বায়ু পুরাণ ৬১-৭০

একষট্টিতম অধ্যায়

সূত বললেন–যুগগুলোতে যে সমস্ত প্রজার জন্ম হয় তাদের বিবরণ বলছি –অসুর, সাপ, গরু, পাখি, পিশাচ, যক্ষ, রাক্ষস প্রভৃতি ও প্রজারা যে যুগে জন্মে ও যতকাল বেঁচে থাকে তা বলছি। পিশাচ, অসুর, গন্ধর্ব, যক্ষ, রাক্ষসদের হঠাৎ কেউ বধ না করলে তারা যুগমাত্র বেঁচে থাকে। মানুষ, পশু, পাখি ও স্থাবরস্পৃহ যুগের ধর্ম অনুযায়ী আয়ু নিয়ে বেঁচে থাকে। কলিতে মানুষের আয়ু একশ বছর মাত্র। এই যুগে মানুষের উচ্চতাও কমতে থাকে।

গরু, ঘোড়া, হাতি, মোষ প্রভৃতি স্থাবরদের যুগে যুগে পরিমাণগত হ্রাস-বৃদ্ধি দেখা যায়। গরুদের কুঁজ অবধি উচ্চতা সাতাত্তর অঙ্গুলী, হাতিদের উচ্চতা আটশত অঙ্গুলি। ঘোড়ার উচ্চতা নয়শ ষাট অঙ্গুলি। বানরদের উচ্চতা পঞ্চাশ আঙুল। দেবদেহের থেকে মানুষ দেহের গুণ কিছুটা কম থাকে। দেবশরীর অধিক বুদ্ধি যুক্ত। গরু, ছাগল, মোষ, ঘোড়া, হাতি, পাখি ও সাপেরা যজ্ঞক্রিয়া সাধক যজ্ঞীয় বলে প্রসিদ্ধ। এরা দেবস্থানগুলোতে দেবতাদের যথেচ্ছ ভোগের জন্য জন্মে থাকে। এরপর আসছে সৎ ও সাধুর বর্ণনা। যাঁরা ব্রহ্মার সাথে অত্যন্ত একাত্মতা লাভ করেছেন, তাদেরই সৎ বলা হয়। যাঁরা দশরকম বিষয়ে ও আটরকম কারণে ক্রুদ্ধ হন না বা আনন্দিত হন না, তারাই জিতাত্মা। গুরুহিতকারী ব্রহ্মচারী বিদ্যায় সাধন করেন বলে তাদের সাধু বলা হয়। ক্রিয়াসাধন করেন বলে গৃহস্থকেও সাধু বলে। এভাবে ব্রহ্মচারী, গৃহস্থ, বানপ্রস্থকারীরা, ভিক্ষুকরা, নিজেদের আশ্রমগুলোর ধর্ম সাধন করেন বলে তাদের সাধু বলা হয়।

দেব, পিতৃ, মুনি, মানব সকলেই জ্ঞানের ভেদাভেদের জন্য ধর্মতত্ত্ব নির্ণয় করতে পারেন না বলে, ধর্ম নিয়ে নানা প্রচার হয়। কুশল ও অকুশল অর্থাৎ ভালো ও মন্দ কাজ দিয়েই ধর্ম বা অধর্ম নির্ণয় করা হয়। ধারণকারী ‘ধৃ’ ধাতু থেকেই ধর্ম শব্দটি এসেছে। যার দ্বারা ইষ্ট লাভ করা যায় তাই ধর্ম। যারা লোভহীন, দম্ভহীন, জিতেন্দ্রিয়, সুশিক্ষিত, সরলমনা, তাঁরাই আচার্য পদবাচ্য। যিনি আচার্য, তিনি আচার পালন করেন। অপরকে আচারে নিষ্ঠ করেন। সপ্তর্ষিরা আদি কল্পীয় জনগণকে ঋক, যজুঃ, সাম, শ্রুতি ও বেদাঙ্গ সম্মত শ্রৌত ধর্ম বর্ণাশ্রম বিভাগজাত।

মন্বন্তরের শেষে যে সপ্তর্ষিরা থাকেন তারাই যুগে যুগে সৃষ্টি বিস্তারের জন্য, ধর্ম প্রচারের জন্য বারবার ধর্মাচার প্রবর্তিত করেন। দান, সত্য, তপস্যা, আলো, বিদ্যা, যজ্ঞ, সন্তান ও দয়া– এই আটরকম গুণ শিক্ষাচারের লক্ষণ। সর্ব মন্বন্তরেই অবশিষ্ট মনু ও সপ্তর্ষিরা এই ধর্মাচরণ করেন বলে এঁদের শিক্ষাচার্য বলে। শুনে যা জানা যায় তা হল সৌত, আর যাকে মনে করা হয়েছে তা স্মার্ত।

এরপর ধর্মের অন্য লক্ষণগুলো বলছি। যা কিছু দেখা যাক না কেন, জিজ্ঞাসা করলে গোপন না করে যথাযথ বলাই হচ্ছে সত্য। ব্রহ্মচর্য, জপ, মৌন ও অনাহার–এগুলি হল তপস্যার মূল কথা এটি খুবই দুঃসাধ্য, পশু, দ্রব্য, হবি, ঋক, সাম, যজু, ঋত্বিক ও দক্ষিণা, এই সমস্তের সংযোগকেই যজ্ঞ বলা হয়। হিত, অহিত সমস্ত কিছুতে সমান দৃষ্টি, দয়া, খারাপ কথা শুনে বা আঘাত পেয়েও খারাপ কথা না বলা, আঘাত না দেওয়া, বাক্য, মন্দ, কাজের যে সংযম তাই ক্ষমা, ইন্দ্রিয় সংযম করার নাম হল ব্রহ্মচর্য। নির্দোষভাবে ব্রহ্মচর্য পালনই দম’। নিজের কিংবা পরের মিথ্যা প্রবৃত্তি সংযমই হল ‘শম। যে দ্রব্য প্রিয় এবং সৎপথে উপার্জন করা হয়েছে। তাই যোগ্য পাত্রে দান করতে হয়। এটাই দানের লক্ষণ। দান তিনরকম– জেষ্ঠা, মধ্যম ও কনিষ্ঠ। জ্যেষ্ঠা দান মুক্তি দায়ক, কনিষ্ঠ দান স্বার্থ সাধক, স্নেহবশে বন্ধুবান্ধব ইত্যাদিতে দানকে বলে মধ্যম কৃত ও অকৃত কাজ ত্যাগই ‘সন্ন্যাস’। শুভাশুভ পরিত্যাগ করাই ত্যাগ। এই শব্দে বাচ্য, আগের স্বয়ম্ভুব মন্বন্তরে ধর্মতত্ত্বজ্ঞ ঋষিরা প্রত্যঙ্গ গুলোর এরকম লক্ষণ বলেছেন।

এবার মন্বন্তরের বিধানগুলোর কথা বলছি। প্রতি মন্বন্তরেই শ্রুতি আলাদাভাবে প্রবর্তিত হয়। ঋক, সাম, যজুঃ দেবতা শ্রোত্র, বিধি, স্তোত্র সমস্তই আগের মত প্রবর্তিত হতে থাকে। প্রতি মন্বন্তরে যেমন দেবতা তাদের সেরকম চাররকম স্তুতি ও ব্রহ্মা রচনা করেন, ঋক, যজুঃ ও সাম বেদের মন্ত্রগুলোও আলাদাভাবে প্রবর্তিত হয়। পূর্ব পূর্ব মন্বন্তরে কঠিন তপস্যাকারী মুনিদের মনে পরিতোষ, দুঃখ, সুখ, শোক থেকে এই পাঁচটি কারণে মন্ত্রগুলো প্রাদুর্ভূত হয়।

ঋষি পাঁচ প্রকার। সেই ঋষি ও আর্যদের লক্ষণ বলব। প্রলয়ের শেষে প্রকৃতির তিনটি গুণের সাম্য ছিল। তখন দেবতাদের কর্তা বা রাজা ছিল না। তারপর দেশকালহীন একটি চেতনার বিকাশ হয়। এর থেকে কাজের প্রবৃত্তি জন্মে, মহত্তত্ত্ব থেকে অহংকার এবং অহংকার থেকে পঞ্চমাত্র জন্মে। তা থেকে স্থান পঞ্চাভূত প্রাদুর্ভূত হয়। সহজসিদ্ধ কারণ সর্বদাই কার্য আকারে পরিবর্তিত হয়। জুলন্ত মশাল যেমন ওপর দিকে উঠে দশদিক আলো করে, শ্রোতজ্ঞ তেমনি কালধর্ম দিয়ে বিবর্তিত হয়ে একদা সমস্ত ব্যাপ্ত করে থাকে। মহত তত্ত্বের বিবরণ দেখবার জন্য সেই সর্বজ্ঞাসাধার সশরীরে আগে যেখানে ছিলেন সেখানেই আছেন। তিনি যেন তমোরূপ মহাগৃহের দ্বারে রয়েছেন। মহান তমোরাশির পায়ে রয়েছেন। মহান বিবর্তিত হলে তার জ্ঞান, বৈরাগ্য, ঐশ্বর্য ও ধর্ম এই চাররকম বুদ্ধি আবির্ভূত হয়। তার এই বুদ্ধি সহজ ও সর্বাধিক প্রভাত বিশিষ্ট। যিনি অব্যক্ত নামে পুরে শুয়ে থাকেন যিনি সেই অব্যক্ত পুরীর অধীশ্বর এবং যার ক্ষেত্র জ্ঞান রয়েছে, তাকে পুরুষ বলে। ক্ষেত্রবিজ্ঞানের তারণ তার নাম ক্ষেত্রজ্ঞ। ঋষি ঋতুগমন, শ্রুতি, সত্য ও তপস্যার্থক। যাঁরা এসব গুণে গুণী তাদেরকেই ঋষি বলে। আদিকালে যিনি উৎপন্ন তাকেও ঋষি বলে। যে ঋষি বুদ্ধি দিয়ে পরমতত্ত্ব জানতে পারেন, তাদের বলা হয় পরমর্ষি। যার পরিমাণের সীমা নেই, তাকে মহান বলা হয়। যে সমস্ত বুদ্ধি পারদর্শী বুদ্ধি দিয়ে মহানকে অবলম্বন করেন, তারা মহর্ষি পদবাচ্য। ঈশ্বরের সন্তানরা যারা অহংকার ও অজ্ঞান ত্যাগ করেছেন। তারাও ঋষিত্ব পেয়ে থাকেন। যাঁরা পঞ্চন্মাত্রে ও সত্যে সমাসক্ত, সেই সত্য দৃষ্টি সম্পন্ন ঋষিদের সপ্তর্ষি বলা হয়।

ঋষি জাতি পাঁচ প্রকার। ভৃগু, মরীচি, অত্রি, অঙ্গিরা, পুলহ, ক্রতু, মনু, দক্ষ, বশিষ্ট –এরা ব্রহ্মার মানস পুত্র। মহান সেই সমস্ত ঋষিরূপে পরিণত হয়েছিলেন বলে তাদের মহর্ষি বলা হয়। এদের সন্তানদের বর্ণনা দেওয়া হল। কাব্য, বৃহস্পতি, উশনা, কশ্যপ, উতথ্য, বামদেব, অযোজষ, উষিজ, কর্ম, বিশ্রবা, শক্তি, বালখিল্য, এরা ঋষিপদবাচ্য ঋষিপুত্র। ঋষিদের বিবরণ শুনুন। বৎসর, নগ্নহু, ভরদ্বাজ, বৃহদুম, শরদ্বান অগস্ত্য, ঐষিজ, দীর্ঘতমা, বৃহদুকথ, শরদ্বত, বাজQবা সুখিও প্রভৃতি ঋষিকরা সত্য প্রভাবে ঋষিত্ব পেয়েছেন।

আরো অন্যান্য মুনিরা এবং এই সমস্ত ঋষিকরা মন্ত্র প্রণয়ন করেন। ভৃগু, কাব্য, প্রচেতা, জিতেন্দ্রিয় পৃথু ইত্যাদি এই রকম উনিশজন মন্ত্রবাদী ঋষি আছেন। অঙ্গিরা বংশের তেত্রিশজন মন্ত্র প্রবর্তক মুনি রয়েছে। কশ্যপ, বৎসর, বিভ্রম, রৈভ্য, অসিত, দেবল এই কয়জন রয়েছেন কশ্যপ বংশের দেবতা, এঁরা সকলেই ব্রহ্মবাদী। অত্রি, আর্চিষ্মান শ্যামাবান, ধীমান এঁরা হলেন অত্রি গোত্রজাত। বশিষ্ঠ, শক্তি পরাশর, ইন্দ্র, প্রমিতি, ভরদ্বাজ, মৈত্র–বরুণ, কুন্তিন, এই সাত মহর্ষি ব্রহ্মক্ষেত্র নিবাসী, ব্রহ্মাক্ষেত্র মহাতীর্থ ব্রহ্মা প্রাচীনকালে তা নির্মাণ করেন। একদা পিতামহ এখানে থাকতেন, সেই পুণ্যতম কুরুক্ষেত্রে দেবতা ও মুনিদের সমাগম হয়। ব্রহ্মা প্রশ্ন করলেন–আপনারা বায়ু দেবতাকে কোথায় দেখেছেন? ঋষিরা তার উত্তরে বললেন–আমরা বায়ু দেবতাকে দেখিনি, ঋষিরা এ-বিষয়ে চিন্তা করতে লাগলেন।

এমন সময়ে একটা ছোট্ট অণুমাত্র পুর তাঁদের চোখের সামনে আস্তে আস্তে বড় হয়ে গেল। সেই পুর বায়ুপুর নামে প্রসিদ্ধ। সেই পুরে আঠারো হাজার ব্রাহ্মণ ও দ্বিগুণ পরিমাণে শূদ্রের আগমন হয়। বায়ু সেই ব্রাহ্মণদের বললেন–আপনারা আমাকে ভক্তি করে থাকেন, অতএব আমার নামই খ্যাত হোক। হে দ্বিজগণ! আপনারা প্রত্যেকে দু-দুজন ব্রাহ্মণের অনুগত হোন। আপনাদের এগারোটি গোত্রের প্রবর্তন হবে। আপনাদের বিয়ের সময় চত্বরের ওপর মঙ্গলস্নান হবে। বলবান মানুষরা তলোয়ার হাতে সেই জায়গা পাহারা দেবেন যাতে সেই স্থান কেউ না দেখতে পায়। এই নিয়মটি আপনাদের জন্য মঙ্গলজনক। সগোত্রা রমণীর জন্য একটি নৈবেদ্য তৈরি করতে হবে। চারজন রমণী কুণ্ডন কার্য করবেন। এই সরোবরে স্নান করলে ভবতাপ দূর হয়। এই সরোবরে আর কেউ স্নান করতে পারবে না। আমার নামে খ্যাত যে ছয়টি জায়গা আছে তা দর্শন করে মানুষ পবিত্র হয়। হে বিপ্রজন! যেখানে হনুমান রয়েছেন, সেই তীর্থ ভূতলে বিখ্যত তীর্থ। বায়ু ধর্ম রক্ষার জন্য তিন দেবতার আদেশে বিপদের স্থাপন করেছেন। রুদ্রদেব যেখানে বিরাজ করছেন। বায়ু সেখানে বাড়াদিত্য নামে সূর্যদেবের প্রতিষ্ঠা করেন। ত্রিলোকাধার সূর্যদেব সহস্ৰকিরণযুক্ত, সমস্ত অস্ত্রে ভূষিত ও রত্নদেবীর সাথে বিরাজ করছেন। যেখানে সূর্য, ব্রহ্ম, রুদ্র ও বিষ্ণু এই চারটি কুণ্ড রয়েছে। সেখানে নবদুর্গা রয়েছেন। দুটি বিষ্ণু, তিনটি শিব, চারটি যজ্ঞ সেখানে উপস্থিত। পৈতে, বিয়েতে এদের কর দেওয়া হয়। শাস্ত্রে অভিজ্ঞ ব্রাহ্মণদের সংখ্যা এখন শূদ্রদের চেয়ে অনেক বেশি। সেই বায়ু স্থান মহাপুরে বাপী, কুয়ো, জলবায়ু, দেবমন্দির, ধর্মশালা, এসমস্ত প্রচুর ছিল। সেখানে রত্নাবতী নামে গঙ্গা বইছে। সেই গঙ্গাই কলিকালে মহাপাতকনাশিনী নদীরূপ নিয়েছে। বায়ু স্থাপিত এই রাজ্য পাপনাশক। আপনাদের কাছে সেই জায়গায় বর্ণনা সংক্ষেপে দিলাম।

বায়ু স্থাপিত বিপ্রের উপমাহীন। এরা বিধর্ম ধ্বংসকারী শাস্ত্র প্রণেতা। হিত ধাতু থেকে হেতু শব্দ নিষ্পন্ন হয়েছে। প্রপূর্বক শংস ধাতু থেকে প্রশংসা এসেছে। এর অর্থ গুণবত্ত যা অনেক আগে ঘটেছে তাকে পুরাকল্প বলে। সেই সব পুরাকল্প শুদ্ধ মন্ত্র ব্রাহ্মণ কল্প নিগমাদি দিয়ে কল্পিত হয়নি অনিশ্চিত ভাবেই রচিত হয়েছিল। এ কল্প যেমন, সে কল্পও তেমনি ব্রাহ্মণদের পক্ষে এটা দশম উপদেশ।

.

বাষট্টিতম অধ্যায়

ঋষিরা সূতকে জিজ্ঞাসা করলেন, প্রাচীনকালে বেদগুলো কিভাবে রচিত হয়? স্বায়ম্ভুব মন্বন্তরে দ্বাপর যুগ উপস্থিত হলে ব্রহ্মা মনুকে বললেন–হে তাত! যুগ পরিবর্তন হওয়াতে দ্বিজাতীরা স্বল্পবীর্য হয়েছে, যুগের দোষে সবাই বীর্যহীন হয়ে পড়েছে। বীর্য, সত্য, তেজ, বাক্য সবই সত্যযুগ থেকে দশহাজার ভাগ ক্ষীণ হয়েছে। এটা আস্তে আস্তে একেবারেই নষ্ট হয়ে যাবে। তাই যাতে বেদ নষ্ট না হয়, সেজন্য বেদকে চারভাগে ভাগ করতে হবে। বেদ নষ্ট হলে যজ্ঞ লোপ পাবে। যজ্ঞলোপে দেবতা নাশ, তার ফলে সর্বনাশ। প্রভু মনু “তথাস্তু’ বলে চতুষ্পদ বেদকে চারভাগে ভাগ করলেন। এখন আপনাদের যে বেদ আছে এটাই সেই ব্রহ্মার নির্দেশানুসারে লোকহিত কামনায় চারভাগে বিভক্ত বেদ, এই মন্বন্তরে দিয়ে অন্যান্য মন্বন্তরের বেদবিভাগ কর্তাদের কথা বলছি। হে দ্বিজোত্তম! আপনারা শুনুন।

এই যুগে বিষ্ণুর অংশ প্রসিদ্ধ পরাশর নন্দন দ্বৈপায়ণ ব্যাস পদবী লাভ করেছেন তিনি ব্রহ্মার আদেশে বেদ বিভাগ করেন। বেদ প্রচারের জন্য চারশিষ্য নিয়োগ করেন। তাদের নাম জৈমিনি, সমন্ত, বৈশম্পায়ন ও শৈল, লোমবর্ষণ তাঁর পঞ্চম শিষ্য।

শৈল ঋগবেদে, বৈশম্পায়ণ যর্জুবেদে, জৈমিনি সামবেদ এবং সুমন্ত অথর্ববেদ অভ্যাস করেন। আর ভগবান দ্বৈপায়ণ ইতিহাস, পুরাণে শাস্ত্র সম্বন্ধে আমাকে শিক্ষা দিয়েছিলেন। যর্জুবেদ একটি ছিল একে তিনি চারভাগে ভাগ করেছেন। যজ্ঞে যে ব্রহ্মকার্য করতে হয় তা অথর্ববেদের মত। দ্বৈপায়ণ ঋকগুলো উদ্ধার করে ঋকবেদ রচনা করেন। সাম সংগ্রহ করে সামবেদ রচনা করেন। আর অথর্ববেদ দিয়ে রাজাদের কি কি কর্তব্য আছে, সেই যা কাজের বিধান করেন। পুরাতত্ত্ব বিশারদ দ্বৈপায়ণ পুরাণ সংহিতাও রচনা করেন। বেদপরায়ণ অন্যান্য ঋষিদের সাথে আলোচনা করে যর্জুবেদ সংগ্রহ করেন। যর্জুবেদের অবশিষ্ট দিয়ে যজ্ঞের বিধান তৈরি হল। এই অনুসারে অশ্বমেধ যজ্ঞ প্রবর্তিত হয়। শৈলমুনি, ঋগুলো সংগ্রহ করে তাদের দুভাগে ইন্দ্ৰপ্ৰমতি ও আর এক ভাগের শিক্ষা দিয়েছিলেন বাস্কলি মুনিকে। বাস্কলি চারটি সংহিতা রচনা করেন শিষ্য দ্বিতীয় শাখা অগ্মিধায়, তৃতীয় শাখা পরাশর, আর চতুর্থ শাখা মুনি শিক্ষা করেন। ইন্দ্ৰপ্ৰমতি মুনি একটি সংহিতা রচনা করে যশস্বী মার্কণ্ডেয় মুনিকে পড়িয়েছিলেন। মার্কণ্ডেয় তার পুত্র সত্যবাকে, সত্যশ্রবা সত্যহিতকে, সত্যহিত, তার মহাত্মা পুত্র সতীকে পড়িয়েছিলেন। বিদ্বান সতশ্রীর তিনশিষ্য হয়। তাদের প্রথম শাক্য, দ্বিতীয় রথীতর এবং তৃতীয় বাষ্কলি ভরদ্বাজ। এরা বিভিন্ন শাখা লিখেছিলেন। দেবামিত্র শাকল্য দ্বিজ, জ্ঞানের অহংকারী ছিলেন, তাই জনক রাজার যজ্ঞে এর বিনাশ হয়। শাংখ্যপায়ন বললেন, জ্ঞানগর্বিত এই মুনি কিভাবে বিনাশ হলেন? জনক রাজার অশ্বমেধ যজ্ঞে কি ঘটেছিল? এ সমস্তই আমাদের দয়া করে বলুন।

সূত বললেন–জনক রাজার যজ্ঞে প্রচুর লোকের আগমন হয়। সেই বিখ্যাত যজ্ঞ দেখার জন্য নানা জায়গা থেকে অনেক মুনি সেখানে উপস্থিত হয়ে ছিলেন। এ সমস্ত মুনিদের মধ্যে জ্ঞানে পাণ্ডিত্যে কে শ্রেষ্ঠ? এ কথা জানবার জন্য রাজার খুব কৌতূহল হল। তিনি বুদ্ধি করে বললেন–আমি তিন হাজার গরু, হাজারের বেশি সোনা, বহু গ্রাম, দান-সামগ্রী ইত্যাদি আপনাদের দান করতে চাই। আপনাদের মধ্যে যিনি প্রধান তিনি এই দান গ্রহণ করুন। তখন এই বিশাল দান লোভে সবাই বিবাদ করতে শুরু করল। সকলেই মনে মনে ভাবল, এগুলি আমি পাওয়ার যোগ্য।

তার মধ্যে মহাতেজস্বী তপস্বী যাজ্ঞবল্ক্য নিজের শিষ্যকে বললেন–বৎস এই ধন নিয়ে বাড়ি চলে যাও। এই ধন আমারই। আমি সর্ববেদের অসাধারণ বক্তা ও পণ্ডিত। যদি কেউ আমার কথায় সন্তুষ্ট না হন, তবে আমার সঙ্গে বিতর্কে আসুন। যাজ্ঞবন্ধ্যের এই কথায় মুনিরা সকলেই রেগে গেলেন। যাজ্ঞবল্ক্য হাসতে হাসতে বললেন–হে সত্যবাদী পণ্ডিতগণ, আপনারা রাগ করবেন না। আপনারা পরস্পর বিচার করুন। সম্পদের লোভে পণ্ডিতরা সগর্বে মহাবিচার করতে বসলেন। সমস্ত ঋষিরা একদিকে, আর যাজ্ঞবল্ক্য একদিকে। মুনিরা সবাই ধীমান, যাজ্ঞবন্দ্যের সাথে বিচারে উত্তর দিতে পারলেন না। ব্রহ্মতেজোরাশি মহাদ্যুতি যাজ্ঞবল্ক্য মুনিদের পরাজিত করে শাকল্য মুনিকে বললেন– তোমার পক্ষের কথা বল। মনে ভাবছো কেন? তুমি তো অজ্ঞান অভিমানে পরিপূর্ণ। যাজ্ঞবল্ক্যর কথায় মুনি শাক্য প্রচণ্ড রেগে গিয়ে কঠিন বাক্যে উত্তর দিলেন–তুমি আমাদের তৃণের মতো অবজ্ঞা করছ? এই মহা সার ধন তুমি নিজেই নিতে চাইছ। যাজ্ঞবল্ক্য উত্তরে বললেন–সৎ ব্রাহ্মণদের বিদ্যালব্ধ জ্ঞানই বল। আমি অর্থ কামনা করি।

বিপ্রদের কামনারূপ প্রশ্নটা হল ধন, আমরাও ইচ্ছা মতন প্রশ্ন করব। জনক রাজার তাই পন। এজন্য আমি ধন গ্রহণ করেছি, যাজ্ঞবন্ধ্যের কথা শুনে প্রচণ্ড রেগে শাক্য মুনি বললেন–এইবার আমি জিজ্ঞাসা করছি, তুমি প্রশ্নের উত্তর দাও। এইবলে তিনি প্রশ্ন করতে শুরু করলেন। দুই পণ্ডিতে তর্ক শুরু হল, শাকল্য মুনির হাজার হাজার প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দিতে লাগলেন যাজ্ঞবল্ক্য। তখন শাকল্য নিরস্ত হয়ে চুপ করে গেলেন। যাজ্ঞবল্ক্য বললেন–তুমি আমার একটি প্রশ্নের উত্তর দাও। না পারলে মরণ অভিশাপ দেওয়া হবে, এই প্রতিজ্ঞা রইল। শাকল্য প্রশ্নের জবাব দিতে না পেরে পরাজিত হয়ে মারা পড়লেন।

এইভাবে মহামতি যাজ্ঞবল্ক্য মুনিদের শত সহস্র প্রশ্নের উত্তর দিয়ে সমস্ত দান ধন গ্রহণ করে শিষ্যদের নিয়ে নিজ ভবনে ফিরে গেলেন। মহাত্মা শাকল্য পাঁচখানি সংহিতা রচনা করেন। তাঁর পাঁচ শিষ্য ছিলেন। শাকল্যের মৃত্যু হলে এই সমস্ত বা বিতণ্ডাকারী ব্রাহ্মণেরা প্রত্যেকেই ব্রহ্মহত্যা পাপগ্রস্ত হয়েছিলেন। সেজন্য তারা চিন্তিত হয়ে ব্রহ্মার কাছে গেলেন। ব্রহ্মা তাদের মনের কথা জানতে পেরে বললেন–তোমরা বায়পুরে যাও, সেখানে গেলে তোমাদের পাপ নাশ হবে। তোমরা সেখানে গিয়ে দ্বাদশী বায়ু কেশ্বরকে এই এগারো রুদ্রকে এবং বিশেষতঃ বায়ু পুত্রদের নমস্কার চারকুণ্ডে স্নান করলে, ব্রহ্মহত্যা থেকে মুক্তি পাবে।

ব্রহ্মার উপদেশে সেইসব বিবাদকারী মুনিগণ তাড়াতাড়ি বায়ুপুরে গিয়ে বিধান অনুযায়ী স্নান সেরে দেবতাদের দর্শন করে উত্তরেশ্বরকে প্রণাম করলেন। তারপর তারা নিজেদের মহিমায় ব্রহ্মহত্যা পাপ থেকে মুক্ত হয়ে সূর্যমণ্ডলে চলে গেলেন। সেই থেকে ঐ তীর্থগুলি পাপনাশক বলে খ্যাত হয়েছে। সেই সময় অঞ্জনার গর্ভের বায়ুপুত্র সত্যবিক্রম হনুমান প্রাদুর্ভূত হন। তখনই বায়ু সেই প্রশস্ত পবিত্র তীর্থ স্বরূপ পুরী নির্মাণ করেন। বায়ুপুরবাসী বিপ্রেরা, বাহ্নহীন লেখান করে শূদ্র বর্ণের জন্য কবর স্থাপন করলেন। তাঁদের রাজ্য এভাবে তৈরী হল।

ঋষিরা বললেন–ভরদ্বাজ, যাজ্ঞবল্ক্য, শালকি, ধীমান, নিগম বিশারদ, দ্বিজোত্তম, শতবলাক, বালকি এবং ভরদ্বাজ এরা প্রথমে তিনখানি সংহিতা রচনা করেন। রথীতর নিরুক্ত রচনা করেন। ঐ রথীতরের তিনজন শিষ্য ছিলেন। যাঁরা সংহিতা প্রবর্তন করেন, তাঁদের বহুবৃচ বলা হল। যিনি যজুর্বেদের উত্তম ষোলো সংহিতা প্রণয়ন করেছেন, সেই বৈশম্পায়ণই যর্জুবেদের প্রবর্তক। বৈশম্পায়ন একমাত্র মহাতপা। যাজ্ঞবল্ক্য ছাড়া অন্য সমস্ত শিষ্যকেই সংহিতা প্রদান করেন। বৈশম্পায়ন ছিয়াশী সংহিতার মধ্যে একটি বিশেষ রূপ কল্পনা দেখতে পাওয়া যায়। তাঁর শিষ্যদের মধ্যে তিনটি ভেদ আছে। এর ওপরে আবার উদীচ্য, মধ্যদেশ ও প্রাচ্যদেশ ভেদে সংহিতাগুলো নয়প্রকার ভেদ সম্পন্ন হয়েছে। সংহিতাবাদী এইসব দ্বিজরা চরক নামে অভিহিত হয়ে থাকেন। ঋষিরা দূতকে জিজ্ঞাসা করলেন–এঁরা কি কারণে চরক হলেন? সূত তখন চরক উৎপত্তির কারণ বলতে লাগলেন। একবার ঋষিদের একটি কাজে আলোচনার প্রয়োজন হলে সবাই মিলে একটি সভায় বসলেন। ঠিক হল যিনি সাত রাত্রির মধ্যে ঐ সভায় যোগদান করবেন না, তিনি ব্রহ্মহত্যা পাপে পাপী হবেন। তারপর সেখানে বৈশম্পায়ন ছাড়া সব ঋষিই এলো, তাই আগের কথা অনুযায়ী বৈশম্পায়নের ব্রহ্মহত্যা দোষ হল। তিনি নিজের শিষ্যদের বললেন–হে দ্বিজগণ, তোমরা সকলে মিলে আমার হয়ে ব্রহ্মহত্যা ব্রত আচরণ কর।

বৈশম্পায়ন শিষ্যদের মধ্যে যাজ্ঞবল্ক্য বললেন–এটা উচিত কম নয়। তিনি আরো বললেন–যে অন্য মুনিরা বৈশম্পায়নের সঙ্গে থাকুন কিন্তু তিনি তপস্যা করে বলসঞ্চয়ের জন্য সেখান থেকে চলে যাবেন। তখন বৈশম্পায়ন রেগে গিয়ে বললেন–তুমি আমার কাছে যে সব বেদবিদ্যা শিখেছ, তা ফেরৎ দাও।

যাজ্ঞবল্ক্যকে বৈশম্পায়ন একথা বলার পরে যাজ্ঞবল্ক্য রক্তবমির দ্বারা সমস্ত যজুর্বেদ গুরুকে আবার ফেরৎ দিলেন। তারপর সূর্যদেবের আরাধনা করতে লাগলেন। সূর্য যত উপরে উঠতে লাগল, যজুর্বেদ। সকল তত ওপরে সৌরমণ্ডলে আশ্রয় নিল। তখন সূর্য সন্তুষ্ট হয়ে বেদগুলি আবার যাজ্ঞবল্ক্যকে দান করলেন। অশ্বরূপধারী যাজ্ঞবন্ধ্যের শিষ্যরা যর্জুবেদ পাঠ করে বলে তারা অশ্বরূপ পেলেন।

যে সব বৈশ্বম্পায়ন শিষ্যরা তার ব্রহ্মহত্যা আচরণ করছিলেন তারাই চরক নামে খ্যাত হয়েছেন। এই হল চরক বিবরণ। যাজ্ঞবন্ধ্যের যেসব শিষ্যরা অশ্বরূপ ধারণ করেছিলেন এরা হলেন কম্ব, বৈধেয়শালী, মধ্যস্থিন, শাপেয়ী বিদিগ্ধ, সাপ্যাউদল, তাম্রবর্ণ, বাৎস্য, গোলক, শেষেরি, আটবী, এণী, বিস্বনী ও সপরাময়–এই পনেরোজন।

সমস্ত যজুর্বেদ একথাটির বিশেষ কল্পনা দেখা যায়। জৈমিনি নিজের ছেলে সুমন্তকে পড়িয়ে ছিলেন। সুমন্ত তার ছেলে সুত্বাকে এবং সুত্বা আবার তার ছেলে সুকর্মকে ঐ সব যজুর্বেদ পড়িয়েছিলেন। সুকর্ম আবার অল্প দিনের মধ্যে এগুলি পড়ে নিয়ে সহস্ৰ শিষ্যকে এগুলি পাঠ করালেন। কিন্তু অধ্যয়নের দিনটি সঠিক ছিল না বলে শতক্রতু ইন্দ্র তার শিষ্যদের বিনাশ করলেন। তখন শিষ্যদের শোকে সুকর্ম নিজের মৃত্যু কামনায় উপবাস শুরু করলে শতক্রতু, সুকর্মকে দুটি বর দিলেন। ইন্দ্র বললেন–হে দ্বিজোত্তম, আপনি রাগ করবেন না। আপনার দুটি মহাভাগ, মহাবীর্য, অমলকান্তি সুপণ্ডিত শিষ্য হবে। এই দুই শিষ্য হাজার সংহিতা অধ্যয়ন করবেন। এই বলে সুকর্মকে নিরস্ত করলেন। ইন্দ্রের বরে তার দুই শিষ্য হলেন–পোষ্যজ্ঞী ও কৌশিল্য। উদীচ্য পৌষ্যজ্ঞীর শিষ্য, আর কৌশিল্যের শিষ্য প্রাচ্য সামগন।

এই দুই শিষ্য তাঁদের শিষ্যদের পাঁচশো করে সংহিতা অধ্যয়ন করান। এখন পৌষ্যজ্ঞী শিষ্য লোকাক্ষী, কুক্ষুমি, কুসীতা এবং মঙ্গলি এই চারজনের বিবরণ শুনুন। অন্ডিমুত্র, কমনীয়, সুবিদ্বান, মূলাচারী, কতিপুত্র ও সত্যপুত্র লোকাক্ষীর এই কয়েকজন শিষ্য। কুথুমির তিনপুত্র, ঔরস, রসপাসর এবং তেজস্বী ভগবিতি। এরা কৌথুম নামে অভিহিত। চেল, পতঞ্জলী প্রভৃতি কৌথুমেয় শিষ্য। এরা ছখানি সংহিতা প্রণয়ন করেছিলেন। ভালুকি, কামহানি, জৈমিনি, লোমগায়নি ইত্যাদি এরা লাঙ্গল নামে অভিহিত। এই লাঙ্গলি শিষ্যরা বহু সংহিতা প্রণয়ন করেছিলেন।

হিরণ্যনাভ নরশ্রেষ্ঠ রাজা চব্বিশটি সংহিতা প্রণয়ন করেন। সেসব শিষ্যগণ তা প্রণয়ন করেন, সে বিষয়ে বলছি। বাড়, সহবীর্য, বাহন, পঞ্চম, বৈশাখ, অঙ্গুলীয়, কৌশিক, পরাবার প্রভৃতি হিরণ্যনাভের শিষ্য। এরা সকলেই সামজ্ঞ। এই সামজ্ঞগণের মধ্যে পৌষ্যজ্ঞী ও কৃতি এই দুজনেই শ্রেষ্ঠ। এরা সংহিতার প্রণেতা। সুমন্ত অর্থব বেদকে দুভাগ করে স্কন্ধকে দান করেছিলেন। কবন্ধ আবার দুভাগ করে পথ্যকে একভাগ ও বেদ পর্ষকে এক ভাগ দান করেন। বেদ পর্ষ আবার তাকে চারভাগ করে মোদ, ব্রহ্মবল, শিল্প বল ও শৌষ্কামুনি এই চার শিষ্যকে দান করেন। পথ্য সংহিতাকে তিনভাগে ভাগ করে কাজলি, কুমুদাদি এবং শৌনিক এই তিন শিষ্যকে দান করেন।

ধীমান শৌনিক আবার একে দুভাগে ভাগ করে। এক ভাগ বসুকে এবং অন্যভাগ সৈন্ধবায়নকে দান করেন। সৈন্ধব আবার তাকে দুভাগে ভাগ করে একভাগ মুঞ্জকেশকে দান করেন। এছাড়া নক্ষত্র কল্প ও তৃতীয় বৈতান কল্প, চতুর্থ অঙ্কিরা কল্প এবং পঞ্চম শাস্তিকল্প প্রভৃতি সংহিতা বিধি আছে।

সংহিতাগুলোর মধ্যে অথর্ব বিকল্পই শ্রেষ্ঠ। আমিও ঐ সংহিতা দুভাগে ভাগ করে পুরাণরূপে প্রণয়ন করেছি। অত্রি বংশোদ্ভব ধীমান সুমতি, কশ্যপ, অকৃতব্রত অগ্নিতুল্য প্রভাবশালী ভরদ্বাজ, বশিষ্ঠ, মিত্রায়ু, সোমদত্ত বংশোদ্ভব সাবর্ণি ও শাংখ্যপায়ন বংশীয় সুকর্মা, আমার এই কজন শিষ্য, সংহিতা কর্তা কাশ্যপ, সাবর্ণি ও শংসপায়ন, এরা তিনজনে প্রথমে তিনখানি সামবেদ সংহিতা প্রণয়ন করে। প্রত্যেকেই আবার তা তিনভাগে ভাগ করেন। এটাই পুরাণে সংহিতরে আদিরূপ।

অন্যদিকে যে সব বেদশাখা দেখা যায় ঐ সব নিয়ে এর সমষ্টি চার হাজার। এছাড়া আরও অনেক শংখ্যপায়নি শাখা আছে। সেগুলিও চার হাজারের বেশি। এই সব বেদ শাখার মধ্যে লোমহর্ষানিক শাখাই মূল। তারপর উত্তম কাশ্যপিকা শাখা, সাবর্নিকা তৃতীয় শাখা। এসব শাখা যজুর্বেদের এই সব সংহিতা, পনেরোটি বালখিল্য সংহিতা, কুড়িটি সাবণী সম্মত সংহিতা, আটহাজার সাম, চৌদ্দ হাজার সামমন্ত্র– এই সব গান করে থাকেন। এছাড়া ব্যাসদেব বারোহাজার ছন্দ রচনা করেছেন। তিনি অনেকগুলি সংহিতা রচনা করেন। রাজমনের সংহিতার দু-হাজার মন্ত্র ও চারগুণ ব্রাহ্মণ পরিসংখ্যা করেছেন। হে ঋষিগণ! এই যে যজুর্বেদের নিখিলমন্ত্র বলা হল, এগুলির সংখ্যা তারও বেশি।

এবার চারণ বিদ্যার কথা শুনুন। চারণ বিদ্যার ঋকসংখ্যা ছ-হাজার ছাব্বিশ। এগারো হাজার কুড়ি সংখ্যক যজুর্বেদের ঋক সংখ্যা দশ হাজার তিনশ আশিটি এবং ঋকমন্ত্র এক হাজার। আবার অথর্ব সংহিতার ঋকসংখ্যা পাঁচ হাজার। এভাবে সব মন্বন্তরে সমান রূপে সংখ্যা নির্দেশ শাখাবেদ, শাখাকর্তা, ভেদহেতু প্রভৃতি বলা হয়ে থাকে। কিন্তু প্রজাপতি শ্রুতিই নিত্য। এর কোনও ভেদ নেই।

এখন যেসব বেদের কথা হয় তাহলে বিকল্প ভেদ বা বিধান। দেবতাদের অনিত্যভাবের জন্যই বারবার মন্ত্রোৎপত্তি হয়। এই যে সব শ্রুতিভেদ রয়েছে। এগুলি দ্বাপর যুগেই ঘটেছে। ভগবান ব্যাস এভাবে বেদ বিভাগ করে শিষ্যদের তা দান করে তপস্যার জন্য অরণ্যে গেলেন। তার শিষ্য প্রশিষ্যরাই এভাবে শাখা ভেদ করেছেন।

শিক্ষা প্রভৃতি অঙ্গ শাস্ত্র ছয়, চার বেদ মীমাংসা ন্যায় বিস্তার, ধর্মশাস্ত্র এবং পুরাণ এই চোদ্দরকম বিদ্যা। আয়ুর্বেদ, ধনুর্বেদ, গন্ধর্ববেদ ও অর্থশাস্ত্র– এই চারটে নিয়ে ঐ বিদ্যা আঠারো প্রকার। প্রথমে ব্রহ্মর্ষি তা থেকে দেবর্ষিরা, এভাবে ক্রমে রাজর্ষি, ঋষি প্রভৃতি এবং সেই সমস্ত থেকে তিন প্রকার ঋষি প্রভৃতি ও শংসিতব্রত মুনি এভাবে ক্রমিক বলা হয়। কাশ্যপ, বশিষ্ঠ, ভৃগু, অঙ্গিরা, অত্রি– এই পাঁচ গোত্রেই ব্রহ্মবাদিরা জন্ম দেন। যাঁরা ব্রহ্মাকে জানতে পারেন তারাই ব্রহ্মর্ষি। ধর্ম, পুলস্ত্য, পুলহ, ক্রতু, প্রত্যুষ, প্রভাস, কাশ্যাপ-এদের ছেলেরাই দেবর্ষি। এদের নাম হল নর ও নারায়ণ ধর্মপুত্র, ক্রতুপুত্র বালখিল্য, পুলহপুত্র কদর্ম, পুলস্ত্য পুত্র কুবের। প্রত্যুষপুত্র অচল, কশ্যপ আত্মজ পর্বত ও নারদ। এঁরা দেবতাদের জানেন, তাই এঁরা দেবর্ষি। মনু প্রবর্তিত বিয় ও ঐশবংশে প্রভু প্রভৃতি সব রাজারা তারা রাজর্ষি। যাঁরা প্রজাদের খুশি করে তাদের মতিবুদ্ধি জানতে পারেন, তারাই রাজর্ষি। যাঁরা ব্রহ্মলোকে প্রতিষ্ঠা পান, তারা ব্রহ্মর্ষি, আর কৌলিন্য, তপস্যা ও মন্ত্ৰষ বক্তৃতা প্রভৃতি গুণসম্পন্ন দিব্য দেবর্ষিদেরও ব্রহ্মর্ষি বলা হয়।

অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ বিষয়ে যাঁদের জ্ঞান আছে, যারা সত্য কথা বলেন, যাঁদের গর্ভ থেকে জ্ঞান স্ফুরণ হয়, যাঁরা মন্ত্রবক্তা, যাঁরা স্বয়ংসম্পন্ন– তাদের ঋষি বলা হয়। দীর্ঘায়ুশকতা, মন্ত্রকারিতা, ঐশ্বর্য, দিব্যদৃষ্টি, জ্ঞানমানিতা, প্রত্যক্ষধর্ম সেবিতা, ঘাত গুণ যুক্ত ঋষি সপ্তর্ষি।

এই সপ্তর্ষিরা গোত্র প্রবর্তন করেন। সবসময় যজন্যজন প্রভৃতি ছ’রকম কাজ করেন। সত্য প্রভৃতি যুগে তাদের বংশে বীরেরা বারবার জন্ম নিয়ে থাকেন। পুত্র পিতা থেকে পিতা পুত্র থেকে জন্ম নেন। এভাবে যুগের শেষ অবধি সংসার বাড়তে পারে। এভাবে গৃহমেধীর সংখ্যা অষ্টাশী হাজার। যাঁরা দিবাকরে দক্ষিণায়নে পিতৃমাস আশ্রয় করেছেন, তারাই প্রজা সৃষ্টির জন্য ও অগ্নিহোত্র পরিগ্রহ করে থাকেন। এছাড়া যাঁরা শ্মশান আশ্রয় করে রয়েছেন, তাদের সংখ্যাও অষ্টাশী হাজার। সূর্যের উত্তরায়ণে সেসব ঋষি স্বর্গে আশ্রয় পেয়েছেন, তারাই মন্ত্রব্রাহ্মণ কর্তা হয়ে জন্ম নেন।

এভাবে দ্বাপরযুগে যখন ভাব বিদ্যা কমতে শুরু করে তখন ঐ শাস্ত্রকার ঋষিরা ভাষাবিদ্যা প্রবর্তন করেন। ত্রেতাদি যুগেও তারাই ঐ সব শাস্ত্রের বিবরণ প্রণয়ন করে থাকেন। ভবিষ্যৎ দ্বাপর যুগে তিনি বেদব্যাস রূপে অবতীর্ণ হয়ে তপস্যা দিয়ে অব্যয় ব্রহ্মপদ লাভ করেন। তপস্যা থেকে কর্মপ্রাপ্তি, কর্ম দিয়ে যশ, যশ দিয়ে সত্য, সত্য দিয়ে অব্যয়, অব্যয় থেকে অমৃত, অমৃত থেকে শুক্র এবং অমৃত থেকে সব কিছুই পাওয়া যায়। ব্রহ্মা বৃহৎ এবং তিনিই সমস্ত পোষণ করেন বলে তার নাম ব্রহ্মা হয়েছে। ঋক, যজুঃ অথর্ব, সাম রূপে যাঁর প্রকাশ সেই ব্রহ্মকে নমস্কার। যাঁর শেষ দেখা যায় না, যিনি ক্ষয়হীন, যা থেকে জগত সম্মোহিত হয়, যিনি অব্যক্ত অমৃত শাশ্বত প্রকৃতির ব্রহ্মা, যিনি প্রধান স্বয়ম্ভু, যাঁর ভাগ নেই সেই বহু বাচক পরম ব্রহ্মকে সবসময় নমস্কার ভগবান অব্যয় ব্রহ্ম। সমস্ত জ্ঞান, সবপ্রকার বেদ ও অসংখ্য সংহিতা কীর্তন করে দেবর্ষিদের যে জ্ঞান দিয়েছেন, ঐ জ্ঞানের অনুসন্ধান অন্য কেউ করতে পারে না। অন্যান্য শাস্ত্রকাররা যে জ্ঞান প্রদর্শন করেন, সে সবই ব্রহ্ম দ্বারা সম্মত ও তার দ্বারা দৃষ্ট পথ। সমস্ত কর্তারই তিনি আদি কর্তা। ব্রহ্মার পুত্র স্বয়ম্ভুব মনুই একমাত্র সমস্ত বিদ্যা জেনে ত্রেতা ও দ্বাপর যুগে তা আবার বিতরণ করেন। তারপর এই সব বিদ্যা ঋষিরা জানার পর তারা সংহিতাগুলোর প্রবর্তন করেন। প্রায় অষ্ঠাশী হাজার বেদবিদ ঋষি যুগে যুগে এই সব সংহিতার প্রবর্তন করেছেন।

দ্বাপরে যে সব বেদবিদ ঋষি সংহিতার প্রবর্তন করে, তাদের গোত্রেই এই সব বিভিন্ন বেদজ্ঞানও বারবার প্রচলিত হয়ে আসছে। আবার যুগক্ষয় হলেও সেই শাখা ও শাখা কর্তার আবির্ভাব হয়। অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ দিয়ে সর্বকালেই সমস্ত কাজ অতীত দিয়ে ভবিষ্যৎ এবং একরকম বলে বর্তমান দিয়ে অতীত, ভবিষ্যৎ পূর্বের ঘটনা স্থির করা হয়। এভাবে মন্বন্তর তত্ত্বও বুঝতে হয়। দেব, ঋষি, পিতা, মনু সবাই মন্ত্রের সাথে ঊর্ধ্বে যেতে পারেন। আবার মন্ত্রের সাথেই ইহলোকে আবর্তিত হন। তারা দোষমুক্ত হয়ে জন্ম নেন, যদি কোনো বিশিষ্ট দোষ দেখা যায় তখন তারা দশদেবযুগ যাতায়াত করে জনলোক থেকে তপোলোকে যান। তপোলোক থেকে তপধার ফিরে আসেন না। এভাবে হাজার হাজার দেবযুগ অতীত হয়েছে। সমস্ত বিনষ্ট হয়ে মুনিদের সাথে ব্রহ্মলোক লাভ করেছে। এই সবের সংখ্যা নির্দেশ সব সময় করা যায় না।

আগে যেমন পিতৃ মুনি দেবতা ও সপ্তর্ষিদের সাথে যুগকল্প ও মন্বন্তরগুলো অতীত হয়ে গেছে, আগামীকালে সেই নিয়মেই মন্বন্তরগুলো অতীত হবে। মন্বন্তরের শেষে সংহার, আর সংহারের শেষে আবার দেবতা ঋষি, মনু ও পিতাদের সৃষ্টি হয়।

এই সংহার বা সৃষ্টির যথাযথ সংখ্যা একশো বছরেও বলতে পারা যায় না। এবার মানুষ পরিমাণের মন্বন্তরের সংখ্যা বলছি। দেবতা ও ঋষিদের মধ্যে যারা সংখ্যা-তত্ত্বে পারদর্শী। তারা ত্রিশকোটি সাতষট্টি নিযুত কুড়ি হাজার বছর মন্বন্তরের পরিমাণ নির্দেশ করেন। দিব্য সংখ্যাতে আট লক্ষ বাহান্ন হাজারের বেশি বৎসর মন্বন্তর, পরিমাণ। এর চোদ্দগুণ করলে যুগসহস্রাত্মক ব্রাহ্মণদিগের পরিমাণ হয়। তখন সর্বভূতের প্রলয় ঘটে। মহেশ্বরই কল্পাদি কালে সর্বভূতের সৃষ্টি করেন।

আগে যে সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর ইত্যাদি চারযুগের কথা বলা হয়েছে তারই একাত্তর আবর্তনে এক মানুষ অধিকার কাল শেষ হয়। প্রভু ভগবান এই রকমই ব্যবস্থা করেছেন। ভবিতব্য অনুসারে আগে যেমন ঋষি দেবাদির সাথে মন্বন্তর অতীত হয়েছে। পরে তেমনি হবে। সর্ব মন্বন্তরেই ঋষিদের পিতা ও মনুরা পুরো মন্বন্তরকাল ধরে সৃষ্টির ব্যাপারটি সম্পূর্ণ করে নিজেদের অবস্থান্তর বুঝতে পেরে মহালোকে চলে যেতেন। মন্বন্তরের দেবতারা এক সত্যযুগ ধরে বিদ্যমান থাকেন। তারপর ভবিষ্যতের দেবতা, পিতৃ, ঋষি ও মনুরা প্রাদুর্ভূত হন। কলিযুগের শেষে কলির অবশিষ্ট জনগণের মধ্যেই সত্যযুগ শুরু হয়ে থাকে। কলি কালের শেষে মনু সপ্তর্ষিরা আবার মন্বন্তর ব্যবস্থা ও সৃষ্টির জন্য তপস্যায় সত্যযুগের আরম্ভের জন্য অপেক্ষা করেন। তখন আবার আগের মতো শস্য উৎপন্ন হয়, প্রজারা স্থানে স্থানে দলবদ্ধভাবে থাকে, নিরাপদ ও বর্ণমাচার শূন্য হয়ে জীবিকার জন্য সচেষ্ট হয়। আগের মন্বন্তরের অবশিষ্ট ধার্মিক মনু ও সপ্তর্ষিরা সন্তানের জন্য পরম কঠিন তপস্যা করেন। তখন আবার দেব, অসুর, পিতা, মুনি, মানব, সর্প, ভূত, পিশাচ, গন্ধর্ব, যক্ষ, রাক্ষস ইত্যাদি উৎপন্ন হয়। মনু ও সপ্তর্ষিরা তখন আদিকালের মানুষ ও দেবতাদের সঙ্গে কাজে নিযুক্ত হয়।

ত্রেতাযুগের আরম্ভকালে দেবতা ও ধন সুপ্রতিষ্ঠিত হলে জনগণ ব্রহ্মচর্য দিয়ে ঋষি ঋণ, সন্তান উৎপাদন করে পিতৃঋণ এবং যজ্ঞ দিয়ে দেবঋণ থেকে মুক্ত হয়। তারা হাজার হাজার বছর বর্ণাশ্রম ধর্ম ঠিকমতো পালন করে স্বর্গে গেলেন। এই সব সিদ্ধি সম্পন্ন জিতেন্দ্রিয় দেবতারা মন্বন্তরে পরিবর্তন দেখেন। এরা সকলে ভীত হলে শূন্য দেবস্থানগুলোতে অন্য দেবতারা আসেন। তারা সত্য, ব্রহ্মচর্য, শাস্ত্রজ্ঞান ও তপস্যা করে সেইসব শূন্যস্থানগুলো পূরণ করেন। সপ্তর্ষি, মনু, পিতৃ ও দেবতাদের মধ্য যারা আগেকার তারা মারা যান। অবশ্য প্রকৃতপক্ষে এটি মৃত্যু নয় একটা বিপদ মাত্র।

অতীত ও অনাগত মন্বন্তর এর প্রতিস্পর্ধী লক্ষণ, স্বয়ম্ভুব মনু এরূপ বলেছেন। এক মন্বন্তরের সঙ্গে অন্য মন্বন্তরের দীর্ঘ পার্থক্য, মহাপ্রলয় পর্যন্ত ঘটে। মন্বন্তরের পরিবর্তনে সকলেই মহান লোকবাসী জল, অপঃ ও সত্যলোক পেয়ে থাকে। আবার সৃষ্টির আগের কালে সত্যলোক ত্যাগ করে নারায়ণ দেবে প্রবিষ্ট হয়ে থাকে।

দিব্যদৃষ্টি সম্পন্ন মানুষের বিবরণ, ব্যাসপ্রণীত কিছুটা সবিস্তারে কিছুটা সংক্ষেপে বর্ণিত, ঈশ্বরদের পুণ্য। কথাতে ভরা পরম পবিত্র এই মহাপুরাণ পাঠ করলে সুঃস্বপ্ন শান্তি ও পরমায়ু প্রাপ্তি হয়, এই স্বয়ম্ভুব মন্বন্তরের বৃত্তান্ত সবিস্তরে একে একে বর্ণনা করলাম।

.

তেষট্টিতম অধ্যায়

শাংখ্যপায়ন বললেন– মন্বন্তরের পর্যায়গুলি আর তখনকার দেবতাদের কথা জানতে ইচ্ছা করে। সূত বললেন–যেসব মন্বন্তর শেষ হয়েছে আর ভবিষ্যতে সেসব মন্বন্তর হবে সংক্ষেপে সেগুলি বলছি। প্রথমে স্বায়ম্ভব, তারপর স্বরোচিষ ও তারপর উত্তম, তামস রৈবত ও চাক্ষুষ এই ছটি মনু অতীত হয়েছে, এবার ভাবী আটজন মনুর বিষয়ে বলছি। সাবর্ণ, রোচ্য, ভৌত্য ও বৈবস্বত ইত্যাদি পরে আলোচনা করব। স্বায়ম্ভব–মন্বন্তরের কথা বলা হয়েছে, এবার মহাত্মা স্বারোচিষ মন্বন্তরের প্রজা সৃষ্টি সংক্ষেপে বলছি।

এই মন্বন্তরে দেবতা তুষিত ও বিদ্বান পারাবত। ঐ দেবতাদের দুটি গণ বলা হয়েছে। ক্রতুর থেকে তুষিতার গর্ভে দুই পুত্র হয় পারাবত ও পৃন্দোজ– এই দুটি গণের প্রত্যেকটি বারোটি করে, সব নিয়ে চব্বিশটি বলা হয়েছে। ধৈবশস্য, বানন্য, গোপ, দেবায়ত, দেবভগবান, অজ, মহাবল, দুরোস, মহাবাহ, আপ, বীর্যবান, মহাজা, চিহ্নিত্বশ, নিভৃত এবং অংশ– এই বারোটি তুষিত। এরা ক্রতু পুত্র ও সোমাপায়ী, প্রচেতা, বিশ্বদেব, সমস্ত, বিশ্রুত, অজিক্ষ, অরিমর্দন, বিদ্বান, মহাবল ধবীয় প্রভৃতি স্বরোচিষ মন্বন্তরে এরা দেবতা। এই দেবতারা ভার্গব, দ্রোণ, ঋষভ ও অগ্নিরা–এরা হলেন সপ্তর্ষি। কেউ কেউ বলেন পৌলস্ত্য, দত্তাত্রি আত্রেয়, নিশ্চল, পুলহ ও রাবান এরাই এই মন্বন্তরের সপ্তর্ষি। চৈত্র কবিরতে, বৃত্তান্ত আদি স্বরোচিষ মনু নয়, পুত্র এরা বংশকর বলে পুরাণে আখ্যাত।

প্রতি মন্বন্তরে সপ্তর্ষি মনু, দেবতা ও পিতৃগণ এর চারটে মূল। এরপর যেগুলি রয়েছে তা পূর্বোক্ত মূল চারটির অবান্তর প্রজা, কখনও ঋষিদের পুত্র দেবতা, কখন দেবতাদের পুত্র পিতৃগণ, আবার কখনও দেবপুত্রদের ঋষি, শাস্ত্রে এটাই বিশেষ করে বলা আছে। এভাবে মনু থেকে ক্ষত্রিয় বৈশ্য ইত্যাদি এবং সপ্তর্ষি থেকে দ্বিজরা উদ্ভূত হয়েছেন। স্বায়ম্ভুব মনুর যেমন প্রজা বিস্তার স্বারোচিষ মুনও তাই। বার বার প্রজা সৃষ্টির ফলে এটি এত বড় হয়েছে, বিস্তারিত বলা অসম্ভব।

এরপর অতীতের তৃতীয় মনু উত্তমের বিবরণ বলছি। এই মনুর শাসন সময়ে পাঁচজন দেবতার কথা বলা হয়েছে। সুধাম, দেব, প্রতদিন, শিব, সত্য–এই গণ পঞ্চকের সত্য, ধৃতি, দম, দান্ত, ক্ষম ইত্যাদি বারোজন দেবতা আছেন। সুধাম ইত্যাদি পাঁচজনের অনুজ আরো বারোজন দেবতা আছেন। তারা হলেন সহস্রাধার, বিশ্বাতামা, শতধার, রহত, বায়ু, বিশ্বপা, বিশ্বকর্মা ইত্যাদি। এরা বংশপ্রবর্তনক। দিন, ক্রতু সুধর্ম, ধৃতধর্মা, যশস্বী ও কেতুমান এরা প্রর্তদনের অনুজ। এরা সবাই সূর্যের উপাসক, সুদান, বসুদনা, সুখমঞ্জস বিষ, হতাশন ইত্যাদি বারোজন শিবের অনুজ। সত্যের অনুজরা হলেন- দিকপতি, বাক্‌পতি, বিশ্ব, মস্ত ইত্যাদি বারোজন।

উত্তম মনুর সময় এই সব দেবতারা উদ্ভূত হয়েছিলেন। উত্তম মনুর ছেলেরা হলেন– অজ, পরস্ত, দিব্য, দিব্যোষধি নয় বেদানুজ, অপ্রতিম, মহোৎসাহ, ঔশিজ ইত্যাদি। এদের থেকে ক্ষত্রিয় বংশ বিস্তারলাভ করেছে। এরপর তামস মনুর বিষয়ে জানা যায়। সত্য, স্বরূপ, সুধী, হরি, তামস মন্বন্তরের এই চার দেবতা। এদের এক একটি গণে পঁচিশজন দেবতা, এই মন্বন্তরে পুলস্ত্য নন্দন রাক্ষসদের প্রাদুর্ভাব হয়।

এবার এই মন্বন্তরে সপ্তর্ষিদের নাম বলছি। কাব্য, হর্ষ, কাশ্যপ, পৃথু, আত্রেয়, অগ্নি ও জ্যোতিধামা- এরা সপ্তর্ষি। এছাড়া ভাগৰ্ব পৌলহ, বশিষ্ঠ, গোত্রীয়, বর্ণপীঠ, চৈত্র এবং পৌল এরা ঋষি। এই ঋষিগণ জনঘট, স্বস্তি নর, স্যাতি, ভয়, প্রিয়ভৃত্য, অবক্ষিদের উদ্যমশীল পৃষ্ঠলোর, ঋত, ঋতকবু- এরা তামস মনুর পুত্র। স্বয়ম্ভর মন্বন্তরে স্বয়ম্ভুব মনুর আদেশে দক্ষ প্রজাপতি প্রথমে উত্তানপাদকে সৃষ্টি করেন। অত্রি ঐ উত্তানপাদকে পুত্র রূপে পান। ইনিই পৃথিবীর রাজা হয়েছিলেন। হে দ্বিজগণ। ধর্মের স্ত্রীর লক্ষ্মীর গর্ভে সুনৃতা নামে বিখ্যাত কন্যা জন্মে। রাজা উত্তম এই ধ্রুব কীর্তিমান, আয়ুষ্মন ও ধনবান ছিলেন। রাজা উত্তানপাদের মনস্বিনী ও স্বরা নামে দুই কন্যা জন্মে, এই দুই কন্যা পবিত্র চরিত্রের ছিলেন।

ত্রেতাযুগের প্রথম দিকে স্বয়ম্ভুব মনুর পৌত্র ধ্রুব অনাহারে কয়েক হাজার বছর তপস্যা করেন। তপস্যায় ব্রহ্মা খুশি হয়ে তাকে পরের প্রলয়কাল পর্যন্ত আকাশে সেখানে উদয় অস্ত কিছুই হয় না সেরকম একটি জ্যোতিষ্কমণ্ডলে সবচেয়ে ভালো জায়গায় স্থান দেন। ধ্রুবের তপস্যার প্রসিদ্ধি আর মাহাত্মের জন্য দৈত্য দানবদের আচার্য শুক্রাচার্য ধ্রুবের শ্রুতিগান করে একটি শ্লোক তৈরি করেন। সাক্ষাৎ ঈশ্বর এই ধ্রুব সপ্তর্ষিদেরকেও পশ্চাদে রেখে তাদের আরো অনেক ওপরে স্বর্গে বাস করতে পারবেন।

ভূমি ধ্রুব থেকে তুষ্টি ও ভব্য নামে দুজন রাজাকে প্রসব করেন। তুষ্টি তাঁর নিজের ছায়াকে বললেন– তুমি একটি নারীরূপ ধারণ কর। তক্ষুনি তার ছায়া সুন্দরী অলংকার পরিহিতা একটি স্ত্রীলোকে পরিণত হল। তুষ্টি ছায়ার গর্ভে পাঁচজন পুণ্যবান পুত্রের জন্ম দেন। এদের মধ্যে একজন হলেন প্রাচীন গর্ভ। এর পুত্র সুবৰ্চা, দারধী নামে এক পুত্রের জন্ম দেন। এই উদারধী আগের জন্মেছিলেন ইন্দ্র। উদারধীর পুত্র দিবঞ্জয়। এর রিপু এবং রিপুঞ্জয় নামে দুই পুত্র জন্মায়। রিপুর পত্নী বুহতী গর্ভে বিদ্বান কর্মজ্ঞা পুত্র বিখ্যাত চাক্ষুষ মনু জন্মলাভ করেন। চাক্ষুষ মনুর ঔরসে নড়লরে গর্ভে ঊরু, পুরু ইত্যাদি দশজন পুত্র জন্মগ্রহণ করেন। ঊরু থেকে আগ্নেয়ীর গর্ভে ওলঙ্গ, অঙ্গিরা, ক্রতু, শিব প্রভৃতি ছয় পুত্র জন্মায়। অঙ্গিরা পুত্র বেন। বেন রাজার অত্যাচারে রেগে গিয়ে ঋষিরা তার ডানহাত নষ্ট করে দেন। সেই বাহু থেকেই তার পুত্র পৃথুর জন্ম। জন্মেই তিনি প্রদীপ্ত আগুনের মতো শোভা ধারণ করেন। ক্ষত্রিয়দের অগ্রজ পৃথু প্রজা পালন করেছিলেন এবং তিনি রাজসূয় যজ্ঞের প্রবর্তক। মহারাজ পৃথুই প্রজাদের কাজের জন্য গরুরূপ ধারিণী পৃথিবীকে দোহন করলে ধরণী শস্য-শ্যামলা হয়ে ওঠে। পৃথিবীকে দোহন করা হলে পৃথিবী ক্ষীর দান করে। সেই ক্ষীর পান করেই ত্রিলোক প্রতিষ্ঠা হল। ঋষিরা জিজ্ঞাসা করলেন- হে মহামতি! দোহনের কথা বলুন।

পৃথু কিভাবে দেব, নাগ, যক্ষ, অপ্সরা, গন্ধর্বদের দিয়ে বসুধা দোহন করলেন, সেই বৃত্তান্ত এবং সেজন্য ঋষিরা বেন রাজার বাহু মথিত করেছিল–তা আমাদের বলুন। সূত বললেন–এটি এক গোপনীয় আখ্যান আপনারা তা শুনুন। রাজা বেন অত্রির মতো ধর্ম রক্ষাকর্তা ছিলেন। প্রজাপতি অঙ্গ, মৃত্যুর কন্যা সুনীথাকে বিয়ে করেন। তার গর্ভে জন্মায় বেন। তিনি ধর্মকে অবহেলা করে স্বেচ্ছাচারী হয়েছিলেন। তার শাসন সময়ে রাজ্য থেকে বেদের চর্চা লোপ পেয়েছিল। তিনি বলতেন কেউ যাগযজ্ঞ করো না, আহুতি দিওনা। তোমরা আমাকে পূজা করো। আমিই যজ্ঞ আমিই পূজ্য।

মরীচি প্রভৃতি মহর্ষিরা দুর্বিনয়ী বেনকে বললেন–হে বেন, তুমি কোনো অধর্ম আচরণ কোরো না। তুমি যা করছে তা সনাতন ধর্ম নয়। তুমি প্রাচীনকালে প্রতিজ্ঞা করেছিলে, প্রজাপালন করবে, কিন্তু তুমিই এখন প্রজাকুলের নিধনের চেষ্টা করছ। ব্রহ্মর্ষিরা তাকে এই কথা বললে, বেন হেসে তাঁদের কথার উত্তর দিলেন–আমি ছাড়া কে আর ধর্মের স্রষ্টা আছে। এ সংসারে বিদ্যায়, তপস্যায়, সত্যে আমার সমান কেউ নেই। আমি মহাত্মা, আমি কারোর থেকে কম নই। কর্ম আমার থেকেই উৎপন্ন হয়েছে। আমি ইচ্ছে করলে এই পৃথিবীকে পুড়িয়ে দিতে পারি, আবার জল দিয়ে প্লাবিত করতেও পারি। এই পৃথিবীকে সৃষ্টি করতে পারি, আবার নাশ করতেও পারি। তখন মহর্ষিরা এই প্রচণ্ড দাম্ভিক, অভিমানী বেনকে বাগে আনতে না পেরে, আগুনের মতো প্রদীপ্ত মহাবাহু বেনকে গ্রহণ করে তার বাহুগাত্র মন্থন করতে লাগলেন। ঋষিরা তার হাত মন্থন করতে থাকলে, বাহু থেকে একটি ছোটখাটো পুরুষ জন্ম নেয়। ঐ পুরুষ ভয় পেয়ে ঋষিদের উদ্দেশ্যে হাতজোড় করে রইলে, ভয়ার্ত ঐ পুরুষকে দেখে ঋষিরা নিষীদ’–এ শব্দটি উচ্চরণ করলেন। তারপর এই পুরুষটি নিষাদদের বংশকর্তা হয়ে অনেক ধীবর সৃষ্টি করল। পরে ঐ পুরুষ বিন্ধ্যপর্বতে বাস করতে লাগল। মহর্ষিরা রেগে গিয়ে আবার বেনের ডানহাত মন্থন করলেন।

তখন বেনের ডানহাতের তালু থেকে আর এক পুরুষ জন্ম গ্রহণ করলেন। এর নাম পৃথু। এ পুরুষটি প্রজ্জ্বলিত আগুনের মতো শোভা পেতে লাগলেন। ইনি তির-ধনুক হাতে এবং মহা প্রভাবশালী কবচ ধারণ করে আবির্ভূত হলেন। এই মহাপুরুষ আবির্ভাব হলে সবাই খুশি হল। বেনও সৎপুত্র দান করে নরক থেকে পরিত্রাণ পেয়ে স্বর্গলাভ করল। এরপর পৃথুর রাজপদে অভিষেক হল। সবদিকের নদী ও সাগরগুলোর জল দিয়ে তার অভিষেক করা হল। অঙ্গিরা ইত্যাদি অন্যান্য মহাত্মাদের সাথে পিতামহ ব্রহ্মা নরশ্রেষ্ঠ পৃথুর অভিষেক ক্রিয়া সম্পূর্ণ করলেন।

মহারাজ পৃথু দেব ও অঙ্গিরার তনয়দের দ্বারা অভিষিক্ত হয়ে বিপুল পৃথিবীর শ্রী সম্পন্ন রাজা হলেন। পিতা বেন যে সব প্রজাদের উৎপীড়ন করেছিলেন, পুত্র পৃথু তাদের পালন করে, প্রজা অনুরাগী রাজা আখ্যা পেলেন আর পালন গুণে সমুদ্রের জলে পরিণত হল। পাহাড়গুলো উচ্চশৃঙ্গ হল। পৃথিবী প্রচুর শস্য দান করল। এ সময় পিতামহ ব্রহ্মা একটি যজ্ঞের অনুষ্ঠান করলেন। সূতী থেকে উৎপন্ন হয়। ঐ যজ্ঞে সামগায়ক এক হোতা অন্যমনস্ক হয়ে, ইন্দ্রের হবির সাথে বৃহস্পতির হবি মিশিয়ে ইন্দ্রের উদ্দেশ্যে আহুতি দিলে মাগধ জন্ম নেন। এই ভুলের জন্য পাপ সঞ্চয় হয়েছিল। যজ্ঞের এই বিপরীত আচার এর জন্য এদের জাতি বিচ্যুতি ঘটেছিল। ক্ষত্রিয় থেকে যজ্ঞের প্রভাবে ব্রাহ্মণ্য লাভ করা যায়। সুতরাং ব্রহ্মাণ্য, ধর্ম এদের প্রথম ধর্ম বলে মনে করা হয়ে থাকে। ক্ষাত্রধর্ম দিয়ে জীবন ধারণ করা এদের মধ্যম ধর্ম। ঋষিরা রাজা পৃথুর স্তব করার জন্য এদেরকে আহ্বান করেন এবং বলেন– তোমরা এই রাজার স্তব কর– এই রকম আদেশ দেন। কিন্তু তারা বলল–নিজের নিজের কাজ দিয়ে দেবতা ও ঋষিদের প্রীত করি। তেজস্বী রাজা পৃথুর গুণ, তেজ, যশ এসব কিছুই আমরা জানি না। তাই কেমন করে স্তব করব? ঋষিরা বললেন–মহাবল পৃথুর কাজ ও চরিত্র সাথে মিলিয়ে স্তব কর।

তখন সূত ও মাগধ ঋষিদের কাছে আদেশ পেয়ে স্তব গান করলে, প্রজানাথ পৃথুকে দেখে খুব খুশি হলেন। প্রজাদের ডেকে বললেন– এই রাজা তোমাদের বৃতি দান করবেন। পৃথু তখন প্রজাদের মঙ্গলের জন্য ধনু-বাণ দিয়ে বসুধাকে অত্যাচার করতে থাকেন। পৃথিবীও পৃথুর ভয়ে গোরুর রূপ নিয়ে ছুটতে থাকেন। বেন পুত্র পৃথুর ভয়ে ব্রহ্মলোক পর্যন্ত ঘুরে বেড়ালেন। কিন্তু জ্বলন্ত আগুনের মত জ্যোতিসম্পন্ন মহাযোগী পৃথুর হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য তারই শরণাপন্ন হন। বসুন্ধরা দেবী বললেন– স্ত্রী-বধে অধর্ম হয়। আপনি আমাকে মেরে কিভাবে প্রজাপালন করবেন?

পৃথিবী বললেন–আমাতে সমস্ত লোক প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। আমার অভাবে প্রজারা বিনাশ হবে। প্রজাদের মঙ্গল চাইলে, আমাকে বিনষ্ট করবেন না। শাস্ত্রকররা স্ত্রীলোকদের অবধ্য বলে নির্দেশ দিয়েছেন। তাই আপনি জেনেশুনে ধর্মত্যাগ করবেন না। ধর্মাত্মা রাজা পৃথু পৃথিবীর এইকথা শুনে রাগ কমিয়ে বললেন–অনেক লোকের মঙ্গলের জন্য একজনকে বধ করলে কোনো পাপ হয়না। তাই হে বসুন্ধরা, আমি প্রজা রক্ষার জন্য তোমাকে বধ করতে চাইছি। তুমি আমার কথার অনাদর করলে আমি তোমায় বধ করে, নিজের শরীর বিস্তার করে প্রজাদের ধারণ করব। তুমি আদেশ পালন কর। শাসন গ্রহণ কর, জীবন দান কর প্রজাদের, তুমি আমার কন্যাত্ব গ্রহণ কর। ধর্ম রক্ষার জন্য তোমায় বর দিলাম।

পৃথুর একথা শুনে পৃথিবী বললেন–হে রাজন, আমি আপনার এই নির্দেশ পালন করব, কিন্তু। আমার দোহনের জন্য একটি বাছুর দান করুন। যাকে দেখে আমার বাৎসল্য ভাব জাগে এবং অমৃত দান করতে পারি। আর আমার এই অসমান ভূমি শরীরকে এভাবে সমান করে দিন, যাতে সব জায়গায় সমান ভাবে সবাই ক্ষীর পেতে পারে।

রাজা পৃথু তখন সমস্ত জায়গা থেকে পাথর উঠিয়ে ফেললেন। কারণ আগের মন্বন্তরের শিলাগুলো অসমান ভাবে বেড়ে উঠেছিল। এইজন্য গ্রামগুলোর ভাগ, শস্য ও গোরক্ষা বণিকপথ কিছুই ছিল না। চাক্ষুষ মন্বন্তরে এরকম অবস্থা ছিল। তারপর বৈবস্তত মন্বন্তরে ঐ সবের সুব্যবস্থা হল। প্রজারা তখন ফল-মূল খেয়ে কোনোরকমে জীবনধারণ করত। তারপর বেনপুত্র পৃথুর রাজত্বে ত্রিলোক সবরকম বস্তুতে ভরে গেল। যে সময় প্রজারা অতিকষ্টে জীবনযাপন করত, সেসময় রাজা পৃথুকে চাক্ষুষ মুনিকে বৎস কল্পনা করে নিজের হাতে পৃথিবীর শস্য সমূহ দোহন করেন।

এই দোহনে শস্যগুলো হল দুধ, পৃথু রাজা দোহনকারী, বৎস-চাক্ষুষ মনুর দোহন পাত্র হল ভূমিতল। ঋষিরা বলেন, পরে আবার বসুন্ধরা পৃথিবীকে দোহন করতে। সেখানে দোহনকারী বৃহস্পতি। বৎস হল সোম, গায়ত্ৰী আদিপাত্র এবং সনাতন ব্রহ্মপ হল দুধ। এরপরে দেবতারা সোনার পাত্রে ধরিত্রীদেবীর যে সুধা দোহন করেন সেই সুধতন তাদের বৃত্তি হয়েছিল। এরপর নাগগণ পৃথিবীকে দোহন করে। এখানে বাসুকি দেহানকারী, ক্ষীর হল বিষ। এই বিষ দিয়েই সমস্ত সাপদের বৃত্তি নির্দিষ্ট হয়। এই বিষের প্রভাবে এরা বলশালী হয়ে ওঠে। বিষই এদের আশ্রয়।

পুণ্যবান যক্ষেরাও পৃথিবীকে দোহন করে। তারপর রাক্ষস, পিশাচেরও বসুমতাঁকে দোহন করে, এখানে দেহানকারী কুবেরক। বৎস বল বলবান রাক্ষস সুমালী আর দোহনের ফলে বেরিয়ে আসে রুধির বা রক্ত। রাক্ষসরা এই রক্ত দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে। পিতারাও ধরিত্রীকে দোহন করেন, দোহনকারী অর্যমা, যম-বৎস্য, সুধা-অমৃত এই সুধা দিয়েই পিতাদের তৃপ্তিসাধন হয়ে থাকে। গন্ধর্বরাও পদ্মপাত্রে বসুমতাঁকে দোহন করে থাকে। এখানে দোহনকারী গন্ধর্বরাজ বিশ্বাবসু, দোহন কাজে বৎস-চিত্ররথ। পবিত্ৰগন্ধ নিবহ ক্ষীর স্বরূপ।

এরপর হিমবানকে বৎস কল্পনা করে শৈলরাজিও মহীকে দোহন করেন। সুমেরু পর্বত দোহনকারী নাগ ঔষধি ও রত্ন হচ্ছে ক্ষীর। এরপর শোনা যায় বৃক্ষরাও পলাশপাত্রে ধরিত্রীকে দোহন করেছিল। এইভাবে যশস্বিনী পৃথিবীকে দোহন করে প্রজাদের পালন করেছিলেন। এজন্য নাম হয়েছে। বসুন্ধরা।

.

চৌষট্টিতম অধ্যায়

সূত বললেনসাগরগামিনী এই ধরিত্রী দেবী প্রাচীনকালে মধু ও কৈটভের মেদে পরিপ্লতা হয়ে মেদিনী নামে খ্যাতি লাভ করেন। ধীমান রাজা পৃথুর কন্যারূপে এই মেদিনী আবার পৃথিবী নামে অভিহিতা।

এইভাবে পৃথু সমস্ত প্রাণীর নমস্য ও পূজ্য হয়েছিলেন। যুদ্ধে জয়লাভে ইচ্ছুক যোদ্ধারাও তার নাম। করে যুদ্ধযাত্রা করতেন। যে যোদ্ধা রাজা পৃথুর নাম নিয়ে যুদ্ধে যায় সে ঘোর যুদ্ধে জয়লাভ করে। আমি আপনাদের পৃথিবী দোহন ব্যাপারে বিশেষ বিশেষ বৎস দোহনকারী এবং পাত্র সব কিছুকেই নিয়ে বললাম। অন্য দোহন ক্রিয়ার কথা এবার শুনুন।

অতীতকালে প্রথমে মহাত্মা ব্রহ্মা বুকে বস করে এই বসুধাতলে বীজগুলো দোহন করেন, তারপর স্বয়ম্ভুর মন্বন্তরে অগ্নীধ ধরিত্রীকে দোহন করেন। এই দোহনে বৎস ছিলেন স্বয়ং স্বয়ম্ভুব মনু। তারপর স্বরোচিষ মন্বন্তরে ধীমান চৈত্র আবার মনুকে বৎস কল্প করে পৃথিবীর শস্য দোহন করে। উত্তম মন্বন্তরে উত্তম মনুকে বৎস কল্পনা করে পৃথিবী থেকে সবরকম শস্য দোহন করেন। ঐ দোহনে তামস মনু বৎস হয়েছিলেন। এই তামস মনুর একটি অন্তর মনু আছে, তার নাম চারিষ্ণব। এই যে অতীত যুগের দেবতা, মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীদের দিয়ে পৃথিবী দেহানের কথা বলা হল। অতীত অনাগত সব মন্বন্তরের এমন হয় জানবেন।

এবার মন্বন্তরের দেবতা ও প্রজাদের কথা শুনুন। পৃথুর দুই পুত্র জন্মায়। অন্তধী ও পালী তাদের নাম। এদের মধ্যে প্রাচীন বহি একজন শ্রেষ্ঠ প্রজাপতি ছিলেন। ইনি বল, বেদবিদ্যা, ও তপস্যায় পৃথিবীর অদ্বিতীয় সম্রাট। এই প্রভু প্রজাপতি সমুদ্র কন্যা সবর্ণাকে বিয়ে করেন। তাদের দশপুত্র হয়। এরা ধনুর্বেদে পারদর্শী ছিলেন। এরা সমুদ্রের জলে পড়ে একই ধর্ম আশ্রয় করে অযুত বছর ধরে মহা তপস্যা করেন। বিশাল বিশাল গাছেরা পৃথিবীকে ঘিরে ফেলে। ফলে বাতাস আর বইতে পারল না। প্রজারা দশ হাজার বছর নিশ্চেষ্ট করে বসে থাকল। তখন সাগরকন্যা ও বহির দশজন পুত্র রেগে গিয়ে মুখ থেকে বাতাস ও আগুন উদ্গার করতে লাগল। গাছগুলি পুড়ে গিয়ে পৃথিবী গাছহীন হল।

কিছু গাছ বেঁচে আছে দেখে রাজা সোম বলেন–হে সমুদ্র পুত্রগণ, আপনার রাগ ত্যাগ করুন। এই কন্যারত্নটি দেখছেন, একে আমি বড় করেছি। এই বৃক্ষ কন্যাকে আপনি স্ত্রীরূপে গ্রহণ করুন। কন্যাটির নাম মারিয়া। এর গর্ভে আপনাদের অর্ধেক ও আমার অর্ধেক তেজ নিয়ে বিদ্বান প্রজাপতি দক্ষ জন্মাবেন। তিনি তেজ ও অগ্নি দিয়ে পৃথিবীর প্রজাদের পালন করবেন।

এরপর সোমের কথায় প্রচেতারা গাছদের ওপর রাগ ত্যাগ করে মারিয়াকে স্ত্রীরূপে গ্রহণ করলেন। ঐ দশ প্রচেতা বা সমুদ্রতান বলে মনের মারিয়ার গর্ভ সঞ্চার করলে মহাতেজা দক্ষের জন্ম হয়। তিনি তার মন দ্বারা প্রজা সৃষ্টি করতে লাগলেন। তিনি মন দিয়ে বর, আর দ্বিপদ ও চতুষ্পদ সৃষ্টি করে অনেক স্ত্রী সৃষ্টি করলেন। দক্ষ তারপর এই সব স্ত্রীজাতির মধ্য থেকে ধর্মকে দশ, কশ্যপকে তেরো ও চাঁদকে নক্ষত্ররূপিণী সতেরো কন্যা দান করলেন। এরপর অরিষ্ঠনেমীকে চার, বাহু পুত্র দুই কন্যা দিলেন।.

এরপর অঙ্গিরাকে দুই এবং কৃশাস্বকে এক কন্যা দান করলেন। এবার এদের বংশধরদের কথা শুনুন। ষষ্ঠ চাক্ষুষ মনুর কাল শেষ হলে সপ্তম প্রজাপতি বৈবস্বত মনুর শাসন সময়ে ঐসব কন্যার, দেবতা, পাখী সাপ, দৈত্যদানব, গন্ধর্ব, অপ্সরা ও অন্যান্য অনেক জাতীয় সন্তান উৎপন্ন হয়। প্রাচীনকালে দর্শন অথবা চিন্তা থেকেই সৃষ্টি হত। ঋষিরা জিজ্ঞাসা করলেন-হে বাগ্মীপ্রবর, দেব, দানব, দেবর্ষি এবং মহাত্মা প্রজাপতি দক্ষের শুভ জন্ম বৃত্তান্ত আপনি আগেই বলেছেন। কিন্তু হে সূত! কি জন্য প্রজাপতি আবার প্রচেতাদের পুত্ররূপে পেলেন ও সোমের দৌহিত্র হয়ে দক্ষ কিভাবে আবার তাঁর শ্বশুর হলেন– এ বিষয়ে আমাদের সংশয় দূর করুন।

সূত উত্তর করলেনউৎপত্তি ও নির্বোধ প্রাণীদের নিত্যধর্ম। ঋষিজনেরাও এই নিয়মে চলেন। প্রাণীদের মধ্যে দেখা কনিষ্ঠ বিচার ছিল তা একমাত্র তপস্যা ছিল শ্রেষ্ঠ এবং তপস্যাই জন্মের কারণ। চাক্ষুষ মন্বন্তরে এই চরাচর প্রজা সৃষ্টি যিনি জানেন, তিনি সম্পূর্ণ আয়ুলাভ করে স্বর্গে যান।

.

পঁয়ষট্টিতম অধ্যায়

সূত বললেন–এখন মহাত্মা বৈবস্বত মনুর অধিকার চলছে। আমি সংক্ষেপে, এদের যথাযথ বর্ণনা করছি। হে ঋষিরা। সপ্তম বৈবস্বত মনুর অধিকারকালে দধীচিপুত্র কশ্যপ থেকে দেবতারা জন্ম নিলেন। আদিত্য, বসু, রুদ্র, সাধ্য, বিম্বদেব, মরুত, ভৃগু এবং অঙ্গিরা এই হল আট দেবতা। এদের মধ্যে কাশ্যপ পুত্র হল আদিত্য, মরুত ও রুদ্র। সাধ্য, বসু ও বিম্বদেব এরা ধর্মপুত্র অত্রেয়। ভৃগু থেকে ভার্গব ও অঙ্গিরা থেকে অঙ্গিরা সের জন্মেছেন। বৈবস্বত মন্তন্তরে এই সব দেবতা ছন্দোগ বলে অভিহিত। এরা প্রলয়কাল পর্যন্ত থাকেন, এই সব দেবতাদের মধ্যে ইন্দ্ৰ তেজস্বী মহাবল। সব মন্বন্তরেই এই ইন্দ্ররা রয়েছেন।

ভূত, ভবিষ্যৎ ও সাম্প্রতিক কালভেদে ইন্দ্রেরা আলাদা আলাদা। শত শত গুণাধিক শত মেধা সম্পন্ন। এবার ভূত, ভবিষ্যত ও সাম্প্রতিক কালের প্রভুদের কথা বলছি শুনুন। দ্বিজগণ বলেন, ভুঃ, ভুব, স্বঃ এই তিনলোক। তারা ভূমিকে ভূর্লোক, অন্তরীক্ষকে ভূব এবং আকাশকে ভব্য স্বলোক বলেন। এসব কাল ও লোকেদের সাধন বলছি শুনুন।

পূর্বকালে ব্রহ্মা ধ্যান করতে করতে প্রথমে ভূঃ এই শব্দটি উচ্চারণ করেন। তখন ভূর্লোক উদ্ভব হয়। ভূ ধাতুর অর্থ সত্য বা বিদ্যমানতা। এই লোক দর্শনীয় ও ভূ-তত্ত্ব এতে রয়েছে। এটি প্রথমে উৎপন্ন হয় বলে একে প্রথম লোকও বলা হয়। তারপর ব্রহ্মা দ্বিতীয় বারে ভূবঃ –এই শব্দটি উচ্চারণ করেন। এই শব্দটি থেকে এসেছে ভূবলোক। এজন্য অন্তরীক্ষকে দ্বিতীয় লোক বলে। এবার ব্রহ্মা ভব্য শব্দটি উচ্চারণ করেন। এজন্য ভব্যলোক উৎপন্ন হল। এই লোককে স্বর্গলোক বলে। ভূমিই ভূর্লোক, অন্তরীক্ষ ভূব আর আকাশ স্বলোক– এই হল ত্রিলোক।

ইন্দ্র এই তিনলোক পালন করেন। দ্বিজেরা তাকে নাথ বলে। প্রতি মন্বন্তরের ইন্দ্রেরা নিজগুণে প্রধান হয়ে যজ্ঞভোজী হন। দেবতারা এবং নিখিল গন্ধর্ব রাক্ষস, পিশাচ, উরগ ও দানবদের উপর যে প্রভুত্ব করে থাকেন, এটিই ঐ দেবেন্দ্রদের মহিমা। দেবতারাই সকল প্রজাদের রক্ষক। এই হল সংক্ষেপে ইন্দ্রের, লক্ষণ। এবার যে সপ্তর্ষিরা স্বর্গে রয়েছেন তাদের কথা বলছি।

কুলিক বংশের থেকে গধিপুত্র মহাতপা বিশ্বামিত্র, ভৃগুকুলের উরুপ্তর জমদাগ্নি, বৃহস্পতিপুত্র ভরদ্বাজ, উতথ্যপুত্র শারস্বত, ধার্মিক গৌতম পঞ্চম স্বম্ভর পুত্র ভগবান অত্রি এবং ষষ্ঠ লোক বিশ্রুত বশিষ্ঠপুত্ৰ বসুমান ও কশ্যপ তন্দক বৎসরে বর্তমান মন্বন্তরে এই সাধুসম্মত সাতজন সিদ্ধ সপ্তর্ষি বৈবস্বত মনুর নজন পুত্র সপ্তম মন্বন্তরীয় রাজাদের বিষয় আপনাদের বললাম।

.

ছেষট্টিতম অধ্যায়

দ্বিতীয় পদের বিবরণ শুনে শংসপায়ন মুনি আবার সূতকে বললেন–হে সূত আপনার কাছে অনুষঙ্গ নামে দ্বিতীয় পাদ শুনলাম। এবার উপোদ ঘতে নামে তৃতীয় পাদ বলুন। সূত বললেন–হে দ্বিজগণ! তৃতীয় পদের কথা বলছি। প্রথমতঃ বর্তমান মহাত্মা বৈবস্বত মনুর চরিত কথা আপনারা শুনুন। চাক্ষুষ মন্বন্তর শেষ হলে বৈবস্বত মন্বন্তর শুরু হয়। এই মন্বন্তর দক্ষ ও মহাত্মা মহাতেজা ভৃগু প্রভৃতি মহাবেদবিদদের অভিশাপে মহেশ্বরের প্রাদুর্ভাব হয়। সেই সপ্তর্ষিরা স্বয়ম্ভব সাত মানসপুত্র রূপে জন্মেছেন। সেই মহাত্মারাই আগের নিয়মনুযায়ী নতুন প্রজাদের সৃষ্টি করেছিলেন।

এই সমস্ত মহাত্মাদের বংশধরেরা গ্রহ নক্ষত্র ঘেরা চরাচর জগতে রয়েছেন। মহাব্রতধারী নৈমিষারণ্যের মুনিরা একথা শুনে সংশয় মনে সূতকে জিজ্ঞেস করলেন, আগের সপ্তর্ষিরা কিভাবে আর জন্মে স্বয়ম্ভব পুত্রত্ব লাভ করলেন, আমাদের কাছে তা বলুন। তখন পৌর নিকোত্তম সূত বললেন– এরা স্বয়ম্ভুব মন্বন্তরে সতীর জন্য ভবদেব দ্বারা, অভিশাপ পেয়েছিলেন। সেজন্য প্রলয়কালে জনতোক থেকে তপস্যালোকে যেতে না পেরে পরম্পরা মিলে এই ঠিক করলেন- আমরা চাক্ষুষ মন্বন্তরে পিতামহের সন্তান হয়ে জন্মালে আমাদের মঙ্গল হবে।

অভিশপ্ত মহর্ষিরা জনলোক থেকে আবার ভূমণ্ডলে আবির্ভূত হলেন। ব্রহ্মার হোমের আগুনের মধ্যে থেকে এই সন্তানের আবির্ভাব হল–এরা হল ভৃগু, অঙ্গিরা মরীচি, পুলস্ত, পুলহ, কুতু, অত্রি, বশিষ্ঠ। সেই যজ্ঞকালে সাম এবং অথর্ব–সমস্তই মূর্তিমান হয়ে সেখানে ছিলেন আর ছিলেন দিক বিদিক, ইলাদেবী, দেবকন্যা, দেবপত্নী, দেবমাতা ইত্যাদি রমণীরা। ব্রহ্মা এদের দেখে রেগে গেলেন। আগুনের মধ্যে শুক্র স্থলন হলে, সেই যজ্ঞের আগুন থেকে ভৃগু নামে পুত্র জন্মাল। মহাদেব তাকে দেখে বললেন–আমি পুত্র কামনায় দীক্ষা গ্রহণ করেছি, এই পুত্র আমার হোক। ব্রহ্মা অনুমোদন করলে মহাদেব তাকে পুত্রত্বে কল্পনা করলেন।

ব্রহ্মা দ্বিতীয় বার শুক্র দিয়ে অঙ্গার-এর মধ্যে আহুতি দিলেন। তার মধ্যে অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সম্পন্ন অঙ্গিরার আবির্ভাব হল। অগ্নি তখন ব্রহ্মাকে বললেন– এ পুত্র আমার হোক, ব্রহ্মা তাই অনুমোদন করলেন। এর পর ব্রহ্মা আগুনে শুক্র হোম করলে তা থেকে ছজন ব্রাহ্মণ জন্মাল। কিরণ থেকে সমুৎপন্ন বলে মরীচি অন্য পুত্ররা ক্রতু, অত্রি, শানিত অস্ত্রের মতো চুল বলে পুরস্থ্য অন্য ছেলের চুল লম্বা বলে পুলহ, বসু অর্থাৎ আগুন থেকে উৎপন্ন তেজস্বীপুত্র বশিষ্ঠ। এরাই লোক সৃষ্টি করেন এদের দ্বারাই প্রজারা বিস্তারলাভ করেছে, তাই এরা প্রজাপতি।

এঁরাই আবার পিতৃগণ নামে সাত ঋষিকে উৎপাদন করেন। মারীচ, ভার্গব, অঙ্গিরা পৌলস্ত্য, পৌলহ, বশিষ্ঠ আত্রেয় এই সাত রকম পিতৃলোক বিখ্যাত। অন্য প্রজাপতিরা হলেন– কর্ম, কাশ্যপ, শেষ, বিক্রান্ত, সুশ্রবা বহুপুত্র কুমার, বিবস্বান, সূচিবা, প্রচেতসা, অরিষ্ঠনেমী ইত্যাদি অনেক প্রজাপতি ছিলেন। কুশসরগ্রহী বালখিল্যেরা পরমাধি পদলাভ করেন। স্বর্গগামী প্রজাপতিরা সার্বভৌম হয়েছিলেন। শাস্ত্রজ্ঞান সম্পন্ন বৈখানদ মুনিরা উড়ন্ত সর্পভস্ম থেকে প্রাদুর্ভূত হল। ব্রহ্মার কান থেকে রূপবান দুই অশ্বিনীকুমার এবং প্রধান প্রধান আরো কয়েকজন প্রজাপতি জন্ম নিয়েছিলেন। রোমকূপের স্বেদ বা ঘাম থেকেও অনেক ঋষির জন্ম হয়েছিল। ব্রহ্মার সেই দ্যুতি থেকে রুদ্র ও আদিত্যের জন্ম। বেদ এবং উৎপাদনে ব্রহ্মা এই সৃষ্টির মূল স্বরূপ।

মারীচ প্রভৃতি মহর্ষিরা মিলে সৃষ্টি কামনায় সেই সুরশ্রেষ্ঠের কাছে গিয়ে তাকে বললেন–আপনার প্রসাদে এই লোক সাধারণ প্রজাদের সৃষ্টি করে সাধনে ইচ্ছুক হয়েছেন। বেদবিদ ও রাজর্ষিরা সবাই দ্বন্দ্ব ভাবের পক্ষপাতী, যাতে এরা দ্বন্দ্বভাব নিয়ে প্রজা সৃষ্টি করতে পারে তার জন্য কন্যা দান করা উচিত। এরা সকলেই বেদমন্ত্রজ্ঞান প্রজাপতি গুণমুক্ত। এই সমস্ত মহাত্মারা, দেবতা ও অন্যান্য ঋষিদের সাথে প্রজা সৃষ্টি করবেন। একথা শুনে লোকগুরু বললেন–আমি এই সমস্ত বিবেচনা করেই প্রথমে দেবতাদের সৃষ্টি করেছি। কিন্তু সেই সব দেবতারা প্রজাপতি বংশেই জন্মাবেন। সেসব প্রজাপতিদের মধ্যে ভৃগুর বংশ সবিস্তারে বর্ণনা করছি।

ভৃগুর দুই স্ত্রী–হিরণ্যকশিপুর কন্যা পৌলমী। ভৃগুর পুত্র কাব্য শুক্রনামে খ্যাত। ইনি দেব অসুরদের আচার্য। শুক্রের চার ছেলে, গো নামে পত্নীর গর্ভেও শুক্রের চার ছেলে-স্বণ্ড, অমর্ক, ত্বষ্ঠা ও বরুত্ৰী–এরা ব্রহ্মার মতেও তেজস্বী বরুত্রীর কয়েকটি পুত্র ছিল। এরা যাগ, পূজা প্রভৃতি ধর্ম লোপ করে মনুর কাছে নিজেদের ইচ্ছা প্রকাশ করতে লাগলেন। তাই দেখে ইন্দ্র বললেন, মনুকে এদেরই পপশ্য করে আমি তোমাকে দিয়ে যজ্ঞ করাবো। বরাত্রির পুত্ররা একথা শুনে পালিয়ে গেল। ইন্দ্র তাদের অনেক ধনরত্ন দিয়ে বশ করলেন, কিন্তু ইন্দ্রকে বিনাশ করবার জন্য যজ্ঞক্ষেত্রে উপস্থিত হলে, ইন্দ্রই তাদের হত্যা করলেন।

শুক্রাচার্যের দেবসাথী নামে এক কন্যা ছিল। ভৃগু পুত্র ত্বষ্টারও কয়েকটি পুত্র হয়। ভৃগু বংশে বারোজন দেবতা জন্মগ্রহণ করেন। পৌলমী অন্তসত্ত্বা হলেও আটমাসে ব্যাধি গ্রস্ত হয়ে বিচ্যুত হয়। সেই সন্তান প্রচেতস নামে খ্যাত হয়। এরপর চ্যবনের রাগে দম নামে রাক্ষসের উৎপত্তি হয়েছিল। চ্যবন সুকন্যার গর্ভে আত্মবান ও দধিচীকে উৎপাদন করেন। দধীচি থেকে সরস্বতীর গর্ভে সারস্বত নামে পুত্র জন্মায়। আত্মবান স্ত্রী রুচির উরুভেদ করে মহাযশস্বী গর্ভে ঋচিক-এর জমদগ্নি নামে ছেলে হয়। জমদগ্নির শতপুত্র হয়। তাদের আবার হাজার হাজার পুত্র। সেই বিপুল ভৃগুবংশের অনেকে অপরাপর মুনিদের আনুগত্যের ফলে সেই সেই গোত্রের অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন বৎস, বিশ্ব, অস্বী, যেন পাণ্ড পথ্য ও সৌনক, ভার্গবেরা, এই সাত গোত্র সাতভাগে বিভক্ত।

এবার অগ্নিপুত্র অঙ্গিরার কথা শুনুন। এঁর বংশে ভরদ্বাজ, গৌতম, ইষ্ণুমণ্ড নামে প্রখ্যাত মহাতেজা সচিরা জন্মেছিলেন। অঙ্গিরার অর্থবনের তিন পত্নী, সুরূপা, স্বরাট, পথ্যা। সুরূপার পুত্র বৃহস্পতি। স্বরাটও চার পুত্রের জন্ম দেন। পথ্যার গর্ভজ পুত্র বিষ্ণু। আর মানসপুত্র সংবর্ত ও বিচিত্ত।

বৃহস্পতির লোক বিখ্যাত পুত্র ভরদ্বাজ। ঔদৰ্য্য, আয়ু, দনু, দর্ভ, প্রাম, হরিপ্যান, হবিষ্ণু, ক্রতু ও সত্য এই দশজন অঙ্গিরা বংশীয় দেবতা। অঙ্গিরা বংশ অনেক বিস্তৃত।

এবার মরীচির উত্তমবংশ বিবরণ বলছি। এ বংশেই স্থাবর জঙ্গম জগত উৎপন্ন হয়। মরীচি প্রজা কামনায় চিন্তিত হয়ে জলকে কামনা করেন। তাঁর ধ্যানের মধ্যে জল তাঁর কাছে এলে তিনি জলমধ্যে বসে থেকে পুত্রহীনের গতি নেই–এই কথা চিন্তা করতে করতে ধ্যান বশতঃ তেজসম্পন্ন অরিষ্টনেমি নামে এক ছেলের জন্ম দেন। ইনি একজন প্রজাপতি। এর নামই কশ্যপ, কশ্যপ সূর্যের পিতা মরিচী সাত হাজার বছর জলমধ্যে থেকে সেই কথা ভেবেছিলেন। সেজন্য তার উৎপন্ন পুত্র জগতে অনুপম ব্রহ্মসম হন। কশ্যপ সূর্যের মতো প্রভাবশালী। সব মন্বন্তরেই ইনি ব্রহ্মার অংশে প্রাদুর্ভূত হন। জলের অন্য নাম কশ্য। কশ্যপানের জন্য তিনি কশ্যপ নামে বিখ্যাত হন। তিনি দক্ষের কাছে কন্যার জন্য তিরস্কৃত হয়ে রেগে গিয়ে ক্রুর বাক্য বলেন। সেই থেকে তিনি কশ্যপ নামে বিখ্যাত হন। ব্রহ্ম দক্ষকে আদেশ করলে দক্ষ তার কয়েকটি কন্যা কশ্যপকে সম্প্রদান করেন। তারা সকলেই ব্রহ্মজ্ঞানবতী এবং লোকেদের মাতৃরূপিণী।

এই সব বৃত্তান্ত যিনি শোনেন তিনি পুণ্যবান, আয়ুস্মান, পাপ থেকে মুক্তি লাভ করেন। এর পর মুনিরা চাক্ষুষ মন্বন্তর শেষ হলে, বৈবস্বত মন্বন্তর কিভাবে শুরু হল সেই বিষয়ে রোমহর্ষণকে আবার জিজ্ঞাসা করলেন। সূত উত্তরে বললেন– বৈবস্বত মন্বন্তরে ব্রহ্মা দক্ষকে ‘প্রজা সৃষ্টি কর’– এমন আদেশ করলে দক্ষ স্থাবর, জঙ্গম নানা রকম প্রজা সৃষ্টি করলেন, দক্ষ প্রজাপতি, জরায়ুজ, অন্তজ স্বেদজ, উদ্ভিজ চার রকম প্রজা সৃষ্টি করতে শুরু করেন, প্রজাপতি দক্ষ দশ হাজার বছর তপস্যা করে, যোগ সামর্থ্য দিয়ে আত্মাকে ভাগ করে মানুষ, উরগ, রাক্ষস দেব, অসুর, গন্ধর্ব ইত্যাদি ঐশ্বর্যশালী তেজরূপ নিজের মতো সন্তান উৎপাদন করেন।

তিনি মনে মনে কল্পনা করেই প্রজা সৃষ্টি করেন। তাঁর সৃষ্ট ঋষি, দেবতা, মানুষ, উরগ, রাক্ষস, পশু, পাখি ইত্যাদি আশানুরূপ বৃদ্ধি পেল না। তখন অসীক্লীকে পতীত্বে বরণ করলেন। অসীক্লীর তপস্যার ফলেই এই স্থাবর জঙ্গম জগত সৃষ্টি হয়েছে। হীরন কন্যা অসীক্লীর গর্ভে দক্ষের হাজার পুত্রের জন্ম হয়। ব্রহ্ম নন্দন, বিবাদ প্রিয় নারদ সেই পুত্রদের কুপরামর্শ দিতে লাগলেন, যাতে তারা অভিশাপ পেয়ে বিনষ্ট হয়। নারদ কশ্যপ প্রজাপতির মানস সন্তান। তিনি দক্ষ প্রজাপতির সন্তানদের সংসার বিরোধী উপদেশ দিয়ে বিনাশ করেন। দক্ষ প্রজাপতি নারদকে বিনাশের জন্য প্রস্তুত হলে, ব্রহ্ম তখন বললেন– আপনার কন্যার গর্ভে আমার সন্তানরূপে নারদ জন্মাবেন। তখন দক্ষ তাকে একটি কন্যা দান করেন। সেই কন্যার গর্ভে নারদ তখন শান্তমুনি রূপে উদ্ভূত হলেন।

একথা শুনে মুনিরা কৌতুক করে জিজ্ঞাসা করলেনহে সূত! নারদ কিভাবে দক্ষ প্রজাপতির ছেলেদের বিনাশ করেন? সূত মুনিদের এই প্রশ্ন শুনে মধুর বাক্যে বললেন–দক্ষের পুত্রগণ প্রজাবৃদ্ধির জন্য মিলিত হলে, নারদ তাদের বললেন–তোমরা ভীষণ নির্বোধ, পৃথিবীর মর্ম তোমরা কিছু মাত্র জানো না। মেদিনীর উৰ্দ্ধঃ, অধঃ অন্ত প্রমাণ না জেনে কিভাবে প্রজা সৃষ্টি করতে চাইছ? এভাবে প্রজা সৃষ্টি করলে, তোমরা দোষী হবে। তারা নারদের এইরকম উপদেশ শুনে বিভ্রান্ত হয়ে নানাদিকে চলে গেল। বায়ব বশীভূত হয়ে বায়ুমণ্ডলে ভ্রমণ করতে লাগল। এইভাবে দক্ষের আত্মজদের বিনাশ ঘটলে, অসীক্লী আবার হাজার পুত্র উৎপাদন করেন। সেই দক্ষ তনয়রা শবর্নাস্ব নামে পরিচিত। এবার তারাও যখন প্রজা সৃজনে সচেষ্ট হলেন, তখন আগের মত নারদ তাদের কুপরামর্শ দিয়ে ভিন্ন বুদ্ধি করলেন। তারা তখন ভালোই হয়েছে ভাবল, আগে ভাইদের খুঁজে বার করা উচিত।

আমরা পৃথিবীর পরিমাণাদি জেনে তবেই প্রজা সৃষ্টি করব। এই ভেবে সবলাশ্বেরা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। সেই থেকেই ভাই-এর অন্বেষণে গেলে আর ফেরে না। আজ পর্যন্ত তারা ফেরেনি। স্ববলা স্বর বিনষ্ট হয়ে গেলে প্রভু দক্ষ রেগে গিয়ে নারদকে অভিশাপ দিলেন– তুমি বিনষ্ট হয়ে, গর্ভবাস কর। পরে দক্ষ আবার ষাট জন কন্যা উৎপাদন করেন। প্রভু কশ্যপ, ধর্ম, ভগবান সেমে এবং অন্য মহর্ষিরা সেই দক্ষ কন্যাদের পত্নীরূপে বরণ করেন।

.

সাতষট্টিতম অধ্যায়

ঋষিরা বললেন–হে সূত! এবার বৈবস্বত মন্বন্তরীয় দেব, দানব ও দৈত্যদের উৎপত্তি বিবরণ বিস্তারিত ভাবে ব্যাখ্যা করুন। সূত বললেন–প্রথমতঃ ধর্মের সভা বর্ণনা করছি। দক্ষ প্রজাপতি ধর্মকে অরুন্ধতী, বসু, যামী, লম্বা, ভানু, মরুন্ধুতী, সঙ্কল্প, মুহুর্তাস, সাধ্যা ও বিশ্বা নামে এই দশ কন্যা সম্প্রদান করেন। ধর্মের এই দশ পত্নীর মধ্যে সাধ্যা থেকে বারোজন সাধ্য নামে দেবতা জন্মে। এরা অন্য দেবতাদের থেকে শ্রেষ্ঠ। প্রজাকামী ব্রহ্মা, বৈবস্বত মন্বন্তরের মুখ থেকে জয় নামে দেবতাদের সৃষ্টি করেন। বারোজন জয় দেবতা ব্রহ্মশাপ বশে এরা স্বয়ম্ভর মন্বন্তরে অজিত নামে, স্বরোচিষ মন্বন্তরে তুষিত নামে এবং উত্তম মন্বন্তরে সত্য নামে উদ্ভূত হন। ধর্মনন্দন বারোজন সাধ্যদের প্রখ্যাত হন। স্বারোচিষ মন্বন্তরে শেষভাগে তুষিত বলে দেবতারা সকলে মিলে কর্তব্য ঠিক করলেন, আমরা মহাভাগ সাধ্যর? ধর্ম থেকে প্রাদুর্ভূত হব। ধর্মের বারোজন সন্তানরূপে চাক্ষুস মন্বন্তরে প্রাদুর্ভূত হলেন। স্বারোচিষ মন্বন্তরে তুষিত দেবতাদের বিপশ্চিত নামে ইন্দ্র এবং সত্য নাচেবিষত, তখন নর-নারায়ণ নামে বিখ্যাত হন। সেই তুষিত দেবতারা সাধ্বত্মঃ লাভ করে মনঃ, অনুমন্তা, প্রাণনর, যান, চিত্তি, হয়, নয়, হংস, নারায়ণ প্রভব ও বিভূ নামে প্রখ্যাত হন। স্বায়ম্ভুব মন্বন্তরে তুষিত দেবতারা হলেন- প্রাণ, অপান, সমান, ইজাল, চক্ষু ইত্যাদি। ধর্মপত্নী বসুর গর্ভে অষ্টবসুর জন্ম। ধর, ধ্রুব, যৌন, আপ, অনল, অনিল, প্রত্যুষ ও প্রভাস –এরা হলেন অষ্টবসু। ধরের পুত্র দ্রাবিন ও হতহ ব্যবহ ধ্রুবের পুত্র এবং, ভাল নামে প্রখ্যাত। সোমের ছেলে বর্বা এবং গ্রহ প্রধান বুধ। আপের পুত্র বৈতণ্ড্য, সম ও শান্ত। অনলের পুত্র হলেন কুমার স্কন্দ ও সনৎ কুমার দুজনেই অনলের তেজঃ পুঞ্জজাত। অনিলের স্ত্রীর নাম শিবা, এর দুইপুত্র। প্রত্যুষের পুত্র দেবল ঋষি। এর ক্ষমাবলে ঔমনস্বী নামে দুই পুত্র জন্মে। বৃহস্পতির বোন যোগস্নিগ্ধা ছিলেন। তিনি অষ্টম বসু প্রভাসের পত্নী হন। এর পুত্র বিশ্বকর্মা, তিনি দেবতাদের শিল্প কর্তা। সবরকম শিল্প ও ভূষণগুলির নির্মাতা।

বিস্বার গর্ভে, ধর্মের দশপুত্র জন্মায়। এবার মুহূর্ত আর তিথিদের নামের উল্লেখ করে বিবরণ বলছি। রবির গতি তারতম্যের ফলে নানা ঋতুর প্রাদুর্ভাব হয়। সেই সমস্ত ঋতুতে অহোরাত্রের মত ছয়শো ভেদ আছে। এতে নানা মুহূর্ত আছে। বেদবিদেরা সেইসবে মুহূর্তের তারতম্য অনুসারে নানা তিথি নক্ষত্রের কল্পনা করে থাকেন। তিথিগুলির ভেদ অনুসারে বিভিন্ন ভাগে পিতৃদান প্রভৃতির ব্যবস্থা করেন। কতকগুলি দিন-মুহূর্ত আছে যেগুলি সূর্যের দ্বারা নির্মিত। আরো পনেরোটি মুহূর্ত আছে– ব্রহ্ম, সৌম্য, আদিত্য ইত্যাদি, এরা দণ্ড, প্রহর প্রভৃতির বোধ ও কালের অবস্থা বিশেষের পরিচায়ক। এদেরও দেবতা সমস্ত গ্রহেরই উত্তর ও মধ্য এই তিনটে জায়গা নির্দিষ্ট আছে। মধ্যস্থান জারদগব, উত্তর স্থান ঐরাবত এবং দক্ষিণস্থান বৈস্বানর নামে প্রসিদ্ধ। অশ্বিনী, ভরনী ও কৃত্তিকা এই তিনটি নাগবীথি পুষ্যা, অশ্লেষা, পুনর্বসু—তিনটি ঐরাবতী বীথি।

জেষ্ঠা, বিশাখা ও অনুরাধা এরা জারদগবী বীথি, পূর্বভাদ্রপদ, উত্তরভাদ্রপদ ও রেবতী এরা বৈশ্বনরী বীথি। দক্ষ তাঁর সতেরোজন কন্যাকে চাঁদের হস্তে সম্প্রদান করেন। এরা জ্যোতিষ্ক শাস্ত্রে সুপ্রসিদ্ধ। বাকি চোদ্দজন কন্যাকে কশ্যপ গ্রহণ করেন। সেই সব লোকমাতা দক্ষ কন্যাদের নাম– অদিতি, দিতি, দনু, কালা, অরিষ্ঠা, সুরামা, সুরভি, ইরা প্রভৃতি, চরিষ্ণু মন্বন্তরে দেবতারা ঠিক করলেন বৈবস্বত মন্বন্তরে অদিতির পুত্ররূপে জন্ম নেবেন।

এই পরামর্শ করে মরীচির ছেলে কশ্যপের ছেলে হয়ে বারো ভাগে জন্ম নিলেন। শতক্রতু ও বিষ্ণু বৈবস্বত মন্বন্তরে নরনারায়ণ রূপে জন্ম নিলেন। এই সব দেবতাদের ও জন্ম মৃত্যু বিধান আছে। প্রজাপতি বিষ্ণুর ও শিবের আবির্ভাব ও তিরোভাব রয়েছে। বারোজেন আদিত্য হলেন- ধাতা, অর্যমা, মিত্র, বরুণ, অংশ, ভগ, ইন্দ্র, বিবস্বান, পূর্ব পর্জন্য ত্বষ্টা ও বিষ্ণু। বিষ্ণু সবার ছোট হলেও প্রভাবে বড়। দক্ষ কন্যা সুরভি তপস্যা দিয়ে মহাদেবের অনুগ্রহে কশ্যপ থেকে বরোজন রুদ্র পুত্র । উৎপাদন করেন। সুরভীর দুটি কন্যাও জন্মে– রোহিণী ও গান্ধারী। রোহিণী চারজন কন্যার জন্ম দেন, হংসলীলা নামে কন্যাটি মহিষ ও মানুষ উৎপাদন করে। ভদ্র নামে কন্যার দ্রুতগামী গন্ধর্ব নামে অশ্বেরা জন্মায়। সেই ঘোড়াগুলো ছিল সাদা সবুজ ও হলুদ রঙের। আবার সুরভি থেকে দক্ষ নামে চাঁদের মতো কান্তিবলে নীলকণ্ঠ বৃষ জন্মায়। সুরভির অনুমতিতে মহাদেবের বাহনত্ব লাভ করে, এতক্ষণ কশ্যপ নন্দন রুদ্র, ধর্মনন্দন সাধ্য, বিশ্বদেবদের এবং বসুদেবের উৎপত্তি বর্ণনা করলাম।

অরিষ্টনেমির ছেলেদের ষোলোজন সন্তান হয়। বিদ্বান বহুপুত্রের চারজন সন্তান জন্মে, এরা বিদ্যুৎ নামে প্রসিদ্ধ। দেবর্ষি কৃশাস্ত্রের পুত্ররা দেবপ্রহরণ নামে প্রসিদ্ধ, এরা প্রতি হাজার যুগান্তে আবার জন্ম নেয়।

হে দ্বিজগণ! তেত্রিশ গণে বিভক্ত সমস্ত দেবতাই ছন্দোগজাত। তাদেরও সৃষ্টি প্রলয় দেখা যায়। দেবতাদের যুগে যুগে আবির্ভাব-তিরোভাব হয়ে থাকে। ঋষিরা জিজ্ঞাসা করলেন। সাধ্য, বসু, বিশ্বদেব, রুদ্র ও আদিত্য থেকে বিষ্ণু ও ভবদেবের আভিজাত্য, প্রভাব কতখানি? কে, কোন্ অংশ বিশিষ্ট অথবা প্রধান, সে সব আমরা জানতে চাইছি। সূত বললেন– হে মুনিগণ ব্রহ্মা বিষ্ণু ও শিবের পরস্পর যে তফাৎ, তা আপনাদের বলছি শুনুন। ব্রহ্মার বিভিন্ন সময়ে রাজসী, তামসী, ঋত্বিকী মূর্তি রয়েছে। এই সব মূর্তির তফাৎ বর্ণনা এরা যায় না। ব্রাহ্ম মূর্তি রাজসী, কালমূর্তি তামসী, এবং স্বাত্বিকী মূর্তি পৌরুষী বলে জানতে হবে।

রাজসী মূর্তি প্রজা সৃজন করেন। স্বাত্বিকী মূর্তি জন্ম থেকে পালন করেন এবং তামসী মূর্তি লয়কালে সমস্ত প্রজাদের গ্রাস করেন। ত্রিলোক-এর সৃষ্টি ও সংহার কাজে রত ব্রহ্মার এক এক রূপে এক এক কাব্যের পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। স্বচ্ছ স্ফটিক মণি যেমন আশ্রয় অনুযায়ী নানা রঙ ধারণ করে যেমন লাল, হলদে ইত্যাদি রঙ ও নানা আকার তেমনই ভগবান স্বয়ম্ভব তেমনি গুণভেদে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও রুদ্র রূপে দেখা দেন। যখন তিনি কালরুপী হন। তখন তার ব্রহ্মমূর্তি থাকে না, যখন পুরুষরূপী হন তখন তার কালমূর্তি থাকে না। রাজসী মূর্তি ব্রহ্মা তা থেকে মরীচি ও মরীচি থেকে কশ্যপের জন্ম হয়, তামসী কালমূর্তি থেকে ভবের উদ্ভব হয়। আর সাত্বিকী পুরুষ মূর্তি থেকে বিষ্ণুর উৎপত্তি।

কালরূপী রুদ্র একমাত্র এই তিনমূর্তি নিয়ে সৃষ্টি পালন ও ধ্বংস করেন। এখানে ব্রহ্মার তিনটি মূর্তির কথা বলা হয়েছে। আর বেদ ও পুরাণ ধর্মশাস্ত্রে স্বয়ম্ভর একটি মূর্তির কথা উল্লেখ আছে, বিজ্ঞানহীন ভিন্নজ্ঞান সম্পন্ন প্রজারা এই নিয়ে বিতর্ক করে।

কেউ ব্রহ্মাকে, কেউ শিবকে, কেউ বিষ্ণুকেই প্রধান বলে নির্বাচন করে থাকে। একই ব্রহ্মা নানা কাজের জন্য নাস দেবতাকার পেয়েছেন। এই সব দেবতাদের এক জনের নিন্দে করলে সকলেরই নিন্দে করা হয়ে থাকে। ঈশ্বরের তত্ত্ব জানার সামর্থ্য কারো নেই। ঈশ্বরই একমাত্র আত্মা। তিনিই তিনমূর্তি গ্রহণ করে প্রজাদের সম্মোহন করছেন। অল্পজ্ঞানী মানুষই একটি প্রধান ও একটি অপ্রধান ইত্যাদি বিভেদ সৃষ্টি করছে।

মূর্তি তিনটির একটি উপাসনা করলে তিনটির উপাসনা করা হয়। সুতরাং এদের এক বা পৃথকের কোনও তফাৎ নেই। আর তারতম্য থাকলেই বা কে জানতে পারে? তিনি প্রজাদের সৃষ্টি করে, পালন করে, আবার ধ্বংস করেন।

পুনর্ভেদে ও কালভেদে তিনি এই কাজ করে থাকেন। তাই এঁকে এক বলা যায়। দ্বিজরা এই একদেবকে, রুদ্র, ব্রহ্মা, লোকপাল, ইন্দ্র, ঋষি, দানব ও নারয়ণ প্রভৃতি বিভিন্ন নামে অভিহিত করেন।

ব্রহ্মমূর্তির অংশে মরীচি এবং মরীচির অংশে কশ্যপ জন্ম গ্রহণ করেন। তামসী মূর্তিতে সংহারকারী রুদ্র প্রাদুর্ভুত হন। আর সাত্ত্বিকী পুরুষ মূর্তির অংশে বিষ্ণু জন্ম নিলেন।

রুদ্রদেব কালরূপে প্রজাদের সংহার সাধন করেন। তিনি কল্পের শেষে সূর্যমূর্তি নিয়ে তিনলোক পুড়িয়ে দেন। বিষ্ণু স্বয়ম্ভর মন্বন্তরে মন থেকে আকৃতির গর্ভে প্রথম উৎপন্ন হন। স্বারোচিষ মন্বন্তরে তুষি দেবতাদের সাথে জন্ম গ্রহণ করেন। উত্তম মন্বন্তরে তিনি বসবতী, দেবতাদের সাথে জন্ম নিয়ে বসবর্তী নামে প্রসিদ্ধ হন। সেই হরি, সত্যা থেকে জন্মে বিষ্ণু নামে খ্যাত হন। অতীতের ঐসব মন্বন্তরে নানান মূর্তি নিয়ে তিনি প্রজাদের রক্ষা করেছেন।

যে যে দেবতার অংশে যার যার জন্ম হয়, তারা সেই দেবতার তেজ, জ্ঞান, বুদ্ধি ইত্যাদি পেয়ে থাকে। যা যা ঐশ্বর্যশালী, শ্রীমান বা প্রভাববান, সেই সমস্ত বিষ্ণুরই অংশ। তিনি এরকম অংশ অনুসারে জন্ম নিয়ে থাকেন। একমাত্র পরমেশ্বর নিজের প্রভুশক্তি দিয়ে নানা আকারে পরিণত হন এবং আবার এক হয়ে যান।

সেই আদিদেবের তেজ নিয়েই সমস্ত মন্বন্তরে স্থাবর জঙ্গম প্রজাদের একবার প্রথম থেকে লয়কাল পর্যন্ত থাকেন। প্রতি কল্পের অন্তে রুদ্রদেব প্রজাদের ধ্বংস করেন।

পরীক্ষা না করে গ্রহণ, পূর্বশ্রুতিতে দৃঢ় বিশ্বাস ও লৌকিক প্রবাদ এইসব কারণে জনগণ প্রকৃত তত্ত্ব জানতে পারে না। যিনি মহৎ সমস্ত কাজগুলির কর্তা এবং আভিজাত্যে সর্বপ্রধান, তিনিই ঈশ্বর। শ্লোকে বলা হয়েছে– ঈশ্বর যোগবল প্রভাবে সূর্য তেজের মতো নিজের প্রতিরূপ অন্য শত সহস্র মুর্তির আবির্ভাব ঘটিয়ে সেই সমস্ত মূর্তির সাথে নানা বিষয় ভোগ ও উগ্র তপস্যা করেন, পরে আবার সেই সমস্ত ধ্বংস করেন।

.

আটষট্টিতম অধ্যায়

নৈমিষারণ্যবাসী ঋষিরা এই সব বৃত্তান্ত শুনে বললেন– হে লোমহর্ষণ, সপ্তম মন্বন্তরে, ইন্দ্র, বিষ্ণু প্রভৃতি মহাতেজা আদিত্য দেবতারা কিভাবে জন্মলাভ করিয়াছিলেন? এই বৃত্তান্ত আমাদের বলুন।

সূত বললেন–সব মন্বন্তরে প্রজা সৃষ্টিতে ইচ্ছুক ব্রহ্মার মুখ থেকে মন্ত্রময় শরীর বিশিষ্ট দেবতার সৃষ্ট হয়। দর্শ, পৌর্ণমাস বৃহৎ, রথম্ভর, আকূত, আকুতি ইত্যাদি সব সন্তান বা ব্রহ্মার প্রথম সৃষ্টি। ব্রহ্মা এঁদের বললেন– তোমরা দেবতা সৃষ্টি কর। স্ত্রী গ্রহণ কর। অগ্নিহোত্র ও যজ্ঞোনুষ্ঠান শুরু করো। ব্রহ্মা একথা বলে অন্তর্হিত হলেন।

কিন্তু তাঁরা ব্রহ্মার কথায় মন না দিয়ে, মন দিয়ে কর্ম সন্ন্যাস গ্রহণ করলেন। কর্মগুলির ফল দেখে তারা সন্তান উৎপাদনে অবহেলা করেন। অর্থ, ধর্ম, কাম, ত্যাগ করে রক্ষজ্ঞানকে অবলম্বন করে আত্মঃ তেজ সংযত করে রইলেন।

ব্রহ্মা তাদের ওপর রাগ করে বললেন–তোমরা প্রজা সৃষ্টি করবে বলেই আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি। অন্য কোনও উদ্দেশ্যে নয়। বৈরাগ্য অবলম্বন করে নিজেদের জন্ম ব্যর্থ করেছে। তাই তোমরা সাতবার জন্মাবে।

দেবতারা ব্রহ্মার অভিশাপে দুঃখিত হয়ে তাঁকে প্রণাম করে অনুনয় করে বললেন–আমরা অজ্ঞানবশে যা করেছি, আপনি সেই অপরাধ ক্ষমা করুন। ব্রহ্মা তাদের বললেন–জগতে আমার আদেশ ছাড়া কেউই স্বতন্ত্রভাবে চলতে পারে না। আমাকে কেউ অতিক্রম করতে পারবে না। আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে কেউ কাজ করতে পারে না।

দেবতাদের পাপ দিয়ে তিনি বললেন–হে সুরোত্তমেরা, তোমরা নিজের ইচ্ছেমতই জগতে জন্ম নিয়ে দেবত্ব পাবে। তোমরা অবিদ্যা মোহাচ্ছন্ন হয়ে ছয় মন্বন্তরেই জন্মলাভ করবে।

ব্রহ্মা একটি শ্লোক বললেন, তার অর্থ হল–বেদবিদ্যা, ব্রহ্মচর্য, সন্তানোৎপাদন, শ্ৰাদ্ধদান, যজ্ঞানুষ্ঠান এবং দান এই সমস্ত সৎকাজের ফলে তোমরা আবার আমার কাছে আসতে পারবে। আমার সাথে চিরস্থায়ী সিদ্ধিলাভ করবে।

ব্রহ্মা একথা বলে সেখান থেকে অন্তর্হিত হলেন। তখন সেই ঐশ্বর্যশালী ও যোগবলযুক্ত জয় নামে দেবতারা যোগ্য মগ্ন হলেন। তাদের শরীরগুলো বিখ্যাত বারোটি হ্রদে পরিণত হল। তারপর তারা সেই বারোজন, স্বয়ম্ভর মন্বন্তরে অজিতার গর্ভে রুচি পুত্র হয়ে জন্ম নিয়ে অজিত নামে বিখ্যাত হন। বিধি, মুনয়, ক্ষেম, নন্দ, অব্যয়, প্রাণ, অপান, সুধামা ঋভু, শক্তি, ধ্রুব ও স্থিতি- এই হল বারোজন দেবতা। এরা সবাই মানস সন্তান। এরা দেবতাদের সাথে যজ্ঞ ভোগী হয়েছিলেন।

তারপর স্বারোচিষ মন্বন্তরে তুষিতার গর্ভে স্বারোচিষ-এর পুত্র রূপে তুষিত নামে দেবতারা প্রাদুর্ভূত হন। তারপর উত্তম মন্বন্তরে উত্তম মনুর পুত্র রূপে হরি নামে প্রসিদ্ধ সেই হরি দেবতারা চরিফুর পুত্র রূপে জন্ম নিয়ে বৈকুণ্ঠ নামে বিখ্যাত হন। এই দেবতারা চাক্ষুস মন্বন্তরে সাধ্যা থেকে সাধ্য নামে খ্যাতি গ্রহণ করে দ্বাদশ আদিত্য নামে বিখ্যাত হন। এইভাবে ব্রহ্মার অভিশাপে জয় দেবতারা সাতটি মন্বন্তরে জন্ম নিয়েছিলেন। এই সাত রকম জন্ম বৃত্তান্ত যে শ্রদ্ধার সঙ্গে পাঠ করে তাকে কোনো পাপ স্পর্শ করতে পারে না। এটাই দেবতাদের অনুশাসন।

ঋষিরা বললেন–হে সূত! এবার দৈত্য, দানব, যক্ষ, গন্ধর্ব, পিশাচ, রাক্ষস সাপ, পশুপাখি, লতা ইত্যাদির উৎপত্তি ও বিনাশ কথা আমাদের কাছে সবিস্তারে বলুন। সূত তখন বললেন– কশ্যপ থেকে দিতির দুই হয়। কশ্যপের সব সন্তানের মধ্যে এই দুটি সর্বশ্রেষ্ঠ। কশ্যপ একবার অশ্বমেধ যজ্ঞানুষ্ঠান করেন। সেই যজ্ঞের সময় তাঁর এক পুত্র হয়। দিতি গর্ভ থেকে সে একেবারে প্রধান পুরেহিতের উচ্চ আসনে গিয়ে বসেছিল। এইকারণে হিরণ্যকশিপু নামে খ্যাত হন। সূত ব্যাখ্যা করে বললেন– প্রাচীনকালে পুষ্কর ক্ষেত্রে কশ্যপ প্রজাপতির অশ্বমেধ যজ্ঞ শুরু হয়। সেই যজ্ঞে, ঋষি, দেবতারা ইত্যাদিরা এসেছিলেন। তখন বিধান অনুসারে পাঁচটি সোনার সিংহাসন, তিনটে কুৰ্চ ও কলস কল্পিত হয়েছিল। দিতি দেবী তখন দশ হাজার বছরকাল গর্ভবতী ছিলেন। মাতৃজঠর থেকে বেরিয়ে পুত্রটি প্রধান হোতার সোনার আসনে বসে বেদ পাঠ করতে লাগলেন। মুনিরা তাকে দেখে নাম রাখলেন, হিরণ্য কশিপু। তার ছোটোভাই হিরণাক্ষ।

তাদের একজন বোন জন্মায়,–সিংহিকা। সিংহিকা বিপ্রাহিত্তির স্ত্রী, রাহুর মা। দিতি নন্দন হিরণ্যকশিপু লক্ষ বছর ধরে তপস্যা করেন। ব্রহ্মা তাঁর তপস্যায় সন্তষ্ট হয়ে বর দিতে চাইলে হিরণ্যকশিপু, যোগ সামর্থে দেবতাদের পরাজিত করার মহেশ্বর্য বর প্রার্থনা করলেন। দিব্য বরদান করে ব্রহ্মা অন্তর্হিত হলেন। হিরণ্যকশিপু সম্বন্ধে পুরাতত্ত্বজ্ঞরা বলেন রাজা হিরণ্যকশিপু যেদিকে যেতেন, দেবতারা, মহর্ষিরা সেই সেই দিকের উদ্দেশ্যে নমস্কার করতেন। এইরকম ছিল তার প্রভাব।

আমরা শুনেছি, পুরাকালে নরসিংহদেব নখ দিয়ে তার বুক চিরে তাকে সংহার করেন। হিরণ্যকশিপু ব্রহ্মার কাছ থেকে বর নিয়েছিলেন, কোন শুষ্ক বা আর্দ্র বস্তু দিয়ে তাকে বিনাশ করা যাবে না। নরসিংহের নখগুলি আর্দ্রও ছিল না, শুষ্কও ছিল না।

হিরণ্যাক্ষের পাঁচটি মহাবল পুত্র ছিল–উকুর, সকুনি, কালনাভ, মহালাভ ও ভূত সন্তাপন। দেবতারাও এদের জয় করতে পারেনি। এদের হাজার হাজার পুত্র ও পৌত্র জন্মে। তারা ‘বালেয়’ নামে খ্যাত। তার পুত্র জন্মায়। প্রহ্লাদ সবার বড়। প্রহ্লাদ পুত্ররা হলো হ্রদ ও নিসুন্দ। নিপুন্দের সুন্দ ও উপসুন্দ । নামে দুই পুত্র হয়। সুন্দের তাড়কা নামের পত্নীকে ব্রহ্মাঘ, মূক, ও মারীচ এই তিনপুত্র হয়।

তাড়কাকে, বলবান রাঘব নিহত করেন। কিরাত যুদ্ধে অর্জুন কর্তৃক মূকদৈত্য মারা যায়। অনুহলাদের পুত্র বায়ু ও সিনীবালী। প্রহ্লাদের পুত্র বিরোচন। অন্য পাঁচ ছেলে–পবেষ্টী, কালনেমি, জম, বাঞ্চল ও শম্ভ। পবোষ্টির তিন পুত্র। জম্ভের চার ছেলে। বাষ্কলের চারপুত্র। কালনেমিরও চারপুত্র। শম্ভুর ছয় পুত্র। বিরোচনের একমাত্র পুত্র প্রতাপ বান বলি। বলির একশো পুত্র। রাজা বলির শকুনি ও পুতনা নামে দুই কন্যা হয়। নষ্টপুত্রা হয়ে দিতি দেবী কশ্যপের সেবা করলেন।

কশ্যপ সন্তুষ্ট হয়ে বর দিতে চাইলেন। দিতি দেবী বললেন–আপনার আদিত্য পুত্রদের দ্বারা আমি হতপুত্রা হয়েছি। আমি দীর্ঘ তেজ সম্পন্ন ইন্দ্ৰহন্তা পুত্র কামনা করছি। মহাতেজা কশ্যপ দুঃখিত চিত্তা স্ত্রীর কথা শুনে বললেন–তুমি শুচি হয়ে থাক, তাহলে ইন্দ্র নিধন করতে পারবে, এমন পুত্র তুমি লাভ করতে সক্ষম হবে। ঋষি কশ্যপ চলে গেলে দিতি দেবী আনন্দিত হয়ে সুশীল নামে বনে গিয়ে ভীষণ তপস্যা করতে শুরু করেন।

এদিকে দেবরাজ ইন্দ্র দিতিদেবীর যঞ্জের কাঠ, অগ্নি, কুশ, ফল ও মূল, যা কিছু প্রয়োজন সবকিছু জোগাড় করে দিলেন। দিতিদেবীকে নানা সেবায় তুষ্ট করলে, তিনি তুষ্ট হয়ে বললেন– আমি তোমার প্রতি খুশি হয়েছি। আর দশ বছর বাদে তোমার ভাইকে দেখতে পাবে। আমি তোমার মতো পুত্র লাভ করে ত্রৈলোক্য বিজয় করব। এই বলে দিতি দেবী দুই হাঁটুর মাঝে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়লেন। তখন ইন্দ্র অবকাশ বুঝে দিতি দেবীর গর্ভে প্রবেশ করে, গর্ভকে ব্রহ্মাস্ত্র দিয়ে সাত ভাগে ভাগ করলেন। সেই গর্ভ বার বার কেঁদে উঠল। ইন্দ্র তখন তাদের আরো সাত ভাগে বিভক্ত করে দিলেন। দিতি দেবী, ঘুম ভেঙে ‘মেরো না’ ‘মেরো না’ বলে আর্তনাদ করলে ইন্দ্র গর্ভ থেকে বেরিয়ে এসে হাত জোড় করে বললেন, আপনি অশুচি ভাবে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। এই সুযোগে আমি ইন্দ্ৰহন্তা গর্ভকে অনেক খণ্ড করে ফেলেছি। গর্ভ বিফল হওয়ায় দেবী দুঃখিত হয়ে বললেন–আমার দোষেই এমন হল। তোমায় কোনো দোষ দিচ্ছিনা। শত্রুবধে তো কোনো দোষ নেই। এবার তুমি আমার গর্ভের সাতটি গণে ভাগ হয়ে মরুত নামে বিখ্যাত হয়ে বিচরণ কর। এদের প্রথম স্কন্ধ পৃথিবীতে, দ্বিতীয় স্কন্ধ সূর্যমণ্ডলে, তৃতীয় স্কন্ধ সপ্তর্ষিমণ্ডলে এবং সপ্তম স্কন্দ ধ্রুবমণ্ডলে অবস্থিত হোক। আমার ছেলেরা সাতবাত স্কন্ধরূপে কালে কালে বিচরণ করুক।

পৃথিবীর প্রথম বাত স্কন্ধ মেঘ পর্যন্ত বিচরণকারী, তার নাম বহ। মেঘ থেকে সূর্যমণ্ডল অবধি দ্বিতীয় বাত স্কন্ধ রয়েছে। তা প্ৰবহ নামে খ্যাত। সূর্য থেকে চন্দ্রমণ্ডল অবধি তৃতীয় বাত স্কন্ধের স্থান, তার ঊর্ধ্বেই নামে প্রসিদ্ধ। তার উর্ধ্বেই সোনাবধি নক্ষত্রমণ্ডল পর্যন্ত সুবহ নামে চতুর্থ বাত স্কন্ধ। এতে আমার পুত্রের বিচরণ করুন। গ্রহ মণ্ডল অবধি পঞ্চম বায়ুস্কন্ধ। এর নাম বিবহ। সপ্তর্ষিমণ্ডল অবধি যে বায়ুস্কন্ধ, তার নাম পরাবহ, এটি ষষ্ঠ বাতস্কন্ধ। সপ্তর্ষিমণ্ডল থেকে ধ্রুব পর্যন্ত সপ্তম বাত স্কন্ধ পরিবহ নামে খ্যাত। আমার আত্মজরা তোমার কাজ অনুযায়ী মরুত নামে বিখ্যাত তোক এবং কালে সেই সেই স্থানে বিচরণ করুন। দিতি দেবী ইন্দ্রের সঙ্গে পরামর্শ করে তার সন্তানদের মরুত এই নামকরণ করেছিলেন। সত্ত্বজ্যোতি, আদিত্য, সত্যজ্যোতি, তির্যকজ্যোতি, সজ্যোতি, জ্যোতিষ্মন ও হরিত এই হল, দিতির গর্ভের প্রথম সাতগণ, এদের আবার সাতটি করে ভাগ করা হলে উনপঞ্চাশজন মরুত সৃষ্টি হয়। দিতি এদের আলাদা নামকরণ করেছিলেন।

পরে দিতি ইন্দ্রকে বললেন– হে পুত্র! তোমার কুশল হোক, আমার এই পুত্রেরা দেবতাদের সাথে সাতটি বাতস্কন্ধে বিচরণ করুক। ইন্দ্র দিতির কথা শুনে হাতজোড় করে বললেন–মাত! তাই হোক। আপনি যা যা বললেন, সবই ঠিকমতো সম্পন্ন হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। আপনার এই মহাত্মা সন্তানরা দেবতাদের মত হয়ে তাদের সাথে যজ্ঞভাগভোজী হবে। এরজন্য মরুতেরা দিতির পুত্র হয়েও দেবত্ব ও অমরত্ব পেয়েছেন।

এইভাবে মাতা দিতি ও পুত্র ইন্দ্র এভাবে নিয়ম নির্ধারণ করে আনন্দিত হয়ে অন্যত্র চলে গেলেন। ইন্দ্র তখন স্বর্গে চলে গেলেন। মরুতদের এই জন্মবৃত্তান্ত যে মানুষ পাঠ করে বা শোনে সে দীর্ঘায়ু হয়। কখনো তার অনাবৃষ্টির ভয় থাকে না।

সূত বললেন–এবার দনুপুত্রদের বংশ বিবরণ বলছি, আপনারা শুনুন। দনুপুত্রদের মধ্যে সবাই বলবান ছিলেন, এদের মধ্যে বিচিত্তি প্রধান। এরা একশোজন ও সকলেই প্রচণ্ড শক্তিমান। সকলেই তপস্যার দ্বারা বর লাভ করেছিলেন। সবাই সত্যবাদী, মহাবল, মায়াবী, ক্রুর ইত্যাদি এইসব নামে বিখ্যাত। এইসব দানবদের মধ্যে যারা প্রধান ছিল তাদের নাম বলছি– মহাবিশ্ব, গবেষ্টি, দুন্দুভি, সেজামুখ, ভগবান, শিল, বামনক, মারীচ, বিক্ষোভ প্রভৃতি। এদের মধ্যে সূর্য চন্দ্রও ছিল। এরা প্রথমে অসুরদের দেবতা ছিলেন। পরে দেবতাদের দলভুক্ত হয়েছেন। এইসব অসুর দৈত্য ও দানব আখ্যায় অভিহিত।

সন্তানু দিতির গর্ভজাত আর অনুভানু দনুর পুত্র। এছাড়া দনুর বংশধরেরা হল– একাক্ষ, ঋষভ, অরিষ্যট, প্রলম্ব, নরক, ইন্দ্ৰবাধন, কেশী, মেরু শম্ব, ধেনু, গবেষ্ঠী, গবাক্ষ ও বীর্যবান, তালকেতু। বিচিত্তির পুত্ররা সিংহিকা গর্ভজাত মহাসুর। এরা সংখ্যায় চৌদ্দজন। রাহু এদের সবার বড়। এরা প্রচণ্ড ধূর্ত, বলবান। এদের দেবতারাও বধ করতে পারে না। জমদগ্নি পুত্র বলবান ভার্গব এদের হত্যা করেন।

পুলোমা ও কালিকা বৈশ্বানরের কন্যা। মহুষ প্রভাব এবং জয়ন্ত শচীর পুত্র। শর্মিষ্ঠা পুরুকে আর উপদানবী জষ্মন্তকে প্রসব করেন। মারীচ, বৈশ্বানরের দুই কন্যা পুলোমা এবং কালিকাকে বিয়ে করেন। এদের ষাট হাজার দানব জন্মগ্রহণ করেন এই সব দানবেরা দেবতাদেরও অবধ্য ছিল। সব্যসাচী এদের হত্যা করেন। ময়দানবের পুত্ররা সবাই বীর। তাদের নাম দুন্দুভি, বৃষ, মহষি, বালিক, বজ্যসম। এছাড়া মন্দোদরী নামে ময়দানবের এক কন্যা ছিল। দৈত্য দানবদের সৃষ্টি সম্বন্ধে জানা গেল।

দনাযুষার পাঁচ ছেলে, পাঁচজনই মহাবল। অরুরু, বলিজন্ম, বিরক্ষ ও বিষ, অরুরুর পুত্র ধুন্ধু নামে মহাসুর। কুবলাম্ব একে হত্যা করেন। বলির পুত্র কুম্ভল ও চক্রধর্ম। এরা দুজন মহা বলশালী। আগের জন্মে এদের নাম ছিল কর্ণ।

বিরক্ষের দুই পুত্র নাম হল–কালক ও বর। বিষের চারপুত্র ছিল–শ্রদ্ধেহা, বদ্রহা, ব্রহ্মাহা, পশুহা। ইন্দ্রের সঙ্গে বৃত্রাসুরের যখন ঘোর যুদ্ধ হয় তখন বৃত্রের নিঃশ্বাস থেকে এরা জন্মগ্রহণ করে। এরা হল শত সহস্র মহাবল রাক্ষস। দৈত্যদের এবং দানবদের সৃষ্টি কথা বলা হল।

.

উনসত্তরতম অধ্যায়

সূত বললেন–পবিত্র অপ্সরা ও গণধররা মৌনেয় নামে খ্যাত ছিল। চিত্র সেন, উগ্র সেন, ঊনায়ু, অনয় ধৃতরাষ্ট্র, পুলোমা প্রভৃতি ষোলোজন দেব ও গন্ধর্বদের অধীনে ছিল চৌত্রিশজন সুন্দরী অপ্সরাগণ। ঐ অপ্সরারা হলেন অন্তার, সুরেওমা, চারুমুখী বরাননা, এদের মধ্যে সুম্মার পুত্র মহাবল যক্ষরী হল– কম্বল, হরিকেশ, কপিল, কাঞ্চন, মেঘমালী, সুষমা চারটি অপ্সরা কন্যা ছিল। বিশাখা, ভরতা, কৃশাগী, লোহেরী–এই চারজন অপ্সরা অনিন্দ্য সুন্দরী মহাত্মা বিশাল ঐ চারকন্যার–গর্ভে চার যক্ষ উৎপাদন করেন।

এইসব ভয়ঙ্কর মহাবলী যক্ষরা সমস্ত জগৎ বিছিয়ে রয়েছে। মহাত্মা বিক্রান্তের কালেয় নামে প্রসিদ্ধ বহু গন্ধর্ব সন্তান হয়। এছাড়া তার তিন কন্যা ছিল। অগ্নিকা, কম্বলা, বসুমতী। এই কন্যারা সৌন্দর্যে ও শক্তিতে অনুপমা। এদের গর্ভে গন্ধর্বরা জন্মে। বিশ্রবা এই কন্যাদের গর্ভে অনেক বিদ্যাকুশল সন্তান জন্মে। সেই মহাত্মা বিক্রান্ত থেকেই অশ্বমুখ কিন্নরদের উৎপত্তি হয়।

হরিষেন, সুষেন, বারিষেন, রুদ্রদত্ত, ইন্দ্রদত্ত, চন্দ্রম, মহাক্রম, বিন্দু ও বিন্দুসার- এরা হল নরমুখ চন্দ্রবংশীয় কিন্নর। এরাই শ্রেষ্ঠ কিন্নর। নাচ, গানে পটু, লোহেরীয় অনেকগুলি সন্তান ছিল। এর মেয়ের নাম খুববিন্দা।

সুতার কালভবন, নির্দেশক, ও বিদেশক ইত্যাদি ভূতগণমিচর ইত্যাদি ভূতগণ ভূমিচর বলে প্রসিদ্ধ। এরাই ভূতদের অধিনায়ক, ভূতেদের মধ্যে যারা ক্ষমতাশালী, তারা গাছের ডগা থেকে আকাশ পর্যন্ত বিচরণ করতে পারে।

দেব-গন্ধর্বরা যশস্বী ও দেবার্চনার রত। বরিষ্ঠের গর্ভে হংস, অন্য জাহা, ইহু বিশন, কসিরুচি, তুম্বুরু ও বিশ্বাবসু নামে আটজন গন্ধর্বের উৎপত্তি হয়। এদের আটজন অরিষ্ঠের পত্নী ছিল। তাদের নাম অনবদ্যা, অনবশা, অন্বিতা, মদন প্রিয়া প্রভৃতি। এরা আটজন অপ্সরা গর্ভজাত। নারায়ণের উরু থেকে যে সর্বাঙ্গ সুন্দরী অপ্সরার উৎপত্তি হয় তার নাম উর্বশী। এর মধ্যে শোভযন্ত গণ ব্রহ্মার মানসী কন্যা। আহুতগণ মনুর পুত্রী।

অপ্সরাদের মধ্যে তিলোত্তমা সবচেয়ে সুন্দরী ও ভাগ্যবতী অপ্সরা। বেদবতী চতুমুখের বেদী থেকে উৎপন্ন হয়েছে। এভাবে বহু হাজার সুন্দরী অপ্সরা গণ দেব ও ঋষিদের পত্নী ও মা। ঐ সব চম্পক বর্ণা সুন্দরীরা প্রিয়জনেদের আনন্দ দান করতেন প্রাচীনকালে প্রজাপতি থেকে নারদ ও পর্বত উৎপন্ন হয়। তার তৃতীয় সন্তান হল অরুন্ধতী। বিনতার পুত্র অরুণ ও গরুড়। এদের ছত্তিশ জন বোন, এরা সবাই ছোট। রুদ্র অনেক নাগ প্রসব করেন। এদের মধ্যে শেষনাগ বাসুকি ও তক্ষকই প্রধান। এবার খণার সন্তানদের কথা বলছি। এদের নাম বিলোহিত ও বিকল। আর সন্তানগুলি হল– সর্বাঙ্গ কেশ, স্কুলাঙ্গ, তুঙ্গনাম, মহকেন, মনোরথ, দীর্ঘনাসিক প্রভৃতি ভীষণ পুত্রদেব প্রসব করেন। আরো অনেক পুত্র ছিল যেমন–ত্ৰিশীর্ষ, ত্রিহন্ত, ত্রিপাদ, কটিহীন।

এদের মধ্যে সবার বড় ভাই ক্ষুধার্ত হয়ে নিজের মাকে ভক্ষণ করতে গেলে। তখন সব থেকে ছোট ভাই বড় ভাইয়ের হাত থেকে মাকে মুক্ত করে বলল–ইনি আমাদের মা, একে খেয়ো না, রক্ষা করো। সেইসময় পিতা কশ্যপ সেখানে এসে স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করলেন–ছেলেরা কি বিরূপ ব্যবহার করেছে আমাকে বল। মেজো ছেলে মায়ের স্বভাব পেয়ে থাকে। মেয়ে বাবার যেমন রূপ হয় তেমনি জলের রূপ হয়। মার স্বভাব দোষে বা স্বভাবগুণে নানা প্রকার সন্তান জন্মে থাকে। আমার মতে, হে দেবী তুমিও রাগী। ভগবান কশ্যপ এই সকল কথা স্ত্রীকে বলে ছেলেদের কাছে ডাকলেন আর উপদেশ দিয়ে জাতি নির্দেশ করলেন। জ্যেষ্ঠ পুত্র মাকে ভক্ষণ করতে গিয়েছিল বলে নাম হল যক্ষ আর কনিষ্ঠ মাকে রক্ষা করতে গিয়েছিল বলে নাম হল রক্ষ। তাদের ক্ষুধিত দেখে বর দিলেন–তোমরা রাত্রে খাবে ও ঘুরে বেড়াবে। তখন তোমাদের শক্তিও বেড়ে যাবে। তোমরা মাকে রক্ষা করো। এই বলে কশ্যপ চলে গেলেন।

কিন্তু পিতা চলে যাবার পরই তারা প্রাণী ধ্বংসকারী অতিকায় মূর্তি নিয়ে যেখানে সেখানে ঘুরে বেড়ালো আর দেব, ঋষি, গন্ধর্ব, কিন্নর, পিশাচ, মানুষ, পশু ও অনেক পাখিদের ধ্বংস করল, অত্যাচার করল। যক্ষ একবার মহাকল পিশাচকে খাবার জন্য নিজের দুই পিশাচ কন্যার সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। দুই কামচারিণী কন্যার সঙ্গে দুই পিশাচ মহাবল রাক্ষসকে সামনে দেখল। তখন দুই পিশাচ নিজে দুই কন্যাকে বললো, রাক্ষসটিকে ধরে নিয়ে এসো। পিতা একথা বললে দুই কন্যা রাক্ষসকে ধরে নিয়ে এল। পিশাচরা তাদের জিজ্ঞাসা করল–তুই কে? কার ছেলে? রাক্ষস তখন সব বৃত্তান্ত বলল। তখন সবশুনে পিশাচরা নিজেদের দুই কন্যাকে রাক্ষসের হাতে সম্প্রদান করল। পিশাচ দুজনের নাম অজ্ঞ ও খণ্ড। অজ বলল আমার এই সর্বাঙ্গ সুন্দরী কন্যারদের নাম ব্রহ্মধনা। এই কন্যা নোমশূন্য। খণ্ডের কন্যা জন্তুধনা।

জন্তুধনার খাদ্য হল জন্তু। এর সর্বাঙ্গে লোম। এই ব্রহ্মধনা ব্ৰহ্মণ নামে পুত্র ও তত্ত্বলা নামে কন্যা প্রসব করে। এবার এই পিশাচ দম্পতির প্রজাসৃষ্টির কথা বলছি। হেতু, হেতু, উগ্র, পৌরষেয়, বধ, ব্যাঘ্র ও সর্প। এইসব রাক্ষসেরা সবাই সূর্যের অনুচর ও সবসময়ে সূর্যের সাথে ভ্রমণ করে থাকে। এদের মধ্যে হেতুর পুত্র লন্ধু। লন্ধুর দুই ছেলে মাল্যবান ও সুমালী। বধের দুই পুত্র বিঘ্ন ও শমন। দুজনেই দুরাচারী।

ব্যাঘ্রের পুত্র নিকুম্ভ। এই নিকুম্ভ জন্তুদের বিঘ্নকারক। এরা সকলেই পরাক্রান্ত রাক্ষস। যাতুধানদের কথা বলা হল। এবার ব্রহ্মধনদের বিবরণ শুনুন। যজ্ঞ, পিতা, মুনি, ক্ষেম, ব্রহ্মা, পাপ, যথা, স্বাকোটক কালি ও সর্প এই দশজন ব্রহ্মধনার গর্ভজাত। ব্রহ্ম রাক্ষসরা এদেরই বংশে উৎপন্ন।

এরপর রয়েছে যক্ষ পুত্রদের কথা। যক্ষ ক্রতুস্থলী নামে অপ্সরাকে লাভ করার জন্য নন্দন বনে এসে দেখল অন্য অপ্সরাদের নিয়ে খেলছে। নিজের রূপ নিয়ে অপ্সরার কাছে যেতে সাহস না পেয়ে গন্ধর্বের প্রণয়ী বসুরুচি রূপ ধারণ করল এবং তখন অপ্সরা ক্রতুস্থলী ভাবাবেশে তার সঙ্গে মিলিত হল। ঐ মিলনের পরে তাদের এক পুত্র জন্মাল। ঐ পুত্র তখনই বিশাল আকার ধারণ করে পরিণত বয়স্কের মতো হয়ে উঠল। ঐ সদ্যোজাত পুত্র নিজের পিতাকে বলল– আমি রাজা। আমার নাম নাভি। পিতা যক্ষ তাকে অভয় দিয়ে বলল তোমার ভয়ের কারণ নেই। তুমি মায়ের রূপ পাবে আর আমার বীর্য। যক্ষ তখন নিজের রূপ ধারণ করল আর হাসিমুখে অপ্সরাকে বলল– সুন্দরী এবার নিজের ছেলের সাথে আমার ঘরে চলো। হঠাৎ তার রূপ পরিবর্তন দেখে অন্য অপ্সরাগণ ভয় পেয়ে পালিয়ে গেল। ক্রতুস্থলীকে তার পুত্র সান্ত্বনা দিয়ে অপ্সরা সমাজে ফিরিয়ে দিলো আর সে তার পিতা যক্ষের সঙ্গে ফিরে গেল। বটগাছই যক্ষদের বাসস্থল। সেখানে গুহ্যকেরা বাস করছিলো। যক্ষ রজতাভ গুহ্যকদের পিতামহ। ঐ রজতাভ দৈত্য কন্যা ভদ্রাকে বিয়ে করে।

ভদ্রার পুত্রদের নাম মণিবর ও মনিদ্র। পুণ্যজনী, দেবজনী এদের স্ত্রী। পুণ্যজনী ও মনিদ্রের পুত্ররা হল–সিদ্ধার্থ, সূর্যতেজ, সুমন্ত, নন্দন, কন্যক, ববির্ক, মণিদত্ত, বসু, সর্বানেভূত, শঙ্খ ইত্যাদি চব্বিশজন সন্তান। দেবজনী ও মনিবরের কয়েকজন পুত্র হল– পুণ্যভদ্র, সুনেত্র, যম, বক, কুমুদ, হিরণ্যাক্ষ, সুরূপ ইত্যাদি।

খসার অনেক রাক্ষসপুত্র ছিল। যেমন- মধু, সুকর, পরশুনাভ, নিশাচর প্রভৃতি। খশার আরও সাতজন কন্যা ছিল। এই সাতবোন আবার ছিল হিংসুক, দুর্মদ, প্রচণ্ড সব রাক্ষসের জননী। রাক্ষসদের মধ্যে কেউ কেউ প্রায়ই ভগবান শঙ্করের আরাধনা করে থাকে। কম্পন নামে যক্ষ কেশিনীর গর্ভে কয়েকজন ভীষণ অসুর জন্মায়। এদের নাম- দংষ্ট্রাকরাল, বিকৃত, মহাকর্ণ, মহোদন্ত হারক প্রভৃতি সব নীচ রাক্ষস। এরা আবার নানা আকার নিয়ে অদৃশ্যভাবে বিচরণ করে। এদের সংখ্যা শত সহস্র এরা পৃথিবীর সর্বত্রই বিরাজ করে। সমস্ত রাক্ষসদের আটমাতা ও আটভাগ আছে। ভদ্রক, নিকর এদের এক ভাগ। এরা মর্ত্যে বিচরণশীল। এভাবে পুতনা প্রভৃতিকে নিয়ে একটি বিভাগ। এরা মনুষ্য জগতে বালকদের অনিষ্ট করে। স্বন্ধ গ্রহাদি কয়েকটি রাক্ষস আছে। এরাও শিশুদের ক্ষতি করে। অগস্ত্য, পৌলস্ত্য, বিশ্বামিত্র নামে যেসব রাক্ষস আছে তাদের রাজা হল কুবের।

এইসব যক্ষ, রাক্ষস ও পিশাচগণের মধ্যে যারা দেবতাদের সমকক্ষ, ভাস্বর, বলবান, সর্বলোক নমস্কৃত, যজ্ঞকারী এবং দেবতাদের তুল্য, তাদের অসুর বলে। সমস্ত রাক্ষসই যক্ষদের মতো প্রভাব। পিশাচগণ যক্ষ অপেক্ষা ঐশ্বর্যে ত্রিগুণহীন। এইভাবে গন্ধর্ব থেকে পিশাচ পর্যন্ত চার জাতীয় দেবযোনী ধন, রূপ, আয়ু, বল, ঐশ্বর্য, বুদ্ধিতে দেবতা ও অসুর থেকে দ্বিপাদহীন। এবার ক্রুর স্বভাবের রাক্ষসদের কথা বলা হচ্ছে। ক্রোধার বারো কন্যা এরা সবাই পুলহের পত্নী। এদের নাম- মৃগী, মৃগনন্দা, ইরাবতী, ভূতা, কার্পস দ্রষ্টা, নিশা, তির্যা, শ্বেতা, সুসা, স্বরা। এদের মধ্যে মৃগীর পুত্র হরিণ, শরভ শশক, রুরা ইত্যাদি। মৃগনন্দার সন্তান মগরাজ, মহিষ, উষ্ট্র, বরাহ, খঙ্গ ও গৌরমুখ। হরিভদ্রার সন্তান সিংহ, গো, লাঙ্গুল, বানর, কিন্নর, ব্যাঘ্র ইত্যাদি। ইরাবতীর গর্ভে হাতির জন্ম হয়, নাম ঐরাবত। এর রং সাদা, চারটি দাঁত, এটি দেবরাজের বাহন।

ঐরাবতের বংশে ভদ্র নামে এক হাতি ছিল। ঐ হাতি জলজাত, সোনার মত রং, ছটি দাঁত। বলাসুর একে বাহন করেছিল। ঐরাবতের পুত্র অঞ্জন, সুপ্রতীক, বামন ও পদ্ম শ্বেতা ও কয়েকটি ক্ষিপ্রগামী হতি প্রসব করেছিল। তারা হল- ভদ্র, মৃগ, মন্দ, সংকীর্ণ। সংকীর্ণ ও অঞ্জন–এরা যমের বাহন। ভদ্র ও সুপ্রতীক বরুণের, পদ্ম ও মন্দ কুবেরের, মৃগ নাম হাতি পাবকের বাহন। পদ্মগজের উগ্র স্বভাবের সন্তানরা মাতঙ্গজ নামে পরিচিত। এছাড়া স্থল, শূল প্রভৃতি বলবীর্যশালী হাতি আছে। এদের নোম ও নখ সাদা। বামদেব নামে হাতি ঘন কালো গায়ের রঙ। সাম থেকে বামন নামে হাতি জন্মে। এরা ভীষণ দ্রুতগামী। এদের বংশ সম্ভুত বিকৃত গজননই মানুষের হাতে আবদ্ধ হয়ে থাকে। সপ্রতীক খুব সুন্দর প্রহারী, সম্পাতী ও পৃথুজিত নামে এর তিন ছেলে। এই বংশে অঞ্জন থেকে অঞ্জনা আর সাম থেকে অঞ্জনাবতীর জন্ম হয়।

সাম ও চন্দ্রমা থেকে কুমুদদ্যুতি ও পিঙ্গলা নামে দুই হস্তিনী জন্মে। পিঙ্গলার পুত্র মহাপদ্ম ও ঊর্মিমালী। এই বংশের নাগগণ অতি প্রচণ্ড, হস্তীযুদ্ধে সুনিপুণ। দেবতারা দেবত্মর যুদ্ধে জয়লাভের জন্য এই নাগগণকে বলরূপে গ্রহণ করেছিলেন। দুটি দাঁত থাকার জন্য দ্বিরাগ, হাত বা শুড় থাকার জন্য বলে হস্তী। দাঁত থাকার জন্য দন্তী। গর্জন করে বলে গজ। কুঞ্জচারী বলে কুঞ্জর। অগ্নির শাপে এরা কথা বলতে পার না। এভাবেই এদের সম্বন্ধে জানা যায়। সমুদ্র থেকে কৌশিকী ও গঙ্গার মাঝে যে স্থান তা অঞ্জন নামে হাতির ও তার বংশের অন্যদের বন। বিন্ধ্যাচলের উত্তর ও গঙ্গার দক্ষিণ দিকের গঙ্গদ্ভেদ থেকে রুরুষ দেশ পর্যন্ত বামন হাতির বন।

সিন্ধু পর্যন্ত পশ্চিম দিকের পর্বতের কাছের জায়গাটি হল যমের বন। ভূতি রুদ্রের অনুচর ভূত প্রসব করে। এরা কেউ মোটা, কেউ রোগা, কেউ লম্বা, কেউ বেঁটে, কেউ কেউ লম্বকর্ণ কারো জিব বা পেট নেই। এরা সব নদী ও সমুদ্রে বাস করে। কেউ কালো, কেউ লাল, কেউবা আবার ধোঁয়ার মত রং। কারো অনেক চোখ, অনেক মাথা, কারো বা মাথা নেই। কেউ বা চন্ত, বিকট, অন্ধ, জটিল। কুঁজো ও বামন কেউ মহাযোগী, কামরূপী কুশহস্ত শবাহারী, কেউ মুগুরধারী, কেউ অসিধারী, কারো মুখ আগুনের মত, কারো মুখ-চোখ দিয়ে আগুন বার হচ্ছে। এদের মধ্যে কেউ কেউ সন্ধ্যাবেলা ও রাতে ঘুরে বেড়ায়। যারা রাতে বিচরণ করে, তারা ভয়ানক।

এরা সাধারণত ভবদেবকেই পূজা করে থাকে। এদের স্ত্রী-পুত্র নেই। এই শত সহস্র ভূত সম্প্রদায় ভূতির সন্তান কশিশা। কম্মুণ্ডী থেকে কুম্মারা জন্মগ্রহণ করে। ষোলোটি কুম্মাণ্ডদের কুল বা বংশ আছে। পিশাচদেরও ষোলোটি গড় আছে। ছাগল-ছাগলী, বক-বকী, কুম্ভমাত্র কুম্ভী ইত্যাদি। পিশাচদের বিকৃতকার অসংখ্য পৌত্র ও পুত্র আছে। এই পিশাচদের, কারো সারা গা লোমে ভরা, কারো চোখ গোলাকার, কারো দাঁত, নখ বড়, কেউ কেউ মানুষ ভক্ষণ করে। কারোর মাথায় চুল নেই। গায়ে লোম নেই। এরা কুণ্ডিকা নামে পিশাচ। তিল ও আমিষ এদের খাদ্য। আর আছে নিতুল্ক পিশাচ, অলকমর্ক পিশাচ, পাংশু পিশাচ, শ্মশানে বাস কারী শুষ্ক, দাড়িগোঁফ রয়েছে, ছেঁড়া কাপড়, এদের নাম, উপচচীর। আরো পিশাচ আছে। হাতির মত মুখ, উটের মত কুঁজ, নাম কুম্ভপাত্র। কোনও পিশাচ অদৃশ্য ভাবে ঘুরে বেড়ায়। এদের বিরাট বড় হাঁ, কানও লম্বা। এরা শূন্যবাড়িতে বাস করে। আবার কিছু পিশাচের হাত-পা খুবই ছোট। এরা বালকদের ভক্ষণ করে। আর রয়েছে পিশিতাদ পিশাচ, স্কন্ধ নামে পিশাচ। পিশাচদের এইরকম ষোলোটি জাতি আছে। ভগবান ব্রহ্মা পিশাচদের দয়া করে তাদেরকে অন্তর্ধান ও কামরূপত্ব বর দান করে। এরাই সন্ধ্যাতেই ঘুরে বেড়ায়। ভাঙা বাড়ি, ফাঁকা বাড়ি, সংস্কার বর্জিত জায়গায় এরা বাস করে।

এছাড়া নদীতীর্থ, মহাপথ সবজায়গায় এরা থাকে। যারা অধার্মিক, বর্ণাশ্রম ধর্মে মন নেই, তারাই পিশাচের আশ্রয়স্থল। মধু, মাংস, তিল, চুন, চাল, দই, ধূপ, ফুল ইত্যাদি উপহার পিশাচদের দিতে হয়। স্বয়ং ব্রহ্মা এই ব্যবস্থা করেছেন। শূলপানি গিরিশ এদের অধিপতি।

এরপর ঋষার সমস্ত প্রজাদের কথা বলছি, শুনুন। ঋষার পাঁচ কন্যার নাম– মীনা, মাতা, বৃত্তা, পরিবৃত্তা ও অনুবৃত্তা। এদের সন্তানরা হল-মকর, তিমি, রোহিত, পাঠীন প্রভৃতি মাছেরা। কুর্ম জাতীয় বহু জলচর বৃত্তার থেকে উৎপন্ন। মণ্ডুক বিকারগুলোর উৎপাদনকারী হল অনুবৃত্তা। শম্বুক, শুক্তি, বরাটক, শঙ্খ বিশেষ, কালকূট প্রভৃতি প্রাণী প্রসব করে পরিবৃত্তা।

এবার স্বেদজ প্রাণীদের কথা বলছি। মাথার চুলে ও কাপড়ে যে উকুন হয়, তা স্বেদজপ্রাণী। জল ও বৃষ্টি থেকে মৃগশরীরে নানারকম কীট জন্মে। তাদের নাম নীলচিত্র, পিপ্পল, দংশ। অনেক ফলের থেকেও নানারকম কীট জন্মে। কাঠ থেকে ঘুণ, দ্রুম থেকে নীলমাছি, গো, মহিষ থেকে অসংখ্য কীট জন্মায়। অষ্টাপদ কীটও আছে। অন্যান্য নানাপ্রকার মশা ও মাছি আছে। এরকম অসংখ্য স্বেদজ প্রাণীগণ রয়েছে। এইগুলি কর্মফলেই ঘটে থাকে।

এখন নৈঋত প্রাণীর কথা বলছি। এরা উপসর্গজাত। কোন কোন দেবতা যযানিজাত, কিছু দেবতা স্বতঃপ্রাদুর্ভূত হয়েছেন। সুরমা একশো সাপ উৎপাদন করেন। তক্ষক সাপেদের আর বাসুকি নাগেদের রাজা। তাম্ৰা যে জাতি উৎপন্ন করেন, তা বলছি স্যেনী, ক্রৌঞ্চী ভার্মা, ধৃতরাষ্ট্র ও শকী। গোনী অরনের থেকে মহাবল পক্ষিশ্রেষ্ঠ সম্পত্তি ও জটায়ুকে লাভ করে। সম্পত্তির এক পুত্র, এক কন্যা জাটায়ু থেকে কাক শকুন ইত্যাদির জন্ম। গরুড়ের ভার্য্যা বাসী, ক্রৌঞ্চী, শুকী, ধৃতরাষ্টী ও ভদ্রা। শুকী গরুড় থেকে ছজন পুত্র প্রসব করে। গরুড়ের পুত্র ও পৌত্রদের চৌদ্দ হাজার সন্তান-সন্ততি বংশবিস্তার করেছে।

এরা ছড়িয়ে আছে শাল্মলী দ্বীপ, দেবকূট পর্বত, পঞ্চ শিখর হেমকুট– এই সব দেশে। মহাত্মা গরুড়েরা এইভাবে সমস্ত পর্বতে ছড়িয়ে আছে। ভাম, উলুক, কাক, ময়ূর, কপোত, তিতির– এরা গরুড়-এর স্ত্রী স্বামীর পুত্র। ক্রোঞ্চীর পুত্র হল– কুবরয়, কুরর, সারস প্রভৃতি মাংসাসী পাখী, ধৃতরাষ্ট্রীয় পুত্ররা হাঁস, কল হংস, চক্রবাক ও অন্যান্য হিংসুক প্রাণী। এদের থেকে আবার অসংখ্য পুত্র-পৌত্রাদি উৎপন্ন হয়।

এবার ইরার বংশ বিবরণ শুনুন। এদের তিনটি কমললোচনা কন্যা জন্মে। এরা বনস্পতি, গাছ ও বীরুহে জননী। এদের থেকেই বড় বড় গাছ মহীরুহের ফুলে ভরা লতা, গাছগুল্ম প্রভৃতি জন্মায় এদের বিস্তৃত বর্ণনা একশো বছরে দেওয়া সম্ভব নয়।

অদিতি ধর্মশীলা, দিতি বলশালিনী, সুরভি তপঃশীলা, দনু মায়াশীলা, মুন অধ্যয়নশীলা। অরিষ্টা গতিশীলা, খশা ক্রোধশীলা, কদ্রু কুরশীলা, ক্রোঞ্চী শ্রুতিশীলা, ইরা অনগ্রহশীলা, দনায়ু-ভক্ষণ দক্ষা, বিনতা বহনশীলা, তাম্ৰা-পাপ শালিনী। এইসব লোকমাতাদের স্বভাব এরকমই। এরা সত্ব, রজঃও তমো গুণে ধার্মিক ও অধার্মিকা দুইই হন।

যেহেতু প্রতি মন্বন্তরে মানুষই দক্ষ কন্যাতে জন্মগ্রহণ করে, এজন্য মানুষই শ্রেষ্ঠ। মানুষই ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষের সাধক। সুরাসুররাই কার্যসিদ্ধির জন্য মনুষ্যলোকে বার বার জন্ম নেয়। সুর, অসুর, অপ্সরা, গন্ধর্ব, যম, রক্ষ, পিশাচ, সুপর্ণ, পাখি, কৃমি, কীট, পতঙ্গ, জলজ পশুদের বংশ বিবরণ বলা হল। মন পবিত্র হয়ে পরম আদরে এইসব বংশ বিবরণ শুনতে বা যে ব্যক্তি এগুলি নিয়ম করে পড়ে তার পুত্র ও ধনলাভ হয়। তার পরলোকেও শুভ গতি হয়ে থাকে।

.

সত্তরতম অধ্যায়

সূত বললেন–মহাত্মা কশ্যপ এভাবে প্রজা সৃষ্টি করার পর বিভিন্ন প্রজাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি নির্বাচন করে তাকে সেই রাজ্যে অভিষেক করলেন। এভাবে তিনি ভগবান বৃহস্পতিকে অঙ্গিরস গণের, বিষ্ণুকে ভালবিদের, আদিত্যদরে পাবকদের দক্ষকে প্রজাপতিদের, প্রহ্লাদকে দৈত্যদের, নারায়ণকে সাধ্যদের, বৃষধ্বজকে রুদ্রদের, বিপ্রচিতিকে দানবদের, বরুণকে জলের, বৈবস্কততকে পিতৃগণকে, সাগরকে নদীদের চিত্র রথকে গন্ধর্বদের উচ্চেঃশ্রবাকে অশ্বদের সিংহকে মৃগদের গরুড়কে পাখিদের, মারুতকে ও অশরীরি প্রাণীর বায়ুকে শব্দ, বাসুকিকে নাগেদের, তক্ষককে সরীসৃপ, কামদেবকে অপ্সরাদের, সংবৎসরকে ঋতু, মাস, পক্ষ, বিপক্ষ, মুহূর্ত, পর্ব, কলা, কাষা অয়ন, গণিত ও যোগের, সুরামাকে পূর্বদিকের, কেতুমালকে পশ্চিমদিকের এবং বৈবস্বত মনুকে মানুষের আধিপত্য নিয়োগ করেন।

ভগবান ব্রহ্মা স্বয়ম্ভর সপ্তদ্বীপা পৃথিবীকে ধর্মানুসারে পালন করছেন। আর সেখানে রাজাদেরও অভিষিক্ত করেছেন। মন্বন্তর শেষ হলে আবার সেইসব রাজারা ভাবী মন্বন্তরে মনু হবেন। এইভাবে অতীত ও ভবিষ্যত নৃপতি ও মনুরা আবির্ভূত ও তিরোহিত হয়ে আসছেন।

প্রজাপতি মহাভাগ কাশ্যপ এইসব পুত্র উৎপাদন করে আবার প্রজা সৃষ্টির জন্য তপস্যা করতে লাগলেন, তিনি ভাবলেন, আমার দুজন গোত্রকর পুত্র হোক। এরূপ চিন্তার ফলে বৎসর ও অসিত নামে দুজন ব্রহ্মবাদী পুত্র হয়। বৎসর থেকে নিধ্রুব ও রৈভ্য জন্মগ্রহণ করে। রৈভ্য থেকে রৈভ্যরা জন্মে। ধ্রুবের পত্নী কুণ্ডপায়ীদের মাতা একপর্ণার গর্ভে আসিতের ব্রশ্নিষ্ঠ নামে পুত্র জন্মে। নিধ্রুব, শাণ্ডিল্য, ও রেভ্য এরা সবাই কশ্যপ দেবল শাণ্ডিল্যদের কথা শুনে মহাযশস্বী হন। বর প্রভৃতিরা দেবলের সন্তান, মানসের পুত্র রিষ্যন্ত, তার ছেলে দম। ত্রেতাযুগের প্রথম রাজা তৃণবিন্দু। এঁর কন্যা অনুপম লাবণ্যময়ী ইলবিলা। রাজা তৃণবিন্দু তাকে পুলস্ত্যর হাতে দান করেন।

ইলাবিলার গর্ভে জন্ম নেয় বিশমা। বিশ্ৰমার চার পত্নী, এঁরা সবাই পৌলস্ত্য কুলের গর্ব। দেবাচার্য বৃহস্পতির-এর কীর্তিমতী কন্যা ছিল। বিমা সেই মেয়েকে বিয়ে করেন। মাল্যবানের কন্যা পুষ্পেকটা ও বাকা এবং মালীর কন্যা কৈকসীও তার স্ত্রী ছিল। বৃহস্পতির কন্যা দেববর্ণিনী গর্ভে বিশ্ৰমার পুত্র বৈশ্রবর্ণ জন্ম নেয়। এই বৈশবর্ণ রূপে রাক্ষসের মতো আর বিক্রমে অসুরের মত। এর পিতা একে ত্রিপাদ স্কুলশীর্ষ, শঙ্কুকর্ণ, লোহিতবর্ণ, হস্রবাহু পিঙ্গল, ভীষণ, বিশ্বরূপধর দেখে বললেন–এই বালক স্বয়ং কুবের কেন না ক’ শব্দে অর্থ কুৎসা, এবং ‘বের’ শব্দের অর্থ শরীর। কু শরীরের জন্যই এই বালক কুবের নামে প্রসিদ্ধ। এই কুবের সিদ্ধির গর্ভে বিখ্যাত নলকুবেরকে উৎপাদন করেন এবং কৈকসী রাবণ, কুম্ভকর্ণ, বিভীষণ ও শূর্পণখাকে উৎপন্ন করেন।

রাবণ দশমাথা, শঙ্কুকর্ণা, পিঙ্গলবর্ণ, চতুষ্পদ, সত্যবুদ্ধি, দৃঢ়তনু, দারুণ ক্রুর ছিলেন। আগের জন্মে ইনি হিরণ্যক শিশু ছিলেন। ইনি চারযুগেই রাজা হয়ে আসছেন। এখন তিনি রাক্ষসদের ত্রয়োদশ রাজা। তিনি ষাটলক্ষ বছর ধরে দেবতাদের ও ঋষিদের ওপর অত্যাচার করে এসেছেন। চব্বিশ ত্রেতাযুগে রাবণ দাশরথি রামের হাতে সবংশে মারা যান।

মহোদয়, প্রহন্ত, মহাপ্রাংজ্ঞ, ও ঘর–পুষ্পেকটার পুত্র। এছাড়া কুম্ভনসী নামে পুষ্পেকটার একজন মেয়ে ছিল। ত্রিশিরা, দুষণ, বিদ্যুৎ, জিহ্বা নামে রাক্ষসরা বাকার পুত্র। এদের কন্যার নাম অশনিকা, আগে যে পুলস্ত্য বংশীয় রাক্ষসদের কথা বলা হয়েছে, তারা সবাই কুরকর্ম। দেব-দুর্জয়, বরপ্রাপ্ত ও পুত্র-পৌত্র সমন্বিত। কুবের হল সমস্ত যক্ষ, রাক্ষস, অসস্ত্য, ব্বৈমিত্র ব্রহ্ম রাক্ষস, বেদধ্যয়নসীল রাক্ষস ইত্যাদির রাজা সাধারণত চার প্রকার, যাতুদান, ব্রহ্মবান, দিবাচর, নিশাচর, পৌলস্ত্য, নৈঋত, অগস্ত্য ও কৌশিক প্রভৃতি সাতগণ রাক্ষস জাতি। এদের সাধারণ রূপ বর্ণনা শুনুন এরা বৃত্তাক্ষ, পিঙ্গলবর্ণ, মহাকায়, মহোদর, শঙ্কুকর্ণ, দারিতাস্য, স্থূল শীর্ষ, স্কুল নাসিক, গম্ভীরাক্ষ, বিভীষণ, বিকট, স্কুল। এরা অন্নভোগী, মাংসাশী পুরুষ ভক্ষণকারী, মনীষীরা রাক্ষসদের এইরকম রূপের বর্ণনা করেছেন। এদের সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানা যায় না। কারণ এরা মায়াবী।

পুলস্তের সন্তানেরা হল– মৃগ, ব্যাল, দংষ্ট্ৰী, ভূত, পিশাচ, ভ্রমর, সাপ, হাতি, কিন্নর, মায়াবী জাতি ও ক্রোধী জাতি। ক্রতু, বৈবস্বত মন্বন্তরে কোন পুত্র হয়নি। কিন্তু তিনি নিজের তেজ বিসর্জন দেননি।

এবার ভগবান অত্রি অর্থাৎ তৃতীয় গর্ভে ভদ্রাস্বের দশ সন্তান জন্মে। নাম ভদ্রা, সুদ্রা, মদ্রা, বালদা, মালদা, বেলা, খলা, লোকপলা, মনোরম ও রত্ন কুটা। আত্রেয় বংশের প্রভাকর এদের স্বামী ছিলেন। ইনি ভদ্ৰায় গর্ভে যশস্বী সোমকে উৎপাদন করেন। একদা স্বভানু সূর্যকে আহত করলে সূর্য স্বর্গের থেকে মাটিতে পড়ে গেলে সমস্ত জগৎ অন্ধকার হয়ে যায়। সেইসময় তার ছেলে সোম আলো দিয়ে জগৎকে অন্ধকার মুক্ত করেন। সূর্য স্বর্গ থেকে পড়ে যাবার সময় অত্রির দ্বারা স্বস্তি তৈহস্ত এরূপ কথা বলার পর আর পড়লেন না। মহাতপা সবিতা অত্রির কন্যাদের মধ্যে নিজের গোত্র উৎপাদন করেন। অত্রির সাহায্যে দেবতাদের যজ্ঞভাগী হন। তিনি নিজের তুল্য দশপুত্র উৎপাদন করেন। এরা তপস্যার প্রভাবে জ্যোতির্ময়, বেদে পারদর্শী। এদের আবার দুইজন ব্রহ্মজ্ঞ পুত্র জন্মায়। এরা হলেন দত্তাত্রেয় আর দুর্বাশা। এদের অবলা নামে একটি বোনও ছিল। পুরাণে বলা হয়েছে অত্রিপুত্র মহাত্মা দত্তাত্রেয়া, ভগবান বিষ্ণুর তনুস্বরূপ। এদের বংশে শ্যাম, মৃদুগল, বলারক পবিষ্টি নামে চারজন মহাবল পুত্র জন্মায়।

কশ্যপ থেকে নারদ পর্বত, ও অরুন্ধতী জন্মে। অরুন্ধতী যেসব প্রজা প্রসব করেন, তাদের নাম বলছি শুনুন। নারদ বশিষ্ঠের হাতে অরুন্ধতিকে সম্প্রদান করেন। পূর্বে দেবাসুর সংগ্রামে উপস্থিত হলে, অনাবৃষ্টির জন্য প্রজারা মারা যাওয়ায়, বশিষ্ঠ করুণা করে তপস্যার প্রভাবে আবার অন্ন, ফলমূল, ওষধি ইত্যাদি দিয়ে তাদের রক্ষা করেন। ভগবান বশিষ্ঠ ভগবতী অরুন্ধতীর গর্ভে ব্যক্তি নামে পুত্র উৎপাদন করেন। দ্বৈপায়ণ গুণবান পুত্র শুকদেবকে পেলেন। পীরবীর গর্ভে শুকদেবের ছটি সন্তান জন্মে। তাদের নাম প্রভু, শম্ভ, কৃষ্ণ, গৌর ও ভুরিশ্রবা সুকের আর মেয়ের নাম কীর্তিমতী। এই কীর্তিমতী যোগজননী। ইনি সাত্ত্বগুহের পত্নী। পরাশরদের এই কটি কথা আছে। ঘৃতাচীর গর্ভে বশিষ্ঠের কুশীতির নামে এক ছেলে জন্মে। পৃথুনন্দিনীর গর্ভে বসু নামে তার আর এক পুত্র জন্মে। বসু পুত্র উপমন্যু। উপমন্যুর বংশধরেরা উপমন্যু নামে খ্যাত। মিত্রা বরুণেরা কন্তিন নামে বিখ্যাত বংশধরের একমাত্র বংশ সম্ভুত বলে সবাই বশিষ্ঠ নামে প্রসিদ্ধ। এইযে বংশবিবরণ এটি বশিষ্ঠের একাদশ পক্ষ, আগের আট ঋষি ব্রহ্মার মানস পুত্র। এদের বংশধরেরা পরস্পর ভ্রাতৃ সম্পর্কে সম্বন্ধে। এরাই পরস্পর ক্রমে দেবর্ষিদের নিয়ে এই তিন লোক ধারণ করেছেন এবং এঁদের শত সহস্র পুত্রেরা সূর্যরশ্মির মত সমস্ত জগৎ ব্যপ্ত হয়ে রয়েছেন।