২. দেবগুরু বৃহস্পতির ছলনায় দানবদের পরাভব

দেবগুরু বৃহস্পতির ছলনায় দানবদের পরাভব

দেবতা ও দানবদের মধ্যে যেন সাপে-নেউলে সম্পর্ক। তাদের মধ্যে প্রায়ই যুদ্ধ হয়। একবার দেবতাদের কাছে যুদ্ধে বিধ্বস্ত হলে, সবাই গিয়ে পড়ল গুরুদেব শুক্রাচার্য্যের পায়ে।

হে গুরুদেব, দেবতারা যুদ্ধে আমাদের হারিয়ে যজ্ঞ করছে। আর সেই যজ্ঞে কিনা আপনি গিয়েছেন? আমরা আপনার অভাবে দিশাহারা। মর্ত্যভূমি ছেড়ে রসাতলে থাকতে হচ্ছে।

এই কথা শুনে শুক্রাচাৰ্য্য তাদের সান্ত্বনা দিয়ে বললেন–তোমাদের ভয় নেই, আমি তোমাদের রক্ষা করব। পৃথিবীতে যত রত্ন, মন্ত্র, ঔষধি আছে সবকিছুই আমার আয়ত্তে। দেবতাদের আছে মাত্র চার ভাগের এক ভাগ। তোমাদের সবকিছুই আমি দান করব।

এদিকে দেবতারা যুক্তি করলেনশুক্রাচার্য্য, আমাদের যা কিছু প্রভুত্ব আছে, তার সবকিছু বরণ করেছেন অসুরদের দেবার জন্য। যতক্ষণ তিনি সেই বিদ্যা দানবদের দিচ্ছেন না, তার মধ্যে গিয়ে আমরা তাদেরকে সংহার করব। আর যারা বেঁচে থাকবে, তাদেরকে পাতালে পাঠিয়ে দেব।

এই চিন্তা করে দেবতারা দানবদের আক্রমণ করলে, দানবরা ভয়ে শুক্রাচার্য্যের শরণাপন্ন হল। দেবতারা তখন তাদেরকে ছেড়ে পালিয়ে গেলেন।

ভার্গব দানবদের বললেন–এইসব ত্রৈলোক্য তোমাদের ছিল। কিন্তু ব্রাহ্মণদের রূপ ধরে বিষ্ণু বলির কাছে প্রার্থী হয়ে ত্রিপাদে সব কিছু কেড়ে নিয়ে বন্দী করে পাতালে পাঠিয়ে দিল। তোমাদের মধ্যে যাঁরা প্রধান, তাদেরকেও দেবতারা বিনাশ করল। এখন অল্প কয়েকজন মাত্র আছ তোমরা। এখন তোমাদের যুদ্ধ করা উচিত নয়। মন্ত্র সাধনের জন্য আমি শিবের কাছে যাচ্ছি। সিদ্ধি লাভ করে দেবতাদের সঙ্গে লড়াই করব। আমার না ফেরা পর্যন্ত তোমরা আমার পিতার আশ্রয় থাকবে।

তারপর শুক্রাচাৰ্য মহেশ্বরের কাছে গিয়ে প্রণাম জানিয়ে বললেন–হে দেব, যে সব মন্ত্র দেবগুরু বৃহস্পতির জানা নেই, দেবতাদের পরাজিত করবার জন্য সেসব মন্ত্র পাবার জন্য আমি আপনার কাছে এলাম।

মহাদেব বললেন–এই মন্ত্র পাবার জন্য তোমাকে একটা ব্রত করতে হবে। পুরো এক হাজার বছর নতশিরা হয়ে কেবল কনধূম পান করে যদি থাকতে পার, তাহলে এই দুর্লভ মন্ত্রগুলি লাভ করতে পারবে।

এই কথা শুনে শুক্রাচার্য্য রাজী হয়ে শিবের চরণ ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করে ব্রত সাধনের জন্যে চলে গেলেন। আর দানবরা তপস্বীর মতো হিংসা, দ্বেষ পরিত্যাগ করে ভৃগুমুনির আশ্রমে থাকল।

