• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • নতুন সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • পুরানো সব ক্যাটাগরি
  • My Account →
  • নতুন সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • পুরানো সব ক্যাটাগরি
  • My Account →
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

৩৮. দীপা চুপ করে আছে

লাইব্রেরি » সমরেশ মজুমদার » সমরেশ মজুমদারের উপন্যাস সমগ্র » সাতকাহন (১ম পর্ব) - উপন্যাস - সমরেশ মজুমদার » ৩৮. দীপা চুপ করে আছে

দীপা চুপ করে আছে দেখে মহিলা বললেন, তুমি নিশ্চয়ই খুব অবাক হচ্ছে। অবাক হবার কথাই। হঠাৎ এভাবে কেন তোমার কাছে এলাম তা ভাবা খুবই স্বাভাবিক।

দীপা কোন কথা বলল না। হঠাৎ মনে হল তার মাথা আর নিতে পারছে না। কেমন যেন টালমাটাল লাগছে নিজেকে। পঞ্চাশ বছর পরে সন্ন্যাসী হয়ে ফিরে আসা ঠাকুর্দার গল্পটিকে ঠাকুমা বলেছিলেন ভূতুডে। এক সময় তো কিছুতেই স্বীকার করতে পারেনি। সে পরে যাকেই ওই গল্প শুনিয়েছে সে-ও মাথা নেড়েছে, ইম্পসিবল। ভূত কিংবা ভণ্ড ছাড়া এমন হতে পারে না। অথচ জীবন অদ্ভুত। এই মহিলাকে নিয়ে এসে মামা বলছেন প্ৰণাম করতে কারণ ইনি তার সৎমা।

সুভাষচন্দ্র বললেন, তোর বাবার খুব ইচ্ছে ছিল এখানে আসে। কিন্তু– কথা শেষ করলেন না। তিনি, অপরাধীর ভঙ্গী নিয়ে তাকালেন।

কিন্তু কি? খুব নিচু গলায় জানতে চাইল দীপা।

তুই কিভাবে নিবি তা বুঝতে পারছিল না। আসলে আমার কাছেই শুনেছে যে আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ের সঙ্গে তোর কোন মিল নেই। সুভাষচন্দ্ৰ বোঝাতে চাইলেন।

কিন্তু মহিলা মাথা নাড়ালেন, আহা! সত্যি কথাটাই বলুন ওকে! শুনেছি তুমি জন্মাবাব পবই দিদি মারা যান। তোমার মাসী দায়িত্ব নেওয়াতে তোমার বাবা মুক্ত করে ফেলেন নিজেকে। আজ তাঁর অনুশোচনা হতেই পারে। কিন্তু যে মানুষটা বাবা হয়ে তোমার জন্যে কোন কর্তব্য কখনও করেনি সে কোন মুখ মিয়ে একদম প্ৰথমে এসে দাঁড়ায় সামনে।

তাই আপনি এসেছেন? দীপার। গলার স্বর পাল্টাচ্ছিল না।

হ্যাঁ। আমার সঙ্গে তো তোমার কোন শত্ৰতা নেই, তুমি আমাকে দ্যাখোনি আমিও না।

ভালই। আপনারা কলকাতায় থাকেন।

হ্যাঁ গো। পাকপাড়ায়, ইন্দ্ৰ বিশ্বাস বোডে। এখান থেকে বেশী দূর নয়।

আমার কথা আপনারা কিভাবে জানলেন?

এবার সুভাষচন্দ্ৰ জবাব দিলেন, আমিই বলেছি।

ওঁদের কথা। আপনি জানতেন?

না, না। জানলে তোমাদের নিশ্চয়ই জানতাম। হঠাৎ যোগাযোগ হয়ে গেল। পাকপাড়ায় তোমার মামীমার সেজে পিসি থাকেন। তাঁর ছেলের বিয়ে দেবেন বলে স্থির করেছিলেন। এক ঘটক সম্বন্ধ নিয়ে এল, মেয়ে স্কুল ফাইনাল পাশ করেছে, পাকপাড়াতেই বাড়ি। আমি এসবের কিছুই জানতাম না। মেয়ে দেখা হয়েছে, এখন দেনাপাওনা নিয়ে কথা হচ্ছে। ছেলে ব্যাঙ্কে চাকরি করে তো! সেই সময় তোমার মামীমার সেজো পিসে একদিন ছুটতে ছুটতে এসে খবর দিলেন, মেয়েটি ভদ্রলোকের দ্বিতীয় পক্ষের, প্রথম পক্ষের বিয়ে হয়েছিল নাকি মালবাজারে। আমরা মালবাজারে এককালে থাকতাম তা তিনি জানতেন। কৌতূহল হল, গেলাম আলাপ করতে। ব্যাস, দেখি তোমার বাবাই মেয়ের বাবা। হাসলেন সুভাষচন্দ্ৰ।

তারপর?

তারপর আর কি হবে? অনেক মান অভিমানের কথা হল। বুঝলাম স্রেফ লজায় তোমার খোঁজখবর করার ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও ওঁর পক্ষে করা হয়ে ওঠেনি। আমার কাছে তোমার খবর পেয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন, তখনই দেখা করতে আসবেন। আমি তাঁকে কোনমতে শান্ত করলাম। তোমার কথা সব বললাম। খুব কষ্ট পেলেন। তারপর থেকেই বলতে আরম্ভ করেছেন, সে কি আমার মুখ আর দর্শন করবে! আমার বড় মেয়ে, যে নেই বলে বিবাগী হয়েছিলাম তার রক্ত ওর শরীরে, ও কি আমাকে কখনও বাবা বলে ডাকরে। খুব নরম মনের মানুষ হে।

এবার ভদ্রমহিলা বললেন, আমি জানি, তোমার অভিমান হওয়া খুব স্বাভাবিক। তবে দিদিকে উনি এত ভালবাসতেন যে ওঁর মৃত্যু সহ্য করতে পারেননি। কিন্তু যতই হোক বাবা সবসময়ই বাবা। আমি কথা দিয়ে এসেছি আজ তোমাকে ওঁর কাছে নিয়ে যাব। দীপার হাত ধরলেন মহিলা বেশ আবেগ নিয়েই। ধীরে ধীরে হাত ছাড়িয়ে নিল দীপা, আজ তো সম্ভবই নয়। আমার শরীর খুব খারাপ।

শরীর খারাপ? কি হয়েছে? সুভাষচন্দ্ৰ জানতে চাইলেন।

খুব দুর্বল লাগছে। উঠে দাঁড়াল দীপা।

তা তো হবেই। এত পড়ার চাপ, তার ওপর পুলিশ-টুলিশের ঝামেলা। মহিলা মাথা নাড়লেন, তাহলে আজ থােক। কাল কিংবা পরশু? মুশকিল হল, তার বেশী দেরি করলে ওঁকে আটকে রাখা যাবে না। এখানে এসে উনি যদি কান্নাকাটি করেন তাহলে পাঁচজনে কি বলবে বল তো? তাছাড়া তোমার বোনেরাত আলাপ করতে উৎসুক।

দীপা জবাব দিল না। মহিলা সুভাষচন্দ্ৰকে বললেন, চলুন! ওকে একটু বিশ্রাম নিতে দিন। দেখে মনে হচ্ছে সারাদিনে ওর ওপর খুব ধকল গিয়েছে।

সুভাষচন্দ্র উঠলেন, ঠিক আছে। কাল আমি বিকেল পাঁচটায় এসে তোকে নিয়ে যাব। শরীরের ওপর যত্ন নিস। অমরনাথ মুখার্জী নেই বলে ভাবিস না তোর সঙ্গে কেউ নেই। আমরা তো আছি। বাইরে পা বাড়ালেন তিনি। দীপা চুপচাপ দাঁড়িয়ে ওদের চলে যেতে দেখল। গেট পেরোবার আগে মহিলা মুখ ফিরিয়ে একবার মিষ্টি করে হেসে যাই বললেন। দীপা নড়ল না। সে কিছুই বুঝতে পারছিল না। সুভাষচন্দ্ৰ যেন বেশ কিছুটা বদলে গিয়েছেন। এখন তাঁর কথাবাতাঁর মধ্যে খুব চেনা একটা লোকের আদল আসছে। লোকটা কে তা সে মনে করতে পারছে না। কিন্তু আজ সুভাষচন্দ্রকে কিছুতেই ভাল লাগছিল না। তার। যে ভদ্রমহিলা তাকে জন্ম দিয়েই দেহ রেখেছেন তাঁর সঙ্গে সুভাষচন্দ্রের যে সম্পক ছিল অঞ্জলির সঙ্গেও একই সম্পর্ক। মনে পড়ছে অমরনাথের চিকিৎসার জন্যে কলকাতায় আসার প্রস্তাব দিয়ে অঞ্জলি যখন চিঠি দিয়েছিল তখন সুভাষচন্দ্ৰ জানিয়েছিলেন, সাতদিনের জন্যে কোন অসুবিধে নেই। খুব খারাপ লেগেছিল তখন। পরে কলকাতায় এলে তিনি অনেক করেছেন। আবার অমরনাথের অসুস্থতা, আর্থিক দুৰ্গতি আরম্ভ হবার পর থেকেই তিনি যেন নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন। সেই একই মানুষ আবার মৃত বোনের পালিয়ে যাওয়া স্বামীর সঙ্গে এতদিন পরে সম্পর্ক তৈরি করার জন্যে ব্যস্ত হয়ে উঠলে অবাক হতেই হয়। দীপা চোখ বন্ধ করল। অসম্ভব। বাবা বলে কাউকে চিন্তা করলেই অমরনাথের মুখ মনে আসছে। যিনি তাকে জন্ম দিয়েছিলেন তাঁর সম্পর্কে কিছুদিন ধরে একটা কৌতুহল তৈরি হচ্ছিল বটে। কিন্তু তাঁকে অমরনাথের জায়গায় বসানোর বিন্দুমাত্র ইচ্ছে তার নেই। আর কাউকে সে কখনও বাবা বলতে পারবে না। কিন্তু এই মহিলা, সম্পর্কে যিনি তার সৎমা, ব্যবহার করলেন বেশ ভাল। একেই হয়তো বুদ্ধিমতীর ব্যবহার বলে।

হোস্টেলের ভেতরে পা বাড়াতে গিয়ে গেটের দিকে নজর গেল। অসীম বলে গেছে কিছু বাদেই ঘুরে আসবে। এর মধ্যে অনেকটা সময় গিয়েছে, কিন্তু ও আসেনি। সুভাষচন্দ্র ওকে পছন্দ করেননি। সে সামনে থাকতেই যে ধরনের ব্যবহার করেছিলেন তাতে বোঝাই যাচ্ছে পরে ভাল কিছু করতে পারেন না। অসীম যদি সেই কারণে অপমানিত বোধ করে তাহলে এই মুহূর্তে তার কিছু করার নেই। মানুষের যদি জরুরি কিছু কথা বলার থাকে তাহলে সে একটা সময় বলবেই।

আজ তাকে বিকল্প জায়গায় থাকতে হবে। দীপা পা বাড়াল। হোস্টেলের ভেতরে আজ ছোটছোট জটলা। মেয়েরা হয়তো ঘুরে ফিরে গ্লোরিয়ার কথাই আলোচনা করছে। কেউ কেউ দীপাকে দেখতে পেয়ে ডাকল। দীপা হাত নাড়ল, মুখে বলল, শরীর খারাপ।

নিজের বিছানা নয়, পুলিশ তালা খুলে না দিলে নিজের ঘরে যাওয়াও যাবে না, তবু বিছানা তো, শুয়ে মনে হল শরীর এতক্ষণ এই আরাম চাইছিল। চোখ বন্ধ করে কিছু মনে করতে চাইতেই সে হতভম্ব, কিছুই মনে করতে পারছে না। মাথার ভেতরটা যেন একদম ফাঁকা। কোন কিছু ভেবে সামনে নিয়ে আসার শক্তি তার এক ফোঁটাও নেই। এই অবস্থায় মনে হল কেউ বা কারা ঘরে ঢুকছে। চোখ খোলার প্রয়োজন মনে করল না দীপা। পারফিউমের গন্ধটা নাকে এল এবং সেইসঙ্গে লুসাকার গলা, শী ইজ শ্লিপিং!

চোখ খুলল দীপা। লুসাকা আর সেই খটমটে নামের মেয়েটি। অদ্ভুত করুণ ভঙ্গীতে তাকিয়ে আছে ওরা। সে উঠে বসল, ইয়েস!

লুসাকা ধাপ করে বিছানায় বসে পড়ল, প্লিজ হেল্প আস!

কি হয়েছে? কথা বলতে একটুও ইচ্ছে করছিল না দীপার। এইসময় দরজায় শব্দ হল। দীপা বলল, কে?

দারোয়ান সামনে এল! অসীম নামে একজন আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাইছে।

দীপা মাথা নাড়ল, বলে দাও আমার শরীর খারাপ, আমি শুয়ে আছি।

দারোয়ান চলে যেতেষ্ট সে লুসাকার দিকে তাকাল। লুসাকার বদলে খটমটে জবাব দিল, সবাই আমাদের দিকে সন্দেহেব চোখে তাকাচ্ছে। এভরিবডি।

আমি কি সাহায্য করতে পারি?

তুমি আমাদের সাজেস্ট কর ওই ছেলেটার কথা পুলিশকে বলব কি না। ওরা আমাদের অনেক জেরা করেছে। কিন্তু ছেলেটার কথা আমরা ভয়ে বলিনি। এখন সবাই যখন আমাদের সন্দেহ করছে তখন ওর কথা বলে দিতে চাইছি। আমরা। কিন্তু খুব ভয় করছে।

ভয় কিসের?

সে লোকাল বয়। আমাদের ক্ষতি করতে পারে। আমাদের কাছে কোন প্ৰমাণ নেই! পুলিশ যদি ওকে কিছু না করে তাহলে আমরাই বিপদে পড়তে পাবি।

কোন ছেলে? কব কথা বলছ?

তুমি জানো না? গ্লোরিয়া তোমাকে কিছু বলেনি?

আমি মনে করতে পারছি না দীপার। সত্যি মনে পড়ছিল না। গ্লোরিয়া এমন কোন স্থানীয় ছেলের গল্প তার কাছে করেনি। যাকে এতটা জড়ানো যায়! সে জিজ্ঞাসা করল, কি নাম ওর?

ভিমল সেইন। খটমটে বলল, হি ইজ ওয়ান ইয়ার সিনিয়ার।

বিমল সেন! দীপা আরছা মনে করতে পারল একটি ছেলেকে। গাড়ি চালিয়ে কলেজে আসে মাঝেমাঝে, ভাল স্বাস্থ্য। স্কটিশে বড় লোকের কিছু ছেলে আসে সময় কাটাতে, তাদের একজন বলে মনে হয়েছিল বিমলকে। গ্লোরিয়ার চেহারায় যে চটক ছিল তাতে জাম্বিয়ার বন্ধুরা ছাড়াও শেষের দিকে কিছু বাঙালি ছেলে ওর সঙ্গে যৈচে আলাপ করেছিল। কিন্তু এ গল্প করলেও কোন বিশেষ নাম গ্লোরিয়া তার কাছে উল্লেখ করেনি।

দীপা জিজ্ঞাসা করল, বিমল কি করেছে?

ও গ্লোরিয়াকে নিজের গ্রামে বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিল।

সে কি? ও শান্তিনিকেতনে যায়নি? চমকে উঠল দীপা।

ওরা গ্রাম দেখে সেখানে যাবে বলে ঠিক করেছিল।

তোমরা এসব কথা পুলিশকে বলোনি কেন? ওরা তো নিশ্চয়ই জিজ্ঞাসা করেছিল?

হ্যাঁ। আমরা ভয় পেয়েছিলাম। কিন্তু—!

দীপা উঠে পড়ল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল ঠিক করে নিয়ে বলল, এসো তোমরা!

সুপারের ঘরে গিয়ে ওরা শুনল তিনি নেই, সম্ভবত প্রিন্সিপালের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছেন। দীপা চিন্তা করল। তারা ইচ্ছে করলে সোজা থানায় যেতে পার ত। কিন্তু সেটা ঠিক হবে কি না বুঝতে পারছে না সে। না, ব্যাপারটা প্ৰথমে সুপাবকেই জানান উচিত। দারোয়ানের কাছ থেকে প্রিন্সিপালের বাড়ির ঠিকানা জানতে চাইল সে। তিনি কলেজের পাশেই কোয়ার্টার্সে থাকেন জেনে ওরা বেরিয়ে পড়ল। ইতিমধ্যে সন্ধ্যা ঘনিয়ে গিয়েছে। রাস্তায় একজনও ভদ্রঘরের মহিলা একা নেই। কালো মেয়েদুটি মাথা নিচু করে হাঁটছিল। যেন গ্লোরিয়ার মৃত্যুর জানো তারাই অপবাধী হয়ে পড়েছে। দীপা জিজ্ঞাসা করল, বিমালোব সঙ্গে ওর খুব বন্ধুত্ব ছিল?

খুব না। কিছু কিছু ছেলে থাকে যারা মেয়েদের সঙ্গে মিশতে চায় শরীরের জন্য, ও সেই ধরনের ছেলে। চোখ মুখ দেখে বুঝতে পাবতাম। ওকে সাবধান ও করে দিয়েছিলাম।

তাহলে? দাপা অবাক হচ্ছিল, একই ঘরে থেকে ও সে এসব কিছুই জানে না।  ও শোনেনি। আসলে ভালবাসার ব্যাপারে একবার ঠিকে গিয়ে ও বেপরোয়া, ত যে গিয়েছিল।

দীপা কথা বাড়াল না। জেনেশুনে| বিষ খাওয়া তো আত্মহত্যা। প্ৰেমে ব্যর্থ হলে মানুষ দেবদাস হবেই? পৃথিবীর সব দেশের মানুষ। দেবদাস মদ খেয়েছিল আরু গ্লোরিয়া নিজেকে নষ্ট করার অন্য পথ বেছে নিল। কিন্তু মূলে তো কোন তফাত নেই। হঠাৎ অসীমের কথা মনে পড়ল দীপার। অসীমকে সে পছন্দ করে। অসীমকে কি সে ভালবাসে? ভালবাসা করে কয়? যদি তার প্রথম শর্ত হয় কষ্ট না দেওয়া, কষ্ট পেতে দেখলে আড়াল করে রাখা তাহলে কি সে চুপ করে বসে থাকতে পারবে? চট করে এই প্রশ্নের উত্তর যে তৈরি হচ্ছে না। অথচ আজ অবধি, একটি মধ্যবিত্ত পবিবারে বা মেয়ে হয়েও কম ছেলের সঙ্গে আলাপ হল না। কিন্তু তাদের কেউ তাকে টানেনি। কেন টানেনি? তার অবস্থা কি সেই মানুষের মতো যার শৈশবেই এঁড়ে লেগে গিয়েছিল। কোনওদিন আর স্বাভাবিক হতে পারল না! সেই এক রাত্রের স্মৃতি কি ভালবাসার মনটোকে উপড়ে নিয়ে গেল? দীপার খুব ইচ্ছে করছিল এখন অসীমের সঙ্গে দেখা করতে।

সাধারণত প্ৰিন্সিপালের সঙ্গে কথা বলার কোনও প্রয়োজন ছাত্রছাত্রীদের হয় না। তিনি থাকেন দূরত্ব নিয়ে তাই ছেলেমেয়েরা এড়িয়ে চলে। এই বিদেশী প্ৰিন্সিপাল যে খুব শৃঙ্খলা মেনে চলতে ভালপাসেন তা সবাই জানে। সুপার তাঁর কাছেই ছিলেন। সমস্ত ঘটনা শুনে তিনি সুপালের সি-কে তাকালেন। সুপার একটু ইতস্তত করে বললেন, চট করে একটা ছেলেকে না জড়িয়ে ফেলে প্রথমেই একটু খোঁজ খবর করলে বোধ হয় ভাল হয়। এরা যা বলছে তা সরাসরি অভিযোগ করা।

প্রিন্সিপাল জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি গ্লোরিয়ার রুমমেট। পুলিশ যখন তোমাকে প্রশ্ন করেছিল তখন এসব কথা তাদের জানাওনি কেন?

দীপা বলল, আমি একটু আগে এদের মুখে ঘটনাটা প্ৰথম শুনি।

প্রিন্সিপাল এবার লুসাকাদের দিকে তাকালেন। তারা মুখ নিচু করল। দীপা বলল, ওরা প্রথমে ভয়া পেয়েছিল। কলকাতায় থাকতে হবে ওদের তাই এখানকার ছেলেকে অভিযুক্ত করতে ঠিক সাহস পায়নি। এখন অবস্থা দেখে আমাকে বলেছে। আপনি যদি ওদের আড়াল করেন তাহলে ভাল হয়। দীপা সত্যি কথা বলে ফেলল।

তোমাদের কাছে কোন প্ৰমাণ আছে ওদের একসঙ্গে বর্ধমানে যাওয়ার?

লুসাকা মাথা নাড়ল, না। কিন্তু আমরা তাই জানতাম। এখন আমরা চাই গ্লোরিয়াকে যে খুন করেছে তার শাস্তি হোক। যদি তার জন্যে আমাদের এই শহর থেকে পড়াশুনা বন্ধ করে চলে যেতে হয় তাতেও রাজি আছি।

ধন্যবাদ। প্রিন্সিপাল খুশি হলেন, কিন্তু তোমরা বিমল সেনের ঠিকানা জানো?

না, ওরা কেউ জানো না। তবে কলেজের খাতায় নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে ঠিকানা! প্রিন্সিপাল টেলিফোন তুলে নম্বর ঘোরালেন। দ্বিতীয়বারে লাইন পাওয়া গেল। নিজের পরিচয় দিয়ে প্রিন্সিপাল বললেন,  গ্লোরিয়ার পোস্টমর্টেম রিপোর্ট পাওয়া গিয়েছে? যায়নি? কেউ ধরা পড়েনি এখনও? শুনুন, আমাকে একজন বলল ওকে আমার কলেজের ছেলে বিমল সেনের সঙ্গে ঘোরাফেরা করতে দেখা গিয়েছে। কে বলল? অফিসার, আপনাকে আমি নিশ্চয়ই নাম বলব। কিন্তু আপনাকে কথা দিতে হবে সোর্স ডিসক্লোজ করবেন না। কি বললেন? হ্যাঁ, আপনারা যদি প্রশ্ন করতে চান তাহলে আমার এখানে চলে আসুন।

রাতে সাড়ে নটা নাগাদ ওরা মুক্তি পেল। পুলিশ অফিসার লুসাকাদের প্রশ্ন করে সব জেনে নিলেন। যেহেতু এ ব্যাপারে ওরা কোনো ভাবেই জড়িত নয় তাই ওদের প্রসংগে কোথাও তুলবেন না বলে কথা দিলেন। সেই রাত্রেই কলেজের অফিসঘর খুলিয়ে খাতা থেকে বিমল সেনের ঠিকানা বার করা হল। অফিসার সতর্ক করে নিলেন যেন এই ব্যাপারটা মেয়েরা হোস্টেলে ফিরে গিয়ে কারো সঙ্গে আলোচনা না করে।

প্রিন্সিপাল সুপারকে বললেন, ওদের সঙ্গে আপনি ফিরবেন না, কিন্তু দারোয়ানকে বলুন ওদের হোস্টেলে পৌঁছে দিতে অনেক রাত হয়ে গিয়েছে।

দীপা বলল, স্যাব, এখান থেকে হোস্টেল বেশী দূরে  নয়, এটুকু পথ আমরা নিজেরাই যেতে পারব।

প্রিন্সিপাল অবাক হলেন,  তোমাদের অস্বস্তি হবে না?

দীপা মাথা নাড়ল, না। তিনজনে গল্প করতে করতে চলে যাব।

সুপারের ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু দীপা লুসাকাদের নিয়ে বেরিয়ে এল। রাস্তা নিঝুম। কসমস রেস্টুরেন্টের সামনে ফাঁকা। দীপার মনে হল এই কলকাতা অন্যবিকম। হোস্টেলে চলে আসতে একটুও অসুবিধে হল না। শুধু বসন্ত কেবিনের সামনে দাঁড়ানো তিন জন প্রৌঢ় চাপা গলায় কথা বলেছিল। তারা হ্যাঁ করে ওদের দেখল। পেরিয়ে আসার সময় কানে এল, দিনকাল কি হল, অ্যাঁ। মেয়েছেলে রাতদুপুরে চরতে বেরিয়েছে! আর কত কি দেখব! দীপা কিছু বলল না। ওর ঘুম পাচ্ছিল। মাথা আড়ষ্ট হয়ে আসছিল।

যাহোক কিছু মুখে দিয়ে নিজের বিছানায় চলে এল সে। চা-বাগানে থাকতে মনোরমা এবং অঞ্জলির শেখানে কিছু অভ্যোস এখনও রয়ে গিয়েছে। বাইরের জামাকাপড়ে বিছানায় শোয়া নিষেধ ছিল। এইটে দীপা আর মানছে না। কিন্তু রাত্রে ঘুমাবার সময় কাচা জামাকাপড় না পারলে অস্বস্তি হয়। হোস্টেলে কেউ সকালের বাসি কাপড় ঘুম থেকে উঠেই ছেড়ে ফেলে না। সেটা কলেজে যাওয়ার আগে স্নানের সময় করে। কিন্তু এই স্নানটা দীপা সেরে নেয়। ঘুম থেকে উঠেই। ফলে বাসি কাপড়ের ঝামেলা বইতে হয় না। দরজা বন্ধ করে কাপড় পাল্টানোর সময় তার মনে হল স্নান করতে পারলে ভাল হত। কিন্তু এখন শরীর একদম বইছে না। টেবিলের ওপর নজর পড়ল। একটা খাম। চিঠি নিশ্চয়ই বিকেলের ডাকে এসেছিল, তারা বেরিয়ে যাওয়ার পর দারোয়ান এখানে রেখে গিয়েছে।

বিছানায় বসে খাম খুলল দীপা। হাতের লেখা চেনা লাগছিল, চিঠির নিচে নাম দেখে সে থমকে গেল। মনোরমা। আজ অবধি কখনও ঠাকুমা তাকে চিঠি দেননি। গোটা গোটা অক্ষরে সুন্দর করে নাম ঠিকানা লেখা। খামের ওপর ঠিকানা লেখা দেখে সে বুঝতে পারেনি। অভ্যস্ত না থাকায়। এখন ভাল লাগল। চিঠি পড়া আরম্ভ করল দীপা সেই ভাল লাগা নিয়ে। পরমা স্নেহাস্পদ মা দীপা, আশা করি ঈশ্বর তোমাকে সবাঙ্গীন কুশলে রাখিয়াছেন। দীপা হেসে ফেলল। এই বাংলায় ঠাকুমা যদি কথা বলতেন তাহলে কেমন হত? কেন বাঙালিরা কথা বলা আর চিঠি লেখার ভাষা আলাদা করত? সে মনোরমার মুখখানা মনে করে মাথা নাড়ল। সর্বদা শরীরের প্রতি যত্ন রাখিও। তোমার শিক্ষাগ্ৰহণে যেন কোন ত্রুটি না হয়। তোমার বয়সের যুবতীর নিকট নানান প্রলোভন আসিবে। কলিকাতা শহরের এই ব্যাপারে অত্যন্ত দুর্নাম আছে। কিন্তু তোমাকে সততার সহিত দিন অতিবাহিত করিতে হইবে। তুমি অত্যন্ত ভাগ্যবতী তাই পড়াশুনার সুযোগ পাইয়াছ। আমার তো সারাজীবন পোড়া কপালের দাগ লইয়াই থাকিতে হইল। ঈশ্বর তোমার আরও মঙ্গল করিবেন।

এই পত্ৰ পাইয়া নিশ্চয়ই তুমি খুব অবাক হইয়া গিয়াছ। তোমাকে পত্র লিখিবার একবিশেষ কারণ আছে। বউমা নতুন জমিতে বাড়ি তৈরী করিযাছেন, এই খবর এখানকার সবাই জানে। বড় সাহেবের কানে সেই খবর তুলিয়া দিবার মানুষের তো অভাব নাই। তিনি নির্দেশ দিয়েছেন। আগামী মাসের প্রথম তারিখের মধ্যে এই কোয়ার্টার্স আমাদের খালি করিয়া দিতে হইবে। যেহেতু বাসস্থানের সমস্যা নাই তাই তাঁহার এই আদেশ। অবশ্য তিনি জানাইয়াছেন যে অমরনাথের কন্যা অথবা পুত্র যদি কখনও চাকরিপ্রাথী হয় তাহা হইলে সে চাকরি পাইবে। তুমি চাকরি করিতে অনিচ্ছা প্ৰকাশ করিয়াছ, তোমার ভ্রাতারা এখনও উপযুক্ত হয় নাই, এই পরিস্থিতিতে আমাদের কোয়ার্টার্স ছাড়িয়া চলিয়া যাইতে হইবে।

এদিকে বাড়ি বাসযোগ্য করিতে যে অর্থ খরচ হইয়া গিয়াছে তাহা অঞ্জলি পূর্বে কল্পনা করে নাই। ওইসব স্থানে কিছুদিন পূর্বেও শিয়াল চরিত। জঙ্গল বলিয়া কেহ ওইদিকে যাইত না। পাকিস্তানের লোকেরা আসিয়া ওই স্থানে বাস করিতে আরম্ভ করিলে অবস্থার পবিবর্তন ঘটিয়াছে। কিন্তু শ্মশানের নদীর জল পেটের পক্ষে খুব খারাপ। তোমার মা একটি কুযা তৈরি করাইয়াছে। কিন্তু একটু বৃষ্টি হইলেই কুয়ার জল উপরে উঠিয়া আসে। আমার পেটে ওই জল সহ্য হইবে না। তোমার মায়ের ইচ্ছা একটি গভীর নলকূপ খনন করানো। কিন্তু তাহার হাত এই মুহূর্তে প্ৰায় শূন্য। ওই বাড়িতে যাওয়ার পর সংসার চালাইবার চিন্তায় সে উন্মাদ-প্ৰায়। আমার কাছে সঞ্চিত যাহা ছিল তাহা তোমার মাকে দিয়াছি। কিন্তু গরিব বিধবার সঞ্চয় আর কি হইতে পারে।

এইরকম পরিস্থিতিতে তোমাকে এই পত্র লিখিতে বাধ্য হইতেছি। তুমি তোমার পড়াশুনা চলাকালীন সময়ের জন্য সমস্ত খরচ, আগাম লইয়া গিয়াছ। আগামী বৎসর যে টাকা খরচ হইবে তাহা এই মুহূর্তে তোমার নিশ্চয়ই প্রয়োজন নাই। তুমি বলিয়া গিয়াছ উপার্জন শুরু করিলে ওই টাকা ফিরাইয়া দিয়া ঋণমুক্ত হইবে। তাই তোমায় লিখি, সুবিলম্বে তিন হাজার টাকা তোমার মায়ের নামে ওই সঞ্চয় হইতে তুলিয়া পাঠাইয়া দাও। এক বৎসরের মধ্যে নিশ্চয়ই তোমার বাবোব অফিসের পাওনা টাকা আদায় হইয়া যাইবে। তখন তোমার মা আবার ওই টাকা তোমার কাছে পাঠাইয়া দিলে। ইহাতে তোমার কোন অসুবিধা হইবার কথা নয়। আশা করি, তুমি আমার এই কথার মর্ম বুঝিবে।

যদি তুমি পত্রপাঠ টাকা পাঠাও তাহলে পুরানো ঠিকানায় পাঠাইও। আমি বিশ্বাস করি তুমি বিলম্ব করিবে না। আমরা অত্যন্ত কষ্টে বাস করিতেছি। অর্থাভাব কি জিনিস তাহা এমন করিয়া কখনও উপলব্ধি করি নাই। আমার শরীর এবং মন বিন্দুমাত্র ভাল নাই। তোমাকে ছাড়া আর কাতাকে এইসব কথা লিখিব!

তোমার অনেক উন্নতি হোক, দিবারাত্র ঈশ্বরের নিকট এই প্রার্থনা করি। তোমার মা নিচু হইয়া তোমাকে পত্র লিখিবেন না। তাহার কাছে সব শুনিয়া আমি এই পত্র লিখিতে বাধ্য হইয়াছি। আশা করি তুমি বিরক্ত হইতেছে না।

তোমার কুশল সংবাদ জানিতে পারিলে আমি এবং তোমার মা খুশি হইব। ইতি, আশীর্বাদিক, তোমার ঠাকুমা।

চিঠিটা পড়ে পাশে রেখে দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল দীপা। খুব অস্বস্তি হচ্ছিল তাব! শরীর আনোচান করছিল। তার কেবলই মনে হচ্ছিল এই চিঠি মনোরমা লেখেননি। কেউ তাঁকে বলে গিয়েছে—এবং তিনি লিখতে বাধ্য হয়েছেন। অঞ্জলির কণ্ঠস্বব যেন স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিল সে। কিন্তু দীপা চিঠিটা তুলে নিল চোখের সামনে। অমরনাথ বেঁচে থাকলে কি করতেন? অ্যাডষ্টতা সরিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল সে।

কদিন ধরে বিমল সেনের গ্রেপ্তার এবং গ্লোরিয়ার মৃত্যু নিয়ে কলেজে খুব হইচই হয়েছিল। কিন্তু ছাত্র আন্দোলনের প্রাবল্যে সেসব চাপা পড়ে যেতে দেরি হয়নি। বিধানচন্দ্র রায়ের বিরোধ বা সম্ভবত এই প্ৰথম একত্রিত হয়ে আন্দোলন শুরু করলেন পশ্চিমবাংলায়। খাদ্যের দাবিতে ট্রামবাস পুড়ল, কিছু মানুষ মারা গেল। ছাত্ররা চিরকালই সরকার বিরোধী হয়। বামপন্থী ছাত্ররা ধর্মঘট ডাকল। কদিন কলকাতায় রাজপথে সংঘর্ষ চলল। তারপর যে কে সেই! একটা বুদবুদ গুলো থিতিয়ে যে যেতে লাগল জল।

টাকা পাঠানোর প্ৰাপ্তি রসিদ ঠিক সময়ে এসেছিল। তারপর মনোরমার পোস্টকার্ড, তুমি যাহা করিলে যাহা কোনকালেই ভুলব না। ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করিবেন। দীপা কোন চিঠি দেয়নি। অতএর ওখান থেকে কোন চিঠি ও সে আশা করেন। ব্যাপারটা আচমকা ঘটে আচমকাই মিলিয়ে গেল। কলকাতার বাজনৈতিক আন্দোলন, কলেজ বন্ধু, খবরেব কাগজের উত্তাপ, অনেকটা সময়। ঘিরে থাকায় দীপার মন কিছুটা চাপা পড়েছিল। হোস্টেলের মেয়েদের সেই কয়েকটা দিন প্ৰায় বন্দীদশায় কাটাতে বাধ্য করেছিলেন সুপাব। গ্লোরিয়ার মৃত্যুর পারেই অনেকরকম আইনকানুন চালু হয়েছিল। স্বাধীনতা পেতে অভ্যস্ত মেয়েদের মনে যতই অসন্তোষ জমুক কিছু করার ছিল না।

রাজনীতি দীপাকে মোটেই টানে না। আন্দোলনেব শুরু এবং শেষ একদম নির্লিপ্ত হয়ে যখন সে দেখছিল, তখন মায়া সক্রিয় হয়ে রাস্তায় নেমেছে। মিটিং মিছিল একদিকে অন্যদিকে নাটকেব। দল করে গিয়েছে একই তালে। দীপা খুব বিস্ময় বোধ করে। কিন্তু ওই জীবন তাকে টানে না। আন্দোলন শেষ হয়ে গেলে, জায়গার জল জায়গায় ফিরে এলে সে একদিন মায়াকে জিজ্ঞেস করেছিল, কি লাভ হল? যখন তোমরা শুরু করেছিলে তখন শেষ জানতে না? মায়া হেসে ফেলল, সত্যি কথা হল, জানতাম। কিন্তু স্বাধীনতার পরে শাসকদের একটা ধাক্কা দেওয়া জরুরি ছিল। ওরা জানল, যা ইচ্ছে তাই করতে পারবে না আর। দেশের মানুষ বুঝতে পারল ইংরেজদের তাড়িয়ে ফেলেই সব কাজ শেষ হয়ে যান্য না। অর্থনৈতিক কাঠামো না পাল্টালে দেশের উন্নতি অসম্ভব। সেইজন্যে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া উচিত।

চলল না কেন?

আমাদের শক্তি সীমিত বলে। যদি কখনও কম্যুনিস্ট পার্টি ক্ষমতায় আসে তখন দেখবে দেশের মানুষের অবস্থা পাল্টে যাবে।

তুমি কি মনে কর বিধানচন্দ্ৰ বায়ের ইমেজ, কংগ্রেসেব ইতিহাস ভুলে গিয়ে দেশেব মানুষ কম্যুনিস্টদের কখনও ক্ষমতায় আসার সুযোগ দেবে?

এখনই হয়তো নয়। কিন্তু একদিন হবেই।

কম্যুনিস্টরা এলে সব পাল্টে যাবে?

একটা রাজা কম্যুনিস্ট পার্টির সরকার হলে সীমিত ক্ষমতার মধ্যে নিশ্চয়ই কাজ করবে। মুশকিল হল ভারতবর্ষের সবকটি রাজ্য একই মানসিকতায় নেই। হলে অন্যরকম হত। তবে তার জন্যে হাত গুটিয়ে বসে থাকা বোকামি!

দীপা জানে এই তর্কের শেষ নেই। কিন্তু ছায়ার বিশ্বাস ওর কাছে সত্যি। আর কেউ যদি বিশেষ আদর্শে বিশ্বস্ত হয়ে কাজ করে যায় তাহলে তার সঙ্গে তর্ক করার কোন মানে হয় না। ছাত্র-ইউনিয়ন করার দৌলতে মায়ার একটাই সুবিধে হয়েছে। সবাই দূর থেকে ওকে নিয়ে নানান গালগল্প করে বটে। কিন্তু সামনাসামনি কেউ ঘাটায় না। একটি সুন্দরী মেয়ে সমস্ত নিয়ম ভেঙ্গে মাথা তুলে ঘুরে বেড়াচ্ছে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ার পর সঙ্গলোভী ছেলের দল অথবা ছিদ্রান্বেষীরা ওকে এড়িয়ে যায়। সাধারণ মেয়েদের ক্ষেত্রে ওরা কিন্তু সাহসী হয়। হয়তো মায়ার সম্পর্কে কোন রহস্য কেউ বোধ করে না বলেই অক্ষম তা ঢাকতে এড়িয়ে যাওয়া সুবিধে বলে মনে করে।

অসীমের সঙ্গে চেষ্টা করেও দীপা কথা বলতে পারেনি। সাধারণত যেখানে অসীম তার জন্যে অপেক্ষা করত। সেখানে ভুলেও আসে না। তাছাড়া ফাইনাল ইযারেব ছেলে বা আর নিয়মিত কলেজে আসছে না। ওদের পরীক্ষার দেরি নেই। অতএর কলেজে দেখা হবার জন্যে মন ছটফট করত। সেই সময় অসীম তাকে এড়িয়ে গিয়েছে। দেখা করার বাসনাটা প্ৰায় জেদে পৌঁছে যাচ্ছিল দীপার। সে ঠিক করেছিল ঠিকানা যোগাড় করে অসীমের বাড়িতে চলে যাবে। এখন পর্যন্ত কলকাতাতেও কোন সহপাঠিনীর ছেলেদের বাড়িতে একা যাওয়ার চল নেই। কিন্তু ছাত্র আন্দোলন, ধর্মঘট ইত্যাদির জন্যে শহরটার অবস্থা পাল্টে যাওয়ায় যে কদিন সময় চলে গেল তার মধ্যেই ওই জেদটা মরে গেল। ববং তার মনে হতে লাগল। কেউ যদি তাকে এড়িয়ে যেতে চায় তাহলে তার পেছনে ধাওয়া করা অত্যন্ত বোকামি। আত্মসম্মান থাকলে কোন মানুষ সেটা করতে পারে না।

কিন্তু অসীমের কথা ভাবলেই তার কষ্ট হয়। এসব কথা বলার মতো বন্ধু তার কেউ নেই। এখন পুরনো ঘরে ফিরে গিয়েছে সে। তার নতুন রুমমেট এসেছে। মেয়েটির নাম শাস্তা। হোস্টেলে জায়গা পায়নি বলে এতকাল এক আত্মীয়ের বাড়িতে ছিল। মেয়েটির নামের সঙ্গে স্বভাবের মিল খুব। এবং বাঙালি মেয়েদের যে স্বভাব সচরাচর দেখা যায় সেট। ওর মধ্যে একদম নেই। অকারণে কৌতূহল দেখায় না, অন্যের ব্যক্তিগত ব্যাপারে কোন প্রশ্ন করে না। দীপার পক্ষে ব্যাপারটা ভালই হয়েছে। কলেজে মায়ার সঙ্গে একধরনের বন্ধুত্ব তার আছে। কিন্তু সেটা ব্যক্তিগত কথা বলার নয়। বরঞ্চ ব্যক্তিগত কথা বলা যায় মায়ার মায়ের সঙ্গে। এখন মাসে একবার ওঁর কাছে যায় দীপা। একদিন গল্প করার সময় সে বলে ফেলল, জানেন মাসীমা, আমি একটা সমস্যায় পড়েছি। বুঝতে পারছি না। আমার কি করা উচিত।

মায়া যথারীতি বাড়িতে নেই। পাশের ঘর থেকে তোমাকের গন্ধ ভেসে আসছে। মায়ার মা বললেন, ওবে বাবা। তোমাদেবী আমলেব সমস্যা কি আমি বুঝতে পারব? অবশ্য আমার শুনতে আপত্তি নেই, তুমি বলতে পারো।

অসীমের সঙ্গে পবিচার্যার পরে যা ঘটেছিল প্রায় অকপটেই দীপা বলে গেল। প্ৰথম দিকে তার কিছুটা অস্বস্তি হচ্ছিল। কিন্তু মাসীমার মুখটা যখন বন্ধুর মত হয়ে গেল তখন আর আটকালো না। পুরোটা শুনে মাসীমা জিজ্ঞেস করলেন, একটা কথা পরিষ্কার বলা তো, তুমি কি ছেলেটাকে ভালবাসো?

দীপা জানতো এই প্রশ্নটা তাকে শুনতে হবে। সে নিচু গলায় বলল, বিশ্বাস ককান মাসীমা, ওর সঙ্গে যতদিন দেখা হত কোনরকম প্ৰতিক্রিয়া হয়নি। ওকে একজন ভাল বন্ধু বলেই মনে হত। এমন কি ও যখন আমার সঙ্গে শিলিগুড়িতে গিয়েছিল তখনও আমি ওর জন্যে কোনও টান অনুভব করিনি।

এখন?

দীপা জানলার দিকে তাকাল, তবিপবাঁ মাথা নাড়ল, আমার শুধু মনে হচ্ছে ও আমাকে ঠিক বুঝতে পারেনি। ও বিশ্বাস করতে চাইছে না। আমার বিয়ে হয়েছিল।

মাসীমা জিজ্ঞাসা করলেন ওকে বিশ্বাস করানোর জন্যে তুমি এত ব্যগ্র কেন?

দীপা চুপ করে রইল। মাসামা হাসলেন, তোমার উচিত এখন ওর সঙ্গে দেখা না করা। ভালবাসা এমন জিনিস লুকিয়ে রাখা যায় না নিজের কাছে। অনেকটা পক্সের মতো, ওষুধ খেলেও চামড়ার ফুটে বের হবেই। তেমনি নিজেই টের পেতে তুমি। বরং, এই ব্যাপারটা এখন যেমন চলছে চলুক! সময় বয়ে যেতে দাও। যদি তোমার ভেতর কিছু তৈরী হয়ে থাকে তাহলে সময় চলে গেলেও সেটা মুখ তুলবে। তোমার সম্পর্কে ওর আগ্রহ কতটা সত্যি সেটাও বুঝতে পারবে তখন।

এসব কথা দীপার অজানা ছিল না। কিন্তু মাসীমার সঙ্গে কথা বলার পর মন বেশ শান্ত হল। জানা জিনিসই অন্যের মুখে বন্ধুর মত শুনতে পেলে আর এক রকম মানে তৈরি হয়। হয়তো নিজের মন যা ভাবছে সেটা সঠিক কিনা তাতে একটা গোপন সন্দেহ থাকে। অন্যের সমৰ্থন পেলে এক ধরনের স্বস্তি তৈরী হয়। এই কারণে মানুষের জীবনে একজন বন্ধুর দরকার। তার জীবনে তেমন কোন বন্ধু ছিল না, মাসীমা আজ সেই কাজটা করলেন। ভদ্রমহিলা বললেন, তোমাকে দেখে মনে হয় তুমি বড্ড ভাবো। এটা তোমার স্বভাব। মায়াকে নিয়ে আমি তো কোন দুশ্চিন্তা করি না। ও যা করছে তা বাঙালি মেয়েরা করে না। তাই ধরাবাঁধা নিয়মে ওকে বেঁধে কি লাভ? আমার আত্মীয়স্বজনরা এ নিয়ে কম কথা বলছেন না। ওদের মতে মেয়েটা নষ্ট হয়ে গিয়েছে। আমি তবু মায়াকে কিছু বলছি না। এত ছেলের সঙ্গে মিশছে, কাউকে মন দিয়েছে কি না তাও জিজ্ঞাসা করিনি।

আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম।

কি বলেছিল?

বলেছিল মন নেবার মত যোগ্যতা কারো থাকলে তবে দেবার কথা ওঠে।

বোঝ। এ মেয়েকে আমি কি বোঝাব! তবে কি জানো, আমাদের এই সমাজব্যবস্থায় নিয়মের বাইরে গিয়ে বেশিদিন নিজেকে ঠিক রাখা মুশকিল।

মনের বোঝা অনেকটা কমে গিয়েছিল মাসীমার সঙ্গে কথা বলে। হালকা হয়ে হাস্টেলে ফিরে এসেছিল দীপা। এসে দেখল সুভাষচন্দ্র একজন বয়স্ক ভদ্রলোকের সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছেন। দীপা দাঁড়িয়ে পড়ল। সে বুঝতে পারছিল আর একটা ঢেউ উঠতে চলেছে। নিজেকে শক্ত করার চেষ্টা করছিল সে প্ৰাণপণে।

Category: সাতকাহন (১ম পর্ব) - উপন্যাস - সমরেশ মজুমদার
পূর্ববর্তী:
« ৩৭. তিনতলার ব্যালকনি
পরবর্তী:
৩৯. সুভাষচন্দ্র এগিয়ে এলেন »

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

বাংলা লাইব্রেরি : উল্লেখযোগ্য বিভাগসমূহ

লেখক ও রচনা

অনুবাদ সাহিত্য

সেবা প্রকাশনী

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

কোরআন

হাদিস

ত্রিপিটক

মহাভারত

রামায়ণ

পুরাণ

গীতা

বাইবেল

বিবিধ রচনা

বাংলা ওসিআর

Download Bangla PDF

হেলথ

লাইব্রেরি – ফেসবুক – PDF

top↑