বামন পুরাণ ০১-১০

বামন পুরাণ (পৃথ্বীরাজ সেন)
অষ্টাদশ পুরাণ সমগ্র অখণ্ড সংস্করণ
উপদেষ্টা– শ্রী নরেশচন্দ্র শাস্ত্রী
সম্পাদনা • পরিমার্জনা • গ্রন্থনা– পৃথ্বীরাজ সেন

আমরা উচ্চারণ করি ‘নারায়ণ নরোত্তম নর দেবী সরস্বতী’ এবং ব্যাসদেবকে নমস্কার করি। আমরা সর্বদা নমস্কার করি সেই বামনের ছদ্মবেশ ধারণকারী বিষ্ণুকে যিনি বলিরাজের স্বর্গ, মর্ত্য ও পাতাল পর্যন্ত বিস্তৃত রাজ্য গ্রহণ করে ইন্দ্রকে দিয়েছিলেন।

নারদ পুলস্ত্য ঋষিকে একসময় বামন পুরাণের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলেন। মহর্ষি নারদ বললেন–হে ব্রাহ্মণ! আমার মনের সন্দেহ নিরুপণের জন্য আমার জিজ্ঞাসা– কেন ভগবান বিষ্ণু বামনরূপ ধারণ করেছিলেন? প্রহ্লাদ দৈত্যবংশে শ্রেষ্ঠ সন্তান হয়েও কেন দ্বিজশ্রেষ্ঠ? আমার সন্দেহ নিরুপণ করুন কারণ আপনি জানেন দক্ষরাজের প্রিয়তমা কন্যা নিজের শরীর ত্যাগ করে গিরিরাজ হিমালয়ের ঘরে জন্মগ্রহণ করে পুনরায় দেবাদিদেব মহাদেবের পত্নীত্ব গ্রহণ করলেন। তিনি আরও জানতে চান তীর্থস্থানগুলির স্থানমাহাত্ম্য, দানের ফল এবং বিভিন্ন ব্রতের বিধিনিয়ম। মুনিবর পুলস্ত্য নারদের প্রশ্নের উত্তরে বললেন–তিনি বামন পুরাণের বিষয়বস্তু প্রথম থেকে শেষ অবধি বলবেন।

গ্রীষ্মকালের উপস্থিতি লক্ষ্য করে দেবী হৈমবতী মন্দার পর্বতে বসে মহেশ্বরকে বললেন– গ্রীষ্মকালের প্রচণ্ড বায়ুপ্রবাহ বশতঃ এই স্থানে দিনযাপন করা যাবে না। এর উত্তরে মহাদেব বললেন– আমার কোনো আশ্রয় নেই। সব সময় বনে ঘুরে বেরিয়ে কাল কাটাই। এরপর গ্রীষ্মকালটা অতি সহজেই ব্রহ্মতলে কাটিয়ে দিলেন শঙ্কর সতী।

এরপর বর্ষাকাল উপস্থিত হল, ঘোর মেঘের অন্ধকারে আকাশ আচ্ছন্ন হল। এরপর সতী তাঁর অন্তরের ভয়ের সঞ্চারের কারণ স্বরূপ মহাদেবকে বললেন– বর্ষাকালের উপস্থিতিতে প্রবল ঝড় প্রবাহিত হচ্ছে, তাই আমার ভয় হয়।

এরপর বর্ষাকালের স্বরূপ বর্ণনায় তিনি বললেন– নীল মেঘগুলিতে ঘনঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, ময়ূর কেকা শুরু করেছে, বৃষ্টির বিন্দুতে বক, হাঁসেরা মেঘের ভজনা করছে। বাতাসের আঘাতে কদম্ব, শাল, অর্জুন, কেতকী গাছের ফুলগুলি বাতাসের আঘাতে ঝরে পড়ছে। হাঁসেরা মেঘের ভয়ংকর গর্জন শুনে সরোবর পরিত্যাগ করে চলে যাচ্ছে। দুর্জন লোকের আচরণে সৎলোকেরা যেমন নিরাপদ নিশ্চিত আশ্রয় ছেড়ে চলে যায়, দেখা যাচ্ছে হরিণেরা দ্রুত অন্যত্র চলে যাচ্ছে তাদের খেলা ত্যাগ করে।

মেঘেরা ক্রমশ খুশিতে বনের দিকে ধাবিত হচ্ছে। সবুজ ঘাসের চাদরের মতো আকাশ মেঘের চাদরে ঢাকা পড়ে আছে। ঘাসের ফুলের মতো সূর্য মেঘাচ্ছন্ন হয়ে মলিন ভাবে বিরাজ করছে আর সুর্যের প্রতি মমতা বশতঃ আকাশে বিদ্যুৎ ঝলকাচ্ছে, নদী দ্রুত ধাবিত হচ্ছে, শাল গাছে পরিপূর্ণ স্থান। দেবীর কথা এযেন দুর্জন লোকের চিত্র স্বরূপ। অসতী নীচ মনোবৃত্তির নারী অসদাচরণ করে মেঘের আঁধারের আড়ালে। শালফুল, কদমফুল, শ্রীফুল, নদীর জল সরোবরের পদ্মের পত্র এই পরিপূর্ণ বর্ষায় প্রধান হয়ে উঠল। দেবী তাই বলেন মন্দার পর্বতে ঘর তৈরি করুন, যাতে রোদের উত্তাপে কষ্টদায়ক ঋতুতে শান্তিতে বাস করা যায়।

সতীর মধুর বচন শুনেও মহাদেব বললেন–যে-ঘর নির্মাণের মতো সঞ্চিত ধন তাঁর কাছে নেই। এরপর তাঁর দুরাবস্থা বোঝাতে বেশভূষার বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেন, বাঘছালে তিনি শরীর আচ্ছাদন করেন, সর্পরাজ তার উপবীত, পদ্ম ও বিঙ্গল নামক সাপ তাঁর কানের কুন্তল, কম্বল ও ধনঞ্জয় নামক সাপ তাঁর কেয়ূর রূপে শোভা পাচ্ছে। আর অশ্বতর ও তক্ষক নাগ তাঁর ডান ও বা হাতের কাঁকন। নীলাজ্ঞ পায়। এরপর সতী শঙ্কিত হয়ে পরেন পুলস্ত্যর কথা শুনে। এরপর সতী ক্রুদ্ধ হয়ে বিলাপ শুরু করেন এবং বেদনা, লজ্জা ও রাগে মুখ নিচু করে উত্তপ্ত নিঃশ্বাস পরিত্যাগ করেন। এরপর সতী মহাদেবের কাছে জানতে চান, তবে কি এই ব্রহ্মতলেই তাঁদের বর্ষাকাল অতিবাহিত করতে হবে? শঙ্কর এর উত্তরে বলেন যদি মেঘপুঞ্জের মধ্যে বাস করা যায় তাহলে আর শরীরে বৃষ্টির জল পড়বে না। পুলস্ত্য জানালেন, এরপর শঙ্কর সতীকে নিয়ে মেঘখণ্ডে আরোহণ করে বাস করতে শুরু করলেন এবং সেই থেকে তিনি ধরিত্রিবাসীর কাছে জীমূতকেতু নামে বিখ্যাত হলেন।

পুলস্ত্যের কথা অনুযায়ী, এরপর শরৎকালের আগমন হল। মেঘের ওপর বর্ষাকাল কাটানোর পর, শরৎকালের আগমনের সাথে সাথে আকাশের বাদলা মেঘ অদৃশ্য হল, গাছে মুকুলোদগম হল। নদীর তীরে দেখা দিল কাশফুল, জলাশয় পরিষ্কৃত হল, পদ্ম সুগন্ধীত হল, অগরু চন্দনের শীর্ষ সঞ্চার আরম্ভ হল, পদ্ম প্রস্ফুটিত হল, চন্দ্র কিরণের দীপ্তি বেড়ে উঠল, লতা ফুলে ভরে উঠল, গবাদি পশুরা আনন্দিত হল, সাধুরা সন্তুষ্ট মনে ঘুরে বেড়াতে লাগলো। সরোবরে পদ্ম, আকাশে তারারা, জলাশয়ের শুদ্ধতা, সাধুগণের হৃদয়ে মমতা সরলতা এবং জ্যোৎস্নার নির্মলতা বিরাজ করতে লাগল।

এই মনোরম সময়ে সতীকে মন্দার পর্বতে নিয়ে গেলেন মহাদেব। এরপর মহাদেব ও সতী মহা সুখে শরৎকাল অতিবাহিত করলেন সেই পর্বতের সমতল শিলাভূমিতে। শরৎ অতিবাহিত হবার পর প্রজাপতি দক্ষ ও বৈকুণ্ঠ অধিপতি বিষ্ণুর জাগরণের পর এক যজ্ঞের আয়োজন করে দ্বাদশ আদিত্য, ইন্দ্র প্রভৃতি দেবগণকে ও কাশ্যপপ্রমুখ ঋষিদের আহ্বান করলেন এবং যজ্ঞ ক্রিয়ার কর্মে নিয়োগ করলেন। এছাড়াও অন্যান্য কাজে নিয়োগ করলেন যথাক্রমে অরুন্ধতীর সঙ্গে পারদর্শী বশিষ্টকে, অনসূয়ার সঙ্গে অত্রিকে। ধৃতির সঙ্গে কৌশিকাকে, অহল্যার সঙ্গে গৌতমকে, মায়ার সঙ্গে ভরদ্বাজকে, চন্দ্রার সঙ্গে অঙ্গিরস ঋষিকে এবং বেদ-বেদান্ত পারদর্শী ঋষিগণকে। চন্দ্রার সঙ্গে অঙ্গিরসকে নিযুক্ত করলেন অরিষ্টনিসিক যজ্ঞের কাঠ, মিষ্টান্ন এবং পানীয় দ্রব্য সংগ্রহের ব্যাপারে, মহাত্মা ভৃগু পারদর্শিতার দরুন নিযুক্ত হলেন যজ্ঞ সংস্কারের কাজে। শুচি সহকারে ধনাধিপতিত্বে দক্ষ বরণ করলেন রোহিণীর সঙ্গে চন্দ্রদেবকে।

প্রজাপতি সকল কন্যা ও জামাতাকে যজ্ঞে আমন্ত্রণ করলেন। কেবল গৌরী ও শঙ্করকে বাদ দিয়ে। এর কারণ নারদ দক্ষের কাছে জানতে চাইলেন, কেন তিনি জ্যেষ্ঠ ও শ্রেষ্ঠ দেব মহাদেবকে যজ্ঞে আমন্ত্রণ করলেন না। পুলস্ত্য এর উত্তরে জানালেন, দরিদ্র হবার দরুণ দক্ষ জ্যেষ্ঠ ও শ্রেষ্ঠ মহাদেবকে যজ্ঞে আমন্ত্রণ জানাননি। পুনরায় নারদ জানতে চাইলেন, দেবরাজ নলপাণি ত্রিলোচন হওয়া সত্ত্বেও কিভাবে কপালী হলেন?

পুলস্ত্য নারদকে জানালেন, যে তিনি একথা স্বয়ম্ভু ব্রহ্মার আদিপুরাণ অনুযায়ী বলছেন। নিমজ্জিত হবার দরুণ সংসার তখন ছিল ভাবাভাবরহিত বিচার বিবেচনা শক্তির অগম্য ও অবিজ্ঞেয়। বৃক্ষ, তৃণ ছিল জলমগ্ন। এই দুর্দিনে সব তমসাচ্ছন্ন ছিল। হাজার বছর ধরে এই অন্ধকারে অনন্ত জলরাশির মধ্যে ভগবান বিষ্ণু নিশাকাল শুয়েছিলেন। রাত্রি অবসানে লোকনাথ দ্বারা, ব্রহ্মা সৃষ্টি পেলেন এবং বিশ্বচরাচরের সৃষ্টিকর্তা বেদবেদাঙ্গ পারদর্শী অদ্ভুত দর্শন পঞ্চানন ব্রহ্মা প্রকাশিত হলেন। এরপর আবির্ভাব ঘটল তমাময় ত্রিলোচনের। তিনি ধারণ করলেন শূল, জটা ও অক্ষমালা। এরপর ব্রহ্মা ও শঙ্কর ভগবান বিষ্ণু সৃষ্ট অহঙ্কারের বশীভূত হলেন।

মহাদেব তখন অহঙ্কারে আবেশ হয়ে ব্রহ্মার কাছে জানতে চাইলেন, তিনি কে? কে তাকে এখানে এনেছে? কে তাকে সৃষ্টি করেছে? ব্রহ্মাও অহঙ্কারে উদ্ধত হয়ে জানতে চাইলেন মহাদেব কে? তার পিতা-মাতাই বা কে? পুলস্ত্য নারদকে জানালেন এইভাবেই উৎপত্তি নিয়ে ব্রহ্মা ও শঙ্করের মধ্যে বিবাদ দেখা দিয়েছিল। তিনি এও জানালেন সেই সময়ই নারদের উৎপত্তি হয়। জন্মাবার সঙ্গে সঙ্গে সুন্দর বীণা ধারণ করে কিল কিল শব্দ করতে করতে আকাশে উৎপত্তি হলেন এবং রাহুকবলিত চাঁদের মতো শঙ্কর ব্রহ্মার কাছে পরাজিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। এর চক্রাধান্ধ পরাজিত রুদ্রকে ব্রহ্মা বললেন, তিনি তাকে চেনেন। তিনি তমোমূর্তি, ত্রিলোচন, দিগম্বর বৃক্ষরোহী ও লোকসংহারকর্তা। এরপর চোখ রাঙিয়ে শংকরব্রহ্মার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন যেন তিনি জগৎ দগ্ধ করে দিতে চান।

সেই সময় সাদা-নীল, নীল, মিশ্র ও সোনার মতো বর্ণে রঞ্জিত পাঁচটি বস্তুর উৎপত্তি হল ত্রিলোচন এবং তিনি বীভৎস আকৃতি ধারণ করলেন। এর ফলে ব্রহ্মা শঙ্করের পরাক্রম দেখাবার জন্য উদ্দিপ্ত করে তাঁকে জড়বুদ্ধিতে অভিভূত করলেন। এর ফলস্বরূপ ক্রুদ্ধ শঙ্কর নখের অগ্রভাগ দিয়ে ব্রহ্মার মস্তক ছেদন করলেন। শঙ্কর তাঁর বাম করতলে সেই ছিন্ন মস্তককে সংলগ্ন করলেন। যা কখনই করতল বিচ্যুত হল না। ব্রহ্মা তখন ক্রোধান্বিত হয়ে এক বীরপুরুষের জন্ম দিলেন। যিনি কবচকুণ্ডল ও শরধারী, মহাবাহু, অক্ষয়ন বাণশক্তি ধর, চতুর্ভুজ মহাতুণী ও আদিত্যের মতো বীর্যবন্ত। বীরপুরুষ তখন মহাদেবকে বললেন–যে, তাকে তিনি হত্যা করবেন না কারণ তিনি পাপী, পাপীকে হত্যা তিনি করবেন না। পবিত্রসলিলা সরস্বতী নদী বয়ে চলেছে নারায়ণ স্থান বদরিকাশ্রমের পাশ দিয়ে সেই স্থানে পার্বতী ও মহেশ্বর চলে গেলেন বীর পুরুষের কথা শুনে। সেই স্থানে গিয়ে শঙ্কর ভগবান নারায়ণের কাছে ভিক্ষা চাইলে নারায়ণ মহেশ্বরকে বললেন, ত্রিশুল দিয়ে তাঁর বামহাতে আঘাত করতে।

এরপর ত্রিশূল দিয়ে মহেশ্বর নারায়ণের বাম হাতে আঘাত করলে তা থেকে তিনটি রক্ত ধারা প্রবাহিত হল যার একটি নক্ষত্ররাশি পরিবেষ্টিত আকাশে আশ্রয় গ্রহণ করল। দ্বিতীয় ধারা পৃথিবীতে ঋষিগণ গ্রহণ করলেন। যার থেকে অত্রি ঋষি ও দুর্বাসা ঋষি উদ্ভূত হলেন। তৃতীয় ধারা ভীষণ দর্শন মহেশ্বরের কপালে পতিত হল। যা থেকে এক যুবা বীরপুরুষ আবির্ভূত হল। কবচধারী এই বীরপুরুষ তখন ধনুর্বাণ হাতে নিয়ে মেঘের মতো গর্জন করে বলল, কার কাধ থেকে তাল ফলের মতো মাথা বিচ্ছিন্ন করবো।

শংকর সৃষ্ট এই বীরপুরুষ তখন ব্রহ্মার সৃষ্ট বীরপুরুষের পরিচয় দিয়ে বলল, এই পুরুষ শতসূর্যের মতো জাজ্বল্যমান এক দস্যুকে বিনাশ করো। সেই বীর সঙ্গে সঙ্গে তখন অক্ষয় বাণ নিয়ে প্রসিদ্ধ ধনুতে সংযোগ করে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হল। এরপর এই দুই বীরপুরুষের মধ্যে সহস্র বৎসর ধরে ঘোরতর যুদ্ধ হল। এরপর শঙ্কর ব্রহ্মাকে জানালেন অসাধারণ বাণ নিক্ষেপকারী আপনার পুত্র নারায়ণের বাহুজাত বীরপুরুষ মহাবাণের দ্বারা পরাজিত হয়েছেন। ব্রহ্মা তখন মহেশ্বরকে জানালেন, এই অজেয় বীরপুরুষ আমার বীরপুরুষের কাছে পরাজিত হয়েছে। এরপর ব্রহ্মা সূর্যমণ্ডলে ও শঙ্কর বীরপুরুষকে ধর্মপুত্র পরায়ণের বিগ্রহে নিক্ষেপ করলেন।

পুলস্ত্য জানালেন, এই দারুণ নরকপাল রুদ্রের করতলে লেগে থাকার ফলে তিনি চিন্তিত ও সন্তপ্ত হয়ে পড়লেন। তখন এক ভয়ঙ্কর দৃশ্য নীলাচলের মতো বৃহৎ পিঙ্গল কেশধারী ব্রহ্মহন্তক শঙ্করের কাছে এলো। তখন এই ভয়ঙ্কর মূর্তিকে শঙ্কর বললেন, কেন তিনি তাঁর কাছে এসেছেন। তখন সেই মূর্তি জানালেন তিনি ব্রহ্মহত্যা এবং তিনি ত্রিশূল পানি রুদ্রদেবের শরীরে প্রবেশ করবেন। যমুনা নদীতে যখন চিন্তিত শোকাছন্ন মহাদেব স্নান করবার জন্য গেলেন তখন ধর্মপুত্র নারায়ণ ঋষির দেখা না পেয়ে তখন যমুনা নদীর জল শুকিয়ে গেল। তখন মহাদেব বৃষে আরোহণ করে সরস্বতী নদীতে স্নান করতে গেলেন। এরপর সরস্বতী নদী অদৃশ্য হলে পুরষ্কারারণ্য, মাগধারণ্য ও সৈন্ধবারণ্যে গিয়ে নিজের মনের মতো স্নান করলেন। এরপর তিনি ধারণ্যে ও নিমিষারণ্যে গিয়ে স্নান করলেন। তথাপি ব্রহ্মহত্যা তাকে ত্যাগ করল না। বিবিধ রকম ব্রত পালন, আশ্রম দেবালয়ে গিয়ে স্নান করেও ব্রহ্মহত্যা পাপ থেকে মুক্তি লাভ করলেন না। এরপর শঙ্কর হে দেবতা নাথ বলে কুরুজঙ্গল গিয়ে আকাশের মধ্যে শঙ্খচক্রগদাধারী পদ্মলোচন নারায়ণের স্তব করতে লাগলেন।

স্তব করতে করতে বললেন– আপনি সকলের আশ্রয় স্বরূপ ও অন্তর্যামী। আপনি গুণাতীত ও রজোগুণ সম্পন্ন। আপনি সমস্ত চরাচর সৃষ্টি করেছেন। আপনি সত্ত্বগুণান্বিত ও তমোমূর্তি সম্পন্ন, আপনার ক্রোধাংশ অহংভাব উৎপন্ন করে। মহাদেব বলেন যে নারায়ণ পৃথিবী, অনল, সলিল ও আকাশ, বায়ু বুদ্ধি মন, ধর্ম যজ্ঞ তপস্যা, সত্য, অহিংসা, শৌচ সরলতা ক্ষমা দান, দয়া, লক্ষ্মী, ব্রহ্মচর্য এবং ঈশ্বর তিনি চতুর্বেদ ও বেদ। প্রতিপাদ্য বস্তু বেদ পারদর্শী ও উপবেদ, ঈশ্বর ও সমস্ত মহাদেব তাকে নমস্কার করে বলেন আপনি সংসারের সবার প্রতি দয়ালু আমাকে পাপ বন্ধন থেকে মুক্তি দিন। আমার অমঙ্গল নাশ করে ব্রহ্মহত্যা পাপজনিত অন্তর দহন থেকে আমাকে রক্ষা করুন।

পুলস্ত্য জানালেন, নারায়ণ এরপর শঙ্করকে তার কথা মন দিয়ে শুনতে বললেন, তাহলেই তাকে ব্রহ্মহত্যা পাপ থেকে মুক্ত করবেন। তিনি এও বললেন–যে, তাঁর কথা অনুধাবন করলে মহাদেবের পাপ ক্ষয় হবে, পুণ্যকাল বাড়বে ও তাঁর কল্যাণ হবে। তিনি জানালেন প্রয়াগ নামক পুণ্যক্ষেত্রে তাঁর দেহ উৎপন্ন এক অক্ষয় পুরুষ সর্বদা যোগনিদ্রায় শয়ন করেন যার ডান পা থেকে বরণা নদী নির্গত।

এই নদী সকল পাপের ক্ষয় করে মানুষের মঙ্গল বিধান করে। তাঁর বাম পা জাত আম নামক প্রসিদ্ধ নদী। এই উভয় নদীই সকলের কাছে পূজনীয়। এই দুই নদীর মধ্যেকার পাপ বিনাশক ত্রিলোক শ্রেষ্ঠ তীর্থস্থানে ভগবান যোগনিদ্রায় শয়ন করেন। ভগবান কেশব এই তীর্থের নিকটস্থ বারাণসী নামক পুণ্যধাম নগরে বাস করেন। এই স্থানে বিলাসিনী রমণীরা কাঞ্চীধ্বনির সাথে ব্রাহ্মণদের দেবগান স্বর মিশ্রিত মধুর রূপ উৎপন্ন হওয়ার দরুণ কুরুগণ বারবার হাসেন। এই স্থানে বাস করলে জনগণ আপনার মধ্যেই লীন হয়ে যায়, মহেশ্বরকে জানালেন একথা। এই স্থানের নারীদের আলতাচিহ্ন দেখে চাঁদও আশ্চর্য হয় স্থলপদ্ম বলে ভ্রম করে। এই স্থলে সূর্যরশ্মি বাধা পায় দিনের বাতাসে সঞ্চারিত সুদীর্ঘ পতাকাগুলিতে এবং রাত্রিতে চাঁদের কিরণ বাধা পায় উঁচু চুড়াতে। প্রলুব্ধ ভ্রমরেরা আকৃষ্ট হয় শ্বেতপদ্ম রূপে ভ্রমবশতঃ চাঁদের মতো সুন্দর অট্টালিকা দেখে।

এখানে জলাশয়ে জলকেলিরত পরীদের সাথে খেলাতে পরাজিত পুরুষরা ক্লান্ত তো হয়ই না বরং নারীদের কোন রূপ বিরূপ মন্তব্যও করে না, আসক্তিও প্রকাশ করে না। এখানে দেবালয়ের প্রবেশপথ বাতাসের সঞ্চালনে রুক্ষ হয় না। নারীদের প্রতি রতি প্রবৃত্তির সংযম হেতু কেউ অত্যাচার করে না। নারায়ণ এও বললেন–যে, এখানে বিলাসিনী রমণীরা মহাদেবের মতো মহানায়কের সঙ্গে মিলিত হয়ে চিকন শরীর লাভ করে। তিনি এও বললেন–যে, সুরশ্রেষ্ঠ মহাদেব এখানে গেলেই ব্রহ্মহত্যা পাপ থেকে মুক্ত হতে পারবেন। এরপর বৃষরোহী মহেশ্বর নারায়ণের কথা শুনে পাপ মুক্তির আশায় ভগবানকে প্রণাম করে গরুড়ের গতি নিয়ে বারাণসী যান এবং মহাদেব বারাণসীতে গিয়ে দশাশ্বমেধঘাট দেখেন ও তীর্থে স্নান করে ভগবান কেশবকে দেখার জন্য গেলেন ও তাকে হৃষিকেশ বলে সম্বোধন করলেন। তিনি জানলেন যে তাঁর অনুগ্রহেই মহাদেবের ব্রহ্মহত্যা জনিত পাপ ক্ষয় হয়েছে। তিনি মহাদেব কেশবের কাছে জানতে চাইলেন যে তথাপি তার হাত হতে কেন নরকপাল স্খলিত হচ্ছে না। এরপর কেশব তাঁকে সবিস্তারে জানালেন, তাঁর সমান পদ্মশোভিত দেবতা ও গন্ধবদের নিকট আদরণীয় পরম পবিত্র হ্রদে পুণ্য করলে তাঁর হাত হতে নরকপাল খসে পড়বে।

এর ফলে ঐ স্থান তীর্থস্থান বলে পরিগণিত হবে এবং রুদ্রদেব পৃথিবীতে কপালী নামে প্রসিদ্ধ হবেন। এরপর মহেশ্বর নরকপাল মুক্ত করার জন্য কেশবের কথানুযায়ী বেদ শাস্ত্রের নিয়মানুযায়ী স্নান করলেন। এর ফল স্বরূপ মহেশ্বর নরকপাল মুক্ত হলেন এবং তীর্থস্থানটি কপাল মোচন নামে বিখ্যাত হল।

পুলস্ত্য এরপর নারদকে বললেন, এইভাবে কপালী বলে পরিচিত হবার জন্য প্রজাপতি দক্ষ তাঁকে আমন্ত্রণ করেন নি। গৌতম কন্যা জরা যখন সতীর সাথে সাক্ষাতের জন্য মন্দার পর্বতে এলেন তখন সতী তাঁর কাছে জানতে চায় কেন বিজয়া, জয়ন্তী ও অপরাজিতা আসেননি? তখন জয়া জানায়, তাঁরা আমন্ত্রণ রক্ষার্থে গৃহস্বামীর গৃহে গেছে। অহল্যা ও গৌতমও গেছেন। সতী সেখানে যেতে ইচ্ছা প্রকাশ করে কিনা তা জানতে জয়া এসেছে। জয়া জানতে চায় যে এই চতুর্দশ ভুবনের সমস্ত প্রাণী, ঋষি, ঋষিপত্নীগণ, দেবতারা এমনকি মাসীরা সকলে, চন্দ্রদেব ও তাঁর পত্নী ঐ যজ্ঞস্থলে গেছেন। তবু কেন তাঁরা আমন্ত্রণ পাননি? কেন মহেশ্বর নিমন্ত্রিত নন?

এইভাবে দেহ ত্যাগ করতে দেখে জয়া শোকে কাতর স্বরে কাঁদতে লাগল। এই ক্রন্দন শুনে শুলপানি মহাদেব জয়ার কাছে এলেন তার কান্নার কারণ জানতে। এসে দেখলেন কুঠারাঘাত ছিন্ন ভুলুণ্ঠিত লতার মতো সতীও ভুলুণ্ঠিত হয়ে আছে। সতীর এই দুর্দশার কথা জানতে চাইলে জয়া জানালেন যে, প্রজাপতির গৃহের যজ্ঞে ইন্দ্র প্রভৃতি দেবগণ, আদিত্যগণ ত্রিভুবনের সকলে নিমন্ত্রিত। নারীরা সকলে তাদের স্বামীসহ নিমন্ত্রিত কেবল তারা নন, একথা শুনে সতীর শোকে এই দশা হয়েছে।

পুলস্ত্য নারদকে জানালেন, যে জয়ার কথা অনুধাবন করার সাথে সাথে মহেশ্বর রুদ্রমূর্তি ধারণ করলেন। তাঁর সমস্ত শরীর থেকে আগুনের শিখা বেরোতে লাগল। তাঁর নোম থেকে বহু অনুচর ও তাদের দলপতিস্বরূপ সিংহ মুখাকৃতি বীরভদ্র নামক পুরুষ আবির্ভূত হল। অনুচরদের সাথে বীরভদ্র দক্ষ যজ্ঞে গেলেন। মন্দার পর্বত হতে হিমালয় ও কনখল থেকে তার নির্গত হয়ে যজ্ঞস্থানের উত্তরে দাঁড়ালেন।

যজ্ঞের পূর্ব-দক্ষিণ দিকে গদা হাতে জয়া ও মহাদেব রুদ্রমূর্তি ধারণ করে যজ্ঞের মাঝে দাঁড়ালেন। তখন ঋষিগণ, গন্ধর্বগণ ও ইন্দ্রদেবগণ চিন্তিত হয়ে উঠলেন। ধর্মদেব এমতাবস্থায় তির ধনুক সহকারে সাপের মতো বীরভদ্রের দিকে ছুটলেন। বীরভদ্রও তখন চার হাতে যথাক্রমে ত্রিশূল, ধনু, বাণ ও গদা গ্রহণ করে ধর্মরাজের দিকে ধাবিত হলেন। বর্ষাকালের বারিধারার মতো ধর্মরাজের দিকে অনর্গল শর বর্ষণ করলেন। ধর্মরাজও নানারূপ অস্ত্র খঙ্গ, গদা, পাশ, কুঠার, অঙ্কুশ, ধনু ও শর গ্রহণ করে বীরভদ্রকে বধকল্পে অবতীর্ণ হলেন, ক্রোধান্বিত এই দুই বীরপুরুষের রক্তাক্ত শির পলাশ ফুলসম হয়ে উঠল। ধর্মরাজ বীরভদ্রের কাছে পরাজিত হলেন এবং বীরভদ্র যজ্ঞস্থানে প্রবেশ করল। বীরভদ্রকে দেখে অষ্টবসু, সুদারান নবগ্রহ, দেবগণ, দ্বাদশ আদিত্য, একাদশ রুদ্র বিশ্বদেবগণ, সাধ্যগণ, সিদ্ধ গন্ধর্ব পন্নগগণ, যক্ষগণ, কিম্পুরুষগণ, পক্ষীগণ, চক্রধরগণ, বিবস্বত বংশজাত রাজা, ধর্মকীর্তি, সোমবংশজাত মহাবাহু ভোজকীর্তি, দৈত্যগণ, দানবগণ ও অন্যান্য সকলে অস্ত্রসস্ত্র গ্রহণ করে ছুটে গেলেন।

বীরভদ্রও ধনুর্বাণ গ্রহণ করে সকলকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। অস্ত্র নিক্ষেপ করে তাঁদের বিদ্ধ করতে লাগল। দেবতারা বীরভদ্র কর্তৃক শর বিদ্ধ হয়ে বারবার পরাজিত হয়ে জয়ের আশা পরিত্যাগ করে রণে ভঙ্গ দিলেন। এরপর বীরভদ্র যজ্ঞস্থানে গিয়ে ঋষিদের যজ্ঞে আগুনে ঘৃতাহুতিতে ব্যাঘাত ঘটালেন। তাকে দেখে বৈকুণ্ঠপতি মহর্ষিদের আশ্বস্ত করে বীরভদ্রকে হত্যা করার জন্য অস্ত্র ধারণ করে সর্পসম তীব্র বাণ নিক্ষেপ করলেন।

শ্রীহরির এই বাণ বীরভদ্রর দেহ স্পর্শ করেই ভূপতিত হল। এরপর কেশব দিব্য অস্ত্রের দ্বারা বীরভদ্রকে বধ করতে উদ্যত হলেন। শূল, গদা ও শর দ্বারা বীরভদ্র গদাধরের প্রক্ষিপ্ত অস্ত্রকে নিবারণ করলেন। এরপর মাধব গদা নিক্ষেপ করলেন। বীরভদ্র গদার অভিঘাত নিবারণ করলেন। এরপর শ্রীহরির লাঙ্গলকেও বীরভদ্র গদা দ্বারা নিবারণ করলেন। একে একে লাঙ্গল, মুষল ব্যর্থ হবার পর শহরি চক্র নিক্ষেপ করলেন। বিষ্ণু মৎস্য রূপ ধারণ করে মধু নামক দানবকে যেভাবে বধ করেছিলেন তেমনি শতসূর্যসম দীপ্তিময় চক্রকেও বীরভদ্র প্রতিহত করলেন।

চক্রর অবস্থা দেখে শ্রীহরি ক্রোধে রক্তাক্ত হয়ে উঠলেন। গণপতিকে ধরে মাটিতে পিষতে লাগলেন। শ্রীহরির বাহু ও উরুর পেষণে গণপতির মুখ থেকে রক্ত ও তার সাথে চক্র বেরিয়ে আসতে লাগল, যা দেখে শ্রীহরি তাকে পরিত্যাগ করলেন। পরাজিত বীরভদ্র এরপর মহেশ্বরের কাছে তার পরাজয়ের কথা জানালেন। রক্তে রাঙা গণপতিকে দেখে ক্রোধান্বিত মহেশ্বর অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সাপের মত নিঃশ্বাস ফেলে যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হলেন। মহাদেব নিজে যজ্ঞস্থলে প্রবেশ করলেন বীরভদ্র ও ভদ্রকালীকে প্রবেশ করার আদেশ দিলেন। এরপর ঋষিগণের মনে ভয়ের সঞ্চার হল যখন তারা দেখল মহাদেব কর্তৃক দক্ষযজ্ঞ ভঙ্গ হয়ে যাচ্ছে। হরি এরপর কুজাহ্মকাননে আশ্রয় নিলেন ক্রোধান্বিত রক্ত চক্ষু মহাদেবকে দেখে সীতা নামক এক পবিত্র নদীতে গেলেন। অষ্টবসুগণ সেখান থেকে পলায়ন করে। এরপর শঙ্করের মধ্যে বিলীন হলেন। বৃষারোহী ত্রিনয়ন রুদ্রগণ, বিশ্বদেবগণ, অশ্বিনীকুমারদ্বয়, সাধুগণ, মরুদগণ, অনল ও আদিত্যগণ পলায়ন করলেন। চন্দ্রদেব তখন যজ্ঞভূমি রাত্রির অন্ধকারে ঢেকে দিয়ে তারকাদের সাথে দ্রুত আকাশপথে আরোহণ করে নিজস্থানে চলে গেলেন। দুই হাতে ফুল নিয়ে কশ্যপ প্রভৃতি ঋষিগণ ভয়ে শতরুদ্রিয় মন্ত্র জপ করতে করতে প্রণামের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইলেন।

দক্ষপত্নীরা প্রবল, পরাক্রমশালী রুদ্রকে দেখে ইন্দ্র ও দেবতাদের নাম উচ্চারণ করে বিলাপ করতে লাগলেন। শঙ্কর এরপর করতলের আঘাতে অনেক দেবসৈন্য বধ করলেন। মহাদেবের ত্রিশূলাঘাত ও পদাঘাতে দেবতাদের অনেকে মারা গেলেন। অনেকে তার দৃষ্টিপাতে ভস্মীভূত হল। শঙ্করের হাতে দেবতা ও ঋষিগণকে নিহত দেখে সূর্যদেব দুইহাত প্রসারিত করে ছুটে গেলেন। নিজের এক হাত দিয়ে মহাদেব পূষার দুই হাত চেপে ধরলেন। এই রূপ নিগ্রহের ফলে তার দুহাতের আঙুল দিয়ে রক্তধারা গড়িয়ে পড়তে লাগল। কিরণমালাধারী সূর্যদেবকে ধরে সিংহের হাতে মৃগশাবকের ন্যায় প্রবলবেগে চারিদিকে ঘোরালেন। এর ফলে তার স্নায়ু ছিঁড়ে গেল এবং হাত ছোট হয়ে গেল। তিনি রক্তস্নাত হয়ে গেলেন। মহেশ্বর তাঁকে ছেড়ে তখন অন্যত্র চলে গেলেন। এরপর পূষার পুনরায় তাকে অবজ্ঞা ভরে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আহ্বান করলে তাঁর দুর্ব্যবহারে মহেশ্বর পূষার দাঁত ভেঙ্গে মাটিতে ফেলে দিলেন। পূষার দাঁত ভেঙ্গে যাবার পর তিনি জ্ঞান হারিয়ে রক্তরাঙা মুখে চৈতন্য লোপ পেয়ে বজ্রাহত পর্বতের মতো মাটিতে পড়ে গেলেন। ভগদেব পূষার এই অবস্থা দেখে রক্ত চোখে মহেশ্বরের দিকে তাকাতে লাগলেন। এর ফলে মহেশ্বর ভগদেবের চোখ উপড়ে ফেললেন।

এইরূপে সকলে রুদ্রের হাতে নিগৃহীত হয়ে ইন্দ্র প্রভৃতি আদিত্যগণ ভীত হয়ে দশদিকে পলায়ন করলেন। মরুৎগণ ও হুতাশনের সাথে সকলে পলায়ন করার পর প্রহ্লাদ ও হিতশ্বরগণ রুদ্রকে প্রণাম করে জোড়হাতে দাঁড়ালেন। রুদ্রদেব দেবতাদের দগ্ধ করার জন্য সেদিকে তাকালে অনেক বীরপুরুষ ভয়ে বিলীন হয়ে গেলেন। অনেকে প্রাণ ভিক্ষা চাইল, কেউ পালাল, তাঁর রুদ্র দৃষ্টিপথে পড়ে কেউ মারা গেল।

অগ্নিগণ ত্রিলোচনের দৃষ্টির পথে পড়ার সাথে সাথেই ভস্মীভূত হলেন। নিজেদের খারাপ সময় উপস্থিত হয়েছে বুঝে অগ্নি বিনষ্ট হবার সাথে সাথেই যজ্ঞও জ্যোতির্ময় মৃগের রূপ ধরে দক্ষিণাসহ ধীরগতিতে আকাশপথে গমন করলেন। তখন ধনু হাতে নিয়ে সেই মৃগের পিছনে মহেশ্বর ছুটলেন তাতে পশুপত শর যোজনা করে। তাঁর দেহ তখন দুভাগ হয়ে গেল। এই দুই দেহের একটি যজ্ঞস্থলে জটাধর ও অপরটি আকাশপথ কালরূপী শব নামে খ্যাত করলেন। এরপর নারদ পুলস্ত্যের কাছে কালরূপী মহেশ্বরের স্বরূপ লক্ষণগুলি জানতে চাইলেন। পুলস্ত্য তখন কালরূপী রুদ্রের লোক কল্যাণে আকাশপথ পরিব্যাপ্ত স্বরূপ বর্ণনা করলেন। কালরূপী শঙ্করের মস্তক বলে বিখ্যাত অশ্বিনী, ভরনী, ও কৃত্তিকার প্রভাবিত মেষরাশি অবস্থিত মঙ্গলের ক্ষেত্রে। শুক্রাচার্যের গৃহ কৃত্তিকার তিন পাদ এবং রোহিণী ও মৃগ শিরার পূর্বাধ বৃষরাশি যদিও এটি তার বদন রূপে খ্যাত। মহেশ্বরের দুটি হাত রূপে প্রসিদ্ধ মৃগশিরার শেষার্ধ আদ্রা ও পুনর্বাসুর তিন পাদ মিথুনরাশি, যা বুধের গৃহ। মহাদেবের শরীরের দুপাশ হল চন্দ্রের গৃহ রূপ, পুনর্বাসুর একপদে, পুষ্যা এবং অশ্লেষা লক্ষপদ কর্কটরাশি মহেশ্বরের হৃদয় হল সূর্যের গৃহ রূপ মঘা, পূর্বফাল্গুনী ও উত্তর ফাল্গুনীর একপাদ সিংহরাশি মহেশ্বর জঠর হল উত্তর ফান্ধুনীর তিন পদে, হস্তা ও চিত্রার অধিভাগ কন্যারাশি যা বুধের দ্বিতীয় কর্মস্থান, মহেশ্বর নাভি চিত্রার শেষার্ধ। স্বাতি এবং বিশাখার তিন পাদ তুলা রাশি বা শুক্রের দ্বিতীয় গৃহ। মহেশ্বর জননেন্দ্রিয় বিশাখার একপাদ অনুরাধা এবং জ্যোয় বৃশ্চিকরাশি এই রাশি দ্বিতীয় ভৌম গৃহ। তার দুটি উরু মূলা, পূর্বাষাঢ়া ও উত্তরাষাঢ়ার এক পাদ ধনুরাশি যা বৃহস্পতির গৃহ। শনির স্থান উত্তরাষায়ার তিন পাদ, শ্রবণা ও ধনিষ্ঠার প্রহসম্বা মকর রাশি শঙ্করের দুটি জানুরূপে বিদিত। শঙ্করের জঙ্ঘা হল ধনিষ্ঠার অপরাধ, শতভিষাও পূর্বভাদ্রপদের তিন পদ কুম্ভ রাশি যা শনির অপর গৃহ। পদদ্বয়রপে পরিচিত

এরপর ত্রিলোচনের ক্রোধভরা নিক্ষিপ্ত তির দ্বারা দক্ষযজ্ঞ বিধ্বস্ত হয়ে গেল, কিন্তু যজ্ঞ পুরুষ কিছুমাত্র বেদনা অনুভব করলেন না। শঙ্করের শরে বিদ্ধ হয়েও তার শরীর তারকারাশিতে পরিবেষ্টিত হল এবং তিনি আকাশপথে অবস্থান করতে লাগলেন।

নারদ এরপর পুলস্থ্যের কাছে এই বারোটি রাশির বিশদ প্রকৃত লক্ষণগুলি জানতে চাইলেন। পুলস্ত্য এরপর এই রাশিগুলির স্বরূপ বর্ণনা করে বললেন– প্রথম রাশি মেষ চর অর্থাৎ বিচরণশীল ও গতিশীল, এটি মেষাকৃতি। এই রাশি নিত্য বিচরণ করে ধন, রত্নরাজি ও নতুন তৃণরাশি শোভিত মনোরম নদীতীরে আজও মেষের সাথে তার বাস। বৃষ স্থির রাশি বা নিজের মতো প্রকৃতি সম্পন্ন গবাদি প্রাণীর মধ্যে বিচরণ করে। এ কৃষিক্ষেত্রে বাস করে। শয্যাসন আশ্রয় রূপে গ্রহণ করে স্ত্রী পুরুষের অবস্থান বীণাবাদনে পটু, রতি ক্রীড়াতে অনুরক্ত, গীত, নৃত্য ও শিল্প ব্যাপারে এর স্থির ও

কাঁকড়ার মত আকৃতি কর্কট রাশির। এটি জলমধ্যে যাতায়াত করে। এ জমির আলে, পুকুর, নদীতীর ও নির্জন স্থানে বাস করে। সিংহ রাশি সিংহের রূপধারি। এর বসবাস পর্বত, বন, গুহা, দুর্গ, ব্যাধপল্লী, পর্বতগুহা ও গহ্বরে এর বসবাস। অলঙ্কার ও প্রদীপধারী কন্যার মতো দেখতে কন্যারাশি। এর স্থির ও বিচরণশীল দুটি রূপ আছে। এর বাস রমণীজনের রতিস্থানে ও নলখাগড়াতে।

তুলাদণ্ডধারী পুরুষের মতো তুলা রাশির আকৃতি যা বিচরণশীল। এর সঞ্চরণ ক্রয়-বিক্রয় স্থানে ও বাস রাজপথ ও গৃহে। বিছাকৃতি হল বৃশ্চিক রাশি যা স্থির। এর গমনস্থান উইপোকার গর্ত ও বাস বিষ, গোবর, কীট ও পাথরে। ধনুধারী ধনুরাশি স্থির ও বিচরণশীল, যার অর্ধেক শরীর মানুষের মতো, এর বাকিটা ঘোড়ার মতো। এর ঘোড়া, বীরপুরুষ ও অস্ত্রশস্ত্র বিষয়ে বিশেষ নিপুণ। এর বাস গতি ও রথের মধ্যে। মকর বিচরণশীল রাশি যা মৃগমুখী কাঁধ, বৃষের ন্যায়, চোখ হাতের ন্যায়, নদীতে এর সঞ্চরণ ও সমুদ্রে এর বাস। শূন্য কলসী কাঁধে জলমধ্যে অবস্থানকারী পুরুষের মতো আকৃতি কুম্ভরাশির। পাশাখেলাতে এর সঞ্চরণ এবং গুঁড়িখানাতে এর বসতি। মীনের আকৃতি মৎস্যযুগলের ন্যায়। এই রাশি স্থির ও বিচরণশীল রূপে আছে। এটি তীর্থস্থানে ও সমুদ্রের জলে সঞ্চরণ করে এবং পবিত্র স্থানে ও দেবতা ব্রাহ্মণদের গৃহে বাস করে। পুলস্ত্য বললেন, এই বারোরাশির সমস্ত লক্ষণ বললাম, এইসব কথা আর কারো কাছে বোলোনা। এই তত্ত্ব প্রাচীন ও গোপন। আমি ভগবান ত্রিলোচনের দক্ষযজ্ঞের ধ্বংসর কথা বললাম যা খুবই পুণ্যজনক ও প্রাচীন যা শুনলে সমস্ত পাপ দূর হয় বা কল্যাণ লাভ করা যায়।

পুলস্ত্য এরপর নারদকে বললেন–প্রাচীনকালে বহচ নামে এক ব্রাহ্মণ ছিলেন। ধর্মের অবতার ছিলেন তিনি। তাঁর ভার্য্যা অরিংসা যার গর্ভে ব্রাহ্মণের চার পুত্র জন্ম নেয়। হরি, কৃষ্ণ, নারায়ণ ও নর তাঁদের নাম। এদের মধ্যে নর ও নারায়ণ জগৎ কল্যাণের তপস্যা করলেন এবং হরি ও কৃষ্ণযোগ সাধনা করতেন। নর নারায়ণ দিব্যদেহধারী পুরাণ প্রসিদ্ধ ছিলেন। তাদের উপযুক্ত আশ্রমরূপ পরিণত হল গঙ্গার প্রশস্তি তটে। হিমালয় পর্বতে অবস্থিত বদরিকাশ্রম। দেবরাজ ইন্দ্রকেও নর নারায়ণ তাদের কঠিন তপস্যার দ্বারা বিচলিত করে তুললেন। সুন্দরী অপসরা রম্ভাকে আশ্রমে পাঠানো হল তাদের মনঃসংযোগে বিঘ্ন ঘটানোর জন্য। অসীম রূপবান মদনদেব অপর হাতে দিলেন অস্ত্র ও সহচর রূপে এসেছিলেন বসন্ত। তিনি এলেন রম্ভার সাথে। এরপর বদিরাকাশ্রমে উভয়েই উপস্থিত হলেন। সেখানে তিনজনেই নিজেদের খুশিমতো ক্রীড়াবিহার করতে লাগলেন।

লাল পলাশ ফুটে উঠল গাছে গাছে, বসন্ত ঋতুর আবির্ভাবে পলাশ ফুলের সৌন্দর্য আরো বৃদ্ধি পেল। গাছের পাতা ঝরে পড়ার ফলে প্রকৃতির এই রূপ দেখে মনে হল বসন্তরূপ সিংহ পলাশপুরুষরূপ নখের দ্বারা হিমরূপ হাতিকে বিদীর্ণ করে প্রকৃতির রঙ্গমঞ্চে হাজির হল। লোব্ধ ও কুন্দফুল বিকশিত হল। বসন্ত যেন হাসছিল। নিজেদের শুদ্ধতার শক্তিতে হিমরূপ হাতিকে বিধ্বস্ত করে। রাজার শরীরে বিরাজিত সোনার অলংকারের মতো শোভা পেতে লাগল কুসুমিত কণিকা ফুলের বনগুলি। প্রভুর পাশে ভৃত্যের সম্মান রাজপুত্রের মতো কণিকার ফুল ও কদম ফুলের আশেপাশে অবস্থান করছিল। অশোক বনগুলি এক মনোরম শোভা ধারণ করল। লাল রঙের উজ্জ্বল ফুল ফুটে ওঠাতে বসন্তরাজের নৃত্যগানের যুদ্ধে আহত হয়ে রক্তাক্ত দেহে ধারণের মত ছিল এই দৃশ্য। ভ্রমরেরা বাড়িতে আত্মীয় আগমনের আনন্দের মতো বসন্তের আগমনে গুঞ্জন করতে লাগল। বেতগাছেরা নদীর তীরে মুকুলিত হয়ে শোভা পাচ্ছিল। এই বেতগাছগুলি আঙ্গুল তুলে বলছিল, আমাদের মতো সুন্দর আর কোন গাছ নেই।

বসন্তলক্ষ্মী মানবশরীর ধারণ করে আর্বিভূত হল বদরিকাশ্রমে। বসন্তলক্ষ্মীর হাতের সৌন্দর্যবর্ধন করল রক্তবর্ণ অশোক ফুল, পদদ্বয় রূপে শোভা পেল পলাশফুল। মুখমণ্ডল হল প্রস্ফুটিত পদ্ম, দেহের শ্যাম শোভা সাধন করল নীল বর্ণের অশোক ফুল। নীলপদ্ম হল তার চোখ, বেলফল তার স্তন। দাঁত হল কুন্দফুল। পুষ্পমঞ্জরী তার হাতের শোভা হল। ঠোঁট তার গন্ধরাজ ফুল সাদা সিন্ধুরার তার নখ, তার গলার স্বর পুরুষ কোকিলের ধ্বনি তার বসন হল কঙ্কাল গাছ, মাথার অলংকার ময়ূরের পালক, সারসের স্বর তার নূপুরের আওয়াজ, প্রত্বিংশ যজ্ঞস্থানের নিকটে যজ্ঞের দ্রব্যগুলি রাখার জন্য পূৰ্বাভিমুখী যে গৃহ থাকে তাকে প্রজ্বংশ বলে এমনই তার চলার ভঙ্গী, মত্ত মরাল সম তার দেহ লোম পুত্রজীবের পুষ্প।

এইভাবে সজ্জিত বসন্তলক্ষ্মী বদরিকাশ্রমে বিরাজ করতে লাগল। উৎসুক হয়ে আশ্রমের রমণীয়তার দিকে তাকালেন নারায়ণ। অনঙ্গ মদনদেবকে দেখে নারায়ণ জানতে চাইলেন, তিনি কে? বর্ষ থেকে যে কন্দর্পের জন্ম হয় তাই কাম নামে অভিহিত হয়। একথা পুলস্ত্য জানতেন। শঙ্করের রোষানলে দগ্ধ হবার পর অনঙ্গ নামে পরিচিত হয়েছে। এরপর নারদ পুলস্ত্যর কাছে জানতে চাইলেন কেন শঙ্কর তাকে দগ্ধ করেছে? শঙ্কর দক্ষকন্যা সতীর মৃত্যুর পর ত্রিলোচন সতী বিরহে দক্ষযজ্ঞ ধ্বংস করে একাকী নানা স্থানে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। একথা পুলস্ত্য নারদকে জানালেন।

বিরহ জনিত শঙ্করকে দেখে উন্মাদ অস্ত্রে তার অঙ্গ বিদ্ধ করেন কন্দর্প এবং মদনদেবের মদন বাণের তাড়নায় উন্মত্ত হয়ে শঙ্কর সতীতে স্মরণ করে বন, সরোবরে ঘুরে বেড়তে লাগলেন। বাণ বিদ্ধ হাতির মতো অন্তরে কষ্ট অনুভব করতে লাগলেন। কোথাও শান্তি পেলেন না। কালিন্দী নদীর সমস্ত জল পুড়ে কালো হয়ে গেল শঙ্কর যখন সেখানে ডুব দিলেন, তথাপি তাঁর দেহ ঠান্ডা হল না। ভ্রমর ও কাজলসম রূপ হল কালিন্দীর জলের, সেই থেকে কবির চোখে কালিন্দী ধরিত্রীর কেশরাশি ও পুণ্যতীর্থে পরিণত হয়ে প্রবাহিত হতে লাগল। এরপর শঙ্কর পবিত্র নদী, সুন্দর সরোবর ও রমণীর নদীর তীরভূমি, অরণ্য, পর্বতে বিচরণ করেও মনের সুখ শান্তি পেলেন না।

শঙ্কর তখন মহামোহিনী দক্ষ কন্যার ধ্যানে নিমগ্ন হয়ে কখনও নিদ্রিত হলেন, কখনও স্বপ্ন দেখলেন, কখনও গান করলেন, কখনও কেঁদে আকুল হলেন। এরপর তিনি দক্ষ কন্যাকে দেখে আপন মনের সান্ত্বনার জন্য তাকে নিষ্ঠুর বললেন, তাকে প্রশ্ন করলেন, তাকে সতী কেন ত্যাগ করলেন, সে কি তাঁর প্রতি রুষ্ট হয়েছে। কেন তাকে সতী কামানলে দগ্ধ করছে। সতী যদি সত্যিই রুষ্ট হয় তবে তার ক্রোধকে প্রশমিত করুক। মহাদেব এও বললেন–তিনি সতীর পদতলে প্রণত হচ্ছেন। এরপর শঙ্কর বললেন–যে তিনি সর্বদা সতীকে স্পর্শ করেন, তার কথা শোনেন, তাকে দেখেন, তাকে আলিঙ্গন করেন তবে কেন সতী তার সাথে কথা বলে না। তিনি তাঁর স্বামী তবে কেন স্বামীর বিলাপে তাঁর প্রাণ গলে না? কেন তাঁর মনে দয়া জাগে না?

শঙ্কর এবার অভিমানে বললেন, আমি জানি তোমার দয়ামায়া নেই। তিনি জানতে চাইলেন, একদিন সতী বলেছিল তাকে ছাড়া বাঁচতে পারবে না। তবে এখন সেকথা কেন মিথ্যা হল। তিনি পুনরায় অনুরোধ করেন ও বলেন, সুলোচনা ফিরে এসে আমার কামতপ্ত দেহ আলিঙ্গন করো। আমার দেহের কাম উত্তাপ সতীর আলিঙ্গন বিনা কমবে না, একথা সত্যের নামে শপথ করে তিনি বললেন। এই সকল স্বপ্নে দেখে শঙ্কর জেগে উঠলেন এবং বনে গিয়ে বিলাপ করতে লাগলেন। সন্তাপ নামক শর দ্বারা কন্দর্প পুনরায় শঙ্করকে বিদ্ধ করলেন তাঁর বিলাপ শুনে।

তাঁর সন্তাপে সমগ্র জগৎ সন্তপ্ত হয়ে উঠল। শঙ্করও দারুণভাবে সন্তপ্ত হয়ে উঠলেন। শঙ্কর এরপর ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। জ্বম্ভনাস্ত্রে মদন তাঁকে পুনরায় বিদ্ধ করলেন। চারিদিকে ত্রিলোচন ছুটতে শুরু করলেন সৃম্ভন করতে করতে কামশরে দারুণ ভাবে নিপীড়ত হয়ে। আচমকা দেখতে পেলেন কুন্দনন্দনী পাঞ্চালিকাকে। তাকে দ্রাতব্য সম্বোধন করে শঙ্কর বললেন, তিনি তাকে চেনেন সে অসীম পরাক্রমশালী। তিনি যেন তাঁর কথা শুনে তাঁর কর্তব্য স্থির করেন। পাঞ্চালিক বললেন, কোনো দেবতার পক্ষে দুঃসাধ্য কাজও তিনি করতে পারবেন শঙ্করের কথায়। কারণ তিনি শঙ্করের প্রতি শ্রদ্ধাবান ও তার দাস। তার কাছে শঙ্করের পরাক্রম ও সাহসের কোন তুলনা নেই। তিনি মহাদেবকে এও বললেন–যে কোনরূপ দ্বিধা না করে যেন শঙ্কর তাঁকে আদেশ করেন।

শঙ্কর এরপর জানান তাঁর পত্নী অম্বিকা নেই, তাই তাঁর দিব্যদেহ সর্বদাই কামানলে দগ্ধ হচ্ছে। তিনি সর্বদাই সৃম্ভন করছেন। মদন বাণে বিদ্ধ হয়ে কিছুতেই তিনি ধৃতি, রতি, সুখশান্তি লাভ করতে পারছেন না। মদনদেব দ্বারা সৃষ্ট এই কামোন্মাদনা, এই সৃম্ভন তাঁর মতে পাঞ্চালিক ছাড়া কোন লোকই জগতে ধারণ করতে পারবে না। অতএব তিনি সব গ্রহণ করুন।

পুলস্ত্যর বাক্য অনুযায়ী পাঞ্চালিক বৃষধ্বজ, মহেশ্বরের কথায় রাজি হয়ে সমস্তই গ্রহণ করলেন। মহেশ্বর তখন তাকে পৃথিবীতে পূজা প্রচলনের বর দিয়ে বললেন, তুমি এই দুঃসহ জ্বম্ভন আমার শরীর থেকে গ্রহণ করেছ, তাই জগতে যে ব্যক্তি চৈত্র মাসে ভক্তি ভরে তোমাকে স্পর্শ বা অর্চনা করবে, সে বৃদ্ধ, নাবালক, যুবক কিংবা নারী যেই হোক, তৎক্ষণাৎ উন্মত্ত হয়ে উঠবে। তারা ভবিষ্যতে রোগযুক্ত হবে, যার তার সামনে নাচ, গান, বাজনা বিভিন্ন রকম ক্রীড়া কৌতুক করবে এবং তার প্রতি একান্তরূপে অনুরক্ত হবে।

ধরাধামে তিনি পাঞ্চালেশ্বর নামে প্রসিদ্ধ হবেন এবং ত্রিলোচনের নামানুসারে তার পূজা প্রচলিত হবে। তার কৃপাতেই পাঞ্চালেরশ্বর পৃথিবীতে পূজনীয় হল। তাকে আরো বললেন, তিনি বর দেবার ক্ষমতা প্রাপ্ত হলেন। ত্রিলোচনের আজ্ঞা পেয়েই যক্ষনন্দন স্থানত্যাগ করলেন। এরা বিভিন্ন স্থানে বিচরণ করতে লাগলেন। তিনি এরপর সর্বত্র পূজা পেতে লাগলেন। হিমালয় পর্বতের দক্ষিণ এবং কালাঞ্জর পর্বতের উত্তর দিকে অবস্থিত এক পবিত্র স্থানে বাস করার জন্য গেলেন। যতনয় চলে যাবার পর ভগবান ত্রিলোচনও স্বর্গ থেকে বিন্ধ্যাচলে চলে গেলেন।

এরপর মদন যখন পুনরায় তাকে দেখে পুষ্পশরে জর্জরিত করতে উদ্যত হন তখন শঙ্কর সে স্থানও পরিত্যাগ করলেন। এরপর গহন দারুবনে মহাদেব প্রবেশ করলেন। মদন সেখানেও তাঁকে অনুসরণ করলেন। দারুবনে বসবাসকারী ঋষি ও তাঁদের পত্নীরা শঙ্করকে দেখে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলেন। এরপর শঙ্কর এদের কাছে ভিক্ষা চাইলে সকলে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন।

ভৃগু ও অত্রি মুনির পরিবারের রমণী যাঁরা পুণ্যাশ্রমে বাস করতেন তাঁদের চিত্তও চঞ্চল হয়ে উঠল মহেশ্বরকে পুণ্যাশ্রমে ঘুরতে দেখে। একমাত্র অরুন্ধতী ও অনসূয়া অটল থাকলেও বাকিরা অবশ হয়ে চারিদিকে ঢলে পড়লেন। অন্য চিন্তা পরিত্যাগ করে তাঁরা নিজ নিজ স্বামীর সেবা শুশ্রূষায় নিবিষ্ট হলেন। এই দুই রমণীরা মহাদেবকে দেখে কাম তাড়নায় তাঁর দিকে ছুটে চললেন কারণ তাদের সকলেরই চিত্ত চঞ্চল হয়ে উঠল। আশ্রমগুলির চিন্তা পরিত্যাগ করে তা ফাঁকা রেখে তাঁরা মহাদেবের পিছু চললেন। এই দৃশ্য যেন মদ মত্ত হস্তীনির হস্তীর দিকে ছুটে যাবার মতো। এইরূপ ঘটনা দেখে ভৃগু ও অঙ্গিরা বংশীয় ঋষিরা মহাদেবের প্রতি ক্রোধিত হয়ে তাঁকে অভিশাপ দিলেন। তারা মহাদেবের লিঙ্গকে ভূমিতে পতিত হবার শাপ দিলেন। ভূমি বিদীর্ণ করে সেই দেবলিঙ্গ পতিত হল। তারা একথা উচ্চারণ করার সাথে সাথেই তখন শূলপানি শঙ্করের আর সাক্ষাৎ পাওয়া গেল না।

তখনই সেই শিবলিঙ্গ একদিকে পৃথিবীর ভেদ করে পাতালে প্রবেশ করল আর অপরদিক আকাশ বিদীর্ণ করে ব্রহ্মাণ্ড ভেদ করতে লাগল। সমগ্র জগৎ তখন চঞ্চল হয়ে উঠল। পাহাড়, নদী, বৃক্ষ, পাতালের তলদেশে, সমগ্র ধরাধাম বিচলিত হয়ে উঠল। ক্ষীরোদ নামক সাগরে অবস্থানকারী শ্রীহরির নিকটে পিতামহ ব্রহ্মা গেলেন এবং তাঁকে ভক্তিভরে প্রণাম করে জানতে চাইলেন, কেন সমগ্র জগৎ এইরূপ বিচলিত?

সমগ্র পৃথিবীর চাঞ্চলতার কারণ স্বরূপ শ্রীহরি জানালেন দারুবনে মুনিদের ক্রোধে শঙ্করের লিঙ্গ ভূতলে পতিত হবার দরুণ এই কাণ্ড ঘটছে। এরপর ব্রহ্মা ও হরি শিবলিঙ্গের সেই স্থানে দ্রুত উপস্থিত হলেন কারণ ব্রহ্মা হরির অদ্ভুত কথা শুনে সেই স্থানে যেতে চাইলেন। সেই স্থানে এসে শ্রীহরির লিঙ্গের শেষ দেখার জন্য গরুড়ের পিঠে চড়ে পাতালে প্রবেশ করলেন এবং ব্রহ্মা লিঙ্গের ঊর্ধ্বসীমা দেখার জন্য হাঁসের পিঠে আকাশে উঠে চললেন। কিন্তু ব্রহ্মা ঊর্ধ্বসীমা দেখতে না পেয়ে ফিরে এলেন। শ্রীহরিও ক্রমে সপ্তপাতালে গিয়েও শেষ দেখতে না পেয়ে ফিরে এলেন। তখন বিষ্ণু ও ব্রহ্মা স্তব করে বন্দনা করে শিবকে বললেন, তুমি শূলপানি বৃষবাহন, তুমি জীমূতবাহন, কবি, ত্রিলোচন মহেশ্বর তোমার প্রভাবে দক্ষযজ্ঞ ধ্বংস হয়েছে, তুমি কালরূপে বিরাজ করছ, তুমি জগতের আদি, মধ্য ও অন্ত, তোমাকে আমরা প্রণাম জানাই।

পুলস্ত্য বললেন, ব্রহ্মা ও বিষ্ণুর স্তব শুনে মহাদেব আপন মূর্তিতে এসে জানতে চাইলেন কেন তারা তাঁর স্তব করছে। মহাদেব বললেন, তাঁর মন খুবই খারাপ, দেহ কামশরে জর্জরিত। তার এক পা চলার ক্ষমতা নেই। তখন হরি ও ব্রহ্মা তাঁকে বললেন, পুনরায় এই লিঙ্গ হতে নিজ মূর্তি ধারণ করতে। কিন্তু মহাদেব জানালেন, দেবতারা তাঁর লিঙ্গের পূজা না করলে তিনি স্বরূপ গ্রহণ করবেন না। হরি এতে সম্মত হলেন। এবং ব্রহ্মা নিজে এই শিবলিঙ্গ পূজার দায়িত্ব গ্রহণ করলেন।

চারটি বর্ণ সৃষ্টি হল লিঙ্গার্চনার জন্য। নানা সদুক্তি পরিপূর্ণ শাস্ত্রবাক্য এই সকল বর্ণের নিকট প্রমাণরূপে পরিগণিত হয়। এই বর্ণগুলির প্রথমটি বৈ, দ্বিতীয়টি পাশুপাত, তৃতীয়টি কালদমন এবং চতুর্থটি কাঁপালিক নামে অভিহিত। বশিষ্ঠের প্রিয় পুত্র শক্তিরূপে জন্মগ্রহণ করেন। স্বয়ং শিব শক্তির গোপায়ন নামে একটি শিষ্য ছিল। রাজা সোমেশ্বর মুনিবর ভরদ্বাজ মহাপাশুপতের শিষ্য ছিলেন। তপোধন আপস্তর হলেন সালদমন, ব্রক্রেশ্বর নামে তাঁর এক শিষ্য ছিল। চতুর্থ বর্ণ হল কাঁপালিক। কুবের হলেন মহাব্রতী। শুদ্র জাতের আগের ছিলেন তার এক বীর শিষ্য। ব্রহ্মা চারটি সম্প্রদায় সৃষ্টি করলেন। শিব পূজার জন্য এবং নিজ গৃহে চলে গেলেন।

এরপর শিব পুনরায় বেড়াতে বেরোলেন। ব্রহ্মার গমনের পর নিজ লিঙ্গ শরীরে গ্রহণ করে চিত্রবান ক্ষুদ্র লিঙ্গ প্রতিষ্ঠিত করে। এরপরও মদনদেব শিবের পিছু নিয়ে তাঁকে বাণের দ্বারা আঘাত করতে উদ্যত হলে শিব তাঁকে দেখে রাগে জ্বলে উঠলেন। মহাদেব এরপর ক্রুদ্ধ হয়ে রক্তনেত্রে মদনদেবের জ্যোর্তিময় শরীরের পা থেকে বগল পর্যন্ত পুড়িয়ে দিতে লাগলেন। মদনদেব তার শ্রেষ্ঠ ধনু দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। নিজের পা পুড়ে যেতে দেখে। ধনু পাঁচটি খণ্ডে বিভক্ত হল এবং মদনদেবের হাতের মুঠোতে ধরা স্বর্ণখচিত অংশটি চাপা গাছে পরিণত হল। এই ধনুর মধ্য ভাগ হীরাখচিত যা বকুল বৃক্ষে পরিণত হল। ইন্দ্রনীল মণিযুক্ত কটিদেশ পটল বৃক্ষ চন্দ্রকান্তমণি যুক্ত অংশ জাতী লতাতে এবং বিক্রমণিযুক্ত ছিলার অংশ মল্লী লতারূপে পরিণত হল। তার সমস্ত শরীর পুড়ে যাচ্ছিল বলে তার ধনুর শরের জাতিসূযী ও সব সুগন্ধ মনোরম ফুলগুলিকে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। তাঁর সংগৃহীত অংশ ও সুস্বাদু ফল, বনের গাছ শঙ্করের কৃপায় দেবভোগ্য হল। হিমালয় পর্বতে তপস্যা করতে গেলেন কামদেবকে দগ্ধ করে পুণ্যলাভের জন্য। পুষ্পধনু কাম দেবকে মহাত্মা শঙ্কর এভাবে দগ্ধ করেছিলেন।

পুলস্ত্য জানালেন, দগ্ধ মদনদেবকে দেখে বদরিকাশ্রমে অবস্থানকারী নারায়ণ মুনি তাকে কন্দর্প বললেন। তাঁকে আহ্বান করার জন্য কামদেব নারায়ণ মুনির মনের এরূপ দৃঢ়তা দেখে অবাক হলেন। এরপর নারায়ণ মুনি অপ্সরাদের দেখে তাঁদের স্বাগত জানিয়ে বসন্তকেও স্বাগত জানালেন। এতে বসন্ত মনে মনে দারুণ ভাবে চিন্তিত হলেন। এই বলে ভগবান একা হেসে বসন্তকে সম্ভাষণ জানালেন, একগুচ্ছ ফুলের মুকুল তুলে তাঁর উরুদ্বয় থেকে এক সুন্দরী রমনী সৃষ্টি করলেন। প্রিয়তম রতি এসে হাজির হয়েছে বলে ভাবলেন কন্দর্প, রমণীর এই অশেষ সৌন্দর্য দেখে এই রমণীকে তার প্রিয়তমার মতো মনে হল কারণ তার কথা বলার ধরন, তাঁর নয়নদ্বয়, তার জ্বভঙ্গিমা, কেশরাশি, নাক, ঠোঁট, উন্নত স্তনদ্বয়, রেখাঙ্কিত আলতো কোমল পেট এসব তার প্রিয়তমার মতো। জঘনস্থল থেকে স্তনতটের দিকে বিস্তৃত হয়ে আছে এই রমণীর রোম রাশি। এ দেখে মনে হচ্ছে যেন ভ্রমরেরা এগিয়ে চলেছে তটভূমি থেকে পদ্মফুলে পরিপূর্ণ জলাশয়ের দিকে। মেখলার দ্বারা অলঙ্কৃত হয়ে আছে এই রমণীর জঘনদেশ। মেখলা পরিহিত রমণীকে ক্ষীরসমুদ্র মন্থনকালে বাসুকী নাগের দ্বারা মন্দারপর্বতকে যেমন দেখাচ্ছিল তেমন দেখতে লাগল। এই শরীর উরুযুগল বদলাস্তম্ভের গোড়ার অংশ উপরের দিকে ধরলে যেমন দেখায় সেইরূপ। রোমহীন তার জঙ্দুটি সুন্দর ও পা দুটি আলতায় শোভিত।

কামদেব এই নারীকে নিয়ে এরূপ নানা চিন্তা করতে লাগলেন। কামোদ্রেক হল কন্দর্পের অন্তরেও এই সুন্দর রমণীকে দেখে। সুতরাং অন্যলোকের কথা কিছু বলার নেই। ঊর্বশীকে দেখে বসন্তও চিন্তিত হলেন। মদনদেব ভাবলেন সূর্যকিরণের তাপে ভীত হয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছে চন্দ্রের দিবাভাগের কোন : এক অজানা শান্তি। অপ্সরাদের ধরে ধ্যানমগ্ন মুনির মতো কিছুকাল দাঁড়িয়ে রইল বসন্ত। এই অবস্থায় কন্দর্প এবং বসন্তকে দেখে নারায়ণ মুনি জানালেন, তাঁর উরু থেকে জন্মেছে এই রমণী। তিনি বললেন, তোমরা একে দেবলোকে নিয়ে গিয়ে দেবরাজ ইন্দ্রকে উপহার দান করো। উর্বশীকে নিয়ে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে তারা দেবলোকে চলে গেলেন ঋষির মুখে এই আদেশ শুনে। বদরিকাশ্রমে অবস্থানকারী ধর্মজ্ঞানী তাপসের কার্যকলাপের এবং রূপযৌবনবতী উর্বশীর বিবরণ তারা দিলেন ইন্দ্রের কাছে গিয়ে। সকলে দারুণভাবে বিস্মিত হন। স্বর্গ, মর্ত্য ও পাতালে এরপর থেকেই নর-নারায়ণের চরিতকথা ছড়িয়ে পড়ল।

হিরণ্যকশিপুর পুত্র প্রহ্লাদ রাজা হলেন তার দুবৃত্ত পিতা নিহত হবার পর। তার অশেষ শ্রদ্ধা ছিল দেবতা ও ব্রাহ্মণদের প্রতি। নৃপগণ যথাসাধ্য যজ্ঞানুষ্ঠান করতে লাগলেন তার সুশাসনের ফলে। ব্রাহ্মণরা নির্বিঘ্নে বিভিন্ন তীর্থক্ষেত্রগুলিতে ভ্রমণ করতে লাগলেন ও নির্বিঘ্নে তপস্যা করতে লাগলেন।

পশুপালনে রত হল বৈশ্যরা। ব্রাহ্মণদের সেবা শুশ্রূষা করতে লাগল শূদ্ররা। চতুবর্ণের লোকেরা এভাবে নিজ নিজ কাজে ব্রত হল। নিজ নিজ কাজে রত হল দেবতারাও। নর্মদা নদীর তীরে নকুলেশ্বর তীর্থে শিবমূর্তি দেখার পর একদিন ভৃগুবংশীয় মহা তপস্বী চ্যবন নামক ঋষি স্নান করার জন্য নর্মদা নদীর জলে নামলেন। নদীর জলে অবগাহন করার সময় এক লোহিতাকার সাপ তাকে গ্রাস করল। চ্যবন সর্পগ্রস্ত হয়ে হরিকে স্মরণ করলেন। শ্রীহরির কৃপায় সাপের সমস্ত বিষ দূর হয়ে গেল, তখন চ্যবনকে নিয়ে রসাতলে চলে গেল সেই বিশাল সাপ। যদিও বিশেষ কোন ক্ষতি তার হলো না, কারণ সাপের বিষ ছিল না।

সাপের হাত থেকে মুক্তি লাভ করে চ্যবন রসাতলে নাগ কন্যাদের দ্বারা পূজিত হয়ে এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াতে লাগল। এরপর দৈত্যপুরীতে এসে হাজির হলেন এবং দৈত্যরাজগণ দ্বারা সমাদৃত ও পূজিত হলেন। পরে প্রহাদের সাথে তার সাক্ষাত হল। প্রহাদ তাকে যথাযোগ্য সম্মান দেখানোর পর। কুশল-প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলেন। তার সাথে সাক্ষাতের কারণ ব্যাখ্যা স্বরূপ চ্যবন জানালেন নর্মদা তীর্থে স্নান করতে নামার সাথে সাথে একটা সাপ তাকে সবলে গ্রাস করে তাকে পাতাল পুরে নিয়ে এসেছে। এই কথা শুনে প্রহাদ মহর্ষি চ্যবনের কাছে পৃথিবী, অন্তরীক্ষ ও রসাতল তীর্থগুলির সংখ্যা জানতে চাইলেন। চ্যবন বললেন–তিন জায়গাতেই বিভিন্ন তীর্থের মধ্যে পৃথিবীতে নৈমিষ তীর্থ, অন্তরীক্ষে পুষ্কর এবং রসাতলে চক্ৰতীর্থ প্রসিদ্ধ। পুলস্ত্য এরপর নারদকে জানালেন, প্রহ্লাদ এই কথা শুনে দানবদের প্রতি আদেশ দিয়ে নৈমিষতীর্থে স্নানে যাবার জন্য প্রস্তুত হতে বললেন। কারণ সেখানে গিয়ে পুণ্ডরীকাক্ষের সাক্ষালাভ করতে পারবে দানবের। প্রহ্লাদের এই কথা শোনা মাত্র সমস্ত দৈত্যকুল পুষ্করতীর্থে যাবার জন্য বিরাট আয়োজন করল এবং অবিলম্বে রসাতল থেকে বেরিয়ে পড়ল। এরপর সকলে বিপুল আনন্দ সহকারে স্নান করল নৈমিষারণ্যে এসে। এরপর প্রহ্লাদ পবিত্র সরস্বতী নদীর সাক্ষাৎ পেলেন নৈমিষ. থেকে কিছুদূরে মৃগয়া ধরতে যাবার পর। এরপর কিছুদূর অগ্রসর হয়ে তিনি বৃহদাকৃতি একটি শাল গাছ দেখতে পেলেন যার শাখা-প্রশাখা সকল অংশই বাণবিদ্ধ ছিল। এমনকি কতকগুলো বাণ ঐ গাছের গোড়ার কাছে পরস্পর সংলগ্ন ছিল।

এরপর আরো অগ্রসর হলেন কারণ সাপকে যজ্ঞোপবীত রূপে ব্যবহার করলে যেরূপ দেখতে হয় এই সমস্ত বাণগুলি সে রূপ দেখতে বলে। এরপর তিনি দুজন মুনির সাক্ষাৎ পেলেন। এই দুই মুনিই গভীর তপস্যায় মগ্ন ছিলেন। তাদের পরনে ছিল কালো হরিণ ছাল, মাথায় ছিল বিশাল জটা রাশি। তাদের সাথে ছিল দুটি দিব্য ধনু যার একটি হল শাঙ্গ ও অন্যটি অজগর। এছাড়াও অক্ষয় বাণে পরিপূর্ণ আরো দুটি তুণ দেখতে পেলেন। এই দেখে প্রহ্লাদের মনে হল এরা নিশ্চয়ই প্রকৃত তাপস নয়। এদের অন্তঃকরণ দাম্ভিকতায় পূর্ণ। তারা কেন ধর্মাচরণের পক্ষে ক্ষতিকর দাম্ভিকতার আশ্রয় নিয়েছেন। প্রহ্লাদ মুনিদের কাছে তা জানতে চাইলেন। তিনি এও বললেন, যে তাদের জটাজুট ও তপস্যার সাথে এই দুই মহাধনুর কোনোরূপ মিল তিনি দেখতে পাচ্ছেন না।

দৈত্যেশ্বরের কোন ভাববার দরকার নেই, বললেন–নর ঋষি–সামর্থ থাকলে যে যা পারে, তার পক্ষে তাই সম্ভব হয়। দৈত্যগণের অধীশ্বর ও ধর্মসেতুর প্রবর্তক বলে নিজের পরিচয় দিলেন প্রহ্লাদে তাদের শক্তির কোন অর্থ নেই তিনি বর্তমান থাকতে, নর ঋষি জানালেন, তারা রীতিমত শক্তি অর্জন করেছেন। নরনারায়ণকে যুদ্ধে জয় করতে পারে এমন কেউ নেই।

একথা শুনে ক্রুদ্ধ হলেন দৈত্যরাজ। যুদ্ধে নর নারায়ণঋষিকে জয় করবার প্রতিজ্ঞা করলেন দৈত্যরাজ। দৈত্যশ্বর ধনুকের ছিলাঘাতে ভীষণ শব্দ করে অরণ্যর শেষে এক জায়গায় তাঁর সৈন্যদল সজ্জিত করলেন। নরঋষি অজগর ধনু দিয়ে অসংখ্য বাণ ছুঁড়তে লাগলেন। যেসব বাণ দৈত্যপতিও প্রতিহত করে দিলেন। দৈত্যরাজের বাণ প্রতিহত করা দেখে নরঋষি ক্রুদ্ধ হয়ে আরো বেশি করে বাণ ছুঁড়তে লাগলেন। এইভাবে প্রহ্লাদ এক বাণ তো নরঋষি দুই বাণ। নরঋষি তিন বাণ মারল প্রহ্লাদ চার বাণ মারে। নরঋষি পাঁচ বাণ ছুঁড়লে প্রহ্লাদ ছয় বাণ। ফলে ক্রমশই দুজনের মধ্যে ভীষণ যুদ্ধ বেধে গেল এবং কেউ পিছু হঠতে চাইল না। নরঋষি আটটি বাণ ছুড়লে দৈত্যপতি নয় বাণ ছুঁড়লেন। এইভাবে নরঋষি যত বাণ মারেন দৈত্যপতি তার চেয়েও বেশি বাণ মারেন। ক্রমে নরঋষি একশো বাণ নিক্ষিপ্ত করলে দৈত্যপতি দুশো বাণ বর্ষণ করলেন। পরে নরঋষি দুশো ও প্রহ্লাদ দশশো এভাবে বাণ বর্ষণ বেড়েই চলল। নরঋষির অসংখ্য বাণে ভূমি দিক অন্তরীক্ষ ছেয়ে গেল দৈত্যপতিও তা ছিন্ন ভিন্ন করে ফেললেন তীক্ষ্ণ বাণ বর্ষণে।

উভয়ে বাণ বর্ষণ করতে করতে এক ভয়ংকর তুমুল যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়লেন। এক ভীষণ শর হাতে নিলেন দৈত্যাধিপতি। মুহূর্তের মধ্যে তার ধনুতে ব্রহ্মাস্ত্র যোজিত হল। নর ঋষিও নিশ্চিন্ত ছিলেন। তিনিও সুতীক্ষ নারায়ণাস্ত্র যোজনা করলেন। আগ্নেয়াস্ত্র গ্রহণ করে দৈত্যপতি উভয় অস্ত্রই প্রয়োগ করলেন। ঋষিবরও নারায়াণাস্ত্রের সাথে মাহেশ্বরাস্ত্র ছুঁড়ে মারলেন। ফলে দুজনের অস্ত্রই ব্যর্থ হল। দৈত্যরাজ ব্রহ্মাস্ত্র বিফল হবার দরুণ ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলেন। তখন তিনি রথ থেকে নেমে গদা হাতে ছুটে আসতে থাকেন। দৈত্যরাজ প্রহ্লাদ গদা হাতে ছুটে এলেন তপস্যা আধার, অসীম বিক্রমশীল ও সমস্ত লোকের পালনকারী বিখ্যাত ঋষি নারায়ণের দিকে।

দৈত্যরাজ প্রহ্লাদের দিকে শাঙ্গ নামক ধনু হাতে নিয়ে নারায়ণ ঋষি ছুটে গেলেন। পুলস্ত্য একথা জানালেন। এরূপে নারায়ণের মাথায় গদার আঘাত করলেন প্রহ্লাদ যথাসাধ্য শক্তি দিয়ে হাতের গদা ঘোরাতে ঘোরাতে। নারায়ণের চোখ দিয়ে আগুনের শিখার মতো জলরাশি বেরিয়ে আসতে লাগল মাথায় আঘাত করার সাথে সাথে। প্রহাদের গদাঘাতে নারায়ণের তো কিছু হলই না তিনি বজ্রাহত পর্বত শিখরের মতো অটল থাকলেন, বরং গদাই শতভাগে টুকরো হয়ে গেল। রথে ফিরে এসে অবিলম্বে দৈত্যাধিপতি হাতে ধনু ধরে তাতে তূণ থেকে বাণ যোজনা করলেন। গাধপত্র বাণ যোজিত, হল তার ধনুতে। যথাশক্তি সেই বাণ নিক্ষেপ করলেন ক্রোধান্ধ হয়ে। নারায়ণ ঋষি অর্ধচন্দ্রের মতো বাণগুলিকে আসার সাথে সাথে অন্যবাণ ছুঁড়ে ছিন্নভিন্ন করে দিলেন এবং প্রহ্লাদকেও বাণ বিদ্ধ করলেন। দেবতারা আকাশপথে এসে হাজির হলেন দেব-দৈত্যের ঘোর যুদ্ধ দেখতে। দেবদুন্দুভি বেজে উঠল আকাশ ভয়ংকর শব্দ করে। অজস্র ধারায় পুষ্পবৃষ্টি হতে লাগল নারায়ণ ও দৈত্যরাজের উপরে। দুই মহাধনুচারণ ঘোরতর যুদ্ধে লিপ্ত হলেন আকাশের দেবতা ও ভূতলের দৈত্যদের সামনে। দর্শকরা যুদ্ধ দেখে প্রচুর আনন্দ পেল। সমস্ত আকাশ দিক্ বিদিক বাণে ছেয়ে ফেললেন দুই যোদ্ধা। নারায়ণ এক তীক্ষ্ণ বাণ ছুঁড়ে প্রহ্লাদের অন্তঃকরণ ভেদ করলেন। তখন দৈত্যপতিও ক্রুদ্ধ হয়ে হৃদয়ে, বাহুদ্বয়ে ও মুখমণ্ডলে নারায়ণকে বিদ্ধ করলেন। অর্ধচন্দ্রাকৃতি এক বাণ নারায়ণ নিক্ষেপ করলেন। সেই বাণের আঘাতে দৈত্যরাজের হাতের মুঠো থেকে ধনু ছিটকে পড়ে গেল। তখন তিনি ধনুতে জ্যা রোপণ করে শত শত বাণ ছুঁড়তে লাগলেন অন্য। নারায়ণও সেই বাণ ছিন্ন করে অন্য বাণ নিক্ষেপ করে দৈত্যরাজকে বিব্রত করে তুললেন। দৈত্যরাজের ধনু ছিন্ন করলেন ক্ষুরধার অস্ত্র দিয়ে, তখন আবার অন্য ধনু হাতে তুলে নিলেন দৈত্যপতি।

এভাবে দৈত্যপতির ধনু বারে বারে ছিন্ন করতে থাকেন নারায়ণ। যখন সমস্ত ধনু ছিন্ন হয়ে গেল তখন দৈত্যরাজ লোহার তৈরি মুগুর নিয়ে ঘোরাতে লাগলেন। এবং তা নারায়ণের দিকে সবেগে ছুঁড়ে মারলেন। নারায়ণ দশটি বাণ দ্বারা সেই মুগুর ছিন্ন করলেন এবং মুগুর ভুলুণ্ঠিত হল। মুগুরের ব্যর্থতায় প্রহ্লাদ হাতে পাশ নিয়ে, তার দিকে নিক্ষেপ করলেন।

নারায়ণ তাও ছিন্ন করে দিলেন। দৈত্যপতি পাশের বিফলতার পর শক্তি গ্রহণ করে নিক্ষেপ করলেন। নারায়ণ এও প্রতিহত করলেন।

এইভাবে দৈত্যরাজের সমগ্র অস্ত্রশস্ত্র ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। তখন তিনি অন্য মহাধনু গ্রহণ করে বাণ বর্ষণে যুদ্ধক্ষেত্র আচ্ছন্ন করে ফেললেন। জগৎগুরু দৈত্যপতির হৃদয়ে আঘাত করলেন নারায়ণস্ত্রে নারায়ণ দৈত্যরাজ এই অস্ত্রের আঘাতে তার রথের ওপর পরে গেলেন। সারথি তাকে নিয়ে গমন করল। জ্ঞান ফেরবার পর সুদৃঢ় ধনুকে হাতে নিয়ে দৈত্যপতি পুনরায় যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলেন। পরে আবার যুদ্ধ করবার কথা বলে নারায়ণ তাকে চলে যেতে বললেন এবং আহ্নিক করতে বললেন।

নৈমিষারণ্যে গিয়ে দৈত্যপতি আহ্নিক করলেন নারায়ণের কথামতো, কিভাবে দাম্ভিক তাপসকে পরাজিত করবেন একথা ভাবতে ভাবতে রাত্রি উপস্থিত হলে নারায়ণের রণকৌশল পরিকল্পনা করতে করতে। যথাসময়ে তাদের মধ্যে যুদ্ধ বাধল। নারায়ণ ও প্রহ্লাদের দিব্য সহস্র বৎসর কেটে গেল এভাবে যুদ্ধ করতে করতে। কিন্তু তথাপি প্রহ্লাদ নারায়ণ ঋষিকে হারাতে পারল না। হাজার বছর পর পীতাম্বর বিষ্ণুর কাছে গিয়ে প্রহ্লাদ জানতে চাইলেন, কেন তিনি নারায়ণ ঋষিকে যুদ্ধে হারাতে পারছেন না? নারায়ণ দেবের উৎপত্তি হয়েছে ধর্ম থেকে একথা জানালেন বিষ্ণু। প্রহ্লাদ কখনই তাকে জয় করতে পারবে না কারণ তার অসীম শক্তি, সমস্ত দেবতা ও দানব একত্রিত হলেও তাকে জয় করা অসম্ভব। প্রহ্লাদ তখন বললেন, প্রকৃতই যদি তিনি অজেয় হন তাহলে তাঁর প্রতিজ্ঞা মিথ্যা হয়ে যাবে। কি করে বেঁচে থাকা যায় প্রতিজ্ঞা পালনে ব্যর্থ হয়ে? অতএব তিনি বিষ্ণুর সামনে পড়ে থেকে না খেয়ে শুকিয়ে মরবেন।

বিষ্ণুর সামনে পুলস্ত্য জানালেন দৈত্যপতি প্রহ্লাদ সনাতন ব্রহ্মার উপাসনায় রত হলেন। পীতাম্বর তখন দৈত্যপতিকে বললেন, নারায়ণ ঋষিকে প্রহ্লাদ জয় করতে পারবে না, তাকে ভক্তি বলে জয় করতে হবে। আমার প্রতি আপনার কৃপা সত্ত্বেও কিভাবে আমি রেহাই পাব নারায়ণের ক্রোধ থেকেও প্রহ্লাদ জানতে চাইলেন। তিনি এও বললেন–যে তিনি ত্রিভুবন জয় করেছেন। দেবরাজ ইন্দ্রও তাঁর কাছে পরাজিত তবু কোন ধর্মপুত্র দেবরাজকে জয় করতে পারলেন না। বিষ্ণু জানালেন তিনিই সেই তাপস তিনিই জগতের মঙ্গল কামনায় ধর্ম স্থাপন করার জন্য দয়া করে তপস্যা করছি।

তাই তিনি যুদ্ধে জয়ী হওয়ার জন্য তাঁরই আরাধনা করতে বললেন। তাকে জয় করা সম্ভব কেবল ভক্তির দ্বারাই। সুতরাং তাকে ধর্মনন্দন তাপসের সেবায় মন দিতে বললেন। সমস্ত দৈত্য দানবকে সেদিন থেকেই তাকে প্রতিপালন করতে বললেন–বিষ্ণু। মহাত্মা দৈত্যরাজ প্রহ্লাদ সানন্দে সেই বিষ্ণুর বাক্য অসুরদের ডেকে বললেন, পুলস্ত্য একথা জানলেন। প্রহ্লাদের অনুরোধে অন্ধক তাঁর রাজ্যভার গ্রহণ করলেন এবং প্রহ্লাদে বদরিকাশ্রমে চলে গেলেন। হাত জোড় করে প্রণাম করলেন নারায়ণের দেখা পেয়ে। তাঁকে জয় না করে কেন প্রণাম করছে প্রহ্লাদ একথা নারায়ণ তাঁর কাছে জানতে চাইলেন। প্রহ্লাদ বললেন, কে তাকে জয় করবে? তাঁর চেয়ে শ্রেষ্ঠ পুরুষ তে নেই। তিনি বিষ্ণু, পুণ্ডরীকাক্ষ, অনন্ত, পীতাম্বর ও সাক্ষাৎ নারায়ণ ও শাঙ্গপানি নামে অভিহিত হয়ে থাকেন। তিনি সনাতন, অক্ষয় ও মহেশ্বর। তিনি এও জানালেন যাজ্ঞিকরা তাঁর পূজা করেন। যোগীরা তাঁর ধ্যান করেন। মনীষীরা অর্চনা করেন ও স্নাতকেরা জপ করেন।

তাঁর অনেক নামের মধ্যে অচ্যুত, হৃষিকেশ, চক্ৰপানি, ধরাধর, মহাসীন, হয়গ্রীব তার নাম। হিরণ্যক্ষের শত্রু বললেন–তাঁকে। তিনি প্রয়োজনে শূকর রূপ ধারণ করতে পারেন। তিনি ঐশ্বর্য, বাণ, বশ, শ্রী, জ্ঞান ও বৈরাগ্য এই ছটি গুণের আধার, তার পিতাকে নরসিংহরূপে তিনিই বিনাশ করেছেন। এমনকি তিনি ব্রহ্মা, ইন্দ্র, চন্দ্র, অগ্নি, বায়ু, বরুণ, যম, সূর্য এমনকি চরাচরে তাঁর অপার মাহাত্ম্যের কথা। তিনি এই সমগ্র জগতে পরিব্যপ্ত করে আছেন ক্ষিতি, জল, তেজ, বায়ু, ব্যোম প্রভৃতি হাজার হাজার রূপে। সুতরাং কেউ তাকে জয় করতে পারবেন না। একমাত্র আপনাকে ভক্তিদ্বারা জয় করতে পারব শক্তি দ্বারা জয় করা সম্ভব না। ভগবান তাঁর এই স্তবে পরিতুষ্ট হলেন। তিনি পরাজিত হলেন প্রহ্লাদের অসাধারণ ভক্তি দ্বারা, পরাজিত হলেন বলে তিনি শাস্তি ভোগ করতে প্রস্তুত হলেন। সুতরাং শাস্তিস্বরূপ তিনি তাকে বর দান করলেন। এবং তাঁকে বললেন–যা ইচ্ছা প্রার্থনা করতে।

প্রহ্লাদ জানালেন, তিনি যা বর দেবেন তাতেই আমি প্রস্তুত। শুধু প্রহ্লাদ জানালেন যে তাঁর সাথে যুদ্ধ করতে গিয়ে যে শারীরিক ও মানসিক পাপ তিনি করেছেন তা যেন, তাঁর দয়াতে দূর হয়। তিনি তাকে সেই বর দিতে বললেন–যাতে নরঋষির সাথে যুদ্ধজনিত পাপও যেন খণ্ডিত হয়। নারায়ণ তাঁর প্রার্থনা পূরণ করলেন এবং তার সমস্ত পাপ নষ্ট হয়ে যাবে একথাও জানালেন। তিনি তাকে দ্বিতীয় কোনো বর প্রার্থনা করতে বললেন।

প্রহ্লাদ জানালেন, এমন বর যেন ভগবান তাঁকে দেন যাতে, তাঁর প্রতি সমস্ত মতি, আশ্রয়, অর্চনা, ধ্যান, মন সর্বদা নিবিষ্ট হয়। নারায়ণ বললেন, তবে তাই হোক। নারায়ণ এবার তাঁকে আরো কিছু বর প্রার্থনা করতে বললেন। প্রহ্লাদ তখন জানালেন, যে কোনো কিছুই তাঁর অলব্ধ নেই, নারায়ণের দয়ায় তিনি সব কিছুই লাভ করেছেন। প্রহ্লাদ জানালেন যে কেবল চান যেন নারায়ণের চরণেই তাঁর সর্বদা ভক্তি থাকে। নারায়ণ জানালেন যে প্রহ্লাদ নিত্য অজর, অমর ও অক্ষয় থাকবে। তিনি বললেন–এবার যাও, ঘরে গিয়ে নিজের কাজ করো। দানব দিগকে সুশাসনে রেখে তিনি এও জানালেন তার কাজে কখনই বিঘ্ন ঘটবে না কারণ তার মন ভগবানের প্রতি অনুরক্ত। প্রহ্লাদ অনন্তকাল রাজত্ব করতে পারবে। নিজ জ্ঞাতির ধর্মাচরণে কখনও যেন বিরত না হয় একথাও বললেন।

পুলস্ত্য এরপর জানালেন যে, একথা শুনে প্রহ্লাদ বললেন, যে রাজ্য তিনি ত্যাগ করেছেন তা কেমন করে পুনরায় গ্রহণ করবেন? নিজ রাজ্যে ফিরে গিয়ে ভগবান দৈত্য ও দানবদের সদুপদেশ দান করবার আদেশ দিলেন। নারায়ণকে প্রণাম করে সানন্দে দৈত্যপতি নিজ নগরে চলে গেলেন। তিনি নগরে পৌঁছনোর সাথে সাথে অন্ধক ও অন্যান্য দানবেরা তাকে সাদরে অভ্যর্থনা জানালেন। তাকে পুনরায় রাজ্যভার গ্রহণের জন্য অনুরোধ করলেন সকলে। কিন্তু প্রহ্লাদ রাজ্যভার গ্রহণ না করে দৈত্যপতিদের সৎপথে পরিচালিত করতে লাগলেন। তার জীবনের ধ্যান জ্ঞান হলেন ভগবান কেশব। পূর্বকালে নারায়ণের কাছে পরাজিত হয়ে দৈত্যপতি প্রহ্লাদ নিজ রাজৈশ্বর্য পরিত্যাগ করে মনকে ভগবানের ধ্যানে সর্বদা সসিদ্ধ রেখে বিশুদ্ধ শরীরে জীবনযাপন করছিলেন।

নারদ পুলস্ত্যের কাছে জানতে চাইলেন, অন্ধকাসুর কিভাবে অন্ধজীবনের অভিশাপ থেকে মুক্ত হলেন? পুলস্ত্য জানালেন, হিরণক্ষের জীবদ্দশাতেই অন্ধকাসুর তার অন্ধত্ব থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন। তাই তাঁকে রাজপদে অভিষিক্ত করা হয়। এরপর অন্ধকের রাজত্বকালে তার বরণীয় কাজ ও দেবতাদের সঙ্গে তার সম্পর্কের কথা নারদ জানতে চাইলেন পুলস্ত্যের কাছে। পুলস্ত্য জানালেন, অন্ধকাসুর রাজা হওয়ার পর শূলপানি শিবের আরাধনা শুরু করলেন। শিব সন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে বর দিলেন।

শিবের থেকে প্রাপ্ত বর অনুযায়ী তিনি কখনও জলে ডুববেন না, আগুনে দগ্ধ হবেন না, দেবতা ও দৈত্যগুরু শুক্রাচার্যকে রাজপুরোহিত হিসাবে নিযুক্ত করলেন। এরপর তিনি সব রাজদের পরাজিত করে ও দেবতাদের আক্রমণ করে সসাগরা বসুন্ধরা ভোগ করার সংকল্প করলেন। দেরি হল না তার সংকল্পকে কাজে পরিণত করতে, সমস্ত রাজারা পরাজিত হয়ে খুব শীঘ্রই তার অধীনতা বরণ করল। এরপর সুমেরু পর্বতে গেলেন অন্ধকাসুর। এই খবর শুনে ইন্দ্র চিন্তিত হয়ে উঠলেন। তিনি যুদ্ধের সাজে সাজিয়ে তুললেন সমস্ত দেবসৈন্যকে। অবিলম্বে সুব্যবস্থা হল অমরাবতী রক্ষার। তাঁর প্রসিদ্ধ বাহন ঐরাবতে চেপে যুদ্ধের জন্য এগিয়ে গেলেন ইন্দ্র। অন্যান্য দেবতাগণ তাঁদের নিজ নিজ অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে নিজ নিজ বাহনে চড়ে তার পিছু পিছু গেলেন। এইভাবে অতিবেগে সমস্ত দেবসেনা স্বর্গ থেকে বেরিয়ে গেল ইন্দ্রের পরিচালনায় হাতি, ঘোড়া ও রথ নিয়ে।

দ্বাদশ আদিত্য ছিল বিশাল দেববাহিনীর সামনে। স্বয়ং শিব ছিলেন পেছনে এবং মাঝে ছিলেন অষ্টবসু। বিশ্বদেবগণ, অশ্বিনীকুমারদ্বয় এবং মরুঙ্গণ, নিজ নিজ বাহনে চেপে যক্ষ ও বিদ্যাধরেরাও দেবসেনার সাথে চললেন। নারদ পুলস্ত্যকে এই যুদ্ধের বিশদ বিবরণ বিস্তারিত ভাবে বলতে অনুরোধ করলেন। নারদ ইন্দ্র থেকে শুরু করে বাকি সব যোদ্ধার বাহনের কথা জানতে চাইলেন। পুলস্ত্য তখন সংক্ষেপে সকলের বাহনের সম্বন্ধে বলতে শুরু করলেন। দেবরাজ ইন্দ্রের বাহন ঐরাবত, এটির সাদা রং ও মহাশক্তিশালী। কালো রঙের পুন্দ্রক নামক মহিষ যমরাজের বাহন, এই মহিষ মনের মতো দ্রুতগামী ও রুদ্রতেজ থেকে উৎপন্ন। বরুণের বাহন জলধি নামক শিশুসার, এর আকৃতি শ্যামবর্ণ এবং এটি রুদ্রের কর্ণমূল জাত। নর কুবেরের বাহন, অম্বিকার পা থেকে এর জন্ম এবং রথের চাকার মতো এর চোখ। একাদশ রুদ্রের বাহনরূপে বিখ্যাত গন্ধর্ব সাপ ও শ্বেতবর্ণ বৃষগণ এছাড়া চন্দ্রমার বাহন রথ, অর্ধ সহস্র হাঁস, রবির বাহক। উট, রথ ও তিন প্রকার ঘোড়া আদিত্যগণের বাহন, হাতি বসুগণের বাহন। সাপ কিন্নরদের আর মানুষ যক্ষগণের বাহন। অশ্বিনীকুমারদ্বয় অশ্বারোহী, সারঙ্গ মরুৎগণের বাহন, গন্ধর্বগণ পদচারী ও শুকবাহন অনর্থগণ। দেবতারা এভাবে যুদ্ধ করতে গেলেন যোদ্ধার বেশে সজ্জিত হয়ে, নারদ এরপর দৈত্যদের বাহন সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাইলেন।

পুলস্ত্য তখন বলতে আরম্ভ করলেন যখন অন্ধকাসুর সমাসীন ছিলেন দিব্যরথে। এই রথের ঘোড়াগুলি ছিল উৎকৃষ্ট জাতীয় এবং দৈর্ঘ্যে প্রস্থে ওই রথ ছিল এক ক্রোশের সিকি ভাগের মতো এবং রথটি ছিল বিশালাকার প্রহ্লাদের, এটি বাহিত ছিল আটটি চাঁদের শোভার মতো সুন্দর অশ্বে, এর একাংশ স্বর্ণবরণ, অপর অংশ শ্বেতবরণ। হাতি ছিল বিরোচনার বাহন, ঘোড়া কুজব্বের, দিব্য রথ ছিল কুজক্ষের শঙ্কর্ণের ছিল ঘোড়া এবং হাতি ছিল হয়গ্রীবের ময়দানবের রথ তার বাহনরূপে বিখ্যাত, ভীষণাকৃতি মাপ ছন্দুভির সিংহ। মুঙ্গর ও গদা ছিল অসুর সেনানী বলি ও বৃত্রের হাতে। দেবসৈন্যকে আক্রমণ করতে উদ্যত হয়েছিল এরা। কোনরূপ বাহন না নিয়ে পায়ে হেঁটেই এরূপে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হল দেব ও অসুর দুপক্ষই। অবশেষে আরম্ভ হল এক ভয়ঙ্কর তুমুল যুদ্ধ। সমস্ত জায়গা ধুলো রাশিতে ছেয়ে গেল। যুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার সাথে সাথে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ধূলিরাশি উথিত হয়ে। তখন পিতা পুত্রকে বা পুত্র পিতাকে চিনতে পারল না। পরস্পর পরস্পরকে বধ করতে লাগল নিজ নিজ দলভুক্ত যোদ্ধাদের মধ্যেই। গতিকে সামলাতে না পেরে দ্রুতগামী রথগুলি একে অপরের ওপর গিয়ে পড়ল। পদাতিক সৈন্যরা তীব্র ক্রোধে পরস্পর পরস্পরকে বধ করতে লাগল। মত্ত হস্তী মত্ত হস্তীর দিকে ছুটে চলল, অশ্বারোহীরা অপর অশ্বারোহীর দিকে ধাবিত হল।

এইভাবে সেই যুদ্ধক্ষেত্র এক ভীষণ নদীর আকার ধারণ করল যখন দেবতা ও অসুর সৈন্যদের মধ্যে যুদ্ধ ভয়াবহ হয়ে উঠল। নিহত সৈন্যদের শোণিতে নদীর জলের মতো রক্তের ধারা বয়ে চলল। নদীর ঘূর্ণিস্রোত যেন রথগুলো, প্রবাহ যেন দ্রুতগামী যোদ্ধার দল। নদীর কচ্ছপ যেন হাতির কপালের গোলাকার অংশ, শরগুলো মাছ, কুমীর যেন তীক্ষাগ্র অস্ত্ররাশি, বিভিন্ন জলজন্তু সৈন্যদের অসিগুলো, শ্যাওলা অন্যান্য অস্ত্ররাশি, জলের গোলাতার পাতা, শকুনি, সারস প্রভৃতি প্রধান প্রধান হাঁস, চক্রবাক পাখি দেবতাদের ব্রজগুলো, বাঁকগুলি হল কাল হংস এবং মুনিজন হলেন পিশাচেরা। এইভাবে যুদ্ধক্ষেত্র এক ভয়ংকর নদীর রূপ ধারণ করে বয়ে চলল। এই নদী সাধারণ লোকের পক্ষে এই নদী পার হওয়া খুবই কঠিন। একমাত্র রথ রূপ ভেলার সাহায্যে সাহসী যোদ্ধারা এই নদী সাঁতরে পেরিয়ে যেতে সমর্থ হবেন। এই ভয়ংকর নদীর যা মাঝখানে সাঁতার কাটতে লাগল যুদ্ধে জয়লক্ষ্মী লাভের লালসায় যোদ্ধারা পরস্পরকে বধ করতে করতে।

ক্রমেই অতি বীভৎস হয়ে উঠল যুদ্ধক্ষেত্রের দৃশ্য, নিহত সৈন্যদের রক্ত পান করতে লাগল কাকেরা। শবগুলি ছিন্নভিন্ন করে মাংস খেতে লাগল, তারা মহানন্দে লাফালাফি ও চেঁচামেচি করতে লাগল পান ভোজনে পরিতৃপ্ত হয়ে। কোথাও আহত যোদ্ধারা মাটিতে শুয়ে ক্ষতের জ্বালায় আর্তনাদ করছে। কোথাও শিয়ালেরা সোল্লাসে চিৎকার করছে। অস্ত্র থেকে ঝড়ে পরা রুধির কোথাও কোন আহত পিপাসার্ত যোদ্ধা পান করছে। ক্রমে এইভাবে যুদ্ধক্ষেত্র শ্মশান ক্ষেত্রে পরিণত হল।

হাজার ঘোড়ায় টানা রথে চেপে ঐরাবত অবস্থানকারী ইন্দ্র দেবসেনাদের সামনে হাজির হল। আটটা ঘোড়া মিলে টানছিল প্রহ্লাদের রথ। সেই রথে চেপে উন্মুক্ত অস্ত্র নিয়ে মহিষারোহী যমরাজের সামনে তিনি গেলেন, এভাবে ক্রমে বিরোচন বর্ষণের, জন্ম কুবেরের, শতমঞ্চর বায়ু এবং মরদানব হতাশার সাথে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হলেন। এছাড়া তুমুল যুদ্ধ শুরু করলেন অতি শক্তিশালী হয়গ্রীর প্রভৃতি দানবরা, আদিত্য, বসু, নাগরাজ প্রভৃতির সাথে। কেউ কেউ হাজার বাণ ছুঁড়তে লাগল, কেউ কেউ বৃহৎ ধনুর ছিলা টানতে লাগল, কেউ কেউ ভীষণ গর্জন করতে লাগল। কেউ আবার প্রতিপক্ষকে সম্বোধন করে বললে তুমি কেন ভীত হয়ে পড়েছ? চুপচাপ দাঁড়িয়ে না থেকে এসে যুদ্ধ করো। যুদ্ধক্ষেত্রে রক্তের নদী বয়ে গেল। শত শত সুতীক্ষ্ণ শরে যুদ্ধক্ষেত্র ছেয়ে গেল, কত সহস্র শত বীর হতাহত হল। মন্দাকিনীর বেগের চেয়েও বেগবান হয়ে উঠল এই রক্ত নদীর স্রোত, ত্রিলোক জয়ের লালসার প্রবলবেগে যুদ্ধে উন্মত্ত হয়ে উঠল দেব ও অসুর উভয় পক্ষই। নদীর পরপারে পৌঁছাতে চেষ্টার ত্রুটি রাখল না কেউ। পরম পুষ্টিদায়ক হয়ে উঠল এই রক্তনদী পিশাচ ও রাক্ষসদের কাছে। রণ-দামামা বেজে চলল দেবতা ও দানবদের মধ্যে। আকাশ থেকে এই ভয়ঙ্কর যুদ্ধের দৃশ্য দেখতে লাগল মুনি ও সিদ্ধগণ। অপ্সরাগণ সম্মুখ সমরে নিহত যোদ্ধাদের যুদ্ধস্থল থেকে স্বর্গে নিয়ে চলল।

১০

দেব-দানবের এক ঘোরতর যুদ্ধের বার্তা দিলেন পুলস্ত্য। বিশাল ধনু হাতে নিয়ে দেবরাজ ইন্দ্র তা থেকে অসংখ্য বাণ ছুঁড়তে আরম্ভ করলেন। অন্ধকাসুর এক বেগবান দীপ্ত ধনু নিয়ে পরস্পর পরস্পরকে আহত করতে লাগল এই সকল বাণ-বর্ষণে। অন্ধকাসুরের দিকে বজ্র ছুঁড়ে মারলেন ইন্দ্র রেগে গিয়ে। দৈত্যরাজও অসংখ্য অস্ত্রশস্ত্র ও তির ছুঁড়ে চন্দ্রকে আহত করল। সাপ যেমন আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায় তেমনি বাণগুলিও ভস্মীভূত হয়ে গেল। দৈত্যপতি কিছুতেই প্রতিহত করতে পারলেন না ইন্দ্রের বজ্ৰকে। দৈত্যরাজ এই বেগবান বজ্ৰকে আসতে দেখে দ্রুত রথ থেকে নেমে শুধু নিজের পায়ের উপর ভর দিয়েই মাটিতে দাঁড়িয়ে রইল।

অন্ধকাসুরের রথের পতাকা, ঘোড়া, সারথি ও রথের উপর বসার স্থানসহ সমস্ত রথ ভস্মীভূত করে দিয়ে দেবরাজ ইন্দ্রের বর্জ্য পুনরায় অন্ধকের দিকে ছুটে চললেন। ইন্দ্রের বজ্রকে আসতে দেখে অন্ধক সজোরে হাতের মুঠির আঘাতে ওই বজ্রকে মাটিতে ফেলে সিংহের মতো ভয়ংকর গর্জন করে উঠলেন। অন্ধককে গর্জন করতে দেখে ইন্দ্র তার দিকে তীক্ষ্ণ বাণ ছুঁড়ে মারলেন। অন্ধক ইন্দ্রের বাহন ঐরাবতের মাথায় হাত দিয়ে সজোরে আঘাত করল ইন্দ্রের বাণ বর্ষণ ব্যর্থ করার জন্য।

অন্ধকাসুরের জানুর আঘাতে ঐরাবতের দাঁত ভেঙে গেল, ঐরাবতের শরীরের বাঁদিকে অন্ধক সাথে সাথে আঘাত করল। এভাবে আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হয়ে ইন্দ্রের হাতি মাটিতে পড়ে গেল। ইন্দ্র তাঁর ঐরাবতের পিঠ থেকে লাফ দিয়ে নেমে গেলেন ঐরাবত মাটিতে পরার আগে এবং এরপর হাতে বজ্র নিয়ে নিজ রাজধানী অমরাবতীর দিকে পালিয়ে গেলেন।

ইন্দ্রের রণে ভঙ্গ দিয়ে পালিয়ে যাবার পর অন্ধকাসুর যাবতীয় দেবসৈন্যকে পদাঘাতে ও করাঘাতে দলিত মথিত করতে লাগল। যমরাজ তার হাতের দণ্ড চারিদিকে ঘোরাতে ঘোরাতে এগিয়ে এলেন দৈত্যবর প্রহ্লাদকে নিহত করার উদ্দেশ্যে। প্রহ্লাদও নিশ্ৰুপ থাকলেন না। প্রহ্লাদও যমরাজ আসা মাত্র সবেগে হাতে ধনু নিয়ে তাকে লক্ষ্য করে শত শত বাণ প্রেরণ করলেন এবং ঘোর গর্জন করতে লাগলেন। এই বাণ বৃষ্টি নিবারণ করার চেষ্টা করতে লাগলেন যমরাজ তার হাতের দণ্ড দিয়ে। অবশেষে প্রহ্লাদের দিকে ছুঁড়ে মারলেন এক ভয়ংকর দণ্ড। ত্রিভুবন দগ্ধ করতে উদ্যত কালাগ্নির মাথা প্রজ্বলিত হয়ে উঠল আকাশ পথে ছুটে আসা যমরাজের দণ্ড। দৈত্যগণ সকলে একযোগে ‘হায় হায়’ বলে চিৎকার করতে লাগল এই জাজ্বল্যমান যমদণ্ড প্রহ্লাদদের দিকে ছুটে আসতে দেখে। সকলেই ভাবলেন

এই আর্তনাদ শুনতে পেয়ে অন্ধকাসুর ‘ভয় নেই, ভয় নেই’ বলতে লাগলেন। তিনি বললেন, তিনি বেঁচে থাকতে কোনো কিছুই তাদের ক্ষতি করতে পারবে না। এই কথা বলতে বলতে খুব দ্রুত ঘটনাস্থলে এসে যমরাজের দণ্ড ধরে ফেললেন। বর্ষাকালীন মেঘের মতো বারবার ভীষণ গর্জন করতে লাগল এবং অন্ধক এই যমদণ্ড হাতে নিয়ে সবেগে চারিদিকে ঘোরাতে লাগল। যমদণ্ডের আক্রমণ থেকে প্রহ্লাদের প্রাণ রক্ষা করবার জন্য দৈত্য ও দানব দলপতিগণ ‘ধন্য ধন্য করতে লাগল। যমরাজের কাছে অন্ধকের যমদণ্ড ঘোরাবার দৃশ্য অসহ্য মনে হল অথচ এই যমদণ্ড অন্ধকের কাছ থেকে পুনরুদ্ধার করার ক্ষমতা তার ছিল না। তাই যমরাজ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পালিয়ে গেলেন। তিনি অসুরদের বেঁধে নিলেন যুদ্ধাস্ত্র দড়ি দিয়ে এবং গদাঘাতে জর্জরিত করে তুললেন। এই সময় বরুণের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে তার কাছে এলো বীর বিরোচন। বরুণদেব জর্জরিত হয়ে পড়লেন বিরোচনের বজ্রের মতো সুকঠিন লৌহ নির্মিত শাবল জাতীয় অস্ত্র শক্তি নামক ক্ষেপণাস্ত্র, শর এবং মুগুরের আঘাতে। বিরোচন ভূপতিত হয়ে পড়ল বরুণদেবের গদার আঘাতে। বলবান বরুণ তৎক্ষণাৎ মত্ত হাতির মতো তাকে বেঁধে ফেললেন দড়ি দিয়ে। কিন্তু সেই বন্ধন শত শত খণ্ডে ছিঁড়ে ফেলেন বিরোচন প্রচণ্ড শক্তি প্রয়োগ করে।

বিরোচনের হাতে বন্দি হলেন বরুণদেব এবং বিরোচনের মত্ত হস্তী দাঁত ও পা দিয়ে বরুণের শরীরে আঘাত করতে লাগল। চন্দ্রদেব বরুণদেবের করুণ অবস্থা দেখে তিনি তার শরীরভেদী বাণ ছুঁড়ে সেই হাতিকে বিদ্ধ করলেন। চন্দ্রদেবের বাণে ক্ষতবিক্ষত ও উন্মত্ত হয়ে উঠে সেই হস্তী বরুণদেবকে মাটিতে ফেলে দিয়ে পদাঘাতে তাঁকে পিষে ফেলতে লাগল। এইভাবে আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হয়ে বরুণদেব হাতির দুটো পা বেশ দৃঢ়ভাবে ধরে ফেললেন। তারপর তিনি মুহূর্ত মধ্যে হাতির সঙ্গে বিরোচনকে আকাশ পথে নিক্ষেপ করলেন এবং হাত পায়ের সাহায্যে মাটিতে ভর দিয়ে মাথা তুলে হাতির লেজ ধরে নিলেন।

বরুণ কর্তৃক নিক্ষিপ্ত হয়ে বিরোচন ও তাঁর বাহন সেই হাতি ভূতলে পতিত হল। তখন মনে হল যেন স্বর্গ থেকে সূর্যদেব সুকেশিপুরকে ভূতলে ছুঁড়ে ফেললেন। এরপর বিরোচনকে বধ করতে ছুটে এলেন জলধিপতি বরুণ তার পাশ যুদ্ধাস্ত্র ও গদা হাতে নিয়ে। মেঘ গর্জনের মতো গভীর আর্তনাদ করে উঠল দৈত্য সেনারা। তারা সবাই ‘হায় হায়’ করে বলে উঠল, সেনাপতি এবার বরুণের হাতে মারা যাবেন। তারা বললেন, প্রহ্লাদ জম্ভ, কুজম্ভ সবাই অন্ধকের সাথে এসে বরুণের হাতে থেকে বিরোচনকে বাঁচান। তারা আরো বলল, তারা সকলে তাদের বাহন সহ বলবান বরুণের হাতে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে, যজ্ঞস্থলে পশুদের মহেন্দ্র যেমন নিহত করেন আমরাও তেমনি পাশ যুধাস্ত্র ও গদা দ্বারা বরুণদেব কর্তৃক নিহত হচ্ছি।

জম্ভ প্রভৃতি দানব সেনাপতিগণ দৈত্যপক্ষের এমন আর্তনাদ শুনে পতঙ্গ পালের আগুনের দিকে ধেয়ে যাবার মতো দ্রুতগতিতে বরুণের দিকে ধাবিত হল। বরুণ এসব দেখে বিরোচনকে ছেড়ে দিয়ে তার পাশ ও গদা নিয়ে জম্ভ প্রভৃতি দৈত্যদের দিকে ছুটে গেলেন ও অসংখ্য দৈত্যসেনা যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হল। বরুণ পাশাস্ত্রের আঘাতে ধরাশায়ী করলেন জম্ভকে, তার পদাঘাতে বৃত্র এক মুষ্টি নিক্ষেপ কুম্ভকে ধরাশায়ী করলেন। দৈত্যরা অস্ত্রশস্ত্র ফেলে দিয়ে যে যেদিকে পারল পালাল দেবশ্রেষ্ঠ বরুণ কর্তৃক বিমর্জিত হয়ে। বরুণের সাথে যুদ্ধ করবার জন্য অন্ধকাসুর তখন দ্রুত যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হল। তখন বরুণ গদা দিয়ে তাকে দারুণ আঘাত করল এবং পাশাস্ত্রে বেঁধে ফেললেন। দৈত্যরাজ অনুকও বরুণের দিকে তারই নিক্ষেপিত গদা ও পাশ ছুঁড়ে মারল মুহূর্ত মধ্যে, বরুণ খুব তাড়াতাড়ি সমুদ্রের জলে গিয়ে লুকিয়ে পড়লেন নিজের অস্ত্র নিজের দিকেই ছুটে আসতে দেখে। সমস্ত দেবসেনা দলিত মথিত হতে লাগল অন্ধকাসুর দারুণভাবে ক্ষেপে ওঠায়।

অগ্নিকে পবনদেব যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠিয়ে দিলেন এবং অগ্নি সমস্ত দৈত্যসেনা দগ্ধ করতে লাগল। মহাপরাক্রমশালী ময়দানব অগ্নির দিকে ছুটে এল। শম্বুরাসুরময়কে সাহায্য করার জন্য পাশে এসে দাঁড়াল। শম্বর ও ময়দানবের গলায় আঘাত করে সবলে তাদের দুজনকে চেপে ধরলেন পবন সহচর বহ্নি। শম্বর ভূতলে পতিত হল শক্তিনামক যুদ্ধাস্ত্রের আঘাতে, শম্বরের দেহ বিদীর্ণ হয়ে গেল। অগ্নিসংযোগে প্রজ্বলিত হয়ে উঠল শম্বর ও ময়ের সমস্ত শরীর। এই দৈত্য দুজন আগুনে দগ্ধ হয়ে ভীষণভাবে চিৎকার করতে লাগল, যেভাবে পশুরাজ সিংহর আক্রমণে আক্রান্ত হয়ে হাতি বেদনার কাতরভাবে যেভাবে রোদন করে। দৈত্যপতি অন্ধক রেগে গিয়ে চোখ লাল করে ফেলল শম্বরের সেই সকরুণ আর্তনাদে, তিনি জানতে চাইলেন শম্বর ও ময়দানবকে কে যুদ্ধে পরাজিত করল। অগ্নি শম্বরকে পুড়িয়ে মেরেছে একথা দৈত্যসেনারা তাকে জানালো এবং দৈত্যরাজকে অনুরোধ করল তাদের বাঁচানোর জন্য। তারা এই আগুনকে নিবারণ করতে পারছেন না। কিছুক্ষণের জন্য অগ্নিকে তার দহনকার্য বন্ধ রাখতে বললেন–হিরণ্যাক্ষনন্দন, অন্ধক সবেগে তার মুগুর হাতে তুলে অগ্নির দিকে ধাবিত হলেন।

হুতাশন আরো ক্রুদ্ধ হলেন অন্ধকের এই গর্বিত ও উদ্ধত বাক্যে। শম্বরকে অবিলম্বে ভূতলে ফেলে দিয়ে সজোরে মাটিতে পিষতে লাগলেন। এক বিশাল মুগুর দিয়ে হুতাশনের মাথায় আঘাত করলেন। অন্ধক প্রহারে আহত হয়ে শাম্বরকে পরিত্যাগ করে অন্ধকের দিকে ছুটে গেলেন। অন্ধক পুনরায় তাঁর মাথায় প্রবলবেগে আঘাত করল। অগ্নি মুগুর দিয়ে তাকে এভাবে ছুটে আসতে দেখে ভয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে অগ্নি পলায়ন করল মাথায় বারবার আঘাত পেয়ে।

এরপর প্রবল পরাক্রম অন্ধকাসুর, বরুণ, চন্দ্র, সূর্য, সাধ্যদেবগণ, বসুগণ কিংবা অশ্বিনী কুমারদ্বয় এইসব দেব যোদ্ধাদের বাণ নিক্ষেপ করে আঘাত করতে লাগল। তারা কালমাত্র দেরি না করে রণে ভঙ্গ দিয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়ন করল। এভাবে ইন্দ্র, রুদ্র, যম, সোম প্রভৃতি দেবসেনানী পরাজিত হলেন অন্ধকাসুরের কাছে। একারণে অন্ধকাসুরকে দানব দলপতিরা বিশেষভাবে সম্মানিত করল। মর্ত্যের সমস্ত রাজা তার বশীভূত হল। তিনি স্বর্গ থেকে মর্ত্যে নেমে তাদের কর দানে বাধ্য করলেন। এভাবে সমস্ত চরাচর অন্ধকের কাছে অবনত হল। এরপর অন্ধক পাতালের প্রধান নগর অশ্মকে এসে সিদ্ধগণও সেখানে গিয়ে বাস করতে লাগলেন।