১৫-১৬. কবরখানায়

১৫. কবরখানায়

অবশেষে এতদিনে তবে লিভভানিয়া রহস্যের উপরে যবনিকা পড়লো। কেবল তো খুনের মামলাই ছিলো না এটা, ছিলো রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার কেন্দ্রবিন্দুও-ঝড়ের যেমন থাকে স্থিরকেন্দ্র, সেই রকম। স্লভদের এই প্রতিনিধি যেহেতু এখন আত্মহত্যা করেছেন, আলেমানরা বলাই বাহুল্য এই নির্বাচনে জিতে যাবে। সাময়িক চাপা পড়বে দ্বন্দ্ব, কিন্তু তবু আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে দু-দলের ভিতরকার বিরোধিতা–সরকারি তত্ত্বাবধানেই হয়তো লিভভানিয়ার এই রুশীকরণ সম্পূর্ণ হবে।

দিমিত্রি নিকোলেফ কেবল আত্মহত্যাই করেননি; এই আত্মহত্যার মধ্য দিয়ে এটাও প্রমাণ করে দিয়ে গেছেন যে তিনিই চোর, তিনিই আততায়ী–যখন দেখতে পেলেন সব ফাঁস হয়ে গেছে, আর রেহাই নেই, তখন আত্মহত্যা না করে যে তার কোনো উপায় ছিলো না।

অধ্যাপকের অন্ত্যেষ্টি হবার পর ইলকা ও জাঁ বাড়ি ফিরলো। জাঁ বেচারির অবস্থা খুবই কাহিল, কী করে সে গিয়ে মুখ দেখাবে ডোরপাট বিশ্ববিদ্যালয়ে? আর এখানে–এখানেও তিনজন ছাড়া তাদের কোনো বন্ধু নেই, সহায় নেই। তিনজন, মানে ভ্লাদিমির ইয়ানোফ, ডাক্তার হামিনে ও মঁসিয়ে দ্যোপোর্থ।

সেদিন ভ্লাদিমিরের সঙ্গে ডাক্তার হামিনের কথা হচ্ছিলো। লিভোনিয়া রহস্যের সত্যি কোনো কিনারা হয়েছে বলে বিশ্বাস করতে রাজি নয় ইয়ানোফ। দিমিত্রিকে সে খুনী বলে ভাবতেই পারে না। যতই কেননা তার বিরুদ্ধে অকাট্য প্রমাণ থাক।

ডাক্তার হামিনে বললেন, নিকোলেফ যে চুরি করেছেন, খুন করেছেন, তা আমিও বিশ্বাস করি না ভ্লাদিমির, যদিও তাঁর কাছেই চোরাই নোট পাওয়া গেছে। তাঁর এই আত্মহত্যা-তারও ব্যাখ্যা আছে। চাপে পড়ে, নাড়া খেয়ে-খেয়ে, নিশ্চয়ই সাময়িক বুদ্ধিভ্রংশ হয়েছিলো তার। কিন্তু একটা ভয়ংকর তথ্য তোমাকে জানাই ভ্লাদিমির। দিমিত্রি নিজের বুকে যে-ছুরিটা বসিয়েছেন, সেটাই আমূল বিঁধেছিলো পোখ-এর বুকে। যতই অবিশ্বাস্য হোক না কেন এই প্রমাণটা আমরা উড়িয়ে দেবো কী করে?

দিমিত্রি-কাছে যদি ও-রকম একটা ছোরা থাকতোই, তাহলে তার ছেলে-মেয়েরা কোনো দিনও সেটা দেখতে পেতো না, এটা কি সম্ভব? ইলকা আর জাঁ সেই ছোরা চোখেও দ্যাখেনি কোনোদিন। আমি এদের অনেকবার জিগেশ করেছি…

এর যে কী উত্তর হবে, তা আমিজানি না, স্নাদিমির । কিন্তু নিকোলেফের কাছে নিশ্চয়ই ছোরাটা ছিলো। দু-দুবার উনি ছোরাটা ব্যবহার করেছেন পোখকে হত্যা করার সময়, তারপর আত্মহত্যা করতে গিয়ে…

কী বলবে বুঝতে না-পেরে ভ্লাদিমির মাথা নিচু করে বসে রইলো।

ডাক্তার হামিনে বললেন : বেচারি ছেলেমেয়েগুলো…ওদের যে কী হবে, তা ভগবানই জানেন…

ইলকা যখন আমার স্ত্রী হবে, তখন জাঁ কি আমার ছোটো ভাই হবে না?

গভীর আবেগের সঙ্গে ডাক্তার হামিনে ভ্লাদিমিরের হাত চেপে ধরলেন।

আপনি কি ভেবেছিলেন আমি ইলকাকে এখন বিয়ে করতে চাইবো না?

না, ভ্লাদিমির। সে-কথা আমি কখনো ভাবিনি…কিন্তু ইলকা…সে কি এখন তোমাকে বিয়ে করতে চাইবে? ওর তো মনে হতে পারে যে ওর বাবার অপরাধের কালো ছায়া সারাক্ষণ ওর উপর ঝুলে থাকবে, তা নিয়ে ও হয়তো তোমাকে ব্যতিগ্রস্ত করতে চাইবে না…

তাহলে বুঝবো যে আমাকে ও আর ভালোবাসে না!

না, ভ্লাদিমির। তাহলে বুঝতে হবে যে ও তোমাকে ভালোবাসে বলেই এই লজ্জা নিয়ে তোমার কাছে যেতে চায় না!

+

ডাক্তার হামিনে ঠিকই অনুমান করেছিলেন। বিয়ের প্রস্তাব হতেই বিষম আপত্তি করলো ইলকা। তার মুখ শুকনো, চোখে বিষণ্ণতা, যেন কোনো দারুণ পোকা তার ভিতরটা কুরে কুরে খাচ্ছে। ভ্লাদিমির অনুনয় করলো।নতজানু হয়ে বসলো তার কাছে, বললো ইলকা বিয়ে না করলে তার জীবনটা নষ্ট হয়ে যাবে। কিন্তু ইন্ধা রইলো অবিচল, পাষাণ-প্রতিমা; শুধু তার চোখ দিয়ে দরদর করে জল পড়তে লাগলো। অস্ফুট স্বরে সে শুধু বলতে লাগলো, তা হয় না, প্লাদিমির, তা হয় না। খুনীর মেয়ে আমি, আমি কী করে বিয়ে করবো তোমাকে…

দুজনেই ভেঙে পড়লো। ইলকা কান্না চাপতে না-পেরে চলে গেলো পাশের ঘরে, ভ্লাদিমির বেরিয়ে পড়লো রাস্তায়। আশাহীন, বিমর্য; সব কেমন ফাঁকা ঠেকতে লাগলো তার কাছে। কিছুক্ষণ ঘুরে বেড়ালো সে উদ্দেশ্যহীন, ঠিকানাহীন, তারপর চলে গেলো ডাক্তার হামিনের কাছে তার শেষ আশ্রয়।

সব সে খুলে বললো ডাক্তারকে।

শুনে ডাক্তার হামিনে বললেন, ভ্লাদিমির, আমি জানতুম এ-রকম হবে। তোমাকে তো আমি বলেছিলুম সেদিন! ইলকাকে আমি এইটুকু বয়েস থেকে চিনি–কিছুতেই ওর মত পালটাবে না, দেখো!

ডাক্তার, আপনি আমার শেষ আশাটুকুও কেড়ে নিচ্ছেন, ভ্লাদিমির যেন প্রায় আর্তনাদ করে উঠলো।

কিন্তু ইলকা যতই কষ্ট পাক,–তুমি তো জানো ও কী-রকম কষ্ট পাচ্ছে–এ-বিয়েতে ও কিছুতেই মত দেবে না। ও সবসময় ভাববে যে ও খুনীর মেয়ে-ওর কোনো অধিকার নেই তোমাকে বিয়ে করার।

কিন্তু দিমিত্রি তো খুন করেননি, ডাক্তার! আমি ঠিক জানি তিনি খুন করেননি!

ডাক্তার হামিনে চুপ করে রইলেন। কী বলবেন তিনি এর উত্তরে! আত্মহত্যা করেই তো নিকোলেফ শেষ প্রমাণটুকু দিয়ে গেছেন যে তিনিই রাতের অন্ধকারের সেই নৃশংস আততায়ী।

ইয়ানোফ শুধু বললে, শুনুন ডাক্তার। ভগবান সাক্ষী, ইলকাকে আমি নিজের স্ত্রী বলেই জানি। আমি অপেক্ষা করবো…।

কীসের জন্য স্নাদিমির?

আমি অপেক্ষা করে থাকবো, কখন ভগবান মুখ তুলে তাকান, সেইজন্য!

+

কয়েক মাস কেটে গিয়েছে। অবস্থার কোনোই হেরফের হয়নি এর মধ্যে। আলেমানরা নির্বাচনে জিতে গিয়েছে। ইলকা বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার পর ভ্লাদিমিরের পক্ষে আর সে বাড়িতে থাকা সম্ভব হয়নি। কিন্তু কাছেই সে বাড়ি ভাড়া করেছে–রোজ যায় ওদের দেখতে। ওদের হাতে টাকাকড়ি বিশেষ নেই। বেঁচে থাকাই ক্রমশ কষ্টকর হয়ে উঠছে। রিগা থেকে চলে যাবে কিনা, সে কথা ভাবছে। ভ্লাদিমির, বলাই বাহুল্য, সাহায্য করতে চেয়েছিলো, কিন্তু ইলকা কোনো সাহায্য নিতেই চায়নি। পাগলের মতো ভালোবাসে সে ইলকাকে–কিন্তু জেদি, একরোখা, অবিচল ইলকা–সে কখনো টলবে না। কিছুতেই সে বিয়ে করবে না ভ্লাদিমিরকে। ভ্লাদিমির বেচারির চোখের সামনে কোনো আশা নেই, কোনো ভবিষ্যৎ নেই–অটল অচল ইচ্ছাশক্তির দেয়ালে মিথ্যাই সে মাথা কুটে মরছে।

পারিবারিক বন্ধুরা ইলকাকে বোঝাবার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু ইলকার সেই এক কথা : কোনো খুনীর মেয়ে কী করে একজন সৎ লোককে বিয়ে করবে।

রিগাশুদ্ধু সব্বাই এতদিনে এ কথা জেনে গিয়েছে। ইলকার প্রশংসায় ওরা পঞ্চমুখ, করুণায় বিগলিত–কিন্তু কী করবে তারা? সবই ভগবানের হাত।

এই যখন অবস্থা, তখন ১৭ই সেপ্টেম্বর জাঁ ও ইলকা নিকোলেফের নামে এক চিঠি এসে হাজির। চিঠি লিখেছেন রিগার পোপ*, তিনি সনির্বন্ধ অনুরোধ করেন তারা যেন সেইদিনই বিকেল পাঁচটার সময় রিগার কবরখানায় যায়।

ডাক্তার হামিনে ও ভ্লাদিমির ইয়ানোফও ঠিক ও রকম চিঠি পেয়েছেন। কীসের এই আমন্ত্রণ, সেটা কেউই বুঝতে পারছিলেন না।

এই কবরখানাতেই দিমিত্রি নিকোলেফের মৃতদেহ কবর দেয়া হয়েছে আত্মহত্যা বল গির্জে তাতে কোনো অংশ নেয়নি, বা কোনো অনুমোদন দেয়নি।

আপনার কি মনে হয়, ডাক্তার? ভ্লাদিমির জিগেশ করলে।

পোপ যখন বলেছেন, তখন আমাদের যাওয়া উচিত। তিনি সকলের শ্রদ্ধার পাত্র, বয়েসও প্রায় ছিয়াত্তর-সাতাত্তর, তিনি নিশ্চয়ই কোনো গুরুতর কারণ আছে বলেই এই আমন্ত্রণ পাঠিয়েছেন।

তুমি যাবে তো, ইলকা? ভ্লাদিমির জিগেশ করলে।

আমি অনেকবার গেছি ওখানে, বাবার জন্য প্রার্থনা করতে। পোপ আক্সিয়েক বাবার জন্য যদি প্রার্থনা করেন, তাহলে ভগবান নিশ্চয়ই তা শুনবেন।

পাঁচটার সময় কবরখানায় গিয়ে জাঁ আর ইলকা দেখতে পেলে অন্যরা আগেই এসে পৌঁছেছেন। তাদের বাবার সমাধির কাছে পোপ বসে আছেন নতজানু, দুর্ভাগা লোকটির জন্য প্রার্থনা করছেন তিনি। পায়ের শব্দ শুনে তিনি মাথা তুলে তাকালেন। যখন ভ্লাদিমির আর ইন্ধা সমাধির কাছে গিয়ে দাঁড়ালে, তিনি শুধু বললেন, ভ্লাদিমির ইয়ানোফ, দেখি তোমার হাত।তারপর ইলকার দিকে ফিরে বললেন, ইলকা নিকোলেফ, তোমার হাত। তারপর দুটি হাত তিনি এক করে দিয়ে রাখলেন সেই সমাধিতে। গম্ভীর স্বরে বললেন, ভ্লাদিমির ইয়ানোফ আর ইলকা নিকোলেফ, তোমরা ভগবানের সামনে স্বামী-স্ত্রী বলে গণ্য হলে।

ইলকা তক্ষুনি হাত সরিয়ে নিতে চাইলো, কিন্তু পোপ বললেন, না, ইলকা, হাত সরিয়ো না।

আমি…খুনীর মেয়ে…

খুনীর নয়, নিরপরাধ এক দুর্ভাগার কন্যা। এমনকী তিনি আত্মহত্যাও করেননি।

জাঁ তখন আবেগে চঞ্চল হয়ে উঠেছে। তাহলে খুনী…সে কে? ভাঙা কুশের সরাইখানার মালিক ক্রোফ।

———
* রাশিয়ার আদি চার্চ গির্জার পুরোহিতদের তখন পোপ বলতো।

.

১৬. পুনর্বাসন

ফুশফুশ ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিলো ক্রোফের; আগের দিন হঠাৎ কাশির ধমক উঠেছিলো তার, রক্ত উঠেছিলো কাশির সঙ্গে, কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তারপর মৃত্যু হয়েছিলো।

মরবার আগে সে ডেকে পাঠিয়েছিলো পোপ অক্সিয়েককে, তার স্বীকারোক্তির জন্য: গত তিন মাস তার বিবেক তাকে অবিশ্রাম কুরে কুরে খেয়েছে, মৃত্যু আসন্ন জেনে সব কথা স্বীকার না করে এই একা লোকটার কোনো সান্ত্বনা ছিলো না। সে যা-যা বলেছিলো, সব হুবহু লিখে নিয়েছিলেন পোপ, তারপর স্বীকারোক্তির নিচে ক্রোফ স্বাক্ষর করেছিলো। এখন তার মৃত্যুর পর তা প্রকাশ করা হলো। স্বীকারোক্তির মধ্যে ছিলো ক্রোফের অপরাধের নির্জল স্বীকৃতি, আর দিমিত্রি নিকোলেফের পুনর্বাসন।

১৩ই এপ্রিল, সেই ভয়ংকর রাত্রে ভাঙা ক্রুশের সরাইখানায় পোখ আর নিকোলেফ এসে রাত কাটাতে চেয়েছিলেন।

অনেকদিন ধরেই ক্রোফের ব্যবসায় লোকসান যাচ্ছিলো। পোখ-এর ঐ পেটমোটা ব্রীফকেস দেখেই ব্যাঙ্কের কর্মচারীর টাকা লুঠ করার মলব তার মাথায় আসে। অন্য যাত্রীটি বলেছিলেন ভোর চারটেয় তিনি চলে যাবেন–কখন তিনি চলে যান তার অপেক্ষা করছিলো সে-কারণ সাবধানের মার নেই–অন্য-কারু উপস্থিতিতে চুরি করার বিপদ অনেক। কিন্তু শেষ অব্দি সে আর লোভ শামলাতে পারেনি। রাত যখন দুটো, তখন সে গিয়ে চুপিসাড়ে ঢুকেছিলো পোখ-এর ঘরে, ভেবেছিলো পোখ বুঝি টের পাবে না।

পোখ কিন্তু ঘুমোচ্ছিলো না। ক্রোফের লণ্ঠনের আলো দেখে সে ধড়মড় করে উঠে বসেছিলো বিছানায়। গোড়ায় কেবল চুরি করাই ইচ্ছে ছিলো তার; এখন যখন দেখতে পেলে যে সে ধরা পড়ে গিয়েছে তখন লাফিয়ে গিয়ে পড়েছিলো বেচারির উপর; কোমরবন্ধে গোঁজা ছিলো এক সুইডেনের ছোরা–বাঁটশুদ্ধু ছোরাটা বসিয়ে দিয়েছিলো সে হৃৎপিণ্ডে।

তারপর পোখ-এর ব্রীফ-কেস হাড়ে দেখেছিলো; বারকরে এনেছিলো ব্যাঙ্ক নোটগুলো–একশো রুবলের নোট এক-একটা–মোট পনেরো হাজার রুবল ছিলো পোখ-এর ব্রীফকেসে।

কিন্তু তারপরেই ব্রীফ-কেসের খোপে সে একটা চিরকুট দেখতে পেয়েছিলো; তাতে লেখা: ব্যাঙ্কনোটের নম্বরগুলো সব ইয়োহাউজেন ব্রাদার্সের কাছে রয়েছে। পোখ এমনিতে ছিলো সাবধানী লোক; যখনি ব্যাঙ্কের টাকাকড়ি নিয়ে কোথাও যেত নম্বরগুলো টুকে রেখে আসতো। এই দেখে ক্রোফ মাথায় হাত দিয়ে বসেছিলো। টাকার জন্যে খুন করেছে, এখন এই টাকা চালাতে গেলে যে সে ধরা পড়ে যাবে। খুন করে কোনো লাভই তো তার হলো না।

তারপরেই মত্সবটা তার মাথায় খেলে গেলো। ভাবলে, খুনের দায়টা অন্য যাত্রীটির ঘাড়ে চাপিয়ে দেবে। বেরিয়ে গেলো সে সরাই থেকে, প্রথম ঘরের জানলার গোবরাটে বাইরে থেকে আঁচড় কেটে দাগ বানালো–যেন জানলা দিয়ে কেউ বেরুতে যাচ্ছিলো বা ঢুকতে যাচ্ছিলো, দৈবাৎ আঁচড় লেগে গিয়েছে। কয়লাগোঁজা হাতুড়ি দিয়ে তারপর দ্বিতীয় ঘরের জানলার খড়খড়ি ভাঙলো, তারপর ফিরে এলো আবার সরাইতে। হাতে অতগুলো টাকা, কিন্তু তার কাছে এদের কোনো দাম নেই। শুধু তাই নয়, এই নোটগুলো এখন তার অপকীর্তির বিপজ্জনক সাক্ষী। রাগে ক্ষোভে সে যেন জ্বলছিলো।

আর এই সময়েই তার মাথায় এলো আরেকটা মলব। অন্য যাত্রীটির ঘরে গিয়ে তার পকেটে এই নোটগুলো চালান করে দিয়ে, তার নিজের যা কিছু আছে, সব হাড়ে নিয়ে এলে কেমন হয়?

