসেই বিকেলে এখানে চলে এসেছে জানলে কিছু যদি ভেবে বসে মধুমিতা!

মধুমিতা চেয়ার টেনে বসল। হাঁপাচ্ছে অল্প অল্প। মেয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সিঁড়ি উঠতে গিয়ে নাকের ডগায় ঘামও জমেছে বিন্দু বিন্দু। আঁচলে মুখ মুছে বলল, –শুটিং শেষ?

–আমার কাজ শেষ। মানে আপাতত। ইউনিট ফিরবে আরও দিন সাতেক পরে।

মউ কন্দর্পর হাঁটু জড়িয়ে ধরেছে। ভাসা ভাসা চোখ দুটো তুলে বলল, শুটিং কী গো কাকু?

কন্দর্প কোলে তুলে নিল মউকে, তুমি এখনও শুটিং মানে জানো না? শুটিং মানে ঢ্যা ঢ্যা ঢ্যা ঢ্যা।

–তার মানে গুলি চালানো?

 –ঠিক তাই। একটা লোক অ্যাকশন বলে হুকুম দেয়, আর আমরা ঢ্যা ঢ্যা গুলি ছুঁড়ি।

 মউয়ের যেন বিশ্বাস হল না কথাটা। একবার মাকে দেখছে, একবার কন্দর্পকে।

মধুমিতা মুখ টিপে হাসল, –তোমার কাকু ঠিকই বলেছে। তোমার কাকু একটা ওস্তাদ বন্দুকবাজ।

কথাটা কী খুব সরল অর্থে বলল মধুমিতা! কন্দর্প ঠিক বুঝতে পারল না। বোকা বোকা মুখে মউকে একটা চকোলেট বার করে দিল পকেট থেকে। সেকেন্ডে মোড়ক খুলে মুখে চকোলেট পুরে দিয়েছে মউ।

মধুমিতা হাঁ হাঁ করে উঠল– আজও ওকে চকোলেট দিলেন?

–কি হয়েছে?

বাচ্চাদের বেশি টফি চকোলেট খাওয়া ভাল নয়। দাঁত নষ্ট হয়ে যায়।

–হাসিও না তো। ছোটবেলায় আমরা চকোলেট কিছু কম খাইনি, আমাদের কি দাঁত নষ্ট হয়ে গেছে? এখনও চিবিয়ে পাঁঠার মাংসর হাড় ভাঙতে পারি। এই তো এবার ঋতুশ্রীর সঙ্গে বাজি রেখে দাঁত দিয়ে পটাপট সোডার বোতল খুলে দিলাম।

মধুমিতা যেন পলকে নিবে গেল, ঋতুশ্রী মানে আপনাদের হিরোইন?

-হুঁ। দারুণ ড্যাশি মেয়ে। যাকে বলে একেবারে মিস চমকো।

–ও। মধুমিতা খানিক অন্যমনস্ক, — শুটিং তা হলে আপনার খুব মজায় কাটল?

— হুহ। মজা! সকাল নটার মধ্যে শীতে কাঁপতে কাঁপতে বেরিয়ে পড়া, রঙচঙ মেখে সারা দিন হাড়ভাঙা খাটুনি…। সন্ধেবেলা যখন ট্যুরিস্ট লজে ফিরতাম, তখন একেবারে আখের ছিবড়ের দশা। অবশ্য এবারে একটু আরামও ছিল। আগে টেকনিশিয়ানদের সঙ্গে ঘর ভাগাভাগি করে থাকতে হত, এবার একেবারে আলাদা রুম, হিরো হিরোইনদের সঙ্গে লাঞ্চ ডিনার…। কন্দর্প গলা তরল করল, বাজারে আমার খাতির অনেক বেড়েছে, বুঝলে? আমি আর এখন হেলাফেলার বস্তু নেই।

–সে তো বটেই। স্বয়ং নায়িকা আপনাকে দিয়ে সোডার বোতল খোলায়!

 ঈর্ষা! না বিদ্রূপ! কন্দর্প কথা না বলে চায়ে চুমুক দিল।

 মউকে কন্দর্পর কোল থেকে নামিয়ে নিল মধুমিতা। চাপা স্বরে বলল, ঋতুশ্রী খুব সুন্দরী, তাই না?

কন্দর্প মনে মনে বলল, সুন্দরী তো বটেই। তবে তোমার তুলনায় নেহাতই অশোকবনের চেড়ি। মুখে বলল, –ওই একরকম। তেল কাজলে রূপসী। ফটোজেনিক ফেস, পর্দায় মন্দ লাগে না। রঙ-ঢংটাও বড্ড বেশি। এক এক সময়ে সহ্য করা কঠিন।

–তার মানে এক এক সময়ে ভালও লাগে?

বাপ। এ যে অশোকদার চেয়েও জটিল জেরা করে! কী করে বোঝায় ঋতুশ্রীর জন্য তিলমাত্র দুর্বলতা থাকলে লালবাগে ভাগীরথীর তীরে বসে আরেক জনের জন্য বুক হু হু করত না কন্দর্পর! বহরমপুরেই বা সারা রাত দু চোখের পাতায় জুড়ে থাকত কে! লালগোলা প্যাসেঞ্জারে সারাক্ষণ কার মুখ দেখতে দেখতে এসেছে কন্দর্প!

মধুমিতার কথার জবাব দিল না কন্দর্প। ভারিক্কি মুখে বলল, তোমার কম্পিউটার ট্রেনিং নেওয়ার কী হল?

মধুমিতাও মুহূর্তে গুছিয়ে নিয়েছে নিজেকে। গলা তুলে বলল, স্যাররা দুজনেই খুব বলছেন ট্রেনিংটা নিয়ে নেওয়ার জন্য। কিন্তু কখন নিই বলুন তো?

রোববার নাও। এদিকে কাছেপিঠে কোথাও কম্পিউটার ট্রেনিংয়ের ইনস্টিটিউট নেই?

–আছে। কিন্তু শুধু এক দিন করলেই কি হবে! তা ছাড়া ছুটির দিনে তো জানেনই আমার একা কোথাও বেরোনোর জো নেই। মেয়ে ছিঁড়ে ফেলবে।

–তা বলে সারা জীবন রিসেপশনিস্টের কাজই করে যাবে? স্কোপ যখন আসছে..

–ম্যাডাম বলছিলেন নার্সিংহোমেই একটা কম্পিউটার কিনবেন। সেখানে কেউ না কেউ তো কম্পিউটার অপারেট করবেই, তার কাছ থেকে শিখে নিতে পারব না?

দ্যাখো। তোমাদের নার্সিংহোমের কাছেও তো একটা ট্রেনিং সেন্টার আছে। দরকার হলে সেখানেও ছোটখাট কোর্স…

মউ অনেকক্ষণ চুপ করে বসে আছে। আর পারল না। দুম করে বলে উঠল, কম্পিউটার কি আমি জানি। বুম্বার বাবার আছে। একতলায়।

কন্দর্প অমলিন হাসল, বুম্বা বুঝি তোমার খুব বন্ধু?

–হ্যাঁ। বুম্বা আমার বন্ধু। বুম্বার বাবা মার বন্ধু।

কন্দর্প হাসতে হাসতে বলল, আর বুম্বার মা বুঝি তোমার দিদার বন্ধু?

–ওমা, তুমি জানো না! বুম্বার তো মা নেই। ওর মা তো ওর বাবাকে ছেড়ে পালিয়ে গেছে।

 মধুমিতা ধমকে উঠল, ও আবার কি কথা! কে বলেছে তোমাকে এসব?

মউ থতমত মুখে বলল, বারে, বুম্বাই তো বলে।

মধুমিতা কটমট করে তাকাল, –দেখেছেন? দেখেছেন এই টুকু টুকু বাচ্চাদের অবস্থা!

–ওদের আর কী দোষ। যা দেখে, যা শোনে, তাই বলে। ওদের সামনেই সকলে সব আলোচনা করছে…

–আমি এসব একদম পছন্দ করি না। মউকে কোল থেকে নামিয়ে দিল মধুমিতা, যাও, দিদার কাছে যাও। হাঁ করে বড়দের কথা শুনতে হবে না।

–আমি যাবই না। আমি কাকুর কাছে থাকব।

 –না। তুমি যাবে। নইলে কিন্তু আমি রাগ করব। মধুমিতার চোয়াল কঠোর, তুমি ও ঘরে গেলে আমি কিন্তু আর অফিস থেকে ফিরব না মউ।

মউয়ের মুখ ছোট্ট হয়ে গেল। ছলছল চোখে বেরিয়ে যাচ্ছে ঘর থেকে। কেমন থমথমে হয়ে গেল ঘরটা।

কন্দর্প বিড়বিড় করে বলল, তুমি কিন্তু খুব নিষ্ঠুরের মতো কথা বললে মধুমিতা।

মধুমিতা নীরব। আঙুল দিয়ে নখ খুঁটছে। কন্দর্প আবার বলল, তুমি কি ওকে এইভাবেই ভয় দেখাও? জানো, এসব কথায় বাচ্চাদের মনে কি রিঅ্যাকশান হতে পারে? শি ইজ সো লাভিং… শি ইজ সো টেন্ডার… এর মধ্যে ওর মনে যদি আতঙ্ক ঢুকে যায়…

–আমার কথা কেউ বোঝে না। আমার যেন কোনও প্রাইভেসি থাকতে নেই! মধুমিতা নাক টানল, সামনে বসে আমাদের সব কথা গিলবে, আর বাইরে গিয়ে উগরে দেবে। আর আমি শাসন করলেই দোষ!

কন্দর্পর বলতে ইচ্ছে হল, আমরা কি তেমন কথা কিছু বলি কখনও!

 কিছু না বলে বসে রইল নিষ্পন্দ। তারপর উঠে গিয়ে দাঁড়াল জানলায়। একটু বুঝি আড়াল খুঁজছে। বাইরে আঁধার নামছে দ্রুত। সেই আঁধারই ছায়া ফেলছে কন্দর্পর বুকে।

ফস করে কন্দর্প বলল, বুম্বার বাবার সঙ্গে তোমার যদি পরিচয় থাকে, তার কাছেই কম্পিউটার শিখে নিতে পারো।

মধুমিতা কি একটু থমকাল! তার সিক্ত আঁখিপল্লবে একঝলক বিদ্যুৎ খেলে গেল যেন। রহস্যময় স্বরে বলল, পারিই তো। বললেই কল্যাণবাবু খুব মন দিয়ে শেখাবেন।

–ভাল করে শিখলে তোমারই আখেরে লাভ। কন্দর্প জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকাল। পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট হাতড়ে বার করল, কিন্তু ধরাল না। ভীষণ সহজভাবে বলার চেষ্টা করল, কম্পিউটার নিয়ে কী করেন ভদ্রলোক?

কনসালটেন্সি। অ্যাকাউন্টস-এর জব।

বাহ, তা হলে তো তোমার সুবিধেই। আসল কাজটা শিখে নিতে পারো। কন্দর্পর স্বর ঠিক ঠিক ফুটছিল না।

সহসা খিলখিল হেসে উঠল মধুমিতা। হাসির আওয়াজ যাতে চৌকাঠ না ডিঙোতে পারে তার জন্য মুখে আঁচল চেপে ধরেছে। হাসির দমকে মুখ গোলাপি হয়ে গেল। হঠাৎ হঠাৎ ঘাড় ঝাঁকাচ্ছে, আবার লুটিয়ে পড়ছে হাসিতে।

কন্দর্প ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। গোমড়া মুখে বলল, –হাসছ কেন? এত হাসির কি হল?

অনেক কষ্টে হাসির ফোয়ারার মুখ বন্ধ করেছে মধুমিতা। ভীষণ চিন্তিত এক মুখ বানিয়ে বলল, কিন্তু আমার যে একটা প্রবলেম হয়েছে।

কী?

–কল্যাণবাবুর কাছে আমার কম্পিউটার শিখতে ইচ্ছেই করে না।

ছদ্ম কৌতুক বুঝেও ভারী মুখে জানলা থেকে ফিরল কন্দর্প। গ্রাম্ভারি ভাবটা বজায় রেখে বলল, –আমি কিন্তু তোমার ভালর জন্যই বলেছিলাম।

–আপনি বুঝি আমার ভাল চান? মধুমিতার মুখভাবে বিকার নেই।

–চাই না? নিজের কাছেই কথাটা কেমন অসহায় শোনাল কন্দর্পর।

আবার হাসিতে ভেঙে পড়েছে মধুমিতা। কানের লতি দুলছে। গলার কাছে একটা নীল শিরা কাঁপছে তিরতির। কোথা থেকে এক বিদ্যুত্তরঙ্গ ভেসে বেড়াচ্ছে হাওয়ায়। শরীরের রোমকূপ শিহরিত হচ্ছে বারবার। ওই নারীকে কি একটু ছুঁয়ে দেখবে কন্দর্প? থাক। দৃশ্যটা ভেঙে যাবে।

কন্দর্প উঠে দাঁড়াল, –তুমি হাসতেই থাকো। আমি চলি।

সঙ্গে সঙ্গে হাসি উধাও, এ কি! এখনই কোথায়! বসুন। মউয়ের সঙ্গে তো আপনার গল্পই হল না। ওকে ডাকি।

–আজ নয়। আরেক দিন হবে। আজ একটু দিদির বাড়ি যাব।

–ও তাই বলুন। দিদির বাড়ি এসেছেন বলেই এখানে একটু দেখা দিয়ে গেলেন!

