১১-১৫. মুষলধারায় বৃষ্টি

মুষলধারায় বৃষ্টি নেমেছিল রাত্রে। প্রকাণ্ড দানার ভারে থরথর কেঁপেছিল মেদিনী। তারই কিছু রেশ রয়ে গেছে ভোরের পথেঘাটে। লেকের ভাঙাচোরা রাস্তাটির খানাখন্দে জমে আছে ঘোলাটে জল। মাঠের ঘাসে পা পড়লে কাদা চলকে ওঠে।

কন্দর্প ছোট ছোট জলকাদা কাটিয়ে দৌড়চ্ছিল। দৌড় নয়, হাঁটা। আবার হাঁটাও নয়, দৌড় আর হাঁটার মাঝামাঝি এক ছন্দ।

ছন্দোময় গতিতে দুবার লেক চক্কর দিয়ে মহাকায় শিরীষ গাছের নীচে এসে থামল কন্দর্প। স্বাস্থ্যসন্ধানী মানুষের ভিড় আজ কম, বোধহয় কাল রাতের বৃষ্টির কারণেই, তবে কন্দর্পের টার্গেটটি এসে গেছে। লেকের পাড়ে একটা সিমেন্টের বেঞ্চি ধরে ওঠবস করছে অশোক মুস্তাফি। বৃষ্টি ধোওয়া স্নিগ্ধ সকালেও দরদর ঘামছে।

কন্দর্প একটু তফাত থেকে চেঁচাল, –দাদা আজ কতক্ষণ?

চর্বি থলথল বেঁটে শরীর ঘুরল সামান্য। উত্তর না দিয়ে আবার ওঠবস করে চলেছে। বিড়বিড় করে গুনছে, একত্রিশ, বত্রিশ, তেত্রিশ…

কন্দর্প ধৈর্য ধরে দাঁড়িয়ে রইল। পঞ্চাশ পর্যন্ত থাকতেই হবে। রোজ সকালে তার এই লেকে আসা শুধুই বিশুদ্ধ স্বাস্থ্যচর্চা নয়, অনেক ছোটামোটা যোগাযোগও হয়ে যায় এখানেই। দুজন ফিল্ম ডিরেক্টরের সঙ্গে এই লেকেই আলাপ হয়েছিল, টিভি সিরিয়ালের এক ক্যামেরাম্যানের সঙ্গেও। তাদের দৌলতে কন্দর্প কাজও পেয়েছিল চার-পাঁচটা। তবে তারা কেউই অশোক মুস্তাফির মতো এত বড় কাতলা ছিল না। লোকটা রেলের বড় সাপ্লায়ার, সম্প্রতি গোটা তিনেক বাংলা ফিল্ম প্রোডিউস করেছে, তার মধ্যে রমরমিয়ে ব্যবসাও দিয়েছে দুটো। হালে লেকের ধারে বিশাল ফ্ল্যাট কিনে হাওড়া থেকে চলে এসেছে। ভাগ্যিস লোকটার চর্বি কমানোর বাসনা চেগেছিল, তাই না আলাপ!

ব্যায়ামের পালা সাঙ্গ হল। সিটে বসে হাঁপাচ্ছে অশোক মুস্তাফি। মুখ হাঁ, আধখানা জিভ ঝুলছে বাইরে।

কন্দর্প গুটি গুটি পায়ে পাশে এল, বর্ষা তাহলে এসে গেল দাদা।

হাঁ মুখ থেকে উৎকট ধ্বনি তুলে একটা বলবান বাতাস বার করল অশোক মুস্তাফি। মন্দ্র স্বরে বলল, আসাই তো উচিত, নয় কি?

–তা ঠিক। জুনের মিডল হয়ে গেল, অফিসিয়ালি তো এইটথ জুনই মনসুন আসার কথা।

–মনসুন কি কারুর হুকুমের চাকর যে ডেট মেনে আসবে?

–খাসা বলেছেন দাদা। সায়েনটিস্টরা এমন কায়দা মারে যেন ওরাই সুইচ টিপে মেঘ নিয়ে আসে।

সায়েন্সটিস্টদের টিজ করবেন না, ওদের প্রেডিকশান আজকাল বেশ মেলে। লাস্ট ইয়ারে ক্যানিং-এর সাইক্লোনের ফোরকাস্টটা হুবহু মিলিয়ে দিয়েছিল।

–মিলবেই তো। কত সব মডার্ন ডিভাইস বেরিয়ে গেছে।

ডিভাইস ফিভাইস কিছু নয় কন্দর্পবাবু, আসল হল অবজারভেশান। চোখ। পাওয়ার অফ স্পেকুলেশান। ইনটিউশান। খনার বচন পড়েননি?

–তা ঠিক। তা ঠিক। লোকটার বাজনায় সঙ্গত করতে কন্দর্প জান লড়িয়ে দিচ্ছিল। মৌসুমি বায়ু, বর্ষাকাল, কোনও কিছুই তার স্বর্গে বাতি দেবে না, অশোক মুস্তাফিকে খুশি করে তোলাই তার এখন প্রথম এবং প্রধান কাজ। প্রাণপণে খনার বচনই মনে করার চেষ্টা করল কন্দর্প। পেয়ে গেছে। লটারি পাওয়া মুখে বলল, –খনার বচনের কোনও তুলনা হয় না দাদা। কী সব লাইন! মঙ্গলে ঊষা বুধে পা, যথা ইচ্ছা তথা যা। যদি বর্ষে আগনে, রাজা যান মাগনে। যদি বর্ষে মাঘের শেষ…

ধুর, ওগুলো বস্তাপচা হয়ে গেছে। অশোক মুস্তাফি শর্টসের পকেট থেকে তোয়ালে রুমাল বার করে মুখ মুছছে। মাথার ওপর গাছের পাতা থেকে টুপ করে খসে পড়ল এক বিন্দু জল, পড়েই ছেতরে গেল। মুস্তাফি টেরচা চোখে তাকাল সেদিকে, –রোমান্টিক বচন একটাও মনে আসছে না? দূর শোভা নিকট জল, নিকট শোভা দূর জল…।

কন্দর্প চুপসে গেল। মহিলা এ সব বচনও ঝেড়েছিল নাকি? একী প্যাঁচ মারা লাইন! মানে কী এ সবের অ্যাঁ? সাধে কী তোর শ্বশুর তোর জিভটাই কেটে নিয়েছিল!

মরিয়া কন্দর্প খানিকটা নির্লজ্জই হল এবার, –যাই বলুন দাদা, ওই সব খনা মনা হেনা, ইনটিউশানে এরা আপনার কাছে নস্যি। আপনি যেদিকে তাকান, সেদিকে সাকসেস।

হল না। মুস্তাফি দু দিকে মাথা দোলাচ্ছে। একটি বছর পঁচিশেকের মেয়ে জগিং করতে করতে আসছিল এদিকে, হঠাৎ মাঝখানে দাঁড়িয়ে আর্চ করছে। সেদিকে জুলজুল তাকাল মুস্তাফি। মেয়েটা ভরাট শরীর ধনুকের মতো বেঁকিয়ে ফেলল, লাল ট্র্যাক সুটে টানটান তার উদ্ধত যৌবন। বার কয়েক ধনুক হয়ে আবার জগিং শুরু করেছে মেয়েটি। দুলতে দুলতে দূরে গাছের আড়ালে মিলিয়ে গেল। আবলুশ কাঠের মতো গোদা গোদা ঊরু কাঁপাচ্ছে মুস্তাফি, –আমার ইনটিউশান খুব খারাপ কন্দর্পবাবু।

দাদা বলতে গিয়ে এবার কন্দর্প খানিকটা ছলকে গেল। বলল, -কেন স্যার?

কাল রাতে বৃষ্টি হবে না ভেবে জানলা খুলে রেখেছিলাম, ঘুম থেকে উঠে দেখি অর্ধেক ঘর জলে ভেসে গেছে।

কন্দর্প হাল ছেড়ে দিল। এই লোকের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া সম্ভব নয়। সরাসরিই পেড়ে বসল কথাটা, –আপনার নতুন প্রোডাকশান তো শুরু হতে চলল দাদা, আমার কথাটা একটু মনে রাখবেন। আপনাকে আমি বলেছিলাম…

কী কথা বলুন তো? মুস্তাফি স্মৃতিভ্রষ্ট মানুষের মতো তাকাল।

–ওই যে বলেছিলাম না, আমি একটু-আধটু অ্যাক্টিং করি…ছোট পিসিমাতে একটা ভাল রোল করেছিলাম…আপনি হয়তো দেখেছেন…ওই যে ইয়াং টুরিস্ট…চার দিনের কাজ ছিল।

বাহ ভাল তো। টোকা দিয়ে আঁটো টিশার্ট থেকে ছোট্ট পোকা ঝেড়ে ফেলল মুস্তাফি, কিন্তু আমার ছবি কবে শুরু হবে তার তো ঠিক নেই ভাই।

–না দাদা, শিগগিরই শুরু হবে, আমি খবর পেয়েছি। আপনি রূপেনদাকে স্টোরি লিখতে দিয়েছেন। স্টোরির আউটলাইনও যে আপনারই দেওয়া, তাও আমি জানি। নরেন হোড় ডিরেকশান দিচ্ছে। কি দাদা, ঠিক বলিনি?

বাহ বাহ, আপনি দেখছি অনেক খবর রাখেন! তা এটা জানেন না, বই-এর কাস্টিং প্রোডিউসার করে না, ডাইরেক্টরই করে।

–ও তো জেনারেল রুল, ও কি আপনার বেলায় খাটে দাদা? আপনার শয়তানের মুখোশ হিট করার পর আপনি ইন্ডাস্ট্রিতে একটা নাম। বাংলা ফিল্মের আন্ধেরার বাজারে আপনি আলো জ্বালিয়ে দিয়েছেন। কথাগুলো বলতে বলতে কন্দর্পের নজর চলে গেছে মুস্তাফির মোটা মোটা ঊরু দুটোর দিকে। কী কুৎসিত কালো লোমে ভর্তি! চোলাই মদের ব্লাডারের মতো পেটটাও কেমন ফেটে বেরোচ্ছে! তীব্র এক বিবমিষা ঠেলে উঠছিল কন্দর্পের গলায়, বমি সামলে বিনয়ে ফিরল, –আপনি বলে দিলে নরেনবাবু রিজেক্ট করতে পারবেন না।

–আমি তো ডাইরেক্টরদের ডিকটেট করি না ভাই।

শালা। মনে মনে চার অক্ষরের খিস্তি আওড়াল কন্দর্প; মুখের হাসিটি বদলাল না, –ডিকটেট কেন বলছেন দাদা? আপনার যে জহুরির চোখ, তা কি নরেনবাবু জানেন না?

ট্র্যাক সুট পরা মেয়েটি আবার সিনে ঢুকে পড়েছে। সাঁতার ক্লাবের দিক থেকে ছুটে আসছে এদিকে। একই জায়গায় এসে দাঁড়াল। হ্রস্ব বেণীর পিছনে দু হাত চেপে মাথা ঠেকাচ্ছে হাঁটুতে। তেজি ঘোটকীর ভঙ্গিমায় টগবগ পা নাচাল কিছুক্ষণ।

অশোক মুস্তাফির চোখ চকচকে, দৃষ্টি সরছে না ট্র্যাক সুট থেকে, আমাকে একটা মেয়ে জোগাড় করে দিতে পারেন?

কন্দর্প তোতলা হয়ে গেল, –মমম মেয়ে! আআ আমি!

 ট্রাক সুট সিন থেকে এগজিট নিচ্ছে। তার গমনপথের দিকে চোখ মেলে মুস্তাফি– চাঙা, আমি একটা নতুন মেয়ে চাই। একদম ফ্রেশ। আমার নেক্সট ফিল্মের জন্য। নায়িকার রোলে নয়, তবে প্রায় নায়িকা। বেশ চনমনে হবে। সিডাকটিভ হবে। নায়কের সঙ্গে ওই যে কি বলে, ইশক ফিশক করবে। কিন্তু হিরোকে সে পাবে না। ভেরি ভাইটাল রোল।

গ্রুপ থিয়েটারের মেয়ে হলে চলবে দাদা?

-না না, ওরা খুব ঠ্যাঁটা হয়। বেশি পাকা। আমার তৈরি দরকার নেই, গার্ডেন ফ্রেশ হলে নিজেই তৈরি হয়ে যাবে। শুধু ফেস খুব ম্যাগনেটিক হওয়া দরকার।

ঝপ করে দীপঙ্করের বউ-এর মুখটা মনে পড়ে গেল কন্দর্পর। কেন যে পড়ল! দীপঙ্কর তার কলেজমেট, কলেজে মোটামুটি ঘনিষ্ঠতাই ছিল তার সঙ্গে। তারপর যা হয়, পাস করার পর যোগাযোগ কমে গেল। দীপঙ্কর ঢুকল একটা প্রাইভেট কোম্পানির সেলসে, কন্দর্প আঁকড়ে ধরল অভিনয়। বছর দুয়েক আগে আচমকা মৌলালিতে দেখা। সদ্য তখন বাগুইআটিতে নতুন ফ্ল্যাট কিনেছে দীপঙ্কর, বিয়েও করেছে বছর দেড়েক। দীপঙ্কর জোর করে বাড়িতে ধরে নিয়ে গেল কন্দর্পকে। খুব আদরযত্ন করল। দীপঙ্করের টুকটুকে বউ আর ছিমছাম ফ্ল্যাট দেখে কন্দর্পের তো মাথা ঘুরে যাওয়ার জোগাড়। বন্ধুর সৌভাগ্যে মনে মনে বেশ ঈর্ষাই হয়েছিল সেদিন। সেই দীপঙ্কর মাস ছয়েক আগে দুম করে মরে গেল। কিডনির এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে। রাসবিহারীর আড্ডায় পল্লবের মুখে খবর পেয়ে কন্দর্প ছুটেছিল বাগুইআটিতে। গিয়ে দেখে, সে এক বিপর্যস্ত অবস্থা। এগারো মাসের বাচ্চা নিয়ে প্রায় অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছে মধুমিতা। দীপঙ্করের অসুখে সমস্ত সঞ্চয় শেষ, মাথার ওপর ফ্ল্যাটের দেনা, প্রাণের দায়ে মধুমিতা একটা চিট ফান্ডের এজেন্ট হয়েছে। স্বামীর শ্রাদ্ধশান্তি চুকে যাওয়ার পরই। বেলার দিকে পোস্ট অফিসে দাঁড়িয়ে লোকজনের এন এস সি-টেন এস সিও করায়, সেখান থেকেও কমিশন আসে দু-চার পয়সা। বিধবা মাকে কাছে এনে রেখেছে, তিনিও আর এক দায়। মাত্র একদিনের পরিচিত স্বামীর বন্ধুকে লজ্জা সংকোচ ভুলে চাকরির জন্য কী করুণ মিনতি মধুমিতার! কন্দর্প আর কোথায় চাকরি পাবে? তাও চেনাজানা একে তাকে ধরে দু-তিনটে ছোটমোটো ইন্টারভিউ জোগাড় করে দিয়েছিল। সেই সুত্রেই আরও বার কয়েক আসা যাওয়া।

কন্দর্প নিজেকে ধমকাল। এই হাঙরটার সামনে মধুমিতাকে নিয়ে আসার কথা মনে এল কী করে তার।

ছেঁড়াখোঁড়া মেঘে ভরে আছে আকাশ। সূর্যতেও কেমন ভেজা ভেজা ভাব। সিক্ত গাছপালা একটা গন্ধ ছড়িয়ে দিয়েছে বাতাসে। লেকের গা বেয়ে, যাচ্ছি যাব করতে করতে চলেছে এক মালগাড়ি। দূরের পাড়ে স্নানে নেমেছে লাইন ধারের বস্তির মেয়েরা।

কন্দর্প মনে করিয়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, –দাদা আজ আপনার কালীবাড়ি যাওয়া নেই?

অশোক মুস্তাফি ঘড়ি দেখল, –ভাল কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন। চলুন চলুন। বলতে বলতে উঠে দাঁড়িয়েছে, মেয়েটার কথা কিন্তু মনে রাখবেন। আমি অবশ্য অনেককেই বলেছি… আজকাল তেমন সুটেবল আনকোরা পাওয়া কঠিন। হেঃ হেঃ।

মন্দিরের দিকে এগোতে এগোতে মুখভাব বদলাচ্ছিল অশোক মুস্তাফির। ঘোড়েল কামুক ক্রমশ ভক্ত সাধক। মন্দিরের সামনে পৌঁছে মা মা স্বরে ব্রহ্মনাদ ছাড়ল বার কয়েক। প্রতিমার পদতলে বসে রোজকার মতো অশ্রুবিয়োগও করল।

কন্দর্প মন্দিরে ঢোকেনি, ফুটপাথে দাঁড়িয়ে গ্লাসে চা খাচ্ছে। মন্দিরের দৌলতে আশপাশে বেশ কয়েকটা দোকান তৈরি হয়ে গেছে। চায়ের দোকান। কোল্ড ড্রিঙ্কস, পান-বিড়ির দোকান। বিকেলের দিকে পাওভাজি ভেলপুরিও বসে। ছোটবেলায় কন্দর্প যখন এদিকে ফুটবল খেলতে আসত, মন্দিরের জায়গায় এখানে একটা চায়ের দোকান ছিল। জীর্ণ। শ্রীহীন। দুর্জনেরা বলে, সন্ধেবেলা নাকি চুল্লুও পাওয়া যেত। তারপর কিসব স্বপ্নাদেশ ফপ্নাদেশ হল, রাতারাতি গজিয়ে গেল মন্দিরটা। প্রথম কয়েক বছর বিশাল লাইন পড়ত ভক্তদের, দূরদূরান্ত থেকে সবাই চরণামৃত নিতে আসত। এখন ভক্তিতে কিছুটা ভাটার টান, তবে বিশেষ বিশেষ দিনে এখনও ভক্তসমাবেশ কম হয় না। আর রইস লোকেদের গাড়ির লাইন তো রোজই লেগে আছে। প্রণামীও ভালই পড়ে।

কন্দর্পের মনে ভক্তি-ভাব কম, তবু বুকটা শুলোয় মাঝে মাঝে–প্রণামীর বাক্সটার দিকে চোখ পড়লে। এরকম একটা স্কিম নিতে পারলে মন্দ হত না, মাস ছয়েকের প্রণামীর টাকায় নিজেই একটা ফিলম প্রোডিউস করতে পারত। হিরোর রোলে অবশ্যই সে স্বয়ং। পাশের স্কাইস্ক্র্যাপারটার মাথায় চোখ তুলল কন্দর্প। আকাশমিনারের মাথায় ওই তো দুলছে সিলভার স্ক্রিন! পর্দায় ক্রেডিট।

টাইটেলে একটার পর একটা নাম ফুটে উঠছে। প্রযোজনা : কন্দর্প রায়! পরিচালনা : কন্দর্প রায়! কাহিনী : কন্দর্প রায়! অভিনয়েও প্রথম নাম কন্দর্প রায়! আচ্ছা, নায়িকা কাকে নেওয়া যায়? সুতন্দ্রা চন্দ্রাণী ঋতুশ্রী..নাহ্, এরা কন্দর্পকে বড় হেলাফেলা করে। অযোধ্যা পাহাড়ে শুটিং করতে গিয়ে চন্দ্রাণী কী বেইজ্জত করেছিল কন্দর্পকে! ছোট্ট একটা রেপ সিন ছিল, ঠিক রেপও নয়, ধর্ষণের বিফল প্রয়াস। কন্দর্প যতবার চন্দ্রাণীর কাঁধ চেপে ধরে, তত বার হাসিতে লুটিয়ে পড়ে চন্দ্রাণী। অ্যাই প্লিজ কাতুকুতু দেবেন না, অ্যাই প্লিজ…। কাট কাট। ডিরেক্টর খুব ধমকাচ্ছিল কন্দর্পকে। আলুবাজদের মতো চেহারা করেছেন, একটা মেয়ের কাঁধ ঠিক করে চেপে ধরতে পারেন না! গোটা ইউনিটের সামনে কন্দর্পর প্রায় কেঁদে ফেলার দশা। চাঁদিপুরে কাঁহা কাঁহা ঢুঁড়ে একটা অপরূপ সোনারঙ ঝিনুক উপহার দিল ঋতুশ্রীকে, মুখ ভেংচে ঋতুশ্রী বলল, ইশ কী পচা গন্ধ বেরোচ্ছে! ফেলে দিন। ফেলে দিন।

নাহ্, বম্বে থেকেই নায়িকা উড়িয়ে আনবে কন্দর্প।

অশোক মুস্তাফি চোখ মুছতে মুছতে বেরোচ্ছে, কন্দর্প মাটিতে নামল।

–কিহে, এখনও দাঁড়িয়ে আছ? মুস্তাফি তো হাসছে, –এই দ্যাখো, তুমি বলে ফেললাম আপনাকে।

উপন্যাসের নায়িকা আপনি থেকে তুমিতে এলে নায়কের যেরকম রোমাঞ্চ হয়, কন্দর্পের মুখেও অবিকল সেই আবেশ, তুমিই তো বলবেন। আপনি হলেন গিয়ে পিতৃতুল্য মানুষ।

বাপ ডেকে বয়সটা বাড়িয়ে দিচ্ছ হে!

 বাবা কি শুধু বয়সে হয় দাদা? বাবা হয় গুণে। বাবা হয় কর্মে।

–ফাইন বলেছ তো। তা থাকা হয় কোথায়?