নিকোলেফের সঙ্গে ছিলো কুড়ি হাজার রুবল–ভ্লাদিমির ইয়ানোফকে দেবেন বলে টাকাটা তিনি সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন। তিনি যখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, তখন তার পকেট হাড়ে টাকাগুলো বার করে আনলে ক্রোফ–এও তো ব্যাঙ্কনোট, কিন্তু নিশ্চিন্ত, এদের নম্বর কারু কাছে টোকা নেই। বার করে নিলে সে পনেরো হাজার রুবল, বদলে রাখলো পোখ-এর ব্রীফ-কেস থেকে চুরি করা টাকাটা, তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। তারপর পাইনবনের মধ্যে ঢুকে একটা গাছের তলায় মাটি খুঁড়ে সে টাকাটা আর ছোরাটা লুকিয়ে রাখলো–এত সাবধানে সে কাজটা হাশিল করলে যে পরে পুলিশ তন্নতন্ন করে খুঁজেও তার কোনো হদিশ পায়নি।

চারটের সময় ঘুম থেকে উঠে নিকোলেফ সরাইওলার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে পেরনাউ-এর উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লেন। আর আঁটো হয়ে সন্দেহের ফাঁস তাঁর গলায় চেপে বসলো। এদিকে ক্রোফের কাছে রয়ে গেলো নিকোলেফের নোটগুলো–ইচ্ছে করলেই সে এগুলো চালাতে পারে, বিপদের কোনো ভয়ই তার নেই। চালালেও সে কতগুলো, খুবই সাবধানে অবশ্য, যাতে অত্যন্ত জরুরি ঋণগুলো মেটে।

সারজেন্ট য়েক চিনতে পেরেছিলো নিকোলেফকে, গোড়া থেকেই তার সন্দেহ ছিলো নিকোলেফের উপর। নিকোলেফ যখন তার ভ্রমণের উদ্দেশ্য ও গন্তব্য বলতে রাজি হননি তখন স্বভাবতই সকলের সন্দেহ পড়েছিলো তার উপর। কিন্তু ভ্লাদিমির ইয়ানোফের নাটকীয় আবির্ভাবের পর থেকেই অবস্থাটা পালটে গেলো। ক্রোফ যখন বুঝতে পারলে যে এবার তার উপরেই সব সন্দেহ এসে পড়ছে, তখন সে বিষম ভয় পেয়ে গেলো। পুলিশের নজরবন্দী সে তখনও, কিন্তু তবু সে নিকোলেফের উপর সন্দেহ চাপাবার আরেকটা ব্যবস্থা করলো। একটা ব্যাঙ্কনোটে রক্ত মাখালে সে, তারপর পোড়ালে তার আদ্ধেকটা রাত্তিরের অন্ধকারে উঠলো সে সরাইয়ের ছাতে;নিকোলেফ যে ঘরটায় গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন, সে-ঘরের চিমনি দিয়ে নোটটা গলিয়ে ফেলে দিলো নিচে। পরের দিনেই কেরস্টোফরা এলেন তদন্তে–আর নোটটা আবিষ্কৃত হলো। আবার অনেকক্ষণ জেরা করা হলো নিকোলেফকে, কিন্তু কেরস্টোফ কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না যে নিকোলেফের দ্বারা অমন-কোনো নৃশংস হত্যাকাণ্ড সম্ভব–তাই তিনি তাঁর নামে কোনো গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করতে রাজি হননি।

ক্রোফ তাতে আরো উদ্বিগ্ন ও শঙ্কাতুর হয়ে উঠলো। নিকোলেফের সমর্থকেরা যে তাকেই সন্দেহ করছে, এটা বুঝতে পেরে তার মাথায় আবার পোকা কিলবিল করে উঠলো। সে কেবল অপেক্ষা করছিলো কখন নিকোলেফ নম্বরি নোটগুলো না-জেনেশুনে চালাবার চেষ্টা করেন–কারণ তাহলে আর তার সমর্থকদের কিছুই বলবার থাকবে না। কিন্তু নিকোলেফ, কই, নোটগুলো তো চালাবারই চেষ্টা করছেন না!

শেষটায় ক্রোফ যখন দেখলে যে তার নামেই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হতে যাচ্ছে, তখন সে সব বিবেচনাশক্তি হারিয়ে ফেললো। সে যদি ঘুণাক্ষরে জানতো যে চোরাই নোটগুলো গিয়ে ইয়োহাউজেন ভাইদের হাতে পড়েছে, তাহলে সে নিজেকে বাঁচাবার জন্য অমন মরিয়া হয়ে উঠতো না।

কিন্তু সে তখনো এ-তথ্য জানতো না। তখনো সে স্বাধীন, রিগা যেতে পারে অনায়াসে; কতবার তো পুলিশই তাকে রিগা যাবার জন্য এত্তেলা পাঠিয়েছিলো। এলো সে রিগায় এক রাত্তিরে, অধ্যাপকের বাড়ির বাইরে ওঁৎ পেতে রইলো, ইচ্ছে অধ্যাপককে খুন করবে- এমনভাবে খুন করবে যে লোকে দেখে ভাবে যেন নেহাৎই আত্মহত্যা।

দৈব ছিলো তার সহায়। দেখলো নিকোলেফ উন্মত্তের মতো ছুটে বেরিয়ে এলেন বাড়ি থেকে। অনুসরণ করলো সে তাঁকে সন্তর্পণে; শেষকালে যখন তাকে ফাঁকা রাস্তায় পেলো, ছোরা বসিয়ে দিলে তার বুকে–সেই ছোরাটা, যা সে একদিন পোখ-এর বুকে বাঁটশুষ্টু ঢুকিয়ে দিয়েছিলো।

এবার আর লোকে প্রমাণগুলো অবিশ্বাস করতে পারলো না। অনুমান করলো যে চোরাই নোটগুলো ইয়োহাউজেনদের হাতে গিয়ে পড়তেই ধরা পড়বার ভয়ে নিকোলেফ আত্মহত্যা করেছেন–আসলে তিনিই পোখ-এর নির্মম হত্যাকারী।

হত্যারহস্যের উপর যবনিকা পড়েছে বলেই পুলিশ ধরে নিলে। ক্রোফ–এখন সে সন্দেহমুক্ত–নিশ্চিন্তচিত্তে দিন কাটাতে পারে। তার ডবল হত্যাকাণ্ডের জন্য কোনো সাজাই তার হবে না।

কিন্তু বেশিদিন আর সুখভোগ করতে হলো না তাকে। যখন রোগের প্রকোপ বাড়লো, বুঝতে পারলো শেষের সেদিন প্রত্যাসন্ন, নরকের ভয়ে ভীত সে সব স্বীকার করে গেলো পোপের কাছে। তার মৃত্যুর পর সব কথা যেন জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয় এই সে বলে গেলো পোপকে–চোরাই টাকা সে বেশি খরচ করেনি; পোপকে বললে তা যেন তার মৃত্যুর পর তিনি তার বৈধ মালিক ভ্লাদিমির ইয়ানোফকে ফিরিয়ে দেন।

দিমিত্রি নিকোলেফের পুনর্বাসন হলো সত্যি, কিন্তু তিনি তা জেনে যেতে পারলেন না। তিনি শয়ান থেকে গেলেন সেই মাটির নিচে, কালো ঠাণ্ডা নিঃসাড় কফিনে, তাঁর মৃন্ময় দেহ ফিরে গেছে মাটিতেই; যেমনভাবে ক্রোফের মৃতদেহ একদিন মাটিতে মিশে যাবে।