কন্দর্প ম্লান হাসল।

মধুমিতা স্থির তাকিয়ে রইল কন্দর্পর দিকে। চোখ সরাচ্ছে না। অদ্ভুত এক স্খলিত মুহূর্ত।

 ক্ষণ পরেই মুহূর্তটাকে ভেঙে দিল মধুমিতা। চোখ সরিয়ে চঞ্চল হল, ইশ, দেখুন তো আমি কী! এতক্ষণ এসেছেন, একবারও আপনার বাড়ির কথা জিজ্ঞেস করলাম না! দাদা বউদি কেমন আছেন? মেজদারা?

–আছে একরকম। দাদা-বউদি এখনও ধাক্কাটা সামলে উঠতে পারেনি। বাবা ওদের দুজনকে খুব ভালবাসত তো।

বাবা বুঝি আপনাকে ভালবাসতেন না?

–আমি যখন জন্মেছি, তদ্দিনে বাবার সব ভালবাসা খরচ হয়ে গেছে। কন্দর্পও হালকা হতে চাইল, আমার জন্য তখন পড়েছিল শুধু চ্যালাকাঠ। দেখবে, এখনও কাঁধে দাগ আছে!

–থাক। ছোটবেলায় কোথায় কি মারপিট করেছেন, এখন সেটা বাবার নাম করে চালাতে চাইছেন।

–বিলিভ মি। আমি কোনওদিন মারকুট্টে ছিলাম না। আমিও না। মেজদাও না। মারপিট করত আমার বড়দা। কোথায় কে একটা কি বলল, ব্যস ওমনি ডাণ্ডা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। ইনফ্যাক্ট দাদাকে চটানোর জন্য আমাকেও চাঁটি মেরে যেত অনেকে।

দু-চারটে লঘু গল্পগাছা করে বেরিয়ে এল কন্দর্প। দরজায় দাঁড়িয়ে মউকে বলল, তোমার মাকে আমি খুব বকে দিয়েছি। আর যদি তোমাকে কিছু বলে…

মউ বড় অল্পেই খুশি। ছোট্ট একটা অলৌকিক হাসি উপহার দিল কন্দর্পকে। মায়ায় ভরে গেল কন্দর্পর বুক। বাচ্চাটার জন্যও কি বেঁচে থাকতে পারত না দীপঙ্কর!

একতলায় নেমে দু পাশের দুটো ফ্ল্যাটের দিকে তাকাল কন্দর্প। দু দিকেরই দরজা বন্ধ। কোনও দরজাতেই নেমপ্লেট নেই। কোন ফ্ল্যাটে থাকে কল্যাণ!

কটমট করে দরজা দুটো দেখছে কন্দর্প। এক প্রৌঢ় সিঁড়িতে এসে থমকে গেল, কাউকে খুঁজছেন আপনি?

না তো। কন্দর্প একটু নার্ভাস হয়ে গেল, আমি ওপর থেকে নামছি।

ও।

সন্দিগ্ধ চোখে কন্দর্পকে দেখতে দেখতে উঠে যাচ্ছে ভদ্রলোক। আরও বিরক্ত মুখে মাথায় হেলমেট চড়াল কন্দর্প। স্টার্ট দিল স্কুটারে। ভুল করে ওপরের দিকে তাকিয়ে ফেলল একবার। সেদিনের সেই কাশফুল নিথর দাঁড়িয়ে আছে জানলায়। একা।

.

জয়শ্রী ছুরিতে আলু কাটতে কাটতে টিভি দেখছিল, ভাইকে দেখে বেশ অবাক, তুই হঠাৎ! এই সন্ধেবেলা!

অনেকক্ষণ পর কন্দর্প গা এলিয়ে বসল, দিদির বাড়ি এলে আবার কৈফিয়ত দিতে হয় নাকি! নে, চা-ফা চড়া। কিছু খাবারদাবার খাওয়া। বাই দা বাই, ঝান্টুটা নেই তো?

–না। কেন রে?

–এমনি। সন্ধেটা মাটি করতে চাই না, তাই। কন্দর্প আরাম করে সিগারেট ধরাল, –তোর হের বর কোথায়? রোববারও পাম্পে পাম্পে ঢুঁ মারছে নাকি! শংকরদা মাইরি একদিনও ইনকাম বাদ দেবে না!

বলার সঙ্গে সঙ্গেই শংকরের আবিভাব। সঙ্গে একটা মিস্ত্রি মতন লোক। কন্দর্পকে না দেখেই সোজা ঢুকে গেল ভেতরে। শোওয়ার ঘরের আলমারি খুলল ঘটাং করে। বন্ধ করল। আবার হনহন করে বেরিয়ে যেতে গিয়ে থমকে দাঁড়াল, শালাবাবু যে! কতক্ষণ?

–এই এলাম। আপনি খুব ব্যস্ত বুঝি?

–লিটল বিট। আঙুল টিপে মাপটা বোঝাল শংকর, যেয়ো না। দেখা হয়ে ভালই হল। তোমার সঙ্গে কথা আছে।

কন্দর্প শংকরকে আমল দিল না, আমাকে কদ্দূর যেতে হবে। আপনি কখন ফিরবেন তার ঠিক নেই…

–আহ, বহেজ কোরো না। বোসো। বলছি যখন কথা আছে, তখন কথা আছে। ফাঁকা কথা নয়, তোমারও ইন্টারেস্টের সওয়াল।

শংকর দুদ্দাড়িয়ে চলে গেল।

.

৪৮.

কন্দর্প একটা ম্যাগাজিনের পাতা ওল্টাচ্ছিল। চটি মতন। খেলার পত্রিকা। পাতায় পাতায় ছবি। রঙিন, সাদাকালো। ফুটবল ক্রিকেট ভলিবল টেনিস হকি। ময়দানের প্রচুর চুটকি খবরও রয়েছে।

কিছুই দেখছিল না কন্দর্প। পড়ছিলও না। শংকর এসে কি বলবে তা নিয়ে সে খুব ভাবিতও নয়। হবে কোনও সাংসারিক জটিল কূটকৌশল। কন্দর্পর কানে এখনও আছড়ে পড়ছে এক হাসির প্রপাত। খিলখিল রিনরিন।

কেন হাসে নারী!

কন্দর্পদের বাড়ির পাশেই, যেখানে এখন ফ্ল্যাটবাড়ি উঠেছে, সেখানে ভারি সুন্দর গোল বারান্দাঅলা বাড়ি ছিল একটা। দোতলা।

ডলিদি মিলিদিদের। দু বোন পালা করে চুল আঁচড়াত বারান্দায় দাঁড়িয়ে। আর টেরিকাটা, আদ্দির পাঞ্জাবি পরা নন্টুদা তখন অবিরাম পাক খেত সামনের রাস্তায়। হঠাৎ হঠাৎ স্টিল ফ্রেমের গগলস চড়াত চোখে, ফাঁপানো চুলে কায়দা করে আঙুল চালাত। হাঁটাটাও ভারি মজাদার ছিল নদার। হাঁসের মতো দুলে দুলে হাঁটত। নন্টুদাকে দেখলেই ডলিদি ডাকত মিলিদিকে। মিলিদি ডাকত ডলিদিকে। তারপর দু বোন লুটোপুটি খেত হাসিতে। ডলিদির বিয়ে হয়েছে এক এন আর আই পাত্রর সঙ্গে। মিলিদির বর আই এ এস। আর নন্টুদা এখন মোড়ের চায়ের দোকানে বসে থাকে দিনরাত। সাট্টার পেনসিলার। চা খেয়ে খেয়েই লিভার পচিয়ে ফেলেছে। বিয়েটাও হয়ে ওঠেনি বেচারার।

কন্দর্পকেও কি ওরকম বোকা প্রেমিক ঠাউরেছে মধুমিতা!

হতেও পারে। জীবনে যখন একটু সাফল্যের মুখ দেখছে কন্দর্প, তখন তো সঙ্গে একটু দুঃখও পেতে হবে। না হলে যে সাফল্যের পেয়ালা ভরে না।

জয়শ্রী খাবার থালা নিয়ে ঘরে এসেছে, নে, তোর জন্য কটা গরম গরম কচুরিই ভেজে আনলাম।

পলকে খুশির চাদর জড়িয়ে নিল কন্দর্প, বাস! ফ্লেবার কী! শংকরদা কারুর ক্ষেত থেকে কড়াইশুটি ঝেঁপে এনেছে নাকি রে?

জয়শ্রী গাল ফোলাল, সব সময়ে ওকে নিয়ে ফাজলামি করিস কেন বল তো?

–ফাজলামি! শংকরদাকে নিয়ে! শংকরদারই গুহায় বসে! আমার ঘাড়ে একটাই মাথা আছে বাপ!

–দেব এক কানচাপাটি।

–দিদি প্লিজ, পতিনিন্দা সহ্য করতে শেখ। ফুট করে সতী হয়ে যাস না। কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। তোর লাশ কাঁধে নিয়ে ঘুরতে শংকরদার তো কালঘাম ছুটবেই, মাঝখান থেকে ব্যাটা ঝান্টু…

অ্যাই চোপ। আলুর দমটা খা। বল কেমন হয়েছে?

থালাটা নাকের কাছে এনে শুকল কন্দর্প, ফাইন।

না খেয়েই বললি?

 –ভাল জিনিস খাওয়ার দরকার হয় না। গন্ধে মালুম হয়।

 –তিব্বতি আলুর দম। টিভি দেখে শিখেছি।

তিব্বতিরা আলুর দম খায়! জন্মে শুনিনি তো! ওই বরফের দেশে ঘাস গজায় না, আলু হয়!

চালান-টালান যায় বোধ হয়। ওরা হয়তো পালেপাব্বনে খায়। কাশ্মীরি কার্পেটে পা ছড়িয়ে বসল জয়শ্রী। ভারী শরীরটাকে একটু ছাতাপাতা করে নিল। শব্দ করে শ্বাস ফেলে বলল, বাবাকে একদিন এই আলুর দমটা রেঁধে নিয়ে গিয়ে খাইয়েছিলাম। কী তোলা তোলা করে খেয়েছিল বাবা!

বাবা তো…। থেমে গেল কন্দর্প। একটু যেন বিষণ্ণ ভাব এল গলায়। বলল, মন খারাপ করে আর কী করবি? ভবিতব্য ছিল, ঘটে গেল।

আঁচলটা একবার চোখে বুলিয়ে নিল জয়শ্রী। বলল, না রে চাঁদু, আমি এখনও ঠিক মানতে পারি না। আপন জনের কাছ থেকে অত বড় আঘাত না পেলে…।

–দাদার কথা বলছিস? কন্দর্পর হাত থেমে গেল, দাদার সঙ্গে তো বাবার নিত্যদিনের ঝগড়া। ও আর বাবা গায়ে মাখত নাকি? তা ছাড়া দাদাও তো কম শাস্তি পায়নি। এখন কেমন পাগলের দশা হয়েছে বল?

–কেন আসল কথাটা এড়িয়ে যাচ্ছিস চাঁদু?

কী কথা?

আগের রাতে বউদি যদি বাবাকে দিয়ে জোর করে সইটা না করিয়ে নিত…

–তোকে কে বলল বউদি জোর করেছে?

–এসব কথা বলতে হয় না ভাই। বোঝা যায়।

–কী করে?

আমি বললাম, মেজদা বলল, তুই বললি, দাদাও বোধহয় একবার কথাটা তুলেছিল… বাবা নিজের ছেলেমেয়েদের কথায় রাজি হল না, আর একটা পরের মেয়ের কথায় নাচতে নাচতে সই করে দিল! এত আনন্দে সই করল যে রাত পোয়াতেই প্রাণবায়ু বেরিয়ে গেল। আমাকে তুই অত মুখ্যু ভাবিস না চাঁদু।

কন্দর্প বড়সড় ঝাঁকুনি খেল। শ্রাদ্ধের দিনই খানিকটা কানাঘুষো চলছিল বটে, কিন্তু সেটা যে পল্লবিত হয়ে এই আকার ধারণ করেছে এটা সে কল্পনাও করতে পারেনি। সংসার বড় গভীর গাড্ডা। কোন দিকের জল যে কোন দিকে গড়িয়ে যায়! ভীষণ খারাপও লাগছিল কন্দর্পর। বউদি তো দ্বিধাতেই ছিল, সে যদি সেদিন কাগজটা এগিয়ে দিয়ে কানের কাছে শাস্ত্রবাণী না আওড়াত তা হলে হয়তো আরও একটু ভাবত বউদি। হয়তো পরদিন বলত। কি তার পরদিন। পরক্ষণে নিজেকে শক্ত করল কন্দর্প। মৃত্যু তো এক অমোঘ নিয়তি। বউদির সঙ্গে কথা না হলেই কি সেদিন পরোয়ানা ফিরে যেত!

তবে এ কথা যখন একবার ছড়িয়েই গেছে, এখন আর লোকজনের মুখ বন্ধ করা মুশকিল। এক জায়গায় মুখ আটকাতে গেলে দশ জায়গা দিয়ে গাঁজলা হয়ে ফেটে বেরোবে। বেচারা বউদি।

কন্দর্প ভার গলায় বলল, তুই ভুল করছিস রে দিদি। বাবা সই করার জন্যই মারা যায়নি। সই যদি বাবা করেও থাকে বউদির মুখ চেয়েই করেছে।

বাজে কথা। আমি বিশ্বাস করি না।

বাবা যে বউদিকে খুব ভালবাসত, এ কথা তো মানবি? ছেলেমেয়েদের থেকেও বউদি অনেক বেশি প্রিয় ছিল বাবার।

–অসম্ভব। তোর এ কথাও আমি মানতে পারলাম না। হ্যাঁ, এটা ঠিক বাবার একটা দুর্বলতা ছিল বউদির ওপর। সেটাকে তুই এক ধরনের অপরাধ বোধও বলতে পারিস। অবশ্য আমার মতে তারও কোনও মানে হয় না। জয়শ্রী উঠে টেবিল থেকে পানজর্দার কৌটো নিয়ে এল। এক মুখ সুপুরি কচকচ চিবোচ্ছে। আবার থেবড়ে বসল কার্পেটে। ঝুঁকে বলল, একটা কথা বুকে হাত দিয়ে বল দেখি চাঁদু। আমাদের দাদা ওই বউকে বিয়ে করার আগে কী এতটা বাউন্ডুলে ছিল? দাদার এই আজকের অবস্থার জন্য বউদির কোনও দায় নেই বলতে চাস? কী পেয়েছে ওই বউয়ের কাছ থেকে? বিয়ের পর থেকেই? হেলাফেলা আর লাথি ঝাঁটা ছাড়া?

বউদিই বা কী এমন সুখে আছে রে?

–মেয়ে মানুষকে সুখ পেতে গেলে অনেক কপাল করে আসতে হয়। আমি বিয়ে করার সময়ে আমার বরের কী হাল ছিল? আর এখন…! তোর শংকরদাকে তালেবরটি করার জন্য কম লেগে থাকতে হয়েছে আমাকে! দাদার জন্য বউদি অসুখী হয়েছে, না বউদির জন্য দাদা, সেটা এখন ভেবে দেখা দরকার।

ইঙ্গিতটা আস্তে আস্তে বিপজ্জনক দিকে যাচ্ছে। কন্দর্প টের পাচ্ছিল। সব পথই ঘুরে ফিরে রোমের দিকে যায়!

মাথা নিচু করে একটা কচুরি শেষ করল কন্দর্প। জল খেল এক ঢোঁক। একটু মিনতির সুরে বলল, বউদির কথাটাও একবার ভাব দিদি। কত হেলপলেস অবস্থায় পড়লে তবে বউদি বাবার কাছে গিয়ে…

বাপ্পার টাকার কথা বলছিল? হুহ, মাত্র তো পঞ্চাশ হাজার টাকা! তোর শংকরদাকে বললে এক দিনে অ্যারেঞ্জ করে দিত। সে নয় দেমাক, চাইবে না। নিজের প্রেসটা তো বেচে দিতে পারত।

–ওই লঝঝড় মার্কা প্রেস বেচে ক টাকা পেত? কোন মহাজন সাত দিনে প্রেস কিনে পঞ্চাশ হাজার টাকার থলি উপুড় করে যেত রে?

–আমার মুখ ছোটাস না চাঁদু। তুইও জানিস, আমিও জানি, বউদির টাকা পাওয়ার আরও অনেক রাস্তা ছিল।

শুভাশিসের দিকে একটা প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত ভাসিয়ে দিল জয়শ্রী। ভাইয়ের প্রতিক্রিয়াটা লক্ষ করল সরু চোখে। কন্দর্পর থমথমে মুখ দেখে কোমল হল সামান্য। গলা নামিয়ে বলল, মেজদাই তো টাকাটা দিতে চেয়েছিল।

কন্দর্প জোর বিষম খেল।

কাশতে কাশতে কচুরির টুকরো ছিটকে আসছে মুখ থেকে। হাঁপাতে হাঁপাতে দম নিল একটু। এ বৃত্তান্ত তার ঘুণাক্ষরেও জানা ছিল না।

জয়শ্রী পানের পিক গিলে বলল, –মেজবউদি আমাকে সব বলেছে।

লাই। আমি বিশ্বাস করি না। মেজদা টাকা দিতে চেয়েছে? মেজগিন্নি জানত সে কথা? অ্যাবসার্ড। মেজবউদি গল্প বানাচ্ছে।

–উউঁহু, বড়বউদির কথা বেদবাক্য, আর মেজবউদি মিথ্যেবাদী! ঠিক আছে চল, আমি সামনা-সামনি ভজিয়ে দেব।

কন্দর্প প্রমাদ গুনল। লেজে আগুন নিয়ে গিয়ে আর একটা লঙ্কাকাণ্ড বাধাবে নাকি দিদি! মধুমিতার বাড়ি থেকেই কেটে পড়া উচিত ছিল।

ঝটিতি কচুরি শেষ করে হাত ধুয়ে এল কন্দর্প। সোফার কাঁধে ফেলে রাখা উইন্ডচিটারটা পরে নিল।

জয়শ্রী হাঁকপাক করে উঠেছে, এ কি, তুই যাচ্ছিস কোথায়? দাঁড়া, চায়ের জল বসাচ্ছি।

–তোর ওই তিব্বতি আলুর দমের পর আর চা চলে না। বাই।

–ও যে তোকে বসতে বলে গেল!

জরুরি দরকার থাকলে ফোন করতে বলবি। আমি কাল সারা সকাল বাড়ি আছি।

–তুই কিন্তু আমার ওপর রাগ করে চলে যাচ্ছিস চাঁদু!

 কন্দর্প আলগা টোকা মারল দিদির গালে, না রে দিদি। দুপুরে মুর্শিদাবাদ থেকে ফিরলাম। বড্ড টায়ার্ড। বাড়ি গিয়ে একটা প্রমত্ত ঘুম লাগাতে হবে।

নিশ্চিন্তে বেরোনো হল না। স্কুটারে স্টার্ট দিতে না দিতেই শংকর। কালিঝুলি মাখা ভগ্নদূতের মতো চেহারা।

চলে যাচ্ছ! বললাম না তোমার সঙ্গে কথা ছিল!

–আপনিই তো নিপাত্তা। কতক্ষণ অপেক্ষা করব?

–আর বোলো না। আমার গাড়িটা রাস্তায় গিয়ার বক্স ভেঙে পড়ে ছিল। ড্রাইভারকে নিয়ে ঠেলেঠুলে গ্যারেজে ঢুকিয়ে এলাম। রোববারের বাজার, তায় শীতকাল, কত কষ্টে যে গ্যারেজটা খোলালাম! শংকর নিজের পোশাকটা দেখাল, নিজে নিজেই কলকবজা খোলার চেষ্টা করছিলাম, দ্যাখো কি হাল হয়েছে! কবে এসব কাজ ছেড়েছি, আর কি পোয়! এসো এসো। দশ মিনিট আরও বসে যাও।

আজ আর বসব না শংকরদা। কন্দর্প ঘড়ি দেখল, বলুন না কী বলবেন?

–একটু সময় লাগবে হে।

লাগুক। বলুন। কন্দর্প একটা সিগারেট ধরিয়ে প্যাকেট বাড়িয়ে দিল।

একখানা দলামোচড়া কালো ন্যাকড়া পকেট থেকে বার করল শংকর। চেপে চেপে হাত মুছে। সিগারেট ধরাল। ঘন ঘন দু-তিনটে টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ল গলগল। প্রায় স্টিম ইঞ্জিনের মতো।

তারপর দুম করে বলল, বড়বউদির সব পরিশ্রম তো ভস্মে গেল হে।

–কেন?

–তুমি আমাকে প্রশ্ন করছ, কেন! ইউ! অশোক মুস্তাফি তো তোমার প্রোমোটার। তুমি তো তারই বইয়ের শুটিং করে বেড়াচ্ছ! তুমি তার কাছের লোক, খবরটা তো তোমারই আগে জানা উচিত!

-হেঁয়ালি ছেড়ে স্পষ্ট করে বলুন। কন্দর্প সামান্য রুক্ষ হল, আমার ভাল লাগছে না।

–চটো কেন শালাবাবু? ঠাট্টা বোঝো না? সেদিন তোমার মুস্তাফিবাবু আমাকে বললেন..

 কন্দর্প বাধা দিল, মুস্তাফিবাবুর সঙ্গে আপনার কোথায় দেখা হল?

-কোথায় দেখা হল সেটা বড় কথা নয়। কী কথা হল সেটাই আসল। ধরো আমাদের চিনেবাজারের ফুটপাতে দেখা হয়েছিল। উনি কাচের বয়াম কিনছিলেন, আমি বেতের ঝুড়ি। হা হা।…মুস্তাফিবাবু বললেন, এত প্ল্যান প্রোগ্রাম ছকলাম, পুরো এগ্রিমেন্টটাই বেকার হয়ে গেল! কী দুর্দৈব! আমি বললাম, কেন? উনি বললেন যাঁর সঙ্গে লেখাপড়া, কাজ শুরু হওয়ার আগেই তো তিনি ইহধাম ত্যাগ করলেন। এখন আমাকে আবার নতুন করে এগ্রিমেন্ট করতে হবে। সব কজন ছেলেমেয়ের সঙ্গে। দুঃখ করছিলেন, মাঝখান থেকে ওঁর হাজার পঞ্চাশেক টাকা নাকি গলে গেল। তা আমি বললাম, হাহুতাশ করছেন কেন? চাঁদু আছে, আমরা আছি, একটা কিছু ব্যবস্থা হবেই।

শংকর থামল। কন্দর্প তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল শংকরের দিকে, –থামলেন কেন? বলুন। বলে যান।

–হ্যাঁ, বলতে তো হবেই। ওঁর কথা শুনে মনে হল ওঁর মনোগত বাসনা তোমরা চার ভাইবোন একদিন একসঙ্গে বসো। এগ্রিমেন্ট নিয়ে আলোচনা করো। যদি কারুর কোনও আপত্তি না থাকে, তবে ওই বয়ানই সাজিয়ে গুছিয়ে উনি পাঠিয়ে দেবেন, তোমরা চারজন সই মেরে দাও। জ্বলন্ত সিগারেট পাশের বনতুলসীর ঝোপের দিকে ছুঁড়ে দিল শংকর। অল্প অল্প ধোঁয়া উঠছে ঝোপ থেকে, ক্রমশ নিবে যাচ্ছে আগুন। সেদিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে শংকর বলল, আমি অবশ্য এগ্রিমেন্টের বয়ান জানি না, তুমি জানতে পারো। তা পঞ্চাশ হাজার টাকাটা বড়বউদি কোন অ্যাকাউন্টে পেল?

কন্দর্পের মুখ বিদ্রূপে বেঁকে গেল, অশোকদা এত কথা বলল, এটা আপনাকে বলেনি?

বলব বলব করছিল, আমি সেরকম গা করলাম না। আফটার অল এটা আমার শ্বশুরবাড়ির ফ্যামিলি ম্যাটার, বাইরের লোকের কাছ থেকে আমি সব কথা শুনব কেন? বলো, ঠিক করিনি?

কন্দর্প হাসল। আকাশের দিকে তাকাল একবার। মেঘের সর ছিঁড়ে মলিন আলো বিছিয়ে গেছে চতুর্দিকে। ঠাণ্ডা ভাবটা বাড়ছে, বাড়ছে। স্কুটারে আলগাভাবে চেপে বসে কন্দর্প হাসিটা ধরে রাখল মুখে। বলল– শ্বশুরবাড়ির ফ্যামিলি ম্যাটার, আপনারই জেনে কী হবে শংকরদা?

–আমার কিছু নয়। অপমান গায়ে মাখল না শংকর। বলল, –তোমার দিদি এর মধ্যে আছে বলেই বলা।

স্কুটারে স্টার্ট দিল কন্দর্প। হেলমেটের কাচ নামাতে নামাতে ক্ষীণ শুনতে পেল, তোমরা তা হলে বসছ কবে?

কন্দর্প চেঁচাল, –সে দিদিকে জানিয়ে দেব।

.

পরদিন দুপুরেই অশোক মুস্তাফির অফিসে গেল কন্দর্প। গিয়েই শোনে যা ভেবেছে তাই, শংকর নিজেই অশোকদার অফিসে এই ঠাণ্ডায় তিন বোতল কোল্ড ড্রিঙ্কস খেয়েছে, আটটা সিগারেট ধসিয়েছে, এবং জ্বালিয়েছে বহুক্ষণ। হেন প্রশ্ন তেন প্রশ্ন, প্রশ্নের আর তার শেষ নেই। শংকরের মতো এমন স্যাম্পেল-আত্মীয় কোত্থেকে জোটাল কন্দর্প!

মুখ লাল করে কন্দর্প হজম করল সব কথা। শুটিং নিয়ে দুটো-চারটে দরকারি কথা বলে বাড়ি ফিরে এল। ইন্দ্রাণী প্রেসে ছিল, ডেকে নিয়ে এল নিজের ঘরে। গম্ভীর মুখে বলল, এবার তো আমাদের সবাইকে একদিন একসঙ্গে বসতে হয় বউদি।

ইন্দ্রাণী ফ্যাল ফ্যাল তাকাল, কীসের বসা?

বাবা তো আর নেই, ভাইবোনেদের মধ্যে এখন খোলাখুলি কথা হওয়া প্রয়োজন।

তাড়া কিসের? হবে।

–তাড়া আছে। মেজদা যে সাকসেশন সার্টিফিকেট বার করার কথা বলছিল, তার কী হল?

 –তোমার দাদার যা অবস্থা…দীপু বলছিল….আর কটা দিন….

–নো মোর আর কটা দিন। তুমি মেজদাকে শিগগিরই মিটিং ডাকতে বলল।

 –এত উতলা হয়ে পড়েছ কেন চাঁদু?

কারণ আছে। আই ক্যান স্মেল আ ফিউম। বাতাসে বারুদের গন্ধ পাচ্ছি বউদি।

ইন্দ্রাণী শ্লথ পায়ে চলে গেল।

শুয়ে আছে কন্দর্প। শুয়েই আছে।

.

৪৯.

সরু গলির ভেতর বাইন্ডিংখানা। ভরা দুপুরেও আলো জ্বলছে ঘরটায়। স্যাঁতসেঁতে মেঝেতে বসে শুকনো চেহারার তিনটি মেয়ে ছাপা কাগজের ফর্মা ভাঁজ করে চলেছে। যন্ত্রের মতো। ঘরে আছে আর একজন মধ্যবয়সী লোক, পাশে তার লেই-এর টিন।

ইন্দ্রাণী দরজায় এসে দাঁড়াল। চোখ চালাচ্ছে ভেতরে, বিপদবাবু নেই? বিপদ, অর্থাৎ বিপদভঞ্জন বাইন্ডিংখানার মালিক। পিছনের শ্যাওলা ধরা কলতলায় টিফিনকৌটো ধুচ্ছে। উঁচু গলায় সাড়া দিল, বসুন দিদি। আসছি। এই বিশু, দিদিকে একটা টুল দে।

ইন্দ্রাণীকে দেখেই মেয়ে তিনটির চোখে খুশির ঝিলিক। একটি মেয়ে কি যেন ইশারা করল দ্বিতীয়জনকে। দ্বিতীয়জন তৃতীয়কে। তৃতীয় মধ্যবয়সীকে বলল, ও বিশুদা, টুলটা এগিয়ে দিন না। দিদি যে দাঁড়িয়ে আছেন। বলেই ইন্দ্রাণীর দিকে ফিরে চোখ টিপল। মজা করছে বিশুর সঙ্গে!

বিশু বিরস মুখে বলল, তুই দে না। আমার হাতে আঠা।

দ্বিতীয় মেয়েটি খিলখিল হেসে উঠল, বাবু তো আমাকে বলেনি, আপনাকে বলেছে।

বললেই হল! এখন ওঠা যায়! তোরা এমন দিক করিস না! বিশু রীতিমতো বিরক্ত। মেয়েরা সমস্বরে কিচমিচ করে উঠল, আহ, একটু উঠলে কি হয়!

–আমাদের ফর্মা গোলমাল হয়ে যাবে না!

ইশ। দিদি কতক্ষণ দাঁড়িয়ে আছেন! ও বিশুদা, বিশুদা গো…

এ সব রঙ্গরস রোজই চলে। একঘেয়ে কাজের মাঝে একটু বিনোদন। অন্য দিন মুচকি মুচকি হাসে ইন্দ্রাণী, আজ তার বিরক্ত লাগছিল। নিজের মন ঠিক না থাকলে সামনের লোকজনের হাসি মশকরা অসহ্য লাগে।

কথা না বলে সন্তর্পণে কাগজের স্তূপ টপকে কাটিং মেশিনের পাশের টুলে গিয়ে বসল ইন্দ্রাণী। রোদ্দুর থেকে নোনাধরা ঘরে ঢুকে শীত শীত করছে, পাতলা চাদরটা সাপটে নিল গায়ে। কদিন ধরেই চাপা একটা নিশ্বাসের কষ্ট হচ্ছে, জোরে জোরে শ্বাস টানল। কোথায় অক্সিজেন? ছাপা কাগজের আনকোরা গন্ধের সঙ্গে একটা চোরা দুর্গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে বাতাসে। ভাল লাগে না, কিচ্ছু ভাল লাগে না।

বিপদ ঘরে এল। সে প্রায় দুর্লভেরই সমবয়সী, দুর্লভের পাশের গ্রামে থাকে, দুর্লভের সূত্রেই তার এই বাইন্ডিংখানার সঙ্গে ইন্দ্রাণীর জানাশোনা। কাজেকর্মে সস্তা না হলেও নগদানগদি টাকা গুনতে হয় না, এটুকুই ইন্দ্রাণীর লাভ।

তা সে লাভের দিনও তো ইন্দ্রাণীর ফুরিয়ে এল! ইন্দ্রাণী কেজো গলায় বলল, আমার হিসেবটা করে রেখেছেন? লুঙ্গিপরা বিপদ পরিষ্কার গামছায় টিফিন কৌটো মুছছে। দেওয়ালের তাকে কৌটো রেখে বলল, –আপনি সত্যি সত্যি সব মিটিয়ে দেবেন?

–দুর্লভবাবু আপনাকে বলে যাননি?

–হ্যাঁ বলেছিল। তবে…। বিপদ কোণের টেবিল থেকে একটা আধছেঁড়া ডায়েরি বার করে পাতা ওলটাল, আপনার আর খুব বেশি নেই। সাতশো পনেরো।

ইন্দ্রাণী ব্যাগ খুলে টাকা বার করছে। বিপদ আবার বলল, পুরোই দিয়ে দেবেন?

হুঁ।

–প্রেস তা হলে আপনি রাখবেন না দিদি?

–না। ইন্দ্রাণী টাকা এগিয়ে দিল, গুনে নিন ভাই।

 তিনটি মেয়েরই হাত থেমে গেছে। কেমন করে যেন দেখছে ইন্দ্রাণীকে।

বিপদ টাকাটা ড্রয়ারে রেখে দিল, গুনল না। ভুরু কুঁচকে বলল, প্রেসের খদ্দের পেয়ে গেছেন?

-আসছে দু-একজন। মেশিন দেখে যাচ্ছে। আপনার হাতে কেউ আছে নাকি?

বউবাজারের একজন বলছিল। আপনার তো হাফ ডিমাই মেশিন, তাই না?

–হুঁ, হাইডেলবার্গ। দেখেছেন তো, এখনও কি ভাল ছাপা হয়।

বিপদ কথাটাকে খুব আমল দিল না। ব্যবসায়ী স্বরে বলল, কত হলে দেবেন? পার্টিকে একটা দর বলতে হবে তো।

–হাজার তিরিশেক। ইন্দ্রাণী অনেকটা বাড়িয়েই বলল।

-উরেব্বাস, অত কে দেবে! সেদিন একটা মার্সেডিজ আঠেরো হাজারে বিক্রি হল। সেও হাফ ডিমাই। বলেই কি যেন ভাবল বিপদ। হট প্রেসে কিছু বই ঢোকানো আছে, সেদিকে তাকিয়ে দেখল একটুক্ষণ, আপনার টাইপ কত আছে?

বাংলা ইংরিজি মিলিয়ে দুশো কেজি মতো হবে।

—কেজি যদি তিরিশ টাকাও হয়, তো ধরুন ছ হাজার। হিসেব কষছে বিপদ, তাহলেও তা আপনার মেশিনের দাম অনেক পড়ে যাচ্ছে!

–আপনি টাইপসুদ্ধু ধরছেন নাকি? টাইপ আমি আলাদা বেচব। ইন্দ্রাণী তড়িঘড়ি বলে উঠল, টাইপের দাম আপনি তিরিশ ধরছেন কেন? জুলাই মাসে আমি আশি টাকা করে কিনেছি… এখনও চল্লিশ কেজি টাইপ প্রায় নতুন আছে।

–সবই আপনার সিসের দরে যাবে। মেশিনও আপনি মেরে কেটে ওই আঠেরো বিশই পাবেন। আজকাল কত লোক ওসব মেশিন লোহালক্কড়ের দামে বেচে দিচ্ছে। পুরনো জিনিসের কি আর কদর আছে দিদি! বিপদ লাইটার জ্বালিয়ে বিড়ি ধরাল, বেশ তো চলছিল দিদি, কেন বেচতে চাইছেন?

ইন্দ্রাণী উত্তর দিল না। দুর্লভ কতটা কি বলে গেছে কে জানে! ইন্দ্রাণী মরিয়া হয়ে প্রেস বেচতে চলেছে, এ কথা শুনলে দর আরও কমে যাবে। সত্যিই তো আঠেরো বিশের বেশি উঠতেই চাইছে না।

ইন্দ্রাণী দাঁড়িয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে হাঁ হাঁ করে উঠেছে বিপদ, এ কী দিদি, যাচ্ছেন কোথায়! চা খেয়ে যান।

–আজ থাক বিপদবাবু, শরীরটা ভাল লাগছে না।

–একটু চায়ে কিছু ক্ষতি হবে না। ….সম্পর্ক মিটিয়ে দিলেন, এর পর কি আর আপনার পায়ের ধুলো পড়বে দিদি!

–তা কেন, আসব মাঝে মাঝে। কাছেই তো আমার বাপের বাড়ি। মানিকতলায়।

–অমন সবাই বলে, কেউ আসে না। একটা হলদেটে কেটলি বিশুর দিকে বাড়িয়ে দিল বিপদ, —একটা স্পেশাল চা নিয়ে আয় তো। বেশি দুধ দিয়ে।

অগত্যা বসতেই হয়। ইন্দ্রাণী ব্যাগ কোলে নামাল।

মেয়েরা এখনও কাজে হাত লাগায়নি, হাঁ করে কথা শুনছে। মুখে বিস্ময়, কিছুটা বিষণ্ণতাও। ইন্দ্রাণী মুখ ঘুরিয়ে নিল। মেয়ে তিনটের একটু আগের রঙতামাশা ভুলে যাচ্ছিল ইন্দ্রাণী। এই যে ছায়া মেয়েটা, বর নেয় না, দুর্গানগরে মায়ে-ঝিয়ে থাকে, মা-টা অসুখে ভোগে বারো মাস, ওই তুলসী আর শিবানী ক্যান্টনমেন্ট থেকে নটা চোদ্দর লোকালে আসে রোজ, ফেরে সেই সাঁঝবেলা পার করে, রূপ আর টাকার অভাবে বিয়ে হয়নি সামান্য হলেও ওদের সঙ্গে তো আলাপ পরিচয় হয়েছিল ইন্দ্রাণীর। নিজেদের দুঃখসুখের গল্প করত মাঝে মাঝে, ঘর পরিজনের কথা বলত, ইন্দ্রাণীকেও কত রকম সরল প্রশ্ন করত মেয়েগুলো। কোথায় যেন একটা সূক্ষ্ম নৈকট্য গড়ে উঠেছিল। হয়তো ইন্দ্রাণীও খেটে খাওয়া মেয়ে বলেই। পুজোর আগে ইন্দ্রাণী ওদের পঞ্চাশটা করে টাকা দিয়েছিল, কী উজ্জ্বল যে হয়ে গিয়েছিল ওদের মুখচোখ! প্রেসটা কি নিছক ব্যবসা ছিল? না। ছিল এক ধরনের মুক্তি। সংসার, চাকরি সব কিছুই তো একটা গণ্ডিতে আবদ্ধ, একমাত্র প্রেসের কাজেই একটু যা ডানা মেলতে পারত ইন্দ্রাণী। সেই ডানা ইন্দ্রাণী নিজের হাতে ছিঁড়ে ফেলছে, এ কষ্ট কে বোঝে!

বিশু চা এনেছে। বিপদ মেঝেয় থেবড়ে বসে বকবক করে চলেছে আপন মনে। এ পাড়ায় কোন প্রেসের কি হাল, এই সব। ইন্দ্রাণী শুনছিল না, চুমুক দিচ্ছে ভাঁড়ে। শেষ ঘণ্টা বেজে গেছে, এখন আর মায়া বাড়িয়ে কী লাভ! আদিত্য তো বলেইছিল ব্যবসা টিকবে না। অফসেটের সঙ্গে পাঞ্জা লড়া সত্যিই খুব কঠিন হয়ে পড়ছিল দিন দিন। দরে, ছাপায়, লোকজনের রুচিতে পিছিয়ে পড়ছিল প্রেস। দু বছর পরে হোক, তিন বছর পরে হোক, এ ব্যবসা মরতই।

শ্বশুরমশাই-এর মৃত্যুটাও যদি এই চোখে দেখতে পারত ইন্দ্রাণী!

.

উমা বলল, কাল রাতে আমি একটা স্বপ্ন দেখেছি রে ইনু।

মার পাশে শুয়ে আছে ইন্দ্রাণী। ক্লান্ত লাগছে, তন্দ্রায় জড়িয়ে আসছে দু চোখ। হালকা ঘোরের মধ্যে রলল, কী স্বপ্ন?

উমা ফিসফিস করে বললেন, তনুর স্বপ্ন।

ইন্দ্রাণী উল্টোদিকে ফিরল, —নতুন আর কী! রোজই তো দ্যাখো।

ঘরে শেষ বিকেলের আলোছায়া। আলো কম, ছায়াই বেশি। বাড়িঅলা পাম্প চালিয়েছে, একঘেয়ে শব্দ চলছে একটানা।

উমা উঠে বসলেন, না রে, এ সেরকম স্বপ্ন নয়। একদম স্পষ্ট স্বপ্ন। ভোররাতে দেখেছি।

 ইন্দ্রাণী তেমন আগ্রহ দেখাল না। দুপুরবেলা প্রায় রোজই মানিকতলায় চলে আসে আজকাল, ঢাকুরিয়ার বাড়িতে থাকতে পারে না। নির্জন ও বাড়িটাকে ওই সময়ে যেন ভূতে পায়। ছমছমে বাতাস, ঘোরে, ফিসফিস শব্দ হয়, প্রেসঘরে বসেও শান্তি নেই, হঠাৎ-হঠাৎ খকখক কাশির শব্দ ভেসে আছে। চেনা শব্দ। বুকের ভেতর গেঁথে যাওয়া শব্দ। মানুষটার শরীরই শুধু চলে গেছে, মানুষটা আছেন। বেশিরকমভাবে আছেন। বাড়ির প্রতিটি আনাচে-কানাচে। মানিকতলায় এলে অনেকটাই শান্তি। দু দণ্ড জিরোনোও হয়, আবার ভূতটাও ঘাড়ে চেপে থাকে না।

উমা টানলেন মেয়েকে, কি রে, ঘুমিয়ে পড়লি নাকি?

না।

এত বেলায় ঘুমোস না, শরীর খারাপ হবে।

 ইন্দ্রাণী চোখ খুলেও বুজে ফেলল। পেনের নিবটা ভেঙে দিলেন জয়মোহন!

উমা ঠেললেন মেয়েকে, এই ইনু।

ইন্দ্রাণী কেঁপে উঠল, ঊ?

জিজ্ঞেস করলি না কী স্বপ্ন?

অন্য ভাবনা ক্ষণিকের জন্য তোলপাড় করছিল ইন্দ্রাণীকে। শ্বশুরমশাইয়ের হাতটা কি চেপে ধরা উচিত ছিল তখন! এগ্রিমেন্টের কাগজটা তক্ষুনি কুটি কুটি করে ফেললে কি বেঁচে যেতেন মানুষটা! তবে কেন, লোকে বলে, নিয়তি কে ন বাধ্যতে! নাকি মানুষের লোভ কামনা আশা-আকাঙ্ক্ষার মাধ্যমেই চুপিসাড়ে নিজের কাজ সেরে যান নিয়তিদেবী!

উমা আবার ডাকলেন, এই ইনু, শোন না। তোর বাবাকে তো বলতে পারি না, তাই তোকেই বলি।

-হুঁ, বলো। ইন্দ্রাণী ঘুরে চোখ রগড়াল, কী দেখেছ? তনু স্কুলব্যাগ নিয়ে দৌড়চ্ছে? তনু টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে বই পড়ছে? জানলায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছে?

না রে, সেরকম নয়। উমার চোখ জ্বলে উঠেও প্রভাহীন হয়ে গেল, কাল তনুকে আর ছোট্টটি দেখিনি। সে বেশ একটা দস্তুরমতো লোক।

-হঁ? ইন্দ্রাণী আধশোওয়া হল।

হ্যাঁ রে, তবে আর বলছি কি! উমা মুখ বাড়িয়ে দেখে নিলেন ধীরাজ কাছেপিঠে আছেন কি। বিছানায় টানটান বসে বললেন, তনু বেশ তাগড়াই হয়ে গেছে রে! কী হাট্টাকাট্টা চেহারা! ইয়া চওড়া কাঁধ! মুখভর্তি দাড়ি! পুলিশের মতো কি একটা ইউনিফর্ম পরে আছে!

তনু! পুলিশের ইউনিফর্ম! বিষণ্ণ ইন্দ্রাণীও হেসে ফেলল।

হাসছিস কেন? হতে পারে না! ওই গড়পারের টুকু, তনুদের সঙ্গে খুব ওঠাবসা ছিল, ও তো এখন পুলিশে চাকরি করে। একদিন আমার সঙ্গে শনি মন্দিরের কাছে দেখা হয়েছিল। আমাকে দেখেই এগিয়ে এসে কথা বলল। তনুর কথা জিজ্ঞেস করছিল। তোর কথা জিজ্ঞেস করছিল। সে তো দিব্যি ইউনিফর্ম পরে গটগট হাঁটছে। তবে তনু কেন পরতে পারবে না?

পারবে না, কারণ তনু পিউরিটান।

–সেটা কি জিনিস? নকশালদের এখন কি যেন বললি, ওই পিউরিটান, ওই বলে নাকি?

ইন্দ্রাণী মনে মনে বলল, নকশালদের এখন কি বলে তা নকশালরাই জানে। তবে যে ভাই দিদির মুহূর্তের স্খলনকে ক্ষমা করতে পারে না, সে কি তার চামড়ার রঙ বদলাতে পারবে কোনওদিন?

মুখে বলল, ও তোমার জেনে কাজ নেই। তুমি টুকুর সঙ্গে তনুকে গুলিয়ে ফেলেছ। …তা মা, তোমার ইউনিফর্ম পরা তনু স্বপ্নে কী করছিল?

–একটা পাহাড়ি রাস্তা ধরে হেঁটে হেঁটে আসছিল। আমাকে দেখে এক গাল হেসে বলল, আমার জন্য চিন্তা কোরো না মা। আমি তোফা আছি। আমি হাত বাড়িয়ে ধরতে গেলাম, ঘুমটা ভেঙে গেল।

ইন্দ্রাণী বলল, এই তোমার স্পষ্ট স্বপ্ন!

–হ্যাঁ রে, বিশ্বাস কর। যতটুকু দেখেছি, ততটুকু এক্কেবারে স্পষ্ট। গায়ের রঙটা কেমন পুড়ে গেছে তনুর! ….ভোরের স্বপ্ন মিছে হয় না ইনু।

মা মেয়ে বসে আছে নিস্পন্দ। ঘরের আলোটুকু যেন মরে গেছে সহসা। এক তাল আঁধারের পিণ্ড গলে গলে মিশে যাচ্ছে চারদিকে। ঠাণ্ডা হয়ে আসছে ঘর। দ্রুত, অতি দ্রুত।

দম বন্ধ হয়ে আসছিল ইন্দ্রাণীর। উঠে আলো জ্বালাল। ফ্যাকাসে মুখে ফিরল বিছানায়, কতদিন আর স্বপ্ন দেখে কাটাবে মা?

 উমা চোখের কোণ মুছলেন, দেখতে কি চাই রে! এসে যায়।

–তুমিও যদি বাবার মতো হয়ে যাও…! ইন্দ্রাণী রূঢ় হতে গিয়েও থেমে গেল। নিচু গলায় বলল, তুমি দুর্বল হয়ে পড়লে বাবার কী হবে মা?

উমা চুপ। একটু পরে উঠে গেলেন রান্নাঘরে। চা করছেন। টুঙ টাঙ শব্দ হচ্ছে কাপডিশের।

ইন্দ্রাণী পাশের ঘরে এল। ধীরাজের কাছে। টিভিতে একটা কার্টুন ছবি হচ্ছে, চোখ গোল গোল করে দেখছেন ধীরাজ। প্রায় শিশুর উত্তেজনায়। কখনও হাসিতে ঠোঁট অল্প ফাঁক হয়ে যাচ্ছে, কখনও ভাঁজ পড়ছে কপালে। ইন্দ্রাণীকে দেখেও হুঁশ নেই।

ইন্দ্রাণী বলে উঠল, সব সময়ে এত টিভি দ্যাখো কেন বাবা?

–অ্যাঁ? ধীরাজ ঘাড় ঘোরাতে গিয়েও ঘোরালেন না, কিছু বলছিস?

বলছিই তো। শুনছ কোথায়?

—শুনছি তো। বল না।

–অত টিভি দ্যাখো কেন?

 –আর কী করব?

বই পড়তে পারো। আগে তো তোমার খুব পড়ার নেশা ছিল।

–দুর, পড়ে কী হবে! টিভিতেই কত গল্প দেখা যায়।

 ঠিক যেন অ্যাটমের মতো কথা। ইন্দ্রাণী কৌতুকের স্বরে বলল, গল্প দেখো ভাল কথা, তা বলে কখনও বই পড়বে না?

–মাথায় থাকে না রে। তিন পাতা পড়ি, তো গোড়াটা ভুলে যাই। হাসির বইটই হলে তবু…

–তাই পড়ো। শুধু শুধু টিভি দেখে চোখের আরও বারোটা বাজছে।

–হাসির বই পাব কোথায়?

ইন্দ্রাণী বলতে যাচ্ছিল, দিলুদাকে বোলো লাইব্রেরি থেকে এনে দেবে। বলল না। দিলুদা আর কত করবে! কেনই বা করবে!

ইন্দ্রাণী বলল, আমার স্কুলের লাইব্রেরি থেকে এনে দেব। পোড়ো।

কার্টুন শেষ। শরৎচন্দ্রের গল্প নিয়ে নৃত্যনাট্য শুরু হয়েছে। এও এক ধরনের কার্টুন, তবে ধীরাজের এতে উৎসাহ নেই। মেয়ের দিকে ফিরলেন, –তোর সঙ্গে কি যেন একটা জরুরি কথা ছিল। কী বল তো?

-বা রে, আমি কী করে বলব!

–তুই জানিস না, না? মাথা চুলকোচ্ছেন ধীরাজ। গলা ওঠালেন, ওগো শুনছ?

 ট্রে-তে তিন পেয়ালা চা সাজিয়ে ঘরে ঢুকলেন উমা, চেঁচাচ্ছ কেন?

-কি একটা কথা যেন ইনুকে বলতে বলছিলে? সেই যে গো কাল, তুমি তখন রুটি দিচ্ছিলে! রুটিটা শক্ত মতো হয়েছিল! র‍্যাশনে গম খুব খারাপ দিল! এত বড় বড় ইটের টুকরো…

–আহ থামো। উমা বেতের সোফায় বসলেন, তোর বাবাকে নিয়ে সামনের মাসে ব্যাঙ্কে যেতে হবে। ওই যে ফি বছর দুবার বেঁচে থাকার সার্টিফিকেট দিতে হয়…

–ও। লাইফ সার্টিফিকেট? সে যাবখন।

 ধীরাজ বললেন, আমি বার বার বললাম ওটা নিজেই করতে পারব। প্রতি মাসেই তো যাচ্ছি। সশরীরে যাওয়া মানেই তো বেঁচে আছি প্রমাণ করা।

–তোমাকে নিয়ে ওইখানেই তো ভয়। উমার গলায় সামান্য ঝাঁঝ। একটু আগের বিষাদ কোথায় উবে গেছে, আগেরবার ভেতরে ঢুকে একটা সই করতে গিয়ে এমন সব উল্টোপাল্টা কাণ্ড করেছিলে! ঘাবড়ে মাবড়ে গিয়ে, হাত পা কেঁপে…

–এঁহ। তোমাকে কে বলল?

–আমার চর সর্বত্র ছড়ানো আছে। সেনবাড়ির পিনু সেদিন টাকা তুলছিল, বাড়ি এসে বলে গেছে।

ধীরাজ লজ্জা লজ্জা মুখে চায়ে চুমুক দিচ্ছেন।

উমা বললেন, আর একটা কথা যে বলার ছিল, বলেছ? যেটা বলার জন্য রাত থেকে ছটফট করছ! তোমার ওপর ভরসা করাই বৃথা, আমারই বলা উচিত ছিল।

ধীরাজ আরও লজ্জা পেলেন, তুমিই বলো।

–কেন, তুমিই বলো না। তুমি তো বেশি লাফাচ্ছিলে।

ইন্দ্রাণী ঈষৎ অধৈর্য হল, একজন কেউ বলেই ফেলো না।

উমা আলগা হাসলেন, –তোকে বলতে ভুলে গেছি। কাল অনেকদিন পর তোর বেলা মাসি এসেছিল। ওরা সব দল বেঁধে কাশী যাচ্ছে। সামনের মাসে। আমাদেরও যেতে বলছিল। দিন পনেরোর জন্য।

যাও না। ভালই তো। বলেই ইন্দ্রাণীর খেয়াল হল, দলের সঙ্গে হোক আর যাই হোক, বাবা মার জন্য সব সময়ই একজন পাহারাদার দরকার। আদিত্যকে সঙ্গে পাঠালে কেমন হয়! মনটাও একটু স্থিত হবে তার। ভালয় ভালয় সইসাবুদটা চুকে গেলে তার যেতে বাধাই বা কোথায়!

ইন্দ্রাণী প্রস্তাবটা পাড়ল। উমা মহা খুশি। ধীরাজও।

 উমা বললেন, সে যা খেয়ালি মানুষ, শেষ পর্যন্ত যাবে তো?

বলে দেখি। সে তো তোমার শিবের অবতার। যেতেই পারে।

 ধীরাজ বায়না জুড়লেন, তুইও চল না ইনু।

–আমি! পাগল নাকি! সামনের মাসে আমার স্কুলের পরীক্ষা। তিতিরের অ্যানুয়াল।

 উমা জিজ্ঞেস করলেন, তোদের বাড়ির ব্যাপারটা কী হল?

 পলকে একটা হাত ভেসে উঠল চোখের সামনে। মৃত্যুদণ্ডে সই করে নিব ভেঙে দিচ্ছে।

আনন্দের মুহূর্তে ছায়া পড়তে দিল না ইন্দ্রাণী। সামলে নিল। বলল, কথাবার্তা চলছে। দেখি কবে কি হয়।

উমা বললেন, তোরা ক তলায় ফ্ল্যাট পাবি রে?

–এখনই কি বলা যায়?

–যে তলাতেই হোক, দক্ষিণমুখো নিস। তোদের এখনকার ঘরটায় আলো বাতাস বেশ কম।

–আজকাল চারপাশে এত বাড়ি, সব দিকেই আলো বাতাস কম মা।

ধীরাজ ফস করে প্রশ্ন করলেন, বাপ্পা ঠিক ঠিক চিঠিপত্তর দিচ্ছে তো?

–দিচ্ছে। খুব চাপে আছে। ফাঁক পেলে লেখে।

–দেখিস ও আবার যেন হারিয়ে…

–চুপ করো। অলুক্ষুণে কথা বোলো না। উমা ধমকে উঠলেন।

আঁধার কখন নেমে গেছে। মাথার ওপর মাঘ শেষের নির্মল আকাশ। ধুলোবালির শহর থেকে ওই মেঘহীন আকাশকেও বড় ঘোলাটে লাগে, গ্রহ তারারাও বড় অস্পষ্ট। বাতাসও উষ্ণ হচ্ছে ক্রমশ, শীতের গোপন কামড়টা আর যেন নেই।

পথে বেরিয়ে বাপ্পার কথা মনে পড়ছিল ইন্দ্রাণীর। বাবা কি ভুল বলেছে কিছু? সত্যিই তো বাপ্পা হারিয়ে গেল। আরও শত সহস্রবার আসবে যাবে, আসবে যাবে, কিন্তু আর কি ছেলেকে সেভাবে কাছে পাবে ইন্দ্রাণী! প্রতিবারই হয়তো একটু একটু করে অপরিচিত হয়ে যাবে বাপ্পা। তা হোক। বাপ্পা মনের সুখে নিজের ভবিষ্যৎ গড়ক। দুঃখ করে ইন্দ্রাণী কারই বা জীবনের গতিপথ বদলাতে পেরেছে!

–ইন্দির, অ্যাই ইন্দির!

 ইন্দ্রাণী চমকে দাঁড়িয়ে গেল। দিলুদা বসে আছে সেনবাড়ির রোয়াকে। ডাকছে তাকে। সেই কৈশোরের নাম ধরে।

.

৫০.

মন খারাপের মুহূর্তে হঠাৎ যদি কেউ হারিয়ে যাওয়া নাম ধরে ডেকে ওঠে, মনটা যেন লহমায় ভাল হয়ে যায়। সংসারের মালিন্য, বেঁচে থাকার জটিলতা, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হাহুতাশ কিছুই যেন আর স্মরণে থাকে না। বুকের ভেতর ঘুমিয়ে আছে এক টাইম মেশিন, সোঁ সোঁ করে ছুটতে থাকে সে, হু হু করে কমে যায় বয়স।

ইন্দ্রাণী হাসিমুখে দিলীপের সামনে এল, –কি গো, অন্ধকারে, একা একা এমন দেবদাস হয়ে বসে আছ কেন?

দিলীপ উঠে দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙল। পরনে জিনস, টিশার্ট, চাদর টাদরের বালাই নেই। ইন্দ্রাণী মনেও করতে পারে না কোনওদিন দিলুদাকে গায়ে শাল চাদর জড়াতে দেখেছে কিনা।

দিলীপের অ্যাথলেটিক চেহারায় বয়স এখনও দাঁত ফোটাতে পারেনি। বনবন হাত ঘোরাচ্ছে সে। পেস বোলারদের মতো কাঁধ ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল, আমাকে দেখে তোর দেবদাস মনে হয়?

ইন্দ্রাণী ঠোঁট টিপল, -হয়ই তো। তবে ভিজে দেবদাস নয়, ড্রাই দেবদাস।

চোয়াল এঁটো করে হাসল দিলীপ, কী আর করা যাবে! তোরা সব পাড়া অন্ধকার করে কেটে পড়লি….

হুঁহ, খুব যে কায়দার কথা! চোখ চালিয়ে চারপাশটা দেখে নিল ইন্দ্রাণী, –তোমার সব সাঙ্গোপাঙ্গরা কোথায়?

–আর সাঙ্গোপাঙ্গ! সব যে যার ম্যাও সামলাচ্ছে। অফিস থেকে ফিরে টুক করে নিজের ডেরায় সেঁধিয়ে যায়।

-সে তো তোমার বন্ধুরা। তার পরের ব্যাচ, তার পরের ব্যাচের সঙ্গেও তো তোমার আড্ডা জমেছিল, তারা সব কই?

তারাও কি আর কচি আছে রে ইন্দির! তারাও সব হ্যাপিলি ম্যারেড হাউস হাজব্যান্ডস। আর তার পরের ব্যাচগুলো তো রকের ধারই মাড়ায় না। সবাই এখন রক শুনতে ভালবাসে, রকে কেউ বসে না। কী স্যাড বল দিকিনি! রক কালচারটাই উঠে গেল!

–আহা, ভারি স্যাড। তোমাদের উত্তর কলকাতার এত বড় কৃষ্টিটা নষ্ট হয়ে গেল!

তুই বুঝি খুব সাউথ ক্যালকাটার মেয়ে বনে গেছিস? থাকিস তো অজ গাঁয়ে। লম্বা চেহারাটা ইন্দ্রাণীর দিকে ঝুঁকল, -তোদের ওখানে এখনও রাত্তিরে শেয়াল বেরোয় ইন্দির?

দিলুদার মুখে বার বার ইন্দির সম্বোধনটা ভারি মধুর লাগছে ইন্দ্রাণীর। ছোটবেলায় পাড়ার যত বয়সে বড় ছেলেদের সঙ্গে পাকা বুড়ির মতো কথা বলত সে, তখনই তার নাম হয়ে যায় ইন্দির ঠাকরুন। সেখান থেকে ইন্দির। তখন শুনলে ভারি চটে যেত ইন্দ্রাণী, এখন যেন একদম অন্য অনুভূতি। যেন ওই ডাকেই লুকিয়ে আছে সেই বালিকা। সেই জোড়া বিনুনি, সেই টরটরে কিশোরী।

ইন্দ্রাণী বালিকার মতোই হাসল, রিসেন্টলি ঢাকুরিয়ায় গেছ তুমি? সুপার মার্কেট হয়েছে। মাল্টিস্টোরেডে ছেয়ে গেছে ঢাকুরিয়া।

–তোদের বাড়ি ভেঙেও নাকি মাল্টিস্টোরেড হচ্ছে?

কথা চলছে।

–অমন খানদানি বাড়িটাকে ভেঙে ফেলবি? তোদের বুঝি এক সঙ্গে থাকতে প্রবলেম হচ্ছে?

যে আলোচনায় যেতে চায় না, সেটাই যে কেন ফিরে ফিরে আসে! বালিকা হওয়ার সাধ হলেই কি আর বালিকা হওয়া যায়! সংসার বড় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেছে চারদিকে। সময় জিনিসটাও বড় নিষ্করুণ। সঙ্গেই ছুটছে, কিন্তু পিছন ফিরে তাকাতে জানে না। ভাল লাগার তাজা মুহূর্তও নিমেষে বাসি হয়ে যায়।

বিষাদটুকু ঝেড়ে ফেলতে চাইল ইন্দ্রাণী। উদাসভাবে বলল, – বোঝোই তো আজকালকার ব্যাপার। …তারপর তোমার কোচিং কেমন চলছে? ফুটবল? ক্রিকেট?

–দুর দুর, ওসব ছেড়ে দিয়েছি।

–সে কি! কেন?

ফুটবল তো আগেই ছেড়ে দিয়েছিলাম। ছেলেগুলো কেউ সিনসিয়ারলি প্র্যাকটিস করতে চায়, মাঠে দুটো চক্কর দিয়েই বলে পাঁচ পাক হয়ে গেল, বকাবকি করলে পেছনে আওয়াজ মারে, সকলের খালি ফাঁকি দিয়ে বাজিমাত করার ধান্দা। আরে, খেলাধুলো হল তপস্যা, সাধনা। আমি অত খেটে দাঁড়াতে পারলাম না, এরা বলে একটা লাথি মেরেই ডিভিশানে খেলতে চায়। কথা বলতে বলতে দিলীপ যেন মনমরা হয়ে পড়ছে, আর ক্রিকেট কোচিংটা এবারেই ছেলে হয় না রে ইন্দির। আমি তো আর স্টেট জোন কিছু খেলিনি, আমার কোচিং-এ কেউ আসবে কেন? অনামী কোচের কাছে পাঠাতে বাপ-মাদের স্ট্যাটাসে লাগে।

–তোমার তবে এখন সময় কাটে কী করে?

 –অফিস করে, আর হরিমটর ভেজে।

–আর এর ওর তার বেগার খেটে?

চাপে পড়ে তো খাটি না, মন চায় বলে করি।

ইন্দ্রাণী দুম করে বলে ফেলল, তুমি এবার একটা বিয়ে করে ফ্যালো দিলুদা।

–বিয়ে! এই বয়সে? অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল দিলীপ।

কী এমন বয়স হয়েছে তোমার? চুয়াল্লিশ? পয়তাল্লিশ? এই বয়সে কেউ বিয়ে করে না? এই তো আমাদের পাড়াতেই একজন ব্যাচেলার তিপ্পান্ন বছর বয়সে বিয়ে করল।

–সে যে করে, সে করে। সবাই কি এক ধাঁচের হয় রে ইন্দির?

বা রে, বুড়ো বয়সে তোমায় দেখবে কে? তোমার দাদা বউদি? ভাইপো ভাইঝি?

বিয়ে করলেই যে বউ দেখবে, তার কোনও গ্যারান্টি আছে? সে তো আমার আগেই ফুটে যেতে পারে। আর ছেলেপিলে? এই তো বিলটুরা তিন ভাই মিলে বাবাকে চ্যাংদোলা করে ওল্ডহোমে পৌঁছে দিয়ে এল। ওখান থেকে হয়তো মুদ্দোফরাসে শ্মশানে টেনে নিয়ে যাবে। দিলীপ গলা নামাল, –এই সেনবাড়ির মাসিমার কী দশা হয়েছে? হেগে মুতে পড়ে থাকে, কেউ ফিরেও তাকায় না।

জয়মোহনের ছবিটা আলগা ছুঁয়ে গেল ইন্দ্রাণীকে। অত খারাপ দশা না হলেও শেষের দিকটা তো বেশ অনাদরেই কেটেছে শ্বশুরমশাইয়ের। ফ্যাকাসে হেসে ইন্দ্রাণী বলল, –তোমার সঙ্গে কথায় পারা যাবে না দিলুদা। তোমার কপালে এই ভূতের মতো একা একা বসে থাকাই আছে।

দিলীপ হো হো হেসে উঠল, কপালের লিখন কে খণ্ডাবে বল? যার ভাগ্যে একা থাকাই লেখা আছে, দোকা তার জুটবে কোত্থেকে?

ক্ষণিকের জন্য বুকটা দুলে গেল ইন্দ্রাণীর। পুতুলদি টুলটুলরা ঠাট্টা করে বলত, দিলুদার নাকি ইন্দ্রাণীকে খুব পছন্দ ছিল। সত্যি কি তার প্রেমে পড়েছিল দিলুদা? মনে হয় না। আবার হতেও পারে। এখন নয় খুব ডেকে ডেকে কথা বলে, আগে মেয়েদের সম্পর্কে কী লাজুক ছিল দিলুদা! একবার সরস্বতী পুজোর পর পাড়ায় শেষরক্ষা নাটক হল, ছেলেরা মেয়েরা সেই প্রথম এক সঙ্গে পার্ট করল সেবার। দিবাকরদা চন্দ্রকান্ত, টুলটুল ক্ষান্তমণি, বাচ্চুদা গদাই, রত্না ইন্দুমতী, দিলুদা বিনোদ, ইন্দ্রাণী কমলমুখী। প্রতিদিন রিহার্সালের সময় আপনি! তুমি! কমল! আমাকে মাপ করলে ডায়ালগটা বলতে গিয়ে তুতলে মুতলে একসা হত দিলুদা। কাধ ঘেঁয়া দূরে থাক, হাতটুকু ধরতে গিয়েও ঘামছে! রোমান্টিক সিনে কী বোকা বোকা যে লাগত দিলুদাকে!

ইন্দ্রাণীই বা বিয়ের কথা তুলে দিলীপকে খোঁচাল কেন হঠাৎ? এতদিন পর যাচাই করার বাসনা? ইন্দ্রাণীর মনেও কি তবে সূক্ষ্ম ধারণা আছে, তার জন্যই বিবাগী হয়ে আছে দিলুদা? না হলে লোকটাকে এত একা দেখেও অকৃত্রিম দুঃখ হচ্ছে না কেন?

ধুস, যত সব বাজে চিন্তা। দিলুদা তাদের পরিবারের উপকারী বন্ধু, তার সম্পর্কে একটু তো খোঁজখবর করতেই পারে ইন্দ্রাণী। তার একাকিত্বে দুঃখিতই বা হবে কেন ইন্দ্রাণী, সত্যিই তো দিলুদা তার এমন কিছু ঘনিষ্ঠ জন নয়! ইন্দ্রাণী ঘড়ি দেখল। ছটা চল্লিশ। বাড়ি ফিরতে ফিরতে আটটা বেজে যাবে। স্কুলের অ্যানুয়াল পরীক্ষার আর বেশি দেরি নেই, কোয়েশ্চেন পেপার তৈরি করে জমা দেওয়ার নোটিস এসে গেছে, বাড়ি গিয়ে কাগজ কলম নিয়ে বসতে হবে।

ইন্দ্রাণী বলল, চলি দিলুদা।

–আয়। এলে একটু দেখাসাক্ষাৎ করিস, তোদের সঙ্গে গল্প করলে মেজাজটা শরিফ হয়ে যায়। দিলীপ হাঁটছে সঙ্গে সঙ্গে, হ্যাঁ রে, তোর মেয়েটা অনেক দিন এ পাড়ায় আসছে না যে?

–ও এখন খুউব ব্যস্ত। ইলেভেন-টুয়েলভের পড়ার চাপ, টিউটোরিয়াল স্কুল… বন্ধুবান্ধবও প্রচুর হয়েছে। এই তো আজ সন্ধেবেলাই সব দল বেঁধে কোন বন্ধুর দিদির বিয়েতে ছুটবে।

–মেয়েটা কিন্তু হয়েছে খুব সুইট। কী রঙ, একেবারে দুধে আলতা। বাস স্টপে এসে দাঁড়াল দিলীপ, তোরা কেউই ওর গায়ের রঙের ধারে কাছে আসতে পারিস না। তুই, তোর বর, তোর ছেলে, কেউ না।

পলকের জন্য নিশ্বাসের কষ্টটা ফিরে এল ইন্দ্রাণীর। রক্তহীন মুখে হাসল সামান্য। ভাগ্যিস শুধু শুভর গায়ের রঙটাই পেয়েছে মেয়ে!

বাস এসে গেছে। ইন্দ্রাণী দুদ্দাড়িয়ে উঠে পড়ল। মানিকতলাতেও বাস বেশ ফাঁকা ফাঁকা ছিল, ভিড় বাড়ছে ক্রমশ। ড্রাইভারের ঠিক পিছনের সিটে জানলায় বসে আছে ইন্দ্রাণী। অবশ বুকে। ফাঁকা চোখে। শুভাশিসের জন্য হঠাৎই বড় মন কেমন করছে। কত দিন আসে না শুভ! সেই শ্বশুরমশাইয়ের কাজের দিন শেষ এসেছিল, তাও তো প্রায় এক মাসের ওপর হয়ে গেল! ফোনও করে না, আশ্চর্য! এত ব্যস্ত হয়ে গেল শুভ! ইন্দ্রাণীর ওপর দিয়ে এত ঝড় বয়ে চলেছে, এ সময়ে শুভ একটু পাশে থাকলেও তো ইন্দ্রাণীর ভাল লাগত। কাজ কাজ কাজ। পুরুষের কি মাঝামাঝি কোনও রূপ নেই? হয় উদভ্রান্তের মতো কাজে ডুবে থাকবে, নয়তো ঘরের মানুষটার মতো চূড়ান্ত কর্মহীন? এর মধ্যে বার দু-তিন নার্সিংহোমে ফোন করেছে ইন্দ্রাণী, পায়নি শুভাশিসকে। বেশি রাতে পাওয়া যেতে পারে ভেবে একদিন তো রাত দশটার পর নার্সিংহোমে ফোন করল। নেই, বেরিয়ে গেছেন ডাক্তারবাবু। কী হল শুভর, শরীর-টরীর ভাল আছে তো? ছন্দার কিছু হয়নি?

পার্কসার্কাস ছাড়িয়ে বেকবাগানের দিকে যাচ্ছে বাস। ইন্দ্রাণীর বুকটা ছলাত করে উঠল। আজ শুভর বেকবাগান চেম্বার না? নামবে নাকি? চমকে দেবে শুভকে?

ইন্দ্রাণী উঠতে গিয়েও উঠতে পারল না। কে যেন আঁচল টেনে হিঁচড়ে বসিয়ে দিল তাকে। কেন ভিখিরির মতো শুভর কাছে যাবে ইন্দ্রাণী!

.

বিয়ে বাড়ি একটু ঝিমিয়ে পড়েছিল। বর আসতেই সব চাঙ্গা। সানাই আবার জোর সুর তুলেছে, শাখ আর উলুধ্বনিতে ঝালাপালা হয়ে গেল কান, ছুটোছুটি শুরু হয়েছে চারদিকে, সকলে হুড়মুড়িয়ে বর দেখতে চলেছে। বরের পিছন পিছন বরযাত্রীদের বাসও এসে গেল। বিয়ের জন্য ভাড়া করা বাড়ি এখন ভিড় আর কলরবে টইটুম্বুর।

বর বসেছে একতলায়। কালচে লাল ভেলভেটের তাকিয়ায় ভর দিয়ে। দু পাশে তার ফুলদানিতে রজনীগন্ধা, মাথার পিছনে টাটকা গোলাপের জালি। এই মাঘেও অল্প অল্প ঘামছে। বেচারা, সম্ভবত ধুতি পরার অস্বাচ্ছন্দ্যে। অথবা মোটা মালার। টোপরটি তার পাশে খুলে রাখা, পুচকে এক নিতবর সেটাকে মূল্যবান ধনরত্নের মতো আগলে বসে আছে।

তিতিররা দরজায় উঁকি দিচ্ছিল। হাসছিল, গা টেপাটিপি করছিল, আবার হাসছিল। কোত্থেকে যেন উড়ে এল দেবস্মিতা। ভারী বেনারসি সামলাতে সামলাতে বলল, কি রে, তোরা এখানে দাঁড়িয়ে কেন? আয়, ইমনদার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই।

তিতির বিদীপ্তাকে ঠেলল, বিদীপ্তা অনিতাকে। আবার কুলকুল হাসি। ঝুলন সিরিয়াস মুখে বলল, আলাপ তো করতেই পারি। কিন্তু তিতিরকে নিয়ে যাওয়াটা ঠিক হবে না।

-কেন? কেন?

ঝুলন ফিসফিস করে বলল, –তিতিরকে একবার দেখলেই কেলো। সুস্মিতাদির হোল টাইমার  তিতিরের পার্ট টাইমার হয়ে যাবে।

আবার রিনরিন হাসি। ঝিরঝির হাসি। কুলকুল হাসি।

দেবস্মিতা সপ্রশংস দৃষ্টিতে তিতিরের দিকে তাকাল, রিয়েলি মঞ্জিমা রায় আজ হ্যাভক করে দিয়েছে। কত জন যে আজ বিয়ে বাড়িতে বিনদাস হয়ে যাবে!

যাবে কি রে, গেছে। বরযাত্রীদের একজন তো তিতিরকে দেখতে গিয়ে তিন বার গেটে হোঁচট খেল।

কে রে? কোন লোকটা? বরের বাবা?

তিতির লজ্জায় লাল হয়ে গেল, যাহ, আমি কী এমন সেজেছি?

সাজগোজ সত্যিই আজ তিতির বেশি করেনি। ঢালা জরিপাড় টিয়ারঙ কাঞ্জিভরম পরেছে একটা। কাকিমার। গলায় রুপোর ওপর সোনার জল করা মার নেকলেস, কানে ছোট্ট ঝোলা দুল, হাতে কয়েক গাছা সরু সরু চুড়ি, কপালে কুমকুমের টিপ, চোখে আলগা আইলাইনার, ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক। চুলে প্রথমে বিনুনিই করেছিল, কাকিমা জোর করে ধরে সুইশ রোল করে দিল। খোঁপাতে সুঁই ফুলের মালা। এইটুকুনিতেই সে যেন আজ রূপকথার রাজকন্যা, পথ ভুলে ঢুকে পড়েছে এক আলোময় বাড়িতে।

ঝুলন দেবস্মিতার তোয়াক্কা না করে ঢুকে গেছে ভেতরে। বরের সামনে গিয়ে হাত বাড়িয়ে দিল, আমি ঝুলন। আপনার হবো হবো শালীর বন্ধু। গ্ল্যাড টু মিট ইউ।

নতুন বর থতমত মুখে তাকাল, তুমিই ঝুলন? দেবস্মিতার মুখে তোমার নাম শুনেছি।

-খুব নিন্দে করেছে বুঝি? বলেনি ঝুলন একটা টমবয়? ছেলে হতে হতে মেয়ে হয়ে গেছে?

 নতুন বর জিভ কাটল, – যাহ, তা বলবে কেন? তুমি তো খুব

-খুব কী? ঝুলন ভুরু নাচাল।

নতুন বর অপ্রতিভ মুখে দেবস্মিতার দিকে তাকাচ্ছে। দেবস্মিতা তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ইমনদা বলতে চাইছে তুই খুব সাহসী মেয়ে। যাকে বলে বীরাঙ্গনা।

ঝুলন মিটিমিটি হাসল। নরম চোখে তাকাল বরের দিকে, আপনাকে কিন্তু ইমন নামটা একদম মানায় না।

–কেন?

-ইমন নামটা কেমন যেন লাইট। আপনি সুস্মিতাদির ওয়ার্সহাফ, আপনার আরেকটু গ্রাঞ্জারাস নাম হওয়া উচিত ছিল।

বরের পাশে বরের দুই বন্ধু। একজন সুট প্যান্ট টাই, অন্যজন চোস্ত পাঞ্জাবি। স্যুট প্যান্ট টাই তিতিরের দিকে টেরিয়ে তাকাতে তাকাতে প্রশ্ন করল, যেমন? একটা এগজাম্পল?

–এই ধরুন… যেমন হল গিয়ে…অ্যাই তিতির, বল না একটা ভারী নাম।

তিতির পুট করে বলে উঠল, দরবারি কানাড়া।

আবার হাসি। রিনরিন। ঝিরঝির। কুলকুল। সঙ্গে হাহা। হোহো।

বিয়েবাড়িতে মাঝখানে প্রশস্ত উঠোন। দোয়ায় ঢাকা। কোনার দিকে চেয়ার টেনে গোল হয়ে বসেছে বন্ধুরা। জোর গুলতানি চলছে। ফিলম ফ্যাশান টিভি সিরিয়াল। নতুন স্কুল কলেজের বন্ধুবান্ধবরাও এসে যাচ্ছে আলোচনায়। এক যুবক তিন বার শরবত যেচে গেল তিতিরদের, তিতিররা উদাসীন ভঙ্গিতে প্রত্যাখ্যান করল। দেবস্মিতা বসছে কিছুক্ষণ, ব্যস্তভাবে উঠে যাচ্ছে। আবার এসে বসেছে, –দেখলি তো, হিয়াটা শেষ পর্যন্ত এল না।

ঝুলনের ভুরুতে ভাঁজ, রিয়েলি স্ট্রেঞ্জ! এক কথায় কন্ট্রিবিউশান দিয়ে দিল, কি গিফট কেনা হবে তাই নিয়ে সাজেশান দিল! ইনফ্যাক্ট স্যান্ডুইচ টোস্টারটা ওরই সাজেশান। এত কিছু করে লাস্টলি ডুব!

–আমার সেদিনই কেমন সন্দেহ হয়েছিল।

কবে?

–যেদিন নেমন্তন্ন করতে গেলাম। কিরকম যেন ছাড়া ছাড়া ভাবে কথা বলছিল। তোর দিদির বিয়ে যেতে তো হবে… দেখি…। হিয়াটা কেমন চেঞ্জ হয়ে গেছে।

বাড়িতে ওরকম একটা ক্যাডাভ্যারাস ঘটনা ঘটে গেল।

অনিতা দুঃখী মুখে বলল, – হিয়াটা খুব বেচারা। সেই কবেএএ থেকে সাফার করছে।

 ঝুলন প্রশ্ন করল, বাড়িতে সেই ছেলেটা ছিল? ওর বাবার সেই স্টেপ সান?

–ছিল না আবার! সেই তো দরজা খুলল। কী ক্যাড একটা ড্রেস পরে ছিল! বারমুডার ওপর পঞ্জাবি! ভাল করে গোঁফের রেখাও ওঠেনি, এখনই কী পাকা পাকা হাবভাব। হিয়াকে দিদি-ফিদি কি বলে না, কায়দা করে আবার ইংরিজিতে ডাক! হিয়া, সামবডিজ কলিং ইউ!

-ঠাস করে একটা চড় মারলি না কেন? ঝুলন ঝেঁঝে উঠল।

–তাই উচিত ছিল। তবে ভেবে দেখলাম, বেচারা হিয়াটার শত্ৰুপুরীতে বাস! 

বিদীপ্তা প্রশ্ন করল, –ছেলেটার মার সঙ্গে আলাপ হল?

–হত না। নিজেই যেচে এসে আলাপ করল। মাটার কথাবার্তা অবশ্য খারাপ নয়। মিষ্টি খেয়ে যেতে বলছিল। হিয়াই চোখের ইশারায় আমাকে না করে দিল।

-কেন?

হু নোজ!… অবশ্য আমি এমনিও খেতাম না। যে মহিলা আমার বন্ধুর জীবনটা স্পয়েল করে দিয়েছে, অর হাত থেকে আমি মিষ্টি খাব? নেভার।

–হিয়ার বাবাকেও বলিহারি! কী করে যে এই বয়সে বিয়ে করার শখ হয়!

–তাও আবার ওই মহিলাকে! শুঁটকি! চিমসে! দেখে আন্টি না বলে আঙ্কল বলতে ইচ্ছে করে।

একটানা এই কাদা ছোঁড়া ভাল লাগছিল না তিতিরের। সে বলে উঠল, হিয়ার ঠাকুমা কেমন আছেন রে?

ঠাকুমাকে তো দেখতে পেলাম না।

–তুই জিজ্ঞেস করিসনি?

না তো। এত তাড়াহুড়োর মধ্যে ছিলাম।

তিতির একটু চিন্তায় পড়ল। অনেককাল হিয়ার বাড়ি যাওয়া হয় না। স্কুলে অবশ্য দেখা হয় হিয়ার সঙ্গে, কথা হয় না তেমন। হিয়া হিয়ার বন্ধুদের সঙ্গে থাকে, তিতির তিতিরের। ঠাকুমা কি বাড়ি ছেড়ে চলে গেল? হিয়া দাদুর শ্রাদ্ধের দিন এসেছিল, কই সেদিন তো কিছু বলল না! হিয়াকে জিজ্ঞেস করতে হবে।

শাঁখ উলু শুরু হয়েছে। তিতিররা ছুটল পড়িমড়ি করে। বর দাঁড়িয়ে আছে ছাদনাতলায়, পিড়িতে চেপে তাকে পাকে পাকে বাঁধছে সুস্মিতাদি।

ঝুলন চুকচুক শব্দ করল, সুস্মিতাদির লাকটা ভাল।

তিতিররা জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল।

বরটাকে যেমন এক্সপেক্ট করেছিলাম তেমন নয়। জোশ নেই। সুস্মিতাদিই দাপাবে।

সুস্মিতাদি আর দরবারি কানাড়া কেউই চশমা খোলেনি কেন রে? চশমা পরে কি শুভদৃষ্টি হয়?

–চশমা খুললে কেউ কাউকে দেখতেই পাবে না। হয়তো নাপিতটার সঙ্গেই সুস্মিতাদির শুভদৃষ্টি হয়ে যাবে।

সুস্মিতাদির দিকে খোলা চোখে না তাকানোই ভাল। চশমাটা বরং ঢালের কাজ করছে।

বেশিক্ষণ হাহা হিহি টীকাটিপ্পনীর সুযোগ পেল না তিতিররা। ডাক পড়েছে খাওয়ার। সেই পরিচিত আইটেম যা গত পাঁচ বছর ধরে প্রতিটি বিয়েবাড়িতে খেয়ে আসছে তিতির। রাধাবল্লভি, আলুর দম, চিলি ফিশ, পোলাও, মুরগি আর শেষ পাতে আইসক্রিম।

আইসক্রিম খেতে খেতে আবার হিয়ার কথা উঠল।

অনিতা বলল, – এই, হিয়ার কি কোনও বয়ফ্রেন্ড হয়েছে নাকি রে?

ঝুলন বলল, -হতেই পারে। আমাদের স্কুলের বেশির ভাগ ফ্রেন্ডই তো বয়।

সেরকম নয়, সামওয়ান স্পেশাল। চামচ চাটতে চাটতে চোখ ঘোরাল অনিতা, -মৌসুমি বলছিল হিয়াকে নাকি দু দিন গঙ্গার ধারের আইসক্রিম পার্লারে দেখেছে। একটা ফর্সা মতন ছেলের সঙ্গে। মৌসুমিকে দেখে হাত নেড়েছে কিন্তু ছেলেটার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেয়নি। রাজা বা রাজু এরকম ধরনের নাম ছেলেটার।

তিতিরের গায়ে কাঁটা দিল। রাজর্ষি নয় তো!

বিদীপ্তা বলল, – হ্যাঁ রে, আমিও একটা ওরকম কথা শুনেছি। পৃথা বলছিল। আমার অবশ্য বিশ্বাস হয়নি। পৃথা নাকি হিয়াকে একটা ছেলের সঙ্গে সিনেমা হলে দেখেছে। ওর সামনের সিটেই দুটো ছেলেমেয়ে খুব ইনটিমেটলি বসেছিল, মানে এমনভাবে যে, ছেলেটার মাথা বার বার অবস্ট্রাক্ট করছিল পৃথাকে। ইন্টারভ্যালে দেখে মেয়েটা হিয়া। ভেবেছিলাম পৃথা ঢপ দিয়েছে।

বুঝেছি। তোরা রাজর্ষির কথা বলছিস। ঝুলন নিজের কাপ শেষ করে তিতিরের কাপে চামচ ডোবাল, –হিয়া-রাজর্ষিকে তো এখন সর্বত্রই এক সঙ্গে দেখা যায়। রাজর্ষির বাবা ঘ্যামচ্যাক ডাক্তার। হিয়া ডাক্তারি পড়বে তো, তাই এখন থেকে লাইন করছে।

তিতিরের জিভ কটু স্বাদে ভরে গেল। রাজর্ষিই! এ যা শুনছে এ তো নিছক বন্ধুত্ব নয়, তার চেয়েও বেশি কিছু। কেন এমন হবে? অজান্তেই নাকের পাটা ফুলে উঠল তিতিরের। কেন টোটোর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে উঠবে হিয়ার? কোন রাইটে টোটোর সঙ্গে একা একা সিনেমা দেখে হিয়া? ইনটিমেটলি বসে?

খাওয়া দাওয়ার পর তিতির তিলমাত্র দাঁড়াল না। ঢাকুরিয়া বাস স্ট্যান্ডে নেমে সাঁ সাঁ করে পার হল রাস্তা। পূর্ণ গতিতে ছুটে আসা মারুতির পরোয়া না করে। যুক্তি বুদ্ধি কোনও কিছুই মাথায় কাজ করছে না তিতিরের, সাংঘাতিক অস্থির অস্থির লাগছে। কেন লাগছে? হিংসে? টোটো তো তার এমন কিছু বন্ধু নয়! টোটোকে কি আদৌ বন্ধু বলা যায়? জানে না তিতির, শুধু হাঁটছে হনহন। ওষুধের দোকান থেকে বেরোচ্ছে বিষ্ণুপ্রিয়াদি, তিতিরকে দেখে হাত নাড়ল, প্রত্যুত্তর দিল না তিতির। হাঁটছে। ওফ, বাড়ি এত দূরে কেন!

বাড়ির গেটে এসে ক্ষণিক থমকাল তিতির। বড় বড় দম নিল। সদ্য পুষ্ট হয়ে ওঠা বুক উত্তেজনায় হাপরের মতো উঠছে নামছে। বড়ঘর অন্ধকার। অন্য দিন ঘরটা পেরোতে গেলে বুক ছমছম করে ওঠে তিতিরের, মনে হয় দাদু যেন ছবি থেকে তাকিয়ে আছে। আজ দৃকপাত না করে পার হয়ে গেল অন্ধকার। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে টান মেরে খুলল জুঁইফুলের মালা, পিষছে আঙুলে।

–তিতির এলি?

তিতির প্যাসেজে নিশ্চল। চেতনায় ফিরল। মা। বড় কাকার ঘরে মা এখন কী করছে!

ইন্দ্রাণী সুদীপের ঘর থেকেই গলা তুলল, টিভিটা চলছে ও ঘরে, বন্ধ করে দিস তো।

টিভি বন্ধ করে খাটে গিয়ে বসল তিতির। বসেই রইল কয়েক মিনিট। সহসা যেন ছেড়ে যাচ্ছে শরীর। অসম্ভব ক্লান্ত লাগছে, উঠতে ইচ্ছে করছে না। উফ, চোখ মুখ দিয়ে আগুন ছুটছে কেন?

শাড়ি খুলে নাইটি পরে নিল তিতির। শাড়িটা পাট করতে করতে একটু স্থিত হল। টলমল পায়ে বাথরুমে গেল, ছটাস ছটাস জল ছেটাচ্ছে মুখে। জল এখনও বেশ ঠাণ্ডা, ধীরে ধীরে শীতল হচ্ছে প্রাণ।

বাথরুম থেকে বেরিয়ে একটু দাঁড়াল তিতির। কী কথা হচ্ছে মা আর বড় কাকার? মার স্বর এমন করুণ শোনাচ্ছে কেন?

বড় কাকা বলল, তোমাকেই দায়িত্বটা নিতে হবে বউদি।

–আমি কেন দীপু? তোমার দাদা কি আমার কথা শোনে? এতকাল দেখেও তোমার দাদাকে চিনলে না?

–তবু যেটুকু শোনে, তোমার কথাই শোনে। এত দূর এগিয়ে আর পিছোনো যায় না বউদি।

বাড়িটা নয় নাই ভাঙা হল দীপু

-মুস্তাফিকে তুমি টাকা ফেরত দেবে কী করে?… হুট করে তুমি তার কাছ থেকে অ্যাডভান্স নিয়ে নিলে, বাবাকে দিয়ে সই করানোর পর স্যাড ঘটনাটা ঘটে গেল। …আমি মানি, সেদিনই বাবার মৃত্যুটা একটা মিয়ার কোইন্সিডেন্স, যাকে বলে কাকতালীয়, কিন্তু স্টিল তার পরে কি আর তুমি দৌরতে পারো? কাম টু রিজন বউদি। মেক দাদা ফিইল, বাড়ি ভাঙাটা সকলের ভালর জন্যই হচ্ছে। চাঁদু মুস্তাফিকে যে সার্টিফিকেটই দিক, তুমি নিশ্চয়ই বুঝে গেছ, মুস্তাফি খুব সরল লোক নয়? দেখছ না, বাবা মারা যাওয়ার পর থেকেই কেমন একটা মেন্টাল চাপ তৈরি করছে?

মা চুপ।

কাকিমা কি যেন বলছে নিচু গলায়, শোনা যাচ্ছে না। তিতিরের খুব শীত করছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *