০৬. পরশুরাম অবতারের কাহিনি

পরশুরাম অবতারের কাহিনি

পদ্মযোনি ব্রহ্মার পুত্র অত্রি মুনির নেত্র থেকে চন্দ্রদেবের আবির্ভাব ঘটেছে। দেব গুরু বৃহস্পতির স্ত্রীর নাম তারা। এক সময় চন্দ্র তাকে হরণ করে নিয়ে আসেন। তাকে গর্ভবতী করে। তিনি এক পুত্রের জন্ম দেন, নাম বুধ, সেই বুধের ঔরসে এবং সুদ্যুম্নের নারী অবস্থায় ইলার গর্ভে পুরুরবা এক সন্তানের জন্ম হয়।

পুরুরবা বংশজাত সন্তান গাধির। গাধির কন্যা হলেন সত্যবতী। তিনি ঋচী মুনিকে স্বামী রূপে বরণ করেন। গাধির কোনো পুত্র সন্তান ছিল না। আর সত্যবতীরও কোনো পুত্র লাভ করতে পারেননি। পুত্র সন্তানের কামনা করে ঋচীক মুনি শ্বাশুড়ির জন্য ক্ষাত্রমন্ত্রে চরু তৈরি করলেন। তারপর তিনি স্নানে গেলেন। সত্যবতীর মাতা অর্থাৎ ঋচীকের শ্বাশুড়ি মনে করলেন, ঋষি নিজের পত্নীর জন্য নিশ্চয়ই উত্তম চরু তৈরি করেছেন, আমি ওটা গ্রহণ করব।

কন্যার নিকট তিনি চরু খেতে চাইলেন। কন্যা সত্যবতী নিজের চরু মাকে দিয়ে দিলেন। আর মায়ের চরু নিজে পান করলেন।

ঋষি স্নান সেরে ফিরে এসে চরু খাওয়ার গল্প শুনে বললেন– প্রিয়ে, তোমার গর্ভে এক দুর্দান্ত ক্ষত্রিয় পুত্রের জন্ম হবে। আর তোমার মাতা জন্ম দেবেন এক ব্ৰহ্মজ্ঞের।

এমন সাংঘাতিক কথা শুনে সত্যবতী অত্যন্ত উতলা হয়ে পড়লেন। তিনি স্বামীর পায়ে ধরে প্রার্থনা জানালেন স্বামী, আপনি এই কার্য বন্ধ করুন।

সত্যবতীর প্রার্থনায় ঋষি বললেন– বেশ, আমি আশীর্বাদ করছি, তোমার পুত্র ব্রহ্মর্ষি হবে। কিন্তু তোমার নাতি হবে ঘোর ক্ষত্রিয়।

সত্যবতী অবশেষে জমদগ্নি নামে এক পুত্রের জন্ম দিলেন। জন্মদগ্নি বিয়ে করলেন রেনুর কন্যা রেনুকাকে। রেনুকার গর্ভে জন্ম নিল বসুমদ প্রমুখ অনেকগুলি সন্তান। তাদের মধ্যে কনিষ্ঠ হলেন রাম, যিনি পরবর্তীকালে পরশুরাম নামে সুখ্যাতি লাভ করেছিলেন।

এদিকে মহারাজ গাধির পুত্র– পুরুকুৎসীর গর্ভে জন্ম নিলেন বিশ্বামিত্র। যিনি ক্ষত্ৰকূলে জন্মলাভ করেও ব্রহ্মমন্ত্রে মন্ত্রিত চরু ভক্ষণের জন্য মহামুনি হয়েছিলেন।

মহামুনি জন্মদগ্নির পুত্র রামকে বাসুদেবের অংশরূপে জ্ঞান করা হয়। তিনি পূজনীয় বেদ, ব্রাহ্মণ বিরোধী অতীব গর্বিত ক্ষত্রিয়কুলকে অতি অল্প অপরাধেই পরশুরাম একুশবর বিনাশ করে পৃথিবীকে ভারমুক্ত করেন।

হৈহয় বংশের পতি হলেন কার্তবীর্যাজুন। তিনি ছিলেন শ্রীহরির অবতার দত্তাত্রয়ের উপাসক। তাঁর আরাধনায় সন্তুষ্ট হয়ে শ্রীহরি তাকে সহস্র বাহু দান করেছিলেন। তিনি সেই সহস্র বাহু দ্বারা নর্মদা নদীর জল আটকে দিলেন। ফলে সেই জল ভাসিয়ে দিল লঙ্কেশ্বর রাবণের দোবার্চনা ভূমি। রাবণ ক্রুদ্ধ হয়ে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন। মহারাজ কার্তবীর্যাজুন ছিলেন অমিত শক্তিশালী। বানরকে যেমন খাঁচায় আবদ্ধ করে রাখা হয়, তিনিও ঠিক তেমনভাবে রাবণকে বন্দি করলেন। মহিষ্মতী নামক নিজের প্রাসাদে। কিছুদিন বাদে তাকে মুক্ত করে দেন নেহাত অবজ্ঞাবশে।

একদিন রাজা কার্তবীর্যাজুন অনুচরবর্গকে নিয়ে মৃগয়ায় বেরিয়েছিলেন। ঘুরতে ঘুরতে মহর্ষি জমদগ্নির আশ্রমে উপস্থিত হয়ে তার আতিথেয়তা গ্রহণ করলেন। মুনি রাজা এবং তার অনুচর বর্গের সকল আপ্যায়ন সুসম্পন্ন করলেন কামধেনুর সাহায্যে।

অগ্নিহোত্র ধেনুর অপূর্ব কীর্তি দেখে রাজা অত্যন্ত মহর্ষির কাছে ওই কামধেনু লোভাতুর হয়ে প্রার্থনা করলেন। ঋষিবর তা দিতে আপত্তি জানালেন। কিন্তু রাজা কোনো আপত্তি শুনলেন না। জোর করে ছিনিয়ে নিলেন। সেই ধেনু নিয়ে এলেন মহিষ্মতী পুরীতে।

পরশুরাম সেই সময় আশ্রমে ছিলেন না। ফিরে এসে সব অবগত হয়ে অত্যন্ত কূপিত হলেন। তিনি কার্তবীর্যাজুনকে বিনাশ করার ইচ্ছা প্রকাশ ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। তিনি মহিষ্মতী নগরী আক্রমণ করলেন। রাজার সতেরো অক্ষে সেনার সাথে অনায়াসে যুদ্ধ করে পরশুরাম সমস্ত রাজ সৈন্যের বিনাশ করলেন।

এবার এগিয়ে এলেন স্বয়ং রাজা কার্তবীর্যাজুন। পরশুরাম তার পরশুর দ্বারা রাজার হাতগুলি কর্তন করলেন। হাজার হাত মাটিতে খসে পড়ল। রাজার মুণ্ড মাটিতে পড়ে গেল। পিতার বিনাশ দেখে তার অযুত সংখ্যক পুত্র ভয়ে প্রাণ নিয়ে সেখান থেকে পালিয়ে গেল। কামধেনুকে উদ্ধার করে পরশুরাম আশ্রমে ফিরে গেলেন।

পিতা জমদগ্নি সব বিবরণ শুনে পুত্রকে অত্যন্ত তিরস্কার করলেন। রাজাকে হত্যা করে পরশুরাম অত্যন্ত পাপকাজ করেছেন। পাপের ভার লাঘব করার জন্য পিতার নির্দেশে তিনি তীর্থ ভ্রমণে বেরিয়ে পড়লেন। এক বছর পর ফিরে এলেন আশ্রমে।

একদিন মহর্ষি জমদগ্নি পত্নীর জল নিয়ে ফিরে আসতে দেরি হল। জমদগ্নি কুপিত হয়ে রেণুকার পুত্রদের হত্যার আদেশ দিলেন। পুত্ররা কেউই মাতৃহত্যা করতে রাজি হলেন না। এগিয়ে এলেন পরশুরাম। পিতার তপস্যার প্রভাব সম্পর্কে তিনি জ্ঞাত ছিলেন। তাই পরশুরাম তার মা এবং বড়ো ভাইদের হত্যা করলেন। পিতা জমদগ্নি পরশুরামের প্রতি অত্যন্ত সন্তুষ্ট হলেন। তিনি পুত্রকে বরদান করতে চাইলেন।

পরশুরাম বললেন– হে পিতা, আপনি যদি আমাকে বর দিতে আগ্রহী হন, তাহলে এমন কাজ করুন, যার ফলে আমার মা এবং বড় ভাইরা আবার প্রাণ ফিরে পায়। এই মৃত্যুর ব্যাপারটা তারা যেন ভুলে যান।

জমদগ্নি মন্ত্রবলে পত্নী ও পুত্রদের বাঁচিয়ে দিলেন। পিতার তপস্যার অমোঘ শক্তি সম্পর্কে অবগত থাকার জন্য পরশুরাম মা এবং বড়ো ভাইদের বিনাশ করতে মোটেও কুণ্ঠিত হননি।

এদিকে নৃপতি কার্তবীর্যের পুত্ররা পিতার মৃত্যুর কথা চিন্তা করে অত্যন্ত অশান্তিতে দিন কাটাচ্ছিলেন। একদিন তারা দেখলেন পরশুরাম বনের পথ ধরে কোথায় চলেছেন। আশ্রমে নিশ্চয়ই মুনি জমদগ্নি একা আছেন। এই কথা চিন্তা করে তারা আশ্রমে আক্রমণ করলেন। জমদগ্নির মুণ্ড আর ধড় আলাদা করে দিলেন। পরশুরামের মা এই দৃশ্য দেখে চিৎকার করে কেঁদে উঠলেন। মায়ের আকুল কান্না পরশুরাম শুনতে পেলেন। তিনি ছুটে এলেন আশ্রমে। মৃত পিতাকে দেখে অত্যন্ত মর্মাহত হলেন। ক্রোধে ফেটে পড়লেন পরশুরাম। হাতে নিলেন পরশু বা কুঠার, ক্ষত্রিয় বংশের নাশ তিনি করবেন।

তিনি মহিষ্মতী পুরীতে এসে প্রবেশ করলেন। রাজার পুত্রদের নিধন করলেন। দেখতে দেখতে সেখানে একটি পর্বতের সৃষ্টি হল। এইভাবে ক্ষত্রিয়গণ অনাচারী হলে পরশুরাম একুশবার পৃথিবীকে নিঃক্ষত্রিয় করেছিলেন।

বর্তমানে তিনি মহেন্দ্র পর্বতে অবস্থান করছেন। আগামী মন্বন্তরে তিনি বেদ প্রবর্তক সপ্তর্ষিদের মধ্যে একজন হবেন। এইভাবে শ্রীহরি ভৃগুবংশে জন্মলাভ করে ক্ষত্রিয়কুলকে বহুবার বিনাশ করেছিলেন।