১২. ইন্দ্ৰ প্ৰমতি চিত্রসেন সংবাদ

ইন্দ্ৰ প্ৰমতি চিত্রসেন সংবাদ

দেবতা ও অসুরদের মধ্যে প্রায়ই যুদ্ধ বাঁধে। ইন্দ্রের বন্ধু রাজা প্রমতি। দেবতাদের সাহায্যের জন্য স্বর্গে যান। একবার তিনি স্বর্গে গিয়ে দেখেন যে, ইন্দ্রকে ঘিরে অনেক দেবতা পাশা খেলায় ব্যস্ত।

তা দেখে প্রতি বিদ্রূপ করে বললেন–ইন্দ্র যারা তোমার অনুগত তাদের সঙ্গে পাশাখেলায় কি আনন্দ আছে? বন্ধুতে বন্ধুতেই পাশা খেলায় মজা আছে।

যদি আমার সঙ্গে খেল তবে আমারও খুব ভালো লাগবে।

সাধারণভাবে পাশাখেলা হয় না। একটা পণ রাখতে হয়। ইন্দ্র প্রমতির কথায় সঙ্গে সঙ্গেই রাজি হয়ে গেলেন। আর পণ রাখলেন ঊর্বশীকে, প্ৰমতি পণ রাখলেন তার ডান হাত। শুরু হল পাশাখেলা। প্রমতি অল্পক্ষণেই ঊর্বশীকে জিতে নিলেন। দ্বিতীয়বার খেলা শুরু হল, পণ রাখলেন ইন্দ্র তার সুবিখ্যাত রথ আর বজ্ৰ। প্ৰমতি রাখল আবার তার সেই ডান হাত।

এবারেও ইন্দ্ৰ হারলেন, বজ্র আর রথ হারলেন। এবারে জিদ চেপে বসল, যেমন করেই হোক, পরবর্তী খেলায় বন্ধুকে হারাতেই হবে। কিন্তু না! নিজেই হেরে গেলেন, খোয়া গেল আরও কতগুলি প্রিয় বস্তু।

এমন সময় বিশ্বাবসু নামে এক গন্ধর্ব সেখানে উপস্থিত। নাচ গান আর পাশাখেলায় গন্ধর্বেরা খুব পটু। ইন্দ্রকে সেই খেলায় হারতে দেখে, বিশ্বাবসু এগিয়ে এলেন ইন্দ্রের সাহায্যে। গর্বোদ্ধত প্ৰমতি বিশ্বাবসুকে জিজ্ঞাসা করলেন–এবার কি পণ রাখবেন তিনি?

বিশ্বাবসু বললেন–আমি গন্ধর্বগণের রাজা, পণ রাখলাম গান্ধর্ব-বিদ্যা। খেলা শুরু হল। একদিকে ইন্দ্র আর বিশ্বাবসু অন্যদিকে রাজা প্রমতি। কিন্তু এমন দুর্ভাগ্য ইন্দ্রের! বিশ্বাবসুকে সঙ্গে নিয়েও হেরে গেলেন প্রমতির কাছে।

অহংকারে মত্ত হয়ে রাজা প্রমতি ইন্দ্রকে বললেন–তুমি একেবারেই নিষ্কর্মা। কেমন করে তুমি যে অমরাবতীর রাজা হলে বুঝতে পারছি না। দেবরাজ হওয়ার কোনও যোগ্যতা নাই। না জান পাশা খেলতে, তাহলে কি জান তুমি? তার চেয়ে তুমি এক কাজ কর, তুমি আমার সেবক হয়ে সেবা কর। গর্বে একেবারে উন্মত্ত হয়ে গেছে রাজা প্রমতি। তারপর ঊর্বশীকে বললেন–তোমাকে দেবতারা খুব খাতির করে রূপ-যৌবন আছে বলে। কিন্তু আমি করি না। তুমি আমার দাসী হবার যোগ্য।

প্ৰমতির এমন কথা শুনে ঊর্বশী বাধা দিয়ে বলল–রাজা তুমি এমন কথা বলো না। দাসীর কাজ করা কি আমার দ্বারা শোভা পাবে?

প্রমতি কিন্তু জেদ ধরেই বললেন–উর্বশী তুমি আমার দাসীর কাজই করবে।

বিশ্বাবসুর ভাই চিত্রসেন গন্ধরাজ সেই সময় সেখানে এসে প্রণতির এমন গর্বিত কথা শুনে তাকে বাধা দিয়ে বললেন–রাজা তুমি পাশা খেলায় খুব দক্ষ বুঝতে পারছি। আমি একবার তোমার সঙ্গে খেলতে চাই।

চোখ দুটি তুলে তাকালেন প্রমতি চিত্রসেনের দিকে। সে খুবই তাচ্ছিল্যের দৃষ্টি! এ আবার কে এল? হাতি ঘোড়া গেল তল, মশা বলে কত জল!

পাশাখেলায় নিয়ম আছে। কেউ এই খেলায় আহ্বান করলে তার সঙ্গে খেলতে হবে। অগত্যা রাজী হলেন মতি, কিন্তু কি পণ রাখবে এ খেলায়? জীবন পণ রাখল চিত্রসেন। খেলা শুরু হল। কয়েকটা দান খেলার পর প্রমতি বুঝলেন চিত্র সেন যে সে লোক নয়, পাশাখেলায় একজন দক্ষ খেলোয়াড়। তাই মন দিয়ে খেললেন, শেষে হার হলো এবার প্রমতির। যা যা সে লাভ করেছিল সব হারতে হল। চিত্র সেন সব জিতে নিল, শুধু তাই নয়। গন্ধর্ব পাশে বন্দি করে তাকে সেই স্বর্গেই রাখল।

বন্দি হয়েই রইলেন মতি, দেশে ফেরা আর হল না। তার পুত্র ও মুনতি মহাভাবনায় পড়ল। বিশ্বামিত্রের পুত্র মধুছন্দার কাছে গিয়ে জানাল পিতার বিষয়।

মধুছন্দা অল্প বয়সেই ব্রহ্মর্ষি, ধ্যানে বসে জানতে পারলেন সব। তখন সুমতিকে বললেন–তোমার বাবা দেবলোকে গিয়ে পাশা খেলে প্রথমে ইন্দ্র আর বিশ্বাবসুকে হারিয়ে খুব অহংকার করেছিলেন। ইন্দ্রকে সেবক এবং ঊর্বশীকে দাসী করতে চান। পরে চিত্ররথ গন্ধর্বের কাছে হেরে সর্বস্বান্ত হলেন, শুধু তাই নয় তার কাছে বন্দিও হন। বর্তমানে তিনি স্বর্গেই বন্দি হয়ে রয়েছেন।

সুমতি, পাশা খেলতে বসলে তার হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। মানুষ অমানুষ হয়ে যায়। তোমার বাবার অবস্থা হয়েছে তাই।

মধুছন্দার মুখে তার বাবার বন্দি দশা জেনে খুব দুঃখ পেল সুমতি। তারপর সবিনয়ে বলল–বাবাকে কি উপায়ে উদ্ধার করা যাবে অনুগ্রহ করে বলুন।

মধুছন্দা বললেন–তুমি উপযুক্ত ছেলের মতই কথা বলছ, কিন্তু সে যে বড় কঠিন কাজ, পারবে কি তুমি?

সুমতি বলল–এমন কি কঠিন কাজ, যা অসাধ্য? আপনি বলুন যত কঠিনই হোক না কেন অবশ্যই চেষ্টা করব।

মধুছন্দা বললেন–পারবে কি তুমি হাজার বছর তপস্যা করতে? তাতে তোমার বাবা মুক্ত হতে পারবে।

সুমতি তাই করল। নিষ্ঠার সঙ্গে তপস্যা করল হাজার বছর। দেবতাদের খুশি করল। তার পিতা রাজা প্রমতির মুক্তি হল। স্বর্গলোক থেকে ফিরে এলেন রাজা, বুঝলেন পাশা খেলার পরিণাম। তাই তিনি আর জীবনে কখনও পাশ স্পর্শ করেন নি।