এই তো কাছেই। ঢাকুরিয়ায়।

খোশমেজাজে দুলকি চালে হাঁটছে মুস্তাফি। দুলকি চালেই প্রশ্ন করল, ঢাকুরিয়ার কোথায়?

-স্টেশনের একটু আগে। বাঁ-দিকে একটা স্কুল আছে, স্কুলের কাছে।

–ওখানে সান্যালদের বাড়িটা চেনো?

–খুব চিনি। বাড়িটা তো ভাঙা হচ্ছে। ঠিক তার উল্টো দিকেই পুরনো একটা বাড়ি আছে না…

–দোতলা বাড়ি? পাঁচিল দিয়ে ঘেরা? সামনে ছোট গেট?

 –হ্যাঁ হ্যাঁ, ওই বাড়িটাই আমাদের।

–গ্যারেজে একটা প্রেস আছে?

–হ্যাঁ। দাদার প্রেস।

–আই সি! কয়েক সেকেন্ড নীরব হয়ে কি যেন ভাবল মুস্তাফি। হঠাৎই বাচনভঙ্গি পুরো পাল্টে ফেলেছে, তুমি তো বেশ খানদানি বাড়ির ছেলে হে! তোমার চেহারা দেখেই আমার গেস করা উচিত ছিল। নাহ্, তোমার জন্য একটা কিছু করতেই হয়। তোমার ঠাকুর্দা রায়বাহাদুর ছিলেন না?

–আ আপনি কী করে জানলেন?

 –আমার ও পাড়ায় যাতায়াত আছে। তোমার ফ্যামিলির তো বেশ নাম আছে ঢাকুরিয়ায়!

জীবনে প্রথম নিজের পরিবারের জন্য গর্ব অনুভব করছিল কন্দর্প। লাজুক মুখে মাথা নামাল।

 মুস্তাফি ঠাণ্ডা স্বরে বলল, -সন্ধেবেলা চলে এস। আই মাস্ট ডু সামথিং ফর ইউ।

কী বলছে রে! নিজের কানকে বিশ্বাস হচ্ছিল না কন্দর্পের। কথা জড়িয়ে গেল, কটার সময় যেতে হবে?

বাই এইট চলে এসো। মুস্তাফি চোখ টিপল, –কোনখানে আসবে জানো তো?

আপনার ফ্ল্যাট আমি চিনি দাদা।

–তুমি ভারি ইনোসেন্ট কন্দর্প। মুস্তাফির চোখে কৌতুক, নিজের ফ্ল্যাটে কি সিনেমার ডিস্কাশন চলে! লেক গার্ডেন্সের ফ্ল্যাটটায় চলে এসো।

ঠিকানাটা পলকে মেমারিতে পুরে নিল কন্দর্প। পথনির্দেশও।

নতলা অট্টালিকার সামনে পৌঁছে দাঁড়িয়েছে মুস্তাফি। এরই সাততলায় তার পারিবারিক ফ্ল্যাট। কন্দর্প বিদায় নিয়ে চলে যাচ্ছিল, মুস্তাফি ফিরে ডাকল, –আসছ তো সন্ধেবেলা? আমি কিন্তু তোমার জন্য ওয়েট করব। ওনলি ফর ইউ।

এর থেকেও মধুর করে কি নায়িকারা আহ্বান জানায় নায়ককে? কন্দর্প ফুরফুরে মেজাজে বাড়ি ফিরছিল। এক লোমশ ভাল্লুকের সঙ্গে মনোরম ভোর কাটানোর আত্মগ্লানি ধুয়ে যাচ্ছিল তার। অশোক মুস্তাফির মতো লোকেদের নির্লজ্জ তেল মারতে কী যে বিশ্রী লাগে! মাঝে মাঝে মনে হয়, গামছা পরে হাইড্র্যান্ট পরিষ্কার করাও এর থেকে সম্মানের কাজ। শিল্পীর যন্ত্রণা শিল্পের ধারকরা কতটুকু বোঝে? তবে হ্যাঁ, কন্দর্প এও জানে, এমন দিন থাকবে না, কন্দর্প রায়ের জন্য কোথাও না কোথাও দরজা খুলে যাবে। যাবেই। তখন এই সব কীট হয়ে থাকার মুহূর্তগুলোর চিহ্ন থাকবে না পৃথিবীতে।

হয়তো বা আজই তার শুরু।

বাড়ি ঢোকার মুখে ভাসন্ত মন গোঁত্তা খেয়ে গেল। কাপালিকটা সাতসকালে এসে গেছে। উল্টো দিকের চায়ের দোকানে বসে পা নাচাচ্ছে।

কন্দর্পকে দেখে গলা চড়াল, রঘুবীর, –এই যে ছোট ভাই, প্রাতঃভ্রমণ হল?

-না তো, ভোরবেলা নাইট ডিউটিতে বেরিয়েছিলাম।

রঘুবীর বিদ্রূপটা গায়ে মাখল না। হ্যা হ্যা হাসছে, –ভোরে ওঠার অভ্যেস খুব ভাল। দেহে অযুত হস্তীর বল আসে। তোমার বড়দাকে কত বলি, সূর্যোদয়টা নিজের চোখে দেখুন রায়দা, আয়ু বেড়ে যাবে। কাকে বলা! তিনি তো…এক কাপ চা চলবে নাকি ছোট ভাই?

না। কন্দর্প সাঁৎ করে বাড়িতে ঢুকে গেল।

 ইন্দ্রাণী রান্নাঘরে জলখাবার তৈরি করছে। ছুটির সময়ে এটা সেটা রাঁধে ইন্দ্রাণী।

কন্দর্প রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়াল, –দাদার স্যাঙাত তো বাইরে এসে গেছে দেখলাম!

ইন্দ্রাণী ঘুরল না, ময়দায় সেদ্ধ আলু পুর ভরে বেলছে। চাকি বেলনে চোখ রেখেই বলল, আমি দেখেছি। তোমরাই দ্যাখো।

–লোকটা কি পাকাপাকি গেঁড়ে বসল নাকি?

–বোধহয়। রোজ সকালে দুটিতে মিলে বেরিয়ে যাচ্ছে, ফিরছে সেই দেড়টা-দুটোয়। তারপর তোমার দাদার ভাতঘুমটি সাঙ্গ হলে আবার যুগলে হাওয়া।

–লোকটাও দুপুরে এখানে থাকে নাকি?

–আগে থাকত না, ক’দিন হল থাকছে। এক পেট ভাত খেয়ে বড়ঘরের সোফায় ভোঁস ভোঁস ঘুমোয়।

কন্দর্প আঁতকে উঠল, বড়ঘরের সোফায়! বাবা কিছু বলছে না?

বাবাকে তো প্রায় জপিয়েই ফেলেছে। অর্জুন গাছের ছাল গুঁড়ো করে এনে দিচ্ছে! ওতে নাকি হার্ট পেশেন্টদের উপকার হয়! ধৈর্য ধরে বাবার মনে-প্রাণের কথা শুনছে! কপাল দেখে নাকি বলেও দিয়েছে বাবার আয়ু আরও উনিশ বছর!

-হুম; তাহলে তো প্রবলেম কেস। হেড কোয়ার্টারে শর্ট সার্কিট করে নিয়েছে। তা তুমি কেসটা টেক আপ করছ না কেন?

–আমি বলতে গেছিলাম। তোমার দাদার সঙ্গে তুমুল হয়ে গেছে। কী সব মানের কথাবার্তা! একজন ব্রাহ্মণ সন্তানের পাতে দুগাল অন্ন দিলে তোমার কি চাল কম পড়ে যাবে! ইন্দ্রাণী গ্যাসে চাটু বসাল, –তাও আমি পরশু দিন লোকটাকে আলাদা ধরে দিয়েছি দু-চার কথা শুনিয়ে। কাল থেকে তাই আর সকালে ভেতরে ঢুকছে না, তোমার দাদার জন্য শিকারি বেড়ালের মতো ওই দোকানে ঘাপটি মেরে বসে থাকছে। এমন নিঘিন্নে লোক, অত কথার পরও কাল দুপুরে এসেছিল।

–ইজ ইট?

–হ্যাঁ। তিতির বলল, আমি আছি কিনা দেখে নিয়ে তোমার দাদা চুপি চুপি খাইয়ে দিয়েছে। কী করি বলো তো? কত আর পাহারায় থাকি!

কন্দর্প চৌকাঠে উবু হয়ে বসল, –দুজনে মিলে যায়টা কোথায়? করে কী?

–ভগবান জানে। বাইপাশের দু’ধারে ফাঁকা মাঠ আছে সেখানে নাকি সারাদিন চরে বেড়ায়। বাপ্পা কোন বন্ধুর মোটর সাইকেলে যাচ্ছিল, দুদিন দেখেছে।

মাঠে! কন্দর্প হ্যা হ্যা হাসল, -ঘাস টাস খায় নাকি?

–তাহলেও তো বুঝতাম বাড়ির কিছু সাশ্রয় হচ্ছে। ইন্দ্রাণী চাটুতে পরোটা সেঁকছে। চামচ দিয়ে বাদাম তেল ছড়াল, –আমার বড় চিন্তা হচ্ছে ভাই। তোমার শুভাশিসদা বলছিল, এসব লোকরা খুব ডেঞ্জারাস হয়! হয়তো বড় কোনও ডাকাতির প্ল্যান আছে! আগেভাগে ঢুকে ঘাঁতঘোঁত জেনে নিচ্ছে! পরে একদিন গ্যাং নিয়ে এসে…! তোমার দিদিদের পাড়ায় কি হল? রাত্রিবেলা পুরো বাড়ির লোককে নিদালি দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে গোটা বাড়ির মাল ম্যাটাডোরে চাপিয়ে চম্পট! সেখানেও নাকি এরকম একটা লোক ঘুরঘুর করত।

–দিদি আবার একটু এক্সট্রা ডায়ালগ মারে। সারাক্ষণ টিভি সিনেমা গিললে যা হয়! কন্দর্প জোরে জোরে নিশ্বাস টেনে পরোটার গন্ধ নিল, কাপালিকটার সম্পর্কে মেজসাহেব মেজগিন্নির কী কমেন্ট?

–ওয়াচে রাখছে, ঝেড়ে কাশছে না। তবে অ্যাটমকে একদম কাছে ঘেঁষতে দেয় না।

–হোয়াই?

রুনার ধারণা লোকটা নাকি বাণ মারতে পারে।

 –ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া বাচ্চাদেরও বাণ লাগে!

কম্পিউটারে জ্যোতিষ হচ্ছে, বাণ মারাটা কী আর বিচিত্র! ইন্দ্রাণী গ্যাস থেকে চাটু নামাল, নাও, দুটো গরম গরম আলুপরোটা খেয়ে নাও।

–একটা দাও। আজ তাড়াতাড়ি খেয়ে বেরোব। ফিরতে রাত হতে পারে।

অশোক মুস্তাফির কথা বলবে কিনা ভেবেও কন্দর্প সামলে নিল। আগে হোক তো। কাজটা পেলে তিতিরকে একটা দামি কোয়ার্টজ ঘড়ি কিনে দিতে হবে। বাপ্পার আছে, তিতিরের নেই, তিতির একদিন কন্দর্পের কাছে মনোবেদনা জানিয়েছিল। মাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরোলে এটাই হবে তিতিরের গ্র্যান্ড উপহার।

কন্দর্প পরোটা ছিঁড়ে মুখে পুরল। হঠাৎ কি ভেবে বলল, কাপালিকটা তো ডেফিনিটলি পাঁড় মালখোর! দাদা আবার শুরু করেনি তো?

মিনতি সুদীপদের বাজার নিয়ে ফিরেছে। মেঝেয় ঢালছে সবজি মাছ মাংস। তার কান বাঁচিয়ে ইন্দ্রাণী বলল, এখনও শুরু হয়নি। তবে হলেই হল।

কন্দর্প বরাভয় দিল, কিচ্ছু ভেবো না, তেমন বেচাল দেখলে বড়ঘরের খিল খুলে এমন পেটান পেটাব লোকটাকে.. রাস্তা দিয়ে যখন হাঁটবে পুরো ওড়িশি পোজে হাঁটবে। এরকম… এরকম!

কন্দর্পের নৃত্যমুদ্রায় হিহি হেসে উঠেছে ইন্দ্রাণী। জলখাবার নিয়ে দোতলায় যেতে যেতে বলল, চ্যাংড়ামি না মেরে এবার বাজারে যাও তো দেখি। এরপর তো মাছের আঁশও জুটবে না।

কন্দর্প কয়েক সেকেন্ড জরিপ করল সুদীপের বাজার। হেভি ওয়েট মার্কেটিং! চিতলের পেটি! মুরগির তাল! নিধিরামের জন্য চারাপোনাও আছে! বাহ। বাহ!

.

দুপুরে তাড়াতাড়ি খেয়ে স্কুটার নিয়ে বেরোল কন্দর্প। এ সময়ে কন্দর্পের অনেক কাজ। সেগুলো অবশ্য কাজ, না অকাজ– তা কন্দর্প জানে না। স্টুডিও পাড়ায় গিয়ে নতুন ফিল্মের খোঁজখবর নেয়, ছোটখাট রোল জোটাবার চেষ্টা করে। কিছু টেকনিশিয়ানের সঙ্গেও তার খাতিরের সম্পর্ক, তাদের মুখরোচক ঘোঁটে অংশগ্রহণ করে। পরিচালকদের অফিসেও মুখ দেখাতে যায়, পাছে মুখটা ভুলে যায় তারা। সময় থাকলে টিভি সেন্টারে যায়, ওখানেও দু-একটা স্নায়ুকেন্দ্র ছুঁয়ে আসতে হয় কন্দর্পকে। এখন টিভি সিরিয়ালের বাজার ভাল, টিভির উঠতি ডিরেক্টরদের মজলিশেও ঘোরে মাঝে মাঝে। তাদের চিত্রনাট্য রচনায় সাহায্য করে, নিদেনপক্ষে স্কুটার চড়িয়ে পৌঁছে দেয় এখান সেখান। স্টুডিও পাড়ায় তার একটা চালু ডাকনাম আছে। স্কুটার কন্দর্প। কন্দর্প নিজেও হিসেব করে দেখেছে এসব কাজে সে যত পেট্রল পুড়িয়েছে তাতে সহজেই একটা বাংলা ছবি তৈরি করে ফেলা যায়। তবুও অভ্যাসটা সে ছাড়তে পারে না। এ এক ভৌতিক নেশা!

কন্দর্প আর একটা কথাও ভাল মতন জানে। আর্টিস্ট হিসেবে সে খুব সুবিধের নয়। অভিনয় নিয়ে সে বিস্তর পড়াশুনো করেছে, অভিনয়ের প্রথাপ্রকরণ সম্পর্কে তার জ্ঞান গভীর, কিন্তু ক্যামেরা চালু হলেই কী যে হয়ে যায় তার! স্পটলাইট সানগান রিফ্লেকটারের উজ্জ্বল ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য অদ্ভুত এক বিক্রিয়া শুরু করে দেয়, অজান্তে আড়ষ্ট হয়ে যায় দেহ। অথচ রিহার্সালের সময়ে সে অন্য মানুষ, তার অভিনয় দেখে তাক লেগে যায় নামীদামি অ্যাক্টরদেরও। ছোটখাট রোলে তাও চলে যায়, বড় রোলে তাকে নিতে ভরসা পায় না কোনও পরিচালক। এখনও এই লাইন ছেড়ে একটা চাকরি জোগাড় করে নেওয়ার এলেম কন্দর্পের আছে, কিন্তু কৈশোর থেকে গড়ে ওঠা সম্মোহনী মায়াকে সে এড়াবে কোন শক্তিতে? তাই এই নিত্যি ছোটা। নিত্যি যাতায়াত। নিত্যি হতাশা।

আজও কন্দর্প নিয়মমাফিক বুড়ি ছুঁয়ে এল কয়েকটা। এক জায়গায় একটা কাজের প্রতিশ্রুতিও পেল। দুদিনের আউটডোর। আমতলার কাছে গড়ে ওঠা এক বিলাসবহুল রিসর্টে। সন্ধের মুখে রাসবিহারী আড্ডার টেবিলে একটু টোকা মেরেই অশোক মুস্তাফির লেক গার্ডেন্সের ফ্ল্যাটে পৌঁছে গেল কন্দর্প। আটটার অনেক আগেই।

ফ্ল্যাটে আর এক মক্কেল বসে। তাকে দেখে অবাক হল কন্দর্প, তবে চমকাল না। রূপেন। স্টুডিওপাড়ার ভাষায়, ক্যাংলা রূপেন। অশোক মুস্তাফির বিশাল অ-পারিবারিক ফ্ল্যাটময় দামি সোফা, কিন্তু রূপেন বসেছে কার্পেটে। আসনপিঁড়ি হয়ে। পাশে তাড়া কাগজ। আধখাওয়া হুইস্কির বোতল। জলের জগ। টইটুম্বুর অ্যাশট্রে। গ্লাস। একটা দুটো নয়, চার-চারটে। প্রতিটি গ্লাসে সোনালি পানীয় টলমল।

মদ আর সিগারেটের মিশ্র ঝাঁঝ নাকে সইতে সময় নিল কন্দর্প। সোফায় বসবে কি বসবে না ভেবে, কার্পেটেই বসল।

কাচের আলমারি থেকে আর একটা গ্লাস বার করছে মুস্তাফি, চলে তো?

কন্দর্প বিনীত গলায় বলল, না দাদা, আমার ঠিক চলে না।

–সে কী হে! ফিলমলাইনে আছ, মাল চলে না! একটা অন্তত নাও।

 –দিন তাহলে। খুব অল্প করে।

ফিলম লাইনে হতাশ হয়ে মাঝে কিছুদিন যাত্রাদলে ঢুকেছিল কন্দর্প। রামধনু অপেরার সহনায়ক। নায়িকার নীরব প্রেমিক, শেষ দৃশ্যে ভিলেনকে মেরে কন্দর্পের মৃত্যু। খুব হিট করেছিল পালাটা। গোটা শীতকাল বীরভূম বাঁকুড়া মালদা কুচবিহার চষে বেড়িয়েছিল কন্দর্প। পকেটে গরম গরম নোট আছে, নামও ছড়াচ্ছে দিকে দিকে। তবে নোট বা নাম তো আর ফোকটে আসে না, জোর চাপ পড়তে লাগল শরীরের ওপর। বিশেষ করে গলায়। নামে নীরব প্রেমিক হলেও খুবই উচ্চগ্রামের অভিনয়, গাঁ-গঞ্জের হাড়কাঁপানো ঠাণ্ডা, উদ্দাম ছোটার ধকল–সব মিলিয়ে কন্দর্প ভারি কাহিল হয়ে পড়ল। তখন কিছুদিন মদ ধরেছিল। সহশিল্পীদের পরামর্শে। ধরেই উল্টো বিপত্তি। বুক আইঢাই, গা ম্যাজম্যাজ, গলা বসে যাওয়া, সবই চরমে। অম্বলের রোগও ধরে গেল ভাল মতন। সিজনটা পার করেই যাত্রাকে শেষ স্যালুট জানাল কন্দর্প। তাতেও রক্ষা নেই, ঘরের ছেলেকে ঘরে ফিরে বিছানায় পড়ে থাকতে হল টানা তিন মাস। তারপর থেকে সুরা দেখলে দূরে দূরেই থাকতে চায় কন্দর্প।

অশোক মুস্তাফিও কার্পেটে বসেছে, কোলে লাল মখমলের তাকিয়া। গ্লাসে চুমুক মেরে বলল, বুঝলে রূপেন, তোমাকে যা বলছিলাম, আমাদের কন্দর্পের জন্য একটা জম্পেশ ক্যারেক্টার তৈরি করো তো দেখি।

রূপেন পুরো গ্লাস গলায় ঢেলে দিল, আপনি বলার সঙ্গে সঙ্গেই আমি ভেবে ফেলেছি অশোকদা। নায়কের একটা বন্ধু বানিয়ে নিচ্ছি।

কী রকম?

বাইরে খুব লাইফফোর্স আছে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে স্যাড, একা। বেহালা বাজানো কেস।

-মন্দ না। দাঁতে চেপে বিদেশি সিগারেট ধরাল মুস্তাফি, ওই যেখানে নায়িকা ডুবে যাচ্ছে ওখানে কন্দর্পকে ঢুকিয়ে দাও।

কী করে হবে দাদা? ওটা তো হিরোর সিন।

না, হিরো নয়, কন্দর্পই হিরোইনকে জল থেকে তুলবে। ওর থ্রু দিয়ে হিরোর সঙ্গে হিরোইনের আলাপ করাও।

–হিরো কি তাহলে একটু মার খেয়ে যাচ্ছে না অশোকদা?

-আহ, যা বলছি করো। যাও, ও ঘর থেকে কয়েকটা চিপসের প্যাকেট নিয়ে এসো।

বিদ্যুৎ বেগে খানিকটা হুইস্কি গ্লাসে ঢেলে নিল রূপেন, চোঁ খেয়ে ফেলল। খ্যাংরাকাঠির মত শরীর টলমলিয়ে উঠে গেছে মধ্যবয়সী লোকটা।

মুস্তাফির খালি গায়ে ফিনফিনে আদ্দির পাঞ্জাবি। ফুল আঁকা সিল্কের লুঙ্গি। দামি পারফিউমের ভুরভুর গন্ধ। হাসছে মিটমিট। কন্দর্পের ঊরুতে আলগা চাপড় দিল, কি, খুশি তো?

–কি যে বলেন দাদা! কন্দর্প গদগদ, — আপনি দেখবেন, আমাকে নিয়ে আপনি ঠকবেন না।

জানি জানি। তোমাকে নিয়ে আরেকটা ভাবনা করা আছে। হিন্দি বলতে পারো?

–মোটামুটি পারি দাদা।

–মোটামুটি নয়, ভাল করে রপ্ত করো। কামিং মানথে দিল্লি যাচ্ছি, ওখানে মাণ্ডি হাউসের সঙ্গে আমার একটা প্রিলিমিনারি কথা হয়ে গেছে। একখানা বাহান্ন এপিসোডের ইয়ে নামাব ভাবছি। ন্যাশনাল চ্যানেলে।

হিন্দি সিরিয়াল! সর্বভারতীয় প্রচার! যাহ, নির্ঘাত স্বপ্ন। রূপেনের গ্লাস ছাড়া বাকি যে তিনটে গ্লাস রয়েছে তার একটা ঠোঁটে তুলল মুস্তাফি। এক চুমুক খেয়ে নামিয়ে রাখল। এবার দ্বিতীয় গ্লাস তুলেছে।

ঘোর লাগা চোখে কন্দর্প দেখছিল মুস্তাফিকে।

মুস্তাফি গলা ফাটিয়ে হেসে উঠল, – কৌতূহল হচ্ছে তো?

কন্দর্প ভ্যাবলা মুখে বলল, – তা একটু হচ্ছে।

–এই যে গ্লাসটা দেখছ, এক নম্বর, এটা হচ্ছে এ কে মুস্তাফির। রেলের জেনারেল অর্ডার সাপ্লায়ার। এই দু নম্বর ফর প্রোডিউসার অশোক মুস্তাফি। আর এই থার্ড হল শুধুই এ মুস্তাফির মুস্তাফি, প্রোপাইটার, মুস্তাফি কন্সট্রাকশন। মাথায় ঢুকল কিছু?

কন্দর্প বুদ্ধুর মতো দুদিকে মাথা নাড়ল।

–তবে খুলেই বলি। তোমাদের বাড়ির সামনে সান্যালবাড়ি ভেঙে আমিই মাল্টিস্টোরেড বানাচ্ছি। আমার কাছে খবর আছে, তোমাদের বাড়িটাও ভাঙার প্ল্যান চলছে। তোমার এক দাদা নিও বিল্ডার্সের দস্তিদারের সঙ্গে জোর কথাবার্তা চালাচ্ছে। অ্যাম আই রাইট?

রূপেন চিপসের প্যাকেট খুলে চিবোচ্ছে খচমচ। শব্দটা হঠাৎ ভীষণ অশালীন লাগছিল কন্দর্পের। ঢোঁক গিলে বলল, – হতে পারে দাদা, আমি ঠিক খবর রাখি না।

মুস্তাফি তৃতীয় গ্লাসে লম্বা চুমুক দিচ্ছে। হাত বাড়িয়ে কন্দর্পের কাঁধ জড়িয়ে ধরল, পৃথিবীটা ভারি কঠিন ঠাঁই ব্রাদার। আ জাঙ্গল অফ ব্রিক উড অ্যান্ড স্টোনস। এখানে কি এত ইনোসেন্ট থাকলে চলে? তোমার বাড়িতে তোমারও তো ইকুয়াল শেয়ার আছে, আছে তো?

কন্দর্প মনে মনে বলল, অবশ্যই আছে, তবে বাবা বেঁচে থাকতে কিছু নেই।

–এবার থেকে খবর রাখো কন্দর্প। তোমার দাদাকে তুমি বিশ্বাস করো ক্ষতি নেই, কিন্তু হু ক্যান সে, তিনি বিহাইন্ড দা টেবল কিছু গুছিয়ে নিচ্ছেন না? তোমাকে বঞ্চিত করে? কী হল, বলো কিছু।

এ যেন সেই ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানো!

 কন্দর্প কাঠ হয়ে গেল।

.

১২.

-তোমার নামে একটা রেজিষ্ট্রি চিঠি আছে।

দু পকেটে হাত দিয়ে বাড়ি ঢুকছিল বাপ্পা, জয়মোহনের কথায় চমকে দাঁড়াল, –তাই! কখন এসেছে?

জয়মোহন কাঠ কাঠ, দুপুর টুপুরে হবে।

–দুপুরে! আড়াইটে অবধি আমিই তো বাড়ি ছিলাম!

–তাহলে আড়াইটের পর হবে। আমি সময় মেপে রাখিনি।

ওফ, কী কথার কী উত্তর! দিন দিন বুড়ো আরও খোঁচো হয়ে উঠছে। বাপ্পা গলা নামাল, –ঠিক আছে, ঠিক আছে। চিঠিটা দাও।

–চিঠি তো আমি নিইনি। পিওনের কাছে আছে।

–মানে!

-তোমার লেটার আমি কেন নিতে যাব? জয়মোহনের টেবিলে অনেক দিন পর আজ তাসের সমারোহ, –আমি প্রতিজ্ঞা করেছি, এখন থেকে এ বাড়ির কারুর ব্যাপারে আর নাক গলাব না।

–নাক গলানোর কি আছে? পিওনের কাছ থেকে একটা চিঠি সই করে নিয়ে নেবে …

 –আমি সই করা ভুলে গেছি।

–ষ্ট্রেনজ! ওপর থেকে কাউকে ডাকতে পারতে?

 –আমি কেন ডাকতে যাব? একতলায় পড়ে আছি বলে কি আমি এ বাড়ির চাকর?

–এটা কিন্তু বাড়াবাড়ি দাদু। জানো আমার কত ইম্পর্ট্যান্ট চিঠি আসার কথা?

–তোমার তো ইম্পর্ট্যান্ট চিঠিই আসবে। বাঁ হাতের গোছা তাস থেকে ফটাস করে চারটে তাস চিত করলেন জয়মোহন, তুমি বলে এখন ভি ভি আই পি লোক, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট সকলের ঠিকুজি কুষ্ঠি তৈরি করছ…।

বাপ্পার মেজাজ বিগড়ে গেল। বুড়ো সকালবেলা বেলের পানা খেয়ে আধঘণ্টা পরে ভুলে যায়, দাওনি দাওনি বলে বাড়ি মাত করে, অথচ দশ দিন আগের ঝাল ঠিক পুষে রেখেছে মনে!

সম্প্রতি বাপ্পার সঙ্গে জয়মোহনের একটা বাগযুদ্ধ ঘটেছিল। বোফর্স কেলেঙ্কারি নিয়ে। জয়মোহনের মতে রাজীব গান্ধী অতি বড় বংশের ছেলে, সুবোধ, নীতিশীল, তার পক্ষে দেশের জন্য কামান কিনতে গিয়ে কাটমানি নেওয়া কখনওই সম্ভব নয়। বাপ্পার রাজনীতিতে তিলমাত্র আগ্রহ নেই, সে শুধু আলগাভাবে বলেছিল, আজকাল যে কোনও ধরনের বড় কেনাবেচায় কাটমানি নেওয়াটাই দস্তুর, রাজীব গান্ধী যদি নিয়েও থাকে, এমন কিছু অন্যায় কাজ করেনি। ব্যস, এইটুকু তর্কেই জয়মোহন রেগে টঙ, ছুঁড়ে ফেলে দিলেন ছানার বাটি, দেওয়ালের দিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে থাকলেন ঝাড়া তিন ঘণ্টা।

দোতলায় মা’র ঘরে ঢুকে বাপ্পা গম্ভীর সুরে বলল, –মা, ওই সেনাইল বুড়োটা কবে মরবে বলতে পারো?

ইন্দ্রাণী টিভিতে সান্ধ্য সংবাদ শুনছিল, ছেলের দিকে ভর্ৎসনার দৃষ্টিতে তাকাল, –ও কি ভাষা হচ্ছে দিন দিন!

–ঠিকই বলেছি। একটা ইউজলেস বুড়ো জগদ্দল পাথরের মতো বাড়িতে বসে আছে আর সুযোগ পেলেই লোকের পেছনে কাঠি দিচ্ছে। এমন লোকের বেঁচে থাকার দরকার কী?

–কেন, তোর কি পাকা ধানে মই দিয়েছে?

–আমার একটা দরকারি রেজিষ্ট্রি চিঠি এসেছিল, দাদু পিওনকে ফিরিয়ে দিয়েছে।

–ও, তাই এত মেজাজ! নিজে গিয়ে কাল পোস্ট অফিস থেকে নিয়ে এলেই হয়।

বাহ, চমৎকার সলুশান!

নয়তো কি, বুড়ো মানুষের মরে যাওয়াটা সলুশান? ইন্দ্রাণী ছেলের ওপর সহজে রাগে না, আজ রূঢ় হল, –পৃথিবীতে তোমার যাকেই পছন্দ নয় তাকেই মরতে হবে?

বাপ্পার মনোগত অভিপ্রায় অনেকটা সেরকমই। এ পৃথিবীতে যা সে পছন্দ করে না, সেরকম কোনও কিছুর অস্তিত্বই তার কাছে অবাঞ্ছনীয়। তবু মা’র ধমকে খানিকটা সংযত করল নিজেকে। পকেট থেকে একটা কাগজ বার করে ছুঁড়ে দিল, –তোমাদের টেলিফোন অফিসে আমি ঘুরে এসেছি। 

–দেখা করেছিলি অফিসারের সঙ্গে? কিছু বলল?

–নতুন আর কী বলবে! এক টেপ চালিয়ে গেল। কেবল ফল্ট। বাড়ি যান। হয়ে যাবে। পাঠিয়ে দেব।

–তুই বলেছিস, কুড়ি দিন হয়ে গেল ফোন খারাপ হয়ে আছে?

–তোমার তো মাত্র কুড়ি দিন! কত জন ওখানে ছ মাস এক বছর ঘুরে বেড়াচ্ছে জানো? ছোটকাকে বলো রাস্তায় যখন মিস্ত্রিরা কাজ করে তখন তাদের কাউকে ধরে কিছু পয়সা দিয়ে দিতে। তোমাদের লাইন ঠিক হয়ে যাবে।

ছোটকাকা কেন? তুইও তো করাতে পারিস। তোর বড়কাকা কিন্তু তোকেই দায়িত্ব দিয়ে গেছে।

অ্যাটমের ছুটি শেষ হয়ে আসছে, সুদীপ রুনা পরশু ছেলে নিয়ে পুরী বেড়াতে গেছে। সপ্তাহ খানেকের জন্য। গরমের ছুটি-পুজোর ছুটিতে সুদীপ বউ-ছেলে নিয়ে পবিত্র কর্তব্যের মতো ভ্রমণে যায়।

বাপ্পা দু-এক সেকেন্ড চুপ থেকে নিস্পৃহ গলায় বলল, আমার কোনও দায়িত্ব ফায়িত্ব নেই। আমি কাউকে ফোনও করি না, কাউকে এ বাড়ির নম্বরও দিই না। দেখেছ, আজকাল আমার কোনও ফোন আসতে?

–কেন? ফোন করা নিয়ে কেউ তোকে কিছু বলেছে।

–না। এমনিই। বাপ্পা এর বেশি উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করল না। কেজো স্বরে বলল, –তবে একটা কথা তোমাকে বলে রাখছি মা, যদি আমার চিঠিটা মিসিং হয় তাহলে আমি কিন্তু তোমার শ্বশুরকে ছেড়ে কথা বলব না।

ইন্দ্রাণী জিজ্ঞাসা করতে যাচ্ছিল কি এমন দরকারি চিঠি, তার কথা অর্ধেক হওয়ার আগেই বাপ্পা বেরিয়ে গেছে ঘর থেকে।

এই বাড়িতে ইলেকট্রিক বিল টেলিফোন বিল এখনও আধাআধি ভাগ হয়। খরচ কমানোর জন্য প্যাসেজের আলো পারলেই নিবিয়ে দেয় ইন্দ্রাণী, আজও দিয়েছিল। বাপ্পা খচ করে জ্বেলে দিল আলোটা। পুড়ক পুড়ক। যত খুশি কারেন্ট পুড়ক। এ বাড়ির সঙ্গে শিগগিরই সব সম্পর্ক কাটাবে বাপ্পা।

নিজের ঘরে ঢুকে বাপ্পার মেজাজ আরও খাট্টা হল। যা ভেবেছে তাই, তিতির বাবার খাটে শুয়ে আছে। বই পড়ছে।

বাপ্পা এক টানে বইটা কেড়ে নিল, দুপুরে আমি বেরিয়ে যাওয়ার পর তুই কী করছিলি রে?

 তিতির উঠল না, শুয়ে শুয়ে ভুরুতে ভাঁজ ফেলল, কেন?

–কেন কী? যা জিজ্ঞেস করছি তার উত্তর দে।

তিতির কয়েক মুহূর্ত ভাবার চেষ্টা করল, –বোধহয় বই পড়ছিলাম।

বাড়িতে পিওন এসে ফিরে যায় একটু দেখতে পারিস না?

এসেছিল বুঝি? তিতিরের চোখে যেন এখনও বইএর ঘোর, তা হবে। আমি খেয়াল করিনি।

–তা করবে কেন? যত সব ন্যাকা ন্যাকা উপন্যাসে মুখ ডুবিয়ে থাকবে! বইটার মলাট উল্টে দেখল বাপ্পা, ইশ, এ যে বাংলা বই! কী নাম? ইছামতী! বিভূতিইই ভূষঅঅণ বন্দ্যোপাধ্যায়! এ লোকটা পথের পাঁচালী লিখেছিল না?

তিতির ঠোঁট বেঁকাল, ভাগ্যিস সিনেমাটা হয়েছিল, তাই তোর অন্তত একজন লেখকের নাম শোনা আছে!

–ফোট তো। আমার অত তোর মতো নাটক-নভেলে মুখ গুঁজে থাকার সময় নেই। আমার অনেক কাজ।

-কী কাজ রে?

–দেখবি দেখবি। টাইম এলে ঠিক দেখতে পাবি। বাপ্পা বোনের মাথায় আলগা চাঁটি মারল, যা ভাগ, কাট তো এখন এখান থেকে।

দরজা বন্ধ করে একা ঘরে টেপ চালিয়ে দিল বাপ্পা। জ্যানেট জ্যাকসন। বিছানায় শুয়ে পায়ের ওপর পা তুলে দিল। গানের তালে পা নাচাচ্ছে জোরে জোরে।

সারাক্ষণ এই ধরনের উদ্দাম গানবাজনা শোনা বাপ্পার একমাত্র নেশা। উচ্ছল সঙ্গীতের ধ্বনি তার মাথায় গিয়ে ক্রমাগত যেন হাতুড়ির বাড়ি মারতে থাকে, ধীরে ধীরে ভোঁতা হয়ে আসে স্নায়ু। আরাম লাগে বাপ্পার, খুব আরাম লাগে।

আজ বাপ্পা আরামের সঙ্গে সঙ্গে একটা ছবিও দেখছিল। তার সামনে এখন ভেসে উঠেছে এক অপার সমুদ্র। আকাশের রঙ মেখে যার বর্ণ গাঢ় নীল। নীল সেই জল কেটে তরতর এগিয়ে চলেছে এক সামুদ্রিক যান। দূরে, বহু দূরে। চতুর্দিকে কোথাও কোনও পাড় নেই, লোকালয় নেই, এমনকী দিগন্তও হারিয়ে গেছে সমুদ্রে। জলে জলেই দিন যায়, রাত আসে। রাত আসে, দিন যায়।

চিঠিটা কি তবে এসে গেল!

চাপা উত্তেজনায় টানটান বাপ্পা উঠে বসল বিছানায়। আরও জোরে বাড়িয়ে দিল টু-ইন-ওয়ানের ভলিয়ুম। দুই খাটের মধ্যবর্তী জায়গায় হাত পা ছুঁড়ে নাচছে।

হঠাই ভুস করে গান বন্ধ হয়ে গেল। চারদিকে ঘন অন্ধকার। আলো পাখা নিবে গেছে। লোডশেডিং।

বাপ্পা দরদর ঘামছে। জবজবে ভিজে শরীর হাঁসফাস করছে গরমে।

পাশের ঘর থেকে ইন্দ্রাণীর গলা শোনা গেল, –দাঁড়া বাপ্পা, হুটোপুটি করিস না, মোম দিচ্ছি।

ধ্যাৎতেরি। ছিটকিনি খুলে বাপ্পা বেরিয়ে এল ঘর থেকে। সোজা ছাদে উঠে গেছে।

বিশ্রী একটা পাতলা পাতলা অন্ধকারে ডুবে আছে চারদিক। মাঝে মাঝে এক-আধটা বাড়ি থেকে ঠিকরে আসছে ইনভার্টারের আলো। চতুর্দিকের কালোর মাঝে ওই ছোপ ছোপ আলো কী যে অশালীন লাগে! চিলচিৎকার করে একটা ইলেকট্রিক ট্রেন স্টেশন ছাড়ল। সাইকেল রিকশার স্রোত বিকট সুরে ভেঁপু বাজিয়ে চলেছে। চাপা কোলাহল বিজবিজ করছে বাতাসে।

এই কলকাতা শহরটাকে এতটুকু ভাল লাগে না বাপ্পার। শুধু ধোঁয়া, শুধু ধুলো, শুধু আবর্জনা! তার সঙ্গে চিটচিটে ভিড়, প্রায়স্থবির যানবাহন, ভাঙাচোরা রাস্তাঘাট, দিনরাত লোডশেডিং, মিটিং মিছিল আন্দোলন, রাস্তার ভিখিরি, নাছোড়বান্দা হকার, ফুটপাথের ঝুপড়ি! এই নরকে যে কী করে থাকে মানুষ! এই শহরে বাপ্পার জন্মটাই একটা অ্যাক্সিডেন্ট। পালাতে হবে বাপ্পাকে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পালাতে হবে এই শহর ছেড়ে।

নিজেদের এই বাড়িটার প্রতিও কণামাত্র টান অনুভব করে না বাপ্পা। তার কাছে বাড়ি মানে একটা ষাট বছরের পুরনো কাঠের মধ্যে ছোট ছোট কয়েকটা ভূখণ্ড। কোনও ভূখণ্ডে বাস করে এক ভিমরতিগ্রস্ত বৃদ্ধ, কোনওটাতে এক ক্লাউন, কোনওটাতে সদাব্যস্ত কর্মী, কোনওটাতে অকর্মণ্য মাতাল। তবু এদের মধ্যে সদাব্যস্ত কর্মীটিকেই যা একটু প্র্যাকটিক্যাল মনে হয় বাপ্পার। যদিও তার স্ত্রীটি একের নম্বরের আপনি-কোপনি টাইপ। কারুর সঙ্গে বিবাদে না গিয়ে দিব্যি মিষ্টি মুখে নিজের আখের গুছিয়ে চলেছে। নিজেদের জন্য দামি দামি খাবার, হালফ্যাশানের নিত্যনতুন ফার্নিচার, শৌখিন বিলাসের উপকরণ। শুধুই নিজেদের জন্য! তার সবেধন নীলমণি লাডলাটিকে বাদ দিলে থাকে আরও দুজন। একটা বোকাসোকা মেয়ে আর এক কঠিনমুখ নারী।

না। মা-বোনের প্রতিও তেমন কোনও জোরদার আকর্ষণ নেই বাপ্পার। কেন নেই, তা বাপ্পা নিজেই জানে না। জানার জন্য কখনও নিজেকে খুঁড়ে দেখার প্রয়োজনও বোধ করেনি বাপ্পা। বাড়ির পুরো পরিবেশটাই তার কাছে অসহনীয়।

ইদানীং আর একটা চিন্তাও হঠাৎ হঠাৎ বাপ্পাকে চিমটি কেটে উঠছে। চিন্তাটা গোপন, অতি গোপন। বলতে গেলে চিন্তাটা প্রায় অবচেতনার স্তরে লুকিয়ে থাকে। শুভাশিস আঙ্কল মা’র বিয়ের আগের বন্ধু, মানুষটাও খুব ভাল, বাপ্পাও তাকে অপছন্দ করার কোনও কারণ খুঁজে পায় না, বিপদে আপদে আঙ্কল চিরকাল তাদের সাহায্য করে আসছে, চেম্বার শেষ করে প্রায় দিনই বাড়ি ফেরার পথে তাদের খবর নিয়ে যায়, তিতির বাপ্পা মা বাবা সকলের জন্য তার সমান উদ্বেগ, কিন্তু কেন? এই কেনর উত্তর খুঁজতে গেলেই মস্তিষ্ক কেমন যেন বাগী হয়ে ওঠে, এক সুপ্ত বিষাদের চোরা স্রোতে ডুবে যেতে থাকে বাপ্পা। এই শহর, এই পরিবেশ আরও দুঃসহ হয়ে ওঠে।

চিঠিটা কি বাপ্পার জন্য কোনও আশা বয়ে এনেছে?

 কলেজের বন্ধু অনীকই প্রথম বাপ্পাকে সমুদ্রের ঠিকানাটা দিয়েছিল। সমুদ্রের ঠিকানা, না জাহাজের? পৃথিবীর বহু দেশের অজস্র জাহাজ এক দেশ থেকে অন্য দেশে পাড়ি দেয়, সমুদ্রপথে ঘুরে বেড়ায় গোটা পৃথিবী। সেই সব জাহাজের কোম্পানিগুলো বিভিন্ন দেশ থেকে নিয়মিত কর্মী নিয়োগ করে, ভারতবর্ষ থেকেও প্রচুর লোক নেয় তারা। এ সব চাকরিতে মাইনে অনেক। তাছাড়াও নাকি অঢেল সুযোগ সুবিধা আর অফুরন্ত আমোদ প্রমোদের ব্যবস্থা থাকে। জাহাজ কোম্পানিগুলোর প্রচুর এজেন্ট ছাড়িয়ে আছে ভারতে, বিশেষত বোম্বাই উপকুলে। কিছু কিছু এজেন্সির কলকাতাতেও পোস্টাল অফিস আছে। সেরকমই বেশ কয়েকটা অফিসের নাম ঠিকানা এনেছিল অনীক। তারপরই অফিসে অফিসে দুই বন্ধুর মিলিত অভিযান। তাদের মাধ্যমেই বোম্বাই অফিসে বায়োডাটা পাঠানো। অনীক বাপ্পা কারওই হায়ার সেকেন্ডারির রেজাল্ট খারাপ নয়, প্রয়োজনীয় সব রকম যোগ্যতাও আছে, তাদের দৃঢ় বিশ্বাস, কোথাও না কোথাও থেকে ডাক তারা পাবেই।

পরদিন বেশ উৎকণ্ঠা নিয়েই পোস্ট অফিসে গেল বাপ্পা। গিয়ে উৎকণ্ঠা আরও বেড়ে গেল। যে পিওনের কাছে চিঠিটি আছে, সে তখনও আসেনি, সে আজ তার বাড়িটির ইলেকট্রিক বিল জমা দিয়ে তবে আসবে। আজই বিল জমা দেওয়ার শেষ দিন, লম্বা লাইন পড়বে, কখন অফিসে পৌঁছবে ঠিক নেই, বাপ্পা যেন এগারোটার পরে আসে। নয়তো বিকেলে। নয়তো কাল। নয়তো পরশু। কেন একজন পিওন যথাসময়ে কাজে আসবে না, কেনই বা তার চিঠি অন্য কর্মচারীর কাছ থেকে পাওয়া যাবে না, এক্ষুনি যদি বাপ্পাকে জরুরি কাজে কাশ্মীর বা কন্যাকুমারিকা চলে যেতে হয় তাহলে ওই চিঠির কী হবে, এরকম ঝাঁক ঝাঁক কূট প্রশ্নে পোস্ট অফিসের লোকজনকে নাজেহাল করার চেষ্টা করল বাপ্পা, লাভ হল না। লোকগুলো এমন নিস্পৃহ মুখে বাপ্পার প্রশ্নগুলো শুনতে লাগল যে হাল ছেড়ে বাপ্পাকে বেরিয়ে আসতে হল ডাকঘর থেকে।

বাপ্পার হাতে এখন এক ঘণ্টার ওপর সময়, বাড়ি না ফিরে আর কি ভাবে সময় কাটানো যায়, ভাবছিল বাপ্পা। একবার অনীকের বাড়ি ঘুরে আসবে? দেখা যাক অনীক চিঠিটা পেল কিনা! নাকি ধীমানদের বাড়িতে ঢুঁ মেরে আসবে? ধীমান দুটো বন জোভি কিনেছে, যদি ক্যাসেট দুটো হাতানো যায়! রুন্টু সামার ভেকেশানে আই আই টি থেকে এসেছে, ওর সঙ্গে আড্ডা মেরেও একটা ঘণ্টা কাটিয়ে দেওয়া যায়। গোলপার্কের ঠেক-এও এখন দু-চারজনকে পাওয়া যেতে পারে। যাবে নাকি!

থাক গে, বাপ্পা কোথাও যাবে না। সব আড্ডাতেই তো সেই একই কথা, এক তর্ক, এক ঠাট্টারসিকতা। ফিলম খেলা রাজনৈতিক নেতাদের মুণ্ডুপাত আর গার্লফ্রেন্ড। একই চর্বিতচর্বণ। সবই এত একঘেয়ে! এত ক্লান্তিকর! তার চেয়ে প্ল্যাটফর্মের বেঞ্চিতে বসে ট্রেনের আনাগোনা দেখা অনেক বেশি বৈচিত্র্যময়। আর সময় তো বহতা নদী, সে তো কাটবেই।

প্ল্যাটফর্মে উঠতেই পিছন থেকে হাঁক। বিষ্ণুপ্রিয়া ডাকছে। হাতে গোছা পোস্টকার্ড। মুখে সাংঘাতিক ব্যস্ত ভাব।

–কোথায় যাচ্ছিস?

–কোথাও না। এমনিই।

–আমি জানি তুই কোথায় যাচ্ছিস। বালিগঞ্জ। এণাক্ষীদের বাড়ি। বিষ্ণুপ্রিয়ার চশমা সদাই নাকের ওপর নেমে আসে, আঙুল দিয়ে বার বার চশমা ঠেলে তোলা তার মুদ্রাদোষ। সেই কাজ করতে করতেই সে তীক্ষ্ণ চোখে পর্যবেক্ষণ করল বাপ্পাকে। খপ করে হাত চেপে ধরল, আজ তুই আমাদের বাড়ি চল।

অনুনয় নয়, আদেশ। বাপ্পা প্রমাদ গুনল। আড্ডার সঙ্গী হিসেবে বিষ্ণুপ্রিয়া মন্দ না, তবে মেয়েটার এক উদ্ভট শখ আছে। প্রতিটি টিভি কুইজের উত্তর পাঠানো। উদ্দেশ্য, মনোলোভা সব পুরস্কার জেতা। দু দিন গোয়াভ্রমণ! তিন দিন ম্যানিলা! চার দিন পাঁচ রাত নেপাল! সাত দিন নিউ ইয়র্ক! মারুতি গাড়ি! এক কেজি সোনা! দশ হাজার টাকার কসমেটিকস! নিদেনপক্ষে ফ্রিজ টিভি মিকসি! আরও নিদেনপক্ষে একটা দুটো অডিও ক্যাসেট কিংবা টিশার্ট! আজ পর্যন্ত বিষ্ণুপ্রিয়া অবশ্য একটা আলপিনও পায়নি। তার আগেই দেশের অন্য বিষ্ণুপ্রিয়াদের উত্তর হয়তো পৌঁছে যায় টিভিতে। কিন্তু বন্ধুদের জীবন উদ্ব্যস্ত হয়ে যায় বিষ্ণুপ্রিয়ার প্রশ্নবাণে। কবে দিল্লি প্রথম তৈরি হয়েছিল? শ্রবণবেলগোলায় কার অতিকায় মূর্তি আছে? স্ট্র্যাটোসফিয়ারের উচ্চতা কত? প্যালেজোয়িক এজ কবে থেকে শুরু? মধুবালার প্রথম তিনটি ফিল্মের নাম কি? শোলেতে গব্বর সিং কোন দিকে মুখ করে থুতু ফেলেছিল? প্রশ্নের পর প্রশ্নের ধাক্কায় বন্ধুরা জেরবার।

আজ বাপ্পা ধরা পড়ে গেল!

বিষ্ণুপ্রিয়ার পোস্টকার্ডের গোছার দিকে অসহায় মুখে তাকাল বাপ্পা, –আজ আমাকে ছেড়ে দে।

পুরুষছাঁট চুল ঝাঁকাল বিষ্ণুপ্রিয়া, একদিন নয় এণাক্ষীদের বাড়ি না গিয়ে আমার বাড়িতেই গেলি। অবশ্য তোর যদি ভাল না লাগে তো আলাদা কথা।

–বিলিভ মি বিষ্ণুপ্রিয়া, আমি এণাক্ষীদের বাড়ি যাচ্ছি না, আমার কাজ আছে।

—কী কাজ?

–আছে। পারসোনাল।

 –আমাকে বলা যায় না? বিষ্ণুপ্রিয়া চোখে চশমা ঠেলল, –কোথায় তোর কাজ? প্ল্যাটফর্মে?

–না, এই কাছেই। পোস্ট অফিসের কথাটা এড়িয়ে গেল বাপ্পা।

-তুই আমাকে কাটাতে চাইছিস? আমি নয় এণাক্ষীর মতো নেকু নেকু কথা বলতে পারি না, আহ্লাদী আহ্লাদী হাসতে পারি না…

বলছি কাজ আছে, এর মধ্যে এণাক্ষী আসে কোত্থেকে?

 –এণাক্ষীর নামে কিছু বললে তোর গায়ে ফোস্কা পড়ে, না?

বাপ্পা হেসে ফেলল, তুই এত জেলাস কেন রে? এণাক্ষী না তোর ছোটবেলার বন্ধু?

বন্ধু না হাতি। সিম্পলি ক্লাসমেট। ওরকম পুরুষচাটা মেয়ে আমার বন্ধু হয় না।

–দাঁড়া এণাক্ষীকে বলব, তুই ওর নামে কি বলিস।

বল গে যা। আই কেয়ার আ ফিগ। ওর স্কুলের কেচ্ছা তো সব্বাই জানে। দীপাঞ্জনের সঙ্গে…ছিঃ। বিষ্ণুপ্রিয়া অন্য দিকে মুখ ঘোরাল, –যাক গে, তুই যাবি আমার সঙ্গে?

বাপ্পা গম্ভীর হল, –তোর তো এখন বাড়ি ফাঁকা। মাসিমা মেসোমশাই অফিস বেরিয়ে গেছে..

–সো হোয়াট? তোর কি ধারণা তোকে আমি সিডিউস করতে নিয়ে যাচ্ছি? বিষ্ণুপ্রিয়া চোখ টিপল, –আমরা কিছু কুইজ সলভ করতে পারি। পারি কিনা?

বাপ্পা অস্বস্তিভরা মুখে চারদিকে তাকাল। প্ল্যাটফর্মে অফিসযাত্রীদের থোকা থোকা ভিড়, খানিক তফাতে কয়েকজন মধ্যবয়স্ক লোক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই তাস খেলছে। দুই বৃদ্ধ সিমেন্টের বেঞ্চিতে বসে হাত পা নেড়ে তর্কে মগ্ন। খালি ঝুড়ির ওপর আয়েশ করে বসে গুলতানি করছে এক দল ভেণ্ডার। মহিলা যাত্রীরা ঘন ঘন ঘড়ি দেখছে, তাদের উদ্বিগ্ন চোখ বার বার লাইনের দিকে। কেউই কথাতে বড় বেশি হামা বাড়িতে আজকাল কেয়াটা কমে এসেছে। কম বাপ্পা বিষ্ণুপ্রিয়ার দিকে দেখছে না।

 তবু যে কেন বাপ্পার বুকে গুড়গুড় ভাব?

বিষ্ণুপ্রিয়াদের বাড়ি আগে প্রায়ই যেত বাপ্পা। উচ্চ মাধ্যমিক থেকে তারা পরস্পরের সহপাঠী, ভাল নোটস তৈরি করার সুনাম আছে বিষ্ণুপ্রিয়ার, নোটস দেওয়া নেওয়া ছাড়াও অনেক বিষয়ে তুমুল আড্ডা জমত দুজনের। সম্প্রতি বাপ্পার যাওয়াটা কমে এসেছে। কমাটা ঠিক বান্ধবীর উদ্ভট শখের কারণে নয়। একা বাড়িতে আজকাল কেমন বদলে যায় বিষ্ণুপ্রিয়া। অতি সামান্য সামান্য কথাতে বড় বেশি হাসে, ঈষৎ রুক্ষ মুখশ্রীতে চকিতে নেমে আসে কমনীয়তার ঢল, বিষ্ণুপ্রিয়ার আপাত চঞ্চল চোখ ভরে ওঠে অচেনা লাবণ্যে। সেই দণ্ডে বিচিত্র এক সিরসিরানি ছড়িয়ে পড়ে বাপ্পার শরীরে। সঙ্গে এক চোরা ত্রাসও।

বাপ্পার কি ভাল লাগে! নাকি খারাপ লাগে! বাপ্পা বোঝে না।

 দ্বিধান্বিত মুখে বাপ্পা বলল, –না গেলে কি খুব রেগে যাবি? তুই তো এখনই কুইজ নিয়ে…আমার জি কে খুব পুওর রে বিষ্ণুপ্রিয়া। পাকিস্তানের রাজধানীর নামই আমার মনে পড়ে না ..

–থাক বুঝেছি। বিষ্ণুপ্রিয়ার মুখে রহস্যময় হাসি, তুই তোর কাজে যা।

 ধীর পায়ে চলে যাচ্ছে বিষ্ণুপ্রিয়া। রেললাইনের গায়েই তার বাড়ি, লাইন পার হওয়ার সময় একবার পিছন ফিরে তাকাল।

অপসৃয়মান বিষ্ণুপ্রিয়াকে ফিরে ডাকতে তীব্র বাসনা জাগছিল বাপ্পার। ক্ষণিকের বাসনা দমিয়ে আনমনে ফিরল পোস্ট অফিসের সামনে।

জনা তিনেক পিওন যন্ত্রবৎ ছাপ মেরে চলেছে চিঠিতে, কর্মচারীরা ক্ষিপ্র হাতে ছোট ছোট কাঠের খোপে ছুঁড়ে দিচ্ছে চিঠিগুলো, তাদের নিপুণ হস্তচালনা এক দৃষ্টে দেখছিল বাপ্পা। অথবা সে কিছুই দেখছিল না।

এগারোটা নয়, বাপ্পার পিওন এল সাড়ে এগারোটায়। সইসাবুদ সেরে লম্বা বাদামি খাম হাতে পোস্ট অফিস থেকে যখন বেরোল বাপ্পা, সূর্য তখন মাঝগগনে। ঝলসাচ্ছে।

বুকের ভেতর নীল সমুদ্রের কল্লোল শুনতে পাচ্ছিল বাপ্পা। বার বার চিঠিটা দেখেও আশ মিটছে না। চিঠির মাথায় জ্বলজ্বল করছে প্রেরকের নাম। পাতা জুড়ে ফুটে আছে সাগরের ডাক। দি ওশান লাইনার্স। বম্বে। ইন্টারভিউ। দশই জুলাই।

মাঝে আর মাত্র সতেরোটা দিন!

আচমকা বাপ্পার বুকটা ধক করে উঠল। মা তাকে যেতে দেবে তো!

.

১৩.

সকাল থেকে পর পর তিনখানা অপারেশান ছিল শুভাশিসের। তিন পৃথক পৃথক নার্সিংহোমে। হ্যাপিহোম, টোটাল কিওর, ব্লু হেভেন। দুটো অ্যাপেনডিসেকটোমি আর একটা হার্নিয়া অপারেশান। এইসব অপারেশানে ঝুঁকি কম, টাকা আসে হুড়হুড়। তৃতীয় দফা অস্ত্রধারণের পর বেলা দেড়টা নাগাদ অপারেশান থিয়েটার থেকে বেরিয়েছে শুভাশিস, ডাক্তারদের কক্ষে বসে সবে একটু জিরোচ্ছে, তখনই ব্লু হেভেনে ফোন এল ছন্দার।

–অ্যাই শুনছ? দুরন্ত খবর! টোটো দারুণ রেজাল্ট করেছে।

ও.টি থেকে বেরোনোর পরমুহূর্তে শুভাশিস কাটাছেঁড়ার কথা ভুলে যায়, তবে শরীর আর মগজের পরিশ্রান্তি রয়ে যায় বেশ কিছুক্ষণ, মাথা অবশ হয়ে থাকে।

শুভাশিস ছন্দার কথা ঠিক অনুধাবন করতে পারল না, কীসের রেজাল্ট?

-আশ্চর্য! সকালে শুনে গেলে টোটোর আজ মাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরোবে, খবরের কাগজের ফার্স্ট পেজে দিয়েছে…

–ও হ্যাঁ, সরি। কত পেয়েছে?

–গেস করো! খুশিতে ফুটন্ত ছন্দা যেন জটিল হেঁয়ালি ছুঁড়ছে।

–স্টার তো পাবেই। চার চারটে টিচার খেটেছে পেছনে। শুভাশিস বাঁ আঙুলে শার্টের দুটো বোতাম খুলে দিল, কত পেল? এইট্টি পারসেন্ট?

হল না। আরও ওঠো।

–এইটি ফাইভ?

–আরেকটু ওঠো।

কত উঠতে হবে রে বাবা! প্রায় দেড় যুগ ধরে শুভাশিস তো খালি উঠেই চলেছে! বিত্তে। বাসনায়। যশে। প্রতিপত্তিতে। তবু তাকে আরও উঠতে বলে ছন্দা!

শুভাশিস খানিকটা লঘু সুরে বলল, পাগলা কি র‍্যাঙ্ক-ফ্যাঙ্ক পেয়ে গেল নাকি?

–পেতে পারে। এইট্টি সেভেন পারসেন্ট সিকিওর করেছে, বুঝেছ? সাতাশি পারসেন্ট। সাত সাতটা লেটার। টোটোদের স্কুলে টোটো সেকেন্ড হায়েস্ট।

ইজ ইট! শুভাশিস খুব বেশি অবাক হতে জানে না। তার পেশা তার বিস্ময়বোধ কেড়ে নিয়েছে। তবু বিস্ময়সূচক ধ্বনিই ঠিকরে এসেছে গলা থেকে, দাও পাগলাকে দাও, ওকে একটু কনগ্রাচুলেট করি।

ও কি এখন বাড়িতে থাকার ছেলে নাকি? রেজাল্ট জানিয়ে লাফাতে লাফাতে বন্ধুদের সঙ্গে বেরিয়ে গেল। ছন্দার হাসিতে জলতরঙ্গ বাজছে, বাড়ি ফিরে আমাকে জড়িয়ে ধরে আমার ছেলের নাচ যদি দেখতে!

–তুমিও তো নাচছ।

–নাচবই তো। আমার ছেলের জন্য ষোলো বছর ধরে আমি কম খাটছি?

মাথার অবশ ভাব যাচ্ছে না কিছুতেই। এমন সময়ে কোনও আনন্দই পূর্ণ উচ্ছ্বাস আনে না। তার মাঝেও আমার ছেলে শব্দবন্ধটি খুট করে কানে বেজেছে। রিসিভার ঘাড়ে চেপে নিপুণ কৌশলে সিগারেট ধরাল শুভাশিস। ঠাণ্ডা গলায় বলল, –তোমার পরিশ্রম কে অস্বীকার করছে? তবে সব ক্রেডিটই তুমি একা নিয়ো না। টোটোর জন্য যে চারজন টিউটর ছিল তাদেরও একটু ভাগ দিয়ো। তারপর ধরো জেনেটিক ফ্যাক্টর বলেও একটা ব্যাপার আছে। আমি শুভাশিস সেনগুপ্ত, আমার বাবা শিবসুন্দর সেনগুপ্ত, এরাও তো লেখাপড়ায় এমন কিছু ফ্যালনা ছিল না। এদের ব্রেনের কিছুটা কি আর টোটো ইনহেরিট করেনি।

–জ্ঞান মারা ছাড়ো। কিচ্ছু ইনহেরিট করেনি। ও আমার ছেলে। শুধু মাদার্স সান।

 –অলরাইট অলরাইট। আমি শুধুই পোশাকি বাবা।

— হ্যাঁ তাই। মুহূর্তের রুক্ষতা কমে ছন্দার গলায় আদুরে ভাব ফিরেছে, আমি কিন্তু একটা পার্টি দেব।

–দিয়ো।

মিনিমাম একশোজনকে ইনভাইট করব।

 –কোরো।

–কোরো তো বলছ, তখন কিন্তু আবার কিপটেমি কোরো না। আমি প্রাণ খুলে খরচা করতে চাই।

–আমাকে অ্যাদ্দিন দেখেও কি তোমার খুব কিপটে বলে মনে হয়?

–কিপটেই তো। সব ব্যাপারে কিপটে। সময়ের ব্যাপারে। ভালবাসার ব্যাপারে।

কী করলে প্রমাণ হবে আমি কিপটে নই?

বলব? করবে?

–হুকুম করেই দ্যাখো।

–আজ সন্ধেবেলা তাড়াতাড়ি চলে এসো।

এসে?

–আমরা তিনজন মিলে হইচই করব। টোটোকে বাইরে ডিনার খাওয়াব। তারপর মাঝরাত অবধি একটা জয়রাইড…

ব্যস এইটুকুন? এতেই খুশি? শুভাশিস সিগারেটে লম্বা টান দিল, ধোঁয়া ছাড়ল বুক খালি করে, শ্রান্ত শরীরে যথাসম্ভব প্রাণ আনার চেষ্টা করল, কোথায় খাবে? পার্ক? গ্র্যান্ড? হিন্দুস্থান ইন্টারন্যাশনাল? বলো তো টেবিল বুক করে দিচ্ছি।

–সে টোটো এসে ডিসাইড করবে। তুমি কটায় ফিরছ?

–সাড়ে আটটা। বড় জোর নটা।

কথাটা মনে রেখো। দেরি করলে টোটো কিন্তু খুব হার্ট হবে।

–ও কে বস।

 শুভাশিস টেলিফোন ছেড়ে দিচ্ছিল, ছন্দা আবার বলল, শোনো শোনো, আরেকটা কথা। বাবাকে কী করে মাধবপুরে খবর পাঠানো যায় বলো তো?

শুভাশিস ভাবল একটু, মনে হয় খবর পাঠানোর দরকার হবে না। তুফানই আজকালের মধ্যে এসে যাবে। তুমি বরং জলপাইগুড়িতে একটা ফোন করে দাও।

–আমার বাপের বাড়ি নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। আমার যাকে যা জানানোর জানিয়ে দিয়েছি। জামাইবাবুকেও অফিসে ফোন করে দিয়েছি। দিদি জামাইবাবু সন্ধেবেলা আসতে পারে।

–একেই বলে গুছোনো গৃহিণী।

–অনর্থক তেল মেরো না। নিজের কর্তব্যের কথা খেয়াল রাখো। টোটোকে তো আমাদের একবার মাধবপুর নিয়ে যাওয়া উচিত, কী বলো?

