০১. মৎস্য অবতারের কাহিনী

অগ্নিপুরাণ (পৃথ্বীরাজ সেন)
অষ্টাদশ পুরাণ সমগ্র অখণ্ড সংস্করণ
উপদেষ্টা– শ্রী নরেশচন্দ্র শাস্ত্রী
সম্পাদনা • পরিমার্জনা • গ্রন্থনা– পৃথ্বীরাজ সেন

মৎস্য অবতারের কাহিনী

অতীত কল্পের অবসান প্রায় আসন্ন। পদ্মযোনি তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থা। তিনি দুচোখ আর খুলে রাখতে পারছেন না। ঘুমে আচ্ছন্ন হলেন। নিদ্রাকালে তার মুখ দিয়ে নির্গত হল নানা উপদেশাবলী। যা বেদ নামে খ্যাত। হয়গ্রীব নামে এক অসুর সেই সব বেদরাজি শ্রবণ করল এবং সেখান থেকে চলে গেল।

এ তথ্য ভগবান শ্রীহরির কাছে অজ্ঞাত রইল না। দানবের কাছ থেকে ওইসব বেদরাজি উদ্ধার করতে হবে। এই উদ্দেশ্যে তিনি একটি ক্ষুদ্র মৎস্যের রূপ ধারণ করলেন।

রাজর্ষি সত্যব্রত বৃতমালা নামে এক নদীতে সে সময় স্নান সেরে তর্পণ করার জন্য অঞ্জলি পেতে নদীর পবিত্র স্বচ্ছ জল ভরতে গেলেন। ঠিক এ সময় শফরী নামধারী মৎস্যরূপী ভগবান তাঁর অঞ্জলিপুটে উঠে এলেন। রাজর্ষি তা দেখে জল ফেলে দিতে উদ্যত হলেন। শ্রীহরি কাতর স্বরে বললেন–হে কৃপাবৎসল রাজা, দোহাই এই নদীর জলে আমাকে ত্যাগ করবেন না। এখানে কেউ আমাকে বাঁচিয়ে রাখবে না। খেয়ে সাবাড় করে দেবে।

ছোট্ট একটি মাছকে কথা বলতে দেখে রাজর্ষি সত্যব্রত অত্যন্ত বিস্মিত হলেন। তিনি শফরীকে তার কমণ্ডলুর জলে স্থান দিলেন।

পরের দিনই সেই মাছের আয়তন বেড়ে গেল। কমণ্ডলুতে তার স্থান অকুলান। মাছ বললহে রাজা, ওই কমণ্ডলুতে বাস করতে আমার অসুবিধা হচ্ছে। দয়া করে অন্য কোনও বৃহৎ স্থানে আমাকে রাখুন যাতে আমি সুখে থাকতে পারি।

রাজা তখন তাকে একটি বড় কলসিতে জায়গা দিলেন। এক রাতের মধ্যে মাছের চেহারা এত বেড়ে গেল যে, কলসিতে সামান্য নাড়া চাড়া করাও তার পক্ষে অসম্ভব হল।

মাছের অনুরোধে রাজা এবার তাকে একটি সরোবরে ছেড়ে দিলেন। এক রাতের মধ্যে দেখা গেল মাছটি এমন আকার ধারণ করেছে যে, সরোবরে বাস করাও তার পক্ষে কষ্টকর হচ্ছে। আরও বড়ও পরিসর তার চাই। রাজা এবার তাকে নিয়ে এলেন একটা হ্রদে। সেখানেও একই অবস্থা, এক রাতের মধ্যে ওই মাছ মহামৎস্যে পরিণত হল।

মাছ বলল–আমাকে আরও বড় এক পরিসরে রাখার ব্যবস্থা করুন।

রাজর্ষি ঠিক করলেন, এই মাছের পক্ষে সমুদ্রই শ্রেয়। এই মনে করে সাগরের দিকে হাঁটলেন।

মাছ আঁতকে উঠল–রাজা আমাকে সাগরে দেবেন না। ওখানে কত রকমের বড় বড় জলজ জন্তু আছে। আমায় ধরে ওরা খেয়ে ফেলবে। আমার প্রাণ যাবে। ভয়ে আমার বুক কাঁপছে!

রাজা সত্যব্রত বিনীত কণ্ঠে জানতে চাইলেন–হে রূপধারী মৎস্য, আপনি কে? কৃপা করে আপনি আমাকে আপনার পরিচয় জ্ঞাপন করে আমাকে উৎকণ্ঠা মুক্ত করুন।

মৎস্যরূপী শ্রীভগবান বললেন–হে রাজর্ষি, আজ থেকে ছদিন পরে অর্থাৎ সাতদিনের মাথায় সমুদ্রে প্রলয় শুরু হবে। জলে ভেসে যাবে চারদিক। স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল সব জলের তলায় চলে যাবে। সে সময় মস্ত বড় একটা নৌকা তোমার কাছে আসবে, আমিই তা পাঠাবো। তুমি ওই নৌকায় সব ধরনের বীজ, ওষধি এবং সাত ঋষিকে নিয়ে উঠে বসবে। বায়ুর প্রবল বেগে নৌকা টাল সামলাতে না পেরে টলমল করবে। ঠিক এ সময়ে একটা মোটা কাছি হাতের পাশে পাবে। আসলে এটা বহুরূপী এক সর্প, আর আমি এ সময়ে এক শৃঙ্গধারী মৎস্যরূপে জলে ভাসব। তুমি সেই কাছির এক প্রান্তে আমার মৎস্য শৃঙ্গের সাথে বাঁধবে। অন্যপ্রান্ত নৌকার সঙ্গে। দেখবে নৌকা স্থির হয়েছে।

শ্রীবিষ্ণু এই উপদেশ দান করে সেই স্থান থেকে সমুদ্রের অতুল নীল জলরাশিতে অদৃশ্য হলেন। রাজর্ষি সত্যব্রত শ্রীহরির আদেশ অনুসারে, বীজ, ওষধি এবং সাত ঋষিকে একত্রিত করে সেই নির্দিষ্ট দিনটির জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন।

সপ্তম দিনে দেখা দিল সেই প্রলয় দুর্যোগ। সমুদ্রের জল ফুলে ফেঁপে উঠল। জলে প্রবল আলোড়ন দেখা দিল। প্লাবিত হল সম্পূর্ণ পৃথিবী। রাজা সত্যব্রত দেখলেন একটা নৌকা আসছে। তিনি সেই নৌকায় বীজ, ওষধি এবং ঋষিদের সঙ্গে নৌকোয় উঠে পড়লেন। সমুদ্রের বিশাল বিশাল তরঙ্গের আঘাতে নৌকা ডুবে যাওয়ার উপক্রম। বিপদের সম্ভাবনা দেখে রাজা সত্যব্রত আকুল হয়ে শ্রী ভগবানের স্মরণ নিলেন। সেই প্রলয় সলিলে এক শৃঙ্গধারী নিযুত যোজন পরিমিত শরীরের একটি স্বর্ণ বর্ণের মৎস্য ভেসে থাকতে দেখা গেল। কাছির ন্যায় দৃষ্ট বহুরূপী বাসুকির দ্বারা নৌকা এবং মৎস্যের শৃঙ্গের সঙ্গে বাঁধা হল মৎস্য অবতারের পূর্ব নির্দেশ অনুযায়ী। তারপর নৃপতি শ্রীহরির নাম গান করতে লাগলেন।

হে মহারাজ পরীক্ষিৎ, রাজা সত্যব্রতের স্তবে সন্তুষ্ট হলেন শ্রীহরি। তিনি জলে ভাসমান অবস্থায় রাজাকে নানা তত্ত্বকথা শোনালেন। এইসব তত্ত্ব উপদেশকে নিয়ে মৎস্য পুরাণ লেখা হয়েছে।

এরপর শ্রীহরি হয়গ্রীব নামক অসুরকে বধ করে বেদগুলি উদ্ধার করেন। ইতিমধ্যে অতীত কল্পের অবসান ঘটেছে। ব্রহ্মার নিদ্রা ভঙ্গ হয়েছে। শ্রীহরি কর্তৃক তিনি তাঁর চুরি যাওয়া বেদসকল ফিরে পেলেন। শ্রীবিষ্ণুর অনুগ্রহ লাভ করে রাজা সত্যব্রত হলেন এই কল্পে বৈবস্বত .(শ্রাদ্ধদেব) মনু, রাজর্ষি সত্যব্রত আর মায়া, মৎস্যরূপধারী শ্রীহরির উপদেশ গাথা সম্বলিত মৎস্যপুরাণ পাঠ বা শ্রবণ করলে সকল জীবের পাপের বিনাশ ঘটে।