১-২. শেষরাত্রের অভিযান

ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন – মেরি শেলি (১৭৯৭-১৮৫১)
অনুবাদ সুনীলকুমার গঙ্গোপাধ্যায়

ভূমিকা

কবি-পত্নী মিসেস মেরি ওলস্টোনক্রাফট শেলির রচনা এই প্রসিদ্ধ উপন্যাস ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন’। প্রায় ত্রিশ বছর আগে এই বইটির চিত্ররূপ সারা পৃথিবীতে যথেষ্ট সাড়া এনেছিল। মূল কাহিনী এবং চিত্ররূপ–এই দুইয়ের থেকে বেছে নিয়ে ছোটদের জন্য কাহিনীটি আমার লিখতে হয়েছে। তাই অনেকক্ষেত্রেই মূল কাহিনী কিংবা চিত্ররূপ যে অনুসৃত হয়নি, তা বলা বাহুল্য।

উইলিয়ম গডউইনের মেয়ে মেরি ওলস্টোনক্রাফট জন্মগ্রহণ করেন ১৭৯৭ খ্রিস্টাব্দের ৩০ আগস্ট লন্ডন শহরে। ১৮১৬ খ্রিস্টাব্দে কবি শেলি প্রথম স্ত্রী হারিয়েট ওয়েস্টব্রুকের মৃত্যুর পর মেরি শেলিকে বিবাহ করেন। তাঁর প্রথম বই ‘ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন’ প্রকাশিত হয় ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে। তার আরো কতগুলো প্রসিদ্ধ রচনা হচ্ছে : ‘ভ্যালপাৰ্গা’ (১৮২৩), ‘দি লাস্ট ম্যান’ (১৮২৬), ‘ফর্চুন অব পার্কিন ওয়ারবেক’ (১৮৩০) এবং ‘লোডোর’ (১৮৩৫)। শেলির মৃত্যু পর্যন্ত তিনি ইটালিতেই ছিলেন, কিন্তু পরে ইংল্যান্ডে ফিরে আসেন। মিসেস শেলি ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দের ২১ মে মারা যান।

‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন’ লিখতে তিনি কীভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন, তার চমকপ্রদ বিবরণ মিসেস শেলি ডায়েরিতে তার স্বকীয় ভঙ্গিতে লিখে গেছেন। এক সূর্যকরোজ্জ্বল সুন্দর গ্রীষ্মের ছুটিতে তিনি, শেলি এবং কবি বায়রন জেনেভাতে মহানন্দে আছেন, এমন সময় ফরাসি ভাষায় অনূদিত কতগুলো জার্মান ভুতুড়ে গল্প তাদের হাতে পড়ে। ওই দুঃসহ কাল্পনিক গল্পগুলো পড়ার পর বায়রন আবেগে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন, বললেন : ‘আমরাও প্রত্যেকেই এক-একটি ভূতের গল্প লিখব।’ তিনজনেই সম্মত হয়ে লিখতে শুরু করেন, কিন্তু একমাত্র মিসেস শেলির ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন ছাড়া আর দুজনের লেখা লোকচক্ষুর অন্তরালেই রয়ে গেল। সঠিক জানা যায়নি যে বায়রন এবং শেলি ভূতের গল্প লিখেছিলেন কি না! ১৩৪৮-এর কার্তিক মাস থেকে এই ‘ফ্ল্যাঙ্কেনস্টাইন’ ‘মাসপয়লা’ মাসিকপত্রে ধারাবাহিক প্রকাশিত হয়েছিল। তারপর কুলজা সাহিত্য-মন্দিরের স্বত্বাধিকারী এবং মাসপয়লা ও রবিবারের সম্পাদক শ্রদ্ধেয় শ্রীযুক্ত ক্ষিতীশচন্দ্র ভট্টাচার্য মহাশয়ের একান্ত আগ্রহে ‘ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন’ পুস্তকাকারে প্রথম প্রকাশিত হয় শ্রাবণ, ১৩৫২ সালে।

সুনীলকুমার গঙ্গোপাধ্যায়

.

. শেষরাত্রের অভিযান

হিমশৈলের শীত-মন্থর আকাশে বাতাসে কেঁপে কেঁপে বাজল চারটে। শীতের শেষরাতে তখনো কেউ জেগে ওঠেনি, তখনো প্রতি গৃহের দ্বার রুদ্ধ। পাখিরা তখনো তাদের বাসায় শীতের শেষরাতের বাতাসের অলস ভাবটুকু পরম তৃপ্তির সঙ্গে উপভোগ করছিল।

কালো গরম পোশাকে সর্বাঙ্গ ঢাকা দুটি লোক খ্রিস্টিয়ানদের সমাধিক্ষেত্রের পাচিলের উপর উঠে দাঁড়াল নিঃশব্দে, সঙ্গে তাদের কোদাল ও শাবল। কুয়াশা ভেদ করে সামনের কিছুই দেখা যাচ্ছিল না, তবু তারা একবার সমাধিক্ষেত্রের দিকে ভালো করে তাকাল।

কিছু কি দেখা যায়? এই নিরন্ধ্র অন্ধকার, এই জমাট কুয়াশার আবরণ–চোখের দৃষ্টি অল্প একটু পথ অগ্রসর হয়েই প্রতিহত হয়ে ফিরে আসে।

কিন্তু তারা শুনেছে, আজই তাদের জীবনের পরম শুভমুহূর্ত আসবে। জীবনের পরম লগন কোরো না হেলা। আজই তাদের কাজ করা চাই। আজই…আজই….

শুধু পথ চেয়ে অপেক্ষা, রাত্রির অন্ধকারে গোপনে নিঃশব্দ প্রতীক্ষা। ঐ যে দেখা যায় দূরে কয়েকজন লোক আবছায়ার মতো স্পষ্ট করে দেখা যায় না কিছুই,

তবু–তবু তারাই হয়তো হবে। আর তবে দেরি করা চলবে না।

সেই লোকদুটি কোদাল ও শাবল মাটিতে ফেলে নিঃশব্দে লাফিয়ে পড়ল সমাধিক্ষেত্রে। তারপর আস্তে আস্তে সেই লোকগুলোর দিকে এগিয়ে গেল। চোখে তাদের হর্ষ, উদ্বেগ, ভয়।

কিছুদূরে কতগুলো লোক কবর খুঁড়ছিল। সেই লোকদুটি তাদের কাছাকাছি এসে থেমে একটু ভালোমতো জায়গা দেখে লুকিয়ে পড়ল। উদ্বেগে তাদের বুক ধুকধুক্ করছে।

প্রতি মুহূর্ত তাদের কাছে যুগ যুগ বলে মনে হচ্ছিল। এই প্রতীক্ষার কি শেষ নেই? শেষ নেই এই অনিশ্চিত সংশয়ের? এই কবর দেওয়া কি শেষ হবে না? এরা তাড়াতাড়ি হাত চালায় না কেন? এই শীতের মাঝে ওরা তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করে চলে যাক, তারা নামুক তাদের কর্মক্ষেত্রে। শেষ হোক এই দীর্ঘ উদ্বেগময় প্রতীক্ষা, শুরু হোক নতুন জীবনের ছন্দময় চাঞ্চল্য।

যাক–শেষ হল তাদের কবর দেওয়া। সেই লোকদুটির এল কর্মক্ষেত্রে নামার সময়। শীতের বাতাস হাড়ের মধ্যে কাঁপুনি ধরিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। এখন চলছে উপাসনা : মৃতের আত্মা সুখে থাকুক। সে এ জন্মে যদি কোনো পাপ করে থাকে, মুছে যাক তা–সে নতুন আলোর সন্ধান পাক!

.

উপাসনা শেষ হলে সকলে উঠে দাঁড়াল। এবারে ফিরতি-পথ। দুঃখে, কষ্টে, শ্রান্তিতে প্রত্যেকের শরীর ভেঙে আসছে। তারা চলে গেল নিচুমুখে–নিঃশব্দে। শীতের তুহিন বাতাসের মাঝ দিয়ে দূর হতে ভেসে আসছিল তাদের সকলের সম্মিলিত জুতোর শব্দ : মচ্‌–মচ্‌।

লোকটি এবার তাদের গুপ্তস্থান হতে বেরিয়ে পড়ল। একবার চারপাশে তাকিয়ে দেখল, কেউ কোথাও নেই। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে তারা বাঁচল। সেই শীতের মধ্যেও মানসিক উত্তেজনায় তাদের কপালে ফোঁটা ফোঁটা ঘাম জমে উঠেছে। আঙুল দিয়ে সেগুলো তারা মাটিতে ছিটিয়ে দিল।

তখন একজন বললেন–ডক্টর ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন, এবারে আমরা তবে আমাদের কাজ আরম্ভ করি। এর পরে বড় বেশি বেলা হয়ে যাবে, পথে লোক চলাচল শুরু হয়ে যাবে। তখন ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি।

ডক্টর ফ্রাঙ্কেনস্টাইন উত্তর দিলেন–হ্যাঁ, এখনই হাত চালানো উচিত।

ভরা দুজনে শাবল কোদাল নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। যেখানে কবর দেওয়া হয়েছিল সেখানে তারা এসে দাঁড়ালেন।

এক অজানা আতঙ্ক, এক গা-ছমছম ভয়, শিরা-উপশিরার মধ্য দিয়ে তুষার-শীতল হিমপ্রবাহ–তাদের সমস্ত শরীরকে যেন অসাড় করে ফেলছিল। এই গোপন শব-সন্ধান বা শব-শিকার মানুষের চোখে কত ঘৃণ্য, কত পাপ! বিবেক বাধা দেয়, কিন্তু তারা নিরুপায়! বিজ্ঞান-সাধনার দুরন্ত আহ্বান তাঁদের এই অসামাজিক কাজে বাধ্য করেছে।

ভিজে মাটির সোঁদা গন্ধ, উঁচু-করা মাটির ঢিপির উপর একটা ক্রশচিহ্ন, কিছু ফুল–তার সুরভি সে জায়গাকে ঘিরে রয়েছে। আর চারদিক নির্জন, তখনো দু-একটা তারা আকাশের শেষ কোণে বসে অবাক হয়ে পৃথিবীর একপ্রান্তে তাদের দিকে চঞ্চল-চোখে তাকিয়ে রয়েছে; বোবা নীল আকাশ যেন ব্যথায় ম্লান হয়ে গেছে, আর সেই বিস্তীর্ণ নির্জন সমাধিক্ষেত্র অসহ-বিস্ময়ে এই দুটি অবাঞ্ছিত মানুষের সমস্ত কাজ লক্ষ করে চলেছে যেন যখন-তখন অট্টহাসি হেসে উঠতে পারে। দু-একটা গাছের শাখা কেঁপে উঠছে মাঝে মাঝে, তার শব্দও সেখানে অস্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। এই নিরাত্ম্য অশরীরীদের বাসস্থানের রহস্যময় আবহাওয়াতে দুজনেই একটু অস্বস্তি বোধ করছিলেন।

ডক্টর ফ্রাঙ্কেনস্টাইন বললেন–নীল, এবার হাত চালান। কিন্তু খুব সাবধান! মৃতদেহের যেন কোনো অনিষ্ট না হয়। কোথাও যেন তার আঘাত না লাগে।

তারা দুজনে খুব তাড়াতাড়ি গর্ত খুঁড়তে লাগলেন। উত্তেজনায় সারা শরীর ঠক ঠক করে কাঁপছিল, কপালে জমে উঠছিল ঘাম। চোখের পাতা পড়ছে না, শুধু হাত চালাও, হাত চালাও। আর সময় নেই।

পাখিরা দু-একটি যেন কোথায় ডেকে উঠল। তবে কি আজ আর এই মৃতদেহের উদ্ধারের কোনো আশা নেই। তবে কি তাদের এই এতদিনের সাধনা ব্যর্থ হয়ে যাবে? তবে কি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বিষয় কেউ জানতে পারবে না– দেখতে পারবে না। মানুষ যে মানুষের চেয়েও বড়, তার শক্তির যে সীমা নেই– এ প্রমাণ কি জগৎ কোনোদিন পাবে না?

নীল বললেন–অসম্ভব, এতখানি খোঁড়া অসম্ভব। এরা কত খুঁড়ে কবর দিয়েছে!

ডক্টর ফ্রাঙ্কেনস্টাইন বললেন–ওদের দোষ কোথায়? এই সমাধিক্ষেত্র থেকে কিছুদিন আগেই আরো কয়েকটা মৃতদেহ চুরি যাওয়াতেই তাদের এই সাবধানতা! সেই শব-শিকারি যে কে–আমার আর আপনার চেয়ে কে আর তাদের ভালো করে জানে?

কিন্তু ঠক্ করে শাবল যেন কিসের উপর লাগল। তারা দুজনেই উৎকর্ণ হয়ে উঠলেন। তবে কি শবাধারে শাবলটা লেগে গেছে। তারা দুজন পরস্পরের মুখের দিকে তাকালেন; মুখে বিজয়ের হাসি, চোখে সাফল্যের জ্যোতি, বুকে জয়গৌরবের উৎকণ্ঠা।

কিন্তু সেটা প্রকাণ্ড এক পাথর। হতাশায় মন ভেঙে গেল। এতক্ষণ অমানুষিক পরিশ্রমের ফল কি সামান্য এক পাথরের জন্য। তাদের আর গর্ত খুঁড়বার সামর্থ্য রইল না, তারা দুজনেই গম্ভীর হতাশায় বসে পড়লেন। এই শীতের মাঝে রাত্রের নিদ্রাত্যাগ করে মিথ্যা এ পণ্ডশ্রম!

কিন্তু বসে থাকলে চলবে না। তারা বৈজ্ঞানিক, তাদের পরীক্ষার মাঝে কত বাধা এসেছে–তবু তো তারা কখনো ম্রিয়মাণ হননি। কখনো হাল ছেড়ে দিয়ে বসে পড়েননি। আজ এতদূর গর্ত খুঁড়ে মাত্র অল্প একটুর জন্য তাঁদের আজীবন সাধনা সফল হবে না? জগৎ কি জানবে না যে ডক্টর ফ্রাঙ্কেনস্টাইন কী বিস্ময়কর অধ্যায় পৃথিবীর বুকে এনে দিলেন!

.

তারা দুজনে আবার নতুন উদ্যমে গর্ত খুঁড়তে লাগলেন। পাথর গেল গুড়ো হয়ে, মাটি চারপাশে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। আর দেরি নেই, আর দেরি নেই…

শবাধারটা তাঁরা দুজনে টেনে তুললেন। এখনো নতুন রয়েছে, কোথাও আঁচড় লাগেনি।

কিন্তু ততক্ষণে সকাল হয়ে এসেছে। এই সময়ে প্রকাশ্য রাজপথ দিয়ে শব চুরি করে নিয়ে যাওয়া উচিত নয়। যখন-তখন ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। তারপর কানাকানি, কৈফিয়ত, হাঙ্গামা–

নীল বললেন–আর গর্ত বন্ধ করতে হবে না। দেরি হয়ে যাবে, কেউ দেখেও ফেলতে পারে। এখন পালানোর চেষ্টা করা দরকার। একবার গিয়ে ল্যাবরেটরিতে

উঠতে পারলে হয়! তারপর

ডক্টর ফ্রাঙ্কেনস্টাইন বললেন–কিন্তু যাব কী করে? সকাল হয়ে এল যে! কুয়াশা এখনো কাটেনি বটে, কিন্তু লোকের চোখে বামালসুদ্ধ ধরা পড়ে যাব।

নীল বললেন–এক উপায় আছে। অনেক ঘুরে যেতে হবে। উঁচু পাহাড়টার উপর দিয়ে ঘুরে পিছন দিক দিয়ে ল্যাবরেটরিতে গেলে কেউ দেখতে পাবে না।

ডক্টর ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন বললেন-এ ছাড়া আর উপায় কী! তাই চলুন।

.

তারা দুজনে শবাধারটিকে কাঁধে করে এগোতে লাগলেন। পাঁচিলের কাছে এসে তার উপর শবাধারটাকে তুলে দিয়ে তারা দাঁড়ালেন। কিন্তু শবাধারটি পাচিলের উপর ঠিক হয়ে থাকতে পারল না। এপাশ-ওপাশ নড়তে লাগল। তারা শবাধারটিকে ভালো করে ধরার আগেই সেটা ওদিকে উলটে পড়ে গেল, দুজনে চিৎকার করে উঠেই পাঁচিল টপকিয়ে ওপাশে লাফিয়ে পড়লেন। উঁচু থেকে পড়ে শবাধারের দু-এক জায়গায় চোট লেগেছে।

আবার শবাধারটিকে তারা তুলে নিলেন। কে জানে ভিতরে মৃতদেহের কী হয়েছে কোনো ক্ষতি হয়েছে কি-না! মনে একটা খটকা লেগে রইল, অস্বস্তিকর এক সংশয়। তাদের আর উঁচু পাহাড়টার উপর দিয়ে যাওয়ার সাহস হল না।

ডক্টর ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন বললেন–সোজা রাস্তা দিয়েই যাব। যা হবার হবে।

শবাধারটিকে কাঁধে করে তারা সোজা রাস্তা দিয়েই চললেন–তবে কুয়াশা কেটে যাবে শিগগির।

পথে আর বাধা নেই। এখনো সমস্ত দেশ নিদ্রামগ্ন, এখনো সুষুপ্তি, এখনো সুখ-শষ্যা! বেঁচে থাকো তোমরা, এদিকে জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ বিস্ময় পূর্ণত্ব লাভ করুক। সফল হোক এক বৈজ্ঞানিকের জীবনব্যাপী নিরলস সাধনা, সফল হোক বিশ্বমানবের এক কল্যাণপ্রচেষ্টা।

যাক–ল্যাবরেটরি ঐ যে দেখা যাচ্ছে।

.

২. ডক্টর ফ্রাঙ্কেনস্টাইন

মধ্য-ইউরোপের তুষার-শৈলে ঘেরা শহরটি। ছোট্ট শহর, তার চেয়ে কম লোকজন। যেদিকে তবু জনমানবের বসতি আছে সেই দিকেই বাজার, সেই দিকেই হোটেল, খেলার মাঠ, সমাধিক্ষেত্র। দুরন্ত শীতে তার সব জায়গাই বরফে জমাট বেঁধে থাকে সব সময়ে।

একটু দূরে যেখানে মানুষের চলাচল প্রায় শেষ হয়েছে, যেখানে পর্বতশৃঙ্গ আরো উদ্যত হয়ে আকাশের উচ্চতা মাপবার জন্য প্রতিযোগিতা করছে–তারই একটি পাহাড়ের উপরে উঁচু-উঁচু পাইন চেরির জঙ্গলের ভিতর দিয়ে অপরিসর একটি পায়েচলা পথ এঁকেবেঁকে উঠে গেছে অনেকটা উপরে। সেইখানে দেখা যায় সুন্দর একটা বাড়ি।

ডক্টর ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের ল্যাবরেটরি।

ডক্টর ভিক্টর ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন তার বসবার ঘরে নির্জীব পঙ্গুর মতো দাঁড়িয়ে রয়েছেন। হাতে একটি চিঠি–কিন্তু তার দৃষ্টি সেই চিঠির ওপরে নেই, জানলার বাইরে কুয়াশার ভিতর দিয়ে দূরের অস্বচ্ছ তুষারমণ্ডিত পর্বতশ্রেণীর ওপর যেন তার দৃষ্টি নিবদ্ধ। চোখের কোণে ছোট্ট মুক্তোর মতো একফোঁটা জল যেন জমে আছে, ঝরে পড়তে পারছে না। পাছে সেই বেদনার্ত সময়ের সমাধি ভঙ্গ করে ফেলে।

এই নিথর নিস্পন্দ মূর্তির দিকে এখন তাকালে মনে হবে না যে ইনি সেই ডক্টর ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন–যিনি আজ পাঁচ বছর ধরে অক্লান্ত বিজ্ঞান-সাধনায় নিমগ্ন ছিলেন, যার প্রতিটি মুহূর্ত ছিল সজীব চঞ্চলতায় পরিপূর্ণ, কাজ–কাজ কাজ ছাড়া আর যার অভিধানে কোনো শব্দ ছিল না।

সেই বিমর্ষ বিধুরতা যেন একটু নাড়া পেল, ডক্টর ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের বুক থেকে অস্ফুট এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এসে সমস্ত ঘরকে যেন প্রবলভাবে নাড়া দিল। হাতের চিঠিটা আর একবার দেখবার চেষ্টা করলেন, চিঠির কয়েকটি লাইন তার চোখে ভেসে উঠতে লাগল। চিঠির শেষটুকু তিনি আর একবার দেখলেন :

যাই হোক্, তুমি বিশেষ চিন্তা কোরো না। তোমার কাজ যতদূর শীঘ্র শেষ করে একবার অন্তত আমাদের দেখা দিয়ে যাও। যদিও আজ বাড়ির সকলে অত্যন্ত গভীর দুঃখে আচ্ছন্ন, যদিও ভগবান ছাড়া আর কারো কাছ থেকে এই বেদনায় সান্ত্বনার আশা করা যায় না, তবুও মনে হয় তুমি এলে বাড়ির চেহারা একটু বদলে যেতে পারে। ইতি। তোমার বাবা আলফোন্স ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন।

বাবার কথা মনে পড়ে যায় ডক্টর ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের। সেই জেনেভার শহরতলিতে সুন্দর ছোট বাড়ি, ছেলেবেলায় বাবার হাত ধরে পাহাড়ে পাহাড়ে বেড়ানো–প্রচুর অর্থ ব্যয় এবং ত্যাগ স্বীকার করে তাকে ইঙ্গলস্টাট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো আর তাঁর বিজ্ঞান-গবেষণার জন্য এই ল্যাবরেটরি তৈরি করে দেওয়া প্রতিদানে তিনি বাবাকে কী দিতে পেরেছেন! কতদিন বাবার সঙ্গে দেখা হয় না, কতদিন মার–

মার কথা মনে পড়তেই আবার চিঠির দিকে তাকালেন, চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এল :

আজ প্রায় পাঁচ বছর হল তোমার দেখা পাইনি। শুনে দুঃখিত হবে যে তোমার মা আজ সাতদিন স্কারলেট ফিভারে ভুগে মারা গেছেন। মৃত্যুর আগে তোমাকে একবার দেখতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তারপর নিজে থেকেই বললেন–না থাক, তার কাজের অসুবিধা হবে।

তোমার ছোট দুই ভাই আর্নেস্ট আর উইলিয়মের খুব কষ্ট হয়েছে। বয়সে তো তারা তোমার থেকে অনেক ছোট। এলিজাবেথ যদিও প্রথমে ভেঙে পড়েছিল, তবু তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে সে শক্ত হয়েছে। সে আর আমাদের বাড়ির বৃদ্ধা পরিচারিকা জাস্টিন সকলের দেখাশুনা করছে। তোমার মার বড় ইচ্ছা ছিল, এলিজাবেথের সঙ্গে তোমার বিয়ে তিনি দেখে যাবেন।

মা–মা নেই। দিনের সূর্যকে যেন একনিমেষে নিবিড় কালো মেঘ ঢেকে ফেলল, সমস্ত পৃথিবী জুড়ে নিরন্ধ্র অন্ধকার, জমাট কুয়াশাভরা আকাশে যেন অমানিশার দুঃস্বপ্ন ঘুরে বেড়াচ্ছে! মা নেই–ভিক্টর ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের মা নেই! এক অসীম শূন্যতা, এক নিঃসঙ্গ অসহায়তা ধীরে ধীরে তার সমস্ত হৃদয় আচ্ছন্ন করে ফেলছে।

কত বছর মাকে তিনি দেখেননি? পাঁচ বছর–তা হবে। মাকে তিনি এই সুদীর্ঘ পাঁচ বছর ভুলে ছিলেন, কিন্তু মা তাকে ভোলেননি। তাঁর কাজের অসুবিধা হবে বলে মৃত্যুর সময়েও মা তাকে দেখতে চাননি। মা, সোনামণি মা!

চোখের সামনে থেকে কুয়াশা যেন ধীরে ধীরে সরে যেতে লাগল। অন্ধকার ভেদ করে একফালি সোনালি রোদ নিঃসঙ্গ হৃদয়ে অনুরণন সৃষ্টি করল। মনে পড়ল ছোট্ট দুটি ভাই আর্নেস্ট আর উইলিয়মের কথা। দাদাকে তারা কত ভালোবাসে। দাদা তাদের বড় বৈজ্ঞানিক–এই গর্বে তারা বুক ফুলিয়ে হাঁটে। আর এলিজাবেথ! মা’র পালিতা কন্যা। একটার পর আর একটা ছোট ছোট ঘটনা তার চোখের সামনে ছায়াছবির মতো এসে সরে যেতে লাগল।

আমাদের এই দুঃখ ও বিপদের দিনে প্রভূত সাহায্য করেছে তোমার বন্ধু ক্লেরভাল। তোমার মা’র সেবা-শুশ্রষা থেকে শুরু করে শেষ কাজ পর্যন্ত নির্বিঘ্নে সুসম্পন্ন সে করেছে। তার কাছে আমাদের ঋণ অপরিশোধ্য। আজও সে সমানে আমাদের দেখাশোনা করে।

হেনরি ক্লেরভাল! ভিক্টর ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের আজন্ম সুহৃদ ও সহপাঠী। বিজ্ঞান পড়ার ঝোঁক থাকা সত্ত্বেও তার বাবা তাকে পড়তে দেননি, পারিবারিক ব্যবসায়ে প্রথম থেকেই ঢুকিয়ে দেন। কেরভাল দেখাশোনা করছে–এই যা ডক্টর ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের সান্ত্বনা।

ডক্টর নীল এসে ঘরে ঢুকে একটু ভীত হয়ে উঠলেন। তাঁর গুৰু ডক্টর ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের চেহারার এ কী পরিবর্তন! আজ প্রায় পাঁচ বছর ধরে তিনি তাঁর সঙ্গে একত্র কাজ করছেন–প্রাণপ্রাচুর্যপূর্ণ ও সদাহাস্যময় এই ব্যক্তিকে কখনো এত অসুস্থ, এত উদ্যমবিহীন দেখেননি। বললেন—স্যার! আপনার কি অসুখ করেছে?

না–ডক্টর ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন উত্তর দিলেন–মা মারা গেছেন, চিঠি এসেছে।

–আপনার তো তবে একবার বাড়ি যাওয়ার দরকার।

বাড়ি!–একটা দীর্ঘনিশ্বাস চেপে ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন বললেন–হ্যাঁ, যাব। তবে আগে কাজ! মা মৃত্যুর আগে আমাকে দেখতে চাননি–আমার কাজের অসুবিধা। হবে বলে। মা-র এতবড় অসুখ–আমাকে কেউ আগে খবর দেয়নি ডক্টর নীল– আমার কাজের অসুবিধা হবে বলে। ডক্টর নীল, কাজ-কাজ–কাজ! আমার আর অপেক্ষা করার সময় নেই। যে কাজ শুরু করেছি, তা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শেষ করতেই হবে। আজ কাজ ফেলে চলে যাব?

ডক্টর নীল বললেন–তা ঠিক। কিন্তু যদি কিছু মনে না করেন তো বলি আপনি ঠিক কী কাজ করছেন মানে আপনি ঠিক কী বিষয় নিয়ে গবেষণা করছেন, আমি আপনার সঙ্গে এতদিন থেকেও ঠিক বুঝতে পারলাম না।

ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন বললেন–আমি যে কী করছি তা আমি কাউকে বলিনি। আপনি আমাকে এত সাহায্য করছেন, তবু আমি আপনার কাছে সেকথা গোপন করে রেখে গেছি। হয়তো আপনি আমাকে অনেক কিছু ভাবতে পারেন বিশ্বাস করুন, আমার সমস্ত অন্তর একসঙ্গে সব কথা আপনাকে অনেকবার বলতে চেয়েছিল, কিন্তু পারেনি–শুধু আপনি হাসবেন বলে। কারণ আমি জানি, আমি অসম্ভবের কল্পনা করছি–অসম্ভবকে সম্ভব করার সাধনা করছি। এই সাধনার জন্য সুদীর্ঘ পাঁচ বছর আমি ঘর-বাড়ি, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব ত্যাগ করে এই নির্জন নির্বান্ধব দেশে ল্যাবরেটরিতে আপনাদের দু-একজনকে নিয়ে পড়ে আছি। কতবার বাবা-মা’র কাছ থেকে চিঠি এসেছে, উত্তর দেওয়ার পর্যন্ত সময় হয়নি। আমার প্রাণের বন্ধু হেনরি ক্লেরভাল কতবার ছুটে এসেছে জেনেভা থেকে আমার খবর নিতে। কতবার সে জিজ্ঞাসা করেছে-কী আমার গবেষণার বিষয় যার জন্য আমি সব ভুলে বসে আছি? তার কাছে আমার কোনো কথা গোপন নেই, কিন্তু কিন্তু তাকেও আমার গবেষণার বিষয় বলতে পারিনি। সে বিশ্বাস করবে না, উপহাস করবে–এই ভয়ে। আপনি বৈজ্ঞানিক, আমার সহকর্মী এবং এই গবেষণার চরম সাফল্যে আপনার দানও কম নয়–এই স্বীকৃতির জন্য আজ আপনাকে আমি সব কথা খুলে বলব। হয়তো বিশ্বাস। হবে না, মনে মনে হাসবেন–তবু কাউকে আমার কথা না বলে পারছি না। কিন্তু তার আগে আপনাকে কথা দিতে হবে যে, একথা আর কাউকে আপনি এখন জানাবেন না।

ডক্টর নীল বললেন–আপনি আমাকে সহকর্মী বলে বেশি সম্মান দিচ্ছেন। আমি আপনার শিষ্য, আপনার নগণ্য এক সহকারী মাত্র। আপনাকে অবিশ্বাস করলে এতদিন আপনার কাছে পড়ে থাকতাম না। আপনি আমাকে সব কথা নির্ভয়ে বলতে পারেন; আমার কাছ থেকে কোনো কথা প্রকাশ পাবে না।

ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন বললেন–ছেলেবেলা থেকে আমার কলকজা এবং বিজ্ঞানের দিকে অত্যন্ত ঝোঁক। অবাক হয়ে দেখতাম কেমন দম দিলে রেলগাড়ি ছুটে চলে, ছোট পুতুল প্রভৃতি নাচে। দিন দিন বিজ্ঞানের ওপর আমার শ্রদ্ধা বেড়ে যেতে লাগল। তারপর যখন বড় হলাম, তখন এক চিন্তা আমাকে পেয়ে বসল-কলকজা দিয়ে যদি পুতুল চালানো সম্ভব হয়, মানুষ গড়া কি অসম্ভব হবে? মানুষ যদি মানুষের প্রাণ নিতে পারে, তবে চেষ্টা করলে কি প্রাণ দিতে পারে না? দিনরাত শুধু ভাবতাম, কী করে মানুষ তৈরি করব।

শুধু সেইজন্যই বাবার শত অমতে, বন্ধু ক্লেরভালের নিষেধ সত্ত্বেও মা’র চোখের জল অগ্রাহ্য করে ইঙ্গলস্টাট বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান পড়তে গেলাম। আমার অধ্যাপকদের মধ্যে দুজন– প্রফেসর ক্রেম্প আর প্রফেসর ওয়ান্ডমান–ঠিক আমার মতোই অদ্ভুত প্রকৃতির ছিলেন। তাদের দুজনের কাছে আমি শুনতাম অ্যালকেমির যুগের অসাধ্যসাধনের প্রচেষ্টার কাহিনী, কত অলৌকিক ঘটনা–সে যুগের বিজ্ঞান যার কারণ দেখাতে পারেনি, অথচ অনেক বিস্ময়কর ঘটনা সম্ভব। হয়েছে। বিশেষ করে প্রফেসর ওয়ান্ডমান আমার এই পাগলামির প্রধান সহায়ক হয়ে উঠলেন। পড়াশোনা শেষ হয়ে গেল, বাড়িতে ফিরে গেলাম কিন্তু মাথায় সেই একই চিন্তা কী করে মৃতে জীবন সঞ্চার করা যায়, কী করে নতুন মানুষ সৃষ্টি করা যায় যে মানুষ জ্ঞানে, বুদ্ধিতে, কর্মশক্তিতে সাধারণ মানুষের চেয়েও বড় হবে। যাকে দিয়ে নতুন এক সুন্দর পৃথিবী সৃষ্টি করা যাবে।…

তিনি বলে যেতে লাগলেন–এইজন্য কত বই পড়তে শুরু করলাম। কত জাদুকরের সঙ্গে আলাপ করেছি এবং তারপর নিজে কিছু কিছু জাদুবিদ্যা শিখতেও শুরু করলাম। মনে মনে অসম্ভব বল পেলাম। জাদুবিদ্যা এবং বিজ্ঞান এই দুই বিদ্যার সাহায্যে যে আমি মানুষ গড়তে পারব–সে বিষয়ে আমি একরকম নিঃসন্দেহ হয়ে গেলাম। ভেবেছিলাম আমার প্রাণের বন্ধু ক্লেরভালের সাহায্য নেব, কারণ একা একা সব করা সম্ভব নয়, কিন্তু ও পাগল ছেলে, ওর ধৈর্য নেই। তাই কী যে করব বুঝে উঠতে পারলাম না। কাজটা আমি গোপনভাবেই করতে চাই; তাই শবদেহ সংগ্রহও গোপনে করাই উচিত। কিন্তু একা যে-কী করে সম্ভব ভেবে উঠতে পারলাম না। এমন সময় আপনার সঙ্গে আলাপ। অর্থাভাবে আপনি বিজ্ঞানচর্চায় মন দিতে পারছিলেন না, সে অর্থাভাব আমি দূর করলাম–একটি শর্তে যে, আপনি বিনা-প্রতিবাদে আমার কথা শুনবেন। আজ পর্যন্ত আপনি আপনার শর্ত সম্পূর্ণ মেনে চলেছেন, যার জন্য আপনাকে আমার আন্তরিক ধন্যবাদ। তারপর আপনি শবদেহ সংগ্রহ করে আমার যে উপকার করেছেন, তা আমি জীবনে ভুলব না।

ডক্টর নীল বললেন–কিন্তু, মানুষ গড়া কি সত্যিই সম্ভব?

ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন বললেন–নয় কেন? আমার সব কাজ শেষ হয়ে এসেছে। শুধু আপনি আজ আর একটা কাজ করে দিন। আপনি সায়েন্স ইনস্টিটিউট থেকে শুধু একটি মানুষের ব্রেন’ এনে দিন। অত্যন্ত গোপনে এবং লুকিয়ে আনতে হবে। তারপর আশা করি, এ ব্যাপারে আর আপনার দরকার হবে না।

ডক্টর নীল বললেন–বেশ, আজই আপনি তা পাবেন।

.

সায়েন্স ইনস্টিটিউট। ডক্টর রে উৎসুক ছাত্রদের বক্তৃতা দিয়ে চলেছেন। ডক্টর নীল ছাত্রদের মধ্যে আত্মগোপন করে আছেন। প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড জারে ‘ব্রেন’গুলো রয়েছে অ্যালকহলের মধ্যে। ডক্টর নীলের গা ছম ছম করে উঠল। আজই বক্তৃতার পর ওরই একটি চুরি করতে হবে। যদি ডক্টর ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের আবিষ্কার সফল হয়… যদি তিনি মানুষ গড়তে পারেন… যদি অতিমানুষ মানুষের হাতে বন্দি হয়, যখন ইচ্ছা তাকে মারো, যখন ইচ্ছা বাঁচাও…তবে…তবে…? সমগ্র জগতে ছড়িয়ে পড়বে ডক্টর ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের নাম–আর তার এককোণে ছোট্ট তারার মতো জ্বলবে তারও নাম। জগতের মনীষীদের মাঝে তাদের নাম থাকবে চিরস্মরণীয় হয়ে–এঁরা মানুষ সৃষ্টি করেছেন, এঁরা মানুষকে অজেয় করেছেন, এঁরা মানুষকে শক্তিমান করেছেন!

ডক্টর নীল লুব্ধদৃষ্টিতে অ্যালকহলে-রাখা বেনগুলোর দিকে তাকিয়ে আছেন। ডক্টর রে যে কী বলছেন তা তার কানে যাচ্ছিল না। তিনি শুধু প্রতীক্ষা করছেন, কখন এই অভিনয়ের শেষ হবে-কখন শেষ হবে বক্তৃতা-কখন রঙ্গমঞ্চে নামবার আসবে লগ্ন!

ঢং ঢং ঢং….

ঘণ্টা বেজে গেল। বক্তৃতার সময় শেষ হয়েছে, এসেছে তার রঙ্গমঞ্চে নামবার চরম মুহূর্ত। চোখের সামনে নাচছে প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড জারগুলো। এক মুহর্ত–শুধু এক মুহূর্তের জন্য চাই সময়! তারপর নতুন উদ্যমে এগিয়ে যেতে হবে সম্মুখের পথে– বাধা নেই, বিঘ্ন নেই–আছে শুধু ছন্দ-হিল্লোলিত জীবনের আলোকিত পথ–আছে। জীবনের গৌরবময় সাফল্য।

.

ডক্টর রে ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেলেন। ছেলেরাও চলে গেল ক্লাস থেকে। ডক্টর নীল এই সময়ের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। ক্লাসটি নির্জন হতেই ছুটে গেলেন তিনি। কোনটা নেবেন ভাববার সময় পেলেন না। এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করার অবকাশ নেই। কে কখন এসে পড়বে, কে কখন দেখে ফেলবে–তাদের সমস্ত পরিকল্পনা নিমেষে নষ্ট হয়ে যাবে। একটা জার থেকে একটা ব্রেন নিয়ে গোপনে বেরিয়ে গেলেন ক্লাস থেকে।

যাক, এখন তিনি নিশ্চিন্ত। এখন আর ধরা পড়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই। সকলের অজ্ঞাতসারে তিনি বেরিয়ে যেতে পেরেছেন।

ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন ব্রেনটা দেখে একটু চমকিয়ে উঠলেন–এ কি মানুষের ব্রেন! কিন্তু আর ভাববার সময় নেই। পাঁচ বছর প্রায় কেটে গেছে এই মানুষটি গড়তে আর অপেক্ষা করতে তাঁর ইচ্ছা ছিল না। অতিমানুষই তো তিনি সৃষ্টি করতে চলেছেন, তবে মিছে এ ভয় কেন? আর যদি মানুষ গড়তে গিয়ে অমানুষ হয়ে যায় তবে প্রাণ যখন দিয়েছেন, নিতেও পারবেন। যদি এ মানুষ না হয়, তবে এর প্রাণ নিয়ে আর একটি মানুষকে প্রাণ দেবেন। সে-ও যদি মানুষ না হয়, তবে দেবেন আর একজনকে। প্রাণদানের রহস্য যখন তিনি উদ্ঘাটিত করতে পেরেছেন তখন আর ভয় কী? তাঁর সাধনা সফল করে তারপর তিনি নেবেন ছুটি।

.

নভেম্বরের মৃত্যু-শীতল অন্ধকার নিচ্ছিদ্র রাত্রি। সমস্ত শহরটায় একটি প্রলয়-লীলা চলছে। কাছের বড় বড় গাছ কাঁপিয়ে শীতের ঝড়ো বাতাস হা-হা করে দরজা-জানালায় ধাক্কা দিচ্ছে, বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা মোটা কাঁচের সার্শির ওপর মাথা খুঁড়ছে। দূরের কাছের সমস্ত পর্বতশৃঙ্গে সাদা জমাট বরফের ওপর দীর্ঘ শীতল রাত্রি জমে আড়ষ্ট হয়ে রয়েছে।

ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের সামনে টেবিলের উপর শুয়ে রয়েছে একটি সুন্দর অতিমানুষ। কী সুন্দর তাকে দেখতে–কী সুন্দর তার মুদিত চোখ, কী সুন্দর তার নির্বাক মুখ, আর কী সুঠাম তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ!

ওই সুন্দর মানুষটির দিকে তাকিয়ে ভাবছেন ফ্রাঙ্কেনস্টাইন। এখন আর বাকি শুধু প্রাণপ্রতিষ্ঠা। হয় মানুষ জিতবে, নয় ভগবান। আজ ভগবানের পরাজয় মানুষের হাতে প্রতিমুহূর্তে। শুধু এই মানুষ মরা-বাঁচার ব্যাপারেই এখনো তিনি অপরাজেয় হয়ে আছেন। যদি এই সাধনায় আজ তিনি জয়যুক্ত হন, তবে পৃথিবীতে দেবত্বের অবসান–মানবের জয়জয়কার। মানুষের এই বিজয়, মানবসমাজের যে কতখানি মঙ্গল করবে এই ভেবে দেবতার নিজে থেকে পরাজয় স্বীকার করা উচিত।

সুদীর্ঘ রাতও ছোট হয়ে আসে। মোমবাতিটি গলে গলে প্রায় নিঃশেষ হয়ে এসেছে। ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন অপলকদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন সেই মূর্তিটির দিকে। কখন আসবে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। কখন জাগবে মানুষ–তার সৃষ্টি এই অতিমানুষ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *