০৫. কপোত কপোতীর অতিথি সৎকার ও ব্যাধের দিব্যজ্ঞান

কপোত কপোতীর অতিথি সৎকার ও ব্যাধের দিব্যজ্ঞান

দেবগিরির বর্তমান নাম ব্রহ্মগিরি। সেখানে এক ব্যাধ বাস করত। তার খুব নিষ্ঠুর স্বভাব ছিল। তার সামনে পশুপাখি কেউ পড়লে আর রক্ষা পেত না। এমনকি সাধু সন্ন্যাসীদেরও মেরে ধরে যার কাছে যা পেত তাই কেড়ে নিত। তার ছেলে মেয়ে বাবাও তেমনি স্বভাবের।

সেই ব্যাধ একদিন শিকারে বেরোল। বেরিয়ে সেদিন সে অনেক শিকার পেল। তির ধনুক দ্বারা সে বহু পশু বধ করল। মাটির উপর খাবার রেখে তার উপর জাল পেতে রেখে দিল। খাবারের লোভে অনেক পাখি সেই জালে এসে ধরা পড়ল। সব পাখিগুলিকে জাল থেকে ছাড়িয়ে খাঁচায় বন্দি করল সে। মনে ভাবল, আজ অনেক অর্থ মিলবে এত পাখি আর পশু বিক্রি করে।

দেখতে দেখতে দুপুর হয়ে গেল। এবার ফেরার সময় হয়েছে। খিদেও তার পেয়েছে, আপাততঃ জল না হলে তার চলছে না। কিন্তু গভীর বনের মধ্যে জল কোথায় পাবে? তার এক কাঁধে মরা পশুর ঝকা আর এক কাঁধে পাখির খাঁচা নিয়ে সে বাড়ি যাচ্ছে, তখন সূর্য পশ্চিম দিকে ঢলে পড়েছে। তার বাড়ি উত্তর দিকে। এই চিন্তা করে সে চলছে। কিন্তু এ পথ সে তো দেখেনি। কতদিন ধরে সে এই বনে শিকার করতে আসছে। কিন্তু আজ তার এমন হল কেন? পাও আর চলছে না। খিদে ও তেষ্টার জ্বালাও সে আর সহ্য করতে পারছে না। সন্ধে হয়ে এল, না আজ বাড়ি ফেরা হবে না। অন্ধকারে পথঘাট দেখা যাচ্ছে না। সে একটা বিশাল গাছের গোড়ায় বসে পড়ল। দুই কাঁধের ঝাঁকা আর খাঁচা নামিয়ে রাখল মাটিতে। সারাদিন ঘুরে ঘুরে একেবারে সে ক্লান্ত হয়ে পড়ল। তাই গাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। সেই গাছের ডালে অনেক পাখি বাস করত এবং সেখানে এক কপোত দম্পতি বাস করত। সেদিন কপোত খাবারের খোঁজে বের হয়নি। কপোতী একাই গিয়েছিল কিন্তু সন্ধে হল তবু কপোতী ফিরে আসছে না কেন? খুব চিন্তা কপোতের মনে। কোনো বিপদ হয়নি তার। অনেকদিন সে একাই যায় আবার ফিরে আসে। কিন্তু আজ ফিরে এলো না কেন? যদি তার কিছু হয়ে যায়, তাহলে আমারও বেঁচে থেকে লাভ নেই।

বাসায় বসে কথাটা ভুলে গিয়েছিল। কারোর মুখ থেকে খাবার ছিনিয়ে নেওয়ার মত পাপ আর হয় না। কবে কে কার শিকার হবে কে বলতে পারে? সবই অদৃষ্ট। এই ভাবনায় কপোত যখন ব্যাকুল হয়ে পড়েছে হঠাৎ শুনতে পেল কপোতীর গলা। সে বলছে, আমি জানি, ঠিক সময়ে না ফিরলে তুমি উতলা হয়ে পড়বে। কিন্তু কি আর আমি করব বল? আজ যে ব্যাধের জালে ধরা পড়েছি তাহলে কেমন করে আমি বাসায় ফিরব?।

কপোত কপোতীর কথা শুনে চমকে উঠল, তুমি কোথায়?

কপোতী বলল, আমি এই গাছের নীচেই আছি, কথা শুনে কপোত নীচে নেমে এলো দেখল-তার কপোতী জালে বন্দি আর সেই ব্যাধ গাছের গোড়ায় ঠেস দিয়ে ঘুমিয়ে রয়েছে। কপোতের প্রাণটা কেঁদে উঠল কপোতীর জন্য। কপোতাঁকে বলল-কপোতী, তুমি এক কাজ কর, আমি জালের মুখটা ঠোঁট দিয়ে খুলে দিচ্ছি, তুমি বেরিয়ে এস। ব্যাধটা তো ঘুমোচ্ছে। সে কিছু জানতে পারবে না।

কপোতী বাধা দিয়ে বলল–না না, তুমি এমন কাজ করো না। আমরা হলাম ব্যাধের খাদ্য আমাদের খেয়েই এরা বেঁচে থাকে। আর আমাকে সে খুব কষ্ট করে ধরেছে। তুমি যদি এখন জালের মুখ খুলে দাও, আর আমি বেরিয়ে যাই, ব্যাধ যখন দেখবে যে তার জলের মুখ খুলে সব পাখি বেরিয়ে গেছে, তখন সে হতাশ হবে তাই বলছি এমন কাজ করো না।

কপোতীর কথা শুনে কপোত বলল–তাই বলে আমার কাছ থেকে তোমাকে ব্যাধ নিয়ে চলে যাবে, আর আমি বসে বসে দেখব, আমার সামর্থ্য থাকতে আমি আমার স্ত্রীকে রক্ষা করব না, এ কি হয়? তুমি কি বলছ?

কপোতী বলল–তুমি আমাকে খুব ভালোবাস। তাই এমন কথা বলছি। তুমি আমাকে জালে বন্দি দেখে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে গেছ। একটু চিন্তা করে দেখ তো আমাদেরকে তুমি যদি মুক্ত করে দাও তাহলে ব্যাধের সংসার চলবে কি করে? ভেবে দেখ, ভগবান ওদেরকে সংসার চালানোর এমন ব্যবস্থাই দিয়েছেন। আজ আমারও ভাগ্যে ছিল ওর শিকার হবার। আমাকে পেয়ে ওদের যদি একটা দিন চলে সেটা তো আমার সৌভাগ্য, আমার এই নশ্বর দেহটা অন্যের সেবায় লাগলে আমি ধন্য হব, ব্যাধের খাদ্য হয়েই তো আমরা জন্মেছি। তার কাছ থেকে খাবার ছিনিয়ে নেওয়া তোমার উচিত নয়।

কপোতীর মুখে এমন কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল কপোত কপোতী ঠিক বলছে। আসলে ব্যাধের জালে আজ সেই কপোতীও বন্দি হয়ে ছিল, এখন বৃক্ষতরে কপোতাঁকে জালবন্দি দেখে কপোত হাহাকার করে বলে উঠল-কপোতী, তুমিই আমাকে বল, এখন আমি কি করব?

কপোতী বলল–স্বামী, তোমার ঘরে আজ ব্যাধ অতিথি হয়ে এসেছে, অতিথির সেবা করা পরম ধর্ম, বেচারা আজ সারাদিন খুব পরিশ্রম করে বড় ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। তুমি ওর আহারের জন্য ব্যবস্থা কর। আজ সারাদিন বেচারা কিছু খায়নি।

কপোত বলল–তুমি তো জান, আমাদের ঘরে খেতে দেবার মত কিছু নেই।

কপোতী বলল–তুমি এখন একটু আগুনের ব্যবস্থা কর। কপোত সঙ্গে সঙ্গে এক এক করে শুকনো পাতা জড় করে দিল ব্যাধের সামনে। কিন্তু আগুন পাবে কোথায়? ডানা মেলে আকাশে উঠল, দেখল দূরে কারা যেন আগুন জ্বেলেছে, তখন সে এক টুকরো জ্বলন্ত কাঠ ঠোঁটে নিয়ে এসে ওই জড় করা শুকনো পাতার উপর দিল, জ্বলে উঠল আগুন।

তখনো ঘুমোচ্ছে সেই ব্যাধ, কিছুক্ষণ পর তার ঘুম ভাঙলো। সামনে আগুন দেখে অবাক হয়ে চমকে উঠলো, কেমন করে আগুন এল এখানে। তার আঁকায় মরা পশুগুলো সব ঠিক আছে সব খাঁচায় বন্দি পাখিগুলোও ঠিক আছে। ব্যাধ কিছুই বুঝতে পারলো না।

তারপর কপোতী কপোতকে ডেকে বলল–এখন তুমি ওই খাঁচার মুখ খুলে দাও। ওই আগুনে আমার প্রাণ বিসর্জন দিয়ে অতিথির খিদে মিটাই। কপোত তার কথায় বাধা দিয়ে বলল–আমি থাকতে তুমি কেন? তুমি তো বন্দি আর অতিথি এখন আমার। তাই আমিই ওই আগুনে প্রাণ দিয়ে অতিথির সেবা করব। এই বলে সেই কপোত সঙ্গে সঙ্গে সেই আগুনের ওপর পড়ে গেল। ব্যাধ এই দৃশ্য দেখে একেবারে অবাক। তখন কপোতী ব্যাধকে বলল–তুমি আমাকে ছেড়ে দাও, স্বামী যখন প্রাণ দিয়েছে, আমি তার স্ত্রী হয়ে কেমন করে বেঁচে থাকব? স্বামীর সঙ্গে আমিও মরতে চাই।

কপোতীর কথা শুনে ব্যাধ যেন কেমন হয়ে গেল। মন্ত্রমুগ্ধের মত খাঁচার মুখ খুলে দিল। আর সঙ্গে সঙ্গে খাঁচা থেকে কপোতী বেরিয়ে সেই আগুনের কাছে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে ব্যাধকে বলল–তুমি আমার ছেলেপুলেদের বধ করো না। পতির শোকে কপোতী তার পরেই ঝাঁপ দিল আগুনের উপরে।

সামান্য একটা পাখির এমন ব্যবহার দেখে নিষ্ঠুর ব্যাধও একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেল। তার বুকেও যেন কষ্ট হতে লাগল। দু’চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। মনটা যেন হাহাকার করে উঠল। নিজেই নিজেকে ধিক্কার দিল খুব। একটা কপোত কপোতীর হৃদয়ে যে উদারতা যে সহানুভূতি, আর সে কিনা মানুষ হয়ে তার এতটুকুও গুণ নেই। এবং সে আকুল হয়ে উঠল তার মন, খাঁচায় সব পাখিদের ছেড়ে দিল সে। আর তার ঘরে ফিরে যাওয়া হল না।