–হুঁ। দেখি যদি পারি তো রোববারই… শুভাশিস ফোন রেখে দিল। কী একটা কথা যেন চক্রাকারে ঘুরছে মাথায়, অথচ মনে আসছে না। কি কথা? ছন্দাকে কী কিছু বলার ছিল? অথবা সদ্য সেরে আসা অস্ত্রোপচার সম্পর্কে কোনও নির্দেশ দেওয়ার ছিল সিস্টারকে? নাকি কোনও জরুরি অ্যাপয়েন্টমেন্ট ভুলে যাচ্ছে সে?

আলোর গতিতে আজকের বাকি দিনটাকে পড়ে নিতে চাইল শুভাশিস। এখান থেকে সোজা একবার গলফভিউ নার্সিংহোমে যেতে হবে, ওখানে দুটো পেশেন্ট আছে। সকালে রাউন্ডে যাওয়ার কথা ছিল, হয়ে ওঠেনি। ওখানে আজ অরূপও আসবে, ঠিক চারটেয়। দুজনে মিলে নিজেদের নার্সিংহোমের জন্য বিকেলে একটা বাড়ি দেখতে যাওয়ার কথা। তারপর ছটায় বেকবাগান পলিক্লিনিক। আর কিছু? আর কিছু?

নার্সিংহোমের কর্মচারী টেবিলে ধোঁয়া ওঠা কালো কফি রেখে গেছে, সঙ্গে প্লেটভর্তি নোনতা বিস্কুট। কাজের ফাঁকে ফাঁকে কালো কফি আর সিগারেটই শুভাশিসের সঞ্জীবনী। সকালে বড়জোর দু পিস স্যান্ডুইচ, একটা আধসেদ্ধ দিশি মুরগির ডিম আর এক কাপ চা খেয়ে বেরোয় সে। ভরাপেটে কাজকর্ম করতে অসুবিধা হয় তার। ক্ষিদে ক্ষিদে ভাবটাই শরীরকে অনেক ঝরঝরে রাখে, মনঃসংযোগে সুবিধা হয়, আঙুলেরা ক্রীতদাসের মতো সাড়া দেয় ছুরিকাঁচির আহ্বানে।

কফিতে চুমুক দিয়ে শুভাশিস আর একটা সিগারেট ধরাল। টোটোর এত বড় একটা খুশির খবরও শরীরকে ঠিক তেমনভাবে উজ্জীবিত করতে পারছে না, মাথা থেকে পাহাড়ি জোঁক ছাড়ছে না কিছুতেই।

অথচ এমনটি তার হওয়ার কথা নয়। তার শরীরের খাঁচা যথেষ্ট মজবুত, সহজে কোনও রোগব্যাধি কাছে ঘেঁষে না, অসুরের মতো খাটার অভ্যাসও তার বহুদিনের। এম এস করার পর প্রথম প্রথম দিনে দশ-বারো ঘণ্টা পর্যন্ত অপারেশন থিয়েটারে কাটিয়েছে শুভাশিস। নিজের হাতে দু-একটা ছোটখাট কাটাছেঁড়া করা ছাড়া বেশির ভাগই তখন ছিল সিনিয়ার ডাক্তারদের সাহায্য করার কাজ। তখন ছিল শেখার দিন, আর তাই মনঃসংযোগেরও প্রয়োজন হত অনেক বেশি। চোখ কান মাথা এক করে সিনিয়ারদের ছুরিকাঁচি চালানোর টেকনিক রপ্ত করার প্রয়াস বিস্তর ব্যায়াম করাত মগজকে। শরীরকেও। তখনও ক্লান্তি নামত রক্তমাংসের দেহে, স্নায়ু বিদ্রোহ করে উঠত, সাইরেন বাজত মস্তিষ্কে। তবে সেই ক্লান্তির প্রকৃতি ছিল যেন অন্য রকম। একচিলতে অবকাশেই কোষ তাজা হয়ে যেত। টগবগে ঘোড়ার মতো আবারও ট্র্যাকে নেমে পড়ত শুভাশিস।

আর এখন মাত্র তিন-চার ঘণ্টা অপারেশান ঘরে উপস্থিতি, তাও সঙ্গে সহকারী, এতেই যে কী বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে শরীর!

তবে কি শুভাশিসের যৌবন গোপনে ফুরিয়ে এল!

নার্সিংহোমের অফিসক্লার্ক ফাইল হাতে ঘরে এসেছে, কয়েকটা ভাউচার সই করার ছিল স্যার।

শুভাশিস ছাইদানে সিগারেট গুঁজল, দিন। কত তারিখ পর্যন্ত আছে?

—ফিফটিনথ জুন স্যার।

ভাউচারে পরপর সই মারল শুভাশিস। কম্পিউটার-চোখে টাকার অঙ্ক যোগ করে নিল। পনেরো দিনে মোট চব্বিশ হাজার। অর্ধেক ক্যাশ, অর্ধেক চেক। অ্যামাউন্টটা মন্দ নয়!

চেক আর ক্যাশের কৃত্রিম উত্তেজক খামগুলো ব্রিফকেসে ভরে শুভাশিস এবার যেন খানিকটা চনমনে হয়েছে। আলগাভাবে বলল, আপনাদের একটু ব্যাকলগ চলছে মনে হচ্ছে?

অডিট চলছিল স্যার, তার জন্যই…। নেক্সট উইক থেকে আপ-টু-ডেট হয়ে যাবে।

–দ্যাটস ফাইন।

–আপনি তো স্যার আজ এখানেই লাঞ্চ করবেন?

ও শিওর।

লোকটা চলে যাওয়ার পর দ্রুত আর একটা সিগারেট শেষ করে শুভাশিস উঠল। আজকের অস্ত্রোপচারের কেসটি ছাড়াও এখানে তার আরও দুজন রুগী আছে, সহকারী সঙ্গে নিয়ে ঝড়ের গতিতে দেখে নিল তাদের। একজনের প্রেসক্রিপশান বদলাল সামান্য, সই করল অন্য জনের রিলিজ অর্ডারে, কবে আবার তার চেম্বারে চেক-আপে আসতে হবে তার তারিখও লিখে দিল। হাতের কাজ সেরে আবার যখন তার নির্দিষ্ট ঘরে ফিরল, তখন টেবিলে খাবার এসে গেছে।

 বোধহীন মুখে খেয়ে চলেছে শুভাশিস। রাত্রি তার ভরপেট আহারের সময়, এখন শুধু পাকস্থলীতে খাদ্য ফেলার নিয়ম বজায় রাখা। চোদ্দশো স্কোয়্যার ফিট ফ্ল্যাটের অধীশ্বর শুভাশিস সেনগুপ্ত, পাশের ব্রিফকেসে হেলায় চব্বিশ হাজার টাকা ছড়িয়ে রাখা ডক্টর শুভাশিস সেনগুপ্ত বর্ণহীন ঝোল থেকে বিস্বাদ মুরগি তুলে চিবোচ্ছে, চামচে করে মুখে তুলছে টক দই, কচকচ কামড় দিচ্ছে শশায়। খাওয়ার ভঙ্গিটি যেন তার নিজস্ব নয়, যেন অবিকল তার মা মনোরমার। নির্বিকার যান্ত্রিক গলাধঃকরণ। খেতে খেতে অভিব্যক্তিহীন চোখ চতুর্দিকে ঘুরছে। দেওয়ালে এসে স্থির হল। ক্যালেন্ডারে লোলজিহ্বা শ্মশানকালী। কালী নয়, বুঝি মহাকাল। ছবিটার দিকে তাকিয়ে আছে শুভাশিস। তাকিয়েই আছে। হঠাৎই তরঙ্গ কেঁপে উঠল শিরদাঁড়ায়।

আজ তো তিতিরেরও রেজাল্ট বেরিয়েছে!

কেমন রেজাল্ট করল তিতির?

তিতিরও কি হাসছে? লাফাচ্ছে? নাচছে? টোটোর মতো?

বুকের গভীরে চক্রাকারে ঘুরন্ত কথাটা আবিষ্কার করে ফেলেছে শুভাশিস! ভাবতেই এক মুক্তির অনুভূতি! খাওয়া ফেলে ক্ষিপ্র হাতে শুভাশিস টেলিফোন ছুঁল। পরক্ষণে সরিয়ে নিয়েছে হাত। ও বাড়ির টেলিফোনটা কি ঠিক হয়েছে? পরশুও তো…! কি ভেবে আবার রিসিভার তুলে নম্বর টিপল। বাজছে। বেজেই যাচ্ছে। বিকল দূরভাষ শব্দঝঙ্কার ফিরিয়ে দিচ্ছে শুভাশিসকে।

শুভাশিসকে ফিরিয়ে দিচ্ছে ইন্দ্রাণী!

কী করে যে এক্ষুনি তিতিরের খবর পাওয়া যায়?

শুভাশিস চামচ নিয়ে নাড়াচাড়া করল খানিকক্ষণ, একটি খাদ্যকণাও মুখে তুলতে পারল না। অস্থির চোখে ঘড়ি দেখল। দুটো চল্লিশ। এই মুহূর্তে কোথাও নড়বার উপায় নেই। গলফভিউতে যেতেই হবে এখন। যারা নার্সিংহোমে অনেক টাকা খরচ করে আসে, তারা ডাক্তারদের কাছে পেশাদারি দায়িত্ব আশা করবে, এটাই তো স্বাভাবিক।

বাইরে বেরিয়ে মারুতিতে স্টার্ট দেওয়ার আগে ক্ষণকাল আকাশ দেখল শুভাশিস। পশ্চিমে হেলে দাঁড়িয়ে আছে বিষণ্ণ সূর্য। গায়ে মেঘের মলিন অ্যাপ্রন।

.

অরূপ বলল, — শালু কাল একটা কথা বলছিল, বুঝলি?

স্টিয়ারিং-এ বসা শুভাশিসের গম্ভীর চোখ সামনের দিকে স্থির ছিল, সামান্য ঘুরল শুধু।

অরূপ বলল, শালুর মতে আমাদের নার্সিংহোমে একটা প্যাথলজিকাল ল্যাবরেটরিও থাকা উচিত।

–তাতে কিরকম মিটার চড়বে খেয়াল আছে?

কত আর। এক্স-রে মেশিন না বসালে বড়জোর চার-পাঁচ লাখ।

–তুই এস্টিমেট করেছিস?

–না, তেমন ডিটেলে কিছু করিনি, তবে ওর মধ্যে হয়ে যাবে মনে হয়।

–কেন আবার ফালতু ঝামেলা বাড়াচ্ছিস? আরও স্টাফ লাগবে, প্যাথোলজিস্ট লাগবে… তার চেয়ে কোনও একটা ক্লিনিকের সঙ্গে পারমানেন্ট অ্যারেঞ্জমেন্ট করে নিলেই তো হয়। মাস গেলে কমিশনও চলে আসে, দায়দায়িত্বও থাকে না…

–নিজেদের ল্যাব থাকলে রেপুটেশন বাড়ে। আর তাছাড়া এখানে কমিশনের তো ব্যাপারই নেই, সবটাই লাভ। আমাদের ব্যাচের দীপককে প্যাথোলজিস্ট হিসেবে নিয়ে নিতে পারি।

–অ্যাজ এ পার্টনার?

–নো। উইল পে হিম।

শুভাশিস চুপ করে গেল। গলফভিউতে মেট্রনের ওপর চেঁচামেচি করে মাথাটা এখনও টিপটিপ করছে। কোথায় কোন রুগীর বিছানায় সামান্য নোংরা দাগ রয়েছে, তার জন্য এত মাথা গরম করার কি যে দরকার ছিল! নিজেদের নার্সিংহোম হলে অবশ্য ওইটুকু দাগও থাকতে দেবে না শুভাশিস। সিগারেট ধরিয়ে চলন্ত গাড়ির জানলা দিয়ে কাঠি ছুঁড়ল অরূপ, – কি রে, কিছু বলছিস না যে?

কী বলব? –

-এগ্রি করছিস, না ডিসএগ্রি করছিস?

শালিনীর যখন ইচ্ছে করেই ফ্যাল। কিন্তু ছোট করে। নো এক্সটারনাল কেস, শুধু নার্সিংহোমের পেশেন্টদের জন্য।

–অফকোর্স। শালুও তো তাই চায়। পরে যদি বাড়ানো যায়…।

ট্রামলাইন টপকে দেশপ্রিয় পার্কের পাশের গলিতে ঢুকেছে শুভাশিস। পাশে একটা মেয়েদের স্কুলের গেটে রাশ রাশ বালিকার জটলা। কিছু উদ্বিগ্ন অভিভাবকও ঘোরাফেরা করছে সামনে। সাবধানে জায়গাটা পার হতে গিয়ে হঠাৎই শুভাশিসের চোখ চলে গেছে ডানদিকের ফুটপাথে। নতমুখে এক কিশোরী চোখ মুছছে, সঙ্গে সম্ভবত তার বাবা। সান্ত্বনা দিচ্ছে মেয়েকে। চকিতে বিচিত্র এক উদ্বেগে ঢিপঢিপ করে উঠল শুভাশিসের বুক। অপাঙ্গে দেখল অরূপকে। নিশ্চিন্ত মুখে সিগারেট খাচ্ছে। টোটোর রেজাল্টটা কি বলবে অরূপকে? থাক, অরূপের যখন রেজাল্ট বেরোনোর বিষয়টা মাথাতেই নেই, বুঝতেও পারেনি, তখন আর কেন প্রসঙ্গটা তুলে অকারণ এক উচ্ছ্বাসের মুহূর্ত গড়ে তোলা?

আচমকা অরূপ চেঁচিয়ে উঠল– থাম থাম, কোথায় যাচ্ছিস? আমরা তো এসে গেছি।

চমকে রাস্তার ধারে গাড়ি পার্ক করল শুভাশিস। পাশেই ছোট্ট কেতাদুরস্ত অফিস। গ্যারেজঘর। কাচের দরজা। প্লাস্টিকের চেয়ার টেবিল। বাড়িভাড়া পাত্রপাত্রী জমিজমা থেকে শুরু করে গৃহশিক্ষক, ছোটখাট চাকরি সব কিছুই মেলে এখানে। ফুটপাথ থেকেই দেখা যায় ভেতরে একটি মেয়ে টাইপ করে চলেছে খটখট।

অরূপ বলল, নামবি নাকি?

শুভাশিস অন্যমনস্কভাবে সিটে হেলান দিল, — নাহ, তুই ডেকে নিয়ে আয়।

ডাকতে হল না, দুই ডাক্তারকে দেখে এজেন্সির মালিক নিজেই বেরিয়ে এসেছে। নিভাঁজ প্যান্টশার্ট পরা মধ্যবয়সী লোকটা বিগলিত মুখে জানলায় উঁকি দিল, এক্ষুনি যাবেন তো স্যার?

অরূপ বলল, – বাড়িটা এখন দেখা যাবে তো?

–অবশ্যই স্যার।

–তাহলে পেছনে উঠে পড়ুন। কদ্দূর?

 –এই তো কাছেই।

গাড়ি স্টার্ট নিতেই এজেন্সির মালিকের ছদ্মবেশ ঝেড়ে ফেলে নিছক দালাল রূপে বিকশিত হয়েছে লোকটা। অরূপ আর শুভাশিসের মাঝখান দিয়ে মাথাটা প্রায় গলিয়ে দিয়েছে, এই বাড়িটা দেখলে আর স্যার চোখ ফেরাতে পারবেন না। পছন্দ এবার হতেই হবে।

অরূপ ধমকের সুরে বলল, সে তো আপনি যে বাড়ি দেখাচ্ছেন সে বাড়ি সম্পর্কেই এক কথা বলছেন।

লোকটা জিভ কাটল, এ সে জিনিস নয় স্যার, একেবারে নার্সিংহোমের জন্যই তৈরি। শুধু রুগী এসে শুয়ে পড়লেই হয়। কী সব ঘর! কী দারুণ লন! কতটা জায়গা! যা একটা গাড়িবারান্দা আছে না স্যার, আপনারা পর পর মারুতি সাজিয়ে রাখতে পারবেন।

-মারুতি তো ঢুকবে, অ্যাম্বুলেন্স ঢুকবে তো?

লজ্জা দিলেন স্যার। অ্যাম্বুলেন্স কি বলছেন, লাইন পাতলে ই এম ইউ লোকাল পর্যন্ত ঢুকে যাবে।

অন্যদিন হলে শুভাশিস লোকটার সঙ্গে ছোটখাট রসিকতা জুড়ত, আজ কেমন যেন উৎসাহ পাচ্ছে না। সৌভাগ্যক্রমে বাড়িটা কাছেই, এসে গেল চটপট। এবং আশ্চর্যের বিষয়, দালালটির কথা খুব একটা মিথ্যে নয়। বাড়িটা একটু পুরনো হলেও বেশ প্রকাণ্ড। একতলা দোতলা মিলিয়ে গোটা আষ্টেক ঘর। সাহেবি আমলের পেল্লাই পেল্লাই সাইজের। দুটো তলাতেই দুখানা করে বিশাল বিশাল বারান্দা, লনটাও খুব একটা ছোট নয়, গাড়িবারান্দায় ট্রেন না ঢুকলেও লরি ঢুকে যাবে তাতে সন্দেহ নেই। দুপাশে দুটো গেটও আছে। সব থেকে বড় কথা বাড়িটা একদম বড় রাস্তার ওপর। বাড়ির মালিক দুই ভাই কানাডায় থাকে, তাদের হয়ে এক বিহারি কেয়ারটেকার দেখাশুনো করছে বাড়িটার। সাইজের তুলনায় ভাড়াও বেশ কম। মাত্র বারো হাজার। সঙ্গে এক লাখ অ্যাডভান্স। বহিরঙ্গের ভোল পাল্টানোর খরচ।

মোটামুটি পছন্দ হলেও শুভাশিস ঠিক তক্ষুনি হ্যাঁ বলল না, গাড়িতে বসে দালাল কাম মালিক লোকটিকে ডাকল– তাহলে দত্তবাবু, আমরা নেক্সট মানডে আসছি।

–আজই একটা টোকেন অ্যাডভান্স করে গেলে ভাল হত না স্যার? অনেক পার্টি ঘুরছে… আপনাদের ফ্ল্যাগটা পোঁতা থাকলে…

অরূপ ধমকাল, — বলছি না সোমবার আসছি! আপনি আবার লোভে পড়ে সাতজনকে দেখিয়ে বেড়াবেন না।

না, না, সে কী কথা! আপনাদের ছেড়ে অন্য কাউকে… দত্তবাবু বিনয়ের অবতার, – স্যার, আমাকে আজ কিছু..

–আপনার এজেন্সিতে তো টাকা দেওয়া আছে!

–এজেন্সির টাকা স্যার এজেন্সির ঘরে চলে যায়। ওভাবে একটা অফিস মেইনটেন করা…

–ঠিক আছে, ঠিক আছে। অরূপ একটা পঞ্চাশ টাকার নোট বার করে দিল, – শাইন মারা অফিস খুলে বসেছেন… লেডি টাইপিস্ট… ছোঁক ছোঁক করার অভ্যেসটা তবু গেল না!

লোকটা হেঁ হেঁ করতে করতে চলে গেল।

ভিড় পথে শামুকের গতিতে এগোচ্ছে গাড়ি। শুভাশিস জিজ্ঞাসা করল, তোকে এখন কোথায় ড্রপ করব?

–তুই এখন কোনদিকে যাবি?

–বেকবাগান। ছটায় আজ পলিক্লিনিক আছে।

–আমাকে তাহলে মিন্টো পার্কে নামিয়ে দে। অরূপ অলসভাবে সিগারেট ধরাল, — আছিস ভালো। পলিক্লিনিক! চেম্বার! একদম জাল বিছিয়ে বসে আছিস, অ্যাঁ? বলতে বলতে খিকখিক হাসছে, উইকে একদিন গড়িয়ার চেম্বারে বসছিস, একদিন শ্যামবাজার চেম্বারে, পুরো নর্থ সাউথ একেবারে গ্রিপে, কি বলিস!

মনের ভেতর শুঁয়োপোকার নড়াচড়া, তবু বিদ্রূপ ফেরত পাঠানোর সুযোগ হাতছাড়া করল না শুভাশিস। মুখে হাসি এনে বলল, – আর তুই যে শালা হসপিটালের আউটডোর থেকে নিজের চেম্বারে বাচ্চা তুলে আনছিস, তার বেলা? এর সঙ্গে শালিনী যেখানে যা ডেলিভারি করে বেড়াচ্ছে সব বেবিই তো তোর!

অরূপ চোখ টিপল, মা বাবারা আজকাল চেম্বারই প্রেফার করে। আর তুইই বল, হসপিটালে কি ঠিকমতো বেবিদের ট্রিটমেন্ট করা যায়? হসপিটাল মানেই কিলবিল কিলবিল!

–আআ, চেম্বারে কিলবিল করলে ক্ষতি নেই, তাই তো? অরূপের হাত থেকে সিগারেট নিয়ে টান মেরে নিল শুভাশিস, আমার তো চেম্বারে ভাই একটা দুটোর বেশি পেশেন্ট আসে না।

–ওই একটা দুটোই তো খাজানা ভরে দিচ্ছে রে শালা। তোর হাতে পড়লেই তো চার হাজার গলে গেল। তারপর ধর যদি তেমন নধর মুরগা হয়… অরূপ হা হা হাসছে, যাক গে, বাজে কথা ছাড়। এই বাড়িটা নেওয়াই ফাইনাল তো? তাহলে কাল একবার শালুকে দেখিয়ে নিয়ে যাব।

বাড়িটা একটু বেশি পুরনো না? কেমন একটা স্যাঁতসেতে ভাব!

–স্যাঁতসেতে নয়, একে বলে শীতল পরিবেশ। ন্যাচারাল এয়ার কুলিং সিস্টেম। দোনামোনা করিস না, রাজি হয়ে যা। বাড়িটার সব থেকে বড় প্লাস পয়েন্টটা লক্ষ করেছিস? কাছেই অত বড় একটা হসপিটাল…।

–তাতে আমাদের কী এল গেল?

–তুই শালা একটা আস্ত গাড়ল। আরে এখন হসপিটাল মানে তো সাক্ষাৎ মৃত্যুপুরী। পাশে মৃত্যুপুরী থাকলে নার্সিংহোমের পশার তুড়ি মেরে জমে যাবে। দেখছিস না সানশাইন কেমন রমরমিয়ে চলছে?

–হুঁ, তা ঠিক। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি পড়ছে, শুভাশিস ওয়াইপার চালিয়ে দিল, কেয়ারটেকারের কথা শুনে মনে হল মালিকরা বোধহয় আর দেশে ফিরবে না। দাঁও বুঝে কিনে নিলে হয় না?

–কিছুদিন যাক আগে। এখনই অত বড় ইনভেস্টমেন্টে যাব না। ভেতরটা পুরো ডেকরেট করতে কত খরচা হবে ভাবতে পারছিস? এমনিই তো ডাক্তারের ফাইল দেখলে ইনকাম ট্যাক্সের লোকগুলো চুলবুল করে, নার্সিংহোম খুলে বসলে পুরো স্টিকিং প্লাস্টার হয়ে সেঁটে যাবে। তার ওপর বাড়ি কিনলে… ওরে বাবা, আমি ভাবতে পারি না।

–ওকে। তাহলে বাড়িটা অ্যাডভান্স করে দিয়ে নেক্সট উইকে ইনটিরিয়ার ডেকরেটারের সঙ্গে বসে পড়ি। ওরা এস্টিমেট দিয়ে দিলে টোটাল বাজেট ফাইনাল করে ফেলব।

–তোর চেনা আছে কেউ?

–আছে বোধহয় একজন। শুভাশিসের অস্পষ্টভাবে মনে পড়ল ইন্দ্রাণীর স্কুলের এক কোলিগের স্বামী মোটামুটি নামী ইন্টিরিয়ার ডেকরেটর। তাকে দিয়ে কাজটা করালে ইন্দ্রাণী হয়তো খুশিই হবে।

অরূপ বলল, –যাকে দিয়েই করাও, গোড়াতেই দুটো কন্ডিশন করে নেবে। পেমেন্ট হবে ক্যাশে। বিলের অ্যামাউন্টেও আমরা যা দেখাতে বলব তাই দেখাতে হবে। ইকুইপমেন্টস কেনার সময়ে তো আর কিছু করা যাবে না, এখানেই যেটুকু ব্ল্যাক খাইয়ে দেওয়া যায়।

অরূপকে তার মিন্টো পার্কের চেম্বারে, নামিয়ে তড়িঘড়ি বেকবাগান পলিক্লিনিকে ছুটল শুভাশিস। ঢুকেই নিশ্বাস বন্ধ হওয়ার জোগাড়। কোনওদিন ছ-সাতটার বেশি রুগী থাকে না, আজ বারোজন নাম লিখিয়ে বসে আছে।

বিপন্ন মুখে রুগীদের ডাকছে শুভাশিস। একে একে। অধৈর্য চোখ বার বার ঘুরছে কব্জিতে। আটটার মধ্যে হয়ে গেলে একবার ইন্দ্রাণীর ওখানে…। হল না। চেম্বার খালি হতে হতে সেই ঘড়ির কাঁটা নটার ঘর ছুঁই ছুঁই।

টোটো-ছন্দা শুভাশিসের প্রতীক্ষায় বসে আছে। হয়তো বা ছন্দার দিদি জামাইবাবুও। ফিরতে হবে। ফিরতে হবে। ফিরতেই হবে বাড়ি!

ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি ঝমঝম ঝরে গেছে খানিক আগে। শরীরময় জলকণা মেখে ফিরছে। শুভাশিসের সাদা মারুতি। মন্থর মনে। অসংখ্য যান যান্ত্রিক পশুর মতো চরে বেড়াচ্ছে রাস্তায়, তাদের জ্বলন্ত চোখের মণি ভেজা রাজপথে বিম্বিত হয়ে ঠিকরে ঠিকরে উঠছে, ধাঁধিয়ে দিচ্ছে নয়ন। মধ্য আষাঢ়ের আকাশ লাল চাদরে ঢাকা।

বাড়ির খুব কাছে এসে শুভাশিস কাঁধে এক অদ্ভুত চাপ অনুভব করল। কে যেন ঠেলছে তাকে, ঘুরিয়ে দিচ্ছে তার স্টিয়ারিং। প্রাণপণ চেষ্টা করেও অদৃশ্য চাপটাকে বিন্দুমাত্র টলাতে পারল না শুভাশিস।

গাড়ির অভিমুখ বদলে গেল।

.

১৪.

আলো ছিল ব্রিজের ওপাশটাতেও, এপারে অন্ধকার। মেঘলা রাতে নিষ্প্রদীপ এলাকাটুকু কেমন যেন আধিভৌতিক। অস্বচ্ছ। লোডশেডিং চলছে।

আধখোলা গেট ধরে কয়েক পল নিশ্চল দাঁড়িয়ে রইল শুভাশিস। প্রায় চোরের মতো। তারপর পায়ে পায়ে ঢুকেছে বড়ঘরে।

সেন্টার টেবিলে হ্যারিকেন। চিমনিটা ঘোর মলিন, ইতস্তত ভুসোকালির ছোপ, ফলত এক দীপ্তিহীন বিভায় স্তিমিত চার দেওয়াল। সামনের সোফায় জয়মোহন ঈষৎ কুঁজো হয়ে বসে। হাতে পাতলা জাপানি পাখা। নাড়ছেন মৃদু মৃদু।

পায়ের শব্দে জয়মোহন মুখ তুলেছেন। ঘোলাটে চোখ অভ্যস্ত ছায়ায় নিশ্চিন্ত, অ, ডাক্তার। এসো, একটু অন্ধকার শেয়ার করো।

অমায়িক ডাক, তবু শুভাশিসের ভেতরে চোরা অস্বাচ্ছন্দ্য। ষোলো-সতেরো বছর ধরে এ বাড়িতে তার অবাধ যাতায়াত, তা সত্ত্বেও রয়ে গেছে ভাবটা। ঢোঁক গিলে আলগা হাসল শুভাশিস, — কতক্ষণ গেছে?

-আগে জিজ্ঞেস করো, ছিল কতক্ষণ।

–আজকাল সারাদিনই যাচ্ছে বুঝি?

–কেন, তোমাদের ওদিকে যায় না?

— যায় হয়তো। শুভাশিস সামান্য সঙ্কুচিত হল, আমাদের বিল্ডিংয়ে তো জেনারেটর আছে, তাই আমরা ঠিক…

–অ। সেই পাবলিক নুইসেন্স। গলগল ধোঁয়া? তোমরা শহরটাকে আরও দূষিত করে দিলে হে।

–আপনার টান আজ একটু বেশি মনে হচ্ছে?

–শেষ বয়সে এই টানটুকুই তো সম্বল।

–ওষুধগুলো ঠিক ঠিক খাচ্ছেন তো?

–পেট তো এখন ওষুধ খেয়েই ভরে ডাক্তার। জিভের স্বাদের খাবার তো কবেই ভুলে গেছি।

ফলটল খাচ্ছেন না? আপনি তো ফল খেতে ভালবাসেন।

–আম তো তোমরা এ বছর খেতেই দিলে না। মিনতিকে কতবার করে বলি বাজার থেকে একটু খেজুর নিয়ে আয়, তা সে ছুঁড়ি আমাকে মোটে পাত্তাই দেয় না। দীপুরা নেই বলে সারাদিন এখন উড়ে বেড়াচ্ছে।

শুভাশিস অন্দরের দিকে তাকাল। পিচঢাকা অন্ধকার। সঙ্গে এক গাঢ় নৈঃশব্দ্য।

কারুর সাড়াশব্দ পাচ্ছি না যে? কেউ নেই নাকি?

বউমা আছে। এই তো একটু আগে আমার মশারি টাঙিয়ে দিয়ে দোতলায় গেল।

— তা আপনি শুয়ে পড়েননি কেন?

-শান্তিতে শোওয়ার জো আছে? দু-দুটো শয়তান মশারির ভেতর সেঁধিয়ে গেছে। হুল উঁচিয়ে পিন পিন তেড়ে বেড়াচ্ছে। চোখের সামনে ঘুরছে তবু ব্যাটাদের দেখা যাচ্ছে না।

শুভাশিস হেসে ফেলল, আপনার নাতনির রেজাল্ট কেমন হল?

–রেজাল্ট? এ তো কঠিন প্রশ্ন ডাক্তার।

–কেন?

–দুপুরে মেয়ে মুখ তোলো হাঁড়ি করে স্কুল থেকে ফিরল। জিজ্ঞেস করলাম, হারে রেজাল্ট কেমন হল? মেয়ে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, খুব খারাপ। খুব খারাপ। আমি ভাবলাম তাহলে বুঝি ফেল করেছে!

–তিতির! ফেল! কী বলছেন কি আপনি!

–না করার কি আছে! করতেই পারে। ওর বাপ-ঠাকুর্দা সকলেরই এক আধবার গা মারার রেকর্ড আছে। বংশের ধারা বজায় রাখতে গেলে ফেল মারাটা এমন কিছু অন্যায় নয়।

শুভাশিস হতবুদ্ধি হয়ে ধপ করে সোফায় বসে পড়ল।

জয়মোহন হাঁপাতে হাঁপাতেও হাসছেন ফিক ফিক, না, না, অত ঘাবড়ানোর কিছু হয়নি। ও মেয়ের ফেল করার মুরোদ কোথায়? বিকেলে চাঁদুর মুখে শুনলাম কি সব স্টার ফার পায়নি, তাই নাকি অত কান্নাকাটি। নম্বর পেয়েছে বাহাত্তর পারসেন্ট। চারটে সাবজেক্টে লেটার।

শুভাশিসের পেশিগুলো অনেকটা শিথিল হল, নাতনির রেজাল্ট তাহলে ভালই হয়েছে বলুন?

–ভাল? কে-এ জানে! বৌমা তো বলছিল এ রেজাল্টও নাকি তেমন ভাল নয়। মেরে কেটে মন্দের ভাল। এই নম্বরেও তিতিরের নাকি ভাল জায়গায় ভর্তি হতে অসুবিধে হবে। আমরা তো বাবা জানতাম পাশ করলেই ছেলেমেয়ে কলেজে ভর্তি হতে পারবে… কি যে দিনকাল বানিয়েছ তোমরা?

জয়মোহন নিজের মনে বকেই চলেছেন। এর পর আর কি কি বলবেন, মোটামুটি শুভাশিসের মুখস্থ। তাঁদের সময়ে পৃথিবী কত সুন্দর ছিল, কলকাতায় কত গাছপালা ছিল, সেই গাছে গাছে পাখি ডাকত, একে অন্যের ভাল ছাড়া কিছু চাইত না, চালের মন দুটাকা ছিল, মাছঅলা মাছ ফাউ দিত, গোয়ালা দুধে জল মেশাত না… আরও কত কি! কেন যে পুরনো দিনকে এত সোনালি ভেবে আঁকড়ে থাকে মানুষ!

শুভাশিস বসে থাকতে থাকতে হাঁপিয়ে উঠছিল। সামনের এই বৃদ্ধ, আর তার বাবা, দুজনেই তো প্রায় সমবয়সী। অথচ দুজনে কত তফাত। পুরনো দিনের স্মৃতি রোমন্থন বাবার ধাতেই নেই। রুগীদের নিয়ে, মাকে নিয়ে, এত ডুবে থাকে বলেই কি? তবে কি কাজকর্ম ছাড়া বেঁচে থাকা আর মৃত্যুভয় মানুষের মনকে অতীত আঁকড়ে ধরতে বাধ্য করে?

নিঃসাড়ে উঠে পড়ল শুভাশিস। সুড়ৎ করে সেঁধিয়ে গেল ভেতরে। পা টিপে টিপে দোতলার প্যাসেজে পৌঁছে থমকে দাঁড়িয়েছে।

তিতিরের চেয়ার-টেবিলে বসে আছে ইন্দ্রাণী। সামনে তাড়া কাগজ। প্রুফ বোধহয়। মোটা মোম জ্বেলে ঝুঁকে আছে কাগজের ওপর।

প্যাসেজের অন্ধকার থেকে বহুকাল পর শুভাশিস চুরি করে ইন্দ্রাণীকে দেখছিল। চেয়ারে বসা ইন্দ্রাণীর ঋজু ভঙ্গিমা, সোনালি দ্যুতিমাখা তার নাক মুখ চোখ, ঈষৎ ঘামভেজা মুখ থেকে আলোর বিচ্ছুরণ, পৃথিবীর সঙ্গে সম্পৰ্করহিত এক নারীপ্রতিমার আত্মমগ্ন কলম চালনা– সবই নির্নিমেষে পান করছিল শুভাশিস। নাহ, বিশ বছরে সময় এই নারীর কিছুই হরণ করতে পারেনি। ওই ইন্দ্রাণী যেন সেই সদ্য কলেজ সোশালে দেখা বৈদ্যুতিক উনিশ। মাঝে অতিক্রান্ত সময় শুধুই যেন এক নিষ্ঠুর মায়া।

হঠাৎই প্রতিমা প্রাণ পেল। সিক্ত কপাল মুছছে আঁচলে। মুখ না তুলেই বলল– বাইরে দাঁড়িয়ে রইলে কেন? ভেতরে এসো। নীচে এতক্ষণ কী করছিলে?

পলকের জন্য স্বরটাকে অলৌকিক ভেবে কেঁপে উঠেছিল শুভাশিস, পলকে বিভ্রম ঘুচেছে। ঘরে ঢুকে খাটে বসে পলকাভাবে বলল, তোমার শ্বশুরমশাই-এর পেট অপারেট করছিলাম।

কপালে ত্রিশূল এঁকে ইন্দ্রাণী ঘুরেছে-কীইই?

-ইয়েস। অপারেশান। তিতিরের রেজাল্ট বার করার জন্য। সত্যিই ভদ্রলোকের স্মল ইনটেসটিনটা কেটে ছোট করে দেওয়া দরকার। প্যাঁচ খেয়ে খেয়ে কমপ্লিকেটেড হয়ে গেছে।

বুড়ো হলে সকলেরই ওই দশা হয়। তোমারও হবে। ইন্দ্রাণীর কপাল থেকে ত্রিশূল মুছল, টোটোর রেজাল্ট কী হল?

টোটো নয়, চকিতে ছন্দার মুখটা দেখতে পেল শুভাশিস। দাঁড়িয়ে আছে ব্যালকনিতে! নয়তো হানটান করছে!

ফিরে আসা অন্য ধরনের অস্বস্তিটা কাটাতে চাইল শুভাশিস। যেন অদরকারি তথ্য পেশ করছে এমন দায়সারা ভঙ্গিতে বলল, ভালই করেছে। এইট্টি সেভেন পারসেন্ট না কত যেন পেয়েছে। গোটা সাতেক লেটার।

বাহ। বাহ।

খুশি হতে গিয়েও ইন্দ্রাণী কেমন চুপসে গেল। বিজিত খেলোয়াড় যেন অভিনন্দন জানাল বিজয়ীকে। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ছেলে এত ভাল রেজাল্ট করেছে, তুমি আজ এখানে এলে যে বড়? তোমার আজ সোজা বাড়ি যাওয়া উচিত ছিল।

–ছেলের রেজাল্টের সঙ্গে আমার বাড়ি ফেরার কী সম্পর্ক?

–এমন আনন্দের দিনে তোমার বউও তো তার স্বামীকে এক্সপেক্ট করতে পারে।

–হাহ্। শী ওনলি এক্সপেক্টস আ পার্টি। অ্যান্ড শী উইল গেট ইট। তার ছেলে আছে। ছেলে ছেড়ে সে কবে আর ছেলের বাবার কথা ভেবেছে?

রহস্যময় আবছায়া ছড়িয়ে আছে ঘরে। ছায়ার আবরণ ভেদ করে ইন্দ্রাণী বুঝি পড়তে চাইছে শুভাশিসকে। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে নীরস ভাবে বলল, – তোমার ছেলেও তো আজ তোমার সঙ্গ চাইতে পারে!

–আর আমি? আমার কোনও চাওয়া নেই? দুপুর থেকে জমে ওঠা অসহিষ্ণুতা সহসা বিস্ফারিত হয়েছে, আমার কি তিতিরের রেজাল্ট জানার ইচ্ছে থাকতে পারে না?

তার জন্য তুমি আজ বাড়ি না গিয়ে এখানে চলে আসবে?

শুভাশিসের গলা খাদে নামল, –আজ দুপুর থেকে তিতিরকে বড় দেখতে ইচ্ছে করছিল রানি।

ইন্দ্রাণীর চোয়াল কঠিন হল, তোমার নার্সিংহোমের কী খবর? বাড়ি দেখতে গেছিলে আজ?

গিয়েছিলাম। কিন্তু তিতির কোথায়?

বাড়ি পছন্দ হল?

–হয়েছে একরকম। কিন্তু তুমি আমার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছ না কেন?

 –নার্সিংহোম করতে গেলে তোমাদের ট্রেড লাইসেন্স, হেলথ লাইসেন্স লাগবে না?

রানি, আমি একটা প্রশ্ন করেছি…

 –তোমার আজ কী হয়েছে শুভ? ছেলের রেজাল্টের খুশিতে নেশা ফেশা করোনি তো?

–তুমি জানো এ বাড়িতে আমি কক্ষনো ড্রিঙ্ক করে আসি না।

 –তাহলে উল্টোপাল্টা বকছ কেন?

–তিতিরের জন্য ছুটে আসাটা অপরাধ? তিতিরকে দেখতে চাওয়াটা অন্যায়? তিতিরের খোঁজ করাটা উল্টোপাল্টা বকা?

–আহ্ শুভ।

শুভাশিস গুম হয়ে গেল। তার আর ইন্দ্রাণীর সম্পর্কের মাঝে একটা অকথিত নিষিদ্ধ এলাকা আছে। পারতপক্ষে দুজনের কেউই এই এলাকায় ঢোকে না। আজ কেন এই অসংযম? সুনসান দোতলা, এক মায়াবী অন্ধকার, ভেজা ভেজা বাতাস, বহুকাল পর ইন্দ্রাণীকে এভাবে নিভৃতে পাওয়া– এরাই কি বাঁধ ভেঙে দিচ্ছে সংযমের?

ইন্দ্রাণী জানলায় দাঁড়িয়ে আছে, সেখান থেকে শুভাশিসের কাছে ফিরল, তোমার মাথায় আজ ভূত চেপেছে শুভ।

শুভাশিস বিমর্ষ মুখে বলল, — তা হবে। নইলে বাড়ি না ফিরে আজ এখানে ছুটে আসি?

 ইন্দ্রাণী আলগাভাবে শুভাশিসের কাঁধ ছুঁল–তিতির আদিত্যর সঙ্গে বেরিয়েছে। রাত্রে ওরা বাইরে খাবে।

–ও। তোমার বর তো বেশ ডিউটিফুল হয়ে উঠেছে দেখছি!

ইন্দ্রাণী হাত সরিয়ে নিল, –হওয়াই তো উচিত।

–ভাল। নেশা-টেশা ছেড়ে দিল… বউ ছেলে-মেয়ের দিকে মন বসছে… তোমরা এবার বেশ একটা হ্যাপি ফ্যামিলি হয়ে যাবে।

-ঠাট্টা করছ?

–আমার সঙ্গে কি তোমার ঠাট্টার সম্পর্ক? তা তোমার ছেলেও কি তার বাবার সঙ্গে গেছে? বাবার হাত ধরে?

–গেছে। তবে হাত ধরে যায়নি। তিতির ওকে হিঁচড়োতে হিঁচড়োতে নিয়ে গেছে।

–তা তুমিই বা বাকি রইলে কেন?

 ইন্দ্রাণী ফিসফিস করে বলল, আমি জানতাম, তুমি আসবে।

এক লহমায় বিহ্বল শুভাশিস। এইটুকু শোনার জন্যই কি সম্মোহিতের মতো আসা!

ইন্দ্রাণী আবার বলল, বাপ্পাটাকে নিয়ে কী করা যায় বলো তো? বম্বে যাওয়ার জন্য ভীষণ জেদ করছে।

শুভাশিস লঘু স্বরে বলল, বাপ্পার বাবা কী বলে?

–এখনও ঠাট্টা? নাকি এখনও রাগ পড়েনি?

শুভাশিস নিজেকে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করল, যেতে চায় তো যাক না। ইন্টারভিউটা দিয়ে আসুক।

–অত দূরে একা একা যাবে? ভাবতেই আমার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে যায়।

বম্বে কী এমন দূর! ট্রেনে উঠবে, আর নামবে।

–তারপর যদি সত্যি সত্যি চাকরিটা হয়ে যায়?

–হলে তো ভালই। কেরিয়ার তৈরি হয়ে যাবে।

ছাই ভাল। কোথায় কোন দূরে চলে যাবে… জাহাজে জাহাজে ঘুরে বেড়াবে… তুমি ওকে একটু বোঝাও না।

কী বোঝাব? বলব, মা র আঁচলের তলায় বসে থাকো?

–তা কেন? বি.কমটা করে দরকার হলে এখানেই চাকরি খুঁজুক। এত তাড়াতাড়ি চাকরি করারই বা দরকার কী? কস্টিং পড়ুক, চাটার্ডের জন্য চেষ্টা করুক, কম্পিউটার কোর্স করুক…

-সবই ঠিক। তবে বাপ্পার যা বয়স, এই বয়সের ছেলেদের আটকানো যায় না। এই বয়সে সব কিছু তুচ্ছ হয়ে যায়, শুধু চোখের সামনে স্বপ্নটা ভেসে থাকে। জাহাজ সমুদ্র বিদেশ, সবই এখন ওর কাছে বড় রোমান্টিক।

-জানি। এই রোমান্টিক হওয়ার পরিণতি কি তাও জানি।

–তুমি কক্ষনও কিছু ভোলো না, তাই না রানি?

 –ভোলা কী সম্ভব?

 ভোলা যে সম্ভব নয়, সে কথা শুভাশিসও জানে। অনেক অনেক বছর আগে এরকমই এক রোমান্টিক নেশায় শহর ছেড়েছিল সে। তবে জাহাজ সমুদ্র বিদেশের স্বপ্ন নিয়ে নয়, তার চোখে তখন অন্য এক মায়াকাজল। এমন এক সমাজ গড়তে হবে যেখানে কোনও অসাম্য নেই, শ্রেণীভেদ নেই, শোষণ নেই, বঞ্চনা নেই, মানুষ তার ক্ষমতা মতো খাটবে, প্রয়োজন অনুযায়ী রোজগার করবে, সামান্য রুটি আর মাথার ছাদের জন্য দীর্ঘশ্বাস পড়বে না মানুষের। সে হবে এক স্বপ্নের সমাজ। সেই স্বপ্নের ঘোরেই ইন্দ্রাণীকে ভুলল শুভাশিস। ইন্দ্রাণীর বিয়ে স্থির হয়ে গেছে জেনেও রাতারাতি চলে গেল গ্রামে। পার্টির নির্দেশে। ঘোর যখন কাটল, তখন আর চোখে বিপ্লব নেই, ইন্দ্রাণীও পিছলে গেছে বহুদূরে।

দিগভ্রান্ত শুভাশিসের কী যে বিপন্ন দশা তখন! শুভাশিস বলল, রানি, একটা কথা বলব?

বলো।

রোমান্টিসিজমের কথা বাদই দাও, বাপ্পার চিন্তার একটা প্র্যাকটিকাল দিকও আছে। এই শহরটা ফুরিয়ে আসছে, এখানে ব্রাইট ফিউচার হওয়া খুব কঠিন। বাপ্পা যদি এখান থেকে ছিটকে গিয়ে শাইন করে, সেও তোমার মঙ্গল।

–কিন্তু বাপ্পাকে ছেড়ে আমি থাকব কী করে?

–অনেককেই তো ছেড়ে থাকা যায় না রানি, তবু ছেড়ে থাকতে হয়। এক সময়ে বিচ্ছেদটাই অভ্যেস হয়ে যায়।

আলো এসে গেছে। আরও খানিকক্ষণ উসখুস করে শুভাশিস উঠে পড়ল। তিতিররা ফেরার আগেই।

মনে যতক্ষণ একটা চিন্তা প্রকট হয়ে থাকে, অন্য চিন্তা ততক্ষণ ঘাপটি মেরে বসে থাকে পাশে। অনেকটা রিপুর মতো। ঢাকুরিয়া ব্রিজ পার হতেই ঘাপটি মারা চিন্তাটা কামড় বসাল শুভাশিসকে।

আজ কি বাড়িতে অগ্ন্যুৎপাত হবে?

নাহ্, কিছুই হল না।

ছন্দাই দরজা খুলেছে। তার মুখচোখ প্রায় স্বাভাবিক।

সিঁটিয়ে থাকা শুভাশিস পাংশু গলায় বলল, সরি। এক্সট্রিমলি সরি। বিশ্বাস করো, নটার মধ্যে ফিরে আসছিলাম, হুট করে পলিক্লিনিকে একটা ফোন এসে গেল। ব্লু হেভেনে আজ যে অপারেশান করেছি, সেই পেশেন্টের ক্যাটগাট সলুশান খুলে গেছে! গিয়ে দেখি ব্লিডিং হচ্ছে। প্রেশারও অনেক ফল করে গেছে! কী যে ঝামেলা না… তোমাদের দিনটা নষ্ট করে দিলাম তো?

ছন্দার ঠোঁটে হাসির রেখা, আজ এমনিতেই যাওয়া হত না।

– ককককেন?

–টোটোর আজ সন্ধেবেলা বন্ধুদের সঙ্গে প্রোগ্রাম ছিল।

–তাই? শুভাশিসের বুক থেকে পাথর সরে গেল, – দ্যাখ কাণ্ড! আমি এদিকে ব্লু হেভেনে ছটফট করে মরছি। কোথায়, আমার ছেলে কোথায়?

-তোমার জন্য এতক্ষণ অপেক্ষা করছিল, একটু আগে শুতে গেল।

–এত তাড়াতাড়ি! সবে তো এগারোটা!

সারাদিন হুড়োহুড়ি করে খুব টায়ার্ড। ডাকব?

–থাক, কাল সকালেই… শুভাশিস ঠোঁট টিপল, বুঝলে, ভাবছি টোটোকে একটা সারপ্রাইজ দেব।

ছন্দা কোনও মন্তব্য করল না। ডাইনিং টেবিলে খাবার সাজাচ্ছে।

শুভাশিস পাশে গিয়ে দাঁড়াল–টোটোকে একটা দামি ক্যামেরা প্রেজেন্ট করব। লেটেস্ট মডেল। জাপানি। ফ্যান্সি মার্কেটে আমার একটা চেনা লোক আছে। ব্যাটা জেনুইন স্মাগলড গুডস সাপ্লাই করে। কি গো, ক্যামেরার আইডিয়াটা ভাল নয়?

–ভালই তো। ছবি তোলার অভ্যেস তো ভালই।

–দেখো, তুমি আবার আমার প্ল্যান ফাঁস করে দিয়ো না।

রাত্রে শুভাশিসের ঘুম আসছিল না। চুপচাপ শুয়ে দু-নৌকোয় পা দেওয়া নিজের জীবনটার কথা ভাবছিল। মাঝেমধ্যেই ভাবনাটা ঘুরে ফিরে আসে, নষ্ট করে দেয় ঘুম। এই টানাপোড়েন আর কদ্দিন? কোনওদিনই কি কোনও একমুখী চিন্তায় থিতু হতে পারবে না সে? ইন্দ্রাণীকে ছেড়ে রাজনীতিতে গেল, সেখানেও দোটানা। আদর্শ বড়, না প্রেম বড়? সমাজ বড়, না ব্যক্তি? মহান আদর্শকে তখন মনে হল নীরস উচ্চাশা। আর স্বপ্ন যেন এক একবজ্ঞা ঘোড়া যার পিঠে সওয়ার হওয়ার ক্ষমতা নেই তার। তারপর ডাক্তারি আর ছন্দাকে নিয়ে যখন এক মসৃণ ভোঁতা জীবনের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত শুভাশিস, তখনই আবার ফিরে এল ইন্দ্রাণী। আবার নতুন টানাপোড়েন। হয়তো বা তখনই একটা চূড়ান্ত ফয়সালা হয়ে যেত, হয়তো শুভাশিস ছেটে ফেলত বালুরঘাটে রেখে আসা নতুন বউকে, হয়তো ইন্দ্রাণীও তার দু বছরের ছেলে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি থেকে বেরিয়ে আসত, কিন্তু শুভাশিসের নিয়তি খণ্ডাবে কে? পর পর কত কী যে ঘটে গেল! গুলিবিদ্ধ তনুময় সুস্থ হওয়ার আগেই নিখোঁজ হয়ে গেল শুভাশিসের ফ্ল্যাট থেকে! বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো সংবাদ এল শুভাশিসের সন্তান ধারণ করে বসে আছে ছন্দা! ব্যস, আবার দোলাচল। ইন্দ্রাণী ততদিনে শামুকের মতো ফিরে গেছে নিজস্ব খোলে। এখানেও খেলাটা শেষ হতে পারত। হল না। একদিকে টোটো এল, অন্যদিকে সৃষ্টিরহস্যের নিয়ম মেনে এসে গেল তিতির। সম্পর্কের সুতোয় জট পড়ল আরও।

এই জট এখন শুভাশিস ছাড়ায় কীভাবে? এ যেন এখন শুধু এক সাঁকোর ওপর দাঁড়িয়ে থাকা। যার দুই প্রান্তই ডুবে আছে জলে। অথৈ জলে।

হঠাৎই শুভাশিসের হুঁশ ফিরল। ছন্দা এসেছে বিছানায়। একটি শব্দও উচ্চারণ না করে, একটুও প্রস্তুতির অবকাশ না দিয়ে আচমকা শুভাশিসের শরীরে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। উপোসি বাঘিনীর মতো আঁচড়াচ্ছে, কামড়াচ্ছে, তোলপাড় করে দিচ্ছে শুভাশিসকে। নিজেই টান মেরে খুলে ফেলেছে রাতপোশাক। নগ্ন নারী হিংস্র কামে পুড়িয়ে মারতে চাইছে পুরুষকে।

শুভাশিসের শরীর তবু বরফপিণ্ড।

অন্ধকারে আরও গাঢ় অন্ধকার হয়ে ফুঁসছে ছন্দা, কী নেই আমার মধ্যে? কী নেই? আজও কেন তুমি ওই মেয়েমানুষটার কাছে গিয়েছিলে? কেন? কেন?…

.

১৫.

জগৎ সংসারে সব কেনর উত্তর মেলা ভার। কিছু কিছু কেন নিজে নিজেই হাত পা ধড় মুণ্ডু গজিয়ে বিকট আকার ধারণ করে। কিছু কেনর জন্ম হয় সমাজ সংসার মানুষের নিত্যনতুন চাহিদায়। আবার অজস্র কেন শুরু থেকেই মোড়া থাকে কুয়াশার আবরণে, শেষেও তাই।

এত সব জটিল তত্ত্বকথা অবশ্য আদিত্যর মাথায় ঢোকে না, তবু মাঝে মাঝে ভাবনাগুলো তার কাছে আসে বইকি। আসতেই থাকে। অবিরল ঢেউএর মতো। সামুদ্রিক ফেনা হয়ে প্রশ্নেরা বুকে ছড়িয়ে থাকে। যে আদিত্যকে একটি দিনের জন্যও ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে দেখতে বলেনি ইন্দ্রাণী, সেই আদিত্যকে হঠাৎ কেন ইন্দ্রাণী চাপিয়ে দিল তিতিরকে এগারো ক্লাসে ভর্তি করার দায়িত্ব? এই যে বাপ্পা আজ ইন্টারভিউ দিতে চলে যাবে দু হাজার কিলোমিটার দূরের এক শহরে, কেনই বা তাই নিয়ে আদিত্যর সঙ্গে একটি বারও আলোচনা করার প্রয়োজন মনে করল না ইন্দ্রাণী? ছেলে চলে যাওয়ার চিন্তায় ইন্দ্রাণী যে ভেতরে ভেতরে গুমরোচ্ছে, এ কথা কি আদিত্য বোঝে না? খুব বোঝে। তবু তার সামনে কেন এতটুকু হালকা হয় না ইন্দ্রাণী?

রঘুবীর প্রশ্ন করল, হল কী রায়দা, এত কি ভাবেন?

ঝমঝম বৃষ্টি ঝরে চলেছে বাইরে। চায়ের দোকানের বেঞ্চি থেকে ফুটো হয়ে যাওয়া আকাশটার দিকে তাকাল আদিত্য, ভাবনার কি আর শেষ আছে রে ভাই?

–কেন, মেয়ের অ্যাডমিশন তো হয়ে গেছে?

–তা হয়েছে। তবু নতুন স্কুল, অচেনা পরিবেশ, আমার ভীতু মেয়েটা ঠিক মতো মানিয়ে নিতে পারবে কিনা…

রঘুবীর ধোঁয়া ওঠা চায়ে চুমুক মারল। হাসছে ফিক ফিক, –এত সব চিন্তা আপনি করেন?

–না করলে কি আর গিন্নি মেয়েকে ভর্তি করার ভার আমার ওপর ছেড়ে দেয়! আদিত্য দায়িত্বশীল পিতার হাবভাব আনল মুখে, কী হ্যাপা যে গেল রে ভাই! ঘুম থেকে উঠেই ছোটো, ভর্তির ফর্মের জন্য বিশাল বিশাল লাইনে দাঁড়াও, সাত জায়গায় ঘুরে ঘুরে কোথায় মেয়ের নাম উঠল দেখে বেড়াও, এসব কি চাট্টিখানি কথা! কোথাও যদি আজ লিস্ট বেরোয়, তো কোথাও বেরোয় দশ দিন পর। একটা কোনও জায়গা টার্গেট করে বসে থাকলে…

যাক গে, ঝামেলা তো চুকেছে। রঘুবীর আদিত্যর উচ্ছ্বাস থামাতে চাইল।

আদিত্য থামল না, চুকেছে, কিন্তু প্রায় কাঁদিয়ে ছেড়েছে। মেয়ে যে স্কুলে ভর্তি হতে চায়, তাদের লিস্ট বেরোল সব্বার শেষে। তা সেখানে ফার্স্ট লিস্টে মেয়ের নাম নেই। মাঝখান থেকে যে দুটো কলেজে নাম উঠেছিল, সেগুলোতেও অ্যাডমিশানের ডেট পার। তারপর সে যে কী টেনশান! মেয়ে মুখ কালো করে বসে আছে…

-মেয়ে ওখানে ভর্তি হতে পারল না? কোথায় হল তবে?

নাহ, মেয়ের আমার লাক ভাল। সেকেন্ড লিস্টে নাম উঠেছে। গতকাল টাকাপয়সা জমা দিয়ে ভর্তির পালা সাঙ্গ করে ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল।

আদিত্য সিগারেট ধরিয়ে জোরে জোরে টান মারল। বৃষ্টিবাদলার বাজারে চায়ের দোকান প্রায় ফাঁকা। নটা বাজতে যায়, সকালটা তবু যেন আজ এগোতেই চাইছে না। পথঘাটের কোলাহলেও এক ধরনের নির্জীব আলস্য। আদিত্য অলস মেজাজে বলল, আমি কোথায় মেয়ের রেজাল্ট দেখে ভাবলাম, যেখানেই যাবে মেয়ে আমার তুড়ি মেরে ভর্তি হয়ে যাবে। ও বাবা, গিয়ে দেখি সব বাপ-মার ছেলেমেয়েই ঝুড়ি ঝুড়ি নম্বর নিয়ে ঘুরছে। তাতেও কারুর তৃপ্তি নেই! এত এত নম্বর সব পায় কী করে বলুন তো?

না পেয়ে উপায় আছে, বাপ মারা যা খাটায় ছেলেমেয়েদের! রঘুবীর সুজির বিস্কুট চিবোচ্ছে কচকচ, বুলি ফুটতে না ফুটতেই হালে জুতে দিচ্ছে। তারপর শুধু টানো আর টানো।

পলকের জন্য অ্যাটমের কচি মুখটা আদিত্যর মনে পড়ে গেল। রুনা যে কি করে ছেলেটাকে নিয়ে! একটুখানি আকাশের দিকে তাকানোরও ফুরসত নেই বেচারার। দীপুটাও কিছু বলে না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে আদিত্য বিড়বিড় করল, –কেন যে এত খাটায়! কেন যে এত খাটায়!

-কোনও বাপ মাই আজকাল আর ছেলেমেয়েদের ছাপোষা গেরস্থ দেখতে চায় না রায়দা। সব্বাইকেই বড় বড় চাকরি করতে হবে, লাখ লাখ টাকা কামাতে হবে, কথায় কথায় বিলেত আমেরিকা ছুটতে হবে…

এই ব্যাপারটাতেই আদিত্যর কেমন ধন্দ লাগে। সবাই যদি এক নম্বর হয়ে যায়, তবে দু নম্বর তিন নম্বর থাকবে কারা? কিংবা কে জানে, এরপর হয়তো আর নিচের তলা, অগা বগা বলে আর কিছু থাকবেই না দুনিয়ায়। পণ্ডিত আর বিজ্ঞানীতে গিজগিজ করবে চারদিক। আচ্ছা, এমন একটা পৃথিবী যদি হয়ও, সেখানে বাপ্পা তিতিরের জায়গা থাকবে কোথায়? বাপ্পা রাশি রাশি টাকা আনছে ঘরে, তিতির জিনস টিশার্ট পরে গটগট অফিস যাচ্ছে, খটাখট কম্পিউটার চালাচ্ছে, প্লেনে চড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে হিল্লি দিল্লি…

নাহ, তিতিরকে নিয়ে অন্তত তেমন কিছু আদিত্য ভেবে উঠতেই পারে না। স্কুলকলেজ পাশ করে একদিন তাকে কাঁদিয়ে মেয়ে চলে যাবে শ্বশুরবাড়ি, হাতে হলুদের ছোপ, কপালে ডগডগে সিঁদুর নিয়ে ঘরদোর সামলাবে, কচি কচি নাতিনাতনি লাফিয়ে লাফিয়ে উঠবে আদিত্যর কোলে, এই না যথেষ্ট। ইন্দ্রাণীও কি এইটুকুতেই সন্তুষ্ট? মনে হয় না। এত অল্পে খুশি হলে কি ছেলেকে অত দূরদেশে যাওয়ার জন্য এক কথায় ছেড়ে দিতে পারত!

সহসা বাইরের ঝমঝম বর্ষা সেঁধিয়ে গেল আদিত্যর বুকে। পক্ষীমাতার মতো কোন শিশুকাল থেকে বাপ্পাকে শুধু নিজের করে আগলে রেখেছে ইন্দ্রাণী। বাপ্পাও বাবাকে তেমন পছন্দ করে না, আদিত্য জানে। তবু এক সর্বগ্রাসী টান হঠাৎ কেন যে আদিত্যর বুকের মাঝে চারিয়ে যায়। হা হা করে ওঠে সমস্ত অস্তিত্ব! এই অনুভূতির নামই কি অক্ষম পিতৃত্ববোধ!

ভাবনার চিমটিটা থেকে আদিত্য ছাড়াতে চাইল নিজেকে। কেজো গলায় রঘুবীরকে জিজ্ঞাসা করল, আমরা তাহলে কখন যাচ্ছি আজ?

রঘুবীর বিড়ি ধরিয়েছে, ঠিক সাড়ে বারোটায় পৌঁছতে হবে।

–অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেয়ে গেছেন?

–পেয়েছি বলেই না বৃষ্টি মাথায় করে সেই দমদম থেকে ছুটে আসা।

–গিয়ে লাভ হবে কিছু?

–মানে! আরে, এ হল রোড কন্ট্রাক্টরির ব্যবসা। পাঁচ টাকার কাজে পঞ্চান্ন টাকা লাভ।

 –কিন্তু সে কাজ আমাদের দেবে কেন? আপনিই তো বলছেন লোকটা পার্টির লোক…

–শুধু পার্টির লোক নয়, মন্ত্রীর ডান হাত। যখন তখন দরজা ঠেলে মন্ত্রীর ঘরে ঢুকে যায়।

–নয় তাই হল। কিন্তু আমি তো পার্টি টার্টি করি না…।

–দূর মশাই, কাজ দেওয়ার জন্য পার্টি লাগে নাকি? কাজ দেবে, কমিশন নেবে, চুকে গেল। তবে যাকে কাজ দেবে তাকেও মোটামুটি চেনাজানা বিশ্বস্ত হতে হবে, তাই না! আর তার জন্য তো আমিই আছি।

আদিত্যর খুঁত খুঁত ভাব তবু যায় না, লোকটার সঙ্গে আপনার সত্যিই পরিচয় আছে তো?

–আরে বাবা, কত বার বলব? বলছি তো আছে। দু দিন-চার দিনের নয়, আজ বিশ বছরের পরিচয়। ওর হাড়হদ্দ সব আমার নখের ডগায়। রঘুবীর দাড়ি চুমরোতে চুমোতে চকচক হাসছে, –নকশাল আমলে লোকটা ছিল পুলিশের খোচড়। তারপর মা জননীর ভক্ত সেজে পাঁচ বছর কাটিয়েছে। তারপর যেই দেখেছে ডামাডোল, অমনই বেনো জল হয়ে লাল রঙে মিশিয়ে নিয়েছে নিজেকে। লোকটার ঘ্যাঁতঘোত জানি বলেই না এত খাতির আমার। গিয়ে দেখবেন কেমন আমার দেওয়া দেড় রতির পান্না ধারণ করে আছে আঙুলে।

আদিত্যর তবু ঠিক বিশ্বাস হয় না। এই রঘুবীর লোকটার সঙ্গে তো কম দিন ঘুরল না, কিন্তু কি লাভ হয়েছে আজ পর্যন্ত? শুধু হঠাৎ তেতে উঠে বাবার সঙ্গে মুখ দেখাদেখি বন্ধ হওয়া ছাড়া? হাসপাতাল থেকে ফেরা ইস্তক কোথায় না নিয়ে গেছে লোকটা! কদিন তো ইস্টার্ন বাইপাসে নিয়ে গিয়ে দিনভর চরকি খাওয়াল। কি, না জমিগুলো দেখে রাখুন রায়দা, আমি মালিকদের ঠিকানা বার করছি। পার্টি ফিট করব আর টপাটপ বেচে যাব। কমিশন সবটাই আপনার। হা হতোস্মি। কেনার লোক তো দূরের কথা, একটি মালিকের নাম ঠিকানাও খুঁজে বার করা গেল না। মাঝখান থেকে জমির স্থানীয় দালালরা ক্রূর চোখে দাড়িওয়ালাকে জরিপ করল কয়েকদিন, তারপর একদিন মাঠের মাঝে চড়াও হয়ে শাসিয়ে গেল দুজনকেই। আর স্টোনের ব্যবসা! তার কথা যত কম বলা যায়, ততই ভাল। প্রথমে বলল, আপনাদের বড় ঘরটা দিন, জ্যোতিষ কার্যালয় খুলব। বাবাকে খুব ভুজুং ভাজুং দেওয়ার চেষ্টা করল। অর্জুন গাছের ছাল, শ্বেতবিড়ালার মূল, আপনি একশো বছর বাঁচবেন, কত কি গ্যাস খাওয়ানো! জানে না তো, ওই দুঁদে বুড়ো কী মেটিরিয়ালে গড়া! যেই একদিন জোর হাঁপের টান উঠল, ওমনি দুর দুর করে দিল ভাগিয়ে। তারপর শুরু হল বাবুর নতুন বায়নাক্কা। একটা ভাল চেম্বার না খুললে স্টোনের ব্যবসা ভাল জমে না রায়দা। একটা চেম্বারের ব্যবস্থা করুন, আমি ক্রেডিটে পাথর এনে আপনার দোকান সাজিয়ে দিচ্ছি। পার্টি ধরে স্টোন গছানোর দায়িত্বও আমার। কোথায় এখন আদিত্যর টাকা ঝলঝলাচ্ছে যে দশ বিশ হাজার টাকা খরচা করে জ্যোতিষালয় খুলবে! এদিকে নিজে তো ঠিক টুকটাক মক্কেল ধরে পাথর ধার করিয়ে চলেছে!

তবে লোকটার যে অনেক কেষ্টবিন্ধুর সঙ্গে পরিচয় আছে, এ কথাও আদিত্য অস্বীকার করতে পারে না। বেশ কয়েক জন হাই-ফাই ব্যবসায়ীর ঘরে আদিত্যকে সঙ্গে করে নিয়ে গেছে রঘুবীর। আদিত্য দেখেছে, তারাও বেশ খাতির করে কথা বলে জ্যোতিষী রঘুবীরের সঙ্গে। পুলিশের দুজন ডিসির বাড়িতেও রঘুবীরের অবাধ যাতায়াত। ওই পান্না চুনীর সুবাদেই।

আদিত্য দোনামোনা করে বলেই ফেলল, দেখুন ভাই, অনেকগুলো দিন তো চলেই গেল। যদি কিছু হয় তো বলুন, নইলে আবার মান লজ্জা খুইয়ে প্রেসটার দেখাশুনাতেই নেমে পড়ি।

–আপনি আমার ওপর বিশ্বাস হারাচ্ছেন রায়দা! আমি বলে আপনার জন্য হন্যে হয়ে ছুটে মরছি.. কোথায় এমন বৃষ্টিবাদলার দিনে মাসিতে আমাতে ঘরে বসে অফিসবাবুদের মতো খিচুড়ি তেলেভাজা খাব, তা নয় এমন দুর্যোগেও শুধু আপনাকে খবর দেওয়ার জন্য…

–আহা, অভিমান করেন কেন? আদিত্য রঘুবীরের হাত চেপে ধরল, কিছুই যে গুছিয়ে ওঠা যাচ্ছে না ভাই।

–এবার যাবে।

–কী করে যাবে? রাস্তা সারানোর কনট্রাকটারিরই বা আমি কী বুঝি?

–আপনার তো বোঝার দরকার নেই। কত বার তো বললাম, কাজ বুঝবে সেই ঠিকাদার যে আদতে কাজটা করবে। রাস্তায় লোক খাটাবে। আমাদের কাজ হবে শুধু গভর্নমেন্টের কাছ থেকে অর্ডারটি বাগানো, আর ওই ঠিকাদারের হাতে অর্ডারটি তুলে দেওয়া। আর গুনে গিঁথে ভাগের টাকাটি ঘরে তুলে আনা।

–এত সহজে টাকা রোজগার হবে?

হবে হবে। আপনি শুধু গভর্নমেন্টের খাতায় একবার নামটা এনলিস্টেড হয়ে যেতে দিন। রঘুবীর এদিক ওদিক তাকিয়ে একটু গলা নামাল, –আবার সেই সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ডিপ্লোমাঅলা ছেলেটাকে পুরো ফিট করা হয়ে গেছে। ব্যাটা কাল অবধি দশ পারসেন্টের কমে রাজি হচ্ছিল না, অনেক রাত পর্যন্ত বাবা বাছা করে সাত পারসেন্টে নামিয়েছি। খুব চালু মাল। বুঝে গেছে, ওর ওই ডিপ্লোমার চোথা কাগজটি না দেখাতে পারলে আমাদের এনলিস্টমেন্ট হবে না। শালা এদিকে একটা কারখানায় কাজও করছে, আবার উপরিরও লোভ ষোলো আনা। তা থাকুক, সাত পারসেন্ট শেয়ারেই থাকুক। বাকি তিরানব্বই তো আপনার আমার।

–তিরানব্বই নয়, যে কাজ দেবে তার ভাগটাও ধরুন।

–হুম। কাজ দেবে, ন্যায্য পাওনা তো নেবেই। তবে একটা কথা রায়দা, আপনাকেও কিন্তু মাঝে মধ্যে সাইটে যেতে হবে।

–সাইট মানে তো উদয়নারায়ণপুর?

–এখন আপাতত উদয়নারায়ণপুর। ওখানেই মাইল পাঁচেকের কাজ পেলে জীবন কেটে যাবে।

–যাহ, পাঁচ মাইল আর কদিনের কাজ?

-আপনি এখনও সত্যযুগে পড়ে আছেন রায়দা! পাঁচ মাইল রাস্তা শীতে শুরু করে বর্ষার আগে শেষ করবেন। বর্ষায় রাস্তা ধুয়ে যাবে, আবার শীতে শুরু করবেন। এইভাবেই বর্ষা আর শীত, বর্ষা আর শীত খেলতে খেলতে জীবন কেটে যাবে। রঘুবীর চোখ ছোট করল, কনট্রাকটারদের যদি কাজেই না লাগে তাহলে ভগবান কষ্ট করে বর্ষা আর শীত দুটো আলাদা ঋতুর সৃষ্টি করতে গেলেন কেন?

আদিত্য চুপ করে গেল। টাল খাওয়া বিশ্বাসটা ফিরতে চাইছে না। রঘুবীরের ওপর আর এক বার নির্ভর করে দেখবে? কিন্তু কাজটা কি এতই সোজা! একটা কোম্পানি খাড়া করে ফেললাম, সঙ্গে সঙ্গে গভর্নমেন্টের খাতায় নাম উঠে গেল, কাজ আসতে লাগল? তাই যদি হয় তবে যে কোনও লোকই তো এভাবে কমিশন খাইয়ে একটা ব্যবসা শুরু করে দিতে পারে!

রঘুবীর উঠে দাঁড়িয়েছে, আপনি তাহলে ঠিক বারোটায় চলে আসছেন তো?

আদিত্য অন্যমনস্কভাবে মাথা নাড়ল।

–কোথায় দাঁড়াবেন মনে আছে? রাইটার্স বিল্ডিংয়ের পশ্চিম গেটে। আমি বীরেনবাবুকে নিয়ে ঠিক বারোটায় কিন্তু ওখানে চলে আসছি।

বৃষ্টি একটু ক্লান্ত হয়েছে। ছাইরঙ মেঘে তবু ছেয়ে আছে আকাশ, বিরতির অবকাশে গুড়গুড় তামাক টানছে। ছিরছির জল ছিটিয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে রিকশাবাহিনী। মানুষজন দ্রুত পায়ে গন্তব্যের দিকে চলেছে। একটা ভেজা কাক এসে চায়ের দোকানের চালে বসল। ক্ষুধার্ত স্বরে চিৎকার করছে। আর এক কাপ গরম চা খেতে খেতে আদিত্য রুনাকেও দেখতে পেল। ছেলেকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে ফিরছে। রঙিন ছাতার আড়াল থেকে আড়চোখে তাকাচ্ছে চায়ের দোকানের দিকে। আদিত্যর সঙ্গে চোখাচোখি হতেই ছাতায় ঢেকে নিল মুখ।

বাড়ি ফিরে আদিত্য আগে ঝটপট দাড়িটা কামিয়ে নিল। স্নান খাওয়া সেরে ঘরে ফিরে দেখল বাপ্পা ফিরেছে। দীপুর কাছ থেকে চেয়ে আনা সুটকেসে সদ্য কেনা ব্রাশ পেস্ট সাবান টুকিটাকি ওষুধপত্র ভরছে। ছোট্ট সুটকেস জামাকাপড়ে বোঝাই। কাল রাত্রেই সব গুছিয়ে দিয়েছিল ইন্দ্রানী, এখন খোলার পর বাক্সটাকে ঠিক মতো কবজা করতে পারছে না বাপ্পা। তাই দেখে তিতির মুখ টিপে হাসছে।

আদিত্য বলল, সর, আমি বন্ধ করে দিচ্ছি।

তিতির জোরে হেসে উঠল, হাত দিয়ো না বাবা, ও কাউকে স্যুটকেস ছুঁতে দিচ্ছে না। আমি বললাম হাঁটু দিয়ে চেপে দিচ্ছি, তুই লাগা…

–অ্যাই, ফ্যাচোর ফ্যাচোর করিস না তো! বাপ্পা কড়মড় করে উঠেছে, হট সামনে থেকে।

আদিত্য নরম গলায় বলল, তোর ট্রেন কটায় রে?

–দুটো পঞ্চাশ। বাপ্পা আদিত্যর দিকে তাকাল না।

কখন বম্বে পৌঁছবে?

–টোয়েন্টি এইট আওয়ার্স লাগে। হিসেব করে নাও।

–ওখানে গিয়ে কোথায় উঠবি কিছু ঠিক করেছিস?

রাস্তায় থাকব না।

–দেখিস, স্টেশনের পাশের হোটেলগুলো বেশির ভাগ কিন্তু চোর হয়।

–হুঁহ। সব জায়গাই কি তোমাদের কলকাতার মতো?

–তা নয়। তবু সাবধান করার জন্য বলা।

 –ঠিক আছে, ঠিক আছে।

ছেলে বিরক্ত হচ্ছে বোঝা যায়, তবু আদিত্যর ছেলের সঙ্গেই কথা বলতে খুব ইচ্ছে হচ্ছিল। আসন্ন যাত্রার উত্তেজনায় টানটান বাপ্পার মুখটা দেখে কেমন যেন মায়া জাগছিল তার। আলমারি খুলতে খুলতে ফের প্রশ্ন করল, নিজের তালাচাবি নিয়েছিস তো? হোটেলের তালাচাবি ব্যবহার করবি না।

হুঁ।

ফিরছিস কবে?

 কাজ শেষ হলে।

–দু-একদিন বেশি থেকে যেতে পারিস। জুহু বিচ, মালাবার হিল…কত সুন্দর সুন্দর বেড়ানোর জায়গা আছে…মহাবালেশ্বর, খাণ্ডালা…

–আমি বেড়াতে যাচ্ছি না।

–তবু যদি সময় পাস..আদিত্য আর কথা বাড়ানোর ভরসা পেল না। আলমারির ড্রয়ারে হাতখরচ রেখে দেয় ইন্দ্রাণী, সেখান থেকে গোটা কুড়ি টাকা পকেটে পুরল। বেরোনোর আগে বাপ্পার পাশে এসে দাঁড়াল কয়েক সেকেন্ড। সঙ্কুচিতভাবে হাত রাখল ছেলের মাথায়, সাবধানে যাস। দুর্যোগের দিন…বুঝিসই তো তোর মা এখানে…

কথা অসমাপ্ত রেখেই পথে নামল আদিত্য। আবার বৃষ্টি আসছে। আকাশ ঘন হয়ে ঝুলে আছে বহুতল বাড়িগুলোর মাথায়।

ছাতা হাতে হনহন পা চালাচ্ছে আদিত্য। বৃষ্টি নামার আগেই বাসে উঠে পড়তে হবে। বাস রাস্তার কাছাকাছি আসতেই সামনে কন্দর্প। আপাদমস্তক বর্ষাতিতে মুড়ে ফিরছে স্কুটারে। আদিত্যকে দেখে থামল, বেরোচ্ছ কোথায়? চারদিকে তো জল জমে গেছে।

কাজ আছে রে। যেতেই হবে।

–পারো তুমি। এমন দিনেও তোমার কাজ? কন্দর্প স্কুটার রাস্তার ধারে সরাল, –তোমার সঙ্গে আমার একটা কথা ছিল দাদা।

–ফিরি। রাত্রে শুনব।

 কন্দর্প দু-এক সেকেন্ড চুপ থেকে বলল, কথাটা খুব আরজেন্ট।

–আরজেন্ট তো সকালে বলিসনি কেন? চা খেতে খেতে দোতলায় এলি…

কথাটা বাড়িতে বলা যাবে না দাদা। কন্দর্প স্ট্যান্ড নামিয়ে স্কুটার ভাল করে দাঁড় করাল, আমাদের সামনের সান্ন্যাল বাড়িটা ভাঙা হয়েছে, দেখেছ?

— দেখেছি। কেন?

–যে লোকটা ওখানে ফ্ল্যাট বানাচ্ছে তাকে চেনো?

–চিনি মানে দেখেছি। লোকটা নাকি ফিল্ম লাইনেরও লোক। আদিত্য এক গাল হাসল, –তোর সঙ্গে আলাপ আছে?

–এতক্ষণ তো ওর সঙ্গেই ছিলাম। আমি ওর একটা ফিল্মে কাজ করছি।

বাহ। আদিত্য ঘড়ি দেখছে। আকাশটাকেও।

–অশোকদা মানে ওই ভদ্রলোকের সম্পর্কে তোমার সঙ্গে একটু আলোচনা ছিল। কন্দর্প ঢোঁক গিলল, অশোকদা আমাদের বাড়িটাও চায়। ভেঙে ফ্ল্যাট বানিয়ে দেবে।

আদিত্য হকচকিয়ে গেল। দীপু একবার হাসপাতালে বাড়ি ভাঙার কথা বলেছিল বটে, ইন্দ্রাণী নিষেধ করায় এই নিয়ে আর মাথা ঘামায়নি সে। দীপুও নতুন করে কথাটা তোলেনি। এখনও সেই। ভাঙাভাঙির ভাবনাচিন্তা চলছে নাকি?

আদিত্য ভুরু কুঁচকে তাকাল, তো?

—বাবার কাছে কথাটা কি করে পাড়া যায়?

—তা আমি কী করে বলব!

-না মানে মেজদা মাঝে একটা খিঁচ বাধিয়ে রেখেছে তো। কি একটা প্রোমোটার ধরে এনেছিল, বাবা তাকে হুট আউট করে দিয়েছে। এখন আমার বলতে যাওয়াটা কি ঠিক হবে?

–এই কথার জন্য তুই আমাকে দাঁড় করিয়েছিস?

 কন্দর্প আদিত্যর হাতে হাত রাখল, দ্যাখো দাদা, যে যাই বলুক, আমি জানি বাবার আসল উইকনেস হচ্ছ তুমি। বাবাকে তুমি যদি চেপে ধরো, বাবা জেদ রাখতে পারবে না।

বাজে কথা। বাবা আমাকে দেখতে পারে না। আদিত্য চোখ সরু করে দেখছে ভাইকে, তাছাড়া আমি বলতে যাবই বা কেন? আমি তো বাড়ি ভাঙা চাই না।

চাইবে না কেন? ওই তো এখন বাড়ির ছিরি! কোনও মেনটেনেন্স নেই, কলি ফেরানোর পয়সা নেই, ভাগের মা গঙ্গা পায় না দশা! নতুন বিল্ডিং হলে একটা ঝকঝকে থ্রিরুম ফ্ল্যাট পেয়ে যাবে। মোজাইক করা। সঙ্গে কিছু করকরে টাকাও।

–আমার ফ্ল্যাটবাড়ি ভাল লাগে না রে। কিরকম বন্তি বস্তি মনে হয়।

টাকাটার কথা ভাবো। অন্তত লাখ খানেক করে দেবে। ক্যাশ। ওই টাকায় তুমি নতুন বিজনেস শুরু করতে পারো।

মুহূর্তের জন্য দোদুল্যমান হল আদিত্য। লাখ টাকা! পরমুহূর্তেই সংবিৎ ফিরেছে। যে বাড়িতে মানুষ জন্মায়, বড় হয়, প্রতি পলে যে বাড়ি থেকে নিশ্বাস নেয়, তার ইট কাঠ বালি সিমেন্ট লোহা সবই তো অঙ্গ প্রত্যঙ্গের মতো হয়ে যায়। আদিত্য চোখ বুজে বলে দিতে পারে তাদের বাড়ির কোথায় কটা দাগ আছে, দাদু ঠাকুমার মৃত্যুচিহ্ন হিসেবে কোন ঘরের মেঝেতে পেরেক পোঁতা আছে, সুদীপ আর সে ছোটবেলায় বল মেরে প্যাসেজের ঠিক কোন জায়গাটার ছালচামড়া তুলে দিয়েছিল একেবারে। আর আদিত্যর মার স্মৃতি তো লেপেজুপে আছে গোটা বাড়িতেই।

রাগত স্বরে আদিত্য বলল, টাকার লোভ দেখাস না চাঁদু। নিজেদের বাড়ি হল নিজেদেরই শরীর, তাকে ভেঙে ফেলার কথা কী করে যে ভাবতে পারিস তোরা!

শরীরও অনন্তকাল থাকে না দাদা। পরমায়ু ফুরোয়। বাড়িও একদিন ভাঙা পড়বেই। আজ, না হয় কাল।

–সে যখন হবে, তখন দেখা যাবে।

–যখন নয় দাদা, শিগগিরই হবে। তুমি কি ভাবছ, মেজদা মেজবউদি এভাবে হাটের মাঝে থাকা চিরকাল মেনে নেবে? একবার যখন মেজদা প্ল্যান করেছে, তখন বাড়ি ভাঙবেই। আর মেজদার নিও বিল্ডার্স যদি কাজটা পেতে পারে, তাহলে তুমি বলো, হোয়াই নট অশোকদা? মেজদা কি সব ব্যাপারে ফেয়ার ডিলিংস করে? নিজেরা সব থেকে ভাল ঘর দুটো নিয়েছে, দোতলার বড় বারান্দাটা নিয়েছে, বড় ভাই হিসেবে তোমার কি ওটা প্রাপ্য ছিল না? তোমার আমার ঘরে ভাল মতন আলো-বাতাস ঢোকে?

–তুই তো বেশ প্যাঁচালো হয়ে গেছিস চাঁদু!

প্যাঁচালো নয়, প্র্যাকটিক্যাল। চোখ কান খোলা রাখা মানুষ।

–তা এতই যদি মরিয়া ইচ্ছে, নিজে গিয়ে বাবাকে বল। মুরোদে না কুলোয় তোর বউদিকে দিয়ে বলা।

-না না বউদি নয়। কন্দর্প যেন শিউরে উঠল, তুমি প্লিজ বউদিকে এসব কথা বোলো না।

–কেন, বউদি নয় কেন? এত ভাব তোদের…

–ও তুমি বুঝবে না। যতই হোক বউদি বউদিই। তুমি দাদা, দাদা। ব্লাড রিলেশান। কন্দর্প তোতলাচ্ছে, আমাদের ভাইয়ে ভাইয়ে কথা, এর মধ্যে বউদিকে টানা ঠিক নয়।

–আসল কথা বল তোর বউদিকে তুই ভয় পাস। আদিত্য হেসে ফেলল, আমিও পাই রে।

 কন্দর্প হাত কচলাল, –তাহলে তুমি বাবাকে বলছ?

বললাম তো আমি বাড়ি ভাঙা চাই না, আমি কেন বলব?

–আমাদের জন্য বলবে। তিতির বউদি বাপ্পার কথা ভেবে বলবে। বাবা মারা গেলে বাড়ি ভাঙা হবেই, কিন্তু তখন মেজদা কনট্রোল নিয়ে নেবে। কি ডিল করবে, কোথায় আমাদের ল্যাঙ মারবে, তুমি টেরও পাবে না। আর অশোকদা করলে, আমাদের দিক আগে টানবে।

দীপুকে তাহলে তখন ঠকানো যাবে বলছিস? আদিত্যর মুখ তেতো হয়ে গেল। একটি কথাও আর বলতে শুনতে ভাল লাগছিল না তার। কন্দর্পের পিঠে আলগা চাপড় মেরে বলল, –ঠিক আছে, একটু ভাবি। বাড়ি বলে কথা! বলেই দ্রুত হাঁটা শুরু করেছে।

বেশ কয়েক পা এগিয়ে আদিত্য ঘুরে তাকাল একবার। কন্দর্প নড়েনি। স্কুটারের পাশে স্থির দাঁড়িয়ে। তাকেই দেখছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *