৩১-৩৫. ভাইফোঁটার পর দিন

ভাইফোঁটার পর দিন রঘুবীরের সঙ্গে উলুবেড়িয়া গেল আদিত্য। দেড়টা নাগাদ অফিসে পৌঁছে দেখল রঘুবীরের লোক চেয়ারে নেই। আগের দিনও ছিল না। কোথায় যে ঘুরে বেড়ায় লোকটা। সরকারি অফিসে এখনও পুজোর আমেজ। টেবিলে কাজকর্ম নেই, অনেক চেয়ারই ফাঁকা। গোটা ঘরেই কেমন যেন ঝিমুনি ঝিমুনি ভাব। দেখে মনে হয় এখন যেন হেমন্ত নয়, শীত ঋতু।

এক ছোকরা নিবিষ্ট মনে বাংলা খবরের কাগজ খুলে শব্দজব্দ করছে। রঘুবীর তার টেবিলে গেল, –কি দীপকভাই, পুজো কেমন কাটল?

ছোকরার একটা চোখ কাগজ থেকে উঠেই নেমে গেল, ভাল। আপনার?

আপনারা ভাল থাকলে আমিও ভাল। সুজিতবাবু কোথায়?

 –এসেছেন। আছেন।

–কিন্তু কোথায়?

–আমি তো আপনার মতো গুনতে পারি না, বলব কী করে?

রঘুবীর একটু ঝুঁকল, আমার অর্ডারটার কিছু খবর জানেন?

-সুজিতদার কেস আমি ঠিক বলতে পারব না। রঘুবীরের দিকে ভাবিত মুখ ওঠাল ছোকরা, –তিন অক্ষরের শব্দ। র দিয়ে শেষ। মানে হল গিয়ে পাখি। কী হতে পারে?

রঘুবীর যেন জানে অথচ রহস্য করছে এমন মুখে আদিত্যকে বলল, কি রায়দা, বলে দিন।

আদিত্য মাথা চুলকোল। ঝপ করে মনেও পড়ে গেল, খেচর?

–তাই তো। হুঁ। খেচর। ছোকরা দ্রুত ছকে পেনসিল চালাল, যান না, স্যার ঘরে আছেন। স্যারের সঙ্গে কথা বলে দেখুন।

দু পা এগোতেই পিছু ডাকল ছোকরা, কি রঘুবীরবাবু, একটা সিগারেট খাইয়ে গেলেন না?

রঘুবীরের ইশারায় তড়িঘড়ি ফিরল আদিত্য। শুধু সিগারেটই দিল না, মিউজিকাল লাইটার ছোকরার মুখের সামনে ধরে জ্বালিয়েও দিল সিগারেট।

টুংটাং শব্দ বাজছে লাইটারে। একটা চেনা সুর।

ছোকরা সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকাল, বাহ, দারুণ লাইটার তো! ফরেন?

আদিত্য আত্মপ্রসাদের হাসি হাসল, জাপানি। আমার ভগ্নীপতি প্রেজেন্ট করেছে।

 ছোকরা জিনিসটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছে। লুব্ধ স্বরে বলল, কদ্দিন ধরে আমার একটা এরকম লাইটারের শখ!

আদিত্য ভয় পেয়ে গেল। সদ্য কালই জয়ির হাত দিয়ে লাইটারটা পাঠিয়েছে শংকর, এর মধ্যেই চোট হয়ে যাবে নাকি? মিনমিন করে বলল, আপনার পছন্দ? বললে আনিয়ে দিতে পারি।

থাক। অনেক দাম। লাইটার ফেরত দিয়ে অন্য শব্দের সন্ধানে ডুব দিল ছোকরা।

আদিত্য কথা বাড়াল না। খাজুরা করতে গেলেই এক্ষুনি গাঁটগচ্চা যাবে। গতবার উলুবেড়িয়ায় এসে একটা বিলিতি ডটপেন দিয়ে যেতে হয়েছে সুজিত মণ্ডলকে। চাঁদু গত বছর দিয়েছিল পেনটা। কী যত্ন করে ব্যবহার করত আদিত্য! তা পেন যাক দুঃখ নেই, কিন্তু কাজ কেন বেরোচ্ছে না। রঘুবীর আজ নিয়ে বোধহয় বার ষোলো এল এখানে। আদিত্য এই তৃতীয়বার। কবে থেকে খুড়োর কলের মতো অর্ডারটা ঝুলছে নাকের সামনে, কিছুতেই জুটছে না। আজ একটা হেস্তনেস্ত হওয়াই উচিত।

রঘুবীরের পিছন পিছন অফিসারের চেম্বারে ঢুকে আদিত্য দাঁড়িয়ে পড়ল। গোলগাল চেহারার স্যারটি এখন আহারে নিমগ্ন। টিফিনকৌটো খুলে রুটি আর ঢ্যাঁড়োশের চচ্চড়ি খাচ্ছে। সঙ্গে গ্রুপ করে রাখা এক দলা ছানা। ছোট্ট প্লাস্টিকের প্যাকেটে এক চিমটে চিনিও আছে।

ঘরে প্রকাণ্ড এক সেক্রেটারিয়েট টেবিল। এক্কেবারে নিকোনো। ফাইল কাগজ কিচ্ছুটি নেই। টেবিলের কাচের নিচে অসংখ্য ভিজিটিং কার্ড। এক কোণে ঘাড় নোয়ানো টেবিল ল্যাম্প, অন্য কোণে ডেট ক্যালেন্ডারঅলা দামি পেনস্ট্যান্ড। ডেট ক্যালেন্ডারে এখনও সেপ্টেম্বর মাস। পেনস্ট্যান্ডে কলম নেই।

বছর পঞ্চাশের স্যারটি আস্ত দুটো মানুষ দেখে বেশ বিব্রত যেন। আদিত্যরা তার খাবার কেড়ে নেবে এমন সন্ত্রস্ত ভঙ্গিতে টিফিনকৌটোর মুখ চাপা দিয়েছে দু হাতে, কী ব্যাপার?

লম্বা শরীর খানিকটা নোয়ালো রঘুবীর, অর্ডারটার ব্যাপারে এসেছিলাম স্যার।

কীসের অর্ডার? কোন অর্ডার?

–সেই যে স্যার উদয়নারায়ণপুরে কয়েকটা কালভার্ট সারানোর কাজ। মহালয়ার আগে এলাম… সুজিতবাবু ছিলেন… আপনার সঙ্গে কথা হল…। আপনি বললেন দু-একদিনের মধ্যে ইস্যু হয়ে যাবে।

বলেছিলাম? কী নাম আপনাদের?

–ত্রিমূর্তি এন্টারপ্রাইস স্যার। বলতে গিয়ে আদিত্যর চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল, আমরা আগস্ট মাসে কোটেশন জমা দিয়েছি।

নামটা স্মরণ করার ছলে মুখের ভুক্তাবশেষ চিবিয়ে নিল স্যার। গিলল। নিশ্চিন্ত ভঙ্গিতে টিফিন কৌটোর ঢাকনা বন্ধ করে হাত জড়ো করল কোলের কাছে। বলল, হুম, মনে পড়েছে। অর্ডারটা তো এখনও হয়নি।

কবে হবে স্যার?

–এখন তো আর হবে না। ইলেকশানের ডেট ডিক্লেয়ারড হয়ে গেছে, এখন আর নতুন কোনও অর্ডার বার করা যাবে না।

কথাটা বুঝতে দু-এক সেকেন্ড সময় লাগল আদিত্যর, — তাহলে আমাদের কী হবে স্যার?

–ওয়েট করুন। ইলেকশানের পরে নতুন গাভমেন্ট আসুক।

 আদিত্য রঘুবীরের মুখের দিকে তাকাল। রঘুবীর আদিত্যর। হঠাৎ কি মনে পড়ে গেছে এমন ভঙ্গিতে পকেট থেকে সুজিত মণ্ডলের জন্য কেনা সিগারেটের প্যাকেটটা বার করে টেবিলে রাখল রঘুবীর। বিনীত স্বরে বলল, কোনওভাবেই কি কিছু হয় না স্যার?

না ভাই, হয় না। স্যার টেরচা চোখে প্যাকেটটা দেখল শুধু, ছুঁল না।

 –আমরা অনেক আশা করে বসে আছি স্যার। তিন মাস হয়ে গেল…

–উপায় নেই ভাই। স্যার এবার সাত্ত্বিক মুখে প্যাকেটের সেলোফেন ছিঁড়ে সিগারেট বার করে ধরাচ্ছে, — আপনারা নতুন পার্টি, আপনাদের এখনও এনলিস্টমেন্ট হয়নি, এসব কাজ করলে তবে আপনাদের ক্রেডেনশিয়াল তৈরি হবে। এখন এই ভোটের মুখে আপনাদের অর্ডার দেওয়াটা অনৈতিক। এ সময়ে এমনিতেই গাভমেন্টের সব কাজকর্ম স্টপ হয়ে যায়…

অফিসারের ঘর থেকে বেরিয়ে মনে মনে গজগজ করছিল আদিত্য। এখন অর্ডার দেওয়া মহাপাপ, এদিকে শালা দিব্যি আদিত্যর কেনা সিগারেট ফুক ফুক টানছে! কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হত কাজটা দিয়ে দিলে! ভোট বলে কি পৃথিবীসুদ্ধ সব কাজ বন্ধ হয়ে বসে থাকবে? কে জানে বাবা, এর পর হয়তো কোনওদিন শুনবে ভোটের আগে সূর্যের আলো দেওয়া স্থগিত, নদীতে জল বইছে না, গাছেরা ফল ফুল ফোটানো বন্ধ রেখেছে! ব্যবসার নাম করে খেপে খেপে ইন্দ্রাণীর কাছ থেকে হাজার আড়াই টাকা নেওয়া হয়ে গেল, একটাও কাজ না দেখাতে পারলে আদিত্য মুখ দেখাবে কী করে? কাল ফোঁটা নিয়ে জয়িকে একশো টাকা দিল, তাও ইন্দ্রাণীর কাছ থেকে চেয়ে! এখন ইন্দ্রাণী মুখে কিছু বলছে না বটে, কিন্তু যেদিন ধরবে সেদিন আদিত্যর ধুধধুড়ি নেড়ে দেবে। বাবাকেও বড় মুখ করে নতুন ব্যবসার গল্প শোনাল, এই বিশ বাঁও জলে পড়ে গেছে শুনলে বাবাও তো ড্যাং ড্যাং নাচবে!

কেউ বোধহয় আদিত্যর কাছ থেকে আর কিছু আশাও করে না। ইন্দ্রাণী তো এক-আধ দিনও জিজ্ঞাসা করতে পারে, কত দূর এগোল আদিত্য? তিতির প্রশ্ন করতে পারে, বাবা কাজকর্ম কিছু পেলে? কাউকেই কোনও সদুত্তর দিতে পারবে না আদিত্য, তবু তো মনে হয় কেউ বুঝি ভরসা করে আছে তার ওপর। এটুকুই কি কম? এতেই বোধহয় বেঁচে থাকার একটা মানে খুঁজে পাওয়া যায়। বিফল হওয়ার দুঃখটাও ঢং ঢং ঘন্টা বাজাতে পারে বুকে।

শব্দসন্ধানী ছোকরা ডাকছে আদিত্যকে, কাজ হল?

আদিত্যর কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না। আলতো ঘাড় নাড়ল দু দিকে।

–হয়ে যাবে। হয়ে যাবে। নির্লজ্জভাবে হাত বাড়াল ছোকরা, বেরোবার আগে আরেক বার মুখাগ্নি করে যান।

বিরক্তি চেপে সিগারেট বাড়িয়ে দিল আদিত্য। ছোকরা আবার মন দিয়ে লাইটারের আওয়াজ শুনল। আদিত্য দ্রুত লাইটারটা পকেটে পুরল। ছেলেটার নজরে লাইটারটা না আজই বিগড়ে যায়।

ছোকরা হাসছে। বোধহয় লাইটার পকেটে পোরা দেখেই। উদাসভাবে বলল, জিনিসটা সত্যিই দারুণ।

আদিত্য জোর করে হাসি ফোটাল, ফ্যান্সি মার্কেটে কিনতে পাওয়া যায়। দাম খুব বেশি নয়। শ খানেক। লাগবে আপনার?

–থাক। ছোকরা রঘুবীরের দিকে ফিরল, সুজিতদা তো এই মাত্র এসে বেরিয়ে গেলেন।

–তাই? কোনদিকে গেছেন?

–কোর্টের দিকে। যান না, পেয়ে যাবেন।

রঘুবীর ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ল। পিছনে আদিত্য।

কোর্ট চত্বরে থইথই ভিড়। পুজো শেষ হতেই লোকজন নতুন উদ্যমে মামলা মোকদ্দমায় নেমে পড়েছে। অনেক দিন পর কোর্ট খুলেছে আজ, উকিলদের চেহারাতেও বেশ উপোসি বেড়ালের ভাব। অনেকেই ইতিউতি শিকারের সন্ধানে ঘুরছে।

সুজিত মণ্ডলকে পাওয়া গেল একটা চায়ের দোকানে। রঘুবীরকে দেখে গ্লাস হাতে উঠে এল লোকটা, সাহেবের ঘরে গেছিলেন কেন?

আদিত্য অভিযোগের সুরে বলল, বা রে, এখনও অর্ডার হাতে পেলাম না, যাব না? আপনি বলেছিলেন পুজোর আগেই পোস্টে চলে যাবে।

–যায়নি বুঝি?

–কেন, আপনি জানেন না?

–সবই জানি। তাবলে আপনারা ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খেতে যাবেন?

রঘুবীর হেঁ হেঁ করল, আপনাকে পেলাম না তাই..। স্যারের সঙ্গে তো একটু আলাপ পরিচয় রাখতে হয়।

-স্যার আপনাদের অর্ডার দিতে পারবেন? ওই আলুভাতেটার নিজে থেকে একটাও সাইন করার মুরোদ আছে?

আদিত্য একটু থিতিয়ে গেল, উনি তো বললেন ভোটের আগে আর হবে না।

হ্যাঁ, সেটা একটা প্রবলেম বটে। বছর পঁয়ত্রিশের সুজিতের মুখ-চোখ নির্বিকার, আসুন, চা খেতে খেতে কথা বলা যাক।

আদিত্যর মুখ তেতো হয়ে গেল। লোকটার সঙ্গে বসা মানেই একগাদা পয়সা ধসে যাওয়া। নিজেই খাওয়াচ্ছে এমন মুখে টোস্ট ওমলেট ঘুগনি পরোটা মিষ্টি যা ইচ্ছে অর্ডার করে যাবে, আর ওঠার সময়ে নির্দ্বিধায় রঘুবীরকে দেখিয়ে দেবে। এবং রঘুবীর দেখাবে আদিত্যকে। দিব্যি খেলা।

আদিত্য কর্তৃত্বের সুর আনল গলায়, এখন চা খাব না। কাজের কথা হোক।

 চায়ের গ্লাস দোকানে রেখে বেরিয়ে এল সুজিত, মাস খানেক তো আপনাদের অপেক্ষা করতেই হবে। বলতে বলতে গাল চুলকোচ্ছে, পুরো টাকাটা যদি দিয়ে যেতেন কবে অর্ডার বাড়ি পৌঁছে যেত।

মানে! আদিত্য থমকাল, আমি তো আপনাকে পুরো টাকাই পাঠিয়ে দিয়েছি।

পুরো কোথায়? হাজারের মধ্যে সাতশো। ওই টাকা কজনের মধ্যে ভাগ হয় জানেন? আমি আছি, বড়বাবু আছে, সাহেবের পিওন আছে, টাইপিস্ট আছে… যে তিনশো বাকি আছে ওটাই তো সাহেবের পাওনা। ওই টাকা সাহেবের হাতে না দিয়ে সাহেবকে সই করতে বলব, আমার একটা প্রেস্টিজ নেই?

আদিত্য বিমূঢ় চোখে রঘুবীরকে দেখছিল। হাজার টাকাই তো চেয়ে নিয়েছিল রঘুবীর, সাতশো দিয়েছে কেন?

রঘুবীর গলা খাকারি দিল। সুজিতকে বলল, আমি তো আপনাকে বলেইছি বাকি টাকা অর্ডার হাতে পেলে দিয়ে যাব। আপনি আমাকে এটুকু বিশ্বাস করতে পারলেন না?

–দেখুন মশাই, তিনশো টাকাটা বড় কথা নয়। আপনাদের সঙ্গে নতুন কাজ করতে শুরু করছি, গোড়াতেই যদি এই ধারবাকি শুরু হয়ে যায়…। ছাব্বিশ হাজার টাকার একটা অর্ডার পেয়েছেন, তার থেকে মাত্র হাজার টাকা বার করতে এত কিন্তু কিন্তু করলে পরে বড় কাজ আপনাদের দেব কোন ভরসায়?

–বেশ, কাল পরশুই আপনাকে টাকা দিয়ে যাব।

–এখন তো আর দিলেও হবে না। ভোটটা যাক।

 রঘুবীর চোরা চোখে আদিত্যকে দেখে নিল একবার। তারপর মরিয়া হয়ে বলল, ব্যাক ডেটে অর্ডার বার করে দিতে পারবেন না?

-না, না ওসব দুনম্বরি আমি করি না। টাকাটা দিয়ে যান, ইলেকশনের পর এসে অর্ডার নিয়ে যাবেন।

রঘুবীর আদিত্যকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করল, মাত্র তো আর এক-দেড় মাসের অপেক্ষা রায়দা, কী বলেন?

আদিত্য নিষ্প্রভ মুখে হাসল। অগত্যা। শেষ দুটো সিগারেট বার করে প্যাকেট ছুঁড়ে ফেলে দিল আদিত্য। সুজিতকে সিগারেট দিয়ে লাইটারের জন্য পকেটে হাত ঢুকিয়েও সাবধান হয়ে গেল। পানের দোকানের গায়ের জলন্ত দড়ি থেকে ধরাল নিজের সিগারেট। লাইটারটা বেঁচে গেল ভেবে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল।

মানুষের বিপদ যে কোন দিক দিয়ে আসে! সুজিত সিগারেট ধরিয়ে গল্প জুড়েছে, ইলেকশানের হাল কী বুঝছেন?

আদিত্য কাঁধ ঝাঁকাল, আমরা আদার ব্যাপারি, আমাদের জাহাজের খবরে কী কাজ?

–এ কী কথা! নাগরিক হিসেবে আপনার একটা ভাবনাচিন্তা নেই? আপনার কি মনে হয় এই কোরাপ্ট গভরমেন্ট থাকা উচিত? দেশের নাম করে যারা কোটি কোটি টাকা ঘুষ খায়, তাদের কি টিকে থাকার কোনও অধিকার আছে?

কী উত্তর দেবে আদিত্য ভেবে পেল না। মুখে একটা হাসি ধরে রাখল শুধু।

হাসিটাই কাল হল। সুজিত ঝপ করে বলল, আমাদের ইলেকশান ফান্ডে কিছু টাকাপয়সা দিন।

 আদিত্য ঢোক গিলল, কত?

সুজিত রঘুবীরকে দেখল, কত বলি বলুন তো? পঞ্চাশ? একশো?

রঘুবীর তাড়াতাড়ি বলে উঠল, না না, একশো অনেক বেশি হয়ে যাবে। পঞ্চাশ। রায়দা, পঞ্চাশটা টাকা দিয়ে দিন না।

ময়লা নোটের মতো মুখ করে টাকাটা বার করল আদিত্য।

সুজিত দু আঙুলে ধরে আছে টাকাটা, রসিদ লাগবে? তাহলে আবার…

রঘুবীর আদিত্যর কাঁধে চাপ দিল, এখন দিতে হবে না। আমি তো কাল পরশু টাকা দিতে আসব, তখন দিয়ে দেবেন।

সুজিত মণ্ডল চলে যাওয়ার পরও অনেকক্ষণ ধন্দ মেরে দাঁড়িয়ে রইল আদিত্য। পকেটে মাত্র উনিশ টাকা পড়ে আছে। যাক, বাড়িটা ফিরতে পারবে। ওই টাকা কটা থাকলে কয়েকটা দিন চলে যেত, আবার কাল সকালে হাত পাততে হবে ইন্দ্রাণীর কাছে।

রঘুবীর সন্তর্পণে হাত ধরল আদিত্যর, আমার ওপর খুব রেগে গেলেন রায়দা?

নাহ। আদিত্য শ্বাস ফেলল, –রাগ করে কী করব! আমার ভাগ্য।

–বিশ্বাস করুন, মাসি খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। ডাক্তার এক গাদা ক্যাপসুল-ট্যাপসুল লিখে দিল… পকেটেও সেদিন একদম কিছু ছিল না…।

–আপনি তো আমাকে বলেননি কিছু?

রোজই বলব বলব করে ভুলে যাই। ওই লোকটা কটা মাত্র টাকার জন্য ওরকম হারামিপনা করবে, কী করে জানব?

–তার পরেও আমার পঞ্চাশ টাকা খসিয়ে দিলেন?

অপরাধী ভাব মুছে গিয়ে রঘুবীরের মুখে দেঁতো হাসি এবার, ও টাকাটা না দিলে লোকটা হয়তো আর কাজটাই দিত না।

আদিত্য কঠিন হল, কাজ কিন্তু এখনও দেয়নি রঘুবীরবাবু।

–দেবে। দেবে। ওই নিয়ে আপনি ভাবছেন কেন? আমি তো আছি।

কে যে আছে, আর কে নেই, আদিত্য যদি ঠিক ঠিক বুঝত! রঘুবীর নির্বিবাদে তিনশো টাকা হজম করে বসে রইল, আদিত্য তার ওপর তবু ক্রোধে ফেটে পড়তে পারে না। এই প্রথম নয়, এর আগেও বেশ কয়েকবার টাকাকড়ি নিয়ে ছোটখাট গণ্ডগোল করেছে রঘুবীর। দশ-বিশ টাকা বেশি নিয়েছে, ভুলভাল হিসেব দিয়েছে, সবই মেনে নিয়েছে আদিত্য। মেনে নেওয়াটাই কি তার অপরাধ? মানুষ মানুষকে বিশ্বাস করবে না, সন্দিগ্ধ শকুনের মতো নজর রাখবে পরস্পরের ওপর, এই কি সম্পর্ক? আদিত্য তো অপদার্থই। ঘোরতর অপদার্থ। কিন্তু অপদার্থ থেকে পদার্থ হয়ে ওঠার ধাপগুলো কী? সংশয়? অবিশ্বাস? নীচতা?

আদিত্য হঠাৎ কড়া সুরে বলে উঠল, কাজটা আপনি কিন্তু ভাল করেননি রঘুবীরবাবু।

রঘুবীর দু-এক সেকেন্ড চুপ করে রইল। তারপর গম্ভীর গলায় বলল, আপনি আমাকে অ্যাকিয়ুজ করছেন?

ইয়েস। আপনার গলতির জন্য কাজটা পিছিয়ে গেল। আপনি আমার বিশ্বাসের অমর্যাদা করেছেন।

–আপনি এ কথা বলছেন রায়দা? রঘুবীর আরও গোমড়া, কার জন্য এত খেটে মরছি আমি? আপনি তো একদিনও আমার বাড়ি গেলেন না। গেলে দেখতে পেতেন দু মুঠো অন্ন সংস্থান করার অবস্থা আমার আছে। আশপাশের পাঁচটা লোক বাবাঠাকুর বলে সম্মান করে আমাকে। আমার কাছ থেকে গ্রহরত্ন কেনে, বিপদে আপদে পরামর্শ নেয়, রাজভোগ না খাই, মাসি-বোনপো নুনভাত খেয়ে থাকি। আমার এই ব্যবসা ব্যবসা করে ছোটাছুটি সবই তো আপনার জন্য। একে ধরা, ওর পেছনে ছোটা, তাকে লাইন করা, এসবের জন্য কোনও মূল্য চেয়েছি কোনওদিন? আর আজ সামান্য তিনশো টাকার জন্য… সেও শুনলেন তো, কাল পরশু এসে দিয়ে যাব।

আদিত্য কখন যেন অন্যমনস্ক পায়ে হাঁটা শুরু করেছিল। ছোট্ট একটা ব্রিজ পার হয়ে, খানিকটা গঞ্জ মতো জায়গা অতিক্রম করে দাঁড়িয়ে গেছে সহসা। সামনে বিশাল চওড়া গঙ্গা বাঁক খেয়ে ঘুরে গেছে। অনেকটা নীচে গেরুয়া জল ছলাৎ ছলাৎ আছাড় খাচ্ছে পাড়ে।

রঘুবীর কথা বলেই চলেছে। কখনও জোরে, কখনও আস্তে, কখনও ইনিয়ে বিনিয়ে, কখনও গমগম স্বরে।

আদিত্য থামাতে চাইল রঘুবীরকে, ওসব কথা থাক।

–থাকবে কেন? আপনি যখন বিশ্বাস অবিশ্বাসের কথা তুললেন, আরও অনেক কথা স্পষ্ট হয়ে যাওয়া দরকার।

ওই নদীকে সামনে রেখে কি কথা স্পষ্ট করবে রঘুবীর? খোলা আকাশের নীচে কী বা তার গোপন আছে? যদি থাকে, সেটুকু তো আড়াল থাকাই ভাল। সত্যিই হয়তো বেচারার মাসিটা অসুস্থ হয়েছিল! বেচারার মাসি ছাড়া আর কেই বা আছে এ সংসারে! রঘুবীর যে মূলত অভাবী, দ;এ পড়া, তা কি এতদিনে বোঝেনি আদিত্য!

রঘুবীরের হাতে হাত রাখল আদিত্য, আহ, থাক না ওসব কথা।

–আমি বড় কষ্ট পেয়েছি রায়দা।

রাগের মাথায় কী বলি, কী ভাবি, তার কি ঠিক থাকে?

–তা ঠিক। রাগ হল চণ্ডাল। রঘুবীর মুহূর্তে গা ঝাড়া দিয়ে উঠেছে। বিড়ি বার করে ধরাল, এই ব্রাহ্মণ সন্তানের ওপর আপনি ভরসা রাখুন রায়দা, আমার দ্বারা আপনার কোনও অনিষ্ট হবে।

আদিত্য নদীটাকে দেখছে। উলুবেড়িয়ার এই জায়গাটা তাকে খুব টানে। রঘুবীরের মুখেই শুনেছে এই সামনেই নাকি একটা জাহাজডুবি হয়েছিল। বেশ ক বছর আগে। এখানে দাঁড়ালে কল্পচোখে জাহাজটাকে দেখতে পায় আদিত্য। কাত হয়ে গেছে এক দিকে। ডুবছে ধীরে ধীরে। প্রকাণ্ড অবয়ব ক্রমে মিলিয়ে গেল। ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে উদাসীন নদী।

আদিত্য হঠাৎ প্রশ্ন করল, জাহাজডুবিতে কি কেউ মারা গেছিল?

রঘুবীর একটু যেন ধাক্কা খেল। তারপর দাড়ি চুমরোতে চুমরোতে বলল, একজনও না। কত নৌকো, কত লাইফবোট এসে গেল…

জাহাজটা কি এখনও জলের তলাতেই আছে?

–কে জানে! টেনে উঠিয়েও নিয়ে যেতে পারে।

–ও জাহাজ কি আর জলে ভেসেছে কোনওদিন?

–সে আমি কি করে বলব! তবে অলুক্ষুণে জিনিস আর ভাসানো ঠিকও নয়।

জাহাজ ডোবা দেখতে খুব ভিড় জমেছিল, না?

–ভিড় মানে! কাতারে কাতারে লোক। কাছের সব গ্রাম শহর ঝেটিয়ে… আমিই তো সেই দমদম থেকে ছুটে এসেছিলাম। অনেক সাহেব মেম এসেছিল, পটাপট ছবি তুলছিল।

-কেন ডুবল বলুন তো জাহাজটা?

 রঘুবীর অম্লানবদনে বলল, ঠিক সময় দেখে যাত্রা শুরু করেনি তাই।

–নাকি জাহাজেরই দোষ?

রঘুবীর আড়চোখে আদিত্যকে দেখল, রোজই এক কথা জিজ্ঞেস করেন কেন বলুন তো?

 উত্তরটা আদিত্যই যদি জানত! বাপ্পা জাহাজে চলে যাবে বলেই কি অজানা আশঙ্কায় বুক কাঁপে তার? নাকি নদীর নীচে মাটি বালি কাঁকরের বিছানায় জাহাজটা এক আশ্চর্য দেশ হয়ে ঘুমিয়ে আছে, যার গোপন করে ডুবুরি হয়ে ঘুরে বেড়াতে সাধ হয় আদিত্যর? কেন হয়! ওখানে কি আদিত্যর সেই গুপ্তধন আছে? নাকি জাহাজটা সে নিজেই? সংসারের সহস্র লোকের চোখের সামনে দিয়ে অসহায় ডুবে গেছে?

আদিত্যর পিঠে রঘুবীর হাত রাখল, চলেন রায়দা। এবার ফিরি।

-ফেরা! কোথায়! আদিত্য বড়সড় শ্বাস ফেলল, আরেকটু বসি।

–আপনাদের ডাক্তারের আজ নার্সিংহোম ওপেন হচ্ছে না?

হুঁ।

যাবেন না সেখানে?

দূরে একটা নৌকো ভাসছে। পাল তোলা নৌকো। হাওয়ায় ফুলে আছে পাল। বাতাস কেটে নৌকো ছুটে চলেছে সরসর। নাকি বাতাস নিয়েই চলেছে?

আদিত্য নৌকোটাকে দেখছিল। ডুবে যাওয়া জাহাজটাকে বুঝি মাড়িয়ে গেল নৌকোটা।

.

৩২.

আদিত্য ট্রেনে ফিরছিল। একা। রঘুবীর চলে গেল কুলগাছিয়ায়। ওখানে কে এক আত্মীয় আছে, তার বাড়ি ঘুরে অনেক রাত্রে কলকাতা ফিরবে। আদিত্যকে যেতে ডাকেনি রঘুবীর, আদিত্যও উৎসাহ দেখায়নি। সন্ধের পর রঘুবীরের সঙ্গে না থাকাই ভাল। রঘুবীর তখন আর মানুষ থাকে নাকি! নেশাড় ভাল্লুকের মতো ছটফট করে, নোংরা দিশি বারে নিয়ে গিয়ে বসায় আদিত্যকে। আদিত্য সতর্ক থাকতে চায়, তবু দু-এক চুমুক খাওয়া হয়ে যায় কোনও কোনও দিন। গত মাসে রঘুবীরের পেটে আবার একদিন বেদনা উঠেছিল। বারে বসেই। তার মুখচোখ দেখে আদিত্য বেশ ভয়ই পেয়ে গিয়েছিল সেদিন। আদিত্যরও আবার ব্যথাটা ফেরত আসবে না তো!

ট্রেনে এখন বেশ ভিড়। যাত্রী আর হকারদের মিলিত কলরবে গমগম করছে কামরা। বসার সিট নেই, আদিত্য বসার চেষ্টাও করেনি। সে যে লোকেরই সিট তাক করে দাঁড়াবে, সে নির্ঘাত হাওড়ায় নামবে। আদিত্য জানে।

ই এম ইউ লোকালের জানলা দরজা দিয়ে হইহই করে হেমন্তের বাতাস ঢুকছে। বাতাসটা বেশ ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা, তবু মানুষের ভিড়ে ওই শীতলতা ভালই লাগছিল আদিত্যর। রড ধরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই ঢুলছিল সে।

–আদিত্য। অ্যাই আদিত্য।

আদিত্য মাথা ঝাড়া দিয়ে এদিক-ওদিক দেখল। রণেন। রোদ-মাখা জানলার ধারে বসে হাসছে।

আদিত্য খুশি হল না। রণেনের সঙ্গে শেষ সাক্ষাৎকারটা তার মোটেই মধুর ছিল না। সামান্য কটা টাকার জন্য বাড়িতে এসে অপমান করে গিয়েছিল রণেন। নিজে না বলে বউকে দিয়ে ইন্দ্রাণীকে কথা শুনিয়েছিল। ইন্দ্রাণী কী ভয়ঙ্কর রেগে গিয়েছিল সেদিন! হাতের চুড়ি বেচে দুর্লভবাবুকে দিয়ে টাকা পাঠিয়ে দিয়েছিল রণেনের অফিসে।

আদিত্য ভারিক্কি মুখে বলল, তুই কোত্থেকে?

–খড়্গপুর। আমি তো এখন ওখানেই আছি। নিমপুরায় একটা কারখানায় জয়েন করেছি।

বা, ভাল খবর। আদিত্য গলা নিস্পৃহই রাখল।

রণেন চেঁচাচ্ছে, তোর প্রেসের কী খবর? আছে, না উঠে গেছে?

–উঠবে কেন? ভালই চলছে।

–কে চালাচ্ছে? তুই, না তোর বউ? সুরজিৎ বলছিল তোর বউই নাকি সামলায়?

 চারপাশের লোকজন দেখছে আদিত্যকে। দু-চার জনের ঠোঁটের কোণে হাসির রেখাও যেন দেখতে পেল আদিত্য। হঠাৎই একটু পাল্টা আঘাত ছুঁড়তে ইচ্ছে হল তার। ঠাণ্ডা মাথায়।

হাসি হাসি মুখে আদিত্য বলল, আমরা ডিউটি ভাগ করে নিয়েছি। ও প্রেসে বসে, আমি অর্ডার পেমেন্ট ডেলিভারিগুলো সামলাই। অর্ডার আসছেও বটে। ওভারটাইম দিয়েও সামাল দেওয়া যাচ্ছে না।

বাহু, তুই তো বেশ দাঁড়িয়ে গেলি রে! আমার ধারণা ছিল…।

আদিত্য কথা কেড়ে নিল, আর দাঁড়ানো। কত ঝঞ্ঝাট। নতুন একটা অফসেট মেশিন বসাচ্ছি, ফোর কালার। বারো লাখ টাকা মতো পড়ে যাবে, বুঝলি। তার ওপর আবার এসি-ফেসি বসাতে হবে।

এতক্ষণে একটু যেন নিবেছে রণেনের মুখ। গলাও। চেঁচানো কমিয়ে স্বাভাবিক স্বরে বলল, ব্যাঙ্ক লোন নিচ্ছিস?

–তা অল্প কিছু নিতে হবে। আদিত্য কায়দা করে ঘাড় ঘোরাল, –এই, শশা খাবি নাকি?

–না নাহ্, শশা-টশা আমার ভাল লাগে না রে। কচকচ করে।

–খা না। আদিত্য ফিচেল হাসল, কচি শশা। নুন লঙ্কার গুঁড়ো দিয়ে…

শশাঅলাকে ডেকে দুটো শশা কাটাল আদিত্য। এগিয়ে গিয়ে দিল রণেনকে। নিজেও খাচ্ছে। খেতে খেতেই বলল, বুঝলি, আমি আবার এদিকে আরেকটা ঝামেলায় ফেঁসে গেছি।

কী রকম? একটু যেন উৎসাহিত মনে হল রণেনকে।

আরেক ব্যবসা ধরে ফেলেছি। রোড কন্ট্রাক্টারি। দু দিক সামলাতে একেবারে জেরবার হয়ে যাচ্ছি রে। গভর্নমেন্টের কাজ, ঠিক সময়ে তুলতে হয়, সাইটে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়…

–এক-একটা কাজে কী রকম থাকে?

কী রকম থাকে? এই ধর গত মাসে উলুবেড়িয়ায় একটা আড়াই লাখ টাকার জব ওঠালাম, তাতে ধর গিয়ে…মনে মনে হিসেবের ভান করল আদিত্য, –যেখানে যা দেওয়ার দিয়ে থুয়ে হাজার পঞ্চাশেক মতো থাকবে।

–একাই করছিস? তুই এ সব কাজ জানলি কী করে?

–একটা আই আই টি সিভিলের ছেলেকে পার্টনার নিয়েছি। চোখের সামনে রঘুবীরের চেহারাটা ভাসিয়ে নিল আদিত্য, দারুণ স্মার্ট। কাজেকর্মে একেবারে চাম্পিয়ান। এ কি, তুই শশা খাচ্ছিস না যে?

কই, না। …খাচ্ছি তো।

–খা। মুখের ভেতরটা টসটসে থাকবে। জল তেষ্টা পাবে না। আদিত্য প্রায় রণেনের কানের কাছে ঝুঁকল, এদিকে আবার যা হয়। গিন্নি নতুন বায়না শুরু করেছে।

কী? রণেনের গলা ফ্যাসফেসে।

–গাড়ি। যা যা ইন্দ্রাণীকে দিতে মন চেয়েছে, সবই আজ রণেনের সামনে দিয়ে দেবে আদিত্য। কল্পনার পোলাওতে একটুও ঘি কম দিতে রাজি নয় সে। হাসি মেখে বলল, গিন্নির ইচ্ছে মারুতি, আমার অ্যাম্বাসাডার। তোর কী মনে হয় রে? অ্যাম্বাসাডারই ভাল, তাই না? হার্ডি গাড়ি।

–সবই ভাল। রণেন আচমকা একটু দূরের দিকে আঙুল দেখাল, অ্যাই, ওদিকে একটা সিট খালি হচ্ছে, বসে যা না।

আদিত্য জানলা দিয়ে বাইরেটা দেখল, –আর বসে কী হবে! সাঁতরাগাছি তো পেরিয়ে গেল। তারপর তোর খবর বল? নিমপুরা ভাল লাগছে?

–ওই এক রকম।

–আয় না একদিন আমাদের বাড়ি। ইন্দ্রাণী খুব তোদের কথা বলে।

–যাবখন। কলকাতায় আজকাল বেশি আসাই হয় না…

–তবু আসিস। আদিত্য চাবুকটা শূন্যে ঝেঁকে নিল, হ্যাঁ ভাল কথা। তুই যে মেশিনটা দিয়েছিলি, ওটা আর কাজে লাগছে না। বেচে দেব ভাবছি। তেমন দরটর না পেলে স্ক্র্যাপের দরেই বেচব। তোর হাতে কোনও পার্টি-টার্টি আছে? তুই মাঝে থাকলে তোরও কিছু কমিশান এসে যেতে পারে।

রণেনের কি মনে পড়েছে আদিত্যকে মেশিন কেনানোর সময়ে লোকটার কাছ থেকে দু হাজার টাকা কমিশন নিয়েছিল রণেন? নিশ্চয়ই পড়েছে। না হলে অমন পাঁশুটে মেরে গেল কেন? তন্ময় হয়ে কী দেখছে বাইরে? প্রকৃতির শোভা? না কলকারখানার বিষাক্ত ধোঁয়া?

হাওড়া স্টেশনে নেমে কোন দিকে যে গেল রণেন!

দুপুরের দুঃখ বিকেলে পৌঁছে খুশি হয়ে গেছে। আদিত্য এখন অনেক চিন্তাশূন্য। ভারহীন। বাড়ি না ফিরে আদিত্য সোজা মানিকতলায় চলে গেল। ইন্দ্রাণীর অসুখের পর থেকে এখন মাঝে মাঝে যায় ও বাড়িতে। ধীরাজের সে দিন ওভাবে হারিয়ে যাওয়া অনেক দিন পর হঠাৎ আবার ছুঁয়ে গেছে আদিত্যকে। রুনার মুখে খবর পেয়ে সে যখন সন্ধেবেলা মানিকতলা গিয়ে পৌঁছয়, তখন সবে ধীরাজকে নিয়ে ফিরেছে ইন্দ্রাণীরা। ধীরাজের ওই বিভ্রান্ত দশা, উমার বিহ্বল চাহনি দেখে নিজেকে কেমন অপরাধী মনে হচ্ছিল আদিত্যর। নিঃসহায় বুড়ো বুড়ির জন্য ইন্দ্রাণী আর কত ছোটাছুটি করবে! তনুময় যখন নেই তখন ছেলের কর্তব্য তো অনেকটা আদিত্যর ওপরও বর্তায়।

শ্বশুরবাড়ি ঢুকে একটু চমকাল আদিত্য। ইন্দ্রাণীও এসেছে আজ। মা বাবার সামনে বসে আছে থম হয়ে।

আদিত্যকে দেখে উমার মুখে হাসি ফুটল, –আজ কী কপাল! মেয়ে জামাই দুজনেই এসেছে।

 ধীরাজ বললেন, –ভালই হয়েছে তুমি এসে গেছ। দ্যাখো না কী সমস্যা চলছে আমাদের।

আদিত্য ব্যস্ত হল, –কেন, কী হয়েছে আবার?

–আর বলল কেন, কালীপুজোর আগের দিন চোদ্দ শাক কিনতে বাজারে গেছিলাম। তা আজকাল তো চাষিদের কাছে ছাড়া চোদ্দ শাক পাওয়াই যায় না। ও সব খাওয়ার রেওয়াজ তো এখন আস্তে আস্তে উঠেই যাচ্ছে। অথচ ছোটবেলায় শুনতাম ঘৃতে বৃদ্ধি বল আর শাকে বৃদ্ধি মল।

এতে সমস্যার কী আছে আদিত্য বুঝতে পারল না, প্রশ্নসূচক চোখে উমার দিকে তাকাল।

 উমা আঙুলের ইশারায় নিজের মাথাটা দেখালেন। ঠোঁট নেড়ে বোঝালেন, ভীমরতি।

ধীরাজ কথা বলে চলেছেন, তা আমার অবশ্য মানিকতলা বাজারে একটা চেনা শাকঅলা আছে। বিরাটির দিকে থাকে। ট্রেনে উল্টোডাঙায় নেমে…।

ইন্দ্রাণীর মুখ থেকে কালো ছায়া সরে গিয়ে অস্ফুট হাসি ফুটে উঠেছে। বলল, বাবার কাছ থেকে তুমি যদি শুনতে চাও, তা হলে রাতটা এখানেই থেকে যেতে হবে। থাকবে?

–আহ্, ঠাট্টা করছ কেন? বয়স্ক মানুষ অত মেপেজুপে কথা বলতে পারে নাকি? আদিত্য লঘু ভর্ৎসনা করল ইন্দ্রাণীকে, –তুমিই বলো না।

বাবা কালীপুজোর আগের দিন বাজার থেকে ফেরার পর বাড়িঅলা এসেছিল নীচে। পাম্প খারাপ হয়ে গেছে, ওরা এখন কদিন জল দিতে পারবে না।

এই কথা শাক দিয়ে শুরু হল! কী ধরতাই! আদিত্য শঙ্কিত চোখে একবার দেখে নিল শ্বশুরমশাইকে। তারপর হেসে ফেলল, –এতে সমস্যার কী আছে? ভারি দিয়ে জল নিলেই হয়।

এ বার উল্টো ধমক দিয়েছে ইন্দ্রাণী, যা বোঝো না, তাই নিয়ে কথা বোলো না তো। এক ভার জলের দাম কত জানো?

–কত হবে? দশ পয়সা…না না, চার আনা।

-কোনও খবরই তো রাখলে না কোনওদিন। এক ভার জল দেড় টাকা, বুঝেছ?

 উমা বললেন, –ওভাবে বলছিস কেন? পুরুষ মানুষরা এত সব খবর রাখে নাকি?

আদিত্য মনে মনে হিসেব করছিল। ধীরাজ উমার যদি দিনে ছ ভার জলও লাগে, মাসে প্রায় দু আড়াইশো টাকার ধাক্কা। সে তো বড় কম নয়! গম্ভীরভাবে বলল, –পাম্প সারাচ্ছে কবে?

ধীরাজ বললেন, –সারাচ্ছে না। ওদের এক চেনা মিস্ত্রি আছে, সে নাকি কালীপুজোর দিন দেশে গেছে। তার দেশ হল গিয়ে উড়িষ্যায়। বালেশ্বরে নেমে বাসে করে…

বাবা। ইন্দ্রাণী থামাল ধীরাজকে। উমাকে বলল, মা, টিভিটা চালিয়ে দাও না, বাবা বসে বসে দেখুক।

টিভি চলতেই ঘাড় ঘুরে গেছে ধীরাজের। ঘরেও সকলের স্বস্তি ফিরে এসেছে।

উমা বললেন, –ওদের চেনা মিস্ত্রি না এলে ওরা পাম্প সারাবে না। সে এক মাসও হতে পারে, ছ মাসও হতে পারে…

বলেছে এ কথা?

–তা হলে আর বলছি কি বাবা!

জল না দেওয়া তো ক্রিমিনাল অফেন্স। বাড়িঅলা যদি পাম্প না সারায় তো ভারির টাকাটা দিয়ে দিক।

বয়ে গেছে ওদের। এই তো ইনু বলতে গেছিল, দিবাকরের বউ যা নয় চাট্টি কথা শুনিয়ে দিল।

মুহূর্তে পৌরুষ জেগে উঠেছে আদিত্যর। একটু আগে ইন্দ্রাণীর একজন অপমানকারীকে নিপুণভাবে বধ করে এসেছে সে, এ বার আরেক জনেরও খবর নেবে নাকি?

তড়াক করে উঠে দাঁড়াল আদিত্য, আমি যাব? কথা বলে আসব?

ইন্দ্রাণী খরখর করে উঠল, –তুমি কি যাবে? আমি গিয়েই কাজ হয়নি…।

–না না, এ সব বাড়তে দেওয়া ঠিক নয়। ওয়ান শুড এগজার্ট ওয়ানস্ রাইট।

ঠিক আছে, তুমি চুপ করে বোসো তো।

আদিত্য বসেও ছটফট করছে, –ওপরে না যাই, থানায় গিয়ে রিপোর্ট করতে পারি। পুলিশ এলে পারমানেন্টলি টাইট হয়ে যাবে। যাব?

–থাক। দয়া করে বোসো এখন।

উমা হাসছেন, তুমি কেন থানা পুলিশের ঝামেলায় যাবে বাবা? আরাম করে বোসো। মুখটা তো শুকিয়ে গেছে দেখছি।

–হ্যাঁ, সেই উলুবেড়িয়া থেকে ফিরছি।

–ওমা, সে তো অনেক দূর!

কী এমন দূর! কাজেকর্মে আমায় প্রায়ই যেতে হয়।

আদিত্যর কথার ধরন দেখে ইন্দ্রাণী হেসে বাঁচে না, তোমার জামাইকে কিছু খেতে দাও মা। বড় খেটে এসেছে।

উমা চোখ পাকালেন, আবার ওভাবে কথা! খেটে আসুক আর নাই আসুক, দূর থেকে তো এসেছে। ক্ষিদে তো পেয়েছেই।

উমা উঠে গেছেন রান্নাঘরে। ধীরাজ টিভিতে বিভোর। আদিত্য চুপচাপ বসে লাইটারটাকে বাজাচ্ছিল। সুর দুলছে প্রজ্জ্বলকে। নীল শিখা স্থির।

আচমকা আদিত্য নিচু গলায় বলল, তুমি আজ এখানে আসবে আমি ভাবিনি।

ইন্দ্রাণী ব্যাগ খুলে কি যেন খুঁজছিল। বিস্মিত চোখে তাকাল, –কেন?

আদিত্য ফস করে বলে ফেলল, -ভেবেছিলাম তুমি হয়তো আজ ডাক্তারের নার্সিংহোমে যাবে।

ইন্দ্রাণীর চোখে আরও বিস্ময়, –কেন?

কাল ডাক্তার অত করে বলে গেল তো। নিজে একটা প্রতিষ্ঠান গড়েছে, কম কথা!

 ইন্দ্রাণী কি হাসল সামান্য? চোখে কি একটু আলোর জ্বলা-নেবা? না আদিত্যর মনের ভুল?

 ক্ষণ পরে ইন্দ্রাণী বলল, -শুভাশিস তো তোমাকেও বলেছিল। তুমি গেলে না কেন?

 দুজনের মাঝখানে শব্দহীন তরঙ্গ ঘুরে বেড়াল কিছুক্ষণ। লাইটার বিনাই নীল এক শিখা কাঁপল আপন মনে। অশ্রুত এক বাজনা বেজে বেজে থেমে গেল।

দুজনেই হাসছে। কেন হাসছে কেউই জানে না। হয়তো বা জানে, জানাটা লুকিয়ে রাখতেই আরও বেশি হেসে উঠছে দুজনে।

লুচি আলুর দম সহযোগে মোটামুটি একটা পরিতৃপ্ত জলযোগ সেরে দুজনে উঠে পড়ল। সদর থেকে আদিত্যকে একবার ডাকলেন উমা, তোমার কি একবার সামনের সপ্তাহে সময় হবে বাবা?

-কেন মা?

–একটু বেলুড় মঠে যেতাম। দীক্ষা তো নেওয়া হল না, ওখানে গিয়ে চোখ বুজে বসে থাকলেও শান্তি লাগে।

–আফসোস করছেন কেন? দীক্ষা নিয়ে নিলেই পারেন।

–সে আর এ জীবনে নেওয়া হবে না।

–কেন, কী এমন কঠিন কাজ? শুনেছি স্বামীজিদের বললেই তাঁরা দীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থা করে দেন।

মনটাকে যে কোথাও বাঁধা দিতে পারি না বাবা। ফাঁকা আছে, ফাঁকাই থাক। যদি কোনওদিন অঘটন ঘটে…! তনুটা ঠাকুরদেবতা একদম মানত না।

আদিত্যর চোখে জল এসে যাচ্ছিল। প্রতীক্ষা কি শুধুই দুঃখ! স্মৃতিতেও কি কোনও সুখ থাকে মানুষের? গলার জমাট পিণ্ড গিলে নিয়ে আদিত্য বলল, আপনি কিছু ভাববেন না মা। তনু ঠিক একদিন ফিরে আসবে।

–তুমি বলছ?

-বলছি। আদিত্য ঘুরল, আমি সামনের শুক্রবার এসে আপনাকে নিয়ে যাব। সকালবেলা গিয়ে দুপুরে ফিরে আসব।

ফুটপাথে নেমে আদিত্য দেখল দিলুদের দরজায় দাঁড়িয়ে কথা বলছে ইন্দ্রাণী। দিলুর সঙ্গে। হাত পা নেড়ে কি সব জানাচ্ছে। বোধহয় বাড়িঅলার কথা। দিলুর ওপর ইন্দ্রাণীর খুব ভরসা।

দিলীপ আদিত্যকে দেখে হাত নাড়ছে। আদিত্যও নাড়ল। এগোল না।

মোড়ে এসে আদিত্য বলল, আমরা কি ট্যাক্সিতে ফিরব?

–ফিরতেই পারি। ইন্দ্রাণী মুহূর্তে রাজি, –তোমার কাছে তো টাকা আছে।

থাক গে। মিনিবাসই ভাল। আটটা বাজে, এখন তো বাস-ট্রাম ফাঁকা হয়ে গেছে।

ইন্দ্রাণী হেসে ফেলল, টাকা বুঝি উড়ে গেছে?

আদিত্য লাজুক হাসল।

–ঠিক আছে, ট্যাক্সি ধরো।

 কলকাতার ট্যাক্সিঅলারা মানুষ চেনে, আদিত্য ডাকলে তারা কেউ দাঁড়ায় না। এত দুর্বলভাবে তাদের ডাকে আদিত্য যে, তাদের প্রত্যয়ই হয় না এই লোকটা সত্যি সত্যি ট্যাক্সিতে উঠতে চায়।

ইন্দ্রাণীই হাত তুলে থামাল একটা ট্যাক্সিকে।

যাচ্ছে দুজনে। দুজনেরই চোখ জানলার বাইরে। দু দিকে। শিয়ালদার বিশাল হোর্ডিংটা দেখতে দেখতে আদিত্য বলল, জানো, আজ ট্রেনে রণেনের সঙ্গে দেখা হয়েছিল।

তাই? ইন্দ্রাণী ফিরল আদিত্যর দিকে।

ব্যাটাকে খুব শিক্ষা দিয়েছি আজ। সোৎসাহে আদিত্য গল্প শুরু করেছে। রণেনের মুখ-চোখের ভাব বলতে গিয়ে একটু রঙ চড়িয়ে দিল গল্পে। রণেন নাকি হিংসেয় দু হাতে চুল খামচাচ্ছিল!

ইন্দ্রাণী কতটা বিশ্বাস করল কে জানে, তবে শুনল মন দিয়ে। ঠোঁট টিপে বলল, –খুব তো ভিজে বেড়াল সেজে থাকো, তুমিও তো সেয়ানা কম নও!

আদিত্য বিচারকের ঢঙে বলল, –এটা ওর প্রাপ্য ছিল।

জ্যামে ট্যাক্সি থেমে আছে মৌলালিতে, অল্প উসখুস করে সিটে হেলান দিয়ে সিগারেট ধরাল আদিত্য। বলল, -চাঁদু বলছিল আজ ডাক্তারের ওখানে যাবে।

–হ্যাঁ, আমাকেও বলছিল।–ওখানে নাকি চাঁদুর এক পরিচিত মেয়ের চাকরি হয়েছে?

বন্ধুর বউ। বন্ধু মারা গেছে।

বিধবা! এ কথা তো চাঁদু বলেনি! চাঁদুটা সব কথাই অর্ধেক অর্ধেক বলে। ফিলম লাইনের লোকগুলোর সঙ্গে ঘুরে ঘুরে ব্যাটা দিন দিন প্যাঁচোয়া হয়ে যাচ্ছে।

ইন্দ্রাণী চোখ বুজে বসে আছে। চোখ বুজেই বলল, আমার কিন্তু চাঁদুর চাকরি দেওয়াটা ভাল লাগেনি।

–কেন?

আমাকে কিছু না জানিয়েই আগে শুভাশিসকে বলেছে। এটা ঠিক কাজ নয়। আমাকে একবার জিজ্ঞেস করে নিতে পারত।

–হুঁ।

 হুঁ নয়, হ্যাঁ। তোমরা কিছু রিকোয়েস্ট করলে শুভাশিস না বলতে পারে না, তোমরা তার সুযোগ নাও। শুভাশিসের তো কোনও অসুবিধেও থাকতে পারে। আমাকে বললে আমি ক্লিয়ারলি কথা বলে নিতে পারতাম। মেয়েটার কোনও এক্সপিরিয়েন্স নেই, ওরা সবে নতুন একটা নার্সিংহোম খুলছে…

আদিত্য কথাগুলো খুব গায়ে মাখল না। কৌতূহলী হয়ে বলল, মেয়েটার ওপর চাঁদুর কোনও উইকনেস্-টুইকনেস আছে নাকি?

–থাকাটা বিচিত্র নয়। খুব সুন্দর দেখতে মেয়েটাকে। বোঝাই যায় না বিয়ে হয়েছিল, এক বাচ্চার মা।

–চাঁদু তোমার কাছে কিছু ঝেড়ে কাশেনি?

 –না। তাইতেই তো সন্দেহ হয়। ও বোধহয় এ বার সত্যি সত্যি প্রেমে পড়েছে।

 আদিত্য অবাক হল, –কেন?

কারণ আগে প্রেমে পড়লেই আমাকে এসে বলত। শুনেই বুঝে যেতাম ও প্রেমে পড়েনি। এ বার কিছু বলেনি বলেই সন্দেহ হয়।

কথার মারপ্যাঁচটা আদিত্য ঠিক ধরতে পারল না। তবু ঘাড় নাড়ল। অনেক দিন পর বউয়ের সঙ্গে প্রাণ খুলে কথা বলতে পেরে খুব আনন্দ হচ্ছিল আদিত্যর। সঙ্গে সঙ্গে একটু মজাও লাগছিল যেন। একই বাড়িতে, একই ছাদের নীচে, একই সংসারে থেকেও প্রাণ খুলে কথা হচ্ছে কি না ট্যাক্সিতে!

আদিত্যর কি যেন মনে পড়ে গেল। কপালে ভাঁজ ফেলে বলল, আচ্ছা, তিতিরটাকে আজকাল এত গম্ভীর দেখি কেন বলো তো?

ইন্দ্রাণী দু-এক সেকেন্ড চুপ, –তোমার মেয়ে, তুমিই জানো।

–আহা, মেয়ে কি আমার একলার?

–তোমার মেয়ের হাবভাবে তো তাই মনে হয়। ইন্দ্রাণী হাসছে।

না গো, তিতিরটার কেমন চেঞ্জ এসেছে। হঠাৎ যেন বড়দের মতো হাবভাব।

–এখনও কি খুকিপনা করবে নাকি?

তা নয়, এত গোমড়া থাকে কেন? আজকাল কথাবার্তা কম বলছে, তুমি লক্ষ করেছ?

–এই বয়সে সব মেয়েই ও রকম হয়।

 ট্যাক্সি পার্ক সার্কাস ময়দানের পাশ দিয়ে যাচ্ছে। চিনচিনে হাওয়ায় শীত করছে বেশ। আদিত্য সিগারেট বাইরে ফেলে হাত বাড়িয়ে দু দিকের কাচ তুলে দিল। ইন্দ্রাণীকে একটু ঠাট্টা করার লোভ সামলাতে পারল না। বলল, –তা ঠিক। তুমিও ওই রকমই ছিলে।

রাজহংসীর মতো ঘাড় হেলাল ইন্দ্রাণী, আমাকে তুমি ওই বয়সে দেখলে কোথায়?

–তখন দেখিনি। দু-চার বছর পরে দেখেছি।

–ওই সময়ে দু-চার বছরেই মেয়েরা অনেক বদলে যায়।

তারপর কি হাজার বছরেও মেয়েরা আর বদলায় না! শক্ত খোলসে পুরে রেখে দেয় নিজেদের!

ট্যাক্সি বাড়ি পৌঁছেছে। প্রশ্নগুলো মনেই রয়ে গেল আদিত্যর। তিতিরকে নিয়ে চিন্তাটাও গেল না।

জয়মোহন বড় ঘরে বসে আছেন। অন্ধ অথর্বের মতো। চেয়ারের বাইরে ঝুলে আছে দুটো হাত। গায়ে একটা পাতলা সুতির চাদর।

আদিত্য ইন্দ্রাণীকে এক সঙ্গে ফিরতে দেখে ঘোলাটে পদার্টা পলকের জন্য সরে গেল চোখ থেকে, –তোরা দুটিতে কোত্থেকে?

–মানিকতলা। ইন্দ্রাণীই জবাব দিল, আপনি এখনও শোননি কেন বাবা?

–এই শুই।

–দেরি করবেন না। সাড়ে নটা বাজে। আমি ওপর থেকে এসে আপনার মশারি টাঙিয়ে দিচ্ছি।

ইন্দ্রাণী চলে গেল।

আদিত্য বাবাকে দেখছিল। মাত্র ক মাসে হঠাৎ যেন বড্ড বুড়ো হয়ে গেল বাবা! ভাবতে গিয়ে বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল। আদিত্যর একদিনের বিস্ফোরণেই বোধহয় জরাটা উল্কার গতিতে ধরে নিল বাবাকে!

আদিত্য পায়ে পায়ে সিঁড়ির দিকে যাচ্ছিল, হঠাৎ জয়মোহনের ডাক শুনতে পেল, –খোকন।

আদিত্য চমকে তাকাল, বাবা তুমি ডাকছ?

–আমি! কই না তো!

ভীষণ অবাক হল আদিত্য, তুমি এক্ষুনি আমাকে ডাকলে না?

–আমি! নাহ্।

বাবাকে অবিশ্বাস করার কোনও হেতু নেই, একইভাবে ঝিমোচ্ছে মানুষটা। মুখ বুকের কাছে ঝুলে আছে।

আদিত্যর বুক সিরসির করে উঠল। কী করে হয়! সে যে এইমাত্র স্পষ্ট শুনল ডাকটা। খোকন!

সেই ঘড়ঘড়ে স্বর! অবিকল বাবার গলার আওয়াজ!

আদিত্যর শুনতে এত ভুল হল!

.

রাতভর চোখের সামনে এক জাহাজডুবি হতে দেখে আদিত্য। ডুবে যাওয়া জাহাজের কক্ষে, ডেকে, ইঞ্জিনঘরে ভেসে বেড়ায় অজস্র নেতানো টাকা। অজস্র। টাকারা মানুষের স্বরে কথা বলে। খোকন! খোকন! ও কি কথা? না আর্তনাদ?

আদিত্যর ঘুম আসে না। ছটফট করে বিছানায়। অস্থির পায়ে ছাদে ওঠে, নেমে আসে, ভূতের মতো ঘুরে বেড়ায় সারা বাড়ি। অলৌকিক ছায়া হয়ে।

কেউ জেগে ওঠে না। ঘুমোয়। নিশ্চিন্তে।

.

৩৩.

নার্সিংহোম উদ্বোধনের দিন চারেক পর পার্টি দিল শুভাশিস। নিজের ফ্ল্যাটে। দিনটা রবিবার, তার ওপর উপলক্ষ নতুন নার্সিংহোম, অরূপ শালিনী শুভাশিস তিনজনেরই পরিচিত গণ্ডির মানুষ ঝেটিয়ে এল পার্টিতে। হইহুল্লোড় হাসিতামাশার বান বয়ে গেল। নিয়ম মাফিক চটুল ইংরিজি বাজনা বাজল, কোমর জড়িয়ে নাচ হল নিয়মমাফিক, বেহেড মাতলামির রীতি বজায় রাখল কেউ কেউ। দিশি বিদেশি সুরা আর হোটেলপক সুখাদ্যে উপচে পড়ল শুভাশিসের ফ্ল্যাট।

আসর ভাঙল মধ্যরাতে।

অরূপ শালিনী গেল সবার শেষে। প্রায় সাড়ে বারোটায়। ফ্ল্যাট খালি হওয়ার পর ফুল স্পিডে ঘুরন্ত পাখার নীচে কয়েক মিনিট মাথা টিপে বসে রইল ছন্দা। ভিড়ে, নিশ্বাসে এতক্ষণ এক কৃত্রিম উত্তাপ ছেয়ে ছিল গোটা ফ্ল্যাটে, ধীরে ধীরে ফিরছে প্রাকৃতিক শীতলতা। এ সময়ে শরীর যেন আর চলে না, সম্পূর্ণ নেতিয়ে পড়তে চায়।

শুভাশিস ব্যালকনিতে এসে পরিতৃপ্ত মুখে সিগারেট ধরাল একটা। উল্টো দিকের ফুটপাতের দেওয়ালে কয়েকটি ছেলে নির্বাচনী স্লোগান লিখছে, এক যুবকের নিখুঁত হাতের টানে ফুটে উঠল দলীয় প্রতীক, শুভাশিস তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল। অথবা দেখছিল না। চোখ দিয়ে আর কতটুকুই বা দেখে মানুষ, দেখে তো মন। শুভাশিসের সেই মন আজ নিজেরই গন্ধে মাতোয়ারা। আত্মমগ্ন। সাফল্যের ছবি ছাড়া এখন অন্য কিছু দেখার তার অবকাশ কোথায়?

ছন্দা ডাক দিল, বাইরে দাঁড়িয়ে কী করছ? ঘরে এসো।

শুভাশিস আনমনে বলল, হাওয়াটা বেশ লাগছে।

–ও হাওয়া মোটেই ভাল নয়। হিম পড়ছে, ঠাণ্ডা লেগে যাবে।

ছন্দার স্বরে অকৃত্রিম উদ্বেগ, শুনতে ভাল লাগল শুভাশিসের। হঠাৎ হঠাৎ এই একটুখানি মায়া, একজনের জন্য অন্যজনের ছোট ছোট ভাবনা, ফোঁটা ফোঁটা অনুভূতি, এরাই বোধহয় এতকাল টিকিয়ে রেখেছে সম্পর্কটাকে। অনুভূতিগুলো যেন ঠিক অনুভূতিও নয়, যেন এক ধরনের অদৃশ্য আঠালো রোঁয়া। অগণন। এক সঙ্গে থাকতে থাকতে কখন আপনি গজিয়ে যায় তারা, আপনিই টানতে থাকে পরম্পরকে। এই টান কখনও কখনও ইস্পাতের শিকলের চেয়েও মজবুত।

শুভাশিস ব্যালকনি থেকে ফিরল। টোটোর ঘরের দরজা আধখোলা। একটু আগেও ঘুরে ঘুরে অভ্যাগতদের হাই হ্যালো করছিল টোটো, এবার বোধহয় ঘুমিয়েছে। ছেলেটা দেখতে দেখতে বড় হয়ে গেল! কেমন সাবালকের মতো আজ দেখভাল করছিল অতিথিদের! তবে শৈশবের কিছু কিছু অভ্যাস এখনও যায়নি, এখনও দরজা খোলা রেখেই ঘুমোয় টোটো।

টানা কাচের দরজা বন্ধ করে লম্বা রডে পদা টেনে দিল শুভাশিস। ছন্দার পাশে বসে বলল, –কি, খুব কাহিল হয়ে পড়েছ তো?

ছন্দা চোখ বুজে মাথা দোলাল-নাহ, ঠিক আছি।

–মোটেই ঠিক নেই। চোখমুখ একেবারে কালো হয়ে গেছে। শুভাশিস ছন্দার পিঠে হাত রাখল। আলগা জড়িয়ে ধরে একটু কাছে টানল ছন্দাকে, মিছিমিছি এই শরীরে জোর করে স্ট্রেইনটা নিলে। অরূপ শালিনীদের ওখানে করলেই হত, ওরা তো করতেও চেয়েছিল।

শুভাশিসের পলকা বাঁধন থেকে ছন্দা ছাড়াল নিজেকে। উদাস ভাবে বলল, শালিনীদের বাড়িতে কথায় কথায় পার্টি হচ্ছে। এটা এখানে না হলে দৃষ্টিকটু লাগত।

–তা ঠিক। তবু তুমি পুরোপুরি সুস্থ থাকলে একটা কথা ছিল। গ্যাদারিংটা তো ক্লাবেও করা যেত, তুমি এমন জেদ ধরলে…

–ক্লাবে ঠিক সুখ হয় না। মাঝখান থেকে গুচ্ছের খরচা…

–দ্যাখো কাণ্ড! শুভাশিস হেসে ফেলল, তুমিই কিনা আমাকে কিপটে বলো। আরে বাবা, একটু নয় বেশি খরচা হতই। তোমার মিডলক্লাস মেন্টালিটিটা এখনও গেল না।

–আমরা তো মিডলক্লাসই।

—নো। উই আর অন দা রাইজ। উঠছি। আরও উঠব। কত দিন পর যে ছন্দার সঙ্গে এত স্বাভাবিক স্বরে কথা বলছে শুভাশিস!

ছন্দা প্রায় গলে গেল, –কোথায় উঠবে? সিলিং-এ?

নো। স্কাই ইজ দা লিমিট। বলতে গিয়েও থেমে গেল শুভাশিস। আকাশ মানে তো এক অনন্ত মহাশূন্য। মাইল কয়েক ওঠার পর বাতাস প্রায় থাকেই না, নিশ্বাসের জন্য অক্সিজেন সিলিন্ডারের প্রয়োজন হয় তখন। সেখানে উঠে কী করবে শুভাশিস হাসিমুখে বলল, দ্যাখো না কোথায় পৌঁছই। তোমাকে আর মাটিতে পা ফেলে হাঁটতে দেব না।

ছন্দাও হাসছে, হাতে হাঁটব নাকি?

–উঁহু। উড়বে। ডানা মেলে। কথাটা বলে নিজেই মনে মনে একটু উড়ে নিল শুভাশিস, সিটি ব্যাংক থেকে আরেকটা গাড়ি কিনছি। মারুতি থাউজেন্ড। তোমার আর টোটোর জন্য। সমীরণ শিগগিরই একটা ভাল ড্রাইভার পাঠিয়ে দেবে বলেছে। বেড়াতে গেলেও এবার থেকে উটি সিমলা কোডাইকানাল নয়, যদি যাই তো অন্য কন্টিনেন্ট। কি, খুশি?

বাতাস বেশ ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। ছন্দা উঠে পাখা দু পয়েন্ট কমিয়ে দিয়ে এল। বালুচরি শাড়ির আঁচল আলগা জড়াল গলায়। সোফার পিঠে মাথা রেখে বলল, টোটো খুব খুশি হবে।

–তুমি হবে না। 

–আমি তো খুশিই।

 ছন্দা কি মন থেকে বলল কথাটা? তবে কেন অপারেশন করাবে না বলে গোঁ ধরে আছে? ভয়? ডাক্তারের বউ হয়েও? না, হিমোগ্লোবিনের পারসেন্টেজ একটু বাড়িয়ে এবার হিসটেরেকটোমিটা করিয়েই নিতে হবে। দরকার হলে জোর করবে শুভাশিস।

পাঞ্জাবির পকেট থেকে দামি প্যাকেটটা বার করে আবার একটা সিগারেট ধরাল শুভাশিস। কদিন ধরে অসম্ভব পরিশ্রম যাচ্ছে। স্যাস-এ শুভাশিসের পেশেন্ট এখনও ভর্তি হয়নি, ষোলোটা বেডের মধ্যে ছটাতে মাত্র রুগী এসেছে, ছটাই শালিনীর। তবু সকাল বিকেল হাজিরা তো সেখানে দিতেই হয় শুভাশিসকে। কত কি গোছানো বাকি। হিসেবপত্র বাকি। মৃদুলবাবু, ইন্দ্রাণীর সেই বন্ধুর বর, কাল অবধি ডাক্তারদের কেবিনগুলো সাজিয়ে উঠতে পারেনি, তার পিছনে লেগে থাকতে হচ্ছে সারাক্ষণ। রিসেপশান কাউন্টারে দুটো টেলিফোনের একটাতে খালি কানেকশান এসেছে, অন্য লাইনটার জন্য দুদিন তদ্বির করতে যেতে হল। দোতলার কিছুটা অংশ শেষ পর্যন্ত বসবাসের জন্য ছেড়েই দিতে হল, তাই নিয়েও কম দৌড়োদৌড়ি গেল না। এর সঙ্গে অন্যান্য নার্সিংহোম আর চেম্বার তো চলছেই। আজ বিকেলেও ভালই ধকল গেল।

তবু শুভাশিসের কথা বলতে ইচ্ছে করছে এখন। সিদ্ধি সমস্ত ক্লান্তিকেই ছুঁড়ে ফেলে দেয়।

 সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে শুভাশিস বলল, পার্টি কিন্তু আজ জমেছিল ভাল, কী বলো?

ছন্দা সামনে পড়ে থাকা সাইড টেবিলে পা ছড়াল, হ্যাঁ, অন্তত তোমাদের ওপেনিং সেরিমোনির মতো ম্যাদামারা হয়নি।

–যাহ, কি এমন খারাপ হয়েছিল সেদিন? ভাল স্ন্যাকস ছিল, মিষ্টি ছিল, আইসক্রিম-কোন্ড ড্রিঙ্কস ছিল…

খাওয়া দাওয়ার কথা বলছি না।

তবে?

–কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা।

কথাটা ঠিক। উদ্বোধনের দিন অনেককেই আমন্ত্রণ জানিয়েছিল অরূপ শুভাশিসরা, ডক্টরস সার্কেলের হাতে গোনা কয়েকজন এসেছিল। সমীরণ ভাস্কররা তো বিকেলে একবার করে বুড়ি ছুঁয়ে। চলে গেল। সপ্তাহের মাঝখানে কে আর সন্ধেবেলা চেম্বার ছেড়ে এসে বসে থাকে! বেশ কয়েকটা ওষুধ কোম্পানির লোক অবশ্য এসেছিল। লোকাল কাউন্সিলার আর গোটা দু-চার সরকারি আমলাও। এছাড়া অরূপ শালিনীর কিছু বন্ধুবান্ধব আত্মীয়স্বজন। আর শুভাশিসের পক্ষ থেকে ছন্দার বাবা মা দিদি জামাইবাবুরা। আর ইন্দ্রাণীর ছোট দেওর চাঁদু।

শিবসুন্দর যে আসবেন না, জানাই ছিল। তুফানও এল না! সেদিন মনে মনে বেশ রাগ হয়েছিল শুভাশিসের। এ যেন তাকে একঘরে করার চেষ্টা। তুফান অবশ্য পরদিনই এসেছিল, শুভাশিসের সঙ্গে তার দেখা হয়নি। আগেই টোটোর মুখে ভাসা ভাসা শোনা ছিল শুভাশিসের, বাবার কি সব সমস্যা চলছে গ্রামে। তুফানও নাকি সে সবই কিছু বলে গেছে ছন্দাকে। শুভাশিস এর কী বিহিত করতে পারে? অনেকবার তো পইপই করে বাবাকে বলেছিল তার কাছে থাকতে, বাবা কর্ণপাতও করেনি। এখন বুঝুক। বাবা যদি আদ্যিকালের ধ্যানধারণা আঁকড়ে থেকে ছেলেকে অস্বস্তিতে ফেলতে পারে, ছেলের কীসের দায় বাবার কথা ভাবার! শুভাশিসের এখন ভাবতে বসার সময়ই বা কোথায়!

আর একজনও যে সেদিন আসবে না শুভাশিস জানত, আশাও করেনি তাকে। তবু চাঁদু যখন এল, তার সঙ্গে কি মেয়েটাকে পাঠাতে পারত না? ইন্দ্রাণী খুব ভাল মতোই বোঝে মেয়ের জন্য কী নিঃসীম আকুতি আছে শুভাশিসের, চিরটাকাল তবু কী নির্মম আচরণ করে গেল! মেয়েকে কিছুটি দিতে দিল না কোনওদিন। একটা ফ্রক না। একটা পেন না। এক জোড়া জুতো পর্যন্ত না। ক্বচিৎ কখনও বই উপহার দিয়েছে, তাও বাপ্পার নাম করে। একটা অসতর্ক মুহূর্তের দায় একাই বহন করতে চায় ইন্দ্রাণী, এতটুকুও ভার দেবে না শুভাশিসকে। মেয়েটা যে শুভাশিসের, সেটাই কোনওদিন মুখ ফুটে স্বীকার করল না! নারী যদি সরবে অস্বীকার করে যায়, তবে সব বুঝেও পুরুষের পিতৃত্বের দাবি কেমন শূন্যগর্ভ হয়ে যায়। সংশয় আর প্রত্যয়ের দোলাচল কুকুরতাড়া করে ছুটিয়ে মারতে থাকে পুরুষকে।

এ সব কথা ভাবলেই মনটা ব্যথিয়ে ওঠে। ফুরফুরে ভাবটা পানসে মেরে যায়। বুকের মধ্যে ইন্দ্রাণী-তিতিরের জন্য যে আলাদা কুঠুরি আছে, তার দরজা সজোরে বন্ধ করল শুভাশিস। কয়েক লহমাতেই একটা হাসি হাসি ভাব এসে গেল মুখে। প্রায় সত্যিকারের হাসির মতো। প্রায় সত্যিকারের কেন, সত্যি সত্যিই।

অ্যাশট্রেতে সিগারেট নিবিয়ে শুভাশিস বলল, তোমার বাবাকে আজ কিন্তু পার্টিতে মিস করেছি।

ছন্দা নেকলেস খুলে অন্যমনস্কভাবে হাতে ঘোরাচ্ছিল। বলল, বাবারও খুব থাকার ইচ্ছে ছিল। মা এমন বাড়ি বাড়ি করে ছটফট করতে শুরু করল!

–দুটো দিন আর থেকে যেতেই পারতেন। এত ড্রিঙ্ক করতে ভালবাসেন..বাড়িতে আজ ভ্যারাইটি স্টক ছিল…।

–সেদিন রাত্তিরে তুমি কিন্তু উচিত কাজ করোনি। নিজে খাচ্ছ খাও, বাবাকে কেন বসাতে গেলে? একে অভ্যেস নেই… বুড়ো মানুষ…

বুড়ো বলে আর যাই বলো। শুভাশিস ঈষৎ কটাক্ষ হানল, তোমার বাবা কিন্তু মাইরি ভাল টানতে পারেন। আগে খুব খেতেন, না?

ছন্দা পলকে গম্ভীর। নেকলেসটা সোফার কোণে ছুঁড়ে দিল, কী করা যাবে, সবাই তো আর তোমার বাবার মতো জিতেন্দ্রিয় নয়। বলেই পাল্টা পিন ফোটাল, অবশ্য তোমার বাবার মতো অসামাজিকও নয়। মানুষের সঙ্গে মিশতে পারে। কথা বলতে পারে।

লঘু ঠাট্টাকে আর বেশি বিপজ্জনক খাতে গড়াতে দিল না শুভাশিস। মনোরম রাতকে কেন মিছিমিছি তেতো করা! ছোট্ট একটা টুসকি মারল ছন্দার কাঁধে, চটছ কেন? ঠাট্টাও বোঝো না?

–তোমার বাবাকে নিয়ে তামাশা করলে তোমার কেমন লাগে?

–একটুও ভাল লাগে না।

—তাহলে?

–তাহলে আবার কি। আই অ্যাম সরি।

ছন্দার চোখে অভিমান, ঠোঁটে সমঝোতার হাসি, তুমি খুব চালাক। স্লাই ফক্স।

শুভাশিস দ্রুত প্রসঙ্গ পালটে নিল, এই, ভাল কথা। তোমাকে তখন ভাস্করের বউ কি বলছিল গো?

অন্যদিন ছন্দার মেজাজ বিগড়োলে আবার সমে ফিরতে অনেক সময় লাগে, আজ লাগল না। চোখ ঘুরিয়ে বলল, সে অনেক কথা। ভাস্করদাও নাকি নার্সিংহোমের প্ল্যান করছে। বালিগঞ্জ ফাঁড়ির কাছে কোন এক ননবেঙ্গলি ভদ্রলোকের নাকি অনেকটা জমি আছে, সে পার্টনার হবে।

–তাই! মুহূর্তে শুভাশিসের ভুরুতে ব্যবসায়ী ভাঁজ।

–দীপা তো সেরকমই বলছিল। ভাস্করদার নাকি বিশাল পরিকল্পনা। প্যাথলজিকাল ল্যাব তো থাকবেই, সঙ্গে আলট্রাসোনো, এক্সরে, পারলে স্ক্যানিং-এরও মেশিন বসাবে। তিনটে ও টি থাকবে। ফার্টিলিটি ক্লিনিক হবে। প্রায় কোটি টাকার বাজেট।

ছাড়ো তো। যত সব বুকনি।

–সত্যিও তো হতে পারে!

–হলে দেখা যাবে। শুভাশিস নিস্পৃহ থাকার চেষ্টা করেও পারল না, ভাস্করের এগেনস্টে আমাদের অ্যাসোসিয়েশানে কত কমপ্লেন জমেছে জানো? একটা পেশেন্টের ফ্যামিলি তো বোধহয় কোর্টে যাচ্ছে। সিম্পল কোলেসেসেকটোমির কেস, হাসতা খেলতা জোয়ান পেশেন্ট, ও টি-তে মরে গেল! প্রেশার ছিল না, সুগার ছিল না, নো আদার কমপ্লিকেশান, ই সি জি রিপোর্টও পারফেক্টলি ও কে…. এখন কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের দোহাই দিয়ে অ্যানেসথেসিস্ট-এর ঘাড়ে দোষ চাপাতে চাইছে।

ছন্দা নিরীহ মুখে বলল, তুমি বোধহয় একটু জেলাস হয়ে পড়ছ।

–আমি! ছোঃ। শুভাশিসের মুখমণ্ডলে ভাঙচুর হল, আমি শুধু ওর ওই বড় বড় কথাগুলো স্ট্যান্ড করতে পারি না। নেহাত আমার ব্যাচমেট, নইলে ওকে থোড়াই ইনভাইট করতাম।  

ছন্দার ঠোঁটে তবু হাসির রেখা, তোমার এই চটে যাওয়াটাকে কী বলে জানো?

কী?

 –মিডলক্লাস মেন্টালিটি। যা নিয়ে তুমি আমায় খোঁটা দিচ্ছিলে।

বহুকাল পর বাড়িতে দরাজ গলায় হেসে উঠল শুভাশিস। আশ্চর্য! মনের কোণ থেকে কেন যে ঈর্ষার ধুলোবালি যায় না? নাকি ঈর্ষাই সাফল্যের প্রাণবীজ?

শুভাশিসকে একটু কথা শোনাতে পেরে ছন্দা আবার উচ্ছল। ক্লান্তি ঝেড়ে উঠে পড়ে কোমরে আঁচল জড়াচ্ছে। বলল, অনেক হয়েছে, এবার তুমি শুতে যাও তো দেখি। আমি ঝটপট এদিকের কাজগুলো সেরে ফেলি।

-রাতদুপুরে তুমি এখন ঘরদোর নিয়ে পড়বে নাকি? ছেড়ে দাও। সকালে কোরো।

–এই অবস্থায় সব ফেলে রেখে দেব?

 শুভাশিস চারদিকে আলগা চোখ বোলাল। সত্যিই নিদারুণ দশা ড্রয়িং স্পেসটার! সোফা ডিভান টেবিল বেতের চেয়ার কিছুই আর স্বস্থানে নেই। কার্পেটময় বিরিয়ানির ভাত, নানের টুকরো ফিশ ফ্রাই-এর কুচি। এঁটো ডিশ বাটি ছড়িয়ে আছে যত্রতত্র। কাচের গ্লাসেদেরও কী অদ্ভুত অদ্ভুত জায়গায় অবস্থান! কেউ সোফার তলায়, তো কেউ ক্যাবিনেটের টঙে। কেউ ঘরের কোণে, কেউ বা জানলায়। সোজা। উল্টো। শোওয়ানো। টোটোর রেজাল্টের পার্টির দিন তিনটে গ্লাস ব্যালকনির টবের পিছনে রাখা ছিল, দুদিন পর আবিষ্কার করেছিল ছন্দা। তাও তো সে পার্টিতে শিবাজি ছিল না! অরূপদের বাড়িতে একবার টবে গ্লাস পুঁতে রেখে গিয়েছিল শিবাজি, আর একবার রেখেছিল ডানলোপিলোর তলায়। আজ শিবাজি কী কীর্তি করে গেছে কে জানে!

ছন্দা খুঁজেপেতে সব গ্লাস এক জায়গায় জড়ো করছে। অনেক গ্লাসেই পানীয় অসমাপ্ত, দু-একটা গ্লাস অর্ধেকেরও বেশি ভর্তি। একটা গ্লাস তুলে শুভাশিসকে দেখাল ছন্দা, কতটা স্কচ ফেলে দিয়েছে দেখেছ?

শুভাশিস অলস মেজাজে বলল, – আরে, যেতে দাও।

ছন্দা গজগজ করছে, খাবি না যদি তো নিস কেন?

–নিতে হয়। সবাই কি আর মাত্রা বোঝে?

–কিন্তু এ তো অপচয়! নিজের পয়সায় খেলে তো কেউ নষ্ট করে না!

শুভাশিস তরলভাবে বলল, সেই মিডলক্লাস মেন্টালিটি।

–সে তুমি যাই বলো, নষ্ট করা ব্যাপারটা আমার একদম বরদাস্ত হয় না।

–তাহলে এক কাজ করো। যে গ্লাসে যা পড়ে আছে সব একটা বোতলে ঢেলে ফেলো। নেক্সট পার্টিতে ওটাই ককটেল বলে সার্ভ করা হবে।

ছন্দা নাক কুঁচকোল, ছি ছি, যত সব ছ্যাচড়া বুদ্ধি।

শুভাশিস মুখ টিপে হাসছে, তোমার কি মনে হয় কেউ টের পাবে?

না পাক। ওরকম কেউ করে নাকি?

করে। যারা রিয়েল বড়লোক তারা করে। হায়দ্রাবাদের নিজাম করত। সাহেবদের বিশাল বিশাল পার্টি দিত, পার্টি শেষ হলে সমস্ত গ্লাসের তলানি নিজের হাতে বোতলে ভরে রাখত।

–ত্যাৎ, যত সব বাজে কথা।

-না গো ম্যাডাম, বাজে কথা নয়। ফ্যাক্ট। নিজামের তখন নাকি গ্যারেজে ডজন ডজন রোলস রয়েস সাজানো। হোল ওয়ার্ল্ডে সে তখন এক নম্বর বড়লোক।

–তুমি কি নিজাম হতে চাও নাকি?

ভাবতে দোষ কী। দাঁড়াও। শুভাশিসের হঠাৎ কি হয়ে গেল। উঠে রান্নাঘরে চলে গেছে। একটা খালি বোতল নিয়ে ফিরে এল। ছন্দার সামনে রাখল বোতলটা, কই, ঢালো।

–এই, তুমি কি পাগল হয়ে গেলে নাকি? শুভাশিসের ভাবভঙ্গিতে ছন্দা হেসে উঠেছে খিলখিল।

শুভাশিস আড়চোখে একবার দেখল ছন্দাকে। গম্ভীর মুখেই বলল, হলটা কি? ঢালো।

ছন্দার হাসি থামল। সন্দিগ্ধ চোখে দেখছে শুভাশিসকে, ক পেগ খেয়েছ আজ?

–ওয়ান। জাস্ট ওয়ান ফর মাই সাকসেস।

ছন্দা হাঁ করে তাকিয়ে আছে।

ছন্দার অপেক্ষায় না থেকে শুভাশিস এবার নিজেই ঝুঁকেছে। একটা একটা করে গ্লাস উপুড় করল বোতলে। দেখতে দেখতে বোতল অনেকটা ভরে এল। প্রায় আধ বোতল। জল মেশানো তরল, জল না মেশানো তরল, সোনালি, কালচে লাল, বর্ণহীন, সব পানীয়ই মিলেমিশে একাকার। রঙটাও বেশ খোলতাই হয়েছে। কোনও পানীয়েরই প্রকৃত রঙ আর পৃথক পৃথক করে চেনা যায় না, তবু মিশ্রণের মধ্যে থেকে প্রতিটি রঙই যেন উঁকি দিচ্ছে। শুভাশিস চোখ রগড়াল। সত্যিই চেনা যাচ্ছে? না দৃষ্টিভ্রম?

কোনওদিন যা করেনি, তাই করে ফেলল শুভাশিস। ছন্দা বাধা দেওয়ার আগেই বোতলটা থেকে সরাসরি পানীয়ে চুমুক দিল। খানিকক্ষণ মুখে রেখে জিভ চালিয়ে অনুভব করল স্বাদটা। গিলে নিতেই ঝং করে ধাক্কা লাগল মাথায়।

শুভাশিস কার্পেটের ওপর থেবড়ে বসে পড়েছে। বসে আছে। বসেই আছে। মৃদু ঝিমঝিম ভাব চারিয়ে যাচ্ছে মস্তিষ্কে। ঝিমঝিম, না রিমঝিম?

ছন্দাকেও হাত ধরে টেনে বসাল শুভাশিস, তুমিও একটু টেস্ট করো।

নিজের বাড়িতে পার্টি থাকলে ছন্দা বিশেষ পান করে না। পার্টি জমার আগেই আচমন করার মতো খানিকটা ছুঁইয়ে নেয় জিভে। এতেই শরীর তার চনমনে থাকে, সারাক্ষণ ছুটে বেড়াতে সুবিধে হয়। শুভাশিস জানে।

বোতলটা ছন্দার হাতে ধরিয়ে দিল শুভাশিস। বলল, আমার কথা রাখো। টেস্ট করো। শরীরটা ফ্রেশ লাগবে।

ছন্দা সামান্য সরে গেল, না।

–ঘেন্না লাগছে?

লাগারই তো কথা। রাতদুপুরে এই দেয়ালা মোটেই ভাল লাগছে না।

শুভাশিস সরু চোখে দেখছে ছন্দাকে, –আমি খেতে পারছি, তুমি পারো না?

ছন্দা কয়েক সেকেন্ড বিস্মিত মুখে তাকিয়ে রইল শুভাশিসের দিকে। বুঝি বুঝতে চাইছে এই অচেনা শুভাশিসকে। একটুখানি বাঁকা হাসল। তাচ্ছিল্যের সঙ্গে আজব সুরার মিশ্রণ খুব অল্প করে ঢালল গলায়, হয়েছে তো? শান্তি?

–কেমন টেস্ট বলো?

ছন্দা নিরুত্তর।

আমার তো দারুণ লাগল। শুভাশিসের চোখে এক আজব ঘোর, অন্যের তলানি এত টেস্টফুল হয়, আমার জানা ছিল না। এই জিনিস দোকানে মিলবে না। নিজামটা খুব চালু ছিল। একেই বলে রিচ ম্যানস ব্রেন।

এঁটো মদ নিয়ে কত গবেষণা! ছন্দা নাক কুঁচকেই আছে।

–মদ কখনও এঁটো হয় না ডিয়ার, ঠোঁট বদলায়। শুভাশিস ছিপি বন্ধ করে বোতলটা সরিয়ে রাখল। বেশ একটা স্ফূর্তির বিকাশ হচ্ছে প্রাণে। বেসুরে গান ধরল, বলো বলো বলো সবে, শত বীণা বেণু রবে, শুভ আবার জগতসভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে…

–তুমি কি এক চুমুকেই মাতাল হয়ে গেলে নাকি? ছন্দা উঠে দাঁড়িয়েছে।

 শুভাশিস হ্যা হ্যা হাসল, আমি তো কখনও মাতাল হই না।

–তাহলে এসব বন্ধ করো। টোটো উঠে পড়বে।

উঠুক। আমার ছেলে জানে আই অ্যাম আর্নিং আ ফরচুন ফর হিম।

যা ইচ্ছে করো।

ছন্দা হাল ছেড়ে কাজে নেমে পড়েছে। একটা একটা করে এঁটো প্লেট বাটি কুড়োচ্ছে, হনহন করে গিয়ে রেখে আসছে সিঙ্কে। ঠেলে ঠেলে ভারি সোফা সরাল। টেবিল টেনে রাখল যথাস্থানে। হাঁপাচ্ছে রীতিমতত। ঘামছেও অল্প অল্প। হাতের পিঠে মুছে নিল কপাল।

শুভাশিস ধীরে ধীরে বোধে ফিরল। উঠে পড়ে বলল, আমার ওপর রাগ করে আবার এসব নিয়ে পড়লে কেন? চলো, শুতে যাই চলো।

ছন্দা কার্পেট থেকে ভুক্তাবশেষ কুড়োচ্ছে। কুড়োতেই থাকল।

শুভাশিস করুণ মুখে বলল, আমার একটা খুশির দিনেও তুমি অসুস্থ শরীর নিয়ে খেটে যাবে?

এতক্ষণে উত্তর শোনা গেল, কে বলেছে আমি অসুস্থ? তুমি যা ইচ্ছে করতে পারো, আমি পারি না?

সেই এক কথা। এক জেদ। শুভাশিস সামান্য তপ্ত হল, না, পারো না। ইউ আর মাই ওয়াইফ। আমি যেভাবে চলব, তোমাকেও সেভাবে চলতে হবে। এক কাড়ি টাকা দিয়ে বাড়িতে এতগুলো কাজের লোক পুষেছি, যদি তোমার দরকার হয় আরও পুষব, তারা কাজ করবে। তুমি নয়।

ছন্দা যেন শুনতেই পেল না। শুভাশিসকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে নিজের কাজ করে যাচ্ছে। ডিভান কষ্ট করে টেনে নিয়ে যাচ্ছে দেওয়ালের দিকে।

অকস্মাৎ রক্ত চড়ে গেল শুভাশিসের মাথায়। ছন্দার নির্লিপ্ত অবজ্ঞাই কি প্ররোচিত করল রাগকে? নাকি আশ্চর্য সুরার প্রভাব নিজাম শুভাশিসের পৌরুষে আঘাত হানল?

দুমদাম চেয়ারে লাথি চালাতে শুরু করেছে শুভাশিস। রাত্রিকে ছিঁড়ে খুঁড়ে সশব্দে টেবিল টানছে। সাজানো চেয়ার টেবিল এলোমলো করে দিল। খ্যাপা মোষের মতো সোফাগুলোকে ধরে ঝাঁকাচ্ছে। ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে যাচ্ছে এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে।

ছন্দা অদ্ভুত রকমের নীরব। গোঁজ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

অচিরেই নিজের রাগে ক্লান্ত হয়ে পড়ল শুভাশিস। রণে ভঙ্গ দিয়ে চলে গেল ঘরে। টানটান শুয়ে পড়ল বিছানায়। শুয়ে শুয়েও আওয়াজ পাচ্ছিল শুভাশিস। আবার আসবাবপত্র টেনে টেনে সাজাচ্ছে ছন্দা। আবার বেসিন সিঙ্কে টুঙ-টাঙ শব্দ।

ছন্দার সঙ্গে সম্পর্কটা বোধহয় এ রকমই চলবে শুভাশিসের! একটুখানি জোড়াতালি, একবার সাজানো, একবার ভেঙে ফেলা। আবার ভাঙা টুকরো নিয়ে সাজাতে বসা।

ভাল। তাই চলুক।

শুভাশিস উঠে বাথরুমে গেল। ঘাড়ে গলায় জল ছিটোচ্ছে। ভিজে মুখ ঘষে ঘষে মুছছে তোয়ালেতে। নরম তোয়ালের স্পর্শে আরাম হল খানিকটা। আয়নায় নিজেকে দেখছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। শুধু মুখ দেখার জন্য আয়নার সামনে বড় একটা দাঁড়ানো হয় না। যা হয়, তা নেহাতই দৃষ্টিপাত।

একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল শুভাশিসের। মুখ চোখ অনেক ভারী হয়ে গেছে। কেমন একটা ফোলা ফোলা ভাব। আগেও চেহারা তার তেমন তীক্ষ্ণ ছিল না, এখন যেন বড় বেশি ভোতা ভোতা। চামড়ার টান ভাব কমতে শুরু করেছে। শরীরের সেলগুলোর মৃত্যুহার বোধহয় বাড়া শুরু হল। আয়নার ওই মানুষটাকে কি আর ইন্দ্রাণীর প্রেমিক বলে চালানো যায়! নাকি ওটা টোটোর বাবার মুখ! অথবা তিতিরের জন্মদাতার! অথবা ছন্দার স্বামীর! কিংবা এদের কারুরই নয়, ওই লোকটা শুধুই একটা তলানি সুরা চাটা হাউই! এক ক্রূর ভোগী আত্মসর্বস্ব পুরুষ! ঘুরছে, ঘুরছে স্বরচিত কক্ষপথে!

দুর, সেই মিডলক্লাস মেন্টালিটি! সফল মানুষদের এসব ভাবতে নেই। আজব সুরার স্বাদ এখনও লেগে আছে শুভাশিসের জিভে। মুখের ভেতর জিভ বোলাতে বোলাতে শুভাশিস পাঞ্জাবি ছাড়ল। শুকল পাঞ্জাবিটাকে। ফ্রেঞ্চ পারফিউম ছাপিয়ে ঘেমো গন্ধ ছিটকে আসছে। কোণের গামলায় এক রাশ জামাকাপড় কাঁচার জন্য জড়ো করা, স্তূপের ওপর পাঞ্জাবিটাকে ছুঁড়ে দিল শুভাশিস। বাথরুমের আলো নেবাল।

ঘরে এসে বাথরুমের দরজা টানতে গিয়ে সহসা শুভাশিসের চোখ বিঁধে গেছে আয়নায়। নিমেষে শিরদাঁড়া বেয়ে হিম স্রোত নেমে গেল।

আলো-আঁধারে আয়নায় ফুটে আছে মনোরমার মুখ! ফাঁকা চোখ তার শুভাশিসের মুখে স্থির!

.

৩৪.

নিজের ঘরে বসে কান খাড়া করে শুনছিলেন জয়মোহন। সন্ধ্যার মা আর মিনতিতে জোর কাজিয়া লেগেছে। প্রায়ই লাগে আজকাল। দশটার পর থেকে ইন্দ্রাণী ফেরা পর্যন্ত এ বাড়ির কোনও শাসক থাকে না, দুজনেই প্রাণ খুলে গলা সেধে নিতে পারে এ সময়ে। রুনা থাকলে ঝগড়াটা তেমন জুতের হয় না, ওপর থেকে রুনা একবার হাঁক পাড়লেই মিনতিকে হেরে যেতে হয়। বাছা বাছা গালাগাল, অশ্লীলতম গ্রাম্য শব্দের চোখা চোখা প্রয়োগ, কিছুই আর শোনা হয় না জয়মোহনের। দিনটা বড় আলুনি আলুনি ঠেকে।

সুখের কথা, রুনা ইদানীং থাকেই না। পুজোর ছুটির পর থেকে ছেলেকে স্কুলে পৌঁছে সে আর বাড়ি ফিরছে না। অ্যাটমের স্কুলের মায়েরা মিলে একটা ক্লাব গড়েছে। রুনা এখন সেই ক্লাবের পাণ্ডা। চাঁদা তুলে স্কুলের গায়েই একটা ঘর ভাড়া করেছে তারা। সেখানে বসে গয়না শাড়ির হালফিল বিবর্তন নিয়ে জোর গবেষণা চলে, কে কত রকম অভিনব রান্না জানে তা শোনানোর প্রতিযোগিতা হয়, সিনেমার নায়ক-নায়িকার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে ভীষণ জরুরি মিটিং বসে, আরও কত কি যে হয়! ছেলেমেয়েদের পড়াশুনো, স্কুলের স্যার-আন্টিদের যথেচ্ছ অবিচার নিয়ে সমালোচনা, নির্ভেজাল শাশুড়ি নিন্দা, পতিনিন্দার ছলে স্বামীগরবে গরবিনী হওয়া, যে একদিনও অনুপস্থিত হয় তাকে নিয়ে রহস্যালাপে মুখর হয়ে ওঠা, সবই ক্লাবের কর্মসূচির অঙ্গ। গত রবিবার রুনার ক্লাব বারুইপুরে ফিস্টও করতে গিয়েছিল। জয়মোহনের জন্য বেশ বড় বড় পাকা পেয়ারা এনেছিল রুনা।

ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজে আছেন জয়মোহন। আহা, খাসা চালাচ্ছে দুজনে। যুগলবন্দির দুই ওস্তাদ আলাপ জোড় সেরে এবার গতে পৌঁছে গেছে।

মিনতি তান ধরল, একদম চোপা করবি না। কাল গোটা হেঁশেল যে মাছের আঁশে ছেতরাপ্যাতরা করে রেখে গেলি, কে ঝ্যাঁটাল সেটা? তোর নাঙ?

পাল্টা তানে জবাব দিল সন্ধ্যার মা, নাঙ করা তো তোর স্বভাব রে মাগি। ভাতার ফেলে এসে পেরেসঘরে ঢলানি করিস…।

-মিছে কথা বলবিনি। মুখ ছিঁড়ে নেব।

 –ওরে আমার সত্যবানের সাবিত্তির রে, ওরে আমার লখিন্দরের বেউলে রে, ওরে মরে যাই রে… বাহ বাহ। তুখোড় চাপান-উতোর চলছে। জয়মোহন সমঝদার শ্রোতার মতো ঘাড় দোলালেন। দেখা যাক মিনতি এবার কি জবাব দেয়!

মিনতি পুরাণ মঙ্গলকাব্যের ধার মাড়াল না। টিটকিরির উত্তরে খিস্তির ঝালা ধরেছে। সন্ধ্যার মারও চোপা খুব, তবে শেষ অবধি মিনতির সঙ্গে এঁটে উঠতে পারে না সে। মিনিট দশেক হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চালিয়ে রণে ক্ষান্ত দিল সন্ধ্যার মা। খুচখাচ গজগজ করছে, কিন্তু আর তেজ নেই।

জয়মোহন হতাশ। দুই রমণীর মধুর বাক্যালাপে সময়টা তাঁর কাটে ভাল, মরা বাড়িটাকে বেশ জ্যান্ত জ্যান্ত লাগে। আজ যেন ঠিক জমল না। কদিন আগে প্রেসের এক ছোকরাকে ছাড়িয়ে দিয়েছে ইন্দ্রাণী, তার বদলে এসেছে এক বদ্ধ কালা বুড়ো কম্পোজিটার। তারপর থেকেই মিনতিটা একটু বেশি খেপি হয়ে গেছে। হুঁড়ি সত্যি সত্যি মজেছিল নাকি? রোজই ভাবেন দুর্লভ এলে জেনে নেবেন ব্যাপারটা, মনে থাকে না। এত অন্য সব কথা বলে দুর্লভ! কত রকম যে গল্প শোনায়! কলকাতা এবার তিনশো বছরে পড়ল, তাই নিয়ে নাকি জব্বর হইহই চলছে শহরে। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে আলো জ্বলছে। ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে নতুন ফোয়ারা বসেছে, ফোয়ারার জল নাকি বাজনার তালে নাচে। একসময়ে এক রসিক মন্ত্রী মনুমেন্টের মুণ্ডিটা লাল করে দিয়েছিলেন, রঙের লালিমা মুছে গিয়ে সেখানেও নাকি রোশনাই এখন। চৌরঙ্গি পাড়াও খুব রুজ লিপস্টিক মেখেছে। এসব তো আর জয়মোহনের চর্মচক্ষে দেখা হবে না, শুনে শুনেই যেটুকু তৃপ্তি হয়।

দেওয়াল ঘড়িতে ঘণ্টা বাজছে। এগারোটা। ইজিচেয়ারের হাতলে রাখা খবরের কাগজটা টানলেন জয়মোহন। পড়বেন আবার। চোখের সামনে ধরার আগে গলা ঝাড়লেন। অঘ্রান শেষ না হতেই ভাল শীত পড়ে গেল। শ্লেষ্মায় গলা বুজে থাকছে সব সময়। ঘড়ঘড়ে গলায় জয়মোহন ডাক দিলেন, মিনতিইই…. দুপ দুপ করে ঘরে এল মিনতি। হাতে একটা সাঁড়াশি।

–আমার গরম জল বসিয়েছিস?

এবার বসাব। মিনতির মুখ এখনও থমথম করছে। ঝড় থামলেও মেঘ কাটেনি।

–এখনও বসাসনি? তোর জন্য আমার রোজ চানে দেরি হয়ে যাচ্ছে।

–আমার হাতে কাজ থাকে।

–সে তো শুনছিলামই। তোর কাজের ঠেলায় পাড়ায় কাক চিল বসছিল না। কথাটা বলেই একটু আফসোস হল জয়মোহনের। এই বয়সের মেয়ে তেতে থাকলে গোখরো সাপ। এক্ষুনি না ফণা তুলে ছোবল মারে। ঘড়ঘড়ে গলা যথাসম্ভব মিহি করে ফেললেন জয়মোহন, আমাকে ভাঁড়টা দে তো।

খাটের তলায় রাখা শ্লেষ্মা গয়েরে আধভর্তি বড় মিষ্টির ভাঁড়টা ঠক করে ইজিচেয়ারের হাতলে রাখল মিনতি। অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে আছে। ঘেন্না। খকখক কেশে অনেকটা কফ তুললেন জয়মোহন। হা হা করে বড় বড় দুটো নিশ্বাস নিলেন। বুক অনেক হালকা।

মিনতি ভাঁড় রেখে চলে যাচ্ছিল, জয়মোহনের ডাকে ফিরল, আবার কী চাই?

জয়মোহন কুণ্ঠিত স্বরে বললেন, ভাঁড়টা ফেলে দে না। অন্য একটা দে।

–নেই।

–কেন, মিষ্টিমাষ্টা আর আসছে না?

–এলে তো পেতেনই।

কে জানে বাবা, কত কিছুই তো আসে বাড়িতে, কতটুকুনেরই বা খবর পান জয়মোহন! এই তো কবে যেন অ্যাটমের মুখে প্যাটিসের গুঁড়ো লেগে ছিল! বাড়ির কেউ তাঁকে জানায়ওনি, এক কুচি ভেঙেও দেয়নি। নেহাত অ্যাটমটার এখনও বুদ্ধি পাকেনি তাই সরল মনে…! দীপুর ঘরে মিষ্টি আসে না, একথা বিশ্বাস করতে হবে! দীপুটা না মিষ্টি খাওয়ার যম ছিল। শোভনা কত লুকিয়ে রাখতেন, ঠিক চুরি করে খেয়ে নিত ছেলে। অবশ্য বলা যায় না, যা বউয়ের ভেড়ুয়া, বউয়ের হুকুমে ছেড়েও দিতে পারে। বউ তো এখন ক্যালোরি কমাচ্ছে! নিজের। বরের। বুড়োটার যে ক্যালোরিই নেই, তার কি হবে!

নাহ, মেয়েই আপন, ছেলেরা পর। বরের কোলে ঝোল টানে ঠিকই, কিন্তু বাপকেও টানে খুব। এলেই মনে করে বাপের জন্য কিছু না কিছু নিয়ে আসে জয়ি। সে রসগোল্লাই হোক, কি সিঙাড়া নিমকিই হোক। গত হপ্তায় গরম গরম মাটন চপ এনেছিল। সঙ্গে কাসুন্দে। আহ, কী ঝাঁঝ! এখনও যেন নাকে লেগে আছে! এবার জয়ি এলে নলেন গুড়ের সন্দেশের কথা বলতে হবে। জয়নগরের মোয়াও এখন ওঠার কথা, ভাঁড়ের নাম করে ভাল রসগোল্লাও যদি আনানো যায়…!

বাড়িতে খবরের কাগজ আসে দুখানা। বড় ছেলের ঘরে বাংলা, মেজর ঘরে ইংরিজি। কন্দর্প আদিত্য বাপ্পা তিতির হয়ে জয়মোহনের কাছে পৌঁছতে বাংলা কাগজের নটা বেজে যায়। সুদীপের ইংরিজি নামে আরও পরে, ছেলেকে স্কুলে নিয়ে যাওয়ার সময়ে ঘরে ফেলে দিয়ে যায় রুনা। ছুটির দিনে নামেই না, মিনতিকে পাঠিয়ে কাগজ আনিয়ে নিতে হয়।

বাংলা কাগজ উল্টোচ্ছেন জয়মোহন। মৌজ আসছে না। নতুন কি এক খিচুড়ি গভর্নমেন্ট তৈরি হয়েছে দিল্লিতে, কাগজ শুধু বক্তিমেতে বোঝাই। ইলেকশানের আগে বাংলা কাগজে অনেক জুস থাকে, পড়তে মজা লাগে। এখন দেখলেই বিরক্তি হয়। সব পার্টি মিলে একটা মা মরা ছেলেকে অভিমন্যুর মতো বধ করল, তাই নিয়ে এত উল্লাসের কী আছে! তেরঙা পার্টির দিন কি ফুরোল? কী বিশ্রী ব্যাপার। জয়মোহনের মনে আছে, এ রাজ্য লাল পার্টির দখলে চলে যাওয়ার পর এক রাত্রি তিনি অন্ন স্পর্শ করেননি। শোভনা কী হাসাহাসিই না করেছিলেন! বাপ মরল সেপোর, কাছা নেয় মেধো! উজিরের হাতি ডুবল, মাঝির বউ কেঁদে মরল! নিজে না রাজনীতি করুন, যে পার্টিকে তাঁর পছন্দ তারা হেরে গেলে কি দুঃখও পেতে পারবেন না জয়মোহন! শত টিটকিরিতেও সে রাতে রুটির থালায় বসেননি জয়মোহন, শুধু দুধটুকু খেয়েছিলেন।

ঠকাস ঠকাস আওয়াজ হচ্ছে কোথায়! রান্নাঘরে না! জয়মোহন কাগজ মুড়ে চেঁচিয়ে উঠলেন, –অ্যাই মিনতি, অ্যাই সন্ধ্যার মা, কি হচ্ছেটা কি?

রান্নাঘর থেকেই জবাব ছুঁড়ল মিনতি, পেরেক পুঁতছি।

রান্নাঘরে পেরেক!

–মেজদা একটা বাসন রাখার খাঁচা কিনে এনেছে, দেওয়ালে লাগাতে বলেছে।

–তা বলে বাড়িটাকে ভেঙে ফেলবি নাকি?

 –ভাঙছি কোথায়! পেরেক দেওয়ালে ঠুকতে হবে না?

ঠুকবি না।

তা হলে লাগানো হবে কী করে?

লাগাবি না। বাড়ি ভেঙে ঘর সাজানোর দরকার নেই।

বউদি কিন্তু পইপই করে লাগাতে বলে গেছে। ফিরে এসে আমার ওপর রাগ করবে।

হুঁহ, রাগ করবে! বলি বাড়িটা কার? তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে হুঙ্কার ছাড়লেন জয়মোহন, –আমি বলছি লাগানো হবে না, হবে না।

আওয়াজ থেমেছে। জয়মোহন দাঁত কিড়মিড় করলেন। এ সংসারে কারুর একটু মায়ামমতা নেই বাড়িটার ওপর? বাড়ি ভাঙতে পারেনি বলে চুনবালি খসিয়ে মজা পেতে চায়? ওটি তো হবে না বাপধন।

বাংলা কাগজ ঠেলে সরিয়ে ইংরিজিটা খুললেন জয়মোহন। এটা তাও পদের। দেশবিদেশের অনেক খবর থাকে। ইরাক-ইরানের লড়াই, লেবাননের গৃহযুদ্ধ, লন্ডনের জাতিদাঙ্গা, শ্রীলঙ্কার তামিল বিদ্রোহ, কতরকম রক্ত গরম করা খবর। পড়তে পড়তে রাগ ক্ষোভ চলে যায়, নতুন উত্তেজনার রোমাঞ্চ জাগে প্রাণে। মাথায় থাকে না, একই খবর পড়েন বার বার। মনটা চনমনে হয়ে ওঠে। সকালের চিনি টোস্ট গুব গুব হজম হয়ে যায়।

বাথরুমে জল দিয়ে ডাকছে মিনতি। স্নানের পথে রান্নাঘরের দরজায় এলেন জয়মোহন। আঁজলা ভরা সর্ষের তেল সর্বাঙ্গে থুপে থুপে ডলছেন। বারোমেসে অভ্যাস। শীতে বড্ড ভাল লাগে।

জয়মোহন রান্নাঘরে চোখ চালালেন, কী রান্না করলি আজ?

–পেঁপের তরকারি। চারা মাছের ঝোল।

–আজও পেঁপে! আর কিছু সবজি ওঠে না বাজারে? কপি টপি আনতে পারিস না? শীতকালে কচি মুলোর ছেঁচকিও খাওয়াবি না?

কপি মুলো তো আপনার বারণ।

–একদিন খেলে কি হয়? জয়মোহন বায়না ধরলেন, –পালংশাক তো আনতে পারিস।

শাক খেলে আপনার পেট ছাড়ে। ডাক্তারবাবু শাক দিতে মানা করেছেন।

শুভাশিস একটা ডাক্তার জুটিয়ে দিয়েছে বটে! হারামজাদা তাকে না খাইয়ে মারবে। শরীরের উন্নতির বেলায় ঠনঠন, ওদিকে নিষেধের বেলায় লিস্টি আঠেরো গণ্ডা।

জয়মোহন সামান্য খেঁকিয়ে উঠলেন, কিচ্ছু হবে না। আনিস তো তুই।

–আমাকে বলছেন কেন? বউদিকে বলবেন। বউদি যা বলে, তাই আনি।

আবার বউদি দেখাচ্ছে ঘুড়ি। রুনাটাও চালাকি শুরু করেছে বটে। নিজে আজকাল দুপুরে বাড়িতে খায় না। মাদার্স ক্লাবে বসে স্যান্ডুইচ-ফ্যান্ডুইচ সাঁটায়। দু বেলাই ভাত না খেয়ে চর্বি কমাচ্ছে! দেখাদেখি দীপুটাও হেভি ব্রেকফার্স্ট করে অফিস যায়, টক দই আর শশা দিয়ে নাকি লাঞ্চ সারে। আর জয়মোহনের জন্য পেঁপে পেঁপে পেঁপে, অবিরল পেঁপে। পুজোর পর থেকে কম সে কম ছ ওয়াগন পেঁপে খাওয়া হয়ে গেল! পেট ঠাণ্ডা হয়, না গুস্টির পিণ্ডি হয়!

সন্ধ্যার মা কাচাকাচি সেরে উঠোনে কাপড় মেলছে। বাথরুমে ঢোকার আগে সতৃষ্ণ চোখে তাকে ডাকলেন জয়মোহন, –তোদের আজ কী হল রে?

গেঞ্জি পাজামায় ক্লিপ লাগাতে লাগাতে সন্ধ্যার মা গলা ওঠাল, এ বেলা ফুলকপি। ওবেলা ডিমের ঝোল।

–মাছ কি?

–চিংড়ি। ফুলকপি দিয়ে ঝোল করা হয়েছে।

–অ। জয়মোহনের বুক কাঁপিয়ে তুলতুলে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। শোভনা এই রান্নাটা বড় ভাল করত। আলু কপি চিংড়ি দিয়ে গা-মাখা গা-মাখা একটা ঝোল বানাত, ঠিক যেন অমৃত।

শোভনাটা কী বেইমান! সারা জীবন সুখ ভোগ করে বুড়ো মানুষটাকে একলা ফেলে রেখে চলে গেল! একবার ভাবল না পর্যন্ত, বউ না থাকলে শেষ বয়সে পুরুষমানুষের কী বেহাল দশা হয়! ওপারে গিয়ে কী মজা মারছে কে জানে!

চোখের কোল মুছে পায়ে পায়ে বাথরুমে ঢুকলেন জয়মোহন। সন্ধ্যার মার কাছে খাবার চেয়ে লাভ নেই, দেবে না। রুনার সঙ্গে ঝগড়া হওয়ার পর থেকে জয়মোহনকে কিছু দেওয়াতে ইন্দ্রাণীর কড়া বারণ। স্কুল থেকে ফেরার পথে প্রায়দিনই জয়মোহনের জন্য লেবু আপেল আঙুর আনে ইন্দ্রাণী, ঘরে এসে সাজিয়ে রেখে যায়। কিন্তু রান্না করা খাবার! ভুলেও না। ভাল। আলাদা হয়েছিস, বুড়ো শ্বশুরের দুঃখ বোঝার তোর কী দায়! একদিন বিরিয়ানি খেয়ে সামলাতে পারিনি, এখন দে, যত পারিস শাস্তি দে।

স্নান খাওয়া সেরে গোটা তিনেক ট্যাবলেট গিললেন জয়মোহন। দুপুরে রাতে খাওয়ার পরই একটা টান মতো ওঠে, বেশ খানিকক্ষণ ঝিম মেরে বসে থাকতে হয়। কী যে বিদঘুটে রোগে ধরল! হৃৎপিণ্ড বড় হয়ে গেছে! হৃৎপিণ্ড, না হৃদয়? রামদুলাল শচীনরা ঠাট্টা করে বলত জয়মোহনের নাকি হৃদয়টা বিশাল! এই হোটেলে খাওয়াচ্ছে, দেদার টাকা ধার দিচ্ছে, দল বেঁধে বাগানবাড়িতে গিয়ে সবার ফুর্তির খরচ জোগাচ্ছে! আশ্চর্য, বন্ধুদের প্রশংসাই অভিশাপ হয়ে করাল ব্যাধির আকার নেবে কে জানত!

হাঁ, টাকা অনেক উড়িয়েছেন জয়মোহন, রোজগারও তত কম করেননি। খোকন শুধু তাঁর ফাটকা খেলে টাকা ওড়ানোটাই দেখল! খোকন জানে না ফাটকা খেলেই যুদ্ধের বাজারে হাজার হাজার টাকা কামিয়েছিলেন তিনি। খোকন কেন, কেউই জানে না। শুধু শোভনা আবছা আবছা আন্দাজ করতেন কিছু। সেই টাকা দিয়েই তো তেল সাবানের কারখানা শুরু। রমরমিয়ে বিশ বছর চলেছিল ব্যবসাটা। সেই ছেচল্লিশ থেকে উনিশশো পঁয়ষট্টি। বেঙ্গল কেমিক্যালের মতো না হলেও ডিভাইন সাবানের নাম ছিল বাজারে। ডিউ পাউডার, ডিউ পারফিউমের জন্য বম্বে হায়দরাবাদ কানপুর থেকেও অর্ডার আসত। হঠাৎ কী যে এক বিশ্বজোড়া মন্দা নামল। টাকাই কেমন শুকিয়ে আসতে লাগল ক্রমশ। কোনও বাজার থেকে পেমেন্ট পাওয়া যায় না, অর্ডার আসে না, শেষে শুরু হল ব্যাঙ্কের কাছে হাত পাতা। তাতেও হচ্ছে না দেখেই তো মরিয়া হয়ে আবার ফাটকায় নেমেছিলেন জয়মোহন। ডোবার সময়ে কি মানুষের খেয়াল থাকে, সে সাপ ধরছে, না সুতো ধরছে! রেসের নেশাটা অবশ্য রামদুলাল ধরিয়েছিল। খুব লোভ দেখাত। একটা জ্যাকপট পেলেই নাকি সব মুশকিল আসান। দুর্বল মুহূর্তে মানুষের লোভও আসে বটে। মাঝখান থেকে সব গেল। শোভনার একরাশ গয়না গেল। কোম্পানির কাগজ, ব্যাঙ্কের টাকা কিছুই বাঁচল না।

রইলটা কি? ছুটন্ত ঘোড়ার মুখ। রাশি রাশি লোকের চোখ ঠেলে আসা গর্জন। আর নিশ্বাস বন্ধ করে রাখা কয়েকটা মুহূর্ত।

এ সবই মনে পড়ে জয়মোহনের। স্পষ্ট নয়, আবছা। যেন ঘন কুয়াশার ওপারে সার সার ছবি। দুপুরবেলার এই সময়টাতে একা একা ছবিগুলোকে হাতড়ান জয়মোহন। হাতড়াতে হাতড়াতে চলে যান বহু দূর। শেষ যৌবন থেকে প্রথম যৌবন। সেখান থেকে কৈশোর। শৈশব। অদ্ভুত ব্যাপার, মাঝে এত কুয়াশা, অথচ ছেলেবেলাটা যেন ঝকঝকে নীল আকাশ! এই তো সেদিন বাবা চালতাবাগান থেকে বাড়ি করে উঠে এলেন ঢাকুরিয়ায়। কতই বা বয়স তখন জয়মোহনের! এই অ্যাটমের মতো, কি তার থেকে একটু বড়! কী শ্রী ছিল তখন এই ঢাকুরিয়ার! চারদিকে কত গাছপালা, বাগান, ঝিল। ফি রবিবার পাথুরেঘাটার বাবুরা পাখি শিকার করতে আসত সামনের প্রকাণ্ড বাগানটায়। বাগান থেকে টানা ঝিল চলে গেছে সেই রেললাইন পর্যন্ত, সারা বিকেল ঝিলের ধারে খেলে বেড়াতেন জয়মোহনরা। এ বাগান থেকে ও বাগানে ছুটতেন। আম চুরি। জাম চুরি। লিচু চুরি। হুম হাম হনুমানের পাল আর টিয়াপাখির ঝাঁক নামত ফলবাগানে। সান্যালদের ন্যাড়ার সঙ্গে আঠা মাখানো জাল ফেলে একবার তিনটে টিয়া ধরেছিলেন জয়মোহন। মা রাখতে দেয়নি, উড়িয়ে দিয়েছিল। একটা বেজিও ধরেছিলেন একবার। এখন যেখানে কালীমন্দির, সেখানে একটা শীতলা মন্দির ছিল। তারই পিছনের ঝোপে পাওয়া গিয়েছিল বেজিটাকে। সেটাও টেকেনি, একটা শঙ্খচূড়কে মারতে গিয়ে নিজেই ছোবল খেয়ে মরেছিল। চারদিকে তখন কত সাপ বেজি শেয়াল। প্রহরে প্রহরে হুক্কহুয়া ডাক। রাত হলেই গা ছমছম। বাবার বন্ধু ফাগুসন সাহেব রেললাইনের ওপারে কবরখানার দিকে দিনদুপুরে একটা শেয়াল মেরেছিলেন। দোনলা বন্দুক দিয়ে। বাগানের পিছনে মাইতিদের উঠোনে শেয়ালটার চামড়া ছাড়ানো হল। মাইতি? না না, জানা। মাইতি তো পাশের বাড়িটা। হরিহর মাইতি, দিগম্বর মাইতি…। ওদের বাড়ির এক ছেলে জয়মোহনের স্কুলে পড়ত। মেদিনীপুরের লোক ছিল ওরা। পাথুরেঘাটার জমিদারদের কাছ থেকে রায়তি স্বত্ব পেয়ে সব চাষবাস করত এখানে। বাবা ওদেরই কার কাছ থেকে যেন এ জমিটা কিনেছিলেন। কি এক বৈরাগি, না মাঝি! ওই সব রায়তরা ঘর জমি বেচে একে একে কোথায় যে চলে গেল। জয়মোহনরা যখন এখানে বাড়ি করে আসেন, তখনও রামলাল ডাকাতের কী প্রতাপ! সাত সুন্দরী বউ-এর নামে ঝিলের পুব পাড়ে শিবমন্দির বানিয়েছিল একটা, ফি চৈত্রে চড়কের মেলা বসত সেখানে। ম্যাজিক লণ্ঠন দেখানো হত, পুতুলনাচের তাঁবু পড়ত, লাঠিখেলা হত, আরও কত মজা।

আহা, ঠিক যেন শহরের কোলে এক সুন্দর গাঁ। ভোরে নগর সঙ্কীর্তন, ঘরে ঘরে বাস্তু পুজো, বারো ইয়ারি পুজোয় থিয়েটার যাত্রা, সবই যেন এই কালপরশুর কথা। এত উজ্জ্বল। এত স্পষ্ট।

একে একে সবই বদলে গেল। যে বছর জয়মোহন কলেজ পাশ করলেন, সেই বছরই বুজিয়ে দেওয়া হল ঝিলটা। ধীরে ধীরে সেই বোজা ঝিলের ওপর গড়ে উঠল ব্যাঙ্ক প্লট। জমিদার বাবুদের ফলবাগান কেটে বসতি শুরু হল। রেললাইনের ওপারেও ঝোপজঙ্গল কেটে, পুকুর বুজিয়ে মানুষের বসবাস বাড়তে থাকল ক্রমশ। কলুপাড়া, তেলিপাড়া, রায়পাড়া, দাসপাড়া, ব্যানার্জিপাড়া, মুখার্জিপাড়া, বেনের মাঠ, নাজিরদের বাগান, দেখতে দেখতে বাড়িঘরের জঙ্গল হয়ে গেল।

বড় রাস্তার ওপারে যোধপুর পার্কের ক্লাবটা তখনও চলছিল। সাহেব-মেমদের খুব ভিড় হত ক্লাবে। ততদিনে জয়মোহনের বিয়ে-থা হয়ে গেছে, খোকনও এসে গেছে। ছেলের হাত ধরে মাঝে মাঝেই ক্লাবের দিকে যেতেন জয়মোহন, হাঁ করে খোকন সাহেব-মেমদের ব্যাডমিন্টন খেলা দেখত।

ক্লাবটাও উঠে গেল। স্বাধীনতার দু-চার বছর পরেই।

সবার শেষে বিদায় নিল শেয়ালদা বজবজ লাইনের লেভেল ক্রসিংটা। টুং টুং গেট। তার জায়গায় তৈরি হল এক বিশাল ব্রিজ। কলকাতা উড়ে এসে মিশে গেল ঢাকুরিয়ায়।

সেটা যেন কত সাল? চৌষট্টি? না না পয়ষট্টি। নাকি ছেষট্টি সাল? খোকন কি তখন কলেজে পড়ত? স্মৃতিটা এখান থেকেই কেমন অস্বচ্ছ হয়ে যায় জয়মোহনের। আর কিছু পরিষ্কার মনে পড়ে না।

 দরজায় ছায়া। জয়মোহন ঝিম লাগা চোখ খুলে তাকালেন। চাঁদু না?

কন্দর্প দরজা থেকেই জিজ্ঞাসা করল, কী হল, ওভাবে ঘাড় ঝুলিয়ে বসে আছ কেন? কষ্ট হচ্ছে?

ঘাড় নেড়ে নেড়ে ছবিগুলো সরালেন জয়মোহন। হাসার চেষ্টা করলেন, বউমা খেয়েদেয়ে একবার এ ঘরে এল না তো?

–ফেরেনি বোধহয়।

এতক্ষণ স্কুল করছে?

–স্কুল কেন করবে! স্কুল থেকেই হয়তো কোথাও গেছে। যায় তো!

কন্দর্প দাঁড়িয়েই আছে। কয়েক সেকেন্ড চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর স্কুটারের চাবি ঘোরাতে ঘোরাতে বলল, বাবা, একটা জিনিস দেখবে?

কী?

কন্দর্পর মুখে লাজুক হাসি, আমি একটা সিনেমায় পার্ট করেছি। এলেবেলে নয়, বড় পার্ট। শিগগিরই বাজারে রিলিজ করছে। ছবির ভিডিও ক্যাসেট আমার কাছে আছে, চাও তো দেখাতে পারি।

–দেখালে দেখব।

–ঠিক আছে। সন্ধেবেলা ফিরে আসি, দেখাব। তিতিরও দেখবে।

জয়মোহন একটু খুশিই হলেন। চাঁদু তাঁকে নিজের সিনেমা দেখাতে চাইছে! যাক, ছেলেটা ফিলম করেই যদি দাঁড়ায়। লাইনটাতে পয়সা আছে। শুধু চরিত্রটাই বিগড়ে যায়, এই যা।

জয়মোহন গদগদ মুখে বললেন, আমি ওপরে উঠে কী করে দেখব?

–ওপরে কেন, তোমার ঘরে দেখব। সাদাকালোতে কিছু খারাপ লাগবে না।

কন্দর্প চলে গেল। হালকা শিস দিচ্ছে যেতে যেতে।

জয়মোহন টুকটুক করে বড় ঘরে এলেন। হঠাৎ নড়াচড়াতে শীতটা কেমন জেঁকে ধরছে। বাইরের দরজার কাছে রোদ্দুরের মতো কি যেন একটা খেলা করছে, চেয়ার টেনে সেই জায়গাটিতে গিয়ে বসলেন জয়মোহন। আষ্টেপৃষ্ঠে গায়ে জড়িয়ে নিলেন জয়পুরি চাদর। চাদরটায় বেশ ওম, জয়ি এনে দিয়েছিল রাজস্থান থেকে।

জয়মোহন আবার ঢুলছেন বসে বসে। ঘুম আসে না, ঢুলুনিই সার। কিবা দিন, কিবা রাত, বুড়ো মানুষের ঘুম বড় বালাই। আসে, আর এসে এসে পালায়। দিনে তাও একরকম, রাতের বেলা বড় কষ্ট! তার ঘোর বার বার ছিঁড়ে যায়, চোখ বুজে অপেক্ষা করতে হয় দিনের। ঘুমানো আর জেগে থাকার মাঝে যে একটা বড়সড় এলাকা আছে, সেটা তখনই টের পান জয়মোহন। না দুধ, না জল, সে এক ছানাকাটা দশা। অথচ এককালে জয়মোহনের ঘুমের কী দাপটই না ছিল! শোভনা বলতেন পাশে বউ খুন হয়ে গেলেও জয়মোহনের নাকি চোখ খুলবে না। বউ খুন হয়নি বটে, কিন্তু ঘুমের মধ্যে পাঁচ-পাঁচখানা ভূমিকম্প পার করেছেন জয়মোহন। একবার তো বাড়ির লোক জেগে উঠে শঙ্খধ্বনি শুরু করেছিল, ঝ্যাং ঝাঝ্যাং কাঁসরঘণ্টাও নাকি বেজেছিল পাড়ায়, তাতেও জয়মোহনের নাসিকাগৰ্জন কমেনি। বাঁ পাশ থেকে ডান পাশ ফিরেছিলেন শুধু। এখন নাক ডাকলেও ডাকে ফুরুর ফুরুর। আর সারা রাতই মনে হয় খাট নড়ছে, ঘর দুলছে, এই বুঝি কড়িবরগা খসে পড়ল।

কী আর করা! যে বয়সের যা। এখন দিন কাটে রাতের প্রতীক্ষায়, রাত কাটে দিনের। দিন মানেও এমন কিছু মহৎ ব্যাপার নয়, দেওয়াল ঘড়ির কয়েকটা শব্দ। গড়িয়ে গড়িয়ে শুরু হবে, তারপর থেমেই থাকবে, থেমেই থাকবে, কখন যেন ফুরিয়ে যাবে ভুস করে। রাত নামের এক ভয়ঙ্কর সময় নেমে আসবে পৃথিবীতে। দিন মানে খিদে তেষ্টার লড়াই। দয়া আর করুণা পাওয়ার জন্য খামচাখামচি। রাত হল গিয়ে শ্বাস টিকিয়ে রাখার মহাসংগ্রাম। বার বার হাঁকপাঁক করে বাথরুমে ছোটো, আর ফিরে এসে বুক খামচে বসে থাকো। এই বুঝি বেরিয়ে গেল প্রাণবায়ু! কী জীবন!

তবু এই জীবনটাকেই আঁকড়ে থাকতে বড় সাধ যায় জয়মোহনের। কী এমন বয়স হয়েছে তাঁর? মাত্র চুয়াত্তর। এই বয়সের লোকেরা অলিম্পিকে দৌড়োয়, ময়দানে হাডুডু খেলে, এমনকী বিয়েতেও বসে। ভাবা যায় পৃথিবীতে সূর্য চন্দ্র আলো বাতাস সবই থাকবে, ফুল ফুটবে, পাখি গাইবে, আর তিনি কিনা ভোকাট্টা হয়ে যাবেন!

কে যেন এল ঘরে! বড় বউমা? খোকন? জয়মোহন চোখ খুললেন। কেউ কোথাও নেই। দুপুরটা যে সুনসান, সেই সুনসান। শুধু দুর্লভের মেশিন চলছে ঘটাং ঘট। আলো সরে গেছে আরও খানিক দূরে।

ঢুলছেন জয়মোহন। আবার। ঘুম আসে না, ঘুম নেই চোখে। চোখের পাতা বড় শুকনো হয়ে থাকে। বুড়োমানুষের ঘুম বড় বালাই। খোকনটা কদিন ধরে ঘুরঘুর করছে আশপাশে। জিজ্ঞাসা করলে উত্তর দেয় না, অথচ মনে হয় কি যেন বলতে চায়। সামনের চেয়ারে বসে আড়মোড়া ভাঙে, ইতিউতি তাকায়। হঠাৎ হঠাৎ উঠে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে তফাতে, চমকে ফিরে আসে। কেন রে খোকন?

আবার কুয়াশা। থকথকে। কুয়াশার ভেতরে এক অতল কুয়ো, গভীর খাদে জল নেই, কে যেন শব্দ বাজাচ্ছে ঝনঝন। জোর হচ্ছে শব্দ। আরও জোর। বাড়তে বাড়তে কানে তালা লেগে গেল।

–ও দাদু শুনছেন? দাদু, ও দাদু…? টেঁসে-ফেঁসে গেছে নাকি রে বাবা?

 জয়মোহনের হাড়পাঁজরা কেঁপে উঠল। পড়াং করে খুলে গেছে চোখ। একটা কালো মুশকো জোয়ান দাঁড়িয়ে জয়মোহনের দরজায়।

কে রে বাপ! যমদূত নাকি!

বুকে খানিকটা বাতাস টানলেন জয়মোহন, অ্যাই, কী চাই?

–ঘুম বটে একখানা! কড়া নাড়তে নাড়তে আঙুল ব্যথা হয়ে গেল!

 যমদূত কি মূর্খ? জানে না, বুড়ো মানুষের ঘুম বড় বালাই?

জয়মোহন গলা খাঁকারি দিলেন, হুঁ, বুঝলাম। কিন্তু ভরদুপুরে চাইটা কী?

—রেজিষ্ট্রি চিঠি আছে। ডটপেন খুলে গোছা কাগজ উল্টোচ্ছে যমদূত।

চিত্রগুপ্ত কি আজকাল রেজিস্ট্রি চিঠিতে ডাক পাঠায়?

জয়মোহন মাড়ি বার করে হাসলেন, আমার নামে?

আপনি কি ইন্দ্রনীল রায়?

ইন্দ্রনীল যেন কার নাম? বাপ্পার না? হ্যাঁ, বাপ্পাই তো। জয়মোহনের ঘোর পুরোপুরি কাটল, –সে তো এখন বাড়ি নেই।

–এ বাড়িতেই থাকে তো? নিন, সই করে নিয়ে নিন।

নেব?

একটু দ্বিধা করে পেনের জন্য হাত বাড়ালেন জয়মোহন। বাপ্পাটা সেবার খুব মুখ শুনিয়েছিল। এবার চিঠিটা নিয়ে লুকিয়ে ফেললে কেমন হয়!

.

৩৫.

তিতির স্কুল থেকে সাড়ে চারটে নাগাদ বাড়ি ফেরে। ছুটির পর স্কুল গেটে খানিক জটলা হয় বন্ধুদের। সম্রাট পাঞ্চালী কুলজিৎ ঝুলন কেউ না কেউ পালা করে খাওয়ায়। আইসক্রিম, কোল্ড ড্রিঙ্কস, চিপস, ভেলপুরি। স্কুল থেকে বাস রাস্তায় আসার পথে নতুন একটা ভিডিও গেমসের দোকান হয়েছে, দল বেঁধে সেখানেও হানা দেয় সকলে। আঙুলের টুসকিতে তিরিশ চল্লিশ পঞ্চাশ টাকা উড়ে যায় এক একদিন। ঝুলন যে ঝুলন, সেও আজকাল ঝ্যাট ঝ্যাট পঞ্চাশ টাকা একশো টাকার নোট বার করে দেয়। তিতিরের খরচা করার দৌড় দশ থেকে বারো, তিতির ওদের সঙ্গে এঁটে উঠতে পারবে কেন? তার চেয়ে মানে মানে তার কেটে পড়াই ভাল।

কেটেই পড়ে তিতির, কিন্তু বিকেলে তার তেমন কিছু করার থাকে না। পুজোর পর থেকে একটা টিউটোরিয়ালে ভর্তি হয়েছে, সপ্তাহে দু দিন ক্লাস, ওই দু দিন তাও যা হোক বিকেলটা পার হয়ে যায়, বাকি বিকেলগুলো বাড়ি ফিরে ভোঁ হয়ে বসে থাকে তিতির। এক আধ দিন মা না থাকলে প্রেসঘরে এসে মেশিনদাদুর সঙ্গে হাবিজাবি বকে, নয়তো ছাদে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে চুপচাপ। কমলা রঙ সূর্য ক্রমশ লাল হয়ে যায়, সরতে সরতে কখন টুক করে হারিয়ে যায় বহুতল বাড়িটার পিছনে, অট্টালিকার ছায়া লম্বা হতে হতে এক সময়ে গ্রাস করে নেয় গোটা ঢাকুরিয়াকে। সন্ধ্যা নামে। কালচে, বিষণ্ণ সন্ধ্যা। অঘ্রানের বাতাস হিম হয়ে আসে, শিশিরে ভিজতে থাকে ছাদ। সোঁদাটে একটা গন্ধ ছড়ায় ছাদ। শুধু তিতিরেরই জন্য। তবে সেই ঘ্রাণও বুক ভরে নিতে পারে না তিতির, হিম পড়ার সময়ে ছাদে থাকলে মা খুব রাগারাগি করে। লম্বা একটা নিশ্বাস ফেলে দোতলায় নেমে আসে সে। ডুবে যায় বইখাতায়, নয়তো টিভিতে।

আজ রুটিনটা একটু অন্য রকম হল। স্কুল থেকে ফিরে তিতির দেখল দাদু ঝিমোচ্ছ না, তাস খেলছে না, বড় ঘরে বসে আছে টান টান।

তিতিরকে দেখেই প্রশ্ন, তুই আজ এত দেরি করলি?

কই না তো। আলগোছে ঘড়ি দেখল তিতির, চারটে পঁয়ত্রিশ। এই সময়েই তো ফিরি।

–তাই কি! আজ যেন একটু বেশি অন্ধকার হয়ে গেছে।

–আকাশে মেঘ আছে। –

-অঘ্রান মাসে মেঘ করল! কোনও মানে হয়!

–তোমার কি অসুবিধে হল?

চাষের ক্ষতি হবে না? ফুলকপি বাঁধাকপির বারোটা বেজে যাবে।

 –তাতেই বা তোমার কি? তিতির হেসে ফেলল, তোমার তো কপি খাওয়া বারণ।

–আমার জন্য নয় রে বুড়ি, তোদের কথা ভেবেই বলা। তোবড়ানো গাল কুঁচকে হাসছেন জয়মোহন, তুই কি এখন কোথাও বেরোবি নাকি?

না। কেন বল তো?

–চাঁদু সিনেমার ক্যাসেট আনবে। আমার ঘরে বসে দেখা হবে।

–সে তো সন্ধের পর!

শীতের সন্ধে দেখতে দেখতে এসে যাবে। তুই যেন কোথাও বেরোস না।

–না রে বাবা না। আমি আছি। হেলেদুলে প্রসন্ন মনে বড়ঘর পেরোল তিতির। ফিলমটার সুবাদে বেশ কয়েকবার ছোটকার নাম বেরিয়েছে কাগজে, স্টিল ছবিও ছাপা হয়েছে। যে কাগজেই বেরোক, কাটিংগুলো যত্ন করে জমিয়ে রাখে ছোটকা, দেখায় সকলকে। এই ফিলমটার ওপর ছোটকার বড় আশা, ছোটকার হাবেভাবে স্পষ্ট বোঝা যায়। নাহ, মন দিয়ে দেখতে হবে ফিলমটাকে। দাদুর ঘরে ক্যাসেট দেখানোর প্ল্যানটা ভালই। অনেকদিন পর দাদুর মুখে নির্মল হাসি দেখা গেল, এ কি কম কথা!

ব্যাগ খুলে রান্নাঘরে টিফিনবক্স নামাতে নামাতে তিতির বলল, কী খাবার করেছ গো মাসি?

 সন্ধ্যার মা আটা ঠেসছে। বলল, পরোটা ভেজে দেব দুটো?

দাও। আলুভাজা দিও সঙ্গে। নরম নরম।

–চা খাবে?

–খেতে পারি।

–ওপরে গিয়ে জামা বদলাও, আমি নিয়ে আসছি।

এক সেকেন্ড ভাবল তিতির, নাহ, আমি নীচে এসে খাব।

দোতলায় এসে আবার চমক। বাবা আছে ঘরে। মশারি টাঙিয়ে ঘুমোচ্ছে। জ্বর হল নাকি! কাল রাত্তিরে খুব কাশছিল বাবা।

মশারি তুলে তিতির আলগা হাত ছোঁওয়াল বাবার কপালে। উঁহু, গা তো গরম নেই। কদিন ধরেই বাবা খুব একটা বেরোচ্ছে না, তা বলে এমন প্রমত্ত ঘুম! এই শীতের বিকেলে! আবার কি আলসেমির ভূত চেপে বসছে বাবার মাথায়! নাকি বাবাও আজ ছোটকার সিনেমার ক্যান্ডিডেট। দিবানিদ্রা দিয়ে তরতাজা করে নিচ্ছে নিজেকে!

ইউনিফর্ম ছেড়ে সালোয়ার-কামিজে নিজেকে বদলে নিল তিতির। শীতকালে বড় ধুলো জমে মুখে, বাথরুমে গিয়ে মুখেচোখে জল দিল, মুছল ঘষে ঘষে। ঘরে ফিরে ক্রিম মাখল, গার্ডার খুলে ছড়িয়ে দিল চুল, হালকা চিরুনি চালাল।

অ্যাটম সাঁই করে ঘরে ঢুকেছে, অ্যাই দিদিভাই, ব্যাডমিন্টন খেলবি?

ওপরে ওঠার সময়েই কাকিমার ঘরের দরজা খোলা দেখেছে তিতির। পুজোর পর থেকে অ্যাটমের সাঁতার বন্ধ, কাকিমা এই সময়টা বাড়িতেই থাকছে এখন।

তিতির গায়ে একটা গুজরাটি কাজ করা সুতির চাদর জড়িয়ে নিল, আমি এখন খাব। আমার পেট চুঁই চুঁই করছে।

–খেয়ে নিয়ে খেলবি?

না। তিতির ভুরু কুঁচকোল, তুই একটু পরে আঁকার ক্লাসে বেরোবি না?

অ্যাটম নির্ভয়ে বলল, আজ আঁকার ক্লাস ডুব।

–কেন রে?

–মার ঘাড়ে ফিক লেগেছে।

–সে কি! কখন! কী করে?

–এই তো একটু আগে। স্কুল থেকে এসেই ফেদার ডাস্টার দিয়ে আমাকে মারছিল, তখন।

কী করেছিলি তুই?

–ইংলিশ ক্লাসটেস্টে আজ টোয়েন্টিফাইভে এইটিন পেয়েছি…..

তিতিরের হাসি পেল। একটু দুঃখও হল যেন। বেচারা অ্যাটম। তিতিরের মা তিতিরকে কোনও দিন আহ্লাদ দেয়নি বটে, আবার তেমনই গায়েও হাত তোলেনি কখনও। তিতিরেরও না, বাপ্পারও না। একবার শুধু চোখ পাকিয়ে তাকাত, তাতেই রক্ত জল। ক্লাস টেস্টে পঁচিশে আঠেরো পাওয়ার জন্যও মা কোনওদিন উদ্বিগ্ন হয়নি। তিতির বাপ্পা কি খুব খারাপ রেজাল্ট করেছে পরীক্ষায়? মার খেলে অ্যাটম কি তার থেকেও ভাল রেজাল্ট করবে?

ভাবনাটা গোপন করে চোখ ঘোরাল তিতির, কাকিমারই লেগে গেল? তোর কিছু হল না?

তিতিরের কামিজ টেনে ঘাড় ওঠাল অ্যাটম। ফিসফিস করে বলল, –মারও তেমন লাগেনি। সকালে ছোটকা ঘরে এসেছিল। মার সঙ্গে ছোটকার কথা হয়েছে। সন্ধেবেলা ছোটকা বাড়িতে সিনেমা দেখাবে। মা দেখবে। সেইজন্যই তো মা আঁকার ক্লাসে যাবে না।

তিতির শিহরিত। বিশ্বপাকা হয়ে উঠছে অ্যাটম। একে যে কাকিমা পরে কী করে সামলাবে!

হাওয়াই চটি পায়ে ফট ফট নামছে তিতির, অ্যাটম চেঁচিয়ে উঠল, কি রে দিদিভাই, খেলবি না?

–খেয়ে নিই, তারপর ভেবে দেখব।

খাবারের প্লেট নিয়ে বড়ঘরে বসেছে তিতির। জয়মোহন ইজিচেয়ারে বসে আপন মনে ঘাড় দোলাচ্ছেন। চোখ বুজে। একটা যেন গুনগুন শব্দও শোনা যাচ্ছে দাদুর গলায়! তিতির কান পেতেছে। বিস্মিত স্বরে বলল, তুমি গান গাইছ নাকি, দাদু?

–আমি? কই না তো। জয়মোহন চোখ খুলে সোজা হওয়ার চেষ্টা করলেন। লুব্ধ দৃষ্টিতে তাকালেন তিতিরের প্লেটের দিকে।

তিতির বলল, আমি যে স্পষ্ট শুনলাম তুমি গান করছ! ছন্দে ছন্দে দুলি আনন্দে…!

ভুল শুনেছিস। জয়মোহন চোখ ঘুরিয়ে নিলেন বাইরের দরজায়। যেন মাপছেন কখন কমবে আলো। মলিন বিকেল চলে যেতে গিয়েও থমকে আছে রাস্তায়।

তিতির ফিক করে হাসল, –তোমার আজ খুব আনন্দ, তাই না?

–কেন?

বা রে, আজ তোমার ছোট ছেলের অ্যাক্টিং দেখবে….

–ছেলেটা বড় গুণের ছিল রে বুড়ি। জয়মোহন আবার চোখ বুজে হেলান দিয়েছেন, –লেখাপড়ায় মাথাটা সাফ ছিল… কী ভাল রেসিটেশান করত ছোটবেলায়! বলো বীর বলো উন্নত মম শির….। কত কবিতা মুখস্থ ছিল চাঁদুর। ওর গলায় দেবতার গ্রাস শুনেছিস?

–শুনিনি! এত বলি ব্রাহ্মণ ঝাঁপ দিল জলে বলেই খাট থেকে জোর একটা লাফ মারত ছোটকা। মা ছোটকাকে পাখার বাঁট নিয়ে তাড়া করত।

জয়মোহন যেন শুনতেই পেলেন না। নিজের মনে বিড়বিড় করে চলেছেন, ছেলেটার দিকে সেভাবে নজরই দেওয়া হল না কোনওদিন। সবার শেষে এল, আড়ালে আবডালে মানুষ হয়ে গেল। নাটক করে বেড়াত বলে কত গালাগাল দিয়েছি এককালে, রা কাড়েনি মুখে। অথচ দ্যাখ, চুপচাপ লেগে থেকে থেকে ঠিক একটা জায়গায় পৌঁছে তো গেছে। যায়নি, তুই বল?

দাদুর স্বরে যতটা প্রশ্ন তার চেয়েও বেশি সংশয়! যতটা সংশয় তার চেয়েও বেশি যেন মায়া! কণ্ঠে মায়া এলে বুড়োমানুষের মুখও যে কত সুন্দর হয়ে ওঠে।

তিতির গলায় উচ্ছ্বাস আনল, পৌঁছল মানে! ছোটকার হাতে এখন কত কনট্র্যাক্ট জানো? তিনটে ফিলম, বাংলা সিরিয়াল, হিন্দি সিরিয়াল….। রাস্তা দিয়ে হাঁটলে লোক ঘুরে ঘুরে ছোটকাকে দেখে।

জয়মোহন মাথা দোলালেন, হুঁ। শুধু আমার ওই অকালকুষ্মাণ্ডটাই….

সন্ধ্যার মা চা রেখে গেছে। কাপ ঠোঁটে ছোঁয়াতে গিয়েও চলকে গেল। মুহূর্তে চোখের সামনে ভেসে উঠল দোতলার ঘর। মশারি খাঁটিয়ে ভোঁস ভোঁস ঘুমোচ্ছে মানুষটা। নির্ভাবনায়। দাদুর কথা কি একবারও মনে আসে না বাবার! দাদুও যেন কী! বড়কা ছোটকা যাকে নিয়েই কথা হোক ঘুরেফিরে ঠিক বাবার প্রসঙ্গে চলে যাবে! ভাল লাগে না তিতিরের।

জয়মোহন ঝুপ করে প্রশ্ন করলেন, সেই ব্রহ্মদত্যিটাকে কদিন দেখছি না কেন রে?

তিতির গোঁজ মুখে বলল, আমি কী করে বলব? আসে, কি আসে না, তাই কি ছাই আমি জানি?

–নিঘঘাত তোর বাবার টাকা মেরে দিয়ে পালিয়েছে।

–হুঁহ, বাবার হাতে যেন কত টাকা!

-বাবার টাকা না হলে, তোর মার টাকা। নিজে তো আর রোজগার করে না, তাই গায়ে লাগে না। তোর মার উচিত ঘেঁটি ধরে ব্যাটাকে প্রেসঘরে বসিয়ে দেওয়া। দুর্লভের সঙ্গে হাতে হাতে মেশিন চালাক।

রাগতে গিয়েও তিতিরের হাসি পেল। বাবা মেশিন চালালে আর দেখতে হবে না, পাকাপাকি তালা ঝুলে যাবে প্রেসে। হাসতে হাসতেই বলল, মাকে পরামর্শটা দিয়ে দেখো।

–আমার দায় পড়েছে। যাদের সংসার, তারা বুঝবে। কাঠ খাবে, আংরা হাগবে। জয়মোহনের গলা ডুবে গেল হঠাৎ, কোনও কর্মই বৃথা যায় না রে, ঠিক একদিন কর্মফল পেতে হয়।

তিতির পরিষ্কার বুঝল না কথাটা। বলল, তুমি কী বলতে চাও বলো তো?

–যারা আমাকে কষ্ট দিয়েছে, তারা কোনও দিন… জয়মোহন থেমে গেলেন, থাক।

 ঘরের হাওয়া পলকে যেন ভারী হয়ে গেল। প্রেসের শব্দ চলছে একটানা। গৃহমুখী পথচারীদের কোলাহল গুঞ্জনের মতো শোনায় এখন। আঁধার নামছিল।

বাইরে কে যেন মিহি সুরে ডাকছে তিতিরকে, তিতির… আই তিতির…!

তিতির ছুটে দরজায় গেল। হিয়া।

-আরে, তুই হঠাৎ!

এলাম। হিয়ার হাসি কেমন কেঁপে গেল, কী করছিলি?

–কিছু না। দাঁড়িয়ে রইলি কেন? ভেতরে আয়।

 হিয়া ঢুকল না। বাঁ হাতে নখ খুঁটছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে, একটু বাইরে যাবি আমার সঙ্গে?

–কোথায়?

 –চল না একটু হেঁটে আসি। কথা ছিল।

 তিতিরের অবাক লাগছিল। হিয়া আজকাল তিতিরের বাড়ির রাস্তা প্রায় মাড়ায়ই না। স্কুলে যখনই দেখা হয়, বেশির ভাগ সময়ে টোটো থাকে হিয়ার সঙ্গে। হাই হ্যালোর বেশি কথা হয় না। যদি কখনও বা একা থাকে, তখন হিয়া আরও অসহ্য। সর্বক্ষণ টোটো আর টোটো। রাজর্ষি এই বলল, রাজর্ষি ওই করল, রাজর্ষির খুব উইট, রাজর্ষির কী রাগ…! ওই অভদ্র অহঙ্কারী ছেলেটার কথা কেন অত শুনবে তিতির! তবু হিয়ার মুখে বার বার টোটোর নাম শুনলে কী যেন একটা হতে থাকে বুকের মাঝে! অসহ্য এক চিনচিনে কষ্ট। কেন যে অমন হয়!

আজও কি হিয়া টোটোর গল্প শোনাতে এল! কিন্তু মুখ এমন কালি হয়ে আছে কেন হিয়ার!

তিতির বলল, দাঁড়া এক সেকেন্ড, চটিটা গলিয়ে আসি।

জয়মোহন পিটপিট করে দেখছিলেন দুই বান্ধবীকে। হাঁ হাঁ করে উঠলেন, তুই এখন বেরোবি নাকি?

যাই। ডাকছে।

চাঁদু কিন্তু এসে পড়বে।

 চলে আসব তাড়াতাড়ি।

কথাটা বলেই সামান্য দুর্ভাবনায় পড়ল তিতির। বিকেলে রাস্তায় বেরোনো মানেই সেই ছেলেটা! তিতির এখন বেরোলেই ঠিক কোত্থেকে এসে হাজির হবে সামনে। মোটর সাইকেল নিয়ে। কথা বলবে না তিতির, তবু জোর করে একতরফা নিজের কথা শুনিয়ে যাবে। কত বড়লোকের বাড়ির একমাত্র ছেলে সে, নিজেদের দুখানা গাড়িও আছে, নিউ মার্কেট এলাকায় তার বাবার কত বড় রেডিমেড জামাকাপড়ের ব্যবসা ইত্যাদি ইত্যাদি। পাস কোর্সে বি কমটা উতরোলেই বাবার দোকান সুকান্তরই হয়ে যাবে, তখন আর তাকে পায় কে! তিতিরের যদি মোটরসাইকেলে উঠতে লজ্জা থাকে তবে তার জন্য গাড়িও আনতে পারে সুকান্ত…! তিতিরের পিত্তি জ্বলে যায় শুনে। একদিন ভুল করে মোটর সাইকেলে উঠে বসেছিল বলে তাকে এতই সস্তা মেয়ে ভাবে সুকান্ত! গাড়ি বাড়ির লোভ দেখায়! ঠাস করে চড় মারতে ইচ্ছে করে ছেলেটাকে। একদিন যদি চেঁচিয়ে লোক জড়ো করা যেত। তাই বা কী করে হয়! তিতিরই তো যেচে ছেলেটার সঙ্গে… ছিহ।

আরও একটা ভয়। পাড়ার অনেকেই তিতিরের পাশে দেখেছে সুকান্তকে, যদি কোনওগতিকে মার কানে কথাটা উঠে যায়…!

ছেলেটা আজকেও যদি কোথাও ওত পেতে থাকে। যদি হিয়ার সামনেই ধরে তিতিরকে! না, টোটো যে শিভালরি দেখাতে এসেছিল, সেই সূত্রেই সুকান্তর সঙ্গে তিতিরের দৈবাৎ আলাপ, এ সব ঘটনা হিয়াকে কেন বলতে যাবে তিতির? কাউকেই জানাবে না কোনও দিন।

তিতির হিয়ার হাত ধরে বলল, এক কাজ করলে হয়। ওপরে চল, ওখানে বসেই কথা বলা যাক।

হিয়া কাতর মুখে ফিসফিস করল, –তোর সঙ্গে একটু প্রাইভেটলি কথা বলতে চাই রে তিতির।

ছাদে চল না। ছাদ নিরিবিলি।

হিয়া তবু ইতস্তত করছিল, তিতির তাকে প্রায় টেনেই নিয়ে গেল ছাদে। সিমেন্টের ধাপিতে হিয়াকে বসিয়ে বলল, বল কি বলবি।

হিয়া চুপ করে আছে। বোধহয় কীভাবে শুরু করবে ভাবছে। মেঘ মেঘ আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল খানিকক্ষণ, ঢোঁক গিলল।

হঠাৎ সিঁড়ি কুঁড়ে উদয় হয়েছে অ্যাটম। ছাদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে একবার দৃষ্টিপাত করল তিতিরের দিকে। ব্যাডমিন্টন র‍্যাকেটে কর্ক রেখে টুঙ টুঙ নাচাচ্ছে।

তিতির বলল, অ্যাই, তুই এখন যা তো এখান থেকে।

অ্যাটম নির্বিকার, আমি তো একা একা খেলছি।

–আর খেলতে হবে না, সন্ধে হয়ে গেছে।

–আমি কর্ক দেখতে পাচ্ছি।

 ঝট করে গিয়ে কর্কটা কেড়ে নিল তিতির, এবার দেখি তো তুই কী করে খেলিস!

 অ্যাটম কর্ক চাইল না, তিতিরদের থেকে হাতখানেক তফাতে বসল ধাপিতে। উল্টোদিকে মুখ। পা দোলাচ্ছে।

তিতির কড়া গলায় বলল, অ্যাটম নীচে যাও বলছি।

অ্যাটম উদাস। বধির।

কি রে, কানে কথা যাচ্ছে না?

–আমি এখন এখানেই বসে থাকব।

–মারব এক ঝাপড়। যা বলছি।

–এঁহ, ছাদ কি তোর একার? ছাদে আমাদেরও ভাগ আছে।

মুহূর্তের জন্য নিশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল তিতিরের। কী বলে অ্যাটম! নিশ্চয়ই কাকিমার মুখে শুনেছে। কী শিক্ষাই না হচ্ছে!

শীতল স্বরে তিতির বলল, তুই ধাপি থেকে উঠে যা বলছি অ্যাটম, আমরা এখানে বসে কথা বলব।

এবার যেন কাজ হল। উঠে সিঁড়ির দিকে এগোচ্ছে অ্যাটম। দরজার কাছে গিয়েও দাঁড়িয়ে পড়ল। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল এদিক ওদিক। এক পা-এক পা করে তিতিরের কাছে এসে খপ করে কেড়ে নিল কর্কটা। চলে গেল অনেকটা দূরে, কার্নিশের ধারে। প্রকৃতির শোভা দেখছে।

তিতির দাঁত কিড়মিড় করল। হিয়ার কাঁধে হাত রেখে বলল, বল তুই। ও বাচ্চা আছে, কিছু বুঝবে না।

হিয়া নতমুখে বসে আছে। হঠাৎ চাপা গলায় বলল, আমি মরে যাব রে তিতির।

হিয়ার স্বরে এমন কিছু ছিল, গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল তিতিরের। শঙ্কিতভাবে বলল, কেন? কী হয়েছে?

–আমি যে কীভাবে তোকে কথাটা বলি!

কী হয়েছে আগে বলবি তো?

 –আমার বাবা আবার বিয়ে করেছে।

–কেন? কবে?

অনেকদিন ধরেই ঘটনাটা ঘটবে ঘটবে করছিল। তুই যখন পুজোর পর আমাদের বাড়ি গিয়েছিলি, তোকে একটা কথা বলব বলেছিলাম, মনে আছে?

–এই কথা?

–হুঁ। পুজোর সময় থেকেই ব্যাপারটা প্যাঁচাচ্ছিল। ভদ্রমহিলার সঙ্গে বাবার যে অ্যাফেয়ার চলছে, আগেই জানতাম। অষ্টমীর দিন বাবা হঠাৎ মহিলাকে বাড়িতে এনে হাজির করল। বাবারই কোলিগ। ঠাম্মা সেদিন বাড়ি ছিল না, বেলুড় মঠ থেকে আমার এক পিসতুতো দাদুর বাড়ি গিয়েছিল। সেই চান্সে মহিলা সারাদিন আমাদের বাড়িতে…! দুজনে মিলে আমাকে কী কনভিন্স করার চেষ্টা! সেদিন সারা রাত আমি ঘুমোতে পারিনি রে তিতির। মা নেই, ভেবেছিলাম অ্যাট লিস্ট বাবা তো আছে…! ঠাম্মা ফিরে এসে খুব রাগারাগি করেছিল বাবার ওপর। বলেছিল বুড়োবয়সে আর লোক হাসাস না। বাবা তখনকার মতো চুপ করল, কিন্তু শুনল না কথা। গত শুক্রবার সেই মহিলাকেই রেজিস্ট্রি করে বাড়িতে এনে তুলেছে। শি ইজ নাথিং বাট আ বিচ। আমার ঘেন্না করছে, ঘেন্না করছে।

হিয়ার চোখ লাল হয়ে গেছে, এত লাল যে এক্ষুনি রক্ত ঝরবে চোখ দিয়ে। তিতির হিয়ার কাঁধে হাত রাখল। কী সান্ত্বনা দেবে হিয়াকে! তার বাবা-মারও এক রত্তি বনিবনা নেই, তা বলে মার পাশে অন্য একটা পুরুষ, বা বাবার পাশে অন্য কোনও নারী কি কল্পনা করতে পারে তিতির।

হিয়া ফোঁস ফোঁস করছে, জানিস, এই মহিলা ইজ আ ম্যারেড উওম্যান? হাজব্যান্ডকে ডিভোর্স করার বহু আগে থেকে বাবার সঙ্গে তার ডার্টি রিলেশন তৈরি হয়েছিল? হাজব্যান্ডটাও একটা বোকার ডিম। ভোঁদাই। দিব্যি শিখণ্ডী হয়ে দাঁড়িয়েছিল, আর বউ সুযোগ মতন কিক আউট করে দিল তাকে। এই হ্যালহেলে লোকগুলোকে যে আমার কি করতে ইচ্ছে করে…! আমি বর হলে ওরকম নোংরা বউকে সহজে ছাড়ান দিতাম না, ভুগিয়ে মারতাম।

তিতির প্রশ্ন করল, তুই এত কথা জানলি কোত্থেকে?

পানজেন্ট স্মেল কখনও চাপা থাকে না। এই নিয়ে আমাদের বাড়িতে ঠাম্মার সঙ্গে কম দিন ধরে অশান্তি চলছে? কিছু বলতে গেলে মার এগজাস্পল দেখায়। আমার মা… আমার মা…। কান্নায় গলা বুজে এল হিয়ার। নাক টানছে। নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বলল, মার বিয়ে, ডিভোর্স কিছুই আমি সাপোর্ট করি না। তোমাদের মধ্যে এতই যদি ইগো ক্ল্যাশ, ছেলেমেয়ে দুটোকে পৃথিবীতে আনার কী দরকার ছিল? তোমরা সুখ করতে চাও করো, তার জন্য আমরা জন্মে সাফার করব কেন? বল আমি কি ভুল বলছি? বল?

তিতির করুণ মুখে দু দিকে মাথা নাড়ল।

–তবু মার একটা ডিফেন্স ছিল। যে বয়সে মার ডিভোর্স হয়েছে, সে বয়সে মার পক্ষে একা থাকার অনেক প্রবলেম। আমার মামার বাড়ির কেউ মাকে জায়গা দেয়নি, মা কী করবে? মা আমাকে সব বলেছে। রনিকে নিয়ে একা একাও থাকতে চেয়েছিল মা, কোথাও বাড়ি ভাড়া পায়নি। সেই সময়ে তরুণ আঙ্কল মাকে একটা শেল্টার তো দিয়েছিল। বাট দিস বিচ, অ্যাট দি এজ অফ ফরটি… কোন সাহসে আমার বাবাকে বিয়ে করল? আমার মা কখনও বাবার সঙ্গে থাকতে থাকতে অন্য লোকের সঙ্গে অ্যাফেয়ার চালায়নি। বাবা তাকে তাড়িয়ে দেওয়ার পর….

কী বলি তোকে বল তো! তিতির ঘাড় ঘুরিয়ে একবার দেখে নিল অ্যাটমকে। ভীষণ অন্যমনস্ক মুখে অ্যাটম ফিরে ফিরে দেখছে হিয়াকে। বন্ধুর কাঁধে চাপ দিয়ে গলা নামাল তিতির, মন খারাপ করিস না। যা হয়েছে তাতে তো তোর কিছু করার নেই।

হিয়া ফুঁপিয়ে উঠল, আমি ঠিক মরে যাব। কিছুতেই বাঁচব না।

 তিতির বলে ফেলল, তোর বাবা মার কৃতকর্মের জন্য তুই কেন মরতে যাবি রে বোকা? তোর লাইফটা তোর লাইফ। তোকে মেনে নিতে বলছি না, সহ্য করে নে।

–পারব না রে। মহিলা আবার নিজের ছেলেটিকেও সঙ্গে নিয়ে এসেছে। রনিরই মতন হবে, কি একটু ছোট। খালি বলছে, তোমার ভাই, তোমার ভাই। তুই বল, এই বুড়ো বয়সে একটা আশমান থেকে টপকানো ভাই আমাকে অ্যাকসেপ্ট করতে হবে? রনির জায়গায়? কোনওদিন একা বাড়িতে পেলে আমি ওই ছেলেটাকে খুনই করে ফেলব।

শিরশিরে ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। হিয়ার ফাঁপানো চুল উড়ছে হাওয়ায়। তরল আঁধারে প্রেতিনীর মতো লাগছে হিয়াকে। শেষ চমকটা সইয়ে নিতে দু-এক সেকেন্ড সময় নিল তিতির। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, পাগলামি করিস না। ঠাকুমা কী বলছেন?

ঠাম্মা তো ও বাড়িতে থাকতেই চাইছে না। আমাকে নিয়ে অন্য কোথাও চলে যাবে বলছে। আবার নাকি সেলাই শুরু করবে। এ কি হয় নাকি? আমাকে মরতেই হবে, আর কোনও রাস্তা নেই।

–আহ হিয়া, ফের ওই কথা! ধমক দিতে গিয়ে নিজেরই স্বর ভিজে গেল তিতিরের, নিজেকে এত একা ভাবছিস কেন? আমরা তোর সঙ্গে আছি।

–কেউ নেই রে। যার এমন হয়, শুধু সেই বোঝে।

কষ্ট করে এক-দেড়টা বছর কাটিয়ে দে। তুই তো ডাক্তারি পড়বি, তখন হোস্টেলে থাকিস। দেখতে দেখতে ডাক্তার হয়ে যাবি, তখন ঠাকুমাকে নিয়ে তুই….

–দেখা যাক কি হয়। রাজর্ষি কী বলছিল জানিস?

রাজর্ষির নামেই বুক ছ্যাঁত করে উঠেছে তিতিরের। স্নান গলায় বলল, ওকেও তুই বলেছিস নাকি?

–হ্যাঁ, একমাত্র রাজর্ষিই জানে। আর তুই জানলি।

কী বলল সে?

বলছিল বাবার কাছ থেকে সেন্ট পারসেন্ট ম্যাচ করে নিবি। তোকে মানুষ করে দেওয়াটা তার কর্তব্য। ডিউটি। তোর বাবাকে কেউ দখল করে নেবে, আর তুই সেটা মেনে নিবি…নো, তুইও তোর বাবাকে দখল করে বসে থাক, এক সেন্টিমিটার ছাড়বি না। বাবাটাই বুঝুক টাগ অব ওয়ারে কোন দিকে যাবে।

তিতিরের গলা অবধি তেতো হয়ে গেল। যেমন ঝগড়ুটে ছেলে, তেমনই হিংসুটে পরামর্শ। আর এই ছেলেই এখন হিয়ার ফ্রেন্ড ফিলজফার অ্যান্ড গাইড! তিতিরের কাছে আসার দরকার কী ছিল হিয়ার? শুধু কাঁদতে?

তিতির মনে মনে বলল, উপদেশ তো পেয়েই গেছিস। তাই কর তবে।

নীচ থেকে ডাক পড়ছে অ্যাটমের। রুনার গলা। ছাদের কোণ থেকে জমাট অন্ধকার হয়ে থাকা অ্যাটম ছুটল তীরবেগে। সিঁড়ির দরজায় পৌঁছে থামল একটু। ঘুরেই চেঁচাল, বাবা মারা ভাল হয় না। আমি জানি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *