৫-৬. তারপর

. তারপর

ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন ফিরে এলেন সাজসরঞ্জাম নিয়ে। এসেই তার মাথাটা ঘুরে গেল। এ কী হয়েছে! ডক্টর নীল ঘাড় খুঁজে পড়ে আছেন। গলার উপর কালো পাঁচটা আঙুলের দাগ–আর সেই দৈত্যটা নেই। খোলা জানলাটা যেন তার বোকামির জন্য বিদ্রূপ করছে। এত করেও শেষপর্যন্ত এত ভুল! একটি ভুলের জন্য ডক্টর নীলের মৃত্যু হয়েছে, না জানি আরো কত বড় মাশুল দিতে হবে।

সমস্ত শরীর তাঁর ঝিমঝিম করে উঠল। উহ্ কী ভুলই তিনি করেছেন দৈত্যটাকে ভালো করে না-বেঁধে রেখে। মুক্ত হয়ে এখন দৈত্যটা যে কী না করবে বুঝে উঠতে পারলেন না তিনি।

এই ল্যাবরেটরিতে এখন তিনি নিঃসহায়, একা। একা তিনি আর কী করতে পারেন? যদি দৈত্যটা আসে তাঁকেও হত্যা করতে, একা তিনি কী করে আত্মরক্ষা করবেন?

একবার মনে হল, হয়তো আর সে ফিরবে না। উত্তুঙ্গ পর্বতশিখরে, দেবদারু, পাইন, চেরি, পিচের বনে, বড় বড় বাড়ির ছাদে, কুয়াশার ভিড়ের মধ্যে হয়তো সে নিজেকে হারিয়ে ফেলবে। তারপর যখন আলো ফুটবে, যখন পথে লোকজন চলাফেরা করবে, তখন ওই অপমূর্তিকে দেখে সকলে প্রাণের ভয়ে ছুটোছুটি করবে, সমস্ত দেশে একটা হৈ-চৈ শুরু হবে। আর পিশাচটা নরহত্যা করে সুন্দর পৃথিবীর বুক রক্তে রাঙা করে দেবে।

ভয়ে আর চিন্তায় তিনি দিশেহারা হয়ে গেলেন। তাড়াতাড়ি উঠে মৃত ডক্টর নীল এবং বেয়ারাকে তারই বাগানে কবরস্থ করলেন। তারপর সমস্ত দরজা-জানলা বন্ধ করে তিনি বসে রইলেন।

বাইরে বেরোতে সাহস হচ্ছে না, কী জানি কোথায় সেই দানবমূর্তি লুকিয়ে আছে। খাওয়ার কথা মনে এল না। একটা ইজিচেয়ারে শুয়ে তিনি ভাবতে লাগলেন তাঁর গবেষণার ব্যর্থতার কথা, সমস্ত জীবনের সাধনার ধূলিসাৎ হওয়ার কথা। মৃত্যুকে তিনি প্রাণে সঞ্জীবিত করেছেন সত্য, কিন্তু এ কী নিদারুণ পরাজয়! অতিমানবের পরিবর্তে এ কী এক রক্তপিশাচের সৃষ্টি। তারই অদূরদর্শিতার জন্য দুই নিরীহ লোকের রক্তপাতে পৃথিবী এখনই কলুষিত হয়ে উঠেছে। মনের মধ্যে এক গ্লানি ধূমায়িত হয়ে উঠছে–ডক্টর নীল আর সেই বেয়ারার মৃত্যুর জন্য তিনিই কি দায়ী নন? হত্যাকারী কি শুধু সেই পিশাচটি? না–না–তিনি–তিনিই প্রকৃত হত্যাকারী!

দুপুর, বিকেল, রাত—একইভাবে কেটে গেল উদ্বিগ্ন চিন্তায়। ভোর হল, টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে, সারা আকাশ মেঘে ছেয়ে রয়েছে। ঘরের দরজা খুলতে তার সাহস হল না। কে জানে যদি সেই দানবটা আবার আত্মপ্রকাশ করে।

এক অনিশ্চিত আশঙ্কায়, এক দুঃসহ অসহায়তায়, এক অস্থির উদ্বিগ্নতায় ল্যাবরেটরির সমস্ত দরজা-জানলা বন্ধ করে ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দিন কাটে। নিঃসঙ্গ সময় বিরাট পাথরের মতো চেপে বসে থাকে–নড়ে না। এক অনিশ্চিত সংশয় বাজপাখির মতো পাখা মেলে সমস্ত আকাশ কালো করে রয়েছে, তার ক্রুর শ্যেনদৃষ্টি তার ওপর নিবদ্ধ। একটু সুযোগ পেলেই সে যেন ঝাঁপিয়ে পড়বে তাঁর ওপর।

দিনের সূর্য পশ্চিমে যাওয়ার সময় দীর্ঘ ছায়া ফেলে। ছায়া দীর্ঘতর হয়। তারপর হঠাৎ সমস্ত পৃথিবী জুড়ে ছায়া, সমস্ত আকাশে অন্ধকার। তার মাঝে এই ল্যাবরেটরি এক দৈত্যপুরী, রূপকথার চিরন্তন রাজপুত্রের মতো ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন নিষ্ঠুর করাল দৈত্যের পদধ্বনি শুনে যান। অন্ধকার রাত্রি যেন কাটে না। চারদিকে বিভীষিকার ছোটাছুটি, চারদিকে ভয়…ভয়…। সেই অন্ধকার ভেদ করে কখন বেরিয়ে আসবে হিংস্র কদাকার রক্তলোলুপ্ত পৈশাচিক এক মুখ, নিঃশব্দ অন্ধকার ভেঙে সাদা দাঁত বের করে খটখট করে বলবে–আমি এসেছি; রক্ত চাই আমি। হে আমার স্রষ্টা, আমার বজ্রকঠিন হাতে একবার ধরা দাও।

.

এইভাবে একের পর এক সুদীর্ঘ দিন, সুদীর্ঘতর রাত কেটে যায়। একই উৎকণ্ঠায়, একই আতঙ্কে ডক্টর ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের নিঃসঙ্গ দিন কেটে যায়। মনে হয়, দূরে কোথাও এক অশরীরী ছায়া ঘুরে বেড়াচ্ছে, কিন্তু সেই দৈত্যকে তিনি স্বচক্ষে দেখেননি। মাঝে মাঝে বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে, এই তুষার-ঝরা কঠিন শীতের রাতে আশ্রয়হীন, বন্ধুহীন সেই দানবটি হয়তো ঠাণ্ডায় জমে বিনষ্ট হয়েছে। একটু আশার আলোয় মুখ উদ্ভাসিত হওয়ার পরমুহূর্তেই সংশয়ের কালো ছায়া এসে তাকে ঘিরে ফেলে। একা নির্বান্ধব এই সংশয়ে দিনের পর দিন থাকায় তাঁর আত্মবিশ্বাস শিথিল হয়ে পড়েছিল।

সেদিন সকাল থেকে ঝড়! আকাশ থেকে অবিশ্রান্ত তুষার ঝরে পড়ছে। এমন সময় মনে হল–কে যেন দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে। ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন চমকে উঠলেন। তবে কী–তবে কী–?

সমস্ত শরীরের রক্ত জমাট হয়ে উঠল যেন!

আবার…আবার দরজায় ধাক্কা! মনে হল একবার চিৎকার করে ওঠেন : কিন্তু এই জনমানবহীন বিজন প্রদেশে কে তার চিৎকারে সাড়া দেবে?

–ভিক্টর! ভিক্টর!!

কার যেন নিচ থেকে গলা শোনা যায়! ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন উৎকর্ণ হয়ে উঠলেন। এ যে–

–ভিক্টর! ভিক্টর!!

হ্যাঁ–এ যে রেভালের কণ্ঠস্বর! ক্লেরভাল–তার চিরসুহৃদ এসেছে। আড়ষ্ট শরীর একমুহূর্তে যেন সচল হয়ে উঠল। ছুটে গিয়ে তিনি সদর দরজা খুললেন।

ক্লেরভাল ঘরে ঢুকেই চমকে উঠলেন; বললেন–এ কী হয়েছে বন্ধু তোমার? চেহারা কেমন করে এমন বিশ্রী হল?

গলা, হাত এবং পা কাঁপছিল ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের। মনে হল যেন একটুও দ্বিধা না করে এই মুহূর্তে সব কথা প্রথম থেকে শেষপর্যন্ত তিনি তাকে বলে এই ভারাক্রান্ত হৃদয়কে একটু হালকা করে ফেলেন, কিন্তু শেষপর্যন্ত সাহস হল না। শুধু অস্কুটস্বরে বললেন–কাজের চাপে শরীরের ওপর অত্যাচার হয়েছে যথেষ্ট। তাই–।

বন্ধুকে বসবার ঘরে নিয়ে যেতে সাহস হচ্ছে না। যদি সেই বিকট মূর্তির সঙ্গে আবার দেখা হয়। তার যে শাস্তি হবার তা তো হয়েছেই, মিছিমিছি কেন বন্ধুর সুখ-শান্তি হরণ করবেন? ক্লেরভালকে সেখানে বসিয়ে রেখে সিঁড়ি দিয়ে ভয়ে ভয়ে তিনি উপরে উঠে গেলেন। কান পেতে যেন কিছু শুনতে চাইলেন। কিন্তু না, সেখানে কোনো শব্দ নেই। বসবার ঘরের খোলা দরজা দিয়ে ভিতরটায় একবার উঁকি মারলেন। না, সে নেই। সে নেই-ইচ্ছা হল, মনের আনন্দে একবার প্রাণ খুলে হাসেন, কিন্তু পারলেন না। চোখের কোণে শুধু অশ্রু জমে উঠল। সে কি আনন্দে, না বেদনায় তার সৃষ্ট প্রথম অতিমানবের বিভীষিকাময় উপস্থিতির অভাবের স্বস্তিতে, না তাকে চিরদিনের জন্য হারিয়ে ফেলার ব্যথায়?

ক্লেরভালকে নিয়ে বসবার ঘরে এলেন তিনি। মনের উদ্বেগকে চাপবার জন্য অফুরন্ত কথা বলে যেতে লাগলেন, কিন্তু সবই যেন অবান্তর এবং সবই যেন অসঙ্গত প্রলাপ বলে নিজেই বুঝতে পারছিলেন। তবু এতদিন পর একটু কথা বলার সুযোগ পেয়ে তিনি আর থামতে পারছেন না।

ক্লেরভাল প্রশ্ন করলেন–তোমার কী হয়েছে? চোখমুখের অবস্থা এমন হয়েছে কেন? তুমি অত কথা বলছ কেন?

কিছুই না, এমনি হয়তো ম্লানমুখে জবাব দেন তিনি।

একসময় ক্লেরভাল জিজ্ঞাসা করলেন–তোমার রিসার্চের কতদূর? আর ডক্টর নীল-ই বা গেলেন কোথায়!

মুহূর্তের মধ্যে তার মুখের সমস্ত রক্ত অন্তর্হিত হয়ে গেল। মনে হল যেন সেই বিরাটকায় দৈত্য তার সামনে দুহাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে বলছে–হে প্রভু আমার,

এবার তোমার পালা। তুমি এসো! তুমি এসো!!

ভয়ে তিনি চিৎকার করে উঠলেন–আমাকে বাঁচাও, আমাকে বাঁচাও। হেনরি, আমি আর সহ্য করতে পারছি না!

জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে গেলেন তিনি।

ক্লেরভালের শুশ্রূষায় একবার বোধহয় তাঁর জ্ঞান হয়েছিল–একটু একটু যেন মনে পড়ে। ক্লান্তি ও শান্তিতে চোখের পাতা ঘুমে জড়িয়ে এসেছিল। অনেকক্ষণ পরে তিনি ঘুম থেকে উঠলেন, কিন্তু বড় দুর্বল বোধ করতে লাগলেন।

আচ্ছন্ন অচেতনতায় এরপর কেটে গেল কয়েকটি সংজ্ঞাহীন দিন–এক নিঃসীম তুষার-মরুর ভেতর দিয়ে তিনি যেন চলেছেন রাত্রিদিন নিঃসঙ্গ, একাকী। কোনোদিন আর বোধহয় সেই মরুভূমি পার হয়ে সবুজ মাটির সন্ধান তিনি পাবেন না; পাবেন না তিনি আর কোনো পরিচিত মুখের দেখা। নির্জন নিম্পাদপ তুষারের মধ্যে তার নিষ্প্রাণ দেহ পড়ে থাকবে, সূর্যের ক্লান্ত রোদে তাঁর অস্থি এতটুকু উষ্ণতা বোধ করবে না।

দিনরাত রেল পড়ে রইলেন তার বন্ধুর পাশে। বন্ধুর অবিচ্ছিন্ন বিজ্ঞান-সাধনাকে তিনি কোনোদিনই স্বাগত জানাতে পারেননি। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর ঘরবাড়ি ছেড়ে, আত্মীয়-স্বজন বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে দূরে এক বিজন প্রদেশে ল্যাবরেটরির মধ্যে একা একা কাজে ডুবে থাকার ফল যে শেষপর্যন্ত ভালো হতে পারে না–তা তিনি জানতেন। তবু মাঝে মাঝে তিনি এখানে এসেছেন, বন্ধুর সঙ্গে দেখা করেছেন, তর্ক করেছেন, বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য জেদ করেছেন–শেষপর্যন্ত ফিরিয়ে নিয়ে যেতে না-পেরে রাগ করে চলেও গেছেন। ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের মা’র মৃত্যুর পর সংবাদ পেয়েও যখন দেখলেন যে তিনি বাড়িতে এলেন না, তখন ক্লেরভালের রাগের আর সীমা ছিল না। কিন্তু বন্ধুর পরিবারের সকলের বেদনাকর পরিস্থিতি আর করুণ অসহায়তার কথা মনে করে তাদের ঠিকমতো কোনো ব্যবস্থা না করে বন্ধুর সঙ্গে এর শেষ মীমাংসা করার কথা ভাবতে পারেননি। প্রথমেই যখন সময় পেলেন তখনই তিনি বন্ধুর কাছে ছুটে এলেন; কিন্তু তার চিরদিনের ভয় ততদিনে ফলিষ্ণু হয়েছে। ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের অস্থিরচিত্ততা ও অসংলগ্নতা দেখে তার ধ্রুব বিশ্বাস হল যে অত্যধিক বৈজ্ঞানিক গবেষণায় তার মস্তিষ্কবিকৃতি ঘটেছে। বন্ধুর এই শোচনীয় পরিণতিতে তার মন সহানুভূতিতে ভরে উঠল, চোখদুটি সজল হয়ে উঠল। মনে মনে স্থির করলেন, একটু সুস্থ হলেই তাকে তিনি ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন।

ক্লেরতালের সেবা-শুশ্রষা ও পরিচর্যায় বেশ কয়েক দিন পরে ফ্রাঙ্কেনস্টাইন সুস্থ হয়ে উঠলেন। ক্লেরভাল বন্ধুর সঙ্গে অত্যধিক বৈজ্ঞানিক গবেষণার কুফল নিয়ে তর্ক করার চেষ্টা করামাত্রই ফ্রাঙ্কেনস্টাইন বলে উঠলেন–তোমার সঙ্গে তর্ক করব না। বৈজ্ঞানিক গবেষণা করা ভালো, না মন্দ–সে সম্বন্ধেও একটা কথা বলব না। তবে আজ আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি যে আর আমি গবেষণা করব না। আমি পরাজিত। প্রকৃতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলাম, জয়ের নেশায় আমি কোনোদিকে ভুক্ষেপ করিনি; কিন্তু শেষপর্যন্ত আমি সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব, পরাজিত ও বিধ্বস্ত। এতখানি আত্মগ্লানি নিয়ে আর গবেষণা করা সম্ভব নয়। তোমাকে কথা দিচ্ছি বন্ধু–এই শেষ। তুমি চলে যাও, আর কয়েকদিন পরে এই ল্যাবরেটরির একটা ব্যবস্থা করে আমিও দেশে ফিরে যাব। জেনেভাতে ক্লেরভালের অনেক কাজ পড়ে ছিল। তাই বাধ্য হয়ে বন্ধুর কথায় বিশ্বাস করে ক্লেরভাল একা ফিরে গেলেন।

.

ক্লেরভাল চলে গেলে পর ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের একে একে মনে পড়ল আগেকার সমস্ত কথা। তার সৃষ্টি সেই অপার্থিব বীভৎসতা। ক্লেরভাল কি তার খবর জানে? তাকে কি সে দেখেছে? কপালে ফোঁটা ফোঁটা ঘাম জমতে লাগল। কিন্তু পরক্ষণেই তার মনে হল, না–ক্লেরভাল নিশ্চয়ই দেখেনি, দেখলে সে তাকে এ-কথাটা জানাত।

ঘরের থেকে বেরিয়ে তিনি একবার বাইরের দিকে তাকালেন। দূরে পাহাড়ের মাথায় মাথায় তুষার-মুকুট সোনালি রোদে ঝকমক করছে, পপলার গাছগুলো মাথা দুলিয়ে তাকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। সমস্ত পৃথিবী রঙিন হয়ে তাঁকে অভিনন্দন জানাচ্ছে।

চারদিক ভালো করে তাকিয়ে দেখলেন তিনি, কোথাও সেই দুষ্ট রাহুর চিহ্ন নেই। এক প্রসন্ন শান্তিতে তাঁর মন ভরে উঠল। মনে হল যেন তিনি আবার নতুন করে জীবন লাভ করলেন। আর বোধহয় সেই বিকট উন্দ্রব এখানে মুখ দেখাতে আসবে না। তার দৃঢ় বিশ্বাস হল যে নিশ্চয়ই এই দুঃসহ শীতে বাইরে জমে সে মারা গেছে। একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে তিনি বাচলেন।

এই কথা মনে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বাড়িতে এত তাড়াতাড়ি ফিরে যাওয়ার সদিচ্ছা তার মন থেকে ধীরে ধীরে মুছে যেতে লাগল। দেশে ফিরে যাওয়ার দিন একটু একটু করে পিছিয়ে দিতে লাগলেন।

একদিন তিনি বেড়িয়ে ফিরে দেখলেন যে বাইরের ঘরে টেবিলের উপর তার বাবার একটা চিঠি পড়ে আছে। একনিমেষে তার আবার মনে পড়ে গেল বাবা, উইলিয়ম, আর্নেস্ট ও এলিজাবেথের কথা। বাড়ির সুন্দর জীবনের কথা আবার নতুন করে মনে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে মনে হল, তাই ভালো–সেখানেই চলে যাবেন তিনি। সকলের সঙ্গে একত্র থাকলে এই অনিশ্চিত বিভীষিকার হাত থেকে অনায়াসে আত্মরক্ষা করা যাবে। আর তা ছাড়া মার মৃত্যুর পর একবার সকলের সঙ্গে দেখা করাও প্রয়োজন!

কিন্তু চিঠিখানা খুলে তিনি নিশ্চল হয়ে গেলেন। হাত থরথর করে কাঁপতে লাগল। তিনি পড়তে লাগলেন :

প্রিয়তম ভিক্টর,

ক্লেরভালের কাছ থেকে জানলাম যে তুমি শীঘ্রই দেশে ফিরে আসছ। তুমি ফিরে এলে তোমাকে আনন্দের সঙ্গে অভ্যর্থনা জানাব–একথা যদি মনে করে থাকে, তা ভুল–ভুল। তুমি এসে আমাদের হাসিমুখ দেখবে যদি মনে করে থাকো তো আশ্চর্য হবে আমাদের চোখে জল দেখে। ভিক্টর, তোমাকে কী করে আমাদের এতবড় সর্বনাশের খবর দেব?

ভিক্টর, উইলিয়ম মারা গেছে। সত্যকথা বলতে গেলে উইলিয়মকে কে যেন হত্যা করেছে। তোমাকে সান্ত্বনা দেব না, শুধু ঘটনাটা আমি লিপিবদ্ধ করছি।

গত বৃহস্পতিবার আমি, এলিজাবেথ আর তোমার দুই ভাই উইলিয়ম ও আর্নেস্ট বেড়াতে গেছিলাম। জায়গাটা এত সুন্দর যে ফিরতে আমাদের সন্ধ্যা হয়ে গেছিল। ফেরার সময় উইলিয়ম ও আর্নেস্টকে দেখতে পেলাম না। ওদের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পরে আর্নেস্ট ফিরে এল। জিজ্ঞাসা করল যে আমরা উইলিয়মকে দেখেছি কি না। সে জানাল যে তারা দুজনে লুকোচুরি খেলছিল। উইলিয়ম দৌড়ে গিয়ে কোথায় যে লুকোল, আর্নেস্ট তাকে খুঁজে পায়নি।

একথা শুনে আমরা শঙ্কিত হয়ে উঠলাম। রাত অন্ধকার হয়ে না-আসা পর্যন্ত আমরা তন্নতন্ন করে খুঁজলাম, কিন্তু তাকে খুঁজে পাওয়া গেল না। এলিজাবেথ বলল, হয়তো সে বাড়ি ফিরে গেছে। আমরা ছুটে এলাম বাড়িতে, কিন্তু সেখানেও সে নেই। আবার আমরা আলো নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। সেই শীতের রাতে অন্ধকারে একা না-জানি সে ভয়ে কী করছে। ভোর প্রায় পাঁচটার সময় তার খোঁজ পেলাম–সুন্দর ফুটফুটে উইলিয়ম ঘাসের উপর নিঃসাড় হয়ে পড়ে আছে। তার গলায় হত্যাকারীর আঙুলের চিহ্ন তখনো জ্বলজ্বল করছে। তোমার মার ছবি মীনে-করা সোনার লকেটটা তার গলায় ছিল, সেটি পাওয়া গেল না। সেই সোনার লকেটের লোভে ফুলের মতো সুন্দর ছেলেটিকে দত্যু হত্যা করেছে।

এলিজাবেথ শোকে পাগল হয়ে উঠেছে। আর্নেস্টের ধারণা : সে-ই তার। ছোটভাই-এর মৃত্যুর জন্য দায়ী, কারণ সে লুকোচুরি খেলতে না চাইলে উইলিয়মের এভাবে মৃত্যু হত না। আমাদের এরকম সুখের বাড়িতে আজ গভীর বিষাদের ছায়া সকলের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে। হত্যাকারী আজও ধরা পড়েনি; কিন্তু আমাদের চেষ্টার ত্রুটি নেই। আমাদের সকলের সম্মিলিত অনুসন্ধানে তার ধরা পড়তেই হবে। ভিক্টর, তুমি তাড়াতাড়ি এসো। তুমি ছাড়া এলিজাবেথকে আর কেউ সান্ত্বনা দিতে পারবে না। তুমি এলে আমরা সকলেই মনে বল পাব। ইতি–

তোমার হতভাগ্য বাবা

.

উইলিয়মের মৃত্যু-সংবাদ শুনে ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন শোক-বিমূঢ় হয়ে গেলেন। আর দেরি করলেন না, সেইদিনই তিনি জেনেভার পথে বেরিয়ে পড়লেন। এখানে থাকতেও তার ইচ্ছা হচ্ছিল না, একা থাকবার খুব সাহসও ছিল না–কখন আবার সেই বিরাটাকার দানব সামনে এসে দাঁড়াবে। তা ছাড়া, মনে মনে ভাবলেন তিনি, উইলিয়ামের হত্যাকারী সেই দস্যুকে ধরে উপযুক্ত শাস্তি বিধান করাও প্রয়োজন।

কিন্তু সে যাত্রা কী বেদনাময়। প্রথমে তার মনে হয়েছিল যে যত শীঘ্র পারা যায় তিনি যাবেন, কিন্তু যতই তিনি যেতে লাগলেন ততই মনের কোণে বিষাদ জমে তার গতিকে মন্থর করে তুলতে লাগল। চারদিকে তিনি তাকিয়ে দেখলেন, শুধু তুষার আর তুষারের পাহাড়। আকাশ থেকে আরম্ভ করে মাটি পর্যন্ত সমস্ত যেন তুষারের সাদা চাদরে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। আকাশে পাহাড়ে গাছপালায়–সব জায়গায় যেন তিনি শুনতে পাচ্ছেন এক করুণ আর্তনাদ। আকাশের আলো যেন নিভে আসতে লাগল।

অতীতে কতবার তিনি এই পথ দিয়ে যাওয়া-আসা করেছেন, তার সুখকর স্মৃতি মনে পড়ল; কিন্তু মাত্র এই একটি আঘাত কেমন করে যেন এক বিরাট পরিবর্তন এনেছে। সর্বত্রই যেন তিনি নাম-না-জানা বিভীষিকা দেখতে পাচ্ছিলেন, ভয়ে সমস্ত শরীর যেন তার পঙ্গু হয়ে যাচ্ছিল।

দুদিন অপেক্ষা করলেন তিনি সুজানে।

.

. দানবের অপকীর্তি

লেকের পাশ দিয়ে রাস্তাটা সোজা চলে গেছে ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের দেশ জেনেভায়। দূর থেকে তিনি দেখলেন তুষারশৃঙ্গ ম ব্লা। তার সৌন্দর্যে তাঁর পূর্বস্মৃতি আবার জেগে উঠল, তিনি কেঁদে ফেললেন। বললেন–আমার সোনার দেশ, আমার সোনার পাহাড়, তোমাদের প্রবাসী ছেলে আজ ঘরে ফিরে আসছে। তোমাদের মুখে প্রশান্তির ছবি–তা কি আমাকে সান্তনা দিতে, না আমার গভীর দুঃখে ব্যঙ্গ করতে?

যতই জেনেভার দিকে এগোতে লাগলেন, ততই এক বিমর্ষ বিষণ্ণতা আর অনিশ্চিত ভয়ে তাঁর মন ভরে উঠল। নিঃশব্দ চরণে কখন চারদিকে রাত নেমে এসেছে, অন্ধকার পাহাড়ে কুয়াশার আস্তরণ। সমস্ত পৃথিবী যেন এক বিরাট নির্মম বিভীষিকার ছবি।

যখন জেনেভায় এসে ডক্টর ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন পৌঁছুলেন, তখন নগরীর দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। সকাল না হলে আর জেনেভায় প্রবেশ করা যাবে না। বাধ্য হয়ে তাঁকে নগরীর থেকে কিছুদূরে সেকেরন গ্রামে সেই রাতের জন্য থাকতে হল। সমস্ত আকাশ কালো, একটি তারার চোখও দেখা যাচ্ছে না। তিনি মনে মনে এক নিদারুণ অস্বস্তি বোধ করতে লাগলেন। এরই কাছে তার ছোটভাই উইলিয়ম নিহত হয়েছে। যেই এই কথা মনে হল, তক্ষুনি তিনি উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর প্রিয়তম ভাইয়ের মৃত্যুস্থান একবার দেখার জন্য চঞ্চল হয়ে উঠলেন।

পথে বেরিয়ে পড়লেন তিনি। আকাশে তখন ঘনঘটা, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, সেই আলোর প্রতিফলনে ম ব্লার তুষারশৃঙ্গ আলোকিত হয় উঠে কত রকমের সুন্দর ছবি একে যাচ্ছে। গাছপালা কাঁপিয়ে ঝোড়ো বাতাস ছুটে আসছে; তিনি একটি ছোট টিলার উপর উঠে দাঁড়ালেন।

বৃষ্টি শুরু হল। তিনি হাঁটতে লাগলেন। কাছেই ভীষণ শব্দ করে বজ্রপাত হল, তার প্রতিধ্বনি দূরের যঁ ব্লা আল্পস থেকে ফিরে এল। বিদ্যুতের চুলকানিতে তাঁর চোখ ধাধিয়ে যাচ্ছে, সামনের জেনেভা লেক মনে হল এক অগ্নিকুণ্ড। তারপর নিরঞ্জ অন্ধকার।

বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে তিনি সেই সুন্দর অথচ ভয়ঙ্কর ঝড়ের তাণ্ডবলীলা দেখতে লাগলেন। হঠাৎ তার মনে হল যেন কাছেরই এক ঝোঁপের ভিতর থেকে এক কালো মূর্তি আত্মপ্রকাশ কলল। তিনি একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন। বিদ্যুতের আলোর ঝলকে সেই মূর্তি স্পষ্ট হয়ে উঠল। তার দানবীয় বিকলাঙ্গ চেহারা দেখে তিনি বুঝতে পারলেন যে, এই সেই শয়তান, সেই নিষ্ঠুর দৈত্য–যাকে তিনি জীবন দান করেছেন। এই শয়তান, এখানে কী করছে? তবে কি তবে কি এই শয়তানই তার ভাইকে হত্যা করেছে? একথা মনে করতেই তার দেহের সমস্ত রক্ত হিম হয়ে এল। তিনি একটি গাছে হেলান দিয়ে দাঁড়ালেন। সেই মূর্তিটি মুহূর্তের মধ্যে তাকে অতিক্রম করে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। কোনো মানুষ ফুলের মতো সুন্দর ছেলেকে হত্যা করতে পারে না। নিশ্চয়ই এই শয়তানই হত্যাকারী! একবার মনে হল যে তার পিছু তিনি ধাওয়া করেন, কিন্তু সেই দৈত্য ম সালেভের খাড়া চূড়া ডিঙিয়ে কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল।

সারারাত তিনি এক অস্বস্তিকর মানসিক যন্ত্রণায় কাটালেন। বাইরের দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় তাঁর মানসিক অস্থিরতা যেন আরো বেড়ে গেল। একটির পর একটি কলুষ বিভীষিকাময় দৃশ্যের ভিতর দিয়ে তার কল্পনা ছুটে চলল। তাঁর শুধু মনে হতে লাগল সেই অমানুষিক অপার্থিব জীবের কথা–যাকে তিনি বিজ্ঞানের আশ্চর্য আবিষ্কার রূপে সৃষ্টি করেছিলেন, যাকে তিনি জীবন ও শক্তি দিয়েছিলেন এবং যাকে তিনি মনুষ্যসমাজে বিচরণ করতে ছেড়ে দিয়েছেন, যার একটির পর একটি নৃশংস কুকীর্তিতে নিজের ওপর ঘৃণা ছাড়া আর তাঁর কিছুই মনে আসে না।

এইভাবে যন্ত্রণাময় এক সুদীর্ঘ রাত কেটে গেল। জেনেভা নগরীর দরজা খোলামাত্র তিনি ছুটে বাড়িতে এলেন। প্রথমেই দেখা হল এলিজাবেথের সঙ্গে। তাকে দেখে এলিজাবেথ কেঁদে ফেলল। বলল–ভিক্টর, তুমি এলে, কিন্তু আর কিছুদিন আগে এলে না কেন? কত দুঃখের মধ্যে তুমি এলে।

ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন জিজ্ঞাসা করলেন–বাবা কেমন আছেন?

ভালোই আছেন–এলিজাবেথ উত্তর দিল। হত্যাকারী ধরা পড়ার পর থেকেই–

ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন চিৎকার করে উঠলেন–হত্যাকারী ধরা পড়েছে? অসম্ভব! কে তাকে ধরতে পারবে? কার এত ক্ষমতা আছে। এর চেয়ে বরং ঝড়ের চেয়ে জোরে ছোটা সম্ভব! আমিও তাকে দেখেছি, কাল রাত পর্যন্ত সে মুক্ত ছিল।

এলিজাবেথ তার মুখের দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে বলল–তুমি কী বলছ, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। হত্যাকারীর সন্ধান পাওয়ার পর আমরাও একেবারে আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলাম। প্রথমে কেউই বিশ্বাস করতে পারেনি, তার বিরুদ্ধে সমস্ত রকম প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও আমাদের বাড়ির কেউ এখনো বিশ্বাস করে না। কে বিশ্বাস করতে পারে যে আমাদের এতদিনকার পরিচারিকা জাস্টিন–যে উইলিয়ম আর আর্নেস্টকে ছেলের মতো মানুষ করেছে–সে-ই উইলিয়মকে হত্যা করবে? এতবড় ঘৃণ্য পাপ করবে!

–জাস্টিন! অসম্ভব। তাকেই কি হত্যাকারী বলে ধরা হয়েছে।

–হ্যাঁ। বিশ্বাস হয় না, তবু তার বিরুদ্ধে এত প্রমাণ! তাছাড়া উইলিয়মের মৃত্যুর পর থেকে তার হাবভাবও কেমন যেন অদ্ভুত। আজই তার বিচার হবে, তখনই সব কথা পরিষ্কার হবে।

এলিজাবেথ জানাল যে উইলিয়মের মৃত্যুর পর জাস্টিন বেশ কয়দিন অসুস্থ হয়ে বিছানায় শুয়ে থাকে। সেই সময় বাড়ির এক চাকর তার জামাকাপড় খুঁজতে খুঁজতে উইলিয়মের মৃত্যুর দিন সে যে-জামা পরেছিল, তার পকেট থেকে তোমার মা’র মীনে-করা লকেটটা পায়। সে বাড়ির কাউকে না জানিয়ে সোজা পুলিশকে গিয়ে খবর দেয়। পুলিশ তাকে হত্যাকারী বলে সন্দেহ করে ধরে নিয়ে গেছে।

আশ্চর্য এই কাহিনী। ফ্রাঙ্কেনস্টাইন বললেন–এলিজা! তোমরা সকলে ভুল করছ। জাস্টিন নির্দোষ, আমি জানি কে হত্যাকারী!

এমন সময় ধীরে ধীরে ডক্টর ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের বাবা ঘরে প্রবেশ করলেন। তাকে দেখে এলিজাবেথ বলে উঠল–শুনেছেন, ভিক্টর জানে যে কে হত্যাকারী!

ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের বাবা আস্তে আস্তে উত্তর দিলেন–আমাদেরও দুর্ভাগ্য যে আমরাও তাকে জানি।

এলিজাবেথ বলল- ভিক্টর বলছে জাস্টিন নয়, জাস্টিন নির্দোষ।

উত্তর এল–তাই যেন হয়, জাস্টিন যেন নির্দোষ প্রমাণিত হয়।

ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের মন কিছুটা স্থির হল। জাস্টিনের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ কোনো প্রমাণ দাখিল করা সম্ভব নয় বলে সে খালাস পেয়ে যাবে। তার হত্যাকারীর কাহিনী এত অবাস্তব এবং এত অবিশ্বাস্য যে সকলকে সে কাহিনী বলাও যাবে না, কেউ বিশ্বাসও করবে না।

.

এগারোটায় জাস্টিনের বিচার হবে। সপরিবারে ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন আদালতে উপস্থিত হলেন। বিচারের এই প্রহসনের সমস্তক্ষণ তিনি নরকযন্ত্রণা অনুভব করতে লাগলেন। তার কৌতূহল ও বেআইনি কাজের ফলে যে শিশু নিহত হয়েছে, চিরকালের জন্য সেই হত্যার ঘৃণ্য অপবাদ মাথায় নিয়ে জাস্টিন জীবিত থাকবে কি? অথচ এই সমস্ত অপকর্মের জন্য দায়ী একমাত্র তিনি। হাজার বার তিনি সকলের সামনে এই হত্যার দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত। সমস্ত অপরাধ তিনি স্বীকার করতে পারলে খুশিই হবেন–কিন্তু হত্যাকাণ্ড অনুষ্ঠিত হওয়ার সময় তিনি এতদূরে ছিলেন যে কেউ তার কথা বিশ্বাস করবে না, পাগলের প্রলাপ বলে তাঁর কথা উড়িয়ে দেবে।

বিচার আরম্ভ হল। জাস্টিনের মুখ ভীতিহীন; সে নির্বাক হয়ে বসে আছে। শত চক্ষুর উৎসুক দৃষ্টিতেও সে বিচলিত নয়।

তার বিরুদ্ধে অভিযোগ বিবৃত করলেন সরকারি উকিল। উইলিয়মের হত্যাকাণ্ডের দিন সারারাত জাস্টিন বাড়িতে ছিল না। ভোরের দিকে তাকে একজন দেখতে পায় হত্যাস্থানের কাছাকাছিই। সেখানে সে কী করছে জিজ্ঞাসা করায় ঠিকমতো উত্তর দিতে পারেনি। বাড়িতে ফেরার পর সকলে যখন তাকে জিজ্ঞাসা করল যে সে সারারাত কোথায় ছিল, তখন সে উত্তর দিয়েছিল যে সে উইলিয়মকে খুঁজছিল। উইলিয়মের মৃতদেহ তাকে দেখানোমাত্র সে কান্নায় ভেঙে পড়েছিল এবং কয়দিন বিছানায় শুয়ে ছিল। তারপর সরকারি উকিল মীনে-করা একটি সোনার লকেট বের করে বললেন–এই সেই লকেট যেটি মৃত্যুর পূর্বে শিশুটির গলায় ছিল এবং মৃত্যুর পর এই মেয়েটির জামার পকেট থেকে পাওয়া যায়।

একথা শোনামাত্র আদালতের মধ্যে ধিক্কার-ধ্বনি শোনা গেল।

জাস্টিনকে তার উত্তর দিতে বলা হল। জাস্টিন বলতে লাগল–ভগবান জানেন যে আমি নির্দোষ। যে উইলিয়মকে আমি নিজের ছেলের মতো প্রতিপালন করেছি, তার একটি ছোট লকেটের লোভে আমি তাকে হত্যা করব–একথা সকলে বিশ্বাস করলেও ভগবান বিশ্বাস করবেন না।

একটু থেমে সে বলে যেতে লাগল যে হত্যাকাণ্ডের রাত্রে সে এলিজাবেথের অনুমতি নিয়েই জেনেভার কাছাকাছি সেনে গ্রামে তার মাসির বাড়িতে গেছিল। রাত ন’টার সময় ফেরার পথে একজন লোকের কাছে সে প্রথম সংবাদ পায় যে উইলিয়মকে পাওয়া যাচ্ছে না। উৎকণ্ঠায়, উদ্বেগে সে অনেকক্ষণ ধরে চারদিক খোঁজ করে। যখন খেয়াল হল, তখন জেনেভা নগরীর দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। কাছাকাছি একটা পোড়ো ঘরে সে আশ্রয় নেয় এবং সারারাত সেখানেই থাকে। মনে হয়, সে কিছুক্ষণের জন্য ঘুমিয়ে পড়েছিল। কারুর পায়ের শব্দে তার ঘুম ভেঙে যায়, কিন্তু কাউকে সে দেখতে পায়নি। সকাল হলে সে বাড়ি ফিরে আসে। কেউ যদি তাকে হত্যাকাণ্ডের স্থানে দেখে থাকে, হয়তো সে যখন উইলিয়মকে খুঁজছিল তখন দেখেছে। যদি সে হত্যাকাণ্ডের স্থানে গিয়ে থাকে তবে সে নিজের অজান্তেই গেছে। লকেটের সম্বন্ধে তার কোনো ধারণা নেই।

তারপর উঠল এলিজাবেথ। সে বলল–আমি নিহত শিশু উইলিয়মের পরিবারে শিশুবয়স থেকে আছি। উইলিয়মের বাবা-মাকে নিজের বাপ-মায়ের মতো দেখেছি এবং তাদের কাছ থেকেও সেই ব্যবহার পেয়ে এসেছি। আমি জাস্টিনকে অনেকদিন ধরে জানি, একই বাড়িতে আমরা প্রায় সাত বছর একত্রে বাস করেছি। তার মতো ভদ্র, অমায়িক ও স্নেহবৎসলা আমি খুব কম দেখেছি। মিসেস ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের অসুখের সময় সে অত্যন্ত যত্ন এবং দায়িত্বের সঙ্গে তার সেবা করেছে। এই পরিবারের প্রত্যেকেই তাকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করেন এবং ভালোবাসেন। যে শিশুর হত্যার অপরাধে জাস্টিন অভিযুক্ত হয়েছে তাকে সে নিজের ছেলের মতো এতদিন দেখেছে। তার বিরুদ্ধে সমস্ত প্রমাণ সত্ত্বেও আমি তার সম্পূর্ণ নির্দোষিতায় বিশ্বাস করি। এই জঘন্য পাপকাজ করার মতো কোনো প্রবৃত্তি তার হতে পারে না, কোনো লোভের বশবর্তী হয়ে সে এ-কাজ করতে পারে না। সে যদি চাইত তবে আমি সামান্য ওই লকেট কেন, আরো অনেক দামি জিনিস তাকে আনন্দে দিতাম–এতখানি আমি তাকে শ্রদ্ধার সঙ্গে দেখি।

এলিজাবেথের এই অকপট ও মর্মগ্ৰাহী আবেদনে সমস্ত আদালতের মধ্যে অস্কুট গুঞ্জন শোনা গেল; কিন্তু জনসাধারণের মধ্যে এই আলোড়ন শুধু এলিজাবেথের সুন্দর জবানিতে জাস্টিনের অপরাধ মার্জনার আবেদনের জন্য–জাস্টিনের ওপর তাদের এতটুকু সহানুভূতি হল না। বরং ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের মহানুভবতার প্রতিদানে এই জঘন্য অকৃতজ্ঞতায় সকলের মন তার ওপর বেশি বিরূপ হয়ে উঠল।

এলিজাবেথের কথা শুনতে শুনতে জাস্টিন কেঁদে ফেলেছিল, কিন্তু সে একটি কথাও বলেনি। বিচারের সবটুকু সময় ধরে ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের মনের মধ্যে যে তোলপাড় হচ্ছিল, তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। জাস্টিন যে সম্পূর্ণ নির্দোষ সে-সম্বন্ধে তার এতটুকু দ্বিধা ছিল না। তিনি একথা জানতেন। তবে কি সেই দৈত্য তার ভাইকে হত্যা করে পৈশাচিক উন্মত্ততায় এই নির্দোষ পরিচারিকার জামার পকেটে সেই লকেটটা রেখে গেছিল?

ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের চোখের সামনে সমস্ত পৃথিবী দুলে উঠল, তারপর দ্রুতগতিতে ঘুরতে লাগল। একটা অগ্নিবলয় সমস্ত পৃথিবীকে গ্রাস করতে করতে আসছে। হঠাৎ একটা বিস্ফোরণ, তারপর অন্ধকার… অন্ধকার, আর সেই কালিমার মধ্য থেকে একটি পৈশাচিক মূর্তি ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে লাগল।

সারা আদালতে তুমুল চাঞ্চল্য। জাস্টিন অপরাধ স্বীকার করেছে, বিচারক তাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন।

জাস্টিনকে প্রহরীরা নিয়ে যাচ্ছে। এলিজাবেথ ছুটে গেল, বলল–জাস্টিন, তুমি এ কী করলে? আমার শেষ সান্ত্বনাটুকুও তুমি কেড়ে নিলে? তুমি–তুমি উইলিয়মকে হত্যা করেছে?

জাস্টিন তার দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে বলল–এলিজা, তুমি কি আমাকে এত

নীচ মনে করো? তুমি কি সত্যই মনে করতে পারো যে আমি উইলিয়মকে হত্যা। করেছি। কিন্তু কী করব? মুক্তি পেলেও সকলের কাছে আমি ঘৃণ্য হয়ে থাকব, কেউ বিশ্বাস করবে না যে আমি নির্দোষ। আর তা ছাড়া উইলিয়মকে আমি নিজের ছেলের মতো মানুষ করেছি। তাকে ছেড়ে আমি কী করে থাকব? তার চেয়ে এই ভালো, স্বর্গে উইলিয়মের সঙ্গে আমার দেখা হবে এবং আমরা দুজনে একসঙ্গে থাকতে পারব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *