০৩-৪. নিকোলেফ পরিবার

৩. নিকোলেফ পরিবার

পরের দিন ১২ই এপ্রিল। বসে কথা বলছিলো তিনজনে-অনেকক্ষণ ধরে তারা বসে আছে আরেকজনের অপেক্ষায়। রিগা শহরের একটা বাড়ির খাবার ঘর এটা; সন্ধে হয়ে গেছে–সাতটা থেকে আটটার মধ্যে হবে সময়। শহরের এদিকটায় সব বাড়িই রুশীদের। এ-বাড়িটা খুব-একটা অবস্থাপন্ন লোকের নয়; মধ্যবিত্তদের বাড়ির মতো, ইট-কাঠের তৈরি। এদিকটায় ইট-কাঠের বাড়ি খুব একটা নেই, বেশির ভাগ বাড়িই কাঠের। দেয়ালের গা কেটে বসানো হয়েছে চুল্লি; সারাদিন ধরে চুল্লিটা জ্বলছে, ৬০ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপ দিচ্ছে—বেশ গা-সওয়া গরম; বাইরে দেয়ালের গায়ে তাপমান যন্ত্রে অবিশ্যি হিমাঙ্কর একটু উপরে উঠেছে পারদ। মাঝখানের টেবিলে জ্বলছে একটা ছোট্ট প্যারাফিন লণ্ঠন। মারবেল-পাথর বসানো একটা খাবার-গাড়ির উপর টগবগ ফুটছে স্যামোভার; সাজানো পেয়ালা-পিরিচ দেখে বোঝা যায় চারজন লোকের চা খাবার কথা। কিন্তু চার-নম্বর ব্যক্তিটি তখনও এসে পৌঁছোয়নি, যদিও চল্লিশ মিনিট আগেই তার আসবার কথা ছিলো।

দিমিত্রি বড্ড দেরি করছে, অতিথিদের একজন মন্তব্য করলেন। ডবল জানলার কাছে গিয়ে বাইরে তাকালেন তিনি, রাস্তা দেখতে লাগলেন। বয়েস তাঁর পঞ্চাশ, পেশা ডাক্তারি, নাম হামিনে–ও-বাড়ির অনেক দিনের বন্ধু। পঁচিশ বছর যাবৎ রিগায় তিনি ডাক্তারি করছেন, মস্ত পশার, নামডাকও যথেষ্ট। অন্য ডাক্তাররা ঈর্ষা করলেও অত্যন্ত দয়া আছে বলে লোকজনের মধ্যে তাঁর দারুণ খাতির। তবে পেশাগত ঈর্ষা যে কত নিচে নামতে পারে, তা তো সব্বাই জানে—পৃথিবীর সবত্রই এই রকম। রুশদেশ তো আর সৃষ্টিছাড়া নয়।

দুই জানলার মাঝখানে দেয়ালে ঝুলছিলো এক পিতামহ-ঘড়ি। তার দিকে তাকিয়ে অতিথিদের আরেকজন বললেন, হ্যাঁ….আটটা প্রায় বাজে। কিন্তু মঁসিয় নিকোলেফের জন্য আরো সিকি ঘণ্টা অপেক্ষা করা যেতে পারে এবং ফরাশি দেশে আমরা বলি যে শেষ সিকি ঘণ্টা পনেরো মিনিটের চেয়েও অনেক লম্বা হয়। বক্তার নাম মঁসিয় দ্যলাপোর্ৎ–তিনি রিগার ফরাশি রাজদূত। বয়েস চল্লিশ, দশ বছর যাবৎ এই শহরে আছেন। হাবভাবে চলনে-বলনে আভিজাত্য, সহজে মেজাজ খারাপ করেন না, স্বভাবটা শান্ত।

বাবা পড়াতে গেছেন শহরের একেবারে অন্য প্রান্তে, তৃতীয়জন ব্যাখ্যা করবার চেষ্টা করলো, বড় দূর যেতে হয় তাঁকে, তাছাড়া এই দুর্যোগে যাতায়াত করাটাও খুব একটা সহজ নয়,–এই আদ্ধেক ঝড় আর আদ্ধেক বরফগলা…ফিরে যখন আসবেন, হাতে-পায়ে আর কোনো সাড় থাকবে না!

হুম! ডাক্তার হামিনে বললেন, চুল্লিটা তো দেখছি আদালতের জজ-সাহেবের মতো নাক ডাকাচ্ছে!… ঘরের ভিতরটায় বেশ গরম আছে, তার উপর স্যামোভারটাও চুল্লির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নাক ডাকাচ্ছে…কয়েক পেয়ালা চা গলায় ঢাললেই দিমিত্রির গা গরম হয়ে যাবে…. কিছু ভেবো না, ইলকা।… আর তাছাড়া তার জন্য যদি ডাক্তার ডাকতে হয়, তাহলেও ঘরের বাইরে যেতে হবে না—আর ডাক্তারও তার অনেক দিনের বন্ধু!

আমরা তা জানি, ডাক্তার! মেয়েটি হেসে ফেললো।

ইলকা নিকোলেফ-এর বয়েস চব্বিশ–পুরোদস্তুর স্লাভ দেখতে। রিগার আলেমান মেয়েদের চেয়ে একেবারে আলাদা রকম দেখতে–তাদের গায়ের রঙ বড় লালচে, চোখগুলোও বড্ড বেশি নীল, চোখে কোনো ভাষা নেই, ধরনধারণ বড্ড টিউটনিক। ইলকার চুল আর চোখের তারা কুচকুচে কালোগায়ের রঙ বেশি ময়লা নয়, কেমন যেন একটা উষ্ণতা মাখানো, সোজা দাঁড়ায়, মুখচোখ সব যেন কেটে বসানো, চোখের দৃষ্টিতে রয়েছে কেমন একধরনের গাম্ভীর্য, কিন্তু সেই কঠোর গাম্ভীর্য মোলায়েম হয়ে যায়, যখন সে কারু দিকে তাকায়—চোখের তারার আড়ালে যেন কোনো অন্তহীন বিষাদ লুকোনো। গম্ভীর ধরনের ভাবুক মেয়ে, ছলাকলা বা চতুরালি নেই স্বভাবে বা পোশাকে, শাদাশিধে সাজে, কিন্তু রুচির ছাপ স্পষ্ট, অর্থাৎ রুশী রক্তওলা লিভেনিয়ার তরুণীর এক নির্ভেজাল প্রতিভূ সে।

দিমিত্রি নিকোলেফ-এর স্ত্রী মারা গেছেন দশ বছর হলো। ইলকাই কিন্তু তাঁর একমাত্র সন্তান নয়। ইলকার ভাই জাঁ আঠারোতে পড়বে শিগগিরই; ডোরপাট বিশ্ববিদ্যালয়ে শেষ ক্লাসে পড়ে। ছেলেবেলায় ইলকাই ছিলো জাঁ-এর মায়ের মতো–ও-রকমভাবে আর-কেউ তাকে ভালোবাসতে বা আদর করতেই পারতো না। ইলকা যেভাবে সংসার চালায়, তাকে প্রায় বলা যায় অলৌকিক। না-হলে অত কম টাকায় সংসার চালিয়ে কিছুতেই জাঁ-কে হয়তো ও-রকম খরচ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে রেখে পড়ানো যেতো না।

দিমিত্রি নিকোলেফ-এর আয় কেবল ছাত্র পড়িয়ে। গণিত ও পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক তিনি, নিজের বিষয় তাঁর নখদর্পণে; বাপের টাকা ছিলো না, কাজেই পড়িয়ে ক-পয়সাই। বা পান! অধ্যাপনার মজুরি সব দেশেই খুব কম, রুশদেশে তো আরো। লোকের শ্রদ্ধা বা সন্ত্রমকে যদি টাকার অঙ্কে হিশেব করা যেতো তো দিমিত্রিকে বলা যেতো ক্রোড়পতি, রিগার ধনকুবেরদের একজনস্লাভদের মধ্যে সবচেয়ে গণ্যমান্যই বুঝি-বা হয়ে পড়তেন রিগায়। মঁসিয় দ্যলাপোর্ৎ আর ডাক্তার হামিনের কথাবার্তা থেকে সেটাই অনুমান হচ্ছিলো। কথাবার্তা। হচ্ছিলো রুশ ভাষায় শিক্ষিত রুশীরা অবিশ্যি ফরাশিতেই কথা বলে, কিন্তু দ্যলাপোর্ৎ চোস্ত রুশ বলেন, শিক্ষিত রুশীর কেতাদুরস্ত ফরাশির চেয়েও রুশ ভাষায় তিনি বেশি শড়গড়।

আচ্ছা ডাক্তার, মঁসিয় দ্যলাপোর্ৎ বলছিলেন, আন্দোলন শুরু হলে বলটিক দেশগুলোর রাজনৈতিক অবস্থাই পালটে যাবে-আর ঠিক আন্দোলনের আগের মুহূর্তে আমরা কথা বলছি… দেখছেন তো এস্তোনিয়ার খবর-কাগজগুলো কেমন জমকালো আর্য ভাষায় গুজব রটাচ্ছে!

আস্তে-আস্তে সব হবে, ডাক্তার ঘোষণা করলেন, বিপ্লব নয়, বিবর্তন। তবে এই আলোমানদের হাত থেকে শিগগিরই শাসন-ব্যবস্থা ও পৌরসভা মুক্তি পেয়ে যারে-সে-দিনের আর দেরি নেই। এই যে আমাদের দেশের উপর ওদের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব রয়েছেকি একটা অদ্ভুত জরদগব ব্যবস্থা নয়?

দুর্ভাগ্যবশত, ইলকা বললে, যখন তাদের হাতে শাসনভার থাকবে না, তখনও তারা সর্বশক্তিমানই থাকবে–কারণ ওদের হাতে অঢেল টাকাকড়ি আছে। তারাই তো জমির মালিক—আর বড়ো-বড়ো চাকরি খালি হলে তো তারাই পায়।

বড়ো-বড়ো চাকরিগুলো, দ্যলাপোর্ৎ বোঝালেন, না-হয় তাদের হাত থেকে কেড়ে নেয়া যাবে। কিন্তু জমিজমার ব্যাপারে ভারি মুশকিল হবে—যদি-বা একান্তই অসম্ভব না হয়, সে-সম্বন্ধে কিছু করা যে অত্যন্ত কঠিন হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।…এক লিভোনিয়াতেই তো আলেমানদের হাতেই বেশির ভাগ জমি।

অকাট্য তথ্য। বলটিক দেশগুলোর অভিজাত, প্রভাবশালী, নিদেন মধ্যবিত্ত কি ব্যাবসাদার সম্প্রদায়ের প্রত্যেকেই প্রায় টিউটনিক। এটা ঠিক যে এই আলেমানদের হাতে পড়ে অন্যরা কেউ-বা হয়েছে ক্যাথলিক, কেউবা হয়েছে প্রটেস্টান্ট, কিন্তু তবু কেউই একেবার পুরোদস্তুর জর্মান হয়ে যায়নি। ফিনদেরই গোত্রের লোক এই এস্তোনীয়রা—বেশির ভাগ লোকেই চাষবাস নিয়ে ব্যস্ত থাকে; কিন্তু রেফেল, ডোরপাট, এমনকী সেন্ট পিটার্সবুর্গে পর্যন্ত অনেকগুলো খবরের কাগজ এস্তোনীয়দের দাবি ও অধিকার বজায় রাখবার জন্যে শোরগোল তুলেছে–কোথাও কেউ তাদের বৈদেশিক প্রভুদের উপরকার রাগ ও অনীহা চেপে রাখবার চেষ্টা করছে না।

দ্যলাপোর্ৎ আরো বললেন, আর এই স্লাভ ও আলেমান রক্তওলা রুশদের মধ্যে সংঘর্ষে কার যে সবচেয়ে বেশি লাভ হবে, তা-ই এখনো আমি বুঝতে পারছি না?

সম্রাট কিছু করুন, বললেন ডাক্তার হামিনে, তাঁর তো বিশুদ্ধ স্লাভ রক্ত। কী করে আমাদের দেশ থেকে বৈদেশিক উৎপাত হঠানো যায় তিনি নিশ্চয়ই সেটা সবচেয়ে ভালো বুঝবেন।

সত্যিই একটা-কিছু করুন তিনি অবশেষে, ইলকা বেশ আবেগ দিয়েই বললে, সাতশো বছর ধরে, আলেমান বিজয়ের পর থেকে, আমাদের চাষীমজুররা বিজেতার অত্যাচার ঠেকাবার চেষ্টা করছে-অথচ আশ্চর্য, এখনও আলেমানরা এ-দেশে রয়ে গেছে!

তোমার বাবা, ইলকাকে মনে করিয়ে দিলেন ডাক্তার, তোমার বাবা তো কী ভীষণ দুঃসাহসের সঙ্গে আমাদের হয়ে লড়েছেন।…তাঁরই হাতে স্লাভদের নেতৃত্ব পড়া উচিত সেটাই সংগত হবে।

লড়েছেন যেমন, তেমনি দুর্ধর্ষ একেকটা শও তৈরি করেছেন, মন্তব্য করলেন দ্যলাপোর্ৎ।

আর তাদের মধ্যে প্রধান হলো ইয়োহাউজেন ভাইগুলো, ডাক্তার সায় দিলেন, ধনকুবের একেকটা ব্যাঙ্কার—দিমিত্রি নিকোলেফ যেদিন রিগা পৌরসভার ভার নেবে, সেদিন তারা তো একেবারে জলে-পুড়ে মরবে। আমাদের শহরে রুশীদের সংখ্যা ছাব্বিশ হাজার, আর লাটরা সবশুদ্ধু চব্বিশ হাজার-–অথচ আলেমানরা সংখ্যায় মাত্র চুয়াল্লিশ হাজার! স্লাভরাই দলে ভারি—আমি ঠিক জানি তারা নিকোলেফকেই ভোট দেবে!

বাবার তেমন উচ্চাশা নেই, ইলকা প্রতিবাদ করলে, কেবল স্লাভরা নিজের দেশে নিজেরা সব ভার পেলেই তিনি খুশি হবেন।

আগামী নির্বাচনেই সেটা হবে, মাদ্মোয়াজেল ইলকা, দ্যলাপোর্ৎ তাকে আশ্বস্ত করলেন, আর দিমিত্রি যদি নির্বাচনে দাঁড়াতে রাজি হয়…

বাবার অবস্থা তো মোটেই সচ্ছল নয়—নির্বাচনে দাঁড়াতে গেলে মস্ত একটা বোঝ কাঁধে এসে চাপবে, ইলকা বাধা দিয়ে বললে, আর আপনি তো এটা জানেন, ডাক্তার, যে লোকসংখ্যার হিশেব থেকে যে-হদিশই মিলুক না কেন রিগা আসলে যতটা-না রুশ শহর, তার চেয়েও অনেক বেশি জর্মান।

দ্বিনা নদীর জল বয়ে যাক, ডাক্তার আবেগে ভরে গেলেন, পুরোনো সব ধ্যান-ধারণা ভেসে যাবে তার জলে, উজান বেয়ে আসবে নতুন ধ্যান, নতুন ধারণা…আর সেই ঢেউয়ের পিঠে সওয়ার হবে দিমিত্রিই।

ধন্যবাদ। আপনাকেও ধন্যবাদ জানাই, মঁসিয় দ্যলাপোর্ৎ। বাবাকে আপনারা খুবই ভালোবাসেন, কিন্তু আমাদের খুব সাবধানে থাকতে হবে। দ্যাখেননি কি মাঝে-মাঝে বাবা কেমন বিমর্ষ হয়ে পড়েন-আর তাঁর মন-খারাপ হয়েছে দেখলেই আমার ভারি অস্বস্তি হয়।

দ্যলাপোর্ৎ ও হামিনে—দুজনেই দিমিত্রির এই হঠাৎ-হঠাৎ বিষণ্ণ হয়ে পড়াটা লক্ষ করেছিলেন। বেশ কিছুকাল ধরেই দিমিত্রি নিকোলেফ কী-একটা বিষয় নিয়ে যেন বড় ভাবিত হয়ে পড়েছেন। কিন্তু দিমিত্রি মানুষটা খুব চাপা ধরনের, সহজে কারু কাছে মন খোলেন না, ছেলেমেয়েদেরও সহজে কিছু বলেন না, এতদিনকার বন্ধু হামিনেকেও কিছু না। সেইজন্যেই কখনও অত্যন্ত ব্যাকুল ও চিন্তিত হয়ে পড়লে আরো জেদ করে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন তিনি-কাজকর্মই তাঁর সান্ত্বনা ও আশ্রয়, হয়তো কাজের মধ্যে ড়ুবে গিয়ে সব ভুলে থাকতে চান। অবিশ্যি তৎসত্ত্বেও রিগার সমস্ত স্লাভ বাসিন্দাই তাকে নতুন পৌরসভার ভাবী প্রতিনিধি বলে মনে করতো।

+

এটা ১৮৭৬ খ্রীষ্টাব্দের কথা। বলটিক দেশগুলোকে রুশী করে ফ্যালো—এই ভাবনাটা ততদিনে শতাব্দী-প্রাচীন হয়ে উঠেছে। একদিন এই দেশজোড়া জাতীয়তাবাদের স্বপ্ন দেখেছিলেন ক্যাথরিন দি গ্রেট। বড়ো-বড়ো গ্রাম ও শহরের শাসনযন্ত্র থেকে ততদিনে জর্মান অপসারণের কাজ শুরু হয়ে গেছে; আঞ্চলিক পরিষদ গুলোর প্রতিনিধি নির্বাচন করতে হলে নাগরিকদের ততদিনে বাধ্যতামূলকভাবে কতগুলো দায়িত্ব পালন করা আবশ্যক হয়ে উঠেছে। বলটিক দেশগুলোর লোকসংখ্যা হবে প্রায় কুড়ি লক্ষ-তার মধ্যে ইহুদি সমেত আলেমানদের সংখ্যা হবে মাত্র দেড় লক্ষ। কাজেই রাজ্যপাল বা উচ্চপদে আসীন কর্মচারীদের পরিচালনায় স্লাভদের ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলবার চেষ্টাটা খুব সহজেই সফল হচ্ছিলো। দ্বন্দ্বটা এখন শুরু হয়েছে পৌরসভা নিয়ে–বর্তমান পৌরসভায় সবচেয়ে বেশি প্রভাব এক ব্যাঙ্কার পরিবারের—ইয়োহাউজেনদের।

রিগার শহরতলিতে, নিকোলেফ পরিবারের সাধারণ পৈতৃক বাড়িটা যেখানে ছিলো, অধ্যাপক নিকোলেফের শ্রদ্ধা ও সম্মান খুব;এদিকটায় প্রায় আট হাজার রুশীর বাস।

ইলকার বয়স চব্বিশ, কিন্তু এখনও যে তার বিয়ে হয়নি, তার কারণ কি দিমিত্রির আয় বেশি নয়? অন্যান্য দেশের মতো লিভেনিয়ার প্রচল কী? মেয়ের সুন্দর মুখই কি তার ঐশ্বর্য, তারপরে যৌতুক কি কেবল গুণপনা আর লাবণ্য হলেই চলে? না, এখানকার স্লাভদের মধ্যে টাকাকড়িই ভালো বিয়ের একমাত্র উপাদান নয়। সেইজন্যেই ইলকার পাণিপ্রার্থনা করে মাঝে-মাঝে যে প্রস্তাব আসতো না, তা নয়; কিন্তু আশ্চর্য, দিমিত্রি আর তাঁর কন্যা সব রাজযোটক বিয়ের প্রস্তাবও এতকাল বারেবারে প্রত্যাখ্যান করে এসেছেন।

তার একটা কারণ অবিশ্যি আছে। কয়েক বছর আগে দিমিত্রির এক বন্ধু মিখায়েল ইয়ানোফ বলে এক স্লভের একমাত্র ছেলের সঙ্গে ইলকার বিয়ে ঠিক হয়েছিলো। ইয়ানোফদের বাড়িও রিগায়, এই একই শহরতলিতে; ভ্লাদিমির ইয়ানোফ পাত্র হিশেবে যোগ্যই–বয়েস তার বত্রিশ, ওকালতি করে, বেশ নাম করেছে এর মধ্যেই। বয়েসের ব্যবধান সত্ত্বেও ভ্লাদিমির আর ইলকা ছেলেবেলা থেকেই একসঙ্গে বড়ো হয়েছে। এই গল্প শুরু হবার চার বছর আগে, ১৮৭২ খ্ৰীষ্টাব্দে, বাগদান হয়ে গিয়েছিলো–তরুণ ব্যবহারজীবীর বয়েস তখন ছিলো আটাশ, আর পাত্রীর বয়েস কুড়ি। ঠিক ছিলো বিয়েটা হবে সেই বছরেই। ও বিয়ের কথা খুব একটা রটানো হয়নি–দুই বাড়িরই গোপন কথা হয়ে ছিলো এটা। বাগদানের ব্যাপারটা এতই গোপনে ছিলো যে বন্ধুবান্ধবরা পর্যন্ত তার টুঁ-শব্দটি শোনেনি। তারপর যেই সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়ে বিয়ের উৎসব হবে, অমনি হঠাৎ সব জল্পনা ভেস্তে গেলো—এলো এক নিদারুণ আঘাত।

জারের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য যে-সব গোষ্ঠী রচিত হয়েছিলো, তারই একটায় যোগ দিয়েছিলো ভ্লাদিমির ইয়ানোফ। এই গোষ্ঠি অবশ্য সরাসরি জারের বিরুদ্ধে সংঘর্ষে নামেনি, কেবল আদর্শের দিক দিয়ে স্বৈরাচারকে তা প্রত্যাখ্যান করেছিলো—কিন্তু সন্দেহপরায়ণ কর্তৃপক্ষ সরাসরি সংঘর্ষ আর আদর্শগত প্রত্যাখ্যানের মধ্যে কোনো ব্যবধান দেখতে পাননি।

সব চেষ্টার আশু মূলোচ্ছেদ করতে হলে আইনের বালাই রাখলে চলে না–তার উপর কর্তৃপক্ষ যা-খুশি তাই করতে পারে। কাজেই সারা দেশে ধরপাকড় শুরু হয়ে গেলো, শহরেশহরে গ্রেফতার হলো লোক; রিগাতেও গ্রেফতার হলো একজন—ভ্লাদিমির ইয়ানোফকে তার বাড়ি থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো, পাঠিয়ে দেওয়া হলো পূর্ব-সাইবেরিয়ার মিনুসিংস্ক খনিতে। আর কি সে কোনোদিন ফিরে আসবে? সাইবেরিয়ায় একবার যে যায়, সে কি আর কখনও ফেরে? এই দুরাশা করবে কে?

দুই পরিবারই দারুণ ঘা খেলো এতে–সারা শহর তাদের সঙ্গে ব্যথিত হলো। এই চোটটা ইলকা হয়তো সামলাতেই পারতো না, কিন্তু তার ভালোবাসাই তাকে জিইয়ে রেখে দিলে। বাগদত্তকে ছেড়ে সে থাকবে না, তার সঙ্গেই যাবে নির্বাসনে, কেবল কর্তৃপক্ষ অনুমতি দিলেই হয়—আর সেই অনুমতি পাবার প্রত্যাশাতেই সে কোনোরকমে নিজেকে টিকিয়ে রেখেছে। কিন্তু, ইতিমধ্যে, ভ্রাদিমিরের পরিণাম কী হয়েছে? সত্যি-সত্যি তাকে কোথায় পাঠানো হয়েছে, সে-খবর কিছুতেই পাওয়া গেলো না। এই চার বছরেও ইলকা সে-সম্বন্ধে কোনো খবর পায়নি।

ছেলেকে ধরে নিয়ে যাবার ছ-মাসের মধ্যেই মিখায়েল ইয়ানোফ টের পেলেন যে তার অন্তিম দশা উপস্থিত। কালমাত্র বিলম্ব না করে তিনি তার সব সম্পত্তি বেচে দিলেন-বেশি হলো না, সবসুদ্ধ মাত্র ২০,০০০ রুবল পাওয়া গেলো ব্যাঙ্কনোটে—সব টাকা মিখায়েল পাঠিয়ে দিলেন দিমিত্রিকে, তার ছেলের জন্য গচ্ছিত রাখলেন। কাজটা এমন গোপনে চোকানো হলো যে এমনকী ইলকাও তা ঘূণাক্ষরেও টের পেলে না। সব টাকা দিমিত্রি গোপনে তুলে রেখে দিলেন।

কস্মিনকালেও যদি জগৎ থেকে মানুষের মর্যাদা ও বিশ্বাস হারিয়ে যায়, তবে তার শেষ আশ্রয় হবে লিভোনিয়া-এ-রকম একটা প্রবাদ আছে। এমন-সব চমকপ্রদ প্রেমিকপ্রেমিকারও খবর মেলে সেখানে, যারা নাকি এমনকী কুড়ি-পঁচিশ বছর ধরে দূর থেকে ভালোবেসে তবে বিয়ে করে—বিয়ে না-করে এতদিন কাটাবার কারণ আর-কিছু নয়, তারা জীবনে প্রতিষ্ঠা না-পেয়ে কিছুতেই বিয়ে করতে চায় না। ভ্লাদিমির আর ইলকার বেলায় অবিশ্যি এ-কথা খাটে না—কারণ সামাজিক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠায় কোনো প্রশ্নই তাদের মধ্যে ছিলো না। ইলকার ছিলো না কিছুই, আর তরুণ ব্যবহারজীবীও তার কাছ থেকে কিছুই চায়নি–এমনকী তার বাবা তার জন্য কী রেখে গেছে, তাও সে জানতো না। তার ছিলো প্রচণ্ড মেধা ও প্রতিভা, আর ভবিষ্যৎকেও সে ডরাতো না। ভ্রাদিমির তো গেলো নির্বাসনে, কিন্তু ইলকা জানতো যে তার বাগদত্ত তাকে কোনোকালেই ভুলে যাবে না, সেও তাকে কখনও ভুলতে পারবে না। যুগল আত্মার দেশ নয় কি লিভেনিয়া?…মাটির পৃথিবীতে প্রায়ই এই যমল আত্মার মিলন হয় না, যদি-না ভগবান দয়া করেন। না-হলে শাশ্বত মিলন ছাড়া আর উপায় কী-চিরন্তন মুহূর্তের মধ্যেই তাহলে পরস্পরে লীন হতে হয়।

ইলকা বসেই রইলো পথ চেয়ে, আর তার মনপ্রাণ পড়ে রইলো ভ্লাদিমিরেরই সঙ্গে, নির্বাসনে। যদি ভগবানের দয়া হয়, যদি সে ক্ষমা পায়—সম্ভবনা অবিশ্যি খুবই কম কিন্তু যদি সে ফিরে আসে। নিজেকে তার শুধুমাত্র বাগদত্তা বলেই মনে হয় না, সে যেন তার পরিণীতা, তার স্ত্রী। ভ্লাদিমির যদি না-আসে তো সে-ই তার কাছে যাবার জন্যে অনুমতি চাইবে। কিন্তু সে চলে গেলে তার বাবার দশা কী হবে? একলা, বুড়োমানুষ বাবা!

সব সত্ত্বেও ইলকা কিন্তু সবচেয়ে দামি কথাটাই জানতো না। দিমিত্রি নিকোলেফ কিছুতেই কিছু খুলে বলবেন না—যদিও কথাটার মধ্যে এমন কিছু নেই, যেটা গোপন রাখা চলে। কিন্তু বলবেনই বা কেন? এই মুহূর্তের দুঃখকে আরো দুর্বিষহ করে তুলে ভাবী বিপদের কথা বলে লাভ কী। শিগগিরই ইলকা সব জানতে পারবে—ফয়সালা হবার দিন এগিয়ে এলো বলে।

দিমিত্রি নিকোলেফের বাবা রিগায় ব্যাবসা করতেন। মারা যাবার সময় ব্যাবসার অবস্থা মোটেই ভালো ছিলো না, ধারে-কর্জে ব্যাবসাটাই বিকিয়ে যেতে বসেছিলো। সেই ঋণ শোধ করতে গেলে চাই নগদ পঁচিশ হাজার রুবল। বাবা দেউলে হয়ে যান, এটা দিমিত্রি চাননি–কাজেই ঠিক করেছিলেন তিনিই সব ধার শোধ করে দেবেন। নিজের স্থাবর-অস্থাবর সব কুড়িয়ে-বাড়িয়ে মাত্র কয়েক হাজার রুবল তিনি যোগাড় করেছিলেন। বাকি টাকাটা শোধ করে দেবার জন্যে সময় দেয়া হয়েছিলো তাঁকে; প্রভূত কৃচ্ছসাধন করে একটু-একটু করে বাকি টাকাটা তিনি অ্যাদ্দিন ধরে শোধ করছিলেন। উত্তমর্ণ আর উে নয়, ইয়োহাউজেনরা। দিমিত্রি নিকোলেফ পিতার ঋণ কাঁধে নিয়ে এতটাই জড়িয়ে পড়েছিলেন যে এখনো সে-টাকা তিনি শোধ করতে পারেননি—এখনও আঠারো হাজার রুবল দেনা রয়েছে, তাঁর কাছে যেটা একটা বিপুল অঙ্ক। এদিকে বকেয়া টাকা চুকিয়ে দেবার তারিখ হচ্ছে আগামি পনেরোই মে-আর পাঁচ সপ্তাহও বাকি নেই।

ইয়োহাউজেনরা আর দেরি করতে রাজি হবে না—নতুন কোনো তারিখই তারা দেবে না। শুধু যদি ব্যাঙ্কার বা ব্যাবসাদারদের সঙ্গে নিকোলেফের কারবার হতো, তাহলে না-হয় কথা ছিলো; কিন্তু ইয়োহাউজেনরা তাঁর রাজনৈতিক শত্রু–লোকের মতে তারই প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী। ইয়োহাউজেনদের বড়ো ভাই ফ্রাঙ্ক—সে-ই ব্যাবসার কর্ণধার; ঐ দেনার দরুন সে তাঁকে প্রায় কিনে রেখেছে।

ফ্রাঙ্ক তাঁকে ছেড়ে কথা কইবে না—মোটেই দয়া করবে না।

ডাক্তার, রাজদূত আর ইলকা আরো আধঘণ্টা ধরে নানা বিষয়ে আলোচনা করলে, কিন্তু বাবার আসতে দেরি হচ্ছে দেখে ইলকা ক্রমেই অস্থির হয়ে পড়ছিলো। হঠাৎ এমন সময় দিমিত্রি দরজার কড়া নাড়লেন।

দিমিত্রির বয়স মাত্র সাতচল্লিশ, কিন্তু দেখে মনে হয় বুঝি আরো দশ বছরের বড়ো। লম্বায় মাঝারি মাপের, দাড়িতে পাক ধরেছে, কপালে রেখা পড়েছে—বিষণ্ণ হলেই বা গম্ভীর হলেই ভাঁজ পড়ে কপালে, কিন্তু মানুষটা এমনিতে বেশ বলিষ্ঠ। মর্মভেদী দৃষ্টি তার, যুবা বয়স থেকেই তাঁর চাউনি এই রকম-ভরাট গলা, যেন সোজা বুক থেকে আওয়াজ ওঠে।

বৃষ্টিভেজা কোট ছাড়তে-ছাড়তে ঘরে ঢুকলেন দিমিত্রি। টুপি খুলে রাখলেন একটা আরাম-চেয়ারের মাথায়, তারপর মেয়ের কপালে চুমু খেয়ে দুই বন্ধুর হাত ধরে সজোরে ঝাঁকুনি দিলেন।

ইলকা তিরস্কার করে বললে, তুমি বড় দেরি করেছে, বাবা!

আটকে গেলুম হঠাৎ, দিমিত্রি বললেন, বড় বেশিক্ষণ পড়াতে হলো।

নাও, চা নাও, ইলকা বললে।

যত খুশি পড়াও, কিন্তু দেখো, খামকা ক্লান্ত হয়ো না, ডাক্তার বললেন, নিজেকে এভাবে বাজে খরচ কোরো না, দিমিত্রি। তোমাকে দেখে আমার ভালো ঠেকছে না। কয়েকদিন বিশ্রাম নাও না।

বিশ্রাম? তা অবিশ্যি মন্দ নয়, নিকোলেফ সায় দিলেন, তা, ও কিছু না—একটা রাত বিশ্রাম নিলেই আবার চাঙ্গা হয়ে উঠবে। নাও, তোমরাও চা নাও। তোমাদের মিথ্যে আটকে রাখতে চাই না। আজ একটু তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তে চাই।

বাবা, কী হয়েছে, বলো। কিছু লুকিয়ো না, ইলকা সোজা তার বাবার চোখের দিকে তাকালে।

কিছু হয়নি। তুই যদি অত ভাবিস, শেষটায় হামিনে আমার কাঁধে একটা মনগড়া অসুখ চাপিয়ে দেবে—আমাকে সারিয়ে তোলার সুখ পাবার জন্যে যা-তা একটা রোগের নাম বলে বসবে!

উঁহু, ডাক্তার মাথা নাড়লেন, কিছু-কিছু লোক আছে, যারা রোগ পুষে রাখে, কিছুতেই সারাতে চায় না।

নতুন কিছু শুনেছেন নাকি, মঁসিয় নিকোলেফ? দ্যলাপোর্ৎ জিগেশ করলেন।

উঁহু। কেবল শুনতে পেলুম গবর্নর-জেনারেল গোরকো হঠাৎ রিগায় ফিরে এসেছেন–অথচ তাঁর এখন সেন্ট পিটার্সবুর্গে থাকার কথা ছিলো।

বাঃ, চমৎকার! ডাক্তার খুশি হয়ে উঠলেন, এ-খবর পেয়ে ইয়োহাউজেন খুব-একটা খুশি হবে বলে মনে হয় না। তার আবার ও-মহল্লায় তেমন দহরম-মহরম নেই।

নিকোলেফের কপালে ভাঁজ পড়লো। দেনার দায়ে বিকিয়ে আছেন বলেই কি ইয়োহাউজেনের নাম শোনবামাত্র তিনি শঙ্কিত হয়ে উঠলেন।

চা তৈরি ছিলো–ইলকা সবাইকে চা ঢেলে দিলে। আরো আধঘণ্টা সবাই মিলে আলোচনা হলো। বলটিক দেশগুলোর দশা কী, রিগার অবস্থাও কি তথৈবচ, স্লাভ-আলেমান সংঘর্ষ, রাজনৈতিক অবস্থা ইত্যাদি নানা বিষয় উঠলো কথাপ্রসঙ্গে। রিগায় যে পৌরসভার প্রতিদ্বন্দ্বিতা প্রবল আকার নেবে, সে-বিষয়ে কারুরই কোনো সন্দেহ দেখা গেলো না।

দিমিত্রি বসে বসে কী যেন ভাবছিলেন। বড় আনমনা দেখাচ্ছিলো তাঁকে। যদিও মাঝে-মাঝেই তাঁর মত চাওয়া হচ্ছিলো তবু তিনি বিশেষ হু-হাঁ করলেন না। তাঁর মন যেন অন্যত্র পড়ে আছে। কিন্তু কোথায়?… কেবল তিনিই জানেন। তাঁর কাছে যখন বিশদ মত চাওয়া হলো, তিনি কেবল দু-এক কথায় সারতে চাইলেন–কিন্তু তাঁর এই এড়িয়ে যাওয়াটা ডাক্তারের মোটেই মনঃপূত হলো না।

শোনো, দিমিত্রি, ডাক্তার ফের বললেন, তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে যে তুমি আমাদের সঙ্গে মোটেই রিগায় বসে নেই।…কোনখানে পড়ে আছে তোমার মন?…নাকি তুমি প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছো?… লোকে তোমাকে চায়, কর্তৃপক্ষও তোমার উপরেই সদয়…তুমি কি চাও যে ইয়োহাউজেনই আবার নির্বাচনে জিতুক?।

আবারও সেই নামটা। ওই নামটা শোনবামাত্র দিমিত্রির সর্বাঙ্গ কেবল কেঁপে ওঠে। হামিনে, নিকোলেফ বললেন, ইয়োহাউজেনদের শক্তি কতটুকু তোমার জানা নেই।

ওরা যতটা ঢক্কানাদ করে, তার চেয়ে অনেক কম। সে তুমি নিজের চোখেই দেখতে পাবে, ডাক্তারও অমনি বলে উঠলেন।

+

সাড়ে-নটা বাজলো ঘড়িতে। ডাক্তার হামিনে আর মঁসিয় দ্যলাপোর্ৎ বিদায় নেবার জন্য উঠে পড়লেন। আবহাওয়া বিশ্রী হয়ে আছে। হাওয়ার ঝাপটা লাগছে জানলায়। কনকনে ঠাণ্ডা। বৃষ্টিও পড়ছে। বাইরে রাস্তার কোণে হাওয়া শোঁ-শোঁ শিস দিচ্ছে, এমনকী চিমনি দিয়ে হাওয়ার ঝাপটা আসছে মাঝে-মাঝে, আর অমনি লাফিয়ে নেচে উঠছে চুল্লির আগুন।

কী ঝড় বাইরে! দ্যলাপোর্ৎ বলে উঠলেন।

এমনকি কোনো ডাক্তারও এই ঝড়বাদলে বাড়ি ছেড়ে বেরুতে চাইবে না, হামিনে ঘোষণা করলেন। আসুন, দ্যলাপোং। আমার কোচবাক্সে করে আপনাকে পৌঁছে দেবো–আমার এই চাকাছাড়া দু-পেয়ে কোচবাক্স…

অনেকদিনকার অভ্যাসবশত ডাক্তার ইলকার কপালে চুমু খেলেন, বন্ধুর হাতে দিলেন। মস্ত ও সহৃদয় ঝাঁকুনি—আর বন্ধু তাদের সদর দরজা অবধি পৌঁছে দিলেন। তারপরেই অতিথিরা ঝড়ের মধ্যে অন্ধকারে মিলিয়ে গেলেন।

ইলকা গেলো বাবাকে শুভরাত্রি জানাতে। নিকোলেফ যেন অন্য দিনের চেয়েও একটু বেশি আদর করলেন মেয়েকে।

আচ্ছা বাবা, ভালো কথা, ইলকা বললে, তোমার কাগজ তো দেখতে পেলুম না। …পিয়ন দিয়ে যায়নি?

দিয়ে গেছে। সন্ধেবেলা বাড়ি ফেরবার সময় পিয়নের সঙ্গে রাস্তায় দেখা—আমাকে হাতে-হাতেই দিয়ে দিয়েছে কাগজটা।

কোনো চিঠি আসেনি?

না, ইলকা, চিঠি ছিলো না।

রোজ, চার বছর ধরে রোজ রাত্রে সেই একই উত্তর-–না তো, চিঠি আসেনি তো৷ চিঠি নেই—অন্তত সাইবেরিয়া থেকে কোনো চিঠি আসে না একদিনও। ইলকার চোখের জলে একদিনও কোনো চিঠির তলায় ভ্লাদিমির ইয়ানোফ নামটা ধুয়ে যায় না—একদিনও না —কোনোদিনও না।

শুভরাত্রি, বাবা, আস্তে বললে ইলকা।

শুভরাত্রি।

.

৪. ডাকের গাড়িতে

পায়ে হেঁটে বা ঘোড়ার পিঠে চড়ে না-যেতে চাইলে বলটিক দেশগুলোর অন্তহীন সমভূমিতে পরিবহণ ব্যবস্থা রয়েছে মাত্র দুটি। এক হচ্ছে রেলপথ-রেফেল থেকে সেন্ট পিটার্সবুর্গ অব্দি মস্ত রাস্তা গেছে রেলের। আর আছে ডাকগাড়ি বা তেলেগু, তাছাড়া আর-কোনো গাড়িই এদিকে চলে না–আর তেলেণ্ড্য হচ্ছে পাজির পাঝাড়া, দারুণ তার বদনাম—আসলে খামারের চার-চাকার বিশ্রী গাড়ি ছাড়া তা আর কিছু নয়। আর ডাক-বওয়া কোচবাক্সটি ততটা আদিম হয়তো নয়। ঠিক গোরুর গাড়ি নয়, বরং ডাকগাড়িকে বলা যায় রীতিমতো একটা শকটই–কিন্তু ভিতরটা নিঃসন্দেহে আরো আরামপ্রদ করা যেতো অনায়াসেই। তবে ঝড়-বৃষ্টিহাওয়ার হাত থেকে রেহাই পাওয়া যায় বটে। ভিতরে বসবার জায়গা থাকে মাত্র চারটে-সপ্তাহে দু-বার করে এই ডাকের গাড়ি রিগা থেকে রেফেল-এ যাতায়াত করে।

১৩ই এপ্রিল সকালবেলায় রেফেল-এর উদ্দেশে যে-ডাকগাড়িটি ছাড়বে বলে অপেক্ষা করছিলো, তার একমাত্র যাত্রীটি তখনও এসে পৌঁছোয়নি। আগের দিনই যাত্রীটি আগাম মাশুল দিয়ে ডাকগাড়ির আসনটা ভাড়া করে গিয়েছিলো। ভদ্রলোকের বয়েস হবে প্রায় পঞ্চাশ; ঠিক কাঁটায়-কাঁটায় গাড়ি ছাড়বার সময় এসে হাজির হলো সে। দিব্যি হাসিখুশি মানুষ, প্রফুল্ল বয়ান, মুখে হাসিটি লেগেই আছে, বেশ তাগড়াই একটা জ্যাকেটে গা মুড়ে রেখে কানঢাকা মাথাঢাকা একটা ওভারকোট চাপিয়েছে তার উপর, বগলে আঁটো করে ধরে রেখেছে একটা ব্রীফ-কেস।

আপিশে ঢুকতেই মেইল-কোচের কনডাকটার সম্ভাষণ জানালে, আরে—পোখ! তাহলে তুমিই ডাকগাড়ির আসন ভাড়া করেছিলে?

হ্যাঁ, ব্রোক্স।

তাহলে তেলেতে গেলে তোমার আর মন ওঠে না আজকাল!..দিব্যি একটা তিন ঘোড়ার কোচবাক্স চাই নিজের তাঁবে?

আর তাছাড়া তোমার মতো সদাজাগ্রত প্রহরীও চাই কিনা?

অর্থাৎ, ছোটো বাবা, খরচের অঙ্কটা ধর্তব্যেই পড়ে না…

না, বিশেষ করে টাকাটা যখন আমি দিচ্ছি না।

কে দিচ্ছে তাহলে?

বড়ো কর্তা স্বয়ংহের ফ্রাঙ্ক ইয়োহাউজেন।

হুমকনডাকটার বলে উঠলেন, তা তিনি ইচ্ছে করলে অবিশ্যি আস্ত কোচবাক্সটাকেই কিনে নিতে পারেন!

তা ঠিকই বলেছো। তবে কিনা, ব্রোক্স, আমি কেবল একটা টিকিটই কিনেছি—দু–একজন সঙ্গী ছাড়া চলে কী করে। সঙ্গে কেউ থাকলে রাস্তাটা অত একঘেয়ে আর বিরক্তিকর ঠেকে না…

বেচারা! তাহলে আজ তোমাকে সঙ্গী ছাড়াই যেতে হবে। এ-রকম অবিশ্যি রোজ হয় না, তবে আজকে…আজকে কেবল একটাই টিকিট বিক্রি হয়েছে, আর সেটা তোমার।

সে কি! আর কেউ যাবে না?

না। যদি-না রাস্তায় আর-কাউকে তুলে নিই তো সারাক্ষণ আমার সঙ্গেই বকবক করতে হবে…উঠে পড়ে, উঠে পড়ো। তা আর কী করবে—তাতে তো আর জখম হয়ে যাবে না! আর তুমি তো জানোই-একটু-আধটু কথাবার্তায় আমার কিছু এসে যায় না।

না, ব্রোক্স, তাতে আমারও কিছু ফোঁসকা পড়ে না।

কোথায় যাচ্ছো বলো দিকি?

একেবারে শেষ অব্দি–রেফেল-এ–ইয়োহাউজেনের এক প্রতিনিধির কাছে। বলে পোখ তার ব্রীফ-কেসের দিকে তাকিয়ে চোখ মটকে ইঙ্গিত করলে–তামার শেকল দিয়ে ব্রীফ-কেসটা তার কোমরবন্ধের সঙ্গে বাঁধা।

আরে-আরে, ছোটো বাবা, ব্রোক্স বললে, ও-রকমভাবে কথা বোললা না!…আমাদের দেখছি শেষ অব্দি একা যেতে হবে না!

সত্যিই সেই সময়ে আরেকটি যাত্রী হন্তদন্তভাবে আপিশে এসে ঢুকে পড়েছিলো। পোখএর ইঙ্গিতটা সে দেখেছে কিনা, ঠিক বলবার জো নেই।

কেউ যাতে তাকে চিনতে না-পারে, যাত্রীটি সেইজন্য যথেষ্ট সাবধান হয়ে এসেছে। আপাদমস্তক মুড়ে রেখেছে ওভারকোটে, টুপিটা শুদ্ধ চোখ পর্যন্ত নামিয়ে সে মুখ ঢেকে রেখেছে। কনডাকটারের দিকে এগিয়ে গিয়ে সে জিগেশ করলে, কোচবাক্সে আর-কোনো খালি আসন আছে?

তিন-তিনটে আসন খালি পড়ে আছে, উত্তর দিলে ব্রোক্স।

একটা হলেই চলবে। কদ্দুর যাবেন? রেফেল?

হ্যাঁ…রেফেল, একটু ইতস্তত করে বললে যাত্রীটি, তারপর কাগজের নোটে ভাড়ার টাকা গুনতে গুনতে কাটা-কাটা গলায় জিগেশ করলে, কখন ছাড়বে?

দশ মিনিটের মধ্যেই।

সন্ধেবেলায় কোথায় গিয়ে পৌঁছবো?

আবহাওয়া খারাপ না-থাকলে পেরনাউ অবধি চলে যেতে পারবো। তবে এই ঠাণ্ডা ঝড়-বাদলে সে কি আর ঠিক করে বলা যায়?

কী মনে হয় তোমার? রাস্তায় থামতে-টামতে হবে নাকি? এবার কথাটা জিগেশ করলে পোখ।

হুম, ব্রোক্সকে একটু ভাবিতই দেখালো, আকাশের চেহারা তো ভালো ঠেকছে না। বড্ড তাড়াতাড়ি মেঘ জমছে!…তবে কেবল যদি বৃষ্টি পড়ে তাহলে ভয় পাই না। কিন্তু সেই সঙ্গে যদি তুষার-ঝুরিও নেমে বসে…

ব্রোক্স, শোনো, পাশের ঘোড়ার সোয়ারদের যদি একটু-আধটু ভোদকা গিলতে দাও, তাহলে কাল সন্ধের মধ্যেই আমরা রেফেল পৌঁছে যাবে।

আশা তো করি তাই। ছত্রিশ ঘটা-তার বেশি সচরাচর লাগে না।

তাহলে, পোখ বললে, এক্ষুনি রওনা হয়ে পড়লে হয় না? খামকা পায়চারি করে কী লাভ?

ঘোড়াগুলো তো তৈরিই আছে, জিন পরানো, লাগাম মুখে, বোক্স বললে, আর কারু জন্যে অপেক্ষাও করছি না…এক পেয়ালা গলায় ঢালা যাক পোখ, চাঙ্গা হয়ে নেয়া যাক—স্লাপস না ভোদকা?

স্লাপস, ব্যাঙ্কের হরকরা জানালে।

গেলো দুজনে সরাইখানায়। কোচোয়ানের সহকারী-যে পাশের ঘোড়াটা শামলাবেতাকেও পিছন-পিছন আসতে ইঙ্গিত করে গেলো। দু-মিনিট বাদেই তারা ফিরে এলো। কোচবাক্সে। অচেনা যাত্রীটি ততক্ষণে নিজের জায়গায় গিয়ে বসেছে। পোখ তার পাশে গিয়ে বসলো, চাকার শব্দ হলো ঘড়ঘড়, আর ঘোড়ার খুরের শব্দ মিশে গেলো তার সঙ্গে। যেতিনটে ঘোড়া কোচবাক্সে জোতা হয়েছিলো, তারা আকারে ছোটো কিন্তু ভারি তেজিয়ান ও টগবগে। শিস দিলেই কাজ হয়—জোর কদমে ছুটে চলে তারা।

ইয়োহাউজেন ব্যাঙ্কে অনেক দিন ধরে চাকরি করছে পোখ। চাকরিতে ঢুকেছিলো অত্যন্ত অল্প বয়েসে, একেবারে পেনশন নেবার আগে পর্যন্ত এই কাজই সে করে যাবে। প্রভুর আস্থাভাজন সে, প্রায়ই মস্ত বড়ো-বড়ো অঙ্ক নিয়ে ব্যাঙ্কের নানা জায়গার প্রতিনিধিদের কাছে যেতে হয় তাকে—যেতে হয় রেফেল, পেরনাউ, মিটটাউ বা ডোরপাট-–শুধু কোচবাক্সওলাদের হাতে এত টাকা ছেড়ে দেয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয় বলেই এ-সব ক্ষেত্রে সে সঙ্গে যায়। তার ব্রীফকেসে এখন আছে পনেরো হাজার রুবল। রেফেল-এর প্রতিনিধির হাতে এ-টাকাটা তুলে দিয়ে আবার সে রিগায় ফিরে আসবে।

যত শিগগির ফিরে আসতে পারে ততই ভালো। ফেরার তাড়াটা মশু। কেন তার এত তাড়াহুড়ো, তা হয়তো ব্রোক্সের সঙ্গে তার কথাবার্তা থেকেই আমরা জেনে নিতে পারবো।

+

রুশী ধরনে লাগাম ধরে আছে কোচোয়ান, হাত দুটো সামনে বাড়ানো, ঘোড়াগুলোকে তাড়া দিচ্ছে খুব করে। শহরের উত্তরভাগ থেকে রওনা হয়েছিলো গাড়ি–এখন অনন্ত স্তেপির উপর দিয়ে গেছে মস্ত রাস্তা–আর তারই উপর দিয়ে যাচ্ছে কোচবাক্স।

আকাশের চেহারা মোটেই আশাপ্রদ নয়, ব্রোক্স আগেই সেটা দেখিয়েছিলো। মাঝে মাঝে ভীষণ দমকা হাওয়া ঝাঁপটা মেরে যাচ্ছে–সূর্য যখন দিগন্তের উপরে উঠলো, ঝোড়ো হাওয়ার প্রতাপও আরো বেড়ে গেলো। তবে ভাগ্য ভালো যে হাওয়া বইছিলো দক্ষিণ-পশ্চিম থেকে।

কুড়ি মাইল পর পর একেকটা ঘাঁটি আছে–সেখানে কোচ বাক্সের ঘোড়া বদল করার ব্যবস্থা আছে, যাতে যাত্রীরা সুস্থ ও সতেজ ঘোড়ায় যেতে পারে–ক্লান্ত ঘোড়ার জন্য যাতে খামকা বেশি দেরি না হয়, তার জন্যই এই ব্যবস্থা।

গাড়ি ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পোখ-এর মেজাজটা বিগড়ে গেলো। হাজার চেষ্টা করেও সে তার সহযাত্রীর মুখ থেকে টু শব্দটি বার করতে পারলে না-লোকটা যেন মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে, কিছুতেই গল্পগুজবে যোগ দেবে না, সে বসে আছে গুটিশুটি মেরে এককোনায়। টুপিটা একেবারে চোখ অব্দি নামানো–কাউকেই সে তার শ্রীমুখ দেখাতে চায় না বোধহয়, এবং হয় সে ঘুমিয়ে পড়েছে, নয়তো ঘুমের ভান করছে। পোখ কত কথা পাড়লে কিন্তু কোনো কথারই কোনো উত্তর এলো না।

এদিকে সারাক্ষণ বকবক না-করলে পোখ-এর আবার পেটের খাদ্য হজম হয় না, কাজেই ব্রোক্সের সঙ্গেই গল্প-গাছা করতে হলো তাকে শেষটায়। ব্রোক্স বসেছিলো কোচোয়ানের পাশে, চামড়ার একটা মাথাঢাকায় নিজেকে মুড়ে রেখেছিলো সে-যাতে হাওয়ার ঝাঁপটা গায়ে নালাগে। তবু কোচবাক্সের সামনে জানলার পাল্লাটা তুলে তারই সঙ্গে কথাবার্তা কয়ে বাঁচলো পোখ। আর কোচবাক্সের রক্ষীটিও যেহেতু আড্ডা দিতে পারলে আর কিছু চায় না, তারও জিভ যেহেতু সারাক্ষণ শুড়শুড় করে, তাই তাদের বকর-বকর আর কিছুতেই থামতে চাচ্ছিলো না।

এবং চতুর্থবার আবার পোখ তাকে জিগেশ করলে, ঠিক বলছো তো, ব্রোক্স কাল সন্ধের মধ্যেই রেফেল-এ পৌঁছুতে পারবো তো?

হ্যাঁ, পোখ–যদি অবশ্য আবহাওয়া একেবারে বেশামাল হয়ে না-ওঠে। রাত্তিরে গাড়ি চালানো অসম্ভব হয়ে না উঠলে আমরা ঠিক সময়েই পৌঁছে যাবো।

আর রেফেল-এ পৌঁছুবার চব্বিশ ঘণ্টা পরেই কোচবাক্স আবার ফিরে আসবে তো?

হ্যাঁ, চব্বিশ ঘণ্টা পরেই আবার রওনা হবে, ব্রোক্স তাকে আশ্বস্ত করলে, ওই ভাবেই

তো টাইম-টেবিল তৈরি হয়েছে।

আবার তুমিই তো আমাকে রিগায় ফিরিয়ে নিয়ে আসবে? ‘

হ্যাঁ পোখ, আমিই–

সন্ত মিখায়েল-এর দোহাই–ইশ, এটা যদি ফিরতি পথ হতো–তোমার সঙ্গেই ফিরে আসছি, এটা যদি হতো!

তা তোমার অত তাড়া কীসের পোখ? আর আমার সঙ্গেই বা ফিরতে চাচ্ছো কেন?

কারণ তোমার একটা নেমন্তন্ন আছে, ব্রোক্স!

নেমন্তন্ন? আমার?

হ্যাঁ, তোমার। আর এই নেমন্তন্নে যেতে তোমার ভালোই লাগবে। ভালো-ভালো খাবার, দামি মদ–আর সঙ্গীরাও খুব ভালো।

তা, ব্রোক্স ঠোঁট চাটলো, ও-রকম একটা নেমন্তন্ন আমার পছন্দ না হলে আমি নিজের উপরেই যে চটে যাবো তা সত্যি…কেউ বুঝি ভূরিভোেজ দিচ্ছে!

দূর! তার চেয়েও বেশি। একটা সত্যিকার বিয়ের ভোজ।

বিয়ের ভোজ! ব্রোক্স একটু অবাকই হলো, তা বিয়ের ভোজে খামকা আমাকে নেমন্তন্ন করবে কেন কেউ?

করবে এই জন্য যে বর তোমাকে খুব ভালোভাবে চেনে, জানে।

বর আমাকে চেনে?

কনেও তোমাকে চেনে।

তাহলে ব্রোক্স ঘোষণা করলে, এই সুখী যুগল কারা সেটা না-জেনেই আমি নেমন্তন্নটা গ্রহণ করছি।

জানবে না কেন? আমিই তোমাকে বলবো।

তাদের নাম বলার আগে, পোখ, এ-কথা আমাকে বলতে দাও যে ঐ ভাবী বরবধূ–তারা ভারি চমৎকার মানুষ।

চমৎকার মানুষ যে, তাতে আর সন্দেহ কী? কারণ আমিই সেই ভাবী বর কি না!

তুমি, পোখ!

হ্যাঁ ব্রোক্স, আমি। আর কনে কে জানো–ভজেনাইদা পারেনসোফ!

ওঃ চমৎকার! সত্যি, এর পরে আমার আর কোনো দ্বিধা নেই!

শুনে তুমি অবাক হলে নাকি?

উঁহু, মোটেই না। আর পোখ, তোমার বয়েস পঞ্চাশ হলেও এটা ঠিক জানি যে তোমরা দুজনেই বিয়ের পরে খুব সুখে থাকবে।

আমার বয়েস পঞ্চাশ, আর ভজেনাইদার পঁয়তাল্লিশ, কিন্তু তাতে কী এসে যায়। কয়েক দিনের জন্যে তো আমরা সুখী হতে পারবো–আর সেটাই আসল। বুঝলে ব্রোক্স, যদি কখনো তুমি প্রেমে পড়ে যাও, তাহলে কিন্তু হুড়মুড় করে বিয়ে করে বোসো না-যদ্দিন পারো, বিয়েটা পিছিয়ে দিয়ো। আমি আর ভজেনাইদা প্রেমে পড়েছিলুম পঁচিশ বছর আগে–তখন আমার বয়েস ছিলো পঁচিশ, আর ভজেনাইদার কুড়ি। কিন্তু দুজনের সব টাকা কুড়িয়ে-বাড়িয়েই কুল্লে একশো রুবলও হয়নি–কাজেই অপেক্ষা করাটাই ছিলো বুদ্ধিমানের কাজ। অন্তত যদ্দিন না আমার কিছুটা টাকা জমে, আর তারও কিছু যৌতুক যোগাড় হয়, তদ্দিন আর ভাগাভাগি করে নেবার কী ছিলো বলো? এখন অবশেষে আমার পকেটে কিছু টাকা জমেছে–লিভোনিয়ার গরিব লোকদের পক্ষে কিছু টাকা জমানোই কী অসম্ভব কাজ তা তো জানো! যাই হোক, বছরের পর বছর ধরে আমরা কেবল আশাই করে গেছি কিন্তু তাতে ভালোবাসায় ভাটা পড়েনি। তারপর অবশেষে একদিন ভবিষ্যতের ভার ও ভাবনা চলে গেলো।

তুমি হক কথাই বলেছে, পোখ।

ইয়োহাউজেন ব্যাঙ্কে আমার চাকরিটা এখন বেশ ভালো-বছরে পাঁচশো রুবল মাইনে। বড়ো কর্তা বলেছেন, বিয়ের পরে আরো কিছু বাড়িয়ে দেবেন। আর ভজেনাইদারও অল্পস্বল্প কিছু আছে। কাজেই আমরা এক অর্থে এখন বেশ ধনীই–মানে আমাদের পক্ষে যতটা ধনী হওয়া সম্ভব। তাহলেও এই ব্রীফ কেসে যত টাকা আছে, তার সিকির সিকিও আমাদের নেই–

পোখ থেমে তার সহযাত্রীর দিকে সন্দেহের চোখে তাকালে। লোকটা সেই থেকে একবারও নড়েনি–বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছে। হয়তো পোখ এরই মধ্যে বড্ড বেশি কথা বলে ফেলেছে।…তারপর পোখ আবার বলতে লাগলো, হ্যাঁ, ব্রোক্স–আমাদের নিজের ধরনে এখন বেশ ধনীই হয়ে পড়েছি! যা টাকাকড়ি আছে, তা দিয়ে ভজেনাইদা বোধ হয় একটা ছোটোখাটো মনোহারী দোকান খুলে বসবে।…বন্দরের কাছে একটা ছোট্ট মনোহারী দোকান বিক্রি হচ্ছে শিগগিরই।

অন্তত একজন ভালো খদ্দের পাবে তোমরা, এই প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, ব্রোক্স জানালে।

ধন্যবাদ, ব্রোক্স, আগাম ধন্যবাদ দিচ্ছি। বিয়েতে তোমাদের যে খানা খাওয়ানো হবে, অন্তত তার জন্যেই তোমার আমাদের দোকানের খদ্দের হয়ে

পড়া উচিত।

কোথায় খাওয়াবে? ভজেনাইদাদের বাড়ি থেকে খুব দূরে নয়। বিয়ের পোশাকে ভজেনাইদাকে কী সুন্দর দেখাবে, দেখে নিয়ো। মাথায় থাকবে মার্টলের টোপর, মাদাম ইয়োহাউজেন আবার ওকে একটা নেকলেসও দিয়েছেন।

তা তো বটেই!…ভজেনাইদার মতো ভালো মেয়ের সুন্দরী না হয়ে উপায় কী! তা, বিয়েটা কবে?

আর চারদিন পরে, ব্রোক্স–ষোলো তারিখে। আর সেইজন্যেই তো আমি তোমাকে অত তাড়া দিচ্ছি। কোচোয়ানকে এটু বেশ করে কড়কে দাও তো হে–না-হয় এদের দু এক গেলাশ ভোদকাই খাইয়ে দেবো। কিন্তু ঘোড়াগুলো যেন ঘুমিয়ে-ঘুমিয়ে না ছোটে! আরে বাপু, বিয়ের বর যাচ্ছে তোমাদের কোচবাক্সে–এক যাত্রাতেই তাকে বুড়ো হয়ে গেলে চলবে কেন?

না না, তা কী হয়! বুড়ো বরকে ভজেনাইদা হয়তো আর পছন্দই করবে, বলে ব্রোক্স হো-হো করে হেসে উঠলো।

উঁহু! ভজেনাইদা মোটেই সে-রকম মেয়ে নয়!…আমার বয়স যদি আরো কুড়ি বছর বেশিও হতো, তবু সে আমাকেই চাইতো।

ব্রোক্সের সঙ্গে পোখের এই হার্দ্য সম্পর্ক ও বন্ধুতার ফলেই শেষ পর্যন্ত। ব্যাপারটা এই দাঁড়ালো যে কোচোয়ান ও সহিসরা ঢক ঢক কবে কিছুটা স্নাক্স গলায় ঢেলে নিয়ে এমনই তাড়াহুড়ো করে গাড়ি ছোটালে যে রিগার ডাকগাড়ি কস্মিনকালেও এর আগে এত জোরে ছোটেনি। কুড়ি মাইল পর-পর ঘোড়াগুলো বদল হয়, জিন খোলা হয়, লাগাম খোলা হয়, ব্রোক্স আর পোখ মাটিতে নেমে আড়মোড়া ভেঙে হাত-পাগুলো একটু টান টান করে নেয়। কিন্তু সেই অচেনা যাত্রীটি একবারও তার আসন ছেড়ে উঠলো না, যদিও পোখরা নেমে গেলেই মাঝে-মাঝে সে জানলা থেকে মুখ বাড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখছিলো।

আমাদের সহযাত্রী দেখছি খুব একটা অস্থির নয়; যাকে বলে জাড্য, তাতেই সে ভরা, বললে পোখ।

তেমন বলিয়ে-কইয়ে লোকও তো নয়,বললে ব্রোক্স।

জানো নাকি লোকটাকে? কে সে?

জানি না। আরে বাপু তার দাড়ির রঙটা যে কী, তাই কখনো দেখিনি।

দুপুরবেলায় যখন আবার আরেক দফা বদলানো হবে, আর আমরা খাওয়াদাওয়া করবো, তখন অবিশ্যি তাকে শ্রীমুখ দেখাতে হবে…

সে যেমন বলিয়ে-কইয়ে, খাইয়েও যদি সে তেমনি তাহলে অবিশ্যি তার দরকার হবে না, তক্ষুনি ফোড়ন কাটলে ব্রোক্স।

বেলা একটা নাগাদ গাড়ি ঢুকলো একটা মস্ত গ্রামে। এখানে আরেক দফা ঘোড়া বদলানো হয়, সহিস কোচোয়ান জিরিয়ে নেয়, যাত্রীরা মধ্যাহ্নভোেজ সাঙ্গ করে। বড়োশড়ো একটা সরাইখানা আছে এই গ্রামে, আরামের ব্যবস্থা আছে, আর সেখানে যাত্রীরা বেশ ভূরিভোজ করে নেয়: শুয়োরছানার স্টু, কুষ্মাণ্ডর শুরুয়া, কালো রুটির কয়েক টুকরো, দিনা নদীর স্যালমন মাছ, শজিসমেত : টাটকা বেকন, কাভিয়ার, আদা-কুঁচি, মুলোর টুকরো, জামের চাটনি এবং স্যামোভার থেকে সদ্য নামানো ধোঁয়া-ওঠা অনিবার্য চা। চমৎকার ভোজ যাকে বলে, আর এই ভোজ ব্রোক্স আর পোখ-এর মেজাজ সারাদিনের জন্য বেশ শরীফ করে রাখলে।

অন্য যাত্রীটির উপরে কিন্তু এই মুখরোচক খাদ্যতালিকা তেমন সুখকর প্রভাব ফেললে না। রেকাবি ভর্তি খাবার নিয়ে সে গিয়ে বেছে-বেছে বসলো ঘরের এককোনায়, মাথার টুপি একবারও খুললো না, একবারও তার পাক-ধরা দাড়ি-গোঁফ দেখতে দিলে না কাউকে। খামকাই পোখ আর ব্রোক্স উঁকিঝুঁকি দিয়ে তার মুখটা নিরীক্ষণ করার চেষ্টা করলে, কিন্তু সে তার কোনো সুযোগই দিলে না। চটপট নিজের খাবার খেয়ে নিয়ে অন্যদের অনেক আগেই গিয়ে নিজের আসন আবার দখল করে বসলো।

লোকটা কে বলো তো? আমরা কি তা কখনো জানতেও পাবো না? জিগেশ করলে পোখ।

আচ্ছা, আমি তোমাকে বলছি লোকটা কে, বললে ব্রোক্স।

তুমি ওকে চেনো নাকি?

নিশ্চয়ই। ঠিকঠাক ভাড়া দিয়ে একজন এসে গাড়িতে উঠেছে–বাস্! এই পরিচয়ই আমার কাছে যথেষ্ট।

দুটো বাজতে যখন কয়েক মিনিট বাকি, তখন আবার কোচবাক্স ছেড়ে দিলে। এবার বেশ জোর কদমেই ছুটছে ঘোড়াগুলো। সহিস কোচোয়ানের মুখে খই ফুটছে, সপ-সপ করে চাবুকের শব্দ হচ্ছে হাওয়ায় আর খুরের শব্দ হচ্ছে খটাখট। পোখ বোধহয় এতক্ষণে তার সব খবরের তহবিল শেষ করে ফেলেছিলো, কারণ এখন আর কনডাকটারের সঙ্গে তার কথাবার্তা তেমন জমলো না। তাছাড়া পেটভর্তি নরম-গরম সুস্বাদু খাবার, তার উপর ভোদকার ভাপ, কাজেই একটু পরেই সে ঘুমে ঢুলে পড়লো- ঘোড়ার খুরের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তার হেলানো মাথাটা নড়তে লাগলো। মিনিট পনেরোর মধ্যেই গভীর ঘুমে ঢলে পড়লো সে–সম্ভবত ভজেনাইদা পারেনসোফের দিব্য ও লাবণ্যময় উপস্থিতিতে তার স্বপ্নাতুর ঘুম ভরে গিয়েছে।

কিন্তু আবহাওয়া তখন ক্রমেই খারাপ হয়ে আসছে। নিচু ভারি মেঘ ঝুলে আছে আকাশে। আর কোচবাক্স যাচ্ছে একটা জলাভূমি দিয়ে–ঠিক ঘোড়ার গাড়ি যাবার উপযুক্ত রাস্তা এটা নয়, ছোটো-ছোটো জলের ধারায় মাটি কীরকম ভেজা-ভেজা আর নরম, কতগুলো জায়গা বেশ এবড়োখেবড়ো।

মাটি যে-সব জায়গায় বড্ড বেশি নরম হয়ে পড়েছিলো, সে-সব জায়গায় গাছের ডাল কেটে পাতা হয়েছে, যাতে চাকা মাটির মধ্যে বসে না যায়। কিন্তু পদাতিকদের পক্ষেই তা যথেষ্ট নয়, কোনো যানবাহনের তো কথাই নেই। কতগুলো গাছের ডাল বড় বাজেভাবে পাতা হয়েছিলো, কোচবাক্সের চাকার তলায় তারা একেবারে ডেবে বসে গেলো বা কখনো সজোরে নড়ে উঠলো–বেশ ভয়ই করছিলো তাতে, যদি গাড়ি উলটে যায়। এই অবস্থায় কোচোয়ান ঘোড়াদের আর তাড়া দেবে কী করে। যাক তারা নিজেদের ইচ্ছেমতো, সাবধানে। ঘোড়াগুলো টাল শামলাতে-শামলাতে চলেছে আস্তে-আস্তে, কোচবাক্সটা দুলছে। কয়েক জায়গায় দুর্ঘটনা হতে-হতেও হলো না। শেষটায় যখন ঘোড়াগুলো নতুন ঘাঁটিতে পৌঁছুলো, তখন এই বিষম রাস্তার ধকলে তারা ভারি কাবু হয়ে পড়েছে–ঘোড়া বদলের ব্যবস্থা না থাকলে যে কী হতো বলাই যায় না; এই ঘোড়াগুলোকে দিয়ে যে কোনো কাজ চলতো না, তা তো বলাই বাহুল্য।

বেলা পাঁচটা নাগাদই বেশ অন্ধকার করে এলো। আকাশে ছেঁড়া-ছেঁড়া কালো মেঘ জমেছে। ঐ জলার মধ্যে দিয়ে ঠিক পথ চিনে চলাই মুশকিল। খুরের তলায় শক্ত মাটি পড়ছে না দেখে ঘোড়াগুলো বারে বারে ভীত ও চকিত হয়ে চিহি ডাক ছেড়ে পাশে সরে যেতে চাচ্ছে।

আস্তে, হট, আস্তে যেতেই হবে আমাদের! ব্রোক্স কেবলই বলতে লাগলো, মাঝরাস্তায় মুখ থুবড়ে পড়ার চেয়ে বরং এক ঘণ্টা দেরি করে যাওয়াই ভালো পেরনাউতে…হট…

এক ঘণ্টা দেরি! এক ঝটকায় পোখ-এর ঘুম ভেঙে গেলো।

সেটাই যথেষ্ট বুদ্ধিমানের কাজ হবে, বললে কোচোয়ান। কয়েকবার এমনকী তাকেও নিচে নেমে পড়তে হয়েছে, লাগাম ধরে টেনে-টেনে হাঁটিয়ে নিয়ে যেতে হয়েছে ঘোড়াদের।

অন্য যাত্রীটি হাঙ্গামা দেখে নড়ে-চড়ে বসলো। জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে সে বাইরে তাকিয়ে দেখবার চেষ্টা করলে। নিরেট অন্ধকার–এই ঘন অন্ধকারে কোনো-কিছুই চেনবার জো নেই। কোচবাক্সের লণ্ঠনের ছোটো-ছোটো টুকরো আলোয় অন্ধকার যেন আরো ঘন হয়ে উঠলো।

কোথায় এসেছি আমরা? পোখ জিগেশ করলে।

পেরনাউ এখনো বারো মাইল দূরে, ব্রোক্স ব্যাখ্যা করলে, একবার ঘাঁটিতে পৌঁছুতে পারলে বাকি রাতটা সেখানেই কাটিয়ে দিতে হবে। সেটাই বোধহয় বুদ্ধিমানের কাজ হবে।

ধুত্তোর! শয়তান ঝড়টাকে নিক…মাঝখান থেকে একদিন দেরি করিয়ে দিলে, চ্যাটাং করে জবাব দিলে বাঙ্কের লোকটি।

+

তবু তারা এগুতেই থাকলো। মাঝে-মাঝে দমকা হাওয়ার ঝাঁপটায় গাড়িটাই উলটে যাবার ভয় হয়। ঘোড়াগুলো ফিরে দাঁড়াতে চায়-বা একপাশে সরে দাঁড়ায়–বা অন্ধকারে ঝপ খায়। অবস্থা ক্রমশই এত ভয়ানক হয়ে উঠেছে যে পোখ আর ব্রোক্স পায়ে হেঁটেই পেরনাউ যাবার কথা বলাবলি করছে; গাড়ির মধ্যে বসে থাকার চেয়ে হেঁটে যাওয়াটাই বোধহয় বুদ্ধিমানের কাজ হবে, হাওয়ার ঝাঁপটায় কখন কী হয় বলা যায় না।

অন্য যাত্রীটির ভাবগতিক দেখে মনে হলো না সে কোচবাক্স ছেড়ে যেতে রাজি হবে। চারপাশের এই তুলকালাম কাণ্ড দেখে কোনো ইংরেজও এতটা উদাসীন থাকত পারতো কিনা সন্দেহ। পকেটের পয়সা দিয়ে সে কোচবাক্সের ভাড়া গুনেছে, পায়ে হেঁটে যাবে বলে তো নয়–এখন তাকে গন্তব্যস্থলে পৌঁছে দেবার দায়িত্ব কোচবাক্সের, সে কেন খামকা এই হাওয়ার মধ্যে হেঁটে যাবে!

হঠাৎ সাড়ে-ছটা নাগাদ, হাওয়ার দাপট যখন চরমে পৌঁছেছে, এক বিষণ্ণ ঝাঁকুনি খেলে কোচবাক্স। সামনের একটা চাকা পড়েছিলো ভিজে নরম মাটিতে, ঘোড়াগুলোকে চাবুক কশিয়ে দিতেই তারা এত জোরে চাকাটায় টান দিলে যে চাকাটা শব্দ করে ভেঙে গেলো, আর তক্ষুনি টাল শামলাতে না পেরে কোচবাক্স বাঁ দিকে কাৎ হয়ে পড়লো।

কোচয়ান যন্ত্রণায় চেঁচিয়ে উঠলো! পায়ে চোট পেয়েছে পোখ, কিন্তু একটাই তার ভাবনা, সেই পেট-মোটা ব্রীফ-কেসটা শামলে রাখার দায়িত্ব তার। একবারও সে ব্রীফ-কেসটাকে হাতছাড়া করেনি–এবার চামড়ার ব্যাগটাকে সজোরে আঁকড়ে বগলদাবা করে সে কোনো রকমে উলটোনো কোচবাক্স থেকে বেরিয়ে এলো।

ব্রোক্স আর অন্য যাত্রীটির গা একটু কেবল ছড়ে গিয়েছে। কোচোয়ানের গায়ে আঁচড়টুকুও লাগেনি, লাফিয়ে নেমে সে ঘোড়াগুলোর দিকে ছুটে গেলো। ফাঁকা একটা জায়গা, কেবল বাঁ দিকে কতগুলো গাছ এলোমেলো দাঁড়িয়ে।

কী হবে আমাদের? জিগেশ করলে পোখ।

কোচবাক্সের তো আর যাবার কোনো উপায় নেই, ব্রোক্স তাকে জানালে।

অচেনা যাত্রীটি তবু টু শব্দটিও করলো না।

পেরনাউ অব্দি হেঁটে যেতে পারবে তো? পোখকে জিগেশ করলে ব্রোক্স।

ঐ বারো মাইল! পোখ কাৎরে উঠলো, পায়ে এই চোট লাগার পরেও!

তা হেঁটে না-গেলেও…ঘোড়ার পিঠে?

ঘোড়ার পিঠে!…কয়েক কদম গেলেই তো অক্কা পাবো!

তাহলে কোনো সরাইখানা খুঁজে বার করে তাতে আশ্রয় নিয়ে রাতটা কাটানো ছাড়া আর উপায় কী! কিন্তু আশপাশে কোনো সরাই আছে কি না কে জানে! পোখ আর অচেনা যাত্রীটির তাছাড়া আর কিছু করার নেই। ব্রোক্স আর কোচোয়ান না-হয় ঘোড়ায় চড়ে ছুতোরের কাছে যাবে–চাকাটা সারিয়ে নেবার জন্যে মিস্ত্রি ডাকতে।

অতগুলো টাকার দায়িত্ব তার ঘাড়ে না থাকলে এই চমৎকার ব্যবস্থাটা পোখ-এর মনঃপুত হতো সন্দেহ নেই… কিন্তু এই পনেরো হাজার রুবল নিয়ে…

তাছাড়া এ রকম ফাঁকা জায়গায় সরাইখানাই বা কোথায়! সরাই না হোক, কোনো খামার বা মদের দোকান হলেও চলে। কিন্তু রাত কাটাবার উপযোগী কোনো কিছু আছে না কি কাছাকাছি? পোখ-এর প্রথম প্রশ্ন হলো এটাই।

হ্যাঁ… ঐ দিকে কিছু-একটা আছে নিশ্চয়ই! অন্য যাত্রীটি হাত তুলে দেখালে। প্রায় দুশো গজ দূরে, বনের একপাশে ক্ষীণ একটা আলোর রেখা। অন্ধকারের মধ্যে গাছপালাগুলো আবছাভাবে জটলা করে আছে যেদিকটায়,তারই এক প্রান্তে। কিন্তু কীসের আলো ওটা? কোনো সরাইখানার লণ্ঠন, না কি কাঠুরেদের উনুন?

কোচোয়ানকে জিগেশ করতেই সে বললে, ওটা ক্রোফের ভাটিখানা।

কেরাফের ভাটিখানা? পোখ জিগেশ করলে।

হ্যাঁ। ”ভাঙা ক্রূশ” নাম।

তাহলে, ব্রোক্স তাদের দিকে ফিরে বললে, তোমরা যদি “ভাঙা ক্রূশে” রাত কাটাতে রাজি থাকো তো সকালে আমরা এসেই তোমাদের তুলে নিতে পারি।

অচেনা যাত্রীটি এই প্রস্তাবে দ্বিরুক্তি করলে না, কারণ এক্ষেত্রে সেটাই হলো মন্দের ভালো ব্যবস্থা। আবহাওয়া ক্রমশ ভয়ংকর হয়ে উঠছে, আরেকটু পরেই নিশ্চয়ই মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়ে যাবে। কনডাকটার আর কোচোয়ানও ঘোড়াগুলো নিয়ে পেরনাউ যেতে মহা মূশকিলে পড়বে।

পোখ-এর জখম হাঁটু বড্ড ব্যথা করছিলো। বাধ্য হয়েই সে প্রস্তাবটায় সায় দিলে, তাহলে তাই হোক। রাত্তিরটা জিরিয়ে নিলে নিশ্চয়ই চোটটা শামলে ওঠা যাবে। আমি কিন্তু তোমারই ওপর পুরোপুরি নির্ভর করে আছি, ব্রোক্স।

ব্রোক্স তাকে আশ্বস্ত করলে, আমি ঠিক সকালেই এসে হাজির হবো, দেখো।

ঘোড়াগুলো খুলে নেয়া হলো। কারণ কাৎ-হয়ে-পড়ে-থাকা কোচবাক্সটা ছেড়ে তাদের চলে যেতে হবে। এই রাতে এ রাস্তায় আর কোনো কোচবাক্স আসবে বলেও মনে হয় না, কাজেই কোচবাক্সটা রাস্তা জুড়ে পড়েই রইলো।

হাতঝাঁকুনি দিয়ে বন্ধুকে বিদায় জানিয়ে পোখ ল্যাংচাতে-ল্যাংচাতে ওই ক্ষীণ আলোর রেখা ধরে এগুলো।

কিন্তু খুঁড়িয়েও সে ভালো করে হাঁটতে পারছিলো না দেখে অচেনা যাত্রীটি বললে যে তার কাঁধে ভর দিয়ে যেতে। সঙ্গীকে যথোচিত ধন্যবাদ দিয়ে ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে পোখ তার সাহায্য নিতে রাজি হলো। আগে লোকটাকে দেখে, বা না-দেখে, যা মনে হয়েছিলো, আসলে হয়তো সে ততটা অসামাজিক নয়।

আর-কোনো দুর্ঘটনা ঘটলো না। সরাইখানাটা ছিলো বড়ো রাস্তার উপরেই। দুশো গজ পথ তারা চট করে পেরিয়ে এলো।

সরাইয়ে ঠিক ঢোকবার মুখে একটা প্যারাফিন লণ্ঠন ঝুলছে। দেয়ালের এককোনায় একটা ঢ্যাঙা খুঁটি উঠেছে–দিনের বেলায় যাতে লোকে দূর থেকে দেখতে পায় সাইনবোর্ডটা। খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে আলোর রেখা আসছে। গেলাশের শব্দ ও কথাবার্তার টুকরো শুনে বোঝা গেলো যে সরাইটা একেবারে নির্জন নয়। সদর দরজার উপরে ঝুলছে একটা সাইনবোর্ড-লণ্ঠনের আলোয় দেখা গেলো ত্যাড়াবাঁকা হরফে তাতে লেখা ভাঙা ক্রুশের সরাইখানা।