১৬. অমিত্রজিতের দানব সংহার

অমিত্রজিতের দানব সংহার

অমিত্রজিৎ পরম ধার্মিক রাজা ছিলেন। মহাবলশালী এবং কৃষ্ণভক্ত। তার শাসনে সকল প্রজারাই খুশি। রাজ্যে কোন চোর ডাকাত নেই। তাই সবাই শান্তিতে আছে।

একদিন রাজসভায় রাজা মন্ত্রীর সঙ্গে বসে রাজ্য নিয়ে আলোচনা করছেন। এমন সময় সেখানে নারদঠাকুর এসে হাজির হলেন। রাজা অমিত্রজিৎ সিংহাসন থেকে উঠে পাদ্য অর্ঘ্য দিয়ে সেবা করলেন তাঁর। রাজার সেবায় নারদ খুব প্রসন্ন হলেন। রাজার বহু প্রশংসা করলেন। রাজা কিন্তু এমন প্রশংসা শুনে দেবর্ষিকে বললেন, না না আমি নই। সবই শ্রীকৃষ্ণের কৃপা। আমরা নিজের ক্ষমতায় কিছু করতে পারি না কখনও, যাই হোক আপনার আসার কারণ কি? নারদ বললেন– রাজা, তুমি ঠিক বলেছ। তাঁর কৃপা ছাড়া কেউ কিছু করতে পারে না। বৃথাই মানুষ অহঙ্কার করে। এখন আমি এসেছি তার কারণ হল কঙ্কালকেতু নামে এক দানব মলয়গন্ধিনী নামে এক বিদ্যাধরী গন্ধর্ব কন্যাকে হরণ করে তাকে চম্পাবতী নগরে লুকিয়ে রেখেছে। তাকে উদ্ধার করে তুমি বিয়ে কর।

আমি পাতাল গিয়েছিলাম হঠকেশ্বর শিব দর্শনে, সেখানেই সেই মলয়গন্ধিনীর সঙ্গে দেখা হয় আমার। সে নিজেই বলল তার কাহিনি। একদিন সে গন্ধমাদন পর্বতে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। এমন সময় দানব কঙ্কালকেতু তাকে মায়াবলে চুরি করে নিয়ে যায় তার চম্পকাবতী পুরীতে। সামনের তৃতীয়া তিথিতে তাকে বিয়ে করবে।

গন্ধর্বকন্যা হবে দানব-ঘরণী। সে দুঃখে কাঁদতে লাগল। দেবী ভগবতীর পূজা করল ভক্তিভরে। তারপর তার স্তব ও স্তুতি করলো। তখন দেবী তাকে সাক্ষাৎ দিয়ে বললেন–হে নন্দিনী, তোমার কোনো ভয় নেই। তোমার বিয়ে হবে এক কৃষ্ণ ভক্তের সঙ্গে। কঙ্কালকেতুকে সেই কৃষ্ণভক্ত রাজা বধ করবে।

এই কথা বলে দেবী অদৃশ্য হয়ে গেলেন। তারপর আমি সেখানে যাই। তখন সেই মলয়গন্ধিনী আমাকে দেবীর আশীর্বাদের কথা বলল। তখন আমি ভাবলাম কৃষ্ণ ভক্ত যুবক রাজা পৃথিবীতে কে আছে? ভাবতে ভাবতে মনে পড়ল তোমার কথা। তাই চলে এলাম তোমার কাছে। তুমিই পারবে সেই গন্ধর্ব কন্যাকে উদ্ধার করতে।

রাজা অমিত্রজিৎ বিস্ময়ে হতবাক। তারপর বললেন– হে দেবর্ষি, আমি তো চম্পকবতী চিনি না, তাহলে কেমন করে উদ্ধার করব সেই কন্যাকে। কেমন করেই বা মারব দানবকে?

দেবর্ষি রাজাকে পথের সন্ধান দিলেন–তুমি একটা পালতোলা নৌকায় করে সাগরে যাবে। দেখতে পাবে একটি সুন্দর রথ উঠবে সাগর থেকে। সেই রথে এক দিব্যকন্যা থাকবে, যার হাতে বীণা থাকবে, সে গান করবে, সেই গানটি হল–ভাল হোক মন্দ তোক কর্ম অনুসারে করিবে ফলের ভোগ ধরার মাঝারে।

এই গানটি যখন শেষ হয়ে যাবে, তখনই রথটি আবার সমুদ্রে ডুবে যাবে। তখন তুমি তোমার নৌকা থেকে সেই রথের উপরে ঝাঁপ দেবে, কিছুক্ষণ পরে দেখবে তুমি পৌঁছে গেছো চম্পকবতী নগরে। সেখানেই পাবে সেই মলয়গন্ধিনীর দেখা। তারপর তুমি তারই কথামত দানবকে মেরে তাকে উদ্ধার করে নিয়ে আসবে। এই বলে দেবর্ষি চলে গেলেন, তার নিজের বাহন ঢেঁকিতে চড়ে।

একটা পালতোলা নৌকা নিয়ে রাজা বেরিয়ে পড়লেন। মাঝ সমুদ্রে যখন তিনি উপস্থিত হলেন তখন একটা রথ সমুদ্রের ভিতর থেকে উঠে এল। রথের মধ্যে এক সুন্দরী গান ধরল ভাল হোক মন্দ হোক, কর্ম অনুসারে/ করিবে ফলের ভোগ ধরার মাঝারে।

গান শুনে রাজা বুঝলেন, দেবর্ষি যা বলেছিলেন তা সবই সত্য। গান শেষ হতেই রথ ডুবল সমুদ্রের জলে। রাজাও ঝাঁপ দিলেন তখন রথের ওপর, তারপর অল্পক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে গেলেন চম্পকবতী নগর। দেখতে পেলেন এক বিরাট প্রাসাদ। দারোয়ান ও বহু লোক উপস্থিত সেই প্রাসাদে। কিন্তু দেবীর কৃপায় রাজাকে কেউ দেখতে পেল না। তারপর রাজা ঢুকে পড়লেন সেই ঘরে। সেখানে মলয়গন্ধিনী রয়েছে।

একটা খাটের উপর শুয়ে মলয়গন্ধিনী কাঁদছে। রাজা যেই সেই ঘরের মধ্যে ঢুকলেন তখন মলয়গন্ধিনী চমকে উঠলেন। অবাক হয়ে রাজাকে দেখলেন। সে বুঝতে পারল এই সেই কৃষ্ণভক্ত রাজা, যে তাকে উদ্ধার করতে এসেছে। সে তাড়াতাড়ি উঠে পড়ল খাট থেকে। রাজার হাত ধরে নিয়ে গেল পাশের ঘরে, যেখানে কঙ্কালকেতুর অস্ত্রাগার। বলল– রাজপুত্র, এখানে দানব কঙ্কালকেতু এসে পড়লে কারোও রক্ষা থাকবে না, তার ত্রিশূলের ঘায়ে সবাই মরবে। তাই যে করেই হোক তার হাত থেকে ত্রিশূলটা নিতে হবে। তারপর ঐ ত্রিশূলের ঘায়েই মরবে ওই দানব। শিবের বরে অন্য কোন অস্ত্র দ্বারা ওই দানব মরবে না। এখন তুমি এখানে লুকিয়ে থাক। ওর আসার সময় হয়েছে।

এই কথা বলে মলয়গন্ধিনী নিজের ঘরে চলে গেল। কিছুক্ষণ পরে কঙ্কালকেতু এল অনেক সোনা, নানারকম রত্ন নিয়ে, ঢেলে দিল মলয়গন্ধিনীর পায়ের কাছে, বলল– এসব তোমার। আমার এই প্রাসাদের যা কিছু আছে সবই তোমার হবে। বল, কি চাই? তুমি আমার রানি হবে, তাই তুমি যা চাও তাই এনে দেব।

মদ খেয়ে এসেছে দানব, তাই কথাগুলো সে তোলাতে তোলাতে বলল– তারপর নেশার ঘোরে আর কথা বলতে পারল না। শুয়ে পড়ল মেঝের উপরেই। তারপর সে নাক ডাকতে লাগল।

দানবকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে মলয়গন্ধিনী তার পাশে পড়ে থাকা ত্রিশূলটি নিয়ে নিল। এবং সেটি নিয়ে পাশের ঘরে যে রাজা লুকিয়ে ছিল তাঁর হাতে গিয়ে দিল। বলল– এই ত্রিশূলের আঘাতেই মারতে হবে দানবকে। অন্য কিছু দিয়ে মরবে না সে। এক্ষুনিই ঘুমন্ত দানবকে মেরে আমাকে উদ্ধার কর।

হাতে ত্রিশূলটি নিল অমিত্রজিৎ এবং চলল সেই ঘরে যেখানে দানব ঘুমিয়ে আছে। ত্রিশূলটা তুলল তাকে মারার জন্য। কিন্তু ভাবল উচিৎ হবে না, ওর সঙ্গে যুদ্ধ করেই ওকে মারব।

এই ভেবে রাজা দানবের গায়ে একটা লাথি মারল, ঘুম ভেঙে গেল দানবের। দানব উঠে দেখল সামনে এক রাজা যার হাতে ত্রিশূল। সে তখন নিজের ত্রিশূলের খোঁজ করল। কিন্তু পেল না। বুঝতে পারল তার ত্রিশূলটাই রাজার হাতে। ক্রোধে ফেটে পড়ল দানব বলল কে তুমি? এখানে এলে কেমন করে? আমার ত্রিশূল তোমার হাতে কেন? ফিরিয়ে দাও আমাকে। দানবের গর্জনে সমস্ত প্রাসাদ যেন কাঁপতে লাগল। কিন্তু রাজা অমিত্রজিৎ নির্ভীক, কারণ তাঁর হাতেই আছে দানবের মরণাস্ত্র।

দানব বুঝতে পারল এবার তার মৃত্যু আসন্ন। সে একদিন গন্ধর্বকন্যাকে বলেছিল যে, সে অমর, কারণ তার মৃত্যু হবে একমাত্র এই ত্রিশূলে। এই ত্রিশূলত সে পেয়েছে শিবের কাছ থেকে। যাতে কেউ এই ত্রিশূলটি নিতে না পারে, তাই সে সবসময় এটা নিজের কাছে রাখত। কিন্তু আজ ঘুমিয়ে পড়ার জন্য তার এই অস্ত্র হাতছাড়া হয়ে গেল। কাজেই তাকে মরতে হবে। কিন্তু বিনাযুদ্ধে মরবে কেন? তাই সে বলল—তুমি কে? আমার ত্রিশূল আমাকে ফিরিয়ে দাও।

রাজা বলল–তোমার অস্ত্রাগারে তো অস্ত্রের কোন অভাব নেই। সেখান থেকে যত খুশি অস্ত্র নিয়ে এসো।

দানব তখন ক্রোধে রাজার বুকে মারল এক ভয়ঙ্কর ঘুষি। কিন্তু মহাবীর অমিত্রজিৎ স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে থাকল, এমন ভাব করল যেন কিছুই হয়নি।

রাজা বলল– দানব তোমার ঘুষি সহ্য করার ক্ষমতা আমার আছে, তা তুমি নিজের চোখে দেখতে পেলে। এবার আমি একটু তোমাকে পরীক্ষা করে দেখি।

এই বলে রাজা এক চড় মারল দানবের গালে। চড় খেয়ে দানব ঘুরতে লাগল লাটুর মত। তারপর লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। সেই সুযোগে রাজা ত্রিশূল বসিয়ে দিল তার বুকের উপর। চিৎকার করতে করতে দানবের দানবলীলা শেষ হয়ে গেল। মলয়গন্ধিনী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। দেবী ভগবতাঁকে প্রণাম জানাল। এমন সময় সেখানে নারদ মুনি এলেন এবং রাজাকে বললেন–সাবাস! আমি জানতাম তুমি এই কাজে সফল হবে। তুমি ছাড়া এই বীরত্বের কাজ কে পারবে? তাছাড়া কৃষ্ণের বলে বলীয়ান তুমি। এখন তোমরা চল, দেবী ভগবতীর ইচ্ছামত তোমাদের বিয়ের ব্যবস্থা করি।

তারপর দেবর্ষি পুরোহিত হয়ে অমিত্রজিতের সঙ্গে মলয়গন্ধিনীর বিয়ে দিলেন। তারপর তাদের চম্পকবতী নগর থেকে বের করে আনলেন অমিত্রজিতের রাজ্যে। তারা নারদকে পূজা করলেন, তারপর নারদ ফিরে গেলেন। কঙ্কালকেতুর মৃত্যুতে দেবতা, গন্ধর্বআদি সকলেই খুব খুশি হলেন। রাজা অমিত্রজিৎকে সবাই আশীর্বাদ করলেন। কৃষ্ণ ভক্তের জয় সর্বত্রই।