১১-১২. মুখোমুখি

১১. মুখোমুখি

অন্য অনেকের মতোই–মেজর ফেরডেরের ইচ্ছে ছিলো–যে জেরার পর যেন দিমিত্রিকে গ্রেফতার করা হয়। বিশেষ করে দিমিত্রির প্রবল জেদ–কিছুতেই তিনি তার রহস্যময় ভ্রমণের উদ্দেশ্য ও গন্তব্যস্থলের কথা যখন খুলে বলবেন না– সন্দেহ আরো বাড়িয়ে দিলে।

তাহলে কেন নিকোলেফকে গ্রেফতার করা হলো না? হাজতে পুরে ধোলাই দেবার বদলে কেন তাকে স্বাধীনভাবে বাড়ি চলে যেতে দেয়া হলো? বলা হয়েছে অবশ্য যে এত্তেলা পাঠালেই তিনি যেন কেরস্টোফের আপিসে এসে হাজির হন, কিন্তু এই সুযোগে তিনি তো পালিয়ে যেতেও পারেন।

রুশদেশে, বা অন্যত্রও, বিচারবিভাগের স্বাধীনতায় এমনিতে হাত দেয়া হয় না। কিন্তু অভিযোগ যেই কোনো রাজনৈতিক চেহারা নেয়, অমনি উধ্বর্তন কর্তৃপক্ষের আবির্ভাব ঘটে। দিমিত্রি নিকোলেফের মামলাটাই তার একটা দৃষ্টান্ত : যখন স্লাভরা তাকে নির্বাচনে দাঁড় করাবার জন্যে তোড়জোড় করছে, ঠিক তক্ষুনি তাঁর বিরুদ্ধে এই ভীষণ অভিযোগ উত্থাপিত হলো। সেইজন্যেই আসলে বলটিক প্রদেশের রাজ্যপাল জেনারেল গোরকো তাকে গ্রেফতার করাটা সমীচীন বোধ করেননি–যখন একেবারে অকাট্যভাবে তার অপরাধ প্রমাণিত হবে, তখনই তাকে সাজা দেবার জন্য সোপর্দ করা হবে। তাছাড়া ম্যাজিস্ট্রেট কেরস্টোফের উপরও তার গভীর আস্থা ছিলো। কেরস্টোফের মর্যাদাবোধ, মুক্তদৃষ্টি, ব্যক্তিত্ব ও বিবেক তাকে সারা দেশেই শ্রদ্ধার আসনে বসিয়েছিলো। কোনো রাজনৈতিক মতবাদ তাকে কর্তব্যপথ থেকে বিচ্যুত করতে পারবে না।

কিন্তু শহরে ততক্ষণে বিষম সাড়া পড়ে গেছে। বেশির ভাগ লোকেই ভেবেছিলো এবং তাদের মধ্যে প্রভাবশালী ধনাঢ্যদের সংখ্যাও অল্প ছিলো না– যে, দিমিত্রি নিকোলেফকে গ্রেপ্তার করা হবে। তাই যখন তাকে স্বাধীনভাবে বাড়ি ফিরতে দেখা গেলো, তখন কোনো-কোনো মহলে প্রবল প্রতিবাদ উত্থিত হলো।

তাছাড়া এই বিষম বার্তা ততক্ষণে গিয়ে নিকোলেফ ভবনেও পৌঁছেছে। ইলকা এতক্ষণে জানতে পেরেছে যে কোনো ভয়ংকর অভিযোগের খড়গ তার বাবার মাথার উপর ঝুলছে। তার ভাই জাঁ এসে পৌঁছেছে বাড়িতে ডোরপাট বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডগোলের কথাও সে সবিস্তারে খুলে বলেছে দিদিকে। বাবা যে স্বপ্নেও কখনও এ-রকম নৃশংস কাজ করতে পারেন না, এ-বিষয়ে তাদের মনে কোনো সংশয় নেই। সংশয় নেই ডাক্তার হামিনে ও মঁসিয় দ্যলাপোের্তের মনেও। খবরটা শোনবামাত্র তারা গিয়ে হাজির হয়েছেন নিকোলেফ ভবনে, এবং ভাইবোনকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। তাদের বক্তব্য হলো, নিকোলেফকে কে না চেনে রিগায়, কে না তাকে শ্রদ্ধা করে, ভালোবাসে, কাজেই অভিযোগ তুললেই তো হলো না তাকে প্রমাণ করা চাই, আর সেক্ষেত্রে তার নিষ্কলুষ অতীত জীবনের স্মৃতি অত্যন্ত সহায়ক হবে।

দিমিত্রি নিকোলেফ বাড়ি ফিরে দেখলেন তার ছেলেমেয়ে ও বন্ধুরা সম্মিলিত হয়ে আছেন বিশ্বাসে অবিচল, বিচারে আস্থাশীল অন্যায় ও আজগুবি অভিযোগের প্রতিবাদে উন্মুখর। বাইরে কিন্তু তখন বিরোধী রাজনৈতিক দলের লোকদের ভিড় ও কোলাহল শুরু হয়ে গেছে–বলাই বাহুল্য রাজনৈতিক দল হিশেবে তারা এই পরিস্থিতির সুযোগ নিতে চাচ্ছে। কেরস্টোফের জেরার কথা খুলে বললেন নিকোলেফ, প্রশংসাও করলেন তিনি কেরস্টোফকে তার মন ভোলা, দৃষ্টি স্বচ্ছ কিন্তু মেজর ফেরডের যে তাকে। হাজতে পোরবার জন্য উৎসুক ও বদ্ধপরিকর, তার এই ধারণাও তিনি সকলকে খুলে বললেন। কিন্তু সব কথা বলবার সময় কেমন ভাঙা-ভাঙা শোনালো তার গলা, কেমন যেন অবসন্ন দেখালো তাকে যেন এই অভিযোগের বিপুল আঘাতে তার মনের শান্তি ভীষণভাবে নাড়া খেয়েছে। তার এখন বিশ্রাম চাই, এ-সব বাজে ব্যাপার মন থেকে মুছে ফেলা চাই– এ-কথা বুঝতে পেরে বন্ধুরা তখনকার মতো বিদায় নিলেন, যাবার আগে তারা বন্ধুর উপর আস্থা জানিয়ে গেলেন তাদের। বন্ধুকে এই অভাবিত বিপদ থেকে বাঁচাবার জন্য নানা শলাপরামর্শ করতে-করতে তারা গেলেন।

এটা তারা বুঝতে পারছিলেন যে নিকোলেফের শত্রুরা তাকে নির্দোষ বলে জানলেও রাজনৈতিক সুযোগগুলো নিতে ছাড়বে না। কোনো-কোনো মহলে উত্তেজনা ও ষড়যন্ত্র বেশ তীব্র চেহারা নেবে। কাজেই এ-ক্ষেত্রে আসল অপরাধীকে খুঁজে বার করা চাই। না-হলে নিকোলেফের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করা না-গেলে এবং আততায়ীকে খুঁজে বার করতে না পারলে, গুজবের বিষ ঝেড়ে ফেলা যাবে না। তাছাড়া জাঁ আর কার্ল-এর ব্যাপারটাও তারা মন থেকে সরিয়ে ফেলতে পারছিলেন না। জাঁকে তারা ছেলেবেলা থেকে চেনেন- সে কার্লকে কখনো ছেড়ে দেবে না, কার্ল-এর এই ইতর ও অন্যায় ব্যবহারের শোধ সে নেবেই। অথচ এখন এই অবস্থায় মাথা গরম করে কিছু করে ফেললেই ইয়োহাউজেনদের হাতে নতুন অস্ত্র তুলে দেয়া হবে। ইশ, একবার যদি জানা যেতো দিমিত্রি কোথায় গিয়েছিলেন, কেন গিয়েছিলেন তাহলে অনেক রহস্য পরিষ্কার হতো অনেক জট খুলে যেতো। কিন্তু কী বিষম তার জেদ এখনও তিনি পণ করে আছেন সে-সম্বন্ধে কোনো কথাই খুলে বলবেন না।

এদিকে ইয়োহাউজেনদের মধ্যেও নানা শলাপরামর্শ হচ্ছে তখন। এটা তারা জানতেন যে নিকোলেফের সঙ্গে পোখ-এর কোনো পরিচয় ছিলে না। দৈবাৎ যদি নিকোলেফ জেনে থাকেন যে পোখ ব্যাঙ্কে কাজ করে, তাহলে সেই কোচবাক্সে এবং সেক্ষেত্রে এই হত্যাকাণ্ড পূর্বপরিকল্পিত নয়, অতর্কিত। তাছাড়া নিকোলেফ যদি হত্যা ও চুরি দুই-ই করে থাকেন, তাহলে এটা নিশ্চয়ই তাঁর জানা নেই যে সব হচ্ছে নম্বরি নোট আর পোখ-এর চিরকেলে অভ্যাস নম্বরগুলো টুকে রাখা। সেক্ষেত্রে চোরাই টাকা খরচা করতে গেলেই তিনি ধরা পড়ে যাবেন, গলায় আঁটো হয়ে ফাঁস বসবে। কিন্তু, ধরা যাক, তিনি চুরি করেননি, খুনও না। সেক্ষেত্রেও তার রেহাই নেই। কারণ তার আর্থিক অবস্থা এখন বিষম শোচনীয়। যে-সব ঋণ ও লগ্নী আছে তাঁর, তা শোধ করবার ক্ষমতাই তার নেই। আর তিন সপ্তাহের মধ্যেই ইয়োহাউজেনদের আঠারো হাজার রুবল তাকে ফেরৎ দিতে হবে, কিন্তু সে-টাকা জোগাড় করার মতো সামর্থ্য বা অবস্থা তার নেই। বলাই বাহুল্য, তিনি আরো কিছু সময় চাইবেন। কিন্তু ফ্রাঙ্ক ইয়োহাউজেন স্থির করে ফেললেন, কিছুতেই তিনি সময় দেবেন না- কোনো দয়া দেখাবেন না–কেননা এই সুবর্ণ সুযোগ হেলায় হারানো যায় না। ফ্রাঙ্ক ইয়োহাউজেনের স্বভাবটাই এ-রকম; নির্মম, দয়াহীন, উদ্ধত, প্রতিশোধপ্রবণ।

+

আঠারোই এপ্রিল কেরস্টোফ এলেন তল্লাশি পরোয়ানা নিয়ে, সঙ্গে মেজর ফেরডের ও সার্জেন্ট য়েক। নিকোলেফ ভবন তারা খুঁজে দেখতে চান– যদি চোরাই টাকার কোনো হদিশ মেলে।

দিমিত্রি নিকোলেফ তাচ্ছিল্যের সঙ্গে তাদের দেখতে দিলেন সবকিছু কোনো প্রতিবাদ করলেন না; সব জিজ্ঞাসারই উত্তর দিলেন, ঘৃণা মিশিয়ে, তাচ্ছিল্যের সঙ্গে। মেজর ফেরডের তার দেরাজ ঘাঁটলেন, আলমারি তাক তন্নতন্ন করে খুঁজলেন, কাগজপত্র পরীক্ষা করে দেখলেন, বাদ দিলেন না চিঠিপত্র, এমনকী হিশেবের খাতাও দেখতে ছাড়লেন না। আর এটা বুঝতে দেরি হলো না যে ফ্রাঙ্ক ইয়োহাউজেনদের ধারণা মোটেই ভুল নয়– নিকোলেফ একেবারেই নিঃস্ব, কপর্দকশূন্য, শুধু ছাত্র পড়িয়েই কোনোক্রমে তার দিন চলে। কিন্তু এই অভিযোগ যখন উঠেছে, তখন তার ছাত্ররাও টিকলে হয়।

তল্লাশি করে অবশ্য হত্যারহস্যের কোনো কিনারাই হলো না। তবে কোনো নিরাপদ গোপন জায়গায় চোরাই টাকা লুকিয়ে রাখার সময় তিনি বিস্তর পেয়েছেন–সরাই থেকে রাত থাকতেই তিনি যে কেটে পড়ে কোথায় গেলেন, সে-জায়গাটার খোঁজ পেলে হতো- সম্ভবত সেখানেই সব টাকা লুকোনো রয়েছে। নম্বরি নোট চালাতে গেলেই চোর ধরা পড়ে যাবে কিন্তু সে কি চট করে ও-টাকা চালাতে চাইবে! যখন নিজেকে সে নিরাপদ ও সন্দেহের অতীত বলে ভাববে, তখনই সে ও-টাকা চালাবার চেষ্টা করবে।

সারা বলটিক অঞ্চলে ততদিনে আলেমান প্রভাবের ফলে জনমত অধ্যাপক নিকোলেফের বিরুদ্ধে চলে গেছে। বেশির ভাগ লোকেই চাচ্ছে তাকে গ্রেফতার করে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হোক, বিচার হোক। কেবল গরিব স্নাভরাই আছে তাঁর পক্ষে কিন্তু তাদেরও মনে আছে খুঁতখুঁতুনি; খটকা তাদেরও কাটেনি। নিকোলেফ যে নিরপরাধ, এ-কথা তারা হলফ করে বলতে পারবে না। কিন্তু তিনি তো স্লাভ– কাজেই সমর্থন তাঁকে করতেই হবে। কিন্তু তাদের ক্ষমতাই বা কতটুকু, অর্থ ও সামর্থ্যই বা কই! ধনী জার্মানদের প্রভাব ও চেষ্টাকে ব্যর্থ করার কোনো ক্ষমতাই তাদের নেই।

এতসব উত্তেজনার মধ্যে দিমিত্রি নিজে কিন্তু আছেন শান্ত ও অবিচল। কোনো কথাই তিনি বলতে চান না পারতপক্ষে, কারু সঙ্গেই না; সারাক্ষণ পড়ার ঘরে বসে থাকেন চুপচাপ। ছাত্রেরা পড়তে এলে রুটিনমাফিক পড়ান, ব্যাস, এই পর্যন্ত! শহরের উত্তেজনা দেখে বন্ধুরা তাকে বারণ করেছিলেন বাড়ি থেকে বেরুতে; তিনি শুধু কাঁধ ঝাঁকিয়ে তাচ্ছিল্যভরে তাদের সে-অনুরোধ মেনে নিয়েছেন। কিন্তু তার এই গুটিয়ে নেয়াটাকে সবাই বেশ একটু ভয় পেলেন। এটা বুঝতে কারু দেরি হলো না যে তার মনের উপর বিষম চাপ পড়ছে।

বলাই বাহুল্য, জাঁ তখনও ডোরপাট বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেরবার কথা ভাবতে পারছিলো না। যতদিন-না নিকোলেফের উপর থেকে সব সন্দেহ কেটে যায়, তদ্দিন ফেরবার কোনো কথাই ওঠে না। তাছাড়া কার্ল-এর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সে নিজেকে শামলে রাখবে কীভাবে। নিকোলেফ কেবল একটা খবরই মাঝে-মাঝে নিতেন–তার কোনো চিঠি এসেছে কি না। কিন্তু না, কোনো চিঠি নেই। ডাকহরকরা এসে অন্য-সব কাগজপত্র দিয়ে যায়, রোজ সে বিলি করে স্লাভদলের রাজনৈতিক মুখপত্র, কিন্তু না–কোনো চিঠি নেই। শেষ পর্যন্ত তাকে কেমন অধীর ও উত্তেজিত দেখাতে লাগলো। যেন একটা জরুরি চিঠি আসবার কথা– কিন্তু কোনো রহস্যময় কারণে সেটা আর আসছে না।

সেদিন পোখ-এর অন্ত্যেষ্টি। ডাক্তার হামিনে ও মঁসিয় দ্যলাপোর্ৎ সকালবেলাতেই এসে নিকোলেফ ভবনে হাজির হয়েছেন। শবাধারে করে পোখ-এর মৃতদেহকে নিয়ে গোরস্থানের দিকে শোকমিছিল যাবার সময় নিকোলেফদের বাড়ির বাইরে গোলযোগ হতে পারে, এই আশঙ্কা ছিলো তাদের। আগে থেকেই সেজন্য সাবধান থাকা উচিত। কিন্তু ইলকা ও জাঁকে সাবধান করে দিলেও ব্যাপারটা দিমিত্রি নিকোলেফকে আগে থেকে জানানো তারা সমীচীন বোধ করেননি।

বাইরে আস্তে-আস্তে লোক জমছে। ভিড়, চ্যাঁচামেচি, বিশ্রী সব জিগির উঠছে। ক্রমশ ভিড় বাড়ছে নিকোলেফ-ভবনের বাইরে। এরই মধ্যে মধ্যাহ্নভোজ সারলেন তাঁরা, ডাক্তার হামিনে ও মঁসিয় দ্যলাপোর্ৎ শুন্ধু। খাবার টেবিলে কোনো কথাই হলো না। শোকমিছিল সম্বন্ধে কোনো উচ্চবাচ্যই হলো না।

দেড়টা নাগাদ বাইরে যখন তুমুল হট্টগোল শুরু হলো, বোঝা গেলো শবাধার আসছে। সম্মিলিত চীৎকারে বাড়িটা শুন্ধু থরথর করে কাঁপছে। হঠাৎ পড়ার ঘর থেকে দিমিত্রি বেরিয়ে এলেন।

বাইরে এত হৈ-হল্লা কেন?

ডাক্তার হামিনে অনুরোধ করলেন, আপনার ঘরে চলে যান। বেরুবেন না। পোখ-এর আজকে অন্ত্যেষ্টি।

পোখ? মানে সেই লোকটা, যাকে আমি খুন করেছি!

ঘরে চলে যান নিকোলেফ, কাতর অনুরোধ করছি আপনাকে…

বাবা!ইলকা ও জাঁও অনুনয় করলো বাবাকে।

কিন্তু দিমিত্রি! তার মনের মধ্যে তখন ঝড় উঠেছে। জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন তিনি, খুলতে চাইলেন জানলার পাল্লা।

না, দিমিত্রি, না। ও-কাজ করবেন না। এ নিছকই পাগলামি আপনার। আপনার কি মাথা খারাপ হয়েছে?

আমি দেখতে চাই। কেউ বাধা দেবার আগেই দিমিত্রি খোলা জানলায় গিয়ে দাঁড়ালেন।

হাজার কণ্ঠে চীৎকার উঠলো, খুন করো ওকে, খুন!

ঠিক সেই মুহূর্তেই, দৈবের কেমন যোগাযোগ, বাড়ির সামনে এসে পৌঁছুলো শবাধার। পাশে আছে ভজেনাইদে পারেনসোফ, পরনে শোকার্ত বিধবার বেশ, কফিনে ফুল ও মালা। তারপর এলো ইয়োহাউজেনদের ব্যাঙ্কের কর্মচারীরা। তারপরে উন্মত্ত জনতা- যারা সমস্ত ব্যাপারটার সুযোগ নিতে চাচ্ছে। তুমুল হট্টগোলের মধ্যে শবযাত্রা থামলো বাড়ির মুখোমুখি। আর উঠলো অট্টরোল : খুনের বদলে খুন চাই।

মস্ত পুলিশবাহিনী নিয়ে কর্নেল রাগুয়েনোভ ও মেজর ফেরডের মোতায়েন ছিলেন বাড়ির কাছে। কিন্তু এই উন্মত্ত জনতা ঠেকাবে কে! পুলিশ! তাদের সাধ্য কী! তাছাড়া দিমিত্রিকে জানলায় দেখবামাত্র রোল উঠেছে, খুনের বদলে খুন চাই! খুনের বদলে খুন!

দিমিত্রি দাঁড়িয়ে রইলেন জানলায়, বুকে আড়াআড়ি ভাঁজ করা হাত, গর্বিত শির; যেন পাষাণমূর্তি, এমনি তিনি অবিচল ও নিশ্চুপ।

শবযাত্রা চলতে লাগলো আবার। চীৎকার উঠলো আরো চরমে, উন্মত্ততা আরো তুঙ্গে। ভিড় থেকে কেউ-কেউ ছুটে এলো বাড়ির দিকে, দরজা তারা ভেঙেই ফেলবে।

পুলিশ সামলে নিলে ব্যাপারটা তখনকার মতো কিন্তু এটা বুঝতে দেরি হলো না যে নিকোলেফকে এই খ্যাপা কুকুরের মতো জনতার হাত থেকে বাঁচাতে হলে তাকে এক্ষুনি গ্রেফতার করতে হবে নইলে এক্ষুনি তাকে এই জনতা ছিঁড়ে ফেলবে।

পুলিশের সব চেষ্টা সত্ত্বেও জনতা বুঝি বেষ্টনী ভেদ করে এগুতো, যদি-না সেই মুহূর্তে ভিড় ঠেলে এগিয়ে আসতে বলিষ্ঠ ও ব্যক্তিত্বময় এক যুবক। সে এসে ভিড় ঠেলে সোজা গিয়ে উঠলো সিঁড়িতে, দরজার কাছে দাঁড়িয়ে হাত তুলে সে থামতে বললো সবাইকে। ভিড়ের চীৎকার ছাপিয়ে শোনা গেলো সেই প্রবল নির্ঘোষ, থামো!

এমনি ব্যক্তিত্ব দৃঢ় তার ভঙ্গি যে হঠাৎ ভিড় গেলো পেছিয়ে, কোলাহল গেলো থেমে।

ফ্রাঙ্ক ইয়োহাউজেন এগিয়ে গেলেন তার দিকে :কে আপনি?

মেজর ফেরডেরও প্রশ্নটার পুনরাবৃত্তি করলেন, আপনি কে?

আমি এক নির্বাসিত- নিজের প্রাণ ও সম্মানের বিনিময়ে দিমিত্রি নিকোলেফ যাকে বাঁচাতে চাচ্ছিলেন!

আপনার নাম?

ভ্লাদিমির ইয়ানোফ!

.

১২. ভ্লাদিমির ইয়ানোফ

রাজনৈতিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলো বলে ভ্লাদিমির ইয়ানোফকে পাঠানো হয়েছিলো সাইবেরিয়ায়–যাবজ্জীবন নির্বাসনে। ইলকা নিকোলেফ, তার বাগদত্তা, স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি আবার কোনোদিন তাকে চর্মচক্ষুতে দেখতে পারে। তারপর নির্বাসনে চার বছর কেটে যাবার পর, ভ্লাদিমির পালালো। পেরিয়ে এলো রুশদেশের বিস্তীর্ণ স্তেপভূমি, পৌঁছুলো এসে পেরনাউ, ইচ্ছে এখান থেকে জাহাজ চেপে যাবে ফরাসি দেশে। এই পেরনাউতেই সে ছিলো লুকিয়ে, পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে বলটিকের সাগরে জাহাজ চলাচল শুরু হলেই কোনো-একটা জাহাজে গিয়ে উঠবে সে গোপনে, এই ছিলো স্থির। কিন্তু থাকে কী করে সে পেরনাউতে! ছন্নছাড়া, ঘরছাড়া, হাতে টাকা নেই; আশ্রয় জোটে কোথায়? তাই সে চিঠি লিখেছিলো দিমিত্রি নিকোলেফকে সাহায্য চেয়ে। এই চিঠি পাবামাত্রই রওনা হয়ে পড়েন অধ্যাপক চাদিমিরের বাবা তার কাছে যে-টাকা গচ্ছিত রেখেছিলেন, তাই তিনি ছেলের হাতে তুলে দেবেন। গোড়ায় নিকোলেফ কাউকেই তার কথা খুলে বলেননি। তার কারণ ভ্লাদিমির সত্যি পেরনাউ পৌঁছেছে কিনা সঠিক তিনি জানতেন না, পরে ভ্লাদিমির তাঁর কাছ থেকে কথা নিয়েছিলো যে কিছুতেই তিনি যেন আপাতত ইলকাকে তার কথা খুলে না বলেন–বিদেশে নিরাপদ জায়গায় থেকে চিঠি লিখলে পরেই তাকে সব কথা বলা চলবে। কাজেই গোপনে রিগা থেকে পেরনাউ যেতে হয়েছিলো নিকোলেফকে। টিকিট কেটেছিলেন রেফেল পর্যন্ত যাতে কেউ বুঝতে না-পারে তার আসল গন্তব্যস্থল কোথায়।

তারপর এই কাণ্ড!

এখন আর কারু বুঝতে বাকি রইলো না কেন ও-রকম জেদ করে সর কথা দিমিত্রি নিকোলেফ চেপে যাচ্ছিলেন। এই নির্বাসিতকে বাঁচাবার জন্যই তিনি এমনকী নিজের প্রাণ সংশয় করে তুলেছিলেন।

দরজা খুলে গেলো; ভ্লাদিমির ইয়ানোফ আলিঙ্গন করলে দিমিত্রি নিকোলেফকে, সম্ভাষণ জানালে জাঁকে, বুকে চেপে ধরলে তার বাগদত্তাকে। কর্নেল রাগুয়েনোফ আর মেজর ফেরডের কলের পুতুলের মতো তাকে অনুসরণ করে ঘরে ঢুকে পড়েছিলেন। এবার তাদের দিকে ফিরে ভ্লাদিমির বললে :

পেরনাউতে হঠাৎ আমি জানতে পেলুম যে দিমিত্রি নিকোলেফকে এক নৃশংস হত্যার জন্য দায়ী করা হচ্ছে, সন্দেহের প্রধান কারণ, তিনি নাকি কিছুতেই বলতে চাচ্ছেন না কোথায় যাবেন বলে তিনি সেদিন কোচবাক্সে চেপেছিলেন, যাত্রার উদ্দেশ্যই বা কী। কেবল আমার নামটি উচ্চারণ করলে সব সন্দেহ থেকে খালাশ পেয়ে যেতেন তিনি, কিন্তু আমাকে তিনি জড়াতে চাননি, সাইবেরিয়া থেকে পালিয়ে এসেছি, একবার হদিশ পেলে আবার পুলিশ আমাকে পাকড়াবে। ব্যাপারটা শোনবামাত্র আমি একতিলও দেরি করিনি– সোজা এখানে এসে হাজির হয়েছি। মিখায়েল ইয়ানোফের বন্ধু আপনি, বন্ধুপুত্রকে বাঁচাবার জন্য আপনি নিজের প্রাণ বিপন্ন করে তুলেছিলেন দিমিত্রি নিকোলেফ। কিন্তু আমি তা হতে দেবো কেন…

ভুল করেছো তুমি, ভ্লাদিমির, ভুল করেছে। আমি নিরপরাধ, আমার কোনো ভয় ছিলো না–শীগগিরই আমার নির্দোষিতা প্রমাণ হয়ে যেতো। কিন্তু আবার তুমি…

কিন্তু আমি কি ঠিক করিনি, ইলকা? ভ্লাদিমির তার বাগদত্তাকে জিগেশ করলে।

নিকোলেফ মেয়েকে বললেন, ও-কথার কোনো উত্তর দিসনে, ইলকা। বাবা আর বাগদত্ত- এ-দুয়ের মধ্যেই তুই বাছবি কাকে? …তোমার কর্তব্যবোধ দেখে আমি তোমাকে সম্মান করছি ভ্লাদিমির, কিন্তু সেই সঙ্গে এও বলতে বাধ্য হচ্ছি যে তুমি একটা আস্ত হাঁদা। কোনো নিরাপদ দেশে চলে যাওয়া উচিত ছিলো তোমার। সেখান থেকে তুমি আমাকে চিঠি লিখতে পারতে। আর সে-চিঠি পাবামাত্র আমি সব কথা খুলে বলতে পারতুম। তুমি বিপদের হাত থেকে রক্ষা পাবে, এই ভরসাতেই আমি এই বিষম দিনগুলো সহ্য করতে পারতুম।

বাবা, ইলকার গলার স্বর খুবই দৃঢ় শোনালো, আমার কথা শোনো। ভ্লাদিমির ঠিক কাজই করেছে। জীবন দিয়েও ওকে আমি কৃতজ্ঞতা জানাতে পারবো না…

ধন্যবাদ তোমাকে, ইক্কা, ভ্লাদিমির বললে, অন্তত একদিনের জন্যও তোমার বাবাকে আমি যে এই বিষম দুর্বিপাক থেকে বাঁচাতে পেরেছি, তাতেই আমার শান্তি।

ভিড়ের মধ্যে এদিকে মুহূর্তে সব যেভাবে পালটে গেলো, তা প্রায় অবিশ্বাস্য। জনমতের মতো চঞ্চল ও অবিরাম পরিবর্তমান আর-কিছু নেই। নিকোলেফের বাড়ি আক্রমণ করবার ইচ্ছে আর কারু রইলো না, পুলিশকে আর জনতার হাত থেকে দিমিত্রিকে বাঁচাবার জন্য তোড়জোড় করতে হবে না।

কিন্তু ভ্লাদিমির ইয়ানোফের অবস্থাটা নতুন অনেক সমস্যা চেতিয়ে তুললো। সন্দেহ নেই, ভ্লাদিমিরের কর্তব্যবোধ ও সহৃদয়তা অনুকরণযোগ্য, কিন্তু সে যে একজন রাজনৈতিক বন্দী তাও তো মানতে হয়। কাজেই কর্নেল রাগুয়েনোফ তাকে বললেন, ভ্লাদিমির ইয়ানোফ, আপনি সাইবেরিয়া থেকে পালিয়ে এসেছেন, রাজ্যপালকে এ-কথা আমায় জানাতে হবে। আপনি যদি কথা দেন যে পালাবার চেষ্টা করবেন না, তাহলে আপনাকে আপাতত এখানে আমি থাকতে দিতে পারি। আমি সে-ফাঁকে রাজ্যপালের সঙ্গে দেখা করে আসবো।

আপনি ভাববেন না, কর্নেল, আমি কথা দিচ্ছি, পালাবো না, ভ্লাদিমির বললে।

সারজেন্ট য়েক ও তার লোকজনকে রাস্তায় পাহারা বসিয়ে কর্নেল রাগুয়েনোফ চলে গেলেন।

আর পুলিশ চলে যেতেই পারিবারিক প্রীতিসম্মিলনীর মধ্যে আনন্দের বন্যা বয়ে গেলো। ভ্লাদিমিরের অবস্থা যে সংকটজনক, এ-কথা সবাই যেন ভুলেই গেলো। সবাই তখন ভবিষ্যতের সানন্দ ভাবনাতেই মুখর ও মশগুল। এই দেখে ডাক্তার হামিনে ও মঁসিয় দ্যলাপোও সাময়িকভাবে বিদায় নিলেন।

কর্নেল ফিরলেন ঠিক এক ঘণ্টা পরে। ভ্লাদিমিরকে তিনি বললেন, জেনারেল গোরকোর আদেশ, আপনাকে রিগা কেল্লায় যেতে হবে। সেন্ট পিটাসবুর্গ থেকে কী নির্দেশ আসে, জেনে, আপনার ব্যবস্থা করা হবে। নির্দেশ আসা পর্যন্ত আপনাকে ঐ কেল্লায় থাকতে হবে।

+

এতদিন সকলের আলোচনার ও উত্তেজনার বিষয় ছিলো পোখ-এর নৃশংস হত্যাকাণ্ড। কিন্তু ভ্লাদিমির ইয়ানোফের আবির্ভাবের পর থেকে সব পালটে গেলো। নিকোলেফ সম্বন্ধে লোকের ধারণা শেষ পর্যন্ত যা-ই থাক না কেন, ভ্লাদিমিরের সাহস ও কর্তব্যবোধের প্রশংসা না-করে উপায় নেই। নিকোলেফকে বাঁচাবার জন্য সে এমনকী নিজের প্রাণের ঝুঁকি নিতেও ইতস্তত করেনি! যাবজ্জীবন নির্বাসন হয়েছিলো তার, ছিলো গুরুতর রাজনৈতিক অভিযোগ; জানে যে এবার ধরা পড়লে তার আর রেহাই নেই; তবু সে বিবেকের আদেশ লঙ্ঘন করতে পারেনি; তাকে বাঁচাবার জন্যই নিকোলেফ নিজের উপর সন্দেহ ঘনীভূত করে তুলেছিলেন- এখন পুরো অবস্থাটা একেবারে উলটে গিয়েছে। সম্রাটের আদেশ কী হবে কে জানে। জার কি আবার তাকে পাঠাবেন সাইবেরিয়ায়– যেখান থেকে অত কষ্ট করে বেচারি পালিয়েছিলো? তাছাড়া এটা ভাবলেও ভুল হবে যে তার আবির্ভাবের সঙ্গে–সঙ্গেই নিকোলেফের নির্দোষিতা অকাট্যভাবে প্রমাণ হয়ে গেলো। বিশেষ করে, রিগায়, যেখানে আলেমানদের সংখ্যা ও প্রভাব নেহাৎ কম নয়, সেখানে এটা ভাবাই ভুল। বড়োলোকদের বেশির ভাগেরই ধারণা এই অধ্যাপক, এই স্লাভ জাগরণের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি, মোটেই নির্দোষ নন। এখনো তো আততায়ীর কোনো সন্ধান মেলেনি। না-হয় ধরেই নেয়া গেলো নিকোলেফ যাচ্ছিলেন ভ্লাদিমিরের উদ্দেশে, কিন্তু এটা তো সত্যি যে ভাঙা ক্রুশের সরাইখানায় তেরো তারিখ রাত্তিরে তিনি ছিলেন। আর এটাও তো সত্যি যে পোখ ঐ রাত্তিরেই ঐ সরাইতে খুন হয়েছে সব টাকাও চুরি হয়েছে! তাছাড়া নিকোলেফ যে-ঘরে ছিলেন, সেই ঘরেই কি জানলা ভাঙার হাতুড়িটা পাওয়া যায়নি? অবশ্য বাইরের কেউ খুন করেছে কি না, তাও নিশ্চিত বলা যায় না। সরাইওলা ক্রোফও খুন করে থাকতে পারে। তারও সব সুযোগ ছিলো। অধ্যাপক চলে যাবার আগে কিংবা পরে, যখন ইচ্ছে সে খুন করে থাকতে পারে। পোখ-এর ব্রীফ-কেসে যে তাড়াতাড়া নোট রয়েছে, তা তো সেও জানতো।

কিন্তু সব তদন্তের পরেও সরাইওলা ক্রোফের বিরুদ্ধে সন্দেহজনক কিছু পাওয়া যায়নি। এমনও হতে পারে যে খুনের জন্য দায়ী আসলে উত্তর লিভোনিয়ার কুখ্যাত ও দুর্ধর্ষ ডাকাতেরা, যাদের ধরবার জন্য পুলিশ অনবরত হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে।

সারাদিন এ-কথাই আলোচনা করছিলেন কর্নেল রাগুয়েনোফ ও মেজর ফেরডের। দ্যাখো মেজর, তোমরা যে বলছে, নিকোলেফ তার ঘরের জানলা দিয়ে ঢুকেছিলো, সেটা নিছকই অনুমান বলে বোধ হচ্ছে আমার।

কিন্তু ঐ দাগগুলো…।

দাগগুলো?… সেগুলো টাটকা দাগ কি না কে জানে! তা তো আর নির্ভুল করে প্রমাণ করা যায়নি। সরাইটা একেবারে বড়ো রাস্তায় উপরে। সে-রাতে বা অন্য কখনো কোনো চোর যে জানলা দিয়ে ঢোকবার চেষ্টা করেনি, তা-ই বা কে বলতে পারে।

একটা কথা মনে রাখবেন, কর্নেল। আততায়ী যে-ই হোক না কেন, সে জানতে পোখ-এর ঘরে মূল্যবান কিছু আছে। এবং নিকোলেফের এ-তথ্য অজ্ঞাত ছিলো না।

সে তো ক্রোফও জানতো। জানতো ব্রোক্স। রাস্তায়-ঘাটে সহিসরাই কি তা জানতো না? পোখ যে-রকম বাক্যিবাগীশ তাতে দেশশুদ্ধ লোক এ-কথা জানতো বলে মনে হয়। সরাইতে যে চাষী বা কাঠরেরা ছিলো, তারাও এমনকী চট করে টের পেয়ে গিয়েছিলো যে পোখ-এর ব্রীফ-কেসে প্রচুর টাকা আছে।

কাজেই আলোচনা করে কোনো সুরাহা হবার জো ছিলো না। প্রমাণ চাই–নির্জল, অকাট্য, শক্ত প্রমাণ। কিন্তু সব তর্কবিতর্ক সত্ত্বেও মেজর ফেরডেরের বদ্ধমূল ধারণা যে নিকোলেই খুনী-আর-কিছুই তিনি মানতে চান না।

তাহলে, কর্নেল রাগুয়েনোফ বললেন, শেষ পর্যন্ত এ-কথা বলতেই হয় যে আলেমানরা চিরকালই আলেমান।

সেই অর্থে স্লাভও চিরকালই স্লাভ থেকে যায়।

দেখা যাক, কেরস্টোফ তদন্ত করে কী বার করতে পারেন। তার গোয়েন্দাগিরির উপরেই এখন সব নির্ভর করছে।

+

কেরস্টোফ কিন্তু চুপচাপ হাত গুটিয়ে বসে ছিলেন না। এই হত্যারহস্যের রাজনৈতিক গুরুত্ব তিনি সম্পূর্ণ অবহিত ছিলেন। সেইজন্যই তিনি গভীর অভিনিবেশ সহকারে তদন্ত চালাচ্ছিলেন। সাক্ষীশাবুদ ডাকা, জেরা করা, খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে সব জানবার চেষ্টা করা কিছুই বাদ যাচ্ছিলো না। সহিসদের তিনি জেরা করলেন, জেরা করলেন কাঠরে ও চাষীদের সেদিন যারা ঐ। সরাইতে উপস্থিত ছিলো। ব্রোক্সকে অনেকবার জিজ্ঞাসাবাদ করা হলো। কিন্তু ব্রোক্স সব সন্দেহের ঊর্ধ্বে। দুর্ঘটনার পর সে কোচবাক্সের সহিস ও গাড়োয়ানদের নিয়ে সোজা গিয়েছিলো পেরনাউ; মাঝখানে একটা সরকারি আস্তাবলে সে যে রাত কাটিয়েছিলো, এ-তথ্য অকাট্য, কেননা প্রচুর সাক্ষী ছিলো তার। কাজেই বাইরের কারু কাণ্ড বলে চালিয়ে দেবার জো ছিলো না এটাকে। রাস্তার চোরডাকাত কী করে জানবে যে পোখ-এর কাছে টাকা আছে, তাছাড়া হঠাৎ তাকে সরাইখানায় রাত কাটাতে হচ্ছে এবং রাত কাটাতে হচ্ছে ঐ ঘরটায়।

কাজই সব সন্দেহ গিয়ে শেষ পর্যন্ত দুজনের উপরেই পড়ছে–সরাইওলা এ ড্রামা ইন লিভভানিয়া আর নিকোলেফ। সন্দেহ নেই যে এদের দুজনের একজনই খুনী। কিন্তু ঘটনার পর থেকেই ক্রোফ ছিলো নজরবন্দী– সবসময় গুপ্তচরের চোখে-চোখে। বহুবার তাকে জেরা করলেন কেরস্টোফ–অনেকক্ষণ ধরে তাকে প্রশ্নের পর। প্রশ্ন করা হলো– যদি অতর্কিতে কিছু বেস বলে ফেলে তো চেপে ধরা হবে। কিন্তু তার আচরণে, কথায়-বার্তায় সন্দেহজনক কিছুই পাওয়া গেলো না।

+

চব্বিশে এপ্রিল জাঁ চলে গেলো ডোরপাট বিশ্ববিদ্যালয়ে। আপাতত অন্তত খুনীর ছেলে বলে কেউ তাকে নিগ্রহই করবে না। সে গিয়ে পৌঁছুতেই তার বন্ধুরা তাকে চেঁচিয়ে-মেচিয়ে স্বাগত জানালে সবচেয়ে উল্লাস প্রকাশ করলে অবিশ্যি গোসপোদিন। কিন্তু বিপক্ষদল তখনও ঠাণ্ডা হয়নি। তারা কেবল গোল বাধাবার সুযোগ খুঁজতে লাগলো–বোঝা গেলো যে একটা রক্তারক্তি কাণ্ড না হয়ে বুঝি যায় না।

কাণ্ডটা ঘটলো পরের দিনেই। জাঁ যখন কার্ল-এর কাছে গিয়ে দাবি করলে যে তাকে ক্ষমা চাইতে হবে, তখন ছোকরা ইয়োহাউজেন আরো উদ্ধতভাবে তাকে অপমান করে কথা বললে। সঙ্গে-সঙ্গে জা তার গালে চড় কষিয়ে দিলে। ফল হলো দ্বন্দ্বযুদ্ধ। এবং তাতে কার্ল ইয়োহাউজেন বিষমভাবে আহত হলো।

এ-খবর যখন রিগা পৌঁছলো, তখন যেন আগুনে ঘি পড়লো। হের ও ফ্রাউ ইয়োহাউজেন তক্ষুনি ছেলের শুষার জন্য ডোরপাট রওনা হয়ে গেলেন। বোঝা গেলো, অচিরেই স্নাভে-জার্মানে ভীষণ দাঙ্গা আসন্ন।

দাঙ্গা বাধার আগেই অবিশ্যি সেন্ট পিটার্সবুর্গ থেকে বার্তা এলো। স্নাদিমির ইয়োনোফকে জার ক্ষমা করেছেন–তার নির্বাসনকে মকুব করা হয়েছে, আর তাকে সাইবেরিয়ায় ফিরে যেতে হবে না। তাকে ছেড়ে দেবার জন্য আদেশ হলো। সবাই মোটামুটি আগেই আন্দাজ করেছিলো যে জারের নির্দেশ এ-রকমই হবে। কেননা ভ্লাদিমির ইয়ানোফের ঘটনাটার কথা সারা দেশে এমনভাবে ছড়িয়ে পড়েছিলো যে, তাকে আবার সাজা দিলে তার রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া হয়তো আর শামলানো যেতো না।