দেবতারা এখন সুযোগ পেয়ে ভূগুর আশ্রমে অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে আক্রমণ করল।

অসুররা অবাক হয়ে ভাবল, আমাদের গুরুদেব এখানে নেই। তপস্বীর মত কালযাপন করছি আমরা অস্ত্র-শস্ত্র ত্যাগ করে। কি করা যায় চিন্তা করে তারা ভৃগুপত্নীর শরণাপন্ন হল।

শুক্ৰমাতা তাদের অভয় দিয়ে দেবতাদের বললেন–এ কি তোমাদের ব্যবহার? আমাদের আশ্রমে দানবরা শান্তভাবে আছে। তাদের নিরস্ত্র দেখে বাহাদুরি দেখাতে এসেছ?

কিন্তু একজন নারীর কথায় দেবতারা ভয় না পেয়ে অস্ত্র ছুঁড়তে লাগল। তাই দেখে ভৃগুপত্নী যোগপ্রভাব ইন্দ্রকে স্তম্ভিত করে দিলেন–তারপর ভৃগুপত্নী বললেন–আমি ইন্দ্রকে বিনাশ করব। এই কথা শুনে দেবতারা সবাই পালিয়ে গেল। আর ইন্দ্র বিষ্ণুর পরামর্শ মতো তার দেহে প্রবেশ করলেন।

এই দেখে শুক্ৰমাতা রেগে গিয়ে বললেন–বিষ্ণুর সঙ্গে ইন্দ্রকে আমি পুড়িয়ে মারব।

মহাতপস্বিনীর এমন কথা শুনে ইন্দ্র ও বিষ্ণু খুব ভয় পেয়ে গেলেন। ইন্দ্র বিষ্ণুকে বললেন–আর কোনো উপায় নেই, ঐ মহাযোগিনীকে এক্ষুণি বধ করুন।

বিষ্ণু স্ত্রীহত্যার ভয়ে ভীত, কিন্তু আর কোনো উপায় না দেখে বিষ্ণু সুদর্শন চক্রের দ্বারা ভৃগুপত্নীর কণ্ঠ ছেদন করলেন।

ভৃগু সমাধিতে মগ্ন ছিলেন। ধ্যান ভঙ্গে এই স্ত্রী বধ দেখে ক্রুদ্ধ হয়ে বিষ্ণুকে অভিশাপ দিলেন–ধর্মতত্ত্ব জেনেও তুমি যখন অবধ্য ত্রীলোককে হত্যা করলে, তার ফলে তোমাকে সাতবার মানুষ হয়ে পৃথিবীতে জন্মাতে হবে।

তারপর ভৃগু যোগবলে মৃত স্ত্রীকে বাঁচিয়ে তুললেন। এভাবে ভৃগুর প্রভাব দেখে ইন্দ্র ভীত ও দুঃখিত হয়ে স্বর্গে ফিরে গেলেন।

একদিন ইন্দ্র তার মেয়ে জয়ন্তীকে বললেন–বর্তমানে খুব বিপদগ্রস্ত আমি। যদি আমার একটা কাজ করে দাও তুমি, তাহলে এই বিপদ থেকে উদ্ধার হতে পারি।

জয়ন্তী বলল–বল বাবা, আমাকে কি করতে হবে?

ইন্দ্র বললেন–শুক্রাচার্য্য দানবদের মঙ্গলের জন্য কঠোর তপস্যা করছে। তুমি তার কাছে গিয়ে তাকে নানাভাবে সেবা করবে। তিনি যাতে পরিতুষ্ট হন, সেভাবেই তুমি তার আরাধনা করবে। তার উদ্দেশ্যেই আমি তোমাকে দান করলাম।

ইন্দ্রে কথামতো জয়ন্তী শুক্রাচার্যের কাছে গিয়ে দেখল, শুক্রাচাৰ্য্য অধোমুখ হয়ে ধুমপান করছেন। তার দেহ একেবারে কঙ্কালসার। তখন জয়ন্তী বহু স্তবস্তুতি করে তার সেবায় নিযুক্ত হল। তার সেই কঠোর ব্রতের সহায়ক সব কাজ করল। এইভাবে এক হাজার বছর পূর্ণ হলে শুক্রাচার্য্যের ধুমব্রত সাঙ্গ হল। মহাদেব তার ব্রত সাধনে তৃপ্ত হয়ে বললেন–হে দ্বিজ, একমাত্র তুমিই এই ব্রত সাধন করলে। তপস্যা, বুদ্ধি, বল, শাস্ত্র-জ্ঞান ও তেজের দ্বারা সমস্ত দেবতাকে একাকী তুমিই বিমোহিত করবে। ভৃগুনন্দন আর একটি কথা মনে রেখো। এই গোপন ব্যাপার কারও কাছে তুমি প্রকাশ করবে না। তুমি ধনবান ও অবধ্য হবে।

শিবের বরে শুক্রাচাৰ্য মহা আনন্দিত হয়ে শিব সম্বন্ধীয় এক দিব্য স্তোত্র পাঠ করলেন। শিব আরও খুশি হয়ে তাঁর দিব্য রূপের দর্শন দিয়ে ভাগবকে স্পর্শ করে অন্তর্হিত হলেন।

তারপর শুক্রাচাৰ্য্য অনুচরী জয়ন্তীকে পাশে দেখে বললেন–হে সুভাগ, কি তোমার পরিচয়? তুমি কিসের জন্য এমন কঠোর সাধনায় রয়েছ? কি অভিলাষে তুমি আমার এমন সেবা করছ? তোমার ভক্তি, বিনয়, ধৈৰ্য্য, সংযম ও স্নেহশীলতায় আমি খুব খুশী। মনে তোমার নিশ্চয় কোনো অভিলাষ আছে, আমার কাছে খুলে বল, যত দুষ্করই হোক না কেন, তোমাকে আমি দেব।

শুক্রাচার্যের কথায় ইন্দ্রকন্যা জয়ন্তী বিনয়ের সঙ্গে বলল–আমার অভিলাষ আপনি তপের দ্বারাই জানতে পারেন। আপনার কাছে কোনো কিছুই অজানা নয়।

তখন ভার্গব দিব্যনেত্র দ্বারা তার মনের ভাব জেনে বললেন–হে ভামিনি, আমার সঙ্গে তুমি দশ বছর বিহার করতে চাও। ঠিক আছে, তাহলে আমার সঙ্গে আমার বাড়িতে চল।

তারপর শুক্রাচার্য জয়ন্তীকে বিবাহ করে দশটি বছর ধরে মায়াবৃত হয়ে তার সঙ্গে বিহার করতে লাগলেন সবার অদৃশ্য হয়ে।

গুরু শুক্রাচার্য্য কঠোর ব্রত সাধনের দ্বারা সিদ্ধিলাভ করে ঘরে ফেরার সংবাদ পেয়ে দানবেরা আনন্দে তার দর্শন লাভের জন্য তার ঘরে গেল। কিন্তু তিনি মায়বৃত থাকায় কেউ তাকে দেখতে পেল না।

দেবগুরু বৃহস্পতি শুক্রাচাৰ্য্য ও জয়ন্তীর বিষয়ে ধ্যানযোগে জেনে শুক্রাচার্য্যের রূপ ধরে দৈত্যদের কাছে গেলেন।

তাদের বৃহস্পতি বললেন–তোমাদের মঙ্গলের আমি এসেছি। শিবের কাছে আমি যে বিদ্যা লাভ করেছি, তা সবই তোমাদের দেব। এই বলে কপট ভাবে তিনি তাদের শিক্ষা দিতে লাগলেন।

