১১-১৫. লতিফুর রহমান মানসিকভাবে

লতিফুর রহমান মানসিকভাবে পুরোপুরি ভেঙে পড়েছেন। সেদিন থানায় রেজার সামনে তিনি শেষ পর্যন্ত হাউমাউ করে কেঁদেছেন। কাঁদতে কাঁদতেই তিনি বলেছিলেন, বিশ্বাস করুন, আমি খুনটা করিনি। এমনকি ছেলেটাকে আমি চিনিও না। আমি একা বৃদ্ধ একজন মানুষ, রিটায়ার্ড একজন শিক্ষক, আমি…।

তিনি কান্নার দমকে কথা বলতে পারছিলেন না। তারপরও কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে আবার বললেন, আপনার বিশ্বাস হয়, আমার পক্ষে ওই ছেলেটিকে খুন করা সম্ভব? ওকে আমি কেন খুন করব বলুন? আপনিই বলুন, কি কারণে আমি…।

লতিফুর রহমান আবারো কান্নায় ভেঙে পড়লেন। তিনি ভেবেছিলেন, রেজা তার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করবেন। কিন্তু তাকে চমকে দিয়ে রেজা উঠে তার কাছে এসে দাঁড়ালেন, তারপর তার কাঁধে হাত রেখে বললেন, স্যার, আপনি ভয় পাবেন না, আপনি আমাকে সত্যি করে খুলে বলুন, ঘটনা কি হয়েছিল!

লতিফুর রহমান ফুল হাতা পাঞ্জাবি পরা বলে তার হাতের ক্ষতটা দেখা যাচ্ছে না। তবে মানসিক এবং শারীরিক ধকলে তিনি তখন অসুস্থ প্রায়। তার শরীরে জ্বরও আছে। তিনি কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, আমি আপনাকে কসম করে বলছি, খুনটা আমি করিনি। কে করেছে তাও আমি জানি না। তবে কি ঘটেছে, সেটি আমি আপনাকে বলব।

রেজা বললেন, জি বলুন?

লতিফুর রহমান অবশ্য কথা বলতে পারলেন না। তিনি বমি করে মেঝে ভাসিয়ে দিলেন। রেজা তাকে ধরতে গিয়ে আবিষ্কার করলেন, তার শরীরে জ্বর। সেদিন আর কোনো কথা বলতে পারেননি লতিফুর রহমান। তাকে ভালোভাবে বাড়িতে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করলেন রেজা। তবে তিনি স্পষ্ট করেই জানিয়ে দিয়েছেন থানার নির্দেশ ছাড়া বাড়ির বাইরে এক পাও যেতে পারবেন না লতিফুর রহমান। একটু সুস্থ হলেই তাকে থানায় আসতে হবে।

লতিফুর রহমান বুঝতে পারছেন না এখন তার করণীয় কী? বা তার সামনে এখন কী অপেক্ষা করছে। তার বিরুদ্ধে কি খুনের মামলা হবে? আত্মপক্ষ সমর্থন করার মতো কোনো সুযোগ কি তার রয়েছে? থাকলেও তিনি কিভাবে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করবেন? এমন নানা প্রশ্ন সারাটাক্ষণ তার মাথায় কিলবিল করতে থাকল। লতিফুর রহমানের হঠাৎ মনে হলো, এর চেয়ে বরং সেদিন লাশটা দেখার পর সঙ্গে সঙ্গেই যদি তিনি পুলিশে খবর দিতেন, তাহলেই বোধহয় সবচেয়ে ভালো হতো। হয়তো এখনকার চেয়ে পরিস্থিতিটা তখন খানিকটা হলেও তার অনুকূলে থাকতে পারত। কিন্তু তিনি নিজে নিজেই সেই সব পথ রুদ্ধ করে দিয়েছেন। যদিও ওই পরিস্থিতিতে তিনি যেটি করেছিলেন, সেটিই ছিল সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত নিরাপদ উপায়।

দুদিন পরে তাকে আবার থানায় নিয়ে যাওয়া হলো। তিনি গ্রামে যাওয়া থেকে শুরু করে একে একে পুরো ঘটনা সবিস্তারে বর্ণনা করলেন। রেজা এর মাঝখানে একটা কথাও বললেন না। লতিফুর রহমানের কথা শেষ হলেও রেজা অনেকক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, আপনার কথা আমি কেন বিশ্বাস করব? আপনি এর আগে পুরোটা সময় খুব আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে একের পর এক মিথ্যা বলেছেন। এখনো যে মিথ্যে বলছেন না, তার নিশ্চয়তা কী?

লতিফুর রহমান নরম গলায় বললেন, যুক্তি।

যুক্তি?

জি। আপনি যুক্তিবাদী মানুষ। একটু যুক্তি দিয়ে চিন্তা করলেই বুঝবেন, আমার মতো একজন মানুষের পক্ষে এই ঘটনা ঘটানো সম্ভব না। তা ছাড়া ছেলেটাকে আমি চিনি না, জানি না। এমনকি এখানে আমার কোনো স্বার্থও নেই।

সবকিছু কি যুক্তি দিয়ে হয় স্যার?

হয় না?

তাহলে আপনি আমাকে একটা যুক্তি দিন যে ওই ছেলেটার লাশ ওখানে কীভাবে গেল?

লতিফুর রহমান এই প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে পারলেন না। রেজা বললেন, ছেলেটার সম্পর্কে আমি যতদূর তথ্য পেয়েছি, সে বখে যাওয়া বিপথগামী তরুণ। এলাকায় চাঁদাবাজি, ছিঁচকে চুরি, ছিনতাই, ইয়াবা ব্যবসা এসবের সঙ্গে সে যুক্ত ছিল। এমনকি হতে পারে যে সে আপনার কাছেও চাদা চেয়েছিল? আর তার জের ধরেই…।

এই প্রশ্নে লতিফুর রহমান চুপ হয়ে গেলেন। এভাবে তিনি ভেবে দেখেননি। রেজা বললেন, তবে হ্যাঁ, আপনার একার পক্ষে খুনটা করা সম্ভব না, এবং খুনের ধরণ দেখে যতদূর মনে হয়েছে, এর সঙ্গে একাধিক মানুষ জড়িত ছিল। সেক্ষেত্রে আপনার সঙ্গে আরো কেউ থাকতে পারে। সেই আরো কেউ কারা, সেটাই আমি জানতে চাইছি।

লতিফুর রহমান অসহায় গলায় বললেন, আমি সত্যিই আর কিছু জানি না রেজা সাহেব। আমি জানি আপনি বিশ্বাস করবেন না, কিন্তু এর বেশি আমি কিছু জানি না। আমি গ্রাম থেকে ফিরলাম, তার দিন দুই বাদে ব্যাংকের ম্যানেজার সাহেব এলেন বাসা দেখতে, আমি খুব খুশি হয়েছিলাম তাকে দেখে। আমি নিজ থেকেই চাইছিলাম উনি ওপর তলার ঘরটা ভাড়া নিন। আমি উনাকে নিয়ে ঘর দেখাতে গেলাম, কিন্তু দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গেই তীব্র গন্ধে আমাদের দম আটকে যাবার দশা হলো। আমি ভেবেছিলাম ইঁদুর বেড়াল কিছু মরে পড়ে আছে কোথাও। খুঁজতে গিয়ে দেখলাম বাথরুমের ভেতর…।

একটু থামলেন লতিফুর রহমান। তারপর দম নিয়ে আবার বললেন, তখনো ব্যাংকার সাহেব ভেতরের বেডরুমে আসেননি। তিনি রুমালে নাক চেপে ড্রইংরুমে দাঁড়ানো। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। আমার ইনসটিংকট বলছিল, এই ঘটনা কাউকে জানানো যাবে না। আমি তখন বাথরুমের দরজা বন্ধ করে উনাকে নিয়ে বের হয়ে গেলাম। আপনিই বলুন, আমি যদি জানতাম যে ওই ঘরে একটা লাশ আছে, তাহলে আমি উনাকে সেখানে নিয়ে যেতাম? আর লাশটাকে এতদিন ওখানে রেখে পচে গন্ধ ছড়ানোর সুযোগ দিতাম?

রেজা চুপ করে রইলেন। লতিফুর রহমানের কথায় যুক্তি আছে। তার চেয়েও বড় কথা তিনিতো চাইলেই ব্যাংকের ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলতে পারেন। তা ছাড়া তার যতদূর মনে পড়ছে, ব্যাংকের ম্যানেজারও বলেছিলেন যে তিনি লতিফুর রহমানের বাড়িতে বাসা দেখার জন্য গিয়েছিলেন।

.

সেদিন বিকেলেই রেজা সরাসরি ব্যাংকে গেলেন। ম্যানেজার রফিকুল ইসলাম প্রচণ্ড ব্যস্ত। অল্পদিনেই প্রচুর মানুষ ব্যাংকে একাউন্ট খুলেছে। লেনদেন শুরু করেছে। জমজমাট হয়ে উঠেছে ব্যাংক। সঙ্গে ব্যাংকের বাইরে মোবাশ্বেরের চায়ের দোকান আর হারাধনের মুচির দোকানও জমে উঠেছে। মোবাশ্বেরের দোকানের গরুর দুধের চা ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। সকাল-সন্ধ্যা চায়ের অর্ডার নিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারে না সে। এখনো বিকেলের চা নিয়ে সে নিজেই এসেছে ম্যানেজারের কাছে। হারাধনের ব্যবসাও ভালো। স্বয়ং রফিকুল আলম হারাধনের কাছ থেকে অর্ডার দিয়ে জুতো বানাচ্ছেন। সেই জুতার স্যাম্পল দেখাতে নিয়ে এসেছে সে।

রেজাকে দেখে রফিকুল আলম উঠে দাঁড়ালেন, আরে আপনি! বলা নেই কওয়া নেই, একদম সশরীরে হাজির। আগে বললেতো একটু ভালো চা-নাশতার আয়োজন করা যেত!

রেজা হাসলেন, মোবাশ্বেরের দোকানের চা পুরি খাওয়ালেই হবে। ওতেই। আমি খুশি।

মোবাশ্বের হাসতে হাসতে বলল, আমি তাইলে চা আর পুরি নিয়াসি ছার?

রফিকুল আলম হেসে অনুমতি দিলেন। তার পায়ে হারাধনের বানানো জুতা, তিনি জুতা দেখিয়ে বললেন, কেমন হবে বলুনতো?

রেজা বললেন, অল্পদিনেই সে বেশ নাম করেছে। ভালো না হলে এত নাম করার কথা না!

রফিকুল আলম সবাইকে বিদায় দিয়ে বললেন, বলুন, তারপর কী খবর?

এটা-সেটা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনার পর রেজা বললেন, আচ্ছা, প্রফেসর সাহেবের ঘরটা কেমন বলুনতো? আপনার পছন্দ হয়ে থাকলে আমি চেষ্টা করে দেখতে পারি। আমার ধারণা, আমি বললে তিনি না করবেন না।

ঘর ভালো। তবে ভালো করেতো দেখতেই পারলাম না!

কেন? দেখতে পারলেন না কেন?

আর বলবেন না। উনারা অনেকদিন পর গ্রাম থেকে এসেছিলেন, সম্ভবত আমি যেদিন গেলাম, তার আগের দিনই। ঘরটর তালা মেরে রেখে গিয়েছিলেন, সেদিনই প্রথম খুললেন। আমরা ঘরে ঢুকতেই মরে পচে যাওয়া কোনো প্রাণীর তীব্র বোটকা গন্ধে আমাদের শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। সম্ভবত ইঁদুর-বেড়াল কিছু মরে পচেছিল। পরে তড়িঘড়ি করে দুজনই বের হয়ে এসেছিলাম। ফলে আর দেখাই হলো না ঘরটা। তবে ভালোই ছিল মনে হয়।

রেজা অবশ্য আর বেশি কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। তবে তার দুশ্চিন্তা আরো বাড়ল। কেউ কাউকে খুন করে কোথাও লুকিয়ে রাখলে সেখানে নিশ্চিত করেই অন্য কাউকে নেবে না। নেয়ার কথাও না। এটা খুব সাধারণ, স্বাভাবিক ব্যাপার। তার চেয়েও বড় কথা, ওই দিনের পরই লতিফুর রহমান টু লেট সরিয়ে ফেলেছেন। তার মানে ওই দিন লাশ আবিষ্কার করার পর তিনি ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন এবং সেজন্যই চাননি বাসা দেখতে আর কেউ আসুক। অর্থাৎ এই অংশে তিনি যা বলেছেন, তা সম্ভবত সত্যি। কিন্তু তাহলে খুনটা করল কে? আর লাশটাই বা ওখানে গেল কী করে!

.

রেজা আর অফিসে গেলেন না। বাসায় এসে দীর্ঘসময় চুপচাপ বসে রইলেন। তিনি উঠলেন রাত ৯টায়। উঠে নিজে নিজেই রান্না করে রাতের খাবার খেলেন। ডিম ভাজি, ডাল আর ভাত। সঙ্গে শুকনো মরিচ। খাবার খেতে ভালো হয়েছে। কিন্তু খেতে বসেও তিনি সম্ভবত আনমনা হয়েছিলেন। ভাত খাওয়া শেষ হতে না হতেই প্রচণ্ড ঝালে তার নাকে মুখে পানি চলে এলো। তিনি পাগলের মতো ছোটাছুটি করতে লাগলেন। এই অবস্থাও চললো বেশ কিছুক্ষণ। তারপর একদম ঝিম মেরে আবার বসে রইলেন। বসে থাকতে থাকতে তার মনে হলো, এতদিন তার মধ্যে যে স্পৃহাটা ছিল, সেই স্পৃহাটা তিনি হারিয়ে ফেলেছেন। তার বিশ্বাস ছিল কেসটা তিনি সমাধান করার খুব কাছাকাছি চলে এসেছেন, বা একটা শক্তিশালী ব্লু বের করে ফেলেছেন। কিন্তু এখন এসে মনে হচ্ছে দীর্ঘ কষ্টকর পথ হাঁটার পর এসে দেখা যাচ্ছে এই পথের কোনো গন্তব্য নেই। এটি একটি কানাগলি। তিনি আসলে কেসটার যেখানে ছিলেন, এখনো সেখানেই আছেন। কিংবা আরো পিছিয়েই গেছেন।

রাতে রেজার ভালো ঘুম হলো না। ঘুমের মধ্যে বিচ্ছিন্ন সব স্বপ্ন দেখলেন তিনি। ফজরের আজানের খানিক পরে ঘুম ভেঙে গেল তার। মা ফোন করেছেন। গত কয়েকদিন মার সঙ্গে কথা হয়নি। মার ফোন ধরতে যে তার খুব ভালো লাগে, তেমনও না। তিনি জানেন, সেইতো একই কথা। রোজ রোজ। এমনিতে মার খবর তিনি অন্য উপায়ে রাখেন। আর রাখেন বলেই হয়তো ওই এক কথা শুনতে ইচ্ছে করেনা বলেই ফোনটা আর ধরেন না তিনি।

আজ ফোন ধরতেই তার মা রেহানা আখতার বললেন, আনু, কেমন আছিস?

খারাপ।

খারাপ কেন?

কারণ তুমি আমাকে আবারো আনু বলে ডাকছে।

তোর নাম যা, তা বলে তোকে ডাকব না?

এটাতো আমার নাম না, ছোটবেলায় নানাভাই আদর করে ডাকত।

আমিও আদর করেই ডাকলাম। সমস্যা কই?।

তুমি অন্য কারণে ডাকছো মা।

অন্য কী কারণ?

রেজা হাল ছেড়ে দেয়া গলায় বললেন, আচ্ছা, তুমি ডাকো। তোমার যেই নামে ডাকতে ভালো লাগে, তুমি সেই নামেই ডাকো।

রেহানা আখতার হাসলেন, আমি একটা বুদ্ধি পেয়ে গেছি, বুঝেছিস?

কী বুদ্ধি?

তুই যখন আমার ফোন ধরবি না, তখন অন্য কারো ফোন নম্বর থেকে ফোন করব। অচেনা নম্বর।

তুমি অচেনা নম্বর পাবে কই?

অচেনা নম্বরের কি অভাব নাকি? কারো কাছে একটা ফোন করার জন্য চাইলেই দেবে।

আমিতো অচেনা নম্বর ধরি না মা।

কেন? কেউ বিপদে পড়ে তোকে ফোন করলে তুই ধরবি না?

রেজা এবার আর কোনো কথা বললেন না। রেহানা আখতার বললেন, শোন, অনন্যা মেয়েটার কিন্তু দুম করে বিয়ে হয়ে যাবে।

অনন্যাটা আবার কে?

আরে স্কুলে পড়ায় যে মেয়েটা। অনু।

ওর নাম অনন্যা নাকি?

হুম, অনুতো ওর ডাক নাম।

আচ্ছা।

আমি কথা বলি?

কী কথা?

বিয়ের কথা?

কার?

কার আবার? তোর আর অনুর।

আমার কথা তুমি বলবে কেন?

তাহলে কে বলবে?

আমি।

রেহানা আখতার খানিক চুপ করে থেকে বললেন, বল তাহলে। তুই বললেতো আমার আর বলতে হয় না।

সময় হলেই বলব।

তোর সময় হবে কবে?

সেটাতো আগেভাগে বলা যায় না মা।

কেন? আগেভাগে বলা যাবে না কেন?

কেন, শোননি আবার? জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে, এই তিনে মানুষের হাত নেই। আগেভাগে কিছু বলা যায় না।

সময় চলে গেলে তখন বুঝবি। মেয়েটার একদিন টুক করে বিয়ে হয়ে যাবে। তখন কান্নাকাটি করেও লাভ হবে না।

তোমার ধারণা ওই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেলে আমি কান্নাকাটি করব?

শুধু যে কান্নাকাটি করবি, তা-ই না। কাঁদতে কাঁদতে গড়াগড়ি খাবি।

তোমার ধারণা ভুল মা।

স্বামী বা প্রেমিক সম্পর্কে মেয়েদের ধারণা ভুল হয়, কিন্তু সন্তান সম্পর্কে মায়েদের ধারণা ভুল হয় না। তারা সন্তানের চোখ দেখে মনের খবর বলে দিতে পারে।

তোমার ধারণা তুমি আমার চোখ দেখে মনের ভেতর ওই মেয়েটাকে দেখতে পাচ্ছো?

হ্যাঁ, পাচ্ছি। সারাক্ষণ দেখতে পাই।

সাবধান কিন্তু মা।

সাবধান কেন?

ওই মেয়েটাকে সারাক্ষণ দেখতে দেখতে আবার স্কুলের বাচ্চাকাচ্চাগুলোর দিকে খেয়াল রাখতে ভুলে যেও না। আগে ওদের দিকে খেয়াল রাখো প্লিজ।

রেহানা আখতার হাসলেন। তারপর খানিক চুপ করে থেকে বললেন, দেখেছিস আনু, তোদের দুজনের নামে কী মিল!

রেজা এই কথার কোনো জবাব দিলেন না। তিনি জানতেন, তার মা উদ্দেশ্যমূলকভাবেই তাকে আনু বলে ডাকে।

রেহানা আখতার এবার নিজ থেকেই বললেন, আনু আর অনু, কী সুন্দর নাম, দেখেছিস? এমন আর হয়? হয় না। একটা মাত্র আকার, বাকি সব এক। সুন্দর না? এটা আল্লাহই ঠিক করে রেখেছে, বুঝেছিস? তুই যতই না করিস, লাভ হবে না। হবেই না।

রেহানা আখতার আরো কিছু বলতে চাইছিলেন, তার আগেই রেজা ফোন রেখে দিলেন।

.

১২.

ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। সন্ধ্যার পরপরই অন্ধকারটাও নেমে এসেছে। সেই অন্ধকারে লতিফুর রহমানের বাড়ির পেছনে নদীতে ছাতা মাথায় বসে আছে নুরু মিয়া আর সবুর। খানিক বাদে এলো আরো একটা নৌকা। নুরু মিয়া নিচু গলায় বলল, কে ওইখানে?

অন্য নৌকা থেকে অনুচ্চ শব্দে সাড়া এলো, আমি আজগর নুরু ভাই।

কয়জন আইছো?

তিনজন?

তিনজনে কাম হইব?

হইব ভাই। আপনে ভরসা রাখেন।

এত সহজ না কিন্তু আজগর মিয়া।

সহজ না দেইখ্যাইতো লোকজন কম আনছি। গোপন কামে লোক আনতে হইব কম। বেশি লোক আনলেই নজরে পইড়া যাওনের চান্স আছে।

এইটা অবশ্য ঠিক কথা বলছ।

সবুর অন্ধকারেই নুরু মিয়ার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল, হারামজাদার বুদ্ধি আছে।

নুরু মিয়া চাপা স্বরে হাসলেন, বুদ্ধি না থাকলে কী নুরু মিয়া কাউরে কাজে নেয়? নেয় না।

দু খানা নৌকা জলের ভেতর ছপছপ শব্দ তুলতে তুলতে উত্তর দিকের অন্ধকারে মিশে যেতে থাকল।

.

চেয়ারম্যান চুন্নু মিয়া রাতে বন্যা উপদ্রুত এলাকাগুলোতে লোকজন নিয়ে টহল দিচ্ছেন। নির্বাচনের আগে আগে এমন দুর্যোগে লোকজনের পাশে থাকাটা জরুরি। প্রশাসনের কাছে আবেদন করে থানা থেকে কিছু পুলিশও পেয়েছেন তিনি। পুলিশের মধ্যে শরিফুলও আছে। চুন্নু মিয়া শরিফুলের দিকে তাকিয়ে বললেন, রেজা সাহেবের সমস্যাটা কী বলেনতো?

কোন সমস্যার কথা বলতেছেন চেয়ারম্যান সাব?

তার কী বুদ্ধিশুদ্ধি কম নাকি?

আমারও তাই ধারণা।

বুদ্ধি কম না হলে সে যা করতেছে, তা করত না।

জি, চেয়ারম্যান সাব। কথা সত্য।

সে আমার সঙ্গে যে আচরণ করে, আমার থানায় বইসা আমার সঙ্গে এই জিনিস করা তার নিজের জন্যই ক্ষতি। সে যত যা-ই ভাবুক, সামনের ইলেকশনেও নমিনেশন আমিই পাব। সে যে গোলাম মাওলার পক্ষ নিয়ে নাচতেছে, মাওলারে দিয়ে কী রাজনীতি হবে? হবে না। সে একটা আস্ত রামছাগল। ছাগল দিয়ে হালচাষ হয় না।

গোলাম মাওলা সাবের ধারণা আবার উল্টা।

তার কী ধারণা?

তার ধারণা রেজা স্যার আপনার পক্ষ নিতেছে।

শোনেন, আমি দুই দিনের বৈরাগী না যে ভাত দেইখাই অন্ন বলব। ছোটবেলা থেইক্যা রাজনীতি করি। কোনো বিলাই ইঁদুর ধরে, মোচ দেখলেই বুঝতে পারি। আপনার স্যারের সামনে বিপদ। এটা আমি বলে রাখছি। সে মাওলার কাছ থেকে রেগুলার টাকা পায়। এই ঘটনা আমি জানি।

টাকা যে-ই দিব, স্যারে নিব। না করব না। আপনে দিলেও নিব চেয়ারম্যান সাব।

চুন্নু মিয়া হাসলেন, এই কাজ আমি করব না। আমি দেখতে চাই তার ক্ষমতা কতদূর। সময় খারাপ গেলে দড়িও সাপ হয়ে ছোবল মারে। কিন্তু দড়িতো দড়িই। খারাপ সময় বেশিদিন থাকেনা। তবে আমি কিন্তু এখনো রাতে ঘুমাতে পারি না।

এত চিন্তায় ঘুম হয় কেমনে? আপনে চেয়ারম্যান মানুষ, আপনের মাথায় কি একটা-দুইটা চিন্তা? হাজার হাজার মানুষের জীবন, মরণ নিয়া আপনের চিন্তা।

হাজার হাজার মানুষের চিন্তায় আমার ঘুম বন্ধ হয় না। তাদের জন্য দুশ্চিন্তা হয়, কিন্তু ঘুম হারাম হয় না।

তাহলে?

চোখ বুজলেই লিখনের মুখটা আমার চোখের সামনে ভাইসা ওঠে। রাতের পর রাত। মনে হয় যেই নদীতে লিখনের লাশ ভেসে উঠছে সেই নদীটা রক্তে লাল করে দিই।

শরিফুল কিছু বলার আগেই সোহরাব মোল্লা বলল, কী যে বলেন না চেয়ারম্যান সাব। আপনের মতো ভালো মানুষরে দিয়া এইসব হইব না। আপনের বাইরেরটা শক্ত হইলেও ভেতরটা নরম। আপনেতো আর গোলাম মাওলার মতো বাইরে নরম, ভেতরে কসাই না। আপনে হইলেন…।

সোহরাব কথা শেষ করার আগেই চুন্নু মিয়া ধমকে উঠলেন, তুই চুপ থাক! তুই আমারে চেনোস না। দলের কথা চিন্তা কইরা আমি ধৈর্য ধরে আছি। দল যদি কিছু না করে, এই বন্যার পানিতে রক্ত মিশে বন্যা আরো বাড়ব।

পুলিশের সামনে যে এসব কথা বলা যায় না, তা যেন মাথায়ই নেই চুন্নু মিয়ার। সোহরাব মোল্লা তাকে সেটিই বোঝাতে চেয়েছিলেন, কিন্তু চুন্নু মিয়া তাকে পাত্তা দিলেন না। তিনি গলার রগ ফুলিয়ে ভয়াবহ সব কথা বলতে লাগলেন।

পরদিন দুপুরে রেজা এলেন লতিফুর রহমানের বাড়িতে। তার সঙ্গে শরিফুল। তারা ঘুরে ঘুরে পুরো বাড়িটা আবার দেখলেন। দেখলেন সবগুলো ঘরই। তিনতলার যে ঘরটিতে লাশ পাওয়া গিয়েছিল, সে ঘরটিও তারা যতটা সম্ভব সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম সম্ভাবনা নিয়েই খতিয়ে দেখার চেষ্টা করলেন। কিন্তু এই ঘরে লাশ আসার আর কোনো উপায় খুঁজে বের করতে পারলেন না। লতিফুর রহমান অসহায় গলায় বললেন, আমি ঘুমাতে পারছি না এসআই সাহেব। সারাক্ষণ মাথার ভেতর যন্ত্রণা। এই বয়সে এসে এত টেনশন আর নিতে পারছি না।

টেনশন নিতে না পারলে অত চাপ সামলে অমন বুদ্ধি করে লাশটাকে সরালেন কীভাবে?

কীভাবে সরালাম এখন নিজেরো বিশ্বাস হচ্ছে না। মনে হচ্ছে একটা ঘোরের মধ্যে কাজটা করেছি।

খুনটাতো আবার ঘোরের মধ্যে করেননি? দেখা গেল নিজেই খুন করে ভুলে গেছেন। এমন কিন্তু হয়, বুঝলেন? অনেকের ক্ষেত্রেই এমন হয়েছে।

লতিফুর রহমান এবার আর কথা বললেন না। রেজা বললেন, আপনি বলেছেন এই বাসার চাবি আপনি ছাড়া আর কারো কাছেই থাকে না?

জি না। ওই যে সিন্দুকটা দেখছেন, ওর মধ্যে সবগুলো চাবি থাকে। আর সিন্দুকের চাবি থাকে আমার কাছে। আমি ছাড়া কারো পক্ষেই কোনো ঘর খোলা সম্ভব না।

আপনার স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলা যাবে?

বলা হয়তো যাবে, কিন্তু তাতে লাভ হবে বলে মনে হয় না। উনি অসুস্থ।

কী হয়েছে ওনার?

শারীরিক মানসিক স্ট্রেস। মাঝে মাঝে খুব হাইপার হয়ে যান।

এত স্ট্রেস কিসের?

লতিফুর রহমান খানিক চুপ করে থেকে বললেন, আমার ছেলেটাকে নিয়ে।

যেন আচমকা মনে পড়েছে, এমন ভঙ্গিতে রেজা বললেন, ওহ, আপনার ছেলের কথাতো ভুলেই গিয়েছিলাম। সেদিন কিছুটা বলেছিলেন, উনিতো আমেরিকায় থাকেন, তাই না?

জি।

উনাকে নিয়ে কী সমস্যা?

বহুবছর সে বিদেশে, দেশে আসছে না। এই নিয়ে খুব মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছে আমার স্ত্রী। সেটা এখন এক্সট্রিম হয়ে গেছে। বুঝতেই পারছেন, একমাত্র সন্তানতো?

উনি আসছেন না কেন দেশে? খুব স্ট্রাগল করে ওখানে গেছে সে। তারপর গিয়েও স্ট্রাগল করতে হয়েছে অনেক। গ্রিন কার্ড পেতেও খুব ঝামেলা হয়েছে। তারপর বোঝেনইতো, পরপর দুটো বাচ্চা হলো, তাদের বড় করা, স্কুলিং, তারপর আর্নিং-এর ব্যাপার। অত দূরের দেশ থেকে দেশে আসা একটা প্ল্যান-পরিকল্পনার ব্যাপার যেমন, তেমনি টাকা পয়সারও ব্যাপার।

সেদিন যে বললেন, এবার আসার কথা ছিল?

জি ছিল। কিন্তু মেয়েটার একসিডেন্টের কারণেইতো আসা হলো না।

.

রেজা নাসিমা বেগম ও ডালিয়ার সঙ্গেও কথা বলার চেষ্টা করলেন, কিন্তু লাভ হলো না। নাসিমা বেগম কোনো কথাই বলতে চাইলেন না। কথা বলতে চাইল না ডালিয়াও। সে পুলিশকে প্রচণ্ড ভয় পায়। তারপরও তার সঙ্গে কিছু কথা হলো। রেজা বললেন, তোমার বাড়ি কোথায়?

ফরিদপুর।

অতদূর থেকে এখানে এলে কি করে?

আমার ভাই নিয়াসছে।

তোমার ভাই কি করে?

রাজমেস্তরির কাম করে। কনস্টাকশনে।

সে নিয়ে আসল কেন? সে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জায়গায় কামে যায়। এইখানেও কামে আসছে। তখন পোরবেচার খালুজানে তারে বলছিল কামের মানুষের কথা।

তখন সে তোমাকে নিয়ে এসেছে?

ডালিয়া ওপর নিচ মাথা নাড়াল। সে তাকিয়ে আছে নিচে, পুলিশের দিকে তাকাতে ভয় পাচ্ছে সে।

এখানে আসার আগে কী করতে তুমি?

ঢাকায় আছিলাম।

ঢাকায় কী কাজ করতে?

কিছু করতাম না। আমার স্বামী কাওরান বাজারে কাঁচা মালের ব্যবসা করত।

এখন স্বামী কই?

তার সঙ্গে যোগাযোগ নেই।

যোগাযোগ নাই কেন?

সে আরেকটা বিয়া করছে।

তুমিতো দেখতে ভালো। চেহারা, গায়ের রংও ভালো। তাহলে স্বামী আবার বিয়ে করছে কেন?

আমার সন্তান হয় না, এইজন্য।

ওহ। তা স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে?

নাহ, হয় নাই।

কেন? সে একসঙ্গে দুই বউই রাখতে চায়?

নাহ, সে আমারে তালাক দিব না। আমারে বলছে তারে ডিভোস দিতে।

তুমি দাও নাই?

ডালিয়া মাথা নিচু রেখেই ডানে-বায়ে মাথা নাড়াল। রেজা বলল, ডিভোর্স দাও নাই কেন?

ডালিয়া এই প্রশ্নের জবাব দিল না। সে মাথা নিচু করে বসে রইল। তবে তার চোখের কোল গড়িয়ে দু ফোঁটা জল টুপটাপ ঝরে পড়ল।

.

এনায়েতের বিষয়েও কথা হলো খানিক। কিন্তু এটি নিশ্চিত যে ঘটনার অনেক পরেই এ বাড়িতে এসেছে এনায়েত। সুতরাং এ ঘটনায় এনায়েতের সম্পৃক্ত বা জানাশোনা থাকার সুযোগ নেই বললেই চলে। লতিফুর রহমানের বাড়ি থেকে বের হয়ে বিকেলে হারাধন মুচির দোকানে গেলেন রেজা। লিখনের বিষয়ে হারাধন মুচিকেও নানা প্রশ্ন করলেন তিনি। লিখন কাদের সঙ্গে মিশতো, কি করত, কার সঙ্গে কেমন সম্পর্ক ছিল, এই সব। হারাধন মুচি যতটুকু জানত, তা বললও। কিন্তু রেজার তাতে খুব একটা লাভ হলো বলে মনে হলো না। রেজা ভেতরে ভেতরে প্রচণ্ড অস্থির হয়ে উঠছেন। এ অবস্থায় নিজের গা বাঁচানোর জন্য হলেও তার উচিত লতিফুর রহমানকেই গ্রেপ্তার করে ফেলা। কিন্তু ঘটনাটি তাকে প্রচণ্ডরকম ভাবিয়ে তুলছে। পুরোপুরি ধোঁয়াশার মধ্যে পড়ে গেছেন তিনি। সারাক্ষণ একটা প্রবল অস্বস্তি, একটা অস্থিরতা কাজ করছে। তিনি জানেন, এর থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় ঘটনার সত্যিকারের অপরাধীকে খুঁজে বের করা। এ ছাড়া আর কোনো কিছুতেই তিনি স্বস্তি পাবেন না। কিন্তু অপরাধীকে খুঁজে পাওয়ার সম্ভাব্য কোনো উপায় রেজার জানা নেই। তার রীতিমতো দিশেহারা লাগছে।

.

সন্ধ্যায় মোবাশ্বেরের চায়ের দোকানের সামনে ভিড়-ভাট্টা লেগেই থাকে। আজও আছে। ব্যাংক ছুটি হয়েছে, ছুটি হয়েছে আরো অনেক অফিসই। তাদের সবার ভিড়ই লেগে আছে এখানে। বিভিন্ন শ্রমিকরাও এই সময়টাতেই যা একটু ফুরসৎ পায়। তারাও এখানে সেখানে বিচ্ছিন্ন দাঁড়িয়ে চা-বিড়ি ফুকছে। সেই ভিড়ে সেদিনের সেই শ্রমিক দেলোয়ারকে দেখে ডাকলেন রেজা। দেলোয়ার সালাম দিয়ে দাঁড়াতেই রেজা বললেন, আর কী খবর তোর? বউ-বাচ্চা ভালো?

বাচ্চাতো এহনো হয় নাই ছার। তয় বউটা ভালো না।

ভালো না কেন?

এই সময়ে কত কিছিমের রোগ-বালাই যে মাইয়া মাইনসের হয়, তার আর শেষ নাই!

তা বাড়ি যাস না কেন? এখন তো বাড়ি থাকা উচিত।

দেলোয়ার অসহায় ভঙ্গিতে হাসল, বাড়ি যাইতে টাকা পয়সা লাগেনা ছার? এই সময় টাকা পয়সাটা খুব দরকার।

তা তোদের সরদার এখনো তোদের টাকা-পয়সা কিছু দেয়নি?

কন্টাকতো এহনো শেষ হয় নাই। শেষ হইলে দিব। এহনো কিছু কিছু দেয়, কিন্তু সেইটা ওই খাওন, হাত খরচের লাইগ্যা। পুরাটা দিব কন্টাক শেষ হইলে।

কিন্তু কন্ট্রাক্ট শেষ হবার আগেই যদি লাগে? যদি তোর বউর ইমার্জেন্সি দরকার হয়ে পড়ে?

তাইলে সর্দাররে জানাইলেই হইব। দিয়া দিব। হারামজাদা হইছে ওই আজগর। অয় দিব না। ঝামেলা করব।

দেলোয়ার হাতের আঙুল দিয়ে আজগরকে দেখাল। তাদের থেকে সামান্য দূরে আজগর দাঁড়িয়ে আছে। আজগরের সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে দুজন অচেনা শ্রমিক আর নুরু মিয়া। সঙ্গে শক্তপোক্ত সবুরও আছে। তাদের একসঙ্গে দেখে রেজার খানিক ক্রু কুঁচকে গেল। ছোট্ট জটলাটার সকলের মুখেই দুশ্চিন্তা এবং গুরুগম্ভীর আলোচনার ছাপ। বিষয়টা কেমন একটা খচখচানি তৈরি করল রেজার বুকের ভেতর। তিনি শরিফুলকে পাশে ডেকে নিয়ে বললেন, ও লোকটার দিকে নজর রেখো।

শরিফুল বলল, ওর নামতো আজগর। নিরীহ লোক, কনস্ট্রাকশন শ্রমিকদের দেখভাল করে।

যেটা বলেছি, সেটা করো। সঙ্গে নুরু মিয়া আর সবুরের দিকেও খেয়াল রেখো।

শরিফুল দ্বিধাগ্রস্ত গলায় বলল, আচ্ছা।

.

পরদিন রাতে রেজাকে খবরটা দিল শরিফুল, স্যার, কিছু একটা ঝামেলা।

রেজা তাকালেন, কী ঝামেলা?

প্রায় ভোর রাতের দিকে উত্তর দিকের বিলে আজগরকে নৌকায় দেখা গেছে।

সঙ্গে কে ছিল?

আরো দুইটা লোক ছিল, চিনি না। তবে শ্রমিক ট্রমিক হতে পারে।

সবুর বা নুরু মিয়া ছিল না?

না স্যার।

ঘটনা কি?

ঘটনা বুঝলাম না। তারা শহর থেকে বের হইল রাইত বারোটা নাগাদ। তারপর বিলের মাঝখানে নৌকা নিয়ে সারা রাইত বইসা রইল।

শুধু বসে রইল? আর কিছু করল না?

না, স্যার, আর কিছুই করল না। ধইরা আইনা দুইটা ডলা দিই স্যার? সব বের হয়ে যাবে।

রেজা চিন্তিত গলায় বললেন, উঁহু। কিছু করো না। জাস্ট নজর রাখো।

.

শহরে ভেতরে ভেতরে যে কিছু একটা ঘটছে সে বিষয়ে নিশ্চিত রেজা। কিন্তু কী ঘটছে সেটি তিনি বুঝতে পারছেন না। পরদিন সন্ধ্যায় গোলাম মাওলার বাড়িতে গেলেন তিনি। গোলাম মাওলা বারান্দায় বসে চা খাচ্ছিলেন। রেজাকে দেখে অবাক হলেও হাসিমুখেই বললেন, কী খবর রেজা সাহেব, গরিবের বাড়িতে হাতির পাড়া!

রেজা হাসলেন, উল্টোটা বললেন ভাই, হাতির বাড়িতে পিপীলিকার পাড়া হবে।

পিপীলিকা কিন্তু ভয়ংকর প্রাণী ভাই। একবার হাতির কানে ঢুকলে খবর আছে। কিন্তু হাতির পাড়ায় পিপড়ার কিন্তু কিছু হয় না!

সব পিঁপড়াতো আর হাতির কান পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে না।

গোলাম মাওলা হাসলেন, আপনি পারবেন।

তার মানে স্বীকার করে নিলেন যে আমি পিপড়া আর আপনি হাতি?

গোলাম মাওলা হো হো হো করে হাসলেন, আপনার সঙ্গে কথায় পারব না ভাই। তা বলেন ভাই, কী খবর?

আপনার জন্য একটা দুঃসংবাদ আছে।

দুঃসংবাদ?

হুম, ওপর মহল থেকে আভাস দেয়া হয়েছে, চাইলে যেকোনো সময় যে কাউকে যেন গ্রেপ্তার করা হয়।

তো করেন গ্রেপ্তার। এরকম একটা খুন হলো, আর আপনি গ্রেপ্তার করবেন? খুন কি খেলা নাকি? আমার শহরে এইগুলা আমি চাইও না। খালি একবার ক্ষমতায় আসতে দেন, দেখেন এই শহরের জন্য কী করি?

রেজা খানিক থেমে বললেন, আমাকে বলা হয়েছে, চাইলে আপনাকেও যেন গ্রেপ্তার করতে পারি!

গোলাম মাওলা সামান্য থতমত খাওয়া গলায় বললেন, আমাকে? আমার বিরুদ্ধে কোনো মামলা আছে? প্রমাণ আছে?

পুলিশের গ্রেপ্তার করতে প্রমাণ লাগে না। মামলা হলেই হয়। আপনার বিরুদ্ধে মামলা আছে।

মামলা? আমার বিরুদ্ধে? কে করেছে, চুন্নু মিয়া?

না, আপনার বিরুদ্ধে মামলা করেছে আপনার বাড়ির কাজের মেয়ে আছিয়া। সে আপনার বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির মামলা করেছে।

গোলাম মাওলা বসা থেকে এক ঝটকায় উঠে দাঁড়ালেন, আছিয়া! সে গত ছয়-সাতদিন আগে বাড়ি যাবে বলে ছুটি নিয়ে গেছে, আর ফেরে নাই। সে কই?

সে কই সেটাতো বলতে পারব না। তবে গতকাল চুন্ন চেয়ারম্যানের ম্যানেজার সোহরাব মোল্লা তাকে নিয়ে থানায় এসেছিল। আমি তখন থানায় ছিলাম না। ডিউটি অফিসার ছিলেন। আছিয়া একা এলে হয়তো সে আপনার বিরুদ্ধে এই মামলা নিত না। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, চুন্নু মিয়া বর্তমান চেয়ারম্যান, সে লোক পাঠালে মামলা না নিয়ে উপায় ছিল না। তা ছাড়া, আপনিতো জানেনই, আমরা এখানকার পুলিশরা এমনিতেই নানা প্রেসারে আছি। ওপর মহলের ভালো নজরে নেই। আর চুন্নু মিয়াও আমার ওপর নানা কারণেই ক্ষেপে আছেন, সো, এই মামলা না নিলে এটা নিয়ে তিনি আরো ঝামেলাই করতেন!

গোলাম মাওলা শান্ত গলায় বললেন, কাজটা চুন্নু মিয়া ভালো করল না। আমি শান্ত ভদ্র মানুষ। আমার সঙ্গে এই খেলাটা খেলে সে ভালো করে নাই।

খেলা আপনিও কম খেলছেন না মাওলা সাহেব। আপনি বুদ্ধিমান মানুষ বলে আপনার খেলা চোখে দেখা যায় না। আমি আপনাকে গ্রেপ্তার করতে আসিনি। একটা কথা জানতে এসেছি, আপনি আমাকে বলেনতো, ভেতরে ভেতরে কী চলছে?

কী চলছে মানে? আপনারা পুলিশ হয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করছেন?

হ্যাঁ, জিজ্ঞেস করছি। শুধু জিজ্ঞেসই করছি না, সতর্কও করছি, কারণ ঘটনা ঘটাচ্ছেন আপনি।

আমি!

হুম, আপনি। আমরা কিছুতো অন্তত টের পাই।

আর চুন্নু মিয়া, উনি কী দুধে ধোয়া তুলসি পাতা?

উনি কী সেটা নিয়ে আপনার না ভাবলেও চলবে। সেটা আমাকেই ভাবতে দিন। আপনি আপনাকে নিয়ে ভাবলেই ভালো হয়।

গোলাম মাওলা শরীর কাঁপিয়ে হাসলেন। তার উদ্দেশ্য ছিল রেজাকে দ্বিধাগ্রস্ত করে দেয়া। কিন্তু রেজা কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালেন না। তিনি এক দৃষ্টিতে শান্ত ভঙ্গিতে গোলাম মাওলার দিকে তাকিয়ে রইলেন। গোলাম মাওলা বললেন, এইজন্যইতো এতদিনেও লিখনের আসল খুনিটা যে কে সেটাই বের করতে পারলেন না। অথচ ঘটনা পানির মতো স্পষ্ট।

তাই?

হুম।

তো সেই পানির মতো স্পষ্ট ঘটনায় আপনি দেখতে পাচ্ছেন যে চুন্নু মিয়া তাঁর আপন ভাগ্নেকে খুন করেছেন?

গোলাম মাওলা মৃদু হাসলেন, শুধু আমি না, চোখ থাকলে আপনিও দেখতে পেতেন এসআই সাহেব। শুধু শুধু অন্য নিরীহ মানুষদের হয়রানি করতেন না। চোখের সামনে স্পষ্ট সাক্ষী প্রমাণ থাক-সত্ত্বেও খুনি গলা উঁচা কইরা লাফ-ঝাঁপ দিয়া বেড়াইতে পারত না।

গোলাম মাওলা সামান্য থেমে বললেন, আমি নিজেই আজ আপনার সঙ্গে দেখা করতে যাইতাম। আপনি আসছেন, ভালো হইছে। একটু দাঁড়ান, আমি ঘর থেকে আসতেছি। আপনের চোখ খোলনের ব্যবস্থা করতেছি।

রেজা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। গোলাম মাওলা অবশ্য বেশি সময় নিলেন না। তিনি মিনিট পাঁচেকের মধ্যে ঘর থেকে চলে এলেন। তার হাতে অনেক দলিল-পর্চার ফটোকপি। তিনি সেগুলো রেজার সামনে রাখলেন। তারপর বললেন, এইগুলা চুন্নু মিয়ার বাপের সম্পত্তির দলিল, জমি-জমার হিসাব। এই যে দেহেন তাদের মোট সম্পত্তির হিসাব। এক শ বিঘার ওপরে হইব জমি। যদিও এর মধ্যে নদীর মইধ্যেই আছে অর্ধেকে মতোন। বাকি যে জমি, দোকান পাট, তার তিন ভাগের দুই ভাগ পাইব চুন্নু মিয়া আর এক ভাগ পাইব তার বোইন। কারণ তারা এক ভাই এক বোইন। কিন্তু এইখানে আরো ঘটনা আছে। যহন চুন্নু মিয়ার ভগ্নিপতি মানে লিখনের বাপ মারা গেল, তখন চুন্নু মিয়ার বাবা জীবিত। লিখনের বয়সও তখন খুব অল্প। অত অল্প বয়সে মেয়ে বিধবা হইল, নাতি বাপ হারা হইল, এই জন্য তিনি তখনই আরো আলাদা কুড়ি বিঘা জমি নাতিরে লিখে দিয়ে গিয়েছিলেন। এই দেখেন, এই হইল ওছিয়তনামা। দেখলেন?

রেজা গম্ভীর মুখে বললেন, হুম।

এখন এইটা কী চুন্নু মিয়া সহজে মাইনা নেওনের লোক? তাইলে তার ভাগে জমি থাকে কতটুক? থাকেই না বলতে গেলে। কারণ তার বাপ লিখনরে যেই জমি লিখ্যা দিয়া গেছে, তার বেশির ভাগই হইছে ভালো জমি। সেইখানে নদীর পানি ওঠে না। আর চুন্নু মিয়ার ভাগের জমি বছরে আট মাস থাকে ডুইবা। এখন হিসাব মিলান। লিখনের মা, মানে চুন্নু মিয়ার বোইনে বাপের সম্পত্তিতে যে ভাগ পাইব, তা কিন্তু লিখনেরই। আবার তার মামা চুন্নু মিয়ার জমির ভাগ থেইকাও সে পাইব কুড়ি বিঘা ভালো জমি। এখন হিসাব মিলান, খুনটা কে করছে? লিখন বাঁইচা থাকলে কার সুবিধা? আর মইরা গেলে কার সুবিধা? মেলান হিসাব।

.

রেজা তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছেন অছিয়তনামাটির দিকে। দেখে সঠিকই মনে হচ্ছে। দলিল-পৰ্চাগুলোও। সবচেয়ে বড় কথা হলো গোলাম মাওলা যে যুক্তি এবং প্রমাণ হাজির করেছেন, সেগুলো এমন একটি খুনকে পুরোপুরি নিশ্চিত করতে না পারলেও যুক্তিগুলো খুবই শক্তিশালী। একে অগ্রাহ্য করারও কোনো উপায় নেই। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, কেসের এই মুহূর্তে যা অবস্থা, তাতে এটিই সবচেয়ে শক্ত প্রমাণ, সবচেয়ে অকাট্য যুক্তি।

গোলাম মাওলা রেজাউল হকের মুখের দিকে তাকিয়ে তার শেষ তীরটা ছুড়লেন, আর এই খুনটা যদি সে করে, তাহলে অটোমেটিক্যালি দোষটা চাপব আমার ঘাড়ে। এক খুনে দুই পথের কাঁটা শেষ। বুঝলেনতো, এক ঢিলে দুই পাখি মারা কারে বলে?

রেজা চিন্তিত ভঙ্গিতে মৃদু ঠোঁট নাড়লেন, হুম।

তার ভাবনা-চিন্তার জগৎ ক্রমশই এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। জটিল থেকে জটিলতর হয়ে যাচ্ছে।

.

১৩.

পরদিন পুলিশ সুপারের অফিসে গেলেন রেজা। গত এক মাসের কেসের অগ্রগতির রিপোর্ট নিয়ে তিনি এসপি সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। গতকাল গোলাম মাওলার কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের কথাও তিনি এসপি সাহেবকে জানালেন। তবে ইচ্ছে করেই এড়িয়ে গেলেন লতিফুর রহমানের ঘটনার কথা। বিষয়টি নিয়ে পুরোপুরি নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত ওই ঘটনার কথা তিনি কাউকেই জানাতে চান না। রেজা জানেন, ওই ঘটনা জানানোর সঙ্গে সঙ্গে সকলেই একপ্রকার হাঁফ ছেড়ে বাঁচবেন। বিনা বাক্যব্যয়ে লতিফুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে এতদিনকার চেপে বসা পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে চাইবেন সবাই। রেজা তা হতে দিতে চান না। তিনি এই রহস্যের সত্যিকারের সমাধান চান। তিনি বিশ্বাস করেন না এই খুনের সঙ্গে লতিফুর রহমান জড়িত।

এসপি সাহেব সময় নিয়ে চুন্নু মিয়া সম্পর্কে গোলাম মাওলার দেয়া তথ্যের কথা শুনলেন। তারপর বললেন, কিন্তু রেজা, এটা একটা সম্ভাবনার কথা হলো । সম্ভাবনা দিয়েতো খুনের মতো একটা বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসা যায় না। তা ছাড়া হি ইজ আ ভেরি ইনফ্লুয়েন্সিয়াল পারসন ইন লোকাল পলিটিকস।

জি স্যার।

তা ছাড়া ধরো, সাসপেক্ট যদি এতটাই ডেসপারেট হতো, তাহলে এ ধরনের পারিবারিক ভাগবাটোয়ারা নিয়ে ফ্যামিলি মেম্বারদের মধ্যে আগেভাগেই একটা দূরত্ব, অবিশ্বাস তৈরি হয়। এখন এই ঘটনা নিয়ে চেয়ারম্যান সাহেবের অসন্তুষ্ট হবার যথেষ্ট যৌক্তিক কারণই রয়েছে। এবং তিনি যেমন মানুষ, তাতে তার সেই অসন্তোষ লুকিয়ে রাখার মতো মানুষও তিনি নন। সেক্ষেত্রে তার বোনেরও সেটা জানার কথা। আর এমনটা হলে নিজের পিতাহারা একমাত্র সন্তানকে তিনি ভাইয়ের কাছে এভাবে পাঠিয়ে দিতেন বলে আমার মনে হয় না।

কথাটা আমিও ভেবেছি স্যার। এমনকি গোলাম মাওলার কাছ থেকে কথাটা শোনার পর আমি লিখনদের বাড়িতেও গিয়েছিলাম। তার মায়ের সঙ্গেও কথা বলেছি। তিনি তার ভাই সম্পর্কে এমন কোনো আভাস দেননি, যাতে তাকে সন্দেহ করা যায়! বরং স্বামীর মৃত্যুর পরপরই যখন তার বাবাও মারা যান, তখন থেকে তার ভাই চুন্নু মিয়াই তাকে আর লিখনকে আগলে রেখেছেন বলেই তিনি জানিয়েছেন।

এএসপি সাহেব এতক্ষণ কোনো কথা বলেননি। এবার তিনি কথা বললেন, হুম। কিন্তু ধরো আবার এমনওতো হতে পারে যে, এই পরিকল্পনা চুন্নু মিয়ার বহু আগে থেকেই ছিল। আর ছিল বলেই বোন আর ভাগ্নের বিশ্বাস অর্জন করতেই তিনি তাদের সঙ্গে এত ভালো আচরণ করেছেন। তাদের আস্থা, বিশ্বাস অর্জন করেছেন। কারণ, তিনি নিজেও হয়তো জানতেন, সম্পর্ক নষ্ট করে সম্পত্তি হস্তগত করার চেয়ে সম্পর্ক ভালো রেখে সম্পত্তি হস্তগত করা বেশি সহজ।

কথাটি কারোই গ্রহণ করতে ইচ্ছে করছিল না, কিন্তু যুক্তিটি কেউ অগ্রাহ্যও করতে পারল না। এএসপি সাহেব যেটি বলেছেন, সেটি ফেলে দেয়ার মতো কোনো কথা নয়। বরং এতদিন ধরে রাজনীতি করে আসা একজন মানুষ এমন করে ভাবলে সেটি অবাক করার মতো কিছু হবে না। বাকিটা সময় প্রাসঙ্গিক অপ্রাসঙ্গিক নানা আলোচনা হলেও তাতে কোনো সমস্যারই কোনো সমাধান হলো না।

.

সন্ধ্যার পর পর পলাশবাড়ি শহরে ঢুকলেন রেজা। শহরের মুখেই তার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল দারোয়ান এনায়েত আর কাজের মেয়ে ডালিয়ার সঙ্গে। তারা দাঁড়িয়ে আছে হারাধনের মুচি দোকানের সামনে। এনায়েত জানাল, নাসিমা বেগম আচমকা অসুস্থ হয়ে পড়ায় তারা ডাক্তারের কাছে এসেছে। সঙ্গে ডালিয়াকে নিয়ে এসেছে নাসিমা বেগমের জন্য তার একান্ত দরকারি কিছু জিনিস পত্র কিনে নিয়ে যেতে। ডালিয়ার হাতে কয়েক জোড়া পুরনো রংচটা ছেঁড়া জুতোও। সেগুলো সেলাই করার জন্য হারাধন মুচির দোকানে দেয়া হয়েছে। সম্ভবত নাসিমা বেগমের পুরনো জুতোগুলো সেলাই করেই পরে ডালিয়া।

.

এনায়েত ডালিয়াকে মুচির দোকানে দাঁড় করিয়ে রেখে আরো কী সব কিনতে গেল। রেজাও ধীর পায়ে হেঁটে এসে দাঁড়ালেন মোবাশ্বেরের চায়ের দোকানের সামনে। একটা চা আর সিগারেটের কথা বলে তিনি চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন। হারাধনের দোকানের সামনে মুখে ঘোমটা টেনে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ডালিয়া। তার দাঁড়ানোর মধ্যে কেমন একটা জড়সড় লাজুক ভাব। এই লাজুকতার একটা অদ্ভুত সৌন্দর্যও আছে। হারাধন মুচিও যেন সেটি খেয়াল করল। এমন রূপবতী তরুণী কাজের মেয়ের সান্নিধ্য সে হেলায় হারাতে চাইছে না। আগ বাড়িয়ে ডালিয়ার সঙ্গে নানা গল্পগুজব করতে চাইছে সে। যদিও ডালিয়া তাতে সাড়া দিচ্ছে কী না তা এতদূর থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না। তবে মাঝে মাঝে সেও যে কিছু কথাবার্তা বলছে তা বোঝা যাচ্ছে। একটা লাজুক মেয়ে কেমন ঘোমটা পরে জড়সড় ভঙ্গিতে অচেনা এক আগ্রহী পুরুষের সঙ্গে কথা বলছে, দৃশ্যটা দেখে রেজার অদ্ভুত রকমের ভালো লাগা কাজ করল। মুহূর্তের জন্য হলেও ডালিয়ার জন্য যে হারাধনের একটা আগ্রহ, একটু ভালো লাগা তৈরি হয়েছে, সেটাকে সত্যিই মনে হলো রেজার। এই আগ্রহ বা ভালোলাগাটুকু বিশেষ কিছুই।

কিছুক্ষণ আগেও সলজ্জ ভঙ্গিতে হারাধনকে এড়িয়ে যাওয়া বা একটা-দুটা কথার উত্তর দেয়া ডালিয়াও যে এইটুকু সময়েই খানিক সপ্রতিভও হয়ে উঠেছে, তাও দৃষ্টি এড়াল না রেজার। এরা কী পরস্পরের জন্য কোনো বিশেষ অনুভূতি ধারণ করে? কে জানে? হয়তো করে। আর সেই অনুভূতির হয়তো কোনো নাম নেই, কোনো সম্ভাবনা নেই। তারপরও এই মুহূর্তটুকু কী যে সুন্দর!

রেজার বুকের ভেতরটা হঠাৎ যেন কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগতে লাগল। মানুষের জীবনে এমন কিছু মুহূর্ত, এমন কিছু অনুভূতি থাকা খুব দরকার। এটুকুই হয়তো জীবনের সৌন্দর্য। কিন্তু তার জীবনে কী এমন কিছু আছে?

রেজা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ ফিরিয়ে নিলেন। দূরে ব্যাংক ম্যানেজার রফিকুল ইসলামকে দেখা গেল। তিনি রেজার দিকেই এগিয়ে আসছেন। কাছে আসতেই রেজা বললেন, কী খবর? বাসা-টাসা কিছু পেলেন?

আর বাসা? ওই এক লতিফুর রহমান স্যার ছাড়া আর কারো বাসাতো ফ্যামিলি নিয়ে থাকার মতো অবস্থায় নেই ভাই।

তাহলে সেখানেই উঠে যান। উনিতো বলেইছিলেন যে কিছু টাকা পয়সা অ্যাডভান্স পেলেই উনি ঘরের বাকি কাজ ঠিক করে দেবেন।

কিন্তু উনিতো মনে হয় না আর বাড়ি ভাড়া দেয়ায় আগ্রহী। টু লেটতো আর দিলেন না।

রেজা খানিক কী যেন ভাবলেন। তারপর বললেন, এক কাজ করি চলেন, একদিন আপনাকে নিয়ে আমি যাই। আমার ধারণা, আমি গেলে প্রফেসর সাহেব না করবেন না।

রেজার প্রস্তাব শুনে রফিকুল ইসলাম খুবই আনন্দিত হলেন, তাহলেতো দারুণ ব্যাপার হয় ভাই। চলেন, আপনার সময়-সুযোগ মতো একদিন যাই।

রেজা হাসলেন, আমি দুয়েকদিনের মধ্যেই আপনাকে জানাব।

ফেরার সময় এনায়েতের সঙ্গে আবারও দেখা হয়ে গেল রেজার। পরদিন যে তারা বাড়ি দেখতে আসবেন, সেটাও এনায়েতকে জানিয়ে রাখলেন রেজা।

.

গভীর রাতে অণুকে ফোন করলেন রেজা। অণু ফোন ধরেই বলল, জি হক সাহেব, বলুন।

আপনি আমাকে হক সাহেব বলেন কেন বলুন তো?

অণু খানিক চুপ করে থেকে বলল, জানি নাতো!

আমারতো একটা নাম আছে?

কোনটা? আমার নামের সঙ্গে মিলিয়ে যেটা? আনু?

রেজার খুবই রাগ লাগছে। কিন্তু সে কিছু বলল না। অণু বলল, কী, হক। সাহেব কি রেগে গেলেন?

রেজা এবারও কথা বললেন না। অণু এবার নরম গলায় বলল, আচ্ছা, বলুন।

রেজা বলল, কিছু বলার নেই অণু। এমনি ফোন করেছি।

এমনি এমনি কেউ কাউকে ফোন করে?

আমি করি।

আপনিও করেননি। যে কারণে ফোন করেছেন, সেই কারণটি বলতে লজ্জা পাচ্ছেন, তাই না?

রেজা এই প্রশ্নের জবাব দিলেন না। চুপ করে রইলেন। অণুই বলল, আপনার ভয় নেই, আমি আপনার মার কাছে বলব না যে মাঝে মাঝে আপনি আমাকে রাত দুপুরে ফোন করেন।

রেজা গম্ভীর গলায় বললেন, স্কুলের ছেলে-মেয়েগুলো কেমন আছে?

হ্যাঁ, ভালো। তবে আপনাকে খুব দেখতে চায়।

আমি চেষ্টা করছি, একটু সময় বের করার। সময়টা বের করতে পারলেই চলে আসব।

আপনার সময় সহজে বের হবে বলে মনে হচ্ছে না।

এটা অবশ্য ঠিক বলেছেন। যে ঝামেলায় পড়েছি, এই ঝামেলা থেকে নিস্তার আছে বলে মনে হয় না।

কী ঝামেলা?

বলতে ইচ্ছে করছে না।

আচ্ছা, বলতে হবে না।

মা ভালো আছেন?

হ্যাঁ ভালো।

আর কী খবর?

আর কী খবর জানতে চান হক সাহেব?

আবার?

তাহলে কী বলব? রেজা ভাই বলব? ভাই শুনতে ভালো লাগবে?

রেজা কথা বললেন না। অণু বলল, তার চাইতে হক সাহেব ভালো না? এই কারণেই হক সাহেব বলি আমি। আপনাকে আমার ভাই ডাকতে ভালো লাগবে না।

রেজা মৃদু হাসল। অণু বলল, বলুন, কী খবর জানতে চান?

না বিশেষ কিছু না। এমনি জিজ্ঞেস করা।

অণু হাসল, আমার বিয়ের খবর জানতে চান?

রেজা জবাব দিল না। অণু বলল, পাত্রের আমাকে দেখে পছন্দ হয়েছে। কিন্তু পাত্রের মায়ের পছন্দ হয়নি। তার ধারণা আমার গায়ের রং খুবই ময়লা।

রেজা চুপ করে রইল। অণু হাসল, কালো মেয়েদের প্রেম খুব সহজে হয়, কিন্তু বিয়ে সহজে হয় না, বুঝলেন?

রেজা বললেন, না, বুঝিনি।

আচ্ছা, আপনাকে বুঝতে হবে না।

রেজা ফোন রেখে দিলেন। তিনি ভেবে পাচ্ছেন না অণুর মতো একটা মেয়েকে কেউ কী করে পছন্দ না করে পারে! তিনি এও ভেবে পাচ্ছেন না, অণু কী সত্যিই কালো? অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, এই প্রশ্নের উত্তর তিনি খুঁজে পেলেন না। তিনি কী কখনো অণুকে এতটা খেয়াল করে দেখেছেন? রেজা এই প্রশ্নেরও কোনো উত্তর পেলেন না। তবে একটা বিষয় তিনি স্পষ্টই বুঝতে পারলেন, সন্ধ্যায় ফাঁকা ফাঁকা লাগা বুকটা এখন আবার পরিপূর্ণ লাগছে।

.

রফিকুল ইসলামকে নিয়ে আবারও লতিফুর রহমানের বাড়ি দেখতে এসেছেন রেজা। তাদের সঙ্গে এসেছে শরিফুলও। শরিফুল ফিসফিস করে বলল, প্রফেসর স্যারেতো এইবার ভয়েই বাড়ি ভাড়া দিয়া দিব।

রেজা চকিতে শরিফুলের দিকে ফিরে নিজের ঠোঁটে তর্জনি চেপে চুপ থাকতে ইঙ্গিত করলেন। লতিফুর রহমান সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে যাচ্ছেন। তার হাতে লাঠি। ডান পায়ের ব্যথাটা আবার বেড়ে যাওয়ায় হাঁটতেও সমস্যা হচ্ছে। ঘরের দরজা খোলার সময় পূর্বের অভিজ্ঞতা থেকেই যেন অবচেতন এক আশঙ্কা আঁকড়ে ধরল তাকে। বিষয়টি রেজার নজর এড়াল না। তিনি হেসে বললেন, আমার কাছে দিন, আমি খুলছি।

রেজা দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলেন। শরিফুল জানালাগুলো খুলে দিতেই হুড়মুড় করে একরাশ হাওয়া ঢুকল ঘরে। খানিকটা আলোকিতও হয়ে উঠল ঘর। রফিকুল ইসলাম আগের দিনের অভিজ্ঞতার কারণেই কী না কে জানে, বার কয়েক নাক টেনে গন্ধ নিলেন। তার কুঞ্চিত কপাল খানিক প্রসারিতও হলো। রেজা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন এপাশ-ওপাশ। এই ঘরে লাশটা কীভাবে এলো, অনেক ভেবেও সেই রহস্যের বিন্দুমাত্র সমাধানও তিনি বের করতে পারেননি। এ এক অবিশ্বাস্য, অদ্ভুত ব্যাপার। তিনি বাথরুমটা খুলে আবার দেখলেন। দেখলেন বারান্দাগুলোও। চওড়া বারান্দাগুলো শক্ত গ্রিলে আবৃত।

বারান্দার দরজাটা বন্ধ করে আবার ঘরে ঢুকতে যাবেন, এই মুহূর্তে চিৎকারটা শুনলেন রেজা। নিচ থেকে নাসিমা বেগমের তীব্র চিৎকার ভেসে আসছে। সঙ্গে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল। সম্ভবত কাঁচের কিছু মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলেছেন তিনি। লতিফুর রহমান ভারি বিব্রত হলেন। তিনি কাঁচুমাচু মুখে বললেন, আমি একটু নিচ থেকে আসছি, আপনারা দেখুন। মাঝে মাঝে ও খুব বেশি অবুঝ হয়ে যায়। বুঝলেন?

রেজা মৃদু হাসলেন, সমস্যা নেই। আপনি আসুন, আমরা আছি।

লতিফুর রহমান এস্ত পায়ে বেরিয়ে গেলেন। রফিকুল ইসলাম বললেন, রেজা সাহেব, বাসাটা নেয়া যায়, কী বলেন?

তা যায়। শহরতো কাছেই। তা ছাড়া নিরিবিলি, খোলামেলা পরিবেশ। আলো হাওয়াও আছে বেশ।

কী মনে হয়, স্যার কি ভাড়া দেবেন?

না দিলে দেখালেন কেন?

তাও অবশ্য কথা। তা ছাড়া পুলিশ নিয়ে এলে না দিয়ে যাবেন কই? হা হা হা।

রেজাও হাসিতে যোগ দিলেন। রফিকুল ইসলাম খুব মনোযোগ দিয়েই দেখলেন ঘরগুলো। কোথায় কোনো আসবাব বসাবেন, জানালার পর্দার সাইজ কী হবে, সোফা, টিভি কোথায় বসবে, বাচ্চাদের ঘরের সাজ-সজ্জা কেমন হবে এইসব। মিনিট কুড়ি পরে তারা বের হলেন। রুমের বাইরে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে তারা কথা বলছিলেন। এই সময়ে লতিফুর রহমান ফিরে এলেন। তিনি আর ঘরের ভেতরে ঢুকলেন না। দরজা টেনে দিতে দিতে বললেন, কি, পছন্দ হলো?

রফিকুল ইসলাম বিনীত ভঙ্গিতে বললেন, জি স্যার। তবে ফাইনালি জানাচ্ছি দুয়েকদিনের মধ্যেই।

লতিফুর রহমান সম্মতির ভঙ্গিতে হাসলেন। তবে তাকে দেখে রেজার মনে হলো তিনি নাসিমা বেগমের অবস্থা নিয়ে চিন্তিত। নাসিমা বেগম আবারও উন্মত্ত হয়ে উঠেছেন। রেজা নিজ থেকেই জিজ্ঞেস করলেন, কী অবস্থা ওনার?

আবার পাগলামি শুরু হয়েছে। বিড়বিড় করে বললেন লতিফুর রহমান।

ছেলেটাকে দেশে আসতে বলুন। দেখবেন সব ঠিক হয়ে যাবে।

হ্যাঁ, এবার যে করেই হোক ব্যবস্থা করতেই হবে। কথা বলতে বলতেই চিন্তিত ভঙ্গিতে বন্ধ দরজায় তালা লাগালেন লতিফুর রহমান। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই রেজার আচমকা খেয়াল হলো, শরিফুল নেই! তিনি গলা চড়িয়ে বার কয়েক শরিফুলকে ডাকলেন, কিন্তু শরিফুল সাড়া দিল না। আশ্চর্য ব্যাপার, এই কিছুক্ষণ আগেও সে এখানেই ছিল, হঠাৎ গেল কই? এদিকে ওদিকে তাকিয়েও কোথাও দেখা গেল না শরিফুলকে! যেন ভোজবাজির মতো হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে সে!

.

তখন সন্ধ্যা নেমে আসছে। সন্ধ্যার সেই আলো-আঁধারিতে গা-টা কেমন ছমছম করে উঠল রেজার! চোখের সামনে থেকে শরিফুল গেল কই?

.

১৪.

শরিফুলকে খুঁজে পাওয়া গেল বাথরুমে। তাকে না পেয়ে তালা খুলে আবার ভেতরে ঢুকলেন রেজা। অন্ধকার ঘরে শরিফুলকে বার দুই ডাকতেই সে ভেতরের ঘরের বাথরুম থেকে সাড়া দিল। তারপর কিছুক্ষণের মধ্যেই হাসতে হাসতে বেরিয়ে এলো, হঠাৎ বড়টার চাপ লাগছিল স্যার। তাই বইসা পড়ছিলাম, আর সামলাইতে পারি নাই।

কিন্তু পানিতে নাই!

ভেতরে বালতি আছে, বালতিতে দেখলাম পানি আছে সামান্য।

লতিফুর রহমান বললেন, আপনারা আসবেন শুনে এনায়েতকে বলেছিলাম বাথরুমগুলা ভালো করে ধুয়ে রাখতে। ভাগ্য ভালো যে ওই জন্যই বালতিতে কিছু পানি পেলেন।

শরিফুল হাসল, দেখছেন স্যার, আমার ভাগ্য কত ভালো! একদম সময় মতো সুযোগ।

রেজাও হাসলেন, একদম।

সবাই নিচে নেমে এলেন। নাসিমা বেগমকে ততক্ষণে ঘুমের ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে ডালিয়া। বাড়ি ভাড়া নিয়ে লতিফুর রহমানের সঙ্গে কথাও হলো। তিনি কোনো ধরনের শর্ত দিলেন না। সরাসরি বললেন, এখানে রেজা সাহেব আছেন, তিনি যা বলেন সেটাই হবে।

রেজা বললেন, ঠিক আছে রফিক সাহেব, স্যারের যেহেতু সমস্যা নেই, আমরা দুজনে একটু আলাপ-আলোচনা করে নিয়ে স্যারকে জানাই, কী বলেন?

রফিকুল ইসলাম হেসে সম্মতি জানালেন। লতিফুর রহমানের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রেজা আর শরিফুল চলে গেলেন থানায়। মাঝরাত অবধি থানায়ই বসে রইলেন তারা। শরিফুল বার কয়েক তাড়া দিল রেজাকে। কিন্তু রেজা তাতে সাড়া দিলেন না। বরং স্থির বসে রইলেন। একটা কথাও বললেন না তিনি। যেন স্তব্ধ পাথরের মূর্তি। মগ্ন হয়ে আছেন কোথাও। রেজার ধ্যান ভাঙল গভীর রাতে। তিনি আচমকা শরিফুলের হাত ধরে বললেন, আচ্ছা শরিফুল, আজ যদি তুমি খুন হয়ে যেতে?

শরিফুল হতভম্ব গলায় বলল, কী বলেন স্যার? খুন হব ক্যান?

ধরো হয়ে গেলে?

কখন? কীভাবে?

লতিফুর রহমানের বাসার বাথরুমে।

মানে!

ধরো আমি আর রফিকুল ইসলাম মিলে তোমাকে বাথরুমে খুন করে রেখে এলাম, তারপর বের হয়ে গেলাম। প্রফেসর সাহেব এসে দরজায় তালা মেরে দিলেন। আমরাও চলে গেলাম।

শরিফুল বড় বড় চোখ করে বলল, স্যার, কী বলছেন এইসব?

রেজা আবারো কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ধরো তিন বা চারজন মানুষ বাসা ভাড়া দেখতে এসেছে। বেশিও হতে পারে। তাদের মধ্যে একজনকে বাকি সবাই প্ল্যান করে খুন করতে নিয়ে এসেছে। তারা খুব নরমালি বাসা দেখছে। এর মধ্যে একজন ঘরের বাইরে লতিফুর রহমানের সঙ্গে কথা বলছেন, বা তাকে নিয়ে নিচে চলে এলো। এই ফাঁকে বাকিরা সেই একজনের গলায় আচমকা ধারালো তার পেঁচিয়ে খুন করে ফেলল। সর্বোচ্চ পাঁচ মিনিটের ব্যাপার। তারা সবাই যেহেতু আগে থেকেই পরিচিত, ঘনিষ্ঠ, সেহেতু খুন হয়ে যাওয়া মানুষটা কিছু বোঝার আগেই ঘটনা ঘটে গেল। তারপর তারা তাকে বাথরুমে আটকে রেখে বের হয়ে লো। লতিফুর রহমান এসে দরজায় তালা দিয়ে দিলেন। তিনি প্রতিদিন অনেক মানুষকেই ঘর দেখান, সুতরাং তার অত ভালো করে খেয়াল করারও কথা না যে কে কে এসেছে, কে কে বের হচ্ছে। ঠিক না?

শরিফুল হতভম্ব চোখে তাকিয়ে আছে। রেজা বললেন, আজ যেমন তুমি বাথরুমে আটকা পড়েছিলে, প্রফেসর সাহেব কিন্তু খেয়ালই করেননি যে তুমি নেই। তিনি দরজায় তালা লাগিয়ে দিয়েছিলেন। তোমার কথা আমাদের জিজ্ঞেসও করেননি। তা ছাড়া বুড়ো মানুষ, অত কিছু খেয়াল করার কথাও না। তুমি আমি হলেও কিন্তু এতকিছু খেয়াল করতাম না। রোজ কত কত মানুষ আসে, অতো কী খেয়াল করা যায়?

শরিফুল ডানে-বায়ে মাথা নাড়ল, তা যায় না।

এমন জটিল একটা খুনের ঘটনার এত সহজ ব্যাখ্যা তার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু রেজার যুক্তির বিপরীতে কোনো যুক্তিও সে খুঁজে পাচ্ছে না। তারপরও সে বলল, কিন্তু কেউ খুন করলে এখানে এনে খুন করবে কেন?

কারণ, এর চেয়ে নিরাপদ আর কিছু হয় না।

শরিফুল জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। বিষয়টা যেন ধীরে ধীরে বুঝতে চেষ্টা করছে সে। রেজা বললেন, এখানে খুন করে রেখে গেলে পুলিশ সহজেই লতিফুর রহমানকে ধরে নিয়ে যাবে। এই নিয়ে পরে আর তেমন কোনো ইনভেস্টিগেশনও হবে না। আর লতিফুর রহমান যা-ই বলুন না কেন, সেটা কেউ বিশ্বাসই করবে না। আসল খুনিরা চিরদিনের জন্য রয়ে যাবে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।

শরিফুল এবার আর কোনো কথা খুঁজে পেল না। রেজাই বললেন, শোন, আরো একটা ব্যাপার আছে, দিনে হোক, রাতে হোক, বাইরে খুন করা সবসময়ই ঝুঁকিপূর্ণ, যে কেউ দেখে ফেলতে পারে। তারপর লাশ লুকানোরও ব্যাপার থাকে। এখানে খুন করলে সেসবের কোন ঝামেলাই আর রইলো না। জাস্ট কোনমতে খুনটা করে নির্বিঘ্নে সটকে পড়তে পারলেই হলো, আর কোন চিন্তা নেই।

জি স্যার। শরিফুলের চোখ বড় বড় হয়ে আছে।

রেজা বললেন, তাছাড়া ধরো, যারা খুন করেছে, তারা যেহেতু লিখনের ঘনিষ্ঠ কেউই ছিলো, সেহেতু চাইলে তারা লিখনকে নিজেদের ঘরেও খুন করতে পারতো। সেটিও সহজ ছিল। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, খুন করে লাশতো আর ঘরে রেখে দিতে পারতো না। লাশ লুকানোর ব্যবস্থা তাদের করতেই হতো। এবং আসল ঝুঁকিটা সেখানেই। কিন্তু এখানে এভাবে খুন করার ফলে সেই ঝুঁকি নেয়ারও আর দরকার পড়লো না। স্রেফ পাঁচ মিনিটের কাজ। তারপর নিশ্চিন্ত।

.

শরিফুল চুপ করে রইল। তখন প্রায় শেষ রাত। রেজা ঝট করে উঠে দাঁড়ালেন। শরিফুল বলল, কোথাও যাচ্ছেন স্যার?

হুম।

কোথায়?

প্রফেসর সাহেবের বাড়ি।

এই শেষ রাতে!

রেজা জবাব দিলেন না। তিনি ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেলেন। শরিফুল কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তার পিছু নিল।

.

শরিফুলের বাইকের হেডলাইটের আলোয় মেঘলা রাতের অন্ধকার কেটে যাচ্ছে। তবে আলোকিত অংশটুকুর বাইরে ঘোর অন্ধকার। যেন ওই অন্ধকারের ভেতর লুকিয়ে থাকা আরো গাঢ় এক ছায়াকেই শিকার করতে চান রেজা। শহর পেরিয়ে তারা বাইরে এলেন। মোবাশ্বেরের দোকান বন্ধ। নির্জন শহরে কেবল ওই হারাধন মুচির দোকানের একটানা ঠুকঠাক শব্দ। কেরোসিনের মৃদু একচিলতে আলো দেখা যাচ্ছে বেড়ার ফাঁক দিয়ে। চারদিকে আর কোথাও কেউ নেই, কিছু নেই। পুরো শহর ঘুমিয়ে জল।

.

লতিফুর রহমানের গেটের কাছে দাঁড়াতেই ভেতর থেকে এনায়েত শব্দ করে উঠল, কেডা ওইহানে? কেডা?

এনায়েতের গলা কাঁপছে। রেজা ভারি অবাক হলেন, এতরাতেও এনায়েত জেগে! তিনি গেটের গায়ে হাতের উল্টোপিঠে শব্দ করে বললেন, আমি রেজা, গেট খোল এনায়েত।

এনায়েত গেট খুলে দিল। তার চোখে ভয়ার্ত দৃষ্টি। রেজা বললেন, এতরাতেও তুই জেগে?

এনায়েত কাঁপা কণ্ঠে বলল, এই বাড়িতে আমি আর থাকব না।

রেজা কৌতূহলী গলায় বললেন, কেন? কী হয়েছে?

এনায়েত উত্তর দিকের দেয়ালের দিকে ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে বলল, এই বাড়িতে জিন-ভূত আছে।

জিন-ভূত আছে মানে?

প্রায় রাইতেই বাইরে শব্দ শোনা যায়। বাড়ির ভেতরেও।

কীসের শব্দ?

তাতো জানি না। তয় মানুষের মতনই। একদিন আমি দেখছিও কিছু, আগুনের গোলার মতো, বাইরে থেকে গেটের মইধ্যে লাফ দিয়া পড়ল। তারপর উধাও।

তুই কাউকে ডাকিস নাই?

কারে ডাকব? তারা থাকে ওপর তলায়, কলাপসিবল গেটে থাকে তালা মারা। চাবিওতো থাকে ছারের কাছে। আমি ডাকলে শুনব?

দিনের বেলা বলিস নাই?

একদিন বলছিলাম, কিন্তু সবাই তখন আমারে লইয়া হাসাহাসি করে, আমি নাকি জিন-ভূত দেখছি।

পেছন থেকে শরিফুল হেসে ফেলল, রাইতের বেলা আগুনের গোলা ওড়াউড়ি করতে দেখলেতো জিন-ভূত হবার কথা! জিন-ভূতের গল্প দিনের বেলা করলে হবে? রাইতের গল্প বলতে হয় রাইতের অন্ধকারেই, বুঝলি?

রেজা বললেন, আজও কিছু দেখেছিস?

না, তয় কী সব শব্দ-টব্দ শুনছি।

রেজা শরিফুলের দিকে ফিরে বললেন, আজগর লোকটাকে না এই বাড়ির পেছনে নদীতে দেখেছিলে?

জি ছার, একদিন রাইতে।

ওর দিকে আরো ভালো করে খেয়াল রাখো। ওরা কোনো একটা বড় মতলবে আছে। খুব সাবধান।

রেজা বাড়ি ঢুকতে গিয়েও কী মনে করে ঢুকলেন না। বাড়ির চারপাশটা একবার চক্কর মারলেন। বৃষ্টি-কাদার দিন বলে মাটিতে নানারকম পায়ের ছাপ। ছাপগুলোও তীক্ষ্ণ চোখে দেখলেন তিনি। এক জায়গায় সাদা সীমানাপ্রাচীরের গায়ে কিছু একটা দেখে খানিক থমকে দাঁড়ালেন রেজা। তবে তেমন গুরুত্ব দিলেন বলে মনে হলো না। পুরো বাড়ি ঘুরে আসতে আসতে ফজরের আজান হয়ে গেল। রেজা এনায়েতকে বললেন লতিফুর রহমানকে খবর দিতে। এই কাকভোরে রেজাকে দেখে লতিফুর রহমান ভারি অবাক হলেন। বললেন, আবার কোনো দুর্ঘটনা রেজা সাহেব?

রেজা হাসলেন, না না স্যার। তবে কিছু জরুরি প্রশ্ন ছিল, ভাবলাম জিজ্ঞেস করেই যাই, না হলে মনের ভেতর আবার খচখচ করবে।

বুঝতে পেরেছি, জরুরি কিছুই হবে। না হলে এত ভোরে এভাবে চলে আসতেন না।

বাড়ির সামনে সিমেন্টের বাঁধাই করা বেঞ্চিতেই বসলেন তারা। রেজা বললেন, গ্রামে যাওয়ার আগের শেষ তিন-চার দিনে আনুমানিক কত জন লোক বাসা ভাড়ার জন্য এসেছিল স্যার?

তাতো মনে নেই রেজা সাহেব।

একজ্যাক্ট বলতে হবে না, আনুমানিক বললেই হবে।

লতিফুর রহমান খানিক্ষণ চুপ থেকে বললেন, পনেরো কুড়িজনতো হবেই।

পনেরো কুড়িজন? নাকি পনেরো কুড়ি বার?

বুঝিনি?

মানে ধরেন আমি বাড়ি ভাড়া নিতে এলাম, আমার সঙ্গে শরিফুলও এলো। আবার কেউ কেউ একাও আসতে পারে, কেউ কেউ তিন চারজন মিলেও আসতে পারে।

সেভাবেতো খেয়াল করিনি, তবে একা সাধারণত কেউ আসে না। আসলে দু তিনজন মিলেই আসে।

সবাই ই?

বেশির ভাগই। একা কেউ এসেছে বলে সেভাবে মনে পড়ে না। শুধু ব্যাংকার সাহেবই সম্ভবত একা এসেছিলেন। আর, হ্যাঁ, দুয়েকজনও আরো হতে পারে, তার বেশি না। কেন বলুনতো?

রেজা জবাব দিলেন না। খানিকটা যেন দমেই গেলেন তিনি। একাধিকজন একসঙ্গে এসেছে এমন ঘটনা অল্প হলে চিহ্নিত করা সহজ হতো। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, লতিফুর রহমান বলছেন বেশির ভাগই একাধিকজন মিলে এসেছেন। রেজা খানিক চুপ থেকে আবার বললেন, আচ্ছা, সবচেয়ে বেশি কয়জন এসেছে একসঙ্গে, সেটা মনে আছে?

লতিফুর রহমানকে এবার বেশ অপ্রস্তুত দেখাচ্ছে, যেন রেজা সাহেবের প্রশ্নের ঠিকঠাক জবাব দিতে না পেরে তিনি উদ্বিগ্ন। সামান্য চুপ করে থেকে তিনি ইতস্তত ভঙ্গিতে বললেন, আসলে ওভাবেতো খেয়াল করা হয় নি রেজা সাহেব, ভাড়াটে বাড়ি দেখতে এলে কজন এলো সেটাতো মাথায় থাকে না।

হুম। আচ্ছা, এমন কী হয়েছিল যে কোনো ভাড়াটেকে ঘর দেখতে দিয়ে আপনি দীর্ঘ সময়ের জন্য নিচে চলে গিয়েছিলেন? ফিরে আর ঘরে ঢোকেননি, বাইরে থেকে তালা মেরে চলে গিয়েছিলেন?

এবার রীতিমতো ভেঙেই পড়লেন লতিফুর রহমান। তিনি ভাঙা গলায়ই বললেন, এমন হয়েছিল হয়তো, সেদিন আপনাদের সঙ্গেওতো হলো। আগেও মাঝেমধ্যে হয়ে থাকতে পারে। একা মানুষ, যখন তখন যেকোনো প্রয়োজনতো হতোই। আর তখনতো এনায়েতও ছিল না। তা ছাড়া আপনার ভাবি যখন তখন ক্ষেপে যায়, বুঝলেন?

রেজা যতটা আশা নিয়ে গিয়েছিলেন তার চেয়ে বেশি হতাশা ও বিরক্তি নিয়ে ফিরে এলেন। লতিফুর রহমানের প্রতি তার রীতিমতো রাগই লাগছে। তিনি মোটামুটি দু-চার জনের একটা বর্ণনা দিতে পারলেই অন্তত তাদের খুঁজে বের করে জিজ্ঞাসাবাদ করা যেত। রেজা নিশ্চিত, খুনটা বাসা ভাড়ার নাম করে এসেই হয়েছে। এর বাইরে আর কোনো সম্ভবনা নেই। কিন্তু যারা এসেছিল, তাদের প্রায় কাউকেই সেভাবে চেনেনই না বা মনেই করতে পারলেন না লতিফুর রহমান। কিছু বলতেও পারলেন না সুনির্দিষ্ট করে।

.

১৫.

আজগর, নুরু মিয়া এবং সবুর দাঁড়িয়ে আছে গোলাম মাওলার সামনে। গোলাম মাওলা গম্ভীর মুখে বসে আছেন। তার হাতে একটা চিঠি। তিনি সেই চিঠিখানা নুরু মিয়ার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, দেখো, নির্বাচনের আগে দলের মূল্যায়ন দেখো। আমারতো দুয়ার ধারে আইসা আছাড় খাওয়ার দশা। সবকিছু নিজের পক্ষে আনলাম এত বছর, এত কষ্ট কইরা, আর এখন, এই এক খুন সবকিছু বানের পানির মতো ভাসাই দিতেছে। বাতাসতো এহন চুন্নু মিয়ার দিকে, অ্যাঁ?

তিনি সামান্য দম নিয়ে আবার সঙ্গে সঙ্গেই বললেন, এই যদি হয় অবস্থা, পাবলিক তার দিকে ঝুলে গেছে, দলও এখন ধীরে ধীরে খুনের বিষয়ে আকারে ইঙ্গিতে আমার দিকেই আঙুল তুলতেছে। আর তোমরা? তোমরা বইসা বইসা আঙুল চুষতেছো?

নুরু মিয়া বলল, আমরাতো চেষ্টার ত্রুটি করতেছিনা মাওলা। কিন্তু পুলিশ টহল বাড়ছে, এহনতো চাইলেই আগের মতো দুম কইরা কিছু একটা কইরা ফালান যায় না। যায়? তহন হাতেনাতে ধরা পড়লে কিন্তু সবই যাবে। লিখনের খুন থেইকা শুরু কইরা কোনো অপরাধই আর তহন এড়াইতে পারবা না? সব অপরাধের দায় আমাদেরই নিতে হইব। যা করছি, তাও। যা করি নাই, তাও।

কিন্তু তাই বইলা এইভাবে হাত গুটাইয়া আর কতদিন বইসা থাকবা? চোর পালাই গেলে বুদ্ধি বাড়লে কিন্তু লাভ নাই।

এই প্রথম কথা বলল আজগর। সে বলল, ছার, আপনে আর কয়টা দিন মাত্র সময় দেন আমারে। আমি আজগর যদি কাজটা করতে না পারি, তাইলে আমি এক বাপের পোলা না।

তুমি চুপ থাকো! বেয়াদবের মতো কথা বলবে না। গোলাম মাওলা রীতিমতো খেঁকিয়ে উঠলেন, টাকা-পয়সা দিয়া আমি কতগুলা গরু-ছাগল পুষতেছি। আমি এত কিছু বুঝি না, পুলিশ থাকুক আর আর্মি থাকুক, ঘটনা আমি ঘটতে দেখতে চাই। তোমরা না পারলে বলো, আমি নিজে যাব।

নুরু মিয়া বলল, আর কয়টা মাত্র দিন সময় দাও মাওলা। কথা যহন দিছি, কাজও করব। কোনো অন্যথা হইব না।

সেইটা এতদিনেই বুঝছি আমি। আর চুন্নু মিয়ার খবর কিছু জানো?

সে তো শুনছি ঢাকা যাইতেছে।

ঢাকা যাইতেছে? এই মুহূর্তে? ক্যান?

নুরু মিয়া খানিক চুপ করে থেকে বলল, আছিয়ারে দিয়া নাকি ঢাকা প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করাইবো, এইখানে তোমার বিরুদ্ধে নারী নির্যাতনের মামলার কিছু হইতেছে না বইলা।

গোলাম মাওলার রাগ যেন মুহূর্তেই দুশ্চিন্তায় পরিণত হলো। তিনি চিন্তিত মুখে বললেন, এই খবর কে দিল?

কথাতো আর চাপা থাহে না, বাতাসে ভাসে।

কবে যাবে কিছু জানো?

না, তয় বন্যার পানি কমার আগে মনে হয় না যাইত পারব। এই অবস্থায় এলাকা ছাইড়া গেলে লোকজন তার ওপর নাখোশ হইব, বুঝতেছ না? সেতো এইবার এই বন্যার কারণেও লোকজনের কাছে খুব জনদরদি হিসেবে নিজেরে প্রমাণ করতেছে।

গোলাম মাওলা হিসহিস করে বললেন, বাইরে থেকে দেখে এরে মনে হয়, কিচ্ছু বোঝে না, কিন্তু ভেতরে ভেতরে সে তো একটা কালসাপ। ছোবল সে দেবেই। যা করার তার আগেই করতে হইব।

.

রেজা এসেছেন ব্যাংকার রফিকুল ইসলামের কাছে। রুমে ঢুকতেই তিনি সহাস্যে স্বাগত জানালেন, আসুন আসুন রেজা সাহেব। কেমন আছেন?

হ্যাঁ ভালো। আপনারতো দেখি মন খুব ভালো।

তা একটু ভালো বৈকি! মানুষ নতুন জামাকাপড় পরলে মন ভালো থাকে, আর আমার মন ভালো থাকে নতুন জুতা পরলে।

রেজা তাকিয়ে দেখলেন রফিকুল ইসলামের পায়ে নতুন জুতা, হারাধন দিয়ে গেল?

হ্যাঁ, এইতো তিন-চার দিন হলো। খুবই সুন্দর জুতো, এত আরামদায়ক হবে আগে বুঝিনি। হি ইজ আ ম্যাজিশিয়ান। রফিকুল ইসলাম জুতোটা উল্টেপাল্টে দেখালেন।

রেজা বললেন, সবাই তাই বলে। তা আর কী খবর? বাসা ভাড়ার ব্যাপারে কী সিদ্ধান্ত হলো?

বন্যার পানিটা একটু কমলেই ফ্যামিলি নিয়ে আসব ভাবছি।

.

রফিকুল ইসলামের সঙ্গে অনেকক্ষণ ধরেই নানা কথাবার্তা বললেন রেজা। ব্যাংক থেকে বের হতে হতে রাত হয়ে গেল অনেক। বৃহস্পতিবার বলেই সবারই একটু দ্রুত বাড়ি ফেরার তাড়া, ফলে রফিকুল ইসলাম ছাড়া বেশির ভাগ কর্মকর্তাই ততক্ষণে চলে গেছেন। দারোয়ান, পিয়নসহ দুয়েকজন কর্মচারী মাত্র আছে। এর ফাঁকে মোবাশ্বের বার কয়েক চা, শিঙাড়া দিয়ে গেল। সে এখন ব্যাংকের নিজস্ব লোক হয়ে গেছে। যেখানে-সেখানে যখন তখন অবলীলায় ঢুকে যেতে পারে। কোনো অনুমতিও লাগে না তার। রফিকুল ইসলামের সঙ্গে বাইরে কিছুক্ষণ হাঁটলেনও রেজা। তারপর আবার ব্যাংকের কাছে ফিরে এলেন তারা। আজকের রাতটা যেন খানিক বেশিই নির্জন। তবে শ্রমিকরা হয়তো আশেপাশেই কোথাও কাজ করছে। তাদের মাটি খোঁড়ার শব্দ, কম্পন অনুভূত হচ্ছে। দিনরাত হাড়ভাঙা খাটুনিতে শহরটা গড়ে তুলছে তারা। এই মুহূর্তে আজগরকে দেখলেন রেজা। দু তিন জন লোক সঙ্গে নিয়ে মোবাশ্বেরের চায়ের দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে সে। তার হাতে সিগারেট। আচার আচরণে নেতাসুলভ ব্যাপার না থাকলেও একটা স্পষ্ট ঔদ্ধত্য রয়েছে। রেজা আচমকা আজগরকে ডাকলেন, নাম কী?

আজগর, ছার।

এইখানে কাজ কী?

এই লেবারগুলান সব আমার, ছার।

তুমিই সর্দার?

না ছার, সর্দার আমার বড় ভাই।

সে আসবে না?

ছোট কামে সে আসে না। সে আসে বড় কামে।

কী নাম তার?

আলাউদ্দিন হাজি। তিনবার হজ করেছেন।

তুমি করো নাই?

করব ছার, ইচ্ছা আছে।

সব ঠিকঠাকতো? লেবারদের টাকা-পয়সা ঠিক মতো দাওতো?

ঈমানে ছার। ঈমান ঠিক না থাকলে সব ভুল। সবার আগে লেবার। এদের গায়ের ঘাম শুকানোর আগে মজুরি দিতে ভাইজানের কঠিন নির্দেশ।

আচ্ছা, যাও।

.

সেই রাতে আবারো অণুকে ফোন দিলেন রেজা। অণু ফোন ধরেই বলল, আপনি কি কোনো কারণে অস্থির হয়ে আছেন হক সাহেব?

নাহ, অস্থির হবো কেন?

এত অল্প বিরতিতেতো কখনো ফোন দেন না, এইজন্য বললাম।

অল্প বিরতিতে ফোন দেয়া যাবে না? ফোন রেখে দেবো?

আপনি রেগে যাচ্ছেন কেন? অবশ্যই ফোন দেয়া যাবে। আপনি চাইলে প্রতিদিন ফোন দিতে পারেন, আমি কিছু মনে করব না।

তোমার ধারণা, আমার তোমাকে প্রতিদিন ফোন দিতে ইচ্ছে করে?

অণু ফিক করে হেসে দিল, জি হক সাহেব, আমার ধারণা আপনার আমাকে প্রতিদিন ফোন দিতে ইচ্ছে করে।

প্রতিদিন ফোন দিতে ইচ্ছে করলে দেই না কেন?

দেন না কারণ তাহলে আপনার গাম্ভীর্য টিকে থাকবে না। আপনি আমার সঙ্গে আপনার ভাব গম্ভীর আচরণ ধরে রাখতে চান।

মানুষ গুরুত্বপূর্ণ মানুষের সঙ্গে ভাব গম্ভীর আচরণ করে। তোমার সঙ্গে আমি কেন ভাব গম্ভীর আচরণ করব? তোমার কী নিজেকে খুব গুরুত্বপূর্ণ কেউ মনে হয়?

অন্যদের কাছে মনে হয় না। দেখেন না, গায়ের রঙের জন্য আমার বিয়ে পর্যন্ত হচ্ছে না। আমি অন্যদের কাছে এতটাই অগুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমার ধারণা আপনার কাছে আমি মহাগুরুত্বপূর্ণ।

তোমার ধারণা ভুল। আমি তোমাকে ফোন দিয়েছি মায়ের খবর নেয়ার জন্য, তোমার জন্য না।

খালাম্মা ভালো আছেন। এখন কি ফোন রেখে দেব হক সাহেব?

অবশ্যই ফোন রেখে দেবে।

আচ্ছা।

অণু আচ্ছা বললেও ফোন রাখল না। রেজাও না, তারা দুজনই ফোন কানে চেপে ধরে বসে রইল।

.

রেজা ফোন রাখলেন দীর্ঘসময় পর। এই সময়টাতে তারা দুজনের কেউই কোনো কথা বললেন না। ফোন রেখে রেজার মনে হলো তিনি নিজেকে যতটা বুদ্ধিমান মানুষ ভাবেন, তিনি আসলে মোটেই ততটা বুদ্ধিমান না। বরং বোকা। তিনি যে বোকা এই বিষয়টা তার আশপাশের মানুষ না জানলেও দুজনমাত্র মানুষ সেটি খুব ভালোভাবে জানে। একজন তার মা রেহানা আখতার, আরেকজন অণু। অণু কি আসলেই তার জীবনে খুব গুরুত্বপূর্ণ কেউ? কিন্তু তিনি সচেতনভাবে অণুকে কখনো গুরুত্ব দিতে চাননি। অণু অবশ্য আজ ফোন রাখার আগে একটা কথা বলেছে, জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষগুলোকেই আমরা বেশির ভাগ সময় চিনতে পারি না। তাদের গুরুত্ব বুঝতে পারি না, ফলে সেই মানুষগুলোই রয়ে যায় আড়ালে, আবডালে। ঠিক সময়ে সেই ঠিক মানুষগুলোকে চিনতে পারলে, তাদের গুরুত্ব বুঝতে পারলে জীবন খুব সহজ হয়ে যেতে পারত। জীবনের অনেক বড় বড় সমস্যার খুব দ্রুত সহজ সমাধান হয়ে যেত।

কথাটা মাথা থেকে তাড়াতে পারলেন না রেজা। দুপুরে ভাত খেতেই শরীরজুড়ে একটু আলস্য ভর করল যেন। তিনি বিছানায় খানিক শরীর এলিয়ে দিলেন। একটু ঝিমুনির মতোও এলো তার। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই রেজার মনে হলো এই ঘটনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষটাকেই কোনো গুরুত্ব দেননি তিনি। সবচেয়ে বেশি গুরুত্বহীন ভেবেছেন। অথচ এই গুরুত্বহীন, আপাতদৃষ্টিতে অগুরুত্বপূর্ণ মানুষটিই হয়ে উঠতে পারে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *