০৫. জগন্নাথ লীলা

জগন্নাথ লীলা

অবন্তীনগরের মহারাজ ইন্দ্রদ্যুম্ন পরম ধার্মিক বিষ্ণু উপাসক ছিলেন। তিনি রাজসূয় ও শত অশ্বমেধ । যজ্ঞ করেছিলেন। তাঁর রূপও যেমন গুণও তেমন।

একসময় তিনি এক তৈথিক ব্রাহ্মণের কাছে জানতে পারলেন যে দক্ষিণ দেশে সমুদ্রের তীরে শ্রীপুরুষোত্তম নামে একটি উত্তম ক্ষেত্র আছে। সেই ক্ষেত্রে নীলগিরি নামে এক পর্বত আছে। সেখানে বীনি নামে একটা কুণ্ড আছে। সেই কুণ্ডে স্নান করলে হাজার অশ্বমেধ যজ্ঞের ফল লাভ হয়। সেখানে সাক্ষাৎ জগন্নাথদেব শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্ম ধারণ করে বিরাজ করছেন। সেই দেবকে দর্শন করলেই

মুক্তিলাভ হয়। ‘ তৈথিক ব্রাহ্মণের মুখে এমন অপূর্ব কথা শুনে রাজার মন বিচলিত হল, তিনি মনস্থির করলেন অবন্তীনগরের বাস উঠিয়ে পুরুষোত্তম ক্ষেত্রেই বাস করব। কাজেই বসবাসের উপযোগী স্থান নির্ণয় করা দরকার। কিন্তু এই দুরূহ কর্মের জন্য কাকে প্রেরণ করবেন?–মহারাজ গভীর চিন্তায় নিমগ্ন হলেন।

তখন সেই ব্রাহ্মণ বললেন– আমার ভাই বিদ্যাপতি সেখানে যাওয়ার পথ চেনে। ওর সঙ্গে কয়েকজন লোক পাঠিয়ে দিন।

মহারাজ সেই ব্যবস্থা করলেন। বিদ্যাপতি চলছেন মনের আনন্দে। ভাবছেন আমার জন্ম সফল হল। আজ আমি নীলগিরি শৃঙ্গে শ্বেত পদ্মস্থিত মুক্তিদাতা চক্রধারী পুরুষকে দেখতে চলেছি। আজ আমার কি সৌভাগ্য!

এই রকম ভাবতে ভাবতে শ্রীবিষ্ণুর রূপ চিন্তা করতে করতে রথে চড়ে চলেছেন বিদ্যাপতি মহানদী পার হলেন। তারপর কিছুদূর গিয়ে বিদ্যাপতি এক গ্রামের সকল লোককেই চতুর্ভুজ রূপে দেখতে পেলেন। রথ থেকে নেমে তাঁদেরকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করলেন। চোখে আনন্দ ধারার অবিরল নির্গমণের জন্য তিনি আর কিছুই দেখতে পেলেন না। তখন তিনি হৃদয়ে ও বাইরে কেবল বিষ্ণুকেই দেখতে পেলেন।

এভাবে বিষ্ণুর ধ্যান, কখনও সাক্ষাৎ দর্শন, কখনও স্তব করতে করতে কতক্ষণ পরে নীলাচল পর্বত দেখতে পেলেন।

পর্বতের তলদেশে এসে রথ থেকে নামলেন। কিন্তু ওপরে ওঠার পথ খুঁজে পেলেন না। তখন তিনি সেই মুকুন্দদেবের শরণ নিলেন।

এমন সময় সেই পর্বতের বিপরীত দিকে কয়েকজনের কথাবার্তা শুনতে পেলেন। তাঁরা ভগবৎ বিষয়ক কথাই বলছেন। তাঁদের কথাবার্তা অনুসরণ করে বিদ্যাপতি তাঁদের কাছে গেলেন। সেখানে ছিল শবর জাতির বাস। সেখানে চতুর্ভুজ বৈষ্ণববৃন্দকে দেখে পরম আনন্দ সহকারে প্রণাম করে হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে রইলেন বিদ্যাপতি।

তারপর বিশ্বাবসু নামে এক বৃদ্ধ শবর হরিপূজা করে সেখানে এলেন। তাঁর দ্বাদশ অঙ্গে তিলক, সর্বাঙ্গে হরিচন্দন লেপন করা। বিদ্যাপতি সেই শান্ত বৈষ্ণবকে দেখে মনে মনে ভাবছেন– এই মহাত্মার কাছে দুর্লভ বিষ্ণুর সংবাদ পাব।

এমন সময় সেই শবররাজ বিদ্যাপতিকে জিজ্ঞাসা করলেন- হে বিপ্র, তুমি কোথা হতে এই দুর্গম বনে এলে? তোমাকে ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাতর দেখছি। আগে তুমি আহারাদি করে সুস্থ হও। তারপর আলাপ করা যাবে। এখন বল, তোমাকে পাকান্ন দেব না ফল মূলাদি খাবে? আজ আমার পরম সৌভাগ্য, জীবনও সফল হল, যেহেতু সাক্ষাৎ দ্বিতীয় বিষ্ণু-স্বরূপ তোমাকে আমি আমার গৃহে পেলাম।

বিদ্যাপতি বললেন–আমার ফলে কিংবা পাকে প্রয়োজন নেই, আমি যে কারণে এখানে এসেছি, সেটি আগে সফল করতে চাই। আমি অবন্তীপুরের রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন রাজার পুরোহিত, শ্রীবিষ্ণুর দর্শন লালসায় এখানে এসেছি। কোনো এক তীর্থযাত্রীর মুখে এই নীলমাধবের কথা রাজা শুনেছেন। তাই তিনিই আমাকে পাঠিয়েছেন। যতদিন না আমি ফিরে যাব ততদিন তিনিও এ ব্যাপারে উৎকণ্ঠিত চিত্তে থাকবেন। কাজেই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সেই বিষ্ণুদর্শন করান।

বিদ্যাপতির মুখে এমন কথা শুনে শবররাজ বিশ্বাবসু বিশেষ চিন্তান্বিত হলেন। হায়! আমাদের দুর্দৈব উপস্থিত হল। এই নির্জনে বিষ্ণুকে ব্রাহ্মণকে দেখালে সকলের কাছে জানাজানি হবে। আর যদি দেখতে না দিই, তাহলে ব্রাহ্মণ আমাকে অভিশাপ দেবেন। ব্রাহ্মণ বর্ণ শ্রেষ্ঠ, বিশেষ করে আজ ইনি আমার অতিথি। এর অভিলাষ পূর্ণ করতে না পারলে আমার ইহলোক পরলোক-দুই নষ্ট হবে।

শবররাজ এমন চিন্তা করতে করতে সহসা মনে করলেন প্রাচীন এক জনপ্রবাদ। এইস্থানে নীলমাধব ভূমিতলে অন্তর্হিত হলে ইন্দ্রের মত পরাক্রমশালী ইন্দ্রদ্যুম্ন নামে এক রাজা, যিনি মানবদেহেই ব্রহ্মলোকে পর্যন্ত যেতে পারেন। এই স্থানে এসে বিষ্ণুকে দারুমূর্তি রূপে স্থাপন করবেন। তাহলে এই ব্রাহ্মণকে ভগবান দর্শন করাই, সবই ঈশ্বরের ইচ্ছা, লোকের চেষ্টার দ্বারায় কিছুই হয় না। এমন চিন্তা করে বিশ্বাবসু অতিথি ব্রাহ্মণকে বললেন– ইন্দ্রদ্যুম্ন নামে এক নরপতি এই স্থানে বাস করবেন– এ বৃত্তান্ত আমরা পূর্বেই শুনেছি। তুমি যখন তার পূর্বেই নীলমাধবকে দর্শন করতে এলে তখন তুমি নিশ্চয় আরও ভাগ্যবান। তাই হে ব্রাহ্মণ, এস, আমরা পর্বতের উপরে যাই।

এই কথা বলে বিশ্ববসু বিদ্যাপতির হাত ধরে একটি সরু রাস্তা দিয়ে যেতে থাকলেন, পাথর আর কাটায় ভরা সেই রাস্তা, কিছুদূর যাওয়ার পর একটি কুণ্ডের কাছে উপস্থিত হলেন।

শবররাজ ব্রাহ্মণকে বললেন– এই মহাকুণ্ডের নাম রীহিন, এতে স্নান করলে বৈকুণ্ঠে গতি হয়, আর এর পূর্বে যে বৃক্ষটি দেখা যাচ্ছে, ওটি অক্ষয় বটবৃক্ষ, ওর ছায়ার দ্বারা মানব ব্রহ্মহত্যার পাপ থেকেও মুক্ত হতে পারে।

হে ব্রাহ্মণ, ওই দেখুন, এই কুণ্ডে নিকুঞ্জের মধ্যে সাক্ষাৎ জগন্নাথ বিরাজ করছেন। তাঁকে একবার দর্শন করতে পারলে সকল সঞ্চিত পাপ নষ্ট হয়ে যায়।

সেই জগন্নাথদেবকে দেখে আনন্দে বিদ্যাপতির সারা দেহে এক শিহরণ সৃষ্টি হল, তারপর সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে বহু স্তবস্তুতি করলেন, তারপর বিনম্র চিত্তে প্রণবমন্ত্র জপ করে প্রসন্ন অন্তরে হাতজোড় করে বসলেন।

বিদ্যাপতিকে এই অবস্থায় দেখে বিশ্বাবসু বললেন– হে দ্বিজশ্রেষ্ঠ, প্রভুকে দর্শন করে, তুমি কৃতার্থ হয়েছে। এখন সূর্য ডুবছে। কাজেই এখানে আর বেশিক্ষণ অপেক্ষা করা উচিত নয়। বনের মধ্যে হিংস্র জন্তুদের বাস। সন্ধ্যার আগেই আমাদের গৃহে ফিরতে হবে। তাছাড়া এখনও তুমি কিছু খাওনি। চল, তাড়াতাড়ি গৃহে ফিরে যাই।

এই কথা বলে বিশ্বাবসু বিদ্যাপতির হাত ধরে তাড়াতাড়ি নিজের গৃহে নিয়ে গেলেন। জগন্নাথের ধ্যানে মগ্ন থাকায় বিদ্যাপতি ক্ষুধা-তেষ্টা কিংবা পথ হাঁটার জন্য যে কষ্ট তা কিছুই বুঝতে পারেননি। তারপর বিদ্যাপতিকে আসনে বসিয়ে প্ৰসাদান্ন খেতে দিলেন। রাজযোগ্য উপাচার দেখে বিদ্যাপতি অবাক হয়ে গেলেন। শবরের বাড়িতে এসব জিনিস কোথায় ছিল? এই শবর দুর্গম অরণ্যে বাস করে। প্রতিবেশীরাও সকলে বনবাসী, কেমন করে পেল এমন রাজন্ন দুর্লভ খাবার।

বিদ্যাপতিকে চিন্তিত দেখে শবররাজ বললেন– আমরা বনবাসী আর আপনারা শহরে বাস করেন, আপনাদের সেবা করবার যোগ্যতা আমাদের নেই। শহরবাসীদের আচার-ব্যবহারও আমাদের জানা নেই। আপনি আবার রাজপুরোহিত, আপনাকে তুষ্ট করার সাধ্য আমার নেই। শবররাজের কথা শুনে বিদ্যাপতি বললেন– হে শবররাজ, তুমি ভোজনের জন্য যে সকল সামগ্রী জোগাড় করেছ তা সাধারণ মানুষের তৈরি বলে মনে হচ্ছে না। রাজারাও এমন খাদ্য চোখে দেখেন না। হে মিত্র, এসব খাবার কোথা থেকে এল, আমার খুব জানতে ইচ্ছা হচ্ছে। বিশ্বাবসু বললেন– এই বিষয় প্রকাশ করা উচিত নয়। কিন্তু তুমি ব্রাহ্মণ অতিথি, তাই গোপন রাখতেও পারছি না।

বিদ্যাপতি এই দুর্লভ প্রসাদের বিষয় জানতে পেরে রোমাঞ্চিত ও আনন্দলাভে চোখের জল আটকাতে পারলেন না। মনে মনে ভাবলেন, এই শবররাজ, ব্যাধবংশে জন্মেও প্রত্যহ ভগবানকে দর্শন আর তাঁর দিব্য নির্মাল্য ভোগ প্রসাদ রূপে লাভ করছেন। এমন ভাগ্যবান কাউকে দেখিনি, আমি আর আমার নিজের ঘরে ফিরে যেতে চাই না। এই শবরের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে এই বনেই থেকে যাই।

এই চিন্তা করে বিদ্যাপতি শবররাজকে বললেন– হে সাধক, আমার আর গৃহে ফিরে রাজসেবা করার কি প্রয়োজন? এখানে তোমার সঙ্গে থেকে জগন্নাথের উপাসনা করে দেহ বন্ধন যাতে ছিন্ন হয়, তার চেষ্টা করব। তুমি যদি আমার মিত্র হলে, তোমার সঙ্গে আমি প্রত্যহ ভগবানকে দেখতে পাব। আমি এখন অবন্তীনগরে ফিরে যাব। মহারাজ ইন্দ্রদ্যুম্ন এখানে আসবেন। বিশাল দেউল তৈরি করাবেন। আর বহুশত উপাচারে ঈশ্বরের পূজা করবেন।

এখন মিত্র, তোমাকে একটি কথা জিজ্ঞাসা করি, মহারাজ ইন্দ্রদ্যুম্ন এখানে এসে কোথায় দেউল নির্মাণ করবেন?

বিশ্বাবসু বললেন– আমি আগে পুরাতন কথা যে সব শুনেছি, তা তোমাকে বলছি শোন। মহারাজ ইন্দ্রদ্যুম্ন যখন এখানে আসবেন, তখন তিনি নীলমাধবের রূপ দেখতে পাবেন না। প্রচুর বালিতে ঢাকা পড়ে যাবে। ভগবান রাজার কাছে অদৃশ্য হয়ে যাবেন।

হে মিত্র, তবে তুমি এই কথা রাজাকে বোল না, ভগবান স্বপ্নযোগে রাজাকে আজ্ঞা করবেন দেউল তৈরি করানোর জন্য। শ্রীহরি দারুমূর্তি হবেন। বলরাম, সুভদ্রা ও জগন্নাথ আর সুদর্শন– এই চার দারুমূর্তিকে পূজা করবার জন্য রাজা ব্রহ্মলোক থেকে ব্রহ্মাকে আনিয়ে মন্দির প্রতিষ্ঠা করবেন।

বিশ্বাবসুর এই কথা শুনে বিদ্যাপতি মনের আনন্দে ভগবানের দিব্যপ্রসাদ খেলেন। তারপর দুজনেই ঘুমিয়ে পড়লেন। সকালে উঠে সমুদ্রে স্নান করলেন। ভক্তিভরে মাধব দর্শন করে প্রণাম জানালেন।

তারপর বিশ্বাবসু বিদ্যাপতিকে নিজের ঘরে পৌঁছে দিয়ে ফিরে এলেন মাধবের মন্দিরে। পুর্বের মত পূজা করে স্তবস্তুতি করলেন, তারপর বিনয়ের সঙ্গে নিবেদন করলেন- হে নরহরি, এতদিন কৃপা করে আমার পূজা নিলে এবার থেকে ইন্দ্রদুম্ন মহারাজা এখানে এসে আপনার জন্য অপূর্ব পুরী নির্মাণ করবেন। দারুরূপে তুমি তার পূজা নেবে। এখন হে লক্ষ্মীপতি, আমার কি গতি হবে? আমার কীর্তি কেমন করে থাকে?

তখন শিলারূপী নারায়ণ বললেন–শুন হে শবররাজ, ইন্দ্রদ্যুম্ন রাজা বহুকাল স্তব করেছেন আমাকে পাবার জন্য, এবার তিনি এখানে আসবেন। আজই রাত্রে আমি প্রচণ্ড ঝড়ের দ্বারা বালুকায় প্রবেশ করব। রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের দ্বারা চারটি দারুমূর্তি নির্মিত হবে, বেশভূষা সকলই নতুন হবে, তারপর তোমার বংশধররা আমার পূজা করবে।

বিশ্বাবসু এই দৈববাণী শুনে মনের খুশিতে ফিরে গেলেন নিজের ঘরে, বিদ্যাপতির সঙ্গে মিলিত হলেন।

দিন শেষে রাত্রি নামল। দেবতাগণ এলেন মাধবের পূজা করবার জন্য। সেই সময় তীব্রবেগে বাতাস বইতে লাগল। বাতাসের সেই তীব্রগতিতে প্রচুর বালুকারাশি উড়ে এসে নীলমাধবকে ঢেকে দিল। প্রবল ঝঞ্ঝা-ক্ষুব্ধ সেই রজনীতে দেবতাগণ আর নীলমাধবের পূজা করতে পারলেন না। বিষণ্ণ চিত্তে তারা স্বর্গলোকে ফিরে গেলেন।

তখন সেখানে দৈববাণী হল– এখন আমার আর দেখা এখানে পাবে না। পুনরায় আমি এখানে অবতীর্ণ হব। এ বিষয়ে বিস্তৃত জানবার জন্য ব্রহ্মার কাছে যাও। তিনি তোমাদের সব জানাবেন। তখন দেবতারা ব্রহ্মার কাছে গেলেন। সব বললেন। রাত্রির মধ্যেই সমস্ত ঘটন। ঘটে গেল কেউ জানতে পারল না।

এভাবে বিদ্যাপতি বিশ্বাবসুর কাছে বিদায় নিয়ে অবন্তীনগরে ফিরে গেলেন। রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের কাছে সকল কথা বললেন। বিদ্যাপতিকে দেখে রাজা অবাক হলেন। নীলমাধব দর্শন করে পুরোহিতের দেহে অপূর্ব জ্যোতি বেরোচ্ছে। বুঝতে পারলেন, সবই নীলমাধবের প্রভাব।

তারপর রাজা সারা রাজ্যে ঘোষণা করলেন সকল প্রজাগণ রাজার সঙ্গে নীলাচলে যাবে। এমন সময়ে রাজদরবারে এলেন নারদ ঠাকুর। ভক্তির মহিমা ও বৈষ্ণবের লক্ষণাদি বর্ণনা করলেন রাজার কাছে। তারপর বললেন– পুরুষোত্তমের অপার মহিমাও!

মহারাজা নারদের মুখে সেই মহিমা শুনে বললেন, “ হে মুনি, আপনি চতুর্দশ ভুবন ঘুরে ঘুরে বেড়ান, কাজেই আপনার অজানা কিছুই নেই, আপনিই আমাকে শ্রীপুরুষোত্তম দর্শন করান।

রাজার কথায় দেবর্ষি নারদ খুব খুশি হলেন। পরদিন সকালে রাজা তাঁর মন্ত্রী সেনাপতি তৎসহ চতুরঙ্গ সেনা, রাজপরিবারের সকলজন আর প্রজাদের নিয়ে যাত্রা শুরু করলেন। নর-নারী, বালক বৃদ্ধ পূর্ণ নীলাচলে চললেন নৃপতি। পথে যেতে এক চণ্ডীর প্রতিমা দেখে মুনির আদেশ নিয়ে সাষ্টাঙ্গে লুটিয়ে প্রণাম করে বহু স্তবস্তুতি করলেন। তারপর কোটি লিঙ্গেশ্বরে গমন করে দর্শন করলেন, ভক্তিভরে পূজা করলেন। রাজার ভক্তি দেখে মহেশ্বর দিব্যমূর্তিতে সাক্ষাৎ দিলেন। বর দিলেন–রাজা তুমি পরম বৈষ্ণব, তোমার দুর্লভ কামনা অবশ্যই পূর্ণ হবে। বৈষ্ণবের আশা কখনই ব্যর্থ হয় না।

বরদান করে শিব অদৃশ্য হলেন। তারপর বিভিন্ন তীর্থ দর্শন করে রাজা সবার সঙ্গে এলেন নীলাচলে। কিন্তু রাজা তাঁর অঙ্গে কিছু অমঙ্গল চিহ্ন অনুভব করলেন, তাঁর বাম চোখ, বাম বাহু ঘন ঘন নাচছে, নারদকে জিজ্ঞাসা করলেন,–মুনিবর এর কারণ কি?

উত্তরে নারদ বললেন– হে রাজা, যাঁর দর্শনলাভের জন্য এত দূর এই নীলাচলে এলে সেই ভগবান এখন অন্তর্ধান করেছেন। তোমার পুরোহিত বিদ্যাপতি সেই মূর্তি দেখেছে। সেই মূর্তি এখন তুমি দেখতে পাবে না।

নারদের মুখে এমন বাণী শুনে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন অচেতন হয়ে ভূমিতে পড়ে গেলেন, বহু যত্নের দ্বারা রাজা চেতন পেলেন। কাঁদতে কাঁদতে দেবর্ষির চরণে পড়ে বললেন– কোন্ কর্মদোষে তিনি দেবদর্শনে বঞ্চিত হলেন?

দেবর্ষি নারদ রাজাকে বহু সান্ত্বনা দিয়ে শান্ত করলেন। তারপর রাজা বিরাট নরসিংহ মূর্তি বটবৃক্ষ ও মুক্তি ক্ষেত্র দেখলেন। নারদ বললেন–নীলমাধব পাষাণরূপ ছেড়ে দারুরূপে প্রকাশ হবেন। এই তত্ত্ব জেনে মহেশ্বর সদা এই ক্ষেত্রে বাস করছেন। রাজা এই কথা শুনে সেই নীলমাধবের বহু স্তবস্তুতি করলেন। তখন রাজার ভক্তি দেখে শুনে দেবগণ বললেন– হে রাজন, চিন্তা করো না। অশ্বমেধ যজ্ঞ দ্বারা বিষ্ণুকে প্রীত কর, যজ্ঞান্তে দেব গদাধর তোমাকে কৃপা করবেন।

দৈববাণী শুনে মহারাজ নারদকে জিজ্ঞাসা করলে উত্তরে নারদ বললেন–নীলকণ্ঠ বিশ্বনাথের কাছে নরসিংহ মূর্তি স্থাপন করে তার সম্মুখে যজ্ঞ কর।

তখন রাজার আদেশে নৃসিংহের মন্দির গঠিত হল। দেবতাগণ শূন্য পথে নৃসিংহের মূর্তি আনালেন, মহারাজ ইন্দ্রদ্যুম্ন সেই মূর্তি মন্দিরে স্থাপন করলেন।

তারপর মহারাজ ইন্দ্রদ্যুম্ন বিশ্বকর্মার পুত্রকে ডেকে দুই ক্রোশ ব্যাপী নগরের পত্তন করালেন। যজ্ঞকার্যে সুনিপুণ ব্রাহ্মণসহ ঋষি, রাজন্যবর্গ, সকল বর্ণের লোকদের নিমন্ত্রণ করে অশ্বমেধ যজ্ঞের আয়োজন করলেন। মহা ধুমধামে যজ্ঞ পূর্ণ হল। রাত্রিকালে জগন্নাথ স্বপ্নযোগে রাজাকে দেখা দিলেন। তাঁর শ্যামলসুন্দররূপ দেখে রাজা অভিভূত হলেন। রাজা হাতজোড় করে নানা স্তবস্তুতি করলেন। মহারাজ এখন স্থায়ীভাবে নীলাচলে বাস করতে লাগলেন। দক্ষিণ সমুদ্রতীরে কয়েকজন চর এক অদ্ভুত জ্যোতি দেখে আশ্চর্য হয়ে গেল। তারা রাজাকে জানাল–এক কাষ্ঠ চারিবর্ণ বিশিষ্ট দেখতে সুন্দর। শ্বেত, রক্ত, নীল, পীত অতি মনোহর, শঙ্খ, চক্র, গদা ও পদ্ম তার গায়ে। সেই কাঠের জ্যোতি যেন শত সূর্যের মত। তার সুগন্ধে দশদিক আমোদিত।

তাদের কথা শুনে মহারাজ অতি বিস্মিত হলেন। রাজার প্রশ্নের উত্তরে নারদ বললেন– মহারাজ অশ্বমেধ যজ্ঞের পুণ্যফল এতদিনে পেলে। এক হাজার যজ্ঞ পূর্ণ হতে আর বাকী একটি। তাই প্রভু তোমাকে সাক্ষাৎ দর্শন না দিয়ে স্বপ্নে দেখা দিলেন। বিষ্ণুমূর্তি স্থাপন করবার জন্য তুমি বহু জন্ম তপস্যা করেছ। তাই তিনি কৃপা করলেন। পরম ভক্ত বলে শবর নীলমাধব পূজা করতে পেরেছে। তুমি শবরের থেকে বড় ভক্ত। তাই তোমার দ্বারা প্রভু দারুমূর্তিরূপে প্রকাশিত হবেন। সেই দেব এখন কাষ্ঠরূপ ধারণ করলেন। তোমাকে কৃপা করবার জন্যই শ্বেতদ্বীপ হতে এই কাঠ এল, এতো আর সাধারণ কাঠ নয়। বিষ্ণুর পঞ্জর।

নারদের মুখে এমন কথা শুনে রাজা মনে পরমানন্দ। নানান মঙ্গল বাজনা বাজিয়ে নেচে নেচে চললেন সেই ব্রহ্মময় কাষ্ঠের কাছে। দারু দেখে সবার মনে অপার আনন্দ, সকলেই সেই দারুব্রহ্মের স্তুতি করলেন।

তারপর সোনা ও নানান রত্নে তৈরি এক বেদীর উপরে সেই দারুব্রহ্মকে স্থাপন করলেন। দেবর্ষির বাক্যে রাজা সেই দারুব্রহ্মাকে ভক্তি ভাবে পূজা করলেন।

এরপর মূর্তি গঠন ব্যাপারে নারদ মুনি এবং রাজা চিন্তা করছেন। এমন সময় দৈববাণী হল– বেদীর ওপর রাখা স্বর্গীয় চারবর্ণ বিশিষ্ট কাষ্ঠ থেকে স্বয়ংক্রিয় উপায়ে নীলমাধবের দারুমূর্তি নির্মিত হবে। একজন বৃদ্ধ শিল্পী মন্দিরের মধ্যে গোপনে মূর্তি গঠন করবে।

দৈববাণী শেষ হতেই এলেন এক বৃদ্ধ রাজার অনুমতি নিয়ে মূর্তি গড়তে চাইল। তারপর প্রবেশ করল মন্দিরের মধ্যে, তারপর পনেরো দিন ধরে কৃষ্ণ, বলরাম, সুভদ্রা এবং সুদর্শনের মূর্তি গড়া হল। জগন্নাথের বর্ণ মেঘের মত কালো। বলরামের বর্ণ শঙ্খের মত সাদা। সুদর্শন রক্তবর্ণ আর সুভদ্রা কুমকুম গৌরীবর্ণ।

দৈববাণী হল– প্রতি বৎসর নতুন করে অঙ্গরাগ করতে হবে। শবররাজ বিশ্বাবসু আর রাজপুরোহিত বিদ্যাপতির বংশধরগণ প্রত্যেক বৎসরেই দারুমূর্তির অঙ্গরাগ করবে।

নিজের কানে সেই দৈববাণী শুনে রাজার পরম আনন্দ আর ধরে না। নতুন বস্ত্র পরিহিত বেদীর উপরে চারমূর্তি দেখে মহা আনন্দ লাভ করলেন। সুভদ্রার দুইপাশে জগন্নাথদেব এবং বলভদ্রদেব প্রকাশিত হলেন। আর জগন্নাথের পাশে সুদর্শনদেব।

দেবর্ষি নারদ বললেন–হে রাজন, তোমার মতো ভাগ্যবান জগতে কে আছে? নিজের ভববন্ধন মুক্তির সঙ্গে সঙ্গে জগতের সকলেরও মুক্তিসাধনের উপায় করলেন।

তারপর মহারাজ বারবার দণ্ডবৎ প্রণাম করে নারদমুনি আর বিদ্যাপতির সঙ্গে নারায়ণের বহু স্তবস্তুতি করলেন। তারপর রাজা পুরোহিতের দ্বারা পূজার সকল উপাচার সংগ্রহ করে নারদের উপদেশে যথা বিধিমতে মূলমন্ত্রে জগন্নাথ, তারপর বলরাম, সুদর্শন ও সুভদ্রারও পূজা করলেন। কৃষ্ণের প্রীতির উদ্দেশ্যে বৈদিক ব্রাহ্মণগণে সোনা, রূপা, গাভী, প্রভৃতি দান করলেন।

দেবর্ষি নারদের অনুমতি নিয়ে রাজা তারপর মন্দির নির্মাণের উদ্যোগ করলেন। বিভিন্ন স্থান থেকে পাথর ও রত্নাদি আনালেন। কিন্তু সুবিশাল মন্দির নির্মাণ করবে কে? কে এমন শিল্পী আছে? রাজা চললেন নারদকে সঙ্গে নিয়ে ব্রহ্মলোকে। ব্রহ্মার চরণে উভয়ে প্রণাম জানিয়ে মন্দির নির্মাণের বিষয় জিজ্ঞাসা করলে ব্রহ্মা তখন বিশ্বকর্মাকে ডেকে জগন্নাথের মন্দির নির্মাণ করবার জন্য আদেশ করলেন।

বিশ্বকর্মা রাজী হলেন। সত্যধামে এসে শুরু করলেন মন্দির নির্মাণের কাজ। তারপর দেবতাগণকে ডেকে ব্রহ্মা বললেন– ভগবান দারুব্রহ্মরূপে নীলাচলে অবতীর্ণ হয়েছেন। আবার যে জন নীলাচলে বাস করবে, তারা ব্রহ্মপদও লাভ হবে, রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন জগন্নাথের মন্দির তৈরি করবে, আমি নিজে প্রতিষ্ঠা করব।

ব্রহ্মার কথা শুনে সেখানে সকল দেবতাগণ মহানন্দে প্রভুর সেবার জন্য যেতে রাজি হলেন।

মহারাজ ইন্দ্রদ্যুম্ন ফিরে গেলেন নীলাচলে, মূর্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সকল দ্রব্য আয়োজন করলেন।

তারপর তিনি শবররাজ বিশ্বাবসুর কাছে গিয়ে তার পায়ে প্রণাম ও স্তুতি করে বললেন–হে, শবররাজ, তোমার শবরকুলে জন্ম হলেও তুমি ধন্য। শ্রীহরি নীলমাধবরূপে তোমাকে কৃপা করলেন। এখন তুমি আমাকে কৃপা কর। তোমার যজ্ঞভূমির তলার গহ্বরে গিয়ে নির্জনে থাকলে নীলগিরি স্থির হবে। তোমার মাথার উপরেই প্রভুর মন্দির তৈরি হবে।

ইন্দ্রদ্যুম্নের কথা শুনে প্রভুর বাক্য স্মরণ করে নিজের ছেলেকে রাজার হাতে তুলে দিয়ে মনের আনন্দে বিশ্বাবসু নিজের তপস্যার জায়গায় চলে গেলেন। সেই গর্তের মধ্যে বসে জগন্নাথের ধ্যান করছেন। তখন চারপাশের বালুকায় ভর্তি হল গর্ত, বিশ্বাবসুর আত্মা পরমাত্মার সঙ্গে লীন হয়ে গেল। বিশ্বকর্মা তাঁর পুত্রকে নিয়ে মন্দির গড়ার কাজ শুরু করলেন। হাজার হাজার লোক তাঁদের সাহায্য করলেন, বড় বড় পাথরের চাঁই বহন ও তুলবার জন্য। সেই মন্দিরটি লম্বায় একশো হাত, চওড়ায় বাইশ হাত আর উঁচু হাজার হাত। তিন দিনেই তৈরি হয়ে গেল এত বড় মন্দির। সাধারণ শিল্পী হলে শত বছরেও যা তৈরি করতে পারত না। চারদিকে প্রাচীর আর স্থানে স্থানে অন্যান্য ঘর তৈরি হল আর এক দিনে। সেই মন্দিরের চূড়া যেন আকাশকে ছুঁয়েছে। সেই চূড়ায় সোনার কলস বসানো হল। সেই মন্দিরের পূর্বদিকে সিংহদ্বার মন্দিরের মধ্যে গর্ভগৃহে রত্নবেদী তৈরি হল।

মন্দির নির্মাণ কাজ শেষ হবার পর বিশ্বকর্মা রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নকে জানালেন, তখন দেবতাগণ ও আপ্তবন্ধুগণের সঙ্গে মহারাজ সেই মন্দির দেখতে গেলেন। সবাই আশ্চর্যবোধ আর পরম আনন্দলাভ করলেন। ত্রিভুবনে এমন বিশাল ও সুন্দর মন্দির আগে কেউ কখনও দেখেনি। তারপর মহারাজ বিশ্বকর্মা বহু প্রশংসা করে জগন্নাথ দর্শনে গেলেন। প্রভুপদে প্রণতি জানিয়ে ভাবাবেশে আপ্লুত হলেন। দেবতাগণও প্রণাম করে স্তবস্তুতি করলেন।

তারপর বাইরে এসে নরসিংহ ক্ষেত্রে গিয়ে ভূমিতে লুটিয়ে সবাই প্রণাম করলেন।

এসব প্রতিষ্ঠার পালা, স্বয়ং ব্রহ্মা আসবেন মূর্তির প্রাণ প্রতিষ্ঠা এবং স্থাপন করবার জন্য। শাস্ত্র অনুসারে যা কিছু প্রয়োজন নারদঠাকুর ফর্দ করে দিলেন। রাজা সেই ফর্দ দিলেন পদ্মনিধির হাতে সুন্দর করে মণ্ডপাদি সাজাতে বললেন। দেবতাদের থাকবার ঘর, ব্রহ্মার বসার ঘর, সিদ্ধ বিদ্যাধরাদি থাকবার ঘর তৈরি করা হল, ফর্দ অনুসারে সকল দ্রব্যই সংগ্রহ করা হল। ইন্দ্রদ্যুম্নের মনের মত করে সব তৈরি করলেন বিশ্বকর্মা আর পদ্মনিধি। আবার সোনা দিয়ে তিনখানি রথ তৈরি করলেন তাঁর নানাবিধ রত্ন অলঙ্কারে পূর্ণ সেই রথগুলি।

তারপর দেবতাদের সঙ্গে ব্রহ্মা নীলাচলে এসে দারুমূর্তি দর্শন করে স্তুতি করলেন। রথে করে সেই দারুমূর্তি নীলাচলে আনা হল, মন্দিরের গর্ভগৃহে রত্নবেদীতে স্থাপন করা হল। তারপর ব্রহ্মা অভিষেক ও প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করলেন। মহা ধুমধামে নানা বাদ্য বাজনা নৃত্যগীত সহকারে সকল কিছু সুসম্পন্ন হল। মূর্তিমান ভগবান বেশে নীলাচলে, কলেবর মনোহর শোভে ক্ষিতি তলে। এইরূপে নীলাচলে দারু ব্রহ্মহরি, মান্যরূপে থাকেন রাজাকে কৃপা করি। ক্রমে ক্রমে কলির প্রভাব বাড়তে লাগল, তখন জগন্নাথদেব পুনরায় লীলা প্রকাশ করলেন।

মহারাজ ইন্দ্রদ্যুম্ন দারুমুর্তি স্থাপন করবার পর মহাপুজা, মহাসেবা আর মহাভোগ নিত্য দেওয়া হল, এইভাবে দ্বাদশ বৎসর গত হল। ত্রয়োদশ বৎসর জ্যৈষ্ঠ মাসে নিত্যদিনের মত একদিন দেবতাগণ রাত্রিকালে এসে জগন্নাথেদেবের পূজাদি করে প্রসাদ খেয়ে ফিরে গেলেন।

তারপর সেই রাত্রিতেই জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রা ও সুদর্শন চারমূর্তি এক হয়ে কাষ্ঠরূপে সমুদ্রের জলে ভাসতে লাগলেন। মন্দিরের মধ্যে যে দারুমূর্তি ছিল তার বেশভূষা সব ছিন্নভিন্ন অতি অপরূপ মুর্তি এখন প্রভাহীন হয়ে বিকৃত আকার হয়েছে।

রাত থেকে সকাল হল। মঙ্গল আরতি করবার জন্য পূজারী ঠাকুর মন্দিরের দ্বার খুলে প্রদীপ হাতে গর্ভগৃহে ঢুকলেন। পরিচারকগণ সকলে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। নানা শব্দে বাজনা বাজছে। পূজারী দেখল ছিন্নভিন্ন জগন্নাথ, আর তিন মূর্তির একই অবস্থা। ভয়ে তার শরীর কাঠ হয়ে গেল। অন্তর শুকিয়ে গেল। তাড়াতাড়ি সকল বাদককে বাজনা বাজাতে নিষেধ করলেন। রাজদূতের দ্বারা রাজার কাছে খবর পাঠালেন। ছুটে এলেন মহারাজ। মন্দিরে ঢুকে জগন্নাথের রুক্ষ, শুষ্ক জরাজীর্ণ দেহ দেখে আছাড় খেয়ে পড়লেন মেঝেতে। মূৰ্ছিত হলেন, সকলের সেবাযত্নে জ্ঞান ফিরে পেলেন।

কাঁদতে কাঁদতে রাজা বললেন– হে কৃপানিধি, আমার কোন অপরাধে প্রভু তুমি অপ্রকট হলে। তুমি বলেছিলে– এই স্থান ছেড়ে কখনও যাবে না। এখন আমার কি অপরাধ হল, বল প্রভু? বহু কষ্টে তোমাকে পেয়ে তোমার আরাধনা করছি। এমন আমাকে নিগ্রহ করছ? মহারাজের কান্না দেখে সবার চোখে জল। এমন সময় দেবর্ষি নারদ সেখানে এলেন। রাজা তার পায়ের তলায় পড়লেন। দেবর্ষি বললেন– হে রাজন, প্রভু কখনই এই নীলাচল ছেড়ে যাবেন না। এখন প্রভু নরবেশ ধারণ করবেন। বিশ্বাবসুর সন্তানরা প্রভুর অঙ্গরাগ করবেন। বিদ্যাপতির বংশের লোক প্রতিষ্ঠা করবেন। পূর্বে জগন্নাথ এমন দৈববাণী করেছেন। এখন সাগরের তীরে সেই কাঠ রয়েছে তা দিয়ে মূর্তি গড়াও। বিশ্বকর্মাকে স্মরণ কর।

মহারাজ নারদের মুখে এমন কথা শুনে স্বস্তি বোধ করলেন। সমুদ্রের কূলে গিয়ে দেখলেন শ্বেত, রক্ত, নীল তার পীতবর্ণের সুন্দর কাঠ। নানাবিধ বাদ্য বাজিয়ে সেই কাঠ আনা হল, নারদাদি মুনি ও বিপ্রগণ বেদধ্বনি করতে লাগলেন। রত্নবেদীর নীচে রাখা হল সেই কাঠ, বেদীর উপরে জরা মূর্তি।

তারপর নিয়মিত সেবার যেমন ব্যবস্থা আছে, তা সমাপন হলে রাজা যোগাসনে বসে বিশ্বকর্মাকে স্মরণ করতে তিনি সেখানে উপস্থিত হলেন। তখন রাজা তাঁকে প্রণাম জানিয়ে মূর্তি নির্মাণের জন্য অনুরোধ করলে তিনি মন্দিরের মধ্যে গিয়ে বেদীর নীচের কাঠ বাটালি দিয়ে পরীক্ষা করে বললেন–রাজা চিন্তা কোরো না এই আপাত অসম্ভব কর্ম প্রভু নীলমাধব নিজেই সম্পন্ন করবেন। মহারাজ, এ কাজ আমার দ্বারা করা সম্ভব নয়। বাটালির ঘা বসাতে পারছি না, তাতে মূর্তি গড়ব কেমন করে?

দেবশিল্পীর কথা শুনে সবাই অবাক। তাহলে মানবশিল্পী এখন কে আছে, যে এই গুরুদায়িত্ব গ্রহণ করবে? কি জানি প্রভুর মনে কি আছে?

বিশ্বকর্মা ফিরে গেলেন। মহারাজ খুব চিন্তায় পড়লেন। দুঃখিত হয়ে নারদের কাছে সব নিবেদন করলেন। তখন ঋষি বললেন– রাজা চিন্তা কোরো না। এই আপাত অসম্ভব কর্ম প্রভু নীলমাধব নিজেই সম্পন্ন করবেন।

এমন সময় ভগবান হরি বৃদ্ধবেশে সেখানে উপস্থিত হলেন। হাতে কাঠ খোদাই করার নানা যন্ত্রপাতি, মাথায় পাকা চুল, গায়ের মাংস সব ঝুলে পড়ছে, দুর্বলতার জন্য শরীর কাঁপছে।

মহারাজ তাকে দেখে মনে মনে বুঝতে পারলেন। এই সেই ভগবান, বৃদ্ধের বেশে এসেছেন মূর্তি গড়ার জন্যই। তখন রাজা সেই বৃদ্ধের স্তুতি করে মূর্তি গড়ার জন্য তাকে অনুরোধ করলেন।

বৃদ্ধ বললেন– আগে কাঠ দেখি তারপর বলব, মূর্তি গড়তে পারব কিনা, তারপর পরীক্ষা করে । দেখে তিনি বললেন– কাঠ খুবই নরম। তিনদিন তিনরাত লাগবে মূর্তি তৈরি করতে। মন্দিরের দ্বার বন্ধ থাকবে। তিন দিন সেই সময় কেউ মন্দিরের মধ্যে ঢুকবে না। হে রাজন, তুমি নিজেই দ্বার রক্ষা করবে।

রাজা রাজি হলেন, হাতে খড়গ নিয়ে দ্বার রক্ষা করছেন! যখন রাত্রি দ্বিতীয় প্রহর হল স্বর্গ থেকে দেবতারা এলেন জগন্নাথ দেবকে পূজা করবার জন্য, মহারাজ হাতজোড় করে বললেন– তিনদিন দ্বার বন্ধ থাকবে, চতুর্থ দিবসে এসে পূজা করবেন।

রাজার বাক্যে দেবতারা খুশি হতে পারলেন না, তাঁরা ব্রহ্মার কাছে ফিরে গেলেন, গিয়ে সব বৃত্তান্ত নিবেদন করলেন। জগন্নাথদেবকে পূজা না করতে পেরে ক্ষোভ জানালেন। ব্রহ্মা তখন নানান সান্ত্বনা ব্যক্যে তাদের সকলকে শান্ত করলেন।

এদিকে মন্দিরের মধ্যে, নারায়ণ নিজেই নিজের দারুমূর্তি গঠন করছেন। বাইরে থেকে রাজা শুনতে পারছেন ঠুকঠাক শব্দ। মনে খুব আনন্দ, অন্তরে উৎকণ্ঠাও আছে। কখন দেখতে পাব পুনরায় জগন্নাথকে, দ্বিতীয় দিনের কাজ শেষ হল আর এক দিনের কাজ বাকী আছে।

এদিকে জগন্নাথ মনে মনে ভাবলেন আমি অঙ্গহীন মূর্তি ধারণ করব। অঙ্গহীন দেখে সবাই অশ্রদ্ধা করবে। সেই পাপে লোক সব নরকে পড়বে। আবার সেই অঙ্গে শ্রদ্ধাভরে যে ভজনা করবে, তার প্রতি প্রভু কৃপাবান হয়ে তাকে বৈকুণ্ঠে স্থান দেবেন।

এমন চিন্তা করে প্রভু মূর্তি গড়ার কাজ বন্ধ করলেন। ভেতরের কোন শব্দ শুনতে না পেয়ে রাজা ভাবলেন মূর্তি নির্মাণের কাজ সমাপন হয়েছে। তাড়াতাড়ি দ্বার খুলে ছুটে গেলেন মূর্তি দেখবার জন্য, কিন্তু একি! মুখের আকার আর নাসা কর্ণদ্বয়, মস্তক আকার কেশ পূর্ণ হয় না। তখন সেই বৃদ্ধ কারিগর চার মূর্তিকে দেখছেন, সকল মূর্তির চিহ্নগুলি মাত্র হয়েছে, রাজা খুব অবাক হয়ে গেলেন, শিল্পী বললেন– রাজা এ আপনি কি করলেন? এখনও একদিনের কাজ বাকি আছে। আপনি কপাট খুললেন কেন? ত্রিভুবনের মধ্যে শ্রীহরিরূপ সবচেয়ে সুন্দর তাই খুব সাবধানে এই মূর্তি গঠন করছি। এখনও কাজ পূর্ণ হয়নি, হাত পা আঙ্গুল তৈরি করতে বাকি আছে।

তখন রাজা হাতজোড় করে কারিগরকে বললেন– আমি ভুল করেছি, এখন আমি দ্বারের দরজা বন্ধ করে বাইরে যাচ্ছি, তুমি মূর্তি গঠনের বাকি কাজ করে দাও।

রাজার কথা শুনে বৃদ্ধ কারিগর হেসে বললেন– আমার দ্বারা আর এ কাজ হবে না। তুমি এই অঙ্গহীন মূর্তিই পূজা কর। আর এক গোপন কথা বলি পূর্বের জীবনে দারুমূর্তির নাভিতে ব্রহ্ম আত্মা আছে। সেই আত্মা নিয়ে এই নবনির্মিত মূর্তিতে স্থাপন কর। নতুন মূর্তির নাভিপদ্মে বাকলের মধ্যে সেই স্থান রয়েছে। কিন্তু মহারাজ এ কাজ তোমার দ্বারা হবে না। বিশ্বাবসু শবরের পুত্রের দ্বারা এ কাজ করতে হবে। সাত পার্টি, কাপড় চোখে বেঁধে এই কাজ করবে। ভুলেও যেন দেখে না ফেল, দেখলেই প্রাণে মারা যাবে। আর বিদ্যাপতি প্রতিষ্ঠা করবে। প্রতি বারো বছর অন্তর প্রভুর এমনি অসম্পূর্ণ মূর্তি গড়া হবে। এই শবরের বংশ আর বিদ্যাপতির বংশের লোকই ওই দুই কাজ করবে। অঙ্গহীন দেখে অবজ্ঞা না করে ভক্তিভরে পূজা কর।

এই কথা বলেই বৃদ্ধ কারিগর অদৃশ্য হয়ে গেলেন। রাজা দেখে অবাক, রাজার আর বুঝতে বাকি রইল না যে, স্বয়ং জগন্নাথই বৃদ্ধ শিল্পীর রূপ ধরে এই মূর্তি গড়ে গেলেন, তারপর বিশ্বাবসুর পুত্রকে এনে ব্রহ্মআত্মা যথাস্থানে স্থাপন করালেন।

তারপর নারদের সঙ্গে যুক্তি করে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন ব্রহ্মলোকে গিয়ে ব্রহ্মাকে এই অঙ্গহীন মূর্তির কারণ জিজ্ঞাসা করলে ব্রহ্মা বললেন– এই মূর্তি যে চিনবে সেই হবে ভাগ্যবান। কাল মহাঘোরে সে পাবে পরিত্রাণ, কলির মানুষেরা মাহপাপী হবে, জাতিভেদ থাকবে না। এই মূর্তি দেখে যার ভক্তি, হবে সে আর কভু এই মূর্তি দেখবে না। সে ভক্তিপদ লাভ করবে।

তারপর রাজা নীলাচলে ফিরে এলে সেইসব নির্মিত মূর্তি রত্নবেদীর উপরে প্রতিষ্ঠা করলেন।