এদিকে শুক্রাচার্য জয়ন্তীর সঙ্গে দশটি বছর বিহার করে শিষ্যগণকে দেখবার উদ্দেশ্যে দৈত্যদের গৃহে গিয়ে দেখলেন তারই বেশ ধরে বৃহস্পতি গুরুর আসনে বসে আছেন।

শুক্রাচার্য্য তখন দৈত্যদের উদ্দেশ্যে বললেন–ওরে মূঢ়গণ, বৃহস্পতির দ্বারা তোমরা প্রতারিত হচ্ছ। আমি তোমাদের গুরু শুক্রাচার্য্য।

তখন দানবরা বিভ্রান্ত হয়ে দুজনকে দেখতে লাগল। একজন গৃহের মধ্যে বসে পাঠ দিচ্ছেন। অন্যজন দাঁড়িয়ে। তারা বুঝতে পারল না কে আসল আর কে নকল।

তাদের এই অবস্থা দেখে ভার্গব বললেন–ওহে মূঢ়গণ, আমিই তোমাদের আচাৰ্য্য। যার দ্বারা তোমরা বঞ্চিত হয়েছ–সে ঐ দেবগুরু বৃহস্পতি। তোমরা বৃহস্পতিকে ছেড়ে আমাকে অনুসরণ কর।

এই কথায় দানবগণ কিছুই স্থির করতে পারল না। বৃহস্পতি তখন বললেন–দৈত্যগণ, আমিই তোমাদের গুরু। আর উনি আমার রূপে বৃহস্পতি, তোমাদের সর্বনাশ করার জন্য এসেছেন।

তখন অসুররা বলল–ইনি আমাদের দশ বছর ধরে শিক্ষাদান করছেন, কাজেই আমাদের গুরু ইনি। তোমাকেই মনে হচ্ছে কপট। ইনি যেই হোন, ইনিই আমাদের গুরু। এখন এঁর আদেশই আমরা পালন করব। আপনি এখন আসতে পারেন।

শুক্রাচার্য্যের অনেক হিত কথা বলাতেও যখন অসুররা তা শুনল না তখন তিনি ভীষণ কুপিত হয়ে বললেন–অচিরেই তোদের পরাজয় হবে।

ভার্গব এই অভিশাপ দিয়ে চলে গেলেন। মনে মনে খুশী হলেন বৃহস্পতি। তারপর অসুরদের ভাবী বিনাশ বুঝতে পেরে নিজের রূপ ধরে সেখান থেকে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।

এই ঘটনায় অসুররা বিভ্রান্ত হয়ে বলাবলি করল–আমরা বঞ্চিত হলাম, আমাদের উভয় দিক দিয়েই বৃহস্পতি তাড়িত করলেন।

তারপর প্রহ্লাদকে সামনে নিয়ে দানবরা ভার্গবের কাছে গেলে, তিনি তাদের দেখে রেগে বললেন–আমি তোমাদের বোঝাবার চেষ্টা করলাম, তখন তোমরা আমার কথা শুনলে না। আমার প্রতি অবমাননার ফলে তোমাদের অচিরেই পরাজয় ঘটবে।

এই কথা শুনে প্রহ্লাদ কাঁদতে কাঁদতে বলল–হে গুরু, আপনি আমাদের পরিত্যাগ করবেন না, আপনারই ভক্ত আমরা। আপনি আমাদের আশ্রয় না দিলে কোথায় যাব আমরা?

প্রহ্লাদের বিনীত বচন শুনে ভার্গব ঘটনা অনুধাবন করে ক্রোধ সম্বরণ করে বললেন–তোমরা ভয় কোরো না। দৈব অতি বলবান, যা ঘটার তা ঘটবেই। তোমরা দেবতাদের জয় করলেও একবার তোমাদের পাতালে গিয়ে থাকতে হবে।

গুরুদেবের এই উপদেশ মাথায় নিয়ে প্রহ্লাদের সঙ্গে দানবেরা সেখান থেকে পাতালে চলে গেল।