১৭. রাজা দিবোদাসের কথা

রাজা দিবোদাসের কথা

সৃষ্টির রক্ষার জন্য আলো, বাতাস, জল এই তিনটি অবশ্যই চাই। কোন একটির অভাব যদি হয় তাহলে সৃষ্টি থাকবে না। একসময় পৃথিবীতে একটানা ষাট বছর ধরে চলল অনাবৃষ্টি। সব জলাশয় গেল শুকিয়ে। ফসল জন্মালো না। চারিদিকে দেখা দিল অনাহার মহামারী। এইসব দেখে চিন্তায় পড়লেন ব্রহ্মা, তাঁর সাধের সৃষ্টি এইভাবে বিলুপ্ত হবে। এর একটা সমাধান করতেই হবে। তিনি কি করবেন বুঝতে পারছেন না। সত্যলোক থেকে চলে এলেন পৃথিবীতে। ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলেন সবকিছু। পৌঁছালেন কাশীতে। সেখানে রিপুঞ্জয় নামে এক রাজর্ষি তপস্যায় মগ্ন ছিলেন।

ব্রহ্মা তাঁর কাছে গিয়ে বললেন– হে রাজর্ষি, তুমি পৃথিবীর রাজা হও। রিপুঞ্জয় বললেন– না বিধাতা তা হয় না। রাজকার্য আমার ভালো লাগে না। তাই তো তপস্যায় বসেছি। দয়া করে আমাকে এই দায়িত্ব নিতে বলবেন না।

ব্রহ্মা বললেন– হে রাজন, তুমি একবার এই পৃথিবীর দিকে চেয়ে দেখ, চারিদিকে এত হাহাকার! তুমি পরম ধার্মিক। তুমি রাজা হলেই পৃথিবীতে আবার শান্তি ফিরে আসবে। পৃথিবী শস্য-শ্যামলা হবে। প্রজারা সুখে বাস করবে। তাই পৃথিবীকে রক্ষা করার জন্যই তোমাকে এই কাজ করতে বলছি।

স্বয়ং ব্রহ্মা অনুরোধ করছেন। তাঁর বাক্য অমান্য করা উচিত নয়। রিপুঞ্জয় বললেন– হে বিধাতা, আমি আপনার আদেশ পালন করতে রাজী আছি। কিন্তু একটা শর্তে।

ব্রহ্মা কি শর্ত জানতে চাইলেন। রাজর্ষি বললেন– দেবতাগণকে ফিরে যেতে হবে স্বর্গে। আর যক্ষ, নাগ, গন্ধবআদি যার যেখানে বাস সবাই চলে যাবে সেখানে। পৃথিবীতে থাকবে কেবল মানুষ, অন্য কেউ নয়।

রাজর্ষির কথায় ব্রহ্মা স্বস্তি পেলেন না, তবুও সৃষ্টিকে রক্ষার জন্য রাজী হলেন রিপুঞ্জয়ের শর্তে।

দিবোদাস নাম নিয়ে রিপুঞ্জয় হলেন পৃথিবীর রাজা। তারপর তিনি ঢেঁড়া পিটিয়ে ঘোষণা করলেন–দেবতারা ফিরে যাবে দেবলোকে। যক্ষরা যক্ষলোকে, নাগেরা নাগলোকে, পৃথিবীতে থাকবে কেবল মানুষ। অন্য কারো থাকা চলবে না। দিবোদাসের শর্ত মেনেই ব্রহ্মা তাঁকে পৃথিবীর সম্রাট করেছেন। কাজেই প্রতিবাদ করতে পারবেন না। এই ব্যাপার তিনি শিবের সঙ্গে পরামর্শ করতে চাইলেন। এইজন্য তিনি কাশীতে গেলেন, শিব তখন প্রাসাদ থেকে বেরিয়েছেন মন্দারকে বর দেবার জন্য। ব্রহ্মাকে দেখেই বললেন– আমি এক্ষুনি কুলদ্বীপ যাব, সঙ্গে পার্বতী, তুমিও চল আমার সঙ্গে। মন্দার কঠোর তপস্যা করছে, তাকে বর দিয়ে আসি।

ব্রহ্মা যে কথা বলতে এলেন সে কথা তার বলা হল না।

তিনজনেই পৌঁছলেন মন্দারের সামনে। মন্দার চোখ মেলে তাকাল, সামনে ব্রহ্মা আর হর-গৌরী। খুব খুশি হয়ে প্রণাম জানাল সে।

তখন মহাদেব বললেন– হে মন্দার, তুমি এমন কঠোর তপস্যা করছ কেন? কোন্ বর পেলে তুমি খুশি হবে।

মন্দার বলল– আপনি সপরিবারে আমার উপরেই বাস করুন। তাতেই আমি ধন্য হব। অন্য কোন ইচ্ছা আমার নেই।

মন্দারের প্রার্থনা শুনে মহাদেব মুস্কিলে পড়লেন। তাঁর সাধের কাশী, এমন সুন্দর স্থান ছেড়ে অন্য কোথাও থাকতে তার ইচ্ছা নেই। কিন্তু মন্দার যেভাবে কঠোর তপস্যা করেছে, তাকে বর দিতেই হবে।

ব্রহ্মা এতক্ষণ যে কথা বলার সুযোগ পাচ্ছিলেন না, তা তিনি এবারে পেয়ে গেলেন। বললেন– দিবোদাসের কথা। শর্ত অনুসারে দেবতাদি সকলকেই পৃথিবী ছেড়ে থাকতে হবে। হে হর, মন্দারেরও অভিলাষ পূর্ণ হবে। আপনি মারেই বাস করুন। আপনি যদি মন্দারের বাসনা পূর্ণ না করেন, তাহলে দিবোদাসের কাছে আমি মিথ্যাবাদী হয়ে যাব। ব্রহ্মার কথা শুনে শিব বললেন– তাই হোক। তোমার কথা রক্ষা হবে, আর মন্দারের বাসনা পূর্ণ হবে।

সপরিবারে মহাদেব চললেন কুলদ্বীপে। দেবতারা চললেন স্বর্গে। নাগ-যক্ষ সবাই যে যার জায়গায় চলে গেলেন। দেবতারা স্বর্গে ফিরে সেখানকার ভোগসামগ্রী উপভোগ করছেন। কিন্তু তাঁদের মনে পড়ে আছে সেই পৃথিবীর দিকে। মন্দারে শিবের কোন কষ্ট নেই। তবুও যেন শান্তি নেই। সকলেই চিন্তা করেন দিবোদাস তো মানুষ। মানুষের পরমায়ু আর কত হবে একদিন তো মরবেই তখন যাওয়া যাবে পৃথিবীতে।

একের পর এক বছর কাটে। আশি হাজার বছর পার হয়ে যায়। তবু দিবোদাস জীবিত থাকে। মহাদেব কাশীতে ফিরতে পারছেন না। দেবতাদের মনেও স্বস্তি নেই। তাঁরা চিন্তা করছেন কিভাবে দিবোদাসের পতন হবে।

গুরু বৃহস্পতির কাছে জানতে চাইলেন, দেবতারা কেমন করে দিবোদাসের পতন হতে পারে। বৃহস্পতি বললেন– দেখতে হবে তার শাসন ঠিক ঠিক চলছে কিনা? যদি না চলে তবেই তার পতন ঘটানো সম্ভব। তখন গোপনে দেবতারা সারা পৃথিবী ঘুরে দেখল– না কোন অধর্মই নেই কোন অশান্তি নেই। তাহলে তাকে পতন করা যাবে কীভাবে? সবাই চিন্তায় পড়লেন। বৃহস্পতি বললেন– তোমরা পৃথিবী ছেড়ে চলে এসেছে। কিন্তু তোমাদের শক্তিকে রেখে এলে কেন? সেই শক্তিকেও যদি সরিয়ে নাও, তাহলে রাজা বিপদে পড়বে।

দেবতারা অবাক হয়ে বললেন– কি রকম, বৃহস্পতি বললেন– অগ্নি চলে এসেছে। কিন্তু তাঁর শক্তিতে অর্থাৎ অগ্নির সাহায্যে মানুষ রান্নাবান্না করছে। বরুণ চলে এসেছে। কিন্তু তাঁর শক্তি জল পৃথিবীর সর্বত্রই আছে। তাই তোমরা চলে এলেও তোমাদের শক্তিতে দিবোদাসের খুব সুবিধাই হচ্ছে। দেবতারা বৃহস্পতির কথা শুনে চিন্তা করলেন, সত্যি তো! আমরা এ কথাটা একবারও ভেবে দেখিনি।

তখন দেবতারা প্রত্যেকেই তাঁদের শক্তিকে আকর্ষণ করে নিলেন। পৃথিবীতে আর আগুন জ্বলে না। আর জলের অভাবে সব কাজ বন্ধ। তেষ্টায় গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। শস্যক্ষেত্রে ফসল শুকিয়ে যাচ্ছে। সবাই ছুটে এল রাজদরবারে। দিবোদাসকে জানালো বিপদের কথা। শুধু প্রজাদের কষ্ট নয়, খোদ। রাজার প্রাসাদেই আগুনের অভাবে রান্নাবান্না বন্ধ। তখন দিবোদাস সবাইকে শান্ত করে বললেন–আমার একটু ভুলের জন্য সকলের এত কষ্ট হল। দেবতাদের পৃথিবী থেকে চলে যেতে বলায় তাঁরা চলে গেলেন। কিন্তু তাঁদের শক্তি সব ছিল। এখন তাঁরা আমাকে জব্দ করার জন্য তারা তাদের শক্তিকেও টেনে নিলেন। যাতে তোমরা সকলে আমার প্রতি বিদ্রোহ কর, প্রজাগণ তোমরা ভয় পেয়ো না। আমি একাই সব শক্তি সৃষ্টি করে তোমাদের সকল অভাব দূর করব।

তারপর মহাযোগী দিবোদাস কেবলমাত্র কুলদেবতা ভাস্করকে রেখে আর সকলকে বিদায় দিয়ে নিজেই যোগবলে সমস্ত শক্তি সৃষ্টি করে সকল প্রজাগণকে শান্তিতে রাখলেন।

পৃথিবীর রাজা বৃহস্পতির বুদ্ধিকে ব্যর্থ করে দিলেন। দেবতারা ভাবলেন তাহলে কি তাঁরা কখনও পৃথিবীতে আসতে পারবেন না? ওদিকে মহাদেবও দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছেন, মনে নেই কোন আনন্দ, মুখে নেই কথা, পার্বতী স্বামীর অবস্থা দেখে খুবই দুঃখ পান।

তখন পার্বতী শিবকে বললেন–একটা মানুষকে এত ভয়? হে মহেশ, আপনি ইচ্ছা করলেই দিবোদাসকে সরিয়ে দিতে পারেন। আর কাশীতেও বাস করতে যেতে পারেন। শিব বললেন–পার্বতী তুমি যা বলছ, তা তত সহজ নয়। যা ইচ্ছা করব, তাই করা যায় না। ধর্মের রক্ষক হয়ে অধার্মিকের মত আচরণ আমাদের সাজে না। দিবোদাস যতক্ষণ ধর্মপথে থাকবে, ততক্ষণ আমরা তার কোন ক্ষতি করতে পারি না। আগে জানতে হবে তার দ্বারা কোন অধর্ম হচ্ছে কিনা?

মহাদেবের চেষ্টায় যোগিনীদের পাঠিয়ে দিলেন পৃথিবীতে তার অনুমতি নিয়েই, চলল তারা সর্বত্র ঘুরে ঘুরে দেখল নানান বেশ ধরে, কেউ ভাল খায়, কেউ তুকতাক করে, লোকের মন ভোলাতে চেষ্টা করে, কিন্তু না, কেউ সফল হল না, পৃথিবীর প্রজারা সকলেই ধর্মপরায়ণ।

যোগিনীরা এখন কি করবে? ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেলে হর-পার্বতী কথা শোনাবে। তারা ভাবল, তার চেয়ে কাশীধামেই থেকেই যাই।

থেকেই গেল তারা। যোগিনীরা ফিরল না দেখে শিব সূর্যকে ডেকে বললেন– হে আদিত্য, তুমি গিয়ে দেখ তো, পৃথিবীর মানুষেরা কি সকলেই ধর্মপথে রয়েছে? যদি থাকে, তাহলে তাদের কোন ক্ষতি করো না। আর যদি কোন অধর্ম দেখতে পাও, তাহলে আমাকে বলবে।

সুর্যদেব কাশীতে এলেন। নানা বেশ ধরে ঘুরতে লাগলেন সর্বত্র, কিন্তু কোথাও কোন অধর্মের চিহ্ন পর্যন্ত দেখতে পেলেন না। কি বলবেন শিবকে? তাই ফিরে না গিয়ে স্যও রয়ে গেলেন কাশীতে। মহাদেব আর কাশী ছাড়া থাকতে পারবেন না, তাই ব্রহ্মাকে ডেকে বললেন– ব্রহ্মা তুমি দিবোদাসের শর্ত মেনে নিয়ে আমাকে ও সকল দেবতাগণকে এমন বিপাকে ফেলেছ যে, তার সীমা নেই। এখন কি যে করা যায়? তুমি একবার পৃথিবীতে গিয়ে দেখ না, যদি কোন অধর্মের চিহ্ন থাকে।

ব্রহ্মা কোন উত্তর না করেই কাশীতে এসে বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের বেশ ধরলেন। উপস্থিত হলেন দিবোদাসের কাছে। রাজা ব্রহ্মাকে দেখেই সিংহাসনে ছেড়ে উঠে পড়লেন, প্রণাম জানালেন ভক্তিভরে। আসনে বসিয়ে নানা সেবাযত্ন করলেন, তারপর হাতজোড় করে বললেন– হে ব্রাহ্মণ ঠাকুর, আপনার জন্য আমি কি করতে পারি?

ব্রাহ্মণবেশী ব্রহ্মা বললেন– এই কাশী এক পুণ্য ক্ষেত্র, এখানে আমি যজ্ঞ করতে চাই। আমি গরীব ব্রাহ্মণ, যজ্ঞ করার অর্থ আমার নেই। তাই আমি এসেছি আপনার কাছে, আপনি যদি এই ব্যবস্থাটুকু করে দেন, তাহলে আমার কামনা পূর্ণ হয়। আপনি একজন মহান ধার্মিক রাজা, আপনার রাজ্যে সকল প্রজাই সুখে আছে। যদি আপনি আমার এই সুখের ব্যবস্থা করেন।

ব্রাহ্মণের কথা শুনে দিবোদাস খুব খুশি হল। বললেন– হে ব্রাহ্মণ, আজ আমার পরম সৌভাগ্য, বহুদিন হল আমি রাজত্ব করছি। এমন প্রস্তাব নিয়ে কেউ আগে আসেনি। আমার রাজকোষে যত অর্থ সঞ্চিত রয়েছে, তার এক পয়সাও আমি আমার নিজের জন্য ব্যয় করিনি। সবই জমা আছে। আজ আমি সেইসব অর্থ আপনাকে দান করলাম যজ্ঞের জন্য, আপনি যজ্ঞ শুরু করুন।

ছদ্মবেশী ব্রহ্মা যজ্ঞ শুরু করলেন। সকল সামগ্রী সংগ্রহ করে দিলেন রাজা দিবোদাস। একান্ত অনুগত দাসের মত তিনি আনন্দের সঙ্গে সকল কাজে সহায়তা করলেন। এক এক করে দশটি যজ্ঞ করলেন ব্রহ্মা। রাজা তার ভাণ্ডার উজাড় করে দিলেন। দিবোদাস ধার্মিক রাজা ছিলেন। ব্রহ্মা কোন খুঁত পেলেন না। কাজেই তাই আর স্বর্গে ফিরে যাওয়া হল না। রয়ে গেলেন কাশীতে।

মহাদেব অস্থির হয়ে পড়লেন। পাঠালেন সেরা সেরা ছত্রিশজন অনুচরকে। সবাই চেষ্টা করল কোনো খুঁত ধরার জন্য। কিন্তু না সকলেই ব্যর্থ হল। রয়ে গেল তারা কাশীতে। মহাদেবের উৎকণ্ঠা আরো বাড়ল। যে যায় কাশীতে সে রয়ে যায়। ফিরে আসে না কেউ। ব্যাপারটা কি? কেউ ফিরছে না কেন? যাই হোক, আমি যেতে না পারি আমার আপনজন তো সকলেই যেখানে গিয়ে বাস করছে। তাদের থাকা মানে আমারই থাকা হল।

কিন্তু মহেশ্বরের মন মানল না। মনে পড়ল গণেশের কথা, ডাকলেন তাঁকে। বললেন–গণেশ, তুমি তো জানো, কাশী আমার প্রিয়। কি একটা সামান্য কারণে সেখানে যেতে পারছি না, অনেককেই পাঠালাম সেখানে, কেউই ফিরে এল না। আসলে ব্যাপারটা যে কি, তা বুঝতে পারছি না। তুমি একবার গিয়ে দেখতো, কোথাও কোন অশান্তি আছে কিনা?

পিতার আদেশে গণেশ চললেন কাশীধামে। দেখলেন– কোথাও কোনো অশান্তি নেই। দিবোদাস বললেন, এখন আর আমার ভালো লাগে না। এ থেকে আমি রেহাই পেতে চাই।

গণেশ বললেন–আপনার সব কিছুই আমি জানি। তবে আমি নিজে কিছু বলব না। আজ থেকে আঠারো দিন পরে আপনার কাছে এক ব্রাহ্মণ আসবেন, তিনিই সব বলবেন আপনাকে।

এই কথা বলে গণেশ চলে গেলেন কাশীতে। এদিকে গণেশ ফিরে না চাওয়ায় শিব বিষ্ণুর শরণাপন্ন হলেন। তখন বিষ্ণু লক্ষ্মীকে নিয়ে গরুড়ের পিঠে চড়ে এলেন কাশীতে। বিষ্ণু ধরলেন বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর বেশ। নাম ধরলেন পুণ্যকর্তা, লক্ষ্মী হলেন পরিব্রাজক আর গরুড় তাদের শিষ্য বিনয় কীর্তি।

এভাবে তারা নগরে ঢুকে বৌদ্ধশাস্ত্রের সহজিয়া পথ শেখাতে লাগলেন সবাইকে। কেউ এর প্রশ্ন করলে, সহজভাবে বুঝিয়ে দিলেন পুণ্যকীর্তি। বলতে লাগলেন–যাগযজ্ঞ, পূজামে, পশুবলির দ্বারা স্বর্গলাভ হয় না। মানুষের দেহটা বেশিদিন থাকতে পারে না। রোগ-জরা গ্রাস করবে। মুক্তি কথার অর্থ হল আনন্দ, তা যদি পেতে হয়, দেহের সামর্থ্য থাকতে থাকতেই করা উচিত।

সবাই পুণ্যকীর্তির কথা শুনে বুঝল ইনি ঠিক কথাই বলছেন, দেহটা যদি ঠিক না থাকে, তাহলে কিছুই ঠিক থাকে না। ভয়ে ভয়ে সবাই কাশী ছেড়ে চলে যেতে লাগল। এদিকে রাজঅন্তঃপুর থেকে রানিরাও শুনেছেন গুণমুগ্ধ রূপী গণেশের গণনার অকাট্য সত্যতা। তাই দূত মারফত তাঁকে গোপনে অন্দরমহলে আনিয়ে জানতে চাইলেন, তাদের ভবিষ্যতের কথা। গুণমুগ্ধ তাদের হাত না দেখেই এমন সব কথা বলতে লাগলেন, যা সেই রানিরা ছাড়া অন্য কেউই জানেন না। অবাক হয়ে গেলেন সকলে তার অদ্ভুত গণনায়। গজানন এইভাবে কৌশলে রানিদের মনও জয় করলেন।

একদিন কথায় কথায় রানি লীলাবতী রাজা দিবোদাসকে গণকের কথা বললেন। এমন একটা। গণনা ইতিপূর্বে কেউ কখনই শোনেনি। রাজার ইচ্ছা হল গণকঠাকুরের সঙ্গে দেখা করবেন। রানি দূতের দ্বারায় গুণমুগ্ধকে আনালেন রাজদরবারে। রাজা তাঁর পরিচয় নিয়ে সমাদর করে সেদিনের মতো বিদায় দিলেন।

রাজার মনটা চঞ্চল হয়ে উঠল। পরদিন সকালেই আবার ডেকে পাঠালেন সেই গণকঠাকুরকে। রাজসভায় নয়, একেবারে অন্দরমহলে নিজের ঘরেই। বসবার আসন দিয়ে রাজা জিজ্ঞাসা করলেন–আপনাকে দেখে আমার মনে হচ্ছে, আপনি একটা সৎ পরামর্শ দিতে পারবেন। তাই ডেকে পাঠালাম আপনাকে। বহুদিন হল রাজ্যশাসন করছি, কিন্তু করার মতো কোন কিছুই লক্ষ্য পড়ল না তার তখন। বাবার কষ্টের কথা চিন্তা করে গণেশ একটা উপায় স্থির করলো। গণৎকারের বেশ ধরলেন। গুণমুগ্ধ নাম ধরলেন। সংসারের মানুষেরা ভাগ্যের ফলাফল জানতে খুব আগ্রহী। ঘুরতে লাগলেন প্রতি দ্বারে। প্রথম প্রথম কেউই তেমন আগ্রহ দেখাল না। কিন্তু গণেশ তাদের মুখ চোখ দেখেই বলতে লাগলেন। তাদের বর্তমান ও ভবিষ্যতের কথা।

নগরবাসীরা বুঝতে পারল, গণকঠাকুর যা বলেছে সবই সত্য, মোটেও তিনি কাউকে ঠকাচ্ছেন না। তখন অনেকেই তার শরণ নিল। এখন গণেশ বুঝলেন– তার ফাঁদে পা দিয়েছে অনেকেই এবার নতুন খেলা শুরু করা যাক। সবাইকে স্বপ্ন দেখালেন রাতে। পরের দিন সকালে তাদের কাছে গিয়ে স্বপ্নের কথা হুবহু বলে দিতে লাগলেন। তারপর বললেন–এই রাজ্যে অল্পদিনের মধ্যেই খুব ক্ষতি হবে। খুব সাবধানে থাকা দরকার। কিংবা যদি কাশী ছেড়ে অন্য কোনো স্থানে চলে যেতে পারো, তাহলে কিন্তু কোনো বিপদের সম্ভাবনা থাকবে না।

এইভাবে গণেশ প্রায় প্রত্যেকেই আলাদা আলাদা ভাবে একই কথা বলতে লাগলেন।

ইতিমধ্যে সবাই গুণমুগ্ধের কথায় বিশ্বাস করেছে। এখন তাই আর অবিশ্বাস করার কথা থাকে না। তখন আনন্দ পেয়েও কি হবে?

তখন মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে পড়ল। ধর্মের নামে অনাচার শুরু করে দিল সবাই। গণেশ এতদিন সবাইকে বিভ্রান্ত করে রেখেছিলেন তাই বিষ্ণুর দ্বারা এত সহজেই মানুষ অত্যাচারী হয়ে উঠল।

পুণ্যকীর্তি পুরুষদের আর পরিব্রাজিকা নারীদের উপর সহজেই প্রভাব বিস্তার করল। দলে দলে প্রায় সকলেই আসতে লাগল। তাদের শিষ্য-শিষ্যা হল। জাতিভেদ কেউ আর মানল না, বর্ণভেদও লোপ পেয়ে গেল। অনাচারে ভরে গেল দেশ।

যত অনাচার বাড়তে লাগলো, তত কমল দিবোদাসের প্রভাব। গণকঠাকুর বলছেন আঠারো দিন পরে এক ব্রাহ্মণ এসে সব বলবেন রাজাকে। তাই রাজা নিত্যই গুণছেন সেই দিনটি কবে আসবে, চারিদিকে অশান্তি, অনাচার সব খবরই পান তিনি। তাই মনটা ছটফট করেছে সেই ব্রাহ্মণের অপেক্ষায়। নির্দিষ্ট দিনে রাজার যেন সময় আর কাটতেই চায় না। এমন সময় এলেন সেই সুদর্শন ব্রাহ্মণ। রাজা দিবোদাস বুঝতেই পারলেন গণকঠাকুরের বলা সেই ব্রাহ্মণ এসে গেছেন। রাজা লুটিয়ে । পড়লেন তার চরণে, সিংহাসনে বসিয়ে পাদ্যাদি দিয়ে পূজা করলেন।

তারপর বললেন, আজ আমার পরম সৌভাগ্য দীর্ঘদিন ধরে পৃথিবী শাসন করছি। প্রজাদের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য দেখলাম। এখন আর পারছি না। এখন আপনি বলুন, আমি এর থেকে কেমন করে মুক্তি পেতে পারি। ব্রাহ্মণবেশী বিষ্ণু বুঝতে পারলেন– গণেশের দ্বারা কিভাবে পথ সব পরিষ্কার হয়ে আছে। জিজ্ঞাসা করলেন –আপনি তো সাধারণ রাজা নন রাজর্ষি, তাহলে আপনার মনে অশান্তির কারণ কি?

রাজা বললেন–কেন এমন হল? হয়তো দেবতাদের বিতাড়িত করে নিজেই সব দায়িত্ব নেওয়ার অপরাধে এমন হল। ব্রাহ্মণ বললেন–না না সেজন্য নয়, তাতে দেবতাদের তো কোন অপকার হয়নি। রাজা বললেন–তাহলে কেন আমি এত দুর্বল, বুঝতে পারছি না। এখন আপনি যা বলবেন আমি তাই করব।

ব্রাহ্মণ বললেন–এই কাশীধাম হল দেবাদিদেব মহাদেবের প্রিয় স্থান, আপনি তাকে এখান থেকে বের করে দিয়ে ভালো করেননি। আপনি তার আরাধনা করুন, সাতদিনের মধ্যেই আপনার অশান্তি কেটে যাবে।

দিবোদাস ব্রাহ্মণের কথামতো গঙ্গার তীরে নতুন এক প্রাসাদ তৈরি করলেন। এক শিবলিঙ্গ তৈরি করে প্রতিষ্ঠা করে নিত্যদিন তার সেবা পূজা করলেন। একমনে ধ্যান করতে লাগলেন।

কাশীর পঞ্চনদের কাছে বিষ্ণু রয়ে গেলেন, গরুড়কে পাঠিয়ে দিলেন মন্দারে, দিবোদাসের সব খবর জানালেন শিবকে।

মাত্র সাতদিন শিব সাধনার পর দিবোদাস মুক্ত হয়ে চলে গেলেন স্বর্গে।

শিব ফিরে এলেন কাশীতে। কিন্তু সেই পুরোনো প্রাসাদে নয় নতুন প্রাসাদ তৈরি করে দিলেন বিশ্বকর্মা, বহু সোনা আর রত্নরাজি দিয়ে। সেই প্রাসাদে মহাদেব পুরো পরিবার নিয়ে আজও বাস করছেন।