১৩-১৪. আবার জেরা

১৩. আবার জেরা

ভ্লাদিমির ইয়ানোফকে যে ক্ষমা করা হলো তার প্রতিক্রিয়া হলো বিপুল শুধু রিগায় নয়, সমগ্র বলটিক রাজ্যগুলিতেই, সরকার যে এখন জার্মান-বিরোধী প্রবণতাকে প্রশ্রয় দিতে চাচ্ছেন, এই নির্দেশে তারও ইঙ্গিত পাওয়া গেলো। শ্রমিকশ্রেণী, সাধারণ মানুষ এতে খুবই খুশি, শুধু ক্ষুব্ধ হলো জমিদারেরা, বণিকসম্প্রদায় ও মধ্যবিত্তরা। তাদের মনে হলো এই নির্দেশের মধ্য দিয়ে শুধু ভ্লাদিমিরকেই নয়, দিমিত্রি নিকোলেফকেও দয়া দেখানো হয়েছে। কিন্তু, এটা ঠিকই যে ভ্লাদিমির যেভাবে দিমিত্রিকে বাঁচাবার জন্য জীবন বিপন্ন করে নিজে থেকেই এসে ধরা দিয়েছিলো, তাতে তাকে ক্ষমা না-করে কোনো উপায় ছিলো না। কিন্তু এর মধ্যে দিয়ে অধ্যাপক নিকোলেফকে সন্দেহ করার জন্যও কর্তৃপক্ষের প্রতিবাদ উহ্য আছে–এতদিন তিনি ছিলেন দেশের সর্বজনশ্রদ্ধেয় ও সম্মানযোগ্য নাগরিক, আগামী নির্বাচনে তিনি স্লাভদলের হয়ে দাঁড়াবেন বলে স্থির; এই অবস্থায় কোনো প্রমাণ ছাড়াই শুধু সন্দেহের উপর ভিত্তি করে তাকে লাঞ্ছিত করা সেন্ট পিটার্সবুর্গ খুব-একটা সুনজরে দ্যাখেনি।

অন্তত জারের বদান্যতার এই অর্থই করলেন রাজ্যপাল জেনারেল গোরকো এবং তার মতামত তিনি অধস্তন কর্মচারীদের কাছে চেপে রাখলেন না। ভ্লাদিমির ইয়ানোফকে মুক্ত করে দেয়া হলো; সে ফিরে গেলো নিকোলেফ-ভবনে। একটু পরেই এলেন পারিবারিক বন্ধুরা : ডাক্তার হামিনে ও মঁসিয় দ্যলাপোর্ৎ। ভ্লাদিমিরের মুক্তিতে সবাই খুব খুশি।

বিকেলে চায়ের বৈঠক বসেই ঠিক হলো ইলকা ও ভ্লাদিমিরের বিয়েটা এবারে হয়ে যাওয়া উচিত। বিয়ের দিন ঠিক হলো ছ-সপ্তাহ পরে। মধ্যবর্তী সময়টা ভ্লাদিমির নিকোলেফ- ভবনেই থাকবে নিচের তলায় একটা ঘরে।

+

নিকোলেফ-ভবনে যখন স্বপ্নেরও অতীত আনন্দের হাট বসেছে, ইয়োহাউজেন পরিবারে তখন কিন্তু অবস্থাটা ঠিক তার উল্টো। তার কারণ এই নয় যে, কার্ল-এর দশা শোচনীয় হয়ে উঠেছে– বরং চিকিৎসক জানিয়েছেন যে সময় ও শুশ্রূষা পেলে কার্ল সেরে উঠবে– জখম যদিও গুরুতর, তবু প্রাণের ভয় নেই। আসলে ফ্রাঙ্ক ইয়োহাউজেনের দুঃখের কারণ অন্যত্র। ভেবেছিলেন, অধ্যাপক নিকোলেফকে বুঝি তিনি শাবাড় করে এনেছেন, কিন্তু এখন দেখতে পেলেন ঘটনার গতি অন্য খাতে বইছে। এখন কেবল তার হাতে আছে শেষ অস্ত্র-দেনার দায়ে শত্রুকে কোণঠাসা করা ছাড়া এখন আর নিকোলেফের ক্ষতি করার কোনো উপায় তার হাতে নেই। এই ঋণপত্রই তাঁর তুরুপের তাস। কিন্তু এই রঙের টেক্কাটিকে সহজে ব্যবহার করতে চাচ্ছিলেন না তিনি, কেননা তার ফলে তার সম্বন্ধে লোকের মনোভাব বিরূপ হয়ে উঠবে বিশেষত এখন যখন লোকের সহানুভূতি নিকোলেফের প্রতি। খুনের ব্যাপারটায় জনমত এখন স্পষ্টতই ক্রোফ-এর বিপক্ষে, সকলেরই এখন ধারণা যে সরাইওলাই সে রাত্রে পোখকে সুযোগ পেয়ে খুন করেছিলো। ফ্রাঙ্ক ইয়োহাউজেনের মনস্তাপের কারণ এখন এই জনমত।

+

সত্যি, জনমতের চাপটা এমনি প্রবল হয়ে উঠলো যে কর্তৃপক্ষকে আবার নতুন করে তদন্তের ব্যবস্থা করতে হলো : আবার যেতে হলো সেই ভাঙা কুশের সরাইখানায়। ৫ই মে কেরস্টোফ নিজে গেলেন সেখানে তদন্তে, সঙ্গে গেলেন মেজর ফেরডের ও সার্জেন্ট য়েক।

ক্রোফ, দেখা গেলো, তাদেরই প্রত্যাশা করছিলো। হঠাৎ এই সমাগম দেখে সে কিন্তু মোটেই অবাক হয়নি। সে শুধু বললে, বুঝতে পারছি, কেউ-একজন আমার ঘাড়েই দোষ চাপাবার চেষ্টা করছে; তবে আশা করছি, আপনারা যাবার আগেই বুঝতে পারবেন যে আমি নির্দোষ।

দেখা যাক, উত্তরে ছোট্ট করে বললেন কেরস্টোফ।

আবার সব তন্নতন্ন করে দেখা হলো; দেখা হলো বাগান, বাগানের। চালাঘর, প্রত্যেক গাছের তলা, ঝোঁপের ধার, শজিখেত। ক্রোফ যদি চুরি করে থাকে, তাহলে নিশ্চয়ই চোরাই টাকা সে কোথাও মাটির তলায় লুকিয়ে রেখেছে– সুতরাং এ-বিষয়টায় নিঃসন্দেহ হওয়া উচিত।

কিন্তু সব খোঁজাখুঁজিই নিষ্ফল হলো, আর টাকা? ক্রোফের সিন্দুকে দেখা হলো সবশুদ্ধ শ খানেক রুক্ল আছে তাদের কোনোটিই নম্বরি নোট নয়।

সব দেখে মেজর ফেরডের একপাশে ডেকে নিয়ে গেলেন কেরস্টোফকে : মঁসিয় কেরস্টোফ, এটা ভুলবেন না যে, খুনের পর থেকে ক্রোফ কখনো একা কোথাও যায়নি ওর পেছনে সবসময় পুলিশের লোক ছিলো। মেজর ফেরডেরের এখনও বদ্ধমূল ধারণা, নিকোলেই খুনী- কাজেই ক্রোফের এখানে তত্ত্বতালাশ করা সবই পণ্ডশ্রম।

কেরস্টোফ বললেন, তা আমি জানি। কিন্তু নিকোলেফ সে-রাত্রে সরাই থেকে চলে যাবার পর পুলিশ আসার আগে পর্যন্ত ক্রোফ কয়েক ঘণ্টা সময় পেয়েছিলো। চোরাই টাকা লুকোবার পক্ষে সেই সময়টুকুই যথেষ্ট।

কিন্তু এখন তো দেখতেই পেলেন ওকে জড়াবার মতো সন্দেহজনক কিছু পাওয়া যায়নি।

এখন পর্যন্ত কিছু পাইনি–তা সত্যি। কিন্তু এখনও তো আমাদের অনুসন্ধান শেষ হয়নি। ঘর দুটোর চাবি তো আপনার কাছে আছে, তাই না?

মেজর ফেরডের চাবি দুটো বার করলেন : সেই দুটি ঘরের চাবি, যার একটায় ছিলো পোখ, অন্যটায় দিমিত্রি নিকোলেফ, পোখ যে-ঘরটায় খুন হয়েছিলো সে-ঘরটাই প্রথমে খোলা হলো।– প্রথমবার সরেজমিন তদন্ত করে যাবার সময় পুলিশ ঘরটাকে যেমন রেখে গিয়েছিলো, ঠিক তেমনি আছে ঘরটি। বাইরে থেকে কেউ যে খড়খড়ি খুলে ঘরে ঢোকবার চেষ্টা করেনি, পরীক্ষা করে দেখে সে বিষয়ে নিঃসন্দেহ হওয়া গেলো। তেমনি পড়ে আছে বিছানা– এলোমেলা; বালিশে রক্তের দাগ, দরজা অব্দি মেঝে লাল রঙে ছোপনো! নতুন কোনো সূত্রই পাওয়া গেলো না : খুনী- সে যেই হোক না কেন– পিছনে কোনো সূত্ৰই রেখে যায়নি।

চলুন তবে অন্য ঘরটায়, কেরস্টোফ বললেন।

প্রথমেই দরজাটা তন্নতন্ন করে দেখা হলো : কবাটের বাইরের দিকে সন্দেহজনক কোনো দাগ নেই। তাছাড়া গত দশদিনে কেউ যে ও-ঘরে ঢোকবার চেষ্টা করেনি, পাহারা-পুলিশ তা হলফ করে বললে তারা কখনো ও-জায়গা ছেড়ে নড়েনি গত দশদিনে। ঘরটার মধ্যে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার।

সার্জেন্ট য়েক গিয়ে জানলা খুলে দিলে, যাতে ঘরে আলো আসে। না, গতবার যেমন রেখে যাওয়া হয়েছিলো তেমনি আছে ঘরটা কোনো বদলের কোনো চিহ্ন নেই। নিকোলেফ যে-বিছানায় শুয়েছিলেন, তার শিয়রের কাছে একটা টেবিলে বাতিদানে একটা আধপোেড়া মোম পড়ে আছে। এক কোনায় একটা চেয়ার, অন্য ধারে একটা টুল। ডানপাশে একটা বন্ধ দেরাজ। চুল্লির উপরে, কিংবা বলা যায় দুটো চ্যাপ্টা পাথরে বসানো কাজ চালানো গোছের চুল্লির উপরে চিমনি বসানো– তার তলার দিকটা সুপরিসর, ছাতের দিকটা ক্রমশ সরু হয়ে গেছে। বিছানাটা দেখা হলো তন্নতন্ন করে–না, সন্দেহজনক কিছু নেই। দেরাজ খুলে দেখা হলো- সেটা ফাঁকা পড়ে আছে- কাপড়চোপড় বা কাগজপত্র কিছুই নেই।

চুল্লির পাশেই পড়েছিলো কয়লা খোঁচাবার লম্বাটে হাতুড়িটা–খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে পরীক্ষা করা হলে সেটাকে। এর মুখটা বাঁকা, দোমড়ানো গোছের, কাজেই খড়খড়ি তুলে হাতুড়িটা ভিতরে ঢুকিয়ে চাপ দিলে জানলা খুলতে দুঃসাধ্য হবার কথা নয়। কিন্তু খিলগুলো এত পুরোেনো ও জীর্ণ যে ছোট্ট একটা কঞ্চি ঢুকিয়ে চাপ দিলেই নিশ্চয় ভেঙে যাবে। আর জানলার গোবরাটে যে-দাগগুলো, তা যে জানলা বেয়ে ভিতরে ঢোকবার সময়ে সৃষ্টি হয়েছে, তা কি হলফ করে বলা যায়? অন্যকোনো কারণেও গোবরাটে ও-দাগ হতে পারে।

চুল্লির কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন কেরস্টোফ। সে-রাত্তিরে যাত্রীটি কি আগুন জ্বালিয়েছিলো? জিগেশ করলেন তিনি ক্রোফকে।

না, সরাইওলা উত্তর দিলে।

কিন্তু এই-যে ছাই পড়ে আছে? এগুলো কি প্রথমবার তদন্তের সময় পরীক্ষা করে দেখা হয়েছিলো?

মেজর ফেরডের বললেন, মনে তো হয় না।

তাহলে এখন পরীক্ষা করে দেখুন।

সার্জেন্ট নিভন্ত চুল্লিটার উপর ঝুঁকে পড়লো। বাঁদিকে দেখতে পেলে একটা কাগজের টুকরো পোড়া কাগজের টুকরো, ছাই-ভস্মের মধ্যে পড়ে আছে।

পোড়া কাগজটা তুলে দেখবামাত্র সবাই চমকে গেলেন : একটা ব্যাঙ্কনোটের টুকরো। হ্যাঁ, একশো রুবলের একটা নোট- নম্বরের জায়গাটা পুড়ে গিয়েছে, বোধহয় টেবিলের ঐ জ্বলন্ত মোমবাতির শিখায় কোনোভাবে পুড়ে গিয়েছে। আরো সাংঘাতিক : রক্তের ছিটে লেগে আছে নোটটায়। খুনীর হাতে রক্ত ছিলো নিশ্চয়ই, রক্তমাখা হাতে ধরেছিলো বলেই রক্তের দাগ লেগেছিলো নোটটায় আর রক্ত লেগেছে বলেই নিশ্চয়ই নোটটাকে সে পোড়াতে চাচ্ছিলো।

আর পোখ-এর ব্রীফ-কেস ছাড়া আর কোত্থেকেই বা আসতে পারে নোটটা। কিন্তু পুরো নোটটা পোড়েনি বলে এখন তার দাম একশো রুবলেরও অনেক বেশি–কেননা খুনীর বিরুদ্ধে এটা প্ৰজ্বলন্ত প্রমাণ।

ক্রোফ আর নিজেকে শামলাতে পারলে না, বলে উঠলো, কী বলেছিলুম? এবার আমার নির্দোষিতায় আর সন্দেহ নেই তো আপনাদের?

কেরস্টোফ প্রথমে তার নোটবইয়ের কাগজের ভাঁজে সন্তর্পণে আধপোড়া নোটকে রাখলেন, তারপর শান্ত ধীর স্বরে বললেন, তদন্ত শেষ হয়েছে–চলুন, এবার যাই।

+

পরদিন সকালবেলাতেই ফ্রাঙ্ক ইয়োহাউজেন এই নতুন তথ্যটি জানতে পেলেন। ব্যাঙ্কনোটের নম্বরের জায়গাটুকু পুড়ে গিয়েছিলো, তাই মিলিয়ে অবিশ্যি দেখা গেলো না, তবে সন্দেহ নেই যে নোটটা পোখ-এর ব্রীফ-কেসেই ছিলো নইলে ওখানে ঐ চুল্লিতে আর কী করে আসবে।

খবর যেন পাখির মতো উড়াল দেয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই রিগার সব লোক এই সংবাদ শুনতে পেলে। নিকোলেফের শুভানুধ্যায়ীরা খবরটা শোনবামাত্র অভিভূত হয়ে গেলেন।বোঝাই যাচ্ছে যে তদন্তের এটা দ্বিতীয় ও বিষম পর্যায়। ইয়োহাউজেনরা অবিশ্যি খুবই আহ্লাদিত হয়ে উঠলেন। এবার আর নিকোলেফের গ্রেফতার ঠেকায় কে? একবার জুরিদের সামনে দাঁড় করালেই এই নৃশংস হত্যার সমুচিত শাস্তি তিনি পাবেন।

চাদিমিরকে খবরটা জানিয়েছিলেন ডাক্তার হামিনে। দুজনেই স্থির করেছিলেন যে নিকোলেফকে এ-সম্বন্ধে তারা নিজে থেকে কিছু খুলে বলবেন না– শিগগিরই অন্য ও ভয়ংকর সূত্র থেকে খবরটা তিনি জেনে যাবেন। ভ্লাদিমির চেয়েছিলো ইলকার কাছ থেকে গুজবটা লুকিয়ে রাখে। কিন্তু তা কি আর সম্ভব? ভ্লাদিমির বাড়িতে এসে দেখলে ইলকা বসে আছে, গভীর শোকে আচ্ছন্ন। তাকে দেখেই বেচারি তীব্র অস্ফুট স্বরে বলে উঠলো, বাবা কোনো দোষ করেননি, ভ্লাদিমির, বাবা নিরপরাধ!

কী আশ্চর্য! এটা কি আবার বলবার কথা নাকি? দিমিত্রি যে নিরপরাধ এটা আমরা সব্বাই জানি। আসল অপরাধীকে খুঁজে বার করতে হবে আমাদের তাহলেই এ-সব গুজব আর রটবে না। আমার কিন্তু খুবই মনে হয় যে দিমিত্রিকে এই খুনের মামলায় জড়াবার পেছনে একটা-কোনো গভীর ষড়যন্ত্র আছে।

খুব-যে একটা ভুল সন্দেহ করেছিলো ভ্লাদিমির, তা নয়। রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র যে কী-রকম গভীর ও দূরস্পর্শী হতে পারে, তা সাইবেরিয়ায় কিছুকাল কাটিয়ে আসার পর তার চেয়ে ভালো করে আর কে জানে। কিন্তু লক্ষণ দেখে মনে হচ্ছে ষড়যন্ত্রকারীরা যে-রকম আটঘাট বেঁধে নেমেছে তাতে দিমিত্রি না আইনের চোখে দোষী বলে প্রমাণিত হয়ে যান। ইলকাকে সান্ত্বনা দিলেও ভ্লাদিমির নিজে কিন্তু একফোঁটাও স্বস্তি পাচ্ছিলো না পুলিশের হাতের এই নতুন সূত্রটিকে তার মনে হচ্ছিলো এই সাজানো মামলার বিরুদ্ধ পক্ষের তুরুপের তাস।

+

বিকেলবেলাতেই এত্তেলা এলো ম্যাজিস্ট্রেটের : নিকোলেফ যেন অবিলম্বে কেরস্টোফের আপিশে গিয়ে হাজির হন। প্লাদিমির সঙ্গে যেতে চেয়েছিলো, কিন্তু দিমিত্রি তক্ষুনি তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে দিলেন।

কেরস্টোফ নিজে কিঞ্চিৎ বিচলিত ছিলেন- এটা তিনি কিছুতেই ভাবতে পারছিলেন না যে দিমিত্রির দ্বারা এই খুন সম্ভব। অথচ যেভাবে প্রমাণ জড়ো হচ্ছে, তাতে দিমিত্রিকে তিনি গ্রেপ্তার করবেন কিনা শিগগিরই সে-সিদ্ধান্ত নিতে হয়।

নিকোলেফকে দেখে প্রথমে তাকে বসতে বললেন তিনি, তারপর বললেন, মঁসিয় নিকোলেফ, কাল আমরা সরাইখানাটায় সরেজমিন তদন্তে গিয়েছিলুম–আমি নিজে উপস্থিত ছিলুম তদন্তের সময়। পুলিশ পুরো বাড়িটা তন্নতন্ন করে খুঁজেছে। নতুন-কোনো সূত্রই পাওয়া যায়নি, তবে আপনি যে-ঘরটায় রাত কাটিয়েছিলেন, সেই ঘরে এই জিনিশটা পাওয়া গেছে। বলে তিনি আধপোড়া ব্যাঙ্কনোটটা বাড়িয়ে দিলেন অধ্যাপকের দিকে।

কী কাগজ এটা?

একটা ব্যাঙ্কনোটের টুকরো–নোটটা পুড়িয়ে চুল্লিতে ফেলে দেয়া হয়েছিলো।

পোখ-এর ব্রীফ-কেসের ব্যাঙ্কনটের একটা?

সম্ভবত। আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, মঁসিয় নিকোলেফ, এটা আপনার বিরুদ্ধে একটা অকাট্য প্রমাণ হিশেবে…

আমার বিরুদ্ধে? অধ্যাপকের গলার স্বর বিদ্রুপে ভরে উঠলো। তাহলে আমার উপর থেকে আপনাদের সন্দেহ যায়নি এখনো? স্নাদিমির ইয়ানোফের বিবৃতি সত্ত্বেও আপনাদের এখনো ধারণা যে আমিই খুন করেছি!

উত্তর দেবার আগে কেরস্টোফ একটু ইতস্তত করলেন। এই অধ্যাপকের উপর পর-পর অনেক ঝড় গেছে, তার জের শামলাতে না-শামলাতেই আবার এই নতুন ও ভয়ংকর প্রমাণ।

নিকোলেফ বললেন, আমি যে ঘরটায় রাত কাটিয়েছিলুম সে ঘরের চুল্লিতে নোটটা পাওয়া গেছে, তাই না?

হ্যাঁ, মঁসিয় নিকোলে।

ধর্মাধিকরণ প্রথম সেখানে পদার্পণ করার পর থেকে ঘরটা বন্ধ ছিলো।

হ্যাঁ, তালা লাগানো ছিলো। দরজাটা যে এর মধ্যে ভোলা হয়নি সে-বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

ফলে কারু পক্ষেই এর মধ্যে সে-ঘরে ঢোকা সম্ভব ছিলো না?

না, কারু পক্ষেই ছিলো না।

ভূমিকাগুলো যেন পালটে গেছে–নিকোলেফ জেরা করছেন, কেরস্টোফ উত্তর দিচ্ছেন। কিন্তু কেরস্টোফ ভেবে দেখলেন, জিজ্ঞাসাবাদের কাজটা যেভাবে এগুচ্ছে, তা আসলে তাকে অনেক অস্বস্তিকর প্রশ্ন করার হাত থেকে বাঁচিয়ে দেবে। তাই তিনি কোনো রকম দ্বিধা না-করেই নিকোলেফের প্রশ্নের উত্তর দিতে লাগলেন।

নোটটাকে খুঁটিয়ে দেখে নিকোলেফ বললেন, রক্তমাখা নোট, অথচ পুরোটা পোড়েনি। কী বললেন, চুল্লির ছাইয়ের মধ্যে পড়ে ছিলো?

হ্যাঁ।

তাহলে প্রথমবার তদন্তের সময় এটা সকলের চোখ এড়িয়ে গিয়েছিলো কেমন করে?

সত্যি কথা বলবো? আমি তা জানি না। ব্যাপারটা আমাকে স্তম্ভিত করে দিয়েছে। কিন্তু নিশ্চয়ই চুল্লিতেই পড়েছিলো নোটটা– কারণ পরে তো কারু দিয়েছে।ঘরে ঢোকা সম্ভব কালেফ বললেন এবড়ে যাওয়া উণ্ডিয় চুল্লিতে

একটু ব্যঙ্গের স্বরে নিকোলেফ বললেন, আমিও আপনার চেয়ে কম স্তম্ভিত হচ্ছি না। তবে আমার বোধ হয় খুব ঘাবড়ে যাওয়া উচিত। কারণ আপনাদের অনুমান নিশ্চয়ই এ-রকম যে, আমিই নোটটাকে পুড়িয়ে চুল্লিতে ছুঁড়ে ফেলেছিলুম।

তা ঠিক।

তাহলে, নিকোলেফ ঠোঁট বেঁকিয়ে বললেন, তো এই দাঁড়ায় যে, নোটটা যেহেতু পোখ-এর বাণ্ডিলের একটা, পোখ-এর ব্রীফ-কেস থেকেই যেহেতু তার হত্যার পর এটা চুরি করা হয়েছে, অতএব সে-রাতে ও-ঘরে যে-লোকটা রাত কাটিয়েছিলো সে-লোকটাই চোর আর খুনী

কেরস্টোফ আগাগোড়া লক্ষ করছিলেন নিকোলেফকে। এ-সম্বন্ধে কারু সংশয় থাকতে পারে কি?

না, তা থাকবে কী করে? কী রকম অকাট্য পারম্পর্য, লক্ষ্য করেছেন? একটা শেকলের অংশ–সিদ্ধান্তও চমৎকার। কিন্তু আপনাদেরই যুক্তির ধরনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে আরেকটা সিদ্ধান্তে গিয়ে পৌঁছোনো যায়।

বলুন।

রাত চারটে নাগাদ সে-রাতে আমি সরাইখানাটা ত্যাগ করি। প্রশ্ন হলো, খুনটা কি হয়ে গিয়েছিলো ততক্ষণে? আমি যদি খুনী হই, তাহলে হয়েছিলো নিশ্চয়ই আর আমি খুনী না-হলে হয়নি। যাকগে, এটা আসলে আমাদের আলোচ্য না। কিন্তু এমনও তো হতে পারে যে আমি চলে যাবার পর আততায়ী খুব ভেবেচিন্তে সব সন্দেহ পোখ-এর সহযাত্রীর ঘাড়ে চাপিয়ে দেবার জন্য সব-কিছু সাজাতে পারতো। সে কি যেতে পারতো না আমার ঘরে, হাতুড়িটা সঙ্গে নিয়ে? সে কি নোটটা ইচ্ছে করে আদ্ধেক পুড়িয়ে নেভানো চুল্লিতে রেখে দিতে পারতো না? সে কি জানলার গোবরাটে আঁচড় কাটতে পারতো না?

আপনি যা বলছেন, মঁসিয় নিকোলেফ, তা থেকে মনে হয় আপনি সরাইওলা ক্রোফকে অভিযুক্ত করছেন।

ক্রোফ, কিংবা অন্য-কেউ। তাছাড়া, খুনী কে, সেটা ধরে দেবার দায় আমার নয়। আমার কাজ হলো নিজেকে বাঁচানো– সব যোগসাজশ ও ষড়যন্ত্রের হাত থেকে আত্মরক্ষা করা।

কেরস্টোফ, সত্যি, একটু বিমূঢ় বোধ করছিলেন। নিকোলেফের কথায় সত্যিই যুক্তি যথেষ্ট। তাছাড়া, তাঁর মতো মানী লোক, সৎ লোক, গোটা রিগা যাঁকে এতকাল সতোর জন্য সম্মান করেছে, তাকে তিনি কিছুতেই খুনী বলে ভাবতে পারছিলেন না। কিন্তু এটাও তো সত্যি যে তদন্তে ক্রোফ-এর বিরুদ্ধে কোনো তথ্যই পাওয়া যায়নি কিছু না।

আরো এক ঘণ্টা ধরে কথাবার্তা হলো দুজনে। কেরস্টোফ নিকোলেফকে এটাও বললেন যে ক্রোফকে সন্দেহ করবার মতো কোনো সূত্র বা প্রমাণ পুলিশের হাতে নেই। কিন্তু ঘটনার পরম্পরা তার প্রতিও বিরূপ।

তখন নিকোলেফ সোজাসুজি বললেন, সূত্রগুলো কার বিরুদ্ধে ইঙ্গিত করছে, সেটা নির্ধারণ করার যাচাই করার দায় আপনাদের। কেউ যদি ভোলা মন নিয়ে ব্যাপারটার দিকে তাকায়, তাহলে আমাকে খুনী বলে সন্দেহ করবে না। আপনি তো এখন জানেন আগে কেন আমি যাত্রার উদ্দেশ্য ও গন্তব্য গোপন রাখতে চাচ্ছিলুম। এখন যখন ভ্লাদিমির ইয়ানোফ নিজেই প্রকাশ্যে আবির্ভূত হয়েছে, তখন আমার সম্বন্ধে আগে যাও-বা সন্দেহ ছিলো তা নিশ্চয়ই কেটে গিয়েছে। কে খুন করেছে সরাইওলা, না বাইরের কেউ, সেটা বার করার দায়িত্ব পুলিশের। কিন্তু আমার এ-বিষয়ে কোনো সন্দেহই নেই যে ক্রোফই খুনী। পোখ যে রেফেল যাচ্ছে ব্যাঙ্কের টাকা নিয়ে, এটা সে জানতো এও যে টাকার অঙ্ক নেহাৎ কম নয়। আমি যে রাত চারটেতে সরাই ছেড়ে চলে যাবো তাও সে জানতো। কত সুবিধে তার–খুনটা করে আমার ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দিলেই চলবে। কখন খুন করেছিলো, আমি সরাই ছেড়ে চলে যাবার আগে না পরে, তা জানি না। কিন্তু আমি চলে যাবার পর আমি যে-ঘরে রাত কাটিয়েছিলুম, সে-ঘরে ঢুকে আমার বিরুদ্ধে সূত্র ছড়াতে প্রমাণ সাজাতে কতক্ষণই বা তার লেগেছিলো। সব সত্ত্বেও তবু যদি আপনাদের বদ্ধমূল ধারণা হয় যে আমিই খুনী, বেশ, তবে জুরির সামনে দাঁড় করান আমাকে–সর্বসমক্ষে ক্রোফকে অভিযুক্ত করবো আমি– সবাই বিশ্লেষণ করে দেখলেই বুঝতে পারবে যে, কে খুনী–আমি না ক্রোফ।

নিকোলেফ মোটেই উত্তেজিত হননি। ঠাণ্ডাভাবে, বৈজ্ঞানিক তথ্য বলবার ভঙ্গিতে, সব কথা বলছিলেন। মামলাটার নিষ্পত্তি করে ফেলেছেন, এ নিয়ে আর উত্তেজিত হবার কিছু নেই, ভঙ্গিটা ছিলো এ-রকম। কেরস্টোফ সব শুনলেন চুপচাপ, কিছু বললেন না। শেষটায় নিকোলেফ জিগেশ করলেন, আপনি কি আমার গ্রেপ্তারি পরোয়ানায় সই করবেন?

উত্তরে কেরস্টোফ শুধু বললেন, না, দিমিত্রি নিকোলে।

.

১৪. আঘাতের পর আঘাত

খুনী কে-ক্রোফ, না অধ্যাপক দিমিত্রি নিকোলেফ–এই প্রশ্নটিকে ঘিরেই লোকের মুখে-মুখে কথা ফিরতে লাগলো। প্রথম থেকেই এই খুনের খবরটা বিপুলভাবে প্রচারিত হচ্ছিলো, নানা রকম রাজনৈতিক স্বার্থ জড়ানো ছিলো বলে বোধহয় এত তার প্রচার–কিন্তু জটিলঝুরি রহস্য, জটের পর জট পাকিয়ে গেছে, এমন একটা খুনও সচরাচর হয় না–তাই গোটা বলটিক প্রদেশে এই নিয়ে হৈ-চৈ উঠলো, তুলকালাম কাণ্ড একেবারে। ক্রোফের দেহে জর্মান রক্ত, নিকোলেফ স্লাভ-কাজেই দুটো বিরুদ্ধ দল তৈরি হয়ে গেলো চটপট, সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামার সর্বনেশে পূর্বাভাস যেন। এদিকে রাজ্যপালের দশাও ক্রমে করুণ হয়ে উঠছে। পৌরনির্বাচন আসন্ন–স্লাভরা এখন অধিকতর উৎসাহের সঙ্গে ফ্রাঙ্ক ইয়োহাউজেনের বিরুদ্ধে দিমিত্রি নিকোলেফকে নির্বাচনে দাঁড় করাবার জন্য তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছে। আর ধনকুবের ইয়োহাউজেনরাও সবান্ধবে দিমিত্রির বিরুদ্ধে কুৎসা রটনায় মুখর। টাকা আছে তাদের, আছে প্রতিপত্তি ও ক্ষমতা, খবরের কাগজগুলো পর্যন্ত তাদেরই হাতধরা। কাজেই শেষ পর্যন্ত রব উঠলো : অবিলম্বে গ্রেফতার করতে হবে দিমিত্রিকে– ও-রকম একটি নৃশংস খুনীকে এভাবে ছেড়ে রাখা চলবে না।

আর এই ডামাডোলের মধ্যেই কেটে গেলো সাত দিন।

এদিকে ইয়োহাউজেনদের কাছে দিমিত্রির দেনার টাকা ফেরৎ দেবার শেষদিন এগিয়ে এলো–পরের দিন চোদ্দই; সেদিন যদি আঠারো হাজার রুবল না-নিয়ে তিনি ইয়োহাউজেন ব্রাদার্স-এর আপিসে হাজির হতে না পারেন, তাহলে তাকে নিয়ে যাওয়া হবে আদালতে। অথচ আজও তিনি টাকাটা জোগাড় করতে পারেননি। প্রায় সাত হাজার রুবল তিনি জমা দিয়েছিলেন কিছুদিন আগে, ভেবেছিলেন বাকি টাকাটা জমা দেবার মেয়াদ একটু বাড়িয়ে দেওয়া হবে কিন্তু এখন সব যেতে বসেছে তাঁর, মান-সম্ভ্রম, সব–এখন দেউলে বলে ঘোষিত না-হয়ে তার কোনো উপায় নেই।

আর ফ্রাঙ্ক ইয়োহাউজেন এটাই চাচ্ছিলেন। হয় দিমিত্রি পুরো টাকাটা নির্দিষ্ট তারিখের মধ্যে জমা দেবেন, নয় দেউলে হয়ে পৌর অধিকার সব হারিয়ে বসবেন–এর মাঝামাঝি কোনো মিটমাটের মধ্যে তিনি যাবেন না। গোড়ায় ভেবেছিলেন খুনের মামলাটায় বুঝি কোণঠাশা করে এনেছেন দিমিত্রিকে, কিন্তু এখন যখন দেখলেন যে খুনের রহস্যের কোনো কিনারাই হলো না, তখন আস্তিন থেকে বার করলেন তাঁর তুরুপের তাস–এই বিপুল ঋণ। কোনো টাকাই তো নেই দিমিত্রির–এ-তথ্য গোপনে সন্ধান নিয়ে নির্ভুল জেনে নিয়েছেন। যদি এখন তিনি টাকাটা জমা দিতে পারেন, তাহলে বুঝতে হবে যে চোরাই টাকা–এবং তাহলে উলটো দিক থেকে তার গলায় ফাঁস এঁটে বসে। না, এই স্লাভদের কোনো দয়া করা চলবে না। শোধ নিতেই হবে কার্ল-এর রক্তপাতের, তাছাড়া দিমিত্রিকে নির্বাচনেও দাঁড়াতে দেয়া হবে না।

পরের দিন সকালবেলাটা কেটে গেলো–ইয়োহাউজেন ব্রাদার্সদের খাজাঞ্চিখানায় দিমিত্রির আবির্ভাব ঘটলো না। বিকেলবেলা, চারটে নাগাদ, পরোয়ানা বার করা হলো খাজাঞ্চিখানা থেকে–সেদিন আঠারো হাজার রুবল জমা দিতে না পারার জন্য পরোয়ানা।

পরোয়ানাটা গিয়ে পড়লো ভ্লাদিমির ইয়ানোফের হাতে। সে তখন ছিলো নিকোলেফ ভবনে। আর তার ফলেই ভ্লাদিমির জানতে পেলো যে কীভাবে নিকোলেফ নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন তার বাবার এই বিপুল ঋণ। পুরো ব্যাপারটা বুঝতে তার একটুও দেরি হলো না। তার বাবার মৃত্যুতে কী লোকশান হয়েছে দিমিত্রির, কীভাবে মুচলেকা লিখে তিনি বন্ধুর ঋণ শোধ করার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন, সব সে জানতে পেলো। আর অমনি সে এটা বুঝলে যে এক্ষেত্রে তার কর্তব্য কী। মিখায়েল ইয়ানোফ কুড়ি হাজার রুবল গচ্ছিত রেখেছিলেন দিমিত্রির কাছেঁড়াদিমিরকে দেবার জন্য। সে-টাকাই তো তাকে পেরনাউতে পৌঁছে দিয়েছেন দিমিত্রি। সে-টাকা থেকে আঠরো হাজার রুবল নিয়ে সে বেরিয়ে পড়লো ইয়োহাউজেন ব্রাদার্সদের খাজাঞ্চিখানার উদ্দেশে।

তখন পাঁচটা বাজে; খাজাঞ্চিখানা বন্ধ হবে ছটার সময়;হুড়মুড় করে বেরিয়ে পড়লো চাদিমির। আর সময় নেই–খাজাঞ্চিখানা বন্ধ হবার আগে তাকে ওখানে গিয়ে পৌঁছুতেই হবে।

কুড়ি মিনিটের মধ্যেই সে পৌঁছে গেলো; খাজাঞ্চির কাছে যেতেই তিনি তাঁকে ব্যাঙ্কের পরিচালকদের ঘর দেখিয়ে দিলেন। ইয়োহাউজেন ভাইরা নিজেরাই এ মামলাটার তত্ত্বাবধান করছেন। দুজনেই ঘরে ছিলেন তখন। ভ্লাদিমিরের পাঠানো কার্ড দেখে একজন বলে উঠলেন : ভ্লাদিমির ইয়ানোফ! নিকোলেফের তরফ থেকে এসেছে দেখা করতে। নিশ্চয় আরো সময় চাইবে।

আর এক ঘণ্টা সময় দেয়া হবে না, নিষ্ঠুর গলায় ফ্রাঙ্ক ইয়োহাউজেন বললেন, কালকেই আমরা আইনের সাহায্য নেবো।

ইয়ানোফকে ঘরে ডেকে পাঠানো হলো।

ভ্লাদিমির ঘরে ঢুকেই খুব ঠাণ্ডা গলায় বললে, দিমিত্রি নিকোলেফ আপনাদের কাছে কিছু টাকা ধারেন–আজকেই সে-টাকা শোধ দেবার কথা, আপনারা সেজন্য সমনও পাঠিয়েছেন।

তা পাঠিয়েছি।

সুদ সমেত টাকার অঙ্ক হচ্ছে আঠারো হাজার রুবল?

হ্যাঁ–কিন্তু আমরা আর সময় দিতে পারবো না

সময় আপনাদের কাছে কে চেয়েছে? তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বললে ভ্লাদিমির।

ফ্রাঙ্ক ইয়োহাউজেন বললেন, টাকাটা দুপুর বারোটার মধ্যে দেবার কথা ছিলো…

তা তো না। আজকের মধ্যে দেবার কথা ছিলো। আর এখনো তো ছটা বাজেনি। আজকের তারিখ তো শেষ হয়ে যায়নি এখনো–অন্তত আমার তো তাই ধারণা।

বিদ্রুপের ভঙ্গিটা ফ্রাঙ্ক ইয়োহাউজেনকে রুষ্ট করে তুললো।

আঠারো হাজার রুবল নিয়ে এসেছেন আপনি?

এই যে আপনার টাকা,ভ্লাদিমির ব্যাঙ্কনোটের তাড়াটা বাড়িয়ে ধরলো, কই, নিকোলেফের মুচলেকাটা কই?

ইয়োহাউজেনরা যেমন আশ্চর্য তেমনি রুষ্ট হয়ে উঠলেন। উত্তর দেবার মতো মেজাজ তাঁদের ছিলো না। এভাবে মুখের গ্লাস পালিয়ে যেতে দেখে তংদের পক্ষে তুষ্ট হওয়া অসম্ভব ছিলো। একটা দেরাজের মধ্যে থেকে ছোটো ইয়োহাউজেন গিয়ে মুচলেকাটা বার করে আনলেন।

ভ্লাদিমির মুচলেকাটা পরীক্ষা করে দেখলো ঠিক আছে। নোটের তাড়াটা বাড়িয়ে দিয়ে বললে, গুনে নিন।

ফ্রাঙ্ক ইয়োহাউজেনের মুখটা কাগজের মতো শাদা হয়ে গেছে। কঁপা হাতে নোটের তাড়াটা তুলে নিয়ে গুনতে লাগলেন। ভ্লাদিমির ঘৃণাভরে তার দিকে। তাকিয়ে রইলো।

হঠাৎ ফ্রাঙ্কের দুটি চোখ জ্বলে উঠলো। হিংস্র একটা আনন্দের ভাব ফুটে উঠলো তাঁর মুখে, মঁসিয় ইয়ানোফ, এই নোটগুলো চোরাই…

চোরাই!

হ্যাঁ। পোখ-এর ব্রীফ-কেস থেকে চুরি করা!

অসম্ভব! পেরনাউতে দিমিত্রি নিকোলেফ আমাকে এ নোটগুলো দিয়েছিলেন।

আমার বাবা ওর কাছে কিছু টাকা গচ্ছিত রেখেছিলেন, সেই টাকা…

বাস্! তাহলে তো সব বোঝাই গেলো! গচ্ছিত টাকাটা তছরুপ করে ভদ্রলোক বিপাকে পড়েছিলেন–তারপর পোখকে খুন করে…

ভ্লাদিমিরের গায়ে যেন শপাং পড়লো চাবুক।

আমাদের খাজাঞ্চিখানায় চোরাই নোটগুলোর নম্বর আছে। এই দেখুন বলে টেবিলের টানা খুলে একটা কাগজ বার করে দেখালেন ফ্রাঙ্ক ইয়োহাউজেন, তাতে খুদে খুদে হরফে নোটের নম্বর টোকা।

ভ্লাদিমিরের মাথাটা যেন ঘুরে গেলো। ওর মাথা আর কাজ করছে না। …সব গেলো, দিমিত্রির আর বাঁচবার আশা নেই। কিন্তু দিমিত্রি…দিমিত্রি নিকোলেফ… তার পক্ষে কি এ-কাজ সম্ভব? এই নৃশংস ও পৈশাচিক রক্তপাত!

ছুটে বেরিয়ে এলো ভ্লাদিমির, সোজা রাস্তায়। পাগলের মতো ছুট লাগালো সে। তার বুকের মধ্যে রাগি ঝড় গজরাচ্ছে, মাথার মধ্যে ভোতা নিঃসাড় কষ্টের ভাব। নিকোলেফ নিশ্চয়ই ব্যাখ্যা করতে পারবেন সবকিছু–নিশ্চয়ই তিনি নির্দোষ–হ্যাঁ, নির্দোষ। নিকোলেফ নিরপরাধ–তার দ্বারা কোনো অপকর্ম সম্ভব নয়। কিন্তু…এই নোটগুলোই তো পেরনাউতে তার হাতে তুলে দিয়েছিলেন নিকোলেফ। তবে কি…

বাড়িতে ঢুকে আর একমুহূর্ত দেরি করলো না ইয়ানোফ। সোজা সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেলো উপরে, অধ্যাপকের ঘরে–চৌকাঠের কাছে দাঁড়িয়ে সে হাঁপাচ্ছে, কিছু ভাবতে পারছে না।

দিমিত্রি নিকোলেফ টেবিলের কাছে বসে আছেন, শুকনো, বিষণ্ণ, জীর্ণ–দুই হাতে মাথা গুঁজে। পায়ের শব্দ শুনে তিনি মুখ তুলে তাকালেন। কী ব্যাপার ভ্লাদিমির!

দিমিত্রি! ভ্লাদিমিরের গলা কি রকম আর্ত ও ভাঙা-ভাঙা। দিমিত্রি! খুলে বলো আমাকে, সব খুলে বলো!…আমি কিছুই বুঝতে পারছি না… না না, তা সম্ভব নয়। বাঁচাও নিজেকে…খুলে বলল।…আমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছি?

কিন্তু ব্যাপার কী ইয়ানোফ? আবার কি নতুন-কিছু ঘটলো? সাংঘাতিক কিছু? কী আমি খুলে বলবো তোমাকে…

দিমিত্রি, এক ঘণ্টাও হয়নি, একটা সমন এসেছিলো তোমার নামে…

ইয়োহাউজেনদের সমন!…তা এখন তো তুমি জানো আমার দশা! ওদের টাকা দেবার ক্ষমতা আমার নেই, আমি একেবারেই নিঃস্ব, দেউলে, কপর্দকশূন্য…এখন ভেবে দ্যাখো আমার মেয়েকে তুমি বিয়ে করবে কিনা…

ইয়ানোফ তিক্তস্বরে বললে, দিমিত্রি, আমি তোমাকে বাঁচাতে চেয়েছিলুম!

তুমি…

পেরনাউতে তুমি আমাকে যে-টাকা দিয়েছিলে সে-টাকা–ঠিক সেই নোটগুলো নিয়ে গিয়েছিলুম আমি খাজাঞ্চিখানায়…

তুমি গিয়েছিলে? কেন, ইয়ানোফ, কেন? মাত্র ঐ কটা টাকাই তো তোমার সম্বল- তোমার বাবা রেখে গিয়েছিলেন তোমার জন্য… ঐ টাকা কটা তুমি এভাবে নষ্ট করলে…

দিমিত্রি, খুব নরমভাবে ভ্লাদিমির বললে, যে-নোটগুলো আমি ইয়োহাউজেনদের দিয়েছি, সেই নোটগুলো পোখ-এর ব্রীফ-কেস থেকে চুরি হয়েছিলো। ব্যাঙ্কের কাছে সব নম্বর আছে…

ব্যাঙ্কনোট! যেন প্রচণ্ড নাড়া খেয়েছেন, এমন আর্তস্বরে চেঁচিয়ে উঠলেন নিকোলেফ যে পুরো বাড়ি কেঁপে উঠলো।

ঠিক তক্ষুনি ঘরে এসে ঢুকলো ইক্কা আর জ; দেখলো যে ভ্লাদিমির দাঁড়িয়ে আছে বিবর্ণ, দু-হাতে মুখ ঢেকে আর নিকোলেফ যেন পড়ে আছেন মাটিতে, হতচেতন, মূৰ্ছায় নীল।

কী ব্যাপার, কিছু জিগেশ না-করেই ভাইবোনে ছুটে গেলো বাবার দিকে। তাকে ধরে বসালো তারা, আস্তে-আস্তে শুশ্রূষা করে জ্ঞান ফেরালো তার। আর জ্ঞান ফিরতেই ভাঙা ফিশফিশে গলায় নিকোলেফ বিড়বিড় করে শুধু বললেন, চোরাই টাকা! চোরাই টাকা!

বাবা! চেঁচিয়ে উঠলো ইলকা, ব্যাপার কী…

ভ্লাদিমির,অনুনয় করে বললে জাঁ, কী হয়েছে বলে তো?

কোনো রকমে উঠে দাঁড়লেন নিকোলেক, স্নাদিমিরের কাছে গিয়ে ভাঙা গলায় বললেন, আমি তোমাকে যে নোটগুলো দিয়েছিলুম, যে নোটগুলো তুমি ইয়োহাউজেনদের কাছে নিয়ে গিয়েছিলে, সেই নোটগুলো পোখ-এর ব্রীফ-কেস থেকে চুরি গিয়েছিলো!

হ্যাঁ।

তাহলে আর আশা নেই আমার। সব শেষ…

ছুটে বেরিয়ে গেলেন তিনি ঘর থেকে; উন্মাদের মতে, আর্তের মতো বেরিয়ে পড়লেন তিনি রাস্তায়, মুখে মরীয়া হতাশার ছাপ, চোখদুটো জ্বলন্ত, কোটরে ঢাকা, গাল ভাঙা, চোয়াল বেরিয়ে আছে; আর ফ্যাশফেঁশে ছেঁড়া-ছেঁড়া গলায় শুধু বলছেন, সব শেষ…সব শেষ…

রিগায় তখন রাত্রি নেমেছে, কালো অন্ধকারে ঢাকা সব। নিকোলেফকে দেখা গেছে শহরতলি দিয়ে টলতে-টলতে যেতে। ভ্লাদিমির দৌড়ে এসেছে পিছন পিছন, হতভম্ব ভাবটা কাটতেই; এসেছে ইক্কা আর জাঁ-ও। শহর ফেলে এলো তারা পিছনে। সামনে পড়ে আছে পেরনাউয়ের রাস্তা, ফাঁকা, অন্ধকার, থমথমে। কেউ কোনো কথা বলছেনা…চুপচাপ এগুচ্ছে তিনজনে।

আরো কিছুদুর এগুতেই তারা লাশটা দেখতে পেলে।

পড়ে আছে দিমিত্রি নিকোলেফের মৃতদেহ, পাশে পড়ে রক্তরাঙা তীক্ষ্ণধার ছুরি…জা আর ইলকা নুয়ে পড়লো বাবার মৃতদেহের উপরে। ইয়ানোফ গেলো কাছাকাছি বাড়িগুলো থেকে সাহায্য চাইতে। সাহায্যের চেষ্টা অর্থহীন। বেঁচে নেই নিকোলে। কিন্তু…

কয়েকজন চাষী স্ট্রেচার নিয়ে এলো। ধরাধরি করে তাকে ফিরিয়ে আনা হলো বাড়িতে। এলেন ডাক্তার হামিনে শুধু মৃত্যুর অব্যবহিত কারণটা লিখে দেবার জন্য।

ঠিক যেমনভাবে পোখ-এর হৃৎপিণ্ডে ছুরি ঢুকেছিলো, সজোর ও আমূল, নিকোলেফের হৃৎপিণ্ড ভেদ করে তেমনি ঢুকেছে ছুরি।

যখন দেখলেন সব শেষ হয়ে গেছে, যখন দেখলেন কোথাও কোনো আশা নেই, তখন আত্মহত্যা করেই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করেছেন দিমিত্রি নিকোলে।

যেন কোনো রহস্য নাটকের মূক শেষ দৃশ্য এইভাবে হতবাক, বিষণ্ণ ও স্তম্ভিত পাত্রপাত্রীরা কলের পুতুলের মতো অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রইলো।